Tuesday 17 October 2023

ষোলো কালা কাকে বলে ? প্রশ্ন উপনিষদ : শ্লোক নং ০৬/০৪


ষোলো কলা কাকে বলে ? প্রশ্ন উপনিষদ : প্রশ্ন উপ: শ্লোক নং ০৬/০৪

কথায় বলে, ষোলোকলা পূর্ন  হলো।  অর্থাৎ সব শেষ হয়ে গেলো নাকি সব পূর্ন  হলো ? এই কলা কথাটার অর্থ কি ?  কলা বলতে আমরা একধরনের বিশেষ ফলকে বুঝে থাকি। কলা বলতে আমরা শিল্পকর্ম বুঝি, কলা বলতে আমরা বিদ্যার এক বিশেষ ভাগকেও  বুঝি। 

আবার আমরা চাঁদের সুধাকে বা অমৃতকে  ষোলো ভাগের  একভাগকে বলে কলা।  চাঁদের ষোলো কলা হলো, ১. অমৃতা, ২. মানদা, ৩. পূষা, ৪. পুষ্টি, ৫.তুষ্টি, ৬.রতি, ৭.ধৃতি, ৮. শশিনী ৯. চন্দ্রিকা, ১০. কান্তি, ১১. জ্যোৎস্না, ১২. শ্রী ১৩. প্রীতি, ১৪.অঙ্গদা, ১৫. পূর্ণা, সবশেষে  ১৬. পূর্ণামৃতা। বলা হয়, এক-একদিন এক-একজন দেবতা কৃষ্ণপক্ষে চাঁদের অমৃত পান করেন,  আর এঁরা প্রতিদিন এক কলা করে পান করেন। আবার শুক্লপক্ষে এক-একদিন এক-এক কলা বৃদ্ধি পেয়ে ১৬ কলা পূর্ন  হয়। 

আমাদের জানি,  পৃথিবী  সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে। আবার  চন্দ্র ঘুরছে  পৃথিবীর চারিদিকে। সূর্যের নিজস্ব আলো আছে কিন্তু চন্দ্রের  কোনো নিজস্ব আলো নেই। সূর্যের আলো চন্দ্রের উপরে আলো প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে এসে পড়ে। একেই আমরা বলি জ্যোৎস্না।  চন্দ্রের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে এর দৃশ্যমান পার্শ্ব বিভিন্নভাবে সূর্যের আলোতে আলোকিত হয়। এই আলোকিত অংশের পরিমাণ একসময় শূন্য হতে বৃদ্ধি পেতে পেতে এক সময় চন্দ্রের সম্পূর্ণ পৃষ্ঠভাগ  আলোকিত হয়, তখন বলা হয় পূর্ণিমা। আবার এই  আলোকিত অংশের পরিমাণ কমতে কমতে একসময় চন্দ্র আমাদের চোখের দৃষ্টির বাইরে চলে যায়।  তখন তাকে  বলা হয় অমাবশ্যা। চন্দ্রের আলোকিত অংশের এই হ্রাসবৃদ্ধির এক একটি ভাগকে  বলা হয় কলা বা চন্দ্রকলা।  ষোলটি কলা পূর্ণ হলে তবেই চন্দ্রের পূর্ণিমা, আবার কলার নিস্পত্তি হলে  অমাবশ্যা হয়। 

আবার অতি অল্প সময়কে নির্দিষ্ট করবার জন্য এই কলা কথাটার প্রয়োগ হয়ে থাকে।  বলা হয়, ক্ষণ-কে ৩০ ভাগ করলে যে সময় তাকে বলে কলা।  আমাদের শাস্ত্রে বলা হচ্ছে, ১৮ নিমেষে এক কাষ্ঠা, ৩০ কাষ্ঠায় এক কলা, আবার ৩০ কলায় এক ক্ষণ।  তো কালের একটা অংশকে বলা হয় কলা। 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে বলা হয়, তিনি ষোলোকলা যুক্ত পূর্নপুরুষ। তার ষোলো কলার নাম হচ্ছে,                                                                                                    

"সঃ প্রাণম অসৃজত প্রাণাৎ শ্রদ্ধাম খং বায়ুঃ জ্যোতিঃ আপঃ পৃথিবী ইন্দ্রিয়ম মনঃ। অন্নম  অন্নাৎ বীর্যম তপো  মন্ত্রাঃ কর্ম লোকা  লোকেষু চ নাম চ।" (প্রঃ ০৬/০৪)

সেই পুরুষ (সগুন ব্রাহ্ম) প্রাণাত্মাকে সৃষ্টি  করলেন, প্রাণ থেকে সৃষ্টি হলো শ্রদ্ধা (জ্ঞান) . এরপর আকাশ (খং), বায়ু, তেজ, জল, পৃথিবী, ইন্দ্রিয় ও মন এবং অন্ন।  অন্ন থেকে ক্রমে বীর্য।  বীর্য বা বল থেকে তপস্যা মন্ত্র (ঋক সাম  যজুঃ অথর্ব) কর্ম, লোক (স্বর্গ, মর্ত, পাতাল) . এবার লোক সমূহে বিভিন্ন নাম ও পদ এলো (সৃষ্টি হলো) . 

প্রশ্ন ছিলো, কে আমাদের শরীর  ছেড়ে চলে গেলে আমাদের মনে হয়, আমিও দেহত্যাগ করলাম। আবার কার কারণেই বা আমি শরীরে ছিলাম ? উত্তর হচ্ছে এই কলা বা প্রাণাদি। 

এবারের শ্লোকে ঋষি পিপ্পলাদ ষোড়শকলা সম্পর্কে বলছেন। এগুলো হচ্ছে - ১. প্রাণ, ২. শ্রদ্ধা ৩. আকাশ, ৪. বায়ু, ৫. তেজ, ৬. জল, ৭, পৃথিবী, ৮. ইন্দ্রিয়, ৯. মন ১০. অন্ন, ১১. বীর্য, ১২. তপস্যা, ১৩. মন্ত্র  ১৪. কর্ম, ১৫. লোক, ১৬. নাম ।  

তো সেই পুরুষ চিন্তা করলেন, কে দেহথেকে উৎক্রমন করলে, আমি উত্ক্রান্ত হবো, আবার কে প্রতিষ্ঠিত হলে আমিও দেহে অবস্থিত থাকবো ? এর উত্তর  হচ্ছে প্রাণ ইত্যাদি।  এই যে প্রাণ ইত্যাদি এগুলো হচ্ছে ষোলোটি কলা। 
এইজন্য তিনি প্রথমে প্রাণকে সৃষ্টি  করলেন। প্রাণ থেকে শ্রদ্ধা অর্থাৎ জ্ঞান। যা থেকে আমাদের "আমি" এই বোধের উৎপত্তি হয়। বিশ্বশক্তির মধ্যে এই অহং-বোধ থেকে ইচ্ছে, আর ইচ্ছে থেকে এই সৃষ্টি। আমাদের মধ্যেও  এই জ্ঞান বা আস্তিক্য বুদ্ধি আছে।  আর এর ফলেই আমার মতো এই ক্ষুদ্র সত্ত্বার মধ্যে  অখন্ড সত্ত্বার স্পর্শ অনুভব করি। এই ক্ষুদ্র আমার মাঝেই সেই বিরাট পুরুষের অবস্থান। এই শ্রদ্ধা (জ্ঞান) আছে বলেই মানুষ জ্ঞান ও কর্ম্ম পথে নিজেকে পরিচালিত করে। সুতরাং নিস্কল (কলাহীন) পুরুষ ও তার শক্তিরূপ প্রাণ ও শ্রদ্ধা এই তিনটি হচ্ছে সৃষ্টির মূল। এবার এই অহংবোধ জ্ঞান (শ্রদ্ধা) বিধাতার মধ্যে বাসনার উদ্রেগ ক'রে পঞ্চভূতের (অপঞ্চীকৃত পঞ্চভূতের) সৃষ্টি করেন। যথাক্রমে সেগুলো হচ্ছে, আকাশ, বায়ু, জ্যোতিঃ, জল ও পৃথিবী। এই পঞ্চভূতকে আশ্রয় করে তৈরী হলো জীবদেহ। তো দেহ উৎপত্তির কারন এই ৭টি  অর্থাৎ প্রাণ, শ্রদ্ধা, ও পঞ্চ মহাভূত। প্রথম প্রাণীকে যদি আমরা আমিবা নামে  ডাকি তবে বলতে হয়, তার উৎপত্তি এই ৭ তত্ত্ব থেকে। এর পরে ইন্দ্রিয়, মন। আমিবার মধ্যেও এই ইন্দ্রিয়শক্তি লক্ষিত হয়, কিন্তু আমিবার মন বলে  হয়তো কিছু থাকে না। সে যাই হোক,  এখন এই প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য দরকার অন্ন। এই অন্নই বল প্রদান করে থাকে। এই অন্ন প্রাণশক্তিকে জাগিয়ে রাখে। আবার অন্ন দ্বারাই জীব বীর্যবান হয়ে ওঠে। এই বীর্য হচ্ছে প্রাণশক্তির উচ্ছাস। এই বীর্য একসময় দেহ ছাপিয়ে উপচে পড়ে এবং নতুন দেহের সৃষ্টি করে। কিন্তু প্রাণের এই যে উপচে পড়া, একে  বলা হয়, অশুদ্ধ প্রাণশক্তি। এই অশুদ্ধ প্রাণশক্তি যখন সংহত হয়, তখন  তাকে বলে তপস্যা বা তপঃশক্তি। এই তপঃশক্তি আবার মন্ত্রের জন্ম দেয়, যা জীবকে উদ্ধার কার্য্যে সাহায্য করে থাকে। মন্ত্র অর্থাৎ মনন করা। এই মননের ফলে জীব একসময় বুঝতে পারে, যে সে প্রকৃতির দ্বারা  অভিভূত হয়েছে।  আবার সে এই অভিভূত অবস্থা থেকে উদ্ধ্বার পাবার প্রচেষ্টা শুরু করে, একেই বলে কর্ম্ম।  সে তখন একটা কর্ম্মলোকের সৃষ্টি করে। এই কর্ম্মলোকই আমাদের ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য জগৎ। এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ নাম ও রূপের দ্বারা আচ্ছাদিত। এই নাম ও রূপের জন্যই জগতে ভিন্নতা পরিদর্শিত হচ্ছে। 

সেই বিরাট  পুরুষ যিনি সমগ্র সৃষ্টিকে ধারণ করে আছেন।  জগতের সমস্ত কিছুই অর্থাৎ প্রাণ থেকে শুরু করে নাম পর্যন্ত এগুলো সবই তাঁরই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। আর এই কারণেই তাঁকে  বলা হচ্ছে ষোড়শকলা যুক্ত পুরুষ। অতয়েব নির্গুণ, নিস্কল পুরুষ থেকেই এই ষোলোকলা এসেছে যা পুরুষ থেকে পৃথক নয়। এইভাবেই সেই পরমপুরুষ নিজেকে প্রকাশ করছেন। 
------------------------