Sunday 25 August 2019

মানুষের আসা যাওয়া - মৃত্যু রহস্য - (দুই ও তিন)

মানুষের আসা যাওয়া - মৃত্যু রহস্য - (দুই ও তিন)

মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ন ঘটনা হচ্ছে তার জন্ম ও মৃত্যু। জন্মের আগে সে ভাবা শেখেনি, তাই জন্মের কারন নিয়ে সে ভাবে নি। কিন্তু মৃত্যুর আগে ভাবতে শিখেছে। তাই মৃত্যুর কারন নিয়ে সে ভাবে।  এক জিজ্ঞাসু একদিন আচার্য্যের  কাছে গিয়ে এই জন্ম - মৃত্যুর  রহস্য নিয়ে প্রশ্ন করে বসলো।
জিজ্ঞাসু : হে পিত  জন্ম -মৃত্যুর রহস্যঃ আমার কাছে অজানা। আপনি দয়া করে এ ব্যাপারে আমাকে জ্ঞান দান  করুন।

আচার্য্য  : দেখো মানুষের জন্ম-মৃত্যু এক গভীর রহস্য । এই রহস্য উন্মোচন করতে গেলে আমাদের মুনি ঋষিদের কথার উপর নির্ভর করতে হবে। অর্থাৎ আপ্ত বাক্যের উপর নির্ভর করতে হবে। আমি যা বলবো তার সত্যতা যাচাই করা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমার কথা শোনো ও অন্তরের গভীরে অনুসন্ধান করো। পরা-বিদ্যাজ্ঞানীরা এই  রহস্যের  উন্মোচন করেছেন এই ভাবে। পরাবিদ্যা জ্ঞানীরা বলছেন :
মানুষের যে দেহটা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়, তা আসলে অন্ন দ্বারা গঠিত, অন্ন দ্বারাই পরিপুষ্ট। একেই আমরা স্থুল  দেহ বলি। এই দেহই  আমাদের সকল দোষ-গুনের আধার, এই ধারণা কিন্তু ঠিক নয়।মৃত্যুর পরে, আমাদের দোষ-গুন্ শেষ হয়ে গেলো, এমনটা নয়। মৃত্যুর পরেও আমাদের কর্মফল, আমাদের জ্ঞান, আমাদের স্মৃতি অর্থাৎ আমাদের সঞ্চিত দোষগুণ বা অর্জিত সংস্কার, প্রারব্ধ রূপে  আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। এসব বুঝতে গেলে আগে আমাদের দেহকে আগে বুঝতে হবে।

আমরা সবাই জানি, পঞ্চভূতের তৈরী  এই দেহ।  এই দেহ বিনষ্ট হয়ে গেলে, পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে। আমাদের আর একটা দেহ আছে, সেটা হচ্ছে সূক্ষ্মদেহ বা লিঙ্গদেহ। এই দেহে স্থুল কোনো উপকরণ নেই। আমাদের আবেগ, কামনা, বাসনা, প্রভৃতি সূক্ষ্ম উপকরণে এই দেহ গঠিত।

এই সূক্ষ্ম দেহের ভেতরে আছে  একটি দেহ  তার নাম মানস দেহ।

এই মানস দেহের অভ্যন্তরে অতি সূক্ষ্ম উপকরণে  তৈরী,আর একটি দেহ আছে তার নাম কারণদেহ। এটাই আমাদের মন, বুদ্ধির আধার।

জিজ্ঞাসু : তাহলে কি আমাদের দেহ একটা ফলের মতো। প্রথমে খোসা, তারপরে মাংস, তার পরে আঁটি  ?

আচার্য্য  : না পুত্র, ব্যাপারটা এমন নয়। আমাদের দেহ আসলে পঞ্চকোষের সমষ্টি।  এগুলো হচ্ছে, অন্নময় , প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময়, এবং আনন্দময়।

ধরো জলের মধ্যে একটা স্পঞ্জের বল - স্পঞ্জের বল হচ্ছে আমাদের এই স্থুলদেহ, আর স্পঞ্জের মধ্যে যে জল সেটা হচ্ছে সূক্ষ্ম দেহ, আর জলের মধ্যে যে বাতাস সেটা হচ্ছে মনোময় দেহ। বাতাসের মধ্যে যে ইথার আছে সেটা হচ্ছে বিজ্ঞানময় দেহ,  আর ইথারের মধ্যে আরো সূক্ষ্ম পদার্থ আছে তাকে বলা হয় আনন্দময় কোষ। অর্থাৎ আমাদের শরীরের সর্বত্র পরস্পরের মধ্যে ওতপ্রোত ভাবে সব দেহ একত্রে অবস্থান করছে।

অন্নময় কোষ : অন্ন অর্থাৎ খাবার, অন্নময়  কোষ মানে খাবার দিয়ে  তৈরি যে কোষ রয়েছে আমাদের শরীরে।
প্রাণময় কোষ : অর্থাৎ উর্জা শরীর।  এই শরীর বায়ুর শক্তিতে তৈরী।

মনময়  কোষ : অর্থাৎ মানসিক শরীর, মনের চিন্তার জগৎ ।

এই তিন শরীরকে  ভৌতিক শরীর  বলে। অন্নময়  শরীর স্থূল।  প্রাণময় শরীর  সূক্ষ্ম  ও মনময়  শরীর অতি সূক্ষ্ম।  কিন্তু এই তিন শরীর-ই  ভৌতিক। এই তিন শরীরের উপরেই আমাদের কর্মের প্রভাব পড়বে। স্থূল শরীর  অর্থাৎ অন্নময় কোষ দ্বারা গঠিত শরীরের উপরে কর্মের ছাপ পড়বে।  তেমনি প্রাণময় ও মনময় শরীরের উপরেও কর্মের প্রভাব আছে। কর্ম-বন্ধন  এই তিন শরীরকে জুড়ে রেখেছে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, সিমেন্ট বা আঠার মতো কর্ম এই তিন শরীরকে জুড়ে রাখতে সাহায্য করে। কর্ম বন্ধন এই তিন শরীরকে জুড়ে রাখে। অর্থাৎ আমাদের কামনা বাসনা থেকে উদ্ভুত কর্ম এই শরীরকে সজীব রেখেছে।

এর পরে আছে :
বিজ্ঞানময় কোষ : এটি ভৌতিক নয় কিন্তু ভৌতিক শরীরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে।

আনন্দময় কোষ :  পুরোপুরি অভৌতিক।

বিজ্ঞানময় শরীর যা আসলে অভৌতিক, এই আনন্দময় শরীরের অর্থাৎ অভৌতিক শরীর ও ভৌতিক শরীরের  সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। তার মানে বিজ্ঞানময় কোষ নিজে অভৌতিক, কিন্তু তিনি ভৌতিক ও অভৌতিক শরীরের মধ্যে সম্পর্ক জুড়ে রাখে।

ভৌতিক শরীরের রূপ বা আকার আছে। অন্নময় শরীর অতি স্থূল, তাই আমরা দেখতে পাই। প্রাণময় ও মনময় সূক্ষ্ম কিন্তু আমাদের অনুভূতির বাইরে নয়। এদুটো আসলে আউড়া বা জ্যোতি। দেখতে না পেলেও আমরা এর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি।

যদি ভৌতিক শরীর নষ্ট হয়ে যায়, তবে এই বিজ্ঞানময় শরীর আনন্দময় শরীরের সঙ্গে মিশে যায় ,এবং তৎপর  আনন্দময় শরীর বিশ্বব্রমান্ডের সাথে বিলীন হয়ে যায় বা একাত্বিভূত হয়ে যায়।

ভৌতিক শরীর পঞ্চভূতের মিশ্রণ।  মৃত্যুর পরে, আমাদের ভৌতিক শরীর পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের কর্মবন্ধন, আমাদের আবার দেহধারণের জন্য উদগ্রীব হয়। ও আমরা আবার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করি। যখন আমরা কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি তখন আমরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সাথে এক হয়ে যাই।  জন্মমৃত্যুর চক্রের থেকে মুক্ত হয়ে যাই। একে বলে, মুক্তি।  কেউ বলে সমাধি।

আর একটা গূঢ় কথা শোনো, আমাদের এই দেহ যা তোমার চোখে পড়ছে, এটি কিন্তু তুমি যা দেখছো, তার থেকে আকারে অনেক বড়। অর্থাৎ তোমার এই স্থূল দেহের চতুর্দিকে ১৫/১৬ ইঞ্চি পর্যন্ত এর বিস্তৃত, একটা আউড়া দেহ আছে । যেটা তুমি বুঝতে পারো না। কিছুদিন, ধ্যান অভ্যাস করলে, তোমার এই আউড়া উপলব্ধি করতে পারবে। ধ্যানের  সময় এই আউড়া ঘনীভূত হয়। এবং আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। এঁকে  কেউ কেউ বলেন, আতিবাহিক  দেহ। এই আতিবাহিক দেহ বা আউড়া সূক্ষ্ম ও স্থুল  দেহের সংযোগ সাধন করে। আমাদের কোনো চিন্তা, আমাদের মনের আবেগ, আমাদের বুদ্ধি, ভাবনা প্রভৃতি স্থুল দেহে প্রকাশিত হবার জন্য, এই ইথারিক দেহ, বা আউড়া বা এর মধ্যে যে  অনুকৃতি থাকে, তার সাহায্য নেয়। এটাই আমাদের অনুভূতির কারন, জীবনী শক্তির কারন, চেতনার কারন। এই ইথারিক  শরীর না থাকলে, মন, চিন্তা,বুদ্ধি, বিবেক আমাদের স্থূল দেহে প্রকাশিত হতে পারতো না। প্রত্যেক মানুষের চারদিকে, এই  বলয় বা জ্যোতির্ময় মন্ডল দেখা যায়। এবং এটা দেখলে মনে হয় একটা ডিম্বাকৃতি বলয়ের মধ্যে একটা স্থুল দেহ  ভাসছে। তুমি যখন বসে আছো. তখনও  এই আউড়া তোমাকে ঘিরে থাকে।

মানুষ যখন শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে সুস্থ সবল,  থাকে তখন এই বলয়  ডিম্বাকৃতি থাকে। যদি তার অন্যথা হয়, অর্থাৎ শরীর সুস্থ না থাকে, মন ঠিক না থাকে, বা মনে কোনো ভয়, বা দুশ্চিন্তা থাকে, এমনকি মনে কোনো অশুভ ভাব থাকে, তবে এই ইথারিক শরীর কিঞ্চিৎ বক্র দেখতে লাগে। অর্থাৎ আঁকাবাঁকা লাগে। এই জ্যোতির্মণ্ডল বা ইথারিক দেহ সুক্ষ, এবং কারন, মনময়, ও প্রাণময়  দেহের উদ্ভাসিত কিরণ। এই জ্যোতির মধ্যে আবার সূক্ষ্ম দেহের জ্যোতি কিঞ্চিৎ চঞ্চল। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, মনের ভাব পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতির বর্ণের পরিবর্তন হয়। যেমন, তোমার মনে যদি
কাম ভাব বা তুমি যদি ইন্দ্রিয় পরায়ন  হও তবে তোমার জ্যোতি গাঢ় লাল রঙের হবে। তুমি যদি স্বার্থপর হও তবে তোমার জ্যোতি বাদামি বর্ণের হবে। আবার তুমি যদি মানসিক অবসাদে ভোগো  তবে তোমার জ্যোতির রং হবে ধূসর বর্ণ। তেমনি তুমি যদি উৎকৃষ্ট মানসিকতার হও তবে তোমার জ্যোতি হবে হলুদ  রঙের। তুমি যদি ঈশ্বর ভক্ত হও তবে তোমার জ্যোতির বর্ণ হবে বেগুনি। আর তুমি যদি আধ্যাত্মিক দিক থেকে উন্নত ব্যক্তি হও তবে তামার জ্যোতির বর্ণ হবে গাঢ় নীলবর্ণ। তুমি যখন, সাধনা করতে করতে, দিব্য দৃষ্টি সম্পন্ন হবে, তবে তুমি এসব দেখতে পাবে। এগুলো কোনো কাল্পনিক ব্যাপার নয়। সাধনায় উপলব্ধ জ্ঞান।  অতএব তুমি নিশ্চই  বুঝতে পারছো, স্থূল দেহের সূক্ষ্ম অংশের নামই ইথারিক দেহ বা আউড়া  দেহ।

জিজ্ঞাসু : এতো গেল দেহের কথা। কিন্তু এই স্থুল দেহের মৃত্যুর পরে কি হয় সেটা আমাকে একটু বলুন দয়া করে।

আচার্য্য : দেখো পুত্র, আমাদের শাস্ত্রে, সাতটি লোকের উল্লেখ আছে। তুমি সেসব শুনেছো । যা  তুমি সকালবেলা প্রতিদিন,  উচ্চারণ করে থাকো।  আর সে গুলো হচ্ছে, ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ, সত্যম।  এই লোককে সপ্ত-ব্যাহৃতি বলা হয়ে থাকে। মানুষ তার স্থুল দেহ নিয়ে, এই পৃথিবী বা ভূ-লোকে বিচরণ করে থাকে। যখন তার এই স্থুল-শরীর নষ্ট হয়ে যায়, তখন সে সূক্ষ্ম দেহে ভুবঃ-লোকে বাস করে। স্থুল দেহের মৃত্যুর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই অর্থাৎ বেশি হলে ৪ থেকে ৫ ঘন্টার মধ্যেই ইথারিক দেহ ত্যাগ করে সূক্ষ্ম দেহ ধারণ করে। এর পরে সাধারণত ২০/২৫ বছর পরে সূক্ষ্ম দেহ ত্যাগ করে স্বর্লোকে  অবস্থান করে। স্বর্লোকে সাধারণত এক হাজার বছরের কাছাকাছি অবস্থান করে। এই স্বর্লোক-ই মানুষের প্রকৃত বাসভূমি। এখান থেকেই মানুষ আবার পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করে। এটাই স্বর্গলোক। অতিশয় উন্নত না হলে, মানুষ এই স্বর্গলোক থেকে উপরে অর্থাৎ মহঃ-জনঃ-তপঃ লোকে যেতে  পারে না। আমরা যেহেতু মানুষের আসা যাওয়া নিয়ে আলোচনা করবো, তাই এই সব লোক অর্থাৎ মহঃ-জনঃ-তপঃ এই লোকগুলো নিয়ে আপাতত আলোচনা করবো না।

জিজ্ঞাসু : হে পিত ! মানুষ কি ভাবে মারা যায় ? অর্থাৎ এক শরীর  থেকে আর এক শরীরে যাত্রা সম্পর্কে যদি কিছু বলেন, দয়া করে।

আচার্য্য : দেখো তুমি যদি দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন হও তবে তুমি মানুষ কি ভাবে মারা যায়, তা তুমি দেখতে পাবে। অর্থাৎ মানুষের মৃত্যুকালে, এই ইথারিক অনুকৃতি কিভাবে দেহ ত্যাগ করে, তা তুমি দেখতে পাবে। মৃত্যুমুখে পতিত মানুষের দেহ থেকে একটা অতি  বেগুনি রঙের কুয়াশা-কুন্ড ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়ে, ওই ব্যক্তির দেহের ন্যায় আকৃতি বিশিষ্ট হয়। এই অতি বেগুনি রঙের দেহের সঙ্গে একটা উজ্বল সুতোর মতো সংযোগকারী রেখা থাকে, যা শরীরের সঙ্গে যুক্ত থাকে।  কিছুক্ষনের মধ্যেই এই সংযোগকারী সুতো দেহ থেকে ছিন্ন হয়ে যায়।  মানুষের মৃত্যু হয়। এর পরে, এই বেগুনি দেহ কিছুক্ষন স্থুল মৃতদেহের কাছেই থাকে।  ঘোরাফেরা করে। হয়তো কাছে কোথাও প্রিয়জনের কাছে যায়। কোনো কোনো সময়, যে প্রিয়জন দূরে থাকে, তার কাছেও যায়। যতক্ষন দেহ থাকে, ততক্ষন এই বেগুনি দেহ স্থুলদেহকে ছেড়ে যায় না।  এমনকি, সে নানা রকম নির্দেশ দিতে থাকে। কিন্তু নিস্প্রান স্থুল দেহ কোনো নির্দেশ পালন করে না , কোনো ডাকে সারা দেয় না। এতে সে অসহায় বোধ করে। শরীরের সৎকার না হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থা চলতে থাকে। এর পরে সে সজ্ঞানে ভুর্বলোকে প্রবেশ করে। মৃত্যুর মুহূর্তে  অজ্ঞান থাকে , কিন্তু মৃত্যুর পরে তার জ্ঞান হয়।  শারীরিক লঘুতা অনুভব করে। মৃত্যুর আগে প্রতিদিন যেমন ঘর বাড়ি, আত্মীয়স্বজন সব দেখতে পারতেন, এখনো সবই তিনি দেখতে, শুনতে পারেন। কিন্তু কোথায় যেন ফারাক অনুভব করেন। সবই তো ঠিক আছে।  তবে সবাই শোকার্ত কেন ? কেউ আমার কথার জবাব দিচ্ছে না কেন ? আমার নিজেকে এত হালকা লাগছে কেন ? দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে আমি যাতায়াত করতে পারছি কিভাবে ।  তাহলে কি স্বপ্ন দেখছি, নাকি মারা গেছি ? এইসব  অসম্ভব সত্য তাকে উদ্বিগ্ন করে দেয়। চঞ্চল করে দেয়।  আর এই সময় তাকে সত্য বোঝাতে, এগিয়ে আসে, সূক্ষ্মলোকবাসী।  তা সে তার মৃত আত্মীয়রা হতে পারে, অথবা অন্য কোনো সত্বা  যাঁরা এই সূক্ষ্ম লোকে বাস করেন তারাও  হতে পারে।এঁরা সবাই নতুন অথিতিকে স্বাগত জানায়। উপদেশ দিতে থাকে। যাতে নতুন জগতে সে স্বাছন্দ বোধ করে।

জিজ্ঞাসু : হে পিত ! এই ভুবর্লোক  কোথায় ?

আচার্য্য : হে পুত্র ! সমস্ত লোকই, এই পৃথিবী ঘিরেই অবস্থান করছে। ভূলোক বলতে আমরা বুঝি, পৃথিবী থেকে একশত মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত বায়ুমণ্ডল-সমন্বিত স্থান। আমাদের সূক্ষ্ম  দেহ যেমন স্থুল দেহের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন লোক এই ভূ-লোকের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সমস্ত লোকই অর্থাৎ সমস্ত সূক্ষ্ম লোকই পৃথিবীর অভ্যন্তরের কিছুদূর হতে আরম্ভ করে, চন্দ্রের ভ্রমনপথ অর্থাৎ চন্দ্র যে অক্ষপথে ভ্রমন করে, সেই  পর্যন্ত বিস্তৃত। চাঁদ যখন ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর কাছাকাছি এসে পরে তখন সূক্ষ্মলোক চন্দ্রকে স্পর্শ করতে পারে। অতিশয় সূক্ষ্ম পদার্থে এই জগৎ নির্মিত। আমাদের যেমন সূক্ষ্ম দেহ আছে, বহির্জগতের সমস্ত পদার্থের সূক্ষ্ম রূপ আছে। সুতারাং এই সূক্ষ্ম জগৎ স্থুলের মতোই একই রকম।  তাই মানুষ মৃত্যুর পরে যখন এই জগতে প্রবেশ করে, তখন সে প্রথমে বুঝতেই পারে না যে সে অন্য কোথাও এসেছে।

জিজ্ঞাসু : হে আচার্য্যদেব ! সূক্ষ্মলোকবাসী মানুষের কি কোনো আকৃতি থাকে ?

আচার্য্য :  হ্যাঁ পুত্র, জীব যখন মৃত্যুর পরে, সূক্ষ্ম দেহপ্রাপ্ত হয়, তখন তার আকৃতি তার মৃত্যুর আগে যেমন ছিল তেমনই হয়। এজন্য, মানুষ মৃত্যুর পরে পরলোকে গিয়ে যখন সে তার বন্ধু, বান্ধব, মা বাবা,ভাই বোন ইত্যাদির সাক্ষাৎ পায়, তখন সে তাকে চিনতে পারে। তুমি যখন দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন হবে,তখন যদি তুমি সূক্ষ্ম জগৎ পর্যবেক্ষন করো তখন তুমি এই সব ব্যক্তিদের চিনতে পারবে।
কিন্তু সূক্ষ্ম জগতের লোকেরা কখনো আমাদের এই স্থুল জগৎ দেখতে পায় না। এই স্থূল জগতের অনুরূপ আর এক সূক্ষ্ম জগৎ তার দেখতে পান মাত্র। এবং এর দ্বারা তারা আমাদেরকে দেখতে পান। কিন্তু, আমাদের সাথে কথাও বলতে চান।  কিন্তু তারা অসহায় হয়ে যান যখন দেখেন যে, তাদের কথায়  আমরা সারা দেই  না। কেন সারা দেয় না সেটা তারা বুঝতে পারে  না। আসলে জীবিত অবস্থায় আমরা যে আউড়া দ্বারা আবিষ্ট থাকি, সেই আউড়া তারা দেখতে পায়। এবং আউড়ার রং দেখেই তারা বুঝতে পারেন, আমরা সুখে আছি না দুঃখে আছি। রাত্রে আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি, তখন, আমাদের সূক্ষ্ম দেহ স্থুল দেহ থেকে বেরিয়ে মৃত আত্মীয়দের সূক্ষ্ম দেহের  সাথে কথা বলতে পারি।  ভাবের আদান প্রদান করতে পারি।  কিন্তু আমরা সব সময় সে সব মনে রাখতে পারি না। আবার কখনো কখনো সেসব কথা আমাদের মনে থাকে, আমরা তখন বলি, স্বপ্নে আমি বাবাকে দেখেছি। জাগ্রত অবস্থায় এটা হয় না। অর্থাৎ ঘুমের মধ্যে আমরা কখনো কখনো সূক্ষ্ম দেহে ভ্রমন করি, এই সূক্ষ্ম জগতে। আমরা যদিও জাগ্রত অবস্থায় মৃত ব্যক্তিদের দেখতে পাই না, কিন্তু মৃত ব্যক্তিরা সব সময়ই আমাদের আউড়া-দেহ দেখতে পান। এই দৃষ্টিতে দেখলে, আমরা বলতে পারি, যারা এই স্থূল দেহ ছেড়ে চলে গেছেন, তারা সব সময় আমাদের দেখছেন, আমাদের সঙ্গে আছেন। তুমি যাকে ভাবছো, মারা গেছে, সে কিন্তু তোমার সঙ্গেই আছে সব সময়। অন্তত প্রিয়জনরা সব সময় তোমার দিকে খেয়াল করছে। শুধু তাই নয়, তারাও আমাদের মতো সুখ দুঃখের অধীন। তারা যখন  স্থুল দেহে ছিলেন, ঠিক সেই মতো জ্ঞান, বুদ্ধি, স্মৃতি, এমনকি স্নেহ, ভালোবাসা, সংস্কার সবই  অক্ষুন্ন আছে। মৃত্যু আসলে, মানুষের একটা ক্রমন্নতির সোপান মাত্র।  বা বলা যেতে পারে, মৃত্যু মানে একটা উন্নতির স্তর  পেরোনো। আর একটা কথা শোনো। তুমি যখন কোনো কিছু চিন্তা করো, তার কোনো অস্তিত্ব মনের বাইরে থাকে না।  কিন্তু সূক্ষ্ম জগতে এই ভাব,একটা  মূর্তি গ্রহণ করে। আমরা যখন কোনো গভীর চিন্তা বা ভাবাবেশে থাকি তার  দ্বারা সূক্ষ্ম জগতে  একটা স্পন্দন শুরু হয়, এবং এর দ্বারা সূক্ষ্ম জগতের পরমাণু সকল ঘনীভূত হতে শুরু করে, এবং মূর্তি ধারণ করে। চিন্তার গভীরতা অনুসারে, এই সব মূর্তি স্বল্প স্থায়ী বা দীর্ঘ স্থায়ী হয় - সবল অথবা দুর্বল হয়। যাদের চিন্তাশক্তি ভীষণ গভীর, তারা চিন্তা প্রসূত ফল প্রতক্ষ্য দেখতে পান। আর একটা কথা বলি, সূক্ষ্ম জগতেও চিন্তাশীল জীব আছেন।

এতো গেল দেহ ত্যাগের কথা। কিন্তু আবার দেহ ধারণ করে কি করে ও কেন এসব নিয়ে আমরা আবার আলোচনা করবো।  কিন্তু আজ নয়।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি  ওঁং ।।

বিবেকানন্দ বলছেন, "সত্য তাদের কাছেই প্রকাশিত হয়, যারা শুধু সত্যের জন্য ভয় ত্যাগ করে, লাভালাভের চিন্তা ত্যাগ করে, সত্যের মন্দিরে উপাসনা করেন। মানুষের বুদ্ধির সচেতন প্রচেষ্টার দ্বারাই এই ব্যাপারে আলোকপ্রাপ্ত হওয়া যায়।"

আমাদের বাড়িতে আমার স্ত্রীর হেফাজতে একটা কৌটার মধ্যে কতকগুলো দানা  আছে।  তো আমি একদিন স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কি ? তো আমার স্ত্রী বললেন এগুলো ফুলের বীজ।  তো আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোনটা কিসের বীজ  তুমি চেনো কি করে ? আর এগুলো লাগিয়ে দিচ্ছো না কেন ? তো তিনি বললেন, প্রত্যেকটি বীজ লাগাবার একটা সময় আছে।  সময়মতো না লাগালে এর থেকে গাছ হবে না। আর তা ছাড়া, এর মধ্যে কোনো কোনো বীজ অপুষ্ট যা থেকে কোনো গাছ হবে না। সেগুলো আমাকে বেছে বার করতে হবে। আর আমি এগুলো চিনি কি করে ? এটা আমার অভিজ্ঞতার ফল। যখন এগুলো সংগ্রহ করেছি, তখন এগুলো আমি ভালো করে দেখে রেখেছি, কোন গাছে  কেমন বীজ হয়। তাই কোন বীজে কি ফুল বা ফল হবে তা আমি বুঝতে পারি।  আর কবে হবে তাও আমি জানি।

আমাদের চিন্তা হচ্ছে কর্মের বীজ। আসলে সমস্ত জিনিস আমাদের মনের মধ্যে আছে। অতীতে যা ঘটেছে, এমনকী বর্তমানে যা ঘটছে সবই আমাদের অবচেতন মনে সংস্কার আকারে সঞ্চিত হয়ে  থাকছে। আমরা যদি আমাদের অবচেতন মনের সংস্কারকে ধরতে পারি তবে সব ঘটনার আগাম খবর বলে দেওয়া যায়। আমাদের অবচেতন মনের সংস্কারকে চেতন স্তরে নিয়ে আসতে গেলে একটা কম্পন তুলতে হয়।এই কম্পন হচ্ছে মাধ্যম। চেতন ও অবচেতন মনের সংযোগের মাধ্যম।  এই কম্পনের ফলে  অবচেতন মনের সংস্কার চেতন স্তরে উদ্ভাসিত হয়। তখন আমরা ভূত ভবিষ্যৎ জানতে পারি।  এমনকি আমরা অন্যের অবচেতন মনের সংস্কারকে এই কম্পনের মাধ্যমে আমাদের চেতন স্তরে টেনে আনতে  পারি।  তখন আমরা অন্যের ভূত ভবিষ্যৎও  জানতে পারি। আর এটি তারাই পারেন, যারা মানসিক উচ্চ শক্তি সম্পন্ন, অর্থাৎ মহাত্মারা, যাদের মনের শক্তি বিশেষ ভাবে বিকাশ লাভ করেছে ।

আমরা যখন দেহ ছেড়ে অনন্তের যাত্রায় বেরিয়ে পড়ি, তখন আমরা মানস দেহে অবস্থান করি। মানস দেহ অর্থাৎ আমাদের চিন্তা-ভাবনার যে মূর্তি তাকে বলে মানস দেহ। আমরা এখন জগতের তৃতীয় স্তরে আছি। অর্থাৎ স্থুল দেহে আছি। স্থুল দেহের বিনাশ হলে আমরা মানস দেহে অবস্থান করি।   অর্থাৎএই মানস দেহ আমাদের চতুর্থ স্তরের বাসিন্দা। আমরা জানি অসংখ বিন্দুর সমষ্টি দিয়ে তৈরি হয় একটা ছবি। এখন এই বিন্দুর-সমষ্টি যখন অসীমে ছাড়িয়ে পড়ে বা  কমতে থাকে তখন ছবি  অস্পষ্ট হয়ে যায়। তৃতীয় স্তরে আসতে  গেলে আমাদের আবার ঘনীভূত হতে হয়। আমাদের মৃত্যুর পরে আমরা আমাদের স্পন্দন বা কম্পন  নিজের সঙ্গে নিয়ে যাই। আর এই কম্পনের গতি অনুযায়ী আমরা নির্দিষ্ট স্তরে প্রবেশ করি। এগুলো স্বয়ংক্রিয়। তাই আমাদের চিন্তা ভাবনা জ্ঞান অনুযায়ী আমাদের মৃত্যু পরবর্তী স্থান নির্দিষ্ট  হয়।  এই সময় প্রথম দিকে  আমরা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় থাকি। যারা পৃথিবীতে থাকাকালীন, উকন্ঠা, না পাবার দুঃখ-যন্ত্রনা নিয়ে ছিলেন, অপূর্ন বাসনা রেখে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের তন্দ্রাঘোর  কাটতেই, চঞ্চলতা অনুভব করেন। পৃথিবীর মায়া-মোহ-আসক্তি তাকে তাকে অস্থির করে তোলে। আর যখন সে দেখে তার কোনো নির্দেশ শরীর, বা অন্য কেউ পালন করছে না তখন  সে অসহায়, অস্থির  ও শোকাচ্ছন্ন হয়ে যায় । আর যারা জ্ঞানত দেহ ত্যাগ করে, তারা মৃত্যুকালীন তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কাটিয়ে চির নিদ্রায় শায়িত থাকে। এই অবস্থাটা আমাদের খানিকটা স্বপ্নের মতো। স্বপ্নে যেমন আমরা একটা জাগতিক পৃথিবীতে ঘুরে  বেড়াই। সুখ-দুঃখ ভোগ করি, এই অবস্থাতেও আমরা একই রকম অনুভব করি। বাসনা যাদের বেশি থাকে তারা ভোগ ভূমিতে নেবে আসে। আত্মীয়স্বজনদের পাশে পাশে ঘুরে বেড়ায়। আমরা যেমন আমাদের ঘুমের মধ্যে ঘুরে বেড়াই, এরা তখন তাদের আত্মীয়স্বজনদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। তাদের সাহায্য করতে চায়। তারা তখন বুঝতেই পারে না, যে তারা মারা গেছে। এই বিশৃঙ্খল অবস্থায় তাদের বেশ কিছু সময় কেটে যায়। আর একদল আছেন, যারা মৃত্যুর পরে বুঝতে পারেন। তারা দেহাতীত হয়ে গেছেন। এরা  তখন শান্তিতে নিদ্রা যান। অর্থাৎ সুসুপ্তির স্তরে অবস্থান করেন। এই সময় তাদের কোনো জ্ঞান থাকে না। এমনকি সময়জ্ঞানও থাকে না। এইজন্য বলা হয়ে থাকে মানুষের বাসনা অনুযায়ী, জ্ঞান অনুযায়ী মানুষ মৃত্যুর পরে, স্বর্গ-নরকে অবস্থান করেন, ভালো বা মন্দ থাকেন । এই জন্য বিভিন্ন আত্মার জন্য বিভিন্ন স্তর নির্দিষ্ট হয়ে যায়। এবং এগুলো সবই আমাদের চিন্তা-ভাবনার ফল। তাই আমাদের চিন্তা -ভাবনা যেমন  সবার আলাদা আলাদা, আমাদের সবার চিন্তা-ভাবনার কম্পনও তেমনি আলাদা আলাদা। আর এই কম্পনের  মাত্রা অনুযায়ী আমাদের বসবাসের স্তর নির্দিষ্ট হয়ে যায়। এখানে ঈশ্বরেরও কিছু করার নেই। একটা কথা আমাদের বোঝা দরকার যে, আমাদের এই যে মনময় শরীর, এটি সুক্ষ কিন্তু অপার্থিব নয়। স্থূল শরীর  যেমন পার্থিব এই সূক্ষ্ম শরীরও পার্থিব। অর্থাৎ অন্নময়, প্রাণময় শরীর যেমন পার্থিব, মনময় শরীরও পার্থিব। এবং এই মনময় শরীর চিরস্থায়ী নয়।  এটিরও পরিবর্তন আছে, নাশ আছে। অন্ন না পেলে যেমন  অন্নময় শরীরের ধংশ হয়ে যায়,  বায়ু না পেলে যেমন প্রাণময় শরীর নাশ হয়ে যায়, আমাদের কামনা বাসনা সংকল্প শেষ হয়ে গেলে এই মনময় শরীরেরও  নাশ হয়ে যায়। এইজন্য স্বাভাবিক মৃত্যুতে দেখবেন, মানুষ প্রথমে খাওয়া ছেড়ে দেয়।অর্থাৎ খাবার থেকে যে শক্তি সে সংগ্রহ করছিলো, তা বন্ধ হয়ে যায়।  এর পরে হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দেয়, অর্থাৎ বায়ু থেকে যে উর্জাশক্তি সে  সংগ্রহ করছিলো, সেটা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মনময় শরীর থেকে যায়। অর্থাৎ কামনা বাসনা আমাদের সহজে ছেড়ে যায় না। এইজন্য, ঋষি-মহাপুরুষরা আমাদের কামনো বাসনা পরিত্যাগ বা নিয়ন্ত্রণ  করতে বলেছেন। অর্থাৎ অন্নময় এবং প্রাণময় শরীর একসময় প্রাকৃতিক নিয়মে শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু মনময়  শরীর, তখনি নাশ হবে, যখন আমরা কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করতে পারবো। আর এই তিনটে শরীর নাশ হয়ে গেলে বিজ্ঞানময় শরীর আনন্দময় শরীরের সঙ্গে মিশে যায়। এবং আনন্দময় শরীর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে বিলীন হয়ে যায়।

মনময় সূক্ষ্ম দেহকে সহজে নাশ করা যায় না। এটি তার কামনা বাসনা পূরণের জন্য আবার দেহ ধারনের জন্য উদগ্রীব হয়। কারন সে জানে দেহ ভিন্ন কামনা বাসনা পূরণের কোনো উপায় নেই।  এই জন্য বলা হয়ে থাকে, মানুষ তার কামনা বাসনা অনুযায়ী দেহ প্রাপ্ত হয়।  এবং এই চক্রের মধ্যেই আমরা অর্থাৎ  বেশির ভাগ প্রাণী ঘুরপাক খাচ্ছি।
মানুষ মৃত্যুর পরে অজ্ঞানের ঘুমে সে আচ্ছন্ন হয়ে পরে, এবং ধীরে ধীরে ঘন্টা চারেকের মধ্যেই  তার আচ্ছন্নতা কেটে যায়। তখন থেকে  বায়বীয় দেহ নিয়ে  সে জীবনের চতুর্থ স্তরে ধাতস্ত হবার চেষ্টা করে।  এই চতুর্থ স্তরের মধ্যেই স্বর্গ-নরক বলতে আমরা যা বুঝি, তা এইখানেই।  এই চতুর্থ জগতের সঙ্গে আমাদের বুঝবার জন্য আমাদের স্বপ্নাবস্থার সাথে তুলনা করতে পারি। আমাদের স্বপ্নের জগতে যেমন এই পৃথিবীর জগতের মতো একটা জগৎ উপলব্ধি করি, এখানেও  আমাদের দৃশ্যমান জগতের অনুরূপ একটা জগৎ বিদ্যমান। পার্থক্য হচ্ছে আমাদের স্বপ্ন ৬ বা ৮ ঘন্টার পরে ভেঙে যায়। আমরা বুঝতে পারি যে আমরা স্বপ্ন দেখছিলাম।  আর এই জগতের স্থিতিকাল দীর্ঘ। এবং এক একজনের ক্ষেত্রে এক এক রকম। তবে অনন্তকাল নয়। এখানেও আমরা ইহজগতে থাকা কালীন যেমন কাজ কর্ম করতাম।  এখানেও সেইরূপই করে থাকি। কেউ যদি ইহজগতে পুজো-অর্চনা করতে ভালো বাসতেন, তবে এখানেও তিনি সেটাই করেন। এখানে চিন্তামাত্র তার কাছে সবকিছু উপস্থিত হয়ে যায়। এমনকি তারা ইহজগতের সবাইকে যাদের তিনি স্মরণ করেন, তাদেরই সাথে মিলিত হতে পারেন। এগুলো তাদের কল্পনা প্রসূত। এমনকি এখানে তারা আহার-পানীয় গ্রহণ করেন। অর্থাৎ এটাকে বলা যেতে পারে চিন্তা বা কল্পনার রাজ্য। আসলে আমরা যখন স্বপ্ন দেখি, সেই মূহুর্তের জন্য স্বপ্নকে আমাদের সত্য বলে মনে হয়। আমরা জানি স্বপ্ন আমাদের চিন্তার আকার বা পরিণতি বিশেষ। স্বপ্নে আমরা যেমন স্পর্শসুখ পাই,  শ্রবণসুখ এবং দৃশ্যসুখ পাই বা বিপরীত ভাবে বলা যেতে পারে, স্বপ্নে আমরা যেমন দুঃখ বা  ভয় পাই,  আতঙ্কগ্রস্থ হই, তেমনি  এখানেও  আমরা মানসিক  দেহ নিয়ে আমরা সমস্ত সুখ-দুঃখ ভোগ করি। এই ভোগেচ্ছা একটা সময় সমাপ্ত হয়। তখন আবার আমরা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি।
এই অবস্থায় এক একজনের ক্ষেত্রে এক একরকম সময়-কাল ধরে চলে। কেউ কেউ বলেন, ২৫/৩০ বছর থাকার পরে, তার আবার ধরণীতে দেহ ধারণের ইচ্ছা প্রবল হয়। কেউ বলেন, হাজার বছর। আসলে বাসনার প্রবলতা অনুসারে এই স্তরে স্থায়ীকাল নির্দিষ্ট হয়।  এই দেহ ধরনের ইচ্ছা যখন প্রবল হয়, সে  সময় আবার সে অজ্ঞান-আচ্ছন্ন হয়ে পরে। এবং এই অবস্থাতেই সে তার ইচ্ছে পূরণের জন্য বা বাসনা পূরণের জন্য উপযুক্ত শরীরের  ভ্রূণের  মধ্যে প্রবেশ করে। এটাকেই বলি আমরা গর্ভধারণ। পার্থিব শরীর  ভিন্ন আমাদের আমাদের ইচ্ছে পূরণের কোনো সুযোগ নেই।  তা সে ভালো ইচ্ছেই বলুন আর ভোগের ইচ্ছেই বলুন। শরীর যন্ত্র ছাড়া আমাদের কোনো আদর্শ বা লক্ষ্য পূরণের কোনো উপায় নেই। তাই অনন্ত কাল কেউ স্বর্গে অর্থাৎ আনন্দে থাকে না বা অনন্ত কাল কেউ নরকে বা নিরানন্দে  থাকে না। এখানেই ফিরে ফিরে আসে। ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যুর  বড় ছিল, ভীষ্ম কথাটা এসেছে ভ্রম থেকে, এই ভ্রম মানুষের সহজে যায় না।ভীষ্মেরও সহজে মৃত্যু ঘটে না। তীরের ঊপরে বিদ্ধ হয়ে, শ্বর-শয্যায়  তাকে বেঁচে থাকতে হয়। আমাদের ভোগেই সুখ, এই ভ্রম যতদিন না যাবে ততদিন আমাদের বার বার ফিরে আসতে  হবে।

এখানথেকে আদর্শবান পুরুষ, বা  প্রাজ্ঞপুরুষ যাকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলে থাকি, তারা আর এই জগতে সাধারণত ফিরে আসেন না। তারা আরো উর্দ্ধে অর্থাৎ পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম  অর্থাৎ মহঃ, জনঃ তপঃ এবং সব শেষে সত্যম বা ব্রহ্মলোকে  যাত্রা করেন।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম। 



পূর্বজীবন :


আমাদের সবার খুব জানতে ইচ্ছে করে, এই জন্মের আগে আমি কি ছিলাম ? না, আমি জাতিস্মরের কথা বলছি না। জাতিস্মর  তার নিজের পূর্বজীবনের কথা বলতে পারে। আমাদের অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা  কিভাবে  জন্মেছি মানুষ হয়ে, কোথায় ছিলাম, কিভাবে এলাম।  আর কিভাবে সমস্ত  মানুষের যাত্রা প্রক্রিয়া সংগঠিত হয় ।  মহাত্মারা বলে থাকেন, জীব তার বাসনা পূরণের জন্য দেহ ধারণ করে। জীব যদি সত্যিই  বাসনা পূরণের জন্যই দেহ ধারণ করে থাকে, তবে বাসনা পূরণের আগেই কেন মানুষের চলে যেতে হয় এই দেহ ছেড়ে। বিশেষ করে  শিশুমৃত্যু তো আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যে,  কোনো বাসনা পূরণের আগেই তার দেহপাত হয়ে গেল। আর বয়স হয়ে গেলে অর্থাৎ আমি যদি ৮০ বা ১০০ বছর বাঁচি, তাহলেও কি, আমাদের বাসনা পূরণ হয় ? আর যদি বাসনা পূরণ না হয় তবে আমাদের কেন চলে যেতে হয় ? আমাদের দেহ ধারণ ও দেহ ত্যাগ কি পূর্ব নির্ধারিত ? কেউ কেউ বলেন, আমাদের কর্মও নাকি পূর্বনির্ধারিত। ঈশ্বর মানুষকে মারতে পারে কি না জানি না, তবে মানুষ মানুষকে মারতে পারে, এটা তো আমরা চাক্ষুস দেখতে পারছি। তাহলে আমাদের জন্ম মৃত্যুতে কার ভূমিকা বেশি ? ভগবানের, নাকি মানুষের, নাকি প্রকৃতির। আমরা এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো।


জড়বাদীরা আত্মায় বিশ্বাস করে না।  ঈশ্বরেও  বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে, জীবসত্ত্বা কতক গুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল। প্রকৃতির সমুদ্রে বুদ্বুদের মতো জীব ভেসে উঠছে, আবার প্রকৃতির সঙ্গেই মিশে যাচ্ছে। এ সবই প্রকৃতির খেলা। অসংখ্য কারণে জীবের যেমন সৃষ্টি  হয়, আবার অসংখ্য কারণেই জীব প্রকৃতির মধ্যে লয় প্রাপ্ত হয়।  জীবের কোনো ব্যক্তি সত্ত্বা নেই। জীব প্রকৃতির অঙ্গ।  এতে জীবের কোনো ভূমিকা নেই। জীবের মরণের সাথে সাথে জীব গঠনের উপাদানসমূহের বিভাজন ও বিনাশ ঘটে থাকে। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনগঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। জীব ইচ্ছে করলেই জন্ম গ্রহণ করতে পারে না। আবার মরতেও পারে না। আসলে জীবের ইচ্ছা, অর্থাৎ জীবন-মৃত্যু, প্রাণের  অর্থাৎ বায়ুর সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। বায়ু নিষ্কাশনের সঙ্গে সঙ্গে জীবসত্ত্বার বিলোপ ঘটে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক কারণেই জীবনের বিলোপ ঘটে।

আমাদের সবার মন এই সমাধানে তৃপ্ত হয় না। পদার্থ কখনো চেতন সত্ত্বার সৃষ্টিকারী হতে পারে না। আমাদের ধীশক্তি পদার্থ দিয়ে উৎপত্তি হয়েছে, এমন কথা বিজ্ঞান প্রমান করতে পারে নি । জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় অবশ্য়ই আলাদা। আর যদি আলাদা না হয়, তবে ধরে নিতে হয় দুজনই চেতন সত্ত্বার অংশ, জড় নয়। মস্তিস্ক কখনো মনকে সৃষ্টি করতে পারে না। মস্তিস্ক বা জড় পদার্থ একটা বাদ্যযন্ত্র বিশেষ। এরমধ্যে সুর আছে, সেটা সত্য।  কিন্তু এই সেই সুর তুলতে গেলে একটা চেতন সত্ত্বার দরকার। আর চেতন সত্ত্বা হচ্ছে শিল্পী। শিল্পী বাদ্যযন্ত্রে সুর তোলেন । জড় আর চেতন সত্ত্বার  সঙ্গে এটাই পার্থক্য। তো চেতন সত্ত্বা একটা আছে।  তা কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক। ঈশ্বরকে আপনি  ছাড়তে পারেন , কিন্তু ঈশ্বর আপনাকে  ছাড়বে না। তা আপনি  যে অবস্থায়ই  থাকুন না কেন  ।

জগতে কোনোকিছু অকারণে হয় না।  এই কথাটা বিজ্ঞান স্বীকার করে। তাহলে জীবন মরনেরও একটা কারন আছে নিশ্চয়। আর এই কথাটা যখন মনে হয়, তখন ইচ্ছে জাগে কারণের অনুসন্ধান করি। আর আমরা এও জানি, কারন কখনো বাইরে থাকতে পারে না। গাছের বীজ গাছের মধ্যেই থাকে। অনু আকারে যে বীজ গাছের মধ্যে থাকে, কালে কালে পরিবেশের দোলায়, সেই বীজ গাছে রূপান্তরিত হয়ে থাকে। শুধু পরিবেশে গাছ হতে পারে না।  তাহলে জীব সৃষ্টির বীজ জীবের মধ্যেই নিহিত আছে। সুপ্ত সেই বীজ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। আর খুঁজে বের করতে গেলে আমাদের জীবনচক্রকে পেছনের দিকে ঘোরাতে হবে। আমরা যেখান থেকে এসেছি সেখানে যেতে হবে। আমাদের মায়ের গর্ভে যেতে হবে। আমাদের শুক্রে যেতে হবে। শুক্রের উৎসে যেতে হবে। "জীবনচক্র" সিনেমাটাকে আমাদের রেউইন্ডিং করতে হবে, অর্থাৎ পিছন দিকে চলা হবে । মায়ের গর্ভ বা পৃথিবী,  বীজকে অংকুরিত করবার  পরিবেশ দেয়।  বেড়ে ওঠার খাদ্য দেয়। কিন্তু বীজ আসে বাবার কাছ থেকে। আর এই বীজ স্থানান্তরিত হয়েছিল কামনার উদ্ভবে। কামনা আমাদের পিতাকে চঞ্চল করে তুলেছিলো অবয়ব তৈরির জন্য।  দেহ ধারনের জন্য। এই কামনা কি পিতার ইচ্ছে ? নাকি আমাদের সূক্ষ্ম শরীরের ইচ্ছে। ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। এই অন্তরকে আমাদের বুঝতে হবে। উপনিষদ প্রাণ সৃষ্টির উৎসকে বলছেন শ্রদ্ধা। অর্থাৎ জলের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অংশকে বলে শ্রদ্ধা। এটিই জীব সৃষ্টির প্রাথমিক ও আবশ্যিক  উপাদান। তাই বলা হয়ে থাকে যে গ্রহে জল নেই সেখানে প্রাণ থাকবে না। কিন্তু জল আমাদের আবরণ বা দেহসৃষ্টির কারন। আমি নই। আমি কিন্তু সবত্র সমস্ত গ্যালাক্সিতে আমি। ঈশ্বরকণা।

আবার,বিজ্ঞান প্রথম প্রাণকে বলছেন, protozoa প্রটোজোয়া  বা প্রথম প্রাণ।  প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে সূক্ষ্ম নির্দিষ্ট আকারবিহীন এককোষী প্রাণী হচ্ছে amoeba এমিবা।  একে কেবলমাত্র অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখা যায়। ক্ষনে ক্ষনে এরা রূপ পরিবর্তন করতে পারে। একটা মাত্র কোষ দিয়েই এদের সমস্ত জৈবিক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এরা কখনো গোল, কখনো ডিম্বাকৃতি, কখনো লম্বা, ইত্যাদি যেকোনো আকার ধারণ করতে পারে। একেই বলে protozoa প্রটোজোয়া বা প্রথম প্রাণী। এমনও তো হতে পারে, এই প্রটোজোয়া কালের সঙ্গে সঙ্গে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে। আর এর মধ্যেই মানুষের সমস্ত শক্তি অদৃশ্য ভাবে লুক্কায়িত ছিল। বেদান্ত দর্শন একেই বলছে সুক্ষ শরীর  বা প্রাণবীজ । আর এর মধ্যেই আছে, আমাদের মন, বুদ্ধি, চিন্তা, ইচ্ছাশক্তি, এবং সমস্ত ইন্দ্রিয়সকল।  আবার এর মধ্যেই আছে আমাদের প্রারব্ধ। এর মধ্যেই আছে এক ইথারীয় শক্তি, বা তরঙ্গ শক্তি  যাকে  আমরা বলি প্রাণশক্তি। সমস্ত দ্রব্যের আদিমতম সূক্ষ্ম সংস্করণ। এবং এই শক্তি আমাদের সবার মধ্যে বর্তমান। তাই প্রাণ  থেকে প্রাণের সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ থেকে মানুষের সৃষ্টি হচ্ছে।

সূক্ষ্ম শরীর আমাদের প্রকৃত মানব সত্ত্বা। এই সূক্ষ্ম শরীরই  মনুষ্য দেহের আকার ধারণ করে। ভোগের জন্য অবয়বের সৃষ্টি  করে। এর জন্য আমাদের বাইরের থেকে কোনো কিছু নেবার প্রয়োজন পড়ে  না।
চেতনশক্তিই শরীর  তৈরি করে, শরীর কখনো চেতন শক্তি তৈরি করে না। এই সুক্ষ শরীরের মধ্যে অনন্ত সম্ভাবনা থাকে। জীবের যখন মৃত্যু হয়, তখন সে তার সমস্ত শক্তি অর্থাৎ মন, বুদ্ধি, স্মৃতি, চিত্ত, অহংকার, চিন্তা, ইচ্ছা এমনকি ইন্দ্রিয় শক্তি অর্থাৎ শ্রবণশক্তি, ঘ্রান শক্তি, দর্শনশক্তি, স্পর্শশক্তি, বাকশক্তি, অর্থাৎ সমস্ত সম্ভাবনা নিয়ে এমনকি আমাদের সংস্কার ও প্রারব্ধ নিয়ে একটা বিদ্যুৎতরঙ্গ আকারে ঘুরতে থাকে। অর্থাৎ সমস্ত পদার্থের অতি সূক্ষ্মকণা সন্নিবদ্ধ হয়ে ঘুরতে থাকে। এটি অব্যক্ত অবস্থা নয়। ব্যক্ত, এবং  ভৌতিক। প্রথম দিকে এরা চতুর্থ স্তরে থাকে।  কালে কালে যারা জ্ঞানলোকের আলো ধরতে পারে, তারা পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম স্তরে প্রবেশ করে। এই রকম স্তর আছে ৫১টি।  যে যত  উপরের স্তরে চলে যায়, তাদের ফিরে আসতে তত দেরি হয়। আমরা বলি  এদের পুনরাবৃত্তি হয় না। কেবল মাত্র চতুর্থ স্তর  থেকেই আমরা আমাদের এই তৃতীয় স্তরে নেবে আসি। এটাই পুনর্জন্ম। অর্থাৎ চতুর্থ স্তর  থেকে তৃতীয় স্তরে নেবে আসা জন্ম। আর তৃতীয় স্তর থেকে চতুর্থ স্তরে চলে যাওয়ায় মৃত্যু।

আমরা আগেই শুনেছি , মৃত্যুকালে,আমাদের চেতন সত্ত্বা বা আত্মা ব্যক্তিবিশেষের সমস্ত শক্তিকে সংকুচিত ক'রে, নিউক্লিয়াসে, প্রাণবিন্দুতে, বা শ্রদ্ধাতে  পরিণত হয়। কালে কালে অনুকূল পরিবেশ পেলে এই শ্রদ্ধা বা প্রাণবিন্দু আবার দেহ ধারণ করে। এখানে মা-বাবা এই দেহ গঠনে সহায়ক হয় মাত্র। দেহগঠনকারী নয়। দেহ হচ্ছে আত্মার আবরণ মাত্র । এবং এই দেহ আত্মাই সৃষ্টি করে থাকে । রেশম কিট  যেমন নিজের লালা নিঃসরণ ক'রে, নিজেকে আচ্ছাদিত করে তেমনি  রেশমকীটের মতো, জীবাত্মা নিজেকে আচ্ছাদিত করে, নিজেরই লালার বা রসের সাহায্যে। এই রসকে উপনিষদ বলছে শ্রদ্ধা । অর্থাৎ জীবের  সূক্ষ্মতম সংস্করণ। মা বাবা কখনোই তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী শিশুর জন্ম দিতে পারে না। যতক্ষন না পর্যন্ত পিতার মধ্যে শুক্রের আবির্ভাব না হয়, যতক্ষন না পর্যন্ত মাতার মধ্যে রজের আবির্ভাব না হয় ততক্ষন মা-বাবা কোনো  দেহের বা শিশুর জন্মে কারন হতে পারে না। আর এই শুক্র  বা রজ  প্রক্রিয়া, মানুষের মধ্যে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বা  সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এমনি এমনি হয়। এর জন্য মানুষের আলাদা করে কিছু করতে হয় না। সূক্ষ্ম শরীর জল কনার মতো। জল  যখন বাষ্পাকারে থাকে তখন সে মেঘ, যখন সে তরল আকারে থাকে তখন সে সমুদ্র। এটি কখনো ধংশপ্রাপ্ত হয় না। অবস্থার পরিবর্তন হয় মাত্র।

আমাদের এই মূলসত্ত্বা  সত্ত্বা যেমন এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হতে পারে, তেমনি অন্য যে কোনো গ্রহে, অন্য যে কোনো মন্ডলে আবির্ভূত হতে পারে। এই সত্ত্বা আলো  ও শব্দ তরঙ্গের সাহায্যে মহাবিশ্বের যে কোনো স্থানে বিচরণ করতে পারে। এটি তখন অভৌতিক অবস্থায় থাকে। পরিবেশ পেলে, প্রাণবিন্দুর মধ্যে নিজেকে অবাধ করে।  ভৌত রূপ নেয়। আর একটা কথা, যে  শক্তি আমাদের এই স্তর পরিবর্তন করায়, তাকেই আমরা বলি পরম-আত্মা। তাকে প্রতিরোধ করবার শক্তি কারুর নেই।

দেখুন মাধ্যাকর্ষন শক্তি যেমন আমাদের এই দেহকে ধরে রেখেছে, আমাদের আত্মাও আকার নেয়, এই মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জন্য। আর এই জগৎটাও মাধ্যাকর্ষণ শক্তির নিয়মে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই ধ্রুব সত্য আপনি মানুন আর না মানুন, তাতে কিছুই এসে যায় না।

আমাদের মূল সত্ত্বা এই প্রাণবিন্দু  অর্থাৎ শ্রদ্ধা সৃষ্টির অতীত। এটি পরমাত্মার প্রতিফলিত জ্যোতি সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর একে সংরক্ষণ করে, প্রাণবায়ু, মন, ইন্দ্রিয়শক্তি,সংস্কার। এই প্রাণবিন্দু দেহ ধারণ ক'রে, আবার নতুন অভিজ্ঞতার সন্মুখীন হয়, সংস্কারের জন্ম দেয়, আবার ভোগের দ্বারা সংস্কারের বিলোপ সাধন করে। এই প্রক্রিয়াই  চলছে যুগের পর যুগ, কাল থেকে কালান্তরে।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম

পূর্ব জীবন (২) 
একটা কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি যে ৮৪ লক্ষ যোনি পরিভ্রমন করে আমরা এই মনুষ্য দেহ পেয়েছি। এই ৮৪ লক্ষ যোনি ব্যাপারটা কি ?
জীবের বেঁচে থাকার জন্য দুটো জিনিসের প্রয়োজন।  এক - প্রাণক্রিয়া অর্থাৎ ফুসফুসের ক্রিয়া। আর একটা হচ্ছে চেতন শক্তি। মায়ের পেটে  যখন থাকি, তখন আমাদের প্রাণক্রিয়া মায়ের প্রাণক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে। পরে, আমাদের নিজস্ব ফুসফুস ক্রিয়াশীল হয়। এই প্রাণক্রিয়ার শুরু কি এখানেই না, না এর কোনো ইতিহাস আছে ? দুই - চেতন শক্তি আমাদের শরীরে কখন শুরু হয় ? অর্থাৎ আত্মা আমাদের শরীরে কখন প্রবেশ করে ?  আচ্ছা, মানুষের মৃত্যুর পরে কি আবার সেই ৮৪ লক্ষ যোনি ঘুরে তবে আবার আমি মানুষ হতে পারবো ? এমনি অনেক প্রশ্ন আমাদের মধ্যে জাগে।
এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে আমাদের প্রাণের উৎসে যেতে হবে। আত্মার গমন নির্গমন ব্যাপারটা বুঝতে হবে। প্রাণ সৃষ্টির একটা প্রক্রিয়া আছে। কিন্তু আত্মা অজন্মা। আত্মার না আছে শুরু না আছে শেষ। ফুসফুস সম্প্রসারণ ও সংকোচনের মাধ্যমে আমরা প্রাণকে গতিশীল করতে পারি। কিন্তু চেতন শক্তি আসা যাওয়া করে কি করে ? এমনি অনেক প্রশ্ন আমাদের মধ্যে জাগে, আমরা আজ তার জবাব শুনবো।
আমরা সবাই জানি, আমাদের দেহ পঞ্চকোষের সমষ্টি। আর তা হচ্ছে, অন্নময়, প্রাণময়, মনময়, বিজ্ঞানময়, ও আনন্দময়। এখন কথা হচ্ছে, কোষ বলতে আমরা কি বুঝি ? বিজ্ঞান বলছে, প্রোটোপ্লাজম সমন্বিত জীবদেহের ক্ষুদ্র একককে বলে কোষ। জীবদেহ এক বা একাধিক কোষ দ্বারা গঠিত। আমাদের দেহে আছে পাঁচ ধরনের কোষ। কিন্তু সমস্ত জীবের দেহে এই পাঁচ ধরনের কোষ নেই। এখন কথা হচ্ছে, প্রোটোপ্লাজম কি ? প্রোটোপ্লাজম হচ্ছে, একধরনের অর্দ্ধ তরল জেলির মতো সজীব পদার্থ। এই প্রোটোপ্লাজম-ই আসলে জীবের প্রাণ পদার্থ। এই প্রোটোপ্লাজম তৈরি হয় কতকগুলো মৌল পদার্থ দিয়ে।  আর তা হচ্ছে - কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, সালফার, ফসফরাস ইত্যাদি মৌল পদার্থ দিয়ে তৈরি। জীবের সমস্ত জৈবিক বা বায়োলজিক্যাল ক্রিয়াগুলো এই প্রোটোপ্লাজমের মধ্যেই  ঘটে থাকে । আর কোষের বৈচিত্র দেখা যায়, তার গঠনপ্রক্রিয়ার মধ্যেই। অর্থাৎ মৌল পদার্থের পরিমান ভেদের জন্য তাদের মধ্যে তারতম্য দেখা যায়।
আমরা বা মনুষ্যদেহ যেমন পাঁচ ধরনের কোষ দ্বারা গঠিত, তেমনি এক ধরনের জীব আছে যারা একটি মাত্র  কোষ দ্বারা গঠিত। যেমন, ব্যাক্টেরিয়া, অ্যামিবা ইত্যাদি।
কতকগুলো কোষ একত্র হয়ে গঠিত হয় টিসু বা কলা। অর্থাৎ কতকগুলি কোষের সমষ্টিকে বলে কলা। আবার কতকগুলো কলার সমষ্টিকে বলে অরগ্যান বা অঙ্গ। আবার কতকগুলো অঙ্গের সমষ্টিকে বলে তন্ত্র, আর কতকগুলো তন্ত্রের সমষ্টিকে বলে জীব। এই জীব আবার অনেক রকম হয়। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পোকা একটা জীব, আবার কুকুর-ছাগল জীব, আবার উদ্ভিদ-এরও প্রাণ আছে।   এদের সবার আকৃতি যেমন আলাদা আলাদা তেমনি গঠনশৈলী ও বেঁচে থাকার কাল বা সময়  আলাদা আলাদা। উদ্ভিদের শাখা, প্রশাখা, পাতা, ফুল, ফল ইত্যাদি তাদের অংগ।   তেমনি জীবের  চোখ, মুখ, কান, ফুসফুস, পাকস্থলী, হৃৎপিন্ড এক-একটা আলাদা অঙ্গ। এই অঙ্গগুলোকে একত্রিত করে তৈরি হয় একটা তন্ত্র যাকে  আমরা বলি সিস্টেম। স্নায়ুতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র, পেশিতন্ত্র ইত্যাদি।
পৃথিবীতে জীব সৃষ্টির আদিতে ছিল, এককোষী, যা কেবলমাত্র অণুবীক্ষণ দ্বারাই দেখা যেতে পারে।  কোটি কোটি বছর  ধরে নানান পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আজকের জীব তৈরি হয়েছে। এই পরিবর্তন এখনো চলছে, এবং আজ থেকে কোটি বছর পরে, জীবের আকার, গঠন ও ক্ষমাতাগত পরিবর্তন  হবে। এবং উন্নততর জীব সৃষ্টি হবে। আর একটা কথা, জীবের যেমন জন্ম আছে, তেমনি জীবের মৃত্যু অবধারিত। তবে কোনো জীব, স্বল্পক্ষন বাঁচে, আবার কোনো জীব বহুদিন যাবৎ বেঁচে থাকে। প্রাণীদের মধ্যে যেমন কচ্ছপ অনেকদিন বাঁচে, তেমনি উদ্ভিদের মধ্যে বটগাছ অনেক দিন বাঁচে। জন্মের পর জীব ক্রমশঃ বৃদ্ধি পায়, বংশ বিস্তার করে, আবার বিপাকীয় ক্রিয়াগুলো যখন হ্রাস পেতে থাকে, তখন জীবের বার্ধক্য আসে. এবং একদিন মৃত্যু হয়।  এটাকেই জীবনচক্র  বলে। অর্থাৎ নতুন কোষ জন্মানো ও পুরাতন কোষের অপসারণ বা মৃত্যু - এটাই আমাদের জীবন বা শারীরিক যাত্রাবৃত্ত ।কোষের মৃত্যুর থেকে যখন কোষের জন্মের হার বেশি থাকে তখন আমরা শিশু থেকে যৌবনে পৌঁছাই। আবার  কোষের জন্মের থেকে মৃত্যুর হার যখন বেশি হয়, তখন আমরা বৃদ্ধাবস্থায় চলে যাই। এর পরে আমাদের প্রাণপাত হয়।
পৃথিবীতে দুই ধরনের বস্তু আছে। যে বস্তুর প্রাণ আছে অর্থাৎ প্রোটোপ্লাজম আছে, তাকে বলা হয় প্রাণী।  আর যাদের এই প্রোটোপ্লাজম নেই বা শুকিয়ে গেছে, তাদের বলা হয় প্রাণহীন বা জড় বস্তু। প্রাণহীন বস্তুর আকৃতির বৃদ্ধি নেই , বংশ বিস্তার করতে পারে না, চলন বা গমন নেই, উত্তেজনাতেও সাড়া দেয় না।  আর যাদের প্রাণ আছে, তাদের আকৃতির বৃদ্ধি আছে, বংশ বিস্তার করতে পারে, চলন বা গমন আছে, এবং উত্তেজনায় সাড়া দেয়।
এখন কথা হচ্ছে, মানুষের বা সমস্ত জীবের প্রাণ আছে, উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। এমনকি এমন উদ্ভিদ আছে যারা উত্তেজনায় সাড়া দেয়, যেমন লজ্জাবতী গাছ। এরা বাতাসের বা মানুষের স্পর্শে নিজেকে সংকুচিত করে নেয়। আবার এমন উদ্ভিদ আছে, যারা গমনে সক্ষম। এমনকি মাংসাশী উদ্ভিদ আছে।  যারা পোকা মাকড় খেয়ে থাকে। সব থেকে গুরুত্ত্বপূর্ন কথা হচ্ছে, এমন কিছু এককোষী জীব আছে, যাদের মধ্যে উদ্ভিদ ও প্রাণীর উভয় লক্ষণ আছে। যেমন ক্রাইস এমিবা ইত্যাদি।  এইজন্য বিজ্ঞানীরা মনে করে থাকেন,  আজকের যে উন্নততর জীব, তা এই সব এককোষী জীব থেকেই হয়েছে।
এত গেলো দেহের কথা, এবং  প্রাণের কথা। পৃথিবীতে যখন প্রাণ সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলছে, তখন আত্মা কোথায় ছিল ? এই দেহে আছে আমাদের আত্মা বা চেতন শক্তি। আমরা আগেই শুনেছি যে, জীবের যখন মৃত্যু হয়, তখন সে তার সমস্ত শক্তি অর্থাৎ মন, বুদ্ধি, স্মৃতি, চিত্ত, অহংকার, চিন্তা, ইচ্ছা এমনকি ইন্দ্রিয় শক্তি অর্থাৎ শ্রবণশক্তি, ঘ্রান শক্তি, দর্শনশক্তি, স্পর্শশক্তি, বাকশক্তি, অর্থাৎ সমস্ত সম্ভাবনা নিয়ে এমনকি আমাদের সংস্কার ও প্রারব্ধ নিয়ে একটা বিদ্যুৎতরঙ্গ আকারে ঘুরতে থাকে। অর্থাৎ সমস্ত পদার্থের অতি সূক্ষ্মকণা সন্নিবদ্ধ হয়ে ঘুরতে থাকে। এটি অব্যক্ত নয় ব্যক্ত। জীব সৃষ্টির প্রক্রিয়া যখন পৃথিবীতে  চলছিল, তখন আত্মা এই প্রক্রিয়ার অব্যক্ত অকর্তা ছিলেন। জীবন যে এই পৃথিবীতে প্রথম শুরু হয়েছে, তা তো নয়। এর আগে জীবনের খেলা চলছিল চন্দ্রে। তখন চন্দ্র ছিল, গ্রহ। এসব কথা আমরা সৃষ্টিতত্ত্বে শুনেছি। জীবন সৃষ্টির প্রাথমিক প্রক্রিয়া এখন শুরু হয়েছে বুধে। এমনকি এই মুহূর্তে আমাদের থেকে উন্নত জীব আছে শুক্রে। এবং এর পরে পৃথিবীতে যখন প্রাণের কাজ শেষ হয়ে যাবে, তখন বুধে প্রাণ স্থানান্তরিত হবে। পৃথিবী আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাবে। এসব কথা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু পরাবিদ্যাবিদদের কাছে এসব  সত্য।
এখন কথা হচ্ছে, আমাদের মৃত্যুর পরে আমাদের কি আবার প্রোটোপ্লাজম থেকে শুরু করতে হবে, মানুষ হবার জন্য ? অর্থাৎ যদি প্রাণ বা প্রোটোপ্লাজম থেকে জীবের শুরু হয়, তবে কি আমাদের আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে ? পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন  না, তবে ব্যতিক্রমও  আছে। মানুষ যদি নিকৃষ্ট জীব হয়ে জন্মাতে চায়, তবে সে তা হতে পারে। কিন্তু সাধারণত তা কেউ চায় না, তাই সে আবার মানুষ হয়েই জন্মাবে।
আত্মা সম্পর্কে  আমরা বিভিন্ন রকম মত শুনতে পাই। চার্বাক বলছেন, চৈতন্য শক্তি হচ্ছে  মিশ্র বস্তুর অতিরিক্ত গুন্। অর্থাৎ যে গুন্ মৌল পদার্থের মধ্যে ছিল না। সেই একাধিক মৌল বস্তু যখন একত্রিত হয়ে যৌগবস্তুতে পরিণত হয়, তখন তার মধ্যে একটা বিশেষ বা অতিরিক্ত গুনের সমাহার লক্ষ করা যায়। আমাদের চৈতন্য শক্তি হচ্ছে এই যৌগবস্তুর অতিরিক্ত গুন্, যা মৌল বস্তুর মধ্যে লক্ষ করা যায় নি।  দুটো রঙ মেশালে একটা নতুন রঙের সৃষ্টি হয়। যা ওই মূল রঙ গুলোর  মধ্যে ছিল না, বা দেখা যায় নি। আপনি চুন সুপুরি খয়ের দিয়ে পান খেয়েছেন, এর মধ্যে কোনোটাই লাল ছিল না। কিন্তু যখন   চুন-সুপুরি-খয়ের-পান  চিবোলেন, অর্থাৎ মেশালেন, তখন একটা নতুন রঙের দেখা মিললো, আর তা হলো লাল। ঠিক তেমনি - কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, সালফার, ফসফরাস ইত্যাদি মৌল পদার্থ দিয়ে তৈরি প্রোটোপ্লাজম । এইসব মৌল  পদার্থ  একত্রিত হয়ে যা তৈরি হলো তা প্রাণ বা প্রোটোপ্লাজম। আবার বিভিন্ন মিশ্রনের  কোষগুলো যখন একত্রিত হলো, তখন আর একটা শক্তি সৃষ্টি হলো আর  তা হচ্ছে চেতন শক্তি।  যাকে আমরা আত্মা বলে থাকি।
বৈদিক যুগে এই মত প্রত্যাহার করা হয়। কারন যোগঋষিগন উপলব্ধি করেছিলেন, প্রকৃতির উপরে আর একটা সত্ত্বা আছে , যাকে তারা বলছেন পুরুষ। এই বিরাট পুরুষ অর্থাৎ ব্রহ্মান্ডের অব্যক্ত শক্তি, যা পরবর্তীতে পুরুষের মধ্যেই ব্যক্ত হয়েছে। যাকে আমরা বলছি, প্রকৃতি।  প্রকৃতি যে সনাতন শক্তির সাহায্যে শৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ থাকছে, তা ওই নিত্যশক্তির খেলা।  প্রকৃতি নিয়মে আবদ্ধ।  আর পুরুষ নিয়মের স্রষ্টা। প্রকৃতি পরিবর্তনশীল, আর পুরুষ অপরিবর্তনীয়। একেই বেদ বলছে ব্রহ্ম। এই বিরাটপুরুষের প্রতিফলিত শক্তি নিয়ে জীব চেতনাসম্পন্ন হয়েছে। প্রাণ ও চেতনা আলাদা, কিন্তু একের সঙ্গে অন্যের একটা সংযোগ আছে। জীবের দেহ থেকে যখন প্রাণের উৎক্রমন ঘটে, তখন আত্মাও দেহকে  ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ পুরুষ সত্ত্বা দেহের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়, প্রাণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আর স্থুল দেহকে বাঁচিয়ে রাখে প্রাণশক্তি। আর প্রাণহীন আমাদের মনময় দেহ বা বিজ্ঞানময় দেহ, ও আনন্দময় দেহ - এদের সাথেও থাকে সেই পুরুষের প্রতিফলিত শক্তি। তাই আমরা যখন দেহের মধ্যে আসি, তখন আমাদের যেখান থেকে পুনরাবৃত্তি হয়, সেখানেই আমরা বীজ আকারে আত্মার প্রতিফলিত শক্তিকে আশ্রয় করে  ছিলাম। তাই প্রাণ যখন শরীরে আসে, অর্থাৎ মাতৃগর্ভে ৪৫-৫০ দিনের মধ্যেই মায়ের প্রাণের সঙ্গে আমাদের সংযোগ তৈরি হয়। আবার মায়ের প্রাণের সঙ্গে যখন আমাদের প্রাণের বিচ্ছিন্নতা ঘটে, অর্থাৎ মায়ের গর্ভের বাইরে আসি তখন আমাদের নিজস্ব প্রাণের ক্রিয়া শুরু হয়।  চৈতন্য শক্তির আবির্ভাব ঠিক একই  সময় হয়ে থাকে। তাই মায়ের পেটে আমরা মায়ের প্রাণ ও চৈতন্য শক্তির আশ্রয়ে থাকি। তখন আমাদের শরীর মায়ের শরীরের একটা অঙ্গবিশেষ মাত্র।  আর মায়ের শরীর  থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে আমরা আমাদের নিজস্ব প্রানক্রিয়ার  সাথে আমাদের চৈতন্যশক্তিকে আশ্রয় করি।
একটা কথা শোনা যায়, যে আমরা নাকি ৮৪ লক্ষ যোনী পরিভ্রমন করে মনুষ্য দেহ লাভ করেছি। সত্য হচ্ছে  চুরাশি লক্ষ একটা কথার কথা, আসলে অসংখ্য যোনী ভ্রমণের  পর আমরা মনুষ্য দেহ লাভ করেছি। কিন্তু আমাদের আবার মনুষ্য দেহ ধারনের জন্য,  প্রথম থেকে শুরু করতে হবে, তা নয়। যারা একবার মানুষ হয়ে জন্মেছেন , তারা মৃত্যুর পরে, যে দেহে অবস্থান করবেন , অর্থাৎ মনময়, বা বিজ্ঞানময় দেহে বা আনন্দময় দেহে সেখান থেকেই  নিজেদের  প্রারব্ধকে সঙ্গে নিয়ে আবার মানুষ হিসেবেই জন্ম গ্রহণ করবেন , তাদের  সংকল্প বা বাসনা পূরণের জন্য। তবে একটা কথা বলি, যারা মনময় দেহে অবস্থান করবেন, তারা  তাড়াতাড়ি আবার আসতে  পারবেন, বা বলা যেতে পারে, আসতে  হবে। আর যারা বিজ্ঞানময় দেহে অবস্থান করবেন, তারা আসতে অনেক দেরি করবেন। আর আনন্দময় দেহে যারা অবস্থান করবেন, তারা শুধু সৃষ্টির কাজে সাহায্য করবার জন্যই এসে থাকেন। আমরা যে উন্নত বা উন্নততর মহাত্মাদের দেখতে পাই, এই পৃথিবীতে তাদের আগমন হয়  বিজ্ঞানময় বা আনন্দময় দেহ থেকে। গীতায় ভগবান যে বলেছেন, আমি ধর্মের পালনের জন্য, অধর্মের নাশের জন্য, এই পৃথিবীতে এসে থাকি।  অর্থাৎ এঁরা আনন্দময় দেহে অবস্থান করছিলেন। এদের ভোগ বা বাসনা বা সংকল্প বলে কিছু নেই।  কেবলমাত্র সৃষ্টিকে সহায়তা করবার জন্য, এঁরা  এসে থাকেন। এদের নিজেদের জন্য এঁরা  কিছু করেন না। জগতের হিত , জগৎবাসীদের শিক্ষা দেবার জন্য এসে থাকেন।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

অকাল মৃত্যু কেন হয় ? আমরা কেন মারা যাই ?

কথা হচ্ছিলো বাসনা পূরণের আগে কেন মানুষ মারা যায়। শিশুরা অকালে কেন চলে যায়। দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের প্রাণ এক মুহূর্তে চলে যায় কেন ? যুদ্ধে অসংখ্য নিরাপরাধ মানুষের প্রাণ যায় কেন ?  আমাদের যখন দেশ  ভাগ হয়েছিল, তখন অসংখ মানুষ দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছিল।  কেন এমন হয়।
আয়ুষ্কাল সম্পর্কে জানতে গেলে, আমাদের আগে বুঝতে হবে, আমরা কেন জন্ম নেই। আর কখন আমাদের মৃত্যুর ডাক আসে। দেখুন আয়ুষ্কাল আমাদের পূর্ব নির্দিষ্ট। আবার এর অন্যথাও আছে।আপনি যে দেহ ধারন করেছেন, সেই দেহ প্রাকৃতিক কিছু বস্তুর সমাহার মাত্র। আর এই সমাহার একটা গতিশীল প্রক্রিয়া। এটি স্থির নয়। প্রতিনিয়ত যাচ্ছে আসছে। এই আসা যাওয়ার গতি আমরা ধরতে পারি না তাই আমাদের মনে হয়, আমরা বা আমাদের দেহ  স্থির আছে । এবং একটা অবয়ব আমাদের চোখের সামনে ভাসছে। একটা কথা আছে, স্রোতের জলে  কখনো দুবার ডুব দেওয়া যায় না। অর্থাৎ এখন যে জলে আপনি ডুব দিলেন, পরের ডুব আপনি অন্য জলে দিচ্ছেন। আমাদের শরীর একটা স্রোতস্বীনি নদী। একটা কম্পন মাত্র। আর কম্পনের  প্রবাহ গতিশীল। আপনারা জানেন, আমাদের শরীরের কোষ প্রতিনিয়ত মরছে, আবার প্রতিনিয়ত জন্মাচ্ছে। এবং ৭ বছর  পরে, আমরা সম্পূর্ণ নতুন দেহ পাই। অর্থাৎ ৭ বছর যে কোষ আমার শরীরকে আশ্রয় করেছিল, তা আর নেই।এবং এই কারণেই আমরা শিশু থেকে ধীরে ধীরে বার্ধক্যে পৌঁছে যাই। এই প্রক্রিয়া আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না।  প্রতিটি জীবের এই দেহ গঠন ও বিনাশ প্রক্রিয়া মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অন্তিম সীমায় পৌঁছে যায়। তাই বিভিন্ন জীবের বেঁচে থাকা বা আয়ু মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট কালের মধ্যেই সম্পন্ন হয়। মানুষ যেমন ৮০-১২০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। কিন্তু একটা কুকুরের শরীর, ৮-১০ বছর বা একটা পোকার শরীর আরো কম দিন বাঁচে। তো সীমা অতিক্রম করা কারুর পক্ষেই সম্ভব নয়। এই দিক থেকে দেখতে গেলে মানুষের আয়ুর একটা উর্দ্ধ সীমা আছে। এই জন্য বলা হয় মানুষের আয়ু পূর্ব নির্ধারিত।
এতো গেলো দেহের কথা, কিন্তু আমরা কেন জন্মাই, অর্থাৎ আমরা কেন দেহ ধারণ করি ?আমি তো দেহ নোই, আমি আত্মা, তো  আমার দেহ ধারনের দরকার কি ? আমরা দেহ ধারণ করি, বাসনা পূরণের জন্য, সংকল্প সাধনের জন্য । এই বাসনা বা সংকল্প  পূরণ হয়ে গেলে আমরা দেহ ছেড়ে দেই। আবার প্রাকৃতিক নিয়মে দেহ অকেজ হয়ে গেলে আমরা দেহত্যাগ করি। অতএব আমাদের দেহ ত্যাগের দুটো কারন (এক)  বাসনা বা সংকল্প  পূরণের অযোগ্য হয়ে যায় যখন আমাদের দেহ,  আর (দুই) বাসনার শেষ হয়ে গেলে।  আমাদের এই দেহ  ভোগায়তন দেহ। পরমাত্মার প্রতিফলন যে জীবাত্মা, সেই জীবাত্মার ভোগ সাধনের জন্য এই দেহ সৃষ্টি করা হয়ে থাকে, আবার এই দেহ ভোগের অযোগ্য বা বাসনার পূরণের শেষে আমরা দেহ ত্যাগ করে থাকি। ফুলে ততক্ষনই মৌমাছি থাকে, যতক্ষন ফুলে মধু থাকে। ফুল প্রকৃতির নিয়মে শুকিয়ে যায়। মৌমাছি অন্য ফুলে মধু খেতে চলে যায়। 
শিশুমৃত্যু প্রসঙ্গে একটা প্রচলিত গল্প বলি। শ্রীবাস অঙ্গনে মহাপ্রভু দলবল নিয়ে নাম-সংকীর্তন করছেন।   কীর্তন চলাকালীন শ্রীবাস পন্ডিতের  এক শিশুপুত্র দেহরক্ষা করে। বাড়িতে কান্নার রোল ওঠে। শ্রীবাস পণ্ডিত বাড়ির সবাইকে কান্না করতে নিষেধ করলো, পাছে কান্নার শব্দে মহাপ্রভুর কীর্তনের ব্যাঘাত ঘটে। কিন্তু মহাপ্রভু তো সর্বজ্ঞাতা। তিনি বললেন, "দেখো, আজ যেন কীর্তনের আনন্দ তেমন জমে উঠতে পারছে না। কারন কি বলতো ? সবাই চুপ । প্রভু আবার বললেন, আমার হৃদয় আজ যেন বড় উদ্ভ্রান্ত। আমার মনে আনন্দের কোনো সাড়া জাগছে না। নিশ্চয় শ্রীবাসের বাড়িতে কোনো শোকের ছায়া পড়েছে। তখন কয়েকজন তাকে বললেন : হ্যাঁ প্রভু  শ্রীবাসের শিশুপুত্র আড়াই ঘন্টা আগে মারা গেছে  . পাচ্ছে আপনার কীর্তনের ব্যাঘাত হয়, তাই এই সংবাদ কাউকে বলা হয় নি। শ্রীবাসের এই অপূর্ব ভক্তি নিষ্ঠা দেখে, প্রভুর চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বললেন : আমার জন্য,কীর্তনের জন্য,কেউ  পুত্রশোক ভুলে যায়, এমন ভক্ত আমি কোথায় পাবো ? তো তিনি সেখানে এক আশ্চর্য্য ঘটনা সংগঠিত করলেন।
মৃত শিশুটিকে শ্মশানে নিয়ে যাবার উদ্যোগ চলছে। সবাই শিশুটিকে ঘিরে রেখেছে। প্রভু তখন, মৃত শিশুটিকে ডেকে বললেন - বৎস, শ্রীবাসের গৃহ ছেড়ে কেন যাচ্ছো তা একবার বলতো ? তো প্রাণহীন দেহে তখন প্রাণের সঞ্চার হলো। ঠোঁট কেঁপে উঠলো - স্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো, প্রভু, এ দেহে বাস করে, শ্রীবাস পন্ডিতের ঘরে যে স্নেহ ও আদার আপ্যায়ন পাবার কথা নির্দিষ্ট ছিল তা পেয়েছি।  এবার বিধির নিবন্ধ অনুযায়ী নতুন আবাসে আমি চলে যাচ্ছি। প্রণাম। অপরাধ মার্জনা করবেন।  কথা কয়টি বলে শিশুটি আবার নিস্প্রান হয়ে গেলো। সবাই নির্বাক। আসলে জীবন-মৃত্যুর ভেদ রেখা তেমন কিছু নয়। সময় অথবা কাজ শেষ হয়ে গেলে, আবার নতুন আবাসে আমাদের যেতে হবে। জীবের এই পরিক্রমা  কাল থেকে  কালান্তর ধরে চলছে।
আসলে ভোগ আমার নয় ভোগ আমার উপাধির।আমি আত্মা। এই দেহ তো আমি নোই, এই দেহ আমার উপাধি মাত্র।  বিখ্যাত সেই উপমা আপনারা সবাই জানেন। একটা গাছে সুমিষ্ট ফল।  গাছের ডালে বসে আছে  দুটো পাখী।  তার একটিতে সুমিষ্ট ফল খায়, আর একটা দেখে। পরম আত্মার কোনো ভোগ নেই।  তিনি দ্রষ্টা। তার কোনো কর্ম নেই, তিনি অকর্তা। তিনি নিঃসঙ্গ তার কোনো সঙ্গী নেই। আর জীবাত্মা বাসনা ভোগের জন্য দেহ ধারণ করে, সঙ্কল্প পূরণের জন্য দেহ ধারণ করে। অফিসের বড়বাবু, অফিস থেকে ফ্লাট পেয়েছেন, গাড়ি পেয়েছেন। প্রচুর অর্থ মাইনে  পান। বড়বাবুর পদ চলে গেলে ফুটুস। বাড়ি, গাড়ি, মাইনে সব বন্ধ  হয়ে যায়। আর এই পদ পাবার জন্য আমাদের সারা জীবনের  প্রয়াস। বড়বাবু হবার জন্য আমরা দিন-রাত পরিশ্রম করে ডিগ্রি নিচ্ছি। কিন্তু ষাট বছর বয়স হয়ে গেলে পদ ক্ষতম। তখন কেই বা চাপরাশী আর কেই বা বড়বাবু। চাকরির যেমন একটা নির্দিষ্ট নিয়মকানুন আছে, প্রকৃতির জগতেও পদ পাবার জন্য অর্থাৎ দেহ ধারণ করবার জন্য নিয়ম আছে। নিয়ম না মানলে, যেমন ষাট বছর না হতেও আপনার চাকরি যেতে পারে। ঠিক তেমনি দেহরক্ষার জন্য আমাদের কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। দেহরক্ষার নিয়ম অর্থাৎ প্রকৃতির নিয়ম যদি আমরা না মেনে চলি তবে আমাদের অকাল মৃত্যু হতে পারে। আবার অনেক সময়, নিজে ভুল না করলেও, যাকে  আমরা বলি কপাল দোষে আমাদের চাকরি চলে যেতে পারে। আসলে কিছু জিনিস আমার নিয়ন্ত্রণে, আবার কিছু জিনিস আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেলে আমার চাকরি চলে যেতে পারে।আবার কোম্পানির  নিয়মবহির্ভূত কর্মের জন্য আমার চাকরি যেতে পারে।ঠিক তেমনি, এই জীবদ্দশায়  আমার কর্ম, আমার পরিবারের কর্ম, আমার আত্মীয়স্বজনের কর্ম, আমার প্রতিবেশীর কর্ম, আমাদের জাতির কর্ম্ম, আমি যে দেশে বাস করি, সেই দেশনায়কদের কর্ম, এ সবই আমার ভবিষ্যৎকে  প্রভাবিত করবে। আমাকে সুখ দুঃখের ভাগিদার করবে। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বা বিপর্যয়ও  আমাকে প্রভাবিত করবে। 
এই প্রোসঙ্গে গুরু নানকের একটা গল্প বলি। দিল্লিতে তখন লোদী বংশের রাজত্ত্ব চলছিল। মোগল সম্রাট বাবর সেইসময় তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে ভারতের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মোগল সৈন্যরা তখন অকথ্য অত্যাচার করেছিল, সাধারণ মানুষের উপরে। এই সময় পরিব্রাজক গুরুনানক ও তার সঙ্গী মর্দানাকেও  জেলে যেতে হয়েছিল ।  আজকের গুজরানওয়ালা জেলার আমিনাবাদ, সেসময় সঈয়দপুর নামে পরিচিত  ছিল।  মোঘল সৈন্যদের হাতে পড়ে এই সঈদপুরবাসীদের বাড়িঘর অগ্নিদগ্দ্ধ হয়েছিল। অবাধে চলেছিল লুণ্ঠন। এখানেই গুরুনানক সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েছিলেন । সাধুর বেশ দেখে, সৈন্যরা তাদের প্রাণে মারে নি বটে, কিন্তু বন্দি জীবন কাটাতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, গুরুনানকের অলৌকিক কার্যকলাপ দেখে, পরে  বাবর তাকে ছেড়ে দিয়েছিলো।
তো বন্দি অবস্থা কেটে গেলে, নানক আবার পরিব্রাজন শুরু করে দিলেন। সেদিনকার সঈয়দপুরের এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে মর্দানা গুরুনানককে প্রশ্ন করলেন, ঈশ্বরের রাজত্ত্বে এই মর্মান্তিক ঘটনা কেন ঘটে ? মুষ্টিমেয় পাঠান হয়তো অপরাধী থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু হাজার হাজার নিরপরাধ নিরীহ মানুষ কেন এই নির্মম দণ্ডের  সম্মুখীন হয় ? ঈশ্বরের এ কেমন ধারা বিচার।?
তো, সেদিন যে বাড়িতে মর্দানা ও গুরুনানক আশ্রয় নিয়ে ছিলেন, সেই বাড়ির সামনে ছিল একটা সুস্বাদু ফলের গাছ। নানক বললেন, তুমি এই গাছের নিচে আজ শুয়ে থাকো।  কাল এর উত্তর পেয়ে যাবে।
গুরুভক্ত মর্দানা সেই রাতে ওই গাছের নিচে একটা কম্বল পেতে শুয়ে পড়ে। এখন হয়েছে কি, ভোর রাতে দিকে পাখির ঠোঁটের আঘাতে পাকা ফল থেকে রস চুইয়ে চুইয়ে মর্দানার দেহের উপরে ঝরে পড়ে। এখন মিষ্টি রসের গন্ধে, পিঁপড়ে চলে আসে। দুচারটে পিঁপড়ে, মর্দানাকে কামড়ে দেয়।  আর মর্দানা ঘুমের ঘোরে, হাত চালিয়ে প্রায় সমস্ত পিঁপড়েকে মেরে  ফেলে।
সকালবেলা গুরুদেব বললেন, মর্দানা চেয়ে দেখো, কম্বলের উপরে তোমার কালকের প্রশ্নের জবাব। ঠিক এই ভাবেই, সঈয়দপুরের হাজার হাজার নিরীহ মানুষ সেদিন মারা গেছিলো। তোমাকে কামড়েছে  মাত্র দুচারটি পিঁপড়ে, কিন্তু দেখো তুমি কয়েক'শ পিঁপড়ে মেরে ফেলেছো। জন্ম-মৃত্যুর এই অমোঘ লীলা চলছে নিরন্তর। অখন্ড সত্ত্বায় সবকিছু বিধৃত।  কর্তা নিজেই যেখানে সর্বত্র ওতপ্রোত ভাবে বিরাজ করছে, সেখানে বিচার - অবিচারের প্রশ্ন ওঠে না। দন্ড আর পুরস্কার সেখানে এক হয়ে যায়।  জীবন একটা যাত্রা। মৃত্যু মানে জীবন পথে বাঁক নেওয়া। মৃত্যুর পর মৃত্যু অতিক্রম করে, জীব এগিয়ে চলেছে, অনন্তের  সাথে নিজেকে বিলিয়ে দেবার জন্য এগিয়ে চলছে ।  মেঘ থেকে জল  পাহাড় বেয়ে, গ্রাম গঞ্জ পার হয়ে সমুদ্রে মিলবে।  এটাই পরিণতি। চলার পথে সুখ দুঃখের অনুভূতি মাত্র। অনন্তে শান্তি।
আমরা যাকে ভালো বা মন্দ বলি, সেটা আমাদের ভাবনাপ্রসূত। প্রকৃতির কাছে ভালো বা মন্দ বলে কিছু নেই। সে একটা শৃঙ্খলে আবদ্ধ।  তার বাইরে যাবার তার উপায় নেই। সূর্য্য ইচ্ছে করলে তাপ  প্রদান বন্ধ করতে পারে না। বায়ু রুদ্ধ হতে পারে না। প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরন করলে শাস্তি পেতে হবে এটা  চিরসত্য।  এর অন্যথা হবার উপায় নেই। তাই আমাদের শরীর যা কিনা প্রকৃতির অঙ্গ  বিশেষ, তা প্রকৃতির নিয়মেই নিঃশেষিত হবে। আপনি তথাকথিত ভালো কাজ করলে আপনি বেশি দিন বাঁচতে পারবেন, আর খারাপ কাজ করলে, বা কিছুই না করলে আপনি তাড়াতাড়ি মারা যাবেন, এর কোনো মানে নেই। আপনি জ্ঞানী হলে আপনি বেশি দিন বাঁচতে পারবেন, আর অজ্ঞানীরা তাড়াতাড়ি মারা যাবেন, এমন অঙ্গীকার প্রকৃতি করে না।
তাই আমাদের আয়ু, দুটো কারণের উপরে নির্ভরশীল। এক আমি কি জন্য এই দেহ ধারণ করেছি। অর্থাৎ আমার বাসনা বা সংকল্প ।  আর যা দিয়ে দেহ ধারণ করেছি, অর্থাৎ প্রকৃতি, আর তার স্থিতিকাল বিষয়ে প্রকৃতির কি নিয়ম। আসলে এই মর্তলোক একদিকে যেমন কর্ম্মক্ষেত্ৰ, অর্থাৎ যার দ্বারা আমরা উন্নত স্তরে থাকতে পারি, ঠিক তেমনি এই মর্তলোক একটা মৃত্যুপুরি, যার দ্বারা আমরা অমৃতের পথে যাত্রা করতে পারি।    

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম  

Sunday 18 August 2019

ব্রহ্ম-সূত্র

ব্রহ্ম-সূত্র

তৃতীয় অধ্যায় - প্রথম পাদ
বেদে আত্মাকে বলা হয়েছে ব্রহ্ম। আজ আমরা ব্রহ্মসূত্র ধরে ব্রহ্মের  খোঁজে বা আত্মার খোঁজে  বেরোবো। জীবাত্মা কোথা থেকে আসে আর কোথায়ই  বা যায় ? আমরা সেই খোঁজ করবো। আমরা বর্তমানে  অসংখ্য জীব-আত্মার সঙ্গে আছি। একটু দেখে নেই জীবের মৃত্যুর পরে তার আত্মা  কোথায় যাচ্ছে। এখানে একটা কথা বলি, ব্রহ্মা আর ব্রহ্ম কিন্তু এক নয়। ব্রহ্মা হচ্ছেন, এই সূর্যলোকের মালিক, আর ব্রহ্ম হচ্ছেন সমস্ত জগতের মালিক।
  
ব্রহ্মসূত্র বলছেন, মৃত্যুকালে জীবের দেহ থেকে যখন প্রাণবায়ু উৎক্রান্ত হয়, তখন জীবাত্মা এই স্থূল দেহের সূক্ষ্ম অনুর দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে। জীৱাত্মা যখন শরীর ছেড়ে অনন্তের  যাত্রায় বেরিয়ে পড়ে, তখন সে  এই স্থূল দেহের অনুরূপ সূক্ষ্ম দেহের দ্বারা আবৃত থাকে। এবং একটি নতুন দেহপ্রাপ্তির আশায় ঘুরতে থাকে। এই দেহান্তরের প্রক্রিয়ায় জীবাত্মা তার স্থূল দেহের সূক্ষ্ম অংশকে ভাবি দেহের বীজ রূপে গ্রহণ করে।

জীব আত্মা যখন স্থুল শরীর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে তখন তার সঙ্গে তার ইন্দ্রিয়গুলোও যাত্রা শুরু করে। জীবাত্মা যখন বেরিয়ে পড়ে, তখন প্রাণের উৎক্রমন ঘটে। আর প্রাণের যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রিয়গুলোও বেরিয়ে পড়ে। আর ইন্দ্রিয়গুলোর যখন  যাত্রা শুরু হয়, তখন আমাদের অবশ্য়ই ধরে নিতে হবে যে এই ইন্দ্রিয়গুলোরও  স্থূল আকার আছে। এইভাবেই জীবের  ভাবি বা ভবিষ্যৎ জন্মের একটা সূচনা বা ভিত্তি স্থাপন হয়। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বৃহদারণ্যক উপনিষদ বলছে  : মানুষের মৃত্যুতে বাক অগ্নিতে প্রবেশ করে, প্রাণ বায়ুতে প্রবেশ করে। মন চন্দ্রে, শ্রোত্র অর্থাৎ শ্রবণ শক্তি   দিকসমূহেপ্রবেশ করে, শরীর পৃথিবীতে, হৃদয় মহাকাশে, লোমসকল ঔষধিগাছে, কেশ বনস্পতিতে, শুক্র ও শোনিত জলের মধ্যে প্রবেশ করে।  তাই যদি হয়, তবে ইন্দ্রিয় সমূহ জীবাত্মার সঙ্গে গমন করে, সেটা কি বলা যায় ? 

আবার কারুর কারুর মতে, জীবাত্মা কখনোই তার পূর্ব দেহের সূক্ষ্ম অংশগুলোকে অর্থাৎ সূক্ষ্ম দেহকে  সঙ্গে নিয়ে যায় না। তার কারন হচ্ছে শরীর  ধারণের উপযুক্ত উপাদান সমূহ সর্বত্র সহজলভ্য। তাই জীবাত্মা কখনোই তার পূর্ব দেহের ভূতবর্গের সূক্ষ্ম-অংশকে সঙ্গে নিয়ে যায় না সঙ্গে নেবার দরকারও  পড়ে না।

এই ব্যাপারটা বুঝতে গেলে, এটা বুঝতে হবে পঞ্চভূতের আহুতি হয়ে গেলে আমাদের কি হয় সেটা সম্পর্কে সম্যক  ধারণা রাখতে হবে। পঞ্চ আহুতি অর্থাৎ শ্রদ্ধা অর্থাৎ তরল আহুতির সুক্ষরূপ হচ্ছে শ্রদ্ধা এছাড়া সোম, বৃষ্টি, অন্ন, বীজ এগুলো পঞ্চ অগ্নিতে অর্পণ করা হয়। এই পঞ্চ অগ্নি হচ্ছে, স্বর্গ, পৰ্জন্য অর্থাৎ বৃষ্টি, পৃথিবী, মনুষ্য ও মানবী ইত্যাদিতে অর্পণ করা হয়। এইজন্য পঞ্চ আহুতি জলকে বলা হয় মনুষ্য। জীবাত্মা জলের দ্বারা আবৃত্ত হয়ে উর্দ্ধলোকে গমন করে। যদিও শরীরের সমস্ত উপাদান সমূহ সহজলভ্য, কিন্তু বীজ সহজলভ্য নয়। এমনকি জীবের যেসব উপাধি অর্থাৎ ইন্দ্রিয়াদি আছে, সেগুলো যেহেতু সে সঙ্গে করে নিয়ে যায়।  তাই  এই ইন্দ্রিয়াদি ও  জীবের  পদার্থগত অস্তিত্ত্ব অবশ্য়ই আছে এটা ধরে নিতে হয়, তা না থাকলে ইন্দ্রিয়াদি  জীবের সঙ্গে যেতে পারে না। 

জলের তিনটি উপাদান, শ্রদ্ধা-সোম-বৃষ্টি।  জল এই তিনটি উপাদান সমন্বিত বলে, মানব শরীরে জলের আধিক্য দেখা যায়। আমরা জানি পঞ্চভূতের মধ্যে অপ একটি। অর্থাৎ জল একটি।  কিন্তু আসলে এই জলের  মধ্যে আছে জলের সূক্ষ্মরূপ অর্থাৎ শ্রদ্ধা, সোম ও বৃষ্টি। তরল আহুতির সূক্ষ্ম রূপকে বলে শ্রদ্ধা।

ব্রহ্মসূত্র বলছে, এই জলই , কালক্রমে মনুষ্যে রূপান্তরিত হয়।  জীব মৃত্যুকালে জলাদি সমন্বিত হয়ে উৎক্রমন করে,এবং তারপরে আবার মনুষ্যরূপে জন্ম গ্রহণ করে।

আমাদের সৎকর্মের ফলভোগ শেষ হয়ে গেলে আমরা আবার পৃথিবীতে নেবে আসি। আমরা যে পথে গিয়েছিলাম আবার সেই পথেয় নেবে আসি। এখন কথা হচ্ছে, আমরা যদি কর্মফল ভোগ করার পরে  , নেবে আসি আবার পৃথিবীতে, তবে যে বলা হয়ে থাকে যে আমরা প্রারব্ধ ফল ভোগ করার জন্য পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করি, সেটা কি তা হলে সত্য নয় ? আসলে দেবতা হয়ে মানুষ তার সৎকর্মের ফল ভোগ করে।  কিন্তু তার যে অসৎ কর্মফল সঞ্চিত হয়েছে, তার কি হবে ? শুভ কর্মফল ভোগের জন্য যেমন দেব-দেহের প্রয়োজন, তেমনি মন্দ কর্মের ফল ভোগের জন্য  পশু দেহ বা কর্ম অনুযায়ী ফলভোগের উপযুক্ত দেহের প্রয়োজন। তাই আমরা আবার দেহ ধরনের জন্য উদগ্রীব হই  কিন্তু জীবের যাতায়াতের রাস্তাটা কি ?

ব্রহ্মসূত্র বলছে, মানুষ যে পথে আসে সেই পথেই যায়। কোথা থেকে আসে আর কোথায়ই বা যায়। ব্রহ্মসূত্র বলছে, মানুষ তার সুকর্মের জন্য স্বর্গ বা চন্দ্রলোকের দিকে যাত্রা করে। আর সেই একই মানুষের, তার দুস্কর্মের জন্য তাকে যেতে হয় যমলোকে। আর সঞ্চিত কর্মফলের ভোগ-অবশিষ্ট অংশ ভোগই নব জন্মের কারন। কতকগুলো কর্ম আছে, যার ফল দেহ ভিন্ন ভোগ সম্ভব নয়। তা সে ইতর জীবদেহ হতে পারে, আবার উৎকৃষ্ট মনুষ্য দেহ হতে পারে।

এই চন্দ্রলোক ও  যমলোক কোথায়, এবং কাকে বলে, সে  সম্পর্কে আমরা একটু জেনে নেবো।   পড়াবিদ্যাবিদগণ বলছেন, এই পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টির পূর্বে চন্দ্রে জীবনের খেলা চলছিল। এই চন্দ্র তখন ছিল গ্রহ।  কালে কালে চন্দ্রে জীবনীশক্তির  বিস্তার ও রক্ষার পরিবেশ নষ্ট হতে থাকে। চন্দ্র নিজেও আস্তে আস্তে ছোট হতে থাকে। একটা সময় চন্দ্র ধোঁয়াশায় পরিণত হবে। এবং অদৃশ্য হয়ে যাবে।

সুতরাং আমরা যে ক্রমবিকাশ শক্তির অন্তর্গত  তার মধ্যে স্থূল গ্রহ - মঙ্গল, পৃথিবী, বুধ। বাকি চারটি অদৃশ্য। আর আমরা ক্রমবিকাশ শক্তির চতুর্থ শৃঙ্খলের, চতুর্থ প্রদক্ষিণকালের চতুর্থ গ্রহ, এবং পঞ্চম মূল জাতির অন্তর্গত। পরাবিদগন বলছেন, পৃথিবীতে এখন পঞ্চম ও ষষ্ঠ শাখাজাতি বর্তমান আছে।      যতদিন যাবে, ততই পৃথিবীতে সর্ববিধ উন্নতির বিকাশ দেখা যাবে। ষষ্ঠ ও সপ্তম মূল জাতির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে  বর্তমান জগতের শিক্ষিত ব্যক্তিগণ, ক্রমশ ধর্মবুদ্ধি লাভ ক'রে, সিদ্ধ শ্রেণীভুক্ত হবেন। এই সপ্তম মূল-জাতির অস্তিত্ব শেষ হতে কত লক্ষ বৎসর লাগবে, তা বলা যায় না। 

পৃথিবী শৃঙ্খল শেষ হলে, নতুন গ্রহকে অবলম্বন করে পঞ্চম শৃঙ্খলের কাজ আরম্ভ হবে। আর তখন asteroids নামক যে গ্রহপুঞ্জ দেখতে পাওয়া যায়, সেটা পিণ্ডীভূত হয়ে একটা বড়ো গ্রহ হবে। এবং ছয়টি অদৃশ্য গ্রহকে নিয়ে, পঞ্চম শৃঙ্খলের কাজ আরম্ভ হবে।

পৃথিবী তখন, জরাজীর্ন ও ক্ষুদ্রাকার হয়ে, নতুন গ্রহের উপগ্রহ রূপে গণ্য  হবে। 

প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় শৃঙ্খলের কাজ শেষ হয়ে গেছে। একমাত্র চাঁদ ছাড়া, আর কোনো গ্রহের চিন্হ নেই। চাঁদও  কালক্রমে জ্যোতির্ময় কুয়াশায় পরিণত হবে। চন্দ্রলোকে যারা জন্তু ছিলো, তারা এখন মানুষ হয়ে জন্মেছে, আর চাঁদে যারা উদ্ভিদ ছিল তারা এখন জন্তু হয়ে জন্মেছে। পৃথিবীর শৃঙ্খলকাজ শেষ হলে, এখানেও এই প্রকার ঘটবে। যে নতুন গ্রহে, পঞ্চম শৃঙ্খল-এর  কাজ আরম্ভ হবে সেখানেও এই প্রকার হবে। আমাদের উদ্ভিদ ওখানে জন্তু হবে, আমাদের জন্তু ওখানে মানুষ হবে, কিন্তু অপেক্ষা করতে হবে, যতদিন না মানুষ সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি হয়।  আর যে সব মানুষ পৃথিবীতে আত্মউন্নতি লাভ করতে পারবে না, তাদের তাদেরও  অপেক্ষা করতে হবে, যতদিন না ওখানে মানুষের আবির্ভাব হয়। এই অপেক্ষাকাল হবে, দীর্ঘ থেকে  দীর্ঘতর। এটাকে বিচারাধীন কাল (Aeoniam  Condemnation Period  ) বলা যেতে পারে। 

পরাবিদ্যা আর ব্রহ্মবিদ্যা মেলাতে গেলে একটা জিনিস মনে হয়, প্রাচীন মুনি ঋষিরা এই চন্দ্রলোক থেকে এসেছিলেন। তাই তারা মনে করতেন, পৃথিবীতে তাদের কাজ শেষ হয়ে গেলে, তারা আবার চন্দ্রে ফিরে যাবেন। কিন্তু যারা আত্মউন্নতি লাভ করতে পারবে না, অর্থাৎ অজ্ঞান তাদের স্থান হবে "অসূর্য্যা নাম তে লোকা"অর্থাৎ এক অন্ধকার আচ্ছন্ন জগতে। এইলোককে ব্রহ্ম বিদ্যাবিদগন বলছেন যমলোক। 


আমরা জানি উদ্ধারের দুটো রাস্তা একটা কর্ম আর একটা জ্ঞান। কর্মের মাধ্যমে মানুষ পিতৃযানের প্রাপ্তি ঘটে, আবার বিদ্যা বা জ্ঞান দ্বারা মানুষ দেবযানের প্রাপ্তি ঘটে। আর একটা আছে ভক্তি যোগ, এরা  কর্ম করে না আবার জ্ঞানের রাস্তাতেও যায় না  কেবল  জন্মায় আর মরে - "জায়স্ব-ম্রিয়স্ব" .। এরা  তৃতীয় লোকের বাসিন্দা।

পৃথিবীতে চার ধরনের প্রাণী দেখা যায়।  জরায়ুজ, অণ্ডজ, একটা স্বেদজ বা শ্যাওলা আর একটা হচ্ছে উদ্ভিদ ।  শ্যাওলা জল থেকে জাত। উদ্ভিদ  পৃথিবীতে থেকে জাত,  অর্থাৎ এই প্রকার প্রাণী স্ত্রী-পুরুষের মিলন ছাড়াই জন্ম নিয়ে থাকে।

জীব চন্দ্রলোক থেকে যাত্রা ক'রে, বিভিন্ন বাহনের মাধ্যমে, অর্থাৎ  প্রথমে আকাশ, তার পড়ে বায়ু, বায়ু থেকে ধুম, ধুম থেকে কুয়াশা, কুয়াশা থেকে মেঘ, মেঘ থেকে বৃষ্টি। তারপর ব্রীহি অর্থাৎ উৎকৃষ্ট ধান উৎপাদনের শক্তি, বা অন্ন -  ঔষধি গাছ, অর্থাৎ যে সব গাছ ফল উৎপাদনের পরেই মারা যায়।  তার পরে বনস্পতি ইত্যাদি রূপে জাত  হন। এবার যে কেউ এই ব্রিহী বা অন্ন যখন ভক্ষণ করে, তখন তার দেহে শুক্র উৎপন্ন হয়। এই শুক্র আবার যোনিপথে গর্ভে প্রবেশ করে। এবং গর্ভ থেকে একটা নতুন দেহের জন্ম হয়। যোনিকে আশ্রয় করে জীব স্বীয় ভোগায়তান দেহ লাভ করে। "যোনেঃ শরীরম।"

একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে, মানুষ কিন্তু এই ব্রীহি বা উদ্ভিদ হয়ে যান না। এগুলো হচ্ছে তাদের বাহন। এই বাহন গুলোতে চেপে জীব পৃথিবীতে আসে। মানুষ যখন মারা যায়, তখন তাকে চিতার অগ্নিতে বা কবরে চড়িয়ে দেওয়া হয়। এবার এই দেহ থেকে উদ্ভূত জল ধোঁয়া হয়ে উপরে উঠে যায়। এবং চন্দ্রলোকে গিয়ে ভোগ শরীর  নির্মাণ করে। চন্দ্রলোকে হচ্ছে ভোগক্ষেত্র। চন্দ্রলোকে জীবগন দেবভোগ্য।  অর্থাৎ দেবগন এদেরকে পেয়ে, দর্শন করে তৃপ্তি অনুভব করেন।

মানুষ যখন উর্দ্ধলোকে যান, তখন জ্ঞানীগণ পূর্ণমাত্রায় সচেতন থাকেন, অর্থাৎ আমাদের যেমন ইন্দ্রিয় অনুভূতি আছে, তাঁরাও ইন্দ্রিয় অনুভূতি সম্পন্ন থাকেন।তাদের গতি সম্পর্কে তারা পূর্ণমাত্রায় সচেতন থাকেন।  কিন্তু যখন তারা ইহজগতে নেবে আসেন, তখন তারা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। পাহাড় থেকে মানুষ পড়ে গেলে মানুষ যেমন কিছুটা সময়ের জন্য  সংজ্ঞাহীন হয়ে যান, পরে আত্মীয়স্বজনরা তাকে সেবাসুশ্রতা দিয়ে, সুস্থ করে তুললে  তিনি আবার  জ্ঞান ফিরে পান। ঠিক তেমনি নেবে আসার যে যাত্রাপথ, জীবের এই অবস্থায়, সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই তার থাকে না। এবং তার ভাবনা অনুযায়ী বা সংকল্প-বাসনা অনুযায়ী তার দেহধারন হয়। জ্ঞানী আত্মা স্বর্গলোককেই নিজেদের বাসভূমি মনে করেন, আর পৃথিবীতে তাদের  স্থিতিকালকে স্বপ্নাবস্থা মনে করেন।

এখন এই যে আমাদের যাত্রা এটি কে পরিচালনা করে ? উপনিষদ বলছেন এটি বৈশ্বানর।  এখন এই বৈশ্বানর কে ?  এই সম্পর্কে একটা গল্প শুনুন।

উপমন্যুর পুত্র প্রাচীনশাল, পুলস্ত পুত্র সত্যযজ্ঞ, ভাল্লবির পুত্র ইন্দ্রদ্যুম্ন, এবং শর্করাক্ষ পুত্র জন এছাড়া  অশ্বতরাশ্বের পুত্র বুড়িল এই কয়জন গৃহস্থ সন্যাসীর মনে প্রশ্ন জাগলো, আমাদের আত্মা কে ? ব্ৰহ্মই বা কি ? তো এই প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য উদ্দালক,  আরুণি মুনির কাছে গেলেন। তিনি এদের  কেকয়  পুত্র অশ্বপতির কাছে নিয়ে গেলেন।

অশ্বপতি বললেন : ১. যাকিছু সুন্দর, যাকিছু উজ্বল তাই বৈশ্বানর। কিন্তু এই দ্যুলোক আত্মার মস্তক মাত্র   ২. আদিত্য বা সূর্য ও তার তেজ, আলোক রশ্মি, ও তার বিচিত্রপূর্ন রঙ এটি আত্মার চোখ। এর নাম বিশ্বরূপ  ৩. এই যে বায়ু এর নাম পৃথকবর্ত্ম , ইনি হলেন আত্মার প্রাণ। ৪. এই যে আকাশ এটিকে বলা হয় বহুল বা বিস্তৃত , আত্মার মধ্যভাগ হলো আকাশ। ৫. জল হচ্ছে আত্মার মূত্রাশয়। ৬. পৃথিবীকে বলা হয় প্রতিষ্ঠা। যিনি হচ্ছেন আত্মার পা।

এখানে আত্মার বিভিন্ন অংশকে আলাদা ভাবে, বোঝানো হয়েছে।  অর্থাৎ বৈশ্বানর বা পরম-আত্মা হচ্ছেন, একটা বিরাট পুরুষ যার ব্যাপ্তি অসীম। আর তার অঙ্গগুলো  হচ্ছে দ্যুলোক, সূর্য, বায়ু, আকাশ, জল  ও পৃথিবী।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ :

আজ আমরা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ থেকে ব্রহ্ম কথা শুনবো।একবার কিছু ব্রহ্ম জিজ্ঞাসু একত্রিত হয়ে পরস্পরকে প্রশ্ন করলেন - ব্রহ্মইকি এই জগতের কারন ? আমরা কোথা থেকে এসেছি ? আমাদের পালনপোষন কে করেন ? মৃত্যুর পর আমরা কোথায় যাবো ? আমরা কেন সুখ দুঃখ ভোগ করি ? আসলে এই প্রশ্নগুলো  আমাদের সকলের, এবং সর্বকালের । প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে জগতের কারন কি ?

কেউ বলছেন, কালই জগতের কারন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জগৎ আজ এই অবস্থায় এসেছে। আবার কালের প্রভাবে এই জগতের নিস্পত্তি হয়ে যাবে। কেউ বলছেন, জগতের সমস্ত বস্তুর একটা নিজস্ব স্বভাব আছে, বা ধর্ম আছে। এই স্বভাবই জগৎ সৃষ্টির কারন। আবার কেউ বলছেন ওসব কিছুই নয়, জগৎ সৃষ্টির কারন হচ্ছে নিয়তি, অর্থাৎ কার্য্য-কারন প্রক্রিয়ার সমষ্টি। আবার কেউ বলছেন, যদৃচ্ছা অর্থাৎ সৃষ্টি কোনো নিয়মে আবদ্ধ নয়, ঈশ্বরের ইচ্ছে হয়েছে তাই এই সৃষ্টি হয়েছে। এর কোনো কারন নেই।  ইচ্ছের আবার কোনো কারন হয় নাকি ? প্রাণ কেন সৃষ্টি হলো ? এর কোনো জবাব হয় নাকি ? কতকগুলো উপাদান অকারণেই একত্রিত হয়েছিল, তাই এমিবার সৃষ্টি হলো। কিন্তু কেন এগুলো অর্থাৎ এমিবার উপাদানগুলো একত্রিত হলো, তা কেউ জানে না। কেউ বললেন, ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম, এই পঞ্চভূত মিলেমিশে এই জগতের উদ্ভব হয়েছে। কেউ বললেন, পরম-আত্মা আর জীবাত্মা মিলে এই জগতের সৃষ্টি করেছে। কেউ বললেন, তোমরা যা বললে সেগুলো সবই সত্যি। একটা সম্মিলিত ক্রিয়ার ফলেই এই জগতের উদ্ভব। অন্যজন বললেন, দেখো যা কিছু ঘটছে, তার একজন কর্তা  আছেন। তাহলে সেই কর্তাটি কে ? মানুষ বড় দুর্বল। মানুষ কখনো পঞ্চভূতকে একত্রিত করে জগৎ সৃষ্টি করতে পারে না। মানুষ নিজেই তার সুখ-দুঃখ দূর করতে পারে না। মানুষ যদি জগৎ সৃষ্টি করতো, তবে সুখ বই দুঃখ থাকতো না। কারন মানুষ কখনোই দুঃখ চায় না। জগৎটা তো ভালো-মন্দের, সুখ দুঃখের আগর। মানুষ যদি এই জগৎ সৃষ্টি করতো তবে সেটা খুবই মনোরম হতে পারতো।  দেখছো না মানুষ দিনে দিনে সুখের সম্পদ বাড়িয়েই চলেছেন।  প্রকৃতিকে টেক্কা দিয়ে কেমন নকল আলো বানাচ্ছে, হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে, দিন দিন কম কষ্টে কি করে বেশি লাভ করা যায়, তার সফল প্রয়াস কেবলমাত্র মানুষই করতে পারে। তাই এই সৃষ্টি  যদি জীবাত্মা বা মানুষ করতো তবে না জানি কত সুন্দর হত আমাদের এই বাসভূমি।
এই আলোচনা যখন চলছে, তখন একজন বয়স্ক ঋষি  ভাবলেন, এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু গভীর ভাবে ভাবতে হবে। তো বললেন এস আমরা ধ্যান করি।
ঋষিরা গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন। এবং আত্মশক্তি বলে তারা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে  দেখলেন  জ্যোতির্ময় পরমাত্মার শক্তিই এই জগতের কারন। আর এই পরমাত্মাকে আড়াল করে রেখেছে মায়া। মায়া তার তিন গুণের সাহায্যে পরমাত্মাকে আড়াল করে রেখেছে। জ্যোতির্ময় পরমাত্মার শক্তিই এই জগতের কারন। আগে ঋষিরা জগৎ সৃষ্টির কারন বলে যা ভেবেছিলেন, সেগুলো কোনোটাই ভুল নয়, কিন্তু অসম্পূর্ন। আর এই সৃষ্টির কারন বলে তারা যা ভেবেছিলেন, তাদের সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করছেন এই পরমাত্মা।
ব্যাপারটা যেন কেমন মনে হয়।  ধ্যানে বসলেন, আর সব কিছু পরিস্কার হয়ে গেল ? তাহলে এই প্রশ্ন (জগৎ কে সৃষ্টি করেছেন ?) হাজার বছর  ধরে কেন চলছে। আর যদি কেউ এটা  বুঝেই থাকেন, তো আমরা বুঝতে পারছিনা কেন ? অর্থাৎ ঋষিরা যদি এটা বুঝেই থাকেন, তবে আমরা বুঝতে পারছি না কেন ? আমাদের কাছে, এগুলো সব শোনা কথা, আমরা কেউ বিশ্বাস করি আর কেউ করি না। কেন ? আর যারা বিশ্বাস করেন , তারাও কি সত্যিই জানেন  যে এই বিশ্বের নিয়ন্ত্রক হচ্ছেন, ব্রহ্ম।
থমাস নেওকমেন বা ধরুন অন্য কিছু নাম ভদ্রলোকের, চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন। আর লক্ষ করছিলেন, কেটলির জল গরম হয়ে, কেটলির মুখটাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিচ্ছে। তার মাথার মধ্যে চিন্তা উঠলো, কেন এমন হয় ? এই চিন্তা থেকেই একসময় আবিষ্কার হয় স্টিম ইঞ্জিনের। কিংবা ধরুন, গাছ থেকে আপেলটা পরে গেল, আর নিউটন ভাবতে লাগলেন, আপেলটা কেন গাছ থেকে নিচে পড়লো, উপরে গেল না কেন ? এর থেকেই আবিষ্কার হয় মাধ্যাকর্ষণ শক্তির। আমরা দেখি, শুনি, কিন্তু বুঝি না। আর যদি বুঝিও তা হলো - আপেলটা মাটিতেই পড়ে - এই জ্ঞান সঞ্চয় করি মাত্র আমরা। আগুনে জ্বাল দিলে জল গরম হয়, এটা আমাদের সঞ্চিত বা প্রত্যক্ষ জ্ঞান। কিন্তু কিছু মানুষ আছেন, তারা ভাবেন, কেন হয় ? এই কেন হয় যারা ভাবেন, তারা শুধু প্রতক্ষ্য জ্ঞানে সীমাবদ্ধ থাকেন না। তারা একটা অনুভবের জ্ঞান অর্জন করেন, এটাকে বলা হয় প্রজ্ঞা।  জ্ঞান হচ্ছে প্রতক্ষ্য বা শোনা, বা বই পড়ে জানা। আর প্রজ্ঞা হচ্ছে অন্তরের অনুভূতি। আর এই অন্তরের অনুভূতি সব সময় ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। যে কোনোদিন রসোগল্লা খায় নি, তাকে আপনি কি করে বোঝাবেন যে রসোগল্লা কেমন। আপনি বড়জোর বলতে পারেন, এটি মিষ্টি। কিন্তু মিষ্টি ও অনেক কিছুই হয়, রসোগোল্লা রসোগোল্লাই ।  তোমার তুলনা তুমি। ব্রহ্মও অনুভূতি লব্ধ জ্ঞান।  এটি প্রাজ্ঞ ব্যক্তির হয়ে থাকে। অন্যকে বোঝানো সম্ভব নয়। আর এই জ্ঞানকে বলে স্বজ্ঞা। মনের গভীরে যখন জ্ঞান আপনা-আপনি জেগে ওঠে তখন তাকে বলে স্বজ্ঞা। যেকোনো প্রশ্ন নিয়ে মনের গভীরে প্রবেশ করলে মনের মধ্যেই এর উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়। আসলে আমাদের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আগে থেকেই আমাদের মনের গভীরে গ্রোথিত হয়ে আছে। আমাদের কাজ হচ্ছে আমাদের অন্তর্চক্ষুকে সেই দিকে ফেরানো। ধ্যান হচ্ছে মনকে একমুখী করার প্রক্রিয়া। আর প্রজ্ঞা বা আমাদের যেকোনো প্রশ্নের উত্তর যখন আমাদের চেতন স্তরে ভেসে ওঠে, তখন তাকে বলে প্রজ্ঞা । তো ঋষিগণ এই ধ্যানের গভীরে প্রবেশ করে, ব্রহ্মকে জানলেন। আর যেহেতু ব্রহ্ম ভাষার অতীত, তাই তারা একটা উপমার সাহায্যে আমাদের ব্রহ্মজ্ঞান দেন করলেন।
তো ঋষিগণ একটা উপমার সাহায্যে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন।  বলছেন : ব্রহ্ম যেন  একটা বিশাল চক্র। যার নাম ব্রহ্মচক্র।  এই ব্রহ্মচক্র, মহাবিশ্বকে ধারণ করে রয়েছেন। কি দেবতা, কি মানুষ, কি জীব-জন্তু, উদ্ভিদ, কীটাণুকীট,এমনকি গ্রহ, উপগ্রহ, তারকমণ্ডলী, সবকিছুই এই চক্রের অন্তর্গত। অর্থাৎ ব্রহ্ম এই মহাবিশ্বের রূপ দিয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেমন করে এই রূপটা দিলেন। সৃষ্টি হচ্ছে ব্রহ্মর মায়াগুনের ক্রিয়া। ব্রহ্ম তার মায়া গুনের সাহায্যেই এই সৃষ্টি করেছেন।  এই মায়া গুন হচ্ছে ব্রহ্মচক্রের পরিধি মাত্র। ব্রহ্ম হচ্ছে বিশ্বের অতীত। আর বিশ্ব হচ্ছে ব্রহ্মসমুদ্রের  মধ্যে বুদ্বুদ  মাত্র। ব্রহ্ম দ্বারা, ব্রহ্মের ভিতরে সৃষ্ট  অর্থাৎ ব্রহ্মর একটা ফোটা এই বিশ্বের মধ্যেও আছেন। অর্থাৎ তিনি বিশ্বের মধ্যেও আছেন, আবার বিশ্বের বাইরেও আছেন। ব্রহ্মকে দেখা যায় না। কারন তিনি তিনটি গুনের দ্বারা আবৃত। এগুলো হচ্ছে সত্ত্বঃ, রজঃ ও তমঃ। এই তিনটি গুনের দ্বারা আবৃত আছেন বলে কেউ তাকে দেখতে পান না।
এই ব্রহ্ম চক্রের ষোলোটি কলা অর্থাৎ পঞ্চ ভূত, পঞ্চ কর্ম-ইন্দ্রিয়, পাঁচটা জ্ঞান ইন্দ্রিয় এবং মন।
পঞ্চভূত : আকাশ, বাতাস, আগুন, জল ও মাটি।
কৰ্মইন্দ্রিয় পাঁচটি : মুখ, হাত, পা, মলদ্বার, ও জনন-ইন্দ্রিয়।
জ্ঞান ইন্দ্রিয় : চোখ, কান, নাক, জিহ্ববা, ত্বক।
এর উপরে আছে আমাদের মন। এই মোট ষোলোটি অঙ্গ বা অংশ মিলিয়ে আমাদের বিশ্ব ।
 এখন আমরা জানি, প্রত্যেকটি চাকায় কতকগুলো স্পোক বা শলাকা থাকে।  ঋষিরা বলছেন, ব্রহ্মচক্র-তেও এইরকম পঞ্চাশটি শলাকা আছে। এই শলাকাগুলো আর কিছু নয় আমাদের মনের অবস্থা বিশেষ।
এগুলো হচ্ছে :প্রথম হচ্ছে ভ্রম : ভ্রম পাঁচরকম  - আত্মপ্রীতি, আসক্তি, ঘৃণা, জীবনতৃষ্ণা এবং বিপর্যয়জ্ঞান।
দ্বিতীয়ত ত্রূটি বা আমাদের দুর্বলতা : এগুলো আছে ২৮টি। মিথ্যা তুষ্টি।
তৃতীয়ত : আমাদের অষ্টসিদ্ধি অর্থাৎ প্রথমতঃ অনিমা (ইচ্ছেমত ছোট হয়ে যাওয়া),
দ্বিতীয়তঃ : লঘিমা (ইচ্ছেমত বড়ো বা হালকা হয়ে যাওয়া), তৃতীয়তঃ  প্রাপ্তি (যেখানে খুশি যেতে পারেন), চতুর্থতঃ  প্রাকাম্যম (যা চাইবেন তাই পেতে পারেন), পঞ্চমতঃ মহিমা (পাহাড়ের মতো বিশাল হয়ে যেতে পারেন), ষষ্ঠত ঈশিত্বম (অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি), সপ্তমতঃ  বশিত্বম (সবাইকে বশ  করার ক্ষমতা) , এবং অষ্টমতঃ বা সবশেষে কাম-অবসাইত ( সব কামনা অপসারণ হয়ে গেল) ।
চতুর্থত : নয়রকম আছে তুষ্টি। এগুলো নিয়ে আমরা ভবিষ্যতে আলোচনা শুনবো।
তো আমরা জানলাম  মোট ৫০টি স্পোক বা শলাকা  আছে এই ব্রহ্মচক্রে।

এরপরে আছে আরো কতকগুলো আছে উপশালাকা এদের সংখ্যা হচ্ছে কুড়িটি
এরমধ্যে দশটা ইন্দ্রিয়।   অষ্টৈক ষড়ভিঃ, অর্থাৎ মানবদেহে আটটি ধাতু। সেগুলো হচ্ছে -ত্বক, চর্ম, মাংস, রুধির, মেদ, অস্থি, মজ্জা, ও শুক্র।
ঋষিগণ বলছেন, এই জগৎ বাসনার বন্ধনে আবদ্ধ। এই বাসনাই আমাদের জগৎ অনুভূতি দিচ্ছে। জড় বস্তুর প্রতি আমরা আসক্ত। বিভিন্ন সম্পর্কের প্রতি, অর্থাৎ দারা-পুত্র-পরিবার এর প্রতি  আমরা মোহগ্রস্থ।   ইন্দ্রিয়সুখের প্রতি আমরা  আসক্ত। আমাদের এই আসক্তি, মোহ, বাসনা যদি না থাকতো  তবে আমরা মুক্ত পুরুষ হয়ে যেতে পারতাম। জগতের প্রতি আমাদের দৃষ্টিকোণ পালটে যেতো। জগৎ বলে আর আমাদের কাছে কিছুই  থাকতো না।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম

সুষুপ্তি : 

আমরা জানি আমাদের মনের তিনটি/চারটি স্তর আছে। প্রথম হচ্ছে চেতন অবস্থা।  দ্বিতীয়টি হচ্ছে স্বপ্নাবস্থা। তৃতীয়টি হচ্ছে সুসুপ্তির স্তর। চতুর্থটি হচ্ছে তুরীয় অবস্থা। আজ আমরা এই  সুসুপ্তির অবস্থা সম্পর্কে জানবো।

আমরা যখন জেগে থাকি, তখন আমরা মনের চেতন অবস্থায় থাকি। আমরা যখন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি, তখন আমরা স্বপ্নাবস্থায় থাকি।  এই স্বপ্নঅবস্থার পরে ঘুমের মধ্যে  আমাদের যে অবস্থা হয় তাকে বলে সুষুপ্তি। শ্রূতি বা উপনিষদ  বলছে, জীব যখন নিদ্রায় মগ্ন হয়, এবং কিছুই জানে না, তখন সে নাড়ীসমূহ অবলম্বনে হৃদয় আকাশে প্রবেশ করে। আমরা যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকি তখন আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় শান্ত হয়ে যায়। কোনো ইন্দ্রিয় অনুভূতি তখন আমাদের থাকে না। এই সময় সে চিন্তা রোহিত হয়ে যায়। না থাকে কোনো সংকল্প, না থাকে কোনো দুশ্চিন্তা, না থাকে কোনো দুর্ভাবনা। না থাকে ভালো লাগার অনুভূতি, না থাকে খারাপ লাগার অনুভূতি। এই সময় আমাদের ইন্দ্রিয়শক্তি আমাদের নাড়ীর মধ্যে অবস্থান করে। এই সময় আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো নিজের মধ্যে মিশে যায়। বাইরের জগতের সঙ্গে আমাদের আর কোনো সম্পর্ক থাকে না। আমাদের নাড়ীগুলো তখন সূর্য্য রশ্মির তেজে পূর্ন  হয়ে যায়। ইন্দ্রিয়গুলো কৰ্মরহিত হয়ে যায়। এই সময় আমাদের ভালো মন্দ জ্ঞান থাকে না। আর এই সময়টাতেই আমরা শুদ্ধ, মুক্ত, বন্ধনহীন অবস্থায়, আমরা আমাদের প্রকৃত স্বরূপে অবস্থান করি।

মৃত্যু পথযাত্রী মানুষ বা জীব যখন পরলোকে যাত্রার প্রস্তূতি নিচ্ছেন, এই সময় যদি আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবরা তাকে ঘিরে থাকে, তবে একটা প্রচলিত প্রশ্ন আমরা করে থাকি।  আমাকে কি চিনতে পারছেন ? এই সময় তার একটা আচ্ছন্ন ভাব বা ঘোরের মধ্যে তিনি থাকেন। প্রাণ বায়ু যতক্ষন আসা যাওয়া করে, ততক্ষন তিনি  চিনতে পারেন। কিন্তু প্রাণবায়ু চলে গেলে তিনি আর দেখতে পান না, চিনতেও পারেন  না। কথাও বলতে পারেন না। মৃত্যুর ঠিক আগে আমরা এই সুসুপ্তির অবস্থায় বা আচ্ছন্ন অবস্থায়  কিছুক্ষন অবস্থান করি। তার পরেই আমরা মনোময় দেহে স্থানান্তরিত হই।

মানুষ যখন স্বপ্নাবস্থায় থাকে তখন আমাদের আত্মা স্বপ্নবৃত্তি অবলম্বনে ইন্দ্রিয়গনকে সঙ্গে নিয়ে নিজের শরীরে যেমন ইচ্ছে ভ্রমন করেন।  কখনো রাজা, কখনো ফকির, কখনো জলে কখনো আকাশে বিচরণ করেন। আবার তিনি যখন সুসুপ্তিতে থাকেন, তখন তিনি কিছুই জানেন না, কিছুই করেন না । আমাদের শরীরে যে বাহাত্তর হাজার নাড়ী আছে, সেই নাড়ীগুলোকে অবলম্বন করে এই শরীরেই অবস্থান করেন। অর্থাৎ সুসুপ্তির সময় আত্মা শরীর ছেড়ে কোথাও যান না। কিন্তু শরীরে ইন্দ্রিয়গুলোর সঙ্গে তিনি থাকেন না। সূর্য্য যেমন একস্থানে থেকে সমস্ত জগৎকে আলোকিত করেন, তেমনি এই  আত্মা আমাদের হৃদয়ে থেকে সর্ব শরীরে চৈতন্য ব্যাপ্ত করে রাখেন।  জাগ্রত অবস্থায় আমরা বুদ্ধির অনুসরণ করি, স্বপ্ন-অবস্থায় আমরা বুদ্ধি সংকুচিত হন।  আর সুসুপ্তির অবস্থায় বুদ্ধির লোপ পায়। এইখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, আত্মার গমন নির্গমন বলে কিছু হয় না। কারন আত্মা সর্বত্র।

আসলে সুষুপ্তি কালে জীবাত্মা পরম-আত্মাতে উপাধিগুলোকে নিয়ে অর্থাৎ আমাদের ইন্দ্রিয়াদি সহ  অবস্থান করে  থাকে। কিন্তু জীবাত্মা যেহেতু মায়াদ্বারা আছন্ন হয়ে থাকে, তাই সুষুপ্তি কালে জীবাত্মার এই একত্ত্ব অনুভব করে পারে না। এই সুষুপ্ত জীব আবার জাগ্রত অবস্থায় আসে।

আমরা যখন সঙ্গাহীন হয়ে যাই, অর্থাৎ সাময়িক মূর্ছা যাই, তখন আমাদের আংশিক সুসুপ্তির উপলব্ধি করতে পারি। অর্থাৎ মূর্ছা-কালীন অবস্থার স্মৃতি আমাদের থাকে না।  তেমনি সুসুপ্তির সময় আমরা কি অবস্থায় ছিলাম সেই স্মৃতিও আমাদের থাকে না।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম।

বিজয়বাবুর জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানটি যিনি বা যারা রেকর্ড করেছিলেন, তারা আমাকে প্রচারের স্বার্থে দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন আমাদের চ্যানেলটি অর্থ উপার্জনের যোগ্য হয়েছে, তখন অন্য কারুর রেকর্ড করা জিনিস থেকে অর্থ উপার্জন অনৈতিক বলে এটি বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপনার অসুবিধার জন্য দুঃখিত। আপনার ফোন / জিমেল ঠিকানা দেবেন, যাদের ভিডিও তাদের বলে দেব। নমস্কার। 




 

Saturday 10 August 2019

মহাপুরুষদের জীবন থেকে

মহাপুরুষদের জীবন থেকে

একজন ভজন গান রচনা করেন। আর একজন সেটা তার সুরেলা কন্ঠে গেয়ে গেয়ে  শোনান। গান যে বাঁধেন, তিনি হিন্দু ঘরে জন্মেছেন, নাম নানক ।  আর গান যে গেয়ে শোনান তিনি মুসলমান ঘরে জন্মেছেন নাম মর্দানা । তো গ্রামে গ্রামে তারা এই গান গেয়ে শোনান। গানের মাঝে মাঝে এই হিন্দু সাধক উপদেশ শোনান। তো গ্রামের লোকেরা তাদের গান শুনেআর উপদেশ  তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কোন মঠের বাসিন্দা  ? কোন সম্প্রদায়ের সাধু । তো যিনি গান বাঁধেন, তিনি বললেন যে নিরাকার সারা বিশ্বে আকার নিয়েছেন, আমরা তারই ধ্যান করি।  তারই মহিমা গেয়ে বেড়াই দিকে দিকে।  আমাদের কাছে নেই কোনো সম্প্রদায়ের প্রশ্ন, নেই কোনো উঁচু-নিচু পার্থক্য। আমার দৃষ্টিতে হিন্দু মুসলমানের ভেদ নেই। দেশে কি একটাও হিন্দু আছে ? মুসলমানও তো  দেখছি না কাউকে।

তো গাঁয়ের মধ্যে এদের প্রচার হয়ে গেল। নবাবের কাজীর কাছে সংবাদ গেলো, একজন হিন্দু মুসলমানদের সম্পর্কে যা তা বলে বেড়াচ্ছে। গর্জে উঠলেন, কাজী।  সেকি হিন্দুর ছেলে নানক, হিন্দুদের নিয়ে যা ইচ্ছে বলুক, কিন্তু মুসলমানদের নিয়ে তামাশা ? মুসলমানদের ধর্ম বা সমাজ নিয়ে হালকা কথা বললে তো তা সহ্য করা যায় না।

নবাব দৌলত খানের দরবারে হাজির  করা হয় নানককে। নবাব রুক্ষ স্বরে বলেন, নানক আমি তোমার উপরে অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছি।  তুমি নাকি বলে বেড়াচ্ছো, এখানে হিন্দুও নেই আর মুসলমানও কেউ নেই। তবে কি বলতে চাও এই কাজী সাহেব বা আমি কেউ মুসলমান নোই ? আমরা সবাই অমুসলমান ?
নানক মুখে স্মিত হাসি হেসে উত্তর দিলেন : নবাব সাহেব, প্রকৃত মুসলমান আমি তাকেই বলবো, যার মধ্যে সত্যিকারের বিশ্বাস জেগেছে। পয়গম্বরের উপদেশবাণী যে নিজের জীবনে প্রয়োগ করেছে। আত্মাভিমান, কম, ক্রোধ, লোভ মোহ  যিনি নির্মূল করতে পেরেছেন। জীবন আর মৃত্যু যার চোখে সমান হয়ে গেছে। আমি তাকেই বলবো প্রকৃত মুসলমান। ঈশ্বরের ইচ্ছার সঙ্গে যার ইচ্ছার মিলন হয়েছে, সেই তো মুসলমান। যিনি সর্বত্র আল্লা-তালহকে দেখছেন তাকে ছাড়া কাকে বলবো মুসলমান ? এমন লোক কোথায় আছে আমাকে বলে দিন।

সভায় চাপা গুঞ্জন উঠলো। কাজীর মুখ ব্যাজার হয়ে গেলো। নবাব মনে মনে খুশি হলেন।  নানকের এই উদার ধর্মবোধ উদার মনোভাবাপন্ন  নবাবকে সত্যে প্রতিষ্ঠিত করলো। কিন্তু কাজী তো ছাড়বার  পাত্র নয়।  তো কাজী বললেন, নানক তোমার্ বক্তৃতা অনেক শুনলাম। এবার ঠিক করে বলতো তুমি কোন ধর্মের মানুষ ? হিন্দু না মুসলমান?

নানক বললেন, আমি কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায়ের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ নোই।

কেন ? এ আবার কি অদ্ভুত কথা ?

নানক বললেন,  দেখুন, যে কোনো সম্প্রদায় চালিত হয় সেই সম্প্রদায়ের প্রবর্তক গুরুর উপদেশ বাণীর মধ্যে দিয়ে।  আর আমি পথ চলি সেই অনাদি, অনন্ত, পরম পুরুষের প্রদর্শিত আলোতে। আমার চোখে ধর্মের ভেদ রেখা বিলুপ্ত হয়ে গাছে।

কথায় কথায় সন্ধ্যা হয়ে গছে।  সন্ধ্যাকালীন নামাজের সময় হয়েছে। সভা ভঙ্গ করে দেওয়া হলো। নবাব বললেন, আমরা নামাজ পড়তে মাসজিতে যাচ্ছি।  তুমি তো অনেক বড়ো বড়ো  কথা বললে, তোমার চোখে ধর্মের ভেদ কিছু নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি। .. তো আমাদের সাথে চলো মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়বে। তোমার আপত্তি আছে ?

নানক বললেন - বিন্দু মাত্র আপত্তি নেই। নামাজ তো ঈশ্বরের স্তূতি।  ঈশ্বরের যে কোনো স্তূতি আমার কাছে পরম শ্রদ্ধার বস্তু। এই বলে নানক,  কাজী ও নবাবের সঙ্গে চললেন মসজিদে।

নামাজ শেষ হয়ে গেলো।কাজী দেখলো, নামাজ কক্ষের এক প্রান্তে, নানক চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে । নামাজ পড়ে  নি। তো কাজী চেপে ধরলো, নানককে - এই বুঝি তোমার নামাজ পড়া ? এই বুঝি তোমার সত্যবাদিতা ?

নানক বললেন - কাজী সাহেব আপনাকে অনুসরণ করে নামাজ পড়বো ভেবেছিলাম। পরম-ঈশ্বরের কাছে প্রাণের প্রার্থনা জানাবো, এই আশা নিয়েই তো এখানে এসেছিলাম। কিন্তু অনুসরণ করবো কাকে ? আপনি তো সত্যি সত্যি আজ এখানে নামাজ পড়েন নি।

কাজী রেগে গেলেন, গর্জে উঠলেন  - তার মানে ? মুখ সামলে কথা বলো - বেয়াদপ কোথাকার  !
নবাবের কানেও নানকের কথাটা ভালো লাগলো না। তিনি বললেন,  তোমার এ কথার অর্থ কি ? তোমাকে এর জবাব দিতে হবে। নইলে পাবে কঠোর শাস্তি পেতে হবে ।

নানক বললেন - হুজুর সত্যি বলছি, আমি এতক্ষন দাঁড়িয়ে দেখলাম - কাজীসাহেব নামাজ পড়েন নি। আর যদি অভয় দেন তো বলি আপনিও নামাজ পড়েন নি।

এতে করে কাজী সাহেব আরো রেগে গেলেন। নবাব বললেন - তবে আমরা এতক্ষন কি করেছি ?

নানক বললেন -  তাহলে শুনুন -কাজী সাহেবের বাড়িতে কিছু দিন আগে,  একটা ঘোটকীর বাচ্চা হয়েছে। বাড়ির উঠোনে এই বাচ্চাটা ঘুরে বেড়ায়। আর এই উঠোনের পাশেই আছে একটা কুয়ো। কাজী সাহেব, নামাজের সময় ঈশ্বর স্তূতি তো মুখে বলছিলেন, কিন্তু মনে মনে ভাবছিলেন, ওই ঘোটকীর বাচ্চার কথা। দুশ্চিন্তা করছিলেন, বাচ্চাটা না কুয়ায় পরে যায়।

কাজী সাহেবের, নানকের কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলেন, মুখ শুকিয়ে গেল। মনে মনে ভাবলেন, তাহলে এই তরুণ সাধক কি তবে অন্তর্যামী ?

নানক বলে চললেন - নবাব সাহেবের মনও নামাজে ছিল না। নবাব সাহেবের মন নামাজ ছেড়ে বিচরণ করছিলো সুদূর কান্দাহার অঞ্চলে। একরাশ টাকা দিয়ে আপনি সেখানে কর্মচারী পাঠিয়েছেন ঘোড়া কেনবার জন্য। আপনি সেই কথাই বার বার ভাবছিলেন।

এই কথা শুনে, কাজীর যেমন অভিমান চূর্ন হয়ে গেছে। নবাব ভাবলেন, সব কথাই  বর্ণে বর্ণে সত্য - নবাবের অস্বীকার করার উপায় নেই।

তখনকার নবাবদের মধ্যে একটা উদারতা ছিল।সত্যিকারের জ্ঞানী, ও সাধকদের তারা সন্মান করতেন।নানককে যথাযথ সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে নানককে বিদায় দিলেন। নানকের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম। 

মহান আত্মা গুরু নানকের পরিব্রাজক  জীবনে বহু অঘটন ঘটিয়েছেন। কখনো করুনার ধারা ঢেলে দিয়েছেন, আবার কখনো তার অলৌকিক যোগবিভূতির ঐশর্য্য ঢেলে দিয়েছেন। নানক তখন পদব্রজে সঈদপুরে এসেছেন। লালু নামে এক কাঠ-মিস্ত্রির ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। লালু গরিব কিন্তু ভক্ত। তো নানক তার বাড়িতে বসে গ্রামের মানুষদের ধর্ম-উপদেশ দিতে লাগলেন। প্রতিদিন বহু লোকের সমাগম হতে লাগলো।

পাঠান সুবেদারের দেওয়ান, মালিক ভগো, এই শহরেই থাকেন। দান-টান  করেন। সাধু সন্তদের জন্য তার বাড়িতে প্রতিদিন ভান্ডারার ব্যবস্থা হয়। বহু সাধারণ মানুষও  সাধু সন্তদের   সঙ্গে খেতে আসেন। মালিক ভগো বেশ একটা আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন। তো একদিন খবর পেলেন এক হিন্দু সাধু লালুমিস্ত্রির বাড়িতে এসেছে, কিন্তু সে কখনো এই ভান্ডারাতে আসেন না। তো ভগো, লোক পাঠালেন, সাধুকে ধরে নিয়ে আসবার জন্য। ভগোর লোকেরা যখন সাধুকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন, তখন এক অমঙ্গলের আশঙ্কা নিয়ে লালু চললেন তাদের সঙ্গে সঙ্গে। মনে মনে ভাবছেন, না জানি আজ কি হতে চলেছে সাধুবাবার কপালে। লালু নিজেকেই এর জন্য দায়ী ভাবতে লাগলেন।

সাধুকে দেখেই মালিক ভগো প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন।  আপনি তো শুনেছি উদার স্বভাবের সাধু, জাতটাত নাকি মানেন না। তো আমার ভাণ্ডারায় ভোজন করতে আসেন না কেন ?

নানক মিটি মিটি হাসছেন। আর নানকের নির্বাক হাসি দেখে আরো উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন আমার কথার উত্তর দিন।

     
























 
  

Friday 9 August 2019

"অমি"-কে ধরবেন কি করে ?

"অমি"-কে ধরবেন কি করে ?

আমরা এর মধ্যে জেনে গেছি, আমি এই দেহ নোই।  আমি এই মন নোই।  আমি বুদ্ধি নোই। তাহলে আমি কে ? আমি নাকি আত্মা।  এই আত্মা ব্যাপারটা কি ? আত্মা বা আমি হচ্ছে চেতন শক্তি যা স্থানান্তরিত হয়। অর্থাৎ চেতন শক্তি প্রথমে আমাদের স্থূল শরীরে থাকে।  তার পরে আমাদের স্থূল দেহের মৃত্যুর পরে মানসদেহে অবস্থান করে। তার পরে মানস দেহের অবলুপ্তিতে চেতনশক্তি আমাদের বিজ্ঞানময় দেহে অবস্থান করে। আমাদের তিনটি পার্থিব  দেহের অর্থাৎ অন্নময়, প্রাণময়, ও মনময়, এই তিনটি দেহের যখন অবলুপ্তি হয় তখন এই চেতন শক্তি বিজ্ঞানময় দেহে ক্ষনিকের জন্য অবস্থান করে। তার পর বিজ্ঞানময় দেহ চেতনশক্তি সহ  আনন্দময় দেহে অবস্থান করে, এবং সবশেষে আনন্দময় দেহ চেতনশক্তিকে নিয়ে তার উৎস অর্থাৎ বিশ্বশক্তি বা  বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু এগুলো হচ্ছে তাত্ত্বিক কথা। সত্যি সত্যি আমাদের অমিকে কি আমরা ধরতে পারি ? যদি ধরতে পারি কিভাবে ধরবো ? সেই গোপন গূঢ়রহস্যঃ আজ আমরা শুনবো। 

আমরা এও জেনে গেছি, যে আমাদের স্নায়ুকেন্দ্রে যখন ঢেউ ওঠে তাকে বলে আমাদের মনের চিন্তা- বা আমাদের কামনা-বাসনা। অর্থাৎ আমাদের মানসিক বৃত্তি। আমাদের চেতনা অর্থাৎ সত্যিকারের আমি যখন এই মানসিক বৃত্তির সঙ্গে মিশে থাকে, তখন আমরা তাকে ধরতে পারি না। তো আমাদের কাজ হচ্ছে আমাদের চেতনাকে এই বৃত্তি থেকে আলাদা করা। এটা কি ভাবে করবো ? এই প্রক্রিয়াকে বলতে পারেন, অমিকে ধরবার খেলা। 

চুপচাপ মেরুদন্ড সোজা রেখে বসুন। মনের গভীরে ঢোকার চেষ্টা করুন। মনে কি কোনো চিন্তা উঠছে ? যদি ওঠে তবে তাকে পর্যবেক্ষন করুন। যতক্ষন না মনের চিন্তা দূরীভূত হচ্ছে, ততক্ষন এই অবস্থায় বসে থাকুন। মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন, যতক্ষন না মন চিন্তাশূন্য হচ্ছে ততক্ষন আমি মনকে ছাড়ছি না। 

এই ভাবে অবস্থানের ফলে, মন চিন্তা ছেড়ে, জ্ঞানের মধ্যে প্রবেশ করবে। এবং আপনি একটা আলোর বিন্দু দেখতে পাবেন। এই আলো আসলে জ্ঞানের আলো। এই আলো  আপনাকে পথ দেখাবে। এই আলোয় আপনি প্রথমে আপনার স্থূল দেহকে দেখতে পাবেন। অর্থাৎ প্রথম প্রথম মনে হবে, এই দেহই আমি। এর পরে,  শুধু আপনি আপনার মুখটা দেখতে পাবেন। অর্থাৎ মনে হবে, আপনার মাথাটাই আপনি। এর পরে আরো অপেক্ষা করুন, মাথার আকৃতি একটি কালো চক্রে পরিণত হবে  যার ভিতরে একটা আলোর বিন্দু দেখতে পাবেন। তখন মনে হবে, এই আলোর বিন্দু  বা মাথার একটা নির্দিষ্ট অংশই  আমি। এবার আপনি এই আলোর বিন্দুটাকে খেয়াল করুন, এটি মাথার কোথায় অবস্থান করছে ? 

এই সময় আপনার মধ্যে আবার চিন্তা উঠতে থাকবে। না একে  এড়িয়ে যাবেন না। চিন্তাগুলোকেই লক্ষ্য কোরতে  থাকেন।  এবার খুজুন কে চিন্তাগুলোকে দেখছে ? এবং মনের মধ্যে প্রশ্ন তুলতে থাকুন, আমি কে ? আমি কে ? প্রশ্ন করুন, আর মনকে গভীর ভাবে লক্ষ করুন। এখন চিন্তা সরে যাবে। আর ভিতরে অর্থাৎ চেতন কেন্দ্র উদ্ভাসিত হবে। এই সময় আপনি একটা অখণ্ডতা নিস্তব্ধতা অনুভব করবেন। এই নিস্তব্ধতার অনুভবই আমি বোধ।  বা অহং বোধ। এবার এটাকে ভালো করে লক্ষ করতে থাকুন। একটা জ্যোতি আপনি এখন দেখতে পাচ্ছেন।আপনার মনে একটা আনন্দ-অনুভব হচ্ছে। এই সময়, আপনার প্রশ্ন অর্থাৎ আমি কে, এটাকে দৃঢ় রেখে অপেক্ষা করুন। 

এর পরের  কাজগুলো আপনাকেই করতে হবে।  গুরুদেব বলছেন, সাধককে এবার একলা যাত্রা করতে হবে। সব শেষে একটা কথা বলি, আমি যতটা  সহজে কথাগুলো বলে গেলাম, এটাকে কার্যকরী করা এতটা সহজ নয়।  এটি প্রথমত সময় সাপেক্ষ, দ্বিতীয়ত একমাত্র গুরুর সান্নিধ্যে, গুরুর নির্দেশে এসব করতে হয়। আমার কথায় একাজ করতে যাবেন  না।   

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম।

"অমি"-কে ধরবেন কি করে ? (২)

আলোচনা করছিলাম, আমার "অমি"কে ধরবো কি করে। গুরুদেব আগের দিন কিছুটা নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, এবার একলা যাত্রা করতে হবে। এই পথে কি একলা যাওয়া যায় ? যাকে চিনি না, জানিনা, তাকে ধরতে গেলে, তাকে পেলেও আমি সনাক্ত করতে পারবো না। গুরুদেবকে এ কথা বলতেই তিনি যা বলেছিলেন, আমরা আজ সেই কথা শুনবো।
আমরা যখন যার মধ্যে অবস্থান করি, তখন আমরা তাই হয়ে যাই। আমরা যখন দেহের মধ্যে প্রবেশ করি তখন আমরা দেহী হয়ে যাই।  আমরা যখন জ্ঞানের মধ্যে প্রবেশ করি তখন আমরা জ্ঞানী হয়ে যাই। আমরা যখন পাপের মধ্যে প্রবেশ করি তখন আমরা পাপী হয়ে যাই।  আসলে আমি ও আমার এই কথাটা ভালো করে বুঝতে হবে। আমি মানুষ, আমি জ্ঞানী, আমি গায়ক, আমি সাধক, আমি লেখক, এগুলো হচ্ছে আমাদের অহং জ্ঞান। আবার আমার দেহ, আমার ছেলে, আমার মেয়ে ইত্যাদি হচ্ছে  সম্মন্ধ-জাত জ্ঞান বা মমতা । অর্থাৎ যার সাথে আমার সম্মন্ধ হয়েছে। এগুলো সবই সাময়িক। কেননা আমি চিরকাল মানুষ, বা গায়ক, বা সাধক, বা লেখক থাকবো না, অর্থাৎ এগুলো সবই কালের অধীন। আবার আমার যাদের সাথে সন্মন্ধ হয়েছে, এগুলোও একসময় থাকবে না। কিন্তু আমি থাকবো। তো আমি এখন কিসের মধ্যে প্রবেশ করেছি সেটা একটু ধ্যান দিয়ে দেখি।
ধ্যান যখন গভীর হবে, আমি বোধকে আলাদা করে নিয়ে মনের উপরে নিবিষ্ট করলে, এই কালের বা সাময়িক  সম্পর্ক গুলোকে আমরা বিচ্ছিন্ন করতে পারবো। আমি কে - এই প্রশ্নটাকে আমাদের মধ্যে দৃঢ় রাখতে হবে। অর্থাৎ আমাদের মূল উদ্দেশ্য আমিকে জানা বা ধরা।  এই ভাব যেন ক্ষনিকের জন্যও ত্যাগ না করি।
আমরা জানি আমাদের পাঁচটা শরীর। বা পাঁচকোষের এই শরীর ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আমি বোধকে ধরবার যে প্রক্রিয়া সেটা আমরা আগের দিন আলোচনা করেছিলাম। সেই প্রক্রিয়ার দ্বারা আমরা মনের স্তরে প্রবেশ করেছিলাম। অর্থাৎ অন্নময় - প্রাণময় কোষ পেরিয়ে মনময়  কোষে প্রবেশ করেছিলাম। এবং গভীর ধ্যানে লিপ্ত থেকে মনকে চিন্তা মুক্ত করেছিলাম। এই অবস্থায় মন কিন্তু বিলীন হয়ে যায় না। এই সময় মনের বৃত্তিগুলো সংস্কার রূপে সুপ্তভাবে থাকে। এই অবস্থায় মনের সংস্কারগুলো মাঝে মধ্যেই জেগে ওঠে। এই অবস্থায় ধ্যানের  গভীরতা যত  বাড়াতে পারবো, তখন
আমিকে আরো ভালো করে ধরতে পারবো। এবং এই আমি-বোধে স্থির হয়ে থাকার  শক্তি ও সময় অর্থাৎ স্থিতিকাল  বৃদ্ধি পাবে। এই অবস্থায় আমরা, আমাদের  দৈনন্দিন কাজের সময়ও , এই আমি বোধকে অন্যান্য মানসিক বৃত্তি থেকে আলাদা করতে পারবো। এই রকম হলে, আপনি জানবেন, আপনার সাধন জীবনের  উন্নতি হয়েছে। মনে রাখবেন, ধ্যান একটা নিরবিচ্ছিন্ন অবস্থা। এমন নয় যে যতক্ষন আমরা  ধ্যানাসনে আছি, শুধু সেই সময়টুকু আমাদের উচ্চ অবস্থা থাকবে, আর তার পরেই আমরা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবো। ব্যাপারটা এমন নয়। আমার আমিবোধকে মানসিক বৃত্তি থেকে আলাদা করে আমার দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপ চালিয়ে যাবো। এটাই প্রকৃত ধ্যানের প্রাপ্তি।

এই ভাবে আমার আমি-বোধকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে ধরে রাখতে পারলে, এবং নিয়মিত ধ্যান সাধনা চালিয়ে গেলে আমরা মনময় কোষ ত্যাগ করে বিজ্ঞানময় কোষে উত্তীর্ন হতে পারবো। এই অবস্থা একটু ভালো করে খেয়াল করুন। এই অবস্থায় আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস-এর গতি কমে যাবে। সাধারণত আমরা যখন শ্বাস নেই সেটা আমাদের নাক থেকে বুকে, বুক থেকে পেটে চলে যায়। কিন্তু আমাদের আমিবোধ যখন মনময় কোষ ছেড়ে বিজ্ঞানময় কোষে ওঠে, তখন আমাদের শ্বাস নাকের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। এবং আরো পরে একসময়  কেবলমাত্র নাসিকাগ্রে অবস্থান করে। এই অবস্থায় আমাদের অস্বস্তি বোধ হওয়া স্বাভাবিক।  কিন্তু গুরুর নির্দেশ নিয়ে, এই সময় ধ্যানে অবস্থানের সময় বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।  এবং তাতে এই অসুবিধা বা অস্বস্তি কেটে যাবে। এই সময় আরো কতগুলো অস্বাভাবিকতা আপনার মধ্যে দেখা দিতে পারে। যেমন শরীরে একটা কম্পন - যার উৎস হচ্ছে মেরুদন্ড। মেরুদণ্ডের মধ্যে একটা শিরশিরানি ভাব।  এমনকি এও মনে হতে পারে, যে একটা ছুঁচ আপনার মেরুদণ্ডের  ভেতর দিয়ে কেউ যেন উপরের দিকে  ঠেলে দিচ্ছে। এই শারীরিক অস্বস্তির সময় ধ্যানে নিরত থাকুন। আপাতত ধ্যান বন্ধ রাখুন। অথবা  কাউকে বলুন, মেরুদণ্ডে ম্যাসেজ করে দিতে। ম্যাসেজ করার সময় খেয়াল করবেন, হাত দিয়ে আলতো  করে পাশাপাশি ম্যাসেজ করতে।  ভুলেও উপর নিচ করবেন না। যদি এতেও  অস্বস্তি না যায়, তবে কয়েকদিন ধ্যান বন্ধ রাখুন। দেখবেন আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছেন। কিন্তু স্বাভাবিক হয়ে গেলেই আবার ধ্যানের অভ্যাস শুরু করুন। দরকার হয় এই অস্বস্তি অল্পবিস্তর সহ্য করুন।

এই সময় থেকে আপনার নানান-রকম দর্শন হতে পারে। জ্যোতি দর্শন হতে পারে। নানানরকম দেবদেবী যা আপনার চেনা বা অচেনা  মূর্তি, বিভিন্ন জায়গা, বিভিন্ন দৃশ্য, তা সে ভালোমন্দ সবই হতে পারে। সুন্দর, কুৎসিত, এমনকি ভয়ঙ্কর হতে পারে। এগুলো একটা সময় চলে যাবে, আর আপনার মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটবে। এগুলো দেখায় আপনার মধ্যে আনন্দ বা ভয় বা উদ্বেগ  দেখা দিতে পারে। আপনি নিস্পৃহ থাকুন। আর আপনি আপনার মধ্যে চিন্তা ওঠান যে এগুলো কে দেখছে ? অর্থাৎ আপনার সেই মূল ও প্রাথমিক প্রশ্ন আমি কে ? এই প্রশ্নকে আঁকড়ে ধরুন।  আমি কে ?
এই অবস্থায় অনেকের চিন্তা শক্তি হারিয়ে যায়। ক্ষনিকের জন্য চেতন শক্তিও  হারিয়ে যায়। যদিও এটা কয়েক  মুহূর্তের জন্য হয়ে থাকে।  তথাপি এই অবস্থা থেকে ফিরে এলে মনে হয়,  আমি কি সমাধিতে ছিলাম। আসলে এটি সমাধি নয়, বলা যেতে পারে আপনার মূর্ছা হয়েছিল।বা আপনি খানিকটা সুসুপ্তির অবস্থায় চলে গিয়েছিলেন।  মন তখন কয়েক মুহূর্তের জন্য  লয় হয়ে গিয়ে ছিলো।

আমাদের একটা কথা সব সময় মনে রাখতে হবে, আমি আমাকে খুঁজছি। তাই আমি কে, অর্থাৎ আমি একটা চেতন সত্ত্বা।  অর্থাৎ যে সব কিছু উপলব্ধি করছে তা একটা চেতন সত্ত্বা এই কথাটা আমাদের সব সময় স্মরণে রাখতে হবে। এই অবস্থায় আমাদের অনেকের  ঘুম পায়। আর ঘুম পেলে জানবেন, আপনার যাত্রা পথে এটি একটি বড়ো বাঁধা। আপনাকে সজাগ থাকতে হবে। চেতন থাকতে হবে। এই বিজ্ঞানময় কোষে যখন  আপনি  অবস্থান করেন, তখন আরেকটা অদ্ভুত উপলব্ধি হয়, আর তা হচ্ছে আমি যেন শরীর নোই। শরীরের মধ্যেও আমি নেই। এই সময় আমাদের চেতন সত্ত্বাটি শরীরের চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়। শরীরের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। তখন যেন মনে হয়, আমি মারা  গেছি। শরীরের সঙ্গে মনের যোগসূত্রটি কেটে গেছে। শরীর স্থির হয়ে বসে আছে, আর আমি শরীরের বাইরে।এমনটি হলে, প্রথম প্রথম আমাদের ভীষণ ভয়ের উদ্রেগ হয়। কিন্তু ভয়ের কিছু নেই। এইসময় দেহের সম্পর্কে কোনো চিন্তা ওঠালে অর্থাৎ কোনো স্মৃতি বার বার ওঠালে, এই অবস্থা কেটে যায়। সাধক তখন সাধারণ অবস্থায় স্থিতিশীল হয়।
বিজ্ঞানময় কোষে যাতায়াত ও স্থিতি  যখন আমাদের সহজ মনে হয়, অর্থাৎ বার বার যাতায়াত করতে করতে এই ব্যাপারটা যখন  সহজ মনে হয়,  তখন এই বিজ্ঞানময় কোষকে অতিক্রম করবার চেষ্টা করতে হয়। শান্ত মনে চেতনাকে আমিবোধে নিবিষ্ট করতে হয়। এইখানে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় এক হয়ে যায়। তখন আমাদের মধ্যে আমি আমাকে জানছি এইরকমটা  মনে হয়। দ্রষ্টা ও দৃশ্য এক হয়ে যায়। এই অবস্থায় আমরা চেতন সত্ত্বার উপরে আমি বোধ বা আমিত্ব আরোপ করে ধ্যানের প্রক্রিয়া চালাতে থাকুন।  প্রক্রিয়াটা এই রকম। প্রথমে বিষয় সম্পর্কে যে চৈতন্য বা বিষয়ের সঙ্গে যে চৈতন্য মিশে আছে, অর্থাৎ বুদ্ধির সঙ্গে বিষয় মিশে যে চৈতন্য আমি বোধের সৃষ্টি করেছে, তাকে আলাদা করতে হয়। অর্থাৎ প্রথমে ভাবুন, আমি আমাকে জানছি, এর পরে কেবলমাত্র আমাকে জানছি, তারও  পরে শুধু জানছি এই ভাবে "আমি"কে আলাদা করুন। আমি আমার মধ্যে আছি,  তারপরে আমার মধ্যে আছি, তারপরে শুধুই  আছি। এইভাবে আমিকে আলাদা করুন। অর্থাৎ জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বলে কিছু থাকবে না, দ্রষ্টা-দৃশ্য বলে কিছু থাকবে না। জ্ঞাতা-জ্ঞেয়  মিশে যাবে, দ্রষ্টা দৃশ্য মিশে যাবে। বিজ্ঞানময় কোষে নিজেকে উত্তীর্ন হতে পারলে এই আছি বোধ স্থির হতে থাকবে। আপনি এক অপূর্ব শান্তি, অহেতুক আনন্দ আপনার মধ্যে স্ফূরিত হতে থাকবে। আমি ও আনন্দ তখন এক হয়ে যাবে। অর্থাৎ আমি যে আনন্দময় সত্ত্বা সেটা আমাদের উপল্বদ্ধিতে স্থায়িত্ত্ব লাভ করবে। যাকে আমরা এতদিন,শরীর-মন-বুদ্ধি-চিত্ত্ব-অহংকার বলে অনুভব করতাম, সেই আমি এখন একমাত্র আনন্দময় সত্ত্বা বলে অনুভব হবে। আমাদের মনে হবে আমরা আনন্দের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছি। আর এটাকেই বলে আনন্দময় শরীরে প্রবেশ।
এই আনন্দময় শরীরকেও আমাদের ছাড়তে হবে। তা না হলে আমরা শরীর বিহীন হতে পারবো না। অর্থাৎ এক-এক করে পাঁচটা শরীরকে ছেড়ে যাবো।  এইজন্য ধ্যানের এই অবস্থায়, আমাদের খেয়াল করতে হবে, এই আনন্দ আসছে কোথা থেকে ? এই আনন্দের উৎস খুঁজতে হবে। এই সময় আমাদের চেতনা শরীর  শূন্য হয়ে পড়ে।  অহংহীন  হয়ে পড়ে। আর আমাদের মনে হয় মহাশূন্য আমাদের গ্রাস করে নিচ্ছে। আমি যেন মহাশূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছি। মহাশুন্য আর আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকছে না। মহাশূন্য আর আমি একই সত্ত্বা। এবার মনে হয়, আমি আর আমিতে  থাকছি না। আমার যেন নিজস্ব সত্ত্বা বলে কিছু নেই।  এই সময় এক গভীর অন্ধকার, এক মহাশুন্য, আমাকে অপ্রকাশ করে ফেলছে। আমি যেন বিশ্বসত্ত্বার সঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বসত্ত্বা আর আমি এক হয়ে গেছি। আমার অহং  বলে আর কিছু থাকছে না। এক অব্যক্ত সাম্যাবস্থা। সমস্ত গুনের বন্ধন, সমস্ত সত্ত্বার বন্ধন, সমস্ত শরীরের বন্ধন   আমার কেটে গেছে। আমি বিশ্বগ্রাসে পতিত। সমস্ত রহস্যভেদ হয়ে গেছে।  এই সময়, অস্তিত্ত্বের দাবি অস্বীকার হয়ে গছে। আমি বলে কিছু নেই। আমি মহাশূন্যের, মহাশূন্যই আমি। এটাই আমার প্রকৃত সত্ত্বা। শিবোহম  শিবোহম, তুহি তুহি। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম।

Thursday 1 August 2019

আত্মার খোঁজে

আত্মার খোঁজে 

ওম সহ নাববতু সহ নৌ ভুনক্তু। সহ বীর্যং করবাবহৈ। 
তেজস্বি নাবধিতম অস্তূ মা বিদ্বিষাবহৈ।। 
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।।
আত্মার খোঁজে (১)
মানুষের আসা যাওয়া আত্মা ভিন্ন সম্ভব নয়।  তাই আমরা আজ আত্মার সন্ধানে যাবো।
কঠোপনিষদ -এর যমরাজ ও নচিকেতার কাহিনী আমাদের সবার জানা। তো কাহিনীতে নচিকেতা নামে  এক কিশোর মৃত্যুরাজ্যে গিয়ে যমরাজকে তিনটি প্রশ্ন করেছিলো। তার মধ্যে শেষ প্রশ্নটি ছিল আত্মার অস্তিত্ত্ব-অনস্তিত্ত্ব সম্পর্কে। হাজার বছরের পুরাতন এই প্রশ্ন আমাদের সবার মনে আজও  জাগে । আমরা মারা গেলে এই দেহটি পুড়িয়ে বা কবর দিয়ে দেওয়া হবে। পঞ্চভূতের তৈরি এই রক্ত-মাংসের এই দেহ পঞ্চভূতে মিশে যাবে। তা হলে আমি বলে কিছু থাকে কি ? আমি বলে যদি কিছু না থাকে তবে শ্রাদ্ধশান্তি - কার্য্যের কি দরকার ? আর  পরজন্ম বা স্বর্গ-নরক বলে কিছু থাকে কি ?

আসলে আমরা কেউ মরতে চাই না। এবং সেই কারণেই আমরা বিশ্বাস করি, মৃত্যুর পরেও আমরা বেঁচে থাকবো। তাই মৃত্যুর পরেও আমার অস্তিত্ত্ব আছে, এটা প্রমান করবার জন্য, আমরা উঠে পরে লেগে আছি। কিন্তু সত্য কি ? সেটা আমাদের জানতে হবে।

মহাভারতের যুদ্ধের পরে, ব্যাসদেবের কাছে ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী তার মৃত পুত্রদের দেখতে চেয়েছিলো। ব্যাসদেব তাদের দেখিয়েছিলেন। এবং মৃত্যুকালীন চেহারায় তারা দেখা দিয়েছিলো। সত্যিই কি এটা সম্ভব ? সাহিত্যে অনেক কাল্পনিক গল্প থাকে, এটা সত্য। আর আমার কাছে এটাও সত্য যে মানুষ যা কিছু কল্পনা করে, বা চিন্তা-ভাবনা করে, তার সবকিছুর প্রতিচ্ছবি  এই জগতে বর্তমান। তাই এই ঘটনা আমার কাছে কল্পনা নয়, সত্য।

আবার একটা প্রশ্ন আমার মধ্যে জাগে, সেটা হচ্ছে মানুষ বা জীবজন্তু যদি মারাই যাবে, তবে আর জন্ম নেওয়া কেন ? আর এত দুঃখ-কষ্ট কেন ? ঈশ্বর যদি আনন্দময় হন , তবে আমাদেরকে চিরজীবী করে আনন্দের মধ্যেই তো রাখতে পারতেন। কেন তিনি তা করেন না।

মারা যাবার পরে আমরা কি চেতন থাকি ? অর্থাৎ মৃত্যু পরবর্তী জগৎ সম্পর্কে কি মৃত্যুর পরে আমরা সবাই জানতে পারবো ? জাগতিক সুখ ক্ষণস্থায়ী। জাগতিক সুখ খুবই স্বল্প-স্থায়ী।  এমনকি আমাদের যে জীবন-পরিসর, অর্থাৎ ৮০-১০০ বছর, তার মধ্যেও  স্বল্পক্ষনই মাত্র মানুষ সুখে থাকে।এর থেকে আরো বড় সত্য হচ্ছে, আমাদের সুখ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে আমরা আইঢাই করি।  যাকে সোজা বাংলায় বলে, সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়। তাই সুখ আমাদের সয় না।

মৃত্যু কেন নির্ধারিত সত্য।  এর অন্যথা হয় না কেন ? ইত্যাদি ইত্যাদি নানান প্রশ্ন আমাদের সবার মনে উঁকি দেয়। আমরা এই সব প্রশ্নের জবাব খুঁজবো।

প্রথমে বলি, মৃত্যুর পরে আমরা সবাই বা আমাদের সবার আত্মা মৃত্যু পরবর্তী জগৎ সম্পর্কে সচেতন থাকে এমন নয়। স্বল্প সংখ্যাক আত্মার এই উপলব্ধি থাকে। বাকিরা ঘোর তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় কাল অতিবাহিত করে। তাই যদি হয় তবে আমরা যারা এই দেহে অবস্থান করছি, তারা কি করে আমাদের মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারবো ?

নচিকেতার গল্পের একটা দিক খেয়াল করুন, নচিকেতা যমরাজের কাছে গেছে, অর্থাৎ এখন তার মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা। দ্বিতীয়তঃ দেখুন, তার জিজ্ঞাসায় সে অটল। হাজার বছর বাঁচার আয়ু, অঢেল ধনসম্পত্তির লোভ সে ত্যাগ করেছে। অর্থাৎ যারা উচ্চ শুদ্ধজ্ঞানে পৌঁছুতে পেরেছেন, যারা পরা-চৈতন্যের স্তরে উপনীত হয়েছেন, একমাত্র তারাই এই জ্ঞানের অধিকারী। তাই মৃত্যুর পর আমাদের কি হবে, বা আমরা মৃত্যুর পরে কি হবো অর্থাৎ আমরা সত্যি সত্যি থাকবো কি না, বা সত্যি সত্যি আমাদের আত্মা বলে কিছু আছে কি না, বা আমরা সত্যি আত্মা কি না, নাকি অন্য কোনো মিশ্র বস্তু, , নাকি কিছুই নয়, তা জানতে গেলে আমাদের পরাচৈতন্য-স্তরে পৌঁছতে হবে। নতুবা আমি যা বলবো, তা আপনার কাছে স্পষ্ট হবে না। এমনিতে যাকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, তাকে ভাষার মধ্যে আবদ্ধ করা মানে অসীমকে সীমাবদ্ধ করা। এইজন্য একাজে দরকার সৎগুরু। যিনি আপনাকে একমাত্র উপলব্ধি দিতে পারেন, বা বলা যেতে পারে, ব্যাসদেবের মতো দিব্যদৃষ্টি দিতে পারেন।

এখন আমরা যমরাজ কি বলেছিলেন, সেটা আমরা একটু দেখে নেই।

যমরাজ বলছেন,  পথ দুটি একটা প্রেয় আর একটা শ্রেয়। প্রেয় অর্থাৎ যে পথে গেলে আমরা প্রিয় বস্তুকে পেতে পারি। আর একটা পথ হচ্ছে শ্রেয় অর্থাৎ যে পথে গেলে আমরা শ্রেষ্ট বস্তুকে পেতে পারি। যদিও এদুটোই বন্ধনের  কারন। অর্থাৎ আপনি ভালো কাজ করলে অর্থাৎ ভালো পথে গেলে আপনার ভালো ফল হবে, আর আপনি খারাপ কাজ করলে খারাপ ফল হবে। ফল দুটোতেই হবে। আর ফল হলে তা ভোগ করবার জন্য আপনাকে আবার পুনরায় জন্ম গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ কর্তা জ্ঞান যতক্ষন আছে, ততক্ষন আমাদের কর্মফল ভোগ করতেই হবে।

বিদ্যা দুই রকম জাগতিক ও আধ্যাত্মিক। একটি জাগতিক বিষয়ের উপরে জ্ঞান আর অপরটি আত্ম বিষয়ে জ্ঞান। জাগতিক বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে মানুষ বৈষয়িক  উন্নতি করতে পারে। আর আধ্যাত্মিক বিষয়ের জ্ঞানের দ্বারা মানুষ নিজের উন্নতি করতে পারে। এখন জাগতিক বিষয়ের জ্ঞান, বা তার প্রয়োগগত ফল, আপনার মৃত্যুর পরেও  এই ইহ জগতের কাজে লাগতে পারে, কিন্তু আপনার নয়। কিন্তু আধ্যাত্মিক জ্ঞান আপনার মৃত্যুর পরেও কাজে লাগতে পারে। এখন কথা হচ্ছে,  পরলোক বলে কিছু আছে কি না, সেই জ্ঞান আমাদের মতো যাদের  নেই, তাদের কাছে এই জ্ঞান অর্থহীন। আর সেই আমরাই এই পৃথিবীটাকে ভরাট  করে রাখি।  অর্থাৎ আমরা জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবদ্ধ হয়ে বার বার ফিরে ফিরে আসি। আর মৃত্যু যন্ত্রনা ভোগ করি।

আত্মা সম্পর্কে কথা বলার লোকের অভাব। তাই আমাদের আত্মা সম্পর্কে শোনার সুযোগ নেই। আবার যে সব ভাগ্যবান শোনার সুযোগ পান, তারা শুনেও এর তাৎপর্য বুঝতে পারেন না। একমাত্র ব্রহ্মজ্ঞানী এই আত্মা সম্পর্কে জানেন। যুক্তি তর্কের দ্বারা আত্মাকে জানা যায় না। যাদের সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি আছে, তারাই আত্মাকে আচার্য্যের কাছ থেকে জানার অধিকারী হন। প্রতক্ষ্য উপলব্ধি ছাড়া আত্মাকে জানা যায় না। আত্মাকে জানতে গেলে বিষয়তৃষ্ণাকে ত্যাগ করতে হবে। যজ্ঞ-ফলের আশা ত্যাগ করতে হবে। আত্মা রয়েছেন হৃদয়ের গভীরে,ইনি ইন্দ্রিয়-গোচর নন। কঠোর আধ্যাত্মিক অনুশীলনের দ্বারা আত্মাকে উপলব্ধি করা যায়।

যেমন ভাবে আমরা বাইরের বস্তুকে দেখি তেমনভাবে আত্মাকে দেখা যায় না। দেখতে গেলে দুটো জিনিস লাগে এক : দৃশ্য ও দুই : দ্রষ্টা। এক্ষেত্রে দ্রষ্টা ও দৃশ্যবস্তু আলাদা নয়। যতক্ষন আত্মা নিজেকে সাধকের নিজের স্বরূপ প্রকাশ না করেন,  ততক্ষন আত্মাকে কেউ দেখতে পান না। এযেন  আয়নাতে নিজেকে দেখা। পরিষ্কার আয়না না হলে, নিজেকে স্পষ্ট দেখা যায় না। ইন্দ্রিয়সুখ থেকে নিজেকে পুরুপুরি  গুটিয়ে নিতে পারলে আমাদের চিত্তশুদ্ধি হয়। তখন সেই স্বচ্ছ মনে আত্মা নিজেকে ধরা দেন। আমাদের মন কামনা বাসনায় পরিপূর্ন।  বিষয় থেকে মনকে নিয়ে গিয়ে যদি আত্মাতে সমাহিত করা যায়, তবে মন শান্ত হয়, একেই বলে চিত্তশুদ্ধি।  চিত্তশুদ্ধি হলে জ্ঞান আপনা আপনি ফুটে ওঠে।

আমরা মনের আলোচনার সময় শুনেছিলাম, মন আর কিছু নয় আমাদের বিভিন্ন স্নায়ুকেন্দ্রের ক্রিয়া। এক একটা স্নায়ু কেন্দ্রে এক এক রকম ক্রিয়া সংগঠিত হয়। নিচের তিনটি কেন্দ্রে অর্থাৎ মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুরে যে ক্রিয়া সম্পাদিত হয় তা আমাদের সাধারণ জীবনের ক্রিয়া। অনাহত চক্র  থেকে এই  আত্ম-উপলব্ধি শুরু হয়। অর্থাৎ অনাহত -বিশুদ্ধি,-আজ্ঞা, ও সহস্রার এই সব স্নায়ু কেন্দ্রে  যখন আমাদের মন নিবিষ্ট হয়, তখন আমরা আত্মার প্রতিফলন অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পাই, এটাই উপলব্ধি। এই আত্মাকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

আমার এক অকালপক্ক বন্ধু, ছোটবেলায় ভারত সেবাশ্রমের এক শিক্ষক  স্বামীজিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, স্বামীজী  ঈশ্বর কেমন ? তিনি বলেছিলেন, দেখো বাবা তোমরা আমার সন্তানের মতো,  এইসব প্রশ্নের কোনো জবাব হয় না।  তবু বলি, যে কোনোদিন ঝাল খায় নি তাকে ঝাল কেমন তা কি ভাষায় দিয়ে বোঝাতে পারা  যায় ?  যায় না, তবে কি করতে হয় ? তার জিভে লঙ্কা ঘষে দিতে হয়। তবে সে হাড়ে  হাড়ে   বুঝতে পারে ঝাল কেমন। ঈশ্বর কেমন তোমরা যখন ঈশ্বর দেখার উপযুক্ত হবে, তখন বুঝবে ঈশ্বর কেমন।

আত্মা উপল্বদ্ধির বস্তূ, এঁকে  ভাষা দিয়ে বোঝানো যায় না।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি  ওম।

আত্মার খোঁজে (২)

আমরা কিছু বয়স্ক মানুষ প্রতিদিন সন্ধ্যে বেলা মিলিত হই। সেখানে একদিন  মৃত্যুর পরে মানুষের কি হয়, সেই আলোচনা হচ্ছিল, আমাদের এক  মিত্র বললো : মৃত্যুর পরে, মানুষের আর কিছু থাকে না। হাওয়ায়  মিলিয়ে যায়। আমি এসব আত্মা-ফাত্মায়  বিশ্বাসও করি না। আর এসব জেনে কোনো লাভ নেই। মিত্র, ব্যাঙ্কে অফিসার ছিল। অবসরকালীন টাকা আছে, আছে পেনশন, একমাত্র ছেলে, ভালো চাকরি করে।   বৈষয়িক মানুষ, বাড়িতে পূজাঅর্চনা করে। তারকেশ্বরে প্রায়ই পুজো দিতে যায়। বাড়িতে শ্রীকৃষ্ণ-শিবঠাকুর-লক্ষ্মী ইত্যাদি ঠাকুরের পুজোও করে, ভক্তি সহকারে। বিশেষ করে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো বেশ ঘটা  ক'রে করে। এই কয়দিন আগে বাড়িতে বাবার মৃত্যুদিন উপলক্ষে গীতাপাঠের আয়োজন করেছিল। ওর বাবা নাকি প্রতিদিন গীতাপাঠ করতো।

কিছু মানুষের ভোগে আনন্দ, ব্যতিক্রমী কিছু মানুষ আছেন, যারা ত্যাগে আনন্দ পান । আমরা সাধারণ মানুষেরা মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে, মনোযোগ না দিয়ে খেয়েপরে সুখে কাটিয়ে দিতে চাই। তাইবাঞ্চিত  বস্তূ পাবার জন্য, আমরা দেবদেবতার পুজো করি। ঠাকুর কাছে মানত করি, । মৃত্যুর পরে  কি হবে সেই চিন্তা করে সময় নষ্ট করতে চাই না। মৃত্যুর পরে মৃত্যুই আমাদের ভার নেবে। তাই তার জন্য মাথা ঘামাই না। খাই-দাই সুখে থাকি, এই হলো আমাদের মনোবৃত্তি।

কিন্তু স্বল্প সংখ্যক মানুষ আছেন, যারা ভয়ে হোক বা সংসারের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে হোক,অথবা অন্তরের ডাকে হোক, তাদের  স্বাভাবিক জীবনের শান্তি ভঙ্গ করে, এই জানার স্পৃহা । মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগায়, মৃত্যুর পরে আমাদের কি পরিণতি হবে ?

বর্তমানে  আমরা যার উপরে নির্ভর করছি, তা সে বিষয়-সম্পত্তি বলুন, আর আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব বলুন, তা  একসময় আমাদের হাত থেকে চলে যাবে। মা-বাবা- চলে গেছেন, ভাই-বোন-বন্ধুবান্ধবও এক এক করে চলে যাওয়া শুরু করেছে। দিনে দিনে আমরা সবাই একা হতে চলেছি । এমনকি  এই সাধের শরীরও আর সাধ দিতে চাইছে না। কানে কম শোনা, চোখে কম দেখা, শুরু হয়েছে। যারা ছিল না, তারা আসা শুরু করেছে।  রোগ-শোক এখন  নিত্য সাথী। সুগার এসেছে, প্রেসার বেড়েছে। জীবনে আমোদ উপভোগ করবার ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে। এবং শাশ্বত সত্য হচ্ছে, জাগতিক সব কিছুই আমাদের ছেড়ে যেতে হবে।  তা সে ধনী-দারিদ্র, সুখী-অসুখী, জ্ঞানী-অজ্ঞানী, যে অবস্থায়ই আপনি থাকুন না কেন।
এখন কথা হচ্ছে, মৃত্যুর পরে কি হবে সে কথা আমাদের জানলেই বা কি হবে, আর না জানলেই বা কি হবে ? আর যে জানে মৃত্যুর পরে কি তার কাছে সেই জ্ঞান থাকবে ? অর্থাৎ আমরা তো এই শরীর  দিয়েই জ্ঞান সংগ্রহ করি, আবার এই শরীরেই জ্ঞান সঞ্চিত হয়। তো আমরা যখন শরীর  বিহীন হয়ে যাবো, তখন কি করে এই জ্ঞান কাজ লাগবে ? যদি ধরেও নেই যে আত্মা বলে কিছু আছে, সেটা তো  ক্রিয়াহীন, তো তার জ্ঞানকর্ম কি ভাবে  কোন কাজে লাগবে ?

একটা বিদ্যালয়ে গেলে দেখবেন, দুটো জিনিস একসাথে আছে। একটা হচ্ছে বিদ্যাগৃহ আর একটা খোলা মাঠ।  বিদ্যাগৃহে যেমন ছাত্ররা শিক্ষা গ্রহণ করে, তেমনি মাঠে খেলাধুলা করে। এই জীবনটাও একটা বিদ্যালয়, সেখানে আমরা যেমন আনন্দ লাভের  জন্য  খেলাধুলা করি, তেমনি শিক্ষা গ্রহণ করি। এখন কেউ যদি শিক্ষা গ্রহণ না করে, শুধু খেলাধুলা করে, তো তার ভবিষ্যৎ নিশ্চয় উজ্জ্বল হয় না। এই জীবন থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। শিক্ষার উদ্দেশ্যেই আমরা এখানে আসি।

যমরাজ যখন, খেলনা দিয়ে নচিকেতাকে ভোলাতে চাইলো, নচিকেতা কিন্তু আত্মজ্ঞান লাভের ইচ্ছা ত্যাগ করলো না। অজ্ঞানী লোকেরা পরলোকে বিশ্বাস করে না, সে সম্পর্কে জানতেও চায় না। এই বিশ্বাস -অবিশ্বাসের পিছনে তাদের  কোনো অনুসন্ধান নেই, কেবল অন্ধবিশ্বাস এদেরকে আঁকড়ে ধরে আছে। এরা  বাসনা নিয়ে জন্মায়, বাসনা নিয়ে মরে। কেননা বাসনার তৃপ্তি এদের কখনো হয় না। বাসনা পূরণের জন্য দেহ ধারণ করে, তাই মৃত্যুর ফাঁদ এরা  এড়াতে  পারে না। এরা  মনে করে, মৃত্যু মানে শেষ, ধংশ। মৃত্যু চরম অবলুপ্তি নয়, শরীরের পরিবর্তন মাত্র। এই জগৎ একটা মৃত্যুপুরী।  এখানে কেন আমরা এসেছি, আমরা জানি না। মৃত্যুর পরে আমরা কোথায় যাবো তা  আমরা জানি না। কিন্তু এটা জানার অধিকার আমাদের সবার আছে। যদি তুমি বলতে পারো, জন্মের আগে তুমি কোথায় ছিলে, আর জন্মের পরে তুমি কোথায় যাবে, তবে তুমি সার্থক, তোমার জীবন সার্থক। শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, হে অর্জুন, তুমি আমি বহুবার জন্ম গ্রহণ করেছি, আমি তা জানি তুমি সেটা জান  না।

আমাদের এই জড় দেহ যেমন প্রতিদিন পরিবর্তন হচ্ছে, আমাদের চিন্তার ধারাও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা আমাদের কল্পনার সাহায্যে একটা চিন্তা দেহ ধারণ করতে পারি।  স্বপ্নের মধ্যে এই চিন্তাদেহে আমরা বিচরণ করে থাকি। এই চিন্তাদেহ আমাদের মতো কথা বলে। এই চিন্তদেহও পরিবর্তনশীল। আমরা যেমন স্থুল দেহের পরিবর্তন  রোধ করতে পারিনা। শিশু থেকে কিশোর, কিশোর থেকে যুবক, যুবক থেকে প্রৌঢ়, প্রৌঢ় থেকে বৃদ্ধ বৃদ্ধ থেকে সূক্ষ্ম শরীর ধারণ করি ।ঠিক তেমনি আমরা আমাদের চিন্তা দেহের পরিবর্তন রোধ করতে পারি না।  মৃত্যুর পরে আমরা যে  সুক্ষ দেহ ধারণ করি , এটি কিন্তু নতুন দেহ নয়। আমরা স্থুল দেহে থাকালীন এই দেহেরও পালন পোষণ করেছি। সুস্বাস্থের জন্য আমরা যেমন খাদ্য, পানীয় গ্রহণ করি, শরীর চর্চ্চা করি। তেমনি আমাদের এই মানসিক দেহের্  সু-গঠনের জন্য বা উন্নত করবার জন্য আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করা অবশ্যিক। অর্থাৎ  আমাদের চিন্তা, আমাদের বুদ্ধি, এই সূক্ষ্ম দেহেই সংস্কার আকারে সূক্ষ্ম রূপে সঞ্চিত থাকে। স্থূল দেহের মৃত্যুর পরে  এই মানস  লোকে মানসদেহে আমরা আত্মজ্যোতিখন্ড সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে থাকি। কিন্তু এই সময়ে আমাদের যেহেতু স্থুল দেহ বলে কিছু থাকে না, আমাদের দৈহিক কর্ম বলে কিছু থাকে না। আর তাই যে জাগতিক জ্ঞান আমরা স্থূল দেহে থাকা কালীন  সংগ্রহ করেছিলাম, তা আর কোনো কাজে লাগে না। কিন্তু যদি কেউ পরাবিদ্যা বা আধ্যাত্মিক জগতের জ্ঞান সংগ্রহ করে থাকে তবে এখানে সেটা কাজে লাগে। এইখানেই সাধারণ মানুষ আর সন্যাসীর মধ্যে পার্থক্য। অর্থাৎ অজ্ঞানী  ও জ্ঞানীর মধ্যে পার্থক্য। এই মানস লোকেও এই পৃথিবীর মতোই অনুরূপ একজগৎ আছে। তাই মৃত্যুর পরে প্রথমে আমরা বুঝতে পারি না। কিন্তু দৈহিক কর্ম না থাকায় নিজেকে অসহায় লাগে। এইখানে জ্ঞানী ও অজ্ঞানীর পার্থক্য। তো আমার মিত্র যে প্রশ্ন  করছিলো, ওসব না জানলে, বা না মানলে কি হয় ? তার জবাব এখানেই নিহিত আছে।

 কিন্তু এই চিন্তা-দেহের পরেও আছে একটা শাশ্বত সত্য আছে । যাক বলে চেতন সত্ত্বা।  এটি জীবাত্মা বা  সূক্ষ্ম শরীর থেকে ভিন্ন। এর সন্ধান অতি দুঃসাধ্য।  তাই যমরাজ  বলছেন, মানুষের এই অন্তর্নিহিত এই সত্ত্বা সম্পর্কে বা চেতন সত্ত্বা সম্পর্কে অতি অল্পলোক সচেতন। আবার যারা সচেতন তার মধ্যে গুটিকয় মানুষ মাত্র একে  জানতে পারে। এই উপল্বদ্ধির জন্য, শিষ্যকে যেমন উপযুক্ত হতে হবে,  তেমনি উপযুক্ত গুরুর প্রয়োজন।
এই শাশ্বত আত্মা সম্পর্কে বক্তৃতা করা সহজ। কিন্তু উপলব্ধি করা সহজ নয়। বই পড়ে, বা আমাদের এই কথা শুনে আত্মউপলব্ধি সম্ভব নয়। বই পড়ে, জাগতিক জ্ঞান হতে পারে। আত্মজ্ঞান প্রাণে প্রাণে উপলব্ধি করতে হয়। আর সেই উপলব্ধি দীর্ঘ দিনের আকুলতা ব্যাকুলতা , ধ্যান ধারণা, সমাধি ইত্যাদির একটা ধারাবাহিক অভ্যাস থেকে হতে পারে।
আর এই আত্মতত্ত্ব জানলে, আমাদের মৃত্যুভয় থেকে চির মুক্তি পেতে পারি। তখন আর নিজেকে দেহ-মন-ইন্দ্রিয় বলে মনে হয় না। তখন এই জড়-নিয়ম থেকে নিজেকে মুক্ত ও স্বতন্ত্র অনুভব করতে পারা যায় । আর এই অনুভব আমাদের দিব্যগুরু দিতে পারেন। তার শিক্ষা, তার সাহায্য ব্যতীত ভ্রান্তপথে ভ্রমন অসম্ভব নয়।
আমাকে কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করেছেন, এই গুরু কোথায় পাবো ? তাদেরকে বলি, গুরু খুঁজতে যাবেন  না। গুরু আপনাকে খুঁজে নেবেন। তারা তাদের দিব্যদৃষ্টিতে আপনাকে দেখছেন, আপনার উপযুক্ত হবার অপেক্ষায় আছেন। একটা জিনিস জানবেন, সবাই তার জ্ঞান-সম্পত্তি উপযুক্ত উত্তরাধিকারীর কাছে রেখে যেতে চান। এর জন্য তারা উপযুক্ত শিষ্যের খোঁজে আছেন।
যোগীবর বরোদাচরণ মজুমদার-এর বাড়িতে গুরুদেব  চলে এসেছিলেন । সেই  সত্যদ্রষ্টা বরদাচরণ যিনি  নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে ক্রিয়াযোগে দীক্ষিত করেছিলেন।  শোনা যায়,  আচার্য্য শঙ্করকে দীক্ষা দেবার জন্য,মহর্ষি পতঞ্জলি গোবিন্দপাদ নাম নিয়ে নর্মদার তীরে অপেক্ষায় ছিলেন। মহাত্মা বাবাজি শ্যামাচরণ লাহিড়িকে দীক্ষা দেবার জন্য, পাহাড়ের গুহায় শ' শ' বছর  অপেক্ষায় ছিলেন। এমনি অনেক উদাহরণ আছে।  এবং এরা সবাই সদ্গুরু। যারা সত্যি সত্যি পথ যেখানে পারেন। তো আপনার জন্যও গুরুদেব অপেক্ষায় আছেন।  সময় হলে ঠিক তিনি এগিয়ে আসবেন। আপনার কাজ ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষা করা, আর অন্তরের নির্দেশে কাজ করে যাওয়া।

আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা, আমরা আগেও শুনেছি, ভবিষ্যতেও শুনতে থাকবো।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি  ওম।

আত্মার খোঁজে  (৩)

আত্মা সম্পর্কে খোঁজ-খবর করছেন অনেকে। কিন্তু সেই সম্পর্কে যিনি শিক্ষা দিতে পারেন, সেই মানুষ কিন্তু বিরলতম। আমাদের মতো সাধারণ সাধক  যারা মনেপ্রাণে পবিত্রতা লাভ করতে পারেনি তাদের পক্ষে এই সব তত্ত্বকথার উপলব্ধি শুধু দুরূহ নয় অসম্ভব। আর একটা কথা হচ্ছে আত্মাকে জানতে গেলে আমাদের একটা ক্রমবিকাশের পথ ধরে এগুতে হয়। বহু গুহ্য সাধনার দ্বারা, এক এক করে স্তর উন্মোচিত হয়।  প্রাথমিক স্তরগুলোর উপলব্ধি যাদের হয় নি, অর্থাৎ আমাদের দেহ বা দেহের স্তরগুলো  সম্পর্কে যিনি সচেতন নন,  তার পক্ষে আত্মার উপলব্ধি অসম্ভব। যারা বক্তৃতা শুনতে চান শুনুন, কিন্তু এই বক্তৃতা শুনে আপনি আত্মাকে জেনে যাবেন, এটা একদমই সম্ভব নয়। তাদের কাছে এগুলো শোনা মানে সময় নষ্ট। আর এগুলো শুধু শোনা কথাই হয়ে থাকবে।  বহু জন্মের সাধনার ফলে, এই জ্ঞান পাওয়া সম্ভব হয় । তবে যদি ধৈর্য্য ধরে এই কথাগুলো শোনেন, তবে আপনার মধ্যে একটা স্পৃহা জগতে পারে এবং একটা প্রাথমিক পথের সন্ধান পেতে পারেন।  তার বেশি কিছু নয়। তাই যারা মনে প্রাণে এখনো পবিত্র হতে পারেন নি, তারা আগে সেই চেষ্টা করুন, তবেই আমাদের এই কথার অর্থ অনুভব করতে পারবেন।শুধু গ্রন্থ পাঠে, বা কারুর কাছে শুনে যে জ্ঞান লাভ হয় তা দিয়ে ব্রহ্মতত্ত্ব বা আত্মা সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধি হওয়া একদমই সম্ভব নয়। এজন্য আমরা আগেই বলেছি, যথার্থ গুরুই আপনাকে এই উপলব্ধি করাতে পারেন ,  গুরুই পারেন  আপনার দিব্য চক্ষু খুলে দিতে । আমরা মহাভারতে দেখেছি, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে আগে দিব্য  চক্ষু দান করেছেন, তার পরে ভগবানের স্বরূপ দেখিয়েছেন বা উপলব্ধি করিয়েছেন । শুধু তাই নয়, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের  কাছে যখন এই সব কথা ব্যক্ত করবার জন্য শূদ্র সঞ্জয়কে দায়িত্ত্ব দিলেন, তখন তাকে ব্যাসদেব দিব্যচক্ষু দান করেছিলেন। আমরা ওই অন্ধ যুধিষ্ঠিরের মতো জ্ঞান-অন্ধ। আমাদের যতক্ষন জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত না হবে, ততক্ষন আমরা কিছুই অনুভব করতে পারবো না। সঞ্জয় কথার মানে হচ্ছে সংযমী। তো যিনি সংযমী তারই জ্ঞান চক্ষু উন্মিলিত হতে পারে। তো আমাদের সংযমী হতে হবে। দিব্যজ্ঞান লাভের জন্য আমাদের অন্তঃকরণ উন্মুক্ত করতে হবে। আপনি আগে যা সব খেছেন, তাতে আপনার পেট ভরে  আছে। শুধু ভরে আছে না বদ  হজম হবার সম্ভাবনাই  বেশি। তাই নিজের অন্তঃকরণকে উন্মুক্ত করুন। যা কিছু তথাকথিত জ্ঞান আপনি সঞ্চয় করছিলেন, সেগুলো খানিক্ষণের জন্য হলেও সরিয়ে রাখুন।
 নিজেকে পরিশুদ্ধ করুন।  আপনি কোথায় জন্মেছেন, বা কি হয়েছেন,সেটা বড়কথা নয়। আপনি কি হতে চান সেটা বড়ো  কথা।

এবার আসল কথায় আসি, যা অবিনাশী তাই আত্মা, এটি সুক্ষ থেকে সুক্ষতর। এটা এতটাই সূক্ষ্ম যে আমরা কল্পনাও করতে পারি না। শুধু সূক্ষ্ম তাই নয়, এটি বেশ কিছু আবরনে  ঢাকা। এইখানে একটা কথা, আত্মাকে তাহলে কি, আবরণ দিয়ে ঢেকে রাখা যায় ? বা আত্মাকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে কে ? দেখুন আত্মা আচ্ছাদিত নয়। আমরা আমাদের চোখের সামনে আচ্ছাদন দিয়ে রেখেছি। আমরা ভাবি সূর্যকে মেঘ ঢেকে রেখেছে। আসলে আমাদের চোখগুলো মেঘে ঢাকা। তাই আমরা সূর্যকে দেখতে পাই না। বিশাল সূর্য্য, তাকে ঢেকে রাখে কার সাধ্য ? আমাদের চোখে অজ্ঞানের রঙ্গিন চশমা।  তাই আমরা যা কিছু দেখি সবেতেই আমার চশমার কাঁচের রঙ দেখতে পাই। সত্য সত্যতেই অবস্থান করে। মানুষ যখন  ঈশ্বর-ভাবনায় ব্যাকুল হয় তখন তাকে বিষয়-ভাবনা আকর্ষণ করতে পারে না। এইজন্য বিষয়-বাসনার পূর্তি বা শেষ হওয়া দরকার। তবেই আপনার মুমুক্ষত্ত্ব জাগার সম্ভাবনা। নতুবা গাছেরও খাবো, আবার তলারও খাবো এটা সম্ভব নয়। আপনি সংসারে আছেন কি পাহাড়ে আছেন, আপনি মন্দিরে আছেন কি মসজিদে আছেন সেটা বড়  কথা নয়, বড় কথা আপনার চেতন কেন্দ্রে কি উদ্ভাসিত হচ্ছে। আপনার মন কোথায় আছে ? বাহ্যিক ধর্মাচরণ এমনকি সৎকাজ, দান - ধ্যান যাই করুন না কেন, তা আপনাকে আত্মউপলব্ধি এনে দিতে পারবে না।

তাই যমরাজ বলছেন, হে নচিকেতা ইন্দ্রিয়নুভূতির বহির্ভূত এই পরম সত্ত্বা আমাদের চেতনসত্ত্বার মধ্যে লুক্কায়িত। অর্থাৎ আমাদের আত্মার বা জীবাত্মার মধ্যেই লুকোনো আছে। আমাদের অন্তরের গুহায় এর অবস্থান।  চির পুরাতন এই সত্ত্বা, সৃষ্টির পূর্বেও ছিল এখনো আছে আবার প্রলয়ের পরেও থাকবে। আর একে জানতে গেলে তোমাকে যোগ অভ্যাস করতে হবে। মনন. নিদিধ্যসন অভ্যাস ক'রে আপনাকে  নির্বিকল্প সমাধিতে পৌঁছতে হবে। তবেই তার সামনে পৌঁছতে পারবেন  আর তাকে উপলব্ধি করতে পারবেন ।
এই প্রসঙ্গে কঠোপনিষদের দুটো শ্লোক খুবই গুরুত্ত্বপূর্ন।  প্রথমটি হচ্ছে : ১/২/১২ নং শ্লোক।  সেখানে যমরাজ বলছেন :
তং দূর-দর্শং - সহজে দেখা যায় না তাকে ।
গূঢ়ম্ অনুপ্রবিষ্ট্ং - অতি সূক্ষ্ম ভাবে অন্তরে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন ।
গুহাহিতং গহ্বরেষ্ঠং পুরাণম  - গুহার ভিতরে  নিহিত অর্থাৎ আমাদের বুদ্ধিরূপ গুহাতে নিহিত সেই কালাতীত আত্মা, পুরাণম   ।
অধ্যাত্ম যোগাদি গমেন - অধ্যাত্ম যোগের অনুশীলন দ্বারা।
দেবং মত্বা ধীরো হর্ষ শোকৌ জহাতি - সেই স্ব-আত্মাকে মনন করে, ধীর ব্যক্তি অর্থাৎ প্রাজ্ঞ ব্যক্তি সুখ দুঃখের অতীতে চলে যান।

অর্থাৎ যমরাজ বলছেন, আমাদের সবার অন্তরে, বুদ্ধিরূপ গুহায় প্রবিষ্ট অতিশয় দুর্বিজ্ঞেয় স্ব-প্রকাশ পরমাত্মাকে যোগ সমাধি দ্বারা অবগত হতে পারেন, এবং এর ফলে সেই ধীর জ্ঞানী ব্যক্তি সুখ-দুঃখের এই জগৎ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারেন।

এতো গেলো আত্মা কোথায় থাকেন, আত্মাকে জানলে কি হয় ? কিন্তু আত্মা কি বা কে ?
শ্লোক নং ২/৩/১৭ তে যমরাজ  বলছেন : 

অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষ-অন্তরাত্মা সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ। 
তং স্বাৎ-শরীরাৎ প্রবৃহেৎ মুঞ্জাৎ ইব ইষীকাম  ধৈর্যেণ। 
তং-বিদ্যাৎ-শুক্ৰম-অমৃতম তং   বিদ্যাৎ-শুক্ৰম-অমৃতম  ইতি।  (২/৩/১৭)

যমরাজ বলছেন, অঙ্গুষ্ঠ পরিমান পুরুষরূপী অন্তর-আত্মা আমাদের সবার হৃদয়ে সদা বিরাজমান। মুঞ্জা ঘাসের কোমল শীষকে যেমন অতি যত্ন সহকারে কোষমুক্ত করতে হয়, সেই ভাবে মুমুক্ষ ব্যক্তিকে, আত্মাকে বিবেক জ্ঞানের সাহায্যে দেহ-মনের থেকে আলাদা করতে হয়। সেই আত্মাকে শুদ্ধ, অমৃতস্বরূপ পরমাত্মার সাথে অভিন্ন বলে জানা যায়।

অঙ্গুষ্ঠ পরিমান, অঙ্গুষ্ঠ মানে বুড়ো আঙুলের কর। অর্থাৎ বুড়ো  আঙুলের করের রেখার সম পরিমান জায়গায় এর অবস্থান। এই জায়গাটা কোথায় না হৃদয়ে। বাস্তবিক এই জায়গাটার আর একটা নাম হচ্ছে অনাহত চক্র। এইখানেই প্রথম আমাদের আত্মানুভূতি হয়। পরবর্তী কালে অনাহত, বিশুদ্ধি, আজ্ঞা, সহস্রার, এবং একদম শেষ পর্যায়ে বিন্দুতে এই চমক ও ধ্বনি মানুষকে আনন্দ অনুভূতির এক চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়।   আর এটা কেমন দেখা যায় ? আমাদের আঙুলের করের  রেখার মতো। অর্থাৎ  বিদ্যুতের রেখার মতো, একটি উজ্জ্বল আলো। বিদ্যুতের রেখা যেমন  ক্ষনিকের জন্য দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়।এটিও ঠিক তেমনি।  কিন্তু একটা ধ্বনি চারিদিকে ছাড়িয়ে পড়ে । আর আমাদের শরীর  চমকে চমকে ওঠে।  আর সেই ধ্বনিটি হচ্ছে ওম। প্রথমদিকে এটি দেখা দিয়ে হারিয়ে যায়, নিরন্তর অভ্যাসে এটির স্থিতিকাল বাড়ে। কিন্তু স্থুল শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে যায়। ঠাকুর  রামকৃষ্ণদেব  বলছেন, এই অবস্থা হলে,  কিছু ব্যতিক্রমি মানুষ বাদে, সবাই একুশ দিনের মধ্যে দেহ ত্যাগ করেন ।

এবার বলছেন, মুঞ্জাঘাসের কোমল শীষকে পেতে গেলে,  যেমন অতি যত্ন সহকারে কোষমুক্ত করতে হয়, সেই ভাবে মুমুক্ষ ব্যক্তিকে  আত্মাকে বিবেক জ্ঞানের সাহায্যে দেহ মনের থেকে আলাদা করতে হয়। মুঞ্জা ঘাস হচ্ছে যা গুচ্ছ আকারে তৈরি হয়। এটি খুব শক্ত।  এই ঘাস পাকিয়ে নৌকোর দড়া বা বলা যেতে পারে খুব শক্ত দড়ি তৈরি করা হয়। এটি কুশ গাছও হতে পারে।  মুঞ্জা ঘাসের মধ্যে কোষবদ্ধ অতি কোমল শীষের সঙ্গে আত্মার তুলনা করা হয়েছে। ঘাস থেকে শীষকে পেতে গেলে যেমন অতি যত্ন সহকারে ঘাস থেকে আলাদা করতে হয়। ঠিক তেমনি আমাদের দেহকোষগুলোকে ধীরে ধীরে আলাদা করে আত্মাকে পাওয়া যায়।

যমরাজ বলছেন, মানুষের দেহ-অভ্যন্তরে, যে অসংখ্য নাড়ী ছড়িয়ে আছে, তার মধ্যে সুষুম্না-নাড়ীই প্রধান। এই নাড়ীর পথ  মেরুমজ্জার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়ে ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে উর্দ্ধগামী হয়ে রয়েছে। যোগীদের ধারণা অনুসারে এই সুষুম্না নাড়ী অবলম্বন করে মানুষ সর্ব্বোচ্চ লোকে পৌঁছাতে  পারে। এখানেই জীবাত্মার উৎক্রমন  ঘটে।  এটি পরম-আত্মার প্রতিফলিত জ্যোতি মাত্র। এবং এর কোনো পরিমান নেই। যে আঁধারে এটি প্ৰতিফলিত হচ্ছে আমরা সেই আঁধারের আকারকেই আত্মার আকার বলে মনে করতে পারি । অর্থাৎ বিভিন্ন চক্রের যে আকার সেই আকারে বা আয়তনে  আমরা আত্মাকে উপলব্ধি করি। এবং এই অনাহত চক্র থেকে যাত্রা শুরু।  এর পরে, বিশুদ্ধি, আজ্ঞা,সহস্রার  প্রতিটি কেন্দ্রেই এই প্রতিফলন আমরা অনুভব করি। এবং এক এক চক্রে আমাদের অনুভূতিও আলাদা আলাদা হয়। এর কারন হচ্ছে প্রতিটি চক্রের রঙ আলাদা আলাদা।আকার আলাদা। এবার আমরা আলোচনা শুনবো কোষগুলো সম্পর্কে যা আমাদের ছাড়াতে হবে।

আমাদের দেহ আসলে পঞ্চকোষের সমষ্টি।  এগুলো হচ্ছে, অন্নময় , প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময়, এবং আনন্দময়।

অন্নময় কোষ : অন্ন অর্থাৎ খাবার, অন্নময়-কোষ মানে খাবার দিয়ে  তৈরি যে কোষ রয়েছে আমাদের শরীরে।
প্রাণময় কোষ : অর্থাৎ উর্জা শরীর।  এই শরীর বায়ুর শক্তিতে তৈরী।

মনময়  কোষ : অর্থাৎ মানসিক শরীর, মনের চিন্তার জগৎ ।

এই তিন শরীরকে  ভৌতিক শরীর  বলে। অন্নময়  শরীর স্থূল।  প্রাণময় শরীর  সূক্ষ্ম  ও মনময়  শরীর অতি সূক্ষ্ম।  কিন্তু এই তিন শরীর-ই  ভৌতিক। এই তিন শরীরের উপরেই আমাদের কর্মের প্রভাব পড়বে। স্থূল শরীর  অর্থাৎ অন্নময় কোষ দ্বারা গঠিত শরীরের উপরে কর্মের ছাপ পড়বে।  তেমনি প্রাণময় ও মনময় শরীরের উপরেও কর্মের প্রভাব আছে। কর্ম-বন্ধন  এই তিন শরীরকে জুড়ে রেখেছে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, সিমেন্ট বা আঠার মতো কর্ম এই তিন শরীরকে জুড়ে রাখতে সাহায্য করে।  অর্থাৎ আমাদের কামনা বাসনা থেকে উদ্ভুত কর্ম এই শরীরগুলোকে সজীব রেখেছে।

এর পরে আছে :
বিজ্ঞানময় কোষ : এটি ভৌতিক নয় কিন্তু ভৌতিক শরীরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। এটি আমাদের শুদ্ধ জ্ঞানের দ্বারা তৈরি।

আনন্দময় কোষ :  পুরোপুরি অভৌতিক। আমাদের মধ্যে যে আনন্দের অনুভূতি হয়, তা এই আনন্দময় কোষের স্পন্দন।

বিজ্ঞানময় শরীর যা আসলে অভৌতিক, এই আনন্দময় শরীরের অর্থাৎ অভৌতিক শরীর ও ভৌতিক শরীরের  সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। তার মানে বিজ্ঞানময় কোষ নিজে অভৌতিক, কিন্তু তিনি ভৌতিক ও অভৌতিক শরীরের মধ্যে সম্পর্ক জুড়ে রাখে। এইজন্য আমাদের স্থুল শরীর ত্যাগের পরেও আমাদের বিজ্ঞানময় শরীর অর্থাৎ আমাদের জ্ঞানের ভান্ডার পরলোকে আমাদের পথ দেখাতে পারে।

ভৌতিক শরীরের রূপ বা আকার আছে। অন্নময় শরীর অতি স্থূল, তাই আমরা দেখতে পাই। প্রাণময় ও মনময় সূক্ষ্ম কিন্তু আমাদের অনুভূতির বাইরে নয়। এদুটো আসলে আউড়া বা জ্যোতি। দেখতে না পেলেও আমরা এর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি।

যদি ভৌতিক শরীর নষ্ট হয়ে যায়, তবে এই বিজ্ঞানময় শরীর আনন্দময় শরীরের সঙ্গে মিশে যায় ,এবং তৎপর  আনন্দময় শরীর বিশ্বব্রমান্ডের সাথে বিলীন হয়ে যায় বা একাত্বিভূত হয়ে যায়।

ভৌতিক শরীর পঞ্চভূতের মিশ্রণ।  মৃত্যুর পরে, আমাদের ভৌতিক শরীর পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের কর্মবন্ধন, আমাদের আবার দেহধারণের জন্য উদগ্রীব হয়। ও আমরা আবার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করি। যখন আমরা কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি তখন আমরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সাথে এক হয়ে যাই।  জন্মমৃত্যুর চক্রের থেকে মুক্ত হয়ে যাই। একে বলে, মুক্তি।  কেউ বলে সমাধি।

এই পঞ্চকোষের পারে বসে আছেন শুদ্ধ আত্মা। পঞ্চকোষের আভরণ উন্মুক্ত হলে আমরা আত্মাকে উপলব্ধি করতে পারি। যিনি এই পরমাত্মাকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন তিনি নিজেকে পরমাত্মার সঙ্গে নিজেকে অভিন্ন মনে করেন। তিনি চাওয়া-পাওয়ার উর্দ্ধে উঠে যান। তিনি তখন নিত্য-সুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-আত্মা। আমাদের গল্পের নচিকেতা এইভাবে মৃত্যুকে অতিক্রম করে অমৃতত্ব লাভ করেছিলেন।আপনি আমি সবাই এই নচিকেতার পথ অনুসরণ করে অমৃতত্ব লাভ করতে পারি।

ওম সহ নাববতু সহ নৌ ভুনক্তু। সহ বীর্যং করবাবহৈ। 
তেজস্বি নাবধিতম অস্তূ মা বিদ্বিষাবহৈ।। 
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ  হরি  ওম।

অনন্ত যাত্রা : স্থুল দেহ নাশের পরে আমাদের কি গতি হয় ?  

বিবেকানন্দ বলছেন, "সত্য তাদের কাছেই প্রকাশিত হয়, যারা শুধু সত্যের জন্য ভয় ত্যাগ করে, লাভালাভের চিন্তা ত্যাগ করে, সত্যের মন্দিরে উপাসনা করেন। মানুষের বুদ্ধির সচেতন প্রচেষ্টার দ্বারাই এই ব্যাপারে আলোকপ্রাপ্ত হওয়া যায়।"

আমাদের বাড়িতে আমার স্ত্রীর হেফাজতে একটা কৌটার মধ্যে কতকগুলো দানা  আছে।  তো আমি একদিন স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কি ? তো আমার স্ত্রী বললেন এগুলো ফুলের বীজ।  তো আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোনটা কিসের বীজ  তুমি চেনো কি করে ? আর এগুলো লাগিয়ে দিচ্ছো না কেন ? তো তিনি বললেন, প্রত্যেকটি বীজ লাগাবার একটা সময় আছে।  সময়মতো না লাগালে এর থেকে গাছ হবে না। আর তা ছাড়া, এর মধ্যে কোনো কোনো বীজ অপুষ্ট যা থেকে কোনো গাছ হবে না। সেগুলো আমাকে বেছে বার করতে হবে। আর আমি এগুলো চিনি কি করে ? এটা আমার অভিজ্ঞতার ফল। যখন এগুলো সংগ্রহ করেছি, তখন এগুলো আমি ভালো করে দেখে রেখেছি, কোন গাছে  কেমন বীজ হয়। তাই কোন বীজে কি ফুল বা ফল হবে তা আমি বুঝতে পারি।  আর কবে হবে তাও আমি জানি।

আমাদের চিন্তা হচ্ছে কর্মের বীজ। আসলে সমস্ত জিনিস আমাদের মনের মধ্যে আছে। অতীতে যা ঘটেছে, এমনকী বর্তমানে যা ঘটছে সবই আমাদের অবচেতন মনে সংস্কার আকারে সঞ্চিত হয়ে  থাকছে। আমরা যদি আমাদের অবচেতন মনের সংস্কারকে ধরতে পারি তবে সব ঘটনার আগাম খবর বলে দেওয়া যায়। আমাদের অবচেতন মনের সংস্কারকে চেতন স্তরে নিয়ে আসতে গেলে একটা কম্পন তুলতে হয়।এই কম্পন হচ্ছে মাধ্যম। চেতন ও অবচেতন মনের সংযোগের মাধ্যম।  এই কম্পনের ফলে  অবচেতন মনের সংস্কার চেতন স্তরে উদ্ভাসিত হয়। তখন আমরা ভূত ভবিষ্যৎ জানতে পারি।  এমনকি আমরা অন্যের অবচেতন মনের সংস্কারকে এই কম্পনের মাধ্যমে আমাদের চেতন স্তরে টেনে আনতে  পারি।  তখন আমরা অন্যের ভূত ভবিষ্যৎও  জানতে পারি। আর এটি তারাই পারেন, যারা মানসিক উচ্চ শক্তি সম্পন্ন, অর্থাৎ মহাত্মারা, যাদের মনের শক্তি বিশেষ ভাবে বিকাশ লাভ করেছে ।

আমরা যখন দেহ ছেড়ে অনন্তের যাত্রায় বেরিয়ে পড়ি, তখন আমরা মানস দেহে অবস্থান করি। মানস দেহ অর্থাৎ আমাদের চিন্তা-ভাবনার যে মূর্তি তাকে বলে মানস দেহ। আমরা এখন জগতের তৃতীয় স্তরে আছি। অর্থাৎ স্থুল দেহে আছি। স্থুল দেহের বিনাশ হলে আমরা মানস দেহে অবস্থান করি।   অর্থাৎএই মানস দেহ আমাদের চতুর্থ স্তরের বাসিন্দা। আমরা জানি অসংখ বিন্দুর সমষ্টি দিয়ে তৈরি হয় একটা ছবি। এখন এই বিন্দুর-সমষ্টি যখন অসীমে ছাড়িয়ে পড়ে বা  কমতে থাকে তখন ছবি  অস্পষ্ট হয়ে যায়। তৃতীয় স্তরে আসতে  গেলে আমাদের আবার ঘনীভূত হতে হয়। আমাদের মৃত্যুর পরে আমরা আমাদের স্পন্দন বা কম্পন  নিজের সঙ্গে নিয়ে যাই। আর এই কম্পনের গতি অনুযায়ী আমরা নির্দিষ্ট স্তরে প্রবেশ করি। এগুলো স্বয়ংক্রিয়। তাই আমাদের চিন্তা ভাবনা জ্ঞান অনুযায়ী আমাদের মৃত্যু পরবর্তী স্থান নির্দিষ্ট  হয়।  এই সময় প্রথম দিকে  আমরা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় থাকি। যারা পৃথিবীতে থাকাকালীন, উকন্ঠা, না পাবার দুঃখ-যন্ত্রনা নিয়ে ছিলেন, অপূর্ন বাসনা রেখে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের তন্দ্রাঘোর  কাটতেই, চঞ্চলতা অনুভব করেন। পৃথিবীর মায়া-মোহ-আসক্তি তাকে  অস্থির করে তোলে। আর যখন সে দেখে তার কোনো নির্দেশ শরীর, বা অন্য কেউ পালন করছে না তখন  সে অসহায়, অস্থির  ও শোকাচ্ছন্ন হয়ে যায় । আর যারা জ্ঞানত দেহ ত্যাগ করে, তারা মৃত্যুকালীন তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কাটিয়ে চির নিদ্রায় শায়িত থাকে। এই অবস্থাটা আমাদের খানিকটা স্বপ্নের মতো। স্বপ্নে যেমন আমরা একটা জাগতিক পৃথিবীতে ঘুরে  বেড়াই। সুখ-দুঃখ ভোগ করি, এই অবস্থাতেও আমরা একই রকম অনুভব করি। বাসনা যাদের বেশি থাকে তারা ভোগ ভূমিতে নেবে আসে। আত্মীয়স্বজনদের পাশে পাশে ঘুরে বেড়ায়। আমরা যেমন আমাদের ঘুমের মধ্যে ঘুরে বেড়াই, এরা তখন তাদের আত্মীয়স্বজনদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। তাদের সাহায্য করতে চায়। তারা তখন বুঝতেই পারে না, যে তারা মারা গেছে। এই বিশৃঙ্খল অবস্থায় তাদের বেশ কিছু সময় কেটে যায়। আর একদল আছেন, যারা মৃত্যুর পরে বুঝতে পারেন। তারা দেহাতীত হয়ে গেছেন। এরা  তখন শান্তিতে নিদ্রা যান। অর্থাৎ সুসুপ্তির স্তরে অবস্থান করেন। এই সময় তাদের কোনো জ্ঞান থাকে না। এমনকি সময়জ্ঞানও থাকে না। এইজন্য বলা হয়ে থাকে মানুষের বাসনা অনুযায়ী, জ্ঞান অনুযায়ী মানুষ মৃত্যুর পরে, স্বর্গ-নরকে অবস্থান করেন, ভালো বা মন্দ থাকেন । এই জন্য বিভিন্ন আত্মার জন্য বিভিন্ন স্তর নির্দিষ্ট হয়ে যায়। এবং এগুলো সবই আমাদের চিন্তা-ভাবনার ফল। তাই আমাদের চিন্তা -ভাবনা যেমন  সবার আলাদা আলাদা, আমাদের সবার চিন্তা-ভাবনার কম্পনও তেমনি আলাদা আলাদা। আর এই কম্পনের  মাত্রা অনুযায়ী আমাদের বসবাসের স্তর নির্দিষ্ট হয়ে যায়। এখানে ঈশ্বরেরও কিছু করার নেই। একটা কথা আমাদের বোঝা দরকার যে, আমাদের এই যে মনময় শরীর, এটি সুক্ষ কিন্তু অপার্থিব নয়। স্থূল শরীর  যেমন পার্থিব এই সূক্ষ্ম শরীরও পার্থিব। অর্থাৎ অন্নময়, প্রাণময় শরীর যেমন পার্থিব, মনময় শরীরও পার্থিব। এবং এই মনময় শরীর চিরস্থায়ী নয়।  এটিরও পরিবর্তন আছে, নাশ আছে। অন্ন না পেলে যেমন  অন্নময় শরীরের ধংশ হয়ে যায়,  বায়ু না পেলে যেমন প্রাণময় শরীর নাশ হয়ে যায়, আমাদের কামনা বাসনা সংকল্প শেষ হয়ে গেলে এই মনময় শরীরেরও  নাশ হয়ে যায়। এইজন্য স্বাভাবিক মৃত্যুতে দেখবেন, মানুষ প্রথমে খাওয়া ছেড়ে দেয়।অর্থাৎ খাবার থেকে যে শক্তি সে সংগ্রহ করছিলো, তা বন্ধ হয়ে যায়।  এর পরে হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দেয়, অর্থাৎ বায়ু থেকে যে উর্জাশক্তি সে  সংগ্রহ করছিলো, সেটা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মনময় শরীর থেকে যায়। অর্থাৎ কামনা বাসনা আমাদের সহজে ছেড়ে যায় না। এইজন্য, ঋষি-মহাপুরুষরা আমাদের কামনো বাসনা পরিত্যাগ বা নিয়ন্ত্রণ  করতে বলেছেন। অর্থাৎ অন্নময় এবং প্রাণময় শরীর একসময় প্রাকৃতিক নিয়মে শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু মনময়  শরীর, তখনি নাশ হবে, যখন আমরা কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করতে পারবো। আর এই তিনটে শরীর নাশ হয়ে গেলে বিজ্ঞানময় শরীর আনন্দময় শরীরের সঙ্গে মিশে যায়। এবং আনন্দময় শরীর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে বিলীন হয়ে যায়।

মনময় সূক্ষ্ম দেহকে সহজে নাশ করা যায় না। এটি তার কামনা বাসনা পূরণের জন্য আবার দেহ ধারনের জন্য উদগ্রীব হয়। কারন সে জানে দেহ ভিন্ন কামনা বাসনা পূরণের কোনো উপায় নেই।  এই জন্য বলা হয়ে থাকে, মানুষ তার কামনা বাসনা অনুযায়ী দেহ প্রাপ্ত হয়।  এবং এই চক্রের মধ্যেই আমরা অর্থাৎ  বেশির ভাগ প্রাণী ঘুরপাক খাচ্ছি।
মানুষ মৃত্যুর পরে অজ্ঞানের ঘুমে সে আচ্ছন্ন হয়ে পরে, এবং ধীরে ধীরে ঘন্টা চারেকের মধ্যেই  তার আচ্ছন্নতা কেটে যায়। তখন থেকে  বায়বীয় দেহ নিয়ে  সে জীবনের চতুর্থ স্তরে ধাতস্ত হবার চেষ্টা করে।  এই চতুর্থ স্তরের মধ্যেই স্বর্গ-নরক বলতে আমরা যা বুঝি, তা এইখানেই।  এই চতুর্থ জগতের সঙ্গে আমাদের বুঝবার জন্য আমাদের স্বপ্নাবস্থার সাথে তুলনা করতে পারি। আমাদের স্বপ্নের জগতে যেমন এই পৃথিবীর জগতের মতো একটা জগৎ উপলব্ধি করি, এখানেও  আমাদের দৃশ্যমান জগতের অনুরূপ একটা জগৎ বিদ্যমান। পার্থক্য হচ্ছে আমাদের স্বপ্ন ৬ বা ৮ ঘন্টার পরে ভেঙে যায়। আমরা বুঝতে পারি যে আমরা স্বপ্ন দেখছিলাম।  আর এই জগতের স্থিতিকাল দীর্ঘ। এবং এক একজনের ক্ষেত্রে এক এক রকম। তবে অনন্তকাল নয়। এখানেও আমরা ইহজগতে থাকা কালীন যেমন কাজ কর্ম করতাম।  এখানেও সেইরূপই করে থাকি। কেউ যদি ইহজগতে পুজো-অর্চনা করতে ভালো বাসতেন, তবে এখানেও তিনি সেটাই করেন। এখানে চিন্তামাত্র তার কাছে সবকিছু উপস্থিত হয়ে যায়। এমনকি তারা ইহজগতের সবাইকে যাদের তিনি স্মরণ করেন, তাদেরই সাথে মিলিত হতে পারেন। এগুলো তাদের কল্পনা প্রসূত। এমনকি এখানে তারা আহার-পানীয় গ্রহণ করেন। অর্থাৎ এটাকে বলা যেতে পারে চিন্তা বা কল্পনার রাজ্য। আসলে আমরা যখন স্বপ্ন দেখি, সেই মূহুর্তের জন্য স্বপ্নকে আমাদের সত্য বলে মনে হয়। আমরা জানি স্বপ্ন আমাদের চিন্তার আকার বা পরিণতি বিশেষ। স্বপ্নে আমরা যেমন স্পর্শসুখ পাই,  শ্রবণসুখ এবং দৃশ্যসুখ পাই বা বিপরীত ভাবে বলা যেতে পারে, স্বপ্নে আমরা যেমন দুঃখ বা  ভয় পাই,  আতঙ্কগ্রস্থ হই, তেমনি  এখানেও  আমরা মানসিক  দেহ নিয়ে আমরা সমস্ত সুখ-দুঃখ ভোগ করি। এই ভোগেচ্ছা একটা সময় সমাপ্ত হয়। তখন আবার আমরা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি।    
এই অবস্থায় এক একজনের ক্ষেত্রে এক একরকম সময়-কাল ধরে চলে। কেউ কেউ বলেন, ২৫/৩০ বছর থাকার পরে, তার আবার ধরণীতে দেহ ধারণের ইচ্ছা প্রবল হয়। কেউ বলেন, হাজার বছর। আসলে বাসনার প্রবলতা অনুসারে এই স্তরে স্থায়ীকাল নির্দিষ্ট হয়।  এই সময় আবার সে অজ্ঞান-আচ্ছন্ন হয়ে পরে। এবং এই অবস্থাতেই সে তার ইচ্ছে পূরণের জন্য বা বাসনা পূরণের জন্য উপযুক্ত শরীরের  ভ্রূণের  মধ্যে প্রবেশ করে। এটাকেই বলি আমরা গর্ভধারণ। পার্থিব শরীর  ভিন্ন আমাদের আমাদের ইচ্ছে পূরণের কোনো সুযোগ নেই।  তা সে ভালো ইচ্ছেই বলুন আর ভোগের ইচ্ছেই বলুন। শরীর যন্ত্র ছাড়া আমাদের কোনো আদর্শ বা লক্ষ্য পূরণের কোনো উপায় নেই। তাই অনন্ত কাল কেউ স্বর্গে অর্থাৎ আনন্দে থাকে না বা অনন্ত কাল কেউ নরকে বা নিরানন্দে  থাকে না। এখানেই ফিরে ফিরে আসে। ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যুর  বড় ছিল, ভীষ্ম কথাটা এসেছে ভ্রম থেকে, এই ভ্রম মানুষের সহজে যায় না।ভীষ্মেরও সহজে মৃত্যু ঘটে না। তীরের ঊপরে বিদ্ধ হয়ে, শ্বর-শয্যায়  তাকে বেঁচে থাকতে হয়। আমাদের ভোগেই সুখ, এই ভ্রম যতদিন না যাবে ততদিন আমাদের বার বার ফিরে আসতে  হবে।

এখান থেকে আদর্শবান পুরুষ, বা  প্রাজ্ঞপুরুষ যাকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলে থাকি, তারা আর এই জগতে সাধারণত ফিরে আসেন না। তারা আরো উর্দ্ধে অর্থাৎ পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম  অর্থাৎ মহঃ, জনঃ তপঃ এবং সব শেষে সত্যম বা ব্রহ্মলোকে  যাত্রা করেন।  

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম।