Wednesday 24 February 2021

মৃত্যু রহস্যঃ - মৃতদেহে কি পুনরায় প্রাণের সঞ্চার ঘটানো সম্ভব ?

 


মৃত্যু রহস্যঃ (1)


মৃতদেহে কি পুনরায় প্রাণের সঞ্চার ঘটানো সম্ভব ?
অকালমৃত্যু রোধ করা কি সম্ভব ?  একটা জিনিস আমরা সবাই মেনে নিয়েছি  যে জন্ম হলে  তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। এটা রোধ করবার সাধ্য কারুর নেই।  তা সে আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্র বলুন বা আমাদের দর্শন শাস্ত্র বলুন - সবাই মেনে নিয়েছেন, যে মৃত্যুকে রোধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এমনকিছু অলৌকিক কাহিনীর কথা আমরা শুনে থাকি, যেখানে সাধু মহাত্মাদের কৃপায়, মরা মানুষ জ্যান্ত হয়ে উঠতে পরে। শুধু  সেযুগে নয়, এই যুগেও, এসব কথা শুনতে  পাওয়া যায়। আমাদের অনুসন্ধানের বিষয়, এইসব কলাকৌশল, ও তার প্রয়োগ পদ্ধতি,  যাতে মরার আগে যেন কেউ না মারা যায়।  অর্থাৎ অকালে যেন কেউ মারা না যায়। আমরা পরবর্তী কয়েকদিন এই প্রসঙ্গে অর্থাৎ অকালমৃত্যু কিভাবে রোধ করা যায় - সেই সম্পর্কে দর্শনশাস্ত্র ও চিকিৎসাশাস্ত্রের মধ্যে অনুসন্ধান মূলক আলোচনা শুনবো।
 
এই প্রসঙ্গে একটা মহাভারতের গল্প দিয়ে শুরু করি। ধীরে ধীরে আমরা বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করবো। আসলে মহাভারতের গল্প আমার কাছে নিতান্ত গল্প নয়, এখানে আছে জীবন জিজ্ঞাসার উত্তর।  এই মহাভারতে আছে গীতা, যা আমাদেরকে জীবনশৈলী শেখায়। ব্যাসদেব বলেছে, মহাভারত হচ্ছে বেদের অর্থাৎ জ্ঞানের  নির্যাস, যা আমাদের গল্পের আকারে শোনানো হয়েছে ।  যাইহোক, মহাভারতের শান্তিপর্বে এই গল্পের কথা বলা হয়েছে। মহামতি ভীষ্ম যখন  শরশয্যায়,  যুধিষ্ঠির জিজ্ঞেস করছেন, হে পিতামহ, আপনি কি কখনো মানুষকে  প্রাণত্যাগের পরে, পূনরুজ্জীবিত হতে দেখেছেন, বা শুনেছেন। ভীষ্ম বলছেন, হ্যাঁ মানুষ যদি অকালে কালের কবলে পরে, তবে তাকে বাঁচানো সম্ভব হতে পারে। একসময় এক ব্রাহ্মণের সুকুমারমতি কুমার গ্রহের ফেরে প্রাণত্যাগ করে। তো ব্রাহ্মণ-পিতা  শোকে কান্নাকাটি করতে করতে তার আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ছেলের মৃতদেহ সৎকারকরবার জন্য, শ্মশানের দিকে যাত্রা করে। সেখানে গিয়ে ছেলেটিকে কোলে নিয়ে তার পিতা-মাতা কান্নাকাটি করতে থাকে। কিছুতেই তাকে মাটিতে কবর দিতে চায় না। এইসময় একটা শকুন তাদের কাছে আসে,  আর বলতে থাকে দেখো মানুষ, সবাই  একদিন না একদিন মৃত্যুমুখে পতিত হবে, তোমারা অহেতুক শোক করছো। মৃত্যু সমস্ত জীবের নিশ্চিত পরিণতি।  এই বালক মৃত। একে তোমরা এক্ষুনি শ্মশানে রেখে দিয়ে, বাড়ি ফিরে যাও। দেখো এই শ্মশানে হাজার হাজার মানুষ তাদের আত্মীয়স্বজনদের মৃতদেহ ত্যাগ করে গেছে। সমস্ত জগৎ এই মৃত্যুশোকে পরিপূর্ন। যারা মৃতদেহ ত্যাগ না করে, তারা তাদের নিজেদের মৃত্যুকেই ডেকে আনে। মৃত্যুশোক মানুষের আয়ুক্ষয় করে থাকে।  অতয়েব আমার কথা শোনো, মৃত বালকের দেহ ত্যাগ করে তোমারা শীঘ্র বাড়ির  দিকে যাত্রা করো। দেখো শ্মশানে শেয়াল শকুনের বাস। কঙ্কালের স্তুপ।  এখানে বেশিক্ষন থাকা তোমাদের উচিত নয়। মর্ত্যলোকে মৃত্যুই সত্য। এখানে সবাইকেই একদিন না একদিন মৃত্যুর মুখে পতিত হতে হবে। আর কালের নিয়মে একবার কেউ মারা গেলে, তাকে আর কখনোই পুনরায় জীবিত করা সম্ভব নয়। ইহলোকে সমস্ত জীবকুল  নিয়তি ও কর্ম্মফলের দ্বারা  বাঁধা।  দেখো সূর্য অস্ত  যাচ্ছে, সন্ধ্যা নেমে আসছে। এক্ষুনি তোমাদের মৃত পুত্রের মায়া ত্যাগ করে, বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত।  এই কথা শুনে, স্মশানযাত্রীগন পুত্রের নিস্প্রান দেহকে শ্মশানে রেখে তার বাড়ির দিকে যেতে উদ্দত হলো।
 
এইসময় কালো রঙের একটা শিয়াল গর্তথেকে বেরিয়ে এলো। বেরিয়েই কথা বলতে শুরু করলো, বললো, আরে তোমরা তো ভীষণ  নির্দয়, নিষ্ঠুর, দেখো এখনো দিনের আলো  আছে,  আর তোমরা ভীত হয়ে এই অল্প-বয়সী বালকের দেহ পরিত্যাগ করে, বাড়িতে চলে যাচ্ছো ? দেখো মুহূর্তের প্রভাব অতি চমৎকার। কখন কি হয়, কেউ বলতে পারে না। এক মুহূর্তের মধ্যেই এই বালকের দেহে প্রাণের সঞ্চার হওয়া আমি আশ্চর্য্যের মনে করি না। খানিক্ষন আগেও যার মুখের মধুর বাক্যে তোমরা পুলকিত হতে, যাকে  কোলে নিয়ে, তুমি অশেষ আনন্দ লাভ করতে, যাকে  তুমি চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিতে, সেই সুকুমার বালককে, এত তাড়াতাড়ি পরিত্যাগ করে এই নির্জন শ্মশানে, এই শেয়াল-শকুনের কাছে রেখে, নিজেরা নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যাচ্ছ ? দেখো  সন্নাসীগণ সন্তান লাভ করতে পারে না। তথাপি তারা বালকের সমাদর করে থাকে। পশুপাখিগন তাদের সন্তানদের কাছ থেকে বৃদ্ধ বয়সে প্রতিপালনের প্রতিশ্রুতি পায় না। তথাপি এরা সবাই সন্তানদের লালন পালন করে থাকে। কিন্তু আজ তোমাদের আচরণ থেকে বুঝতে পারলাম, মানুষ কত নিষ্ঠুর। মানুষের শরীরে স্নেহ-মমতা নেই। তোমাদের শোক-কান্নাকাটি দেখে মনে হচ্ছে - এগুলো সবই কৃত্তিম। যে তোমার কুলরক্ষক তাকে তুমি শ্মশানে রেখে চলে যাচ্ছ ? দেখো ইষ্ট  বস্তু কখনোই পরিত্যাগ করতে নেই। দেখো, মানুষের বিপদে যদি মানুষ কাছে থাকে, মানুষের অসময়ে যদি মানুষের কাছে আত্মীয়স্বজন কাছে থাকে, তবে তাকে বহিঃশত্রু আক্রমন করতে পারে না। দেখো প্রাণ সকলের প্রিয়। সকলেই স্নেহের বশীভূত।  সাধুসন্তগণ পশুপাখিদের স্নেহ প্রদর্শন করে থাকে। এখন তোমাদের গলার মালা স্বরূপ এই বালক - একে  তোমরা পরিত্যাগ করে চলে যাচ্ছ ? তোমাদের উচিত, শোক পরিত্যাগ করে, কুলরক্ষক এই পুত্রকে নিরীক্ষণ করা, ও সর্ব শক্তিমান ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা, যাতে কালের প্রভাব থেকে সে মুক্ত হতে পারে। এই কথা শুনে ব্রাহ্মণগণ বালকের মৃতদেহ রক্ষার্থে আবার মৃত সন্তানের কাছে ফিরে এলো। 

ব্রাহ্মণদের ফিরে আসতে  দেখে, শকুন আবার বলতে শুরু করলো। হে মনুষ্যগন, তোমরা  অতিশয়  নির্বোধ। এই নীচাশয় নৃশংস অল্পবুদ্ধি শৃগালের কথায় আবার ফিরে এলে ? আর কিজন্যই বা আত্মার অস্তিত্ত্বে অবিশ্বাসী হয়ে, এই পঞ্চভূত-পরিশূন্য নিস্প্রান বস্তুর উপরে আকৃষ্ট হয়ে, শোকাভিভূত হচ্ছো ? যে তপঃপ্রভাবে, তোমরা পাপ থেকে বিমুক্ত হতে পারবে, সেই তপঃ অনুষ্ঠানে তোমাদের যত্নবান হওয়া উচিত। তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করলে, কিছুই দুর্লভ হয় না। অতয়েব শোক ত্যাগ করো। দেখ, সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য নিয়েই দেহের জন্ম হয়ে থাকে। তোমাদের দুর্ভাগ্যের প্রভাবেই এই বালক তোমাদের শোকসাগরে নিমজ্জিত করে দেহ ত্যাগ করেছে। তোমার সন্তান-সন্ততি বলো, জাগতিক সম্পত্তি বলো সবই তপবল দ্বারাই লভ্য। পূর্বজন্মে যেমন তপস্যা করেছো, এই জন্মে সেই অনুযায়ী সুখ-দুঃখ ভোগ করতে হবে। জীব আগে সুখ-দুঃখ সংগ্রহ করে, তারপরে জন্ম গ্রহণ করে থাকে। কেউ কারুর কর্ম্মফল ভোগ করতে পারে না। সকলেই স্ব-স্ব সুকৃত ও দুষ্কৃত অনুসারে ফল ভোগ করে থাকে। অতয়েব তোমরা অধর্ম্ম থেকে বিরত হয়ে, নিজ নিজ ধর্ম্ম পালন করো। অতয়েব, স্নেহ-মমতা-শোক-দুঃখ ত্যাগ করে, বালকের দেহ শ্মশানে নিক্ষেপ করে, এখান থেকে চলে যাও । কর্ত্তাকেই শুভ-অশুভ ফল ভোগ করতে হয়। তার বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়-স্বজন এদের এখানে কিছু করবার নেই। অতয়েব শীঘ্র শ্মশান পরিত্যাগ করাই বিধেয়। কি বিদ্বান, কি মূর্খ, কি ধনবান, কি নির্ধন সবাই নিজ নিজ শুভ-অশুভ কাজের ফল ভোগান্তে কালের কবলে নিপতিত হয়।  এর জন্য শোক করা বৃথা।  কাল সকলের নিয়ন্তা।  কাল কখনো পক্ষপাতিত্ত্ব করতে পারে না। কি বালক, কি যুবক, এমনকি কি গর্ভস্থ সবাইকে  কাল আক্রমন করে থাকে। জগতের এটাই গতি।  এর অন্যথা সম্ভব নয়। এই কথা শুনে ব্রাহ্মণগণ আবার নিজনিজ গৃহের দিকে পা বাড়ালেন। 

কালো শৃগাল এই সব কথা শুনছিলো। শৃগাল বললো, আমি বেশ বুঝতে পারছি, শকুনের কথায় তোমাদের স্নেহের লোপ পাচ্ছে। আমি জানি এই বালকের মৃত্যুতে বৎসবিহীন গাভীর মতো অবস্থা তোমাদের। তোমাদের কান্না কাটি দেখে, আমারও ভিতরে শোকের আবহ তৈরী হয়েছে। আমারও চোখে জল আসছে। দেখো, সব ব্যাপারে নিজের সাধ্য মতো চেষ্টা করা উচিত। শুধু শোক-দুঃখ-পরিতাপ কোনো কাজের কথা নয়। দেখো চেষ্টা করলে দৈবফল লাভ করা যায়। শুধু পরিতাপ করে কখনো সুখ অর্জন করা যায় না। দৈবফলে যেমন অসম্ভব সম্ভব হতে পারে, তেমনি পুরুষকারের প্রভাবেই দৈবফল লাভ করা যেতে পারে। যত্ন সহকারে চেষ্টা করা অভীষ্ট লাভের উপায়। অতয়েব তোমরা বালককে জীবিত করবার জন্য, আপ্রাণ চেষ্টা করো। চেষ্টা ব্যতিরেকে হতাশ হয়ে, নির্দয় হয়ে বালককে পরিত্যাগ করো না। দেখো, পিতার শরীর  থেকে উৎপন্ন এই পুত্র।  এই পুত্র তোমার বংশরক্ষা করবে। পিতার অর্দ্ধ অংশ হচ্ছে পুত্র। সেই পুত্রকে শ্মশানে রেখে তোমরা কোথায় গমন করছো ? কিছুক্ষন অপেক্ষা করো। সূর্য অস্তাচলে গেলে, এমনকি সন্ধ্যা হয়ে গেলেও হয়  একেবারে পুত্রের সাথে বাড়িতে যাবে, নতুবা পুত্রের সাথে এইখানেই থেকে যাবে। 

এবার আবার শকুন, কথা বলা শুরু করলো। বললো, হে মানবগন, আমি হাজার বছর হলো জন্ম গ্রহণ করেছি।  কিন্তু কখনো, কাউকে কালের কবলে নিপতিত হবার পরে, পুনরায় জীবিত হতে দেখি নাই। কেউ গর্ভ অবস্থায়ই মারা যায়।  কেউ জন্মের পরেই মারা যায়, কেউ শৈশবে মারা যায়। কেউ যৌবনে মারা যায়।  দেখো, মানুষ বলো, পশু-পাখি বলো, সবার ভাগ্য অনিত্য। কি স্থাবর, কি অস্থাবর জীব  জঙ্গম সবাই পরমায়ুর অধীন। অনেকেই প্রিয় পুত্র-প্রিয়জনদের শ্মশানে পরিত্যাগ করে গৃহে গমন করে থাকে।  আবার দেখো, একসময় নিজেই শ্মশানে পরিত্যক্ত হয়। মানুষ মাত্রেই ভালো-মন্দ সমস্ত কিছু পরিত্যাগ করে একসময় পরলোক গমন করে থাকে।  এর কোনো অন্যথা নেই। অতয়েব প্রাণহীন এই দেহ, তা সে হোক না প্রিয়তম পুত্রের, জীবনহীন দেহ প্রাণহীন কাঠের মতো।  এই দেহের প্রতি স্নেহ করা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আর এই ভবিতব্যের নিস্পত্তির জন্য, কখনোই কোনো পরিশ্রম করে লাভ নেই। তোমরা যে এর জন্য শোক করছো, তা এই মৃত পুত্র  শুনতেও পারছে না, দেখতেও পাচ্ছে না, তাহলে কেন তোমরা এর জন্য অকারণ শোক করছো।  মৃতদেহ সত্ত্বর পরিত্যাজ্য - এই অমোঘ বাক্য  তোমাদের স্মরণ রাখা উচিত। মৃত গাছে জল দিয়ে কোনো লাভ নেই, মৃত শরীরে কঠোর বচন বা মূল্যবান উপদেশ, কোনো কাজে লাগে না। এমনকি মৃত শরীরে কখনোই প্রাণের সঞ্চরণ ক্ষেত্র হতে পারে।  অতয়েব, হে মানবগন তোমরা এই মৃতদেহ পরিত্যাগ করে শীঘ্র এই স্থান ত্যাগ করো। এই কথা শুনে আবার ব্রাহ্মণগণ গৃহাভিমুখে গমন-উদ্দত হলো।  

আবার শৃগাল দ্রুতপায়ে সেখানে এসে মৃত বালকের দিকে চেয়ে থাকলো। বললো, হে মানবগন তোমরা অহেতুক এই শকুনে কথায় বিচলিত হচ্ছো। এই বালক পিতৃলোকের পিন্ডদাতা। একে ত্যাগ করলে, একসময় তোমাদের মনে পরিতাপ  হবে,  ভবিষ্যতের পরিতাপ থেকে তোমরা রেহাই পাবে না। আমি শুনেছি, রামচন্দ্র তপস্যারত শূদ্র হৃষীকে বিনাশ করলে, সেই ধর্ম্ম প্রভাবে,এক ব্রাহ্মণ বালক পুনরায় জীবিত হয়েছিল। ধর্ম্মিকশ্রেষ্ঠ রাজর্ষি শ্বেত তার মৃত পুত্রকে পুনর্জীবিত করেছিল। অতয়েব, মৃত ব্যক্তির পুনর্জীবন নিতান্ত অসম্ভব নয়। তোমরা এখানে কান্নাকাটি করলে, হয়তো কোনো সিদ্ধপুরুষ বা মুনি অথবা কোনো দেবতা তোমাদের প্রতি দয়া  প্রকাশ করতে পারেন। এই কথা শুনে ব্রাহ্মণগণ পুনরায় পুত্রকে কোলে নিয়ে নিরন্তর রোদন করতে লাগলেন। 

আবার শকুনের আবির্ভাব হলো। মানুষের কান্নাকাটির শব্দ  শুনে, শকুন বিরক্ত হয়ে  বলতে লাগলো, তোমরা আবার বালকের শরীরে চোখের জল ফেলছো ? এই শিশু ভবিতব্যের শাসন-নিয়মে চিরনিদ্রা প্রাপ্ত হয়েছে। কি তপস্বী, কি জ্ঞানী, কি অজ্ঞানী, কি ধনী কি নির্ধনী সবাই একসময় কালের কবলে শমনভবনে গমন করতে হয়। পৃথিবী নামক এই মৃত্যুপুরীতে কোটি কোটি বালক-বৃদ্ধ তাদের দেহ  পরিত্যাগ করেছে।  তোমরা এই চিরসত্যকে  অস্বীকার করে, মৃত এই বালককে জীবিত কোরবার জন্য উদগ্রীব হয়েছো ? মৃত ব্যক্তির জন্য শোক করা বৃথা।  মানুষ মারা গেলে আর তাকে কখনোই জীবিত করা যায় না। একটা কথা শুনে রাখো, মানুষ তো ছাড়  -  শতশত শৃগাল একত্র হয়ে শতশত বৎসর চেষ্টা করলেও, কখনোই মৃতদেহে প্রাণের সঞ্চার করতে  পারে না।  কিন্তু আমি জানি, যদি ভগবান রুদ্রদেব, কার্ত্তিকেয়, ব্রহ্মা বা বিষ্ণু স্বয়ং এসে যদি বড় দান  করেন, তাহলে এই শিশু পুনর্জীবিত হতে পারে। তোমাদের কান্নাকাটি, তোমাদের শোক, তোমাদের চিৎকার চেঁচামেচি কোনো জীবন লাভের  উপায় হতে পারে না। আমি এই শকুন, আর ওই শৃগাল, বা তোমরা  মানবগন, - সকলেই স্ব -স্ব পাপ-পুন্যভার বহন করবার নিমিত্য অবস্থান করছি।  বিজ্ঞব্যাক্তিগন এই কথা স্মরণ রেখে অন্যের অবান্তর কথায় কান দেন না। তোমরা যত্নসহকারে , ধর্ম্মের অনুষ্ঠান, সত্যবাক্যের অনুশীলন, শাস্ত্রের আলোচনা, ন্যায়পথ অবলম্বন করে জীবন ধারণ করো। সমস্ত প্রাণীদের প্রতি সরল ও দয়া প্রকাশের চেষ্টা করো। জীবিত থেকে পিতা-মাতা ও অন্যান্যদের পালন পোষন তত্ত্বাবধান না করলে অধর্ম্মে লিপ্ত হতে হয়। এই বালকের এমন কোনো অঙ্গভঙ্গি দেখা যাচ্ছে না. যাতে সে জীবিত হতে পারে। সুতরাং এই বালকের জীবিতলাভের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। অতয়েব, তোমরা এই অহেতুক শোক পরিত্যাগ করে, মায়া মমতা পরিত্যাগ করে, নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করো। এই কথা শুনে ব্রাহ্মণগণ বাড়ি ফিরবার জন্য উদ্যোগী হলো। 

শৃগাল আবার কথা বলা শুরু করলো :  বললো, এই মর্তলোক অতি ভয়ানক স্থান। এখানে জীবের জীবিতকালে অতি অল্প। প্রতিটি মানুষ জীবনে প্রিয়জনের বিয়োগব্যথায় কাতর হয়ে থাকে। এই জগতে সমস্ত কাজই অলীক, সব কাজই অপ্রিয়। কিসে কি হয়, কে বলতে পারে ? অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ জীবিত থাকতে কতনা স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা প্রদর্শন করে থাকে। আর সেই প্রিয়জনের মৃত্যু হলে, পরক্ষনেই তাকে পরিত্যাগ করে থাকে। আর এই শকুনের কথা শুনে, মানুষ নিজ নিজ কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান শূন্য  হয়ে যায়। একটা জিনিস শুনে রাখো, জীবনে সুখের অবসানে দুঃখ এসে থাকে আবার দুঃখের অবসানে সুখ এসে থাকে। আর এই সুখ দুঃখ কালের অধীন।  কালের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সুখ -দুঃখের অবসান হয়ে থাকে। ইহকালে কেউ চিরকাল  সুখ বা চিরকাল দুঃখ ভোগ করতে পারে না। তবে সময়ে কর্তব্য অবহেলা করা উচিত নয়। আমর বালকের সুমুখশ্রী দেখে মনে হচ্ছে, তার শরীরের লাবণ্য দেখে মনে হচ্ছে, এই পুত্র অবশ্যই  জীবিত। অতয়েব একে  তোমাদের পরিত্যাগ করা উচিত নয়। শ্মশানবাসী শৃগালের এই মনোহর কথা শুনে, ব্রাহ্মণগণ আবার বালকের কাছে অবস্থান করতে লাগলো। 

শকুন  আবার বলছে,  শোনো হে মানবগন, এই শ্মশান অতি ভয়ঙ্কর। রাত  হলেই শ্মশানের ভয়ঙ্কর রূপ প্রকট হয়ে ওঠে।  এখানে রাতে পেঁচা, যক্ষ, রাক্ষস নিরন্তর বাস করে থাকে। অতয়েব, রাত হতে না হতেই, এই স্থান পরিত্যাগ করা অবশ্য কর্তব্য। বরং বাড়িতে গিয়ে, এই বালকের প্রেতকার্য্যের অনুষ্ঠান করো। এর পরে এখানে মাংসাশী প্রাণীদের আসা শুরু হবে। এর পরে একটু রাত  হলেই মাংসাশী প্রাণী তোমাদের আক্রমন করতে পারে। অরণ্য থেকেও ভয়ানক এই স্থান। এখানে থাকলে, নানান রকম ভয়ঙ্কর ধ্বনি তোমাদের ভীত করে তুলবে। অতয়েব অজ্ঞানী শেয়ালের কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে, তোমাদের অবশ্যই  এই স্থান পরিত্যাগ করা কর্তব্য। এতে তোমাদের সবার সমূহ বিপদ হতে পারে । 

শৃগাল বললো, হে মানবগন যতক্ষন না সূর্যদেব অস্তাচলে যাচ্ছেন, ততক্ষন এখানে বসে অশ্রুরুদ্ধ বদনে নির্ভিক চিত্তে বসে বালককে রক্ষা করো, তাকে নিরীক্ষণ করো। শকুনের নিষ্ঠুর বাক্যে বিশ্বাস করলে, আর এই সুন্দর মুখ দর্শন করতে পারবে না। 

ব্রাহ্মণগণ একবার শকুনের কথা আবার শিয়ালের  কথায়, কিংকর্তব্য-বিমূঢ় হয়ে গেলো। শ্মশানে অবস্থান করবার পক্ষে যুক্তি আবার বিপক্ষে যুক্তিজাল তাদেরকে আবদ্ধ  করে ফেললো।  কি করবে তা তারা বুঝতে পারছিলো না। শেষে ক্রন্দনরত অবস্থায় শ্মশানে অবস্থান করাই স্থির করলেন।

 এই ঘটনা পর্যবেক্ষন করছিলেন, পার্বতী-বল্লভে স্বয়ং মহাদেব।  মাতা পার্বতীর  অনুরোধে, এই ব্রাহ্মণদের দুঃখ  দর্শনে ভূতপাবন ভবানীপতি সেই শ্মশানে এসে উপস্থিত হলেন। এবং করুনার স্বরে বললেন, আমি মহাদেব, আমি তোমাদের বড় দিতে এসেছি।  তোমরা তোমাদের অভিলাষিত বড় প্রার্থনা করো। তখন সমস্ত উপস্থিত ব্রাহ্মণসকল মহাদেবকে প্রণাম করলেন। বললেন, আমরা সবাই এই বালকের প্রাণনাশের কারনে আমরা  মৃতপ্রায় হয়েছি। অতয়েব, এই বালককে জীবন দান করে আমাদের শান্তিপ্রদায়ক হউন। এই কথা শুনে ভূতনাথ জলাঞ্জলি গ্রহণপূর্বক "শতায়ু হও" বলে  বালককে পুনরায় জীবিত করলেন। 

এই ভাবে, সেই ব্রাহ্মণগণ স্বয়ং ভূতনাথের প্রসাদে মৃতবালকের পুনর্জীবন লাভ করে পুলকিতচিত্তে দেবাদিদেবকে অভিবাদন পূর্বক পরম সুখে অবস্থান লাগলেন। 

 এই কাহিনী  বলে, মহামতি ভীষ্ম বলছেন,   আলস্যবিহীন অধ্যবসায় ও ভগবান শঙ্করের অনুগ্রহে অবিলম্বে ফললাভ হয়ে থাকে। দৈব ও বুদ্ধি সহযোগে পুরুষকার মিলিত ভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে  পারে।

গল্পকথা। কিন্তু এই গল্পের মধ্যে যে সত্য নিহিত আছে, তা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।

 আমি আমার একটা ছোট্টবেলার গল্প বলি। আমাদের বাড়ির কাছে, দুটো বিল ছিল, একটা ছোট আর একটা বড়ো। এই বড়ো বিলে চৈত্র বৈশাখ মাসে বহু বাচ্চারা শিংমাছ-কাঁকড়া ধরতে যেত। এই সময় মাছ কিছু ছোট গর্তের মধ্যে ঢুকে থাকতো।  সেখান দিয়ে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেগুলোকে বার করা হতো।  কখনো কখনো হাত ঢুকিয়ে  বের করে  আনতো। তো আমিও মাঝে মধ্যে নিতাইয়ের সাথে এই কাজের সাথী হতাম। তো একদিন হয়েছে কি, বিলের পারের মাঠের মধ্যে গিয়ে দেখি সঞ্জীবন আমাদের আর এক বন্ধু,  মাঠের মধ্যে অচৈতন্য অবস্থায় শুয়ে আছে।  আমরা ভাবলাম হয়তো সাপের কামড়ে মারা গেছে। তো নিতাই চিৎকার করে তার বাবাকে ডাকতে লাগলো। ওর বাবা নানান রকম তুকতাক  জানতো। তো দেখলাম,  সঞ্জীবনকে  নিতাইয়ের বাবা চিৎ করে শোয়ালো। ওর শরীরের  উপরে শুয়ে পড়লো। নিতাইকে বললো, বিল থেকে জল এনে চোখ-মুখে ছিটিয়ে দিতে। নিতাইয়ের বাবা সঞ্জীবনের   মুখের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে জোরে ফুঁ দিতে লাগলো। কয়েকবার ফুঁ দিতেই দেখলাম, সঞ্জীবন হাঁচি দিতে লাগলো।  আর ধীরে ধীরে সুস্থ  হয়ে বসলো। পরে বোঝা গেলো, ও ভেবেছিলো, ওকে সাপে কামড়েছে।  তাই ভয়ে সে মূর্ছা গেছে।  হয়তো এই অবস্থায় থাকলে, সে মারাও যেতে পারতো।  

মানুষ কেন, কোনো জীবই চিরস্থায়ী নয়। এমনকি কোনো বস্তুও চিরস্থায়ী নয়।  প্রতিটি দেহের একটা সময়সীমা আছে। যা তাকে তার পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যাবে।  আর এই সময়সীমা প্রকৃতির নিয়মে আবদ্ধ। কিন্তু অকালমৃত্যু কেন হবে ? এখান থেকে আমরা বের হতে পারি কি না, সেটাই আমাদের গন্তব্য। পরের দিন আমরা আবার এই আলোচনায় যাবো।  আজ এই পর্যন্ত।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

মৃত্যু রহস্যঃ - ২  প্রাণহীন দেহে প্রাণের সঞ্চার  - একটা অনুসন্ধান কোনো সিদ্ধান্ত নয়। 

আগেরদিন আমরা মহাভারতের শান্তিপর্ব থেকে একটা গল্প শুনেছিলাম। সেখানে আমরা একটা কথা আমরা শুনেছিলাম, মানুষ যদি অকালে কালের কবলে পরে, তবে তাকে কিভাবে বাঁচানো যায়। মহাত্মা ভীষ্ম বলছেন, ধৈর্য্য সহকারে বুদ্ধিদীপ্ত পুরুষকার ও দৈবের অনুগ্রহে অকাল মৃত্যু থেকে মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হতে পরে। অসম্ভব সম্ভব হতে পারে, যদি আমরা আলস্য বিহীন অধ্যবসায়ে লিপ্ত  হতে পারি।  আর লক্ষে সর্বশক্তি নিয়গ করে কর্ম্মে লিপ্ত হতে আমাদের দৈব অনুগ্রহ লাভ হতে পারে।  আরো একটা জিনিস আমরা শুনেছিলাম, মানুষের অকালমৃত্যুর কারন, পিতা-মাতার অবিমৃষ্যতা। যাই হোক, আজ আমরা শুনবো, হরিবংশ থেকে আরো একটি কাহিনী।

হরিবংশে বর্ণিত ঘটনার সাক্ষী ছিলেন, স্বয়ং অর্জুন।  আমরা তার মুখ থেকেই ঘটনাটি শুনবো। 

অর্জুন  তখন দ্বারকায় গিয়েছিলেন । সেখানে ধর্ম্মাত্মা শ্রীকৃষ্ণ শাস্ত্র অনুসারে একাহব্রতে  দীক্ষিত হয়েছিলেন। দীক্ষা হয়ে যাবার পরে, বসে গল্পগুজব হচ্ছে, এমনসময় এক ব্রাহ্মণ এসে কান্নাকাটি জুড়ে দিলো। প্রশ্ন করে জানা গেলো, ব্রাহ্মণের, পর-পর তিনটি সন্তান সুতিকাগৃহেই পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হয়েছে। এবার আবার তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হয়েছেন । আগত সন্তান যেন আর মারা না যায়, সেই আর্তি নিয়ে তিনি দ্বারকায় এসেছেন। এখন শ্রীকৃষ্ণ  বলছেন, আমি সবে যজ্ঞে দীক্ষিত হয়েছি। এখন আমার পক্ষে যজ্ঞের কাজ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়।  কিন্তু ব্রাহ্মণকে রক্ষা করাও কর্তব্য। তো অর্জুন বলছেন,  কেশব আপনি চিন্তা করবেন না  আপনি যদি বলেন, তবে আমি ব্রাহ্মণকে রক্ষা করতে পারি। কৃষ্ণ স্মিত হেসে বললেন, ঠিক আছে, যাও তবে যেতে তো ক্ষতি নেই।
 ঘটনার বিস্তারে যাবো না,অর্জুন সেখানে গিয়ে সমস্যার সমাধান করতে পারলো না, ব্রাহ্মণের চতুর্থ সন্তান সুতিকাগৃহেই প্রাণত্যাগ করলো। তো ব্রাহ্মণ অর্জুনকে তাচ্ছিল্য করলে যা তাই নয় তাই বলে  তিরস্কার করতে  লাগলো।  যদি গোবিন্দ আসতো, তবে হয়তো এযাত্রা রক্ষা হতো। ইত্যাদি ইত্যাদি। তো অর্জুন ফিরে এলো শ্রীকৃষ্ণের কাছে, আর তার ব্যর্থতার কাহিনী বর্ণনা করলো। শ্রীকৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ তার রথ  প্রস্তুত করে, অর্জুনকেই  সাথে নিয়ে  রওনা হলেন, সমস্যার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে। রথ বন-জঙ্গল পার হয়ে, নদী-সমুদ্র পার হয়ে, পাহাড় পর্বত পার হয়ে বিবর-অভ্যন্তরে প্রবেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। বিবর কথাটা  খেয়াল করুন - বিবর কথার অর্থ হচ্ছে গহ্বর - বি মানে আভরণ অর্থাৎ আবরনে ঢাকা যে অঞ্চল। আসলে অন্ধকারের আবরণ উন্মেষ করে সূর্যলোকে প্রবেশ। একেই বলে বিবর অভ্যন্তরে প্রবেশ।    প্রথমে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে অর্থাৎ যেখানে স্পর্শ ইন্দ্রিয় ভিন্ন অন্য ইন্দ্রিয় কাজ করে না, সেখানে প্রবেশ করলেন। এর পর সেই তমসা কাটিয়ে স্নিগ্দ্ধ আকাশ পথে প্রবেশ করলেন। সেখান থেকে তেজরাশির মধ্যে প্রবেশ করলেন। এখানে অর্জুনকে অপেক্ষায় থাকতে বলে, শ্রীকৃষ্ণ ওই তেজঃপুঞ্জের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তেজঃপুঞ্জের মধ্যে নিজেকে লিন করে দিলেন।  এর পর অর্জুন কিছু দেখতে পেলেন না। কিছুক্ষন পরে দেখলেন, শ্রীকৃষ্ণ চারটি ব্রাহ্মণ কুমারকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন। 

অর্জুন পরবর্তীতে শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করছেন, তুমি কিভাবে এই অন্ধকার দূর করে তেজের  মধ্যে  বিলীন হয়ে গেলে ? শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, এই যে তেজরাশি তুমি দেখেছো, তা আসলে আমারই ব্রহ্মহ্ময় তেজ। ওই তেজ আমাদের স্থূল-সূক্ষ্ম স্বরূপ প্রকৃতি মাত্র। যোগীগণ ওই তেজঃময় প্রকৃতিমধ্যে বিলীন হতে পারলে, মুক্তি লাভ করতে পারেন । আমিই ওই প্রদীপ্ত তেজোরাশি। আসলে আমরা সবাই ওই প্রদীপ্ত তেজরাশী মাত্র। কিন্তু সাধারণ মানুষ নিজেকে নানান বৈভব দিয়ে নিজেকে ঢেকে রেখেছে। তাই সে তার স্বরূপ সম্পর্কে বিস্মৃত হয়েছে।  যাত্রা পথে যে বন-সমুদ্র-পাহাড়-আকাশ-তেজ  অর্থাৎ এই বাহ্যিক প্রকৃতি থেকে প্রকৃতির সূক্ষ্মতম রূপের মধ্যে প্রবেশ। কার্য্য থেকে কারনে প্রবেশ। 
 শ্রীকৃষ্ণ এই যে অবস্থার কথা বর্ননা করলেন, এটি আসলে আমাদের ধ্যানময় অবস্থা মাত্র।  কিন্তু কথা হচ্ছে, শ্রীকৃষ্ণ এই অনুভূতির মধ্যে ধ্যানের  মাধ্যমে  প্রবেশ করলেও, কিভাবে অর্জুন এই অবস্থাগুলো প্রতক্ষ্য করেছিল?  এই সম্পর্কে আমরা কখনো পরবর্তীতে আলোচনা করবো। শুধু একটা উদাহরণ দিতে পারি, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পদস্পর্শে    নরেনের ব্রহ্মানুভূতির কথা নিশ্চয়ই আপনা শুনেছেন।   কিন্তু অন্য আর একটা প্রশ্ন  হচ্ছে, শ্রীকৃষ্ণ এই মৃত কুমারদের কিভাবে কোথা থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে এলেন ? এটা বুঝতে গেলে আমাদের জগতের অনিত্যতা, ও সময়-স্থানের বিজ্ঞান, ও শব্দ বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে হবে। এটি কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়। সবই সম্ভব দৈবের প্রভাবে।  আর এই দৈবশক্তি আমাদের সবার মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় আছে।  আমরা এই শক্তির উন্মেষ ঘটাতে  পারি না।  কিন্তু যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ সেটি পারেন। আসলে সব কথা সাধারনের বোধগম্য নয়। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমরা সবাই এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে পারি, সেই সম্ভাবনা আমাদের সবার মধ্যেই লুক্কায়িত আছে। এ  সম্পর্কে জানতে হবে।  এবং নিরন্তর   তপস্যা, স্বাধ্যায়ঃ ও ঈশ্বর-প্রণিধান করতে হবে।  আর একেই বলে ক্রিয়াযোগ। তো ক্রিয়াযোগে যাঁরা সিদ্ধ কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই, তাদের পক্ষে মৃত দেহে প্রাণের সঞ্চার করা সম্ভব। 

এবার অন্য একটা গল্প বলি, এই গল্পটি আপনারা শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দ বীরোচিত "Autobiography of a  Yogi" বইতে পাবেন। যোগানন্দের গুরু ছিলেন শ্রী যুক্তেশ্বর গিরিজি মহারাজ। এই গিরিজীর গুরু ছিলেন, লাহিড়ী মহাশয় অর্থাৎ শ্রী শ্যামাচরণ লাহিড়ী।  তো যুক্তেশ্বর  গিরিজী বলছেন,  রাম যিনি গিরিজীর গুরুভাই, একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এশিয়াটিক কলেরায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। লাহিড়ী মহাশয় কখনো অসুস্থতার সময় ডাক্তার ডাকা বারন  করতেন না। তো দুজন ডাক্তারকে ডাকা হলো। কিন্তু গিরিজী গুরুদেব লাহিড়ী মহাশয়ের কাছে বন্ধুর অসুস্থার কারনে, খুব কান্নাকাটি করতে লাগলেন।
তো লাহিড়ী মহাশয় বললেন, " আরে ডক্তারেরা তো রামকে দেখছে, তবে আর ভাবনা কী। সে ভালো হয়ে যাবে।" কিন্তু রামের বাড়িতে এসে দেখলেন, ডাক্তার চলে গেছেন। একজন আবার লিখে গেছেন, "আমাদের যতদূর করবার সবই করেছি, কিন্তু এর আর কোনো আশা নাই" ।একে গুরুদেবের আশ্বাস বাক্যে অগাধ বিশ্বাস, অন্যদিকে  রামের মুখখানা দেখে মনে হলো, সত্যিই মরন এগিয়ে আসছে। এবার সব শেষ। একবার গুরুদেবের কথায় বিশ্বাস আবার পরক্ষনেই ভীতিমূলক সন্দেহ - এই দোদুল্যমান অবস্থায় রাম  চিৎকার করে বলে উঠলো, যুক্তেশ্বর, গুরুদেবের কাছে দৌড়ে যা, বল গিয়ে যে আমি চললুম। আমার শেষ কাজের আগে যেন তিনি আমার দেহকে আশীর্বাদ করেন।" এই কথা বলে রাম  মরনের কোলে ঢোলে পড়লো। অন্য একজন শিষ্য সেখানে এলে, তাকে কাছে থাকতে বলে, যুক্তেশ্বরজী  আবার গুরুজীর কাছে ছুটলাম। গুরুদেবের দেখা হতেই বললেন, "রাম কেমন আছে গো ?" গিরিজি বললেন, ঘন্টাকতক বাদেই দেখবেন, তাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গুরুদেব লাহিড়ী মহাশয় বললেন, তোমরা শান্ত হয়ে ধ্যানে বসো, বলে নিজেও  সমাধিতে মগ্ন হলেন। ভোরের দিকে লাহিড়ী মহাশয় আশ্বাস দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, এঃ অরে কালকে কেন বললে না, যে ওষুধ-টসুধ গোছের একটা প্রতক্ষ্য কিছুর সাহায্য চাই ? তারপর রেড়িরতেলের প্রদীপ দেখিয়ে বললেন, একটা ছোট্ট শিশিতে ওই প্রদীপটা থেকে ক্ষানিকটা তেল ঢেলে নিয়ে রামের মুখে সাত ফোটা ঢেলে দাও  দেখি ?"

খানিকটা তেল নিয়ে যুক্তেশ্বরজী রামের বাড়িতে গিয়ে দেখেন, রামের দেহ  মৃত্যুকঠিন হিমশীতল। তার এই বীভৎস অবস্থার দিকে না তাকিয়ে, ডান  হাতের আঙ্গুল দিয়ে ঠোঁট দুটো ফাক করে, বাঁ হাতে তার দাঁতলাগা মুখের উপর ফোটা-ফোটা তেল ঢালতে লাগলেন । সাতফোটা তেল তার ঠোঁট স্পর্শ করতেই রামের দেহ ভীষণ ভাবে থরথর করে কেঁপে উঠলো। ধরফর  করে উঠে রাম  আশ্চার্য্য হয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। আর স্পষ্ট ভাবে বললো, লাহিড়ী মহাশয়কে দেখলুম, এক অতি উজ্জ্বল জ্যোতির্মন্ডলের মাঝখানে, যেন সূর্য্যের মতো জ্বলছেন। তিনি আমায় আদেশ করলেন, ওঠ ওঠ, ঘুম ছেড়ে উঠে পর আর যুক্তেশ্বরকে সঙ্গে করে নিয়ে আমার কাছে দেখা করতে এস। বলেই তেড়েফুড়ে উঠে জামাকাপড় পরে, গিরিজির সঙ্গে লাহিড়ী মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করতে ছুটলো । 

লাহিড়ী মহাশয় মিটিমিটি হেসে বললেন, যুক্তেশ্বরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এবার থেকে তুমি রেড়ির তেলের শিশি সঙ্গে রাখতে ভুলবে না নিশ্চই ? মনে রেখো, অক্ষর, অন্বয় পরমাত্মাই যেকোনো লোককে আরাম করে তুলতে পড়েন, ডাক্তার থাকুক আর না থাকুক। তেলের দাওয়াই দেওয়ার কোনো মানে হয় না - কেবল এইটুকু ছাড়া যে  প্রত্যক্ষ একটা কিছু চাই - প্রতীক আর কি। 

এখানে একটা জিনিস করুন, লাহিড়ী মহাশয় প্রথমে ধ্যানে বসলেন, সমাধিস্থ হলেন, রামের নিকট স্বপ্নে দেখা দিলেন, নির্দেশ দিলেন, এবং রামকে জাগ্রত করলেন। আমরা সবাই মৃত্যুর পরে, একটা অন্য জগতে বিচরণ করে থাকি। সেখানে বিশ্বশক্তির নির্দেশ পেলে, অতি অল্প ক্ষেত্রে হলেও, দেহত্যাগী আত্মা  আবার মৃতবৎ শরীরে ফিরে আসতে বাধ্য হয় ।   বিশ্বশক্তির অমোঘ নির্দেশ পালন ভিন্ন অন্য উপায় নেই। এই ধরনের ঘটনা, শুধু আমাদের ধর্ম্মশাস্ত্রে বর্ণিত আছে তাই নয়, এই অভিজ্ঞতা বিশ্বের বহু ডাক্তারদের জীবনেও হয়েছে। আমরা জন্ম নেবার সময় যেমন কিভাবে আসি, তা জানি না, কারন তখন আমরা সাধারণ মানুষগণ তমসাচ্ছন্ন  বা  তন্দ্রাবস্থাতে থাকি।  আবার যখন দেহান্তর প্রাপ্ত হই তখনও তমসাচ্ছন্ন অবস্থাতেই থাকি। অর্থাৎ স্থূল দেহ থেকে সূক্ষ্ম দেহে,  সূক্ষ্মদেহ থেকে অতি অতিসূক্ষ্ম দেহে স্থানান্তরনের  সময় আমরা জ্ঞান হারাই । তাই পূর্বস্মৃতি আমাদের কিছুই থাকে না। 

যাইহোক, এগুলো আমাদের কাছে অকল্পনীয়, অলীক গল্পকথা মাত্র । কিন্তু এমনটা তো হতে পারে, মহাযোগী লাহিড়ী মহাশয়, বা যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে এমনকিছু ক্ষমতা নিশ্চই ছিল, যা আমাদের জ্ঞানের বাইরে।  কিন্তু তাই বলে এগুলোকে অসত্য বলে উড়িয়ে না দিয়ে এর মধ্যে অনুসন্ধান করলে হয়তো মানুষের কল্যানে কোনো নতুন তথ্য পেতে পারি।   

যাই হোক। আজ এই পর্যন্ত। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

এবার  আমরা শুনে নেবো, এই আশ্চার্য্যজনক ঘটনার যিনি নায়ক, সে শ্রীকৃষ্ণ কে ছিলেন।      

 
মৃত্যু রহস্যঃ - ৩ - প্রাণহীন দেহে  প্রাণের সঞ্চার। 

দেওয়াল ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে। বুঝলাম ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে।  তো নতুন ব্যাটারি কিনে এনে লাগালাম । ঘড়ি চলা শুরু হলো, কিন্তু পেন্ডুলামটা দুলছে না। একটু নাড়িয়ে দিতেই পেন্ডুলাম দুলতে  শুরু করলো, আর চলতেই থাকলো । সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে, কিন্তু শিশুর প্রাণক্রিয়া শুরু হচ্ছে না। ধাঁই বা নার্চ  শিশুর শরীরকে  নেড়েচেড়ে উল্টে পাল্টে দিতেই কোন এক অজ্ঞাত কারনে  শিশুর শ্বাসক্রিয়া শুরু হলো। একই সঙ্গে শুরু হলো জীবনের প্রাণক্রিয়া। আর সারা জীবন ধরেই এই ক্রিয়া চলতেই থাকলো। 
 
আমাদের মৃত্যু সম্পর্কে বা বলা যেতে পারে, জীবন সম্পর্কে আমাদের কত ভুল ধারণা আছে, তা এই খবরটা শুনে বোঝা যেতে পারে। আমেরিকার মতো দেশে, যাকে আমরা পৃথিবীর সমস্ত দিক থেকে একটা উন্নত দেশ হিসেবে মনে করি, সেখানে বেশ কিছু বড় বড়  কোম্পানি CRYONICS অর্থাৎ উন্নত ধরনের মর্গ বা হিমঘর তৈরী ক'রে, সেখানে মৃত মানুষের শবদেহ রক্ষিত করা হচ্ছে, শুধু এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে শীঘ্রই মরা মানুষকে বাঁচিয়ে তোলার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হবে, এবং আর এই কৌশল আবিষ্কার হলেই, তার এই মৃতদেহ আবার বাঁচিয়ে তোলা হবে।  অর্থাৎ আবার তিনি পৃথিবীকে উপভোগ করতে পারবেন। আর এই মৃতদেহগুলোকে  ৫০ থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত অবিকৃত অবস্থায় হিমঘরে বাঁচিয়ে রাখা যাবে। জীবনের প্রতি মানুষের যে মোহ, বা বেঁচে থাকবার উগ্র ইচ্ছে, একে আশ্রয় করে,  মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমেরিকান অসৎ কোম্পানিগুলো ব্যবসায় নেমেছে। ভাবলে অবাক হতে হয়।  এরা  কি জানেনা, মরা মানুষ কখনোই বেঁচে উঠতে পারে না। এরা কি জানে না, বৃদ্ধ কখনো শিশু বা যুবক হতে পারে না। বাংলা একটা সিনেমায় দেখেছিলাম, যুবক হবার জন্য, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাগন কিভাবে এঁদো পুকুরে ডুব দিচ্ছে, আর যৌবন ফিরে পাচ্ছে । মানুষের এই কল্পনা কি বাস্তবে পরিণত হতে পারে ? যযাতি কথা আমরা মহাভারতে পড়েছি। যিনি বৃদ্ধ বয়স থেকে  যুবক বয়সে ফিরে এসে জীবনকে উপভোগ করেছিলেন। সত্যিই কি এটা সম্ভব ? যদি সম্ভব হয়, তবে কিভাবে সম্ভব ? আর যদি সম্ভব না হয়, তবে কেন সম্ভব নয় ? এই সম্পর্কে আজ আমরা  শুনবো। মৃত্যুকে ভালোভাবে বুঝতে গেলে আমাদের প্রথমে জন্মকে বুঝতে হবে।  

দেখুন পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু হয় না। জীবন প্রবাহ কোনো সরলরেখা নয় যে চলতেই থাকবে।  জীবন প্রবাহ একটি বৃত্ত, যা ঘুরেঘুরে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে মিলিত হয়। বার বার মিলিত হয়। আমরা জানি সন্তান জন্মের জন্য, পিতার শুক্রশক্তি ও মাতার রজঃ শক্তির মিলনে তৈরী হয় ভ্রূণ। এই ভ্রূণ ধীরে ধীরে মাতা-পিতার অবয়ব গ্রহণ করে থাকে। এতদিন আমরা জানতাম এই দুই শক্তি একই শরীরে থাকা সম্ভব নয়।  কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানীগন বলছেন, কোনো কোনো মানুষের  শরীরে অর্থাৎ যাকে রাপান্তরকামী বা নপুংশক বলে থাকি  তাদের শরীরে এই দুই শক্তিই  বর্তমান।  এখন সমকামিতার দ্বারা যদি এই দুই শক্তিকে জাগ্রত করা যায়, তবে সেই নপুংশক মায়ের শরীরে পুরুষের শুক্র প্রবেশ না করিয়ে সন্তান উৎপাদন সম্ভব। এছাড়া টেস্ট টিউব বেবির কথা এখনতো পরীক্ষিত সত্য।
জীবন অসীম সম্ভাবনাময়, এখানে যা কিছু ঘটতে  পারে। এখানে মানুষের একটা নির্দিষ্ট আয়ু আছে।  আবার দেখুন, শিব-কৃষ্ণ-কালী সবাই ক্রিয়াশীল বলে আমাদের ধারণা। হোক না তারা দেবতা কিন্তু তার আমাদের সহায় হতে পারে বলে আমাদের মনে করি। অর্থাৎ তারা কি সবাই  বেঁচে আছে ? বা তাদের পক্ষে কি কোন কার্য্য সম্পাদন করা সম্ভব ? কেউ কেউ বলে থাকেন,  আপেক্ষিকতা, কালের গতিকে রুদ্ধ করা, সময়ের কাছে নিজেকে  বেঁধে রাখা, আলোর গতিকে বুঝলে, আমরা আমাদেরকে অমর  করতে পারি।  
 আসলে আমরা সবাই বেঁচে থাকতে চাই, তা সে আমাদের   জীবনেে যতই   দুঃখ-কষ্ট  থাকুক না কেন। আর এই কারণেই আমরা হাজার হাজার বছর  যাবৎ সাধনা করতেও প্রস্তুত। যেকোনো মূল্য ধরে দিতে পারি - এজন্য। কিন্তু সত্য হচ্ছে, মৃত্যু যেমন অবশ্যম্ভাবী, তেমনি মৃত্যু আমাদের আবশ্যিক। মৃত্যু আমাদের যেমন নতুন শরীর দান করে থাকে, তেমনি জীবনের ধারাবাহিকতা  আমাদের জীবনকে সংস্কার করে থাকে এই মৃত্যু । 

আমরা  জানি, আমাদের এই শরীর অসংখ্য কোষের সমষ্টি। প্রতিদিন আমাদের শরীরের এক  থেকে দেড়  ভাগ কোষ মারা যায়। আর তার জায়গায় নতুন কোষের জন্ম হয়। এর মধ্যে কোনো কোষ স্বল্প সময় বাঁচে, কিছু কোষ কিছুদিন বাঁচে, কিছু কোষ কয়েক-মাস বা কয়েক বছর বাঁচে।  ৭ বছরের বেশী  আমাদের আমাদের শরীরে কোনো কোষই  বেঁচে থাকতে পারে না।  শৈশবে আমাদের শরীরের কোষের জন্মহার, কোষের মৃত্যু-হারের তুলনায় বেশী থাকে। আমাদের যখন ২৮ বছর বয়স হয়, তখন  এই মাত্রা সমান সমান হয়ে যায়। ৫৬ বছর পর থেকে কোষের মৃত্যুহার জন্ম হারের তুলনায় বেশি হতে শুরু করে থাকে। এতে করে আমাদের শরীর দিন দিন ক্ষীণ হতে থাকে। এই হিসেবে ধরলে  আমাদের গড় আয়ু হওয়া উচিত, ২৮*৩ = ৮৪ বছর। কিন্তু মানুষ এর আগেই মারা যেতে পারে আবার  ৮৪ বছর  পরেও বেঁচে থাকতে পারে, সেটি নির্ভর করে তার জীবনশৈলীর উপরে। আকস্মিক দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ইত্যাদি অস্বাভাবিক কারনে মৃত্যু এই নিয়মের মধ্যে পরে না। প্রত্যেক মানুষের বৃদ্ধি যেমন নির্ভর করছে, তার শরীরের কোষ বৃদ্ধির উপরে, তেমনি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নির্ভর করে, ভ্রূণ তৈরির উপরে। আমাদের শরীরের এই কোষ এক থেকে দেড়  ভাগ মারা যায় প্রতিদিন, আবার মোট জনসংখ্যার এক থেকে দেড়  ভাগ মারা যায়, প্রতিদিন। কিন্তু মৃত্যুর হার জন্মের  তুলনায় কম। তাই পৃথিবীতে জনসংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু পৃথিবীর আয়তন বা ওজনের কোনো হেরফের হচ্ছে বলে শোনা যায় না। 
আসলে কেউ আসছে, কেউ যাচ্ছে, অর্থাৎ পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় জন্ম-মৃত্যু চলছে, জীব ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে, নিকৃষ্টতর জীব-জন্তু ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে লোপ পাচ্ছে। এককালে যেমন ডাইনোসর পৃথিবীর উপরে দাপিয়ে বেরিয়েছে, আজ মানুষ পৃথিবীর দখল  নিয়েছে, ভবিষ্যতে এই পৃথিবী অন্য্ কোনো উন্নততর জীবের দখলে চলে যাবে।  এই ব্যাপারটা আমাদের নজরে আসে না। 
 জীব কেন জন্মায় এর বায়োলজিক্যাল ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হলেও, জীব সৃষ্টির কারন বিজ্ঞান এখনো দিতে পারে নি। বলা হয়ে থাকে পৃকৃতির মধ্যে বিবর্তনের যে  স্বাভাবিক ধর্ম্ম, সেই ধর্ম্ম অনুযায়ী  এই জীবনের সৃষ্ট করেছে।   অন্যদিকে মৃত্যুর বায়োলজিক্যাল ব্যাখ্যা দিতে পারলেও, কেনই বা আমাদের মৃত্যু হয়, কেনই বা জন্মের সময় নারী-পুরুষের একটা সমতা রক্ষা হয়, তার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান এখনো দিতে পারে নি।  আমাদের দর্শনশাস্ত্র এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে - অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা নিজেকে নিজের লীলাসংগী করবার জন্য, দ্বিধাবিভক্ত করে থাকেন নিজেকে । আমরা দেখেছি, অনু পরমাণু একটা নির্দিষ্ট আকারের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলে, আপনা থেকেই দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায়। এর কারন এখনো পাওয়া যায় নি।
বাইরের থেকে দেখলে জীবদেহকে একটা স্বয়ংক্রিয়  যন্ত্রের মতোই মনে হয়। জীব প্রকৃতি থেকে তার খাদ্য সংগ্রহ করছে, নিজেকে পরিপুষ্ট করছে, অপ্রয়োজনীয় পদার্থ শরীর  থেকে বের করে দিচ্ছে, বংশ বিস্তার করছে, এমনকি নিজের শরীরের ক্ষয়-ক্ষতি নিজেই মেরামত করে নিচ্ছে । এগুলো সে কেন করছে, তা কিন্তু বিজ্ঞান বলতে পারে না। আবার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য, নিজেই নিজের শরীরের মধ্যে সহনশক্তি বা নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে উন্নত করে নিচ্ছে। এই যে স্বাভাবিক ক্রিয়া, এটি সে নিজেকে টিকিয়ে রাখবার জন্য করে থাকে, কিন্তু কোথেকে এই শক্তি সে সংগ্রহ করে থাকে  সেই ব্যাখ্যা দেওয়া মুশকিল। আসলে পদার্থ ও শক্তির মিশ্রণ এই জীব সত্ত্বা। আর এই শক্তির আহরণ করে থাকে জীবকুল থেকেই। এ ছাড়াও চেতনশক্তি জীবের আরো একটি লক্ষণ। আর এই চেতন-শক্তিকে বলা হয়ে প্রতিফলিত শক্তি মাত্র।যেমন আমরা জানি,চাঁদের আলো, সূর্য্যের কিরণ মাত্র। সূর্য্যের  মূল শক্তির উৎস এখনো, বিজ্ঞান বের করতে পারে নি। সূর্য হিলিয়াম গ্যাসের সাহায্যে উজ্জীবিত থাকে, কিন্তু এই অফুরন্ত হিলিয়াম গ্যাস কে যোগাচ্ছে, বা কোথা থেকে আসছে, সেই ব্যাখ্যা এখনো পাওয়া যায় নি। 

উন্নততর জীবের মননশীলতা আছে, যা ব্যাকটেরিয়া বা অনুন্নত জীবের নেই।  জীবের ক্ষুদ্র একক কোষ হচ্ছে জীবকোষ। এই কোষের মধ্যে আছে, প্রোটোপ্লাজম।  প্রোটোপ্লাজম-এর মধ্যে আছে প্লাস্টিড, মাইটো-কনড্রিয়া । এই কোষ সর্বদা সঞ্চরণশীল। কিন্তু জীব যখন প্রাণহীন হয়, তখন এই সব কোষ চলনশক্তি রোহিত হয়ে যায়। কিন্তু এর রঙের পরিবর্তন হতে থাকে। ধীরে ধীরে তামাটে রঙ ধারণ করে থাকে।  এ এক অদ্ভুত খেলা। মৃত শরীরে নতুন কোষের জন্ম হতে পারে না, অথচ  ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হতে থাকে। 

কোষগুলো তৈরী হয় কতকগুলো মৌলিক পদার্থের সংমিশ্রনে - যেমন কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, ফসফরাস, গন্ধক, পটাশিয়াম, নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম ম্যাগনেশিয়াম, লোহা, এছাড়াও থাকে বোরন-মলিবডেনাম, তামা, দস্তা, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি। এই সব মৌলিক বস্তুর মিশ্রনে একটা নতুন গুনের উৎপন্ন হয়, জেক বলে জীবনীশক্তি। কোষের কেন্দ্রে আছে নিউক্লিয়াস। এই নিউক্লিয়াস হচ্ছে কোষের নিয়ন্ত্রক শক্তি বা বলা যেতে পারে মস্তিস্ক। এই অসংখ্য কোষের সম্মিলিত শক্তি নির্ধারণ করে থাকে পরবর্তী জীবের আকার বা বৈশিষ্ঠ। এদের স্মৃতি ধারণ করবার ক্ষমতা আছে। মানুষের স্মৃতির বৈজ্ঞানিক বিশ্লষন  করতে গিয়ে  পাওয়া গেছে গেছে DNA (deoxy-ribo-nucleic acid) এবং RNA.ribo-nucleic acid.

DNA -   (deoxy-ribo-nucleic acid) - তৈরী হয়, রাইবোস শর্করা, পিউরিন, পাইরিমিডিন ও ফসফেট দিয়ে। এই ডিএনএ আমাদের স্মৃতি ধারণ করে থাকে, এমনকি পূর্বজীবনের স্মৃতি ধারণ করে থাকে।  অর্থাৎ জীবের পূর্ব-জীবন সম্পর্কে ধারণা  করতে হলে আমাদের এই ডিএনএ পরীক্ষা করতে হয়।

ডিএনএ-অনু বিশেষ এনজাইমের সাহায্যে তৈরী হয় RNA .আরএনএ অনু জীবের নির্দেশ বহন করে থাকে। আমার এই DNA অর্ধেক পাই পিতার দেহ থেকে বাকি অর্ধেক পাই মাতার দেহ থেকে। আমরা সবাই এই জীন বাহিত বলে, আমরা মাতা-পিতার মতো সমস্ত  গুন্-স্মৃতি ইত্যাদির বাহক হয়ে থাকি ।  মানুষের মৃত্যুর পরেও তার সন্তানদের দেহে এই জিনের দেখা মেলে। দেহ থেকে দেহান্তরে এই জীন হাজার হাজার বছর ধরে  প্রবাহিত হয়ে চলেছে। তাই বলা হয়ে থাকে জীবের মৃত্যু হয়, ব্যক্তির মৃত্যু হয়, কিন্তু তার জন্মগত কোনো গুণাবলীর বা স্বভাবের পরিবর্তন হয় না। এ এক আশ্চর্য্য কৌশল।আমরা যেমন আমাদের ছেলে-মেয়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের অপূর্ন আশা পূরণ করতে চাই, তেমনি আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের মধ্যেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি। 

তো এই কোষের জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে যত সময়ের পার্থক্য ঘটতে থাকে, তত জীবের বেড়ে ওঠা ও মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবার ঘটনা নিরন্তর ঘটতে থাকে। জীবন সৃষ্টির প্রক্রিয়া যেমন জটিল জীবের মৃত্যু প্রক্রিয়া তেমনি আরো জটিল। জীবের উন্নতি বিধানের জন্য, মৃত্যুর প্রয়োজন।  জীবনের বেঁচে থাকবার জন্য অন্য জীবের  মৃত্যু আবশ্যিক। আমরা ভাবি মৃত্যু মানে জীবের ধংশ।  ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়, মৃত্যু জীবনকে উন্নত করবার একটা প্রক্রিয়া বিশেষ। মৃত্যু একটা আশ্চার্য্য কারিগরি বিদ্যা যা কোনো অদৃশ্য শক্তি পরিচালনা করে থাকেন। আমাদের মৃত্যু আসে নানান রোগের কাঁধে চেপে। এই রোগ প্রতিহত করবার জন্যও আমাদের শরীরে এন্টিবডি আছে, যাকে  আমরা বলে থাকি প্রত্যক্রমন শক্তি বা ইমিউনিটি। জীবন এক অদ্ভুত রহস্যঃ।  এই নিয়ে আমরা পরবর্তীতে আবার  আলোচনা করবো। আজ এই পর্যন্ত। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম। 



-----------

এয়ারপোর্ট ১ নং থেকে হলদিরাম।  হলদিরাম থেকে বাঁ-দিকে চার্নক হাসপাতাল ছুঁয়ে সোজা চিনারপার্ক হয়ে এক্কেবারে নারকেলবাগান (রবীন্দ্র তীর্থ)। সেখান থেকে ডানদিকে (অর্থাৎ সল্টলেকের দিকে) নারকেলবাগানের পরবর্তী বাস-স্টপেজ প্রাইড হোটেল বা বিকেক তীর্থ। এবার আবার ডানদিকে প্রাইড হোটেলের পাশ দিয়ে রাস্তা। প্রাইড হোটেলের নিচে দেখবেন, স্টেট ব্যাঙ্ক, বন্ধন ব্যাংক। এর পরে একটা রাস্তা বাঁ-দিকে গেছে।  সেটি ছেড়ে দিন।  পরের বাঁ-দিকের রাস্তার নং ৯৯। এই রাস্তায় ঢুকুন চারটি  বাড়ি বাদ  দিয়ে পঞ্চম  বাড়ি।  বাড়ির নং BA - ৬৮, (বাড়ির সামনে লেখা আছে) রাস্তার  নং. ৯৯, সেক্টর (এরিয়া) -এক,  কলকাতা - ১৫৬. প্রাইড হোটেল থেকে ১-২ মিনিট হাটা রাস্তা। 
আমার ( বিনয় রায় )-ফোন নং .  ৯৮৩০৫৪২১৮৫। 
--
--
----------------------

মৃত্যু রহস্যঃ - ৪  প্রাণহীন দেহে প্রাণের সঞ্চার। 
       
যেকোনো ঘটনা ঘটলে, সম্পৃক্ত  অসংখ্য সম্ভাব্য ঘটনার  জন্ম হতে পারে । এর মধ্যে কোনটা বাস্তবায়িত  হবে আর কোনটা বাস্তবায়িত হবে না।   আর এটা নির্ভর করছে পরিস্থিতি পরিবেশের উপরে। ধরুন আপনি তীর্থ করতে বেরুলেন। হ্যাঁ আপনি সবকিছু ঠিকঠাক করেই বেরুলেন ।  কোথা থেকে কোথায় যাবেন, সেখানে কয়দিন থাকবেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ঘটনা বহু সম্ভাবনার জন্ম দেয়।  তীর্থ করে আপনি ভালোভাবে নির্দিষ্ট দিনে বাড়ি ফিরে আসতে  পারেন। বা আগে-পরে বাড়ি ফিরতে পারেন । আবার দেখা গেলো, আপনি সেখানে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এমনকি আপনি মারাও যেতে পারেন। হয়তো,  সেখানে আপনার সাথে কোনো ঋষি মহাপুরুষের সাক্ষাৎ হতে পারে। আপনার মনের একটা পরিবর্তন হতে পারে। আপনি একটা নতুন জীবন পেতে পারেন। ইত্যাদি ইত্যাদি।   তো তীর্থ করতে গিয়ে কি হতে পারে, তা আপনি জানেন না, আবার বলা যেতে পারে, আপনি কিন্তু একটা বা একাধিক  নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই আপনি তীর্থের পথে পা বাড়িয়েছেন । ঠিক তেমনি, আমরা যখন জন্ম গ্রহণ করি, তখন কিঁছু সংকল্প /বাসনা নিয়ে আমরা জন্ম গ্রহণ করে থাকি, বা দেহ ধারণ করে থাকি।  কিন্তু আমার জন্ম-নেবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আরো   বহু সম্ভাবনার  জন্ম দিয়ে থাকি। অর্থাৎ যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই, যে  জন্ম গ্রহণ করা  আমাদের ইচ্ছাধীন, তথাপি একথা সত্য, যে জন্ম গ্রহণ করবার পরে, আমাদের জীবনে অনেক কিছুই ঘটতে  পারে। যা আসলে সম্ভাবনা মাত্র।  আপনি জীবনে তথাকথিত প্রতিষ্ঠা পেতে পারেন, আবার নাও পেতে পারেন ।  আপনি দীর্ঘজিবি হতে পারেন, আবার নাও হতে পারেন। তো কি-কি হতে পারে তা আমাদের অজানা থাকলেও, অনেক কিছুই হতে পারে, সেটি সত্য। আবার এই সম্ভাবনাগুলো যেমন  আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে হতে পারে আবার  আমাদের আয়াত্ত্বাধীন হতে পারে , এইসবই  ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা মাত্র । এই কথাগুলো বুঝতে আমাদের কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। ঠিক তেমনি আমরা যখন দেহান্তরের জন্য, দেহ থেকে বেরিয়ে পড়ি, অর্থাৎ আমাদের যখন মৃত্যু হয়, তখন অসংখ্য সম্ভাব্য ঘটনার জন্ম হতে পারে।  সেগুলো আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করবো। 

যাক হোক, এই জায়গা থেকে আমরা একটা শিক্ষা নিতে পারি, বা একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে সামনেও আমার অসীম সম্ভাবনা আছে । এবার,  এই অসীম সম্ভাবনাগুলো সম্পর্কে আমাদের যদি একটা ধারণা  থাকে, একটা জ্ঞান থাকে, তবে আমরা আগে থেকে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। যেমন যেখানে আপনি তীর্থ করতে যাচ্ছেন, সেখানে আপনি কোথায় থাকবেন, তার জন্য আগে থেকেই হোটেল বুকিং করতে রাখতে পারেন। কতদিন থাকবেন, তার জন্য কত টাকা লাগতে পারে, তার ব্যবস্থা আগে থেকে করে নিতে পারেন।সেখানকার জলবায়ু সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে, একটা ছাতা বা শীতবস্ত্রের ব্যবস্থা রাখতে পারেন ইত্যাদি ইত্যাদি।  এতে করে আপনার যাত্রাকালীন সম্ভাব্য অসুবিধাগুলো, যা ঘটতেও পারে, আবার নাও ঘটতে পারে, সেগুলো  দূর হতে পারে। এছাড়া অনেক ভ্রমন সংস্থা আছে, তাদের সাথে যদি আপনি তীর্থযাত্রায় বেড়োন, তবে, তারা আপনার অনেক ঝামেলা সামলানোর দায়িত্ব নিয়ে নেবে। এরা  যেহেতু বারবার সেখানে গিয়েছে, তো সেখানকার সম্পর্কে তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে।  কোথায় ডাক্তার পাওয়া যেতে পারে। কোথায় বাজারঘাট আছে। কোথায় কি পাওয়া যায়।  এমনকি কোথায় ভালো-জাগ্রত মন্দির আছে, সে সম্পর্কেও তাদের কাছে, একটা পূর্ব ধারণা আছে। তো ভ্রমন সংস্থা,  আপনাকে সাময়িক হলেও একটা নিরাপদ যাত্রার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনি অজানা জায়গায় গিয়েও নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। পূর্ব পরিকল্পনা মতো ভ্রমন শেষ করে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে আসতে পারেন।

আমাদের এই জীবনপথে যাত্রা, যা আমাদের দেহ ধারনের মুহূর্ত থেকে শুরু হয়েছে, সেখানেও বহু সম্ভাবনার বিষয় আছে। জীবন হচ্ছে, অসীম সম্ভাবনার ক্ষেত্র। এখানে যেমন  মিলন আর বিচ্ছেদের খেলা, কেউ আসে কেউ যায়। আবার জীবন আমাদের আত্মিক উন্নতির অনেক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়।   আসা-যাওয়া নিয়মে বাঁধা, তেমনি আমাদের আত্মিক উন্নতিও নিয়মে বাঁধা ।  কিন্তু সেই নিয়ম আমাদের জানা নেই। কেনই বা আসি, কেনই বা যাই।  কখন আসি আর কখন আমাদের চলে যেতে হয়। এ সম্পর্কে আমাদের কোনো পরিষ্কার ধারণা  নেই। আবার ও ঠিক কিছু কিছু নিয়ম আমাদের জানা আছে। কবে মারা যাবো তা আমরা জানি না। কিন্তু এটা জানি আমাদের একদিন মরতেই হবে, এবং সেটা ৮০ থেকে ১০০ বছরের বেশি না হবার সম্ভাবনা। আমরা জানি, শরীর  থাকলে রোগভোগ থাকবে,  কিন্তু এটা জানি না কবে কিভাবে কোন রোগের  প্রকোপে আমাদের পড়তে হবে। শেষ জীবন আমার কেমন হবে, তা আমরা জানি না । এসবই আমাদের কাছে ধোঁয়া ধোঁয়া একটা অস্পষ্ট ধারণা মাত্র। নির্দিষ্ট করে আমাদের পক্ষে কিছুই বলা সম্ভব নয়। 

আমরা সবাই জানি, জীবন হচ্ছে শ্বাসের খেলা বা প্রাণশক্তির খেলা। প্রাণশক্তি যখন স্পন্দিত হয়, তখন সে গতি লাভ করে থাকে। এই প্রাণশক্তিকে উপনিষদ বলছে ব্রহ্ম। প্রাণশক্তির এই গতিশীল স্পন্দন বহির্জগতে তাপ, আলো,  মহাকর্ষ, তড়িৎ, এমনকি জল-মৃত্তিকা সৃষ্টির কারন। এদের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে, উৎপন্ন হয় পঞ্চভূত।  পঞ্চভূতের মিশ্রনের তারতম্য অনুযায়ী জন্ম হয়  বিভিন্ন আকারের বস্তু যা ধীরে ধীরে রূপান্তর হতে হতে তৈরি হয়  প্রাণীদেহ। এরা সবাই সেই প্রাণশক্তির নিয়মের অধীনে কাজ করে থাকে। এমনকি আমাদের অন্তর্জগতে যে ক্রিয়া চলছে, তা সবই এই প্রাণশক্তির ক্রিয়া, যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে চৈতন্য শক্তি ।

অর্থাৎ বিশ্বের উৎপত্তি হচ্ছে প্রাণশক্তি থেকে। যাকে  উপনিষদ বলছে ব্রহ্ম। কেউ বলছেন পরমাত্মা। কেউ কেউ অবশ্য এই প্রাণশক্তির উপরে পরব্রহ্মের কথা বলেছেন। আমরা সেই আলোচনায় যাবো না। যাইহোক,  এই প্রাণশক্তি থেকে প্রথমে উৎপন্ন হয়, আকাশ।  আকাশের মধ্যে উৎপন্ন হলো ঈথার । ঈথার সম্পর্কে বিশেষ কিছু এখনো জানা নেই, তবে অনুমান করা হয়, ঈথার  মহাশূন্য পরিব্যাপ্ত অতিসুক্ষ পদার্থ বিশেষ। অর্থাৎ আকাশের যেমন সীমা  পরিসীমা নেই, তেমনি এই ঈথারের কোনো সীমা পরিসীমা নেই।  এমনকি পরিমাপ করা সম্ভব নয়। বলা হয়ে থাকে, ঈথার আকাশকে পূরণ করে রাখে। অর্থাৎ আকাশকে ধরে রেখেছে, এক চিরন্তন-বিশ্বশক্তি (পরব্রহ্ম)। আর আকাশ ধরে রেখেছে ঈথারকে অর্থাৎ সূক্ষাতিসূক্ষ পদার্থ বিশেষকে। প্রাণশক্তি বা বিশ্বশক্তি বা ব্রহ্ম যখন এই পরমাণুর মধ্যে স্পন্দন সৃষ্টি করছেন, তখন পরমাণুগুলো একে অপরকে আকৃষ্ট করছে, এবং গঠিত হচ্ছে অনু। আবার অণুগুলোর মধ্যে আকর্ষণ বিকর্ষনের ফলে তৈরী হয়েছে পঞ্চভূত। ক্ষিতি,অপ,তেজ,মরুৎ ব্যোম। সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে, শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ নামক গুনগুলোর। 

 আমাদের মনে হতে পারে, এই ক্রিয়া প্রাকৃতিকভাবেই সংগঠিত হচ্ছে, কিন্তু সত্য হচ্ছে একটা বৃহৎশক্তি একে পরিচালনা করছে। এই বৃহৎ শক্তিই হচ্ছে প্রাণ শক্তি, বা ব্রহ্ম, আর উপরে আছেন, পরব্রহ্ম । দেখুন জড় বস্তুর মধ্যে উত্তাপ, বিদ্যুৎ, আকর্ষণ-বিকর্ষণ, এমনি নানান শক্তি অবশ্যই  আছে। কিন্তু এর মুলে আছে, প্রাণশক্তি। আমরা উপনিষদে দেখেছি, সমস্ত ইন্দ্রিয়ের রাজা হচ্ছে প্রাণ।  এমনকি মনেরও  রাজা হচ্ছে প্রাণশক্তি। আমাদের দেহের যে স্বয়ংক্রিয় তন্ত্র অর্থাৎ হজম করা, স্বাস-প্রশ্বাস, অপ্রোজনীয় খাদ্যাবশেষ বের করে দেওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি যা কিছু স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা আছে, সেই সব ক্রিয়া পরিচালনা করে থাকে প্রাণশক্তি। প্রাণশক্তি না চাইলে আমাদের দেহরূপ জড়বস্তু কোনো ক্রিয়াই  করতে সক্ষম হয় না। আমাদের দেহে যখন প্রাণশক্তি ক্রিয়াশীল না থাকে তখন আমাদের এই জীবদেহ মৃতদেহ বা নিষ্প্রাণবস্তু বই কিছু নয়। কিন্তু আবার এটাও সত্য যে সমস্ত ভৌতিক বা অভৌতিক সমস্ত বস্তুর মধ্যেই এই শক্তি অবশ্য়ই সদা বিদ্যমান। 

আগেই বলেছি, উপনিষদ এই প্রাণশক্তিকে বলছে ব্রহ্ম । আবার এই ব্রহ্মের মধ্যেই প্রাণশক্তি ও চৈতন্য শক্তি অভিন্ন। প্রাণহীন চৈতন্য যেমন হয় না, তেমনি প্রাণের মধ্যেই চৈতন্য ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আবার বুদ্ধির প্রকাশ দেখলেই বুঝতে হবে সেখানে প্রাণ বিদ্যমান। জগতে প্রাণহীন বলে কোনো বস্তু হয় না। সমস্ত বিশ্বই প্রাণময়। এমনকি আমাদের মৃতদেহের মধ্যেও প্রাণের উপস্থিতি আছে। অনু-পরমাণুর মধ্যেও প্রানের অস্তিত্ত্ব আছে। প্রাণ আমাদেরকে গতিশীল করে রেখেছে। এখন কথা হচ্ছে মৃত দেহের মধ্যে যদি প্রাণ থাকে তবে, আমাদের এই মৃতদেহকে প্রাণহীন বলা হয় কেন ? আর আমরা গতিশীল থাকতে পারি না কেন ? আসলে অজৈব বস্তুতে প্রাণের প্রকাশ রুদ্ধ হয়ে থাকে। প্রাণের স্পন্দন সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই তাকে আমার মৃত বা জড় বস্তু বলে থাকি। এর পরের দিন আমরা আলোচনা শুনবো, প্রাণ কিভাবে ও কখন আমাদের মধ্যে প্রবেশ করে গতিশীল হয়, আবার কোথায় কিভাবে প্রাণের প্রকাশ রুদ্ধ হয়ে যায়। আবার পুনরায় কোথায় কিভাবে ধীরে ধীরে আমরা প্রাণের প্রকাশকে গতিশীল হতে দেখতে পারি। আসলে জীবন মৃত্যু  একটা অসীম  সম্ভাবনা - এখানে যাকিছু হতে পারে। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।   হরি ওম। 

মৃত্যু রহস্যঃ : ৫ : অমর মৃত্যুকথা । 

এক স্বামীজী একসময় আমাকে একটা বিষ্ময়কর  কথা বলেছিলেন।  বলছেন, মানুষ এমনকি সমস্ত জীবজন্তু  লড়াই করে বেঁচে থাকবার জন্য।  আর সন্যাসী-সাধকগণ লড়াই করেন  মৃত্যুর  জন্য। জীবজগৎ মৃত্যুকে ভয় পায়, আর যোগী-সান্যাসীগণ  সেই মৃত্যুর দেবতার সঙ্গে আলিঙ্গন করবার জন্য আকুলিত হয়। তুমি যদি যোগীদের যোগক্রিয়া সম্পর্কে অনুসন্ধান করো তাহলে দেখতে পাবে, তাঁরা প্রাণশক্তিকে রুদ্ধ করবার চেষ্টা করছে।  আর এটা সবাই জানে, প্রাণশক্তিকে রুদ্ধ করা মানে মৃত্যুকে ডেকে আনা। তো যোগক্রিয়া হচ্ছে, মৃত্যুকে ডেকে আনার একটা প্রক্রিয়া মাত্র। আসলে সমাধির অর্থই হচ্ছে, প্রাণশক্তির গতিকে ধীর করা। আর কৈবল্য হচ্ছে, প্রাণশক্তির গতিকে রুদ্ধ করা। তাই  কৈবল্য  অবস্থায়, মানুষ শরীর  ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ আত্মা বা চৈতন্য-শক্তি শরীর  ছেড়ে অনন্তে আশ্রয় নেয়।

আজ আমরা কিছু যোগীপুরুষের মৃত্যুকালীন অবস্থা সম্পর্কে শুনবো। আসলে মৃত্যু মানে তো ধংশ নয়, মৃত্যু মানে, পরিবর্তন মাত্র। স্বামী বিবেকানন্দ যেদিন দেহত্যাগ করেন, সেই ৪-জুলাই, ১৯০২ শুক্রবার (বাংলা ২০ আষাঢ় ১৩০৯ সাল ) স্বামীজী দুপুর ১১ তা নাগাদ, স্বামী শুদ্ধানন্দ শুক্ল-যজুর্বেদ থেকে একটা মন্ত্র ও তার অর্থ পাঠ  শুনেছিলেন : 
মন্ত্রটি হচ্ছে : সুষুম্নঃ সূর্য্যরশ্মি-চন্দ্রমা গন্ধর্বস্তস্য নক্ষত্রান্যপ্সরসো ভেকুরয়ো নাম। 
স ন ইদং ব্রহ্মক্ষত্ৰং পাতু তস্মৈ স্বাহা বাট্ তাভ্যঃ স্বাহা। 
হরফ প্রকাশণী গ্রন্থে এর অর্থ লেখা আছে,  "যজ্ঞের দ্বারা সুখপ্রদ, সূর্য্যের কিরণতুল্য চন্দ্রমা রূপ গন্ধর্ব ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় আমাদের রক্ষা করুন। স্বাহা ও বষট্ মন্ত্রে তাকে আহুতি  দিচ্ছি। তার কান্তি বিকিরণকারী নক্ষত্র নামে অপ্সরা আছে, তাকে স্বাহা মন্ত্রে আহুতি দিচ্ছি।" 
জানিনা এই অর্থ তিনি শুনেছিলেন কি না, তবে, যাই তিনি শুনেছিলেন, সেই  অর্থ শুনে স্বামীজী বলেছিলেন, এই ব্যাখ্যা  আমার মনে লাগছে না। ভাষ্যকার সুষুম্না পথের  যে ব্যাখ্যাই সেকালে করুন না কেন, পরবর্তীকালে তন্ত্রাদিতে দেহ-অভ্যন্তরস্থ সুষুম্না নাড়ী বলে যা উক্ত হয়েছে, তারই বীজ এই বৈদিক মন্ত্রে নিহিত রয়েছে।"
এই মন্ত্রে,  আসলে যজ্ঞ বলতে বোঝায়, যোগক্রিয়া। এই যোগক্রিয়া দ্বারা আমাদের শরীরে সূর্য্যের কিরণ তুল্য তেজ সংগঠিত হয়, চন্দ্রমা অর্থাৎ চাঁদের যে জ্যোৎস্না সেই স্নিগ্ধতা ভরপুর হয়ে ওঠে শরীর। বিশ্বশক্তি আমাদের সবার শরীরে সুষুম্না নাড়িকে  আশ্রয় করে থাকে। সকলের মস্তিষ্কের মধ্যস্থলের  ঠিক উপরিভাগে, বিন্দু বা রবি কল্পিত হয়,  হৃদয় অন্তরীক্ষ রূপে কল্পিত হয়, স্বর্গলোক আমাদের মস্তক, ভূলোক আমাদের পা। শরীরস্থিত  জলে অবস্থান করে থাকে আমাদের প্রাণবায়ু বা আয়ু। যা শরীর ছাড়ার পরে সূক্ষাতি-সূক্ষ্ম অবস্থায়,বায়ুকে আশ্রয় করে থাকে। এই আহুতি আসলে যোগক্রিয়া। যোগ বলতে আমরা বুঝি  বায়ুর ক্রিয়া - বায়ুকে শরীরের মধ্যে ইচ্ছেমতো পরিচালনা করা। বায়ুকে বিভিন্ন নাড়ীর মধ্যে সঞ্চালন করা।  আর এর  ফলেই উজ্জীবিত হয়, বা প্রকাশ পায় বায়ুর বিভিন্ন গুন্।  
আসলে আমরা আলোচনা করছিলাম মৃত্যু নিয়ে। দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়া মানে মৃত্যু,  অথবা শরীরের মধ্যে প্রাণের প্রবেশর  অর্থ জন্ম।   এই প্রসঙ্গে,  দুই একজন মহাত্মার মৃত্যুকালীন অবস্থা দেখে নেবো।  স্বামী বিবেকানন্দের দেহত্যাগের প্রক্রিয়া সম্পর্কে শুনে নেবো। তার আগে একটা কথা বলি, আপনারা শুনে থাকবেন, ঠাকুর রামকৃষ্ণ মৃত্যুর আগে পঞ্জিকা পড়ে শোনাতে বলতেন। স্বামীজীও মৃত্যুর আগে পঞ্জিকা নাড়াচড়া করতেন। আসলে শুভক্ষণ-এর অপেক্ষা করতেন  আমরা মহাত্মা ভীষ্মকেও দেখেছি, শরশয্যায় অসীম শারীরিক যন্ত্রনা সহ্য করেও তিনি উত্তরায়ণের অপেক্ষায় নিজের শরীরে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অর্থাৎ একটা বিশেষ ক্ষনে তাঁরা দেহ ছেড়ে অনন্তে যাত্রা করতে চান। 
যাই হোক, স্বামীজীর দেহান্তর প্রক্রিয়া কিভাবে সংগঠিত হয়েছিল, সেটা আমরা একবার শুনে নেবো। সন্ধ্যা ৭টা বাজে।  বেলুড় মঠে তখন সন্ধ্যারতির ঘন্টা বেজেছে। স্বামীজী নিজের ঘরে গঙ্গারদিকে মুখ করে বসলেন  অর্থাৎ পূর্ব দিকে মুখ করে বসলেন। ব্রজেন্দ্র নামে এক অল্প-বয়সী সন্যাসী যে তার মৃত্যুকালীন একমাত্র সাক্ষী ছিল, তাকে বাইরে বসে ধ্যান করতে আদেশ দিলেন । নিজে জপের মালা হাতে নিয়ে ধ্যানে বসলেন ঘরের মধ্যে । একঘন্টা পরে, অর্থাৎ ৮টা  নাগাদ স্বামীজী ব্রজেন্দ্রকে ডেকে বাতাস করতে বললেন। স্বামীজীর ভীষণ গরম বোধ হতে লাগলো। দরজা-জানলা খুলে দিতে বলে শুয়ে পড়লেন।  হাতে জপের মালা। ব্রজেন্দ্রকে পা  টিপে দিতে বললেন। এইভাবে প্রায় একঘন্টা কেটে গেলে, স্বামীজী  ডান দিকে কাত হয়ে শুলেন।  স্বামীজীর মুখ দিয়ে বাচ্চার কান্নার মতো অস্পষ্ট ধ্বনি বেরিয়ে এলো।  রাত ন'টার  কাছাকাছি, তার ডানহাত কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগলো। সঙ্গে গভীর নিশ্বাস ছাড়লেন। মাথা  বালিশ থেকে গড়িয়ে গেলো। দুই এক-মিনিট পরে, তিনি আরো একবার গভীর নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর সব স্থির হয়ে গেলো।  এখন রাত্রি ৯টা বেজে দশ মিনিট। ডাক্তাররা কেউ বললেন, সন্যাস রোগে মারা গেছেন, কেউ বললেন, মাথার শিরা ছিড়ে  গেছে, আবার কেউ বললেন হৃৎক্রিয়া বন্ধ হওয়াই  মৃত্যুর কারন। ভক্তগন বুঝলেন, স্বামীজী যোগ-অবলম্বনে, সমাধিমার্গে দেহত্যাগ করেছেন। 
আমরা জানি, মহামতি ভীষ্ম শরশয্যায় থাকাকালীন দেহ ত্যাগ করেছিলেন। এই অবস্থাতেই, তিনি তার প্রিয়জনদের সাথে বিভিন্ন প্রসঙ্গে উপদেশের কথা শুনিয়েছিলেন। মৃত্যুর ঠিক আগে, ভীষ্ম প্রথমে মৌনতা অবলম্বন করলেন। মূলাধারে চিত্তকে সন্নিবেশিত করে যোগ অবলম্বন করলেন। এর পর তিনি অন্তর-কুম্ভক করলেন। বায়ুকে নিরুদ্ধ করার ফলে প্রাণবায়ু নিরুদ্ধ হলো। এরপর বায়ু উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হলো। এবার যে যে অঙ্গ পরিত্যাগ করে বায়ু ক্রমশ উর্দ্ধে উঠতে হতে লাগলো, তাঁর সেই সেই অঙ্গ শরশুন্য অর্থাৎ অগ্নিরোহিত হলো ও বর্নরহিত (ব্রনরহিত) অর্থাৎ চৈতন্যহীন হতে আরম্ভ হলো। সামনে ছিলেন, ব্যাসদেব, অন্যান্য মহর্ষিগন, পান্ডবগন ও স্বয়ং বাসুদেব। কিছুক্ষনের মধ্যেই ভীষ্মের গাত্র থেকে সমস্ত শর-ব্রণো উপনীত হলো, এবং প্রাণবায়ু ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে উল্কার ন্যায় আকাশপথে উত্থিত হলো। ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে আকাশে উত্থিত তেজোরাশি সবার সামনে বিলীন হয়ে গেলো। - মহাভারত - অনুশাসন পর্ব্ব।
যাইহোক, এর আগে আমরা একটা মন্ত্রের কথা শুনেছি । পরে দুইজন মহাত্মার মৃত্যু কালীন অবস্থার কথা শুনলাম। আসলে মৃত্যু হচ্ছে প্রাণবায়ু রুদ্ধ হওয়া। এটা স্বেচ্ছাকৃত হতে পারে, আবার অনিচ্ছাকৃত হতে পারে। আমাদের মতো মানুষ হয়তো অনিচ্ছাকৃত ভাবেই প্রাণবায়ু ত্যাগ করে থাকে। কিন্তু যোগীমহাত্মাগণ ইচ্ছাকৃত ভাবেই প্রাণবায়ু ত্যাগ করে থাকেন। স্বামীজী মৃত্যুর ৫ বছর আগে থেকেই মৃত্যুর কথা বলতেন। শুধু মহাত্মাগণ নন, আমরা সবাই মৃত্যুর আগে, নিজের মনে একটা সারা পেতে থাকি। কেউ সেটা বুঝি কেউ সেটাকে উপেক্ষা করে থাকি।
প্রশ্ন (৩/৭) উপনিষদ বলছে, যদি কোনো মানুষ পুণ্যকর্ম করে থাকে, তবে মৃত্যুকালে উদ্যান বায়ু তাকে সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে দিয়ে পুন্য লোকে নিয়ে যায়। অর্থাৎ মৃত্যুকালীন সময়ে উদান বায়ুর একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। (৩/১০) মৃত্যুকালে, জীবাত্মা প্রাণে প্রবেশ করে। সঙ্গে থাকে মন এবং সেই সময়কার মনের চিন্তা ও বাসনা। প্রাণ তখন অগ্নি অর্থাৎ উদান বায়ুর সঙ্গে যুক্ত হয়। কেননা উদানই তাকে দেহের বাইরে নিয়ে যায়।
যাইহোক এতো গেলো মহাত্মাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর কথা। কিন্তু মৃত্যুর পরে, আবার দেহে প্রাণের স্পন্দন যে পুনরায় হতে পারে, সেই সম্পর্কে আমরা আরো দুটো গল্প শুনবো, আচার্য্য শংকরের জীবনী (আচার্য শংকর- স্বামী অপূর্বানন্দ পৃ-১০০ এবং পৃ - ৮৪) থেকে। আচার্য শংকর তখন মুকাম্বিকা তীর্থে, অম্বিকাদেবীর মন্দির অভিমুখে চলেছেন। যেতে যেতে রাস্তার মধ্যে, শংকর দেখতে পেলেন, এক দ্বিজদম্পতি মৃতপুত্র কোলে নিয়ে কান্নাকাটি করছেন। তাদের এই ক্রন্দনধ্বনি আচার্যের প্রাণস্পর্শ করলো। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে গেলেন। আর দম্পতি তার মৃত সন্তানকে শঙ্করের চরণতলে রেখে মৃতপুত্রের প্রাণভিক্ষা করতে লাগলেন। শঙ্কর চুপচাপ দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে, ভগবতীর স্তব করতে লাগলেন। কিছুক্ষন পরে, সহসা শিশুদেহে প্রাণের স্পন্দন ফিরে এলো। সবাই আশ্চর্য্য হয়ে শংকরের পদধূলি নিতে লাগলো।
জানিনা এসব গল্প কাহিনী কি না। তবে একটা কথা বলা যেতে পারে, যোগীপুরুষ যোগক্রিয়ার সাহায্যে অনেক বিভূতির অধিকারী হতে পারেন। যা আমরা পতঞ্জলির বিভূতিযোগে দেখতে পাই। তাই লৌকিক দৃষ্টিতে যা অলৌকিক তা যোগীর ইচ্ছাশক্তিতে বাস্তব হতে পারে। আসলে বিশ্বশক্তির ইচ্ছে আর যোগীগণের ইচ্ছের মধ্যে তখন আর ফারাক থাকে না।
এবার একটু অন্য স্বাদের গল্প শুনবো, যেখানে প্রাণ বেরিয়ে যাবার পরে পুনরায় সেই দেহে ফিরে এসেছে, যেখানে অন্য কোনো মহাপুরুষের কৃপা ছিল না। আচার্য শংকরের কাছে, ধর্ম্ম প্রচারের একটা উপায় ছিল, ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের তর্কযুদ্ধে পরাজিত করা। আর তাঁকে এবং তার শিষ্যদের নিজের সম্প্রদায়ভূত করা। তো পণ্ডিত মণ্ডন মিশ্রকে পরাজিত করে, তর্কের শর্ত অনুযায়ী তাকে দীক্ষিত করা কালীন, এক অভূতপূর্ব সমস্যার মধ্যে পড়লেন শংকর। মণ্ডন মিশ্রের স্ত্রী উভয়ভারতী বাধা দিলেন। বললেন,"আত্মনোঽর্ধং পত্নী" - আমি তার পত্নী, আমাকে জয় করে তবে, আমার স্বামীকে শিষ্য করুন। এইধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য শংকর প্রস্তুত ছিলেন না। আর নারীর সঙ্গে শাস্ত্রীয় বাতবিতণ্ডায় তিনি নিজেকে জড়াতে চাইলেন না। আসলে নারীকে তিনি তার উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ভাবতেই পারতেন না। তো উমাভারতী ছাড়বার পাত্র নয় - বললেন, ঋষি যাজ্ঞবল্ক গার্গীর সঙ্গে শাস্ত্রীয় বিচারে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। রাজা জনক সুলভার সঙ্গে বিচারে লিপ্ত হয়েছিলেন, তো আপনি কেন আমার সঙ্গে শাস্ত্রীয় বিচারে অনিচ্ছা প্রকাশ করছেন ? তাই যদি হয়, তবে আমার স্বামী যার অর্ধাঙ্গিনী আমি স্বয়ং, তাকে আপনার শিষ্যত্ব গ্রহণের অনুমতি আমি দিচ্ছি না। তো উভয়ভারতী - ছিলেন বিদুষী মহিলা, যার জন্য তাকে বলা হতো সরস্বতীদেবী। তো শংকর বাধ্য হয়ে নিমরাজি হলেন। কিন্তু সরস্বতীদেবী কয়েকটা সূক্ষ্মতর প্রশ্নের ভিতরে প্রবেশ করেই বুঝলেন, শঙ্কর সমস্ত শাস্ত্রে পারঙ্গম। কৌশলে, তার দুর্বল জায়গায় ঘা দিলেন, জিজ্ঞেস করে বসলেন, কামশাস্ত্র বিষয়ক প্রশ্ন। এখন সন্যাসী মানুষ শংকর, তিনি কামশাস্ত্রকে সন্যাস-রীতি অনুযায়ী বরাবর পরিত্যাগ করে এসেছেন। শঙ্কর উত্তরবিমুখ হয়ে, মৌনতা অবলম্বন করলেন। অবশেষে বললেন, আমি এই বিষয়ে মুখ খুললে, সন্ন্যাসের আদর্শ কলুষিত হবে। আমি এই প্রশ্নের জবাব দেব, গ্রন্থের সাহায্যে। দেহান্তরে প্রবেশ করে, আমি এই গ্রন্থ রচনা করবো।
যাইহোক, এর পরে, বনপথে ভ্রমন করতে করতে, একস্থানে গুহার মধ্যে নিজের স্থুল দেহকে রেখে, শিষ্যদেরকে ওই দেহ রক্ষার দায়িত্ত্ব দিয়ে, যোগ অবলম্বন করলেন। আর যোগবলে লিঙ্গ-শরীর ধারণ করলেন, এবং আকস্মিক ভাবে মৃত, রাজা অম্রুকের মৃতদেহে ,সূক্ষ্মদেহে, প্রবেশ করলেন, । রাজগৃহে, রাজদেহে, শঙ্কর কামকলার বিদ্যা আয়ত্ত্ব করলেন। অধ্যয়ন করলেন, কন্দর্প শাস্ত্র। রচনা করলেন, কামকলার উপরে প্রামানিক গ্রন্থ। যদিও এইধরনের কোনো গ্রন্থের সন্ধান আমার জানা নেই।
ঠিক একই ধরনের কাহিনী পাই আমরা মৎস্যেন্দ্রনাথের জীবনে। আমরা যোগী গোরক্ষনাথের কথা শুনেছি। তার জীবনীকার বলছেন, গোরক্ষনাথের গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ তার দেহকে রক্ষা করবার ভার গোরক্ষনাথকে দিয়ে, মৎস্যেন্দ্রনাথ আসামের এক রাজার দেহে প্রবেশ করেছিলেন।
এছাড়া, মহাভারতের শান্তিপর্বে, দেখা যায়, সুলভা নামে এক সন্ন্যাসিনী রাজর্ষি জনক-দেহে প্রবেশ করেছিলেন। আবার অনুশাসন পর্বে আমরা দেখতে পাই, দেবশর্মার শিষ্য বিপুল, গুরুর নির্দেশ অনুসারে তার গুরুপত্নী রুচির দেহে প্রবেশ করেছিলেন।
যাইহোক, এই ঘটনা সত্য না নিতান্তই গল্প, তাও আমার জানা নেই। তবে এই ধরনের ঘটনার কথা অসম্ভব বলে আমি মনে করি না। অলৌকিক বলে উড়িয়ে দিলে, সত্য জানা যাবে না। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, "বজ্রোলি" যোগবলে পরকায়ে প্রবেশ সম্ভব। অর্থাৎ আত্মাকে প্রাণবায়ুর সঙ্গে অন্য শরীরে প্রবেশ করানো যেতে পারে, আবার একই শরীরে প্রবেশ করানোও যেতে পারে। অন্তত কাহিনী গুলো সেই রকমই আভাস দিচ্ছে।
যাই হোক, আমাদের আলোচ্য বিষয় প্রাণের গমন - নির্গমন। রুদ্ধ প্রাণের গতিকে কিভাবে গতিশীল করা যায়। তো প্রশ্ন উঠতে পারে, সেই আলোচনায় আমরা এতো ভূমিকা করছি কেন ? আসলে, এই বিষয়ের গভীরে যেতে গেলে, প্রথমে একটা বিশ্বাসের বাতাবরণ চাই। এই বিশ্বাস না থাকলে, আমাদের অনুসন্ধানের প্রতি আগ্রহ আসা সম্ভব নয়। বিশ্বাস থেকেই বিজ্ঞানের শুরু হতে পারে। অবিশ্বাস মানুষকে কখনো অনুসন্ধানের জন্য অনুপ্রেরণা দিতে পারে না। আর অনুসন্ধানই সত্যকে উদ্ঘাটন করতে পারে। এই সম্পর্কে আমরা আবার পরের দিন শুনবো। আজ বাক্যের বিরাম দিলাম।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।

অমর মৃত্যু কথা- ষষ্ঠ পর্ব। (THE SECRET OF DEATH) - ৬

আসলে শরীরে মধ্যে যে জীবকোষ আছে, তাদের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে আমাদের ফুসফুস।                         
           











     

     
  











Friday 19 February 2021

প্রাণ - রহস্যঃ : প্রশ্ন উপনিষদ

 


মৃত্যু রহস্যঃ (৬) : প্রাণ - রহস্যঃ

মরা মানুষ কি কখনো বেঁচে উঠতে পারে ? মৃত দেহে কি প্রাণের সঞ্চার সম্ভব ? জিজ্ঞাসুর এই প্রশ্ন শুনে স্বামীজী যেন বিরক্ত হলেন।  কোনো জবাব দিলেন না। পরদিন সকালবেলা, স্বামীজী কতকগুলো শুকনো কাঠ-পাতা জোগাড় করে আগুন জ্বালাতে বললেন। আমরা ভাবলাম, শীতের সকালে উত্তাপ নেবার জন্য বোধহয়, আগুন জ্বালাতে বলেছেন। কিছুক্ষন পরে, অগ্নিশিখা মিলিয়ে গেলো, আগুন নিভু-নিভু হয়ে এলো।   তখনও  জ্বালনির ভিতরে অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ জোনাকির মতো  রয়ে গেছে। বললেন, আরো কিছু কাঠ পাতা ছাইয়ের উপরে দিয়ে দিতে। এবারে ফুঁ দিতে বললেন। আমরা তাই দিলাম, আগুন আবার তীব্র আকার নিলো। অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হয়ে আবার আগের মতো হয়ে উঠলো। কিন্তু ধীরে ধীরে, ইন্ধনের অভাবে, একসময় আগুন আবার নিভে যেতে লাগলো। এর পরে একসময় পড়ে রইলো শুধুই  ছাই। স্বামীজী  আবার কাঠ-পাতা দিতে বললেন, ফুঁ দিতে বললেন। কিন্তু আগুন আর জ্বলে উঠলো না। স্বামীজী বললেন, এই হচ্ছে তোমাদের কালকের প্রশ্নের জবাব।       

স্বামীজী বলছেন, কাল কাউকে ছাড়বে না। সবাইকেই কালের কবলে পড়তে হবে। এখন কথা হচ্ছে, দিন রাত্রি আছে বলেই, আমরা কালের ধারণা  করে থাকি। অর্থাৎ চন্দ্র সূর্য আছে বলে, কালের পরিবর্তন লক্ষিত হয়। আমরা যদি চন্দ্র সূর্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম, তবে কাল আমাদের ইচ্ছেমতো প্রবাহিত হতো।  অথবা নিজেকে যদি চন্দ্র সূর্য্যের গন্ডির বাইরে  নিয়ে যেতে পারি, তবে চন্দ্র সূর্য যার প্রভাবে কাল গতি সম্পন্ন হয়েছে, তার প্রভাব থেকে আমরা মুক্ত থাকতে পারতাম। আসলে আমাদের মনে হয়, কাল গতিশীল, কিন্তু সত্য হচ্ছে কাল স্থির, আমরা এই জগৎ, জগতের সমস্ত বস্তু, এমনকি আমার এই দেহ  গতিশীল। 

আমাদের দেহের মধ্যেও আছে এই চন্দ্র-সূর্য। সূর্য অর্থাৎ পিঙ্গলা নাড়ী, আর চন্দ্র অর্থাৎ ইড়া নাড়ী। এই দুই নাড়ী আমাদের দেহের মধ্যে কালপ্রবাহ সৃষ্টি করে থাকে। কিন্তু সুষুম্না নাড়ী ওই দুই নাড়ীর অর্থাৎ ইড়া ও পিংলা নাড়ীর মধ্যবর্তী হওয়ায় সাধকগণ সাধন বলে জানতে পেরেছেন, কালের অধীনে থাকলে মৃত্যু অনিবার্য।  তারা তাদের গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন, সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রাণবায়ু প্রবাহিত হলে কালকে জয় করা যায়, ওমর হাওয়া যায়। সুষুম্না নাড়ী কালের অধীন নয়, বরং কালের বিনাশকারিনী। এই কারনে বলা হয়ে থাকে, কালজয়ী হতে গেলে, এই কালবিনাশিনী এই সুষুম্না নাড়ীর তত্ত্বের গুহ্য-রহস্যঃ জানতে হবে। প্রাণ বায়ু যখন সুষুম্না মার্গে প্রবেশ ক'রে ব্রহ্মরন্ধ্রে লিন হয় তখন দিন ও রাত্রি রূপ কালের অভাব বসতঃ যোগীর আয়ু বৃদ্ধি  হয়। যিনি এই সমাধির অভ্যাস দীর্ঘকাল করেছেন, তিনি দেহান্ত হবার পূর্বেই জানতে পারেন, কখন তার দেহান্ত হবে। আর তিনি তখন ব্রহ্মরন্ধ্রে প্রাণ বায়ুকে ধারণ করে কালের নিবারণ করেন, এবং স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করেন। যাইহোক, এসব গুহ্যবিদ্যা, গুরুবিদ্যা, এসব গুরুমুখে শুনতে হয়, আর শুধু শুনলেই হবে না, নিরন্তর অভ্যাস করতে হবে।  তবে আজ আমরা প্রাণের কথা  শুনবো।      

জন্ম মৃত্যু হচ্ছে প্রাণের আসা যাওয়ার খেলা।  অথবা অন্যভাবে বলা যায়, জীবন হচ্ছে শ্বাসের খেলা। শ্বাসের শুরুতে প্রাণের শুরু, শ্বাসের শেষে প্রাণের শেষ। দেখুন চৈতন্যহীন জীব বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু প্রাণহীন জীব বলে কিছু নয় না। এই প্রাণের সাহায্যে আমরা সবাই যেমন বেঁচেবর্তে  থাকি, ঠিক তেমনি আবার এই  প্রাণের সাধনা করেই আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ  করতে পারি। কিন্তু আশ্চর্য্যের কথা হচ্ছে প্রাণ কোথা থেকে  আসে, আবার কোথায় চলে যায়, তা আমরা জানি না। আবার দেখুন শরীর  বিনা সাধন হয় না। কিন্তু এই শরীরে কিভাবেই বা প্রাণের গমন নির্গমন হয়, তা আমরা জানি না। এসব কথা বুঝতে গেলে, আগে এই দেহে বায়ুর ক্রিয়া সম্পর্কে, তেজের ক্রিয়া সম্পর্কে ও জলের ক্রিয়া সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে হবে। প্রথমে আমরা বায়ুর কথা শুনে নেবো। 

আমরা জানি পঞ্চভূতের তৈরী এই শরীর। এই শরীর প্রকৃতি প্রসূত। আর প্রকৃতি ত্রিগুণাত্বক - সত্ত্বঃ-রজঃ-তমঃ । প্রকৃতির এই তিনটি গুন্ যখন সাম্যাবস্থায় থাকে তখন প্রকৃতি অব্যক্ত। আবার এই ত্রিগুণের মধ্যে যখন স্পন্দন ওঠে শুরু হয় সৃষ্টি। সমস্ত সৃষ্টি তা সে চেতন বলুন, আর অচেতন বলুন সবই প্রকৃতির অঙ্গ-প্রতঙ্গ। সত্ত্বগুণ হচ্ছে আত্মশক্তির মূল স্পন্দন। রজঃগুন হচ্ছে ক্রিয়াশক্তির মূল স্পন্দন। ক্রিয়াশক্তির এই যে কার্যরূপ তাকে বলে তমোগুণ। এই ক্রিয়াশক্তিই সৃষ্টিকে ভাঙে গড়ে।  

শক্তির এই তমোগুণ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে পঞ্চতত্ত্ব।  প্রথমে কারণ-রূপী মহাকাশ, যার গুন্ হচ্ছে শব্দ । এই মহাকাশ থেকে বায়ু অর্থাৎ প্রানশক্তি  উৎপন্ন হয়েছে। বায়ুর নিজস্ব গুন্ হচ্ছে, স্পর্শ,  আর উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে শব্দ। তাই বায়ুর দ্বিবিধ গুন্ শব্দ ও স্পর্শ। এই বায়ু যেমন আমাদের ত্বক অর্থাৎ স্পর্শ-ইন্দ্রিয়ে অনুভব জাগায়, তেমনি এই বায়ু আমাদের দেহের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোকে অর্থাৎ দেহের রক্ত-রসকে দেহের সর্বাঙ্গে পরিচালিত করে থাকে। এই বায়ুই আমাদের দেহের প্রাণশক্তি, প্রাণবিজ ও প্রাণকোষ নির্মাতা। 

আকাশ আমাদের দৃষ্টিগোচর নয়, বায়ুও আমাদের দৃষ্টিগোচর নয়। কিন্তু আকাশে স্থিত বায়ু সাহায্যেই আমরা স্পর্শ অনুভব করে থাকি। মুনিঋষিগন বলে থাকেন, আমাদের এই স্থূল দেহ একটি ক্ষুদ্র ব্রহ্মান্ড বিশেষ। আমরা আকাশে যেমন বায়ু-অগ্নি-ব্রুনের খেলা প্রতক্ষ্য করে থাকি, অর্থাৎ ঝড়, বিদ্যুৎ, মেঘ বা বৃষ্টির খেলা দেখতে পাই, তেমনি আমাদের দেহের মধ্যেও এই ত্রিদেবতার খেলা চলছে। আমাদের দেহভান্ড যদিও পঞ্চভূতের মিশ্রণ, তথাপি এই তিন ভূতের অর্থাৎ জল, বায়ু ও অগ্নির অধিক প্রাধান্য দেখতে পাই আমাদের শরীরে। আবার এই তিন ভূতের মধ্যে বায়ু ভূতের প্রাধান্য অধিক। 

এখন কথা হচ্ছে এই বায়ু  আমাদের শরীরের কোথায় বসে কি কাজ করে থাকে। দেখুন সমস্ত ভূতগুলোই যেমন আমাদের শরীরের সমস্ত অঙ্গে   ক্রীড়ারত, তেমনি বায়ুভূত  আমাদের সমস্ত শরীরেই ক্রিয়াশীল। তথাপি প্রত্যেকটি ভূতের কর্ম্মকেন্দ্র আলাদা আলাদা। যেমন বায়ু-ভূতের প্রধান কর্ম্মকেন্দ্র হচ্ছে আমাদের বক্ষ-প্রদেশ। এই বুকের মধ্যে আছে ফুসফুস, হৃদযন্ত্র, মঙ্গলগ্রন্থি এবং প্রাণকোষ নির্মাণকারী গ্রন্থি ইত্যাদি পাঁচটি গ্রন্থি ও অনেকগুলো উপগ্রন্থি আছে এখানে। এই হৃদয়ক্ষেত্রকেই সাধকগণ অনাহত চক্রের কর্ম্মস্থল বলে থাকেন। এই চক্রের কাজ বিরামহীন ভাবে চলছে। এই চক্রে অবিরত কাজ চলছে। এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম নেই।  আসলে এই চক্রের বিশ্রাম মানে আমাদের চির বিশ্রাম বা মৃত্যু। বিজ্ঞান বলছে বুকের পিছনের স্পাইনাল কর্ড লেভেল বা সুষুম্না নাড়ী থেকে বারো-জোড়া স্নায়ু যার প্রত্যেক জোড়ায় একটি গ্রাহক ও অন্যটি প্রেরক স্নায়ু, আমাদের বুকের মধ্যে বিস্তার করে আছে।  
পঞ্চভূতের মধ্যে  মরুৎ অর্থাৎ বায়ু সবথেকে শক্তিশালী ও সংযোগকারী। উপনিষদে একেই  ব্রহ্ম বলে আখ্যা  দেওয়া হয়েছে। এবং প্রাণ যখন আমাদের শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যায়, তখন  প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে আত্মাও আমাদের শরীর  ছেড়ে চলে যায়।  অর্থাৎ প্রাণের সঙ্গে আত্মার একটা ঘনিষ্ট সংযোগ আছে।  উপনিষদ বলছে, প্রাণ হচ্ছে আত্মার ছায়া। অর্থাৎ প্রাণ ও আত্মাকে আলাদা করা যায় না। প্রাণ আমাদের শরীরের সমস্ত জায়গায়  পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। এই বায়ুকে বা মরুৎকে  পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রাণ-অপান-সমান-ব্যান-উদান।
শ্বাসের সঙ্গে আমরা যে বায়ু গ্রহণ করি, ফুসফুস এই বায়ুকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে দেয়।  আর তা হলো প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ও ব্যান বায়ু। এগুলো আসলে বায়ুর কর্ম্মের  বিভাগ মাত্র, বায়ুর নয়। যাই হোক,  

প্রাণ - অর্থাৎ উইন্ড অফ লাইফ (wind of  life ) : এর কাজ হচ্ছে, শ্বাসগ্রহণ ও শ্বাস ত্যাগ।  অর্থাৎ ফুসফুসকে পরিচালনা করা। প্রাণ আমাদের শরীরের তেজ, আদিত্য, চক্ষু স্বরূপ। আমরা খাবার খাওয়ার  সঙ্গে সঙ্গে যে খাবার পেটে চলে যায়, এটা এই প্রাণবায়ুর কাজ। ধমনীর সাহায্যে আমাদের সর্ব্ব অঙ্গে রক্ত পরিচালনা, অর্থাৎ শিরা, উপশিরা, স্নায়ু ইত্যাদির কাজকে পরিচালনা করে থাকে, এই প্রাণ বায়ু। 

অপান - অর্থাৎ ইন্টেস্টিনাল ওইন্ড (intestinal wind) : এই বায়ু সাধারণত আমাদের নিম্নাঙ্গে প্রবাহিত হয়।  অর্থাৎ মলমূত্র-শুক্র, রজঃ নিঃস্বরণ,  এমনকি সন্তানকে নিচে নাবিয়ে আনতে  সাহায্য করে এই অপান বায়ু। অপান  আমাদের বাকশক্তি, আবার অপান আমাদের শরীরের অগ্নি। অপান  বায়ুর প্রধান কাজ প্রাণবায়ুকে আকর্ষণ ক'রে, প্রাণ বায়ুর শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াকে সাহায্য করা।

সমান - সমান কথাটার ইংরেজি হতে পারে smooth  । অর্থাৎ যে বায়ু প্রাণ ও অপান বায়ুর ক্রিয়ার মধ্যে  একটা সমতা বজায় রাখে, তাকে বলে সমান বায়ু । আমরা যা কিছু খাই বা পান করি, সেই  সকল বস্তুকে জীর্ন করা, রূপান্তরিত করা এই সমান বায়ুর কাজ।  সমান বায়ু আমাদের হজম শক্তি। জীর্ন খাদ্যের সার ও অসার অর্থাৎ প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয়  অংশকে পৃথক করে অসার ভাগ বৃহৎ-অন্ত্রের ভিতর দিয়ে মলনারীতে প্রেরণ করে থাকে এই সমান বায়ু।  প্রাণ ও অপান বায়ুর কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করার দায়িত্ব এই সমান বায়ুর।

ব্যান - ব্যান বায়ুর সাহায্যে আমরা আমাদের সর্ব শরীরে এমনকি মস্তিষ্কে রক্ত প্রেরণ করতে পারি। এই ব্যান বায়ুর সাহায্যে আমরা রোগমুক্ত হতে পারি। ব্যান-বায়ুকে বলা হয় আমাদের কারন স্বরূপ। মানুষ কানের সাহায্যে জ্ঞান লাভ করে থাকে, চন্দ্র আমাদের খাদ্যের উৎস।  খাদ্য আমাদের শক্তি যোগায়। শরীরের রস-রক্তকে প্রয়োজন মতো সমস্ত শরীরে দ্রুত পরিবেশন করা, আমাদের শরীরের সংকোচন-সম্প্রসারণ, মস্তিষ্কে রক্ত পাঠানো, শরীর  থেকে ঘাম বের করে দেওয়া, এই ব্যান বায়ুর কাজ। এই ব্যান বায়ু কুপিত হলে আমাদের দেহে রোগের  প্রকোপ হয়, এমনকি আমরা মারা  যাই।  

উদান - গুট্টুরাল ওইন্ড guttural air  এই উদান  বায়ুর সাহায্যেই  আমরা কথা বলি। আবার এই উদান বায়ুর সাহায্যে আমরা কুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করতে পারি। হৃদয়ের উর্দ্ধদিকে যে দ্বার আছে, আমাদের পা থেকে উর্দ্ধগামী বায়ু, এই ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে উপরের দিকে উঠে যায়। এই উদান  বায়ুর সাহায্যেই মানুষ শব্দ করে থাকে, কথা বলে, গান করে। এই উদান  বায়ুর সাহায্যেই আমাদের মন-বুদ্ধি স্মৃতি পরিপুষ্ট হয়ে থাকে। সাধকের কাছে এই উদান  বায়ুর খুব গুরুত্ত্ব।  কারন, এই উদান  বায়ুর সাহায্যেই সাধকের  মন অতীন্দ্রিয় জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করে। 

বায়ুর অবশ্য আরো পাঁচ রকম হয়। অর্থাৎ বায়ু দশ রকম। এবং তাদের আলাদা আলাদা কাজ আছে যা আমাদের শরীরে সংগঠিত হয়।   আমরা সেই বিষয়ে যাবো না।  

আমাদের  শরীরের শ্বাসক্রিয়া শুরু হলে তবেই  আমাদের  কৰ্মইন্দ্রিয় (বাক,পানি,পাদ, পায়ু,উপস্থ ) জ্ঞান ইন্দ্রিয় (কর্ন, চর্ম, চক্ষু, জিহবা, ও নাসিকা)  ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। শ্বাস-প্রক্রিয়ার গুরুত্বের কথা চিন্তা করে ভগবান বোধহয়,  শ্বাস  প্রক্রিয়ার জন্য দুটো অঙ্গ বা দুটো ইন্দ্রিয় ব্যবহার করার ব্যবস্থা করেছেন । এই জন্য  শরীরের অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো বিশ্রাম নিলেও, নিদ্রা গেলেও এই প্রাণশক্তির ক্রিয়া প্রতিনিয়ত চলতে থাকে।  কখনই বিশ্রাম নিতে পারে না। দিন-রাত অনবড়ত  কাজ করতে থাকে। যতক্ষন এই প্রাণশক্তি প্রবাহমান থাকে ততক্ষনই আমাদের আয়ু থাকে। প্রাণ যতক্ষন কর্মক্ষম থাকে ততক্ষনই আমাদের জীবিত বলা হয়।  এই প্রাণশক্তির কাজ শেষ হয়ে গেলে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। এই প্রাণের শক্তিতেই দৃষ্টি-শক্তি, এই প্রাণের শক্তিতেই শ্রবণ শক্তি, এই প্রাণের শক্তিতেই ঘ্রান শক্তি, বাক শক্তি, জ্ঞানশক্তি, পাচন  শক্তি। প্রাণের ক্রিয়া শুরুতে জীবন শুরু হয় - আবার প্রাণের ক্রিয়া শেষে জীবনের শেষ হয়। ত্রিলোকে যা কিছু বর্তমান সবই প্রাণের অন্তর্গত।

অতএব এই প্রাণক্রিয়া আমাদের স্থূল শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে। আমাদের মৃত্যুর সময়, আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়শক্তি সংকুচিত হতে থাকে। এবং অপানবায়ু প্রথমে আমাদের শরীর  ছেড়ে দেয়। ফলতঃ মৃত্যুকালীন সময় আমরা মল-মূত্র ত্যাগের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারাই। তার পরে ধীরে ধীরে ব্যান, উদ্যান, সমান এবং সব শেষে প্রাণবায়ু আমাদের দেহ ছেড়ে দেয়। এই প্রাণবায়ুর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চেতনশক্তি, বা আত্মা আমাদের স্থূল শরীর ছেড়ে দিয়ে আমাদের সংস্কারকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে থাকে। অর্থাৎ তখন আমরা সাধারণ মানুষরা মনোময় দেহে অবস্থান করি। উন্নত মহাত্মারা মনময় দেহকে  ছেড়ে দেন, তারা বিজ্ঞানময় দেহে অবস্থান করেন। অর্থাৎ বাসনা-সংকল্প বিহীন অবস্থায় শুধু জ্ঞানময় জগতে  তাঁরা অবস্থান করেন। এর পরে বিজ্ঞানময় দেহ ছেড়ে আনন্দময় শরীরে, এবং সব শেষে অনন্তে অর্থাৎ পরমাত্মার সঙ্গে বিলীন হয়ে যান।  যাই হোক, এর পরের দিন আমরা শুনবো, প্রাণ কোথা থেকে আসেন , কিভাবেই বা শরীরে প্রবেশ করেন, কিভাবেই বা সারা শরীরে ছড়িয়ে আমাদের কর্ম্মক্ষম  করে তোলেন , আবার কিভাবেই বা তিনি আবার আমাদের শরীরে ছেড়ে বেরিয়ে যান। আর  কোথায়-ই বা  চলে যান। আজ এই পর্যন্ত। 
   
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  

প্রাণের উদ্ভব পৃথিবীতে বা বিশ্বের অন্য কোথাও কবে কিভাবে হয়েছিল, তার সঠিক তথ্য এখনো পর্যন্ত বিজ্ঞান দিতে নি। প্রাণের সৃষ্টি পৃথিবীতেই প্রথম হয়, নাকি বিশ্বের অন্য কোথাও প্রাণীর সৃষ্টির পরে, পৃথিবীতে তার আগমন হয়, এই ব্যাপারটাও বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। এই সম্পর্কে পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, পৃথিবীর আগেও প্রাণের অস্তিত্ত্ব এই সৌর মন্ডলের চন্দ্রে  ছিল, পরে বুধে এই প্রাণক্রিয়া চলবে, বর্তমানে শুক্র ও প্রথিবীতে এই প্রাণক্রিয়া চলছে। তবে শুক্রে মানুষের থেকেও উন্নত ধরনের জীব বর্তমান। বিজ্ঞান বলছে (energy) E = mc২ (mass*current)  
--------------------------------
--------------------------------

ছান্দোগ্য উপনিষদ : ওম্

উপনিষ বলছে, "ওম্ ইতি এতৎ অক্ষরম্ উদ্ গীথম্ উপাসিত" অর্থাৎ ওম ব্রহ্মের সবচেয়ে নিকটবর্তী। এই অক্ষরকে উদ্গীথ রূপে উপাসনা করবে। ব্রহ্মের নিকটবর্তী অর্থাৎ এ যেন ব্রহ্মের ছায়া স্বরূপ। অক্ষর অর্থাৎ যার ক্ষয় নেই, আবার অক্ষর অর্থাৎ লিপি, অর্থাৎ ব্রহ্মকে যদি লিপির মধ্যে আবদ্ধ করতে হয়, তবে তাকে "ওম্" এই অক্ষরের সাহায্যে প্রকাশ করা যেতে পারে।  এই ওম-কে উদ্গীথ অর্থাৎ উচ্চস্বরে  গীত - এইভাবে ব্রহ্মার উপাসনা করতে হবে। 

সমস্ত ভূতাদি বস্তুর  সার হচ্ছে পৃথিবী। অর্থাৎ পৃথিবীই সমস্ত কিছুর ধারক।  আবার পৃথিবীর ধারক  হচ্ছে জল। জল আবার সমস্ত উদ্ভিদের ধারক। অর্থাৎ জলবিহীন উদ্ভিদ থাকতে পারে না।  উদ্ভিদ আবার সমস্ত জীবজন্তুর ধারক। অর্থাৎ সমস্ত জীবজন্তু এই উদ্ভিদের উপরে নির্ভরশীল।  এই উদ্ভিদ বিভিন্ন ভাবে সমস্ত জীবজন্তুকে বাঁচিয়ে রেখেছে। মানুষের সার হচ্ছে তার বাকশক্তি। এই বাক্শক্তির মধ্যে শ্রেষ্ট হচ্ছে স্তূতি  বা ঋকমন্ত্র। এই স্তূতি সর্বকালে সর্বজনকে সন্তুষ্ট করতে পারে। আবার এই স্তুতিবাক্যঃ যদি সুর করে গাওয়া হয়, তবে তা আমাদেরকে আরো প্রীতি দান করে থাকে। তো সুর করে যদি স্তুতিবাক্যঃ গীত হয়, তবে সেখানে একটা মধুময় আবহাওয়া তৈরী হয়। আবার এই বাক  আসছে প্রাণ অর্থাৎ প্রাণবয়ুর থেকে। অর্থাৎ প্রাণের সাহায্যেই ওম উদ্গীথ হচ্ছে। 

    


















------------
ভালোকথা শুনতে কার না ভালো লাগে। কিন্তু ভালো কথা বলার লোক কোথায়  ? আর ভালো বলতেই বা আমরা কি বুঝি ?  আসলে ভালো বলতে আমরা  সেই কথাই বুঝি, যা আমার পছন্দের কথা। কিন্তু সত্য হচ্ছে, যা আমাদের পক্ষে কল্যাণকর, সেটাই ভালো কথা । আমাদের দর্শন শাস্ত্রগুলো একটা একটা কঠিন হীরের খন্ড । এর থেকে রস বার করা ভীষণ শক্ত। আর এই সব শাস্ত্র বুঝতে গেলে, আমাদের ভাষার উপরে দখল চাই, পান্ডিত্য চাই, আর চাই গভীর মনোযোগ। বিষয় বা ভাষা যদি খটোমটো   হয়, তবে মনোযোগ দেওয়া খুব কঠিন। তাই আমরা একটু সহজ করে বুঝবার চেষ্টা করবো, কঠিন বিষয়গুলোকে। 

প্রশ্ন হচ্ছে কোথা থেকে আমরা এসেছি ? আবার কোথায় চলে যাবো  ? অর্থাৎ প্রাণীসকল কোথা থেকেই বা  আসে আর কোথায় যায়  ?  আমাদের এই জীবনের উৎসই বা কি ? ঠিক এরকম একটা প্রশ্ন করেছিলেন, কবন্ধী নামক  এক জিজ্ঞাসু  ঋষিগুরু  পিপ্পলাদকে। ঋষি পিপ্পলাদ এর উত্তরে যা বলেছিলেন, তা "প্রশ্ন" উপনিষদ নাম খ্যাত। আমরা সেই প্রশ্ন উপনিষদ থেকে পিপ্পলাদের মুখে শুনবো, এই প্রশ্নের উত্তর। প্রাণী কোথা থেকে আসে, আবার কোথায় চলে যায়  ?

ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন - প্রজাপতির সন্তান সৃষ্টির ইচ্ছে হলো। সেই উদ্দেশ্যে তিনি তপস্যা শুরু করলেন। এবং তিনি এই জ্ঞান লাভ করলেন যে, যদি অন্ন থাকে আর সেই অন্নের একজন ভোক্তা থাকেন, তবে তারা সম্মিলিত ভাবে বহু সন্তান সৃষ্টি করতে পারবে। 

এখন কথা হচ্ছে এই প্রজাপতি কে ? তাকেই বা কে সৃষ্টি করলো ? দেখুন প্রজাপতি কোনো ব্যক্তি নন। 
প্রজা কথাটার মানে যা সৃষ্টি হয়েছে। পতি  কথাটার মানে স্বামী বা প্রভু। ইনি  কোনো ব্যক্তি নন। যেখানে বা যার কাছে, সৃষ্টির বীজ সংগ্রহীত থাকে তাকে  বলে প্রজাপতি। এই সংগ্রহশালায় কোটি কোটি তাক, কোটি কোটি খোপ। সীমাহীন মৌচাক।   অর্থাৎ এটি একটি সীমাহীন  সংগ্রহশালা। অর্থাৎ এটি একটি বৃহত্তর শক্তিমাত্র যা সৃষ্টির বীজকে যুগ  যুগান্তর ধরে বয়ে নিয়ে চলেছে।  আসলে প্রাণের কোনো সৃষ্টি নেই, প্রাণের কোনো বিনাশ নেই। কখনো এটি কারণরূপে বা বীজ আকারে আছে, আবার কখনো কার্যরূপে প্রতীয়মান হচ্ছে। পিতা থেকে সন্তান আবার সন্তান থেকে পিতা। বীজ থেকে গাছ আবার গাছ থেকে বীজ। ডিম্ থেকে মুরগী আবার মুরগী থেকে ডিম্। এটি একটি প্রবহমান ধারা। কালের অতীত এই ধারা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বয়ে চলেছে। এর না আছে শুরু, না আছে শেষ। কখনো কারণে লয় হয়ে আছে, কখনো প্রকাশিত হচ্ছে । জগৎ কারুর সৃষ্টি নয়, জগৎ একটা অভিব্যক্তি মাত্র। এটি কখনো প্রকাশিত, কখনো অপ্রকাশিত। চন্দ্র তার আদ্রতা দিয়ে, অন্ন সৃষ্টি করেন। সূর্য্য তাকে অর্থাৎ অন্নকে  টেনে তোলেন। তাই চন্দ্রকে বলে অন্ন আর সূর্যকে বলা হয় অন্যের ভোক্তা। প্রাণ এবং অন্ন দুটি পৃথক বস্তু নয়, রূপের পার্থক্য মাত্র। প্রতিযুগে কত কিছু  আসে যায়, আবার কল্পান্তে সেসব বীজ আকারে উৎসে ফিরে যায়। এযেন সেই অন্ধ পাগলি বুড়ির মতো, যা কিছু পায়, যা কিছু সে অবহেলায় থাকতে দেখে, সব সে তার ঝুড়িতে ভরে রাখে। এক এক সময় সে সব আবার সে মাটিতে ছড়িয়ে ফেলে। তখন সেই বীজ থেকে অংকুর হয়ে গাছ জন্মায়। গাছ বড় হয়, ফল দেয়, বীজ হয়, আবার সে মরে যায়।  বুড়ি আবার গাছের নিচে আসে অবহেলায়  ছড়িয়ে থাকা ফল-বীজ ঢুকিয়ে রাখে ঝোলার মধ্যে। 

জীবন এই ভাবেই চক্রাকারে ঘুরপাক খাচ্ছে। জন্ম থেকে মৃত্যু আবার মৃত্যু থেকে জন্ম। কার্য্য থেকে কারন, আবার কারন থেকে কার্য্য। প্রাণের না আছে সৃষ্টি না আছে লয়।  না আছে জন্ম না আছে মৃত্যু। একবার প্রকাশিত একবার অপ্রকাশিত। একবার বীজ একবার গাছ। একবার কার্য্য, একবার কারন। কারণে অপ্রকাশিত, কার্য্যে প্রকাশিত। 

বেদান্ত বলছে, এই প্রজাপতি এসেছেন ব্রহ্ম থেকে।  মৌচাকের খোপগুলো প্রজাপতি। এখানেই বীজ। এখানেই মধু। খোপ যেমন একাধিক, প্রজাপতিও একাধিক। আমরা সবাই একএকটা প্রজাপতি। আমরাই বীজের আকার ধারণ করি। আবার আমরাই গাছে পরিণত হই। ব্রহ্মার কোনো ইচ্ছে বা আকাঙ্খা নেই। তাই তিনি নির্গুণ।   কিন্তু আমার বা প্রজাপতির আছে। প্রজাপতি থেকে সৃষ্টি হয়, আবার প্রজাপতিতেই ফিরে যায়। প্রজাপতি কোনো চেষ্টা করেন না। তিনি কেবল সংকল্প করেন, তিনি কেবল চিন্তা করেন। তাঁর এই সৃষ্টির সংকল্প-চিন্তা থেকেই চন্দ্র-সূর্য্যের যুগলবস্তু প্রকাশিত। চন্দ্র অর্থাৎ রয়ি বা অন্ন বা খাদ্য। আদ্রতা চন্দ্রের বিশেষত্ব। যা সবকিছুকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। আবার অন্ন থাকলে তার একজন ভোক্তা থাকবে।  সেই ভোক্তা হচ্ছেন সূর্য। এই সূর্যই প্রাণ। আর এই প্রাণের প্রকাশ ত্রিবিধ। সূর্য, ভূতাগ্নি, জঠরাগ্নি। এই জঠরাগ্নি আমাদের খাদ্য হজম করায়। ভূতাগ্নি ভূতকে দাহ  করে। সূর্য গ্যাসীয় পদার্থকে দাহ করে, যাকে  আমরা হিলিয়াম  গ্যাস বলি। প্রাণ আসে সূর্য থেকে, খাদ্য যা আমাদের বেঁচে থাকতে  সাহায্য করে, তা আসে চন্দ্র থেকে। আবার এই চন্দ্র সূর্য পৃথক নয়, শুধু নাম আর রূপেই পার্থক্য মাত্র । 

উপনিষদ বলছেন, জগতে দুটো বস্তূ প্রাণ ও অন্ন।  আর দুটোই প্রাণীর  খাদ্য। আবার প্রাণ খাদ্যকে অর্থাৎ অন্নকে গ্রহণ করে। প্রাণ হচ্ছে সূক্ষ্ম খাদ্য, অন্ন হচ্ছে স্থূল খাদ্য।  আপাত দৃষ্টিতে এই দুটো আলাদা মনে হলেও, তারা এক, আলাদা নয়। প্রাণ ও খাদ্যের মিলিত সত্ত্বাই প্রাণী। 

সূর্যই সমস্ত কিছুকে প্রকাশ করেন ।  সূর্যই জীবের অন্তরাত্মা। জগতের সব রূপই সূর্য্যের রূপ। সূর্যের তেজ প্রকাশকে  যে বস্তু প্রতিফলিত করতে  অক্ষম সেই বস্তু ভূতে পরিণত হয়।  তাই মানুষ মারা গেলে ঠান্ডা হয়ে যায়। দেহের উত্তাপ জীবনের লক্ষ্মণ। প্রাণের লক্ষণ। এই প্রাণ যখন অগ্নি রূপে থাকেন, তখন তিনি আধিভৌতিক, অর্থাৎ পদার্থগত। আবার এই প্রাণ যখন জীবন তখন আধ্যাত্মিক। তাই প্রাণ আমাদের আয়ু প্রদান করে, আর এটি প্রাণের  প্রকাশক্ষন, অর্থাৎ কতদিন প্রাণী বেঁচে থাকবে  তা  স্থির করে, আবার গ্রহণ করে বা অপ্রকাশের ক্ষণ ঠিক করে, বা মৃত্যুক্ষণ ঠিক করে। 

এই সূর্যই আমাদের প্রাণের উৎস।  এই সূর্যই আমাদের জ্ঞানের উৎস। আপনারা যারা বেদ  পড়েছেন তারা জানেন, বেদে কেবলই সূর্য্যের উপাসনা, তা সে প্রতক্ষ্য হোক বা অপ্রত্যক্ষ হোক। সূর্যকে সর্ব্ব দেবতার উর্দ্ধে স্থান দেওয়া হয়েছে। যারা সেই বিখ্যাত মন্ত্র গায়ত্রী, শুনেছেন তারা জানেন। এই  মন্ত্রে জ্ঞানের প্রতীক সেই সূর্য বা সাবিতদেবকে আহ্বান করা হচ্ছে। সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে। উপনিষদে সূর্যকে বলা হচ্ছে, বিশ্বরূপং (সমস্ত রূপ), হরিণং, (উজ্জ্বল)  জাতবেদসম (সর্বজ্ঞ) পরায়নম (সকলের আশ্রয়) একং জ্যোতিঃ (একমাত্র আলো ) ।

আবার আমরা প্রজাপতির কথায় ফিরে যাই। এই প্রজাপতি সংবৎসর, অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা ।  দুই পথে তার যাতায়াত।  উত্তর ও দক্ষিণ। জগতে দুই শ্রেণীর মানুষ আছেন, একদল জ্ঞান লাভের  জন্য, কর্ম্ম
করেন, অর্থাৎ ঈশ্বর চিন্তন করেন।  আর এক শ্রেণীর মানুষ আছেন, যারা সন্তান লাভের   জন্য কর্ম্ম করেন। অর্থাৎ বিষয় চিন্তায় মগ্ন থাকেন।   আর এদের জন্য পথও দুটো। একটা উত্তরায়ণ আর একটা দক্ষিণায়ন। সূর্য যখন দক্ষিণ গোলার্ধে থাকে তখন দক্ষিণায়ন। একেই বলে চন্দ্রের পথ। আবার সূর্য যখন উত্তর গোলার্ধে থাকে তখন তাকে বলে উত্তরায়ণ। এই পথ হচ্ছে সূর্য্যের পথ।

জ্ঞান লাভের পথই সূর্য্যের পথ। অর্থাৎ আলোর পথ। আর ভোগ বিলাসীর জন্য চন্দ্রের পথ। অর্থাৎ অন্ধকারের পথ। উত্তরমার্গীগন অর্থাৎ আলোর পথের যাত্রী, ধীরে ধীরে আদিত্যপদ লাভ করেন। আদিত্য সমস্ত প্রাণীর আশ্রয়। এটাই প্রাণীর সর্ব্বোত্তম অবস্থা। একবার এই পদ লাভ হলে মানুষ আর ফিরে আসে না। আত্মানম্ অন্বিষ্য। আত্মাকে অনুসন্ধান করো। কিন্তু এই আত্মাকে অনুসন্ধান করবো কি করে ? উপনিষদ বলছেন,  তপস্যা ও কৃচ্ছ্র সাধনার দ্বারা।

অন্যদিকে ভোগ বিলাসীরা চন্দ্র পথের যাত্রী। অর্থাৎ অন্ধকারের যাত্রী। এরা বার বার ফিরে ফিরে আসেন। আর সুখ-দুঃখ ভোগ করেন।  চন্দ্রের পথ অন্ধকার আচ্ছন্ন। চাঁদ সব সময় বদলাচ্ছে।  কখনো পূর্ণচন্দ্র। কখনো অর্দ্ধচন্দ্র আবার  কখনো অমাবস্যা।  সূর্য্যের কোনো পরিবর্তন নেই। চন্দ্রের ক্ষয়-বৃদ্ধি আছে সূর্য্যের ক্ষয়-বৃদ্ধি  নেই। আমরা যদি নিজেকে মৃত্যুর অধীন মনে করি, তবে সব সময় ভয় আমাদের তারা করে বেড়াবে। আর যদি আমরা যদি নিদেরকে শ্বাশত আত্মা মনে করি, তবে আমরা নির্ভয় থাকতে পারবো। 

অন্নই প্রজাপতি। অন্ন থেকে আসে প্রাণের বীজ। এই বীজ থেকে সমস্ত প্রাণীর জন্ম। আবার প্রাণী থেকে প্রাণ বেরিয়ে গেলে অন্নে পরিণত হয়ে যায়। অন্ন থেকে আবার প্রাণের বীজ। এই চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রাণী জগৎ। একেই বলে জন্ম মৃত্যুর চক্র। আত্মজ্ঞান এই চক্র  থেকে বেরিয়ে যাবার উপায়। উপনিষদ এই শিক্ষাই  দেয় আমাদের। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি  ওম।

 প্রশ্ন উপনিষদ -২

কথায় বলে কান টানলে মাথা আসে। ঠিক তেমনি প্রাণ টানলে আত্মা আসে। আসলে সরাসরি আমরা ঈশ্বরের কাছে যেতে পারি না। তাই ঈশ্বরের সঙ্গে যিনি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, আমরা তার সঙ্গে ভাব জমাতে চাই। যাতে একসময় আমরা ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে যেতে পারি ।  আমি অনেক গো-পালককে দেখেছি, গরুর বাচ্চাটাকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছেন, আর পিছন পিছন মা-গরু আপনা আপনি আসছে। তাই আমরা যদি প্রাণ সম্পর্কে ভালো ভাবে জানতে পারি, তবে আমাদের ঈশ্বর জ্ঞান স্বভাবিক ভাবেই এসে যাবে।   তাই আধ্যাত্মিক সাধকদের কাছে প্রাণের খুব কদর। বাহ্যিক দিক থেকে দেখতে গেলে, সমস্ত সাধক এই প্রাণের সাধনাই করে থাকেন। আজ আমরা এই প্রাণের কথা শুনবো। প্রাণ কোথা থেকে আসে?  তিনি কি ভাবে শরীরে প্রবেশ  করেন ? কি ভাবে তিনি সারা শরীরে ছড়িয়ে যান ?  কি ভাবে তিনি শরীরকে কর্মক্ষম করেন। কি ভাবেই বা তিনি আবার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যান ? কি ভাবে তিনি প্রাণী ও পদার্থসমূহকে ধারণ করেন ? আমাদের যে ইন্দ্রিয়শক্তি আছে, তা কিভাবে এই প্রাণকে আশ্রয় করে থাকে ? ঠিক এই প্রশ্নগুলো করেছিলেন, অশ্বলপুত্র  ঋষি পিপ্পলাদকে। আমরা সেই সব কথা শুনবো। কিন্তু তার আগে শুনে নেবো, আমাদের শরীরের মধ্যে যে ইন্দ্রিয়গুলো আছে, যাদের সাহায্যে আমরা বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখি তার  সঙ্গে আমাদের প্রাণের সম্পর্ক কি ? আর এসব কথাই শুনবো  আমরা ঋষি পিপ্পলাদের কাছ থেকে। 


ইন্দ্রিয় ও প্রাণের কথা  আমরা শুনছি প্রশ্ন উপনিষদের কথা। প্রশ্ন কথাটার অর্থ হচ্ছে জিজ্ঞাসা। আমাদের মতো সাধারণের মানুষের মধ্যে মাঝে মধ্যে নানান রকম প্রশ্ন জেগে ওঠে । প্রশ্ন উপনিষদে এই সাধারণ মানুষের প্রশ্নগুলোকে নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ভৃগুবংশীয় ভার্গব। প্রশ্নটা খুবই সাধারণ। ভার্গব বলছেন, হে গুরুদেব, কয়টি ইন্দ্রিয় প্রাণীর দেহকে ধারণ করে থাকে ? তার মধ্যে কোন ইন্দ্রিয় দেহকে প্রকাশ করে থাকে ? আবার ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে কোনটি প্রধানতম ? 
ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন।  এই আকাশের মধ্যে আছেন বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী, বাক, মন, চক্ষু ও কান। এঁরা সবাই দেবতা অর্থাৎ বিশেষ গুনের অধিকারী। এরাই বানম বা দেহকে বলিষ্ঠ করে। বানম  অর্থাৎ অস্থায়ী।  দেহের কর্ম্ম শেষ হলে  যেহেতু দেহের নাশ হয়। তাই দেহকে বলছেন বানম।

আমরা জানি আমাদের এই দেহ পাঁচটি উপাদানে গঠিত। অর্থাৎ আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও পৃথিবী এই পাঁচটি উপাদানে এই প্রাণীদেহ গঠিত। আবার এই পাঁচটি উপাদান দিয়েই তৈরি হয়েছে, আমাদের কর্ম্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞান ইন্দ্রিয়। কর্ম-ইন্দ্রিয় অর্থাৎ বাক(মুখ), পাণি(হাত), পাদ(পা), পায়ু (মল-মূত্র), উপস্থ (জনন-ইন্দ্রিয়) । আর জ্ঞান ইন্দ্রিয়গুলো হচ্ছে, চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক। এছাড়া আর একটা ইন্দ্রিয় আছে, তা হচ্ছে আমাদের মন। আর এই সব কিছুর পিছনে আছেন আমাদের প্রাণশক্তি বা জীবনীশক্তি। এর মধ্যে প্রাণ-ই সবথেকে শ্রেষ্ট। এই প্রাণের ক্রিয়াতেই জীবন শুরু হয়।  আবার প্রাণের ক্রিয়াশেষে জীবনের শেষ। 

ঋষি পিপ্পলাদ একটা গল্পের মাধ্যমে, প্রাণের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝিয়েছেন। বলছেন, একবার ইন্দ্রিয়সকল দাবি করলো, যে তারাই দেহকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সক্রিয় রেখেছে। তারা বলছে, আমরাই দেহকে ধারণ করে আছি। তো প্রাণ বললো, এইভাবে তোমরা মোহগ্রস্থ হয়ো না, অহংকার কোরো না। আমার শক্তিতেই তোমাদের শক্তি। আমিই নিজেকে পাঁচ ভাগ করে এই দেহকে  ধারণ করে আছি।  আর আমার এই পাঁচ ভাগ হচ্ছে, প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান।  প্রাণের কাজ হচ্ছে শ্বাস গ্রহণ ও শ্বাস  ত্যাগ করা । অপানের কাজ হচ্ছে, খাদ্য বস্তু থেকে অসার পদার্থ বর্জন করা।  ব্যান দেহের স্নায়ুকে ক্রিয়াশীল করে। উদ্যান দেহের তাপ রক্ষা করে, সমান খাদ্যকে হজম করতে সাহায্য করে। এই পাঁচটি শক্তি দ্বারা আমি অর্থাৎ প্রাণ দেহকে সচল রাখি, ও কারক্ষাম রাখি। 

তো প্রাণের এসব কথায়, ইন্দ্রিয়গণ কর্নপাত  করলো না। তারা তাদের অহংকারে মত্ত হয়ে রইলো। প্রাণ এতে ক্ষুব্ধ হলো, এবং দেহ ছেড়ে বেরিয়ে যাবার ভান করলো। যেই না প্রাণ বেরিয়ে যাবার উপক্রম করলো, তখন ইন্দ্রিয়গণ শক্তিহীন হয়ে পড়লো। ত্রাহি ত্রাহি রব শুরু হয়ে গেল। উপনিষদ বলছেন, মৌচাক থেকে যখন রানী মৌমাছি বেরিয়ে যায়, তখন সব মৌমাছি তাকে অনুসরণ করে। শরীর  থেকে প্রাণ যদি বেরিয়ে যায়, তবে ইন্দ্রিয়সকলও প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়।  তারা কেউই প্রাণ বিহীন দেহে থাকতে পারে না। প্রাণ ছাড়া তাদের কোনো কর্ম্ম ক্ষমতা থাকে না। সমস্ত ইন্দ্রিয় এমনকি মনও প্রাণের শক্তিতে সক্রিয় থাকে। 

ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, এই প্রাণ-ই পৃথিবী, প্রাণই চন্দ্র, প্রাণই সূর্য, এমনকি মেঘ-বৃষ্টি-বায়ু, সব-ই প্রাণের অন্তর্গত। প্রাণ কার্যরূপে স্থূল, আবার কারন রূপে সূক্ষ্ম। স্থূল-সূক্ষ্ম যা কিছু পদার্থ সবই প্রাণ।  তাই প্রাণ অমর - চিরস্থায়ী। 

এই প্রাণ-ই সূর্য-রূপে বাইরে উত্তাপ বিকিরণ করছেন, আবার অগ্নি-রূপে শরীরের ভিতরে উত্তাপ রক্ষা করছেন। এই প্রাণের সাহায্যে যেমন তাপ-আলো উৎপাদন হচ্ছে, তেমনি মেঘ, বৃষ্টি, অন্নের সৃষ্টি হচ্ছে। তাই প্রাণ হচ্ছে, অমৃত, সমস্ত জীবের আশ্রয় এই প্রাণ। 

জ্ঞান অর্থাৎ সমস্ত বেদাদিও এই প্রাণকে আশ্রয় করে অবস্থান করছেন। প্রাণেই সবকিছু প্রতিষ্ঠিত। "প্রাণে সর্বং প্রতিষ্ঠিতম।" আমরা যা কিছু শুনছি, দেখছি, এমনকি অনুভব করছি, সবই প্রাণের প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। 

প্রাণ প্রজাপতি রূপে মাতৃগর্ভে অবস্থান করে। প্রাণ-ই পিতা-মাতার রূপ নিয়ে, সন্তান হয়ে জন্মায়। ইন্দ্রিয়গণ আসলে প্রাণের জন্য উপহার নিয়ে আসে। চোখ নিজের জন্য কিছু  দেখে না। কান নিজের জন্য কিছু শোনে না। সমস্ত ইন্দ্রিয় আসলে প্রাণের জন্য উপহার সংগ্রহ করছে মাত্র। প্রাণ-ই দেবতা, আর তাকে আহুতি দিচ্ছে ইন্দ্রিয়সকল। আসলে ইন্দ্রিয়গণ বাহক মাত্র। ইন্দ্রিয়গুলো আসলে যেন এক এক জন ঋষি। ঋষিরা যেমন আমাদের সত্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করেন , ইন্দ্রিয়গণ তেমনি আমাদের এই জগৎকে জানতে সাহায্য করে।  প্রাণশক্তি ইন্দ্রিয়কে সঠিক ভাবে চালনা  করে, সত্যকে জ্ঞাত হচ্ছে। প্রাণ-ই সমস্ত প্রাণীগণের পিতা, প্রাণ-ই সমস্ত ইন্দ্রিয়গনের পিতা। আমাদের দেখা, শোনা, কথাবলা, চিন্তা করা, এমনকি আমাদের যত  মানসিক কর্ম্ম আছে, সবই এই প্রাণের জন্যই সম্ভব হচ্ছে। প্রাণ ছাড়া আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় অকেজো। জগতে যা কিছু আছে, সবই প্রাণ রক্ষা করছে। প্রাণের নিয়ন্ত্রনেই জীব জগতের সমস্ত কার্য্য সম্পাদিত হচ্ছে। মা যেমন সন্তানকে রক্ষা করেন, প্রাণ তেমনি আমাদের সকলকে রক্ষা করছেন। অতএব আসুন আমরা প্রানেরই উপাসনা করি। 

প্রশ্ন উপনিষদ -৩

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রাণ কোথা থেকে আসে?  তিনি কি ভাবে প্রবেশ শরীরে করেন ? কি ভাবে তিনি আমাদের  সারা শরীরে ছড়িয়ে যান ?  কি ভাবে তিনি শরীরকে কর্মক্ষম করেন। কি ভাবেই বা তিনি আবার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যান ? কি ভাবে তিনি জীব  ও পদার্থসমূহকে প্রাণ ধারণ করেন ? আমাদের যে ইন্দ্রিয়শক্তি আছে, তা কিভাবে এই প্রাণকে আশ্রয় করে থাকে ? ঠিক এই প্রশ্নগুলো করেছিলেন, অশ্বলপুত্র কৌসল্য ঋষিগুরু পিপ্পলাদকে। আমরা এই ঋষি পিপ্পলাদের মুখ থেকে এই সব প্রশ্নের জবাব শুনবো। 

আমাদের প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে প্রাণ কোথা থেকে আসে ? ঋষি পিপ্পলাদ বলছেন, প্রাণ আসে আত্মা থেকে। আমাদের দেহের যেমন একটা ছায়া থাকে, এবং এই ছায়াকে যেমন দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না, তেমনি আত্মার ছায়াই হচ্ছে প্রাণ। আত্মাতেই প্রাণ নিহিত আছে, আর এই প্রাণের ইচ্ছেতেই, অর্থাৎ এই প্রাণ যখন ইচ্ছে করেন, তখন তিনি শরীরকে ধারণ করেন। অর্থাৎ শরীরে প্রবেশ করেন। তো প্রাণ যখন শরীরে প্রবেশ করেন, তখন এটা বুঝতে হবে,  আত্মাও তখন শরীরে প্রবেশ করেন। কেননা ছায়াকে তো শরীর  থেকে আলাদা করা যায় না। তেমনি আত্মাকে ছায়া থেকে বা ছায়াকে আত্মা থেকে আলাদা করা যায় না। সমুদ্র থেকে যেমন তার ঢেউকে আলাদা করা যায় না। সমুদ্র না থাকলে ঢেউয়ের কথা ভাবা যায় না।  তেমনি আত্মা না থাকলে তার ছায়া অর্থাৎ প্রাণকে ভাবাই  যায় না। আর প্রাণকে সত্য বলে মনে হয়, তার কারন তার প্রাণ  আত্মার সঙ্গেই প্রাণ ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন।  আত্মা থেকে প্রাণকে আলাদা করলে কেবল বাতাস। প্রাণহীন বাতাস বলে যেমন কিছু হয় না, আত্মাহীন  জীব  বলে যেমন কিছু হয় না, তেমনি  প্রাণহীন আত্মা বলেকিছু হয় না। আত্মাতে  প্রাণ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।  কিন্তু প্রাণ হচ্ছে ভৌতিক, আর আত্মা হচ্ছে অভৌতিক। তা হলে আমরা বুঝলাম, প্রাণ আসে আত্মা থেকে। প্রাণ ভৌতিক, আর  আত্মা হচ্ছেন অভৌতিক। কিন্তু দুজনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।  

আমাদের পরবর্তী প্রশ্ন হচ্ছে প্রাণ  কি ভাবে শরীরে প্রবেশ করেন ? জীবাত্মাতে অন্তর্নিহিত মনের ইচ্ছেতেই এই স্থূল শরীরে তিনি আসেন। অর্থাৎ শরীরে প্রাণ আলাদা করে কখনো আসেন না, আসতে  পারেন না। আসেন আত্মা, আর স্বাভাবিক ভাবেই প্রাণ এই আত্মাকে বহন করে নিয়ে আসেন। এই কথাটা আমরা আরো একটু ভালো-ভাবে বুঝবার চেষ্টা করবো।  উপনিষদ বলছেন, আমাদের মনের গতি বা আমাদের মনের যে প্রবণতা, আমাদের মনের যে সংকল্প, যে আকাঙ্খা তাকে রূপ দেবার জন্য, মন এই দেহ সৃষ্টি করে। তাই উন্নত  মন উন্নত  দেহের সৃষ্টি করে, সংকল্প অনুযায়ী যোগ্য শরীরে সে প্রবেশ করে । শরীরবিহীন কোনো সংকল্পই পূরণ হবার নয়, তা সে ভালো বলুন, বা মন্দ বলুন। সংকল্প পূরণ কেবলমাত্র  শরীর  সাধ্য। অর্থাৎ আমাদের আকাঙ্ক্ষা বা সংকল্প পুরনের জন্য আমাদের উপযুক্ত শরীর  লাভ হয়। বেদান্ত দর্শন বলছে, শরীর যেন একটা জোঁক, এক পাতা থেকে আর এক পাতায় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।  তেমনি প্রাণ, এক দেহ থেকে আর এক দেহে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অর্থাৎ জীবাত্মাই এক দেহ থেকে আর দেহে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সংকল্প সাধনের জন্য। আর প্রাণ  ইন্দ্রিয়গুলোর সাহায্যে নিদিষ্ট কর্ম্ম সম্পাদন করতে থাকেন।  বা বলা যেতে পারে, প্রাণ ইন্দ্রিয়গুলোকে যথা নির্দিষ্ট  কর্ম্মে নিযুক্ত করছেন। এখন কথা হচ্ছে,  প্রাণ আমাদের জীবদেহে কখন প্রবেশ করেন। আমরা জানি, আমরা যখন শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া করছি, তখন আমাদের শরীরে প্রাণের প্রবেশ ঘটছে। আর ক্রিয়া শুরু হয়েছিল, মায়ের পেট থেকে শিশু হিসেবে বেরিয়ে পড়বার সঙ্গে সঙ্গেই।  তাহলে কথা হচ্ছে, আমরা যখন মায়ের পেটে বা গর্ভে   ছিলাম, তখন কি আমাদের  শরীরের মধ্যে প্রাণের যাতায়াত ছিল না ? ছিল, কিন্তু তা ছিল, মায়ের প্রাণের অংশ।  অর্থাৎ মায়ের মধ্যে যে প্রাণের যাতায়াত ছিল, সেই প্রাণ-ই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো।  তার আগে আমার শরীর ছিল ভ্রূণ আকারে, তখনও আমি মায়ের প্রাণের আশ্রয়ে ছিলাম । তারও আগে, আমার দুটি শারীরিক সত্ত্বা ছিল, একটা হচ্ছে রজঃ আর একটা হচ্ছে শুক্র। শুক্র ছিল, পিতার দেহে, রজঃ ছিল, মায়ের দেহে। এই দুই শক্তি তখন যে শরীরে অবস্থান করতো, তখন সেই শরীরের প্রাণের আশ্রয়ে ছিল। শুক্রের/রজঃ সৃষ্টির আগে আমি  ছিলাম, অন্নের আকারে। তখনও আমার মধ্যে প্রাণের শক্তি বিরাজ করতো।  

 আমাদের পরের প্রশ্ন ছিল, কি ভাবে  প্রাণ  সারা শরীরে ছড়িয়ে যান ? কি ভাবে তিনি শরীরকে কর্মক্ষম করেন ?


প্রাণ যখন আমাদের এই স্থূল শরীরে প্রবেশ করেন, তখন আমাদের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে বা বলা যেতে পারে, কর্মক্ষম  হয়ে ওঠে। প্রাণের অবর্তমানে শরীরে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বর্তমান থাকা সত্ত্বেও কর্ম্মক্ষমতাহীন হয়ে, অর্থাৎ নির্জীব অবস্থায়  অবস্থান করে মাত্র। প্রাণ স্থূল শরীরে প্রবেশ করেই যেটা করেন, সেটা হচ্ছে ক্ষমতা প্রদান।  তিনি নিজেকে ৫টি ভাগে ভাগ করে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে দেন। চোখ, কান, মুখ, নাক - এখানে প্রাণ নিজে অবস্থান করেন। শরীরের মাঝামাঝি অংশে পাঠিয়ে দেন সমান বায়ুকে। শরীরের নিমাঙ্গে পাঠিয়ে দেন অপান বায়ুকে। ব্যান বায়ু সমস্ত ধমনীর মধ্যে প্রবেশ করেন। আর উদান বায়ু প্রবেশ করেন, আমাদের কেন্দ্রীয় ধমনীতে অর্থাৎ ইড়া, পিঙ্গলা,  সুষুম্না, নাড়ীর মধ্যে। এখানেই  চিত্রাণি, বজ্রাক্ষা,  নাড়ী অবস্থান করে । এইভাবে তিনি সমস্ত শরীরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েন ও শরীরকে জীবন্ত করে তোলেন, ক্রিয়াশীল করে তোলেন।  

একদম শেষ প্রশ্ন ছিল,  কি ভাবেই বা তিনি আবার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যান ? 

উপনিষদ বলছেন : প্রাণীর মৃত্যুকালে উদানবায়ুর ভূমিকা গুরুত্ত্বপূর্ন। এই উদানবায়ু জীবাত্মাকে দেহের বাইরে নিয়ে যায়। এই উদান বায়ুর ত্রিবিধ গতি, উর্দ্ধ-নিম্ন-মধ্যে। জীবাত্মার কর্ম্ম অনুসারে, উদান  বায়ু এই গতি নির্দিষ্ট করে। কেউ পুণ্যলোকে, কেউ পাপলোকে, আবার কেউ মনুষ্যলোকে গতিলাভ করে। উদ্যান বায়ু শরীরে উত্তাপ দান করে। উদ্যান বায়ুর অবর্তমানে শরীর শীতল হয়ে যায়। আর সমস্ত ইন্দ্রিয় তখন মনে লীন হয়ে যায়। এবং সে তখন জন্মান্তরের জন্য প্রস্তুত হয়।  এই সময় মন  সূক্ষ্ম অবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলোকে  নিয়ে, প্রাণে প্রবেশ করে, আর প্রাণ তখন আত্মার অনুসরণ করে। নাক বা মুখ বা বিশেষ ক্ষেত্রে ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে আত্মা বেরিয়ে যায়।

সাধন মার্গের লোকেরা যখন একটু উচ্চ পর্যায়ে চলে যান, তখন তারা এই উদ্যান বায়ুকে  করেন। উদ্যান বায়ুর অবস্থান যেহেতু, সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে, তাই উদ্যান বায়ুকে উর্দ্ধগতি করবার জন্য চেষ্টা করেন। এবং উদ্যান বায়ুকে ব্রহ্মরন্ধ্রে চালান করেন। এসব কথা আমরা পরিবর্তিতে আলোচনা করবো।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।  
আমরা কি আমাদের মৃত্যুকে পিছিয়ে দিতে পারি ?

যার জন্ম আছে তার মৃত্যুও আছে।  হাজার সাধ্য-সাধনা করেও কেউ অমরত্ত্বের বর লাভ করতে পারেনি।   এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ইচ্ছে করলে কি আমরা আমাদের মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখতে পারি ? আমাদের কি ইচ্ছামৃত্যু সম্ভব ? না আমি আত্মহত্যার কথা বলছি না। আত্মহত্যা যে করা যায়, অর্থাৎ যেকোনো সময় যে আমি নিজেকে মেরে ফেলতে পারি, সেটা তো আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। কিন্তু আমরা কি আমাদের মৃত্যুকে কিছু দিনের জন্য হলেও পিছিয়ে দিতে পারি।

আমরা মহাভারতে পড়েছি, মহাত্মা ভীষ্ম যখন যুদ্ধক্ষেত্রে শর-শয্যায় শায়িত হলেন,  তখন দক্ষিণায়ন চলছে। মহাত্মা ভীষ্ম দক্ষিণায়নে দেহত্যাগ করতে চান নি। উত্তরায়নের অপেক্ষায় নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। অচেতন অবস্থায় নয়, সচেতন ভাবেই তিনি বেঁচে ছিলেন। আর এই সময় যুধিষ্ঠিরকে যে  আপ্তবাক্য শুনিয়েছিলেন,তা  আমাদের কাছে চিরস্বরণীয় হয়ে আছে।

এতো গেলো পূরাণের কথা।  কিন্তু আমরা মহাযোগী গোরক্ষনাথের কথা শুনেছি। এই মহাযোগী নাকি মৃত্যুর সময়  বলেছিলেন, এই দেহ ছাড়ার  পরে আমি সিদ্ধ দেহে অবস্থান করবো, তোমরা আমার দর্শন পাবে, সাহায্য পাবে। এই বলে মন্দির কক্ষে প্রবেশ করলেন, এবং তৎক্ষণাৎ মন্দির কক্ষ এক স্বর্গীয় সুগন্ধে ও স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠে। উপস্থিত শিষ্যরা নাকি দেখেছিলো, গোরক্ষনাথের স্থূল দেহ, একটা শুভ্র জ্যোতিমণ্ডলে পরিণত হয়ে গেছে।  এবং খানিক্ষন পরে, তার লোকত্তর সিদ্ধ দেহ উর্ধাকাশে মিলিয়ে যায়। এসব কি গল্পকথা, নাকি এর মধ্যে সত্যতা আছে ?
  
আমরা আদিগুরু শঙ্করাচার্য্যের কথা শুনেছি, তার গুরুদেব ছিলেন, মহাত্মা গোবিন্দপাদ।  তিনি নাকি আসলে মহর্ষি পতঞ্জলি। আর এই মহর্ষি পতঞ্জলি হাজার হাজার বছর  ধরে অপেক্ষা করছিলেন, নর্মদা নদির তীরে, একটা গুহার মধ্যে,  আচার্য্য শঙ্করকে দীক্ষা দেবার জন্য।

আমরা বাবাজির নাম শুনেছি।  যিনি কয়েক'শ  বছর অপেক্ষা করেছিলেন, শ্রী শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়কে দীক্ষা দেবার জন্য। বাবাজি নাকি শ্যামাচরণ লাহিড়ীর আগের জীবনের গুরুও  ছিলেন।

আমরা যোগাচার্য্য শ্রীমৎ স্বামী শিবানন্দ সরস্বতীর কথা শুনেছি।  তিনি বলেছিলেন, যোগীদের ইচ্ছামৃত্যু হয়।

ভারতবর্ষে হাজার হাজার মহাপুরুষ ছিলেন, এমনকি এখনো হয়তো আছেন, যারা ইচ্ছামৃত্যু বরন করতে পারেন, বা করে থাকেন ।

এখন কথা হচ্ছে এটা কি আদৌ সম্ভব। দেখুন এই ব্যাপারটা বুঝতে গেলে আমাদের প্রাণত্যাগের বা মৃত্যু প্রক্রিয়াটা ভালোভাবে বুঝতে হবে। আর এটাও আমাদের বুঝতে হবে, আমার অর্থাৎ আত্মার কিন্তু মৃত্যু নেই।  কেবল মাত্র স্থূল শরীরের মৃত্যু। আসলে মৃত্যু হয় আমাদের দুটো শরীরের, সেটা হচ্ছে, অন্নময় ও প্রাণময় শরীরের। এর মধ্যে একটা হচ্ছে স্থুল (অনন্ময়) আর একটা হচ্ছে সূক্ষ্ম (প্রাণময়) . বাকি যে শরীর  অর্থাৎ মনময়, বিজ্ঞানময়, ও আনন্দময় শরীরের কিন্তু এক্ষুনি মৃত্যু হচ্ছে না। সে যাই হোক, আমরা যাকে  মৃত্যু বলতে বুঝি, অর্থাৎ আমাদের দেহের মৃত্যু, সেটা কি ভাবে সংগঠিত হয় ?

মৃত্যুর সময় আমাদের কি হয় ? প্রথমে আমাদের খাদ্য গ্রহণ করবার ইচ্ছা চলে যায়। অর্থাৎ আমাদের অন্নময় শরীরের  ক্ষয় বৃদ্ধি হতে থাকে। আমরা জানি আমাদের শরীরে প্রতিদিন অসংখ্য কোষ  জন্মাচ্ছে, আবার প্রতিদিন অসংখ্য কোষ মারা যাচ্ছে। যতদিন কোষ জন্মের হার মৃত্যুর থেকে বেশি থাকে, ততদিন আমাদের শরীর  বৃদ্ধি পেতে থাকে। আবার ঠিক যখন উল্টোটা ঘটে অর্থাৎ যখন  আমাদের কোষের মৃত্যুর হার জন্মের থেকে বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখন আমাদের শরীরের নাশ হতে থাকে । কিন্তু  এসব সত্ত্বেও, অর্থাৎ না খেয়ে, বা শুধু জল খেয়ে  মানুষ বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারে, কারন কিছু কোষ আছে, যারা সর্বাধিক ৭ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু এই কোষ গুলো বেঁচে থাকার জন্যও খাদ্যের প্রয়োজন। আর এই খাদ্য শুধু অন্ন নয়, এর মধ্যে আছে প্রধানত বায়ু, তারপরে অগ্নি।

আমাদের জীবন হচ্ছে শ্বাসের খেলা। শ্বাসের ক্রিয়া শুরুতে আমাদের জীবনের শুরু হয়, আবার শ্বাসের শেষে আমাদের জীবন শেষ হয়।  এই শ্বাসের মাধ্যমেই আমাদের শরীরের  সমস্ত প্রক্রিয়া চলে।  পঞ্চভূতের মধ্যে  মরুৎ অর্থাৎ বায়ু সবথেকে শক্তিশালী ও সংযোগকারী। উপনিষদে একেই  ব্রহ্ম বলে আখ্যা  দেওয়া হয়েছে।এবং প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে আত্মাও আমাদের শরীর  ছেড়ে চলে যায়।  অর্থাৎ প্রাণের সঙ্গে আত্মার একটা সংযোগ আছে।  প্রাণ আমাদের শরীরের সমস্ত জায়গায়  পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। এই বায়ুকে বা মরুৎকে  পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রাণ-অপান-সমান-উদান-ব্যান। আমাদের শরীরে প্রাণের বা বায়ুর ক্রিয়াটাকে একটু বুঝে নেই। শ্বাসের সঙ্গে আমরা যে বায়ু গ্রহণ করি, ফুসফুস এই বায়ুকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে দেয়।  আর তা হলো :

প্রাণ - অর্থাৎ উইন্ড অফ লাইফ (wind of  life ) : এর কাজ হচ্ছে, শ্বাসগ্রহণ ও শ্বাস ত্যাগ।  অর্থাৎ ফুসফুসকে পরিচালনা করা। আমরা খাবার সঙ্গে সঙ্গে যে খাবার পেটে চলে যায়, এটা এই প্রাণবায়ুর কাজ।
অপান - অর্থাৎ ইন্টেস্টিনাল ওইন্ড (intestinal wind) : এই বায়ু সাধারণত আমাদের নিম্নাঙ্গে প্রবাহিত হয়।  অর্থাৎ মলমূত্র-শুক্র এমনকি সন্তানকে নিচে নাবিয়ে আনতে  সাহায্য করে এই বায়ু।
সমান - সমান কথাটার ইংরেজি হতে পারে smooth  । অর্থাৎ যে বায়ু প্রাণ ও অপান বায়ুর ক্রিয়ার মধ্যে  একটা সমতা বজায় রাখে, তাকে বলে সমান বায়ু ।
উদান - গুট্টুরাল ওইন্ড guttural air  এই উদ্যান বায়ুর সাহায্যেই  আমরা কথা বলি। আবার এই উদ্যান বায়ুর সাহায্যে আমরা কুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করতে পারি।
ব্যান - ব্যান বায়ুর সাহায্যে আমরা আমাদের সর্ব শরীরে এমনকি মস্তিষ্কে রক্ত প্রেরণ করতে পারি। এই ব্যান বায়ুর সাহায্যে আমরা রোগমুক্ত হতে পারি।

আমাদের  শরীরের শ্বাসক্রিয়া শুরু হলেতবেই  আমাদের  কৰ্মইন্দ্রিয় (বাক,পানি,পাদ, পায়ু,উপস্থ ) জ্ঞান ইন্দ্রিয় (কর্ন, চর্ম, চক্ষু, জিহবা, ও নাসিকা)  ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। শ্বাস-প্রক্রিয়ার গুরুত্বের কথা চিন্তা করে ভগবান বোধহয়,  স্বাস প্রক্রিয়ার জন্য দুটো অঙ্গ বা দুটো ইন্দ্রিয় ব্যবহার করার ব্যবস্থা করেছেন । এই জন্য  শরীরের অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো বিশ্রাম নিলেও, নিদ্রা গেলেও এই প্রাণশক্তির ক্রিয়া চলতে থাকে।  কখনই বিশ্রাম নিতে পারে না। দিন-রাত অনবড়ত  কাজ করতে থাকে। যতক্ষন এই প্রাণশক্তি প্রবাহমান থাকে ততক্ষনই আমাদের আয়ু থাকে। প্রাণ যতক্ষন কর্মক্ষম থাকে ততক্ষনই আমাদের জীবিত বলা হয়।  এই প্রাণশক্তির কাজ শেষ হয়ে গেলে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। এই প্রাণের শক্তিতেই দৃষ্টি-শক্তি, এই প্রাণের শক্তিতেই শ্রবণ শক্তি, এই প্রাণের শক্তিতেই ঘ্রান শক্তি, বাক শক্তি, জ্ঞানশক্তি, পাচন  শক্তি। প্রাণের ক্রিয়া শুরুতে জীবন শুরু হয় - আবার প্রাণের ক্রিয়া শেষে জীবনের শেষ হয়। ত্রিলোকে যা কিছু বর্তমান সবই প্রাণের অন্তর্গত।

অতএব এই প্রাণক্রিয়া আমাদের স্থূল শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে। আমাদের মৃত্যুর সময়, আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়শক্তি সংকুচিত হতে থাকে। এবং অপানবায়ু প্রথমে আমাদের শরীর  ছেড়ে দেয়। ফলতঃ মৃত্যুকালীন সময় আমরা মল-মূত্র ত্যাগের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারাই। তার পারে ধীরে ধীরে ব্যান, উদ্যান, সমান এবং সব শেষে প্রাণবায়ু আমাদের দেহ ছেড়ে দেয়। এই প্রাণবায়ুর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চেতনশক্তি, বা আত্মা আমাদের স্থূল শরীর ছেড়ে দিয়ে আমাদের সংস্কারকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে থাকে। অর্থাৎ তখন আমরা সাধারণ মানুষরা মনোময় দেহে অবস্থান করি। উন্নত মহাত্মারা মনময় দেহকে  ছেড়ে দেন, তারা বিজ্ঞানময় দেহে অবস্থান করেন। অর্থাৎ বাসনা-সংকল্প বিহীন অবস্থায় শুধু জ্ঞানময় জগতে  তাঁরা অবস্থান করেন।

এতো গেলো আমাদের পার্থিব শরীর  দেহত্যাগের কথা। কিন্তু আমাদের মূল যে প্রশ্ন পার্থিব দেহ ত্যাগের সময় নির্ধারণ কি আমরা নিজেরা করতে পারি? অর্থাৎ এই ত্যাগের প্রক্রিয়াকে আমরা কি পিছিয়ে দিতে পারি ? যদি পারি, তবে তা কি ভাবে সম্ভব হতে পারে ?

আমরা এতক্ষনে বুঝতে পেরেছি, জীবন হচ্ছে শ্বাসের ক্রিয়া। তো এই শ্বাস-প্রশ্বাস যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তবে আমাদের আয়ু আমরা নিজেরাই বর্ধিত করে নিতে  পারি। তবে একটা কথা মনে রাখবেন, প্রাকৃতিক নিয়মে আমাদের শরীরের ক্ষয় হবে। এই ক্ষয়কে নিবারণ করবার কথা ক্ষমতা কারুর নেই। তবে এই ক্ষয় বৃদ্ধির মাত্রা কমানো যেতে পারে। আমরা আজ সেই আলোচনায় যাবো না। আমাদের প্রশ্ন প্রাণবায়ুকে ধরে রাখা, বা প্রাণবায়ুকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা । এই শ্বাস-প্রশ্বাস এর প্রক্রিয়া করে আমাদের শরীরের একটা মূল্যবান অঙ্গ যার নাম  ফুসফুস।  অতএব  আমাদের ফুসফুসকে সবসময় সক্রিয় রাখতে হবে।  সুস্থ  সবল রাখতে হবে। তার জন্য আমাদের এই ফুসফুসের ব্যায়াম  করতে হবে। আর সেটা হচ্ছে প্রাণায়াম। আর এই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের ফুসফুস যাতে কোনো রকমে সংক্রামিত না হয়।  অর্থাৎ অন্যের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। আর এই কাজটাই করে থাকেন, আমাদের সাধু-সন্তেরা। অর্থাৎ নেশা না করা। ধোঁয়া আমাদের ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। নির্মল বাতাসের পরিবেশে নিজেকে রাখা।  এইজন্য, নির্জন পাহাড়ে থাকা ফুসফুসের জন্য ভালো।  এইবার মূল যে কাজ সেটা হচ্ছে  অনুলোম-বিলোম বা সহজ প্রাণায়াম দিয়ে শুরু করে, শেষে কুম্ভক  অভ্যাস করা।অর্থাৎ বাতাসকে একবার নিজের শরীরের মধ্যে আটকে  রাখা। আবার বাতাসকে একবার সম্পূর্ণ শরীরের বাইরে আটকে রাখা।   আমরা জানি ধ্যানের একটা প্রক্রিয়া হচ্ছে, শ্বাস-প্রশ্বাস গতিকে পর্যবেক্ষন করা, শেষে তাকে নিজের ইচ্ছে মতো নিয়ন্ত্রণ করা, এবং সব শেষে  শরীরের ভেতরে  বা বাইরে মরুৎকে  আটকে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় নিজেকে সামিল করা। এইভাবে আমরা শ্বাস প্রশ্বাস কে যদি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে  পারি তবে আমরা  আমাদের মৃত্যুকে পিছিয়ে দিতে পারি। আর একটা কথা বলি, ফুসফুসকে ভালো রাখবার জন্য, দুবেলা শঙ্খ বাজানো, ধূপের গন্ধ নেওয়া, বা সুগন্ধি ফুলের বাস নেওয়া, কাঁসর-ঘন্টার ধ্বনি শোনা - খুবই উপকারী।

এখন কথা হচ্ছে, এইসব কথা যদি সত্যি হয়, তবে তো মানুষ অমর  হয়ে যেতে পারে। না পারে না, কারন আমরা জন্মগ্রহণ করি আমাদের বাসনা পূরণের জন্য, সংকল্প সাধনের জন্য। আর স্থুল দেহ ভিন্ন আমাদের সঙ্কল্প বা বাসনা পূরণ সম্ভব সম্ভব নয়।  তো শরীর যখন আমাদের সংকল্প পূরণের অযোগ্য হয়ে যাবে। তখন আমরা অবশ্য়ই এই পার্থিব দেহ ছেড়ে অন্য দেহে চলে যেতে চাইবো। তাই আমরা কখনোই অমর হতে চাইবো না।

সব শেষে একটা কথা বলি, আমরা কি করে বুঝবো যে আমার জন্মের সময় নির্ধারিত আয়ু বাড়লো কি কমলো ? দেখুন আমি জন্মেছি, ১৯৫৪ সালের ৯-ই অক্টোবর শনিবার, সকল ছটায় । আর আমার মারা যাবার কথা ২০৩০ সালের ২০ নভেম্বর, বুধবার, দুপুরের একটু আগে।  না এটা আমার মনগড়া কথা নয়।  আমার কুষ্টিতে সেরকম লেখা আছে। তো আমার কথার সত্যতা প্রমান করবার জন্য আমাদের সবাইকে  অপেক্ষা করতে হবে ২০৩০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত।

এই প্রসঙ্গে তিব্বতিবাবার একটা গল্প বলি, তিব্বতিবাবা কলকাতার এক ভক্তের গৃহে এসেছেন।  সেখানে তিনি তার গুরুদেব পরমানন্দ ঠক্কর বাবার সাধন ঐশর্য্য এবং তার দীর্ঘ আয়ুষ্কালের কথা শোনাচ্ছিলেন। বলছেন, ঠক্কর বাবার বয়স কয়েকশত বৎসর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। একথা শুনে, এক শিক্ষিত ভদ্রলোক বলে বসলেন, বাবাজি আজকের দিনে এসব কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, বরং বলবে, এসব "ঠাকুরমার ঝুলির গল্প"।একথা শুনে তিব্বতি বাবা বললেন, শুনে রাখ নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের নামই জীবন। এদুটোর ক্রিয়া বন্ধ  করার কৌশল যে জানে, সে-ই পারে জীবনের গতিকে স্তম্ভন করতে, সেই পারে শত শত বৎসর জীবিত থাকতে। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আপন-ভোলা নিরাসক্ত মনে যদি সংকল্প জেগে ওঠে, শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া যায় নিরুদ্ধ হয়ে, আর জীবনের পরিধিও হয়ে যায় বিস্তৃততর। আমার গুরুদেবের শক্তির পরিমান তোরা শালা কি বুঝবি ? (ভারতের সাধক - খন্ড - ৬ পৃষ্ঠা -১৯০)
 
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।
মৃত্যুর অভিজ্ঞতা :
ছেলেটি ঘুমুলে তার কোনো হুঁশ থাকে না। ডাকাডাকি তো দূরের কথা তার শরীরে আঘাত করলেও, তার ঘুম ভাঙে না। এমনকি তাকে বিছানা থেকে নামিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে গেলেও তার ঘুম ভাঙে না। আসলে ঘুমুলে তার দেহ-বোধ লোপ পেয়ে যেত। যেখানে সে বসতো, সেখানেই সে ঘুমিয়ে পড়তো। এর ফলে, দুস্টু ছেলেরা তার পিছনে  লাগতো। শারীরিক নির্যাতন করতো।  আর এই দুস্টু ছেলেদের হাত থেকে বাঁচতে, একদিন এক অন্ধকারময় ভূগর্ভে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। স্থানটি ছিল আলো-বাতাস বর্জিত। উঁইপোকা, ইঁদুর আর নাম না জানা অসংখ্য পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল। কিন্তু এতে কিশোরের  কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। বিষাক্ত পোকার কামড়ে তার সর্বাঙ্গে ক্ষতের সৃষ্টি হলো। শুভাকাঙ্খীগণ অনুরোধ-উপরোধ করলেও, বালক ভূগর্ভের আসন ছেড়ে বাইরে আসতে  চাইলো না।  এর পর জোর করে তাকে বাইরে আনা  হলো, দেখা গেলো, তার সমস্ত শরীর, পোকার কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে। কিন্তু বালকের  না আছে কোনো যন্ত্রণাবোধ, না আছে শরীরবোধ। আসলে সে ঘুমাবিষ্ট নয়, ধ্যানাবিষ্ট হয়ে যেত নিজের অজ্ঞাতসারেই।  উত্তর জীবনে এই ঘুম-কাতুরে বালকটি রুপান্তরিত হয়, মহাজ্ঞানী তাপসরূপে। যার নাম আমরা শুনেছি - মহর্ষি রমন। 

এই মহাজ্ঞানীর জীবনে মৃত্যু-অভিজ্ঞতা হয়েছিল।  মহর্ষি রমন বলছেন, একদিন ১৯১৮ সালের এক স্নিগ্ধ  সকালে কয়েকজনকে নিয়ে গুহার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন।  পথে তার সমস্ত শরীর  কোনো এক অজ্ঞাত কারনে শিথিল, অবসন্ন হয়ে পড়ে। তখন বহির্জগতের সমস্ত দৃশ্য অন্তর্হিত হলো, চোখের সামনে একটা সাদা পর্দা নেমে এসে দৃষ্টিকে অবরুদ্ধ করে দিলো। মহর্ষি বলছেন, আমি থমকে গেলাম। আছাড়  খাবো ভেবে, পথ চলা বন্ধ করে, দাঁড়িয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে আবার সব স্পষ্ট হলো। আমি আবার পথ চলা শুরু করলাম। কিন্তু শীঘ্র আবার আমার চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এলো। বেশ বুঝতে পারছি, ধীরে ধীরে বাহ্যজ্ঞান লোপ পাচ্ছে। আমি আবার পাথরে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। এরপর তৃতীয়বার এলো, চৈতন্য অবলুপ্তির পালা। একটা সাদা পর্দা আমার চোখের সামনের সমস্ত দৃশ্য ঢেকে দিলো। রক্ত সঞ্চালন ও শ্বাসক্রিয়া কি রুদ্ধ হয়ে গেলো ? সঙ্গে ছিল, বাসুদেব শাস্ত্রী ।  আমার শরীর নাকি তখন কৃষ্ণাভ নীল। বাসুদেব, আমি মরে  গেছি ভেবে, আমাকে  দুই হাতে জড়িয়ে কান্না জুড়ে দিলো। আমার  কিন্তু তখনও  চেতন ধারা লোপ পায়  নি। একটা আছন্ন ভাব আমাকে জাগিয়ে রেখেছে। আমি অভ্যাস বশতঃ আসনের ভঙ্গিতেই বসে আছি। পাথরে হেলান দেবার প্রয়োজন বোধ হয় নি। রক্তের গতি যেন রুদ্ধ হয়ে গেছে, শ্বাস-প্রশ্বাস নিরুদ্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থায়,  মিনিট পনেরো কেটে যাবার পরে, সারা দেহে আকস্মিকভাবে কম্পন অনুভূত হতে লাগলো। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন শুরু হলো, রক্তের সঞ্চালন, শ্বাস-প্রশ্বাস। সারা শরীর  থেকে প্রবলভাবে ঘাম বেরুতে লাগলো।শরীর আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। এযেন মৃত্যুর অনুভূতি।

শ্বাস রুদ্ধ হবার ঘটনা আমি সামনে থেকে  একবার দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছি। স্ত্রীর জিভ অসার হয়ে গেছে, স্বাদ-বোধ লোপ পেয়ে গেছে। আগেও কয়েকজন  ডাক্তারকে  দেখিয়েছি , কিন্তু কোনো সুরাহা হয় নি। স্ত্রীর ধারণা  হয়েছে, তার লিভারটা বোধহয় পচে গেছে। ডাক্তারবাবু বলছেন, কিছুই হয় নি, কিন্তু জিভে যে স্বাদবোধ নেই, এটাতো সত্য।   তো আমার দাদা-প্রতিম ডাক্তার দশরথ বিশ্বাসের কাছে গেছি, তার বাড়িতে। সেখানে কিছুক্ষন বসে কথা বলতে বলতে স্ত্রী হাঁসফাঁস করতে লাগলেন । কথা বলতে পারছেন  না। হাবভাবে বুঝলাম, তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমি কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে গেলাম। ডাক্তারবাবু, দৌড়ে ভিতরে চলে গেলেন। আমি কিছু না বুঝে ব্যাগের ভিতর থেকে জলের বোতল থেকে তার মাথায় জল ঢালতে লাগলাম। স্ত্রী আমার হাত থেকে বোতলটা নিয়ে, মুখের ভিতরে জল ঢেলে দিলেন। কিছুক্ষনের মধ্যে তিনি আবার শ্বাস নিতে শুরু করলেন।  ঘটনাটা বোধহয়, এক মিনিট বা দুই  মিনিটের। কিন্তু এর মধ্যে মনে হলো, স্ত্রী নতুন জীবন পেলেন, যমের  দুয়ার থেকে ফিরে এলেন । আসলে আমার স্ত্রী কথা বলতে বলতে মৌরি চিবোচ্ছেলেন। আর মৌরির দানা গলায় বেঁধে এই দুর্যোগ উপস্থিত হয়েছিল। সেই থেকে তিনি মৌরি খাওয়া  ছেড়ে দিলেন। আসলে কিছুদিন ধরে লক্ষ করছিলাম, আমার স্ত্রী মাঝে মধ্যে মৌরি চিবুতো। এতে করে নাকি তার ভালো লাগতো। একটা নেশার মতো হয়ে গেছিলো। মৌরিতে যে এমনতরো বিপদ আসতে  পারে, তা আমাদের কারুর ধারণার মধ্যে ছিল না। সেই মুহূর্ত থেকেই তিনি মৌরি খাওয়া ছেড়ে দিলেন, যা তাকে এক বিরল দমবন্ধের অনভিপ্রেত অসহনীয় অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করেছিল। আর আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে, জিভের অসারভাবও কেটে গেলো। স্ত্রী বলতে লাগলেন, দমবন্ধ হয়ে মরার কষ্ট কি, তা এবার টের পেলাম। জীবনে আর মৌরি খাবো না কোনোদিন।