Tuesday 28 April 2020

প্রার্থনা করবো কার কাছে ?


প্রার্থনা কিভাবে কাজ করে ?

দক্ষিণেশ্বরে রসিকলাল নামে  একজন ঝাড়ুদার ছিল। ঠাকুর রামকৃষ্ণের কাছে বহুলোক তাঁর কথা শুনতে আসেন । কিন্তু রসিকলাল  কিন্তু যেতে পারে না।  ছোটজাত বলে। তো একদিন, ঠাকুর পঞ্চবটি থেকে একা একা ফিরছেন, সেই সুযোগে সে ঠাকুরের পায়ে পড়ে  কাঁদতে লাগলো। ঠাকুর তাঁকে স্নেহের সুরে  বললেন, বাছা রসিক, ওঠ্ উঠে দাঁড়া। চিন্তা করিস না, রসিক তোর দায়িত্ত্ব সব আমি নিলাম। তুই শুধু তোর কাজ করে যাস। এক মনে ভক্তি করে,সকল সন্ধ্যা প্রার্থনা জানাস। ঠাকুর এই কথা অর্থাৎ প্রার্থনা, সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। মৃত্যুর আগে রসিক দেখলো, এক দিব্য  পুরুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে, রসিক বলে উঠলো - "ও আপনি আপনার কথা রেখে আমাকে দেখা দিয়েছেন!" এই বলে সে প্রাণত্যাগ করলো। তো প্রশ্ন হচ্ছে, প্রার্থনার  কি এই  ফল ? 

সমস্ত সাধু মহাত্মাগণ বলে থাকেন প্রার্থনা করা ভালো। আমরা যখনই বিপদে পড়ি, তখন আমরা প্রার্থনা করে থাকি। সমস্ত ধর্ম্মগুরু এই প্রার্থনার কথা বলে থাকেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, কার কাছে প্রার্থনা করবো ? আর কিই-বা প্রার্থনা করবো ? আমরা তো সর্বদা অভাবের যন্ত্রনায়  ভুগছি, তাহলে কী বিষয়ের জন্যই প্রার্থনা করবো ? মহাত্মাগণ বলে থাকেন,  ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো। আমাদের মতো সাধারণের মানুষের কাছে, ঈশ্বর আছেন কি নেই তার কোনো প্রত্যক্ষ প্রমান নেই। আর যদি গুরুদেবের কথায় বিশ্বাস করে ধরেও নেই যে ঈশ্বর আছেন, তাহলেও, একথা বিশ্বাস করার কি কোনো কারন আছে, যে ঈশ্বর আমার প্রার্থনা শোনেন, বা আমার প্রার্থনার ভাষা বোঝেন। কেননা পৃথিবীতে অসংখ্য ভাষাভাষীর  লোক আছে, তারা সবাই যে যার ভাষায় প্রার্থনা করছে, তো সব ভাষায় কি তিনি বোঝেন ? আর যদি ধরেই নেই তিনি সব ভাষাই বোঝেন, তাহলেও কি এই সমস্ত প্রাণীর যে চাহিদা, অর্থাৎ প্রার্থনা তা তার পক্ষে পূরণ করা সম্ভব ?  একদল মানুষ আছেন, যারা বলে থাকেন, বিশ্বাসের সঙ্গে আকুল হয়ে প্রার্থনা করলে, ঈশ্বর অবশ্য়ই সারা দেন।

আর একদল মানুষ আছেন, যারা বলে থাকেন, ঈশ্বর বলে কিছু আছেন, তার কোনো প্রমান নেই।  আর যদি থেকেও থাকেন, তিনি যে প্রার্থনায় সারা দেন তার কোনো প্রতক্ষ্য প্রমান নেই।  যদি ঈশ্বর সত্যি সত্যি থাকতো, এবং তিনি যদি আমাদের প্রার্থনায় সারা দিতেন, তবে মানুষের সারা জীবভোর যে দুঃখ ভোগ করতে হয়, এই দুঃখই থাকতো না। মা কখনো সন্তান  হারা হতেন না।  মানুষও কখনো অনাহারে থাকতেন না। আর সত্যি কথা বলতে কি, মানুষ তাহলে মারাই যেতো না.কারন, মানুষ তো যুগ যুগ  ধরে কেবল সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকতে চেয়েছে।

এইসব প্রশ্নের মীমাংসা তর্কের দ্বারা হওয়া সম্ভব নয়। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বার বার বহু ভক্তকে বলেছেন, প্রার্থনা করো। বিশ্বাস রাখো। আবার স্বামী বিবেকানন্দ, যিনি রামকৃষ্ণের মানস সন্তান, তিনি বলছেন কর্ম্ম করো।  রাজযোগের আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে না।  যা বলছি, তা অনুসরণ করে দেখো, প্রতক্ষ্য ফল পাবে। তো কেউ বলছেন, বিশ্বাসে মিলে বস্তু, কেউ বলছেন অন্ধের মতো বিশ্বাস করো না, কাজ করো ফল পাবে। আমরা কোন পথে যাবো ?

আধ্যাত্মিক জগতের ক্রিয়াকর্ম্মের একটা মস্তবড় পরিণতি হচ্ছে, এর ফল ভীষণভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকর্ম্মের ফল, অনুভূতি,  কেবলমাত্র ব্যক্তিগত  অভিজ্ঞতায় ধরা পড়ে। এই অভিজ্ঞতা অন্যকে দেখানো যায় না। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার ফল, বা অলৌকিক কান্ড সাধকের অন্তর্লোকে ঘটে থাকে। কথায় বলে, ঈশ্বরের কৃপায়, অন্ধ দৃষ্টি ফিরে পায়, মুক কথা বলে, বধির শ্রবণশক্তি ফিরে পায়। পাহাড় টলে  যায়। এগুলো আসলে কথার কথা। তাই যদি হতো, তবে অধ্যাত্ববিদ্যা চিকিৎসা বিদ্যার মতো মানুষের ব্যবহারিক জীবনে  কাজ করতে পারতো। তা কিন্তু হয়নি। আর এই ভরসাও  কখনো অধ্যাত্মবিদগন দিয়ে থাকেন না। ঠাকুর রামকৃষ্ণকে তার অসুস্থতার সময়, ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল। এখনো, স্বামীজিরা অসুস্থ হলে, ডাক্তার ডাকেন বা হাসপাতালেই  যান। তাহলে কি প্রার্থনার কোনো মূল্য নেই ? ঈশ্বর বলে কি কিছু নেই? ঈশ্বর কি সর্ব্বশক্তিমান নন ? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো আমরা।

আসলে প্রার্থনার তাৎপর্য্য অন্যত্র লুকিয়ে আছে। প্রার্থনা একজন মানুষকে দিতে পারে আত্মবিশ্বাস। বাড়িয়ে দিতে পারে মনের শক্তি। আর এর ফলে মানুষ জীবনের অনেক অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ন  হয়ে যেতে পারে। এইখানেই প্রার্থনার মূল্য। প্রার্থনা মানুষকে তার ইচ্ছাশক্তিকে বাড়িয়ে দিতে পারে। আর এই ইচ্ছাশক্তির জোরেই মানুষ সব অসাধ্য সাধন করতে পারে। বিশ্বশক্তির একটা ক্ষুদ্র অংশ আছে, প্রত্যেক জীবের মধ্যে।  বিশেষ করে, মানুষের মধ্যে এই শক্তি সীমাহীন। এই শক্তি সম্পর্কে মানুষ সচেতন নয়।  প্রার্থনা মানুষকে এই শক্তি সম্পর্কে সচেতন করে তুলে পারে, অবশ্যই  পারে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, কেউ প্রার্থনা করছে, কোনো মাটির প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে, বা একটা শিলাখণ্ডের সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু প্রকৃতভাবে সে প্রার্থনা করছে, নিজের কাছেই। বৃহৎ সত্বার যে ক্ষুদ্র সংস্করণ আছেন, প্রত্যেক জীবের মধ্যে, সেই অখন্ড সত্ত্বার কাছেই সে প্রার্থনা করছে। যে শক্তি তার নিজের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও অপ্রকাশিত হয়ে আছে, নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে, সেই ঘুমন্ত সত্ত্বাকে সে জাগিয়ে তোলে প্রার্থনার মাধ্যমে। তাই সে যা পায় এই প্রার্থনার মাধ্যমে, তা সে নিজের কাছ থেকেই পেয়ে থাকে। প্রার্থনা একটা চাবি, এই চাবির মাধ্যমে খুলে যেতে পারে, বিশ্বশক্তি দ্বার ।  এর ব্যবহার আমরা জানি না। আমাদের অন্তরে যে বিশ্বভাণ্ডার মজুত আছে, তার দ্বার খুলে যেতে পারে, প্রার্থনার মাধ্যমে। 

প্রার্থনা আর কিছু নয়, খোঁজে বেরিয়ে পড়া। আর এই বেরিয়ে পড়বার জন্য আমাদের দরকার কিছু যোগ্যতা।  আর তা হলো, আমাদের বুঝতে হবে, প্রকৃতি প্রদত্ত, বা মাতা-পিতার প্রদত্ব এই পঞ্চভূতের শরীর।  এই শরীর প্রকৃতির নিয়মে বাঁধা। এর অন্যথা হবার কোনো উপায় নেই। কিন্তু এই শরীরের মধ্যে যে পুরুষ-শক্তি আছে, সে কোনো নিয়মে বাধা নয়। এই পুরুষ কোনো বাঁধা মানে না। সে তার ইচ্ছাশক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়। সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে, সে যা ইচ্ছে তাই হতে পারে। তার অসাধ্য কিছু নেই। আমাদের চিত্তের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে শুভ শক্তি। শুভ চিন্তাই , আমাদেরকে শুভকর্মে প্রবৃত্ত করবে। আর শুভ চিন্তা, শুভ কর্ম্ম আমাদের শুভ ফল প্রদান করবেই।  এর কোনো অন্যথা হবে না। কথায় বলে, ঈশ্বর তাকেই সহযোগিতা করে, যে চেষ্টা করে। অলস-নিচেষ্ট মানুষকে ঈশ্বর কখনো প্রতিশ্রুতি দেন না। মানুষ এক পা বাড়ালে, ঈশ্বর দশ-পা এগিয়ে আসেন। বিশ্বশক্তি কোনো কল্পনার বিষয় নয়, এমনকি অজানা বিষয় নয়।  এই বিশ্বব্রহ্মান্ড যে শৃঙ্খলার মধ্যে আবধ্য, সেটা বুঝতে আমাদের কোনো পন্ডিতের কাছে যেতে হয় না। আর এই নিয়ম শৃঙ্খলার একজন প্রবর্তক অবশ্যই  আছেন, তিনিই এই শৃঙ্খলার রক্ষক। প্রকৃতি-প্রদত্ত্ব শরীর যেমন হাজার বছর  বাঁচতে পারে না। সূর্য যেমন আলো  দেওয়া বন্ধ  করতে পারে না। বাতাস যেমন স্থির হয়ে থাকতে পারে না। তেমনি, শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যতিরেকে জীব কখনো জীবন ধারণ করতে পারে না। আর এই পঞ্চভূতের মধ্যেই লুকিয়ে আছে, ঈশ্বরের অদম্য শক্তি। এই শক্তি  পঞ্চভূতের থেকে আলাদা, কিন্তু দ্রবীভূত হয়ে আছে, আমাদের এই পঞ্চভূতের শরীরের মধ্যে। সেই শক্তিকে প্রকাশিত করবার নামই প্রার্থনা। সেই ঘুমন্ত শক্তিকে জাগিয়ে তোলার নামই প্রার্থনা। প্রার্থনার শক্তির কোনো সীমা -পরিসীমা নেই। অফুরন্ত এই শক্তি।  এর প্রভাবে হয়না, এমন কিছু আমরা কল্পনাও করতে পারি না। সব হয়, সব হয়। প্রার্থনার জন্য আমাদের দরকার একাগ্রতা। মনের সমস্ত শক্তি  চিত্তের উপরে নিক্ষেপ করা। এতে করে আমাদের মানসিক শক্তির  তীব্রতা বৃদ্ধি পায় এবং নির্দিষ্ট লক্ষে কেন্দ্রিত হওয়ায় প্রচন্ড শক্তির স্ফূরণ হয়। আর প্রার্থনাকারীকে লক্ষ পূরণের জন্য, ধাবিত করে। সে তখন, হাজার বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও সমস্ত বাধা অতিক্রম করে,  দুর্বার গতিতে লক্ষপূরণের জন্য ধাবিত হয়। আর লক্ষ পূরণ না  করে সে থামতে পারে না । যা আগে সে করবার সাহস সঞ্চয় করতে পারে নি, আজ সেই কাজ অনায়াসে নিজের ক্ষমতাবলেই সম্পাদন করে ফেলে। এখানেই প্রার্থনার সাফল্য।
   
ধর্ম্ম মানুষকে বাঁচার অনুপ্রেরণা জোগায়। ধর্ম্ম মানুষের মধ্যে একটা আদর্শের স্থাপন করে থাকে। আর ধার্মিক মানুষ এই আদর্শকে নিয়ে বাঁচার জন্য অন্তরের  ভিতরে একটা তীব্র ইচ্ছে অনুভব করে থাকেন । প্রার্থনা এই আদর্শকে নিয়ে বাঁচার উপায় বাতলে দেয়। প্রার্থনা যত গভীর হয়, যত দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে ততই আমরা নতুন মানুষ হয়ে উঠি। আমাদের জীবনে পরিবর্তন আসে, আমাদের চরিত্রের মধ্যে, আমাদের আচরণের মধ্যে সেগুলো ফুটে ওঠে। এই পরিবর্তন এতটাই স্পষ্ট যে এটি যেমন নিজের মধ্যে একটা নির্ভয়-শান্ত অথচ একটা স্ফূর্তি, একটা শক্তি, একটা আত্মনির্ভরতা জেগে ওঠে ।  প্রার্থনার এটাই লাভ। প্রার্থনায় মরা মানুষ বেঁচে ওঠে না।  কিন্তু ম্রিয়মান মানুষ, ভীতু মানুষ, হয়ে উঠতে পারে সতেজ, হয়ে উঠতে পারে সাহসী। এইখানেই প্রার্থনার কারিকুরি। 
সবশেষে একটা প্রচলিত অথচ অসীম  শক্তিশালী মন্ত্র পাঠ করে আমাদের বাক্যের সমাপ্তি করবো। 

ওঁং ভূর্ভুবঃ স্বঃ। ওঁং তৎসবিতুর্বরেন্যং।
ভর্গো দেবস্য ধীমহি। ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ওঁং।
ওঁং শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ

হে (ভূঃ-ভূবঃ-স্বঃ) ত্রিলোকেশ্বর ! সবিতাদেবের পরব্রহ্মাত্মক সেই বরণীয় তেজকে আমরা ধ্যান করি। সেই সবিতা আমাদের বুদ্ধি-বৃত্তিকে প্রেরিত করুন।ওঁং আমাদের ত্রিবিধ শান্তি হোক।


Sunday 26 April 2020

আবার আত্মার খোঁজে


আবার আত্মার খোঁজে - এবার  মহাভারতের পাতায়

জীবদেহে পরমাত্মার উপলব্ধি।  পৃ ৮২২. 
মহাত্মা ভীষ্ম মৃত্যু শয্যায় বা বলা যেতে পারে, শরশয্যায়। ধর্মাবতার যুধিষ্ঠির এসেছেন, তাঁর কাছে, জীবনের শেষ কথা কটি শুনতে। মহাত্মা ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যু। উত্তরায়নের  অপেক্ষায় আছেন। তাই কিছুটা সময় পাওয়া গেলো, গঙ্গাপুত্র মৃত্যুঞ্জয়ী মহাপুরুষের কাছ থেকে মূল্যবান উপদেশ গ্রহণের। 
বেদ সাধারণের বুদ্ধিগ্রাহ্য় নয়। এই ব্রহ্মবিদ্যা ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের জন্য। মহাভারত কিন্তু সর্ব্ব সাধারণের জন্য। তাই বেদের তত্ত্বকথা মহাভারতের মধ্যে গল্পের আকারে, সাধারণের বোধগম্য করে পরিবেশন করা হয়েছে। তো ভীষ্মদেব বলছেন, দেবতাদের কুলগুরু হচ্ছেন,মহর্ষি  বৃহস্পতি।  আর মহর্ষি বৃহস্পতির  গুরুদেব হচ্ছেন প্রজাপতি মনু।  তো দেবগুরু বৃহস্পতি একদিন প্রজাপতি মনুর কাছে  বলছেন, আমি বেদাদি অধ্যায়ন  করেছি, সব ব্যাকরণ পড়েছি। কিন্তু আকাশাদি মহাভূতের কারন কি, তা জানি না। জীব যে কিভাবে এক দেহ থেকে বেরিয়ে আর একটা দেহে আশ্রয় নেয়, তা আমার জানা নেই। হে মহাত্মন, যদি কৃপাবশতঃ এই সম্পর্কে বিস্তারিত কীর্তন করেন। 

তো প্রজাপতি মনু বললেন, হে মহর্ষি সেই অবিনাশী পুরুষ থেকেই আকাশের সৃষ্টি হয়েছে। আবার আকাশ থেকে বায়ু, বায়ু থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে জল, জল থেকে এই জগৎ, আর জগৎ থেকে জগতের সমস্ত পদার্থ মায় জীবজগৎ সৃষ্টি হয়েছে। আবার অন্তিম কালে, যাবতীয় শরীরীর যে পার্থিব শরীর আছে, তা প্রথমে জলে, তার পরে জল থেকে তেজে, তেজ থেকে বায়ুতে, তারপর বায়ু থেকে অন্তরীক্ষে গমন করে থাকে। কিছু শরীরী আছেন, যাঁরা অন্তরীক্ষ অতিক্রম করে, পরমপুরুষে লিন হয়ে যান।  একেই বলে মোক্ষলাভ। পরমপুরুষে যাঁরা  লীন হয়ে যান, তারা আর ফিরে আসেন না। অর্থাৎ তাঁরা আর কোনো দেহে স্থিত হন না। 

এখন কথা হচ্ছে, এই পরমপুরুষ কে ? এই পরমপুরুষকে ভাষার দ্বারা আবদ্ধ করা যায় না। তিনি বাক্যের অতীত। তিনি কি নন, সেটা বড়জোর বলা যেতে পারে। তিনি সমস্ত গুনের উর্দ্ধে।  তিনি না শীত না উষ্ম, না কোমল না তীক্ষ্ণ, না অম্ল না কষা, না তেতো না মধুর, অর্থাৎ সমস্ত গুন্ রোহিত। আবার তিনি শব্দ-গন্ধ বা রূপ-সম্পন্ন নন।  তিনি পরাৎপর স্বভাবশূন্য। অর্থাৎ তিনি ইন্দ্রিয়াদির স্বভাবের উর্দ্ধে। ইন্দ্রিয় দ্বারা যে সব কর্ম্ম তা তিনি করেন না। তাই তার  স্বভাব বলে কিছু নেই। আমরা  বিভিন্ন ইন্দ্রিয় দ্বারা বিষয়ের বিভিন্ন অনুভব করে থাকি, যেমন ত্বক দ্বারা স্পর্শফল, জিহ্বা দ্বারা আস্বাদন বা রস অনুভব করে থাকি। কর্ন দ্বারা, শব্দ, ঘ্রাণশক্তির সাহায্যে গন্ধ, চক্ষু দ্বারা রূপ অনুভব  করে থাকি। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ এর বাইরে কিছু অনুভব করতে পারি না। কিন্তু যিনি বা যে ব্যক্তি রস থেকে রসনাকে, দুর্গন্ধ থেকে নাককে, শব্দ থেকে কানকে, স্পর্শ থেকে ত্বককে, এবং রূপ থেকে চোখকে নিবৃত্ত করতে পারেন, তিনিই নিজের স্বভাবকে বুদ্ধি প্রভৃতি হতে শ্রেষ্ঠ বলে বুঝতে সমর্থ হন। 

আমাদের মধ্যে যে কর্তাভাব, আমাদের মধ্যে যে কর্ম্মের প্রবৃত্তি, আমাদের মধ্যে যে শোকের (করণের) অনুভূতি, আমাদের মধ্যে যে দেশ ও কালের অনুভূতি, আমাদের মধ্যে যে সুখ-দুঃখের অনুভূতি, আমাদের  যে প্রবৃত্তি আমাদের যে অনুরাগ, এই সবকিছু যে কারণে হয়ে থাকে তাকেই বলে স্বভাব। সমষ্টিগতভাবে এই স্বভাবকে বলে পরমাত্মা, আর ব্যষ্টিগত ভাবে, বলে জীবাত্মা। আসলে এই স্বভাবই সমস্ত কাজ করছে। অর্থাৎ স্বভাব বা তিনিই কারন, আর স্বভাবজাত যা কিছু তা হচ্ছে কার্য্য। 

পাপ-পুন্য যেমন পরস্পর বিরুদ্ধ কিন্তু একই মানুষ্য শরীরে বাস করে থাকে, ঠিক তেমনি জ্ঞান জড়বস্তু না হয়েও জড়দেহে নিবদ্ধ হয়ে আছে। প্রদীপ যেমন প্রজ্বলিত হয়ে, অন্যের বিষয়বোধ করিয়ে  দেয়, ঠিক তেমনি জ্ঞান জীবআত্মাকে  বা মানুষের ইন্দ্রিয়গনের বিষয়বোধ সম্পাদন করছে। মন্ত্রী-পরিষদ যেমন রাজ্যের বিভিন্ন বিষয়, রাজার গোচরে আনেন, তেমনি আমাদের ইন্দ্রিয়গণ বাহ্য-জগতের সমস্ত বিষয়-বোধ সম্পাদন করছে। মন্ত্রীদের থেকে রাজা যেমন শ্রেষ্ঠ, তেমনি শরীরের ইন্দ্রিয়গণ থেকে জীবাত্মা শ্রেষ্ঠ। অগ্নির শিখা, বাতাসের বেগ, সূর্য্যের রশ্মি, নদীর জল, যেমন বারবার গমনাগমন করছে, ঠিক তেমনি, আমাদের এই দেহ, একবার নষ্ট আবার একবার উদ্ভূত হচ্ছে। যতক্ষন ইন্ধন থাকে ততক্ষন অগ্নিশিখা দৃষ্টিগোচর থাকে। ইন্ধন শেষ হয়ে গেলে, অগ্নিশিখা দৃষ্টিগোচর থাকে না। তাই বলে কি অগ্নি  নেই, তা নয়। কাঠের মধ্যে আগুন, ধোঁয়া  আছে।  কিন্তু কাঠকে কুড়ুলের দ্বারা  টুকরো করেও, আগুনের বা ধোঁয়ার  দেখা মিলবে না।  ঠিক তেমনি, মানুষের শরীরকে টুকরো টুকরো করে ফেললেও, আত্মা বা জীবাত্মার সন্ধান মিলবে না। কিন্তু এই কাঠকে যদি আমরা সঠিক উপায়ে ঘর্ষন করতে পারি, তবে এই কাঠের মধ্যেই ধোয়া ও অগ্নি দেখতে পাবো। ঠিক তেমনি, আমরা যদি বুদ্ধিকে যদি শান দিতে পারি, অর্থাৎ সঠিক জ্ঞান অর্জনের সাহায্যে আমরা জীবাত্মা ও পরমাত্মাকে দর্শন করতে পারি। মানুষ যেমন স্বপ্নে, নিজের পার্থিব দেহকে বিছানায় রেখে, পৃথকভাবে চৈতন্য প্রভাবে  ভূমন্ডল ঘুরে বেড়াতে পারে, আবার জাগ্রত অবস্থায়, পার্থিব দেহকে অভিন্নভাবে দর্শন করে, ঠিক তেমনি, মন ও বুদ্ধি সম্পন্ন দশ ইন্দ্রিয় (জ্ঞান -ইন্দ্রিয় ৫টি, চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক। কর্ম্ম ইন্দ্রিয় -৫টি বাক, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ ) এছাড়া অন্তর-ইন্দ্রিয় ৪টি - মন, বুদ্ধি, অহংকার ও চিত্ত ও বায়ুযুক্ত জীবাত্মা  (দশ বায়ু, প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান  এবং নাগ, কূর্ম্ম, কৃকর, দেবদত্ত ও ধনঞ্জয়) জীবনান্তে দেহকে একবার আপনা হতে পৃথকভাবে দর্শন করেও পুনরায় এঁকে অভিন্ন বিবেচনা পূর্বক দেহান্তরে গমন করে থাকে।  
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
 ( দেহের মধ্যে বায়ুর যে ক্রিয়াস্থান, এই ক্রিয়া-স্থান ভেদে বায়ুকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন ১. বুকের মধ্যের বায়ুকে বলে প্রাণ। ২. নাভি থেকে নিম্নাঙ্গের বায়ুকে বলে অপান।  ৩. নাভি থেকে বুকের নিচ পর্যন্ত যে স্থান সেখানকার বায়ুকে বলে সমান। ৪. কন্ঠের বায়ু উদান। ৫. এছাড়া সর্ব্ব শরীরে যে বায়ু ছড়িয়ে আছে তাকে বলে ব্যান বায়ু।এগুলোর ক্রিয়া সম্পর্কে আমরা আগে শুনেছি। এছাড়া আমাদের শরীরে যে সাড়ে তিন লক্ষ বা অসংখ্য  নাড়ী আছে তার মধ্যে ছড়িয়ে আছে যে বায়ু, সেগুলো হচ্ছে, নাগ, কূর্ম্ম, কৃকর, দেবদত্ত ও ধনঞ্জয়। আর এগুলোর কর্ম্মক্ষেত্ৰ বা চলাচলের ক্ষেত্র হচ্ছে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাক্ষ্যা ও চিত্রাণি। নাগ বায়ু আমাদের উদ্গার তুলতে সাহায্য করে। কূর্ম্ম বায়ু আমাদের উন্মীলন অর্থাৎ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সংকোচন-প্রসারণের সাহায্য করে থাকে। কৃকর বায়ু আমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা জাগিয়ে তোলে। দেবদত্ত বায়ু আমাদের হাই  তুলতে সাহায্য করে। এবং ধনঞ্জয় বায়ু আমাদের হিক্কা তুলতে সাহায্য করে। এইভাবে বায়ু ও তার ক্রিয়া-পদ্ধতি সম্পর্কে যিনি উপলব্ধি করেছেন, তিনি সেই বিরাট-পুরুষ ব্রহ্মান্ডকে জ্ঞাত হতে পেরেছেন, আবার এই ক্ষুদ্র ভান্ডকে জ্ঞাত হতে পেরেছেন।  তিনি নিশ্চিত-রূপে মুক্ত পুরুষ এবং অবশ্যই উত্তম অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছেন।) 
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------   

পরমাত্মা কখনোই এই যে সুখ-দুঃখ কর্ম্ম প্রভাবে উৎপত্তি, বৃদ্ধি, ক্ষয় ও মৃত্যু এগুলো কখনোই প্রাপ্ত হন না। তিনি অদৃশ্য দেহ পরিগ্রহ করে দেহ থেকে দেহান্তরে গমন করে থাকেন। চোখের দ্বারা এই রূপ প্রত্যক্ষ করা যায় না। এঁর স্পর্শ কেউ অনুভব করতে পারেন না। তিনি ইন্দ্রিয় দ্বারা কোনো কার্য্য সাধন করেন না।  আবার চক্ষু ইত্যাদি ইন্দ্রিয়গণ তাকে নিরীক্ষণ করতে সমর্থ হয় না। কিন্তু তিনি এদেরকে সবসময় নিরীক্ষণ করছেন। যেমন আগুনের মধ্যে লৌহখন্ডে  আগুনের সন্তাপের কারনে আগুনের রূপ লৌহখন্ডের মধ্যে নিরীক্ষিত হয়। ঠিক তেমনি, জীবদেহে, পরমাত্মার চৈতন্যস্বরূপই নিরীক্ষিত হয়ে থাকে। 

জীবাত্মা এক দেহ ত্যাগ করে, অদৃশ্যভাবে  অন্য দেহে প্রবেশ পূর্বক,  সেই দেহের গুনে গুণবান জ্ঞান করে। দেহী যখন দেহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়, তখন সেই দেহ তার উদ্ভূত বস্তুতে অর্থাৎ পঞ্চভূতে প্রবেশ করে থাকে। এবং ইন্দ্রিগুলোও নিজ নিজ উপাদানকে আশ্রয় করে। অর্থাৎ শ্রবণশক্তি আকাশের মধ্যে বিলীন হয়, ঘ্রাণশক্তি পৃথিবীকে আশ্রয় করে, দৃষ্টিশক্তি তেজের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়, আস্বাদন শক্তি সলিলে আশ্রয় নেয়, এবং স্পর্শগুন বায়ুতে আশ্রয় নেয়। এইভাবে আমাদের পাঁচ-ইন্দ্রীয় শক্তি পঞ্চভূতকে আশ্রয় করে রয়েছে। আবার এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়-গুন্ মনের অনুগত হয়ে আছে । মন আবার বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত, বুদ্ধি আবার স্বভাবের অনুগত। জীব তার স্ব-স্ব কর্ম্ম অনুযায়ী অর্জিত নতুন দেহে পূর্ব জন্মের পাপ-পুন্য বহন করে থাকে।  জলের পোকা যেমন স্রোতের অনুকূলে গমন করে, তেমনি মন বুদ্ধিকে অনুসরন করে থাকে। আমরা যখন দ্রুতগামী ট্রেনে ভ্রমন করে থাকি, তখন বাইরের দৃশ্যকে চঞ্চল বলে মনে হয়। কিন্তু ট্রেন যখন স্টেশানে স্থির হয়ে থাকে, তখন আমাদের এই ভ্রম দূর হয়। ঠিক তেমনি জ্ঞানবান ব্যক্তির বুদ্ধি যখন স্থির হয়, তিনি তখন অনায়াসে ঈশ্বরের যথার্থতা নির্নয় করতে সমর্থ হন। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ বস্তু যেমন আমরা অণুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা দেখতে পারি, দূরের বস্তু যেমন আমরা দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখতে পারি, নিজের মুখ দেবার জন্য যেমন আমরা আয়নার ব্যবহার করে থাকি, পরমাত্মা নিতান্ত সূক্ষ্ম ও অদৃশ্য হলেও, বিরাট এবং দূরস্থ হলেও বুদ্ধির প্রভাবে আমরা সেই মহান অর্থাৎ বিরাট বা অতিশয় ক্ষুদ্র বলে যাঁকে  আমরা দেখতে পারছিলাম না, তাঁকে তখন আমরা বুদ্ধির প্রভাবে দর্শন করতে পারি। এর পরের  দিন আমরা শুনবো আত্মাকে দর্শনলাভের উপায়। 
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। 

আত্মাকে দর্শন লাভের  উপায়।  আত্মাকে দর্শন স্থূল -মনুষ্য দেহ ভিন্ন সম্ভব নয়। তথ্যসূত্রঃ মহাভারত - শান্তিপর্ব্ব। 

আজ অক্ষয়-তৃতীয়া ।  এইদিন মহাভারত লেখা শুরু হয়েছিলো।  আমরাও আজ  শুনছিলাম মহাভারত কথা। দুর্লভ এই মনুষ্য শরীর।  কেন জানেন ? একমাত্র এই মনুষ্য শরীরেই আত্ম উপলব্ধি সম্ভব। এই স্থুল মনুষ্য দেহেই একমাত্র দর্শন করা যায় আত্মাকে। এই মনুষ্য  শরীরেই একমাত্র  অনুভব করা যায় পরমাত্মাকে। হ্যাঁ এই স্থূল মনুষ্য  শরীরেই ঈশ্বরের কৃপায় তাঁর দর্শনলাভ সম্ভব হয়। তাইতো দেবতারাও মনুষ্য শরীর পাবার জন্য লালায়িত। কিন্তু কি ভাবে ? আজ আমরা সেই কথাই শুনবো।
আর একটা কথা, মানুষ, কেবলমাত্র মানুষই  ঈশ্বরের খোঁজ করে থাকে । স্থূল মনুষ্য দেহধারীই  অর্থাৎ  মানুষ যখন কেবলমাত্র স্থুলদেহে অবস্থান করে থেকে, তখনই  সে ঈশ্বরের খোঁজ করে থাকে। মানুষ যখন , স্থুল দেহ ত্যাগের পরে, হাজার বছর ভুবর্লোকে অবস্থান করে, মানসদেহে অবস্থান করে, যা আমরা মহাত্মাদের কাছ থেকে শুনে থাকি, তো সেখানে বসেই তো সে পরমাত্মার খোঁজ করতে  পারে। ঈশ্বরকে খোঁজা  তো  মনের কাজ, যতদূর আমরা বুঝেছি ।  তো মানসদেহে সেই কাজটি করা যেতেই পারে। কিন্তু তা কেন হয় না ? আসলে স্থুল মনুষ্য দেহ ভিন্ন অন্য কোনো রূপে বা অবস্থায়, ঈশ্বরের সাধনা সম্ভব নয়। তাই মহাত্মাগন  প্রাণপাত করার আগে পর্যন্ত ঈশ্বরের সাধনায় লিপ্ত থাকতে চান। এই সম্পর্কেই আজ  এবার   আমরা  মহাভারতের কথা শুনবো।         

প্রজাপতি মনু ও দেবগুরু বৃহস্পতির কথোপকথন হচ্ছিলো । প্রজাপতি মনু দেবর্ষি বৃহস্পতিকে  উদ্দেশ্য করে বলছেন, হে ব্রহ্মন, ইন্দ্রিয়সহকৃত অর্থাৎ   বিভিন্ন ইন্দ্রিয় দ্বারা আমরা যে  জ্ঞান লাভ করে থাকি, বা কর্ম্ম করে থাকি, জীবচৈতন্য,  সেই ইন্দ্রিয় দ্বারা অর্জিত পূর্ব-পূর্ব অনুভূত সেই  বিষয় সমূহ কালান্তরে স্মরণ করে থাকে । এবং ইন্দ্রিয়সমূহ বিলীন হলে স্বপ্নযোগে পরম-স্বভাবই  বিষয় অনুভব করেন। সেই স্বভাব অনেক সময় এককালে অর্থাৎ  ইহজন্ম বা পরজন্মে দৃষ্ট শব্দ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়-বিষয়-সমুদয় সন্নিহিতের ন্যায় অর্থাৎ যেন নিকটেই আছেন, এইভাবে   প্রকাশ করে দেন। এবং এই একমাত্র সর্বোৎকৃষ্ট স্বভাবই  পরস্পর বিভিন্ন অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ প্রভৃতি তিন অবস্থাতে সাক্ষীরূপে সঞ্চরণ করে থাকেন।

এই বিষয়টা  একটু ভালো করে বুঝে নেবো। বাংলায় একটা প্রচলিত প্রবচন  আছে, "স্বভাব যায় না ম'লে আর ইল্লৎ যায় না ধু'লে" । অর্থাৎ আমাদের তথাকথিত মৃত্যুর পরেও আমাদের স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হয় না, যেমন মানুষের মনের মধ্যে যে নোংরামি আছে, তা কখনো ধুয়ে পরিষ্কার করা যায় না। প্রজাপতি মনু বলছেন, আমাদের মৃত্যুর পরে, আমাদের ইন্দ্রিয়শক্তি  পঞ্চভূতের সঙ্গে মিশে  থাকে। কিন্তু ইন্দ্রিয়লব্ধ যে জ্ঞান তা আমাদের স্বভাবের মধ্যে থাকে। আর এই স্বভাবএর স্মৃতিতে  আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের সাহায্যে  তিনি তখন তা প্রত্যক্ষ করতে থাকেন। এগুলো তখন তার কাছে প্রকাশিত সত্য। এবং এই  অবস্থা ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সর্ব্ব কালের জন্য চলতে থাকে, এবং আমাদের ব্যষ্টি স্বভাব এটাকে উপলব্ধি করতে থাকেন, আর সমষ্টি স্বভাব সাক্ষী হিসেবে নির্লিপ্ত থাকেন। অর্থাৎ জীবাত্মা এটাকে মনোময় শরীরে উপভোগ করেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে, আত্মার কোনো ভোগ নেই, আত্মা কেবল পরস্পর বিরুদ্ধ সত্ব রজঃ ও তম গুন্ জনিত সুখ-দুঃখাদি অবগত হয় থাকেন মাত্র, তাঁকে এসব ভোগ করতে হয় না। বায়ু যেমন কাঠ দ্বারা জ্বলতে থাকা অগ্নিতে প্রবেশ করে, ঠিক তেমনি আত্মা ইন্দ্রিয়সমুদায়ে প্রবিষ্ট হন। কিন্তু পরমাত্মা যেহেতু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তাই জ্ঞান, ঋষিবাক্য, বিচার  এবং সবশেষে সজ্ঞা দ্বারা তার দর্শনলাভের চেষ্টা করাই সঙ্গত।

মানুষ ইন্দ্রিয়দ্বারা আত্মাকে বুঝতে পারে  না। কিন্তু সর্বজ্ঞ সর্ব্বদর্শী পরমাত্মা সবসময় আত্মাকে দেখছেন। হিমালয়ের অনেক দুর্গম জায়গা আছে, যেখানে এখনো মানুষ যেতে পারে নি। চাঁদের পৃষ্ঠদেশে কি আছে, বা শুক্রগ্রহে কি আছে, তা আমাদের কাছে এখনো অজানা । কিন্তু চাঁদকে আমরা দেখতে পাই। হিমালয় সম্পর্কে একটা ধারণা থাকলেও, সমগ্র হিমালয় সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। ঠিক তেমনি মানুষের মধ্যে আত্মজ্ঞান থাকলেও তাকে আমরা সম্পূর্ণ রূপে জানতে পারি না। আত্মজ্ঞান ভিতর থেকে উদয় হয়।  আপনা থেকেই আত্মজ্ঞান হয়ে থাকে। এর জন্য কোনো বিষয়ের আশ্রয় নিতে হয় না। পন্ডিতগণ আজকে যে সুন্দর বৃক্ষটি দেখছেন, তারা জানেন, এই বৃক্ষের  কোনো রূপ আগে ছিল না, আবার পরেও  থাকবে না। তবু গাছটি অপরূপ সুন্দর । পন্ডিতগণ জানেন, সূর্যের চারিদিকে  পৃথিবী ঘুরছে, এমনকি সূর্য্যও গতিশীল, এগুলো প্রতক্ষ্যভাবে জ্ঞাত হওয়া সম্ভব নয়, তথাপি এই অপ্রতক্ষ্য জ্ঞান বিচারের দ্বারা অবগত হওয়া যায়। ঠিক তেমনি, সুদুর্লভ হলেও, বুদ্ধিরূপ প্রদীপের দ্বারা আত্মাকে নিরীক্ষণ করা সম্ভব। জ্ঞানের স্বরূপ এবং জ্ঞেয় পরমাত্মাতে বিলীন করতে অভিলাষ করে থাকেন। অর্থাৎ নিজেকে পরমাত্মার সঙ্গে একাত্মীভূত করার  প্রয়াস করে থাকেন। মনের মধ্যে আকুলতা ব্যাকুলতা যত  বাড়তে থাকে, বিলীন হবার  উপায় তত স্পষ্ট হতে থাকে। জেলেরা বড়শিতে মাছ গেঁথে, মাছ ধরে থাকে। শিকারীরা  পোষা হরিণ দিয়ে, বনের হরিণকে খাঁচায় ঢোকায়। পোষা পাখি দ্বারা  আকাশের পাখি, কুনকো  হাতি দ্বারা জঙ্গলের হাতি ধরা যায়। ঠিক তেমনি জ্ঞান দ্বারা জ্ঞেয়পদার্থ  ধরতে হবে। কথায় বলে, সাপ কুন্ডলি পাকিয়ে তার লেজ বা চরণ নিরীক্ষণ করে থাকে। ঠিক তেমনি জড়দেহ মধ্যে যে জ্ঞান, যা আসলে জড় নয়, কিন্তু জড় দেহের মধ্যেই থাকে। সেই জ্ঞানই পারে, দেহমধ্যে সূক্ষ্ম যে জ্ঞেয় বস্তু আছে তাই প্রত্যক্ষ করতে। দেখুন, চোখ চোখকে দেখতে  না। কানের কোনো কেন নেই।  ইন্দ্রিয় কখনো ইন্দ্রিয়কে জানতে পারে না। ঠিক তেমনি বুদ্ধি দ্বারা পরম-বোধ্যকে  জানা সম্ভব নয়।

চাঁদ সবসময় আকাশে আছে, তথাপি অমাবস্যার সময় দেখা যায় না। আত্মা মানুষের শরীরে বর্তমান থাকলেও, কেউ তাকে প্রত্যক্ষ করতে পারে না। আবার আত্মা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও তাঁকে কেউ প্রত্যক্ষ করতে পারে না। চাঁদ যেমন অমাবস্যান্তে আবার রূপ পরিগ্রহ করেন। ঠিক তেমনি আত্মা দেহান্তর প্রাপ্ত হয়ে পুনরায় প্রকাশিত হন। চাঁদ যেমন ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ হন, বৃদ্ধি প্রাপ্ত হন, আবার ক্ষয় প্রাপ্ত হন, এটি চাঁদের স্থূল দেহের গুন্।  ঠিক তেমনি জীবের স্থূল দেহের জন্ম, বৃদ্ধি, ক্ষয়প্রাপ্ত বা মৃত্যু হয়ে থাকে। এগুলো স্থুলদেহের গুন্ বা পরিনাম। আত্মাতে এই গুন্ বা এই যে ক্ষয়-বৃদ্ধি জনিত পরিনাম, কখনোই আরোপ করা যায় না। চাঁদের দ্বিতীয়া, পঞ্চমী, একাদশী আছে।  এবং একেক সময় তার আকার বা রূপের পরিবর্তন হয়, কিন্তু আমরা জানি চাঁদ একই আছে। ঠিক আমাদের বাল্য অবস্থা, কৈশোর অবস্থা, যৌবন অবস্থা, প্রৌঢ় অবস্থা বা বার্ধক্য অবস্থা আছে  কিন্তু আমরা জানি মানুষটি সেই একই আছে। রাহু যেমন চাঁদকে বা সূর্যকে  গ্রাস  করলে, আমরা রাহুর (ছায়া) অস্তিত্ত্ব টের পাই, আবার পরিত্যাগ ৰলে আর দেখতে পাই না, ঠিক তেমনি আত্মা যখন জীবদেহে প্রবেশ করেন, তখনই তাকে অনুমান করা সম্ভব  হয়। আবার দেহ পরিত্যাগ করলে আর তাকে অনুমান করা সম্ভব নয়। চাঁদ যেমন অমাবস্যাতে অদৃশ্য থাকলেও, নক্ষত্রমন্ডলী তাকে পরিত্যাগ করে না ঠিক তেমনি আত্মা শরীর  থেকে মুক্ত হলেও কর্ম্মফল থেকে  মুক্ত হতে পারেন  না।  কর্ম্মফল নিয়ে আত্মা ভূমন্ডলে ভ্রমন করে থাকেন । কিন্তু তখন তিনি উপনিষদের ভাষায়  শ্রদ্ধা (অর্থাৎ আত্মবীজ ) । বীজে সব আছে, কিন্তু প্রকাশ নেই।  বীজ পূর্নতা পায়  না, যতক্ষন না সে প্রকৃতির সহযোগিতা  পায়। তাই আত্মা  যখন স্থুল প্রাকৃতিক পঞ্চভূতের  দেহর মধ্যে প্রবেশ করে তক্ষুনি তাকে ধরতে হয়। বড়শির আঁধারে  মাছ যখন ঠোকর মারে, ঠিক তক্ষুনি তাঁকে ডাঙায় তোলে  জেলে।

আত্মা সর্বত্র আছে।আবার দেহের মধ্যেও আছে। জেলে যেমন মাছ ধরতে গেলে জালের সাহায্য নেয় । মাছকে গন্ডিবদ্ধ করবার জন্য। ঠিক তেমনি আমাদের এই দেহ জালের সাহায্য নিতে হবে। আত্মাকে ধরতে গেলে আমাদের দেহ-জালকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের এই  স্থুল  দেহ এই জাল।  এখানে প্রতিনিয়ত আত্মা অর্থাৎ চেতনশক্তি  প্রবেশ করছেন আবার বেরিয়ে যাচ্ছেন।  অর্থাৎ এই মনুষ্য দেহে আত্মার প্রতিনিয়ত যাতায়াত।  তাই জাল দিয়ে যেমন জেলে মাছ ধরে, আমাদের দেহ-জাল দিয়ে আমাদের আত্মাকে ধরতে হবে।
যোগীরা বলছেন,  আমাদের শ্বাসের সঙ্গে তিনি প্রতিনিয়ত যাতায়ত করছেন, আমরা যদি নিবিষ্ট চিত্তে এই শ্বাস-প্রশ্বাসের গতির দিকে দৃষ্টি রেখে স্থির হয়ে বসে থাকতে পারি, তবে আমরা চেতনশক্তি বা আত্মাকে আমরা ধরতে পারবো। দর্শন করতে পারবো।
হঠযোগীগণ বলছেন,  আমাদের শরীরের নাড়ীশুদ্ধি করে, অর্থাৎ আমাদের সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে যে শ্লেষ্যা ও মলাদি আছে তা পরিষ্কার করে, বায়ুকেকে দেহাগ্নি দ্বারা প্রজ্জ্বলিত করে, উর্দ্ধগতিসম্পন্ন করে, সুষুম্না নাড়ীর ভিতর দিয়ে ব্রহ্মদেশে নিয়ে যেতে পারি, তবে সেখানে আমাদের ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার  হয়।
ঈশ্বরভক্ত গন বলছেন, আমরা যদি প্রার্থনা ধ্যান-জপ করি তবে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে পারি। এমনি নানান পথের সন্ধান দিয়েছেন আমাদের মুনি ঋষিগণ।  আমরা যেকোনো পথেই ঈশ্বরের সন্ধান করতে পারি। তবে যে ভূমির উপরে দাঁড়িয়ে, এই সাধন সাধনা করতে হবে, তা এই মনুষ্য শরীর। এই স্থুল শরীর। এর অন্যথা নেই। তাই প্রজাপতি মনু বলছেন, আত্মদর্শনের একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে এই মনুষ্য শরীর  যার কোনো বিকল্প নেই।   

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম।  

Monday 20 April 2020

যমরাজ কারুর বাপের কেনা গোলাম নয়।



যমরাজ কারুর বাপের কেনা গোলাম নয়।

পরম-পুরুষ শ্রী রামচন্দ্রের  রাজত্বে, বাপের বর্তমানে ছেলের মৃত্যু হচ্ছে। পণ্ডিত  ব্রাহ্মণগণ নিদান দিলেন, শুদ্র শম্বুকের উগ্র তপস্যা এর কারন। তো বিশ্বামিত্র মুনি  রামচন্দ্রকে নিয়ে গভীর জঙ্গলে খুঁজে খুঁজে, শম্বুকের সন্ধান পেলেন। শম্বুক তপস্যা-রত  ছিলেন। রামচন্দ্র তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জানো, তোমার এই তপস্যার জন্য, রাজ্যে অরাজকতা শুরু হয়েছে?  পিতার বর্তমানে পুত্রের মৃত্যু হচ্ছে ? ঋষি শম্বুক বিনীত ভাবে বললেন, যমরাজ কারুর বাপের কেনা গোলাম নয়, মানুষ তার স্বকৃত কর্ম্মফল ভোগ করে মাত্র। বিধির নির্দেশেই জীবের জন্ম-মৃত্যু হয় । এতে মানুষের কোনো হাত নেই। রামচন্দ্র এই ধ্রুবসত্য  বাক্য শুনে, ক্ষনিকের জন্য থমকে গেলেন। বিশ্বামিত্র মুনি রামচন্দ্রকে  বললেন, দেখেছো শুদ্রের স্পর্ধা, রাজার মুখের উপরে কথা বলে। শীঘ্রই নিধন করো, এই পাপিষ্ঠকে। রামচন্দ্র তক্ষুনি ঋষি শম্বুককে তীরবিদ্ধ করে হত্যা করলেন।

শ্রীকৃষ্ণ যজ্ঞ করছেন।  এক ব্রাহ্মণ এসে, কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন। তাঁর নাকি সন্তান জন্মের পরেই পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হয়। এর জন্য দায়ী নিশ্চই রাজ্যের রাজা। তো উপস্থিত সবাই  তাকে শান্ত হতে বললেন।  কিন্তু ব্রাহ্মণ কথা শুনছেন  না। চিৎকার চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিয়েছেন । তো শ্রী কৃষ্ণের কাছে খবর গেলো। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে পাঠালেন। অর্জুন ব্রাহ্মণকে নিয়ে তার বাড়িতে গেলেন, সেখানে কড়া পাহারা দিতে লাগলেন, যাতে যম ব্রাহ্মণের বাড়ির ত্রিসীমানায় না আসতে  পারে।  কিন্তু   শত চেষ্টা করেও, সমস্যার সমাধান করতে পারলেন না। শেষে শ্রীকৃষ্ণ নিজেই সমস্যা সমাধানের জন্য, যমরাজের কাছে গেলেন। যমরাজ বিনীত ভাবে বললেন, বিধির বিধান খণ্ডন করবার ক্ষমতা তার নেই। তো শ্রীকৃষ্ণ সেখান থেকে চললেন, বিধির বিধায়ক   সেই পরম পুরুষ নারায়ণের কাছে। সেখান থেকে তার অনুমিত নিয়ে, ব্রাহ্মণের সমস্ত সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন।

দুটোই পৌরাণিক কাহিনী। তো মৃত্যুকে আপনি কিভাবে দূরে রাখবেন ? সেতো আপনার অধীন নয়। আপনি নিজের সন্তুষ্টির জন্য, মৃত্যুর জন্য অন্যকে দায়ী করে তাকে  মারতে পারেন।  আপনি মৃত্যুকে ডাকতে পারেন। কিন্তু আপনি মৃত্যুকে দূরে সরিয়ে দিতে পারেন না। রামচন্দ্র মৃত্যুকে দূর করবার পরিবর্তে মৃত্যুকেই ডেকে এনেছিলেন। কিন্তু  শ্রীকৃষ্ণ মৃত্যুর সীমিত ক্ষমতাকে অস্বীকার করেন নি, বরং জীবনের মূল উৎসে চলে গিয়েছিলেন। আর সেখান থেকেই পুনরায় জীবনকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। তো আমরা কোন পথ অবলম্বন  করবো ?

বছর  পাঁচেক আগে আমর এক অন্তরঙ্গ বন্ধু মারা যায়। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমরি হাসপাতালে গেলাম। সামান্য একদিনের অসুস্থতায় সে মারা যায়।  অথচ, প্রতিনিয়ত সে ডাক্তারের নির্দেশ  অনুযায়ী, বডি চেক-আপ করতো। তার এই অকালমৃত্যু আমাকে অসহায় করে তোলে। বন্ধুটির একটি মাত্র মেয়ে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠ শেষ করে, সবে চাকরি পেয়েছে। ভাবলাম,  ওর তো ছেলে নেই, মেয়ে-বৌ কতদূর কি করবে, যাই সৎকারের ব্যবস্থা তো করতে হবে। তো আমাদের আর এক বন্ধুকে নিয়ে আমরি হসপিটালে  গেলাম। গিয়ে দেখলাম, ওর স্ত্রী ভেঙে পড়েছেন । কিন্তু মেয়েটিকে দেখলাম, একদিনেই সে যেন বড়ো হয়ে গেছে।  মাকে সামলাচ্ছে, হসপিটালের বিল মেটাচ্ছে, হাসপাতালের স্টাফদের সাথে কথা বলছে, কিভাবে কি করতে হবে, সব জেনে  নিচ্ছে।

ত্রিবান্দ্রম বিশ্ববিদ্যালয়ের মালয়ালাম ভাষার অধ্যাপক ছিলেন, মিস্টার নায়ার। বিশিষ্ট ভদ্রলোক কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই। তাদের ছয় বছরের শিশুটি কিছুদিন ধরেই অসুস্থ থেকে মারা যায় । শিশুটি মৃত্যুর ঠিক আগে, মাকে  বললো বাবাকে একটু ডেকে দাও। ।  বাবা কাছে এলে, ছেলেটি উচ্চস্বরে একটা  স্তোত্র পাঠ  করতে লাগলো। বাবা তো অবাক, এই স্তোত্র তাকে কখনো শেখানো হয় নি।  সে নিজেও এই স্ত্রোত্র কখনো শোনেনি। এর পরেই ছেলেটি দেহ ত্যাগ করলো। এই ঘটনা শ্রী নায়ার-এর জীবনে একটি চরম পরিবর্তন আনলো।  যা তাকে ঈশ্বরমুখী করে দিয়েছিলো। আর একটা জিনিস সে বুঝছিলো, তা হচ্ছে, মানুষ প্রতিনিয়ত তার সংস্কার নিয়ে দেহ থেকে দেহান্তরে ভ্রমন করছে। আমরা স্বল্পবুদ্ধি নিয়ে এর সত্যতা বুঝতে পারবো না।

জীবের মৃত্যু কখন এসে হানা দেবে, তা সাধারন জীবের অজ্ঞাত। আর এই মৃত্যু মুহূর্তে মানুষ বড়  অসহায় বোধ করে। মানুষ যখন সুস্থ  সবল থাকে, তখন সে ধুলিকনাকে মাড়িয়ে চলে। মৃত্যুতে সে  নিজেই ধুলিকনাতে পরিণত হয়ে যায়। চুল যখন মাথায় থাকে, তখন আমাদের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে। যখন সে খাবার থালায় বসতে চায়, তখন সে ঘৃণার বস্তু হয়ে যায়।  সাপ  যখন শিবের  মাথায় থাকে, তখন সে পূজার যোগ্য, মাথা থেকে নেবে গেলেই লাঠির আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে যায়। দেহে যতক্ষন প্রাণ থাকে, ততক্ষন দেহের কদর। প্রাণহীন দেহ পরম-প্রিয়জনের কাছেও ত্যাগের বস্তু, ভয়ের বস্তু। সবথেকে আশ্চর্য্যের কথা হচ্ছে, প্রতিমুহূর্তে আমরা মৃত্যুর সম্মুখীন হচ্ছি, তথাপি ভাবছি, মৃত্যুর আমার জন্য নয়। সব মৃত্যুর কথাই আমরা ভুলে যাই। এমনকি আমরা আমাদের নিজেদের মৃত্যুর কথাও ভুলে যাই। আমি নিজে যে কতবার মারা গেছি, সে সব আমি ভুলে বসে আছি। আমি আবার মরবো, আবার ভুলে যাবো। কিন্তু মৃত্যুভয় আমাদের পিছু হটে  না। তাই আমরা সবাই মৃত্যু ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে আছি। জীবনে চার-পাঁচটি জিনিস আমাদের এড়িয়ে যাবার উপায় নেই।

১. শিশু থেকে আমরা একদিন অবশ্য়ই বৃদ্ধ হবো।
২. কোনো না কোনো দিন আমাদের এই শরীর  অসুস্থ হয়ে পড়বেই।  তা আপনি যতই সাবধানে চলুন না কেন, বা আপনি নিজে ডাক্তার হলেও অসুখ আপনাকে রেয়াত করবে না।
৩. আমাদের সবাইকে একদিন মরতেই হবে। এবং তাও একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই।  অর্থাৎ যে ধরনের শরীর  আপনি পেয়েছেন, সেই শরীরের পরমায়ু জন্মের সময় নির্দিষ্ট হয়ে গেছে।
৪. প্রতিনিয়ত আমাদের চাহিদার পরিবর্তন হতে থাকবে। এর থেকে রেহাই নেই।
৫. আমাদের ভাবনা-চিন্তা, কর্ম্ম আমাদের পরবর্তী শরীরের রূপ নির্দিষ্ট করছে, এর কোনো অন্যথা নেই।

অর্থাৎ আজকে আমি যে শরীর  প্রাপ্ত হয়েছি,  তা আমার পূর্ব্ব-পূর্ব্ব জীবনের কর্ম্ম ও ভাবনা-চিন্তার ফল। বার্ধক্যে আমাদের যৌবনের অহংকার থাকে না। অসুস্থ অবস্থায় আমার স্বাস্থ্যের অহংকার আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মৃত্যুতে আমাদের জীবনের অহংকার থাকে না। কোনো জিনিস দীর্ঘকাল ব্যবহারের ফলে জীর্ন হয়ে গেলে, বা আমাদের কোনো জিনিস হারিয়ে গেলে, তার প্রতি আমাদের আসক্তি ত্যাগ করা উচিত। এবং বোঝা উচিত যে হয়, সেটি আমার দোষে হারিয়ে গেছে, বা বহুদিন ব্যবহারের ফলে, সেটি আর ব্যবহার-যোগ্য নেই। এর জন্য অন্য কেউ দায়ী নয়। নিয়তি, বা অপব্যবহার জনিত কারনে এটি ঘটে থাকতে পারে। আসলে আমিই আমার বর্তমান অবস্থার জন্য  দায়ী।

একটা অদৃশ্য শক্তি প্রতিনিয়ত নিখিল বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে। একটু ধীর হয়ে বসে  ভাবলেই, এটা আমরা বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারি । কিন্তু আমাদের মৃত্যুর আগে কি ছিলাম, আর মৃত্যুর পরে আমরা কি হবো, সেটা আমাদের কাছে অজানা। আমরা কেন সুখ-দুঃখের মধ্যে হাবুডুবু খাই, তা আমরা জানি না। এই পৃথিবীলোক বলুন, আর সৌরজগৎ বলুন, সবই সূক্ষ্ম নিয়মের দ্বারা শৃঙ্খলিত। এ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যে সময়ের যে ব্যবধান, একে আজও আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। বটগাছ কেন দীর্ঘকাল বাঁচে, কচ্ছপ কেন দীর্ঘকাল বাঁচে, স্বামী ত্রৈলঙ্গ বা বাবা লোকনাথ কেন সাধারণের মানুষের থেকে বেশিদিন বাঁচেন , তা আমরা জানি না। অথবা একটা কীট কেন কয়েকঘন্টা বাঁচে, পাখী কেন মাত্র ২-৩ বছর বাঁচে, একটা কুকুর কেন ৮-১০ বছর বাঁচে, মানুষ কেন ৮০-১০০ বছর  বাঁচে, তা আমরা জানি না ।  জীবে জীবে  এই যে জীবনধারণের সময়কাল, কে এর নিয়ন্তা, কে এর নির্ধারক ? এর ব্যতিক্রম কিভাবেই হয়। এই সব প্রশ্নের জবাব আমাদের কাছে নেই। তবে এটা ঠিক যে, কিছু মহাত্মা আছেন, কিছু অনুসন্ধিৎসু মানুষ আছেন, যাঁরা এইসব প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন। এই মহাত্মাগণ আসলে বহু জন্মের অভিজ্ঞতালব্ধ মহান পুরুষ। আমরা যারা সদ্য সদ্য মনুষ্য শরীর পেয়েছি, তাদের পক্ষে এদের কথার গুরুত্ত্ব বোঝা সম্ভব নয়। আমাদের মধ্যে নিম্নতর পশুবৃত্তি লোপ পায়নি, যথার্থ জ্ঞানের উন্মেষ হয় নি।

যাই হোক, তাঁরা বলছেন, আমাদের সুখ-দুঃখের মূল হচ্ছে আমাদের মন। আর আমাদের অজ্ঞানতা আমাদের দুঃখ দুর্দশার  মূল। আমরা যত  অজ্ঞানতা কাটিয়ে উঠতে পারবো, আমাদের মন তত পরিষ্কার হবে, আর আমরা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবো। ঠাকুর বলতেন, যে সয় সেই রয়। প্রতিটি সংসারে সহনশীল মানুষের সংখ্যা যত বেশি থাকবে,সেই সংসার তত সুখের হবে। পৃথিবীটা সহাবস্থানের জায়গা। এখানে একজন আর একজনের  সহযোগিতার মাধ্যমেই বেঁচে থাকে। কিন্তু আমরা আমাদের ব্যক্তি স্বার্থে, গোষ্ঠীস্বার্থে, দেশের স্বার্থে অন্যের ক্ষতি সাধন করবার কথা ভাবি। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে  হবে। আমাদের একে অন্যের পরিপূরক হতে হবে। একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। আমাকে কেউ যেন ভয় না পায়।  আমিও যেন অন্যকে ভয় না করি। অন্তরের ভিতর থেকে ভালো বাসতে  হবে সবাইকে । বসুধৈব কুটুম্বকম।

কিন্তু আমাদের মুশকিল হচ্ছে, আমাদের যারা শিক্ষক, সমাজের যারা অধ্যাপক, তাঁরা আমাদের মধ্যে রাগ, দ্বেষ, ঘৃণা ইত্যাদি আবেগকে জাগিয়ে সমাজকে উদ্দীপ্ত করে, তাপ গ্রহণ করতে চান।

তাইতো দেখি, বৈদিক শাস্ত্রের অমোঘ বাণী :

অথর্ববেদ দ্বিতীয় কান্ড : চতুর্থ অনুবাক  : দ্বিতীয় সুক্ত : পৃ : ৪৭ 

অগ্নে যৎ তে  তপস্তেন তং প্রতি তপ যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ১
হে অগ্নি  তোমার যে সন্তাপ শক্তি আছে, তা দিয়ে আমাদের শত্রুর প্রতি প্রজ্বলিত হও, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
অগ্নে যৎ হরস্তেন  তং প্রতি হর যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ২
হে অগ্নি তোমার যে সংহার শক্তি আছে, তা দিয়ে তুমি শত্রুদের সংহার করো, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
 অগ্নে যৎ তেঽর্চিস্তেন তং প্রত্যর্চ যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ৩
হে অগ্নি, তোমার যে দীপ্তি আছে, তা দিয়ে তাকে দগ্ধ করবার জন্য দীপ্ত হও, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
অগ্নে যৎ তে শোচিস্তেন তং  প্রতি শোচ যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ৪
হে অগ্নি,  তোমার যে শোকজনন সামর্থ আছে, তা দিয়ে তাকে শোকযুক্ত করো, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
অগ্নে যৎ তে তেজস্তেন তম তেজসং কৃনু  যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ৫ 
হে অগ্নি, তোমার যে পরকে অভিভব করার যে তেজ আছে, তা দিয়ে তাকে নিস্তেজ করো, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।

অগ্নিদেব  আমাদের কথা অনুযায়ী কাজ করেন কি না জানিনা। কিন্তু আমরাই অগ্নিকে ইন্ধন যোগাই, একথা সত্য । অথচ অধিক সত্য হচ্ছে, পৃথিবীতে আমরা কেউ কারুর শত্রূ নোই। আমরা সবাই পরমাত্মার অংশ। পরম-পিতার সন্তান। আমরা সবাই এক - অভিন্ন।এই অমোঘ সত্য আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে।  সবাই ভালো থাকুক, সবাই নিরাতঙ্কে থাকুক।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 


Saturday 18 April 2020

করোনা

করোনা -  ভয়  দূর করবো কি করে  ? 

ওম সর্ব্বেষাং মঙ্গলং ভূয়াৎ, সর্ব্বে সন্তু নিরাময়াঃ। 
সর্ব্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু, মা কশ্চিৎ দুঃখভাক ভবেৎ।   

চারিদিকে একটা ভয়ানক আতঙ্কের আবহ তৈরি হয়েছে। এতবড়ো আতঙ্ক ইতিহাসে কখনো তৈরি হয়েছে বলে জানা নেই। আর আতঙ্কের কারন হচ্ছে করোনা ভাইরাস।  মারণরোগের অদৃশ্য জীবাণু। করোনা  ভাইরাস একধরনের জীবাণু যা মানুষকে তৎক্ষণাৎ মেরে  ফেলতে পারে । আর এর জন্য না আছে কোনো ঔষধ, না আছে কোনো প্রতিষেধক। এমনকি এই রোগটাকে বা এই রোগের ভাইরাসের বাহক হচ্ছে মানুষের শরীর। তাই এর জন্য মানুষকে বিচ্ছিন্ন রাখবার জন্য, একটা মরিয়া চেষ্টা চালানো হচ্ছে। আসলে অজানাকে মানুষের ভীষণ ভয়। তা সে অজানা রোগই বলুন, আর অজানা ভবিষ্যৎ বলুন। সরকারের পক্ষ থেকে যা সাবধানতা নেওয়া হয়েছে,  ডাক্তার বিশেষজ্ঞরা যা  পরামর্শ দিচ্ছেন, তা আমাদের অবশ্য়ই পালন করা উচিত। একটা জিনিস খেয়াল রাখা উচিত  সেটা  হচ্ছে, আমার দ্বারা যেন অন্যের ক্ষতি না হয়।
আমাদের সমাজে  সংক্রামক রোগের  জীবাণুকে (virus) নাশ করবার জন্য, বা তাড়ানোর জন্য, একটা চিরাচরিত প্রথা আছে।  আর তা হচ্ছে ধুপ-গোগগুল-লোবান-কর্পূর ইত্যাদি মিশিয়ে বা আলাদা ভাবে  নারকেলের ছোবড়ার দিয়ে ধোঁয়া দেওয়া। এছাড়া, উলুধ্বনি,শঙ্খধ্বনি, ঘন্টার ধ্বনি, কাঁসরের  ধ্বনি, এমনকি ডমরুর ধ্বনি, সংক্রামক জীবাণুকে দূরে তাড়াতে সাহায্য করে। সাধুগণ যে ধুনি জ্বেলে বসে থাকেন, তাতেও জীবাণু নাশ হতে পারে। ঘিয়ের প্রদীপ, নিদেন পক্ষে সর্ষের তেলের প্রদীপ, জ্বালিয়ে রাখলে এমনকি মোমের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখলেও, আমরা নির্দিষ্ট পরিসরে জীবাণু মুক্ত থাকতে পারি। এগুলো আপনাদের সবার জানা, আমরা শুধু মনে করিয়ে দিলাম।
এবার   একটু অন্য কথায় আসি। এই করোনার মাধ্যমে আমরা কি ভালো কিছু পেতে পারি ? আপনি হয়তো ভাবছেন, সে আবার কি ?   দেখুন, আমরা  এখন ঘরবন্দি হয়ে আছি। চারিদিক এখন নিঝুম। এমনকি এখন শহর দূষণ মুক্ত।  এই সময়টাকে কাজে লাগান। আসলে প্রত্যেক সাধকের একটু নির্জনতা প্রয়োজন। তো তো আজকের এই বাধ্যতামূলক নির্জনতা আমাদের জীবনকে বদলে দিতে পারে। এই সময়, ভালো বই পড়ুন, ধ্যান-ধারণায় একটু বেশি সময় দিতে পারি এখন আমরা । পরিবারের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর সময়তো  এটা।  এর পরে আর এই সুযোগ পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। তাই সবার সঙ্গে আনন্দে থাকুন।   এই সময় অবশ্যই প্রাণায়াম করুন, নিয়ম করে। যারা সময়ের দোহাই দিয়ে প্রাণায়ামকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন, তাদেরকে বলি এই সময়ে প্রাণায়ামে অভ্যস্ত করে নিন নিজেকে । প্রাণায়ামে আপনার অবশ্যই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। তা সে যে কোনো রোগ-ই হোক না কেন। আর একটা কাজ করতে পারেন, সেটা হচ্ছে, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা। প্রার্থনার মধ্যে যে অসীম শক্তি রয়েছে, সেটা এবার নিজের থেকে পরীক্ষা করবার সময় এসেছে।
দেখুন মারা আমাদের সবার যেতেই হবে। এটা আমরা সবাই জানি। এই চিরসত্যকে স্বীকার করতেই  শিখুন।  তাই মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে, যে কয়দিন বেঁচে আছেন, নির্ভয়ে বাঁচুন । কিন্তু নির্ভয় আমরা হবো কি করে ? দেখুন আজ থেকে ৬০-৭০ বছর  আগে, এমনকি আমাদের  ছেলেবেলায় আমরা দেখেছি, কলেরায় গ্রামের পর গ্রাম উজার  হয়ে যেতে । কলেরার রুগীকে শেষকৃত্য করবার জন্য কোনো লোক পাওয়া যেত  না। আমরা দেখেছি পক্স এর মহামারী। আমরা দেখেছি টি.বি. রুগীর কাছে কেউ যেত  না। প্লেগে একসময় মহামারী হয়েছে। এইসব রোগ এখন হয় পালিয়ে গেছে, নতুবা আমাদের চিকিৎসার আয়ত্ত্বে মধ্যে এসে গেছে।   সত্যি কথা বলতে কি, এই করোনা রোগটা আসছে বিদেশ থেকে। অর্থাৎ যাদের সঙ্গে বিদেশের যোগ আছে, তারাই এই রোগটাকে নিজেদের অজ্ঞাতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তাই এই মুহূর্তে এই রোগ শহর-কেন্দ্রিক।   তো প্লেগ, কলেরা, টিবি যেমন  ছিলো গ্রামের রোগ   । তবে শুরুটা শহর  থেকে হলেও, গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগবে না, যদি না আমরা সতর্ক হই। সত্যি  বলতে কি এই করোনার ঔষধ অবশ্য়ই  আবিষ্কার হয়ে যাবে।  শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাই ধৈর্য্য ধরে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে।  জয় কিন্তু মানুষেরই হবে, রোগের  নয়। মানুষের বিজয় রথ  ধ্বজা উড়িয়ে অবশ্য়ই  এগিয়ে যাবে । 
আমরা সবাই কিন্তু ভাবছি,  যে আমি মরছি না। তো আমি যদি নাই মারা যাই, তবে আর আমার ভয় কিসের ? ভাবনা কিসের ? আর সত্য কথা বলতে কি, আমরা তো কেউ মারাই  যাই না। আমরা স্থূল শরীর  ত্যাগ করি মাত্র। এবং অবশ্য়ই আমাদের বাসনা পূরণের জন্য, আবার নতুন শরীরে আমরা আসবো।  তখন আর করোনা থাকবে না।  তো ভয় না পেয়ে, দুশ্চিন্তা না করে, যতদিন, যতটুকু সময় আমরা এই শরীরে আছি, ততক্ষন আমরা যেন, আমাদের কর্তব্য থেকে বিরত না হই। সবাই ভালো থাকুন। অবশ্য়ই ভালো থাকবেন।  জানবেন, ঈশ্বর যা কিছু করেন, আমাদের মঙ্গলের জন্যই করেন। আমরা ক্ষুদ্রবুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারি না।  কিন্তু সত্য এটাই।  
ওম   শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।


ওম সর্ব্বেষাং মঙ্গলং ভূয়াৎ, সর্ব্বে সন্তু নিরাময়াঃ। 
সর্ব্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু, মা কশ্চিৎ দুঃখভাক ভবেৎ।  
বাড়িতে বসে করোনার  পরীক্ষা কি করে করবো  ? বা করোনা কি করে নিয়ন্ত্রণ করবো ?  
প্রায় পনেরো কুড়ি বছর  আগের কথা।  এই কলকাতার বুকে  আমি একটা আশ্রমে গিয়েছিলাম। সেখানে রাজযোগের তালিম দেওয়া হয়। সাধারণ মানুষকে  এই রাজযোগে  আকৃষ্ট  করবার জন্য,  প্রথম দিন যোগের উপরে একটা সুন্দর  ভাষণ দেওয়া হয়, আর সেটা বাধ্যমূলক ভাবে শুনতে হয় সবাইকে । ভাষণে  যোগের  উপকারিতা, পবিত্র জীবনে যোগের ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে কিছু কথা বলা হতো। এই বক্তব্যের মধ্যে, একটা কথা আমার কানে  খুব বেজেছিল,  আর  সেটা হচ্ছে, ২০২৫ সাল থেকে  নাকি পৃথিবীতে সত্যযুগ  শুরু হবে। আর এই সত্যযুগে প্রবেশ করতে হলে আমাদেরকে একটা  শোধন পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে  হবে, তা সে শারীরিক ভাবেই হোক বা মানসিক ভাবেই হোক।আমাদের চিন্তা ধারায় পবিত্রতা না এলে, আমাদের কর্ম্মে সততা না এলে, আমরা সেই সত্যযুগের জন্য, বিবেচিত হবো না। আর সেই শোধন পদ্ধতি হচ্ছে রাজযোগ।   আমার কাছে সেদিন, কথাগুলোকে একটু অতিমাত্রায়, কল্পনার ফানুস বলে মনে হয়েছিল। শীঘ্রই মহাপ্রলয় আসবে, তাতেকরে এই এই শুদ্ধ আত্মাগুলো শুধু বেঁচে থাকবে, বাকি সবাই মারা যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। 
  
আজ এই গৃহবন্দী অবস্থায় , সেদিনের সেই কথাগুলো মনে পড়ছে । তাহলে কি সেই শোধন ক্রিয়া শুরু হয়ে গেল ? এই কয়দিনের মধ্যেই আমাদের পারিপার্শিক দূষণ অনেকটাই কমের দিকে। পাখিদের কলতান মনে হয়,  একটু বেড়েছে ? শব্দদূষণ তো অনেকটাই কমে গেছে।  এখন দুপুর বেলা রীতিমতো রাস্তাঘাট সুনশান। একটা নিস্তব্ধতা আমাদেরকে  ঘিরে রেখেছে। আর এ সবই সেই করোনা ভাইরাসের ভয় থেকে। সমস্ত রাজনৈতিক দল এখন একসুরে ভাইরাসের মোকাবেলা করতে চাইছে। জনগণ যেন হঠাৎই সচেতন হয়ে উঠেছে। সবাই এখন ভালো ছেলের মতো দুপুর বেলা মায়ের কোলে ঘুমুতে যাচ্ছে। একটা ব্যস্ত জীবন, একটা চঞ্চল ছেলে, একটা অস্থিরমতি ছেলে  যেন শান্ত ধীর হয়ে গেছে। করোনা ভাইরাস আমাদেরকে তাড়া  করে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। অথবা বলা যেতে পারে, আমরা স্বেচ্ছাকৃত ভাবে গৃহবন্দী হয়েছি। আর করোনা আমাদের দোরগোড়ায় এসে গেছে। আমাদের এখনো  করোনা  ভাইরাস আক্রমন করে নি। শুধু আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এযেন সেই ছেলে ঘুমুলো, পাড়া জুড়োলো  বর্গী এলো দেশের মতো অবস্থা ।
যাইহোক, করোনা ভাইরাস  আমাদের দেশে এসে গেছে, এব্যাপারে কোনো সন্দেহের জায়গা নেই । কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আক্রান্ত কি না সেটা আমরা জানি না। কারন প্রথম দিকে নাকি, এটা বোঝাই  যায় না। আর এটা পরীক্ষা করতেও নাকি ৩-৫ দিন  লাগে। আর এই পরীক্ষার ব্যবস্থা সবত্র পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই  করোনা ভাইরাস পরীক্ষা করার সুযোগ এখনো সীমিত। তবে আমাদের অবশ্য়ই সতর্ক থাকতে হবে।  আর সরকারি নির্দেশ মেনে, ডাক্তার  বিশেষজ্ঞ দের পরামর্শ মেনে আমাদের নিজেদেরকে  সামাজিক দূরত্ত্ব বজায় রেখে চলতে  হবে। আনন্দবাজারে দেখছিলাম, আমেরিকা নাকি এক ধরনের কিট আবিষ্কার করেছে, যার দ্বারা  মাত্র মাত্র ৪৫ মিনিটে আক্রান্ত রুগীকে চিহ্নিত করতে পারে। যদিও আমাদের দেশে এখনো এই রিপোর্ট পেতে ৩-৫ দিন লেগে যাচ্ছে। এবং এই পরীক্ষা করবার জন্য যে কীটের প্রয়োজন তা পর্যাপ্ত পরিমানে রাজ্যের  হাতে নেই।

যোগাচার্য্য  রামদেব এই অবস্থায় একটা সমাধান দিয়েছেন। করোনা সম্পর্কে নিজেকে নিজেই শংসাপত্র দেবার একটা উপায় বলেছেন  । আর এই বক্তব্য  ABP NEWS CHANNEL গত ২০-০২-২০২০,  প্রচার করেছে। আপনারা দেখে নিতে পারেন। তিনি বলছেন, অন্তর-কুম্ভক করবার জন্য। অর্থাৎ আপনি যদি, বুক ভোরে শ্বাস নিয়ে, জালন্ধর বন্ধ করে, ১ মিনিট অন্তর-কুম্ভক  করতে পারেন, অর্থাৎ শ্বাসকে ১ মিনিট ভিতরে রুখে দিতে পারেন, তবে আপনি নিশ্চিত, যে করোনা ভাইরাস-এর মতো কোনো জীবাণু আপনার মধ্যে অবশ্য়ই নেই। আসলে কুম্ভক তা সে অন্তরকুম্ভক বলুন, বা বাহ্য কুম্ভক বলুন, এটি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার একটা মাপকাঠি। আর সত্যি কথা বলতে গেলে, আমাদের মুনিঋষিগন বিভিন্ন আসনে  বসে, এই কুম্ভকের সাহায্যে  নিজেকে সুস্থ  সবল রাখতেন বা রাখেন । আমাদের নিজেদের বাস্তব অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে, বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে প্রাণায়ামের গুরুত্ত্ব অপরিসীম । আর প্রাণায়ামের অর্থ  প্রাণবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করা। যোগাচার্য্য  রামদেব পাঁচটি  প্রাণায়ামের অভ্যাস করতে বলেছেন, সঙ্গে সূর্য-নমস্কার। সেগুলো হচ্ছে, ভস্ত্রিকা, কপালভাতি, অনুলোম-বিলোম, ভ্রামরী ও উদ্গীথ।
 আসলে জীবন তো  শ্বাসের খেলা। তো শ্বাসের নিয়ন্ত্রণ মানুষের জীবনী শক্তিকে উজ্জীবিত করে, এটা পরীক্ষিত সত্য । তবে যোগাচার্য্য যে এক মিনিট অন্তর-কুম্ভক  করতে বলেছেন , সেটা সমস্ত সাধারণ মানুষের পক্ষে, বিশেষ করে যারা কোনোদিন প্রাণায়ামের অভ্যাস করেন নি।  তাই বলে ঘাবড়ানোর কিছু নেই  । আচার্য্যদেব  বলছেন, তিনি নিজে দুই থেকে আড়াই মিনিট  কুম্ভক করতে পারেন।   কিন্তু আমরা যদি ৩০-৪০ সেকেন্ড এই শ্বাসকে আমাদের ভিতরে রুদ্ধ করে রাখতে পারি, তাহলে জানবেন,  স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আপনার মধ্যে আছে। অভ্যাসের মাধ্যমে আমাদের এই ক্ষমতাকে বাড়িয়ে নিতে হবে। তবে মনে রাখবেন, অন্তরকুম্ভক করুন, বাহ্য কুম্ভক নয়। বাহ্য কুম্ভক এক মিনিট করা, বহু অভ্যাসের মাধ্যমেই হতে পারে মাত্র । ৫-১০ সেকেন্ড যদি আপনি বাহ্য়  কুম্ভক করতে পারেন, সেটাই যথেষ্ট। আসলে আমাদের যতক্ষন না নাড়ী  শুদ্ধি হচ্ছে, ততক্ষন আমাদের দেহ  বায়ুসাধন প্রক্রিয়া করার উপযুক্ত নয়। তাই আচার্য্য  রামদেব যা বলেছেন, অর্থাৎ পাঁচটি প্রাণায়াম ও সূর্যপ্রণাম, এগুলো আপনি দিনে একবার, সম্ভব হলে ৫টি প্রাণায়াম দিনে দুই বার অভ্যাস করুন। খালি পেটে অভ্যাস করুন। আর নিজেকে পরীক্ষা করবার জন্য অন্তর-কুম্ভক দিনে তিন চার বার করুন । এতে করে আপনার শরীরের মধ্যে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বেড়ে যাবে। আর আপনি তখন বাইরের যেকোনো জীবাণুকে প্রতিহত করতে পারবেন। তা সে করোনা ভাইরাস হোক    বা অন্য কোনো জীবাণু হোক ।
 হার্ট বা ফুসফুসকে অধিক ক্রিয়াশীল রাখতে আর একটা মোক্ষম দাওয়াই আছে, সেটা হচ্ছে প্রতিনিয়ত দুবেলা, আমাদের শাঁখ বাজানো।  শঙ্খ বাজালেও আমাদের ফুসফুস অধিক ক্রিয়াশীল থাকতে পারে।   মূল কথা হচ্ছে, আমাদেরকে নিজেদের থেকেই নিজের শরীরের মধ্যেই রোগের  প্রতিষেধক  ক্ষমতার বৃদ্ধি  করতে হবে। তবেই আমরা সুস্থ -সবল থাকতে পারবো। তা সে আপনি যে বয়সেই থাকুন না কেন। যাদের এই অভ্যাস আছে, তারা জানেন, তাদের প্রত্যক্ষ করেছেন, বেঁচে থাকতে, সুস্থ থাকতে ডাক্তারের চেয়ে বা ঔষদের চেয়ে বেশি দরকার প্রাণবায়ুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, আর প্রতিনিয়ত তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।

শ্রীমৎ স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী তো বলছেন, প্রকৃত যোগী ইচ্ছামৃত্যু  বরণ  করতে পারেন । যারা হঠ যোগের সাধনা করেন, তারা আজীবন জিরোগ করতে পারেন।

এছাড়া, যোগাচার্য্য রামদেব আবার  বলছেন, আমলা, এলেবেরা, গিলোই, তুলসী, এগুলোর  সেবন, আপনাকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করতে  পারে। নিজেকে ঘরবন্দি করা, নিয়মিত প্রাণায়াম করা, এবং আমলা -এলেবেরা-গিলোই-তুলসী সেবন করা, আর  নিজেকে আনন্দে রাখা, এগুলো করলে  শুধু করোনা ভাইরাস থেকে নয়, যেকোনো ভাইরাস থেকেই আপনি সুরক্ষিত থাকতে পারবেন। 
দেখুন করোনা ভাইরাস আক্রমন থেকে আমাদের কি হয় ? করোনা প্রথমে  আমাদের  শ্বাস ক্রিয়াকে বাঁধা সৃষ্টি করে। আমাদের ফুসফুসের ক্রিয়াকে বাধা সৃষ্টি করে। তখন   প্রাণ বায়ুকে নির্ধারিত পরিমানে পাবার জন্য, আমরা শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াকে দ্রুত করতে বাধ্য হই।  অর্থাৎ করোনা আমাদের ফুসফুসের স্বাভাবিক ক্রিয়াকে  বাধা দেয়। ।  আমাদের শ্বাস স্বাভাবিক  ভাবে যতটা গ্রহণ করবার দরকার, সেটা বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুততালে বইতে  থাকে। অর্থাৎ আমাদের ফুসফুস সংক্রামিত হয়েছে। তো কোরোনার আক্রমনে একবার আমাদের ফুসফুস সংক্রামিত হয়ে গেলে, সেটাকে সারিয়ে তোলার ঔষধ এখনো আবিষ্কার হয় নি। ফুসফুসের ক্রিয়া আবার অন্য কারণেও ব্যাহত হতে পারে। তো যে কারণেই  আমাদের ফুসফুস ক্রিয়া ব্যাহত হোক না কেন, তার জন্য, আমরা আগে থেকে যদি প্রাণায়ামে অভ্যস্থ থাকি,  অর্থাৎ প্রাণবায়ু যদি আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে তবে বাহ্যিক কোনো আক্রমন আমাদের কাবু করতে পারবে না। 
ভালো থাকুন, ভালো রাখুন। 

ওম সর্ব্বেসাম স্বস্তিরভবতু, ওম সর্ব্বেসাম শান্তিরভবতু, 
ওম সর্ব্বেসাম পূর্নম ভবতু, ওম সর্ব্বেসাম মঙ্গলম ভবতু। 
ওম শান্তি  শান্তি   শান্তিঃ।  হরি  ওম।

যমরাজ কারুর বাপের কেনা গোলাম নয়।

পরম-পুরুষ শ্রী রামচন্দ্রের  রাজত্বে, বাপের বর্তমানে ছেলের মৃত্যু হচ্ছে। পণ্ডিত  ব্রাহ্মণগণ নিদান দিলেন, শুদ্র শম্বুকের উগ্র তপস্যা এর কারন। তো বিশ্বামিত্র মুনি  রামচন্দ্রকে নিয়ে গভীর জঙ্গলে খুঁজে খুঁজে, শম্বুকের সন্ধান পেলেন। শম্বুক তপস্যা-রত  ছিলেন। রামচন্দ্র তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জানো, তোমার এই তপস্যার জন্য, রাজ্যে অরাজকতা শুরু হয়েছে?  পিতার বর্তমানে পুত্রের মৃত্যু হচ্ছে ? ঋষি শম্বুক বিনীত ভাবে বললেন, যমরাজ কারুর বাপের কেনা গোলাম নয়, মানুষ তার স্বকৃত কর্ম্মফল ভোগ করে মাত্র। বিধির নির্দেশেই জীবের জন্ম-মৃত্যু হয় । এতে মানুষের কোনো হাত নেই। রামচন্দ্র এই ধ্রুবসত্য  বাক্য শুনে, ক্ষনিকের জন্য থমকে গেলেন। বিশ্বামিত্র মুনি রামচন্দ্রকে  বললেন, দেখেছো শুদ্রের স্পর্ধা, রাজার মুখের উপরে কথা বলে। শীঘ্রই নিধন করো, এই পাপিষ্ঠকে। রামচন্দ্র তক্ষুনি ঋষি শম্বুককে তীরবিদ্ধ করে হত্যা করলেন।

শ্রীকৃষ্ণ যজ্ঞ করছেন।  এক ব্রাহ্মণ এসে, কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন। তাঁর নাকি সন্তান জন্মের পরেই পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হয়। এর জন্য দায়ী নিশ্চই রাজ্যের রাজা। তো উপস্থিত সবাই  তাকে শান্ত হতে বললেন।  কিন্তু ব্রাহ্মণ কথা শুনছেন  না। চিৎকার চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিয়েছেন । তো শ্রী কৃষ্ণের কাছে খবর গেলো। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে পাঠালেন। অর্জুন ব্রাহ্মণকে নিয়ে তার বাড়িতে গেলেন, সেখানে কড়া পাহারা দিতে লাগলেন, যাতে যম ব্রাহ্মণের বাড়ির ত্রিসীমানায় না আসতে  পারে।  কিন্তু   শত চেষ্টা করেও, সমস্যার সমাধান করতে পারলেন না। শেষে শ্রীকৃষ্ণ নিজেই সমস্যা সমাধানের জন্য, যমরাজের কাছে গেলেন। যমরাজ বিনীত ভাবে বললেন, বিধির বিধান খণ্ডন করবার ক্ষমতা তার নেই। তো শ্রীকৃষ্ণ সেখান থেকে চললেন, বিধির বিধায়ক   সেই পরম পুরুষ নারায়ণের কাছে। সেখান থেকে তার অনুমিত নিয়ে, ব্রাহ্মণের সমস্ত সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন।

দুটোই পৌরাণিক কাহিনী। তো মৃত্যুকে আপনি কিভাবে দূরে রাখবেন ? সেতো আপনার অধীন নয়। আপনি নিজের সন্তুষ্টির জন্য, মৃত্যুর জন্য অন্যকে দায়ী করে তাকে  মারতে পারেন।  আপনি মৃত্যুকে ডাকতে পারেন। কিন্তু আপনি মৃত্যুকে দূরে সরিয়ে দিতে পারেন না। রামচন্দ্র মৃত্যুকে দূর করবার পরিবর্তে মৃত্যুকেই ডেকে এনেছিলেন। কিন্তু  শ্রীকৃষ্ণ মৃত্যুর সীমিত ক্ষমতাকে অস্বীকার করেন নি, বরং জীবনের মূল উৎসে চলে গিয়েছিলেন। আর সেখান থেকেই পুনরায় জীবনকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। তো আমরা কোন পথ অবলম্বন  করবো ?

বছর  পাঁচেক আগে আমর এক অন্তরঙ্গ বন্ধু মারা যায়। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমরি হাসপাতালে গেলাম। সামান্য একদিনের অসুস্থতায় সে মারা যায়।  অথচ, প্রতিনিয়ত সে ডাক্তারের নির্দেশ  অনুযায়ী, বডি চেক-আপ করতো। তার এই অকালমৃত্যু আমাকে অসহায় করে তোলে। বন্ধুটির একটি মাত্র মেয়ে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠ শেষ করে, সবে চাকরি পেয়েছে। ভাবলাম,  ওর তো ছেলে নেই, মেয়ে-বৌ কতদূর কি করবে, যাই সৎকারের ব্যবস্থা তো করতে হবে। তো আমাদের আর এক বন্ধুকে নিয়ে আমরি হসপিটালে  গেলাম। গিয়ে দেখলাম, ওর স্ত্রী ভেঙে পড়েছেন । কিন্তু মেয়েটিকে দেখলাম, একদিনেই সে যেন বড়ো হয়ে গেছে।  মাকে সামলাচ্ছে, হসপিটালের বিল মেটাচ্ছে, হাসপাতালের স্টাফদের সাথে কথা বলছে, কিভাবে কি করতে হবে, সব জেনে  নিচ্ছে।

ত্রিবান্দ্রম বিশ্ববিদ্যালয়ের মালয়ালাম ভাষার অধ্যাপক ছিলেন, মিস্টার নায়ার। বিশিষ্ট ভদ্রলোক কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই। তাদের ছয় বছরের শিশুটি কিছুদিন ধরেই অসুস্থ থেকে মারা যায় । শিশুটি মৃত্যুর ঠিক আগে, মাকে  বললো বাবাকে একটু ডেকে দাও। ।  বাবা কাছে এলে, ছেলেটি উচ্চস্বরে একটা  স্তোত্র পাঠ  করতে লাগলো। বাবা তো অবাক, এই স্তোত্র তাকে কখনো শেখানো হয় নি।  সে নিজেও এই স্ত্রোত্র কখনো শোনেনি। এর পরেই ছেলেটি দেহ ত্যাগ করলো। এই ঘটনা শ্রী নায়ার-এর জীবনে একটি চরম পরিবর্তন আনলো।  যা তাকে ঈশ্বরমুখী করে দিয়েছিলো। আর একটা জিনিস সে বুঝছিলো, তা হচ্ছে, মানুষ প্রতিনিয়ত তার সংস্কার নিয়ে দেহ থেকে দেহান্তরে ভ্রমন করছে। আমরা স্বল্পবুদ্ধি নিয়ে এর সত্যতা বুঝতে পারবো না।

জীবের মৃত্যু কখন এসে হানা দেবে, তা সাধারন জীবের অজ্ঞাত। আর এই মৃত্যু মুহূর্তে মানুষ বড়  অসহায় বোধ করে। মানুষ যখন সুস্থ  সবল থাকে, তখন সে ধুলিকনাকে মাড়িয়ে চলে। মৃত্যুতে সে  নিজেই ধুলিকনাতে পরিণত হয়ে যায়। চুল যখন মাথায় থাকে, তখন আমাদের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে। যখন সে খাবার থালায় বসতে চায়, তখন সে ঘৃণার বস্তু হয়ে যায়।  সাপ  যখন শিবের  মাথায় থাকে, তখন সে পূজার যোগ্য, মাথা থেকে নেবে গেলেই লাঠির আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে যায়। দেহে যতক্ষন প্রাণ থাকে, ততক্ষন দেহের কদর। প্রাণহীন দেহ পরম-প্রিয়জনের কাছেও ত্যাগের বস্তু, ভয়ের বস্তু। সবথেকে আশ্চর্য্যের কথা হচ্ছে, প্রতিমুহূর্তে আমরা মৃত্যুর সম্মুখীন হচ্ছি, তথাপি ভাবছি, মৃত্যুর আমার জন্য নয়। সব মৃত্যুর কথাই আমরা ভুলে যাই। এমনকি আমরা আমাদের নিজেদের মৃত্যুর কথাও ভুলে যাই। আমি নিজে যে কতবার মারা গেছি, সে সব আমি ভুলে বসে আছি। আমি আবার মরবো, আবার ভুলে যাবো। কিন্তু মৃত্যুভয় আমাদের পিছু হটে  না। তাই আমরা সবাই মৃত্যু ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে আছি। জীবনে চার-পাঁচটি জিনিস আমাদের এড়িয়ে যাবার উপায় নেই।

১. শিশু থেকে আমরা একদিন অবশ্য়ই বৃদ্ধ হবো।
২. কোনো না কোনো দিন আমাদের এই শরীর  অসুস্থ হয়ে পড়বেই।  তা আপনি যতই সাবধানে চলুন না কেন, বা আপনি নিজে ডাক্তার হলেও অসুখ আপনাকে রেয়াত করবে না।
৩. আমাদের সবাইকে একদিন মরতেই হবে। এবং তাও একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই।  অর্থাৎ যে ধরনের শরীর  আপনি পেয়েছেন, সেই শরীরের পরমায়ু জন্মের সময় নির্দিষ্ট হয়ে গেছে।
৪. প্রতিনিয়ত আমাদের চাহিদার পরিবর্তন হতে থাকবে। এর থেকে রেহাই নেই।
৫. আমাদের ভাবনা-চিন্তা, কর্ম্ম আমাদের পরবর্তী শরীরের রূপ নির্দিষ্ট করছে, এর কোনো অন্যথা নেই।

অর্থাৎ আজকে আমি যে শরীর  প্রাপ্ত হয়েছি,  তা আমার পূর্ব্ব-পূর্ব্ব জীবনের কর্ম্ম ও ভাবনা-চিন্তার ফল। বার্ধক্যে আমাদের যৌবনের অহংকার থাকে না। অসুস্থ অবস্থায় আমার স্বাস্থ্যের অহংকার আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মৃত্যুতে আমাদের জীবনের অহংকার থাকে না। কোনো জিনিস দীর্ঘকাল ব্যবহারের ফলে জীর্ন হয়ে গেলে, বা আমাদের কোনো জিনিস হারিয়ে গেলে, তার প্রতি আমাদের আসক্তি ত্যাগ করা উচিত। এবং বোঝা উচিত যে হয়, সেটি আমার দোষে হারিয়ে গেছে, বা বহুদিন ব্যবহারের ফলে, সেটি আর ব্যবহার-যোগ্য নেই। এর জন্য অন্য কেউ দায়ী নয়। নিয়তি, বা অপব্যবহার জনিত কারনে এটি ঘটে থাকতে পারে। আসলে আমিই আমার বর্তমান অবস্থার জন্য  দায়ী।

একটা অদৃশ্য শক্তি প্রতিনিয়ত নিখিল বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে। একটু ধীর হয়ে বসে  ভাবলেই, এটা আমরা বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারি । কিন্তু আমাদের মৃত্যুর আগে কি ছিলাম, আর মৃত্যুর পরে আমরা কি হবো, সেটা আমাদের কাছে অজানা। আমরা কেন সুখ-দুঃখের মধ্যে হাবুডুবু খাই, তা আমরা জানি না। এই পৃথিবীলোক বলুন, আর সৌরজগৎ বলুন, সবই সূক্ষ্ম নিয়মের দ্বারা শৃঙ্খলিত। এ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যে সময়ের যে ব্যবধান, একে আজও আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। বটগাছ কেন দীর্ঘকাল বাঁচে, কচ্ছপ কেন দীর্ঘকাল বাঁচে, স্বামী ত্রৈলঙ্গ বা বাবা লোকনাথ কেন সাধারণের মানুষের থেকে বেশিদিন বাঁচেন , তা আমরা জানি না। অথবা একটা কীট কেন কয়েকঘন্টা বাঁচে, পাখী কেন মাত্র ২-৩ বছর বাঁচে, একটা কুকুর কেন ৮-১০ বছর বাঁচে, মানুষ কেন ৮০-১০০ বছর  বাঁচে, তা আমরা জানি না ।  জীবে জীবে  এই যে জীবনধারণের সময়কাল, কে এর নিয়ন্তা, কে এর নির্ধারক ? এর ব্যতিক্রম কিভাবেই হয়। এই সব প্রশ্নের জবাব আমাদের কাছে নেই। তবে এটা ঠিক যে, কিছু মহাত্মা আছেন, কিছু অনুসন্ধিৎসু মানুষ আছেন, যাঁরা এইসব প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন। এই মহাত্মাগণ আসলে বহু জন্মের অভিজ্ঞতালব্ধ মহান পুরুষ। আমরা যারা সদ্য সদ্য মনুষ্য শরীর পেয়েছি, তাদের পক্ষে এদের কথার গুরুত্ত্ব বোঝা সম্ভব নয়। আমাদের মধ্যে নিম্নতর পশুবৃত্তি লোপ পায়নি, যথার্থ জ্ঞানের উন্মেষ হয় নি।

যাই হোক, তাঁরা বলছেন, আমাদের সুখ-দুঃখের মূল হচ্ছে আমাদের মন। আর আমাদের অজ্ঞানতা আমাদের দুঃখ দুর্দশার  মূল। আমরা যত  অজ্ঞানতা কাটিয়ে উঠতে পারবো, আমাদের মন তত পরিষ্কার হবে, আর আমরা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবো। ঠাকুর বলতেন, যে সয় সেই রয়। প্রতিটি সংসারে সহনশীল মানুষের সংখ্যা যত বেশি থাকবে,সেই সংসার তত সুখের হবে। পৃথিবীটা সহাবস্থানের জায়গা। এখানে একজন আর একজনের  সহযোগিতার মাধ্যমেই বেঁচে থাকে। কিন্তু আমরা আমাদের ব্যক্তি স্বার্থে, গোষ্ঠীস্বার্থে, দেশের স্বার্থে অন্যের ক্ষতি সাধন করবার কথা ভাবি। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে  হবে। আমাদের একে অন্যের পরিপূরক হতে হবে। একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। আমাকে কেউ যেন ভয় না পায়।  আমিও যেন অন্যকে ভয় না করি। অন্তরের ভিতর থেকে ভালো বাসতে  হবে সবাইকে । বসুধৈব কুটুম্বকম।

কিন্তু আমাদের মুশকিল হচ্ছে, আমাদের যারা শিক্ষক, সমাজের যারা অধ্যাপক, তাঁরা আমাদের মধ্যে রাগ, দ্বেষ, ঘৃণা ইত্যাদি আবেগকে জাগিয়ে সমাজকে উদ্দীপ্ত করে, তাপ গ্রহণ করতে চান।

তাইতো দেখি, বৈদিক শাস্ত্রের অমোঘ বাণী :

অথর্ববেদ দ্বিতীয় কান্ড : চতুর্থ অনুবাক  : দ্বিতীয় সুক্ত : পৃ : ৪৭ 

অগ্নে যৎ তে  তপস্তেন তং প্রতি তপ যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ১
হে অগ্নি  তোমার যে সন্তাপ শক্তি আছে, তা দিয়ে আমাদের শত্রুর প্রতি প্রজ্বলিত হও, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
অগ্নে যৎ হরস্তেন  তং প্রতি হর যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ২
হে অগ্নি তোমার যে সংহার শক্তি আছে, তা দিয়ে তুমি শত্রুদের সংহার করো, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
 অগ্নে যৎ তেঽর্চিস্তেন তং প্রত্যর্চ যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ৩
হে অগ্নি, তোমার যে দীপ্তি আছে, তা দিয়ে তাকে দগ্ধ করবার জন্য দীপ্ত হও, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
অগ্নে যৎ তে শোচিস্তেন তং  প্রতি শোচ যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ৪
হে অগ্নি,  তোমার যে শোকজনন সামর্থ আছে, তা দিয়ে তাকে শোকযুক্ত করো, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
অগ্নে যৎ তে তেজস্তেন তম তেজসং কৃনু  যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ৫ 
হে অগ্নি, তোমার যে পরকে অভিভব করার যে তেজ আছে, তা দিয়ে তাকে নিস্তেজ করো, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।

অগ্নিদেব  আমাদের কথা অনুযায়ী কাজ করেন কি না জানিনা। কিন্তু আমরাই অগ্নিকে ইন্ধন যোগাই, একথা সত্য । অথচ অধিক সত্য হচ্ছে, পৃথিবীতে আমরা কেউ কারুর শত্রূ নোই। আমরা সবাই পরমাত্মার অংশ। পরম-পিতার সন্তান। আমরা সবাই এক - অভিন্ন।এই অমোঘ সত্য আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে।  সবাই ভালো থাকুক, সবাই নিরাতঙ্কে থাকুক।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 
  

Friday 17 April 2020

করোনা নিধন মানস-যজ্ঞ :

করোনা নিধন মানস-যজ্ঞ :

মানুষ যখনই যার কাছ থেকে ভয় পেয়েছে, তখনই তার পুজো শুরু করেছে। যার শক্তিকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, আমরা তার কাছে প্রার্থনা করি, আমাদের ক্ষতি না করবার জন্য । অথবা বিশ্বশক্তির কাছে, প্রার্থনা করি, এই মনুষ্য নিধনকারী অশুভ শক্তিকে বিনাশের জন্য। আমরা সূর্যদেবের পুজো করে থাকি।  আমরা মা-শীতলার পুজো করে থাকি। আজ আমরা করোনা নিধন মানস-যজ্ঞ  করবো, বিশ্ব শক্তির কাছে, প্রার্থনা মন্ত্র  উচ্চারণ করবো, করোনার নিধনের জন্য। আর এই মন্ত্র আমরা উচ্চারণ করবো, আমাদের মুনি-ঋষিদের দেওয়া অথর্ব, যজুঃ  বেদ  থেকে।

খরস্রোতা নদী পার হতে গেলে, আমাদের শারীরিক শক্তি দরকার, সাঁতার বিদ্যা আয়ত্ত্ব করা দরকার, আর দরকার আত্মবিশ্বাস। বাঁশের সাঁকো পেরোতে গেলে নির্ভিক হতে হবে, স্থির চিত্ত হতে হবে। চঞ্চল চিত্তে বাঁশের সাঁকো পেরুনো যায় না।
মনকে শান্ত করবার জন্য, আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য, বিশ্বশক্তির কাছে প্রার্থনা এক আশ্চর্য্য ফল প্রদান করতে পারে। আজ  আমরা তারই চর্চা করবো।

মনে মনে ইট-মাটি দিয়ে একটি যজ্ঞ বেদি নির্মাণ করুন। অথবা পিতলের বা তামার যজ্ঞ পাত্র সংগ্রহ করুন। ডুমুরের ডাল, বা বেল গাছের ডাল   সংগ্রহ করুন, যজ্ঞকাষ্ঠ হিসেবে। ঘি, মধু, চন্দন, কর্পূর, তিল, তুলসী, বেলপাতা, ফুল জল ইত্যাদি   কাছে নিয়ে নিন। সবই কিন্তু মনে মনে।

এবার আচমন করুন। অর্থাৎ মনে মনে হাতের তালুতে খানিকটা গঙ্গা জল নিয়ে ঠোঁট স্পর্শ করুন।
 ওম অমৃতোপস্তরণমসি স্বাহা।
ওম অমৃতাপিধানমসি স্বাহা।
ওম সত্যং যশঃ শ্রীর্ময়ী শ্রয়তাং স্বাহা।
হে অমৃত! তুমি আমার আচ্ছাদন স্বরূপ হও।  হে অমৃত ! তুমি বিচ্ছাদন স্বরূপ হও।  সত্য, যশ এবং ঐশর্য্য  আশ্রয় করুক আমাদেরকে ।

এবার এই মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে শরীরের নির্দিষ্ট অঙ্গে মনে মনে জল স্পর্শ করুন।
মুখে - ওম বাঙমেঅস্যেঽস্তু।
নাসিকায় - ওম নসোর্মে প্রাণঽস্তু।
দুই চোখে -   ওম অক্ষর্মে চক্ষুরস্তু।
দুই কানে - ওম কর্নয়োর্মে শ্রোত্রমস্তু।
দুই বাহুতে - ওম বাহ্বোর্মে বলমস্তু।
দুই উরুতে - ওম উর্ব্বোর্মে ওজঽস্তু।
সর্বাঙ্গে : ওম অরিষ্টানি মেঽঙ্গানি তনুস্তন্বা মে সহ সন্তু।

 এবার শুধু মন্ত্র উচ্চারণ করুন।

ওম ভূঃ ভুবঃ  স্বঃ।
ওম ভূর্ভুবঃ ওম স্বঃ ওম দৌরিব ভুম্না পৃথিবীব  বারিম্ণা ।.
ওম  তস্যান্তে পৃথিবী দেবযজনিপৃষ্ঠে অগ্নিম অন্নাদম অন্নাদ্যায়াদধে।
হে ত্রিলোকেশ্বর, ভূ, ভুব, ও স্বর্গ লোকের অধীশ্বর, তোমাকে প্রণাম। আকাশের মতো ব্যাপক ও জ্যোতিস্মান ভূমির ন্যায় বিস্তৃত তোমার পিঠের উপরে, যেখানে দেবগনের তৃপ্তির জন্য যজ্ঞ হয়, সেই পৃথিবীকে প্রণাম।  অন্নাদি ভস্মিভূত করে যে অগ্নি, সেই  অগ্নিকে আজ আমরা, অন্নাদির জন্যই স্থাপন করছি।
এবার মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে মনে মনে  কর্পুরে অগ্নি সংযোগ করতে হবে।
ওম উদ্বুধ্যস্ব অগ্নে প্রতি জাগৃতি
ত্বম ইষ্টাপুর্তে সং সৃজেথাম অয়ং চ।
অস্মিন্ত সধস্থে অধ্যুত্তর  অস্মিন বিশ্বে দেবা
যজমানশ্চ সীদত।
হে অগ্নি, তুমি জাগ্রত হও, ওঠো।  শ্রৌত ও স্মার্ত কর্ম্মে এই যজ্ঞ বেদিতে স্থিত হও। দ্বিতীয় বেদীতে বিশ্বের সমস্ত দেবগন এবং যজমান উপবেশন করুন।

 যজ্ঞ কাষ্ঠ থেকে ৮ আঙ্গুল পরিমিত কাষ্ঠখন্ড নিয়ে মনে মনে  ঘিয়ে ভিজিয়ে নিন। এবং মন্ত্র উচ্চারণের শেষে অগ্নিতে নিক্ষেপ করুন।

ওম অয়ন্তঃ ইদম আত্মা জাত বেদস্তেন অধ্যস্ব বর্দ্ধস্ব চেদ্ধ বর্দ্ধয় চাস্মান প্রজয়া  পশুভিঃ ব্রহ্মবর্চ্চ সেনান্নাদ্যেন সমধেয় স্বাহা। ইদম অগ্নয়ে জাত বেদসে ইদং ন মম।
হে অগ্নি, এই সমিধ তোমার আধার, এর দ্বারা তুমি প্রজ্জ্বলিত হও, বর্ধিত হও  এবং আমাদেরকে বর্দ্ধিত করো। সমস্ত সন্তান-সন্ততিদের বর্দ্ধিত করো। সমস্ত গৃহপালিত পশুদের বর্দ্ধিত করো।  আমাদের অন্নাদি বর্দ্ধিত করো। আমাদের ব্রাম্হতেজ দান করো। এই আহুতি জাতবেদা অগ্নির জন্য, আমার জন্য নহে।
এবার প্রতি মন্ত্রের শেষে যজ্ঞানীতে ঘৃত আহুতি দিন মনে মনে।
 অথর্ব বেদ - তৃতীয় অনুবাক -

তৃতীয় সুক্ত :  ওং আয়ুৰ্দা অগ্নে জরসং বৃণানো ঘৃত প্রতীকো ঘৃতপৃষ্ঠো অগ্নে। ঘৃতং পীত্বা মধু চারু গব্যং পিতেব পুত্রানভি রক্ষতাদিমম। (১)
 হে আয়ুদানকারী অগ্নি, হে জরাপর্য্ন্ত আয়ুদানকারী অগ্নি, তুমি ঘৃতপ্রতীক, তুমি ঘৃতপৃষ্ঠ। আমাদের দ্বারা আহুত মধুর নির্মল ঘৃত  পান করে, তুষ্ট হয়ে, পিতা যেমন পুত্রকে রক্ষা করে, সেই ভাবে তুমি এই মানবের রক্ষা করো।
ওং পরি ধত্ত ধত্ত নো বর্চসেমং জরামৃত্যুং কৃনিত দীর্ঘমায়ুঃ। (২)
 হে দেবগন, আমাদেরকে তুমি এমন কাপড় পরিয়ে দাও,  আমাদেরকে এমন তেজস্বী করো, যাতে আমাদের অকাল-মৃত্যু না হয়, আমাদেরকে তুমি দীর্ঘায়ু করো।

পঞ্চম সুক্ত :
যথা দৌশ্চ পৃথিবী, চ ন বিভীতো ন রিষ্যতঃ। এবা মে প্রাণ মা বিভেঃ।  ১
দেবাদির আশ্রয়রূপ দ্যুলোক ও মনুষ্যাদির আশ্রয়স্থল এই ভূলোক।  দেব ও মনুষ্যের উপজীব্য এই ভূলোক ও দ্যুলোক বলে এখানে তাদের কোনো ভয় নেই, এখানে বিনষ্ট হবার কোনো কারন নেই। তাই হে প্রাণ, শত্রূ, গ্রহ ও রোগাদি থেকে ভয় বা মরন আশঙ্কা করো না।
যহাঽশ্চ রাত্রি চ ন বিভীতো ন রিষ্যতঃ। এবা মে প্রাণ মা বিভেঃ ২
এখানে দিন রাত্রি কখনো ভীত হয় না, বিনষ্ট হয় না। অতয়েব হে প্রাণ তুমি ভয় বা মরণের আশঙ্কা করো না।
যথা সূর্যশ্চ চন্দ্রশ্চ ন  বিভীত  ন রিষ্যতঃ।  এবা মে প্রাণ মা বিভেঃ ৩
এখানে চন্দ্র সূর্য কখনো ভীত  বা বিনষ্ট হয় না। অতয়েব প্রাণ তুমি ভয় বা মরণের আশঙ্কা করো না।
যথা সত্যাং চানৃত্যং চ ন বিভীত  ন রিষ্যতঃ।  এবা মে প্রাণ মা বিভেঃ। ৫
এখানে সত্য়বস্তু কখনো ভীত বা বিনষ্ট হয় না।  অতয়েব হে প্রাণ তুমি ভয় বা মরণের আশঙ্কা করো না।
ষষ্ঠ সুক্ত :
প্রাণাপানৌ মৃত্যোর্মা পাতং স্বাহা। ১
হে প্রাণ ও অপান দেবতাগণ তোমরা আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করো। স্বাহা মন্ত্রে তোমাকে আহুতি দিচ্ছি।
দ্যাবাপৃথিবী উপশ্রুতা মা পাতং স্বাহা।  ২
হে দ্যাবা পৃথিবী শ্রবণশক্তি প্রদান করে, আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করো। স্বাহা মন্ত্রে তোমাকে আহুতি দিচ্ছি।
সূর্য চক্ষুষা মা পাহি স্বাহা।  ৩
হে চক্ষুর দেবতা সূর্য তুমি রূপ দর্শন শক্তির দ্বারা আমাদের মৃত্যুর  হাত থেকে রক্ষা করো। স্বাহা মন্ত্রে তোমাকে আহুতি দিচ্ছি।
অগ্নে বৈশ্বানর বিশ্বৈর্মা দেবৈঃ পাহি স্বাহা।  ৪
হে বৈশ্বানর অগ্নি, সমস্ত দেবতারদের সাথে আমাকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করো। স্বাহা মন্ত্রে তোমাকে আহুতি দিচ্ছি।
বিশ্বম্ভর বিশ্বেন মা ভরসা পাহি স্বাহা। 
হে বিশ্বম্ভর সকল পোষন শক্তির দ্বারা আমাকে মৃত্য থেকে রক্ষা করো। স্বাহা মন্ত্রে তোমাকে আহুতি দিচ্ছি।

সপ্তম সুক্ত :
ওজোঽস্যোজো মে দাঃ স্বাহা। ১ 
হে অগ্নি তুমি ওজোরূপ, আমাকে ওজ দাও।   স্বাহা মন্ত্রে তোমাকে আহুতি দিচ্ছি।
সহোঽসি সহো মে দাঃ স্বাহা। ২
হে অগ্নি, তুমি তেজ রূপ আমাকে তেজ দাও। স্বাহা মন্ত্রে তোমাকে আহুতি দিচ্ছি।
বলমসি বলং মে দাঃ স্বাহা। ৩
হে অগ্নি, তুমি বলরূপ, আমাকে বল দাও। স্বাহা মন্ত্রে তোমাকে আহুতি দিচ্ছি।
আয়ুর স্যায়ুর্মে  দাঃ স্বাহা। ৪
হে অগ্নি তুমি আয়ুরূপ, আমাকে আয়ু দাও। স্বাহা মন্ত্রে তোমাকে আহুতি দিচ্ছি।
শ্রোত্রমসি শ্রোত্রং  মে দাঃ স্বাহা। ৫
হে অগ্নি তুমি শ্রোত্র রূপ, আমাকে শ্রবণ শক্তি দাও। স্বাহা মন্ত্রে তোমাকে আহুতি দিচ্ছি।
চক্ষুরসি চক্ষুর্মে   দাঃ স্বাহা। ৬
হে অগ্নি তুমি চক্ষুরূপ, আমাকে দর্শন শক্তি দাও।  স্বাহা মন্ত্রে তোমাকে আহুতি দিচ্ছি।

অথর্ববেদ দ্বিতীয় কান্ড : চতুর্থ অনুবাক  : দ্বিতীয় সুক্ত : পৃ : ৪৭ 

অগ্নে যৎ তে  তপস্তেন তং প্রতি তপ যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ১
হে অগ্নি  তোমার যে সন্তাপ শক্তি আছে, তা দিয়ে আমাদের শত্রুর প্রতি প্রজ্বলিত হও, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
অগ্নে যৎ হরস্তেন  তং প্রতি হর যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ২
হে অগ্নি তোমার যে সংহার শক্তি আছে, তা দিয়ে তুমি শত্রূদের  সংহার করো, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
 অগ্নে যৎ তেঽর্চিস্তেন তং প্রত্যর্চ যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ৩
হে অগ্নি, তোমার যে দীপ্তি আছে, তা দিয়ে তাকে দগ্ধ করবার জন্য দীপ্ত হও, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
অগ্নে যৎ তে শোচিস্তেন তং  প্রতি শোচ যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ৪
হে অগ্নি,  তোমার যে শোকজনন সামর্থ আছে, তা দিয়ে তাকে শোকযুক্ত করো, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
অগ্নে যৎ তে তেজস্তেন তম তেজসং কৃনু  যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ৫ 
হে অগ্নি, তোমার যে পরকে অভিভব করার যে তেজ আছে, তা দিয়ে তাকে নিস্তেজ করো, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।

তৃতীয় সুক্ত :
 বায়ো যৎ তে  তপস্তেন তং প্রতি তপ যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ১
হে বায়ু,  তোমার যে সন্তাপ শক্তি আছে, তা দিয়ে আমাদের শত্রূর  প্রতি প্রজ্বলিত হও, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
বায়ো  যৎ হরস্তেন তং   প্রতি হর যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ২
হে বায়ু, তোমার যে সংহারণ শক্তি আছে, তা দিয়ে তুমি শত্রুদের সংহার করো,যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
বায়ো যৎ তেঽর্চিস্তেন তং প্রত্যর্চ যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ৩
হে বায়ু, তোমার যে দীপ্তি আছে, তা দিয়ে তাকে দগ্ধ করবার জন্য দীপ্ত হও, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
বায়ো যৎ তে শোচিস্তেন তং  প্রতি শোচ যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ৪
হে বায়ু ,  তোমার যে শোকজনন সামর্থ আছে, তা দিয়ে তাকে শোকযুক্ত করো, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
বায়ো যৎ তে তেজস্তেন তম তেজসং কৃনু  যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ৫ 
হে বায়ু , তোমার যে পরকে অভিভব করার যে তেজ আছে, তা দিয়ে তাকে নিস্তেজ করো, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।

পঞ্চম সুক্ত  :
চন্দ্র  যৎ তে  তপস্তেন তং প্রতি তপ যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ১
হে চন্দ্র   তোমার যে সন্তাপ শক্তি আছে, তা দিয়ে আমাদের শত্রুর প্রতি প্রজ্বলিত হও, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
চন্দ্র  যৎ হরস্তেন তং   প্রতি হর যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ২
হে চন্দ্র  তোমার যে সংহারণ শক্তি আছে, তা দিয়ে তুমি শত্রুদের সংহার করো,যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
চন্দ্র  যৎ তেঽর্চিস্তেন তং প্রত্যর্চ যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ৩
হে চন্দ্র , তোমার যে দীপ্তি আছে, তা দিয়ে তাকে দগ্ধ করবার জন্য দীপ্ত হও, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
চন্দ্র  যৎ তে শোচিস্তেন তং প্রতি শোচ যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ৪
হে চন্দ্র ,  তোমার যে শোকজনন সামর্থ আছে, তা দিয়ে তাকে শোকযুক্ত করো, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
চন্দ্র  যৎ তে তেজস্তেন তম তেজসং কৃনু  যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ৫ 
হে চন্দ্র , তোমার যে পরকে অভিভব করার যে তেজ আছে, তা দিয়ে তাকে নিস্তেজ করো, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।

ষষ্ঠ সুক্ত :
অপো যদ্ বস্তুপস্তেন তং প্রতি তপত  যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ১
হে চন্দ্র   তোমার যে সন্তাপ শক্তি আছে, তা দিয়ে আমাদের শত্রুর প্রতি প্রজ্বলিত হও, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
অপো   যৎ বো হরস্তেন তং  প্রতি হর যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ২
হে চন্দ্র  তোমার যে সংহারণ শক্তি আছে, তা দিয়ে তুমি শত্রুদের সংহার করো,যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
অপো   যৎ বঃ বোঽর্চিস্তেন তং প্রত্যর্চ যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ৩
হে চন্দ্র , তোমার যে দীপ্তি আছে, তা দিয়ে তাকে দগ্ধ করবার জন্য দীপ্ত হও, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।
আপো   যৎ বস্তেজস্তেন তম তেজসং কৃনুৎ  যোঽস্মান দ্বেষ্টি যং বয়ং দ্বিস্মঃ।  ৪ 
হে চন্দ্র , তোমার যে পরকে অভিভব করার যে তেজ আছে, তা দিয়ে তাকে নিস্তেজ করো, যে  শত্রূ  আমাদের বিদ্বেষ করে, আমরা যাদের দ্বেষ করি।

ওম ভূর্ভুবঃ স্বঃ।  ওম তৎসবিতুৰ বরেণ্যম। ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ওম স্বাহা। (তিনবার)

 ওঁং হৌং জূং স্বঃ ওঁং ভূঃ র্ভূবঃ স্বাঃ। 
ওঁং  ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টি বর্ধনম। 
উর্ব্বারুক্মিব বন্ধনান্ মৃত্যুর্মুক্ষীয় মাঽমৃতাৎ।।
ওম্ স্বাহা ভুবঃ ভূঃ ওম্ স্বঃ জূং হৌং ওঁং 
ওম স্বাহা। ( তিন বার)

ওম ব্রহ্মার্পনং ব্রহ্ম হবির ব্রাহ্মগ্নৌ ব্রহ্মনা হুতম।
ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্ম কর্ম্ম সমাধিনা।
ওং তৎ সৎ হরিঃ ওং।

ওং অগ্নে ত্বংসমুদ্রং গচ্ছ
ওং পৃথ্বি ত্বং শীতলা ভব। 

ওম সর্ব্বেষাং মঙ্গলম ভূয়াৎ সর্ব্বে সন্তু নিরাময়াঃ ।
সর্ব্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু মা কশ্চিৎ দুঃখভাক্ ভবেৎ।
নন্দন্তু সর্ব্ব ভূতানি নিরাতাঙ্কনি সন্তু চ।
প্রীতিরস্তু পরস্পরং সিদ্ধিরস্তু চ কর্ম্মনাম।
স্বস্তস্তু নিত্যশো  রাজ্ঞঃ শং প্রজাভ্যস্তথৈব চ।
স্বস্তস্তু দ্বিপদে  নিত্যং শান্তিরস্তু চতুষ্পদে।
শান্তিরস্তু নো দেবস্য ভূর্ভুবঃ স্বঃ শিবং তথা।
সর্ব্বতঃ শান্তিরস্তু নো সৌম্যা  ভূতানি চৈব হি।
ত্বং দেব জগতঃ স্রষ্টা পাতা দৈবতমেব হি।
প্রজা পালয় দেবেশ শান্তিং কুরু জগৎপতে।
যো মহি স্নিহ্য়তি  তস্য শিবমস্তু সদা ভুবি।
যশ্চ মাং দ্বেষ্টি লোকেঽস্মিন সোঽপি ভদ্রানি পশ্যতু।
 ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ হরি ওং।

ওম দৌঃ শান্তিঃ অন্তরীক্ষং শান্তিঃ পৃথিবী শান্তিঃ রাপঃ শান্তিঃ রোষধয়ঃ শান্তিঃ বনস্পতঃ শান্তিঃ বিশ্বে দেবাঃ শান্তিঃ ব্রহ্ম শান্তিঃ সর্ব্বং শান্তিঃ শান্তিরেব শান্তিঃ সা মা শান্তিরেধি।


Tuesday 7 April 2020

ভবিষ্যৎ মানুষ কেমন হবে ? সাধনা পর্ব - ১২


করোনার পরে, ভবিষ্যৎ মানুষ কেমন হবে ?
ওম সর্বেসাম মঙ্গলম  ভূয়াৎ। সর্বে  সন্তু নিরাময়াঃ।
সর্বে ভদ্রানী পশ্যন্তু মা কশ্চিৎ দুঃখভাগ ভবেৎ।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। 
ঘরে বসে আছি।  একটু গল্প শোনা যাক।
একটা সাপের ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। তো সে ভগবানের কাছে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা করছে, হে ভগবান আমাকে একটা ব্যাঙ দাও, খেয়ে বাঁচি। তো ভগবান তাকে একটা ব্যাঙ দিলো।  সাপটি অমনি ব্যাঙটাকে খপ করে ধরলো। এখন ব্যাঙটা ভয় পেয়ে গেলো। ভাবলো এবার মরেছি।  আর বাঁচার উপায় নেই। তো সে ভয়ে, প্রাণের তাগিদে, ভগবানের নাম করতে লাগলো। হে ভগবান আমাকে সাপের হাত থেকে বাঁচাও। তো ভগবান পরে গেল মহা বিপদে। কাকেই বা মারে, আর কাকেই বা
বাঁচায় ? ভগবান এখন উভয়  সংকটে। ব্যাঙকে বাঁচাতে গেলে সাপের খাবার জোটে না। আবার সাপের খাবার যোগান দিতে গেলে ব্যাঙের প্রাণ যায়। তো ভগবান এই উভয়-সঙ্কট থেকে বাঁচার জন্য একটা উপায় বের করলো। ব্যাঙকে বললো, মরেছিস তো মরার মতো মর। আর সাপকে বললো, ধরেছিস তো ধরার মতো ধর। এখন ব্যাঙ মরার মতো পড়ে  রইলো। সাপ ভাবলো, ব্যাঙটা  মরে  গেছে। এইবার সে মুখটাকে একটু আলগা করলো, গিলবে বলে। যেই না সাপ  মুখটাকে আলগা করেছে, অমনি ব্যাঙ লাফিয়ে পগার পার। তো সাপ  বললো, হে ভগবান, একি করলে আমার  খাবার ছিনিয়ে নিলে ? ভগবান বললো, তোকে বলেছিলাম, ধরার মতো ধর,  তো তুই ধরে আবার ছেড়ে দিলি কেন ?
আরো একটা গল্প, ব্রহ্মাপুত্র নারদমুনি ও ভগবান বিষ্ণু বিষ্ণুলোকে বসে আছেন। এদিকে কপোত  কপোতি ডালিম গাছে বসে প্রেম নিবেদন করছে। শিকারী শর নিক্ষেপ করবার জন্য, ধনুকে তীর স্থাপন করছে।  এই ঘটনা নারদের দৃষ্টিতে এলো। তো নারদ ভগবানকে বললেন, হে ভগবান, আপনি কপত  কপতিকে  বাঁচান। আপনার শ্রেষ্ঠ গুন্ প্রেম।  সেই প্রেম নিবেদনের সময়, কারুর প্রাণ গেলে, আপনার বদনাম হবে। তো ভগবান বললেন, কিন্তু শিকারী গত তিন দিন ধরে শিকার পায়  নি।  তার ঘরে ছেলে-মেয়েরা আজ তিন দিন উপবাসী। আমি কাকে রেখে কাকে ধরি। তো নারদের পীড়াপীড়িতে ভগবান সাপের রূপ ধরলেন, আর শিকারীকে কামড়ে দিলেন। শিকারী, হায় ভগবান বলে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। কপোত কপোতি সেই শব্দে উড়ে পালালো। ভগবান এবার ওঝার রূপ ধরলেন, আর শিকারীকে ঝাড়ফুঁক করে বাঁচিয়ে দিলেন।
তো আমরা যদি একবার আকুল ভাবে ভগবানকে ডাকি, তবে ভগবান অবশ্য়ই আমাদের সমস্ত দায়িত্ত্ব নেবেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, আমাদের ভগবানের ইচ্ছে অনুযায়ী চলতেও হবে। ব্যাঙ, শিকারী, সাপ সবাই ভগবানকে আকুল ভাবে ডেকেছিল। কপোত  কপোতি ভগবানকে ডাকেনি।  তবু রক্ষা পেল কারন, ভগবানের শ্রেষ্ঠ গুনের সাধনা করছিলো তারা। তো আমাদের তিনটি কথা মনে রাখতে হবে। ১. ভগবানকে আকুল ভাবে ডাকতে হবে। ২. আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী নয়, ভগবানের ইচ্ছে অনুযায়ী চলতে হবে।  সবশেষে ৩. ভগবানের গুনের সাধনা করতে হবে। তাহলে আমরা অবশ্য়ই রক্ষা পাবো।
আমরা ভগবানের কাছে অনেককিছু চাই। কিন্তু ভগবানের কথা অনুযায়ী চলি না। ভগবানের গুনের সাধনাও  করি না। একজন শিশুর কাছে প্রার্থনা মানে যেমন সে মা-বাবার কাছে নানান জিনিস চায়, তেমনি ঈশ্বরকেও সে একজন বিরাট দাতা  মনে করে। এই শিশু অবস্থাই আমাদের সারা জীবন ধরে চলতে থাকে। আর আমার প্রার্থনার উত্তর না পেলে বা আকাঙ্খিত  বস্তু না পেলে, আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্ত্বে সন্দিহান হয়ে উঠি।
 এখন একটা ভয়ানক যুদ্ধ চলছে। অদৃশ্য একটা শক্তি, যাকে  আমরা বলছি করোনা,  মানুষকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, মেরে ফেলবার জন্য। আমরা তার ভয়ে, আক্ষরিক অর্থেই দরজা জানলা বন্ধ করে, বসে আছি। আমার একটা জিনিস মনে হচ্ছে, আমরা কি মানুষকে ভয় পাচ্ছি, না করোনাকে ? কারন আমরা তো এখন করোনার বাহক মানুষকেই এড়িয়ে যেতে চাইছি। কোরোনাকে তো আমরা চিনিনা। তার বাহককে আমরা চিনি। 
দেখুন পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি হবার অনেক আগে থেকেই, জীবনের সৃষ্টি হয়েছিল। তাই জীবন সৃষ্টির প্রাথমিক অবস্থা সম্পর্কে মানুষের কোনো প্রতক্ষ্য অভিজ্ঞতা থাকা সম্ভব নয়। এই সন্মন্ধে, বিভিন্ন সম্প্রদায়, বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্ন রকম মত প্রদান করেছেন। 
কেউ বলছেন, সর্ব্বশক্তিমান ঈশ্বর জীবন সৃষ্টি করেছেন, আর সৃষ্টির আদিকাল থেকেই জীব একই রকম আছে। অপরিবর্তিত আছে। 
কেউ বলছেন, অজীব বস্তু থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই   জীবনের উৎপত্তি ঘটেছিলো। যেমন স্যাঁতসেতে মাটিতে এমনি-এমনি পোকার জন্ম হয়। 
আরো একদল আছেন, যারা বলে থাকেন,  পৃথিবীর বাইরে কোনো না কোনো গ্রহে, জীবনের বিকাশ ক্রিয়া চলছিল। সেখান থেকে মহাকাশ প্রতিরোধী রেনুর মাধ্যমে বা অন্য কোনো ভাবে, পৃথিবীতে জীবনের সঞ্চার হয়। পরাবিদ্যাবিদগন এই মতে  বিশ্বাস করেন।  
আর একদল আছেন, যারা বলে থাকেন, জীব একটা ধারাবাহিক রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল মাত্র ।
তো যেভাবেই জীবের সৃষ্টি হোক না কেনো, পৃথিবী  যেমন মৌল পদার্থের সমন্বিত গ্যাসীয় ও বাস্পপূর্ণ একটা ঘূর্ণমান জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড ছিল,  তেমনি জীবের সম্ভাবনাও  একদিন মৌল পদার্থের মধ্যে নিহিত ছিল। ধীরে ধীরে পরিবেশ ও জলে অবস্থিত রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রনের ফলে আমাদের জীবনের আদি পূর্বসূরী অণুগুলো যেমন এমাইনো, এসিড, সুগার, নাইট্রোজেন বেস ইত্যাদির সৃষ্টি হয়েছিল। আবার এই আদি অণুগুলোর পারস্পরিক মিশ্রণ ও বিক্রিয়ার ফলে, প্রোটিন, পলি-স্যাকারাইড, নিউক্লিক এসিড ইত্যাদি গঠিত হয়েছিল।          

যারা বিজ্ঞানের ছাত্র তারা জানেন,  তুষার যুগের শেষ ভাগে ক্রমাগনন মানুষ থেকে আধুনিক মানুষের উৎপত্তি ঘটেছিলো। এই আধুনিক মানুষের দক্ষতা ও কৃষ্টিগত পরিবর্তন হলেও, এদের শারীরিক বা গঠনগত পরিবর্তন বিশেষ কিছু হয় নি। এরা  প্রথম দিকে নদী, হ্রদ, সমুদ্র ইত্যাদির তীরে সমাজবদ্ধ ভাবে বসবাস আরম্ভ করেছিল । এরা তীর-ধনুক, বাসনপত্র, গহনা, কিছু ধাতব অস্ত্রসস্ত্র বানাতেও পারতো।  তবে এই ধাতু ছিল, মৌল-ধাতু। মাত্র হাজার পাঁচেক বছর  আগে,  মিশ্র ধাতু বা শংকর ধাতু অর্থাৎ ব্রোঞ্জের গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল। এরা প্রথমে ক্যাসপিয়ান সাগরের তীরে আবির্ভূত হয়েছিল। পরে এরা  তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে তিনদিকে গমন করে। একদল আফ্রিকা-মালয়েশিয়া যাদের বলা হয়, নিগ্রয়েড (NIGROID) একদল ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায়, এদের বলা হয় - ককেসয়েড (CAUCASOID) আর এক দল মঙ্গোলয়েড (MONGOLOID) যারা চীন সাইবেরিয়া, জাপান ইত্যাদি স্থানে যাত্রা করেছিল। 
এই যুগের আগে ছিল,ক্রমাগনন  CRO-MAGNON MAN. ইটালি ও ফ্রান্সে এদের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এদের উচ্চতা ছিল প্রায় ছয় ফুট (১.৮ মিটার) .এদের কপাল ছিল চ্যাপ্টা, চোখের উপরে ছিল একটা খাঁজ। এরা  সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতো, দেহ  পশুদের মতো লোমে ভরা ছিলো না ।  কিন্তু অল্পবিস্তর লোমশ দেহ। এদের  নাক সরু ও উঁচু।   মুখ-মন্ডলের চোয়াল ছিল কিছুটা সামনের দিকে এগুনো। এরা গুহার মধ্যে বাস করতো।  পশু-চর্ম্ম দ্বারা নিজেদের দেহকে আবৃত করে রাখতো। যেখানে খাবারের প্রাচুর্য্য পেতো সেখানে এরা  দলবেঁধে বাস করতো। বলা হয়ে থাকে। পৃথিবী যখন তুষারে ঢেকে যায়, তখন এরা ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে চলে যায়। 
এর পরে  তুষারযুগের শেষ ভাগে আসে এই আধুনিক রূপের মানুষ। অর্থাৎ আধুনিক মানুষের বয়স মাত্র ১০ হাজার বছর  বা তার কাছাকাছি। 
এতো গেলো আমাদের পূর্বপুরুষের কথা। আমাদের ভবিষ্যতের প্রজন্ম কেমন হবে ? আজ মানুষ তাদের দৈহিক পরিবর্তন না করতে পারলেও, প্রযুক্তির উন্নতি সাধন করেছে। মানুষ এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, সে এখন প্রকৃতির মরন কামড় সহ্য করতে পারে। এমনকি পরিবেশকে সে পরিবর্তন করতে পারে। নৃবিজ্ঞানীগন বলছেন, ভবিষ্যৎ মানুষ হবে আরো লম্বা, রোগা, মুখাকৃতি হবে গোল গম্বুজের মতো। মস্তিষ্কের আয়তন বৃদ্ধি  পাবে। দেহ হবে লোমশূন্য। এদের জীবিত-কাল বৃদ্ধি পাবে। এবং আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে, এদের পায়ের কেনো আঙুলটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। নৃ-বিজ্ঞানীগন  ভবিষ্যতের মানুষের  নাম রেখেছেন, হোমো সাপিয়েন্স ফিউচারিস - HOMO SAPIENS  FUTURIS.
পৃথিবীতে যে কতো ধরনের জীব আছে, তার ইয়ত্বা নেই। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে এমনকি মাটির নিচে  যে কতো ধরনের জীব আছে, তা আমরা জানিও না।  এর মধ্যে মাত্র ১৭-১৮ লক্ষ ধরনের জীবের সন্ধান আমাদের বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন। পৃথিবীতে আরো কত লক্ষ ধরনের জীব বা জীবাণু আছে তার কথা আমরা এখনো জানিই না। এই ১৭-১৮ লক্ষ জীবের মধ্যে  জীবাণু আছে, ৪০০০ রকমের। এই ৪০০০ বা তার থেকে বেশি সংখ্যক জীবাণুর মধ্যে যেগুলো সংক্রামক এবং আমাদের  শরীরের পক্ষে বিষ তাকে বলা ভাইরাস।
পৃথিবীতে অবস্থিত, এই জীব গোষ্ঠী আসলে একে আরেক জনকে আশ্রয় করে বেঁচে আছে। এখান থেকেই আমরা খাদ্য পাচ্ছি, এখান থেকেই আমরা ঔষধ  পাচ্ছি। 
প্রকৃতি ও পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই জীব জগতের উথ্বান ও অবলুপ্তি ঘটছে। তো এখন পরিবেশের নিয়ন্ত্রণে মানুষের একটা ভূমিকা আছে। এই পরিবেশের দৌলতেই, বহু ধরনের জীবের অবলুপ্তি হচ্ছে, আবার  বিভিন্ন জীবাণুর উথ্বান ঘটছে, যা আমাদের সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের করোনা এই পরিবেশের দান।  হ্যাঁ এই পরিবেশ হয়তো প্রথমে তৈরি হয়েছে চিনে বা বিদেশে, কিন্তু কোরোনার বেঁচে থাকার পরিবেশ আছে পৃথিবীর সর্বত্র। ঘূর্ণি ঝড়ের উৎপত্তি হয় জলাশয়ে, কিন্তু ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম গঞ্জে সর্বত্র । 
দেখুন এই পৃথিবীটা তো আমার আপনার একার নয়। সমস্ত জীবের এই পৃথিবীতে অধিকার। আমরা বা মানুষ  অধিক শক্তিশালী হবার কারনে, আমরা পরিবেশকে আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখবার চেষ্টা করছি।  আর এই করে, পৃথিবীর যে ইকোসিস্টেম তাকে আমরা নষ্ট করছি। আর নতুন যে পরিবেশের সৃষ্টি করছি, সেখানে দেখা দিচ্ছে, নতুন নতুন ব্যাক্টেরিয়া, বা ভাইরাস। এর কেউ ছিল না তা নয়, এরা  সুপ্ত ছিল, পরিবেশের দৌলতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। জীব যেমন পরিবেশের জন্যই একদিন রূপ ধারণ করেছিল, ঠিক তেমনি পরিবেশের তারতম্যে জীবের নাশ বা জন্ম হতে পারে।  যেমন জমা জলে মশার উৎপত্তি হয়। তো জীবকে বেঁচে থাকবার জন্য, ভালো থাকার জন্য,  পরিবেশের  সংরক্ষণ করতে হবে। পালিয়ে বাঁচার উপায় নেই। ঘরের মধ্যে কতদিন বন্দি থাকবেন ? যদিও এই মুহূর্তে ঘরবন্দি থেকে সাময়িক সামাল দেওয়া যেতে পারে।  কিন্তু পৃথিবীর পরিবেশের সংরক্ষণ আরো বেশি জরুরি। আর একটা কথা হচ্ছে, ঘরে বসে সাময়িক সময়ের জন্য আমরা বাঁচতে পারি, কিন্তু বাইরের শত্রূ  কতদিন থাকবে, তা তো জানি না। তো কতদিন আমরা ঘরে বসে থাকবো। আমাদের যেটা দরকার আমাদের কোরোনার  সঙ্গে লড়াই করবার ক্ষমতা অর্জনের। তাই ঘরে বন্দি আছেন, থাকুন, কিন্তু এই সময় নিজেকে  শক্তিশালী করুন, কোরোনার  সঙ্গে লড়াই করবার শক্তি অর্জন করুন।  অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, আমাদের শরীরে যে ইমিউনিটি সিস্টেম আছে, অর্থাৎ স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধের  ক্ষমতা আছে, তাকে  বাড়িয়ে তুলুন। আর সেটা হচ্ছে, প্রতিদিন নিয়ম করে দুবেলা প্রাণায়াম করুন।আমাদের শরীরে যে দুজন ডাক্তার আছেন, অর্থাৎ অশ্বিনীকুমারদ্বয় আছেন, তাদের স্মরনাপন্ন হোন। অনুলোম। বিলোমের  অভ্যাস করুন। কপাল ভাতি  করুন। নিয়ম করে অভ্যাসের মাধ্যমে আমাদের কুম্ভকশক্তি অর্থাৎ দীর্ঘ সময়, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে রুদ্ধ করবার ক্ষমতা অর্জন করুন। প্রাণ শক্তিকে ধরে রাখবার কৌশল আয়ত্ত্ব করুন।  তবেই আপনি করোনার সাথে লড়তে পারবেন। করোনা আপনাকে দেখে দূরে পালাবে। হায় হায় করে হতাশ হয়ে লাভ নেই। গালে হাত দিয়ে ঘরে বসে থেকে লাভ নেই।   বিমর্ষ হয়ে বসে থেকে লাভ নেই। আবার এটা ছুটি কাটানোর সময়ও  নয়।  এই সময়, আমাদের জীবনকে উচ্চ জীবন ধারায় পরিবর্তনের বা প্রবাহিত করবার  একটা উপযুক্ত সময়। এটা আমাদের জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট।  সব সময়ই উপভোগের সময়। সব সময়ই শিক্ষার সময়।  তা সে যত  যন্ত্রণার দিন আসুক না কেন। আমাদের এর থেকে শিক্ষা নিতে হবে। 
আমার এক বন্ধুর পেটে জল জমেছিলো। তো ডাক্তারবাবু মোটা সিরিঞ্জ দিয়ে জল বার করতেন ।  তো একদিন হলো কি, সঠিক  জায়গায়   সিরিঞ্জ  না ঢুকবার কারণে বার বার স্থান পরিবর্তন করে, সিরিঞ্জ ঢোকাতে হচ্ছিলো ।  এতে করে আমার বন্ধুর কষ্ট হচ্ছিলো।  এমনকি ডাক্তার বাবুরও খারাপ লাগছিলো।  তো ডাক্তারবাবু বললেন, আপনার খুব কষ্ট  হচ্ছে ? বন্ধুটি তার উত্তরে বলেছিলো, আপনি করুন, এই দিন আর আসবে কি না জানিনা, আমাকে কষ্টটাকে উপভোগ করতে দিন।
 তো যেকোনো অবস্থাতে উপভোগ করুন।  আজ আপনি বাড়িতে বসে আছেন, ছুটির মেজাজে নয়, বরং সৃজনশীল কিছু করুন। আনন্দে থাকুন।  আর সব থেকে বড়ো  কথা, আর যাতে কোনোদিন এই অবস্থায়  যেতে না হয়, তার   জন্য, নিজের রোগ  প্রতিরোধ শক্তিকে বাড়ানোর যে প্রক্রিয়া, অর্থাৎ আমাদের মুনি ঋষিদের দেওয়া যে প্রক্রিয়া, অর্থাৎ  প্রাণায়ামে  নিজেকে অভ্যস্ত করে নিন। এবং এই অভ্যাসকে ভবিষ্যতেও চালিয়ে যান। তবেই সার্থক হবে আমাদের গৃহবন্দী কাল।

ওম সর্বেসাম স্বস্তিরভবতু।
ওম সর্বেসাম শান্তিরভবতু।
ওম সর্বেসাম পূর্নমভবতু।
ওম সর্বেসাম মঙ্গলম ভবতু।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।

সাধনা পর্ব - ১২ প্রাণায়ামে কেন আমরা সমৃদ্ধ হই  ?

নমস্তে হর শোচিষে নমস্তে  অস্ত্বর্চিষে।
অন্যাঁস্তে অস্মত্তপন্তু হেতয়ঃ পাবক অস্মভ্যং শিবো ভব। (শুক্ল যজুর্বেদ ৩৬/২০)

হে অগ্নি, সকল রসের শোষক, পদার্থের প্রকাশক তোমার তেজকে নমস্কার। তোমার জ্বালাসমূহ আমাদের ছাড়া অপরকে জ্বালা দিক, আমাদের প্রতি শোধক ও শান্ত হও।

মশার জ্বালায় ধ্যান করা, একটা বিড়ম্বনা হয়েছে। কোরোনাকে না মারতে পারলে, মানুষ বাঁচতে পারবে না।
পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও প্রাচ্য বিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, একটা গোপন বিদ্যা বা গোষ্ঠী বিদ্যা আর একটা সার্বজনীন বিদ্যা। পাশ্চাত্য বিজ্ঞান বা আধুনিক বিজ্ঞানে সব মানুষের অধিকার, আর প্রাচ্য বা আধ্যাত্মিক বিদ্যা একটা বিশেষ মনুষ্য গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর এই কারণেই প্রাচ্যের যে অধ্যাত্ম বিদ্যা  তা দিনে দিনে লোপ পেয়ে গেছে। আর আধুনিক বিজ্ঞানের প্রসার ঘটেছে। বেদে অর্থাৎ জ্ঞানে আমাদের  মা-বোনের অধিকার ছিল না । এমনকি আপনি যদি ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম না নিয়ে থাকেন, তবে বেদ আপনার জন্য নয়। ভারত একসময় চিকিৎসা শাস্ত্রে, সমৃদ্ধ ছিল। আজ আর নেই, তার কারন হচ্ছে, ভারতের যে চিকিৎসা পদ্ধতি, তার কার্য্য কারন আমরা এখন আর জানি না। ভারতের  অনেক মহাত্মা  নাকি মরা মানুষকে জ্যান্ত করতে পারতেন। একজনের কাটা মাথা এমনকি অন্যের শরীরেও   জোড়া লাগাতে পারতেন। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের মাথাকে জোড়া লাগিয়েছিলেন। রাজা দক্ষের শরীরে ছাগলের মাথা বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গনেশের শরীরে হাতির মাথা বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এসব আমাদের কাছে গল্প কাহিনী। এর যদি কোনো সঠিক পদ্ধতি আমাদের জানা থাকতো, তবে আমরা বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারতাম। ঋষি পুরুষ আপনাকে ছুঁয়ে দিলে, আপনার মধ্যে বিদ্যুতের চমক বইতে পারে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ নরেনকে ছুঁয়ে দিতেই, নরেনের মাথা বনবন করে ঘুরেছিল, অখণ্ড ব্রহ্মের অনুভূতি হয়েছিল । এমনকি মহাত্মাগণ  মানুষের মনের পরিবর্তন করে দিতে পারতেন। অর্থাৎ মানসিক  রোগের চিকিৎসার  কথাও তারা জানতেন। আজ সে সব কথা আমাদের কাছে, বুজরিকির মতো শোনায়।  তার একমাত্র কারন হচ্ছে, এই বিদ্যা তথাকথিত গুরুদেবরা নিজেদের মধ্যে কুক্ষিগত করে রাখতেন । ফলে গুরুদেবের মৃত্যুর পরে, সেই সব বিদ্যা লোপ পেয়ে গেছে। অথবা এসব বিদ্যা সীমিত মানুষের মধ্যে কুক্ষিগত হয়ে রয়েছে।  সার্বজনীন হতে পারে নি। আমরাও পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের  উপরে নির্ভরশীল হয়ে গেছি। তবে আমি একটা কথা বিশ্বাস করি, আমাদের পুরান কাহিনীতে যে সব কথা রূপকের মাধ্যমে লেখা আছে, তার যদি যথাযথ অর্থ আমরা বুঝতে পারতাম, তবে অনেক  গুহ্যবিদ্যা আমাদের কাছে ব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠতে পারতো।   মানুষ যা কিছু কল্পনা করতে পারে, তা এই বিশ্ব-ব্রমান্ডের কোথাও না কোথাও ব্যক্ত বা অব্যক্ত অবস্থায় অবশ্য়ই আছে। আমাদের ভাবনা যত  গভীর হবে, আমরা তখন অবশ্য়ই সেইমতো কর্ম্মে প্রবৃত্ত হবো, আর আমাদের কল্পিত বস্তু তত  প্রস্ফুটিত হবে। তাই আমাদের পুরানের  গল্প,  আমার কাছে কল্পনা নয়, সত্যি।
প্রাণায়াম এই রকমই একটা প্রক্রিয়া, যা আমাদের ঋষি-মুনিগন আয়ত্ত্ব  করেছিলেন।  সরকার যার স্বীকৃতি দেয়  নি। সাধারণের মধ্যে   যার কদর মেলেনি। এমনকি স্বাধীনতার পরেও, বিচ্ছিন্ন ভাবে, কারুর কারুর একক প্রচেষ্টায়, যেমন শ্রীমৎ স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী মতো মনিষীদের চেষ্টায়  এই প্রণায়ামের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলেও, সম্প্রচার করা হয় নি। গত কয়েক  বছর, বিশেষ করে, যোগাচার্য্য রামদের দৌলতে, এবং মিডিয়ার দৌলতে,  এই প্রাণায়ামের প্রচার প্রসার হয়েছে। এবং এখনকার ভারত সরকার, এর কদর করছে।
এখন কথা হচ্ছে, এই প্রাণায়াম আমাদের কি করতে পারে ? আসলে প্রাণায়াম আধ্যাত্মিক যোগ সাধনার প্রবেশ দ্বার। আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীন যে সব দোষত্রূটি আছে, আমাদের যে অজ্ঞানতা  আছে, তাকে দূর করবার জন্য, চিত্তবৃত্তিকে ধীর স্থির করে, সমাধি লাভের  দ্বারা  একটা অনাবিল আনন্দ লাভের  জন্য, মুনি ঋষিগণ কিছু যৌগিক প্রক্রিয়ার আবিষ্কার করেছিলেন, প্রাণায়াম সেই যৌগিক প্রক্রিয়ার অন্তর্গত একটা ক্রিয়া মাত্র। আর এই যৌগিক প্রক্রিয়ার অনুসরণে কিছু উপরি-লাভ   হয়। এই অতিরিক্ত পাওনাই  হচ্ছে, শারীরিক সুস্থতা। এখন কথা হচ্ছে, প্রাণায়াম আমাদের শরীরে কি ভাবে কাজ করে ? শ্বাস-প্রশ্বাস তো আমাদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তো প্রাণায়াম অর্থাৎ বিশেষভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস, কি ভাবে আমাদের শরীরে উপকার বা বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে, তা আমরা আলোচনা করবো।
প্রথমে বলি, শ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ না করেও, শুধু শ্বাসের প্রতি মনোযোগ দিয়ে বসে থাকলেও আমরা শ্বাসের  সাহায্যে ভালো ফল পেতে পারি। ধরুন, আপনার দুটি  দশ-বারো  বছরের ছেলে-মেয়ে  পড়তে বসেছে। তো আপনি যদি তাদের প্রতি মনোযোগ দেন, অর্থাৎ আপনি যদি তাদের পাশে শুধু বসে থাকেন, তবে দেখবেন , আপনার ছেলে-মেয়ে দুটো মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। আর যদি আপনি রান্না ঘরে যান, তবে দুটিতে গল্প জুড়ে দেবে, বা খুনটুসি শুরু করবে।  ঠিক তেমনি, শ্বাসের প্রতি মনোযোগ দেওয়া আর না দেওয়ার মধ্যে পার্থক্য।
এবারে আমরা একটু গভীরে প্রবেশ করবো। শ্বাস নেওয়া মানে  বাতাস নেওয়া। এই বাতাসের মধ্যে কি আছে ? বাতাসের মধ্যে প্রায় ৭৮%  আছে নাইট্রোজেন, ২১% আছে অক্সিজেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড  আছে  .০৩% । এ ছাড়া আছে, আর্গন, হাইড্রোজেন, নিয়ন, হিলিয়াম, মিথেন, ক্রিপ্টন ইত্যাদি সব দুষ্প্রাপ্য গ্যাস। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের  ধারণা হচ্ছে, বাতাস থেকে আমরা অক্সিজেন নেই আর কার্বন-ডাইঅক্সাইড ছেড়ে দেই। ব্যাপার অর্দ্ধ  সত্য। আমরা যে বায়ু গ্রহণ করি, তার মধ্যে বেশিরভাগ থাকে নাইট্রোজেন (৭৮%) আবার যেটা ছেড়ে দেই তার মধ্যেও  বেশিরভাগই  নাইট্রোজেন, অক্সিজেন থাকে ১৬.৪% কার্বন-ডাইঅক্সাইড থাকে ৪.০০% অর্থাৎ যখন বায়ু ছাড়ছি, তার মধ্যে CO২ নেবার থেকে ছাড়ছি বেশি।    .
আমাদের শরীরের মধ্যে ভগবান যে কাঠামো তৈরি করেছেন তাতে ফুসফুস থেকে রক্ত কণিকা অক্সিজেনই শোষণ করে, এবং কার্বন-ডাইঅক্সাইড ছেড়ে দেয়। তাই নাইট্রোজেন ইত্যাদি যা কিছু আমাদের শরীরে প্রবেশ করে, সেগুলো শোষণ করে না, বা করতে পারে না। শ্বাসক্রিয়ার সাহায্যে আমরা আমাদের শরীরের কোষগুলোর পুষ্টি সাধন করে থাকি। অর্থাৎ অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকি। অন্যদিকে কার্বন-ডাইঅক্সাইড নির্গত করে থাকি। আবার এটাও জেনে  রাখা দরকার, কার্বন-ডাইঅক্সাইড একটা মাত্রায় রক্তে থাকা আবশ্যক।
যে প্রক্রিয়ার দ্বারা অক্সিজেনের গ্রহণের মাত্রা ফুসফুসে বেড়ে যায়, এবং কার্বন-ডাইঅক্সাইড নিষ্কাশনের মাত্রাও বেড়ে যায়, সেই ক্রিয়াকে বলে প্রাণায়াম। এখন আমাদের বোঝা দরকার, অক্সিজেন গ্রহণে  প্রাণায়াম  কি ভাবে কাজ করে।
আমরা জানি, এই শ্বাসকার্যে আমাদের সাহায্য করে দুটো  ফুসফুস। আবার ফুসফুসকে সাহায্য করে শ্বাসপেশি। শ্বাস কার্য্যে আমাদের বুকের ভিতরে যে ফাঁকা জায়গা আছে তার সংকোচন সম্প্রসারণ হয়। এটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হয়। অর্থাৎ আমরা যখন বিশ্রামে থাকি, তখন আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস মিনিটে ১০-১৮ বার হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা যখন পরিশ্রান্ত হই, বা পরিশ্রমের কাজ করি, তখন এই গতি বেড়ে যায়। অর্থাৎ তখন আমাদের অক্সিজেন-এর প্রয়োজন বেশি হয়। যাইহোক, আমাদের এই ফুসফুস দুটোর নিচে আছে, পেটের  ঠিক উপরে আছে  ডায়াফ্রাম Diaphragm আমরা যখন শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ করি, তখন এই মধ্যচ্ছদা বা ডায়াফ্রাম সংকুচিত হয়ে নিচের দিকে নেবে যায়।  তখন আমাদের বক্ষগহ্বর বা বুকের ভিতরের ফাঁকা জায়গা প্রসারিত হয়। প্রাণায়ামের সময় আমরা এই মধ্যচ্ছদাকে ইচ্ছেমতো বৃদ্ধি করে থাকি। আর একটা কথা হচ্ছে, বিশ্রামের সময়, আমাদের নিঃশ্বাস একটা নিষ্ক্রিয় পদ্ধতি, কিন্তু বলপূর্বক যখন আমরা শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ করি, তখন এই পেশিগুলো ক্রিয়াশীল হয়। আর একটা কথা হচ্ছে, শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া করবার সময়, কিছু বায়ু, নাসারন্ধ্রে, শ্বাসনালিতে এবং Bronchiole ইত্যাদি অংশে আবদ্ধ  থাকে। এই বায়ু বায়ুথলিতে প্রবেশ করতে পারে না, এবং স্বাভাবিক গ্যাসীয় আদান-প্রদান প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু আমরা যখন প্রাণায়াম করি, অর্থাৎ বায়ুকে নিবদ্ধ করে রাকি, বা জোরে জোরে, বা দীর্ঘক্ষণ ধরে শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়াকে কার্যকরী করি, তখন এইআবদ্ধ বায়ুর বেশিরভাগ গ্যাসীয় লেনদেনের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারি।
আমরা যে পরিবেশে বাস করি, তার সঙ্গে আমাদের খাপ খাইয়ে চলতে হয়। আমাদের চারিদিকে বহু অদৃশ্য জীব যাকে আণুবীক্ষণিক জীব বলা হয়ে থাকে।  অর্থাৎ যা একমাত্র অণুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা আমরা দেখতে পারি। এইসব জীবের দেহজাত পদার্থ আমাদের দেহে প্রবেশ করে আমাদেরকে অসুস্থ করে তোলে। এই অদৃশ্য জীবকেই বলে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, তাদের প্রতিবিষ এবং নানাপ্রকার বিজাতীয় প্রোটিন ইত্যাদি ইত্যাদি । আমাদের দেহের বাইরের থেকে যেসব প্রোটিন জাতীয় বস্তু দেহের মধ্যে প্রবেশ করে, তাকে বলে এন্টিজেন। এই এন্টিজেনকে বাধা দেবার জন্য, আমাদের দেহে যে প্রোটিন থাকে, তাদের বলে এন্টিবডি।  রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু, ভাইরাস ইত্যাদি বিজাতীয় পদার্থের বিরুদ্ধে দেহে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে তাকেই বলে ইমিউনিটি সিস্টেম, বা রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা। ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী,  এই ইমমুনিটিসিস্টেম বাড়িয়ে কোরোনার বিরুদ্ধে লড়বার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সহজাত ইমিউনিটি সিস্টেম বাড়ানো  আসলে সময়সাপেক্ষ।   যাইহোক, এই প্রতিরোধ  ক্ষমতা দুই রকম, একটা হচ্ছে, সহজাত আর একটা হচ্ছে অর্জিত।
সহজাত রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা আমাদের জন্মগত। আমরা মায়ের দুধ থেকেই এটি প্রথমে সংগ্রহ করে থাকি আমরা । এটি কোনো নির্দিষ্ট জীবাণুর জন্য কাজ করে এমন নয়, যে কোনো জীবাণু যা আমাদের দেহের ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক তার বিরুদ্ধেই লড়াই চালিয়ে  যেতে পারে।
আর অর্জিত রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা আমরা বিভিন্ন রকমের ভ্যাকসিন গ্রহণের মাধ্যমে পেতে পারি। এটি নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট জীবাণুর জন্য কাজ করে থাকে।
আমাদের শরীরে অক্সিজেনের ভূমিকা গুরুত্ত্বপূর্ন। কারন অক্সিজেন হচ্ছে, আমাদের কোষগুলোর খাদ্য। কোষের দুর্বলতা, বা মৃত্যু মানেই আমাদের শরীরের অসুস্থতা বা মৃত্যু। তাই  যে কোনো উপায়ে আমাদের অক্সিজেন সংগ্রহ করতে হবেই, নতুবা আমরা প্রাণহীন হয়ে যাবো। নিয়মিত প্রাণায়ামের অভ্যাসে ফলে আমাদের প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের প্রাপ্তি ঘটে। সাধারণত আমরা যখন শ্বাস গ্রহণ করি তখন আমরা মাত্রা ৫০০ মিলি বায়ু গ্রহণ করে থাকি।  কিন্তু আমরা যখন গভীর ভাবে শ্বাস গ্রহণ করি, তখন বা গভীর ভাবে  শ্বাস ছাড়ি, তখন আমরা ৪-লিটার  পর্যন্ত শ্বাস গ্রহণ করতে পারি। এতে করে, আমাদের বুক ফুলে ওঠে, আর এই ফুলে ওঠার সময় আমাদের ফুসফুসের মধ্যে যে শ্বসন অংশ আছে, আছে, যারা গাদাগাদি করে অবস্থান করছে, তারা একটু বেশি স্থান নিয়ে অবস্থান করতে পারে, ও দহন  ক্রিয়ায়  অংশ গ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ বাতাস থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ ও কার্বন-ডাইঅক্সাইড ছেড়ে দেবার যে ক্রিয়া, তা বেশি সময় ধরে এবং বেশি পরিমান শিরারক্ত বায়ুথলি থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে, ও কার্বন-ডাই অক্সাইড ছেড়ে দিতে পারে।
এছাড়া যে নিষ্ক্রিয় বায়ুস্থান  আমাদের মধ্যে থাকে তা দিনে দিনে বাড়তে থাকে, অর্থাৎ বেশ খানিকটা বায়ু দহনক্রিয়ায় অংশগ্রহণ  করতে পারে না। সুস্থ  মানুষের ক্ষেত্রে এই নিষ্ক্রিয় বায়ুরস্থান প্রায় একই থাকে।  কিন্তু যখন ফুসফুসে  কোনো রোগের  প্রকোপ দেখা দেয়, তখন এই নিষ্ক্রিয় বায়ুর পরিমান বাড়তে থাকে। প্রাণায়াম অর্থাৎ শ্বাসপ্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ, এই নিষ্ক্রিয়বায়ুর পরিমাণকে সীমাবদ্ধ রাখে। ফলে আমরা অক্সিজেন বেশি পরিমানে রক্তে  প্রবাহিত করতে পারি। আমরা যখন কপালভাতি করি, তখন নিষ্ক্রিয় বায়ু বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। আবার যখন অনুলোমবিলোম করি, তখন আমাদের ডায়াফ্রাম সংকুচিত করে, বুকের মধ্যে বায়ু ধারনের জন্য বেশি জায়গা করে দিতে পারি।
আর এইভাবে, প্রাণায়ামের সাহায্যে, আমরা আমাদের শরীরে অক্সিজেনের  মাত্রা বৃদ্ধি করতে পারি। আর অক্সিজেন যদি আমাদের শরীরে, মস্তিষ্কে বেশি মাত্রায় প্রবেশ করে, তবে আমাদের মধ্যে সমস্ত কোষের পুষ্টি হবে, আর কোষের পুষ্টি মানেই তো শরীরের সমৃদ্ধি। কেননা আমাদের শরীর তো কতকগুলো কোষের সমষ্টি মাত্র।  আর আমরা অবশ্য়ই রোগমুক্ত শরীর নিয়ে, দীর্ঘজীবী হবো।
সবশেষে বলি, আমাদের এই শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া পরিচালনা করে মস্তিস্ক। তো আমরা যখন শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে মনোযোগ দেবো, তখন অবশ্যই  আমাদের মস্তিস্ক আরো বেশি ক্রিয়াশীল হয়ে উঠবে।আর আমরা হয়ে উঠবো, আরো বেশি ধীশক্তি সম্পন্ন। চিকিৎসায় বিদ্যায় একটা বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে এই প্রাণায়াম।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

শান্তির খোঁজে।
ইশঃ করতু কল্যাণং সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ।
সর্ব্বঃ শ্রেয়ঃ সমাপ্নোতু সর্ব্বো নিৰ্ব্বণমৃচ্ছতু। ।
সর্ব্বস্তরতু দুর্গাণি সর্ব্বো ভদ্রাণি পশ্যতু।
সর্ব্বঃ কামানবাপ্নোতু  সর্ব্বঃ সর্ব্বত্র নন্দতু। ।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।

চারিদিকে একটা দমবন্ধ করা অবস্থা চলছিল কিছুদিন থেকে । এরই মধ্যে একটা শান্তির বাতাস বইতে শুরু করেছে।আপনারা খেয়াল করেছেন কিনা জানিনা।  কালবৈশাখী যখন শুরু হয়, একটা তপ্ত  ঝোড়ো হাওয়া  আমাদের সবকিছুকে  ওলটপালট করে দেয়। শেষে এক পশলা বৃষ্টি, বাতাসকে ঠান্ডা করে দেয়। ঝড়ের দাপটও কমে যায়।   আমাদের হৃদয়ে একটা প্রশান্তির, একটা স্বস্তির বাতাবরণ তৈরি করে দেয়। মমতার মাতৃহস্ত আমাদের সেই স্বস্তির হাওয়া গায়ে  লাগিয়েছে। আজ কোরোনায় আক্রান্তকারীরা সুস্থ হয়ে ঘরে  ফিরতে শুরু করেছেন । মমতাময়ীর একটা আবেদন আমার কানে সুধা ঢেলেছে, সেটা হচ্ছে, মানবিক হোন।  সবাই ভালো থাকুন। এইখানেই আমরা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি।
আমরা কতটা মানুষের পক্ষে, আর কতটা করোনার  বিপক্ষে। হাসপাতালগুলো এখন খাঁ-খাঁ করছে। কারন রোগ বা রুগী নেই তা নয়। হাসপাতালে পৌঁছতে গেলে যে যান-বাহন দরকার তা এখন আর মিলছে না। তাই তারা হাসপাতালে পৌঁছতে পারছে না। এতে করে কত মানুষ বিনা চিকিৎসায় মরতে বাধ্য হচ্ছে, তার পরিসংখ্যান কে  রাখে ?  কিছুদিন থেকে অপারেশন টেবিল ফাঁকা। পাড়ায় কোনো ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না। সব চেম্বার বন্ধ। ঔষধের দোকান খোলা, কিন্তু ডাক্তার নেই। সবাইকে নাকি বাধ্যতামূলক ভাবে হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। এ এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি।

কোনো এক গ্রাম্য কবি, একসময় ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন "আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে" । কিছু দিন আগে কথা, বিমল যে কিনা আমাদের বাড়িতে মাঝে মধ্যেই টুকটাক কাজ করতে আসে, সেদিনও সে  আমাদের বাড়িতে কাজ করতে আসে। তো সেদিন লক্ষ করলাম, বিমল যেন কাজে ফাঁকি দিচ্ছে,  নয়, কাজের গতি নেই। তো আমি বিমলকে জিজ্ঞেস করলাম,  কি খবর বিমল, তোমার শরীর   ঠিক আছে তো ? বিমল বললো,  না শরীরটা ভালো লাগছে না।
জন্ম মৃত্যু দুটো প্রচলিত শব্দ মাত্র। সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে, এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।রূপান্তর বা পরিবর্তন সাধনের কারণরূপে  উভয়েই সমান ধর্ম্ম বিশিষ্ট।  আমরা যাকে  জীবিত বলি, সেও প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে। আমাদের শৈশব, আমাদের বাল্য, কৈশর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ত্ব, বার্ধক্য প্রভৃতি অবস্থার মূল কারন এই পরিবর্তন। আমাদের মৃত্যুও একটা পরিবর্তনের সোপান মাত্র। জীবদেহ প্রতিনিয়ত পৰিৱর্তনের ফলে অবস্থান্তর প্রাপ্ত হচ্ছে। আমাদের মৃত্যুও সেই রকম একটা পরিবর্তন সাধন করে, আমাদের নতুন দেহ প্রাপ্তির হেতু হয়ে থাকে। জন্ম কালে যেমন আমরা নতুন দেহ প্রাপ্ত হই, মৃত্যুকালেও আমরা নতুন দেহ প্রাপ্ত হই। সুতরাং জন্ম-মৃত্যু উভয় ক্ষেত্রে আমাদের নতুন দেহ প্রাপ্তি করায়।  সেই দিক থেকে দেখতে গেলে জন্ম-মৃত্যু একই ব্যাপার। জন্মে আমরা স্থূল দেহ পাই, আর মৃত্যুতে আমরা সূক্ষ্ম দেহ পাই। এটা একটা আবর্তন মাত্র। বরং মৃত্যুতে আমরা উজ্জ্বলতর জীবনে প্রবেশ করি। আর সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের নিজস্ব কোনো সম্পত্তির ক্ষয় বা পরিবর্তন হয় না। আমাদের স্বভাব, আমাদের স্মৃতি, আমাদের আকৃতি, আমাদের বুদ্ধি, আমাদের মন, আমাদের ইন্দ্রিয়বৃত্তি ইত্যাদি পূর্ন মাত্রায় বর্তমান থাকে। মৃত্যুর মাধ্যমে আমরা যে আত্মীয়কে আজ হারিয়েছি ভাবছি, তা সত্য নয়। কিছুকালের জন্য, তিনি আমাদের চক্ষুর অন্তরালে থাকেন মাত্র। এযেন বিদেশে চাকরি করতে যাওয়া, বা শিক্ষা গ্রহণ করতে যাওয়া। বা বলা যেতে পারে, আমরা আজ শিক্ষা গ্রহণ করতে স্থূল দেহ ধারণ করেছিলাম, মৃত্যুতে আমরা দেশে ফিরে যাই। আমরা যাদের ভালোবাসি, আমাদের যারা আত্মীয়, এমনকি আমাদের যারা শত্রূ, তাদের কাউকেই আমরা হারাতে পারি না, হারাতে হয় না। কিছুদিন আমাদের দৃষ্টিশক্তির আড়ালে থাকে মাত্র। কখনো কখনো এই দৃষ্টিশক্তি আমাদের খুলে যেতে পারে, আমাদের নিদ্রাকালীন অবস্থায়। তাই আমরা অনেকে স্বপ্নে তাদের সাথে মিলিত হই । আর স্বপ্ন আমাদের বেশি করে আসা শুরু হয়, আমাদের নিজেদের মৃত্যু আসন্ন হয়। তাই মৃত্যুর কিছু আগে,আমরা আমাদের মৃত আত্মীয়-স্বজনদের স্বপ্নে দেখতে পাই।

আমাদের এই স্থূল জগতের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে সূক্ষ্ম থেকে আরো সূক্ষ্মতর আরো অনেকগুলো জগৎ। এই সব জগতেও জীবের বাস আছে। সেখানেও আমাদের স্থুল জগতের অনুরূপ আর একটা জগৎ। স্থূল জগৎ যেমন নিয়মের অধীন।  সূক্ষ্ম জগৎ তেমনি নিয়মের অধীন। নিয়ম বহির্ভূত কোনো কর্ম্ম সংগঠিত হয় না।  যিনি সকল কিছুর নিয়ন্তা, তিনি প্রেমের আধার। জীবের কল্যানে তিনি যে সব ব্যবস্থা করে রেখেছে, তা আমাদের কাছে আপাতত বৈষম্যমূলক মনে হলেও, এগুলো ন্যায়ের উপরে প্রতিষ্ঠিত এবং যার পরিনাম অবশ্য়ই সুখবহ।

আমরা জানি আর না জানি, একটা কথা শুনে রাখুন, জীব জগৎ পরিচালনা করবার জন্য, উন্নত মহান আত্মারা সর্বদা মঙ্গল কর্ম্মে রত আছেন। এঁরা ঈশ্বরের কাজকে সহায়তা করে থাকেন। বিশ্বের মঙ্গল কামনায়, তারা অহর্নিশ নিযুক্ত আছেন। সাধন জগতের সঙ্গে যুক্ত থাকলে, প্রতিনিয়ত তাদের উপস্থিতি আপনি উপলব্ধি করবেন। ইটা কোনো কল্পনার বিষয় নয়। এসব ধ্রুব সত্য।

জগতে সুখ-দুঃখ একটা আপেক্ষিক  শব্দ। প্রকৃত পক্ষে দুঃখের কোনো কারন নেই। যদি আপনি দুঃখে থাকেন, তবে জানবেন, আপনি ঈশ্বরের কাছাকাছি আছেন। দুঃখ জীব জগৎকে কল্যাণের পথে চালিত করে থাকে। দুঃখ আমাদের স্বকৃত, কল্পিত।  আর এই দুঃখে ভগবানের কোনো কর্তৃত্ত্ব নেই। এটি আসলে আমাদের কর্ম্মঋণ। দুঃখ কর্ম্মঋণ শোধ করবার একটা উপায় মাত্র। তাই এটিকে আমাদের সাদরে গ্রহণ করা উচিত। প্রকৃতপক্ষে জীব-আত্মা  সুখ-দুঃখের অতীত। আমাদের স্থূল দেহ বা মানস-দেহ সুখ-দুঃখ অনুভব করে মাত্র। আমাদের কামনার দেহ শোকে স্পন্দিত হয়। কিন্তু জীবাত্মা এইসব দুঃখ-শোকের বাইরে অবস্থান করে থাকে। যারা সত্যিকারের আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করতে পেরেছেন, তারা কখনো সুখ-দুঃখে বিচলিত হন না। আমাদের পার্থিব জীবন সুখ-দুঃখের মিশ্রণ। গাছপালা যেমন জল-বাতাস-মাটি-আলো থেকে পরিপুষ্ট হয়।  জীবআত্মা তেমনি সুখ-দুঃখে পুষ্টি  লাভ করে থাকে। তাই বলা হয়ে থাকে, জীবাত্মার উন্নতিতে আমাদের সুখ-দুঃখের প্রয়োজন আছে। আমাদের প্রিয়জনের মৃত্যু আমাদের ক্ষণিকের বিচ্ছেদ মাত্র। আমার যেমন বিনাশনেই, প্রিয়জনেরও বিনাশ নেই। শুধু অবস্থান্তর মাত্র। তাই মৃত্যু একটা অলীক কল্পনা মাত্র। আসলে আমাদের পরলোক সম্পর্কে কোনো ধারণার না থাকার জন্য, এবং আমাদের কামনাময় দেহ বা মানষদেহের ক্ষুধার জন্য আমরা শোক করে থাকি। এছাড়া, আমাদের তথাকথিত ধর্ম্মশাস্ত্র পরলোক সন্মন্ধে একটা অস্পষ্ট, একটা অনিশ্চিত, একটা ভয়াবহ, একটা বিভীষিকার জন্ম দিয়েছে। নিশ্চয়তা ত্যাগ করে, অনিশ্চিতে আমাদের ভয়ের উদ্রেগ হয়। তেমনি একটা নিশ্চিত আশ্রয়, যা আমাদের জীবন দিয়েছে, সেটাকে ছেড়ে আমরা পরলোকে যেতে ভয় পাই। পরলোক সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের অভাবই  এই ভীতির কারন। সংসারে যার বন্ধন  নেই, মরণেও তার  ভয় নেই। পরলোক আসলে একটা শান্তির স্থান, সুখের স্থান।  সেখানে  আমরা বহুকাল যাবৎ আত্মীয় প্রিজন সহ পরম সুখে বাস করতে পারি। যার এই সংসারে কোনো বন্ধন নেই, সেই মৃত্যুতে আনন্দিত হয়। কারন, সে জানে, দীর্ঘ প্রবাসের পর, আজ সে গৃহে যাত্রা করছে। সংসার একটা শিক্ষাকেন্দ্র। এখানে আমরা আসি শিক্ষা গ্রহণ করবার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এখানে এসে বিষয়ের চমকে আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য ভুলে যাই। আর শিক্ষা গ্রহণ সমাপ্ত হবার আগেই যখন, আমাদের চূড়ান্ত পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়, তখন আমরা ভীত হয়ে পড়ি। বাড়িতে গেলে বাবা বকবে, পরীক্ষায় পাশ হলো না। আমরা আসলে স্বগৃহে ফিরে যাচ্ছি। যারা আমার সঙ্গে যেতে পারছে না, তাদেরও একদিন সেখানে যেতে হবে।  তখন আমরা একত্রে মিলিত হতে পারবো। একটা কথা বলি, সংসারের প্রতি আপনার যত  আসক্তি থাকবে, প্রিয়জনদের প্রতি জট আপনার মোহ থাকবে, তত আপনার মৃত্যুটাকে ভয়ানক, কষ্টকর, বেদনাদায়ক মনে হবে। নতুবা বাড়ি ফেরা তো আনন্দের।

আমরা কর্ম্ম করতে পৃথিবীতে আসি।  শুভ-অশুভ সমস্ত কর্ম্মের ফল আমাদের অবশ্যই  ভোগ করতে হবে। এখানে না আছে কোনো হিসেবের ভুল, না আছে ঈশ্বরের হাত। আমাদের এই পার্থিব জীবনে, অথবা  কামনার লোকে, মানস  শরীরে দুঃখের কারন হচ্ছে, আমাদের স্বকৃত কর্ম্ম। আর একমাত্র ভোগের দ্বারাই সেই কর্ম্ম ফলের ক্ষয় হতে পারে। কিন্তু যাদের তত্ত্বজ্ঞান জন্মেছে, তাদের বর্তমান কর্ম্মফল দগ্ধ হয়, কিন্তু প্রারব্ধ কর্ম্মের ফল ভোগ করতেই হয়। প্রারব্ধ কর্ম্মফল অখণ্ডনীয়। আমাদের অনেকের ধারণা আছে, শারীরিক কর্ম্মই কর্ম্ম, না আমাদের চিন্তাও কর্ম্ম। এমনকি শারীরিক কর্ম্ম থেকে আমাদের মানসিক কর্ম্মের প্রভাব অনেক বেশি। একটা কথা ভাবুন, শরীরের সুখ সীমাবদ্ধ সময়ের জন্য কিন্তু আমাদের মানসিক কল্পিত সুখ অনন্ত।

অদৃশ্য জগৎ যেখানে করোনার বাস।

করোনাকে আমরা সাধারণ মানুষেরা  বলছি জীবাণু। আসলে করোনা কিন্তু জীবানু  নয়। করোনা হচ্ছে একটা ভাইরাসের নাম। আর VIRAS কথাটা আসলে ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ হচ্ছে বিষ। ভাইরাস হচ্ছে একটা বস্তু। জীব ও জড়ের মধ্যবর্তী পর্যায়ের একপ্রকার বস্তু। অর্থাৎ না জীব না জড়। এটি নিউক্লিয় প্রোটিন দিয়ে গঠিত। অতিশয় ক্ষুদ্র আকৃতি, অৰ্থাৎ অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া আমাদের খালি চোখে ধরা পড়ে  না। ভাইরাস সম্পূর্ণ ভাবে পরজীবী। জীবের শরীরে যে কোষ আছে, সেই কোষের বিপাকীয় শক্তি নিয়ে এর জৈবিক বৈশিষ্ঠ প্রকাশ হয়।  অর্থাৎ তখন সে জীবাণুতে পরিণত হয়। যতক্ষন সে পোষোক  কোষের সাহায্য  না পায়, ততক্ষন সে নিষ্ক্রিয়, অর্থাৎ নির্জীব। অর্থাৎ ভাইরাস যতক্ষন আমাদের শরীরের ভিতরে কোষের সংস্পর্শে না আসছে, ততক্ষন এটি একটি বস্তু মাত্র। এবং এর কোনো প্রজনন ক্ষমতা বা বংশবৃদ্ধি হয় না। ক্ষতিও করতে পারে না। বিষ যেমন আমাদের শরীরে প্রবেশ না করলে  কোনো ক্রিয়া করতে পারে না, তেমনি করোনা আমাদের শরীরের মধ্যে প্রবেশ না করলে আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। আর এই প্রবেশ দ্বার হচ্ছে মূলত আমাদের নাক, মুখ, চোখ ইত্যাদি দিয়ে। অতএব  এই জায়গাগুলোকে সুরক্ষিত রাখুন।

এই নিউক্লীয় বস্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে DNA যুক্ত হলেও RNA যুক্ত ভাইরাসও দেখা যায়। প্রোটিনের প্রকারভেদে  এরা তিন রকম হতে পারে। এর মধ্যে A  স্ট্রেন এর বিস্তৃতি ও রোগ সৃষ্টি করবার ক্ষমতা বেশি।

ভাইরাসের দেহকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত হচ্ছে বাইরের দিকটা বা বাইরের আবরণ হচ্ছে ক্যাপসিড CAPSID ।  এটা প্রোটিন দিয়ে গঠিত। কেন্দ্রের অংশটি লিপিড LIPID  দ্বারা গঠিত। আর মাঝের অংশটিকে নিউক্লিওয়েড  NUCLEOID

আমরা জানি আমাদের এই যে দেহ, তা কিছু জড় পদার্থের সমষ্টি মাত্র। এর মধ্যে যতক্ষন প্রাণশক্তির গমন-নির্গমন অব্যাহত থাকছে, ততক্ষন আমরা জীবিত বা প্রাণবন্ত। জড় পদার্থ বিকারশীল।  অর্থাৎ জড়ের সর্বদা পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু চৈতন্যের কোনো বিকার নেই, নির্বিকার।  চৈতন্যের কোনো পরিবর্তন নেই।

জীবজগতের যে ক্রমবিকাশ তা ত্যাগের উপরে প্রতিষ্ঠিত।  প্রকৃতি যে উন্নত থেকে উন্নততর, মহৎ থেকে মহত্তর  কোটি কোটি মূর্তি সৃজন  করছেন,  সৃষ্টিবৈচিত্রের প্রত্যেক পর্ব্বে যে উন্নয়ন আমরা লক্ষ করছি, তার মুলে আছে বিসর্জন। একটা মূর্তি বিনাশপ্রাপ্ত না হলে আর একটা নতুন মূর্তির সৃষ্টি হতে পারে না। পৃথিবীর আদি থেকে খনিজ পদার্থ থেকে মানুষ সৃষ্টি পর্যন্ত সমস্ত প্রক্রিয়াই ত্যাগের উপরে প্রতিষ্ঠিত। এ'কের বিনাশে অন্যের উদ্ভব। দুর্বলের বিনাশে সবলের স্থিতি।

পৃথিবীতে বা প্রকৃতিতে আমাদের সমস্ত জীব এমনকি অজীব পদার্থের মধ্যে একটা খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক। একেই বলে বাস্তুতন্ত্র। আমরা মাছ, মাংস উদ্ভিদ খেয়ে বেঁচে থাকি। মাছ ছোট মাছ বা পোকা খেয়ে বেঁচে থাকে। ছোটমাছ জুপ্লাঙ্কটন খেয়ে বেঁচে থাকে জুপ্লাঙ্কটন আবার ফাইটোপ্ল্যাংটন  খেয়ে বেঁচে থাকে। এই ফাইটোপ্ল্যাংটন  সৌর শক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে। এই রাসায়নিক শক্তি তখন ফাইটোপ্ল্যাংটোনের মধ্যে শক্তিরূপে আবদ্ধ থাকে। আমাদের যে সবুজ ঘাস বা  উদ্ভিদ এরাও সূর্য্যশক্তি কে  নিজের দেহে  রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে। কিছু প্রাণী আছে তৃণভোজী।  এই তৃণভোজীদের খেয়ে বেঁচে থাকে আবার মাংশাসী প্রাণী।

জন্ডিজের ঔষধ।

আমি তখন কলেজে পড়ি।  আমার এক বন্ধুর জন্ডিস হয়েছে, খবর পেয়ে আমরা বন্ধুরা মিলে  দেখতে গেলাম তাকে । সেখানে গিয়ে  জন্ডিস ভালো করবার এক অতি  আশ্চর্য্য প্রক্রিয়ার  কথা জানতে পারলাম। দেখলাম, বন্ধুটি একটা মালা পড়ে  বসে আছে। বললাম এটা কি ? তো সে বললো, ওর মা নাকি কার কাছ থেকে এনে দিয়েছে। মাত্র ১০ টাকা দাম। স্বপ্নে পাওয়া মালা। এটা নাকি ভীষণ উপকারী।   টাকাটা নাকি ব্যয় হয় ঠাকুর পুজোয়। ভদ্রলোক মালার কোনো দাম নেন না। কোনো পারিশ্রমিক নেন না। অব্যর্থ প্রক্রিয়া।  মালাটা নাকি মাথায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।  এখন দেখলাম গলায়। ধীরে ধীরে মালার পরিধি বড়  হবে। এক সময় মালা বড় হতে হোতে  কোমর দিয়ে বেরিয়ে যাবে। ব্যাস জন্ডিস ক্ষতম। দারুন ব্যাপার। বললাম, ডাক্তারের কাছে যাস নি ?  না, আর এসব ব্যাপারে ডাক্তারের কাছে গিয়ে লাভ নেই।  অহেতুক পয়সা খরচ। এই মালা পরে অসংখ্য লোক ভালো হয়েছে।  শুধু শুধু ডাক্তারের কাছে যাবো কেন ? আমি বিমর্ষ হয়ে চলে আসি। বিজ্ঞান মনস্ক মন আমার আমি এইসব টোটকাতে বিশ্বাস করি না।  দুই একজনের কাছে খোঁজ নিয়ে জানলাম, স্বপ্নে পাওয়া মালার নাকি খুব চাহিদা। আর এতে করে রোগ ভালোও হচ্ছে। একটু ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলাম। ব্যাপারটা কি ? মালা তৈরি যিনি করেন, তার কাছেও গেলাম। কিভাবে কি দিয়ে মালা  তৈরি করছেন, ইত্যাদি জানতে।  তো তিনি বললেন, বিশ্বাস থাকতে হবে, কিছু নিয়ম কানুন মানতে হবে তবে রোগ ভালো হয়ে যাবে। নিয়মকানুন না মানলে রোগ সারবে না। আমার বিজ্ঞান আশ্রিত  মন খুব বিপদে পড়ে  গেল।

ভদ্রলোকের কাছে যাতায়াত শুরু করলাম। দেখলাম, বামনহাটি গাছের ডাল, কখনো কখনো ভৃঙ্গরাজ গাছের ডাল  দিয়ে  মালাটা তৈরী করছেন। মালা তৈরী করার মধ্যে একটা কারিগরী কৌশল আছে। ডালগুলোকে একইঞ্চি মতো, ছোট ছোট টুকরো করে কেটে কাঁচা অবস্থাতেই মালা তৈরি করা হয়। টুকরোগুলো আড়াআড়ি ভাবে ধরে আঙুলে দুইপাক সুতোর ফাঁস দিয়ে পর পর ঘেসে আলগা করে গাঁথা হয়। এই সুতোর গিটগুলোর মধ্যে একটা বিশেষ কায়দা থাকে। গাছের টুকরো যখন শুকোতে  থাকে, অর্থাৎ ফাঁপা ডালগুলো যখন শুকোতে থাকে, তখন কাঠিগুলো সরু হয়, আর সুতোর বাঁধন  ততই ঢিলে হতে থাকে। ফলে দুটো কাঠির মধ্যে ফাঁক বাড়তে থাকে, আর মালার দৈর্ঘ বাড়তে থাকে। অর্থাৎ মালা যখন গাঁথা হয়, তখন মালার দীর্ঘ যা থাকে, মালা যত  শুকোতে থাকে মালা তত বড়ো হয়, কিন্তু বাঁধন প্রক্রিয়ার ফলে মালা টাইট থাকে। তাই ছোট মালা একসময় যা মাথা দিয়ে ঢুকতো না, সেটা একসময় কোমর দিয়ে বেরিয়ে যায়। আসলে এই মালা আপনি শরীরে ধারণ না করে যদি, দেওয়ালে পেরেকে ঝুলিয়ে রাখেন, তাহলেও এই মালা দিন দিন শুকোবে আর বড়ো  হবে। অদ্ভুত কৌশল।

এতো গেলো মালা তৈরির কৌশল, কিন্তু লোকে যে বলে এতে করে জন্ডিসের মতো একটা মারাত্মক অসুখ সেরে যায়, তার কি অসত্য ? তা যদি না হয়, তবে ব্যাপারটা কি ?

এই ব্যাপারটা বুঝতে গেলে, আমাদের বুঝে নিতে হবে, জন্ডিস ব্যাপারটা কি ? বাংলায় এই রোগকে বলে কামলা, বা পান্ডু  রোগ।  আমরা জানি জন্ডিসে আমাদের  মূত্র হলুদ বর্ণের হয়। চোখ এমনকি আমাদের শরীর খানিকটা হলুদ বর্ণ ধারণ করে।

আমাদের শরীরে একটা গুরুত্ত্বপূর্ন গ্রন্থি হচ্ছে যকৃৎ বা liver এইখানে আছে আমাদের রক্ত তৈরির কারখানা, পিত্ত তৈরির কারখানা, আর চিনি বা কাৰ্বোহাইড্রেড  তৈরির কারখানা । আমরা যে খাবার খাই, তা  জীর্ন হয়ে  রস রূপে যকৃতে গমন করে। সেখানে রঞ্জক-পিত্ত-এর সাহায্যে এই রসকে রক্তে  পরিণত করে। রক্তে কোনো দূষিত পদার্থ থাকলে, সেটিকে সেঁকে শুদ্ধ করে আমাদের লিভার। রক্তকে লাল করে হিমোগ্লোবিন। সুস্থ শরীরে রক্তের লোহিত কণিকা ভেঙে তৈরি হয় হলুদ রঙের যৌগ  বিলিরুবিন। প্রথমে বিলিরুবিন লিভারে তৈরি হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন পর্য্যায়ে নানান পথ বেয়ে প্রধানত চর্ব্বি জাতীয় খাদ্য হজম করতে সাহায্য করে, এই বিলিরুবিন। আর এই কারণে খাদ্য হজম করতে ইন্টেস্টাইনে বা অন্ত্রে  আসে। এখানে পরিপাক ক্রিয়া হয়ে যাবার পরে, বিলিরুবিনের বেশিরভাগটা স্টার্কো বিলিনোজেনে পরিণত হয়ে আমাদের বর্জ্য পদার্থের সঙ্গে বেরিয়ে যায়।  এবং সেই কারণেই আমাদের মলের রঙ হলুদ। খানিকটা আবার পেচ্ছাপের সঙ্গে বেরিয়ে যায়, সেই কারণে আমাদের পেচ্ছাপের রঙও হালুন বর্ণের দেখা যায়। এবার যদি কোনো কারণে আমাদের শরীরে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন অতিরিক্ত বিলিরুবিন আমাদের দেহের চামড়া বা মিউকাস মেমব্রেনে ছড়িয়ে পড়ে। তখন আমাদের শরীর হয় হলুদ বর্ণের। আর একেই আমরা বলি কামলা বা জন্ডিস। এখন কথা হচ্ছে, এটা কেন হয় ? 

আমাদের লিভারের মধ্যে যে সরু সরু নালী আছে, সেখানে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সংক্রমণে লিভার কোষের কার্য্য ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তার ফলে ১. বিলিরুবিন স্বাভাবিক ভাবে বেরুতে পারে না, জমতে থাকে। এর থেকে হয় হেপাটাইটিস রোগের  উৎপত্তি। আমাদের রক্তে যে স্বাভাবিক রঞ্জক পদার্থ আছে, তাকেই বলে যৌগ পিগমেন্ট বা বিলিরুবিন। রক্তের লোহিত কণিকা ভেঙে তৈরি হয় বিলিরুবিন। এই বিলিরুবিন তৈরির একটা নির্দিষ্ট সময় আছে, যদি কোনো কারনে এই সময়সীমার আগেই লোহিত কণিকা ভাঙতে শুরু করে, তবে আমাদের শরীরে বিলিরুবিনের মাত্রা অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায়। আর এর ফলেই জন্ডিসের রোগের  উৎপত্তির হতে পারে । এখন কথা হচ্ছে, ইটা কি ভাবে ভালো হতে পারে ?

আমাদের শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এই রোগকে নির্মূল করতে পারে। আর এর জন্য দরকার আমাদের সম্পূর্ণ বিশ্রাম। খাবার মধ্যে প্রচুর পরিমানে গুলুকোজ, ভিটামিন ও পরিশুদ্ধ জল। এছাড়া এই সময় অবশ্য়ই চর্ব্বি  জাতীয় খাবার পরিত্যাগ করতে হবে। এতে আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই এন্টিবডি তৈরি হবে। এবং আমরা সত্বর  সুস্থ হয়ে উঠবো। 

যাইহোক আমাদের আলোচনার বিষয় শরীর নয়, আমাদের আলোচ্য বিষয় কুসংস্কার। আমাদের লিভার যখন ঠিক ঠিক মতো কাজ করতে না পারে, তখন আমাদের এই কামলা হবার সম্ভাবনা থাকে। সেখান থেকে বাঁচতে গেলে আমাদের যেটা করতে হবে, তা হচ্ছে, আমাদের খাদ্যের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। চর্বি জাতীয় খাবার খাওয়া চলবে  না ,বিশ্রাম নিতে হবে।  গ্লুকোজ, ভিটামিন এবং পরিশুদ্ধ জল খেতে হবে। এতে করে আমাদের মধ্যে এন্টিবডি তৈরি হবে, লিভারের মধ্যে যে ভাইরাস ছিল, তার  ধংশ হবে। এতে বামনহাটি  বা ভৃঙ্গরাজ গাছের ডালের মালার কোনো ভূমিকা নেই।