Thursday 21 November 2019

ধ্যান করুন, হৃদয়কেন্দ্রে-(VDO) DHYAN KENDRA - SASANKA SEKHAR PEACE FOUNDATION

ভগবানকে পেতে গেলে, ধ্যান করুন, হৃদয়কেন্দ্রে।

ভগবানকে পেতে গেলে 


ভগবানকে পেতে গেলে একটা আধ্যাত্মিক জগৎ তৈরী করতে হবে, নিজের মধ্যে। আর সেই জগতেই ভগবানের আসন পাতবো। পরিবেশ অনেক সময়  ভগবানকে পেতে সাহায্য করে। সময় কাটাবো ভগবানের সঙ্গে।

আমার এক বন্ধু আছে, সে সারাদিন নাকি একাএকা একটা ঘরে  থাকে। বাড়িতে তার স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে আছে। তথাপি সে একা একটা ঘরেই  বেশিরভাগ সময় কাটায়। সেই ঘরেই সে ঠাকুরের আসন পেতেছে। একটা আলমারি আছে, তাতে বই ঠাসা। সারাদিন মুখ গুঁজে আছে বইয়ের মধ্যে।  অথবা ধ্যানে বসে আছে। তো আমি তাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি সারাদিন একা একা থাকো কি করে ? সে আমার প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে গেলো।  কেন, একা  কেন ? আমার ঘরে বহু লোক আছে, তুমি তাদের দেখতে পাও না, আমি দেখতে পাই।  তারা আমার সঙ্গে কথা বলে। আমি অবাক হয়ে গেলাম।  পাগল হয়ে গেছে নাকি ? যতদূর  জানি এই ঘরে, কাউকে সে ঢুকতে দেয় না। আমি জিজ্ঞেস করি,  তারা কারা ? সে আলমারির দিকে আঙ্গুল তুলে, বললো - ওই দেখো, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, প্রণবানন্দ, বঙ্কিম , শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়ার, এরিষ্টটল।  এদিকে দেখো, শ্রীকৃষ্ণ, ব্যাসদেব, রামচন্দ্র,  চৈতন্য, হরিচাঁদ, ........আর এই পাশে দেখো, আমার মা-বাবা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, এদিকে সরস্বতী, মালক্ষ্মী, মহাত্মা গুরুনাথ, সাঁইবাবা,  এক এক করে নাম বলে গেলো। আমি বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
আসলে কি জানো, ওঁরা  সবাই আমার সঙ্গে কথা বলে, আমি ওদের কথা বোঝার চেষ্টা করি। না বুঝতে পারলে, চুপচাপ বসে থাকি। ......তোমরা যাকে ধ্যান বলো। আসলে কি জানো, আমি সৎসঙ্গ করার চেষ্টা করছি। আর এর ফলেই আমাকে বাইরে বেরুতে হয় না। এঁরাও আমাকে বেরুতে দিতে চায় না। তো বলো তুমি কেমন আছো ?
ওর কথা শুনে, আমার মধ্যে একটা অনুভুতি প্রবল হয়ে উঠলো। আমি যে ভিড়ের মধ্যে আছি, সেখানে সবাই সমস্যায় আছে।  আর আর বন্ধুটি যাঁদের সঙ্গে আছে তাঁরা   সবাই সমস্যা কাটিয়ে উঠেছে। আমরা যাদের সঙ্গে আছি, তারা তো সবাই সুখ-দুঃখের দাস। এঁরা  সবাই সুখ দুঃখের অতীত। সত্যিকারের সৎ সঙ্গ  এটি।

ও আমাকে আর একটা সুন্দর কথা বললো, জলে ডুবে যাওয়া মানুষকে বাঁচিয়েছো কোনোদিন ? আমি বললাম, না সে সুযোগ কখনো হয়নি আমার। তো সে বললো - জলে ডুবে যাওয়া মানুষকে বাঁচাতে গেলে, দূর থেকে তাকে সাহায্য করতে হয়।  ডুবন্ত মানুষকে  তুমি ধরো, কিন্তু তোমাকে ধরতে দিও না। তুমি ওর কাছে যেতে পারো, কিন্তু ওকে তোমার কাছে আসতে  দিও না।   কারন কাছে গেলে ডুবে যাওয়া মানুষ বাঁচার জন্য,  তোমাকে সে আঁকড়ে ধরবে। আর এতে করে, তুমিও মরবে, সেও মরবে। তাই ডুবতে যাওয়া মানুষকে দূর থেকে সাহায্য করো। কিন্তু কখনও কাছে যেও না। সংসারের মানুষ নানান সমস্যায় জর্জরিত। এঁরা ঠাকুরের মন্দিরে যায়, সমস্যার সমাধানের জন্য, বাসনার  পূরণের জন্য। এঁরা  বিপদে ঠাকুরকে ডাকে, বিপদ কেটে গেলে, আবার যে-কে সেই। তাই এইসব সংসারী মানুষকে দূর থেকে সাহায্য করো। কখনো তাদের সঙ্গে জড়িয়ে যেয়ো না। তবে সেও মরবে, তোমাকেও মারবে।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

ধ্যান করুন, হৃদয়কেন্দ্রে।

ভগবানকে পেতে গেলে একটা আধ্যাত্মিক জগৎ তৈরী করতে হবে, নিজের মধ্যে। আর সেই জগতেই ভগবানের আসন পাততে হয় । পরিবেশ অনেক সময়  ভগবানকে পেতে সাহায্য করে। সময় কাটাবো ভগবানের সঙ্গে। এই মানসিকতা নিয়ে আমাকে ধ্যানাবিষ্ট হয়ে থাকতে হবে। আর  আমি যদি ভগবানের ধ্যানে আবিষ্ট থাকতে পারি, তবে, পরিবেশ আমার অনুকূলে চলে আসতে বাধ্য থাকবে।

ধ্যান করুন, হৃদয়কেন্দ্রে। ভগবানের আসন পাতুন, হৃদয়কেন্দ্রে।  প্রাথমিক সাধকদের পক্ষে হৃদয়কেন্দ্রে ধ্যান সবথেকে নিরাপদ, ও প্রশস্ত। যদিও ধ্যান বলতে বোঝায়, জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন। ধ্যান শুরু হয় একাগ্রতা দিয়ে। এখন কিসের উপরে একাগ্র হবো ? ইষ্টদেবতার উপরে একাগ্র হবো।  আমার ইষ্টদেবতাকে কোথায় স্থাপন করবো। হৃদয়ে স্থাপন করবো। এখন কথা হচ্ছে, এই হৃদয় কোথায় ? আর আমার ইষ্টদেবতাই বা কে ? এই ইষ্টদেবতা আর কেউ নন পরম-পুরুষ, পরম-পিতা, পরম-আত্মা, পরম-ঈশ্বর।

হৃদয়কেন্দ্র কোথায় ? আসলে আমাদের ধৈর্য্য ভীষণ কম। এই হৃদয়টা তো আমার, অন্য কারুর নয়। তো যেটা আমার, সেটাকে খুঁজে বার করার দায়িত্ত্বও  তো আমাকেই নিতে হবে।  হৃদয়কেন্দ্র খুঁজে পেতে গেলে, আমাদের শরীর ও মনের যেমন পবিত্রতা চাই, ব্রহ্মচর্য্য চাই।  আর ব্রহ্মচর্য্য মানে শারীরিক ভাবে ব্রহ্মচর্য্য পালন শুধু নয়। ত্যাগ ও তিতিক্ষা অবশ্য়ই প্রয়োজন। ধৈর্য্য ধরে অনুসন্ধান করতে হবে,  তবেই আমরা আমাদের হৃদয়কেন্দ্রকে খুঁজে পাবো। অন্য কেউ আমার  হৃদয়কেন্দ্রকে খুঁজে দিতে পারবে  না।

প্রাথমিক ভাবে সাধককে এটা বুঝে  নিতে হবে যে, হৃদয় বলতে আমরা ফুসফুস দুটোর মাঝখানে যে রক্তমাংসের হৃদযন্ত্র  আছে, এটা সেই  আধ্যাত্মিক জগতের হৃদয়কেন্দ্র  নয় । এই অঞ্চলে যে আকাশ আছে,যেখানে ইথারীয় তরঙ্গ আছে,  সেই অঞ্চলকেই আমাদের  নির্দিষ্ট করতে হবে হৃদাকাশ হিসেবে । এর পরে,  সাধনার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আপনি আপনার হৃদয় খুঁজে পাবেন। কারুর মতে  অনাহত চক্রকে আমরা  এই ভাবনার কেন্দ্র হিসেবে ধরে নিতে পারি । কুণ্ডলিনী শক্তি জাগরণের সময় যেমন আমাদের প্রথমে চেতনকেন্দ্র বা চক্রগুলো সম্পর্কে একটা কাল্পনিক ধারণা করে নিতে হয়, তেমনি হৃদয়কে চিহ্নিত করতে হলে প্রথমে আমাদের হৃদযন্ত্রের সংলগ্ন এই আকাশ বা ইথার-তরঙ্গের প্রবাহিত স্থানকে চিহ্নিত করতে হবে। এই হৃদয়কেন্দ্রেই  ভক্তসাধক ঈশ্বরের সাকার রূপ দেখতে পান।

দেখুন, আমাদের প্রাণবায়ুর সঙ্গে চেতনার ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে । তো এই প্রাণবায়ু আমাদের হৃদয়কেন্দ্রে ঘোরাফেরা করে। অতএব এই প্রাণবায়ুকে বিশ্লেষণ করলে, আমরা  চৈতন্যকে ধরতে পারবো । তবে, সেখানে চেতনার মাত্রা কম থাকায়, আমরা প্রথমে ধরতে পারি না।  দুধের সঙ্গে মাখন মিশে আছে। প্রথমে এটি আমাদের কাছে শোনা কথা, কিন্তু যখন আপনি দুধকে নাড়াচাড়া শুরু করবেন , ধীরে ধীরে আপনি বুঝতে পারবেন, মাখন উঠে আসছে। ঠিক প্রাণবায়ুর দিকে যত গভীর পর্যবেক্ষন ক্রিয়া করবেন, তখন আপনি চৈতন্যকে  ধরতে পারবেন। আমাদের উর্জ্বা শক্তি যেমন সমস্ত শরীরে ব্যাপৃত , তেমনি আমাদের চেতন শক্তিও সমস্ত শরীরে ব্যাপৃত। এবং ঠিক এই কারণেই, আমাদের সমস্ত শরীরেই স্পর্শ-চেতনার অনুভব করি। এমনকি এই চেতনাকে  আমরা আমাদের মনোময় দেহেও  অনুভব করি। আমরা জানি আমাদের মানসিক শরীর হচ্ছে সূক্ষ্ম উপাদানে তৈরী। আমাদের এই মন যখন চেতনার স্পর্শ পায়, কেবলমাত্র তখনই সে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। চেতনাবিহীন পদার্থ অর্থাৎ হাড়-মাংসের এই শরীর, এমনকি আমাদের মন  কেবলমাত্র চেতনার স্পর্শেই সজীব হয়ে উঠতে পারে ।

আমাদের ধ্যান এই হৃদয়-আকাশেই করতে হবে। আমাদের হৃদযন্ত্রের আশেপাশে যে আকাশ বা শূন্যস্থান রয়েছে, তা আমাদের স্থুল  শরীরে বা মনোময় শরীরে অনুপ্রবিষ্ট বিশাল আকাশের অংশ মাত্র। আর এটাই জীবাত্মার আসন। এখানেই তিনি সদা অবস্থান করছেন। আবার এটাও  বলা যেতে পারে, পরম-আত্মার প্রতিফলিত ক্ষেত্র এই হৃদাকাশ । এই আকাশ আমাদের হৃদয়স্থলে থাকলেও, বিশাল আকাশ থেকে একে পৃথক করা যায় না। ঠিক যেমন এর মধ্যে যে চৈতন্য শক্তি আছে, তাঁকেও পরম চৈতন্য থেকে আলাদা করা যায় না। এই অনন্ত চৈতন্য সর্বত্র সবার ভিতর অনুস্যুত হয়ে আছে। তা সে মাটি, জল, আগুন, আকাশ, বাতাস, এমনকি আমাদের চক্ষু, কর্ন, নাসিকা,জিব্বা, ত্বক, আবার মন, চিত্ত, বুদ্ধি, অহংকার - তিনি সবার ভেতরেই অণুমাত্র হয়ে অবস্থান করছেন। তিনিই আমাদের অন্তরস্থ নিয়ন্তা - অমর জীবাত্মা।

কিন্তু কথা হচ্ছে, অধ্যাত্ম সাধক সেটা উপলব্ধি করবেন  কি ভাবে ? সেই মোক্ষম উপায় হচ্ছে ধ্যান। ধ্যান একটা অনুসন্ধান ক্রিয়া।  যার মাধ্যমে আমাদের অনুভূত হবে, প্রতক্ষ্য চৈতন্য শক্তি।

বেদান্ত বলছে , আত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। আমাদের মধ্যে যেমন হৃদয়- আকাশ আছে, ঠিক তেমনি  বিশ্ব-হৃদয়েও আকাশ আছে।  আর সেই একই আকাশ আমাদের মনময় শরীরে এমনকি বিশ্ব শরীরে অনুস্যূত হয়ে আছে। এই একই চৈতন্য শক্তি যেমন জীবাত্মায় আছেন, তেমনি আছেন পরমাত্মায়।  সব রূপের মধ্যেই তিনি বিদ্যমান। তিনি যেমন ব্যষ্টি রূপে আছেন, তেমনি সমষ্টি রূপে নিজেকে  প্রকাশিত করে সদা বিদ্যমান। ব্যষ্টি আত্মার বা জীবাত্মার আবাস এই হৃদয়-আকাশ। আবার পরম-চৈতন্যের আবাস এই জীবাত্মার মধ্যে। আসলে জীবাত্মা হচ্ছে  পরমাত্মার অংশ। তাই জীবাত্মা কখনোই পরম-আত্মা ভিন্ন থাকতে পারে না। সাগরের ঢেউ, সাগরের বুদ্বুদ কখনোই সাগর ছেড়ে থাকতে পারে না। সূর্য্যের রশ্মি কখনো সূর্যকে ছেড়ে থাকতে পারে না। তাই অনন্ত-আকাশ না থাকলে, আমাদের হৃদয়-আকাশেরও কোনো অস্তিত্ত্ব থাকতে পারে না। জীবাত্মা ও পরম-আত্মা অবিচ্ছেদ্দ। এই দুই চৈতন্য আলাদা  নয় এক। এটা আমাদের ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে।

তাই আমরা যখন হৃদয়কেন্দ্রে গভীর ভাবে মনোনিবেশ করবো, তখন এই হৃদয়-আকাশে যে পরম-চৈতন্য অবস্থান করছেন, সেটাও আমাদের দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস ও অনুভব করবার চেষ্টা করতে হবে।
অনন্ত কখনো সান্ত হতে পারে না। অনন্ত থেকে কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। তাই সেই অনন্তই আমাদের হৃদয়-আকাশে বর্তমান।  এর কোনো অন্যথা হতে পারে না। জ্ঞানালোক যেমন আমার মধ্যে, তেমনি একই জ্ঞানালোক সমগ্র বিশ্বে ব্যাপ্ত হয়ে আছে। আমাদের এই শরীর তো ব্রহ্মের আবাস-স্থল। আমাদের শরীর হচ্ছে ব্রহ্মপুর। তাই আমি যেটুকু চেতনার উপলব্ধি করছি বা করতে পারছি, সেই চেতনশক্তিকে আমাদের বিশ্ব চেতন শক্তির সঙ্গে লিন করে দিতে হবে। এইসব কথা প্রথমে আমাদের কাছে কল্পনা বলে মনে হবে। এবং সাধনার প্রথম দিকে এই কল্পনার সাহায্যেই এগুতে হবে। কিন্তু সাধনা যত  গভীর হবে, তত আমরা উপলব্ধি করবো, এগুলো কোনোটাই কল্পনা নয়। সবই সত্য। গভীর নিষ্ঠা, ধৈর্য্য, ত্যাগ, ও আধ্যাত্মিক অনুশীলন আমাদের এই চরম সত্যের কাছে উপস্থিত করে দেবে।

সবশেষে বলি, ধ্যান মানে, সেই এক অখন্ড সত্ত্বাকে  অগ্রাধিকার দেওয়া। আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, নিজেকে নৈতিক ভাবে উন্নত করা, পবিত্র করা  - এগুলো আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের উপাদান। আর এই উপাদানের সাহায্যেই আমরা সিঁড়ি করে নেবো। আর এই সিঁড়ি বেয়ে  পৌঁছে যাবো আমাদের লক্ষে। হৃদয়-আকাশে আমাদের সাথে মিলন হবে পরম-আত্মার সঙ্গে।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।    

Monday 18 November 2019

গায়ত্রী মন্ত্র জপ ও তার ফল

গায়ত্রীদেবী
গায়ত্রী মন্ত্র 

ॐ भुर्भुब: स्वः। ॐ  ततसबिटुर बरेण्यं ।
भर्गो देबष्य धीमहि। धियो यो नः प्रोचोदयात ॐ ।। 

ওঁং ভূর্ভুবঃ স্বঃ।   তৎসবিতুর্বরেন্যং। 
ভর্গো দেবস্য ধীমহি। 
ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ।
 হে (ভূঃ-ভূবঃ-স্বঃ) ত্রিলোকেশ্বর ! সবিতাদেবের পরব্রহ্মাত্মক সেই বরণীয় তেজকে আমরা ধ্যান করি। সেই সবিতা আমাদের বুদ্ধি-বৃত্তিকে প্রেরিত করুন।

এই মন্ত্রেরও  একটা বাঁধন আছে। সেই বাঁধন  দিয়ে মন্ত্রটি হবে এই রকম। 

  ওঁং ভূর্ভুবঃ স্বঃ। ওঁং  তৎসবিতুর্বরেন্যং। 
ভর্গো দেবস্য ধীমহি। 
ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ওঁং।


ভোরবেলা সূর্যোদয়ের দেড় ঘন্টা আগে উঠে পড়ুন। আধা ঘন্টার মধ্যে বাহ্যক্রিয়া সম্পন্ন করুন। হাতে, পায়ে, চোখে, মুখে ভালো করে জলের ছিটে  দিন। এর  পর একটা নির্দিষ্ট কম্বলের আসনে মেরুদণ্ড সোজা করে বসুন, হাতদুটো কনুই থেকে ভাজ করে কোলের উপরে রাখুন, আঙুলের মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিন, নিচে না বসতে পারলে চেয়ারে বসুন।  চেয়ারে কম্বল বিছিয়ে নিন । পা-টা মাটিতে না রেখে কম্বল বা কাঠের উপরে রাখুন।  সূর্যোদয়ের থেকে একঘন্টা গায়েত্রী মন্ত্র পাঠ করুন।
বালক রবীন্দ্রনাথের পৈতে হয়েছে। বেচারামবাবু  অন্যদের সঙ্গে রবিকেও  কিছু বেদমন্ত্র উচ্চারণ  শিখিয়ে দিলেন। তো নতুন ব্রাহ্মণ হওয়ার পরে গায়ত্রীমন্ত্র জপ করবার জন্য রবির ঝোঁক হলো। মন্ত্রটা এমন নয়, যে ছোট্ট রবি এই মন্ত্রের তাৎপর্য্য বুঝতে পারবে। রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী কালে লিখছেন, 
"আমার বেশ মনে আছে, আমি "ভূর্ভুবঃ স্বঃ" এই অংশকে অবলম্বন করে, মনটাকে খুবকরে প্রসারিত করতে চেষ্টা করতাম। কী বুঝতাম, কী ভাবতাম তা স্পষ্ট করে বলা কঠিন, কিন্তু কথার মানে বোঝাটাই  মানুষের পক্ষে সবচেয়ে বড়ো জিনিস নয়। "
তিনি আবার বলছেন, "গায়ত্রীমন্ত্রের কোনো তাৎপর্য আমি সে বয়সে যে বুঝতাম তা নয়, কিন্তু মানুষের অন্তরের এমন কিছু একটা আছে, সম্পূর্ণ না বুঝলেও যাহার  চলে।"
একদিনের কথা মনে পড়ে - আমাদের পড়বার ঘরে, শানবাঁধানো মেজের এক কোন বসে, গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতে করতে, সহসা আমার দুই চোখ ভরিয়া কেবল জল পড়তে লাগলো। জল কেন পড়ছে, তা আমি কিছুমাত্র বুঝতে পারলাম না। .... আসলকথা অন্তরের অন্তঃপুরে যে-কাজ চলছে, বুদ্ধির ক্ষেত্রে সকল সময় তার খবর এসে পৌঁছয় না।"
মেঘের ডাকের কি কোনো মানে আমরা জনি, কিন্তু শুনলেই আতঙ্কে ঘরের মধ্যে ঢুকে যাই। আপনি বলতে পারেন, ঐসময় পৃথিবীতে একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ নেবে আসে, যেটা আমাদের জীবন হানির কারন হতে পারে, তাই আমরা ভয় পাই। কিন্তু বলুনতো  একটা শিশুও  এই ডাক শুন্লে আঁতকে ওঠে। সেতো আপনার মতো জ্ঞানী নয়, তবে সে কেন ভয় পায় ?  
আপনি যে কোকিলের ডাক শোনেন, তার কি কোনো অর্থ বোঝেন ? বোঝেন না, তবু কোকিলের স্বর আমাদের মনে সারা জাগায়। আমরাও কোকিলের সঙ্গে সঙ্গে কু - কু করে ডাকতে শুরু করি। কেন ?
আসলে ধ্বনিতে এমনকিছু শক্তি আছে, যা আমাদের ভালো বা মন্দ অনুভূতি এনে দিতে পারে। আর ধ্বনি যদি অর্থবহ হয়, তবে আমাদের অন্তরে তার একটা বিশাল প্রভাব পড়ে।  তাই হরিনাম যখন ছন্দবদ্ধ সুর করে গাওয়া হয় তখন তা  শুনে মানুষ  কেঁদে ফেলে। 
এই গায়ত্রী মন্ত্রের ধ্বনি ও অর্থের মধ্যেও এমন একটা গভীর তত্ত্ব আছে, যা মানুষকে আলোড়িত করে। মানুষের স্নায়ু তন্ত্রে একটা আলোড়ন তোলে। আর এই ধ্বনি যখন বার-বার উচ্চারিত হয়, আমাদের ভিতরে তখন একটা শোধনপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। আর আমরা উপলব্ধি করি, আমরা হয়ে উঠি, নিত্য-শুদ্ধ-মুক্ত-আত্মা।  
ওঁং ভূর্ভুবঃ স্বঃ। ওঁং তৎসবিতুর্বরেন্যং। ভর্গো দেবস্য ধীমহি। ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ।
হে (ভূঃ-ভূবঃ-স্বঃ) ত্রিলোকেশ্বর ! সবিতাদেবের পরব্রহ্মাত্মক সেই বরণীয় তেজকে আমরা ধ্যান করি। সেই সবিতা আমাদের বুদ্ধি-বৃত্তিকে প্রেরিত করুন।

হে পরমপিতা, পরম-ঈশ্বর, হে ত্রিলোকের পতি, যিনি কারণেরও কারন, যার কোনো কারন নেই , সেই মহেশ্বরকে আমরা স্মরণ করছি। সেই জ্ঞান-জ্যোতিঃ-কে আমরা আহ্বান করছি . সেই সবিতা অর্থাৎ সূর্যকে আমরা ধ্যান করছি। আমরা জ্ঞান সূর্য্যের ধ্যান করছি। সূর্য্যের যে তেজঃরশ্মি প্রতিনিয়ত বিচ্ছুরিত হচ্ছে তার আমরা ধ্যান করছি। এই জ্ঞানসূর্য্য থেকে জ্যোতিঃ সর্বদা বিচ্ছুরিত হচ্ছে, তাঁদেরকে আমি আহ্বান  করছি। আমার প্রার্থনা, এই জ্ঞান সূর্য্যের জ্যোতি আমার বুদ্ধিবৃত্তিকে জাগ্রত করুন। 
আপনি শুধু মনে মনে ভাবুন, একটা জ্ঞানসূর্য্য, যা এই প্রত্যক্ষ সূর্য থেকেও কোটি কোটি গুন্ বড়। এই জ্ঞানসূর্য্য থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে কোটি কোটি রশ্মি। যা জ্ঞানতেজঃ সম্পন্ন। এই জ্ঞান তেজ আমার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করছে। আমার বুদ্ধিবৃত্তি এতে করে সমৃদ্ধ হচ্ছে। আমি জ্ঞান তেজষ্মী হচ্ছি। মন্ত্রটি মনে মনে জপ করুন, আর এই ভাবনাকে জাগিয়ে তুলুন। এই সময় আপনার শরীরের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত হবে। আপনি অনুভব করতে পারবেন, আপনার শরীরে একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছে। আপনার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে পারে। খানিক্ষন পরে, আপনার শরীর স্থির হয়ে যাবে, এবং আপনি অনুভব করবেন , গায়েত্রী মন্ত্র আপনার ভিতরে আপনা-আপনি ধ্বনিত হচ্ছে।আপনি তখন সাক্ষী হয়ে যান। আর যতক্ষন সম্ভব এটাকে উপলব্ধি করতে থাকুন। 

মাত্র কয়েকদিন এটা করতে পারলে, আপনি লক্ষ করবেন,  এতে করে আপনার মধ্যে একটা পরিবর্তন হচ্ছে । আপনি লক্ষ করবেন, আপনার বৌদ্ধিক শক্তি বেড়ে গেছে। যা কিছু আপনি দেখছেন, যাকিছু আপনি পড়ছেন, যা কিছু আপনি শুনছেন, সবকিছুই আপনার কাছে বোধগম্য হচ্ছে। বিষয় আপনার কাছে, পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। আপনার মনে হবে, শিক্ষক আপনার ভিতরেই আছেন। আপনার মধ্যে একটা পবিত্র ভাব জেগে উঠবে। আপনার ভয় দূর হয়ে যাবে। আপনার মধ্যে শঙ্কা দূরীভূত হবে। আপনি মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত শান্তি অনুভব করবেন। আসলে এই মন্ত্র আমাদের গ্রন্থিগুলোকে সক্রিয় করে। গ্রন্থিগুলিতে রস নিঃসৃত হতে শুরু করে। নিস্তরঙ্গ এই রস আমাদের এক স্বর্গীয় আনন্দে ভরপুর করে দেয়। 
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম। 

ওঁং ভূর্ভুবঃ স্বঃ। ওঁং তৎসবিতুর্বরেন্যং। ভর্গো দেবস্য ধীমহি। ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ।
হে (ভূঃ-ভূবঃ-স্বঃ) ত্রিলোকেশ্বর ! সবিতাদেবের পরব্রহ্মাত্মক সেই বরণীয় তেজকে আমরা ধ্যান করি। সেই সবিতা আমাদের বুদ্ধি-বৃত্তিকে প্রেরিত করুন। 

ঈশ্বর আমাদের  চর্মচক্ষুর গোচরে আসবে না। তাকে কান দিয়েও শুনতে পারবো না। কোনো ইন্দ্রিয় দিয়েই আমরা তাকে অনুভব করতে পারবো না। সারাদিন পরিশ্রম করেও তাকে আমরা ধরতে পারবো না। হাজার বছর  তপস্যা করেও তাকে আমরা জানতে পারবো না। শুদ্ধাভক্তি জাগ্রত হলে আমরা এই ব্রহ্মজ্ঞানের যোগ্য হবো। ঠাকুর রামকৃষ্ণ এই বলে আশীর্বাদ করতেন, যে তোর  শুদ্ধাভক্তি জাগ্রত হোক।  আমাদের যখন নির্মল বুদ্ধি জাগ্রত হবে, যখন নিত্য  ধ্যান -পরায়ণ হবো, তখনই আমরা ব্রহ্ম দর্শন করতে পারবো। 

এখন কথা হচ্ছে, এই শুদ্ধাভক্তি কি ভাবে জাগ্রত  হবে ? এর একমাত্র উপায় হচ্ছে, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা। আমাদের নতুন করে ভগবানের কাছে কিছু চাওয়ার নেই। ভগবান আমাদের যা দিয়েছেনা, তার সদুপযোগ করতে হবে। আর এই প্রার্থনাই  করা হয়েছে, গায়ত্রী মন্ত্রে - " আমাদের বুদ্ধি-বৃত্তিকে প্রেরিত করুন। " জীবনে অপহার্য্ হচ্ছে বস্তু হচ্ছে, যথার্থ বোধ। 





















Tuesday 12 November 2019

একই মানুষ দুই দেহে কি ভাবে থাকতে পারে ?

একই  মানুষ দুই দেহে কি ভাবে থাকতে পারে  ?


আজ আমরা শুনবো , একটা অলৌকিক ঘটনা  সম্পর্কে। বিজ্ঞান  যার কোনো  ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। 


আমরা শুনেছি, এমনকি আমাদের অনেকের অভিজ্ঞতা বলে, বহু মহাপুরুষ তাঁর স্থূল দেহ নিয়ে যথেচ্ছ বিচরণ করতে  পারেন। বহু সাধক তার গুরুদেবকে স্মরণমাত্র দর্শন পান। বিবেকানন্দ  পেয়েছেন রামকৃষ্ণের দেখা। এমনকি ঠাকুরের  মৃত্যুর পরেও ঠাকুরের জ্যোতির্ময় দেহ  দেখতে পেয়েছেন।  এমনকি ঠাকুরের কাছ থেকে নির্দেশও  পেয়েছেন, বিবেকানন্দ । বাবা লোকনাথ, বিজয় গোস্বামীকে গভীর জঙ্গলে আগুনের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন।   শ্রীশ্রী  রাম ঠাকুর এমনি ভাবে অনেক শিষ্যকে দেখা দিতেন। শুধু রামঠাকুর বা বাবা লোকনাথ নয়, অনেক মহাত্মা বা  অনেক মহাপুরুষ আছেন এবং ছিলেন, যারা তাদের স্মরণপ্রার্থীকে দেখা দিয়ে থাকেন। তো রামঠাকুরের  এক শিষ্য শ্রী শুভময় দত্ত একবার শ্রীশ্রী  রামঠাকুরকে প্রশ্ন করেছিলেন,আচ্ছা মানুষ কি নিজ শরীর এবং পরিহিত বস্ত্রাদি সহ শূন্যে এক স্থান থেকে আর এক স্থানে চলে যেতে পারেন  ? তো রামঠাকুর উত্তর দিয়েছিলেন, "হ্যাঁ যে যে স্থান দিয়ে বিদ্যুৎ যেতে পারে, মানুষ ঐ সব স্থান দিয়ে যেতে পারে, এবং একই সময় বহু স্থানে উপস্থিত থাকে পারে।" (শ্রী শ্রী ঠাকুর রামচন্দ্র দেব স্মরণে - পৃ ২৩)

এতো শুধু দেখা দেওয়া বা উপদেশ দেওয়া। এটা আমাদের কারুর কারুর মনে  হতে পারে, যে  এগুলো সবই আমাদের মনের ভ্রম। কিন্তু মানুষ তার নিজের দেহকে নিষ্ক্রিয় রেখে অন্য দেহে প্রবেশ করে, এবং নতুন দেহে সে  জ্ঞান সংগ্রহ করছেন, এটা খুব কম শোনা যায়। এই   রকম দুজন মহাপুরুষের কথা আজ আমরা শুনবো। এবং এগুলো সম্ভব কি না সেই সব কথাও  শুনবো।

আচার্য্য শঙ্কর বিচার-যুদ্ধে মন্ডন আচার্যকে পরাজিত করলেন। পণ্ডিত মন্ডন  পাছে প্রতিশ্রূতি অনুযায়ী সন্যাস নিয়ে না নিতে পারেন , তাই  তার স্ত্রী সরস্বতীদেবী, আচার্য্য শঙ্করকে পরাজিত করবার মানসে, আজীবন ব্রহ্মাচারীকে  কাম বিষয়ক প্রশ্ন করে বসলেন, এতে করে  আচার্য্য শঙ্কর   বাকরুদ্ধ হয়ে যান। তখন বাধ্য হয়ে তিনি এক মাস সময় চেয়ে  নেন এই   প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য। এবং  তৎক্ষণাৎ জঙ্গলে প্রবেশ করেন। এদিকে রাজা অম্রুক জঙ্গলে শিকারে এসে   হঠাৎ মারা যান। আচার্য্য শঙ্কর তার বর্তমান দেহকে একটি গুহায় রেখে, তার শিষ্যকে দেহ রক্ষার ভার দিয়ে ওই রাজা  অম্রুকের শরীরে প্রবেশ করেন শঙ্করাচার্য । রাজা বেঁচে ওঠেন আর শঙ্করের দেহ মৃতপ্রায় হয়ে গুহার মধ্যে পড়ে  থাকে। ওই রাজ্ দেহে থেকে শঙ্কর কাম শাস্ত্র রচনা করেন। তারপর আবার রাজদেহ পরিত্যাগ করে, আচার্য্য শঙ্করের দেহে প্রবেশ করেন। এই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন তার শিষ্য পদ্মপাদ। এসব আমাদের কাছে  বইপড়া গল্প।

এমনি আর একটা কাহিনী  আমরা শুনেছি। মহাযোগী গোরক্ষনাথের কথা আপনারা সবাই শুনেছেন। এই গোরক্ষনাথের গুরু ছিলেন, শিবস্বরূপ মৎস্যেন্দ্রনাথ। গোরক্ষনাথের এক সময় মনে হলো, কায়াসিদ্ধি অর্থাৎ শরীরের উর্দ্ধে ওঠা, বা শরীরকে সূক্ষ্মতম-বৃহত্তম   করা এই সাধনা আজও পূর্ণাঙ্গ হয় নি। তো গুরু মহারাজ কাছে থাকলে হয়তো সব কথা জানা  যেত। তাই  তিনি গুরুকে স্মরণ করলেন। কিন্তু গুরুর দেখা নেই।  তো ভাবলেন, গুরু কোথায় আছে, সেটা নিজশক্তিবলে জানতে হবে। ধ্যানাবিষ্ট  হয়ে তিনি আশ্চর্য্য হয়ে দেখলেন, গুরুদেব রয়েছেন কামরূপে। এবং সেখানে শত শত  তরুণী দ্বারা তিনি বেষ্টিত। ভাবলেন, একি ? গুরুদেব ভোগসুখে ডুবে আছেন ?  কামরূপ রমনীদের রাজ্য। ভাবলেন, হয়তো গুরুদেব প্রারব্ধ বসতঃ এই দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। তো যোগীরাজ গোরক্ষনাথ গুরুদেবের উদ্ধারের নিমিত্ত সেখানে উপস্থিত হলেন। এবং অনেক চেষ্টায় সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে  গুরুদেবের জ্যোতির্ময় দিব্য দেহ নিয়ে  আসেন।এখন, গোদাবরী তীরে ভজন কুটিরে আসার পরে, গোরক্ষনাথ আশ্চর্য়্য় হয়ে দেখেন, গুরু  মৎস্যেন্দ্রনাথের স্থুল দেহ সেখানেই ধ্যানাবিষ্ট। আর তার সামনে কয়েকজন সেবক ভক্ত হাতজোড় করে বসে আছেন । এবং লক্ষ করলেন, এতক্ষন  গুরুদেবের যে দিব্যদেহ তার   সঙ্গে ছিল, সেই জ্যোতির্ময় দিব্যদেহ গুরুদেবের স্থুল দেহের মধ্যে মিশে গেলো। একি অদ্ভুত অলৌকিক কান্ড। সেবকরা  বললো, গুরুদেব এখানেই এই গোদাবরী তীরেই অবস্থান করছেন।  এক দিনের জন্যও কোথাও যাননি।

তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো ? মানুষ কি একই সঙ্গে দুটো দেহে অবস্থান করতে পারে ? আমরা এই প্রশ্নের জবাব খুঁজবো। আসলে এই দেহটা আমাদের সংকল্প পূরণের জন্য। এই কথাটা আমাদের ভালো ভাবে মনে রাখতে হবে।

প্রথমে বলি, প্রাণহীন ও চেতনাহীন এক জিনিস নয়। আমরা অনেক  সময় সঙ্গাহীন হয়ে যাই, তার মানে এই নয় যে আমরা মারা গেছি। আমাদের যখন ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করা হয়, তখন কি আমরা প্রাণহীন হই ? হই না। আসলে চেতনাহীন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু প্রাণহীন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। ডাক্তাররা আমাকে অচৈতন্য করে অপারেশন টেবিলে তোলে। আমার জ্ঞান থাকে না, কিন্তু আমি বেঁচে থাকি। এই  অচেতনতা আমাদের খানিক্ষন পরে কেটে যায়। আর এই অচেতন  অবস্থায় কি ঘটেছিলো, তা আমাদের মনে থাকে না, কারন আমার চেতনা ছিলো না।  কিন্তু এটা সত্য যে আমি সেই সময় মারা যাই নি। আমি ছিলাম।

ধ্যানে আপনারা যারা আমিকে ধরার চেষ্টা করেছেন, তারা খেয়াল করেছেন যে এই প্রক্রিয়ায় একটা সময় আসে, যখন আমাদের মনে হয়, আমার আমি সত্ত্বা দেহের বাইরে ঘোরাফেরা করছে।  আমি যেন মারা গেছি। কেউ কেউ এটাকে সমাধি ভেবে থাকেন, আসলে এটি একটি সঙ্গাহীন অবস্থা। যদিও সেটা খুব স্বল্প সময়ের জন্য।  আবার যখন আমরা আমাদের পুরোনো  স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলি, তখন আবার আমি দেহের মধ্যে প্রবেশ করি।   আমার অহং যখন আমাদের দেহের বাইরে অবস্থান করে তখন  আমাদের খুব ভয় করে। কিন্তু এটা যাদের অভ্যাস হয়ে গেছে, তারা এই সময়টাকে দীর্ঘায়িত করতে পারেন । অর্থাৎ দেহ থেকে অহংকে আলাদা করতে পারেন । এবং ইচ্ছেমতো ভিতর-বাহির করতে পারেন । বেশিক্ষন যারা এই অহংকে বাইরে রাখতে  পারেন, তারাই সমাধি লাভ করতে পারেন। যদিও সমাধিতে অহংবোধও  লোপ পায় ।

সার্কাসের খেলা দেখেছেন, কেমন একটা দড়ির উপর দিয়ে হাটছে। ব্যালান্সের খেলা।  আপনি আমি পারবো না। ভীষণ মনোযোগের খেলা। মনটা এদিক ওদিক হয়ে গেলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।   কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষক পেলে, এবং যদি আমরা এটি বার বার অভ্যাস করি, তবে আমি আপনিও এই খেলা দেখাতে পারবো। কিন্তু একা একা এই চেষ্টা করতে গেলে , আমাদের জীবন সংশয় হতে পারে।

 ঠিক তেমনি ধ্যানের সাহায্যে আমরা আমাদের অহংকে আমাদের শরীর থেকে আলাদা করতে পারি। এবং এই অহংকে যেমন আমরা বাইরে রাখতে পারি, বিশ্ব শক্তির  সঙ্গে একাত্মীভূত করতেও  পারি। এই সময় সাধক অনুভব করেন, যে জ্যোতির এক ক্ষুদ্র  অংশ সে নিজে। এই সময় সাধকের অহংবোধ ছাড়া অন্য কোনো বোধ থাকে না। পরে অবশ্য অহংবোধও  লোপ  পায়। কিন্তু এই অহং বোধ লোপ পাবার আগের স্তরে, অহংকে  আলাদা করে, আমাদের বাসনা বা সংকল্প পূরণের জন্য উপযুক্ত আধার বা শরীর খুঁজে নিতে পারি।  সেটাই করেছিলেন, আচার্য শঙ্কর। নিজের জ্ঞান সংগ্রহের জন্য, কামের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের জন্য, যুবক রাজা অম্রুকের শরীরে প্রবেশ করেছিলেন আচার্য্য শংকর  । যে শরীর  তখন ছিল অচেতন।
আর মৎস্যেন্দ্রনাথ করেছিলেন, শিষ্য গোরক্ষনাথকে কায়াসিদ্ধি লাভের শিক্ষা দেবার জন্য।
সব শেষে একটা কথা বলি, এইসব গুহ্যতত্ত্ব সর্ব্বসাধারণের জন্য নয়। গুরুবিনা এইসব সাধনা নিষিদ্ধ।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।   


Monday 11 November 2019

আত্মার কি কোনো ব্যক্তিসত্ত্বা আছে ?


আত্মার কি কোনো ব্যক্তিসত্ত্বা আছে ? 


প্রতিনিয়ত আমাদের এই দেহের পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমাদের মনের পরিবর্তন হচ্ছে।  প্রতিনিয়ত আমাদের জ্ঞানের পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমাদের ব্যাক্তিত্ত্বের  পরিবর্তন হচ্ছে। আমি কিন্তু একই আছি। তো এই যে আমি একই আছি, আমাদের মৃত্যুর পরেও কি এই আমি একই থাকি ? অর্থাৎ মৃত্যুর পরে, আমাদের আত্মশক্তি  কি কারুর সঙ্গে অর্থাৎ পরম বিশ্বশক্তির  সঙ্গে একাত্মীভূত হয়ে যায়  ? এই যে আমি আমার নিজস্বতা আমাদের স্বতন্ত্রতা এটা কি আমাদের মৃত্যুর পরেও বজায় থাকে ? স্থুল দেহের পরিবর্তন, মনের পরিবর্তন, ব্যাক্তিত্ত্বের পরিবর্তন এগুলো আমরা ধরতে পারি কি করে ? আমাদের স্মৃতির সাহায্যে। অর্থাৎ স্মৃতি আমাদের বলে দেয়, আগের আমি আর এখনকার আমি, একই আমি। এই স্মৃতি যদি আমাদের না থাকে, তবে আগে কি ছিলাম তা আমরা মনে করতে পারবো না। আর সেই আমি আর এই আমি, একই ,এটাও আমাদের উপল্বদ্ধিতে আসবে না। তো মৃত্যুর পরে আমাদের স্থূল দেহ থাকবে না। তো স্মৃতি, যা আমাদের এই মস্তিষ্কে অবস্থান করছে, তা এই স্থূল দেহের নাশের সঙ্গে সঙ্গে বিনষ্ট হয়ে যাবে। তাহলে মৃত্যুর পরেও এই আমি আর ভবিষ্যতের আমি একই, এটা আমরা উপলব্ধি করবো কি করে ? আর কেই বা এটা উপলব্ধি করবে ? আর স্মৃতির ভাণ্ডারে আমাদের প্রতিনিয়ত অনেক নতুন জিনিসের সংযোজন ঘটছে, আবার পুরাতন স্মৃতি আমাদের হারিয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর পরেও কি একই প্রক্রিয়া চলতে থাকে আমাদের স্মৃতি-ভান্ডে। বিজ্ঞান বলছে, স্মৃতি আমাদের নিম্নতর মস্তিষ্কের কাজ।  স্থূল দেহের মৃত্যুর পরে, আমাদের এই স্থূল মস্তিস্ক থাকবে না। তবে তখন আমাদের স্মৃতি কোথায় সংরক্ষিত থাকবে ? চেতন মস্তিস্ক  আমাদের স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে।  মৃত্যুর পরে, আমাদের এই মস্তিস্কই যদি না থাকে, তবে কে এই স্মৃতিচারণ করবে ? এই সব অনেক প্রশ্ন আমাদের সবার মনে উঁকি দেয়।  আমরা এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো।

প্রথমে বিজ্ঞানের কথা দিয়ে শুরু করি। এই কিছুদিন আগেও আমরা শুনতাম, সব রোগের ঔষুধ আছে, মনের রোগের  কোনো ঔষুধ নেই। এখন কিন্তু আর সেই কথা আমরা শুনি না। ডাক্তাররা বলছেন, মনের রোগেরও ঔষুধ আছে।  আপনি মনোবিদের কাছে যান। তো কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তারবাবুরা নার্ভের ঔষধ দিচ্ছেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং অর্থাৎ আপনার মনের কথা জেনে, মনের  কষ্ট  জেনে  আপনার মনকে উপদেশের মাধ্যমে, আপনার মানসিক রোগ নিরাময় করছেন। তো বিজ্ঞান এখন শুধু আর স্থূল দেহের চিকিৎসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তারা আমাদের মানস দেহের চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছেন।
আমাদের মুনি ঋষিরা হাজার হাজার বছর  আগে থেকেই, উপলব্ধি করেছিলেন, মানুষের দেহ পাঁচটি। এবং তার চিকিৎসাও পঞ্চবিধ। বিজ্ঞান এখন দুটো দেহের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। আর স্বামী রামদেবের দৌলতে আর একটা দেহের চিকিৎসা সম্প্রতি সার্বজনীন হয়েছে। সেটা হচ্ছে প্রাণময় দেহ। এবং সেটা এখন বিজ্ঞান জগতেও স্বীকৃত হয়েছে।  এবং আমি বিশ্বাস করি, ঈশ্বরের কৃপায়, বিজ্ঞানও একদিন পাঁচটি দেহ সম্পর্কেই  জ্ঞাত হবে। এবং তার চিকিৎসা পদ্ধতিও জানতে পারবে। শুধু দরকার যেটা তা হচ্ছে, অন্ধ-বদ্ধ ধারণা যেন আমাদের প্রগতিকে আটকে না দেয়।
যাই হোক যে কথা বলছিলাম, আমরা আমাদের স্মৃতির সাহায্যেই আমাদের পুরাতন আমি ও বর্তমানের  আমির মধ্যে সাযুজ্য খুঁজে পাই। আর স্মৃতি থাকে আমাদের দেহের মধ্যে।  তবে আমাদের দেহের নাশ হয়ে গেলে আমরা কি ভাবে পুরাতন আমি আর বর্তমানের আমির মধ্যে সাযুজ্য খুঁজে পাবো। এই ব্যাপারটা বুঝতে গেলে আমাদের সেই পুরাতন কথা আর একবার স্মরণ করতে হবে।  আর তা হচ্ছে আমাদের দেহ একটি নয়, আমাদের দেহ পাঁচটি। আর প্রত্যেকটি দেহের মধ্যেই আমাদের আমিত্ত্বের বীজ লুক্কায়িত আছে। প্রত্যেক গাছ তার মৃত্যুর আগে তার বীজের মধ্যে তার ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে সুরক্ষিত করে রেখে যায়। বীজ দেখে বোঝা মুশকিল, তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা। কিন্তু সত্য হচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ,  ও সুরক্ষা  পেলে সেই বীজ আবার বৃহৎ গাছের আকার নেবে। এবং আবার সে বীজে অসংখ্য সম্ভাবনা রেখে যাবে। ঠিক তেমনি আমরাও আমাদের সমস্ত শক্তিকে, সম্ভাবনাকে বীজ আকারে সঙ্গে নিয়ে  যাই। আমরা কেউ মরি না, অর্থাৎ আমাদের কখনো নাশ হয় না। আমরা খোলস ছাড়াই মাত্র। আমাদের স্থূল ও প্রাণময় দেহের নাশের পরে, আমরা মনোময় দেহের মধ্যে অবস্থান করি। এবং এই দেহের মধ্যেও আমাদের সমস্ত শক্তি নিহিত থাকে। আমাদের মনোময় দেহের নাশ হয়ে গেলে, আমরা বিজ্ঞানময় দেহে অবস্থান করি। সেখানেও আমাদের সমস্ত শক্তি সংরক্ষিত থাকে। তবে হ্যাঁ, আমরা যখন প্রকৃতিকে আশ্রয় করি, আর এই প্রকৃতির জগতে বাস করি,তখন আমাদের প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলতে হয়। স্বয়ং ভগবানও  যখন মানুষ হিসেবে জন্ম গ্রহণ করেন, তাকেও প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলতে হয়। আর যখন যেমন দেহে বা যার মধ্যে আমরা আশ্রয় গ্রহণ করি, সাময়িক ভাবে, সেটাকেই আমরা আমি বলে ভাবতে শিখি। আর এটাকেই বলে অজ্ঞান। অর্থাৎ আমি কে সেটা আমি ভুলে যাই। এখন আমি যে সংসারে আছি, যে মা-বাবার আশ্রয়ে আছি, যে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে আছি, তাদেরকেই আমি, আমার ভাবি। এটাকে বলে আমাদের সম্মন্ধ বা মোহ। আর এটাই আমাদের বন্ধন।  এই মোহ  যখন আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো, তখন আমরা আমাকে জানতে পারবো।
আমাদের যখন তথাকথিত মৃত্যু হয়, তখন আমরা আমাদের একসঙ্গে দুটো দেহ ত্যাগ করি। অর্থাৎ আমরা আমাদের অনন্ময় দেহ, যা অন্ন দ্বারা পুষ্ট  ছিল, সেটাকে ত্যাগ করি। এবং আমাদের প্রাণময় দেহ যা প্রাণবায়ু দ্বারা পুষ্ট ছিল, সেটাকে আমরা ত্যাগ করি। আর এর পরে, আমাদের মতো সাধারণ লোকেরা মনোময় দেহে অবস্থান করি। এই মনোময় দেহে যখন অবস্থান করি, তখন আমরা মনোময় জগতে বাস করি। এই মনোময় জগৎ আমাদের স্থূল জগতের মতোই একটা জগৎ। অর্থাৎ আমরা যখন স্বপ্ন দেখি, তখন যেমন আমরা এই স্থুল জগতের মতোই একটা জগতে বিচরণ করি।  তেমনি মনোময় জগতও  এই স্থূল জগতের মতো একটা জগৎ। স্থূল জগতে আমাদের কর্ম্মক্ষমতা থাকে  কিন্তু মনোময় জগতে আমাদের কর্ম্ম ক্ষমতা  থাকে না। অথচ সেখানেও মনের সাহায্যে আমাদের স্বাভাবিক বৃত্তি অনুসারে আমাদের মনে হয় যেন আমরা কর্ম্ম  করছি। ঠিক স্বপ্নের মতো।  স্বপ্নে আমাদের মনে হয়, অনেক কিছু করছি, কিন্তু সত্যি সত্যি কিছু করছি না। আর স্বপ্ন জগতে যেমন অনেক কিছু করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যেমন আমি আকাশে উড়ছি, বা জলের মধ্যে ডুবে আছি, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে খেলা করছি, ইত্যাদি ইত্যাদি তেমনি মনোময় জগতেও আমাদের অনেক কিছু করতে হয়। আর সেটা সেই ধরনের হয়, যা আমরা স্থূল জগতে থাকার সময় করতাম বা করার কথা ভাবতাম। অর্থাৎ স্থূল জগতে থাকার সময় যদি আমার পূজা অর্চনা করবার অভ্যাস করে থাকি, তবে মনোময় জগতেও একই রকম করতে থাকি। আবার এই মনোময় জগতে, আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী যে কারুর সাক্ষাৎ পেতে পারি। এগুলো তখন সত্যি মনে হয়। তখন স্থূল জগতের কোনো জ্ঞান আমাদের থাকে না, কিন্তু স্থূল জগতে যেমন আচরণ করতাম, সেখানেও ঠিক তেমনি আচরণ করতে থাকি। আর আমার সুখ দুঃখ অনুভবও হতে থাকে।
এই মনোময় শরীরে যেহেতু আমাদের সমস্ত শক্তি নিহিত থাকে, এমনকি ইন্দ্রিয় শক্তি এই দেহের মধ্যে নিহিত থাকে, তেমনি থাকে স্মৃতিশক্তি ।  তবে সুপ্ত। কিন্তু উন্নত মহাত্মারা দুটো জগতের স্মৃতি তখন অর্থাৎ স্থূল জগতের ও মনোময় জগতের স্মৃতি জাগ্রত করতে পারেন। এই মনোময় শরীরের খোলস পাল্টিয়ে মহাত্মারা জ্ঞানময় জগতে প্রবেশ করেন।  অর্থাৎ তখন তারা  বিজ্ঞানময় শরীর ধারণ করেন। এই বিজ্ঞানময় শরীর আর কিছু নয়, আমাদের জ্ঞান।  আর এটি অপার্থিব। অনন্ময় শরীর স্থূল প্রাণময় শরীর সূক্ষ্ম মনোময় শরীর সূক্ষতম।  কিন্তু এই তিন শরীরই পার্থিব, কিন্তু বিজ্ঞানময় শরীর অপার্থিব। কিন্তু বিজ্ঞানময় শরীর অপার্থিব হলেও পার্থিব শরীরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। অর্থাৎ আমরা এই স্থূল শরীরে থাকা কালিন জ্ঞান সংগ্রহ করতে পারি। এবং জ্ঞানময় শরীরকে পুষ্ট করতেও  পারি।
এখন কথা হচ্ছে, স্মৃতি নিয়ে। স্মৃতি রক্ষিত থাকে বিজ্ঞান অনুযায়ী মস্তিষ্কে। আর মন সম্পর্কে বিজ্ঞান বলছে, মন হচ্ছে আমাদের স্নায়ুর ক্রিয়া। আর স্নায়ু ক্রিয়াশীল হয় জ্ঞানেন্দ্রিয়র সাহায্যে। তো ইন্দ্রিয় শক্তি,  অর্থাৎ জ্ঞান ইন্দ্রিয়গুলোর শক্তি  যদি আমাদের মনোময় দেহেও অবস্থান করে তবে আমাদের মনোময় দেহেও স্মৃতি সুরক্ষিত থাকতেই পারে।
বেশিরভাগ মানুষ এই মনোময় দেহে অনির্দিষ্ট কিছুকাল অবস্থানের পরে আবার স্থূল দেহে প্রবেশ করে। তো তখনও তার সঙ্গে তার সেই স্মৃতিশক্তিও  থাকে। কিন্তু সুপ্ত থাকে। আর এই স্মৃতিশক্তি অব্যবহৃত থাকার জন্য অতলে তলিয়ে যায়। কিন্তু থাকে। অর্থাৎ আমাদের অবচেতন মনে এই স্মৃতি সুরক্ষিত আছে বা থাকে।  আর একে জাগ্রত করবার আমরা কেউ চেষ্টা করি না। মহাজনরাও, স্মৃতি জাগ্রত করবার জন্য কাউকে উৎসাহিত করেন না। কারন, তাতে তার বর্তমান জীবন প্রভাবিত হতে পারে। সমাজে শৃঙ্খলার অভাব ঘটতে পারে।  শুধু পারে না ঘটবে। তাই এটি গুপ্তপ্রক্রিয়া। জ্ঞানীরা এটা  করে থাকেন, নিজেকে  সমৃদ্ধ করবার জন্য। সমাজের কল্যাণের জন্য। আমাদের মতো সাধারণ লোকের এটি কারায়ত্ত্ব হলে, এই শক্তির অপব্যবহারের সম্ভাবনা। ধরুন আপনি জেনে গেলেন আগের জীবনে আপনাকে কেউ ঠকিয়েছিলো।  তো আপনার মধ্যে তখন একটা  বিদ্বেষ ভাবের উদয় হবে। এবং আপনি উত্তেজিত হয়ে, সমাজের এমনকি আপনার নিজের ক্ষতি করে বসবেন।
তাই জন্ম- জন্মান্তরের   স্মৃতি আমাদের সবার মধ্যে আছে, এটা আমাদের অবচেতন মনের মধ্যেই আছে।  এটা জাগ্রত কারো সম্ভব। কিন্তু না করাই ভালো।  কিন্তু এটা সত্য, এই আমি আর সেই আমি একই। আমার কোনো পরিবর্তন নেই। আমি শাশ্বত। অমর। চিরকালীন। আমি এক অমৃত-যাত্রার যাত্রী মাত্র। মাঝে মধ্যে খোলস পাল্টাই মাত্র।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

বেদান্তের মূল কথা হচ্ছে, আত্মা অমর। আমাদের প্রত্যেকের আত্মাই অমর। পঞ্চভূতের এই দেহের মৃত্যু হলেও আত্মার মৃত্যু নেই। এমনকি এই আত্মা শুন্যে বিলীন হয়েও যায় না। এবং এই আত্মার অনন্তযাত্রারও  কোনো বিরাম ঘটে না। কারুর কারুর মতে অমরত্ত্ব নাকি  লাভ করতে হয়, অর্থাৎ অমরত্ত্ব অর্জিত গুনের দ্বারা হতে পারে। এখন কোন্ কোন্ গুনের অধিকারী হলে বা কতটা গুনের অধিকারী হলে মানুষ অমর হতে পারে, তার কোনো মাপকাঠি নেই।   আবার  কেউ বলেন,  অমরত্ত্ব বলে কিছু হয় না। কিন্তু বেদান্ত বলছে, অমরত্ত্ব বা নিত্যতা আত্মার স্বভাব।  এর কোনো পরিবর্তন করা যায় না। আর তার জন্য কোনো বিশেষ গুন্ আয়ত্ত্ব করতে হবে, তারও  কোনো মানে নেই। এই অমরত্ত্ব না কোনো আশীর্বাদ, না কোনো অর্জিত শক্তি। এটি আমাদের নিজস্ব স্বভাব মাত্র।
দেখুন, সৃষ্টি আছে, অথচ ধংশ নেই এমন কোনো বস্তুর কল্পনা অলীক। এমন কোনো বস্তুর কল্পনা করা যায় না, যার  শুরু আছে অথচ শেষ নেই। এটা একেবারেই অসম্ভব। আসলে স্থান ও কাল যেমন সীমাহীন, অনন্ত তেমনি তেমনি আত্মাও অমর। এই দেহ সৃষ্টির পূর্বেও ছিল আমাদের দেহের বিনাশের পরেও থাকবে।
এখন কথা হচ্ছে, যদি আমাদের এই দেহের জন্মের আগে আমার অস্তিত্ত্ব থেকে থাকে তবে তা আমরা ভুলে যাই কি করে, বা আমরা মনে করতে পারি না কেন ? আসলে আত্মার অমরত্ত্ব  প্রমানের জন্য স্মৃতি কোনো মানদন্ড হতে পারে না। বেদান্ত বলছে,যদি ধরেও নেই, স্মৃতি একটা  মানদন্ড হতে পারে, তবে বলি, যারা রাজযোগ অভ্যাস করেছেন , বা  ঋষি পতঞ্জলির যোগশাস্ত্র পড়েছেন, তারা জানেন :
"সংস্কারসাক্ষাৎকরনাৎ পূর্বজাতিজ্ঞানম্" অর্থাৎ সংস্কারকে বুঝতে পারলে, পূর্বজন্মের জ্ঞান হতে পারে। প্রাক অভিজ্ঞতার এই ছাপ আমাদের অবচেতন মনের গভীরে সংরক্ষিত আছে। এর কখনো বিনাশ  নেই। আমাদের এই পূর্বসঞ্চিত জ্ঞান বা অভিজ্ঞতাকে চৈতন্যের মাধ্যমে জাগ্রত করতে পারি। এটাই বলে স্মৃতি। রাজযোগীরা তাদের এই অবচেতন মনের সুপ্ত সংস্কারের উপরে গভীর মনোযোগ স্থাপন করে, তার বিগত জীবন-পরম্পরার সমস্ত ঘটনাকে স্মরণে আনতে  পারেন। আমাদের দেশে এমন অনেক মহাপুরুষের সন্ধান আমরা জানি, যারা তাদের নিজের অতীত জীবন সম্পর্কে জানেন। এমনকি শুধু নিজের অতীত জীবন  নয়, অন্যের অতীত জীবন সম্পর্কেও জানতেন। আমরা মহা-যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনেছি, তিনি অর্জুনকে বলছেন -  হে অর্জুন, তোমার, আমার বহুবার জন্ম হয়েছে, তুমি তা জান  না, কিন্তু আমি সে সব জানি। অর্জুনকে নিয়ে কৃষ্ণ যখন মহাদেবের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন, তখন মহাদেব তাদের নর ও নারায়ণ বলে  সম্মোধন করেছিলেন। অর্থাৎ শিবজি তাদের পূর্ব জন্মের নাম ধরে ডেকেছিলেন। এই সব কথা যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মনে ছিল।  কিন্তু অর্জুনের সে সব মনে ছিল না।  তাই  শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, তুমি তা জান  না, কিন্তু  আমি সেসব জানি।
আমরা ভগবান বুদ্ধকে তার পূর্ব-পূর্ব জীবনের কথা বলতে শুনেছি। শুধু তাদের নিজের পূর্ব জীবনের কথা নয়, তার কাছাকাছি যারা থাকতো দেবদত্ত ইত্যাদিদের পূর্ব জীবনের কথা বলতে শুনেছি। এমনকি এখনো  অনেক মহাপুরুষ  আছেন, যারা তাদের পূর্ব জীবনের কথা জানেন।
আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা  আত্মা সম্পর্কে কিছুই জানি না। এমনকি আমাদের অবচেতন মনে কি সংস্কার আছে তাও জানি না। বা সেই সম্পর্কে কোনো  জ্ঞান নেই। এই অবচেতন মনকে বেদান্ত বলছে চিত্ত। আমাদের সমস্ত সংস্কারের ভান্ডার হচ্ছে এই চিত্ত। আমাদের চিত্তে এই সব সংস্কার সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কিন্তু যখন আমাদের ইচ্ছা শক্তিকে জাগ্রত করি, এবং আমাদের চিত্তের উপরে গভীর মনোনিবেশ করি, তখন চিত্তের ভিতরে অবস্থিত স্মৃতির উপরে আমাদের জ্ঞানের আলোর বন্যা বইতে শুরু  করে, আর আমাদের স্মৃতি  স্পষ্ট হয়ে যায়। তখন আমরা আমাদের এই স্মৃতিকে আমাদের চেতন মনের স্তরে তুলে নিয়ে আসতে  পারি।
দেখুন আমাদের সামনে বাতাসে অনেক ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে, বহু সুর, ধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছে।  কিন্তু আমরা তা দেখতে পাই না, শুনতে পাই না। কিন্তু যদি রিসেপ্টর অর্থাৎ গ্রাহক যন্ত্র ও প্রজেক্টর বা অভিক্ষেপন যন্ত্র  যদি আমাদের সক্রিয় থাকে তবে এগুলো আমাদের চোখে বা কানে ধরা দিতে পারে। আবার দেখুন, ছবি যা কতকগুলো বিন্দুর সমষ্টি মাত্র,  যখন একটা নির্দিষ্ট ঘনীভূত মাত্রায় থাকে, তবে তাকে আমরা দেখতে পাই , বেশি ঘনীভূত অবস্থায় বা ঘনত্ত্বের মাত্রা যদি কমে যায়, তবে আমরা সেই ছবি  দেখতে পাই না।তাই আমাদের চোখে অদৃশ্য, বা কানে শোনা না গেলেও,  এগুলোর অস্তিত্ত্ব যেমন আমরা অস্বীকার করতে পারি না, তেমনি পূর্ব জীবনের স্মৃতি  আমাদের নেই তা আমরা বলতে পারি না। আসলে আমাদের শরীরের যখন পরিবর্তন হয়, অর্থাৎ এক শরীরের থেকে যখন আমরা আর এক শরীরে প্রবেশ করি, তখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা একটা মূর্ছা অবস্থার  মধ্যে দিয়ে যাত্রা করি। আমাদের মাথায় আঘাত লাগলে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের পূর্ব স্মৃতি হারিয়ে যায়। কিন্তু আবার নতুন করে আঘাত লেগে আকস্মিক ভাবে আবার সেই স্মৃতি ফিরে আসতে  পারে। এমনি অনেক ঘটনার কথা আমরা সবাই শুনেছি। সেই রকম আমাদের অবচেতন মনের পর্দায়, আমাদের পূর্ব পূর্ব জীবনের সমস্ত ঘটনার  স্মৃতি সুপ্ত বা অদৃশ্য অবস্থায় আছে। তার অস্তিত্ত্বে অস্বীকার করা মানে সত্যকে অস্বীকার করা।
আমরা কিছু মনে করতে পারি আর না পারি, আমাদের একটা সহজাত বৃত্তি আছে, যা আমার চরিত্র গঠনের উপাদান। আমার এটা ভালো লাগে, আবার এটা ভালো লাগে না। একে ভালো লাগে, তো ওকে ভালো লাগে না। পাহাড় ভালো লাগে, তো সমুদ্র ভালো লাগে না। কেন এমন হয়। আমাদের মধ্যে এত যে বৈচিত্র, এর কারন কি ? আসলে আমাদের পূর্ব জীবনের অভিজ্ঞতাই এই জীবনের অভিব্যক্তি। আমরা  পূর্ব জীবনে যে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা  সঞ্চয় করেছিলাম, সেটা আমাদের চেতন মন ধরতে পারছে কি পারছে না, সেটা বড় কথা নয়। আমি  রক্ত দেখলে ভয় পাই। ঝড়ের কথা শুনলে ভয় পাই। আবার আমি ধ্যানে আনন্দ পাই। এগুলো আমাদের সবই পূর্বসংস্কার থেকে হয়। অনেকে ছোটবেলা থেকে গান করতে ভালোবাসে,  ছবি আঁকতে ভালোবাসে।  এগুলো আমাদের সবই পূর্বসংস্কার থেকে হয়। কেউ কেউ বলে থাকেন, গায়কের ছেলে তাই গান গাইতে ভালো বাসে।  আসল ব্যাপারটা কি জানেন, আমরা যারা এই জনমে গানকে ভালোবাসি, পূর্নতা অর্জনের জন্য, পরের জীবনে আমরা সেই লক্ষ পূরণের জন্য উপযুক্ত মা-বাবা খুঁজে নেই।  ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যারা এই জীবনে যোগসাধনা করতে করতে মারা যান, তার পরবর্তী জীবনে যোগসাধনার উপযুক্ত পরিবারে বা পরিবেশে জন্ম গ্রহণ করবেন। তাই আপনি যে ধরনের সাধনাই করুন না কেন, পরবর্তী জীবনে সেই সাধনার লক্ষে জন্ম ও দেহধারন করবেন। তাই মানুষ বা জীব ধীরে ধীরে উন্নততর দেহপ্রাপ্তি হয়। আর এই ভাবেই আত্মার উর্দ্ধগতি সম্ভব হচ্ছে।
আমাদের এই ব্যক্তি-আত্মার অবচেতন-মনের অন্তরালে লুকোনো থাকে আমাদের পূর্বাপর জীবনের অভিজ্ঞতা। আর সেখান থেকেই আমরা অনুপ্রেরণা পাই, লক্ষ বস্তুর দিকে ধাবিত হই। জীবন একটা পরম্পরা। মানুষের মধ্যে অনেক পাশবিক বৃত্তির লোক আছেন। আসলে এঁরা পূর্বের জীবনে অনুন্নত জীব ছিলেন। সুকৃতির বসে মনুষ্যদেহ পেয়েছেন, কিন্তু বৃত্তি পরিবর্তন হয় নি। আমার এক বন্ধুর ছেলে, বাজারে গেলেই মুরগির দোকানে দাঁড়িয়ে মুরগি কাটা দেখতো, আর আনন্দে লাফাতো। আবার এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা অন্যের কষ্ট এমনকি সিনেমা দেখে কেঁদে ফেলেন। এগুলো সবই পূর্ব জীবনের সংস্কার। অতীত জীবনগুলোর কর্ম্মফল আমাদের প্রারব্ধ আকারে ভোগ করতে হবে, আর এই জীবনের কর্ম্মফল যা ভোগ করা হলো না, তা পরবর্তী জীবনে ভোগ করতে হবে। তাই বলা হয়ে থাকে প্রারব্ধ খন্ডাতে পারে না কেউ। কিছুই  নষ্ট হবে না।
কিন্তু কথা হচ্ছে এই স্মৃতি আমাদের এক দেহ থেকে আর এক দেহে, বা এক জীবন থেকে আর এক জীবনে স্থানান্তরিত হয় কি করে ? আসলে স্মৃতি আমাদের সম্পূর্ণরূপে দেহযন্ত্রের উপরে নির্ভর করে না। এটি ঘোরে জীবাত্মার সাথে সাথে। দেহযন্ত্রের নাশ আছে, কিন্তু এই আত্মার নাশ নেই। আমাদের স্থুল দেহের মৃত্যুকালে আমাদের সমস্ত শক্তি এমনকি ইন্দ্রিয়শক্তি সূক্ষ্ম আকারে পরমাত্মার সেই আত্মজ্যোতিখন্ড সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে থাকে। জীবাত্মার প্রচ্ছন্ন সেই শক্তি, পরবর্তী শরীরে অধিগত ক্ষমতাকে পুনর্বিকাশ করে মাত্র। প্রত্যেক ব্যক্তি-আত্মার সঙ্গে যে স্মৃতি সঞ্চিত থাকে তা পরবর্তী কালে বিশেষ পরিস্থিতিতে আমাদের চেতন স্তরে উঠে আসে, ফল দান  করবার জন্য।আর এই শক্তি বা স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা আমাদের ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।  এই বিকাশ আমাদের স্তরের পরিবর্তন করে।  তাই আমরা বিভিন্ন স্তরের মানুষ দেখতে পাই।
এখন কথা হচ্ছে স্মৃতি আমাদের অগোচর বা অদৃশ্য  থাকে কেন ? আমাদের জ্ঞানীন্দ্রিয় চেতনার অধিকতর শক্তিশালী আলো আমাদের স্মৃতিকে নিষ্প্রভ  করে রাখে, তাই আমরা একে জানতে বা বুঝতে পারি না ।  কিন্তু আমরা যদি বাইরের জগৎ থেকে আমাদের জ্ঞানীন্দ্রিয়গুলোকে অন্তর জগতের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে পারি, অর্থাৎ চোখের পর্দা যদি ভিতরের দিকে খুলতে পারি,  ও আমাদের অন্তরের গভীরে যে চৈতন্যলোক আছে, সেখানে মানসিক রশ্মির প্রতিফলন ঘটাতে পারি তবে, আমরা আমাদের পূর্ব -পূর্ব জীবনকে জানতে ও স্মরণ করতে পারবো।
যারা এই অতীত জীবন সম্পর্কে জানতে চান, তারা আগে আত্মসংযমের অভ্যাস করুন। এতে ইন্দ্রিয়গুলো নিজের আয়ত্ত্বে আসবে। এবার মনকে নিবিষ্ট ও দৃঢ় করে, অন্তঃকরণের চৈতন্যলোকে স্থির করুন। তখন মনজ্যোতিঃ উদ্ভাসিত হবে।  সেই আলোতে আপনি স্নাত হবেন, এবং স্বয়ংকে  জানতে পারবেন। স্বয়ংকে জানতে পারলে, আপনার পূর্বাপর সব জানতে পারবেন। আর যারা এই সাধনায় সিদ্ধ হবেন, তারা অনির্বান চৈতন্যলোকের আনন্দ, উন্নত সার্থক জীবন, এবং জীবনের পরিপূর্ণতা পাবেন ।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি  ওম। 

Wednesday 6 November 2019

স্থুল মানব দেহ-ভাণ্ড ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড HUMAN BODY & SPACE

স্থুল মানব দেহ-ভাণ্ড ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড HUMAN BODY & SPACE

মানবদেহ এক বিস্ময়। কত যে কারিকুরি আছে এই দেহে, তার ইয়ত্ত্বা নেই। বিজ্ঞান এখনো দেহের সমস্ত অঙ্গের কার্যকারিতা সম্পর্কে অবহিত নয়। আবার আমাদের এই স্থুল দেহই চৈতন্যের আবাসস্থল। তাই আমাদের এই মনুষ্য জীবন ও মানুষের এই স্থূল দেহ আমাদের সাধনার মূল আশ্রয়। বহু জন্ম অতিক্রান্ত করে, লক্ষ লক্ষ যোনি ভ্রমণের পর আমরা এই মনুষ্যদেহ প্রাপ্ত হয়েছি। একমাত্র মনুষ্যদেহেই আমাদের কর্ম্মফল সঞ্চিত হয়। তাই আমরা সবাই আবার মনুষ্যদেহ প্রাপ্ত করতে চাই।
মনুষ্যদেহ ভিন্ন সাধন সম্ভব নয়। তাই মানব জীবন  আমাদের কাছে, অতি মূল্যবান। আমাদের এই দেহকে ভালো করে জানতে হবে। আমরা জানি আমাদের এই  দেহ কতকগুলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমাহার মাত্র । এই দেহকে শারীরবিদগন এক রকম ভাবেই  দেখেছেন।  অধ্যাত্ম পথের  পথিকরা এই দেহকে অন্য ভাবে দেখেছেন। তারা মনে করেন, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনুরূপ একটি ব্রহ্মান্ড, হচ্ছে আমাদের এই দেহ । আমরা আজ সেই কথাই  শুনবো।

বাউল লালন ফকির বলছেন :
দেব-দেবতাগন / করে আরাধন / জন্ম নিতে মানবে।।
কত ভাগ্যের ফলে না জানি / মন রে পেয়েছো এই মানব তরণী।
বেয়ে যাও ত্বরায় সুধারায় / যেন ভারা  না ডোবে।।
এই মানুষে হবে মাধুর্য-ভজন / তাইতো মানুষরূপ গড়লে নিরঞ্জন।
এবার ঠকলে আর না দেখি কিনার / অধীন লালন তাই ভাবে।।

বেশিরভাগ ধর্ম্মপ্রান মানুষ অল্পবিস্তর যোগের ক্রিয়া করে থাকেন। অর্থাৎ তাঁদের সাধনকেন্দ্র এই দেহ। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, জৈন, মুসলমান, সবাই কিঁছু না কিছু শারীরিক ক্রিয়া অবশ্য়ই করে থাকেন। অর্থাৎ দেহের মাধ্যমেই আমাদের সাধন ভজন।  আমরা সবাই মনে করি, ঈশ্বর যেমন বাইরে আছেন  বৃহৎ আকারে, তেমনি আমাদের দেহে আছেন  সূক্ষ্ম আকারে। এই দেহের মধ্যেই আছেন পরমতত্ত্ব, বা পরমাত্মা। দেহের বাইরে যেমন আছে পঞ্চতত্ত্ব, সপ্তলোক, নদী, সাগর, দ্বীপ, পর্বত। তেমনি আমাদের শরীরকে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ বলে কল্পনা করা হয়েছে। তাইতো একটা প্রচলিত কথা আছে যে, যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে এই দেহ-ভান্ডে।

আমরা জানি আমাদের মেরুদণ্ডকে আশ্রয় করে, ছটি চক্র আছে। এর মধ্যে সবথেকে নিচে, যে মূলাধার চক্র আছে সেখানে কুণ্ডলিনী শক্তি, অর্থাৎ সৃষ্টিশক্তি সুষুপ্ত অবস্থায় আছেন। এই কুণ্ডলিনীকে প্রাণ-অপান বায়ুর সাহায্যে ক্রিয়া দ্বারা  জাগ্রত করে, সুষুম্নার ভিতর দিয়ে উর্দ্ধগতি করাতে পারলে, সেই বায়ু সূক্ষ্ম অবস্থায় সহস্রারে অর্থাৎ পরমশিবের সাথে মিলিত হন । মানুষ তখন, ত্রিগুণাতীত ব্রাহ্মীস্থিতি লাভ করতে পারেন ।

তাই দেহকে অবলম্বন করেই সাধনা। তা সে হিন্দু, বৌদ্ধ, তান্ত্রিক, যোগী, বৈষ্ণব, বাউল, সুফি, যাই বলুন না কেন, সবাই এই দেহকে অবলম্বন করেই সাধনা করছেন। আমরা সবাই  জানি, পঞ্চভূতের এই দেহ। এই পঞ্চভূত কি ভাবে আমাদের দেহে অবস্থান করছেন দেখুন।

ক্ষিতি অর্থাৎ কঠিন পদার্থ বা পৃথিবী : আমাদের শরীরে, অস্থি, চর্ম, নাড়ী, লোম ও মাংস এই পাঁচটি পৃথিবীর গুন্, বা বিকার অবস্থা।
অপ অর্থাৎ তরল পদার্থ বা জল : মল, মূত্র, শুক্র, শ্লেষ্মা ও শোনিত - এই পাঁচটি হচ্ছে জলের গুন্।
তেজ অর্থাৎ তাপ বা অগ্নি : ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, মোহ, ক্ষান্তি (ক্ষমা বা তিতিক্ষা) - এই পাঁচটি হচ্ছে তেজের গুন্।
মরুৎ  অর্থাৎ বায়বীয় পদার্থ বা বাতাস  :  বিরোধ, আক্ষেপন, আকুঞ্চন, ধারণ ও তৃপ্তি - এই পাঁচটি হচ্ছে বায়ুর গুন্।
ব্যোম অর্থাৎ বিশাল বা আকাশ : রাগ, দ্বেষ, মোহ, ভয় ও লজ্বা - এই পাঁচটি হচ্ছে আকাশের গুন্।

পঞ্চভূতের মধ্যে বায়ু প্রধান।  তাই আমরা বায়ু সম্পর্কে এবার আমরা আরো একটু গভীরে যাবো। বায়ু দশ রকম বা বায়ুর দশটি গুন্ - প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান (এগুলো অর্থাৎ এই পাঁচটি  আমরা জানি ) এছাড়া আছে, নাগ, কূর্ম, কৃকর অর্থাৎ কয়ার পাখি, দেবদত্ত্ব( দেবতাদের কর্তৃক প্রদত্ত্ব ) ও ধনঞ্জয় (যিনি ধনকে জয় করেছেন)। এই মোট দশটি বায়ুর গুন্। প্রাণবায়ু আমাদের হৃদয়ে অবস্থিত। অপান আমাদের গুহ্যদেশে। নাভিদেশে আছে সমান, কন্ঠে উদানবায়ু, এবং সর্বশরীরে ছড়িয়ে আছে ব্যানবায়ু। এই পাঁচটি বায়ু প্রধান।  নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত্ব ও ধনঞ্জয় - এগুলো আমাদের নাড়ীতে অবস্থান করে। অর্থাৎ আমাদের শরীরে যে ৭২০০০ নাড়ী  আছে, তার মধ্যে অবস্থান করে।  তবে প্রধানত পাঁচটি নাড়ী অর্থাৎ ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাক্ষ্যা ও চিত্রাণি এই পাঁচটি নাড়ীতে অবস্থান করে। কেউকেউ বলে থাকেন, ললাট, উরঃ, স্কন্ধ, হৃদয়, নাভি, ত্বক ও অস্থিতে এই পাঁচ নাগাদি বায়ু অবস্থান করে।

আমরা যে সাতটি তল ও  লোকের কথা জানি, সেগুলোর অবস্থান এই রকম :
লোক :ভূর্লোক  নাভিদেশে, ভুবর্লোক হৃদয়ে, স্বর্লোক আমাদের কন্ঠে, মহর্লোক আমাদের চক্ষুদ্বয়ে।  ভ্রূদ্বয়ে আমাদের জনলোক, ললাটে তপোলোকে, সহস্রারে সত্যলোক।
তল:তল সাতটি।  তাদের অবস্থান এই রকম : পাদের আধোভাগ হচ্ছে অতল, পাদের উর্ধভাগ হচ্ছে বিতল।জানুদ্বয়ে সুতল, সন্ধি-রন্ধ্রে হচ্ছে তল, গুদমধ্যে বা গুহ্যমধ্যে তলাতল, লিঙ্গমূলে রসাতল,পাদের অগ্রভাগ ও কটির সন্ধি-স্থলে পাতাল।
পর্বত :আমাদের মূলাধার চক্রে একটা ত্রিকোণ কল্পনা করা হয়েছে। এটি পর্বতের বিশেষ অবস্থান কেন্দ্র। ত্রিকোণের উর্দ্ধকোনে  মন্দর  পর্বত। ডানকোনে কৈলাশ পর্বত। বামকোনে হিমালয়। এছাড়া ত্রিকোণের উর্ধভাগে বিন্ধ্য ও বিষ্ণু পর্বত। এছাড়া আছে ত্রিকোণে মেরু পর্বত। এই মোট সাতটি পর্বতের অবস্থান কেন্দ্র।
দ্বীপ :আমাদের দেহের অস্থিতে অবস্থান করছে জম্বুদ্বীপ, মাংসে কুশদ্বীপ, শিরা সমূহে ক্ৰৌঞ্চদ্বীপ, রক্তে আছে শাকদ্বীপ।  আমাদের শরীরের উর্ধভাগে সমস্ত সন্ধিদেশে শাম্বলি দ্বীপ, লোমপূর্ন স্থানে প্লক্ষদ্বীপ এবং নাভিতে পুস্কর দ্বীপ।
সমুদ্র :লবন সমুদ্র আমাদের মূত্র। শুক্র হচ্ছে ক্ষীরোদসাগর। মজ্জা হচ্ছে দধিসাগর। চর্ম হচ্ছে ঘৃতসাগর। বসা অর্থাৎ আমাদের অবস্থিতি বা আধার হচ্ছে  জল সাগর। কটিরক্তে ইক্ষুসাগর। এবং শোনিতে সুরাসাগর অবস্থিত।
গ্রহ :নাদচক্রে সূর্য অবস্থিত। বিন্দুচক্রে চন্দ্র। মঙ্গল আছে আমাদের চক্ষুতে। হৃদয়ে আছে বুধ।  পেটে বা উদরে আছে বৃহস্পতি। শুক্রে আছে শুক্রগ্রহ। নাভিচক্রে শনি, মুখে আমাদের রাহু আর নাভিতে কেতু।

ঈশ্বরের প্রকাশ স্বরূপ এই ব্রহ্মান্ড। আর এই ব্রহ্মান্ডের ক্ষুদ্র সংস্করণ হচ্ছে আমাদের এই মানবদেহ। এর মূল্যশুধু  অসীম নয়, এটি একটি দুর্লভ বস্তূ। আমরা কেবল বাইরে আমার স্বামীকে খুঁজছি। স্বামীতো ঘরেই আছেন। অশরীরী আমাদের শরীরেই লুকিয়ে আছেন। এই দেহের মধ্যেই গঙ্গা-যমুনা। এখানেই মিলনক্ষেত্র গঙ্গাসাগর। এখানেই প্রয়াগ, হরিদ্বার, বারাণসী। এটাই তীর্থক্ষেত্র। এটাই পীঠস্থান। রত্নসার বলছে :
ভান্ডকে জানিলে জানি ব্রহ্মাণ্ডের তত্ত্ব।
ভান্ড বিচারিলে জানি আপন মাহাত্ম।

বহু ধর্মমতে আমাদের এই দেহের মধ্যেই ঈশ্বরের বাসস্থান কল্পনা করা হয়েছে। এটা  শুধু কল্পনা নয়, এটি বাস্তব সত্য। প্রথম দিকে এই কল্পনা নিয়ে এগুতে হয়। ক্রমে ক্রমে এই সত্য সাধকের উপল্বদ্ধিতে আসে। এমনকি কিছু কিছু সূক্ষ্মতত্ত্ব সামনে আসে, যখন মনে ঈশ্বর সম্পর্কে দৃঢ়তা আসে। এমনকি ঈশ্বরের সঙ্গে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রতিনিয়ত ঈশ্বরের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। সমস্ত সাধনাই আত্মউপলব্ধির সাধনা। এবং একমাত্র দেহকে অবলম্বন করেই আমরা স্থূল থেকে সূক্ষ্মে অগ্রসর হয়ে, সবশেষে আত্মার স্বরুপত্বে পৌঁছানো যায়। স্থুল থেকে সূক্ষ্মে অগ্রসর হওয়া মানে, সৃষ্টিধারার বিপরীত গতিতে অগ্রসর হওয়া। জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন দুটো ভাবে হতে পারে, এক যদি পরমাত্মা স্বেচ্ছায় জীবাত্মার কাছে আসেন, আর জীবাত্মা যদি তার গতি পরমাত্মমুখী করেন। তো দেহের সাধন দ্বারা  মানুষের সহজাত স্বাভাবিক অবস্থা লাভ করা। এই অবস্থাতেই মানুষ ব্রহ্ম-স্বরূপত্ত্ব লাভ করে। তাই তন্ত্রমতে চক্রভেদ, বা পাতঞ্জল মতে অষ্টাঙ্গ যোগাভ্যাস, বেদান্তের পঞ্চকোষ-বিবেক  সাধন, বৌদ্ধদের কায়-বাদ, বৈষ্ণবদের ভক্তিসাধন, বাউলদের সহজিয়া সাধন, মূলত একই পথের প্রকারভেদ মাত্র। তাই লালন বলছেন, একবার আপনারে চিনলে, পরে যায় অচেনারে চেনা।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম। 



Tuesday 5 November 2019

মৃত্যুশোক থেকে কি ভাবে উদ্ধার পাবো ?

মৃত্যুশোক থেকে কি ভাবে উদ্ধার পাবো ?

আমাদের মৃত্যুর সঙ্গে  জড়িয়ে আছে দুঃখএই দুঃখ থেকে আমরা পরিত্রান পাবো কি করে ? নিজের মৃত্যুর কথা ভাবলে, আমাদের ভয় হয়। আর অন্যের বা প্রিয়জনদের মৃত্যু চিন্তায়  আমাদের দুঃখ হয়। 

আমরা ভাবি, কখনো, কোনোভাবে, সতর্ক না করেই আমাদের কাছে মৃত্যু এসে হানা দেয়।  প্রিয়জনের মৃত্যুতে আমরা অসহায় বোধ করি। জীবনের সব আশা তখন  এক লহমায় নির্মূল হয়ে যায়। অত্যন্ত কঠিন হৃদয়ও কাঁপতে থাকে। বেঁচে থাকতে যে ধুলিকণাকে আমরা মাড়িয়ে চলি, কয়েকদিন পরে, আমার মৃত্যু হলে, আমি সেই ধুলিকনাতে পরিণত হয়ে যাবো। আমার এই পরিণতি আমার কঠিন হৃদয়কে কাঁপিয়ে দেয়। যে শরীরকে আমরা এত যত্ন করি, আদর করি, প্রাণহীন সেই  দেহকেই আমরা অবজ্ঞা করি। ভয় করি। তাড়াতাড়ি, এটাকে ধূলিস্যাৎ করে দিতে চাই।

তবে মৃত্য়ু কি একটা ভয়ঙ্কর জিনিস ? এর উত্তরে কেউ বলছেন, হ্যাঁ, আবার কেউ বলছেন না। জ্ঞানী মানুষদের কাছে, এটা কোনো ভয়ঙ্কর জিনিস নয়। আবার আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে, এটি একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা। 

প্রত্যেক মানুষের জীবনে মৃত্যু একটা গুরুত্ত্বপূর্ন ঘটনা। তা সে নিজের মৃত্যু হোক বা প্রিয়জনদের।অথচ বিস্ময়ের ঘটনা হচ্ছে, এই মৃত্যু নিয়ে আমরা বিশেষ কিছু ভাবি না। আমরা নিজেদেরকে খুব বুদ্ধিমান ভাবি, কিন্তু মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের দারুন ভাবে সীমাবদ্ধ। আমরা বেঁচে থাকার জন্য ভাবি, আমরা কেউ মরে যাবার জন্য ভাবিনা।  একদল মানুষ আছেনা, যারা এই মৃত্যুকে জীবিকা করে নিয়েছেন। তারা বলেন, মৃত্যুর আগে দান  ধ্যান করো, তবে তোমার স্বর্গলাভ হবে। আর যে বেঁচে থাকতে দান ধ্যান  করতে পারেনি, বা করে থাকলেও সেই   মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে কেউ যদি, গয়ায় গিয়ে  পিন্ড দান করেন । ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে দান ধ্যান করেন, তবে মৃত ব্যক্তির আত্মার স্বর্গলাভ নিশ্চিত। আর তা না করতে পারলে, মৃত ব্যক্তির আত্মার নরকবাস করতেই হবে। 

আর একটা আশ্চর্য়্য় ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ তার আত্মীয়স্বজনদের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখলে, বিস্ময় বোধ করে। দুঃখও পায়। কিন্তু সেটা কয়েকদিনের জন্য, কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপর আবার নিজেকে শান্তনা দেয়। আমাদের সবাইকে একদিন মরতে হবে, কাউকে আগে যেতে হবে, কেউ কয়েকদিন পরে যাবে । এই ভেবে, আবার সে তার নিজের বেঁচে থাকবার লড়াই করতে লেগে যায়। 

এর মধ্যে আবার কিছু মানুষ আছে, যারা তার নিজের  ভিতরে প্রশ্ন তোলে, মৃত্যু কি ? মৃত্যুর পরে কি আছে ? এই প্রশ্ন যারা তোলে, তারাও কিন্তু নিকটজন মারা গেলে বিয়োগব্যথায় জর্জরিত হয়, নিজেকে অসহায় বোধ করে, চোখের জল ফেলে। আবার কদিন পরে, সেই দুঃখ সে ভুলে যায়। আবার যখন তার নিজের মৃত্যু আসে, তখন সে যন্ত্রনায়  ছটফট করে, ভয়ে কাতর হয়।সাধারণ মানুষ তো ছাড় ঠাকুর রামকৃষ্ণকে আমরা  দেখেছি মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে। লক্ষনের  মৃত্যুশোকে  রামচন্দ্রকে জলেডুবে মরতে হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের বিরহ যন্ত্রনায় কাতর হয়ে শ্রীরাধিকাকে জলে ডুবে মরতে হয়েছে। তাহলে মৃত্যু কি সমস্ত যন্ত্রণার অবসান ঘটায় ?

এক দম্পতির ৭ বছরের এক পুত্র মারা যায়। তো মা-বাবা সেই স্মৃতি নিয়ে সারাক্ষণ  শোকের জীবন কাটাচ্ছেন । তারা সারা জীবন এটাই ভাবতেন, যে ভগবান কেন আমাদের সন্তানকে ছিনিয়ে নিলেন। এর মধ্যে এক তীর্থস্থানের হোটেলে  একদিন দেখা হলো এক দম্পতির সাথে, তাদের ১৯ বছরের ছেলে মারা গিয়েছে। তো কথায় কথায় তারা বললো, "আমি একাই আমার সন্তান হারাই  নি। এই বিশ্বে আরো বহু মা-বাবা আছেন, যারা তাদের সন্তান হারিয়েছেন।" 

সন্তানহারা মা গিয়েছিলো, ভগবান বুদ্ধের কাছে, তার মৃত সন্তানের প্রাণভিক্ষা করতে। তো ভগবান বুদ্ধ তাকে গ্রামে পাঠিয়েছিলেন, যে বাড়িতে কোনোদিন মৃত্যু শোকের ছায়া পড়েনি,সেই বাড়ি থেকে   একমুঠো সর্ষে ভিক্ষে করে  আনতে। আসলে পৃথিবীতে এমন কোনো বাড়ি নেই যেখানে মৃত্যুশোক স্পর্শ করে নি।  ভগবান এটা ভালোভাবে জানতেন। আমরা  ভাবি, শোক দুঃখ কেবল আমার ঘরে। আসলে তো তা  নয়। 

তো পৃথিবীটা মৃত্যুপুরী। এখানে একমাত্র  মৃত্যুই  সত্য। জন্ম নিশ্চিত নয়, কিন্তু মৃত্যু নিশ্চিত। আমাদের সবাইকে মৃত্যুর সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে নিতে হবে। যাকিছু অবশ্যম্ভাবী তাকে মেনে নিতে হবে। 

মৃত্যুকে যিনি ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন, যিনি মৃত্যুর স্বরূপ ও প্রকৃতি জানতে পেরেছেন, তিনি মনকে শান্ত করতে পারেন। তখন তার কাছে বেঁচে থাকা অনন্ত যাত্রায় বিশ্রাম, আর কিছু যাত্রাসামগ্রী সংগ্রহ করা, তার পরে আবার, অনন্ত যাত্রায় বেরিয়ে পড়া। 

আমরা তো বেঁচে থাকার  জন্য লড়াই করি, সংগ্রাম করি, জ্ঞান সংগ্রহ করি, অর্থাৎ ডিগ্রি আদায় করি। কিন্তু সেজন্য তো আমাদের জীবন নয়। আসলে বেঁচে থাকার জন্য কোনো লড়াইয়ের প্রয়োজন নেই। কোনো পরিশ্রমের প্রয়োজনই  নেই। সেটা আমরা বুঝি না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একজায়গায় বলছেন, 
অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্য্যুপাসতে ।
তেষাং নিত্যাভি যুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্ ।।

যেসব ভক্ত আমার প্রতি অনান্যচিত্ত হয়ে, আমার  চিন্তা ও উপাসনা করে, আমাতে নিত্য যুক্ত সেই সব ভক্তের যোগক্ষেম আমি বহন করি। 
এই যোগক্ষেম কথাটার মানে কি ? অপ্রাপ্ত বস্তুর প্রাপ্তি এবং প্রাপ্ত বস্তুর রক্ষা। আপনি যখন ছোট ছিলেন, তখন আপনার মা বা বাবা  আপনার জন্য কোনো বস্তুর প্রয়োজন মনে করলে, সেটি তাঁরা খুশী মনে নিয়ে আসতেন। অর্থাৎ আপনি যদি নির্ভরশীল হন, তবে ভগবান আপনাকে বেঁচে থাকার জন্য, সমস্ত সামগ্রী তিনি নিজেই যোগাড় করে দেবেন। আপনাকে শুধু তাঁর উপরে, আন্তরিক নির্ভরতা আনতে হবে ।   

 আমাদের যে জন্য এখানে আসা সেটা হচ্ছে, অনন্ত যাত্রার জন্য রসদ সংগ্রহ। নিজেকে চাঙ্গা করা। আমরা যদি সেটা না করতে পারি, তবে যখন আমাদের আবার বেরিয়ে পড়তে হবে, তখন আমরা নিঃস্ব অসহায় হয়ে যাবো। 

মৃত্যু মানে অতিথি নিবাস থেকে বেরিয়ে পড়া। হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়া। হোটেলের কোনো কিছুই আমার নয়। যাদের সঙ্গে হোটেলে ছিলাম, তারাও কেউ আমার নয়।  এই চিরসত্য আমাদের বুঝতে হবে। তবেই আমরা মৃত্যু শোক থেকে রেহাই পাবো।  

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম। ।