Thursday 31 May 2018

জীবাত্মা - সত্যধর্ম ও আমি

জীবাত্মা - সত্যধর্ম ও আমি 



মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত তার তত্ত্বজ্ঞান উপাসনা গ্রন্থে বলছেন। জ্ঞানের আশ্রয়-দ্রব্য হচ্ছে  "আত্মা"। অর্থাৎ জ্ঞানকে যিনি আশ্রয় করে আছেন তিনিই আত্মা। আর মহাত্মা গুরুনাথ প্রথম কথাতেই আত্মার স্বরূপ বলে দিলেন।  অর্থাৎ আত্মা  হচ্ছে জ্ঞানের আশ্রয় দ্রব্য। এবার বলছেন, আত্মা দুই প্রকার : পরমাত্মা বা ঈশ্বর ও জীবাত্মা। ক্ষিতি ও অঙ্কুরাদির কর্তৃত্ব যিনি করেন, তিনিই   ঈশ্বররূপে  অনুমেয়। আর জীবাত্মা হচ্ছে  মানস-প্রত্যক্ষ-সিদ্ধ। কথাটা আবার বলি : ক্ষিতি ও অঙ্কুরাদির কর্তৃত্ব যিনি করেন, তিনিই   ঈশ্বররূপে  অনুমেয়। আর জীবাত্মা হচ্ছে  মানস-প্রত্যক্ষ-সিদ্ধ।

 ক্ষিতি অর্থাৎ পৃথিবী  . গুরুদেব কিন্তু পৃথিবী কথাটা ব্যবহার করেন নি। বলছেন ক্ষিতি অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যত মৃত্তিকা বা মৃত্তিকা দ্বারা নির্মিত বস্তু আছে অর্থাৎ জড়বস্তু আছে তার যে কর্তৃত্ত্ব করেন, এবং অঙ্কুরাদি অর্থাৎ  প্রাণ সৃষ্টির প্রক্রিয়ার উপরে যিনি কর্তৃত্ত্ব করেন, তিনিই ঈশ্বর। অর্থাৎ বিশ্ব শক্তি নিয়ন্ত্রক-ই  হচ্ছেন ঈশ্বর বা পরমাত্মা।    

গুরুদেব কিন্তু তার আলোচ্য গ্রন্থ, তত্ত্বজ্ঞান-উপাসনায়   প্রথমে বৈশেষিকদর্শন, সাংখ্যদর্শন, তারপরে পাতঞ্জলদর্শন থেকে আত্মা সম্পর্কে বলেছেন।  আমরা কিন্তু সেই আলোচনায় যাবো না। আমরা গুরুদেব  কি বলছেন সেটা দেখবো।  গুরুদেব একদম শেষে তারই লেখা  সংস্কৃত তত্ত্বজ্ঞানম   থেকে বঙ্গানুবাদ করে  যা বলছেন সেখান থেকেই আমরা শুনবো।

আমি তো সংস্কৃত বুঝি না, তবুও যারা বোঝেন তাদের জন্য গুরুদেবের লেখা সংস্কৃত তত্ত্বজ্ঞানম গ্রন্থ থেকে মূল কথা (সংস্কৃত) পড়ে শোনাচ্ছি।

"নায়মাত্মা শরীর মিন্দ্রিয়ং বা। আত্মা শরীর  বা ইন্দ্রিয় নয়।

আহতে শরীরে, বিষয়ে ইন্দ্রিয়-প্রবিষ্টে চ অন্যমনস স্তদুভয়াননুভাবাৎ।   শরীর আঘাত প্রাপ্ত হলে, বা  বিষয়ে ইন্দ্রিয় প্রবিষ্ট হলেও, যদি অন্যমনস্ক থাকা যায়, তবে এই উভয়েরই  অনুভব হয় না।

প্রাঞ্চ ঊচুঃ, চাতুর্দ্দশসু  ( নব্যাস্তূ  সপ্তসু ) বর্ষেষু গতেষু  পরিবর্তণীয়ানি শারীরস্য মস্তিস্কস্য চ উপাদানানি, নতু স্মৃত্যাদয়ো ভাবাঃ।  প্রাচীনদিগের  মতে  ১৪ বছর, আধুনিক মতে  ৭ বছরের মধ্যে  শরীরের  ও মস্তিষ্কের সমস্ত উপাদানের পরিবর্তন হয়।  কিন্তু স্মৃতি প্রভৃতি  ভাব পরিবর্তিত হয় না।

অতএব স্মৃত্যাদয়ো যত্র বিদ্যন্তে  স আত্মা, ন শরীরং ন মস্তিস্কঞ্চ। অতয়েব স্মৃতি ইত্যাদি ভাব যাতে বিদ্যমান আছে বা  ধরা থাকে সে-ই আত্মা, এটি না শরীর  না মস্তিস্ক।

পরং স চৈতন্যবান্। কিন্তু ইহা  চৈতন্য বিশিষ্ট।  

শরীরমিন্দ্রিয়ানিচ  করণানি, আত্মা তু কর্ত্তা। শরীর  বা ইন্দ্রিয়গণ হচ্ছে করন, আর আত্মা হচ্ছে কর্তা।

 অতএব শরীরেন্দ্রিয় মস্তিস্কাতিরিক্ত  শ্চৈতন্যবান  এবং আত্মা। এতএব শরীর, ইন্দ্রিয়, মস্তিস্ক থেকে অতিরিক্ত কিছু, যা চৈতন্যবান  এবং তিনিই আত্মা।

এর পরে গুরুদেব একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা  বলছেন সেটা হচ্ছে আত্মা ও প্রাণ বা জীবন সম্পর্কে। আমাদের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে আত্মা আমাদের শরীরকে  বাঁচিয়ে রাখে। আত্মা বা চেতন শক্তি চলে গেলে আমাদের শরীরের মৃত্যু হয়। ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়।  জীবনী শক্তি ও চেতনা  শক্তি দুটো আলাদা জিনিস।

শুনুন গুরুদেব কি বলছেন :

জীবনী-শক্তিঃ প্রাণ-সংজ্ঞয়া অভিধীয়তে, সা চ আত্মনঃ পৃথক্। জীবনী শক্তি যা প্রাণ নামে খ্যাত, সেটা আত্মা থেকে পৃথক।

আত্মনো ধর্ম্ম   শ্চৈতন্যং তওু প্রাণ-ধর্ম্মো ন। আত্মার ধৰ্ম চৈতন্য যা প্রাণের ধৰ্ম নয়।

 তথাত্বে সতি শ্বাসাদীনি প্রাণ কার্য্যাণি চৈতন্যাভাবে  ন  ভবিতুং শক্ন্ু বন্তি। তাই যদি হতো তবে শ্বাস প্রভৃতি প্রাণ-কার্য্য-সমূহ চৈতন্য অভাবে হতে পারতো না।

অতএব  দেহেন্দ্রিয়-মস্তিস্কপ্রাণাতিরিক্ত আত্মা।" অতয়েব দেহ, ইন্দ্রিয়, প্রাণ ইত্যাদি থেকে অতিরিক্ত কিছুই হচ্ছে  আত্মা।      


 আমাদের দৈহিক সব কিছুর পরিবর্তন হয়, কিন্তু আমাদের  স্মৃতির পরিবর্তন হয় না।  স্মৃতি বা ভাব পরিবর্তিত হয় না। অতএব গুরুদেব বলছেন, এই স্মৃতির ভাব যাতে বিদ্যমান আছে তিনিই আত্মা। ।

খেয়াল করুন, গুরুদেব বলছেন : এই শরীরে অবস্থিত ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যিনি জ্ঞাত হন তিনিই  আত্মা। কে জ্ঞাত হয় ? ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে জ্ঞান আমরা সংগ্রহ করি, তা আসলে  কে বোঝে বা জ্ঞাত হন ? আমাদের সাধারণ ভাবে মনে হয় মন এই জ্ঞাতা। আমরা যখন যা কিছু দেখছি, শুনছি, বা আস্বাদন করছি, সেটি প্রথমে যায় আমাদের মস্তিষ্কে। মস্তিস্ক পাঠিয়ে দেয় চেতনমনে, চেতনমন পাঠিয়ে দেয়, বুদ্ধির কাছে। বুদ্ধি তার  পূর্ব সংস্কার অনুযায়ী  ইন্দ্রিয়লবদ্ধ বিষয়ের সঙ্গে জ্ঞানকে মেশায়। বা  জ্ঞান প্রদান করে। এইবার  বিচার করে। এবং মনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়।  এই সমগ্র ব্যাপার থেকে যে জ্ঞান হয় সেটা আমাদের স্মৃতিতে চলে যায়।  এই স্মৃতিকে যিনি ধরে রেখেছেন তিনিই চেতনা বা আত্মা, চৈতন্য শক্তি। ইনি অকর্তা।  কিছুই করেন না। দ্রষ্টা মাত্র। সাক্ষী মাত্র। সাক্ষী যেমন শুধু দেখেন না - স্মৃতিতে ধরে রাখেন , এবং প্রয়োজনে প্রকাশ করতে পারেন বা করেন । আত্মা তাই সাক্ষী, বিভু, চৈতন্য, নিরাকার, নির্বিকার।

গুরুদেব বলছেন ৭ বা ১৪ বছরের মধ্যে  আমাদের শরীরের বা মস্তিষ্কের সমস্ত উপাদান পরিবর্তিত হয়ে যায়। আসলে আমাদের শরীর অসংখ্যা কোষের সমষ্টি।  এই কোষ প্রতিনিয়ত জন্মাচ্ছে, প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি প্রাপ্ত হচ্ছে আবার মারা যাচ্ছে।  এই মৃত কোষগুলোই বিভিন্ন ভাবে আমাদের শরীর  থেকে মল-মূত্রের সঙ্গে  বেরিয়ে যায়। আমাদের অল্প বয়সে এই কোষ বৃদ্ধি,  কোষ অবলুপ্তের থেকে বেশি হয়। তাই আমাদের শরীর  বৃদ্ধি পায়।  একটা বয়সের পরে আমাদের এই কোষের প্রজনন ক্ষমতা কমে যায় ফলত  আমাদের শরীরের  বৃদ্ধি হয় না। আমরা বৃদ্ধ হবার পথে এগিয়ে যাই। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজ আমার শরীরে বা মস্তিষ্কে যে উপাদান আছে, একটা সময়ের পরে তা আর একেবারেই থাকবে না। শরীর  তখন সম্পূর্ণ নতুন উপাদানের মিশ্রণ হবে। একটা নয়  বছরের শিশুর শরীরে  আজ যা আছে - ষোলো বছর বয়সে, তার পুরোনো শরীরের কিছুই আর থাকবে না। এমনকি মনও এক থাকবে না। কিন্তু স্মৃতি থেকে যাবে। আমি, আমার শরীর-মন  কিন্তু আর আগের মতো নেই।  এটা  আমরা সবাই বুঝি। এমনকি আমাদের শরীরের একটা অঙ্গহানি হয়ে গেলেও আমরা  কিন্তু আমরা ভাবি আমিতো আছি । কিন্তু এই আমি আর সেই আমি এক নই অর্থাৎ সেই শরীর  নেই,সেই  মন, আমার আর এখন নেই।   তবু স্মৃতি আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে।  তাই আমরা ভাবি।  সেই শিশু বিনয় আর  এই প্রৌঢ়  বিনয় একই। এই স্মৃতি যিনি ধরে রাখেন তিনিই আত্মা বা জীবাত্মা।

ব্যক্তিগত স্মৃতি যিনি ধরে রাখেন তিনি জীবাত্মা। আর যিনি সমগ্র জগতের স্মৃতি যিনি ধরে রাখেন তিনিই পরমাত্মা বা পরমপিতা পরমেশ্বর। ।  
   
এরপরে  গুরুদেব আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন, সেটা হচ্ছে, আমরা যাকে  প্রাণ শক্তি বা জীবনী শক্তি বলি. অর্থাৎ যার দ্বারা মানুষ বেঁচে থাকে,  সেই  প্রাণ কিন্তু আত্মা থেকে আলাদা। আত্মার ধৰ্ম হচ্ছে  চৈতন্য।  আর প্রাণের ধৰ্ম  হচ্ছে  জীবনীশক্তি  । চৈতন্য না থাকলেও মানুষের প্রাণের কাজ চলতে পারে। তাই তো দেখি চেতনাবিহীন মানুষেরও স্বাসপ্রস্বাস চলতে থাকে।

শরীরে এমন একটা কিছু আছে যার সুখ, দুঃখ, প্রযত্ন, ইচ্ছা ও দ্বেষ  জ্ঞান আছে, কিন্তু অনুভব নেই। ইনিই আত্মা। ইনি  না শরীর, না মন. না মস্তিস্ক।  এগুলোর অর্থাৎ শরীর, মন, মস্তিষ্কের  পরিবর্তন আছে।  কিন্তু স্মৃতির পরিবর্তন নেই। এই স্মৃতি যাতে থাকে তাকেই  বলে আত্মা ।

মহাত্মা গুরুদেব বলছেন, আত্মার কর্মক্ষেত্র হচ্ছে অন্তঃকরণ অর্থাৎ মন, বুদ্ধি, অহংকার ও চিত্ত । আত্মার আছে  ইচ্ছা।  অন্তঃকরণের আছে প্রবৃত্তি।   সংশয়, নিশ্চয়, অহংকার, স্মরণ।  মন কোনো কিছু দেখলেই সংশয় সৃষ্টি করে, বুদ্ধি এই সংশয় দূর করে, অহংকার গর্ব্ব করে, অর্থাৎ আমার-আমি করে।   আর চিত্ত স্বরণ করে।
আত্মা যখন অন্তঃকরণের সাথে তন্ময় হয়ে থাকে, তখন তারও প্রবৃত্তি থাকে। এই অবস্থায়
জীবাত্মার সমস্ত কর্মই  ত্রিবিধ : কর্ম, ভোগ, জ্ঞান।  এই কারণে জীব, একাধারে কর্তা,  আবার ভোক্তা, ও জ্ঞাতা  বলে কথিত হয়। আত্মা চৈতন্যাত্মক, শারীরাদি  জড়াত্মক।

তাহলে গুরুদেবের কথায় আমাদের কাছে দুটো জিনিস পরিষ্কার হলো।  একটা হচ্ছে জীবনীশক্তি বা প্রাণশক্তি।  যা আমাদের শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে।  আর একটা হচ্ছে চেতন শক্তি যা স্মৃতির ধারক, ইনিই আত্মা।

বিখ্যাত শাস্ত্র গ্রন্থে যা পাইনি তাই পেলাম গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথের গ্রন্থে। আপনারা যারা মহাত্মা গুরুনাথের বই পড়ার সৌভাগ্য পান নি, বা পেলেও পড়েন  নি, তাদের অনুরোধ করবো, শুধু হাজার বছরের পুরোনো হলেই ভালো হয়,  বিশ্বাসযোগ্য হয়, তা নয়। বরং নতুনের মধ্যে আরো ভালো জিনিস পেতে পারেন। জাগতিক বিজ্ঞান যেমন উন্নতি করছে, আধুনিক  আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানও  সত্যের গভীরে ঢুকছে। খোলা মন নিয়ে  এগিয়ে আসুন।  সত্যকে উপলব্ধি করুন। 

জয় গুরুদেব ; জয় গুরুদেব ; জয় গুরুদেব ; জয় গুরুদেব।
নমঃ গুরুদেব ;নমঃ গুরুদেব ;নমঃ গুরুদেব ;নমঃ গুরুদেব।
জয় গুরুনাথ ;জয় গুরুনাথ ; জয় গুরুনাথ ; জয় গুরুনাথ।
নমঃ গুরুনাথ ;নমঃ গুরুনাথ ; নমঃ গুরুনাথ ;নমঃ গুরুনাথ।

জয় জয় সদগুরুর জয় ;  জয় জয় জগৎ-গুরুর জয়। জয় জয় গুরুনাথের জয়। জয় জয় পরমপিতা পরমেশ্বরের জয়। হরি  ওঁং।

       


   

Friday 18 May 2018

সাধনা - সত্যধর্মের আলোতে মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্তের বই - "তত্ত্বজ্ঞান-দ্বিতীয় খণ্ড- সাধনা " অবলম্বনে

সাধনা - সত্যধর্মের  আলোতে 

 মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্তের বই - "তত্ত্বজ্ঞান-দ্বিতীয় খণ্ড- সাধনা " অবলম্বনে 

সাধনা - কথাটা খুবই প্রচলিত। কিন্তু সাধনা বলতে আমরা কি বুঝি ? মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন অভ্যাসকে সাধনা বলে।  যেকোনো সফলতার  পিছনে থাকে সাধনা। যে কোনো সফলব্যক্তির পেছেনে থাকে সাধনা। এই সাধনা বা অভ্যাস দুই প্রকার।  এক -পার্থিব বা বাহ্যিক জগৎ সম্মন্ধীয় সাধনা। আর দুই - আধ্যাত্মিক বা সূক্ষ্মাজগৎ সংক্রান্ত সাধনা। পার্থিব বা বাহ্যিক জগৎ সম্মন্ধীয় সাধনা দ্বারা আমরা পার্থিব জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন  করতে পারি। আমাদের জাগতিক জগতের উন্নতি এই সাধনবলেই সম্পন্ন হয়েছে। অন্যদিকে,  আধ্যাত্মিক বা সূক্ষ্ম জগৎ সংক্রান্ত সাধনা থেকে আমরা সূক্ষ্ম জগৎ সম্পর্কে জানতে পারি। পরিণামে,  ব্রহ্মজ্ঞানের প্রাপ্তি হয়ে থাকে। মহাত্মা বলছেন : যে অভ্যাস প্রভাবে মানুষের দোষরাশি গুণরাশিতে পরিণত হয়, আত্মার সতেজ দশা সংসাধিত হয়  এবং পরিশেষে জীব বা জীব-আত্মা পূর্ণস্বরূপ সৎ-চিদানন্দ  অনন্ত মহার্ণবে সুনিমগ্ন হয় - সেটাই আধ্যাত্মিক সাধনা। আসলে  গুরুদেবের লেখা পান্ডিত্যে ভরা। সহজ পাচ্য নয়। তাই আমরা  আমাদের মতো করে সহজ ভাষায় বিষয়ে প্রবেশ করবো।

গুরুদেব বলছেন, সাধনা এমন একটি বিষয় যে তুমি চাও বা না  চাও, ইচ্ছা করো বা না করো, তোমাকে কোনো না কোনো সাধনা করতেই হবে। এই যে ইচ্ছার উর্দ্ধে যে সাধনা, আমাদের আপনা আপনি হয়, তাকে বলে ব্যতিরেকি সাধনা। আসলে সেই মঙ্গলময় অনন্ত পুরুষ, পূর্ণ পুরুষ, তাঁর ইচ্ছে পূরণের জন্য, তিনি এই সাধনা আমাদের দিয়ে করান। তিনি চান তার অংশ সমূহকে কালে কালে অনন্ত শক্তি প্রদান করতে। তাই ব্যতিরেকি সাধনা, মঙ্গলময়ের নিয়মে, আপনা আপনি হয়, প্রাকৃতিক ভাবেই হয়।  এর জন্য আমাদের কোনো প্রয়াস করতে হয় না। এক টুকরো বীজ কোথাও পড়ে থাকলে, বিনা চেষ্টাতেই, অঙ্কুর উদ্গম হবে। কালে কালে গাছে বা বৃক্ষে পরিণত হবে। জীবের , শৈশব  থেকে কৈশোর, কৈশোর   থেকে যৌবন, যৌবন থেকে প্রৌঢ়, প্রৌঢ়  থেকে বৃদ্ধ - এই উন্নতি বা ক্রমবিকাশ আপনা আপনি হয়।  এর জন্য আমাদের কিছু করতে হয় না।এমন কি মৃত্যুর জন্যেও আমাদের কিছু করতে হয় না।    আমাদের হজম করার জন্য কিছু করতে হয় না। চোখের পাতা আপনা আপনি পড়ে। এর জন্য আমাদের আলাদা করে কিছু করতে হয় না। গুরুদেব বলছেন, এগুলো যদি তুমি সচেতন ভাবে করো, তবে তোমার মঙ্গল হবে। এবং এই সচেতন ভাবে করাকেই সাধনা বা ধ্যান বলে। ধ্যান অর্থাৎ মনোযোগ, বা চেতন বা জাগ্রত অবস্থায় কিছু করা। অমনোযোগী হয়ে করা  আর মনোযোগ সহকারে করার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে । যে কোনো কাজ মনোযোগ সহকারে করলে সেটা উৎকৃষ্ট ফল দেবে, আর মনোযোগ না দিয়ে করলে সেটা যেমন তেমন হবে।

তুমি  বাল্য অবস্থায় বৃদ্ধ আবার বৃদ্ধ অবস্থায় বালক হতে পারো, যদি তুমি চেষ্টা করো, সাধনা করো, সচেতন থাকো। চেষ্টা করলে যে কোনো অবস্থায় তুমি আনন্দে থাকতে পারো। আর চেষ্টা না করলে তুমি সময়ের দাস, পরিস্থিতির দাস হয়ে যাবে।  এবং পরিস্থিতি তোমাকে সুখ দুঃখের অনুভূতি দেবে। আর তুমি যদি সচেতন থাকো, তবে পরিস্থিতি তোমার দাস হয়ে যাবে। আর তুমি সাম্যাবস্থায় অবস্থান করবে। সাধনা করা আর না করার মধ্যে এখানেই পার্থক্য।

গুরুদেব বলছেন - যত প্রাতঃস্মরণীয় পুরুষ সবাই সাধনা করেই পাশমুক্ত হয়েছেন। তা সে দেবাদিদেব মহাদেব বলুন,  কার্ত্তিক - গনেশ বলুন  আর কংশ -ধ্বংস কারী কৃষ্ণ বলুন আর ধনুকধারী রাম
বলুন , সবাই সাধন বলেই শক্তি অর্জন করেছেন। বুদ্ধদেব বলুন আর যীশু বলুন, মোহাম্মদ বলুন আর মহাবীর বলুন সবাই সাধন বলেই শক্তি অর্জন করেছেন। অতএব সাধনাই শক্তি, জ্ঞান, প্রেম , পরমানন্দ লাভের একমাত্র ও অদ্বিতীয় পথ।

সাধনার বিভাগ :

আমরা আগেই বলেছি সাধনা দুই প্রকার : আধ্যাত্মিক ও পার্থিব।  আবার আধ্যাত্মিক সাধনা দুই রকম। এক - অন্বয়ি সাধনা  ; দুই - ব্যতিরেকি  সাধনা।

অন্বয়ি সাধনা  :  মহাত্মা বলছেন - সাধনীয় বিষয়ের অংশতঃ সাধনা-সহকারে সমুদায়ের সাধনা করা যার বিষয়, তাকে অন্বয়ি সাধনা বলে। মনে করো ধর্মে বিশ্বাস করতে হবে।  তাহলে ধর্মের উপকারিতা অল্প অল্প জ্ঞাত হয়ে, ধীরে ধীরে ধর্মের প্রতি বিশ্বাস, বা আগ্রহ বাড়িয়ে ধর্মে লিপ্ত হওয়াকে অন্বয়ি সাধনা বলে।  অর্থাৎ ধীরে ধীরে কোনো বিষয়ের প্রতি নিবিষ্ট চিত্ত হওয়াকে অন্বয়ি সাধনা বলে।

ব্যতিরেকি সাধনা : ধর্মাচরণ না করার ফলে যে অপকারিতা হয় তা পদে পদে অনুভব করে, বা দেখে  ধর্মে বিশ্বাস অর্জনকে ব্যতিরেকি সাধনা বলে।

আধ্যাত্মিক সাধনাকে আবার শ্রেয়ঃ ও প্রেয়ো ভেদে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সাংসারিক কাজ সম্পূর্ণ ভাবে পরিত্যাগ করে সাধনাকে শ্রেয়ঃ সাধনা বলা হয়। শ্রেয়ঃ সাধক বলেন সংসারে থেকে সাধন হয় না। তাই এখনই সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়ো। অন্যদিকে প্রেয়ো সাধক বলেন, সংসারে থেকেই  মাতা-পিতার সেবা করো, স্ত্রী-পুত্রের প্রতি কর্তব্য পালন করো, তাদের ভালোবাসলেই, ঈশ্বরের সেবা করা হবে । গুরুদেব বলছেন প্রথমে প্রেয় পথ পরে শ্রেয়ঃ পথ অবলম্বন করা কর্তব্য।

এ ছাড়া যোগ সাধনা, গুন্ সাধনা, মন্ত্র  সাধনা - অর্থাৎ যোগ সাধনা বা শারিরীক কসরত দ্বারা  শরীরকে সুস্থ রেখে ঈশ্বরে নিবিষ্টচিত্ত হওয়াকে যোগ সাধনা বলে। মংত্র সাধনা আসলে শব্দ বা ধনির সাহায্যে ঈশ্বর অনুভূতি বা সাক্ষাৎ লাভ। এর পর গুন্ সাধনা। ঈশ্বর  অনন্ত গুনের অধিকারী।  তাঁর সেই গুনের সাধনা অর্থাৎ অভ্যাস দ্বারা নিজেকে উন্নত করা, একেই গুন্ সাধনা বলে।

এর পর আছে , সশক্তিক সাধনা এবং নিঃশক্তিক সাধনা। অর্থাৎ ক্রমশঃ শক্তি সঞ্চয় করে নিজেকে পূর্ণব্রহ্মের অন্তর্গত হওয়াকে সশক্তিক সাধনা বলে। আর আমার কিছুই নাই , আমি সর্বশূন্য, সবই তুমি  এই ভাব অবলম্বন করে যে সাধনা তাকে নিঃশক্তিক সাধনা বলে।

এতক্ষন মহাত্মা গুরুনাথ সাধনার প্রকারভেদ বোঝাচ্ছিলেন।  এবার সাধকের কি কি করা উচিত সে সম্পর্কে বলছেন।

সত্য : গুরুদেব বলছেন, সাধককে সর্বদা সত্য পথে চলতে হবে।  সর্বদা  সত্যব্রত অবলম্বন করতে হবে। সত্য ভাষণ, সত্যপথে গমন এবং পরম অবলম্ব-বোধে সত্য গ্রহণ করতে হবে। মহাত্মা বলছেন, তোমার মধ্যে যখন অটলভাবে সত্য প্রতিষ্ঠা হবে, তখন তুমি যা বলবে তাই সত্য হবে। সাধক তখন রোগীকে রোগ মুক্ত করাতে পারবে। নির্ধনকে ধন লাভ করাতে পারবে। অভক্তকে ভক্তি লাভ করাতে পারবে। অর্থাৎসত্যেপ্রতিষ্ঠ  সাধক  মুখে যা বলবেন, বাস্তবে তাই হবে।

অহিংসা : অর্থাৎ হিংসা না করা। গুরুদেব বলছেন হিংসা দুই রকম - এক : প্রাণী বধ জনিত হিংসা ;
 দুই : প্রাণী পীড়ন জনিত হিংসা। অহিংস ব্যক্তি সদা আনন্দে থাকে। শুধু আনন্দে থাকে না, অহিংস ব্যক্তির আশেপাশে একটা অহিংস-পরিবেশ তৈরী হয়। ফলতঃ অহিংস ব্যক্তির আশেপাশে যারা থাকে এমনকি জীব জন্তুও অহিংস হয়ে যায়, এটা আপনা আপনি হয়ে পড়ে । হিংসা, হিংসাকে ডেকে  আনে।  আসলে তুমি যা দিচ্ছো - সেটা তরঙ্গ আকারে ছাড়িয়ে পড়ে।  ফলে অহিংস সাধককে ঘিরে  একটা অহিংসার  বাতাবরণ তৈরি হয়।
অহিংসার কথা বলতে গিয়ে গুরুদেব আমাদেরকে সতর্ক করেছেন : বলছেন আমরা অনেকে মনে করি : আমরা মাছ-মাংস খাই বটে, কিন্তু মাছ ধরি না, মারি না, রান্নাও করি না তবে আমরা কি ভাবে দোষী হবো ? গুরুদেব বলছেন : আহরণকারী - অনুমতিদায়ক - বধকারী -  ক্রয়-বিক্রয় কারী -সংস্কারকারী ও উপভোগকারী এই ছয়জনই খাদক। অতয়েব গুরুদেবের কথা অনুযায়ী এই সব বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, যদি কিনা আমরা সত্যিকারের সার্থক অহিংস-সাধক হতে চাই।

অস্তেয় : বা  চুরি না  করা, অর্থাৎ ধনস্বামীর অনিচ্ছায় বা অজ্ঞাতসারে তার ধন গ্রহণ করাকে চুরি করা বা স্তেয় বলে। শুধু চুরি করা না, চুরি করার কথা ভাবাও পাপ। গুরুদেব বলছেন : মানুষের মন থেকে যখন পরধন গ্রহণের ইচ্ছা সম্পূর্ণ ভাবে দূরীভূত হয়, তখন এক বিচিত্র ব্যাপার সংগঠিত হয়। যে ধনের জন্য মানুষ চৌর্য্য বৃত্তি অবলম্বন করে সেই  ধন-রত্ন রাশীকৃত রূপে সাধকের পদানত হয়।

ব্রহ্মচর্য্য :  ব্রহ্মচর্য কথাটির মানে বীর্যকে রক্ষা করা। বীর্য হচ্ছে রক্তের নির্যাস। দুধ থেকে যেমন ঘি মাখন হয় - তেমনি মানুষের রক্ত থেকে তৈরি হয় বীর্য। এই বীর্য ধী শক্তি বর্ধক।  প্রাণ সৃষ্টির পুরুষাকার, এই বীর্যের মধ্যে অবস্থান করে। এটি আমাদের লিঙ্গমূলে অবস্থান করে। এই শক্তি তমগুনে নিম্নগামী হয় হয়, অর্থাৎ প্রকৃতির দিকে ধাবিত হয়।  আবার রজ গুনে এই শক্তি ঊর্ধ্বগামী হয়। কুণ্ডলিনী জাগ্রত হওয়া মানে এই বীর্যের যে শক্তি অর্থাৎ ঊর্যাশক্তি সুষুম্না নারী বেয়ে উর্ধগামী হওয়া। অতএব  বীর্য রক্ষা করা মানে আপনার ঊর্যাশক্তি বৃদ্ধি পাওয়া। আপনার মন - শরীর এক অপূর্ব বলবতি-অনাবিল   আনন্দে চনমন করবে যদি আপনার ঊর্যাশক্তি বৃদ্ধি পায় । গুরুদেব বলছেন ব্রহ্মচর্য  পালন না করলে মানুষ কখনোই মহৎ কর্মে  সিদ্ধমনোরথ হতে পারে না।

অপরিগ্রহ : অপরিগ্রহ কথাটার মানে অন্যের কাছ থেকে কোনো দ্রব্য না নেওয়া। অর্থাৎ দান গ্রহণ না করা। আগে বলেছেন চুরি না করতে অর্থাৎ না বলে কিছু না নিতে, এবার বলছেন দান গ্রহণ না করতে। গুরুদেব বলছেন দান গ্রহণ করলে দাতার মধ্যে যে নিকৃষ্ট ভাব, গ্রহীতার মধ্যে সেটা চলে আসতে  পারে। এ ছাড়া  তুমি কারুর কাছ থেকে দান গ্রহণ করার ফলে  দাতার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বে। তোমার মন বিশুদ্ধ থাকবে না। তুমি দাতার অনুগ্রহের পাত্র হয়ে যাবে। মহাত্মারা সদা সর্বদা মাথা উঁচু করে বাঁচেন। কিন্তু পরিগ্রহ করলে অর্থাৎ দান গ্রহণ করলে তোমার মন বিশুদ্ধ থাকতে পারে না। আর মন যখন তোমার শুদ্ধ পথে চলবে তখনি তুমি মুক্তিপথে অগ্রগামী হতে পারবে। গুরুদেব বলছেন অপরিগ্রহে প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্ব জন্মের বিষয় জানা যায়।

শৌচ :  শৌচ অর্থাৎ শুচিত্ব। এটি দুই প্রকার।  একটা হচ্ছে বাহ্যিক শুচিত্ব - যা আমরা শরীর  পরিষ্কার, বেশভূষা পরিষ্কার ইত্যাদির মাধ্যমে রাখতে পারি।  আর একটা হচ্ছে আভ্যন্তরীণ শুচিত্ব যা আমাদের জ্ঞান ও তপস্যা দ্বারা করতে হবে। আসলে এটি অন্তঃকরণের শুদ্ধি। এই  অভ্যন্তরীণ শুচিত্বই প্রধান। এই অভ্যন্তরীণ শৌচ থেকেই মনের প্রফুল্ল্তা আসে, একাগ্রতা আসে,আমরা ইন্দ্রিয়কে জয়  করতে পারি অর্থাৎ জিতেন্দ্রিয় হতে পারি।  এবং সর্বপরি আমাদের আত্মদর্শনের ক্ষমতা জন্মে এই অভ্যন্তরীণ শুচিতা থেকেই। তাই আমাদের সর্বদা শৌচ বজায় রাখতে হবে তা সে শারীরিক হোক আর অন্তঃকরণের হোক। এটাই আমাদের আত্ম-দর্শনের পথ দেখাবে।

সন্তোষ :  বর্তমান বা উপস্থিত অবস্থাতে তৃপ্ত থাকা। এতেই পরম সুখ লাভ হবে। তোমার যা কিছু আছে তাতেই তুমি সুখী হও। ঈশ্বর যা কিছু দিয়েছেন তাতেই তুমি তৃপ্ত হও। আসলে ঈশ্বর প্রদত্ত সম্পদের পরিমাপ করতে পারিনা না বলে আমরা ভাবি কম পড়ে  গেল, আর এই কম পড়ার বেদনা আমাদেরকে  কস্তূরী  মৃগের মতো চঞ্চল করে তোলে। আমরা জাগতিক সুখের আশায় দাপাদাপি করি আর কষ্ট ভোগ করি। প্রকৃত জ্ঞান আমাদের সন্তোষ দিতে পারে।  তাই জ্ঞানী সর্বদা সন্তোষ লাভ করেন। আমরা যারা অজ্ঞান সর্বদা অতৃপ্তিতে ভুগি ও কষ্ট পাই।

তপস্যা : নিবিষ্ট চিত্তে, কঠোর ক্লেশ স্বীকার করে, নিজ নিজ কর্মে লিপ্ত থাকাকেই তপস্যা বলে। জঙ্গলে, পাহাড়ে, নদীর  পাড়ে একাকী বসে থাকাকেই তপস্যা বলে না। তপস্যা হচ্ছে, স্ব - স্ব -ধর্ম- কর্মে নিবিষ্ট চিত্ত  হওয়া, একাগ্র হওয়া, যা কিছু করছো তাতে সমস্ত শক্তি নিয়োগ করা। গুরুদেব বলছেন  এই তপস্যা বলেই মানুষ অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন হতে পারে। দূরশ্রবণ -দূরদর্শন  ক্ষমতা এই তপস্যা বলেই হতে পারে।

স্বাধ্যায় : বার বার একই জিনিস করাকে স্বাধ্যায় বলে। যে কোনো জিনিস বার বার করলে সেই কর্মের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। পাথরের উপরে মাটির কলসি রাখলে  কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে না।  কিন্তু  একই পাথরের উপরে প্রতিদিন কলসি  রাখলে দেখবেন সেখানে কলসির  পশ্চাৎদেশের আকার নেবে। প্রতিনিয়ত পাথরের উপরে জল পড়লে পাথর পর্যন্ত ক্ষয়ে যাবে।  তাই বার বার বীজ মন্ত্রের জপ্ করুন জপের সুফল অনুভব করবেন। বার বার করে ধর্মশাস্ত্রের পাঠ করুন, দেখবেন আপনার উপল্বদ্ধির স্তরে নতুন নতুন অনুভূতি দেবে।  আপনি আগে যা বোঝেননি , তা বুঝতে পারবেন। গুরুদেব বলছেন বেদই স্বাধ্যায় শব্দ বাচ্য।  মন্ত্র-উচ্চারণ বারবার করলে অভিলষিত দেবাদি দর্শন লাভ হয়। সৎশাস্ত্র পাঠে বহু বিষয়ে জ্ঞান জন্মে।

ঈশ্বর উপাসনা :  ঈশ্বরের কাছে উপবেশনই উপাসনা। প্রতিদিন নিয়ম করে উপাসনা করুন।  গুরুদেব বলছেন এই উপাসনার প্রভাবেই সত্য, অহিংসা, অস্তেয়  প্রভৃতি সহজেই প্রতিষ্ঠিত হয়। নিয়মিত যে উপাসনা করে তার শক্তির সীমা নেই। গুরুদেব বলছেন এই উপাসনা বলেই ধ্যান, ধারণা, সমাধি প্রভৃতি সহজেই আয়ত্ব করতে পারেন। আপনারা সবাই জানেন সত্যধর্মে উপাসনাকে সবথেকে বেশি  গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

প্রত্যাহার : প্রত্যাহার কথাটা মানে হচ্ছে ত্যাগ বা সরিয়ে দেওয়া। ইন্দ্রিয়গণ যখন তাদের স্বাভাবিক ধৰ্ম অর্থাৎ কান দ্বারা শব্দ গ্রহণ,ত্বক দ্বারা স্পর্শ গ্রহণ, চোখ দ্বারা রূপ গ্রহণ, জিব্বা দ্বারা রস গ্রহণ, নাক দ্বারা ঘ্রান গ্রহণ, এই সকল গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বিরত থেকে চিত্ত যখন  স্বরূপে অনুকরণ করে - তখন তাকে প্রত্যাহার বলে। ধ্যান করার যার অভ্যাস আছে তিনি বুঝতে পারবেন - প্রথম প্রথম ধ্যান করার সময়, নানান অবাঞ্চিত দৃশ্য, অবাঞ্চিত শব্দ ভেসে আসে। এই অবাঞ্চিত শব্দ-দৃশ্য উপেক্ষা করে চিত্তে মন স্থির করতে হয়। এই যে অবাঞ্চিত শব্দ-দৃশ্য-গন্ধ, এগুলোকে উপেক্ষা করাকেই বলে  প্রত্যাহার।

ধারণা :  মনকে বিষয়-বিশেষে বদ্ধ  রাখার নাম ধারণা।  প্রত্যাহারে আমাদের  ইন্দ্রিয়গণ বিষয় ত্যাগ করে চিত্তে লীন-প্রায় হয় , আর ধারণায় ইন্দ্রিয়ের চিত্তে লীনপ্রায় অবস্থায় মন সেই বিষয় বিশেষে নিযুক্ত থাকে। আমাদের  এই অবস্থায় আমাদের মন ও ইন্দ্রিয়গণ বিশেষ বিষয়ে অর্থাৎ ইস্টে নিযুক্ত বা আবদ্ধ হয়ে যায়। বাহ্যিক বিষয়বোধ প্রায়  লোপ পেয়ে যায় ।

ধ্যান : অনন্য  চিত্ত হয়ে লক্ষ্যে  বা ইস্টে স্থিতিই ধ্যান। অর্থাৎ যাকে  তুমি জানতে চাও তা সে সাকার-ই  হোক আর নিরাকার-ই হোক তার মধ্যে যখন চিত্ত  স্থির হয়, তখন তাকে ধ্যান বলে। এই সময়ে ইস্ট ভিন্ন অন্য কোনো কিছু চিত্তে প্রতিফলিত হয় না। কেবল ইস্ট চিন্তন থাকে, এবং এই ইস্ট চিন্তনকে ধ্যান বলে।

চিত্তকে কোনো পদার্থে বন্ধ রাখার নাম ধারণা।  আর সেই পদার্থে যদি জ্ঞানের তন্ময়তা হয় তবে তাকে ধ্যান বলে। অর্থাৎ ধারণা  থেকে ধ্যান আরো সূক্ষ্ম।

এই সূক্ষ্মতার তারতম্য অনুসারে ধ্যান ত্রিবিধ। স্থুল, জ্যোতির্ধ্যান, পর-ব্রহ্মের ধ্যান।  গুরুদেবের বা পিতামাতার,বা দেবদেবতার ধ্যানকে স্থুল  ধ্যান বলে। ধ্যানের সময় যখন শুধু জ্যোতি বর্তমান থাকে তখন জ্যোতির্ধ্যান বলে। আর কুণ্ডলিনী জাগ্রত হয়ে অর্থাৎ উর্জা শক্তি জাগ্রত হয়ে যখন সহস্রার বা বিন্দুতে মন স্থির হয়, তখন তাকে পর - ব্রহ্মের  ধ্যান বলে। ধ্যান দ্বারা বিভূতি জন্মে। বিভূতিকে উপেক্ষা করে ধ্যান প্রক্রিয়া চালিয়ে গেলে তত্বজ্ঞান জন্মে।

গুরুদেব বলছেন : ধ্যানের সাতটি পর্যায় : ঘোরতর অন্ধকার - তারপরে বিরল অন্ধকার - তারপরে মূর্তি দর্শন - তারপরে দেব-জ্যোতিঃ দর্শন - তার পরে বিভিন্ন দেবদেবতার সহিত কথাপোকথন - এর পরে ব্রহ্ম-তেজ মাত্র দর্শন  - একদম শেষে ব্রহ্ম দর্শন।

সমাধি : বিচ্ছেদ বিহীন ভাবে , অর্থাৎ নিরলস ভাবে ধ্যান প্রক্রিয়া চালিয়ে গেলে ধ্যান সমাধিতে পরিণত হয়। ধ্যানে বাহ্য জ্ঞানের আভাস থাকে। সমাধিতে বাহ্য জ্ঞান লোপ পায়। এই অবস্থা চলতে থাকলে তার শরীর  বোধ লোপ পায়, ক্ষুধা তৃষ্ণা বোধ থাকে না, কর্তব্য-অকর্তব্য বোধ থাকে না, বাহ্যিক হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে যান । এই সময় তার শরীর  রক্ষার জন্য অন্যের সাহায্য দরকার পড়ে। এই সময় তাকে ঘিরে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে যা সাধক উপেক্ষা করে, কিন্তু ঘটে। তিনি তখন ব্ৰহ্মময়, জগৎ অসত্য হয়ে যায়। শরীর  রক্ষার কোনো তাগিত না থাকায় অচিরেই তিনি দেহ ত্যাগ করেন।
ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ। .......

সাধনা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে গুরুদেব আরো দুটো কথা বলেছেন তার মধ্যে একটি হলো আসন ও অপরটি হলো প্রাণায়াম।

আসন : যেরূপ বসলে কোনো কষ্ট বোধ হয় না, অথচ শরীর  স্থির থাকতে পারে, তাকেই আসন বলে। যেমন পদ্মাসন , বীরাসন, স্বস্তিকাসন, ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যি কথা বলতে কি, আসনের সঙ্গে ঈশ্বরের সাধনার কোনো যোগ নেই। কিন্তু দেহভিন্ন যে হেতু সাধনা চলে না তাই আসনাদি অভ্যাস করে শরীরকে সাধনার উপযোগী করে রাখা জরুরী বলে হঠযোগীরা মনে করেন।আসলে ধ্যান আর আসন একসাথে উচ্চারিত হয়। ধ্যান করতে গেলে প্রাথমিক ভাবে স্থির আসনে বসা জরুরি। শরীর  অসুস্থ থাকলে চিত্ত-মন অস্থির হবে, আপনি স্থির হয়ে বসতেই পারবেন না। আপনার ধ্যান সমাধি কিছুই হবে না। তাই হঠযোগীরা সাধনা আরম্ভের শুরুতে এই আসন অভ্যাস করার পক্ষপাতী।

প্রাণায়াম : প্রাণ অর্থাৎ জীবনীশক্তির আয়াম অর্থাৎ বিস্তার যা থেকে হয় তাকে প্রাণায়াম বলে। বায়ু পূরণ, বায়ু ধারণ ও বায়ু রেচন অর্থাৎ পূরক, কুম্ভক , ও রেচক  এগুলো নির্দিষ্ট সময় ধরে করাকে প্রাণায়াম বলে। এই প্রাণায়ামের সাহায্যে মানুষ দীর্ঘজীবী হতে পারে। একটি নির্দিষ্ট সময়ধরে প্রাণ বায়ুকে নিয়ন্ত্রিত করাকেই প্রাণায়াম বলে।  গুরুদেব বলছেন ১২, ২৪, অথবা ৩৬ সেকেন্ড ধরে বায়ু নিন বা পূরণ করুন, এর পর এর চতুর্গুণ সময় ৪৮,৯৬, এবং ১৪৪ সেকেন্ড সময় ধারণ করুন অর্থাৎ কুম্ভক করুন। তার পরে ২৪,৪৮,৭২ সেকেন্ড ধরে রেচক করুন। এতে আপনার জীবনী শক্তি বৃদ্ধি পাবে। আপনার চেতন শক্তি বৃদ্ধি পাবে। এটি একটি শক্তিশালী প্রক্রিয়া।  গুরুর আশ্রয়ে থেকে এই প্রক্রিয়ার অভ্যাস করতে হয়। কেননা এই প্রক্রিয়ায় মানুষের শরীরের স্বাভাবিক স্পন্দন বাধাপ্রাপ্ত হয়। কখন এই প্রক্রিয়া করতে হবে, কতক্ষন করতে হবে, অস্বাভাবিক অবস্থায় কি করতে হবে, কখন বিশ্রাম  নিতে হবে, এগুলো শরীর  বুঝে করতে হবে। সবার জন্য যেহেতু সময়ক্রম একই রকম হবে না, তাই নির্দেশক বা গুরুর সাহায্য ছাড়া করা উচিত নয়। এতে মানুষ পাগল হয়ে যেতে  পারে।  এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তাই সাবধান থাকবেন।  নিতান্ত কৌতহলের বশে এই পথে পা দেবেন না।

গুরুদেব বলছেন এসব আসন-প্রাণায়াম করে কোনো লাভ নেই, বরং প্রকৃত গুরুর উপদেশ অনুসারে কাজ করলে আধ্যাতিক বিষয়ে উন্নতি লাভ সহজ হবে। তাই ঈশ্বর বিষয়ে অনুশীলন করো।  ধ্যান-ধারণায় প্রবৃত্ত হও।  ভক্তবৎসল দয়াময়ের দয়ায় জানতে পারবে তিনি জ্ঞান স্বরূপ।  এবং তিনিই একমাত্র জ্ঞান স্বরূপ। বাহ্য চেষ্টায় বহু বছরেও জ্ঞান লাভ হয় না, তার উপাসনা করো, তবে অতি অল্প সময়ে "ব্রহ্ম সত্যং জ্ঞানম্" এই উপলব্ধি  তোমার হবে। তিনি অনন্ত কিন্তু আনন্দ স্বরূপ।  তিনি প্রেমময়। গুরুদেব বলছেন তুমি উপাসনা ও ধ্যানে ব্যাপৃত থাকো - আর অনুভব করো - জগদীশ্বর সর্বশক্তিমান ; জগদীশ্বর সর্বব্যাপী ; জগদীশ্বর মঙ্গলময়। এই প্রত্যয়  সমস্ত সাধকের, সমস্ত সত্যধর্ম  অনুরাগীর মধ্যে  পরিস্ফুট হবে। অতএব গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথসেনগুপ্ত  বলছেন ধর্মার্থী  ও মোক্ষার্থী উভয়েরই প্রথম কর্তব্য উপাসনা ও ধ্যান।  

 :

ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ  
 


             





   
           



   
             


Tuesday 8 May 2018

ঈশ্বর উপাসনার জন্য ঈশ্বরকে জানা জরুরী কি ?

ঈশ্বর উপাসনার  জন্য ঈশ্বরকে জানা জরুরী কি ?

প্রশ্ন উঠেছিল : গুরুদেব তো জগদীশ্বরের উপাসনার কথা বলছেন। কিন্তু যাকে  জানি না, চিনি না, এমন কি যার  অস্তিত্ব সম্পর্কে আমার কোনো সম্যক  ধারণা নেই তার উপাসনা কি করে হবে ? যাকে  চিনিনা, সে যদি আমার সামনে এসে হাজিরও  হয়, তাহলেও তাকে আমি চিনতে পারবো না। তাহলে এই উপাসনার অর্থ কি ? উপাসনা কি নিতান্ত বিনোদন ?

জবাব এসেছিলো অন্তর থেকে :

আগে ঈশ্বর, না আগে সাধনা - এটা  বুঝতে হবে। তর্কে পাওয়া যাবে না বাস্তবতা বুঝতে হবে। আমি সাঁতার শিখতে চাই, তো জলে নাবতে  হবে। আমি যদি বলি যতক্ষন সাঁতার না শিখছি, ততক্ষন জলে নাব্বো না।  তাহলে সাঁতার শেখা  যাবে ? সাঁতার না শিখে যেমন জলে নাবা উচিত নয়। যুক্তির দিক থেকে এটা ঠিক। আবার জলে না নাবলে সাঁতার শেখা যাবে না। এটাও ঠিক।

সাইকেল চড়া  শিখে তবে সাইকেলে চাব্বো।  যুক্তির দিক থেকে এটা ঠিক। কিন্তু সাইকেলে না চড়ে, সাইকেল চড়া শেখা  যায় না।

তেমনি জগদীশ্বরকে জেনে, চিনে, তবে তার উপাসনা করবো। তবে তোমার কোনোদিন উপাসনা করা হবে না। হ্যাঁ সাঁতার শেখার আগে গভীর জলে যেও না, তেমনি উপাসনার আগে জগদীশ্বর সম্পর্কে একটা ধারণা বা বিশ্বাস থাকলে ভালো হয়।

ঈশ্বরকে আসলে কেউ চিনিয়ে দেয় না, দিতে পারে না ।  ঈশ্বর এগিয়ে আসেন তাই আমরা তাকে চিনি, জানি, উপলব্ধি করি, অনুভব করি। আমার দরকার আকুলতা, ব্যাকুলতা, আগ্রহ। সদ্যজাত সন্তান ক্ষুধা পেলে কান্না করে, মা তার স্তন এগিয়ে দেয়, মুখের কাছে স্তনের বোটা ধরে, সন্তান সংস্কার বশে হা করে, স্তন থেকে দুধ চুষে চুষে তৃপ্তি পায়, চাহিদা পূরণ করে, ক্ষুধা মেটায়। আগে থেকে তাকে জানতে হয় না, দুধ কোথায় থাকে, দুধ  কেমন দেখতে , কি তার গুন্ ? সে শুধু কান্না করে, ব্যাকুলতা প্রকাশ করে। মা কান্না শুনে  ছুটে  আসে, দুধ এগিয়ে দেয়। সন্তান পরম সুখে পান করে।

ঈশ্বর কে পাবার জন্য ঈশ্বরকে জানার দরকার নেই। কোনো জ্ঞান তোমাকে ঈশ্বর অনুভূতি দেবে না,
তোমার আগ্রহ, তোমার ব্যাকুলতা, তোমার গভীর বিশ্বাস তোমাকে ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যাবে, বা ঈশ্বর তোমার কাছে ধরা দেবে।