Friday 21 September 2018

সত্যধর্ম - গুরুতত্ত্ব (চতুর্থ ভাগ )

সত্যধর্ম - গুরুতত্ত্ব
গুরুবিনা কি সাধন হবে না ? (চতুর্থ  ভাগ )


অধ্যাত্ম জীবনে সাহায্য নেওয়া বা দেওয়া :


গুরুতত্ব সম্পর্কে  লিখতে লিখতে এক সময় মনে হয়, আমার নিজেরই তো জ্ঞান হয় নি।  আমার নিজেরই তো মুক্তি হয় নি। তো আমি আবার জ্ঞান দেওয়া শুরু করেছি। গুরুদেবতো বলেছেন উপযুক্ত গুরু না পেলে চিরজীবন গুরুহীন থাকা ভালো। আমি যা বলছি তা তো এক রকম গুরুগীরি। এটা কি একটা প্রবঞ্চনা নয় ? 

আসলে আমার নিজের মনে হয়, অধ্যাত্ম জীবনে প্রথম প্রথম সংগঠিত ভাবে এগোতে পারলে ভালো হয়। অর্থাৎ সৎসঙ্গ খুব জরুরি।  আর তা ছাড়া একটু ভাবুন,  আমরা তো সবাই শৃঙ্খলে আবদ্ধ। বন্ধনে আবদ্ধ।  এক জনের হাত আর একজনের হাতে  বাঁধা। আমরা কারারুদ্ধ। আমাদের সামনে খাবার আছে জল আছে। দেখছি কিন্তু খেতে পারছি না।  আমরা এই শৃঙ্খলবদ্ধ হাত দিয়েই  কিন্তু অন্যদের খাইয়ে দিতে পারি।  তো  একজন  আর এক জনকে যদি খাইয়ে দেই, তবে আমাদের সবার ক্ষিদে মিটতে পারে। দর্শনটা এখানেই।  আমি নিজের ভালোর জন্য, অপরের ভালো করতে চাইছি। নিজের ক্ষিদে মেটানোর জন্য অপরকে খাইয়ে দিচ্ছি।  আখেরে আমার পেট ভরবে। এটাই উদ্দেশ্য। 
আমি একবার এক স্বামীজিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আপনি কি সত্যি কিছু পেয়েছেন ? যা অন্যকে দিতে চাইছেন ? তো তিনি আমাকে একটা সুন্দর উত্তর দিয়েছিলেন। বলছেন : আমি তো এইভাবেই বড়ো হয়েছি।  ছোটবেলায় অর্থাৎ স্কুল জীবনে আমি পরের  বাড়ি থেকে পড়াশুনা করতাম। আমরা বলতাম লজিং থাকা।  তো সেখানে আমাকে ওই বাড়ির ছোটছোট ছেলেমেয়েদের পড়াতে হতো । আমি নিজেও পড়তাম, আবার অন্যদের পড়াতাম। তাতে আমাদের কোনো ক্ষতি হয় নি। বরং তাদেরও  লাভ হয়েছে।  আমারও লাভ হয়েছে। 
অধ্যাত্মজীবনেও কিছুটা উন্নীত হলে অন্যকে সাহায্য করা উচিত। তবে হ্যাঁ নিজ শক্তির সীমানা অতিক্রম করো না। আর যদি সাহায্য করতে চাও, তবে অন্যের জন্য জগদীশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো। এটা তো পারো। আমি মনে করি, নিজে সাধনা না করলে, আমি নিজে  শুদ্ধ না হলে, অন্যকে সেই ব্যাপারে উপদেশ দেওয়া অপরাধ। আর তাতে কোনো কাজও  হয় না।

আসলে প্রকৃত গুরু তো সবার ভাগ্যে জোটে না। হ্যাঁ ভন্ড  গুরুর অভাব নেই। সত্যিকারের গুরুর কিন্তু সত্যিই অভাব। তাই গুরু না পেলে কি ভাবে নিজেকে উন্নত করা যায়, সেই উদ্দেশ্যে নিজের কাছে প্রশ্ন অনেক। নিজেই নিজের আচার্য্য হয়ে উত্তর দেওয়া। তাই কাউকে ভুল বোঝানো, বা কাউকে জ্ঞান দান করা আমার উদ্দেশ্য নয়। নিজের প্রস্তুতির জন্য এ সব লেখা বা বলা। আমি নিজের কথা নিজে শুনি। আমার মনন করতে সুবিধা হয়।

যাই  হোক যে কথা বলছিলাম।  আগের  দিন আমরা গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথের দেওয়া ১০টি নির্দেশ-এর মধ্যে প্রথম নির্দেশ  নিয়ে আলোচনা করছিলাম। অর্থাৎ উপাসনার কথা আলোচনা করছিলাম, আজ আমরা দ্বিতীয় নির্দেশ নিয়ে আলোচনা করবো আর তা হচ্ছে  -
 
        
২) গুরুজনের প্রতি ভক্তি করো।

সাংসারিক জীবন থেকে আধ্যাত্মিক জীবন অনেক অনেক বেশী কঠিন।  সাংসারিক জীবন, পাপ পুণ্যের জীবন, ভালো মন্দ নিয়ে আমাদের সংসার। কিন্তু আধ্যাত্মিক জীবনে পাপ বলে কিছু  নেই।  মুহূর্তের জন্যও যদি তোমার মধ্যে পাপ ঢুকে  যায় বা অসৎ প্রবৃত্তি জেগে ওঠে তোমার আধ্যাত্মিক জীবন আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। সেই জন্য তোমাকে প্রতি মুহূর্তে সজাগ থাকতে হবে। সাংসারিক জীবনে বিশ্রাম আছে, সংশোধন বলে একটা কথা আছে।  কিন্তু আধ্যাত্মিক জীবনে না আছে বিশ্রাম, না আছে সংশোধনের কোনো সুযোগ। তোমাকে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। জন্ম জন্মান্তর ধরে এই ভাঙা গড়ার খেলা চলছে। একটা উদাহরণ দিয়ে কথাটা বলি। তোমাকে হয়তো কেউ বললো, তুমি যদি দম বন্ধ্ করে থাকতে পারো তবে তুমি আকাশে বিচরণ করতে পারবে। এখন তুমি খানিকক্ষন দম বন্ধ করে দেখলে, তুমি ধীরে ধীরে পৃথিবী ছেড়ে আকাশের দিকে  যাচ্ছো। এখন আকাশে ওঠার পরে যদি ভাব, একটু দম নিয়ে দেখি কি হয়।  তাহলে কি 

হবে ? তুমি  ধরাশায়ী হবে।  এবং আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। তাই মহাত্মাগণ আধ্যাত্মিক জীবন শুরুর প্রথমে কিছু কঠোর নিয়ম পালন করতে বলেন।  ছেলেবেলায় মাকে দেখতাম, রুটি শেঁকার আগে তাওয়া গরম করে নিতো। ঠিক ঠিক মতো তাওয়া গরম না হলে রুটি ঠিক মতো হবে না। এও  তেমনি, আধ্যাত্মিক জীবনে প্রবেশের শুরুতে নিজেকে তৈরী করে নেওয়া। আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য, প্রাথমিক দিকে  সাংসারিক জীবনে আগে আমাদের  নৈতিক হতে হবে। তাই গুরুদেব বলছেন, গুরুজনদের প্রতি ভক্তি করো। এখন গুরুজন কারা ? আর ভক্তিই বা কী ? 

গুরুদেব বলছেন, মাতা-পিতা আমাদের জন্মের কারন। তারাই আমাকে প্রতিপালন করে বড়ো করেছেন। এঁরাই আমার সবথেকে কাছের মানুষ। এরাই আমাকে প্রথম ভালোবাসার স্পর্শ দিয়েছেন। প্রকৃতির জগতে বেঁচে থাকার জন্য  সহযোগিতা করেছেন, বেঁচে থাকার শিক্ষা দিয়েছেন। গুরুদেব বলছেন, যে পরম আরাধ্যা জননী ৯ মাস ১০ দিন গর্ভে ধারণ করে অশেষ কষ্ট ভোগ করেছেন। আমাকে স্তন সুধা পান করিয়ে, সমস্ত বিপত্তি থেকে রক্ষা করেছেন।  আমাদের মল-মূত্র পরিষ্কার করেছেন। আমার রোগভোগে সেবা-যত্ন করেছেন। আমার সুখে সুখিনী, আমার দুঃখে দুঃখিনী হয়েছেন। আসলে মায়ের কথা বলে বোঝানোর দরকার নেই।  আমরা সবাই উপলব্ধি করি।  কিন্তু মায়ের প্রতি আমাদের কর্তব্য সবাই সমান মতো পালন করি না। মায়ের প্রতি কর্তব্য পালনে যদি আমাদের এতটুকু অনীহা বা ঘাটতি থাকে, তবে আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনে আসা বৃথা।  পণ্ডশ্রম মাত্র। এইজন্য আমরা দেখি, সন্যাস জীবনে প্রবেশের জন্য মায়ের অনুমতি নিতে হয়।  মায়ের অনুমতি ছাড়া সন্যাস জীবন সফল হয় না।  আদি শঙ্করাচার্যকে  আমরা দেখেছি,  তাঁর  নিজের প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও, যতক্ষন মা অনুমতি দেন নি, ততক্ষন তিনি সংসারেই ছিলেন। সচল শিব  ত্রৈলঙ্গস্বামীকে আমরা দেখেছি, ঘর ছাড়ার আগে মায়ের দেহত্যাগ অবধি অপেক্ষা করেছেন। তো মাকে কষ্ট দিয়ে যারা আধ্যাত্মিক জীবনের সুখ খুঁজছেন, তারা বৃথা মরীচিকার পিছনে ছুটছেন। তো আধ্যাত্মিক জীবনের প্রথম কর্তব্য মায়ের সেবা করা।  মাকে সুখে রাখা। এর কোনো বিকল্প নেই। 


গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথ  বলছেন পিতা আমাদের ভরণপোষণের জন্য অবিরাম পরিশ্রম করেও ক্লান্তি বোধ করেন নি। আমাদের সুখের জন্য, আমাদের ভালো থাকার জন্য, আমাদের লেখাপড়া শেখাবার জন্য, আমাকে রক্ষা করার জন্য, পিতা অক্লান্ত পরিশ্রম করে, জীবনের সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে, আমাকে রক্ষা করেছেন। আমরা যতটুকু জ্ঞান লাভ করেছি, তার বীজ মাতা-পিতাই রোপন করেছেন। তো এই  আমাদের জীবনে   সর্বোত্তম ও ভক্তিভাজন এই পিতা মাতা। 


এর পরে যারা আমাদের শিক্ষাগুরু  আছেন, অর্থাৎ পরিবারের বয়স্কজন, আমার শিক্ষাক্ষেত্রের শিক্ষকজন, এবং সবশেষে আমার আধ্যাত্মিক জগতে  প্রবেশের জন্য যিনি উৎসাহিত করেছেন,  সম্যক  জ্ঞান  দান করেছেন, তারা সবাই আমাদের ভক্তিভাজন। এদের প্রতি যথাযোগ্য সন্মান, ভক্তি বিনা আমার অধ্যাত্ম জীবনের কোনো উন্নতি সম্ভব নয়।মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন - তুমি যদি এদের প্রতি ভক্তি না করতে পারো তবে সেই জগৎপিতার, জগৎগুরুর প্রতি ভক্তি করা দুঃসাধ্য।


গুরুভক্তি আমাদের কি আশ্চর্য্য ফল দান করতে পারে, তারই একটা কাহিনী বলবো।  আচার্য্য আদি শঙ্করের নাম নিশ্চয় শুনেছ। তার এক শিষ্য ছিল যার নাম আনন্দগিরি। ডাকনাম শুধু গিরি। সে লেখাপড়া বিশেষ জানতো না। কিন্তু দেখতে শুনতে খুব ভালো ছিল। সে ছিল শুদ্ধচেতা, সরলমতি।আর প্রচণ্ড গুরুভক্ত।  সে সারাক্ষন গুরুসেবায় নিযুক্ত থাকতো। সব সময় তার মনে হতো এই  বুঝি  গুরুদেব তাকে ডাকছে। সে জন্য, সে মাঝে মধ্যে গুরুদেবের ঘরের সামনে, শীতের রাতে, উন্মুক্ত জায়গায় মাটির উপরে শুয়ে থাকতো। যাতে গুরুদেবের ডাক সে শুনতে পারে।  আচার্য্যের অন্য সমস্ত শিষ্যই বেশ পণ্ডিত ছিল। যার জন্য আচার্য্য শঙ্কর তার শিষ্যদের বিষয় নির্বাচন করে, তার উপরে লিখতে বলতেন। এখন গিরি তো কিছু লিখতে পারতো না। গুরুদেব তাকে কিছু লিখতেও দেয়  না। এর জন্য গিরির মনে খুব দুঃখ।গিরি মনে মনে গুরুদেবের কাছে প্রার্থনা করতো, হে গুরুদেব, আমাকে জ্ঞান দাও। আমি যেন অন্যদের মতো শাস্ত্র বুঝতে পারি, ভাষ্য লিখতে  পারি।  হে গুরুদেব আমাকে দয়া করো, করুনা করো। আর, গিরি কিছু বুঝুক না বুঝুক, গুরুদেব যখন কিছু বলতেন, বা উপদেশ দিতেন, তখন গিরি,আচার্যের পাশে গিয়ে তাকে বাতাস করতো, বা গামছা নাড়িয়ে গুরুদেবকে মশা মাছি  থেকে রক্ষা করতো। এবং নিষ্ঠা সহকারে গুরুদেবের বাণী  শুনতো। পান্ডিত্যের  দিক থেকে, গিরি যেমন অন্য্ শিষ্যদের পাশে আসতে পারতো  না,  তেমনি গুরুভক্তির দিক থেকে গিরি ছিল সবচেয়ে উঁচুতে। 

তো একদিন হো'লকি, গুরুদেব সবাইকে নিয়ে বসেছেন উপদেশ দান করার জন্য, শাস্ত্র ব্যাখ্যা শোনাবার জন্য। কিন্তু গিরি নেই।  গুরুদেব জিজ্ঞেস করলেন, গিরিকে তো দেখছি না ! সবাই বললো, গিরি নদীতে গেছে, স্নান করার জন্য, আর ও তো স্নান করার সময় একটু বেশিই নেয় তার কারন ওই সময় গিরি আপনার বস্ত্র ধৌত করে। তো গুরুদেব বসে আছেন। সবাই বলছে, উপদেশ শুরু করতে। কিন্তু গুরুদেব গিরির অপেক্ষায় বসে আছেন।  আচার্য্য বললেন, একটু অপেক্ষা কর। গিরি এখুনি আসবে। কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পরও গিরি এলো না দেখে, পদ্মপাদ নামে  তার প্রধান জ্ঞানী শিষ্য বললো :  গিরি কি আপনার শাস্ত্র ব্যাখ্যা বুঝতে পারে ? আচার্য্য বললেন, গিরি বুঝতে পারেনা ঠিক, কিন্তু সে অতি নিষ্ঠা ভরে, অতি শ্রদ্ধা সহকারে সবকিছু শোনে। 

এদিকে গিরি কাপড়চোপড় পরিষ্কার করছে আর মনে মনে বলছে, হে গুরুদেব, তুমি আমাকে জ্ঞান দাও। আমি যেন ওদের মতো শাস্ত্র বুঝতে পারি, আর ভাষ্য লিখতে পারি। এমন সময়, সেই নদীর পারে, অর্থাৎ তুঙ্গা ও ভদ্রা নদীর সঙ্গম স্থলে  তার যেন মনে  হল, গুরুদেব তার দিকে প্রসন্ন চিত্তে তাকিয়ে আশীর্বাদ করছেন। আর তার অন্তর লোক এক দিব্য  আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। গিরির মনে হলো, সে যেন সর্ব বিদ্যার অধিকারী হয়ে গেছে। তার সমগ্র মন, প্রাণ, এক অনির্বচনীয় আনন্দে ভরপুর হয়ে গেল। গিরি, গুরুদেবের উদ্দেশে দৌড় শুরু করলো। এবং গুরুদেবের কাছে এসে, তার চরণ বন্দনা শুরু করলো, এক ছন্দবদ্ধ শ্লোকে। 
দ্বাদশাক্ষরী তোটক  ছন্দে পরম পবিত্র সেই আকুতি : বলছেন : সমুদ্রের জল আমার জন্ম-মরন, সমুদ্রের মাছ আমার সুখ দুঃখ।  হে ভগবান, হে গুরুদেব সেই ভবসমুদ্রে পতিত হয়ে আমি অশেষ দুঃখ ভোগ করছি। আমি অন্য কোনো গতি না পেয়ে, হে গুরুদেব তোমার শরণ নিলাম। দয়াকরে, কৃপা করে, শরণাগতকে উদ্ধার করো। 

তখন গুরুদেব বলছেন : তোমার বিষয়ে আসক্তিই সব দুঃখের কারন।  বিষয়ে আসক্তি ত্যাগ করে, দেহাত্মবুদ্ধি ত্যাগ করে, পরম-আত্মার চরণে নিবেদিত হও।  হে তত্ত্ব-পিপাসু সমস্ত মোহপাশ ছিন্ন করো।  

 গিরির মুখে এই বিশুদ্ধ শ্লোক শুনে, যার মধ্যে সেই চিরকালীন আবেদনের সুর, উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেল।  গুরুদেব তাকে সস্নেহ কাছে টেনে নিলেন। সকলে বুঝলো গুরুদেবের কৃপা হলে সব সম্ভব। 

জানিনা গল্প কথা কিনা।  তবে আমি মনে করি তার কৃপা হলে সব সম্ভব। তার কৃপা যখন বর্ষিত হয়, তখন আমাদের দ্বারা এমন সব কাজ সম্ভব, যা আমার যোগ্যতার বাইরে। আর তার কৃপা থেকে যখন আমরা বঞ্চিত হই, তখন আর সেই মতো কাজ করতে পারি না। আমাদের দিয়ে তিনিই সব কাজ করিয়ে নেন। আমরা তার হাতের ক্রীড়নক মাত্র। 

অর্জুন একবার শ্রীকৃষ্ণকে বলেছিল : তুমি তখন যুদ্ধে ক্ষেত্রে বসে কি সব আত্মতত্ব ইত্যাদি গুড় রহস্যঃ বলেছিলে, তো যুদ্ধক্ষেত্রে আমিতো সব বুঝিনি, তুমি কি দয়াকরে, আবার আমাকে সেই সব কথা একবার বলবে ?যোগেশ্বের 
শ্রীকৃষ্ণ তখন বলেছিলো, তখন কি বলেছিলাম তাতো আমার মনে নেই, তা আর আমি জীবনে কোনোদিন বলতেও পারবো না। তবে  আত্মতত্ব সম্পর্কে এখন যা বলতে পারি, তা তুমি শোনো। আগের কথা গুলো গীতা হয়েছিল, একই শ্রীকৃষ্ণের  একই বিষয়ের কথা আর কিন্তু  গীতা হয় নি।  একই  শিল্পীর, এক একটি স্টেজে এক একদিনের গান  বা নাচ খুব ভালো হয়।  কেন হয়, সেই ব্যাখ্যা সে নিজেও জানতে পারে না। তবে হয়। তাই পরমাত্মা-পরম-ঈশ্বর আসলে আমাদের গুরুরূপে, পিতা-মাতা রূপে আসেন, শিক্ষক  রূপে আসেন, তাদের আমাদের ভক্তি করা উচিত।  তাদের  কথা আমাদের পালন করা উচিত।  তাদের সেবা করা উচিত। এর কোনো বিকল্প নেই। 

এইবার মা-বাবার ভক্তি প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি। তারপরেই এই প্রসঙ্গ শেষ করবো। পুরাকালে পুণ্ডরীক নামে এক ব্রাহ্মণ  ছেলে বিয়ের পরে বউ ভক্ত হয়ে গেল। এখন বাবা যা বলে তা আর তার ভালো লাগে না।  মা যা বলে তা তার ভালো লাগে না। বৌ বাপের বাড়ি গেলে, সেও শ্বশুর   বাড়ি চলে যায়। এখন মায়ের কাজে সাহায্য করতে বললে,  ছেলে বলে,বৌ কি তোমাদের বাড়ির কাজের লোক ? বাবা ছেলেকে পৌরিহিত্য করার কথা  বলতেই, ছেলে বলে উঠলো, আমি চালকলার ব্যবসা করবো না।  বাবা জিজ্ঞেস করলো, তা তুই কি করবি ? ছেলে বললো, শ্বশুরমশায়  আমাকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছেন। আমি তাই করবো। 

ব্রাহ্মণ বাবা-মা  ছেলের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে, ঠিক করলো - তারা সংসার ছেলের উপরে ছেড়ে দিয়ে, তীর্থ যাত্রায় বেরিয়ে পরবে।  যেমন কথা তেমনি কাজ।  তারা দুই জন্য তীর্থ যাত্রায় বেরিয়ে পড়লো। এদিকে ছেলে তার বৌকে ঘোড়ায় চাপিয়ে বাবা-মায়ের পিছন পিছন চলতে লাগলো।  এক আশ্রমে এসে বাবা-মা রাত্রি যাপন করতে লাগলো। ছেলে-বৌমাও  সেই আশ্রমে রাতের জন্য আশ্রয় নিলো। গভীর রাতে ছেলেটি দেখলো, তিনজন নোংরা শাড়ী পরিহিত সুন্দরী নারী বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো এবং কিছুক্ষন পরে, পরিচ্ছন্ন পোশাক পড়ে বেরিয়ে গেল।  পরদিন রাতেও সেই একই দৃশ্য দেখলো।  তারপরদিনও  অর্থাৎ তৃতীয় দিনে যখন আবার সুন্দরীদের সেই গৃহে প্রবেশ করতে দেখলো, সে তখন বিছানা থেকে উঠে, সুন্দরীদের পরিচয় জানতে চাইলো, তখন সুন্দরীরা তাকে বললো - আমরা গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী। সারাদিন সবাই আমাদের সলিলে অবগাহন করে, সমস্ত পাপ দিয়ে যায়।  আমরা এখানে আসি সারাদিনের সেই পাপ পরিষ্কার করার জন্য। তোমার মতো যারা পাপী, মাতা-পিতাকে কষ্ট  দেয়, পাপ কর্মে লিপ্ত থাকে, আর পাপ মোচনের জন্য আমাদের সলিলে অবগাহন করে। তাদের জন্যই আমাদের এই দুর্দশা।এ কথা শুনে, ছেলেটির চৈতন্য হলো।  এবং প্রতিজ্ঞা করলো আজ থেকে সে মাতা-পিতার সেবা করবে, তাদের কোনো কষ্ট দেব না। 

সেইমতো বাবা-মাকে নিয়ে বাড়ী  ফিরলো। এবং বাবা মায়ের বাধ্য ছেলে হয়ে গেল। রাতে শোবার আগে, ছেলে-বৌ দুজনে মিলে  বাবা-মায়ের পা টিপে  দেয়, যতক্ষন না তারা ঘুমায়। তো একদিন হলো কি, স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ  এলো ছেলেটাকে ডাকতে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ  বললো তোমার সাথে আমার কিছু কাজ আছে।  ছেলেটি বললো, এখন আমি ব্যস্ত আছি। শ্রীকৃষ্ণ বললো আমাকে বসতে দেবে না ? ছেলেটি একটা ইটের টুকরা ছুড়ে দিয়ে বললো, হয় বসো  নয় দাঁড়িয়ে থাক, আমার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমার সাথে কথা বলতে পারবো না। অর্থাৎ বাবার ঘুম না আসা পর্যন্ত আমি বাবার সেবা করবো। আর এই সময় যত বড় কাজই থাকুক, আর যেই আসুক, পিতা সেবায় সে বিরত হতে পারবে না। শ্রীকৃষ্ণ সারারাত সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলো। প্রচলিত কাহিনী যে, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ ইট-এর উপরে  দাঁড়িয়ে ছিল, কালান্তরে সেখানে বিটঠলা, অর্থাৎ ইটের উপরে দাঁড়ানো বিষ্ণু মন্দির  প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।  
এটাই বহিরঙ্গ সাধনা। এই বহিরঙ্গ সাধনায় পারঙ্গম হলে, তবেই অন্তরঙ্গ সাধনার যোগ্য  উঠতে পারি আমরা। গুরুজনদের প্রতি  যদি আমরা ভক্তি, শ্রদ্ধা না করতে পারি,  তবে ঈশ্বরের  ভক্তি শ্রদ্ধা  কি করে  করবো ?                                   

পরম-ঈশ্বরই  আমাদের কাছে, পিতামাতা রূপে আসেন। গুরু রূপে আসেন। ইষ্ট  রূপে আসেন। তাই আমাদের  মাতা-পিতার মাধ্যমে, গুরুজনের মাধ্যমে, গুরুদেবের মাধ্যমে, ইষ্টের মাধ্যমে, দেবতার মাধ্যমে, এগুতে হবে। এইজন্য মহাত্মা গুরুনাথ  "ধর্ম্মার্থীর কর্তব্য" সন্মন্ধে বলছেন  মাতা, পিতা, শিক্ষক, রাজা, ও অন্যান্য গুরুজনদিগকে যথোচিত ভক্তি করবে।  দেবদেবীগনের প্রতি ভক্তি ।   এটাই মহাত্মা গুরুনাথের শিক্ষা।  গুরুদেব  আসলে সাধন পথে আসতে গেলে তিনটি জিনিসের প্রতি গুরুত্ত্ব দিতে বলেছেন, আর তা হচ্ছে - প্রেম, ভক্তি, ও একাগ্রতা। এই ভক্তির বহিরঙ্গ সাধনাই  গুরুভক্তি, বা গুরুজনের প্রতি বা মাতা-পিতার প্রতি ভক্তি।  আমরা এই বহিরঙ্গ সাধনা না করে অন্তরঙ্গ সাধনায় সিদ্ধ হতে  পারবো না। আমরা এই গুরুজনদের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধার মাধ্যমেই ঈশ্বর ভক্তি লাভ করতে পারবো। 

সমাপ্ত।   

        

Sunday 16 September 2018

সত্যধর্ম - গুরুতত্ত্ব - গুরুবিনা কি সাধন হবে না ? (৩)

সত্যধর্ম - গুরুতত্ত্ব
গুরুবিনা কি সাধন হবে না ? (তৃতীয় ভাগ )




আগেরদিন আমরা সত্যকামের  কথা শুনছিলাম।  এবং শুনেছিলাম  যে , আমাদের   যদি ব্যাকুলতা  থাকে, তবে গুরু ছাড়াও আমাদের ব্রহ্মজ্ঞান হতে পারে। আমরা  যদি যোগ্য হতে পারি, তবে প্রকৃতি আমাদের আচার্য্য বোনে যান। আমরা যে কোনো জায়গা থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। কিন্তু  আমাদের  যদি চেষ্টা না থাকে, হাজার গুরু করলেও আমাদের   কোনো উন্নতি হবে না। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন : যদি তেত্রিশ কোটি দেবতায় তোমার বিশ্বাস থাকে অথচ তোমার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস না থাকে, তবে কখনোই তোমার মুক্তি হবে না।

আমরা একলব্যের কথা শুনেছি। মহাভারতের আদিপর্ব্বে এই কাহিনীর উল্লেখ আছে। জাত-ব্যবস্থা আমাদেরকে কি ভাবে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছিল, গুরু থেকে বঞ্চিত করেছিল তারই এক নির্মম কাহিনী, এই একলব্যের কাহিনী। ভ্রষ্ট  গুরুর কাহিনী। মহাভারতের যুগে, নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র এই একলব্য। একলব্য ছিল ভীল সম্প্রদায় ভুক্ত।  এই সময়ে দ্রোণাচার্য নামে এক ব্রাহ্মণ শস্ত্র বিশারদ ছিলেন। তিনি কৌরব বংশীয় রাজার সন্তানদের অস্ত্র শিক্ষা দিতেন।  গুরু দ্রোণাচার্য্যের সংগ্রামনৈপুণ্য শুনে, বহু জায়গা থেকে তার কাছে  অস্ত্র শিক্ষা লাভ করবার জন্য শিক্ষার্থী  আসতো।  এমনি ভাবে একদিন একলব্য এলো শিক্ষাগুরু, অস্ত্র শিক্ষক দ্রোণাচার্য্যের কাছে। কিন্তু সে ছিল মূলনিবাসী, আর্যদের দৃষ্টিতে ম্লেচ্ছ , অস্পৃশ্য, সতীর্থদের অর্থাৎ অন্যান্য শিক্ষার্থীদের  সমতুল্য নয়। অর্থাৎ আর্য্যদের সমতুল্য নয়। তাই একলব্য যখন গুরু দ্রোণাচার্যকে অস্ত্র শিক্ষা দেবার জন্য অনুরোধ করলো দ্রোণাচার্য একলব্যকে  শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করতে রাজী হলেন  না। তখন নিষাদরাজ-তনয় একলব্য দ্রোণাচার্য্য কে প্রণাম করে, বিষাদমগ্ন হয়ে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলো। যা তার নিজের বিচরণ ভূমি। সেখানে সে গুরু দ্রোণাচার্যের মাটির মূর্তি তৈরি করে, অস্ত্র শিক্ষার অভ্যাস করতে লাগলো। যার নিষ্ঠা গভীর, তাকে ভগবান সহযোগিতা করেন। একলব্যও ধীরে ধীরে, কিছুদিনের মধ্যেই সমস্ত অস্ত্রের প্রয়োগ, সংহার, সন্ধানবিষয়ে পারঙ্গম হয়ে উঠলো। আসলে গুরু তোমার  মনে, তোমার  অন্তরে, তোমার  ভিতরে,  তোমার বাহিরে।  তোমার  ভাবনাই  তোমার  গুরুর কাছে পৌঁছে দেবে। তোমার  বিবেক সর্বোত্তম গুরু।  তার কাছে আশ্রয় নাও ।  তিনিই তোমাকে  পথ দেখাবেন। তোমার  কাজ বিবেকের নির্দেশে কাজ করা। বিবেকবর্জিত কাজ করা মানে, অধঃপতন।  আর বিবেক নির্দেশিত কাজ করা মানে  ঈশ্বরের কাজ করা। আর সেটাই উন্নতির গোপন কথা। আর সেটাই সাম্যাবস্থায় থাকা। আনন্দে থাকা।

এর পরের কাহিনী অতি নির্মম। তোমরা  সবাই জান,  গুরু দ্রোণাচার্য , গুরুদক্ষিণার নামে, একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ, কেটে নিয়ে   তার প্রিয় শিষ্য  অর্জুনের ধনুর্বিদ্যায় একাধিপত্য নিশ্চিত করেছিলো।  অর্জুনকে খুশি করেছিল। আমরাও এইসব  গুরুদেবের সন্তুষ্টির জন্য সব করি।  কিন্তু তাদের কাছে আমাদেরকে  দেবার জন্য কিছুই থাকে না। আমি এইসব গুরু যারা গুরুমাহাত্য জানে না , গুরুর কর্তব্য জানে না, তাদের থেকে দূরে থাকতে বলছি। মহাত্মা গুরুনাথ বলেছেন, উপযুক্ত গুরু যদি না মেলে তবে সারাজীবন গুরুহীন থাকা ভালো।

কিন্তু শুনলে অবাক হবে, পাপ ছাড়েনা বাপকে। পাপ মানুষের জন্ম-জন্মান্তরের সাথী। এই একলব্য-ই মৃত্যুর পরে ধৃষ্টদ্যুম্ন হয়ে জন্মে ছিল, আর আচার্য্য দ্রোণের মস্তক, ধর থেকে আলাদা করে দিয়েছিলো। একলব্য কত বড়  বীর ছিলেন, তা শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর পরে তার পিতা বসুদেবের বিলাপ থেকে পাওয়া যায়।  বসুদেব বলছেন : হে ভাগ্নে  অর্জুন, যে কৃষ্ণ আগে মহাবল পরাক্রান্ত কেশী কংস, শিশুপাল, নিষাদরাজ একলব্য প্রভৃতি ভূপালগনকে নিহত করেছিলেন, এখন তিনিই যদুকুল ক্ষয় হতে দেখেও উপেক্ষা করেছেন। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস।

আর একটা গল্প বলি :

রাস্তায়, এক বৃদ্ধা, তন্ন তন্ন করে কি যেন খুঁজছেন । জিজ্ঞেস করলাম কি খুঁজছেন ? বললো আমার গোপালকে খুঁজছি। আমি ভাবলাম, গোপাল, তাও আবার রাস্তায় ? কে গোপাল ? আপনার ছেলে ? বললো না আমার সোনার গোপাল। আমার ঠাকুর। জিজ্ঞেস করলাম কোথায় হারিয়েছে ? বললো ঠাকুর ঘরে ছিল। তো সেখানে না খুঁজে এখানে খুঁজছেন কেন ? তখন বৃদ্ধা আমাকে একটা আশ্চর্য সত্য বললো, তা হচ্ছে - গুরুদেব যে বললো : আলোতে খুঁজতে।  ঠাকুর-ঘরে তো আলো নেই, তাই এখানে খুঁজছি। এখানে আলো  আছে।
আমরাও ঈশ্বরকে খুঁজি গুরুদেবের কাছে, অন্তরের বাইরে। ঈশ্বর তো গুরুদেবের কাছে নয়।  ঈশ্বর আমাদের অন্তরে। আমরা, গুরুদেব যা বলছেন তা বুঝি না। বুঝলেও সে অনুযায়ী কাজ করি না।   করলেও উল্টোটা করি। গুরুদেব তো রাস্তা বলে দেন। চলতে হবে আমাদের।

ছেলেবেলায় একটা কথা শুনতাম , শিক্ষক ছাত্রকে   বলেছেন,  বলো : My Head মানে আমার মাথা, ছাত্র বলছে , My Head মানে মাস্টার মহাশয়ের মাথা।

ভগবান বলছেন:
"সর্ব ধর্ম্নান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।"

তথাকথিত  সমস্ত ধর্ম্ম, অর্থাৎ তোমার পূর্ব সংস্কার অনুযায়ী যাকে তুমি ধর্ম্ম ভাবছো, সেই ভাবনা ত্যাগ করে মামেকং অর্থাৎ সেই এক এবং  অদ্বিতীয় আমিকে শরণ করো , অর্থাৎ পরম পিতাকে আশ্রয় করো।  আমরা তা না করে, মানুষ শ্রীকৃষ্ণের ছবি  নিয়ে বসে গেছি পূজা করতে। এতে কি হবে ?

তবু বলি আধ্যাত্মিক গুরু, আধ্যাত্মিক জগতে হাত ধরে নিয়ে যান । তাই গুরুকরন অতি আবশ্যক। আমরা বাড়ি বসে পড়াশুনা করতে পারি।  তবু আমরা ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠাই।  কেবল গুরুকরনেই আমাদের সন্দেহ জাগা উচিত নয়। কেবল বয়স বাড়লেই, আমাদের জ্ঞান বাড়ে না। হ্যাঁ এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা জন্ম থেকেই ভগবানকে অনুভব করেন , এরা ঈশ্বরীয় চেতনা  নিয়েই জন্মান । তাদের ক্ষেত্রে হয়তো গুরুদেবের দরকার পারে না। কিন্তু তবু আমরা দেখি, রামকৃষ্ণদেবেরও   গুরু ছিলো। যোগেশ্বর  শ্রীকৃষ্ণেরও  গুরু ছিল।  আচার্য্য প্রণবানন্দের গুরু ছিলো।   আদি শঙ্করাচার্যেরও  গুরু ছিল।     

কিন্তু সবার গুরু ছিল বলেই আমারো গুরু থাকবে, তার কোনো মানে নেই। আমার যোগ্যতা অনুসারে, আমার গুরুলাভ হবে। তাই বলছিলাম নিজেকে যোগ্য করে তোলো। কিন্তু কি করলে আমরা যোগ্য হয়ে উঠবো ? মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত কি বলছেন এই প্রসঙ্গে ? আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করবো। 

মহাত্মা গুরুনাথ দশটি নির্দেশ দিয়েছেন।  বলছেন  :

১) প্রতিদিন অন্তত তিন ঘন্টা জগদীশ্বরের উপাসনা করো।
২) গুরুজনের প্রতি ভক্তি করো।
৩) সর্বদা সত্য কথা বলবে। 
৪) পরের দ্রব্য হরণ করবে না।
৫) জিতেন্দ্রিয় হবে।
৬) আত্মহত্যা বা নরহত্যা করবে না
৭) যাতে বুদ্ধি বাড়ে, তার জন্য চেষ্টা করবে।
৮)  ধৈর্য্য ও ক্ষমা গুনের সাধনা করবে।
৯) শরীর ও মন পবিত্র রাখবে। 
১০) প্রতিদিন গুরুমূর্তি ধ্যান করবে।

আমরা এগুলো এক এক করে আলোচনা করবো : কিন্তু আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে, যাদের উপযুক্ত গুরুদীক্ষা হয় নি, তাদের জন্যই এই আলোচনা। 

১) প্রতিদিন অন্তত তিন ঘন্টা জগদীশ্বরের উপাসনা করো।

জগদীশ্বরের উপাসনা বলতে আমরা কি বুঝি ? জগদীশ্বর সম্পর্কে আমাদের কি ধারণা ?
সাধারণতঃ ঈশ্বর বা জগদীশ্বর বলতে আমরা বুঝি সৃষ্টি, স্থিতি, লয়-এর কর্তা। তার থেকেই সব সৃষ্টি, আবার তাতেই লয়। যদিও তিনি আসলে আরো বড় কিছু। তার কাজ শুধু, সৃষ্টি, স্থিতি বা লয় নয়। এই সৃষ্টি-স্থিতি-লয় এর কর্তা তার একটি অংশ মাত্র।  তিনি এসবেরও উর্দ্ধে বৃহৎ  কিছু। এই সত্য উপলব্ধি করতে গেলে আমরা জীবাত্মা, আর তিনি পরমাত্মা- এটা দৃঢ় ভাবে বুঝতে হবে। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে  । আমরা যাকে আমি বলি, অর্থাৎ মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার, ইন্দ্রিয়-বর্গ বা এই দেহ, এর থেকে সত্যিকারের আমি সম্পূর্ণ  আলাদা। আমরা এক একটি আত্মা, সেই পরম-আত্মা বা অনন্ত চৈতন্যের অংশ। নিজেকে যতক্ষন অবধি মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার, ইন্দ্রিয়-বর্গ বা এই দেহ থেকে স্বতন্ত্র না ভাবতে পারছি ততক্ষন সেই পরম-আত্মা বা পরম চৈতন্য সম্পর্কে কিছুই জানতে সক্ষম হবো না। উপাসনার শুরুতে আমাদের জানতে হবে বা উপলব্ধি করতে হবে, পরম-আত্মার  সঙ্গে জীবাত্মার সম্পর্ক চিরন্তন। এই মিলন শাশ্বত।  তবু মনের মালিন্য হেতু আমরা ঈশ্বরকে ছেড়ে তারই  সৃষ্টিতে আসক্ত হয়ে পড়েছি । 

আমরা তো ঈশ্বরকে চাই না। আমরা তাকে আমাদের ইচ্ছা পূরণের জন্য,  কাজে লাগাতে চাই। আমাদের বাসনাগুলো পূরণের জন্য তাকে কাজে লাগাতে চাই। আর যখন,সেই বাসনা পূরণ না হয়, তখন আমরা অবিশ্বাসী হয়ে পড়ি। এইজন্য ঈশ্বর সম্পর্কে আমাদের একটি সঠিক ধারণা চাই। একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, ঈশ্বর আমাদের বাসনাপূরণের যন্ত্র নয়। তিনি এসব থেকে বহুগুন বেশী কিছু।

আমরা ভাবি, ঈশ্বর সর্বশক্তিমান একজন পুরুষ মাত্র। তারও আমাদের মতো দেহ আছে। সেই দেহ কখনো স্থুল আবার কখনো সূক্ষ্ম। আমরা তাঁর  সেই স্থুল  দেহ দেখতে চাই। এই ভ্রমে যাঁরা পতিত তাঁরা সেইমতো আবদ্ধ হয়ে পড়েন। 

কেউ ভাবেন "অহং ব্রহ্মাস্মিন্" । আমিই ব্রহ্ম। "সোঽহং" - তিনিই আমি। "তত্ত্বমসি" -  আমিই সেই। এটি একটি ভয়ানয়ক অসত্য কথন।  মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন,  হে ক্ষুদ্র মানব, তুমি যখন অপর একজন মানুষকেই আত্মতুল্য জ্ঞান করতে পারো না, তখন অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডেশ্বরকে কিভাবে আত্মতুল্য বোধ করবে ? ক্ষুদ্রতম প্রস্তরকণা কিভাবে নিজেকে হিমাচলকে আত্মসদৃশ্য বিবেচনা করবে ? আমি ভাবি, শরীরের অসংখ্য কৃমিকীট, অসংখ্য কোষ তারা কি নিজেদেরকে মানুষ ভাবে  ? জীবাত্মা কখনো পরম-আত্মার তুল্য হতে পারে না। এ সবই  আমাদের অহং-এর ভ্রম। 

ঈশ্বর সচ্চিদানন্দ, - তিনি অনন্ত অস্তিত্ব, অনন্ত চেতনা, অনন্ত আনন্দ। তিনি জীবাত্মায় স্ফূরিত হন মাত্র। আবার আমরাও তাতেই থাকি। 

আমাদের এই অনুভূতি আনতে  হবে যে,  আমরা জীবাত্মা, আমরা পরম-আত্মার মধ্যে, আমরা তাঁরই পরম সান্নিধ্যে আছি।  তিনিই  আমাদের প্রিয় থেকে প্রিয়তর, নিকট থেকে নিকটতর। এই চেতনা আমাদের ভিতর জাগিয়ে তুলতে হবে। এটাই উপাসনা। অর্থাৎ ঈশ্বরের কাছে আসন পেতে বসা।  সমুদ্রের মধ্যে বুদ্বুদ আমি। মহাসাগর আমাদের ধারণার বাইরে। তাই আমরা যে ঢেউয়ের উপরে খেলছি, তার সাথে একাত্ম হতে হবে।  এবং সময় হলে, এই ঢেউয়ের মাধ্যমে মহাসাগরের সঙ্গে আমাদের একাত্মতা হবে। 

তাই আমাদের  মাতা-পিতার মাধ্যমে, গুরুদেবের মাধ্যমে, ইষ্টের মাধ্যমে, দেবতার মাধ্যমে, এগুতে হবে। এইজন্য মহাত্মা গুরুনাথ  "ধর্ম্মার্থীর কর্তব্য" সন্মন্ধে বলছেন  মাতা পিতা শিক্ষক, রাজা, ও অন্যান্য গুরুজনদিগকে যথোচিত ভক্তি করবে।  দেবদেবীগনের প্রতি ভক্তি করবে। পূজা করবে, কিন্তু মনে রাখতে হবে - তাঁরা কেউ জগদীশ্বর নয়। সব থেকে  বড় কথা হচ্ছে, যার কৃপায় তুমি জগদীশ্বর লাভের পথ প্রাপ্ত হয়েছো, সেই গুরুদেবের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি করবে। এই সমর্পন-ই উপাসনা। 

কখন উপাসনা করবো, বা কতক্ষন উপাসনা করবো। মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন অন্ততঃ তিন ঘন্টা উপাসনা করবে।  উপাসনার পক্ষে ব্রাহ্ম-মুহূর্ত  ও  নিশীথ অর্থাৎ গভীর রাত অতি প্রশস্ত সময়।  এছাড়া সকাল, দুপুর, ও সন্ধ্যা এই পাঁচ সময় উপাসনার উপযুক্ত সময়।যাদের পক্ষে পাঁচবার উপাসনায় বসা সম্ভব নয়, তারা অন্তত  দুই বার, বিশেষ করে ভোরবেলা অর্থাৎ ব্রাহ্মমুহূর্ত ও সন্ধ্যাবেলা উপাসনায় বসা উচিত। মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন, যারা আত্মউন্নতির জন্য বিশেষভাবে লালায়িত, তারা প্রতিমুহূর্তে জগদ্বিশ্বরের মঙ্গলময় নাম উচ্চারণ স্মরণ করবে। 

আমি অনেককে বলতে শুনেছি, আমরা গৃহী মানুষ, আমাদের এতো সময় কোথায় ? আমার মনে হয় এটা একটা অজুহাত মাত্র। আমরা প্রতিদিন খাবার সময় পাই।  শোবার  সময় পাই। প্রকৃতির ডাকে সারা দেবার সময় পাই। এমনকি আড্ডা দেবার সময় পাই। কিন্তু উপাসনার সময় পাই না। শরীরের ক্ষিদে  মেটানোর জন্য, মনের ক্ষিদে মেটানোর জন্য, সময় পাই কিন্তু আত্মার ক্ষিদে মেটানোর সময় পাই না। অতয়েব সময়-অভাবের ওজর ত্যাগ করতে হবে আমাদের। 

উপাসনার জন্য, ব্রাহ্মহ্মমুহূর্ত বা ভোরবেলা সবথেকে ভালো। রাতের ঘুম আমাদের স্মৃতিকে বিলুপ্ত করে দেয়। বাহ্যিক পরিবেশ শান্ত থাকে।  আমাদের মন শান্ত থাকে।  তখন মনকে একাগ্র করা সহজ হয়। যখন আমরা ঘুম থেকে উঠি, তখন আমাদের চেতন মন ক্রিয়াশীল থাকে না। অবচেতন মন তখন সহজে সব কিছু ধরতে পারে। তাই সে সময় মনকে যা কিছু নির্দেশ করা হয়, তখন তা অবচেতন মনের গভীরে প্রবেশ করে। এই সময় ধ্যানের গভীরে সহজে প্রবেশ করা সম্ভব হয়। মনের গভীর স্তরে প্রবেশ করা সম্ভব হয়। এবং এই সময় জগদীশ্বরের নাম-গুনগান আমাদের এক উচ্চতর আনন্দ অনুভূতি প্রদান করে। এটা আসে মনের গভীরতম স্তর থেকে। এই আনন্দ-অনুভূতিকে ধরে রাখবার জন্য, আমাদের উপাসনার পরে, খানিক্ষন নীরব থেকে এই আনন্দানুভূতি উপভোগ করা উচিত।  এতে যেমন নিজের অন্তরে শান্তি বজায় থাকবে, তেমনি সংসারে শান্তি বৃদ্ধি পাবে। এবং আমার সারাদিনের আচরণে এই শান্ত ভাব অন্যকে প্রভাবিত করবে। নিরবিচ্ছিন্ন উপাসনার  অভ্যাস তোমার মনকে উচ্চস্তরে তুলে রাখতে সহায়তা করবে। 

গুরুদেব, মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন এই সময় দীক্ষাবীজ উচ্চারণ করবে।  যা আসলে পরম-ঈশ্বরের গুনবাচক শব্দ মাত্র। আমাদের আলোচ্য বিষয় যেহেতু, অদীক্ষিত ব্যক্তিদের জন্য। তাই আমি বলবো আপনি যেকোনো  ইষ্ট-দেবতার নামের সঙ্গে প্রণব (ওঁং)আদি-অন্তে  যোগ করে, অথবা গায়েত্রী মন্ত্র , মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র ইত্যাদি যে কোন মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারেন। তবে মন্ত্রের সঠিক অর্থ ও উচ্চারণ জেনে নেবেন। মন্ত্রের অর্থ না জানলে সেই  শব্দ আপনার ভিতরে আলোড়ন তুলতে পারবে না। 

এই প্রসঙ্গে একটা সত্য ঘটনা বলি।  আমি তখন দুর্গাপুরে কাজ করি। আমাদের অফিসে একজন সহজ-সরল ইংরেজি না জানা কর্মচারী ছিল। তাকে কেউ একজন "thank  you" বলেছিলো।  ও আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো "থ্যাংক্যু" কাকে বলে ? আমি বললাম - thank you মানে ধন্যবাদ। ও আবার জিজ্ঞেস করলো সেটা কি ভালো না খারাপ। বললাম ভালো-খারাপ কিছু নয়। ও সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গেলো লোকটার কাছে। গিয়ে বললো : থ্যাংক্যু যদি ভালো হয় তো ভালো।  আর যদি খারাপ হয় তবে তোর  বাবা থ্যাংক্যু তোর মা থ্যাংক্যু তো চোদ্দগুষ্ঠী থ্যাংক্যু। বলে গর্বের  সঙ্গে আমার দিকে তাকালো। তো বুঝুন শব্দের মানে যদি আপনি না বোঝেন, অর্থাৎ মন্ত্রের মানে যদি আপনি না বোঝেন, তবে আপনার মধ্যে কোনো আলোড়ন হবে না। আর যদি বোঝেন আপনি সেইমতো আন্দোলিত হবেন।   

তবে আমি একটা কথা বলি, আপনি সব কিছু ছেড়ে, শুধু "ওঁং" এই শব্দটিকে আশ্রয় করুন। ইনিই সব মন্ত্রের মূল। এটি এমন একটি শব্দ - যা অদৃশ্য নিরাকার, নিরপক্ষের প্রতীক। আবার সাকারের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার করা চলে। এটি একাধারে শব্দ আবার ধ্বনি। শব্দ অর্থাৎ যার অর্থ আছে। আর ধ্বনি অর্থাৎ মূর্ছনা আছে কিন্তু মানে নেই। আবার ধ্বনিরও উর্দ্ধে।  অর্থাৎ ধ্বনি সৃষ্টি হয় আঘাতে, অর্থাৎ দুটো জিনিসের আঘাতে ধ্বনির সৃষ্টি। ওঁং এমন জাদুকাঠি যা এমনি এমনি হয়। একটু ব্যাখা  করে বলি।  যখন আমরা কথা বলি, তখন আমরা শব্দব্রহ্মের   স্থুল রূপটি শুনতে পাই।  একে বলে বৈখরী। এই বৈখরী সাধারণত কন্ঠনালী ও জিহ্বা প্রভৃতির আলোড়নে সৃষ্টি হয়। এর পেছনে আছে শব্দ যা চিন্তাপ্রণালীর কাজ। একে বলে মধ্যমা ধ্বনি। চিন্তা আরো সূক্ষ্মতর আবেগের ফল। চিন্তাও শব্দ সমষ্টি মাত্র।  একে বলে পশ্যন্তি ধ্বনি।  এই পশ্যন্তি ধ্বনির  উৎপত্তি শব্দব্রহ্ম থেকে। এই স্তরের ধ্বনিকে বলে পরা। সুতরং বলা যেতে পারে শব্দের শুরু প্রথমে পরা, তারপর পশ্যন্তি, তারপরে মধ্যমা, তারপরে বৈখরী যা আমরা শুনে থাকি। 
চিন্তা এক গতিশীল কার্যপদ্ধতি। আর তার জন্ম  হলো এক অপ্রকাশিত উৎস থেকে। যা আমাদের দেহ-মনকে প্রভাবিত করে। সাধারণত  অশুভ চিন্তায় আমরা মনের গভীরে প্রবেশ করি না। শুভ চিন্তায় আমরা  গভীরে প্রবেশ করি। আর আধ্যাত্মিক চিন্তা আমাদের আরো বেশী গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। মন্ত্র আমাদের উৎসে পৌঁছিবার পথ দেখিয়ে দেয়। মন্ত্র আমাদের উৎসের অনুভূতি অর্থাৎ আনন্দ উপলব্ধি করায়।  এটাই আধ্যাত্মিক অনুভূতি। ঠিক ঠিক জপ্ করতে পারলে আপাত-স্তব্ধ ধ্বনি, জীবন্ত হয়ে ওঠে, শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এটা ঠিক ভাষায় বোঝানো যায় না। যে ভাগ্যবান সাধক এই অকৃত্তিম-অনাবিল আনন্দ  উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তিনিই একমাত্র জানেন।

আমি বেশি কথায়  যাবো না। যদিও ওম, বা ওং  বা ওঁং এর কোনো মানে হয় না।  এটি নাদব্রহ্ম। আমাদের উৎসের সঙ্গে ওঁনার সন্মন্ধ। তাই এঁকে ব্যাখ্যা করা মানে ওঁনাকে সীমিত করা। তবু ঋষিরা যা বলেছেন তাই বলি।  সত্ত্ব রজঃ তম - অর্থাৎ সমস্ত গুনের প্রতীক উঁনি। সৃষ্টি-স্থিতি-লয় এর প্রতীক উঁনি। সমস্ত দুঃখ হরণকারী, সুখদায়ক এই "ওঁং"।

এবারে বলি, এই প্রণব কি ভাবে জপ্ করতে হবে।  আসলে জপ্ যখন জোরে উচ্চারিত হয় তখন তাকে বলে বাচিক জপ্। যখন মন্ত্র মনে মনে উচ্চারিত হয় কিন্তু ঠোঁট নড়ে, তখন বলে উপাংশু জপ্। আর যখন ঠোঁটও নড়বে না অথচ মনে মনে জপ্ করাকে বলে মানসিক জপ্। এই জপ্ প্রথম দিকে বাচিক, তারপরে উপাংশু, এবং সবথেকে শেষে মানসিক জপ্ করতে বলা হয়। আমি বলি - আপনি প্রথমে শব্দ বা মন্ত্র উচ্চারণ করুন, যতক্ষন পারেন করতে থাকুন , একসময় দেখবেন, আপনার আর উচ্চারণ করতে ইচ্ছা করছে না। তখন আপনি যদি লেগে থাকেন  তখন আপনার জপ্ উপাংশুতে পরিণত হবে। ধীরে ধীরে মানসিক জপে পরিণত হয়ে যাবে ।  আপনি শুধু জপে  লেগে থাকুন।সময়ের দিকে নয়। মনটা ভিতরে নিবিষ্ট করুন।  অল্প দিনেই আপনার নেশা ধরে যাবে। ভালো থাকার অদ্ভুত উপায়। ঘড়ি ধরে কখনো উপাসনা হয় না। যতক্ষন পারবেন, উপাসনায় থাকুন। যখন আপনার জিহ্বা আপনা আপনি থেমে যাবে, তখন মনে হবে মন্ত্র আপনার ভেতর থেকে বেরুচ্ছে। আর আপনি মন্ত্রের অক্ষর বা আকার দেখতে পাচ্ছেন। এর পরে আকার মুছে যাবে শুধু অহং আর চৈতন্য থাকবে।

রামকৃষ্ণ বলতেন জপ্ করো মনে, বোনে আর কোনে। একটা নির্জন জায়গায় বেছে  
নাও । সচেতন ভাবে জপ্ শুরু করো। আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা সূক্ষ্ম থেকে বৌদ্ধিক বা চিন্তার স্তরে  যাবো। তারপর আধ্যাত্বিক বা চেতন স্তরে  যাবো। এই সময় নিম্ন স্তরের স্পন্দন বা চিন্তা আমাদের পরিহার করতে হবে। অন্তরীক্ষে শব্দ, ছবি  ভেসে বেড়াচ্ছে। রেডিও/টিভি যেমন এগুলোকে ধরবার জন্য রিসেপ্টর হিসেবে কাজ করে আবার প্রজেক্টর হিসেবে কাজ করে,  তেমনি তুমি যখন অন্তরে লিন হবে তখন তোমার তিনটি সত্ত্বা সক্রিয় থাকবে। রিসেপ্টর(গ্রাহক), প্রজেক্টর (অভিক্ষেপক) এবং ভিউয়ার বা দর্শক। এই সময় তোমার মধ্যে পবিত্রতার তারতম্য অনুযায়ী মনের ইচ্ছে অনুযায়ী বা মনের শক্তি অনুযায়ী অর্থাৎ তোমার অবচেতন মন যা দেখতে চায় তাই দেখতে, শুনতে থাকবে। এই অবস্থা, যে কোনো সাধক উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু মন যত পবিত্র থাকবে তুমি ততো তাড়াতাড়ি এই স্তর পেরোতে পারবে। এইজন্য আধ্যাত্মিক জীবনে পবিত্রতা দরকার। সেই কারণেই, আধ্যাত্মিক জীবনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কিছু কঠোর নিয়ম পালন করতে বলেন গুরুদেবরা। আমার কথা শুনে বা এই লেখা পড়ে তোমার কোনো উপলব্ধি হবে  না।
সতর্কতা :
ধ্যান বা জপের সময় ঘুম বা তন্দ্রা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। ঘুম ঘুম ভাব এলে কিছুক্ষন পায়চারি করে নিলে ভালো হয়।  আর মন যখন চঞ্চল থাকে, তখন জোরে জোরে জপ্ করা উচিত। তাহলে মনের চঞ্চলতা দূর হয়ে যাবে। জপ্ শুরু করার আগে, বিশ্বাস একান্ত প্রয়োজন। কেননা জপের পরিণতি তুমি জানো  না। আর এ এমন একটা রাস্তা যা সময় দিয়ে বা দৈর্ঘ দিয়ে মাপা যায় না। তোমার গভীর বিশ্বাস না থাকলে, তুমি সন্দেহজনক মন নিয়ে এগুতে গেলে তুমি হয় পথভ্ৰষ্ট হবে বা গতি হারিয়ে ফেলবে। ফলতঃ অবিস্বাসী মন নিয়ে এ পথে একদম পা বাড়াবে না। তার চাইতে যেমন আছো তেমন থাকো।  অহেতুক সময় নষ্ট না করা ভালো। 

সমাপ্ত    তৃতীয় ভাগ ।    
        
          


  

 

Friday 7 September 2018

সত্যধর্মের আলোতে গুরুতত্ব (দ্বিতীয় ভাগ )


গুরুবিনা কি সাধন হবে না ? (দ্বিতীয় ভাগ )





আগেরদিন আলোচনা করছিলাম - গুরুতত্ব সত্যধর্মের   আলোতে। এবং বলছিলাম যে ,
আমার  যদি ব্যাকুলতা না থাকে, আমার যদি চেষ্টা না থাকে, হাজার গুরু করলেও আমার  কোনো
উন্নতি হবে না। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন : যদি তেত্রিশ কোটি দেবতায় বিশ্বাস থাকে অথচ তোমার আত্মবিশ্বাস না থাকে, তবে কখনোই তোমার মুক্তি হবে না।

আমি যদি আন্তরিক না হই   স্বয়ং ভগবানও আমার ভালো করতে পারবে না। আর আমার যদি ব্যাকুলতা থাকে,  আমার যদি আন্তরিকতা থাকে, আমার যদি প্রবল আগ্রহ থাকে, তবে ভালো গুরুও পাওয়া যাবে, ভগবানকেও পাওয়া যাবে। মাটিতে চিনি ফেলে রাখুন, কোত্থেকে পিঁপড়ে এসে যাবে, আপনি জানেন না। গাছে ফল পাঁকলে, কোত্থেকে কাঠবিড়াল এসে যাবে, পাখি এসে যাবে তা আপনি জানেন না।  কিন্তু আসে। এটাই সত্য। আমরা যদি খাঁটি শিষ্য হতে পারি, তবে সত্যিকারের গুরু কোত্থেকে আসবেন, কবে আসবেন, তা আপনি-আমি জানি না। তবে আসবে এটা  নিশ্চিত।

এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি।  গল্প তো অনেক আছে।  গুরু ছাড়াও যে বিদ্যালাভ হয় এমনকি ব্রহ্ম-বিদ্যা লাভ হয়, সে প্রসঙ্গে  ছান্দোগ্য-উপনিষদ থেকে একটা কাহিনী বলি।

সত্যকামের নাম শুনেছেন নিশ্চই।  মহান ঋষি। যিনি জাবাল সত্যকাম নামে পরিচিত। জাবাল হচ্ছে তাঁর মায়ের নাম।  গোত্র পরিচয়হীন সত্যকাম। অর্থাৎ পিতৃ পরিচয় যার জ্ঞাত নেই। সেই গোত্র পরিচয় হীন সত্যকাম,  তার সরলতার জন্য, মহাঋষি গৌতমের আশ্রমে জায়গায় পেয়েছিলেন । সত্যকাম গুরুকরনের  আশায় যেদিন ঋষি গৌতমের সামনে উপস্থিত হলেন, প্রথম দর্শনেই সত্যকামকে ঋষি গৌতমের ভালো লেগে গেল। কিন্তু এই গোত্র পরিচয় হীন বালককে দীক্ষা দিলেন না। তাকে আগে উপনয়ন করালেন।  অর্থাৎ পৈতে পড়ালেন। সোজা কথায়  ব্রাহ্মণ সন্তান বানালেন। আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, কোনো এক অজ্ঞাত কারনে, এমনও হতে পারে, আশ্রমবাসী ব্রাহ্মণ সন্তানরা গুঞ্জন তোলায়, তাকে তিনি আশ্রমে রাখলেন না, কোনো উপদেশ দিলেন না। কেবল শ-চারেক দুর্বল ও কৃশ অর্থাৎ হাড্ডি মাস সার গরু দিয়ে বললেন, যাও এদের সেবা করো। সত্যকাম অভিমানের সুরে বললেন - ঠিক আছে, এরা যতদিননা সংখ্যায় হাজার হচ্ছে ততদিন আমি ফিরবো না। এই বলে  গুরুগুলোকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

সত্যকাম গরুগুলোকে নিয়ে চললেন গভীর জঙ্গলে। যেখানে লোকালয়ের কোনো খবর না পৌঁছয়। যেখানে আশ্রমের কোনো খবর না পৌঁছয়। যেখানে শুধু প্রকৃতির অঢেল আশীর্বাদ। মানুষের কোলাহল বর্জিত নির্জনস্থান। শুধু নদীর শীতল জলের কলকল ধ্বনি।  পাখির কুজন। কোমল কচি ঘাস। আর আছে গাছ ভরা  ফল। শান্ত, নীরব, ধ্যানময় জীবনের জন্য অপূর্ব দেব-ভূমি। বালক সত্যকাম গরুগুলোর দেখা শুনা করেন, সকাল সন্ধ্যা ধ্যানে মগ্ন  থাকেন। নির্জনে গরুদের সঙ্গে কথা বলেন। গাছের সঙ্গে কথা বলেন। নদির জলের সঙ্গে কথা বলেন। অদ্ভুত ভাবে প্রকৃতির একজন হয়ে গেলেন। এখন গরুরাও  ওর কথা বোঝে, সত্যকামও  গরুদের কথা বোঝে, গাছেরা ওর  কথা বোঝে, গাছের কথা সত্যকাম বোঝে, নদীর  ভাষায়  সত্যকাম কথা বলে। সমস্ত কিছুর মধ্যে ও অর্থাৎ সত্যকাম  চেতনার সাক্ষাৎ করে। মাঝে মাঝে  আশ্রমের কথা মনে পড়ে। মায়ের মুখ খানি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আবার সব ভুলে যায়।  প্রকৃতির একজন হয়ে যায়।

 এই ভাবে কত দিন, কত মাস, কত বছর কেটে গেছে, তা সে জানে না। একদিন শুনলো, একটা বৃষ বলছে  এসো সত্যবান আমি তোমাকে ব্রহ্ম-কথা বলি। আমরা তো এখন হাজার হয়ে গেছি।  এখন তো তোমার আশ্রমে ফিরে যাবার সময় হলো।  তার আগে ব্রহ্ম কথা শোনো।  যে কথা শোনার জন্য, যাঁকে  জানার জন্য তুমি প্রানপ্রিয় মাকে  ছেড়ে আশ্রমে এসেছিলে সেই ব্রহ্ম-কথা বলি শোনো। এই বলে বৃষরুপী বায়ুদেবতা, অগ্নিদেবতা, হংসরূপী সূর্যদেব, এবং মদগু নাম্নী এক জলচর পাখী যা বলেছিলো তা হলো :

ব্রহ্মের চারি পাদ : প্রতি পাদের চারটি কলা :
প্রথম পাদের  : পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ এই চারটি কলা।
দ্বিতীয় পাদ  : জীবজন্তু, তরুলতা পূর্ন সুন্দর পৃথিবী এক কলা ;  অন্তরিক্ষ আর একটি কলা  ;  দীপ্ত দ্যুলোক একটি কলা ; বিশাল সমুদ্র আর একটি কলা।
তৃতীয় পাদ  : অগ্নি, চন্দ্র, সূর্য ও বিদ্যুৎ -  এক একটি কলা।
চতুর্থ পাদ :  প্রাণ শক্তি, দৃষ্টিশক্তি,  শ্রবণ শক্তি, এবং মন - এক একটি কলা।

সত্যকাম সহস্রাধিক হৃষ্টপুষ্ট ধেনু সকল নিয়ে এবার গুরু গৌতমের আশ্রমে এলেন। গুরুকরণের মোহ  তার কেটে গাছে। মনে তার অনাবিল আনন্দ, অহেতুক আনন্দ।নির্মল আনন্দ। শরীরে তার জ্যোতি বেরোচ্ছে।   সারা মুখে এক জ্যোতি।  সত্যকাম এসে গুরুকে প্রণাম করলেন। গুরুত্ব সত্যকামকে  দেখে অবাক। সারা মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তির জ্যোতিঃ, এক দীপ্তি, অথচ বিনম্র।

এর পরের  ব্যাপারটা শুনুন  :  গুরুদেব গৌতম ভাবলেন, কাম সারছে।  এই ব্যাটা তো গুরুগিরি ঘুচিয়ে দেবে। বললেন : হে সৌম্য ! তোমাকে ব্রহ্মজ্ঞানীর ন্যায় দীপ্ত দেখাচ্ছে।  তুমি কি কারুর কাছ থেকে ব্রহ্ম-জ্ঞান লাভ করেছো ? সত্যি করে বলো।

সত্যকাম বিনম্র ভাবে বললো : হ্যাঁ ভগবান, আমি ব্রহ্ম-জ্ঞান লাভ করেছি।  কিন্তু কোনো মানুষের কাছ থেকে নয়, প্রকৃতি-দেবতাদের কাছ থেকে আমি এই গুহ্য বিদ্যা লাভ করেছি।

গুরুদেবের চিন্তা হয়ে গেলো।  বললেন  : শোনো গুরু ছাড়া কোনো মানুষ বা দেবতার কাছ থেকে এই শিক্ষা লাভ করা যায় না। আমি তোমাকে সমুদয় ব্রহ্ম তত্ত্ব উপদেশ করছি।  তুমি স্থির চিত্তে এই ব্রহ্মবিদ্যা গ্রহণ করো।  এই বলে আবার একবার গুরুদেব, একই কথা অর্থাৎ যে কথা প্রকৃতির কাছ থেকে  শুনেছিলেন, সেই কথাই   বলে গেলেন।

তো যেটা বলছিলাম। নিজের মধ্যে আকুতি জাগলে,  নিজেকে তৈরী করতে পারলে, নিজেকে উপযুক্ত করে তুলতে পারলে গুরু এসে যাবে। শুধু নিজেকে জাগান, আর অপেক্ষা করুন । নিজের ভিতরেই গুরু জাগ্রত হয়ে যাবেন।

মহাত্মা গুরুনাথের দেহধারী গুরু কে ছিলেন ? শুনেছি দেবাদিদেব মহাদেব তার গুরু ছিলেন। তাহলে তো এটা মনে হয়, দেহধারী ব্যক্তি ছাড়াও গুরুকরন হয়। আসলে আপনি কাকে গুরু ভাবছেন সেটাই বড়  কথা। আপনি নিজেকে কতটা যোগ্য করে তুলতে পারছেন সেটাই বড়  কথা। আপনার গুরু কে ছিলেন, তিনি কত গুণী ছিলেন, তার কত নামডাক ছিল, তার কত শিষ্য আছে বা ছিল, সেটা বড় কথা নয়। আপনি  গুরু হতে পেরেছেন কি না সেটাই বড় কথা। প্রকৃত গুরুর কাজ শিষ্য করা নয়। প্রকৃত গুরুর কাজ গুরু তৈরি করা। শিষ্য তৈরি করা নয়। চেলা তৈরী করা নয়। প্রজ্বলিত প্রদীপ থেকে প্রদীপ জ্বলতে পারে। প্রকৃত গুরু থেকে গুরুই হতে পারে। যারা নিজেরা চেলা, তারা চেলাই তৈরী করে।  সত্যিকারের গুরু কখনো চেলা তৈরী করে না। সত্যিকারের গুরু সর্বদা গুরু তৈরী করে।




















  

Thursday 6 September 2018

প্রশ্ন ও উত্তর

১. ধর্ম্ম বলতে কি বোঝায়  ?

ধৰ্ম বলতে আমি বুঝি, প্রকৃতির নিয়ম। ধর্ম্ম মেনে চলা মানে প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলা। আগুনের ধৰ্ম উত্তাপ প্রদান করা বা শুষ্ক করা । জলের ধৰ্ম আদ্র করা। বাতাসের ধৰ্ম  ছড়িয়ে দেওয়া। তেমনি মানুষের ধৰ্ম আত্ম-উপলব্ধি করা। 
   
২. ধর্ম্ম পথে চলতে গেল, একান্তভাবে, কি কি বিষয়ের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন ?

ধৰ্ম পথে চলতে গেলে, অজ্ঞানতাকে কাটিয়ে উঠতে হবে। প্রকৃতির ধর্মকে বুঝতে হবে। প্রকৃতি ও পুরুষের মিশ্রনেই এই জগৎ। প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে চলে। পুরুষ আপন খেয়ালে চলে। প্রকৃতিতে কার্য কারন সম্পর্ক আছে। পুরুষে কোনো কার্য কারন সম্পর্ক  নেই। ইচ্ছাশক্তি পুরুষের। কর্মশক্তি প্রকৃতির।   

৩. মহাত্মা গুরুনাথ প্রবর্তিত "সত্য ধর্ম্ম" আপনার কাছে আদর্শ ধর্ম্ম বলে মনে হয় ?

ধৰ্ম একটাই।  সত্য, অসত্য বলে কিছু নেই। ধৰ্ম কখনো অসত্য হয় না। ধৰ্ম স্থিত।  একে পরিবর্তন করা যায় না।  মানুষের কল্যাণের জন্য মহাপুরুষরা কিছু পথ বা  উপায় বলে দেন।  সেটাকেই আমরা ধর্মপথ  বলে মনে  করি। মহাত্মা গুরুনাথ প্রবর্তিত সত্য-ধৰ্ম এমনি একটি পথ মাত্র। এখানে উনি বহু ধর্মপথের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। ধৰ্মপথ  বলতে সাধারণতঃ আমাদের যেটা বলা হয়ে থাকে - সেটা হলো, সত্য কথা বলো, সৎ পথে চলো, সৎ সঙ্গ করো। ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি কিন্তু  ধৰ্ম বলতে আমি বুঝি, প্রকৃতির নিয়ম। ধর্ম্ম মেনে চলা মানে প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলা। আগুনের ধৰ্ম উত্তাপ প্রদান করা বা শুষ্ক করা । জলের ধৰ্ম আদ্র করা। বাতাসের ধৰ্ম  ছড়িয়ে দেওয়া। তেমনি মানুষের ধৰ্ম আত্ম-উপলব্ধি করা। স্ব-স্থিত থাকা। আমরা স্ব-স্থিত থাকতে পারিনা বলে, যত দুঃখ - কষ্ট পাই। আমরা নিজেকে ভুলে গেছি বলে এতো দুঃখ। আমরা নিজেকে ভুলে যাই বলে এতো কষ্ট।

কেউ তার নিজের ধর্ম ছোট মনে করে না। আপনারাও নিশ্চই আপনাদের ধর্মকে ছোট মনে করেন না। এ প্রসঙ্গ একটা গল্প বলি। উপনিষদের গল্প : ছান্দোগ্য উপনিষদের গল্প।

একদিন প্রাণ অর্থাৎ শ্বাস, মন, বাক্য, চোখ, কান এদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া বাঁধলো।  প্রত্যেকেই বলছে আমি বড়ো। কিন্তু কে বড়ো কিছুতেই মীমাংসা হয় না। শেষে কোনো উপায় না দেখে, সকলে পরামর্শ করে তাদের পিতা প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলো। বললো : বাবা আমাদের মধ্যে কে বড়  তা ঠিক করে দিতে হবে।  প্রজাপতি তো সব কিছুর স্রষ্টা। দেবতা অসুর, পৃথিবী, গাছপালা, মানুষ, - এমনকি মানুষের মন, প্রাণ, হাত, পা, চোখ কান, সমস্তই  তার সৃষ্টি। সবারই পিতা তিনি। ভালো মন্দ, জ্ঞানী, অজ্ঞানী সবই  তার সৃষ্টি। সন্তানতুল্য। ব্রহ্মা পড়ে গেলেন মহা বিপদে, কাকে ছোট বলবেন, আবার কাকেই বা বড়ো বলবেন। হাজার হলেও বাবার কাছে সব ছেলেই তো সমান।  কাকেই বা ছোট বলবেন কাকেই বা বড়ো বলবেন ।  প্রজাপতি ব্রহ্মা। বুদ্ধির ডিপো।  উপায় একটা বার করে ফেললেন।  এবং বললেন - তোমাদের মধ্যে কে শরীর  ছেড়ে গেলে শরীরের অবস্থা সব থেকে খারাপ হয়, সেই শ্রেষ্ট।

বকবক যে বেশি করে অর্থাৎ বাক্য অমনি লাফিয়ে পড়লো। - আমি চললাম - দেখি এবার তোমাদের  কি দশা হয়? আমিই সব চাইতে বড়, এটা  যতক্ষন পর্যন্ত স্বীকার না করছো ততক্ষন আমি আর আসছি না।  বাক্য শরীর  ছেড়ে গেল। - কিন্তু বোবা মানুষও তো বাঁচে। এখন আর শরীর  কথা বলে না বটে। চোখে দেখে, কানে শোনে, মন দিয়ে ভাৱনা-চিন্তা করে। প্রাণে তো বেঁচে আছেই। কাজেই বিশেষ অসুবিধা হলো না। এখন এক মাস, দুই মাস, ছয় মাস, এক বছর  হয়ে গেল। কেউ আর তাকে ফিরিয়ে নেবার জন্য এলো না। বাক্য শেষপর্যন্ত হতাশ হয়ে  এসে দেখেদেখলো, শরীরটা তো বেশ ভালোই আছে। বরং আগের চাইতে আরো ভালো হয়েছে। দেখে একটু বিমর্ষ হলো। বললো কি হে সব কেমন আছো ? সবাই বললো - ভালোই ছিলাম। কথা বলতে পারিনি বটে, তবে,চোখে দেখেছি, কানে শুনেছি, মন দিয়ে  ভাবনা-চিন্তাও করেছি, আর প্রানে যে বেঁচে  ছিলামই, তাতো দেখতেই পারছো । বাক্যের মাথা হেট্ হয়ে গেল।  কথা না বলে, সুরসুর করে শরীরের মধ্যে প্রবেশ করলো।

এবার চোখ আল্ল্হাদে নেচে উঠলো। বাক্যের সঙ্গে তার লড়াইটা সবচেয়ে বড়। তাই বাক্য যখন হেরে গেছে, তখন সে ভাবলো, আমি ছাড়া পৃথিবী অন্ধকার। দুনিয়াটা তো আমিই দেখি। হয় এবার আমাকে বড়ো বলে মানো, নতুবা আমি চললাম। কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে, চক্ষু গড গড  করে শরীর থেকে বেরিয়ে পড়লো। কিন্তু অন্ধের ওতো জীবন চলে। চোখে দেখতে পারছে না বটে, কিন্তু কথা বলছে, কানে শুনছে, মনে চিন্তা-ভাবনা করছে আর প্রাণে তো বেঁচে আছেই। চক্ষুও এক বছর, বাইরে থেকে, কারুর কাছ থেকে ফেরার ডাক না পেয়ে, ফিরে এসে দেখে,  শরীর  তো ভালোই আছে।বরং আরো ভালো হয়েছে।  তাই কোনো কথা না বলে চুপি চুপি আবার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করলো।

এবার চোখের নিকটতম প্রতিবেশী হচ্ছে কান। তারও অহংকার কম নয়। যখন চোখের সামনেই চোখের  পরাজয় ঘটলো, কান ভাবলো এবার আমার শ্রেষ্টত্ব দেখাই না কেন।  হয় এবার আমাকে বড়ো বলে মানো, নতুবা আমি চললাম। কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে, কান  গড গড  করে শরীর থেকে বেরিয়ে পড়লো। কিন্তু বধির-এর  ওতো জীবন চলে। কানে শুনতে  পারছে না বটে, কিন্তু কথা বলছে, চোখে দেখছে , মনে চিন্তা-ভাবনা করছে আর প্রাণে তো বেঁচে আছেই। কান-ও  এক বছর, বাইরে থেকে, কারুর কাছ থেকে ফেরার ডাক না পেয়ে, ফিরে এসে দেখে,  শরীর  তো ভালোই আছে বরং আরো ভালো হয়েছে ।  তাই কোনো কথা না বলে চুপি চুপি আবার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করলো।

এবার মন।  সে শুধু ভাবে।  বিচার করে, চিন্তা করে। চিন্তা হীন জীবন হয় নাকি ? তাহলে আমিই শ্রেষ্ট। মন বললো দেখো, আমি আর প্রান,  এ ছাড়া তো কেউ আর বাকি রইলো না। প্রাণ করে টা  কি ? কেবল আসে আর যায়। তোমরা তাহলে আমাকেই শ্রেষ্ট বলে মেনে নাও। আসলে প্রাণ  এই লড়াই-এ ছিলই  না। কোনো কথাই বলে নি। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে মন এবার রেগে মেগে বেরিয়ে গেল। দেখ কেমন লাগে। এখন আর শরীরে বিচার নাই, চিন্তা নাই, ভাবনা নাই। তবু শরীর বেঁচে আছে।
তবে কে বড়ো  ? মন-ও এক বছর  পরে ফিরে এলো। এসে দেখে শরীরতো দিব্যি আছে। কোনো কথা না বলে মন শরীরের মধ্যে প্রবেশ করলো।

এবার প্রাণের পালা। প্রাণ  জানে কে বড়ো। যে বড় তার অহংকার নেই। বড়ো বড়ো কথাও বলে না। নীরবে নিভৃতে নিজের কাজ করে চলে। আর তার জন্যই  সবার বাড়-বাড়ন্ত ।  সবার অহংকার। সেই সকলকে পোষন করছে। সেই সবাইকে শক্তি যোগাচ্ছে। কিন্তু সে নির্বিকার। সকলের অভিমান যখন চূর্ণ হয়ে গেল - তখন নিজেকে জানান দেবার জন্য প্রাণ শরীর  ছাড়ার উপক্রম করলো। ত্রাহি ত্রাহি রব  উঠে গেলো সবার মধ্যে। বিপদ বুঝে মন, বাক্য, চক্ষু, কান সবাই এসে প্রাণের পায়ে পড়লো।  ছেড়ে যেও না, ছেড়ে যেও না। তুমিই সব, তুমিই সব, তুমিই বড়, তুমিই শ্রেষ্ট, তুমিই বশিষ্ট, তুমিই প্ৰতিষ্ঠা, তুমিই সম্পদ, তুমিই আয়তন, তুমিই আত্মা - তুমি চলে গেলে সব শব্  হয়ে যাবে ।              

এখন সত্য-ধর্ম্ম আদর্শ ধর্ম্ম কেন ? ধরুন আপনি একটা সোনি কোম্পানির  টিভি কিনেছেন। এখন টিভি কেনার সময় সময় আপনাকে একটা লিফলেট দিয়েছে। তাতে কিছু সতর্কবাণী লেখা আছে। যেমন, এটি আগুনে পুড়ে যাবে, জলের মধ্যে টিভি রাখলে টিভি নষ্ট হয়ে যাবে। ইত্যাদি, ইত্যাদি। এখন টিভিটা যদি ভাবে, বা টিভির ক্রেতা যদি ভাবে, আমি জলেও থাকবো  , আগুনের কাছেও যাবো , দেখিনা কি হয় ? তাহলে কি হবে ? অক্কা পেয়ে যাবে।  হবে না ? হবে। তেমনি ভগবান যখন মানুষকে বা এই জীব জগৎকে, সৃষ্টি করেছেন তখন কিছু সতর্ক বাণী বলে দিয়েছেন। এটাই ভগবানের আইন, কুদরত কি কানুন। প্রকৃতির নিয়ম। বিধির বিধান। ভগবানের এই বাণী নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করবো। এখন  আমাদের  সেই  সতর্ক বাণী মেনে চলা উচিত।  যদি না করি তাহলে আমাদের দুঃখ হবে। আমরা দুঃখী হবো। এবং আমাদের দুঃখী হবার এটাই কারন।

এখন টিভিটা খারাপ হয়ে গেলে কি করবো ? কেউ বলবে, বাড়িতে মিস্ত্রি ডাকো। কেউ বলবে দোকানে নিয়ে যাও। আমি বলবো কোম্পানিকে খবর দাও। কেননা একমাত্র কোম্পানিই জানে এর মধ্যে কি আছে, এবং কি ভাবে একে  ভালো করতে হবে। মহাত্মা গুরুনাথ এই কোম্পানিকে খবর দেবার কথাই বলেছেন। তিনি সাধুদের কাছে যেতে বলেননি। দেবতাদের কাছে যেতে বলেননি। পরম-আত্মার কাছে অর্থাৎ পরম-পিতার কাছে যেতে বলেছেন। যিনি আমাদের সৃষ্টি-কর্তা।  অন্যরা ঘরে, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গনেশ, কৃষ্ণ, শিব কে ডেকে আনতে  বলছেন। কেউ বলছেন আশ্রমে  যাও।  পাহাড়ে যাও।  মন্দিরে যাও, মাসজিতে যাও গুরুদ্বারে যাও ।  গুরুদেব বললেন পরমাত্মার কাছে বস।  তার  কাছে বস উপাসনা কারো , তাকেই ডাক, তার কাছে প্রার্থনা জানাও। ভজন কারো । এইখানেই সত্যধর্ম আর অন্য্ ধর্মের মধ্যে পার্থক্য। ওরা বলছে দেবতাদের পূজা করো, ওরা  বলছে আশ্রমবাসী হও। মহাত্মা বলছেন সব ছেড়ে এককে ধরো।

এখন এই প্রকৃতির আইন  কি ? আর পুরুষের আইন  বা কি ?

প্রকৃতির জগতে কারন ভিন্ন কর্ম হয় না। প্রকৃতির তার নিজস্ব নিয়মে চলে। এখানে কারুর হাত নেই।
তুমি বীজ লাগাও গাছ হবে।  গাছ লাগাও ফল হবে। পরিবেশ পেলে অবশ্যই  হবে। প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মানুবর্তিতা আছে। তোমার ইচ্ছে মতো সে হবে না। সময় ও পরিবেশ পেলে তবেই হবে। এবং নির্দিষ্ট ফলই  দেবে। এর জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। পরিচর্যা করতে হবে। বীজ লাগিয়েই গাছ দেখতে পারবে না।  সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ পেলে তবেই হবে।

কিন্তু পুরুষের জগৎ আলাদা। এখানে কোনো নিয়মের বালাই নেই। এখানে আবেগই শেষ কথা। অসীম অনন্ত পুরুষ আপন খেয়ালে ভাঙছেন গড়ছেন। ইচ্ছাই শেষ কথা। এই দুটিরই অবস্থান আছে আমাদের মধ্যে। তাই আমরা প্রকৃতি পুরুষের মিশ্রণ।

 আমরা গুন্ থেকেই দ্রব্য চিনতে পারি ।  আমরা গুন্ থেকেই সাধারণ পুরুষ ও মহাপুরুষের মধ্যে পার্থক্য নির্নয় করতে পারি। অতএব তুমি যদি সাধারণ পুরুষ থেকে উত্তম পুরুষ হতে চাও তবে যে  গুনের সাধনা কারো। 
গুরুদেবও, এই গুনের সাধনার কথা বলেছেন। প্রেমের সাধনা, অর্থাৎ সর্ব উচ্চতম গুনের সাধনা। মাস্টারের ছবি  সামনে রেখে ধ্যান করলে জ্ঞান হয় না। শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। মাস্টার মহাশয় যা বলেছেন তাই করতে হয়। মানতে হয়।

সব শেষে বলি, আপনাদের মধ্যে যে আত্মিক সম্পর্ক আমার চোখে পরে, সেটাই আমাকে সত্য ধৰ্ম সম্পর্কে জানতে উৎসাহ জোগায়। সত্য ধর্মের এখানেই সার্থকতা।
   
        
     
৪. সাধনা, ভজনা, উপাসনা  ভিন্ন মানব জীবনে, ধর্ম্ম পথে চলা সম্ভব কি না ?

সাধক যা করেন তাই সাধনা।  ভক্ত যা করেন, তাই ভজনা।  ঈশ্বরের কাছে উপবেশন মানেই উপাসনা। এগুলো সবই মনের ধৰ্ম। মানসিক বৃত্তির উন্নতি সাধনে, এগুলো সহায়ক। আগেই বলেছি, পুরুষ আপন খেয়ালে চলে।  তাকে ধরা যায় না।  তিনি ধরা দেন।   

৫. সংগীত ধর্ম্ম পথে কতটা সহায়ক ?

ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য যত  পথ আছে, যা মানসিক বৃত্তির উন্নতি সাধনে সহায়ক, তার মধ্যে সংগীত সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। তাই সঙ্গীত ধৰ্ম পথে অবশ্যই সহায়ক।

তবে একটা কথা বলি, মহাত্মা গুরুনাথের বই পড়ে  আমার যেটা মনে হয়েছে, ধর্ম্মপথে চলতে চলতে আমাদের অনেক গলি ঘুচি দিয়ে প্রধান রাস্তায় আসতে  হয়। এই প্রধান রাস্তা হচ্ছে একাগ্রতা। এক অর্থাৎ সেই পরমপিতা পরমেশ্বরের সঙ্গে নিজেকে এক করা, এককে অগ্রাধিকার দেওয়া ।  একাগ্রতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আর একদিন হবে। এই গলি হচ্ছে গান। এটি প্রধান রাস্তায় যাবার পথ মাত্র। প্রধান রাস্তা নয়। যারা গলির মধ্যে থাকেন, তাদের তো গলি পেরোতে হবে। তাই গান ভালো। অন্তরের মলিনতা দূর করে, এই ধর্মসঙ্গীত ।   তবে এটা রাস্তার প্রারম্ভ মাত্র।  ঈশ্বরের পথ থেকে   যেটা বহু দূর। প্রধান রাস্তা হচ্ছে, একাগ্রতা। 

সমাপ্ত