Wednesday 27 October 2021

দুঃশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন (১,২,৩,৪)


 বাস্তব জীবনের গল্প যা জীবন বদলে দিতে পারে। 

ধর্ম্ম বলতে আমাদের  একটা ধারণা  আছে  যে ধর্ম্ম পালন বোধহয়, আমাদের বাস্তব জীবনের সুখ-দুঃখ থেকে বিশ্রাম  নেওয়া। ধর্ম্ম কথাটার সঙ্গে আরো একটা কথা জড়িয়ে আছে, তা হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা।ইংরেজি ভাষায়  একটা  RELIGION  আর একটা SPIRITUALITY

জীবনে এমন কোনো মানুষ দেখলাম না, যার কোনো নাম নেই। এমনকি নামের নাকি একটা অর্থও আছে। নামগুলো নিতান্ত একটা ধ্বনি নয়, তার  একটা অর্থ আছে।  আর এই অর্থের সঙ্গে মানুষটির কোনো মিল নেই। যার মধ্যে বিনয় বলে কিছু নেই, উগ্রতা যার স্বভাবের মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে, তার নাম নাকি বিনয়। এ-এক অদ্ভুত হাস্যসকর ব্যাপার।   আজকাল শুধু তো আবার জীব জন্তুদেরও একটা করে নাম দেওয়া হয়। আর এই মানুষই বোধহয়, সমস্ত বস্তুর, সমস্ত জীব-জন্তুর  একটা করে নাম দিয়েছে। তেমনি মানুষের একটা বিশেষ জীবন ধারার  নাম দেওয়া হয়েছে। ধর্ম্ম বলতে আমরা কিছু নীতিবাক্যের কথা বুঝে থাকি, যা আমাদের জীবনকে একটা নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করতে পারে। কিছু বিধিনিষেধ যা আমাদেরকে সতর্ক করতে পারে।   অন্যদিকে আধ্যাত্মিকতা  বলতে আমরা বুঝি এক ভাবধারা বা একটা  মানসিক অবস্থা যা আমাদেরকে জীবন ধারনের  জন্য নয়, জীবন থেকে উত্তীর্ন হতে সাহায্য করতে পারে। জীবনের উর্দ্ধে উঠতে সাহায্য করতে পারে। সমাজ জীবনে ধর্ম্ম আমাদের বিশেষ  সংস্কৃতিবান  করতে পারে। তাই সমাজের জীবনীশক্তি এই ধর্ম্মের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আধ্যাত্মিকতা সমাজ-সংস্কৃতির সঞ্জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। ধর্ম্ম হারিয়ে গেলে, আমাদের সংস্কৃতি হারিয়ে যাবে। কিন্তু আধ্যাত্মিকতা হারিয়ে গেলে, আমরা পশুবৎ জীবনে প্রবেশ করবো। সমাজের উন্নতির জন্য ধর্ম্ম ঔষধের  কাজ করতে পারে।  কিন্তু আহ্যাত্মিকতা পশু থেকে মানুষকে মহৎ মহামানবে উন্নীত করতে পারে। 

19th October, 2021 

দুঃশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন (১) 

আমার এক বন্ধুর বাবার খুব শরীর  খারাপ।  খবর পেয়ে তাকে দেখতে গেলাম।  শুনলাম, ওর দাদার চাকরি চলে গিয়েছে। সেই খবর পাওয়া মাত্রই ওর বাবা শয্যা নিয়েছেন। ডাক্তার এলেন, বললেন, কোনো কিছু বুঝতে পারছি না। কিছু ভিটামিন আর নার্ভের ঔষধ দিচ্ছি, দেখেন কি হয়।  কিছুদিনের মধ্যেই ওর দাদা আবার একটা চাকুরী  পেয়ে গেলো। ওর বাবাও সুস্থ  হয়ে উঠলো। 

ভালো থাকার জন্য, আমরা কতকিছুই  না করি। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবন অনেক  সহজ হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বরং আধুনিক জীবন আমাদের অনেক বেশি উচ্চাকাঙ্খী করছে। বিজ্ঞান জীবনের একটা দিক দেখে। পৃথিবী থেকে চন্দ্র-সূর্যের একটা ভৌগলিক দিক অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক  দর্শন করতে পারি ।  পৃথিবীকে উপর থেকে ছবি নিলে, পৃথিবীর একপৃষ্ঠ ছবিতে আসতে  পারে। বাকি অর্ধেকটা অদৃশ্য থেকে যায়। একটা নদী দেখলে, আমরা তার উৎস-পরিণতি, পাড়ের ঘরবাড়ি, মানুষজন দেখতে পারি। আমরা ভাবি গতির গতি সমুদ্রমূখী, আর উৎস পার্বতমুখী।  নদীর আরো একটা দিক আছে, যা আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। আর তা হলো, নদী সূর্যমুখী, নদীর সমস্ত জলকণা, এমনকি সমুদ্রের সমস্ত জল বাষ্প আকারে বাতাসের সাহায্যে সূর্য্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সেই জল আবার বৃষ্টি আকারে নদীতে পাহাড়ে জঙ্গলে, এমনকি সমুদ্রে পতিত হচ্ছে। ঠিক তেমনি আমাদের জীবন নদীর প্রবাহে অনেক অদেখা শক্তি কাজ করছে, যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে  না। মাতৃ গর্ভ থেকে জীবাত্মা  শরীর ধারণ করে, মৃত্যুর সমুদ্রে পতিত হচ্ছে। মৃত্যুই আমাদের কাছে শেষ কথা। কিন্তু কেউকেউ অর্থাৎ আমাদের প্রাচীন মুনিঋষিগন প্রতক্ষ্য করেছিলেন, জীবন মৃত্যুর উপরেও আরো একটা জীবন প্রবাহ আছে, যাকে তারা বলছেন, জীবাত্মার অনন্ত যাত্রা। জীবাত্মা ফিরে ফিরে আসে। .দেহাতীত হয়ে আত্মা সূর্যলোকেই অবস্থান করে, আবার পৃথিবীর টানে, মর্তলোকের  টানে আবার সে ফিরে ফিরে আসে। এইসব কথা বিশ্বাস করতে চান করুন, যারা বিশ্বাস করতে চান না, তারা অহেতুক যুক্তির তর্কের দ্বারা খণ্ডন  করতে গিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। বরং নিজে যাতে ভালো থাকতে পারেন, সেই চেষ্টা করুন। 

জীবনে সমস্যা নেই এমন কোনো মানুষ নেই। আর এই সমস্যা যে আমাদের স্বকৃত কর্ম্মের জন্য, একথা অস্বীকার করি কি করে?  কিন্তু কথা হচ্ছে, যার কর্ম্ম তাকেই ফল ভোগ করতে দাও, এই কথা বলে আমরা যেন দুর্ভাগার কাছ থেকে দূরে না সরে থাকি। বিপন্ন মানুষকে সাহায্য করা, আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত। দুর্দশাগ্রস্থ ব্যক্তিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে না পারলে, আমাদের মনুষ্য নামক  শ্রেষ্ঠ জন্মের সার্থকতা কোথায় ?  আসুন, আমরা সবাইমিলে জীবনের সমস্যাগুলোর সঙ্গে লড়াই করি। 

অতিরিক্ত পরিশ্রম করে কেউ মারা যায় না। বরং অখাদ্য, কুখাদ্য খেয়ে, অথবা পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে, জীবনীশক্তি নষ্ট হয়। মানসিক উদ্বেগ মানুষকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দেয়। চিতাগ্নি  দেহকে দাহন করে, আর চিন্তা রূপ অগ্নি জীবনকে তিলে তিলে ভষ্মে পরিণত করে দেয়। তো জায়গাটা আমাদের বুঝতে হবে, আর এই গহীন-অরণ্য থেকে আমাদের বের হতে হবে। 

---------------- 

 দুঃশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন (২) 

ক্রোধাৎ ভবতি সন্মোহঃ সন্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ 
স্মৃতিভ্ৰংশাদ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রনশ্যতি।  গীতা- ২/৬৩

ক্রোধ থেকে মোহ, মোহ থেকে স্মৃতিবিভ্রম। আর স্মৃতিভ্রষ্ট হলে বুদ্ধিনাশ ঘটে, আর বুদ্ধিনাশের ফলে বিনাশপ্রাপ্তি হয়। 

আমার বাবা ভীষণ রাগী  ছিলেন। আমরা তাঁর ভয়ে সব সময় তটস্থ থাকতাম। বাবা বাড়িতে থাকলে, আমরা আর সবাই যে বাড়িতে আছি, তা কেউ বুঝতেই পারতো না। বাবা রাগের বশে আমার ছোট ভাইকে একদিন নর্দমার মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। মাকেও কারনে অকারনে ধমক দিতেন। এমনকি মাঝে মধ্যে তার গায়ে হাত তুলতেন।  আমরা এমনকি প্রতিবেশীদের কেউ প্রতিবাদ করতে পারতেন না। বাবার রাগ এমনই ভীষণ ছিল, হিজড়া যারা কাউকেই কখনো তোয়াক্কা করতো না, তারাও বাবা বাড়ি থাকলে, আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করতে চাইতো না। বাবাকে সবাই সমীহ করে চলতো। এমনকি বাবাকে কেউ উপেক্ষা করবার সাহস দেখাতো না। বাবার যারা সমবয়সী, তারাও বাবার এই রাগকে প্রশমিত করবার সাহস পেত  না। তখন বুঝতাম না, এখন বুঝি, বাবা এই রাগের কারণেই পেপটিক আলসারের রোগে ভুগতেন। আর এই কারণেই  অসহ্য পেটের  ব্যথায় কষ্ট  পেতেন। 

আমাদের প্রত্যেকের জীবনে একটা চাপা উত্তেজনা আছে, আছে যন্ত্রনা, আছে দুঃখকষ্ট। এইযে জীবনের কষ্ট তা  সহ্য করবার ক্ষমতা ভগবান সবাইকে  সমান ভাবে দেন নি। এই দুঃখ-কষ্ট আর আমাদের অহংভাব, আমাদের বঞ্চিত বস্তু না পাওয়া, আমাদেরকে ক্রোধান্বিত  করে তোলে। আর এই রাগের প্রকাশ আমাদের জীবনকে আরো দুর্বিষহ করে তোলে। 
সারাদিন বাইরে বাইরে পরিশ্রম করে, সারাদিন বাইরে লোকের কাছে অপমানিত হতে হতে, মানুষের মধ্যে একসময় রাগের জন্ম হয়।  আর এই রাগের বহিঃপ্রকাশ প্রকাশ হয় অদ্ভুতভাবে , দুর্বল আপনজনের ঘাড়ে  গিয়ে পড়ে, নতুবা সে নিজেই নিজের ক্ষতি করে বসে। নিজের মাথার চুল ছিড়তে থাকে।  একসময় রাগের বসে এমন কাজ করে বসে যার জন্য তাকে অনুতপ্ত হতে হয়। রাগের বসে একবার বাবা আমার দাদাকে খড়ম দিয়ে মাথায় আঘাত করেছিলেন । দাদার মাথা কেটে গলগল করে রক্ত ঝড়তে থাকে।  দাদা অজ্ঞান হয়ে যায়। আমরা হাসপাতাল থেকে ডাক্তার ডাকতে ছুটি। (হ্যাঁ তখনকার দিনে,  হাসপাতালের ডাক্তারবাবুকে বাড়িতে ডাকলে, তিনি বাড়িতে এসে রুগী দেখে যেতেন।) ডাক্তারবাবু এসে, দাদার মাথায় ৫/৬টি শেলাই করে দেন। বাবা তখন বুম  মেরে বসে ছিলেন ।  হয়তো অনুশোচনা করছিলেন। কিন্তু রাগের বশে যা তিনি করে ফেলেছেন, তারজন্য যা ক্ষতি হবার তাতো হয়ে গিয়েছিলো। তাই দাদা বাবাকে ভয় করতেন, হয়তো শ্রদ্ধাও করতো কিন্তু ভালোবাসত কিনা আমার সন্দেহ আছে। 

রাগ আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। রাগের সময় আমাদের মস্তিকের রক্তবাহী শিরা ছিঁড়ে  যেতে পারে। এমনকি রাগের চোটে, আমাদের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। - এমনকি এরফলে আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। রাগ  পুষে রাখলেও আমাদের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। পুষেরাখা রাগ, ভবিষ্যতে আমাদেরকে   এমন কাজে আকস্মিকভাবে  নিয়োগ করে ফেলতে পারে, যা আমরা স্বাভাবিক অবস্থায়  চিন্তাও করতে পারে না। 

এখন কথা হচ্ছে, রাগ কি আমাদের বাহ্যিক ঘটনার সংস্পর্শে ঘটে থাকে ? নাকি এর জন্য আমাদের শারীরিক গঠন দায়ী ? কিছু লোককে আমরা রাগী  লোক বলেই চিহ্নিত করে থাকি। আর এদেরকে আমরা সাধারণত এড়িয়ে  যেতে চাই। আমরা জানি গ্রন্থির অন্তর্মুখী রসের সূক্ষ্যাংশ দ্বারা আমাদের মন গঠিত হয়। আর মানসিক গঠনের উপরে মানসিক জীবন পুষ্টিলাভ করে থাকে। এই গ্রন্থিচক্রে রসের নিঃসরণের প্রকার ও পরিমান ভেদের কারনে মানুষে মানুষে প্রভেদ দেখা যায়। ব্যোমগ্রন্থি, বায়ুগ্রন্থি, অগ্নিগ্রন্থি, বরুনগ্রন্থি, পৃত্থিগ্রন্থি, অহংগ্রন্থি, মহৎগ্রন্থি এইযে সাতটি  গ্রন্থি, আমাদের শরীরে আছে, তারমধ্যে সবকটি গ্রন্থি সবার শরীরে সমান ভাবে কার্যকরী থাকে না। বিশেষ গ্রন্থির আধিক্য হেতু, মানুষে মানুষে স্বভাবের তারতম্য দেখা যায়।  যাদের অগ্নিগ্রন্থির প্রাবল্য থাকে, তাদের মধ্যে ধৈর্য্যের অভাব দেখা যায়।  এদের মধ্যেই অস্বাভাবিক ক্রোধের বহির্প্রকাশ দেখা যায়।  দেখবেন  একই ঘটনা,  বিভিন্ন মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে আলোড়ন তোলে। তাই কেউ রেগে যায়, আবার কেউ দুঃখ পায়, কেউ আবার আনন্দ পায়। আপনি হয়তো ভাবছেন, একই ঘটনায় কেউ আনন্দ পায়, আবার কেউ দুঃখ পায়,  এমনটা আবার হতে পারে নাকি ? হ্যাঁ পারে।  আমার এক বন্ধুর ছেলে, বাজারে গেলেই, বাবাকে মুরগির দোকানে টেনে নিয়ে যেতো।  আর সেখানে মুরগি কাটা দেখে, সে আনন্দে লাফাতো। আবার এমন অনেক বাচ্চাকে দেখেছি, এসব দেখলে, সে চোখবুজে থাকতো। কিংবা সেখান থেকে দ্রুত সরে পড়তো। আমার ছেলে, ছোটবেলায়,   জ্যান্ত মাছ কাটা দেখতেই  পারতো না।  মাকে সে কিছুতেই জ্যান্ত মাছ কাটতে দিতো না। কান্নাকাটি জুড়ে দিতো। এগুলো সবই আমাদের শরীরের গ্রন্থির খেলা। 

আমাদের নেতিবাচক চিন্তার বা আবেগের ফলে, আমাদের শরীরে একটা রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়, আর এর ফলে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থের নিঃসরণ হতে থাকে।  আবেগের ফলে মানুষের যখন কান্না পায়  তখন তার চোখদুটো জলে ভোরে আসে।  এমনকি নাক দিয়ে জল ঝড়তে শুরু করে।
আমরা প্রায় কেউই জানিনা, এই আবেগকে কিভাবে সংযত করবো। আমরা রেগে গেলে, আমাদের চোখ লাল হয়ে যায়, ভ্রু কুঁচকে যায়, এমনকি গলার স্বর উচ্চস্তরে বাধা হয়ে যায়, আমরা চিৎকার করতে থাকি।  এইসময় আমাদের রক্তচাপ বেড়ে যায়। হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। রাগ প্রশমনের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এইযে আমাদের ক্রোধের ফলে শারীরিক পরিবর্তন তা আমাদের স্বাভাবিক শরীরের ভারসাম্যকে নষ্ট করে দেয় ।  এমনকি আমার শরীর, হাত-পা কাঁপতে থাকে।রাগ দেখিয়ে, বিপক্ষকে হয়তো দমিয়ে রাখা যায়, বা ভয় দেখানো যায়। আর এতেকরে আমার উদ্দেশ্য হয়তো কখনো কখনো সফল হয়, কিন্ত আখেরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়, ক্রোধান্বিত ব্যক্তির। এমনকি এর ফলে তার জীবনের আয়ু কমে যায়। তো আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, আমরা যেন ক্রোধের স্বীকার না হই।  
--

দুশ্চিন্তাহীন  নতুন জীবন (৩) SASANKA SEKHAR LIFE STYLE 

চিন্তা তা সে সে সুচিন্তা হোক, বা দুশ্চিন্তা যা-ই হোক, এই দুই ধরনের চিন্তাই আমাদের স্বভাবের সঙ্গে মিশে আছে। আমাদের জন্মের পর থেকেই আমরা বাঁচার জন্য লড়াই শুরু করে দেই । জন্মের পর থেকেই আমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণার  উদ্রেগ হয়। এই যে ক্ষুধা তৃষ্ণা এর জন্য আমাদের কোনো প্রয়াস করতে হয় না। এমনি এমনি হয়। অর্থাৎ শরীরকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য, শরীরকে বর্দ্ধিত করবার জন্য, ভগবান প্রদত্ত একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এটি। এর পরেই যে জিনিষটি মনের  মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে আসে, তা হচ্ছে, ভয়। এই ভয়ের ভাব জাগিয়ে তুলবার জন্যও আমাদের আলাদা করে কিছু করতে হয় না। কিন্তু কিসের  এই ভয় ? কিসের জন্য এই ভয় ? মৃত্যু ভয়।  ক্ষুধা তৃষ্ণা যেমন শরীরকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য স্বাভাবিক চাহিদা। তেমনি ভয় আমাদেরকে মৃত্যু থেকে রেহাই পাবার  রক্ষা কবচ। এই ভয় মানুষকে সতর্ক করে মৃত্যুর থেকে দূরে থাকবার জন্য। মায়ের কোল  থেকে পরে যাবার ভয়, বিছানা থেকে পরে যাবার ভয়। এই ভয় যদি মানুষের স্বভাবের মধ্যে ভগবান না দিতেন, তবে মানুষ এমন সব কাজ করে ফেলতো, যাতে তার জীবন বিপন্ন হয়ে উঠতো। তো ভয় আমাদের জন্মগত মানসিক বৃত্তি। ক্ষুধা-তৃষ্ণা যেমন আমাদের শরীরের স্বাভাবিক চাহিদা, শরীরের বৃত্তি , ভয় তেমনি আমাদের মানসিক বৃত্তি । বেঁচে থাকবার সতর্কিকরন বৃত্তি। ভয় থেকেই আমরা সতর্ক হয়ে যাই। মহাত্মাগণ বলছেন, পূর্ব-পূর্ব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই আমাদের দুটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আয়ত্ত্ব করে থাকি। বার বার আমরা না খেতে পাওয়ার  যন্ত্রনা ভোগ করছি, বারবার আমরা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছি। সেই অভিজ্ঞতা আমাদের সূক্ষ্ম কারন শরীরে স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে। 

এই ভয় থেকেই, বা বেঁচে থাকবার তাগিদ থেকেই  আসে আমাদের চিন্তা। যা আসলে আমাদের মানসিক বৃত্তি। বেঁচে থাকবার জন্য অনুকূল ও প্রতিকূল অবস্থাকে বিচার করে থাকে আমাদের এই  চিন্তা-সম্পদ । তো আমরা যখন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে যখন পরে যাই, তখন যে চিন্তা আমাদের মধ্যে আসে, তাকে বলে দুশ্চিন্তা। তো ক্ষুধা তৃষ্ণা ভয় সমস্ত জীব বা প্রাণীর মধ্যেই ভগবান দিয়ে দিয়েছেন। প্রাণী মাত্রই এই তিনের অধিকারী। 

ভয়ের উল্টোটা হচ্ছে, সাহস। তো আপনি যখন নিজেকে দুর্বল ভাববেন, অর্থাৎ পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করবার জন্য নিজেকে অসহায় ভাববেন, তখন ভয় আপনাকে আঁকড়ে ধরবে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে আমাদের হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠতে হবে। অর্থাৎ মানসিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। এই মানসিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে, দুটো জিনিস জ্ঞান-অভিজ্ঞতা,  ও ঈশ্বর নির্ভরতা। জ্ঞান আমরা দুই ভাবে সংগ্রহ করতে পারি, এক হচ্ছে অন্যের জীবনে এই পরিস্থিতিতে তারা কি করেছিলেন, সেই কথা জানা। অর্থাৎ মহাত্মাদের জীবনীগ্রন্থ পাঠ  করা। আর একটি, এই অবস্থাতে আপনি নিজে আগে কি করে বেঁচেছিলেন। দ্বিতীয়তঃ অন্য কারুর প্রতি নির্ভর করা। তা সে মা-বাবা হতে পারে, অর্থাৎ অধিক শক্তিশালীর শরণ নেওয়া। এই অধিক শক্তিশালী হচ্ছেন, স্বয়ং ঈশ্বর বা বিশ্বশক্তি যাঁকে  আমরা কেউ দেখতে পাই না, কিন্তু তিনি আমাদের দেখতে পান। আর আপনি যদি মন-প্রাণ দিয়ে ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পন করতে পারেন, তবে জানবেন, ঈশ্বর আপনাকে পথ দেখিয়ে দেবেন।  আপনার কাজ সেই পথে নিজেকে পরিচালনা করা। ঈশ্বর আপনার মনে সাহস এনে দেবেন। আর  আপনার মনে যদি সাহস থাকে, তবে যেকোনো সমস্যায় আপনি শান্ত চিত্তে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে  পারবেন। সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ভীতু মানুষ বাঁশের সাঁকো পার হতে গিয়ে সাঁকো নাড়িয়ে, নিজের বিপদ ডেকে আনে।  আর সাহসী মানুষ নির্ভিক চিত্তে জীবননদী পেরিয়ে যায়, উদ্বেগবিহীন ভাবে। তো আপনাকে সাহসী হতে হবে, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে, আর মহাত্মাদের পথ অবলম্বন করতে হবে। 
-----------------       

আর এক্ষেত্রে আমাদের প্রথম দরকার হয়ে পরে,  

যাই হোক, আমরা শুনছিলাম, এই ক্রোধ আমাদের অগ্নিগ্রন্থির ক্রিয়া। তাই আমরা স্বামী শিবানন্দ সরস্বতীর কাছ থেকে  অগ্নিগ্রন্থির কথা একটু শুনে নেবো । 
ইংরেজ পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন বলছেন,   পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ-খাওয়ানোই হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা।   

অগ্নিগ্রন্থি :  প্লীহা,(SPLEEN)  যকৃৎ (LIVER), অগ্ন্যাশয় (PANCREAS) , সূর্য্যগ্রন্থি, SUNGLAND শুক্রগ্রন্থি (SPARM GLAND)  
----------------------

 মনকে শান্ত করবার সাতটি উপায়।  
১. আমাদের মন যখন বিষয়গত কারনে উদ্বিগ্ন বা চঞ্চল হচ্ছে, তখন  এই অস্থির মনকে শান্ত করবার জন্য, সেই অস্থিরতার কারন যে বিষয়চিন্তা সেখান থেকে তাকে সরিয়ে অন্য বিষয়ে নিবদ্ধ করা।  এতে করে মন শান্ত হয়ে উঠবে।  
২)  মনকে শান্ত করবার জন্য আমাদের মৃত্যু চিন্তা করা উচিত।  মৃত্যু চিন্তা করলেই দেখবেন, মন এক লহমায় শান্ত হয়ে গেছে। মনকে শান্ত করবার এটি সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। 
৩) মহাত্মা গন বলছেন,  নাসিকাগ্রে,  তালুতে প্রভৃতি ইন্দ্রিয়স্থানে মনকে ধারণা বা একাগ্র করলে, অলৌকিক দিব্য  গন্ধাদির সাক্ষাৎ লাভ হয়, এতেকরে আমাদের শাস্ত্রে বিশ্বাস বা আগ্রহ জন্মে এবং চিত্ত স্থির হয়।
৪) হৃদয়মধ্যে প্রকাশশীল চিত্তসত্ব বিষয়ে ধারণা  করলে, শোকরহিত জ্যোতির্ময়ী প্রবৃত্তি উৎপন্ন হয়, তাতেও চিত্তের স্থৈর্য সম্পাদন হয়।
৫) যাঁদের মধ্যে আসক্তি নেই, তেমন মহাপুরুষের চিত্তে সমাধি করলে চিত্ত স্থির হয়। 
৬) স্বপ্নে দেখা, দেবতামূর্তি অথবা সাত্ত্বিকী সুষুপ্তি-বৃত্তিকে অবলম্বন দ্বারাও, যোগীর চিত্ত স্থির হয়। 
৭) সুখদায়ক কোনো স্মৃতি মনের মধ্যে জাগিয়ে তুললে, মন আনন্দে  ভরপুর হয়ে ওঠে ও চিত্ত স্থির হয়।


দুশ্চিন্তাহীন  নতুন জীবন (৪) SASANKA SEKHAR LIFE STYLE 

আমরা সবাই ব্যস্ত। কারন আমরা সবাই সামাজিক জীব। আমাদের অনেক কর্তব্য আছে। আমাকে আমার বাবা-মাকে সন্তুষ্ট করতে হবে, আমাদের ছেলেমেয়েদের সন্তুষ্ট করতে হবে। অফিসের বসকে সন্তুষ্ট করতে হবে। পাড়ার পরিবেশীদের সন্তুষ্ট করতে হবে। আর এই কর্তব্য করতে গিয়ে, আমরা নিজের সন্তুষ্টির কথা ভুলে বসে আছি। আমরা অন্যকে সন্তুষ্ট করার মধ্যে ভালো থাকতে চাইছি। আর কর্তব্য করতে করতে নিজের কষ্ট ডেকে আনছি।স্বামী  বিবেকানন্দ বলছেন, "কর্তব্য আমাদের রোগবিশেষ হয়ে পরে এবং তা আমাদের সবসময় সামনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। কর্তব্য আমাদেরকে ধরে রাখে এবং আমাদের সারা জীবনটাই দুঃখপূর্ণ করে তোলে। এটি মনুষ্যজীবনের ধ্বংসের কারন। ....... কর্তব্য মানুষের অন্তরাত্মাকে দগ্ধ করে দেয় । কর্তব্য বেচারাকে ভগবানকে ডাকবার অবসারটুকুও দেয়  না। স্নানাহারের সময় পর্য্যন্ত দে না।  কর্তব্য যেন সর্বদা তাদের মাথার ওপর ঝুলছে। কর্তব্যের টানে, সারাদিন বাড়ির বাইরে কাজ করে, বিড়ি ফিরে এসে আবার কর্তব্য করতে বসে, রাতে ঘুমুতে যাবার আগে, আবার কালকের কর্তব্যের কথা চিন্তা করে। এই কর্তব্যের হাতথেকে যেন মুক্তি নেই। তো এতো ক্রীতদাসের জীবন। আর কর্তব্য করতে করতে একসময় ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে, মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। মৃত্যুর সময় যমদূত যখন শিয়রে এসে দাঁড়ায়, তখনও এরা  কর্তব্যের কথা চিন্তা করে। আমি কর্তব্যের জন্য, না আমার জন্য কর্তব্য এই কথাটা এরা  ভুলে যায়।  এরা  কর্তব্যের ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে যায়।
তাহলে কি আমাদের কর্তব্য সম্পর্কে যে ধারণা তাতে কোনো ভুল আছে ? 

কর্তব্য কোথায় কিভাবে পালন করতে হবে, সে বিষয়ে আমাদের আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে। নিজ সমস্যা সমাধানের উপায় না খুঁজে আমরা অপরকে  সাহায্য করতে এগিয়ে যাই। আর এটি আমরা করে থাকি ভালোবাসার তাগিদে নয়, আত্মতুষ্টির স্বার্থে। আমরা আত্মগরিমার তুষ্টির জন্য অন্যদের ব্যাপারে নাক গলাই । আর এতেকরে, আমরা অন্যের পছন্দের পাত্র না হয়ে অপছন্দের পাত্র হয়ে উঠি।  শেষ জীবনে এসে দেখি, ছেলে-মেয়ে, এমনকি নিজের স্ত্রী আমাকে সহ্য করতে পারছে না। কেননা, আমি অযাচিত ভাবে তাদের উপকার না করে স্থির থাকতে পারি না। আমরা অন্ধকে রাস্তা পার করে দিতে চাই।  কিন্তু একথা জিজ্ঞেস করি না, সে রাস্তা পার হতে চায় কি না। আমরা বোকাকে বুদ্ধিমান করতে চাই, কিন্তু সে বুদ্ধিমান হতে চায় কিনা তা আমরা ভুলেও জিজ্ঞেস করি না। লোন  করা টাকায় আমরা কম্বল বিতরণ করতে চাই। কিন্তু আমরা জানিনা, তার কিসের দরকার, খাবার না কম্বল।  ফলত আমাদের লোনের টাকায় কেনা কম্বল তার কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। 
-------------------
ভালো থাকতে গেলে গুরুকে খুঁজুন। 

"গুরুদেব" কথা শুনলেই, আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের কথা মনে পড়ে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, জীবনকে মসৃন করতে গেলে, জীবনে কিছু শিখতে গেলে, জীবন-সমস্যার সমাধানের জন্য, একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির সাহায্য অবশ্য়ই প্রয়োজন। আমাদের অবশ্য়ই একজন বা একাধিক গুরুর প্রয়োজন। একজন শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিকে আপনি অভিভাক হিসেবে নির্বাচন করুন। যদি মা -বাবা বেঁচে থাকেন, তবে তাদেরকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ত্ব দিন। তার কথায়  অবশ্য়ই গুরুত্ত্ব দিন। তার প্রতি বিশ্বাস রাখুন। অথবা  যার সাথে কথা বললে আপনার ভালো লাগে, যিনি আপনার বাড়িতে এলে আপনার ভালো লাগে, যার বাড়িতে গেলে আপনার ভালো লাগে, হতে পারে সে আপনার অনেকদিনের বন্ধু, হতে পারে সে আপনার অফিসের বস,  হতে পারে সে আপনার পাড়ার কোনো বয়স্ক ব্যক্তি। যাকে  আপনি মনের কথা মনখুলে বলতে পারেন, যার কাছে আপনি শান্তনা পান, স্বস্তি পান, যার কাছে আপনি প্রশ্রয় পান, এমন একব্যক্তিকে নির্বাচন করুন, যাকে  আপনার বুদ্ধিমান বলে হয়।দেখুন, গুরুভিন্ন আমাদের চুরিবিদ্যাও রপ্ত হতে পারে না। জীবনভর বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য, এইসব অভিজ্ঞ ব্যক্তির কথার অনেক গুরুত্ত্ব। এর মধ্যে কোনো রহস্যের সন্ধান করতে যাবেন না। বিজ্ঞান সম্পর্কে এমনকি সহজপাঠ পড়তে গেলেও একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের প্রয়োজন, তেমনি জীবনবিদ্যা অর্জন করবার জন্য একজন অভিজ্ঞ মানুষের খুব প্রয়োজন। একটা জিনিস জানবেন, সামনের দিন কেমন হবে, তা আপনি জানেন না , কিন্তু যিনি এই বয়স পেরিয়ে গেছেন, তিনি জানেন, কোনো বয়সে কি সমস্যা আসতে  পারে।  আর তার সমাধান কিভাবে করতে হবে। একটি নয় বছরের কন্যা জানেনা, একদিন তার ঋতুস্রাব শুরু হবে। তো আকস্মিকভাবে এই অবস্থার মধ্যে পড়লে, সে ঘাবড়ে যাবে। এমনকি কান্নাকাটি শুরু করে দিতে পারে।  কিন্তু যখন সে মা-মাসির কাছে, বা দিদির কাছে, বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হয়, তখন সে এটিকে জীবনের স্বাভাবিক অবস্থা বলে ভাবতে শুরু করে।  এবং এই অবস্থায় আমাদের কি করা উচিত সে সম্পর্কে সতর্ক হয়ে যায়। 

অর্জুনের মধ্যে যুদ্ধ সম্পর্কে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। আর মন মোহগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল। সখা শ্রীকৃষ্ণের কাছে সে নিজেকে সমর্পন করে বলেছিলো, আমাকে পথ দেখাও। আচার্য্য শঙ্কর তার বিবেক চূড়ামণি গ্রন্থে - শিষ্য বলছেন, হে গুরুদেব, আমি জন্ম-মরন তরঙ্গ-সংকুল সমুদ্রে পড়েছি, এই কষ্ট  থেকে আমাকে রক্ষা করুন। 

হিন্দুদের মধ্যে দ্বিজ হবার একটা প্রথা আছে। কুলগুরুর একটা প্রচলন আছে। যদিও আজকাল আর সেইসব কুলগুরুর সাক্ষাৎ আর পাওয়া যায় না। নির্ভরতায় একটা স্বস্তির ভাব জাগে মনে। সমর্পণের মধ্যে  একটা শান্তি আছে। স্বাভাবিকভাবে জীব অজ্ঞান হয়ে জন্মায়। তো জীবনপথে চলতে গেলে, তার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করতে হয়। চোখে তো জগতের দৃশ্য দেখতে পায়। তাকে ভাষা শিখতে হয়, মনের ভাব প্রকাশ করবার জন্য , তাকে জানতে হয়, কোন জিনিসের কি নাম ।  কোন  জিনিসের কি উপকার বা অপকার।  কোনটা খেলে ভালো হবে, কোনটি খেলে খারাপ হবে। কিসে হাত দিলে হাত পুড়তে পারে, কিসে হাত দিলে হাতে ঠান্ডা লাগবে। কোন জিনিসের কেমন স্বাদ।  ইত্যাদি ইত্যাদি জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা কারুর না কারুর সাহায্য ভিন্ন আমরা বাঁচতে পারি না। আসলে কোনো মানুষই একা বাঁচতে পারে না। আমরা সবাই সবার সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকি। তো বাহ্যিক স্বাভাবিক  জীবনে যেমন আমাদের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন, তেমন সমস্যা সংকুল জীবনে আমাদের মানসিক শরীরকে সাহায্য করবার জন্য প্রয়োজন একজন প্রকৃত জ্ঞানী , যিনি আমার প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন, যিনি আমাকে বিপদের দিনে সঠিক পথের  সন্ধান দিতে পারেন, এমন একজন মানুষের খুব প্রয়োজন। 

জীবনের দুটো দিক, একটা হচ্ছে জীবন সমস্যা সংকুল, জীবনবোধ মানেই অভাব বোধ,  জীবন মানেই মৃত্যু থেকে বাঁচার লড়াই। আবার অন্যটি হচ্ছে, জীবন মানে আনন্দ। সমস্যা সমাধানে আনন্দ, অভাব মেটানোতে আনন্দ, আবার মৃত্যুকে হারিয়ে বেঁচে থাকবার আনন্দ। সমস্যার জন্য, আমাদের আগবাড়িয়ে কিছুই করতে হয় না। জন্মের পর থেকেই শরীরের খাদ্যের অভাব বোধ হয়, জীবন শুরুতেই স্বাসের অভাববোধ হয়। আর এই অভাবকে মেটাতে গেলে আমাদের ক্রিয়াশীল হতে হয়। তাই এই পৃথিবীকে বলা হয়, কর্ম্ম-জগৎ। এই জগতে কর্ম্মহীন হয়ে কেউ থাকতে পারে না। আর কর্ম্মের গুড় রহস্যঃ আমরা জানি না।  কি করলে কি হবে, তা আমরা জানি না। তবুও কর্ম্মহীন হয়ে থাকতে পারি না। আর ভুল কর্ম্মের জন্য, জন্য আমাদের শাস্তি পেতে হয়। 

 ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলছেন, বিকারহীন, মরনহীন, সদ্বস্তুকে জানতে গেলে আমাদের অন্তরাত্মাকে জাগাতে হবে। আর এই অন্তরাত্মাকে জাগাতে গেলে, আমাদের শুধু শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ করা বা এই সম্পর্কে আলোচনা করাই  যথেষ্ট নয়।  এর জন্য দরকার আমাদের অনুভূতিশক্তিকে শক্তিশালী করা। আমাদের অন্তরে যে আলোকরাশি প্রজ্বলিত আছে, সেই অন্তর্লোকের প্রতক্ষ্য অনুভূতি চাই। এখন কথা হচ্ছে, এই দেহের মধ্যে সেই আত্মজ্যোতি বিরাজ করছে, তবে তা আমাদের কেন উপলব্ধ হচ্ছে না, আর কিভাবেই বা এই আত্মজ্যোতিকে আমরা প্রতক্ষ্য করতে পারবো।  আর এই আত্মজ্যোতি প্রতক্ষ্য করলেই বা আমাদের কি এমন পরিবর্তন হবে, যাতে করে আমরা আনন্দে থাকতে পারবো ? কেননা আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আনন্দে থাকা। 

দেখুন যা দেহ থেকে জন্মেছে, তাই দেহ।  আর যা আত্মা থেকে জন্মেছে তাই আত্মা। আবার গুলিয়ে গেলো।  দেহ থেকে যা জন্মেছে, সেটি দেহ তা না হয় বোঝা গেলো।  কিন্তু আমরা তো জানি আত্মা অজর, অমর, জন্মহীন, মৃত্যুহীন। তবে আত্মা থেকে আবার আত্মার জন্ম হয় নাকি ? দেখুন জল সবই সমুদ্রের, কিন্তু জল যখন বাটিতে বা ঘটিতে নিয়ে নেওয়া হলো, তখন আর তা সমুদ্র থাকলো না। অর্থাৎ একটা আবরনের দ্বারা জলকে আলাদা করে ফেলা গেলো।  এখন এই জল আবার একদিন সমুদ্রে মিশে যাবে, তা সে সুয্যরশ্মির মাধ্যমে হোক, বা নদীর মাধ্যমে হোক, একদিন আবার সেই জল সমুদ্রে মিশে যাবে। কিন্তু এই ঘটনা যে কবে ঘটবে তা আমরা কেউ  জানি না। 
আধ্যাত্মিকতা মানেই হচ্ছে, এই সময়কে ত্বরান্বিত করা। ডিম্ থেকে বাচ্চা হয়, কিন্তু সব ডিম্ থেকে কি বাচ্চা হয় ? হয় না, কারন পরিবেশ, প্রযত্ন ইত্যাদির অভাব। বীজ থেকে গাছ হয়, কিন্তু সব বীজ থেকে কি গাছ হয় ?  হয় না। এর জন্য দরকার উপযুক্ত পরিবেশ, ও যত্ন নেওয়া। কিন্তু সব বীজ বা ডিমের মধ্যে সম্ভাবনা  আছে। আর এই বীজ বা ডিম্ নিজে থেকে নিজের যত্ন নিতে পারে না। এর জন্য এক-জনের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। সেই ব্যক্তিটি হচ্ছেন, আমাদের মাতা-পিতা, শিক্ষক, আচার্য্য, গুরুদেব। যারা অজ্ঞান-জীবকে আলোর জগতে নিয়ে আসতে  পারেন, জ্ঞানের আলো  দেখাতে পারেন । 

সত্যদ্রষ্টা আচার্য যখন আধ্যাত্মিক দীক্ষা দেন, তখন জীবাত্মা আর পরমাত্মার সমন্নয় সাধন করে থাকেন। এই ব্যাপারটি এক চীনা সাধু তাও খুব সুন্দর ভাবে দেখিছিলেন। তিনি দুটো বীণার  তারকে একই শুরে বাঁধলেন। একটি বীনা পাশে রেখে, হাতে রাখা বীণাটিতে টুং করে আওয়াজ করলেন, অমনি পাশে রাখা বীণাটি টুং করে বেজে উঠলো। হাতে রাখা বীণাতে যখন তিনি যে সুর তুলছেন, পাশে রাখা বীণাতে সেই একই সুরের ধ্বনি উঠতে লাগলো। কারন দুটো বীণা একই সুরে  বাঁধা। যখন একটি বীণার তারের লয় পাল্টে দেওয়া হলো, তখন অপরটি বেসুরো আওয়াজ করতে লাগলো। আওয়াজ হলো, কিন্তু সুরের তাল বা প্রভাব কেটে গেলো। ঠিক তেমনি আমরা নিজে নিজে পড়তে পারি, নিজে নিজে ভাবতে পারি, নিজে নিজে কথা বলতে পারি, কিন্তু সেই ভাবনা, সেই অধ্যায়ন, সেই কথা কখনোই ঈশ্বরের সুরের সঙ্গে মিল খাবে না। ব্যক্তির আত্মা বা জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার তত্ত্বটি আমরা যদি না মেলাতে পারি, তবে জীবনের যে অসীম আনন্দ তা পেতে পারি না।  সবই তখন বেসুরো লাগে। অসহ্য লাগে। জীবন হয়ে ওঠে বিষময়।  কিন্তু যখন পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মেলবন্ধন হয়ে যায়, তখন জীবন এক অনাবিল আনন্দে ভরপুর হয়ে ওঠে।

আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের প্রথম দিকে এগুলোকে আমরা বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে চাই, কিন্তু আমার যে বিচার বা বুদ্ধি তা দিয়ে এই গুরু-শিষ্য সম্পর্ক মেলাতে পারি না। আর সন্দেহের দানা বাঁধে। গুরুর নিদেশ অনুযায়ী কাজ করতে হবে, তবেই গুরুর মাহাত্ম বোঝা যাবে। গুরুর নির্দেশ লাভ যথেষ্ট নয়, সাধকের উচিত সর্বক্ষণ নিজের সঙ্গে লড়াই করে যাওয়া। হৃদয়ের ব্যাকুলতা যত  বাড়বে, তত আমরা গুরুমহাত্ম বুঝতে পারবো। 

যিনি দুঃখের মধ্যে আছেন, তার সাথে কথা বলে আপনি কখনোই আনন্দ পেতে পারেন না। কিন্তু যিনি আনন্দে আছে, তার সাথে মেলামেশা করলে, আপনার মধ্যেও আনন্দের স্ফূরণ ঘটতে পারে। যথার্থ  গুরুদেব তিরস্কার করেন কৃত্তিম, কিন্তু তার হৃদয়ের ভালোবাসা অকৃত্তিম। উত্তম আচার্য্য তার শিষ্যের মধ্যে একটা তৃষ্ণা জাগিয়ে তোলেন, এমনকি আধ্যাত্মিক স্পন্দনসমূহ সঞ্চালিত করে শিষ্যের হৃদয়ে সঞ্চার করে দেন। কিন্তু এই কাজ তিনি তখনই করতে পারেন, বা করে থাকেন, যখন উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান পান। তাই বলা হয়ে থাকে, গুরুদেব শিষ্যকে খুঁজে বের করে আনেন। বীজকে প্রস্ফুটিত করেন। তাকে লালন-পালন করেন। একসময় তার সমস্ত আধ্যাত্মিক শক্তি দিয়ে তাকে আগলে রাখেন। 

স্বামী ব্রহ্মানন্দ  বলছেন,  দেখো যথার্থ গুরু যিনি ব্রহ্মানুভূতি লাভ করেছেন, তার সাক্ষাৎ পাওয়া আমাদের ভাগ্যের ব্যাপার। আর যদি এমন কাউকে ভাগ্যক্রমে পেয়েও যাও, তবু সবসময় বা তোমার প্রয়োজনের সময় তাকে নাও পেতে পারো। কিন্তু তোমার অন্তরে একজন আচার্য্য আছেন, তিনি হচ্ছেন তোমার শুদ্ধ মন। আর এই শুদ্ধমনের মধ্যেই বিরাজ করছেন, বিবেকরূপী গুরু । তাই আমাদের উচিত, ধ্যান, প্রার্থনা, উপাসনা জপ-তপ, যোগক্রিয়া ইত্যাদি দ্বারা আগে শরীর  ও মনকে শুদ্ধ করা। যখন তোমার মন শুদ্ধ হবে, তখন দেখবে, তোমার এই শুদ্ধমনই তোমাকে নির্দেশ পাঠাবে। অন্তর থেকেই তোমাকে সঠিক পথে চালিয়ে নিয়ে যাবে। এমনকি তোমাদের দৈনন্দিন কাজেও এই অন্তর্গুরু তোমাকে সঠিক পথ দেখাবে, তোমাকে সাহায্য করবে।  তোমার সমস্ত সমস্যার সমাধানের উপায়কে বলে দেবে।    
















 

   

            

       

  














 

Sunday 24 October 2021

জীবন জিজ্ঞাসা - আত্মহত্যা


জীবন জিজ্ঞাসা (৫.১০.২০২১)/আত্মহত্যা/ইচ্ছেপূরণ  

দেখুন, যার যেমন ভাব, তার তেমন লাভ। তবে একটা কথা বলি, নিজেকে চিনতে   চেষ্টা করুন, নিজেকে বুঝবার চেষ্টা করুন ।  আপনি কোন্ ভাবের মানুষ তা বুঝবার চেষ্টা করুন।  আপনার মধ্যে যে সুপ্ত গুন্ আছে, তাকে বিকশিত করবার চেষ্টা করুন। আপনার যে সৃজনশীল ক্ষমতা আছে, তাকে বুঝবার চেষ্টা করুন।  এবং সেই অনুযায়ী, আপনি আপনার জীবনকে সার্থক করবার চেষ্টা করুন। অন্যের কি ভালো আছে, আমাকে তাই হতে হবে, এই চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দিন।

 আপনি কৃষ্ণ ভক্ত। কৃষ্ণছাড়া আপনার  কাছে ঈশ্বর বলে  কিছু নেই। তো আপনি শ্রীকৃষ্ণের জীবনী পড়ুন। আপনি  শ্রীমদ্ভাগবৎ পাঠ করুন। আপনি  শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা পড়ুন। আপনি হরিবংশ পাঠ করুন।   আপনি যে স্থুলশরীর নন আপনি  একটা শুদ্ধ আত্মা শ্রীকৃষ্ণের এই কথায় আপনি বিশ্বাস করুন। ও এই সত্যে উপল্বদ্ধির স্তরে নিজেকে   নিয়ে যান।  আপনি কি জানেন, এই জন্মের পিতা মাতা, পূর্ব জীবনে আপনার সঙ্গে কোন সন্মন্ধে আবদ্ধ ছিলেন।  আপনি এই স্থূল দেহ ত্যাগের পরে,  কোথায় যাবেন , কোন দেহে স্থিত হবেন, তা কি আপনি জানেন ?   আপনি কি এই জীবন নিয়ে সুখী ?  এই সবকথা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জানতেন। এবং তিনি একজন জাতিস্মর ছিলেন। তিনি যোগেশ্বর ছিলেন।  তিনি জানতেন, তিনি এর আগের জীবনে  নারায়ণ নাম এই পৃথিতে এসেছিলেন, এবং নারায়ণ পর্বতে তপস্যা করে গিয়েছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে কখনো কেউ দুঃখী হতে দেখেন নি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন, সমস্ত অবস্থায় স্থির চিত্ত।  আপনি কি নিজের উদ্বেগকে দূর করতে পেরেছেন ? ভগবান শ্রীমুখ নিঃসৃত গীতায় এইসব প্রশ্নের জবাব আছে। কিভাবে, জীবন-সংগ্রাম করতে হয়। কিভাবে নিজেকে জানতে হয়, তার উত্তর আছে, এই গীতার বাণীতে। আপনি সেই অনুযায়ী সাধনায় লিপ্ত হন।  আমি কেবল শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত এই অবস্থায়, নিজেকে আটকে রাখবেন না। ভক্ত, ভগবানের উর্দ্ধে এই চতুর কথায় বিশ্বাস করে, নিজেকে প্রতারণা করবেন না। এই কথার যথার্থ অর্থ অনুধাবন করবার চেষ্টা করুন। 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ  বলছেন, কৰ্ম্মী অপেক্ষা জ্ঞানী শ্রেষ্ট, জ্ঞানী অপেক্ষা তপস্বী শ্রেষ্ট। তপস্বী অপেক্ষা যোগী শ্রেষ্ঠ।  অতয়েব, হে অর্জুন, তুমি যোগী হও। (৬/৪৬) আবার পরবর্তী শ্লোকে বলছেন, যোগীদের মধ্যে যিনি মদ্গতচিত্ত হয়ে আমার ভজনা করেন, সমস্ত যোগীর মধ্যে তিনি আমার সাথে অধিকতর যুক্ত। (৬/৪৭) 

 তো আমাকে আগে কর্ম্ম করতে হবে, জ্ঞান অর্জন করতে হবে, তপস্যা করতে হবে, তারপর যোগী হতে হবে।  একদম শেষে ভক্ত হতে হবে। নিস্কর্মা, অজ্ঞানী,, যার তপঃ সাধনা নেই, তার পক্ষে যোগী হওয়া সম্ভব নয়।  আর সত্যিকারের যোগী না হয়ে, কখনোই যথার্থ  ভক্ত হওয়া যায় না। যারা ভাবছেন, ভগবানের নামে  আবেগের বশে কেঁদেকেটে সটান ভক্ত হয়ে যাবো, তিনি ভক্ত নয়, ভন্ড। তারা অন্যকে নয়, নিজেকেই প্রতারণা করছেন। ভাবের ঘরে চুরি করছেন। 

--------------------  

জীবনে কত প্রশ্নের জবাব পাওয়া হলো না। আমরা নানান রকম কষ্ট  ভোগ করে থাকি।  শারীরিক, মানসিক, প্রাকৃতিক, আধ্যাত্মিক ইত্যাদি নানান রকম কষ্ট  জীবনে বেঁচে থাকার আনন্দকে কেড়ে নেয়।লোকে বলে, আমরাই আমাদের কষ্টের জন্য দায়ী। তো আমরা যদি দায়ী হই, তবে আমরা আমাদেরকে সংশোধনকরে নেই না কেন ? নাকি আমরাই চাই কষ্টে থাকতে ? বহু সৎ মানুষকেও দেখি দুর্দশাগ্রস্থ হতে। আমাদের ক্ষুদ্রবুদ্ধি, আমাদের সীমিত অন্তর্দৃষ্টি, এই কষ্টের কারন নির্ধারণ করতে পারে না। কিন্তু এইসব দুর্ভোগের হাত থেকে রেহাই পেতে পারতাম, যদি আমরা উত্তরণের কৌশলটি জানতাম আর তার প্রয়োগ করতে পারতাম। 

আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে যা ধরা পরে, তা হচ্ছে, সুকর্ম্ম সুখপ্রদ, আর দুষ্কৰ্ম্ম দুঃখপ্রদ। কিন্তু এই সুকর্ম্ম ও দুষ্কর্ন্মের সূক্ষ্মতত্ত্ব আমরা বুঝতে পারি না। আমাদের দৃষ্টিতে যা সুকর্ম্ম, আমাদের দৃষ্টিতে যারা সৎমানুষ তাঁদেরও যখন দুর্দশাগ্রস্থ হতে দেখি, তখন আমরা অবাক হয়ে যাই । আশ্রমবাসী মহাত্মাকে, ঠাকুর রামকৃষ্ণকে যখন শারীরিক কষ্ট  ভোগ করতে দেখি, তখন আমাদের সমস্ত বিদ্যা, সমস্ত জ্ঞান গুলিয়ে যায়। তখন আমাদের মনে  হয়, এইসব  প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। 

মহাত্মাগণ বলছেন, আগুন লাগার আগেই আমাদের সতর্ক হতে হবে। আর আগুন যদি লেগেই যায়, তার উৎস না খুঁজে আগুন নেভানোর কাজ করতে হবে। সব কিছুর, কার্যকারন সম্পর্ক,  আমরা বুঝতে পারবো, তার কোনো মানে নেই। মানুষের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ মন কর্ম্মের এই উচ্চ মূল্যবোধগুলোকে বুঝতে পারে। আর আমরা ফ্যাল ফ্যাল করে ম্যাজিশিয়ানের ম্যাজিক দেখে অবাক হই ।  কোনো কার্য্য-কারন ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না। তাই আমাদের উচিত মহাত্মাদের কথায় বিশ্বাস করা। তাদের উপদেশ অনুসারে কাজ করা। তাঁরা বলছেন, প্রার্থনা, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, শুধু শুভবুদ্ধির জন্য প্রার্থনা, আমাদের এই দুঃখের জীবনকে আনন্দময় করে তুলতে পারে। এতে করে, আমাদের মন শুদ্ধ হবে, হৃদয় নির্মল হবে। আর এই শুদ্ধ মন, নির্মল হৃদয়ে আনন্দ অবস্থান করবে। ফুলে যখন মধু জমে, তখন যেমন ভোমরা মধু পান করতে করতে গুন্গুন্ করে গান গায়, তেমনি শুদ্ধমনে, নির্মল হৃদয়ে ঈশ্বরের আনন্দময় সত্তা এসে আমাদেরকে মধুর সুরে গান শোনাবো, আমাদের মনকে  আনন্দে ভরিয়ে তুলবে ।

আমরা সবাই সেই সত্তার অংশ, যিনি সৎ-চিৎ-আনন্দম। 

 -------------------------- 

আত্মহত্যা একটা সামাজিক ব্যাধি।  আত্মহত্যার প্রবণতা  ঠেকাবেন কি করে  ? 

ঘটনা ১. আজ থেকে প্রায় পচিঁশ/ত্রিশ বছর  আগের কথা। শুনলাম আমাদের এক অফিসকর্ম্মী সুরেনের বড়ো ছেলে আত্মহত্যা করেছে। ও ব্যারাকপুরে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকে। দুই ছেলে। বড়টি  সেবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে, ছোটোটি  ক্লাস ওয়ানে  পড়ে। সুরেন তখন অফিসে । ওঁদের মা তখন বাজারে বেরিয়েছে।  পাড়ার একটি ছেলে, যে ওদের বন্ধু এসেছে, বাড়িতে খেলা করবে বলে। ওর মা বাজার থেকে বাড়িতে এসে দেখে, জানালার রডের সঙ্গে দড়িতে বড়ো  ছেলের গলা বাঁধা। নিথর দেহ। বাড়িতে পুলিশ এলো। সন্দেহ হলো, কেউ ওর গলা বেঁধে হত্যা করেছে। নাকি আত্মহত্যা ?  

ঘটনা ২ :আমাদের গ্রামের বাড়ির পাড়ায়, খবর রটে  গেলো, একটি মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে গাছের ডালে আত্মহত্যা করেছে। আমরা সবাই দেখতে গেলাম। দেখলাম, যে গাছে, মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে, সেই গাছটি কেটে ফেলা হলো। মেয়েটির সঙ্গে গাছেরও প্রাণ গেলো।  শুনলাম পাড়ার ছেলে শুভময় বাড়িছেড়ে পালিয়েছে। সেই শুভময়কে আর কোনোদিন পাড়ায় আমরা দেখিনি।  কিন্তু শুনেছি, সে নাকি আজও সেই গাছের কাছে আসে। কান্নাকাটি করে। 

ঘটনা ৩ : আরো একটি জোড়া আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিলো, আমাদের পাড়ায়।  কিন্তু সেটি আমি দেখতে যায়নি। দুইজন একসাথে, একটি ১৭/১৮ বছরের ছেলে, ও একটি ১৪/১৫ বছরের মেয়ে একই ঘরের মধ্যে ঘরের আড়ার  সঙ্গে দড়ি বেঁধে একই দিনে একই সাথে আত্মহত্যা করেছে। 

ঘটনা ৪ : মায়ের একমাত্র ছেলে।  পড়াশুনায় খুবই ভালো। বিদেশে চাকুরী পেয়ে সবে সেখানে  গেছে। একবছরের মধ্যে জানা গেলো, ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে। এই ঘটনা খবরের কাগজে বেরিয়েছিল।  ছেলেটিকে বিয়ে দেবার জন্য মা চেষ্টা করছিলো। মেয়েও ঠিক হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু ছেলেটি চাকুরী স্থল থেকে ছুটি পায়নি। আর অফিসের মধ্যেই আত্মহত্যা করেছে।  

এমনি অসংখ্য আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিদিন। এই কয়েকদিন আগে, আমাদের বাড়ির পার্শে এক ভদ্রমহিলা বছর ৬০ বয়স হবে।  নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে, আগুন লাগিয়ে মারা গেলেন। ভদ্রমহিলার এক ছেলে, এক মেয়ে। নিজে বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। গরিব পরিবার। শোনা যায়, ছেলেমেয়েরা চিকিৎসার জন্য, দৌড়োদৌড়ি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো। তাই মাকে যথেষ্ট নজর দিতে পারছিলো না। আর মা নিজেকে অসহায় ভেবে, আত্মহত্যার পথ বেছে  নেয়।   

আমাদের সবারই জানতে ইচ্ছে করে, মানুষ কেন আত্মহত্যা করে ? প্রথম ঘটনাটির কারন কি খেলা ? দড়ি নিয়ে খেলতে খেলতে গলায় ফাঁস লেগে গিয়েছিলো ? অনেকে সুরেনকে এই ঘটনার জন্য প্রতিবেশী ছেলেটির বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করতে বলেছিলো।  কিন্তু সুরেন তা করেনি।  ও বলতো, আমার ছেলে মারা গেছে, ওকে আর ফিরে পাবো না। কিন্তু আরো একটা সংসারে দুঃখের আগুন জ্বালাতে চাইনা। 

দ্বিতীয় ঘটনাটি, একটা মারাত্মক সামাজিক ভুলের ঘটনা। মেয়েটি নাকি বন্ধুর সাথে খেলতে খেলতে সন্তানের মা হতে চলেছিল। কুমারী অবস্থায়, সন্তানের মা হওয়া জৈবিক কারনে ঘটতে পারলেও,  সামাজিক দৃষ্টিতে  এটি অসম্ভব ঘটনা। সমাজ এই ঘটনাকে মেনে নেয় না। পরিবারের কেউও  এই আকস্মিক ঘটনার জন্য, ক্ষমা করে না। মৃত্যুই তাকে এই সমস্যার সমাধান এনে দিতে পারে। আর সেই পথই সে বেঁচে নিয়েছিল। 

তৃতীয় ঘটনা নিতান্তই  বাল্যপ্রেমের ঘটনা। এই প্রেমের মূল্য চুকিয়েছিলো, প্রেমিক-প্রেমিকা  নিজেদেরকে শেষ করে। সমাজ, পরিবার যাকে  স্বীকৃতি দিতে পারে না, সেই অস্বীকৃতির সম্ভাবনাই ডেকে আনে মৃত্যুর মতো বিভীষিকাকে। 

চতুর্থ ঘটনা মনে হয়, একাকীত্ত্বের যন্ত্রনা ও  অফিসের নিয়মের বেড়াজাল। যে ছেলেটি, মায়ের আঁচলে আঁচলে ঘুরেছে, একদিন তাকে মাকে ছেড়ে, উচ্চাশা  পূরণের জন্য, বিদেশে যেতে হয়েছিলো।  মাকে  ছেড়ে দিয়ে ছেলেটি বড্ড একা  হয়ে গিয়েছিলো। এই নিঃসঙ্গতা, এবং এর থেকে কিছুতেই বেরুতে না পারার  জন্য আত্মহত্যার  পথ বেঁচে নিয়েছিল। 

আত্মহত্যা সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানীগন বলে থাকে, এটি আত্মহত্যাকারীর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত। কেউ কেউ বলে থাকেন, যার মধ্যে একবার আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়, সে আর সেই প্রবণতা থেকে বেরুতে পারে না। ফলত দেখা যায়, বারবার সে আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকে। 

কিন্তু কেন এই আত্মহত্যা ? আর এর থেকে আমরা বেরুবো কি করে। আত্মহত্যার ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষণ করলে, আমরা কি দেখতে পাই ? 

১. অস্বীকৃত প্রেম - প্রেমে ব্যর্থতা - যা অনেক ক্ষেত্রে কিশোর কিশোরীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা এনে দিতে পারে। 

২. অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্খ্যা : নিজের উচ্চাকাঙ্খ্যা বা মা-বাবার উচ্চাকাঙ্খ্যা পূরণের অসফল হয়ে, নিজেকে অযোগ্য, অসহায় মনে হয়। তা সে স্কুল-কলেজের পড়াশুনার ফল বলুন, বা বাবার কাছ থেকে, প্রত্যাশিত জিনিস না পাওয়া হোক। আমি দেখেছি, বাবার কাছে, একটা সাইকেল চেয়ে না পেয়ে, একটা মেয়ে আত্মহত্যা করেছিল।  তো জীবনের  আকাঙ্খিত বস্তুকে না পাবার ব্যর্থতা থেকে নিজের মধ্যে একটা হীনমন্যতা গ্রাস করে।  আর এর থেকে  মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবার ইচ্ছেটাই  চলে যায়।। 

৩. সমাজের রক্তচক্ষু। নিজের ইচ্ছে ও সমাজের ইচ্ছেকে পূরণ করতে না পারলে, নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে। আমি যা করেছি, তাতে সবাই আমাকে ছিঃ-ছিঃ করবে। এই ভয় থেকে, অপমান থেকে বাঁচার জন্য, সুন্দর জীবনকে সে বিসর্জন দেয়। 

৪. শারীরিক ব্যাধি  জনিত যন্ত্রনা থেকেও অনেকে জীবনে বেঁচে থাকবার ইচ্ছে লোপ পেয়ে যায়। 

দেখুন, আমরা সবাই সৎ-চিৎ-আনন্দ স্বরূপের অংশ। জীবনে বেঁচে থেকে আমরা সবাই এই আনন্দের সন্ধান করে থাকি। অর্থাৎ নিজেকে খুঁজে থাকি। আসলে দেহ ধারণ করবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরকে  বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট করা হয়।  আর তাই আমরা বিষয়ের মধ্যেই নিজের অজ্ঞাতসারে  আনন্দ অর্থাৎ নিজের সত্তাকে খুঁজে ফিরি।   এই আনন্দের উত্তাপ গ্রহণ করবার জন্য, যদি আমরা বাঁধাপ্রাপ্ত হই তখন আমাদের বেঁচে থাকবার জন্য, যে ইচ্ছেশক্তি তা হ্রাস পায়।   আমরা সবাই হয়তো ভুলে  গেছি, আমরা দেহ ধারণ করি, আমাদের সংকল্প পূরণের জন্য, বাসনা পূরণের জন্য। তো যদি দেহ আমাদের এই কাজে বাধা দেয়, তবে আমরা বেঁচে থাকবার কোনো অর্থ খুঁজে পাই না। 

ভালোবাসা : মানুষ ভালোবাসার কাঙাল। এই ভালোবাসা ব্যতীত কোনো মানুষই বেঁচে থাকতে পারে না। জন্মের পর থেকেই, মায়ের স্নেহ, বাপের আদর, আত্মীয়স্বজনের অহযোগিতা, প্রিয়ার হাসি মুখ - একজন মানুষকে ধীরে বেঁচে বেড়ে উঠবার জন্য সহযোগিতা করে থাকে। এই জায়গায় সমাজের, পরিবারের একটা ভূমিকা থাকে। এই ভালোবাসায় যদি আঘাত আসে, বা বঞ্চিত হই, তখন আমাদের বেঁচে থাকবার ইচ্ছে ক্ষীণ হয়ে আসে। 

 উদ্দেশ্য : কোনো মানুষই উদ্দেশ্যবিহীন হয়ে জীবন ধারণ করতে পারে না। যিনি পাহাড়ের চূড়াতে অবস্থান করছেন, গভীর জঙ্গলে অবস্থান করছে, তারও একটা উদ্দেশ্য আছে। তো আমাদের সবার বেঁচে থাকবার জন্য, একটা উদ্দেশ্য চাই।  কথায় বলে আশায় বাঁচে চাষা।  অর্থাৎ প্রতিনিয়ত উজ্জ্বল  ভবিষ্যতের আশায় আমার বেঁচে থাকতে চাই। এই আশা থেকে বঞ্চিত হয়,  তারা হতাশ হয়ে, জীবনের উদ্দেশ্যকেই  ব্যর্থ মনে করে। তখন বেঁচে থাকবার আর কোনো অর্থ সে খুঁজে পায়  না।  ফলত সে নিজেকে শেষ করে দেয়।   

তো আত্মহত্যার প্রবণতা রোধ করতে গেলে, আমাদের সবার মধ্যে  সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। আপনার কাছের  মানুষের প্রতি, আপনি মনোযোগ দিন। সবাই  সবাইকে বুঝবার  চেষ্টা করুন। তাচ্ছিল্য নয়, উপেক্ষা নয়, তাহলেই  দেখবেন, জীবন আনন্দময় হয়ে উঠবে। যে কেউ ভুল করতে পারে, তাকে ভুল শুধরাবার সুযোগ করে দিন। কাউকেই অসহায় হতে দেবেন না।  তাহলে  দেখবেন, আত্মহত্যা করবার মানসিকতা দূর  হয়ে গেছে। 

সহ্য করবার ক্ষমতা বৃদ্ধি করবার চেষ্টা করুন। দেখুন, যেকোনো মানুষের জীবনেই সুখ-দুঃখ আসবে।  বিপর্যয় আসবে। দুঃখহীন জীবন বলে কিছু হয় না। তো দুঃখের মোকাবিলা করবার শক্তি অর্জন করবার জন্য, বিশ্বশক্তির কাছে প্রার্থনা করুন। তো দেখবেন, বিশ্বশক্তি আপনাকে মনের সাহস এনে দিয়েছে।  আপনি যখন  বিশ্বশক্তির আশ্রিত হয়ে যাবেন, তখন  আপনার ভয় দূর হয়ে যাবে, দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যাবে। জীবন হয়ে উঠবে অর্থপূর্ণ। 

আপনার সন্তান বা প্রিয়জনের  মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিলে তাকে প্রথমেই উচিত মনোবিদের কাছে নিয়ে যাওয়া। নেশাগ্রস্থদের নেশা নিরাময়ের চিকিৎসা  করা। তাকে বেশি করে, মানুষের মধ্যে মেলামেশার সুযোগ করে দেওয়া। তার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার মনের কথা জানবার চেষ্টা করা। এবং তার মনে যদি কোনো ভয়, ক্ষোভ, উদ্বেগ বা অশান্তির জন্ম হয়ে থাকে তবে তাকে নির্মূল করবার চেষ্টা করা উচিত। বাড়িতে বা তার কাছে, অস্ত্রশস্ত্র, বিষ জাতীয় ঔষধ, না রাখা। বেশি ঔষধ খাওয়া, বা খাওয়ানো একদম ঠিক নয়। সন্দেহভাজন ব্যক্তি থেকে তাকে দূরে রাখা উচিত । প্রতিনিয়ত তাকে আশ্বাস বাক্য দেওয়া। সন্তান যাতে মুখচোরা না থাকে, তার জন্য তাকে সহজ-সরল জীবনের মধ্যে নিয়ে আসা। সন্তানকে চোখে চোখে রাখা। এব্যাপারে, কারুর সাথে,  অহেতুক আলোচনা না করা। আত্মহত্যা জনিত কোনো সিনেমা বা চ্যানেল দেখতে না দেওয়া। এইসময় সৎসঙ্গের খুবই প্রয়োজন। 

সবশেষে বলি, ঠাকুরের কাছে সকল সন্ধ্যে প্রার্থনা করুন। প্রতিদিন নিয়ম করে প্রাণায়াম করুন, সবাইকে প্রাণায়ামের সুফলের কথা বলুন, এবং পরিবারের যেকোনো বয়সের সদস্যকে  প্রাণায়াম করতে উৎসাহ জোগান ।  বাড়ির সবাইকে তা সে বুড়ো-বাচ্চা  সবাইকে প্রাণায়াম কোরবার জন্য উৎসাহ দিন। আর জানবেন, প্রাণায়ামে একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে, তার মধ্যে সবসময়  সদর্থক চিন্তার উদ্রেগ হবে। জীবন  হবে গতিশীল। প্রকৃতির নিয়মে তো সবার একদিন স্থুল দেহ ছেড়ে চলে যেতেই হবে।  কিন্তু সেটি তখন আর অকালে হবে না। আত্মহত্যা অর্থাৎ নিজেকে শেষ করবার চিন্তা, তখন আর মাথার মধ্যে কিছুতেই আসবে না। দৈনন্দিন কাজের মধ্যেও একটা উৎসাহ দেখা দেবে। জীবন হবে উদ্বেগহীন।  নিরাশা তখন আর তাকে ঘিরে ফেলতে পারবে না। জীবন হবে উচ্চাশায় পরিপূর্ন, ও  কর্তব্য-পরায়ণ। একটা শান্তির বাতাবরণ তখন জীবনকে ঘিরে রাখবে। আমরা দীর্ঘ শান্তিময় জীবনের অধিকারী হবো আমরা । 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  

ধর্ম্মীয় গোড়ামীর উর্দ্ধে এক বিশেষ সাধন প্রক্রিয়া 

ধর্ম্মে উন্নতি করতে গোড়ামি না থাকাই  ভালো। কিন্তু এই গোড়ামি থেকে রেহাই পাবো কি করে ? 

ঋষি অরবিন্দ, তিনি একাধারে বিপ্লবী অন্য দিকে তিনি ঋষি। ঋষি অরবিন্দ একসময় তার সহধর্মিনী মৃণালিনী দেবীকে এক চিঠিতে লেখেন, ভগবান আমায় যে গুন্ দিয়েছেন, যে শিক্ষা যে  বিদ্যা দিয়েছেন, যে ধন দিয়েছেন, সবই ভগবানের। এসব যদি আমি নিজের জন্য ব্যবহার  করি, তবে চোর সাব্যস্ত হবো। আমার উচিত প্রয়োজনীয় টুকু রেখে বাকিটা ভগবানের প্রতিভূ ত্রিশকোটি ভাইবোনের জন্য, তাদের হিতের  জন্য এই সম্পদ বিলিয়ে দেওয়া। এই বিষয়ে তুমি আমার সহধর্ম্মিণী হবে ? এর উত্তরে মৃণালিনী দেবী, এক অদ্ভুত জবাব দিয়েছিলেন। লিখছেন, যেকোনো মতে  ভগবানের সাক্ষাৎ দর্শন করতে হবে। ঈশ্বর যদি থাকেন, তবে তার সাক্ষাৎ করবার কোনো না কোনো পথ অবশ্য়ই থাকবে। হিন্দুধর্ম্ম বলে, নিজের শরীরের মধ্যে নিজের মনের মধ্যে সেই পথ আছে। সেই পথে যাবার  নিয়মও তারা দেখিয়ে দিয়েছেন। সেইসব নিয়ম আমি পালন করতে আরম্ভ করেছি। আর এক মাসের মধ্যেই আমি অনুভব করতে পারলাম, হিন্দু ধর্ম্মের কথা মিথ্যে নয়। আমার ইচ্ছে তোমাকেও  সেই পথে নিয়ে যাই।    

আজকাল ধর্ম্ম ও গোড়ামির মধ্যে আর কোনো পার্থক্য নেই।  বরং বলা যেতে পারে, গোড়া-ধর্মান্ধ মানুষকেই বেশি ধর্ম্মিক বলে মনে হয়। ধর্ম্মের সঙ্গে গোড়ামি যেন মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। আবার আমরা মুখে অনেক বড়ো  বড়ো  কথা বলি, কিন্তু আমাদের মধ্যে যে গোড়া সংস্কার জগদ্দল পাথরের মতো, চেপে বসে আছে , তা আমরা সহজে ত্যাগ করতে পারি না। হিন্দু সমাজের জাতিভেদ নামক কু-প্রথা, গুরু-সর্বস্য  ধর্ম্ম  ও বিভিন্ন আচার-বিচারের মধ্যে গোড়ামিকে ভেঙে ফেলতে তৈরি হয়েছিল ব্রাহ্মসমাজ। যারা হিন্দুদের গোড়ামিগুলোকে যুক্তি দিয়ে খন্ডন করতেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, ব্রাহ্ম সমাজ আসলে হয়ে উঠেছিল, নতুন ব্রাহ্মণদের একটা  সমাজ। শ্রী বিজয় গোস্বামী সাধনজগতের প্রথম দিকে এই ব্রাহ্মসমাজের সভ্য ছিলেন। এবং অন্যতম প্রচারক ছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তার সত্য-সন্ধানী মন, বিদ্রোহ করে ওঠে। এই সম্প্রদায়ের প্রবর্তক ছিলেন, মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর। তো একদিন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যুবক বিজয়কৃষ্ণ প্রশ্ন করে বসলেন, আচ্ছা বলুনতো, জাতিভেদই যদি আমরা না মানি তবে আর এই উপবীত রাখা কেন ?  পৈতে রেখে, নিজেকে ব্রাহ্মণ প্রমান করা, আর জাতিভেদ না মেনে নিজেকে ব্রাহ্ম পরিচয় দেওয়া, এতো কপটাচার। দেবেন্দ্রনাথ বিজয়কৃষ্ণের এই কথায় পৈতে ত্যাগ করেন নি, কিন্তু যুবক বিজয়কৃষ্ণ পৈতে ত্যাগ করেছিলেন, সেই দিন থেকেই। এবং বিজয়কৃষ্ণ একদিন সত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন।    

আসলে, দৈনন্দিন জীবনের মতো, অধ্যাত্ম জীবনের ক্রিয়া-কর্ম্মেও   আমরা কিছু বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে দিয়ে চলতে ভালোবাসি। ধর্ম্মের মধ্যে কোনো ভেদ নেই।  ভেদ সৃষ্টি হয়, আমাদের মতবাদে। সত্য সন্মন্ধে আমাদের একটা একদেশদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আমরা আধ্যাত্মিক জগতের যে যে স্তরে  অবস্থান করি, সেখান থেকে সত্যের একটা রূপ দেখি। আমরা ভুলে যাই, যে আমরা  সত্যের যে রূপটি দেখছি, তা সত্যের নানান রূপের মধ্যে একটা রূপ মাত্র। বিশাল হিমালয়।  এর প্রাকৃতিক আবহাওয়া, রূপ, সৌন্দৰ্য্য, সর্বত্র এক নয়।  আবার এই বহুত্ত্বের মধ্যেও একটা একত্ত্ব আছে।  এই একত্ত্বকে উপলব্ধি গেলে, আমাদের উচ্চ থেকে উচ্চ স্তরে নিজেকে নিয়ে যেতে হবে। আমরা যে চেতন স্তর  থেকে  রুপগুলোকে উপলব্ধি করি, তা আসলে একদেশদর্শী।  পূর্ন সত্য নয়।  মহাত্মাগণ বলছেন, জ্ঞানাতীত নিরপেক্ষ স্তরে উঠতে পারলে, প্রকৃত স্বরূপ সন্মন্ধে আমাদের সঠিক উপলব্ধি হতে পরে। 

আমরা যখন যার উপাসনা করি, তখন আমাদের সেই চেতন স্তরের উপলব্ধি হয়।  আমরা যদি কৃষ্ণের উপাসনা করি, তবে আমাদের কৃষ্ণ চেতনা জাগে।  আমরা যখন মা-কালির উপাসনা করি, তখন আমাদের শক্তি-চেতনা জাগে।  আমরা যখন শিবের উপাসনা করি, তখন আমাদের মধ্যে শিব চেতনা জাগে।  এমনকি আমরা যখন, খ্রিস্টের উপাসনা করি, তখন আমাদের খ্রিস্ট চেতনা জাগে।  আমরা যখন বৌদ্ধের উপাসনা করি, তখন আমাদের মধ্যে বৌদ্ধ-চেতনা জাগে।  আবার আমরা যখন রামকৃষ্ণের উপাসনা করি, তখন আমাদের মধ্যে রামকৃষ্ণ চেতনা জেগে উঠতে পারে।  আমরা যখন গুরুনানকের  উপাসনা করি, তখন আমাদের নানক-চেতনা জাগে। আমরা যখন মোহাম্মদের উপাসনা করি তখন আমাদের মধ্যে মোহাম্মদের চেতনা জাগে। 

এইযে আলাদা আলাদা চেতন-স্তর, এই প্রত্যেক চেতন স্তর থেকেই আমরা সেই জ্ঞানাতীত চেতন স্তরে পৌঁছতে পারি।  তার কারন হচ্ছে, এঁদের সবাই, সেই জ্ঞানাতীত স্তরের সঙ্গেই যুক্ত। সূর্যদেবের অনেক গ্রহ আছে। গ্রহের আবার উপগ্রহ আছে। এঁরা  সবাই কিন্তু  সেই সূর্য্যের আলোতে আলোকিত।  তো যেখান থেকেই আপনি শুরু করুন না কেন, আপনি সেই সূর্য্যের আলোতেই আলোকপ্রাপ্ত হতে পাবেন।  এমনকি সেখান থেকেই আপনি সূর্য্যে যাবার রাস্তা পেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু যে রূপ, যে শক্তি, যে মহাত্মা আপনাকে প্রেরণা দিতে পারে না, তার সাধনায় কখনো সিদ্ধি আসতে  পারে না। আমাদের সেই মহাত্মাকেই অনুসরণ করা উচিত, যার সঙ্গে আমার মানসিক প্রবণতার সাযুজ্য আছে। যিনি আমাকে আমার আদর্শ অনুযায়ী তৃপ্তি দিতে পারেন। যিনি কৃষ্ণের উপাসনা করছেন, তাকে বুদ্ধদেবের উপাসনার কথা বললে, কাজে লাগবে না। আবার যারা বুদ্ধের উপাসনা করছেন, তাকে কৃষ্ণের উপাসনার কথা বলা ঠিক হবে না। এতে তার আধ্যাত্মিক জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে। ধর্ম্ম বিষয়ে যারা অন্ধ, তারা অন্যকেও অন্ধ করে রাখতে চায়। 

জগতে সমস্ত মহান অবতারগন,  পয়গম্বরগন, একই ঈশ্বর তত্ত্বের ভিন্ন-ভিন্ন প্রকাশ মাত্র। সকলের জন্য একজন-মাত্র  ত্রাতা আছেন, এমনটি নয়। ত্রাতাগন সবার জন্য হতে পারেন, কিন্তু আমরা সবাই আলাদা আলাদা, তাই আমাদের ত্রাতাও আলাদা আলাদা। তাই সকলের উপরে একজন ত্রাতাকে  চাপিয়ে দেওয়া, একটা ক্ষতিকারক মনোভাবের পরিচায়ক।  

এই ভুল বোঝাবুঝি শুধু অবতারবাদীদের ক্ষেত্রে নয়, দ্বৈত-অদ্বৈত বিশিষ্টাদ্বৈত বাদীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কেউ বলছেন, দেব-দেবী এমনকি অবতারগন সবই মায়ার দ্বারা সৃষ্ট। অতয়েব এঁদের উপাসনা ভ্রান্ত পথ। এইসব কথা যারা বলছেন, তাঁরাও নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিচ্ছেন। যারা অদ্বৈতবাদী তাদের স্মরণ রাখা উচিত, সর্বভূতেই একমাত্র ঈশ্বরের প্রকাশ দেখতে পাই। নির্গুণ ব্রহ্ম ও সগুন ব্রহ্মের মধ্যে গুরুত্ত্বের দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই। জ্ঞানাতীত নিরপেক্ষ স্তরে পৌঁছাতে গেলে, সর্বভূতে ঈশ্বরের ব্যাপ্তি - এই ভাবনা থেকে, এই উপলব্ধি থেকেই সেই উচ্চস্তরে পৌঁছানো যেতে পারে। 

প্রথমে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, ঈশ্বর আমার অন্তরে অবস্থান করছেন। তারপরে উপলব্ধি করতে হবে, এই একই ঈশ্বর অন্য সবার  অন্তরে অবস্থান করছেন। এর পরে এই নাম-রূপের অতীতে তাঁর অবস্থান উপলব্ধি করতে হবে।  সবসময় মনে রাখতে হবে, জগৎ ব্রহ্মময়। জগৎ পরিবর্তনশীল হলেও, সময়ের নিরিখে জগৎ অসৎ নয়।  কেননা, জগতের মধ্যেই ব্রহ্ম বিরাজ করছেন। তো ব্রহ্মকে স্বীকার করলে, জগৎকে অস্বীকার করা চলে না। 

আমাদের মতো সাধারণ ঈশ্বর অনুসন্ধানীর বিড়ম্বনা হলো, আমরা আমাদের নিজেদের পছন্দমত ব্যক্তি-রূপটিকে ধরে রাখতে চাই। আর এই স্বাচ্ছন্দ্যের অবস্থান থেকে আমরা নিজেকে আলাদা করতে পারি না। এটি আসলে আমাদের জড়বাদী মানসিকতার জন্য হয়ে থাকে। কেননা আমরা নিজেকে এই জড় শরীরের মধ্যে আবদ্ধ রেখে, নিজেকে শরীর ভেবে নিশ্চিন্ত আছি। আর এই জড়রূপী, দেবতামূর্তি বা দেহধারী অবতারগনকে, আমার থেকে আলাদা করে ঈশ্বরের জায়গায় আসন পেতে দিয়েছি। এমনকি আমরা ভাবছি, এটাই আধাত্মিক জগতের উচ্চতর স্থান। 

যদিও আমরা যারা শরীর-সর্বস্য জীব, আমাদের  পক্ষে অনন্ত চৈতন্যের ধারণা  বা ধ্যান করা সম্ভব নয়। তবুও আমাদেরকে  এই কাল্পনিক জগতে কল্পনার সাহায্যে স্থাপন করতে বাধা কোথায় ? আমাদের দেহ সত্য, আমাদের ব্যক্তিত্ত্ব সত্য, আমাদের চিন্তাও সত্য। তাই আমরা যদি চিন্তা করতে পারি যে, আমরা এই দেহ থেকে পৃথক একটা সত্ত্বা।  যার নাম আত্মা বা অন্য কোনো কিছু, যা একটা বিশ্বব্যাপী শক্তি। অনন্তে যার পরিব্যাপ্তি। তার পরে, নিজেকে একটা আলোর বিন্দু,  অনন্ত ঈশ্বর-আলোকের অংশ হিসেবে কল্পনা করতে পারি। যে আলোকবিন্দু অসীম-অনন্ত আলোর অংশ  হিসেবে আলোর মধ্যেই ডুবে আছে। এই ভাবনার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে পারলে, নিজের জড়ভাবকে একদিন খর্ব করা যাবে। 

আবার একবার বলি - আমরা সবাই এক-একটি জীবাত্মা।  আর প্রত্যেকটি জীবাত্মা কতকগুলো  স্থুল-সূক্ষ্ম-অতিসূক্ষ্ম  শরীর নামক  আবরণের দ্বারা ঢাকা। প্রত্যেকের একটা করে স্থুল আবরণ   আছে,  প্রাণময় আবরণ  আছে, মনোময় , জ্ঞানময়, আনন্দময়, আবরণ আছে।  আর শরীররূপী আবরনে নিজেকে ঢেকে, জীবন নাটকে অভিনয় করছে, সেই আলোর বিন্দু, যার নাম আত্মা।  

আপনি যদি একটু গভীর ভাবে চিন্তা করেন, নিজেকে প্রশ্ন করেন, আপনার এই রূপ কিভাবে এলো ? আপনার ব্যাক্তিত্ত্বের  উন্মেষ কিভাবে হলো  ? এইভাবে চিন্তা করতে করতে দেখবেন, আপনার এই "আমি" ধারণা নিরাকার সত্তায় মিশে যাচ্ছে। আমরা এই নিরাকার সত্তার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতে পারি না।  কিন্তু আমরা যাদের মহাত্মা বলি, যাদের আমরা অবতার বলি, তারা সবাই এই নিরাকার পরম চৈতন্য সত্তার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম অনুভব করেছিলেন। আর চৈতন্যের সংস্পর্শে একবার এলে, আমরা জীবজগতের সীমানা ছাড়িয়ে  চৈতন্যের জগতের বিশ্বচেতনা অনুভব করে, ধন্য হই। 

সাধক সাধনায় যত অগ্রসর হতে থাকে, সে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে, সে এককালে নিরাকার ছিল, ধীরে ধীরে নিরাকার থেকে সাকার হয়েছে, আবার সে আকার থেকে নিরাকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। এটাই পরিণতি।  এটাই ভবিতব্য। যতদিন আমরা আকারে আসক্ত থাকবো, ততদিন আমরা জন্ম-মৃত্যুর চক্রে  আবদ্ধ  থাকবো। ভাবনা থেকেই আকারের জন্ম, আবার ভাবনাই আমাদেরকে নিরাকারে লীন করে দিতে পারে। নিরাকারে লীন হওয়াই ঈশ্বরপ্রাপ্তি। তখন মন এমনটা উচ্চস্তরে আপনাকে স্থাপন করে দেবে, যেন আপনি ঈশ্বরভূত।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

দুশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন (৪) 

জীবন-জমিতে কিভাবে ভালো অর্থকরী ফসল উৎপাদন করবেন ? 

আমার বাড়ির পাশে একটা ছেলে আছে। বয়স কত হবে - বড়জোর ত্রিশ-বত্রিশ। ছেলেটি লেখাপড়া বিশেষকিছু করেনি। প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পেরুতে পারেনি।    ওর বাবা একজন মাতাল। ওর বাবার কোনো আয় নেই। ওর মা পরের বাড়িতে কাজ ক'রে, সংসার চালায়।  সংসারে ছোটবেলা থেকে সে দেখে এসেছে, দারিদ্র আর ঝগড়াঝাটি ।  ওর মা ভীষণ ঝগড়ুটে। তথাপি একদিন নাকি ওর মা-বাবা  প্রেম করে বিয়ে হয়েছিল। কাছেই মামা বাড়ি।  ওর বাবা চেয়েচিন্তে মদ খেয়ে বাড়িতে আসে, আর মায়ের মুখের গালাগালি, এমনকি মারধর খেয়ে ঘুমিয়ে পরে। মাঝেমধ্যে বাড়ির সামনে রাস্তায় শুয়ে থাকে। মা-ছেলে মিলে বকাবকি করে, মারধর করে, বাড়িতে নিয়ে যায়।ছেলেটি এর মধ্যেও  প্রেম করে, একটা  বিয়েও  করেছিল, কিন্তু ওর মায়ের গালাগালি সহ্য করতে না পেরে ওর বৌ  বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।   পৈতৃকসূত্রে (আসলে ভ্রাতৃসূত্রে) ১ কাঠা জমি পেয়েছে। ধীরে ধীরে সে ওই একচিলতে জমিতে এখন একটা ২.১/২ তলা বাড়ি তুলেছে। বাড়িতে এখন সে পায়রার ব্যবসা করে, আরো অনেক পাখি কেনা বেচা করে। আরো একটা সে কাজ করে তা হচ্ছে, জমির বাড়ি কেনা বেচার  দালালি। কিন্তু তার সাফল্যের পিছনে রহস্যটা  কি ? দেখুন, আপনি গরিব ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছেন কি বড়োলোকের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছেন, সেটা বড়ো কথা নয়, কোনো অপরাধও নয়।  আপনি সারাজীবন গরিব থেকে যাওয়াটাই  অপরাধ। আপনি ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছেন কি শুদ্রের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছেন সেটা আপনার কোনো অপরাধ নয়, আপনি চিরকাল অজ্ঞান থেকে যাওয়াই  অপরাধ। জীবন হচ্ছে, অগ্রগতির সোপান। জীবন কেবল বইয়ে দেওয়া নয়।  জীবন অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানের পথে এগিয়ে যাওয়াই জীবন। জীবন একটা কর্ম্মক্ষেত্ৰ।  এখানে কর্ম্মের মাধ্যমে আমরা আমাদের ভবিষ্য়্ত্কে পাল্টে নিতে পারি।  যা কিনা স্বর্গের দেবতারাও পারে না। কারন স্বর্গের দেবতাদের কোনো কর্ম্মফল সঞ্চয় হয় না। কিন্তু মানুষের কর্ম্মফল সঞ্চিত হতে পারে।   এখন কথা হচ্ছে, আপনি কি জানেন, আপনার জীবনের উদ্দেশ্য কি ? কেন আপনি এই পৃথিবীতে এসেছেন ? আর এর জন্য আপনাকে কি করতে হবে ? আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই এই প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর জানি না। একজন শিশুকে প্রশ্ন করলে, সে বলবে, সে ডাক্তার হতে চায়, সে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। সে পাইলট হতে চায়।  ইত্যাদি ইত্যাদি।  কিন্তু একজন পরিণত মানুষ জানেই না তার জীবনের লক্ষ কি ? কিন্তু আপনি যদি আপনার ইচ্ছেমতো জীবন পেতে চান, তা সে এই জীবনেই হোক, বা পরবর্তী জীবনে হোক, আপনাকে আগে লক্ষ স্থির করতে হবে। আপনি কোথায় যাবেন, সেটা না জানলে, আপনাকে টিকিট বিক্রেতা আপনাকে টিকিট  দেবে না। বিভ্রান্ত মানুষ কখনও গন্তব্য ঠিক করতে পারে না।  তাই তারা জীবনের ইতস্তত গন্ধ-অন্ধ গলিতে সারাজীবন ঘুরে ঘুরে মরে। তো আপনাকে একটা লক্ষ ঠিক করতে হবে। আর এই লক্ষে পৌঁছোবার জন্য, আপনাকে একটা পরিকল্পনা করতে হবে। আপনি কি চান, সেটা একটা কাগজে লিখে ফেলুন। এরপর আপনার বাঞ্চিত বস্তু বা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য, সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ের কথা ভেবে, লিখে ফেলুন। এই সম্ভাব্য উপায়ের মধ্যে কোনটি সর্বোৎকৃষ্ট ও আপনার পক্ষে সহজ বলে মনে হয়, সেটিকে নির্দিষ্ট করুন। দেখুন, আমাদের জীবনে কি দরকার ? সুস্থ  দেহ,  মনের শান্তি, আর জীবনে সাফল্য। ঈশ্বর আপনাকে এগুলো পাবার জন্য, সমস্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রীর যোগান দেবেন। কিন্তু ভগবানকেও আপনাকে কিছু দিতে হবে। আপনার ভিতরে একটা ইস্হেশক্তি আছে। সেই ইচ্ছেটাকে সাফল্যের ভেলায় চাপিয়ে দিতে হবে।  সাফল্যের ইচ্ছেটা ভগবানকে  দিতে হবে। প্রত্যেকের কাছে আরো একটা জিনিস আছে আর সেটা হচ্ছে, প্রশ্ন করবার শক্তি - আর ভগবানের কাছে আছে সেই প্রশ্নের উত্তর। প্রত্যেকের আছে চাইবার শক্তি, আর ভগবানের কাছে সেই জিনিস দেবার শক্তি। কিন্তু ভগবানের কাছে কিছু চাইতে যাবেন না। যে ছেলে খাই খাই করে, তাকে মা গুরুত্ত্ব দেয়  না। বরং বকুনি দেয়।  কিন্তু যে ছেলে খাবারের জন্য, মায়ের কাছে বায়না করে না, মা সেই সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত নজর দিয়ে থাকেন। তাই ভগবানের কাছে চাইতে যাবেন না, বরং ভগবানকে বলুন, হে ভগবান বাঞ্চিত বস্তু পাবার জন্য, আমার সংকল্প পূরণের জন্য, আমাকে উপায় বলে দাও। এখন ভগবানের কাছে যখন আপনি প্রশ্ন করবেন, তখন ভগবান আপনাকে কিছু টাস্ক দেবেন, আর বলবেন, এগুলো করলেই তোমার বাঞ্চিত ফল তুমি পেতে পারো। এখন আমাকে সেই টাস্কগুলো করে ভগবানকে দেখাতে হবে।  তবেই তিনি আমাদের পুরস্কৃত করবেন। তাই শুধু স্বপ্ন দেখলে হবে না। শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখলে, আপনাকে বিফলতার যন্ত্রনা ভোগ করতে হবে। কিন্তু যারা স্বপ্ন পূরণের দাওয়াই-এর খোঁজ করে, তারাই স্বপ্ন পূরণ করে জীবন স্বার্থক করতে পারে। আমাদের শাস্ত্র পূরণে অনেক যাগযজ্ঞের কথা বলা আছে, যাতে নাকি আমাদের সমস্ত আশা পূরণ হতে পারে, এমনকি আমাদের শত্রুদের নাশ করতে পারে এই যাগযজ্ঞ। কিন্তু যাগযজ্ঞ মানে হচ্ছে উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যথাবিধি কর্ম্ম করা।  অর্থাৎ  বুদ্ধিসহযোগে কর্ম্ম সম্পাদন করা। দেখুন আপনি যখন সাফল্যলাভ করতে চাইবেন, তখন আপনাকে অবশ্যই  কিছু না কিছু দিতে হবে। সাফল্য কোনো সস্তা বস্তুও  নয়। আবার ভীষণ দামিও নয়। তবে, এখানেও দরকষাকষির ব্যাপার আছে। যারা লক্ষপূরণের জন্য, কঠোর পরিশ্রম করতে প্রস্তুত। তারা একটা রাস্তা পেয়ে যাবেন।   কিন্তু শুধু পরিশ্রম করলে হবে না, আপনার লক্ষবস্তুর বিষয়ের উপরে জ্ঞান অর্জন করতে হবে, কাজে যাবার আগে নিজেকে প্রস্তুত  করতে হবে। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা  থাকতে হবে। তবে কর্ম্ম আপনাকে আশানুরূপ ফল প্রদান করবে।  আমরা প্রথমে যে ছেলেটির কথা শুনেছি, সেই ছেলেটির কিছুই ছিল না। না বিদ্যে-বুদ্ধি না টাকা পয়সা, না আত্মীয়স্বজন। কিন্তু  তার  মাথার মধ্যে ছিল দুটো জিনিস এক প্রবল ইচ্ছেশক্তি, আর একটি হচ্ছে মাথার মধ্যে একটা পরিকল্পনা। ছেলেটা আমাকে  বলেছিলো, সে শুধু বাড়ি-জমির ক্রেতা-বিক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতো।  আর এর জন্য সে জনবহুল জায়গায়, রেলস্টেশনে নিজের নাম ঠিকানা দিয়ে পোস্টার সেটে রাখতো। এবং প্রতিদিন কিছু সময় সেই পোস্টারের আছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পোস্টার পড়বার ভান করতো ।  আর তার দাঁড়িয়ে থাকাটাই এক  অদ্ভুত কাজ করতো।  তাকে দাঁড়িয়ে পোস্টার পড়তে দেখে  অন্যরাও  সেই পোস্টার পড়তে লাগলো। এই কাজটুকুই তাকে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করতে মন্ত্রের মতো শক্তি জুগিয়েছিল। শুধু একটা পরিকল্পনা। ইচ্ছেশক্তি, পরিশ্রম করবার মানসিকতা ও সঠিক পরিকল্পনা, আপনার জীবনে অবশ্যি সাফল্য এনে দেবে। সুতারং জীবনে সাফল্য পেতে গেলে, একটা সুষ্ঠূ পরিকল্পনা করতে হবে। পরিকল্পনাবিহীন কর্ম্ম নিষ্ফলা। এমনকি কুফল প্রদান করতে পারে।আর এই  পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজে নিযুক্ত হতে হবে। সাফল্য তখন আপনার হাতের মুঠোয় এসে যাবে। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

--------------------- 

মানুষের দুঃখ যাবে কবে  ?

আমার মাঝে মধ্যে হয়, যে মানুষ নিজেই নানান রকম দুঃখের মধ্যে দিন অতিবাহিত করছে, সে কি করে অন্যের দুঃখের নিবৃত্তি করবে ?  যে মানুষ নিজেই খেতে পায়  না, সে অন্যের ক্ষিধে কিভাবে মেটাবে ? তবু দেখি, মানুষ মানুষের উপকার করবার জন্য, উঠেপরে লেগে আছে। যতদূর জানি, মানুষ, শুধু মানুষ কেন সমস্ত জীবজন্তু সবথেকে নিজেকেই ভালোবাসে। আবার এও মনে হয়, মানুষ নিজের দুঃখে যত কষ্ট পায়, তার থেকে অধিক কষ্ট  পায়, অন্যের দুঃখ মোচন করতে না পারার  জন্য। মানুষ যে কেন মানুষকে ভালোবাসে, এটাও আমার বোধের বাইরে। 

ভগবান বুদ্ধ এসেছিলেন, মানুষের দুঃখ নিবৃত্তি করবার জন্য, ভগবান বুদ্ধ চলে গেছেন।  কিন্তু মানুষের দুঃখ কি গেছে ? ঈশ্বরের সন্তান যিশুখ্রিস্ট এসেছিলেন, মানুষের দুঃখ দূর করবার জন্য।  কিন্তু মানুষের দুঃখ কি চলে গেছে। ভগবান রামচন্দ্র, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এসেছিলেন, ধর্ম্ম-রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে।  কিন্তু ধর্ম্ম রাজ্য কি প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বিবেকানন্দ মানুষের দুঃখ দেখে, ঈশ্বরকে ছেড়ে মানুষের দুঃখ দূরকরবার জন্য বলেছেন, নিজেও অক্লান্ত পরিশ্রম করে, অকালে দেহ ছেড়েছেন।  কিন্তু মানুষের দুঃখের সীমানা তাতে এতটুকু কমেছে কি ? কেন মানুষ মানুষের উপকার করতে চায়, আর কেনই বা সবাই দুঃখে থাকে ? কে দেবে এর উত্তর ?   আমাদের পন্ডিতমশাই একদিন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সবাই যেন সবাইকে ঠকাতে চাইছে। আর এতে করে আমরা সবাই আসলে অন্যের কাছে ঠকে  যাচ্ছি। কিন্তু ব্যাপারে যদি উল্টো হতো, অর্থাৎ আমরা সবাই সবাইকে যদি জিতিয়ে দিতে চাইতাম, তবে হয়তো আমরা সবাই জিতে যেতাম। হায়রে, পণ্ডিতমশাইয়ের এই আশা যদি পূরণ হতো !

--------------------------------- .

   


     


         













Monday 18 October 2021

প্রশ্নের উত্তর কেন দেয় না ? এতো কষ্ট কেন ?

 


প্রশ্নের উত্তর কেন দেয় না ? জানেনা তাই, দেয় না। 

গল্প ১. একবার এক পাগলা সাধুর কাছে, জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সাধু জীবনের উদ্দেশ্য কি।  কিসে জীবন সার্থক হবে ? তো পাগলা সাধু একটি আশ্চার্য্য জবাব দিয়েছিলো। সেটা হচ্ছে ধরো-মারো-কাটো-খাও।  সাধু যে সত্যি পাগোল, সেটা বুঝে নিয়ে তারা সবাই চলে গেল। পাগলের কাছ থেকে কিই বা আশা করা যেতে পারে ? সাধুকে পাগোল-ছাগল ইত্যাদি বলে গালাগাল দিতে দিতে তারা চলে গেল। সাধু হাসতে  লাগলো। একজন মূর্খ,  সাধুর কাছে বসে রইলো।  তো সাধু জিজ্ঞেস করলো।  তুই বসে আছিস কেন ? তো সে বললো আমি কিছু বুঝি নি তাই বসে আছি। আমি বোকা তো তাই কিছু বুঝিনি।   আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন। তো সাধু বললো, কে বললো তুই বোকা, তুই ব্যাটা আসলে চালাক। তাই এখনো বসে আছিস। যা ভাগ। তো মূর্খ বসেই থাকলো। সাধুকে তামাক সেজে দিলো। কল থেকে জল এনে দিলো।  বাড়ি থেকে খাবার এনে দিলো।

সাধু খুশি হয়ে বললো - শোন  ধরো-মারো-কাটো-খাও এর মানে হচ্ছে। যথার্থ গুরুকে ধরো। গুরুর কাছে মরার মতো পড়ে থাকো। কামনা বাসনাগুলোকে মারো। মায়ার বাঁধন কাটো। তার পরে পরমানন্দ ভোগ করো। মূর্খ সেই হয়, যে ঈশ্বর ছাড়া কিছু বোঝে না। পাগল সেই হয়, যে ঈশ্বরের প্রেম পেয়েছে। প্রেমেই তো মানুষ পাগল হয়।

গল্প ২ : মূর্খ ডাকাতের হাতে ধরা পড়েছে সর্বজ্ঞ নারদ। নারদ ব্রহ্ম-জ্ঞানী।  পাপ পুণ্যের পার্থক্য বোঝেন। নারদ ডাকাতকে তার মধুর বাণী দিয়ে, বোঝাতে চেষ্টা করলো ডাকাতি করা মহাপাপ।  আর সেই পাপের  ভাগ একমাত্র ডাকাতকেই নিতে হবে।  যাদের জন্য সে এই ডাকাতি করছে,  এই পাপের  ভাগ তারা কেউ নেবে না। এইসব ছেঁদো কথায় ভুলবার পাত্র নয়, ডাকাত।  বরং উল্টে চিৎকার করে নারদমুনিকে গালাগাল দিতে লাগলো।  কথায় কাজ হচ্ছে না দেখে নারদ ডাকাতকে পিতা মাতা স্ত্রী-সন্তানদের কাছে পাঠালো। সেখান থেকে ফিরে ডাকাত অন্য মানুষ হয়ে গেলো। শুধু কথায় কাজ হয় না, অভিজ্ঞতার মধ্যেই প্রকৃত শিক্ষা হয়। 
গল্প তিন : এক সাধু মহারাজ মানুষের সমাবেশে কাছে প্রতিদিন ঈশ্বরের কথা বলতেন। আর তার ড্রাইভার সাথী প্রতিদিন একই কথা বিভিন্ন সমাবেশে শুনতেন। তো একদিন ড্রাইভার বললো,  আপনি তো প্রতিদিন একই কথা বলেন, আর সবাই কেমন মুগ্ধ হয়ে শোনে। আমিও এসব বলতে পারি। তো ঠিক হলো, এর পরদিন ড্রাইভার বক্তৃতা করবে, আর সাধু মহারাজ ড্রাইভার সেজে গাড়িতে বসে থাকবে। ড্রাইভার কিন্তু খুবই সুন্দর ভাবে বক্তৃতা করলেন। সবাই হাত তালি দিয়ে প্রশংসা করলো। শেষে প্রশ্ন- উত্তর পর্বে এসে, ড্রাইবার ঘাবড়ে গেলেন। সমস্ত কঠিন  প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই।  কিন্তু সাধুসঙ্গে উন্নত ড্রাইভার, বুদ্ধি করে বললেন, এসব সহজ সহজ  প্রশ্নের উত্তর আমার ড্রাইভার বলে দেবে।  বলে সে  ড্রাইভাররুপি সাধুমহারাজকে  ডেকে দিলেন। তো শুধু শুনলে কাজ হয় না।  
গল্প চার : আমি এক (স্বঘোষিত)ভগবানকে জানতাম, নাম বললে, আপনারাও তাকে চিনতে পারবেন। তিনি ভীষণ জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তাকে দেখতাম, সবসময় বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করতেন ।  কেউ হয়তো কৃষ্ণভক্ত, এসেছেন তার সাথে কৃষ্ণের আশ্চার্য্য ঐশ্বরিক গুণাবলী নিয়ে আলোচনা করতে। স্বঘোষিত  ভগবান,  শ্রীকৃষ্ণের  বদনাম করা শুরু করে দিতেন। আর এতে করে ভক্ত রেগে মেগে গালাগাল করতে করতে চলে যেতেন। তাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলতেন, ও ব্যাটা কৃষ্ণের সমর্থনে লোক খুঁজছে। কৃষ্ণকে খুঁজছে না। আমাকে ওর দলের লোক ভেবেছে। তো লক্ষ স্থির করুন, আর লক্ষে পৌঁছাবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন। 
গল্প পাঁচ : অর্জুনের মতো মহামানবের মনে প্রশ্ন জেগেছিলো, উত্তর দিয়েছিলেন, স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। এতে অর্জুনের লাভ হয়েছিল কিনা জানি না, তবে সমস্ত মানবজাতির লাভ হয়েছে। মহাভারতের যুদ্ধের পরে,অর্জুন একসময় সখা শ্রীকৃষ্ণকে বলেছিলেন, আমি তোমার সেই মূল্যবান কথা বিস্মৃত হয়েছি, আমার কিছুই মনে নেই।  তুমি যদি  আরো একবার  এই প্রসঙ্গে উপদেশ দাও । আর এই প্রশ্নের জবাব  আছে মহাভারতের অনুগীতা পর্ব্বে। 
সত্য হচ্ছে : আমরা বাইরে প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আছে নিজের মধ্যে। প্রশ্ন তাকেই করা যায়, যার প্রতি আমার শ্রদ্ধা জাগ্রত হয়েছে।  ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, গুরুসেবা করবে, গুরুকে প্রশ্ন করবে। গুরুসেবা অর্থাৎ গুরুকে তৃপ্ত করা।  আর গুরু তখনই তৃপ্ত হন, যখন শিষ্য গুরুর বাক্য অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। গুরু বলেছেন, জমিতে বৃষ্টির জল ধরে রাখতে।  তো শিষ্য মাটি দিয়ে আলকে বেঁধে রাখতে পারছে না দেখে, সারারাত আলের উপরে শুয়ে জল আটকাবার চেষ্টা করতে লাগলো। 

গুরু বলেছেন, অগ্নিকে প্রজ্জ্বলিত করে, শীতের রাতে বাইরে সারারাত ধ্যানে বসে থাকতে। তো, শিষ্য ধ্যানে বসে  ঘুমিয়ে পড়েছে, আর কখন অগ্নি নিভে গেছে। শীতের রাতে শিষ্য বাধ্য হয়ে গুরুদেবের কাছে দেশলাই চাইলেন, আগুন জ্বালাবার জন্য । গুরুদেব রেগে জ্বলন্ত অগ্নিকাষ্ঠ দিয়ে শিষ্যকে আঘাত করলেন।   
তাহলে শশাঙ্ক শেখরের কাজটা কি ? শশাঙ্ক শেখরের কাজ হচ্ছে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলা।  আর যার মধ্যে প্রশ্নের উদ্গিরণ হয়েছে, সে ব্যাটা প্রশ্নের উত্তর ঠিক খুঁজে পাবে। যার মধ্যে প্রশ্নরূপ বীজ  আছে, তার মধ্যেই উত্তররূপ বৃক্ষ  আছে। এর জন্য তাকে শশাঙ্ক শেখরের কাছে আসতে  হবে না। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর যেমন প্রশ্নকর্তার  নিজের ভিতরে আছে, উত্তর আছে প্রকৃতির মধ্যে। শশাঙ্ক শেখর সামান্য সাধারণ মানুষ মাত্র। সামান্য সাধক মাত্র। যার নিজের মধ্যেই ব্রহ্মজ্ঞান-এর অভাব, সে কি করে ব্রহ্মজ্ঞান দান  করবে ?  বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, শিক্ষক হবার যোগ্যতা তার নাই। যা কিছু লেখা, বলা,  এর উৎস অন্য কোথাও হয়তো স্বয়ং শশাঙ্ক-শেখরের (শিব) কাছেই আছে। 


মানুষ কোথা থেকে আসে, আবার কোথায় চলে যায় ?
 
জিজ্ঞাসু শিষ্য : মানুষ মরলে কোথায় যায় ? 

গুরুদেব : যেখান থেকে এসেছিলো সেখানেই চলে যায়। 

শিষ্য : কোথা থেকে এসেছিলো, আর কোথায়ই বা চলে যায় ? 

গুরুদেব : ভাষা দিয়ে একথা বোঝানো যায় না। 

শিষ্য : তাহলে কিভাবে বুঝবো ? 

গুরুদেব : দুটো শুকনো কাষ্ঠখন্ড নিয়ে এসো।

শিষ্য দুই টুকরো শুকনো কাঠের টুকরো নিয়ে এলো। 
 
গুরুদেব :এবার দুটো কাঠ ঘষতে থাকো। 

শিষ্য দুটো কাঠে ঘর্ষণ শুরু করলো। 

গুরুদেব : আরো জোরে, আরো জোরে। 

ঘষতে ঘষতে একসময় আগুন জ্বলে উঠলো। দাউদাউ করে করে অগ্নিশিখা উর্দ্ধমুখী হয়ে উঠলো। 

গুরুদেব : এবার দেখতে থাকো। যতক্ষন না আগুন নিভে যায়। 

একসময় আগুনশিখা অদৃশ্য হয়ে গেলো। 

গুরুদেব : এবার নিজেকে প্রশ্ন করো, আগুন কোথা থেকে এলো ?  কোথায়ই বা চলে গেলো ?

শিষ্য ভাবতে লাগলো, আগুন কোথা থেকে এলো, আবার কোথায়ই বা চলে গেলো ? এই ভাবনাই চলছে, যুগযুগ ধরে। কোথা থেকেই বা আসে, আর কোথায়ই বা চলে যায় ?  

----------------

পিতার মৃত্যুর পরে, লোটা  আর লাঠি সম্বল করে ৮/৯ বছরের এক জন্মসিদ্ধ মহাপুরুষ  ভাই-মাতা কে ছেড়ে, গৃহত্যাগী হলেন। সন্ন্যাসরূপী এই ছোট্ট ছেলেটিকে সবাই ভালোবাসে। যেখানে সে যায়, সবাই তাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। শিশুসন্যাসীকে সবাই তাদের সঙ্গে রাখতে চায়।  কিন্তু শিশুর সংস্কার তাকে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়, তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। আর সে নিঃসঙ্গ হয়ে যায় ।  পাহাড়ে পাহাড়ে, জঙ্গল থেকে জঙ্গলে, এক গুহা থেকে আর  এক গুহায়, বরফের রাজত্বে সে ঘুরে ফেরে।  কখনো তার খাবার  জোটে, কখনো আবার জোটে না। তো এক মহাজন পণ্ডিত ব্যক্তি, যিনি ভাষণ, ভজন আর ভোজন সম্বল করে, ঈশ্বরের গুনকীর্তন করে বেড়ান,  তাঁর নজর পড়লো এই দিব্য শিশুটির উপরে। আহা-রে কি দিব্যকান্তি  শিশু। কিন্তু অনাহারে, তার চেহারায় দুর্বলতার ছাপ।  করুনায় তার মন ভোরে  উঠলো। শিশুটিকে সে খাবারের জোগান  দিতে লাগলো। শিশু যেখানে যায়, মহাজন তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। একটা সময়, হলো কি, শিশুটি তার  খাবারের জন্য আর এক জায়গায় বসে থাকতে চাইলো  না। আর মহাজনকে উপদেশ দিলেন, খাবার সংগ্রহে, বা খাবার পাঁকানোর জন্য, সময় নষ্ট করা ঠিক নয়।  মহাজনের মধ্যেও যেন এই অনুভূতি হতে লাগলো। কিন্তু খাবার ভিন্ন শরীর বাঁচে না, এই কথাটা সে ভুলে যেতেও  পারলো না।   আবার  সে শিশুটিকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারলো না।  শিশুটি পথের রুক্ষতায় ক্লান্ত হয়ে পড়লো। মহাজন তার কাছ থেকে তার লোটাটা হাতে নিলো, শিশুটির কষ্ট  লাঘব হবে  বলে। কিন্তু লোটাটা  হাতে নিতেই, লোটার সৌন্দর্য্যের দিকে তার আকর্ষণ হলো।  মনে মনে ভাবলো, এই লোটাটা  তার নিজের  হলে কেমন হয় ? কি সুন্দর কারুকার্য্য করা, এই লোটা । এটি আর কোথাও পাওয়া যাবে না। সে এখন আর লোটাটিকে  হাতছাড়া করতে চায় না। শিশু সন্যাসী, মহাজনের মনের কথা টের পেলেন। মহাজনের কাছ থেকে লোটাটি নিয়ে, পাহাড়ের গায়ে ছুড়ে ফেললেন , আর লোটাটি ভেঙে শত-টুকরো হয়ে গেলো। মহাজন আহত বাঘের মতো হয়ে গেলো।  শিশু সন্যাসী বললেন -  আপনি  এখান থেকে পশ্চিম দিকে চলে যান, আমি পুবের দিকে যাবো। আমার সঙ্গে আপনি অনেকদূর এসেছেন, কিন্তু এখন থেকে আমাদের রাস্তা আলাদা।  আবার কখনো নিশ্চয় দেখা হবে।     

কপাল বা ভাগ্য লিখন -  মনে হয়, মানুষের এতো কষ্ট  কেন ?

 ভগবানের সৃষ্টিতে এতো দুঃখ কেন ? এর উত্তরে  কেউ কর্ম্মের কথা বলেছেন। ভগবান বিশ্বাসী মানুষ বলছেন, সবই ঈশ্বরের ইচ্ছে। লক্ষ করেছি, ভাগ্য সম্পর্কে সব সময় আমাদের মধ্যে একটা  বিপরীতমুখী ধারণা প্রবাহিত হয়ে থাকে। কেউ বলেন, ভাগ্যবিধাতা হচ্ছেন, ঈশ্বর। আর ঈশ্বরের নির্দেশ ছাড়া একটা গাছের পাতাও  নড়ে না। আবার কেউ বলেন, যেমন কর্ম্ম তেমন ফল। আমরা যেমন কর্ম্ম করবো, আমরা সেই মতো ফল পাবো। আমরা যখন কোনো বিপদে পড়ি, তখন আমরা আবার ঈশ্বরমুখী হয়ে থাকি।  ঈশ্বরের কাছে বিপদ থেকে মুক্ত হবার জন্য প্রার্থনা করে থাকি।   যদি সমস্ত কিছু আমাদের কর্ম্ম দ্বারা নির্ধারিত হয়, তবে আমরা কেন ঈশ্বরমুখী হয়ে বিপদ থেকে নিষ্কৃতির আশা করি ?  আবার আমরা যে কর্ম্ম করি, তার ফলও সবসময় আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী হয় না। আমরা চাই  এক, আর হয় আর-এক। তো মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমাদের ভাগ্য কি পূর্ব-নির্দিষ্ট  ? কে এই ভাগ্য বিধাতা ? বা আমাদের কর্ম্মও  কি পূর্বনির্ধারিত ? আমরা কি কারুর হাতের পুতুল হয়ে, রোবটের মতো কর্ম্ম করে থাকি ? 
 
যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই, যে আমাদের ভাগ্য বিধাতা হচ্ছেন, সর্ব্বশক্তিমান ঈশ্বর। তবে মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন জাগে, আমরা সবাই একই ভগবানের সন্তান।  তাহলে মানুষের এত কষ্ট  কেন ? তাহলে মানুষে মানুষে এত প্রভেদ কেন ? নাকি অনেক ভগবান আছেন ? যারা আমাদের ভাগ্য লিখছেন। অনেক পরীক্ষক আছেন, যারা  আমাদের কর্ম্মের খাতা দেখে, নিজের খেয়াল-খুশী  মতো  আমাদের ভাগ্য লিখে রাখছেন।  কেন কেউ কোটিপতির ঘরে জন্ম নিচ্ছেন, আর কেউ গৃহহীন-অন্নহীন গরিবের ঘরে জন্ম নিচ্ছেন ? আমরা সবাই ঈশ্বরের সন্তান - একথা যদি সত্য হয়, তবে পিতা কি কখনো তার সন্তানদের মধ্যে প্রভেদ করতে পারেন ? ঈশ্বর দূরে থাকুক, একজন সাধারণ পিতা বা মাতা যদি তার সন্তানের জন্য, ভাগ্য লিখতে বসেন, তবে কি তিনি এক-এক সন্তানদের জন্য, আলাদা আলাদা ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারেন ? বিশেষ করে,  পিতা-মাতা  কি কখনো তার সন্তানদের দুঃখের মধ্যে ফেলে দিতে পারেন ? আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে পিতা-মাতার  দ্বারা এই বৈষম্য কখনোই সম্ভব নয়। পিতা-মাতা যদি তার সন্তানের ভাগ্য লিখতেন, তবে কোনো সন্তানের কপালে দুঃখের কথা লিখে রাখতে পারতেন না। তাহলে ঈশ্বর, যাঁকে আমরা পরম পিতা  বলে মনে করি, এবং সত্যিই যদি তিনি  আমাদের পরমপিতা, হন, এবং তিনি যদি ভাগ্যের লেখক হন, তবে আমাদের জীবনে বৈষম্য আসবার কথা নয়। 

এমনকি আমাদের কর্ম্মের পরিচালক যদি স্বয়ং ঈশ্বর হতেন, তবে নিশ্চয় তিনি আমাদের কু -কর্ম্মের মধ্যে লিপ্ত করতেন না। কেননা খারাপ কর্ম্মে কখনো  পিতা মাতা উৎসাহ দিতে পারেন না, বরং খারাপ কর্ম্ম থেকে আমাদের বিরত অবশ্য়ই করতেন। তো কে এই কর্ম্মের নির্ধারক ? ঈশ্বর না আমি না অন্য কোনো শক্তি ? 
 
আর যদি ধরেই  নেই, আমরাই আমাদের কর্ম্মের পরিচালক, আমাদের নিজস্ব কর্ম্ম-ই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে থাকে, তবে আমরা তো - এও  দেখি, বহু মানুষ প্রাণপাত পরিশ্রম করেও, দুমুঠো অন্যের জন্য হা-পিত্তেস করছে।  আবার বড়োলোকের ঘরের ছেলে, কোনো কাজ না করে ফেলে ছড়িয়ে খাবার কাছে। কেউ সারাদিন রিক্সা টেনে, রাস্তার ফুটপাতে, পুলিশের লাঠির গুতো খেয়ে, ঘুমোনোর জায়গা খুঁজছে।  আবার নিস্কর্মা বড়লোক পিতার সন্তান কেউ ৯ ইঞ্চি মোটা গদিতে  হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। কেন এই বৈষম্য ? কেউ সুযোগের অভাবে, আর্থিক দৈন্যতার কারনে স্কুল কলেজের শিক্ষা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আবার কেউ বড়োলোকের ছেলে হবার সুবাদে, বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। একই কাজ ক'রে যদি একই ফল হয়, তবে আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্ম্মরত কেরানিদের মধ্যে মাইনের হেরফের কেন দেখি ? রেলে একরকম মাইনে  তো ব্যাঙ্কে আর একরকম মাইনে । কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরীতে একরকম মাইনে , আবার রাজ্যসরকারের চাকরিতে এক রকম মাইনে । তো একই কাজ করে, একই যোগ্যতার অধিকারী হয়েও,  একই ফল আমরা পেতে পারি, তা নয়। তবে এর মধ্যে রহস্যঃ কোথায় ? হে সৃষ্টিকর্তা তোমার লীলা আমাদের বোঝার শক্তি দাও।  

আজ আমরা   এইসব জটিল ও রহস্যে ঘেরা  প্রশ্নের জবাব খুঁজবো। 
  
দেখুন ঈশ্বরের ইচ্ছেয় আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ হয়, এই কথার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য প্রমান পাওয়া যায় না। তাহলে ধরে নিতে হয়, কর্ম্মই আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকে।  এখন কথা হচ্ছে, কি সেই কর্ম্ম যা আমাদের ভবিষ্যৎ এমনকি পরবর্তী জীবনের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকে ? 
কর্ম্ম বলতে সাধারণত আমরা দৈহিক কর্ম্ম বুঝে থাকি।  কিন্তু কর্ম্ম হচ্ছে আমাদের ভাবনা-প্রসূত ক্রিয়া । আমাদের লক্ষ্য, আমাদের উদ্দেশ্য, আমাদেরকে কর্ম্মে প্রবৃত্ত করে থাকে। আমরা শুনেছি, জীবাত্মা বা আত্মা হচ্ছে একটা শক্তি যা আমাদের মন ও শরীরকে পরিচালনা করে থাকে। তো এই শক্তি আমাদের মনের সাহায্যে ভাবনার মাধ্যমে শরীরের সাহায্যে কর্ম করে থাকে। অর্থাৎ কর্ম্ম আসলে আমাদের মনের ভাবনার প্রতিফলন। আর জীবাত্মা তার ভোগ সাধনের জন্য, মনের মধ্যে এই ভাবনার উদ্রেগ করে থাকে। ভাবনা শরীরের সাহায্যে কর্ম্মে পরিণত  হয়। আর কর্ম্ম তার নির্দিষ্ট ফল প্রদান করে থাকে। 

মহাত্মাগণ বলছেন, কর্ম্ম তিন প্রকার প্রারব্ধ, ক্রিয়মান, ও সঞ্চিত কর্ম্ম। আর এই কর্ম্ম হচ্ছে, ১. কামনা প্রসূত, অর্থাৎ আমাদের কামনাকে পূরণ করবার জন্য, যেসব কর্ম্ম করে থাকি,  ২. বাসনা বা সংকল্প প্রসূত, অর্থাৎ সংকল্প পূরণের জন্য আমরা যে সব কর্ম্ম করে থাকি। আর ৩.  হচ্ছে মানস প্রসূত বা মনের চিন্তা বিশেষ । 
  
যাই হোক, আমরা কর্ম্মের সূক্ষ্ম তত্ত্ব বুঝবার চেষ্টা করবো। 
কামনা প্রসূত : আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা - প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শ উপভোগ করবার যে প্রবৃত্তি সবসময় আমাদের মনের মধ্যে বর্তমান থাকে, যার দ্বারা ভোগ্য বিষয়ে আমাদের আসক্তি জন্মে তা কামনা প্রসূত কর্ম্ম । এই যে কামপ্রবৃত্তি, এর সঙ্গে ধর্ম্মের কোনো বিরোধ নেই। এটি জীবের ধর্ম্ম।  কিন্তু মানুষের মধ্যে অন্যায্য অধিকার পাইবার জন্য একটা প্রবৃত্তি কাজ করে থাকে। আর এই অবস্থায় আমাদের মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে একটা পার্থক্য থাকায়, আমাদের মধ্যে অতৃপ্তির জন্ম নেয়।  যা দুঃখের কারন। 
বাসনা প্রসূত : মানুষের মধ্যে দুটো বৃত্তি কাজ করে, এক হচ্ছে, বিষয়ের সংস্পর্শে এসে, কাঁচা আমিকে তুষ্ট রাখা।  আর একটা হচ্ছে, পাঁকা আমিকে তুষ্ট করা। সত্য, সংযম, পবিত্রতা, নিঃস্বার্থপরতা, জ্ঞান অর্জন, লোকহিতকর কার্য্য করা, ইত্যাদি বৃত্তির অনুশীলনীতে মানুষ একধরনের তৃপ্তি পায়, যা আসলে পাঁকা আমির তৃপ্তি সাধন করে থাকে।  এখানে যদি সাধ ও সাধ্যের মধ্যে পার্থক্য হয়, তবেও  মানুষ দুঃখী হয়ে থাকে। 
মানস প্রসূত : মনের মধ্যে যখন এই কামনা ও বাসনার উৎপত্তি হয়, তখন তা  আমাদেরকে কর্ম্মে উদ্দীপ্ত করে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে,  মনের চিন্তাকে  কার্য্যে সম্পাদন করা, বা না করা দুটোই ফলদায়ী কর্ম্ম। এই ব্যাপারটা আমাদের একটু ভালোভাবে বুঝতে হবে। 
আমাদের  মনের মধ্যে যখনই কোনো চিন্তার উদ্রেগ হলো, জানবেন, তখনই তা ফল প্রদানে উন্মুখ হবে - তা সে কার্যে রূপান্তরিত হোক বা না হোক। অর্থাৎ শুধুমাত্র চিন্তা ফলপ্রদানে সক্ষম। ধরুন আপনি মনে মনে ভাবছেন, পরীক্ষায় পাশ করলে ভালো হয়, মেয়েটিকে বা ছেলেটিকে স্ত্রী বা স্বামী হিসেবে পেলে ভালো হয়। একটা চাকরি পেলে ভালো হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি।  কিন্তু এব্যাপারে আপনি কোনো উদ্যোগই  গ্রহণ  করলেন না, অথচ নিজের মনের মধ্যে চিন্তা আকারে রয়ে গেলো।  তো  এর জন্যও আপনার মধ্যে একদিন  দুঃখের উদ্রেগ হবে। আবার ঈশ্বর অন্বেষণ করার মতো কাজ হচ্ছে, আমাদের মানসিক- শরীরের কাজ। ঈশ্বর চিন্তন আমাদের একটা তৃপ্তি এনে দিতে পারে।
এইখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, আমাদের যেমন স্থুল, সূক্ষ্ম, ও কারন দেহ আছে, তেমনি আমাদের পাঁচকোষের দ্বারা নির্মিত পাঁচটি শরীর আছে। আর আমাদের যে কর্ম্ম তাও বিভিন্ন শরীর করে থাকি। আমাদের এই যে ঈশ্বরের অনুসন্ধান রূপ কর্ম্ম তা হয়ে থাকে আমাদের মানস শরীরে। আমরা সাধারণত কর্ম্ম বলতে বুঝি স্থুল  দেহের কর্ম্ম। কিন্তু আমাদের অন্য শরীরগুলোরও কর্ম্ম করবার শক্তি আছে।  যদিও পৃথিবীই আমাদের কর্ম্ম ভূমি।  আর পার্থিব জীবনে আমরা সূক্ষ্ম, স্থুল বা মানস দেহের যে কোনো  কর্ম্ম করি না কেন, পরলোকে অর্থাৎ স্থুল দেহের নাশের  পরে, আমরা সেই কর্ম্মের ফল ভোগ করবো না।  আবার পৃথিবীতে এসে, সেই কর্ম্মের ফল ভোগ করতে হবে।

প্রারব্ধ কর্ম্ম : আমরা জানি,  যে সব কর্ম্মের ফল ভোগ করবার জন্য, আমরা জীবদেহ নিয়ে পৃথিবীতে এসে থাকি, তাকেই বলে প্রারব্ধ কর্ম্ম। অর্থাৎ পূর্ব-পূর্ব জীবনের কর্ম্ম। আর এই প্রারব্ধ কর্ম্ম যখন ফলদানে উন্মুখ হয়, তখন সেই কর্ম্মফল আমরা কোনোভাবেই রোধ করতে পারি না। 

ক্রিয়মান কর্ম্ম : আমরা এই পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করে, বা দেহধারন করে যে সমস্ত কর্ম্ম করে থাকি, তাকে বলে ক্রিয়মান কর্ম্ম। এই ক্রিয়মান কর্ম্মের ফল যেমন আমরা এই জীবনে ভোগ করতে পারি, আবার ভবিষ্যৎ জন্মেও ভোগ করতে পারি। এটি আমাদের ইচ্ছেধীন নয়, এটি স্থান-কালের গতির উপরে নির্ভর করছে। কোনো কর্ম্ম আশু ফল প্রদান করে থাকে, আবার কোনো কোনো কর্ম্ম দীর্ঘকাল পরে ফল প্রদান করে থাকে। মহাত্মাগন বলে থাকেন, আমাদের যখন আত্মজ্ঞান উৎপন্ন হবে, তখন এই সব কর্ম্মের প্রভাব থেকে আমরা নিষ্কৃতি পাবো। অর্থাৎ ক্রিয়মান কর্ম্মফল থেকে নিষ্কৃতি পাবো। কিন্তু প্রারব্ধ কর্ম্মফল আমাদের ভোগ করতেই হবে। 
 
চিন্তাপ্রসূত কর্ম্ম : চিন্তা-প্রসূত কর্ম্ম নিয়ে আমাদের একটু ভালোভাবে বোঝার প্রয়োজন। আমাদের পাঁচটি কর্ম্ম-ইন্দ্রিয় (বাক-পাণি-পাদ-পায়ু-উপস্থ অর্থাৎ মুখ, হাত, পা, মলদ্বার ও লিঙ্গ ) দ্বারা যে সমস্ত কর্ম্ম সম্পাদন করে থাকি, তার ভালো মন্দ বোঝা আমাদের সাধারনের জ্ঞানের বিষয়। অনেক সময়, আমরা না বুঝে, বা বিচার বিশ্লেষণ না করে, অনেক কাজ করে আমরা অনুতপ্ত হই।  আবার অনেক সময় আমরা বুঝেশুনেও বিবেকের নির্দেশকে অগ্রাহ্য করে প্রবৃত্তির বশে অন্যায় কাজ করে বসি । এসব আমরা বুঝি, আবার সংশোধন করেও নিতে পারি।  কিন্তু আমাদের চিন্তা যে কর্ম্ম করছে, তা আমাদের জ্ঞানের বিষয় নয়। আর চিন্তাপ্রসূত কর্ম্ম আদালতের বিচার্য বিষয়ও  নয়। চিন্তা  শারীরিক উদ্দম ছাড়া যে ফলপ্রসূ হতে পারে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা জানি, চিন্তা হচ্ছে মনের অবস্থা বিশেষ মাত্র।  কিন্তু সত্য হচ্ছে, চিন্তার বাস্তব রূপ আছে, আর এই চিন্তার মধ্যে বস্তুর ধর্ম্ম বিরাজ করছে। শুধু চিন্তা দ্বারাই আমরা নিজের বা অপরের উপকার বা অপকার করতে পারি। 

আমরা জানি  ঐকান্তিকভাবে চিন্তাই হচ্ছে তপস্যা, যা মুনি ঋষিগণ করে থাকেন। আর তপস্যার ফল আমাদের বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে বর্ণিত আছে। শাস্ত্র বলছেন, তপঃপ্রভাবসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে কিছুই দুর্লভ নয়। তপস্যার সাহায্যে সমস্ত ঐশর্য্য লাভ করা যেতে পারে। শুধু মুনি ঋষিগণের তপঃরূপ  চিন্তা নয়, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের যে চিন্তা তাও কখনো নিষ্ফলাহতে পারে না। সাধারণ চিন্তাও  ফল প্রদান করে থাকে।  একটা কথা জানবেন, সমস্ত লোক, (অর্থাৎ ভূঃ ভূূবঃ-স্বঃ মহঃ জনঃ তপঃ সত্যম )  ওতপ্রোত ভাবে পৃথিবীতেই অবস্থান করছে।  এমনকি আমাদের শরীরেই সমস্ত লোক অবস্থান করছে। আমাদের দেহ স্থুল -সূক্ষ্ম-সূক্ষ্মতর- সূক্ষ্মতম-কারন  ভেদে পাঁচ রকম। সূক্ষ্ম দেহের জ্যোতির্বিম্ব আমাদের স্থুলদেহকে বেষ্টন করে   আছে। এই সুক্ষদেহ বা আলোক দেহ, আমাদের গভীর ধ্যানে  উপলব্ধ হয়।  বিজ্ঞান এখন এই সত্যকে স্বীকার করছে। আমাদের শরীর  থেকে প্রায় দেড়ফুট পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। এই সূক্ষ্ম দেহই আসলে আমাদের কামনার আধার। এরজন্য একে বলা হয়, কামদেহ। আমাদের মনের আবেগ বা কামের প্রভাবে এই  বর্ণচ্ছটায় বর্ণের পার্থক্য হয়। আমাদের মনে যেমন  প্রবৃত্তি জেগে ওঠে, সেই অনুসারে বর্ন পরিবর্তনের দ্বারা জ্যোতির্বিম্ব সূক্ষ্ম জগৎ থেকে সূক্ষ্ম পরমাণু আকর্ষণ করে থাকে। আর এই পরমাণু হাজার হাজার আজ্ঞাবহ চিন্তামূর্তিতে সৃষ্ট হয়। এই চিন্তা মূর্তিকেই  আমরা শ্রীকৃষ্ণের সেনাবাহিনী  হিসেবে জানি।  

এখন কথা হচ্ছে এই চিন্তামূর্তি কিভাবে কাজ করে ? দেখুন এই চিন্তা মূর্তি অর্থাৎ সূক্ষ্ম-পদার্থে নির্মিত মূর্তি  আমাদের মানসিক জগতের নিম্ন স্তরের হওয়ার ফলে এদের মধ্যে সামান্যতম চৈতন্য অবস্থান করে থাকে। অর্থাৎ কিঞ্চিৎ চৈতন্যের সঞ্চার এদের মধ্যেও  হয়ে থাকে। তো প্রবৃত্তির লক্ষবস্তু নিকটে থাকলে, এই চিন্তামূর্তি সেই লক্ষ বস্তুর কাছে গিয়ে, তার সূক্ষ্মদেহে একই প্রকার প্রবৃত্তির উন্মেষ ঘটাতে চেষ্টা করে। অর্থাৎ প্রেরকের চিন্তা যত  গাঢ় হবে, এবং যতক্ষন বেশিক্ষন স্থায়ী হবে, এইসব চিন্তাপ্রসূত জীবের অস্তিত্ত্ব তত দীর্ঘস্থায়ী ও ফলপ্রদ হবে। এইজন্য বলা হয়ে থাকে, আমাদের কারুর সম্পর্কে কুচিন্তা পোষণ করা গর্হিত কর্ম্ম। কেননা এতে যার সম্পর্কে চিন্তা করা হয়, তার ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে। আবার যদি প্রেরক সু-চিন্তা করে, তবে গ্রাহকের অর্থাৎ যার সম্পর্কে আপনি চিন্তা করছেন, তার  ভালো হবার সম্ভাবনা থাকে। 

পরাবিদ্যাবিদ  ক্ষিতিনাথ ঘোষ "জীবন মরণ"    বলছেন, চিন্তা বস্তু ও বিষয় দুইই। চিন্তার গভীরতা অনুযায়ী চিন্তা-প্রসূত বস্তু সবল বা দুর্বল হয়ে থাকে। সারা বিশ্বে চিন্তার স্রোত অবিরাম গতিতে চলছে। এরা কৃত্তিম হলেও, এদের ভৌতিক সত্তা আছে। এদের কাজ করবার শক্তি আছে, জীবনীশক্তি আছে। এমনকি বুদ্ধিও আছে। আমাদের চন্ডি  পূরাণে, প্রবল শক্তিসম্পন্ন এইসব ভৌতিক সত্তা ভয়ানক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলো। এগুলো আমাদের কাছে গল্পকথা  মনে হয়।  কিন্তু সূক্ষ্ম জগৎ সম্পর্কে যাদের ধারণা তাদের কাছে, এই দৃশ্যপট স্পষ্ট। সুতরাং আমাদের কাছে, এই চিন্তাপ্রসূত মূর্তির কোনো বাস্তব সত্যতা নেই। আবার আমাদের কপালে যখন কোনো দুর্ভোগ বা সৌভাগ্যের উদয় হলো, তখন আমাদের বিষ্ময় জাগে, কেন হলো, কিভাবে হলো ?  আসলে আমাদের চিন্তাশক্তি দুর্বল, তাই তাই আমাদের চিন্তাপ্রসূত সত্তা স্বল্পায়ু ও দুর্বল। আমরা যদি একই বিষয়ের উপরে, দীর্ঘকাল চিন্তা করতে থাকি, তবে নতুন নতুন সাত্তার জন্ম হবে এমনি পূর্ব প্রসূত সত্তার জীবনীশক্তি বর্দ্ধিত হবে। আমার চিন্তার উদ্দেশ্য ভালো বা মন্দ যাই হোক না কেন, চিন্তাপ্রসূত মূর্তিগুলোর প্রকৃতিও সেই মতো হবে। আর এদের প্ররোচনায়, আমাদের মনে আবার সুচিন্তা বা কুচিন্তা উদয় হতে থাকবে। তাই দেখবেন, কুচিন্তাকারীর মনে কুচিন্তার উদয় হয়, আর শুভ চিন্তার অধিকারীর  মধ্যে সর্বদা শুভ চিন্তার উদ্রেগ হয়। তাই বলা হয়ে থাকে, যদি আমরা আমাদের বা অন্যকারুর ভালো বা মঙ্গল চাই, তবে আমাদের  মঙ্গল চিন্তার প্রবাহিত বইয়ে দিতে হবে।  গভীর চিন্তাই প্রাথমিক ভাবে ধ্যান। চিন্তা যখন এক বিষয়ে স্থিত হয়, তখন তাকে বলে ধ্যান। ধ্যান যত   গভীর হবে, ধ্যানমূর্তি গুলোও তত সতেজ-সবল হবে। আর এই ধ্যানেই যোগীগণ অষ্টসিদ্ধি লাভ করে থাকেন। এদের কাছে, কোনো কিছুই অধরা থাকে না।  ধ্যানযোগীগণ, পরম শান্তিতে বাস করেন।   

মানুষের শারীরিক শক্তির একটা সীমা  আছে, কিন্তু মানুষের মানসিক চিন্তার ক্ষমতা অসীম। আমাদের শারীরিক কর্ম্ম তা সে খারাপ ভালো যাই হোক না কেন, তার একটা সীমা  আছে, কিন্তু আমাদের মানসিক চিন্তা প্রসূত কর্ম্মের ক্ষমতা  অসীম। তাই চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। দেহকে আপনি একটু চেষ্টা করলেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন। কিন্তু চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা দুরূহ কাজ। অথচ এই চিন্তাই একটা মানুষকে মহামানব করে তুলতে পারে, অধিক শক্তিশালী করতে পারে, আবার এই চিন্তাই  মানুষকে নরকের দ্বারে পৌঁছে দিতে পারে। অসহনীয় কষ্টের মধ্যে ফেলে দিতে পারে। আমাদের বিভিন্ন ধর্ম্ম অনুষ্ঠানে, বা আমাদের বিভিন্ন সামাজিক কাজে, যে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, শুভ-ইচ্ছা শক্তিকে শব্দব্রহ্ম-এর দ্বারা  সূক্ষ্ম জগতে আজ্ঞাবহ সচেতন চিন্তামূর্তি সৃষ্টি করা। এইসব মূর্তি আমাদের মতো স্থুল  দেহধারীর তো বটেই এমনকি কামলোকবাসী মৃত্য ব্যক্তিদেরও  প্রভূত উপকার করতে পারে। আমাদের বিবাহ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মন্ত্রের সাহায্যে এই শক্তিধর চিন্তামূর্তি সৃষ্টি ক'রে, স্বামী-স্ত্রী উভয়কে রক্ষা করা হয়ে থাকে। যাইহোক, আমাদের মঙ্গল চিন্তা, শুভ চিন্তা যেমন আমাদের নিজেদের রক্ষা করতে পারে, তেমনি যার সম্পর্কে এই চিন্তা প্রবাহিত করা হয়, তারও এতে ভালো হতে পারে। তাই কর্ম্মের কথা আলোচনা করতে গিয়ে আমরা অবশ্য়ই এই চিন্তার দিকে খেয়াল রাখবো। চলবে। ..........

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম। 

কপাল বা ভাগ্য লিখন -   মানুষের এতো কষ্ট  কেন ? (২)

মহাত্মাগণ বলছেন, মানুষের চিন্তাই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকে। অর্থাৎ মানুষ তার নিজের ভাগ্য নিজেই লিখে থাকে। আর এই ভাগ্য লিখনের তিনটি সূত্র ১. সংকল্প পূরণের চিন্তা, ২. বাসনা পূরণের চিন্তা ৩. তৎজনিত কার্য্য। এখন কথা হচ্ছে, কোন শক্তিবলে আমরা এই চিন্তায় লিপ্ত হই ?  

জীবাত্মার  শক্তিই আমাদের  মনের মধ্যে ভাবনার উদ্রেগ করে থাকে। জীবাত্মা তার অস্তিত্ত্ব শরীরের মধ্যে  বজায় রাখবার জন্য, জীবাত্মা তার ভোগের নিমিত্য, এই ভাবনার উদ্রেগ করে থাকে।  এই ভাবনার তিনটে দিক। 
১. যা আমি নিজের থেকে  ভাবছি। অর্থাৎ নিজের জন্য ভাবছি। তার একটা প্রভাব আমার মধ্যে পড়ছে। আমরা আমাদের অস্তিত্ত্ব রক্ষার জন্য, স্বাভাবিক ভাবেই চিন্তা করে থাকি।   এই যে নিজের থেকে ভাবনা, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমার সংকল্প বা বাসনা পূরণের ভাবনা। এই ভাবনা আমাদের বাহ্যিক দৃশ্যমান জগৎ থেকে আসতে  পারে, আবার আমাদের মনের মধ্যে যে সংকল্প আছে, তার পূরণের উদ্দেশ্যে হতে পারে, আবার অস্তিত্ত্ব রক্ষার কারনে হতে পারে। আর এই চিন্তা বা ভাবনা আমাদের জন্ম-জন্মান্তর ধরে চলছে। 
বাহ্যিক দৃশ্য এবং আমাদের পূর্ব জীবনের সংস্কার আপনাকে কিভাবে ভাবনাকে প্রভাবিত করে দেখুন। ধরুন আপনি একটা ফুল দেখছেন, তো আমার মধ্যে একটা ভাবনার উদয় হচ্ছে। আপনি যদি শিল্পী হন, অর্থাৎ আপনার মধ্যে যদি শিল্প সংস্কার থাকে, তবে আপনার মধ্যে ফুলের গঠনগত সৌন্দর্যের দিকে আপনি আকৃষ্ট হবেন। আপনি ফুলের উপরে আলতো করে, হাত বোলাতে পারেন। গন্ধ উপভোগ করতে পারেন।  কিন্তু যদি আপনি মালি হন, ফুলের ব্যবসায়ী হন,  তবে আপনি অতকিছু চিন্তা না করে, ফুল  বিক্রি করবার কথা ভাবেন, আর ফুলটিকে ছিঁড়ে ঝুড়ির মধ্যে রাখবেন। আপনি যদি জাগতিক প্রেমিক হন, তবে ফুলটিকে ছিঁড়ে  আপনি আপনার প্রেয়সীর মাথায় গুঁজে দেবেন। আবার যদি আপনি ঈশ্বর প্রেমী হন, তবে আপনি ফুলটিকে ছিঁড়ে ঈশ্বরের পায়ে নিবেদন করবেন। তো কি করবেন, সেটা নির্ভর করছে, আপনার সংস্কারের উপরে। আর আমরা জানি সংস্কার আর কিছুই নয়, আমাদের পূর্ব-পূর্ব জীবনের চিন্তা মাত্র। 
 অস্তিত্ত্ব রক্ষার জন্য চিন্তা - আবার ধরুন, আপনি আপনার সামনে একটা সাপ /বা বাঘ দেখলেন, .আপনার যদি এই বাঘ বা সাপ সম্পর্কে কোনো পুরোনো অভিজ্ঞতা থাকে, যা আপনি শুনে বা দেখে সংগ্রহ করেছিলেন, তবে মুহূর্তের মধ্যে এদের থেকে নিজেকে সতর্ক করে লাভিয়ে পগারপার হয়ে যাবেন। কিন্তু একটা শিশু, যার মধ্যে বাঘ বা সাপ কোনো পুরোনো অভিজ্ঞতা নেই, সে কিন্তু স্থির হয়ে বসে থাকবে, তাতে তার যাই পরিণতি হোক না কেন। এতে করে তার মধ্যে কোনো চিন্তার উদ্রেগ হবে না।     

২.  তো অন্যের আচরণ, অর্থাৎ যাদের সঙ্গে আমি সম্পর্কযুক্ত তাদের আচরণ বা প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে একটা ভাবনা আমার মধ্যে আসছে। কোনো একটা দৃশ্য দেখলাম, পাখির গান শুনলাম, তারও একটা প্রভাব আমার মধ্যে পড়ছে। আবার অন্যে আমার সম্পর্কে কি ভাবছে, তার একটা প্রভাব আমাদের মধ্যে আসছে। অর্থাৎ অন্যের ভাবনা প্রসূত কর্ম্ম আমাকে প্রভাবিত করছে।  ধরুন, আমাকে কেউ বকাবকি করলো, বা আমার প্রসংশা করলো। এর দ্বারা আমার মন প্রভাবিত হলো। এর ফলে আপনার মধ্যে নতুন ভাবনার সৃষ্ট হতে পারে, অর্থাৎ কর্ম্মের সৃষ্টি হতে পারে।   

৩. আবার  পরিবেশ পরিস্থিতির ভাবনার পাল্টা একটা ভাবনা আমাদের মধ্যে তৈরী হচ্ছে । অর্থাৎ অন্য কেউ আমার আচরণে কষ্ট  পেলো, দুঃখ পেলো, বা আনন্দ পেলো, এর ফলে প্রতিদানে সেও আমার সম্পর্কে নিজের মধ্যে একটা ভাবনা তৈরী করলো।  এই যে অন্যের ভাবনা সেটিও আমাকে প্রভাবিত করতে পারে।  অর্থাৎ কেউ  আমার আচরণে কষ্ট  পেয়ে, পাল্টা একটা কিছু করলো, বা বললো, তো  তার কথা বা কর্ম্ম আমাকে বিব্রত করতে পারে।  আবার আমার আচরণে আনন্দ পেয়ে, সেও আমাকে একটা আনন্দপূর্ণ বাক্য বা আচরণ করলো। এসবই আমাকে প্রভাবিত করবে। আসলে আমি যা কিছু ভাবছি, তা যেমন আমার প্রবৃত্তির লক্ষবস্তুকে প্রভাবিত করছে, তেমনি অন্য কেউ কিছু ভাবলে, তাদের প্রবৃত্তির লক্ষবস্তুকে প্রভাবিত করছে। চিন্তার খেলা এইভাবে নিরন্তর চলছে।   

তো ভাবনা আমার - কিন্তু তার প্রভাব তিন রকম। আমি নিজের সম্পর্কে কি ভাবছি, অন্যরা আমার সম্পর্কে কি ভাবছে, আর আমি অন্যের সম্পর্কে কি ভাবছি। একটা হচ্ছে বর্তমান, অর্থাৎ এখন আমার মধ্যে যে ভাবনার উদ্রেগ হচ্ছে, একটা হচ্ছে অতীত যা আমি আগে ভেবেছিলাম, আর একটা হচ্ছে ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান যা আমি অন্যের সম্পর্কে ভেবেছিলাম, এবং তার প্রতিদানে তাদের কাছ থেকে এক বিপরীত ভাবনা, যে ভাবনা আমাকে  প্রভাবিত করছে বা করবে ।   

এখন ভাবনা হচ্ছে একটা শক্তি যা আমাদের মূল সত্তা অর্থাৎ আত্মা থেকে  থেকে উৎসারিত হচ্ছে। এই শক্তি মনকে প্রভাবিত করছে।  এখন এই শক্তি মনের  থেকে চিন্তা আকারে উৎপন্ন হয়ে, বিস্তার লাভ করছে। চিন্তার বা ভাবনার স্তরে থাকে সংকল্প ও বাসনা। আর এর প্রকাশরূপকে বলে কার্য্য।  এই তিনটিই আমাদের ভাগ্য সৃজন করে থাকে। 

এই চিন্তার ক্ষমতা অসীম। আমাদের যে মনের শক্তি বা মানসিক শক্তি তা আমরা এই চিন্তা থেকে পেয়ে থাকি। পূর্ব পূর্ব জীবনে আমি যে চিন্তার অনুশীলন করেছিলাম, বর্তমান জীবনে আমি সেইমতো মানসিক শক্তি অর্জন করেছি। এইজন্য আমরা বারবার বলেছি, ধ্যান করতে।  তার কারন হচ্ছে, ধ্যানে আমরা গাঢ় চিন্তায় মগ্ন থাকি। আর এই ধ্যান অবস্থায়, আমাদের চিত্তবৃত্তি এক বিষয়েই নিবদ্ধ থাকে। জ্ঞানবৃত্তির একতানতাকে ধ্যান বলে। প্রতিদিন নিয়ম করে ধ্যান করলে, আমাদের চিত্ত বৃত্তি শান্ত হয়, এবং ক্রমশঃ মানসিক শক্তি বৃদ্ধি হতে থাকে। আর মানসিক শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমরা  চিন্তার একটা উচ্চস্তরে মনকে স্থাপন করতে পারি। মনের এই উচ্চস্তরে আমাদের যে চিন্তার উদ্ভব হয়, তার সংযাগে আমাদের কামনা বাসনার কোনো সম্পর্ক থাকে না। আপন স্বার্থসিদ্ধির কোনো কল্পনা তখন আর অবশিষ্ট থাকে না। এই উচ্চ শ্রেণীর চিন্তাই আমাদের আধ্যাত্মিক সম্পদ। মানুষ সংকল্প প্রধান জীব। আর ইহজগত থেকে প্রয়াণের পরে, আমরা আবার সংকল্প সাধনের উপযুক্ত দেহ জন্মান্তরে ধারণ করে থাকি। মনের নিম্ন স্তরে যে চিন্তার উদ্রেগ হয়, তার মধ্যে কামনা-বাসনার মিশ্রণ থাকে।  আর ফলেই, আমরা পার্থিব বন্ধন  সৃষ্টি করে থাকি। এই জগতে এসে আমি যাদের সঙ্গে সন্মন্ধে আবদ্ধ হয়েছি, তা আমার পূর্ব জীবনের চিন্তার ফল।  আমি নিশ্চয়ই আগের জন্মে এদের উদ্দেশ্যে আমার চিন্তারাশিকে প্রবাহিত করেছিলাম। 

 ক্ষিতিনাথ ঘোষ মহাশয় বলছেন, আমাদের কামনার সাথে আমাদের মনের গভীর সংযোগ আছে। আর এই কামনা থেকেই কামদেহ  সৃষ্টি হয়ে থাকে। আমাদের কামনার শুচিতার উপরে,  আমাদের পরবর্তী জীবনের কামদেহ পুষ্টিলাভ করে থাকে। ক্ষিতিবাবু, আরো বলছেন, মনের মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তি পোষণ করলে, জীব বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম গ্রহণ করে থাকে। কিংবা কুৎসিত বংশানুক্রমিক রোগের  বীজ শরীরে ধারণ করে থাকে।  জানিনা এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে কি না। তবে এটা  ঠিক পিতামাতা যদি উশৃঙ্খল কাম-জীবনযাপন করে, তবে তারা বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্মদাতা হতে পারে । আসলে মানুষ যেমন চায়, সেইমতো দেহ ধারণ করে থাকে। এমনকি পিতা-মাতা পছন্দ করে থাকে কামনা পূরণের উদ্দেশ্য নিয়ে। আমাদের কর্ম্ম, আচার-আচরণ, আমাকে সেইমতো পরিবেশে এমনকি দেশ নির্বাচন করিয়ে দেয়।  ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যোগভ্রষ্ট পুরুষ পরবর্তী জন্মে সেই পরিবেশে, সেই মাতা-পিতার ঘরে জন্ম গ্রহণ করে, যেখানে সে যোগের সমস্ত সুযোগ সুবিধা পাবে। কামনার অনুরূপ হয় সংকল্প, আর সংকল্প অনুযায়ী জীব কর্ম্ম করে থাকে ।  আবার কর্ম্ম অনুযায়ী ফল লাভ করে থাকে। 

আমরা এই কামনা দ্বারাই আমাদের ঐহিক সম্পর্ক স্থাপন হয়ে থাকি  । পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, যে যাকে  চায়, স্বর্গবাস কালীন, সে তাকেই পায়।  আবার  সেই ভাব-বন্ধনের আকর্ষনে পরজন্মে আবার তাদের সাথেই মিলিত হয়। তো বুঝতে পারছেন, আমাদের কর্ম্ম আমাদের শুধু এই জীবনের বিষয় নয়, ইহকালের বিষয় নয়,  এই কর্ম্মফল আমরা পরবর্তী জীবনেও ভোগ  করতে থাকবো।

মহাত্মাগণ বলছেন, সাধারণ মানুষের চিন্তা থেকে কামনা প্রবলতর। আর এই কারণেই সে কামনা দ্বারা ঐহিক সম্পর্ক সৃষ্ট করতে  চায়। আমরা ভাবি, আমাদের সম্পর্কের জন, ভালোবাসার জন, যেন আমাদের মৃত্যুর পরেও আমাদেরই সাথে থাকে।  আর তাই সাধারন মানুষের স্থুল দেহ নাসের পরে, এমনকি সে যখন স্বর্গে বাস করে, সেখানে সে তাকেই পায়। আবার এই ভাববন্ধনের আকর্ষনে, পরবর্তী জীবনে আবার তাদের সাথেই সন্মন্ধে আবদ্ধ হয়। আর এই কামনার প্রকৃতির উপরে অর্থাৎ শুভ কামনা ও অশুভ কামনা আমাদের শত্রু ও মিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরী করে। আমরা আমাদের বাহ্যিক দৈহিক কর্ম্মের বিচার বিশ্লেষণ করতে পারে।  তার ভালো মন্দ বিচার করতে পারি।  কিন্তু আমাদের মনের মধ্যে যে চিন্তা অহরহ আসছে, তার বিচার করতে পারি না। এমনকি তাকে সহজে বন্ধও  করতেও পারি না।
আমরা ধারণাও করতে পারি না যে আমাদের চিন্তাই আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ে দিচ্ছে। আমাদের ভাগ্য লিখে দিচ্ছে। 

বৃহদারণ্যক উপনিষদ বলছেন, জীব কামময়। তিনি যেমন যেমন  কামনা করেন, সেইমতো তিনি কৃতসংকল্প হন।  আর যেমন কৃতসংকল্প হন, সেইমতো কর্ম্মে লিপ্ত হন, আবার যেমন যেমন কর্ম্ম করেন সেইরূপ ফল সম্পাদন করেন। (৪/৪/৫) "অথো খল্বাহু কামময় এবায়ং পুরুষ ইতি স যথাকামো ভবতি তৎ ক্রতুর-ভবতি, যৎ  ক্রতুর-ভবতি,  তৎ কর্ম্ম কুরুতে, যৎ কর্ম্ম কুরুতে তৎ অভিসম্পদ্যতে।" 
এখন কথা হচ্ছে, আমরা যা কিছু করি তা সবই কামনা থেকে জাত।  আর যেহেতু আমাদের কর্ম্ম কামনা জাত কর্ম্মফল কামনা অনুযায়ী হয়ে থাকে। আমরা যদি কামনা রোহিত হয়ে কর্ম্ম করতে পারি, তবে আমাদের কর্ম্মফল ভোগ করতে হবেনা। অর্থাৎ কামনাবিহীন কর্ম্ম কোনো কর্ম্ম ফল প্রদান করে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণও বলছেন, আসক্তিবিহীন কর্ম্ম করতে। কামনাবিহীন কর্ম্ম করতে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, কামনাবিহীন কর্ম্ম কোনো জীব করতে পারে কিনা সন্দেহ। এইজন্য আমাদের দুটো   ১. আমাদের কর্ম্মের উদ্দেশ্য যেন সৎ ও শুভ হয়। ২. আর একটি হচ্ছে, পরমাত্মাকে সাক্ষী রেখে কাজ করুন। অর্থাৎ আপনি জানবেন, আপনার সমস্ত কাজের একজন দ্রষ্টা আছেন, আর তিনি হচ্ছেন ঈশ্বর।  তখন দেখবেন, আপনি  বিরুদ্ধে কাজ করতে পারবেন না।  আপনি কি করছেন সেটা বারো কথা নয়, আপনি কি উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছেন, সেটাই বড়ো  কথা। অস্ত্র হাতে দুই ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে, একজনের উদ্দেশ্য হচ্ছে রুগীর শরীরে অস্ত্রপচার করে রুগীকে সুস্থ জীবন দান  করা, অরে একজনের উদ্দেশ্য হচ্ছে অস্ত্রের আঘাতে কারুর প্রাণনাশ করা। তো উদ্দেশ্য বড়ো কথা, কর্ম্ম নয়।

উপনিষদ বলছেন, আসক্ত হয়ে জীব, সেই ফলই পান, যাতে ওই জীবের পরিচায়ক মনটি অর্থাৎ শুদ্ধ বা অশুদ্ধ মনের মধ্যে  উদ্ভূত অভিলাষ হয়েছে। জীব ইহলোকে যা কিছু করেন, পরলোকে সেই কর্ম্মের ভোগ শেষ করে, পুনর্বার কর্ম্ম করবার জন্য, পরলোক থেকে ইহলোকে আসেন। ফলাকাঙ্খী জীবের এই রকমটাই হয়ে থাকে। আর যারা অকাম, নিষ্কাম, আপ্তকাম, ও আত্মকাম,  তাঁর গমনাগমন নেই, দেহান্তরপ্রাপ্তিও নেই।  ( শ্লোক - ৪/৪/৭) বৃহদারণ্যক উপনিষদের এই জায়গাটা আমাদের মধ্যে প্রশ্নের জাগরণ করতে পারে। অর্থাৎ পরলোকেও আমাদের তাহলে ভোগ সম্পন্ন হয় ? যদি হয়, তবে প্রারব্ধ কর্ম্ম কেন থাকবে ? আর মৃত্যুর পরে তো আমাদের এই স্থুল দেহ থাকবে না, তবে কিভাবে সেখানে আমাদের ভোগ সম্পন্ন হবে ?  এই ধরনের কথা আমরা গীতাতেও পাই। তো এই সব কথার যথার্থ অর্থ আমরা পরবর্তীতে  শুনবো।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

জীবাত্মার কাকে বলে ? 

উপনিষদ বলছেন, অহম ব্রহ্মাস্মিন, আমিই ব্রহ্ম।  আমিই যদি ব্রহ্ম হই, তবে জীবাত্মা বা আমি, বা আমার আলাদা একটা সত্তা যা আমরা উপলব্ধি করি, যা  আমাদেরকে  অন্যদের থেকে আলাদা করেছে, সেই জীবাত্মার   উৎপত্তি কিভাবে হলো। সবাইকেই,  যদি ব্রহ্ম বলা হয়, ব্রহ্মই যদি সব, কখনো তিনি ব্যক্ত, কখনো তিনি অব্যক্ত - ও যদি সত্য হয়, তবে জীবাত্মা বলে আলাদা কিছু থাকে কি ? 

দেখুন, সন্ধিনী, সম্বিৎ ও হ্লাদিনী এই যে তিনটি শক্তি তা ভগবানে পূর্ণভাবে প্রকটিত। কিন্তু জীবের মধ্যে তা বীজভাবে প্রসুপ্ত। 
সন্ধিনী কথাটার অর্থ হচ্ছে, যার মধ্যে মিলন ইচ্ছে জাগ্রত হয়েছে। বৃষ দ্বারা আক্ৰান্ত ঋতুমতী গাভীর  সঙ্গে এই সন্ধিনী কথাটার উপমা দেওয়া হয়েছে। তো ভগবানের মধ্যে এই সন্ধিনী শক্তি পূর্ন  ভাবে প্রকটিত। সম্বিৎ অর্থাৎ জ্ঞান বা  চৈতন্য।  আর হ্লাদিনী কথাটার অর্থ হচ্ছে   আহ্লাদযুক্ত, হৃষ্টা। ভগবানের  সেই স্বরূপ শক্তি যার দ্বারা স্বয়ং তিনিই  আনন্দলাভ করে থাকেন । তো এই তিনটি শক্তি ভগবানে পূরণ ভাবে প্রকটিত আর জীবের মধ্যে সুপ্ত।
 আমরা জানি জীবদেহ  প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু আমরা যাকে  জীবাত্মা বলি তা আসলে তপলোকের বাসিন্দা, ভগবানের অংশ মাত্র । এই তপলোক, অর্থাৎ অপার্থিব আলোক লোক থেকে ভগবানের অংশ  রশ্মির সাহায্যে জনলোকে নেমে আসে। এবং সেখানে হিরন্ময় কোষ গ্রহণ করে। এর পর ক্রমশ মহর্লোকে নেমে আনন্দময় কোষের দ্বারা আবৃত হয়। এর পর স্বর্গলোকে বিজ্ঞানময় কোষের দ্বারা আবৃত হয়। এ তিনটি কোষের দ্বারা আবৃত অর্থাৎ হিরণ্ময়, আনন্দময় ও বিজ্ঞানময় কোষের দ্বারা আবৃত চৈতন্যকে বলা হয়, আত্মা-বুদ্ধি-মনস। এই আত্মা-বুদ্ধি-মনস ধীরে ধীরে পুষ্টি লাভ করতে থাকে, সুসংহত হতে থাকে। এই পুষ্টিকৃত সুসংহত সত্তা পরবর্তীতে জীবাত্মা হবে।

 এবার, এই আত্মা-বুদ্ধি-মনস-এর অংশ রূপস্বর্গে নেমে ভাবনাময়, ভুবর্লোকে নেমে বাসনাময়, এবং সবশেষে ভুলোকে নেমে ইথার-নির্মিত কোষ ও স্থূলজড় নির্মিত কোষ অর্থাৎ ভাইরাস-দেহ (বস্তু থেকে জীবসৃষ্টির মধ্যাবস্থা)  গ্রহণ করে ও স্থাবর রূপে প্রকাশিত হয়। ইথার ও কঠিন-তরল-বায়বীয় ভেদে জীবের শরীরকে ছয়টি কোষের সমন্নয় বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ জীবের শরীরের  সংখ্যা ছয়টি। এগুলোকেই আবার পিন্ডদেহ, লিঙ্গদেহ, কারন দেহ বা স্থূল, সুক্ষ ও কারন প্রভৃতি আখ্যা দেওয়া হয়েছে।  উপনিষদ বলছেন,  কঠিন-তরল ও বায়বীয় পদার্থে নির্মিত শরীরকে বলা হয়, অনন্ময় শরীর। পার্থিব আকাশ তত্ত্বে অর্থাৎ ইথারে নির্মিত শরীরকে বলা হয়, প্রাণময় শরীর। বাসনাময় ও ভাবণাময় কোষদুটোকে মিলিয়ে, জীবের মনোময় শরীর।  আর সূক্ষ্মতর  তিনটি শরীর যা অপার্থিব তা হচ্ছে, বিজ্ঞানময়, আনন্দময়, ও হিরণ্ময়  .

ভগবানের অংশ, যখন, তপলোক থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসে,  এবং হিরণ্ময়, আনন্দময়, বিজ্ঞানময় কোষে আবৃত হবার ফলে চৈতন্যের যে জীব ভাব প্রকাশ পায়, তাকেই বলে জীবাত্মা। আবার জীবাত্মার যে অংশ স্থুল ও সূক্ষ্ম পদার্থের অর্থাৎ জড়দেহ, মানস (ভাবনা ও বাসনা) দেহের আশ্রয়ে যে প্রকাশ তাকে বলে, ভূতাত্মা।  
--------------------------     

 

    
 















 


         

















  .