ঈশ উপনিষদ
- শশাঙ্ক শেখর শান্তি ধাম -
ঈশ উপনিষদ
মঙ্গলাচরণ মন্ত্র :
ওঁ পূর্ণমদ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।
ওঁ পূর্ণমদ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওঁং
ওঁ - পরমআত্মার নাম বিশেষ
পূর্ণমদঃ - পূর্নম-অদঃ - সর্বব্যাপী সেই
পূর্ণমিদং - পূর্নম-ইদং - অনন্ত এই
পূর্ণাৎ - পূর্ণ থেকে
পূর্ণমুদচ্যতে - পূর্ণম -উদচ্যতে - দৃশ্যমান জগৎরূপে প্রকাশিত হয়েছেন।
পূর্ণস্য - পূর্ণের
পূর্ণমাদায় - পূর্ণম -আদায় - পূর্ণকে সরিয়ে দেওয়া হয়
পূর্ণমেবাবশিষ্যতে - পূর্ণমেব-অবশিষ্যতে - পূর্ণই অবশিষ্ট থাকে।
এখানে পূর্ণ কথাটা দিয়ে একদিকে পরমব্রহ্মকে বোঝানো হচ্ছে, আবার জগৎরূপ ব্রহ্মকে বোঝানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এই ব্রহ্ম অনন্ত, আবার এই জগৎরূপ ব্রহ্মও অনন্ত। এখন পরমব্রহ্ম থেকে যদি জগৎরূপ ব্রহ্মকে সরিয়ে নেওয়া হয়, তবে সেই অনন্ত ব্রহ্মই থাকেন। কারন হচ্ছে, জগৎরূপ যে ব্রহ্ম তা সেই পরমব্রহ্ম-এর উপর আরোপ করা হয়েছে।
এখানে দুটো শব্দ খুব গুরুত্বপূর্ণ - অদঃ ও ইদং - উহা ও ইহা। একটা শিশু যখন জন্ম গ্রহণ করে তখন দুটো জ্ঞানেন্দ্রিয় প্রথমে সক্রিয় হয়, একটা হচ্ছে চোখ, আর একটা হচ্ছে কান। আর এর ফলে তার কাছে দুটো জিনিস স্পষ্ট হতে থাকে, একটা হচ্ছে শব্দ আর একটা হচ্ছে দৃশ্য। আর এই দুয়ের মাধ্যমে সে বহির্জগৎ সম্পর্কে সতর্ক হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে তার বাকি তিনটি জ্ঞানেন্দ্রিয় সজাগ হতে শুরু করে, অর্থাৎ নাসিকা, জিহবা ও ত্বক। আর এই পাঁচ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সে বাহির জগতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। কিন্তু এই যে জগৎ-দর্শন তা হয়ে ওঠে জানলার ছিদ্র দিয়ে বিশ্বজগৎ দর্শনেই মতো। এর দ্বারা সে সমগ্র জগতের দর্শন সে পায় না। এই যে বহির্জগৎ একে উপনিষদ "ইদম" শব্দটি দিয়ে বুঝিয়েছেন। ইদম অর্থাৎ ইহা। এটি স্থান, কাল, পাত্র সমন্বিত একটা নিয়ত পরিবর্তনশীল বস্তু বা জগতের প্রতীক। কিন্তু এই যে ইদম যা আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এর পিছনে আছে আরো এক জ্ঞান। এই জ্ঞান ইন্দ্রিয়লব্ধ নয়। একেই বলা হচ্ছে অদঃ বা ঐ অর্থাৎ যা দূরে রয়েছে। আবার দেখুন ঐ এবং এই দুটো শব্দ একটি আরেকটির উপরে নির্ভরশীল। এই দুটোকে আলাদা করা যায় না। ঐ - যা দূরে রয়েছে, তাকে আমি ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করতে পারছি না, তাই সেই দূরের অপরিবর্তনশীল বস্তুকে জ্ঞানাতীত বলা হয়। আসলে "এই" হচ্ছে কার্য্য আর "ঐ" হচ্ছে কারন। একটা দৃশ্য, আর একটা অদৃশ্য,একটা অভিজ্ঞতালব্ধ, আর একটা অভিজ্ঞতার বাইরে। ব্রহ্ম-এর পূর্ণ থেকেই জগতের পূর্নতা এসেছে।
তিনবার শান্তিঃ উচ্চারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের সকলের ত্রিবিধ (আধ্যাত্মিক - শারীরিক ও মানসিক, আধিদৈবিক - পরিবেশ ও প্রাকৃতিক, আধিভৌতিক - হিংস্র জীব-জন্তু থেকে যে বিঘ্ন) শান্তিঃ হোক।
আয়নায় প্রতিফলিত যে রূপ, জলের পাত্রে সূর্য্যের যে প্রতিচ্ছবি, এগুলো ততক্ষন সত্য যতক্ষন আকাশের সূর্য বা প্রতিফলনকারীর অবস্থান আয়নার উপরে থাকে। আয়না সরে গেলে, সূর্য্যের কোনো ক্ষয় বা বৃদ্ধিকিছুই হয় না। তেমনি এই যে জগৎ এটি পরমব্রহ্ম-এর প্রতিফলন মাত্র। জগৎ নির্বাপিত হয়ে গেলেও, সেই অনন্ত সর্বব্যাপী নিত্য ব্রহ্মস্বরূপের কোনো পরিবর্তন হয় না।
----------------------
ঈশ উপনিষদ
ঈশ উপনিষদ আসলে শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতার সবশেষ অধ্যায় (৪০-তম) থেকে নেওয়া। শুক্ল যজুর্বেদ আসলে কর্ম্মকান্ড নিয়ে আলোচনা। কিন্তু এই অধ্যায়ে অর্থাৎ একদম শেষ (৪০) অধ্যায়ে এসে জ্ঞানের কথা বলা হচ্ছে। ঈশ উপনিষদে মোট ১৮টি শ্লোক। কিন্তু শুক্ল যজুর্বেদের এই অধ্যায়ে ১৭-টি শ্লোক আছে। এর সঙ্গে আরো একটা শ্লোক যোগ করে মোট ১৮টি শ্লোক নিয়ে ঈশ উপনিষদ। আমরা শুধু এই শ্লোকগুলোর যথার্থ অর্থ এবং আমাদের জ্ঞানাকাশে মন্ত্রের যে চিত্র ফুটে উঠছে, সেই দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবো। তাঁর কথা শুনবো, সেই ঈশ্বরের কথা শুনবো, যা কেবল আমাদের চিদাকাশে দৃশ্যমান হচ্ছে ।
ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎকিঞ্চিৎ জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম। (শ্লোক-১)
ঈশা বাস্যমিদং সর্বং - ঈশ্বর কর্তৃক আচ্ছাদিত এই সবকিছু
যৎকিঞ্চিৎ জগত্যাং জগৎ। - জগতের মধ্যে যা কিছু জগৎ
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা - তাকে ত্যাগের দ্বারা পালন করো
মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম। - কারুর ধনের প্রতি লোভ করো না।
এই সবকিছু (জগৎ - অর্থাৎ যা কিছু দেখছো) ঈশ্বরের দ্বারা অভিব্যাপ্ত হয়েছে। এঁকে নিষ্কাম ভাবের দ্বারা সেবন করো। কোনও ধনের প্রতি লালসা করো না।
জগৎ প্রপঞ্চময়। এই আছে এই নেই। জগৎ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। এই জগৎ এক মুহূর্তের জন্যও কোনো কিছুকেই এক অবস্থায় ধরে রাখতে পারে না। কিন্তু এই জগৎ যিনি ধরে রেখেছেন, তিনি অবিচল, অপরিবর্তনীয়, পরমেশ্বর। তিনিই এই জগতের সমস্ত কিছুর আশ্রয়। আমাদের এই স্থূল দেহের প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। একদিন আমরা সবাই শিশু ছিলাম, ধীরে ধীরে আমরা কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে চলেছি। কিন্তু যে আমি শিশুকালে ছিলাম, যৌবনেও সেই আমিই আছি। আমার কোনো পরিবর্তন নেই। আজ আমি বৃদ্ধ হয়েছি, এখনো সেই আমিই আছি। একদিন এই দেহের নাশ হবে, একসময় এই দেহ অগ্নিতে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, বা কবরের মধ্যে গলে পচে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে, কিন্তু আমি থাকবো। এই সত্যকে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। এই দেহের প্রতি আমাদের আসক্তি ত্যাগ করতে হবে। অনিত্য বস্তুর প্রতি আমাদের আকর্ষণ ত্যাগ করতে হবে, আসক্তি ত্যাগ করতে হবে, বস্তুর প্রতি আমাদের লোভ-লালসা ত্যাগ করতে হবে। জগতের সমস্ত কিছুর মধ্যে একটা সত্য নিহিত আছে, যা অপরিবর্তনীয়, যা নিত্য, আর তাকেই উপনিষদ বলছে ব্রহ্ম। এই যে দৃশ্যমান জগৎ একদিন ব্রহ্ম থেকেই এসেছিলো, ব্রহ্মতেই স্থিত আছে, আবার ব্রহ্মতেই ফিরে যাবে। এই সত্য আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। আসক্তি, মোহ, মমতা সব একদিন দূর হয়ে যাবে - কারন যখন বস্তু আর এই আকারে থাকবে না, সেইদিন সেই বস্তুর প্রতি আমাদের আকর্ষণও শেষ হয়ে যাবে। তবে বস্তুর পরিণতি সম্পর্কে যদি সম্যক জ্ঞানের উপলব্ধি থাকে, তবে এই আসক্তি, লোভ, মোহ এক্ষুনি দূর হয়ে যাবে।
বুদ্ধদেবের আশ্রমে একজন শিষ্য দীর্ঘ দিন একই এলাকায় ভিক্ষে করতে যেত। আর একই এলাকায় তার ভিক্ষেসামগ্রীর প্রাপ্তি দিন দিন কমে যেতে লাগলো। বুদ্ধদেব লক্ষ করলেন, ছেলেটি বিমর্ষ হয়ে সারাদিন বসে থাকে। খবর নিতেই জানতে পারলেন , ওই এলাকায় একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছে সে। তো ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করতেই সে তা স্বীকার করলো। কিন্তু বুদ্ধদেব বললেন, তুমি যার প্রেমে পড়েছো, সে তো অনিত্য, আজ আছে কাল নেই। হে শিষ্য, আত্মস্থ হও। আত্মার সাথে সম্পর্ক জোড়ো। কিন্তু যুবক এসব কথার অর্থ কিছুই বুঝতে পারলো না। কিন্তু সর্বজ্ঞ বুদ্ধদেব জানতেন, মেয়েটি দুদিন বাদেই দেহত্যাগ করবে, কারন তার কর্ম্ম শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সেসব কথা তিনি কিছুই বললেন না। শুধু বললেন, ৭দিন অপেক্ষা করো। ৭-দিন পরে, তোমার কাছে ওই মেয়েটিকে নিয়ে আসা হবে। তখন যদি তোমার ইচ্ছে হয়, তবে তাকে বিয়ে করে সংসার করো। তো শিষ্য খুব খুশি হলো। কিন্তু নিয়তির পরিহাস, ৭-দিন পরে, ওই মেয়েটির মৃতদেহ, তার মা-বাবা বুদ্ধের আশ্রমে নিয়ে এলেন। ঘণ্টাকয়েকের মধ্যেই মেয়েটির দেহে পচন শুরু হলো। ছেলেটিকে প্রশ্ন করা হলো, তুমি কি এই দেহটিকে ভালো বেসেছিলে ? ছেলেটি উদাস হয়ে গেলো - আর বুদ্ধের পা জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো।
জগতের সমস্ত বস্তুই পরিবর্তনশীল, কিন্তু এই বস্তুর মধ্যে আছেন স্বয়ং ব্রহ্ম যিনি অপরিবর্তনীয়। এখন কথা হচ্ছে বস্তুর পরিণতি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কি করে হবে ? উপনিষদ বলছে, নিজেকে ব্রহ্মরূপে, বিশুদ্ধ চৈতন্য রূপে চিন্তা করো। গভীরভাবে এই চিন্তা করতে করতে একদিন তোমার অনিত্য জগতের প্রতি আসক্তি দূর হয়ে যাবে। এই সত্যকে মনের মধ্যে দৃঢ় করো, যে জগৎ মায়া - এই জগৎ আমাদের অজ্ঞানের কারনে, আমাদেরই মনের ভ্রমজ্ঞান থেকে উৎপন্ন হয়েছে। মনের এই ভ্রমজ্ঞান কেটে গেলে, জগতের অস্তিত্ত্ব থাকবে না। যা ক্ষণস্থায়ী তার প্রতি লোভ করে কি হবে ? বরফ জলে পরিণত হয়েছিল, জল বাস্পে পরিণত হয়েছিল। বাষ্প মেঘে পরিণত হয়েছিল। মেঘ বৃষ্টিতে পরিণত হয়েছিল। বৃষ্টি নদীতে পরিণত হয়েছিল। নদী সমুদ্রে মিশে গিয়েছিলো। এই সত্যকে ধরবার চেষ্টা করো। দৈহিক সুখ, ধনসুখ, সবই ক্ষণস্থায়ী। ব্রহ্ম চিন্তায় মগ্ন থাকো. ব্রহ্মই সত্য - আমিই ব্রহ্ম - এই জ্ঞান অন্তরে রেখে উদাসীন হয়ে জগতের সবকিছুকে লালন-পালন করো। কাউকে ছেড়েও দিও না, কাউকে ধরেও রেখো না।
---------------------------
ঈশ উপনিষদ শ্লোক নং -২
কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেচ্ছতং সমাঃ
এবং ত্বয়ি নান্যথেতোহস্তি ন কর্ম লিপ্যতে নরে। (শ্লোক-২)
কুর্বন্নেবেহ - কুর্বন-এব -ইহ = এখানে করেই
কর্মাণি = কর্ম্মসমূহ
জিজীবিষেচ্ছতং সমাঃ। জিজীবিষেৎ-শতং সমাঃ - যদি শত বৎসর বাঁচার ইচ্ছে হয়
এবং ত্বয়ি -এইভাবে তোমাতে
নান্যথেতোহস্তি - অন্যথা-ন অস্তি -অন্য কোনো পথ নেই
ন কর্ম লিপ্যতে - কর্ম্মফলে লিপ্ত হবে না
নরে। - ওহে মানুষ।
এইভাবে (নিষ্কামভাবের দ্বারা) কর্ম করে, (নির্লোভী হয়ে) মানুষ শতবৎসর জীবিত থাকবার ইচ্ছে করতে পারে। এই হচ্ছে মুক্তির পথ। অন্য কোনো পথ নেই। ওহে মানুষ কর্ম্মফলে লিপ্ত হবে না।
প্রথম শ্লোকে আমরা শুনেছি, "ঈশ্বরের দ্বারা জগৎ অভিব্যাপ্ত হয়েছে। এঁকে নিষ্কাম ভাবের দ্বারা সেবন করো। কোনও ধনের প্রতি লালসা করো না।" যজুর্বেদ সংহিতা আসলে কর্ম্মকান্ডের বিধি ও নিষেধের গ্রন্থ। এখানে বিভিন্ন ধরনের ধর্ম্ম-কর্ম্মের মাধ্যমে জাগতিক দুঃখ নিবারণ ও সুখের আহরণের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু এই যজ্ঞাদি কর্ম্ম যা আসলে আমাদের জাগতিক কামনা-বাসনা পূরণের দাওয়াই তা কখনও আমাদের মুক্তির পথ দেখাতে পারে না। বৈরাগ্যই মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমরা কর্ম্ম-দেহে অবস্থান করবো, আর সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে কেবল ব্রহ্ম চিন্তন করবো, তা আমাদের পক্ষে যেমন সম্ভব নয়, এমনকি এতে করে আমাদের শরীর রক্ষাও হবে না। এমনকি ঈশ্বর সৃষ্ট এই জগতের তাতে কোনো উন্নতি হতে পারে না। তাই শুক্ল যজুর্বেদের একদম শেষ অধ্যায়ে এসে বলছেন, কাজ তো করতেই হবে, দীর্ঘায়ুও অৰ্জন করতে হবে, কিন্তু কাজ করলে তো ফল ভোগ করতে হবে। তাই আমরা যদি ফলাকাঙ্খ্যা ত্যাগ করে কাজ করতে পারি, কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করে কাজ করতে পারি, তবে আমাদের চিত্ত শুদ্ধি হবে, বিবেকজ্ঞান বৃদ্ধি পাবে, এমনকি আমাদের ইন্দ্রিয়সুখের স্পৃহা ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। অর্থাৎ আমরা যদি সমস্ত কর্ম্ম ঈশরের উদ্দেশ্যে করতে পারি, তবে কর্ম্মফল জনিত সুখ-দুঃখের ভাগিদার হতে হবে না আমাদের। যদিও ত্যাগের পথই মুক্তি প্রদায়িনী, তথাপি নিষ্কাম কর্ম্মের পথ আমাদের উভয় লক্ষ্য পূরণ করতে পারে। তাই একদিকে দেহাদির ধর্ম্ম পালন হলো, ভূতাদির শান্তি করো। আবার ঈশ্বরের ইচ্ছেয় সমস্ত কর্ম্ম করো। এবং কর্ম্মফল ঈশ্বরকেই অর্পণ করো।
শ্রীমদ্ভগবৎ গীতাতেও আমরা এই বাণীর প্রতিধ্বনি পাই। শ্রী গীতার ২/৫০ নং শ্লোকে বলা হচ্ছে, "বুদ্ধিযুক্ত কর্ম্মযোগী এই লোকেই সুকৃত ও দুষ্কৃত উভয়ই ত্যাগ করেন, সেজন্য তুমি (অর্জুন) নিষ্কাম কর্ম্মযোগ অনুষ্ঠান করো। কর্ম্মযোগ হচ্ছে কর্ম্মের কৌশল। " এই বুদ্ধিযুক্ত অর্থাৎ অর্থ সমত্ব-বুদ্ধি যুক্ত। ২/৫১ নং শ্লোকে বলা হচ্ছে বুদ্ধিযুক্ত মনীষীরা কৰ্ম্মজাত ফল ত্যাগ করে জন্ম-বন্ধ-বিনির্মুক্ত হয়ে নিরুপদ্রব বিষ্ণুর পরমপদ লাভ করেন। আবার শ্লোক নং ৫/১০, বলছেন, "যিনি ব্রহ্মে কর্ম্মসকলের ফল ও আসক্তি ত্যাগ করেন, তিনি জলের দ্বারা পদ্মপত্রের ন্যায় পাপ-পুণ্যের দ্বারা লিপ্ত হন না।"
-----------
ঈশ উপনিষদ শ্লোক নং -৩
অসূর্যা নাম তে লোকা অন্ধেন তমসাবৃতাঃ
তাংস্তে প্রেত্যাভিগচ্ছন্তি যে কে চাত্মহন্যে জনাঃ। (শ্লোক নং ৩)
অসূর্যা নাম তে লোকা - অসূর্য অর্থাৎ সূর্য্যহীন, বা অসুরচিত, নামে যে লোক বা স্থান,
অন্ধেন তমসাবৃতাঃ - অজ্ঞান অন্ধকারের দ্বারা আবৃত।
তাং-তে প্রেত্যাভিগচ্ছন্তি - সেই লোকে দেহত্যাগের পর গমন করেন
যে কে চ-আত্মহন্যে জনাঃ - যিনি আত্মহত্যা করেন, অর্থাৎ যাদের আত্মজ্ঞান হয়নি।
এমনসব লোক (স্তর বিশেষ) আছে, যা অজ্ঞান অন্ধকারের দ্বারা আচ্ছন্ন। একেই বলে অসূর্যঃ লোক বা অসুরলোক। অন্ধ ব্যক্তি যেমন তমসার দ্বারা আচ্ছন্ন, তেমনি জ্ঞানান্ধ ব্যক্তি আত্মজ্ঞানের অভাবে অজ্ঞান-অন্ধকারের দ্বারা আবৃত। এইসব অজ্ঞান ব্যক্তি মৃত্যুর পরে অসুরলোক বা সূর্য্যহীন লোক প্রাপ্ত হয় ।
বলা হয়, ৮৪ লক্ষ (অর্থাৎ অসংখ্য) যোনি ভ্রমনের পরে, জীবাত্মা এই মনুষ্য দেহ প্রাপ্ত হয়। এসবই স্থূল দেহের ভেদ। স্থাবর, উদ্ভিদ, স্বেদজ, অন্তজ প্রভৃতি অবস্থাকে গ্রহণ ও পরিহার করে, ধীরে ধীরে স্রোতের শেষে এসে জরায়ুজ শ্রেণী প্রাপ্ত হয়। এর পর এই জরায়ুজ শ্রেণীর উন্নত অবস্থায় এসে, একসময় এই দুর্লভ মনুষ্য দেহ লাভ করে। নদী যেমন সাগর থেকে বাষ্প-মেঘ-বৃষ্টি-জল-পাহাড়-নদী, অর্থাৎ রূপান্তরিত হতে হতে ধীরে ধীরে গ্রাম গঞ্জ ভেদ করে আবার সমুদ্রের দিকে ধাবিত হয়, তেমনি জীবাত্মা পরমাত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধীরে ধীরে আবার সেই পরমাত্মার দিকে ধাবিত হয়। জীব একদিন প্রকৃতির গর্ভে পরমাত্মা কর্তৃক বীজ রূপে গ্রথিত হয়েছিল। এইজন্য বীজরূপে জীব প্রকৃতির গর্ভ থেকে উদ্গমন শুরু করে, পরমাত্মারই টানে। মাটিতে গ্রথিত বীজ থেকে যেমন সূর্য্যের টানে অঙ্কুর হয়ে উত্থিত হয়, তেমনি জীব লক্ষ-কোটি জন্মের পরে উৎকৃষ্ট দেহপ্রাপ্ত করে। বলা হয়, এই যে উত্থান এ তার কৃতকর্মের ফল নয়, এই প্রক্রিয়া বা পরিণতি প্রকৃতির স্বভাবজাত। প্রকৃতিতে কোনো কিছু এক জায়গায় এক মুহূর্তের জন্যও স্থির থাকতে পারে না। হয় ক্ষয় নয় বৃদ্ধি অথবা দুইই একই সঙ্গে চলতে থাকে। জন্ম-মৃত্যু একই সঙ্গে চলতে থাকে। এই যে মনুষ্য দেহ, এই দেহের মধ্যেও প্রতি মুহূর্তে কেউ মারা যাচ্ছে কেউ জন্মাচ্ছে। কোনো কোষ জন্মাচ্ছে তো কোনো নতুন কোষের জন্ম হচ্ছে। এই জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে জীবন প্রবাহ চলছে। জীবন-নদী বেয়ে চলেছে। এসব প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটে থাকে। এর জন্য আমাদের কারুর কোনো কিছু করবার দরকার পড়ে না।
আমাদের যতদিন না অহং ভাবের সৃষ্টি হচ্ছে, ততদিন আমাদের কর্ম্মের অধিকার জন্মে না। অতএব মনুষ্য দেহ পাবার আগে পর্যন্ত আমরা যত দেহ ধারণ করেছি, তা সে চুরাশি লক্ষ হোক বা তার কম-বেশি যাই হোক, সেখানে আমাদের কর্ম্ম-প্রেরণা বা ব্যক্তিগত ইচ্ছে-অনিচ্ছা বলে কিছু ছিল না। কিন্তু যখনই আমরা এই মনুষ্য দেহের সঙ্গে সংস্পর্শে এসেছি, সেই দিন থেকেই আমাদের কর্তৃত্বাভিমান উৎপন্ন হয়েছে এবং কর্ম্মের উৎপত্তি ও ফলভোগের উৎপাত শুরু হয়েছে। এইজন্য মনুষ্য দেহকে বলা হয় কর্ম্ম দেহ। এখানে কর্ম্ম কথা বলে, ভালো কর্ম্ম ভালো ফল দেবে, আর খারাপ কর্ম্ম খারাপ ফল দেবে। এটাও সেই প্রকৃতির নিয়ম। এখানেও পরমেশ্বরের কোনো হাত নেই। সাধন ক্রিয়া করতে করতে এক সময় প্রকৃতির স্রোতের প্রভাব ধীরে ধীরে কমতে থাকে। যোগীপুরুষের মধ্যে প্রকৃতির প্রভাব থাকে না। জীব তার স্বকৃত কর্ম্মের ফল স্বরূপ, স্ব স্ব লোক প্রাপ্ত হয়। এই স্ব-কৃত কর্ম্মের ফলেই, জীব অধোগতি বা উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হয়। প্রকৃতির গতিপথ সরল হলেও, কর্ম্মের গতিপথ চক্রাকার এবং অনন্ত বৈচিত্রে ভরা। মনুষ্য দেহে অভিমানের বিকাশের ফলে অনন্ত প্রকার লীলার স্ফূরণ ঘটে থাকে। যতক্ষন এই অভিমানের নিবৃত্তি না হয়, ততক্ষন সরল গতির সূত্রপাত হয় না। এই সরলগতি প্রাপ্ত হবার জন্য যত সাধন-ভজন যোগাদির ক্রিয়াকলাপ। মনুষ্যদেহের এই যে বিচিত্র গতিপথ এসব কেবল মুক্ত পুরুষেরাই জ্ঞাত হয়ে থাকেন।
মনুষ্যদেহ লাভের পরেও যারা আত্মজ্ঞান লাভের জন্য সচেষ্ট না হন, তারা জানবেন আত্মঘাতী পুরুষ। এরা জীবনের আসল উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে শরীরকে আমি ভেবে শরীরের সেবাযত্ন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে। আর ইন্দ্রিয় সুখে মগ্ন হয়ে আছে। জগতের বৈচিত্রে বিমোহিত। জীবনের উদ্দেশ্য ভুলে গেছে। নিজেকে ভুলে গেছে। জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মসংযম। এই আত্মসংযমের দ্বারা ব্রহ্ম বা আত্মার সঙ্গে একাত্মতা উপলব্ধি করতে হবে। সাধনক্রিয়ার সাহায্যে অন্তঃস্থিত সজ্ঞাকে জাগ্রত করে, উপলব্ধি করতে হবে, আমিই সেই পরমাত্মা। আমি শুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ। আমি নিত্যমুক্ত, আমি নামরূপহীন। আমি কোনো নিয়মের অধীন নয়। আমি আত্মা, আমি অপরিবর্তনীয়, আমি অনন্ত, সর্বব্যাপী, আমি বাক্য মনের অতীত সেই সৎ সত্ত্বা। আমার না আছে জন্ম, না আছে মৃত্যু, আমি সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম। এই উপলব্ধিতে স্থিত হতে পারলে, তাঁর আর জন্ম-মৃত্যুর কবলে পড়তে হবে না।
এই পথ যারা অবলম্বন না ক'রে, কেবলমাত্র দেহাভিমানী হয়ে, কর্ত্তৃত্বাভিমানী হয়ে ইন্দ্রিসুখের জন্য ছুঁটে বেড়াচ্ছেন, তাদের ইহলোক, পরলোক দুই অজ্ঞান অন্ধকার দ্বার আবৃত। উপনিষদ-এর ঋষি বলছেন, এইসব অজ্ঞান ব্যক্তি মৃত্যুর পরে অসুরলোক বা সূর্য্যহীন লোক প্রাপ্ত হন।
----------------
শ্লোক নং - ৪ ঈশ-উপনিষদ
অনেজদেকং মনসো জবীয়ো নৈনদ্দেবা আপ্নুবন পূর্বমর্ষৎ
তদ্ধাবতোঅন্যানত্যেতি তিষ্ঠৎ তস্মিন্নপো মাতরিশ্বা দধাতি। (৪)
অনেজদেকং - অনেজৎ-একং - নিশ্চল এক
মনসো জবীয়ো - মনের চেয়ে বেশী বেগবান
নৈনদ্দেবা আপ্নুবন - এনৎ-ন-দেবা - আপ্নুবন - ইন্দ্রিয়সমূহ এর নাগাল পায় না।
পূর্বমর্ষৎ - পূর্বম-অর্ষৎ - সকলের আগে
তদ্ধাবতোঅন্যানত্যেতি - তৎ-ধাবতঃ-অন্যান্য-অতি-এতি - অন্য সকলকে অতিক্রমন করে যান
তিষ্ঠৎ - স্থির থেকেও
তস্মিন্নপো - তস্মিন-অপঃ - তাঁর অবস্থাতেই জলাদি অর্থাৎ কর্ম্ম সমূহ
মাতরিশ্বা - বায়ু বা জগৎ-বিধায়কসূত্রাত্মা বা হিরণ্যগর্ভ
দধাতি - ক্রিয়া করতে সমর্থ হন অর্থাৎ বিশেষ ভাবে পালন করেন।
পরমাত্মা নিশ্চল অর্থাৎ গতিহীন। অথচ তিনি মনের থেকেও অধিক বেগশালী। তাঁর সেই বেগের সাথে ইন্দ্রিয়-দেবতাগন পা ফেলে চলতে পারে না। তিনি সব সময় যেন সবার আগেই চলছেন। তিনি নিজে স্থির থেকেও সকলকে অতিক্রম করেন। এই পরব্রহ্মে স্থিত হয়ে, অন্তরীক্ষ গামী (মাতরিশ্বা) পবন (বায়ু) জলকে ধারণ করে থাকে।
ব্রহ্ম এক এবং নিশ্চল। ব্রহ্ম এমন একটা শব্দবন্ধ যার দ্বারা সবকিছুর মধ্যে যে মূলশক্তি তা সে সদর্থক হোক বা ও নঞৰ্থক (নেগেটিভ ও পজেটিভ) হোক দুটো শক্তিকেই বোঝানো হচ্ছে। তিনি এক আবার বহু, তিনি নেই আবার আছেন, তিনি করেন না আবার করেন, তিনি স্থির আবার সর্বত্র। তিনি গতিহীন, আবার তাকে কেউ অতিক্রম করতে পারেন না। তিনি দেখেন না আবার দেখেন, তিনি শোনেন না আবার শোনেনা ইত্যাদি ইত্যাদি। জগতের সমস্ত কিছুই তিনি পরিচালনা করেন, আবার তিনি নিজে কিছুই করেন না। তিনি কার্য্য স্বরূপ আবার তিনিই কারন স্বরূপ। এইজন্য বলা হয়, ব্রহ্মকে বর্ণনা করা যায় না বাক্য দিয়ে, আবার তাকে মন দিয়ে অনুভব করাও যায় না, তাঁকে বুদ্ধি দিয়ে বিচার করাও যায় না। তিনিই আকার আবার তিনিই সাকার। তিনি কোনো বস্তুতে নেই, আবার সর্ববস্তুতে আছেন। তাঁর কোনো নাম নেই, আবার সব নামই তাঁর। বস্তুত তার সমকক্ষ কেউ নেই, তাই তাঁকে কারুর সঙ্গেই তুলনা করা যায় না। তিনি অতুলনীয়, অবৰ্ণনীয়।
এখন কথা হচ্ছে, পরষ্পর বিরোধী শক্তি বা উপনিষদের মধ্যে ব্রহ্ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে যে পরস্পর বিরোধী উক্তি বিধৃত হয়েছে - এতে করে আমরা ব্রহ্ম সম্পর্কে কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না। তাহলে এতসব ব্রহ্মকথা কেন, যাঁকে বোঝা যাবে না, যাঁকে বাক্য দিয়ে প্রকাশ করা যাবে না, যাঁকে মন উপলব্ধি করতে পারবে না, তাঁকে নিয়ে আমরা কেন এতো সময় নষ্ট করতে যাবো ? তিনি আছেন কি নেই, তা নিয়ে এই পরস্পর বিরোধী বক্তব্য শুনে আমাদের কি লাভ ? তিনি থাকলে থাকুন, তিনি না থাকলে না থাকুন। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে লাভটা কি ?
এইখানে উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, ব্রহ্ম-এর একটা স্থির অবস্থা, অব্যক্ত অবস্থা বা নির্গুণ অবস্থা আর একটা হচ্ছে ক্ষুব্ধ, ব্যক্ত বা সগুন অবস্থা। তিনিই আমাদের চৈতন্য স্বরূপ। তিনিই সচ্চিদানন্দ স্বরূপ। তিনিই পরমাত্মা। তাঁকে বাদ দিয়ে জগৎ মিথ্যে। তাকে বাদ দিলে, দৃশ্য থাকবে না দ্রষ্টাও থাকবে না। তাকে বাদ দিলে জ্ঞাতা থাকবে না জ্ঞেয় থাকবে না। এমনকি তাঁকে বাদ দিলে, আমি বলেও কিছু থাকবে না। তাঁর অস্তিত্বেই আমার অস্তিত্ব। তাই তাঁকে না বুঝলে, আপনাকে (নিজেকে) চেনা যাবে না। তো আমরা কেউ অস্তিত্ববিহীন হতে চাই না। আমরা সবাই আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। আমরা আমাকে জানতেও চাই। তাই তাঁর কথাই আলোচ্য বিষয় হতে পারে, অন্য সব আলোচনা বৃথা।
আমাদের মন, শরীর আসলে নিষ্ক্রিয় পদার্থ। মন-শরীর তখনই সক্রিয় হতে পারে, যখন আত্মা বা ব্রহ্ম এই শরীর মনে প্রাণের সঞ্চার করেন । আত্মাই মনকে টেনে নিয়ে যায়, তাই মনকে আমরা দ্রুতগামী বলে থাকি। তিনি সর্বত্র বিরাজ করছেন। শুধু মন নয়, এই যে শরীর, এই শরীরের যে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সবই এই আত্মার অস্তিত্বের কারনে সক্রিয় হচ্ছে। প্রকৃতিতে যতসব উপাদান আছে, সবার সম্পর্কেই এই একই কথা প্রযোজ্য। এই শক্তিই সমস্ত কার্যের কারন। কারন না থাকলে যেমন কোনো কাজ হতে পারে না, তেমনি তিনি না থাকলে আমাদের কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে না। পঞ্চভূতের মধ্যে একটি হচ্ছে বায়ু। এই বায়ু যখন আত্মার সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন তা আমাদের প্রাণশক্তিতে রূপান্তরিত হয় , আর এই প্রাণ বায়ুই আমাদের জীবনীশক্তি প্রদান করে থাকে। শুধুমাত্র বায়ু আমাদেরকে রক্ষা করতে পারে না, যদি না এর মধ্যে আত্মার মিলন ঘটে। এই বায়ুকে বলা হয় মাতরিশ্বা । মাতর মানে শূন্য, শ্বা অর্থাৎ চলমান। এই বায়ু যখন পরমাত্মার সংস্পর্শে আসে, তখন সে গতিশীল হতে পারে। তাই বায়ুকে বলা হয় সূত্রাত্মা। অর্থাৎ এই বায়ুকে যিনি সঠিক ভাবে আয়ত্বে আনতে পারেন, এই বায়ুকে যিনি ধরতে পারেন, তিনি ব্রহ্মকে ধরতে পারেন। বায়ু হচ্ছে সুতো। এই বায়ুরুপ সুতোই অব্যক্ত ব্রহ্ম আর ব্যক্ত ব্রহ্মের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী। এইজন্য যোগীপুরুষগন বায়ুর সাধন অর্থাৎ প্রানায়ামাদি ক্রিয়া করে থাকেন। ব্রহ্ম সমস্ত কার্য্যের কারন স্বরূপ, কিন্তু তিনি কিছুই করেন না। তাঁর থেকেই সমস্ত জগৎ ব্যক্ত হয়েছে, বা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁকে আশ্রয় করেই সমস্ত কিছু স্থিত হয়েছে - আবার ব্রহ্মতেই মিলিয়ে যাচ্ছে - এই প্রক্রিয়া প্রতিনিয়ত, প্রতিক্ষনে চলছে। এই প্রক্রিয়ার ফলে জগৎ প্রকাশিত হচ্ছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা সাবই ব্রহ্ম থেকেই এসেছি, আবার একদিন ব্রহ্মতেই মিলিয়ে যাবো। এই সত্যের উপল্বদ্ধিতে নিজেকে স্থাপন করতে হবে।
-----------
ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-৫)
তদেজতি তন্নৈজতি তদ্দুরে তদ্বন্তিকে
তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যত । (শ্লোক -৫)
তদেজতি - তৎ-এজতি - তিনি চলেন
তন্নৈজতি - তৎ ন এজতি - তিনি চলেন না
তদ্দুরে -তৎ-দূরে - তিনি দূরে
তদ্বন্তিকে- তৎ-উ-অন্তিকে - তিনি কাছেও
তদন্তরস্য সর্বস্য - তৎ-অন্তঃ-অস্য সর্বস্য - তিনি এই (জগৎ) সবকিছুর অন্তরে
তদু - তৎ -উ - তিনিই আবার
সর্বস্যাস্য - সর্বস্য-অস্য - তিনিই আবার এর (জগতের)
বাহ্যত - বাইরে।
তিনি সচল, আবার অচল, তিনি দূরে আবার নিকটে, তিনিই জগতের সবকিছুর অন্তরে ও বাহিরে।
ব্রহ্ম বলতে আমরা একটা পরষ্পরবিরোধী ভাবকে বুঝি। আমরা যখন শ্রী গীতা পড়ছিলাম, সেখানেও দেখেছি, এই পরস্পর বিরোধী ভাবের প্রকাশ। শ্লোক নং ১৩/১৬ তে একই কথা বলা হয়েছে, তিনি অন্তরে -বাহিরে, তিনি চল -অচল, তিনি নিকটে আবার দূরে। আসলে ব্রহ্ম বিশ্ব চরাচরের ভিতরে ও বাইরে বিদ্যমান। তিনি যেমন আমাদের মন বুদ্ধি ইন্দ্রিয়ের ধারণার অতীত, তেমনি শ্রদ্ধালু বাল-সুলভ সাধকের কাছে তিনি নিকট থেকে নিকটতম। তিনি অভক্তের দৃষ্টিতে বহু দূরে, আবার ভক্তের নিকট তিনি অতি কাছে। তিনি অজ্ঞানীর নিকট বহু দূরে, আবার যথার্থ জ্ঞানীর নিকট, কাছে। তিনি পার্থিব জ্ঞানীর কাছে বহু দূরে, তিনি প্রাজ্ঞ-ব্যক্তির নিকট, কাছে। তিনি ভক্তের কাছে রূপধারী চলমান শক্তি। অভক্তের কাছে তিনি নিশ্চল অব্যক্ত। অভক্তের কাছে তিনি জন্ম-মৃত্যু রূপ বিভীষিকা, আবার ভক্তের কাছে তিনি জন্ম-মৃত্যু রহিত পরমানন্দ স্বরূপ। এঁকে বুঝতে গেলে, আমাদের এঁর মধ্যে প্রবেশ করতে হবে, তখন জ্ঞাতা-জ্ঞেয়-জ্ঞান সব এক হয়ে যাবে।
----------------------
ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-৬-৭)
যস্তু সর্বাণি ভূতান্যাত্মন্যেবানুপশ্যতি
সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো না বিজুগুপ্সতে। (শ্লোক-৬(
যস্তু - যঃ-তু = কিন্তু যিনি বা যে ব্যক্তি
সর্বাণি = সকল
ভূতান্যাত্মন্যেবানুপশ্যতি - ভূতানি-আত্মনি-এব-অনুপশ্যতি = আত্মাকে সর্বভূতের মধ্যে দেখেন,
সর্বভূতেষু চ-আত্মানং = সর্বভূতের মধ্যে আত্মাকে
ততো ন বিজুগুপ্সতে -- সেহেতু কাউকেই ঘৃণা করেন না।
যিনি সকলের মধ্যে নিজেকে (আত্মাকে) দেখেন, আবার নিজের মধ্যে সকলকে দেখেন, তার মধ্যে ঘৃণা থাকতে পারে না।
আমরা সবাই স্বরূপত এক। বিরাট থেকে ক্ষুদ্র, ধনী থেকে দরিদ্র, জ্ঞানী থেকে অজ্ঞানী, এমনকি মানুষ থেকে পশু, পাখী থেকে কিট পতঙ্গ, স্থাবর-জঙ্গম-উদ্ভিদ সবার মধ্যেই একই সত্ত্বা বিরাজ করছে। পাত্র ভেদে আকার গ্রহণ করেছে। আবার গুন্ ভেদে স্বভাব হয়েছে, কিন্তু আমরা সবাই সেই এক আত্মার উপরে ভিন্ন ভিন্ন আবরণ দিয়ে ঢাকা। এই আবরণ বা মুখোশ বা পোশাক আলাদা হবার জন্য, আমাদেরকে আলাদা মনে হচ্ছে। আলাদা আলাদা নামে , ভিন্ন ভিন্ন রূপে আমাদের প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। পোশাকের ভিন্নতার কারনে, গুনের ভিন্নতার কারনে, আমরা কেউ রাজা, কেউ মহারাজা, কেউ সেপাই, কেউ বা দরবেশ সেজেছি। জগৎরূপ সংসারে খেলা করবার জন্য, জগৎমঞ্চে অভিনয় করবার জন্য, আমরা বিচিত্র সব পোশাক পড়ে আছি মাত্র। ভিতরে আমাদের সবার একই সত্ত্বা বিরাজ করছেন। মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই একত্বকে উপলব্ধি করা। এই সত্যকে অনুভব করা। তাহলে আমাদের মধ্যে সমস্ত দ্বেষ, ঘৃণা, রাগ, দূর হয়ে জীবন হয়ে উঠবে প্রেমপূর্ণ।
যস্মিন-সর্বাণি ভূতানি আত্মৈবাভূদ্বিজানতঃ
তত্র কো মোহঃ কঃ শোক একত্বমনুপশ্যতঃ। (শ্লোক-৭)
যস্মিন-সর্বাণি ভূতানি - যখন সর্বভূত সমূহ
আত্মৈবাভূদ্বিজানতঃ - আত্মা-এব-অভূত-বিজানতঃ = আত্মাই হয়ে গেছে, এইরূপ জ্ঞাত হবে,
তত্র কো মোহঃ কঃ শোক - সেখানে কোথায় মোহ, কোথায় শোক,
একত্বমনুপশ্যতঃ - একত্বম-অনুপশ্যতঃ = একরূপে দেখেন যিনি।
যখন কেউ সবকিছুর মধ্যে এক আত্মাকেই দেখেন, এবং এইরূপ যাঁর জ্ঞান হয়েছে, তাঁর মধ্যে কোনোকিছুর প্রতিই মোহ থেকে না। অর্থাৎ তিনি কোনো কিছুইতেই আসক্ত হন না, আবার কোনো কিছুর জন্য শোক করেন না।
আত্মজ্ঞ পুরুষ সব কিছুর সঙ্গে একাত্মতা উপলব্ধি করেন। আত্মাই সর্বভূতে রয়েছে, আর আমিই সেই আত্মা। মানুষ যখন এই উপল্বদ্ধিতে আসে, তখন সব এক হয়ে যায়। তখন সব পার্থক্যবোধ বিলোপ হয়ে যায়। আসলে বাস্তব বা ব্যবহারিক জীবনে বৈচিত্রের সমাহার। এই বৈচিত্রকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু মনের মধ্যে এই জ্ঞান যদি দৃঢ় হয়, যে এসব অজ্ঞান মনের কল্পনা বৈ কিছু নয়, তখন সবকিছুর প্রতি যেমন একটা অনাসক্ত ভাব আসে, তেমনি হারানোর শোক থেকে রেহাই পাওয়া যায়। তখন দুঃখ বলে কিছু থাকবে না।
--------
ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-৮)
সপর্যগাচ্চুক্রমকায়মব্রণমস্নাবিরং শুদ্ধমপাপবিদ্ধম
কবির্মণীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভুর্যাথাতর্থ্যতোঅর্থান্ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।
সপর্যগাচ্চুক্রমকায়মব্রণমস্নাবিরং - স পর্য্গাৎ-শুক্ৰম-অকায়ম-অব্রণম-অস্মাবিরম = তিনি, প্রাপ্ত হন, পরম তেজময়, রূপহীন, অক্ষত, শিরাহীন
শুদ্ধমপাপবিদ্ধম - শুদ্ধম-অপাপবিদ্ধম = পবিত্র দোষ রোহিত
কবির্মণীষী - কবিঃ-মনীষী = কবি অর্থাৎ প্রাজ্ঞ মনের নিয়ন্তা
পরিভূঃ - উত্তম, সবার উপরে যাঁর স্থান
স্বয়ম্ভুর্যাথাতর্থ্যতোঅর্থান্ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ - স্বয়ম্ভুঃ-যথাতথ্যতঃ-অর্থান-ব্যদধাৎ-শাশ্বতিভ্যঃ = যিনি স্ব ইচ্ছায় অবতীর্ন হন, যথাযথ রূপে, পদার্থসমূহকে বা কর্ম্ম ফল সমূহকে, সৃষ্টি করে আসছেন, বা বিধান করেন, চিরন্তন।
সমাভ্যঃ - কাল থেকে বা সমস্ত কাল ব্যাপী।
তিনি (ব্রহ্ম) সর্বব্যাপী, জ্যোতির্ময়, নিরাবয়ব, অক্ষত, অচ্যুত, নির্ম্মল, নিজ মনের নিয়ন্তা, সর্বোৎকৃষ্ট, স্বয়ম্ভু এবং চিরন্তন। তিনিই সবার জন্য কর্তব্যের বিধান করেন।
দেখুন, যতক্ষন আমাদের মধ্যে দ্বৈত বোধ থাকবে, ততক্ষন আমাদের মধ্যে আমি-তুমি, ভালো-মন্দ, শত্রু-মিত্র, অর্থাৎ দ্বিবিধ বোধের স্থিতি থাকবে। কিন্তু যখন এই দ্বৈতবোধের অভাব ঘটবে, তখন আমি-আমার বোধ চলে যাবে। মন তখন আকাশের মতো বিশাল, সবত্র সমদর্শী, উদার হয়ে উঠবে। তখন সমস্ত পৃথিবাসীকে, এমনকি সমস্ত ব্রহ্মান্ডকেই আমি বলে মনে হবে। সবই তখন নিজের বলে বোধ হতে থাকবে। আর আমি সকলের মধ্যেই আছি, এই বোধে যখন বোধিত হবো, তখন আমি মুক্ত, উদার, সর্বগ্রাহী হয়ে, মনের শুদ্ধতম স্তরে স্থিত হতে পারবো। আত্মা কেবল সাক্ষী মাত্র। দৃশ্যমান জগতের কোনো কিছুই আত্মা থেকে বাইরে নয়, আবার সবার মধ্যে সেই একই আত্মা বিরাজ করছেন। তাঁরই প্রভাবে জগতের সমস্ত কর্ম্ম সম্পাদন হচ্ছে, তাঁরই প্রভাবে সমস্ত কর্ম্মফল সংগঠিত হচ্ছে, কিন্তু তিনি স্বয়ং অকর্তা হয়ে বিরাজ করছেন। সমস্ত কর্ম্মফলের উর্দ্ধে নিস্কল হয়ে অবস্থান করছেন। আত্মার এই স্বরূপকে জানতে পারলে, স্বয়ং-কে জানা হবে। পৃথিবী সবাইকে তা সে ভালো হোক, মন্দ হোক, সবাইকে আশ্রয় দিয়েছেন, সূর্য সবাইকে আলো বিতরণ করছেন, নদী সবাইকেই জল দান করছেন, বাতাস সবাইকেই প্রাণের স্পর্শ দিচ্ছেন। এখানে কোনো ভেদ বিচার নেই। এবার আপনি আলোকে, জলকে, বাতাসকে, কিভাবে ব্যবহার করবেন - তাতে সূর্য, পৃথিবী, বরুন, এঁদের কিছুই এসে যায় না। আপনি জল দিয়ে নোংরা পরিষ্কার করছেন, তাতে জল কখনো নোংরা হয় না, আপনি অগ্নি দিয়ে আবর্জনা জ্বালিয়ে দিচ্ছেন, এতে করে অগ্নির মধ্যে আবর্জনা জমে না। আপনি পৃথিবীকে যতই অত্যাচার করুন না কেন, তিনি প্রতিবাদ করেন না। তো আত্মার কোনো বিকার নেই। তিনি যেমন ছিলেন, তেমনই আছেন।
তিনি জ্যোতিঃস্বরূপ হয়ে সর্বত্র বিরাজ করছেন, তাঁর কোনো আকার নেই, তিনি নিখুঁদ, তিনি কখনো নিজের স্থান থেকে চ্যুত হন না, তিনি সমষ্টি মনের নিয়ন্তা, তাঁর থেকে উৎকৃষ্ট কেউ নেই, তিনি স্বপ্রকাশিত, তিনি চিরস্থায়ী। তিনিই সমস্ত কর্ম্মের ফল দাতা। তার বিধানেই সমস্ত জগৎ তটস্থ হয়ে আছে। তার ভয় সবাই ভীত হয়ে স্ব-স্ব কর্ম্ম করে চলেছেন। তত্ত্বজ্ঞ পুরুষ এই অক্ষয় পুরুষকে এইভাবেই জেনে থাকেন।
---------------------
ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-৯)
অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যে অবিদ্যামুপাসতে
ততো ভূয় ইব তে তমো য উ'বিদ্যায়াং রতাঃ। (শ্লোক নং ৯)
অন্ধং - আত্মজ্ঞানের অভাবে যিনি দৃষ্টিহীন
তমঃ - অজ্ঞানের অন্ধকার
প্রবিশন্তি - প্রবেশ করেন,
যে - যাঁরা
অবিদ্যামুপাসতে - অবিদ্যাম-উপাসতে = অবিদ্যাকে উপাসনা করেন।
ততো ভূয় ইব - তা থেকে আরো বেশী
তে তমো - অন্ধকারের মধ্যে
য উ'বিদ্যায়াং রতাঃ-- জ্ঞানাভিমানে রত (ব্যক্তি প্রবেশ করেন)
যারা কর্ম্মবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞাত না হয়ে অজ্ঞানের মতো কর্ম্ম করেন, তাঁরা অজ্ঞান অন্ধকারের জগতে প্রবেশ করেন। কিন্তু সেই ব্যক্তি আরো বেশী অন্ধকারের গভীরে প্রবেশ করেন, যিনি জ্ঞানী হয়েও অজ্ঞানীর মতো কাজ করেন।
অন্ধং তমঃ - অর্থাৎ অজ্ঞানরূপ অন্ধকার। যারা অবিদ্যা বশতঃ অর্থাৎ অজ্ঞানীর মতো, নানান জাগতিক কর্ম্ম অর্থাৎ যজ্ঞাদি করেন, কেবলমাত্র কামনা বাসনা পূরণের জন্য, তাদের পক্ষে আত্মজ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। আবার উল্টো দিকে বলা যায়, যাদের আত্মজ্ঞান লাভ হয় নি, তারাই কেবল কর্ম্মের গতি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকবার জন্য, কামনা বাসনা পূরণের জন্য কর্ম্মাদির আশ্রয় নেন। এই ক্রিয়াকর্ম্মে আসক্ত মানুষ আসলে নিজের সম্পর্কে অজ্ঞ। এঁরা অহং-এর বশবর্তী হয়ে কেবল আমি-আমার এই বোধে কর্তৃত্বাভিমানী হয়ে কর্ম্ম করে থাকেন। আর ফল স্বরূপ তারা যুগ যুগ ধরে বাসনা পূরণের জন্য, জন্ম থেকে জন্মান্তরে পরিভ্রমন করে থাকেন। অর্থাৎ সেই বক্র গতির বা পিতৃযানে ভ্রমন করছেন।
কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের কথা হচ্ছে, যারা জ্ঞানী, সব জেনেবুঝেও একই ধরনের কর্ম্ম অর্থাৎ জাগতিক কামনা বাসনা পূরণের জন্য কর্ম্ম করছেন, তারা আরো বেশি অজ্ঞান অন্ধকার জগতে প্রবেশ করছেন। যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একসময় অর্জ্জুনকে বলেছিলেন, তুমি আর্য হয়েও অনার্য্যের মতো আচরণ করছো। যাদের জন্য শোক করার প্রয়োজন নেই, তাদের জন্য তুমি শোক করছো, আবার পন্ডিতের ন্যায় কথা বলছো ?
দেখুন যিনি শারীরিক দিক থেকে পঙ্গু, যিনি চোখে দেখতে পান না, কানে শুনতে পান না, তাকে যেমন পাহাড়ের শীর্ষে পায়ে হেটে উঠতে বলা বৃথা। তাকে শাস্ত্র কথা শোনানো যায় না, তাকে কৈলাশ পর্ব্বত দর্শন করানোও যায় না। তার তীর্থ ঘরে বসেই হতে পারে। কিন্তু যিনি সক্ষম, তার ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য নয়। আমরা যখন বলি, "আমি-আমার" তখন আমরা এই দেহ-মনকেই ইঙ্গিত করে থাকি । এই ধারণা ভুল বলেই এদেরকে শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিতগণ অজ্ঞানী বলে থাকেন। এদের আচরণের মধ্যে দেহাভিমান থাকলে - সেটাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে হবে।
কিন্তু একজন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত যখন নিজেকে আত্মা বলে পরিচয় দেন, আর জাগতিক বিষয় সম্পদ আহরণের জন্য লালায়িত হন, এবং সামান্য শারীরিক সুখ-দুঃখে বিচলিত বোধ করেন, তাদের অপরাধ ক্ষমাহীন। এরা কথা বলে পন্ডিতের মতো - কিন্তু কাজ করে মূর্খের মতো।
দেখুন, জ্ঞান-হীন কর্ম্ম আমাদের মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য সফল করতে পারে না। আবার কেবলমাত্র শুষ্ক জ্ঞানের অধিকারী হয়ে, নিষ্কর্মা হয়ে ভোগের রাজত্বে বসে থাকা, বা জেনে বুঝে বাসনা পূরণের জন্য যজ্ঞাদি ক্রিয়া করা বা দেবদেবীর পুজো অর্চ্চনা করা - অধিক অপরাধের। না বুঝে ভুল করা, আর জেনেবুঝে অপকর্ম্ম করা এক কথা নয়। যারা কর্ম্মের গতি সম্পর্কে অবহিত হয়েও সেই নিষ্কাম কর্ম্ম লিপ্ত হন না, তার আত্মঘাতী।
অজ্ঞান মানুষ অবিদ্যা জনিত কারনে বিবিধ কর্মানুষ্ঠান করে, এরা সত্যকথা বলতে কি, নিজেরাই জানে না, এই কর্ম্ম তাকে কোন পথে নিয়ে যাবে। এরা অজ্ঞান অন্ধকারে পথ খুঁজে ফেরে - আর এই পথের মধ্যেই একসময় শরীর ছেড়ে দেয়। আর ফিরে ফিরে আসে, দেহ থেকে দেহান্তরে ঘুরে ঘুরে মরে।
কিন্তু একদল মানুষ আছেন, এরা পন্ডিতের মতো কথা বলেন, অন্যকে নৈতিক শিক্ষা দেন, আর নিজে অনৈতিক আচরণ করেন, তাদের মুক্তি আরো বেশি দূরে থাকে। তারা জানে, যোগক্রিয়া দ্বারা সজ্ঞা লাভ হতে পারে, ধ্যানাদি দ্বারা আত্ম-জ্ঞান লাভ হতে পারে, সকাম কর্ম্ম পরিত্যাগ করতে হবে, বৈরাগ্যবান হতে হবে - এসব জেনেও তার অজ্ঞানীর মতো আচরণ করেন। অজ্ঞানী ব্যক্তিকে জ্ঞান দান করা যায়, ক্ষুধার্তকে অন্ন দান করা যায়, তৃষ্ণার্ত কে জল খাওয়ানো যায়। কিন্তু যার পেট হাবিজাবিতে ভর্তি হয়ে রয়েছে, তাকে কিছু দিলে, সে খেতে পারে না। এমনকি ভালো জিনিস দিলেও, তার বমি হয়ে যেতে পারে। সে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। তাই ঋষি বলছেন, অজ্ঞানীকে আত্মজ্ঞান দান করা সহজ, কিন্তু অভিমানী পন্ডিতের কখনো আত্মজ্ঞান হয় না।
---------------
ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-১০)
অন্যদেবাহুর্বিদ্যয়া অন্যদাহুরবিদ্যয়া
ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে । (১০)
অন্যদেবাহুর্বিদ্যয়া - অন্যৎ-এব-আহু-বিদ্যয়া = অন্য একরূপ ফল বলা হয়ে থাকে বিদ্যার যথার্থ অনুষ্ঠানে
অন্যদাহুরবিদ্যয়া - অন্যৎ -অহু-অবিদ্যায়া = অন্য একরূপ ফল বলা হয়েছে অবিদ্যার অনুষ্ঠানে।
ইতি শুশ্রুম = এইরূপ শুনেছি
ধীরাণাং = ধীর পুরুষের নিকট থেকে
যে = যাঁরা
নস্তদ্বিচচক্ষিরে - নঃ-তৎ-বিচচক্ষিরে = আমাদেরকে সেই বিষয়টি ভালোভাবে বুঝিয়েছেন।
ধীরব্যক্তি অর্থাৎ জ্ঞানী ব্যক্তিগন বলে থাকেন অবিদ্যার পথ ও বিদ্যার পথ ভিন্ন ভিন্ন ফল প্রদান করে থাকে।
মূর্খের কর্ম্ম আর পন্ডিতের কর্ম্মের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। এই সব কর্ম্মের ফলও আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। এই বিষয়ে আমরা পরবর্তী শ্লোক থেকে শুনবো। তবে বিদ্যাই বলুন, আর অবিদ্যাই বলুন এর কোনোটিই আত্মজ্ঞান লাভের সহায়ক নয়। কারন অজ্ঞানের কর্ম্ম আর বিদ্বানের কর্ম্ম - দুইই ফলপ্রদ। অর্থাৎ এদের সমস্ত কর্ম্মই ফল প্রদান করে থাকে। আসলে কর্ম্ম মাত্রেই ফল প্রদান করে থাকে। সকাম কর্ম্মফল সবাইকেই ভোগ করতে হয়। তা সে পুন্য কর্ম্ম হোক বা পাপ কর্ম্ম হোক। পুন্য কর্ম্মে জীবের সুখ ভোগ হতে পারে, আর পাপকর্ম্মে দুঃখ ভোগ হতে পারে। তাই বিচক্ষণ ব্যক্তি বিদ্যা জনিত কর্ম্ম বা অবিদ্যাজনিত কর্ম্ম দুইই পরিত্যাগ করে থাকেন। যাইহোক, কোনো কর্ম্মে কি ফল হয়, সে সম্পর্কে উপনিষদের ঋষিগন কি বলছেন, সেটা আমরা একবার দেখে নেই।
বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ
অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়াহমৃতমশ্নুতে। (১১) - শুক্ল যজুর্বেদে মন্ত্র নং ৪০/১৪
বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ - বিদ্যাং চ অবিদ্যাং চ = বিদ্যা বলুন আর অবিদ্যা বলুন
যস্তদ্বেদোভয়ং সহ - যঃ-তৎ-বেদ-উভয়ং সহ = যিনি উভয়কে একত্রে জানেন
অবিদ্যয়া = অবিদ্যার দ্বারা (অবিদ্যাজনিত কর্ম্ম দ্বারা)
মৃত্যুং তীর্ত্বা = মৃত্যুকে অতিক্রম করেন
বিদ্যয়াহমৃতমশ্নুতে- বিদ্যয়া -অমৃতম-অশ্নুতে = বিদ্যা দ্বারা অমৃত লাভ করেন।
যিনি অবিদ্যার কারনে যজ্ঞাদি কর্ম্ম করেন, তিনি যজ্ঞ দ্বারা অমরত্ব লাভ করেন, আবার বিদ্যা লাভের ফলে উপাসনা ইত্যাদি করেন, এতে করে তিনি অমৃত বা আনন্দ লাভ করেন।
কর্ম্ম রহস্যে ভরা। কর্ম্মের গতি কি, তা নির্ধারণ করা খুবই জটিল। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তিও এই কর্ম্মের রহস্যঃ উন্মোচন করতে অক্ষম। কিসে যে কি হয়, তা কে বলতে পারে ? বাস্তবিক পক্ষে এই রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে আচ্ছা আচ্ছা পণ্ডিতও ভুল করে বসেন। কর্ম্মরহস্যে যার জ্ঞান হয়নি, সেই জ্ঞানাভিমানী ব্যক্তি কর্ম্মকে ব্রহ্মজ্ঞানের বাধা বলে মনে করেন এবং কর্ম্ম থেকে দূরে থাকেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে কর্ম্মবিনা মুক্তি নেই। বাহ্যত জ্ঞানাভিমানী কর্ম্ম থেকে নিজেকে বিরত রাখলেও, তার চিন্তনকর্ম্ম চলতেই থাকে। মনের মধ্যে নানান প্রশ্নের উদয় হয়, মনের মধ্যে নানান বাসনার উদ্রেগ হয়, আর এই প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে বা বাসনার নিবৃত্তির জন্য বিরূপ চিন্তন করতে থাকেন। কর্ম্মের পরিণতি বা নিস্কর্মের ফল সম্পর্কে অজ্ঞানতার কারনে, নিজেকে আলস্য, নিদ্রা ও প্রমাদের মধ্যে নিমজ্জিত করে, দুর্লভ মনুষ্য জীবনের অমূল্য সময় হেলায় অতিবাহিত করেন।
এইজন্য তত্তজ্ঞ ব্যক্তি বলে থাকেন, জ্ঞান ও কর্ম্মের যথাযথ রহস্যের কথা সম্যকরূপে জেনে, এই উভয়ের অনুশীলন চালিয়ে যেতে হবে। যারা কর্ম্মের রহস্য জেনেছেন, তাঁরা বাহ্যত শাস্ত্র বিহিত কর্ম্মকে ত্যাগ করেন না। কিন্তু সেই কর্ম্মে তাঁর না থাকে কর্তৃত্বাভিমান, না থাকে কামনা-বাসনা পূরণের আকাংখ্যা। তিনি প্রারব্ধ বশে বা গুরুর নির্দেশে, ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে যন্ত্রবৎ কর্ম্ম করে যান। এই অবস্থায় তার জীবনযাত্রা চলতে থাকে সহজ-সরল-সাবলীল ভঙ্গিতে। তার না থাকে ত্যাগের মনোভাব, না থাকে ভোগের মনোভাব। তাঁর না থাকে আসক্তি, না থাকে অনাসক্তি। তাঁর সামনে যাকিছু উপস্থিত হয়, তাই দিয়েই তিনি সন্তুষ্ট চিত্তে জীবন নির্বাহ করেন। এই অবস্থায় তার চিত্তে কোনো অতৃপ্তির ভাব না থাকার কারনে জীবন হয়, ছন্দময় পরমসুখের। নিরন্তর কর্ম্ম সাধন, বিবেক বৈরাগ্যের ফলে এবং ব্রহ্মবিচারে নিরন্তর বিচরনের ফলে, একসময় তাঁর চিত্তে পরমেশ্বরের জ্ঞানালোকের ঝলক ভেসে ওঠে। একসময় তিনি পরব্রহ্ম পরমেশ্বরকে অন্তরে উপলব্ধি করেন। এবং সেখানেই ব্রহ্মময় হয়ে অবস্থান করেন। এইজন্য বলা হয়, শ্রীগুরুর নির্দেশে, ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে কর্ম্ম করা ও মনের মধ্যে নিরন্তর ব্রহ্ম চিন্তন করতে পারলে মোক্ষ ও পরমানন্দ দুইই লাভ করা যেতে পারে ।
---------------
ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-১২)
অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেহসম্ভূতিমুপাসতে
ততো ভূয় ইব তে তমো য উ সম্ভূত্যাং রতাঃ (১২) + শুক্ল যজুর্বেদে মন্ত্র নং ৪০/০৯
অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি = অন্ধ (জ্ঞানান্ধ) অন্ধকারে (অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে) প্রবেশ করে।
যেহসম্ভূতিমুপাসতে - যে-অসম্ভূতিম-উপাসতে = যিনি অব্যক্তকে উপাসনা করেন
ততো ভূয় ইব = তা হতে যেন অধিকতর
তে = তারা
তমো = অন্ধকারে
য উ সম্ভূত্যাং রতাঃ = তিনিও পরমেশ্বরে রত অর্থাৎ যিনি পরমেশ্বর নিয়ে মেতে আছেন।
যারা অব্যক্ত ঈশ্বরের উপাসনা করেন, তারা অন্ধের মতো অন্ধকারে প্রবেশ করেন। কিন্তু যারা ব্যাক্তের পূজাপাঠ করেন, তারা আরো গভীর অন্ধকারে প্রবেশ করেন।
ভারতীয় দর্শন কখনও শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে, একথা স্বীকার করেন না। ভারতীয় দার্শনিকগণ বলেন, শূন্য থেকে কখনো কোনো কিছুর সৃষ্টি হয় নি, আর হতেও পারে না। আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতাও একই কথা বলে। কারন ভিন্ন কার্য্য হতে পারে না। যেকোনো ঘটনার পিছনে একটা কারন অবশ্যই থাকবে। তো এই জগৎ যদি কার্য্য হয়, তবে অবশ্যই এই জগতের পিছনে একটা-না-একটা কারন অবশ্যই আছে। এখন আমরা অনেক সময় কারণকে বুঝতে পারি না বা ধরতে পারি না। তাই বলে কারনের অস্তিত্ত্ব নেই তা কিছু নয়। প্রকৃতির জগতে কারন ভিন্ন কোনো কার্য্য হয় না। সব কিছুর পিছনে একটা কারন আছে। একটা গাছ দেখলে বুঝতে হবে, একটা বীজ আছে। হ্যাঁ সেই বীজটাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না, কারন বীজ আমাদের চোখের আড়ালে আছে, মাটির নিচে আছে। কিন্তু ওই বীজ আছে বা ছিল বলেই, আজ এই গাছটিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। এখন গাছ ওই বীজের মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় ছিলো। এই বীজকে আশ্রয় করে, গাছের জন্ম হয়েছে। তো জগতের দুটো অবস্থা একটা ব্যক্ত আর একটা অব্যক্ত। উপনিষদের ভাষায় একটা সম্ভূতি, আর একটা অসম্ভূতি। দুইই এক। শুধু দুই নয়, আসলে আজ যাকে বহু বলে মনে হচ্ছে, তা আসলে সেই এক।
এখন কথা হচ্ছে, এই দুইয়ের যেকোনো একটিকে নিয়ে যারা মেতে আছেন,এরা সবাই সেই একই অজ্ঞানের অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। দেখুন অসম্ভূতি অর্থাৎ যার জন্ম হয়নি, সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না - অথচ তার উপাসনা করছেন, হয়তো ভয় বা কিছু পাবার আশায়। আবার যিনি সম্ভূতির অর্থাৎ নাম-রূপ আছে, এমন কারুর উপাসনা করছেন, তিনি সেই অনিত্য বস্তুর প্রতি নিষ্ঠা প্রদর্শন করছেন। যা প্রতিমুহূর্তে পাল্টাচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে, এমনকি একসময় ইন্দ্রিয়ের অগোচরে চলে যাচ্ছে, তাকে নিয়ে মেতে থাকা মানে পরিনামে হাতে থাকবে শূন্য। আর যা অব্যক্ত তার সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারনাই নেই, তিনি আছেন কি নেই সেই উপল্বদ্ধিও আমাদের নেই। তো যার সম্পর্কে কোনো জ্ঞান আমাদের নেই, তার উপাসনা কি করে হবে, আর তাকে প্রাপ্তই বা কিভাবে করা যাবে ?
আসলে উপনিষদের ঋষিগন বলতে চাইছেন, তু-হি। ত্ৎ ত্বম অসি - তুমিই সেই। বাইরেই বলো আর ভিতরেই বলো কেবল তুমিই আছো। স্বয়ংকে খোঁজো। স্বয়ং-এর উপাসনা করো। অতীত নয়, ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমানে এসো। তুমি, তোমার স্বরূপ সেই আত্মাই সব। এর বাইরে কিছু নেই। আর এই আত্মা তোমার হৃদয়গুহায় অঙ্গুষ্ঠ পরিমান, আলোকজ্যোতিঃ স্বরূপে অবস্থান করছেন । আর সেই আলোতেই জগৎ উদ্ভাসিত হচ্ছে। এই আলো নিভে গেলে, কোথায় জগৎ ? এই আলোর কারণেই সমস্ত কিছু প্রতিফলিত হচ্ছে। আর তুমি স্বয়ং সেই জ্যোতিঃ।
-------------
ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-১৩-১৪)
অন্যদেবাহুঃ সম্ভবাদন্যদাহুরসম্ভবাৎ
ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে। (১৩) শুক্ল যজুর্বেদে মন্ত্র নং ৪০/১৩
অন্যদেবাহুঃ - অন্যাৎ-এব-আহুঃ = অন্য ফলের কথা বলেন পন্ডিতেরা
সম্ভবাদন্যদাহুরসম্ভবাৎ - সম্ভবাৎ-অন্যাৎ-আহুঃ অসম্ভবাৎ = ব্যক্ত প্রকৃতি থেকে অন্য বা ভিন্ন ফল অব্যক্ত প্রকৃতি থেকে।
ইতি শুশ্রুম - এইরকম শুনেছি
ধীরাণাং - ধীর বা জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছে
যে - যাঁরা
নস্তদ্বিচচক্ষিরে- নঃ-তৎ-বিচচক্ষিরে = আমাদেরকে সেইরূপ ব্যাখ্যা করেছেন।
পন্ডিতদের কাছে জানা যায়, ব্যক্ত (প্রকৃতি) ও অব্যক্ত (হিরণ্যগর্ভ) অসম্ভূতি ও সম্ভূতির উপাসনা আলাদা আলাদা ফল প্রদান করে থাকে।
বলা হয়, যিনি যার কথা চিন্তা করেন, ধীরে ধীরে তিনি সেই ধ্যেয় বস্তুর গুন্ লাভ করেন। যখন আপনি অব্যক্ত ঈশ্বরের উপাসনা করবেন, তখন আপনি সেই অব্যক্ত ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করবেন। আবার আপনি যদি এই ব্যক্ত প্রকৃতির উপাসনা করেন, অর্থাৎ ব্যক্ত প্রকৃতির ধ্যান করেন, তবে সেই ব্যক্ত বস্তুর গুনের আধারে পরিণত হবেন।
(অ)সম্ভূতিং চ বিনাশং চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ
বিনাশেন মৃত্যুং তীর্ত্বাহসম্ভূত্যাহমৃতমশ্নুতে (১৪) শুক্ল যজুর্বেদে মন্ত্র নং ৪০/১১
(অ)সম্ভূতিং চ - অব্যক্ত অবস্থাও
বিনাশং চ - বিনাশ হবে,
যস্তদ্বেদোভয়ং সহ - যঃ-তৎ -বেদ -উভয়ং -সহ = যিনি উভয়কে জানেন
বিনাশেন - বিনাশশীল অর্থাৎ ব্যাক্তের
মৃত্যুং - মৃত্যুকে
তীর্ত্বাহসম্ভূত্যাহমৃতমশ্নুতে - তীর্ত্বা-অসম্ভূত্যা-অমৃতম-অশ্নুতে = অব্যক্তের উপাসনার দ্বারা অতিক্রম করে অমৃতত্ব লাভ করেন।
যিনি সম্ভূতি ও অসম্ভূতি উভয়ের উপাসনা একসঙ্গে করেন, তিনি অব্যক্তের (অসম্ভূতি) উপাসনা দ্বারা অমৃতত্ব লাভ করেন, আবার ব্যাক্তের (সম্ভূতি) উপাসনা দ্বারা মৃত্যুকে জয় করেন।
যা কিছু আজ ব্যক্ত হয়েছে, তা একসময় অব্যক্তে পরিণত হবে। আমরা জানি সত্য এক। এবং এই সব কিছু সেই এক-থেকেই এসেছে - আবার একদিন সেই একেই ফিরে যাবে। তো আমরা যেখান থেকে এসেছি, আবার সেখানেই ফিরে যাবো। অর্থাৎ ব্রহ্ম থেকে সব কিছুর সৃষ্টি হয়েছে, আবার সবকিছু সেই ব্রহ্মতেই ফিরে যাবে। তাহলে ব্যক্ত আর অব্যক্তের মধ্যে মূলত কোনো পার্থক্য নেই। কোনো কিছুই নিঃশেষ হয়ে যাবে না। যা ছিলো তাই থাকবে, যা ছিলো না তা কখনো হবে না। তাই একদিকে জন্ম-মৃত্যু জাগতিক দিক থেকে যেমন সত্য, ঠিক তেমনি পারমার্থিক বিচারে, জন্ম মৃত্যু বলে কিছু নেই, এসব ভ্রম বই কিছু নয়। আসলে সবকিছুই পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে। কোনো কিছুই থেমে নেই, তো চলমান জগৎ অরূপ ব্রহ্মের রূপ মাত্র। যা বিন্দুর মধ্যে বিক্ষুব্ধতার কারনে দৃশ্যমান হয়েছে।
মূলত সম্ভূত আর অসম্ভুতের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমি-আপনি-এজগৎ কেউই এই রূপে ছিলাম না, আবার থাকবোও না। কিন্তু আমি (আত্মা) সত্ত্বার কখনো বিলোপ হবে না।
তাই যে যারই উপাসনা করুন না কেন, উপাসনা কখনো বিফলে যাবে না। যখন আমরা অব্যক্তের উপাসনা বা চিন্তন করি, তখন আমরা অব্যক্তের সঙ্গেই চিরন্তন হয়ে উঠি। ব্যক্ত প্রকৃতি আর অব্যক্ত প্রকৃতির সঙ্গে মূলত কোনো পার্থক্য নেই। আজ যা ব্যক্ত তা একদিন অব্যক্ত ছিল, আবার ভবিষ্যতে একদিন অব্যক্ত হয়ে যাবে।
তাই আপনি কার উপাসনা করছেন, সেটা বড়ো কথা নয়, কেন করছেন, সেইটাই বড়ো কথা। কি করছেন, সেটা বড়ো কথা নয়, কার উদ্দেশ্যে করছেন সেটাই বড়ো কথা। আপনার লক্ষ যদি সেই এক সত্যের দিকে ধাবিত হয়, তবে জানবেন, এই সম্ভূতি, অসম্ভূতি, ব্যক্ত, অব্যক্ত, বিদ্যা, অবিদ্যা, জ্ঞান, অজ্ঞান, এরা আলাদা কোনো প্রয়োজন সিদ্ধ করতে পারে না। কর্ম্মপাশ থেকে মুক্ত হতে হবে - সাধনা হবে নিষ্কাম কর্ম্ম - প্রাপ্তি হবে আত্মজ্ঞান। আর তখন সব উপাসনার উর্দ্ধে আপনি আত্মজ্ঞানী মুক্ত পুরুষ, যাঁর কখনো বন্ধনই হয়নি।
--------------------
ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-১৫)
হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম
তত্ত্বং পূষ্ন্নপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে। (১৫) শুক্ল যজুর্বেদে মন্ত্র নং ৪০/১৭
হিরণ্ময়েন পাত্রেণ - জ্যোতির্ময় (সোনার বরণ) পাত্রের দ্বারা
সত্যস্যাপিহিতং মুখম - সত্যস্য-অপিহিতম-মুখম = সত্যের মুখ আবৃত
তত্ত্বং - তৎ-ত্বং = তুমি তা
পূষ্ন্নপাবৃণু - - পূষন-অপাবৃণু = হে সূর্য, দয়া করে অনাবৃত করো
সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে = যাতে সত্যের অনুসন্ধানী দেখতে পায়।
সত্যের মুখ উজ্জ্বল সোনার পাত্রের দ্বারা আবৃত হয়ে রয়েছে। হে পূষন (অর্থাৎ জগতের সবকিছুকে যিনি পালন পোষন করেন, সেই সূর্যদেব ) তুমি এই আবরণকে দয়া করে সরিয়ে দাও, যাতে সত্য-সন্ধানী আমি সত্যকে দর্শন করতে পারি।
আমরা জানি, এই যে স্থূল জগৎ আমাদের চোখের সামনে ভাসছে, তার পালন-পোষন করতে হচ্ছেন, সূর্যদেব। জগতের যাবতীয় বস্তু ও জীবনের উৎস হচ্ছে সূর্য। সূর্য অগ্নির গোলক মাত্র। এই সূর্য যেন একটা উজ্বল সোনার পাত্র। এই সূর্য্যের রশ্মি, সমস্ত বস্তুকে আলোকিত করছে, প্রকাশ করছে। কিন্তু এই অতি-উজ্জ্বল সূর্য্যের দিকে আমরা চোখ রাখতে পারি না। সূর্য্যের দিকে তাকালে, আমরা যেন কিছুই দেখতে পাই না, সূর্য আমাদের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। এই উজ্জ্বল বর্ণের সূর্য্যের অন্তরালে কি এমন আছে, কোন সত্য লুকিয়ে আছে, যা আমাদেরকে বাঁচা-বাড়ার শক্তি যোগাচ্ছে ? আমরা সেই সত্যরূপ পরমব্রহ্মকে দেখতে চাই, কিন্তু আমরা তা দেখতে পাচ্ছি না, কারন তোমার (প্রখর তেজসম্পন্ন সূর্য্যের) দিকে তাকালে আমরা চোখে অন্ধকার দেখি। আমরা সেই সত্য-ব্রহ্মের সন্ধান করছি, যা তোমার প্রখরতার কারনে প্রত্যক্ষ করতে পারছি না। তাই আমরা সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা করছি, তোমার এই সোনার বরণ অতি উজ্বল ঢাকনা সরিয়ে নাও - যাতে আমরা সত্য ব্রহ্মের সাক্ষাৎ করতে পারি।
জগতের সমস্ত বস্তুই এই আলোর গোলকে ঢাকা। আমরা যা কিছু দেখছি, তা আসলে একটা আলোর মোড়কে ঢাকা। তাই আমাদের কাছে সত্য প্রতিভাত হচ্ছে না।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, বৃহদারণ্যক উপনিষদের কথা, সেখানে ঋষি বলছেন, যিনি সত্যব্রহ্ম ইনিই আদিত্য। এই আদিত্য পুরুষ রশ্মি অবলম্বন করে, অক্ষি পুরুষে (চোখে) প্রতিষ্ঠিত, আবার অক্ষিপুরুষ ইন্দ্রিয়সকলের সহায়ে আদিত্যপুরুষে প্রতিষ্ঠিত। জীবাত্মা যখন দেহত্যাগ উদ্যত হয়, তখন এই আদিত্যমন্ডলকে রশ্মিহীন দেখেন, তখন এই রশ্মিসকল এনার নিকটে আসে না।
এখনকথা হচ্ছে সত্যকে দেখবার জন্য, আলোর প্রয়োজন। আর এই আলো হচ্ছে, জ্ঞানের আলোক। এই জ্ঞান-আলোকের সাহায্যে আমাদের বিচারবুদ্ধি জাগ্রত হবে, আমাদের বিবেকজ্ঞানের উন্মেষ হবে। তখন সেই সত্য আমাদের কাছে উদ্ভাসিত হবে, যা অপরিবর্তনশীল, যা অক্ষয়, যা চিরন্তন, যা ধ্রুব। তাই উপনিষদে প্রার্থনা করা হচ্ছে, সত্য আমাদের কাছে প্রকাশিত হোক, আমরা যেন অজ্ঞান অন্ধকারের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে না ফেলি। সূর্যই আলো , জ্ঞানই আলো, যা সত্যকে আবরণহীন করে। হে সূর্যদেব, হে জ্ঞান, তুমি তোমাকে অবরণহীন করো, তুমি তোমার প্রখরতা স্তিমিত করো - যাতে আমরা সত্যকে প্রতক্ষ্য করতে পারি।
-------------------
ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-১৬)
পূষন্নেকর্ষে যম সূর্য প্রাজাপত্য
বূহ্য রশ্মীন সমুহ তেজঃ।
যত্তে রূপং কল্যানতমং তত্তে পশ্যামি
যোহসাবসৌ পুরুষঃ সোহহমস্মি (১৬) শুক্ল যজুর্বেদে মন্ত্র নং- ?
পূষন্নেকর্ষে - পূষন-একর্ষে = হে পূষন, অর্থাৎ জগতের পোষন কারী সূর্যদেব, একাকী বিচরণকরী
যম সূর্য প্রাজাপত্য - যম অর্থাৎ মৃত্যুর দেবতা বা সর্ব্বনিয়ন্তা, সূর্য প্রজাপতির প্রিয়
বূহ্য রশ্মীন সমুহ তেজঃ - এই রশ্মিসমূহকে, তেজকে সরিয়ে নিন।
যত্তে রূপং কল্যানতমং তত্তে পশ্যামি - যাতে তোমার যে কল্যাণময় রূপ তা আমি দেখতে পাই।
যোহসাবসৌ পুরুষঃ - যঃ-অসৌ-অসৌ - পুরুষঃ = যাতে সেই (সূর্য্যমন্ডলে ) সেই (ওই পরমপুরুষকে)
সোহহমস্মি - সঃ-অহম-অস্মি = তিনিই আমি হই।
হে জগৎ-পোষণকারী, নিঃসঙ্গ, হে সর্বনিয়ন্তা, হে প্রজাপতিপ্রিয় সূর্যদেব, দয়াকরে তুমি তোমার তেজঃরশ্মিকে সম্বরন করো। আমি তোমার কল্যানতম রূপ দেখতে চাই। আমিই সেই পুরুষ, যিনি তোমার মধ্যে রয়েছেন।
সূর্যই জগতের পালক-পোষক। এই পূষন-একর্ষ একাকী বিচরণকারী, সর্ববজ্ঞানের আধার। ইনি জগতের নিয়ন্তা তাই, এঁকে যম অর্থাৎ কল্যাণকারী বলা হচ্ছে। সমস্ত প্রাণী প্রজাপতি-ব্রহ্মা থেকে এসেছে, এই প্রজাপতির অত্যন্ত প্রিয় হচ্ছে, সূর্যদেব। এই সূর্য বাহ্যত আলোক প্রদান করে, আবার সূর্যতেজ হচ্ছে, ঈশ্বরের শুদ্ধিকরণ ঔষধ। সূর্যতেজ জগতের সমস্ত কিছুকে শুদ্ধ করে থাকে। কিন্তু এই সূর্য্যতেজ এতটাই প্রখর যে তা সাধারনের সহ্যাতীত। তাই উপনিষদের ঋষিগণ প্রার্থনা কছেন, যেন এই সূর্য্যের তেজ কিঞ্চিৎ সম্বরণ হলে, আমি সেই কল্যানতম রূপের দর্শন করতে পারি।
সূর্যকে হিন্দুশাস্ত্র ব্রহ্ম-এর প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। শুধু তাই হয়, যাঁরা দেব-দেবতার মূর্তিধ্যানের মধ্যে যেতে চান না, তাদেরকে এই জ্যোতিঃ বা প্রভাত সূর্য ধ্যানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সূর্য হচ্ছেন, প্রতক্ষ্য দেবতা। এই সূর্যের অসীম শক্তি ও স্বর্ণাভ সৌন্দর্য আমাদের উপল্বদ্ধির মধ্যে সহজেই জাগ্রত হতে পারে। আর এই সূর্য থেকে যদি আমরা তার কিঞ্চিৎ শক্তি, বা সৌন্দর্য্য প্রাপ্ত হতে পারি, তবে আমরা কৃতার্থ হয়ে যেতে পারি। এইপার্থিব সূর্য থেকে যে তেজঃরশ্মি প্রতিনিয়ত বিকিরিত হচ্ছে, তা যেমন জগতের শুদ্ধিকরনে সাহায্য করে, তেমনি আমাদের ভয়, আমাদের আশঙ্কা দূর করতে সাহায্য করে। এই সূর্যই জগতের প্রকাশক। এই সূর্য রশ্মির মধ্যেই অসংখ্য গুনের সমাহার। এই সূর্যই বীজকে অঙ্কুরে রূপান্তরিত করে। এই সূর্যই আমাদের জ্ঞানের আলোক প্রদান করতে পারে। সূর্য্যের প্রকাশের ফলেই আমাদের বিষয়জ্ঞান হচ্ছে। বলা হয়, জীব এই সূর্য্যরশ্মির সাহায্যেই লোক থেকে লোকান্তরে যাতায়াত করে থাকে। মৃত্যুকালে জীবাত্মা এই সূর্য্যরশ্মি, বা চন্দ্ররশ্মি-তে আরোহন করে, বাঞ্চিত লোকে গমন করে। এই সূর্য-ধ্যানের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সাধক নিজের স্ব-রূপের উপলব্ধি করতে পারে। অর্থাৎ আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারে। আত্মসংযম, বৈরাগ্য, ও সূর্য্-ধ্যান সাধককে আত্মস্থিত করতে পারে। তখন অনুভবে আসে যে, বিশ্ব-আত্মা ও জীবাত্মার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এ-দুটোই অভিন্ন।
----------------
ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-১৭-১৮)
বায়ুরনিলমমৃতমথেদং ভস্মান্তং শরীরম
ওঁ ক্রুতো স্মর কৃতং স্মর ক্রুতো স্মর কৃতং স্মর। শ্লোক-১৭ (শুক্ল যজুর্বেদে মন্ত্র নং- ১৭)
বায়ুরনিলমমৃতমথেদং ভস্মান্তং শরীরম - বায়ুঃ-অনিলম-অমৃতম - এখন আমার প্রাণবায়ু মহাবাযুতে (বিশ্বপ্রাণে) বিলীন হোক।
অথ-ইদং ভস্মান্তং শরীরম - এখন এই শরীর ভস্মিভূত হোক।
ওঁ -- ঈশ্বরের নাম
ক্রুতো স্মর - ভগবানকে স্মরণ করো,
কৃতং স্মর - নিজের কৃত কর্ম্মসমূহকে স্মরণ করো
ক্রুতো স্মর - স্মরণীয়কে স্মরণ করো
কৃতং স্মর - আবার নিজের কৃত কর্ম্মসমূহের স্মরণ করো।
(শেষ হয়ে এলো জীবন প্রবাহ ) এখন প্রার্থনা করি, আমার প্রাণবায়ু যেন বিশ্বপ্রাণের সঙ্গে বিলীন হয়ে যায়। এই দেহ যেন আগুনে পুড়ে ভষ্ম হয়ে যায়। যাকিছু তোমার দ্বারা কৃত হয়েছে তাকে স্মরণ করো। অক্ষর ব্রহ্মকে স্মরণ করো। বারবার নিজকৃত (শুভ) কর্ম্মের স্মরণ করো।
জীবন সায়াহ্নে এসে, আমরা যখন মৃত্যুর সম্মুখীন হই, তখন আমরা কত কিছুই না চিন্তা করি। কত কিছুই তো করা হলো না। কত কাজ বাকি রয়ে গেল। নাতির বিয়েটা দেওয়া হলো না। বিষয় আশয় যা কিছু সারা জীবন ধরে সংগ্রহ করেছি, তার রক্ষা কে করবে ? আমি চলে গেলে, এদের (ছেলে-মেয়ে-পরিবার) কি হবে। এমনি এ নানান চিন্তা মাথার মধ্যে এসে ভিড় করে। মন উতলা হয়ে ওঠে একসময় নিজেকে অসহায় বলে মনে হয়। কিন্তু চিন্তা ছাড়তে পারি না। অবশ্য চেষ্টাও করি না। উপনিষদের ঋষি বলছেন, মৃত্যুর সময় মানুষের মনের মধ্যে নানান চিন্তার উদ্রেগ হয়। কিন্তু এইসময় আমাদের কেবল সেই ভগবানের স্মরণ করা উচিৎ। সারা জীবন যা কিছুই করা হোক না কেন, জীবনের শেষে এসে, কেবল মাত্র শুভ চিন্তার উদ্রেগ করা উচিত। জগৎ যেমন ছিল তেমনই পরে রইবে, আমি চলে যাবো, কোথায় যাবো, তা আমরা জানি না। মহাত্মাগণ বলছেন, তুমি মৃত্যুকালে যেমন চিন্তা করবে, পরবর্তীতে তুমি সেইমতো লোক প্রাপ্ত করতে পারবে। তাই উপনিষদের বাণী হচ্ছে, মৃত্যু কালে আমাদের তাঁর অর্থাৎ সেই পরমপিতা-পরমেশ্বরের স্মরণাপন্ন হওয়া উচিত। বার বার চেষ্টা করে, বিষয় চিন্তা থেকে নিজেকে সরিয়ে ঈশ্বর চিন্তন করা উচিত। এমনকি আমরা যারা মৃত্যু পথযাত্রীর মৃত্যুশয্যার কাছে উপস্থিত থাকি, তাদেরও ঈশ্বরের কাছে আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থনা করা উচিত। প্রার্থনার বা গুণকীর্তনের মূল্য অপরিসীম।
অগ্নে নয় সুপথা রায়ে অস্মান
বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান ।
যুযোধ্যস্মজ্জুহুরাণমেনো
ভূয়িষ্ঠাং তে নম-উক্তিং বিধেম । শ্লোক-১৮ (শুক্ল যজুর্বেদে মন্ত্র নং- ১৬)
অগ্নে - হে অগ্নি,
নয় - নিয়ে যাও ,
সুপথা - সুপথে
রায়ে -- শুভ কর্ম্মফল লাভের উদ্দেশ্যে
অস্মান - আমাদেরকে
বিশ্বানি - সমস্ত
দেব - হে দেব
বয়ুনানি - কর্ম্মসকলকে
বিদ্বান - (আপনি) জ্ঞাত আছেন।
যুযোধ্যস্মজ্জুহুরাণমেনো - যুযোধি-অস্মৎ-জুহুরাণম-এনঃ = সকল অশুভ কর্ম্মের ফল আমার কাছ থেকে দূর করুন
ভূয়িষ্ঠাং তে নম-উক্তিং বিধেম = বারবার নমস্কার বচন উচ্চারণ করি ।
হে অগ্নি দেবতা, যা আমার পক্ষে হিতকর, সেই শুভফল লাভের উদ্দেশ্যে, অনুগ্রহ করে আমাকে সেই সুপথে চালিত করুন। আমার সমস্ত কৃতকর্ম্ম সমন্ধে আপনি জ্ঞাত আছেন । সকল অশুভ কর্ম্মের ফল আমার কাছ থেকে দূর করুন । বারবার আমি নমস্কার বচন উচ্চারণ করি ।
অগ্নিদেবের কাছে, আমাদের প্রার্থনা, আমরা জানি না, আমাদের পক্ষে হিতকর কোন পথ। আমাদের পক্ষে যা কিছু হিতকর, তা লাভের জন্য, আমাদেরকে সুপথে চালিত করুন। মৃত্যুর পরে, আমাদের এই স্থূল শরীর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, কিন্তু সূক্ষ্ম শরীর থাকবে। এই সূক্ষ্ম শরীরে আমাদের সূক্ষ্ম ইন্দ্রিসকল সহ কৃতকর্ম্ম সংস্কারের আকারে আমাদের মধ্যে থাকবে। এসবই জড় কিন্তু সূক্ষ্মরূপে অব্যক্ত অবস্থায় থাকবে। বলা হয়, যার যেমন কর্ম্মফল সঞ্চিত হয়েছে, তা তখন পূর্ব পূর্ব জীবনের প্রারব্ধর সঙ্গে মিশে আমার ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্দিষ্ট করবে, গন্তব্যলোক নির্দিষ্ট করবে। যার যেমন কর্ম্ম সেই অনুযায়ী জীবাত্মা হয় পিতৃলোক, নয় দেবলোকে প্রবেশ করবে। সেখানকার স্থিতিকাল শেষ হয়ে গেলে, আবার এই কর্ম্মদেহে কর্ম্ম লোকে প্রবেশ করবে। এই আসা যাওয়া চলতেই থাকে জন্ম থেকে জন্মান্তর যাবৎ। কিন্তু যেদিন মানুষের স্বরূপের জ্ঞান হয়, যেদিন সমস্ত কামনা বাসনার বিলোপ হয়, সেদিন জীবনের অসারতা উপল্বদ্ধিতে আসে। আর যে মুহূর্তে মানুষ সংসারের অসারতা বুঝতে পারে, সেদিন থেকে মানুষ ত্যাগ-বৈরাগ্যের পথ অবলম্বন করে, অপার্থিব জগতের বাসিন্দা হয়ে যায়। একদিন জীবাত্মা যেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কর্ম্ম জগতে প্রবেশ করেছিল, আবার সেই পরমাত্মায় বিলীন হয়ে সচ্চিদানন্দ স্বরূপ হয়ে যায়। এই হচ্ছে মুক্তি।
ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণ মুদচ্যতে
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওঁং
ওঙ্কাররূপ ব্রহ্ম অনন্ত এই জগৎও অনন্ত। এই জগৎ সেই ব্রহ্মের উপরে আরোপিত সত্য মাত্র। তো ব্রহ্ম থেকে জগৎকে সরিয়ে নিলে, সেই ব্রহ্ম অনন্তই থাকেন। আমাদের ত্রিবিধ শান্তি হোক।
ঈশ উপনিষদ বা ঈশাবাস্যঃ উপনিষদ সমাপ্ত হলো।
No comments:
Post a Comment