Sunday 9 July 2023

প্রশ্ন উপনিষদ রহস্যঃ - শশাঙ্ক শেখর শান্তি ধাম



প্রশ্ন উপনিষদ রহস্যঃ 

- শশাঙ্ক শেখর শান্তি ধাম


প্রশ্ন  উপনিষদ রহস্যঃ -  ভূমিকা  


অথর্ব্ব  বেদ নামে একটা  অধ্যাত্ম উচ্চজ্ঞানের গ্রন্থ আছে।  কতিপয় অতিশয় জ্ঞানীব্যক্তি  বলে থাকেন, এই গ্রন্থটি আসলে পরবর্তীতে বেদ  বলে প্রচার করা হয়েছে। তাঁরা  বলছেন, বেদ  চারটি নয়  তিনটি, ঋক, সাম, যজুঃ। "বেদত্রয়"। কিন্তু আমাদের শ্রীমৎ স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী মহাশয় এই অথর্ব্ব বেদকে মূল বেদের অন্তর্ভুক্ত  বলেই মনে করেন।  আর সেই কারণেই, তিনি এই বেদত্রয় কথাটার একটা সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন।  বলছেন - সমগ্র বেদের তিনটি ধারা এক - পদ্য, দুই গদ্য, তিন গান। সামবেদ হচ্ছে গানের সঙ্কলন, যা স্বর-সংযোগে গীত হয়ে থাকে। ঋক্বেদ হচ্ছে কবিতা সঙ্কলন , যজুর্বেদ হচ্ছে গদ্যাংশ। অথর্ব্ব বেদও গদ্যের আকারে লেখা। 

দেখুন শাস্ত্র গ্রন্থ পাঠ  করে, আমরা অনেক কিছু জানতে পারি। কিন্তু সেই জ্ঞান হচ্ছে জ্ঞানের আভাস মাত্র। জ্ঞানের প্রতিচ্ছবি মাত্র।  মানুষের যেমন ছায়া - তেমনি গ্রন্থ হচ্ছে জ্ঞানের লিপিবদ্ধ অবস্থা, প্রকৃত জ্ঞানের ছায়া মাত্র । এই জ্ঞানকে উপলব্ধি করতে গেলে, আমাদের এমন একজন মানুষের দরকার যিনি এই জ্ঞানের উপলব্ধি করেছেন। রসোগোল্লার রচনা পড়ে , রসোগোল্লার স্বাদ পাওয়া যায় না। এর জন্য আমাদের সেই ময়রার কাছে যেতে হয়, যিনি এই রসোগোল্লা নিজে খেয়েছেন, এবং অন্যকে খাওয়াতে পারেন। এখন কথা হচ্ছে, এই ময়রা বা প্রকৃত মানুষটিকে কোথায় পাবো, যিনি ব্রহ্মকে জেনেছেন, ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেছেন। এই ব্যক্তি হচ্ছে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ, যিনি ব্রহ্মকে জ্ঞাত হয়ে নিজের মধ্যে ব্রহ্মকে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন, এবং যিনি নিজেই ব্রহ্ম হয়ে গেছেন। । এখন এই উপনিষদের ব্রহ্ম আর ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যিনি রসোগল্লা খেয়েছেন, যার পেটের মধ্যে রসোগোল্লা প্রবেশ করেছে, তার শরীর  ও রসোগল্লার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কেননা রসোগোল্লা  এখন আর বাইরের বস্তু নয়, তার শরীর-মন এখন রসোগোল্লাময় হয়ে গেছে। রসোগোল্লা  আর তাঁর  মধ্যে ভেদ রেখা মুছে গেছে। 

এখন কথা হচ্ছে কে যে ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেছেন, তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষ জানবে কি করে ? আসলে সত্যকে উপলব্ধি করবার জন্য, আমাদের নিজেদের মধ্যে কিছু পরিবর্তন আবশ্যিক হয়ে থাকে  । আর এই পরিবর্তন তখনই শুরু হয়,  যখন নিজের  মধ্যে প্রশ্ন জাগতে থাকে। যখনই আপনার মধ্যে ব্রহ্ম বিষয়ে জিজ্ঞাসা জাগবে, তখন আপনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সেই পুরুষের সন্ধান করবেন, যিনি ব্রহ্মকে লাভ করেছেন। হ্যাঁ প্রথমেই আপনি তাঁর  সন্ধান পাবেন, বা পেলেও তাকে আপনি সহজেই চিনে নিতে পারবেন, এমনটা নাও হতে পারে। আপনাকে ধৈর্য্যধরে আচার্যকে পরীক্ষা করতে হবে, আবার আচার্য্যের সামনে আপনাকে পরীক্ষা দিতে হবে। এই দুই পরীক্ষাই একদিন দুজনকে কাছে নিয়ে আসবে। আর আপনি যথার্থ আচার্য্যের কাছে পৌঁছে যাবেন। 

এই পরীক্ষার  কথা দিয়েই শুরু হয়েছে প্রশ্ন উপনিষদ। আমরাও আজ থেকে এই রহস্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়বো।  অন্যান্য  উপনিষদের মতোই মঙ্গলাচরণ দিয়ে, অর্থাৎ প্রার্থনা বাক্য দিয়ে প্রশ্ন উপনিষদের শুরু। 

মঙ্গলাচরণ মন্ত্রঃ 

"ওঁ ভদ্রং কর্ণেভিঃ শৃণুয়াম দেবা ভদ্রং পশ্যেম অক্ষভিঃ যজত্রাঃ ।
স্থিরৈঃ অঙ্গৈ তুষ্টুবাংসঃ তনুভিঃ ব্যশেম দেবহিতং যদায়ুঃ ।" 

হে দেবগন, আমরা যেন কান দিয়ে, যাকিছু ভালো তাই শুনতে পাই।  হে পূজ্য দেবগন, আমরা যেন চোখ দিয়ে যাকিছু ভালো তাই দেখতে পাই। আমার এই স্থির শরীর  ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে যেন তোমাদের স্তুতি করতে  পারি। 
দেবগন  আমাদের জন্য যে আয়ু আমাদের জন্য বিহিত করেছেন, তা যেন আমরা লাভ করতে পারি।  
হে দেবগন আমাদের যেন  শরীর  মনে শান্তি থাকে। আমরা যেন পরিবেশ ও প্রকৃতি থেকে শান্তি পাই, আমরা যেন কীট -পতঙ্গ-হিংস্র-প্রাণীর প্রভৃতি  থেকে শান্তি পাই।  অর্থাৎ আমাদের যেন আধ্যাত্মিক, অধিদৈবিক ও আধিভৌতিক বিষয়ে শান্তি থাকে।  

এখন কথা হচ্ছে, ভালো কথা শোনা, ভালো জিনিস দেখা, - এই যে ভালোর কথা বলা হচ্ছে, এই ভালোটা কি ? আসলে যা কিছু আমাদের পক্ষে  কল্যাণকর, হিতকর, শুভ তাই যেন আমরা দেখি, শুনি ও বলি।  আমরা যেন  এমন কিছু না শুনি, দেখি, বা বলি, যা আমাদেরকে উত্তেজিত করে, আমাদের মধ্যে কামনা-বাসনার উদ্রেগ করে, যা আমাদের পক্ষে অশুভ। অর্থাৎ শ্রেয় বস্তুর দিকে আমাদের যেন স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকে। এতে করে আমরা আমাদের ভবিষতে শুভময় চিন্তা ও কর্ম্মে  স্বাভাবিক আকর্ষণ বোধ করবো। এই প্রার্থনার মধ্যে আরো একটা জিনিস চাওয়া হয়েছে, তা হচ্ছে, আমার যেন স্থির শরীর  ও চিত্তের অধিকারী হতে পারি। অর্থাৎ আমাদের শরীর  মন স্থির থাকুক।  আসলে ঘুরিয়ে আমরা আমাদের সুস্থ শরীর-মনের জন্য প্রার্থনা করলাম। এই শরীর  ও মন যদি কারুর সুস্থ  থাকে, তবে তার জীবনে যেমন শান্তির অভাব ঘটে না, তেমনি সে তার জীবনের মূল লক্ষের দিকে স্থির চিত্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্ম্মে প্রবৃত্ত হতে পারে । সুস্থ  শরীর  ও মনের অধিকারী হয়ে আমরা  দেবতাদের স্তুতি-পূজা করতে পারবো। শরীর মন সুস্থ  থাকলে, আমরা ঈশ্বর প্রদত্ত আয়ু ভোগ করতে পারবো।  আমাদের অকাল মৃত্যুর কবলে পড়তে হবে না। 

যাইহোক, আমরা একটা গুরুত্ত্বপূর্ন উপনিষদের (প্রশ্ন) পাঠক হতে চলেছি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, আমরা সবাই যেন সুস্থ শরীর  ও শুদ্ধ মনের অধিকারী হয়ে, উপনিষদের মধ্যে নিহিত সত্য-জ্ঞানকে উপলব্ধি করতে পারি। আমরা যেন যতদিন ইচ্ছে বেঁচে থেকে ঈশ্বরের স্তুতিগান করতে পারি। 

প্রার্থনার গুরুত্ত্ব :

প্রত্যেকের জীবনেই প্রার্থনার একটা বিশেষ গুরুত্ত্ব আছে। এই প্রার্থনা যে কবে মানুষের অজ্ঞাতসারেই, মানুষের মধ্যে প্রবেশ করেছে, তা কেউ জানে না।  আসলে মনুষ্যদেহ  সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ প্রার্থনা পদ্ধতির আবিস্কা করেছে। আদিম যুগের  মানুষ প্রার্থনা করতো ভয়ে, আতঙ্কে এবং নিজেকে রক্ষার তাগিদে। ধীরে ধীরে এই প্রার্থনা  হয়ে উঠেছে, মানুষের বাসনা পূরণের রাস্তা। আজও  আপনি রাস্তা ঘাটে মন্দিরে মসজিদে গির্জায় এই প্রার্থনার সুর শুনতে পাবেন। প্রার্থনা  আসলে জীবন যন্ত্রনা থেকে মুক্তির ব্যাকুলতা প্রকাশ। এই প্রার্থনাই  ধীরে ধীরে জীবাত্মাকে ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যাবার রাস্তা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ভগবৎ  ভক্ত এই প্রার্থনার মাধ্যমেই নিজেকে ঈশ্বরের কাছে সমর্পন করে থাকেন ।  বেদের মধ্যে বহু মন্ত্রে এই প্রার্থনার ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়।  এর মধ্যে গায়েত্রী মন্ত্র সম্পর্কে আমরা সবাই শুনেছি। এই প্রার্থনার সূক্ষ্মতম রূপ হচ্ছে ধ্যান। ধ্যানে আমরা আমাদের মনের প্রবাহকে ঈশ্বরমুখী করে নিঃশব্দে জ্ঞানালোকের সন্ধান পেয়ে থাকি। এই জ্ঞান-অন্বেষণকারী যখন প্রার্থনায় মগ্ন হয়ে যায়, তখন সে তার হৃদয় কেন্দ্রে একটি শূন্যবোধ অনুভব করে। এই শূন্যবোধ একসময় দিব্য আনন্দের যে উৎসমুখ, সেই ঈশ্বরের কাছে সাধককে পৌঁছে দেয়। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, যার মধ্যে এখনও ঈশ্বরে বিশ্বাস জন্মায় নি, তার কাছেও এই প্রার্থনার একটা গুরুত্ত্ব আছে। নাস্তিক ব্যক্তিও বিপদে পড়লে, এই প্রার্থনা বাক্যের উচ্চারণ করে থাকে। নাস্তিক ব্যক্তিরা জন্মের আগে কিছু ছিল না, আবার মৃত্যুর পরেও কিছু থাকবে না, এই  অজ্ঞান ভাবনায়  ভাবিত হয়েও, প্রার্থনা  তাকে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখবার পথ দেখায়। আসলে অনন্ত কালের কাছে, এই জীবন একটা ক্ষনিকের তরে ভেসে ওঠা চঞ্চল বুদ্বুদ মাত্র। সামান্য ক্ষনের জন্য ভেসে উঠে বিশেষ আকার নেয়, আবার সেই অনন্তের  সঙ্গেই  মিশে যায়। এই অনন্তই ঈশ্বর - যা নিত্য, সর্বব্যাপী, জন্ম-মৃত্যু রোহিত । 
যাই হোক, যেকোনো পবিত্র অনুষ্ঠান করবার আগে, অশুভ শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করবার জন্য, আর শুভ শক্তিকে স্ফূরিত করবার জন্য, আমাদের প্রার্থনা খুবই কার্যকরী একটা প্রক্রিয়া। প্রার্থনাতে যিনি ঐকান্তিক, তার কাছে এই ব্যাপারটা স্পর্ষ্ট হয়ে ওঠে। 


--------------------------------------------
--------------------------------
প্রশ্ন  উপনিষদ রহস্যঃ  - প্রথম প্রশ্ন শ্লোক ০১/০১-১৬

প্রশ্ন উপনিষদে ছয়টি প্রশ্ন  ও তার উত্তর দেওয়া আছে। প্রশ্নগুলো হচ্ছে  :

১. এই প্রাণীরা কোথা থেকে আসে ? ২. প্রাণীর দেহে স্থিত ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে  কোনটা দেহেকে ধারন করে থাকে ? ৩. প্রাণ কোথা থেকে আসে - শরীরে কিভাবে প্রবেশ করে -কিভাবে দেহের মধ্যে ছড়িয়ে যায় -কিভাবে  প্রাণ কাজ করে - কিভাবেই বা শরীর  ছেড়ে বেরিয়ে যান ? ৪. মানুষের ইন্দ্রিয়সকল- কে কখন ঘুমায়, কেই বা জেগে থাকে ? ৫. ওম-কে ধ্যান করলে কি লাভ হয় ? ৬. ষোলোকলা বিশিষ্ট পুরুষকে আপনি জানেন কি ? মৃত্যুর সময় আমাদের দেহ ছেড়ে কে বেরিয়ে যায় ? একটা রূপক গল্পের ছলে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হচ্ছে।  শুরুটা এই রকম : 

প্রথম প্রশ্ন : 
 
"ওঁ সুকেশা  চ ভারদ্বাজঃ  শৈবাশ্চ্য সত্যকামঃ সৌর্যায়নী চ গাৰ্গ্যঃ 
কৌশল্যঃ চ আশ্বলায়নঃ ভাৰ্গবো বৈদর্ভীঃ কবন্ধী কাত্যায়নন্তে হৈতে 
ব্রহ্মপরা ব্রহ্মনিষ্ঠাঃ পরম ব্রহ্ম অন্বেষমাণা এষ  হ বৈ তৎ  সর্বং বক্ষ্যতীতি 
তে হ সমিৎ পাণয়ো ভগবন্তং পিপ্পুলাদম উপসন্নাঃ ।" (১/১)

(ঋষি)  ভরদ্বাজ পুত্র সুকেশা, শিবপুত্র সত্যকাম, গর্গবংশীয় সৌর্যায়নী, অশ্বল পুত্র কৌসল্য, বিদর্ভ দেশের ভৃগুর পুত্র ভার্গব, কাত্যায়ন তনয় কবন্ধী - এঁরা সবাই ছিলেন, ব্রহ্মপরা, ব্রহ্মনিষ্ঠ,  পরম  ব্রহ্মের অনুসন্ধান ক্রিয়ায় সমর্পিত প্রাণ। এঁরা সবাই সম্যক ভাবে ব্রহ্মকে জানতে ইচ্ছুক। এবং সেই উদ্দেশ্যে এঁরা সবাই যজ্ঞকাষ্ঠ হস্তে  একদিন গুরু পিপ্পলাদের নিকট উপস্থিত হলেন। 

তো ছয়জন যুবক, সুকেশা , সত্যকাম,  সৌর্যায়নী,  কৌসল্য, ভার্গব, ও  কবন্ধী।  সুকেশা - যিনি কেশবের অনুগামী, সত্যকাম, যিনি সত্যের কামনা করেন, সৌর্যায়নী,  - সূর্য্যের মতো উজ্বল যার দেহ, অর্থাৎ তেজস্বী, কৌসল্য - যিনি দক্ষতা  সম্পন্ন, ভার্গব অর্থাৎ  দেবতেজঃ সম্পন্ন   ও  কবন্ধী - যার দেহের সাথে মস্তকের বন্ধন ছিন্ন হয়েছে।  

তো প্রথমে আমাদের ঈশ্বর বিশ্বাসী হতে হবে, সত্যের প্রতি দৃঢ় নিষ্ঠা রাখতে হবে, সুস্থ  শরীরের অধিকারী হতে হবে, তীক্ষ্ন বুদ্ধি সম্পন্ন হতে হবে, দেবতেজঃ  অর্থাৎ  শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ও শক্তিশালী হতে হবে। সব চেয়ে বড়ো  কথা হচ্ছে, ব্রহ্মকে জানতে গেলে মস্তক নয়, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। তো এই যে ছয়জন যুবকের কথা বলা হলো,  আসলে এরা সবাই জিজ্ঞাসুর গুন্ মাত্র।  এইগুন সম্পন্ন  মানুষ  সগুনব্রহ্ম  অর্থাৎ জগৎ বিষয়ে জ্ঞানী হয়ে থাকেন ।  এঁদের জগৎ সম্পর্কে আর জানবার কিছু নেই।  তো প্রথমে জগৎ বিষয়ের জ্ঞান সংগ্রহ করতে হবে।  তারপরে এই জগৎ যাঁর উপরে দাঁড়িয়ে আছে, বা এই জগতের মধ্যে যে সূক্ষ্ম-অতিসূক্ষ্ম তত্ত্ব  আছে, তার কথা চিন্তা করতে হবে । দেখুন, যার  শরীর  সুস্থ  নয়, যার অর্থচিন্তা দূর হয়নি, যার জাগতিক বিষয়ের প্রতি লোভ রয়েছে, বিষয় বাসনা যার পূর্ন  হয় নি, তার পক্ষে ঈশ্বর চিন্তন সম্ভব নয়।  যিনি পেটে  ক্ষিদে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন,  তাকে ঈশ্বরজ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা বৃথা। আগে শারীরিক সুস্থতা অৰ্জন করুন, মনের মধ্যে থেকে সমস্ত কামনা বাসনা দূর করুন, বা অর্থ চিন্তা দূর করুন, অর্থাৎ আপনার মধ্যে যদি কোনো অভাব থাকে তাকে ভাবে পরিণত করুন। তার পরে ব্রহ্ম চিন্তন করতে পারবেন। আর ব্রহ্ম-চিন্তন তাদের পক্ষেই  সম্ভব যাদের ভোগ শেষ হয়েছে।  যিনি পার্থিব বস্তু অৰ্জনের  কৌশলই  আয়ত্ত্বে আনতে  পারেন নি, তার পক্ষে সেই দুর্লভ ঈশ্বরকে ধরা অসম্ভব। যা সুলভ তা সামনে আছে, যা দুর্লভ তা গভীরে আছে। বেশিরভাগ মহাপুরুষ জন্ম নেয়, রাজার ঘরে। রামচন্দ্র,  বুদ্ধদেব, এঁরা সবাই রাজার ঘরে এসেছিলেন।  গরিবের ঘরে আসে সেই ভগবৎ সত্ত্বা, যিনি সবকিছুর উর্দ্ধে। এঁরা জন্মসিদ্ধ। এঁরা  প্রতিভা কে সঙ্গে নিয়ে জন্মান, এদের প্রতিভা অৰ্জন করতে হয় না।  এঁরা জন্ম-জন্মান্তরের জ্ঞানী, এদের জ্ঞান অৰ্জন করতে হয় না। সাধারণ মানুষ জন্ম নেয় অজ্ঞান অবস্থায়, ধীরে ধীরে মানুষ জ্ঞান অৰ্জন করে থাকে।  কিন্তু ভগবৎ সত্ত্বা, জন্ম-জন্মান্তরের জ্ঞানী। এঁদের পার্থিব দেহও জ্ঞানজ্যোতিঃ স্বরূপ। 

যাইহোক, যে ছয়জন শিক্ষার্থীর নাম করা হয়েছে, এঁরা  সবাই  সগুন ব্রহ্ম-এর কথা জানতেন। এখন এঁরা পরব্রহ্ম জ্ঞান অৰ্জন করতে আগ্রহী। উপনিষদে বলা হচ্ছে, ব্রহ্মপরাঃ অর্থাৎ ব্রহ্মে নিবেদিত প্রাণ । বলা হচ্ছে, এঁদের  আছে ব্রহ্মনিষ্ঠা অর্থাৎ এঁরা সবাই ব্রহ্মে  অনুরাগী।  এরা  সবাই পরম-ব্রহ্ম অন্নেষন মনা - অর্থাৎ এদের মন পরব্রহ্মকে জানতে ইচ্ছুক। পর ব্রহ্মকে জানতে আগ্রহী। যেদিন অন্য সবকিছুকে ছেড়ে কেবলমাত্র আত্মতত্ত্ব জানবার জন্য মন ব্যাকুল  হবে, সেই দিন মানুষ নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে অগ্রাহ্য করে, জাগতিক সমস্ত বস্তু প্রাপ্তির আনন্দকে উপেক্ষা করে, ব্রহ্মানন্দের খোঁজে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, বেরিয়ে পড়ে। ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। নচিকেতার মনে এই প্রশ্ন জেগেছিলো - কেউ বলে আত্মা আছে, কেউ বলে আত্মা নেই, সত্য কি ? হে গুরুদেব আমাকে সত্য করে বলুন। গুরুদেবের কাছে শিক্ষার্থীরা সমিধ কাষ্ঠ নিয়ে উপস্থিত হলো। সমিধ কাষ্ঠ হচ্ছে, অগ্নির খাদ্য। যা থেকে অগ্নি প্রজ্বলিত হয়।  আসলে সমিধ কাষ্ঠ হচ্ছে সেই বস্তু যা পেলে গুরুদেব খুশি হন। সমিধ কাষ্ঠ হচ্ছে, সেই  শিষ্য যার মধ্যে জ্ঞানাগ্নি সুপ্ত অবস্থায় আছে।  কেবল গুরুদেবের স্পর্শের অপেক্ষায়। গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা, বিনয়, এবং ব্রহ্মজ্ঞান লাভের  সুতীব্র  আগ্রহের প্রতীক হচ্ছে সমিধ কাষ্ঠ। 

ঋষিগুরু পিপ্পলাদ হচ্ছেন, মহর্ষি দেবদর্শের মহান শিষ্য। ইনিই অথর্ব্ব বেদের একটা শাখা প্রস্তুত করেন। এই শাখার  নাম হচ্ছে, পিপ্পলাদি শাখা। পিপ্পল কথাটার অর্থ হচ্ছে অশ্বথ বৃক্ষ। পিপ্পল-আদি বা ইত্যাদি হচ্ছে সেই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষকুল যাঁদের  আশ্রয়ে বহু ব্রহ্মজিজ্ঞাসু আশ্রয় পেয়ে থাকেন। তো আজ আমরা সেই পিপ্পলাদ নামক ব্রহ্মজ্ঞ  পুরুষের দেওয়া ব্রহ্মজ্ঞান সমুদ্রে অবগাহন করবো।  
-------------- 



" তান হ স ঋষিঃ উবাচ ভূয় এব  তপস্যা ব্রহ্মচর্যেণ শ্রদ্ধয়া সংবৎসরং সংবৎস্যথ 
যথাকামং প্রশ্নান পৃচ্ছত যদি বিজ্ঞাস্যামঃ সর্বং হ বো বক্ষ্যাম ইতি। "(১/২) 

ঋষি (পিপ্পলাদ) তাঁদের বললেন, তপস্যা, ব্রহ্মচর্য এবং শ্রদ্ধা নিয়ে (শাস্ত্র ও গুরুর প্রতি) এক বছর আমার সঙ্গে একত্রে বাস করো। তারপর, তোমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী প্রশ্নসমূহ জিজ্ঞেস করো।  যদি আমি সেই জিজ্ঞাসার উত্তর জানি, তবে সেসব আমি তোমাদেরকে বলবো। 

ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, আমি যদি জানি, তবেই তোমাদের প্রশ্নের উত্তর দেবো। যথার্থ আচার্য্যের এই হচ্ছে, মনোভাব, অর্থাৎ সহজ-সরল ও অত্যন্ত বিনয়ী - সবজান্তা ভাব নেই, জ্ঞানের গর্ব্ব নেই।  

দেখুন, বিদ্যা দানেই বৃদ্ধি পায়। কিন্তু অনধিকারীকে এই দান ভষ্মে ঘি ঢালার সামিল। তো ব্রহ্মবিদ্যা উপযুক্ত অধিকারীকে না দিলে, সেই ব্রহ্মবিদ্যা ফল প্রদান করে না। এই জন্য, জিজ্ঞাসুকে  নিজের কাছে রেখে, তার হৃদয়ের নির্ম্মলতা, বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা, মনের শুদ্ধ ও উচ্চ ভাব , এমনকি তার মনের মধ্যে চলা যে চিন্তাধারা, এই সবকিছু  ব্রহ্মজ্ঞানের উপযুক্ত কি না তার পরিচয় নিতে হয়। আবার নিজের পরিচয়ও  জিজ্ঞাসুকে দিতে হয়। আর এর জন্য কমপক্ষে এক বৎসর, অর্থাৎ সম্বৎসরের প্রত্যেকটি ঋতুতে জিজ্ঞাসুর মনের কি অবস্থা হয়, তা একবার পরীক্ষা করে নিতে হয়। আপনারা যাঁরা  সাধন জগতের মানুষ তাঁরা  লক্ষ করে থাকবেন, দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময় সাধনার পক্ষে উপযুক্ত। এই সময় সাধন ভজন অধিক ফল প্রদান করে থাকে, এইসময় মনের একাগ্রতা, শরীরের স্থিরতা বেশি থাকে  ।  যেমন ভোরবেলা, বা সন্ধ্যার সময় মানুষ এই সাধন ভজন করে থাকে।  আবার বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময়, সাধন ভজনের গুরুত্ত্বপূর্ন।  যেমন শরৎকাল, হেমন্তকাল, ও বসন্ত কাল। এই সময় সাধনার ফল অধিক হয়ে থাকে।  শীতে আমরা জবুথবু হয়ে যাই, আবার গরমে আমরা ছটফট করি। বর্ষায় মন আনচান করে।  তাই কমপক্ষে  একবছর এই পরীক্ষার প্রয়োজন হয়ে থাকে। ঠিক এই কারনে কিনা জানিনা, বছরের এই সময়গুলোতে নানান রকম দেবদেবীর পুজোর আয়োজন করা হয় থাকে।  শরৎকালে বিশ্বকর্ম্মা,  দুর্গাপুজো দিয়ে শুরু আর শেষ হয়, দোলযাত্রাতে। 
এবার কথা হচ্ছে, এঁদেরকে  নিজের কাছে রেখে দেবার দরকার কি ? বললেই তো পারতেন, তোমরা ব্রহ্মচর্য্য তপঃ সাধন ইত্যাদি এক বছর ঘরে বসে অভ্যাস করবার পরে, আমার কাছে এসো। তা না বলে, তিনি এদেরকে নিজের কাছে রেখে দিতে চাইলেন।  কারন হচ্ছে, গুরু যেমন শিষ্যদেরকে পরীক্ষা করেন, তেমনি শিষ্যদেরও উচিত গুরুদেবকে যাচাই করে নেওয়া। গুরুদেবের দৈনিন্দিন জীবনচর্চার মধ্যে তাঁর উৎকর্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। তো গুরুদেবের সান্নিধ্যে না থাকলে, গুরুদেবকে চেনা যায় না। তার প্রতি শ্রদ্ধাও আসে না। আর এই কারণেই ঋষি পিপ্পলাদ  এই ছয় যুবককে অর্থাৎ ব্রহ্মজিজ্ঞাসুদেরকে তাঁর  নিজের কাছে, নিজের আশ্রমে বসবাস  করবার নির্দেশ দিলেন। আর এই একবৎসর যাবৎ তাদেরকে শ্রদ্ধা সহকারে তপস্যা, ও ব্রহ্মচর্য্য পালনের নির্দেশ দিলেন। 

তো ব্রহ্মজ্ঞানের জন্য আমরা তিনটে উপাসনার  কথা শুনলাম। শ্রদ্ধা, তপস্যা, ও ব্রহ্মচর্য্য।  

প্রথমে হচ্ছে শ্রদ্ধা। আপনি যা কিছু করুন না, কেন সেই কাজে যদি আপনার শ্রদ্ধা না থাকে, তবে সেই কাজে সুফল আসে না। অশ্রদ্ধা সহকারে  শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ, বৃথা পন্ডশ্রম মাত্র। আচার্য্যের প্রতি শ্রদ্ধা, আচার্য্যের বাক্যের প্রতি শ্রদ্ধা, এবং যে কাজ করছেন, অর্থাৎ যোগ-ধ্যান যা কিছুই করুন না কেন, সেই কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধা থাকা জরুরি। এর পরে হচ্ছে তপস্যা। তপস্যা হচ্ছে নিজেকে তাপিত করা, নিজেকে আলোকময় করা। এই তাপ  ও আলো  হচ্ছে  শক্তির রূপ। যার অন্তর  তাপিত তার হৃদয়ে প্রাণ উর্দ্ধমুখী হয়ে শক্তির সঞ্চার করে।  নিজের মধ্যে অগ্নি প্রজ্বলিত করতে হবে। এই অগ্নি প্রজ্বলিত করতে গেলে, যেমন নানাবিধ যোগক্রিয়ার অভ্যাস করতে হয়, তেমনি মনকে বহির্মুখ থেকে ঘুরিয়ে অন্তর্মুখী করে ধ্যানস্থ হতে  হবে।  মন যখনই  অন্তর্মুখী হবে, তখন মনের বৃত্তি সকল সংযত  হবে। আর এই সংযত বৃত্তি মনের মধ্যে একটা বিশেষ তেজের সৃষ্টি করবে। মনের মধ্যে এই তেজকে প্রজ্বলিত করা, ও তাকে ধীরে  ধীরে বৃদ্ধি করাই  আসল তপস্যা। মনের মধ্যে তখন বৃহতের সংস্পর্শে আসবার জন্য একটা ব্যাকুলতা জন্মাবে। অগ্নি যেমন বায়ুকে উর্দ্ধমুখী করে, তেমনি তপঃ সাধিত  মন বৃহতের কামনা করবে। তখন আর এই ক্ষুদ্র সংসারের মধ্যে মন আটকে থাকতে চাইবে না। মনকে অসীমের দিকে তুলে ধরতে হবে। শরীর মন এবং বাককে তপস্যার সাহায্যে সংযত করতে হবে। 

আর এই দেহ-মনের শুদ্ধতা আনবার জন্য, ব্রহ্মচর্য্য ইত্যাদি পালন করতে হবে। ব্রহ্মচর্য্য অর্থাৎ কায়-মন-বাক্যে সংযমের অভ্যাস করতে হবে। শারীরিক ভাবে তপঃ সাধন করলে, মন এমনিতেই অহিতকর কার্য্যে লিপ্ত হতে পারে না। এই শুদ্ধ মনেই যথার্থ জ্ঞানের পিপাসা তীব্র হয়ে থাকে। এই সময় মন শাস্ত্রাদির প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। গুরুবাক্যের প্রতি মনোযোগ বাড়ে। অপরের কল্যাণ কামনা, এমনকি নিজের মধ্যে একটা সৌম্যভাব জেগে ওঠে। 

বলা  হয়,  তপস্যা ব্রহ্মচর্য্য ও শ্রদ্ধা মানুষের মধ্যে ক্ষাত্রতেজকে বৃদ্ধি করে। সাধন পথের  সমস্ত বাধা ধৈর্য্য সহকারে অতিক্রম করবার জন্য, মনের মধ্যে একটা তীব্র শক্তির অনুভব হয়ে থাকে। জীবনের উচ্চ আদর্শের জন্য, তামসিক বাধাকে দূর করবার জন্য, আত্মস্থিত হবার জন্য, নিজের মধ্যে শক্তির সঞ্চার হয়ে থাকে।  আর এই কারণেই, ঋষি পিপ্পলাদ, জিজ্ঞাসুদেরকে একবছর ধৈর্য্য ধরে  কৃচ্ছ্রসাধন, ও আত্মসংযমের অভ্যাস করতে বললেন। আসলে এই একবৎসর গুরুগৃহে থাকবার  সুযোগে তারা যেন ঋষি পিপ্পলাদকেও, ভালোভাবে সামনে থেকে প্রতক্ষ্য করে নিতে পারে, তার সুযোগ  করে দিলেন। 

----------------বলা হয়, বেদ  অপৌরুষেয়।  অর্থাৎ বিশেষকোনো পুরুষের লেখা নয়। গুরুপরম্পরায় মুখেমুখে যে জ্ঞান শিষ্যদেরকে দেওয়া হতো, তাকে বেদ  বলা হয়। ঋষি ব্যাসদেব প্রথমে এই জ্ঞান একত্রিত করে লিপিবদ্ধ করেন। সমস্ত উপনিষদ এই বেদ  থেকেই  নেওয়া হয়েছে।  প্রশ্ন উপনিষদ অথর্ব্ব বেদের অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ আছে।ঋষিগুরু পিপ্পলাদ হচ্ছেন, মহর্ষি দেবদর্শের মহান শিষ্য। ইনিই অথর্ব্ব বেদের একটা শাখা প্রস্তুত করেন। এই শাখার  নাম হচ্ছে, পিপ্পলাদি শাখা।  

----------------------------

প্রশ্ন উপনিষদ শ্লোক - ০১/০৩

"অথ কবন্ধী কাত্যায়ন উপেত্য  পপ্রচ্ছ।  ভগবন  কুতো হ বা ইমাঃ প্রজাঃ প্রজায়ন্ত ইতি । "(১/৩)

এখন (একবছর পরে) কত্য-তনয়  কবন্ধী (ঋষি পিপ্পলাদের কাছে) উপস্থিত হলেন, এবং প্রশ্ন করলেন, হে প্রভু, এইসব প্রাণীগণ কোথা থেকে আসে ? 

প্রথম প্রশ্ন, প্রশ্নকর্ত্তা কবন্ধী। কবন্ধী কথাটার অর্থ যার দেহ থেকে মস্তক আলাদা হয়ে গেছে। অর্থাৎ যিনি বিচারের দ্বারা, বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত নন। তার প্রশ্ন হৃদয়ের প্রশ্ন।  প্রাণীগণ কোথা থেকে আসে ? আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, ঋষিপুত্রগন এসেছেন, ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে, তাহলে, প্রাণীগণ কোত্থেকে আসে, এই প্রশ্নের সার্থকতা কোথায় ? সরাসরি এই প্রশ্ন দিয়েই শুরু করতে পারতেন, ব্রহ্ম কি, কিভাবেই বা আমরা সেই ব্রহ্মকে জানতে পারবো। একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, এই যে ঋষিপুত্রগন, এরা কেউ আমাদের মতো সাধারণ মানুষ নন, এরা  সবাই পার্থিব বিষয় জ্ঞানের উচ্চে অবস্থান করছেন। তো তাদের প্রশ্নের মধ্যেও একটা ধারাবাহিকতা আছে। আসলে বিষয়  তো ব্রহ্ম, কিন্তু সরাসরি ব্রহ্মবিদ্যা প্রাপ্ত হওয়া যায় না। 

ঋষিপুত্রগন জানেন,  গুনভেদে ব্রহ্ম দ্বিবিধ, সগুন ও নির্গুণ। যা কিছু দৃশ্যমান, তার উৎস ও পরিণতি সম্পর্কে আমরা না জানতে পারলে, সেই পরমতত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া  যাবে না।  সৃষ্টি তত্ত্বকে না ধরতে পারলে, সৃষ্টির রহস্যকে  উন্মোচন না করতে পারলে, ব্রহ্মতত্ত্বকে আমরা আমাদের ধারণার মধ্যে আনতে  পারবো না। কেননা ব্রহ্ম  বিষয়ে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। কিন্তু আমরা চোখের সামনে যা কিছু দেখছি, তার সম্পর্কে আমাদের ধারণা  করা সহজ। আসলে, আপনার লক্ষ যাই হোক না কেন, আপনি যেখানে আছেন, সেখান থেকে আপনার যাত্রা শুরু করতে হবে। যেখানে আপনি যাবেন, অর্থাৎ যেখানে আপনার গন্তব্য, সেখান থেকে যাত্রা শুরু করা যায় না। আর এই কারণেই, কবন্ধী প্রাণ অর্থাৎ প্রাণী সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। জীবের বেঁচে থাকবার, অন্যতম সহায় হচ্ছে, প্রাণবায়ু। যা আমাদের শ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করছে, আবার বেরিয়ে হচ্ছে। আর এই প্রাণ বায়ুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাই, কবন্ধী প্রথমেই  বায়ু সম্পর্কে প্রথম প্রশ্ন করলেন। বায়ুকে আমরা চোখ দিয়ে দেখতে না পারলেও, বায়ুকে আমরা ত্বক দিয়ে অনুভব করতে পারি। বায়ু যে সর্বত্র অনুসৃত হয়ে আছে, এই সত্য আমাদের কাছে বোধগম্য। আর এই বায়ুই যে সমস্ত প্রাণীকে বাঁচিয়ে রেখেছে, এই সত্য আমাদের কাছে প্রতক্ষ্য সত্য, অভিজ্ঞতা লব্ধ  জ্ঞান। আর এই কারণেই, কবন্ধী  প্রথমে বায়ু বা প্রাণের কথা জিজ্ঞেস করলেন। আসলে সৃষ্টি ও স্রষ্টা  অভিন্ন।  সৃষ্টিকে জানতে পারলে, আমাদের কাছে স্রষ্টার সম্পর্কে একটা ধারণা  করতে পারবো। তো কবন্ধীর প্রথম প্রশ্ন খুবই গুরুত্ত্বপূর্ন - কোথা থেকে আসে জীব ? 
--------------------
প্রশ্ন উপনিষদ শ্লোক - ০১/০৪

"তস্মৈ স হোবাচ - প্রজাকামো বৈ প্রজাপতিঃ স তপঃ অতপ্যত স তপঃ তপত্বা  স মিথুনম উৎপাদয়তে। রয়িং চ প্রাণং চত্যেতৌ মে বহুধা প্রজাঃ করিষ্যত  ইতি।" (১/৪) 

তাঁকে (কবন্ধীকে) তিনি (ঋষি পিপ্পলাদ) বললেন, সেই প্রজাপতি প্রজা কামনা ক'রে, তপস্যা অর্থাৎ চিন্তা করলেন। তপস্যার  ফল স্বরূপ এটা উপলব্ধি করলেন, যে রয়ি (অর্থাৎ  প্রাণ-চন্দ্র-অন্ন)  এবং সূর্য (ভোক্তা) এই দুইয়ের মিথুনে বহু প্রজার সৃষ্টি হবে (অর্থাৎ উৎপাদন কার্য্য সম্পাদিত হবে) .

মনের মধ্যে যে ভাবের উদয় হয়, মনের মধ্যে যে চিন্তার উদয় হয়, সেই ভাব- সেই চিন্তা একসময় বাস্তবে পরিণত হয়। আপনি কোনো একদিন হয়তো ভেবেছিলেন, ইট-কাঠ-পাথর দিয়ে একটা বাড়ি তৈরী করবেন। আপনি হয়তো কোনো দিন ভেবেছিলেন, পড়াশুনা করে একদিন চাকরি করবেন, আপনি হয়তো একদিন ভেবেছিলেন, আপনার স্ত্রী হোক, পুত্র হোক, কন্যা  হোক। আজ হয়তো সে সব হয়েছে। আপনি যদি আজ জনক/জননী হন, আপনি যদি বাড়ির মালিক হন, তবে জানবেন, একদিন না  একদিন, আপনার মনের মধ্যে এই বাড়িঘর, স্ত্রী-পুত্র চিন্তা আকারে জন্ম নিয়েছিল। আর সেই চিন্তাই আপনাকে কর্ম্মে প্রবৃত করেছে, এবং আপনার মনের চিন্তা মনের ভাবনা বাস্তবে রূপ পেয়েছে। এর মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা  কিছু নেই। আপনার ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়িত করবার জন্য, আপনি একদিন এই রসদের সন্ধান করেছিলেন।  তো কোনো কিছু সৃষ্টি করতে গেলে যেমন আমাদের প্রথমে চিন্তা করতে হয়, তেমনি জগৎ সৃষ্টি রহস্যের মধ্যে নিহিত আছে, এই চিন্তা। এখন কথা হচ্ছে, চিন্তা উদয় হয়েছিল, আমাদের মনে, তাই আমরা বাড়ি-ঘর-পুত্র-কন্যা লাভ করেছিলাম। আমাদের সবার একটা আলাদা আলাদা মন আছে, এই মনকে আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু বেশ উপলব্ধি করতে পারি। তেমনি এই ব্রহ্মান্ডের একটি মন আছে, যাকে বলা হয়, সমষ্টি মন। অর্থাৎ আমাদের সবার মনের যে উৎস তাকে বলা হয়, সমষ্টি মন। এই সমষ্টি মনের চিন্তন থেকেই প্রথম সৃষ্টির কল্পনা করা হয়েছিলো। এখন কথা হচ্ছে, শুধু চিন্তা করলেই কি আমাদের স্ত্রী-পুত্র-ধন-দৌলত প্রাপ্তি হবে ? হবে না, এর জন্য দরকার সৃষ্টির উপাদান, বা সামগ্রী, সংগ্রহ করা। আমরা যেমন এই সৃষ্টির মূল উপাদান এই পৃথিবী থেকেই সংগ্রহ করি, তেমনি, সমষ্টি মনের অধিকারী বুঝতে পেরেছিলেন, যে সৃষ্টির উপাদান আছে এই চন্দ্র-সূর্য্যের মধ্যে। এই চন্দ্র সূর্যের মিথুনে তৈরী হতে পারে প্রজা সকল। 

সুতরাং ভাব বা আবেগ থেকেই সৃষ্টি। সৃষ্টির এই মূল ভাব বা ইচ্ছে যিনি ধারণ করে থাকেন, তাকে বলা হয় হিরণ্যগর্ভ। এই হিরণ্যগর্ভকেই বলা হয় প্রজাপতি। হিরণ্যগর্ভ হচ্ছে, চেতনার বিক্ষুব্ধ অবস্থা। তো প্রজাপতির এই সৃষ্টি বাসনা  থেকে দুটো শক্তির আবির্ভাব হলো।  রয়ি ও প্রাণ। রয়ি বা চন্দ্র  হচ্ছেন শক্তির প্রতীক। আর প্রাণ হচ্ছে সূর্য।  এই রয়িকে বলা হয় অন্ন, অর্থাৎ ভোগ্য, আর সূর্যকে বা প্রাণকে বলা হয় ভোক্তা। এই দুটো আলাদা নয়, একজন আরেকজনকে ধারণ করে আছে। আসলে খাদ্য ও খাদক একত্রে বাস করে থাকে। গাছে ফুল ফল হলে দেখবেন, কোথা থেকে ভ্রমর, পাখিরা এসে গেছে। এক টুকরো চিনি রাখলেই দেখবেন পিঁপড়ে এসে গেছে। এমনকি ফলটা ফলে রাখলে, একদিন পচা  ফলে পোকা অর্থাৎ প্রাণের জন্ম হবেই। খাদ্যের সঙ্গে খাদকের একটা সন্মন্ধ আছে। আমরা মারা গেলে, আমার গলিত মৃত-দেহের মধ্যে পোকার জন্ম হবে। 

অন্ন দ্বারা যেমন আমাদের শরীর  পুষ্টি লাভ করে থাকে, তেমনি এই খাদ্যকে  হজম বা জীর্ন করে থাকে আমাদের জঠরাগ্নি।  প্রাণ ত্রিবিধ সূর্য, অগ্নি বা  ভূতাগ্নি, যা আমরা দাহ্য পদার্থ থেকে পাই, আর  জঠরাগ্নি, যা আমাদের খাদ্য হজম করতে সাহায্য করে থাকে।  এই জঠরাগ্নিকেই বলা হয় বৈশ্বানর ব্রহ্ম।   
অন্ন ভোগ্য বা খাদ্যবস্তুকে প্রাণ বা  ভোক্তা গ্রহণ করছে। তো অন্নই প্রাণকে টেনে এনেছে। আর এঁদের  এই মৈথুন ক্রিয়াই জগৎ সৃষ্টি ও রক্ষার মুলে। উপনিষদে এই প্রাণতত্বকে পরিস্ফুট করা হয়েছে অন্ন ও অন্নাদ, ভোগ্য ও ভোক্তা, চন্দ্র-সূর্য, রয়ি-প্রাণ ইত্যাদি রূপে। 

আসলে হিন্দু শাস্ত্র কখনোই জন্ম-মৃত্যুতে বিশ্বাস করে না। জন্ম-মৃত্যু একটা চক্র মাত্র যা আসলে প্রাণের গতিপথ। যতক্ষন সূর্য আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়, তখন আমরা তাকে দিন বলি, আবার সূর্য যখন অস্ত  যায়, তখন তাকে আমরা রাত্রি বলি। ঠিক তেমনি প্রাণ যখন প্রকাশিত হয়, তখন জীবন আবার প্রাণ যখন অপ্রকাশিত থাকে, তখন তাকে আমরা মৃত্যু বলে থাকি।  প্রাণের কখনো বিনাশ নেই। প্রাণ সব সময় আছে, কখনো কারন রূপে, আবার কখনো কার্য্য রূপে। প্রাণ যখন কার্যরূপে থাকে তখন তাকে আমরা জীবন বলি, আবার প্রাণ যখন কারন রূপে থাকে তখন তাকে আমরা মৃত্যু বলি। আসলে এই জগৎ কারুর সৃষ্টি নয়, এই জগৎ একটা প্রকাশ মাত্র, একটা অভিব্যক্তি মাত্র। প্রজাপতি থেকে জগৎ প্রকাশিত হয়, আবার সেই প্রজাপতিতেই জগৎ নিষ্প্রভ হয়ে হয়। এই জগৎ প্রকাশের জন্য প্রজাপিত সংকল্প বা গভীর চিন্তা ছাড়া কিছুই করেন না।  আর এই সংকল্প থেকেই প্রাণ ও রয়ি বা সূর্য ও চন্দ্রের প্রকাশ ঘটেছে। চন্দ্রের স্নিগ্ধতা অন্নকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করছে, আবার এই অন্নকে  ভোগ করবার জন্য সূর্য বা প্রাণ এসে উপস্থিত হচ্ছে অন্নের মধ্যে। এই হচ্ছে জগৎ প্রকাশের গূঢ়  রহস্যঃ।  

প্রশ্ন উপনিষদ শ্লোক - ০১/০৫

"আদিত্যো হ বৈ প্রাণো রয়িঃ এব চন্দ্রমা রয়ির্বা এতৎ সর্বং যৎ মূর্তং চ অমূর্তং চ তস্মান মূর্তিরেব রয়িঃ । "(১/০৫)

আদিত্যই প্রাণ। রয়ি হচ্ছে চন্দ্র।  যা কিছু  মূর্ত অথবা অমূর্ত উভয়ই খাদ্য। 

এই পর্যন্ত ঋষি পিপ্পলাদের কাছ থেকে যা আমরা শুনতে পেলাম, তাকে সৃষ্টির পিছনে তিনটি তত্ত্বের সন্ধান পেলাম। প্রথম হচ্ছেন, প্রজাপতি - যিনি চিন্তা করলেন।  তো চিন্তা কে করতে পারে ?  যাঁর চেতনা আছে । তো প্রজাপতি বলে যাঁকে উল্লেখ করা হচ্ছে তিনি অবশ্যই চৈতন্যবান। দ্বিতীয় পেলাম প্রাণ যাঁকে আদিত্য বা সূর্য বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। ইনি  অর্থাৎ এই প্রাণ, আদিত্য, বা সূর্য যে নামেই তাঁকে ডাকা হোক না কেন, আসলে ইনি  ভোক্তা, ইনিই রশ্মি । সবশেষে পেলাম রয়ি বা চন্দ্র। 
রয়ি কথাটা বাংলা সংসদ অভিধানে খুঁজে পেলাম না। শ্রীমৎ স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী বলছেন, "রি" এবং "রৈ" এই উভয় ধাতু থেকে নিস্পন্ন হতে পরে। "রি" ধাতুর অর্থ শক্তি, বা ঐশর্য্য। আবার "রৈ" কথাটার অর্থ শব্দ, স্বর্গ, ধন ইত্যাদি । ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, চৈতন্য থেকে যখন সৃষ্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে, তখন তার অবলম্বন হয় এই প্রাণ ও রয়ি। সূর্যকে কেন্দ্র করে তিনটি  লোক  (ভূঃ ভূব স্বঃঃ ) . আবার অনন্ত কোটি সূর্য (নক্ষত্র) আছে,  এই অনন্ত কোটি সূর্য্যের যিনি অধিপতি তিনি হচ্ছেন চন্দ্র। এই চন্দ্রকে বল হয় সোম বা অমৃত। এই ব্যাপাটা বুঝতে আমদের একটু কষ্ট  হবে।  কারন আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, চন্দ্র হচ্ছে পৃথিবীর  উপগ্রহ, কিন্তু এখানে যে চন্দ্রের কথা বলা হচ্ছে, তা পৃথিবীর উপগ্রহ চন্দ্র নয়। আমরা জানি, সূর্য (নক্ষত্র) শুধু এই দৃশ্যমান একটি আলোকখন্ড রূপ সূর্য নয়, এছাড়াও যে কোটি কোটি সূর্য আছে, সেই আদিত্যলোকের পর হচ্ছে চন্দ্রলোক। বলা হচ্ছে সূর্যলোক এবং আদিত্যলোক ব্যাপ্তির দিক থেকে যেমন আলাদা তেমনি আমরা যে চন্দ্র দেখি, তার উর্দ্ধে আছে আরো একটা চন্দ্রলোক। এই চন্দ্রলোক হচ্ছে সেই চন্দ্রলোকের প্রতিচ্ছবি - ভোগভূমি । চাঁদের সঙ্গে সূর্য্যের যে সম্পর্ক, প্রাণের সাথে রয়ির সেই সম্পর্ক। ঋষি বলছেন, "যৎ মূর্তং চ অমূর্তং" যাকিছু আকার বিশিষ্ট, অর্থাৎ পৃথিবী, জল, তেজঃ, আবার যা-কিছু  নিরাকার অর্থাৎ আকাশ বায়ু এ সমস্তই রয়ি। আর এই যে দৃশ্যমান জগৎ এই প্রাণ ও রয়ির  মিশ্রনে প্রকাশমান হয়েছে।  যাইহোক, সূর্য আমাদের জীবনীশক্তির বা প্রাণের ঘনীভূত রূপ।  আর চন্দ্র হচ্ছে ভূতগুলোর (পঞ্চভূতের) পুষ্টিকারক শক্তি। তো আমাদের স্থূল শরীরের পোষন হয় চন্দ্রিমা শক্তির দ্বারা আবার জীবনীশক্তির পোষন হয় প্রাণ বা সূর্য্যের শক্তি দ্বারা। 
 তো এই জগৎ দুই বস্তুর সমাহার। একজন খাদ্য  আর একজন খাদক।  একজন সূক্ষ্ম একজন স্থূল। একজন প্রাণ একজন রয়ি। একজন পুরুষ একজন প্রকৃতি, আর এই প্রাণকে ধারণ  করে আছে রয়ি। আপাত দৃষ্টিতে প্রাণ ও রয়িকে  খাদ্য ও খাদককে আলাদা বলে মনে হলেও, বস্তুত এরা  অভিন্ন। 
--------------
প্রশ্ন উপনিষদ শ্লোক - ০১/০৬

"অথ আদিত্য উদয়ন  যৎ প্রাচীং  দিশং প্রবিশতি তেন প্রাচ্যান প্রাণান রশ্মিষু সন্নিধত্তে  ।  যৎ  দক্ষিণাং যৎ প্রতীচীং যৎ উদীচীং যৎ অধঃ যৎ ঊর্ধ্বং যৎ অন্তরা  দিশঃ  যৎ সর্বং প্রকাশয়তি তেন সর্বান  প্রাণান রশ্মিষু সন্নিধত্তে । "(১/৬)

আদিত্য উদিত হয়ে যেমন পূর্ব  দিগন্তে প্রবেশ ক'রে তাঁর নিজ  রশ্মি  দ্বারা পূর্ব দিকে অবস্থিত সমস্ত প্রাণীকে প্রাণ দান করেন, তেমনি দক্ষিণ, উত্তর পশ্চিম উপর নিচ কাছে দূরে সমস্ত দিকে রশ্মি  ছড়িয়ে  প্রাণ দান করেন।  এইভাবেই  সূর্য রশ্মি সমস্ত প্রাণকে সঞ্জীবিত করে থাকেন  । এই আদিত্য শব্দটি আমরা একটু ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করি। 

 ব্রহ্মার মানস পুত্র হচ্ছে মরীচি (রশ্মি) , অর্থাৎ আত্মার তেজঃ রশ্মি।  এই মরিচীর পুত্র হচ্ছে কশ্যপ।  এই কশ্যপ হচ্ছেন মদ-মাতাল (কশ্য =মদ, প = যিনি পান করেন) অর্থাৎ ক্ষুব্ধ, যার আচরণ কোনো বিধি  নিয়ম মেনে চলে না।   এই কাশ্যপের দুই পত্নী, দিতি ও অদিতি। অদিতির গর্ভে কশ্যপের পুত্রগণ হচ্ছেন, বিবস্বান, অর্য্যমা, পূষা, ত্বষ্টা, সবিতা, ভগ, ধাতা,  বিধাতা, বরুন, মিত্র, শত্রু, এবং উরুক্রম,এই বারোজন। এদের সবাইকেই আদিত্য বলা হয়।  তো দ্বাদশ আদিত্য। মতান্তরে, ঋকবেদে ৬, তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা আছে ৮। যাইহোক, বলা হয়, সূর্য্যের বারো মাসে যে বিভিন্ন মাত্রায় এবং বিভিন্ন প্রকারের  তেজঃ দৃষ্ট হয়, বা নির্গত হয়, তাকে দ্বাদশ আদিত্য বলা হয়। এই অদিতির সন্তানদেরকে  বলা দেবতা।  আর অন্যদিকে দিতির গর্ভজাত সন্তানদের বলা হয় দৈত্য।  

যাইহোক,  রশ্মি বা সূর্য্যরশ্মিই প্রাণশক্তির আধার। এই সূর্য্যরশ্মিকে আশ্রয় করে, প্রাণশক্তি দশ দিকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। এখন কথা হচ্ছে, প্রাণ অমূর্ত, কিন্তু আদিত্য রশ্মি মূর্ত। অর্থাৎ প্রাণের প্রকাশ হচ্ছে এই আদিত্য। সৌর জগতে প্রাণ এই আদিত্যরশ্মিকে আশ্রয় করে সমস্ত কিছুকে প্রাণবন্ত করছে। একদিক থেকে বলতে গেলে, এই সূর্য হচ্ছে আমাদের আত্মস্বরূপ। 

তো অদিতি থেকে আদিত্য, আর দিতি থেকে দৈত্য। অদিত  অর্থাৎ যাকে  খন্ড করা যায় না। অখন্ড চেতনা বা জ্ঞান। আর দিতি অর্থাৎ অজ্ঞান বা খণ্ডিত চেতনা। এই অখন্ড চেতনার অধিকারীকে বলা হয় দেবতা। 

উপরোক্ত শ্লোকে বলা হচ্ছে "তেন সর্বান  প্রাণান রশ্মিষু সন্নিধত্তে" । (১/৬)  - এই আদিত্যের রশ্মিকে আশ্রয় করে, প্রাণের ধারা এই মর্তলোকে নেমে এসেছে।  আমরা শুনেছি, যোগীপুরুষগন এই রশ্মিকে আশ্রয় করে নাকি, অমৃতলোকে গমন করে থাকেন। আদিত্যের এই প্রানধারাই বিশ্বকে প্রাণবন্ত করেছে। আদিত্যের রশ্মি ধারা ধরেই, প্রাণের প্রবাহ সমগ্র বিশ্বে ছেয়ে  আছে। 

যোগরাজ বলছেন, সমস্ত মনুষ্য দেহে, মস্তিষ্কের ঠিক মধ্যভাগে একটা ক্ষুদ্রাদিক্ষুদ্র বিন্দু বা ছিদ্র লক্ষ করা যায়।  এর  সঙ্গে ব্রহ্মরন্ধ্রের অর্থাৎ সুষুম্নার উপরিভাগের একটা যোগসূত্র  আছে। মস্তিকের তালুতে স্থিত  এই বিন্দুর সাহায্যেই  মানুষ মহাকাশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছে। বিশ্বশক্তি সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করছে।  মানুষের মূলাধারের যে শক্তি, সেই শক্তিকে  যোগীপুরুষগন সুষুম্না পথে উর্দ্ধগামী করে সহস্রার  স্থিত যে পরমচেতনা তার সঙ্গে মিশিয়ে, নিজে ব্রহ্মময় হয়ে যান।  
------------------------

প্রশ্ন উপনিষদ শ্লোক - ০১/০৭

" স এষ বৈশ্বানরো বিশ্বরুপঃ প্রাণঃ অগ্নিঃ উদয়তে। তৎ এতৎ ঋচা অভ্যুক্তম । "(১/৭)

তিনি সকল প্রাণীর অন্তরে নিহিত বৈশ্বানর। তিনিই বিশ্বরূপ অর্থাৎ জগতের সমস্ত রূপই তিনি। প্রাণ বা আদিত্য, অগ্নিরূপে উদয় হচ্ছেন ।  একথাই ঋক-মন্ত্রে বলা হয়েছে। 

প্রাণরূপ আদিত্যই ক্রমানুসারে সূর্য, অগ্নি, বৈশ্বানর  ইত্যাদি রূপে প্রকাশ পাচ্ছেন । জগতের সব রূপই সূর্য্যের। বৈশ্বানর অর্থাৎ বিশ্বপ্রাণ যখন নরের আকৃতি ধারণ করেন। এই প্রাণই অগ্নি রূপে খাদ্যকে পরিপাক করে,দেহকে সজীব রাখছে।  
আমার ভাবতে অবাক লাগে, বহু যুগ আগে ভারতের মুনি ঋষিদের হৃদয়ে প্রশ্ন জেগেছিলো, মানুষ কিভাবে শ্রেষ্ঠত্ব অৰ্জন করতে পারে ? জীবনের সার্থকতা কোথায় ? জীবনের চরম উৎকর্ষতা  লাভের  উপায় কি ? আর এর উত্তর তাঁরা  পেয়েছিলেন এইভাবে -  জীবনে শিক্ষা ও ধর্ম্ম যদি একই উদ্দেশ্যে চালিত হয়, তবে জীবন সমস্যার সমাধান যেমন হতে পারে, তেমনি হতে পারে জীবনের চরম প্রাপ্তি। মানুষের এই যে চরম প্রাপ্তি, তা দেহ-মনের উর্দ্ধে। আমাদের দেহ-মনের যে সংঘাত তা কেবল পশুজীবন। এই পশুজীবনের পারে যেতে হবে, আর তা হতে পারে, একমাত্র নিজের মধ্যে বিবর্তনের মাধ্যমে। প্রত্যেক মানুষের  নিজের অন্তরে ক্রমবিকাশের এক ধারা প্রবাহিত হচ্ছে, এই ক্রম-বিকাশ মানুষকে একদিন চরম উৎকর্ষতা এনে দেবে। পশু জীবনের যে অনুভুতি, সাধারণ  মানুষের যে অনুভূতি, সেখানে থেকে বেরিয়ে একটা  উন্নততর অনুভূতির জগতে  প্রবেশ করতে হবে। আমাদের উপনিষগুলো, এই উন্নততর অনুভূতি-জাত  মানবিক ক্রমবিকাশের পথে এগিয়ে যেতে সোপান হিসেবে কাজ করতে পারে। এই উপনিষদ গুলো, সেই মুনিঋষিদের দেওয়া উপহার, যা আমরা ঋষি মুনিদের উত্তরসূরি হিসেবে পেয়েছি। 

যাইহোক, আমরা শুনছিলাম, প্রশ্ন উপনিষদের কথা। ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন,  "স এষ বৈশ্বানরো" প্রত্যেক জীবের মাঝে তিনি বৈশ্বানর রূপে অবস্থান করছেন। আমাদের বেঁচে থাকবার জন্য এই  বৈশ্বানর অগ্নির প্রয়োজন। এই বৈশ্বানর অগ্নি আমাদের শরীরের মধ্যে থেকে সমস্ত খাদ্যবস্তুকে জীর্ন করছে। আর সেই খাদ্য থেকে নির্যাস বের করে, শরীরের পুষ্টি প্রদান করছে, আবার অপ্রয়োজনীয় সামগ্রী শরীর  থেকে বের করে দিচ্ছে। কারুর যদি খাদ্যকে জীর্ন করবার ক্ষমতা না থাকে, তবে তার অকালমৃত্যু অবধারিত। এতে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই।  কবিরাজ মহাশয় বলে থাকে - অগ্নিমন্দা হয়েছে। অর্থাৎ শরীরের অগ্নি কমে গেছে। আমাদের দেহে যে উত্তাপ তা এই বৈশ্বানর অগ্নির কারণেই ঘটে থাকে। এই শরীর  থেকে যদি কোনো কারনে, অগ্নি বেরিয়ে যায়, তখন আমাদের শরীর শীতল হয়ে, মৃত্যুমুখে পতিত হবে। তো শরীরের উত্তাপ হচ্ছে প্রাণ বা জীবনের লক্ষণ, এই উত্তাপ যখন দেহ ছেড়ে চলে যায়, তখন দেহ প্রাণহীন হয়ে যায়। আর এই উত্তাপ বা অগ্নি আসছে কোথেকে ? এই উত্তাপ আসছে সূর্য থেকে। সমস্ত প্রাণী এই সূর্য থেকেই উত্তাপ সংগ্রহ করছে। তাই প্রাণীরূপে সূর্যকে বৈশ্বানর বলা হয়ে থাকে। 
এই সূর্যকেই আবার বলা হচ্ছে বিশ্বরূপ। আসলে প্রাণ বা সূর্য সবকিছুকেই প্রকাশ করছে। তো জগতে যাকিছু পদার্থ, তা সূর্যেরই প্রকাশ মাত্র। তাই সূর্যকে বলা হচ্ছে বিশ্বরূপ। 
আমরা শুনছি,  প্রশ্ন উপনিষদ অর্থাৎ  অথর্ব্ব বেদের অংশ। ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, ঋক বেদেও  এমনটা বলা হয়েছে। তো ঋষি পিপ্পলাদ নিজের অনুভবের  সঙ্গে ঋক্বেদের ঋষিদের অনুভবের ঐক্য আছে বলে, নির্দিষ্ট করলেন। 

এখন কথা হচ্ছে, ঋক্বেদের কোথায় এই অগ্নিকে প্রাণ,  বা বিশ্বরূপ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে ? ঋক্বেদের শুরুতেই অগ্নির স্তুতি করা হয়েছে। ঋক্বেদের ৩১ নং সূক্তে শ্লোক ৩ - এ বলা হচ্ছে : 

ত্বমগ্নে প্রথমো মাতরিশ্বন আবির্ভব সুত্রুতূয়া বিবস্বতে 
অরেজেতাং রোদসী হোতৃবূর্ষেহসঘ্নো ভারম-যজো-মহো বসো । (ঋক্বেদ-প্রথম অষ্টক- ৩১/০৩) 

হে অগ্নিদেব, আপনিই আদিভূত, বিশ্বের প্রাণবায়ু স্বরূপ, ভগবৎ কর্ম্ম সাধণেচ্ছু  এই প্রার্থনাকারীর সমীপে, আপনি প্রকটিতো  হন।  ইত্যাদি ইত্যাদি। ...

আসলে ব্রহ্ম  চারভাবে বিকাশমান। জাগরনে ব্রহ্মা, স্বপ্নে বিষ্ণু, সুসুপ্তিতে রুদ্র, আর তূরীয়তে পরম-অক্ষর। এই যে তুরীয় অবস্থা, তখন তিনি আদিত্য, তিনিই বিষ্ণু, তিনিই পুরুষ, তিনিই ঈশ্বর, তিনিই প্রাণ, তিনিই জীব, তিনিই অগ্নি। তাঁর  নামের অন্ত  নেই, অগ্নি তাঁর  একটা নাম. তাঁর  রূপের অন্ত  নেই, অগ্নি তাঁর  একটা রূপ, তার গুনের অন্ত  নেই, তেজ তার একটা গুন্। তাঁর  শক্তির অন্ত  নেই, দাহিকা শক্তি তার একটা শক্তি।  তাঁর  প্রভার অন্ত নেই, দীপ্তি তাঁর  একটা প্রভা । যখন তিনি জ্যোতির্ময় তখন তিনি অগ্নিরূপে মর্ত্যলোকে, সূর্যরূপে অন্তরীক্ষে আর দেবাদি রূপে স্বর্গলোকে বিরাজ  করেন।    
-------------------------

বিশ্বরূপং হরিণং জাতবেদসং পরায়ণং জ্যোতিরেকং  তপন্তম  ।
সহস্র রশ্মিঃ শতধা বর্তমানঃ প্রাণঃ প্রজানাম উদয়তি এষ সূর্যঃ।  (১/৮)

এই সূর্য উদয় হচ্ছেন। তিনিই সমস্ত রূপ, বিশ্বরূপ।  তিনি উজ্বল, সর্বজ্ঞ, সকলের আশ্রয়। তিনি জ্যোতিস্বরূপ হয়ে  সহস্র কিরণ দ্বারা সবাইকে উত্তাপ দিচ্ছেন। তিনি শতরূপে বর্তমান।  তিনিই প্রজাসকলের প্রাণ দান  করছেন। 

এই শ্লোকে সূর্যদেবের কিছু বিশেষণ বলা হচ্ছে। তিনি বিশ্বরূপং - বিশ্বের সমস্ত রূপ-ই তাঁর  রূপ। আমরা জানি এই জগৎ আলোর কারসাজি ছাড়া কিছু নয়। জগৎ আসলে আলোর তরঙ্গ বিশেষ। যা প্রতিক্ষনে পরিবর্তন হচ্ছে। তাই আলোর আকাশে যে রূপ ভেসে উঠছে, তা  এই সূর্যরশ্মির খেলা ছাড়া কি বা বলা যেতে পারে। হরিণং - তিনি উজ্বলবর্ণের গতিশীল - যা জগৎকে বহন করে নিয়ে চলেছে। তিনি জাতবেদসং - অর্থাৎ তিনিই সর্বজ্ঞ। তার ভিতর থেকেই বেদ ইত্যাদি জ্ঞানভাণ্ডার জাত  হয়েছে। পরায়নং - তিনিই সমস্ত কিছুর আশ্রয়। জ্যোতিরেকং - তিনিই একমাত্র জ্যোতি, তাঁর দ্বারাই সমস্ত কিছু আলোকিত হচ্ছে। তিনি তপন্তম - তাপ  প্রদানকারী অর্থাৎ ঈশ্বরের  শুদ্ধিকরন শক্তি। সহস্র রশ্মি - অর্থাৎ তার অগুনতি রশ্মি এই অনন্ত আকাশকে আলোকময় করে রেখেছে। তিনি শতধা বর্তমান - অর্থাৎ সব কিছুর মধ্যে তিনিই  আছেন। তিনিই ভিতরে, তিনিই বাইরে - তিনিই অন্তর্জগৎকে উদ্ভাসিত করছেন, আবার বাহ্য জগতকে প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রাণঃ প্রজানাম - তিনি সমস্ত প্রজা অর্থাৎ প্রাণীর প্রাণ। এই সর্ব্বগুন সম্পন্ন সূর্যদেব উদিত হচ্ছেন, তাই প্রাণীকুল প্রাণবন্ত হচ্ছে। তো সূর্য থেকে প্রাণের ধারা রশ্মিঃ রূপে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। এই প্রাণের খেলাই  সর্বত্র চলছে। আবার পরিণতিতে প্রাণেই অর্থাৎ সূর্য্যেই ফিরে যাচ্ছে। এককথায় বলতে গেলে বলতে হয়, সূর্য হচ্ছেন, প্রাণের সমষ্টিরূপ জ্যোতির্গোলক। এই প্রাণীজগৎ সূর্য থেকেই প্রতিনিয়ত বিচ্ছুরিত হয়ে নানান রূপে নানান নামে জগতে বিচরণ করছে। আবার সূর্যেই  ফিরে যাচ্ছে। জীবদেহের মৃত্যুর পরে, প্রাণশক্তি এই সূর্য্যের রশ্মির সাহায্যে বাঞ্চিত লোক প্রাপ্তি করে।  সূর্য নিভে গেলে, এই জগৎরূপ-দৃশ্য অদৃশ্য হয়ে যাবে। সূর্যদেবকে আমাদের শতকোটি প্রণাম। এই অসীম শক্তিধর, অনন্ত গুণসম্পন্ন জ্ঞানজ্যোতি স্বরূপ  সূর্যদেবকে আমরা কিভাবে জানবো  ? হে পরমেশ্বর সেই জ্ঞানচক্ষু আমাদের উন্মোচন করে দাও। হৃদয়ে জ্বলে উঠুক জ্ঞানজ্যোতি। 
-----------------------

 প্রশ্ন উপনিষদ শ্লোক - ০১/০৯

"সংবৎসরঃ বৈ  প্রজাপতি তস্য অয়নে দক্ষিণং চ উত্তরং চ।  তদ্যে হ বৈ তৎ ইষ্টাপূর্তে কৃতং তৎ  উপাসতে তে চান্দ্রম  সম এব লোকম অভিজয়ন্তে। ত  এব পুনঃ আবর্তন্তে তস্মাৎ তে ঋষয়ঃ প্রজাকামা দক্ষিণং প্রতিপদ্যন্তে। 
এষ  হ  বৈ রয়িঃ যঃ পিতৃযাণঃ ।" (০১/০৯) 

প্রজাপতি স্বয়ং সম্বৎসর। তার গতি একবার উত্তরে এবার দক্ষিণে। অর্থাৎ এই দুই পথে তার আসা যাওয়া। যারা বৈদিক ক্রিয়া কর্ম্ম অর্থাৎ ইষ্টপূর্তির ক্রিয়া করেন, তারা এই কর্ম্মে কৃতার্থতা  বোধ করেন। বৈদিক ক্রিয়া কর্ম্মে উপাসনা রত এইসব ব্যাক্তিগন চন্দ্রলোক লাভ করেন। এবং আবার এই মর্তলোকে ফিরে ফিরে আসেন। এই কারনে যে ঋষিগণ প্রজা   কামনায় অর্থাৎ সন্তান কামনায়, এই দক্ষিণ দিকে গমন করেন, যা পিতৃলোকের পথ, বা  পিতৃযান । এষঃ হ বৈ  রয়ি - এই হলো রয়ি। 

প্রাণ এবং রয়ি দুয়ে মিলে প্রাণী। প্রাণ হচ্ছে সূর্য আর রয়ি হচ্ছে চন্দ্র। সূর্য হচ্ছে খাদক, আর চন্দ্র হচ্ছে খাদ্য। তো খাদ্য ও খাদের সম্মিলিত সত্ত্বাই প্রাণী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সূর্য প্রাণ এটা না হয়, বোঝা গেলো। কিন্তু এই প্রাণ কোন পথে আসে, আর কোন পথেই  বা যায় ? আবার  প্রাণ ও রয়ি মিলে  প্রাণী, এই প্রাণীর প্রকাশ ও অপ্রকাশ কিভাবে ঘটে থাকে। 
এই প্রসঙ্গে ঋক্বেদের কয়েটা ঋকের উল্লেখ করি। 

ওঁ ঋতং  চ সত্যং চাভিদ্ধাৎ তপসোহধ্যজায়ত 
ততো রাত্র্যজায়ত ততঃ সমুদ্রো অর্ণবোঃ । ঋক্বেদ - ১০/১৯০/১
ওঁ সমুদ্রাদর্ণবাদধি সংবৎসরো অজায়ত 
অহো রাত্রাণি বিদধদ বিশ্বস্য মিষতো বশী । (১০/১৯০/০২) 
ওঁ সূর্য্যাচন্দ্রমসৌ  ধাতা যথা পূর্ব্বং কল্পয়ৎ 
দিব্যং চ পৃথিবীং চ অন্তরিক্ষমথো স্বঃ । (১০/১৯০/৩) 

প্রজ্বলিত তপস্যা থেকে ঋত অর্থাৎ যজ্ঞ এবং সত্য জন্ম গ্রহণ করলো।  পরে রাত্রি জন্ম গ্রহণ করলো। এর পরে জলপূর্ণ সমুদ্র। (১)

জলপূর্ণ সমুদ্র থেকে সম্বৎসর জন্ম গ্রহণ করলেন। তিনি দিন ও রাত্রি সৃষ্টি করছেন। এবং তাবৎ লোকে তা দর্শন করছে। (২)

সৃষ্টিকর্তা যথা সময়ে সূর্য ও চন্দ্রকে সৃষ্টি করলেন এবং স্বর্গ পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টি করলেন। (৩) 

দুটো তত্ত্ব - একটা স্থির আর একটা অস্থির। একটা ঋত আর একটা সত্য। ঋত অর্থাৎ গতি। তো সম্বৎসর হচ্ছে ঋত অর্থাৎ গতিশীল। কিন্তু এই গতির একটা ছন্দ আছে। দিনের পরে রাত, আবার রাতের পরে দিন। কিন্তু এই রাত দিন সমান নয়।  বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে রাত  ও দিনের সময় সমান  সমান থাকে। ধীরে ধীরে একজনের সময়ের বৃদ্ধি  ঘটে, আর অন্য জনের হ্রাস ঘটে। সূর্যকে কেন্দ্র করেই এই রাত  দিন সংগঠিত হচ্ছে। আবার এই সূর্যকে কেন্দ্র করেই সম্বৎসর সংগঠিত হচ্ছে। এটি একটি  চক্র বিশেষ। একবার ঘুরে ফিরে একটা নির্দিষ্ট  জায়গায় আসে, আবার ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে দূরত্ত্ব বাড়ায়। সত্যকে কেন্দ্র করে ঋত প্রকাশিত হচ্ছে। অর্থাৎ সত্য আছে কেন্দ্রে আর তাকে আবর্তিত করে ঋত প্রকাশিত হচ্ছে। 

সম্বৎসর হচ্ছে কালচক্র। এই কালচক্রকে অবলম্বন করেই, আদিত্যরূপী প্রজাপতি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় ক্রিয়া করছেন। এই কালচক্রের গতি বা অয়ন  হচ্ছে উত্তর থেকে  দক্ষিণে, আবার দক্ষিণ থেকে উত্তরে।  দক্ষিণায়নের যে চায় মাস, তাতে সূর্য দক্ষিণের দিকে ভ্রমন করে। একে  বলা হয় কাল রূপ পরমেশ্বরের দক্ষিণ অঙ্গ। আবার উত্তরায়ণের চায় মাস উত্তর অঙ্গ। এই যে উত্তর অঙ্গ এটি প্রাণ স্বরূপ।  আর দক্ষিণ অং রয়ি অর্থাৎ বাহ্য  ভোগ 
স্বরূপ। 
উপনিষদের বলেন, মানুষ দুই শ্রেণীর। এক শ্রেণীর মানুষ আছে, যারা মনে করেন, এই জীবন ভোগ-বিলাসের জন্য। কিন্তু কালের গতিতে একসময় তাদের মনে হয়, এই ভোগ শেষ হতে চলেছে। কেননা শরীর  আর সাধ দিচ্ছে না। তখন মনের মধ্যে একটা ভয়, আসক্ত, অনিশ্চিয়তা এসে সামনে দাঁড়ায়।  তখন তারা নানান রকম লোক হিতার্থে যজ্ঞাদি ক্রিয়া, অথবা লোক কল্যাণকর কার্য করে থাকেন। এরা মনে করেন, ভালো কাজ করলে, মৃত্যুর পরে স্বর্গসুখ লাভ করতে পারবো। অর্থাৎ মৃত্যুর পরেও তাদের মধ্যে ভোগ-বিলাসের কামনা থেকে যায়। 
আর একদল মানুষ আছে, যারা জীবনকে একটা গভীর তাৎপর্য পূর্ন  মনে করেন। তারা জানতে চান, মানুষের স্বরূপ কি ? কথা থেকে তারা এসেছে, কোথায়ই বা তারা চলে যাবে। এইসব মানুষ নিজেকে খোঁজার তাগিদে, একসময় বহির্মুখী মনকে অন্তর্মুখী করে তোলেন। এরা  বহির জগৎ থেকে অন্তর্জগতে প্রবেশ করেন। আর এই গভীর চিন্তনের ফলে তাদের মধ্যে সুপ্ত যে গুণাবলী রয়েছে, তার প্রকাশ হতে থাকে। এরা  জাগতিক ভোগসুখকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন। তো প্রথম শ্রেণীর মানুষ যা কিছু করুন না কেন, তা হয়ে থাকে সকাম  কর্ম্ম। এরা হয় ইহকালে অথবা পরকালের পুরস্কারের আশায় কর্ম্ম করেন। এদের আত্মজ্ঞান লাভের  কোনো ইচ্ছে থাকে না।কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ আত্মজ্ঞান লেভার উদ্দেশ্য কর্ম্ম করেন। কোনো পুরস্কারের আশায় নয়, ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে কর্ম্ম করেন। এরা  পুরস্কারের আশা করেন না, এঁরা  কাজ করেন, নিজের আনন্দে। 

উপনিষদ বলছে, মানুষ যেমন দুই শ্রেণীর।  তেমনি কালের গতিপথও দ্বিবিধ। একটা দক্ষিণায়ন, আর একটা উত্তরায়ণ। সূর্য যখন দক্ষিণ গোলার্ধে থাকে, তখন দক্ষিণায়ন।  একেই বলে চন্দ্রের পথ।  আর যখন সূর্য উত্তর গোলার্ধে থাকে তখন তাকে বলে উত্তরায়ণ।  একে  বলে সূর্য্যের পথ। অর্থাৎ একটা প্রাণের পথ আর একটা রয়ির  পথ। 
আসলে এসবই রূপক মাত্র। প্রত্যেক মানুষের জন্যই  দুটো পথ খোলা।  একটা জ্ঞানের পথ আর একটা অজ্ঞানের পথ। জ্ঞান  হচ্ছে  আলোকময় জীবনের পথ, আর অজ্ঞান হচ্ছে অন্ধকারময় জীবনের গতিপথ। আপনি জ্ঞানের পথে যত  এগুবেন, অর্থাৎ জ্ঞান তা সে পার্থিব হোক, বা অপার্থিব হোক, আপনাকে একটা মসৃন জীবনের সন্ধান দেবে। আপনি যখন এটা সম্যক  রূপে উপলব্ধি করবেন, একদিন মৃত্যু আমার সামনে এসে দাঁড়াবেই দাঁড়াবে, কেননা আপনার মা-বাবা-আত্মীয়স্বজন কেউই আপনার অপেক্ষায় বসে নেই, তারা সবাই এই স্থূল দেহ ত্যাগ করে চলে গেছে, এই অমোঘ সত্য যখন আপনার কাছে স্পষ্ট হবে।  তখন মৃত্যুকে বরণ  করতে আপনার কোনো কষ্ট  হবে না। আপনার মন তখন সত্যকে স্বীকার করবার ক্ষমতা অৰ্জন করবে।  আবার যদি আপনি এটাও মনে করেন, যে এই জীবনই আমাদের প্রথম বা শেষ জীবন নয়, বারবার ফিরে ফিরে আসতে  হবে এই পৃথিবীতে, মায়ের কোলে, তাহলেও আপনি এই ঈশ্বর সৃষ্ট জগতের হিতের  জন্য, আগামী প্রজন্মের শিশুদের জন্য এমনকিছু করতে চাইবেন, যাতে আগামী প্রজন্মের মানুষ সুখে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে। কেবল নিজের জন্য নয়, সবার জন্য ভালো কিছু করবার একটা উদ্দম আপনি অনুভব করবেন। 

যাই হোক, কর্ম্মমার্গ উত্তম এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আবার আকাংখ্যা রোহিত হয়ে কর্ম্ম করাও অত্যন্ত কঠিন। আর কিছু না হোক, ভালো কাজ করে, একটা গর্ববোধ আসে। ভালো কর্ম্মের জন্য ইহকালে ধন-সম্পদ অৰ্জন করা যায়,  এমনকি পরকালে স্বর্গ লাভ করা যায়।  কিন্তু আবার ফিরে ফিরে এই ভোগভূমিতে ভোগায়তন শরীরে ফিরে ফিরে আসতে  হয়। কিন্তু যাঁরা কর্ম্ম করেন, কেবল সত্য কি এই জ্ঞান লাভের জন্য, তাঁরা কি ইহলোকে, কি পরলোকে, একটা জ্যোতির্ময় মনোময় লোকে বাস করেন। একটা অমৃতময় লোকে বাস করেন। সেই যমরাজের কথায় পথ দুটো একটা শ্রেয়, আর একটা প্রেয়। প্রেয় আমাদের চেতনশক্তিকে নিষ্প্রভ করে।  আর শ্রেয় আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। 
------------------   
      
প্রশ্ন  উপনিষদ শ্লোক -০১/১০ 

অথঃ উত্তরেণ তপস্যা ব্রহ্মচর্যেণ শ্রদ্ধয়া বিদ্যয়া  আত্মানম অন্বিষ্য আদিত্যম অভিজয়ন্তে। 
এতৎ বৈ প্রাণায়াম আয়তনম এতৎ অমৃতম অভয়ম এতৎ পরায়ণম এতস্মাৎ ন পুনরাবর্তন্ত ইত্যেষ নিরোধঃ তৎ এষ  শ্লোকঃ । (১/১০)

কিন্তু এমন অনেকে আছেন, যাঁরা  তপস্যা, ব্রহ্মচর্য ইত্যাদি শ্রদ্ধা সহকারে পালন করেন। শাস্ত্র অধ্যয়ন  করেন।  শাস্ত্র বাক্য ও গুরুবাক্যের প্রতি বিশ্বাস রেখে, আত্মার অনুসদ্ধান কর্ম্মে জীবনপাত করেন। এঁরা উত্তরায়ণের পথ অবলম্বন করে আদিত্য পদ লাভ করেন।  এই আদিত্য হচ্ছে প্রাণ, ইনিই অমৃত ও অভয়। এই সর্ব্বোত্তম অবস্থা লাভ করলে, আর পুনরাবর্তন হয় না। এই হলো শেষ যাত্রা।  এই বিষয়ে একটা শ্লোক আছে। 

এর আগে শ্লোকে আমরা দক্ষিণায়ন পথের অর্থাৎ অজ্ঞান অন্ধকারের পথের  কথা শুনেছি।  এবার বলছেন, জ্ঞান-আলোকের পথের  কথা। এই জ্ঞান আলোকের পথের সন্ধান তাঁরাই  পান, যাঁরা শ্রদ্ধা সহকারে তপস্যা, ব্রহ্মচর্য এবং  শাস্ত্রজ্ঞান লাভের জন্য প্রচেষ্টা করেন। তপস্যা ও ব্রহ্মচর্য্যের কথা এর আগে শুনেছি।  অর্থাৎ প্রবৃত্তির টানে গা ভাসিয়ে না দিয়ে, এই স্রোতের বিরুদ্ধে যাওয়ার অর্থাৎ উৎসমুখের দিকে দৃষ্টি ফেরানোকেই বলে তপস্যা। আর এই তপস্যার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে গেলে, চাই ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ শরীরের ওজঃ শক্তিকে নিম্নমুখী হতে না দিয়ে, একে  উর্দ্ধমুখী করে তোলা। সাধারনের ওই ওজঃশক্তি প্রাকৃতিক ভাবেই নিম্ন মুখী হয়ে থাকে। অর্থাৎ নদী যেমন সাগর মুখী, জল যেমন  সর্বদা নিম্নমুখি, তেমনি এই জৈব শরীরের ওজঃশক্তি নিম্নমুখী হয়ে প্রকৃতির সৃষ্টিকলীলায়  অংশগ্রহণ করে থাকে। এই ওজঃ শক্তি আমাদের শরীরে প্রাকৃতিক নিয়মেই জীবনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে (যৌবনে) উৎপাদন হয়ে থাকে।  যিনি এই ওজঃ শক্তিকে, প্রাকৃতিক নিয়মকে উপেক্ষা করে,  তার নিম্নগামী স্বভাবকে মনের দৃঢ়তার সাহায্যে উর্দ্ধমুখী করতে পারেন, তিনি অতিশয় তেজস্বী ও শুদ্ধ শরীরের অধিকারী হয়ে ওঠেন। একেই বলে  ব্রহ্মচর্য্য। এঁদের মন তখন কেবলমাত্র ব্রহ্মে বিচরণ করে। এঁদের  মন এক  উচ্চ চিন্তাধারায়  প্রবাহিত হতে থাকে। এঁরা কখনো প্রবৃত্তির বশীভূত থাকেন না। 

এর পরে আছে, শ্রদ্ধা ও  বিদ্যা। পরাবিদ্যার গভীরে প্রবেশের প্রবল ইচ্ছেশক্তিকে বলে শ্রদ্ধা। নদী যেমন স্বাভাকিক ভাবে, সমুদ্রমূখী হয়, জল যেমন নিম্ন-মুখী  হয়, এর জন্য তাকে কোনো প্রয়াস করতে হয় না। আবার এই স্বাভাবিক গতিকে সে রুখে দিতেও  পারে না। ঠিক তেমনি আমাদের প্রবৃত্তি সদা বিষয়মুখী হয়ে থাকে, এর জন্যও আমাদের কোনো প্রচেষ্টা  করতে হয় না। দেখুন জল যেমন নিম্নগামী, তেমনি অগ্নি আবার উর্দ্ধগামী। আমরা যাকিছু খাদ্য সামগ্রী গ্রহণ করছি তার বেশিরভাগটাই আমাদের শরীরের বিভিন্ন ছিদ্রপথ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। এর জন্য আমাদের আলাদা করে কিছুই করতে হয় না। এই  ক্রিয়াকে  থামানো যায় না। থামানো উচিতও নয়। এই স্থূল শরীরের খাবারের জন্য স্থূল শরীরের কর্ম্মেন্দ্রিয় ক্রিয়া করে থাকে। আবার আমাদের আছে, একটা বিজ্ঞানময় শরীর।  এই শরীরের পুষ্টির জন্য আমাদের জ্ঞানেন্দ্রিয়  ক্রিয়া করে থাকে। এই জ্ঞানেন্দ্রিয়র সাহায্যে সে বিষয়জ্ঞান সংগ্রহ করে থাকে। এই বিষয় জ্ঞান দ্বিবিধ, একটা পার্থিব, আর একটা অপার্থিব। পরা অপরা।  দেখুন কাদা মাটি দিয়ে, আপনি হনূমান তৈরী করতে পারেন, আবার এই কাদামাটি দিয়েই  আপনি শিবঠাকুর তৈরী করতে পারেন। আর এই সিদ্ধান্ত নেয়, আমাদের মন, তার বুদ্ধির সাহায্যে। তো যার বুদ্ধি নির্ম্মল, তার হাতে  শিব ঠাকুরের মূর্তি  তৈরী হবে, আর যার বুদ্ধি নির্ম্মল নয়,  সে বাঁদরের মূর্তি তৈরী করবে। এইজন্য সুশিক্ষা ও শাস্ত্র গ্রন্থাদি পাঠ দ্বারা মন যতক্ষন না বিচারশীল হতে পারে, ততক্ষন মন পরাবিদ্যা লাভের  উপযোগী হয় না। ব্রহ্মচর্য্য দ্বারা মন একাগ্র হয়, আর একাগ্র চিত্তে বিষয়ের গভীরে যাওয়ার ক্ষমতা অৰ্জন হয়। মনের মধ্যে সূক্ষ্ম বিচারশক্তি জেগে ওঠে। বিচারশক্তি সূক্ষ্ম হলে  বিশুদ্ধ জ্ঞানলাভ হয়। আর এই বিশুদ্ধ জ্ঞানের সাহায্যেই আত্মানুসন্ধানের পথে এগিয়ে যেতে হয়। 

দেখুন, আমরা সবাই "আমি-আমার" করি । কিন্তু এই আমিকে আমরা কেউ জানি না। এই প্রকৃত আমিকে জানবার উপায় হচ্ছে শ্রদ্ধা,  ব্রহ্মচর্য্য ও তপস্যা। সূর্য হচ্ছে সমস্ত কিছুকে শুদ্ধিকরণের মাধ্যম। তেমনি জ্ঞানসূর্য্য মানুষের অন্তঃকরণকে  শুদ্ধি করনের মাধ্যম। চন্দ্রের মধ্যে ক্ষয়-বৃদ্ধি  আছে, সূর্যের কোনো ক্ষয় বৃদ্ধি  নেই।  আমাদেরকে সবসময় সুখ-দুঃখ-জন্ম-মৃত্যু তারা করে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি জানতে পারি, এই দেহের ক্ষয় বৃদ্ধি  হলেও আমার কোনো ক্ষয়-বৃদ্ধি নেই। আমার কোনো জন্ম মৃত্যু নেই। অর্থাৎ আমার প্রকৃত সত্ত্বা হচ্ছে সেই অবিনশ্বর আত্মা, যা জন্ম-মৃত্যুর অধীন নয়, শ্বাশত, অমর।  তখন আমাদের মধ্যে আর এই পরিবর্তনশীল জগৎ উদ্বিগ্নতা আনতে পারবে না। আমার মধ্যে ভয়-ডর বলে কিছু থাকবে না।  তাই ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, "এতৎ অমৃতম অভয়ম". এই অবস্থাই অমৃত - এই অবস্থাই অভয়দান করে থাকে।  আর এই অবস্থা প্রাপ্ত হলে  "এতস্মাৎ ন পুনঃ আবর্তন্তে। - এখান  থেকে আর  ফিরে আসতে  হয় না। এই হচ্ছে তত্তজ্ঞ  পুরুষের লক্ষণ। 

-------- 
প্রশ্ন  উপনিষদ :শ্লোক :  (০১/১১-১২)

"পঞ্চ পাদং পিতরং দ্বাদশ অকৃতিং দিব আহু পরে অর্ধে পুরীষিণম ।
অথেমে অন্য উ পরে বিচক্ষণং সপ্ত চক্রে ষড়র আহু অর্পিতম ইতি। " - (০১/১১)  

(আদিত্যের) পাঁচটি পাদ, বারোটি আকৃতি। জগৎ-স্রষ্টা পিতা, দিব্যলোক ও মর্তলোকের মধ্যবর্তী স্থানের উপরে অবস্থিত স্থানে জল বর্ষণ করেন।  অন্যরা বলেন, এই সর্বজ্ঞ (আদিত্য) সপ্তচক্র বিশিষ্ঠ রথ চালনা করেন। সেই রথের  চক্রের প্রতিটিতে আবার ছটি  করে শলাকা। এই আদিত্যেই (যার পাঁচটি পাদ, বারোটি আকৃতি) জগৎ প্রতিষ্ঠিত। 

এই মন্ত্রে রূপকের সাহায্যে আদিত্যকে বর্ণনা করা হয়েছে। এই আদিত্যই জগৎ সৃষ্টি করছেন, আবার জগৎকে ধারণ করে আছে। এই আদিত্যের পাঁচটি পা অর্থাৎ পাঁচটি ঋতু। আমারা জানি ছয়টি ঋতু, কিন্তু এখানে হেমন্ত ও শরত  ঋতুকে  একটি ঋতু ধরে পাঁচটি ঋতুর কথা  বলা বয়েছে।  বারোটি আকৃতি অর্থাৎ বারোটি মাস। দিব্য লোক অর্থাৎ স্বর্গলোক। তো স্বর্গ ও মর্তের মধ্যবর্তী যে আকাশ সেখানে সূর্যদেব জলকে আকর্ষণ করে মেঘের সৃষ্টি করছে।  এবং মেঘ থেকে বৃষ্টিরূপে জলের আকারে পৃথিবীতে ফিরে আসছে।  অর্থাৎ জল একবার পৃথিবী থেকে  স্বর্গলোকের কাছাকাছি পর্যন্ত যাচ্ছে আবার সেখান থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসছে। 

অন্যেরা বলছেন, আদিত্য সপ্তচক্র  বিশিষ্ট রথে বসে আছেন।  এই সপ্তচক্র  হচ্ছে  সূর্যরশ্মির সাতটি  রঙ। এই চক্রে  আবার ছয়টি শলাকা, অর্থাৎ ছয়টি ঋতু। তো ছয় বা পাঁচটি ঋতুই বলুন, বা সূর্য্যে-রশ্মির সাতটি  রঙ বলুন,  এগুলো সবই সূর্যকে ঘিরে রয়েছে বা ঘটছে । আসলে কাল (সময়) অনন্ত, অসীম, আমরা একে সীমারেখা দিয়ে বুঝে নেবার চেষ্টা করেছি । আর এই সীমা  টানতে গিয়ে স্থির সূর্যকে গতিশীল কল্পনা করে, দিন রাত্রি, মাস বছর, ইত্যাদির নামে অভিহিত করেছি। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ হিসেবে চিহ্নিত করেছি। বস্তুত এই সময়ের বিভাগ করা যায় না। আর এই সময়ের বিভাগকে পন্ডিতগণ  প্রজাপতির সৃষ্টি বলে উল্লেখ করেছেন। 

-----------

প্রশ্ন উপনিষদ : শ্লোক ০১/১২

"মাসো বৈ  প্রজাপতিঃ তস্য কৃষ্ণপক্ষ এব রয়িঃ শুক্ল প্রাণঃ তস্মাদেত ঋষয়ঃ শুক্ল ইষ্টং কুর্বন্তি ইতরে 
ইতরস্মিন। " (শ্লোক ০১/১২)

বছরের  মতো মাসও  এই প্রজাপতির প্রতীক। কৃষ্ণপক্ষ হচ্ছে রয়ি বা চন্দ্র, আর শুক্ল পক্ষ হচ্ছে প্রাণ বা সূর্য। এই কারনে কেউ কৃষ্ণপক্ষে (যাঁরা  রয়িকে কামনা করেন) ইষ্টকর্ম্ম করেন, কেউবা শুক্লপক্ষে (যাঁরা  প্রানের কামনা করেন) ইষ্টকর্ম্ম করেন। 

আসলে দিন বলুন আর রাত  বলুন, মাস বলুন, ঋতু বলুন বা বছর বলুন, শুক্ল পক্ষ বলুন আর কৃষ্ণ পক্ষ বলুন, এসব কিছুর মধ্যেই  প্রজাপতি বিরাজ করছেন। প্রজাপতির ভাবনার মধ্যেই এসব ভাসছে। আসলে প্রতিটি ক্ষণ প্রতিটি দিন, রাত্রি, মাস বৎসর, পক্ষ, ঋতু সবই তাঁর। সবই পরমাত্মার রূপ মাত্র। কিন্তু আমাদের যার যেমন ভাব, আমাদের প্রাপ্তিও সেই রকম হয়ে থাকে।  কেউ রয়িকে প্রাধান্য দিচ্ছেন, অর্থাৎ ভোগ্য বস্তুকে আকাঙ্খ্যা  করছেন, কেউ আবার প্রাণকে অর্থাৎ আত্মজ্ঞানকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। এমনিতে শুক্লপক্ষে আমাদের প্রাণক্রিয়া উজ্জীবিত থাকে, আর কৃষ্ণপক্ষে আমাদের ভোগলিপ্সা জাগ্রত হয়।  কিন্তু যথার্থ ভাবে আত্মজ্ঞানীর অধিকারী হয়েছেন, তাঁর  কাছে কৃষ্ণ পক্ষ, শুক্ল পক্ষ সবই সমান। কথায় বলে রাতে জাগে ভোগী আর রুগী। কিন্তু অধিক সত্য হচ্ছে যোগীও এই রাত্রি জাগরণ করে থাকেন। তো সময় বা কালের বশবর্তী হয়ে অজ্ঞান  নিজ পার্থিব বাসনা পূরণের  জন্য কর্ম্মে লিপ্ত হন,  অন্য দিকে জ্ঞান-অন্বেষণকারী  ব্যক্তি অপার্থিব জ্ঞান  সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সেই কালকেই ব্যবহার করে থাকেন। 

--------------------

প্রশ্ন  উপনিষদ : শ্লোক ০১/১৩

"অহোরাত্রো বৈ প্রজাপতিঃ তস্য অহঃ এব প্রাণো রাত্রিঃ এব রয়িঃ প্রাণং বা এতে প্রস্কন্দন্তি যে দিবা রত্যা সংয়ুজ্যন্তে ব্রহ্মচর্যমেব তদ যদ্রাত্রৌ রত্যা সংয়ুজ্যন্তে ।" - (০১/১৩) 

অহোরাত্রি অর্থাৎ দিন রাত্রি প্রজাপতির দুটি অংশ। দিন তাঁর  প্রাণ, আর রাত্রি তার রয়ি । যারা দিনের বেলা ইন্দ্রিয়সুখকে প্রশ্রয় দেন, তারা নিজের জীবনকে ধংশ করেন। আর যারা রাত্রিবেলা তা সম্পন্ন করেন, তা আত্মসংযম। 
আমরা সবাই জগতের অংশ। জগৎকে অস্বীকার করা মানে নিজেকে অস্বীকার করা। বৈদিক ঋষিগণ এই সত্যকে কখনো অস্বীকার করেন নি।  জীবনের চাহিদা, জীবনের যন্ত্রণাকে তারা উপেক্ষা করেন নি।  জীবনের যে জৈবিক চাহিদা, এমনকি সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য যে কামনার ভূমিকা তাকে তাঁরা  গুরুত্ত্ব সহকারে বিচার করেছেন। জীবনের নানান রকম সমস্যা সমাধানের, শত্রু থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবার বিভিন্ন উপায় হিসেবে তাঁরা  বিভিন্ন কর্ম্মযজ্ঞের  বিধান দিয়েছেন। বিধি সন্মত ভাবে এইসব যজ্ঞক্রিয়া সম্পাদিত হলে, মানুষ তার জীবনের চাহিদা পূরণ করতে পারেন। ইহলোক, পরলোক উভয় কালের হিত  বা অহিত সম্পাদন করতে পারে। আবার মানুষের স্থূল  শরীরের যে জৈবিক চাহিদা, অর্থাৎ শারীরিক ও মানসিক যে চাহিদা তা পূরণের জন্য তারা নানান উপায়ের কথা বলেছেন। 

বলছেন, দিন রাত্রি উভয়ই সেই প্রজাপতি স্বরূপ । একে  অস্বীকার করা যায় না। একটিকে বাদ  দিয়ে অন্যটির অস্তিত্ত্ব থাকেনা। আবার আমাদের যে শরীর  তা যেমন কর্ম্মের নিমিত্ত তৈরী হয়েছে তেমনি এই মনুষ্য  দেহ দিয়েই ভোগসাধন সম্পাদিত হয়ে থাকে। দেবতাদের দেহ কেবলমাত্র ভোগ সম্পাদিত হবার জন্য, তাঁদের  কর্ম্ম বলে কিছু  নেই। কেবলমাত্র সঞ্চিত কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য দেবদেহ তৈরী হয়ে থাকে। আবার পশুকুলের দেহ কর্ম্ম দেহ। এরা ভালো মন্দ যাই করুক না কেন, এদের কর্ম্মফল সঞ্চিত হয়  না। এদের কর্ম্ম নিস্ফলা।  এইজন্য পশুদেহকে বলা হয় কর্ম্ম দেহ। গরু খাস খায়, হিংসা করে না, তাই  সে পুন্য সঞ্চয় করছে, আর বাঘ হিংসা করছে বলে তার পাপ হচ্ছে ব্যাপারটা এমন নয়।  এদের কর্ম্মের পাপ-পুন্য বলে কিছু হয় না।  কিন্তু মানুষের দেহ পাপ-পুন্য সঞ্চয়ের জন্য কর্ম্ম করতে পারে। 

তো মনুষ্যদেহ  কেবল কর্ম্ম করবে, আর ভোগ থেকে বিরত থাকবে, তা হতে পারে না। এইজন্য জীবনের সময়কালকে (জন্ম থেকে  মৃত্যু) চারটি আশ্রমে তাঁরা  ভাগ  করেছেন। ব্রহ্মচর্য্য , গার্হস্থ, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। আবার বিভিন্ন সময়ের জন্য, পক্ষের জন্য, ক্ষনের জন্য, তাঁরা  বিভিন্ন কর্ম্মের নির্দেশ দিয়েছেন। তেমনি দিনকে তাঁরা  কর্ম্মচঞ্চল বলে, প্রাণবন্ত বলে, এইসময় কর্ম্মের নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে রাত্রিতে তাঁরা  ভোগসম্পাদনের কথা বলেছেন।  দিনে থাকে প্রাণের আধিপত্য অর্থাৎ সূর্য্যের রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে  এসে প্রভাব বিস্তার করছে। আবার রাত্রিতে সর্য্যের অনুপস্থিতিতে চন্দ্রের (রয়ি) আধিপত্য  দেখা যায়।  দিনের বেলা কামতাড়িত হয়ে যে সন্তান আসে, তা হয় দৈত্যসুলভ। যেমন হয়েছিলো ঋষি কশ্যপ ও দিতির ক্ষেত্রে। তাই ঋষি পিপ্পলাদ এই শ্লোকে দিনের বেলাকে  ইন্দ্রিয়সুখের সময় নয়, এর জন্য রাত্রিবেলাকে নির্দিষ্ট করেছেন। শ্রীমৎ স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী বলছেন, যৌন আকাঙ্খ্যাকে নিগ্রহ করা সহজ সাধ্য নয়। যাদের মধ্যে আত্মচেতনা মূর্ছিত হয়ে আছে, সৃষ্টিলীলায় তারাই প্রকৃতিকে সাহায্য করে থাকে। দেখুন কুলি-মজুরের কাজ ভাবনা চিন্তা নয়, তারা শারীরিক পরিশ্রম ক'রে, বিশাল সৌধ  নির্ম্মাণ করতে পারে। কিন্তু সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনা এদের মধ্যে আসে না।  এই ভাবনা চিন্তার জগতের মানুষদেরকেই বলা হয় চিন্তাশীল ব্যক্তি, পণ্ডিত ব্যক্তি। এরাই নিজেদের সম্পর্কে ভাবে, সমাজ সম্পর্কে ভাবে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবে, রাষ্ট্র সম্পর্কে ভাবে। এমনকি ঈশ্বর সম্পর্কে ভাবে। আর যারা শ্রমজীবী মানুষ তারা শরীরের ক্ষিদে  মেটাবার জন্য উদয়-অস্ত  পরিশ্রম করে। একসময় এরা স্বাস্থ্যভঙ্গের শিকার হয়, রোগ-ভোগ এদের সারা  জীবনের সঞ্চয়। এজন্য ঋষিগণ বলছেন, সংযম হচ্ছে সুখের মূল। তোমার চিত্ত যদি প্রকৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে পুরুষের (ঈশ্বরের) চিন্তা না করতে পারে, তবে বৃথা এই মনুষ্য  জীবন। প্রাণশক্তিকে অপচয় না করে, চিত্তকে বলিষ্ঠ করো, সংযমী হও, চেতনাকে উর্দ্ধমুখী করো। 

মহাত্মা গুরুনাথ বলতেন, মাসে এক, বছরে বারো, যদি পারো তবে আরো কম করো। সহধর্ম্মিণীর  ঋতুকালকে রক্ষা করো। সংযমী হয়ে, সদা ব্রহ্মে বিচরণ করো - ব্রহ্মানুভূতির  এটাই পথ। 

প্রশ্ন উপনিষদ শ্লোক - ০১/১৪-১৫

"অন্নং বৈ প্রজাপতিঃ ততো হ বৈ তৎ রেতঃ তস্মাৎ ইমাঃ প্রজাঃ প্রজায়ন্ত ইতি । "(০১/১৪) 

অন্নই প্রজাপতি । এই অন্ন থেকেই রেতঃ ও শুক্র উৎপন্ন হয়। এই শুক্র থেকে সমস্ত প্রাণীর জন্ম হয়। 

ঋষি পিপ্পলাদকে জিজ্ঞাসু কবন্ধী প্রশ্ন করেছিলেন, হে প্রভু, এইসব প্রাণীগণ কোথা থেকে আসে ? উত্তর হচ্ছে, প্রথমে প্রজাপতির (সৃষ্টিকর্তার) প্রথম প্রকাশ  হচ্ছে সূর্য এবং  চন্দ্র। একজন প্রাণ আরেকজন রয়ি বা অন্ন। এর পরে হচ্ছে সম্বৎসর, মাস  দিন, রাত্রি।  আর সবশেষে প্রাণবীজ অর্থাৎ শুক্র ও রেতঃ। এই প্রাণবীজ অর্থাৎ শুক্র  ও রেতঃ থেকেই সমস্ত প্রাণীর আবির্ভাব। ছিলেন এক হলেন বহু। 

সৃষ্টির মুলে আমরা যে ক্রমোন্নতি দেখি, তা আসলে ব্রহ্মের বিবর্তন। এখন কথা  হচ্ছে ব্রহ্ম হচ্ছেন চেতনসত্ত্বা। এই চেতন সত্ত্বাকে আত্মশক্তিতে পরিণত করবার জন্য জড় ও প্রাণের মিলন ঘটেছে। প্রাণের শক্তিতে জড় প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। জড়বস্তু প্রাণবন্ত হয়ে জীবদেহের সৃষ্টি করছে। প্রজাপতির মধ্যে যখন প্রজা-কামনার সৃষ্টি হয়েছে, তখন সেই কামনা অন্নরূপে, অর্থাৎ ভোজ্য বস্তু রূপে  এই জগতে রূপায়িত হয়ে উঠেছে। পঞ্চভূতের মধ্যে প্রাণ সুপ্ত। এই সুপ্ত প্রাণ পঞ্চভূতের কিয়দংশকে নিয়ে অন্নরূপে (ভোগ্য) ফুটে উঠেছে। তো উদ্ভিদ বা শষ্য  হচ্ছে প্রাণের প্রথম প্রকাশ। ক্ষিতি, অপ , তেজ, মরুৎ  অর্থাৎ মাটি, জল, আলো , বাতাস, থেকে এই প্রাণকোষ খাদ্য সংগ্রহ করছে। এই হচ্ছে প্রাণসৃষ্টির গর্ভগৃহ। সুতরাং সৃষ্টির মুলে আছে অন্ন, এই অন্নের  মাঝে আছে প্রাণশক্তি। এই অন্ন প্রাণ ও জড় শক্তির মিশ্রণ। এই প্রাণশক্তি ও চেতনার অমূর্তরূপ হচ্ছে প্রজাপতি। একেই বলে হিরণ্যগর্ভ। 
---------------

"তদ্যে হ বৈ  তৎ প্রজাপতিব্রতং চরন্তি তে মিথুনম উৎপাদয়ন্তে। তেষাম এব এষঃ ব্রহ্মলোকো যেষাং তপো ব্রহ্মচর্যং যেষু সত্যম প্রতিষ্ঠিতম। "(০১/১৫) 

এইজন্য যারা প্রজাপতির নিয়ম পালন করে সন্তানের জন্ম দেন, তারাই শুধু ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হন। অর্থাৎ  যারা কৃচ্ছসাধন করেন এবং সংযত জীবন যাপন করেন, যারা সত্যে প্রতিষ্ঠিত তাঁরাই  ব্রহ্মলোক (আসলে পিতৃলোক বা চন্দ্রলোক - যেখান থেকে আবার ফিরে ফিরে আসতে  হবে ) প্রাপ্ত হন। 

আমাদের একটা  ধারনা হচ্ছে সংসার জীবন মানেই ব্রহ্মচর্য্য থেকে স্খলন। সংসারী মানুষের পক্ষে ব্রহ্মচর্য্য পালন সম্ভব নয়। আসলে ব্রহ্মচর্য্য কথাটার মানে শুধু শরীরের বীর্যরক্ষা নয়। ব্রহ্মচর্য্য  হচ্ছে আত্মসংযম, ব্রহ্মচর্য্য হচ্ছে তপস্যা , ব্রহ্মচর্য্য হচ্ছে নিজেকে সত্যে প্রতিষ্ঠিত করা। এই সত্য তার কর্ম্মে, তার চিন্তায়, ও বাক্যে প্রতিফলিত হবে। আপনি সংসারী কি সন্যাসী, আপনি গৃহে আছেন, কি পাহাড়ের গুহায় আছেন, আপনি মন্দিরে আছেন কি মসজিদে আছেন, সেটা বড়ো  কথা নয়, আপনি কায়-মন-বাক্যে সত্য সংলগ্ন আছেন কি না সেটাই বড়ো কথা।  আপনি ল্যাঙট পরে আছেন কি লুঙ্গি পরে আছেন, আপনার বস্ত্র শ্বেত বর্ণের কি গেরুয়া বর্ণের সেটা বড়ো  কথা নয়। মনের লাগাম  আপনার হাতে আছে কি না, চিন্তার প্রতি আপনার নিয়ন্ত্রণ আছে কি না, বাক ও কর্ম্মে আপনার মিল আছে কি না, সেটা বিচার্য ।  বাক্যে আপনার সত্য প্রতিষ্ঠিত আছে কি না। সেটাই ব্রহ্মচর্য্য , অন্য কথায় ব্রহ্মচর্য্য  মানে ব্রহ্মে বিচারণকারী ।

দেখুন, পিতা-মাতার চিন্তা-ভাবনা যত  বিশুদ্ধ হবে, তার সন্তান-সন্ততির মধ্যে এই চিন্তার প্রভাব পড়বে।  পিতা -মাতার কর্ম্ম-বীজ রূপ সংস্কার  ও সন্তানের নিজস্ব কর্ম্মবীজরূপ সংস্কার নিয়ে একটা নতুন মনুষ্য দেহ তৈরী  হয়। তো পিতামাতার সংস্কারের সঙ্গে সন্তানের নিজস্ব সংস্কার মিলে  একটা নতুন সংস্কারের জন্ম হয় - যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে প্রবাহিত হবে। তো আমাদের নতুন প্রজন্ম পিতামাতার চিন্তাকেই এগিয়ে নিয়ে যায়। সাত্ত্বিক পিতা-মাতার গৃহে, সাধকরা আসেন।  যোগ-পরায়ণ  দম্পতির কোলে যোগসাধকের জন্ম হয়। 

আর এই কারনে আমাদের প্রাচীন মুনি-ঋষিগণ সমস্ত দম্পতিকে সংযমী হবার উপদেশ দান  করেছেন, যাতে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কুলশ্রেষ্ঠ হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণ করে, দেশ ও জাতিকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারে। 
আপনারা জানেন, পঙ্গু সন্তান জন্মের প্রথম ও প্রধান কারন হচ্ছে, পিতা -মাতার উশৃঙ্খল যৌনজীবন। মায়ের পেটে  সন্তানের সুস্ত্ৰপাত হলে, যৌনাচার নিষিদ্ধ। প্রকৃতি ঋতুমতী না হলে, রমন নিষিদ্ধ। ঋষিগণ বলছেন, পিতা -মাতার মনের খুঁত তার সন্তানের দেহে ফুটে ওঠে। অধিকন্তু বিকলাঙ্গ লোকের মন বিকল হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এরা  ব্রহ্ম  চিন্তন থেকে দূরে থাকে। সংযমী পিতা  মাতার  সন্তানের দেহ যেমন নিখুঁত হবে, মন হবে শুদ্ধ।  এই দেহ হবে শুদ্ধ, ব্রাহ্মীতনু । সুতরাং জাতির অকল্যাণে জন্য যেমন মা-বাবা দায়িত্ত্ব এড়াতে পারেন না, তেমনি জাতির কল্যানের জন্য পিত-মাতার অবদান অনস্বীকার্য। 

প্রশ্ন উপনিষদ - ০১/১৫-১৬

সুতরাং ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, "তেষাম এব এষঃ ব্রহ্মলোকো যেষাং তপো ব্রহ্মচর্যং যেষু সত্যম প্রতিষ্ঠিতম।" যাদের তপস্যা আছে, ব্রহ্মচর্য্য  আছে,  যারা সত্যানুরাগী সেই দম্পতি ব্রহ্মলোকে গমন করেন। এঁরাই  দেবযান  পথে আদিত্যলোক লাভ করেন। এঁদের  আর  মর্তলোকে ফিরে আসতে  হয় না।  

আসলে জাগতিক কামনা-বাসনার প্রতি যতদিন আকর্ষণ থাকে, ততদিন জানবেন, চিত্ত মলিন। চিত্তের মালিন্য দূর করতে গেলে, জাগতিক কামনা বাসনার উর্দ্ধে উঠে, জীবনে তপস্যাকে ব্রত করে নিতে  হবে, সত্যের প্রতি নিষ্ঠা বজায় রাখতে হবে, আর অবশ্যই  ব্রহ্মচর্য্য অর্থাৎ নিজেকে সংযমী হতে হবে।  তবেই আমরা সেই জ্যোতির্লোকের সন্ধান পাবো, সেই আদিত্যলোকর বাসিন্দা হতে পারবো। এই স্থূল শরীরে থাকা কালীন, মনকে যত উচ্চ চিন্তায় প্রবাহিত করতে পারবো, মৃত্যুর পরে, এমনকি মৃত্যুর আগেই আমরা ব্রহ্মলোকের ব্রহ্মানন্দ উপভোগ করতে পারবো। 
---------

"তেষাম অসৌ বিরজো ব্রহ্মলোকো ন যেষু জিহ্মম অনৃতং  ন  মায়া চেতি। "  (১/১৬)

যাদের মধ্যে মিথ্যাচার, কুটিলতার লেশ মাত্র নেই, তাঁরাই  শুধু ব্রহ্মলোক প্রাপ্তির যোগ্য। 

"তেষাম অসৌ বিরজো ব্রহ্মলোকো" - রজঃ কথাটার অর্থ ধূলি।  আমাদের যে দ্বেষ, হিংসা, অহঙ্কার  তা এই রজঃ  গুনের কারনে হয়ে থাকে। এখানে বলা হচ্ছে "বিরজো" - অর্থাৎ ধূলি ময়লা বিহীন - নির্ম্মল শুদ্ধ সত্ত্বা। তো আমরা যদি ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হতে চাই, তবে আমাদের শুদ্ধ হতে হবে।  এর পরে চাই ঋজুতা অর্থাৎ সহজ-সরল ভাব। আমার মধ্যে যেন কোনো কুটিলতা না থাকে, "ন জিহ্মম"। না থাকবে কোনো মিথ্যাচার "অনৃতম"। প্রতিষ্ঠিত হতে হবে সত্যে। "ন মায়া  চেতি" - কপটতা থাকবে না। 

তো কবন্ধীর করা প্রথম প্রশ্নের জবাব শেষ হলো। প্রাণীসকল কোথা থেকে আসে ? উত্তর হলো প্রজাপতি থেকে। এই প্রজাপতি থেকে সূর্য-চন্দ্র।  সূর্য হচ্ছে প্রাণ, আর চন্দ্র হচ্ছে  রয়ি। প্রাণ হচ্ছে জীবন আর রয়ি হচ্ছে প্রাণ ধারনের উপাদান। প্রাণ হচ্ছে ভোক্তা, আর রয়ি হচ্ছে অন্ন বা ভোগ্য। মানুষের  আত্মসংযম, তপস্যা, ব্রহ্মচর্য, এবং সত্যনিষ্ঠা হচ্ছে, মানুষের ক্রমন্নতির সোপান। সৎভাবে সৎকর্ম্মে পিতৃলোক প্রাপ্তি।  কিন্তুসেখান থেকে আবার ফিরে আস্তে হবে।  আর নিষ্কাম কর্ম্মে প্রাণ প্রজাপতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। প্রজাপতি ভোক্তা ও ভোগ্যের কারনে প্রাণীরূপ ধারণ করেছেন। তো ভোক্তা ও ভোগের থেকে নিবৃত্তি লাভ করতে পারলেই, স্ব -স্বরূপে স্থিতি। 
 
 প্রশ্ন উপনিষদের প্রথম প্রশ্নের সমাধান হলো। 

--------------------- 

প্রশ্ন উপনিষদ রহস্যঃ - দ্বিতীয় প্রশ্ন 

শ্লোক ০২/০১-১৩

প্রশ্ন উপনিষদ - শ্লোক ০২/০১-০২
 
"অথ হৈনং ভাৰ্গবো বৈদর্ভিঃ পপ্রচ্ছ। ভগবন কত্যেব দেবাঃ প্রজাং বিধারয়ন্তে কতর এতৎ প্রকাশয়ন্তে ? কঃ পুনরেষাং বরিষ্ঠ ইতি।" (২/০১)

এর পর তাঁকে (ঋষি পিপ্পলাদকে) বিদর্ভ দেশীয় ভার্গব প্রশ্ন করলেন - হে ভগবন ক'টি  ইন্দ্রিয়-দেবতা  প্রাণী-দেহকে ধারণ করে? এদের মধ্যে কারা দেহকে প্রকাশ করে ? এদের মধ্যে কোনটি প্রধানতম ? 

আমরা জানি ইন্দ্রিয়সকলের সাহায্যেই চেতনশক্তি নিজেকে প্রকাশ করছে। যার মধ্যে ইন্দ্রিয় অর্থাৎ কর্ম্মেন্দ্রিয়, জ্ঞানেন্দ্রিয় ও অন্তরেন্দ্রিয় নিষ্ক্রিয় তা জড়। এই ইন্দ্রিয়গুলো দৈব শক্তির আধার। এইজন্য ইন্দ্রিয়গুলোকে এখানে দেবাঃ বা দেবতাগণ বলা হচ্ছে। আর দেহ বা জীব হচ্ছে, এই দেবতাগনের প্রজা। প্রশ্ন করছেন, ভার্গব।  আক্ষরিক অর্থে  ঋষি ভৃগুর পুত্র হচ্ছেন, ভার্গব। বিদর্ভ দেশীয় ভার্গব। ভৌগলিক দিক থেকে মধ্যপ্রদেশ। প্রথম  প্রশ্ন  করেছিলেন,কবন্ধী যাঁর ধর থেকে মাথা আলাদা হয়ে গেছে। তখন প্রশ্নটা ছিল হৃদয় থেকে। এবারের প্রশ্নকর্ত্তা হচ্ছে ভার্গব।  ভর্গ - কথাটার অর্থ হচ্ছে জ্যোতিঃ - তেজ। ভার্গব বলে বোঝায় তেজঃ  বিশিষ্ট মুনিবিশেষ - এঁকেই বলা হয় শুক্রাচার্য। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রজা বা সৃষ্টিরক্ষার মুলে কোন  দেবশক্তি  কাজ করে ? কার কারণেই বা এই জীবলোক ফুটে উঠছে ? এঁদের  মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে ?
কবন্ধীর প্রথম প্রশ্নের জবাবে ঋষি পিপ্পলাদ বলেছিলেন, সৃষ্টি মুলে হচ্ছেন প্রজাপতি ব্রহ্ম। দুটো পরস্পর বিরোধী শক্তির (খাদ্য-খাদক, প্রাণ-রয়ি চন্দ্র-সূর্য) তিনি এই সৃষ্টিকে প্রকাশিত করেছেন। এবার এই সৃষ্টির বিশদ আলোচনার জন্য এই দ্বিতীয় প্রশ্নের উল্লেখ। ক'টি  ইন্দ্রিয়-দেবতা  প্রাণী-দেহকে ধারণ করে ? এদের মধ্যে কারা দেহকে প্রকাশ করে ? এদের মধ্যে কোনটি প্রধানতম ? 
-------------
"তস্মৈ স  হঃ উবাচ আকাশঃ হ বা এষ দেবো বায়ুঃ অগ্নি আপঃ পৃথিবী বাঙমনশ্চক্ষুঃ শ্রোত্রং চ।  তে প্রকাশ্য অভিবদন্তি বয়ম এতদ  বানম অবষ্টভ্য বিধারয়ামঃ । "(০২/০২)

তাঁকে (ভার্গবকে) তিনি (ঋষি পিপ্পলাদ) বললেন, আকাশই  এই দেবতা। তেমনি বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী, বাক, মন, চোখ এবং কানও দেবতা।  এঁরা  সবাই  নিজ নিজ ক্ষমতার কথা বলতে লাগলেন। তাঁদের  সকলের দাবি, যে তাঁরাই  এই দেহকে বলিষ্ঠ করছেন  এবং দেহকে ধারণ করে আছেন।  

এবার ঋষি পিপ্পলাদ, ভার্গবের  প্রশ্নের জবাবে, একটা রূপক গল্প বলতে শুরু করলেন। একবার এই ইন্দ্রিয়সকলের মধ্যে বিবাদের সূত্রপাত হলো, কে শ্রেষ্ঠ ? সবাই ভাবছেন, যে তিনিই শ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ পাঁচটি কর্ম্মেন্দ্রিয় পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়, এবং একটি অন্তরেন্দ্রিয়, এদের মধ্যে বিবাদ শুরু হলো। তারা সবাই বলছেন, এই যে দেহ, তা আমিই ধারণ করে আছি। 

অর্থাৎ সমস্ত ইন্দ্রিয়ের মধ্যে অহঙ্কারের সৃষ্টি হয়েছে। এই অহঙ্কার  ব্যাপারটা আমরা একটু বুঝে নেই। কোথা থেকে এলো এই অহঙ্কার ? 

বেদান্ত বলছেন, পঞ্চভূত (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ব্যোম) এবং মন, চক্ষু এবং শ্রোত্র  এরা  সবাই দেবতা। দেবতা অর্থাৎ এক বা একাধিক গুনের অধিকারী। আর এই দেবতাগণ সবাই পরমাত্মা থেকেই উৎপত্তি হয়েছে।  প্রথমে আকাশ, তারপর  বায়ু,  অগ্নি, অপ, পৃত্থি ইত্যাদি পৰ্য্যায়ক্রমে উৎপত্তি হয়েছে।  আবার এই যে পঞ্চভূত, এর যে সাত্ত্বিক অংশ তা থেকে তৈরী হয়েছে,  মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহঙ্কার। 

এই ব্যাপারটা আমরা একটু বিশদে বুঝবার চেষ্টা করি। যা কিছু আমরা দেখছি, তার পিছনে একটা কারন আছে। এই কারনগুলোর আবার একটা সূক্ষ্ম কারন আছে। এই যে কারনে কারন, আবার তার কারন - এই ব্যাপারটা সংক্ষিপ্ত কবর জন্য, বা এই ব্যাপারটায় দাড়ি টানবার জন্য, মহাত্মাগণ আমাদের বুঝিয়েছেন এইভাবে। 

পার্থিব অনুর সূক্ষ্ম বিষয় হলো গন্ধ তন্মাত্র, জলের তন্মাত্র  হচ্ছে রস, বায়ুর তন্মাত্র  হচ্ছে স্পর্শ, আকাশের তন্মাত্র   হচ্ছে শব্দ। এই যে তন্মাত্র এদের সূক্ষ্মত্বের কারন হলো, অহঙ্কার। এই অহঙ্কারের (লিঙ্গ) উৎপত্তি মহৎ তত্ত্ব থেকে। 
তো পঞ্চ তন্মাত্র (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ) হচ্ছে পঞ্চভূতের (ক্ষিতি, অপ , তেজঃ , মরুৎ , ব্যোম ) কারন স্বরূপ। যা কোনো  কিছুতে লয় হয়, তা তার লিঙ্গ। আর যার লয় হয় না, তাকে বলে অলিঙ্গ। এই অলিঙ্গই প্রধান প্রকৃতি।পুরুষের সান্নিধ্য বশতঃ  প্রকৃতি থেকে ধীরে ধীরে মহত্তত্ত্ব থেকে  বুদ্ধি, বুদ্ধি থেকে  অহঙ্কার  তারপরে পাঁচ-তন্মাত্র। এইবার অহংকার থেকে একাদশ ইন্দ্রিয়, আর পাঁচ তন্মাত্র  থেকে পঞ্চভূত। তো মোট চব্বিশটি তত্ত্ব ও এক পুরুষ এই মোট পচিঁশ হচ্ছে আমাদের অহঙ্কারের  উপলব্ধি। এই অহঙ্কারের  উপলব্ধির কারনে মনের মধ্যে বিকারের জন্ম হচ্ছে। এই মনঃ বিকার-ই  আমি আমি করে বেড়াচ্ছে। অর্থাৎ আমি ভালো আমি মন্দ, আমি জ্ঞানী, আমি অজ্ঞানী, আমি দেখছি, আমি শুনছি, আমি বলছি ইত্যাদি করে বেড়াচ্ছে। এই যে বিকার এটি মহৎ-তত্ত্বের  উৎপত্তি,  পুরুষের নয়। পুরুষ মহৎ-তত্ত্বের  নিমিত্ত কারন, উপাদান কারন নয়। আর এই পুরুষ উপাদান কারন না হওয়ায় পুরুষ প্রযোজক মাত্র।  
----------- 
 
প্রশ্ন উপনিষদ রহস্যঃ : শ্লোক ০২/০৩

"তান  বরিষ্ঠঃ প্রাণ উবাচ। মা মোহং আপ্দ্যথ অহম এব  এতৎ পঞ্চধা আত্মানং প্রবিভজ্য এতৎ বাণম  অবষ্টভ্য বিধারয়ামি ইতি তে অশ্রদ্দধানাঃ বভূবুঃ। "  (০২/০৩)

তাঁদের  মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রাণ বললেন, মোহগ্রস্থ হয়ো  না। আমি আমাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে, যার যা কাজ তাকে তা ভাগ করে দিয়ে, এই  দেহকে ধারণ করে সুরক্ষিত রেখেছি। কিন্তু তাঁরা (ইন্দ্রিসকল) প্রাণের এই কথায় শ্রদ্ধাশীল ছিল না। 

ইন্দ্রিয়সকল  যখন  নিজের শক্তিকেই শ্রেষ্ঠ বলে অহঙ্কার করছে, তখন এই দেহস্থিত সেই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণ, ইন্দ্রিয়সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মোহগ্রস্থ হয়ো না। 

মানুষের এই হচ্ছে প্রকৃত অবস্থা। মানুষ মোহগ্রস্থ হয়ে আছে। মানুষ ভাবছে, সে-ই সমস্ত কর্ম্মের কর্ত্তা।  আর তার এই কর্তৃত্বাভিমানই তাকে  সমস্ত কর্ম্মফল ভোগ করাচ্ছে। আর সুখ-দুঃখ ভোগ করতে করে  জীবন কাল শেষ করে শেষে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ছে।  তথাপি মোহ তার কাটে না। 

ভাবছে আমি ছাড়া সংসার অচল হয়ে যাবে। আমি মারা  গেলে কি হবে, আমার স্ত্রী-ছেলে-মেয়ের কি গতি হবে  ?  আমি ছাড়া এই বিশাল সম্পত্তি কে রক্ষা করবে ? আমার মতো সংসারবুদ্ধি আর কার আছে ? আমার মতো রক্ষাকর্ত্তা আর কে আছেন, এই সংসারে ? এই সব ভাবতে ভাবতে, জীবনপাত পরিশ্রম করে, শরীরটা রোগের  ডিপো বানিয়ে ধুঁকতে  থাকে।  তথাপি, সংসার মোহ তার যায় না। নিজের মধ্যে একটা  আত্মম্ভরী ভাব, আমিই সব - এই ভাব নিয়েই একদিন সে কবরের মধ্যে শুয়ে পড়ে।  হায়  রে মানুষ ! 

জীবন হচ্ছে শ্বাসের খেলা, শ্বাসের শুরুতে জীবন শুরু, আবার শ্বাসের শেষে জীবনের শেষ। এমনকি এক মুহূর্তের জন্য আমাদের শ্বাস রুদ্ধ হয়ে গেলে, আমরা উতলা হয়ে উঠি।  আর এই শ্বাসকে গ্রহণ করবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি। নাক বন্ধ  হয়ে গেলে, আমরা মুখ দিয়ে শ্বাস গ্রহণ করে থাকি। এই শ্বাসক্রিয়াই মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে।  আর সবচেয়ে আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই শ্বাসকে আমরা কেউ গুরুত্ত্ব দেই  না। কখন সে আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে, কতক্ষন সে আমাদের শরীরের ভিতরে থাকছে, আর কখন  সে বেরিয়ে যাচ্ছে, তার দিকে আমাদের কোনো মনোযোগ নেই।  আমরা ভাবি শ্বাস তো এমনি এমনি হয়।  এর জন্য আমাদের কোনো কিছু করবার আছে, তাও  আমরা জানি না। 
এই ব্যাপারটা আমাদের যোগগুরুগন সম্যক রূপে উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁরা  বুঝেছিলেন, এই শ্বাসক্রিয়া যেমন আমাদের শরীরকে বাঁচিয়ে রেখেছে, জীবনকে আশ্রয় দিয়েছে, তেমনি অশ্বিনীকুমারদ্বয় এই শ্বাস-প্রশ্বাস  আমাদের শরীরকে রোগমুক্ত দীর্ঘজীবন দান  করতে পারে। আর এই কারণেই তাঁরা  প্রাণায়াম অর্থাৎ প্রাণের আয়ামের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছেন।  এমনকি ঈশ্বরের খোঁজেও তাঁরা  এই শ্বাসের ক্রিয়াকেই অবলম্বন করেছেন। এই শ্বাসই প্রাণ। আর প্রাণই আত্মার ছায়া স্বরূপ। তাই জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে সুশৃঙ্খল শ্বাসক্রিয়া। আমরা যেন এই প্রাণকে আমাদের জীবনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে, তার আয়ামের ব্যবস্থা করি।  তাহলে আমাদের জীবন সুখময়, আনন্দময়, এমনকি  নীরোগ শরীরের অধিকারী হতে পারি।  দীর্ঘ আয়ুর  (শতায়ু) অধিকারী হতে পারি। 

 যাই হোক, আমরা ঋষি পিপ্পলাদের কথায় ফিরে আসি। প্রাণ বলছেন, আমি নিজেকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে,  সচল রেখেছি। এই পাঁচটি ভাগ কি ? প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান , সমান। প্রাণের কাজ হচ্ছে, আমাদের শ্বাস গ্রহণ ও বৰ্জন করা। অর্থাৎ প্রাণ নিজের কাছে এই মূল দায়িত্ত্বটি রেখে দিয়েছে।  অপান-এর কাজ হচ্ছে, খাদ্যের অসার পদার্থ বৰ্জন  করা, ব্যান-এর কাজ হচ্ছে, দেহের সমস্ত নাড়ী মধ্যে প্রবেশ করে সমস্ত স্নায়ুকে সক্রিয় রাখা, আর উদ্যান বায়ুর কাজ হচ্ছে,  শরীরের তাপকে সুসরক্ষিত করা ও  খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করা। প্রাণ নিজেকে  এই পাঁচটি শক্তিতে  বিভক্ত করে, স্থূল শরীরকে সচল রেখে, দেহকে ক্রিয়াশীল করেছে।

কিন্তু আমরা কেউ প্রাণের গুরুত্ত্ব বুঝি না।  শ্বাস যেমন আমাদের এমনি এমনি প্রবাহিত হয়, আমাদের হজমও  যেন এমনি এমনি হয়। এমনকি আমাদের দেহ থেকে বর্জ  পদার্থ বেরিয়ে দেহকে নির্ম্মল রাখছে, এর জন্য আমাদের কিছুই করতে হয় না।  আমরা কিছু করিও না। কিন্তু সত্য হচ্ছে প্রাণের এই মাহাত্ম যিনি সম্যক  রূপে উপলব্ধি করেছেন, এবং তিনি (যোগীপুরুষ)  প্রাণক্রিয়ার দিকে  মনোযোগ দিয়ে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছেন।  
--------------------------- 
                                                                           
প্রশ্ন উপনিষদ রহস্যঃ : শ্লোক : (০২/০৪)

সঃ অভিমানাৎ ঊর্ধ্বম উৎক্রামতে ইব তস্মিন  উৎক্রামতি অথ  ইতরে  সর্ব এবোৎ  উৎক্রামন্তে  তস্মিন চ প্রতিষ্ঠমানে সর্ব এবং প্রাতিষ্ঠন্তে। তদ্যথা মক্ষিকা মধুকর রাজানম উৎক্রামন্তং সর্বা এব উৎক্রামন্তে তস্মিন চ প্রতিষ্ঠমানে সর্বা এব প্রাতিষ্ঠন্ত এবং বাঙ-মনঃ-চক্ষুঃ শ্রোত্রং চ তে প্রীতা প্রাণং স্তুন্বন্তি । (২/০৪)

(ইন্দ্রিয়গনের অহঙ্কার  আর অশ্রদ্ধা দেখে) তিনি (প্রাণ) অভিমান বশতঃ শরীর  ছেড়ে যাবার উপক্রম করলেন। আর যেমনই  তিনি শরীর  ছেড়ে যাবার উপক্রম করলেন, তক্ষুনি অন্যান্য ইন্দ্রিয়সকল শরীর  ছেড়ে যাবার উপক্রম করলেন। যখন তিনি (প্রাণ) স্থির হলেন, তাঁরাও  (ইন্দ্রিসকল) যে যাঁর  জায়গায় ফিরে এলেন। যেমন  মৌমাছির রানীকে উড়ে যেতে দেখে,  সকল মৌমাছি উড়ে যায়, আবার রানী মৌমাছি নিজের জায়গায় স্থির হলে সব মৌমাছি যে যার জায়গায় থাকে। বাক-মন-চোখ-নাক-কান ইত্যাদি ইন্দ্রিয়গুলো মৌমাছির দলের মতো, প্রাণের শ্রেষ্ঠত্ব দেখে, তাঁর স্তব করতে লাগলেন। 

এই শ্লোকের নেপথ্যে আরো একটু কাহিনী আছে। এই কাহিনী আমরা ছান্দোগ্য উপনিষদে,ও বৃহদারণ্যক উপনিষদে  দেখতে পাই।
ইন্দ্রিয়সকল সবাই বলছে আমি বড়ো। প্রাণ মন বাক চক্ষু কান সবাই বলছে, আমিই শ্রেষ্ঠ। কিছুতেই এর মীমাংসা হচ্ছে না। এখন সবাই বিচারের  আশায়, প্রজাপতি  ব্রহ্মার  কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। প্রজাপতি ব্রহ্মা সর্বজ্ঞ, আবার তিনিই এদের সবার পিতা। এখন পিতার কাছে কেউই ছোট বা বড়ো  নয়, সবাই সমান। যাকে  যে কাজের জন্য পাঠানো হয়েছে, সে সেই কাজে অবশ্যই  শ্রেষ্ঠ। তো পিতা  প্রজাপতি ব্রহ্মা পড়ে  গেলেন, মহা বিপদে। কাকেই বা তিনি ছোটো  বলেন, আর কাকেই বা তিনি বড়ো  বলেন ! কে ছোটো  আর কে বড়ো  তা তিনি জানেন, কেননা, তিনিই এদের জন্মদাতা। তথাপি কাউকেই তিনি ছোটো  বলতে চাইলেন না, কিন্তু যে যার ক্ষমতা সম্পর্কে এঁরা সবাই অবহিত থাকুক, এবং যে  যার জায়গায় এঁরা  সবাই সম্মানিত থাকুক - এই বোধ জাগিয়ে তুলবার, অথচ সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করবার   জন্য তিনি একটা উপায় বের করলেন।  বললেন, তোমাদের মধ্যে যে শরীর ছেড়ে গেলে, শরীরের সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়, সেই সব চাইতে শ্রেষ্ঠ। 
  
এখন আমাদের বাক একটু বেশী  কথা বলে, বুঝুক না বুঝুক, কথা বলাই তার কাজ। প্রজাপতি যেই না বললেন, তোমাদের মধ্যে যে শরীর ছেড়ে গেলে, শরীরের সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়, সেই সব চাইতে শ্রেষ্ঠ। এই কথা শুনেই,  শরীরের বাক শক্তি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করবার জন্য, শরীর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন, দেখ কেমন লাগে। আমাকে শ্রেষ্ঠ বলে না মেনে নিলে, আমি আর শরীরের মধ্যে ফিরে আসছি না। এখন শরীরের থেকে বাকশক্তি চলে গেলে, শরীর  বোবা হয়ে গেলো, এখন আর সে কথা বলতে পারে না।  কিন্তু কথা না বললে কি হবে, বোবা মানুষেরও  তো জীবন চলে। কথা বলতে পারে না বটে, কিন্তু আর সব কিছুই সে করতে পারে। অর্থাৎ শরীর  আগের মতোই আছে, কেবল বাকহীন অবস্থা। চোখ, দিয়ে দেখে, কান দিয়ে শোনে, মনের মধ্যে ভাবনার উদয় হয়, এমনকি সে প্রাণে বেঁচেও আছে।  কাজেই বিশেষ কোনো অসুবিধা হলো না শরীরের। একমান দুই মাস, ছয় মাস, একবছর হয়ে গেলো, শরীর ভালোই আছে।  আর কথা না বলার ফলে, অর্থাৎ মৌন থাকার ফলে, শরীরের শক্তি ক্ষয় হচ্ছে না, ফলতঃ শরীরের  মধ্যে যেন  একটা জেল্লা বেরুচ্ছে।  বাক এবার চুপি চুপি এসে শরীরকে জিজ্ঞেস করলো, কিহে, আমার অবর্তমানে কেমন ছিলে  ? শরীর  বললো,  মন্দ কি ? কথা বলতে পারছিলাম না ঠিক কিন্তু আমি শুনতাম, দেখতাম, ভাবনা চিন্তা করতাম, এমনকি প্রাণে বেঁচে আছি, তা তো দেখতেই পারছো। একথা শুনে বাকের মাথা নিচু হয়ে এলো।  চুপি চুপি আবার সে শরীরের মধ্যে প্রবেশ করলো। 

প্রশ্ন উপনিষদ রহস্যঃ : শ্লোক : (০২/০৪-০৫)

এবার চোখ আল্হাদে  নেচে উঠলো। বাকের সঙ্গে চোখের এক লম্বা  লড়াই বরাবর ছিল। চোখ জানে আমি না থাকলে, জগৎ অন্ধকার। সে এবার নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করবার জন্য, শরীর  ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু শরীর ঠিক চলতে লাগলো। এখন আর সে দেখতে পায়  না বটে, কিন্তু মুখে কথা বলতে পারে, কান দিয়ে শুনতে পারে, মন দিয়ে ভাবনা চিন্তা-ভাবনা  করতে পারে।  তাই অন্ধ শরীর বেশ চলতে লাগলো, আর প্রাণে সে তো বেঁচেই রইলো। তো একসময় চোখ লজ্বা পেয়ে, আবার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করলো। 

এইভাবে এক এক করে বাক, চোখ, কান, চলে গেলেও, কখনো সে বোবা, কখনো সে অন্ধ, কখনো সে বধির হয়ে থাকলেও প্রাণে সে বেঁচে থাকলো। এখন থাকলো শুধু প্রাণ আর মন। মন একসময় ভাবলো, প্রাণ করেটা  কি ? প্রাণ তো শরীরের জন্য কিছুই করে না। তো নিজের শ্রেষ্ঠও প্রমান করবার জন্য, একসময় মনটা শরীর থেকে  উধাও হয়ে গেলো। এখন আর সে চিন্তা করতে পারে না। শরীর  এবার শিশুর মতো হয়ে গেলো। এখন সে বিচার করতে পারে না। কিন্তু প্রাণে বেঁচে থাকলো।  শেষ মন ফিরে এসে দেখে শরীর  তো দিব্যি আছে। তার অভাবে কোনো পরিবর্তন শরীরের মধ্যে সে দেখতে পেলো না। তার সুরসুর করে মন আবার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করলো। 

এবার প্রাণের পালা, . প্রাণ এতদিন সব চুপচাপ দেখছিলো। যে শ্রেষ্ঠ সে নিজেকে শ্রেষ্ঠ জেনেও কখনো বড়াই  করে না। প্রাণ জানে, সবাই তা সে চোখ, কান, মুখ, এমনকি মন সবই  প্রাণের কারনে প্রাণবন্ত ও  ক্রিয়াশীল হয়ে আছে। কিন্তু সে নির্বিকার থেকে নিঃশব্দে কাজ করে চলে, সবাই  বিশ্রাম নেয়, কিন্তু  প্রাণ কখনো এক মুহূর্তের জন্য শরীর  ছেড়ে যায় না। শরীর, বিশ্রামে থাকুক, কাজের মধ্যে থাকুন, জেগে থাকুক, বা ঘুমিয়ে থাকুক, প্রাণ  সদা  জেগে তার নিজের কর্ম্ম করে যাচ্ছে।  তার না আছে ক্লান্তি, না আছে বিশ্রাম। প্রাণের কারণেই শরীরের হাত, পা, চোখ, কান, নাক, মুখ, ক্রিয়াশীল হতে পারে, এদের সবাইকেই প্রাণ পোষন করছে। 

তো প্রাণ এবার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার ভান করতেই, সবাই ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার শুরু করে দিলো। ছেড়ে যেও না ছেড়ে যেও হে প্রাণ, বলে প্রাণের স্তুতি শুরু করে দিলো সবাই। সবার অভিমান চূর্ন হলো। তুমিই বড়ো , তুমিই শ্রেষ্ঠ, তোমার জয় হোক। সমস্ত ইন্দ্রিয়সকল বলে উঠলো, তুমিই রাজা , তুমিই জীবন, তুমিই পুষ্টি।  তোমার স্থিতিতে আমাদের স্থিতি। তুমি না থাকলে, আমরা আশ্রয়হীন হয়ে যাই। আমরা নির্ভরতা হারাই  . তুমি আছো, তাই আমরা আছি। তোমার জয় হোক। 

উপনিষদ এখানে একটা সুন্দর  উপমার সঙ্গে প্রাণের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বুঝিয়েছেন। বলছেন, মৌচাক থেকে রানী- মৌমাছি উড়ে গেলে, সমস্ত মৌমাছি রানীর পিছন পিছন ধাবিত হয়।  আর মৌচাক তখন ফাঁকা হয়ে যায়। মৌচাকে রানী-মৌমাছি প্রবেশ করলে, সমস্ত মৌমাছি চাকের উপরে এসে বসে। গম-গম করে মৌচাক।  মধুতে ভরে ওঠে।  তেমনি, প্রাণ শরীরে প্রবেশ করলে,  সমস্ত ইন্দ্রিয় তখন প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের মধ্যে  প্রবেশ করে। আবার শরীর  ছেড়ে প্রাণ বেরিয়ে গেলে, সমস্ত ইন্দ্রিয় এই  প্রাণহীন দেহকে হেলায় ত্যাগ করে প্রাণের সঙ্গে ধাবিত হয়। 
বাক বলছে, আমি আমার শক্তি দ্বারা সবাইকে পরাস্থ  করে ধন-সম্পত্তি পেয়ে থাকি তাই ঋষিগণ আমাকে বলেন, বশিষ্ঠ তো আমি যদি বশিষ্ঠ হই , তবে হে প্রাণ তুমিও বশিষ্ঠ। কেননা তোমার শক্তিই আমার শক্তি। 
চক্ষু বলছে, আমি দেখি, তাই শরীরের পতন বা বিপদ হয় না, এই কারনে  ঋষিগণ আমাকে প্রতিষ্ঠা বলেন ।  হে প্রাণ আমি যদি প্রতিষ্ঠা হয়, তবে তুমিও প্রতিষ্ঠা। কেননা তোমার শক্তিই আমার শক্তি। 
কান বলে উঠলো, আমরা দ্বারা সমস্ত জ্ঞানের  কথা শ্রুত হয়ে থাকে, তাই আমাকে ঋষিগণ সম্পদ বলে থাকেন । আমি যদি সম্পদ হই , তবে হে প্রাণ, তুমিও সম্পদ। কেননা তোমার শক্তিই আমার শক্তি। 
মন বলে উঠলো, আমি সকলের আশ্রয়, তাই ঋষিগণ আমাকে বলেন, আয়তন।  আমি যদি আয়তন হই তবে তুমিও আয়তন।  কেননা তোমার শক্তিই আমার শক্তি। 
বস্তুত প্রাণ আছেন, তাই শরীররূপ জড় পদার্থ প্রাণী নামে  খ্যাত হয়েছে। আর এই প্রাণ হচ্ছেন, আত্মার ছায়া স্বরূপ। প্রাণকে আশ্রয় করেই, সমস্ত জ্ঞানের সঞ্চার হয়ে থাকে। এই জ্ঞানকেই বলে আত্মজ্ঞান।  
-------------

এষঃ অগ্নি তপতি এষঃ সূর্য 
এষ প্রজন্যো মঘবান এষ বায়ুঃ ।
এষ পৃথিবী রয়ির্দেবঃ 
সৎ অসৎ চ অমৃতম চ যৎ। (০২/০৫)

ইহাই (প্রাণই) অগ্নি রূপে তাপ প্রদান করেন। ইহাই সূর্য।  ইহাই মেঘ।  ইহাই মঘবান অর্থাৎ দেবরাজ ইন্দ্র।  ইহাই বায়ু। ইহাই পৃথিবী।  ইহাই চন্দ্রদেব। ইহাই সৎ আবার অসৎ, যা অমৃত স্বরূপ। 

ইন্দ্রিয়গনের দ্বারা প্রাণের প্রশস্তি শুরু হলো। তে প্রীতা প্রাণং স্তুন্বন্তি - প্রাণ শরীরে স্থির হলে, ইন্দ্রিয়গণ স্বস্তি পেয়ে, প্রাণের স্তবগান করতে লাগলেন।  

এই প্রাণই অগ্নি রূপে তাপ  প্রদান করছেন, সূর্যরূপে আলো  প্রদান করছেন, মেঘ রূপে বৃষ্টি প্রদান করেন। এই প্রাণই   দেবরাজ ইন্দ্ররূপে সবকিছুকে পালন করছেন ইনিই বায়ু অর্থাৎ প্রাণবায়ু রূপে সর্বত্র বিদ্যমান।  ইনিই দেবতারূপে জগৎকে প্রকাশ করছেন, ইনিই প্রথিবী রূপে আশ্রয় প্রদান করছেন। চন্দ্র রূপে জ্যোৎস্না (অন্ন) প্রদান করছেন। আবার এই যে পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য কে প্রকাশ করছেন। তিনিই  সৎ, অর্থাৎ স্থূল সৃষ্টিতে যা প্রকাশিত আবার  অসৎ অর্থাৎ যা অব্যক্ত  হয়ে বিরাজ করছেন।  একমাত্র প্রাণই অমর। 

আত্মচেতনা থেকে সর্বপ্রথম মহাপ্রাণের স্ফূরণ  হয়েছে। এর পরে এই প্রাণ থেকেই যাবতীয় সৃষ্টি উদ্ভূত হয়েছে। সৃষ্টি যাকিছু মূলতত্ত্ব সেসব এই প্রাণ থেকেই আবির্ভূত হয়েছে। 

প্রশ্ন উপনিষদ রহস্যঃ : শ্লোক : (০২/০৫-৭)

অরা ইব রথনাভৌ প্রাণে সর্বং প্রতিষ্ঠিতম 
ঋচো যজুংষি সামানি যজ্ঞঃ ক্ষত্ৰং ব্রহ্ম  চ।  (০২/০৬)

রথচক্রে শালাকাগুলো যেমন চক্রের কেন্দ্রকে আশ্রয় করে থাকে, থিন তেমনি জগতের সবকিছু এই প্রাণকে আশ্রয় করে আছে।  এমনকি ঋক, যজুঃ , সাম এই তিন বেদ, বৈদিক যজ্ঞ, ক্ষত্রিয়  ব্রাহ্মণ সকল এই প্রাণকে আশ্রয় করে আছেন।  
ইন্দ্রিয়গণ প্রাণের প্রশস্তি গাইতে গিয়ে বলছেন : প্রাণই সমস্ত কিছুর কেন্দ্র বিন্দু। 

প্রাণকে রথের  চাকার নাভি হিসাবে তুলনা করা হয়েছে। রথের  চাকার এই কেন্দ্র বিন্দুকে  আশ্রয় করে চাকার শলাকাগুলো বৃত্তাকারে আশ্রিত হয়ে আছে।  তেমনি প্রাণকে আশ্রয় করে, এই জগৎ সংসার প্রতিষ্ঠিত আছে। ঋষি বেদত্রয়, অর্থাৎ ঋক, সাম , যজুর্বেদ অর্থাৎ পরাবিদ্যা  ও অপরাবিদ্যা  বা পার্থিব জ্ঞান ও অপার্থিব জ্ঞান যাই বলুন না কেন, এই প্রাণকে আশ্রয় করেই আছে। আমাদের যা কিছু ক্রিয়াকর্ম্ম তা এই প্রাণ আছে বলেই সম্ভব হচ্ছে। আপনি ক্ষত্রিয় হন বা ব্রাহ্মণ, শূদ্র হন বা বৈশ্য, আপনার মধ্যে সেই একই প্রাণ খেলা করছে।  এই প্রাণের কারণেই সবাই নিজেকে জাহির করতে পারছে। তো সবই প্রাণের প্রকাশ - এতে আমাদের কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
----------------------- 

"প্রজাপতিঃ চরসি গর্ভে ত্বমেব প্রতিজায়সে। 
তুভ্যং প্রাণ প্রজাস্ত্বিমা বলিং  হরন্তি  যঃ  প্রাণৈ প্রতিতিষ্ঠসি। "(০২/০৭) 

(হে প্রাণ) তুমি প্রজাপতিরূপে গর্ভে (মাতৃগর্ভে) বিচরণ করো। তাঁর প্রতিরূপ (মা-বাবার প্রতিরূপ) নিয়ে জন্মগ্রহণ করো। হে প্রাণ, তুমিই  শরীরের মধ্যে ইন্দ্রিসকলকে নিয়ে বাস করো। তোমার জন্য প্রজাসকল উপহার হিসেবে ভোগ্যবস্তু আহরণ করে। 

ইন্দ্রিয়দেবগন  প্রাণের স্তুতি করছেন। বলছেন, হে প্রাণ তুমিই প্রজাপতি। প্রজাপতি কথাটার অর্থ সমস্ত প্রজাদের পতি  বা প্রভু। অর্থাৎ সমস্ত প্রাণীসকলের স্বামী হচ্ছেন প্রাণ, বিশ্বপ্রাণ । হে প্রাণ,  তুমি যার মধ্যে প্রবেশ করো, তারই আকৃতি নিয়ে তুমি  আবির্ভূত হও। অর্থাৎ তুমি পিতা-মাতার অনুরূপ দেহ ধারণ করো।  আবার তোমার মা-বাবাও তোমারি অনুরূপ। তুমিই বারবার আসা যাওয়া করছো ।  তুমিই পুত্র তুমিই পিতা, তুমিই মাতা তুমিই কন্যা। প্রাণের উপস্থিতির কারণেই ইন্দ্রিসকল দেহস্থিত হ'তে পেরেছে। আবার ইন্দ্রিয়সকল যা কিছু সংগ্রহ করছে, (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ) তা কেবল তোমারি জন্য, তোমাকেই উপহার দিচ্ছে। 
বিশ্বপ্রাণ বা সমষ্টি প্রাণ থেকেই ব্যষ্টি প্রাণ।  বিশ্বপ্রাণই  প্রজাপতি।  আর  প্রজাপতি থেকেই প্রানেরধারা উৎসারিত হয়ে সৃষ্টি ধারাতে পরিণত হচ্ছে। কামশক্তি-কারনে   নর-নারীর মধ্যে দৈহিক সংযোগ ঘটেছে। তখন শুক্র  ও রজের  মিলনে ভ্রূণের সৃষ্টি হচ্ছে। এই ভ্রূণকে আশ্রয় করে মহাপ্রাণ জীবরূপে আবির্ভূত হন। সুতরাং প্রত্যেক মায়ের গর্ভের মধ্যেই প্রজাপতি বিরাজ করছেন। এবং পিতা-মাতার অনুরূপ দেহ নিয়ে জীব নামে  খ্যাত হয়েছেন। ইন্দ্রিয় সকলের সাহায্যে তিনি ভোক্তা হয়েছেন। তো বীজই প্রাণ যা জীবরূপে ইন্দ্রিয়সকল দ্বারা পূজিত হচ্ছে। যে শক্তি এই সৃষ্টিকে স্পন্দিত করছে, জানবেন সেখানেই আছে প্রাণ। গর্ভস্থ ভ্রুনকেও এই প্রাণবীজ শুক্র  স্পন্দিত করে দেহরূপে ভূমিষ্ট করছে। এইজন্য গর্ভস্থ ভ্রুনকেও এখানে প্রজাপতি বলা হচ্ছে। 
--------------
প্রশ্ন উপনিষদ রহস্যঃ : শ্লোক : (০২/০৮-০৯)

"দেবানাম অসি বহ্নিতমঃ পিতৃণাং প্রথমা স্বধা। 
ঋষীণাং চরিতং সত্যম অথর্বা অঙ্গিরসাম অসি।" (০২/০৮) 

হে প্রাণ তুমিই দেবতাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞাগ্নিতে প্রদত্ত যজ্ঞের আহুতির বাহক। তুমিই পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত অন্নপিন্ড গ্রহণ করো। ঋষিগণ যে সত্য জ্ঞানের অনুশীলন করছেন, তাও  তুমি। অর্থাৎ ঋষিগণ এই প্রানেরই সাধনা করছেন। 

অগ্নি সমস্ত কিছুকে তার উৎসে বহন করে নিয়ে যায়। এই অগ্নি প্রাণ বা বায়ুর  কারণেই  প্রজ্বলিত হয়। দেবতাদের উদ্দেশ্যে যে যাগযজ্ঞ করা হয়, তাতে যা কিছু আহুতি দেওয়া হয়, তা দেবতাদের কাছে এই অগ্নিই বহন করে নিয়ে যায়। প্রাণই দেবতা আবার এই প্রাণই ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সমস্ত কিছু গ্রহণ করছেন। পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে নিবেদিত যে অর্ঘ অর্থাৎ শ্রাদ্ধ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে যা কিছু পিতৃ পুরুষের আত্মার শান্তির কামনায় প্রদান করা হয়, তা আসলে এই প্রানকেই নিবেদন করা হয়। 

ঋষি বলতে বোঝায়, সংসারকে অতিক্রম করে যিনি জ্ঞানমার্গে বিচরণশীল। এখানে ইন্দ্রিয়সকলই ঋষি, কারন এই ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই জীব জ্ঞান সংগ্রহ করে । আমাদের পাঁচটি জ্ঞান-ইন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ন , নাসিকা, জিহ্বা  ত্বক) যা সমস্ত গুনের গ্রাহক অর্থাৎ এই ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই আমরা শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এই তন্মাত্রের গুন্জ্ঞান সংগ্রহ করছি। তারাই আমাদের কাছে জগৎকে উদ্ভাসিত করছে, আবার আমাদের অন্তরেন্দ্রিয়  রূপ মন আমাদের ঈশ্বর উপল্বদ্ধিতে সাহায্য করছে। এই ইন্দ্রিয়সকলই আমাদের জ্ঞানের মাধ্যম। আবার এই ইন্দ্রিয় প্রাণের শক্তিতেই উজ্জীবিত রয়েছে।  প্রাণহীন ইন্দ্রিয়ের কোনো শক্তি নেই। সুতরাং ইন্দ্রিয়গণ বলছেন, তোমার জন্যই  আমরা কাজ করছি, করতে পারছি। এই ইন্দ্রিয় সংযমের মাধ্যমেই মানুষের  বোধশক্তির বৃদ্ধি হয়ে থাকে। ইন্দ্রিয় সংযম বলতে ইন্দ্রিয়কে নিষ্ক্রিয় করা নয়, ইন্দ্রিয়শক্তিকে সঠিক রাস্তায় পরিচালিত করা।  আবার এই ইন্দ্রিয়গণ যেহেতু কেবলমাত্র প্রাণশক্তির উপরে নির্ভরশীল, তাই যোগীপুরুগ্ণ এই প্রাণের আয়ামের  সাহায্যে ইন্দ্রিয়ের শক্তি বৃদ্ধি  করে, সজ্ঞা অৰ্জন করে থাকেন। 
--------

ইন্দ্রঃ ত্বং  প্রাণ তেজসা রুদ্রঃ-অসি পরিরক্ষিতা। 
ত্বম অন্তরিক্ষে চরসি সূর্যঃ ত্বং জ্যোতিষাং পতিঃ।  (০২/০৯) 

হে প্রাণ, তুমিই ইন্দ্র। সংহারকারী শক্তিতে তুমি রুদ্র। আবার তুমিই রক্ষাকর্তা। তুমি অন্তরীক্ষে বিচরণ করে বেড়াও। তুমিই আকাশের বিচরণকারী জ্যোতিষ্ক মন্ডলীর প্রভুরূপ সূর্য। 

ইন্দ্র হচ্ছেন সমস্ত দেবতাদের রাজা। ইন্দ কথাটার অর্থ জ্যোতিঃ বা চেতনা। আমাদের এই স্থূল-জড়-শরীরে চেতন শক্তি ইন্দ্রিয়ের মাধমে ক্রিয়ারত। তাই মানুষকে জীবন্ত বলে মনে হচ্ছে। আর এই ইন্দ্রিয় সকলকে ক্রিয়াশীল করেছে প্রাণশক্তি। এই ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই মায়াশক্তিরূপ  (অজ্ঞান)  সৃষ্টির বৈচিত্র উপভোগ বা প্রতক্ষ্য হচ্ছে  ।  সেই দিক থেকে দেখতে গেলে, এই জগৎ উদ্ভাসিত হচ্ছে কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়ের কারণেই।  এই ইন্দ্রিয় সকলের মধ্যে অন্তরিন্দ্রিয় মন যেমন রাজা, তেমনি মনের রাজা হচ্ছেন, প্রাণ। এই প্রাণের কারণেই মন সহ  সমস্ত ইন্দ্রিয়  ক্রিয়া করছে। তো ইন্দ্র হচ্ছেন দেবতা। এই ইন্দ্রকেই বেদে বলা হয় সূর্য।  এই ইন্দ্রের কৃপায়, অর্থাৎ জ্যোতিরূপ চেতনার প্রভাবে জীবের অজ্ঞান দূরীভূত হতে পারে। এই ইন্দ্রদেবতাকেও বলা হচ্ছে প্রাণের একটা রূপ মাত্র। 

হিন্দু ধর্ম্ম শাস্ত্রে পরমেশ্বর বা পরমাত্মা সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, এই তিন শক্তির ধারক। ঈশ্বর সম্পর্কে  আমাদের অনেকের ধারণা হচ্ছে, তিনি কেবল মঙ্গলময়, কল্যাণকারী, শুভ শক্তি । তাঁকে  স্মরণ করলে, আমাদের কেবল বাঞ্চিত  ফল পাবো।  অর্থাৎ তিনি কেবল জীবের সুখ প্রদানকারী, তিনি একজন বিরাট দাতা ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে ভালো, মন্দ, সুখ-দুঃখ, শুভ অশুভ সবই তিনি। ভালো যেমন তার শক্তিতেই হচ্ছে, তেমনি যাকে  আমরা খারাপ, অহিতকর, অশুভ  বলি, তাও  সেই একই শক্তির দ্বারা সংগঠিত হচ্ছে।  আমরা জানি,  সৃষ্টি স্থিতি, লয় - এই তিন  পৃথক ক্রিয়ার জন্য, হিন্দু শাস্ত্রকারগন তিন দেবতার কল্পনা করেছেন।  তাঁরা  হচ্ছেন,  ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। এই শিবকে বিভিন্ন রকম রূপে কল্পনা  করা হয়েছে।  এই শিবের যে ভীষণ প্রলয়ের রূপ, তাকে বলা হয় রুদ্র। বেদ  উপনিষদ  বলছেন, এই মঙ্গলময়ের উগ্র ধংশকারী  রূপ হচ্ছেন রুদ্র - কেউ বলেন সূর্য। এঁরা  সবাই সেই প্রানেরই বিকাশ মাত্র।  
------------------ 
প্রশ্ন উপনিষদ রহস্যঃ : শ্লোক : (০২/১০-১৩)

যদা ত্বং অভিবর্ষসি তে ইমাঃ প্রাণ তে প্রজাঃ। 
আনন্দরুপাঃ তিষ্ঠন্তি কামায় অন্নং ভবিষ্যতীতি।  (০২/১০)

হে প্রাণ তুমি যখন (মেঘের দ্বারা) বর্ষণ করো, তখন সমস্ত প্রজা  (তোমার সন্তানেরা) উৎফুল্ল  হয়ে ওঠে। কারন তখন তারা মনে করে ভবিষ্যতে আমাদের অন্ন কামনা পূরণ হবে। 

ইন্দ্রিয়সকল প্রাণের স্তুতি করছেন।  বলছেন, প্রাণই বৃষ্টির উৎস। বর্ষার ফলে সমস্ত প্রাণিকুল উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। কারন বৃষ্টি হলে ফসল ভালো হবে, অর্থাৎ প্রচুর অন্ন উৎপাদন হবে। আর এই অন্নই প্রাণকে আকৃষ্ট করে। ফলতঃ প্রাণীকুল অন্নাধিপতি হয়ে সুখী হয়। বৃষ্টি হচ্ছে প্রানধারা বা চেতনধারা যা পৃথিবীতে বৃষ্টির আকারে নেমে আসে। আর এই বৃষ্টি মহাপ্রাণের ইচ্ছেতেই ঘটে থাকে। আসলে প্রাণই প্রাণের রক্ষাকর্তা। কখনও সে খাদ্য, কখনো সে খাদক। শিশুর জন্মের সঙ্গেই মায়ের বুকে দুধের সঞ্চার হয়। প্রাণী সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণীর খাদ্যরূপ অন্নের সৃষ্টি হয়েছে। জীব সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই জীবের মধ্যে খাদ্যের প্রয়োজন হয়, তাই প্রাণই খাদ্যের গ্রাহক, আবার এই প্রাণই খাদ্যের প্রেরক। প্রাণের কারণেই বৃষ্টি-অন্ন-প্রাণীর পুষ্টি। 
--------------

ব্রাত্যঃ  ত্বং  প্রাণ একর্ষিঃ অত্তা বিশ্বস্য সৎপতিঃ । 
বয়ম আদ্যস্য দাতারঃ পিতা  ত্বং মাতরিশ্ব নঃ। (০২/১১)

হে প্রাণ তুমি পতিত। তুমি একাই  ঋষি হয়ে যজ্ঞে আহুতি দিচ্ছ আবার যজ্ঞ-ফলের ভোক্তা হয়েছ । তুমিই জগতের পরম পতি।  তুমিই প্রথম জন্ম গ্রহণ করেছো। তুমিই তোমার পিতা, তুমিই তোমার মাতা। 

হে প্রাণ, তুমি আচারহীন ব্রাত্য, একর্ষি  নামক অগ্নিরূপে তুমিই যজ্ঞের ভোক্তা।  তুমিই জগতের চিরন্তন প্রভু।  আমরা সেই আদিপুরুষ তোমাকে (প্রাণকে)  হবি প্রদান করি। হে মাতরিশ্ব তুমি আমাদের পিতা। 

ব্রাত্য কথাটার অর্থ পতিত। অর্থাৎ যিনি আচারনহীন, সংস্কারহীন। এক সময় পূর্বদেশের অধিবাসীদের বলা হতো ব্রাত্য। এঁরা বৈদিক বিধি-বিধান মানতেন না। অথর্ব বেদের দ্রষ্টা ঋষিগণ অগ্নির উপাসক ছিলেন। অত্তা কথাটার অর্থ ভোক্তা। এই ভোক্তা অন্যকে প্রাণময় করে তোলেন। অন্ন যতক্ষন প্রাণীর বাইরে থাকে ততক্ষন নিতান্ত জড়। কিন্তু যখন ভোক্তা সেই অন্ন গ্রহণ করেন, তখন তা প্রাণীর অঙ্গস্বরূপ হয়ে যায়, প্রাণীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। বিশ্বপ্রাণ শক্তিকে বলা হয় মাতরিশ্বা। এইজন্য ইন্দ্রিয়সকল বলছেন, হে মাতরিশ্বা তুমিই পিতা, অর্থাৎ আমরা তোমার সন্তান।  
------------------------- . 

যা তে তনূঃ বাচি প্রতিষ্ঠিতা  যা শ্রোত্রে যা চ চক্ষুষি । 
যা চ মনসি সন্ততা শিবাং তাং কুরু মোৎক্রমীঃ । (২/১২)

তোমার যে তনু  (অংশ) আমাদের বাকে, শ্রবনে, চোখে, মনে একযোগে প্রতিষ্ঠিত আছে, তাদের কল্যাণ করো, তাদের পরিত্যাগ করো না। 

প্রাণবায়ু আমাদের সকল ইন্দ্রিয়গুলোকে সক্রিয় করছেন। এই প্রাণবিহীন  ইন্দ্রিয় অকেজো। আমাদের  প্রার্থনা, হে প্রাণ, সবসময় আমাদের সঙ্গে থাকুন, ইন্দ্রিসকলকে সুপথে পরিচালিত করুন। আমাদের যে বাকশক্তি, শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, মনন শক্তি সহ যত  শক্তি আমরা আমাদের মধ্যে দেখতে পাই, তা সবই প্রাণের উপস্থিতির কারনে প্রাণের শক্তি দ্বারাই ঘটে থাকে। কিন্তু দুঃখের কথা হচ্ছে, একসময় ইন্দ্রিয়াদি-শরীর এই প্রাণের উৎক্রমন ঘটে থাকে। প্রাণের এই উৎক্রমন আগমনই জড়দেহকে প্রাণবন্ত করে রাখে। মানুষের মধ্যে যে চেতনশক্তি তার বিকাশ   এই প্রাণের সহায়তা থেকেই হয়ে থাকে। প্রাণের দিব্য  প্রকাশ এই  মানব দেহে। মানব মনকে প্রজ্ঞার আলোতে দীপ্ত করে এই কল্যাণময় প্রাণ। তাই আমাদের প্রাণের কাছে প্রার্থনা জীবনের পূর্ন  বিকাশ না হওয়া পর্যন্ত যেন, তুমি আমাদের পরিত্যাগ করো না। তুমিই চেতনাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদেরকে উদ্দীপ্ত করছো। তুমি  দয়া করে আমাদের ছেড়ে যেও না।  

প্রাণস্য ইদং বশে  সর্বং ত্রিদিবে যৎ প্রতিষ্ঠিতম 
মাতেব পুত্রান রক্ষস্ব শ্ৰীঃ চ  প্রজ্ঞাং চ বিধেহি ন  ইতি।  (০২/১৩)

জগতের সব কিছু প্রাণের অধীনে। মা যেমন সন্তানকে রক্ষা করেন, প্রাণ তেমনি আমাদেরকে রক্ষা করুন। তিনি আমাদের জ্ঞান ও সৌভাগ্য প্রদান করুন।  এই আমাদের প্রার্থনা। 

প্রশ্ন উপনিষদে প্রথম প্রশ্নে  আমরা প্রাণের স্বরুপত্বের সম্পর্কে শুনেছি। দ্বিতীয় প্রশ্নে এসে, প্রাণের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে শুনলাম। প্রাণের স্তুতি করলাম। ত্রিলোকে যা কিছু আছে, সবই প্রাণের অধীনে। প্রাণই বিশ্বের সমস্ত কিছুর পিতা-মাতা। তো প্রাণই আমাদের জীবনকে পূর্ন  করছে, প্রাণই পুষ্টি  যোগাচ্ছে। প্রাণই আমাদের মধ্যে চেতনশক্তিকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রকাশ করছে। তো প্রাণের কাছে আমাদের প্রার্থনা, আমরা যেন সৌভাগ্যবান হতে পারি, আমরা যেন যথার্থ জ্ঞানের অধিকারী হতে পারি। 

প্রশ্ন উপনিষদের দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর শেষ হলো। 
-----------   

প্রশ্ন উপনিষদ রহস্যঃ - তৃতীয় প্রশ্ন 

শ্লোক নং ০৩/০১-১২

প্রশ্ন উপনিষদ রহস্যঃ - শ্লোক নং ০৩/০১-০২

"অথ  হৈনং কৌসল্যঃ চ আশ্বলায়নঃ পপ্রচ্ছ । ভগবন কুত  এষ প্রাণো জায়তে কথম আয়তি অস্মিন শরীরে আত্মানং বা প্রবিভজ্য কথং প্রাতিষ্ঠতে কেন উৎক্রমতে কথং বাহ্যম অভিধত্তে কথম অধ্যাত্মম ইতি।"  (০৩/০১)

এর পরে, অশ্বলপুত্র কৌশল্য তাঁকে (ঋষি পিপ্পলাদকে) প্রশ্ন করলেন, হে ভগবন, প্রাণ কোথা থেকে আসেন,  এই শরীরে কিভাবে প্রবেশ করেন, নিজেকে কিভাবেই-বা বিভক্ত করে, শরীরের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থাকেন ?  কিভাবে তিনি (শরীর থেকে) উৎক্রান্ত  হন? কিভাবে তিনি বাইরের বস্তু ধারন করেন, অর্থাৎ  এই শরীর  ধারণ করেন ? 

কৌশল্য এক নিঃশাসে  অনেকগুলো প্রশ্ন করলেন। প্রাণ, কোথা থেকে আসে,  কিভাবে শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে ? কিভাবেই বা প্রাণ নিজেকে ভিন্ন ভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে, সারা শরীরের মধ্যে নিজ কর্ম্ম সাধিত করেন ? আবার কিভাবেই বা তিনি শরীর  থেকে বেরিয়ে যান  ? কিভাবে প্রাণ এই প্রাণহীন বস্তু অর্থাৎ জড় শরীর রূপ পদার্থকে ধারণ করেন ? সবশেষ প্রশ্ন হচ্ছে, "কথম-অধ্যাত্মম" - অর্থাৎ শরীরের সঙ্গে যুক্ত বিষয়গুলোকে কিভাবে তিনি ধারণ করেন ? অর্থাৎ ইন্দ্রিয় ইত্যাদির সঙ্গে তিনি কিভাবে নিযুক্ত করেন ? 

কৌসল্য -  অর্থাৎ যিনি দক্ষতা  সম্পন্ন, কুশলী। দেখুন, বাহ্যজগৎ যা আমাদের চোখের সামনে ভাসছে, তার একটা উৎপত্তি আছে, আবার বিনাশ আছে। তো যার একবার বিনাশ হয়, সে আর ফিরে   আসে না। মানুষ মারা গেলে, সে আর বেঁচে ওঠে না।  যে গাছ শুকিয়ে গেছে, অর্থাৎ একটা গাছ মারা গেলে, সে আর ফলফুলে ভরে উঠতে  পারে না। বাহ্যত আমরা গাছটিকে একই দেখি, কিন্তু কার্যত সে নিষ্ক্রিয়।  এ আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা। কিন্তু এই যে বিনাশ, এ কেবল প্রাণের আসা যাওয়ার কারনেই  ঘটে থাকে। জন্ম-মৃত্যু এ কেবল প্রাণের খেলা। জড়ের মধ্যে প্রাণের প্রবেশে জীবকুল জগৎখেলায় মেতে ওঠে।  আবার প্রাণের নিষ্ক্রমনে জগৎ-খেলার শেষ হয়।  তো এই প্রাণ কোথায় ছিলো ? কোথা থেকে এলো ? এ এক অদ্ভুত জাদুকাঠি, যার ছোঁয়ায়, জড়বস্তু প্রাণবন্ত হয়ে চৈতন্যশক্তির স্ফূরণ করে থাকে। অর্থাৎ শরীর  যখন প্রাণহীন, তখন সে চৈতন্যহীন, আবার যখন সে প্রাণবন্ত, তখন সে চৈতন্যবান। তো এই জাদুকাঠিকে আমাদের খুব জানতে ইচ্ছে করে। এই প্রাণশক্তি কিভাবেই বা আমাদের শরীরে প্রবেশ করে ? কীভাবেই বা সে আমাদের সমগ্র শরীরকে  ক্রিয়াশীল করে তোলে, আবার কীভাবেই বা সে আমাদের শরীরে ছেড়ে চলে যায় ? 

ঋষি পিপ্পলাদ আগেই বলেছেন, প্রাণ নিজেকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেন। এই যে বিভাগ, এটি কিভাবে ঘটে থাকে ? আর প্রাণের এই যে বিভিন্ন বিভাগ এদের বিভিন্ন অংশের কাজটাই বা কি ? আবার দেখুন, দৃশ্যমান জগতের বিভিন্ন জীব জন্তুর ভিন্ন ভিন্ন কাজের ধারা। প্রাণ একা কিভাবে এই অসামাঞ্জস্যপূর্ণ কাজগুলোকে সংগঠিত করে ? প্রাণের এই অদ্ভুত ক্রিয়াকৌশল আমাদের সবারই জানতে ইচ্ছে করে। প্রশ্ন উপনিষদের প্রবক্তা ঋষি পিপ্পলাদের কাছে থেকে আমরা এই সব গূঢ় তত্ত্বকথা শুনবো। 

"তস্মৈ সঃ হ উবাচ অতিপ্রশ্নান পৃচ্ছসি ব্রহ্মিষ্টো  অসি ইতি । তস্মাৎ  তে অহং ব্রবীমি ।" (০৩/০২) 

কৌসল্যের প্রশ্ন শুনে - ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, তুমি দুর্জ্ঞেয়  প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছো। যেহেতু তুমি ব্রহ্মিষ্ট, অর্থাৎ তোমার ব্রহ্মে নিষ্ঠা আছে, তাই  তোমার এই (দুরূহ) প্রশ্নের জবাব আমি দেব। 

প্রশ্নটা অতিশয় কঠিন। দেখুন যার কারনে, আমরা সবাই আজ বেঁচেবর্তে আছি, সুখ-দুঃখ ভোগ করছি, পার্থিব অপার্থিব জ্ঞান সংগ্রহ করছি, এমনকি আত্মা বা ব্রহ্ম  সন্মন্ধে আমরা জানতে উৎসাহিত হচ্ছি, সেই প্রাণ আমাদের কাছে দুর্বোধ্য। এই প্রাণের কারনে আজ আমরা সবাই প্রাণবন্ত, কিন্তু প্রাণের সম্পর্কে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই, প্রাণ সম্পর্কে আমাদের কোনো  জ্ঞান নেই, এমনকি আমরা কেউ প্রাণের দিকে খেয়ালই  করি না, প্রাণ আপন খেয়ালে কাজ করে চলেছে, আর আমরা তাঁকে  অবহেলা করে বাহ্যত অবশ হয়ে অকারনে এই সংসারের কাজে নিজেরকে  ভাসিয়ে দিচ্ছি। 

আমরা পার্থিব জ্ঞানের অভিলাষী, আমরা আমাদের এই শরীর  সম্পর্কে বিদ্যা অৰ্জন করতে চাই, কিসে ভালো থাকবো তা জানতে চাই, আমরা আমাদের মন সম্পর্কে জানতে  চাই, এমনকি আমরা এই পৃথিবী সম্পর্কে জানতে চাই , গ্রহ নক্ষত্রাদি  সম্পর্কে জানতে চাই, মহাকাশ সম্পর্কে জানতে চাই,  কিন্তু আমরা আমার সম্পর্কে জানতে চাই না। আমরা আত্মজ্ঞানের পিয়াসী নোই। এই প্রাণই পারে, আমাদের আত্মজ্ঞানের উপলব্ধি করাতে, এই প্রাণই পারে আমাদের স্ব -স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে, যদি আমরা দিনের কিছুটা সময় এই প্রাণের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে পারি।  

যাইহোক, ঋষি পিপ্পলাদ কৌসল্যকে  বলছেন, তুমি ব্রহ্মনিষ্ঠ, অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য তোমার মন ব্যাকুল হয়েছে। এই বিষয়ে তুমি গভীর ভাবে চিন্তা করছো - তা না হলে এই গুহ্য প্রশ্ন তোমার মনের মধ্যে উদয় হবার কথা নয়। তাই আমি প্রসন্নচিত্তে তোমাকে তোমার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর প্রদান করবো।  তুমি ধীরস্থির হয়ে আমার কথা শোনো। আসলে আমরা যারা এই  বইয়ের পাঠক, তারা যেন ধীর স্থির হয়ে ঋষি পিপ্পলাদের কথায় মনোযোগ দেই, তাঁর কথায় আমরা যেন শ্রদ্ধাশীল হই। তাহলে সত্য আমাদের কাছে আর অধরা থাকবে না। আরো সত্য হচ্ছে, এই প্রাণের সঙ্গে দিনের কিছুটা সময় যদি অতিবাহিত করতে পারেন, তবে আপনি জীবনে নির্ভিক চিত্তে, শঙ্কাহীন চিত্তে এই পৃথিবীতে বিচরণ করতে পারবেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই। 
-------------------- 

প্রশ্ন উপনিষদ - শ্লোক নং : ০৩/০৩-০৪

"আত্মন এষ প্রাণো জায়তে যথৈষা পুরুষে ছায়া এতস্মিন এতৎ আততং  মনোকৃতেন আয়াতি অস্মিন শরীরে। " - ০৩/০৩

প্রাণ আত্মা থেকে আসে।  পুরুষের যেমন ছায়া আছে, একই ভাবে প্রাণ আত্মাতেই অন্তর্হিত থাকে।  ইচ্ছে হলে স্থূল  দেহে নেমে আসে।

ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, প্রাণ আত্মা থেকে আসে অর্থাৎ এই প্রাণ আত্মা থেকে উদ্ভূত। জগতের সবকিছুর উৎপত্তি  সেই এক আত্মা থেকেই  হয়েছে। তাহলে জগতের অন্যসব বস্তুর সঙ্গে এই প্রাণের পার্থক্য কোথায় ? এখানে ঋষি পিপ্পলাদ প্রাণকে আত্মার ছায়ার সঙ্গে তুলনা করছেন। অর্থাৎ প্রাণশক্তি আত্মা থেকে এলেও, এই প্রাণকে আত্মা থেকে আলাদা করা যায়  না। অগ্নির দাহিকাশক্তি যেমন অগ্নি থেকে আলাদা করা যায় না, তেমনি প্রাণ আত্মার শক্তি বিশেষ যা আত্মা থেকে আলাদা করা যায় না। অর্থাৎ যেখানে প্রাণ সেখানে আত্মা আবার যেখানে আত্মা সেখানেই প্রাণ। মন এবং চিন্তা যেমন আলাদা করা যায় না, সমুদ্র ও তার ঢেউ যেমন আলাদা করা যায় না, তেমনি আত্মা থেকে প্রাণকে আলাদা করা যায় না। 
এখন কথা হচ্ছে ছায়া বলতে আমরা বুঝি যা সত্য নয়, ছায়া সবসময় বস্তু সাপেক্ষ। বস্তুর উপরে ছায়া নির্ভরশীল। তাহলে কি প্রাণ সত্য নয় ? ঠিকই প্রাণ সত্য নয়।  আবার আমরা জানি এই প্রাণই জগৎকে ধরে রেখেছে, জগৎকে ক্রিয়াশীল করছে এই প্রাণ। আর এই প্রাণের কারণেই জগৎকে সত্য বলে মনে হচ্ছে। আসলে চৈতন্য ও জড়ের মাঝামাঝি এই প্রাণের অবস্থান। জড় যখন চৈতন্যময়ময় হয়, তখন জানবেন, তা এই প্রাণের কারণেই তা হয়েছে। চৈতন্য ও প্রাণকে আলাদা করা যায় না। অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, প্রাণ যেন চৈতন্যের বাহন। এই বাহনে চেপেই চৈতন্য জগৎজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গুটিপোকা নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে, কারন গুটির মধ্যে পোকা আছে। তেমনি চৈতন্যের মধ্যেই প্রাণশক্তি বিরাজ করছে, বা বলা যেতে পারে চৈতন্যের মধ্যে প্রাণ ঢুকে পড়েছে, । আর এই কারণেই চৈতন্যকে গতিশীল বলে মনে হচ্ছে। আসলে চৈতন্য স্থির প্রাণ গতিশীল। প্রাণের এই গতির কারণেই, প্রাণের এই চঞ্চলতার কারণেই চৈতন্যের মধ্যে  বিক্ষুব্ধ ভাবের উদয় হয়েছে। আর এই বিক্ষুব্ধ ভাব থেকেই জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। 

ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, ইচ্ছে হলে, প্রাণ স্থূল দেহে নেমে আসে। এখন কথা হচ্ছে এই ইচ্ছেটা  কার ? এই ইচ্ছে হচ্ছে সমষ্টি মনের। সমষ্টি মনে যখন যখন কামনার উদ্রেগ হয়, তখন সূক্ষ্ম জগতে, জ্যোতির্ময় দেহ অব্লম্বন করে প্রাণ আত্মপ্রকাশ করে। প্রাণ ও মন যেন একই সত্তার দুটো পিঠ। দেহকে আশ্রয় করে যে প্রাণের বিকাশ ঘটে, তা আসলে  কাম  বা মনোবাসনার ফলে ঘটে থাকে। সৃষ্টিকর্ত্তা প্রজাপতির মনোবাসনা থেকেই প্রাণের অভিব্যক্তি। বাসনাই ভোগদেহ সৃষ্টি করছে।  আবার জীবের কামনা থেকেই বিচিত্রসব ভোগদেহ  সৃষ্ট হচ্ছে। 

আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা হচ্ছে, আমাদের মনের মধ্যে যখন বিভিন্ন ধরনের বিষয়ভোগের বাসনা তৈরী হয়, তখন সেই ভোগের পরিতৃপ্তির জন্য আমরা বিষয় সংগ্রহ করে থাকি।  ঠিক তেমনি স্রষ্টার  মধ্যে যখন কামনার সৃষ্টি হয়, তখন তিনি প্রাণ এবং তৎপরে মন, বুদ্ধি, অহংকার, ভূতাদি, বিষয়াদি ইত্যাদি সৃষ্টি করে প্রাণের দ্বারা এদেরকে পরিচালনা করেন। তাই ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, "মনকৃতেন অস্মিন শরীরে আয়াতি"  মনের ক্রিয়া শুরু হলে, অর্থাৎ মনের মধ্যে বাসনা জাগলে, (প্রাণ) এই স্থূল দেহে আসেন। প্রাণ যেন আত্মার হাতের যাদুদন্ড।  ইচ্ছে হলো, লোহাকে ছুঁয়ে সোনা করে দিলেন, মাটি ছুঁয়ে সন্দেশ করে দিলেন। আত্মা যেন প্রাণকে সঙ্গে নিয়ে  এক দেহ থেকে আরেক দেহে ঘুরে ঘুরে জগৎকে আস্বাদন করছেন। 

যথা সম্রাট এবং অধিকৃতান বিনিজুঙক্তে। এতান গ্রামানেতান গ্রামান  অধিতিষ্ঠস্ব ইতি এবম এব এষ প্রাণ ইতরান প্রাণান পৃথক পৃথগেব সন্নিধেত্তে।  (০৩/০৪)

সম্রাট যেমন স্বীয় অধিকৃত ভূমিকে বিভিন্ন গ্রামাদিতে বিভক্ত করে, প্রত্যেক গ্রামে নিজের নিযুক্ত শাসনকর্তা স্থাপন করে, রাজ্য শাসন করেন, তেমনি মুখ্য প্রাণ তার অধীনস্থ ইন্দ্রিয়সকলকে যথা নির্দিষ্ট কর্ম্মে নিযুক্ত করেন। 

আমরা আগেই  শুনেছি, বাসনা পূরণের কারনে এই ভোগ দেহ তৈরী করা হয়। এখন এই ভোগ সম্পাদন করবার জন্য প্রাণ তার  অধীনে (আসলে চেতন শক্তির অধীনে) বিভিন্ন ইন্দ্রিসকলকে নিয়োগ করেন। অর্থাৎ চোখের দ্বারা দর্শন তৃপ্তি, কর্ন  দ্বারা শ্রবণ তৃপ্তি, নাসিকা দ্বারা গন্ধ গ্রহণ তৃপ্তি, জিহবা দ্বারা রসের আস্বাদন, ত্বকের দ্বারা স্পর্শ তৃপ্তি গ্রহণ করে থাকেন। এইভাবে প্রাণ স্বীয়শক্তি দ্বারা  ইন্দ্রিয়গণকে  শক্তিমান করে, ভোগ সম্পাদন করছেন। 

------------- 

 
প্রশ্ন উপনিষদ রহস্যঃ  শ্লোক নং ০৩/০৫

"পায়ু উপস্থে অপানম চক্ষুঃ শ্রোত্রে মুখ নাসিকাভ্যাং প্রাণঃ স্বয়ং প্রাতিষ্ঠতে মধ্যে তু  সমানঃ। 
এষ হি  হুতম অন্নং সমং নয়তি তস্মাৎ এতাঃ সপ্ত অর্চিষঃ ভবন্তি।" (০৩/০৫)

পায়ু (মলদ্বার) ও উপস্থ (জনন-ইন্দ্রিয়) অপানবায়ুর কর্ম্মকেন্দ্র। উপস্থ কথাটার অর্থ হচ্ছে যা সামনে থাকে। আর পায়ু অর্থাৎ যা পিছনে থাকে অর্থাৎ গুহ্যদেশ। চোখ, মুখ, নাক, কান, এখানে প্রাণ নিজে অবস্থান করে ক্রিয়া করে থাকেন। সমান বায়ু থাকেন শরীরের কেন্দ্রস্থলে অর্থাৎ মধ্যভাগে। সমান বায়ু খাদ্যকে জীর্ন করে সার পদার্থ (রক্ত ইত্যাদি) তৈরী করে। প্রাণের অগ্নি  থেকে সাতটি  শিখা  নির্গত হয়। 

ঋষি পিপ্পলাদ এর আগে বলছেন, প্রাণ নিজেকে ৫ ভাগে ভাগ করে, শরীরের বিভিন্ন কর্ম্মকেন্দ্রে স্থাপন করেছেন। এবার তিনি তিন রকম প্রাণক্রিয়া সম্পর্কে বলছেন। 

দেখুন কালকে আমরা ৩ ভাগে ভাগ করেছি।  অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। কিন্তু সত্য হচ্ছে কাল অনন্ত।  তেমনি দিগ-কে আমরা চার ভাগে, অর্থাৎ পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ ভাগ করেছি, কেউ কেউ আবার এই দিগকে দশ ভাগে ভাগ করেছেন, অর্থাৎ পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর দক্ষিণ, নৈঋত, বায়ু, ঈশান, অগ্নি,উর্দ্ধ, অধো । কিন্তু সত্যিই কি এদের এইভাবে ভাগ করা যায় ? যায় না, তথাপি আলোচনার সুবিধের জন্য প্রাণকে কেউ দশ ভাগে ভাগ করেছেন, কেউ পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন। 
প্রাণের পাঁচ ভাগ বলতে - প্রাণ, অপান, সমান, ব্যান, উদান। এর সঙ্গে আরো পাঁচটি ভাগে কথা আছে আর তা হচ্ছে, নাগ , কূর্ম, কৃকর , দেবদত্ত, ধনঞ্জয়। 

প্রাণ : প্রাণ নিজের হাতে যে কাজটি রাখেন, তা হচ্ছে শ্বাস গ্রহণ ও শ্বাস ত্যাগ, হৃদযন্ত্রের পরিচালনা, খাদ্যবস্তুকে পেটের  মধ্যে চালনা করা, ধমনীর সাহায্যে সারা শরীরে রক্ত পরিচালনা করা, শিরা ও স্নায়ুগুলোকে নিজ নিজ কাজে প্রবৃত্ত করা। 

অপান  - অপান বায়ু, পায়ু ও উপস্থের কাজকে অনুষ্ঠিত করে।  অর্থাৎ মল, মূত্র, শুক্র ইত্যাদিকে অধঃপতিত করা অপান  বায়ুর কাজ ।  নারীদেহে রজঃ  নিঃসরণ, সন্তান পোষন ও সন্তান ভূমিষ্ট করানোর কাজ অপান  বায়ু করে থাকে। আরো একটা প্রধান কাজ এই অপান  বায়ু করে থাকে, আর তা হচ্ছে, শ্বাস-প্রশ্বাসের যে ক্রিয়া, অর্থাৎ বায়ুকে আকর্ষণ করা, ও নিঃসরণ করা - এই কাজে সাহায্য করে থাকে এই অপান বায়ু। 

সমান : সমান বায়ু আমাদের জঠরাগ্নিকে অর্থাৎ পিত্তরসকে সক্রিয় রাখে। এই পিত্তরসই আমাদের খাদ্যকে জীর্ন করতে সাহায্য করে থাকে।  আবার অর্ধজীর্ন খাদ্যকে গ্ৰহণী নাড়ীতে গমনে সাহায্য করে। প্রাণ বায়ু ও অপান  বায়ুর মধ্যে সমতা রক্ষা করা এই সমান বায়ুর কাজ। জীর্ন খাদ্যের সার পদার্থ ও অসার পদার্থকে আলাদা ক'রে, অসার পদার্থকে বৃহদন্ত্রের ভিতর দিয়ে মল-নাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়। সমান বায়ুই  আমাদের  শরীর গঠনে সর্বত  ভাবে সাহায্যে করে। আমরা যে খাদ্য অর্থাৎ জল, বায়ু, অন্ন গ্রহণ করি, তা থেকে শরীরের পুষ্টি বিধান করে থাকে, এই সমান বায়ু । 

উদান : এই শ্লোকে উদ্যান বায়ু সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এই উদান  বায়ুর সাহায্যেই  মানুষ শব্দ করে থাকে। এই উদান  বায়ুর সূক্ষ্ম অংশ থেকে তৈরী হয়, আমাদের মন-বুদ্ধি-স্মৃতি। এই উদান  বায়ু যোগী পুরুষকে অতীন্দ্রিয় জগতে প্রবেশ করতে সাহায্য করে থাকে। 

ব্যান : ব্যান সম্পর্কেও এই শ্লোকে কিছু বলা হয়নি। ব্যান বায়ু আমাদের শরীরের রক্ত-রসকে সমগ্র শরীরে প্রেরণ করে থাকে। শরীরের সংকোচন, সম্প্রসারণ, দেহ থেকে ঘামের নিঃসরণ ইত্যাদি এই ব্যান বায়ুর কাজ।  

শিব সংহিতায় (শ্লোক ৩/৮) বলা হচ্ছে, নাগ বায়ু উদ্গার, কূর্ম্ম বায়ু উন্মীলন (সংকোচন ও প্রসারণ), কৃকর  বায়ু ক্ষুধা-তৃষ্ণা, দেবদত্ত বায়ু হাইতোলা, এবং ধনঞ্জয় বায়ু হিক্কা তোলার কাজ করে থাকে। 

ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন,  "তস্মাৎ এতাঃ সপ্ত অর্চিষঃ ভবন্তি". - এই যে প্রাণ, অপান ও সমান বায়ু এরা, যেন প্রাণের সাতটি শিখা।  অর্থাৎ এদের সাত রকমের অভিব্যক্তি। এগুলো হচ্ছে, আমাদের দুটো চোখ, দুটো কান, দুটো নাসারন্ধ্র, এবং জিভ। এই সাতটি জায়গায়  প্রাণের তেজঃপ্রবাহ যেন অগ্নিশিখা হয়ে এগুলোকে প্রকাশিত করছে, বা ক্রিয়াশীল রাখছে। এই অগ্নি শিখা  না থাকলে, এরা  অর্থাৎ চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহবা, ত্বক - এই পাঁচ ইন্দ্রিয় কোনো কাজই করতে পারতো না। আর আমাদের জগৎ-জ্ঞান হতেই পারতো না। অর্থাৎ প্রাণের এই অগ্নিই ইন্দ্রিসকলকে  অভিব্যক্ত করছে আর  জীবাত্মা জগতের জগৎ-বিষয় আস্বাদন করছে। 

------- 
প্রশ্ন উপনিষদ রহস্যঃ - তৃতীয় প্রশ্ন (শ্লোক নং. ০৩/০৬-০৭}

"হৃদি হি  এষ  আত্মা। অত্র এতৎ একশতকং নাড়ীনাং তাসাং শতং শতম একৈকস্যা দ্বাসপ্ততির্দ্বা-সপ্ততিঃ প্রতিশাখা নাড়ী সহস্রাণি  ভবন্তি  আসু ব্যানঃ  চরতি।" (০৩/০৬)

হৃদয়ই  আত্মার আসন। এখানে একশত  নাড়ী রয়েছে। প্রতিটি নাড়ীর একশত শাখা। প্রতিটি শাখার বাহাত্তুর হাজার উপশাখা। ব্যান এই নাড়ী ও তার শাখা-প্রশাখার মধ্য  দিয়ে বিচরণ করছে। 

ঋষি পিপ্পলাদ এখানে নাড়ী শব্দের দ্বারা শিরা, ধমনী ও স্নায়ুকেই বুঝিয়েছেন। "হৃদি হি  এষ  আত্মা" - আত্মা হৃদয়ে বাস করেন। এই হৃদয় বলতে আমরা যেমন হৃদপিণ্ড বা হৃদযন্ত্র বুঝি, তেমনি এই হৃদয় বলতে অধ্যাত্ম পুরুষগন বোঝেন, বুকের মধ্যে হৃদয় সংলগ্ন আকাশ বা শূন্য স্থান। এই হৃদয়াকাশেই আত্মার উপলব্ধি হয়। 

এই হৃদপিন্ড থেকে বহু ধমনী ও শিরা বেরিয়ে, শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে  সমস্ত শরীরকে বেষ্টন  করে রয়েছে।  আমাদের দেহের মধ্যে যে চেতনশক্তি তা আমাদের শরীরের মধ্যে নানান ভাবে প্রকাশিত হয়। আমরা আগেই শুনেছি, প্রাণ হচ্ছে আত্মার শক্তি। তো এই শক্তি ব্যান বায়ুর মাধ্যমে সমস্ত শরীরে ব্যাপ্ত হয়ে আছে। 

ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, হৃদপিন্ড বা হৃদয়স্থল থেকে একশত নাড়ী তার আবার প্রতিটির একশত শাখা, আবার প্রতিটি শাখার আবার ৭২ হাজার উপশাখা রয়েছে, যা ব্যান  বায়ুর বিচরণ ক্ষেত্র। এই যে সংখ্যাটি বলা হয়েছে, এই সংখ্যা অসংখ্যের নির্ণায়ক। এই নাড়ীর যেমন শাখা উপশাখা আছে,  তেমনি এক একটা নাড়ীর মধ্যেও একাধিক নাড়ীর অবস্থান।  যেমন সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে আছে, আরো দুটো নাড়ী চিত্রাণি ও বজ্রাক্ষ্যা। তো  বিচিত্র এই দেহ।  এর নির্ম্মাণ কৌশল আজও  আমাদের কাছে সম্পূর্ণ রূপে জ্ঞাত নয়। 
যাইহোক, হৃদপিন্ড থেকে যে সব ধমনী, শিরা বেরোয়, সেগুলোর মধ্যে দিয়েই হৃদপিন্ড সমস্ত শরীরে রক্ত সঞ্চালন করে থাকে। আর এই রক্তের মধ্যে যে বেগ   তা আসে এই ব্যান বায়ুর গতিশক্তি থেকে। আচার্য্য শংকর বলছেন, সূর্য থেকে যেমন সূর্য্যরশ্মি বা কিরণমালা জগতের সবত্র ছাড়িয়ে পড়ছে, এও  ঠিক তেমনি। 

উপনিষদ বলছে, .এই যে হৃদকেন্দ্র থেকে এক-শত  নাড়ী, প্রতিটি নাড়ীর একশত শাখা, আবার প্রতিটি শাখার ৭২ হাজার প্রশাখা সমস্ত শরীরের মধ্যে ছড়িয়ে  আছে। এবং প্রত্যেকেরই নিজস্ব ক্রিয়া আছে, যা আমাদের দেহ-মনকে প্রভাবিত করছে। তবে এরা  কিভাবে, এবং কি কি কাজ করছে, তার সমস্ত বিবরণ আমাদের কাছে এখনও  অজানা। তবে এর মধ্যে যে গতি লক্ষিত হয়, তা যে ব্যান বায়ুর কারনে হয়ে থাকে, সে সম্পর্কে আমাদের প্রাচীন, মুনি ঋষিগণ নিশ্চিত ছিলেন। আজও এই সত্যকে আমরা অস্বীকার  করতে পারিনা।
------------------- 

"অথ একয়া উর্দ্ধ উদানঃ পুন্যেন পুণ্যং লোকং নয়তি পাপেন পাপম উভাভ্যাম এব মনুষ্যলোকম।" (০৩/০৭)

এর মধ্যে একটি (নাড়ী) উদান বায়ুর সাহায্যে পুণ্যবানকে পুণ্যলোকে নিয়ে যায়, পাপীকে পাপলোকে নিয়ে যায়, যাদের মধ্যে  পাপ-পুন্য  উভয়ই থাকে তাকে মনুষ্য  লোকে নিয়ে যায়। 

এর মধ্যে একটি নাড়ী অর্থাৎ সুষুম্না নাড়ী। আমরা জানি মৃত্যুকালে মনুষ্য  দেহ ছেড়ে আত্মা )জীবাত্মা) বেরিয়ে যায়। ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন,  কোনো মানুষ যদি পুন্য কর্ম্ম করেন, তবে তিনি মৃত্যুকালে উদান  বায়ুর সাহায্যে সুষুম্না নাড়ীপথ ধরে পুণ্যলোকে গতি প্রাপ্ত হন। আবার যদি কেউ পাপ কর্ম করে, তবে তাকেও এই উদান  বায়ু পাপ  লোকে নিয়ে যায় ।  আবার কেউ যদি পাপ*পুন্য উভয় কর্ম্ম করে থাকেন, তবে তিনি মনুষ্য লোকে যান। 

আসলে, উদান  বায়ুর ভূমিকা আমাদের জীবনে, এমনকি আমাদের তথাকথিত মৃত্যুর পরেও, এই উদান  বায়ুর ভূমিকা গুরুত্ত্বপূর্ন। দেহের মৃত্যুতে জীবাত্মা স্থূলদেহ থেকে বাইরে  বেরিয়ে যায়। কিন্তু কোথায় যায়, আর কিভাবেই বা  যায়, কার সাহায্যেই বা যায়, তা আমাদের কাছে অজ্ঞাত।  ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, এইসময় উদান বায়ুর  সাহায্যে কর্ম্ম অনুযায়ী আমাদের ভিন্ন ভিন্ন লোক প্রাপ্তি হয়। 

আমরা জানি আমাদের মেরুদণ্ডের মধ্যে  তিনটে  ধমনী বা নাড়ী আছে। এই তিনটি  নাড়ী (ইড়া, পিঙ্গলা সুষুম্না) একে  অন্যকে বেষ্টন  করে আছে। এর মধ্যে মধ্যস্থলে আছে সুষুম্না। এই সুষুম্না পথ দিয়েই জীবাত্মা দেহ ছেড়ে বেরিয়ে যায়। মানুষ যখন দেহত্যাগ করে, অর্থাৎ অন্তিম  মুহূর্তে এই উদান বায়ুর ভূমিকা গুরুত্ত্বপূর্ন। উদান বায়ুই  জীবাত্মাকে সঙ্গে নিয়ে নির্দিষ্ট লোকে পৌঁছে দেয়। 
এই সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে কেবলমাত্র উদান  বায়ুই  চলাচল করে থাকে। আমাদের যে বোধশক্তি তা এই উদান বায়ুর  ফলে ঘটে থাকে। মৃত্যুকালে এই বোধশক্তি উদানে লয়প্রাপ্ত হয়। এই উদান  বায়ুর জন্যই  মৃত্যুকালে মানুষের বোধশক্তি হারিয়ে  যায়। দেহ থেকে উৎক্রান্ত  হয়ে জীবাত্মা তার সংস্কার  অনুযায়ী, ভাবনা  চিন্তা, জ্ঞান অনুযায়ী গতিলাভ করে থাকে। এমনকি ভাবি ভবিষ্যৎ দেহ গঠনে অর্থাৎ  নিজেই একটা নতুন পরিবেশ সৃষ্টি ক'রে, নিজের ভবিষ্যৎ নির্দিষ্ট করে।  এই জগতে বিচরণকালে, সে যেমন যেমন চিত্তের অধিকারী হয়েছে, যেমন যেমন জ্ঞানের সাধন  করেছে, তার অন্তরাত্মা সেই মতো শুদ্ধ বা অশুদ্ধ , শান্ত বা অশান্ত, ভোগমুখী বা ভোগবিমুখ অর্থাৎ  যেমন যেমন আচরণে সে অভ্যস্থ ছিল, মৃত্যুর পরেও  সে সেইমতো লোক প্রাপ্তি হয়, এমনকি তার ভবিষ্যৎ ভাবিদেহ নির্মাণের কাজ শুরু করে। অর্থাৎ কখনো সে জ্যোতির্লোকে, কখনো সে তমসাচ্ছন্ন  লোকে, আশ্রয় গ্রহণ করে। এই জ্ঞানালোক বা জ্যোতির্লোকে ও তমসাচ্ছন্ন  লোক বা অজ্ঞানের লোক এর মাঝখানে আছে একটা জ্ঞান ও অজ্ঞানের মিশ্রিত লোক,. ঋষি পিপ্পলাদের ভাষায় " উভাভ্যামেব মনুষ্যলোকম" - উভয়ের মধ্যে  এই মনুষ্যলোক।  

বলা হয়, পুন্য কর্ম্ম ফলের কারনে, উদ্যান বায়ু পুণ্যলোকে নিয়ে যায়, যেখান থেকে আর মর্তলোকে ফিরে আসতে  হয় না।  পাপ-কর্ম্মের  ফলে তাকে পশুযোনি প্রাপ্ত হতে হয়, আর পাপ-পুন্যরূপ মিশ্রকর্ম্মের  ফলেই দুর্লভ মনুষ্য  শরীর  প্রাপ্ত হয়।  
--------- 

প্রশ্ন উপনিষদ - তৃতীয় প্রশ্ন (শ্লোক নং. ০৩-০৮)

"আদিত্যঃ হ বৈ বাহ্যঃ প্রাণ উদয়তি এষ হি  এনং চাক্ষুষং প্রাণম অনুগৃহ্নানঃ। 
পৃথিব্যাং যা দেবতা সৈষা পুরুষস্য  অপানম অবষ্টভ্য অন্তরা যৎ আকাশঃ স সমানো বায়ুঃ ব্যানঃ ।" (০৩/০৮) 

বাহ্যত সূর্যই প্রাণ। চক্ষুকে অনুগ্রহ  করবার জন্যই  যেন সূর্যের উদয় হয়। এই প্রাণই পৃথিবীর অধিপতি।  তিনি (প্রাণ) তাঁর  অধীনস্থ অপানকে দৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। অন্তরীক্ষে অর্থাৎ স্বর্গ ও মর্তের মাঝখানে যে আকাশ সেখানে আছে সমান বায়ু, আর সর্বত্র যে বায়ু ব্যাপ্ত হয়ে আছে তা ব্যান বায়ু। 

বাস্তবিক পক্ষে আদিত্য থেকে প্রানধারা বিচ্ছুরিত  হচ্ছে।  এই আদিত্যই স্থূলরূপে সমস্ত জীবের প্রাণস্বরূপ। এই আদিত্য নিঃসৃত প্রানধারা যতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, ততদূরই সঞ্জীবন। এই আদিত্যের রশ্মিধারা প্রাণরূপে কোথাও স্থূল দেহে, কোথাও সুক্ষ দেহে অভিব্যক্ত হচ্ছে।  প্রাণিকুল এই আদিত্যের কারণেই প্রাণবন্ত। এই আদিত্য রশ্মির সাহায্যে প্রানধারাকে অবিরাম বর্ষণ করছে। এই প্রাণের সাহায্যে ইন্দ্রিসকল উজ্জীবিত  হচ্ছে।  জীবাত্মা এই প্রাণের সাহায্যে  ইন্দ্রিয়সকলকে   ক্রিয়া করবার শক্তি যোগাচ্ছে। ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, প্রাণ যেন চক্ষু ইত্যাদিকে অনুগ্রহ করছেন। প্রাণের অধিষ্ঠানের কারণেই, ইন্দ্রিয়গণ ক্রিয়াশীল হয়ে, জীবাত্মাকে শব্দ , স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ উপভোগ করাচ্ছে। 

পৃথিবীর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হচ্ছেন প্রাণ। এই প্রাণের কারণেই পৃথিবীতে জীবসকল পুষ্টিলাভ করতে পারছে। অসংখ্য কোষের সমষ্টি  এই জীবদেহ। আবার অসংখ্য জীবদেহ পৃথিবীর কোলে বিচরণ করছে। এরা  সবাই প্রাণবন্ত, এমনকি চেতনা সম্পন্ন। এমনকি যাকে  আমরা জড় বলে মনে করি, তাদের মধ্যেও প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে চেতনার ক্ষীণধারা প্রবাহিত হচ্ছে। যেখানে প্রাণ সেখানেই চেতনা।  তাই ব্রহ্মান্ডের ভিতরে বাইরে যা কিছুর অস্তিত্ত্ব সবাই চৈতন্যবান। এই চেতনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর তাই আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি না। কিন্তু সবার মধ্যেই চৈতন্য  শক্তি আছে, এমনকি এই যে পৃথিবী, যাকে অচেতন মাটির ঢেলা বলে মনে করি, তার মধ্যেও আছে প্রাণ, আছে চৈতন্য। 

অপান  বায়ু শরীরের নিম্ন ভাগে অবস্থান করে থাকে। এই অপানের কারণেই আমাদের মল-মূত্র-শুক্র-ডিম্ব ইত্যাদির  ধারণ ক্ষমতা। জীব যেমন এই অপান-এর  দ্বারা বংশধারা বজায় রেখে থাকে, তেমনি পৃথিবীতে যত প্রাণীসকল, তার মূলেও আছে এই অপানবায়ুর ক্রিয়া। এই অপান বায়ু সমস্ত কিছুকে ধারণ করে আছে। সন্তান কামনায়, মায়ের মধ্যে যেমন রেতধারা প্রবাহিত হয়, ঠিক তেমনি আদিত্যের রেতধারা পৃথিবীতে বর্ষা রূপে নেমে আসে। ধরিত্রী মাতা গর্ভবতী হন । পৃথিবী ফুল-ফলে, প্রাণের ছোঁয়ায় ইল্লোলিত হয়। হিন্দুদের মধ্যে পৃথিবী মাতার ঋতুকালের বিশেষ উৎসব অম্বুবাচী আষাঢ়মাসে পালন করা হয়। 

স্থূল শরীরের মধ্যভাগে হচ্ছে সমান বায়ুর কার্যক্ষেত্র। এখানে সমান বায়ু আমাদের অন্নাদিকে জীর্ন  করে  রস-রক্ত ইত্যাদিতে পরিণত করে। ঠিক তেমনি ভূলোক ও দ্যুলোকের মাঝে  যে আকাশ সেখানেই অবস্থান করে সমান বায়ু। এই সমান বায়ুর কারণেই, সবাই যে যার জায়গায় স্থির আছে। সমান বায়ু ভূলোক ও দ্যুলোকের মাঝে অবস্থান করে প্রাণের ক্রিয়াকে সচল রেখেছে। 

তো স্থূল জীবদেহে নিম্নাঙ্গে অবস্থা ক'রে, অপান  বায়ু যেমন সৃষ্টি  রক্ষার কাজে নিয়োজিত,   তেমনি সেই বিরাট  পুরুষের নিম্নাঙ্গ হচ্ছে এই ভূলোক - এখানেই  বিরাটপুরুষ তার সৃষ্টি ধর্ম্ম রক্ষা করছেন। 

আর ব্যান বায়ু যেমন আমাদের শরীরের সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে আছে, তেমনি ত্রিলোকের সর্বত্র এই ব্যানবায়ুর ক্রিয়া চলছে। এই ব্যান হচ্ছে চালক শক্তি, দেহের সর্বত্র তার কর্ম্মস্থল। আমাদের হৃৎপিন্ড, নাড়ীসকল তার নিয়ন্ত্রণে।  ঠিক তেমনি এই ব্যান বায়ু যেন সমগ্র সৃষ্টির রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজ করছে।  

--------------------

প্রশ্ন উপনিষদ - তৃতীয় প্রশ্ন (শ্লোক নং. ০৩/০৯-১০)

"তেজো হ বা উদানঃ তস্মাৎ উপশান্ত তেজাঃ পুনর্ভবম ইন্দ্রিয়ৈঃ মনসি সম্পদ্যমানৈঃ । " (০৩/০৯) 

তেজ বা অগ্নিই উদান। অতএব যার দেহের তাপ (অগ্নি)  নিভে গেছে, তার সমস্ত ইন্দ্রিয় তখন মনে সংহত হয়।  এবং সে পুনর্জন্মের জন্য  প্রস্তুত হয়। অর্থাৎ তার মৃত্যু হয়। 

আমরা দেখেছি, মানুষের মৃত্যুর প্রাক্কালে, মানুষ প্রথমে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে।  অর্থাৎ এই অবস্থায়, সে সব কিছু শুনতে পায়, কিন্তু কথা বলতে পারে না।  এর পরে কানে শুনতে পায়  না, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে,   কিন্তু  মনের মধ্যে  নানান চিন্তার উদয় হতে থাকে।  অর্থাৎ তখনও  মনের ক্রিয়া চলতে থাকে। মন যখন শরীর  ছেড়ে যায়, তখন আমরা চেতনা হারাই, কিন্তু প্রাণ থাকে,  অর্থাৎ এইসময় উদান  বায়ুর ক্রিয়া বন্ধ  হয়ে যায়, শরীর শীতল হতে শুরু করে, উত্তাপ থাকে না। একসময় প্রাণ দেহ ছেড়ে চলে যায়। তো মানব দেহে উদান  বায়ুর ক্রিয়া গুরুত্ত্বপূর্ন। দেহের উত্তাপ যখন নিষ্প্রভ হয়ে যায়, তখন সমস্ত ইন্দ্রিয় তার মনের মধ্যে প্রবেশ করে, মন প্রাণে প্রবেশ করে, প্রাণ আত্মাতে প্রবেশ করে।  

এই উদান  বায়ু যেমন মানবদেহে গুরুত্ত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে, তেমনি এই যে বিশ্বব্রহ্মান্ড রূপ বিরাট পুরুষ, তার মধ্যেও এই উদান বায়ুর ভূমিকা গুরুত্ত্বপূর্ন। এই উদান  হচ্ছে তেজঃশক্তি। এই উদান বায়ু যেমন যোগীপুরুষকে আত্মস্বরূপের  পথে সহায় হয়, তেমনি এই উদান  বায়ু বা তেজঃশক্তি সবকিছুকে উর্দ্ধগতি সম্পন্ন করছে। এই যে সৃষ্টি তা একদিন আবার স্বরূপে ফিরে যাবে। ব্রহ্ম থেকে যে সৃষ্টি শুরু হয়েছিল, তা একদিন, এই তেজশক্তিই টেনে ব্রহ্মের মধ্যে লয় করে দেবে। ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, "উপশান্ত তেজাঃ" - অর্থাৎ এই তেজ যখন  শান্ত হবে, তখন আর এই  সৃষ্টি থাকেব না। প্রাণকে আশ্রয় করে যেমন সৃষ্টি ফুটে উঠেছিল, তেমনি উদানকে আশ্রয় করে সৃষ্টি স্বরূপে ফিরে যাবে। 

তো প্রাণ যেমন সৃষ্টির  বীজ, তেমনি উদান হচ্ছে ধংশের নিদান।  আর এই যে উদান এও সেই প্রাণেরই  অংশ। সমষ্টি মনে  কামনার উদয় হয়েছিলো, মনের এই কামনাকে ইন্দ্রিয়সকল পূর্ন  করছিলো। তো মনের এই কার্যকারিতা জীব ও জগৎরূপে উদ্ভাসিত হচ্ছে। আবার উদান  সেই সৃষ্টিকে উর্দ্ধগামী করে, প্রলয় ঘটায়। মানব দেহের মৃত্যুকে পরিচালিত করে এই উদান  বায়ু।  আবার এই উদান  বায়ু ঋষি পুরুষদের আত্মস্থ করে, আত্মজ্ঞান দান  করে। এই আত্মজ্ঞান লাভ না হওয়া পর্যন্ত জীবের কামনা-বাসনা দূর হয় না। কামনা-বাসনা রূপ সৃষ্টির বীজ মনের মধ্যে লুক্কায়িত থাকে। আর এই বীজই আবার ইন্দ্রিয়াদির সাহায্যে অংকুরিত হতে শুরু করে, একসময় নতুন দেহে পুনর্জন্ম গ্রহণ করে। এ এক আশ্চর্য্য জ্ঞান যা সম্যক ভাবে উপলব্ধি করতে পারলে, পুনর্জন্মের হাত থেকে হয়তো রেহাই পাওয়া যায়। 
------------     .  

"যৎ চিত্তঃ তেন এষ  প্রাণম আয়াতি।  প্রাণঃ তেজসা যুক্তঃ সহ আত্মনা যথা সঙ্কল্পিতং লোকং নয়তি। " (০৩/১০) 

যার চিত্ত মৃত্যুকালে যেমন চিন্তা করে, সেই চিন্তা নিয়েই সে (জীবাত্মা) প্রাণের সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রাণ তখন উদান বা তেজঃশক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়। এই উদান তাকে দেহের বাইরে নিয়ে যায়। এই তেজঃপূর্ন আত্মা (জীবাত্মা) অভীষ্ট লোকে গমন করে। 

জীবাত্মা যখন দেহ ছেড়ে যায়, তখন শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয় মনের মধ্যে লয় হয়, মন প্রাণের মধ্যে লয় হয়, প্রাণ (উদান)  জীবাত্মাকে সঙ্গে নিয়ে তার অভীষ্ট লোকে পৌঁছে দেয়। 
আসলে মানুষ কামনার দাস। মানুষের কামনার শেষ নেই। আমাকে এক ভদ্রলোক মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, ভাই জীবনে যখন আর কামনা-বাসনার  পূরণের সম্ভাবনা থাকে না, তখন জীবন অর্থহীন হয়ে যায়। তাই জীবনকে সুখী রাখতে গেলে, বাসনার শেষ করতে নেই। অদ্ভুত জীবন ধর্ম্মী কথা। যতক্ষন শ্বাস ততক্ষন আশ। আশার  যেন শেষ নেই। ছেলের পরে, নাতি চাই, নাতির পরে পুতি চাই। থাকবার জন্য জমি চাই, জমির পরে বাড়ি চাই, বাড়ির পরে অট্টালিকা চাই।  চাই আর  চাই।  এই চাওয়ার যেন শেষ নেই। একেই বলে জীবন। 
অন্তঃকরনের এই  কামনা অনুযায়ী প্রাণের আগমন হয়। দেহ ছেড়ে যে প্রাণ বেরিয়ে গেলো, এই প্রাণই আবার তেজঃযুক্ত হয়ে জীবাত্মাকে সঙ্গে নিয়ে অভীষ্ট লোকে নিয়ে গেলো। সেখানে কিছুদিন থাকার পরে  আত্মা আবার নতুন দেহ গ্রহণ করলো। 
সমষ্টি  মনের ইচ্ছেতে এই বিরাট ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি হয়েছে। জীবের মধ্যে সেই চেতনশক্তির অভিব্যক্তি হচ্ছে। সমষ্টি মনের একটা অংশ হচ্ছে মানব-মন।  তাই মানব মন তার নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ক্ষমতা রাখে। প্রত্যেক মানুষের ভাবনা চিন্তাই তার ভবিষ্যৎ। এই ভাবনা চিন্তা আসলে একটা সুক্ষ-জগৎ, যার মধ্যে সে বাস করে। এই ভাবলোক মানুষের সুখ-দুঃখের কারন হয়ে থাকে । যাকে  আমরা বলি অদৃষ্ট  অর্থাৎ দেখা যায় না। মানুষের এই ভাবনা চিন্তার মধ্যে যদি শুদ্ধতার ভাব আসে, তবে মানুষ সুখ-শান্তির অধিকারী হতে পারে। 

প্রশ্ন উপনিষদ রহস্যঃ শ্লোক নং ৩/১০-১২

মানুষের কামনা বাসনার কারনে, মানুষকে বারবার এই জগতে ফিরে ফিরে আসতে  হয়। এই কামনা বাসনাই প্রাণকে আশ্রয় করে, নতুন দেহের সূত্রপাত করে থাকে। ঋষি পুরুষগন বলে থাকেন, কোথায় জন্মেছো ,সেটা  কথা নয়, কি করছো, কি ভাবছো, সেটাই বড়ো কথা।  সাধন পথে থাকলে মন-বুদ্ধি নির্ম্মল হয়। তখন বিচারশক্তি বৃদ্ধি পায়। সাত্ত্বিক ভাবনা উদয় হতে শুরু  করে। মৃত্যুকালে এই ভাবনা-চিন্তা সংস্কার আকারে সঙ্গে নিয়ে সে ইহলোক ত্যাগ করে।  এবং উদান বায়ুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজের কামনালোকে উপস্থিত হয়। চিন্তা-ভাবনার  শুদ্ধতা তাকে ভবিষ্যৎ দেহপ্রাপ্তি করে দেয়। 

---------- 

প্রশ্ন উপনিষদ - তৃতীয় প্রশ্ন (শ্লোক নং ৩/১১-১২)

"য এবং বিদ্বান প্রাণং বেদ ন হ অস্য প্রজা হীয়তে অমৃতঃ ভবতি। তৎ এষ শ্লোকঃ। " (৩/১১)

যে বিদ্বান ব্যক্তি প্রাণকে এইভাবে জেনেছেন, তিনি কখনও প্রজাহীন (সন্তানহীন) হন না। তিনি অমৃতত্ত্ব লাভ করেন। এই সম্পর্কে একটা শ্লোক আছে। 

যিনি প্রানতত্ত্ব সম্পর্কে সম্যকরূপে অবহিত হয়েছেন, তার কাছে জীবন রহস্য, সৃষ্টি রহস্যঃ পরিস্ফুট হয়েছে। তিনি প্রাণকে প্রজাপতি রূপে জেনেছেন। আর এই প্রাণের সঙ্গে তিনি একাত্ম হয়ে,  প্রজাপতির সঙ্গে অভিন্ন হয়ে গেছেন। এই প্রাণই প্রজাপতি, প্রাণই হিরণ্যগর্ভ।  আসলে সমষ্টি  মনে প্রকাশিত  চৈতন্য স্বরূপ এই প্রাণ।    প্রাণকে জানলে, মানুষ প্রাণের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়। তো প্রাণ না কারুর পিতামাতা, না কারুর জন্মদাতা, না কারুর সন্তান-সন্ততি। প্রাণের না আছে জন্ম না আছে মৃত্যু।  মানুষ যখন প্রানতত্ত্বকে সঠিক ভাবে জ্ঞাত হন, তখন তিনি প্রানস্বরূপে স্থিত হয়ে অমৃতত্ত্ব বা অমরত্ব লাভ করেন। 


"উৎপত্তিম আয়তিং স্থানং বিভূত্বং  প্রাণস্য চৈব পঞ্চধা। অধ্যাত্মং চৈব প্রানস্য বিজ্ঞায়  অমৃতম অশ্নুতে বিজ্ঞায় অমৃতম অশ্নুতে। " (৩/১২)

(যিনি প্রাণের ) উৎপত্তি, আগমন, স্থিতি, পঞ্চ বিভূত্ব, অধ্যাত্ম, বিষয়ে অবগত আছেন, তিনি অমৃতত্ব লাভ করেন - সেই বিজ্ঞ ব্যক্তি অমৃতত্ব লাভ করেন। 
যিনি প্রানতত্ত্ব সম্পর্কে সম্যকরূপে অবহিত হয়েছেন, তার কাছে জীবন রহস্য, সৃষ্টি রহস্যঃ, এমনকি তথাকথিত মৃত্যুরহস্যঃ  পরিস্ফুট হয়েছে। প্রাণ পরমাত্মা থেকে আসে। প্রাণ আত্মার বিকার বিশেষ। আর বাসনা  পূরণের জন্য, প্রাণরূপী আত্মা উপযুক্ত শরীরে নিজেকে স্থাপন করেন। নিজেকে পাঁচভাগে ভাগ করে (প্রাণ, অপান , ব্যান, উদান , ও সমান) বিশেষ বিশেষ  কার্য সম্পাদনের জন্য নিয়োগ করেন। এই প্রাণের উপস্থিতিতেই  স্থূল জড় দেহ চৈতন্যবৎ বোধ হচ্ছে। এইজন্য অদ্বৈতবাদীগণ প্রাণকে মায়া নামে  অভিহিত করেছেন। তো এই প্রাণ বা মায়ার রহস্য যতদিন না আমাদের কাছে পরিস্ফুট হচ্ছে, ততদিন আমাদের দুঃখত্রয়ের মধ্যে থাকতে হবে। জন্ম, মৃত্যু, জীবত্ব ইত্যাদির হাত থেকে আমরা নিষ্কৃতি পাবো না। তো সাধনার দ্বারা আমাদের বোধশক্তিবাড়াতে হবে, বিচারশক্তি বৃদ্ধি করতে হবে, প্রজ্ঞাকে আয়ত্বে আনতে   হবে। শ্রবণ, মনন, পঠন-পাঠন, ও প্রাণাদি ক্রিয়া  দ্বারা প্রাণের রহস্য উন্মোচন করতে হবে। প্রাণের সাহায্যেই সেই সৎ-চিৎ-আনন্দকে মায়াজাল থেকে ছিন্ন করে তুলে আনতে হবে। আত্মস্বরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। 

তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর শুনে আমরা সবশেষে অনুধাবন করতে পারলাম যে প্রাণ পরমাত্মার শক্তি।  এই পরমাত্মা শক্তিরূপে প্রাণের "আমি বহু হবো" এই বাসনা থেকে নিজেকে বহুরূপে আস্বাদন করবার নিমিত্ত এই ভোগদেহ সৃষ্টি করেছেন। মুখ্যপ্রাণ নিজেকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে, এই স্থূল, সূক্ষ্ম, জড়, চেতন সত্ত্বার সৃষ্টি করেছেন। এই সৃষ্টির যেমন অধোগতি আছে, তেমনি আছে উর্দ্ধগতি, আছে সমান গতি। আছে ব্যাপ্তি, আছে সঙ্কুচিত ভাব। এই প্রাণশক্তির অবতরণ ও উৎক্রমনই জন্ম মৃত্যুর খেলা। এই প্রাণকে স্বস্বরূপে উপলব্ধি করতে পারলে, জীবন অমৃতময় হয়ে উঠে পারে। 



প্রশ্ন উপনিষদের তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর সমাপ্ত হলো। 
-----------------    
প্রশ্ন উপনিষদ : চতুর্থ প্রশ্ন।

শশাঙ্ক শেখর শান্তিধাম। 

প্রশ্ন উপনিষদ : চতুর্থ প্রশ্ন। (শ্লোক নং- ০৪/০১) 

অথ  হৈনং সৌর্য্যায়নী গার্গ্যঃ পপ্রচ্ছ। ভগবন এতস্মিন পুরুষে কানি স্বপন্তি ? কানি অস্মিন জাগ্রতি ? কতর এষ দেবঃ স্বপ্নান পশ্যতি ? কস্যৈতৎ সুখং  ভবতি ? কস্মিন নু সর্বে সম্প্রতিস্থিতা ভবন্তি ইতি । (০৪/০১) 

এবার গর্গ বংশের সৌর্য্যায়নী তাঁকে  (ঋষি পিপ্পলাদকে) প্রশ্ন করলেন, হে ভগবন, পুরুষের শরীরে কোন কোন ইন্দ্রিয় নিদ্রা যায়, বিশ্রাম গ্রহণ করে ? কোনো ইন্দ্রিয় সদা জাগ্রত থাকে, এবং কর্ম্মে লিপ্ত থাকে ? এই দুই প্রকার ইন্দ্রিয়ের মধ্যে কোনটি স্বপ্ন দেখে ? সুসুপ্তির সময় কোন ইন্দ্রিয় আনন্দ উপভোগ করে ? সুসুপ্তির  অবস্থায় ইন্দ্রিয়সকল কোথায় থাকে ?

তো এই শ্লোকের কথায়, আমাদের বুঝতে সুবিধে হলো, যে ইন্দ্রিয়সকল দুই প্রকার। আর তা হচ্ছে, কেউ সারাক্ষন কাজ করছে, জেগে আছে, একমুহূর্তের জন্যও সে বিশ্রাম নিতে যায় না। আর একদল আছে, যারা বিশ্রামের সুযোগ গ্রহণ করে থাকে। এবারের প্রশ্নে আরো একটা জিনিস মনে হচ্ছে, আলোচনা যেন অপরা থেকে পরা  বিদ্যার মধ্যে প্রবেশ করছে। 

নিদ্রা বা বিশ্রাম সম্পর্কে আমাদের একটা অভিজ্ঞতা সবারই আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কে ঘুমায় ? কেন ঘুমায় ? কে আবার জেগে ওঠে ? ঘুম বা বিশ্রাম ব্যাপরটা কি ? এই ঘুম বা নিদ্রাকে কে আকর্ষণ করে ? আবার কে আমাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে ? এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটা গুহ্যতত্ত্ব নিহিত আছে। আমরা জানি আমরা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ি তখন আমাদের ঘুম পায়, আমাদের যখন খিদে পায়  তখন আমরা খাই। কিন্তু কে খায়, কেই বা ঘুমায় ? জগৎ যখন অন্ধকারময় হয়, সূর্যদেব যখন অন্তরালে, তখন আমরা ঘুমাই। এই জীবদেহে আছে ইন্দ্রিয়াদির অধিষ্ঠান। এই ইন্দ্রিয়কে কার্যকরী করছে, এক অতীন্দ্রিয় পুরুষ বা পরমাত্মা। আমরা যখন একটু গভীর ভাবে বিচার করি, তখন আমরা বুঝতে পারি, এই ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সেই অতীন্দ্রিয়শক্তি ক্রিয়া করছেন, জগৎকে আস্বাদন করছেন। এই ঘুম আমাদেরকে সতেজ  করে তোলে - কারন এই ঘুমের মধ্যেই আমরা সেই অতীন্দ্রিয়শক্তির সঙ্গে মিলিত হই। 
 
জীবের জীবনকালকে মহাত্মাগণ চার ভাগে ভাগে করেছেন। জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি, তুরীয়। জাগ্রত অবস্থায় আমাদের দেহ-মন-ইন্দ্রিয়সকল ক্রিয়াশীল থাকে। স্বপ্নাবস্থায় শরীর ক্রিয়াশীল থাকে না, তখন মন ক্রিয়া করে। স্বপ্নে আমরা যাকিছু দেখি, করি, তা কেবলমাত্র মনের বা মানসিক শরীরের সাধন হয়ে থাকে।  এর পরে আমরা সুসুপ্তিতে যাই, তখন আমাদের শরীর, মন দুইই  নিষ্ক্রিয় অবস্থায় অবস্থান করে। সুসুপ্তিতে আমরা অজ্ঞান হয়ে যাই। সুসুপ্তিতে আমাদের  শরীর মন দুই নিস্ক্রিয় কিন্তু সংজ্ঞাহীন  হয়ে যাই। জাগ্রত অবস্থায় আমরা জাগতিক বিষয়ের চিন্তা করি। স্বপ্নে আমরা স্বপ্ন জগতের মধ্যে বিচরণ করি।  এই স্বপ্নের  জগৎ বাহ্য জগতের অনুরূপ একটা জগৎ। সুসুপ্তিতে আমাদের এই বাহ্য  ও স্বপ্ন জগৎ থেকে দূরে চলে যাই। তখন অজ্ঞান অন্ধকারের মধ্যে ডুবে থাকি। কোনো কোনো ভাগ্যবান পুরুষ তুরীয় অবস্থায় চলে যান। এই জ্ঞানাতীত অবস্থায় তিনি উপলব্ধি করেন, দৃশ্যমান জগৎ, স্বপ্নের জগৎ, - এর বাইরেও একটা জগৎ আছে, যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। এই পরিবর্তনশীল জগতের বাইরেও আরো একটা জগৎ আছে, যার অপরিবর্তনীয়। এমন একটা সত্তা আছে, যা এই জগৎকে ধরে রেখেছে। এই অপরিবর্তনীয় সত্তার নাম দেওয়া হয়েছে ব্রহ্ম  বা আত্মা। জগতের  সমস্ত বস্তু যেন এখান  থেকে অগ্নি-স্ফুলিঙ্গের মতো বিকিরিত হচ্ছে। সমস্ত বস্তু যেন এখান  থেকেই আসছে, আবার এখানেই ফিরে যাচ্ছে। 

আমরা সবাই (সাধারণ মানুষ) এই ত্রিবিধ (জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি) অবস্থার মধ্যে বিচরণ করছি। তো এই ত্রিবিধ অবস্থা সম্পর্কে যদি আমরা বিচার বিশ্লেষণ করি, তবে আমরা সৃষ্টি-প্রলয় সম্পর্কে জ্ঞান পেতে পারি। আবার পিন্ড ও ব্রহ্মান্ডের মধ্যে মূলত কোনো পার্থক্য নেই। পিন্ডকে যদি আমরা বুঝতে পারি, তবে আমরা ব্রহ্মান্ড সম্পর্কে ধারণা  করতে পারবো। গাঢ়  ঘুমে আমাদের চেতনা থাকে না। এমনকি এই সময় আমাদের মনের স্পন্দন থেমে যায়। তখন আমাদের জ্ঞান ও কর্ম্ম ইন্দ্রিয় অসার হয়ে থাকে। তো এই নিদ্রা অবস্থা থেকে কে আমাদের জাগিয়ে তোলে ? এই ঘুমের মধ্যে কেই বা আমাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে কাজ করে ? এইসব রহস্যের কথা  আমরা ঋষি পিপ্পলাদের মুখ থেকে পরবর্তীতে শুনবো। 

---------

প্রশ্ন উপনিষদ - চতুর্থ প্রশ্ন (শ্লোক ৪/২-৩)

তস্মৈ স হোবাচ । যথা গার্গ্য মরীচয়ঃ অর্কস্য অন্তং গচ্ছতঃ সর্বা এতস্মিন তেজোমন্ডলে একীভবন্তি। তাঃ পুনঃ পুনঃ উদয়তঃ প্রচরন্তি এবং হ বৈ তৎ সর্বং পরে দেবে  মনসি একীভবতি। তেন তর্হি এষঃ  পুরুষঃ ন শৃণোতি ন পশ্যতি ন  জিঘ্রতি ন  রসয়তে  ন  স্পৃশতে ন  অভিবদতে ন  আদত্তে ন  আনন্দয়তে  ন  বিসৃজতে ন  ইয়ায়তে স্বপিতি ইতি আচক্ষতে। (০৪/০২)
   
তিনি (পিপ্পলাদ) তাঁকে (গার্গ্য) বললেন, হে গার্গ্য  সূর্য যখন অস্ত  যায়, তখন সমস্ত রশ্মি এই তেজমন্ডলে একীভূত হয়ে যায়।  পুনরায় যখন সূর্য উদিত হয়, তখন সেই (কিরণরাশি) পুনরায় ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক একই ভাবে, (সুসুপ্তির অবস্থায়) সব ইন্দ্রিয়সকল তাদের দেবতা মনের মধ্যে একীভূত হয়ে যায়। আর এই কারণেই সেই মুহূর্তে (সুসুপ্তির অবস্থায়) এই পুরুষ না শুনতে পায় , না দেখতে পায়, না ঘ্রান নিতে পারে, না আস্বাদন করতে পারে, না স্পর্শ করতে পারে, না অভিবাদন করতে (কথা বলতে) পারে, না কোনোকিছু গ্রহণ করতে পারে, না ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করতে পারে, না মলমূত্র ত্যাগ করতে পারে, না চলাফেরা করতে পারে। তখন লোকে বলে তিনি নিদ্রা গিয়েছেন। 

জগতের সবকিছুই কখনও  ব্যক্ত কখনও  অব্যক্ত। কখনো সূক্ষ্ম কখনও  স্থূল। কখনও  ক্রিয়াশীল কখনো নিষ্ক্রিয়। কখনও জাগ্রত, কখনও  নিদ্রামগ্ন। তথাপি জগৎ আছে জগতেই। চেতনা আছে চেতনাতেই। জাগতিক সূর্য্যের যেমন উদয় অস্ত  আছে, তেমনি আমাদের দেহের যে ইন্দ্রিয়সকল আছে, তাদেরও  উদয় অস্ত  আছে। রাতের বেলা আমরা সূর্যদেবকে দেখতে পাই না, তাই বলে কি সূর্য নেই ? তা নয়।  তেমনি আমাদের ইন্দ্রিয়বৃত্তি সকল কখনও  নিষ্ক্রিয় কখনও  বা সক্রিয়। ইন্দ্রিসকলের এই নিষ্ক্রিয় অবস্থাকে আমরা বলি  নিদ্রাবস্থা। এই ইন্দ্রিয়সকল যখন সক্রিয় তখন আমরা জগৎকে আস্বাদন করি, উপভোগ করি, অর্থাৎ জাগ্রত অবস্থা । আর এই সময় কান দিয়ে শ্রবণসুখ, নাক দিয়ে ঘ্রানসূখ, চোখ দিয়ে দর্শনসুখ, ইত্যাদি নানান ভাবে আমরা এই জগৎসুখের ভোগ করছি। ইন্দ্রিসকলের এই কার্যভূমিকা থেকেই, আমরা জগৎ থেকে এঁদের  অনুভূতি পেয়ে থাকি।  আবার ইন্দ্রিয়সকলের এই কার্যকারিতা যখন স্তব্ধ হয়ে যায়, তখন সেই অবস্থাকে বলে নিদ্রা, তখন এই অনুভূতি সকল উধাও  হয়ে যায়।   

এখন কথা হচ্ছে, এই নিদ্রাকালে এই ইন্দ্রিসকলের অবস্থান কোথায় হয় ? ইন্দ্রিসকলের অবস্থান হয় মনের (ইন্দ্রিয়গনের রাজা)  মধ্যে। রশ্মির উদ্ভব যেমন অগ্নির-গোলক সূর্য, তেমনি ইন্দ্রিয়-চেতনার উৎস হচ্ছে মন। এই যে মন বলা হলো, এই মন কিন্তু আমাদের সংকল্প-বিকল্পের উদয়কারী সেই ব্যষ্টি মন নয়, এই মন হচ্ছে দ্যূতিশীল বুদ্ধিতত্ত্ব বা মহৎ-তত্ত্ব থেকে উদ্ভূত, সমষ্টি মন, যেখানে কর্ম্ম জগতের বীজ নিহিত আছে। এই দ্যূতিশীল মন থেকে একদিন উৎপত্তি হয়েছিলো ইন্দ্রিয়সকল। তো আমাদের  যে ১১ ইন্দ্রিয় (৫টি কর্ম্মেন্দ্রিয়, ৫টি জ্ঞানেন্দ্রিয় ও ব্যষ্টিমন ) তা সুসুপ্তির অবস্থায় এই দ্যূতিশীল মনের মধ্যে লয়প্রাপ্ত হয়। এই মনকে ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, পর-দেব অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ দেবতা। মনই এই ইন্দ্রিয়সকলের দেবতা - যা ইন্দ্রিয়সকলকে দ্যুতি প্রদান করছে। এই মনই আবার ইন্দ্রিয়সকলকে নিষ্প্রভ করছে। 
-----------

"প্রাণ-অগ্নয় এব এতস্মিন  পুরে জাগ্রতি।  গার্হপত্যো হ বা এষঃ অপানঃ ব্যানঃ অন্বাহার্য পচনো যৎ গার্হপত্যাৎ প্রনীয়তে প্রণয়াৎ আহবনীয়ঃ প্রানঃ ।" (০৪/০৩)

এই পুরে (দেহে) অগ্নি স্থানীয় প্রাণ-ই সব সময় জেগে থাকে। অপান  হলো গার্হপত্য অগ্নি। ব্যান হলো অন্ন-আহার পচনকারী। এই প্রাণকে গার্হপত্য অগ্নি থেকে নেওয়া হয়েছে। 

একটা সময় ছিলো, যখন ঘরে ঘরে দেশলাই পাওয়া যেত না। তখন আমরা দেখেছি একটা মালসার (মাটির পাত্র) মধ্যে তুষ, ঘুটে ইত্যাদি দিয়ে সারাক্ষন অগ্নিকে সংরক্ষণ করা হতো। এই অগ্নিকে কখনো নিভতে দেওয়া হতো না। অগ্নি তো সর্বত্র, কিন্তু অগ্নিকে ব্যবহারযোগ্য করবার জন্য একে উজ্জীবিত রাখা হতো।  এই আগুন-মালসা থেকেই  পাটকাঠি সহযোগে  অগ্নি নিয়ে উনুন বা প্রদীপ জ্বালানো হতো। গৃহস্থের ঘরে এই যে সংরক্ষিত অগ্নি, একেই বলা হয়  গার্হপত্য অগ্নি। এঁকে সর্ব্বক্ষন সুরক্ষিত রাখা হতো। বছরের পর বছর এই অগ্নি টিম টিম করে জ্বলতে থাকতো।  এঁকে কখনোই নিভতে দেওয়া হতো না। আবার প্রাচীনকালে মুনি-ঋষিদের আশ্রমে যজ্ঞ করবার জন্য অগ্নির প্রয়োজন হতো। গৃহস্থের ঘরে যেমন মালসার মধ্যে অগ্নি সংরক্ষণ করা হতো, তেমনি আশ্রমে একটা ধুনি সর্বদা জ্বালিয়ে রাখতেন। এই অগ্নি থেকেই সমস্ত প্রয়োজনীয় কাজ অর্থাৎ পাকাদিক্ৰিয়া, যজ্ঞাদি ক্রিয়া ইত্যাদি  করা হতো।  

গার্গ্য  প্রশ্ন করেছিল " কানি অস্মিন জাগ্রতি ?" উত্তরে ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, "গার্হপত্যো হ বা এষঃ অপানঃ" - এই গার্হ্যপত্য অগ্নি বা অপান সবসময় জেগে থাকে। ঋষিগণ অগ্নি প্রজ্বলিত করতেন দুটো কাষ্ঠখন্ডের ঘর্ষণের দ্বারা।  এই কাষ্ঠখন্ডকে বলা হয় অরনীকাষ্ঠ। এই দুটো কাঠের ঘর্ষনে যেমন অগ্নি জ্বলে ওঠে অর্থাৎ ব্যবহার যোগ্য অগ্নি উৎপন্ন হয়, তেমনি সন্তান কামনায় স্বামী-স্ত্রী বা মাতা-পিতা  দৈহিক মিলনরূপ অরনী মন্থন করে। এখন দেহের এই রিরংসা বা কামবাসনা মুলে আছে অপান  বায়ু। এই অপান বায়ুর কারনে রজঃ-বীর্য নিম্নগামী হয়ে থাকে। তো দম্পতি প্রজাপতিরূপে এই ধর্ম্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়, অপান বায়ুর কারনে। ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, এই অগ্নিরূপী প্রাণের নাম অপান।  এই অগ্নি একবার প্রজ্বলিত হলে, তাকে রক্ষা করতে হয়। রক্ষা করবেন কিভাবে ? রক্ষা করতে লাগে ইন্ধন। এই ইন্ধন হচ্ছে আমাদের খাদ্যসমাগ্রী বা অন্ন। আর এই কারণেই আমাদের প্রতিনিয়ত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। 

এইবার এই অগ্নির দক্ষিণাংশে অর্থাৎ ডান  দিকে  আর একটা উনুন জ্বালানো হয় - রান্না-বান্না করবার জন্য। অর্থাৎ অন্নাদি পাক করবার জন্য। এঁকে  বলে  দাক্ষিনাগ্নি। আবার গার্হপত্য অগ্নি থেকে যে অগ্নি নিয়ে যে নতুন অগ্নিকুন্ড জ্বালানো হতো তাকে বলা হয় আহবনীয়  অগ্নি। 

অপানকে বলা হয় গার্হপত্য অগ্নি।  এই অপান  বায়ু সব সময় রয়েছে। আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি, তখন এই অপান  বায়ুর জায়গা দখল  করে নেয় প্রাণ বায়ু। এইজন্য প্রাণবায়ুকে বলে আহবনীয় অগ্নি। ব্যান বায়ু আমাদের ডান নাক দিয়ে অর্থাৎ শরীরের দক্ষিণ অংশ দিয়ে নির্গত হয়, এইজন্য একে  বলা হয় দাক্ষিনাগ্নি।  

তো আমরা যখন নিদ্রামগ্ন থাকি, তখন এই তিনটে বায়ু, অর্থাৎ অপান , ব্যান ও প্রাণ বায়ু জেগে থাকে। অর্থাৎ আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি, তখন যেমন আমরা প্রাণে বেঁচে থাকি, আবার এইসময় খাদ্য হজম ক্রিয়া স্বাভাবিক নিয়মেই চলতে থাকে। তো অগ্নিরূপী প্রাণের অধ্যাত্মরূপ রূপ হচ্ছে, অপান , ব্যান, ও প্রাণ। এদের না আছে বিশ্রাম, না আছে ঘুম। এঁরা সদা জাগ্রত প্রহরীর মতো, আমাদেরকে রক্ষা করছেন। 

একটা গুড় কথা হচ্ছে, এই অপান বায়ুর আকর্ষনেই প্রাণবায়ু দেহ থেকে বহির্গত হতে পারে না। প্রাণ তো বহির্গত হচ্ছে প্রতিনিয়ত কিন্তু এই অপান  তাকে আবার টেনে আবার  দেহের ভিতরে প্রবেশ করাচ্ছে । যদি কোনো কারনে অপান বায়ুর ক্রিয়া রুদ্ধ হয়ে যায়, তবে প্রাণ আর দেহের মধ্যে প্রবেশ করতে পারবে  না।  এই জন্য অপান বায়ুকে অর্থাৎ গার্হপত্য অগ্নিকে গৃহস্থ সর্বদা সুরক্ষিত রাখেন। 

এই অগ্নিতে তাই সর্বদা কাষ্ঠখন্ড বা ভোজ্যদ্রব্যঃ আহুতি দিতে হয়। এই আহুতির ফলেই অগ্নি সুরক্ষিত থাকে, পঞ্চপ্রাণ পুষ্টি লাভ করে। আর ঠিক এই কারণেই জীব অভুক্ত থেকে বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারে না। প্রতিনিয়ত তাকে খাদ্যদ্রব্য পরিবেশন করতে হয়। আমরা যে প্রতিদিন খাবার খাই, তা আসলে প্রাণাগ্নির জ্বালানি । এই জ্বালানি না দিলে, প্রানাগ্নি নিভে যাবে। আমরাও মৃত্যুমুখে পতিত হবো। 

 ঋষি বলছেন, "প্রাণ-অগ্নয় এব তস্মিন  পুরে জাগ্রতি। "  প্রানাগ্নি এই দেহরূপ পুরে সদা জেগে আছেন।  
--------------------  

প্রশ্ন উপনিষদ - (শ্লোক নং - ০৪/৪)

"যৎ  উচ্ছ্বাস  নিঃশ্বাসৌ এতৌ  যঃ  আহুতী  সমং  নয়তি ইতি সঃ সমানঃ। মনো হ বাব যজমানঃ । ইষ্টফলম এবং উদানঃ। স এনং যজমানম অহরহঃ ব্রহ্ম গময়তি। "  (০৪/০৪)

যিনি  নিঃশ্বাস প্রশ্বাসকে (শ্বাসবায়ুকে)  সমান দুই ভাগে ভাগ করেন, তিনি সমান । মন হচ্ছে যজমান, অর্থাৎ যার উদ্দেশ্যে যজ্ঞ  করা হয়। এই যজ্ঞের ইষ্টফল হচ্ছে উদান। সেই (উদানই) যজমানকে (মনকে) ব্রহ্মের কাছে নিয়ে যায়। 

 আগের শ্লোকে আমরা তিনটি বায়ু, অর্থাৎ প্রাণ, অপান ও ব্যান বায়ু সম্পর্কে শুনেছি।  এবার বলছেন, সমান ও উদান বায়ুর কথা। 

ঋষি পিপ্পলাদ এই উপনিষদে আমাদের শ্বাসক্রিয়াকে একটা অগ্নিহোত্র যজ্ঞের সঙ্গে তুলনা করছেন। এখানে মন যেন যজমান। সমান বায়ু হচ্ছে এই অগ্নিহোত্র যজ্ঞের হোতা  অর্থাৎ পুরোহিত। এই সমান বায়ু শ্বাসক্রিয়াকে (নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস) দেখাশুনা করছেন। এই নিঃশ্বাস ও প্রশ্বাস যেন দুটো আহুতি। শরীরের সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য, সমানবায়ু শ্বাসবায়ুর মধ্যে অর্থাৎ নিঃশ্বাস ও প্রশ্বাসের মধ্যে একটা সমতা বজায় রাখেন। যজ্ঞক্রিয়া ঠিক ঠিক মতো হলে, অগ্নি উর্দ্ধমুখী হয়ে যজ্ঞের ফলদানকারীর কাছে নিয়ে যান। তেমনি শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিক ঠিক মতো প্রবাহিত হলে, শরীরের উদানবায়ু কার্যকরী হয়ে ওঠে।  আর এই উদান  বায়ু একসময় মনকে  ব্রহ্মেের কাছে নিয়ে যায়। এই অবস্থাকে বলে সুষুপ্তি বা গাঢ় নিদ্রা। 

দেখুন যজ্ঞের আগুন ঠিক ঠিক মতো জ্বলতে পারে তখনই যখন ঠিক সময়ে ঠিক ভাবে আহুতি দেওয়া হয়। আমাদের দেহের মধ্যে যে যজ্ঞ চলছে, অর্থাৎ দেহস্থ যে প্রাণাগ্নি তাতেও আহুতি দিতে হয়। আগে আমরা শুনেছিলাম, এই আহুতি হচ্ছে খাদ্যবস্তু বা অন্ন।  এবার বলছেন, অন্নের  মতো বায়ুও প্রাণাগ্নির খাদ্য। অন্ন না পেলে যেমন জীবের জীবন চলে না, তেমনি বায়ু গ্রহণ না করে, জীব মুহূর্তকালও জীবিত থাকতে পারে না। আমরা আগেই শুনেছিলেন, অপান বায়ুর আকর্ষনে বেরিয়ে যাওয়া প্রাণ আবার দেহের মধ্যে ফিরে ফিরে আসে।এবং সামান্য ক্ষনের জন্য এই দেহে স্থিত থেকে আবার সে বেরিয়ে যাবার উপক্রম করে। অর্থাৎ সামান্যক্ষন এই শরীর সমতাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। প্রাণ ও অপানের এই যে সমতা প্রাপ্তি, এটি সমান বায়ুর কারনে হয়ে থাকে। 

আমরা জানি, যজমান যজ্ঞ করে ইষ্টফল বা আত্মকল্যানের জন্য। সাধকের জীবনের লক্ষ হচ্ছে আত্মোন্নতি। তাই সাধকের মনের মাঝে এই আত্মোন্নতির কামনার বীজ রয়েছে। এই আত্মস্বরূপকে যতদিন না সে উপলব্ধি করতে পারছে, ততদিন মনের গতিবেগ থামবে না। তাই ইন্দ্রিয়সকলের অধিপতি এই মন হচ্ছে যজ্ঞের যজমান। যজ্ঞের ফলে অশুভ অদৃষ্ট দূর হয়ে শুভ অদৃষ্টের উৎপন্ন হয়। মন যখন এই শুভ  কার্যে উদ্যোগী হয়, তখন উদান  বায়ুর শক্তি বিকশিত হয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে সুষুম্না নাড়ী মার্গে প্রবেশ করে। এই উদান  বায়ুকেই বলা হয় কুণ্ডলিনী  শক্তি। এই কুণ্ডলিনী শক্তি একসময় সুষুম্না নাড়ীকে  আশ্রয় করে উর্দ্ধগামী হতে শুরু করে। আর এটি সক্রিয় হবার কারনে  মনের মধ্যে সত্ত্বগুণের বৃদ্ধি পায় । আত্মচেতনার প্রতীক এই কুণ্ডলিনী যখন সুষুম্না পথ ধরে, বিভিন্ন চক্র ভেদ করে সহস্রারে পৌঁছায়, তখন সাধক যজ্ঞফল অর্থাৎ মোক্ষের অধিকারী হন। এইজন্য ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, এই উদান বায়ুর সাহায্যে  সাধক ব্রহ্মলোকে গমন করেন। 

এই উদান বায়ু সাধককে প্রজ্ঞার অর্থাৎ প্রকৃত জ্ঞানের জগতে নিয়ে যায়। এই উদান হচ্ছে, সৃষ্টির আনন্দ শক্তি। যতদিন মানুষ অজ্ঞানের অবস্থায় থাকে, ততদিন মানুষ এই জ্ঞানের নির্ম্মল আনন্দ উপভোগ  করতে পারে না । যোগক্রিয়া ঠিক ঠিক মতো সম্পন্ন হলে, শরীরের উদান  বায়ু কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে, অর্থাৎ মন ও ইন্দ্রিয়সকলকে সুসুপ্তির অবস্থায় নিয়ে যায়। 
---------------------------

প্রশ্ন উপনিষদ : চতুর্থ প্রশ্ন - শ্লোক ০৪/০৫

"অত্র এষঃ দেবঃ স্বপ্নে মহিমানম  অনুভবতি। যৎ দৃষ্টং দৃষ্টম অনু পশ্যতি শ্রুতং শ্রুতম এব অর্থম অনুশৃণোতি দেশদিগন্তরৈঃ চ প্রত্যনুভূতং পুনঃ পুনঃ প্রত্যনুভবতি দৃষ্টং চ অদৃষ্টং চ শ্রুতং চ অশ্রুতং চ অনুভূতং চ অননুভূতং চ সৎ চ অসৎ চ সর্বং পশ্যতি সর্বঃ পশ্যতি ।" (০৪/০৫) 

এবার এই দেবতা (মন) স্বপ্নাবস্থায় নিজের মহৎ শক্তিকে অনুভব করেন । যা কিছু তিনি আগে দেখেছেন, স্বপ্নাবস্থায় তা তিনি আবার দেখেন। আগে যা শুনেছেন, তাই তিনি পুনরায় শোনেন। দেশ-দেশান্তরে যাকিছু তিনি অনুভব করেছেন, তা তিনি পুনরায় অনুভব করেন। যাকিছু দৃষ্ট অথবা অদৃষ্ট , শ্রুত অথবা অশ্রুত, অনুভূত অথবা অননুভূত, সৎ বা অসৎ, সব কিছুই (স্বপ্নাবস্থায়) দর্শন করেন। তিনিই যেন সব হয়েছেন, এই ভাবেই তিনি সব দেখেন।

প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের এই তিন অবস্থা, জাগ্রত-স্বপ্ন-সুষুপ্তি। আবার আমাদের  মনেরও তিনটি অবস্থা, চেতন, অবচেতন, ও অচেতন। (অতিচেতন মন, যা তুরীয় অবস্থায় ঘটে থাকে, তা   আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়।) জাগ্রত অবস্থায় আমাদের মনের  চেতন অবস্থা। স্বপ্নে আমাদের অবচেতন বা অর্ধচেতন অবস্থা আর সুসুপ্তির অবস্থায় অচেতন অবস্থা। ঋষি পিপ্পলাদ এই শ্লোকে স্বপ্নাবস্থা বা আমাদের মনের অবচেতন অবস্থা সম্পর্কে আলোচলা করছেন। জাগ্রত অবস্থায় আমাদের চেতন মন ও স্থূল শরীর ক্রিয়াশীল থাকে। কিন্তু স্বপ্নাবস্থায় আমাদের স্থূল শরীর নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। অন্যদিকে সুসুপ্তির অবস্থায় আমাদের মন ও শরীর  দুইই  নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে। 

স্বপ্নে যেহেতু একমাত্র মনের স্বমহিমা প্রকাশ পায়, তাই ঋষি এখানে মনকে বলছেন দেব। আমরা জানি মন হচ্ছে চেতনধর্ম্মী  দ্যূতিশীল। আমরা এর আগে শুনেছি, আত্মশক্তি প্রাণ ইন্দ্রিগুলোকে চেতনা সম্পন্ন করেছে। আর এই ইন্দ্রিয়গুলোর স্বামী হচ্ছেন, মন।  তিনিই সমস্ত ইন্দ্রিয়ের পরিচালক। এই মনকে ভালোভাবে না বুঝতে পারলে, সেই মনের অতীত, ইন্দ্রিয়ের অতীত পরমপুরুষকে জানা যাবে না। 

যাইহোক, অবচেতন মন স্বপ্নাবস্থায় ক্রিয়া করে থাকে। স্বপ্নে আমাদের সামনে থেকে বাহ্য জগৎ অদৃশ্য হয়ে যায়।  কিন্তু বাহ্য জগতের অনুরূপ একটা জগৎ আমাদের সামনে ফুটে ওঠে।  এবং সেই জগতের সাথে অবচেতন মনের সাহায্যে আমরা একীভূত হয়ে যাই। তখন বাহ্য জগতের  উপলব্ধি আমাদের থাকে না। ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, জাগ্রত অবস্থায় আমরা যা কিছু দর্শন করি, এইসময় (স্বপ্নাবস্থায়) আবার সেই একই দৃশ্য প্রতক্ষ্য করি।  জাগ্রত অবস্থায় আমরা যেসব জায়গায় গেছি, যাকিছু শুনেছি, দেখেছি, অনুভব করেছি, তারই একটা বিকল্প অনুভূতি, দৃশ্য ইত্যাদি আমাদের মনের আয়নায় ভেসে ওঠে।  তবে একথা ঠিক, স্বপ্নে আমাদের এমন সব অনুভূতি হয়, বা এমন অনেক দৃশ্য আমরা দেখি, যা আমরা আগে এখনো দেখিনি, বা শুনিনি।  আবার এমন সব অনুভূতি হয়, যা আমাদের আগে কখনো হয় নি। এমন হতে পারে, এগুলো আমাদের পূর্ব পূর্ব জীবনের অভিজ্ঞতা, অথবা আমাদের মনের সুপ্ত আকাঙ্খ্যা যার সম্পর্কে হয়তো আমরা সচেতন নোই। স্বপ্নে আমরা বাঘ দেখে ভয় পাই, সোনা-দানা পেয়ে আনন্দিত হই, প্রিয় মানুষকে দেখে  খুশি হই, এমনকি নিজেকে সম্রাট বা ভিক্ষারী মনে হয়।  যুদ্ধে পরাজিত হই, মৃত মানুষকে কাছে পাই।  ইত্যাদি নানান বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়, এসবের ব্যাখ্যা এখানে নেই।  মনস্তাত্ত্বিকগন বলে থাকেন, শুদ্ধ মনে শুভ স্বপ্নের উদয় হয়, আনন্দ হয়,অশুভ মলিন চিত্তে বা মনে বা  শঙ্কাজনিত  চিত্তে নানান ভয়ের দৃশ্য ফুটে ওঠে। আবার সাধন প্রভাবে যদি আমাদের মনকে আমরা নিরুদ্ধ করতে পারি, তবে মন দেহাতীত হয়ে বহু অতি-ইন্দ্রিয় অনুভূতি প্রাপ্ত হতে পারি। জ্যোতির্ময় মূর্তি দেখতে পারি। অনাহত  ধ্বনি শুনতে পারি।  তবে এই অনুভূতি, দর্শন, শ্রবণ, সবই সেই মনের খেলা। এর সঙ্গে অধ্যাত্ম জগৎ বা বাস্তব জগতের কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলো  আমাদের মনের সুপ্ত বাসনা ছাড়া কিছু নয়। 
---------------  

প্রশ্ন উপনিষদ - শ্লোক নং ০৪/০৬-০৭)

"স যদা তেজসা অভিভূতো ভবতি। অত্র এষ  দেবঃ স্বপ্নান  ন পস্যতি অথ  তদা এতস্মিন শরীরে এতৎ সুখং ভবতি। " (০৪/০৬) 

সেই (মন) যখন তেজের দ্বারা অভিভূত হয়, তখন দেব (মন) আর স্বপ্ন দর্শন করে না। এই অবস্থায় (সুসুপ্তিতে) এই শরীরে সুখ বিরাজ করে। 

জাগ্রত অবস্থায় আমাদের শরীর, ইন্দ্রিয়, মন সক্রিয় থাকে। যখন আমরা ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি, অর্থাৎ স্বপ্নাবস্থায় থাকি, তখন আমাদের শরীর নিষ্ক্রিয় থাকে। কিন্তু মন এই অবস্থায় সক্রিয় থাকে। এই স্বপ্নাবস্থায় আমরা দেখি, শুনি, কথা বলি, এমনকি কাজ করি। অথচ শরীর  আমাদের বিছানায় পড়ে  রয়েছে। আমাদের মনে হচ্ছে, যেন আমার শরীর  কাজ করছে। এবং এই অবস্থায় আমাদের যাকিছু কাজ, শ্রবণ, দর্শন ইত্যাদি যাই হোক না কেন, তাকে আমরা সেই মুহূর্তের জন্য  অসত্য বলে মনে করি না। বরং এইসময় আমাদের ভয়, আনন্দ,ইত্যাদি অনুভূতিগুলোও হয়ে থাকে - যা অসত্য নয়। 
( বি. দ্রঃ :   এইসময় অর্থাৎ স্বপ্নাবস্থায় এমনকি সুসুপ্তিতে - আমাদের শরীরের স্নায়ু তন্ত্র ক্রিয়াশীল থাকে, এইসময় আমাদের খাদ্য হজম ক্রিয়া, এমনকি অনেক সময় আমাদের বাহ্য ক্রিয়া অর্থাৎ পায়খানা, প্রচ্ছাপ, এমনকি শুক্ররস শরীর  থেকে নির্গত হতে পারে । তাই স্থূল শরীর বিছানায় পরে থাকলেও, শরীরের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া অবশ্যই চলতে থাকে, যেটা ঋষি পিপ্পলাদ এখানে উল্লেখ করেন নি। আসলে স্বপ্নাবস্থায়  আমাদের মনময় শরীর, প্রাণময় শরীর, বিজ্ঞানময় শরীর আনন্দময় শরীর, ইত্যাদি অকেজো হয়ে যায় না। আর সুসুপ্তির সময় আমাদের অন্নময়  শরীর ও মনময় শরীর নিষ্ক্রিয় থাকলেও, প্রাণময়, বিজ্ঞানময়, ও আনন্দময় শরীর নিস্ক্রিয় হয় না। )

যাইহোক, স্বপ্নাবস্থায় যেমন আমাদের স্থূল শরীর  নিষ্ক্রিয় থাকে কিন্তু মন ক্রিয়াশীল থাকে, তেমনি সুসুপ্তিতে শরীর ও মন দুইই  নিষ্ক্রিয় থাকে। গাঢ় ঘুমে আমাদের শরীর মন দুইই  নিষ্ক্রিয় থাকে। এইসময় আমরা সঙ্গাহীন হয়ে যাই। তাই সুষুপ্তি থেকে হঠাৎ যদি  আমরা জাগ্রত অবস্থায় ফিরে আসি, তখন আমাদের সংজ্ঞা  ফিরতে খানিকটা সময় নেয়। আর সুসুপ্তি থেকে  আমরা অনেক বেশি সতেজ  ভাব নিয়ে জাগ্রত অবস্থায় ফিরে আসি। সুসুপ্তিতে বিষয় বোধের লোপ হয়, তাই তখন ভেদজ্ঞান থাকে না। তখন দেহ-মন ইত্যাদির মধ্যে কোনো পার্থক্য অনুভব করি না। এইজন্য বলা হয়, সুসুপ্তিতে মানুষ আত্মস্থ হয়। 

ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, সুসুপ্তির অবস্থায় আমরা চৈতন্যের আলোয় অভিভূত হয়ে পড়ি। অহং ভাবের বিলোপ হয়, জীবাত্মা ও পরমাত্মা যেন মিলিত হয়, আর একটা পরম সুখের অনুভূতি হয়। " এতৎ সুখং ভবতি। " আসলে চিত্ত বৃত্তির নিরোধ হয়, এই সুসুপ্তিতে। আর চিত্ত বৃত্তি নিরুদ্ধ হলেই, আত্মস্বরূপের জ্ঞান ও আনন্দ অনুভব হবেই। যদিও এই আনন্দ অজ্ঞান অবস্থায় হয়ে থাকে - তাই একে  পূর্ণানন্দ বলা যায় না। পূর্ণানন্দের অনুভূতি পূর্ণজ্ঞানেই হয়ে থাকে। তো স্বপ্নহীন সুসুপ্তির অবস্থায় আমাদের যে আনন্দ স্বরূপের উপলব্ধি হয়, তার মুলে রয়েছে সেই আনন্দময় ব্রহ্মেের সান্নিধ্য ।
-------------

"স যথা সোম্য  বয়াংসি বাসবৃক্ষং  সং প্রতিষ্ঠন্তে এবং হ বৈ তৎ সর্বং পর আত্মনি সং প্রতিষ্ঠতে। " (০৪/০৭) 

 হে সৌম্য, পাখিরা যেমন (ক্লান্ত হলে) গাছের বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য সচেষ্ট হয়,  তেমনি জগতের সবকিছু পরমাত্মায় প্রতিষ্ঠিত হয়। 

সুসুপ্তিতে জীবাত্মা ক্ষনিকের জন্য পরমাত্মায় স্থিত হয়। আর এই কারনে সুসুপ্তিতে জীব নির্ম্মল আনন্দ উপভোগ করে। যদিও এটি শুদ্ধ চৈতন্যের অবস্থা নয়, শুদ্ধ চৈতন্যের আভাস  মাত্র। এইসময় জীবাত্মা ও পরমাত্মাতে একটা ভেদরেখা থাকে । এই ভেদ রেখা হচ্ছে অজ্ঞানজনিত। কিন্তু অজ্ঞান তখন নিষ্ক্রিয়। তাই নিষ্ক্রিয় অজ্ঞান থেকে  যখন আমরা আবার সরে আসি, অর্থাৎ আবার যখন জেগে উঠি, তখন আবার আমরা আগের মতো অবস্থায় ফিরে আসি। চিত্তের মলিনতার কারনে, আত্মাকে কাছে পেয়েও আমরা ধরতে পারি না। 

ঋষি পিপ্পলাদ এই ব্যাপারটা  একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন। বলছেন, পাখিরা উড়তে উড়তে ক্লান্ত  হয়ে একসময় বাসায় ফিরে যাবার জন্য চেষ্টা করে।  একটু বিশ্রাম নিতে চায়।  কারন উড়তে উড়তে ক্লান্তি আসে।  এই পাখিদের মতো আমরাও, সারাদিনের ক্লান্তি দূর করবার জন্য, আমরা গাঢ় ঘুমের কোলে ঢোলে পড়ি। যেখান থেকে এসেছি, সেখানে যেতে চাই। সুসুপ্তিতে আমরা সেই পরমাত্মার সঙ্গে ক্ষনিকের জন্য মিলিত হয়ে, বিশ্রাম নিয়ে, আবার আমরা জগৎ আকাশে উড়তে শুরু করি। 

জগৎ অজ্ঞান জনিত কামনা-বাসনা পূরণের কর্ম্মস্থল। অপূর্ন বাসনা আমাদের কর্ম্মে প্রবৃত্ত করছে। আর আমরা কর্ম্মফলের অধীন হয়ে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে  ঘুরপাক খাচ্ছি। কিন্তু পরমাত্মা থেকে বেশিদূরে যেতে পারি না, সুষুপ্তি আমাদের ক্ষনিকের  জন্য হলেও পরমাত্মার কোলে বসিয়ে দেয়। হাতে-পায়ে, সারা শরীর কর্দমাক্ত হলে, যেমন পিতা  কোল থেকে আবার নামিয়ে দেয়, তেমনি আমরা যেন প্রতিদিন পিতার সান্নিধ্য পেলেও, কামনা-বাসনা রূপ কালিমা লিপ্ত মন নিয়ে, সেখানে বেশিক্ষন থাকতে পারি না। তো, সুষুপ্তি আমাদের স্বল্প ক্ষনের জন্য, স্থূল জগৎ থেকে দূরে নিয়ে যায়।  একটা অদ্বৈত অবস্থার মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয়।  আমরা আনন্দ অনুভব করি  ।
-------------- 

প্রশ্ন উপনিষদ : শ্লোক নং ০৪/০৮

"পৃথিবী চ পৃথিবীমাত্রা চ আপঃ চ আপোমাত্রা  চ তেজঃ চ তেজোমাত্রা চ বায়ুঃ চ বায়ুমাত্রা চ আকাশঃ চ আকাশমাত্রা চ চক্ষুঃ চ দ্রষ্টব্যং চ শ্রোত্রং চ শ্রোতব্যং চ ঘ্রাণং চ ঘ্রাতব্যং চ রসঃ চ রসয়িতব্য চ ত্বক চ স্পর্শয়িতব্যং চ বাক চ বক্তব্যং চ হস্তৌ চ দাতব্যং চ উপস্থঃ চ আনন্দয়িতব্যং চ পায়ুঃ চ বিসর্জয়িতব্যং চ পাদৌ চ গন্তব্যং চ মনঃ চ মন্তব্যং চ বুদ্ধিঃ চ বোদ্ধব্যং চ অহঙ্কারঃ চ অহংকার্তব্যং চ চিত্তং চ চেতয়িতব্যং চ তেজঃ চ বিদ্যোতয়ি তব্যং চ প্রাণঃ চ বিধারয়ি তব্যং চ । (০৮/০৮) 

পৃথিবী ও তার তন্মাত্র (গন্ধ), জল ও তন্মাত্র (রস), তেজ ও তার তন্মাত্র  (রূপ)., বায়ু ও তার তন্মাত্র - (স্পর্শ),  আকাশ ও তার তন্মাত্র (শব্দ), ...........
চক্ষু ও তার দ্রষ্টব্য অর্থাৎ দৃশ্য,  কান ও কানের দ্বারা যা শোনা হয়, অর্থাৎ শব্দ, নাক ও তার দ্বারা যে গন্ধ নেওয়া হয়, জিভ ও তার দ্বারা যে আস্বাদন করা হয়, অর্থাৎ রস, ..........
ত্বক ও তার দ্বারা যে বিষয় স্পর্শ করা হয়, বাক ও তার বক্তব্যঃ,  হাত ও তার গ্রহণ যোগ্য বস্তু,  জনন-ইন্দ্রিয় ও তার ভোগের বিষয়, পায়ু ও তার বৰ্জন বিষয়, অর্থাৎ মলাদি, পাদদ্বয় ও তার গন্তব্য স্থান,  ..........
মন ও তার মননের বিষয়, বুদ্ধি  ও তার বৌদ্ধব্য বিষয়, অহঙ্কার  ও তার অভিমানের বিষয়, চিত্ত ও তার চিন্তার বিষয়, তেজ অর্থাৎ জ্ঞান ও জ্ঞানের বিষয়, প্রাণ ও প্রাণ যা ধারণ করে।  (এই সব কিছুই নাম-রূপ বা মায়ার বিচিত্র অভিব্যক্তি। এসবই পরমাত্মায় বিলীন হয়। )

এখানে সৃষ্টিরতত্ত্ব ও  উপকরণ সম্পর্কে বলা হচ্ছে। সাংখ্য দর্শন বলছে, সৃষ্টিতত্ত্বের গোড়ায় মূল কারন রূপে অবস্থান করছে পুরুষ ও প্রকৃতি। এই আদি পুরুষ ও আদি প্রকৃতি অব্যক্ত, সর্বব্যাপী, অনন্ত, কালাতীত। এখান  থেকেই এসেছে মহৎতত্ত্ব অর্থাৎ বুদ্ধি যা সৃষ্টির প্রথম প্রকাশ স্বরূপ। এই মহত্তত্ত্ব থেকে অহঙ্কার। এই অহঙ্কার  ত্রিবিধ সাত্ত্বিক, রাজসিক, এবং তামসিক অহঙ্কার । এই সাত্ত্বিক অহংকার থেকে এসেছে মানস।  এই মানস  থেকে কর্ম্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়। অন্যদিকে তামসিক অহঙ্কার  থেকে এসেছে পাঁচটি তন্মাত্র শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ।  আবার পাঁচ তন্মাত্র  থেকে পাঁচ মহাভূত, ক্ষিতি অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম । তো কেউ একজন পুরুষ এই সৃষ্টির কারন  স্বরূপ, এমন ধারণা সাংখ্য দর্শন অনুমোদন করে না। 

তো সমষ্টি  মন থেকে মানস, ও পাঁচটি  জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচটি কর্ম্মেন্দ্রিয় এবং পাঁচটি মহাভূত - এই ষোলোটা তত্ত্বের উৎপত্তি। মহাচৈতন্য থেকে মহৎ, অহঙ্কার ,এবং পাঁচটি তন্মাত্র এই ৭জন।  তো একটা বিকৃতি তত্ত্ব, আর একটা প্রকৃতিতত্ত্ব। এই হচ্ছে সৃষ্টির  মূল কারন। 

সনাতন হিন্দু দর্শনে বলা হচ্ছে, জগৎ পাঁচটি উপাদনের সমষ্টি। ক্ষিতি, অপ , তেজ, মরুৎ , ব্যোম। এই উপাদানগুলো আবার সূক্ষ্ম ও স্থূল ভেদে দুই প্রকার । সূক্ষ্ম অবস্থায় এগুলোকে বলা হয় তন্মাত্র - অর্থাৎ শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস গন্ধ। এই যে সূক্ষ্ম থেকে স্থূল পরিণত হওয়া, এর কারন হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন ভাগের বা পরিমানের সূক্ষ্ম তন্মাত্রের  মিশ্রণ। সূক্ষ্ম অবস্থায় যখন উপাদানগুলো থাকে,  তখন এগুলোর মধ্যে কোনো মিশ্রণ থাকে না অর্থাৎ অপঞ্চিকৃত অবস্থা। কারুর সঙ্গে কারুর মিলন হয় নি। মিলনের ফলে স্থূল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ক্ষিতি বা মাটির মধ্যে পাঁচটি তন্মাত্র বর্তমান।  অর্থাৎ ক্ষিতির নিজস্ব  তন্মাত্র  হচ্ছে, গন্ধ, কিন্তু  শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, ও ক্ষিতির নিজস্ব তন্মাত্র   গন্ধ মিলে  স্থূল পৃথিবীর জন্ম হয়েছে। তো তন্মাত্রের বিভিন্ন মিশ্রনের জন্য, স্থূল উপাদানের বা পঞ্চভূতের সৃষ্টি হয়েছে। 

আবার আমাদের যে ইন্দ্রিয়সকল, এদের সবার ভোগের নির্দিষ্ট বিষয় আছে, যেমন চোখের বিষয় হচ্ছে দৃশ্য,  কানের বিষয় হচ্ছে শব্দ, নাকের বিষয় হচ্ছে গন্ধ, জিহ্বার বিষয় হচ্ছে স্বাদ, ত্বকের বিষয় হচ্ছে স্পর্শ। 

আবার মন নামক ইন্দ্রিয়কে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে - সেগুলো হচ্ছে, মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার ও তেজ। মনের বিষয় মনন, বুদ্ধির বিষয় হচ্ছে বিচার, অহঙ্কারের বিষয় হচ্ছে "আমি-তুমি" ভাব জাগিয়ে তোলা, চিত্তের বিষয় হচ্ছে  চিন্তন। এই চিত্তই অতীতকে ধারণ করে রাখে, অর্থাৎ এখানে আমাদের স্মৃতি রক্ষিত থাকে।  তেজের বিষয় হচ্ছে জ্ঞান। 
এই তেজকেই বলা হয় শুদ্ধ মন,  আত্মার দীপ্তি এখানেই ফুটে ওঠে। এই তেজই আমাদের বোধশক্তি। এই তেজ বা জ্ঞান আমাদের ব্রহ্ম  উপলব্ধি করিয়ে থাকে। 

ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, "প্রাণশ্চ বিধারয়িতব্যং" - প্রাণই আমাদেরকে ধারণ করে রাখে, অর্থাৎ যাকিছু পঞ্চভূত, পঞ্চ তন্মাত্র, ইন্দ্রিয়াদি সম্বলিত সত্ত্বা তা সে স্থূল হোক বা সূক্ষ্ম একে ধারণ করে আছে প্রাণ। সমস্ত ব্রহ্মান্ডের মাঝে এই প্রাণ যেন সবাইকে এক সূত্রে গেথে রেখেছে। আর এই কারণেই ব্রহ্মান্ডকে প্রানবন্ত বলে মনে হচ্ছে, চেতনাবান বলে মনে হচ্ছে। আবার আমাদের এই যে স্থূল দেহ, যাকে  একটা ক্ষুদ্র ব্রহ্মান্ড বলা হয়, একেও  একসূত্রে গেথে রেখেছে প্রাণ। প্রাণের স্থিতির কারনে শরীরের সমস্ত অঙ্গ  প্রতঙ্গ কলাদি একত্রিত  হয়ে আছে।   প্রাণের  বিয়োগে সবাই যে যার জায়গায় গমন করবে। 
----------------  

প্রশ্ন উপনিষদ : শ্লোক নং ০৪/০৯

"এষ হি  দ্রষ্টা  স্প্ৰষ্টা শ্রোতা ঘ্রাতা  রসয়িতা মন্তা বোদ্ধা কর্তা  বিজ্ঞানাত্মা  পুরুষঃ। স পরে অক্ষরে আত্মনি সম্প্রতিষ্ঠতে।"  (০৪/০৯)

এষ অর্থাৎ   জীবাত্মাই দ্রষ্টা, শ্রোতা, ঘ্রাতা, রস আস্বাদনকারী, মননকারী।  তিনিই সব কিছু প্রতক্ষ্য করেন, তিনিই কর্তা। তিনি বিজ্ঞানাত্মা পুরুষ। তিনি  শ্রেষ্ঠ অক্ষর অর্থাৎ নিত্য, তিনি পরমাত্মায় প্রতিষ্ঠিত, অর্থাৎ জীবাত্মা। 

চেতন শক্তির স্থূল প্রকাশ হচ্ছে ইন্দ্রিয়সকল। এই ইন্দ্রিয়সকলের মাধ্যমে আমরা বিষয়ের অনুভূতি প্রাপ্ত হচ্ছি। এখন কথা হচ্ছে এই ইন্দ্রিয়সকলের কি আদৌ কোনো ক্ষমতা আছে, যার  দ্বারা সে দেখা, শোনা, ইত্যাদি করতে পারে, যদি না এখানে মন উপস্থিত থাকে ? পারে না। আসলে মনের উপস্থিতেই আমরা দেখা শোনা, কথা বলা, স্বাদ  গ্রহণ করা ইত্যাদি করে থাকি ।   আপাতত মনে হয়, যেন ইন্দ্রিয় সকল করছে। আসলে মনের সান্নিধ্যে এসেই ইন্দ্রিয়সকল বিষয়ের অনুভূতি যোগাচ্ছে। আবার আরো একটু গভীরে গেলে দেখবো,  মন হচ্ছে সূক্ষ্ম পদার্থ মাত্র। এই মনকে বাদ  দিয়েও, ইন্দ্রিয়সকল  তার ক্রিয়া করতে পারে, কিন্তু তা আমাদের অনুভূতিতে আসে না। তো মন হচ্ছে চেতনার সূক্ষ্ম প্রকাশ। আবার এই ইন্দ্রিয়সকল, এসব আমাদের দেহের অংশ, এমনকি মন আমাদের দেহের অংশ, অর্থাৎ অন্নের সূক্ষ্ম অংশই মনের গঠন করে থাকে।  তো দেহের যখন বিনাশ ঘটবে, সঙ্গে সঙ্গে মনেরও  বিনাশ ঘটবে।  তাহলে কি আমাদের মধ্যে কোনো শ্বাশ্বত সত্য বলে কিছু নেই ? 

উপনিষদ বলছে, এই শাশ্বত সত্তা হচ্ছে জীবাত্মা। এই জীবাত্মাই প্রকৃত পক্ষে মন ও ইন্দ্রিয়ের পিছনে থেকে এই দর্শন শ্রবণ ইত্যাদি করছে। এই জীবাত্মাই ভোক্তা। আর এই দেহ-ইন্দ্রিয়-মন ইত্যাদি হচ্ছে ভোগের মাধ্যম মাত্র। ইনিই কর্তা , ইনিই নিয়ামক। আর এই জীবাত্মা অক্ষর-পরব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত ।

দর্শন  ইন্দ্রিয়ের (চোখ) সাহায্যে  তিনি সৃষ্টির রূপ-বৈচিত্র উপভোগ করছেন। চেতনশক্তি ভোক্তা হিসেবে, ব্যষ্টি  দেহে চক্ষুরূপে ফুটে উঠেছেন । তেজতত্ত্ব থেকে এই চক্ষুর উদয় হয়েছে।  

ইনিই কর্নেন্দ্রীয়ের সাহায্যে শব্দাদিকে উপভোগ করছেন - যা আকাশ তত্ত্বের প্রকাশ।  

আবার স্পর্শ অনুভব রূপ বিষয় ভোগের নিমিত্ত্ব ত্বক রূপে ফুটে উঠেছেন, যা বায়ুতত্ত্বের প্রকাশ।

আবার ঘ্রান-ইন্দ্রিয়ের  (নাসিকা) সাহায্যে গন্ধময়ী পৃথিবীকে উপভোগ করছেন, যা পৃথ্বি তত্বের প্রকাশ। 

ইনিই রসেন্দ্রীয়ের (জিহ্বা) দ্বারা  ভোজ্য বিষয়ের রস উপভোগ করছেন, যা অপ  তত্ত্বের প্রকাশ। 

তো সৃষ্টির এই পাঁচ উপাদান দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে, জীবাত্মাই দ্রষ্টা, শ্রোতা, ঘ্রাতা, স্প্রষ্টা এবং রসয়িতা রূপে জীবদেহে আশ্রয় করে, আত্মস্বরূপ ভুলে, নিজেকে সংসারের অভিন্ন অংশ ভেবে জগতে বিচরণ করছেন।  

ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, ইনিই মন্তা , বোদ্ধা, কর্ত্তা, বিজ্ঞানপুরুষ।
 
মন্তা - মন-উপাধিযুক্ত আত্মাকে বলা হয় মন্তা। জীবের মধ্যে, বিশেষ করে মানুষের মধ্যে  আছে মনন শক্তি।  এই শক্তি দ্বারা সে সমস্ত কিছুকে বিচার বিশ্লেষণ  করে।  কোনো বিষয় সে গ্রহণ করবে, আর কোন বিষয় সে পরিত্যাগ করবে, তা সে ঠিক করে নেয়। যা গ্রহণ যোগ্য অর্থাৎ সুখকর, তাকে সে গ্রহণ করে, আর যা অসুখকর তা সে বৰ্জন  করে। আর এটি করে, তার সঞ্চিত অভিজ্ঞতার সাহায্যে। 

বোদ্ধা - অর্থাৎ বুদ্ধির সংগ্রহশালা। মন যখন সংশয়ের অতীত হয়, তখন তার মধ্যে একটা নিশ্চিত জ্ঞানের ভাব জন্মে - একেই বলে বুদ্ধির স্বরূপ। এই বুদ্ধির ভিতর দিয়েই আত্মা প্রতিবিম্বিত হন। অর্থাৎ বুদ্ধির সাহায্যে বিচার করে আমরা নিত্য-অনিত্যের প্রভেদ বুঝতে পারি। আত্মা বুদ্ধিতে প্রতিবিম্বিত হন বলেই, আমরা বুদ্ধির সাহায্যে আত্মাকে জানতে  করতে পারি।  সমষ্টি বুদ্ধিকেই বলে মহৎ-তত্ত্ব। 

কর্ত্তা- অহঙ্কার বা আমিত্বের অভিমান থেকে কর্ত্তা ভাব জেগে ওঠে। আত্মার "আমি আছি - এই ভাব" থেকে সেই অজর অমর আত্মা দেহ, মন, ও বুদ্ধির উপাধিযুক্ত হয়ে অহঙ্কার রূপে ফুটে ওঠে। আর জীবাত্মার সমস্ত কার্য এই অহংকার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। তো জীবের মধ্যে যে কর্তৃত্বাভিমান তা এই অহঙ্কার থেকে জাত। 

বিজ্ঞানাত্ম পুরুষ -  আমরা জানি, চক্ষু, কর্ন , নাসিকা, জিহ্বা , ত্বক এগুলো আমাদের বহিরেন্দ্রীয়। আবার মন, বুদ্ধি চিত্ত অহঙ্কার এগুলো হচ্ছে আমাদের অন্তরেন্দ্রিয়। এর মধ্যে চিত্ত হচ্ছে আমাদের স্মৃতির সংগ্রহশালা। অর্থাৎ এখানেই আমাদের সমস্ত ধারণা বা জ্ঞান, সঞ্চিত হয়ে থাকে। এইজন্য যখন আমরা কোনো বিষয়ের সংস্পর্শে আসি, তৎক্ষণাৎ সেই বিষয়ে আমাদের পূর্ব অর্জিত জ্ঞানের সাহায্যে সেই বিষয়ে বিচারে প্রবৃত্ত হতে পড়ি। সুতরাং সর্ব্ব  প্রকার জ্ঞানের গ্রহীতা হচ্ছে চিত্ত। এই চিত্ত দ্বারাই সংগৃহিত জ্ঞান সঞ্চিত হয়ে থাকে। মন দ্বারা জ্ঞান লাভ হয়, বুদ্ধি দ্বারা জ্ঞানের বিচার হয়, আর চিত্ত দ্বারা জ্ঞানের সঞ্চয় হয়। এই মন-বুদ্ধি-চিত্তকে যিনি ধারণ করে আছে, তাকে বলে হয় বিজ্ঞানাত্ম। সুতরাং আমাদের হৃদয়ে বা অন্তঃকর্ণে বিশিষ্ট আত্মাই বিজ্ঞানময় পুরুষ। জীব যখন এই বিজ্ঞানময় অবস্থায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পরে, তখন নির্গুণ পরমাত্মাতে প্রতিষ্ঠা পায়  .তখন একটা অভিভূত অবস্থা।  একেই বলে আত্মস্বরূপে স্থিতি। 

কিন্তু আমরা যেহেতু নিজেদেরকে এই দেহ মনের অধীন বলে মনে করি, এর ফলেই আমাদের মধ্যে ভেদ ভাবের সৃষ্টি হয়, আমরা সবাই আলাদা আলাদা ব্যক্তিতে পরিণত  হয়ে যাই। এই ভেদভাবের চিন্তাই  আমাদেরকে শরীর- মনের মধ্যে বদ্ধ  করে রেখেছে। ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন,  "স পরে অক্ষরে আত্মনি সম্প্রতিষ্ঠতে।"  পর কথার অর্থ সার্বভৌম সর্বোচ্চ সত্তা । অক্ষর কথাটার অর্থ যার ক্ষয় নেই - নিত্য অপরিবর্তনীয়। অর্থাৎ সেই আত্মা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত, যা আমাদের প্রকৃত সত্তা, শাশ্বত অপরিবর্তনীয় সত্তা ।  এই অবস্থায় পৌঁছুলে আমাদের মধ্যে ভেদবুদ্ধি ঘুচে যায়, আমি-আমার ভাব চলে যায়, গুরু-শিষ্যে প্রভেদ ঘুচে যায়। এই হচ্ছে মুক্তি বা মোক্ষ। তো কেবলমাত্র নিজেকে অন্তর্মুখীন করতে পারলেই আমরা পরম-আত্মাতে  বিরাজ করতে পারি। স্ব-স্বরূপে স্থিতি লাভ করতে পারি। 

--------------------    
 
প্রশ্ন উপনিষদ : শ্লোক নং ০৪/১০  

"পরম এব  অক্ষরম প্রতিপদ্যতে স যো হ বৈ তদ্-আচ্ছায়ম  অশরীরম অলোহিতং শুভ্ৰম অক্ষরং বেদয়তে যঃ তু সোম্য।  স সর্বজ্ঞঃ সর্বো ভবতি।  তদেষ শ্লোকঃ।"  (০৪/১০) 

হে সৌম্য, যিনি উজ্বল, শরীরহীন, অ-লোহিত অর্থাৎ লাল বর্ণের নয়,  এই বিশুদ্ধ অক্ষরকে জানেন, তিনি অক্ষরের  সঙ্গে এক হয়ে যান। যাঁর  এই জ্ঞান হয়েছে তিনি  সর্বজ্ঞ  হয়ে সর্ব্বভূতের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেন। এই বিষয়ে একটা শ্লোক আছে। 

আমরা সবাই  এই শরীরকে "আমি"  বলে  মনে করি । আবার আমরা এও জানি, এই দেহ রক্ত-মাংস-হাড্ডির সমাহার। আসলে স্থূল দেহ একটি  আলোর তরঙ্গ  মাত্র।  এই আলোর উৎস সূর্য (প্রাণ), সূর্য্যের নিজস্ব কোনো ছায়া নেই, কিন্তু এই সূর্য্যই সমস্ত বস্তুর ছায়ার কারন। আলো  না থাকলে, ছায়া মিলিয়ে যায়। তেমনি দেহ থেকে যখন প্রাণ (উদান) বিচ্ছিন্ন হয়, তখন স্থূল দেহ মিলিয়ে যায়। তখন আমি (দেহ) বলে কিছু থাকে না। 

কিন্তু আমরা যখন সত্যের সম্মুখীন হই , আমাদের যখন জ্ঞান হয়, তখন আমরা বুঝতে পারি, আমি এই শরীর নয়, এই দেহের মধ্যে আমি অবস্থান করছি মাত্র। জামা-প্যান্টের মধ্যে যেমন একটা শরীর বা আমি থাকে, তেমনি এই শরীর  হচ্ছে আমার আবরণ। জামা প্যাণ্ট খুলে ফেললেও উলঙ্গ আমি থাকি। আবার আমি যেমন জামা-প্যান্ট পাল্টাতে পারি,  আমি দেহ রূপ আবরণকেও পাল্টাতে পারি। 

আসলে আমি শরীর  নোই, শরীর  আমার আবরণ মাত্র। তাহলে প্রশ্ন ওঠে আমি কে ? আমি জীবাত্মা। এই জীবাত্মা শরীর  নয়, এটি একটি জ্যোতিঃ  বিশেষ।  অর্থাৎ আত্মা হচ্ছে তরঙ্গায়িত আলো-বিশেষ যা খেলে বেড়াচ্ছে। ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন,  এটি অ-লোহিত।  লোহিত অর্থাৎ রক্তবর্ণের নয়। তাহলে এর বর্ণ কি ? আসলে আলো হচ্ছে  বিভিন্ন বর্ণের (গুনের)  সমাহার। অর্থাৎ তিনি সগুন।  আবার আলোর কোনো নিজস্ব রং (গুন্) নেই। অর্থাৎ তিনি নির্গুণ। তো কখনো তিনি সগুন, আবার কখনো তিনি নির্গুণ। 

ঋষি বলছেন, তিনি "অচ্ছায়ম" - আমরা জানি, দ্বিতীয় বস্তুর উপস্থিতিতে ছায়ার উৎপন্ন হয়। সূর্য্যের আলো  যখন বাড়ীর  উপরে পড়ে , তখন বাড়ীর  ছায়া দেখা যায়। যখন গাছের উপরে পড়ে তখন গাছের ছায়া দেখা যায়। কিন্তু যখন দ্বিতীয় বস্তুর উপস্থিতিই নেই, তখন তার ছায়া থাকতে পারে না। যখন কেবলমাত্র আত্মা জ্যোতিরূপে উদ্ভাসিত তখন ছায়ার দেখা পাওয়া যায় না। তো আত্মা জ্যোতি স্বরূপ পূর্ন  অদ্বিতীয়  সত্ত্বা।  তাই তিনি  "অচ্ছায়ম" .


 
----------------------------

প্রশ্ন উপনিষদ রহস্যঃ : পঞ্চম প্রশ্ন

শশাঙ্ক শেখর শান্তি ধাম  
প্রশ্ন উপনিষদ - পঞ্চম প্রশ্ন  শ্লোক - ০৫/০১

"অথ হৈনং  শৈব্যঃ সত্যকামঃ পপ্রচ্ছ।  স যো  হ বৈ তৎ ভগবন মনুষ্যেষু প্রায়ণান্তম ওঙ্কারম অভিধ্যায়ীত। কতমং বাব স তেন লোকং জয়তীতি।  তস্মৈ স হোবাচ । (০৫/০১)

এরপরে, অর্থাৎ চতুর্থ প্রশ্নের উত্তরদান শেষ হলে, শিবিপুত্র সত্যকাম প্রশ্ন করলেন, হে ভগবন, যদি কেউ প্রাণ থাকতে অর্থাৎ  মৃত্যু পর্যন্ত ওঙ্কারের ধ্যান করেন, তিনি কোন কোন প্রসিদ্ধ লোক  প্রাপ্ত হন ? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি (ঋষি পিপ্পলাদ) বললেন।" (০৫/০১) 

যিনি সত্যকে কামনা করেন, তিনিই সত্যকাম। দেহাভিমানীর পক্ষে অদ্বৈত তত্ত্বের ধারণা করা কঠিন। গুরুদেবের মুখে আমরা অনেক কথা শুনে থাকি। এথেকে আমাদের মধ্যে এক ধরনের তাত্ত্বিক জ্ঞান হয় বটে, কিন্তু প্রত্যক্ষ্য জ্ঞান একমাত্র সাধন লব্ধ। এমনকি শাস্ত্র অধ্যয়ন করে, আমরা যে অপ্রতক্ষ্য  জ্ঞান অর্জন করি, তা কেবল কাগুজে বিদ্যা। এর দ্বারা জ্ঞানের অনুভব হয় না।  কথায় চিরে ভেজে না। সেই দেশ কালের অতীত, যা "অবাঙমানসগোচরম"  তাকে অনুভবে আনবো কি করে ? এইজন্যই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে, সাধনব্রতের অবলম্বন করতে হয়। 

তাই ঋষি পিপ্পলাদ, এবার সত্যকামের প্রশ্নের জবাবে, সাধন পথের সন্ধান দিচ্ছেন। প্রথমে প্রতীকের উপাসনা। দেখুন দেহ থাকতে, দেহাতীত হয়ে, সর্বদা আত্মস্থ থাকা কেবল অসম্ভব নয়, এটি ভীষণভাবে জীবন বিমুখ, ও দুঃখদায়ক। তাই প্ৰথমেই অব্যাক্তের সাধনা করা যায় না। আমরা সবাই এই দেহেই আছি, রূপের মধ্যে আমাদের বাস। আমরা কারুর গুনের কথা ভাবতে গেলেও, তার রূপের কল্পনা করি। গুরুদেবের কথা যখন ভাবি, তখন আমাদের মাংস চক্ষুর সামনে সেই গুরুদেবের অবয়ব ভাসতে থাকে।  পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, আমরা যে চিন্তা করি, তারও একটা রূপ আছে। তাই প্রথমে প্রতীকের উপাসনার কথা বলা হয়ে থাকে। যা অব্যক্ত, যা অমূর্ত তাকে কোনো মূর্ত বস্তুর মধ্যে আরোপ (কল্পনা) করে উপাসনার বিধির নাম প্রতীকের উপাসনা। চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ী রূপে আবাহন করাই প্রতীকের উপাসনা। আসলে  সাধক যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, তার ধারণাশক্তিকে ক্রমে ক্রমে উন্নত করে তবেই ব্রহ্মধারণায় নিয়ে যাওয়া হয়। আর এই কারণেই, বিভিন্ন মূর্তি, শিবলিঙ্গ, শালগ্রামশিলা, প্রভাত সূর্য, মহানামমন্ত্র, বীজমন্ত্র, ইত্যাদির সাহায্যে উপাসনার শুরু করতে হয়। এই ওঙ্কারের উপসানাও এক রকম প্রতীকের উপাসনা। তবে এই ওঙ্কারের উপাসনা প্রতক্ষ্য ফল প্রদান করে থাকে - অর্থাৎ শব্দব্রহ্মের উপাসনা স্থূল শরীরকে শুদ্ধ তত্ত্বের মধ্যে সহজেই প্রবেশ ঘটিয়ে দিতে পারে। এই ওঙ্কারের উপাসনায় (উচ্চারনে) আমাদের শরীরের নাড়ীশুদ্ধি হয়ে, একটা বিশুদ্ধ শরীরের অধিকারী হতে পারি আমরা। এই সত্য আমাদের ঋষিমুনিদের হাজার বছরের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল, যা আমরা সহজেই প্রাপ্ত হয়েছি। অতি প্রাচীন সেই বৈদিক বা তার আগে থেকেও এই ওঙ্কারের উপাসনা চলে আসছে।  এমনকি এই আধুনিক যুগেও, এর প্রচলন ও মাহাত্ম এতটুকু কমে নি। 

যাইহোক, ঋষি সত্যকাম প্রশ্ন করছেন, ওঙ্কারের উপাসনার দ্বারা কোন প্রসিদ্ধ লোক প্রাপ্ত হওয়া যায়। এখন এই লোক বলতে আমরা কি বুঝি ?  লোক হচ্ছে আলোর তরঙ্গের বিশেষ বিশেষ স্তর। কেউ বলেন, এগুলো আমাদের চিন্তা বা জ্ঞানের স্তর ভেদ। কেউ বলেন  এসব সৃষ্টির স্তরবিশেষ।  হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে ৭টি লোক যা পৃথিবী ও  উর্দ্ধ দিকে অবস্থান করছে।  এগুলো হলো, ভূলোক, ভুবর্লোক, স্বর্লোক, মহর্লোক, জনলোক , তপোলোক, ও সত্যলোক। এছাড়া পৃথিবীর নিম্ন ভাগে আরো সাতটি তল  বা লোক আছে, সেগুলো  হচ্ছে, অতল, বিতল,  সুতল, তলাতল, রসাতল, পাতাল, মহাতল। ঋষি-মিনিগন বলে থাকেন, প্রণব সাধনায় উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হওয়া যায়।  তাই আমাদের আলোচনা এই উর্দ্ধলোক সম্পর্কে।  এই যে সাতটি  লোক, এর মধ্যে ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ - এই তিনটি লোক সৃষ্টির নিম্ন স্তর।  এই তিন লোকে জীব অনন্ময়, প্রাণময়, ও মনোময় দেহে অবস্থান করে থাকে। মহর্লোকে জীব স্বচ্ছ অন্তঃকরণ  বিশিষ্ট হয়ে থাকে। জনঃ  তপঃ ও সত্য - এই তিনটি লোক সৃষ্টির উর্দ্ধতম অবস্থা।  জনঃ লোক কেবল আনন্দে ভরপুর।  এখানে ত্রিবিধ দুঃখের স্থান নেই। তপঃ লোককে বলা হয় জ্ঞানলোক। এই লোকের অধিকাংশই অবিনশ্বর জ্ঞানের অধিকারী। সবশেষে সত্যলোক, যেখানে ব্রহ্মের উপাধিবিহীন শুদ্ধ অবস্থা। এই লোককে কেউ কেউ তুরীয় অবস্থা  বলে থাকেন। যাইহোক, সত্যকাম প্রশ্ন করছেন, ওঙ্কারের উপাসনার দ্বারা আমরা কোনো প্রসিদ্ধ পরলোক প্রাপ্ত হতে পারি। পরবর্তীতে আমরা এই প্রশ্নের জবাব শুনবো, ঋষি পিপ্পলাদের কাছ থেকে। 

--------------------------
প্রশ্ন উপনিষদ শ্লোক নং ০৫/০২

"এতদ্বৈ সত্যকাম পরং কি অপরং চ ব্রহ্ম যৎ ওঙ্কারঃ। তস্মাৎ বিদ্বান এতেন এব আয়তনেন একতরম অন্বেতি।" (০৫/০২)

হে সত্যকাম, ওঙ্কার যেহেতু পরব্রহ্ম আবার অপরব্রহ্ম (অর্থাৎ ওঙ্কার একদিকে সগুনব্রহ্ম  আবার নির্গুণ ব্রহ্ম) সেইজন্য বিদ্বান  ব্যক্তি ওঙ্কারকে ব্রহ্মের প্রতীক রূপে ধ্যান করেন। এবং উভয়ের মধ্যে (সগুন অথবা নির্গুণ) যেকোনো একটিকে অনুসরণ করেন। 

ব্রহ্মকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়েছে, একটা সগুন ব্রহ্ম আর একটা নির্গুণ ব্রহ্ম। আসলে ব্রহ্মকে বিভক্ত করা যায় না, কিন্তু সবকিছুর মধ্যে যেহেতু ঋষিগণ ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেছিলেন, তাই তাঁরা আমাদের বুঝবার সুবিধের জন্য ব্যক্ত-অব্যক্ত, সগুন-নির্গুণ ইত্যাদি শব্দের দ্বারা প্রকাশ করেছেন। এখন  কথা হচ্ছে ব্রহ্ম বলতে আমরা কি বুঝি। দেখুন প্রতিটি শব্দের সঙ্গে একটা বস্তু বা বিষয় জড়িয়ে আছে।  অর্থাৎ প্রত্যেকটি শব্দের একটা অর্থ আছে। যদিও এই যে অর্থ এটি আমাদের স্বকল্পিত। ছোটবেলায় আমাদের কান ধরে শেখানো হয়েছে, এটি তোমার কান - বা বাবাকে দেখিয়ে শেখানো হয়েছে, ইনি তোমার বাবা।  বাবা শিশুকে কোলে তুলে, বার বার উচ্চারণ করেছেন, আমার বাবা কৈরে ? এইযে আমার বাবা - ওম...ম বলে শিশুকে বাবা হামি খেয়েছেন , আদর করেছেন । শিশু আপ্লুত হয়েছে, খুশি হয়েছে।  এই ধ্বনির সঙ্গে শিশু একদিন বাবার শরীর বা অস্তিত্বেকে মিলিয়ে নিয়েছে।  তাই বাবার সঙ্গে সঙ্গে সেও বাবা বলতে শিখেছে। বাবা শব্দের সঙ্গে সেই একটা চেহারা বা অবয়বের ধারণা তার স্মৃতিতে গেথে নিয়েছে।  তো প্রতিটি শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখের সামনে একটা অবয়ব ভাসে। আর এটি কেবলমাত্র শেখানো বুলি। তো যেকোনো শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখের সামনে একটা চিত্র ফুটে ওঠে, যা আসলে কল্পনা, কিন্তু দীর্ঘদিন অভ্যাসে এটি আমাদের অভিজ্ঞতা বা স্মৃতিতে গেঁথে  যায় । 

কিন্তু ব্রহ্ম বলতে আমাদের চোখের সামনে কিছু ভেসে ওঠে না। তার কারন এই ব্রহ্মকে আমরা কেউ দেখিনি, এমনকি এর কোনো চিত্র আমাদেরকে কেউ দেখাতে পারেন নি।  আর যদি কেউ এটিকে একটা মানুষের রূপে এঁকে দেখাতেনও তাহলেও সেটি হতো কেবল কল্পনা বিশেষ, যার কোনো অস্তিত্ত্ব আমাদের বোধে নেই।  না আছে ব্রহ্মেের  কোনো রূপ, না আছে আছে তাঁর তুল্য কোনো বস্তু, বা বৈশিষ্ঠ, যার সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। কথায়  বলে যাঁকে  আপনি জানতে পারছেন, তা ব্রহ্ম নয়। তাহলে কি যা জানেন না তাই ব্রহ্ম। না তাও  নয়।  ব্রহ্ম অজ্ঞেয়।  ব্রহ্মকে জানা যায় না। আবার একমাত্র ব্রহ্মই জ্ঞেয়। বাংলা অভিধান বলছে, "যিনি স্বীয় তেজঃ  বা জ্যোতিঃ  দ্বারা তমসাচ্ছন্ন দিঙমণ্ডল আলোকিত করে স্থাবর-জঙ্ঘমাত্মক বিশ্বরূপে প্রকাশ পেয়েছেন, তিনি ব্রহ্ম।" তো জগৎ একসময় তমসাচ্ছন্ন ছিল। অর্থাৎ অব্যক্ত অবস্থায় ছিলো। এই অব্যক্ত অবস্থাকে বলা হয়েছে নির্গুণ ব্রহ্ম। আবার যখন এই অব্যক্ত অবস্থা থেকে জ্যোতির প্রভাবে ব্যক্ত হয়েছেন, তখন তিনি সগুন ব্রহ্ম। 

এখন কথা হচ্ছে এই ব্রহ্মেের সঙ্গে ওঙ্কারের সম্পর্ক কি ? ওঙ্কার  একটা ধ্বনি বিশেষ। এই ধ্বনির সঙ্গে সৃষ্টির ও শ্রষ্টার  একটা গভীর সম্পর্ক। সাধক  যখন গভীর ধ্যানে মগ্ন হবেন,  তখন এই ধ্বনি সাধকের  মধ্যে অনুরণিত হয়। আমরা যখন অসুস্থ হই, তখন আমাদের মুখ দিয়ে এই ওঙ্কারের ধ্বনি আপনা থেকে বেরিয়ে আসে। শিশু এমনকি সমস্ত সরল  জীবের গলায় এই ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে। একটু খেয়াল করলেই আমরা সেটি ধরতে পারি। এই ধ্বনি  কোনো বিশেষ অর্থ বহন করে না, আবার এই ধ্বনি সমস্ত  শব্দের মূল - যা অর্থবহ বা অর্থবহ নয় । পৃথিবীতে যত ভাষা আছে, সমস্ত ভাষার মূল হচ্ছে ওঙ্কার। সমস্ত ভাষার বীজ এই ওঙ্কার। তো সমস্ত শব্দের প্রতীক বা মূল হচ্ছে ওঙ্কার। 
 যখন এই সৃষ্টি বা প্রকাশ উদ্ভাসিত হয়েছিল, তখন এই ওঙ্কারের ধ্বনি দিয়েই তা শুরু হয়েছিল । 
উপনিষদ বলছে, সৃষ্টির প্রথম প্রকাশ হচ্ছে আকাশ, তার পরে জ্যোতিঃ বা অগ্নি। এই আকাশ তত্ত্বের গুন  হচ্ছে শব্দ, আর অগ্নির গুন হচ্ছে রূপ।  তাই  বলা হয়, এই ওঙ্কারই (শব্দ) সমস্ত সৃষ্টির মূল কারন। আর জ্যোতিঃ সমস্ত রূপের করেন। আর জ্যোতিঃ এবং ওঙ্কার, বজ্রপাত ও বজ্রধ্বনি একই সাথে ঘটে থাকে। এই কারনে ব্রহ্ম বলতে আমরা ওঙ্কার ধ্বনিকেই বুঝে থাকি। 
এখন এই ওঙ্কারকে  যখন অক্ষরের মধ্যে আমরা আবদ্ধ  করলাম তখন তা হলো, ওং, ওঁ, ওম, ওঁং । এই চার বানানে এটিকে প্রকাশ করা হলো। এই ওঙ্কারকে  আবার বলা হয় প্রণব - অর্থাৎ প্রতিনিয়ত নতুন। অর্থাৎ এই ওঙ্কারের ফলেই জগৎ প্রতিনিয়ত নতুন সৃষ্টির সম্মুখীন হচ্ছে।  এই পৃথিবী প্রতিনিয়ত নতুনের সৃষ্টি করছে, এই ওঙ্কারে ধ্বনির মধ্যে দিয়ে।  এই ওঙ্কার  যখন আমরা মুখ দিয়ে সশব্দে উচ্চারণ করছি, তখন তাকে বলা হচ্ছে উদ্গীৎ । ওঙ্কার যখন অক্ষরের মধ্যে আবদ্ধ  হলো তখন হলো অক্ষর-ব্রহ্ম। এই অক্ষর ব্রহ্ম  বলতে আমরা তাঁকেই বুঝি যাঁর  কখনো ক্ষয় নেই।
আসলে এই ওঙ্কারের কথা শেষ করা যায়  না,  বলা হয় ওঙ্কারের মহিমার শেষ নেই। জীব প্রতিনিয়ত এই ওঙ্কারের উচ্চারণ করছে বলেই, তার মধ্যে প্রতিনিয়ত নতুনের (কোষের) সৃষ্টি হচ্ছে। জীব জ্ঞাতসারে হোক বা অজ্ঞাতসারে হোক, এই প্রণবের জপ করে চলেছে। এই ওঙ্কারকেই বলা হয় ত্রিগুণাত্মক (সত্ত্বঃ -রজঃ তমঃ) । এঁকেই বলা হয় জীবের তিন অবস্থার প্রতীক অর্থাৎ জাগ্রত অবস্থা, স্বপ্নাবস্থা, ও সুসুপ্তির অবস্থা। এঁকেই বলা হয়, সৃষ্টিকর্ত্তা, পালনকর্ত্তা, ও সংহার কর্ত্তা, আবার ব্যক্ত, সূক্ষ্ম, অব্যক্ত। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, তস্য বাচক প্রণব - ব্রহ্মের প্রতীক হচ্ছে ওঙ্কার -প্রণব - ওম। এই ওঙ্কারের ধ্যানের মাধ্যমে আমরা সগুন ও নির্গুণ ব্রহ্মে প্রবেশের অধিকারী হতে পারি। 

---------------
প্রশ্ন উপনিষদ : শ্লোক নং - ০৫/০৩ 

"স যদি  একমাত্রম অভিধ্যায়ীত স তেন এব সংবেদিতঃ  তূর্ণম  এব জগত্যাম অভিসম্পদ্যতে। তম ঋচঃ মনুষ্যলোকম উপন্য়ন্তে স তত্র তপসা ব্রহ্মচর্যেণ শ্রদ্ধয়া সম্পন্নো মহিমানব অনুভবতি ।" (০৫/০৩) 

তিনি যদি ওঙ্কারের একটি মাত্র মাত্রার   (অ)  ধ্যান করেন, তবে এর দ্বারা যে জ্ঞান  হবে, তা জাগতিক জ্ঞানের পক্ষে যথেষ্ট। তিনি  আবার মানবজন্ম  লাভ করবেন। এবং তিনি সাধন পথে তপস্যা, ব্রহ্মচর্য, আত্মসংযম ইত্যাদির অভ্যাস করবেন। তার মধ্যে গুরুবাক্যে বিশ্বাস, শাস্ত্র বাক্যে বিশ্বাস জন্মাবে। আর এই সকল গুনের জন্য তিনি  সকলের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠবেন। 

ওঙ্কার  বা ওম তিনটি অক্ষরের দ্বারা প্রকাশ করা হয়, অ-উ-ম। "অ"  হচ্ছে প্রথম মাত্রা, "উ"  হচ্ছে দ্বিতীয় মাত্রা আর "ম" হচ্ছে তৃতীয় মাত্রা। তো ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, কেউ যদি ওঙ্কারের কেবল মাত্র প্রথম মাত্রা বা "অ" - এর ধ্যান করেন, তবে তিনি পুনরায়, পৃথিবীতে দুর্লভ এই মনুষ্য দেহ নিয়েই জন্ম গ্রহণ করবেন। অর্থাৎ  এনার আর পশুযোনিতে ভ্রমন করতে হবে না। শুধু তাই নয়, নতুন দেহে তিনি শাস্ত্র ও গুরুবাক্যে বিশ্বাস করে, তপস্যা, ব্রহ্মচর্য, আত্মসংযম -এর অভ্যাস করে, নিজেকে উন্নত করবেন। তিনি সবার শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠবেন। অর্থাৎ পরবর্তী জীবনে তিনি যথার্থ সাধকের সংস্কার নিয়েই  জন্ম গ্রহণ করবেন। 

এই যে "অ" যাকে  বলা হচ্ছে প্রথম মাত্রা, এটি আসলে আমাদের জাগতিক অবস্থার প্রতীক। আমরা শুনেছি, ব্রহ্মস্বরূপ আমাদের  তিন অবস্থা, জাগ্রত, স্বপ্ন, ও সুষুপ্তি। সৃষ্টির যে স্থূল অবস্থা অর্থাৎ দৃশ্যমান জগৎ সংসার, এর প্রতীক হচ্ছে "অ" . এই জাগ্রত অবস্থায়, যিনি যথার্থভাবে জাগ্রত থাকেন, তাঁর  যে জ্ঞান হয়, তা হচ্ছে জাগতিক জ্ঞান। এই জাগতিক জ্ঞান জীবকে কামনা-বাসনার উর্দ্ধে নিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু দেহ-মনে শুদ্ধ হবার বাসনা তার মধ্যে জেগে ওঠে। দৈহিক ভাবে সুস্থ  থাকা, মানসিক দিক থেকে স্থির  থাকার প্রবৃত্তি তার মধ্যে জেগে ওঠে। ফলতঃ তিনি মৃত্যুর পরে এমন ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন, বা এমন দেহপ্রাপ্ত হন, যার মধ্যে সাধন সংস্কার সঞ্চিত থাকে। 

তো ওঙ্কার হচ্ছে স্বয়ং ব্রহ্মের প্রতীক। এঁর  তিনটে মাত্রা। এর মধ্যে "অ" হচ্ছে স্থূল জগতের প্রতীক। এখন কেউ যদি ওঙ্কারকে  ব্রহ্মের প্রতীক না ভেবে, কেবল মাত্র প্রথম মাত্রার ধ্যান করেন, অর্থাৎ জাগ্রত অবস্থায় কেবলমাত্র জগৎ সম্পর্কে সচেতন থাকেন, তবে এই স্থূল জড় জগতের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে পড়েন। জগৎ সম্পর্কে তার জ্ঞান যতই বর্দ্ধিত হোক না কেন, এমনকি তিনি যদি সাত্ত্বিক জীবনে অভ্যস্ত হন, তাহলেও, মৃত্যুর পরে, আবার তাকে এই কর্ম্মদেহে পৃথিবীতে ফিরে আসতে  হয়। যেখানে তাঁর  জীবন শেষ হয়েছিলো, তিনি সেখান থেকেই  আবার পরবর্তী জীবন শুরু করেন। আসলে এসব কথার মাধ্যমে ঋষি পিপ্পলাদ আমাদেরকে শুধু দেহ বা জড় পদার্থ নিয়ে নিজেকে ব্যতিব্যস্ত না  রাখতে বলছেন। আমরা যেন কেউ এই জড় জগতের একজন ভেবে, নিজেকে বিভ্রান্ত না করি। 

এবার আমরা ওঙ্কার  সম্পর্কে আরো একটু গভীরে প্রবেশ করবার চেষ্টা করি। ওঙ্কার ত্রিমাত্রা বিশিষ্ঠ। এবং এবং বলা হচ্ছে, ওঙ্কার  হচ্ছে উপাসনার শ্রেষ্ঠ আশ্রয়। এই ওঙ্কার ত্রিমাত্রা বিশিষ্ঠ। প্রণবের প্রথম মাত্রা হচ্ছে ঋক বা ঋক্বেদ। ঋক কথাটার মানে হচ্ছে স্তুতি। 
এই যে বিশ্বপ্রাণ তা ব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এই বিশ্বপ্রাণের স্পন্দন হেতু এই ব্রহ্মান্ডের সমস্ত সৃষ্টি ক্রিয়া চলছে। প্রাণের এই স্পন্দন হেতু শব্দ তরঙ্গ  সৃষ্টি হয়।  এই শব্দতরঙ্গকে উপনিষদ বলছেন, শব্দব্রহ্ম। তন্মাত্র রূপ আকাশের সাথে প্রাণের অভিঘাতের ফলেই এই শব্দ তরঙ্গ সৃষ্টি হচ্ছে। এইজন্য বলা হয়, আকাশের গুন্ হচ্ছে শব্দ। এই শব্দকে  উপনিষদের দৃষ্টিতে চার পর্য্যায়ে দৃষ্ট হয়ে হয়ে থাকে। এগুলো হচ্ছে পরা, পশ্যন্তি, মধ্যমা, বৈখরী। এই যে পরা  ও পশ্যন্তি, এই ধ্বনি সাধারণ অর্থে শ্রুতি গোচর নয়। এই ধ্বনি অব্যক্ত, একেই বলে অনাহত ধ্বনি। এবার যখন সৃষ্টির  সূক্ষ্ম অবস্থা এলো, তখন তাকে বলা হয় মধ্যমা। আর স্থূল অবস্থায় বৈখরী। যোগাচার্য্যগন বলছেন, এই পরা  আমাদের মূলাধারে, পশ্যন্তি মনিপুরে, আর বৈখরী বিশুদ্ধ চক্রে অর্থাৎ কন্ঠ দেশে অবস্থান করে থাকে। এই ধ্বনির সাহায্যে আমাদের জ্ঞানের অনুভব হয়, আর বাকশক্তির  সাহায্যে তা প্রকাশিত হয়। 

আমরা যখন এই প্রণব বা ওঙ্কারের প্রথম মাত্রা উচ্চারণ করি, তখন তা হয়ে ওঠে বিশ্বপ্রাণের স্তুতি। এই ঋক কথাটার অর্থও স্তুতি। এই স্তুতি বা ঋক্বেদের জ্ঞানকে যাঁরা ভালো ভাবে আয়ত্বে আনতে  পেরেছেন, এঁরাই যথার্থ  বিদ্বান। এঁদেরকেই আমরা বলি দার্শনিক। এঁরা শুদ্ধ বিচারবুদ্ধির দ্বারা ব্রহ্ম-স্বরূপের ধারণা  করতে পারেন। আর ঠিক এই কারণেই, ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, যাঁরা ওঙ্কারের প্রথম মাত্রা সম্পর্কে জ্ঞাত হয়েছেন, তারা সাধারনের মধ্যে শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু এঁরা দার্শনিক, পূর্ণজ্ঞানী নন। ব্রহ্মানুভূতি এঁদের  হয় না। তাই এঁদেরকে বারংবার পৃথিবীতে ফিরে ফিরে আসতে হয়। আর ব্রহ্মানুভূতি লাভের  জন্য এঁরাই প্রয়াসী হন। তপস্যা অর্থাৎ নিজেকে তাপিত করা, ব্রহ্মচর্য পালন, অর্থাৎ  তেজঃশক্তিকে ধরে রেখে ব্রহ্মভাবে ভাবিত হওয়া, ইত্যাদির অনুশীলন করেন। শ্রদ্ধা অর্থাৎ গুরুবাক্যের প্রতি ও শাস্ত্র বাক্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এঁরা  পূর্ন  জ্ঞানের পথে চলতে শুরু করেন। এই জ্ঞানই আত্মশক্তি যা  অন্তরে অস্ফুট ছিলো , তা ফুটে ওঠে। ওঙ্কারের প্রথম মাত্রার মনন করে, অর্থাৎ ঋক্বেদের ঋকগুলোকে মনন করে মানুষ প্রজ্ঞাবান হয়ে ওঠেন।  আর প্রজ্ঞাই একসময় আত্মমহিমাকে অনুভব করিয়ে দেয়।   

--------------

প্রশ্ন উপনিষদ - শ্লোক নং ০৫/০৪

"অথ যদি দ্বিমাত্রেণ মনসি সম্পদ্যতে  সঃ অন্তরিক্ষং যজুৰ্ভিঃ উন্নীয়তে সোমলোকম । স সোমলোকে বিভুতিম অনুভূয় পুনরাবর্তন্তে। " (০৫-০৪) 

কিন্তু যদি তিনি (ওঙ্কারের) দ্বিমাত্রার অর্থাৎ "উ" -এর ধ্যান করেন, তবে মানসিক সমৃদ্ধি লাভ করেন। যজুর্বেদের দ্বারা তিনি অন্তঃরীক্ষের মধ্যে দিয়ে সোমলোকে (চন্দ্রলোক) গমন করেন। সেই সোমলোকে তিনি ঐশ্বর্যের অনুভব করেন এবং পুনরায় (এই মর্তলোকে ) ফিরে আসেন। 

উপনিষদ ওঙ্কারের দ্বিতীয় মাত্রা বা "উ" কে যজুর্বেদের প্রতীক হিসেবে দেখেছেন। অভিধান বলছে, যে মন্ত্রের অক্ষরে চরণ  বা অবসান সম্পর্কে কোনো নিয়ম নেই, তাকে বলে যজুঃ। অর্থাৎ গদ্যের আকারে লেখা। যজ কথাটার অর্থ পুজো করা।  এই যজ থেকেই যজ্ঞ কথাটা এসেছে। 

তো প্রথম মাত্রায়  আমরা ঋক অর্থাৎ ঈশ্বরের স্তুতির কথা শুনেছিলাম, এবার যজুর্বেদের যজ্ঞাদির কথা শুনছি। প্রথম মাত্রায়  আমরা জাগ্রত অবস্থার কথা শুনেছিলাম, এবার স্বপ্নাবস্থার কথা শুনছি। যজুর্বেদে যজ্ঞাদি দ্বারা ইহকাল-এর সুখ শান্তি এমনকি  পরকালের জন্য সুখ-শান্তি পাওয়ার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। বলা হয়, যজুর্বেদ উক্ত যাগ-যজ্ঞের দ্বারা যজমানের অর্থাৎ সাধকের সুকৃতি সঞ্চয় হয়। আর এরফলে সাধক মৃত্যুর পরে সোমলোক প্রাপ্ত হয়ে থাকে। সোম কথাটার অর্থ চন্দ্র। তো সোম লোক বলতে আমরা চন্দ্রলোককে বুঝে থাকি। এই চন্দ্র কিন্তু পৃথিবীর উপগ্রহ চন্দ্র নয়।  এই চন্দ্রকে বলা হয়, রয়ি বা অন্ন। সোম কথাটার আরো একটা অর্থ হচ্ছে অমৃত। আসলে এর আগে যখন আমরা বিভিন্ন লোকের কথা শুনেছিলাম, তখন সোমলোক বলে কোনো লোকের কথা শুনিনি।  আমরা স্বর্গ লোকের কথা শুনেছিলাম। এই স্বর্গ লোকের নিম্ন স্তরকে বলা হয় সোমলোক । এখানে সূক্ষ্ম দেহধারী দেবতাদের বাস।  এখানে ভোগ সুখের অসীম ভান্ডার।  এখানে আছে কল্পবৃক্ষ। এখানে যা চাওয়া যায়, তাই পাওয়া যায়।  আসলে এই স্তরে সূক্ষ্ম দেহধারী তার চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কিছু প্রাপ্ত হয়ে থাকেন।  স্বপ্নাবস্থায় যেমন আমাদের মানসিক দেহে সুখ দুঃখ ভোগ করি, তেমনি এই সোমলোকে সূক্ষ্ম দেহে ইচ্ছেমত ভোগ-লালসার পূরণ হয়। এই অবস্থায়, তার মনের মধ্যে যা কিছু কামনার উদ্রেগ হয়, তাই তার সামনে এসে উপস্থিত হয়। এমনকি এই অবস্থায় আমরা আমাদের পূর্ব-পূর্ব পুরুষের সান্নিধ্য পেতে পারি। 

ওঙ্কারের প্রথম মাত্রার ধ্যানে যেমন জাগতিক সুখ-ভোগ, সুস্বাস্থ্য ইত্যাদি  আয়ত্তে আসে, তেমনি দ্বিতীয় মাত্রার ধ্যানে স্থূল ও সূক্ষ্ম জগতের সুখ-সৌভাগ্য লাভ করা যায়। কিন্তু চন্দ্রের যেমন ক্ষয়-বৃদ্ধি  আছে, তেমনি এই নিম্ন -স্তরের স্বর্গলোকেও ভোগ-সুখের ক্ষয়-বৃদ্ধি হয়ে থাকে। ফলতঃ এখানকার ভোগ সম্পন্ন হলে তাকে আবার এই মর্তলোকে কর্ম্ম অনুযায়ী স্থূল দেহ ধারণ করতে হয়। 

তো "উ" যাকে  বলা হচ্ছে  যজুর্বেদের প্রতীক, এর ধ্যান আমাদেরকে অন্তঃরীক্ষের মধ্যে দিয়ে একটা স্বপ্নের জগতে নিয়ে যায়।  স্বপ্নাবস্থায়  যেমন আমরা স্থূল জগতের অনুরূপ একটা জগতে বিচরণ করি, ঠিক তেমনি ওঙ্কারের "উ"  মাত্রার ধ্যান  আমাদেরকে মৃত্যুর পরে, এই স্থূল জগতের অনুরূপ, একটা জগতের বাসিন্দা করে দেয়।  এখানে বসবাসের সময় ফুরিয়ে গেলে আমরা আবার এই পৃথিবীতে মানুষ রূপে জন্ম গ্রহণ করি। আর এই নতুন জন্মে আমরা সাধন জগতের দিকে অগ্রসর হবার জন্য অনুপ্রাণিত হই। 

------------
প্রশ্ন উপনিষদ - শ্লোক নং ০৫/০৫-০৬

"যঃ পুনরেতং ত্রিমাত্রেণ ওম ইতি এতেন অক্ষরেণ পরং পুরুষম অভিধ্যায়ীত স তেজসি সূর্যে সম্পন্নঃ । যথা পাদোদরঃ ত্বচা বিনির্মুচ্যত এবং হ বৈ স পাপমনা বিনির্মুক্তঃ স সামভিঃ উন্নীয়তে ব্রহ্মলোকং স এতস্মাৎ জীবঘনাৎ পরাৎ পরম পুরিশয়ং পুরুষম ঈক্ষতে।  তৎ এতৌ শ্লোকৌ ভবতঃ । "(০৫/০৫) 

যিনি তিন অক্ষর বিশিষ্ট ওঙ্কারের তৃতীয় মাত্রার ধ্যান করেন,  তিনিই পরম পুরুষের ধ্যান করেন, এবং  জ্যোতির্ময় সূর্য্যে লিন হয়ে যান।  সাপ যেমন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে, ঠিক সেই ভাবে, তিনি নিজেকে সমস্ত পাপ  থেকে মুক্ত করেন।  তিনি সাম  মন্ত্রের মধ্যে দিয়ে ব্রহ্ম লোকে উন্নীত হন। তিনি জীবসমষ্টিময় অর্থাৎ হিরণ্যগর্ভ থেকেও শ্রেষ্ঠ পরমপুরুষকে ধ্যানের  মাধ্যমে হৃদয়পদ্মে দর্শন করেন। এই বিষয়ে দুটো শ্লোক আছে। 

ওঙ্কারের প্রথম মাত্রার ধ্যানে ঋকমন্ত্রের সাধন হয়। অর্থাৎ জ্ঞানের প্রাথমিক ধাপ - স্তুতিবাচক ধ্বনির উচ্চারণ।  দ্বিতীয় মাত্রার ধ্যানে  যজুর্বেদ, বা যাগযজ্ঞ ক্রিয়া কর্ম্মের সাধন - জ্ঞানের দ্বিতীয় ধাপ। তৃতীয় মাত্রায় সামবেদীয় জ্ঞান। অর্থাৎ শরীর-মনের মধ্যে একটা ছন্দ জাগিয়ে তোলা। শ্বাস প্রশ্বাসের মধ্যে, শরীরের প্রতিটি  অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের  মধ্যে একটা সাম্যভাব স্থাপন করা। জগৎ ছন্দময়। প্রতিটি স্পন্দনের একটা ছন্দ আছে।  জগৎ এই ছন্দের কারণেই, সুষ্ঠ ভাবে চলছে। কেউ কাউকে আঘাত করছে না। তো ছন্দকে  যদি আমরা আশ্রয় করতে পারি, জীবনের ছন্দকে যদি আমরা অনুভব করতে পারি, তবে আমাদের জীবন হয়ে উঠবে ছন্দময়, সহজ ও সত্যময়। 

এই ছন্দে নিজেকে একাত্মীভূত করতে পারলে, জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে মিলনসুখ অনুভব করতে পারা যায় । এর  সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর তুলনা করা চলে না। সুর, ছন্দ ও কথা যখন এক তানে বইতে শুরু করে,  তখন একটা সুখানুভূতি হয়। কিন্তু উল্টোটা হলে, বিরক্তির উদ্রেগ হয়।  এইজন্য সুরেলা গান উপাসনার বিশেষ অঙ্গ। বলা হয়, এই গান স্বর্গ ও মর্তের মধ্যে একটা সেতু তৈরী করে দেয়। জীব-ভাবনা ও ব্রহ্ম-ভাবনার মধ্যে একটা বন্ধন তৈরী করে। এইজন্য ওঙ্কারের এই তৃতীয় মাত্রা "ম" কে বলা হচ্ছে সামবেদীয় জ্ঞান। 

আমরা জানি, আদিত্যলোক থেকে প্রানধারা সৃষ্টিরূপে প্রতিনিয়ত বর্ষিত হচ্ছে। সমগ্র জগৎ তা সে স্থূল হোক বা সূক্ষ্ম এই আদিত্যলোকের মধ্যেই অন্তর্নিহিত হয়ে আছে।এই আদিত্য-আকাশে আছে লক্ষ-কোটি সূর্য যা  নক্ষত্রের আকারে জ্বলজ্বল করছে। এই আদিত্যলোকের অধিপতি ব্রহ্ম। তার লোককেই বলা হয় ব্রহ্মলোক। দেহরূপ ক্ষুদ্র এই ব্রহ্মান্ডের মধ্যে আমাদের হৃদয় প্রদেশে, চিদাকাশে জ্যোতি স্বরূপ সেই পরমপুরষের বাস। যখন এই জ্যোতির মধ্যে আমরা প্রবেশ করবো, তখন পরম-পুরুষের সান্নিধ্য অনুভব করবো।  এই জন্য ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন,  পরাৎ পরম পুরিশয়ং পুরুষম ঈক্ষতে। ওঙ্কারের  ধ্যানের মাধ্যমে হৃদয়পদ্মে আসীন পরমাত্মার সাক্ষাৎ অনুভূতি লাভ করা যায়। 
--------------- 

"তিস্রো মাত্রা মৃত্যুমত্যঃ প্রযুক্তা অন্যোন্যসক্তা অনবিপ্রযুক্তাঃ । ক্রীয়াসু বাহ্য অভ্যন্তর মধ্যমাসু সম্যক প্রযুক্তাসু ন কম্পতে জ্ঞঃ । " (০৫/০৬)

ওঙ্কারের তিন মাত্রাকে যিনি পৃথক ভাবে ধ্যান করেন, তিনি মৃত্যুর অধীন। কিন্তু এই তিন মাত্রাকে অর্থাৎ এই তিন মাত্রা যখন  পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত  হয়, তাঁকে ধ্যান করাই  যথার্থ ধ্যান। বাহ্য, অভ্যন্তর এবং মধ্যম (জাগ্রত, স্থান, সুষুপ্তি) ক্রিয়াতে জ্ঞানী আর বিচলিত হন না। 

ওঙ্কারের তিন মাত্রা,   অ-উ-ম।  জীবকুলের তিন অবস্থা জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি। এই তিন অবস্থাতেই সেই আমি এক অখন্ড সত্ত্বা। এই অখন্ড জ্ঞানই যথার্থ জ্ঞান, আর দ্বৈতজ্ঞান আসলে অজ্ঞান, বা  ভ্রমজ্ঞান। এই অখন্ড জ্ঞান যতদিন না হবে, ততদিন, আমরা সবাই মৃত্যুকে সত্য ভেবে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে যাবো, আর একদিন মৃত্যু এসে আমাদের টেনে নিয়ে যাবে। এ যেন ছায়ার সঙ্গে লড়াই।  নিজের ছায়াকেই শত্রু ভেবে, তরোয়াল উঁচু করে দৌড়োচ্ছি, আর ছায়াও অনুরূপ তরোয়াল উঁচু করে আমার পিছন পিছন, বা সামনে সামনে দৌড়োচ্ছে। আর এই যে ছায়া এটি তৃতীয় বস্তুর উপস্থিতিতেই  ঘটে থাকে। আমাদের সংস্কার, আমাদের শিক্ষা, আমাদের পরিবার, আমাদের সমাজ এই পীড়াদায়ক পরিস্থিতি তৈরী করছে। আর আমরা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে  চলেছি। 
তো উপনিষদের ঋষিগণ  বলছেন,যিনি ওঙ্কারকে তিন অবস্থার সঙ্গে যুক্ত করে ধ্যান করেন, অর্থাৎ একটা নিখিল বিশ্বসত্ত্বার সাথে একাত্মতা অনুভব করেন, তিনি যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, তিনি এই ব্রহ্মস্বরূপ জগতের সঙ্গে অভিন্নতা  বোধ করেন। তিনি নিজেকে কখনো অন্যের সঙ্গে আলাদা বলে মনে করেন না। তখন তিনি সমস্ত রকম ভয় থেকে মুক্ত হয়ে নির্ভিক অবস্থায় এই জগতে বিচরণ করেন। ওঙ্কারকে  এই ভাবে যিনি জেনেছেন, তার মধ্যেই আত্মজ্ঞানের উদয় হয়েছে। তিনি না দূরে, না কাছে, তিনি সবত্র। 

প্রশ্ন উপনিষদ - শ্লোক নং ০৫/০৬-৭

ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন,   "অন্যোন্যসক্তা অনবিপ্রযুক্তাঃ" - ত্রিমাত্রা প্রণবের উচ্চারণ যদি ঠিক ঠিক ভাবে অনুষ্ঠিত হয়, তবে "ন কম্পতে জ্ঞঃ " অর্থাৎ তখন তার মধ্যে আর স্পন্দন বা কাঁপুনি থাকে না। তিনি তখন অচঞ্চল হয়ে নির্ভিক হয়ে বিশ্বরূপ দর্শন করেন। 

এই যে পিন্ড দেহ, এটি সেই বিরাট ব্রহ্মান্ডের  একটা ক্ষুদ্রাদিক্ষুদ্র সংস্করণ। বিরাট পুরুষের মধ্যে যেমন ভাঙা গড়ার খেলা চলছে, তেমনি এই ক্ষুদ্র  দেহের মধ্যেও  ভাঙা গড়ার খেলা চলছে।  এই রহস্যের উন্মোচন করাই জ্ঞান। যে বিশ্বশক্তির স্পন্দন হেতু এই ভাঙা গড়ার খেলা চলছে সেই শক্তিকে আমাদের  আয়ত্বে আনতে  হবে। যোগাচার্য্যগন অন্তর্মুখী হয়ে মানব সত্ত্বার এই রহস্যকে অবগত হবার জন্য সাধনা  করে থাকেন। এই সাধনার ফলেই অধ্যত্ম  জ্ঞানের উদয় হয়। আর সাধারণ মানুষ হয়ে ওঠেন মহামানব। মানব সভ্যতার মধ্যে রূপান্তরন ঘটে। 

আমরা যদি আমাদের এই তিন অবস্থাকে ভালোভাবে বুঝতে পারি, অর্থাৎ আমাদের বাস্তব জ্ঞান (জাগ্রত অবস্থা) স্বপ্নজ্ঞান (স্বপ্ন অবস্থা) ও স্থির অক্রিয় অবস্থার জ্ঞান (সুসুপ্তির অবস্থা),  একে  যদি আমরা সম্যক রূপে উপল্বদ্ধিতে আনতে  পারি,  তাহলে আমাদের স্থূল সূক্ষ্ম ও কারন শরীর  সম্পর্কে অবগত হতে পারি। তখন আমরা বুঝতে পারবো, এই যে আলাদা আলাদা ত্রিমাত্রা বা তিনটে অবস্থা, তা আসলে অজ্ঞানের অবস্থা। কিন্তু যখন ত্রিমাত্রাকে অতিক্রম করে আমরা যখন অখন্ড সত্ত্বায় পৌঁছতে পারি, তখন আমাদের তুরীয় অবস্থায় বিরাজ করতে পারি। যখন আমাদের মধ্যে এই ত্রিমাত্রার জ্ঞান হবে, তখন এর যে প্রভাব, অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ, তম - এই ত্রিগুণের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে আমরা আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারি। ওঙ্কারের সাধনা, প্রতীকের সাধনা হলেও, এই প্রতীক (শব্দ) যথার্থই ব্রহ্মস্বরূপ। যা আমাদের প্রকৃত সত্ত্বার, আত্মস্বরূপের  স্থূল অভিব্যক্তি। যখন আপনি এই ওঙ্কারের মধ্যে মন-প্রাণ দিয়ে প্রবেশ করবেন, তখনই এর সত্যতা উপল্বদ্ধিতে আসবে। প্রাচীন ভারতের মুনি-ঋষিদের এই আবিষ্কার বিষ্ময়কর। 
 
--- --------- 

"ঋগভিরেতং যজুৰ্ভিঃ অন্তরিক্ষং সামভিঃ যৎ তৎ কবয়ো বেদয়ন্তে । 
তম ওঙ্কারেণ এব  আয়তনেন অন্বেতি বিদ্বান তৎ যৎ শান্তম  অজরম  অমৃতম অভয়ং পরং চ ইতি।" (৫/০৭)

ঋক মন্ত্রের সাহায্যে এই (মনুষ্য) জগৎ, যজুর্মন্ত্রের সাহায্যে অন্তরীক্ষ লোক (চন্দ্রলোক) এবং সামমন্ত্রের  সাহায্যে সেই (ব্রহ্ম) লোক লাভ করেন, জ্ঞানীগণ এইরূপ জ্ঞাত হয়ে থাকেন। বিদ্বানব্যক্তি ওঙ্কাররূপ প্রতীকের ধ্যানের মধ্য দিয়ে, এই ত্রিবিধ লোকের জ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। আর এর ফলে তিনি শান্ত, জরাহীন, অমৃত ও নিৰ্ভয়পদ লাভ করে থাকেন। এবং পরমাত্মার সাথে একীভূত হয়ে যায়। 

ওঙ্কারের তিনটি মাত্রা।  সাধন পথেও এই তিনটি সিঁড়ি পেরুতে হয়।  প্রথম মাত্রায় আমাদের জাগতিক জ্ঞানের বৃদ্ধি  হবার কথা বলা হয়েছে।  মন ও বুদ্ধির দ্বারা আমরা যতটুকু জ্ঞান অৰ্জন করতে পারি, তাকেই ওঙ্কারের প্রথম মাত্রা বা ঋকবেদীয় জ্ঞান বলা  হচ্ছে। এই জ্ঞান সাধককে ইহজগতে সমৃদ্ধির জন্য লাভজনক করে দেয় । তো আমাদের যে সুপ্ত প্রতিভা, আমাদের যে সাধারণ বুদ্ধি তাকে বৃদ্ধি করে, আমরা ইহজগতে সহজেই সুখ সমৃদ্ধি করায়ত্ব করতে পারি। একেই বলে জাগ্রত অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান । 

এর পরে যজুর্বেদীয় জ্ঞান।  অর্থাৎ যজ্ঞাদির বিধি নির্দেশ সম্পর্কে জ্ঞান।  এই যজ্ঞাদি হচ্ছে ইহকাল ও পরকালের সমৃদ্ধির উপায় বিশেষ। আমাদের যেকোনো কাজে সাফল্য পেতে গেলে, সেই লক্ষ পূরণের জন্য উপায়গুলোর প্রতি গভীর মনোযোগী হতে হয়। এই উপায়গুলোর প্রতি যে যত  বেশি মনোযোগী হতে পারেন, তার জীবনে সাফল্যের মাত্রা তত বেশি হয়ে থাকে। প্রাণযজ্ঞের দ্বারা যেমন অন্তরীক্ষলোক জয় করা যায়, তেমনি মৃত্যুর পরে এই অন্তরীক্ষ লোকের ভোগসুখের অধিকারী হাওয়া যায় । ওঙ্কারের দ্বিতীয় মাত্রার ধ্যানে এই অন্তঃরীক্ষের জ্ঞান হয়। একেই বলে স্বপ্নাবস্থার জ্ঞান । 

এর পরে সাধকের মধ্যে যখন বিশুদ্ধ জ্ঞানের সঞ্চার হয়, তখন সাধকের চিত্ত নিষ্কাম হয়। একেই  বলে সামবেদীয়  জ্ঞান। জীবনের সমস্তক্ষেত্রে একটা সাম্যাবস্থা আসে। তখন না থাকে উদ্বিগ্নতা, না থাকে চঞ্চলতা, না থাকে ভয়ের বাতাবরণ।  তখন তার মধ্যে সুখ-দুঃখের অনুভূতির মধ্যে বিশেষ ফারাক লক্ষিত  হয় না।  এই অবস্থাকেই বলা হয়, ব্রহ্মলোকে বাস। এই অবস্থায় সে পুনর্জন্ম থেকে অব্যাহতি পেয়ে থাকে।  তখন তার মধ্যে একটা নিস্পৃহ ভাবের উদয় হয়। একেই সামবেদীয় জ্ঞান বা সুসুপ্তির অবস্থা বলে। 

প্রশ্ন উপনিষদ - শ্লোক নং ০৫/০৭

তো আমরা তিনটে লোক পেলাম, একটা হচ্ছে পৃথিবী বা ভূলোক, দ্বিতীয় হচ্ছে ভুবর্লোক, আর তৃতীয় হচ্ছে স্বর্লোক। কিন্তু আমরা আগে শুনেছিলাম, ৭টি লোক আছে। আসলে এই যে ব্রহ্মলোক বলা হলো, যা  সামবেদীয় জ্ঞানের ফলে লাভ হয়ে থাকে, এই ব্রহ্মলোককেই চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে,  মহঃ, জনঃ, তপঃ, সত্যম।  
জ্ঞানের প্রভাবে সাধক প্রথমে মহর্লোকে উপস্থিত হয়, এখান থেকে তাঁকে আর পৃথিবী লোকে ফিরে আসতে  হয় না। এখানে অজ্ঞানের প্রভাব থাকে না। এখান  থেকে ধীরে ধীরে অসীম বিশ্বশক্তির কৃপা লাভ হতে থাকে। সাধক এই ব্রহ্মলোকে অপর-ব্রহ্মের  সাথে নিজেকে অভিন্ন বোধ করেন । নিখিল বিশ্বের সাথে তিনি একাত্মতা অনুভব করেন। এই হচ্ছে ওঙ্কারের মধ্যে প্রবেশ। প্রণবের মধ্যে প্রবেশ। ওঙ্কারের সাধনা। তখন সাধক তুরীয় অবস্থা প্রাপ্ত হন।  এই তুরীয় অবস্থায় সাধক সমস্ত বন্ধনের  উর্দ্ধে নিজেকে বিস্তার করে দেন। তখন তাঁর আর আলাদা সত্ত্বা থাকে না। তিনি তখন বিশুদ্ধ চৈতন্যের সঙ্গে একাকার হয়ে যান। এই অবস্থাকে ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন "শান্তম  অজরম  অমৃতম অভয়ং পরং চ ইতি।" তিনি প্রশান্তিতে অবস্থান করেন, তাঁর না আছে জরা-ব্যাধি, না আছে মৃত্যু ভয়। সাধক তখন স্থির, অসীম, সমাহিত।  তখন আর কোনো কিছুই তাকে প্রভাবিত করতে পারে না। 

এই পরম অবস্থা লাভ করাই মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য। যা ওঙ্কারের সাধনা দ্বারা সহজেই প্রাপ্ত হওয়া যায়। ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, ওঙ্কারের সাধনায় পরম সত্যকে লাভ করা যায় - তুরীয় অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া যায়। 

প্রশ্ন উপনিষদের পঞ্চম প্রশ্নের সমাধান হলো। 
------------------------- 
প্রশ্ন উপনিষদ রহস্যঃ 
শশাঙ্ক শেখর শান্তি ধাম।
 
প্রশ্ন উপনিষদ - ষষ্ঠ প্রশ্ন 
শ্লোক নং : ০৬/০১

"অথ  হৈনং সুকেশা ভারদ্বাজঃ পপ্রচ্ছ।  ভগবন  হিরণ্যনাভঃ কৌসল্যো রাজপুত্রো মাম উপেত্যং প্রশ্নম পৃচ্ছত।  ষোড়শকলং ভারদ্বাজ পুরুষং বেথু । তমহং কুমারম অব্রুবম ন অহম ইমং বেদ । যদি অহম ইমম অবেদিষম কথং তে ন  অবক্ষ্যম ইতি। সমূলো  বা এষ পরিশুষ্যতি যঃ অনৃত্যম অভিবদতি তস্মাৎ ন অর্হামি অনৃতং বক্তুম । স তৃষ্ণীং রথম আরুহ্য প্রবব্রাজ । তং ত্বা পৃচ্ছামি  ক্বাসৌ পুরুষ ইতি। " - (০৬/০১)

 এর পরে ঋষি ভরদ্বাজ পুত্র তাঁকে (ঋষি পিপ্পলাদকে) প্রশ্ন করলেন। ভগবন, কোসল দেশীয় রাজপুত্র হিরণ্যনাভ একসময় আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস  করেছিলেন, হে ভরদ্বাজ পুত্র, ষোলোকলা বিশিষ্ট পুরুষকে কি আপনি জানেন ? আমি সেই কুমারকে বললাম, আমি এ বিষয়ে কিছু জানিনা।  যদি জানতাম তবে আপনাকে বলবো না কেন ? যে লোক মিথ্যে কথা বলে সে সমূলে বিনষ্ট হয়।  অতয়েব আমি মিথ্যে বলতে পারি না।  এই কথা শুনে তিনি  নীরবে রথে চড়ে চলে গেলেন । এখন আমি আপনাকে সেই বিষয়ে  প্রশ্ন করছি,  সেই পুরুষ কোথায় ?

এখানে একটা বিষয় খেয়াল করুন, সুকেশা সরাসরি ঋষি পিপ্পলাদকে প্রশ্ন করছেন না। তিনি যেন অন্যের কোনো প্রশ্নের বিষয় ঋষি পিপ্পলাদের কাছে তুলে ধরছেন। সুকেশা অধ্যাত্ম বিদ্যায় অগ্রণী ছিলেন। এবং তাঁর এই খ্যাতি নিশ্চয়ই চারিদিকে ছাড়িয়ে ছিলো।  তা না হলে, তাঁর কাছে রাজপুত্র রথে চেপে, তার কাছে আসতেন না। 

দ্বিতীয়তঃ তিনি (হিরণ্যনাভ) রথে চেপে এসেছিলেন, আবার সেই রথে চেপেই চলে গেলেন। যেন রাজপুত্র তাঁর রাজ্-অভিমান নিয়ে সুকেশাকে পরীক্ষা করতে এসেছিলেন। পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে, অধিক দম্ভের সঙ্গে সুকেশাকে পরিত্যাগ করে চলে গেলেন। 

তৃতীয়তঃ - উপনিষদ   বলছে, যিনি বলেন, তিনি ব্রহ্মকে জানেন না, তিনিই ব্রহ্মকে জানেন।  যিনি বলেন যে তিনি ব্রহ্মকে জানেন,  তিনি ব্রহ্মকে জানেন না। যারা বলেন  এই তত্ত্ব জানেন না, তাদেরই  এই তত্ত্ব জানা, যারা বলেন, তাঁরা জানেন, এ তত্ত্ব তাদের অজানা। 

"যস্য অমতম তস্য মতং মতং যস্য ন বেদ সঃ । 
অবিজ্ঞাতং  বিজানতাং  বিজ্ঞাতম বিজানতাম।  (কেন উপনিষদ - শ্লোক নং ০১/০৩)
 
একদিন মুক্তানন্দ গিরি মহারাজ বলেছিলেন, যা তুমি জানো না, তা তুমি বোলো না, আর যা তুমি জানো তা অনধিকারীকে বোলো না।    রাজপুত্র অনাধিকারী - তার আত্ম-অভিমান রয়েছে। তাই মাথা উঁচু করে এসেছিলেন, আবার মাথা উঁচু করেই চলে গেলেন। গুরুদেবের কাছে, শিক্ষকের কাছে, আচার্য্যের কাছে, মাথা নিচু করে যেতে হয়। রাজা জনক একদিন ঋষি অষ্টাবক্র মুনিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সত্য কি ? এখন যা দেখছি, সেটা সত্য, না স্বপ্নে যা দেখেছি, সেটা সত্য। ঠোঁটকাটা অষ্টাবক্র মুনি বলেছিলেন, তুমি রাজা, সিংহাসনে বসে আছো, আমি মাটিতে বসে আছি।  সত্য জানতে গেলে, আগে মাটিতে নেমে এসো।  চলো নির্জনে,  জঙ্গলে। আগে আমাকে গুরু হিসেবে বরণ  করো,  গুরু দক্ষিণার প্রতিশ্রুতি দাও। তার পরে প্রশ্ন করো। রাজর্ষি জনক তাই করেছিলেন। 

তো আমাদের মধ্যে জানবার আগ্রহ নেই, আছে কেবল বক্তাকে পরীক্ষা করবার প্রবণতা। তাই আমরা প্রশ্নের জবাব পাই না। জ্ঞান লাভে  ইচ্ছুক ব্যক্তির হৃদয়ে প্রশ্নের বান  যতক্ষন না বিদ্ধ হচ্ছে, যতক্ষন না হৃদয় থেকে রক্ত ঝরছে, যতক্ষন না মনের মধ্যে আকুলিবিকুলি তৈরী হচ্ছে, ততক্ষন  আমরা প্রশ্নের জবাব পেতে পারি  না। আদর্শ গুরু পথ দেখান আদর্শ শিষ্যকে। যারা জানে না, তারা অনেক কথা বলে, যারা জানতে চায়, তারা কথা কম বলে, চিন্তা করে বেশী। 
যাইহোক, সুকেশার মধ্যে প্রশ্ন জেগেছে। সারা প্রশ্ন-উপনিষদে এতদিন যাকিছু শুনলাম, তা আসলে বাহ্য। এতক্ষন আমরা কেবল  উপাধি সম্পর্কে শুনেছি। আমরা জাগ্রত অবস্থার কথা শুনেছি, আমরা স্বপ্নাবস্থার কথা শুনেছি, আমরা সুসুপ্তির কথা শুনেছি। কিন্তু এই সবকিছুর আশ্রয়দাতা যিনি, সেই পরমাত্মা সম্পর্কে আমরা কিছুই শুনিনি। এই পরমাত্মা শুধু উৎস নন, তিনি নিজেকেই  সবকিছুর মধ্যে প্রকাশ করছেন। পরমাত্মা থেকে সব কিছু আসছে, আবার সেই পরমাত্মার মধ্যে সব কিছু ফিরে যাচ্ছে। কারণের যিনি কারন সেই পরমাত্মা সম্পর্কে জানতে গেলে, আমাদের মন-বুদ্ধিই যথেষ্ট নয়, দরকার গুরুকৃপা। যতক্ষন গুরুদেব সদয় না হন, ততক্ষন তিনি অধরা থাকেন। আর আমরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের জ্বালে আটকে থাকি। 

প্রশ্ন উপনিষদ শ্লোক নং ০৬/১-০৩

শিষ্য সুকেশা  গুরু পিপ্পলাদকে প্রশ্ন করছেন, ষোলোকলা বিশিষ্ঠ সেই পুরুষ কোথায় ? ষোলো কলা ব্যাপারটা কি ? কলা কথাটার অর্থ বিদ্যা। আবার অগ্নির শিখাকে বলে কলা। অর্থাৎ জ্যোতির্বিন্দু।   আমরা জানি ষোলো আনায় এক টাকা। এক হচ্ছে পূর্ন  সংখ্যা। পুরুষ কথাটা এখানে আত্মাকে বোঝানোর জন্য বলা হয়েছে। তো অনন্ত-অনন্ত-অনন্ত গুনের যিনি অধিকারী, সেই অনন্ত জ্যোতির্ময় পুরুষ  কোথায়  ? অর্থাৎ পূর্নপুরুষ সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন কি জানেন না, প্রশ্নটা  এমন নয়, প্রশ্নটা হচ্ছে তিনি কোথায় ? অর্থাৎ আমার দৃঢ়   বিশ্বাস, যে এই পূর্নপুরুষ সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত জ্ঞাত আছেন, এখন দয়া  করে তাঁর সন্ধান দিন, তিনি কোথায় ? "তং ত্বা পৃচ্ছামি  ক্বাসৌ পুরুষ" ? তাই প্রশ্ন করছি, সেই পূর্নপুরুষ কোথায় ? ঋষি পিপ্পলাদ এবার মোক্ষম প্রশ্নের সম্মুখীন। এর পরে আমরা তার  শ্রীমুখ থেকে, অমোঘ প্রশ্নের জবাব শুনবো।  
-------------

"তস্মৈ স হোবাচ। ইহ  এব অন্তঃ শরীরে সৌম্য স পুরুষো যস্মিন এতাঃ ষোড়োশকলাঃ প্রভবন্তি ইতি ।" (প্রঃ ০৬/০২)

তিনি (ঋষি পিপ্পলাদ) তাঁকে (সুকেশাকে) বললেন, হে সৌম্য এখানে (দেহের মধ্যে) অন্তঃশরীরে (হৃদয় আকাশে) সেই পুরুষ (পরমাত্মা) আছেন। যাতে এই ষোড়শকলা প্রভাব বিস্তার  করে আছে। 

পুরুষ কথাটার  অর্থ যিনি অন্যের অভাব পূরণ করেন। আবার পুর কথার অর্থ শরীর - যিনি এই এই শরীররূপ নগর বা পুরে  বাস করেন, তিনি পুরুষ। অর্থাৎ দেহী বা আত্মা। তো দেহের মাঝে যিনি দেহীরূপে, শরীরের মধ্যে যিনি চৈতন্যরূপে বিরাজ করছেন তাঁকে বলা হয় পুরুষ। 
কেউ কেউ বলে থাকেন, এটি একটি বিশেষ শক্তি, যা কেবলমাত্র এই শরীরকে আশ্রয় করেই  থাকেন। তাঁরা বলে থাকেন  এই যে চৈতন্য এটি চারভুতের ক্রিয়ার ফল। অর্থাৎ অসীম আকাশের মধ্যে  ক্ষিতি, অপ , তেজ, মরুৎ এই চার ভূতের মিশ্রনের ফলে বা বলা যেতে পারে, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এই চারটি গুনের মিশ্রনের ফলে একটা নতুন গুনের উৎপন্ন  হয়েছে - একেই বলে চৈতন্য। সুতরাং পুরুষ বা চৈতন্য দেহাতিরিক্ত কিছু নয়। দেহের নাশের সঙ্গে সঙ্গে এই পুরুষের বিলোপ সাধন হয়। এক মহাশূন্যের মাঝে এই চেতনার বিলুপ্তি হয়। শূন্য থেকে এই জগৎ সৃষ্টি হয়েছে, আবার এই শূন্যের মাঝে এই জীবশক্তি, জড়শক্তি, সবই লয় প্রাপ্ত হয়। 

আবার কেউ বলেন, এই যে প্রকৃতি ইনি ত্রিগুণময়ী। সত্ত্ব রজঃ তমঃ এই তিনটে গুনের মধ্যে যখন স্পন্দন বা বিক্ষোভ তৈরী হয়, তখন এই এই বৈচিত্রময় জগৎ উদ্ভাসিত হয়। এই যে চেতন বা পুরুষ ইনি  উদাসীন, নিরপেক্ষ, এবং অসংখ্য। অগ্নি থেকে যেমন অসংখ্য স্ফুলিঙ্গ নির্গত হয়, সূর্য থেকে যেমন অসংখ্য রশ্মি নির্গত হয়, তেমনি মহাজাগতিক শক্তি থেকে এই চেতনার স্ফূরণ হচ্ছে। 

উপনিষদ কিন্তু এইসব কথার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করে থাকেন।  উপনিষদের ঋষিগণ বলে থাকেন, অখন্ড আত্মা প্রাণরূপ দর্পনের মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে, জীবদেহে ভিন্ন ভিন্ন নাম-রূপের সৃষ্টি করেছে। মুলে এই আত্মা প্রথমে মায়াযুক্ত হয়ে, তারপর প্রাণযুক্ত হয়ে, ষোড়শকলা উৎপন্ন করছে। তাই উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, যেকোনো শরীরের মুলে আছেন সেই চেতনা। পুরুষ হচ্ছেন, বীজস্বরূপ যা থেকে এই ষোলোকলা বিশিষ্ঠ এই দৃশ্যমান জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। নির্গুন ব্রহ্মই এই ষোলোকলা বিশিষ্ঠ  সগুন ব্রহ্ম।  ব্রহ্ম-এর উপাধিগুলোকে বলা হয় কলা। এই কলাই জগতেরপ্রকাশিত ব্রহ্মকে গুনগত  ভিন্নতার সৃষ্টি করেছে। ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, হ হৈব  অন্তঃশরীরে।  অর্থাৎ এই শরীরের মধ্যেই তিনি আছেন। নিস্কলের  মধ্যে  যখন মায়ার স্পন্দন প্রভাব বিস্তার করে, তখন এই কলার যেমন প্রাণ ইত্যাদির সৃষ্টি হয়। তো কলা হচ্ছে বৃক্ষ (জগৎ) আর পুরুষ হলেন বীজ। এই বীজরূপ পুরুষ আমাদের শরীরের ভিতরে হৃদাকাশে বিরাজ করছেন। 
--------------

"স ইক্ষাং চক্রে।  কস্মিন অহম উৎক্রান্ত উৎক্রান্তো ভবিষ্যামি কস্মিন বা প্রতিষ্ঠিতে প্রতিষ্ঠাস্যামি ইতি ।"  (প্রঃ ০৬/০৩)

সেই (ষোলোকলা বিশিষ্ঠ) পুরুষ চিন্তা করলেন, কে শরীর ত্যাগ করেন, যারজন্য আমি শরীর  ত্যাগ করি ?  কে থাকেন, যারজন্য আমি থাকবো ? 

এই যে ষোলোকলা বিশিষ্ঠ পুরুষ ইনি ভাবছেন, কার উৎক্রান্তে আমাকেও উৎক্রান্ত হতে হয়, আবার কার কারণেই বা আমি এই শরীরের মধ্যে থাকি। তার মানে ষোলোকলা পুরুষ ছাড়াও আরো কেউ আছেন, যার কারনে এই ষোলোকলা পুরুষের আগমন ও নিষ্ক্রমন ঘটে থাকে। আসলে পুরুষ যখন কলারূপ উপাধিযুক্ত নন, তখন তিনি নিস্কল, নির্গুণ । আর যখনই  তিনি কলাযুক্ত হলেন, তখন তিনি সগুন বা কলাযুক্ত পুরুষ । আমরা উপনিষদে সেই বিখ্যাত রূপক গল্পের কথা শুনেছি, গাছে দুটো পাখি, একটি নিষ্ক্রিয়, দ্রষ্টা স্বরূপ।  আর একটি ভোক্তা, গাছের ফল ভোগ করছেন। তো একজন যিনি না ভোক্তা না কর্ত্তা। আর একজন ভোক্তা এবং কর্ত্তা। একজন পরমাত্মা আর একজন  জীবাত্মা। এই জীবাত্মাকেই বলা হচ্ছে ষোলোকলা বিশিষ্ঠ পুরুষ। 

এখন এই পরমাত্মা রূপ পুরুষ নিজেকে প্রকাশ করেন কিভাবে ? তিনি কিভাবেই বা এই কলা, দেহ এবং অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন ? এখানে ঋষি পিপ্পলাদবলছেন, "স ইক্ষাং চক্রে" - তিনি দেখলেন, বা চিন্তা করলেন। এই চিন্তার সাহায্যেই তিনি নিজের মধ্যে সবকিছুকে প্রকাশ করতে লাগলেন। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে আমাদের শরীর  ছেড়ে চলে গেলে আমাদের মনে হয়, আমিও দেহত্যাগ করলাম। আবার কার কারণেই বা আমি শরীরে ছিলাম ? 
---------------------- 

প্রশ্ন উপনিষদ : শ্লোক নং ০৬/০৪

"সঃ প্রাণম অসৃজত প্রাণাৎ শ্রদ্ধাম খং বায়ুঃ জ্যোতিঃ আপঃ পৃথিবী ইন্দ্রিয়ম মনঃ। অন্নম  অন্নাৎ বীর্যম তপো  মন্ত্রাঃ কর্ম লোকা  লোকেষু চ নাম চ।" (প্রঃ ০৬/০৪)

সেই পুরুষ (সগুন ব্রাহ্ম) প্রাণাত্মাকে সৃষ্টি  করলেন, প্রাণ থেকে সৃষ্টি হলো শ্রদ্ধা (জ্ঞান) . এরপর আকাশ (খং), বায়ু, তেজ, জল, পৃথিবী, ইন্দ্রিয় ও মন এবং অন্ন।  অন্ন থেকে ক্রমে বীর্য।  বীর্য বা বল থেকে তপস্যা মন্ত্র (ঋক সাম  যজুঃ অথর্ব) কর্ম, লোক (স্বর্গ, মর্ত, পাতাল) . এবার লোক সমূহে বিভিন্ন নাম ও পদ এলো (সৃষ্টি হলো) . 

প্রশ্ন ছিলো, কে আমাদের শরীর  ছেড়ে চলে গেলে আমাদের মনে হয়, আমিও দেহত্যাগ করলাম। আবার কার কারণেই বা আমি শরীরে ছিলাম ? উত্তর হচ্ছে এই কলা বা প্রাণাদি। 

এবারের শ্লোকে ঋষি পিপ্পলাদ ষোড়শকলা সম্পর্কে বলছেন। এগুলো হচ্ছে - ১. প্রাণ, ২. শ্রদ্ধা ৩. আকাশ, ৪. বায়ু, ৫. তেজ, ৬. জল, ৭, পৃথিবী, ৮. ইন্দ্রিয়, ৯. মন ১০. অন্ন, ১১. বীর্য, ১২. তপস্যা, ১৩. মন্ত্র  ১৪. কর্ম, ১৫. লোক, ১৬. নাম ।  

তো সেই পুরুষ চিন্তা করলেন, কে দেহথেকে উৎক্রমন করলে, আমি উত্ক্রান্ত হবো, আবার কে প্রতিষ্ঠিত হলে আমিও দেহে অবস্থিত থাকবো ? এর উত্তর  হচ্ছে প্রাণ ইত্যাদি।  এই যে প্রাণ ইত্যাদি এগুলো হচ্ছে ষোলোটি কলা। 
এইজন্য তিনি প্রথমে প্রাণকে সৃষ্টি  করলেন। প্রাণ থেকে শ্রদ্ধা অর্থাৎ জ্ঞান। যা থেকে আমাদের "আমি" এই বোধের উৎপত্তি হয়। বিশ্বশক্তির মধ্যে এই অহং-বোধ থেকে ইচ্ছে, আর ইচ্ছে থেকে এই সৃষ্টি। আমাদের মধ্যেও  এই জ্ঞান বা আস্তিক্য বুদ্ধি আছে।  আর এর ফলেই আমার মতো এই ক্ষুদ্র সত্ত্বার মধ্যে  অখন্ড সত্ত্বার স্পর্শ অনুভব করি। এই ক্ষুদ্র আমার মাঝেই সেই বিরাট পুরুষের অবস্থান। এই শ্রদ্ধা (জ্ঞান) আছে বলেই মানুষ জ্ঞান ও কর্ম্ম পথে নিজেকে পরিচালিত করে। সুতরাং নিস্কল (কলাহীন) পুরুষ ও তার শক্তিরূপ প্রাণ ও শ্রদ্ধা এই তিনটি হচ্ছে সৃষ্টির মূল। এবার এই অহংবোধ জ্ঞান (শ্রদ্ধা) বিধাতার মধ্যে বাসনার উদ্রেগ ক'রে পঞ্চভূতের (অপঞ্চীকৃত পঞ্চভূতের) সৃষ্টি করেন। যথাক্রমে সেগুলো হচ্ছে, আকাশ, বায়ু, জ্যোতিঃ, জল ও পৃথিবী। এই পঞ্চভূতকে আশ্রয় করে তৈরী হলো জীবদেহ। তো দেহ উৎপত্তির কারন এই ৭টি  অর্থাৎ প্রাণ, শ্রদ্ধা, ও পঞ্চ মহাভূত। প্রথম প্রাণীকে যদি আমরা আমিবা নামে  ডাকি তবে বলতে হয়, তার উৎপত্তি এই ৭ তত্ত্ব থেকে। এর পরে ইন্দ্রিয়, মন। আমিবার মধ্যেও এই ইন্দ্রিয়শক্তি লক্ষিত হয়, কিন্তু আমিবার মন বলে কিছু হয়তো কিছু থাকে না। সে যাই হোক,  এখন এই প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য দরকার অন্ন। এই অন্নই বল প্রদান করে থাকে। এই অন্ন প্রাণশক্তিকে জাগিয়ে রাখে। আবার অন্ন দ্বারাই জীব বীর্যবান হয়ে ওঠে। এই বীর্য হচ্ছে প্রাণশক্তির উচ্ছাস। এই বীর্য একসময় দেহ ছাপিয়ে উপচে পড়ে এবং নতুন দেহের সৃষ্টি করে। কিন্তু প্রাণের এই যে উপচে পড়া, একে  বলা হয়, অশুদ্ধ প্রাণশক্তি। এই অশুদ্ধ প্রাণশক্তি যখন সংহত হয়, তখন  তাকে বলে তপস্যা বা তপঃশক্তি। এই তপঃশক্তি আবার মন্ত্রের জন্ম দেয়, যা জীবকে উদ্ধার কার্য্যে সাহায্য করে থাকে। মন্ত্র অর্থাৎ মনন করা। এই মননের ফলে জীব একসময় বুঝতে পারে, যে সে প্রকৃতির দ্বারা  অভিভূত হয়েছে।  আবার সে এই অভিভূত অবস্থা থেকে উদ্ধ্বার পাবার প্রচেষ্টা শুরু করে, একেই বলে কর্ম্ম।  সে তখন একটা কর্ম্মলোকের সৃষ্টি করে। এই কর্ম্মলোকই আমাদের ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য জগৎ। এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ নাম ও রূপের দ্বারা আচ্ছাদিত। এই নাম ও রূপের জন্যই জগতে ভিন্নতা পরিদর্শিত হচ্ছে। 

সেই বিরাট  পুরুষ যিনি সমগ্র সৃষ্টিকে ধারণ করে আছেন।  জগতের সমস্ত কিছুই অর্থাৎ প্রাণ থেকে শুরু করে নাম পর্যন্ত এগুলো সবই তাঁরই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। আর এই কারণেই তাঁকে  বলা হচ্ছে ষোড়শকলা যুক্ত পুরুষ। অতয়েব নির্গুণ, নিস্কল পুরুষ থেকেই এই ষোলোকলা এসেছে যা পুরুষ থেকে পৃথক নয়। এইভাবেই সেই পরমপুরুষ নিজেকে প্রকাশ করছেন। 
-------------- 
প্রশ্ন উপনিষদ শ্লোক ০৬/০৫

স যথা ইমাঃ  নদ্যঃ স্যন্দমানাঃ সমুদ্রায়ণাঃ সমুদ্রং প্রাপ্য অন্তং   গচ্ছন্তি ভিদ্যেতে তাসাং নামরূপে সমুদ্র ইত্যেবং প্রচ্যতে। এবম এব অস্য  পরিদ্রষ্টুঃ ইমাঃ ষোড়শকলাঃ পুরুষায়ণাঃ পুরুষং প্রাপ্য অন্তং গচ্ছন্তি, ভিদ্যতে চ আসাং নামরূপে পুরুষ ইতি এবং প্রচ্যতে স এষঃ অকলঃ অমৃতঃ ভবতি তদেষ শ্লোকঃ। (প্রঃ - ০৬/০৫)

নদী যখন সমুদ্রে উপস্থিত হয়, তখন নদী অদৃশ্য হয়ে যায়। নদী বা তার নাম-রূপ বিনষ্ট হয়ে যায়। তখন নদী সমুদ্র নামেই নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। ঠিক তেমনি ষোড়শকলা বিশিষ্ট পুরুষ যখন নিস্কল পুরুষের সঙ্গে মিলিত হন, তখন নাম-রূপ বিনষ্ট হয়। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি (কলাযুক্ত) যখন নিজেকে জানতে পারেন, তখন তিনি সমস্ত  উপাধি বর্জিত নিস্কল পুরুষ হয়ে যান। সেই আত্মজ্ঞানী  ব্যক্তি নিজেই নির্গুণ ব্রহ্মস্বরূপ হয়ে অমরত্ব লাভ করেন।  এ বিষয়ে একটা শ্লোক আছে। 

এর আগে আমরা ষোলোকলা সম্পর্কে শুনেছি। এই ষোলোকলা হচ্ছে সেই নির্গুণ ব্রহ্মেের ভিন্ন ভিন্ন ভাব বা শক্তি। ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, নদী যখন সমুদ্রে মিশে যায়, তখন  নিজস্ব পরিচয়, রূপ ইত্যাদি থাকে না। এটা আমরা বুঝি যে এই সমুদ্র থেকে একদিন জল, মেঘ হয়ে আকাশে গিয়েছিলো, আকাশে একদিন জ্বলীয়  বাষ্প, মেঘ হয়ে ঘনীভূত হয়েছিল ।  আবার একদিন এই মেঘ, বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীতে নেমে এসেছিলো।  জল একদিন পাহাড় থেকে নদীর রূপ নিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করেছিল। একদিন এই নদী সমুদ্রের মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়েছিলো। এই বাস্তব সত্য আমাদের সবার কাছেই অভিজ্ঞতা লব্ধ।  এর মধ্যে আমরা কোনো তর্কের জায়গা দেখি না। কিন্তু পরম পুরুষ এই ষোলোকলা যুক্ত হয়ে সৃষ্টিতে অভিব্যক্ত হয়েছে, এই ব্যাপারটা আমাদের মাথার মধ্যে ঠিকমতো না ঢুকলেও, আমরা তর্কের খাতিরে মেনে নিতে পারি। যদিও এটি আমাদের উপল্বদ্ধিতে আসে না। প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন,  কোনো ব্যক্তি যখন এই ব্যাপারটা সম্যক  রূপে জানতে পারেন, অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যখন এই কলাযুক্ত পুরুষকে জানতে পারেন, অর্থাৎ নিজেকে জানতে পারেন, তখন তিনি সমস্ত উপাধি বর্জ্জিত সেই নিস্কল পুরুষ হয়ে যান। এবং তিনি অমরত্ব  লাভ করেন। এই ঋষিবাক্যের মধ্যে সত্য কোথায় আছে ?

দেখুন কোনো কিছু জানলে, আমার সেই বিষয়ে জ্ঞান হবে, এ কথা সত্য। ইতিহাসকে জানলে, বিজ্ঞানকে জানলে, আমি বৈজ্ঞানিক বা ঐতিহাসিক হতে পারবো। কিন্তু ঐযে ঐতিহাসিক চরিত্র, তার সঙ্গে আমার পার্থক্য থাকবে। আমি আর ওই ঐতিহাসিক চরিত্র এক হয়ে যাবো না। ঠিক তেমনি কোনো ব্যক্তিকে জানলে, তার বিষয়ে আপনার জ্ঞান হবে একথা সত্য।  কিন্তু আপনি তখন সেই ব্যক্তির সঙ্গে এক  হয়ে যাবেন, এমনটা সত্য নয়। আপনার ও  আপনার জ্ঞাত বিষয় বা ব্যক্তির  মধ্যে পার্থক্য কিন্তু ঘুচবে না। ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, এই পার্থক্য ঘুচে যাবে, সাধারণ জ্ঞান আর ব্রহ্মজ্ঞানের মধ্যে এখানেই পার্থক্য।  আপনি যখন ব্রহ্ম বিষয়ে সম্পূর্ণ রূপে জ্ঞাত হবেন, তখন আপনি স্বয়ং ব্রহ্ম  হয়ে যাবেন । এই ব্যাপারটা আমরা একটু  বুঝবার চেষ্টা করবো। 

আপনারা সেই ভেড়ার পাল  ও বাঘের বাচ্চার গল্পটা শুনে থাকবেন। এক বাঘিনী শিকারির আঘাতে আহত হয়ে, গর্ভপাত ক'রে, অর্থাৎ একটা বাচ্চার জন্ম দিয়ে,  সেখানেই মারা যায়। বাঘের বাচ্চা মায়ের কাছে ঘুরঘুর করতে থাকে। এইসময় এক রাখাল বালক, ভেড়া চড়াতে এসে, সেই বাঘের বাচ্চাটিকে দেখতে পায়।  এবং বাচ্চাটিকে নিয়ে সে তার ভেড়ার  পালের সঙ্গে লালন পালন করতে থাকে। প্রতিদিন যখন সে ভেড়ার পালকে চড়াতে নিয়ে যায়, বাঘের বাচ্চাটিকেও সঙ্গে করে নিয়ে যায়। দিন দিন বাঘের বাচ্চা, ভেড়ার বাচ্চাদের সাথে বড়ো  হতে থাকে। একদিন ভেড়ার পালে বাঘের আক্রমন হলো। আর ওই বাঘের বাচ্চাটিকে বাঘ ভেড়া ভেবে ধরে ফেললো। কিন্তু সে ভালো করে তার দিকে তাকালো, তখন সে বুঝতে পারলো, এই বাচ্চাটি ভেড়া নয়, সে বাঘ। বাঘের বাচ্চাটি কিন্তু ভেড়াদের  সাথে মিশে মিশে নিজেকে ভেড়াই  ভাবতো।  বাঘকে সে ভয় পেতো।  ভেড়ার মতো ঘাস-পাতা খেত, ভেড়াদের  মতোই ভ্যা ভ্যা করে ডাকতো। বাঘ তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলো, যে সে ভেড়া নয়, সে বাঘের বাচ্চা। বাঘ তাকে মাংসের টুকরো এনে  দিতে লাগলো খাবার জন্য।  প্রথম দিকে ভেড়াটি সেই মাংসের টুকরো মুখে দিতো না। কিন্তু ধীরে ধীরে সে সেই মাংসের স্বাদ নিতে শিখলো। বাঘটি একদিন এক পাতকুয়োর কাছে নিয়ে গিয়ে জলের আয়নায় তার ছবি দেখিয়ে তাকে বোঝাতে লাগলো, যে সে আসলে   ভেড়া নয়, সে বাঘ। নিজের ছবি  জলের আয়নায় দেখে, আর বাঘের দিকে তাকিয়ে, মেলাতে লাগলো। যখন বুঝলো, তার চেহারা আর বাঘের চেহারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, তখন সে নিজেকে বাঘ ভাবতে লাগলো। একসময়  সেই ভেড়ার বাচ্চা বাঘের মতো হুঙ্কার দিতে শুরু করলো। ভেড়া এবার  বাঘে  রূপান্তরিত হলো। সে তখন নিজেকে চিনে নিয়েছে। তো ঋষি পিপ্পলাদ বলতে চাইছেন, আমরা আমাদের স্বরূপ ভুলে গেছি।  যেদিন আমাদের আত্মজ্ঞান হবে, সেদিন আমরা স্বয়ং ব্রহ্ম হয়ে যাবো। আসলে আমরা কেউ ব্রহ্ম হবো, ব্যাপরটা এমন নয়, আমরা সবাই আসলেই সেই  ব্রহ্ম। আমাদের মূল সত্ত্বা সেই ব্রহ্ম। 

আরো একটি ছোট্ট গল্প বলি। এক রাজা যখন জঙ্গলের পথ দিয়ে পরিবার নিয়ে আসছিলো, তখন একদল ডাকাতের পাল্লায় পড়ে ।  ডাকাতরা তার ধন-দৌলতের সঙ্গে তার তিন বছরের ছোট্ট ছেলেটিকেও হরণ  করে নিয়ে যায়। সেই থেকে ছোট্ট ছেলেটি ওই  জঙ্গলের মধ্যে ডাকাতদের সঙ্গে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে। 

এখন রাজার চরেরা ওই জঙ্গলে ঘুরতে শুরু করে। দীর্ঘ বারো বৎসর পরে, একদিন ওই ডাকাতের দলের কিছু লোক রাজার সৈন্যদের হাতে ধরা পরে। তাদের সবাইকে ধরে রাজার কাছে বিচারের জন্য পেশ করা হয়। মন্ত্রী মহাশয়, ওই জঙ্গল থেকে আনা ডাকাতদের দিকে তাকিয়ে দেখেন, রাজার মতো দেখতে এক কিশোর ওই ডাকাতের দলে।  প্রথমে সন্দেহ, পরে তিনি নিশ্চিত হন, যে এই সেই রাজার ছেলে যে বারো বৎসর আগে ডাকাতদের হাতে পড়েছিল। এই সেই রাজার ছেলে, যাকে  ডাকাতরা ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। রাজাকে এই সংবাদ দিতেই, ছেলেটিকে ডাকাতদের থেকে  আলাদা করা হলো। ছেলেটি কিন্তু নিজেকে ডাকাত বলেই  ভাবতো। কিন্তু মন্ত্রী মহাশয় ও অন্যান্য পরিষদের কথায়, কিশোরের মধ্যে পুরোনো স্মৃতি ভেসে উঠলে লাগলো।  এবং নিজেকে রাজার ছেলে বলে ভাবতে শিখলো। 

তো কখোন আমাদের পুরোনো স্মৃতি জেগে উঠবে তা আমরা জানি না।  আমাদের যে কখন  স্বরূপের জ্ঞান হবে তা আমরা জানিনা। আমাদের যে কখন, কার কথায় পুরোনো স্মৃতি ভেসে উঠবে, তা আমরা জানি না। তবে সত্য হচ্ছে, আমরা সবাই একই পিতামাতার সন্তান। আমরা সবাই এক। যাঁরা ধ্যানের গভীরতায়  আত্মচেতনার সঙ্গে ব্রহ্ম চেতনার অনুভব করেন, তাঁরা ঋষি পিপ্পলাদের এই কথার যথার্থতা  অনুভব করতে পারেন। 

--------------------------------  
 
প্রশ্ন উপনিষদ - শ্লোক ৬/০৬-০৮

"অরা ইব রথনাভৌ কলা যস্মিন প্রতিষ্ঠিতাঃ।  তং  বেদ্যং পুরুষং বেদ যথা মা বো মৃত্যুঃ পরিব্যাথা ইতি। "  (প্রো - ০৬/০৬) 

রথচক্রের নাভিতে (চাকার মধ্যবিন্দুতে) এর শলাকাগুলো গ্রথিত থাকে। সেই পুরুষকে জানো, যাঁর  মধ্যে  কলাগুলো গ্রথিত থাকে। তাহলে মৃত্যু তোমাকে ব্যথিত করতে পারবে  না। 

ঋষি  পিপ্পলাদ আবার একটি  উপমার সাহায্যে  জ্ঞাতব্য বিষয়ের নির্দেশ করছেন। বলছেন, রথের  যে চাকা, তার মধ্যে আছে বহু শলাকা।  এই শলাকাগুলোর একটা কেন্দ্রবিন্দু আছে - যাকে হৃষি বলছেন,  নাভি। অর্থাৎ চাকার এই শলাকাগুলো এই কেন্দ্র বিন্দুর থেকে এসেছে, আবার এই কেন্দ্রবিদুর উপরেই  শলাকাগুলো  আশ্রিত। ঠিক তেমনি ব্রহ্মের যে কলা তার কেন্দ্র বিন্দুতে আছেন নিস্কল ব্রহ্ম। আর এই নিস্কল ব্রহ্মকে আশ্রয় করেই সকল ব্রহ্ম (সগুন ব্রহ্ম বা কলাযুক্ত ব্রহ্ম) অভিব্যক্ত হচ্ছে। "তং বেদ্যং পুরুষম" সেই পুরুষকে জানতে হবে। সেই পরমাত্মাকে জানতে হবে। ঋষি বলছেন, এটা উপলব্ধি করো যে তুমিই সেই পুরুষ, তুমিই সেই আত্মা, তুমিই ব্রহ্ম। আর এই পুরুষ জন্ম-মৃত্যু রহিত। তো তুমি যখন উপলব্ধি করবে, যে তুমি সেই নিত্য শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত আত্মা, তখন আর তোমার মধ্যে মৃত্যু ভয় থাকবে না। তখন ,উপল্বদ্ধিতে আসবে, যে তুমি অমৃতের সন্তান, তুমি অমৃতময়। 
---------------

"তান হ উবাচ এতাবৎ এব অহম এতৎ  পরং ব্রহ্ম বেদ। ন অতঃ পরম অস্তি ইতি ।" (০৬/০৭)

তিনি (পিপ্পলাদ) বললেন, আমি এই পর্যন্ত পরব্রহ্ম বিষয়ে জানি।  তাঁর সম্পর্কে এর অতিরিক্ত আর কিছুই  জানবার নেই। 

প্রশ্ন উপনিষদে একের পর এক ছটি প্রশ্ন ও তার উত্তর আমরা শুনলাম।  প্রশ্ন ও উত্তরগুলো গুলো এইরকম
 
১. এই প্রাণীরা কোথা থেকে আসে ? - প্রাণী প্রজাপতি ব্রহ্মা  থেকে আসে।
 
২. প্রাণীর দেহে স্থিত ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে  কোনটা দেহেকে ধারন করে থাকে ? - প্রাণ। 
 
৩. প্রাণ কোথা থেকে আসে - শরীরে কিভাবে প্রবেশ করে -কিভাবে দেহের মধ্যে ছড়িয়ে যায় -কিভাবে  প্রাণ কাজ করে - কিভাবেই বা শরীর  ছেড়ে বেরিয়ে যান ? 
প্রাণ পরমাত্মা থেকে আসে। প্রাণ আত্মার বিকার বিশেষ। আর বাসনা  পূরণের জন্য, প্রাণরূপী আত্মা উপযুক্ত শরীরে নিজেকে স্থাপন করেন। নিজেকে পাঁচভাগে ভাগ করে (প্রাণ, অপান , ব্যান, উদান , ও সমান) বিশেষ বিশেষ  কার্য সম্পাদনের জন্য নিয়োগ করেন। এই প্রাণের উপস্থিতিতেই  স্থূল জড় দেহ চৈতন্যবৎ বোধ হচ্ছে। প্রাণের উৎক্রমনে উদান বায়ু বিশেষ ভূমিকা পালন করে। 

 ৪. মানুষের ইন্দ্রিয়সকল -  কখন ঘুমায়, কেই বা জেগে থাকে ?  সুসুপ্তিতে ইন্দ্রিসকল ঘুমায়। - এই পুরে (দেহে) অগ্নি স্থানীয় প্রাণ-ই সব সময় জেগে থাকে।

 ৫. ওম-কে ধ্যান করলে কি লাভ হয় ? - ওঙ্কারের ধ্যান করলে,  সত্ত্ব, রজঃ, তম - এই ত্রিগুণের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে আমরা আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারি। 

 ৬.  মৃত্যুর সময় আমাদের দেহ ছেড়ে কে বেরিয়ে যায় ? প্রাণ জীবাত্মাকে সঙ্গে নিয়ে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। 

সবশেষে বললেন, সেই বিরাট  পুরুষ, পরমাত্মা  সমগ্র সৃষ্টিকে ধারণ করে আছেন।  জগতের সমস্ত কিছুই অর্থাৎ প্রাণ থেকে শুরু করে নাম পর্যন্ত এগুলো সবই তাঁরই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। আর এই কারণেই তাঁকে  বলা হচ্ছে ষোড়শকলা যুক্ত পুরুষ। অতয়েব নির্গুণ, নিস্কল পুরুষ থেকেই এই ষোলোকলা এসেছে যা পরমপুরুষ থেকে পৃথক নয়। এইভাবেই সেই পরমপুরুষ নিজেকে প্রকাশ করছেন।

একথা বলে ঋষি পিপ্পলাদ শিষ্যদেরকে বললেন, এই হলো পরমতত্ত্ব।  এর চেয়ে বেশিকিছু আমি জানিও না, আর জানবারও কিছু নেই। 
-------
"তে তম অর্চয়ন্ত ত্বং হি নঃ পিতা যঃ অস্মাকম অবিদ্যায়াঃ পরং পারং তার‍য়সি ইতি । নমঃ পরম ঋষিভ্যো নমঃ পরম ঋষিভ্যঃ ।"  (০৬/০৮)  

এবার তাঁরা (ওই শিষ্যগণ) তাঁকে (ঋষি পিপ্পলাদকে) অর্চনা করে বলতে লাগলেন, আপনিই আমাদের পিতা, কারন আপনিই আমাদের অবিদ্যার পরপারে নিয়ে গেলেন। মহান ঋষিদের পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি। 

আত্মজ্ঞানই সর্বোচ্চ জ্ঞান। অর্থের বিনিময়ে এই বিদ্যা অৰ্জন করা যায় না। একমাত্র ব্রহ্মজ্ঞানী গুরুদেবের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা, ও গুরুকৃপা দ্বারা এই জ্ঞান অৰ্জন করা যায়। তপস্যা দ্বারা আপন হৃদয়কে শুদ্ধ করে, আত্মসমর্পনে ভাব নিয়ে, কায়-মন-বাক্যে গুরুর সেবা করতে পারলে, অর্থাৎ গুরুবাক্যে শ্রদ্ধা রেখে, সেই মতো ক্রিয়াদি সম্পন্ন করতে পারলে, গুরুদেবের মধ্যে শিষ্যের প্রতি স্নেহ রসের নিঃসরণ হয়। তখন গুরুদেব শিষ্যের হৃদয়ে এই দিব্যজ্ঞানজ্যোতি দান  করেন। আমরা শুনেছি, ছয় শিষ্য গুরুদেবের আশ্রমে এক বৎসরকাল গুরুসেবা অর্থাৎ গুরুবাক্যঃ অনুসারে সাধন ক্রিয়াদিতে নিযুক্ত ছিলেন। এর ফলে শিষ্যগণ যেমন শ্রদ্ধালু হয়েছিলেন, তেমনি গুরুদেব স্নেহ পরায়ণ হয়ে, তাঁর উপলব্ধ যাকিছু ব্রহ্মজ্ঞান, তা তিনি শিষ্যদের মধ্যে অকাতরে প্রবেশ করিয়ে দিলেন। গুরু প্রদত্ত দিব্যজ্ঞানজ্যোতি শিষ্যের অন্তরকে আলোকিত করে তুললো। শ্রদ্ধাভরে গুরুদেবের পায়ে, প্রণত হলেন। পিতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা অর্পণ করলেন। ঋষিজ্ঞানে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন।  

আমরাও এই ব্রহ্মবিদ্যা প্রবর্তক ঋষিকূলের কাছে শ্রদ্ধাবনত মস্তকে প্রণাম জানাই। 

প্রশ্ন উপনিষদের ষষ্ঠ প্রশ্নের সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে এই উপনিষদের বাণীর ইতি টানা হলো। 

----------

        

 


    



 

   

   

      



 

 
  



  
 





 
 

         

       

    

 



  

   


 



.


   
  




   
  
  

  .

 

  

 

 

   


 


 

  

  

    



 

 



 

    



    
 
    




    
 








মানুষ কি একটা কলের পুতুল ? - প্রশ্ন উপনিষদ (চতুর্থ প্রশ্ন)

























 

 

 

No comments:

Post a Comment