Saturday 9 April 2022

যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - ষষ্ঠ অধ্যায় - ধ্যানযোগঃ


                                যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা -  ষষ্ঠ  অধ্যায় 
 - ধ্যানযোগঃ 

ওঁং নারায়নং নমস্কৃত্য  নরঞ্চৈব নরোত্তমম্
দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদীরয়েৎ ওঁং। 
২০.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - ষষ্ঠ অধ্যায়  - ধ্যানযোগঃ

"যোগ" শব্দটির অর্থ সংযোগ সাধন। যে সাধন প্রণালীর মাধ্যমে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সংযোগ সাধন হয়, তাকেই বলে যোগ। আমরা এর আগে কর্ম্ম-সন্যাস যোগ সম্পর্কে যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের  মুখে শুনেছি। এবার যোগের মুলে "ধ্যানযোগে" প্রবেশ করবো। 

যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - ষষ্ঠ অধ্যায়  - ধ্যানযোগঃ
 
শ্লোক নং ৬/১
অনাশ্রিতঃ কর্ম্মফলং কার্য্যং কর্ম্ম করোতি যঃ 
স সন্যাসী চ যোগী চ ন নিরগ্নিঃ ন চ অক্রিয়।  (৬/১)

কর্ম্মফলের আশা না রেখে যিনি কর্ত্তব্য কর্ম্ম করেন, তিনি সন্যাসী, তিনি যোগী।  যিনি অগ্নি স্পর্শ করেন না, যজ্ঞাদি কর্ম্ম করেন না এবং যিনি কর্ম্মহীন থাকেন তিনি যোগী বা সন্যাসী নন। 

যিনি কর্ম্মফলের আশা না রেখে কর্তব্য কর্ম্ম সম্পাদন করেন, তিনিই যোগী, তিনিই সন্যাসী। এখন কথা হচ্ছে, মর্তলোকে এসেছেন, কর্ম্মলোকে এসেছেন, কর্ম্মের নিমিত্ত শরীর ধারণ করেছেন, আর কর্ম্ম না করে থাকবেন, সেটি অলীক কল্পনা। মানুষকে এমনকি সমস্ত  জীবকূলকে কর্ম্ম করতেই হবে। তা সে ইচ্ছেয় করুন আর অনিচ্ছায় করুন। কর্ম্মহীন জীবন বলে কিছু হয় না। শরীরে থাকলে, বাস্তবিক পক্ষে কর্ম্মত্যাগ সম্ভব নয়। আর কর্ম্ম থাকলে, কর্ম্মফল থাকবে।  এই অবস্থায় সত্যিকারের কর্ম্ম ত্যাগ কিভাবে সম্ভব ? এই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন, যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ। স্থুল  দৃষ্টিতে বিচার করলে, বোঝা যায়, মানুষ কর্ম্ম করে দুটো কারনে, এক - নিজের জন্য, নিজের তৃপ্তির জন্য, দুই- অপরের জন্য, সার্বিক কল্যাণের জন্য। এইযে লোকহিতের জন্য যাঁরা কর্ম্ম কারনে, তাদের মধ্যেও দুই ধরনের মানুষ আছেন, একদল লোকের উপকার করছি, এই ভাব নিয়ে কর্ম্ম করেন। আর এক দল আছেন, যারা মনে করেন, সর্বভূতে ঈশ্বরের অবস্থান, তো সর্বভূতে স্থিত সেই ভগবানের প্রীতার্থে কর্ম্ম করছেন। আসলে কর্ম্ম বড় কথা  নয়, কেন কর্ম্ম করছেন, কি উদ্দেশ্যে কর্ম্ম করছেন,  সেটাই বড়  কথা।  আর জানবেন, আপনার কর্ম্মের উদ্দেশ্যই আপনাকে কর্ম্মফলের কাছে টেনে নিয়ে যাবে। যাঁদের কর্ম্মের লক্ষ স্বয়ং ভগবান, তার কর্ম্মফল শ্রীভগবানে সমর্পিত হয়ে যায়। তাই কর্ম্মেন্দ্রিয় কি করছে, সেটি বড়  কথা নয়, এই কর্ম্মেন্দ্রীয়ের যিনি পরিচালক অর্থাৎ মন যদি ভগবানে সমর্পিত হয়, অথবা  মন যদি নিরুদ্ধ হয়, তবে তাঁর সকল কর্ম্মফল ভগবানে অর্পিত হয়।  কর্ম্মফল তা সে ভালো বা মন্দ যাই হোক না কেন, তা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। আমরা বিষয় সংগ্রহে কর্ম্ম করে থাকি। কিন্তু ভাগবত শক্তি আহরণের জন্য যদি আমরা কর্ম্ম করি, তবে আমরা আমাদের ভিতরে যে ভাগবত সত্তা আছে, তাকে জাগিয়ে তুলতে পারি। একেই ক্রিয়ার উচ্চ  অবস্থা বলা হয়ে থাকে। একেই বলে সন্ন্যাসী-রাজা। একাধারে সন্যাসী অন্যদিকে কর্ম্মবীর। 

যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ  বলছেন,  যিনি অগ্নি স্পর্শ করেন না, যজ্ঞাদি কর্ম্ম করেন না এবং যিনি কর্ম্মহীন থাকেন তিনি যোগী বা সন্যাসী নন।  "ন নিরগ্নিঃ ন চ অক্রিয়"। 
যিনি যজ্ঞকর্ম্মাদি করেন না, এবং যিনি কর্ম্মহীন থাকেন, এই দুই ধরনের লোকই  যোগী নন, তিনি সন্যাসী নন। এখন কথা হচ্ছে, নিরগ্নি অর্থাৎ অগ্নিকে স্পর্শ করেন না, বা অগ্নির ব্যবহার করেন না, এই কথাটার দ্বারা কি বোঝাতে চাইছেন ? আমরা জানি বেদে বিভিন্ন রকম যজ্ঞ কর্ম্মের কথা বলা আছে। সেখানে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে, ঘৃত ইত্যাদি বিভিন্ন দ্রব্যাদি অর্পণ করা হয়, বিভিন্ন দেবতাদের আহবান করা হয়, স্তুতি করা হয়, শেষে যজ্ঞকারী যজ্মানের জন্য  বিভিন্ন দ্রব্য তা পার্থিব হোক, বা অপার্থিব হোক, যাঞ্চা করা হয়। 
আমরা এও জানি, এই পৃথিবী একসময় একটা অগ্নির গোলক ছিল। কোটি বছরের পূর্বের  সেই  অগ্নির গোলক আজ প্রাণময় পৃথিবী। প্রশ্ন উপনিষদ বলছে, "আদিত্য হ বৈ প্রাণঃ" (১/৫) - আদিত্য (সূর্যই) প্রাণ. সুর্য্যই প্রথম রূপ। প্রাণরূপী সূর্যকে বলা হয় বৈশ্বানর। ঋক্বেদের শুরুতেই এই অগ্নিদেবের স্তোত্র দিয়ে শুরু হয়েছে।  গায়েত্রী মন্ত্রকে বলা হয়, বেদের সার, তার কারন হচ্ছে, এই মন্ত্রের জ্ঞানের প্রতীক, সেই সূর্য্যের প্রার্থনা করা হয়েছে। সূর্যকে বলা হয়, সবকিছুর আশ্রয় স্থল। সূর্য আমাদেরকে তপঃ সাধনা করাচ্ছে । অর্থাৎ পরিশ্রম করতে বল যোগাচ্ছে। সূর্য সবার মধ্যে আছেন।  সমস্ত প্রাণী সূর্য থেকেই জীবন ও পুষ্টি লাভ করছে। আমাদের যে খাদ্য হজম করছি, তাও  এই অগ্নির সাহায্যেই  হচ্ছে।    
তো জীবন ধারনের জন্য যেমন আমাদের সূর্য অপরিহার্য, তেমনি সাধন জগতে এই অগ্নির গুরুত্ত্ব অপরিসীম।  সাধকের সমস্ত কর্ম্মই যজ্ঞ। তো যজ্ঞকর্ম্মে অগ্নি প্রধান ভূমিকা নিয়ে থাকে। অগ্নি সমস্ত কিছুকে তার উৎসে ফিরিয়ে দিতে পারে। অগ্নি হচ্ছে ঈশ্বরের শুদ্ধিকরণ শক্তি। এই শক্তির সাহায্যেই তিনি সমস্ত বস্তুকে শুদ্ধ করে থাকেন। আলোর প্রকাশে মানুষের মধ্যে থেকে ভয়-ভীতি দূর হয়ে যায়।   এমনকি এই যে স্থুল জীবকুল, এই জীবকূলকেও শুদ্ধ করতে পারে, এই অগ্নি।আমাদের মৃত্যুর পরে, এই শরীরকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হয়। তার কারন অগ্নিই পঞ্চভূতকে তার নিজস্ব স্তরে নিয়ে যেতে পারে সহজে।      
সাধন জগতে এক ধরনের যজ্ঞ আছে, সেখানে প্রাণ-অপানের আহুতি দেওয়া হয়।  আর এই ক্রিয়ার ফলে বায়ু উত্তপ্ত হয়ে, শুদ্ধ হয়ে, সূক্ষ্ম হয়ে উর্দ্ধগামী হয়। এই উর্দ্ধগামী বায়ু তখন সুষুম্না নাড়ীপথে সহস্রারের দিকে ধাবিত হয়। ভগবান যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যিনি এই অগ্নির উপাসনা করেন না, তিনি যোগী নন। আর এই যোগক্রিয়া অর্থাৎ প্রাণ-অপান-এর  ক্রিয়া যিনি করেন না, তিনি কর্ম্মহীন। 
--------------------------------------      

 ২১.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - ষষ্ঠ অধ্যায়  - ধ্যানযোগঃ

শ্লোক নং - ৬/২-৩

যং সন্ন্যাসমিতি প্রাহুর্যোগং তং বিদ্ধি পান্ডব 
ন হি অসংন্যস্ত সংকল্পো যোগী ভবতি কশ্চন। (৬/২)

হে পাণ্ডব, যাকে সন্ন্যাস বলে - তাকেই যোগ জেনো। সংকল্প ত্যাগ করতে না পারলে, কেউ যোগী হতে পারে না। 

যোগী বলতে আমরা সাধারণত বুঝি, যিনি প্রাণায়াম ইত্যাদি যোগক্রিয়া করেন, তিনি যোগী। আর সন্যাসী বলতে আমরা তাঁকেই বুঝি, যিনি অসন্যাস্ত অর্থাৎ যিনি কোনো কিছুর সঙ্গে ন্যস্ত নন। যোগেশ্বর  শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যিনি সন্যাসী তিনিই যোগী।  আবার যিনি যোগী তিনিই  সন্যাসী। তো কামনা ও তৎজনিত কর্ম্ম যিনি ত্যাগ করেছেন, তিনি সন্যাসী। কিন্তু সত্য হচ্ছে, সন্যাসীর মধ্যে বৈষয়িক কামনা না থাকলেও, মোক্ষাভিলাষ তাঁর থাকে। আর যথার্থ  যোগীর মোক্ষাভিলাষ থাকে না। যোগীর মধ্যে যতক্ষন যোগৈশ্বর্জ্য অর্জ্জনের উৎসাহ  থাকে, কিন্তু বিষয়বাসনা রোহিত থাকেন, ততক্ষন সন্ন্যাসী আর যোগীর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। সন্যাসীর যখন মোক্ষাভিলাষ ত্যাগ হয়, তখন সন্ন্যাসী যোগী বটে। আসলে কাম্য কর্ম্ম ত্যাগ সন্ন্যাসের প্রধান লক্ষণ। একথা আমরা পরবর্তীতে শুনবো ভগবানের শ্রীমুখে। কিন্তু কাম্য কর্ম্ম  ত্যাগ অপেক্ষা কর্ম্মফল ত্যাগের মহিমা বেশি। যোগী কর্ম্ম করেন, কিন্তু তাঁর সমস্ত কর্ম্ম ভগবানের প্রীতার্থে। গুরুদেবের নির্দেশ পালন যাঁর ধর্ম্মকর্ম্ম। এমনকি যোগী ইচ্চারহিত, ভগবত ইচ্ছেতেই তাঁর সমস্ত কর্ম্ম সাধিত হয়। আমাদের চাওয়া পাওয়ার সংসার।  এমনকি আমরা ভগবানের প্রার্থনা করি, ভগবানের করুনা, দয়া, পাবার জন্য।  এমনকি আমরা ভগবানের প্রতক্ষ্য সাক্ষাতের অভিলাষী হয়ে কর্ম্ম করে থাকি।  কিন্তু যোগীর মধ্যে এই চাওয়া-পাওয়ার ভাব নেই। তিনি কর্ম্মে উদ্দমী, কিন্তু কর্ম্মফলে নিস্পৃহ। যোগী সঙ্কল্পবর্জ্জিত। আসলে যোগপ্রভাবে, যে চঞ্চল মনের মধ্যে সংকল্পের উদয় হয়, সেই মন যোগীর স্থির হয়ে সঙ্কল্পরহিত হয়ে গেছে। যোগী শুদ্ধ মনের অধিকারী। আর এই শুচিশুভ্র মন ব্যতীতি ভগবৎ স্বরূপের জ্ঞান হওয়া সম্ভব নয়। এইজন্য বলা হয়ে থাকে চিত্তের সর্ব্বপ্রকার বৃত্তির নিরোধের  নামই যোগ। "যোগঃ-চিত্তবৃত্তি-নিরোধঃ" পাতঞ্জল যোগদর্শন (সমাধিপাদ- ২)।  চিত্তের পাঁচটি বিকার - প্রমান, বিপর্যয়, বিকল্প, নিদ্রা, স্মৃতি। রজো ও তম গুনের বিনাশ না হলে, সত্ত্বগুণের আধিক্য দেখা যায় না। আর এই সত্ত্ব গুনের দ্বারা আচ্ছাদিত চিত্ত হয় শুদ্ধ, নির্ম্মল। এখানে চিত্তের বিকার হয় না। 

প্রাণপ্রবাহ যতক্ষন আমাদের ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ীর মধ্যে প্রবাহিত হয়, ততক্ষন সংসার। মন তখন বিষয়মুখী। যোগ-অভ্যাসের দ্বারা যখন এই প্রাণবায়ু সুষুম্নামার্গে প্রবাহিত হতে শুরু করে, তখন চিত্ত হয় শান্ত, শুদ্ধ, পবিত্র মনের অধিকারী। মন তখন আত্মমুখী হয়। এই দুর্লভ অবস্থায় পৌঁছানো, এবং সেই অবস্থায় স্থিত  থাকাই, যোগাভ্যাসের মুখ্য উদ্দেশ্য। এ একটা অদ্ভুত অবস্থা যেখানে সব আছে, আবার কিছুই নেই। যোগরাজ বলছেন, যার প্রাণ সুষুম্নাবাহিনী হয়ে সহস্রারে স্থির হয়ে গেছে, যিনি ইড়া পিঙ্গলা নদী ছেড়ে সুষুম্না নদীতে সাঁতার কাটতে কাটতে সহস্রাররূপ সমুদ্রে, স্থির হয়েছেন, তিনিই যোগী। যোগী হন জ্ঞানী ও আত্মসাক্ষাৎকার সম্পন্ন। যোগী স্পৃহাশূন্য, বিষয়বৈরাগ্য সম্পন্ন। আসলে বিষয়ের স্বরূপ জ্ঞান উৎপন্ন হলে, বিষয়কে  হেয় বলে মনে হয়, আর পরমার্থ বিষয়ে মন স্থির হয়। যদিও এই যে বিষয়ে বৈরাগ্য আর প্র্মার্থে স্থির চিত্ত - এই অবস্থা বেশিক্ষন স্থায়ী হয় না। আবার ফিরে ফিরে সেই বিষয়-চিন্তা তাকে ঘিরে ধরে। বারবার এই বিষয়কে পরিহার, ও ব্রহ্মে মনকে স্থির করবার প্রয়াস চলতেই থাকে। 

ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোম - এই পঞ্চতত্ত্ব হতে সৃষ্টি। সৃষ্টির প্রথমে যেমন আকাশ তত্ত্ব থেকে সমস্ত তত্ত্বের আবির্ভাব হয়েছে, তেমনি সাধনক্রিয়ার দ্বারা পৃত্থি তত্ত্ব থেকে ধীরে ধীরে আকাশ তত্ত্বে উত্তরণ হয়। একসময় এই পঞ্চতত্ত্ব পরমতত্ত্বে অর্থাৎ তত্ত্বাতীত নিরঞ্জন সত্ত্বায় লয় হয়ে যায়। এখন কথা হচ্ছে, এই অবস্থা যোগীর বোধগম্য কি করে হয় ? যখন প্রাণবায়ু সুষুম্নাপথে প্রবেশ করে, তখন যোগী ধ্যানস্থ থাকেন । ধ্যানস্থ অবস্থায় যোগী সংকল্প বিহীন থাকেন । প্রথম দিকে এই স্থিরতা বেশিক্ষন বজায় থাকে না। সংকল্প এসে এই স্থিরতাকে ভেঙে দেয়। কিন্তু নিরন্তর ধ্যানের  অভ্যাস যোগীপুরুষকে যোগের আরূঢ় করে। অর্থাৎ এই অবস্থায় যোগের ক্রিয়া আপনা-আপনি সংগঠিত হয়। সংকল্প রোহিত, বিকার রোহিত মনে আর কোনো কর্ম্মের প্রভাব থাকে না। কিন্তু যাঁরা সবে মাত্র যোগে আরোহন করতে পেরেছেন, তাদের মধ্যে মাঝেমধ্যে সংকল্পের উদয় হতে পারে।  এই অবস্থায় জানবেন, সাধনের পরিপক্কতা আসেনি। এই অবস্থায় পুনঃ পুনঃ শম-এর  অভ্যাস করতে হয়।  শম অর্থাৎ বিষয়ে বারম্বার দোষ  দর্শন করে, মন যখন স্বীয় লক্ষবস্তু পরব্রহ্মে নিরত ভাবে অবস্থান করে তখন তাকে শম বলা হয়। এই শমতার অভ্যাসে মনকে বিষয় থেকে গুটিয়ে এনে, যখন  নিরালম্ব হয়ে আত্মাতে স্থির হওয়া সম্ভব হয়, তখন বোঝাযাবে, সাধনক্রিয়ায় পাক ধরেছে। এই সময় সাধকের  একমাত্র কর্ম্মই হচ্ছে সঙ্কল্পজনিত কর্ম্ম ত্যাগ করা। মনকে বৈরাগ্যে স্থাপন করা। 

তো প্রাণের স্থিরতা থেকে আসে, মনের স্থিরতা।  সাধনক্রিয়ার সাহায্যেই একদিন   স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কাম-ক্রোধাদির লোপ সাধন হবে, কিন্তু ততদিন মনকে সৎসঙ্গের সাথে, জ্ঞানভক্তি উদয়ের জন্য সচেষ্ট হতে হবে। কর্ম্ম ত্যাগ ও ব্রহ্মস্থিতি আলাদা কিছু নয়। কর্ম্ম ত্যাগ হলে ব্রহ্মে স্থিতি হয়, আবার ব্রহ্মে স্থিত হলে কর্ম্ম ত্যাগ হয়।  তাই যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সন্যাস আর কর্ম্মত্যাগী পুরুষ, এবং যোগী অর্থাৎ নিষ্কামকর্ম্মবীর এই দুইয়ের মধ্যে আসলে  কোনো পার্থক্য নেই।  সন্যাসী ও যোগীর  মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।                    

আরুরুক্ষোঃ মুনের্যোগং কর্ম্ম কারনম উচ্যতে 
যোগারূঢ়স্য তস্যৈব শমঃ কারনম উচ্যতে। (৬/৩)

যোগসাধনায় আরোহনেচ্ছু মুনির পক্ষে নিষ্কাম কর্ম্মই অবলম্বন।  যোগারূঢ় অবস্থায়, চিত্তের সাম্য বা সমতাই সিদ্ধযোগীর পরম আশ্রয়।

ফলাকাঙ্খ্যা রোহিত হয়ে কর্ম্ম করাই যোগে-আরূঢ় অবস্থা। মনকে স্থির করতে পারলে মুনি হওয়া যায়। কিন্তু মনকে স্থির করতে গেলে, আগে প্রাণবায়ুকে স্থির  করতে হয়। কিন্তু ক্রিয়াহীন হয়ে প্রাণবায়ুকে স্থির করা বা সূক্ষ্মবায়ুকে সুষুম্নাপথে চালিত করা, সম্ভব নয়। যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে একটা শব্দ ব্যবহার করেছেন, "আরুরোক্ষ"  আরুরোক্ষ কথার অর্থ হচ্ছে - যোগী যখন সাধন ক্রিয়া শুরু করেন, তখন তার মনের মধ্যে একটা সংকল্প থাকে যে তিনি ক্রিয়া করে, বায়ুকে স্থির করবেন, বায়ুকে স্থির করলে মন স্থির হবে, মন তখন আনন্দে পরিপূর্ন হবে। এই যে অবস্থা, একে যোগক্রিয়া  অবশ্য়ই বলা যেতে পারে, কিন্তু এই অবস্থায় যোগীর মনে একটা সংকল্প পাক কাছে, আমি আনন্দিত হবো, আমার মন স্থির হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই অবস্থাতে মন তখনও আজ্ঞাচক্রে স্থির হয়নি, তথাপি একটা ক্ষনিকের আনন্দ এসে মাঝে মধ্যে মনের কোনে ঝলকের মতো ভেসে উঠতে পারে। এই যে আনন্দপ্রাপ্তির অবস্থা ক্ষনে ক্ষনে উদয় হচ্ছে, যোগীর এই অবস্থাকে বলা হয় "আরুরোক্ষ" অবস্থা। এখানে সংকল্প সম্পূর্ণরূপে বিলোপ হয় নি।  মন আজ্ঞাচক্রে স্থিতও হয় নি। আবার এই ক্রিয়া করতে করতে করতেই একসময় প্রাণ-মন স্থির হয়ে আসে, তখন আর ফলাকাঙ্খ্যা থাকে না কিন্তু চিত্তে আনন্দ স্থায়ী হতে থাকে। মন হয় বিক্ষেপশূন্য। তখন উন্মনা  অবস্থায় যোগী তার ক্রিয়া সম্পাদন করে থাকেন। প্রাণ মনের যখন এই অবস্থা তখন বহিরিন্দ্রিয় ও অন্তর-ইন্দ্রিয়ের মধ্যে একটা সমতা লক্ষ করা যায়। তখন এঁরা একযোগে জ্ঞানসংগ্রহের কাজে লেগে পড়ে। এইসময় কোনো বৃত্তির উদয় হয় না। এইসময় অচলাবুদ্ধির পরিপাক শুরু হয়। অর্থাৎ ক্রিয়া চলতে থাকে । এই ক্রিয়ার সাহায্যেই সাধক একসময় সাধনার পরাবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হন। আরুরুক্ষ অবস্থায় আনন্দ  ক্ষনিকের জন্য আসে আবার চলে যায়, কিন্তু যোগের পরাবস্থায়, আনন্দের ছেদ থাকে না। কিন্তু এই অবস্থায় স্থিতি  লাভ করতে গেলে, শমতা রক্ষা করে চলতে হয়।  শম অর্থাৎ বিষয়ে বারম্বার দোষ  দর্শন করে, মন যখন স্বীয় লক্ষবস্তু পরব্রহ্মে নিরত ভাবে অবস্থান করে তখন তাকে শম বলা হয়। এই অবস্থায় মনের মধ্যে কেবলমাত্র একটা চিন্তা অর্থাৎ আত্মচিন্তা উদয় হতে থাকে। মনের মধ্যে যখন কেবলমাত্র আত্মচিন্তনের  প্রভাব চলতে থাকে, তখন যে অবস্থা হয়, এঁকেই যোগরূঢ় অবস্থা বলা হয়। এই অবস্থা থেকেও একসময় সাধকের অধঃপতিত বা যোগ থেকে বুত্থিত হবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু বারবার চেষ্টার ফলে আত্মচিন্তন একসময় স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাবে পরিণত হয়ে যায়। তখন এই অবস্থার স্থায়িত্ব বাড়তে থাকে। এই সময় একদিকে  যেমন আত্মচিন্তনরূপ ধ্যা চলতে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাহারের দিকেও যত্নশীল  হতে হয়। অর্থাৎ লেগে থাকতে হয়। মন আত্মা থেকে বেরিয়ে গেলেই আবার তাকে ধরে এনে আত্মাতে স্থাপন করতে হয়। এইজন্য সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। আরুরুক্ষ যোগী পুরুষ, সাধনের দ্বারা মনকে স্থির করেন বটে, কিন্তু মাঝে মধ্যে তার মনে সংসার চিন্তন ভেসে ওঠে। কিন্তু বারবার প্রত্যাহারের সাহায্যে এই অবস্থার উন্নতি হয়। তখন সাধন ক্রিয়ার সমাপ্তিতেও মনের মধ্যে সংসারচিন্তন আসতে  পারে না। এঁরা যখন সংসারের স্বাভাবিক কাজ সম্পাদন করেন, অর্থাৎ শরীর রক্ষার জন্য, বা আবশ্যিক কর্ম্মে লিপ্ত হন, তখনও মনের মধ্যে আত্মচিন্তন চলতে থাকে। অর্থাৎ আরুরুক্ষ অবস্থা আসলে যোগারূঢ় অবস্থার প্রাথমিক লক্ষণ, এই অবস্থার উন্নতিতেই যোগারূঢ় অবস্থায় পৌঁছে যান যোগী ।  

------------------------------------   
২২.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - ষষ্ঠ অধ্যায়  - ধ্যানযোগঃ
শ্লোক নং - ৬/৪

যদা হি নেন্দ্রিয়ার্থেষু ন কর্ম্মস্বনুষজ্জতে
সর্ব্বসংকল্পসন্যাসী যোগারূঢ়স্তদোচ্যতে (৬/৪)

যখন সাধক সমস্ত সংকল্প ত্যাগ করে রূপ-রস- ইত্যাদি ইন্দ্রিয় ভোগ্য বিষয়ে ও কর্ম্মে আসক্ত হন না, তখন তিনি যোগারূঢ় বলে কথিত হন। 
ইন্দ্রিয়ার্থেষু অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ে যিনি আসক্ত নন, আসক্তির কারন স্বরূপ যে কর্ম্ম সংকল্প তা যিনি ত্যাগ করতে পেরেছেন, তিনিই  যোগারূঢ় অর্থাৎ যোগের শীর্ষে আরোহন করে অবস্থান করছেন। আসলে কর্ম্ম ত্যাগে কারুর বাসনার ত্যাগ সম্পূর্ণ হয় না। মারের ভয়ে, সমাজের ভয়ে, পুলিশের ভয়ে, আমরা অনেক কিছু করতে প্রবৃত্ত হই  না সত্য, কিন্তু মনের মধ্যে এই কামনার আগুন জ্বলতে থাকে। মনে মনে আমরা এমন সব কাজ করি, যা শুনলে বা দেখলে, আমি নিজেই নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাবো। তাই ভগবান যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কর্ম্ম ত্যাগে বাসনার বিলোপ হয় না, একমাত্র সংকল্প ত্যাগ  করতে পারলে, বাসনার ত্যাগ হয়।  আর বাসনার ত্যাগ হলে আমাদের কর্ম্ম মিটে যায়। সাধন ক্রিয়া করতে করে, একসময় ইন্দ্রিয়দ্বারা বিষয়ের উপস্থিতি সত্ত্বেও, বিষয় গ্রহণে অনীহা, বা বিষয় গ্রহণের জন্য কোনো সংকল্পের উদয় হয় না, তখন বুঝতে হবে যোগী যোগারূঢ় অবস্থায় এসেছেন। অন্তর্মুখী মনে যখন কোনো সংকল্পের লেশমাত্র থাকে না, তখন সাধকের সমাধির অবস্থা। এই সমাধির অবস্থায়, ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয় অর্থাৎ শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ এগুলোর দিকে মন আকৃষ্ট হয় না। অনেক সময় দেখা যায়, বিচারপূর্বক বিষয়কে হেয় প্রতিপন্ন করতে বুদ্ধি অপারগ হচ্ছে, তখন সাধকের হতাশার অবস্থা দেখা যায়। তখন বুঝতে হবে, বুদ্ধির মধ্যে ভ্রমজ্ঞান উৎপন্ন হয়েছে। আসলে কোনো বিষয়ে ভাসা-ভাসা  জ্ঞান আমাদের সত্যে পৌঁছতে বাধা সৃষ্টি করে থাকে। নদীর গভীরে প্রবেশ করলে যেমন জলের ঢেউ লক্ষিত হয় না, শান্ত গতির প্রবাহ চোখে পড়ে, তেমনি নির্মল বুদ্ধি, জ্ঞানের গভীর সমুদ্রে প্রবেশ করতে পারে।  তখন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সজাক  থেকে বিষয়ের বিচার ক'রে, সত্যজ্ঞানে সাধককে প্রতিঠিত করতে পারে। নতুবা ভ্রমাত্মক জ্ঞান সাধককে বিভ্রান্ত করে তোলে। স্থির আত্মার বহির্দেশে চিত্তের বিক্ষিপ্ততা হেতু, শুদ্ধ আত্মাকে অশুদ্ধ বলে মনে হচ্ছে। এই চিত্ত যখন শান্ত হবে, তখন চিত্তে প্রতিবিম্বিত আত্মা স্থির হিসেবেই দৃষ্টিগোচর হবে। আর আত্মাকে সঠিকভাবে দর্শনের জন্য দরকার  যোগাভ্যাস। যোগাভ্যাসে চিত্তে উদ্ভূত তরঙ্গ শান্ত হয়ে যায়। প্রাণের স্পন্দন  হেতুই আসলে চিত্তের স্পন্দন। প্রাণের সাধনায়, যখন প্রাণ স্থির হয়, তখন চিত্ত স্থির হয়, বুদ্ধি স্থির হয়। তখন স্পন্দনহীন চিত্তের সঙ্কল্পরূপ ঢেউ-এর দেখা যায় না। আর এই বাসনারূপ তরঙ্গ চিত্তের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়, তখন সঙ্কল্পহীন চিত্ত বৃত্তির নিরোধ হয়।  একেই বলে ধ্যান-সমাধি। তখন আত্মা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। একেই আত্মসাক্ষাৎকার, স্বরূপের দর্শন, যোগারূঢ় অবস্থা ইত্যাদি বলা হয়ে থাকে। 
----------------------------

 ২৩.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - ষষ্ঠ অধ্যায়  - ধ্যানযোগঃ
শ্লোক নং - ৬/৫-৬        

উদ্ধরেৎ আত্মনা আত্মানং নাত্মানম অবসাদয়েৎ 
আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ। (৬/৫)

বিবেকযুক্ত মনের দ্বারা জীবাত্মাকে উদ্ধ্বার করবে। জীবাত্মাকে অবসন্ন বা অধঃপতিত করবে না। যেহেতু এই মনই জীবাত্মার বন্ধু, আবার মনই জীবাত্মার শত্রু। 

মন  আত্মার উদ্ধারকর্তা। আবার মন আত্মাকে অধঃপতিত করতে পারে। এইজন্য সাধনজগতে মনের এতো গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। যোগের সাহায্যে প্রাণকে স্থির করা হয়। পার্থিব জগতে বায়ু অস্থির হলে, বাতাসে ঝড়ের বেগ দেখা দিলে, সমস্ত পার্থিব বস্তু চঞ্চল হয়ে ওঠে। শরীরের মধ্যে যে প্রাণবায়ুর সন্তরন তা যদি স্থির না থাকে, তবে স্বভাব-চঞ্চল মনকে সে বহির্মুখী করে বিষয়ে নিবদ্ধ করবে। বিষয় গ্রহণে মনে বুদ্-বুদ্ উঠবে  বা স্পন্দিত করবে। আমাদের  শ্বাস যতক্ষন ইড়া-পিঙ্গলা  দিয়ে প্রবাহিত হয়, ততক্ষন আমরা সংসারমুখী হয়ে  বিষয়জনিত  সুখ-দুঃখ ভোগ করি। এই অবস্থায় জীবকুলের সংসার ভাবনা চলতে থাকে। যোগশাস্ত্র বলছে, আমাদের মূলাধারে স্থিত আছে সংসার সৃষ্টির সমস্ত রহস্যঃ। ইন্দ্রিয়লব্ধ যে গুন্ শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ তার লীলাক্ষেত্র হচ্ছে মূলাধার স্থিত পঞ্চচক্র। মন এই মূলাধার চক্রে যতক্ষন বিচরণ করবে, ততক্ষন সংসার ক্ষেত্রে বিচরণ। বিষয়াদির আকর্ষণ। আমরা যাকে  অভ্যাস বলি, তা আসলে আমাদে সংস্কারজনিত। এই সংস্কার আমাদেরকে বিষয়ের দিকে প্রতিনিয়ত আকর্ষণ করছে। আমরা আমাদের বৃত্তির অধীন হয়ে অবস্থান করছি। আমাদের বুদ্ধি থেকেও সংস্কার প্রবল।  তাই বুদ্ধি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মনকে বিষয় থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। এইজন্য দরকার শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ। সৎগুরুর উপরে শ্রদ্ধা রেখে তার কথার মান্যতা দিয়ে, মনকে বোঝানো। সঙ্গে সঙ্গে গুরু নির্দেশে সাধনক্রিয়ার সঙ্গে নিজেকে নিবদ্ধ করা। এই সাধন ক্রিয়া, যা প্রাণক্রিয়াও বটে, নিরন্তর অভ্যাসের ফলে, আমাদের পুরাতন অভ্যাস ধীরে ধীরে লোপ পেতে পারে।  অর্থাৎ আমাদের মধ্যে যে সংসারমুখী,  সংস্কার আছে,তা ধীরে ধীরে চাপা পড়ে।  অর্থাৎ নতুন সংস্কার দ্বারা পুরাতন সংস্কার ঢাকা পড়ে যায়। এমনকি সেই পুরাতন সংস্কার কালের গর্ভে বিলীন হয়েও যেতে পারে। প্রাণ সাধনার দ্বারা প্রাণের গতি ইড়া পিঙ্গলা  থেকে সুষুম্না পথে প্রবাহিত হয়, আর মূলাধারস্থিত যে পঞ্চচক্র তার ভেদ ক্রিয়া শুরু হয়, একসময় মন আজ্ঞাচক্রে এসে স্থির হয়। একেই বলে আত্মার উর্দ্ধগতি, বা আত্মার উদ্ধার। মন যতক্ষন আজ্ঞাচক্রে এসে স্থির না হয়, ততক্ষন আত্মার উদ্ধার হয় না। 

বিষয়মুখী মনকে অন্তর্মুখী করতে হবে, এই ক্রিয়াতে যিনি অবহেলা করবেন, তিনি নিজেই নিজের শত্রু। যদিও একদিন না একদিন, বিষয়মুখী মন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে, অবসন্ন হয়ে অন্তর্মুখী হবেই, তথাপি এই ঘুরে মরার জ্বালা নিবারনের জন্য বুদ্ধিমান সাধক মনকে অন্তর্মুখী করবার জন্য সচেষ্ট হন। অপক্ক দেহে যে মনের স্থিতি সে সংকল্প করবেই।  কিন্তু পক্ক দেহি মনকে নিয়ন্ত্রণে রেখে কর্ম্মে প্রবৃত্ত করবে। আত্মকর্ম্মে নিযুক্ত করবে। কামসঙ্কল্প থেকেই মনের এই বিক্ষিপ্ত আচরণ। প্রাণ থেকেই   মনের  উৎপত্তি ।  তো প্রাণের স্থিরতা এলেই মনকে স্থির করা যায়। মন স্থির হলে কামসঙ্কল্প নির্বাপিত হয়ে যায়। তাই প্রাণকে স্থির করাই  বুদ্ধিমানের কাজ। প্রাণায়াম ইত্যাদি দ্বারা প্রাণকে স্থির করতে হবে। প্রাণ স্থির হলে মন-বুদ্ধি স্থির হবে। স্থির  বুদ্ধি একাগ্রতা বৃদ্ধি  করবে। উদ্বেগশূন্য একাগ্র চিত্তে মন ধ্যানস্থ হবে।  আত্মসাক্ষাৎকার হবে।  

বন্ধুরাত্মাত্ননস্তস্য যেনাত্মৈবাত্মনা জিতঃ 
অনাত্মনস্তু শত্রুত্বে বর্ত্তেতাত্মৈব শত্রুবৎ। (৬/৬)

যিনি বিবেকযুক্ত মন দ্বারা আত্মাকে জয় করেছেন, তার মন জীবাত্মার বন্ধু।  কিন্তু অজিত-আত্মার মনই শত্রুর ন্যায় শত্রুতা করে  থাকে।

সাধনক্রিয়া না করলে, বা সাধন ক্রিয়া করলেও একদিন সবাই  আমরা কালের গ্রাসে পতিত হবো।  যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমুখে আমরা শুনেছি, আত্মা অজর, অমর, অবিনাশী, অপরিবর্তনীয়। স্থুল দেহের নাশ  আছে,  এমনকি সূক্ষ্ম দেহের হয়তো নাশ আছে, কিন্তু আত্মার  বিনাশ নেই। তো এই আত্মার উন্নতি বা অবনতি কি করে হয় ? আসলে আত্মার কোনো পরিবর্তন হয় না।  সূর্যকে কেউ টেনে নিচে নামাতে পারে না, আবার উঁচুতেও ওঠাতে পারে না। সূর্যকে কেউ মলিন করতে পারে না। কিন্তু মেঘ সূর্য্যের আলোকে সাময়িকভাবে ঢেকে দিতে পারে। সূর্য যেখানে প্ৰতিবিম্বিত হয়, অর্থাৎ যে জলপাত্রে, বা আয়নায় প্রতিবিম্বিত হয়, সেই জলপাত্র যদি তরঙ্গ সংকুল হয়, আয়নায় যদি ধুলো-বালি থাকে তবে সূর্য সেখানে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হতে পারে না। তখন স্থির সূর্যকে তরঙ্গের মধ্যে দুলতে দেখা যাবে। আয়নায় সূর্যকে মলিন দেখাবে। তেমনি পরম-আত্মা যেখানে প্রতিফলিত হচ্ছেন, অর্থাৎ জীবাত্মা, আরো স্থুলভাবে বলতে গেলে মন যদি বিক্ষিপ্ত  হয়, চঞ্চল হয়, তবে মনে আত্মার প্রতিচ্ছবি যথাযথভাবে স্ফূরিত হবে না। যে ঘুমুতে চায়, তাকে জাগানো যায় না।  যে ডুবতে চায়, তাকে ভাসানো যায় না। যে সংসারে ডুবে থাকতে চায়, তাকে কেউ উদ্ধ্বার করতে পারে না। নিজে সচেষ্ট হলে, উদ্দমী হয়ে সাধন কর্ম্মে লিপ্ত হলে তবে উদ্ধার সম্ভব। তুমি তোমার দেহ-মনের অশুদ্ধতার কথা চিন্তা করো, তবে তোমাকে দেহ-মন নিয়েই থাকতে হবে।  একবার যদি তুমি স্থিরচিত্ত হয়ে সেই আনন্দময় আত্মার কথা চিন্তা করো, তবে তোমার স্বরূপের কথা মনে পড়বে। যার ইন্দ্রিয় স্বেচ্ছাচারী, যার মন অস্থির, যার প্রাণবায়ু অস্থির তার পক্ষে আত্মার স্বরূপ জ্ঞান সম্ভব নয়। যিনি ক্রিয়া করে, প্রাণকে স্থির করতে পেরেছেন, যার মধ্যে থেকে দেহাভিমান দূর হয়ে গেছে, যার মধ্যে থেকে সমস্ত উপাধির আসক্তি দূর হয়েছে, তিনি আপনাতে আপনি থাকেন। এই প্রাণই চঞ্চল হয়ে স্থুল, সূক্ষ্ম ও কারন শরীরে প্রকাশিত হচ্ছে।  জাগ্রত অবস্থায় স্থূল শরীর ক্রিয়াশীল থাকে, স্বপ্নাবস্থায় সূক্ষ্ম শরীর ক্রিয়া করে।  কিন্তু সুসুপ্তির সময় স্থুল সূক্ষ্ম দুই শরীরই ক্রিয়াহীন হয়ে অবস্থান করে। কিন্তু অজ্ঞানের আবরণ তাকে ঢেকে রাখে। এই অজ্ঞানের আবরণ সরিয়ে দিতে পারলে, প্রকৃতির ক্রিয়া থেমে  যাবে। আমি-আমার ভাব চলে গেলে, ইন্দ্রিয় মনের বশে এলে, মন ব্রহ্মে স্থিত হলে, ত্রিতাপ জ্বালা চলে যাবে। বিবেক জাগ্রত হলে, মনের বিষয়াশক্তি, ত্যাগ করে আত্মাতে স্থির হবে। বিষয়-বিষের জ্বালা দূর হয়ে যাবে। সমস্ত স্থিরচিত্ত পুরুষ নিজেই নিজের বন্ধু।  আবার সমস্ত অস্থির চিত্ত পুরুষ নিজেই নিজের শত্রু। তাই যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ  বলছেন, অজিতাত্মার মন শত্রুর মতো নিজেকে উৎপীড়ন করে, আর জিতাত্মার মন  বন্ধুর মতো নিজেকে প্রসন্ন করে।        

২৪.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - ষষ্ঠ অধ্যায়  - ধ্যানযোগঃ
শ্লোক নং - ৬/৭-৯ 

জিতাত্মনঃ প্রশান্তস্য পরমাত্মা সমাহিতঃ 
শীত-উষ্ম-সুখ-দুঃখেষু তথা মান-অপমানয়োঃ। (৬/৭)

শীত, গ্রীষ্ম, সুখ, দুঃখে এবং মান  অপমানে প্রশান্ত ভাবাপন্ন জিতাত্মার হৃদয়ে পরমাত্মা সমাহিত থাকেন।

যিনি নিজ আত্মাকে জয় করেছেন, অর্থাৎ আত্মাকে যিনি সম্যকরূপে  জেনেছেন, তার মধ্যে যে উচ্চ উপল্বদ্ধির অবস্থা আছে, তা আমাদের বাহ্য জগতের মাপকাঠি দিয়ে মাপা যায় না। একজন সাংসারিক মানুষ যে দৃষ্টিতে কার্যের বিচার করেন, সেই একই  দৃষ্টিতে একজন পাগল বা একজন মাতাল-এর কার্য্যকে বিচার করা যায় না। পাগল বা মাতালের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা, যা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়। সাধনক্রিয়া দ্বারা একজন যোগী যখন সাধনার উচ্চ  অবস্থা প্রাপ্ত হন তার মধ্যে সমদর্শীর ভাবের উৎপন্ন হয়। সমস্ত বস্তুতে যেমন তিনি সেই অন্তর্নিহিত সত্য, আত্মাকে উপলব্ধি করেন, তেমনি নিজের মধ্যেও তিনি সেই একই আত্মাকে সাক্ষাৎ করে থাকেন। এঁকে আমাদের সাধন বুদ্ধিতে মাপা যায় না। 
এক সাধিকার  কথা শুনেছিলাম, তিনি বলছেন, শরীরে আঘাত লাগলে, যে ব্যাথা হয় না তা নয়, তবে এই ব্যথাকে আমি উপেক্ষা করি,। সাধারণ মানুষের যেমন বিশ্রাম, নিদ্রার প্রয়োজন আমার সেই প্রয়োজন উপলব্ধি করি না। রাতে আমি ধ্যান-জপ করি,  শ্রীগুরু নির্দেশ মতো শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া করি, দিনের বেলায় সাংসারিক কাজকর্ম্ম করি। আমার কাজের কোনো প্রয়োজন নেই, কেননা কাজ থেকে যে ফল উৎপন্ন হয়, তা আমাকে গ্রহণ করতে হয় না। একটা জ্যোতিঃ সবসময় আমাকে ঘিরে রাখে, যা  আমার সমস্ত প্রয়োজন মিটিয়ে আমাকে এই জগতে স্থির করে রেখেছে। আমার মধ্যে কোনো ব্যস্ততা নেই,  আবার বিশ্রাম নেই। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষাতে আমি কোনো বিশেষ সুবিধে বা অসুবিধে বোধ করি না। এই এক কাপড়েই আমার চলে যায়।

এখানেও যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যথার্থ যোগী এই অবস্থায় শীত-উষ্ম, মান-অপমান,  ইত্যাদির বোধ রোহিত হয়ে যান।  এখন কথা হচ্ছে তাহলে কি তিনি চৈতন্যরহিত অবস্থায় অবস্থান করেন ? আসলে আমাদের মধ্যে চৈতন্যের যে মাত্রা আর যোগীর মধ্যে যে চৈতন্যের যে মাত্রা তার মধ্যে বিস্তর ফারাক। আমাদের শ্রবণশক্তি, আমাদের দৃষ্টিশক্তি একটা বিশেষ মাত্রায় ঘটে থাকে, এই মাত্রার তারতম্যে আমাদের মধ্যে দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণ শক্তির লোপ ঘটে। তো যোগীপুরুষ একটা বিশেষ মাত্রায় বা স্তরে অবস্থান করেন, যা আমাদের বোধের বাইরে। এই যোগীপুরুষ প্রারব্ধ বশে সুখ-দুঃখ, এমনকি প্রাত্যহিক কর্ম্ম অবশ্য়ই করেন, কিন্তু তাতে তার আত্মস্থিতি অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটে না। তিনি সর্বদা সেই কূটস্থে স্থির থাকেন। তার হৃদয়ে পরম-আত্মা প্রকট।          

জ্ঞান বিজ্ঞান তৃপ্ত-আত্মা কূটস্থো বিজিতেন্দ্রিয়ঃ 
যুক্ত ইতি-উচ্যতে যোগী সমলোষ্ট্রাশ্ম-কাঞ্চনঃ।  (৬/৮)

জ্ঞান ও বিজ্ঞান দ্বারা যার অন্তর-আত্মা পরিতৃপ্ত, যিনি কূটস্থে স্থিত আছেন, যার ইন্দ্রিয়গণ বিশেষভাবে বশীভূত, যিনি মাটি, মনি ও সোনায় যিনি সমদর্শী এইরূপ যোগীপুরুষকে যোগযুক্ত বলা হয়ে থাকে। 

জ্ঞান হচ্ছে নিজের সম্পর্কে জ্ঞান। ইন্দ্রিয়সকল কিছুই করে না , যা কিছু করবার করছে মন। আবার মন উদ্ভাসিত হচ্ছে প্রাণের দ্বারা। প্রাণ উদ্ভাসিত হচ্ছে চৈতন্য শক্তির দ্বারা। যখন জ্ঞানের উন্মেষ হয়, তখন বুঝতে পারি, এই যে দেহ-মন-বুদ্ধি এদের স্বকীয়তা বলে কিছু নেই। দেহাদিতে যখন আত্মা বলে ভ্রম না হয়, তখন তাকে বলে জ্ঞান। অর্থাৎ আমি এই দেহ-মন-বুদ্ধি নোই। কিন্তু সাধনক্রিয়া করতে করতে যখন সেই আত্মাতে স্থিত হওয়া যায়, তখন তা বিশেষ জ্ঞান বা বিজ্ঞান। অর্থাৎ ক্রিয়ার পরাবস্থাই  বিজ্ঞানপদ লাভ। যখন আত্মভাব ছাড়া সবকিছুর বিলোপ হয়, তখন ঘটে বিগত-জ্ঞানের অবস্থা। এই অবস্থায় এক পরম-আনন্দ, একটা তৃপ্তি অনুভব হয়, যা সমস্ত জাগতিক সুখের উর্দ্ধে। একেই বলে কূটস্থে আটকে থাকা, ব্রহ্মে অটল  থাকা। তখন যোগীর মধ্যে যে নির্বিকার ভাবের উদয় হয়, তা যোগীকে সমস্ত জাগতিক ব্যাপারে উর্দ্ধে তুলে ধরে। তখন টাকা-মাটি মাটি-টাকা হয়ে যায়। তখন স্ত্রী-পুরুষ, শত্রু-মিত্র বোধ থাকে না। অর্থাৎ সমস্ত বস্তুর মধ্যে যে বাহ্যিক অসাম্য আছে, তা আর বোধে আসে না। একটা সাম্যাবস্থায় অবস্থান করেন। তখন সমস্ত প্রকাশ তাঁরই স্ব-রূপের প্রকাশ বলে প্রতীয়মান হয়। একেই যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যোগযুক্ত অবস্থা।     

সুহৃদ-মিত্র-অর্য্যুদাসীন মধ্যস্থ দ্বেষ্যবন্ধুষু
সাধুষ্বপি চ পাপেষু সমবুদ্ধির্বিশিষ্যতে।  (৬/৯)

সুহৃদ, মিত্র, ও শত্রু সম্পর্কে   যিনি উদাসীন, মধ্যস্থ, বা বিবাদমান দ্বেষকারী, বন্ধু, সাধু, বা পাপী  - এই সকলের প্রতি যারা সমবুদ্ধি হয়েছে, তিনিই প্রশংসার  পাত্র।  

যোগে  আরূঢ় ব্যক্তি সর্বত্র সমজ্ঞান সম্পন্ন হন। তখন ভালো-মন্দ, আপন-পর জ্ঞান না থাকায়, তিনি সর্বত্র রাগ-দ্বেষহীন হয়ে যান। বিকারশূন্য অবস্থায় বিরাজ করেন। এই অবস্থায় যোগীর না আছে ভ্রমজ্ঞান, না আছে কোনো দ্বন্দ, না আছে কোনো সংশয়। ইন্দ্রিয়সকল তার নিজকর্ম্মে লিপ্ত থেকেও মন  বিষয়বিমুখ। যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এই যোগীপুরুষকেই প্রসংসার পাত্র বলছেন। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই পরমাত্মাকে উপলব্ধি করতে গেলে আমাদের কি করতে হবে ? উপনিষদ  বলছেন, প্রার্থনা দিয়ে শুরু  করতে হবে। সবিতাদেবের  কাছে প্রাথনা  করতে হবে। একাগ্রচিত্তে ধ্যান করতে হবে। মন-ইন্দ্রিয়গুলোকে বাহ্য জগৎ থেকে অন্তর্মুখী করতে হবে। আমরা জানি, আমাদের জ্ঞানেন্দ্রিয়  আমাদের কাছে বিষয়কে প্রকাশ করে।  কিন্তু সত্য হচ্ছে, ইন্দ্রিসকল এই শক্তি পাচ্ছে অগ্নের্জ্যোতিঃ থেকে।  ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন, এক-সের ঘাঁটিতে কি পঞ্চাশ সের  দুধ ধরে ? আমি ঈশ্বর দর্শন করতে চাই, বা আমি আত্ম-উপলব্ধি করতে চাই, শুধু মুখে বললে হবে না।  এর জন্য চাই উপযুক্ত শরীর-মন-ইন্দ্রিয়।  না হলে এই অসীম শক্তিধর এই বিরল অনুভূতির বেগ ধারণ করা সম্ভব হবে না।  এইখানেই যোগাভ্যাসের প্রয়োজন।  এইখানেই যোগাভ্যাসের প্রাসঙ্গিকতা। যোগ অভ্যাসের ফলে আমাদের ইন্দ্রিয়-রূপ যন্ত্রগুলি তীক্ষ্ণ ও মজবুত হবে। বিচারশক্তি দিয়ে, স্থুল  ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ থেকে নিজের মনকে গুটিয়ে নিতে গেলে, আমাদের বিচার-বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে হবে।  দায়িত্ত্ব আমাদেরই। সবিতার কাছে প্রার্থনা অর্থাৎ নিজের মধ্যে এই অগ্নির্জ্যোতি প্রজ্বলিত করতে হবে।  আর তা হচ্ছে  আর প্রাণ ও অপানের আহুতির দ্বারা। প্রথমে কামনা পূরণের  জন্য কর্ম্ম, এর পরের ধাপ হচ্ছে, প্রাণায়াম।  শ্বাসপ্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মন ও ইন্দ্রিয়ের সংযম হবে। একসময় সমাধি বা ঈশ্বরে অর্থাৎ ব্রহ্মে মন নিবিষ্ট হবে। সবশেষে আত্মজ্ঞান লাভ হবে।  পূর্নতা  পাবে সাধের মানব জীবন।  
--------------   
২৫.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - ষষ্ঠ অধ্যায়  - ধ্যানযোগঃ
শ্লোক নং - ৬/১০-১২

যোগী যুঞ্জীত সততমাত্মানং রহসি  স্থিতঃ 
একাকী যতচিত্তাত্মা নিরাশীরপরিগ্রহঃ। (৬/১০)

 যোগী একাকী নিৰ্জ্জন স্থানে থেকে সংযতচিত্ত, আশঙ্কাশূন্য ও পরিগ্রহশূন্য হয়ে নিরন্তর চিত্তকে  সমাহিত করবেন। 

এর আগে আমরা শুনেছি, যোগে আরূঢ় পুরুষের লক্ষণ।  এবার যোগেশ্বর এই যোগে কিভাবে যোগ দিতে হবে, তার সম্পর্কে বলছেন। বলছেন, আগে মনে মনে স্থির করুন যে আপনি যোগের পথ অবলম্বন করবেন। মনকে দৃঢ় করে, সংকল্প করুন যে আপনি যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা অনুযায়ী যোগের পথে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করবেন।  এবার সঙ্গহীন হবার চেষ্টা করুন।  অর্থাৎ আপনার চারিদিকে যে যোগহীন ব্যক্তির ছড়াছড়ি তাদের সঙ্গ ত্যাগ করুন। এমনকি যারা যোগের পথ এড়িয়ে ভগবানের সান্নিধ্য পাবার অমূলক চেষ্টা করছেন, তাদের থেকেও  দূরে থাকুন। মনকে নিরোধের চেষ্টা করতে হবে। অবান্তর আলোচনা করতে যাবেন না।  এমনকি ঈশ্বর আছেন, কি নেই সেইসব অহেতুক আলোচনায় নিজেকে জড়াবেন না। একটা জিনিস জানবেন, যারা বলছেন, ঈশ্বর আছেন, তারা কেবলমাত্র অন্ধবিশ্বাসের উপরে ভিত্তি করে এইসব কথা বলছেন, আবার যারা বলছেন, ইশ্বর নেই, তারাও অন্ধকারের জগতের বাসিন্দা। এই দুই ধরনের মানুষই কোনোদিন ঈশ্বরের খোঁজ করেন নি।  এমনকি খোঁজ করবার চেষ্টাও করেন নি। তো এদের কথায় নিজেকে বিভ্রান্ত করবেন না। আপনি যদি শ্রীগীতার কথায় আস্থা রাখতে পারেন, অর্থাৎ যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের  কথায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেন, তাঁর কথায় যদি আপনার শ্রদ্ধা জাগে, তাঁর কথায় আপনি যদি সন্দেহ না করেন, তবে তার উপদেশ, নির্দেশ অনুযায়ী কাজে লেগে পড়ুন । অন্ধ বিশ্বাস নয়, প্রথমে সহজ সরল হয়ে, নিজের মধ্যে যে পূর্বার্জিত সংস্কার আছে, তাকে খালি করুন।  হাবিজাবি খেয়ে, যদি আপনার পেট ভর্তি হয়ে থাকে, শুষ্কপন্ডিত মূর্খের কথায়  আপনার মনের মধ্যে যদি কোনো ভ্রমজ্ঞান জন্মে থাকে তাকে প্রথমে পরিহার করুন। ভ্রমজ্ঞান দূর না করতে পারলে, পেট খালি না করতে পারলে, আপনি ভগবানের প্রসাদ  থেকে কোনো উপকার পাবেন না। একেই বলে নির্জনে যাওয়া। আক্ষরিক অর্থে  নির্জনতা  মানে, জনমানবহীন স্থান। তো বন-জঙ্গলে গিয়ে, বা পর্বত শিখরে গিয়েও যদি  আপনার ভিতরের অজ্ঞান, সংস্কার, জাগতিক চাওয়া-পাওয়া, সংসারের সম্পর্ক - এসব থেকে যদি নিজের মনকে বিচ্ছিন্ন করতে না পারেন,  তবে বৃথা এই জঙ্গলবাস।  বৃথা এই পাহাড়ের নির্জনতা। একটা জিনিস জানবেন, একা না হলে সেই "এক"-কে পাওয়া যায় না।তো আমাদের একা হতে হবে। যে মুহূর্তে তুমি একা হতে পারবে, সেই মুহূর্তেই  তুমি সেই অদ্বিতীয় সত্তাকে উপলব্ধি করতে পারবে। রাজা সুরথ রাজ্য ছেড়ে জঙ্গলে গিয়েও একা হতে পারেন নি। তো আমরা সংসার ত্যাগ করি, বা অরণ্য-পর্বতে কিংবা গিরিগুহায় বাস করি, যথার্থ অর্থে আমরা সহজে কেউ একা হতে পারি না। অথচ চরম সত্য হচ্ছে, আমরা এসেছি একা, আবার শেষের দিনে আমাকে একাই যেতে হবে, তবে মাঝের এই কয়দিন কতকগুলো উপসর্গ জোগাড় করে, বহুত্বের যন্ত্রনায় নিজেকে নিঃশেষ করছি কেন ? আসুন যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ মতো নিজে একটু একা হবার চেষ্টা করি।  

যাইহোক, একা না হতে পারেন, একান্তে খানিকটা সময় বাস করবার চেষ্টা করুন। অন্তত যতটুকু সময় আপনি যোগাভ্যাস করবেন, ততক্ষন চিত্তের বিক্ষিপ্ত অবস্থা থেকে বিশ্রাম নিয়ে কোনো একটা ঘরের কোনে, বা ঠাকুরের মূর্তির সামনে,  যোগাভ্যাসের জন্য স্থির শরীরে অবস্থান করুন। এখানে বিষয়চিন্তাকে মনের মধ্যে আসতে দেবেন না। মনোবিজ্ঞানীগণ বলে থাকেন, দুঃখের কথা ভুলতে গেলে, নিজের সুখের স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে হয়। জীবনের লক্ষ স্থির ক'রে, অর্থাৎ ভগবৎ অনুভূতি লাভের  ইচ্ছেকে সহায় করে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণীর কথা স্মরণ করতে থাকুন। আসলে যোগ অভ্যাসকারীকে আকাংখ্যাহীন হতে হবে। চিদ্গতপ্রাণ হতে হবে। শরীর ও মনের সংযম অভ্যাস করতে হবে। প্রাণায়ামের ক্রিয়া দ্বারা একসময় অবশ্য়ই মন স্থির হবে। কারুর দেখাদেখি যোগের অভ্যাস করা যায় না। মন থেকে যাদের যোগের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয় নি, যারা যোগেশ্বরের কথায় অবিশ্বাস করেন, তাদের যোগক্রিয়া ভষ্মে ঘি ঢালা। বহু জন্মের সুকৃতির ফলে যোগে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আর যোগের ফল জন্ম-জন্মান্তর ধরে চলতে থাকে। দেবাদিদেব মহাদেব বলছেন, একজন্মেই যোগাভ্যাসে মুক্তি হওয়া সম্ভব। কর্ম্মহীন জ্ঞান কোনো ফল দান  করতে পারে না। আর সমস্ত কর্ম্মের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট কর্ম্ম হচ্ছে নিষ্কাম যোগক্রিয়া। 

শুচৌ দেশে প্রতিষ্ঠাপ্য স্থিরম-আসনম-আত্মনঃ 
ন-অত্যুচ্ছ্রিতং না-অতিনিচং চৈলাজিনকুশোত্তরম্। (৬/১১) 

পবিত্র স্থানে না অতি উঁচু, না অতি নিচু অবস্থায়  কুশাসন , তার উপরে হরিনের চামড়ার আসন, তার উপরে বস্ত্রাসন বিছাতে হবে। 

এই আসন ব্যাপারটা একটু ভালোভাবে বুঝতে হবে। বাহ্যিক দিক থেকে বলা হয়েছে, পবিত্র দেশে, প্রথমে কুশের তৈরী আসন, তারপরে হরিণ-চর্ম্ম-আসন, তারপরে রেশম কাপড়ের আসন। আবার বলা হচ্ছে না উঁচুতে না নিচুতে আসন পাততে হবে। প্রথমে বলি এখনকার যুগে হরিনের চর্ম্ম শুধু দুর্লভ নয়, বোধহয় রাষ্ট্রীয় আইনবিরুদ্ধ বটে। তো হরিনের চামড়া না হলে, আসন অভ্যাস করা যাবে না, সেই ধারনা  ঠিক নয়। 

আরো একটা কথা বলি, যোগাভ্যাসের জন্য, আসন একটা নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করে ভালো।  বারবার পরিবর্তন করলে, চিত্তের বিক্ষিপ্ত অবস্থা সহজে যেতে চায় না। মাটিতে বা কাঠের আসনে বসে যোগের অভ্যাস করতে নেই।  কারন হচ্ছে, যোগের অভ্যাসকালীন, শরীরের মধ্যে একটা দিব্য তেজশক্তি উৎপন্ন হয়।  কাঠ, প্থিবী বা মাটি হচ্ছে সুপারিবাহী। এইজন্য প্রাণের সাধনায় যে শক্তি যোগী সংগ্রহ করলো, তা যদি প্থিবী টেনে নেয়, তবে সাধকের সঞ্চয়ে কিছুই থাকে না। এইজন্য অপরিবাহী, কুশাসন, মৃগ বা ব্যাঘ্র চর্ম্ম এবং রেশম কাপড়ের ব্যবহার চলে আসছে, প্রাচীন কাল থেকে। আরো একটা কথা হচ্ছে, আসন উঁচু হলে, অর্থাৎ মোটা গদি  হলে বসাটা হয়তো আরামপ্রদ হতে পারে, কিন্তু এতে করে শরীর ঋজু থাকে না। আবার পাতলা আসনে বেশিক্ষন স্থিরাবস্থায় থাকা অসহ্য হয়ে ওঠে। তো প্রথমে আসনে স্থির হয়ে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকবার অভ্যাস রপ্ত করতে হয়।
 
যদিও এইযে আসনের  কথা বলা হলো, এটি আসলে বাহ্যিক আসন। যোগীর ব্যবহারিক জগতের আসন, ও আধ্যাত্মিক আসন সবসময় বৈরাগ্যের আসনে স্থাপন করতে হয়। যদিও শরীরের মাধ্যমেই আমাদের সাধন করতে হবে।  তথাপি এই শরীরের ভিতরেই আছে, স্থির আসন পাতবার জায়গা। সুষুম্নার ভিতরে প্রাণবাহী ব্রহ্মনাড়ী। গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর মিলন স্থানে অর্থাৎ সুষুম্না-বজ্রাক্ষ্যা-চিত্রাণি নাড়ীর সন্ধিস্থলে মনকে স্থির করতে হয়। ব্রহ্মর্ষিগন এইখানে মনকে নিবদ্ধ করে ধ্যানমগ্ন  হয়ে থাকেন।  আসলে এই যে পবিত্র দেশের কথা বলা হয়েছে, সেটি হচ্ছে ব্রহ্মদেশে বসতে হবে, অর্থাৎ হৃদয়াসনে বসুন। না অতি নিচু, না অতি উঁচু, অর্থাৎ না গুহ্যদেশে, না আজ্ঞাচক্রে  প্রথমে আসন পাতুন অনাহত চক্রে। কুশ হচ্ছে মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান হচ্ছে মৃগচর্ম্ম, নাভিস্থান অর্থাৎ মনিপুর হচ্ছে রেশম বস্ত্র। এই তিন চক্রের উপরে অবস্থান করছে হৃদয়কেন্দ্র বা অনাহত চক্র। সমস্ত সাধকের পক্ষে এই হৃদয়কেন্দ্র নিরাপদ আসনের স্থান, এখানে শুদ্ধ মনকে স্থাপন করুন। অর্থাৎ যখন সাধন ক্রিয়া করতে হবে, তখন শ্বাসবায়ুকে পূরক করে, কুম্ভক করবার সময় লক্ষ রাখতে হবে হৃদয়কেন্দ্রে। মেরুদন্ড সোজা করে পূরক করবার সময় হৃদয়ে একটু জোর লাগে, তখন হৃদয়কে একটু সংকুচিত হয়, আবার আবার রেচক করবার সময় হৃদয় যেন একটু সম্প্রসারিত হয়। স্বাভাবিক ভাবে মনে হয়, শ্বাসবায়ু গ্রহণের সময় হৃদয় প্রসারিত হয়, আর শ্বাসবায়ু পরিত্যাগ করবার সময় হৃদয় সংকুচিত হয়। কিন্তু শ্বাসবায়ু ছেড়ে দেবার পরে, শ্বাসবায়ু গ্রহণের ঠিক আগেই হৃদয়কে সম্প্রসারিত করতে হবে। আবার শ্বাসবায়ু সম্পূর্নরুপে ছেড়ে দেবার পরেও এই অবস্থা বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ হৃদয় খালি হবে কিন্তু প্রসারিত থাকবে। আর  প্রাণের বেগ ধারণ হবে, অনাহত চক্রে,   এই কথাটা খেয়াল রাখতে হবে। এই অনাহত চক্রে প্রাণশক্তির স্থিরতা এলে, হৃদয়গ্রন্থি ছিন্ন হয়ে প্রাণবায়ু সুষুম্নামার্গ ধরে উর্দ্ধগামী হবে। তখন সাধকের মধ্যে সম্পূর্ণ স্থিরতা আসতে পারে। 
 
তত্র-একাগ্রংমনঃ কৃত্বা য্তচিত্তেন্দ্রিয়ক্রিয়ঃ 
উপবিশ্যাসনে যুঞ্জ্যাদ যোগম-আত্মবিশুদ্ধয়ে।  (৬/১২) 

সেখানে  মনেক একাগ্র করে চিত্ত ও ইন্দ্রিয়ের সংযম অভ্যাস করবে। অন্তঃকরণ শুদ্ধ করে, যোগের অভ্যাস করবে। 

হৃদয়গ্রন্থি ছিন্ন হয়ে গেলে, মনকে আজ্ঞাচক্রে স্থাপন করে, বিন্দুর চিন্তন শুরু করতে হবে।  আজ্ঞাচক্রে বিন্দুর চিন্তন   করলে, মন স্থির হয়ে আসে। এগুলো অবশ্য ধীরে ধীরে করতে হবে।  প্রথমে প্রাণায়ামে অভ্যস্থ হতে হবে। প্রাণায়ামের মধ্যে নিজেকে একাগ্র করলে, অর্থাৎ প্রাণের আসা-যাওয়ার দিকে খেয়াল করে বসে থাকলে, বিষয় থেকে মন সরে এসে, প্রাণের সঙ্গে মিলিত হবে। তখন  চিত্তে  বৃত্তির প্রভাব যত  কমতে থাকবে  মন তত একাগ্র হতে শুরু করবে । ধীরে ধীরে চিত্তে বৃত্তির স্ফূরণ ক্ষীণ হবে, এবং চিত্ত শুদ্ধ হতে থাকবে। মনকে বিবেক-বুদ্ধির সাহায্যে বারবার বোঝাতে থাকুন, বিষয়ে সুখ নেই। বিষয়ে সুখ নেই। মন ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বিষয়কে অনুভব করে সত্য, কিন্তু প্রাণের স্পন্দন ব্যাতিত মন ইন্দ্রিয়বিষয় গ্রহণে সমর্থ হয় না। তাই প্রাণায়াম করতে করতে প্রাণ যখন ধীরে ধীরে স্থির হতে শুরু করবে, তখন মনও হয়ে বিষয়বিমুখ হবে। মন স্থির হবে।  জীবের মধ্যে কর্তৃত্বাভিমান উৎপন্ন হলে, প্রাণ-মন আন্দোলিত হয়। চিত্তে যতক্ষন বিষয়ের ছবি, ভাসতে থাকে ততক্ষন যোগে স্থিত হওয়া যায় না। তো প্রাণ আন্দোলিত হয়ে যাতে মনকে অস্থির করে না তোলে, বা মনকে বিক্ষিপ্ত না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রাণ ও মনের স্থিরতা থেকে চিত্তের শুদ্ধাবস্থা আপনা আপনি এসে যায়। এবার মনকে ভগবতমুখী করে তুলতে হবে। আসলে ভগবত স্মরণ যখন গভীর হয়,  তখন প্রাণ-মন দুইই স্থির হয়। কিন্তু আমাদের মতো সাংসারিক মানুষের মন যেহেতু স্বাভাবিক কারণেই বিষয়কে নিয়েই চলতে হয়, তাই আমাদের মনে সারাক্ষন বিষয়চিন্তাই উঠতে থাকে।  এখন আমরা যখন নিষ্কাম হয়ে, প্রাণকর্ম্ম শুরু করবো, তখন প্রাণের স্থিরতার সঙ্গে সঙ্গে মন স্থির হয়ে, ইষ্টে প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রাণায়ামের কাজই প্রাণবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা। আর যার মধ্যে প্রাণকে নিয়ন্ত্রণ করবার ক্ষমতা এসেছে তিনি নিজের মনকে যেকোনো স্থানেই একাগ্র করতে পারেন। এই একাগ্রতা যত  গভীর হতে থাকে  সাধক তত  সমাধির দিকে এগিয়ে যান। অর্থাৎ তার মধ্যে একটা সাম্যাবস্থার সৃষ্টি হয়। তাই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন,  অন্তঃকরণ শুদ্ধ করে, যোগের অভ্যাস করবে। আসলে অন্তঃকরণ সবারই শুদ্ধ।  শুধু বিষয়চিন্তা এসে মনকে মলিন করেছে, ভারী করেছে, এখানে থেকে বেরুতে পারলেই আমরা শুদ্ধচিত্তের স্বাদ পেতে পারি। 
------------    
২৬.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - ষষ্ঠ অধ্যায়  - ধ্যানযোগঃ
শ্লোক নং - ৬/১৩-১৪

সমং কায়শিরোগ্রীবং ধারয়ন্নচলং স্থিরঃ 
সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং দিশশ্চানবলোকয়ন্।  (৬/১৩)

দেহ-মস্তক-গলা সমতা বজায় রেখে, অর্থাৎ সোজা রেখে,  নিশ্চল ও স্থির হয়ে নিজ নাসিকা অগ্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, অন্যদিকে দৃষ্টি না দিয়ে, অবস্থান করবে।

মেরুদন্ড সোজা রেখে, গলা ও মাথা সমানভাবে সরলরেখায় অবস্থান করতে হবে। এর আগে আমরা আসনের কথা শুনেছি।  এবার বলছেন, কিভাবে এই আসনে নিজেকে স্থাপন করতে হবে। সাধন ক্রিয়ার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে, মেরুদন্ডকে সরল-রেখায় অর্থাৎ দন্ডায়মান অবস্থায় স্থাপন করতে হবে। মেরুদন্ড বক্র থাকলে, আলসেমি, উদাসীনতা ইত্যাদির প্রশ্রয়ে যোগে বিঘ্ন ঘটে থাকে। বায়ুর উর্দ্ধগতি বাধাপ্রাপ্ত হয়।  এমনকি মনের উচ্চ অবস্থা থাকে না। আসলে মেরুদন্ডকে আশ্রয় করেই আমাদের সুষুম্না, ইড়া, পিঙ্গলা এমনকি বজ্রাক্ষ্য, চিত্রাণি, ব্রহ্মনাড়ী অবস্থান করছে। এখানেই সমস্ত চক্রের অবস্থান।  এখন থেকে সমস্ত শরীরে নাড়ীজাল বিস্তার ঘটেছে। তো মেরুদন্ড যখন সরল-দণ্ডের আকারে দন্ডায়মান থাকে ঋজু ও স্থির অবস্থায় থাকে তখন তার মধ্যে বায়ুর  উর্দ্ধগতি সহজসাধ্য হয়।  যোগশাস্ত্রে বলা হয়েছে, মেরুদণ্ডের নিম্নাংশ অবস্থান করছে আমাদের মূলাধারে।  এই মূলাধারে কুলকুন্ডলিনী শক্তি নিদ্রিতা আছেন। সাধারণ মানুষের  এই শক্তি নাভিচক্রের নিচে অর্থাৎ মনিপুর চক্র থেকে মূলাধার চক্র পর্যন্ত যাতায়াত ক'রে, সৃষ্টিক্রিয়া করে থাকে। একটু  খেয়াল করলে দেখতে পারবেন, জীবজন্তুর মেরুদন্ড পৃথিবীর সঙ্গে সমান্তরাল রেখায় অবস্থান করে থাকে।  একমাত্র মানুষের মেরুদন্ড পৃথিবীর বিপরীত মুখী অর্থাৎ উর্দ্ধমুখী বা সূর্যমুখী   হয়ে অবস্থান করছে। আর এই কারণেই মানুষের মননশক্তি জীবজগতের মধ্যে সর্বাধিক। তো ঈশ্বরপ্রদত্ত এই ঐশীশক্তিকে কেবলমাত্র মানুষই  সদ্ব্যবহারের সুযোগ পেতে পারে। মানুষ একসময় মহামানব, দেবমানবে উন্নত হতে পারে। সাধনক্রিয়ার সাহায্যে কুলকুন্ডলিনী শক্তিকে বিভিন্ন চক্র ভেদ করে যখন সহস্রারে স্থাপন করা যায়, তখন যোগীর সর্বোচ্চ অবস্থা অর্থাৎ যোগীপুরুষ  একসময় ব্রহ্মময় হয়ে যান। 

যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এখানে নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে বলছেন। সর্ব্বসাধারনের জন্য, এই পন্থা উত্তম। দুর্বল মানুষ হৃদয়কেন্দ্রে মনকে স্থাপন করবেন।  মাধ্যমাধিকারীর জন্য নাসিকাগ্র, এবং  যারা সবল মনের অধিকারী,  তারা  অর্দ্ধ-উন্মিলিত নেত্রে ভ্রূযুগলের মধ্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারেন। কিন্তু ভ্রূযুগলের মধ্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে গেলে দেখবেন, কিছুক্ষনের মধ্যে মাথাঘোরা শুরু হয়েছে।  সেক্ষেত্রে যোগেশ্বর ভগবান উক্ত নাসাগ্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা শ্রেয়। তবে যেখানেই (ভ্রুমধ্যে, নাসিকাগ্রে, বা হৃদয়ে) মনের অবস্থান থাকুক না কেন, বা দৃষ্টি থাকুক না কেন, এই অবস্থায় সাধকের চিত্তবিক্ষেপের লয় হবে।         

প্রশান্তাত্মা বিগতর্ভী ব্রহ্মচারী ব্রতে স্থিতঃ 
মনঃ সংযম্য মত-চিত্তোযুক্ত আসীত মৎপরঃ। (৬/১৪)

প্রশান্ত চিত্ত, নির্ভিক, ব্রহ্মচারী, মনকে সংযত করে, মদ্গতচিত্ত মৎপরাপায়ন হয়ে সমাহিত হবে। 

এইভাবে যোগের অভ্যাস করলে, একসময় সমাহিত অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া যায়। আমি কিছু নোই, আমার বলে কিছু নেই। বারবার মনের মধ্যে এই চিন্তার উদয় ঘটাতে পারলে মন বিক্ষেপশূন্য হয়ে যায়। মন স্থির হয়। আমাদের মেরুদণ্ডের মধ্যে যেসব চক্রে  আছে, তাতে একবার মূলাধার থেকে সহস্রার, আবার সহস্রার থেকে মূলাধার পর্যন্ত মনকে টেনে নিয়ে যেতে পারলে, মন সঙ্কল্পশূন্য হয়ে ওঠে।  তখন মনের মধ্যে আর কোনো বৃত্তির উদয় হয় না। একেই বলে ব্রহ্মে বিচরণ বা ব্রহ্মচর্য্য। এই অবস্থায় মন হয় ভয়শূন্য, শান্ত প্রশান্ত। মদ্গত চিত্ত বা মৎপরায়ণ কথাটার অর্থ সেই আত্মাতে স্থিত হওয়া। অর্থাৎ স্বরূপে অবস্থান করা। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, যোগীর ধ্যেয় হচ্ছে, জ্যোতির্ময় আত্মা। গীতায় যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন,  পরমপুরুষ, ঈশ্বর। মূলত দুইই এক। আপনাতে আপনি থাকা।   

---------------------------   

২৭.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - ষষ্ঠ অধ্যায়  - ধ্যানযোগঃ
শ্লোক নং - ৬/১৫

যুঞ্জন্নেবং সদাত্মনং যোগী নিয়ত-মানসঃ
শান্তিং নির্বাণপরমাং মৎসংস্থাম-অধিগচ্ছতি। (৬/১৫) 

এইভাবে সদা মনকে সমাহিত করে নিরুদ্ধচিত্ত যোগী পরম নির্বাণ প্রাপ্ত হয়ে,  মদীয় অর্থাৎ আপন   স্বরুপভূতা শান্তি প্রাপ্ত হন।

যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, এইভাবে সমাধির অভ্যাসের ফলে, মায়াশক্তির কল্পিত এই সংসার ও দেহাভিমান রূপ ব্যাধি থেকে জীবের পরিত্রান হতে পারে। তাই যোগের অভ্যাসের দ্বারা প্রাণকে ও মনকে নিশ্চল করে, সমাধিবান হয়ে আত্মদর্শন সম্ভব। সাধনক্রিয়ার দ্বারা চিত্ত সংযত হলে, মনের যে বহির্মুখী স্বভাব, তার নিবৃত্তি ঘটে। আর মনে এই বৃত্তির সমাপ্তি ঘটলে, যোগী নিজ-স্বরূপে নিমগ্ন  হয়ে যান। এইভাবে স্বরূপে স্থিতিলাভ হলে, পরম-শান্তি লাভ হয়ে থাকে। যোগীর উদ্দেশ্য সিদ্ধি হয়। এই নির্বানই ভগবানের সাক্ষাৎস্বরূপ প্রকৃত জ্ঞান। বলা হয়ে থাকে ব্রহ্মজ্ঞান গুহ্য। যোগী যখন দেহ থেকে ভিন্ন হয়ে  আত্মস্বরূপে অবস্থান করতে পারেন  তখন সাধক ব্রহ্মময় হয়ে যান।  তখন আত্মস্বরূপ ও ঈস্বরস্বরূপ অভিন্ন বলে জ্ঞানের উদয় হয়। এই জ্ঞানের উদয় সাক্ষাৎ ভগবানের স্বরূপ জ্ঞানসূর্য্যের উদয়। এই জ্ঞান কেবলমাত্র অনুভূতি সম্পন্ন। এই জ্ঞানের প্রকাশের কোনো মাধ্যম নেই।  ইনি  স্ব-প্রকাশ। সাধকের যখন এই অনুভূতি লাভ হয়, তখন তাঁকে ব্রহ্মপদ লাভ হয়েছে, বলা হয়ে থাকে। একেই জীবন-মুক্তি বলা হয়ে থাকে। তখন না থাকে কোনো ভয়, ক্রোধ, এমনকি তিনি ইচ্ছারহিত হয়ে অবস্থান করেন। 

চিত্তের সমতা হলে জিতেন্দ্রিয় অবস্থা লাভ করা যায়। প্রাণায়াম ইত্যাদির দ্বারা মন-প্রাণ স্থির হবে। আসলে ঠিকঠিক মতো কুম্ভক হলে তবেই চিত্ত সমাহিত হয়। এইসময়   বিচারশক্তি বৃদ্ধি পাবে। আর এই বিচারশক্তি কাজে লাগিয়ে, বিবেককে জাগ্রত করতে হবে। ভগবৎ বিশ্বাস দৃঢ় করতে হবে। ভগবানকেই আশ্রয় করে সাধনায় নিবদ্ধ থাকতে হবে ।  প্রথম দিকে সগুন উপাসনা শ্রেয়। সগুন উপাসনার দ্বারা আমাদের চিত্ত শুদ্ধ হবে। চিত্ত শুদ্ধ হলে, যথার্থ জ্ঞান হবে। কিন্তু একটা সময় সগুন উপাসনাকে রেখে নির্গুণের উপাসনা করতে হবে। সাধন ক্রিয়ার উচ্চ অবস্থায় পৌঁছলে অদ্বৈত ভাবের উপলব্ধি হবে। 

ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, "তৎ প্রতিষেধার্থম-এক-তত্ত্বাভ্যাসঃ" (সমাধিপাদ-৩২) অর্থাৎ চিত্তের বিক্ষেপগুলোকে উপশমের জন্য সেই এক অর্থাৎ ঈশ্বরতত্ত্বের অভ্যাস করা উচিত। তো যোগে প্রবৃত্ত সাধককে  সেই এক-কেই ধরতে হবে।  আর মন হচ্ছে সমস্ত বিকারের কারন, সমস্ত বৈকল্যের কারন।  তাই মনকে নিরুদ্ধ করতে হবে। আবার প্রাণকে স্থির করতে না পারলে, মনকে স্থির করা সম্ভব নয়। তাই প্রাণক্রিয়ার দ্বারা প্রাণ যাতে স্পন্দন রোহিত হয় তার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। প্রথমে সাধনার দ্বারা যে সহজকুম্ভক অনুষ্ঠিত হয়, তার দ্বারা প্রাণ মস্তকের মধ্যে প্রবেশ করলে, মন সঙ্কল্পশূন্য হয়ে মনের নিরোধ সমাধি হয়। প্রথমে এই অবস্থা ক্ষনিকের জন্য দেখা দিয়েই হারিয়ে যায়। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই অবস্থা শুভ আভাস। কালে কালে ক্রিয়ার অভ্যাসের মাত্রা যত  বাড়তে থাকে, নিরোধের স্থিতিকাল  তত দীর্ঘ হতে থাকে। তখন অর্থাৎ নিরোধের অবস্থায় আত্মজ্ঞানের উদয় হয়।  আত্মজ্ঞান অর্থাৎ আত্মা কি, আত্মার সঙ্গে দেহ-ইন্দ্রিয় ইত্যাদির সম্পর্ক কি, অথবা এই যে জড়বস্তুসকল দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, তার সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক কি ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞানের  উদয় হতে থাকে।  যদিও এটি ধারনা বিশেষ। এইসময় আত্মা ও মন-বুদ্ধি-অহঙ্কার ইত্যাদির সঙ্গে আত্মার বিশেষ পার্থক্য স্পষ্ট হতে থাকে। এই উপলব্ধি বেশিক্ষন স্থায়ী না হলেও, যদি বারবার এই ভাবের উদয় হয়, তখন ধীরে ধীরে স্বরূপের ধারণা  জন্মাতে থাকে। যত  এই ধারণা  দৃঢ় হতে থাকে, তত অজ্ঞান, অহংকার, রাগ, দ্বেষ এবং আমাদের যে পঞ্চক্লেশ তা দূরে সরে যেতে থাকে, এমনকি একসময় চিরতরে ক্ষয় হয়ে যায়। তখন এক অহৈতুকী, বস্তু-নিরপেক্ষ, কামনাবিহীন  আনন্দ প্রকাশ হতে থাকে। একেই বলে ব্রহ্মানন্দ । মনের একাগ্রতা যত গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে, তত বুদ্ধির সূক্ষ্মতা দেখা যায় ।  একেই বলে প্রজ্ঞা।  

ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, "ঋতম্ভরা তত্র প্রজ্ঞা" . প্রজ্ঞা হচ্ছে প্রকৃষ্ট জ্ঞান। ঋতম্ভরা হচ্ছে সাক্ষাৎ অনুভূতি। চিত্তের প্রশান্তি হয়েছে এমন পুরুষের অন্তঃকরণ পুরো সত্যে পূর্ন। মনের একাগ্রতা বৃদ্ধি থেকেই আসে সমাধিপ্রজ্ঞা। তখন ধ্য়েয় বস্তুতে যে ভাব হয় তাকে বলে সম্প্রজ্ঞাত সমাধি। এই একাগ্রতার অবস্থায় যদি অভীষ্ট বস্তুতে মনকে সংলগ্ন রাখা যায়, তাহলে বস্তুর অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যায়, আর সেই বস্তু সম্পর্কে পরিপূর্ন জ্ঞান লাভ হয়। এইজন্য একে  সম্প্রজ্ঞাত সমাধি  বলা হয়। চিত্তের বিক্ষিপ্ত অবস্থায় যে সমাধি তা অস্থায়ী। তখন ক্লেশের সম্পূর্ণ নিবারণ হয় না। এইসময় ভগবৎ-আরাধনা-রূপ যোগের অভ্যাস দ্বারা চিত্তকে বন্ধা অর্থাৎ প্রসব-ক্ষমতাহীন করতে হয়। তাহলে জ্ঞান স্থায়ী হয়, বৈরাগ্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। বিক্ষেপের নিবন্ধ হেতু সুখ-দুঃখ আর মনকে প্রভাবিত করতে পারে না। তখন অভীষ্ট বস্তুতে চিত্ত নিরুদ্ধ না হয়ে চিত্ত অভীষ্টবস্তুতে লয় হয়, অর্থাৎ তখন চিত্তের নিরালম্ব অবস্থা। আলাদা কোনো অবলম্বন থাকে না। একেই নিরোধ সমাধি বা অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলা হয়। তখন দ্রষ্টা আর দৃশ্য এক হয়ে যায়। এই অবস্থায় সাধনার বস্তু ও সাধকের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। 

এই যে প্রক্রিয়া অর্থাৎ সম্প্রজ্ঞাত সমাধি এটি অভ্যাসের ফলেই হয়ে থাকে। কিন্তু অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি তখনই হতে পারে, যখন  সমস্ত বৃত্তির লোপ হয়, প্রার্থিত থাকে না কোনো কিছু। তখন চিত্তের চিত্তত্ব লোপ পায়। যে চিত্তে কামনা-বাসনার উদ্রেগ হচ্ছিলো, যে চিত্তে জন্ম-মৃত্যু বোধ হচ্ছিলো, যে চিত্তে সুখ-দুঃখের উপলব্ধি হচ্ছিলো, সেই চিত্তের সমূলে উৎপাটন ঘটে থাকে। চিত্তের এই  অবস্থা প্রাপ্তি, জানবেন জন্ম-জন্মের সাধনার ফলে হয়ে থাকে, আর তাঁর জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হতে হয় না।  .নিরন্তর ভগবৎ নির্ভরতা, ভগবৎ চিন্তায় তন্ময়তা সাধককে এই অবস্থায় এনে দেয়।  এইসময় সাধনার বাহ্যিক ক্রিয়া বলে কিছু থাকে না। সম্প্রজ্ঞাত সমাধি, অভ্যাসের ফলে সহজে লাভ হয়ে থাকে। কিন্তু অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি ঈশ্বরকৃপাতেই সম্ভব হয়ে থাকে। 

অনেক সাধক, মন্ত্রাদি জপ্ করতে করতে, নাম-কীর্তন করতে করতে চিত্তের নিরোধ অবস্থায় পৌঁছাতে পারেন। এই অবস্থাকে ভাবসমাধি বলা হয়ে থাকে। এইসময় কূটস্থে নানান মূর্তি দর্শন, জ্যোতিঃ দর্শন ইত্যাদি হয়ে থাকে। এই দর্শন করতে করতে চিত্তের তন্ময়তা আসে। কিন্তু এতে প্রজ্ঞা লাভ হয় না। একসময় জ্যোতি দর্শন করতে করতে বিন্দুর দর্শন হয়।  চিত্ত বিন্দুতে স্থির হয়। আবার যোগপথের অনুগামী সাধকের প্রাণায়াম ইত্যাদির অভ্যাসে শরীর-মন-প্রাণ স্থির হয়ে গেলে, এক সাত্ত্বিক নিরোধের অবস্থা হয়, একটা অহৈতুকী আনন্দের অনুভূতি হয়। এগুলো সবই সম্প্রজ্ঞাত সমাধির মধ্যে পড়ে। 

সমাধি জিনিষটা কি  তা ভালোভাবে আরো একবার বুঝবার চেষ্টা করি। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, যোগ হচ্ছে চিত্ত বৃত্তির নিরোধ। কিন্তু চিত্ত বৃত্তি নোরোধ হলেই সমধিবান হওয়া যায় না। আসলে সমাধি বেশিরভাগ সাধকের কাছে একটি শোনা শব্দ মাত্র। পরের মুখে কখনো ঝাল খাওয়া  যায় না। সমাধি কখনো কোনো ক্রিয়া দ্বারা সংগঠিত হতে পারে না। তো যোগক্রিয়া পদ্ধতি গুরুদেব তাঁর  শিষ্যকে শেখাতে পারেন। কিন্তু সমাধির ভূমিতে  কাউকে টেনে নেওয়া যায় না। এটি  স্বয়ংক্রিয়। বাঁধাধরা নিয়মের উর্দ্ধে। চিত্তের মধ্যে যে বৃত্তিসমূহ নিরন্তর উঠছে, তার নিরোধের নাম হচ্ছে যোগ-অভ্যাস। যোগ অভ্যাস দ্বারা একাগ্রতা বাড়ে। একাগ্রতার অভ্যাস যখন গভীর থেকে গভীরতর হয়, তখন মন নিরুদ্ধ হয়ে থাকে। এই যে মনের নিরুদ্ধ অবস্থা একে  আমরা সমাধি বলে থাকি। কিন্তু নিরুদ্ধ অবস্থা মাত্রেই সমাধি নয়। এটি হচ্ছে মনের একতানতা।  মনের এই একতানতা যে কোনো বাহ্য বস্তুতেই হতে পারে। তখন ধ্যেয় বস্তু ছাড়া মনের মধ্যে অন্য কোনো কিছু নাও থাকতে পারে। আমরা অনেক সময় একধরনের বাহ্যবস্তুতে, এমনকি অন্তস্থিত বস্তুতে  একাতানতা অনুভব করে থাকি। ঋষি ধ্যানস্থ ছিলেন, রাজা এসে ডাকাডাকি করলেন, জল খেতে চাইলেন। কিন্তু ঋষি তা টের পেলেন না। রাজা তাঁর গলায় মৃত সাপের মালা গেঁথে দিয়ে চলে গেলেন। ঋষি ধ্যান থেকে যখন বুত্থিত হলেন তখন তিনি দেখলেন, তার গলায় কেউ একজন মৃত সাপের মালা গেথে দিয়েছেন। তো বিষয়ের প্রতি একতানটা কেটে গেলে, আমরা আবার বুত্থিত হয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারি। অর্থাৎ এখানে আত্মবিস্মৃতি ঘটে নি। দেহাভিমান কাটে নি।  কিন্তু ব্রজগোপীগন শ্রীকৃষ্ণের ধ্যানে করতে করতে আত্মবিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলেন। এখানে ব্রজগোপীগন সবকিছুর মধ্যে সেই কৃষ্ণকেই দেখছেন । গাছপালা, নদ-নদী, পশু-পক্ষী সবেতেই সেই একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ  বৈ কিছু নেই। 

 যোগ অভ্যাসের সময় প্রাণায়ামের দ্বারা যোগীর চিত্ত স্পন্দনশূন্য হয়ে যায়, দেহজ্ঞান লুপ্ত হয়ে যায়। তখন এই যে মিথ্যা আমি, তার বোধ থাকে না। দেহজ্ঞান থাকে না। তখন মনের মধ্যে কোনো বাসনা না থাকায়, একটা বিশুদ্ধ চৈতন্য বোধের উদয় হয়। আর এই বিশুদ্ধ চৈতন্য যেহেতু সর্ব্বব্যাপক তাই  বোধের পরিধি অখণ্ডধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। এই অবস্থায় বিচ্ছিন্ন যে অহংজ্ঞান বা বিভিন্ন ভাবনার যে স্পন্দন তা লুপ্ত  হয়ে যায়। এইসময় বিচ্ছিন্ন আমি বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। তখন না কর্ত্তা না ভোক্তা। এই হচ্ছে প্রাণায়ামের ফল।

এইবার চিত্তে যে সংকল্পের তরঙ্গ উঠছে, তাকে ব্রহ্ম-ভাবনায় ভাবিত করতে হবে। অর্থাৎ আমি ভগবানকে চাই, ব্রহ্মকে চাই, এই যে ভাবনা বা সংকল্প তা ত্যাগ করতে হবে। পরম-ব্রহ্ম যখন নিজ ভাবনায় অর্থাৎ নিজ শক্তির ভাবনায় যুক্ত হন, তখন সেই ভাবনার স্পন্দন থেকে জগৎ সৃষ্টি হয়ে থাকে। এই যে ব্রহ্মসঙ্কল্প, এই সংকল্প মানুষের  মধ্যেও ক্ষুদ্র আকারে রয়েছে। এই স্পন্দন আমাদেরকে বহির্মুখী করেছে। এই সংকল্পের অবসান হওয়া চাই। অর্থাৎ মনের যে ধর্ম্ম, সংকল্প তার অবসান হওয়া  চাই। বিচারের দ্বারা  বিষয়ের মধ্যে দোষ  দর্শন করতে করতে একসময় বিষয় স্পৃহার অবসান ঘটে।  কিন্তু বিষয়লিপ্সা সহজে যাবার নয়।  বিষয় সঙ্গ সহজে যায় না। কেননা বিষয় এবং মন পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। স্পন্দনের  কারনে মনের উৎপত্তি। অতয়েব যা স্পন্দন তাই মন। আবার যা মন তাই প্রাণ।  তাই মন-প্রাণ-স্পন্দন আলাদা করা যায় না। সুতরাং একটি থাকলে আর-একটি থাকবে। তো স্পন্দন আসে প্রাণ থেকে। তো এই প্রাণের মধ্যে যে তরঙ্গ উঠছে, তাকে প্রথমে থামাতে হবে। যোগীপুরুষগন বলে থাকেন, প্রাণায়াম ইত্যাদির সাহায্যে প্রাণকে স্পন্দনহীন করা সম্ভব। প্রাণ স্পন্দনহীন হলে মন ও তার সংযাগে ইন্দ্রিয়বৃত্তি নিস্পন্দিত হতে বাধ্য। 

এইজন্য একদিকে যেমন আমাদের প্রণামের অভ্যাস করতে হবে তেমনি আমাদের সাধুসঙ্গ বা সাত্ত্বিক কর্ম্মে মনকে নিযুক্ত করতে হবে। প্রাণায়ামে যখন মন বসবে, তখন এবং বারবার প্রত্যাহারের সাহায্যে মনকে সঙ্কল্পশূন্য করে,  স্থির করতে হবে।  মন যখন সঙ্কল্পশূন্য বা স্থিরতায় আনন্দ পেতে শুরু করবে, তখন বিষয়স্পর্শে যে তাৎক্ষণিক সুখ তা আর সে করতে চাইবে না। এই অবস্থায় প্রকৃত ভাবে বিষয়-ত্যাগ  সম্ভব হবে।  এইজন্য  সৎসঙ্গ যেমন প্রয়োজন তেমনি নিজেকে নির্জনে স্থাপন করাও প্রয়োজন। নানান রকম বৈষয়িক অভাব-এর মধ্যে থেকে নিজেকে পরীক্ষা করতে হবে, যে মন চঞ্চল হচ্ছে কি না। উপবাসে অর্থাৎ খাদ্যের অভাবে, বা শরীরে আঘাতজনিত ব্যাথার কারনে মন চঞ্চল হচ্ছে কি না সেটা খেয়াল রাখতে হবে। অর্থাৎ মন যদি শরীরের দিকে দৃষ্টি দেয়, তবে বুঝতে হবে, মন এখনো ব্রহ্মে স্থির হতে পারে নি। মনের ময়লা  এখনো যায় নি। অর্থাৎ প্রতিনিয়ত মনকে ভাগবত স্মরণে রাখতে হবে। প্রাণায়াম ইত্যাদির সাহায্যে যেমন প্রাণকে স্থির করতে হবে, তেমনি বাহ্যিক বিষয়ের সঙ্গে মন যাতে সম্পৃক্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে এটা ঠিক প্রাণায়ামের সাহায্যে, প্রাণের স্থিরতা, মনের স্থিরতা, বুদ্ধির স্থিরতা, ইত্যাদি এলে, মনের ময়লা দূর হয়ে যায়। একসময় আপনা-আপনি ভগবত কৃপা এসে যায়।  এর জন্য আলাদা কিছু করতে হয় না। তো চিত্তকে  বৃত্তিশূন্য করতে হবে। তাহলেই চিৎ-স্বরূপের সন্ধান পাওয়া যাবে। নির্ব্বান কথাটার অর্থ হচ্ছে অশান্তির নাশ। লোভের  নাশ, ঘৃণার নাশ, মায়ার নাশ। একটা পবিত্র জীবনধারা। যেখানে সাংসারিক ভোগ বিলাস বাসনার বিনাশ হয়েছে।                    
 
   
----------------------------
২৮.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - ষষ্ঠ অধ্যায়  - ধ্যানযোগঃ
শ্লোক নং - ৬/১৬ 

ন-অত্যশ্নত অস্তু যোগ অস্তি ন চ একান্তম অনশ্নতঃ
ন চ অতি স্বপ্নশিলস্য জাগ্রত নৈব চ অর্জ্জুন। (৬/১৬)

হে অর্জ্জুন যিনি অত্যাধিক আহার করেন, বা অত্যাধিক উপবাস করেন, তাঁর যোগ হয় না। অতিশয় ঘুমকাতুরে, বা নিদ্রাহীনের যোগ হয় না।           

অতিভোজন, বা উপবাস শরীরের স্বাভাবিক চাহিদার বাধা সৃষ্টি করে থাকে।  শরীরের ভারসাম্য নষ্ট করে থাকে। অতিভোজনে যেমন শরীর অসুস্থ হতে পারে, রোগব্যাধির সৃষ্টি হতে পারে, তেমনি শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রদান না করলে, শরীর দুর্বল হয়ে, মন-বুদ্ধি ইত্যাদিকে দুর্বল করে দেবে। একটা জিনিস আমাদের সবার খেয়াল রাখতে হবে, এই শরীরের মাধ্যমেই, আমরা যেমন সাংসারিক ক্রিয়া-কর্ম্ম  করতে পারি, তেমনি এই শরীর-মনের সাহায্যেই আমাদের আধ্যাত্মিক ক্রিয়া-কর্ম্ম  করতে হয়। শরীর ভিন্ন যেমন জগৎ মিথ্যা, তেমনি অসুস্থ শরীর আমাদের দুঃখের কারন। শরীরের রোগাদি যোগের বিঘ্নস্বরূপ। তো স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য, যেমন আমাদের পুষ্টিকর পরিমিত আহার গ্রহণ করতে হবে, তেমনি অতিরিক্ত বা অপরিমিত আহার আমাদের শরীরের বল-শক্তিকে ক্ষয়বৃদ্ধি করে থাকে। যাঁরা যোগের জন্য অধিক সময় ব্যয় করতে চান, তাদের একাহারী হওয়া শ্রেয়। হঠযোগীগন বলে থাকেন, আমাদের পাকস্থলীর অর্দ্ধেক খাবার দ্বারা, একচতুর্থাংশ জল দ্বারা পূরণ করবে।  বাকি এক-চতুর্থাংশ বায়ু দ্বারা পূরণ করবে। কথায় বলে  আমাদের পেট ও মন  ৭০ ভাগ রোগের জন্মদাতা। 

এখন কথা হচ্ছে, সমস্ত জীবজন্তুর কেন খাদ্যের প্রয়োজন ? আসলে বস্তু যখন প্রাণের সংস্পর্শে আসে, তখন সে প্রাণী হয়।  ভাইরাস হচ্ছে এই বস্তু থেকে প্রাণ সৃষ্টির মধ্যম অবস্থা।  ভাইরাস  যদি প্রাণের সংস্পর্শে আসতে  পারে, তবে সে প্রাণবন্ত হতে পারে। নতুবা প্রাণের সম্ভাবনার বিলোপ সাধন হয়। অর্থাৎ  এই প্রাণই প্রাণের খাদ্য, যা তাকে বেঁচে-বেড়ে উঠতে সাহায্য করে থাকে । প্রাণই প্রাণের রক্ষক আবার প্রাণই প্রাণের ভক্ষক। প্রাণী প্রাণকে আশ্রয় করেই  বেঁচে থাকে।  যোগশাস্ত্র মতে ক্ষিতি-অপ-তেজ অর্থাৎ সৃষ্টি উপাদান প্রাণশক্তি থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এই প্রাণশক্তি সমস্ত বস্তুর মধ্যেই নিহিত আছে। আবার বাতাসের মধ্যেও নিহিত আছে।এই বায়ুরূপী প্রাণশক্তি দ্বারাই বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি হয়েছে, এবং হচ্ছে। আমাদের এই যে দেহভান্ড প্রাণের কারণেই প্রাণবন্ত আছে। এই বায়ু ৪৯ ভাগে বিভক্ত হয়ে দেহ স্থিত  থেকে, দেহের গঠন ও পরিচালনা করছে।  আমরা শ্বাসের সাহায্যে যে প্রাণশক্তি সংগ্রহ করি, তা আমাদের শরীরের সমুদয় প্রয়োজন মেটাতে পারে না। আবার তেজ থেকেও আমরা যে প্রাণশক্তি সংগ্রহ করি, তা একক ভাবে আমাদের প্রয়োজন মেটাতে পারে না।  তাই আমরা খাদ্যের সাহায্য গ্রহণ করি। আসলে সমস্ত খাদ্য, যা আমরা গ্রহণ করি, তা  হচ্ছে, বায়ুর সমবায়ে গঠিত। কিন্তু আমরা যে শ্বাসবায়ু গ্রহণ করি, তা থেকে আমাদের প্রয়োজন মতো প্রাণশক্তি গ্রহণ করতে সক্ষম নোই। এই জন্য, প্রাণশক্তি সম্পন্ন খাদ্যের দরকার হয় আমাদের। আবার অন্যদিকে আমরা কার্য্যাদি উপলক্ষে প্রাণশক্তির ক্ষয় করি। তাই আমাদের শরীরের ক্ষয় রোধের জন্য, শরীরের পালনের জন্য, এমনকি শরীর বৃদ্ধির জন্য, আমাদের খাদ্যের প্রয়োজন হয়।  এই খাদ্যের সূক্ষ্মাংশ থেকেই আমাদের রক্ত, মাংস, হাড়. এমনকি মন উৎপাদিত হচ্ছে। কথায় বলে তুমি যা খাচ্ছো, তুমি তাই হয়ে যাচ্ছো। তো খাদ্য যেমন আমাদের শারীরিক শক্তি প্রদান করছে, তেমনি খাদ্য আমাদের মানসিক উন্নতিতে সাহায্য করছে। 

পৃথিবীতে প্রাণের প্রথম অভিব্যক্তি হচ্ছে উদ্ভিদ। উদ্ভিদ হচ্ছে, এমন একটা প্রাণী, যা পৃথিবী অর্থাৎ মাটি-পাথর, সূর্য অর্থাৎ আলো বা সূর্য্যরশ্মি এবং বাতাস  ইত্যাদিতে যে প্রাণশক্তি নিহিত আছে, তা সে সংগ্রহ করতে সক্ষম।  কিন্তু মানুষ তা পারে না।  এই যে মাটি, জল, বাতাস, আলো - এর থেকে প্রাণশক্তি সংগ্রহ করবার অসীম শক্তি নিহিত আছে এই উদ্ভিদ কুলের মধ্যে, তা  জীবকুলের মধ্যে নেই।  তাই সমস্ত জীবকুল এই উদ্ভিদকূলের উপরেই  নির্ভরশীল।  হ্যাঁ কিঁছু প্রাণী আছে, যারা সম্পূর্ণ ভাবে মাংসাশী। আসলে দেখবেন, এই যে মাংসাশী প্রাণীর খাদ্য, তার উৎস  কিন্তু  সেই উদ্ভিদ।  যেমন বাঘের খাদ্য হরিণ, এই হরিণ মূলত উদ্ভিদের উপরেই বেঁচে থাকে। তো সমস্ত প্রাণী এই প্রাণের সংগ্রহকারী মূল উদ্ভিদের কাছ থেকেই প্রাণের শক্তি সংগ্রহ করে থাকে। 

তো যে কথা বলতে চাইছি, তা হচ্ছে, আমাদের প্রাণশক্তি সংগ্রহ করতে হবে প্রতিনিয়ত।  আর প্রাণশক্তি আমরা উদ্ভিদকূলের কাছ থেকে সহজেই পেতে পারি। তাই যোগীর পক্ষে  নিরামিষ খাদ্য শ্রেয় ও সহজপাচ্য। 

যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আরো একটা কথা বলছেন, তা হচ্ছে অতিরিক্ত ঘুমকাতুরে, বা নিদ্রাহীনের  যোগ হয় না। যোগশাস্ত্রে অনেক খাদ্যনীতির কথা বলা আছে - যা আমাদের প্রাচীন মুনিঋষিগন বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে সিদ্ধান্তে এসেছেন। মূল ব্যাপার হচ্ছে, যা আপনার শরীরকে সুস্থ  রাখে, সবল  রাখে, মনকে উদ্বিগ্ন করে না - সেই খাবার আপনার পক্ষে উপযুক্ত। তা সে যোগ করুন আর না করুন। তবে যোগী হতে গেলে, মিতাহারী হওয়া আবশ্যক, আলস্য ত্যাগ করা আবশ্যক । লোকে বলে, শরীরের নাম মহাশয়, যা সহাবে তাই সয়। আমাদের একটা ধারণা হচ্ছে, ঘুমুলে শরীরের বিশ্রাম হয়। কিন্তু বিশ্রাম আর আলস্য এক জিনিস নয়।  অতিরিক্ত ঘুম আলস্যের লক্ষণ। তামসিক গুনের বৃদ্ধিতে ঘুম বেশি বা কম হয়ে থাকে। অতিনিদ্রায়, বা অনিদ্রায় শরীরে ও মনে তমোগুণ বাড়ে। ফলত সাধনক্রিয়ায় ব্যাঘাত হয়। আবার যোগাভ্যাসকারীকে দিবানিদ্রা ত্যাগ করতে হয়। আসলে যোগীকে রাত্রির দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রহর ঘুমুনোর সময়। প্রথম প্রহরে মননের সময়।  আর চতুর্থ প্রহরে ধ্যানাদির সময়। সাধারণ মানুষের ঘুম ৬ থেকে ৮ ঘন্টা যথেষ্ট।  কিন্তু যোগীকে ৪ ঘন্টার মধ্যে ঘুমের প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। 
---------------------------    

২৯.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - ষষ্ঠ অধ্যায়  - ধ্যানযোগঃ
শ্লোক নং - ৬/১৭

যুক্তাহার-বিহারস্য যুক্ত-চেষ্টস্য কর্ম্মসু 
যুক্ত-স্বপ্নাব-বোধস্য যোগ ভবতি দুঃখহা।  (৬/১৭)

যিনি পরিমিত আহার-বিহার পরায়ণ, যিনি পরিমিত চেষ্টাশীল,  যিনি পরিমিতরূপে নিদ্রা ও জগরনে থাকেন, তাঁর যোগ দুঃখ নিবারক। 

শুদ্ধধন পুত্র গৌতম আহার নিদ্রা ত্যাগ করে, প্রতিজ্ঞাবশতঃ নিজের সর্ব্বশক্তি দিয়ে ধ্যানমগ্ন হলেন। শেষে এমন অবস্থা হলো, যে শরীর ছেড়ে যেতে হয় আর কি ! কিন্তু তখনও  লক্ষবস্তুর সন্ধান মেলেনি। শেষে অন্ন ভক্ষনে শরীরের শক্তি ফিরে পেয়ে, আবার তপস্যায় রত হলেন। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হওয়া ভালো, কিন্তু একটা জিনিস জানবেন, প্রকৃতির দান  এই শরীর, প্রাকৃতিকের নিয়মের অধীন। নিয়মের অন্যথা হলে শরীরের নাশ অবশ্যম্ভাবী। আর শরীরের মাধ্যেমেই সমস্ত সাধনা করতে হয়। এই স্থূল শরীরের মধ্যেই পাপ-পুন্য অৰ্জন হতে পারে। আর এই শরীর সাধনার দ্বারাই মানুষ যেমন দেবত্বে উন্নীত হতে পারে, তেমনি পিশাচে পরিণত হতে পারে। কিন্তু সত্য হচ্ছে অশরীরী হয়ে কোনো সাধন করা যায় না। . তাই দেহকে আশ্রয় করেই আমাদের সমস্ত ক্রিয়া করতে হয়।  দেবতাদের কোনো কর্ম্ম নেই।  তাই তাদের পান-পুন্য সঞ্চয় হতে পারে না। আবার ইতর প্রাণীরও কোনো পাপ-পুন্য সঞ্চয় হতে পারে না।তাই বলা হয়ে থাকে,  দুর্লভ এই মনুষ্য  শরীর । হিন্দু শাস্ত্র বলছে, ৮৪ কোটি যোনি ভ্রমনের পরে, এই দুর্লভ মনুষ্য শরীর লাভ হয়েছে।  দেবতারাও এই শরীরের আকাংখ্যা করে থাকেন। তো এই শরীর সম্পর্কে আমাদের যত্নশীল হতে হবে। তার মানে এই নয়, যে শরীর  সর্বস্য হতে হবে। আসলে শরীর একটা ব্রহ্মাস্ত্র। এঁকে ভালো মন্দ দুই কাজেই  লাগাতে পারেন। তবে সর্বাগ্রে দরকার শরীরের যথাযথ রক্ষা। তবেই শরীর সাধন জীবনের ব্রহ্মাস্ত্র হতে পারে।  
বুদ্ধদেব, তার শিষ্যদেরকে বলতেন, "একটা বাদ্যযন্ত্রের তারগুলো যদি অত্যাধিক শিথিল বা শক্ত করে বাঁধা হয়, তবে তাতে আশানুরূপ সুন্দর সুর ঝংকৃত হয় না।  তেমনি সাধকের দেহ-মনকে যদি অত্যাধিক ভোগ-পরায়ণ  বা তপঃক্লিষ্ট করা হয়, তবে তা কখনো যোগসাধনার অনুকূল ও উপযোগী হয় না।"  

যোগ-অভ্যাসের প্রথম দিকে অবশ্য়ই বাঁধাধরা  নিয়মের মধ্যে নিজেকে বেঁধে রাখতে হয়। নিয়ম করে, যোগের অভ্যাস করতে হয়।  আমার একসময় এক বৈষ্ণৱ আখড়ায় যাতায়াত ছিলো।  কি অদ্ভুত এদের স্ব-শাসন পদ্ধতি। ভোর বেলা উঠে বিছানাতেই ঠাকুরের নাম জপ করতে বসে যান। তারপরে শৌচক্রিয়াদি স্নান শেষে,  ঠাকুরঘর পরিষ্কার। ঠাকুরের পূজার আয়োজন। পুজো শেষে কীর্তনাদি।  এরপর নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট বৈষ্ণবের মাধুকরী। একদল আখড়াতেই নানান বৈষয়িক কাজ করেন। মাধুকরী থেকে ফিরে এলে, ভোগ রান্নার কাজ শুরু  হতো।  তাঁরা কখনো মনে করতেন না, নিজেরদের খাবার প্রস্তুত হচ্ছে।  সব সময় ঠাকুরের ভোগের নিমিত্ত রান্না হতো। সেখানে থেকে ঠাকুরের সামনে ভোগ নিবেদন করতেন। এবার প্রসাদ ভক্ষণ। তারপর  বিশ্রাম।  বিকেলে, শাস্ত্রপাঠ বা শ্রবণ।  কীর্তনের  আসর। আবার ঠাকুরের ভোগ নিবেদন, ঠাকুরকেকে শুইয়ে  দিয়ে তবে নিজের বিশ্রাম।  আপাতত মনে হতে পারে, একটা গতানুগতিক জীবন। কিন্তু দেখেছি, প্রতিমুহূর্তে এঁদের মধ্যে মানসিক তৃপ্তি ও উন্নতি। যা তাদের চোখ-মুখ দেখলেই বোঝা যেত।  কখনো কোনো সমস্যায় বিব্রত হতে দেখিনি। সমস্যা সমাধানের জন্য, প্রয়াস ছিল, কিন্তু সমস্যা কখনো এর গায়ে মাখতেন না। সবসময় একটা ঈশ্বর নির্ভরতা এদেরকে রক্ষা করতো। এদের মুখ থেকে কখনো হাসি মিলিয়ে যেত না।  এমনকি, কারুর মৃত্যু এদের মনকে বিষণ্ণ  করতে পারতো না। মৃত্যু মানে, যেন ঈশ্বরের সাথে মিলন।  মৃত্যু মানে ঈশ্বরের চরণপ্রাপ্তি। এক অদ্ভুত জীবন পদ্ধতি। 

যোগ অভ্যাস করতে চাইলেও, নিজের সংযমের বেড়াজাল দিয়ে ঘিরে রাখতে হবে। ঠিক সময় শয়ন, ঠিক সময়ে জাগরণ, ঠিক সময়ে ভোজন, ঠিক সময়ে ভজন। ঠিক সময়ে যোগক্রিয়া-ধ্যানাদি ক্রিয়া। এইযে রুটিন, একে নিজেই তৈরী করতে হবে, নিজেই পালন করতে হবে। যম , নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান, ও  সমাধি এই আটটি স্তম্ভ দিয়ে ঘর বানাতে হবে। আর এই অভ্যাসের ফলে তৈরী হবে যোগের দৃঢ় ভূমি। প্রাণায়ামের দ্বারা চিত্তের বহির্বৃত্তি ধীরে ধীরে অন্তর্মুখীন হবে। চিত্ত শুদ্ধ হবে। আর শুদ্ধ-চিত্তে বুদ্ধি তীক্ষ্ণ হবে। সাধনার মধ্যে শৃঙ্খলা না এলে, শরীরের মধ্যেও বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। নিয়ম করে  যোগের অভ্যাসে শরীর নীরোগ হবে, যোগীর মধ্যে এমন জ্ঞানের বা অনুভবের ক্ষমতা জন্মাবে,  যে সত্য-অসত্য, ভালো-মন্দ, ইত্যাদি বিচারের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অন্তঃকরণে কোনো অশুভ সংস্কারের জন্ম হতে পারে না। বরং অশুভ সংস্কার যদি ভিতরে থাকে তা ধীরে ধীরে চাপা পরে যায়।  এমনকি দীর্ঘ যোগ-অভ্যাসে কুসংস্কারের বিনাশ ঘটে। ব্যবহারিক জগতেও পরিবর্তন লক্ষিত হয়। সামাজিক যে সম্পর্ক তার মধ্যে একটা ঢিলে ঢালা ভাবের জন্ম হতে শুরু করে। ঈশ্বরের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হতে শুরু করে। তো সুশৃঙ্খল জীবনেই যোগ সম্ভব, যোগের উন্নতি সম্ভব। উশৃঙ্খল মানুষ যোগের অযোগ্য। যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, পরিমিত আহার-বিহার, পরিমিত চেষ্টা, পরিমিত নিদ্রা, পরিমিত জাগরণ - ইত্যাদি যোগীর নিত্যধর্ম্ম। আর এইরুপ  যোগী দুঃখরহিত  হন। 

-----------------------          

৩০.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - ষষ্ঠ অধ্যায়  - ধ্যানযোগঃ
শ্লোক নং - ৬/১৮

যদা বিনিয়তং চিত্তমাত্মন্যেবাবতিষ্ঠতে 
নিঃস্পৃহ সর্ব্বকামভ্যো যুক্ত ইত্যুচ্যতে তদা। (৬/১৮)

যখন বিশেষভাবে সংযত চিত্ত আত্মাতেই স্থিতি লাভ করে, তখন যোগী কামনাশূন্য হন। এরূপ যোগীপুরুষ যোগসিদ্ধ বলে কথিত হন।

যখন চিত্ত বিশেষভাবে নিরুদ্ধ হয়, এবং আত্মাতে স্থিত হয়, তখন যোগী কামনাশূন্য হন। সাধন জগতের প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে কামনা শূন্য হতে হবে। এখন কথা হচ্ছে, আমরা সবাই যদি কামনাশূন্য হতে পারতাম, যদি সংকল্প রোহিত হতে পারতাম, তবে আমাদের এই স্থুলদেহ ধারনের দরকারই হতো না। তো কামনা-সংকল্প পূরণের জন্যই এই দেহে আমরা অবস্থান করছি। যখন আমাদের কামনা পূরণ হয়ে যাবে, বা কামনা পূরণের জন্য, যেদিন আমাদের এই দেহ অকেজো হয়ে যাবে, তখন আমরা আবার এই দেহ ছেড়ে নতুন  দেহের সন্ধানে বেরিয়ে পড়বো। এই যে অনন্ত যাত্রা, এই যে অস্থিরতা,  এর কারণেই জগৎ সৃষ্টি-ধংশ চলছে। আমরাও ঘুরে ঘুরে মরছি।  যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, এই অস্থিরতা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের স্থির হতে হবে। এই অস্থিরতা কাটাতে গেলে আমাদের সংযত চিত্ত হতে হবে। সংযত চিত্ত অর্থাৎ পঞ্চভূত থেকে যে ভোগ্য পদার্থ আমাদেরকে আকর্ষণ করছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে  হবে। তো একদিক থেকে বেরিয়ে আসতে  গেলে, নিশ্চই অন্য দিকে যেতে হবে।  আমাদের গতিমুখ পরিবর্তন করতে হবে। এবার তাহলে গন্তব্য কোথায় হবে ? প্রথমে তো ভোগ্য পদার্থ আমাদের লক্ষ ছিলো। শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ আমাদেরকে টানছিলো।  এবার গতিমুখ  কোথায় হবে।  যোগেশ্বর বলছেন, আত্মাতে স্থিত হতে হবে। আত্মাতে অর্থাৎ নিজের মধ্যে নিজেকে টেনে নিয়ে আসতে  হবে। এইযে নিজের মধ্যে নিজেকে টেনে বসানো একেই বলে স্থিত হওয়া। সংযমী হওয়া, অর্থাৎ নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে আনা। এখানে একটা কথা খেয়াল করুন, সংযত চিত্ত বা সংযমী অর্থাৎ আমাকে সংযমী হতে হবে, ত্যাগী নয়। কেননা আমারা  যে পঞ্চভূতের স্থুল দেহে বাস করছি, তার রক্ষার জন্য, এই পঞ্চভূতের সংস্পর্শে থাকা জরুরি। কিন্তু বিষয়বিমুখ হয়ে অবস্থান করতে হবে।

বিষয় ভাবনা হলেই, চিত্ত সেই বিষয়ের আকার ধারণ করে। চিত্তের বৃত্তিরূপের এটাই পরিনাম। যেমন আমরা দেহের কথা চিন্তা করতে করতে নিজেকে দেহ ভাবি। জ্ঞানের কথা চিন্তা করতে করতে আমরা নিজেকে জ্ঞানী ভাবি।  ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনি হাজার হাজার হাজার  বৃত্তি আমাদের চিত্ত সাগরে প্রতিনিয়ত ঢেউ-এর মতো উঠছে। এখন সংযত চিত্ত   দ্বারা আমরা যখন এই বহু বিষয় থেকে একটিমাত্র বিষয়ের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করতে পারি, তখন চিত্তে একমাত্র সেই ধ্যেয় বৃত্তিই উঠতে থাকে। এই অবস্থাকে যোগীপুরুষগন বলছেন, সম্প্রজ্ঞাত সমাধি।  আবার যখন সেই একটা বৃত্তিও থাকে না, এবং দীর্ঘকাল কোনো বৃত্তির উদয় হয় না, তখন যে অবস্থা হয়, তাকে বলে অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি। যোগের চরম প্রাপ্তি। তো এই যে অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি এটি বৈরাগ্যের চরম অবস্থায় আসতে পারে। একেই যোগেশ্বর ভগবান বলছেন, "নিঃস্পৃহ সর্ব্বকামেভ্য" .

এখন কথা হচ্ছে, এখানে অর্থাৎ এই অসম্প্রজ্ঞাত অবস্থায় আসবার জন্য, প্রাণায়াম বা যোগসাধনার স্থান কোথায় ? মনের মধ্যে থেকে সমস্ত বৃত্তির নাশ করলেই হলো। সর্ব্বাবস্থায় ভগবৎ চিন্তন করতে করতে একসময় নিশ্চই এই অবস্থা লাভ হতে পারে। কথা সত্য, কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে। আসলে যতক্ষন আমাদের সম্পূর্ণরূপে বৈরাগ্যের অবস্থা না আসবে, মন যতক্ষন আসক্তিশূন্য না হবে, ততক্ষন আত্মচিন্তন আসতে  পারে না। আমরা জানি চিত্তের চঞ্চলতাই চিত্তের অশুদ্ধি বা মলিনতা। বাসনা থাকলে, চিত্তশুদ্ধি জন্মায় না। প্রাণের স্পন্দন দ্বারাই মনের মধ্যে বাসনারূপ তরঙ্গের উদ্ভব হয়। প্রাণ স্থির না হলে, ভগবৎ উপাসনা হতে পারে না। সুতরাং প্রাণকে স্থির করতে গেলে প্রাণের সাধনা অর্থাৎ প্রাণায়াম করতে হবে। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন,  যোগের অনুষ্ঠান দ্বারাই চিত্তের অশুদ্ধির নাশ হতে পারে। চিত্তের বিক্ষেপরূপ অশুদ্ধি ক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানের অভিব্যক্তি হতে থাকে। একমাত্র প্রাণক্রিয়ার দ্বারাই  আত্মার প্রকাশ ঘটে। আত্মার অস্তিত্ত্ব সম্পর্কে  আমাদের অজ্ঞান, তা দূরীভূত হয়ে যায়। এমনকি আত্মার ধারণা হতে শুরু করে। আসলে আধ্যাত্মিক জগতে চিত্তের স্থাপন এবং আত্মার সঙ্গে বন্ধন, একমাত্র  প্রাণায়াম আমাদের অজ্ঞাতসারেই করে দিতে পারে। আমরা যেমন প্রাণায়াম করতে করতে আধ্যাত্মিক জগতের কথা ভাবি, তেমনি প্রাণায়াম আমাদের সেই আধ্যাত্মিক জগতে  স্থাপন করে দেয়। প্রাণায়াম করলে যেমন আমাদের প্রাণ স্থির হয়, মন স্থির হয়, তেমনি আমাদের বুদ্ধি তীক্ষ্ণ হয়।  ফলে আমাদের বিচারশক্তি বৃদ্ধি পায়। সাধনা করতে করতে বুদ্ধি অন্তর্মুখী হয়ে একবার ডুবে যায়, আবার বুত্থান হয়। যতদিন এই বুত্থান চলতে থাকে, ততদিন বুদ্ধির শুদ্ধি হয়নি বুঝতে হবে। একসময় বুদ্ধি সম্পূর্ণরূপে শুদ্ধ হলে আত্মপ্রত্যয় নদীর স্রোতের মতো বইতে থাকে। এইযে বুদ্ধির অখন্ড ধারা জানবেন, এটি যোগের প্রাপ্তি। একসময় বুদ্ধি বুত্থানরহিত হয়ে আত্মাতে লয় হয়ে যায়। যোগের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়।  

--------------------------------------             
৩১.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - ষষ্ঠ অধ্যায়  - ধ্যানযোগঃ
শ্লোক নং - ৬/১৯-২১
        
যথা দীপো নিবাতস্থো ন ইঙ্গতে স উপমা স্মৃতা 
যোগিনো যতচিত্তস্য ষুঞ্জতো যোগমাত্মনঃ। (৬/১৯)

বায়ুশূন্য স্থানে যেমন দীপশিখা চঞ্চল হয় না, আত্মবিষয়ে  যোগ অভ্যাসকারী তেমনি সংযতমনা যোগীর উপমা বলে জানিও। 

এখানে যোগেশ্বর যোগীদের সাধনার উচ্চ অবস্থার কথা উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছেন।  বলছেন, বায়ুহীন অবস্থায় দীপশিখা যেমন নিশ্চল থাকে, প্রদীপ শিখা যেমন সবসময় উর্দ্ধমুখী হয়ে আকাশকে স্পর্শ করে, একসময় এই প্রদীপের এই শিখাটি দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়, ঠিক তেমনি অবস্থা হয়, যোগীর। যোগক্রিয়ার দ্বারা যোগীর চিত্ত সংযম হতে হতে সমস্ত বৃত্তিগুলো একমুখী হয়ে একসময় একাকার হয়ে যায়। তখন  চিত্তের স্পন্দন সূক্ষ্ম  সূক্ষ্মতর, সূক্ষ্মতম হতে হতে একসময় অসীম চিদাকাশের বিলীন হয়ে যায়।  দীপশিখা যেমন বায়ুশূন্য স্থানে নিশ্চল থাকে,  চিত্ত বৃত্তিহীন হলে,  তেমনি বায়ুশূন্য স্থানের প্রদীপশিখার মতো   স্থির হয়ে যায়। আর চিত্ত যখন স্পন্দনহীন হয় তখন চিত্তের আর কোনো বৃত্তি অবশিষ্ট থাকে না ।   জল স্থির হলে  ঢেউ থাকে না, তেমনি চিত্ত স্থির হলে চিত্তে বৃত্তির প্রকাশ থাকে না। চিত্ত আত্মসত্তার সাথে একীভূত হয়ে যায়। চিত্তের চঞ্চলতা থেকে আমরা পাই, তা আসলে ভ্রমজ্ঞান। এই ভ্রমজ্ঞানের এই জ্ঞেয় বস্তুও কল্পিত। তাই চিত্তের অস্থির অবস্থায় যে সুখ বা দুঃখের অনুভব হয়, তাও আসলে ভ্রম বৈ  কিছু নয়। চিত্ত যখন স্পন্দনরহিত অবস্থায় স্থির হলো, তখন যে জ্ঞানের বিকাশ ঘটে, তাই যথার্থ জ্ঞান। এই জ্ঞানের আলোতে যা কিছু দর্শন হয়, তাকেই ব্রহ্মদর্শন বলা হয়ে থাকে। জ্ঞানের স্বচ্ছতার কারনে, চিত্তে বিষয়ের কোনো প্রভাব থাকে না। তাই বিষয়ের প্রতি কোনো মোহ  বা আকর্ষণ থাকে না। তো প্রাণের চঞ্চলতা থেকে চিত্তের চঞ্চলতা, প্রাণের স্পন্দনরহিত অবস্থা থেকে চিত্তের বিষয় তৃষ্ণা রোহিত অবস্থায় যোগী সমাধিবান হন।    

যত্র-উপরমতে চিত্তং নিরুদ্ধং যোগ সেবয়া
যত্র চ এব আত্মনা-আত্মনাং পশ্যন-আত্মনি তুষ্যতি।  (৬/২০)

যে অবস্থায় যোগ-অভ্যাসের দ্বারা নিরুদ্ধ চিত্ত উপরত হয়, এবং যে অবস্থায় শুদ্ধকরন দ্বারা আত্মাকে দেখে আত্মাতেই তুষ্টি লাভ করে।

প্রাণায়াম ক্রিয়ার দ্বারা প্রাণবায়ু স্থির হলে প্রাণের চঞ্চলতা দূর হয়ে যায়। আর প্রাণের চঞ্চলতা বা স্পন্দন  থেকেই মনের উৎপত্তি। তাই যার প্রাণবায়ু স্থির হয়ে  গেছে, তার মন বলে কিছু থাকে না। প্রথমে যে মন সর্বদা বিষয়ের দিকে ছুটতো, সেই মন না থাকায় কে আর বিষয়ের দিকে ছুটবে ? মনের চঞ্চলতা হেতু যে ভ্রমজ্ঞানের উদয় হয়েছিল, যখন মন স্থির হয়ে আত্মার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে, সে তখন দেহকে ভুলে গেছে। তখন দ্রষ্টা-দৃশ্য, ধ্যাতা ও ধ্যেয় এই দুইটি বিষয়মাত্র বোধের বিষয়। এতক্ষন যে শত  সহস্র খন্ড খন্ড জ্ঞান যা চঞ্চল মনের বিষয় ছিল, সেই খণ্ড জ্ঞানের বিষয়  তখন মনে  আসে না। এর পরে একসময় , ধ্যাতা আর ধ্যেয় বস্তুর মধ্যে পার্থক্য লক্ষিত হয় না। অর্থাৎ এইসময় ধ্যাতা, ধ্যেয়র মধ্যে মিশে একাকার হয়ে যায়। খন্ড চৈতন্য অখন্ড চৈতন্যের  মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তখন কেবল একের  জ্ঞান অবশিষ্ট থাকে। খন্ড আকাশ আর মহাকাশের মধ্যে কোনো ভেদরেখা থাকে না। হৃদয়-আকাশ  মহাকাশের মধ্যে বিলীন হয়ে  যায়। এই সময় চিত্তের যে বৃত্তিস্বরূপের দেখা মেলে, একেই বলে যোগ। অর্থাৎ সাধনক্রিয়ার উচ্চতর অবস্থা। এই অবস্থায় চিত্তের মধ্যে এতদিন যে অনবরত স্পন্দন দেখা দিছিলো, সেই স্পন্দন  আত্মসত্তার মধ্যে ডুবে এক নিশ্চল অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই নিশ্চল অবস্থা দীর্ঘকাল স্থায়ী হলে, যোগী আত্মারাম হয়ে যান। 
সাধন ক্রিয়ার দ্বারা প্রাণের স্থিরতা  যত দীর্ঘস্থায়ী হতে থাকে, যোগী মধ্যে এই নিশ্চল অবস্থা ধীরে ধীরে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায়। যোগের এটাই উচ্চ অবস্থা। এইসময় বিভিন্ন দৃশ্যের অবতারণা হয়ে থাকে, যা আসলে নিজেকেই নিজে দেখা। যোগী তখন জ্যোতিকেই তার স্বরূপ হিসেবে দেখেন। কে দেখছে, কাকে দেখছে, এই বিচার বা বিতর্ক তখন অন্তর্হিত হয়ে যায়। একেই সম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলা হয়ে থাকে। এই অবস্থায় আত্মার মধ্যেই আত্মা প্রতিষ্ঠিত হয়, ও নিরবিচ্ছিন্ন আনন্দপ্রবাহে অভিভূত হয়ে যান যোগী।            

সুখম-আত্যন্তিকং যৎ-তৎ-বুদ্ধি গ্রাহ্যম-অতীন্দ্রিয়ম। 
বেত্তি যত্র ন চৈবায়ং স্থিতঃ-চলতি তত্ত্বতঃ। (৬/২১)  

যে অবস্থায় এই যোগী বিশুদ্ধ বুদ্ধিগ্রাহ্য় ইন্দ্রিয়ের অগোচর নিরতিশয় যে সুখ তা অনুভব করেন, এবং যে অবস্থায় স্থিত হলে আত্মস্বরূপ হতে বিচলিত হন না। 

যে আনন্দ বুদ্ধির অগোচর, যে আনন্দ ইন্দ্রিয়ের গ্রাহ্য নয়, এমন একটা আনন্দ ক্রিয়ার পরাবস্থাতে প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই আনন্দ বাক্যের অতীত।  আমাদের যে আনন্দ অনুভব হয়, তা আমাদের বুদ্ধির অগোচর নয়, ইন্দ্রিয়দ্বারাই এই আনন্দের  অনুভব হয়ে থাকে। তবে একটা কথা আমাদের বুঝতে হবে, প্রাণের প্রবাহের কারণেই আমাদের ইন্দ্রিয়শক্তি জাগ্রত হয়। তো প্রাণ যখন স্থির হয়ে যায়, অর্থাৎ প্রাণের প্রবাহ থেমে   গেলে, আমাদের ইন্দ্রিয়ের সমস্ত শক্তি লোপ পেয়ে যায়।  তো যোগের উচ্চ অবস্থাতে প্রাণ স্থির হওয়ার ফলে, ইন্দ্রিয়ের শক্তি স্তব্ধ হয়ে যায়। ইন্দ্রিয়সকল তখন সুপ্ত হয়ে থাকে। ফলে, সাধকের বাহ্য  অনুভব তখন কিছুই থাকে না।  এই অবস্থাতে ইন্দ্রিয়লব্ধ কোনো জ্ঞান বা অনুভব থাকে না। কিন্তু অন্তরে নিরন্তর একটা সমাধিসুখ প্রবাহিত হতে থাকে। কিন্তু এই আনন্দ কিসের দ্বারা অনুভব হয়। আসলে প্রাণের প্রবাহ স্থির হলে, তখন বুদ্ধি সূক্ষ্ম হয়, এমনকি ইন্দ্রিয়শক্তি তখন এই প্রাণের সঙ্গেই একাকার হয়ে যায়। এই অবস্থা প্রথম দিকে স্বল্পক্ষণের জন্য দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়। কিন্তু ক্রিয়ার নিরন্তর অভ্যাসের ফলে, এই বিরল অবস্থা দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়।  এমনকি সমাধি থেকে বুত্থিত হবার পরেও এই অবস্থা চলতে থাকে। কিন্তু প্রাণ যদি স্থির হয়ে যায়, অর্থাৎ যদি আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি যদি রুদ্ধ হয়ে  যায়, তাহলে কি মানুষ অর্থাৎ এই স্থূল দেহ জীবিত থাকে পারে ? আসলে বায়ু রুদ্ধ হয়ে গেলেও, মূলাধার থেকে বিশুদ্ধ বায়ু সহস্রার পর্যন্ত মৃদু ভাবে সঞ্চরণশীল থাকে। আমাদের সমস্ত চক্রে চক্রে এই বায়ুর প্রবাহ চলতে থাকে। এইসময় বুদ্ধি কিন্তু লয় হয় না। যদিও  বুদ্ধি এইসময় সূক্ষ্ম ও তীক্ষ্ণ আকার ধারণ করে।  আর এই কারণেই এই বুদ্ধির সাহায্যেই এই সুখের স্পর্শ লাগে। কিন্তু এই বুদ্ধি অপ্রকাশ্য। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়দ্বার রুদ্ধ থাকার জন্য বুদ্ধি এই অবস্থাকে প্রকাশ করতে পারে না। যখন এই অবস্থা ছুটে  যায়, তখন একটা স্মৃতি তার মধ্যে জাগরিত থাকে।  তাই যোগীরাজ বলছেন, এই অনুভব যে কি তা ভাষায় বলা যায় না।  শুধু পরমানন্দ, এই সুখের অন্ত  নেই। এই সুখস্পর্শ ক্ষনিকের জন্য হলেও, স্মৃতিতে বহুদিন পর্যন্ত থেকে যায়। জগতের সমস্ত পদার্থ এই অনন্দ-রেণু  দিয়ে পূর্ন। এঁকে  যোগশাস্ত্র বলছেন সম্প্রজ্ঞাত সমাধি।

ওম নমঃ শ্রী ভগবতে বাসুদেবায়ঃ। 
 -----------------------------------        
০১.০৪.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - ষষ্ঠ অধ্যায়  - ধ্যানযোগঃ
শ্লোক নং - ৬/২২-২৩

যং লব্ধা চ-অপরং লাভং মন্যতে  নাধিকং ততঃ
যস্মিন স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে।  (৬/২২) 

যে অবস্থা লাভ করলে, অন্য কোনো লাভ, এর থেকে বেশি লাভ বলে মনে হয় না এবং যে অবস্থায় স্থিত হলে গুরুতর দুঃখ বিচলিত করতে পারে না।  (তাকেই যোগযুক্ত অবস্থা হয়) 

যাঁকে কোনোকিছুর বিনিময়ে ছাড়তে ইচ্ছে করে না, তা হচ্ছে যোগ। যোগের সাহায্যে চঞ্চল মন যখন স্থির হয়, তখন যে প্রাপ্তির পরাকাষ্ঠা দেখা যায়,  অন্য কোনো প্রাপ্তির সঙ্গে তার  তুলনা হয় না।  যার জন্য এই অবস্থাপ্রাপ্ত যোগীপুরুষকে বলা হয় আপ্তকাম। এইসময় সমস্ত ভ্রান্তি দূর হয়ে যায়। কে এই স্থুল দেহে অবস্থান করছেন, অর্থাৎ আমার স্বরূপ কি, তার সম্পর্কে অভ্রান্ত জ্ঞান হয়। যোগীর যদি এই অবস্থা নিরন্তর চলতে থাকে, অর্থাৎ অষ্টপ্রহরকাল চলতে থাকে, তবে  তাঁর মধ্যে দুঃখ-ক্লেশ  ইত্যাদি অনুভূতির লোপ পায়। ব্যবহারিক সমস্ত কর্ম্ম করবার ক্ষমতা থাকলেও, কামনা বাসনা, সংকল্প, আশা, নিরাশা ইত্যাদি কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। আমরা জানি অন্তঃকরণ বৃত্তির বিষয় সস্পর্শ হলে সুখ-দুঃখের অনুভব হয়। কিন্তু এই অবস্থায়, যোগী পুরুষের অনুভব শক্তির এমন একটা মাত্রা লক্ষিত হয়, যা সাধারনের অনুভূতি মাত্রা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। শিশুর বিষ্ঠায় ঘৃণা নেই, মুদ্রায় আকর্ষণ নেই। সাধক এই সময় চিত্তের বৃত্তিগুলোকে নিরুদ্ধ করে বুদ্ধি সহযোগে আত্মায় এমনভাবে আটকে গেছেন, যে সেখানে থেকে তিনি আর বিচ্ছিন্ন হন না। চিত্ত তখন একাগ্রভূমি ছেড়ে নিরোধভূমিতে পৌঁছে গেছে। এঁকে সাধনার সুখময় অবস্থা বলা হয় ।  যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যোগের এই অপূর্ব মহিমা দেখে ক্রিয়াকেই সর্বস্য করবার উপদেশ প্রদান করছেন। এঁকেই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলা হয়ে থাকে, যা একমাত্র যোগের চরম সীমায় যাঁরা পৌচচ্ছেন, তাঁরাই অনুভবের যোগ্য। তাই বার বার মনে হয়, এই সব যোগের গুহ্য কথা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন স্বয়ং ভগবান ছাড়া কার মুখ থেকেই বা আমাদের শোনাতে  পারতেন ?

তং বিদ্যাৎ-দুঃখ-সংযোগ-বিয়োগং যোগসংজ্ঞিতম
স নিশ্চেয়ন যোক্তব্যো যোগো-অনির্ব্বণ্ণচেতসা। (৬/২৩) 

এইভাবে যোগের স্থিতিতে  দুঃখ-সংযোগের বিয়োগ হয়। এই দুঃখবিয়োগই যোগ। এই যোগ নির্ব্বেদশূন্য চিত্তে বা হতাশাশূন্য হয়ে নিরন্তর অভ্যাস করা কর্তব্য।

যোগীর পক্ষে যোগসাধনা একদিকে যেমন নিরন্তর নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে করা উচিত, তেমনি, লেগে থাকার মতো দৃঢ় মানসিকতা থাকা চাই । মানুষ জগতের বিষয় সমূহের সংস্পর্শে এসে আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। আর সত্য হচ্ছে বিষয়ের আনন্দের পিছনে লুকিয়ে থাকে দুঃখ। এই স্থুল সাময়িক আনন্দের সমাপ্তিতে দুঃখ এসে দেখা দেয়। তাই এমন কোনো মানুষ খুঁজে পাবেন না, তা সে জ্ঞানী হন বা অজ্ঞানী, রাজা বা ভিখারি, ভালো বা মন্দ যার জীবনে দুঃখের ছোঁয়া লাগেনি। 

একটা জিনিস জানবেন, এই শরীর  একদিন থাকবে না। জীবকুল প্রীতি মুহূর্তে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। এই ধ্রুব সত্য আপনাকে স্বীকার না করে উপায় নেই। আর এই স্বল্প পরিসর জীবনে, বিষয় ,লাভের জন্য, জাগতিক জ্ঞান লাভের  জন্য, একটু সন্মান লাভের  জন্য,  আমরা সারা জীবন নিজেদের মধ্যে মারামারি-খুনোখুনি করে জীবনকে নিঃশেষ করছি। আমাদের এই বিষয়-অভিমুখী প্রয়াস, পরিশ্রম, একে  যদি আমরা একটু ঘুরিয়ে ভগবত মুখী করতে পারতাম, এমনকি নিজেকে জানবার জন্য ব্যয় করতে পারতাম, তবে শুধু ইহকালে নয়, মৃত্যুর পরেও আমরা অনেক শান্তিতে থাকতে পারতাম। আপনি হয়তো বলবেন, মৃত্যুর পরে, কি হবে আমরা জানি না। তো বলবো, যা জানেন না তাকে জানবার চেষ্টা করে দেখুন।  তখন বুঝতে পারবেন, এই স্থুল  শরীরে নাশের  পরেও একটা অনন্ত জীবনের অস্তিত্ত্ব আছে । সেখানে আপনার পূর্ব্ব-পূর্ব্ব পুরুষগন আছেন।  আমরা ঘুমিয়ে থাকলে বাহ্য  জগৎ আমার কাছ থেকে হারিয়ে যায় না। আমি যখন এই জগৎ ছেড়ে স্বপ্নের জগতে বিচরণ  করি,  অর্থাৎ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি, তখনও  কিন্তু এই জগৎ জগতের মতোই সত্য থাকে। আবার যখন আমরা উঠি তখন বাস্তবের সম্মুখীন হই।  তেমনি, জানবেন, এই যে আপনি জেগে আছেন, বলে ভাবছেন, এটি স্বপ্ন বই কিছু নয়। একদিন অর্থাৎ ৮০ বা ১০০ বছর পরে, আপনার এই স্বপ্ন ভেঙে যাবে।  আর সেই দীর্ঘ অনন্তজীবন পথের যাত্রী হতে হবে আপনাকে। এই সত্য আপনি উপলব্ধি করতে পারেন বা না পারেন, এই সত্যের সামনে একদিন আপনাকে দাঁড়াতেই হবে। ইন্ধনের কারনে, কাঠে কাঠে ঘর্ষণের কারনে যেমন অগ্নি রূপ ধারণ করে, আবার ইন্ধন শেষ হয়ে গেলে, অগ্নি রূপহীন হয়ে যায়।  কিন্তু অগ্নি কখনো নিঃশেষিত হয় না।  তেমনি আপনার এই স্থূল দেহ, পঞ্চভূতের মৈথুনের কারনে তৈরী হয়েছে।  আবার একসময় এই  রূপ ছেড়ে অরূপের পথে যেতে হবে।  আপনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন। এই সত্য যেদিন আপনি যোগক্রিয়ার মাধ্যমে উপল্বদ্ধিতে আনতে পারবেন, সেদিন, আপনি বুঝবেন, আপনি এক আনন্দময় সত্তা। আপনার উপাধি আপনার  স্বরূপকে ঢেকে রেখেছে মাত্র। মেঘ কেটে গেলে যেমন সূর্যের প্রকাশ ঘটে, তেমনি আপনার উপাধির নিঃসরণে আপনার স্বরূপের প্রকাশ ঘটবে। মিথ্যে এই বিষয়ানন্দ - যা আসলে আমাদের সমস্ত দুঃখের কারন। 

এইজন্য যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের অধ্যাবসায়ের সাথে সাধন করবার উপদেশ দিচ্ছেন। প্রথম দিকে এই সাধনা আমাদের কাছে নিরস বলে মনে হলেও, আমাদের মধ্যে প্রাপ্ত ফলের আকাঙ্খার কারনে  নিরাশার সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু জানবেন, সাধনায় কোনো আশা রাখতে নেই।  আর যার আশাই নেই তার মধ্যে নিরাশার জন্ম হতে পারে না। প্রানপনে সাধনা করলে, আমাদের চেষ্টা কখনো ব্যর্থ হতে পারে না। একদিন না একদিন অযাচিত ভাবে ভগবৎ কৃপা আমাদের সাধনার ফল এনে দেবে। এই সত্যে দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন। আর যোগেশ্বর ভগবানের মধ্যে যদি কৃপা করবার প্রবৃত্তি না থাকতো, তবে এই গুহ্যবিদ্যা যোগবিদ্যা যা তিনি একসময় সূর্যদেবকে দান  করেছিলেন, তা তিনি পুনরায় সখা  অর্জ্জুনের মাধ্যমে  আমাদেরকে দেবার প্রয়াস করতেন না। তো সৎগুরুদেবের প্রতি বিশ্বাস রাখুন।  অন্তত যোগেশ্বর ভগবানের কথায় দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন। তার কথা অনুযায়ী যোগক্রিয়ায় নিযুক্ত হন। গুরুবাক্যে যার বিশ্বাস আছে, সাধনায় যার দৃঢ়তা আছে, তার যোগের ফল মিলতে বিলম্ব হয় না। সাধনার কিছুদিনের মধ্যেই আপনার ভিতর থেকে কেউ একজন আপনাকে সাহায্য করছে, এই উপলব্ধি এসে যাবে। শুধু শ্রীগুরুর নির্দেশ পালন করুন।  শ্রী গুরুর নির্দেশে কোনো সন্দেহ করবেন না। এই মুহূর্তে গুরুর আদেশ যদি আপনার কাছে বোধগম্য নাও হয়, তথাপি কেবলমাত্র বিশ্বাসের  উপরে ভর করে, শুধু তাঁর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করুন। সাধনায় ফাঁকি মানে নিজেকে ফাঁকি দেওয়া। নিজেকে ঠকাবেন  না। ------------- চলবে। ..... 

০২.০৪.২০২২        
তং বিদ্যাৎ-দুঃখ-সংযোগ-বিয়োগং যোগসংজ্ঞিতম
স নিশ্চেয়ন যোক্তব্যো যোগো-অনির্ব্বণ্ণচেতসা। (৬/২৩) 

পূর্ব-প্রকাশের পর (১) : 

যোগ  গুরুবাক্যে নিঃসন্দেহে হয়ে গুরুবাক্য অনুসারে চলতে হবে। নিরন্তর মাসের পর মাস বছরের   পর বছর  পরিশ্রম  করে যেতে হবে। এই  পেলেন, কি বুঝলেন, সেদিকে, খেয়াল না করে, শুধু গুরুর বাক্যে বিশ্বাস রাখুন, যে একদিন না একদিন এর ফল মিলবে, এই নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি নিয়ে যোগক্রিয়ায়  লেগে থাকুন। আপনি যদি কিছু না বোঝেন, তাহলে জানবেন  এখনও বোঝার যোগ্যতা আসে নি। অভীষ্ট ফল লাভের  জন্য যোগ্যতা অৰ্জন করছেন আপনি। তখন নিজেকে আরো সচেষ্ট করতে হবে। আরো আরো অভিনিবেশ দরকার, আরো অধ্যাবসায় দরকার। মন যতক্ষন বৈরাগ্যবান না হবে, মন যতক্ষন বিবেকের কথায় না  চলবে,ততদিন পুনঃ পুনঃ মনকে বিষয় থেকে ছিনিয়ে এনে আত্মাতে স্থাপন করতে হবে। এই ক্রিয়া নিরন্তর করতে হবে।  বারবার এই ক্রিয়ার ফলে এটি অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে।  তবে অবশ্য়ই এই ক্রিয়া করতে হবে সচেতন ভাবে। উদাসীনতার  স্থান নেই এখানে। প্রাণের অন্তরতম প্রদেশে যে স্থিরভাব আছে, তাকে উপলব্ধি করতে হবে। সমুদ্রের ঢেউ কেবল সমুদ্রের উপরেই থাকে, সমুদ্রের গভীরে যখন প্রবেশ করবেন, তখন দেখবেন , সমুদ্র  কতো শান্ত। তো প্রাণের ধারার মধ্যে দুটো ভাবের প্রবাহ চলছে, একটা তার পরম স্থির ভাব, আরেকটা অস্থির ভাব। প্রানকেই বলা হয়, ব্রহ্ম-এর প্রকৃতি। প্রাণের চঞ্চল ভাব যখন স্থিরতার মধ্যে প্রবেশ করে, তখন সেই স্থির অচঞ্চল ভাবকেই বলা হয় আত্মা। এঁকেই, এই জ্ঞানকেই বলা হয় পরমবিদ্যা।  এই বিদ্যা, অবিদ্যারূপ সচঞ্চল মায়া দ্বারা ঢাকা।  একে উন্মুক্ত করতে হবে। চিরস্থির সেই পরমাত্মা থেকে মহামোহময়ী অবিদ্যা ক্ষেত্রে স্থিত আত্মাকে  (জীবাত্মাকে) বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ক্ষেত্রজ্ঞ জীব এই শরীর  ও ইন্দ্রিয়ের সাথে মিলে-মিশে নিজেকে বিস্মৃত হয়েছে। এবং নিজেকে এই দেহ ভাবছে। আর এরফলে জীব দুঃখ-কষ্টরূপ ভবযন্ত্রনা ভোগ করছে। আবার জীব যখন এই ভবযন্ত্রনায় অস্থির হয়ে ওঠে, তখন সে স্বরূপের সন্ধান শুরু করে এবং সাধনক্রিয়ার সাহায্যে স্বরূপের উপলব্ধি লাভ করে। তাই যে পথে নিজেকে পরমাত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন, আবার সেই পথেই পরমাত্মামুখী হতে হবে। যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই পথের সন্ধান দিতে গিয়ে বলছেন, অধ্যাবসায় ও অনির্বিন্ন-চিত্ত থাকা আবশ্যিক। জীবন শ্বাসের খেলা।  এই শ্বাসকে ধরতে পারলেই, আপনি জীবনের স্বরূপ ধরতে পারবেন। স্বাশের সঙ্গেই আছেন সেই চৈতন্যস্বরূপ।  তো শ্বাসের নাগাল পেলে, শ্বাসকে আশ্রয় করে আপনি সেই চৈতন্যে পৌঁছে যাবেন।             

বায়ু রহস্যঃ - যোগিবর শ্রীশ্রী শ্যামাচরণ লাহিড়ীর কাছ থেকে এই বায়ু রহস্যের কথা সংক্ষেপে  শুনে নেবো। 

বায়ু ৪৯ প্রকার : এই বায়ুর সংসারে ৭ ভাই। এই ৭ ভাইয়ের আবার ৭টি করে সন্তান। তো  বায়ুর সংসারে মোট ৪৯ জন সদস্য। এই সাতটি প্রধান বায়ুর ৭সাতটি  আবাসস্থল। 

বায়ুর আবাসস্থল :

ইড়া - মেরুদণ্ডের বামদিকে এর অবস্থান। 
পিঙ্গলা - মেরুদণ্ডের ডানদিকে প্রবাহিত। 
সুষুম্না - মেরুদণ্ডের মধ্যভাগে অবস্থিত। 
পূষা - (তাম্রপর্নী) - বাম  চক্ষুতে।  
অলম্বুষা -(গৌতমী) - ডান  চক্ষুতে।   
হস্তিনী (সিন্ধু) - ডান কানে।  
গান্ধারী (কাবেরী) -বাম কানে।
 
বায়ুর ক্রিয়াস্থল :

সমান - নাভিতে 
উদান - কন্ঠে 
ব্যান - সর্ব্ব শরীরে 
অপান - গুহ্যদেশে 
হৃদয়ে - প্রাণ 
(বায়ুর সপ্তবিধ কাজ : প্রবাহ,  আবহ, উদ্বহ, সংবহ, বিবহ, পরিবহ, পরাবহ)

শিব সংহিতায় বলা হচ্ছে, বায়ুর নানান প্রকার কাজের  জন্য, তার নামও নানান প্রকার। এর মধ্যে দশটি শ্রেষ্ঠ প্রাণবায়ুর মধ্যে প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান প্রধান।  এছাড়া আছে   নাগ, কূর্ম্ম, কৃকর, দেবদত্ত, ধনঞ্জয়।  এই মোট দশটি বায়ু। 
নাগের  কাজ হচ্ছে উদ্গার তোলা। 
 কূর্ম্ম বায়ুর কাজ হচ্ছে উন্মীলন, নির্মিলন অর্থাৎ প্রসারণ-সংকোচন।
 কৃকর বায়ুর কাজ হচ্ছে ক্ষুধা-তৃষ্ণা।
 দেবদত্ত বায়ুর কাজ হচ্ছে হাইতোলা। 
এবং ধনঞ্জয় বায়ুর কাজ হচ্ছে হিক্কা তোলা। 

প্রাণ-এর কাজ   হচ্ছে, শ্বাস গ্রহণ, ত্যাগ, হৃদযন্ত্র পরিচালন, খাদ্যবস্তুকে উদরে প্রেরণ, ধমনীর সাহায্যে রক্তকে পরিচালন করা, শিরা-উপশিরাকে  স্নায়ুদলকে স্বীয় কর্তব্যে প্রবৃত্ত করা। 
প্রাণ বায়ুর  শ্বাসপ্রশাসকে সঞ্চালিত করার    এই কাজে প্রাণকে সহযোগিতা করে অপান বায়ু।  আবার মল, মূত্র, শুক্রকে অধঃপতিত করে অপান বায়ু । নারীর সন্তান ধারণ,  সন্তান ভূমিষ্ট, রজঃনিঃসরণ ইত্যাদি কাজ অপান বায়ু করে থাকে। 
সমান বায়ুর কাজ  হচ্ছে, জঠরাগ্নিকে প্রজ্বলিত রাখা। অর্থাৎ পাচক-পিত্ত  রসকে সক্রিয় রাখা। জীর্ন ও অজীর্ণ  খাদ্যকে পৃথক করা ও অসার বস্তুকে মল নাড়িতে প্রেরণ করা। আবার প্রাণবায়ু ও অপান বায়ুর  কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করে, এই সমান বায়ু। 
আমরা  যে কথা বলি, শব্দ উচ্চারণ করি, গান করি ইত্যাদি কাজে সাহায্য করে উদান বায়ু। এই উদান বায়ুর সূক্ষ্ম অংশ আমাদের বুদ্ধি ও স্মৃতিকে পুষ্ট  করে থাকে। 
ব্যান বায়ু আমাদের  মস্তিষ্কে রক্ত প্রদান করে থাকে। এমনকি  শরীরে রক্ত সঞ্চালন ক্রিয়া করে থাকে। আমাদের যে ঘাম নিঃসৃত তা  ব্যান বায়ুর কাজ। 

তো বায়ু আমাদের শরীরের  গুরুত্ত্বপূর্ন কাজগুলো  চলেছে, যার জন্য আমরা বেঁচে আছি, অথচ  আমাদের আলাদা করে  কোনো প্রয়াস করতে হয় না। অথচ আমরা যদি এই বায়ুর ক্রিয়ার দিকে  একটু ধ্যান দিতে পারতাম, তবে এই বায়ুর সাহায্যে আমরা অতীন্দ্রিয় রাজ্যে প্রবেশ করতে পারতাম।       

বেদে বায়ুকে বলা হয়েছে, অন্তঃরীক্ষের দেবতা। পৃথিবীতে অগ্নি, অন্তরীক্ষে বায়ু, আর দ্যুলোকে সূর্য। বায়ুকে চারটি নাম ধরে  ডাকা হয়েছে, বাত অর্থাৎ বাতাস, বায়ু, মরুৎ ও মাতরিশ্বা। বায়ুকেই  বলা হচ্ছে প্রাণময় অমৃত।  "নমস্ তে বায়ো, ত্বম এব প্রতক্ষ্যং ব্রহ্ম" -  বায়ু তোমাকে নমস্কার, তুমিই প্রত্যক্ষ ব্রহ্ম। এই ভূতরূপী বায়ুকে আমরা স্বাশের সঙ্গে টেনে নিয়ে বেঁচে আছি। তাই অধ্যাত্ম দৃষ্টিতে বায়ু হচ্ছে প্রাণ। 

আমাদের নাভিতে যে বায়ুর স্থান তাকে বলে সমান, কন্ঠে আছেন উদান।  এই উদান বায়ুর চাপে বায়ু যখন সর্ব্ব শরীরে ব্যাপ্ত  হন,তখন তাকে বলে ব্যান। এই ব্যান গুহ্য দেশে গিয়ে অপান নাম ধারণ  করেন।অপান  আবার হৃদয়ে গিয়ে প্রাণ নাম ধারণ করেন।
ওম নমঃ শ্রী ভগবতে বাসুদেবায় নমঃ 
চলবে।.... 

০৩.০৪.২০২২        
তং বিদ্যাৎ-দুঃখ-সংযোগ-বিয়োগং যোগসংজ্ঞিতম
স নিশ্চেয়ন যোক্তব্যো যোগো-অনির্ব্বণ্ণচেতসা। (৬/২৩) 

পূর্ব-প্রকাশের পর : (২) 

আমরা আগেই শুনেছি বায়ুর সপ্তবিধ কাজ। সেগুলো হচ্ছে  প্রবাহ,  আবহ, উদ্বহ, সংবহ, বিবহ, পরিবহ, পরাবহ। এই সম্পর্কে আমরা একটু বিস্তারিত শুনে  নেবো মহাত্মা যোগীরাজ শ্রী চরণ লাহিড়ী মহাশয়ের কাছ থেকে। আমাদের অনেকের  ধারণা  হচ্ছে যোগসাধন সংসারে থেকে  সম্ভব নয়। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমাদের যত মুনি-ঋষিগণ ছিলেন, তাঁরা প্রায় সবাই সংসারী ছিলেন। তাদেরও ছেলে-মেয়ে স্ত্রী ছিলো।   সত্যি কথা কি এই সব সংসারী যোগীপুরুষগনই আমাদের প্রায় সমস্ত শাস্ত্র গ্রন্থের প্রণেতা। আমাদের এই গুহ্য-গীতার যিনি প্রণেতা, ব্যাসদেব  তাঁরও স্ত্রী-পুত্র ছিল। যিনি এই শিক্ষা  দিচ্ছেন, সেই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং সংসারী ছিলেন। আবার যাঁকে এই যোগশিক্ষা দিচ্ছেন, অর্থাৎ অর্জ্জুন,  তিনিও সংসারী ব্যক্তি ছিলেন। তো যোগের কথা সংসারীদের শুনে  লাভ নেই এমনটা নয়।  বরং  সংসারীদের জন্যই এই যোগ শিক্ষা জরুরী ।  দেখুন যার গৃহে থেকে সাধনক্রিয়া সম্ভব হচ্ছে না, তার পক্ষে গুহায় গিয়ে সাধন সম্ভব হবে, এমন  নিশ্চয়তা নেই। পরমাত্মাকে  উপলব্ধি করতে  গেলে, সমাধি সাধনের  কোনো বিকল্প নেই। সংসারে সেটা সম্ভব।   আসলে যোগ আর   কিছুই নয়, - যোগ হচ্ছে চিত্তকে  নিরোধের অবস্থায় পৌঁছানোর একটা কৌশল মাত্র । আর এই ক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত আছে বায়ু।  যা আমাদের  কাছের, এবং সবচেয়ে পরিচিত।
তো যে কথা  বলছিলাম, প্রাণ একসময় স্থির ছিল।  প্রাণ তেজের  প্রভাবে বেগবান  হয়েছে। আবার এই তেজের  সাহায্যেই প্রাণকে স্থির করতে হবে। প্রাণের বিভিন্ন গতি। অর্থাৎ প্রাণের কর্ম্ম হচ্ছে চেষ্টা করা। এই চেষ্টিত বায়ুর নাম যথাক্রমে : প্রবাহ, আবহ, উদ্বহ, সংবহ, বিবহ, পরিবহ, পরাবহ। জগতের সমস্ত ক্রিয়াই প্রাণের ক্রিয়া । বায়ু সূর্যতেজরূপে   সমুদ্রের জলকে বাস্পে পরিণত করছে। অর্থাৎ পদার্থকে জীর্ন করছে। বাষ্পকে  উর্দ্ধে বহন করে নিচ্ছেন। সেখানে বাষ্প মেঘরূপে বিচরণ করছে।  মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে, তখন নিম্নগতি সম্পন্ন হচ্ছে, নদীরূপে ধরাতলে প্রবাহিত হচ্ছে। একসময় সমুদ্রে মিশে যাচ্ছে। তেমনি বায়ুই তেজরূপে খাদ্যকে  জীর্ন করছে। শরীরে  সঞ্চালন করছে।  মস্তকে রক্ত প্রেরণ করছে। শ্লেষ্মা রস উৎপাদন করছে,  শ্লেষ্মা রস নিঃসরণ করছে। 
     
১. প্রবাহ : Flow প্রাণের রূপ বিদ্যুতের ন্যায় জ্যোতির্ময়।  হচ্ছে জ্যোতির্ময় সত্তা। সবত্র ব্যাপক আছে। 
২. আবহ : condition  প্রাণের কর্ম্ম হচ্ছে জীর্ন করা। এর রূপ বালকের সাদৃশ্য, অর্ব্বাচীন অস্থির। আমাদের দেহের অন্তরে একেই উদান বায়ু  বলে।   
৩.উদ্বহ : Exhaustion এই বায়ু সমস্ত উর্দ্ধে ধারণ করে রেখেছেন। আমাদের সমস্ত শিরা উপশিরা দ্বারা শরীরের চারিদিকে রক্ত সঞ্চারণ করছেন। আবার মস্তকেও রক্ত প্রেরণ করছেন।  শ্লেষ্মা উৎপন্ন হচ্ছে, আবার শ্লেষ্মা নিঃসরণ হচ্ছে, সবই এই বায়ুরশক্তির  ক্রিয়া। এঁকে  ব্যান বায়ু বলা হয়ে  থাকে।  
৪. সংবহ : connection আমাদের শরীরে বারোটি নাড়ী নদীরূপে সমস্ত শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে।  এগুলো হচ্ছে - ১.ইড়া (গঙ্গা), ২. পিঙ্গলা (যমুনা), ৩. গান্ধারী (কাবেরী), ৪. হস্তিনী (সিন্ধু), ৫. পুষা (তাম্রপর্নি), ৬. অলম্বুষা (গৌতমী) ৭-৮. সুষুম্না (সরস্বতী) - সুষুম্নার  উপরে ও ভিতরে দুই  স্থানে প্রবাহ আছে, তাই এঁকে দুটো ধারা হয়। ৯. কুহু (নর্মদা) ১০-১১.বারণী (গোমতী - এর প্রবাহ দুটো) ১২. সর্বাঙ্গে আছে পয়স্বিনী। এই বারোটি বায়ু আমাদের শরীরে নদীরূপে প্রবাহিত হচ্ছে। এই বায়ুর গতিধারার কারণেই জীব বেঁচে আছে। এই বায়ু মস্তকে গিয়ে পঞ্চভূতের আকর্ষণ করছে। 

শরীরের মধ্যে যে অপান বায়ু, যা সঠিক প্রাণায়ামের দ্বারা উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হতে পারে, মূলাধারের শক্তিকে ব্রহ্মরন্ধ্রে নিয়ে যেতে পারে। 
৫. বিবহ :  বায়ু যেমন জীবকূলকে বাঁচিয়ে রাখে, তেমনি এই বায়ুর প্রকোপে, শরীরে রোগব্যাধির জন্ম হয়। এই বায়ু রুক্ষ  হলে, শরীরে ক্রোধের সৃষ্টি হয়। সমান বায়ুর সঙ্গে যদি শ্লেষ্মা যোগ হয়, তবে আমাদের মৃত্যুও  হতে পারে। 
৬. পরিবহ : Transportation বায়ুর দ্বারা সমস্ত কিছু আকাশময় হয়। এই বায়ুর প্রভাবে পাখি আকাশে উড়তে পারে। মাছ জলে থাকতে পারে। অর্থাৎ আকাশে  ও জলে সঞ্চারণ করতে পারে। এর দ্বারাই ইড়া নাড়ী স্থির  হয়। 
৭. পরাবহ : এই বায়ু প্রাণীসকলকে বাঁচিয়ে রাখেন, আবার মৃত্যুকালে নির্গত  যান। 

একটা শিশুর জন্ম হয়েছে, কিন্তু শ্বাসক্রিয়া শুরু হয়নি। অর্থাৎ শ্বাসবায়ু  ভিতরে  যাচ্ছে না, বাইরেও আসছে না। নার্স শরীরটাকে উল্টে-পাল্টে , নাড়াচাড়া করতেই শিশু প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো। অর্থাৎ শরীরের সমস্ত অপ্রত্যঙ্গ কার্যকরী হয়ে উঠলো। একটা জলের পাম্প মেশিন, তাতে পেট্রল আছে, সমস্ত যন্ত্র-পাতি ঠিক  আছে। কিন্তু মেশিনটা চলছে না। কেউ একজন হ্যান্ডেল দিয়ে চাকাটাকে ঘুরিয়ে দিলো, মেশিন সশব্দে  চলতে শুরু করলো। বাতাস চারিদিকে ঘুরে  বেড়াচ্ছে, কিন্তু মৃতের শরীরে প্রবেশ করছে না। আর শরীরের মধ্যে বাতাসের প্রবেশ না থাকবার জন্য, আমরা শরীরকে মৃত বলছি। এখন কথা  হচ্ছে, শরীরের মধ্যে কে বাতাস প্রবেশ করায় ? আপনি  বলবেন,ফুসফুস ক্রিয়াশীল হলেই শরীরের মধ্যে বাতাসের প্রবেশ ঘটে। কিন্তু কে এই ফুসফুসকে ক্রিয়াশীল করে, বা সারাজীবন এই ফুসফুসকে কে  ক্রিয়াশীল করে  রাখে ?  হতে পারে, নার্স এই কাজটায় সহযোগিতা করেছিলো, তারপর থেকে এই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ফুসফুস  চলছ। কিন্তু কে এই ক্রিয়া  একদিন বন্ধ করে দেয় ? আসলে প্রাণশক্তি আমাদের দেহটিকে  পরিচালনা করছে।  স্বয়ংক্রিয় বলে কিছু হয় না। প্রাণশক্তিই সমস্ত যান্ত্রিক শক্তির পরিচালক। তাঁরই নির্দেশে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সমস্ত স্বয়ংক্রিয় যান্ত্রিকশক্তি। চন্দ্র, সূর্য পৃথিবী, গ্রহ, নক্ষত্র সবাই তাঁর নির্দেশে নির্দিস্ট কক্ষপথে ঘুরছে।  একটা ,জিনিস জানবেন, কেউ স্বাধীন নয়। একমাত্র প্রাণশক্তি স্বাধীন।  এই প্রাণশক্তিকে আপনি ঈশ্বর বলতে  পারেন, ভগবান বলতে পারেন, GOD বলতে পারেন, আল্লাহ বলতে পারেন। আবার তেজবিহীন প্রাণ নিষ্ক্রিয়, গতিহীন। যেই তেজের  সংস্পর্শে  এলো, প্রাণ গতিশীল হলো। এইজন্য প্রাণের প্রথম রূপ তেজোময়।

ঋক্বেদের শুরুতেই (সুক্ত  নং ১-২) পরব্রহ্মের বিভূতি রূপ অগ্নি ও বায়ুকে স্নিগ্ধরূপে স্নিগ্ধ সুধাধারে, স্নিগ্ধ হিল্লোলে উপস্থিত হবার জন্য আহবান হয়েছে। এই বায়বীয় সূক্ত আসলে যোগ-এর  অবতারণা। যিনি প্রাণবায়ু রূপে সেই স্থুল দেহে নিত্য-বিরাজিত, সেই বায়ুকে  প্রেমের বন্ধনে, প্রীতির শৃঙ্খলে হৃদয় পিঞ্জরে আবদ্ধ করতে হবে। হৃদিমধ্যে বায়ুকে নিরুদ্ধ করতে পারলেই তোমার যোগ সাধনা  সার্থক হবে।   এবার আমরা আবার যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যোগকথায় ফিরে যাবো।   
---------------------------------------------   

০৪.০৪.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - ষষ্ঠ অধ্যায়  - ধ্যানযোগঃ
শ্লোক নং - ৬/৪
যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবার ধ্যানযোগের মাধ্যমে কিভাবে সমাধির অভ্যাস সম্ভব, সেকথা আলোচনা করছেন।আমার মাঝে  মধ্যে মনে হয়, সমাধি  কি জীবন থেকে নিষ্কৃতি পাবার উপায় ? আমাকে  ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেছিলেন, এসব কথায় সাধারণ মানুষের কি লাভ হবে ? সাধারণ মানুষের আছে ক্ষুধা-তৃষ্ণা, সাধারণ মানুষের আছে নিদ্রাসুখ, আছে মৈথুনের মাধ্যমে সৃষ্টির আনন্দ।  যোগের কথায় সাধারনের কী লাভ হবে ? দেখুন সাধারণত পশুর খাদ্যের জন্য তাকে খাদ্যের সন্ধানে বেরুতেই হয়। কিন্তু গৃহপালিত পশুর খাদ্যের চিন্তা থাকে না।  প্রভু তার খাদ্যের ব্যবস্থা করেন । তেমনি যিনি ঈশ্বরের কাছে   আত্মসমর্পন করেছেন, তার বেঁচে  থাকার  জন্য তাকে চিন্তা করতে হয় না। এমনকি মৃত্যু তাকে  ভীত-সন্ত্রস্ত না। সাধারনের আছে নিদ্রাসুখ যা  কিছুক্ষন পরেই ভেঙে যায়।  কিন্তু সমাধিতে আছে চিরনিদ্রার সুখ।  প্রকৃত সমাধিবান পুরুষের নিদ্রাসুখ চলতেই থাকে। মৈথুনসুখ মানুষের সাময়িক। দুটো স্থুল শরীরের  মিলনে এই সুখের উপলব্ধি। কিন্তু আত্মসুখ অর্থাৎ আত্মার সঙ্গে  মিলনের সুখের কোনো তুলনা হয়  না। তো সবাই  আমরা একসময় সাধারণ থাকি।  আর এই সাধারণ থেকে ধীরে ধীরে অসাধারন হয়ে ওঠাই সাধনা - যোগ সাধনা।       

সংকল্প প্রভবান কামাংস্ত্যক্ত্বা সর্ব্বানশেষতঃ 
মনসৈববে-ইন্দ্রিয়গ্রামং বিনিয়ম্য সমন্ততঃ। (৬/২৪)

সংকল্প হতে জাত সমস্ত কামনাগুলোকে নিঃশেষে ত্যাগ করে, মনের দ্বারাই ইন্দিরায়গুলোকে সমস্ত বিষয় থেকে বিশেষ  প্রত্যাহৃত হবে। 

পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কামনা সংকল্প থেকে জাত। একে অর্থাৎ কামনাগুলোকে সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করতে হবে। দেখুন বিষয় আমরা ত্যাগ করতে পারি কখন - যখন সেই বিষয়ে আমাদের বিতৃষ্ণা আসে। আর বিষয়ের তৃষ্ণা বা বিষয়ের প্রতি স্পৃহা কখন যেতে পারে - তখন বিষয়ের প্রতি আমরা বীতশ্রদ্ধ হই। এই বীতশ্রদ্ধ ভাব তখনই আসতে পারে, যখন আমরা বিষয়ের বিচার করতে সক্ষম হই। আর বিচার কে করে ? বিচার করে মন, বুদ্ধির সাহায্যে। এই বুদ্ধি যার যত সূক্ষ্ম ও  তীক্ষ্ণ, তার বিচার তত সঠিক। মন যখন বিচারশীল হয়, তখন মন বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়। আর বুদ্ধির দ্বারা মন পরিচালিত হলে সে ইন্দ্রিয়ের কথায় আসক্ত হবে না। তো বিচারের দ্বারা মনকে সংযত করতে পারলে, মন বিষয় গ্রহণে উদাসীন হয়ে যাবে। এখন যোগাভ্যাস দ্বারা যদি প্রাণ-মনকে স্থির করতে পারি, তবে বুদ্ধি স্বচ্ছ হবে, ক্ষুরধার হবে। বিচারশক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে। এইসময় মন আর ইন্দ্রিয়মুখী বা বিষয়মুখী চাইবে না। মন হবে সঙ্কল্পরহিত।  আর সঙ্কল্পরহিত মনে কামনার লেশমাত্র অবশিষ্ট থাকবে না। এই কথাটাই বলছেন, যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। ভগবৎ চিন্তায় যাঁর আগ্রহ হয়েছে, বিষয়ে তাঁর অনীহা আসে। চঞ্চল প্রাণ, মনকে অস্থির করে।  তো যোগাভ্যাসের দ্বারা প্রাণকে স্পন্দন-রোহিত করতে হবে। তখন মন নিস্পন্দ হয়ে যাবে, ইন্দ্রিয়সকল তখন মনকে আকর্ষণ করতে পারবে না।    


শনৈঃ শনৈরুপরমেদ্ বুদ্ধ্যা ধৃতিগৃহীতয়া
আত্মসংস্থং মনঃ কৃত্বা ন কিঞ্চিদপি চিন্তয়েৎ। (৬/২৫) 

বার বার এই অভ্যাসের দ্বারা ধীরে ধীরে ধারণা বশীকৃত বুদ্ধি দ্বারা বিগতস্পৃহ মনকে আত্মাতে নিশ্চল করে, চিন্তাহীন হবে। 

মনকে চিন্তাশূন্য করতে হবে, মনকে আত্মাতে স্থির করতে হবে। যোগের এইতো মূলসূত্র বা উদ্দেশ্য। যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, বারবার যোগের অভ্যাস দ্বারা আমাদের বুদ্ধি দ্বারা বশীভূত স্পৃহাশূন্য মনকে আত্মাতে স্থির করতে  হবে। দেখুন চিন্তা সহজে যাবার নয়। যোগক্রিয়ার সাহায্যে মনকে ধীরে ধীরে  নিম্ন চক্র অর্থাৎ  মূলাধার থেকে ধীরে ধীরে উর্দ্ধ চক্রের অভিমুখী করতে হবে। এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসকে ধীরে ধীরে প্রবাহিত করতে হবে। প্রথম  শ্বাসকে অতিবেগে চালনা করলে উপকারের চেয়ে ক্ষতি হতে পারে বেশি। শ্বাসকে  গ্রহণ করবার সঙ্গে সঙ্গে মনকে মনকে প্রতি চক্রে কিছুক্ষনের জন্য স্থির করতে হবে। প্রতিটি চক্রে মনের স্থিতি প্রয়োজন।  যদিও নিম্ন চক্রে অর্থাৎ মূলাধার স্বাধিষ্ঠান এমনকি মনিপুরে বেশিক্ষন অবস্থান না করাই ভালো।