Wednesday 31 July 2019

মনের গভীরে

মনের গভীরে  


 আমরা অনেকেই জানি মন ত্রিস্তরীয় : চেতন - অবচেতন - অতিচেতন। হঠযোগীরা বলেন : দেহ শুদ্ধ হলেই মন শুদ্ধ হবে। এবং একমাত্র শুদ্ধ মনই আত্মউপলব্ধি করতে পারে। তো যার দ্বারা আত্মউপলব্ধি হবে তাকে একটু বুঝে নেই।

এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি : ছেলে বলছে আমি কাঁঠাল খাবো। বাবা বাজার থেকে কাঁঠাল কিনে এনেছে। বাবা ছেলেকে কাঁঠালের পরিচয় দিচ্ছে। এই যে উপরের কাঁটা কাঁটা আস্তরণ দেখছিস  এঁকে বলে ছোবড়া। আস্তরণ ছাড়ালে কোয়া, কোয়ার ভিতরে আঁটি, আর এইযে কোয়ার বাইরে যে দেখছিস এটাকে বলা হয় ভুচরো।  আর ভেতরে মুগুরের মতো দেখছিস এটাকে বলে মোথা। ছেলে বলছে তো বাবা কাঁঠাল কোথা ?

তো মনকে খুঁজলে, দেহের মধ্যে কোথাও পাওয়া যাবে না। তবু আমাদের মনকে জানতে হবে।

যারা বিজ্ঞানের ছাত্র তারা জানে -  মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের কাজ কে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। একটা হচ্ছে সুষুম্না কান্ডীয় (Spinal Cord  Level ) , দ্বিতীয়টা হচ্ছে নিম্নতর মস্তিস্ক স্তর (Lower Brain Level) উচ্চতর মস্তিস্ক স্তর  (Upper Brain Level )

এই উচ্চতর মস্তিস্ক আমাদের মাথার সবচেয়ে বা আমাদের দেহের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ন অংশ। আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার সংগ্রহশালা হিসাবে কাজ করে। অতীতের অভিজ্ঞতার অধিকাংশ স্মৃতিই এখানে সঞ্চিত থাকে। এছাড়া আমাদের শরীরের যে প্রতিক্রিয়া হয় অর্থাৎ যাকে  আমরা চেতন মনের কাজ বলি, তার খবর এখানে সঞ্চিত থাকে। এবং নিজের ইচ্ছায় সে খাবরাখবরকে কাজে লাগিয়ে দেহের চেষ্টীয় প্রতিক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

নিম্নতর মস্তিস্ক দ্বারা দেহের অধিকাংশ অবচেতন কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। রক্তচাপ,শ্বাসক্রিয়া, ক্রোধ, উত্তেজনা, যৌনক্রিয়াকলাপ, যন্ত্রনা, আত্মতুষ্টি, এগুলো সবই নিম্নতর মস্তিষ্কের কাজ।  অতএব আমরা যাক অবচেতন মনের কাজ বলি তা এই নিম্নতর মস্তিস্ক করে থাকে।

দেহের ইন্দ্রিয়সকল দ্বারা গৃহীত সমস্ত সংবাদ বা উদ্দীপনা সুষুম্নাকাণ্ডে প্রেরণ করা হয়।  এবং সুষুম্নাকাণ্ড এই সংবাদের ভিত্তিতে সুষুম্না কাণ্ডের উদ্ভাবনী প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব হয়। এটা স্বয়ংক্রিয় এবং সংজ্ঞাবহ সংকেত সুষুম্নাকাণ্ডে যাবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায়। এটাই অতিচেতন মনের কাজ বলতে আমরা যা বুঝি তাই।

মন কোনো আলাদা বস্তূ  বা স্নায়ু নয়। বিভিন্ন স্নায়ুর ক্রিয়াকে আমরা মনের ক্রিয়া বলি। মন বলে কিছু নেই সবই স্নায়ুর খেলা।  আমাদের এই স্নায়ুর কেন্দ্রে যেতে হবে।  স্নায়ু যেখান থেকে  শুরু হয়েছে সেটা মস্তিস্ক। আর স্নায়ুর অবতরণ ক্ষেত্রে হচ্ছে সুষুম্না কাণ্ড। তাই সুষুম্না নাড়িকেই আমাদের আশ্রয় করতে হবে যদি আমরা আত্মউপলব্দ্ধি করতে চাই। এই স্নায়ুকেন্দ্রে প্রতিফলিত হবে আমাদের অধরা ঈশ্বর।আমাদের চেতন স্বরূপ।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ             

আধ্যাত্মিক জগতের প্রবেশদ্বার হচ্ছে "মন" .মনকে না জানলে সাধন জগতের কিছুই জানা যায় না।তাই সাধনা করতে চাইলে মনকে বুঝতে হবে, ধরতে হবে। শুধু সাধন জগতে নয়, আমাদের এই পার্থিব জীবনে অর্থাৎ  ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে সবশেষে বিশ্বস্তরীয় জীবনে মনের গুরুত্ত্ব অপরিসীম। যে মনকে জেনেছে, তার জীবনে সুখ এসেছে, আর যে জীবনে কখনো মনকে বুঝতে পারেনি, তার জীবনে দুঃখই দুঃখ। মনিষীরা বলছেন, মানুষের জীবনে বন্ধনের কারণও এই মন। যে মনকে জেনেছে, সে স্বাধীন, সুখী। আর যে মনকে জানতে পারেনি, সে বন্ধনে আবদ্ধ, পরাধীন।

এখন মন কথাটার অভিধানগত অর্থ  কি ? মন বলতে আমরা কি বুঝি ?  যার সাহায্যে মানুষ মনন করে, তাকেই বলে মন। এই মনকে আবার কেউ কেউ বলেন চিত্ত। চৈতন্য যেখানে প্রতিফলিত হয় সেটাই চিত্ত। মনকে আবার কেউ বলেন, অন্তঃকরণ। অর্থাৎ ভিতরে বা  অন্তরে যিনি কাজ করেন, তাকে বলে অন্তঃকরণ। এই মনের সাহায্যে আমরা জ্ঞান, বুদ্ধি আহরণ করি, তাই একে কেউ কেউ পেলেন প্রজ্ঞা। সমস্ত ইন্দ্রিয়ের ইনিই প্রবর্তক, তাই কেউ কেউ এঁকে  বলেন, প্রবৃত্তি। আবার বলা যায়, আমাদের ইচ্ছাশক্তির প্রবর্তক ইনি তাই এঁকে প্রবৃত্তি বলা যায়। আবার কেউ এঁকে হৃদয় বলে আখ্যা দিয়েছেন। অর্থাৎ আমাদের দয়ার ভাব উদয় হয় এখানে তাই হৃদয়। তা আপনি মনকে  যে নামেই ডাকুন না কেন, মন মনেই থাকবে। আসলে মনের বিভিন্ন ক্রিয়ার জন্য বা তার বিভিন্ন রকমের স্বভাবের জন্য আমরা ভিন্ন ভিন্ন নাম ডাকি। মন আমাদের অধরা। মন কোথায় থাকে আমরা জানি না। কেবল তার উপস্থিতি টের পাই, বা অনুমান করি মাত্র।

আমরা জানি, আমাদের পঞ্চভূতের শরীরের কোথাও মনকে খুঁজলে পাওয়া যাবে না।  আসলে স্নায়ুর ক্রিয়া। সাধকের ভাষায় চক্রের ক্রিয়া। তাই চক্রগুলো সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে।

আমাদের দর্শন, আমাদের শ্রবণ, ইত্যাদি  আমাদের শরীরের বিভিন্ন চক্রে  আঘাত করে, এবং সেখানে স্পন্দন তোলে, তাকে চঞ্চল করে তোলে, এবং ক্রিয়াশীল করে তোলে। আমাদের বিশেষ বিশেষ জায়গায় বা গ্রন্থিতে আলোড়ন তোলার  সক্রিয় ভূমিকা নেয়, আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়। । আর ওই গ্রন্থি যখন ক্রিয়াশীল হয়ে যায়, তখনি আজব ব্যাপার সংগঠিত হয়। মানুষ তখন চিন্তাকরতে শুরু করে, ভাবনা করতে শুরু করে। এবং এই স্পন্দনধারায় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে  মানুষের চিন্তা ধারার পরিবর্তন হয়। বিচারাধারার পরিবর্তন হয়। কর্মধারার পরিবর্তন হয়। মানুষ পাশবিক প্রবৃত্তি ত্যাগ করে, দেবমানব হয়ে যায়।  মানুষের চক্র সংখ্যা ১১৪।  সমস্ত চক্র (১১৪) ক্রিয়াশীল হতে পারে। ১১৪টি চক্রের মধ্যে ১০৮টি চক্র ক্রিয়াশীল করা যায়। এসব আসলে মহামানবের ব্যাপার। অবতারদের ব্যাপার। এই জন্য জপের মালায় ১০৮টি পুঁথি থাকে। মহামানবের ১০৮টি চক্র ক্রিয়াশীল থাকে।  বাকি ছয়টি ক্রিয়াশীল হয় না। কিন্তু মাত্র ৭টি চক্র বা ১১টি স্পর্শকাতর জায়গায় আমরা যারা সাধারণ মানুষ, একটু চেষ্টা করলেই সেগুলিকে ক্রিয়াশীল করতে পারি। সেজন্য এই জায়গাগুলো সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণা থাকা দরকার। প্রথমে এটি কল্পনা করে নিতে হয়। সাধনার সঙ্গে সঙ্গে এই সব জায়গায় মৃদু কম্পন অনুভূত হয়। তখন এর সঠিক অবস্থান জানা যায়।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ 


আমাদের শরীরে ১১টি স্পর্শকাতর জায়গা আছে, যেগুলো আমাদের মনের ক্রিয়াকে সংগঠিত করে, এই এগারোটি জায়গার  মধ্যে মেরুদণ্ডের  মধ্যে ৬ টি। এবং মস্তিষ্কে ৩ টি। এবং দুটি আছে মুখাবয়বে। এগুলোর ক্রিয়াকে আমরা আমাদের মনের ক্রিয়া বলে থাকি।  
আমাদের মেরুদণ্ডের দুইদিকে দুটো নাড়ী  আছে, তার নাম  ইড়া,  পিঙ্গলা। এই ইড়া ও পিঙ্গলার মাঝে অর্থাৎ ইড়ার ডানদিকে ও পিঙ্গলার বাম  দিকে সুষুম্না নাড়ী অবস্থান করছে। এই সুষুম্নার মধ্যে আছে   বজ্রাখ্যা নাড়ী। আর বজ্রাখ্যা নাড়ীর মধ্যে অবস্থান করছে  চিত্রাণি নাড়ী। এই নাড়ীগুলোর বিভিন্ন স্থানে কিছু সংযোগস্থল আছে, যেখান থেকে উভয়পার্শ্বে বিভিন্ন স্থান থেকে একাধিক স্নায়ু নির্গত হয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। এগুলোকে বলে গ্রন্থিচক্র। স্পাইনাল কর্ড লেভেলে বা মেরুদন্ড সংলগ্ন স্নায়ুর সংযোগস্থল গুলো হচ্ছে :
মূলাধার,(মেরুদণ্ডের শেষে,পায়ুদেশের খানিকটা উপরে, ) 
স্বাধিষ্ঠান, (লিঙ্গমূলে) 
মনিপুর,(নাভির ঠিক পিছনে ) 
অনাহত, (হৃদয়ের পিছনে ) 
বিশুদ্ধি, (কন্ঠার ঠিক পিছনে) 
আজ্ঞা, (মেরুদণ্ডের শুরুতে - এটি ভ্রূযুগলের পিছনে নিম্ন মস্তিষ্কে)

এছাড়া  আছে 
সহস্রার, (মস্তিষ্কের তালুতে) 
বিন্দু, (সহস্রারের ঠিক উপরে )

এর পরেও আমাদের মুখাবয়বে  তিনটি স্পর্শকাতর জায়গা সম্পর্কে আমাদের ধারণা রাখা উচিত।  সেগুলো হল : 
 ভ্রূযুগল মধ্যে, যাকে আমরা ত্রিনয়নের স্থান বলি 
নাসিকাগ্র ; অর্থাৎ নাসিকার অগ্রভাগ 
এবং চিদাকাশ অর্থাৎ চোখ বুজলে যেখানে আমরা অন্ধকার দেখি । :

  এগুলো  ক্রিয়াশীল করলে, এখন থেকে রস নিঃসরণ হয়। আর রসের স্পন্দন আমাদের ভাবনার জগতে আলোড়ন তোলে, আমাদের ক্রিয়াশীল করে তোলে,  বা এগুলোর সাম্যাবস্থা থাকলে আমরা ভালো থাকি, আর এগুলো অস্থির হলে বা চঞ্চল হলে আমাদের মন চঞ্চল হয়।  

 আমরা জানি সমগ্র ব্রহ্মান্ড সাতটি  লোক বা স্তরে  বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে : ভূ-লোক, ভুব-লোক, স্বঃ-লোক, মহঃ-লোক, জনঃ-লোক, তপঃ-লোক, এবং সত্যম বা  সত্য-লোক। আবার আমাদের শরীরের মধ্যেও সপ্ত ধাতু আছে যেমন : শুক্র, শোনিত, মজ্জা, মেদ, মাংস, অস্তি , ত্বক। এই দেহের এক একটা স্থান এক একটা লোকের কর্ম- কেন্দ্র। এই কর্মকেন্দ্রের নামই চক্র বা গ্রন্থিচক্র । এই গ্রন্থিগুলো বা এক একটা গ্রন্থি এক এক তত্ত্বের কর্মকেন্ত্র। তত্ত্ব অর্থাৎ পঞ্চতত্ত্ব - ক্ষিতি, অপ, তেজ. মরুৎ , ব্যোম। দেহের প্রধান প্রধান গ্রন্থি গুলির অন্তর্মুখী রস  নিঃসরণের ক্ষমতা আছে। এই অন্তর্মুখী রসই রক্তের সঙ্গে মিশে দেহের গঠন ও পালনপোষন করে। এবং আমাদের  মানসিক জীবন  বা মন গঠন করে। যার দেহে যে গ্রন্থির আধিপত্য বেশি বা যার দেহে যে গ্রন্থি অধিক ক্রিয়াশীল, তাকে সেই গ্রন্থিপ্রধান মানুষ বলা হয়।
গ্রন্থি বা  চক্র থেকে  নির্গত অন্তর্মুখী রস, রসের স্পন্দন  আমাদের মনের ক্রিয়া সম্পাদন করে। তাই একে আমরা মন  গঠনের কারন বলে থাকি। 

যদিও সমস্ত গ্রন্থিই আলাদা আলাদা ভাবে সারা শরীরে ক্রিয়াশীল। তথাপি এক এক গ্রন্থির এক একটি প্রধান কার্যকেন্দ্র  আছে। এগুলোকে স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী ব্যাখ্যা করেছেন এই ভাবে। :

আজ্ঞাচক্র : কণ্ঠদেশ থেকে ললাটের মধ্যবর্তী অংশ   আকাশ তত্ত্বের কাজ করে। অর্থাৎ ব্যোম গ্রন্থি বলা যেতে পারে। এখানেই  ইন্দ্রগ্রন্থি ( THYROID) উপেন্দ্রগ্রন্থি (Para-Thyroid ), তালুগ্রন্থি (Tonsil ),  লালা গ্রন্থি (Salivary Glands ) ইত্যাদির কর্মক্ষেত্র   । এখান থেকেই যে অন্তর্মুখী রস  নিঃসৃত হয় আমাদেরকে সুস্থ থাকতে  সাহায্য করে।  এই গ্রন্থিগুলি  সুস্থ-সবল থাকলে - আমাদের স্নেহ, প্রীতি, ভালোবাসা, উচ্চ চিন্তা বা গভীর চিন্তা করার ক্ষমতা থাকে। আর গ্রন্থিগুলি  অতি সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে আমাদের বিষাদ, উচ্চ চিন্তার ক্ষমতা হ্রাস, হতদ্যম, আলস্য, কর্মবিমুখতা প্রভৃতি দেখা দেয়। ব্যোম তত্ত্বে সত্ত্বগুণের আধিপত্য। 
                                                                                                                                                   অনাহত চক্র : এর পরে আসছে বক্ষ প্রদেশ।  এটি বায়ুতত্বের প্রধান কর্মকেন্দ্র। এখানে দুটো ফুসফুস, হৃদযন্ত্র, মঙ্গলগ্রন্থি (thymus ) এবং প্রাণকোষ নির্মাণকারী গ্রন্থি এবং অনেকগুলো উপগ্রন্থি এই বায়ু গ্রন্থির অন্তর্গত। বায়ুই দেহের প্রধান রক্ষক ও পরিচালক।
এই বায়ু গ্রন্থি ও তার তার অন্তর্গত গ্রন্থিগুলি সুস্থ-সবল থাকলে একদিকে যেমন দেহ সুস্থ থাকে তেমনি এই গ্রন্থিই মানুষকে ধীর-স্থির, শুদ্ধ-শান্ত, শ্রদ্ধাশীল, ও মহাকর্মী করে । বায়ু ঠিকমতো কাজ না করলে মানুষ অস্থিরমতি, অকৃতজ্ঞ, কৃতঘ্ন হয়।

মনিপুর : এর পরে আসছে মধ্যপ্রদেশ অর্থাৎ পেট। এটি অগ্নিগ্রন্থির  অন্তর্গত। এখানে কি আছে এক বার দেখে নেই। প্লীহা,(Spleen ) যকৃৎ(liver ) অগ্ন্যাশয় (Pancreas ) শুক্রগ্রন্থি (Adrenal Gland )  প্রভৃতি গ্রন্থি অগ্নিগ্রন্থির প্রধান কর্মক্ষেত্র। অগ্নিগ্রন্থিই শরীরে তাপ প্রদান করে। প্রাণকে সঞ্জীবিত রাখে। এই অগ্নিগ্রন্থি থেকে যে রস  নিঃসৃত হয় তা Nitric Acid , Hydrochloric Acid, Sulphuric Acid প্রভৃতি দাহিকাশক্তি সম্পন্ন উপাদানের সমাহার। এই অগ্নিরসই পাচকরস, পিত্তরস, অম্লরস। এই অগ্নিরস অন্নকে দগ্ধ করে, রসরক্তে পরিণত করে। দেহের মাংস মেদ অস্থি প্রভৃতি গঠনে সহায়তা করে।
এই অগ্নিপ্রধান লোকেরাই হয় মহাতেজস্বী, উদ্দমী  ।  নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা থাকে এঁদের। আর এই গ্রন্থি যদি ঠিক ঠিক মতো কাজ না করে তবে তারা হয় কামুক, ঝগড়ুটে, দাম্ভিক, অহংকারী, উগ্র, অস্থির, অসহিষ্ণু।
স্বাধিষ্ঠান চক্র মূলাধার চক্র :এর পরে আসছে নিম্নাঙ্গ। বরুণগ্রন্থি  অর্থাৎ মূত্রগ্রন্থি,(kidney ), প্রজাপতি গ্রন্থি বা পিতৃগ্রন্থি (Testis ) কন্দর্প-গ্রন্থি (Prostate gland ), মদনগ্রন্থি (cowpers Gland ), মাতৃ গ্রন্থি (Ovary ) রতি গ্রন্থি,(Bartholins gland)  মিথুন  গ্রন্থি (Skenes gland ) . এগুলো সবই  বরুন গ্রন্থির অন্তর্গত। এই বরুণগ্রন্থির নিঃসৃত অন্তর্মুখী রসে সন্তান বীজ বা শুক্রকীট উৎপন্ন হয় ও সৃষ্টিধারাকে অব্যাহত রাখে। এই শুক্র হতেই দেহের সমস্ত উপাদান অর্থাৎ স্নায়ু, তন্তু  কোষ, মাংস, মজ্জা, অস্থি সমস্তই গড়ে ওঠে। বরুণগ্রন্থি হতে নিঃসৃত রসকে বলা হয় সোমরস।
ব্রুনগ্রন্থি প্রধান লোকেরা খুব সহৃদয় হয়। এদের মিষ্টি ব্যবহার, মিষ্টি কথা মানুষকে আকর্ষণ করে। এরা বৈষয়িক প্রতিষ্ঠা পায়। বরুণগ্রন্থি  ঠিক ঠিক মতো কাজ না করলে মানুষ স্বার্থপর, পরশ্রীকাতর, ক্রোধী ও কামুক হয়।
পৃথ্বি গ্রন্থি অস্থি ও মাংস উপাদানের কারন ক্ষেত্র। পৃথ্বি গ্রন্থির শক্তি ও তার প্রকাশ সুপ্ত।
পৃথ্বি গ্রন্থিপ্রধান লোকেরা স্থুলদেহী হয়।  স্বভাব হয় উদার,ও সহিষ্ণু। এরা  সাধারণত ঝামেলা এড়িয়ে চলে। এই গ্রন্থির অসামাঞ্জস্যে মানুষ হয় ভোগী স্বার্থপর।
আধুনিক বিজ্ঞান  বলছে  : স্নায়ুতন্ত্র বা nurvas system আমাদের বাহির জগৎ ও অন্তর্জগতের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে।   এই স্নায়ুতন্ত্র গঠিত হয় স্নায়ু তন্তু অর্থাৎ সুতো বা fibre-এর   মতো একপ্রকার পদার্থ দিয়ে। তন্তু গুলো বিভিন্ন আকারের হয়। সরু, মাঝারি,পাতলা। কর্ম অনুসারে এরা  তিন ধরনের হয়।  প্রথম গ্রাহক বা receptor, দুই প্রেরক বা বাহক conductor (Neurone ) এবং তিন কারক বা effector . এই তিন রকম কাজের সাহায্যে স্নায়ুতন্ত্র আমাদের অন্তর্জগৎ ও বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।
আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি  অর্থাৎ চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিব্বা, ত্বক, এই  পাঁচটি ইন্দ্রিয় এবং দেহের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত গ্রাহক কোষগুলি বাইরের জগতের উদ্দীপনা বা ভৌত বা রাসায়নিক পরিবর্তন গ্রহণ করে। এইবার গৃহীত উদ্দীপনা সংবেদ স্নায়ু বা বাহক স্নায়ুর মাধ্যমে স্নায়ুকেন্ত্র অর্থাৎ মস্তিস্ক বা সুষুম্নাকাণ্ডে পাঠিয়ে দেয়।
এইবার মস্তিস্ক বা সুষুম্নাকাণ্ড অর্থাৎ স্নায়ু কেন্দ্র এই উদ্দীপনার বিশ্লেষণ করে এবং ক্রিয়া স্থান বা কারকে অর্থাৎ effective organ- এ বাহকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। 
এইবার স্নায়ু কেন্দ্র থেকে গৃহীত আদেশ অনুসারে ক্রিয়াস্থান বা কারকে কার্য সম্পাদিত হয়।
অতএব আমাদের কাছে একটা জিনিস পরিষ্কার : মস্তিস্ক হচ্ছে স্নায়ু কেন্দ্র।  এবং এখানেই সুষুম্না অর্থাৎ স্নায়ুতন্ত্রের প্রধান কর্মক্ষেত্র , এবং  এখান থেকেই বাহক তন্তুর সাহায্যে  সমস্ত নির্দেশ পাঠাচ্ছে। এবং সেই মত আমরা কাজ করছি বা আমাদের কার্য সম্পাদিত হচ্ছে।
 অহং গ্রন্থি বা অহং তত্ত্বের স্থান ললাট বা আমাদের কপাল।  এই অহং গ্রন্থি আমাদের সমস্ত গ্রন্থির অর্থাৎ পঞ্চগ্রন্থির (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম)  কর্তৃত্ব করে। আমাদের দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, চিন্তাশক্তি, বিচারশক্তি, স্মৃতিশক্তি, সমস্ত কিছুই অর্থাৎ পঞ্চইন্দ্রিয়শক্তির  (চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিব্বা, ত্বক) কর্ম পরিচালনা হয় এই অহং গ্রন্থি থেকে। এদের দোষ, ত্রূটি, দুর্বলতা সবই  যথাসাধ্য সংশোধন করে এই অহংগ্রন্থি।
এই অহংগ্রন্থি প্রধান লোকের ভিতর থেকেই বেরিয়ে আসে উচ্চ প্রতিভা, সাধু-মহাত্মা।  এই অহংগ্রন্থি ক্রিয়াশীল না থাকলে দেখা দেয় হৃদয়হীনতা, নিচটা, দুসটুবুদ্ধি।
মহৎগ্রন্থি আমাদের ললাটের উপরে। অর্থাৎ অহংগ্রন্থির কিঞ্চিৎ উপরে অবস্থিত। এরই মধ্যে আছে সোমগ্রন্থি, দেবক্ষগ্রন্থি (Pineal Gland ), রুদ্র গ্রন্থি, সহস্রার গ্রন্থি  প্রভৃতি। এই মহৎ গ্রন্থির অন্তর্মুখী রসের নাম সোমধারা। এই সোমধারাই মাথা থেকে নেবে দেহের সমস্ত গ্রন্থিকে, সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ-সবল ও প্রাণবন্ত রাখতে সাহায্য করে।
এই মহৎ গ্রন্থি প্রধান লোকই মহাপুরুষ, অবতার রূপে পূজিত হন। পৃথিবীতে এঁরাই নরোত্তম। ভগবৎ প্রাপ্তির অপার্থিব অনাবিল আনন্দ এঁরাই আস্বাদন করেন।
মহৎগ্রন্থির ঠিক উপরে আছে ব্রহ্মরন্ধ্র, যা আমাদের দেহাকাশ ও দিব্যাকাশকে  যুক্ত রেখেছে। এই ব্রহ্ম বা সহস্রার প্রদেশেই চেতনার অনন্ত পারাবার, এই প্রদেশই  গুণাতীত ভূমি। একেই কেউ বলে কৈলাস, কেউ বলে পরমশিব ও পরমাশক্তির অধিষ্ঠান ভূমি।
এই গ্রন্থিস্রাব বা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালা আমাদের জীবন, আমাদের ব্যক্তিত্ব, আমাদের মন, আমাদের স্বভাব নিয়ন্ত্রিন করছে । 
অতএব আমরা বুঝলাম, মন কোনো আলাদা বস্তূ  বা স্নায়ু নয়। বিভিন্ন স্নায়ুর ক্রিয়াকে আমরা মনের ক্রিয়া বলি। মন বলে কিছু নেই সবই স্নায়ুর খেলা।  আমাদের এই স্নায়ুর কেন্দ্রে যেতে হবে।  স্নায়ু যেখান থেকে  শুরু হয়েছে সেটা মস্তিস্ক। আর স্নায়ুর অবতরণ ক্ষেত্রে হচ্ছে সুষুম্না কাণ্ড। এটি শেষ হয়েছে আমাদের মূলাধারে। তাই সুষুম্না নাড়িকেই আমাদের আশ্রয় করতে হবে যদি আমরা আত্মউপলব্দ্ধি করতে চাই। এই স্নায়ুকেন্দ্রে প্রতিফলিত হবে আমাদের অধরা ঈশ্বর। আমাদের চেতন স্বরূপ।

ওম শান্তি ওম শান্তি ও শান্তিঃ।  

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মনের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। আমাদের জীবনে যখন কোনো বিপদ আসে, বা কোনো পরিবর্তন আসে, তখন আমাদের মনে কি হয় ? প্রথমে আমাদের মনে  আশঙ্কা জাগে , তারপরে ভয় আসে , তারপরে হয় রাগ এবং সব শেষে হয়  দুঃখ। 
আমাদের মনের তিনটি স্তর  আছে। এগুলো হচ্ছে সাত্ত্বিক, রাজসিক, ও তামসিক। আমরা যখন যে স্তরে  থাকি, অর্থাৎ আমাদের মানসিক অবস্থা যে স্তরে থাকে, আমরা সেই মতো চিন্তা করি। এবং একই বিপদের অবস্থায়  তিন রকম মানসিকতার মানুষ তিন রকম  বিচার শুরু করে দেয় । 

ধরুন আপনি একজন অবসর প্রাপ্ত ব্যক্তি। সারা জীবনের সঞ্চয় ব্যাংকে রেখেছেন। এখন  ব্যাংকের সুদের উপরে নির্ভর করে আপনাকে চলতে হয়। এখন হঠাৎ করে বা দিনে দিনে ব্যাঙ্কের সুদের হার কমে যাচ্ছে। আপনার মনে কি প্রতিক্রিয়া হবে ? 

তামসিক মনের প্রতিক্রিয়া : এতো মহা ঝামেলা ! দিন দিন জিনিসের দাম বাড়ছে, ঔষধের দাম বাড়ছে, আর ব্যাঙ্কের সুদের হার কমিয়ে দিচ্ছে ? এই সব অযোগ্য লোকেদের ক্ষমতা দিলে এই হয়। একটু শান্তিতে থাকতে দেবে না। সুদের হার কমিয়ে দিলেই কি দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ? বেশী পাকামি এই সরকারের। এই পরিস্থিতিতে কি যে করবো, কিছুই বুঝতে পারছি না। এরা  কবে ব্যাঙ্কটাকেই তুলে দেবে।  ছেলে বা বৌ হয়তো বললো, তুমিতো দেখছো,  সুদ কমছে দিন দিন।  অন্য কিছু করো। আমি তো আগেই বলেছিলাম, টাকাগুলো আমাকে দাও, আমি ব্যবসাতে লাগাই, আমি তোমাকে ব্যাঙ্কের  থেকে বেশি সুদ দেবো। অমনি তেড়েফুড়ে উঠবেন, আমাকে জ্ঞান দিতে এস না তো। তোমার থেকে আমার কি বয়স  কম ? অনেক দেখেছি, টাকা গুলো নিয়ে ধংশ করার তাল। 

রাজসিক মনের প্রতিক্রিয়া : নাঃ এ পথে হচ্ছে না। অন্য পথ দেখতে হবে। ডিম্ কখনো এক ঝুড়িতে রাখতে নেই। শুনেছি, ...... ব্যাঙ্কে বেশী সুদ দেয়।  কিছু টাকা ওখানে সরিয়ে রাখতে হবে। কিছু একটা করতে হবে, সময়মতো ডাক্তারের কাছে যাওয়া ভালো। সমস্যা থাকলে তার সমাধান আছে। একটা রিস্ক নিয়ে দেখি, শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ডে কিছু টাকা সরিয়ে দিলে কেমন হয় ? একটা ফ্লাট কিনে ভাড়া দিলে কেমন হয় ? ফিনান্সিয়াল কন্সাল্ট্যান্ট-এর সাথে কথা বলে দেখি, কি করা যায়। ছোটোখাটো একটা কিছু করলেও হয়। বসেই তো থাকি সারাদিন বাড়িতে।  

সাত্ত্বিক  মনের প্ৰতিক্ৰিয়া : দেখো জীবনে উত্থান পতন আছে। সুদ একসময় ১৩.৫% ছিল।  ধীরে ধীরে কমছে। তবুতো আমার কিছু টাকা ব্যাঙ্কে আছে, সেখান থেকে সুদ পাই, সারা ভারতবর্ষে কত লোক আছে, যাদের না আছে সঞ্চয়, না আছে পেনশন। তারাও তো বেঁচে আছে। কি আর হবে, এখন তো না আছে পোশাকের জন্য খরচ, না আছে মাছ মাংস খাবার লোভ। ঠিক চলে যাবে। প্রাণায়ামটা নিয়মকরে করতে হবে।  যাতে ওষুধের জন্য খরচ বাঁচানো যায়। হতাশ হয়ে লাভ নেই, দেখি বাড়ির সবার সাথে আলোচনা করে, একটা পথ নিশ্চয়ই বের হবে। সব সমস্যার সমাধান আছে।  এরও সমাধান আছে। 

তামসিক মানসিকতার মানুষ স্থিতাবস্থা পছন্দ করে। নতুন ভাবে চিন্তা করা বা নতুন পদক্ষেপ তার আসে না। উদ্দমহীন মানুষ এরা। 
অন্যদিকে রাজসিক মানসিকতার লোকেরা, নতুন চিন্তা  ও নতুন কর্মে আগ্রহ দেখায়। যদিও সে নতুনের মধ্যে যেতে চায়, কিন্তু সে আগের মতোই  ভালো থাকতে চায়। এবং সম্ভব হলে পূরনো  দিনে ফিরতে চায়।  
আর সাত্বিক মানুষ নতুন চিন্তা, নতুন কর্ম নতুন পরিস্থিতি সব কিছুকে সে মানিয়ে নিতে চায়। পুরুনো অবস্থাকে আঁকড়ে ধরে হতাশ হতে চায় না। সমস্যার সমাধান খোঁজে। নতুন ভালো কিছুর জন্য আশায় থাকে।

তামসিক মনের মানুষেরা সাধারণত স্থিতাবস্থায় থাকতে চায়। বিপদের লক্ষণ দেখলেও সতর্ক হয় না।  ভাবে, আমার ক্ষেত্রে এসব হবে না। নিজের বিপদ বা দুঃখের জন্য সে অন্যকে দায়ী করে।  অন্যকে দোষী ভাবে। নিজের ভুল বুঝতে চায় না। নিজেকে পাল্টাতেও চায় না।

রাজসিক মনের মানুষেরা পুরোনো পরিস্থিতি খারাপ বা পরিবর্তন হবার সম্ভাবনা হতে দেখলে, আগে থাকতেই নতুন পথের সন্ধান করে। সে আগের মতোই ভালো থাকতে চায়। পরিবর্তিত অবস্থায় খারাপ থাকার কথা সে ভাবতেই চায় না। চেষ্টা করে যাতে সমস্যার সমাধান হতে পারে। 

সাত্ত্বিক মনের মানুষরা পরিস্থিতির উপরে নজর রাখে। এবং সামান্য অভাসে সে ভবিষ্যৎ অনুমান করতে পারে। এবং সেই মত ব্যবস্থা নেয়। নিজের বিপদের জন্য, অন্যকে দায়ী করে না। বরং সমাধানের রাস্তা খোঁজে। পরিস্থিতি যখন তার নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন সে নতুন পরিস্থিতিকে মেনে নেয়।

নিজের ভাবনাকে ধরার চেষ্টা করুন। বিপদের সময়, নতুন পরিস্থিতিতে আপনার মনের অবস্থা কি হয়। তাহলে আপনি নিজের মনকে বুঝতে পারবেন। আর নিজের মনকে যদি আপনি ধরতে পারেন,  অর্থাৎ ভাবনা আপনাকে দুঃখ দিচ্ছে, না আনন্দ দিচ্ছে এটা যদি আপনি ধরতে পারেন, তবে আপনি আপনার ভাবনাকে প্রভাবিত করবার চেষ্টা করতে পারবেন । ভাবনাকে বলুন, ভেবে কিছু লাভ হবে না। কি করতে হবে তাই বলো। তখন আপনার ভিতর থেকে জবাব এসে যাবে।  আর সেই মতো কর্মে লিপ্ত হয়ে যান। অতীত আপনার হাতে নয়। বর্তমান আপনার হাতে।  আর বর্তমান আপনাকে ভবিষ্যতের রাস্তা তৈরি করে দেবে।

কতকগুলো মানুষ আছে যারা চিরকালই দুঃখে থাকে। আসলে তারা তামসিক মনের অধিকারী। কিছু মানুষ আছে, তারা চেষ্টা দ্বারা নিজের পরিবর্তনের চেষ্টা করে। এঁরা রাজসিক মনের অধিকারী। আর এক শ্রেনীর মানুষ আছেন তার সব পরিস্থিতিতে ভালো থাকে - অর্থাৎ সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়। আবার বিচারশীল পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করে না। এরাই সাত্ত্বিক মনের মানুষ। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ       














      
























       


বীজমন্ত্র বা ঈশ্বরের নামের মাহাত্ম্য

রাম - কৃষ্ণ - শিব - কালী  কোথায় থাকেন ?
বীজমন্ত্র বা ঈশ্বরের নামের মাহাত্ম্য

ওঁ সহ নাববতু।  সহ নৌ ভুনক্ত্ু। সহ বীর্যং করবাবহৈ।
 তেজস্বি নাবধীতমস্ত্ু মা  বিদ্বিষাবহৈ।।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।

আজ আমরা দেবতাদের অবাস স্থল নিয়ে আলোচনা করবো। আমরা যে নাম সংকীর্তন করি, বা বিভিন্ন নাম জপ্ করি, এর উৎস কোথায় ? আমরা কেউ কৃষ্ণ  নাম করি, কেউ রাম  নাম করি, কেউ শিবের নাম জপ্ করি। কেন করি ? কেউ বলেন,  এই নামে  ধ্বনির  মাহাত্ম। কেউ বলেন, মন্ত্রের  অর্থ না বুঝে জপ্ করলে কিছু হয় না। কেউ বলেন, নির্দিষ্ট সংখ্যাক জপ্ করলে তবে জপ্  সার্থক হয়। আজ আমরা সেই রহস্যঃ বোঝার চেষ্টা করবো।   

আমাদের দেহের তিনটি ভাগ।  স্থুল -সুক্ষ - কারন। সাধু-মহাত্মারা এটা অনুভূতিলব্ধ জ্ঞানের সাহায্যে উপলব্ধি করেছেন। তাঁরা স্থুল -সুক্ষ -কারন ভেদে দেহের অন্তর-পথকে তিনটি নামে উল্লেখ করেছেন। পিন্ডদেশ, অন্ডদেশ, এবং ব্রহ্মদেশ। আমাদের তিনটি জিনিস প্রধান - দেহ-মন-আত্মা। এছাড়া আছেন, পরমাত্মা। এখন পরমাত্মাকে অনুভব করতে গেলে, এই আত্মাকে দিয়েই অনুভব করা যায়। বিজ্ঞানীরা যেমন কোনো জিনিষকে বিশ্লেণ করতে গেলে, বস্তূর স্থুলতা থেকে ধীরে ধীরে, সুক্ষ তত্বের দিকে এগিয়ে যান , তেমনি সাধু-মহাত্মারাও স্থুল থেকে সূক্ষ্মের দিকে এগিয়ে যান, সাধনার সাহায্যে। 

সাধু-মহাত্মারা, মূলাধার ইত্যাদি ছয়টি চক্র সমন্বিত দেবাদিলোককে  বলছেন, পিণ্ডদেশ। প্রলয়ে এগুলোর লয় হয়। এর উপরে আছে অন্ডদেশ।  এখানেও ছয়টি স্তর আছে। সেগুলো কাল বা সময় দ্বারা রচিত। প্রলয়কালে এগুলোরও  লয়  হয়। পিন্ড ও অণ্ডদেশের  অতীত হচ্ছে ব্রহ্মান্ড। এই ব্রহ্মান্ডদেশ   মহাকাল দ্বারা রচিত। এখানেও কিঞ্চিৎ মায়া বর্তমান। এখানেও ছটা স্তর  আছে। সাধারণ প্রলয়ে এর লয় হয় না।  কিন্তু মহাপ্রলয়ে এর লয় হয়। 

এই ব্রহ্মান্ড ভূমির অতীত হচ্ছে পরমভূমি,  যাকে চৈতন্যভূমি বলা হয়। এখানে মায়ার লেশমাত্র নেই। সাধু-মহাত্মাদের মতে, প্রলয়কালে, এমনকি মহাপ্রলয়কালেও, এই পরমবস্তু ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। সাধু-মহাত্মাদের এখানেই গন্তব্য, এখান থেকেই আমরা আসি, এখানেই রক্ষিত আছে সমস্ত সৃষ্টির বীজ।  এখানেই জীবের সত্যিকারের মুক্তি। 

পিন্ডদেশ : ১. মূলাধার চক্র - এর অধিপতি হচ্ছেন শ্রী গনেশ।  চতুর্দল পদ্ম ২. স্বাধিষ্ঠান চক্র - এর অধিপতি ব্রহ্মা। ষটদল পদ্ম।  ৩. মনিপুর চক্র - এর অধিপতি বিষ্ণু - অষ্টদল পদ্ম। 
৪. অনাহত চক্র - দ্বাদশদল পদ্ম - অধিষ্ঠাত্রী দেবী, কালী-দূর্গা ইত্যাদি শক্তি। ৫. বিশুদ্ধচক্র - ষোলো দল পদ্ম - এখানকার অধিপতি হচ্ছেন শিব। ৬. এর উপরের ভূমি আজ্ঞাচক্র - দ্বিদলপদ্ম - এর অধিপতি ব্রহ্ম। 

এখানে একটা জিনিস খেয়াল করুন, মূলাধারে শ্রীগণেশ। স্বাধিষ্ঠানে ব্রহ্মা, মনিপুরে বিষ্ণু, অনাহতে শক্তির দেবী - কালী-দূর্গা ইত্যাদি, বিশুদ্ধে শিব, এবং আজ্ঞাচক্রে ব্রহ্ম ।  অর্থাৎ এই শিবভূমির নিচে সমস্ত দেবতাদের অবস্থান বলে শিবকে বলা হয়েছে দেবাদিদেব মহাদেব। মহাদেবের উপরে অর্থাৎ বিশুদ্ধচক্রের উপরে আজ্ঞাচক্র যেটা ব্রহ্ম-ভূমির অন্তর্গত।   

পিণ্ডদেশের এই ছটা ভূমি অণ্ডদেশের অনুকরণে মায়া রচনা করেছে। যাতে সাধক প্রকৃত তত্ত্বের সন্ধান না পায়। 

অন্ডদেশ : এবার অণ্ডদেশ সম্পর্কে শুনুন। আসলে অন্ডদেশের অনুকরণেই তৈরী হয়েছে পিন্ডদেশ। অর্থাৎ আমরা আগে যেটা আলোচনা করলাম। এখানে আছে :

১. চতুর্দল কমল  : মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহংকার প্রভৃতির কেন্দ্রবিন্দু।
২. ষটদল কমল : আমাদের থার্ড আই বা তৃতীয় নেত্রের ঠিক নিচে।  এই শক্তিপ্রবাহ থেকেই আমাদের জন্ম, বেঁচেথাকা, বৃদ্ধি, ক্ষয়, ভবিষ্যৎ, এবং মৃত্যুর কাজ পরিচালিত হয়।
৩. অষ্টদল কমল : আমাদের তৃতীয় নেত্রের মধ্যে অবস্থিত। পঞ্চতত্ব  (ক্ষিতি, অপি, তেজ, মরুৎ , ব্যোম ) এবং ত্রিগুণের (সত্ত্বঃ, রজঃ, তমঃ) উৎপত্তি স্থান এটি।
৪. দ্বাদশদল পদ্ম : এটি সহস্রদল কমলের অন্তর্গত।
৫. শ্বেত শূন্য - এর প্রতিবিম্ব পিণ্ডদেশের বিশুদ্ধ চক্রে শেতাম্বর শিবস্থানে পড়েছে।
৬. দ্বাদশদল পদ্ম - এটি ত্রিকুটির নিম্নভাগে।

এখানে কালের খেলা। উচ্চতর কেন্দ্রের ঠিক অবিকল চিত্র ফুটে উঠেছে নিম্ন কেন্দ্রে। এইজন্য সাধকরা এখানে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। এখানে  অর্থাৎ পিন্ডদেশে এসেই, সাধক মনে করেন, উচ্চকেন্দ্রে  অর্থাৎ অন্ডদেশে  এসে গেছেন।

ব্রহ্মান্ডদেশ :  ব্রহ্মান্ডদেশ আজ্ঞাচক্র থেকে সহস্রার  চক্রের মধ্যে। এই সহস্রার -ভূমির অধিপতি হচ্ছেন, পরমপুরুষ-নিরঞ্জন পুরুষ। এখন থেকে দশটি ধুন বা নাদ প্রকট হয়েছে। আসল বিষ্ণুভূমি, শিবভূমি, এবং ব্রহ্মভূমি এখানে। অর্থাৎ সহস্রদল পদ্মে এই তিন ভূমি অবস্থান করছে। এর উপরিভাগে আছে পরব্রহ্ম। পিন্ডদেশ ও অণ্ডদেশ  হচ্ছে  ব্রহ্মান্ড দেশের নকল, যা  তৈরি করে রেখেছেন  কাল এবং মায়া । কাল ও মায়া মাইল  তৈরি করেছেন, অন্ডদেশ আর মায়া তৈরি করেছেন পিন্ডদেশ।

সে যাই হোক, পিণ্ডদেশ ও অণ্ডদেশের  আসল কেন্দ্র হচ্ছে ব্রহ্মান্ডভূমি। আর এই ব্রহ্মান্ডভূমি থেকে দশটি ধুন  বা নাদ অর্থাৎ   শব্দ তরঙ্গ বিভিন্ন দেশে এবং  বিভিন্ন ভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, পরব্রহ্ম থেকেই সমস্ত নাদের উৎপত্তি।  কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় এসে, এই শব্দ তরঙ্গ বিভিন্ন ভাবে শ্রুত হচ্ছে, অর্থাৎ শব্দ তরঙ্গ পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন হচ্ছে, পরিবর্তন হচ্ছে তার শক্তিমত্তার । যেমন একই নদী বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধ্বনি উৎপাদন করে থাকে।  উৎসে একরকম, পাহাড়ের গায়ে এক রকম, সমতল ভূমিতে একরকম, আবার সমুদ্রের নিকটে আরএক রকম। তাই একই ধ্বনি যখন প্রবাহিত হয়, কালক্রমে তার শক্তি ও পর্যায়ের পরিবর্তন হচ্ছে ।  আর এই ব্রহ্মান্ডদেশের সর্বোচ্চ ধাম থেকে যে ধ্বনি প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে, তা পিন্ডদেশের মূলাধার পর্য্যন্ত প্রবাহিত হচ্ছে। এবং বিভিন্ন স্তরে  এসে তার শক্তি ও তরঙ্গের মাত্রার পরিবর্তন হচ্ছে।

ব্রহ্মভূমিতে  এটা হচ্ছে রাং বা ক্লিং ( কৃষ্ণের বাঁশির সুর )
দ্বিদলপদ্মে হচ্ছে প্রণব বা ওঙ্কার ( অনাহত নাদ )
ত্রিকূতি মন্ডলে অর্থাৎ ত্রিনয়ন স্থানে বেদের চারি মহাবাক্য রূপে চারিধারার প্রকাশ পাচ্ছে অর্থাৎ জ্ঞানের প্রকাশ ।
বিশুদ্ধ চক্র -  অর্থাৎ শিবভূমিতে এসে বম্ বম্ ববম্ রূপে প্রকাশ পাচ্ছে।
অনাহত চক্রে - এই ধ্বনি হয়ে যাচ্ছে ক্রিং।
মূলাধারে - গং গং রূপ পাচ্ছে।

আর এই কারণেই আমরা দেখি শ্রীকৃষ্ণের বীজ মন্ত্র হচ্ছে ক্লীং।  রামের বীজ মন্ত্র হচ্ছে রাং।  ব্রহ্মের  বীজ মন্ত্র হচ্ছে ওং বা ওঁ। মাকালীর বীজ মন্ত্র হচ্ছে ক্রীং।  শ্রীগণেশের বীজ মন্ত্র হচ্ছে, গং।

প্রসঙ্গত একটা কথা বলি, এই যে চক্রগুলোর কথা বলা হয়েছে, যা আমাদের শরীরের মেরুদণ্ডের বিভিন্ন অংশে অবস্থিত। এগুলো আর কিছুই নয়, গ্রন্থিচক্র, অর্থাৎ এই সব জায়গায়, বিভিন্ন গ্রন্থির বিভাগ স্থল। গ্রন্থিগুলো নেবে এসেছে উচ্চ মস্তিস্ক থেকে, এখানে গ্রাহক ও প্রেরক গ্রন্থির বিভাগ স্থল। এবং এই স্থলগুলোর আকার খানিকটা ওই বীজ অক্ষরের মত। অর্থাৎ দেবনাগরী  ভাষায় যদি ওই মন্ত্রগুলো লেখা যায়, তা আমাদের গ্রন্থিচক্রের আকারের মতোই হবে।  আমাদের ঋষিদের এ এক অদ্ভুত পর্যবেক্ষন। শরীরবিদ্যার বইতেও আজকাল এইসব গ্রন্থিচক্রের কথা লেখা আছে।

তাই আমাদের কোনো দেবতাকে পেতে হলে সেই দেবভূমি হতে আগত  তরঙ্গের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে হবে। ধ্বনিটা  আসল। অর্থাৎ আমি যদি, মা কালীকে বা শক্তিদেবীকে অনুভব করতে চাই, তবে অনাহত চক্রে যে ক্রীং ধ্বনিত হচ্ছে, তার সঙ্গে আমাকে একাত্ম করতে হবে। শুধু মুখে বা মনে মনে মন্ত্র উচ্চারণ করলে হবে না। এই ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে হবে। অর্থাৎ আপনি যদি মাকালীকে পেতে চান তবে অনাহত চক্রে যে ধ্বনি ক্রীং  ক্রীং  ধ্বনি অনবরত ঝংকৃত হচ্ছে তার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে হবে। এই ধ্বনির তরঙ্গ প্রবাহ  আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে মা কালির কাছে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ এই  ক্রীং  ক্রীং ধ্বনির সঙ্গে বা অনাহত চক্রের ধ্বনির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন বলে, তিনি মাকালীর দর্শন পেয়েছিলেন। ঠিক তেমনি ব্রহ্মান্ডভূমির মন্ত্র  হচ্ছে বা ধ্বনি হচ্ছে ক্লীং। যিনি ব্রহ্মান্ডভূমির সঙ্গে বা কৃষ্ণের সঙ্গে যুক্ত হতে চান তাকে এই ব্রহ্মান্ড ভূমির ধ্বনির সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। আবার বিশুদ্ধ চক্রের যে ধ্বনি বম বম, তার সাথে যুক্ত হতে পারলে আপনি শিবময় হয়ে যাবেন।

এখন কথা হচ্ছে, আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, এই জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি। আমাদের পিন্ডদেশ থেকে অণ্ডদেশে উত্তরণ করতে হবে, নিজেকে এবং তার পরে অণ্ডদেশ থেকে ব্রহ্মান্ডদেশ-এ যেতে হবে। দেবভূমির তুলনায়, পরব্রহ্ম ভূমি অধিকতর চৈতন্যময়।  এবং এটাই প্রকৃত অক্ষয় ধাম বা আনন্দ ধাম।  এই নির্মল চৈতন্যদেশ আমাদের ইষ্ট , আমাদের মালিক, আমাদের উপাস্য। জীবের এটাই পরম পুরুষার্থ। এখান থেকে যে পবিত্র ধ্বনি উদ্গীত হচ্ছে তার সঙ্গে একাত্ম হতে  হবে। এটাই সত্যিকারের  নাম। বা নামের উদ্দেশ্য। নাম্ জপের  উদ্দেশ্য।


ওম শান্তি, শান্তি, শান্তিঃ।  হরি  ওম।















৩. 

    


Saturday 27 July 2019

শান্তির সন্ধানে

মহাভারত - শান্তি পর্ব্ব  


সূচনা : 

ওম সর্বেষাম শান্তির্ভবতু ; ওম সর্বেষাম স্বস্তির্ভবতু।। 
ওম সর্বেষাম পূর্নম ভবতু ; ওম সর্বেষাম মঙ্গলম ভবতু।।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।।

মহাভারতের যুদ্ধের পরে পঞ্চপাণ্ডব, ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর ইত্যাদি সবাই মিলে  ভাগীরথীর জলে, যুদ্ধে নিহত সবার জন্য সলিলক্রিয়া সম্পাদন করলেন। এর পর পান্ডবরা ভাগীরথীর তীরে একমাস ছিলেন। এইসময় বহু মহাত্মা যেমন ব্যাসদেব  নারদ কন্ব  ইত্যাদি সবাই তাদের কাছে দেখা করতে আসতেন।এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঋষি তাদের  মূল্যবান উপদেশ দান করতেন।  এই সময় যুধিষ্ঠির মনমরা হয়ে থাকতেন।
তো একদিন মহর্ষি নারদ  বললেন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, আপনি নিজ বাহুবলে, বাসুদেবের প্রসাদে ও ভাগ্যবলে এই অখন্ড ভূমন্ডল পরাজয় করেছেন, যুদ্ধের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এখন আপনার সুখের সময়, এই সময় আপনি বিষণ্ণ কেন ?
যুধিষ্ঠির বললেন : ভগবন, আমি আমার বাহুবলে নয়, এই যুদ্ধে বাসুদেবের অনুগ্রহে, আর ভীম  অর্জুন, এদের বাহুবলে আমি এই পৃথিবীকে জয় করেছি। কিন্তু আমার রাজ্য লোভের  জন্য, আমাদের জ্ঞাতিকুল ক্ষয় করেছি। দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্রকে হারিয়েছি, অভিমন্যুকে হারিয়েছি , এতে করে আমার এই জয়লাভ পরাজয়ের ন্যায় বোধ হচ্ছে। জানিনা শ্রীমধুসূদন  দ্বারকায় গেলে পুত্রহীনা সুভদ্রা তাকে কি বলবে। পুত্রহীনা দ্রৌপদীকে দেখলে আমার শোকানল বাড়তে থাকে। না জেনে, আমাদের বড়ভাই কর্নকে আমরা নিহত করেছি। এতে করে আমি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না।
নারদ বললেন : হে ধর্মরাজ আপনার বড়ভাই কর্ন বড় যোদ্ধা ছিলেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি একজন অভিশাপগ্রস্থ, বঞ্চিত মানুষ ছিলেন। অতয়েব তার জন্য শোক করা কর্তব্য নয়। সবই পূর্ব্ব নির্দিষ্ট। পুরুষার্থের দ্বারা ভাবিতব্যকে খণ্ডানো  যায় সত্য, কিন্তু বিনাশকালে পুরুষার্থঃ নেতিবাচক কাজে লিপ্ত হয়ে যায়। তাই নিয়তির অবধ্য কেউ নয়। অতয়েব বৃথা শোক করো না।
ভাগীরথীর তীরে পঞ্চপাণ্ডব একমাস অবস্থান করেছিলেন। এইসময় বহু মূল্যবান উপদেশ তিনি বিভিন্ন ঋষি মহাঋষিদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। তাতে রাজধর্ম পালনের কথা যেমন আছে, তেমনি জীবন ধর্মের উপদেশ।  আছে দেহতত্ত্বের কথা, আছে জীবাত্মা-পরম-আত্মার কথা, আছে মোক্ষের কথা । আমরা এই দেহতত্ত্ব ও  আত্মার কথা শুনবো।কিন্তু তার আগে শুনবো, শোক নিবারণের উপায়।  
এই শান্তিপর্ব্বে একটা অধ্যায় হচ্ছে মোক্ষপর্ব্ব। সেখানে যুধিষ্ঠির পিতামহ ভীষ্মকে একটি চিরন্তন প্রশ্ন  করেছিলেন,  - মানুষ কি ভাবে শোক তা সে যে কারণেই হোক  অর্থাৎ ধনক্ষয় বা পিতা -মাতা পুত্র-কন্যা প্রভৃতির মৃত্যুতে আমাদের যে শোক হয় তার থেকে আমরা কি ভাবে পরিত্রান পাবো ?

ভীষ্ম বললেন : কারুর মৃত্যু হলে বা অর্থনাশ হলে আমরা শমগুণাদির দ্বারা এই শোক নিবারণ করতে পারি। শম অর্থাৎ ইন্দ্রিয়।  এই ইন্দ্রিয় দমনের দ্বারা আমরা আমাদের শোক নিবারণ করতে পারি। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলেছেন মহামতি ভীষ্ম। গল্পটা আমরা শুনবো। 
শোনজিৎ রাজার স্ত্রী-পুত্র মারা গেছেন। এই সময়  এক ব্রাহ্মণ শোকসন্তপ্ত শোনজিৎ রাজার কাছে এসে বললেন, মহারাজ আপনি অজ্ঞানের ন্যায় শোক করছেন কেন ? ভেবে দেখেছেন কি, দুদিন পরে, লোকে আপনার জন্যই শোক করবে। কি আপনি, কি আমি, আমরা সবাই পুরুষ হতে এই ইহলোকে এসেছি, আবার সেই পুরুষেই লয়  প্রাপ্ত হবো। 
সমস্ত জীব, কি মানুষ কি দেবতা, কি পশু কি পাখি আমরা সবাই নিজেদের কর্মের জন্যই  দুঃখ ভোগ করছি। আমরা নিজের আত্মাকে নিজের বলে জ্ঞান করি না। অথচ এই অনিত্য জগৎকে নিজের বলে জ্ঞান করে থাকি। আমরা জানি এই পৃথিবীর সমস্ত বস্তুতে সবার অধিকার আছে। অথচ সেইসব বস্তু আমরা আমার সংগ্রহে রাখতে চাই।  এজন্য আমাদের অন্তরে সুখ বা দুঃখের উদ্রেক হয় না। বিশাল সমুদ্রে দুটো কাঠের টুকরো ক্ষনিকের জন্য মিলিত হয়, আবার আলাদা হয়ে যায়। ঠিক তেমনি এই সংসার সমুদ্রে আমরা পরস্পর ক্ষনিকের জন্য মিলিত হই।  আবার আলাদা হয়ে যাই। স্ত্রী, পুত্র, জ্ঞাতি-বান্ধব এরা সবাই ক্ষনিকের  জন্য মিলিত হয়, আবার আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু এই সমুদ্রেই তারা অবস্থান করে। তাই মায়া, মোহ, স্নেহ, এগুলো সবই বন্ধনের  কারন। এসবে আমাদের অভিভূত হওয়া উচিত নয়।  মিলন অবসম্ভাবী নয়, কিন্তু মিলন হলে বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী। এরা সবাই  আমাদের চোখের অগোচর চিন্ময় সত্ত্বা থেকে উৎপন্ন হয়েছে, আবার সেই চিন্ময় সত্ত্বাতেই বিলীন হয়ে যায়। তোমার এই মৃত পুত্রের স্বরূপ তুমি জানো  না। তাহলে তুমি কিসের জন্য শোক করছো ? বিষয় ভোগে অতৃপ্তি আমাদের দুঃখের কারন। আবার দুঃখের নাশেই   সুখ। সুখ থেকেই দুঃখ আবার দুঃখ থেকে সুখ উৎপন্ন হয়ে থাকে।
এই জগতে সুখ-দুঃখ চক্রাকারে ঘুরছে। সুখের পরেই দুঃখ।  আবার দুঃখের পরেই সুখ। কেউ চিরকাল সুখে, বা কেউ চিরকাল দুঃখে থাকে না। তুমি আগে সুখ ভোগ করেছো, তাই এখন দুঃখ ভোগ করতে হচ্ছে। কিছুদিন পরেই আবার সুখ ভোগ করতে পারবে। 
সুখ-দুঃখ আমাদের শরীরকে আশ্রয় করে থাকে। অতয়েব আমরা, যারা নিজেদেরকে দেহ মনে করি, তারা  দেহকে আশ্রয় করেই  যেমন কর্ম করে থাকি, তেমনি ফলভোগও  আমাদের করতে হয়। জীবন আমাদের শরীরের সাথে উৎপন্ন হয়, শরীরের সাথে বর্তমান থাকে, আবার শরীরের সাথেই বিনষ্ট হয়ে যায়। বিষয়-আসক্ত অকৃতার্থ মানুষ  মায়া-মোহ-স্নেহপাশে আবদ্ধ হয়ে জলের মধ্যে বালির সেতুর মতো ভেঙে পড়ে । কলু  যেমন তিলকে চাকায় পেষণ করে, ঠিক তেমনি অজ্ঞান-জাত ক্লেশ আমাদেরকে সংসারচক্রে পেষণ করছে। নির্বোধ মানুষ স্ত্রী-পুত্র-আত্মীয়দের ভরন পোষণ করবার জন্য কুকর্ম করে, এবং শেষে একমাত্র নিজেই সেই কুকর্মের জন্য ক্লেশ ভোগ করে থাকে। আবার এদের মৃত্যুতে নিজেই নিজেকে দগ্ধ করে।
এই সংসারে সুখ দুঃখ ঐশ্বর্য্য - অনৈশ্বর্য্য সবই দৈবায়ত্ত। আমরা সবাই দৈব প্রভাবে সুখ-দুঃখ ভোগ করে থাকি। কেউ আমাদের সুখের বা দুঃখের কারন নয়। শত্রু আমাদের দুঃখের কারন নয়, আবার মিত্র আমাদের সুখের কারন নয়। আমাদের জ্ঞান বা কর্ম আমাদের অর্থ এনে দিয়েছে, এবং সেই অর্থ থেকে আমরা সুখ ভোগ করছি, এমনটা নয়। আবার আমাদের বোকামি আমাদের অর্থ নাসের কারন, বা আমাদের দুঃখের কারন এমনটা নয়। একমাত্র দৈবই আমাদের সুখের বা দুঃখের কারন। দৈব অনুকুল না হলে, সুখভোগের চেষ্টা নিরর্থক। গরুর বাচ্চা, গোপালক, গোস্বামী, গো-চোর এর মধ্যে যে গরুর দুধ পান করে, সেই গরুর দুধের অধিকারী। অন্যের উপর মমতা প্রকাশ বিড়াম্বনা মাত্র। 
এইজগতে সেই সুখী, যে সুষুপ্তি লাভ করতে পেরেছেন । এই জগতে সেই সুখী যে নির্বিকল্প সমাধি লাভ করতে পেরেছেন । যারা ভেদ-দর্শী,  যারা সর্বত্র বৈষম্য দেখেন, তারা সুখী হতে পারেন না। সুষুপ্তি ও সমাধি দ্বারাই যথার্থ সুখ ভোগ হয়ে থাকে। 
যারা উন্নত বুদ্ধি সম্পন্ন - যারা সুখে থেকেও সুখ দুঃখ-শুন্য, যারা দুঃখে থেকেও সুখ-দুঃখ শুন্য এবং মাৎসর্য্যবিহীন হয়েছেন, অর্থ বা অনর্থ তাদেরকে কখনোই বিচলিত করতে পারে না। যারা বহুশাস্ত্রে পণ্ডিত, অথচ তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে পারেন নি, তাদের অবশ্য়ই নিরন্তর সুখ দুঃখ ভোগ করতে হবে। বিবেকহীন বোকারা শত্রূকে পরাস্ত করে আনন্দ পায়। আর ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে। আলস্যে দিন যাপন  করে, তাদের পরিণামে দুঃখই হয়। সময়মতো দক্ষতার সাথে কাজ করাই সুখ উৎপত্তির কারন। ঐশর্য্য ও বিদ্যা উৎসাহী-দক্ষ ব্যক্তিকে আশ্রয় করে থাকে। সুখ দুঃখ, প্রিয়-অপ্রিয় যাই উপস্থিত হোক না কেন, অবিচলিত চিত্তে তাকে অনুভব করাই  বুদ্ধিমানের কাজ। 
শরীরের কোনো অঙ্গও  যদি শোক, ত্রাস, আয়াসের কারন হয়, তবে তাকে পরিত্যাগ করা  কর্তব্য। ত্যাগেই প্রকৃত সুখ হতে পারে। বিষয় অনুরাগী পুরুষ বিষয়ের অনুসন্ধান করতে করতেই জীবন শেষ করে দেয়। মানুষ তো পূর্ব্ব জন্মাকৃত কর্মফল ভোগ করবার জন্য জন্ম গ্রহণ করে। অর্থাৎ প্রারব্ধ ভোগ করার জন্য জন্মায়। কি পণ্ডিত, কি মূর্খ, কি বলবান, কি দুর্বল সবাইকে প্রারব্ধ ভোগ করতে হয়। তাই বর্তমানের সুখ দুঃখের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে, অকর্তা জ্ঞানে যথাযথ কর্তব্য করে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। 
কামনা আমাদের ক্রোধের হেতু। ক্রোধ আমাদের বুদ্ধিনাশের হেতু। বুদ্ধিনাশ আমাদের ধংসের হেতু। শোক আমাদের উৎসাহকে নষ্ট করে দেয়। অনুৎসাহ আমাদের আলস্য এনে দেয়। আলস্য  আমাদের কর্মে অনীহা জন্মায়। কর্মে অনীহা আমাদের কর্তব্যকে অবহেলা করে। কর্তব্যে অবহেলা আমাদের বিনাশের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। 
যখন আমরা ভয়, বিষয়-অনুরাগ, বিদ্বেষ বুদ্ধি কায়-মন-বাক্যে পরিত্যাগ করতে পারবো, তখন আমাদের চিত্ত প্রসন্ন হয়ে উঠবে, এবং আমরা যথার্থ সুখী হতে পারবো।  পিঙ্গলা নামে  এক প্রেমিকা  একবার তার  বাঞ্চিত প্রিয়তমের কাছ থেকে বঞ্চিত হয়ে বলছে : যে  সর্ব্ব অন্তর্যামী নির্বিকার পুরুষ, আমরি হৃদয়ে বসবাস করছেন, আমি তাকে কামাদি দ্বারা সমাচ্ছন্ন করে রেখেছি  ।  একদিনও তার স্মরনাপন্ন হইনি।  আজ আমি আত্মজ্ঞান বলে  অজ্ঞানরূপ  খুঁটির উপর, এই নবদ্বার সম্পন্ন গৃহ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন   করবো।  এতদিন যারপ্রতি আমি অনুরক্ত ছিলাম, এর পরে সে এলে তাকে আর আমার প্রিয়তম বা স্বামী বলে মনে করবো না। আজ আমার তত্ত্বজ্ঞান  উদয় হয়েছে, আমাকে আর এই নররূপী ধূর্তরা  বঞ্চনা করতে পারবে না। ভগবান তুমি অসীম দয়াময়, আমাকে এই বঞ্চনার মাধ্যমে তুমি আমাকে বিষয়বাসনা ত্যাগের জ্ঞান দিয়েছো। এই  বিরহব্যথার মাধ্যমে তুমি আমাকে জিতেন্দ্রিয় হবার পথ দেখিয়েছো।   আশা পরিত্যাগই পরমসুখের কারন। আশাহীন মানুষ সুখে নিদ্রা যায়।      

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম। 

শান্তির  সন্ধানে (২) - কালের অমোঘ গতি :

একদিন যুধিষ্ঠির পিতামহ ভীষ্মকে জিজ্ঞেস করলেন, হে পিতামহ, কাল বড় ভয়াবহ। কাল অর্থাৎ সময়  কখনো দাঁড়িয়ে থাকে না। প্রতিনিয়ত কাল অতীত হচ্ছে। এই অবস্থায় আমাদের কি করা 
কর্তব্য ?

পিতামহ ভীষ্ম বললেন, একটা ইতিহাসের গল্প বলি। একসময় তথাকথিত ধর্ম-কর্মে নিপুন এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তার এক মেধাবী নামে পুত্র ছিল। এই পুত্র ছিল মোক্ষধর্মে কুশল। পিতাকে মেধাবী মোক্ষ লাভে অক্ষম দেখে, একদিন জিজ্ঞেস করলেন, হে পিতা মানুষের জীবিতকাল অতি সত্বর প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। জ্ঞানী ব্যক্তিরা একথা জেনে, কি ধরনের অনুষ্ঠান করে থাকেন, এ সম্পর্কে আমাকে বিস্তারিত বলুন।  আমি সেই অনুযায়ী কাজ করবো। 

পিতা বললেন :  হে পুত্র মানুষের শৈশব উত্তীর্ন হলে, ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করা উচিত। এই সময় গুরুগৃহে থেকে  বেদ অধ্যয়ন করা  উচিত। তার পরে পিতৃলোকের পরিত্রানের জন্য, সংসারে থেকে পুত্র উৎপাদন করা উচিত। প্রৌঢ় অবস্থায় যথাবিহিত নিয়মে যাগযজ্ঞ করা উচিত।  একদম শেষে জঙ্গলে গিয়ে মুনিবেশে সাধন ভজন করা উচিত।

পুত্র বললেন : হে পিতা প্রতিনিয়ত লোক ব্যাধিগ্রস্থ হচ্ছে, জ্বরাগ্রস্থ হচ্ছে, নিহত হচ্ছে, মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। কাল প্রতিনিয়ত  সবকিছু গ্রাস করছে,কালের গতি অপ্রতিরোধ্য।  কিন্তু আপনি এসব ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন নন। আপনি কি সুন্দর ভালো ভালো কথা বলছেন, আর নিশ্চিন্ত আছেন ।

পিতা : কে মানুষকে আক্রমন করছে ? কে নিহত করছে ? কে সেই অবিনাশী যে নিয়ত যাতায়াত করছে ?

পুত্র : আপনি কি বুঝতে পারছেন না, যে জ্বরা-ব্যাধি মানুষকে প্রতিনিয়ত আক্রমন  করছে। মৃত্যু মানুষকে নিধন করছে। দিন চলে যাচ্ছে, রাত্রি আসছে, আবার রাত্রি চলে যাচ্ছে দিন আসছে। আপনি এদের গতাগতি কি একদম অনুধাবন করতে পারছেন না ? আমার নিশ্চিত ধারণা, মৃত্যু কখনো কাউকে তোয়াক্কা করে না, কাউকে পরিত্যাগ করে না। এই অবস্থায় আমরা কি অন্ধের মতো কালের অপেক্ষায় থাকবো ? প্রতিদিন মানুষের পরম-আয়ু ক্ষয় হচ্ছে। এই জগতে কারুরই সুখের প্রত্যাশা প্রত্যাশা নেই। অথচ আমরা কেমন অন্যমনস্ক হয়ে বিষয় ভোগে প্রবৃত্ত হয়ে আছি। কিন্তু এই বিষয়ভোগ পরিতৃপ্ত হতে  না হতেই মৃত্যু দ্বারা আমরা আক্রান্ত হয়ে থাকি। আমাদের কাজ, আমাদের ভোগ  শেষ হতে হতে পারে না,  তার আগেই মৃত্যু আমাদের আক্রমন  করে থাকে। 

হে পিতা কোনো কর্তব্য কর্ম আমাদের ফেলে রাখা উচিত নয়। আজকের কাজ এখনই করা উচিত। কালকের কাজ আজকেই করা উচিত। আমাদের কাজ শেষ হোক না হোক, মৃত্যু কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করবে না। কার কখন মৃত্যু হবে, কেউ তা জানে না। তাই আমরা যেহেতু জানিনা, মৃত্যু কখন আমাদের ডেকে নেবে, তাই বৃদ্ধাবস্থা অবধি অপেক্ষা করে, তবে আমাদের ধর্মাচরণ করতে হবে, এটা ঠিক নয়। তাই যখন যে অবস্থাতে থাকুন, আর যে বয়সে থাকুন, সব সময় আমাদের ধর্মানুষ্ঠান করা উচিত। ধর্মানুষ্ঠান করলে কি ইহলোক কি পরলোক সর্বত্র শাশ্বত আনন্দে থাকতে পারবো। 

মানুষ মোহে আবিষ্ট হয়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার নিমিত্ত কাজ করে থাকে এমনকি কেউ কেউ এদের সন্তুষ্টির জন্য কুকার্যে লিপ্ত হয়। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা যাতে ভালো থাকে, সুখে থাকে, আনন্দে থাকে তার জন্য, তার জন্য সে ভালো-মন্দ সব কিছুই করবার জন্য প্রস্তুত থাকে। কিন্তু কাল কাউকে রেহাই দেয় না। মৃত্যু কোনোদিন  কোনোকিছুর জন্য অপেক্ষা করে না। যে বিষয়ের প্রতি আমরা  আসক্ত ছিলে, যে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার প্রতি আমরা  মোহগ্রস্থ, সবার কাছ থেকে মৃত্যু আমাদের  ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাবে। কোন কাজ করা হয়েছে, কোন কাজ করা হয় নি, কোন কাজ অর্ধেক করা হয়েছে, সবই যথাপূর্ব্ব পড়ে থাকবে। তুমি শুধু অসমাপ্ত কাজের কথা চিন্তা করতে থাকবে, আর মৃত্যু সবাইকে  টেনে নিয়ে চলে যাবে। কাল কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করে না।  কার  কি কাজ সমাপ্ত হয়েছে, আর কোন কাজ  বাকি রয়েছে, কোনো কিছুর জন্য সে অপেক্ষা করবে না। এমনকি  রাজা কি ভিক্ষারী,  দুর্বল কি বলবান, জ্ঞানী কি অজ্ঞানী কাউকেই তোয়াক্কা করে না মৃত্যু । যখন মানুষের এই অবস্থা, মানুষ যখন প্রতিনিয়ত জরা ব্যাধি মৃত্যুতে আক্রান্ত হচ্ছে, আপনি, হে পিতা কি ভাবে নিশ্চিন্তে অবস্থান করছেন ?

জনশ্রূতি যাতে আপনি বিশ্বাস করেন, অরণ্য হচ্ছে দেবভূমি। সংসারে বা নগরে অবস্থান বন্ধন-সম। পুণ্যাত্মারা এই বন্ধন ছিন্ন করতে পারে, কিন্তু পাপাত্মারা এই বন্ধন ছিন্ন করতে পারে না। কিন্তু এই কথা ঠিক নয়।  আপনি কোথায় আছেন, সেটা বড়ো কথা নয়। আপনি কার আশ্রয়ে আছেন সেটাও বড়ো কথা নয়, আপনার প্রবৃত্তি কেমন সেটাই বড় কথা। আপনি যদি হিংসাকে বর্জন করতে পারেন, আপনি যদি কায়-মন-বাক্যে অন্যের অনিষ্ট চিন্তা না করেন, আপনার জীবিকা যেন অন্যের জীবিকাকে অপহরণে প্রবৃত্ত না হয়। সত্যব্রত পরায়ণ ও শমদমনাদি  গুন্ সম্পন্ন হয়ে কেবল সত্য়বলে মৃত্যুকে পরাজয় করা অবশ্য কর্তব্য। 

আমাদের এই ঈশ্বর প্রদত্ত দেহের মধ্যে মৃত্যু ও অমৃতত্ত্ব উভয়ই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। মোহে যারা অন্ধ তারাই মৃত্য়ুলাভ করে। আর যারা সত্যপথ অবলম্বন করে, তারা অমৃত লাভ করে। অতএব আমরা হিংসা, কাম, ক্রোধ পরিত্যাগ করে একমাত্র সুখপ্রদ সত্যকে অবলম্বন করে মৃত্যুকে পরিহাস করবো। এবং সূর্য্যের উত্তরায়ণের সময়ে শান্তিমার্গ অবলম্বন, জ্ঞান অর্জন, বাক্য-মন-কার্য্যে সংযম আয়ত্ত্ব করবো। আমাদের কারুরই পশুবলি যজ্ঞ বা ক্ষত্রিয়দের মতো বিনাশকারী কার্য্যে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। আমার সন্তান বলে কিছু হয় না। বা আমি কারুর সন্তান বলে কিছু হয় না। সন্তান সব সময় সয়ম্ভূ।আমাদের উচিত পুত্র-উৎপাদনের বাসনা পরিত্যাগ করে, আত্মনিষ্ঠ হয়ে জীবাত্মাকে পরম-আত্মায় আহুতি প্রদান করা। এটাই আসল যজ্ঞ মনুষ্য জীবন এই সৎ-কর্মের জন্য। সৎকর্ম প্রভাবে এই মানুষ এই মঙ্গলময় যজ্ঞ করতে পারে। বিদ্যার মতো চোখ, ফল-ত্যাগের মতো সুখ, এবং বিষয়স্পৃহার মতো দুঃখ আর কিছুই নেই। 

ঈশ্বরের প্রতি আমাদের একাগ্র হতে হবে, সর্বভূতে আমাদের সমভাব রাখতে হবে, সত্যে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। স্বধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকে হবে। অন্যকে দন্ড দেবার ভাবনা পরিত্যাগ করতে হবে। সরলতা অভ্যাস করতে হবে। তবেই আমরা প্রকৃত মানুষ হতে পারবো। এসবই মানুষের পরম ধন। 

হে পিতা আপনাকে নিশ্চয়ই কালের কবলে পড়তে হবে, তখন আপনার জন্য, এই ধন-মান-যশ দারা -পুত্র পরিবার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজন কোন কাজে লাগবে না । এখন আপনার এই দেহ মধ্যে প্রবিষ্ট আত্মাকে অনুধ্যান করুন। আপনার পিতা-পিতামহ-মাতা-মাতামহ কোথায় গিয়েছে তাকি আপনি জানেন ? কে বলেছে আপনাকে আপনার পুত্র উদ্ধার করবে ? স্বয়ং স্বয়ংকে উদ্ধার ভিন্ন কোনো রাস্তা নেই। তাই পরলোকে কেউ কারুর নয়, কেউ কারুর প্রতি নির্ভরশীল নয়। এই জগতে আমরা ভাবি, আমরা কারুর না কারুর প্রতি নির্ভরশীল, আমরা প্রতিও  আমার পরিবার নির্ভরশীল। এইরকম আমাদের পূর্বপুরুষেরাও ভাবতেন।  কিন্তু সত্য হচ্ছে, বাস্তব হচ্ছে আমরা কেউ কারুর প্রতি নির্ভরশীল নয়। আমার পূর্বপুরুষেরা সবাই দেহ ত্যাগ করেছেন। আমরাও দেহ ত্যাগ করে চলে যাবো।  জগৎ জগতের মতো চলবে। 

এই কথা বলে মহাত্মা ভীষ্ম বললেন - হে ধর্মরাজ জ্ঞানবান পুত্র এই কথা বললে পিতা তার কথায় আস্থা রেখে সত্যধর্মের অনুষ্ঠান করে কাটিয়েছিলো। তুমিও সত্যধর্ম পরায়ণ  হয়ে পরম-সুখে কালাতিপাত করো। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।         
  

Wednesday 3 July 2019

ইচ্ছাশক্তির রহস্যঃ

ইচ্ছাশক্তির  রহস্যঃ

ইচ্ছে শক্তি, WILL POWER . কার ইচ্ছায় চলি আমরা ? ইচ্ছে ব্যাপারটা কি ? আমি ইচ্ছে করলেই কি সব কিছু বদলে যাবে ? ইচ্ছে ব্যাপারটা অদ্ভুত।  আপনি যা ইচ্ছে করেন, তা কিভাবে পাবেন ? আপনি যা হতে চান, তা কি ভাবে হবেন ? কিভাবেই বা ইচ্ছেটা করবেন ? 

ইচ্ছে আর কিছুই নয়, ইচ্ছে হচ্ছে আমাদের ভাবনা বা চিন্তার অব্যক্ত অবস্থা । আমরা যা ভাবছি, তা আমাদের ইচ্ছেশক্তি দ্বারা সম্ভব হচ্ছে। । ইচ্ছে অব্যক্ত, এই ইচ্ছে যখন ক্রিয়াশীল হয় তখন তাকে আমরা বলি  চিন্তা বা ভাবনা ।   বলা যেতে পারে, আমাদের সবার ভাবনা বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ভাবনাই ভগবানের ইচ্ছে। আর ইচ্ছেই রূপ পরিগ্রহ করে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমরা যা কিছু দেখছি, সবই আমাদের ভাবনা প্রসূত। আমি আপনি যা কিছু ভাবছি,  সেটাই রূপ পরিগ্রহ করছে। সৃষ্টির আদি থেকে এই নিয়ম চলে আসছে, এবং ভবিষ্যতেও চলবে। তাই আমাদের ভাবনার নিয়ম জানতে হবে, যাতে প্রত্যেকটি ভাবনা মঙ্গল প্রসব করে।

কোয়ান্টাম ফিজিক্স (quantam physics ) বলছে, আমাদের এই যে বিশ্বব্রহ্মান্ড তার উৎপত্তি হয়েছে, ভাবনা থেকে। ভাবনা হচ্ছে একটা ক্রিয়া, যার ফলে এই বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কার ক্রিয়া। ইচ্ছাশক্তির ক্রিয়া।  অব্যক্ত ইচ্ছাশক্তি যখন ক্রিয়াশীল হয় তখন তাকে আমরা বলি ভাবনা। আর ভাবনা থেকেই সৃষ্টি।

আমরা সবাই আসলে ঈশ্বরের ইচ্ছাশক্তির ভাবনার ফল। ঈশ্বরের ইচ্ছাশক্তির একটা ক্ষুদ্রতম অংশ আছে, আমাদের সবার মধ্যে। যার ফলে আমরা প্রতিনিয়ত ভাবি। খুব কম সময় আছে, যখন আমরা ভাবনা রোহিত হতে পারি। তা সেটা বুঝি আর না বুঝি। এমনকি আমরা যখন কোনো কাজে নিযুক্ত আছি, তখনও আমরা কিছু না কিছু ভেবে চলেছি।

আমাদের তিনটি অবস্থা।  জাগ্রত, স্বপ্ন, ও সুষুপ্তি। আমরা জাগ্রত অবস্থায়  চিন্তা তো  করিই, এমনকি স্বপ্নেও আমারদের ভাবনা চলতে পারে।  কেবলমাত্র সুসুপ্তিতে আমরা ভবনাবিহীন থাকতে পারি।

আমরা জানি, আমাদের চিন্তার একটা রূপ আছে। আর এই রূপ,  সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনু দিয়ে তৈরি, এমনকি তার কিঞ্চিৎ চৈতন্যশক্তিও আছে। আমাদের চিন্তার লক্ষবস্তূ যদি কাছাকাছি থাকে, তবে এই সূক্ষ্ম চিন্তাদেহ তক্ষুনি লক্ষবস্তুর দিকে ধাবিত হয়। এমনকি লক্ষবস্তু যদি, বহু দূরেও থাকে সেখানে সে দ্রুত পৌঁছে যায়। এবং সেখানে লক্ষবস্তুর ভিতরে আমার ভাবনা প্রভাবিত করে।

এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলি। আমি যখন চাকরি করি। আমার অফিসে তখন কাজের খুব চাপ। আর আমার যিনি সুপার বস,মিস্টার সুদান,  তিনি কিছু কাজ বোঝেন না, কারন তিনি ছিলেন সামরিক বাহিনীতে। এবং সরাসরি, দেশোয়ালি ভাইয়ের সহযোগীতায় উচ্চপদে বহাল হয়েছেন, তাই কাজ না বোঝার জন্য, ওপরওয়ালার কাছ থেকে গালাগালি খেতেন, আর আমাদের দিয়ে,  কাজ করানোর জন্য, তার একমাত্র  সম্বল ছিল মেজাজ । মাঝে মধ্যে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতেন। এমনকি একদিন, সে আমাকে শারীরিক ভাবে নির্যাতন করার চেষ্টাও  করেছিলেন ।  আমি ছিলাম অসহায়। আমি ভেঙে পড়লাম। আকুল ভাবে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলাম, ভগবান ওকে শুভবুদ্ধি দাও।  আমার কাছে একটা বই ছিল, মিস্টার  আর.কে.  গোয়েঙ্কার লেখা,  THE ART OF  LIVING, - আমি   সেই বইটা নিয়ে, আর এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে, ভয়ে ভয়ে তার চেম্বারে গিয়ে, তাকে দিলাম। বললাম বইটা পড়বেন।  ঈশ্বরের অপার  করুনা, তার পর দিন, রবিবার, সুদানের টেলিফোন পেলাম,  আমাদের বাড়িতে আসতে চায়, - এবং বললো, আমি তোমার বড়ভাই, আমি তোমার কাছে, ক্ষমা চাইছি। আমি স্তম্ভিত, আশ্বস্ত হলাম।  এর পরে, আর কোনোদিন, সুদান, কাউকে গালাগালি করতো না। মানুষটা কেমন যেন পাল্টে গেলো।

যেকোনো পরিস্থিতিতে, আপনার চিন্তাকে মঙ্গলের পথে পরিচালিত করুন। দেখবেন, আপনার শুভচিন্তা অন্যকে প্রভাবিত করবেই করবে।

মানুষের সঙ্গে অন্যান্য জীবের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, মানুষ শুভ চিন্তা করতে পারে, অন্যান্য জীব শুভ চিন্তা করতে পারে না। তারা শারীরবোধের উপরে উঠতে পারে না।

অনেকে বলেন, আমরা আমাদের ভাবনার মাধ্যমে, আমাদের আর্থিক উন্নতি পড়তে পারি। কথাটা সর্ব্বত সত্য। আসলে যে যা চায়, সে তাই  পায়। আজ যাদের আপনি, অর্থবান দেখছেন, তারা সবাই সর্ব্বক্ষন অর্থের কথাই চিন্তা করছেন,- তাই তারা অর্থবান হচ্ছেন। তবে একটা কথা খেয়াল করবেন, অর্থ মানুষের তিন পুরুষের বেশি থাকে না। কারন, প্রচুর অর্থ এসে গেলে , মানুষের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে, হারানোর ভয়, তখন শুধু তারা হারানোর ভয়ে আক্রান্ত হন। এবং এই হারানোর ভয় থেকেই তাদের সত্যি সত্যি অর্থলোপ পেতে থাকে।    কিন্তু মানুষের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, আনন্দ। পার্থিব জিনিস আমাদের সুখ দিতে পারে। কিন্তু পার্থিব জিনিসের সুখ সাময়িক, শুধু সাময়িক নয়, এটা  দুঃখের বাহকও বটে ।

আপনার ইচ্ছেকে আপনার ভাবনাকে প্রভাবিত করতে চাইলে, আপনার মনকে শান্ত করতে হবে। আর মনকে শান্ত করার একমাত্র ও অব্যর্থ উপায় হচ্ছে প্রাণায়াম - ধ্যান - ধারণা - । এই তিনটি জিনিস যদি আপনি, নিমিয়ত করতে পারেন, তা সে যত  অল্প সময় হোক, আপনি দেখবেন, আপনার ইচ্ছাশক্তি প্রবল থেকে প্রবল হচ্ছে। আপনার নিজের প্রতি বিশ্বাস, এবং সব বিষয়ে একটা সদর্থক ভাব আপনাকে শক্তি যোগাবে। একটা জিনিস জানবেন, আমরা একটা শব্দ ও আলোর তরঙ্গে ভাসমান। এই তরঙ্গের ফ্রিকোয়েন্সি আপনাকে স্থির বা অস্থির করছে । ধ্যান, প্রাণায়াম, এই তরঙ্গের ফ্রেকুয়েন্সিকে এডজাস্ট করবে। আপনি এক অনাবিল আনন্দে থাকবেন।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ - হরি ওম।

আমরা আলোচনা করছিলাম ইচ্ছেশক্তি নিয়ে। ইচ্ছে করলেই নাকি আমরা ভালো থাকতে পারি।  আমাদের ভাবনাই নাকি, আমাদের ভালো রাখে, বা মন্দ রাখে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কেউ আমাদের খারাপ চাই না। কেউ ইচ্ছে করে, অবাঞ্চিত বস্তু বা অবাঞ্চিত ব্যবহার আশা করেন  না। তবুও এগুলো হয়।  তাহলে এগুলো কি করে হচ্ছে ? এমন চিন্তাও তো  কেউ করে না যাতে  তার নিজের অমঙ্গল হয়। কিন্তু আমাদের অমঙ্গল তো হচ্ছে।

প্রথমে বলি, প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধাচরণ করে কেউ পার পাবে না। আপনি আগুনে হাত দেবেন আর আপনার হাত পুড়বে  না, এটা হবে না। আপনি ছাদ থেকে ঝাঁপ মারবেন, আর আপনার হাত পা ভাঙবে না, এটা হবে না। আপনি বৃষ্টিতে ভিজবেন, আর আপনার জ্বর হবে না, সেটা চিন্তা করবেন না। তবে এগুলো করার আগে আপনার ভাবনা, আপনাকে ভোগাচ্ছে, এটা সত্য। আগুনে হাত পড়ার আগে বা পরে  আপনি ভয় পেয়েছিলেন কি না ভাবুন, যদি ভয়-ভাবনা আপনার এসে থাকে তবেই আপনার হাত পুড়বে।  ছাদ  থেকে পড়ার আগে আপনার ভয়-ভাবনা আপনাকে ভোগাবে। একই ঘটনায় কেউ কেউ বেঁচে যায়, তার কারন তার মধ্যে ভয়-ভাবনা একদমই  আসেনি। এরকম কদাচিৎ হয়, কিন্তু হয়। শ্রী  শৈলেন্দ্র নারায়ণ ঘোষাল, নর্মদা পরিক্রমাকালে  পাহাড় থেকে পড়ে  গিয়েছিলেন। তন্দ্রাছন্ন অবস্থায় তার মনে হয়েছিল, কেউ যেন তাকে কোলে করে পাহাড় থেকে নিচে নেবে এসেছেন । এগুলো গল্পকথা নয়।  ভাবনাবিহীন মানুষের ক্ষতি করা শুধু শক্ত নয়, অসম্ভব।

দেখুন বিজ্ঞান বলছে, আমরা প্রতিনিয়ত হাজার হাজার চিন্তা করছি। আমাদের চিন্তার প্রতি আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আমরা যা কিছু দেখছি, শুনছি  তা থেকে আমাদের  যেমন অভিজ্ঞতা হচ্ছে, তেমনি চিন্তার রশদ যোগাচ্ছে এগুলো। একই ঘটনা বা একই দৃশ্য আমাদের বিভিন্ন লোকের মনে, বিভিন্ন রকমের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবাচ্ছে। কারুর মৃত্যু,  তার পরিবারে একরকম চিন্তার উদ্রেক করে, আবার প্রতিবেশীর মনে অন্যরকম। কাছের কেউ মারা গেলে একরকম, দূরের কেউ মারা গেলে আর এক রকম। আপনি যখন কোনো সংবাদ শুনছেন, আপনার পাকস্থলীতে আপনার অন্ত্রের স্নায়ু মণ্ডলীতে ঠিক তক্ষুনি একটা প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। আপনার  একটা বিশেষ অনুভূতি শুরু হয়, এবং আপনার ভাবনাকে প্রভাবিত করে এই অনুভূতি। আপনি কাল্পনিক অনেক কিছু ভাবা শুরু করেন। অর্থাৎ এই শ্রুতি বা দর্শন হচ্ছে একটা সংকেত, যা আপনাকে চিন্তান্বিত হতে বাধ্য করে। আপনার এই অনুভূতি সম্পর্কে আপনি সজাগ থাকুন। অর্থাৎ চিন্তার উৎস সম্পর্কে সজাগ থাকুন। এবং এ সম্পর্কে আপনি কি ভাবছেন, যেটা বোঝার চেষ্টা করুন।

আমাদের দুরকমের অনুভূতি, একটা ভালো আর একটা মন্দ। কোন অনুভূতি  আপনাকে রাগিয়ে দেবে, অর্থাৎ আপনার ভিতরে ক্ষোভের সৃষ্টি করবে, কোনটা আপনাকে হতাশ করবে, অসহায় করে দেবে। এগুলো সবই খারাপ অনুভূতি। আবার কিছু অনুভূতি আপনাকে উৎসাহ যোগাবে,  উদ্দীপিত করবে।  এগুলো আপনার ভালো অনুভূতি। যখন আপনার খারাপ অনুভূতি হবে, তখন আপনি ভালো ভাববেন, এটা কখনোই হবে না। তাই আপনার অনুভূতির উপরে নির্ভর করবে আপনার ভাবনা। আপনার ভাবনার একটা ফ্রীকোয়েন্সি বা তরঙ্গের মাত্রা আছে। আপনি যে তরঙ্গে যখন থাকবেন, আপনার ভাবনা সেই তরঙ্গে প্রবাহিত হবে। আপনার তরঙ্গ যত  দ্রুততালে প্রবাহিত হবে, আপনার ভাবনায় তত খারাপ জিনিস প্রবাহিত হবে , বা উত্তেজক চিন্তা প্রবাহিত হবে।  এবং যত আপনি উত্তেজক চিন্তা করবেন, তত আপনি আরো দ্রুত তরঙ্গের উচ্চ স্কেলে পৌঁছে যাবেন। এবং আপনার ভাবনার মধ্যে আরো খারাপ অনুভূতি বৃদ্ধি পাবে। খারাপ পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে নিয়ে যায়, খারাপ ভাবনা আরো খারাপ ভাবনার দিকে নিয়ে যায়।

কিন্তু উল্টোটা করে দেখুন, অর্থাৎ আপনার তরঙ্গের গতি স্থির করুন,  আপনার শরীরের স্পন্দন ধীর করার চেষ্টা করুন, আপনার পালসবিট্ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করুন, আপনার মধ্যে স্থিরতা আসবে, আপনার ভাবনার মধ্যে ভালো অনুভূতি আসবে। আপনি যত   খারাপ ভাববেন তত খারাপ  হবে, আপনি যত  ভালো ভাববেন, তত ভালো হবে। অর্থাৎ যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজের দিকে খেয়াল করুন, পরিস্থিতির বিশ্লেষণ শুরু করুন, নিজেকে নিজের জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিন, পরিস্থিতির স্বীকার হতে দেবেন না। ঘটে যাওয়া কোনোকিছুকে আপনি বদলাতে পারবেন না। কিন্তু ভবিষ্যতের ঘটনার উপর আপনার নিয়ন্ত্রণ আছে।  সেটা ভেবে, নিজের ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

আমাদের ভাবনার মধ্যে একটা বিশাল জায়গা জুড়ে আছে ভয়। আর ভয় ব্যাপারটা পুরোপুরি কাল্পনিক। আশঙ্কা থেকে ভয়ের উৎপত্তি। আশঙ্কা অমূলক নাও হতে পারে, কিন্তু ভয় কাল্পনিক। একটা ঘটনা বলি, আমার একবার হঠাৎ বদলি হয়ে গেল কলকাতা থেকে দুর্গাপুরে। আমি ঘরকুনো মানুষ । আমার মন যেতে চাইছে না। সারাজীবন কলকাতায় থেকে এসেছি। এমনকি প্রমোশন পর্যন্ত নেইনি, এই বদলির ভয়ে। এখন সেই বদলি হতে হলো , এই ব্যাটা নাটগুন্ডের জন্য । নাটগুন্ডে মানে আমাদের জি.এম। ভাবতে লাগলাম - ছেলেটা সবে ১২ ক্লাস পরীক্ষা দিয়েছে, কদিন পরে ওকে কলেজে ভর্তি করতে হবে। স্ত্রী কি করে এসব ঝামেলা সামলাবে ? এই বয়েসে বাচ্চাদের বাবার অবিভাবকত্ত্ব, খুব দরকার, এখনতো মায়ের কথায় ছেলেটা পাত্তাই দে না। নিশ্চই ছেলেটা  বকে যাবে।
দুর্গাপুর একটা ছোট্ট শহর, আধুনিক জীবনযাত্রার পক্ষে এটি সুবিধার নয়। কলকাতার বন্ধুবান্ধবদের ছেড়ে যেতে হবে। ওখানে নাকি মাওবাদীদের ঝামেলা।  শিল্পাঞ্চলে বাড়িভাড়া পাওয়া ঝামেলা, তাছাড়া বাড়িভাড়াও বেশী।   ঠান্ডা-গরম দুটোই  ওখানে খুব বেশী।ওখানে নাকি, বাতাসে কয়লার কনা ঘুরে বেড়ায়। ভবিষ্যতে টি.বি. নির্ঘাৎ।  এখন আমার বয়স ৫৫, এই বয়সে নতুন জায়গায় এডজাস্ট করতে আমার খুব অসুবিধা হবে।  ইত্যাদি ইত্যাদি নানান কিছু ভাবতে লাগলাম। কিন্তু উপায় না থাকায়, নিমরস চিবোতে চিবোতে, ঈশ্বরের উপরে ভরসা করে, দুর্গাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।  রাত নটায় ট্রেন পৌঁছনোর কথা পৌঁছলো রাত  বারোটায়। দুর্গাপুর চিনি না। ওই রাতে হোটেল খোঁজা অসম্ভব। ভগবানের কি অসীম কৃপা দেখুন, তাপস নামে  এক সহকর্মী বন্ধুকে খবর দিয়েছিলাম, ও ওখানকার ছেলে, সে হোটেল বুক করে, ওই রাতে স্টেশানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে একটা রিক্সা করে দিয়ে, ও বাড়িতে চলে গেলো। এর পরে, খুব ভালো জায়গায়, খুব কম পয়সায় থাকার জায়গা পেয়েছি। অফিসের সবার সহযোগিতা পেয়েছি। অসংখ পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা হয়েছে, নতুন বন্ধু পেয়েছি। ছেলেকে বর্ধমান ইউনিভার্সিটির - একটা কলেজে ভর্তি করাতে পেরেছি। চার বছর ছিলাম, কষ্ট হয়েছে, কিন্তু ভালো ছিলাম। সবাই সহযোগিতা করেছে , এখন মনে হয়, বাইরে আথিতিয়তা, আন্তরিকতা  অনেক বেশী। তাই কাল্পনিক ভায়ের ভাবনা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখুন।

আমরা অনেকে ভাবি, ভাবনার উপরে আবার নিয়ন্ত্রণ রাখা যায় নাকি ? ভাবনাতো এমনি এমনি আসে। আমাদের ভাবনা, আমাদের অনুভূতি এরা তো নিজেরাই নিজেদের চালক। তাদেরকে একটা কথা বলি, আমি ভালো আছি, এটা ভাবার চেষ্টা করে দেখুন, আর এটা ভাবলে, আপনি ভালো অনুভব করবেন, আর এ থেকেই আপনার ভবিষ্যৎ ভালোর দিকে যাবে। একটা শক্তিশালী ফ্রীকোয়েন্সি আপনার মধ্যে কাজ শুরু করবে। আর এটা প্রতিনিয়ত  অভ্যাস করলে, আপনার মধ্যে একটা আদত  তৈরি হয়ে যাবে, ভালো থাকার। এবং আপনি নিজেকে একটা নতুন ফ্রেকুয়েন্সিতে নিয়ে গেছেন বলে মনে হবে। সর্বদা একটা সুখের অনুভূতি সারাদিন ধরে রাখতে পারবেন। হোক না খারাপ ঘটনা, আপনি নিজেকে ভালো বাসুন, নিজের যেটা খারাপ লাগে, সেটাকে অবহেলা করে, উদ্দেশ্যমূলকভাবেই  আপনি ভালো থাকার কাজ চালিয়ে যান। যেকোনো ঘটনায়, কয়েক মুহূর্ত নিয়ে, নিজের ভেতরের দিকে ফোকাস করুন, আলো  ফেলুন, দেখুন-ভাবুন, আপনার অনুভূতিটা ভালো না খারাপ, যদি ভালো অনুভব না করেন,  তবে অন্তরের অনুভূতির উপরে, উদ্দেশ্যমূলক ভাবে, ভালো থাকার আলো ফেলুন।  ৩০ সেকেন্ড পর্যন্ত চোখ বুজে, অন্তরের অনুভূতির উপরে, সুখানুভূতির আলো ফেলুন। এটা প্রথমদিকে একটু কঠিন মনে হবে, কিন্তু পরে দেখবেন, অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এতে শুধু আপনি ভালো থাকবেন তাই নয়, আপনার বাঞ্ছিত  বস্তূ, আপনার কাছে আসতে  শুরু করবে। তাহলে আজ থেকেই শুরু করুন, ইচ্ছেশক্তির সাহায্যে ভালো থাকার খেলা ।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ - হরি ওম।

আজ আমরা ইচ্ছা শক্তির তৃতীয় পর্ব্বে প্রবেশ করবো। আমাদের পুরান কাহিনীতে , অনেক গভীর তত্ত্বকথা গল্পের আকারে বলা আছে । যাতে সাধারণ লোক বুঝতে পারে। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষরা সেটাকে গল্প বলেই ভাবি। ভিতরের তত্ত্বকে বুঝতে পারি না। আপনারা পরশ পাথরের গল্প গুনেছেন, আলাদীনের  প্রদীপ-এর গল্প শুনেছেন। গল্পগুলো শুনে আমাদের ভালো লাগে, কিন্তু এগুলো যে সত্যি হতে পারে, সেটা আমরা জানি না। আলাদিনের প্রদীপের গল্পই ধরুন। আলাদিন, প্রদীপটা হাতে নিয়ে ঘষতো অমনি একটা জীন বেরিয়ে আসতো। বলতো, "প্রভু, বান্দা হাজির, আদেশ করুন, কি করতে হবে, আপনার ইচ্ছেই আমার কাছে আদেশ।"  এই যে ইচ্ছের কথা বলা হচ্ছে, এর কোনো সীমারেখা নেই।  যা ইচ্ছে তাই  চাইতে পারে আলাদীন ।  আর তা  পূরণ করে দেবে, এই জিনটি। ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত লাগে, আমরা ভাবি, হলেতো ভালোই হয়, কিন্তু এসব তো গল্প।  আর গল্পের গরু গাছে চড়ে । এমনটা যে সত্যিই হতে পারে, আজ সেই গল্প বলবো ।   শুধু বলবো না, প্রয়োগ করে দেখে নেবেন আপনারা ।

দেখুন, এই বিরাট মহাবিশ্ব , তার যে শক্তি, সেটার রূপ হলো ওই  জীন। অসংখ্যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তি কনায় তৈরি এই জিনের শরীর। একে আপনি অবতার বলতে পারেন, ঈশ্বরের দূত  বলতে পারেন, জীন বলতে পারেন । যে নামেই আপনি ডাকুন না কেন,  এটি আসলে আপনারই বৃহত্তর সত্ত্বা।  যে আপনার ভিতরেই আছেন, কিন্তু সুপ্ত ভাবে। তাই আমরা তাকে চিনতে বা জানতে পারি না। ইনি আমাদের সবকিছুই নজরে রাখছেন। ইনি আমাদের ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগকর্তা। ইনি কোনো প্রশ্ন করেন না, শুধু আপনার ভাবনার দিকে নজর রাখছেন। এই শক্তি ধরে নেয়, আপনি যা ভাবছেন, আপনি তাই চাইছেন। এই শক্তি কোনো প্রশ্ন করে না। আপনি যা ভাবেন, এই শক্তি, সঙ্গে সঙ্গে আপনার সেই  ইচ্ছে অনুযায়ী মহাবিশ্বে পরিবেশ ও ঘটনার মধ্যে দিয়ে, যন্ত্রচালিতের মতো ইচ্ছে পূরণ করে দেয়।

তাই আমাদের যেটা উচিত, সেটা হচ্ছে,  প্রথমত চাইতে শেখা। অর্থাৎ সঠিক ভাবনা। আপনি কি চান সেটা সম্পর্কে আপনি স্বচ্ছ, দৃঢ়, ও নিশ্চিত হন। তার পর অর্ডার দিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করুন, সন্দেহ প্রকাশ করবেন না, যে আপনার কথা ইচ্ছেশক্তি শুনেছেন  কি না। আপনি ধরুন, কোনো ক্যান্টিনে গেছেন, ক্যাটালগ দেখে খাবারের অর্ডার করেছেন, এখন খাবার গরম করতে, বা তৈরী করতে সময় লাগে, সেটুকু সময় অপেক্ষা করুন, বার বার জিজ্ঞেস করবেন না যে আমার অর্ডার নেওয়া হয়েছে কি না। আপনার কাজ শুধু অর্ডার করা আর অপেক্ষা করা। ইচ্ছেশক্তি আপনার কথা শুনলো কি না, সেই সন্দেহ যেন আপনার মনের মধ্যে না আসে। আপনি  শুধু নিজে  নিশ্চিত হোন, যে আপনার যা দরকার সেটা আপনি চেয়েছেন। এবং ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করুন।

এর পরের  পদক্ষেপ হচ্ছে, বিশ্বাস করা। আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে, যে আপনি যা চেয়েছেন, তা আপনার জন্য এসে গেছে, আপনি এবার সেটা খাচ্ছেন, বা ব্যবহার করছেন। আপনি সেই খাবারের সুগন্ধ পাচ্ছেন।  বা আপনি যে জিনিষের অর্ডার করেছিলেন, সেটা আপনি পেয়ে গেছেন। এবং আপনি সেটা ব্যবহার করছেন। আমাদের আধ্যাত্মিক জগতেও এইরকম প্রথম দিকে একটা কল্পনা করার ব্যাপার আছে। সেটা হচ্ছে, আমরা যখন প্রথম প্রথম বিভিন্ন চক্রের উপরে ধ্যান শুরু করি, তখন চক্রের অবস্থান আমাদের কল্পনা করে নিতে হয়। পরবর্তীকালে, এইসব চক্রের সঠিক অবস্থান নিজে থেকেই  উপলব্ধি করা যায়।

একটা কথা বলি, এই বিশ্বের কোনোকিছুই আপনার বা আমার নয়।  সবই পরমপিতার, পরম-ঈশ্বরের। আমরা তার সন্তান।  তো আপনার পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী আপনি। আপনি যেমন এগুলো ব্যবহার করতে পারেন, তেমনি এ-সব কিছুতে, আপনারই একমাত্র অধিকার। এক্ষেত্রে আপনার কোনো যোগ্যতার দরকার নেই , কেবলমাত্র আপনি যে, পরম-পিতার সন্তান, আর  এই সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, সেটা আপনাকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস  করতে হবে।

কিন্তু  কথা হচ্ছে, যা আপনি  সত্যি সত্যি পান নি, তা পেয়ে গেছেন সেটা কেন ভাবতে যাবেন ? দেখুন, আপনার মনে আপনি যে প্রতিচ্ছবি তৈরি করছেন, সেটা মহাবিশ্বের ইচ্ছাশক্তিতে প্রতিফলিত হচ্ছে।  অর্থাৎ বিশ্ব-ইচ্ছাশক্তি হচ্ছে  আয়না।  আপনি যা ভাবছেন, তার প্রতিচ্ছবি সেই  আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছে। আর আয়নায় যদি কিছুর প্রতিচ্ছবি পড়ে তাহলে জানবেন, বহির্বিশ্বে সেই ছবির অনুরূপ বস্তু অবশ্যই  অবস্থান করে থাকবে। আর আপনার কাম্য বস্তু তখন আপনার হাতের নাগালে।

আর একটা কথা বলি, আপনার ব্যাকুলতা বাড়াতে হবে।   ভগবান ব্যাকুলতা দেখেন , যোগ্যতা নয়। মানুষ কেন গরিব হয় জানেন, তারা চাইতে জানে না।  সে জানে, বা  সে ধরে নিয়েছে যে  তার বাবা গরিব, বাবা দিতে পারবে না। তাই সব সময় ভাবে, আমরা গরিব। আমাদের চাওয়া সাজে না। তাই  তারা গরিব  হয়েই  থাকে।

একটা ঘটনা বলি, আমার ছেলে তখন ছোট। পাড়ার কারুর সাইকেল দেখে, তার সাইকেল পাবার বাসনা হয়েছিল। আর  আমার কাছে, এইসব বায়না ছিল অহেতুক, বড়োলোকের খেয়াল। কেননা সাইকেল দিয়ে কি হবে ? বরং মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করুক, ভবিষ্যতে অনেক সাইকেল হবে। ছেলে চুপ হয়ে গিয়েছিলো। একদিন হঠাৎ দেখি, গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে ঘরের মধ্যে কি যেন  খুঁজছে। আমি বললাম কি হয়েছে বাবা ? বললো আমার সাইকেল কোথায়।  এইখানেই তো ছিল। আমি অবাক হয়ে গেলাম, আমি তো সাইকেল কিনে দেই  নি। পরদিন কি মনে হল, ও.ডি থেকে টাকা তুলে, অর্থাৎ ধার করে,  বেন্টিক স্ট্রিট থেকে ছেলের জন্য সাইকেল কিনে  নিয়ে এলাম। এখন মনে হয়, মানুষ যখন ব্যাকুল হয়, পরমপিতা তার সমস্ত ইচ্ছে পূরণ করেন।

আপনি যে পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছেন, উত্তরাধিকার সূত্রে সেই পরিবারের সম্পত্তির উপরে আপনার অধিকার আছে। এখন আপনি  এই মুহূর্তে সেই সম্পত্তি পেয়েছেন কি না সেটা বড় কথা নয়, আপনি পাবেন, এই বিশ্বাস আপনার থাকা উচিত। এবং এই মুহূর্তেই আপনি অবশ্য়ই তার মালিক, এবং আপনি সে সব  ব্যবহারও করছেন। এই যে পিতার সম্পত্তিতে পুত্রের অধিকার আছে, এটা আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে। দেখুন, এই আলো, এই বাতাস, এই জল, এই জমি এগুলো কোনো মানুষের নয়, এগুলো সব পরম-পিতার সম্পত্তি। আমরা ব্যবহার করার অনুমতি পেয়েছি মাত্র।

 এর পরেও যদি আপনার অবিশ্বাস থাকে তবে, অন্ততঃ বিশ্বাস করার ভান করুন। অভিনয় করুন, যেন আপনি সব পেয়ে গেছেন। আর এই ভান, বা অভিনয় করতে করতে আপনি একসময় গভীর ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করবেন যে আপনি এগুলোর মালিক, আপনি সবকিছু পেয়ে গেছেন। আপনি পেয়েছেন, এই বিশ্বাস যখন আপনার দৃঢ় হয়ে গেছে, তখন দেখুন কি মিরাকেল ঘটতে চলেছে আপনার জীবনে। মহাবিশ্বের ইচ্ছাশক্তি, আপনাকে আপনার কাঙ্ক্ষিত বস্তু দেবার জন্য প্রস্তূতি শুরু করে দেবে। কি ভাবে আপনাকে দেবে, তা  আপনার জানার দরকার নেই। শুধু বলবো, সন্দেহ করবেন না। নিরাশ হবেন না।  হতাশ হবেন না। শুধু অনুভব করুন, আপনার কাঙ্খিত বস্তুর সাথে, আপনি মিলিত হয়েছেন। ঠিক সেই সময় একটা জিনিস ঘটবে, তা হচ্ছে আপনার ফ্রীকোয়েন্সিতে পরিবর্তন আসবে। এখানে বুদ্ধি কাজ করে না। এই খেলাটা আপনার ফ্রীকোয়েন্সির পারিবর্তনের খেলা।  নিজেকে ভালো অনুভূতির ফ্রেকুয়েন্সিতে রাখতে পারলেই, আপনি সফল।  আর কাঙ্খিত বস্তু আপনার হাতের মুঠোয় এসে যাবে ।

ওম শান্তি, শান্তি, শান্তিঃ - হরি ওম

আমরা এবার ইচ্ছাশক্তির চতুর্থ পর্ব্বে প্রবেশ করবো। কল্যাণীর এক ভদ্রলোক রামকৃষ্ণ মিশনের এক স্বামীজীর কাছে চিঠি লিখেছেন, "আমার ক্যানছার হয়েছে, ডাক্তারবাবু বলেছেন আমার আয়ু আর একবছর। আমি ভীষণ ভেঙে পড়েছি। কি করবো বুঝতে পারছি না। আমাকে কিছু উপদেশ দেবেন।" তো স্বামীজী, তক্ষুনি তাকে লিখলেন, আপনি তো তবু এক বছর বাঁচবেন, বলেছেন ডাক্তারবাবু। আমাকে কিন্তু কোনো ডাক্তার এক বছর  কেন একদিনও বাঁচার প্রতিশ্রূতি দেয়নি। আপনি ভাগ্যবান আরো এক বছর আপনি মানুষের সেবায় কাজ করতে পারবেন। ঈশ্বর মঙ্গলময়। আপনার মঙ্গল করুন। - ইতি ভবদীয়। ....

ভদ্রলোক এখন নেই, কিন্তু এই ঘটনার পরেও  ভদ্রলোক বারো বছর  বেঁচে ছিলেন। এবং মানুষের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন।

আমার এক সহকর্মী বন্ধু আছে, মোহনলাল তিওয়ারি,  তার কোমরের হাড়ে দু দুবার অপারেশন করতে হয়েছে। একবার পেটে জল জমে গিয়েছিলো।   ডাক্তার বাবু , মোটা সিরিঞ্জ দিয়ে জল বার করতেন। তো একবার হলো কি, জায়গা  মতো নিডল না ঢোকার জন্য, বার বার ফুটো করতে হচ্ছিলো। ডাক্তারবাবু অনুতাপের স্বরে বলেছিলেন, আপনার খুব কষ্ট  হচ্ছে তাই না , তার জবাবে মোহন বলেছিলো, না না - " you proceed, I am enjoying,আপনি করুন,  আমি উপভোগ  করছি, , এই ব্যাথা  আর কোনো দিন হবে কি না  জানিনা। আমাকে উপলব্ধি করতে দিন।  মোহনলাল এখন পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়। ভালো আছে।

আমার এক বন্ধু আছে, পবিত্র সরকার। আমি তখন কলেজে পড়ি, পবিত্র অসুস্থ হয়েছে। সাতদিন ধরে, পেটে ভীষণ ব্যাথা  । ঠাকুরনগর হাসপাতালের তৎকালীন ডাক্তারবাবু ডক্টর রমেন দাস, বললেন ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে দাও।  আমরা ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিলাম। এক  দিন পরেই, ওর পেটব্যথা সেরে গেল। আমরা ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছিল ? ডাক্তারবাবু একটা আশ্চর্য্য কথা বললেন, কিছুই হয় নি। ওকে কোনো ওষুধও  দেই  নি।

আমার বাবা ডাক্তার ছিলেন। বাবাকে দেখেছি, যেকোনো রুগীকে উনি সব সময় আশ্বাসের বাণী শোনাতেন। বলতেন, কিছুই হয় নি। ভালো হয়ে যাবে। আমি তো আছি না - কি ? বহু লোককে বলতে শুনেছি ব্রজেন ডাক্তারবাবুর কাছে গেলে আমার অর্ধেক রোগ সেরে যায়।  কেন এমন হয় ?

এই রহস্যকে ধরবার চেষ্টা করবো আমরা।  আমাদের মধ্যে কিছু অন্তর্নিহিত সত্য আছে। আমরা যা ভাবি যা বিশ্বাস করি তাই হয়। রুগী যদি সত্যিই ভাবে ও বিশ্বাস করে, ট্যাবলেটে কাজ হবে তাহলে সে সুস্থ হয়ে যাবে। ওষুধের সাথে মনের ভাবনা যদি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবে তা আশ্চর্য্য ফল দেয়। আপনি এই মহাবিশ্বের অসীম শক্তিকে অনুভব করবার জন্য যদি নিজেকে উম্মুক্ত  করেন, তবে মহাশক্তি আপনাকে সব ভালো কিছু দেবার জন্য উন্মূখ হবে। আর নেতিবাচক ভাবনার আশ্রয় নিয়ে যদি নিজের দরজা বন্ধ করে রাখেন, তবে আপনি  অস্বাছন্দ  অবস্থাতেই থাকবেন। জীবন হবে যন্ত্রণাদায়ক, তা সে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেই বলুন, আর আর্থিক দিক থেকেই বলুন। আমাদের অধিকাংশ  শারীরিক রোগ আমাদের নেতিবাচক ভাবনার ফল, আমাদের দুশ্চিন্তার  ফল। শরীরকে ভালো বাসুন, শরীরের সঙ্গে কথা বলুন। তাকে খানিকটা সময় দিন। শরীর  ও মনের পুষ্টির জন্য শৃঙ্খলা বজায় রাখুন।

আমাদের দেহে যখন কোনো রোগের প্রকাশ ঘটে, আমরা যখন  অস্বাছন্দ অনুভব করি, তখন তাকে সঠিক ভাবনার ঔষধ দিয়ে, বদলে দিতে পারি। মজার সিনেমা দেখুন, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাচুন, মন খুলে হাসুন, এবং সঠিক ভাবনা, ভাবতে শিখুন সব ঠিক হয়ে যাবে।

ভগবান আমাদের শরীর তৈরি করবার সময়,  আমাদের শরীরের মধ্যেই শরীর সারাইয়ের প্রক্রিয়া করে রেখেছেন। আমাদের ছোটবেলায়, ছোটোখাটো আঘাত, বা ছড়ে গেলে কোনো ওষুধের সাহায্য নিতাম না। আমি অবশ্য এখনো নেই না। এমনি এমনি সেরে যেত। এখনো যায়।  সমস্ত রোগের  প্রতিরোধ করবার ক্ষমতা আমাদের নিজেদের মধ্যেই আছে। আমাদের শরীর প্রতিমুহূর্তে লক্ষ লক্ষ কোষকে শরীর  থেকে বের করে দেয়, আবার লক্ষ লক্ষ নতুন কোষকে সৃষ্টি করে। আমাদের দেহ প্রতিদিনই বদলে যাচ্ছে। আমরা প্রতিদিনই নতুন দেহ পাচ্ছি। তাহলে, যে সব কোষকে আমরা অসুস্থ ভাবছি, বা আমাদেরকে অসুস্থ করছে, তারা কি করে বছরের পর বছর  থাকতে পারে ? আসলে আমাদের ভাবনাই তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে। আপনি সব সময় নিজেকে পূর্ন ভাবুন, অসম্পূর্ন ভাববেন না। ভগবান আপনাকে সামঞ্জস্য পূর্ন শরীর দিয়েছে, কিন্তু আপনি নিজেকে অপূর্ন ভাবছেন, তাই আপনি অসামঞ্জস্য হয়ে পড়ছেন।

বার্ধক্যও আমাদের ভাবনার ফল। আপনি আদর্শ স্বাস্থ্যের কথা ভাবুন, অনন্ত যৌবনের কথা ভাবুন।  ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে  দেখুন,  ১২৫ বছর  বয়সেও তাকে যুবক মনে হয়। বাবাজিকে ২৫০ বছরেও কিশোর মনে হতো ।

যারা সারাক্ষন রোগের  কথা বলে, তারা রুগী হয়েই থাকে। আপনার  রোগ সব ডাক্তারকে দিয়ে দিন, আর আপনি ভালো থাকুন। নিজে বলুন, আমি খুব ভালো আছি।  আপনি অনুভব করুন, আপনি মহাসুখী।  আপনি সেই সব ভাবুন, যাতে আপনি ভালো থাকেন। আমি পারবো না যারা বলে, তারা পারে না। আর যারা পারবে বলে, তারা পারে।  আজ নয়তো কাল, তারা পারবেই।

আমি তখন খুলনা মেসে থাকি, ১৮৫, বিবি গাঙ্গুলি  স্ট্রিটে। তো আমাদের সঙ্গে কালিদা থাকতো।  বড্ড খুঁতখুঁতে।আমি আর শ্যামল মিলে  ঠিক করলাম, লোকটাকে অসুস্থ করে তুলবো। অল্প বয়সের দুস্টুমি আর কি। আমাদের সঙ্গে একজন ডাক্তারবন্ধু ছিল, ও কলকাতা মেডিকেলে পড়তো।  তো তার কাছ থেকে আমরা  কতগুলো লিফলেট পেয়েছিলাম। সেখানে বিভিন্ন রোগের উপসর্গ লেখা থাকতো।আমরা  প্রতিদিন, একটা করে লিফলেট কালিদার টেবিলে রেখে দিতাম। এবং লক্ষ করতাম কালিদা সেটা মনোযোগ দিয়ে পড়ছে । এবং পড়বার পর বিছানার তলায় লুকিয়ে রাখতো।  দুচার দিন পরেই লক্ষ করলাম, কালিদা ওই ডাক্তার বন্ধুর সঙ্গে তার অসুবিধাগুলো নিয়ে আলোচনা করছে। তার নাকি প্রেশার বেড়ে গেছে, সুগার দেখা দিয়েছে। বুকের মধ্যে ডীপ ডীপ করে, ইত্যাদি ইত্যাদি। অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন । পাচ্ছে রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েন ।

ঠাকুর রামকৃষ্ণ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। তার অনুগামীরা সবাই বলছেন, আপনি মাকে  একবার বলুন না আপনাকে ব্যাধি থেকে মুক্তি দিতে  - আপনি যা বলেন, মা তো তাই শোনেন । ঠাকুর মাকে এই তুচ্ছ কথা বলতে পারেন নি।  ঠাকুর জানেন, মানুষ প্রারব্ধ ভোগ করার জন্য, জন্ম গ্রহণ করেন, ঠাকুর চাইতেন, মা আমাকে জ্ঞান দাও, ভক্তি দাও, বৈরাগ্য দাও। ঠাকুর যা চেয়েছেন, তাই পেয়েছেন।

আবার অন্যদিকে দেখুন, শাম্ব তার পিতা শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে যখন জানতে পারলেন, যে তার কুষ্ঠ হবে, তখন ভগবানের কাছে জানতে চাইলেন, আমাকে ভালো হবার উপায় বলে দিন। তো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে সরজু নদির তীরে, তপস্যা করতে বলেছিলেন, এবং তাই করে  সে ভালো হয়েছিল। তো আপনি যা চান তাই হবে, আপনি যা ভাববেন, তাই হবে।

আপনি যদি অন্যের অসুস্থতার কথা শোনেন, আপনার মধ্যে সেই ভাবনা আসবে, এবং আপনি কষ্ট  পাবেন। আর এতে, আপনার জীবনে সেই অসুস্থতাকেই ডেকে আনবেন। তার চেয়ে আপনি ওই ব্যক্তির সুস্থতার  কামনা করুন শক্তিশালী ভাবনা দিয়ে, সহাভূতি দেখান, তার পরে ভুলে যান। কোনো মানুষের কষ্টের বা অসুস্থতার প্রতি নজর দেবেন না, বরং তার সুস্থতার দিকে নজর ঘুরিয়ে দিন। ভালো থাকার এটাই নিয়ম।

আপনি যখন ভাবছেন, আপনার মধ্যে এক বিশেষ ধরনের রাসায়নিক ক্রিয়া সংগঠিত হচ্ছে, আপনার স্নায়ুকেন্দ্রে বিশেষ ধরনের লালা নিঃসৃত হচ্ছে। আপনার শরীরকে নতুন করে সংগঠিত করছে, নতুন কোষের সৃষ্টি করছে। আপনার চারিদিকে কি হচ্ছে সেটা বড় কথা নয়, আপনার ভাবনাই আপনার ভিতরে পরিবর্তন করছে। সঠিক ভাবনা, অর্থাৎ আমি ভালো আছি, আমি সুস্থ আছি, আপনাকে  সুস্থ রাখবেই। মানুষ তাই হয়, যা সে ভাবে।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ

ওম পূর্নমদঃ পূর্নমিদং পূর্ণাৎ পূর্নম-উদচ্যতে ।
পূর্নস্য পূর্নমাদায় পূর্নমে-অবশিষ্যতে ।।
ওম শান্তি-শান্তি-শান্তিঃ।
ইন্দ্রিয়-অগোচর অপার্থিব-সূক্ষ্ম জগৎ এবং ইন্দ্রিয় গোচর  এই পার্থিব জগৎ উভয়ই বিশ্বশক্তিতে পরিপূর্ন। আর এই বিশ্বশক্তি হতেই তাবৎ সৃষ্টি পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়ে আছে। বিশ্বশক্তি থেকে এই সৃষ্টি হলেও বিশ্বশক্তি পূর্নরূপেই অবশিষ্ট আছে।

ইচ্ছে শক্তির পঞ্চম পর্ব।

আমি যখন চাকরিতে ঢুকি তখন সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কে দুটো কর্মচারী সংগঠন। একটি বামপন্থী।  যাদের স্লোগান ছিল - লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই। আর একটি ছিল দক্ষিণপন্থী সংগঠন যাদের স্লোগান ছিল - হামকো যো টকরায়গা, চুড় চুড় হো যায়গা।
প্রত্যেক মানুষের প্রবণতা হলো, তার যা ভালো লাগে, সে তাই চায়। সে সুখ চায়, তাই সে সুখের কথা ভাবে। আবার সে অনেক কিছু চায় না। দুঃখ, লাঞ্চনা, দারিদ্র এগুলো সে চায় না।  এগুলো কি ভাবে দূর করতে হবে, তার কথা সে আরো বেশি করে ভাবে। সে যা চায়, তার থেকে বেশি মনোযোগ দেয় যেগুলো সে চায় না সেগুলোর প্রতি।
আমরা সর্ব্বক্ষন লড়াইয়ের জন্য তৈরী হয়েই আছি। আমরা রোগের বিরুদ্ধে, অভাবের বিরুদ্ধে, আতঙ্কের বিরুদ্ধে, হিংসার বিরুদ্ধে লড়াই করেই চলেছি। যা চাই না তার বিরুদ্ধে লড়াই করাটা যেন আমাদের একমাত্র কাজ। এই জন্যই যেন আমরা জন্ম গ্রহণ করেছি।
আর হচ্ছে ঠিক উল্টো। যা চাইছি না তাই বাড়ছে। হিংসা বেড়েই চলেছে, আতঙ্কবাদ বেড়েই চলেছে, হাসপাতালে রুগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।এমনকি রোগের  সংখ্যাও  বেড়েই চলেছে।  আমাদের অভাব বেড়েই চলেছে। আমাদের দারিদ্রতা বেড়েই চলেছে। তো যা  চাইছি না তাই বাড়ছে। আর যা চাইছি তার দেখা মিলছে না। অধর্মের যুদ্ধ করে কৌরব বংশ শেষ হয়ে গেছে, আর ধর্মের যুদ্ধ করে যদু বংশ শেষ হয়ে গেছে। দ্রৌপদীর মর্যাদা রক্ষায় যে অর্জুন অজেয় আখ্যা পেয়েছিলো, সেই অর্জুন  যদুবংশের নারীদের মর্যাদা রক্ষা করতে পারে নি। ভগবান রামচন্দ্র সীতামায়ের সতিত্ত্বে সন্দিহান হয়েছিলো, তাই রাজ্যের প্রজারাও সন্দেহ প্রকাশ করেছিল।   বিচিত্র এই জগৎ।  
আসলে ব্যাপারটা কি জানেন, আমরা যার কথা  বেশি  চিন্তা করি, আমরা তাকেই জন্ম দেই। আমরা যার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করি, আমরা তাকেই সৃষ্টি করি। আমরা যুদ্ধ চাই না, তাই যুদ্ধ হয়। আমরা লড়াই চাই না তাই লড়াই হয়।  আমরা দুর্ভোগ চাইনা, তাই আমাদের কাছে দুর্ভোগ আসে। আমরা যখন যার চিন্তা করি, তখন আমাদের সমস্ত শক্তি তার সঙ্গে যুক্ত করি, আর আমাদের সেই  অবাঞ্চিত বস্তুর শক্তি তখন বৃদ্ধি হয়ে যায়।
যুদ্ধ-বিরোধী কোনো আন্দোলন হওয়া উচিত নয়, গরিবী হঠাও কোনো আন্দোলন হতে পারে না। সন্ত্রাস বিরোধী কোনো আন্দোলন হতে পারে না। হিংসা-বিরোধী কোনো আন্দোলন হতে পারে না। কারন যা আমরা চাই না - এই আন্দোলন সেই জিনিসের উপরে আলোকপাত করছে। যা ছিল অজানা তাই জ্ঞানে এসে গেল। এবং শক্তিশালী হয়ে গেল।
তখন বামপন্থীদের রমরমা। তারাই সরকার চালাচ্ছে। তো SUCI একটা বন্ধ ডাকলো।  খবরের কাগজে তার কোনো প্রচার নেই। সাধারণ মানুষ কিছু জানে না।  তো সন্ধেবেলা বামপন্থীদের মিছিল বেড়োলো, বন্ধ  মানছি না মানব না। .... পরদিন দেখলাম সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেল। আমরা যা চাই না, তার প্রচার, তার প্রতি দৃষ্টিপাত, বা আলোকপাত করা মানে তাকে শক্তিশালী করে দেওয়া।
আমাদের মুখ্যমন্ত্রী জয় শ্রীরাম ধ্বনি শুনতে চান না। বাচ্চা ছেলেদের দিকে তেড়ে গেলেন। আর তখনই বিস্ফোরণটা ঘটলো, চারিদিকে জয় শ্রীরাম ধ্বনি শুরু হয়ে গেল।
আপনি যার বিরোধী তাকে উপেক্ষা করুন। আপনি যা চান তাই ভাবুন। বামপন্থীরা একবার যুদ্ধ-বিরোধী মিছিলে যোগ দেবার জন্য,  মাতা টেরেসাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। মাতা টেরেসা বলেছিলেন, আপনারা শান্তির জন্য  মিছিল করুন, আমি থাকবো।
আসলে বিরোধিতা করা, সঠিক জীবন দর্শন নয়। আপনি যুদ্ধ বিরোধী না হয়ে শান্তিকামী হন। আপনি দারিদ্রতার বিরুদ্ধে লড়াই না করে, আপনি ধনী হবার  জন্য লড়াই করুন, নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে লড়াই নয়, স্বরাক্ষরতার সমর্থনে লড়াই হওয়া উচিত। আপনি যা হতে চান, তাই বলুন, যা হতে চান না তা ভাবতে যাবেন না। আপনি কাকে চান না, সেটা ভাববেন না, আপনি যাকে চান তার কথা ভাবুন। আমরা যদি খারাপ জিনিস থেকে মন সরিয়ে ভালো জিনিসে মনকে কেন্দ্রীভূত করতে পারি, তবে খারাপ জিনিস থাকতেই পারে না। সব খারাপ অদৃশ্য হয়ে যাবে। আপনি যেটা চান  না, সেটা কত খারাপ, সেটা কত ক্ষতিকর, ভয়ানক ইত্যাদি কথা  বললে তর্ক বেড়ে যাবে। আর সেই জিনিসই এসে যাবে। আপনার সেই খারাপ জিনিসের চিন্তা খারাপ জিনিসের শক্তিকে বাড়িয়ে দেবে। নেতিবাচক চিন্তা দিয়ে আপনি জগতের কোনো উপকার করতে পারবেন না। তাই আপনি দুনিয়ার খারাপ ঘটনার দিকে  মনযোগ  দেবেন, ততই খারাপ ঘটনার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ঘটে যাবে।
স্বামী প্রনাবন্দজী তার আশ্রমে একসময় কোনো খবরের কাগজ রাখতেন না, কারন উনি দেখেছেন, খবরের কাগজে প্রধান প্রধান খবরই নেতিবাচক। আর তা আশ্রমীদের  মধ্যে খারাপ প্রভাব বিস্তার  করবে। আশ্রমীদের মধ্যে কাউকে খবরের কাগজ পড়তে দেখলে বলতেন কাগজে কি আশ্রমের খবর আছে ? আপনার চারপাশে কি ঘটছে, সেটা কোনো কথা নয়, আপনি যা চান তার প্রতি আপনার শক্তিশালী ভাবনাকে  কেন্দ্রীভূত করুন। আর আপনার ভালো ভাবনা দিয়ে ভালো থাকার অনুভূতি দিয়ে জগৎকে বার্তা পাঠান। খবর রাখা এক জিনিষ আর খবরের দ্বারা  প্রভাবিত হওয়া অন্য জিনিষ। আপনি প্রভাবিত হবেন না, আপনি প্রভাবিত করুন। এই জগতে এক মহোৎসব চলছে, আপনি সেই মহোৎসবের সঙ্গে নিজেকে সামিল করুন।
এই পরিবর্তনশীল জগতে দুটো জিনিষ চিরকাল ছিল - আছে - থাকবে।  আর তা হলো সুতিকাগৃহ আর শ্মশান। জীবন এই দুইয়ের  মাঝখানে একটি প্রবাহমান নৌকার যাত্রী আপনি । যদি আপনার ভিতরে ভয়, লোভ, পরিপূর্ন হয়ে থাকে, আর না পাওয়ার বেদনা আপনার অভিজ্ঞতা হয়, তবে তো আপনি নিজেকে অভিশপ্ত মনে করবেন। আপনার ভিতর যে সৃজন-ভাবনা আছে ভালো বাসা আছে, প্রেম আছে তা আপনি জগৎকে বিলোতে থাকেন। আর যত আপনি বিলোবেন, তত যাবে বেড়ে। আপনি শত্রূদের  জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করুন, তাদের শুভবুদ্ধি দেবার জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করুন, তাদের আশীর্বাদ করুন। তখন তারা আপনার কাছে ঘুরে আসবে আর মিত্র হয়ে যাবে। আপনার নেতিবাচক সমালোচনা ওদের অশুভ শক্তিকে শক্তি যোগাবে। আপনি ওদের যত প্রশংসা করবেন, তত ওরা  দুর্বল হবে, আর আপনিও নতুন ফ্রেকুয়েন্সিতে বাস করবেন, একটা ভালো লাগার অনুভূতিতে আপনার উত্তরণ ঘটবে।


চিত্রগুপ্তের খাতা বলে সত্যি কিছু আছে কি না আপনি-আমি জানিনা। আর সেখানে আমার-আপনার  ভাগ্যের কথা লেখা আছে কি না, তাও  জানিনা। এই মুহূর্তে আমরা  আছি।  কাল আমরা  থাকবো না। কিন্তু আমরা  কেন আছি, কিই বা করছি, সেটা ভবিষ্যতের কাউকে জানতে গেলে এই চিত্রগুপ্তের খাতার সন্ধান করতে হবে। চিত্রগুপ্তের খাতায় আমাদের  কথা কবে লেখা হয় ? আমার-আপনার  জন্মের আগে না পরে। আমরা শুনেছি, রাম  জন্মের আগে রামায়ন লেখা হয়েছিল। তার মানে জীবন শুরুর আগে জীবনী লেখা হয়।  আমার-আপনার  জীবন তেমনই হবে, যা সেই পরম-পুরুষ আগে থেকে রচনা করে রেখেছেন। তাহলে আবার বিচার কিসের ?  আর যদি ভবিষ্যতে লেখা হয় তবে আমরা  ভবিষ্যতের বিচারের কথা না ভেবে, এখন আপনার   জীবনে যা ইচ্ছে তাই আপনি করতে পারেন। আপনার জীবন খাতায়, যা কিছু লেখা আছে, অর্থাৎ চিত্রগুপ্ত যদি কিছু লিখে থাকেন, তা সব মুছে ফেলুন, আর আপনি যা ইচ্ছে তাই লিখে রাখুন। আপনি আগে কি করেছিলেন, সব ভুলে যান। আপনার জীবন এখন থেকেই শুরু হোক।  হ্যাঁ এখনই। আপনি আপনার আনন্দ খুঁজে নিন। এবং তাতেই জীবন কাটান।
আমরা ভবিষ্যতের কথা ভেবে, বর্তমানকে কষ্টকর করে তুলি। আর সব সময় এটা হতে থাকে। বারবার ভেবেছি, এটা  করলে ভবিষ্যৎ ভালো হবে না, কিন্তু ভবিষ্যতের সেই ভালো দিনটা আর আসে না।  মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। ছোটবেলায়, মা-বাবার শাসন - তারপরে মাস্টার-মহাশয়ের শাসন, তারপরে অফিসের বসের শাসন, বাড়িতে বৌয়ের শাসন, শেষদিকে ছেলের শাসন। বৌমার শাসন। আর প্রত্যেকেই বলেছে, এটা করলে ভালো হবে না। আর এখন শুনছি, আগে যদি  এটা করতে, তবে  ভালো হতো। এই সব করতে করতে, শুনতে শুনতে আমি হেজে গেছি। এখন ভাবি, আমার যা ভালো লাগে আমি তাই করবো। যাতে আমি আনন্দ পাই, আমি তাই করবো। যাতে আমি স্বাধীনতা পাই, আমি তাই করবো। যাতে আমি সুখে থাকি, আমি তাই করবো, আমি হাসতে  চাই। আমি যদি এক-ঘন্টা ধ্যান করে আনন্দ পাই, তবে আমি তাই করবো। যদি আমি নিরামিষ খেয়ে আনন্দ পাই তবে আমি তাই করবো। পোষা বিড়ালটাকে আমার স্ত্রী যখন আদর করে, দেখেছি সে আনন্দে থাকে। রাস্তার কুকুরটাকে যখন সে খাবার দেয়, তখন সে আনন্দ অনুভব করে। অর্থাৎ আমি যা চাই, তা যাতে আছে আমি তাই করবো। এবং তখন সেটাই হবে।
প্রত্যেকটি কাজে অন্তরের আনন্দ আমাদের  সাফল্য এনে দেয়। আনন্দহীন কাজ সাফল্য আনতে  পারে না। তাই আমি কাজ করবো, আনন্দের জন্য, আর এটাই সাফল্যের চাবিকাঠি। আপনি এখন আমার কথা শুনছেন,যদি আপনার ভালো লাগে তবেই শুনবেন, নতুবা বন্ধ করে দিন। আর যা ভালো লাগে তা খুঁজে বের  করুন। যা আপনার হৃদয়ের কথা, আপনি তাই শুনুন। আপনি নিজের জন্য যা বেছে নেবেন, সেটাই ঠিক। বেছে নেবার অধিকার আপনার, স্বাধীনতাও আপনার। আপনি শুধু আনন্দকে অনুসরণ করুন।
আপনি যদি আনন্দে থাকতে পারেন, অবিরাম একটা আনন্দময় জীবনের জগতে বাস করতে পারেন, তবে বিশ্বশক্তির আসল হৃদ্স্পন্দন আপনি অনুভব করতে পারবেন। হৃদয়ের সুর আপনি শুনতে পারবেন । এবং বিশ্বশক্তি আপনাকে প্রাচুর্য্যে ভরিয়ে দেবে। আপনি শুধু আনন্দকে অনুসরণ করুন, ভিড়ের পেছেনে দৌড়াবেন না, তবেই আপনার পেছনে ভিড় দৌড়োবে। বিশ্বশক্তি আপনার জন্য দুয়ার খুলে দেবে। একটা কথা আপনারা  শুনে থাকবেন। পরম-ঈশ্বর আনন্দময়, আপনিও সেই ফ্রীকোয়েন্সিতে থাকুন, যা আন্দময়, তাহলে পরম-ঈশ্বরের ফ্রীকোয়েন্সি আর আপনার ফ্রিকোয়েন্সি মিলে যাবে।
অনুষ্ঠান বাড়িতে গেলে দেখবেন, মেয়েরা মেয়েরা এক জায়গায় হয়ে যায়। পুরুষ-পুরুষ এক জায়গায় হয়ে যায়।  পুরুষের মধ্যে যারা রেলে  কাজ করে, তারা এক জায়গায় হয়ে যায়, আর যারা ব্যাঙ্কে কাজ করে তারা এক জায়গায় হয়ে যায়। কারন তাদের ভাবনা এক - আলোচ্য বিষয়ও এক। আপনি সেই ফ্রেকুয়েন্সিতে নিজেকে রাখুন, যা পরম-পিতা পরম-ঈশ্বরের ফ্রিকোয়েন্সি।  তাহলে আপনি সেই বিশ্বশক্তিকে অনুভব করবেন। এবং মহাবিশ্বের প্রাচুর্য্য আপনার কাছে উন্মুক্ত হয়ে যাবে। আপনি যাতে উৎসাহিত বোধ করেন, আপনি যে কাজে আপনার আবেগ মেশাতে পারবেন, যে কাজ আপনাকে উদ্দীপনা দেবে,  আপনি সেই ভাবে, সেই কাজে নিযুক্ত রাখুন নিজেকে। যদি গান ভালো লাগে আপনি তাই করুন, যদি বই পড়তে ভালো লাগে আপনি তাই করুন। যদি বেড়াতে ভালো লাগে, তবে আপনি তাই করুন। আপনি আপনার নিজস্ব বাস্তবতায় বাস করবেন, কিন্তু এক ভিন্ন জগতে  নিয়ে যান মনকে।
এর পর আপনি দেখবেন, আপনার কাছে অসম্ভব বলে কিছু থাকবে না। একটা সীমাহীন মহাশূন্যে মনকে নিয়ে যান। একটা কল্পনার জগৎ তৈরী করুন, মনে করুন, যেখানে আপনার মনের অনুভূতি য আপনার ব্যবহারিক সম্ভাবনাকে ছুঁয়ে থাকে মনে মনে ভাবুন, আমি যা খুশি করতে পারি। যেখানে খুশি যেতে পারি, যা খুশি পেতে পারি।
আমরা সব সময় অসম্ভবের কথা ভেবেছি। ভালো রেজাল্ট করতে পারবো কি না।  ভালো চাকরি পাবো কি না। আমার স্ত্রী ভালো হবে কি না। আমার ছেলে ভালো হবে কি না। এইসব নেতিবাচক চিন্তা ছেড়ে দিন। আপনি সীমাহীন শক্তির অধিকারী। আপনি ভাবুন, আমি ভালো ছাত্র, আমার ভালো রেজাল্ট হবেই। আমি ভালো চাকরি পাবোই। আমি ভালো, তাই আমার স্ত্রী ভালো হবেই। আমি ভালো তাই আমার ছেলে ভালো হবেই।  সুস্বপ্নের ভালোর মধ্যে নিজেকে দেখুন।  আপনার ভিতরে অসীম শক্তি। আর এই শক্তির যত ব্যবহার করবেন, ততই আপনি নিজের ভিতরে তা অনুভব করবেন। আপনি সুখী হবার জন্য জন্ম গ্রহণ করেছেন। আপনি মানুষকে অনেককিছু দেবার জন্য জন্ম গ্রহণ করেছেন। আপনি আজ যা আছেন, তার থেকে আরো বড় কিছু, আরো ভালো কিছু হবার কথা আপনার। আপনি সেই শক্তিকে জাগিয়ে তুলুন। আপনি আপনার ভাগ্যের স্রষ্টা। আপনি কি করবেন, কি হবেন,তা আপনিই ঠিক করবেন। আপনি ঈশ্বরের আশীর্বাদ ধন্য।
দরকার শুধু ভাবনার পরিবর্তন করা। ব্যাস তারপর দেখবেন , আপনার জীবনে মিরাকেল এসে যাবে। ভাবতে শুরু করুন, দুনিয়ার সব থেকে বড় শক্তি আপনার ভিতরে। সেই সবাইকে পুষ্টি যোগাচ্ছে, সেই আপনাকে আচ্ছাদন দিচ্ছে, সেই আপনাকে রক্ষা করছে, সেই সমস্ত অস্তিত্ত্বকে রক্ষা করছে। সেই একই শক্তির  নির্দেশেই সূর্য্য আপন কক্ষপথে ঘুরছে। তার নির্দেশেই বাতাস বইছে। তার নির্দেশেই পৃথিবী আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। চারিদিকে যাকিছু, ভালো, যাকিছু সুন্দর, সবই আমার অপেক্ষা করছে। আপনি আগে যা ভেবেছেন, আপনি এখন তাই হয়েছেন। আপনি এখন যা ভাবছেন, ভবিষ্যতে আপনি তাই হয়ে যাবেন। বিশ্বপিতার সন্তান আপনি। এই বিশাল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী আপনি। আপনি পূর্ন, আপনি আনন্দ, আপনার মধ্যে নিরানন্দ কৃত্তিম, আপনার মধ্যে অপূর্নতা কৃত্তিম। আপনি আনন্দময় সত্ত্বার  সন্তান। আপনি পূর্ণের  বংশধর। মানুষের সন্তান তো মানুষ হয়। ঈশ্বরের সন্তান ঈশ্বরই হয়।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।