Friday 28 May 2021

"আত্মাকে /আমিকে ধরবেন কি করে ? (পুনঃপ্রকাশ)/গুরুর সন্ধানে


আত্মাকে /আমিকে  ধরবেন কি করে ? (পুনঃপ্রকাশ)

পর্ব -১
আমরা এর মধ্যে জেনে গেছি, আমি এই দেহ নোই।  আমি এই মন নোই।  আমি বুদ্ধি নোই। তাহলে আমি কে ? আমি নাকি আত্মা।  এই আত্মা ব্যাপারটা কি ? আত্মা বা আমি হচ্ছে চেতন শক্তি যা স্থানান্তরিত হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, জীর্ন দেহ পরিত্যাগ করে, নতুন দেহে আশ্রয় গ্রহণ করে।তবে সত্য হচ্ছে, এই নতুন দেহে আশ্রয় গ্রহণ করে ততক্ষন, যতক্ষন না তার বাসনা বা সংকল্প পূরণ হয়।

 কিন্তু বাসনাহীন সঙ্কল্পহীন  আত্মার গতিপথ অন্যরকম। অর্থাৎ চেতন শক্তি প্রথমে আমাদের স্থূল শরীরে থাকে।  তার পরে আমাদের স্থূল দেহের মৃত্যুর পরে মানসদেহে অবস্থান করে। তার পরে মানস দেহের অবলুপ্তিতে চেতনশক্তি আমাদের বিজ্ঞানময় দেহে অবস্থান করে। আমাদের তিনটি ভৌতিক বা পার্থিব   দেহে।   অন্নময়, প্রাণময়, ও মনময়, অর্থাৎ স্থুল, সুক্ষ, ও অতিসুক্ষ  এই তিনটি দেহের যখন অবলুপ্তি হয় তখন এই চেতন শক্তি বিজ্ঞানময় দেহে বা অভৌতিক দেহে  ক্ষনিকের জন্য অবস্থান করে। তার পর বিজ্ঞানময় দেহ চেতনশক্তি সহ  আনন্দময় দেহে অবস্থান করে, এবং সবশেষে আনন্দময় দেহ চেতনশক্তিকে নিয়ে তার উৎস অর্থাৎ বিশ্বশক্তি বা  বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু এগুলো হচ্ছে তাত্ত্বিক কথা। সত্যি সত্যি আমাদের আমিকে কি আমরা ধরতে পারি ? যদি ধরতে পারি কিভাবে ধরবো ? সেই গোপন গূঢ়রহস্যঃ আজ আমরা শুনবো। ১০টি প্রক্রিয়া, সাধনত ১০ সপ্তাহের পরিক্রমা। তবে আপনার অবস্থান অনুযায়ী এই পরিক্রমার সময় নির্ধারণ হবে।   

আমরা এও জেনে গেছি, যে আমাদের স্নায়ুকেন্দ্রে যখন ঢেউ ওঠে তাকে বলে আমাদের মনের চিন্তা- বা আমাদের কামনা-বাসনা। অর্থাৎ আমাদের মানসিক বৃত্তি। আমাদের চেতনা অর্থাৎ সত্যিকারের আমি যখন এই মানসিক বৃত্তির সঙ্গে মিশে থাকে, তখন আমরা তাকে ধরতে পারি না। তো আমাদের কাজ হচ্ছে আমাদের চেতনাকে এই বৃত্তি থেকে আলাদা করা। এটা কি ভাবে করবো ? এই প্রক্রিয়াকে বলতে পারেন, অমিকে বা আত্মাকে  ধরবার খেলা। এই প্রক্রিয়াকে আমরা দশভাগে ভাগ করেছি। 

প্রক্রিয়া : ১
চুপচাপ মেরুদন্ড সোজা রেখে বসুন। মনের গভীরে ঢোকার চেষ্টা করুন। মনে কি কোনো চিন্তা উঠছে ? যদি ওঠে তবে তাকে পর্যবেক্ষন করুন। যতক্ষন না মনের চিন্তা দূরীভূত হচ্ছে, ততক্ষন এই অবস্থায় বসে থাকুন। মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন, যতক্ষন না মন চিন্তাশূন্য হচ্ছে ততক্ষন আমি মনকে ছাড়ছি না। 

প্রক্রিয়া : ২ 
এই ভাবে অবস্থানের ফলে, মন চিন্তা ছেড়ে, জ্ঞানের মধ্যে প্রবেশ করবে। এবং আপনি একটা আলোর বিন্দু দেখতে পাবেন। এই আলো আসলে জ্ঞানের আলো। এই আলো  আপনাকে পথ দেখাবে। এই আলোয় আপনি প্রথমে আপনার স্থূল দেহকে দেখতে পাবেন। অর্থাৎ প্রথম প্রথম মনে হবে, এই দেহই আমি। এর পরে,  শুধু আপনি আপনার মুখটা দেখতে পাবেন। অর্থাৎ মনে হবে, আপনার মাথাটাই আপনি। এর পরে আরো অপেক্ষা করুন, মাথার আকৃতি একটি কালো চক্রে পরিণত হবে  যার ভিতরে একটা আলোর বিন্দু দেখতে পাবেন। তখন মনে হবে, এই আলোর বিন্দু  বা মাথার একটা নির্দিষ্ট অংশই  আমি। এবার আপনি এই আলোর বিন্দুটাকে খেয়াল করুন, এটি মাথার কোথায় অবস্থান করছে ? 

প্রক্রিয়া : ৩
এই সময় আপনার মধ্যে আবার চিন্তা উঠতে থাকবে। না একে  এড়িয়ে যাবেন না। চিন্তাগুলোকেই লক্ষ্য কোরতে  থাকেন।  এবার খুজুন কে চিন্তাগুলোকে দেখছে ? এবং মনের মধ্যে প্রশ্ন তুলতে থাকুন, আমি কে ? আমি কে ? প্রশ্ন করুন, আর মনকে গভীর ভাবে লক্ষ করুন। এখন চিন্তা সরে যাবে। আর ভিতরে অর্থাৎ চেতন কেন্দ্র উদ্ভাসিত হবে। এই সময় আপনি একটা অখণ্ডতা নিস্তব্ধতা অনুভব করবেন। এই নিস্তব্ধতার অনুভবই আমি বোধ।  বা অহং বোধ।

প্রক্রিয়া : ৪ 
 এবার এটাকে ভালো করে লক্ষ করতে থাকুন। একটা জ্যোতি আপনি এখন দেখতে পাচ্ছেন।আপনার মনে একটা আনন্দ-অনুভব হচ্ছে। এই সময়, আপনার প্রশ্ন অর্থাৎ আমি কে, এটাকে দৃঢ় রেখে অপেক্ষা করুন। 

প্রথম ৪ সপ্তাহ এই প্রক্রিয়া প্রতিদিন নিয়ম করে নির্দিষ্ট সময়ে নির্জনে অভ্যাস করতে থাকুন। আর পরবর্তী প্রক্রিয়াতে যাবার আগে, আমাদের কথাগুলো শুনুন। 

একটা কথা বলি, এই   কাজগুলো আপনাকেই করতে হবে। অর্থাৎ এই কাজ আপনাকে স্বয়ং করতে হবে।  আপনার হয়ে অন্য কেউ করে দিতে পারবে না।   গুরুদেব বলছেন, সাধককে এবার একলা যাত্রা করতে হবে। তবে, আমি যতটা  সহজে কথাগুলো বলে গেলাম, এটাকে কার্যকরী করা এতটা সহজ নয়।  এটি প্রথমত সময় সাপেক্ষ, দ্বিতীয়ত একমাত্র গুরুর সান্নিধ্যে, গুরুর নির্দেশে এসব করতে হয়। গুরুদেব সবসময় আঁধার ভেদে, অর্থাৎ আপনার ব্যাকুলতা ও শারীরিক মানসিক প্রস্তুতির পরীক্ষা করে, সাধনপথের নির্দেশ দিয়ে থাকেন।    আমার কথায় একাজ করতে যাবেন  না।  এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। 

তথাপি আত্মাকে যে ধরা যায়, নিজেকে যে আত্মস্থ করা যায়, আর গুরু সান্নিধ্যে এটি অবশ্য়ই সম্ভব  হতে পারে সেই বিশ্বাস জাগ্রত করবার জন্য, এই আলোচনা। এটি শুনলে আপনার মধ্যে একটা ধারণা এমনকি আপনার মধ্যে আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের  প্রেরণা জন্মাতে পারে। 

আত্মাকে /আমিকে  ধরবেন কি করে ? (পুনঃপ্রকাশ)
পর্ব -২ 
আগের দিন আমরা শুনেছিলাম,  এবার একলা যাত্রা করতে হবে। কিন্তু এই পথে কি একলা যাওয়া যায় ? যাকে চিনি না, জানিনা, তাকে ধরতে গেলে, তাকে পেলেও আমি সনাক্ত করতে পারবো না। গুরুদেবকে এ কথা বলতেই তিনি যা বলেছিলেন, আমরা আজ সেই কথা শুনবো।

একটা কথা একটু গভীরে বুঝবার চেষ্টা করুন যে, আমরা যখন যার মধ্যে অবস্থান করি, তখন আমরা তাই হয়ে যাই। আমরা যখন দেহের মধ্যে প্রবেশ করি তখন আমরা দেহী হয়ে যাই।  আমরা যখন জ্ঞানের মধ্যে প্রবেশ করি তখন আমরা জ্ঞানী হয়ে যাই। আমরা যখন পাপের মধ্যে প্রবেশ করি তখন আমরা পাপী হয়ে যাই।  আসলে আমি ও আমার এই কথাটা ভালো করে বুঝতে হবে। আমি মানুষ, আমি জ্ঞানী, আমি গায়ক, আমি সাধক, আমি লেখক, এগুলো হচ্ছে আমাদের অহং জ্ঞান। আবার আমার দেহ, আমার ছেলে, আমার মেয়ে ইত্যাদি হচ্ছে  সম্মন্ধ-জাত জ্ঞান বা মমতা । অর্থাৎ যার সাথে আমার সম্মন্ধ হয়েছে। এগুলো সবই সাময়িক। কেননা আমি চিরকাল মানুষ, বা গায়ক, বা সাধক, বা লেখক থাকবো না, অর্থাৎ এগুলো সবই কালের অধীন। আবার আমার যাদের সাথে সন্মন্ধ হয়েছে, এগুলোও একসময় থাকবে না। কিন্তু আমি থাকবো। তো আমি এখন কিসের মধ্যে প্রবেশ করেছি সেটা একটু ধ্যান দিয়ে দেখি।

প্রক্রিয়া : ৬ 
ধ্যান যখন গভীর হবে, আমি বোধকে আলাদা করে নিয়ে মনের উপরে নিবিষ্ট করলে, এই কালের বা সাময়িক  সম্পর্ক গুলোকে আমরা বিচ্ছিন্ন করতে পারবো। আমি কে - এই প্রশ্নটাকে আমাদের মধ্যে দৃঢ় রাখতে হবে। অর্থাৎ আমাদের মূল উদ্দেশ্য আমিকে জানা বা ধরা। এই উদ্দেশ্যকে বা ভাবনাকে আমাদের মনের মধ্যে বারবার উৎসারিত করতে হবে।  এই ভাব যেন ক্ষনিকের জন্যও ত্যাগ না করি।
 
এই ছয়টি প্রক্রিয়া মোট চার সপ্তাহ ধরে চলবে। 

আমরা জানি আমাদের পাঁচটা শরীর। বা পাঁচকোষের এই শরীর ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আমি বোধকে ধরবার যে প্রক্রিয়া সেটা আমরা আগেই  আলোচনা করেছি । সেই প্রক্রিয়ার দ্বারা আমরা মনের স্তরে প্রবেশ করেছিলাম। অর্থাৎ অন্নময় - প্রাণময় কোষ পেরিয়ে মনময়  কোষে প্রবেশ করেছিলাম। এবং গভীর ধ্যানে লিপ্ত থেকে মনকে চিন্তা মুক্ত করেছিলাম। এই অবস্থায় মন কিন্তু বিলীন হয়ে যায় না। এই সময় মনের বৃত্তিগুলো সংস্কার রূপে সুপ্তভাবে থাকে। এই অবস্থায় মনের সংস্কারগুলো মাঝে মধ্যেই জেগে ওঠে। এই অবস্থায় ধ্যানের  গভীরতা যত  বাড়াতে পারবো, তখন আমিকে আরো ভালো করে ধরতে পারবো। এবং এই আমি-বোধে স্থির হয়ে থাকার  শক্তি ও সময় অর্থাৎ স্থিতিকাল  বৃদ্ধি পাবে। এই অবস্থায় আমরা, আমাদের  দৈনন্দিন কাজের সময়ও , এই আমি বোধকে অন্যান্য মানসিক বৃত্তি থেকে আলাদা করতে পারবো। এই রকম হলে, আপনি জানবেন, আপনার সাধন জীবনের  উন্নতি হয়েছে। মনে রাখবেন, ধ্যান একটা নিরবিচ্ছিন্ন অবস্থা। এমন নয় যে যতক্ষন আমরা  ধ্যানাসনে আছি, শুধু সেই সময়টুকু আমাদের উচ্চ অবস্থা থাকবে, আর তার পরেই আমরা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবো। ব্যাপারটা এমন নয়। আমার আমি-বোধকে মানসিক বৃত্তি থেকে আলাদা করে আমার দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপ চালিয়ে যাবো। এটাই প্রকৃত ধ্যানের প্রাপ্তি।

প্রক্রিয়া : ৭
এই ভাবে আমার আমি-বোধকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে ধরে রাখতে পারলে, এবং নিয়মিত ধ্যান সাধনা চালিয়ে গেলে আমরা মনময় কোষ ত্যাগ করে বিজ্ঞানময় কোষে উত্তীর্ন হতে পারবো। অর্থাৎ জ্ঞানময় জগতে বিবরন করবো। তখন নিত্য-অনিত্য জ্ঞান জন্মাবে। পার্থিব ও অপার্থিব জগৎ সম্পর্কে একটা ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকবে।  এই অবস্থা একটু ভালো করে খেয়াল করুন। এই অবস্থায় আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস-এর গতি কমে যাবে। সাধারণত আমরা যখন শ্বাস নেই সেটা আমাদের নাক থেকে বুকে, বুক থেকে পেটে চলে যায়। কিন্তু আমাদের আমিবোধ যখন মনময় কোষ ছেড়ে বিজ্ঞানময় কোষে ওঠে, তখন আমাদের শ্বাস নাকের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। এবং আরো পরে একসময়  কেবলমাত্র নাসিকাগ্রে অবস্থান করে। 

ধ্যানের বাধা :
এই অবস্থায় আমাদের অস্বস্তি বোধ হওয়া স্বাভাবিক।  কিন্তু গুরুর নির্দেশ নিয়ে, এই সময় ধ্যানে অবস্থানের সময় বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।  এবং তাতে এই অসুবিধা বা অস্বস্তি কেটে যাবে। এই সময় আরো কতগুলো অস্বাভাবিকতা আপনার মধ্যে দেখা দিতে পারে। যেমন শরীরে একটা কম্পন - যার উৎস হচ্ছে মেরুদন্ড। মেরুদণ্ডের মধ্যে একটা শিরশিরানি ভাব।  এমনকি এও মনে হতে পারে, যে একটা ছুঁচ আপনার মেরুদণ্ডের  ভেতর দিয়ে কেউ যেন উপরের দিকে  ঠেলে দিচ্ছে। এই শারীরিক অস্বস্তির সময় ধ্যানে নিরত থাকুন। আপাতত ধ্যান বন্ধ রাখুন। অথবা  কাউকে বলুন, মেরুদণ্ডে ম্যাসেজ করে দিতে। ম্যাসেজ করার সময় খেয়াল করবেন, হাত দিয়ে আলতো  করে পাশাপাশি ম্যাসেজ করতে।  ভুলেও উপর নিচ করবেন না। যদি এতেও  অস্বস্তি না যায়, তবে কয়েকদিন ধ্যান বন্ধ রাখুন। দেখবেন আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছেন। কিন্তু স্বাভাবিক হয়ে গেলেই আবার ধ্যানের অভ্যাস শুরু করুন। দরকার হয় এই অস্বস্তি অল্পবিস্তর সহ্য করুন।

এই সময় থেকে আপনার নানান-রকম দর্শন হতে পারে। জ্যোতি দর্শন হতে পারে। নানানরকম দেবদেবী যা আপনার চেনা বা অচেনা  মূর্তি, বিভিন্ন জায়গা, বিভিন্ন দৃশ্য, তা সে ভালোমন্দ সবই হতে পারে। সুন্দর, কুৎসিত, এমনকি ভয়ঙ্কর হতে পারে। এগুলো একটা সময় চলে যাবে, আর আপনার মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটবে। এগুলো দেখায় আপনার মধ্যে আনন্দ বা ভয় বা উদ্বেগ  দেখা দিতে পারে। 

প্রক্রিয়া - ৮ 
আপনি নিস্পৃহ থাকুন। আর আপনি আপনার মধ্যে চিন্তা ওঠান যে এগুলো কে দেখছে ? অর্থাৎ আপনার সেই মূল ও প্রাথমিক প্রশ্ন আমি কে ? এই প্রশ্নকে আঁকড়ে ধরুন।  আমি কে ?
এই অবস্থায় অনেকের চিন্তা শক্তি হারিয়ে যায়। ক্ষনিকের জন্য চেতন শক্তিও  হারিয়ে যায়। যদিও এটা কয়েক  মুহূর্তের জন্য হয়ে থাকে।  তথাপি এই অবস্থা থেকে ফিরে এলে মনে হয়,  আমি কি সমাধিতে ছিলাম। আসলে এটি সমাধি নয়, বলা যেতে পারে আপনার মূর্ছা হয়েছিল।বা আপনি খানিকটা সুসুপ্তির অবস্থায় চলে গিয়েছিলেন।  মন তখন কয়েক মুহূর্তের জন্য  লয় হয়ে গিয়ে ছিলো।

আমাদের একটা কথা সব সময় মনে রাখতে হবে, আমি আমাকে খুঁজছি। তাই আমি কে, অর্থাৎ আমি একটা চেতন সত্ত্বা।  অর্থাৎ যে সব কিছু উপলব্ধি করছে তা একটা চেতন সত্ত্বা এই কথাটা আমাদের সব সময় স্মরণে রাখতে হবে। এই অবস্থায় আমাদের অনেকের  ঘুম পায়। আর ঘুম পেলে জানবেন, আপনার যাত্রা পথে এটি একটি বড়ো বাঁধা। আপনাকে সজাগ থাকতে হবে। চেতন থাকতে হবে। এই বিজ্ঞানময় কোষে যখন  আপনি  অবস্থান করেন, তখন আরেকটা অদ্ভুত উপলব্ধি হয়, আর তা হচ্ছে আমি যেন শরীর নোই। শরীরের মধ্যেও আমি নেই। এই সময় আমাদের চেতন সত্ত্বাটি শরীরের চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়। শরীরের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। তখন যেন মনে হয়, আমি মারা  গেছি। শরীরের সঙ্গে মনের যোগসূত্রটি কেটে গেছে। শরীর স্থির হয়ে বসে আছে, আর আমি শরীরের বাইরে।এমনটি হলে, প্রথম প্রথম আমাদের ভীষণ ভয়ের উদ্রেগ হয়। কিন্তু ভয়ের কিছু নেই। এইসময় দেহের সম্পর্কে কোনো চিন্তা ওঠালে অর্থাৎ কোনো স্মৃতি বার বার ওঠালে, এই অবস্থা কেটে যায়। সাধক তখন সাধারণ অবস্থায় স্থিতিশীল হয়।

প্রক্রিয়া - ৯
বিজ্ঞানময় কোষে যাতায়াত ও স্থিতি  যখন আমাদের সহজ মনে হয়, অর্থাৎ বার বার যাতায়াত করতে করতে এই ব্যাপারটা যখন  সহজ মনে হয়,  তখন এই বিজ্ঞানময় কোষকে অতিক্রম করবার চেষ্টা করতে হয়। শান্ত মনে চেতনাকে আমিবোধে নিবিষ্ট করতে হয়। এইখানে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় এক হয়ে যায়। তখন আমাদের মধ্যে আমি আমাকে জানছি এইরকমটা  মনে হয়। দ্রষ্টা ও দৃশ্য এক হয়ে যায়। এই অবস্থায় আমরা চেতন সত্ত্বার উপরে আমি বোধ বা আমিত্ব আরোপ করে ধ্যানের প্রক্রিয়া চালাতে থাকুন।
 প্রক্রিয়াটা এই রকম। প্রথমে বিষয় সম্পর্কে যে চৈতন্য বা বিষয়ের সঙ্গে যে চৈতন্য মিশে আছে, অর্থাৎ বুদ্ধির সঙ্গে বিষয় মিশে যে চৈতন্য আমি বোধের সৃষ্টি করেছে, তাকে আলাদা করতে হয়। অর্থাৎ প্রথমে ভাবুন, আমি আমাকে জানছি, এর পরে কেবলমাত্র আমাকে জানছি, তারও  পরে শুধু জানছি এই ভাবে "আমি"কে আলাদা করুন। আমি আমার মধ্যে আছি,  তারপরে আমার মধ্যে আছি, তারপরে শুধুই  আছি। এইভাবে আমিকে আলাদা করুন। অর্থাৎ জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বলে কিছু থাকবে না, দ্রষ্টা-দৃশ্য বলে কিছু থাকবে না। জ্ঞাতা-জ্ঞেয়  মিশে যাবে, দ্রষ্টা দৃশ্য মিশে যাবে। বিজ্ঞানময় কোষে নিজেকে উত্তীর্ন হতে পারলে এই আছি বোধ স্থির হতে থাকবে। আপনি এক অপূর্ব শান্তি, অহেতুক আনন্দ আপনার মধ্যে স্ফূরিত হতে থাকবে। আমি ও আনন্দ তখন এক হয়ে যাবে। অর্থাৎ আমি যে আনন্দময় সত্ত্বা সেটা আমাদের উপল্বদ্ধিতে স্থায়িত্ত্ব লাভ করবে। যাকে আমরা এতদিন,শরীর-মন-বুদ্ধি-চিত্ত্ব-অহংকার বলে অনুভব করতাম, সেই আমি এখন একমাত্র আনন্দময় সত্ত্বা বলে অনুভব হবে। আমাদের মনে হবে আমরা আনন্দের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছি। আর এটাকেই বলে আনন্দময় শরীরে প্রবেশ।

প্রক্রিয়া : ১০ 
এই আনন্দময় শরীরকেও আমাদের ছাড়তে হবে। তা না হলে আমরা শরীর বিহীন হতে পারবো না। অর্থাৎ এক-এক করে পাঁচটা শরীরকে ছেড়ে যাবো।  এইজন্য ধ্যানের এই অবস্থায়, আমাদের খেয়াল করতে হবে, এই আনন্দ আসছে কোথা থেকে ? এই আনন্দের উৎস খুঁজতে হবে। এই সময় আমাদের চেতনা শরীর  শূন্য হয়ে পড়ে।  অহংহীন  হয়ে পড়ে। আর আমাদের মনে হয় মহাশূন্য আমাদের গ্রাস করে নিচ্ছে। আমি যেন মহাশূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছি। মহাশুন্য আর আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকছে না। মহাশূন্য আর আমি একই সত্ত্বা। এবার মনে হয়, আমি আর আমিতে  থাকছি না। আমার যেন নিজস্ব সত্ত্বা বলে কিছু নেই।  এই সময় এক গভীর অন্ধকার, এক মহাশুন্য, আমাকে অপ্রকাশ করে ফেলছে। আমি যেন বিশ্বসত্ত্বার সঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বসত্ত্বা আর আমি এক হয়ে গেছি। আমার অহং  বলে আর কিছু থাকছে না। এক অব্যক্ত সাম্যাবস্থা। সমস্ত গুনের বন্ধন, সমস্ত সত্ত্বার বন্ধন, সমস্ত শরীরের বন্ধন   আমার কেটে গেছে। আমি বিশ্বগ্রাসে পতিত। সমস্ত রহস্যভেদ হয়ে গেছে।  এই সময়, অস্তিত্ত্বের দাবি অস্বীকার হয়ে গছে। আমি বলে কিছু নেই। আমি মহাশূন্যের, মহাশূন্যই আমি। এটাই আমার প্রকৃত সত্ত্বা। শিবোহম  শিবোহম, তুহি তুহি। 

সবশেষে বলি, এই প্রক্রিয়া গুরুসান্নিধ্যে অভ্যাস করতে হয়। আমাদের এই লেখা পড়ে এইসব করতে যাবেন না। দুর্বল মনের মানুষ তো অবশ্য়ই এইসব কথা শুনেও শুনবেন না। কেননা এটি একটি অতীন্দ্রিয় জগতে প্রবেশ ও অবস্থানের প্রক্রিয়া । এখানে সবই শিবময়। যা ধংসের ও মঙ্গলের প্রতীক। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম।

সিদ্ধগুরু ছাড়া কি যোগসাধন হবে না ?

যোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্রহ্মানন্দ লাভ।  আর এই ব্রহ্ম-অনুভূতি বা ব্রহ্মানন্দ লাভ সিদ্ধযোগীর সান্নিধ্যেই একমাত্র লভ্য। আর সেইজন্যই আমরা যখনই যোগের সন্মন্ধে বিস্তারিত কথা শুনি, তখন যোগবিদ্যার সঙ্গে একটা কথা বারবার উচ্চারিত হয়, যে সৎ-গুরু বিহীন এই যোগের অভ্যাস করবেন না। তো কথা হচ্ছে, সেই যোগগুরু আমরা কোথায় পাবো ? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। এই সমস্যার কারন হতে পারে, ভৌগলিক, অর্থাৎ এদের বাস নির্জনে। কোটিতে হয়তো এক-আধজন সংসারে থাকতে পারেনা। এর কারন আরো একটা হতে পারে, তা হচ্ছে  আমাদের কাছে তথ্যের অভাব, অর্থাৎ কোথায় সেই গুরুদেবের অবস্থান তা আমরা জানি না । সিদ্ধগুরুর যেমন অভাব তেমনি সবথেকে বড় অভাব  হচ্ছে, উপযুক্ত ছাত্রের, বা জিজ্ঞাসুর  । অর্থাৎ আমাদের মধ্যে আকুলতার অভাব। 

আবার এই যোগগুরুর মধ্যে দুটো ভাগ আছে, একদল নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চান। তারা মনে করেন, আমি এখনো গুরু হবার যোগ্য নোই। আমি নিজে এখনো গন্তব্যে বা লক্ষে পৌঁছতে পারিনি। অনন্ত এই যাত্রাপথ। একের পর এক সত্য উদ্ঘাটিত হতে থাকে এই যাত্রায়। তো এইসময় অন্যকে সাহায্য করার নামে  সময় অতিবাহিত করা  মানে নিজের যাত্রাপথের বিঘ্ন সৃষ্টি করা। 

আরেক দল আছেন, তারা অন্যকে সাহায্য করার মধ্যে একটা আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন। নিজে উপরের ক্লাসের ছাত্র হয়ে নিচের ক্লাসের ছাত্রদের পড়ানো একটা আত্মতৃপ্তি দান  করে থাকে। এঁরা যেকোনো ছাত্রকেই গ্রহণ করে থাকেন ।

কিন্তু সত্যিকারের সিদ্ধগুরু, উপযুক্ত ছাত্রের বা অধিকারীর  খোঁজ করে থাকেন, অর্জিত জ্ঞানসুধাকে সংরক্ষণের জন্য। তাঁর বহু সাধনায় অর্জিত জ্ঞান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই বিদ্যা রেখে যেতে  চান। আর এই কারণেই আমাদের কাছে যোগগুরুর অভাব আবার এই কারণেই এই গুহ্যবিদ্যা দিন দিন লোপ পেতে চলেছে। ঠাকুর রামকৃষ্ণকে গুরু খুঁজে বেড়াতে হয়নি। বারোদা চরণ মজুমদারকে গুরু খুঁজে বের করতে হয়নি। এঁরা ঘরে বসেই গুরুর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। আবার এমন অনেক সিদ্ধিসাধক আছেন, যারা গুরুর খোঁজে হন্যে হয়ে ঘর ছেড়েছেন। যোগ্য আধার পেলে গুরুদেবগনও  তাকে শিক্ষা/দীক্ষা দেবার জন্য উদগ্রীব হন। শুদ্ধ আধার  বিবেকানন্দকে দীক্ষা দেবার জন্য পওহারীবাবা আগ্রহী ছিলেন।  

তো, যিনি ঈশ্বর উপলব্ধি করেছেন, কেবলমাত্র সেই সিদ্ধপুরুষের কাছেই যোগশিক্ষা করা কর্তব্য। অধ্যায়ন বা শাস্ত্রপাঠ মানুষকে একটা পথের সন্ধান দিতে পারে মাত্র। কিন্তু ব্যবহারিক বিদ্যা গুরুর কাছ থেকেই পেতে হয়। সিদ্ধ পুরুষের জীবনই যোগ। তাই তার সান্নিধ্যে না থাকলে, যোগশিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। অন্যদিকে সিদ্ধগুরুর নির্দেশ অনুযায়ী সূক্ষাতিসূক্ষ অন্বেষনে অগ্রসর হবার মতো প্রবল ইচ্ছেশক্তি না থাকলে, ধৈর্য্য না থাকলে, এই পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। সিদ্ধপুরুষের সান্নিধ্যে এলে, এবং তার কৃপা হলে, আমাদের সমস্ত দুর্বলতা কেটে যায় সত্য, কিন্তু প্রথম দিকে এদের কাছে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয়। প্রথম দিকে এরা ভাবি শিষ্যকে নিজের সেবার কাজে নিযুক্ত করেন, বা আশ্রমের বিভিন্ন জাগতিক কাজে নিযুক্ত করেন। যা আমাদের মতো অহংকারী মানুষের পক্ষে অবাঞ্চিত কাজ, যা যোগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে ভাবতেই পারি না। আসলে এইসময় আমাদের  সহ্য ক্ষমতার পরীক্ষা করা হয়। লক্ষে আমরা কতটা দৃঢ়, সেই পরীক্ষা দিতে হয়, আমাদের। খেয়ালের বশে, বা নিতান্ত কৌতূহলের বশে, এমনকি শুধুমাত্র অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে এই পথে আসা শুধু নিরর্থক নয়, বিপদজনকও বটে। 

আর একটা কথা বলি, আপনি গুরুর সাক্ষাৎ পেলেন, তার কাছে আপনার যোগশিক্ষার ইচ্ছে নিবেদন করলেন, আর তক্ষুনি  গুরুদেব আপনাকে আপনার ইচ্ছে পূরণ করে দিলেন, এমনটা হবার নয়।  এই বিদ্যা রাতারাতি আয়ত্ত্ব করবার বিষয় নয়। আর সিদ্ধগুরু পাত্রাপাত্র বিচার না করে, আপনাকে মুক্তিমন্ত্র  দান  করবেন না। আর এই বিষয় কোনো জাগতিক বস্তুর বিনিময়ে সংগ্রহ করা যায় না। সাঁতার শেখাবার আগে, দেখবেন সাঁতার শিক্ষক আপনার শারীরিক শক্তি, আপনার শ্বাসের শক্তির বৃদ্ধি করবার জন্য, বিভিন্ন ব্যায়াম ও প্রাণায়ামের শিক্ষা দেন। এর পর যখন জলে নামান হয়, তখন তিনি নিজে জলে নেমে, আপনাকে সাহায্য করেন, কিন্তু জলে নেমে  আপনি নিষ্ক্রিয় থাকলে, সাঁতার শিক্ষক আপনাকে প্রয়োজনে শুধু মুখে নয়, হাতের চাপড় দিয়েও আপনাকে উপযুক্ত করবার চেষ্টা করবেন।

 ঠিক তেমনি,  সিদ্ধগুরুর দায়িত্ত্ব আপনাকে মুক্তির পথের  সন্ধান দেওয়া। জীবন-মৃত্যুর চক্র থেকে বিচ্ছিন্ন করা।  যোগ কোনো শারীরিক কসরৎ নয়।  যোগ কোনো শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়াও নয়। এমনকি যোগ কোনো মানসিক ব্যায়ামও  নয়। যোগ একটা প্রক্রিয়া যা ঈশ্বর অনুভূতি এনে দিতে পারে।    যোগ এমন একটা প্রক্রিয়া যা আমাদের স্থুল শরীরে থাকা কালীন অবস্থাতেই ব্রহ্মানুভূতি অনুভব করাতে পারে ।  

বেদান্তদর্শনে, বা যোগদর্শনে বহুবিধ যোগের প্রণালী উল্লেখ করেছেন।  কঠোপনিষদে যমরাজ বলছেন, যোগাভ্যাস করে যারা অবিলম্বে সিদ্ধিলাভ করতে অসমর্থ, বা অপারগ, তাঁদেরও নিরাশ হবার কারন নেই।  তাঁরাও কালক্রমে, সৎ-কর্ম্মের অনুষ্ঠান ক'রে  মুক্ত হয়ে যাবেন। 

রাজযোগ আলোচনা প্রসঙ্গে যমরাজ বলছেন, (২/৩/১৬) মানুষের দেহের অভ্যন্তরে অসংখ্য নাড়ী ছড়িয়ে আছে।এর মধ্যে সুষুম্না নাড়ী প্রধান। এই নাড়ী শরীরের  মেরুমজ্জার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়ে, ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে, উর্দ্ধগামী হয়ে রয়েছে। যোগীগণ মনে করেন, এই সুষুম্না নাড়ী অবলম্বন  করেই মানবাত্মা সর্বোচ্চ লোকে পৌঁছতে পারেন  । স্থুলদেহ ত্যাগ কালে অর্থাৎ স্থুলদেহের মৃত্যুকালীন সময়ে, উদান বায়ুর সাহায্যে এই উৎক্রমন ঘটে থাকে। এই উৎক্রমন যদি, সুষুম্না নাড়ী অবলম্বন করে, উর্দ্ধগামী হয়, তবে মানবাত্মার অমৃতত্ব লাভ হয়। কিন্তু অন্যপথে অর্থাৎ ধমনীর পথ ধরে  মানবাত্মা নিষ্ক্রান্ত হলে, জীবের পুনর্জন্ম অবশ্যম্ভাবী।  ব্রহ্মরন্ধ্র হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সর্বোচ্চ স্থান। একেই বলা হয় ব্রহ্মলোক। এই ব্রহ্মলোক মানবাত্মার উন্নতির পরাকাষ্ঠা হিসেবে চিহ্নিত হয়। এখানেই মানবাত্মা নিত্যলোকের দর্শন পায়।  অর্থাৎ যেলোকে অমরাত্মা স্থিত হন। আর এর অন্যথা হলে, মানবাত্মা পুনঃ পুনঃ জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্ত  হতে থাকে। আর দুঃখ-কষ্ট -ক্লেশের ভাগিদার হতে থাকে। এইজন্য, যোগীগণ সুষুম্না কাণ্ডের জাগরণ ঘটিয়ে, বায়ুকে উর্দ্ধগামী করেন। সিদ্ধযোগী ভ্রূযুগলের মধ্যবর্তী স্থানে অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রে বায়ুকে স্থির করেন। শরীর থেকে মনকে ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করে, এই আজ্ঞাচক্রে একাগ্র করেন। এই অবস্থায় মানব কেবল চৈতন্যময় হয়ে অবস্থান করেন। দেহত্যাগকালে, যোগীর আত্মা সুষুম্না নাড়ী অব্লম্বন করে, ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে, উর্দ্ধমুখী হয়ে অনন্তে যাত্রা  করেন। এই যে আত্মার উৎক্রমন ক্রিয়া, এই ক্রিয়ায় সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে থাকে।  কিন্তু সিদ্ধ যোগী, যিনি নিয়মিত রাজযোগ অভ্যাস করেন, তিনি এই উৎক্রমন ক্রিয়ায় নিজেকে নিযুক্ত করতে পারেন। এই উৎক্রমন ক্রিয়ার জ্ঞান, ও কৌশল আয়ত্ত্ব করে যোগীর সাধনা।

 যাদের পক্ষে  সৎগুরু বা সিদ্ধযোগীর সন্ধান করা সম্ভব নয়, তাদেরকে দুটো  কথা বলি। প্রথমতঃ যা কিছু করবেন, তা সে শারীরিক হোক, বা মানসিক হোক, গভীর মনোযোগের সাথে করুন। আপনি জল পান করছেন,  ছবি  আঁকছেন, কি অফিসের কাজ করছেন, বা রাস্তায় হাঁটছেন - বা আকাশের মেঘ দেখছেন, যা কিছুই করুন না কেন, সদা সচেতন থাকুন। যে কাজ করছেন, সেই কাজে আপনি গভীর মনোযোগ দিন। অহেতুক তাড়াহুড়া করবেন না। যে কাজ করবেন, তা আপনার সাধ্য অনুযায়ী সর্ব শক্তি  নিয়োগ করে, করুন। প্রত্যেকটি কাজ আপনার ক্ষমতা অনুযায়ী উৎকৃষ্টতর করবার চেষ্টা করুন।

 দ্বিতীয়তঃ, প্রতিনিয়ত নিজের  শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে খেয়াল করুন। জানবেন, শ্বাসের সঙ্গেই বিশ্বের  প্রাণশক্তি, শ্বাসের সঙ্গেই  বিশ্বের  চেতনাশক্তি, এই শরীরে প্রতিনিয়ত যাতায়াত করছে। মুহূর্তের জন্য, এই যাতায়াতের পথে বিঘ্ন হ'লে, আপনার প্রাণপাত হবে। আর আপনি যদি শ্বাসক্রিয়ার  দিকে সদা সতর্ক থাকতে পারেন, তবে জানবেন, আপনার আপনার লক্ষ পূরণের জন্য, স্বয়ং ঈশ্বর আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। তা সে গুরুর সন্ধান হোক, জীবনে প্রতিপত্তিলাভ হোক,  অথবা জীবনে সুখের সন্ধান হোক। সবই দেখবেন, আপনার সামনে এসে হাজির হচ্ছে। এর জন্য আলাদা করে কোনো প্রয়াস করতে হবে না। একটা জিনিষ জানবেন, আপনার সঙ্গে একটা বিশ্বশক্তি সবসময় আপনার দিকে খেয়াল রেখেছে।  আপনাকে রক্ষা করছে।  এমনকি আপনাকে সতর্ক করছে। আপনি সেই  দৈববাণী  কি শুনতে পাচ্ছেন ? যদি শুনতে পান, তবে তার নির্দেশকে উপেক্ষা না করে, তার নির্দেশ অনুযায়ী জীবনের কর্ম্ম নির্ধারণ করুন। দেখবেন সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। তা সে আধ্যাত্মিক হোক বা জাগতিক হোক। তার নির্দেশেই সবকিছু চলছে, আপনি-আমি  নিমিত্ত মাত্র।  আপনি-আমি তো ছাড়, সমস্ত জগতের সমস্ত কিছু সংগঠিত হচ্ছে তাঁর নির্দেশে । তাঁর নির্দেশেই অগ্নি তাপ বিকিরণ করছে, সূর্য কিরণ দান করছে, চাঁদ জ্যোৎস্না দান করছে, বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। মেঘ বৃষ্টি দেন করছে।  তাই  তাঁর নির্দেশ মেনে চলুন, দেখবেন, সমস্ত সমস্যার সমাধান তিনিই করে দেবেন। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

শান্তিতে মরতে পারলে বাঁচি। (১)  মূলসূত্র : কঠোপনিষদ 

আমাদের বাড়িতে এক বুড়িমা আসতেন। বছর দুই আগেও আসতেন, এখন আর দেখি না। বড্ড অসহায়, কিন্তু স্বনির্ভর  ছিলেন। তার বয়স ৭০ /৮০ না তার বেশী তা বলতে পারবো না। কিন্তু নিজেই চাল-ডাল  ভিক্ষে করে, নিজের হাতে রান্না করে জীবন নির্বাহ করতেন। মুখে সব সময় একটা হাসি লেগে থাকতো। গৃহস্থের কাছে কিছু পেলে কৃতজ্ঞতা জানাতেন, কিন্তু কিছু না পেলেও, কখনো গোমড়ামুখো হতে দেখিনি।  তো এই বুড়িমা একটা কথা বলতেন, এখন শান্তিতে মরতে পারলে বাঁচি। আমাদের মতো সাধারনের কাছে, এটি একটি স্ববিরোধী কথা, মরলে আবার কেউ বাঁচে নাকি ?  

আসলে বাঁচা বা মরা দুটি আপেক্ষিক শব্দ মাত্র। একটির সঙ্গে আরেকটির পরিপূরক। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু যেন ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।   যারা মনে করে আমি জন্মেছি, তাদের অবশ্য়ই মনে রাখা উচিত যে সে একদিন মরবেই । কিন্তু যে জন্মেনি কোনোদিন সে আবার মরবে কি করে ? যার জন্ম নেই, তার মৃত্যুও নেই। এই বাঁচা বা মরা  কথাটার অর্থ রূপান্তর মাত্র। না কেউ  জন্মে না কেউ মারা যায়। 

নচিকেতার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিলো, মানুষের মৃত্যুর পরে কি আর তার কোনো অস্তিত্ত্ব থাকে ?
কঠোপনিষদে নচিকেতা যমরাজকে তার এই সংশয়ের কথা জানিয়েছিল। নচিকেতা বলছে, হে যমরাজ, প্রতিনিয়ত জীবের মৃত্যু হচ্ছে। কেউ বলেন, মৃত্যুর পরে স্থুল দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। এরপর তার আর কোনো অস্তিত্ত্ব থাকে না,   আবার কেউ বলেন,  মৃত্যুর পরে মানুষ নাকি আত্মারূপে বা সূক্ষ্মদেহে   যমলোকে প্রবেশ করে। আর সেখানে সে কৃতকর্ম্মের  ফল ভোগ করে।  আর এই যম লোকের রাজা আপনি। তো মানুষ স্থুলদেহ ত্যাগ করার পরে যমলোকের বাসিন্দা হয়।  এইরকম একটা কথা  আমরা শুনে থাকি।  সত্যিই কি মৃত্যুর পরে জীবের কোনো অস্তিত্ত্ব থাকে  ? আত্মা বলে কিছু আছে কি ? 

আমরা ভাবি, মৃত্যুর পরে কি হবে, সেই কথা আমরা নিশ্চই মৃত্যুর পরে জানতে পারবো। কিন্তু সত্য হচ্ছে, মৃত্যুর পরে কি হয়, তা দেহ বিচ্ছিন্ন স্বয়ং আত্মাও জানতে  পারে না। কেবলমাত্র অতি অল্প সংখ্যক মানবাত্মা  এই সম্পর্কে জ্ঞাত থাকেন । আর এই জ্ঞান সে দেহে থাকাকালীন অবস্থাতেই অর্জন করেছিলেন । যমরাজ বলছেন, মৃত্যুর পরে কি হয়, তা দেবতারাও জানার জন্য আগ্রহী। অর্থাৎ দেবতারাও এই বিদ্যা আয়ত্ত্ব করতে পারে নি। আর এই বিষয়ে নানা মুনির নানা মত।  এর কারন হচ্ছে, যিনি যে অবস্থায় আছেন, তিনি সেইমতো দর্শন করে থাকেন । তাই এই সম্পর্কে সঠিক তত্ত্ব একমাত্র যমরাজই দিতে পারেন, যিনি এই রাজ্যের রাজা ।
এখন কথা হচ্ছে, এই যমরাজ কে ? বলা হয়ে থাকে ইনি মৃত্যুর রাজা। আর এর সাগরেদ হচ্ছে, রোগ, ব্যাধি, বার্ধক্য ইত্যাদি। আর এনার একজন যোগ্য ম্যানেজার আছেন, তার নাম চিত্রগুপ্ত। এই চিত্রগুপ্তের খাতায় যুগযুগ  ধরে জীবের জন্ম মৃত্যুর দিনক্ষণ লেখা আছে।  আর এনার এমন ক্ষমতা যে সারা পৃথিবীর সমস্ত জীব, জন্তু তা সে আকাশচারী  হোক, জলচরী হোক, বা স্থলচারী হোক, এমনকি মাটির নিচে, পাতালে,   বসবাসকারী কীটপতঙ্গ হোক বা সমুদ্রের নিচের কোনো পাতাসবাসী হোক,  সবাই এই যমরাজের   নজরের মধ্যে। যমরাজের হাত থেকে ছিঁটকে  গিয়ে, হাজার হাজার বছর কেউ বেঁচে আছেন বা স্থূল দেহে অবস্থান করছেন, এমন দৃষ্টান্ত নেই। অদ্ভুত তার শাসন ব্যবস্থা। অদ্ভুত তার শাসন প্রণালী। আর এই শাসন চলছে, জীব সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই। এখন কথা হচ্ছে, এই যমরাজ কে ? আসলে রূপক এই যমরাজের পরিচয় হচ্ছে, সূর্যপুত্র।  যমির  পুত্র যম। যমরাজকে বলা হয়ে থাকে ধর্ম্মরাজ। আর মহাভারতের যুধিষ্ঠির হচ্ছেন, সাক্ষাৎ যমরাজের অবতার। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, যমরাজ হচ্ছে সেই ব্যক্তি যিনি প্রথম মৃত্যুকে দর্শন করেছিলেন। অর্থাৎ যম রাজ্যে  প্রবেশকারী প্রথমব্যাক্তি।    

আমাদের দৃষ্টিতে, কঠোপনিষদের যমরাজ আসলে একজন শিক্ষক, আচার্য্য, গুরুদেব। এনার একটা বাড়ি আছে।  সেখানে তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন।  তার সমাজের ভয়ও আছে। এমনকি তিনি পাপের  ভয়ও  করেন। তা না হলে, নচিকেতা যখন তার বাসস্থলে পৌঁছান, তখন দেখা যায়, যমরাজ বাড়িতে নেই। তো তিনদিন পরে, যমরাজ বাড়িতে ফিরে, দুয়ারে ব্রাহ্মণ যুবককে দেখে ঘাবড়ে গেলেন কেন ? তিনদিন তিনরাত নচিকেতা না খেয়ে তার দুয়ারে হত্যে  দিয়ে পড়ে আছেন  দেখে, তিনি সূর্যপুত্র  বৈবস্বত অর্থাৎ তার ভাইকে  ডেকে তাড়াতাড়ি জল আনতে  বললেন, নচিকেতার পা ধুয়ে দেবার জন্য।   

দেখুন মৃত্যুর পরে কি হয়, সেই তত্ত্ব  যারা যেমন জানেন  বা ভাবেন, তাদের  কাছে, মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা ঠিক তেমন ভাবেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। যমরাজ বলছেন, অজ্ঞানীগণ মরোত্তীর্ণ অবস্থা উপলব্ধি করতে পারেন না।  তা সে ইহলোকে হোক বা পরলোকে।  কারন মৃত্যুর পরে, এরা সঙ্গহীন ও সঙ্গাহীন অবস্থায় ইতস্তত ঘোরাফেরা করে। ফলত এদের পরলোক সন্মন্ধে কোনো জ্ঞান থাকে না। কিন্তু এদের মধ্যে থাকে সুপ্ত বাসনা-কামনা। আর এই কামনা বাসনার তাড়নায়, এরা পরবর্তী দেহ ধারনের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। আর এই কারণেই এরা পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহন করে থাকে। তাই এদের কাছে, তাদের পূর্ব জীবন, অর্থাৎ যেখান থেকে এসেছে, সেই সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই থাকে না।  এমনকি কেন এসেছে, অর্থাৎ আমাদের কেন এই দেহ ধারণ করতে হয়, তার সত্যিকারের উদ্দেশ্য কি তা তার জানা নেই। এঁরা বিষয়সুখে মগ্ন থাকতে চায়।  বিষয়ের পিছনে ছুটে  বেড়ায়।  বিষয়কে কেন্দ্র করে ঘূর্ণিপাকের  বায়ুর মতো বিষয়কে কেন্দ্র করে জন্মের পর জন্ম ধরে ঘুরতে থাকে। আর আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে,এরা  বিষয়কে কেন্দ্র করে ঘোরে  বটে কিন্তু বিষয়কে প্রাপ্তির যে নেশা তা তাদের কোনোদিন শেষ হয় না। নেশারুরা যেমন বারবার নেশার দ্রব্য সংগ্রহ করবার জন্য ছুটে  বেড়ায়। এরাও বাসনার তৃপ্তির জন্য, জন্ম থেকে জন্মান্তর ধরে ঘুরে বেড়ায়। তবু বাসনার তৃপ্তি হয় না।  তাই যমরাজ বলছেন, এরা বারবার অধিগত হয়, অর্থাৎ বারবার  জন্ম ও মৃত্যু বরণ  করে। 

দেখুন জগৎ দুটো, একটা পার্থিব আর একটা অপার্থিব। আমরা যখন যে জগতে অবস্থান করি, তখন সেই জগৎকে সত্য বলে মনে করি। ধরুন আপনি জেগে আছেন, তো আপনি এই পার্থিব জগতের সমস্ত কিছু সত্য বলে আপনার কাছে প্রতিভাত হচ্ছে। এই আকাশ, এই বাতাস, এই সূর্য, এই পৃথিবী, এই পৃথিবীর মানুষজন, আপনার আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব, এমনকি আপনি নিজে একটা পার্থিব শরীর সবই আপনার কাছে সত্য বলে মনে হচ্ছে। আর এগুলো আপনি প্রতক্ষ্য করছেন।  আপনি ফুলের গন্ধ পাচ্ছেন, আপনি মধুর সংগীত উপভোগ করছেন, আপনার সুন্দর স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে আপনি নিজের চোখের সামনে দেখছেন, আপনি রসগোল্লার স্বাদ নিচ্ছেন, মায়ের কোলের স্পর্শসুখ বা মায়ের স্নেহ, বাবার আদর  অনুভব করছেন - এগুলো সবই তাৎক্ষণিক ভাবে সত্য বলে আপনার মনে হচ্ছে। 

আবার দেখুন আপনি যখন ঘুমিয়ে আছেন, তখনও আপনি আছেন, শরীর ক্রিয়াশীল না থাকলেও আপনি এই শরীরেই আছেন। এবং আপনি সেই স্বপ্ন জগতের সমস্ত কিছু অবিকল পার্থিব জগতের মতোই উপভোগ করছেন।  তখনও আপনি ইন্দ্রিয়শক্তি কাজ করছে। অর্থাৎ আপনি শুনছেন, দেখছেন, খাবারের স্বাদ উপভোগ করছেন, এমনকি স্ত্রী-সান্নিধ্য অনুভব করছেন।  স্বপ্নের জগতে সবই আছে, আপনিও সেখানে আছেন, অবিকল এই পার্থিব জগতের মতোই। এই স্বপ্নাবস্থাতে আপনার কাছে এই জগৎ অনুভবের অযোগ্য নয়, এমনকি অবিশ্বাস্য নয়, একবিন্দু অসত্য আপনার মধ্যে তখন জগতে পারে না। কিন্তু এইসব অসত্য বলে মনে হয় তখনই যখন আপনি ঘুম বা স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠেন। এই জেগে ওঠাও যেমন সত্য, স্বপ্নে বিচরণ সত্য, আবার এই পার্থিব জগৎ সত্য। আপনি হয়তো বলবেন, না স্বপ্ন কখনো সত্য হতে পারে না। কিন্তু এই কথা কখন আপনি বুঝতে পারেন, যখন আপনি জেগে ওঠেন। যতক্ষন আপনার মধ্যে জাগ্রত অবস্থা না হচ্ছে, ততক্ষন আপনার কাছে স্বপ্ন অবশ্য়ই সত্য বলে প্রতিভাত হচ্ছিলো। 

আবার ধরুন, আপনি গাঢ় ঘুমে আছন্ন। সেখানে এই পার্থিব, অপার্থিব দুটো জগৎই অদৃশ্য হয়ে গেছে। তাবলে কি এই দুটো জগতের অস্তিত্ত্ব নেই ? তা কিন্তু নয়, দুটো জগৎই আছে, কিন্তু আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। অর্থাৎ আপনি কোন অবস্থাতে আছেন, তার উপরে নির্ভর করছে, জগতের স্থিতি। আপনি জেগে আছেন, তাই পার্থিব জগৎ আপনার কাছে দৃশ্যমান, আপনি স্বপ্নাবস্থায় আছেন তাই স্বপ্নের জগৎ আপনার কাছে দৃশ্যমান, আর আপনি যখন গাঢ়  ঘুমে আচ্ছন্ন আছেন, তখন এই দুটো জগৎই আপনার কাছ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। 

আমাদের ইহকাল ও পরকাল, ঠিক তেমনি। কাল কথাটার অর্থ হচ্ছে, সময়। ইহকাল অর্থাৎ বর্তমান সময়।  আর পরকাল হচ্ছে, বর্তমানের আগের সময় বা পরের সময়।  পরকাল বলতে আর একটা জিনিস বোঝায়, জন্মের আগে ও মৃত্যুর পরে যে কালে বা সময়ে আমরা অবস্থান করি, তাকে বলা হয় পরকাল। ঠিক তেমনি প্রত্যেক মানুষের দুটো অবস্থা একটা হচ্ছে চেতন অবস্থা আর একটি হচ্ছে অচেতন অবস্থা।  অচেতন অবস্থায় মানুষ প্রকৃত সত্যকে ধরতে পারে না। তখন সে নানান রকম অসত্য বা মরীচিকাকে সত্য বলে মনে করে। অন্ধকার রাতে যেমন মানুষ দড়িকে সাপ বা সাপকে দড়ি বলে মনে করে। ওই মুহূর্তে সে যা ভ্রমাত্মক দৃষ্টিতে দেখছে, তাকে সে সত্য বলেই  মনে করছে, এবং সেইমতো সে আচরণ করছে। এতে তার কোনো দোষ  নেই। কিন্তু টর্সের আলোতে যেমন তার ভুল ভেঙে যায়, তেমনি জ্ঞানের আলোক যখন মানুষের অন্তরে প্রবেশ করে তখন তার ভুল ভেঙে যায়। 

এই সব জ্ঞানের কথা আমরা ধীরে ধীরে শুনবো। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।                 

শান্তিতে মরতে পারলে বাঁচি। (২)











h

Saturday 8 May 2021

SIMPLE LIVING HIGH THINKING - সাধারণ জীবন ও উচ্চ চিন্তা / সম্মোহন


 SIMPLE LIVING HIGH THINKING - সাধারণ জীবন ও উচ্চ চিন্তা 
ভগবানের রাজত্বে ভেদাভেদ নেই। 

SIMPLE LIVING HIGH THINKING - এই উক্তিটি শুনে আমার বন্ধু মন্তব্য করেছিল, ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা আরকি। জানিনা, ছেঁড়া  কাঁথায় শুয়ে লক্ষ টাকার স্বপ্ন দেখা যায় কি না, তবে মানুষের চিন্তায় যখন উৎকর্ষতা আসে, তখন তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। এটা আমার প্রত্যক্ষ করা  সত্য। 

দুপুরবেলা বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। গেটের দরজায়, দুটি মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাকে দেখে বললো, রামকৃষ্ণ   আশ্রম থেকে এসেছি। কিছু সাহায্য চাই। বিলে দেখলাম,  লেখা শ্রী রামকৃষ্ণ অনাথ আশ্রম । তো তাদের জিজ্ঞেস করলাম, অনাথ কে ? ঠাকুর রামকৃষ্ণ ? নাথ কথাটার অর্থ হচ্ছে ঈশ্বর। ঈশ্বর-বিহীন কেউ হতে পারে ? পারে না।  বাপুজি আদর করে নাম রেখেছিলেন, হরিজন, অর্থাৎ হরির জন । অভিধান খুলে দেখি, হরিজন কথার একটা অর্থ হচ্ছে হিন্দু সমাজে অস্পৃশ্য করে রাখা সম্প্রদায়ের লোক। 

 বহু মানুষ মনে করেন, নির্যাতিত শ্রেণীর জন্য, শিক্ষার প্রয়োজন। আমার  মাঝে মধ্যে মনে হয়, যারা নির্যাতন করেন , তাদের শিক্ষার প্রয়োজন আরো বেশি। অনাথ আমরা কেউ নোই, আবার হরিজন আমরা সবাই। বিশেষ শ্রেণীকে এই নামে  ডাকা শুধু অন্যায়  নয়, গর্হিত কাজ । 

আমার বাড়ির পাশে, একটা কুকুর   ২টি বাচ্চা দিয়ে, অকালে মরা যায়। বাচ্চাগুলো একজায়গায় জবুথবু হলে শুয়ে থাকতো। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, কুকুরের বাচ্চাদের বড়  করবার দায়িত্ত্ব হচ্ছে, মা-কুকুরের। বাবা কুকুরের কোনো দায়িত্ব নেই।  মাঝে মধ্যে কুকুরের বাচ্চা  গুলো বাড়ির মধ্যে চলে আসতো।  কিন্তু তাড়া খেয়ে আবার ফিরে যেত। লাঠি-ঝাঁটা আর এঁটোকাঁটা খেয়ে তারা বড়ো  হতে লাগলো। বাড়ির ছোটছোট ছেলেমেয়েরা কিন্তু ওই কুকুরের বাচ্চা গুলোকে ভালো বাসতো। তাদের আদর করতো, মাঝেমধ্যে খাবার খেতে দিতো। কিন্তু কুকুরের বাচ্চা গুলো সেই খাবার প্রথমদিকে  ছুঁয়েও  দেখতো না। বাচ্চাগুলোর কাছে গেলে, ওরা  ভয় পেয়ে দৌড় লাগাতো। যখন কেউ ধারে কাছে থাকতো না, তখন তারা সেই খাবারগুলো খেয়ে নিতো। এর পরে লক্ষ করতাম, যেখানে খাবার দেওয়া হয়, সেখানে এসে কুকুরের বাচ্চাগুলো  ঘুরঘুর করতো। এইভাবে, বেশ  কিছুদিন যাবার পর, দেখলাম, বাচ্চা ছেলেমেয়েরা তাদের কাছে গেলে, তারা বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করতো, ধীরে ধীরে তাদের কাছে আসতে  লাগলো। অর্থাৎ এখন কুকুরগুলো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। বড়দের কাছে, লাঠি-গুতো  খেয়ে, এটাই তাদের প্রাপ্তি ভেবেছিলো, কিন্তু ছোটদের কাছে, খাবার পেয়ে, আদর ভালোবাসা পেয়ে, তারা বাচ্চাদের  খেলার সাথী হয়ে উঠলো।  এমনকি, তাদের রক্ষক হয়ে উঠলো। 

তো যারা বিদ্বান, সভ্য, শিক্ষায় অনেকটা এগিয়ে, তাদেরকে বলি, অবহেলিত মানুষগুলো অকৃত্তিম ভালোবাসা চায়, লোকদেখানো মানবসেবা চায় না। তথাকথিত নিম্নবর্গের মধ্যে যারা নেতা স্থানীয়, তাদের পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন, তারা কতনা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তারা যদি, তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষের কাছ থেকে সহনশীলতা এবং ভালোবাসা পেতেন, তবে, তারা সেটাই ভাগ করে নিতে শিখতেন। তুমি যা পেয়েছো, সেটাই তুমি দিতে পারবে। তুমি যদি নিজে ভালোবাসা, সহানুভূতি না পাও, তবে তা তুমি দেবে কি করে ? এক উচ্চবর্ণের নেতা বলছিলেন, আমরা দলিতদের বিরুদ্ধে নোই, কিন্তু দলিত সংরক্ষণ আইনের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ দলিতদের নির্যাতন করা তাদের চিরকালীন আইনসিদ্ধ অধিকার, তাদের  বিচার করবার অধিকার কারুর নেই।  অর্থাৎ মনুবাদী সমাজ যে কথা বলেছিলেন, তারা  গো-ব্রাহ্মণের রক্ষক, মানুষের নয় । তাই তারা উচ্চবর্ণের অপরাধীদের জন্য সংরক্ষণ চায় ।   ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়কে নির্যতন করলে, করতে পারে, ক্ষত্রিয় বৈশ্যকে   নির্যতন করতে পারবে, বৈশ্য শূদ্রদের  নির্যাতন করতে পারে। কিন্তু উল্টোটা হতে পারবে না। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য সবাই মিলে   শূদ্রদের নির্যাতন  করতে পারবে, এটাই মনুবাদী সমাজের আইন। দেশের আইন সেইমতো কেন হবেনা ?  সবল দুর্বলকে অত্যাচার করবে, নিধন করবে, ভোগ করবে, আবার সেবা নেবে, এটাই প্রকৃতির নিয়ম, জঙ্গলের নিয়ম । অন্যদিকে সভ্য  সমাজ, ভগবানের সমাজ   কিন্তু এর উল্টো কথা বলে, দুর্বলের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে বলে, দুর্বলের রক্ষক হতে বলে সবলকে । অন্যায়কারী, অত্যাচারী, অধার্ম্মিক এদের সভ্য করা, বিচারশীল হওয়া, ভগবানের রাজত্ত্বের নিয়ম।  আমরা যদি সভ্য  হতে চাই, আমরা যদি ভগবানের নিয়মকে মেনে চলতে চাই, আমরা যদি ভগবানের রাজত্ত্বে বাস করতে চাই,  তবে জঙ্গলের নিয়মকে ভাঙতে হবে। দুর্বলকে সংরক্ষিত করে  রাখতে হবে। তাদের আরো আরো ভালোবাসা দিতে হবে, আমাদের আরো সহনশীল হতে হবে, আমাদের আরো সহানুভূতিশীল হতে হবে। 

একটা কথা বলি, সমাজ থেকে আপনি যেমন নেবেন, সমাজকে তেমনি দিতেও হবে। এই দেওয়া-নেওয়াই বেঁচে থাকবার রসদ।সংসারের নিয়ম।  আমরা জানি শ্বাস-প্রশ্বাস দ্বারা আমরা বেঁচে থাকি। পুষ্টিকর খাদ্য নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি। কিন্তু একটা কথা ভাবুনতো, আপনি  খালি বাতাস গ্রহণ করবেন, শরীর থেকে বাতাস বের করবেন না, কুম্ভক করে বসে থাকবেন, তাহলে আপনি কি বেঁচে থাকতে পারবেন। ঠিক তেমনি, আপনি শুধু পুষ্টিকর সুস্বাদু খাবার গ্রহণ করবেন, কিন্তু বাহ্য-প্রচ্ছাপ করবেন না, তাহলে কি আপনি বেঁচে থাকবেন ? থাকবেন না। তেমনি সমাজে যদি শুধু গ্রহণকারীর সংখ্যা বেড়েই চলে, ত্যাগীর সংখ্যা কমতে থাকে, তবে এই মনুষ্য সমাজ একসময় ভেঙে খান খান হয়ে যাবে।ভগবান এর প্রতিশোধ নেবেন। আমাদের উচিত, প্রযোজনয়ী-টুকু রেখে, বাকিটা ফিরিয়ে দেওয়া।  

জীবনের উদ্দেশ্য, জীবাত্মার বিকাশ সাধন। পরমাত্মার জ্ঞান অর্জন। দেখুন, আমরা সবাই সম্পদ সংগ্রহে ব্যস্ত। তা সে জাগতিক সম্পদ বলুন, বা অন্তরের  সম্পদ বলুন। আমরা সবাই আসলে দেহ ধারণ করি, কর্ম্ম করবার জন্য। নিজেকে সমৃদ্ধ করবার জন্য। আমাদের ব্যক্তিসত্ত্বার বিকাশের জন্য আমরা দেহ ধারণ করি।   আমরা সবাই আনন্দে থাকতে চাই। দুই ভাবে, আমরা এই আনন্দের অবস্থায় যেতে পারি। জাগতিক সম্পদ বৃদ্ধি করে, আমরা আনন্দ পেতে পারি।  আমাদের বেশিরভাগের উদ্দেশ্যই  হচ্ছে প্রাচুর্য্যের মধ্যে শান্তির  সন্ধান । গুটিকয় মানুষ আছেন, যারা জাগতিক বস্তু নয়, অন্তরের মধ্যে শান্তি খোঁজেন। আর এই শান্তি তাদের আসে পরিছন্ন চিন্তা থেকে, শুভ চিন্তা থেকে। আর এই চিন্তার উৎকর্ষ সাধনের উপায় বাতলায় ধর্ম্মীয় সৎগুরুগন। মানুষের চিন্তাধারার মধ্যে পরিবর্তনই আনাই তাদের কাজ। মানুষের মধ্যে প্রেম গুনের উৎকর্ষ সাধন তাদের কাজ। 

আমাদের মতো সাধারনের জন্য সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার মানে হচ্ছে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান ইত্যাদির সংস্কার, বা সুলভ করা । শরীরকে টিকিয়ে রাখবার জন্য, আমরা সমস্ত বাধা অতিক্রম করতে চাই। অহং-এর চরিতার্থ করবার জন্য, আমরা সংগ্রাম করি। তাই যেখানে সে জন্মেছে, তার যে কর্ম্মক্ষেত্ৰ, তার যে আত্মীয়স্বজন, তাদের সঙ্গে তার যে সামাজিক সম্পর্ক - এটা বজায় রাখবার জন্য, এমনকি দৃঢ় করবার জন্য, সংগ্রামে লিপ্ত হই। আমাদের জীবন সংগ্রাম আসলে নিজেকে সফল করবার  সংগ্রাম। আমাদের সংগ্রাম হিংসার সপক্ষে, ঈর্ষার সপক্ষে, অশান্তির সপক্ষে । প্রতিবেশীরা আমার থেকে এগিয়ে যাবে, এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। এমনকি আমার স্ত্রী আমার থেকে এগিয়ে যাবে, এটা আমাদের কাছে অসহ্য। আর সারা জীবন এই সংগ্রামে লিপ্ত থেকে আমরা নিঃস্ব হয়ে যাই আর মৃত্যুকালে আমাদের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, কি পেলাম ? মানুষ তখন বুঝতে পারে, সে অসহায়, একটা হালবিহীন নৌকার যাত্রী। 

আর ঐযে গুটিকয় মানুষের কথা বলছিলাম,  তারা চেতনার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকেন। তারা তাদের চিন্তার মধ্যে সমতা আনেন। আর চিন্তার মধ্যে যখন তার সমতা এসে যায়, তখন  সমস্ত জিনিসকে   সে সঠিক ভাবে দেখতে পারেন। অর্থাৎ আপনি যত  উপরে উঠে যাবেন, তখন যেমন নিচের জিনিসগুলোকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় না, তেমনি সমস্যাগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে যান। তখন একটা ধর্ম্ম বৃক্ষের জন্ম হয়, যা একটি চরিত্রবান ও সৎগুণসম্পন্ন মানুষরূপ ফল প্রদান করতে পারে। একেই বলে দিব্যচেতনা সম্পন্ন মানুষ।  একেই বলে আত্মউপল্বদ্ধি।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

ঈশ্বরীয়  প্রেম-ভালোবাসার খোঁজে। (১) ভালোবাসা কারে কয় ?  : ঈশ্বর প্রেমের মহিমা। ভগবানকে ভালোবাসুন

জীবাত্মার অনন্ত যাত্রাপথে দুটো বাঁক - টার্নিং পয়েন্ট। একটা জন্ম একটা মৃত্যু। ভালোবাসা মানুষকে জন্ম দেয়, রূপান্তর ঘটায় , জীবনের বিকাশ ঘটায়, আর ভালোবাসার অভাব  মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। ভালোবাসা মানুষকে বাঁচার প্রেরণা যোগায়।ভালোবাসার অভাব  মানুষকে শেষ করে দেয়  আজ আমরা নিখাদ ভালোবাসা নিয়ে কয়েকটা কথা শুনবো। 

সাত-আট মাস আগে, আমার এক আত্মীয়ের নাতি হয়েছে, তো তাকে দেখতে গেলাম। তো বৌমা নাতিকে কোলে করে নিয়ে আমার কাছে এলো। আর বাচ্চাকে লক্ষ করে বলতে লাগলো। ওই দেখো দাদু- এসেছে, তোমাকে দেখতে। আরো কতসব কথা বৌমা বাচ্চার দিকে মুখ করে বলতে লাগলো। আমরা জানিনা, বাচ্চারা এইসব কথার অর্থ বুঝতে পারে কি না। বাচ্চাটা আমার দিকে মুখ করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। মুখে একটু মিষ্টি হাসি ফুটলো। এরপরদিন, আমি আবার ওদের বাড়িতে যাই, সেদিন  বাচ্চাকে  স্নান কারবার সময়।  স্নানের আগে তেল মাখানোর সময় ও ভীষণ কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে । আমি রাস্তা থেকে তার কান্না শুনতে পেলাম। বৌমা নানান কথা বলে তাকে শান্ত করবার চেষ্টা করতে লাগলো। আমার মনে হতে লাগলো, শিশু তো কথা বলতে পারে না।  মা যা বলছে শিশু কি তা বুঝতে পারে ? শিশু বুঝুক না বুঝুক মা কিন্তু কথা বলা বন্ধ করে না। আসলে শিশু সব বুঝতে পারে। তাই মা যখন তাকে ধমক দেয়, তখন সে কেঁদে ওঠে। আবার মা যখন তাকে আদর করে, চুমু খায়, ভালো ভালো কথা বলে তখন সে হাসে। শিশু সব বুঝতে পারে। সে হয়তো মায়ের ভাষা বোঝেনা, কিন্তু ভাব বুঝতে পারে। ভালোবাসার ভাষা শুধু মানুষ নয়, জীবজন্তু, গাছপালা সবাই বুঝতে পারে। শিশু যেমন হাত-পা নেড়ে, মুখের হাসি দিয়ে তা প্রকাশ করে থাকে।  ঠিক তেমনি পশু-পাখি বিভিন্ন ভাবে তা প্রকাশ করে থাকে। ভালোবাসা গাছের ফুল-ফল দিতে এমনকি নতুন পাতা  ছাড়তে উদ্দীপ্ত হয়। 

বিজ্ঞান এখনো মায়ের ভালোবাসার উৎসের  সন্ধান দিতে পারে নি। কিন্তু শিশু স্বাভাবিক ভাবে বড়ো হয়ে উঠবার জন্য, তার বুদ্ধির স্বাভাবিক বিকাশের জন্য, মায়ের ভালোবাসা একান্ত প্রয়োজন। আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের মেয়ে সন্তান, জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই তার মাকে-বাবাকে হারায়। মেয়েটি বহুদিন কিছু খেতে চাইতো না। ঘ্যানর ঘ্যানর করতো। ধীরে ধীরে তার শরীরের বৃদ্ধি হয়েছে ঠিকই কিন্তু তার মানসিক বুদ্ধি-বৃত্তির বিকাশ ঘটেনি। এটা-কি ভালোবাসার অভাবে ?

ভালোবাসা মানুষকে নিরাপত্তা দেয়।  ভালোবাসা মানুষকে সমস্ত ভয় থেকে দূরে রাখে। ভালোবাসা একটা দিব্য  শক্তি। ভালোবাসা আমাদের কাজের প্রেরণা জোগায়। পৃথিবীর বিকাশের জন্য, মানবজাতির বিকাশের জন্য, এমনকি জীবজন্তু, উদ্ভিদ ভালোবাসার জোগানে সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। ভালোবাসা একটা জীবনদায়ী ঔষধ, আমাদের মানসিক সুস্থতা এমনকি শারীরিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে গেলে ভালোবাসার মতো অমোঘ ঔষধ আর নেই। এই ভালোবাসাই  পারে, একজন মানুষকে রুপান্তরিত করতে। মানুষকে  মানবিক করে গড়ে তুলতে। ভালোবাসা মানুষকে দীর্ঘজীবী করতে পারে। আবার ভালোবাসার অভাব মানুষকে করতে পারে হতাশ, দুঃখী এমনকি নিষ্ক্রিয় করে রাখতে পারে। যে বাড়িতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ভালোবাসা পায়  না, তারা তাড়াতাড়ি অসুস্থ হয়ে পড়ে, এমনকি অকালে মারা যায়।   

ছোটবেলা থেকে যে শিশু স্নেহ-ভালোবাসা পায়  নি, সে হয়ে উঠতে পারে নিষ্ঠূর, কর্তব্য বিমুখ, অসৎ. সমাজ বিরোধী। ছোটবেলা থেকে যে শিশু  ভয়ের পরিবেশে মানুষ হয়েছে, তার মধ্যে নিষ্ঠূরতা, ক্রূরতা, হিংসা - এইসব খারাপ গুণগুলো স্বাভাবিক ভাবেই বৃদ্ধি পাবে। তাই আমরা দেখতে পাই, বাড়িতে মা-বাবার সঙ্গে যখন ঝগড়াঝাটি হয়, তখন শিশু অসহায় হয়ে ওঠে, কেঁদে ওঠে - আর এই সব ঘটনার প্রভাব তার সারা জীবন ধরে চলতে থাকে। 

আমাদের মধ্যে একটা সাধারণ ধারণা আছে, ভালোবাসা মানে একটা আবেগের খেলা, যা একমাত্র বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে হতে পারে, আর যার শেষ পরিণতি হচ্ছে শারীরিক দিকে থেকে কাছাকাছি পৌঁছনো। ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়, ভালোবাসা কখনো কামনা-ভোগবাসনা বা দেহ সৌন্দর্য্যের  এমনকি গুনের আকর্ষণের বিষয় নয়। ভালোবাসা একটা স্বীকৃতি। ভালোবাসা একটা সদবৃত্তির অনুসন্ধান ও প্রকাশ। ভালোবাসা মানে মনোযোগ। ভালোবাসা মানে সুখদুঃখের মধ্যেও স্মরণে রাখা। ভালোবাসা মানে পরিপূর্ন বিকাশের জন্য যা প্রয়োজন তা পূরণ করা। 

আপনি আপনার সন্তানকে ভালোবাসেন, মানে সন্তানের পরিপূর্ন বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু করে থাকেন। এই ভালোবাসা সন্তানকে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমেরও হতে পারে, আবার তার কৃতিত্বের জন্য প্রসংসা হতে পারে। আপনি যখন আপনার বাড়িকে-গাড়িকে ভালোবাসেন, তখন আপনি আপনার বাড়িকে বা গাড়িকে পরিষ্কার-পরিছন্ন করতে চাইবেন। সময়মতো তার মেরামতি করবেন। অর্থাৎ আপনার ভালোবাসা যার উপরে বর্ষিত হবে, সে যাতে ভালো থাকে তার চেষ্টা করবেন। আপনি আপনার দেহকে যদি ভালো বসেন, তবে আপনি অবশ্যই  দেহের প্রতি খেয়াল রাখবেন। সময় মতো পুষ্টিকর খাদ্য খাবেন, সময়মতো ঔষধ সেবন করবেন। অর্থাৎ দেহকে ভালো রাখবার জন্য যা করবার তাই আপনি করবেন। এবং এর মাধ্যমে আপনি নিজেকে বা দেহকে ভালো রাখবেন। আপনি একটা আনন্দ অনুভব করবেন। তো আপনি দেখুন, ভালোবাসলে, যাকে আপনি ভালো বাসবেন সে যাতে ভালো থাকে তার জন্য আপনি সমস্ত উপায় খুঁজে বের করবেন, এবং সেই মতো কাজ করবেন, আর সত্যি কথা বলতে কি আপনি এর মাধ্যমে নিজের মধ্যে একটা তৃপ্তি খুঁজে পাবেন। সর্ব্বশেষে আপনি নিজে ভালো থাকবেন।

দেখুন আপনি  যদি জনপ্রিয় হতে চান , তবে যাদের কাছে জনপ্রিয় হতে চান , তাদের আপনি ভালোবাসুন, তাদের সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করুন , তাদের কাজে উৎসাহ দিন । তাদের উন্নতির কথা চিন্তা করুন । আপনি তখন তাদের কাছে অবশ্য়ই জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন।  

আবার আপনি  যদি পণ্ডিত হতে চান , তবে আপনি  বই-পাঠের  প্রতি ভালবাসা গড়ে তুলুন । বইয়ের বিষয়ের প্রতি গভীরভাবে মনোযোগী হোন । যখন আপনি  বইয়ের বিষয়ের প্রতি অনুরক্ত হবেন , তখন দেখবেন  আপনার  ভিতরে নতুন নতুন ক্ষেত্র খুলে যাবে, আপনার  মধ্যে নতুন নতুন ধারণার জন্ম হবে, নতুন নতুন  জ্ঞানের উন্মেষ ঘটতে থাকবে। 

আপনি  যদি  সুস্থ থাকতে চান, তবে আপনি আপনারা  চারিপাশের মানুষগুলোর সুস্বাস্থ্য কামনা করুন। এমনকি আপনার  চারিপাশে যত  জীবজন্তু ঘোরাফেরা করছে, এমনকি যত  গাছপালা, আপনার  চারিপাশে বিরাজ করছে তাদের ভালো থাকতে সাহায্য করুন ।  তবে দেখবেন আপনিও   স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠেছেন, তা সে শারীরিক হোক বা মানসিক ।    

এরপরে আমরা আর একটু গভীরে প্রবেশ করুন । আপনি যদি ঈশ্বরকে ভালোবাসেন, যিনি  বিশ্বপিতা, যিনি সমস্ত বিশ্বসংসারের মালিক, তাকে যদি আপনি ভালোবাসেন তাহলে কি হবে, আপনি ভগবানের  ভালো চাইবেন, আর ভগবানের  বিকাশের চেষ্টা করবেন। অর্থাৎ ঈশ্বর তখন আপনার মধ্যে প্রকাশিত হবে। আপনার মধ্যে তখন ঈশ্বরের অসীম গুনের প্রকাশ হতে থাকবে। এটাই ঈশ্বর-প্রেমের মহিমা। নিজের মধ্যে কিভাবে ঈশ্বরপ্রেম জাগিয়ে তোলা যায়, সে সম্পর্কে আমরা ভবিষ্যতে আলোচনা শুনবো।

 ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

ঈশ্বরীয় প্রেম-ভালোবাসার খোঁজে  (২) 

 যে কোনোদিন প্রেমে পড়েনি, তাকে প্রেম সম্পর্কে কিছু বোঝানো ঝকমারি বটে। প্রেম আমাদের কাছে একটা অর্থবহ শব্দ বটে, কিন্তু প্রেম বলতে আমরা কিছুই বুঝতে পারি না। প্রেম বলতে আমরা বুঝি একটা মানুষের সঙ্গে আর একজন মানুষের গভীর ভালোবাসা। একটা রূপের সঙ্গে আর একটা রূপের নৈকট্য। তো ঈশ্বর যার কোনো বিশেষ রূপ নেই, তার সঙ্গে নৈকট্য কিভাবে হবে ? তাই ঈশ্বর প্রেম সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। কাউকে দিয়ে প্রেম করানো  যায় না, প্রেম এমনি এমনি হয়। প্রেম আমাদের স্বভাবজাত কিন্তু দুটো আবরণ দিয়ে প্রেমকে ঢেকে রাখা হয়েছে। একটা হচ্ছে আমাদের অহংবোধ, আর একটা হচ্ছে আমাদের কামনা। প্রেম নদীর  দুটি ধারা। একটা সমুদ্রমূখী, আর একটা উৎস মুখী। একটা জোয়ার আর একটা ভাটা। একটা কামনা বাহিত আর একটা অহং-বাহিত। আজ আমরা প্রেমকে কিভাবে অহং ঢেকে রেখেছে, সেই সম্পর্কে দুটো গল্প শুনবো। 

প্রেম, জোয়ারে ভেসে ভেসে আমির সৃষ্টি হয়েছে। আর এই আমিই আর এক আমির জন্ম দিচ্ছে। যতদিন আমি আমি করবো, ততদিন আমিরই জন্ম হতে থাকবে। এখন এই অহং বা আমি কে ? আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি আমি কে ? দেহের মধ্যে যদি আমিকে খুঁজতে চাই, তবে আমিকে কোথাও খুঁজে পাবো না। আমার হাত, আমার পা, আমার মাথা, আমার বুক, আমার পেট, আমার শরীর,  কোথাও আমি নেই। এগুলোকে বাদ  দিলে যেটা থাকবে সেটি হচ্ছে শূন্যতা। এখানেও  আমি বলে কেউ নেই। এই শূন্যতা আমি নয়, এই শূন্যতা ঈশ্বর।  

এক ফকির সান্যাসীকে রাজা ডেকে পাঠালেন, যাঁকে  সবাই পাগলা নিমাই বলে চেনে। তো রাজার লোক তাকে বললো, নিমাইবাবা আপনাকে রাজা ডেকেছেন। পাগলা সাধু বললো, এখানে নিমাই বলে কেউ থাকে না, নিমাই বলে কেউ  নেই। রাজার লোক বললো, চালাকি করবেন না, আমরা  আপনাকে দেখতে পাচ্ছি।  আর আপনি কিনা বলছেন, নিমাই বলে কেউ নেই ? ঝুটমুট ছাড়ুন, আপনি যাবেন কিনা বলেন, নতুবা আমরা আপনাকে   জোর করে নিয়ে যাবো। তো পাগলা সাধু নিজের শরীরের দিকে আঙ্গুল ঠেকিয়ে বললো, একে যেতে বলছো ? ঠিক আছে যাবে-ও।  কিন্তু একটা জিনিস জেনে রেখো এখানে নিমাই বলে কেউ নেই। লোকে একে নিমাই বলে ডাকে বটে, কিন্তু নিমাই বলে এখানে কেউ থাকে  না । তো পাগলের কথায় গুরুত্ত্ব না দিয়ে, রাজার আদেশ মতো, রাজার লোকেরা  পাগলা নিমাইসাধুকে রথে চড়িয়ে রাজার দরবারে নিয়ে গেলো । রাজা বললেন, আসুন নিমাই বাবা। নিমাই বাবা বললেন, নিমাই বলে এখানে কেউ নেই। রাজা বললেন, আশ্চর্য্যের কথা বলছেন আপনি, নিমাই বাবা বলে যদি কেউ নাই  থাকে, তবে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কে ? আর আমার কথার জবাবই  বা কে দিচ্ছে ? নিমাইবাবা বললেন, আপনার নিমাই রথে চেপে এসেছে। তাইতো ? কিন্তু এখানে রথ কোথায় ? রাজা বললেন, কেন সামনে রাখা আছে, আপনি দেখতে পাচ্ছেন না ? পাগোল নিমাই বললো, দেখতো পাচ্ছি, কতকগুলো ঘোড়া। আর তার পিছনে, চাকার উপরে কিছু কাঠ-গদ্দি, সামিয়ানা ইত্যাদি, ইত্যাদি । এগুলো সব আলাদা করে দিন। তো তখন কি থাকবে ? শূন্য। তো শূন্যটা  কি রথ ? তো রথ কোথায় ? সম্রাট তখন নির্বাক হয়ে গেছেন। পাগলাবাবা বলতে শুরু করলেন, আসলে নির্দিষ্ট কিছু বস্তুর সমষ্টি হচ্ছে আপনাদের দৃষ্টিতে রথ। বস্তু গুলোকে আলাদা করে দিলে, রথের কোনো অস্তিত্ত্ব থাকবে না। কাঁঠালের মধ্যে কাঁঠাল বলে কিছু নেই, আছে ছোবড়া, ভূচরো, আছে কোয়া, আঁটি,  মোথা, কাঁঠাল বলে কিছু নেই, এগুলোর মিলিত সত্ত্বাকে বলা হয়ে থাকে কাঁঠাল।  এইভাবে যদি আমরা আমিকে খুঁজতে থাকি, তবে দেখবো, এই দেহের মধ্যে আমি বলে কেউ নেই। হাড্ডি-রক্ত-মাংসের শরীর। মন-বুদ্ধি-চিত্ত নিয়ে তৈরী হয়েছে অহংকার।  শেষে  আছে শুধু শূন্য। আর এই শূন্যতা আপনি নন, শূন্যতা হচ্ছে ঈশ্বর। 

আমাদের আলোচ্য বিষয় প্রেম। আর এই শূন্যতা থেকেই প্রেমের জন্ম। এই শুন্যই  পারে অন্য শূন্যের সঙ্গে মিলিত হতে। শূন্যের সঙ্গে শূন্যের মিলনের জন্য কোনো বাধা থাকে না। শূন্যের ব্যাপ্তি অসীম। আমাদের চিদাকাশ, আমাদের হৃদয়াকাশ, গন্ডিবদ্ধ নয়। ঘটাকাশ অসীম আকাশের অংশ মাত্র। ঘট ভেঙে গেলে  ঘটাকাশ যেমন অসীমের সঙ্গে এক হয়ে যায়। ঠিক তেমনি আমাদের হৃদয়ের শূন্যতা  অসীম শূন্যতার অংশ মাত্র। তাই হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের মিলন হচ্ছে প্রেম। যা শূন্যের সঙ্গে শূন্যের মিলন মাত্র।  

জলের জন্য কুঁয়ো খোঁড়ার দরকার, অর্থাৎ পাথর-মাটি সরিয়ে একটা শূন্যতা বের করে আনতে  হবে. তবেই , কুয়োতে জল আসতে  পারবে। জলকে খোঁজার দরকার পড়ে  না, দরকার পড়ে শূন্যতার, যা আমরা মাটি-পাথর সরিয়ে আনতে  পারি। জলকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, তাই আমরা জলের সন্ধান পাচ্ছি না। জল বাইরে আসার সুযোগ পাচ্ছিলো না। জল  যখন গর্তের মধ্যে  শূন্যতার সন্ধান পেলো, তখন জল বেরুতে লাগলো। মাটির মধ্যেই জল ছিল। 

আমাদের সবার মধ্যে ঈশ্বর-রূপ এই শূন্যতা আছে। আর এই শূন্যতা হচ্ছে প্রেমের আকর। এই শূন্যতাকে আমরা আমাদের মন-বুদ্ধি-অহং দিয়ে ঢেকে রেখেছি। হাড়-রক্ত-মাংস দিয়ে ঢেকে রেখেছি। আমাদের শূন্যতা "আমি" দিয়ে ভরাট  করে রেখেছি। মানুষ আমি-আমি করে নিজেকে ভরিয়ে রেখেছে, তাই প্রেম-বারি বেরুতে পারছে না। আমাদের পেট-বুক  ভর্তি অহংকার। তাই প্রেমের ঝর্ণার দেখা নেই। 

খোলা আকাশের নিচে বহুকালের পুরোনো একটা গাছ ছিল। আকাশের দিকে তার শত শত হাত প্রসারিত করে দিয়েছিলো সে। যখন ওই গাছে সুগন্ধি ফুল ফুটতো তখন হাজার হাজার মৌমাছি মধু খেতে আসতো।  যখন গাছে ফল হতো, তখন হাজার হাজার পাখি এসে হাজির হতো ফলের প্রত্যাশায়। যখন পাখিরা ডিম্ দেবার জন্য বাসার বানাবার প্রয়োজন মনে করতো, তখন সেই গাছের ডালে এসে বাসা তৈরী করতো। পোকা-মাকড় আশ্রয় খুঁজতো এই গাছের কোটরে।  পথিক যখন রোদে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়তো, তখন গাছের ছায়ায় এসে ক্লান্তি দূর করতো। 

তো এই গাছের নিচে একটা ছোট্ট শিশু রোজ এসে খেলা করতো। গাছ তো বিশাল কিন্তু শিশু ছোট্ট।  কিন্তু তবুও তাদের মধ্যে বন্ধুত্ত্ব হলো। আসলে সেই বড়োর সঙ্গেই  ছোটোর বন্ধুত্ত্ব হতে পারে, যে বড়ো নিজেকে কখনো বড়ো  বলে মনে করে না। যে বড়ো তার নিজের মধ্যে শৈশব জাগিয়ে রাখে। যার মধ্যে বড়ো  বলে কোনো অহংকার থাকে না। আসলে এই গাছটার মধ্যে কোনো ধারণাই ছিল না যে কত্ত্ব বড়ো। কতো বিশাল তার দেহ। কেননা সে সবসময়  আকাশের বিশালত্ত্বই দেখেছে। সে সবসময় পৃথিবীর বিশালত্ত্ব দেখেছে।  তাই সে নিজেকে বড়ো বলে ভাবতেই শেখেনি। আসলে আমি বড়ো এই অহংকার মানুষের মধ্যেই হয়ে থাকে। মানুষের অহংকার মানুষকে বড়ো ভাবতে শেখায়। আর প্রেম তার সঙ্গেই হোতে পারে, যার বড়ো-ছোটো জ্ঞান জন্মায় নি। যে কাছে আসে তার সঙ্গেই তার একটা সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়। তো শিশু খেলতে খেলতে গাছের সঙ্গে সখ্যতা তৈরী করে নিলো। গাছ শিশুকে আপন করে নিলো। গাছের উপরের ডালে ছিল, ফুল-ফল।  গাছ তার মাথা নিচু করে শিশুকে ফল-ফুল দিয়ে আনন্দে রাখতো। মানুষের অহংকার মানুষকে নিচের দিকে ঝুঁকতে বাধা দেয়।  কিন্তু গাছের তো কোনো অহংকার ছিল না। সে ঝুঁকতে রাজি ছিলো। বাচ্চাটি গাছের শীতল ছায়ায়, ফুল-ফল নিয়ে আনন্দে মেতে থাকতো। 

কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মে, শিশু ধীরে ধীরে বড়ো  হতে লাগলো। শিশু এখন কিশোর।  এবার সে গাছের উপরে উঠতে পারে।  তাই সে গাছের ডালে উঠে ঘুমিয়ে থাকতো। ফুল দিয়ে মালা গেথে গলায় পড়তো। নাচতো, গাইতো।  ফল খেয়ে ক্লান্তি দূর করতো। গাছের পাতার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকতো। ডাল  ধরে ঝুলতো।  দোল খেতো। গাছের এতে আনন্দ হতো। শিশুরও আনন্দ হতো। 

শিশু ধীরে ধীরে আরো বড়ো  হতে লাগলো। এখন আর সে প্রতিদিন আসতে  পারে না।  এখন সে স্কুলে যায়।  পড়াশুনার চাপ। বড়ো হতে হবে, লেখাপড়া শিখে আরো বড়ো  হতে হবে। পরীক্ষার চাপ, বাড়ির কাজের চাপ। প্রতিদিন আসা সম্ভব নয়, কিন্তু গাছটি প্রত্যাশায় থাকতো, আর ডাকতো - আয় শিশু আয়। প্রতিদিন ভাবতো আজ বুঝি আসবে। আসলে প্রেমিক সবসময় প্রেমাস্পদকে ডাকে। প্রেম সবসময় প্রতীক্ষায় থাকে, এই বুঝি সে আসবে। কিন্তু ছেলেটি প্রতিদিন আসতে  পারতো না, তবে মাঝে মধ্যে আসতো। আর গাছ অপেক্ষায় থেকে থেকে উদাস হয়ে যেত। 

ছেলেটি এখন কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিয়েছে। এখন তার মধ্যে উচ্চাকাঙ্খা দেখা দিয়েছে। ঘর বাধার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছে। একদিন যুবক যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, গাছ তখন যুবককে ডেকে বললো, তুমি এখন আসো  না কেন ? আমি কিন্তু তোমার অপেক্ষায় থাকি। তো যুবক বললো, আমাকে এখন অনেক কাজ করতে হয়, রোজগার করতে হয়। তোমার কাছে এলে তো আর টাকা পাওয়া যাবে না। আমার টাকার খুব দরকার। আমাকে বিয়ে করতে হবে, সংসার করতে হবে। আসলে যুবকের এখন আমি বোধ এসে গেছে। আকাঙ্খা জেগেছে। তাই এখন তার অনেক কিছু দরকার। আর প্রেমের কাছে দরকার বলে কিছু হয় না। তবু সে দিতে চায়। গাছ বললো, আমি তোমাকে সব কিছু দিতে পারি। তুমি আমার ফল-ফুল নিয়ে বেচে টাকা পেতে পারো ;. তুমি আমার ডাল গুলোকে কেটে নিয়ে বেচে অনেক টাকা পেতে পারো। এগুলো নিয়ে যাও। ছেলেটি তখন ফল-ফুল-ডাল -পালা ভেঙে নিয়ে চলে গেলো।  আর সেগুলো বেচে সে অনেক টাকা পেলো। কিন্তু এর পরে আর সে গাছের কাছে আসতো  না।  কারন গাছ তো তাকে আর  কিছু দিতে পারবে না। এখন গাছে আর ফুল-ফল নেই, ডালপালা সব কেটে নেওয়া হয়ে গেছে। যুবক এখন ব্যবসা শুরু  করে দিয়েছে।  টাকা দিয়ে কি করে টাকা ধরতে  হয়, সে বিদ্যায় সে এখন রপ্ত হয়েছে। গাছের কথা  সে ভুলেই গেলো। গাছটি উদাস হয়ে গেলো, কাটা গাছের গা বেয়ে রস পড়তে লাগলো। গাছ কাঁদছে।  কেননা ছেলেটি এখন আর তার কাছে আসে না। সে নিজেকে উজাড় করে দিতে চায়। আর প্রতীক্ষায় থাকে ছেলেটি কখন আসবে। 

তো হঠাৎ আবার একদিন ছেলেটি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, গাছটি আবার তাকে ডাকলো।  বললো, তুমি আসো  না কেন ?  ছেলেটি বললো, তোমার কাছে এসে কি হবে ? আমি এখন একটা বাড়ি তৈরি করবো, আমার অনেক টাকা দরকার।  গাছটি বললো, তুমি আমাকে কেটে বাজারে বিক্রি করো। অনেক টাকা পাবে।  তা দিয়ে তোমার বাড়ি হয়ে যাবে। ছেলেটি তখন গাছটিকে করাত  দিয়ে কেটে বাজারে নিয়ে বিক্রি করে অনেক টাকা পেলো। এখন রইলো, শুধু গাছের গোড়া। এখনো গাছ ছেলেটির কথা ভুলতে পারে নি। সব সময় সে ভাবে ছেলেটি ভালো আছে তো।  কোনো বিপদ-আপদ হয়নি তো ? তা না হলে সে আর আসে না কেন ? মনে মনে ভাবে, একটু যদি তার খবর পেতাম তাহলে নিশ্চিন্ত  হতে পারতাম। 

এই হচ্ছে প্রেম।  যার জন্য সে তার সর্বস্য এমনকি জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারে। প্রেমের কোনো ভাষা হয় না।  প্রেমের কোনো শাস্ত্রব্যাক্ষা হয় না। প্রেম মানুষকে নিঃস্ব করে দেয়। প্রেম মানুষের দৃষ্টিশক্তির মধ্যে থাকে, প্রেম মানুষের বাকশক্তির  মধ্যে থাকে, প্রেম মানুষের শ্রবণ শক্তির মধ্যে থাকে, প্রেম মানুষের স্পর্শে থাকে। প্রেম মানুষের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হয়। প্রেম প্রকাশ পায় , নীরবতায়। তাই প্রেমের কথা বলা যায় না। প্রেম এক শূন্যতা। এই শূন্যতাই ঈশ্বর। প্রেম ও ঈশ্বরের মধ্যে কোনো ফারাক নেই।  আগুন ও তার দাহিকা শক্তিকে আলাদা করা যায় না। জল ও তার আদ্রতা আলাদা করা যায় না। তেমনি ঈশ্বর ও প্রেম আলাদা করা যায় না। যথার্থ প্রেমিক সর্বদা ঈশ্বরের সংস্পর্শেই  বেঁচে থাকেন। অহংয়ের লোপ না হলে প্রেমের সঞ্চরণ হয় না। 

পরের দিন আমরা প্রেমের অন্য যে আভরণ আছে - কামনা সে সম্পর্কে আলোচনা করবো। 


ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

ঈশ্বরীয় প্রেম-ভালোবাসার খোঁজে  (৩)

ভোগ থেকেই ভগবানের প্রাপ্তি হতে পারে। কথাটা  শুনে হয়তো তথাকথিত পণ্ডিত সাধু-সন্ত, যারা ভগবানের  পসরা সাজিয়ে বিক্রিবাট্টা ক'রে, বেঁচেবর্তে  আছেন,  তারা আমার কথায় প্রতিবাদ করবেন। হয়তো তেড়ে আসবেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে এই কামনার সিঁড়ি দিয়ে আমরা ইহজগতে নেবে এসেছি। ভগবান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি। তো যে সিঁড়ি দিয়ে আমরা নেবে এসেছি, সেই সিঁড়ি দিয়েই আমরা আবার ভগবানের কাছে পৌঁছতে পারি। এটাই আমাদের চেনা পথ। কিন্তু তথাকথিত পণ্ডিত ব্যক্তিগণ এই সিঁড়িটাকে উপেক্ষা করতে বলছেন। আর   পন্ডিতগণ যত এটাকে এড়িয়ে যেতে বলছেন, আমরা তত সেটাকে আঁকড়ে ধরে আছি। এক সাধু তার শিষ্যকে বলেছিলেন, ভগবানের নাম জপের সময় যেন সে হনুমানের কথা ভুলেও মনে না করে। আর সত্য হচ্ছে, শিষ্য যখনই জপে বসতো, তখন মনটা চঞ্চল  হনুমানের মূর্তি দেখতে পেতো।     

৩৫০০ বছর আগের রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের কথা আমাদের কাব্য গাথায় লেখা হয়ে আছে। হাজার হাজার বছর  যাবৎ আমরা প্রেমের কথা শুনেছি, প্রেমের গান গেয়েছি, প্রেমের ভজন গেয়েই  চলেছি। কিন্তু মানুষের মধ্যে আজও প্রেমের দেখা নেই। বরং বলা যেতে পারে, মানুষের মধ্যে বিষ।  সাপে  কামড়ালে মানুষ বেঁচে যেতে পারে। কুকুরে কামড়ালে মানুষ বেঁচে যেতে পারে।  কিন্তু মানুষে কামড়ালে মানুষের মৃত্যু অবধারিত। 

হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের সাধু-মাহারাজগন ঈশ্বরের কথা বলেছেন, কিন্তু আমরা আজও  ঈশ্বরের দেখা পেলাম না। হাজার বছর ধরে আমাদেরকে কামনা-বাসনা ত্যাগ করতে বলেছেন, তাহলে আমরা নাকি শান্তিতে থাকতে পারবো, আজও  আমাদের কামনা বাসনা লোপ পায়নি। আর এই যে ঈশ্বরের দেখা না পাওয়া, জীবনে শান্তি খুঁজে না পাওয়া, কামনা-বাসনা ত্যাগ করতে না পারা, এর জন্য নাকি আমরাই দায়ী। এমনকি কিছু-কিছু সাধু-সন্ত তো এই কামনা-বাসনার জালে ফেঁসে জেলের ভাত খাচ্ছেন। 

এই দোকানদার পাখা বিক্রি করছে। এই পাখা নাকি হাজার বছর যাবৎ শীতল হাওয়া দিতে পারে। ৭ দিনেই পাখা ভেঙে গেলো।  তো দোকানদার বললো, আপনি মশাই পাখার ব্যবহারই  জানেন না। এটিকে সামনে রেখে মাথাকে ঘোরাতে হয়।  আপনি ঠিক মাথাকে একজায়গায় রেখে পাখাকে ঘোরাচ্ছিলেন। তাই পাখাটার এই দশা  হয়েছে।  

মানুষের জীবনে প্রেমের ঝর্ণা ধারা কোনো ভজন-কীর্তন  প্রবাহিত করতে পারেনি। পন্ডিতগণ বলে থাকেন, মানুষের মন এর জন্য দায়ী। মানুষের মনে বিষ তাই, প্রেম আসতে  পারে না। আসলে সাধারণ মানুষের মনে বিষ নয়, বিষ হচ্ছে পন্ডিতের  শিক্ষায়। পন্ডিতের  কথায়। পন্ডিতের  মুখে। কারন তারা করে এক আর বলে এক। পন্ডিতগণ বলছেন, নারী নরকের দ্বার। আবার এই পন্ডিতরাই মাতৃমূর্তি নারীর পুজোর ব্যবস্থা বিধান দিয়েছেন । ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের শেখানো হয়, তুমি মেয়েদের সাথে মিশবে না।  আবার  মেয়েকে বলা হয়, তুমি না মেয়ে, তোমাকে ভেবে-চিন্তে চলতে হবে। এর পরে যখন ছেলেমেদের বিয়েথা হবে, আর যখন তারা শারীরিক ভাবে মিলিত হবে, তখন তার মনে যদি একটা পাপবোধ আসে, তাকে সংশোধন করবো কি করে ? স্বামী দেবতা, স্ত্রী ঘরের লক্ষ্মী। কিন্তু শাস্ত্র বলছে, নারী নরকের দ্বার। তো আমার যিনি মা, আমার যিনি বোন, আমার যিনি স্ত্রী - সবাই আমাকে নরকের দ্বারে টেনে নেবার জন্য ? স্ত্রী আমার অর্ধাঙ্গিনী - তো আমার অর্থঅঙ্গ   তাহলে নরক ?   আসলে হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতি ও কুশিক্ষার ফল হচ্ছে আজকের মানুষ। আমাদের সংস্কৃতিটাই দ্বৈতে  ভরা, ভুলে ভরা । যার ফলে আমাদের মনে বিষ। বলা হয়, আমাদের সংস্কৃতি খারাপ নয়, আমরা খারাপ। আমি বলি, মানুষ তো আজ সংস্কৃতির জঞ্জালে চাপা পড়ে আছে, আসল মানুষটি হারিয়ে গেছে।

দেখুন জমিতে যে বীজ আপনি রোপন করবেন, সেই মতো গাছ হবে, সেই মতো ফল-ফুল হবে।  এখন আপনি নিম  গাছের বীজ পুঁতে যদি আশা করে সুমিষ্ট আম হবে, তার চেয়ে আহাম্মকি আর কি হতে পারে।  আপনি নিজেকে  আড়াল করবার জন্য বলতে পারেন, মাটির দোষ। কিন্তু আপনি জানেন, এটা মাটির দোষ  নয়, এটা বীজের দোষ । কিন্তু আপনার-আমার  সাহস নেই সেই সত্য  কথা বলার। আমাদের সংস্কৃতি  মানুষের মধ্যে হিংসা দ্বেষ -এর বীজ বপন করে রেখেছে। তাই মানুষ আজ ধর্ম্মের নামে   হিংসায় লিপ্ত। মানুষ আজ উগ্র, অশান্ত, দন্দ্ব, অশ্রদ্ধা ঘৃনায় পরিপূর্ন। আসলে যে বীজ আমাদের ধর্ম্মগুরুগন রোপন করেছেন, তারই গাছ আজ বড়ো  হয়েছে, তার ফল আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমাদের ধর্ম্মগুরুগন যদি আমাদের মধ্যে প্রেমের বীজ রোপন করে থাকতো তবে মনুষ্যরূপী বৃক্ষে  প্রেমের ফলই দেখা যেত।

বলা হয়ে থাকে তুমি ধর্ম্মকে ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারোনি, তাই তোমার কাছে, ধর্ম্মের ধ্বজা টিকতে পারেনি।  এক ছাতার দোকানদার বলছেন, তার দোকানের ছাতা সারাজীবন চলে যাবে। এই ছাতার মতো ছাতা আর কোথাও পাবেন না।  জীবনে আর দ্বিতীয় ছাতা কিনতে হবে না। তো ভদ্রলোক  একটু বেশি দাম দিয়ে হলেও,  বিশ্বাস করে ছাতাটা  কিনে নিয়ে এলেন ।  ছাতার কাপড় ভীষণ পাতলা। শিকগুলোও কেমন নড়বড়ে। তবু দোকানদারকে বিশ্বাস করে, আর দোকানের চাকচক্য দেখে, সবচেয়ে বড়ো  কথা দোকানের ভিড় দেখে ভদ্রলোক  তাড়াতাড়ি একটা ছাতা সংগ্রহ করে নিলেন । ছাতাটা ৭-দিনের মাথায় ভেঙে গেলো। দোকানদার বললো, মহাশয় ছাতার কি দোষ, আপনি ছাতা ব্যবহার করতে পারেননি।  আপনি নিশ্চয়ই রোদ-জলে ছাতা ব্যবহার করেছেন। আমাদের বিলে দেখবেন লেখা আছে, ছাতাকে রোদ  জল থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন । তো সত্যধর্ম্মের কথা  কোথাও হয়তো ছোট্ট করে লেখা আছে, আমরা সেটা দেখতে পাই না। তাই আমরা ধর্ম্মের ধ্বজা ভেঙে ফেলি। 

প্রেম প্রকৃতির ধর্ম্ম। তাই মানুষের চেয়ে পশু-পাখির মধ্যে প্রেমের প্রবাহ দেখতে পাওয়া যায় বেশি । এদের কোনো সংস্কৃতি নেই, এদের কোনো সভ্যতা নেই। এমনকি মানুষের মধ্যে যারা তথাকথিত অসভ্য জাতি বলে পরিচিত তাদের মধ্যে প্রেমের ধারা অনেক বেশি। প্রেম মানুষের স্বাভাবিক স্বভাব।  কিন্তু তথাকথিত সভ্য  সমাজ সেই স্বাভাবিক স্বভাবকে দমিত করে রেখেছে। প্রেম এমন কোনো বস্তু নয়, যে তাকে খুঁজতে যেতে হবে। প্রেম আমাদের প্রত্যেকের  ভিতরে আছে। প্রাণের সুগন্ধই প্রেম।  আর এই প্রাণহীন জীব বলে কিছু হয় না। তো যার মধ্যে প্রাণের  ছোঁয়া আছে, তার মধ্যেই প্রেমের ফল্গুধারা প্রভাহিত হচ্ছে। কেবল আমাদের সংস্কৃতি এই ফল্গুধারাকে চাপা দিয়ে রেখেছে, একটা কংক্রিটের বাঁধ দিয়ে রেখেছে। অতএব প্রেমের খোঁজ কোথাও করতে হবে না। প্রেমের জন্য কোনো বিশেষ  সাধনা করতে হবে না। 

একটা টুকরো পাথরের মধ্যে শিবলিঙ্গ আছে, আছে যীশু-কৃষ্ণের মূর্তি। ঢাকা পরে আছে। শিল্পী, মূর্তির বাইরের আবরণ সরিয়ে মূর্তিকে বের করে নিয়ে আসেন। শিল্পী কোনো মূর্তি তৈরী করেন না, তিনি কেবল পাথরের আবরণ গুলোকে সরিয়ে দেন, যাতে মূর্তি প্রকাশিত হতে পারে। ডাক্তার কখনো  আমাদের শরীরের মধ্যে সু-স্বাস্থ্যের খোঁজ করেন না।  তিনি আমাদের মধ্যে রোগ-জীবাণুর খোঁজ করেন। যা সরিয়ে দিলে, আমাদের স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের দেখা মিলতে পারে। স্বাস্থ্য আমাদের ভিতরেই আছে, রোগজীবাণু বাইরে থেকে আসে। আসলে স্বাস্থ্য ডাক্তাররা  তৈরী করতে পারেন না।  স্বাস্থ আমাদের ভিতরে আছে, কেবল যা আমাদের ভিতরে ছিল না, অথচ বাইরে থেকে  ঢুকে গেছে, বা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোকে বের করে দেওয়াই আমাদের ডাক্তারের কাজ। 

তাই প্রেমকে বুঝতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে, প্রেম প্রকাশিত হতে পারছে না কেন, কোথায় বাধা প্রাপ্ত হচ্ছে, সেটাকে চিহ্নিত করা। ডাক্তার যেমন জীবাণুকে চিহ্নিত করে।  আমাদের তেমনি বুঝতে হবে, আমাদের মধ্যে প্রেমের বিকাশ হচ্ছে না কেন, বাঁধাটা কোথায়?

নদী সাগরে পৌঁছে যাবে, যদি না সে বাঁধা পায়।  প্রকৃতির বাঁধাকে সে স্বাভাবিক ভাবেই অতিক্রম করতে পারে। এমনকি সামনে যদি পাহাড় এসে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলেও সে পাহাড়কে  পাশ কাটিয়ে সমুদ্রের অভিমুখী হবে।  কিন্তু মানুষ যদি বাঁধা দেয়, কংক্রিটের বাঁধ তৈরী করে দেয়  তবে নদী রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। বীজ প্রকৃতির বাঁধাকে অতিক্রম করবার জন্য, প্রকৃতির কাছ থেকেই শক্তি পায়। এমনকি এই বাঁধাই তাকে প্রকাশিত হতে সাহায্য করে, শক্তি সঞ্চয় করতে সাহায্য করে থাকে। বীজের উপরে সামান্য মাটি ছাড়িয়ে দিতে হয় , বীজকে অংকুরিত হতে সাহায্য করে থাকে, এই মাটির আবরণ । আমাদের কাছে মনে হতে পারে, বীজকে  ঢেকে রেখেছে ওই মাটি।  কিন্তু না ওই মাটিই তাকে শক্তি যোগাচ্ছে সূর্যকিরনের দিকে নিজেকে উন্মুখ করে দিতে। 

এখন কথা হচ্ছে মানুষ বা আমাদের ধর্ম্মগুরুগন কি এমন বাধা সৃষ্টি করলো, যাতে আমাদের স্বাভাবিক স্বভাবের বিকাশ হতে পারলো না।  আমাদের ভিতরের প্রেম প্রকাশিত হতে পারলো না। আসলে প্রেমের বিকাশ বাসনার মধ্যে দিয়ে হতে পারে। কামের মধ্য দিয়ে হতে পারতো।  কিন্তু ধর্ম্মগুরুগন আমাদের এই পথ বন্ধ  করে দিয়েছেন। গঙ্গা যেমন বইতে শুরু করে গঙ্গোত্রী থেকে, তেমনি প্রেমগঙ্গা বইতে শুরু করে কাম-বাসনা থেকে। ধর্ম্মগুরুরা সবাই এই পথ সম্পর্কে বলেছেন কামনা-বাসনা ছিঃ - এটি অধর্ম্ম, এটি পাপ। এই পাপ থেকে বিরত থাকো। অথচ কেউ একবারও ভাবলেন না, কামনা আমাদের উৎসাহবর্ধক শক্তি।  আর এই শক্তি রূপান্তরিত হয় প্রেমে। কাঠের পরিণতি কয়লা, কয়লার পরিণতি হীরে। কাঠের চেয়ে কয়লার মূল্য বেশি, কয়লার থেকে হীরের মূল্য অনেক বেশি। ঠিক তেমনি আমাদের কাম-শক্তি থেকে প্রেমের জন্ম হতে পারে। প্রেমের মন্দিরে উঠবার জন্য, প্রথম ধাপ হচ্ছে কামনা। যাকে  আমরা শত্রূ  করে ফেললাম। ধর্ম্মগুরুগন বললেন, কামের সঙ্গে লড়াই করো, ব্রহ্মচর্য পালন করো। তো যে শক্তি আমাদের উদ্দীপিত করতে পারতো, যে শক্তি আমাদে প্রেমের মন্দিরে যেতে সাহায্য করতে পারতো, সেই শক্তি ভেঙে ফেলে দেবার কথা বলা হলো। সেই শক্তির সঙ্গে লড়াই করতে বলা হলো। 

আর একটা কথা হচ্ছে, প্রেম অনুভূত হয়, মনে। মন স্বাভাবিক ভাবেই চঞ্চল।  বলা হলো মনকে শান্ত করো।  ওকে কোথাও ঘুরে বেড়াতে দিও না। তো একটা শিশুকে আপনি যদি ঘরবন্দি করে ফেলেন, তার স্বাভাবিক বিকাশ হবে কি করে, মনকে যদি বন্দি করতে চান, তবে মনের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হবে। এমনকি সে বিদ্রোহ করতে পারে। তো যে মনের সাহায্যে আমরা প্রেমের আস্বাদন  গ্রহণ করবো, সেই মনকে আমরা শত্রূ বানিয়ে ফেললাম। দমিয়ে দিতে চাইলাম।  

ঈশ্বর আমাদের এই মনের সাহায্যে নিজেকে উদ্দীপ্ত ক'রে, কামনার উদ্রেগ করেছেন। আর মন যখন কামনার দ্বারা উত্তপ্ত হয়, তখন সে আনন্দের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য সার্বিক প্রয়াস করে থাকে। অর্থাৎ ঈশ্বর যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই  জগতে ক্রিয়া করছেন , সেই দুটো স্বাভাবিক মাধ্যমকে আমরা অস্বীকার করলাম। 

আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, আমর এই যে দেহ তা আমাদের মা-বাবার কামনার ফল। আমার যে সন্তান তা আমার কামনা-বাসনার  ফল। গাছে যে ফুল ফল ফোটে সে সব কামনার শক্তিতেই সংগঠিত হচ্ছে।  এমনি আমার এই যে ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য সাধনা সেসব এই কামনার ফল। এমনকি আমি যে জন্মান্তরে আবার ফিরে  ফিরে আসবো, সেসব আমাদের কামনা বাসনার ফলমাত্র। 

আপনি কি জানেন, পায়রা বকবকম করে কেন ? ময়ূর কেন নাচে ? কোকিল কেন কুহু-কুহু করে। আপনি কি জানেন, আমরা কেন সাজুগুজু করি ? সবই আমাদের কামনা-বাসনা থেকে উদ্ভূত। এই যে পাহাড়ের গুহায় শত শত সন্যাসী ধ্যানমগ্ন কিসের  আশায়। বাসনা  পূরণের আশায়। ঈশ্বরকে পাবার বাসনা তাদের মধ্যে এতটাই তীব্র যে, সব সংসার ছেড়ে, তারা গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন। নিরাসক্ত হয়ে নয়, বাসনা  চরিতার্থ করবার জন্য, সংসার ছেড়েছেন। আপনি বলবেন এসব উচ্চতর আদর্শ। দেখুন উঁচু নিচু বলে কিছু নেই। কেউ ছেলে চায়, কেউ মেয়ে চায়, কেউ মানুষকে ভালো বসে, কেউ প্রকৃতিকে ভালোবাসে, কেউ ঈশ্বরকে ভালোবাসে। আকাঙ্খ্যা সবার মধ্যে কাজ করছে। কামনা বাসনা মানুষকে উচ্চতর আদর্শের দিকে নিয়ে যেতে পারে।  এর কোনো বিকল্প নেই। তাই  কামনা বাসনা ত্যাগের কথা, ধর্ম্মগুরুদের এই বাণী, শুধু অসত্য  নয়, আমাদের বিপথগামী করে তুলতে পারে। ঈশ্বর-প্রদত্ত্ব এই শক্তিকে উপেক্ষা নয়, বরং একে আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে হবে। তবেই আমরা প্রেমের সন্ধান পাবো ।  তবেই আমরা আনন্দের সন্ধান পাবো। 

ঋষি যখন নব-দম্পতিকে আশীর্বাদ করেন, তখন বলেন, শত-পুত্রের জননী হও। আমরা কি কামনা-বাসনা হীন হয়ে শতপুত্রের জননী হবো ? তাই কামের সঙ্গে শত্রুতা নয়, বন্ধুত্ত্ব স্থাপন করতে হবে। আর এই কামনা বাসনাকে রূপান্তর ক'রে, আমাদের প্রেমে পরিণত করতে হবে। মানুষের জীবনে প্রেমের বীজ নিহিত আছে। সেখানে  কুড়ি ফোটাতে হবে, কুড়ি থেকে ফুলে পরিণত করতে হবে। আর এটা না হবার জন্য, মানুষই দায়ী - নিজের তৈরী বাঁধা সে অতিক্রম করতে পারছে না। প্রেমের গঙ্গা তো ঈশ্বর বইয়ে দিয়েছেন, আপনার আমার সবার মধ্যে। জীবাত্মা, সবসময় পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হবার জন্য উদগ্রীব। আমরা কামনা-বাসনার বিরোধিতা করতে গিয়ে, প্রেমের অঙ্কুরকে বিনষ্ট করে  চলেছি। আমরা কামের বিরুদ্ধে লড়াই করে করে জীবন শেষ করে দিলাম। একটা কথা আমাদের মনে রাখা ভালো, মানুষ কখনো কামনা থেকে মুক্ত হতে পারবে না। কামনা বাসনা পূরণ করবার জন্য আমাদের দেহ ধারণ করতে হয়েছে। আর আমরা যা করতে এসেছি, আমরা যা করবার জন্য, জীবধারন করেছি, তাকে বলছি পাপ।  আর এই পাপই  সারা জীবন ধরে বহন করে চলেছি। এই ধারণা  ত্যাগ করুন। এই ধর্ম্মগুরুদের ত্যাগ করুন। যারা প্রেমকে পাপ বলছে। যতদিন মানুষ পন্ডিতদের এই অনাচার থেকে মুক্ত হতে না পারবেন, ততদিন আমাদের প্রেমের বিকাশ হতে পারবে না। সূর্য্যের কাছে যাবার জন্য যেমন সূর্য্যরশ্মি সাহায্য করতে পারে। আর সূর্য্যরশ্মির মধ্যেই সমস্ত সূর্য্যশক্তি নিহিত আছে।  তেমনি পরমাত্মার কাছে যাবার জন্য প্রেম হচ্ছে একমাত্র রশি  বা  সিঁড়ি যা বেয়ে আমরা ঈশ্বরের কাছে পৌঁছতে পারি। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম।  

 প্রেম-ভালোবাসা আমাদের ইন্দ্রিগ্রাহ্য় বস্তু বা রূপের সঙ্গে হতে পারে। মানুষ যেমন মানুষকে ভালোবাসে,জীবজন্তুকে  ভালোবাসে তেমনি সে গান ভালোবাসে, সৌন্দর্য ভালোবাসে । যদিও আমরা একটা মাটির বা পাথরের মূর্তি গড়ে, ঈশ্বরের রূপ দিয়েছি।  কিন্তু আমরা মনে মনে সবাই জানি, এটি আসলে ঈশ্বর নয়। মহাত্মাগণ বলছেন,  ভালোবাসা ও প্রেম, কাছাকাছি অর্থ বহন করে সত্য, কিন্তু এর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। ভালোবাসা  আসলে একটা অংকুর আর প্রেম হচ্ছে বৃক্ষ। ভালোবাসাই  ধীরে ধীরে  প্রেমে পরিণত হয়। যদিও ঈশ্বরপ্রেম কথাটা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে, একটা অবাস্তব ব্যাপার। ভালোবাসা আমরা দেখতে পাইনা বটে, কিন্তু আমরা অনুভব করি,  ভালোবাসা হয়ে থাকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর সঙ্গে। আমাদের মধ্যে যারা নিকৃষ্ট তারা মনে করে থাকেন, ভালোবাসা একমাত্র বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গেই হতে পারে। যাইহোক,  ভালোবাসা পার্থিব, প্রেম অপার্থিব। ভালোবাসার পরিণতি হচ্ছে প্রেম। ভালোবাসা হচ্ছে জীবাত্মার স্বভাবজাত গুন্। আর প্রেম হচ্ছে পরমাত্মার স্বভাবজাত গুন্। আর পরমাত্মার অংশ হচ্ছে জীবাত্মা।  জীবাত্মার মধ্যেই কিঞ্চিৎ প্রেম লক্ষিত হয়। ভালোবাসার প্রভাব মৃতপ্রায় মানুষকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে। বৃদ্ধকে যুবকে পরিণত করতে পারে। কিছুদিন আগে খবরে পাতায়  দেখছিলাম, এক বৃদ্ধাশ্রমে বসবাসকারী  ৭৫ বছরের এক যুবক ৬৮ বছরের তরুণীকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে যাচ্ছেন। তো ভালোবাসা মানুষকে চাঙ্গা করতে পারে। সে তখন বয়সের তোয়াক্কা করে না। 

 ভালোবাসা হচ্ছে অপরের সুখ-দুঃখের অনুভূতিকে নিজের বলে অনুভব করা। ভালোবাসার মানুষকে পেলে প্রাণ শীতল হয়ে ওঠে। ভালোবাসার মানুষ বা এমনকি জিনিস পেলে, আমাদের আত্মা তৃপ্তি লাভ করে থাকে। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত রসামৃত ভোগের ভাবের উদয় হয়। আর উল্টোটা হলে আমাদের হৃদয় নিরস ক্লেশকর, একটা অশান্তির ভাবের সৃষ্টি হয়। আসলে আমাদের মধ্যে যখন ভালোবাসা জাগে, তখন আমরা ভালোবাসার দৌলতে ভালোবাসার পাত্র/পাত্রীর মধ্যে  কেবল গুনের উৎকর্ষ দেখতে পাই। দোষ দেখবার চোখ থাকে না। কেবল গুন্ আর গুন্। ভালোবাসা আমাদের জীবনে একটা প্রশান্তি এনে দেয়। 

ভালোবাসা গুনটি  সমস্ত জীবের মধ্যেই বর্তমান। কেবল ভালোবাসার বস্তু বা ভাজন  আলাদা আলাদা। আমরা বেশিরভাগ  জাগতিক বস্তুর ভালোবাসায় আকৃষ্ট হই, আবার গুটিকয় মানুষ  অপার্থিব বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয় ।  

 অধ্যাত্ম সাধকের নিত্য ও অনিত্য, সৎ-অসৎ বস্তু সম্পর্কে সাময়িক ধারণা  থাকা দরকার। তা সে আপনি যে পথের পথিক হন।  অর্থাৎ আপনি ভক্তিমার্গ, যোগমার্গ, বা জ্ঞান মার্গ - যে পথের  সাধক হোন না কেন। জ্ঞান -ভক্তি-প্রেম  কথাটা একসাথে উচ্চারিত হয়। আসলে জ্ঞান থেকে আসে ভক্তি।  অর্থাৎ কারুর সম্পর্কে যখন আমাদের জ্ঞান হয়, যে ইনি আমার থেকে উন্নত অর্থাৎ আমার থেকে বয়সে বা গুনে, বা শারীরিক বলে, যে কোনো ভাবেই হোক, এমন ধারণা যে যিনি আমার থেকে উন্নত  তখন তার সম্পর্কে আমাদের মধ্যে একটা ভক্তির ভাবের উদয়। আর এই ভক্তি থেকে আসে ভালোবাসা, আর ভালোবাসা থেকে আসে প্রেম। 

ঠাকুর রামকৃষ্ণকে দেখতে আসা দর্শকের মধ্যে প্রথমে ঠাকুর সম্পর্কে একটা অন্যরকম ধারণা   জন্মায় তার কথাবার্তা শুনে।  অর্থাৎ ইনি যে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ নন, এই ধারণা দর্শনার্থীর মধ্যে দৃঢ় হয়, প্রথমে। আর এই ধারণা যত  দৃঢ় হয়, তত তার   সম্পর্কে একটা উচ্চভাব  পোষন হয়।  এই উচ্চভাব দর্শকের মধ্যে ভক্তির উদ্রেগ করে। এই ভক্তি থেকে ভালোবাসা জন্মায়। এইখানে একটা কথা বলি, ভালোবাসা অনেক সময় আসক্তির জন্ম দিতে পারে। অর্থাৎ একদিনের না দেখা যেন অসহ্য বেদনার উদ্রেগ করে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ নরেনকে ভালোবাসতেন, তাই তাকে প্রতিদিন আসতে  বলতেন।আর নরেনকে দেখলেই ঠাকুর ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে পড়তেন।  তো নরেন ভাবতো, ঠাকুরের আমার প্রতি আসক্তি হয়েছে। তো নরেন ঠাকুরকে বলেছিলেন, আমার প্রতি তোমার এই আসক্তি ভালো না। তো এর পরে একসময় , ঠাকুর নরেনের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঘরভর্তি লোকের সামনে হয়তো ঠাকুর নানান কথা বলছেন, এমন সময় নরেন  এসেছে, তো তখন ঠাকুর কথা বন্ধ  করে দিতেন।  নরেন  চলে গেলে আবার কথা শুরু করে দিতেন। কয়েক সপ্তাহ যাবৎ এই অবস্থা চলেছিল। এই সময় প্রতিদিন নরেন আসতো, ঠাকুরকে দেখে আবার চলে যেত।  কোনো কথাবার্তা হতো না। কয়েক সপ্তাহ চলে যাবার পরে, ঠাকুর একদিন নরেনকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি তো সাথে কথা বলি না, তবু তুই আসিস কেন ? - তো নরেন বলেছিলো, আপনি কি মনে করেন, আমি আপনার কথা শুনে আসি ? আমি আপনাকে ভালোবাসি, তাই আসি। এই হচ্ছে ভালোবাসা, যা কোনো কিছুর প্রত্যাশা করে না।

প্রেম সীমাহীন। ভক্তি জ্ঞান থেকে আসে।  এমনকি ভয় থেকেও ভক্তির উদ্রেগ হতে পারে। ভক্তির মধ্যে একটা  দ্বৈত ভাগ থাকে। অর্থাৎ তুমি শক্তিশালী আমি দুর্বল, তুমি জ্ঞানী আমি  অজ্ঞানী, তুমি অসীম আমি সীমিত - ইত্যাদি ইত্যাদি। ভক্তিতে একটা ভয় বা সমীহের ভাব  থাকে। শক্তিশালী, বা ক্ষমতাশালীকে, এমনকি যিনি আমাকে লালনপালন করছেন, বিভিন্ন বিপদ থেকে রক্ষা  করছেন, তাদের প্রতি আমাদের ভক্তি শ্রদ্ধা জন্মায় । তা সে আমার মাতা-পিতা হতে পারে, কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি হতে পারে, বা কোনো অধিক জ্ঞানী ব্যক্তি হতে পারে।  ভক্তির ভাজন অসীম নয়, আবার ভক্তির লয় আছে। অর্থাৎ যাকে  আমি ভক্তি করছি, তার কোনো একটা আচরণ বা কোনো গর্হিত কর্ম্ম আমাকে আঘাত করতে পারে। আমার বিশ্বাস ভেঙে যেতে পারে। এর ফলে তার প্রতি আমার যে ভক্তি কাজ করতো, সেটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

 কিন্তু প্রেমে দ্বৈত  ভাব থাকে না। প্রেমে দুটি সত্ত্বার একত্রীকরণ সম্ভব হয়।   প্রেম আপনা-আপনি স্ফূরিত হয়, এর জন্য প্রেমিকের বা প্রেমভাজনের কোনো গুনের আবশ্যক নয়। প্রেম এমনি এমনি হয়। প্রেমের কোনো কারন নেই, প্রেম জীবাত্মার স্বভাব, যা পরমাত্মার প্রতিফলিত অংশ মাত্র। তাই প্রেমশক্তি  যার মধ্যে একবার জাগ্রত হয়েছে, তা কখনো বিনষ্ট হবার নয়। প্রেম প্রস্ফুটিত হয়, স্ফূরিত হয়, প্রেমের জন্ম হয় না। প্রেম আমাদের বা বলা যেতে পারে, সমস্ত জীবাত্মার স্বভাবজাত গুন্ । 

আগেই বলেছি, প্রেম আমাদের স্বভাবজাত। কিন্তু আমাদের প্রেম স্থুলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ও  সম্পর্কযুক্ত।  এখান থেকে আমাদের বেরুতে হবে। মহাত্মাগণ ঈশ্বরের সর্ব্বব্যাপী সত্ত্বাকে অনুভব করেন। শুধু তাই নয়, তারা ঈশ্বরের জন্য, জাগতিক সমস্ত কিছুকে ত্যাগ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। আবার অন্যদিকে মানুষ যখন ঈশ্বর প্রেমে ব্যাকুল হন, তখন ঈশ্বর তাকে আরো কাছে পেতে চান আর তাই তার কাছ থেকে সমস্ত জাগতিক বস্তু এমনকি প্রিয়জনকে দূরে সরিয়ে দেন। আমরা আসলে ভাবি, ঈশ্বরকেও চাই, আবার সংসারকেও চাই। প্রেমিক যেমন প্রেমিকাকে একমাত্র তার-করে রাখতে চায়,  অন্যের দিকে মনোযোগ একদম সহ্য করতে পারে না। ঠিক ঈশ্বরও তার ভক্ত-মানুষের প্রেমে পাগল হয়। আর তখন ভক্তকে নানান দিক থেকে সরিয়ে কেবলমাত্র ঈশ্বরানুরাগী করে গড়ে তোলে।আর এই জন্য আপনারা লক্ষ করবেন,  ঈশ্বরপ্রেমীর জীবনে নানান দুঃখ কষ্ট। রামচন্দ্রকে চোদ্দ বছর বনবাসে কাটাতে  হয়েছে।  স্ত্রী-হরণ হয়েছে - ইত্যাদি ইত্যাদি, পান্ডবদের বনবাসে কাটাতে হয়েছে। শ্রীচৈতন্যদেব ছোটবেলায়, পিতৃহারা হয়েছেন, এমনকি তার প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন। দ্বিতীয় স্ত্রীকেও তিনি ত্যাগ করেছেন।  বুদ্ধদেব রাজসুখ ত্যাগ করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন।  ... ইত্যাদি ইত্যাদি।স্বামী   বিবেকানন্দর পিতার মৃত্যুর পর, আর্থিক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। মা সারদাকে ঠাকুর দেহান্তরের পরে, আর্থিক দুর্গতির মধ্যে পড়তে হয়েছে। সমস্ত ঈশ্বরপ্রেমী মানুষের জীবনী পড়লে বুঝতে পারবেন, কেউ জাগতিক সুখ-ভোগের সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরপ্রেমী হতে পারেন নি।  আমাদের মধ্যে তিন ধরনের প্রেমিক আছে একদল যারা কেবল নিজের সুখের জন্য প্রেমিকাকে চায়। আর একদল আছে, যারা ভালোবাসা ভাগ করে নিতে চায়। এরা  দু-জন দু-জনের সুখের কথা ভাবে। আর সর্বশেষে আর এক ধরনের প্রেমিক আছেন,  যারা নিজের সুখের কথা ভেবে প্রেম করেন না, তাদের সমস্ত মন পরে থাকে প্রেমাস্পদের সুখের জন্য। এই শেষের শ্রেণী ঈশ্বরপ্রেমের উপযুক্ত। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি :        

সম্মোহনী বিদ্যা আয়ত্ত্বের কৌশল  : ঘুম পাড়ানো বিদ্যা। HYPNOTISM-1

তথ্যসূত্র : সম্মোহন বিদ্যা : প্রেফেসর রাজেন্দ্রনাথ রুদ্র। 

আমরা বহু মানুষকে সমীহ করে চলি।  তা সে আমাদের মা-বাবা হতে পারে, স্কুলের শিক্ষক হতে পারে, বা ডাক্তারবাবু হতে পারে, সরকারি কোনো বড় অফিসার হতে পারে। আবার কোনো সাধু সন্ন্যাসী হতে পারে। কেন ? আসলে তাদের সম্পর্কে অবচেতন মনে একটা সম্মানের জায়গা কখনথেকে  তৈরী হয়ে আছে , তা আমরা জানি না।  তাদের কথার অবাধ্য হতে পারি না। কেন ? সন্মোহিনী বিদ্যা  এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারে।  

প্রথমেই বলি সন্মোহনী  বিদ্যা বা হিপ্নোটিজম হাজার হাজার বছর  ধরে চলে আসছে। কারুর কাছে, এগুলো ভোজবাজি, কারুর কাছে এগুলো অবিজ্ঞনিক - কুসংস্কার।  সম্মোহন বিদ্যা একটা অদ্ভুত অলৌকিক বিদ্যা। এতদিন এই বিদ্যা গোপন ছিল। এই বিদ্যার দ্বারা  মানুষের, যেমন উপকার করা যেতে পারে, ঠিক  তেমনি অপকার করা যেতে পারে। আমরা এই বিদ্যার প্রয়োগ সম্পর্কে কিছু কথা শুনবো, যা আমাদের সাধুসন্তেরা করে থাকেন। হিপ্নোটিজম  একটি স্বীকৃত বিজ্ঞান। কোনো ভোজবাজি নয়। ১৮৮২ সালে এই নিয়ে গবেষণার জন্য তৈরি হয় "দি  সোসাইটি ফর ফিজিক্যাল রিসার্চ -  THE SOCIETY FOR PHYSICAL RESEARCH. 1892 সালে ব্রিটিশ মেডিকেল এসোসিয়েশন বিস্তর অনুসন্ধানের পর রায় দেয় , যে হিপ্নোথেরাপি একটা বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতি। ১৯৫২ সালে বি.এম.এ. আবার একে পুনরায় স্বীকৃতি দেয়। ১৯৫৮ সালে আমেরিকা আমেরিকান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন স্বীকৃতি দেয়।  এর পরে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশান হিপ্নোথেরাফিকে স্বীকৃতি দেয়। সবশেষে ২০০৪ সালে ভারত সরকারও হিপ্নোথেরাপি কে অনুমোদন দেয়। 

ছোটবেলায়, আমরা মায়ের মুখে ঘুম পাড়ানো গান শুনেছি। গল্প শুনে শুনতেও আমাদের ঘুম এসে যায়। কারুর কারুর বই পড়তে পড়তে ঘুম এসে যায়। গান বা সুরধ্বনি শুনতে শুনতে আমাদের ঘুম এসে যেতে পারে। তো ঘুম আমাদের ক্লান্তি থেকে আসতে  পারে, অর্থাৎ ক্লান্তি থেকে যখন আমরা বিশ্রাম নিতে চাই, তখন আমাদের ঘুম আসে। আমরা জানি এই ঘুমের সময় আমাদের অবচেতন মন কাজ করে থাকে। ঘুমের সময় স্বপ্নে আমরা বাহ্যিক জগতের মতো আর একটা এমনিতর জগতে বিচরণ করে থাকি। 

হিপ্নোজ কথাটার অর্থ হচ্ছে ঘুম।  এটি গ্রিক শব্দ। হিপ্নোটিজম বলতে আমাদের মধ্যে একটা ধারণা আছে, এটি বশিকরন বিদ্যা। ব্যাপারটা ঠিক অমনি নয়। আসলে ঘুমের মাধ্যমে, বা আমাদের তন্দ্রাবস্থাতে যে মন কাজ করে, তাকে কিছু নির্দেশ পাঠানো এই বিদ্যার কাজ।  এবং এর মধ্যে, আমাদের শারীরিক অসুস্থতা ঠিক হতে পারে, মানসিক অসুস্থতা ঠিক হতে পারে। আসলে আমাদের অবচেতন মনকে কিন্তু নির্দেশ পাঠানো। আর অবচেতন মন যেহেতু কোনো যুক্তি তর্কের ধার ধরে না, তাই সে আমাদের নির্দেশ মতো কাজ করতে পারে। তা সে ভুল হোক বা ঠিক।  তাই এই নির্দেশ পাঠাতে গেলে আমাদের সতর্ক থাকতে হয়, যাতে আমরা কোনো অনিষ্টকর নির্দেশ আমাদের অবচেতন মনকে না দিয়ে ফেলি।

প্রত্যেক মানুষের মধ্যে দিব্যদৃষ্টি লাভ করবার একটা শক্তি নিহিত আছে।  তা সে  কারুর  ক্ষেত্রে অল্প আবার কারুর ক্ষেত্রে অধিক।  যাদের মধ্যে এই স্বভাব অধিক পরিমানে আছে, তারা স্বল্প চেষ্টাতেই  সম্মোহনী বিদ্যা আয়ত্ত্বে আনতে  পারেন। কিছু মানুষ দেখবেন, সিনেমা বা নাটক দেখতে   দেখতে কাঁদছেন। এরা সাধারণত সংবেদনশীল মানুষ হয়ে থাকেন। এরা  তাড়াতাড়ি সন্মোহিত হন। আবার  এই মানুষগুলোর মধ্যেই  যাদের আহার বিহারে সংযম আছে, যারা পবিত্র জীবন যাপন করে থাকেন,  তাদের পক্ষে এই দিব্যদৃষ্টি লাভ সহজ হয়ে থাকে।  এমনকি এই শক্তি আমাদের অজ্ঞাতসারে প্রাকৃতিক ভাবেই আমাদের কারুর কারুর মধ্যে দেখা দিতে  পারে। সাধু-সন্তগন যখন এই শক্তি অর্জন করেন, তখন তাদের ত্রিকালজ্ঞ বলা হয়ে থাকে। হৃদয়ের গভীর আকাঙ্খ্যাকে বলে ইচ্ছাশক্তি। এই ইচ্ছাশক্তিকে বাড়িয়ে তোলা, এবং মানুষের মঙ্গলকর কাজে ব্যবহার করা এই বিদ্যার উদ্দেশ্য। আমরা আজ এই বিদ্যার সাহায্যে কিভাবে  মানুষকে ঘুম পাড়ানো  যায়, তার একটি ধারাবাহিক প্রবচন শুনবো।   

ঘুম পাড়ানো বিদ্যা 

বহু মানুষ আছেন, যারা অনিদ্রায় ভোগেন। তাদের জন্য এই ক্রিয়াটি প্রয়োগ করতে পারেন। আগে আপনি ঠিক করুন, কাকে আপনি ঘুম পাড়াবেন । প্রথমেই বলি,  ঘুম পাড়ানো বিদ্যা প্রয়োগ করতে গেলে, যাকে  আপনি ঘুম পাড়াবেন, তার সহযোগিতা দরকার। এবার তাকে বিছানায় শুয়ে পড়তে বলুন, হাতদুটো শরীরের পাশে মেলে রাখতে বলুন। অথবা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসতে বলুন।  হাতদুটোকে কোলের উপরে রাখতে বলুন। শরীরের সমস্ত মাংশ-পেশীগুলোকে  শিথিল করতে বলুন। এবার তাকে ভাবতে বলুন, আমার শরীর শক্তিহীন - বলশূন্য - নির্জীব হয়ে পড়েছে। মাথাটা ক্রমশঃ ভারী হয়ে আসছে। চোখ দুটো বন্ধ  হয়ে আসছে - আমি কিছুতেই চোখের পাতা খুলতে পারবো না। ভাবতে বলুন, আমার শরীর অসার হয়ে আসছে, আমি অবসন্ন হয়ে পড়েছি, আমি এক্ষুনি  ঘুমিয়ে পড়বো। আমার খুব গভীর ঘুম হবে. আমি এখনই ঘুমিয়ে পড়বো। 

এবার আপনি ওর নাকের অগ্রভাগে স্থির ও গভীর দৃষ্টিপাত করুন। এরপর  আপনার হাতদুটো দিয়ে পাস্ দিতে হবে।  পাস্ অর্থাৎ উভয় হাতের আঙুলগুলোকে প্রসারিতকরে, মাথার সামনে স্থাপন  করুন। এবার হাত দুটোকে ধীরে ধীরে শরীরের উপর থেকে টেনে পা পর্যন্ত নিয়ে যান। এইভাবে ৫ থেকে ১০ মিনিট করতে থাকুন। একে স্পর্শযুক্ত নিম্নগামী পাস্ বলে। এই পাস্ দেবার সময় আপনার দৃষ্টি সদা রুগীর নাসা-মুলে রাখতে হবে, আপনি নিজে কুঁজো হয়ে কাজটা করবেন। পাস্ দেবার সময় রুগীকে গম্ভীর স্বরে নির্দেশ দিতে থাকুন। - ঘুম - ঘুম - ঘুম - গভীর নিদ্রা - ঘুম ঘুম আরো গভীর ঘুম।  ঘুম - ঘুম - ঘুম - আরো গাড়ো  নিদ্রা। চার-পাঁচ মিনিট এইভাবে আদেশ দিতে থাকুন।  এবার বলুন, তোমার মাথা আস্তে আস্তে ভারী হয়ে পড়ছে - তোমার শরীর  ধীরে ধীরে খুব অলস - অবসন্ন হয়ে পড়ছে। তোমার চোখ বন্ধই আছে, তোমার চোখের পাতা গভীর ভাবে চোখের উপরে চেপে বসেছে। তোমার কেবলই ঘুম পাচ্ছে -  ঘুমের  মধ্যে তুমি হারিয়ে যাচ্ছ। আঃ কি আরাম - এমন ঘুম জীবনে কখনো হয়নি। এখন তুমি  কিছুই অনুভব করতে পারছো না। তোমার একটুও নাড়াচাড়া করতে ইচ্ছে করছে না তোমার নাড়াচাড়ার শক্তি  চলে গেছে। তুমি আমার কথা ছাড়া কারুর কথা শুনতে পাচ্ছ না। কেবল আমার্ কথাই শুনতে পাচ্ছ।চার-পাঁচবার এই একই নির্দেশ দিতে  থাকুন। ঘুম-ঘুম-ঘুম গভীর ঘুম।  ঘুম-ঘুম-ঘুম গভীর ঘুম। চার-পাঁচ বার এই একই কথা বলতে থাকুন। এবার বলুন, খুব আরামদায়ক ঘুমে তুমি প্রবেশ করেছো। গভীর নিদ্রায় তুমি প্রবেশ করেছো।  শান্তিদায়ক নিদ্রায় তুমি প্রবেশ করেছো। গভীর নিদ্রা। গভীর ঘুম হচ্ছে তোমার। আরো গভীর ঘুম হচ্ছে তোমার। আমি না জাগালে এই ঘুম তোমার ভাঙবে না। আমি ছাড়া এই ঘুম তোমাকে কেউ ভাঙাতে পারবে না। এইবার তোমার জোরে জোরে শ্বাস প্রশ্বাস বইছে।  খুব জোরে, আরো জোরে - আরো জোরে। এখন তুমি নাক ডেকে ঘুমুতে থাকবে। তুমি ঘুমোও, ঘুমোও। 

এই সময় যদি দেখো রুগীর শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক ভাবে বইছে, জোরে বইছে না, তাহলে তুমি নিজে জোরে জোরে শ্বাস প্রশ্বাস টানতে-ফেলতে  থাকো।  তোমার শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনে রুগীও  জোরে জোরে শ্বাস প্রশ্বাস ফেলতে শুরু করবে। যখন রুগী শ্বাস প্রশ্বাস জোরে জোরে টানতে থাকবে, তখন তুমি শ্বাস প্রশ্বাস স্বভাবিক করো। আবার বলতে থাকো তোমার গভীর ঘুম এসে গেছে।  তুমি গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে গেছো।  তোমার ঘুম এখন আর ভাঙবে না। যতক্ষন না আমি তোমাকে জাগতে বলবো, ততক্ষন আর তুমি জাগবে না।  গভীর নিদ্রা, গভীর ঘুম, আরামদায়ক নিদ্রা, শান্তিদায়ক নিদ্রা। .........

এখন কথা হচ্ছে ঘুম পাড়াবার  চেষ্টা তো আমি করলাম, কিন্তু সে ঘুমুলো কি না সে কথা আমি বুঝতে পারবো কি করে ? কিছু দুস্টু ছেলে আছে, যারা এর পর খিল-খিল  করে হেসে উঠে বলবে, আমি তো ঘুমোই নি। এবার তোমার  পরীক্ষার করবার পালা। শুধু ঘুম তো নয়, তুমি এবার এর  অবচেতন মনকে কিছু নির্দেশ দেবে, যা সে মানতে বাধ্য হবে। তো সেইজন্য, বুঝে নিতে হবে সে আমাদের নির্দেশ অনুযায়ী ঘুমুলো কি না। তবে একটা কথা বলি ঘুম পাড়ানোর এমনি তরো ১২টি পদ্ধতি আছে। একটা পদ্ধতিতে কাজ না হলে, অন্য পদ্ধতি বা একাধিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে।শুধু এইভাবে অন্যকে নয়, তুমি  নিজেকেও নির্দেশ পাঠিয়ে নিদ্রার জগতে প্রবেশ করতে পার। আসলে ঘুম আমাদের উদ্দেশ্য নয়, আমাদের অবচেতন মনকে কিছু নির্দেশ পাঠানো, অর্থাৎ আমাদের সমস্ত কর্ম্মের যে নির্দেশক তাকে নিয়ন্ত্রিত করা, নির্দেশ পাঠানো। যদিও ঘুম মানুষের ক্রিয়া  শক্তি সঞ্চয় করবার একটা আবশ্যক ও স্বাভাবিক ক্রিয়া। যাইহোক আমাদের রুগী ঘুমোলো কি না - তা একবার দেখে নেই। আরো একটা কথা ঘুম থেকে কিভাবে তাকে জাগাতে হবে, সেই প্রক্রিয়া না-জেনে কাউকে ঘুম পাড়াতে যাবে না।  তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।  এর পরের দিন আমরা সেই সম্পর্কে আলোচনা করবো। 

১. যদি  রুগীর স্বাস প্রশাসগুলো সমান, দীর্ঘ ও গভীর হয়, তবে বুঝবেন, রুগী ঘুমিয়ে পড়েছে। 

২. চোখের পাতা আস্তে টেনে তুলে কিছুক্ষন ধরে রাখতে হবে, যদি চোখের মনি নড়াচড়া করে, তবে জানবেন , সে ঘুমোয় নি।  চোখের মনি নাড়াচাড়া করবে না গভীর ঘুমে থাকলে। 

৩. চোখের মনির পাশে যে সাদা অংশ আছে, সেখানে আস্তে আঙ্গুল স্পর্শ করে দেখুন  রুগী চোখের পাতা বন্ধ  করবার চেষ্টা করছে কি না। যদি চেষ্টা না করে, তবে জানবে, রুগী গভীর ঘুমে আছন্ন।

৪. রুগীর চোখের মধ্যে আস্তে আস্তে ফুঁ দিলে, সে চোখ বন্ধ করতে চেষ্টা করছে কি না খেয়াল করো।  যদি না করে জানবে, গভীর নিদ্রায় আছে রুগী। 

৫.এবার  রুগীর একখানা হাত আস্তে আস্তে উপরের দিকে ওঠাও, আর আদেশের  স্বরে বলতে থাকো, তোমার এই হাতটাকে আমি সোজা করে দাঁড় করিয়ে রাখবো, একে শক্ত করে রাখো, শিথিল হবে না বা পড়ে  যাবে না এবার . তোমার হাতটি ধীরে ধীরে খুব শক্ত হচ্ছে, লোহার মতো শক্ত হচ্ছে, হাত কিছুতেই নিচে পড়বে  না, কখনো পড়বে  না।  যতক্ষন আমি তোমাকে শিথিল করতে না বলবো, ততক্ষন হাত লোহার মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। এতে তোমার ঘুমের কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। দুই-তিন বার এইভাবে আদেশ-নির্দেশ দেবার পরে, হাতটি শক্ত হয়েছে কিনা খেয়াল করো, কিছুক্ষন অপেক্ষা করো, এর পর হাত সোজা করে দাও, দাঁড়িয়ে থাকুক, হাতটাকে টিপে দেখো, হাত শক্ত আছে কি না। যদি হাত  শিথিল না হয়ে শক্ত থাকে, দন্ডায়মান থাকে তবে জানবে, রুগী ঘুমিয়ে আছে।  চার-পাঁচ মিনিট পরে আদেশ দিয়ে হাতকে আবার আগের মতো শিথিল করে নিচে নাবিয়ে দাও ।  

৬. ঠিক একই ভাবে রুগীর পা আস্তে আস্তে উঠিয়ে সরল রেখায় সোজা করে শূন্যে দাঁড় করিয়ে দেবে।  এই সময় বলবে, তোমার পা, উরু থেকে গোড়ালী পর্যন্ত শক্ত হচ্ছে - ধীরে ধীরে আরো শক্ত হচ্ছে, শক্ত হচ্ছে।  আমি একে শূন্যে যেভাবে রেখেছি, পা সেইভাবে, সেই অবস্থাতেই থাকবে।  কখনো শিথিল বা নুয়ে পড়বে  না। যতক্ষন আমি শিথিল হতে না বলবো, ততক্ষন এইভাবে কঠিন ভাবে, পা উঁচু হয়ে থাকবে, এবং তোমার ঘুমের কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। ৪/৫ মিনিট এই অবস্থায় থাকলে তার নিদ্রা গভীর হয়েছে বলে বুঝবে।  এবং তোমার আদেশ মতো রুগীর শরীর  কাজ করছে, ইটা নিশ্চিত হতে পারবে । এর পরে আদেশ দিয়ে, পা-কে আবার শিথিল করে দাও। এর পরের দিন আমরা ঘুম ভাঙানোর প্রক্রিয়ার কথা শুনবো।  ততক্ষন অপেক্ষা করুন। মনে রাখবেন, আমাদের কাজ কিন্তু ঘুম পাড়ানো  নয়, আমাদের কাজ হচ্ছে, রুগীর শরীরের সমস্ত রোগ নিরাময় করা। ধীরে ধীরে আমরা সেইসব কথা শুনবো। অতিরিক্ত উৎসাহিত হয়ে, এই প্রক্রিয়ার প্রয়োগ করতে যাবে না।  এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। এই একটি বিজ্ঞান সম্মত প্রক্রিয়া, কিভাবে এটি কাজ করে, সে সম্পর্কেও আমরা শুনবো। ধৈর্য্যধরে অপেক্ষা করুন।     

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

 

সম্মোহনী বিদ্যা আয়ত্ত্বের কৌশল  : মোহিত-ঘুম ভাঙ্গানো   বিদ্যা। HYPNOTISM-2

তথ্যসূত্র : সম্মোহন বিদ্যা : প্রেফেসর রাজেন্দ্রনাথ রুদ্র। 

ডঃ এডগার কেইসি। না ভদ্রলোকের কোনো ডাক্তারি ডিগ্রি ছিল না। কিন্তু তিনি চিকিৎসা বিদ্যায় একটা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী  ছিলেন।  ১৯১০ সালে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় একটা খবর বেরিয়েছিল। সেখানে বলা হচ্ছে, "এডগার কেইসিকে যখন সন্মোহিত করা হতো তখন তিনি চিকিৎসকের ভূমিকায় যে ক্ষমতা দেখাতেন তা দেখে বিশ্বের বড়বড় চিকিৎসকগন বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যেতেন। কেইসির অলৌকিক ক্ষমতা দেশের প্রখ্যাত চিকিৎসকদেরও নজর কেড়েছিল।" যাঁর চিকিৎসা সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না, তাকে যখন সম্মোহিত করা হতো, তখন তিনি রুগীর কি রোগ হয়েছে, তা বলতে পারতেন ও তার চিকিৎসা কি হবে তাও বলে দিতেন।  তাকে শুধু  রোগীর নাম, ঠিকানা দেওয়া হতো।  রোগী যেখানেই থাক, তা পাশের ঘরেই হোক আর হাজার মাইল দূরে হোক, কেইসি তার সম্মোহিনী নিদ্রার মধ্যে অতীন্দ্রিয় দৃষ্টিতে সব দেখতে পেতেন  . তিনি এই মোহিতনিদ্রার  মধ্যেই কথা বলতে শুরু করতেন। এই অবস্থায় তিনি যে কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতেন। 

আমাদের দেশও বহুমহাত্মাগণ রুগীর শরীর স্পর্শ করে, কি সব বিড়বিড় করে বলেন, আর রুগী রোগমুক্ত হয়ে যায়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কুজোঁকে সোজা করেছিলেন।  এসব আমরা শুনেছি, কেউ কেউ হয়তো এইসব ঘটনার সাক্ষী হতে পেরেছি। আসলে যার নির্দেশে আমরা সবাই নানান রকম কাজ করে থাকি, আমাদের শরীরের বিভিন্ন কাজ সম্পাদন হয়ে থাকে, তাকে সম্মোহনের মাধ্যমে কিছু নির্দেশ পাঠানো, এই বিদ্যার উদ্দেশ্য। 

আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে এই ক্ষমতা কিভাবে অর্জন করা যায়। তার আগে আমরা দেখে নি ডঃ কেইসি কিভাবে এই ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। ডঃ কেইসির যখন মাত্র ২১ বছর বয়স, তখন তার ল্যারিঞ্জাইটিস হয়েছিল।  আর এতে, তার গলার স্বর চিরতরের মতো হারিয়ে যায়। এই সময় হার্ট নামে  এক যাদুকর, তাদের গ্রামে আসে। যাদুকর হার্ট কেইসিকে সম্মোহিত ক'রে, তাকে কিছু নির্দেশ পাঠান।  আর কেইসি সেই সম্মোহিত অবস্থায় কথা বলতে শুরু করলেন । কিন্তু দুঃখের কথা হচ্ছে, তিনি যখন জেগে উঠতেন, তখন আর কথা বলতে পারতেন না। এর পরে, লেইন নামে  এক অস্টিওপ্যাথিস্ট (অর্থাৎ হাড়, পেশীর অস্ত্রোপচার করে চিকিৎসা করেন) সম্মোহিনী বিদ্যা প্রয়োগ করে, কেইসিকে সারিয়ে সরিয়ে তোলেন। আর আশ্চর্য্যের কথা হচ্ছে, নিজেকে সারানোর এই চিকিৎসার পদ্ধতির কথা বলে দিয়েছিলেন, সম্মোহিত কেইসি নিজেই । অন্যদিকে  লেইন নিজে পাকস্থলীর যন্ত্রনায় ভুগছিলেন বহুদিন থেকে। কেইসিকে সম্মোহিত করে, তার কাছ থেকে লেইনি তার নিজের চিকিৎসার কথাও জেনে নিয়েছিলেন। কেইসি পরে একটানা ৪৩ বছর যাবৎ এই  ক্ষমতার মাধ্যমে হাজার হাজার রুগীকে তাদের রোগ নিরাময়ে সাহায্য করেছিলেন। তার এই অলৌকিক চিকিৎসা সম্পর্কে হাজার হাজার পৃষ্ঠার  বই লিখেছেন বহু লেখক কিন্তু তার এই অলৌকিক বিদ্যার রহস্য সম্পর্কে অর্থাৎ সম্মোহিনী বিদ্যার বই খুব কম। আমরা সেই সম্মোহিনী বিদ্যা সম্পর্কে শুনবো প্রেফেসর রাজেন্দ্রনাথ রুদ্র মহাশয়ের লেখা বই  "সম্মোহন বিদ্যা"  থেকে যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৫ সালে, কলকাতা থেকে । 

কিন্তু যেকথা আপনাদের বলা প্রয়োজন সেটি হচ্ছে আমি মোহিতবিদ্যার শিক্ষক নোই। আমি কাউকে কখনো মোহিত করবার চেষ্টা  করেও  দেখিনি। তবে এই বিদ্যার সারবস্তু নিয়ে, আমার আগ্রহ আছে, নিজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে দেখেছি, অর্থাৎ নিজের দেহকে সুস্থ রাখতে পেরেছি, এই  বিদ্যার প্রয়োগ করে ।  এই বিদ্যার প্রয়োগকারীদের অনেক ঘটনার কথা নানান বইতে পড়বার  সুযোগ হয়েছে। তাই এই বিদ্যা অর্জন করে, কেউ যদি কারুর উপকার করতে পারেন, বা নিজেও  উপকৃত হতে পারেন, সেই আগ্রহ জাগিয়ে তুলবার জন্য, এই আলোচনা। কাউকে শেখানো বা জ্ঞান দেওয়া  উদ্দেশ্য নয়। কেবলমাত্র এই গুপ্ত বিদ্যা সম্পর্কে আগ্রহ জাগানো  উদ্দেশ্য। আমি যে বইয়ের সাহায্য নিয়েছি, তার নাম আগেই বলেছি,  সম্মোহিনী বিদ্যা, লেখক প্রেফেসর রাজেন্দ্রনাথ রুদ্র। এই বইটি লেখক নিজেই ১৯৩৫ সালে প্রকাশ করেছিলেন, ১০৫/৫, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোড, কলকাতা থেকে।  

যাই হোক, এর আগের দিন আমরা শুনেছিলাম, কিভাবে রুগীকে নিদ্রিত করা যায়। অবশ্য এই নিদ্রা স্বাভাবিক নিদ্রা নয়। একে বলা যেতে পারে মোহিত নিদ্রা। অর্থাৎ নিদ্রার মধ্যেও রুগীর শরীর আমার নির্দেশ/আদেশ মতো কাজ করবে। এমনকি নিদ্রার মধ্যে সে কথা বলবে, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ  চালনা করবে।   আমাদের শরীরের ভিতরে অর্থাৎ ফুসফুস, হৃৎপিন্ড, লিভার, রক্ত-প্রবাহ , এমনকি আমাদের মাথার মধ্যে যে সব সুক্ষ স্নায়ুর  ক্রিয়া, আমাদের মেরুদণ্ডের মধ্যে যে নাড়ীর ক্রিয়া, অর্থাৎ   আমাদের শরীরের সমস্ত কিছু, নিয়ন্ত্রণ করে যে অবচেতন  মন তাকে আমরা নির্দেশ পাঠাবো, আর সেই মতো অঙ্গগুলো পরিচালিত করবে অবচেতন মন। 

প্রথমেই বলি, আমরা যাকেই মোহিত করবো, তা সে তার জাগ্রত অবস্থায়, হোক, বা নিদ্রিত অবস্থাতে হোক, এই অবস্থায় রুগীকে প্রকৃতিস্থ করতে গম্ভীর  আদেশসূচক স্বরে "জাগো-জাগো-জেগে ওঠো-জেগে ওঠো- জাগো-জাগো- জাগো বলতে হবে।  ৪/৫ মিনিট অপেক্ষার পরেও, যদি রুগী না জেগে ওঠে তবে তার শরীরের উপরে পাস্ দিতে হবে। নিদ্রিত করবার জন্য, আমরা স্পর্শযুক্ত নিম্ন গামী পাস্ দিয়েছিলাম, এবার স্পর্শযুক্ত উর্দ্ধগামী পাস্ দিতে হবে। অর্থাৎ আগে দিয়েছিলাম, মাথা থেকে পাস্ শুরু করেছিলাম, এবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পাস্ দিতে হবে।  সঙ্গে সঙ্গে বলতে হবে - জাগো-জাগো-জাগো- সেরে গেছে -সেরে গেছে - জাগো -জাগো ইত্যাদি। যদি এতেও জাগ্রত না হয়, তাতে চিন্তা করবার কিছু নেই, বা ভয়ের কিছু নেই। কারন এই সম্মোহিনী নিদ্রা বা মোহিত নিদ্রা কখনোই বিপদজনক নয়। যারা  স্বাভাবিক ভাবে একটু বেশি ঘুমকাতুরে, তাদের  সহজে  ঘুম ভাঙে না। এক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করবার কিছু নেই। রুগীকে  একটু নির্জনে  নীরব স্থানে রেখে দিন।  দশ থেকে ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই মোহিত নিদ্রা স্বাভাবিক নিদ্রায় পরিণত হবে। এখন আবার বলতে হবে - জাগো -জাগো -জাগো তুমি আর বেশিক্ষন ঘুমুবে না। জেগে ওঠো।  আমি আর তোমাকে বেশিক্ষন ঘুমুতে  দেব না।  জাগো-জাগো-জাগো জেগে ওঠো।  এখন আমি এক থেকে ২০ পর্যন্ত গুনবো, এর মধ্যে অবশ্যই  তুমি জেগে উঠবে। এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ জাগো জেগে ওঠো জাগো - ঘুমভেঙ্গে জেগে ওঠো তোমার ঘুম ভেঙে গেছে - জাগো -জাগো - ছয় -সাত-আট -নয়-দশ - জাগো -জাগো -তোমার ঘুম ভেঙে গেছে, তের -চোদ্দ -পনের-ষোলো- সতের -আঠারো-ঊনিশ -কুড়ি - জাগো-জাগো- ওঠো- জাগো - তোমার ঘুম ভেঙে গেছে - ওঠো- উঠে দাঁড়াও। এইভাবে নির্দেশ পাঠাতে থাকবেন। ঠিক ঠিক মতো এই নিয়মের অনুসরণ করতে পারলে, মোহিত ব্যক্তি অবশ্য়ই জেগে উঠবেন, এবং প্রকৃতিস্থ হয়ে উঠবেন।  একটা কথা মনে রাখতে হবে, তাকে শারীরিক দিক থেকে কখনো আঘাত করবেন না। অর্থাৎ ঠেলে ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করবেন না। বা জোরে চিৎকার করে, বা হাততালি দিয়ে এই মোহিত ঘুম ভাঙতে চেষ্টা করবেন না।  এতে ঘুমন্ত ব্যক্তির স্নায়ুমণ্ডলীতে আঘাত লাগলতে পারে। কেবল মৌখিক আদেশ-নির্দেশ ও পাস্ দ্বারা জাগ্রত করলে  তার শরীরের বা মনের কোনো অনিষ্ট হবার সম্ভাবনা নেই। অতএব মোহিত বিদ্যা প্রয়োগ করতে গেলে, এই কার্যকরী নিয়মের প্রয়োগ ব্যতীত অন্য নিয়মের সাহায্য নেওয়া বাঞ্চনীয় নয়। রুগী জাগ্রত হয়ে গেলে বেশ সুস্থ সবল   বোধ করবে। যদি এর অন্যথা হয়, তবে তার নাসামূলে স্থির ও তীব্র দৃষ্টি  নিক্ষেপ করবেন এবং আদেশের স্বরে বলবেন, তোমার কোনো প্রকার দুর্বলতা বা অবসন্নতা নেই - কোনো প্রকার শ্রান্তি বা অবসাদ নেই, তুমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ  ও সবল হয়েছো। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে, অর্থাৎ অহেতুক কোনো ব্যক্তিকে  মোহিতনিদ্রার জন্য আহবান করবে না।  তবে প্রথম প্রথম এই বিদ্যা-শিক্ষার অনুশিলন করবার সময়, নিদির্ষ্ট ব্যক্তির মধ্যে প্রয়োগ করে,অর্থাৎ শিক্ষর্থীদের মধ্যে  একে  অপরের উপরে প্রয়োগ করে বিদ্যা আয়ত্ত্বে আনা  যেতে পারে।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।

ভগবানের ইচ্ছেটা কি ?

মানুষ ভালো নেই। এক বন্ধু লিখেছেন, "গুরুদেব, আপনার কন্টাক্ট নাম্বারটা যদি দয়া করে দেন, আমি মৃত্যু থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারি। আমি রোগগ্রস্থ, শয্যাশায়ী।" প্রথমেই আমি পরমপিতার  কাছে প্রার্থনা করি,  হে ঈশ্বর তুমি ওঁকে সুস্থ-সবল করে দাও। আপনাদেরও বলবো, ঈশ্বরের কাছে, আমার এই বন্ধুর  আরোগ্যের জন্য প্রার্থনা করুন।  বন্ধুকে  বলি,   আমি কারুর গুরুদেব নোই। এমনকি সাধু-সন্ত নোই। আমি আপনাদের মতোই একজন সাধারণ মানুষ। আমার কোনো তথাকথিত দেহধারী গুরুদেবও নেই। আমি একজন জিজ্ঞাসু মাত্র। আমার অন্তরে  প্রশ্ন জাগে, আর তার উত্তর খুঁজি নিজের মধ্যেই ।  মহাত্মাদের কথা,  যা অনুভব করি, সত্য বলে মনে করি, সেই কথাগুলো আমার বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়, যা আসলে নিজেকেই শোনাই। আপনার ইচ্ছে হলে শুনতেও পারেন, আবার নাও পারেন। সত্যি কথা বলতে কি, যারা ইউটুউবে  গুরুর সন্ধান করছেন, তারা করুনার পাত্র।এর থেকে বোঝা যায়, মানুষ আজ কত অসহায়।  গুরুদেব আমাদের ভিতরে-বাইরে সর্বত্র বর্তমান।

গুরুগীতায় আছে - অখন্ড-মন্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরম - গুরুদেব সর্বত্র ব্যাপ্ত।গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু গুরুর্দেব মহেশ্বরঃ -  তিনি সমস্ত দেবতার দেবতা, ব্রহ্মানন্দং পরম সুখদং কেবলম জ্ঞানমূর্তিম।  তিনি আমাদের জ্ঞান স্বরূপ, সুখানুভূতি  স্বরূপ, আনন্দ স্বরূপ। 

নিখিল বিশ্ব কাঁদছে। গৌতম মানুষের পরিণতি দেখে রাজসুখ ত্যাগ করে, দুঃখ নিবারনের জন্য নিজের মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন। আমরা আমাদের নিত্য সত্তা  সেই আত্মাকে দেখতে পাই না। যিনি নাকি সুখ-দুঃখের উর্দ্ধে।  কিন্তু মানুষের দুঃখের সঙ্গে একাত্মতা  অনুভব করি। আর  দেখি, মানুষ সারাজীবন দুঃখের সঙ্গে লড়াই করে করে ক্লান্ত হয়ে, একদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মৃত্যুর দিনেও তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে জন্মায়, কাঁদতে কাঁদতে মৃত্যু বরণ  করে । এর থেকে পরিত্রানের কি কোনো উপায় নেই ? উপায় আছে, আজকের এই কথাগুলো  শুনুন। 

দেখুন, মানুষ জন্ম গ্রহণ করেছে, কর্ম্ম করবার জন্য।  আবার  এই কর্ম্মফল মানুষকে বারবার জন্ম মৃত্যুর চক্রের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখে। এখন থেকে রেহাই পাবো কি করে ?  ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কর্ম্মকে যোগে পরিণত করো। তাহলে কর্ম্মফল ভোগ করতে হবে না। কিন্তু কর্ম্মকে যোগে পরিণত করবো কি করে ? ফলের আশাতেই আমরা কর্ম্ম করে থাকি। ভালো থাকবার জন্য, আমরা কর্ম্ম করে থাকি। কিন্তু ফল হয় উল্টো, অর্থাৎ এই কর্ম্মই আমাদের বারবার কষ্ট দেয়। মৃত্যুপুরীতে টেনে নিয়ে আসে। দেখুন, আমাদের সবার মধ্যে ভগবান একটা জিনিস দিয়েছেন, সেটা হচ্ছে ধীশক্তি। যা আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি সংগ্রহতে সাহায্য করে থাকে। আর এই জ্ঞানই আমাদের মুক্তির পথের অবলম্বন। এই জ্ঞান আমরা সংগ্রহ করে থাকি, আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে। আর ইন্দ্রিয় কাজ করে থাকে বহির্জগতের সংস্পর্শে এসে। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলো বহির্মুখী। এই ইন্দ্রিয়গুলো যদি অন্তর্মুখী করতে পারি, তবে আমরা আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারি। অর্থাৎ আমাদের মধ্যে প্রাণের সাহায্যে যে চেতন শক্তি প্রতিনিয়ত আমাদের মধ্যে যাতায়াত করছে, তাকে যদি ধরতে পারি, তবে আমরা চৈতন্যর জ্ঞানালোকে নিজেকে উদ্ভাসিত করতে পারি। তখন আমরা যে কর্ম্ম করবো, তা আমাদের বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হবে না, তা আমাদের বাহ্যিক জ্ঞানের দ্বারাও পরিচালিত হবে না, তা হবে আমাদের প্রজ্ঞার দ্বারা পরিচালিত কর্ম্ম। এই প্রজ্ঞার দ্বারা পরিচালিত কর্ম্ম করলে বিষয়ের জ্ঞান সহজেই আমাদের আয়ত্ত্বে আসবে। আমাদের মধ্যে একাগ্রতা বৃদ্ধি করবে, কর্ম্মে স্ফূর্তি আনবে, কর্ম্মে অনীহা দূর করে দেবে, কর্ম্ম তখন আনন্দ দায়ক হবে, কল্যাণকর হবে। জীবন তখন ভয়শূন্য হবে, কর্ম্মফলে তখন নিস্পৃহ ভাব জন্মাবে। কাল্পনিক ভবিষ্যতের সুখের আশা তখন দূর হয়ে যাবে। অতএব না পাওয়ার বেদনা তখন আমাদের আঘাত করতে পারবে না।

লোকে বলে নিজের জন্য কাজ করলে ভবিষ্যতে দুঃখ পেতে হয়। আর অপরের জন্য করলে সুখে থাকা যায়। এই যে সুখ-দুঃখ এগুলো ভীষণ ভাবে, তাৎক্ষণিক, সাময়িক। যদি আনন্দকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চান, যদি সত্যিকারের আনন্দ পেতে চান, তবে একমাত্র নিজের জন্যই কর্ম্ম করুন। আপনার ভেতরে একটি সুপ্ত প্রতিভা আছে, তাকে জাগিয়ে তুলুন। মা-বাবা বলছেন, আপনাকে ভালোভাবে পড়াশুনা করতে হবে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। অর্থাৎ সমাজ আমাদের শিক্ষা দিতে চায়। সমাজের চাহিদা আমাদের দিয়ে পূরণ করতে চায়। কিন্তু আপনার তো পড়াশুনা ভালো লাগে না, আপনার কবিতা লিখতে ভালো লাগে, ছবি আঁকতে ভালো লাগে, আপনার হয়তো গায়ক হতে ইচ্ছে করে, আপনার হয়তো শিল্পী হতে ইচ্ছে করে। আপনার হয়তো কথা বলতে ভালো লাগে, এই যে আপনার ইচ্ছে এগুলোকে প্রখর ভাবে, যাচাই করুন। যদি অন্তরের গভীরে, আপনার মধ্যে ভগবান এই বীজ বপন করে থাকেন, তবে এই প্রতিভাকে লালন পালন করুন। এগুলোকে জল সিঞ্চন করুন, আলোকিত করুন। তবেই আপনি সুখে না থাকুন, আনন্দে থাকবেন। একজন প্রশ্ন করেছিলেন, ভগবানের ইচ্ছেটা কি ? এটাই ভগবানের ইচ্ছে। যখন আপনি বুঝবেন, ভগবানের ইচ্ছে কি, এবং সেই অনুযায়ী কর্ম্ম করেন, তখন আপনার আর দুঃখ হবে না। কষ্ট থাকবে না। আপনার কাজ হবে ভিতরের সজ্ঞা থেকে। আপনার আঁকা ছবি কে কিনলো, না কিনলো তাতে কিছুই যায় আসে না। আপনার গান কে শুনলো, আর না শুনলো, তাতে কিছুই যায় আসে না। আপনার কথা কে শুনলো না শুনলো, তাতে আপনার কিছুই যায় আসে না। আপনি তখন কাজ করেন, আপন-মনের তৃপ্তির জন্য। আপনি তখন নিজের সৃষ্টির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেন, আর অনাবিল আনন্দের মধ্যে থাকবেন।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।

বিশ্বাসে বস্তু মেলায় ?

কথায় বলে বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। সত্যিই কি বিশ্বাস করলে বস্তু পাওয়া যায় ? নাকি তর্কের মধ্যেই বিচারের মাধ্যমেই সত্যে উপনীত হাওয়া যায়। আমাদের সমাজটা চলছে আস্থা ও বিশ্বাসের জোরে। আপনি দোকানে গিয়ে জিনিস হাতে পাবার আগেই টাকাটা বাড়িয়ে দেন বিশ্বাস করে। আপনি কখনো ভাবেন না, টাকাতো দিলাম, কিন্তু জিনিস পাবো তো ? আপনি বাসে ট্রামে উঠছেন, গন্তব্যে পৌঁছবেন বলে, আপনার মনে কখনো সন্দেহ জাগে না যে আপনি গন্তব্যে পৌঁছতে পারবো কি না। মাসে শেষে বেতন পেলে আপনি বিশ্বাস করে স্ত্রীর কাছে টাকাটা দিলেন, একথা আপনার মনে কখনো আসে না, যে টাকাটা ফেরত পাওয়া যাবে কি না। আপনি আপনার মা-বাবাকে বিশ্বাস করেন, ভাইবোনদের বিশ্বাস করেন, বন্ধুবান্ধবদের বিশ্বস করেন। মা-বাবাকে বিশ্বাস করে আমরা নিরাপত্তা পাই। শিক্ষককে বিশ্বাস করে আমরা জ্ঞান অর্জন করি, বাস-ড্রাইভার করে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাই। দোকানদারকে বিশ্বাস করে আমরা প্রয়োজনীয় জিনিস পাই। স্ত্রীকে বিশ্বাস করে আমরা শান্তিতে থাকি।বিজ্ঞানীগন তাদের অনুমানকে বিশ্বাসে পরিণত করেন, ও অনুসন্ধানে রত হন। এবং একসময় সত্যে প্রতিষ্ঠিত হন।

আমরা হয় ধর্ম্মে বিশ্বাস করি, নতুবা নাস্তিকতায় বিশ্বাস করি। আমরা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলকে বিশ্বাস করি। আমরা নিজেদের একটা নৈতিকতায় বিশ্বাস করি। আমরা বিস্বাসকরি বিজ্ঞানকে, আমরা বিশ্বাস করি ভারতীয় দর্শনকে। এই যে বিশ্বাস এটি আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এসেছে। এবং আমরা যে দৈনন্দিন কাজ কর্ম্ম করে থাকি , তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে এই বিশ্বাস। বছরের পর বছর চাকরি করে, আপনি যে ব্যবসাও করতে পারেন, সেই বিশ্বাস আপনার নেই। আপনাকে কেউ চাকরি ছেড়ে যদি ব্যবসা করতে বলে, তবে আপনি শুনবেন না। কিন্তু এমনতো হতে পারে, যে চাকরি থেকে ব্যবসায় আপনি আরো বেশি রোজগার করতে পারতেন। কিন্তু ভগবান না করুন, আপনার যদি চাকরি চলে যায়, তবে কিন্তু আপনি ব্যবসার দিকে ঝুঁকতে পারেন। কলকাতায় আপনি বহুদিন থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, এখন যদি আপনাকে কেউ যদি হঠাৎ বলে, আপনাকে বোম্বাই যেতে হবে, সেখানেই চাকরি করতে হবে, তবে আপনি যেতে চাইবেন না। কিন্তু এমন নয়, যে আপনি সেখানে গিয়ে চাকরি করতে পারবেন না। বা এমন নয়, যে আপনি ব্যবসা করতে পারবেন না। আসলে পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে, আমরা নিজেকে নিজের মতো করে স্বাচ্ছন্দে রাখতে চাই। আসলে পরিস্থিতি আপনার যোগ্যতাকে প্রকাশ হতে দিচ্ছে না । অথবা বলা যেতে পারে, পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে, আমরা আমাদের গুনগুলোকে ঢেকে রেখেছি। আমাদের পরিস্থিতির দাস বোনে গেছি। অর্থাৎ আমরা ধরে নিয়েছি, আমার পারবো না। আর এই যে আমরা ধরে নিচ্ছি, আমরা পারবো না, এটাই আমাদের উন্নতির অন্তরায়। ধরুন আপনার ৭০ বছরের শরীর। তো আপনাকে এখন দৌড়াতে বললে, আপনি বলবেন, এই বুড়ো বয়সে কি দৌড়ানো যায় ? কিন্তু আপনাকে যদি কুকুরে তাড়া করে, তখন কিন্তু আপনি হুড়মুড় করে দৌড়াতে শুরু করে দেবেন। অর্থাৎ আপনার যে বিশ্বাস - আমি দৌড়োতে পারি না, সেটা সত্য নয়।

ঠিক তেমনি আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের জন্য, আপনাকে অনুরোধ করলে, আপনি বলবেন, এই বয়সে আর যোগ-ধ্যান করতে বলবেন না। আপনাকে যদি ত্রিশ বয়সে বলা হতো, তখনও আপনি বলতেন, অরে এসব কাজ করবার সময় কি আছে আমার। অফিস-সংসার নানান ঝামেলা। অর্থাৎ আমরা একটা ধারণা করে বসে আছি, একটা বিশ্বাসের মধ্যে দৃঢ় হয়ে গেছি যে, এসব আমাদের কাজ নয়।

আমাদের প্রত্যেকের জীবনে একটা স্বপ্ন থাকে, আদর্শ থাকে, একটা লক্ষ থাকে। ছোটবেলায় আমরা মা-বাবার মতো হতে চাই। বড়ো হয়ে আমরা শিক্ষকের মতো হতে চাই। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার আইএএস অফিসার হতে চাই, কেউ বা নেতা হতে চাই। আর হবার জন্য আমাদের নিজেদের মধ্যে একটা বিশ্বাস গড়ে তুলতে হয়, যে আমি এটা হতে পারি। আর এই বিশ্বাস আমাদের সাহায্য করে থাকে। কিন্তু কখনো কি এটা ভেবে দেখেছেন , যে এই যে স্বপ্ন-আদর্শ-লক্ষ পূরণের জন্য কতদিন লাগে, আর লক্ষে পৌঁছোবার পরে, তার স্থায়ীত্ত্ব কতদিন থেকে ? গ্রাজুয়েট হতে গেলে ২১ বছর লাগে, ডাক্তার-ইঞ্জিনীয়ার হতে গেলে ২৫ বছর লাগে। ২৮ বছর বয়স হয়ে গেলে আর নতুন কিছু হওয়া যায় না। চাকরির জন্য আমরা হন্যে হয়ে ঘুরি। ষাট বছর বয়স হয়ে গেলে আমাদের আর চাকরি থাকে না। এই জীবনে যা কিছু হই না কেন, তা সে পণ্ডিত-মূর্খ, বলশালী বা ক্ষমতাশালী, গরিব বা ধনী, ৭০-৮০-৯০ বছর পরে, অর্থাৎ আমাদের মৃত্যুর পরে, এই হওয়ার আর কোনো মূল্য থাকে না। বিষয় সম্পত্তি, গাড়ি-বাড়ি সবই যা এখন থেকে সংগ্রহ করেছিলাম, সবই এখানেই পড়ে থাকবো। আমি আর এই দেহে থাকবো না। এই বিষয় সম্পত্তিও আর আমার থাকবে না, অন্য কারুর হয়ে যাবে।

মনের পরিবর্তনে শারীরিক রোগ-নিরাময়

আমার এক বন্ধু মারা গেছেন, খবর পেয়ে তার বাড়িতে গেলাম। গিয়ে শুনলাম, বন্ধুর স্ত্রী তার স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি এখন শয্যাশায়ী। তো তার সাথে কথা বলছি, এমন সময় বন্ধুর ৪-৫ বছরের নাতি এলো কাছে, আমাকে দেখে বললো, তুমি কে ? আমি বললাম, আমি তোমার বন্ধু। অমনি সে আমার কোল ঘেঁষে দাঁড়ালো। আমি বললাম, তুমি খুব ভালো ছেলে। সঙ্গে সঙ্গে ওর মা বললো, ভালো না ছাই , ও স্কুলে যেতে চায় না। তো আমি তাকে বললাম, কেন দাদুভাই স্কুলে যেতে চাও না কেন ? তো ও আমাকে একটা অদ্ভুত কথা বললো, স্কুলে গেলে আমার শরীর খারাপ করে।

মানুষের কেন রোগ-বালাই হয় ? মানুষের মনের সঙ্গে শরীরের ভালো থাকা না থাকার কি কোনো সম্পর্ক আছে ? আমরা আজ রোগ নিরাময়ের মনের ভূমিকা নিয়ে কিছু কথা শুনবো। রোগ নিরাময়ের জন্য কিছু উপায় খুঁজবো। মনোবিদগন বলছেন, নেতিবাচক চিন্তা আমাদের শারীরিক রোগের মূল কারন। আমাদের মন যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন শুরু হয় আমাদের নেতিবাচক চিন্তা। আমরা যদি নিয়মিত মাইন্ড-কন্ট্রোল মেথডের সাহায্য নিতে পারি, তাতে আমরা আমাদের রোগের আগাম আভাস পেতে পারি, রোগ প্রতিরোধ করতে পারি, আর রোগের নিরাময় তখন সহজ হয়ে যায়।

শরীর থাকলে রোগ থাকবে। পৃথিবীতে এমন কোনো দিন ছিলোনা যখন রোগ-ব্যাধি ছিল না। আবার এমন দিন আসবে না যেদিন পৃথিবী থেকে সমস্ত রোগ চলে যাবে। তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যত দিন যাচ্ছে, তত নতুন নতুন রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। রুগীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। আমাদের কি এর থেকে রেহাই নেই ? রেহাই পেতে গেলে আমাদের খুঁজতে হবে রোগের উৎসকে। মনোবিদ, পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, রোগের কারন লুকিয়ে আছে আমাদের মনের গভীরে। আমরা চাই তাই আমাদের রোগ হয়। আমরা না চাইলে, আমাদের কিছুতেই রোগ হতে পারে না। আমাদের মধ্যে যে রাগ, হিংসা, ঈর্ষা দ্বেষ, ভয়-ভাবনা ও অপরাধবোধ বাসা বেঁধে আছে, তা থেকেই যাবতীয় রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে।

এছাড়া আছে প্রাকৃতিক কারন। আমরা জন্মের পর থেকেই প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করে থাকি। আমাদের জন্মের পর-পর জামা, কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। অর্থাৎ প্রকৃতির কোল থেকে আমরা নিজেকে সরিয়ে রাখি। পশু-পাখি, এই কর্ম্মটি করে না, তাই তাদের মধ্যে রোগের প্রকপ কম। কিন্তু পশু-পাখি যখন গৃহপালিত হয়ে যায়, তখন তাদের মধ্যে রোগ-ব্যাধি দেখা দেয়। এইজন্য যখন আমরা প্রকৃতির কোলে লালিত-পালিত হবো, প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলবো, তখন আমাদের মধ্যে আর রোগ ব্যাধি দেখা দেবে না।

আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয়, মন থেকে কিভাবে রোগের সৃষ্টি হয়, এবং তা আমরা কিভাবে নিরাময় করতে পারি। আগেই বলেছি, আমাদের ভিতরে যে রাগ দ্বেষ, ভয়, ইত্যাদি পুষে রেখেছি, তা থেকেই আমাদের সমস্ত রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে। হৃদরোগ, হাঁপানি, রক্তাল্পতা, মাইগ্রেন পেন, কোষ্ঠকাঠিন্যতা, বুকে ব্যথা, চর্ম্ম রোগ, হাঁটুব্যথা, মায় আমাদের সমস্ত ব্যাধির উৎপত্তি হচ্ছে আমাদের মন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, উন্নত দেশের ৫০% মানুষ মানসিক রোগে সরাসরি আক্রান্ত। এর কারন হচ্ছে, আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ, আমাদের সামাজিক প্রথা, আমাদের পুরোনো ধ্যান-ধারণাকে পুষে রাখা ইত্যাদি।

সমস্ত ধর্ম্মের মূল কথা হচ্ছে মানবতা। জ্ঞান, প্রেম, ভালোবাসা, বৈরাগ্য, । সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, নিজেকে ভালোবাসতে হবে। আর নিজেকে ভালোবাসতে গেলে, প্রথমেই আমাদের নিজের দেহকে ভালো বাসতে হবে। তারপর, আমাদের যে চিরন্তন সত্তা তাঁকে ভালো বাসতে হবে। আমরা যখন নিজেকে ভালোবাসতে শিখবো, তখন আমরা অন্যকেও ভালোবাসতে শিখবো। আর ঠিক তখন থেকেই আমরা সবাই সুস্থ-স্বাভাবিক থাকতে পারবো।

আমাদের মনের অপূর্ন বাসনা, যা চেয়েছিলাম, তা না পাওয়া, আর যা চাইনি তাই পাওয়া আমাদের মধ্যে রাগের সৃষ্টি করে, দ্বেষের সৃষ্টি করে। আর এই রাগ আমাদের মধ্যে এক ধরনের বিশেষ রসের নিঃসরণ শুরু করে। দীর্ঘদিন মনের এই রাগ, দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত রস নিঃসরণ শরীরের ভারসাম্য নষ্ট করে। শেষ পর্যন্ত শরীরকে অতিরিক্ত কোষের উৎপাদন করতে বাধ্য করে, যা পরিণামে ক্যান্সার, টিউমার বলে অভিহিত হয়ে থাকে। কেউ যদি অতিরিক্ত সমালোচিত হয়, তখন তার মধ্যে আর্থারাইটিস জন্ম নেয়। অপরাধবোধ থেকে ব্যথা বেদনা। ভয় বা দুশ্চিন্তা থেকে আসে আলসার ইত্যাদি ।

আমাদের মনের দুটো কর্ম্মক্ষেত্ৰ। চেতন মন ও অবচেতন মন। চেতন মন বুদ্ধির সাহায্যে কাজ করে, কিন্তু অবচেতন মন সংস্কারের বসে কাজ করে থাকে। এইভাবেই আমাদের জীবন অতিবাহিত হয়। আমাদের অবচেতন মনে যখন নেগেটিভ বা নঞর্থক চিন্তা চলতে থাকে, তখন আমাদের রোগ-ব্যাধির উৎপত্তি হয়। যদি আমরা আমাদের এই নঞর্থক চিন্তাকে দূরীভূত করতে পারি, তবে আমরা সুস্থ সবল থাকতে পারবো।

আমাদের মনের এই যে কর্ম্মধারা, বা মনের চিন্তার ভাবধারা এটা আমরা ছোটবেলা থেকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলি। এটিকে সহজে পরিবর্তন করা যায় না। জন্মের পর থেকেই আমাদের মনে পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক পরিবেশের শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা - এমনকি আমাদের চারিদিকে যে সব মানুষ ঘোরাফেরা করছে, তাদের আচরণ থেকেও আমরা শিক্ষা গ্রহণ করে থাকি। প্রকৃতি আমাদের নানান রকম শিক্ষা দিয়ে থাকে। এই যে শিক্ষা বা ইন্দ্রিলাবদ্ধ যে জ্ঞান তা আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে ভর্তি হতে থাকে। আর এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জ্ঞান বুদ্ধির বিকাশ হতে থাকে। এই জ্ঞান বুদ্ধি আমাদের চিন্তাকে প্রভাবিত করে। আমাদের মনের চাহিদাকে প্রভাবিত করে থাকে। আমাদের মধ্যে একটা প্রত্যাশার জন্ম নেয়। আমি যেমন কিছু মানুষের কাছ থেকে খারাপ ব্যবহার প্রত্যাশা করি না তেমনি কিছু মানুষের আচরণ আমাদেরকে ক্ষুব্ধ বা আনন্দ প্রদান করে থাকে। আমরা যেহেতু একটা নির্দিষ্ট পরিবারে জন্ম থেকে বড়ো হয়ে উঠি, তাই আমাদের মধ্যে সব চেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে এই পরিবারের। তাই দেখবেন, আমরা কোনো-কোনো সময় পারিবারিক সূত্রে কিছু রোগের জন্ম দিয়ে থাকি।
তো রোগ আসে আমাদের চিন্তা থেকে। অর্থাৎ নঞর্থক চিন্তা থেকে অর্থাৎ যা আমার পাওয়া উচিত নয়, অর্থাৎ যা আমার পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি, সেগুলো পাবার জন্যও আমাদের মধ্যে একটা ব্যাকুলতা তৈরী হয়, আর এগুলো না পেলে, আমাদের মধ্যে না পাওয়ার বেদনা, আমাকে ক্ষুব্ধ করে, রাগান্নিত করে, যার ফল আমাদের শরীরের রসের নিঃসরণ। যা ভবিষ্যতের রোগের কারন। অতএব রোগ সৃষ্টি করি আমরা নিজেরাই। কিন্তু কথা হচ্ছে এখান থেকে বেরুতে গেলে আমাদের কি করতে হবে। আমাদের সৎসঙ্গ করতে হবে। সৎ-উপদেশ আমাদের ভাবনাকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারে। আমাদের উদ্বেগকে প্রশমিত করতে পারে।

বাচ্চা ছেলেটি স্কুলে যেতে চায় না, আর স্কুলে যাবার সময় হলেই, সে বায়না করে, বার-বার বাথরুমে যায়, এমনকি শরীর খারাপের ভান করে। আর এটা যদি দীর্ঘদিন চলতে থাকে দেখবেন, সে সত্যি সত্যি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিন্তু যদি তাকে বলা হয়, তোমাকে স্কুলে যেতে হবে না, তবে সে হাসিখুশি থাকবে, আর অসুস্থতার ভান করবে না, বারবার বাথরুমেও যাবে না। কথা হচ্ছে,ছেলেটি যা চায় না, তা সে যেকোনো কারনেই হতে পারে, পড়া না পারার জন্য বকুনির ভয়, বা ক্লাসের ছেলেদের হাতে মার্ খাবার ভয় । আমাদের অফিসের নারায়ণবাবু, অবসরের আগে, প্রায়ই কামাই করতেন। আমি তার বাড়িতে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, তিনি অফিসে আসবার জন্য সমস্ত প্রস্তুতি নিতেন, স্নান খাওয়া-দাওয়া সেরে, একটু বিশ্রম নিতেন। বেরুনোর আগেই বলতেন, আমার শরীরটা ভালো নেই, আমি আজ অফিসে যাবো না। আসলে, তাকে অফিসে যে কাজ দেওয়া হয়েছিল, তা তিনি পারতেন না। আর অফিসে বস একটু কড়া ধাতের ছিলেন, ফলতঃ বকাবকি করতেন। তো হোলো কি, আমরা সাবই মিলে বললাম, নারায়ণবাবু, আপনাকে অফিসে কিছু করতে হবে না, আমরা সবাই আপনার কাজ করে দেবো। আপনি শুধু অফিসে আসুন। এর পর থেকে দেখলাম, তিনি প্রায় প্রতিদিন অফিসে আসা শুরু করলেন।

আমাদের সমাজে বেশিরভাগ মায়েদের সারাজীবন ধরে, সমালোচনা শুনতে হয়, পান থেকে চুন খসলেই। এমনকি সংসারের জন্য কিছু আনতে বললেই, শুনতে হতো, বাবার বকুনি নীরবে সব সহ্য করতেন। আর এর ফল হয়, বাতের বেদনা। হাঠুতে ব্যথা। আমাদের মধ্যে যে সৃজনশীল ক্ষমতা আছে, তা যদি না করতে পারি, তবে থাইরয়েড হতে পারে। আপনি কোনো কাছের লোকের কাছ থেকে যদি অপমানিত হন, তবে আপনার সাইনাস হতে পারে। আপনি যদি নিজেকে দুর্বল ভাবেন, তবে আপনার এলার্জি হবে। আপনি যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তবে আপনার কোলাইটিস হবার সম্ভাবনা। যারা সবসময় অতীত নিয়ে চিন্তা করেন, তাদের কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। আপনার মধ্যে যদি অপরাধবোধ থাকে, তা সে যেকোনো কারণেই হোক না কেন, তবে আপনি অবসাদের রোগে ভুগবেন। মানুষের মধ্যে থেকে যখন আনন্দের গতি রুদ্ধ হয়ে যায়, তখন তার হৃদরোগ হবার সম্ভাবনা। এইসব কথা বা রোগের কারন আমাদের অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নাও হতে পারে কিন্তু পরাবিদ্যাবিদ গন এমনকি মনোবিজ্ঞনীগন এমন কথাই বলে থাকেন । কিন্তু কথা হচ্ছে, এর থেকে আমাদের রেহাই হবে কি করে ? আসলে এই যে আমাদের মনের অবস্থা, আমাদের চিন্তার প্যাটার্ন, এগুলো আমাদের জন্ম থেকে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। একদিনেই পাল্টে ফেলা যাবে, এমন ভাবার কোনো কারন নেই। কিন্তু ধৈর্য্য ধরে আমাদের কথাগুলো শুনলে, এবং সেই অনুযায়ী কাজ করলে, আপনি ব্যাধি নামক শত্রু থেকে নিশ্চিত রেহাই পাবেন।

আমাদের মধ্যে যে রোগের উপসর্গ দেখা দেয়, অর্থাৎ ব্যথা, বেদনা, অস্বস্তি, জ্বর, মাথাধরা ইত্যাদি এগুলো আদৌ কোনো রোগ নয়, রোগের উপসর্গ মাত্র। আপনার শরীরে একটা ফোঁড়া হলে জ্বর হতে পারে, আমার ঠান্ডা লেগে ফুসফুস আক্রান্ত হলেও জ্বর হতে পারে। তো জ্বর কোনো রোগ নয়, রোগের উপসর্গ মাত্র। আর আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এই উপসর্গের উপশমের জন্য চিকিৎসা করে থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞান যেমন রোগের উপসর্গের চিকিৎসা করে থাকে, মনের সাহায্যে যদি শরীর সুস্থ করতে হয়, তবে আমাদের মনের মধ্যে, যে রাগ, দ্বেষ, ঘৃণা, হিংসা পুষে রেখেছি, সেগুলোকে দূর করতে হবে। এখন কথা হচ্ছে আপনার মনের মধ্যে যে উপসর্গের উৎপত্তি হয়েছে, তার খবর বাইরের কেউ জানবে কি করে ? বাইরের কেউ না জানুক, আপনি নিজে কিন্তু সেসব জানতে পারবেন। আপনি যদি নিজের মনকে বিশ্লেষণ করেন তবে আপনি নিশ্চিত আপনার মনের অবস্থা ধরতে পারবেন। কিন্তু ধরলেই তো হবে না এগুলোকে দূর করবেন কি করে ?
প্রথমেই বলি, আপনি সুস্থ থাকতে চান কি না সেটা আগে ঠিক করুন। মনকে সেই ভাবে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করুন। প্রতিদিন নিয়মিত হাঁটাচলা করুন। দুচারটে খালিহাতে ব্যায়াম, আসন প্রাণায়াম ইত্যাদি করুন। ভালো বই পড়ুন। কিছুক্ষন নিজের পছন্দের কাজ করুন, যেমন গাছের পরিচার্য্যা, আর্ত মানুষের সেবা, পশু-পাখির পরিচর্য্যা। কবিতা লিখুন, মাটি দিয়ে পুতুল বানান, সেলাইয়ের কাজ করুন, অর্থাৎ কিছু সৃজনশীল কাজ যা আপনার ভালো লাগে, তা সে যেকোনো মানের হোক না কেন। অর্থাৎ নিজেকে অক্টিভ রাখুন।
এরপর যেটা দরকার সেটা হচ্ছে প্রার্থনা। অর্থাৎ বিশ্বশক্তির কাছে প্রার্থনা। ঘুমুতে যাবার আগে, এবং ঘুম থেকে উঠে বিশ্বশক্তির কাছে প্রতিদিন নিয়ম করে প্রার্থনা করুন। আপনার ভিতর থেকে দ্বেষ-হিংসা-রাগ-অভিযোগ আছে তা যাতে দূর হয়, তার জন্য প্রার্থনা করুন । আপনার মধ্যে যাতে শুভবুদ্ধি জাগ্রত হয়, তার জন্য প্রার্থনা করুন। আপনার মনের শক্তি যাতে বৃদ্ধি পায়, আপনি যাতে সমস্ত সমস্যার সাথে লড়াই করবার শক্তি পান, তার জন্য প্রার্থনা করুন। প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু ঘটনা ঘটে, যার পরিবর্তন কর যায় না.সেই সমস্ত অবশ্যম্ভাবী পরিণতিকে মেনে নেবার জন্য মানসিক শক্তির জন্য প্রার্থনা করুন। এতে দেখবেন, আপনার মন শান্ত হয়ে যাচ্ছে। সবাইকে ক্ষমা করতে থাকুন। ভগবানের কাছে, সবার জন্য শুভহোক, এই প্রার্থনা করুন।

শ্বাস-প্রশ্বাসকে ধীর করবার জন্য প্রয়াস করুন। আপনি দেখবেন, রেগে গেলে, বা অস্বাভাবিক যে কোনো পরিস্থিতে, এমনকি সেটা আনন্দেরও হতে পারে,আপনার জোরে জোরে শ্বাস বইছে। এই শ্বাসকে ধীর করবার চেষ্টা করুন। আর এটা করবার উপায় হচ্ছে, শ্বাসপ্রশ্বাসের দিকে গভীর ভাবে মনোযোগ দেওয়া। এটা করলেই শ্বাস-প্রশ্বাস-এর গতি ধীর হতে থাকবে। তখন আপনি একটা স্বাভাবিক শান্তির জগতে প্রবেশ করবেন।

সময়মতো সব কাজ সারুন, লোভ সম্বরন করুন। তাহলে আপনার উদ্বিগ্নতার কোনো কারন থাকবে না। আপনি নিশ্চিন্ত জীবনের অধিকারী হবেন।

প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা উচ্চস্বরে প্রণবের সঙ্গে প্রিয় কোনো নাম উচ্চারণ করুন, অন্ততঃ ১৫-১৫ ৩০ মিনিট। ভ্রামরী করুন ৫-১০ মিনিট।

প্রতিদিন নিয়ম করে, খানিক্ষণের জন্য নিজের শরীর-মনকে শান্ত অবস্থায় বসিয়ে রাখুন। অর্থাৎ ধ্যানে বসুন। ধ্যানে না বসতে পারেন, কিছুক্ষন চুপচাপ মৃদু সংগীতের ধ্বনি শুনুন। ঘড়ির টিক-টিক আওয়াজ শুনুন, বা পাখার শো-শো শব্দ শুনুন। এতে করে আপনার মন স্থির হবে। আর মন শান্ত হয়ে গেলে, আপনি নিশ্চই ভালোই থাকবেন। আপনার সমস্ত শারীরিক অসুস্থতা দূর হয়ে যাবে। আপনি নির্ভয়ে, আনন্দে দিন অতিবাহিত করতে থাকবেন। মনে একটা উৎসাহ-স্ফূর্তি বজায় থাকবে।
আজ এই পর্যন্ত, ঈশ্বর সবার মঙ্গল করুন।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।

জীবন ভাঙা গড়ার অনুশীলনী : (১) শুধু বসে থাকা

জীবনকে নতুন করে গড়তে গেলে, প্রথম যেটা দরকার সেটা হচ্ছে, জীবনকে ভেঙে ফেলা। আমাদের জীবন বিশেষ কিছু প্রক্রিয়াকে বেঁছে নিয়েছে, যার সাহায্যে সে জীবনের স্বাদ গ্রহণ করছে। বেঁচে থাকার রসদ যোগাচ্ছে। জীবনের এই স্বাদ যদি পাল্টাতে চান, তবে বেঁচে থাকবার এই চিরাচরিত অভ্যাসগত প্রক্রিয়াকে ভেঙে ফেলতে হবে। লোহা দিয়ে কাস্তে বানাতে গেলে লোহাকে গরম করতে হবে, পেটাতে হবে, মাটি দিয়ে যদি মূর্তি গড়তে চান, তবে মাটিতে জলের ছিঁটে দিতে হবে, মাটিকে ছানতে হবে। সোনাকে গলাতে হবে, যদি অলঙ্কার গড়তে চান। তো আজ থেকে আমরা সেই বিশেষ প্রক্রিয়ার কথাগুলো শুনবো, যা আপনি করতে অভ্যস্ত নন।

অনুশীলনী ১ : শুধু বসে থাকুন। শুধু বসে থাকুন। নাড়াচাড়া করবেন না। কথাটা শুনলে মনে হবে, এ আর বিশেষ কি ব্যাপার। বসে তো থাকাই যায়। বসে থাকা মানে আমাদের কাছে বিশ্রাম। হ্যাঁ বসে থাকা মানে আমাদের কাছে বিশ্রাম। কিন্তু বিশ্রামের কৌশল না জানা থাকার জন্য, আমরা বসে থেকে যতটা বিশ্রামের সুযোগ নিতে পারতাম, তা আমরা নিতে পারি না। আমরা বসে থেকে চিন্তা করতে থাকি। বসার নাম করে আমরা ঝিমুতে থাকি।

পরিষ্কার দেওয়াল অথবা একটা সবুজ গাছের টবের থেকে তিন/সাড়েতিন ফুট দূরত্ত্বে বসুন। যেকোনো সুখাসনে বসুন। মেরুদন্ড সোজা করে বসুন। চোখ থাকবে অর্ধউন্মীলিত। একটা হাত সোজা করে দিন। অন্য হাত কনুই থেকে ভাজ করে, হাতের পাতা অন্য হাতের কনুই-এর উপরে রাখুন। এই অবস্থায় ১৫ থেকে ৩০ মিনিট থাকতে হবে। যখন এই ভঙ্গিমায় বসে থাকবেন, তখন চোখকে দেখতে দিন, কানকে শুনতে দিন। কিন্তু চোখ কি দেখবে, কান কি শুনবে, তার কোনো নির্দেশ দেবেন না। চোখের সামনে যা আসছে, তাই সে দেখুক। কানে যে শব্দ ভেসে আসছে, তাই সে শুনুক। তবে আপনি কোনো দর্শনীয় বস্তুর দিকে বা কোনো বিশেষ শব্দের উপরে ধ্যান দেবেন না। চোখ দেখছে, কিন্তু আপনি কিহু দেখছেন না, কান শুনছে, কিন্তু আপনি কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। চোখ শুধু দেখছে, বা কান শুধু শুনছে। অর্থাৎ নিজেকে এই চোখ কান অর্থাৎ ইন্দ্রিয় থেকে আলাদা রাখুন।

শুধু বসে থাকুন, চোখ মেলে বসে থাকুন। কিছুই করবেন না। শুধু বসে থাকা একটা অসহ্য কাজ। কিন্তু এই বসে থাকায় যদি আপনি অভ্যস্ত হয়ে যান, যদি কয়েক মাস এই অনুশীলনী চালিয়ে যেতে পারেন, কয়েকঘন্টা ধরে শুধু বসে থাকার নিরন্তর চেষ্টা যদি চালিয়ে যেতে পারেন, আস্তে আস্তে আপনার মধ্যে অনেক কিছু ঘটতে থাকবে। প্রথম দিকে আপনার ঘুম ঘুম পাবে। বসে বসে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায়, আপনি স্বপ্ন দেখা শুরু করে দেবেন। বহু এলোমেলো চিন্তা আপনার মনের মধ্যে আনাগোনা শুরু করে দেবে। মন বলবে, বসে থেকে, অহেতুক কেন সময় নষ্ট করছো ? এই সময় তুমি দুটো অর্থকরী কাজ করতে পারো। সিনেমা দেখতে পারো, বই পড়তে পারো। দাবা খেলতে পারো। কিছু না হোক, কারুর সঙ্গে একটু আড্ডা মারতে পারো। কেন বসে বসে সময় নষ্ট করছো ? জানবে, জীবনে সময়ের বহুত মূল্য। বসে থাকা মানে সময় নষ্ট করা। ইত্যাদি ইত্যাদি মন এই সময় শত শত যুক্তি দেখাতে থাকবে। কিন্তু এইসময় আপনাকে শুধু বসে থাকতে হবে। মনের সমস্ত উপদেশকে উপেক্ষা করে আপনাকে বসে থাকতে হবে। এইসময় আপনার মধ্যে দৃষ্টিভ্রম দেখা দেবে। এইসময় আপনি নানান রকম স্বপ্ন দেখতে থাকবেন। এই সময় আপনার ঘুমঘুম পাবে। একসময় নিজেকে নেশাগ্রস্থ মনে হবে।

কিন্তু যদি আপনি এই বসে থাকবার অভ্যাস চালিয়ে যেতে পারেন, তবে একসময় আপনার জীবনে পরিবর্তন আসবে, আসবেই আসবে, একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র আপনার সামনে ভাসতে থাকবে। আলোর বন্যা বইতে থাকবে। একটা দিন আসবে, যখন আপনার আর ঘুম ঘুম ভাব আসবে না। আপনি তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবেন, কোনো অজানা সত্যের জন্য। আপনার মন একসময় আপনাকে নিয়ে বিরক্ত হয়ে যাবে। এতক্ষন মন যেসব কথা বলছিলো, যেসব যুক্তি দেখাচ্ছিল, সে সব আপনি উপেক্ষা করেছেন, তাই মন হতাশ হয়ে বসে পড়বে। মন তখন চুপ-চাপ বসে থাকবে। তখন মন শুধু আপনাকেই দেখতে থাকবে। কোনো ঘুম থাকবে না, কোনো দৃষ্টিভ্রম থাকবে না, কোনো স্বপ্ন থাকবে না, এমনকি কোনো চিন্তা থাকবে না। আপনি শুধুই বসে আছেন, আপনি শুধুই বসে আছেন, কিছুই করছেন না। আপনার চারিদিকে একটা নীরবতা বিরাজ করবে। সমস্ত কিছু শান্ত, আনন্দময়, আশীর্বাদপূর্ণ জীবন হবে আপনার। এইসময় আপনি ঈশ্বরে প্রবেশ করবেন, এইসময় আপনি সত্যের জগতে প্রবেশ করবেন। আর আপনি এক নতুন আমি হয়ে যাবেন। শুধু বসে থেকেই সব পাওয়া যায়, দৌড়ঝাঁপ মানুষকে স্বরূপ থেকে বিস্মৃত করে দেয়।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।

জীবন ভাঙা গড়ার অনুশীলনী - (২)
নেশাগ্রস্থ ,মানুষ কি ধ্যানাসক্ত হতে পারে ?

এক ভদ্রমহিলা তার স্বামীকে নিয়ে এসেছেন গুরুদেবের কাছে। গোবেচারা স্বামী। ভদ্রলোকের বয়স ৬০ পেরিয়ে গেছে। ভদ্রমহিলা গুরুদেবের হাত-পা ধরতে কান্নাকাটি করতে লাগলেন। আমার স্বামীকে বাঁচান।
গুরুদেব বললেন কি হয়েছে তোমার ? ভদ্রমহিলা বললেন, গুরুদেব, আমার স্বামী মদে আসক্ত। ডাক্তার বলেছেন, এইভাবে মদ খেলে, উনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না।
গুরুদেব বললেন, বাঁচবে না কেন, আপনার স্বামী তো দিব্বি সুস্থ। ঠিক আছে, আমি দেখছি, আপনি কান্নাকাটি করবেন না, বাইরে গিয়ে বসুন। আমি ওনার সাথে কথা বলছি।
ভদ্রলোক : আমি অনেক চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই মদ ছাড়তে পারছি না। এমন নয় যে আমি চেষ্টা করছি না। আমি অনেকবার প্রতিজ্ঞা করেছি, যে আমি আর মদ ছোঁবো না। আমি চেষ্টা করছি, কিন্তু দুই-একদিন পরেই আমার মাথায় যে মদের-ভূত চেপে বসে তাকে আমি কিছুতেই ছাড়াতে পারি না। ধীরে ধীরে আমি আমার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি আর মদ ছাড়া বাঁচতে পারবো না। আবার ডাক্তারবাবু বলছেন, আমি মদ খেলে মারা যাবো। হে গুরুদেব আমাদের পথ দেখান। আমি একটা অপদার্থ। হে গুরুদেব আমি কি করলে মদ ছেড়ে দিতে পারবো, আমাকে পথের সন্ধান দিন।
গুরুদেব : দেখো, মদ কেউ ছাড়তে পারে না। এটা ধরা যায়, কিন্তু ছাড়া যায় না। আমাদের যাকিছু অভ্যাস, তা সে খারাপ হোক বা ভালো হোক, অভ্যাস মানুষকে দিয়ে তার অজ্ঞাতসারে কাজ করিয়ে নেয়। সে যখন অভ্যাসবসে কাজ করে, তখন তার মধ্যে বিবেকবুদ্ধি কাজ করে না। তাই বিচারহীন মানুষ অভ্যাসের দাস। একে পাল্টাতে গেলে অন্য অভ্যাসের মধ্যে নিজেকে নিয়োগ করতে হয়।
মদ-বৃক্ষ তোমার মধ্যে শিকড় গেড়ে ছড়িয়ে বসেছে। এখন এই ব্যাপারে আমার কোনো উপদেশ তোমার মাথায় ঢুকবে না। কিন্তু কথা হচ্ছে মদ তুমি ছাড়বে কেন ? লোকেরা বলছে তাই ? তোমার স্ত্রী চাইছে তাই ? নাকি তোমার মধ্যে ভয় ঢুকেছে ? কতদিন ধরে তুমি মদ খাচ্ছো ?

ভদ্রলোক : তা ত্রিশ-চল্লিশ বছর হবে।

গুরুদেব : তো দেখো, ত্রিশ-চল্লিশ বছর যাবৎ তুমি মদ খাচ্ছো। তুমি বিয়ে করেছো কত বছর ? সেটাও ত্রিশ চল্লিশ বছর হবে নিশ্চই। তো আমি বললে তুমি তোমার ত্রিশ-চল্লিশ বছরের স্ত্রীকে ছাড়তে পারবে ? পারবে না। কারন স্ত্রী তোমার জীবনে গেঁথে গেছে। তোমার স্ত্রীকে ছাড়া তুমি থাকতে পারবে না। তবে কি জানো, তুমি এখন মদে আসক্ত হয়ে গেছো। তোমার শরীর এই মদের রাসায়নিক গুণগুলো নিয়ে বাঁচতে শিখেছে। মদের মধ্যে যে রাসায়নিক ক্রিয়া সংগঠিত হয়, তার সঙ্গে তোমার শরীর রপ্ত করে ফেলেছে। এখন তোমার মধ্যে যে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে মদের রসায়ন নিয়ে, তাকে উল্টোদিকে ঘোরাতে হবে। তোমার মধ্যে যে কাজটা আপনা থেকে সংগঠিত হচ্ছে, তাকে অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয় চাকা এখন উল্টোদিকে ঘোরাতে হবে। ব্যাপারটা কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। তবে একটা কথা আমার মনে হয়, তোমার অসীম সহ্যশক্তি। আজকালতো শুনেছি, একটা বউ/স্বামী লোকে আর বেশি দিন পুষছে না। কিন্তু তুমি দেখছি, মদের বোতলগুলোকে নিয়ে ৩০/৪০ বছর ঘর করতে পারছো। তুমি তো দেখছি, সত্যিই ধ্যানী ব্যক্তি।

তুমি একটা কাজ করতে পারো, মদ ছেড়ে দেবার কথা ভুলে যাও। কি দরকার মদ ছাড়ার ? যাকে নিয়ে তুমি ত্রিশ চল্লিশ বছর শান্তিতে আছো, তাকে ছেড়ে দেবার কথা ভুলে যাও। দেখো মদ ছাড়লে তুমি মানসিক ও শারীরিক কষ্ট ভোগ করবে, আর তুমি যদি মদ না ছাড়ো, তবে তোমার শারীরিক কষ্ট হবে ঠিকই কিন্তু মানসিক স্ফূর্তিতে থাকবে।

ভদ্রলোক : না গুরুদেব ডাক্তারবাবু বলেছেন, মদ না ছাড়লে, আমার শরীর কোনোদিন ভালো হবে না। আমি নাকি তাড়াতাড়ি মারা যাবো।

গুরুদেব : তাতে কি যায় আসে, কিইবা পার্থক্য হবে এতে। তোমার ৬০ বছরের উপরে বয়স হয়েছে। দেখো, তুমি কয়দিন আগে মরলে কি কয়দিন পরে মারা গেলে, তাতে কি যায় আসে। তুমি শুক্রবার মরবে কি রোববার মরবে, জানুয়ারিতে মরবে, কি আগস্টে মরবে, তাতে কি যায় আসে? আর মরন তো নিশ্চিত। আজ নয় তো কাল। কেন তুমি মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছো ? দুবছর বেশি বাঁচলে, কি দুবছর আগে মারা গেলে তাতে কি যায় আসে ?
তার চেয়ে তুমি একটা কাজ করো, যা করছো, সেটা তুমি মনোযোগ দিয়ে করো। ভুলে যাও মদ খাওয়া ভালো কি খারাপ, মদ খেলে বাঁচবে কি মরবে। তুমি শুধু একটা কাজ করো, মদ খাবার সময় তুমি তাড়াহুড়ো করো না। স্ত্রীর ভয়ে ঢক-ঢক করে তাড়াহুড়ো করে মদ গিলে ফেলো না। মদটাকে তুমি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করো। মদকেই তুমি তোমার ধ্যানজ্ঞান করো। মদ খেলে তুমি নিশ্চই একটা অদ্ভুত আনন্দ তোমার শরীরের মধ্যে অনুভব করো। এই আনন্দটাকে ধরে রাখবার চেষ্টা করো। মদ খাবার সময় তাড়াহুড়ো করো না। ধীরে সুস্থে উদ্বেগহীন হয়ে বসো। যদি সম্ভব হয়, এইসময় একটা মৃদুসংগীতের ক্যাসেটে চালিয়ে দাও। আলমারি থেকে মোদের বোতল বের করো। গ্লাস বার করো। ধীরে ধীরে বোতল থেকে রঙ্গিন মদ গ্লাসের মধ্যে ঢালো। যেন মধু পড়ছে, এর পর একটুকরো বরফ দাও, একটু জল দাও। এবার ধীরে ধীরে গ্লাসের কানায় ঠোঁট ছোঁয়াও। দেখো ঠোঁটে একটা ঠান্ডা শান্তি অনুভব হবে। এই স্পর্শসুখে নিজেকে ডুবিয়ে দাও। এরপর ধীরে ধীরে গেলাসের মধুতে চুমুক দাও। অনুভব করবার চেষ্টা করো, তোমার মুখ থেকে গলা, গলা থেকে পেট, পেট থেকে পাকস্থলীতে মধু প্রবেশ করছে। তোমার মাথার মধ্যে একটা নাগরদোলায় চড়ার অনুভূতি শুরু হয়েছে। এই অনুভূতির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করবার চেষ্টা করো। এই অনুভূতির মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দাও। আর এইসব করো, খুবই সচেতন ভাবে। নিজেকে হারিয়ে যেতে দিও না। নিজেকে সজাগ রাখো। নিজেকে চেতন রাখো।

ভদ্রলোক : গুরুদেব আপনি এসব কি বলছেন ? আপনি কি আমার সাথে মস্করা করছেন ?

গুরুদেব : দেখো, জীবনটা একটা খেলা। জীবনটা একটা নাটক, আর এই নাটকে তোমাকে যে অভিনয় করতে বলা হয়েছে, তোমাকে সেই কথাগুলোই বলতে হবে। আমি তোমার সাথে মস্করা করছি বলে ভেবো না, আমি সত্যি সত্যি তোমার সাথে মস্করা করছি। মস্করা সমানে সমানে হয়। আমি যদি তোমার সাথে মস্করা করি, তবে জানবে, আমি তোমাকে আমার সমান ভেবে নিয়েছি। তাই মস্করাকে মস্করা ভেবো না। মদ যখন তোমার গলায় ঢালবে, তখন সচেতনভাবে হয় মধু নয় বিষ ভেবে গ্রহণ করো। মদকে যদি তুমি মদ ভাব, তবে তোমার ক্ষতি হবে, আর মদকে যদি তুমি মধু ভাব, তবে তোমার উপকার হবে। দেখো হিন্দুশাস্ত্রে বলা হয়েছে, "অনন্ময় ব্রহ্ম" অন্নই ব্রহ্ম। তো জানবে মদও ব্রহ্ম। যাকিছু তুমি গ্রহণ করছো, ব্রহ্মজ্ঞানে গ্রহণ করো। আমি যাকিছু বললাম, জানবে এটি তোমার সাধনা। আমি তোমাকে একটা নতুন যোগের কথা বললাম। ধীরে ধীরে, নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে, সচেতনভাবে তোমার এই মদগ্রহন পর্বের মধ্যেই তোমার সাধনা চলতে থাকবে। আবার বলছি, জানবে অন্নই ব্রহ্ম। আর অন্নই আমাদের পুষ্টি সাধন করছে, অন্নই আমাদের লালন-পালন করছে। অন্যলোক কি বলছে, তাতে কিছুই এসে যায় না। অন্যলোক বলছে, এটি খারাপ, এদের কথায় কান দিও না। তুমি নিজেকে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে ডুবিয়ে দাও। তবে তুমি নিজের মধ্যে পূর্নতা খুঁজে পাবে। যাকিছু করবে, সম্পূর্ণ সত্ত্বা দিয়ে করো। নিজের লক্ষকে স্থির রাখো। যেদিন তুমি মদের মধ্যে ডুবে যেতে পারবে, যেদিন তুমি মদের মধ্যে ব্রহ্মকে উপলব্ধি করতে পারবে, সেদিন তোমার মদ খাওয়া সার্থক হবে। আর সেদিন তোমার মদ মধুতে পরিণত হবে। আর জানতো মধু বেশি খাওয়া যায় না। তোমারও মদ খাওয়া তখন ছুটে যাবে। তুমি হবে যথার্থ যোগী।

বিঃদ্রঃ - যারা নেশাগ্রস্থ তা সে যেকোনো ধরনের নেশা হোক না কেন, উল্লিখিত প্রক্রিয়ার মাধ্যকে নেশাকে যোগে পরিণত করতে পারেন।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।

জীবন ভাঙা গড়ার অনুশীলনী - (৩)

আজ কোনো কথা নয়, আজ কিছু শোনা নয়, আজ কিছু করা নয়। আজ আমরা রবো নীরব। কারন আমরা আজ ধ্যানে প্রবেশ করবো । ধ্যান এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। ধ্যান এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। ধ্যান এক অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা। ধ্যান একটা ঝুঁকির কাজ। ধ্যান করতে গেলে সাহসের প্রয়োজন হয়। ধ্যান এক গভীর উত্তাল সমুদ্রের মধ্যে ঝাঁপ দেওয়া। ধ্যান তারাই করতে পারে, যারা ভাগ্যের অন্বেষনে দুঃসাহসিক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। ধ্যান এমনটা কাজ যা একমাত্র দুঃসাহসিক লোকেরাই করতে পারে। ধ্যান মানে নিজের মধ্যে বিরাজ করা। কোনো কাজ নয়, কোনো চিন্তা নয়, কোনো আবেগ নয়, ধ্যান হচ্ছে নিজের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রবেশ করা। ঘুর্ণিপাকের কেন্দ্রবিদুতে প্রবেশ করা। ব্রহ্মান্ড ঘুরছে, সূর্য ঘুরছে, পৃথিবী ঘুরছে, জগৎ ঘুরছে, আমরাও ঘুরছি। এইযে ঘুরছি, কাকে ঘিরে ঘুরছি। এই ঘূর্ণাবর্তের কেন্দ্র বিন্দুতে কে আছে ? কি আছে ? কিছু একটা আছে যাকে যাঁকে ঘিরে আমরা সবাই ঘুরছি। সত্যিই ঘূর্ণির কেন্দ্রে কেউ আছে কি ? হয়তো আছে, হয়তো নেই।

যখন সমস্ত কম্পনকে সরিয়ে রাখা যায়, কেন্দ্রে একটা স্থির স্থিতাবস্থার সন্ধান মেলে। এই স্থির স্থিতাবস্থাতে অবস্থান করে ধ্যান। ধ্যান করা যায় না। ধ্যান হয়। ধ্যান কিছু করার বিষয় নয়। ধ্যান বোঝার বিষয়। যখনই সময় পাবেন, সমস্ত কাজ, সমস্ত চিন্তা বাদ দিয়ে এক মুহূর্তের জন্য নীরবতায় অবস্থান করুন। নিজের কেন্দ্রে কি হচ্ছে তা দ্রষ্টা হয়ে যান। নিজের মধ্যে কে বসে আছে, তার দিকে খেয়াল করুন।

ধ্যান মানে নীরবতায় অবস্থান করা। এই নীরবতা মানে কিন্তু এমন নয়, যে কথা না বলা বা শব্দ না করা, নীরবতা অর্থ শব্দব্রহ্মের ভিতরে প্রবেশ করা। আমাদের ধারণা হচ্ছে, ধ্বনি দেখা যায় না, কিন্তু ধ্যানের মধ্যে আপনি যখন প্রবেশ করবেন, তখন বুঝতে পারবেন, আপনি এক তরঙ্গায়িত আলোক রশ্মির মধ্যে প্রবেশ করেছেন, যা আসলে শব্দ বৈ কিছু নয়। এই আলোর তরঙ্গ আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এক অদ্ভুত নীরবতার জগতে। আসলে আপনি কেন্দ্রবিন্দু হতে যত দূরে থাকবেন, আপনার ঘুর্নন পথ তত দীর্ঘ হবে। কিন্তু আপনি যত কেন্দ্রবিন্দুতে নিকটে অবস্থান করবেন, তত আপনার ঘূর্ণনপথ সংকীর্ণ হতে থাকবে। একটা সময় এমন হবে, অর্থাৎ যখন আপনি কেন্দ্রে অবস্থান করবেন, তখন আপনার ঘূর্ণনপথ শূন্য হয়ে যাবে।