সত্যধর্ম-এর আলোতে ঈশ্বরের খোঁজ
: উপাস্য নির্ণয় :
: উপাস্য নির্ণয় :
আমাকে মাঝে মধ্যে সত্যধর্মের উপাসনায় যেতে হয়। কারন আমার স্ত্রী, আমার জীবনসঙ্গিনী এই ধর্মে দীক্ষিত। এবং সে একটা অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে গুরুদেব, মহাত্মা গুরুনাথকে ভালোবাসে। শুধু ভালোবাসে নয় নির্ভর করে। এই নির্ভরতা আমাকে প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। কি আছে এখানে যাতে তার এত আস্থা ? সেই খোঁজেই আমি মাঝে মধ্যে সত্যধর্মের উপাসনায় উপস্থিত হই। তো সেখানে নিরাকার পরমাত্মা পরমেশ্বরের বা পরম পিতার উপাসনা হয়। কিছু ভালোলাগা মানুষের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। ভালো লাগে। গুরুপূজা হয়। গুরুপূজার একটা অঙ্গ হিসেবে শাস্ত্র অর্থাৎ মহাত্মা গুরুনাথের বই থেকে পাঠ করে শোনানো হয়। শুনি কিন্তু বুঝি না, অনুভবও কিছু করি না। । তাই একা একা বাড়িতে বসে মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত-র বই পড়ছিলাম। বই পড়ার একটা সুবিধা হচ্ছে, একই কথা বার বার চোখের সামনে ভাসে, শোনা যায়, আবার শব্দগুলো চোখের সামনে ভাসে। আমি মনন করি, ভালো লাগে।
মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন উপাসনা করো। কার উপাসনা করবো ? গুরুদেব বলছেন জগদ্দীশ্বরের উপাসনা করো। কিন্তু কে এই জগদ্দীশ্বর ? যাকে চিনি না, জানিনা তাঁর উপাসনা কি ভাবে হবে ? তিনি কোথায় থাকেন ? কেমন দেখতে ? কি তার গুন্ ? আর তিনি যে সত্যিই আছেন তার প্রমান কি ? সারা জীবন ধরে খুঁজলেও তাকে পাবো না, যদি না তাকে চিনি আমি। অথবা কেউ যদি আমাকে ছিনিয়ে না দেয়। তাহলে কিসের উপাসনা ? শুধু বিনোদন নয় তো ? দুই চারটা গান গাইলাম। প্রার্থনা করলাম। ধুপ ধুনো জ্বালালাম, সবাই মিলে প্রসাদ খেলাম। বেশ একটা আত্মতৃপ্তি অনুভব করলাম। ব্যাস এই পর্যন্তই ? না আর কিছু আছে ?
মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন উপাসনা করো। কার উপাসনা করবো ? গুরুদেব বলছেন জগদ্দীশ্বরের উপাসনা করো। কিন্তু কে এই জগদ্দীশ্বর ? যাকে চিনি না, জানিনা তাঁর উপাসনা কি ভাবে হবে ? তিনি কোথায় থাকেন ? কেমন দেখতে ? কি তার গুন্ ? আর তিনি যে সত্যিই আছেন তার প্রমান কি ? সারা জীবন ধরে খুঁজলেও তাকে পাবো না, যদি না তাকে চিনি আমি। অথবা কেউ যদি আমাকে ছিনিয়ে না দেয়। তাহলে কিসের উপাসনা ? শুধু বিনোদন নয় তো ? দুই চারটা গান গাইলাম। প্রার্থনা করলাম। ধুপ ধুনো জ্বালালাম, সবাই মিলে প্রসাদ খেলাম। বেশ একটা আত্মতৃপ্তি অনুভব করলাম। ব্যাস এই পর্যন্তই ? না আর কিছু আছে ?
একটা ঘটনা বলি। শিরডির সাঁইবাবা - নাম শুনেছেন নিশ্চই। তো তাকে এক ভদ্রলোক দুপুরে খাবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছেন। খাবারের সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ। ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন। এই বুঝি বাবা আসে। বাবা আর আসছেন না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। বাবা আর আসেন না। সন্ধ্যে হয়ে গেল। বাবা আর আসেন না। একটা কুকুর ঘুর ঘুর করছে। ভদ্রলোক খাবার রেখে উঠতে পারছেন না। কুকুরটাকে যতই তাড়ানো হচ্ছে, কুকুরটা একটু দূরে গিয়ে অপেক্ষা করছে। ভদ্রলোক, লোক পাঠালেন, বাবার কাছে। বাবা বললেন - আমিতো গেছিলাম রে। কিন্তু তোর মনিব তো লাঠি দিয়ে তারা করলো। লোকটি বললো - সে কি বাবা কখন গেছিলেন ? আমার বাবু তো সারাক্ষন আপনার অপেক্ষায় বসে আছেন। বাবা বললেন - তোর বাবুতো লাঠি নিয়ে বসে আছে। আমি যাই কি করে ? খাই-ই বা কি করে ?
ভগবানকে না চিনলে এই হয় দশা। ভগবান এসে বসে থাকে। আর আমি লাঠি নিয়ে বসে থাকি। ভগবান আসতে চায়, আমরা তাকে তাড়াতে চাই।
গুরুদেব এইজন্য কতকগুলো প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তারই লেখা তত্ত্বজ্ঞান উপাসনা গ্রন্থে । প্রশ্নগুলো হলো :
১.জগদীশ্বরের অস্তিত্বের প্রমান কি ?
২.তিনি এক কি বহু ?
৩.তিনি সাকার কি নিরাকার ?
৪. তিনি সগুন কি নির্গুণ ?
৫.তার স্বরূপ কী ?
প্রশ্নগুলো আমার মনে ধরলো। এবং জবাব জানবার জন্য আগ্রহী হলাম। প্রশ্নের জবাবে যাবার আগে, মহাত্মা গুরুনাথ প্রবর্তিত সত্যধর্মের পরিধি সম্পর্কে আমার কৌতূহলের দু একটা প্রশ্ন শোনাই। তার পরে জবাব খুঁজবো ।
সত্ধযর্মের যে কোনো অনুষ্ঠানে যাই না কেন, উপস্থিতজনের মধ্যে বেশীরভাগই নমঃশুদ্র সম্প্রদায়ের লোকজন। অথচ মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ছিলেন। সংস্কৃতে তার দখল ছিল। কবি ছিলেন। এহেন পণ্ডিত ব্রাহ্মণের প্রবর্তিত ধর্মে নমঃশুদ্র ছাড়া অন্যরা সংখ্যায় কম কেনো ?
শুনেছি মহাত্মা নিবারণ চন্দ্র পান্ডে, তার প্রধান শিষ্য ছিলেন। সে জন্য কি ? মহাত্মা গুরুনাথের গুরু কে ছিলেন ? যদি গুরু কেউ না থেকে থাকে , অর্থাৎ দেহধারী গুরু না থেকে থাকে, তবে তিনি গুরুবাদের সমর্থক কেন ছিলেন ? তার বই পড়ে, আমি সামান্যই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তবুও মনে হয়েছে তিনি উচ্চ কোটির মানব ছিলেন। এবং আধ্যাত্বিক অনুভূতি সম্পন্ন পণ্ডিত ব্রাহ্মণ (জ্ঞানী) ছিলেন।
এবার আসল কথায় আসি।
প্রশ্নগুলো আমার মনে ধরলো। এবং জবাব জানবার জন্য আগ্রহী হলাম। প্রশ্নের জবাবে যাবার আগে, মহাত্মা গুরুনাথ প্রবর্তিত সত্যধর্মের পরিধি সম্পর্কে আমার কৌতূহলের দু একটা প্রশ্ন শোনাই। তার পরে জবাব খুঁজবো ।
সত্ধযর্মের যে কোনো অনুষ্ঠানে যাই না কেন, উপস্থিতজনের মধ্যে বেশীরভাগই নমঃশুদ্র সম্প্রদায়ের লোকজন। অথচ মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ছিলেন। সংস্কৃতে তার দখল ছিল। কবি ছিলেন। এহেন পণ্ডিত ব্রাহ্মণের প্রবর্তিত ধর্মে নমঃশুদ্র ছাড়া অন্যরা সংখ্যায় কম কেনো ?
শুনেছি মহাত্মা নিবারণ চন্দ্র পান্ডে, তার প্রধান শিষ্য ছিলেন। সে জন্য কি ? মহাত্মা গুরুনাথের গুরু কে ছিলেন ? যদি গুরু কেউ না থেকে থাকে , অর্থাৎ দেহধারী গুরু না থেকে থাকে, তবে তিনি গুরুবাদের সমর্থক কেন ছিলেন ? তার বই পড়ে, আমি সামান্যই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তবুও মনে হয়েছে তিনি উচ্চ কোটির মানব ছিলেন। এবং আধ্যাত্বিক অনুভূতি সম্পন্ন পণ্ডিত ব্রাহ্মণ (জ্ঞানী) ছিলেন।
এবার আসল কথায় আসি।
১.জগদীশ্বরের অস্তিত্বের প্রমান কি ? - মহাত্মা এর উত্তরে যা বলেছেন আমরা তা সংক্ষেপে আলোচনা করবো কিন্তু এই আলোচনা আমার ভাষায়। তাই যথাযথ মহাত্মা গুরুনাথকে এর মধ্যে পাবেন না। আমি যদি মহাত্মার কথা বা জবাব বুঝতে ভুল করি আমার ব্যাখ্যায় ভুল হবে। তার জন্য মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি।
মহাত্মা বলছেন, যে কোনো কাজেরই একজন কর্তা আছেন। একটা বই দেখলে আপনি নিশ্চই বলবেন এর একজন লেখক আছেন। একটা ঘট দেখলে আপনি নিশ্চই বলবেন এই ঘট তৈরীর পিছনে একজন কুমোর বা কারিগর আছেন। তাহলে আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় না যে এই বিশাল বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের এক জন কর্তা আছেন। তিনিই জগদীশ্বর।
এ থেকে কি ঈশ্বরকে জানা বা চেনা গেল ? আমিতো ভাই চিনতে পারলাম না। আর তা ছাড়া এই ধরনের যুক্তি বড্ড সোজা সরল, প্রচলিত যুক্তি। । জল দেখে যদি আমি ভাবি এটা হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন এর মিলিত সত্বা এবং তার সৃষ্টি হয়েছে বিশেষ পরিবেশের জন্য, প্রাকৃতিক কারণে তাহলে আমি কি কিছু ভুল বুঝবো ? নাকি আমি ভাববো এর পেছেনে ভগবান আছে ?
আর একটা যুক্তি আমি প্রায়ই শুনি। তোমার বাবা আছেন, তোমার ঠাকুরদা আছেন বা ছিলেন, তার বাবা ছিলেন, তার বাবা ছিলেন, তার বাবা, তার বাবা ছিলেন। এটা বিশ্বাস করতো ? তা যদি করো, তবে শেষ যে বাবা ছিলেন তিনিই ঈশ্বর। এই কথাটাও আমার কাছে যুক্তিপূর্ন মনে হয় না। কারন - বাবা, ঠাকুরদা, দাঠাকুর্দা, ইত্যাদি ছিলেন। এটা সত্য। কিন্তু অতীত। ঈশ্বর অতীত নয়, ঈশ্বর বর্তমান। তাই এগুলো আমার কাছে সরল ব্যাখ্যা মনে হয়।
এ থেকে কি ঈশ্বরকে জানা বা চেনা গেল ? আমিতো ভাই চিনতে পারলাম না। আর তা ছাড়া এই ধরনের যুক্তি বড্ড সোজা সরল, প্রচলিত যুক্তি। । জল দেখে যদি আমি ভাবি এটা হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন এর মিলিত সত্বা এবং তার সৃষ্টি হয়েছে বিশেষ পরিবেশের জন্য, প্রাকৃতিক কারণে তাহলে আমি কি কিছু ভুল বুঝবো ? নাকি আমি ভাববো এর পেছেনে ভগবান আছে ?
আর একটা যুক্তি আমি প্রায়ই শুনি। তোমার বাবা আছেন, তোমার ঠাকুরদা আছেন বা ছিলেন, তার বাবা ছিলেন, তার বাবা ছিলেন, তার বাবা, তার বাবা ছিলেন। এটা বিশ্বাস করতো ? তা যদি করো, তবে শেষ যে বাবা ছিলেন তিনিই ঈশ্বর। এই কথাটাও আমার কাছে যুক্তিপূর্ন মনে হয় না। কারন - বাবা, ঠাকুরদা, দাঠাকুর্দা, ইত্যাদি ছিলেন। এটা সত্য। কিন্তু অতীত। ঈশ্বর অতীত নয়, ঈশ্বর বর্তমান। তাই এগুলো আমার কাছে সরল ব্যাখ্যা মনে হয়।
মহাত্মা এর পরে যুক্তি দিচ্ছেন - যে কোনো ঘটনার পিছনে একটা ক্রমান্বয়ী কারন থাকে । অর্থাৎ যে কোনো কাজের পিছনে একাধিক কারন আছে। আবার কারণেরও কারন আছে। এই কারন খুঁজতে খুঁজতে যখন আর কারন পাওয়া যায় না তখন তাকে আমরা বলি ঈশ্বর বা জগদ্দীশ্বর। অর্থাৎ উৎসের শেষ। যেমন বৃষ্টির পিছনে মেঘ, মেঘের পিছনে সমুদ্র, সমুদ্রের পিছনে নদী, নদীর পিছনে বরফ, বরফের পিছনে ঠান্ডা।.ঠান্ডার পিছেনে কি ?......ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রাণের পিছনে অন্ন, অন্যের পিছনে পৃথিবী, পৃথিবীর পিছনে জল, জলের পিছনে অগ্নি, অগ্নির পিছনে বায়ু, বায়ুর পিছনে আকাশ, আকাশের পিছনে কি ? জানিনা। এই অজানাই ঈশ্বর।
এবার খানিকটা ধাতস্থ হলাম। অজানাই ঈশ্বর। ঈশ্বরকে জানা যায় না। শুধু অনুভব করতে হয়।
এবার খানিকটা ধাতস্থ হলাম। অজানাই ঈশ্বর। ঈশ্বরকে জানা যায় না। শুধু অনুভব করতে হয়।
এই বার মহাত্মা গুরুনাথ একটু গভীরে প্রবেশ করছেন। অর্থাৎ প্রথম দুটি যুক্তি, সাধারণের কাছে বুদ্ধিগ্রাহ্য় ও গ্রহণ যোগ্য। কিন্তু পরের প্রমান সাধারণের জন্য নয়, এটি সাধকের কাছে উপলবদ্ধ জ্ঞান । আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা উপলব্ধি করি কি দিয়ে? আমরা উপলব্ধি করি ইন্দ্রিয় অর্থাৎ চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিব্বা, ত্বক ও মন দিয়ে। এই ছয় রকম ভাবে আমাদের প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয়। এর বাইরেও আর একটা উপলব্ধি বা অনুভব আমাদের হয়। তাকে বলে প্রত্যক্ষবৎ জ্ঞান। এটি সাধারণের হয় না, এটি সাধকদের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব। অর্থাৎ সাধক যখন মনের উর্দ্ধে উঠতে পারে তখনই একমাত্র এই অনুভব সম্ভব। মন যখন জীবাত্মায় লয় হয় অর্থাৎ নিবিষ্ট হয়, এবং জীবাত্মা যখন পরমাত্মায় লয় হয় তখন এক অমৃতাতীত অনুভূতি হয়। এটা কাউকে বোঝানো যায় না কিন্তু বোঝা যায়। কেউ কেউ এটাকে মানসিক বিকার বলে থাকেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ যেমন পাগল ও ব্রহ্মজ্ঞানীর মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না। তেমনি এই ঈশ্বর অনুভূতি কোনো জাগতিক উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যায় না। কিন্তু সত্য। ঠাকুর রামকৃষ্ণ যখন বাবা ত্রৈলঙ্গ স্বামী সাথে দেখা করতে গিয়ে ছিলেন, তখন তারা মৌন ভাব অবলম্বন করে ভাব বিনিময় করে ছিলেন। পঙ্গু বাক্যে যা সম্ভব নয়। মহান ঋষিদের এই প্রত্যক্ষ অনুভূতি ঈশ্বর অস্তিত্বের প্রমান। এটা মানতে হয়, আর সাধনার দ্বারা অনুভব করতে হয়। ইন্দ্রিয়লদ্ধ জ্ঞানের সীমার বাইরে এর অবস্থান। অতএব জগদীশ্বর আছেন।
এইখানেই মহাত্মা সাধারণ থেকে ছাপিয়ে গেলেন। জ্ঞানাতীত ঈশ্বরের সন্ধান দিলেন।
এইখানেই মহাত্মা সাধারণ থেকে ছাপিয়ে গেলেন। জ্ঞানাতীত ঈশ্বরের সন্ধান দিলেন।
মহাত্মা এর পরে বললেন : যার তুল্য কেউ নেই। তাকে তুলনা দিয়ে বোঝানো যায় না। অনুমান করা যেতে পারে মাত্র। যাকে তুমি দেখো নি তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করা বা না করা তোমার ব্যাপার। বিশ্বাস না করলে, বা বিশ্বাস অনুযাযী কর্মে প্রবৃত্ব না হলে, তুমি তার অনস্তিত্বেও বিশ্বাস করতে পারবে না। অর্থাৎ সে যে নেই সেটাও তোমার জানা হলো না। তাই মহান মুনি ঋষিরা যা যা বলে গেছেন, সেই মতো কাজ করলে বা বিশ্বাস করলে তোমার অনুভূতিতে ঈশ্বর আসবেন। নতুবা তোমার বিশ্বাস অবিশ্বাস সবই অনর্থক। আবার অন্ধ বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনোটাই না থাকা ভালো।
এবারে মহাত্মা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। ঈশ্বরকে জানতে গেলে নিজেকে উপযুক্ত করে তোলো। তবেই তিনি ধরা দেবেন তোমার অনুভূতিতে। নতুবা সবিই মিথ্যা। মহাত্মাদের প্রদর্শিত পথে নিজেকে যোগ্য করে তোলো। ভেলকি বাজি নয়। এটা জাগতিক পদার্থ নয়, যে বাজার থেকে কিনে তোমাকে দিয়ে দিলাম। অথবা পিতৃক সম্পত্তি নয়, যে জন্ম সূত্রে পেয়ে গেলাম। এটা অর্জন করতে হয়। ঈশ্বরের কৃপা আর তোমার পৌরুষ তোমাকে ঈশ্বর অনুভূতি দিতে পারে। অন্য কোনো উপায় নেই।
যাই হোক, ঈশ্বরের অস্তিত্বে আমাদের সবার আস্থা আছে। আমার কথা যারা শুনছেন, তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন বলেই উপাসনা করেন। অতএব এ নিয়ে আর বেশী আলোচনা নিষ্প্রয়োজন।
২. ঈশ্বর এক, কি বহু ?
মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন যে - তর্ক দ্বারা ঈশ্বরকে বোঝা যাবে না। না। সহজ সরল ভাবে তাকে বুঝতে হবে।আমিও বিশ্বাস করি, জ্ঞান দ্বারা ঈশ্বরকে বোঝা যাবে তর্কে তাকে পাওয়া যাবে না। পন্ডিতদের শাস্ত্রে ঈশ্বর নেই। ঈশ্বর আছে অনুভবে।
মহাত্মা বলছেন, এই জগতে পরস্পর বিপরীত শক্তি কার্য্য করে। যেমন দিন আছে, তেমনি রাত আছে। যেমন সকাল আছে তেমনি সন্ধ্যা আছে। যেমন গরম আছে তেমনি ঠান্ডা আছে। যেমন আলো আছে, তেমনি অন্ধকার আছে। যেমন সুখ আছে তেমনি দুঃখ আছে। যেমন সাহস আছে তেমনি ভীরুতা আছে। যেমন নিষ্ঠূরতা আছে তেমনি সহানুভূতি আছে। পরমাণুতে আকর্ষণ আছে বিকর্ষণ আছে। বায়ুতে জীবন আছে আবার জীবন-নাশকতাও আছে। সূর্য্য-রশ্মিতে প্রকাশ শক্তি আছে আবার রোগ-জনন প্রবণতা আছে। নদীর জলে উর্বরতা আছে আবার প্লাবন আছে।
মহাত্মা এবার আধ্যাতিক জগতের কথা অর্থাৎ সূক্ষ্ম গুনের কথা বলছেন । প্রেম পরম সুখের কারন আবার প্রেমই ক্লেশের কারন। দয়া আত্মপ্রসাদের কারন আবার দয়াই ঘোরতর দুঃখের হেতু। সবকিছুই বিপরীত ভাবাপন্ন গুণদ্বয়ের সংযুক্তি। যদি সৃষ্টির কারণের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাবো দুটো শক্তি হতে এ জগৎ উৎপন্ন হয়েছে । এই দুই শক্তির একটি আকর্ষণ অপরটি বিকর্ষণ। একটি পুরুষ অপরটি প্রকৃতি। একটি শিব অপরটি শক্তি। একটি লক্ষ্মী অন্যটি নারায়ণ। তাহলে কি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির কারন দুই ? না, এই সৃষ্টির মূল এক। আসলে খেয়াল করুন এই দুই বিপরীত শক্তি একই পদার্থের দ্বিবিধ গুন্ মাত্র। এ যেন একই মুদ্রার দুটি পিঠ। আসলে কিন্তু মুদ্রার দুটি পিঠ নয়, তিনটি পিঠ। একটু খেয়াল করে দেখবেন। দুটো দুই দিকে, আর একটি মাঝে। মাঝের সার্কেল বা চক্র বিপরীত শক্তিদ্বয়ের মধ্যে সমন্নয় ঘটায়। সৃষ্টির কারণও তিন শক্তির একত্রিকরন বৃহৎ সত্বা । ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব - সত্বঃ, রজঃ, তমঃ। অর্থাৎ সৃষ্টির খেলা তিন রকম। জন্ম-পালন-মৃত্যু। অবিরাম এই খেলাই চলছে। এই তিন-এ মিলে এক। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা এক এবং অদ্বিতীয়।
এই জগৎ পঞ্চভূতের সমাহার। মহাত্মা বলছেন : আকাশ থেকে বায়ু, বায়ু থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে জল, আবার জল থেকে ভূমি উৎপন্ন হয়। আবার বিপরীত ভাবে ভাবুন, ভূমি জলে বিলীন হয়। জল অগ্নিতে বিলীন হয়। অগ্নি বায়ুতে বিলীন হয়। বায়ু আকাশে বিলীন হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে স্থুল, সূক্ষ্মে বিলীন হচ্ছে। অতএব দেখা যাচ্ছে সূক্ষ্ম থেকে স্থুলের উৎপত্তি আবার প্রত্যেক স্থুল পদার্থ সূক্ষ্মে লীন প্রাপ্ত হচ্ছে। আর এই সূক্ষ্মতম যিনি তিনিই জগতের আদি কারন। এই আদি কারন-ই ঈশ্বর। অতএব ঈশ্বর এক।
মহাত্মা পরম সত্যের সন্ধান দিলেন। যারা বহুঈশ্বরের আকর্ষণে আছেন, তারা আসলে মায়াকেই ঈশ্বর ভাবছেন। তারা আসলে বহু ঘটে প্রতিবিম্বিত একই চৈতন্য শক্তির খেলা দেখছেন। ঈশ্বর এক। আমাদের চিত্তে ইশ্বরের ছায়া মাত্র। প্রতিটি জীবের মধ্যে, বস্তূর মধ্যে ঈশ্বর প্রতিফলিত হচ্ছে। দর্পনের ছায়ার মত। আমরা ভাবছি ঈশ্বর বহু। আসলে ঈশ্বর এক, এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত থাকা উচিত নয়। মহাত্মা সত্যকে তুলে ধরলেন।
৩.ঈশ্বর সাকার কি নিরাকার ?
ঈশ্বর সাকার কি নিরাকার ? এই প্রশ্ন সাধকের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ভক্ত ঈশ্বরকে দেখতে চায়। ঈশ্বর সাকার না হলে সেটা সম্ভব নয়। ঠাকুর রামকৃষ্ণ নরেনকে বলেছিলেন দেখাতে পারি, এই যেমন তোকে দেখছি। হিন্দুদের মধ্যে কেউ সাকারবাদী আবার কেউ নিরাকারবাদী । আবার একদল আছেন যারা উভয়কে স্বীকার করেন। তারা বলেন ঈশ্বর সাকার আবার নিরাকার। আবার খৃস্টান, মুসলমানগণ নিরাকারে বিশ্বাস করেন। হিন্দু ধর্মের বহু সাধক সাকারে সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেছেন। মহাত্মা গুরুনাথ ঈশ্বরকে নিরাকার-ই মনে করেন। নিরাকারবাদেই তার পক্ষপাতিত্ব বা সমর্থন আছে বলে মনে হয়। কিন্তু এবার যখন আলোচনার বিষয়বস্তূ ঈশ্বরের আকার নিয়ে, তখন তিনি দ্বিধায় পরে গেলেন। তাই বলছেন - এ সন্মন্ধে মত প্রকাশ করা আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তির পক্ষে একান্ত অসাধ্য ব্যাপার। .. আমি তো কর্তা নোই যে, সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো। আমি করন মাত্র। ভগবানই জানেন তিনি এ কার্যে কেন আমাকে প্রবর্ত্তিত করলেন। অর্থাৎ তিনি না পারছেন আকারকে সমর্থন করতে , না পারছেন আকারকে অস্বীকার করতে। তিনি জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি সত্যের পূজারী। সত্যকে অস্বীকার তার পক্ষে অসম্ভব। আবার জ্ঞান তাকে এই সত্যে উপনীত হতে বাধা দিচ্ছে যে, ঈশ্বর সাকার । তাই মহাত্মা গুরুনাথ মধ্যপন্থা অবলম্বন করলেন। কিন্তু নিরাকারে প্রাধান্য দিয়েছেন।
মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন - কতকগুলো জ্ঞান আমরা সাকার হতে সংগ্রহ করি। প্রথমে পুষ্পের জ্ঞান, তার পরে এর গন্ধের জ্ঞান। পুষ্প সাকার কিন্তু গন্ধ নিরাকার। দুটোই সত্য। আবার কতকগুলো জ্ঞান বা বোধ প্রথমে নিরাকার থেকে হয় - পরে সেটা সাকার হয়। যেমন ক্ষুধাবোধ, এটি নিরাকার জ্ঞান।খাদ্যে ক্ষুধার নিবৃত্তি, এটি সাকার জ্ঞান। অতয়েব দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো জ্ঞান আগে সাকারে লব্ধ হয়। কোনো কোনো জ্ঞান আগে নিরাকারে লব্ধ হয়।
মহাত্মা এবার মহাদেবর স্মরণ নিলেন : বলছেন :
মহাদেব দেবী পার্বতীকে বলছেন :
সাকারেণ বিনা দেবি / নিরাকারো ন লভ্যতে।
নিরাকারং বিনা দেবী / সাকার-অপি না লভ্যতে
বীজং বিনা না বৃক্ষঃ স্যদ /বিনা বৃক্ষ্যং না বীজকম।
এটি বোধ হয় শিব পুরান থেকে নেওয়া। যার অর্থ হচ্ছে - সাকার ব্যতীত নিরাকার লব্ধ হয় না। আবার নিরাকার ব্যতিরেকেও সাকার লব্ধ হয় না। বীজ ব্যতিরেকে বৃক্ষ হতে পারে না। আবার বৃক্ষ থেকেই বীজের উৎপত্তি। ডিম আগে না মুরগি আগে - এ প্রশ্নের সমাধান করা যায় না। কিন্তু কে আগে এই সমস্যা বা সমাধান থেকে আমরা ইশ্বেরের সাকারত্ব বা নিরাকারত্ব নিরুপন করতে পারবো না। যারা সাকারের উপাসনা করেন তারাও বলছেন সাধকের হিতের নিমিত্ত ব্রহ্মার রূপ কল্পনা করা হয়েছে। "সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মণো রূপ কল্পনা "। অর্থাৎ রূপ কল্পনা মাত্র। সত্য নয়। সাধকেরা প্রথম অবস্থায় নিরাকার ব্রহ্ম ধারণা করতে পারে না। তাই ব্রহ্মের রূপ কল্পনা করা হয়েছে। অতএব রূপ কল্পনা মাত্র। আসলে ঈশ্বর নিরাকার।
দেখুন সাকার ভক্তও বলছেন - ভগবান থেকে ভক্ত বড়ো, ভক্ত থেকে নাম বড়ো। অর্থাৎ সাকার ভক্তরাও ধীরে ধীরে নিরাকারের দিকে যাচ্ছেন। ভক্তরা যখন জপ্ করেন তখন দেখবেন - প্রথমে সশব্দে জপ্ করেন, তারপরে শুধু ঠোঁট নেড়ে জপ্ করেন, এর পরে ঠোঁট নাড়াও বন্ধ হয়ে যায়। তখন মনে মনে জপ্ করেন। অর্থাৎ ধীরে ধীরে অন্তরে প্রবেশ করেন। সেই নিরাকারের সাধনায় লিপ্ত হন।তাহলে বোঝা যাচ্ছে ঈশ্বর নিরাকার। আবার দেখুন ঈশ্বর-এর রূপ সম্পর্কে বলা হচ্ছে - ব্রহ্ম চিন্ময়, অপ্রমেয়, নির্গুণ ও অশরীরী। "চিন্ময়স্যাপ্রমেয়স্য নির্গুণস্যাশরীরিণঃ" । অর্থাৎ যারা সাকারের সাধক তারাও বলছেন ঈশ্বর চিন্ময় অর্থাৎ জ্ঞানময়। যিনি জ্ঞানময় তার আবার শরীর হয় নাকি ? তিনি অপ্রমেয় অর্থাৎ যার পরিমান করা যায় না। তো যার পরিমান করা যায় না তাকে কি করে আকার দেবেন ? তিনি নির্গুণ ও অশরীরা। অর্থাৎ তার শরীর নেই . অতএব সাকার বাদীরাই স্বীকার করছেন তার শরীর নেই। সুতারং মহাত্মা গুরুনাথ যে বলছেন ঈশ্বর নিরাকার - সেটাই সত্য।
আমরা এর আগে আলোচনা করেছি স্থুল পদার্থ ধীরে ধীরে সূক্ষ্মে লয় হয়। অর্থাৎ ভূমি জলে লীন হয়। জল তেজ বা অগ্নিতে লীন হয়। তেজ আবার বায়ুতে লীন হয়। বায়ু আবার আকাশে লীন। আকাশ যাতে লীন হয় এবং তাকে যদি আমরা ঈশ্বর বলি তবে বলতেই হয় ঈশ্বর নিরাকার ও অতিসূক্ষ্ম এবং সর্বত্র।
আবার দেখুন ভূমি বা আমাদের পৃথিবী জলের উপরে ভাসছে। জল মৃত্তিকা খণ্ড থেকে তিন গুন্ বড়ো। আমরা সবাই জানি পৃথিবীর ৭৫% জল, কেবল মাত্র ২৫% মাটি। তাহলে মাটি থেকে জলের পরিমান বা আকার বড়ো। তাই তো জলের মধ্যে পৃথিবী ভাসতে পারছে। যদি জলের পরিমান কম হতো তবেতো পৃথিবী নামক মৃত্তিকা খণ্ড ভাসতে পারতো না। আবার জলের আধার হচ্ছে তেজ। তেজের আধার হচ্ছে বায়ু। বায়ুর আধার হচ্ছে আকাশ। আকাশের আধার হচ্ছে ঈশ্বর বা পরমাত্মা।অতএব ঈশ্বর নিরাকার, অসীম। তেজ বা অগ্নি অব্দি আকারে পাওয়া যায়। তারপর
থেকেই অনুভূতিতে যেতে হয়। এই অনুভূতির সূক্ষ্মতম স্তরে ঈশ্বর স্পন্দিত হয়। অতএব ঈশ্বর কখনো সাকার হতে পারেন না।
এইবার মহাত্মা আরো গভীরে প্রবেশ করছেন। ঈশ্বর তো নিরাকার। কিন্তু বহু মহাত্মা তো সাকারের সাধনা করতেন, এবং সিদ্ধ পুরুষ হিসেবে তাদের স্বীকার করা হয়েছে। তারা ঈশ্বরের সাক্ষাৎ করেছেন। কত মহাত্মা যে ঈশরের সান্নিধ্য পেয়েছেন, দর্শন পেয়েছেন সেগুলো কি সব
মিথ্যা ? না তাদের ভ্রম ? জ্ঞানীরা সাকার মানে না। কিন্তু ভক্ত, ঈশ্বর প্রেমিক ? তারাতো সাকারেই ঈশ্বর দর্শন করেন । তবে ? মহাত্মা বলছেন - গুনের মধ্যে ভক্তি ও প্রেম অতি প্রধান। গুণীজনের মধ্যে ভক্ত ও প্রেমিক শ্রেষ্ট। তারা তো সাকার মানেন। তারা তো মিথ্যা বলেন না। মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন তিনি নিরাকার হয়েও সাকার হতে পারেন। কি জ্ঞানী, কি ভক্ত, কি প্রেমিক এঁরা সাবলম্ব্য গুনের পরম উৎকর্ষ লাভ করেন। এবং ঈশ্বরকে নিরীক্ষণ করেন। এ বিষয়ে কোনো মতান্তর নেই। এই ঈশ্বরের দর্শনের সময় ইন্দ্রিয়গণ মনে লীন হয়। মন জীবাত্মায় লীন হয়। জীব স্বীয় প্রভুর কৃপায় তার সাক্ষাৎকার লাভ করে। এই সাক্ষাৎকার এক অনির্বচনীয় দর্শন। সেই অরূপ-রূপ দর্শন যার ভাগ্যে ঘটে, তিনিই তা অনুভব করতে পারেন, কিন্তু বলতে পারেন না। অতএব ঈশ্বরের সর্বাব্যাপিত্ব হেতু তাকে সর্বাবস্থায় সর্বপ্রকারে দর্শন সম্ভব। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এইবার কিন্তু মহাত্মা সাকার ঈশ্বরকে মানলেন। কিন্তু এখানে একটা কথা লক্ষ্য করুন। সাবলম্ব গুনের পরম উৎকর্ষ লাভ করেন। এই সাবলম্ব কথাটার মানে কি ? সাবলম্ব অর্থাৎ স্ব-স্থিত। যে গুনের সাহায্যে মানুষ নিজের মধ্যে প্রবেশ করেন। অর্থাৎ বাহ্যিক জগৎ তার কাছে মিথ্যা বলে প্ৰতিত হয়। সব কিছুকেই এক-এ-স্থিত বলে মনে করেন। তার জগৎ ব্রহ্মময়। ব্রহ্মই জগৎ। নিজেকেও ব্রহ্ম বলে মনে হয়। তোমাকেও ব্রহ্ম বলে মনে হয়। তাকেও ব্রহ্ম বলে মনে হয়। অহম ব্ৰাহাস্মিন - ওং তৎ সৎ - সোহম। এটা সাধনার শেষ পর্যায়। এর পরে আর মানুষ দেহে থাকেন না। দেহ ত্যাগ করেন।
মহাত্মা কিন্তু এবার সতর্ক করছেন। বলছেন কেউ যেন তাই বলে, মনুষ্য রূপধারী রাম, কৃষ্ণ বা বিভিন্ন দেবদেবীকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বলে ভেবে না বসেন । এদের প্রতি শ্রদ্ধা বা ভক্তি, বিশ্বাস থাকা ভালো কিন্তু তাই বলে এদেরকেই ঈশ্বর বা সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর ভাবা মূর্খতা। এবং ঈশ্বরকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা। যিনি সর্বদা সর্বত্র বিদ্যমান আছেন তাকে যে কোনো পদার্থে বা জিবে স্থিত সেটা ভাবতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু সেই পদার্থই সব নয়, বা সেই মানুষ ঈশ্বর নন, বা শেষ কথা নয়, এটা বুঝতে হবে।
এবার একটু অন্য্ কথা বলি। ধ্যানে সাধকেরা তার ইষ্ট বা গুরুদেবের প্রতিচ্ছবি কল্পনা করে ধ্যান করেন। তখন গুরুদেবকে বা তার ইষ্টকে জ্যান্ত বলে মনে হয়। তখন সেই ইষ্টদেবতার সঙ্গে বা গুরুদেবের সঙ্গে কথা বলা যায়।এবং কথা বলেন সাধক। সেই প্রতিচ্ছবিও কথা বলে। আপনারা নিশ্চয় শুনেছেন আমাদের আজ্ঞা চক্র বা তৃতীয় নয়ন বলে একটা কথা আছে। এটি একটি শক্তিশালী বার্তা প্রেরণ কেন্ত্র। বিশ্বাস করতে হবে না, এই বার্তা প্রেরণ কেন্দ্রে নিজের মনকে স্থির করে আপনি যদি কাউকে আদেশ বা নির্দেশ দেন, তবে সে তা পালন করতে বাধ্য হবে। এটা আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। এটি একটি অসাধারন গতিশীল শক্তি। কোনো ব্যক্তির ছবি, বা প্রতিমাকে মনের মধ্যে রেখে, তার ক্ষুদ্র প্রতিমাকে ধ্যানে নিয়ে আজ্ঞা চক্র থেকে যদি ভিজা মাটির মূর্তির উপরে, বা ছবির উপরে নিবিষ্ট করা যায় তবে সেই মাটির মূর্তি আর সাধারণ থাকে না। সেটা আপনার আজ্ঞা দ্বারা সঞ্চারিত চলমান শক্তিতে পরিণত হয়ে যায়। তখন আপনি যা স্নরন করবেন, সেটা গতিশীল হয়ে যাবে। মূর্তিপূজা এই প্রক্রিয়ার গভীর প্রয়োগ । আমি মনে করি, ঈশ্বর তো বিরাট। আর এই সর্বত্র বিরাজমান বিরাটের কাছে পৌঁছেতে আমরা মূর্তির মাধ্যমে যেতে পারি। একটা কথা আছে, যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে এই ভান্ডে অর্থাৎ মানব শরীরে। এবং শুধু তাই আছে না, সেই প্রপোরশনে অর্থাৎ সেই ভাগে আছে। অর্থাৎ জল ৭৫%, আকাশ ____, বায়ু _____ অগ্নি _____ মৃত্তিকা _____ । আপনার মস্তিস্ক আর পরমাত্মার মস্তিষ্কের সঙ্গে একটা সম্পর্ক আছে। এই দুই সন্মন্ধকে যুক্ত করার জন্য একটা সেতু চাই। এই সেতু নির্মিত হতে পারে মূর্তি দিয়ে। কেননা আপনি নিরাকার কিছুর সঙ্গে সোজা সুজি সম্পর্ক স্থাপিত করতে পারবেন না। আপনি আকারে বর্তমান। নিরাকার সম্পর্কে তো আপনার কিছু জানা নেই। তাই যে যাই বলুক না কেন পরমাত্মা নিরাকার, অপ্রকাশিত। সেটা শুধু শুধু কথার কথা হয়ে যাবে আপনার কাছে। আপনার অনুভবের মধ্যে কিন্তু আসবে না। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে যত অনুভব আছে, সেগুলোর সাবি আকৃতির অনুভব। রূপের অনুভব। আমাদের কারুর মধ্যে নিরাকারের একটাও অনুভব নেই। কারুর কথা ভাবা মানে তার রূপের কথা। অবয়বের কথা। তার সূক্ষ্ম গুনের কথাতেও আমরা রূপ কল্পনা করি। আর যার সন্মন্ধে কোনো ধারণা নেই তার সম্পর্কে কোনো শব্দ আপনাকে তার স্মরণ করাতে পারবে না। তাই আপনি নিরাকারের কথা বলতে থাকবেন আর সাকারের মধ্যে বাস করবেন। যদি সত্যি সত্যি আপনি নিরাকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চান তবে আপনাকে এমন একটি মূর্তি নির্মাণ করতে হবে যার একদিকে সাকার আর এক দিকে নিরাকার। ইটা একটা অসম্ভব রহস্যময় মূর্তি হবে। একটু ভাবুন, আমরা যেখানে রয়েছি, সেখানে তার সীমা প্রকাশিত। আর অন্যদিকে পরমাত্মা যেখানে আছেন সেটা সীমাহীন অপ্রকাশিত। তাই মূর্তিকে দুটো কাজ করতে হবে আমরা যেখানে সেখানে সে প্রকাশিত হবে, আর পরমাত্মা যেখানে আছেন সেখানে নিরাকারের মধ্যে হারিয়ে যাবে। এই ধরনের কথা হয়তো কখনো শোনেননি।
একটা কথা শুনুন যে ব্যক্তি পূজা করে, সে ওই মাটির মূর্তিকে পূজা করে না। সে ওই ছবিকে পূজা করে না। সে পূজা করে ওই ছবির মধ্যে তার পিতাকে, মাতাকে, গুরুকে । দেবতাকে। ইষ্টকে। পরমাত্মাকে। মূর্তির কখনো পূজা হয় না। মূর্তির মধ্যে আমি যাকে দেখতে চাই তার পূজা করা হয়। আর যার কাছে মূর্তি দৃশ্যমান, সে কখনো পূজা শেখেনি, সে পূজা করে না। তার পূজা সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। পূজা আর মূর্তি দুটো আলাদা কথা। পূজা মূর্তির হয় না, পূজা হয় ভাবনার। যে পূজা করে, সে কখনো মূর্তি দেখতে পায় না। যে মূর্তি দেখতে পায়, সে কখনো পূজা করে না। পূজা মূর্তিকে মুছে ফেলার কৌশল। আমরা তো আকৃতি সম্পন্ন, সেই আকৃতিকে মুছে ফেলার কৌশলই পূজা।দেহাতীত হয়ে যাওয়াই পূজা। পূজায় দৃশ্যমান আকৃতি, আকৃতিবিহীন হয়ে যায়। তবেই পূজা সম্পন্ন হয়। প্রকাশিত অংশে পূজা আরম্ভ হয়, অপ্রকাশিতে পূজা সম্পন্ন হয়। পূজা সাধককে গ্রাস করে নেয়। যারা পূজা করেনি তারা ভাবে পাথর রেখে কি হবে ? আর যারা পূজা করেছে তাদের পাথর হারিয়ে যায়, সীমা হারিয়ে যায়, অসীমে প্রবেশ করে আর তখন পরমাত্মা প্রকট হয়ে যায়।
ভগবান শ্রীচৈতন্য যখন দুহাত তুলে কৃষ্ণনাম করে, মিরা যখন পূজার ছলে নাচ করে, মতুয়ারা যখন হরিবোল হরিবোল করে তখন তারা নিজেরা পূজার মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। এদের জন্য সেখানে কোনো মূর্তির অস্তিত্ব থাকে না। পূজা শুরু হলে মূর্তি বিলীন হয়ে যায়। মূর্তি তো প্রারম্ভ মাত্র। আমরা যারা পূজার কিছু বুঝি না, তারা মূর্তি দেখতে পাই। তাই আমার মনে হয় - সত্যিকারের পূজা যত কমতে থাকবে, মূর্তি তত বাড়তে থাকে, পূজা শুরু হলে মূর্তি অন্তর্হিত হবে।
মূর্তি তো পরমাত্মাকে দেখবার জানলা মাত্র। আমি দেহের মধ্যে থেকে পরমাত্মাকে দেখতে চাই। আমার তো দেহ আছে। অর্থাৎ আমি আকৃতি সম্পন্ন। তো জালনা ও তো আকৃতি সম্পন্ন হবে , কিন্তু জানলা খুলে যখন আকাশের দিকে তাকাবো তখন নিরাকারের মধ্যে প্রবেশ করবো। এই দেহের মধ্যে জানলা আছে, সেটাকে খুলতে হবে। আকাশকে দেখতে হবে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে জানলা ছোট্ট। কিন্তু আকাশ তো বড়ো। কিন্তু ছোট্ট জানলা দিয়েইতো বড়ো আকাশকে দেখা যায়। এটা বোঝানো কঠিন কিন্তু সত্যি। যে জানলা কখনো খোলেনি, যুক্তি দিয়ে তাকে বোঝানো কঠিন হবে যে বৃহৎ আকাশকে, আয়তনে ছোট্ট জানলা দিয়েও দেখা যায়। মূর্তি পূজা এই জানলা খোলার প্রক্রিয়া। আপনি মন্দিরের কাছে যেতে পারেন। মূর্তির কাছে যেতে পারেন। কিন্তু পূজার কাছে যেতে পারেন না। কতকগুলো বিষয় আছে যার অভিব্যক্তি সম্ভব নয়। এগুলো অন্তরের ব্যাপার। আন্তরিক বস্তু প্রদর্শন সম্ভব নয়।
সাকার নিরাকার দুটি পৃথক নয়। একটি ওপারের সঙ্গে সংযুক্ত। যাকে আমরা সাকার বলি সেটা নিরাকারের অংশ। আবার যাকে আমরা নিরাকার বলি সেটিও সাকারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আমরা সাকারে আছি। আমার দেহ সাকার। আমরা সম্পর্ক গড়ি সাকারের সঙ্গে। এই সত্য তো অস্বীকার করলে চলবে না যে আমরা সাকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। আর আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমাদের সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে হবে। যেখানে আমাদের যাওয়া উচিত, সেখান থেকে যাত্রা শুরু করা যায় না। যেখানে আছি সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে হয়। যেখানে আমরা নেই সেখান থেকে যাত্রা শুরু করা যায় না। আমরা যা কিছু জেনেছি আকারের মধ্যেই জেনেছি। আমরা প্রেম করেছি - আকারে। আমরা রাগ করেছি আকারে। আমরা ঘৃণা করেছি আকারে। আসক্ত হয়েছি তাও আকারে। বন্ধুত্ব করেছি আকারে। শত্রূতা করেছি তাও আকারে। ঈশ্বরের নিরাকারত্ব যেমন সত্য। আমাদের আকারত্ব তেমনি সত্য। আমাদের মন যখন কিছু ধরে রাখে সেটা আকারেই ধরে রাখে।
তাই মহাত্মা গুরুদেবকে যখন আমরা স্মরণ করি তখন তার আকারের কথাই আমাদের চোখে ভাসে। আর এই জন্য নিরাকারের দিকে যদি যাত্রার জন্য যখন আমাদের বেরোতে হয়, তবে আমাদের নিরাকারের জন্য আকার সৃষ্টি করতে হবে।
৫. ঈশ্বরের স্বরূপ কী ?
মহাত্মা গুরুনাথ তার চতুর্থ প্রশ্ন অর্থাৎ ঈশ্বর সগুন কি নির্গুণ এই আলোচনায় যাবার আগে পঞ্চম প্রশ্ন ঈশ্বরের স্বরূপ কী এই নিয়ে আলোচনা করছেন। আমরাও সেই পথেই যাবো। এখানেও মহাত্মা গুরুনাথ প্রথমেই বলছেন : এই প্রশ্নের উত্তরদান বড়ই সুকঠিন এমনকি অসাধ্য বললেও অত্যুক্তি হয় না। তিনি অনির্বচনীয়। যা অনির্বচনীয়, তাকে বচন দিয়ে কিভাবে প্রকাশ করা যাবে ? সুতরাং মহাত্মা নিজেই বলছেন : "আমি যা বলবো তাও সম্পূর্ণ হতে পারবে না। যিনি ঈশ্বর দর্শন লাভ করেছেন তিনিই জানেন ঈশ্বর কিরূপ !" তাই মহাত্মা গুরুনাথ এই মহৎ কার্যে অনন্ত মঙ্গলময় জগদীশ্বরের করুনা এবং মহাত্মাদিগের সাহায্য প্রার্থনা করছেন।
মানুষের জীবনে যা কিছু শ্রেষ্ট, সুন্দর,সত্য তাকে জানা যেতে পারে, অনুভব করা যেতে পারে, কিন্তু ব্যাখ্যা করে বলা বা বোঝানো শক্ত। শুধু শক্ত নয় অসম্ভব। মাছ, যার জন্ম, জীবন, মৃত্যু সবই জলের মধ্যে তাকে যদি জিগ্যেস করা হয় জল কি, তবে তার পক্ষে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব হবে। আমরা প্রেম করি, প্রেমের গান গাই, প্রেম খুঁজে কাউকে দিতে পারি না। তেমনি আমরা সবাই ঈশ্বরের মধ্যে জন্মাই , বেঁচে থাকি, আবার মরেও যাই। কিন্তু ঈশ্বরকে বুঝিও না। বোঝাতেও পারি না।
মহাত্মা গুরুনাথ এই অসম্ভব কাজে হাত দিয়েছেন। তাই প্রথমেই সংশয় প্রকাশ করছেন। তিনি বলছেন, বায়ুর কিছু গুন্ আছে। এখন আপনার ঘরে বায়ু আছে কি না সেটা জানবার জন্য যদি গুন্ গুলোর সন্ধান করি, এবং বায়ুর সব গুনের সন্ধান পাই তবে বলতে পারি, আপনার ঘরে বায়ু আছে। আর যদি তা না পাই তবে বলতে পারি আপনার ঘরে বায়ু নেই। এখন বায়ুর গুন্ যদি অসীম হয় তাকে বোঝা মুশকিল হবে।
আবার আমরা জানি, চারটে আশ্রম : ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য , বানপ্রস্থ, সন্যাস। এখন কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয় তুমি কোন আশ্ৰমী ? তিনি সোজাসুজি বলতে পারেন আমি গৃহস্থ-আশ্রমী . আবার এও বলতে পারেন আমি ব্রহ্মচারী নোই,বা বানপ্রস্থে নেই, আবার সন্যাস-আশ্রমে নেই। তাহলেও আমরা বুঝতে পারি ভদ্রলোক গৃহী। এখন আশ্রমের সংখ্যা যদি অসংখ্য হয় তবে তাকে বোঝা মুশকিল হবে।
তাই ঈশ্বর যেহেতু অসীম গুনের অধিকারী, তাই তাকে নির্দিষ্ট গুনের পরীক্ষায় বোঝা যাবে না। আবার তিনি যেহেতু অসীম, সর্বত্র তাই তাকে কোথাও নেই এটা বলা যাবে না।
তাহলো কোন পথে তাকে বুঝবো ? তাই, মহাত্মা গুরুনাথ সাধন কার্যে যখন হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থান করছিলেন, সেখানে এক মহাত্মার কাছে যা শুনেছিলেন তাই বলছেন : " ঈশ্বর নিরাকার, চৈতন্যস্বরূপ। এরূপ বললে ঈশ্বর সন্মন্ধে কিছুই বোঝা না। যার আকার নেই, তাতো বুঝলাম কিন্তু কি আছে সেটা তো বুঝলাম না ? তার চৈতন্য আছে অর্থাৎ জ্ঞান আছে। জ্ঞানের আকার নেই সত্য কিন্তু জ্ঞান যার মধ্যে আছে তার তো আকার আছে। তবে কি ঈশ্বর সাকার এটা স্বীকার করতেই
হয় ?
হিমালয়ের সেই মহাত্মা বলছেন : এই দৃশ্যমান জগতের প্রতি বা তার অংশের প্রতি দৃষ্টিপাত করো অর্থাৎ যা দেখা যায়, শোনা যায়, স্পর্শ করা যায় সবই কতকগুলো গুনের সমষ্টি মাত্র। ধরো এক টুকরো কাগজ - তার শুভ্রত্ব, তার আয়তন, তার আকৃতি, তার কাঠিন্য, এই সব গুনের সমষ্টিই হচ্ছে কাগজ। ঈশ্বর হচ্ছে অনন্ত গুনের সমষ্টি মাত্র। এই আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী সকল-ই কেবল গুনের সমষ্টি মাত্র। গুন্ ব্যতীত দ্রব্যের অস্তিত্ব থাকে না। সমস্ত দ্রব্য-ই গুনের সমষ্টি মাত্র, বা গুনের প্রকাশক মাত্র। কি পদার্থ, কি আত্মা সকলই কেবল গুন্ সমষ্টি। কি স্রষ্টা, কি সৃষ্টি সবই গুনের সমষ্টি। সকলই গুণময়। অতএব জগদীশ্বর অনন্ত গুনের সমাহার। অনন্ত গুনাগুনের সমাহারেই ঈশ্বর। যিনি নির্বিদিত বা নির্বেদ্য অর্থাৎ অজ্ঞাত বা অজ্ঞেয় গুন্ যার তিনিই নির্গুণ-ঈশ্বর। যার গুণরাশি এ পর্যন্ত অবধার্য্য হয় নাই তিনিই নির্গুণ। অতএব ঈশ্বর অনন্ত অনন্ত অনন্ত গুণময়। এবং গুনের সাধনাই জগদীশ্বরের সাধনা। মহাত্মা গুরুনাথ তাই গুনের সাধনাকেই ঈশ্বরের সাধনা বলছেন।
এবার মহাত্মা গুরুনাথ কয়েকটা মৌলিক প্রশ্নের উপর পরম-ঈশ্বরের স্বরূপ নির্নয় করছেন। প্রশ্নগুলো হলো :
তিনি সুখ স্বরূপ কি দুঃখ স্বরূপ ?
তিনি ধৰ্ম স্বরূপ কি অধর্ম স্বরূপ ?
তিনি চৈতন্য স্বরূপ কি অচেতনস্বরূপ ?
তিনি পুরুষ স্বরূপ কি রমণী স্বরূপ ?
তিনি প্রকৃতি কি পুরুষ ?
পরম আত্মার গুন্ যেমন অনন্ত, সেই অরূপের রূপও অনন্ত। তাকে পূর্ণ ভাবে দর্শন করা সম্ভব নয়।সুখ দুঃখের একত্বই ঈশ্বরের স্বরূপ। তিনি ধৰ্ম অধর্ম উভয়ের একত্ব মিশ্রণ। তিনি চেতন অচেতন উভয়ের অনন্ত মিশ্রণ। তিনি না রমণী না প্রকৃতি না পুরুষ। তিনি অনন্ত প্রকৃতি-পুরুষাত্বক। অর্থাৎ অনন্ত একত্বই ঈশ্বর।
এবার একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। একটা ছোট্ট গ্রামে একটা ছোট্ট স্কুল। সেখানে পণ্ডিত মশাই ক্লাসে রামায়ন পড়াচ্ছেন। ছেলেগুলো অন্যমনস্ক। কেউ কেউ ঝিমোচ্ছে। পণ্ডিতমশায়ও বোধকরি ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে পড়াচ্ছেন। আসলে পণ্ডিত মাশয়ের সব মুখস্ত। সামনে বই খোলা ছিল। কিন্তু তার বই দেখার কোনো দরকার ছিল না। সে সবই জানতো। তাই টেপ রেকর্ডের মতো, যন্ত্রের মতো সে বলে যাচ্ছিল। ওই মুহূর্তে সে জানেই না সে কি বলছে। তোতা পাখির মতো বলে যাচ্ছে। যারা মুখস্ত শব্দ বলে তারা জানেই না সে কি বলছে। হঠাৎ ক্লাসের সবাই তটস্থ হয়ে পড়লো। স্কুল ইন্সপেক্টর আসছেন। ইন্সপেক্টর ক্লাসের ভিতরে ঘুকলেন। ছাত্ররা সতর্ক হয়ে বসলো। পণ্ডিত মহাশয়ের ঝিমুনি কেটে গেল। খানিকটা বিরক্তি, খানিকটা সাবধানতা। ইন্সপেক্টর এসে জিজ্ঞেস করলেন - কি পড়াচ্ছেন ? পণ্ডিত মশায় বললেন - এই রামায়ন আর কি। বাঃ - তো রামায়ন থেকে একটা প্রশ্ন করি।
তো রামায়ন থেকে একটা সহজ ছোট্ট প্রশ্ন করলেন। "তোমরা কি বলতে পারো, শিবের ধনুক - হরধনু কে ভেঙে ছিল ? কেউ কিছু বলার আগেই একজন ছাত্র দাঁড়িয়ে উঠে বললো। ক্ষমা করবেন স্যার - আমি জানি সবাই বলবে আমি ভেঙেছি। আমি কিন্তু স্যার গত পনেরো দিন স্কুলে আসিনি। আর শিবের ধনুক আমি দেখিওনি, ভাঙিও নি। আমাকে যেন কেউ দোষী না করে। যখনি স্কুলে কিছু ভাঙে আমাকেই দোষী করা হয়। ইন্সপেক্টর তো অবাক। উনিতো ভাবতেও পারছেন না - এই রকম কেউ বলতে পারে। তিনি শিক্ষকের দিকে তাকালেন। পণ্ডিত মশায় - হাতে বেত তুলে নিলেন। টেবিলের উপরে দু ঘা মেরে বললেন - নিশ্চয় ও ভেঙেছে । এটা ওর বরাবরের অভ্যাস। বললেন - যদি তুই না ভেঙে থাকিস তবে তুই কেন বললি যে আমি ভাঙিনি ? ইন্সপেক্টর তো থ। ছাত্রের অবস্থা তো বটেই, মাস্টারের জ্ঞানের দৌড়ও বুঝে গেলেন। ক্লাস থেকে বেরিয়ে প্রধান শিক্ষকের ঘরে গেলেন।
প্রধান শিক্ষক সমস্ত ঘটনা শুনে বললেন - আপনি কিছু ভাববেন না। ও ব্যাটাই ভেঙেছে। কিন্তু আপনি কিছু বলতে যাবেন না। তাহলে বিপদ হবে। প্রায় দু মাস শান্তিপূর্ণ ভাবে স্কুল চলছে। আপনি আর অশান্তি ডেকে আনবেন না। কাউকে কিছু বলার দরকার নাই। আমি ঠিক করে দেব। যেই ভাঙুক আমি ঠিক করে দেবো। কাউকে কিছু বলার দরকার নাই। ইন্সপেক্টরের এবার হতবম্ব হবার অবস্থা। যেই ভাঙুক উনি ঠিক করে দেবেন , কি ঠিক করে দেবেন ? কথা না বাড়িয়ে উনি সেক্রেটারির কাছে গেলেন। সব শোনার পরে সেক্রেটারি - গম্ভীর হয়ে গেলেন। বোবা হয়ে গেলেন। কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলেন না। তার বাকশক্তি হারিয়ে গেছে।
গুরুদেব বলছেন ঈশ্বর অনির্বচনীয়। বাক্য দিয়ে না যায় বোঝা, না যায় বোঝানো। ঈশ্বরকে বুঝলে মানুষ বোবা হয়ে যায়। ভাষা হারিয়ে যায়। ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ।
৪. ঈশ্বর সগুন কি নির্গুণ ?
এতক্ষন আমরা ঈশ্বরের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সেখানে আমরা ঈশ্বরের অসীম অনন্ত গুনের কথা বলেছিলাম। নির্গুণ মানে এই নয় যে যার কোনো গুন্ নেই। নির্গুণ বললে গুণহীন বোঝায় না। তার গুন্ আমাদের ধারণার অতীত। ব্রহ্ম সগুন আবার নির্গুণ। সগুন ও নির্গুণ বলে দুটি ব্রহ্ম নেই। ব্রহ্ম যখন চলমান তখন সগুন অর্থাৎ গুনের প্রকাশ। যখন নিশ্চল তখন গুনের অপ্রকাশ। তিনিই গতিহীন আবার তিনিই স্থির। তাই তিনিই সগুন আবার তিনিই নির্গুণ। তিনিই প্রকাশ রূপে এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড, আবার তিনিই সুপ্ত সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। মহাত্মা গুরুনাথ একটা সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন - ভারতবাসী যখন হিমালয় দেখেন তখন উত্তর দিকে দেখেন। আবার তিব্বতবাসী যখন হিমালয় দেখেন তখন দক্ষিণ দিকে দেখেন। যার ভূগোল জ্ঞান আছে তিনি বুঝবেন দুটোই সত্য। যার ভূগোল জ্ঞান নেই তার কাছে যে কোনো একটি মিথ্যা। জ্ঞান হলে এই ভ্রম দূর হবে। ঈশ্বর সগুন আবার নির্গুণ। যারা সগুনের অর্থাৎ নির্দিষ্ট গুনের উপাসনা করে তারা খন্ডের উপাসনা করে। যারা নির্গুণের উপাসনা করে তারা পূর্ণের উপাসনা করে। যে যেমন গুনের উপাসনা করে, সে তেমনি ফল পায়।
"তং যথা যথোপাসতে, তদেব ভবতি"
পরমাত্মাকে যেমন যেমন উপাসনা করে, তদ্রুপ-ই হয়।
মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন গুন্-উপাসনা অনুসারেই যখন ফল হয় তখন ব্রহ্মজ্ঞান বিকাশের পূর্ব অব্দি সগুনের উপাসনাই করা উচিত। ব্রহ্ম জ্ঞান হলে নির্গুণের উপাসনা করা কর্তব্য। ধর্মক্ষেত্রে প্রবেশার্থীর অর্থাৎ প্রথম প্রথম সগুন উপাসনা করা উচিত এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
এবার আমরা এই প্রসঙ্গে একটু শ্রীমৎ ভগবৎ গীতার কিছু প্রাসঙ্গিক কথা একটু আলোচনা করবো।
গীতায় অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রশ্ন করছে :
অর্থাৎ বাসনাহীন বা আসক্তিহীন কর্ম। আর একটা নতুন পদ্ধতি তা হলো ভক্তিযোগ। আশ্রমীদের মধ্যে গুরুভক্তি আগেও ছিল, কিনতু ভগবানে ভক্তি কথাটার প্রচলন ছিল না, নির্ভরতা ছিল। আর দেবতা বলতে ছিল প্রকৃতি। বিশেষ করে আর্যদের মধ্যে নিরাকার সাধনাই প্রচলিত ছিল। শ্রীকৃষ্ণ এসে এই ভক্তিযোগ চালু করলেন। এবং এটা ভারতবর্ষের আবিষ্কার। শ্রীকৃষের আবিষ্কার। ব্যাসদেবের আবিষ্কার। অন্য কোনো ধর্মে এই ভক্তিবাদ আজও আসেনি। এবং এই ভক্তিবাদের আকর্ষণেই লক্ষ লক্ষ্য বিদেশী হিন্দু-ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। আশ্চার্য্য ব্যাপার হচ্ছে এই ভক্তি আমাদের অন্তরে জন্ম থেকেই আছে। এটা জাগ্রত করার জন্য শুধু বলছেন শ্রীকৃষ্ণ। নতুন কিছু সংগ্রহ নয়।
ওম মহাত্মা গুরুনাথায় নমঃ
ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ
এবারে মহাত্মা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। ঈশ্বরকে জানতে গেলে নিজেকে উপযুক্ত করে তোলো। তবেই তিনি ধরা দেবেন তোমার অনুভূতিতে। নতুবা সবিই মিথ্যা। মহাত্মাদের প্রদর্শিত পথে নিজেকে যোগ্য করে তোলো। ভেলকি বাজি নয়। এটা জাগতিক পদার্থ নয়, যে বাজার থেকে কিনে তোমাকে দিয়ে দিলাম। অথবা পিতৃক সম্পত্তি নয়, যে জন্ম সূত্রে পেয়ে গেলাম। এটা অর্জন করতে হয়। ঈশ্বরের কৃপা আর তোমার পৌরুষ তোমাকে ঈশ্বর অনুভূতি দিতে পারে। অন্য কোনো উপায় নেই।
যাই হোক, ঈশ্বরের অস্তিত্বে আমাদের সবার আস্থা আছে। আমার কথা যারা শুনছেন, তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন বলেই উপাসনা করেন। অতএব এ নিয়ে আর বেশী আলোচনা নিষ্প্রয়োজন।
২. ঈশ্বর এক, কি বহু ?
মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন যে - তর্ক দ্বারা ঈশ্বরকে বোঝা যাবে না। না। সহজ সরল ভাবে তাকে বুঝতে হবে।আমিও বিশ্বাস করি, জ্ঞান দ্বারা ঈশ্বরকে বোঝা যাবে তর্কে তাকে পাওয়া যাবে না। পন্ডিতদের শাস্ত্রে ঈশ্বর নেই। ঈশ্বর আছে অনুভবে।
মহাত্মা বলছেন, এই জগতে পরস্পর বিপরীত শক্তি কার্য্য করে। যেমন দিন আছে, তেমনি রাত আছে। যেমন সকাল আছে তেমনি সন্ধ্যা আছে। যেমন গরম আছে তেমনি ঠান্ডা আছে। যেমন আলো আছে, তেমনি অন্ধকার আছে। যেমন সুখ আছে তেমনি দুঃখ আছে। যেমন সাহস আছে তেমনি ভীরুতা আছে। যেমন নিষ্ঠূরতা আছে তেমনি সহানুভূতি আছে। পরমাণুতে আকর্ষণ আছে বিকর্ষণ আছে। বায়ুতে জীবন আছে আবার জীবন-নাশকতাও আছে। সূর্য্য-রশ্মিতে প্রকাশ শক্তি আছে আবার রোগ-জনন প্রবণতা আছে। নদীর জলে উর্বরতা আছে আবার প্লাবন আছে।
মহাত্মা এবার আধ্যাতিক জগতের কথা অর্থাৎ সূক্ষ্ম গুনের কথা বলছেন । প্রেম পরম সুখের কারন আবার প্রেমই ক্লেশের কারন। দয়া আত্মপ্রসাদের কারন আবার দয়াই ঘোরতর দুঃখের হেতু। সবকিছুই বিপরীত ভাবাপন্ন গুণদ্বয়ের সংযুক্তি। যদি সৃষ্টির কারণের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাবো দুটো শক্তি হতে এ জগৎ উৎপন্ন হয়েছে । এই দুই শক্তির একটি আকর্ষণ অপরটি বিকর্ষণ। একটি পুরুষ অপরটি প্রকৃতি। একটি শিব অপরটি শক্তি। একটি লক্ষ্মী অন্যটি নারায়ণ। তাহলে কি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির কারন দুই ? না, এই সৃষ্টির মূল এক। আসলে খেয়াল করুন এই দুই বিপরীত শক্তি একই পদার্থের দ্বিবিধ গুন্ মাত্র। এ যেন একই মুদ্রার দুটি পিঠ। আসলে কিন্তু মুদ্রার দুটি পিঠ নয়, তিনটি পিঠ। একটু খেয়াল করে দেখবেন। দুটো দুই দিকে, আর একটি মাঝে। মাঝের সার্কেল বা চক্র বিপরীত শক্তিদ্বয়ের মধ্যে সমন্নয় ঘটায়। সৃষ্টির কারণও তিন শক্তির একত্রিকরন বৃহৎ সত্বা । ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব - সত্বঃ, রজঃ, তমঃ। অর্থাৎ সৃষ্টির খেলা তিন রকম। জন্ম-পালন-মৃত্যু। অবিরাম এই খেলাই চলছে। এই তিন-এ মিলে এক। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা এক এবং অদ্বিতীয়।
এই জগৎ পঞ্চভূতের সমাহার। মহাত্মা বলছেন : আকাশ থেকে বায়ু, বায়ু থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে জল, আবার জল থেকে ভূমি উৎপন্ন হয়। আবার বিপরীত ভাবে ভাবুন, ভূমি জলে বিলীন হয়। জল অগ্নিতে বিলীন হয়। অগ্নি বায়ুতে বিলীন হয়। বায়ু আকাশে বিলীন হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে স্থুল, সূক্ষ্মে বিলীন হচ্ছে। অতএব দেখা যাচ্ছে সূক্ষ্ম থেকে স্থুলের উৎপত্তি আবার প্রত্যেক স্থুল পদার্থ সূক্ষ্মে লীন প্রাপ্ত হচ্ছে। আর এই সূক্ষ্মতম যিনি তিনিই জগতের আদি কারন। এই আদি কারন-ই ঈশ্বর। অতএব ঈশ্বর এক।
মহাত্মা পরম সত্যের সন্ধান দিলেন। যারা বহুঈশ্বরের আকর্ষণে আছেন, তারা আসলে মায়াকেই ঈশ্বর ভাবছেন। তারা আসলে বহু ঘটে প্রতিবিম্বিত একই চৈতন্য শক্তির খেলা দেখছেন। ঈশ্বর এক। আমাদের চিত্তে ইশ্বরের ছায়া মাত্র। প্রতিটি জীবের মধ্যে, বস্তূর মধ্যে ঈশ্বর প্রতিফলিত হচ্ছে। দর্পনের ছায়ার মত। আমরা ভাবছি ঈশ্বর বহু। আসলে ঈশ্বর এক, এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত থাকা উচিত নয়। মহাত্মা সত্যকে তুলে ধরলেন।
৩.ঈশ্বর সাকার কি নিরাকার ?
ঈশ্বর সাকার কি নিরাকার ? এই প্রশ্ন সাধকের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ভক্ত ঈশ্বরকে দেখতে চায়। ঈশ্বর সাকার না হলে সেটা সম্ভব নয়। ঠাকুর রামকৃষ্ণ নরেনকে বলেছিলেন দেখাতে পারি, এই যেমন তোকে দেখছি। হিন্দুদের মধ্যে কেউ সাকারবাদী আবার কেউ নিরাকারবাদী । আবার একদল আছেন যারা উভয়কে স্বীকার করেন। তারা বলেন ঈশ্বর সাকার আবার নিরাকার। আবার খৃস্টান, মুসলমানগণ নিরাকারে বিশ্বাস করেন। হিন্দু ধর্মের বহু সাধক সাকারে সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেছেন। মহাত্মা গুরুনাথ ঈশ্বরকে নিরাকার-ই মনে করেন। নিরাকারবাদেই তার পক্ষপাতিত্ব বা সমর্থন আছে বলে মনে হয়। কিন্তু এবার যখন আলোচনার বিষয়বস্তূ ঈশ্বরের আকার নিয়ে, তখন তিনি দ্বিধায় পরে গেলেন। তাই বলছেন - এ সন্মন্ধে মত প্রকাশ করা আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তির পক্ষে একান্ত অসাধ্য ব্যাপার। .. আমি তো কর্তা নোই যে, সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো। আমি করন মাত্র। ভগবানই জানেন তিনি এ কার্যে কেন আমাকে প্রবর্ত্তিত করলেন। অর্থাৎ তিনি না পারছেন আকারকে সমর্থন করতে , না পারছেন আকারকে অস্বীকার করতে। তিনি জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি সত্যের পূজারী। সত্যকে অস্বীকার তার পক্ষে অসম্ভব। আবার জ্ঞান তাকে এই সত্যে উপনীত হতে বাধা দিচ্ছে যে, ঈশ্বর সাকার । তাই মহাত্মা গুরুনাথ মধ্যপন্থা অবলম্বন করলেন। কিন্তু নিরাকারে প্রাধান্য দিয়েছেন।
মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন - কতকগুলো জ্ঞান আমরা সাকার হতে সংগ্রহ করি। প্রথমে পুষ্পের জ্ঞান, তার পরে এর গন্ধের জ্ঞান। পুষ্প সাকার কিন্তু গন্ধ নিরাকার। দুটোই সত্য। আবার কতকগুলো জ্ঞান বা বোধ প্রথমে নিরাকার থেকে হয় - পরে সেটা সাকার হয়। যেমন ক্ষুধাবোধ, এটি নিরাকার জ্ঞান।খাদ্যে ক্ষুধার নিবৃত্তি, এটি সাকার জ্ঞান। অতয়েব দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো জ্ঞান আগে সাকারে লব্ধ হয়। কোনো কোনো জ্ঞান আগে নিরাকারে লব্ধ হয়।
মহাত্মা এবার মহাদেবর স্মরণ নিলেন : বলছেন :
মহাদেব দেবী পার্বতীকে বলছেন :
সাকারেণ বিনা দেবি / নিরাকারো ন লভ্যতে।
নিরাকারং বিনা দেবী / সাকার-অপি না লভ্যতে
বীজং বিনা না বৃক্ষঃ স্যদ /বিনা বৃক্ষ্যং না বীজকম।
এটি বোধ হয় শিব পুরান থেকে নেওয়া। যার অর্থ হচ্ছে - সাকার ব্যতীত নিরাকার লব্ধ হয় না। আবার নিরাকার ব্যতিরেকেও সাকার লব্ধ হয় না। বীজ ব্যতিরেকে বৃক্ষ হতে পারে না। আবার বৃক্ষ থেকেই বীজের উৎপত্তি। ডিম আগে না মুরগি আগে - এ প্রশ্নের সমাধান করা যায় না। কিন্তু কে আগে এই সমস্যা বা সমাধান থেকে আমরা ইশ্বেরের সাকারত্ব বা নিরাকারত্ব নিরুপন করতে পারবো না। যারা সাকারের উপাসনা করেন তারাও বলছেন সাধকের হিতের নিমিত্ত ব্রহ্মার রূপ কল্পনা করা হয়েছে। "সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মণো রূপ কল্পনা "। অর্থাৎ রূপ কল্পনা মাত্র। সত্য নয়। সাধকেরা প্রথম অবস্থায় নিরাকার ব্রহ্ম ধারণা করতে পারে না। তাই ব্রহ্মের রূপ কল্পনা করা হয়েছে। অতএব রূপ কল্পনা মাত্র। আসলে ঈশ্বর নিরাকার।
দেখুন সাকার ভক্তও বলছেন - ভগবান থেকে ভক্ত বড়ো, ভক্ত থেকে নাম বড়ো। অর্থাৎ সাকার ভক্তরাও ধীরে ধীরে নিরাকারের দিকে যাচ্ছেন। ভক্তরা যখন জপ্ করেন তখন দেখবেন - প্রথমে সশব্দে জপ্ করেন, তারপরে শুধু ঠোঁট নেড়ে জপ্ করেন, এর পরে ঠোঁট নাড়াও বন্ধ হয়ে যায়। তখন মনে মনে জপ্ করেন। অর্থাৎ ধীরে ধীরে অন্তরে প্রবেশ করেন। সেই নিরাকারের সাধনায় লিপ্ত হন।তাহলে বোঝা যাচ্ছে ঈশ্বর নিরাকার। আবার দেখুন ঈশ্বর-এর রূপ সম্পর্কে বলা হচ্ছে - ব্রহ্ম চিন্ময়, অপ্রমেয়, নির্গুণ ও অশরীরী। "চিন্ময়স্যাপ্রমেয়স্য নির্গুণস্যাশরীরিণঃ" । অর্থাৎ যারা সাকারের সাধক তারাও বলছেন ঈশ্বর চিন্ময় অর্থাৎ জ্ঞানময়। যিনি জ্ঞানময় তার আবার শরীর হয় নাকি ? তিনি অপ্রমেয় অর্থাৎ যার পরিমান করা যায় না। তো যার পরিমান করা যায় না তাকে কি করে আকার দেবেন ? তিনি নির্গুণ ও অশরীরা। অর্থাৎ তার শরীর নেই . অতএব সাকার বাদীরাই স্বীকার করছেন তার শরীর নেই। সুতারং মহাত্মা গুরুনাথ যে বলছেন ঈশ্বর নিরাকার - সেটাই সত্য।
আমরা এর আগে আলোচনা করেছি স্থুল পদার্থ ধীরে ধীরে সূক্ষ্মে লয় হয়। অর্থাৎ ভূমি জলে লীন হয়। জল তেজ বা অগ্নিতে লীন হয়। তেজ আবার বায়ুতে লীন হয়। বায়ু আবার আকাশে লীন। আকাশ যাতে লীন হয় এবং তাকে যদি আমরা ঈশ্বর বলি তবে বলতেই হয় ঈশ্বর নিরাকার ও অতিসূক্ষ্ম এবং সর্বত্র।
আবার দেখুন ভূমি বা আমাদের পৃথিবী জলের উপরে ভাসছে। জল মৃত্তিকা খণ্ড থেকে তিন গুন্ বড়ো। আমরা সবাই জানি পৃথিবীর ৭৫% জল, কেবল মাত্র ২৫% মাটি। তাহলে মাটি থেকে জলের পরিমান বা আকার বড়ো। তাই তো জলের মধ্যে পৃথিবী ভাসতে পারছে। যদি জলের পরিমান কম হতো তবেতো পৃথিবী নামক মৃত্তিকা খণ্ড ভাসতে পারতো না। আবার জলের আধার হচ্ছে তেজ। তেজের আধার হচ্ছে বায়ু। বায়ুর আধার হচ্ছে আকাশ। আকাশের আধার হচ্ছে ঈশ্বর বা পরমাত্মা।অতএব ঈশ্বর নিরাকার, অসীম। তেজ বা অগ্নি অব্দি আকারে পাওয়া যায়। তারপর
থেকেই অনুভূতিতে যেতে হয়। এই অনুভূতির সূক্ষ্মতম স্তরে ঈশ্বর স্পন্দিত হয়। অতএব ঈশ্বর কখনো সাকার হতে পারেন না।
এইবার মহাত্মা আরো গভীরে প্রবেশ করছেন। ঈশ্বর তো নিরাকার। কিন্তু বহু মহাত্মা তো সাকারের সাধনা করতেন, এবং সিদ্ধ পুরুষ হিসেবে তাদের স্বীকার করা হয়েছে। তারা ঈশ্বরের সাক্ষাৎ করেছেন। কত মহাত্মা যে ঈশরের সান্নিধ্য পেয়েছেন, দর্শন পেয়েছেন সেগুলো কি সব
মিথ্যা ? না তাদের ভ্রম ? জ্ঞানীরা সাকার মানে না। কিন্তু ভক্ত, ঈশ্বর প্রেমিক ? তারাতো সাকারেই ঈশ্বর দর্শন করেন । তবে ? মহাত্মা বলছেন - গুনের মধ্যে ভক্তি ও প্রেম অতি প্রধান। গুণীজনের মধ্যে ভক্ত ও প্রেমিক শ্রেষ্ট। তারা তো সাকার মানেন। তারা তো মিথ্যা বলেন না। মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন তিনি নিরাকার হয়েও সাকার হতে পারেন। কি জ্ঞানী, কি ভক্ত, কি প্রেমিক এঁরা সাবলম্ব্য গুনের পরম উৎকর্ষ লাভ করেন। এবং ঈশ্বরকে নিরীক্ষণ করেন। এ বিষয়ে কোনো মতান্তর নেই। এই ঈশ্বরের দর্শনের সময় ইন্দ্রিয়গণ মনে লীন হয়। মন জীবাত্মায় লীন হয়। জীব স্বীয় প্রভুর কৃপায় তার সাক্ষাৎকার লাভ করে। এই সাক্ষাৎকার এক অনির্বচনীয় দর্শন। সেই অরূপ-রূপ দর্শন যার ভাগ্যে ঘটে, তিনিই তা অনুভব করতে পারেন, কিন্তু বলতে পারেন না। অতএব ঈশ্বরের সর্বাব্যাপিত্ব হেতু তাকে সর্বাবস্থায় সর্বপ্রকারে দর্শন সম্ভব। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এইবার কিন্তু মহাত্মা সাকার ঈশ্বরকে মানলেন। কিন্তু এখানে একটা কথা লক্ষ্য করুন। সাবলম্ব গুনের পরম উৎকর্ষ লাভ করেন। এই সাবলম্ব কথাটার মানে কি ? সাবলম্ব অর্থাৎ স্ব-স্থিত। যে গুনের সাহায্যে মানুষ নিজের মধ্যে প্রবেশ করেন। অর্থাৎ বাহ্যিক জগৎ তার কাছে মিথ্যা বলে প্ৰতিত হয়। সব কিছুকেই এক-এ-স্থিত বলে মনে করেন। তার জগৎ ব্রহ্মময়। ব্রহ্মই জগৎ। নিজেকেও ব্রহ্ম বলে মনে হয়। তোমাকেও ব্রহ্ম বলে মনে হয়। তাকেও ব্রহ্ম বলে মনে হয়। অহম ব্ৰাহাস্মিন - ওং তৎ সৎ - সোহম। এটা সাধনার শেষ পর্যায়। এর পরে আর মানুষ দেহে থাকেন না। দেহ ত্যাগ করেন।
মহাত্মা কিন্তু এবার সতর্ক করছেন। বলছেন কেউ যেন তাই বলে, মনুষ্য রূপধারী রাম, কৃষ্ণ বা বিভিন্ন দেবদেবীকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বলে ভেবে না বসেন । এদের প্রতি শ্রদ্ধা বা ভক্তি, বিশ্বাস থাকা ভালো কিন্তু তাই বলে এদেরকেই ঈশ্বর বা সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর ভাবা মূর্খতা। এবং ঈশ্বরকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা। যিনি সর্বদা সর্বত্র বিদ্যমান আছেন তাকে যে কোনো পদার্থে বা জিবে স্থিত সেটা ভাবতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু সেই পদার্থই সব নয়, বা সেই মানুষ ঈশ্বর নন, বা শেষ কথা নয়, এটা বুঝতে হবে।
এবার একটু অন্য্ কথা বলি। ধ্যানে সাধকেরা তার ইষ্ট বা গুরুদেবের প্রতিচ্ছবি কল্পনা করে ধ্যান করেন। তখন গুরুদেবকে বা তার ইষ্টকে জ্যান্ত বলে মনে হয়। তখন সেই ইষ্টদেবতার সঙ্গে বা গুরুদেবের সঙ্গে কথা বলা যায়।এবং কথা বলেন সাধক। সেই প্রতিচ্ছবিও কথা বলে। আপনারা নিশ্চয় শুনেছেন আমাদের আজ্ঞা চক্র বা তৃতীয় নয়ন বলে একটা কথা আছে। এটি একটি শক্তিশালী বার্তা প্রেরণ কেন্ত্র। বিশ্বাস করতে হবে না, এই বার্তা প্রেরণ কেন্দ্রে নিজের মনকে স্থির করে আপনি যদি কাউকে আদেশ বা নির্দেশ দেন, তবে সে তা পালন করতে বাধ্য হবে। এটা আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। এটি একটি অসাধারন গতিশীল শক্তি। কোনো ব্যক্তির ছবি, বা প্রতিমাকে মনের মধ্যে রেখে, তার ক্ষুদ্র প্রতিমাকে ধ্যানে নিয়ে আজ্ঞা চক্র থেকে যদি ভিজা মাটির মূর্তির উপরে, বা ছবির উপরে নিবিষ্ট করা যায় তবে সেই মাটির মূর্তি আর সাধারণ থাকে না। সেটা আপনার আজ্ঞা দ্বারা সঞ্চারিত চলমান শক্তিতে পরিণত হয়ে যায়। তখন আপনি যা স্নরন করবেন, সেটা গতিশীল হয়ে যাবে। মূর্তিপূজা এই প্রক্রিয়ার গভীর প্রয়োগ । আমি মনে করি, ঈশ্বর তো বিরাট। আর এই সর্বত্র বিরাজমান বিরাটের কাছে পৌঁছেতে আমরা মূর্তির মাধ্যমে যেতে পারি। একটা কথা আছে, যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে এই ভান্ডে অর্থাৎ মানব শরীরে। এবং শুধু তাই আছে না, সেই প্রপোরশনে অর্থাৎ সেই ভাগে আছে। অর্থাৎ জল ৭৫%, আকাশ ____, বায়ু _____ অগ্নি _____ মৃত্তিকা _____ । আপনার মস্তিস্ক আর পরমাত্মার মস্তিষ্কের সঙ্গে একটা সম্পর্ক আছে। এই দুই সন্মন্ধকে যুক্ত করার জন্য একটা সেতু চাই। এই সেতু নির্মিত হতে পারে মূর্তি দিয়ে। কেননা আপনি নিরাকার কিছুর সঙ্গে সোজা সুজি সম্পর্ক স্থাপিত করতে পারবেন না। আপনি আকারে বর্তমান। নিরাকার সম্পর্কে তো আপনার কিছু জানা নেই। তাই যে যাই বলুক না কেন পরমাত্মা নিরাকার, অপ্রকাশিত। সেটা শুধু শুধু কথার কথা হয়ে যাবে আপনার কাছে। আপনার অনুভবের মধ্যে কিন্তু আসবে না। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে যত অনুভব আছে, সেগুলোর সাবি আকৃতির অনুভব। রূপের অনুভব। আমাদের কারুর মধ্যে নিরাকারের একটাও অনুভব নেই। কারুর কথা ভাবা মানে তার রূপের কথা। অবয়বের কথা। তার সূক্ষ্ম গুনের কথাতেও আমরা রূপ কল্পনা করি। আর যার সন্মন্ধে কোনো ধারণা নেই তার সম্পর্কে কোনো শব্দ আপনাকে তার স্মরণ করাতে পারবে না। তাই আপনি নিরাকারের কথা বলতে থাকবেন আর সাকারের মধ্যে বাস করবেন। যদি সত্যি সত্যি আপনি নিরাকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চান তবে আপনাকে এমন একটি মূর্তি নির্মাণ করতে হবে যার একদিকে সাকার আর এক দিকে নিরাকার। ইটা একটা অসম্ভব রহস্যময় মূর্তি হবে। একটু ভাবুন, আমরা যেখানে রয়েছি, সেখানে তার সীমা প্রকাশিত। আর অন্যদিকে পরমাত্মা যেখানে আছেন সেটা সীমাহীন অপ্রকাশিত। তাই মূর্তিকে দুটো কাজ করতে হবে আমরা যেখানে সেখানে সে প্রকাশিত হবে, আর পরমাত্মা যেখানে আছেন সেখানে নিরাকারের মধ্যে হারিয়ে যাবে। এই ধরনের কথা হয়তো কখনো শোনেননি।
একটা কথা শুনুন যে ব্যক্তি পূজা করে, সে ওই মাটির মূর্তিকে পূজা করে না। সে ওই ছবিকে পূজা করে না। সে পূজা করে ওই ছবির মধ্যে তার পিতাকে, মাতাকে, গুরুকে । দেবতাকে। ইষ্টকে। পরমাত্মাকে। মূর্তির কখনো পূজা হয় না। মূর্তির মধ্যে আমি যাকে দেখতে চাই তার পূজা করা হয়। আর যার কাছে মূর্তি দৃশ্যমান, সে কখনো পূজা শেখেনি, সে পূজা করে না। তার পূজা সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। পূজা আর মূর্তি দুটো আলাদা কথা। পূজা মূর্তির হয় না, পূজা হয় ভাবনার। যে পূজা করে, সে কখনো মূর্তি দেখতে পায় না। যে মূর্তি দেখতে পায়, সে কখনো পূজা করে না। পূজা মূর্তিকে মুছে ফেলার কৌশল। আমরা তো আকৃতি সম্পন্ন, সেই আকৃতিকে মুছে ফেলার কৌশলই পূজা।দেহাতীত হয়ে যাওয়াই পূজা। পূজায় দৃশ্যমান আকৃতি, আকৃতিবিহীন হয়ে যায়। তবেই পূজা সম্পন্ন হয়। প্রকাশিত অংশে পূজা আরম্ভ হয়, অপ্রকাশিতে পূজা সম্পন্ন হয়। পূজা সাধককে গ্রাস করে নেয়। যারা পূজা করেনি তারা ভাবে পাথর রেখে কি হবে ? আর যারা পূজা করেছে তাদের পাথর হারিয়ে যায়, সীমা হারিয়ে যায়, অসীমে প্রবেশ করে আর তখন পরমাত্মা প্রকট হয়ে যায়।
ভগবান শ্রীচৈতন্য যখন দুহাত তুলে কৃষ্ণনাম করে, মিরা যখন পূজার ছলে নাচ করে, মতুয়ারা যখন হরিবোল হরিবোল করে তখন তারা নিজেরা পূজার মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। এদের জন্য সেখানে কোনো মূর্তির অস্তিত্ব থাকে না। পূজা শুরু হলে মূর্তি বিলীন হয়ে যায়। মূর্তি তো প্রারম্ভ মাত্র। আমরা যারা পূজার কিছু বুঝি না, তারা মূর্তি দেখতে পাই। তাই আমার মনে হয় - সত্যিকারের পূজা যত কমতে থাকবে, মূর্তি তত বাড়তে থাকে, পূজা শুরু হলে মূর্তি অন্তর্হিত হবে।
মূর্তি তো পরমাত্মাকে দেখবার জানলা মাত্র। আমি দেহের মধ্যে থেকে পরমাত্মাকে দেখতে চাই। আমার তো দেহ আছে। অর্থাৎ আমি আকৃতি সম্পন্ন। তো জালনা ও তো আকৃতি সম্পন্ন হবে , কিন্তু জানলা খুলে যখন আকাশের দিকে তাকাবো তখন নিরাকারের মধ্যে প্রবেশ করবো। এই দেহের মধ্যে জানলা আছে, সেটাকে খুলতে হবে। আকাশকে দেখতে হবে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে জানলা ছোট্ট। কিন্তু আকাশ তো বড়ো। কিন্তু ছোট্ট জানলা দিয়েইতো বড়ো আকাশকে দেখা যায়। এটা বোঝানো কঠিন কিন্তু সত্যি। যে জানলা কখনো খোলেনি, যুক্তি দিয়ে তাকে বোঝানো কঠিন হবে যে বৃহৎ আকাশকে, আয়তনে ছোট্ট জানলা দিয়েও দেখা যায়। মূর্তি পূজা এই জানলা খোলার প্রক্রিয়া। আপনি মন্দিরের কাছে যেতে পারেন। মূর্তির কাছে যেতে পারেন। কিন্তু পূজার কাছে যেতে পারেন না। কতকগুলো বিষয় আছে যার অভিব্যক্তি সম্ভব নয়। এগুলো অন্তরের ব্যাপার। আন্তরিক বস্তু প্রদর্শন সম্ভব নয়।
সাকার নিরাকার দুটি পৃথক নয়। একটি ওপারের সঙ্গে সংযুক্ত। যাকে আমরা সাকার বলি সেটা নিরাকারের অংশ। আবার যাকে আমরা নিরাকার বলি সেটিও সাকারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আমরা সাকারে আছি। আমার দেহ সাকার। আমরা সম্পর্ক গড়ি সাকারের সঙ্গে। এই সত্য তো অস্বীকার করলে চলবে না যে আমরা সাকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। আর আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমাদের সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে হবে। যেখানে আমাদের যাওয়া উচিত, সেখান থেকে যাত্রা শুরু করা যায় না। যেখানে আছি সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে হয়। যেখানে আমরা নেই সেখান থেকে যাত্রা শুরু করা যায় না। আমরা যা কিছু জেনেছি আকারের মধ্যেই জেনেছি। আমরা প্রেম করেছি - আকারে। আমরা রাগ করেছি আকারে। আমরা ঘৃণা করেছি আকারে। আসক্ত হয়েছি তাও আকারে। বন্ধুত্ব করেছি আকারে। শত্রূতা করেছি তাও আকারে। ঈশ্বরের নিরাকারত্ব যেমন সত্য। আমাদের আকারত্ব তেমনি সত্য। আমাদের মন যখন কিছু ধরে রাখে সেটা আকারেই ধরে রাখে।
তাই মহাত্মা গুরুদেবকে যখন আমরা স্মরণ করি তখন তার আকারের কথাই আমাদের চোখে ভাসে। আর এই জন্য নিরাকারের দিকে যদি যাত্রার জন্য যখন আমাদের বেরোতে হয়, তবে আমাদের নিরাকারের জন্য আকার সৃষ্টি করতে হবে।
৫. ঈশ্বরের স্বরূপ কী ?
মহাত্মা গুরুনাথ তার চতুর্থ প্রশ্ন অর্থাৎ ঈশ্বর সগুন কি নির্গুণ এই আলোচনায় যাবার আগে পঞ্চম প্রশ্ন ঈশ্বরের স্বরূপ কী এই নিয়ে আলোচনা করছেন। আমরাও সেই পথেই যাবো। এখানেও মহাত্মা গুরুনাথ প্রথমেই বলছেন : এই প্রশ্নের উত্তরদান বড়ই সুকঠিন এমনকি অসাধ্য বললেও অত্যুক্তি হয় না। তিনি অনির্বচনীয়। যা অনির্বচনীয়, তাকে বচন দিয়ে কিভাবে প্রকাশ করা যাবে ? সুতরাং মহাত্মা নিজেই বলছেন : "আমি যা বলবো তাও সম্পূর্ণ হতে পারবে না। যিনি ঈশ্বর দর্শন লাভ করেছেন তিনিই জানেন ঈশ্বর কিরূপ !" তাই মহাত্মা গুরুনাথ এই মহৎ কার্যে অনন্ত মঙ্গলময় জগদীশ্বরের করুনা এবং মহাত্মাদিগের সাহায্য প্রার্থনা করছেন।
মানুষের জীবনে যা কিছু শ্রেষ্ট, সুন্দর,সত্য তাকে জানা যেতে পারে, অনুভব করা যেতে পারে, কিন্তু ব্যাখ্যা করে বলা বা বোঝানো শক্ত। শুধু শক্ত নয় অসম্ভব। মাছ, যার জন্ম, জীবন, মৃত্যু সবই জলের মধ্যে তাকে যদি জিগ্যেস করা হয় জল কি, তবে তার পক্ষে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব হবে। আমরা প্রেম করি, প্রেমের গান গাই, প্রেম খুঁজে কাউকে দিতে পারি না। তেমনি আমরা সবাই ঈশ্বরের মধ্যে জন্মাই , বেঁচে থাকি, আবার মরেও যাই। কিন্তু ঈশ্বরকে বুঝিও না। বোঝাতেও পারি না।
মহাত্মা গুরুনাথ এই অসম্ভব কাজে হাত দিয়েছেন। তাই প্রথমেই সংশয় প্রকাশ করছেন। তিনি বলছেন, বায়ুর কিছু গুন্ আছে। এখন আপনার ঘরে বায়ু আছে কি না সেটা জানবার জন্য যদি গুন্ গুলোর সন্ধান করি, এবং বায়ুর সব গুনের সন্ধান পাই তবে বলতে পারি, আপনার ঘরে বায়ু আছে। আর যদি তা না পাই তবে বলতে পারি আপনার ঘরে বায়ু নেই। এখন বায়ুর গুন্ যদি অসীম হয় তাকে বোঝা মুশকিল হবে।
আবার আমরা জানি, চারটে আশ্রম : ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য , বানপ্রস্থ, সন্যাস। এখন কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয় তুমি কোন আশ্ৰমী ? তিনি সোজাসুজি বলতে পারেন আমি গৃহস্থ-আশ্রমী . আবার এও বলতে পারেন আমি ব্রহ্মচারী নোই,বা বানপ্রস্থে নেই, আবার সন্যাস-আশ্রমে নেই। তাহলেও আমরা বুঝতে পারি ভদ্রলোক গৃহী। এখন আশ্রমের সংখ্যা যদি অসংখ্য হয় তবে তাকে বোঝা মুশকিল হবে।
তাই ঈশ্বর যেহেতু অসীম গুনের অধিকারী, তাই তাকে নির্দিষ্ট গুনের পরীক্ষায় বোঝা যাবে না। আবার তিনি যেহেতু অসীম, সর্বত্র তাই তাকে কোথাও নেই এটা বলা যাবে না।
তাহলো কোন পথে তাকে বুঝবো ? তাই, মহাত্মা গুরুনাথ সাধন কার্যে যখন হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থান করছিলেন, সেখানে এক মহাত্মার কাছে যা শুনেছিলেন তাই বলছেন : " ঈশ্বর নিরাকার, চৈতন্যস্বরূপ। এরূপ বললে ঈশ্বর সন্মন্ধে কিছুই বোঝা না। যার আকার নেই, তাতো বুঝলাম কিন্তু কি আছে সেটা তো বুঝলাম না ? তার চৈতন্য আছে অর্থাৎ জ্ঞান আছে। জ্ঞানের আকার নেই সত্য কিন্তু জ্ঞান যার মধ্যে আছে তার তো আকার আছে। তবে কি ঈশ্বর সাকার এটা স্বীকার করতেই
হয় ?
হিমালয়ের সেই মহাত্মা বলছেন : এই দৃশ্যমান জগতের প্রতি বা তার অংশের প্রতি দৃষ্টিপাত করো অর্থাৎ যা দেখা যায়, শোনা যায়, স্পর্শ করা যায় সবই কতকগুলো গুনের সমষ্টি মাত্র। ধরো এক টুকরো কাগজ - তার শুভ্রত্ব, তার আয়তন, তার আকৃতি, তার কাঠিন্য, এই সব গুনের সমষ্টিই হচ্ছে কাগজ। ঈশ্বর হচ্ছে অনন্ত গুনের সমষ্টি মাত্র। এই আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী সকল-ই কেবল গুনের সমষ্টি মাত্র। গুন্ ব্যতীত দ্রব্যের অস্তিত্ব থাকে না। সমস্ত দ্রব্য-ই গুনের সমষ্টি মাত্র, বা গুনের প্রকাশক মাত্র। কি পদার্থ, কি আত্মা সকলই কেবল গুন্ সমষ্টি। কি স্রষ্টা, কি সৃষ্টি সবই গুনের সমষ্টি। সকলই গুণময়। অতএব জগদীশ্বর অনন্ত গুনের সমাহার। অনন্ত গুনাগুনের সমাহারেই ঈশ্বর। যিনি নির্বিদিত বা নির্বেদ্য অর্থাৎ অজ্ঞাত বা অজ্ঞেয় গুন্ যার তিনিই নির্গুণ-ঈশ্বর। যার গুণরাশি এ পর্যন্ত অবধার্য্য হয় নাই তিনিই নির্গুণ। অতএব ঈশ্বর অনন্ত অনন্ত অনন্ত গুণময়। এবং গুনের সাধনাই জগদীশ্বরের সাধনা। মহাত্মা গুরুনাথ তাই গুনের সাধনাকেই ঈশ্বরের সাধনা বলছেন।
এবার মহাত্মা গুরুনাথ কয়েকটা মৌলিক প্রশ্নের উপর পরম-ঈশ্বরের স্বরূপ নির্নয় করছেন। প্রশ্নগুলো হলো :
তিনি সুখ স্বরূপ কি দুঃখ স্বরূপ ?
তিনি ধৰ্ম স্বরূপ কি অধর্ম স্বরূপ ?
তিনি চৈতন্য স্বরূপ কি অচেতনস্বরূপ ?
তিনি পুরুষ স্বরূপ কি রমণী স্বরূপ ?
তিনি প্রকৃতি কি পুরুষ ?
পরম আত্মার গুন্ যেমন অনন্ত, সেই অরূপের রূপও অনন্ত। তাকে পূর্ণ ভাবে দর্শন করা সম্ভব নয়।সুখ দুঃখের একত্বই ঈশ্বরের স্বরূপ। তিনি ধৰ্ম অধর্ম উভয়ের একত্ব মিশ্রণ। তিনি চেতন অচেতন উভয়ের অনন্ত মিশ্রণ। তিনি না রমণী না প্রকৃতি না পুরুষ। তিনি অনন্ত প্রকৃতি-পুরুষাত্বক। অর্থাৎ অনন্ত একত্বই ঈশ্বর।
এবার একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। একটা ছোট্ট গ্রামে একটা ছোট্ট স্কুল। সেখানে পণ্ডিত মশাই ক্লাসে রামায়ন পড়াচ্ছেন। ছেলেগুলো অন্যমনস্ক। কেউ কেউ ঝিমোচ্ছে। পণ্ডিতমশায়ও বোধকরি ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে পড়াচ্ছেন। আসলে পণ্ডিত মাশয়ের সব মুখস্ত। সামনে বই খোলা ছিল। কিন্তু তার বই দেখার কোনো দরকার ছিল না। সে সবই জানতো। তাই টেপ রেকর্ডের মতো, যন্ত্রের মতো সে বলে যাচ্ছিল। ওই মুহূর্তে সে জানেই না সে কি বলছে। তোতা পাখির মতো বলে যাচ্ছে। যারা মুখস্ত শব্দ বলে তারা জানেই না সে কি বলছে। হঠাৎ ক্লাসের সবাই তটস্থ হয়ে পড়লো। স্কুল ইন্সপেক্টর আসছেন। ইন্সপেক্টর ক্লাসের ভিতরে ঘুকলেন। ছাত্ররা সতর্ক হয়ে বসলো। পণ্ডিত মহাশয়ের ঝিমুনি কেটে গেল। খানিকটা বিরক্তি, খানিকটা সাবধানতা। ইন্সপেক্টর এসে জিজ্ঞেস করলেন - কি পড়াচ্ছেন ? পণ্ডিত মশায় বললেন - এই রামায়ন আর কি। বাঃ - তো রামায়ন থেকে একটা প্রশ্ন করি।
তো রামায়ন থেকে একটা সহজ ছোট্ট প্রশ্ন করলেন। "তোমরা কি বলতে পারো, শিবের ধনুক - হরধনু কে ভেঙে ছিল ? কেউ কিছু বলার আগেই একজন ছাত্র দাঁড়িয়ে উঠে বললো। ক্ষমা করবেন স্যার - আমি জানি সবাই বলবে আমি ভেঙেছি। আমি কিন্তু স্যার গত পনেরো দিন স্কুলে আসিনি। আর শিবের ধনুক আমি দেখিওনি, ভাঙিও নি। আমাকে যেন কেউ দোষী না করে। যখনি স্কুলে কিছু ভাঙে আমাকেই দোষী করা হয়। ইন্সপেক্টর তো অবাক। উনিতো ভাবতেও পারছেন না - এই রকম কেউ বলতে পারে। তিনি শিক্ষকের দিকে তাকালেন। পণ্ডিত মশায় - হাতে বেত তুলে নিলেন। টেবিলের উপরে দু ঘা মেরে বললেন - নিশ্চয় ও ভেঙেছে । এটা ওর বরাবরের অভ্যাস। বললেন - যদি তুই না ভেঙে থাকিস তবে তুই কেন বললি যে আমি ভাঙিনি ? ইন্সপেক্টর তো থ। ছাত্রের অবস্থা তো বটেই, মাস্টারের জ্ঞানের দৌড়ও বুঝে গেলেন। ক্লাস থেকে বেরিয়ে প্রধান শিক্ষকের ঘরে গেলেন।
প্রধান শিক্ষক সমস্ত ঘটনা শুনে বললেন - আপনি কিছু ভাববেন না। ও ব্যাটাই ভেঙেছে। কিন্তু আপনি কিছু বলতে যাবেন না। তাহলে বিপদ হবে। প্রায় দু মাস শান্তিপূর্ণ ভাবে স্কুল চলছে। আপনি আর অশান্তি ডেকে আনবেন না। কাউকে কিছু বলার দরকার নাই। আমি ঠিক করে দেব। যেই ভাঙুক আমি ঠিক করে দেবো। কাউকে কিছু বলার দরকার নাই। ইন্সপেক্টরের এবার হতবম্ব হবার অবস্থা। যেই ভাঙুক উনি ঠিক করে দেবেন , কি ঠিক করে দেবেন ? কথা না বাড়িয়ে উনি সেক্রেটারির কাছে গেলেন। সব শোনার পরে সেক্রেটারি - গম্ভীর হয়ে গেলেন। বোবা হয়ে গেলেন। কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলেন না। তার বাকশক্তি হারিয়ে গেছে।
গুরুদেব বলছেন ঈশ্বর অনির্বচনীয়। বাক্য দিয়ে না যায় বোঝা, না যায় বোঝানো। ঈশ্বরকে বুঝলে মানুষ বোবা হয়ে যায়। ভাষা হারিয়ে যায়। ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ।
৪. ঈশ্বর সগুন কি নির্গুণ ?
এতক্ষন আমরা ঈশ্বরের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সেখানে আমরা ঈশ্বরের অসীম অনন্ত গুনের কথা বলেছিলাম। নির্গুণ মানে এই নয় যে যার কোনো গুন্ নেই। নির্গুণ বললে গুণহীন বোঝায় না। তার গুন্ আমাদের ধারণার অতীত। ব্রহ্ম সগুন আবার নির্গুণ। সগুন ও নির্গুণ বলে দুটি ব্রহ্ম নেই। ব্রহ্ম যখন চলমান তখন সগুন অর্থাৎ গুনের প্রকাশ। যখন নিশ্চল তখন গুনের অপ্রকাশ। তিনিই গতিহীন আবার তিনিই স্থির। তাই তিনিই সগুন আবার তিনিই নির্গুণ। তিনিই প্রকাশ রূপে এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড, আবার তিনিই সুপ্ত সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। মহাত্মা গুরুনাথ একটা সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন - ভারতবাসী যখন হিমালয় দেখেন তখন উত্তর দিকে দেখেন। আবার তিব্বতবাসী যখন হিমালয় দেখেন তখন দক্ষিণ দিকে দেখেন। যার ভূগোল জ্ঞান আছে তিনি বুঝবেন দুটোই সত্য। যার ভূগোল জ্ঞান নেই তার কাছে যে কোনো একটি মিথ্যা। জ্ঞান হলে এই ভ্রম দূর হবে। ঈশ্বর সগুন আবার নির্গুণ। যারা সগুনের অর্থাৎ নির্দিষ্ট গুনের উপাসনা করে তারা খন্ডের উপাসনা করে। যারা নির্গুণের উপাসনা করে তারা পূর্ণের উপাসনা করে। যে যেমন গুনের উপাসনা করে, সে তেমনি ফল পায়।
"তং যথা যথোপাসতে, তদেব ভবতি"
পরমাত্মাকে যেমন যেমন উপাসনা করে, তদ্রুপ-ই হয়।
মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন গুন্-উপাসনা অনুসারেই যখন ফল হয় তখন ব্রহ্মজ্ঞান বিকাশের পূর্ব অব্দি সগুনের উপাসনাই করা উচিত। ব্রহ্ম জ্ঞান হলে নির্গুণের উপাসনা করা কর্তব্য। ধর্মক্ষেত্রে প্রবেশার্থীর অর্থাৎ প্রথম প্রথম সগুন উপাসনা করা উচিত এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
এবার আমরা এই প্রসঙ্গে একটু শ্রীমৎ ভগবৎ গীতার কিছু প্রাসঙ্গিক কথা একটু আলোচনা করবো।
গীতায় অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রশ্ন করছে :
এবং সততযুক্তা যে ভক্তাঃ ত্বাং পর্যা-উপাসতে
যে চ অপি অক্ষরম-অব্যক্তং তেষাং কে যোগবিত্তমা।
অর্থাৎ যে ভক্ত তোমাতে সততযুক্ত হয়ে তোমার (রূপের) উপাসনা করে আর যারা তোমার অব্যক্ত অক্ষর রূপের সাধনা করে, তাদের মধ্যে শ্রেষ্ট যোগবিদ কে ?
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার উত্তরে বলছেন :
ময়ি-আবেশ্যমান যে মাং নীতিযুক্ত উপাসতে
শ্রদ্ধয়া পরয়া-উপেতা-অস্তে মে যুক্ততমা মতাঃ।
যারা আমাতে মন নিবিষ্ট করে, আমাতে নীতিযুক্ত হয়ে আমার উপাসনা করে, আমার মতে তারাই শ্রেষ্ট।
শুনলে মনে হয়, এতো অহংকারের কথা। এ কথা হয় বোকা বলতে পারেন নতুবা বুদ্ধ বলতে পারেন।ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আগেই বলেছেন ঈশ্বর অব্যক্ত। এই অব্যক্ত ঈশ্বরের কথা পুরাতন ব্রহ্মবিদগণ, বেদবিদগণ বলে গেছেন। তো যারা অব্যক্ত পরম-ঈশ্বরের সাধনা করছে, তাদের থেকে তোমার এই মনুষ্যরূপী শ্রীকৃষ্ণের সাধনা করা, কি করে শ্রেষ্ট হয়। তাছাড়া এই শ্রীকৃষ্ণের জন্মের আগেও ঈশ্বর ছিলেন, এবং তার উপাসক-ও ছিলেন , তবে তারা সবাই নিকৃষ্ট সাধনা করে ছিল ? আর শ্রীকৃষ্ণের আমলেও তো শ্রীকৃষ্ণের পূজা হতো না। কেউ কেউ হয়তো তাকে ভগবানের অবতার বলে স্বীকার করতো। কিনতু তখনও শ্রীকৃষ্ণকে ঘিরে সাধন পদ্ধতির উদ্ভব হয় নি। তাহলে শ্রীকৃষ্ণ এসব কি বলছেন ?
এইখানেই গীতার সংযোজন। এর আগে বেদ-নির্দিষ্ট পথে সাধন হতো। বেদে কর্মকাণ্ড অর্থাৎ জাগযজ্ঞ করবার পদ্ধতি ছিল। আর ছিল জ্ঞান কাণ্ড, অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা। চিত্ত-নিরোধের পদ্ধতি যা পতঞ্জলি প্রবর্তন করেছেন - আশ্রমীদের এই চিত্তনিরোধের পদ্ধতি বা অষ্টাঙ্গ যোগ করতে দেখা গেছে।
শ্রীকৃষ্ণ এসে জ্ঞানযোগের সঙ্গে যোগ করলেন নিষ্কাম কর্মযোগ।
এখন সাধন পদ্ধতি দুই প্রকার - দ্বৈতবাদ আর অদ্বৈতবাদ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই দ্বৈতবাদের আবিস্কারক। শ্রীকৃষ্ণ একদিকে বলছেন ঈশ্বর অব্যক্ত, আবার বলছেন : যারা আমাতে মন নিবিষ্ট করে,আমাতে নিত্যযুক্ত হয়ে ঐকান্তিক ভক্তি সহকারে আমার উপাসনা করে, তারাই শ্রেষ্ট। এখন কেন শ্রেষ্ট ? প্রশ্ন এখানেই। আর একটা প্রশ্ন শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে ভগবান বলছেন, এটা কি তার অহমিকা নয় ? নিজেকে জাহির করা নয় ? তিনি যদি ভগবান হন তবে তার কর্মেই আমরা তার ভগবানত্ব বুঝবো বা দর্শন করবো। নিজেকে কেন বলতে হবে আমি ভগবান, আমার পূজা করো। এর থেকে আমরা কি শিখবো ? আমরা কি নিজের ঢাক নিজে পেটাতে শিখবো না ?
এই প্রসঙ্গে আমি দুটো উদাহরণ দেই। এক : স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজ, ভারত সেবাশ্রম এর প্রতিষ্ঠাতা। ইনি একটা সময়ে, তার শিষ্যদের কাছ থেকে আক্ষরিক অর্থে পূজা গ্রহণ করতেন। স্বামীজী আসনে বসতেন, ভক্তরা তাকে মালা পড়াতেন, ভোগ দিতেন, ফুল, বেলপাতা , ধুপ, প্রদীপ দিয়ে তার পূজা করতেন, আরতি করতেন। প্রণবানন্দজি নিজেকে শিব ভাবতেন। আর শিষ্যদের বলতেন পূজা করতে। এখন, তার সমবয়সী যে সব সন্যাসী, যারা তার মানবসেবা কর্মের সহযোগী ছিলেন, তাদের কাছে এটা অশোভন লাগতে লাগলো। তারা একদিন, একথা স্বামী প্রনাবনান্দকে বললেন। প্রণবানন্দ তাদের বলে ছিলেন : দেখো, মা বাবাকে যদি পূজা করা যায়, তবে আমার পূজায় দোষ কোথায় ? আমি যেটা বলতে চাইছি - মহাপুরুষরা নিজের পূজার প্রচলন নিজেরাই করেছেন। পূজা পাবার জন্য অনেক দেবতা, নানান ভাবে ভক্তদের বিড়ম্বনায় ফেলতো, এমন গল্পতো বহু আছে।
আর ঠাকুর রামকৃষ্ণ নিজেকে অবতার বলে প্রচারের ভাগিদার ছিলেন। ভৈরবী যজ্ঞেশ্বরী যখন তাকে অবতার বলে প্রচার করতে চেয়েছিলো, এবং পান্ডিত্সভা ডাকবার জন্য বলছিলেন। তখন ঠাকুর রামকৃষ্ণই মাথুরবাবুকে এই পান্ডিত্সভা ডাকবার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা। তাহলে এও তো এক প্রকার নিজেকে ভগবানের অবতার বলে প্রচার করা , এবং সেটা নিজে থেকেই করা। আসলে ভগবানকে আমরা তো চিনি না। তাই ভগবানরাও নিজেকে ভগবান বলে প্রচার করে। আবার ভন্ডরাও নিজেকে ভগবান বলে প্রচার করে। কালের গতিতে ভগবান বেঁচে থাকে, ভন্ডরা হারিয়ে যায়। শ্রীকৃষ্ণের আমলেও দ্বিতীয় বাসুদেব ছিল পৌন্ড্র। ইনি আসামের দিকে কোনো রাজ্যের রাজা ছিলেন, তার কাকার পুত্রের নাম ছিল বলরাম। তার সুদর্শন চক্র ছিল। নিজেকে বাসুদেব বলে প্রচার করতেন। অতএব শ্রীকৃষ্ণ একা নিজেকে ভগবান বললেন, বা নিজের প্রচার নিজেই করেছেন এমন নয়। এইরকম প্রচার আকছার এখনো হচ্ছে। আগেও হয়েছে। যাই হোক এখন আমরা অদ্বৈত বাদ সম্পর্কে আলোচনা করবো।
যারা অদ্বৈতবাদের সাধনা করেন,অর্থাৎ নিরাকারের সাধনা করেন তারা নিজেরা জানেন এটি একটি সময়সাপেক্ষ, এমনকি জন্ম জন্মান্তর লেগে যেতে পারে, এই উপলব্ধিবোধের চূড়ান্তে পৌঁছাতে। এছাড়া ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষ আর তথাকথিত পাগলের মধ্যে প্রায়শই কোনো পার্থক্য থাকে না। একজন চৈতন্যবান পুরুষ আর একজন চৈতন্যহীন। যার জন্য ঠাকুর রামকৃষ্ণের মতো ব্রহ্মজ্ঞানীকে তখনকার অনেক পণ্ডিত পাগল বলতো। যার যেমন জ্ঞানের বহর আর কি ? তবুতো রামকৃষ্ণ দ্বৈত - অদ্বৈত দুরকম সাধনা করেছিলেন।
মহর্ষি অষ্টাবক্র মুনি তার সংহিতায় ব্রহ্মজ্ঞানী সম্পর্কে এক জায়গায় বলছেন :
মহর্ষি অষ্টাবক্র মুনি তার সংহিতায় ব্রহ্মজ্ঞানী সম্পর্কে এক জায়গায় বলছেন :
নির্বাসন নিরালম্বঃ স্বচ্ছন্দো মুক্তবন্ধনঃ।
ক্ষিপ্তঃ সংস্কারবাতেন চেষ্টতে শুস্কপর্নবৎ।।
অর্থাৎ বাসনারাহীত, কর্তব্যবুদ্ধিবিহীন, রাগদ্বেষের অনধীন বন্ধনহেতু অজ্ঞানশূন্য জ্ঞানী প্রারবদ্ধকর্মরুপ বায়ুদ্বারা প্রেরিত হয়ে পবন-সঞ্চালিত শুস্কপত্রের ন্যায় কর্ম প্রচেষ্টা করে থাকেন।
তাহলে ভাবুন তো এই ব্রহ্মজ্ঞানী কেমন আছেন। ব্রহ্মবিদ তো জড়বৎ। না আছে দুঃখ না আছে আনন্দ। না আছে কর্তব্যকর্ম। না আছে দ্বেষ, না আছে রাগ, না আছে মমতা, না আছে স্নেহ। উনি কাঁদেন না, হাসেন না। অথবা ওনার হাঁসা-কাঁদার সাধারণ মানুষ কি বোঝে ? ওনার থাকা না থাকা সমান। উনি স্ব -স্বরূপে স্থিত।
তাহলে ব্রহ্মজ্ঞানী হতে সময় লাগে, আর তার পরে যা হয় তা আর কোনো কম্মে লাগে না। তাহলে অদ্বৈতপথে এই ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে কি লাভ ? যার দেহ জ্ঞান থাকে না।
আর ভক্তিযোগের সাধনার ফল আলোচনার আগে আমরা সাকার সাধনা আর নিরাকার সাধনার পার্থক্যটা একবার আমরা বুঝে নেই।
ঈশ্বর নিরাকার, নির্গুণ, অব্যক্ত, অব্যয়, সর্বত্র। কয়েকজন লোক নির্বাক হয়ে আকাশ দেখছে। কেউ আকাশে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কেউ আকাশের নীল বর্ণ দেখছে। কেউ আকাশের ক্ষনে ক্ষনে পরিবর্তিত মেঘ দেখছে। কেউ সে মেঘের মধ্যে শিবের মূর্তি দেখছে, কেউ শিব লিঙ্গ দেখছে, কেউ ইস্ট মূর্তি দেখছে, কেউ হাতি দেখছে। আবার কেউ কিছুই দেখছে না, শুধুই মেঘ দেখছে, আর সে বিরক্ত হচ্ছে। যে মেঘ দেখছে, সে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছে। যে ইষ্টমূর্তি দেখছে সে আনন্দে আত্মহারা হচ্ছে। আপনি কি বিরক্ত হতে চান ? ধৈর্য্য হারাতে চান ? নাকি আনন্দ পেতে চান ? আনন্দ আকারেই দিতে পারে। নিরাকারে আনন্দ দুর্লভ।
ঈশ্বরকে কি দেখা যায় ? কিভাবে দেখা যায় ? ঈশ্বর কি আকার নেয় ?
ঈশ্বরকে অবশ্যই দেখা যায়। কিভাবে ঈশ্বরকে দেখা যায় না, সেটা আগে ভাবুন। তবেই ঈশ্বরকে দেখতে পারবেন। ঈশ্বরকে না দেখার কোনো উপায় নেই। বরং ঈশ্বরকে দেখতে না পারাটাই আশ্চর্য্য। ঈশ্বর অবশ্যই আকার নেন। আপনি যেমন তাকে দেখতে চান, তেমন ভাবেই তিনি আপনাকে দেখা দেবেন। আপনি দেখছেন কিনতু সনাক্ত করতে পারছেন না। তাই ভাবছেন আমি দেখতে পারছি না। আসলে ঈশ্বর আপনি, আপনার ভিতর, বাহির, সর্বত্র যা কিছু দেখছেন সবই ঈশ্বর। তবে আমি দেখছি না, এটা কত বড়ো ভুল, বুঝতে পারছেন ? ঈশ্বর-সমুদ্রের মধ্যে বুদ্-বুদ্ আমি। এখানেই জন্ম, এখানেই লয়। মানুষের শরীরের মধ্যে যেমন অসংখ্য কোষ, আমিও তেমনি ঈশ্বরের বিরাট শরীরের কোষ মাত্র। শরীরেই জন্ম, শরীরেই মৃত্যু। যতদিন বাঁচি, ঈশ্বর থেকেই খাদ্য সংগ্রহ করি, বা ঈশ্বরই খাদ্য যোগায়। এক সময় ঈশ্বরেই লয় প্রাপ্ত হই। আমি বা অহং বলে কিছু নেই। এগুলো মন-বুদ্ধির খেলা। মন বুদ্ধির ওপারে আমি বলে কিছু থাকে না।
নিরাকারই সাকার হয়। আবার সাকার থেকে নিরাকার। জলের তিন রকম অবস্থা। বায়বীয়, তরল, কঠিন। তাপমাত্রার তারতম্যে এই প্রকারভেদ। বায়বীয় জল সর্বত্র। তরল জল নদী, নালা, পুকুরে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পৃথিবীর মধ্যেও পাওয়া যায়। কঠিন জল আমরা বরফের আকারে দেখতে পাই। বায়বীয় জল আমাদের ভোগ্য বস্তু নয়। কঠিন জলের আইচক্রীম খাই, তরল জলে তৃষ্ণা মেটাই। বায়বীয় জলে আমাদের তৃষ্ণা মেটায় না। বাহ্যিক কোনো কাজ বায়বীয় জলে আমাদের হয় না। অর্থাৎ নিরাকারে আমরা আনন্দ পাই না। কোনো কাজে লাগে না। তৃষ্ণা পেলে, হা করে থাকলে বায়বীয় জল, আপনার তৃষ্ণা মেটাবে ? তাহলে বায়বীয় জল সত্য কিনতু আনন্দ দেয় না। তাই ঈশ্বর সাধনায় যদি আনন্দ পেতে চান তবে সাকারের সাধনা করুন।
নিরাকারের শক্তি সাকারের মধ্যেই প্রকাশ পায়। আকাশের একটা গুন্ - শব্দ, বাতাসের দুটো গুন্ - শব্দ, স্পর্শ। আগুনের তিনটি গুন্ শব্দ, স্পর্শ, রূপ। জলের চারটি গুন্ -শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস। মাটির পাঁচটা গুন্ - শব্দ, স্পর্শ, রূপ,রস, গন্ধ। তাহলে দেখতে পাচ্ছেন, নিরাকার থেকে সাকারের দিকে যত যাচ্ছে তত তার গুন্ বেড়ে যাচ্ছে। এবং আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো এই গুন্ গুলো থেকেই জ্ঞান সংগ্রহ করছে। কান দিয়ে আমরা শব্দ শুনছি। চোখ দিয়ে আমরা রূপ দেখছি। নাক দিয়ে আমরা গন্ধ শুঁকছি। মুখ দিয়ে আমরা রসের আস্বাদন করছি। ত্বক দিয়ে আমরা স্পর্শ করছি। এ সবই আমাদের সুখ ও দুঃখের আস্বাদন করাচ্ছে। এ থেকেই আমরা সুখ দুঃখের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছি আমাদের অজ্ঞাতসারে। দৈহিক সুখ দুঃখের কারন এই ইন্দ্রিয়গুলো। তাই মহাপুরুষগন বলছেন, ইন্দ্রিয়গুলোকে সংযমী করো, যদি সুখী হতে চাও। যাক অন্য্ কথায় চলে যাচ্ছি। আমাদের মূল আলোচনা , নিরাকার ঈশ্বর।
আপনি আগুন চান। আগুন পেতে গেলে আপনাকে একটা মাধ্যম করতে হবে। আগুন সবত্র আছে। কিনতু কাঠি বা কাঠ চাই। আর চাই বারুদ। এই বারুদ দেন গুরুদেব। মাধ্যম ছাড়া আগুনের প্রকাশ হয় না। তেমনি ঈশ্বরের প্রকাশ যদি দেখতে চান তবে মাধ্যমকে আশ্রয় করুন। আর নিজেকে তৈরি করুন। অপেক্ষা করুন আকুলতা নিয়ে।
আজও নাকি শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি শোনা যায়, বৃন্দাবনে। আপনি কি বলবেন সত্যিই শোনা যায় ? আপনি বলবেন - পাগল ? আজও রাশলীলা দেখা যায়। আপনি কি বলবেন - পাগল ? আপনার এক্সপোজারে যদি ব্যাটারি বা ইলেকট্রিসিটি থাকে, অর্থাৎ আপনার মধ্যে যদি ভক্তি থাকে, অনুরাগের সুইচ দিয়ে দিন। ঠিক দেখতে পাবেন রাসলীলা , শুনতে পাবেন বাঁশি । আপনার আগে পিছনে সর্বত্র, গান ভেসে বেড়াচ্ছে। নাচের ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। কিনতু আপনার যদি এক্সপোজার অর্থাৎ টিভি থাকে তাতে যদি ইলেকট্রিসিটি থাকে, সুইচটা অন করে দিন আপনি সব দেখতে পাবেন। এক্সপোজারের মধ্যে কিনতু কিছু নেই। ওটা ভেঙে ফেললেও ভিতরে ছবি পাবেন না. গান পাবেন না। গান আছে সর্বত্র,ছবি আছে সর্বত্র। আপনার এন্টেনা ঠিক করুন, নিজেকে যোগ্য করুন, ব্যাকুল হন, নিরন্তর তৎগতপ্রাণ হন , তবেই তাকে দেখতে পারবেন তার বাঁশি শুনতে পাবেন।
আপনি ফল খেতে চান ? ফলের স্বাদ আপনি কান্ডে পাবেন না। বীজ তো বিস্বাদ। ভক্তিবাদীরা ফল খায়। নিরাকারবাদীরা মাটির মধ্যে উৎস খোঁজে,মাটির মধ্যে স্বাদ খোঁজে। আপনি কোনটা চান ?
অতএব শ্রীকৃষ্ণ বলছেন : আমার মতে তারাই শ্রেষ্ট যারা ভক্তি সহকারে আমার (রূপের) উপাসনা করে। ভক্তিবাদেই আনন্দ, আকারেই আনন্দ, নিরাকারে আনন্দ নেই, জ্ঞানী নিরস।
দুধের মধ্যে মাখন আছে, দই আছে। আপনি যদি ফেলে রাখেন , দুধ দই হয়ে যাবে। আর যদি ঝাঁকান তবে মাখন পেতে পারেন। তখন জলে ভাসতে পারবেন। না হলে জলে মিশে যাবেন। নিজেকে ঝাঁকান-ঝাঁকান, আরো জোরে, আরো জোরে নিজেকে ঝাঁকান, তবে আপনি নিজেকে মাখন করতে পারবেন। নতুবা একদিন জলে মিশে যাবেন। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন ভক্তিবাদ-ই শ্রেষ্ট। সাকারের উপাসনাই শ্রেষ্ট। আমি বলি, সাধকের পক্ষে সাকারবাদ ভালো, জ্ঞানীর পক্ষে নিরাকারবাদ শ্রেষ্ট। গুরুদেব যেটা বলছেন প্রথমে সগুনের উপাসনা, তারপর ব্রহ্মজ্ঞান হলে নির্গুণের উপাসনা।
ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ