Thursday 24 February 2022

ব্রহ্মের খোঁজে।

 


ব্রহ্মের খোঁজে। (ছান্দোগ্য উপনিষদ - অষ্টম অধ্যায় ) ব্রহ্মজ্ঞান 

আবার সেই ব্রহ্মরূপ চরম সত্যের খোঁজে। আমরা যখন কারুর খোঁজ করতে চাই, তখন প্রথমে আমরা তার বাড়ির ঠিকানার জোগাড় করি। তো আমরা আজ ব্রহ্মের খোঁজ করবো। তো প্রথমে তার ঠিকানাটা বুঝে নেই। ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছেন,  (শ্লোক :৮/১/১) এই দেহ হচ্ছে ব্রহ্মনগর। এর ভিতরে পদ্মের মতো একটা অনুপম গৃহ আছে, যার নাম হৃদয়।  এই হৃদয়ের ভিতরে একটা ক্ষুদ্র আকাশ আছে। এই আকাশের মধ্যে বিরাজ করছেন  সেই ব্রহ্ম বা পরম-আত্মা।

উপনিষদ বলছে, এই আকাশের মধ্যে আছে স্বর্গ-মর্ত। এই আকাশের মধ্যে আছে অগ্নি, বায়ু, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র এমনকি আছে বিদ্যুৎ যা আমরা মাঝে মধ্যে বাইরের আকাশে দেখতে পাই। তো এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের এই শরীর তো নশ্বর, এই আছে এই নাই। তো ব্রহ্ম যদি  হৃদয় মধ্যে  বাস করেন, তবে আমাদের এই শরীরের মৃত্যুর পরে, তাঁর গতি কি হয় ? তখন তিনি কোথায় থাকেন ? আসলে এই দেহের নাশ হতে পারে, জরাগ্রস্থ হতে পরে, কিন্তু এর মধ্যে যে অন্তরাকাশ আছে সেই ব্রহ্মপুর না জরাগ্রস্থ হয়, না তার মৃত্যু হয়। তিনি তখনও সেই আকাশেই বিরাজ করেন।  কখনো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, কখনো বৃহৎ থেকে বৃহত্তর।

দেখো তুমি যখন ঘুমুচ্ছ, তখনও তুমি আছো, আবার তুমি যখন জেগে আছো, তখনও তুমিই আছো। আমরা যখন জেগে থাকি, তখন আমাদের দেহ-মন দুইই সক্রিয় থাকে। আর ঘুমুলে আমাদের কি হয় ? আমাদের দেহ কাজ করে না। ঘুম আবার আমাদের দুই প্রকার, একটা গভীর ঘুম, আর একটা হালকা ঘুম।  হালকা ঘুমে আমরা স্বপ দেখে থাকি।  অর্থাৎ হালকা ঘুমে আমাদের মন কাজ করে, কিন্তু দেহ নিষ্ক্রিয় থাকে। কিন্তু গভীর ঘুমে আমরা দেহ-মন কোনোটাই কাজ করে না। অর্থাৎ এই সময় আমাদের দেহ ও মন দুইই নিষ্ক্রিয় থাকে।  তাই গভীর ঘুমে  দেহ-মন দুইই সম্পূর্ণ রূপে বিশ্রামের অবস্থায় থাকে। তাই গভীর ঘুম থেকে আমরা যখন জেগে উঠি তখন সম্পূর্ণ সতেজ হয়ে উঠি। উপনিষদ বলছে, গভীর ঘুমের নাম সুষুপ্তি।  এই সুসুপ্তিতে আমরা নাকি আত্মার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাই। কথাটা ভালোকরে খেয়াল করুন, উপনিষদের দ্রোষ্টাপুরুষগন বলছেন, এই গভীর ঘুমে আমরা আত্মার সঙ্গে এক হয়ে যাই।  কিন্তু আবার যখন আমরা জেগে উঠি, তখন আমরা আবার যা ছিলাম, তাই হয়ে যাই। আমরা যদিও অজ্ঞান কিন্তু এই সুসুপ্তির সময় আমাদের অজ্ঞানতার আড়াল সাময়িকভাবে সরে যায়।  কিন্তু এই কথা আমারা জানি না। প্রতিদিন রাতে বা গভীর ঘুমে আমরা আত্মার সাথে মিলিত হই। কিন্তু আমরা তা মনে রাখতে পারি না। আর কজনই বা তা আমরা জানি ?  সেই সচেতনতা আমাদের কোথায় ? ঘুমিয়ে থাকলে, বাঘ আর হরিনের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।  কিন্তু জেগে উঠলেই বাঘ হয় হিংস্র-শক্তিশালী  আর হরিণ হয় নিরীহ-দুর্বল। আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি, তখন আমাদের অজ্ঞানতাও  ঘুমিয়ে থাকে। আবার যখন জেগে উঠি তখন অজ্ঞানতা আমাদেরকে ঘিরে রাখে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন, পাপী যখন  গঙ্গাস্নানে যায়, তখন পাপ গঙ্গার পাড়ে গাছে চড়ে  বসে। গঙ্গা থেকে উঠে এলেই পাপ আবার আমাদের ঘাড়ে  চেপে বসে।

সুষুপ্তি বা গভীর ঘুম আমাদের সাময়িকভাবে পূর্ন  বিশ্রামের মধ্যে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু আমাদের অজ্ঞানতা দূর করতে পারে না। তাহলে আমাদের এই অজ্ঞানতা যাবে কি করে ? মহাত্মাগণ বলছেন, জ্ঞান হচ্ছে তরবারি যা সাহায্যে অজ্ঞানকে দূর করা যায়। অন্ধকারকে দূর করবার জন্য যেমন আলো জ্বালাতে  হয়, তেমনি অজ্ঞান-অন্ধকারকে দূর করতে গেলে, জ্ঞান-আলো প্রজ্বলিত    করতে হয়। 

ঋষি উদ্দালক আরুণি পুত্র শ্বেতকেতুকে বলছেন, দড়িতে বাঁধা একটা পাখী এদিক ওদিক উড়ে মুক্ত হতে চায়,  শেষে অপারগ হয়ে  বন্দীদশাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়।  তেমনি সুসুপ্তিতে আমাদের মন ছোটাছুটি করে কোনো আশ্রয় না পেয়ে, নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে প্রানকেই অর্থাৎ আত্মাকেই আশ্রয় করে। মন তখন প্রাণে আশ্রয় নেয়। 

দেখো আমাদের শরীরের ক্ষুধা তৃষ্ণা আছে। আর এই ক্ষুধা-তৃষ্ণা পায়  তখনই  যখন খাদ্য বা পানীয়ের অর্থাৎ অন্ন বা জলের অভাব বোধ করে শরীর। তো এই শরীরের কারন হচ্ছে খাদ্য ও জল। অর্থাৎ শরীর খাদ্য ও পানীয় দ্বারা তৈরী। একটু আগে যে কলা আমার খাবার টেবিলে ছিলো, তা এখন খাবার পরে, আমার শরীরে ঢুকে আমার শরীর হয়ে গেছে। একটু আগে যে জল গেলাসের মধ্যে ছিল, তা পান করবার পরে,  এখন আমার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে আমার দেহ হয়ে গেছে। অদ্ভুত এই গতিক্রিয়া। অদ্ভুত এই গতিশীল জগৎ। যা ক্ষনে ক্ষনে পরিবর্তিত আকার নিচ্ছে।  

এই জগতে সব সময় আমরা দুটো জিনিস দেখতে পাই।  একটা হচ্ছে খাদ্য আর একটা হচ্ছে খাদক। একটা হচ্ছে কারন, আর একটা হচ্ছে কার্য্য। এই কার্য-কারন সবসময় চলছে, মুরগি  থেকে ডিম্ হচ্ছে, আবার ডিম্ থেকে মুরগি হচ্ছে। বীজ থেকে গাছ হচ্ছে, আবার গাছ থেকে বীজ হচ্ছে। আজ যে পুত্র, কাল সে পিতা, আজ যে কন্যা কাল সে মাতা। আজ যে ছাত্র কাল সে শিক্ষক। আজ যে শিষ্য কাল সে গুরু। আজ যে যুবক, কাল সে বৃদ্ধ।  আজ যে জীবিত, কাল সে মৃত।  আজ যে কার্য্য কাল সে অন্যকার্য্যের কারন হচ্ছে। তো দেহের একটা উৎস আছে, তেমনি এই জগতেরও একটা উৎস আছে। দেহের কার্য্য আছে , আবার সেই কার্য্যের  কারণও আছে।  দেহের উৎস  কখনো মাতা-পিতা আবার কখনো খাদ্য-পানীয়, ইত্যাদি । 

তো যা শুনছিলাম, ব্রহ্ম কোথায়, না ব্রহ্ম আমাদের হৃদয়ে। ব্রহ্মপুরে।  আমরা যখন সুসুপ্তিতে থাকি তখন আমরা সবাই এই ব্রহ্মপুরে ব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যাই । আবার যখন আমাদের গভীর ঘুম বা সুসুপ্তির নিদ্রা আসে, তখন আমাদের আর কিছুই মনে থাকে না। এই ব্রহ্ম বলতে আমাদের কাছে কোনো স্পষ্ট ছবি ভাসে না, বা ব্রহ্ম বলতে আমরা কিছুই বুঝতে পারি না। আসলে ব্রহ্ম আছেন প্রাণের সঙ্গে মিশে। হৃদয় আকাশে অবস্থান করছেন । তাই এই প্রানকেই বলা হয় আত্মা। প্রাণের গতাগতি সম্পর্কে আমাদের একটা উপলব্ধি আছে।  অর্থাৎ শ্বাসপ্রশ্বাস সম্পর্কে আমাদের একটা প্রতক্ষ্য অনুভূতি আছে। তাই প্রাণ বলতে  আমরা ব্রহ্মকেই বুঝবো।  আর সেই  ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার বা আত্মসাক্ষাৎকারের স্থান হচ্ছে এই ব্রহ্মপুর, অর্থাৎ হৃদয়স্থল, হৃদয়-আকাশ।  

ঋষি উদ্দালক আরুণি বলছেন, আমরা যখন সুসুপ্তিতে যাই, তখন একটা আনন্দঘন মূর্তি এই শরীর  থেকে উত্থিত হয়ে, পরম-জ্যোতি লাভ করে, স্ব-স্বরূপে বিরাজ করেন। ইনিই আত্মা, ইনিই ব্রহ্ম, ইনিই সত্য-স্বরূপ। 

সুষুপ্তি বলতে আমরা বুঝি গভীর ঘুম, যেখানে স্বপ্ন বলে কিছু থাকে না। এই সুষুপ্তি অবস্থায় জীবাত্মা স্থুল দেহ ছেড়ে নিজের প্রকৃত স্বরূপে অবস্থান করে থাকেন। এখন কথা হচ্ছে নিজের স্বরূপটা কি ? জীবাত্মার  কি কোনো রূপ আছে ? না এই জীবাত্মার কোনো রূপ নেই, আবার অন্য দিক থেকে বলতে গেলে রূপ আছে, কারন আলো বা জ্যোতিঃ অগ্নি থেকে উৎপন্ন।  আমরা জানি অগ্নির রূপ আছে। তাহলে জ্যোতিরও একটা রূপ আছে।  আর তা হচ্ছে এই স্থুল-মানব দেহ সদৃশ্য অবয়ব । 

আমাদের যতক্ষন দেহবোধ থাকে, ততক্ষন আমরা দেহের প্রতি আসক্ত হয়ে থাকে। আর এই দেহের সাহায্যেই আমরা ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করে থাকি। আর এই ইন্দ্রিয়সুখভোগের লিপ্সা থেকেই আমাদের যত  অশান্তি। কিন্তু মহাত্মাদের মূর্তির দিকে তাকিয়ে দেখবেন, একটা শান্ত-স্নিগ্ধ-উজ্বল মূর্তি। এই যে মহাত্মাদের স্থুল দেহের মধ্যে প্রশান্ত ভাব, তা আমাদের সবার স্ব-রূপেই আছে। তাই আমাদের ধর্ম্ম শাস্ত্রগুলো বারবার বলছে, দেখো সবকিছুই তোমার ভিতরে আছে। সমস্ত শক্তি, সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত আনন্দ আমাদের সবার মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় আছে। 

নিজের এই প্রকৃত স্বরূপটা যখন আমাদের উপল্বদ্ধিতে আসে, তখন এই স্থুলদেহের প্রতি আসক্তি থাকে না। এমনকি এই যে দেহের কষ্ট, এগুলোকেও আমল দিতে ইচ্ছে করে না। সমাধি  অবস্থায় মা সারদা, এই জ্যোতিঃ স্বরূপ-কে  উপলব্ধি করে বলেছিলেন, "কি করে আবার এই বিশ্রী শরীরটায় ঢুকবো? " 

আত্মার সঙ্গে মিলনে যে অপূর্ব আনন্দ, সুসুপ্তির অভিজ্ঞতা থেকে সে সম্পর্কে আমাদের সামান্য একটু ধারণা  হতে পারি । কিন্তু সুষুপ্তি আমাদের বেশিক্ষন স্থায়ী হয় না। তো  এই সুসুপ্তির অবস্থা আমরা কিভাবে চিরস্থায়ী করতে পারি  ? আচার্য্য শঙ্কর বলছেন, ক্রমাগত ধ্যান করে যেতে হবে।  ক্রমাগত ভাবতে হবে, আমরা স্বরূপতঃ ব্রহ্মের সঙ্গে এক  ও অভিন্ন। এইভাবে ধ্যান করতে করতে একদিন আমাদের এই উপলব্ধি  হবে। অনুভূতি বা উপলব্ধি না হলে আমাদের স্বরূপের জ্ঞান হবে না। দিনের পর দিন যদি আমরা ব্রহ্ম-প্রসঙ্গ নিয়ে ধ্যানস্থ হতে পারি, তবে আমরা উপকৃত হবো। 

উপনিষদ বলছে, ব্রহ্মচর্য ও আত্মসংযমের দ্বারাই ব্রহ্মকে জানা যায়। 

তদ্য এবৈতং ব্রহ্মলোকং ব্রহ্মচর্য্যেণ-অনুবিন্দন্তি 
তেষাম-এব-এষ ব্রহ্মলোকঃ-তেষাম সর্বেষু লোকেষু কামচারঃ ভবতি। 

অর্থাৎ যারা ব্রহ্মচর্য্যের দ্বারা ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হন, সেই ব্রহ্মলোক তাঁদেরই হয় ।  তারা তখন ইচ্ছেমতো সবলোকেই যেতে পারেন। 

এখন কথা হচ্ছে, আমরা যখন শাস্ত্রে  এই  মিষ্টি মিষ্টি কথা পড়ি, যা আমাদের শুনতে বা পড়তেও   ভালো লাগে, কিন্তু, এই শুষ্ক   কথাতে কি আমাদের ব্রহ্ম সম্পর্কে কোনো জ্ঞান বা উপলব্ধি হতে পারে ? দেখুন "ব্রহ্মচর্য" শব্দটির অর্থ হচ্ছে "ব্রহ্ম চরতি" অর্থাৎ যিনি সর্বদা ব্রহ্মে বিচরণ করেন। কঠোপনিষদে দুটি পথের কথা বলা হয়েছে, একটা শ্রেয় আর একটা প্রেয়। যারা ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করতে চান, তাঁদের বিচারশক্তি কাজে লাগাতে হবে। মনে মনে ভাবতে হবে, যা কেবল আপাতমধুর, অথচ ভবিষতের পক্ষে ক্ষতিকর, তা আমরা গ্রহণ করবো না। আর যা শ্রেয়, হিতকর তাই আমি লাভ করতে চাই। 

দেখুন ধর্ম্ম কোনো জাদুকরের জাদুবিদ্যা নয়। ধর্ম্ম মানে সংযমী কঠোর জীবন। ধর্ম্ম মানে সত্যকে উপলব্ধি করবার জন্য হৃদয়ের ব্যাকুলতা। আমাকে  দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে।  সমস্ত কাজের মধ্যে, সমস্ত চিন্তার মধ্যে "আমি ব্রহ্মকে চাই" এই ভাব জাগিয়ে রাখতে হবে। ইন্দ্রিয় তার নিজস্ব কাজ করবেই ।  কিন্তু মনকে সারাক্ষন ব্রহ্মচিন্তায় মগ্ন করে রাখতে হবে। তখন দেখবেন, আপনার আর জগতের মধ্যে কোনো আড়াল নেই। আমি বাইরেও আছি, আবার ভিতরেও আছি। আমাদের মধ্যে থেকে তখন দ্বৈতবোধ চলে যাবে। বাহির-ভিতর এক হয়ে যাবে। তখন সবকিছুর মধ্যে সেই এক এবং অদ্বিতীয় ব্রহ্মকেই অনুভব করবো। এই ব্রহ্মচর্যকেই আবার বলা হয় যজ্ঞ। এই যজ্ঞ বা ব্রহ্মচর্য নিয়ে পরবর্তীতে আমরা আবার শুনবো।  আজ ব্রহ্মবাক্যের বিরাম দিলাম।

 ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।         

 

    

        






    

Wednesday 23 February 2022

আত্মসমর্পন


 ঈশ্বরে আত্মসমর্পন বা শরণাগতি (১)

মহাত্মাগণ বলে থাকেন, ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পন হচ্ছে সাধনার সর্বোচ্চ অবস্থা। অথচ আমাদের মতো সাধারনের কাছে, মনে হয়, ঈশ্বরের অনুগ্রহ পাবার জন্য ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পন  এর থেকে সহজ পন্থা আর কিছু নেই। আমরা যখনই বিপদে পড়ি, আমাদের মন যখন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যায়, যখন আমরা সংকটের মধ্যে পড়ি, তখন আমরা ঈশ্বরের কাছে আত্ম সমর্পন করতে চাই।  আর মনে মনে ভাবি ঈশ্বর আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন।  তিনি আমার মনের শক্তি বাড়িয়ে দেবেন। তিনিই আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধ্বার করবেন। তো আত্মসমর্পন আমাদের কাছে সবচেয়ে সহজ উপায়, যার দ্বারা করুনাময় ঈশ্বরের করুণার পাত্র হতে পারি। আসলে ঈশ্বরে আত্মর্পন ব্যাপারটা কিন্তু এতো সহজ পন্থা নয়, যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষ মনে করে থাকে। বহু দুর্বল চিত্তের মানুষকে বলতে শুনেছি,  যা করেন ভগবান, আমি আর কি করবো ? ভাবখানা এমন যেন তিনি সবকিছু ঈশ্বরের প্রতি ছেড়ে নিশ্চিত আছেন। আসলে কিন্তু তার মধ্যে সবসময় একটা সিদ্ধান্তহীনতা, একটা ভীতির ভাব, একটা আশঙ্কা তাকে  ঘিরে আছে। সুখে-দুঃখে যখন তিনি বিচলিত হন, তখন এই সত্য বেরিয়ে আসে।  

সত্যি কথা বলতে কি, অধ্যাত্ম জীবন দুর্বলের জন্য নয়।  অধ্যাত্ম-জীবন কেবল মাত্র সবলের জন্য। এই শক্তি শারীরিক শক্তি থেকে শুরু করে মনের শক্তি ও ঐশ্বরিক শক্তি। আমরা যদি আমদের ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে, সংযমী হতে পারি, তবে আমাদের মনে ও শরীরে একটা ঐশী-শক্তি ভর করে, এই শক্তিই আমাদের আধ্যাত্মিক পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। ঈশ্বর নির্ভরতার নামে  ভণ্ডামি কোনো কাজে আসে না।  

শ্রীমদ্ভগবৎ গীতায় (শ্লোক নং-১৮/৬৬) যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, 

"সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরনং ব্রজ  
অহং ত্বা সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িয্যামি মা শুচঃ।"  

অর্থাৎ সমস্ত ধর্ম্ম ত্যাগ করে, তুমি আমার শরণ নাও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করবো - শোক করো না।

এখন কথা হচ্ছে এখানে আমি কে ? আমি হচ্ছেন, স্বয়ং কূটস্থ ঈশ্বর। পাপ কি ? পাপ হচ্ছে আমাদের কামনা বাসনা। শোক অর্থাৎ আমাদের সংশয়জনিত, বা আশঙ্কা জনিত দুঃখ। 

শ্রী গীতার এই কথা যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, তখন  অর্জুনের সামনে সশরীরে উপস্থিত  ছিলেন, স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তো তখন  ভগবানের শরণ নেওয়া অর্জুনের  পক্ষে যতটা সহজ ছিল, আমাদের পক্ষে অতটা সহজ নয়। কেননা আমরা কেউ ভগবানের সান্নিধ্য পাইনি।  আর যাঁকে  আমরা দেখিনি, যার ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারনাই নেই, তার প্রতি নির্ভর করে, বসে থাকা বা কাজে প্রবৃত্ত হওয়া, মূর্খামি ছাড়া আর কিছু নয়।  এখন যদি আমি ভাবের ঘরে চুরি করি তবে সে কথা আলাদা। কাজ না করবার অছিলায় যদি আমি সব দায়িত্ত্ব সেই অদৃশ্য ভগবানের ঘাড়ে  চাপিয়ে দিয়ে, নিজে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে চাই, তাহলে তা হবে আত্মপ্রবঞ্চনা। 

শ্রী গীতার ১৮/৬১ নং, শ্লোকে বলছেন, "ঈশ্বর সর্ব্ভূতানাং হৃদ্দেশে-অর্জ্জুন তিষ্ঠতি"।   ঈশ্বর সর্বভূতের  হৃদয়ে স্থিত।  

তো ঈশ্বর সর্বভূতের হৃদয়ে অবস্থিত। তাহলে আমার আপনার সবার মধ্যেই ঈশ্বর আছেন। তাহলে আমাদের সমর্পনের আগে থেকেই ঈশ্বর  আপনার আমার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন। তাহলেকি, এমন কখনো হতে পারে, আমি যদি তাঁর কথা  না শুনি, বা তাঁর  ইচ্ছেমতো না চলি  তবে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন ? আসলে প্রাণশক্তি চলে গেলে আমাদের শরীরেরমৃত্যু হতে পারে, কিন্তু ঈশ্বর আমার কাছে আছেন কি না, তার উপরে আমার বাঁচা মরা নির্ভর করে না। কেননা, এমন অনেকেই তো আছেন, যারা  ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন। ঈশ্বরের উপরে তারা নির্ভরও করেন না।   তারা  তাদের পুরুষকার-এর উপরে বিশ্বাস করেন।  কর্ম্মেই তাদের বিশ্বাস।  এতে কি তাদের  ভালো বা খারাপ বেশি কিছু হয়েছে ? ঈশ্বর কি তাদের ছেড়ে চলে গেছে ?   

এই একই শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ  বলছেন, ( ১৮/৬১) "ভ্রাময়ন্ সর্ব্ব ভূতানি যন্ত্ররূঢ়ানি মায়য়া।" সমস্ত ভূতকে আমি যন্ত্রের মতো ঘুরিয়ে থাকি। তাহলে আমি যন্ত্র আর সেই যন্ত্রের চালক তিনি অর্থাৎ স্বয়ং ভগবান। একথা যদি সত্য হয়, তবে  আমার এই শরীর  হচ্ছে যন্ত্র, আর এই যন্ত্রের পরিচালক হচ্ছেন, স্বয়ং ঈশ্বর। তাই যদি হয়, তবে আমার আপনার আলাদা করে কি করার আছে ? আমরা  তো তাঁর হাতের পুতুল। যেমন নাচায়, তেমনি নাচি। আসলে এইসব হেয়ালিপূর্ন কথাবার্তা, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়। এই জায়গাটা আমরা একটু বোঝার চেষ্টা করবো। 

দেখুন, ঈশ্বর কি বা কে ? সহজে বলতে গেলে, আমাদের কাছে ঈশ্বর হচ্ছে একটা শক্তি যা প্রাণের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। যে শক্তির সাহায্যে আমরা চেতনা সম্পন্ন  হতে পারি। এই শক্তি না থাকলে আমরা সংজ্ঞা  হারিয়ে ফেলি, কিন্তু বেঁচে থাকি, কারন প্রাণ-ই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।  একমাত্র প্রাণের বিয়োগেই  আমাদের মৃত্যু হতে পারে।  তার আগে নয়। তাহলে ঈশ্বরের কাছে নিঃসর্তভাবে  আত্মসমর্পনে আমাদের কি লাভ হবে। আর কিভাবেই বা আত্মসমর্পন করবো ?

প্রথমে বুঝে নেই ঈশ্বরের শক্তি বা চেতন শক্তির কথা। তার আগে আমাকে অর্থাৎ "আমি কে ?"সেটা একটু  বুঝে নেই। আমরা আমি  বলতে  বুঝি এই শরীর, মন ও আত্মা বা  একটা চেতনশক্তি। তার মানে শরীর-মন-আত্মা এই তিনের  মিলিত সত্তা হচ্ছে "আমি"।  তো শরীর ভালো রাখতে গেলে, আমাদের অন্ন গ্রহণ করতে হবে এবং স্বাসপ্রশাস ক্রিয়া করতে হবে। তো অন্ন গ্রহণ-বর্জন, শ্বাসের গ্রহণ-বর্জন, বা  আগমন ও  নির্গমন ঠিক ঠিক মতো হলে, আমরা বা আমাদের শরীর বেঁচে থাকতে পারে। এর পর আসছে চেতন শক্তি যাঁকে বলা হচ্ছে আত্মা। এই চেতন শক্তি না থাকলে, আমরা কিছুই জানতে বা বুঝতে পারতাম না। এই চেতন শক্তিই আমাদের সুখ-দুঃখের অনুভূতি এনে দেয়।  এই চেতন শক্তি যদি না থাকতো তবে আমরা জড় পদার্থে পরিণত হয়ে যেতাম। আমাদের কোনো বোধশক্তি থাকতো না। অর্থাৎ এই বোধশক্তির যিনি মালিক তিনি হচ্ছেন আত্মা বা জীবাত্মা। এই জীবাত্মাই সমস্ত কিছু ভোগের কারন। 

এখন বাকি রইলো ঈশ্বর। ঈশ্বর হচ্ছেন একটা  নিরপেক্ষ শক্তি যার সাহায্যে এই জীবাত্মা আত্মবান  হয়ে থাকে। এই নিরপেক্ষ শক্তিই সমস্ত জগতের সঞ্চালক। এই শক্তির দ্বারাই জীবাত্মা শক্তি সংগ্রহ করেন, এই শক্তিই সমস্ত প্রাণীকূলকে এমনি সমস্ত বস্তু সমূহকে পরিভ্রমন করান। 

এখন এই শরীরের মধ্যে আছে জীবাত্মা। যা যথার্থ আমি। এই জীবাত্মা যতক্ষন শরীরের মধ্যে আছে, ততক্ষন শরীর অনুযায়ী তাকে চলতে হয়। প্রত্যেকটি শরীরের একটা নিজস্বতা আছে।  প্রত্যেক শরীরের একটা নিজস্ব ক্ষমতা আছে।  পাখির শরীর আকাশে উড়তে পারে। মাছের শরীর জল ছাড়া বাঁচে না। মানুষ মৃত্তিকাচারী। তো এই মনুষ্য শরীরের যাত্রী হিসেবে বসে আছি এই  "আমি"। এই শরীরের একটা নির্দিষ্ট আয়ু আছে।  আমি ইচ্ছে করলেই হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকতে পারি না। প্রকৃতির নিয়মে একদিন শরীরের নাশ অবশ্যম্ভাবী।

এখন কথা হচ্ছে, ঈশ্বর আমাদের চালিত করছেন। তাহলে ভালো মন্দ যা কিছু করছি, এসবই ঈশ্বরের কাজ, আমার নয়। তাহলে আমাদের মধ্যে পার্থক্য কেন। আমি যদি যন্ত্র হই, আর ঈশ্বর যদি এই যন্ত্রের চালক হন, তবে আমাদের দায়বদ্ধতা কোথায় ? আমরা সবাই  একই কাজে, বা একই ফল ভোগ করছি না কেন  ?  

দেখুন বিদ্যুৎ একটা শক্তি। এই বিদ্যুতের সাহায্যেই সমস্ত যন্ত্রাদি পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু সব যন্ত্র কি একই ফল দিচ্ছে ? ফ্রিজ বরফ বানাচ্ছে, কুলার ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে, আবার এ.সি. মেশিন গরম হাওয়া দিচ্ছে। ভাল্ব বৈদ্যুতিক আলো  দিচ্ছে। তো সব যন্ত্রই বিদ্যুৎ দ্বারা পরিচালি হচ্ছে, কিন্তু তার ফল আলাদা আলাদা হচ্ছে। এখন যন্ত্র থেকে ফল উৎপন্ন হচ্ছে, তাতে বিদ্যুৎশক্তির কোনো আগ্রহ নেই। এমনকি এই যে যন্ত্র সে নিজেও জানে না, সে কি ফল দান  করছে। কম্পিউটার যেমন যেমন ইনপুট দেওয়া হচ্ছে, সেইমতো আউটপুট বেরুচ্ছে। কম্পিউটার এই কাজ করছে, নিজের অজ্ঞাতসারেই। তাহলে আমরা বুঝলাম, ঈশ্বর বা বিদ্যুৎশক্তি নিরপেক্ষ। যন্ত্র অর্থাৎ শরীর সেও নিজের অজ্ঞাতসারে ফল প্রদান করছে বা ক্ষমতা অনুসারে ফল প্রদান করছে। এর বাইরে সে যেতে পারে না। বাকি রইলো জীবাত্মা বা  - চেতনশক্তি যার  কারনে সব কিছু হচ্ছে। এই জীবাত্মা তার নিজের ভোগের জন্য এইসব কার্য্য করছে। এখন এই জীবাত্মা কিসে ভিত্তিতে এমন সব করছে।  জীবাত্মা এসব করছে তার স্বভাব অনুযায়ী। জীবাত্মার সঞ্চয় বা ইনপুট হচ্ছে সংস্কার। আর সে এই সংস্কার অনুযায়ী, আউটপুট দিচ্ছে। তাই বলা হয়, যার যেমন স্বভাব তার তেমন কর্ম্ম। আর যার যেমন কর্ম্ম তার তেমন ফল। 

এখন এই যে স্বভাব, তা সে খারাপ ভালো যাই হোক না কেন, এই স্বভাবকে মানুষ পাল্টাতে পারে। এই জায়গায় মানুষ স্বাধীন। আর  সমস্ত জীবকুলের মধ্যে একমাত্র মানুষই পারে নিজেকে শোধরাতে। নিজের সংস্কারকে পরিবর্তন করতে।  নিজের স্বভাবকে পরিবর্তন করতে।  অন্য কোনো জীব সহজে তার স্বভাবের পরিবর্তন করতে পারে না। কিন্তু মানুষ পারে। তাই আমরা দেখতে পাই, যুগ যুগ  ধরে, বাঘ বাঘের জায়গায় আছে, শকুন শকুনের জায়গায় আছে, সাপ সাপের জায়গায় আছে,  এদের স্বভাবের কোনো পরিবর্তন নেই।  কিন্তু মানুষের স্বভাবের পরিবর্তন হচ্ছে, আদিমযুগের মানুষের সঙ্গে আধুনিক যুগের মানুষের মধ্যে অনেক পার্থক্য। এখন আর সে কাঁচা মাংস খায় না। এখন সে শুধু পৃথিবীর মধ্যে আবদ্ধ  নয়, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে তার গতি। মানুষের বৌদ্ধিক উন্নতি হয়েছে। সে প্রকৃতিকে জয় করতে পেরেছে।  

কিন্তু আমরা যদি  ওই ঐশ্বরিক শক্তি থেকে দূরে সরে যাই, তখন আমরা অনেক বেশি স্বার্থ -কেন্দ্রিক হয়ে যাই।  তখন আমাদের উচ্চগতি না হয়ে আমরা  অধোগতি সম্পন্ন হই।  ঈশ্বরের শরণ মানে হচ্ছে আমাদের চেতনশক্তিকে কেন্দ্রীভূত করা। আর আমরা জানি যেকোনো শক্তি যখন কেন্দ্রীভূত হয়, তখন তার কার্যক্ষমতা অধিকতর হয়ে ওঠে। আমরা যদি ঈশ্বরশক্তিকে প্রার্থনার দ্বারা  কেন্দ্রীভূত করতে পারি তখনই আমরা অনুভব করবো, একটা অদৃশ্য শক্তি যেন এসে আমাদের উদার করে দিচ্ছে, উর্দ্ধগতিসম্পন্ন করে দিচ্ছে। একেই বলে আত্মসমর্পন বা বা ঈশ্বরে শরণাগতি। ধীরে ধীরে আমরা এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত শুনবো। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  

চলবে। .............

ঈশ্বরে আত্মসমর্পন বা শরণাগতি (২) 

রাজা পরীক্ষিত আসন্ন মৃত্যুর মুখে। আগামী ৭ দিনের মধ্যেই মৃত্যু নিশ্চিত। পরীক্ষিত উপস্থিত ঋষিগনকে বললেন, আসন্ন-মৃত্যুর কালীন অবস্থায়, জীবের কর্তব্য কি ?  আমাকে বলুন। ঋষিগণ এর ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। কেননা তারা জানেন, জপ, ধ্যান, জ্ঞান, যোগ, তপস্যা প্রভৃতি বহু সাধনাই  তো আছে।  আর এই সব সাধনায়, জীবকুলের উদ্ধ্বার তো হতে পারে অবশ্য়ই, কিন্তু তাতো আর মাত্র সাত দিনে ফল দিতে পারে না। ঋষিগণ পড়লেন, মহা বিপদে, আবার দেরি করলেও চলবে না।  সময় তো মাত্র ৭ দিন।  এখন প্রতিটি দিন, রাত্রি, ঘন্টা, মিনিট সেকেন্ড গুরুত্ত্বপূর্ন। কিন্তু সবাই চুপ - সবাই ভাবছেন, কি করা যায় ? মাত্র সাতদিনের মধ্যে একটা মানুষকে কিভাবে মুক্তির পথ দেখানো যায়। এইসময় হঠাৎ সেখানে এসে উপস্থিত হলেন, সর্বত্যাগী সন্ন্যাসি শুকদেব। 

রাজা পরীক্ষিতের প্রশ্নের উত্তরে শুকদেব এক-কথায় উত্তর দিয়ে দিলেন।  বললেন, যারা মৃত্যুকে অতিক্রম করতে চায়, তাদের সর্বময় ভগবান শ্রীহরির কথা শ্রবণ-কীর্তন এবং স্মরণ করাই উচিত। প্রত্যেক জীবের মৃত্যু তার সঙ্গে সঙ্গে চলছে। অনন্ত কালের তুলনায় এই জীবনকাল অতি অল্প। সমস্ত জীবকুল মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই জীবনকালই একমাত্র স্মরণ, মনন, কীর্তনের উপযুক্ত  সময়। এইসময় মনুষ্য জীবন হেলায় অতিবাহিত হলে, কালের গহ্বরে পতিত হতে হবে। শুরু হলো ভাগবতের কথা। এই 

মহাগন বলছেন, ঈশ্বর তাঁর কাছেই থাকে যার জীবন অনিশ্চিত। যার  জীবনে দুঃখের অনুভূতি নেই,  যার জীবনে অনিশ্চয়তা নেই , যার জীবনে দ্বন্দ্ব নেই, যার মধ্যে  জীবন সম্পর্কে  প্রশ্ন নেই, যার মধ্যে জীবন সম্পর্কে  জিজ্ঞাসা জাগেনি, তার কাছে ঈশ্বর বলে কিছু নেই। শ্রীশ্রী নিগমানন্দের  অধ্যাত্ম জীবন শুরু হয়েছিল, চাকুরী জীবনের বিড়ম্বনা আর স্ত্রী-বিয়োগের মধ্যে দিয়ে। আপনারা হয়তো হরিহরবাবার কথা শুনেছেন। বিহারের ছাপরা জেলায় তার জন্ম।  স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত সংসারে হরিহরবাবার জন্ম।  কিন্তু হঠাৎ একদিন তাঁর  পিত-মাতা দুজনকেই অসময়ে মারা যান । আশ্রয়হীন অভিভাবকহীন হরিহর (সেনাপতি) অনুজভাইয়ের সংসারে আশ্রয় পান।  দৈব দুর্বিপাকে, সেই অনুজ ভাইও  অকালে মারা যান। শোকের নির্মম আঘাত, তরুণ হরিহরের জীবনে আনে  বৈরাগ্য। সংসার ছেড়ে অজানার পথে হরিহরের যাত্রা শুরু হয়।

 স্বামী বিবেকানন্দ অর্থাৎ যুবক নরেন, পিতার মৃত্যুর পরে অসহায় হয়ে পড়েছিল। নিদারুন অর্থ কষ্ট  থেকে বাঁচবার জন্য, একটা চাকুরী পাবার আশায়  কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কোনো কুল কিনারা না পেয়ে, ঠাকুর রামকৃষ্ণকে ধরে ছিলেন।  ঠাকুর তাকে পাঠিয়েছিলেন, মায়ের কাছে। না এর মানে আমি একথা বলতে চাইছি না যে স্বামী বিবেকানন্দের কোনো পূর্ব সংস্কার ছিল না, অবশ্য়ই ছিলো। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ তখনও  জানেন না, তার ভবিষ্যৎ কি ? যারা স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী পড়েছেন, তারা জানেন বিবেকানন্দ জীবন কিন্তু মোটেই ফুল বিছানো রাস্তা  নয়, বরং বহুর কষ্টে একটার পর একটা কাঁটা সরিয়ে তাকে এগুতে হয়েছে।    

এমনি অনেক মহাত্মা পুরুষ-এর আধ্যাত্মিক জীবন শুরু হয়েছিল, সাংসারিক দুঃখ কষ্ট থেকে। একথা ঠিক অনেক মনীষী তাঁদের সংস্কার নিয়ে আসেন, এঁরা তাদের অসম্পূর্ন সাধনজীবন পূরণ করবার জন্য জন্ম গ্রহণ করেন।  কিন্তু শুভ সংস্কার তো আর একদিনে এমনকি এক জীবনে সংগ্রহ হয় না। এর জন্য তাদের অনেক শোক-তাপ সহ্য করতে হয়েছে।  তাই আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনে একটু  অনিশ্চয়তা থাকা ভালো। আর এই অনিশ্চিয়তা থাকলে, মানুষ নিশ্চয়তার খোঁজে বেরুতে পারে। তা না হলে মানুষ জড়বৎ হয়ে যায়।  জীবন সবসময় নির্ভরতা খোঁজে। আর আমরা জাগতিক বস্তুর মধ্যে, সম্পর্কের মধ্যে নির্ভরতা খুঁজি।  ছোটবেলায়, মায়ের কাছে নির্ভরতা পাই। একটু বড়ো  হলে পিতার কাছে নির্ভরতা পাই।  একসময় সমাজের কাছে নির্ভরতা পাই, রাষ্ট্রের  কাছে নির্ভরতা পাই।  তাই এই সম্পর্কগুলোকে আমরা সবাই বাঁচিয়ে রাখতে চাই। এই সম্পর্কের মধ্যেই আমি বেঁচে থাকতে চাই।  কেননা এখানে নির্ভরতা আছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, এই যে নির্ভরতা এটি শুধু সাময়িক নয়, এটি  বড়োই ভঙ্গুর। তাই একদিন এই নির্ভরশীল মানুষের মৃত্যু হয়, ারা আমার বড্ড অসহায় হয়ে পড়ি।  

স্বামীজী বলছিলেন, ঈশ্বরকে যদি জানতে চাও, ঈশ্বরকে যদি পেতে চাও, তবে এই জাগতিক নির্ভরতাগুলো  থেকে নিজেকে সরিয়ে নাও। তুমি জাগতিক সমস্ত সম্পর্ক, সহায়তা থেকে যদি বঞ্চিত হও, তবে তোমার মঙ্গল হবার সম্ভাবনাই বেশি। তোমার সমস্ত অতীত মূল্যবোধ, তোমার বন্ধুত্ত্ব আত্মীয়তাবোধ, আসক্তি সব যদি ভেঙে যায়, যাকে  ধরে তুমি বেচেছিলে।  তাহলে দেখবে, তোমার মধ্যে মঙ্গলসূর্য্যের উদয় হবে। মঙ্গলশঙ্খ তখন মধুর সুর তুলবে। শান্তনাবাক্য শুনতে  যেও না। আশ্বাস বাক্য শুনতে যেও না।  তাহলেই তোমার মঙ্গল। কারন যখন তোমার কাছে শান্তনা বাক্য অসার মনে হবে, আশ্বাসবাক্য অন্তঃসারশূন্য মনে হবে, তখন তোমার মন ঈশ্বরমুখী হবে। তুমি তখন ঈশ্বরের দিকে মুখ ফেরাতে পারবে। যিনি তোমার চিরকালীন, শাশ্বত ও একমাত্র প্রকৃত বন্ধু, তোমার সঠিক পথপ্রদর্শক। 

বাস্তবিক পক্ষে এই অভিজ্ঞতা খুবই কষ্টদায়ক। কিন্তু এর প্রয়োজন অনস্বীকার্য্য।  আমরা যখন সুখে থাকি, তখন আমাদের মধ্যে যখন আত্মবিস্মৃতি ঘটে। আর যখন আমরা দুঃখে থাকি,  তখন আমরা ঈশ্বরের পথের সন্ধান পেতে পারি না। আমরা কেউ আমাদের ভবিষ্যৎ জানি না। অনিশ্চয়তার এই ভবিষ্যৎ-শূন্যতাকে আমরা অনিত্য বস্তুর আকাংখ্যা  দিয়ে পূরণ করতে চাই। আমরা সবাই তাই করি। বর্তমানের দুঃখ আমরা ভবিষ্যতের সুখকল্পনা দিয়ে ঢেকে রাখতে চাই।  কিন্তু এতে করে বর্তমানের দুঃখকে আমরা ভবিষ্যতের দিকে টেনে নিয়ে যাই। এটি আমাদের সুখ কল্পনা থেকেই হয়ে থাকে। আমরা কখনো প্রার্থনা করি না যে হে ভগবান আমাদের দুঃখ দাও, আমাকে কষ্ট দাও, আমাকে বিপদ দাও।  কেননা এগুলো আমরা কেউ  চাই না। কিন্তু সত্য হচ্ছে, এগুলো নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। এখান থেকে আমরা বেরুতে পারি না। মায়াশক্তি এতটাই প্রবল যে যুগযুগ  ধরে মানুষ এই পথকেই  আঁকড়ে ধরে আছে।..........

কিন্তু এর মধ্যে কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ আছেন, কিছু বিরল মানুষ আছেন, যারা নিজের স্বভাবজাত প্রবৃত্তিকে অগ্নি দগ্ধ করছেন। আর সেই অগ্নিদগ্ধ প্রবৃত্তিকে হাতুড়িপেটা করছেন। এই হাতুড়িপেটার শব্দ, এই অগ্নির উত্তাপ, আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলে। আমরা  মনে মনে বলি, কে তোমাকে এসব করতে বলেছিলো ? এখন বোঝো ঠেলা। কিন্তু এইসব বিমূঢ় মানুষ জানে না, মাটি না ছানলে, ধাতু না গলালে, হাতুড়ির বারি না মারলে,  মনোহর  শিবমূর্তি তৈরী হতে পারে না। দুঃখ মানুষকে খাঁটি করে তুলতে পরে। জিজ্ঞাসা মানুষকে উত্তরের খোঁজ এনে দেয়। আমার  মাঝে মধ্যে মনে হয়, সব দুঃখ আসলে মানুষকে শিক্ষা দেবার জন্য। আমাদের স্বভাবজাত কুবৃত্তিগুলোকে সংযত রাখার জন্য সাধনার আগুনে পোড়াতে হবে। তবেই আমাদের দুঃখজনিত শিক্ষা লাভ হবে। প্রকৃত ঈশ্বর বিশ্বাসী, ঈশ্বর সন্ধানী কখনো ঈশ্বরের কাছে, তার জাগতিক দুঃখ  নিবারনের কথা বলে না, বিষয়সুখের প্রত্যাশাও করে না। দুঃখ-কষ্টের অবসানের কথাও বলে না। কেন সে জানে  এগুলোর মাধ্যমেই ঈশ্বর তাকে কাছে টানছেন।  তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। দুঃখই পারে দুঃখের নিবৃত্তি ঘটাতে। যার জীবনে কোনোদিন দুঃখ আসেনি তার কাছে কোনোদিন ঈশ্বরও আসেন নি। 

এখন কথা হচ্ছে এই দুঃখের কারন কি ? আমাদের অহমিকাই আমাদের দুঃখের কারন। আমরা যখন ভগবৎ কৃপার কথা ভুলে , আমাদের ইচ্ছাকে আমাদের শারীরিক শক্তিকে প্রকৃত কর্তা  মনে করি, তখন আমরা দুঃখকে ডেকে  আনি।   . আমরা যখন ঈশ্বরের শক্তিতে বলবান হয়ে, ঈশ্বরের সৃষ্টিকে  আঘাত করি,  আমরা যখন ঈশ্বরের শক্তিতে বলবান হয়ে, ঈশ্বরকেই অস্বীকার করি,  তখন আমাদের দুঃখের বোঝা বাড়তে থাকে। আপনারা নিশ্চই সেই মুষিকের  গল্প শুনেছে, যে প্রভুর কৃপায়, ব্যাঘ্রের ন্যায় শক্তিশালী হয়ে, প্রভুর কৃপা ভুলে প্রভুকেই আক্রমন   করেছিল। ভগবান আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছে, ভগবান আমাদের সীমিত ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, আমরা তার ব্যবহার করে অবশ্য়ই অধিক বলবান হতে পারি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই শক্তি আসলে ঈশ্বরেরই শক্তি। আর তা যদি করি, তবে জানবেন, ঈশ্বরের কৃপা-স্রোত  একদিন বন্ধ  হয়ে যাবে। তখন আমরা সবাই  নিঃসঙ্গ ও শূন্যতার মধ্যে প্রবেশ করবো। একটা জিনিস জানবেন, ভগবান আমাদেরকে না চাইতেই অনেক কিছু দিয়েছেন, আর সেগুলো আমাদের ভগবানকেই ফিরিয়ে দিতে হবে। আমাদের দাতা  হতে হবে। আমাদের অহংবোধ জট কমতে থাকবে, আমাদের তত সুখ-শান্তি বাড়তে থাকবে। মনকে জাগ্রত রাখো। মনকে বিচারশীল হতে দাও। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, তুমি যদি ঈশ্বরের দিকে এক পা বাড়াও , তবে ঈশ্বর তোমার দিকে দশ পা এগিয়ে আসবেন। এর পরের দিন আমরা শুনবো, জাগতিক দুঃখকে কিভাবে আমরা আধ্যাত্মিক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারি। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

ঈশ্বরে আত্মসমর্পন বা শরণাগতি (৩) 

দুঃখভোগকে আমরা কিভাবে আধ্যাত্মিক শক্তিতে পরিণত  করবো ?

প্রত্যেক মানুষের জীবনে, দুঃখ এমন একটা জিনিস যা না চাইতেই পাওয়া যায়। দুঃখ পাবার জন্য আমরা হয়তো কোনোদিন নিজেদের  অজ্ঞাতসারে কিছু না কিছু করে থাকতে পারি, কিন্তু জ্ঞাতসারে দুঃখের জন্য আমাদের  কিছুই করতে হয় না।  এ এক অদ্ভুত জিনিস, আমাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা যেমন জন্ম গ্রহণ করবার সঙ্গে সঙ্গেই আসে. তেমনি আমাদের দুঃখ আমাদের জন্মসূত্রে পাওয়া। আর আমরা এই দুঃখকে দূর করবার জন্য, সারা জীবন আমরা লড়াই চালিয়ে যাই। কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, সব কিছু হারিয়ে গেলেও, দুঃখই  আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকে। আমাকে এক মদো -মাতাল বন্ধু বলেছিলো, দেখো সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, আমি না চাইলেও সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে, কিন্তু নেশা আমাকে ছাড়বে না। আমি না চাইলে, সে আমার কাছ থেকে  যাবে না, এমনকি আমি চাইলেও সে আমাকে ছেড়ে  ছেড়ে যাবে না । এদের সাথে আমাদের এমনই  গভীর সম্পর্ক। তো দুঃখ-বোধ মানুষের, শুধু মানুষ কেন সমস্ত জীবের কাছে না চাইতেই আসে। এবং সারাজীবন আমাদের পায়ে পায়ে চলে। 

দুঃখ আমাদের দুই রকম।  এক হচ্ছে শারীরিক কষ্ট  অর্থাৎ রোগব্যাধি ইত্যাদি, আর হচ্ছে মানসিক কষ্ট, অর্থাৎ মন খারাপ । শারীরিক কষ্টের জন্য আমাদের সারাজীবনের ডাক্তারের সাথে  যোগাযোগ রেখে চলতে  হয়, শারীরিক কসরত করতে হয়, সঠিক ও  পুষ্টিকর  খাদ্য খেতে হয় । আবার মানসিক কষ্ট নিবারনের জন্য, আমরা ধর্ম্ম-শাস্ত্রের  স্বস্তিবাক্য শুনে থাকি। কিন্তু যা কিছুই করি না কেন, শেষের দিনে সেই রোগ-ভোগের কারণেই  আমাদের দেহ ছেড়ে চলে যেতে হয়। দেহ ছেড়ে চলে গেলে, হয়তো আমাদের দেহের রোগভোগের শেষ হয়, কিন্তু মানসিক যন্ত্রণার কি শেষ হয় ?  যারা ভাবেন, মৃত্যুর পরে শরীরের সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ হয়ে গেলো, তাদের কথা আলাদা, কিন্তু যারা মনে করেন, মৃত্যুর পরেও আমাদের মানসিক শরীরে বাস করতে হয়, মৃত্যুতে সব শেষ হয়ে যায় না।  আমি বলে একটা কিছু থাকে, অর্থাৎ আত্মা বলে একটা কিছু আছে, যা শারীরিক মৃত্যুর পরেও শেষ হয়ে যায় না।  এরা  কিন্তু মৃত্যুর পরেও মানসিক যন্ত্রনার লাঘবের জন্য লড়াই চালিয়ে যান। আর সেই  কাজটা হচ্ছে সঠিক ধর্ম্মাচরন। অর্থাৎ মৃত্যুহীন একটা জীবনের সন্ধান করে থাকেন তাঁরা। আর সেই অনন্ত জীবন যাতে উর্দ্ধমুখী হয়, ঈশ্বরসন্ধানী হয়, নিজের উৎসমুখী হয়,তার জন্য তারা সচেষ্ট থাকেন। 

ঠাকুর রামকৃষ্ণ স্থুল  শরীরে থাকবার সময়, অনেকবার  শারীরিক রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। ঠাকুর বলতেন, রোগভোগ হলো, আমাদের শরীরে বাস করবার জন্য ট্যাক্স দেবার মতো। কখনো কখনো এই ট্যাক্সটা  এতো বেশি হয়ে যায়, যে আমাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায়। তাই ঠাকুর বলতেন, শরীর  যন্ত্রনা ভোগ করে করুক, ও আমার মন, তুমি আনন্দে থাকো। 

ঈশ্বরের কৃপায়, আমাদের সমস্ত দুঃখ দূর হয়ে যাবে, এমন ভাবার কোনো কারন নেই । আবার ঈশ্বরের প্রকৃত ভক্ত, অর্থাৎ সাধনার পরাবস্থায়  যাঁরা পৌঁছে গেছেন, তারা ঈশ্বরের কাছে টাকা-পয়সা-বিষয়াদির জন্য  যাঞ্চাও  করেন না।  বরং তাঁরা মনে করেন, বিপদের দিনেই ঈশ্বরের সান্নিধ্য অনুভব করা যায়।  প্রত্যেকের  জীবনে অসুখকর অভিজ্ঞতা হবে, দুঃখ-কষ্ট, কোনো না কোনো আকারে প্রত্যেকের  জীবনেই আসবে। এঁকে  কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না। আমরা যারা সাধারণ  মানুষ, দুঃখের দিনে মুষড়ে পড়ি, আর  মহাত্মাগণ এই দিনগুলোকেই  দিব্যজীবনে উত্তরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। এটাই হচ্ছে পার্থক্য। অবশ্য এর  থেকে এমন ভাবনা যেন না আসে যে, দুঃখই ঈশ্বরকে পাবার উপায়, আর ঈশ্বরকে পেতে গেলে দুঃখের খোঁজে বেরিয়ে পড়তে হবে। 

আমাদের উচিত হবে স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হওয়া। অর্থাৎ সুখ-দুঃখের জীবনকে মেনে নেওয়া। সংসারের কাজের সঙ্গে যদি আমরা একটু আধটু অধ্যাত্মিক অনুশীলন চালিয়ে যেতে পারি,  তবে আমাদের মানসিক চিন্তাধারার পরিবর্তন হবে। ঘটনার আকস্মিকতায়,  পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বাড়বে। শীত গ্রীষ্ম, বর্ষা আসবে, আর আমাদের তার জন্য নিজের সহ্য ক্ষমতা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি আমাদের প্রতিরোধের উপায়গুলোকেও  আয়ত্ত্ব করতে হবে। অর্থাৎ ঘরবাড়ি, শীতের পোশাক ইত্যাদির জন্য প্রয়াস করতে হবে। 

দেখুন আমাদের প্রত্যেকের  একটা আলাদা জগৎ আছে। একটু চিন্তা করলেই সেটা ধরতে পারবেন। এমনকি আমরা প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন জগতে ঘোরাফেরা করে থাকি। আপনি আপনার ছেলে-মেয়ে-মা-বাবা ইত্যাদি নিয়ে আপনার একটা পারিবারিক জীবন। এখানে আপনার একটা জগৎ।  আবার আপনার আত্মীস্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ইত্যাদিকে নিয়ে একটা আলাদা জগৎ। এখানে আপনার আচরণ আপনার পারিবারিক জগৎ থেকে আলাদা। আপনি যখন স্কুল-কলেজের ছাত্র সেখানে বন্ধুবান্ধব নিয়ে আপনার একটা আলাদা জগৎ।  আপনার কর্ম্মক্ষেত্রের সহকর্ম্মীদের নিয়ে একটা আলাদা জগৎ।  এমনি তর বহু জগতের বাসিন্দা আপনি-আমি সবাই ।  কিন্তু এই ভিন্ন ভিন্ন জগতের আমিকে নিয়ে একটা মেলবন্ধন করে আমার-আপনার একটা নিজস্ব ব্যক্তিত্ত্ব গড়ে উঠেছে। আবার আপনার এই ব্যাক্তিত্ত্বের সঙ্গে আপনার বাহ্যিক আচরণ, এবং অন্তরের কথা আলাদা হতে পারে। আমরা অনেক সময় মুখে এক, আর কাজে আলাদা হয়ে থাকি। আমাদের সমস্ত ইচ্ছে যেমন পূরণ হবার  নয়,  তেমনি সমস্ত ইচ্ছেও  প্রকাশের যোগ্য নয়। এদিক থেকে দেখতে গেলে, আমরা সবাই একটা বিচিত্র মিশ্রণ। আমরা সবাই এক-একটা বিচিত্র মানুষ নামক প্রাণী। 

এই বিচিত্র মানুষটাকে একটা উচ্চতর উদ্দেশ্যের দিকে ধাবিত করতে হবে। জন্মসূত্রে আমরা যে ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে এসেছি, তার সদ্ব্যবহার করতে হবে। সময়-সুযোগের অনুযোগ না করে, যে সময় ও সুবিধা আমরা পেয়েছি তার সার্বিক প্রয়োগ করতে হবে। একটা জিনিস জানবেন, জগতে সব মানুষ যেমন ভালো-মন্দের মিশ্রণ, তেমনি জগতে সমস্ত বস্তুই ভালো মন্দের মিশ্রণ। তো এই জাগতিক বস্তু লাভ, এমনকি কোনো মানুষকে যদি আপনি ভালোবাসেন, তবে তার ভালো মন্দ দুটোকেই নিতে হবে। আপনি শুধু  ভালোটা নেবেন, আর খারাপটা  নেবেন না তা হতে পরে না।  তাই বলা হয়ে থাকে সমস্ত আকাঙ্খিত বস্তুই আমাদের সুখ ও দুঃখ উভয়কে নিয়েই আমাদের কাছে আসে। একটা ছেড়ে আমরা অন্যটাকে  নিতে পারি না। আমরা আজ যে অবস্থায় আছি, তা আমাদের অতীত ও বর্তমান বাসনাগুলোর ফল। আমাদের ভবিষ্যৎ হবে, আমাদের আজকের বাসনার ফল। তো আমাদের ভবিষ্যৎ আমি যেমন দেখতে চাই, সেই মতো আমাদের চিন্তা করতে হবে। তবে আমাদের সবসময় পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে। শীতের সময় কেন গরম হবে না তা নিয়ে আমাদের সময় নষ্ট বা কষ্ট  পেয়ে কোনো লাভ নেই। আবার দুঃখ-কষ্টের সময় নিষ্ক্রিয় হয়ে, বসে থাকলেও, সময় বসে থাকবে না। কালের গতি আমাদের পরিবর্তিত পরিস্থিতে নিয়ে ফেলবে। আমরা যদি অদৃষ্টকে মুছে ফেলে, শুভ  কর্ম্মকে আশ্রয় করতে পারি, জাগতিক বস্তুর উপরে নির্ভর না করে আমরা যদি আনন্দময় সত্ত্বা সেই ঈশ্বরের উপরে নির্ভর করতে পারি তবে এই জগৎ আমাদের কাছে একটা শিক্ষাকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। আর এর মাধ্যমে আমরা ঈশ্বর সান্নিধ্য অনুভব করতে পারি।  দেখুন আমি আপনি সবাই আমাদের মা-বাবার সন্তান, আমরা সবাই মানুষ একথা যেমন সত্য, তেমনি  অধিক সত্য হচ্ছে, আমরা সবাই সেই ঈশ্বরের সন্তান, ক্ষুদ্র এক-একজন ঈশ্বর। এই অনুভূতিতে যখন আমি ডুবে থাকবো, তখন আমাদের সমস্ত দুঃখ আধ্যাত্মিক পথের  দিশারী হয়ে উঠবে। 

--------------চলবে। ............ 

ঈশ্বরে আত্মসমর্পন বা শরণাগতি (৪) আত্মসমর্পনের কিছু কার্যকরী পদ্ধতি 

আত্মসমর্পন তখনই হতে পারে, যখন মানুষ দুঃখে-দুঃখে জর্জরিত হয়ে যায়।মানুষ যখন দিশেহারা হয়ে যায়। মানুষ যখন ভয়ে  আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে যায়, যখন  আঘাতে আঘাতে মানুষ যখন জীর্ন অবসন্ন হয়ে পড়ে, তখন মানুষের মধ্যে আত্মসমর্পনে ভাব জেগে ওঠে। উড়তে উড়তে ডানাগুলো যখন অবসন্ন বোধ করে, তখন পাখি আশ্রয় খোঁজে । যার আত্ম-প্রচেষ্টা শেষ পর্যায়ে চলে গেছে, সেই জানে আত্মসমর্পন কাকে বলে। স্রোতের মুখে সাঁতার কাটার ক্ষমতা যখন লোপ পায়, তখন সে আত্মসমর্পন করতে পারে।   পুলিশের জেরার মুখে অপরাধী আত্মসমর্পন করে। এই আত্মসমর্পন সম্পর্কে আমরা কিছুটা বুঝতে পারি। 

কিন্তু এছাড়া আরোও  এক ধরনের আত্মসমর্পন আছে। আসলে আত্মসমর্পন হচ্ছে মনের একটা ভাব।  যখন সে উপলব্ধি  করে, সে বিশ্বাত্মার অংশ, তখন আত্মসমর্পনের যোগ্য হয়ে ওঠে । যখন সে বোঝে যে তার এই দেহ-মন সেই উচ্চতর  শক্তির দ্বারাই  পরিচালিত একটা যন্ত্র মাত্র। কিন্তু যন্ত্র কি কখনো বুঝতে পরে, যে সে একটা যন্ত্র মাত্র ? যন্ত্রের মধ্যে এই বোধ জাগ্রত করতে গেলে, যন্ত্রের মধ্যে চেতনার দরকার পড়ে । আমাদের এই দেহযন্ত্রের মধ্যেও যখন সত্যিকারের চেতনার উন্মেষ ঘটে তখন আমাদের আত্ম সমর্পনের  ভাব জেগে উঠতে পারে। নতুবা আমরা স্থুল-বুদ্ধিতেই জাগ্রত হয়ে স্বয়ং প্রভু হয়ে বসি। আর সমস্ত কর্ম্মভার, নিজেই কাঁধে  করে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। ট্রেনের মধ্যে বাক্সপাটরা মাথায় নিয়ে বসার দরকার পড়ে না। কিন্তু আমরা অবুঝ, আমরা ভাবি, আমার বোঝা আমাকেই বইতে হবে, তাই বোকার মতো মাথায় নিয়ে বসে থাকি। 

এইখান থেকে আমাদের বেরুতে হবে।  কিন্তু কিভাবে ? দেখুন নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো অসম্ভব কাল্পনিক চিত্র তৈরী করতে যাবেন না।  আপনার ভবিষ্যৎ কি হবে তা আপনি জানেন না।  তাই ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে যাবেন না।  না এর মানে এই নয়, যে আপনার কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থাকবে না।  তা নয়, .ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অবশ্যই  থাকবে, ভবিষ্যৎ কর্ম্ম-ধারা  অবশ্য়ই থাকবে।  কিন্তু ওই পর্যন্ত - তারপর সমস্ত কিছু ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দিন। সঠিক টিকিট   কাটুন, সঠিক ট্রেনে  চড়ুন, এবার সিটে বসে পড়ুন।  ট্রেন কিভাবে, কোন রাস্তা দিয়ে আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে, তা নিয়ে ভাবতে যাবেন না, বারবার জানলা দিয়ে উঁকি দেবেন না  . দরজা দিয়ে বাইরে দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন হবেন না।  এমনকি আপনার মালপত্র সবই ওই ট্রেনের মধ্যে রেখে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকুন। শুধু সতর্ক থাকুন।  চেতন থাকুন।

 ধীরে ধীরে আমাদের শিখতে হবে, ঈশ্বরের সঙ্গে কিভাবে সুর মেলাবো।  গানের আসরে দেখবেন, গায়ক গানের সুরের সঙ্গে নিজের গলার সুরকে মেলাতে চেষ্টা করেন।  গলার সুর আর হারমোনিয়ামের সুর যদি একতালে না হয়, তবে জানবেন, দর্শকের  কানে,  এমনকি আপনার  কানেও গান  বেসুরো লাগছে । আপনার সমস্ত কাজে  আপনি যন্ত্র বোনে যান।  আর ঈশ্বর হোক  যন্ত্রী, যন্ত্রের চালক।   তবে এমন অবস্থায় একদিন এসে পৌঁছাবেন, যেদিন আমাদের সম্পূর্ণ সত্তার সুর ঈশ্বরের সুরের সঙ্গে এক হয়ে যাবে। আর আপনার জীবনের গান তখন হবে সুমধুর।  

একটা জিনিস জানবেন, ঈশ্বরন স্মরণ নিয়ে যিনি কাজে হাত দেন, কাজ করতে করতে যিনি ঈশ্বরের প্রতি নির্ভরশীল থাকেন, প্রতি মুহূর্তে যিনি সেই বিশ্বশক্তির কথা চিন্তা করতে থাকেন, তবে তার কাজে ভুলের সম্ভাবনা কমে যাবে। আমরা অনেক সময় মুখে বলি যে আমি ঈশ্বরের শরণাগত।  কিন্তু আমরা কাজ করি, আমাদের ইচ্ছেমতো। আমাদের সবারই  কিছু না কিছু সংস্কার আছে।  আমরা সবাই সেই সংস্কারের দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকি। আমাদের অনেকের বই পড়তে ভালো লাগে না।  কিন্তু গান শুনতে ভালো লাগে । কারুর হয়তো ছবি আঁকতে  ভালো লাগে, আবার কেউ দুমিনিট ধীর-স্থির হয়ে বসতে পারে না। দৌড়ঝাঁপ করতে ভালো লাগে। এগুলো সবই আমাদের শরীরের বায়ুর খেলা। আমাদের যে বিভিন্ন গ্রন্থি আছে, তার খেলা এগুলো। 

দেখুন কোনো না কোনো ব্যাপারে আমরা আসক্ত। আসক্তি নেই, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।  তবে আজ যার প্রতি সে আসক্ত কাল হয়তো তার প্রতি সেই  আসক্তভাব আর  নাও হতে পারে। অর্থাৎ আসক্তির বস্তুর পরিবর্তন হয়ে থাকে। এইযে আসক্তির বস্তুর পরিবর্তন হয়, সেটি তার অজ্ঞাতসারেই হয়ে থাকে। ছোটবেলায় যে খেলনার জন্য বাবার কাছে সে বায়না ধরতো, আজ আর সেই খেলনা তাকে আকর্ষণ করে না। তো আসক্তির বস্তু যদি জাগতিক বস্তু না হয়ে, শিল্পের মধ্যে আসে, সৃষ্টিধর্ম্মি কাজের মধ্যে আসক্ত হয়, তবে জানবেন তার পরিবর্তন হচ্ছে। একসময় এই আসক্তি যদি ঈশ্বরের জন্য হয়, আর সে ঈশ্বরের খোঁজে বেরিয়ে পরে, তবে জানবেন, সে আরো এগিয়ে গিয়েছে। তো যা আমি বলতে চাইছি, থাক না আসক্তি, আসক্তির বস্তুর পরিবর্তন করুন।  আর তা করুন সচেতন ভাবে।  লোক দেখানো নয়, মন থেকে এই আসক্তি আসুক। 

প্রত্যেকের তার সাধ্য অনুযায়ী প্রত্যাশা করা উচিত।এইজন্য আগে নিজের যোগ্যতা, সাধ্য সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। নিজেকে বিচার বিশ্লেষণ দ্বারা বুঝবার চেষ্টা করুন ।   সাধ্যের বাইরে প্রত্যাশা আখেরে দুঃখ ডেকে আনে। আপনি যদি আর্থিক দিকে থেকে গরিব হন, তবে গরিবী খানাতেই সন্তুষ্ট থাকতে চেষ্টা করুন। আপনি যদি বড়োলোক হন, তবে আপনার উচিত, নিজেকে সম্পত্তির পাহারাদার হিসেবে নিজেকে ভাবা । জানবেন, ওই সম্পত্তি একদিন অন্য কারুর কাছে ছিল, আজ আপনার কাছে এসেছে, আবার আগামীকাল অন্য কারুর হাতে চলে যাবে। আপনার মৃত্যুর পরে তো যাবেই, এমনকি আপনি বেঁচে থাকতেও এই সম্পত্তি আপনার হাতছাড়া হতে পারে। আর যদি আপনার হাতছাড়া না হয়, তবে অন্যের সম্পদের পরিমান বাড়বে  কি করে ? তাই ভাববেন না, এই সম্পত্তি জন্মসূত্রে পেয়েছেন, কি আপনি অর্জন করেছেন, এগুলো সবই ঈশ্বরের সম্পদ। সবচেয়ে বড়ো  কথা হচ্ছে, এই সম্পদের অধিকারী আপনি নয়। আপনার কাছে আজ এগুলো এসেছে - এই মাত্র । এবার  আপনি নিজের জন্য প্রয়োজনীয়টুকু রেখে বাকিটা যোগ্যপাত্রে দান  করুন। এতে আপনার মনের শান্তি আসবে।  একটা তৃপ্তি আপনাকে ঘিরে থাকবে সব সময় । 

ঈশ্বর আপনাকে যা দিয়েছেন, তার উৎকৃষ্ট ব্যবহার করুন। আপনার মধ্যে আছে অসীম জ্ঞানের ভান্ডার, আপনার মধ্যে আছে সুপ্ত প্রতিভা, আপনার মধ্যে আছে কর্ম্মদক্ষতা, আপনার মধ্যে বুদ্ধির অসীম শক্তি, আপনার মধ্যে আছে সেই কামনাবিহীন প্রেম, এগুলোর আপনি সদ্ব্যবহার করুন। আপনার সুপ্ত প্রতিভাবে জাগ্রত করুন। আপনার মধ্যে যে গুনের সমাবেশ আছে, তাকে মানব কল্যানে ব্যবহার করুন। অন্ধকে পথ দেখান। খঞ্জকে হাতে একটা লাঠি ধরিয়ে দিন। দুর্বলকে সাহস  জোগান। এই কাজগুলোই আপনাকে ঈশ্বরের কাছে যেতে সাহায্য করবে। 

আমরা অনেকে মুখে অনেক ভালো ভালো কথা বলি, নিজেকে ঈশ্বরের দাস, ঈশ্বরের অনুগ্রহের পাত্র  হিসেবে প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করি। আমরা মৃতের আত্মীয়কে শোক থেকে দূরে থাকতে বলি। ভাবখানা এমন যেন, এই অবস্থায় পড়লে, আমি তোমার মতো কান্নাকাটি করতাম না, তোমার মতো ভেঙে পড়তাম না।  সবই ঈশ্বরের লীলা বলে, সহাস্যে জীবন অতিবাহিত করতাম।  আসলে এইসমস্ত লোক, প্রবঞ্চক, প্রতারক।  সে জানে না যে, সে নিজের সঙ্গে নিজেই প্রতারণা করছে।  আর সমান্য ৫০০ টাকা হারিয়ে গেলে, বাড়ির কাজের লোককে গালাগালি শুরু করে দেয়। এরা  আত্মম্ভরী। এরা  নিজেই নিজের প্রসংসা করে থাকে। পরের ছেলে গোল্লায় গেলে এরা  পরমানন্দ ভোগ করে থাকে। আর মুখে আহা আহা ক'রে, শান্তনার শুষ্ক বুলি আওরায়। এইসব মানুষকে এড়িয়ে চলুন। 

নিজের সমালোচনা করুন, কিন্তু মনে রাখবেন, এই আত্মসমালোচনা মানে নিজেকে দুর্বল প্রতিপন্ন করা নয়, নিজেকে শুধরে নেবার দাওয়াই। আমরা যদি আমাদের অন্তরের  পরিবর্তন না করি, আমরা যদি আমাদের চিন্তাধারায় পরিবর্তন না আনতে  পারি, তবে  আমরা আমাদের স্থিতাবস্থায়, অর্থাৎ এখনকার অবস্থায় যে কষ্ট সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছি, যে কষ্টের মধ্যে আছি তার পরিবর্তন হবে না।  একটা জিনিস জানবেন, আমার কষ্ট আমারই চিন্তার দৈন্যতার কারনে হয়েছে।    তাই আমাদের চিন্তার মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে। 

আরো একটা কথা হচ্ছে, আমরা আমাদের মনকে ইচ্ছেমতো চলতে দিয়ে, নিজের মধ্যে কামনা-বাসনার জালের মধ্যে নিজেকে অবরুদ্ধ  করে রেখেছি।  সেখান থেকে বেরুতে গেলে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনতে  হবে। একটা জিনিস জানবেন, জগৎ পরিবর্তনশীল, প্রতিমুহূর্তে জগতের পরিবর্তন হচ্ছ। আজ আপনি যে দুঃখ-কষ্টের মধ্যে আছেন, তারও অবশ্য়ই পরিবর্তন হবে।  পরিবর্তনই জগতের নিয়ম।  একে আপনি শত চেষ্টা করেও আটকাতে পারবেন না। দুঃখের দিন চলে গিয়ে সুখের দিন আসবে। তাই যখন যেমন তখন সেই অবস্থার জন্য নিজের মধ্যে একটা সাম্য অবস্থা আনতে  হবে। এই প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে আমাকেও পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে। আর আমি যদি মানিয়ে  চলতে না শিখি, তবে প্রতি পদক্ষেপে আমাকে ঠোক্কর খেতে হবে। আমাদের মধ্যে যে জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার আছে, তার পরিবর্তন করতে হবে। এই প্রসঙ্গে ঠাকুর কথায় বলে  -  প্রশ্রয় দিলে মাথায় চড়ে। নিজের মনকে দুর্বল হতে দেবেন না। নিজের মনকে আজেবাজে চিন্তা থেকে বিরত রাখুন। নিজের মনকে ঈশ্বর চিন্তকে প্রবাহিত হতে দিন।  নিজের মনকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। মানিয়ে নিতে শিখুন, ধৈর্য্য ধরতে শিখুন, নিজের লক্ষে স্থির থাকুন, পরিশ্রমী হোন।  বিবেকের নির্দেশে কাজ করুন। এই বিবেকগুরুই আপনার ঈশ্বরে আত্মসমর্পনে যোগ্য করে তুলবে।  

----------------------------  

ছান্দোগ্য উপনিষদ : (৩/১৬/১-৭)

আর্য্যশাস্ত্র প্রদীপের লেখক যোগত্রয়ানন্দ  (শশীভূষণ সান্যাল) ব্যবহারিক জীবনে একজন চিকিৎসক ছিলেন।  তিনি আয়ুর্বেদ,এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, ক্রোমপ্যাথি, বায়োকেমিক বহু চিকিৎসা প্রণালী সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত ছিলেন। যেখানে যেমন প্রয়োজন সেই মতো চিকিৎসা করতেন। তিনি  আরো একটা চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োগ কৌশল জানতেন, সেটি হচ্ছে, বৈদিক মন্ত্রের শক্তির আশ্রয় নিয়ে, রোগীকে রোগমুক্ত করতেন। তিনি ঋক্বেদ অথবা অথর্ববেদের মন্ত্র প্রয়োগ করে রোগীর রোগ মুক্ত করতেন। মহামহোপাধ্যায় ডক্টর গোপীনাথ কবিরাজ, তার সাধুসঙ্গ ও সৎ প্রসঙ্গ গ্রন্থে (দ্বিতীয় খন্ড) বলছেন, যোগত্রয়ানন্দজী রুগীকে সম্মুখে বসিয়ে তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ডান  হাতের আঙ্গুল  সঞ্চালন করতে করতে বিধি অনুসারে বেদ  মন্ত্র উচ্চারণ করতেন। আর এই ক্রিয়ার সাহায্যেই রুগীকে  রোগমুক্ত করতেন । এই গোপীনাথ কবিরাজ একজন স্বনামধন্য শাস্ত্রব্যাখ্যাকার। আবার এই যোগত্রয়ানন্দ সম্পর্কে একসময় স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, "আমরা ইচ্ছে হয়, কোনো নির্জন গুহায় গিয়ে, আপনার চরণতলে বসে, ঋষিদের শাস্ত্রগুলো একান্ত মনে পাঠ  করি। (ভারতের সাধক-চতুর্থ খন্ড) ।

তো আমরা যেটা বলতে চাইছি, আমাদের বেদগ্রন্থে অনেক মন্ত্র আছে, যার সঠিকপ্রয়োগে, আমরা রোগমুক্ত থাকতে পারি। এমনকি আমরা সুস্থ শরীরে বহুদিন বাঁচতে পারি।  আজ সেইসব জ্ঞানী মহাপুরুষ আমাদের সন্ধানের বাইরে। মন্ত্রের প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কেও আমরা অবগত নোই। তথাপি এই মন্ত্রগুলো কিন্তু আজ আর গোপন নেই।  সেগুলো আজ বই আকারে প্রকাশিত। আজ আমরা সেই অসীম শক্তিশালী দুটো মন্ত্রের কথা শুনবো।      

ছান্দোগ্য উপনিষদে ষোড়শ খন্ডে নিজের জীবনকে দীর্ঘায়ু করবার জন্য, কিছু উপায় অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। ছান্দোগ্য উপনিষদে, কিভাবে আমরা জীবনের চরম লক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে পারি, তার একটা রূপ রেখা এখানে পাওয়া যেতে পারে। এই উপনিষদে দুটি উপায়ের কথা বলা হয়েছে, প্রথমটি হচ্ছে সকাম  উপাসনা।  আর একটি হচ্ছে পরব্রহ্মের ধ্যান। দুটোই ভালো, কিন্তু অধিকাংশ মানুষের পক্ষে প্রথমটি শ্রেয়। কারন যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তার সমন্ধে কোনো ধারনা করা আমাদের মতো সাধন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ব্রহ্ম যিনি বাক্য মনের অতীত সেই ব্রহ্ম আমাদের কাছে অর্থহীন। বেশিরভাগ মানুষকেই বাসনা তাড়া করে নিয়ে বেড়ায়। বাসনা পূরণ হলেই সে খুশী। আবার এঁরা শারীরিক রোগ-ব্যাধিতে কষ্ট  পায়। এমনকি বাসনা পূরণের আগেই এদের অকাল মৃত্যু হয়ে থাকে। 

আর এই কারণেই, এখানে অর্থাৎ ছান্দোগ্য উপনিষদের   তৃতীয়  অধ্যায়ে ষোড়শ খন্ডে জীবনকে একটা যজ্ঞ রূপে ধ্যান করতে বলা হয়েছে। এখানে জীবনের স্বাভাবিক আয়ু বলা হয়েছে ১১৬ বছর।  এই একশ ষোলো বছরকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে ২৪+৪৪+৪৮ বছর।

জীবনের প্রথম ২৪ বৎসরের মধ্যে যদি কোনো ব্যাধি তাকে যন্ত্রনা দেয় তবে সে বলবে : 

 "প্রাণা বসব ইদং মে প্রাতঃসবনং  মাধ্যন্দিনং সবনম অনুসন্তনুতেতি মাহং প্রাণানং বসূনাং মধ্যে যজ্ঞো বিলোপ্সীয় ইতি। " (৩/১৬/২) হে প্রাণগন, হে বসুগন, আমার এই জীবনের প্রথম অংশকে মধ্যজীবন পর্যন্ত বিস্তৃত করে দিন. যজ্ঞরূপী আমি যেন, আমার প্রাণরূপী বসুগনের মধ্যে বিলীন না হই। 

জীবনের মধ্যবর্তী ৪৪ বছর, যদি কোনো ব্যাধি বা অন্য কিছু তাকে পীড়া দেয় তাহলে সে বলবে :

"প্রাণা রুদ্রা ইদং মে মাধ্যন্দিনং সবনং তৃতীয়সবনমনুসন্তনুতেতি। মাঽহং প্রাণনাং রুদ্রাণাং মধ্যে যজ্ঞো বিলোপ্সীয় ইতি।"  (৩/১৬/৪) হে প্রাণগন, হে রুদ্রগন, আমার এই জীবনের মধ্যবর্তী অংশকে (মাধ্যন্দিন সবনকে) পরবর্তী আটচল্লিশ বছর (তৃতীয় সবন) পর্যন্ত  বিস্তৃত করুন।  যজ্ঞ রূপে আমি যেন আমার প্রাণরূপ রুদ্রের মধ্যে বিলীন না হয়। 

এর পরে যে ৪৮ বছর আয়ু তাই তৃতীয় সবন। এই শেষ ৪৮ বছরে যদি রোগাক্রান্ত হয়, তবে সে বলবে : 

"প্রাণা আদিত্যা ইদং মে তৃতীয় সবনম আয়ুঃ অনুসন্তনুত  ইতি। মাঽহং প্রাণায়াম আদিত্যানাম মধ্যে যজ্ঞো  বিলোপ্সীয় ইতি।" (৩/১৬/৬) হে প্রাণগন  হে আদিত্যগণ  আমার এই সায়ংকালীন সবনকে পূর্ণায়ু পর্যন্ত বিস্তৃত করুন। যজ্ঞরূপী আমি যেন প্রাণরূপ অদিতীগণের মধ্যে বিলীন না হই।

ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে, ইতরার পুত্র মাহিদাস এই যজ্ঞ বিজ্ঞান জেনে বলেছিলেন, হে ব্যাধি, তুমি কেন বৃথা আমাকে পীড়িত করছো ? আমি তো এই রোগে মরবো না। তিনি ১১৬ বছর বেঁচেছিলেন।(ছান্দোগ্য : ৩/১৬/৭) আমরা এই মন্ত্রের যথাযথ প্রয়োগ বিধি জানি না। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, মন্ত্রের যথার্থ অর্থ জেনে যদি বারবার একই মন্ত্র জপ করা হয়, তবে মন্ত্রের শক্তি একসময় আমাদের ইপ্সিত বস্তু পাবার পরিবেশ করে দিতে পারে। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম। 

ঘুমিয়ে পড়ো না, সজাগ থেকো। সাধন জগতের মূল কথা  জেগে থাকা।  

শ্রীগীতার আলোচনা চলছিল।  কিছু শ্রোতা চোখবুজে মনোযোগ দেবার ভান করছিলো। কিছুক্ষন পরে দেখলাম, তাদের মাথা নুয়ে পড়েছে।  অর্থাৎ ঘুমিয়ে পড়েছে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন চৈতন্য হোক। মনে করুন, আপনি ঘুমিয়ে আছেন, আর আপনার পাশে আপনার মা বিছানায় বসে আছেন। একই বিছানা একই ঘর। আপনি ঘুমিয়ে আছেন, আর আপনার মা জেগে আছেন। আপনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছেন। আপনার মা তা দেখতে পারছেন না। একই ঘর, একই সময়, একই বিছানা, আপনার মা যা দেখছেন, আপনি তা দেখতে পারছেন না, আর আপনি যা দেখছেন আপনার মা তা দেখতে পারছেন না। এমন হতে পারে আপনি এখন আর সেই ঘরের মধ্যে এমনকি বিছানার  মধ্যেও নেই , আপনি অন্য  কোথাও বিচরণ করছেন। কিন্তু আপনার মা সেই ঘরের মধ্যেই  বিছানায় বসে আছেন।আপনি যখন স্বপ্নের  জগতে বিচরণ করছেন, আপনার মা তখন বাস্তবে বিছানায় বসে আছেন, আর আপনি তখন বাস্তবে বিছানায় শুয়ে আছেন  । 

গতকাল যা ঘটে গেছে, আজ তা অলীক স্বপ্ন মাত্র।  স্বপ্ন আর অতীতের ঘটনার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যা ঘটে গেছে, তা তাকানকার মতো সত্য ছিল বটে, আর আর তা সত্য নেই।  কেননা এই ঘটনা আর কেউ দেখতে পারবে না। তো যে ঘটনা গত হয়ে গেছে, তা আজ যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়।  অতীত ঘটনা আর আজকের স্বপ্নের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এই অতীত ঘটনা শুধু রয়ে গেছে আপনার স্মৃতির মধ্যে, আপনার মনের মধ্যে। কি পার্থক্য আছে, এই বাস্তব গতকালের আর অবাস্তব গত কালের মধ্যে ? এই বাস্তব আর অবাস্তব যাই বলুন না কেন সবই এখন শুধু আপনার মনের মধ্যে স্মৃতি আঁকড়ে রয়ে গেছে। তাই সমস্ত অতীত অলীক স্বপ্ন বই কিছু নয়। ঠিক তেমনি ভবিষ্যতে যা ঘটবে, তাও আজকে দিনে দাঁড়িয়ে, স্বপ্ন বৈ  কিছু নয়। তাই এই অতীত ও ভবিষ্যৎ দুটোকেই অলীক বলে জানবেন। অতীত-ভবিষ্যৎ স্বপ্ন বই কিছু নয়। 

আর এই অতি ও বর্তমানের মাঝে আছে বর্তমান। এটাই অর্থবহ,  বর্তমানই আমাদের কাছে বাস্তব। আবার দেখুন আজকের এই দিন, আজকের এই ঘটনা, আগামীকাল অতীতের গর্ভে চলে যাবে। আজ ধীরে ধীরে  কালে পরিণত হচ্ছে। বর্তমান প্রতিমুহূর্তেই অতীত হয়ে যাচ্ছে। আবার ভবিষ্যতও  বর্তমানের মধ্য দিয়ে অতীতের গর্ভে চলে যাচ্ছে। যা ছিলো বাস্তব তা কেমন মুহূর্তের মধ্যে অলীক অতীত হয়ে যাচ্ছে।  আমাদের স্মৃতির মধ্যে চলে যাচ্ছে।  আমাদের মনের মধ্যে শুধু একটা ছবি  থেকে যাচ্ছে। তো অতীত যেমন অলীক, ভবিষ্যৎও তেমনি অলীক। কেবলমাত্র এক মুহূর্তের জন্য বর্তমানে  ভেসে  উঠছে, আবার অতীতের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, আমরা যাকে  বাস্তব বলি, তা আসলে মুহূর্তের খেলা মাত্র। এই আছে এই নেই। একেই হিন্দু শাস্ত্র বলছে মায়া। 

সত্য বা বাস্তব  তো তাই যা থেকে যায়। কি সেই বস্তু যা সব সময় থেকে যায় ? বাস্তব সত্য হচ্ছে সেই বস্তু যা সময়ের উর্দ্ধে কালের উর্দ্ধে। অবাস্তব হচ্ছে সেই ঘটনা বা বস্তু যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্হিত হয়ে যায়। অতীত সময়ের সঙ্গে মিলে  আছে বা মিলে গেছে । কিন্তু বর্তমানকে অস্বীকার করা, বর্তমানকে অবাস্তব ভাবা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। অতীতকে আপনি অলীক কল্পনা  বলে ভাবতে পারেন, ভবিষ্যৎকেও আপনি অলীক স্বপ্ন  বলে ভাবতে পারেন, কিন্তু বর্তমানকে আমাদের পক্ষে অবাস্তব বলে ভাবা সম্ভব নয়, অস্বীকার করাও সম্ভব নয় । আসলে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করছে বর্তমান। অতীত ও ভবিষ্যতের  মাঝে দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান। তো যার শুরু ও শেষ, অর্থাৎ  আগা-পাছা অবাস্তব তাকে আপনি বাস্তব বলে ভাবছেন ? যার শুরু অবাস্তব, যার শেষ অবাস্তব, তার মধ্যবর্তী অবস্থা কি করে বাস্তব হতে পারে ? আসলে বর্তমান আমাদের অভিজ্ঞতা, বর্তমান আমাদের অনুভূতি। এই বর্তমান আমাদের কাছে কিছুতেই কল্পনা মাত্র হতে পারে না ।  যেমন অতীত আমাদের কাছে এখন শুধু স্মৃতির বিষয়, ভবিষ্যৎ আমাদের স্বপ্নের বিষয়, বর্তমান কিন্তু  আমাদের কাছে প্রতক্ষ্য বিষয়, প্রতক্ষ্য জ্ঞান। তাই বর্তমানকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। বর্তমান কে আমরা বাস্তব ভাবছি। 

দেখুন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান অতীত হয়ে যাচ্ছে, আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যৎ বর্তমান হচ্ছে। এই যে সময়ের গতি একে  দেখছে  কে ? একে  দেখছেন আপনি। আপনিই  আসলে সময়ের সাক্ষী। আপনার সামনেই  সবকিছু ঘটছে। এই আপনি যিনি অভিজ্ঞতা নিচ্ছেন, যিনি ভবিষৎস্বপ্ন দেখছেন, যিনি অতীত স্মৃতি ধরে রাখছেন, তিনি হচ্ছেন আসল - একমাত্র তিনিই হচ্ছেন বাস্তব সত্য । আর সব মিথ্যা।  কেননা একমাত্র দ্রষ্টা আপনি  অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ এই তিন ক্ষেত্রেই উপস্থিত আছেন। এই "আমি" বা সাক্ষীকে আবিষ্কার করাই সমস্ত ধর্ম্মের মূল উদ্দেশ্য। দেখুন স্বপ্নের সময় আপনি আছেন, হতে পারে সব স্বপ্ন মিথ্যে কিন্তু যিনি স্বপ্ন দেখছেন সেই দ্রষ্টা  তিনি অসত্য নন । আবার দেখুন স্বপ্ন উদ্ভাসিত হবার জন্য একজন স্বপ্নদ্রষ্টার প্রয়োজন। স্বপ্নের দ্রষ্টা না থাকলে সেখানে কোনো স্বপ্নের উদ্ভবই  হতে পারে না। স্বপ্ন অবাস্তব হতে পারে, স্বপ্ন অসত্য হতে পারে, কিন্তু স্বপ্নের যিনি দ্রষ্টা অর্থাৎ সেই "আমি" কখনো স্বপ্ন হতে পারে না। এমনকি স্বপ্ন শেষ হয়ে গেলেও, এই আমির শেষ হয় না। এই যে আমি রূপ সাক্ষী একেইই খুঁজে নিতে হয় ধ্যানের  সাহায্যে। ধ্যানের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই অমিকে ধরা। 

একব্যক্তি একদিন স্বপ্ন দেখার গল্প বলছিলো, তার স্ত্রীকে।  বললো, আমি কালকে খুব একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছি।  তো স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, কি সেই  বাজে স্বপ্ন ? তো ভদ্রলোক বললো, দেখো, কাল রাতে আমি স্বপ্নে একটা বিয়েবাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিলাম। তো স্ত্রী বললো, তা খারাপ কি হলো ? ভদ্রলোক বললো, স্বপ্ন খারাপ কিছু ছিল না, কিন্তু যেই আমি খাবার মুখে দিতে যাবো, ঠিক সেই সময় আমার ঘুম ভেঙে গেলো। আসলে, আমরা প্রতিমুহূর্তেই অতীতে ঘোরাফেরা করি, আর আমাদের খারাপ লাগে। আমরা ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ঘুমিয়ে থাকি। আমরা সেই অন্ধকারের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকি।এই ভবিষ্যৎ স্বপ্নের মধ্যে ঘোরাফেরা করা, বা ভবিষ্যৎ স্বপ্নের মধ্যে বিভোর হওয়া আমাদের স্বভাবে পরিণত হয়ে গেছে। আর স্বপ্ন পুরন না হলে আমরা হতাশ হয়ে উঠি। আমাদের জেগে থাকতে হবে, যাতে ভবিষ্যতের স্বপ্ন আমাদের পেয়ে না বসে, আবার অতীতের স্মৃতির মধ্যে আমরা যেন ঘোরাফেরা না করি। আমাদের সজাগ থাকতে হবে। যা অতীত হয়ে গেছে তা যেন আপনাকে পেয়ে না বসে, আমাদের যেন হতাশ না করে । যা ভবিষ্যৎ তা অনিশ্চিত, তা যেন আমাদের নিরাশ না করে। 

একটা জিনিস জানবেন, প্রতি মুহূর্তে আপনার সামনে ভবিষ্যৎ বর্তমানের আকারে  এসে দেখা দেবে, আবার মুহূর্তের  মধ্যেই সেই বর্তমান অতীতের গর্ভে ঢুকে যাবে। ভবিষ্যৎ আপনাকে হতাশ করবে যদি আপনি বর্তমানে ঘুমিয়ে থাকেন। যদি আপনি সজাগ থাকেন, যদি আপনি ভবিষ্যৎকে হতাশায় পরিণত হতে না দিতে চান, তবে আপনি বর্তমানে সজাগ থাকুন। আপনি যদি বর্তমানে সজাগ থাকেন, তবে অতীত হারিয়ে যাবে। অতীত তো শুধু আপনার স্মৃতিতে ছিলো, একসময় আপনার স্মৃতি থেকে সেই  অতীত হারিয়ে যাবে। আর যখন আপনার মধ্যে থেকে অতীত মুছে যাবে, আপনার কাল্পনিক ভবিষ্যৎ  থাকবে না, তখন একটা ঝলক দেখা হবে আপনার মধ্যে। মেঘহীন স্বচ্ছ আকাশের উদয় হবে। একটা ধুম্রবিহীন অগ্নি শিখা প্রজ্বলিত হয়ে উঠবে। একেই বলে জ্ঞানের উন্মেষ। এখানে কেবলমাত্র সাক্ষীরূপে আপনি উপস্থিত। যেখানে আপনি থাকবেন না সেখানে কোনো ঘটনায় থাকতে পারে না। আর  কেবলমাত্র দ্রষ্টা আপনি হবেন  হবেন স্থায়ী  বাস্তব। অন্য সব মুছে যাবে, কেবল "আমি"  বর্তমান থাকবে। সময়ের স্রোতে আপনি যখন ডুব দেবেন, তখন আপনার উপরে দিয়ে ভবিষ্যৎ বর্তমানকে  ছুঁয়ে অতীতের দিকে ধাবিত হবে। আপনি শুধু সাক্ষী হয়ে বর্তমানে উপস্থিত থাকবেন। একটা জিনিস জানবেন, জগতে  কোনো কিছুই স্থির নয়, আসছে যাচ্ছে। এই আসা যাওয়ার মাঝে কেবল মুহূর্তের জন্য বর্তমানের রেখাকে ছুঁয়ে যায়, এই ঘটনার প্রবাহ। আপনি শুধু দ্রষ্টা, সজাগ দৃষ্টি রাখুন।  আপনি শুধু চেতন থাকুন। 

কিন্তু দুঃখের কথা হচ্ছে, আমরা অতীতের জালে আটক হয়ে যাই। যা হয়ে গেছে, যা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, তা আমাদের মনের মধ্যে থেকে যায়।  ঘটনা শেষ হয়ে গেছে।  আরো কোনোদিন সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটা সম্ভব নয়, তথাপি সেই অতীত, অতীতের ঘটনা আমাদের মনের মধ্যে হুল ফোটাতে থাকে। দূরের কোনো নক্ষত্রে কোনো বিপর্যয় ঘটলে, আমরা সেই ঘটনা পর্যবেক্ষন করি কয়েক বছর পরে। যা ঘটে গেছে, তার কোনো রেশ চলতে থাকে আমাদের মনের মধ্যে দিনের পর দিন। 

আপনার সামনে শুধু বর্তমান দৃশ্য আকারে থাকবে, এই বর্তমানকে পর্যবেক্ষন করতে গেলে আপনাকে সদা সজাগ থাকতে হবে। আপনি যদি শুধ বর্তমানে মনোযোগী থাকেন, তবে, ভবিষ্যৎ নিরাশ  করতে পারবে না। আপনি যদি বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তবে অতীত আপনার কিছুই করতে পারবে না। যা ঘটে গেছে, তা আপনাকে প্রভাবিত করতে পারবে না, কিন্তু যা ভবিষ্যতে ঘটতে  চলেছে, তা আপনাকে প্রভাবিত করতে পারে। বর্তমান একদিন অতীত হয়ে যাবেই। আবার ভবিষ্যৎও  বর্তমানের মধ্যে মুহূর্তের জন্য  দেখা দিয়ে অতীতের মধ্যে ঢুকে যাবে। পার্থক্য হচ্ছে আপনি ঘুমিয়ে আছেন, না জেগে আছেন। 

একটু গভীর ভাবে ভাবতে গেলে বুঝতে পারবেন,  বর্তমান বলে কিছু হয় না। কেননা বর্তমান সবসময় অস্থির, প্রবাহমান । বর্তমান   সবসময় সিনেমার ছবির  মতো সরে সরে যাচ্ছে। বর্তমান ক্ষণিক মাত্র দেখা দিয়ে উবে যাচ্ছে। আর আপনি ভবিষ্যতের  দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমরা সব সময় কিছু না কিছু দেখছি। আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকছি, তখনও দেখছি। কিন্তু একটা সময় আসে যখন আমরা আর কিছুই দেখি না। যখন আমরা সুসুপ্তিতে থাকি অর্থাৎ গভীর ঘুমে থাকি তখন আমরা কিছুই দেখতে পাই না।  আমরা যখন অচেতন থাকি তখন আমরা কিছুই অনুভব করতে পারি না। কিন্তু আমরা যদি চেতন থাকতে পারি, আর শরীর ঘুমুতে থাকে  অর্থাৎ তুরীয় অবস্থায় থাকি, তখন আমাদের কাছে সত্য উদ্ভাসিত হয়। তখন দ্রষ্টা ভিন্ন অন্য কেউ থাকে না। তখন শুধুই নিজেকেই  দেখতে থাকি।দ্রষ্টা দৃশ্য এক হয়ে যায়। একেই বলে সমাধির অবস্থা। 

আমরা যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনি, আমরা যখন যীশুখ্রিষ্টের কথা শুনি,  আমরা যখন ভগবান বুদ্ধের কথা শুনি, আমরা যখন ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা শুনি, তখন সেগুলো অসত্য। কেননা এগুলো আমাদের অনুভুতিতে আসে না।  আমরা যখন বুদ্ধকে চোখে দেখতে পাই, শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে পাই, তখন তা অসত্য। কেননা আমরা তখন ঘুমিয়ে থাকি।  কিন্তু আমরা যখন রামকৃষ্ণকে কথা অনুভব করি, আমরা যখন শ্রীকৃষ্ণের কথা অনুভব করি, আমরা যখন বুদ্ধের কথা অনুভব করি, তখন তা সত্য। এই শ্রীকৃষ্ণের কখনো জন্ম-মৃত্যু হয় না।  এই রামকৃষ্ণের কখনো জন্ম মৃত্যু হয় না।  এই খ্রিষ্টের কখনো জন্ম মৃত্যু হয় না। এখন একথা আমাদের বুঝতে হবে, আমাদের অনুভব করতে হবে, এই মুহূর্তে আপনি যা কিছু শুনছেন, দেখছেন, তা সত্য নয়।  কিন্তু আপনি যদি কিছু অনুভব করতে পারেন, তবে তা সত্য। আপনি কত শাস্ত্র পড়েছেন, আপনি কত শাস্ত্রবাক্য মুখস্ত করেছেন, সেটা বড়ো কথা নয়। আপনি কি অনুভব করতে পেরেছেন, সেটাই সত্য।   

ঘটনা আপনি যা দেখছেন, বা শুনছেন, তা সত্য  নয়। যা ঘটছে বলে আপনার মনে হচ্ছে, তা আসলে মুহূর্তের ঘটনার প্রবাহ মাত্র । এই ঘটনার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে মূল সত্য। আমাদের দুই ধরনের ঘুম আছে, একটা হচ্ছে আমাদের শরীর যখন ঘুমের মধ্যে আছে।  আর একটা হচ্ছে, আমাদের শরীর তো জেগে আছে, কিন্তু আমরা ঘুমিয়ে আছি। একটা রাতের ঘুম আর একটা দিনের ঘুম। যতক্ষন আপনার মনের মধ্যে চিন্তার বিলুপ্তি না হচ্ছে, ততক্ষন আপনার  চোখ বন্ধ।  যেদিন চিন্তার সম্পূর্ণ বিলোপ সাধন  হবে, সেইদিন আপনার চোখ খুলে যাবে। তাই ঠাকুর বলছেন, চৈতন্য হোক। এই চৈতন্য যেদিন জাগ্রত হবে, সেই দিন আপনি অন্য মানুষ হয়ে যাবেন। পুরাতন শেষ হয়ে যাবে, আপনি তখন  অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ  নিয়ে চিন্তা করতে যাবেন না, আর যা নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না তা আপনাকে হতাশ করতেওঁ পারবে না। আপনি সেই জগতে পৌঁছে যাবেন, যেখান না আছে মৃত্যু, না আছে জন্ম। অথচ সবকিছুই কেবল আছে। না আছে, পুরাতন, না আছে নতুন। আছে শুধু আনন্দ-আনন্দ-আনন্দ ।    

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

নিজের মধ্যে জ্ঞানের আলো  জ্বলে উঠুক

আমরা যেন সবাইকে ভালো করবার জন্য উঠে পরে লেগেছি। সবাইকেই আমাদের ভালো করতেই হবে।  না হলে জগৎ উচ্ছন্নে যাবে। মা-বাবা আমাদের ভালো করতে চাইছে, পাড়া প্রতিবেশীগণ  আমাদের ভালো করতে চাইছে, স্কুলের মাস্টার মশাই আমাদের ভালো করতে চাইছে। পাড়ার বয়স্ক লোকেরা আমাদের ভালো করতে চাইছে। পাড়ার মাস্তানরা আমাদের ভালো করতে চাইছে। পাড়ার  নেতারা আমাদের ভালো করতে চাইছে। রাষ্ট্রনেতারা আমাদের ভালো করতে চাইছে। সমাজকৰ্ম্মীরা আমাদের ভালো করতে চাইছে। সমাজবাদীরা আমাদের ভালো করতে চাইছে। সাম্ৰাজ্যবাদীরা আমাদের ভালো করতে চাইছে। ধর্ম্মীয় গুরুরা আমাদের ভালো করতে চাইছে।  আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, তাহলে কি আমি ভালো নেই ? সবাই আমাদের কানে উপদেশের বাণী শোনাচ্ছে। আমরা যেন ভালো থাকি। আর এর মধ্যে একসময় আমি ভাবি এরা  সবাই, যারা আমাদের ভালো করতে চাইছে, তারা সবাই  ভালো আছে তো ? নাকি এরা  সবাই রুগী, আর আমাদেরকেও এরা রুগী ভাবছে, বা রুগী বানাতে চাইছে  ?  

প্রচলিত একটা গল্প আছে আপনার শুনে থাকবেন। গল্পটা আরো একবার শুনুন। একটা হৃষ্টপুষ্ট কুকুর ছিল। তো তার হৃষ্টপুষ্ট চেহারা আর গলার গম্ভীর আওয়াজ বলে সে কুকুরের সর্দার  বোনে গেলো। সারা শহরের কুকুররাই তাকে মান্য  করে চলে। সে নিজে চিৎকার করে না, কিন্তু সারা শহরের কুকুর কারনে অকারনে চিৎকার করে।  আর এতেকরে সর্দার কুকুরের রাতের ঘুম নষ্ট হয়। একদিন সমস্ত কুকুরকে ডেকে সে বললো, দেখো তোমাদের নির্বুদ্ধিতার কারনে, কারনে অকারনে ঘেউ ঘেউ করবার জন্য, তোমাদের  উন্নতি হচ্ছে না। অহেতুক চিৎকার করে, তোমরা তোমাদের শক্তি ক্ষয় করছো। একটা চোর যাচ্ছে, তোমরা চিৎকার করছো, একটা পুলিশ যাচ্ছে  তোমরা চিৎকার করছো, একটা পোস্টম্যান যাচ্ছে তোমরা চিৎকার করছো, একটা সাধু যাচ্ছে তোমরা চিৎকার  করছো। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, তোমরা সবাই একত্রে চিৎকার করছো, যেন তোমরা সব বিপ্লবীর দল। কি চাও তোমরা ? তোমরা কি সবাইকে ভালো করতে চাইছো ? এইসব পুলিশ, চোর, সাধু, পোস্টম্যান, এরা কি তোমার কথায় আসে, না যায়, যে এদের দেখে তোমার সবাই মিলে তারস্বরে চিৎকার করছো। অহেতুক কেন নিজের শক্তি ক্ষয় করছো ? একটা জিনিস জানবে, এরা  কেউ তোমাদের পাত্তাই  দেয়  না। তোমাদের চিৎকারে কি এদের আসা-যাওয়া বন্ধ  হয়েছে, না হবে। এবার থেকে তোমরা এসব বন্ধ করো।  চুপচাপ নিজের কাজ করো। অহেতুক শক্তিক্ষয় বন্ধ করো। এইভাবে যদি তোমরা তোমাদের শক্তিক্ষয় না করতে তাহলে আজ এই কুকুর-জাতি সমগ্র বিশ্বকে জয় করতে পারতো । এইভাবে অকারনে শক্তিক্ষয় না করে সৃজনশীল কর্ম্মে মনোযোগ দাও।  নিজের খাদ্য সংগ্রহ করো, নিজের সন্তানদের প্রতি লক্ষ রাখো। এই ঘেউ ঘেউ করা বন্ধ করো। দেখো, কুকুরের চিন্তাধারা খুবই উন্নত। এরা  প্রভুভক্ত। এরা  পরোপকারী। কিন্তু অকারনে চিৎকার করা এদের অভ্যাস। আর এই অভ্যাসের ফলেই, সে নানান বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে। চিৎকার করে তোমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছো। সেই সকাল থেকে তোমরা চিৎকার করা শুরু করো, আর সারা রাত  ধরে তোমাদের চিৎকার চলছে।  কিন্তু এতে কি কোনো পরিবর্তন হচ্ছে ? চোর-পুলিশ-সাধুর আসা যাওয়া কি বন্ধ হয়েছে  দেখতে পাচ্ছ ? যাদের দিকে তাকিয়ে তুমি চিৎকার করছো, তারা সবাই কিন্তু তাদের কাজ করেই চলেছে।  এতটুকু পরিবর্তন হচ্ছে কি ? 

কুকুরগুলো ভাবছে, সর্দার তো কথাগুলো ঠিকই বলছে। চিৎকার করে আমাদের ক্ষতিই হচ্ছে। আমাদের শক্তি ক্ষয় হচ্ছে।  কি করবো, ঘেউ ঘেউ করা আমাদের স্বভাব। আমরা কুকুর বৈ তো নয়। আমাদের চরিত্রের মধ্যেই ঘেউ ঘেউ করবার প্রবৃত্তি রয়ে গেছে। একে  ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। 

তো একদিন তারা ঠিক করলো, আজ সর্দার কুকুরের জন্মদিন। আজ আমরা কেউ চিৎকার করবো না। তো সবাই রাতের অন্ধকারে কুন্ডলি পাকিয়ে যে-যার ডেরায় চুপচাপ শুয়ে থাকলো। এটা তাদের পক্ষে, অর্থাৎ  চিৎকার না করে থাকা, কুকুদের পক্ষে খুব কঠিন কাজ, তাদের স্বভাব বিরুদ্ধ । এটা সেই ধ্যানের মতো।  ধ্যানে  করতে বসলেই, সারা রাজ্যের চিন্তা মাথায় এসে বসে। যারা সব সময় চিৎকার করে, তাদের পক্ষে চুপচাপ বসে থাকা একরকম অসম্ভব ব্যাপার। কুকুরগুলো সাধু নয়, এরা সাধারণ কুকুর। কিন্তু কুকুর এখন চোখ বুজে দাঁতে-দাঁত চেপে শুয়ে রইলো যাতে সে কিছু দেখতে না পায় । ভাবলো, একদিন বৈ-তো নয়। 

 তো আজ রাতে চারিদিকে শুনশান।  কোনো কুকুরের টু শব্দটি শোনা যাচ্ছে না। নিঃঝুম সেই রাতে সর্দার কুকুর বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। শহর ঘুরে দেখতে লাগলো। সে বিভ্রান্ত হয়ে গেলো। একটা কুকুরেরও দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। মনে মনে ভাবলো,এখন সে কাকে শিক্ষা দেবে ? কি শিক্ষা দেবে ? চারিদিক নিস্তব্ধ। মধ্যরাত্রি পেরিয়ে গেলো। ধীরে ধীরে তার মধ্যে একটা অস্বস্তি শুরু হলো। হলো টা কি ? সে কখনো ভাবেনি, যে কুকুরেরা তার কথা শুনবে। সে জানতো এরা কখনো শিষ্টাচার শিখবে না।  কারন এরা  সবাই কুকুর। এদের স্বভাবই হচ্ছে চিৎকার করা। কিন্তু সত্য হচ্ছে, কুকুরগুলো আজ শান্ত হয়ে গেছে। এখন সে কুকুরগুলোকে আর কি শেখাবে ? এখন সে কাদের নেতৃত্ত্ব দেবে ? এই প্রথম সে উপলব্ধি করলো, যে তার মধ্যে একটা শক্তি জাগ্রত হয়েছে। নিঃশব্দ রাত্রিতে তার মধ্যে একটা শক্তি জাগ্রত হয়েছে। এখন কোনো চোরকে দেখা যাচ্ছে, পুলিশকে দেখা যাচ্ছে না, সাধুকে দেখা যাচ্ছে না, পোস্টম্যানকে দেখা যাচ্ছে না।  তথাপি তার  ভিতর থেকে চিৎকার করতে ইচ্ছে করলো।  ঘেউ ঘেউ করতে ইচ্ছে করলো। আর এই ভাবনা থেকেই সর্দারকুকুর চিৎকার জুড়ে দিলো। ঘেউ-ঘেউ-ঘেউ। আর যখন সে ডাক শুরু করলো, তখন অন্য সমস্ত কুকুর দেখলো, তাহলে আমরা কেন চুপচাপ বসে থাকবো ? আমরা স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে কেন কষ্ট  পাবো ? সারা শহর জুড়ে তখন কুকুরের ঘেউ ঘেউ কর্কশ-ধ্বনি বেজে উঠলো।  সারা শহর  যেন গভীর রাতে জেগে উঠলো।

কুকুরগুলো তখন সর্দারের কাছে এলো। বললো, মূর্খ কেন তুমি আমাদের বলেছিলে চুপ থাকতে ? কেন তুমি বলেছিলে, যে আমরা যদি চুপ থাকি, তবে আমরা সারা পৃথিবী জয় করতে পারবো ? আমাদের পৃথিবী জয়ের প্রয়াসকে কেন বন্ধ করে দিলে ? সর্দার শান্ত হলো, বিমর্ষ হলো, আর সব কুকুরগুলো আবার চিৎকার জুড়ে দিলো। 

মনে রাখবেন, সবাই আমাদের ভালো করতে চাইছে, যা আসলে অসম্ভব। কিন্তু এই অসম্ভবকে সবাই সম্ভব করতে চাইছে। আপনি যখন অন্যের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করবেন, অন্যের ভালো করবার জন্য উদগ্রীব হবেন, আপনি নিজের সমস্যার সমাধানের কথা ভুলে যাবেন। আগে নিজের সমস্যা বুঝবার চেষ্টা করুন। নিজের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করুন। নিজেকে শোধরাতে চেষ্টা করুন। নিজেকে ভালো করবার চেষ্টা করুন। কেননা এটাই আপনার প্রাথমিক ও প্রধান কাজ। 

নিজের জমিতে চাষ শুরু করুন। ফাঁকা মাঠে বীজ ছাড়াবেন না। তাহলে বীজ পাখিতে খেয়ে যাবে। আগে নিজের জমিতে চাষ শুরু করুন।  বীজ বোনার পরে, মাটি দিয়ে ঢেকে দিন।  জমির চারি পার্শে বেড়া দিয়ে দিন। আর অপেক্ষা করুন। অন্যের জমিতে বীজ বুনতে যাবেন না।  অন্যের সমস্যায় নাক গলাতে যাবেন না।  অন্যকে ভালো করতে যাবেন না। অন্যকে পরিবর্তন করতে যাবেন না। নিজেকে পরিবর্তন করুন। আর এই কাজটি অন্য কেউ করে দিতে পারবে না।  আপনাকেই আপনার পরিবর্তন করতে হবে। জগৎকে শোধরাতে যাবেন না।  নিজেকে শোধরান। এই কথাগুলো যতদিন আমাদের হৃদয়ঙ্গম না হবে, ততদিন সময়ের অপব্যবহার হবে। নিজের ঘরে প্রদীপ জ্বালুন। নিজের ঘরকে আলোকিত করুন। আপনার ঘরে যখন আলো  জ্বলে উঠবে, দেখবেন, তখন সবাই আপনার কাছ থেকে আলো  নিতে আসবে। তখন হাজার প্রদীপ জ্বলে উঠবে। আপনার  ঘর আলোকিত হলে, আপনার পাড়া আলোকিত হবে, আপনার গ্রাম আলোকিত হবে, আপনার দেশ আলোকিত হবে। অন্যের ঘরে আলো জ্বালার আগে, নিজের ঘরে আলো  জ্বালুন। নিজেকে আলোকিত করুন। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

-------------------                  

                             

  


   

  

         

                



 

         



 

           

                      









  

Sunday 20 February 2022

কোথা থেকে আসে জীব, কোথা চলে যায় ? ছান্দোগ্য উপনিষদ - ষষ্ঠ অধ্যায় (CHANDOGYA UPANISHAD 6TH CHAPTER)


ছান্দোগ্য উপনিষদ - ষষ্ঠ অধ্যায়  (CHANDOGYA UPANISHAD 6TH CHAPTER)

কোথা থেকে আসে জীব, কোথা চলে যায় ?  জীবাত্মা  বারবার, বহুবার জন্ম গ্রহণ করে, বারবার দেহে থেকে দেহান্তরে পরিভ্রমন  করে।  

ছান্দোগ্য উপনিষদে ঋষি উদ্দালক বলছেন " সর্বাঃ প্রজা সত আগম্য ন বিদুঃ সত আগচ্ছামহে ইতি" .  সমস্ত প্রজা অর্থাৎ জীবসকল, জানে না যে সে  সৎ অর্থাৎ ব্রহ্ম থেকে  এসেছে।"   

জীবকুল দুটো আশ্চার্য্য জিনিস নিয়ে দৌড়োচ্ছে। একটাকে সে ধরে রাখতে চাইছে, আর  একটাকে সে ছেড়ে দিতে চাইছে। কিন্তু ফল হচ্ছে উল্টো।  যাকে সে ধরে রাখতে চাইছে, তাকে ধরে রাখতে পারছে না। আর যাকে সে ছেড়ে দিতে চাইছে, তাকে সে ছাড়তে পারছে না। মানুষ জীবনকে ধরে রাখতে চাইছে, আর মৃত্যুকে কে ছেড়ে দিতে চাইছে। মানুষ সুখকে ধরে রাখতে চাইছে আর দুঃখকে ছেড়ে দিতে চাইছে। কিন্তু ফল হচ্ছে উল্টো, মানুষ মৃত্যুর কাছে হার স্বীকার করছে একদিন।  মানুষ দুঃখকে নিয়েই চলতে বাধ্য হচ্ছে। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার, যাকে  আমি চাইছি না, সে আমাকে ছাড়ছে  না, যাকে  আমি চাইছি সে আমার সাথে থাকছে না।     

 জীবন একটা যজ্ঞ। আমরা জানি মানুষের বেঁচে থাকবার প্রাথমিক শর্তই র হচ্ছে প্রাণের প্রবাহ, প্রাণশক্তি । কিন্তু আমাদের বাকশক্তি, শ্রবনশক্তি, এমনকি মনঃশক্তি সবাই গুরুত্ত্বপূর্ন।  আমাদের পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়। এছাড়া আছে মন যাকে  বলা হয় অন্তরিন্দ্রিয়। কেউ যদি জীবনে সাফল্য পেতে চান, মনুষ্য জীবনকে সার্থক করতে চান, অর্থাৎ  আধ্যাত্মিক উন্নতি করতে চান তবে তাকে  যজ্ঞ করতে হবে। আর এই যজ্ঞে, বাক হচ্ছে সমিধকাষ্ঠ। এইবাক্শক্তিকে প্রথমে প্রজ্জ্বলিত করতে হবে। বাকই পুরুষের শক্তি। এর পরে,  প্রাণ হচ্ছে এই যজ্ঞের ধুম।  অর্থাৎ অগ্নি থেকে যেমন ধুম নির্গত হয়, তেমনি মুখ দিয়ে (মৃত্যুকালে) প্রাণবায়ু নির্গত হয়। এরপরে, জিহ্বা হচ্ছে যজ্ঞের শিখা।  জিহ্বার রঙ লাল অগ্নিশিখার রঙও লাল। চক্ষু হচ্ছে অঙ্গার। কর্ন হচ্ছে স্ফুলিঙ্গ। আর অগ্নি হচ্ছে স্বয়ং নারী-মাতা । দেবগন এই অগ্নিরূপ নারীতে শুক্রের আহুতি দেন। সেই আহুতি থেকেই গর্ভ সঞ্চার হয়ে থাকে। জরায়ু দ্বারা আবৃত এই গর্ভ নয় মাস দশ দিন বা যতদিন আবশ্যক ততদিন মাতৃজঠরে বাস করার পরে জন্ম গ্রহণ করে থাকে। সন্তান জন্ম গ্রহণ ক'রে যতদিন আয়ু থাকে ততদিন সে জীবিত থাকে তারপর নির্দিষ্ট সময়ে কর্ম্মফল অনুযায়ী নির্দিষ্ট লোক লাভের  জন্য দেহ ত্যাগ করে থাকে। এর পরে দেহের অন্তেষ্টির জন্য, তাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হয়, যে অগ্নি থেকে সে এসেছে। সেখানেই সতার  নির্বাণ প্রাপ্তি হয় । 

সৃষ্টির পূর্বে : একটা দিন ছিল, যেদিন আমি আপনি ছিলাম না। আবার এমন একদিন আসবে যেদিন আমি আপনি থাকবো না। এমনকি একটা দিন ছিল, যেদিন এই পৃথিবীতে কোনো প্রাণের সঞ্চার হয়নি। এমনকি পৃথিবীর আজকের যে আকার, সেই আকারেও পৃথিবী ছিলো না। এমনও হতে পারে, এমন একদিন ছিল, যেদিন পৃথিবীটাই ছিল না। তো যদি কিছু নাই থেকে থাকে তবে কোথা থেকে এলো এই সব ? এইসব কথা শুধু আমাদের কল্পনা নয়, এগুলো বৈজ্ঞানিক সত্য, যে একসময় প্রাণিকুল ছিল না, একসময় পৃবীটাই ছিল না। কিন্তু তাহলে তো প্রশ্ন জাগে এল  কোথা থেকে।  কিভাবেই বা এলো ? 

মহাত্মাগণ বলছেন, শূন্য থেকে কিছু সৃষ্টি হতে পারে না। এটা আমাদের অভিজ্ঞতা লব্ধ বাস্তব  জ্ঞানও বটে যে শূন্য থেকে কিছু সৃষ্টি হতে পারে না  । বেদান্ত বলছে, এই জগৎ আগেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে, কিন্তু এই আকারে ছিল না, আবার ভবিষ্যতে এই আকারে থাকবেও  না। বেদান্তের এই কথাটাও আমাদের বিশ্বাস করতেই  হয়, কেননা আজ যে জগতের আকার আমার চোখের সামনে ভাসছে, কাল সেই আকারে জগৎ ছিল না।  প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে জগতের আকার পাল্টাচ্ছে। আর আমরা সবাই এই ধারাবাহিক পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে পরিবর্তিত আকারে নিয়ে চলেছি। 

ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছে, সেই সৎ-পুরুষ  সংকল্প করলেন, আমি বহু হবো। এর পরে তিনি তেজ সৃষ্টি করলেন, তেজ থেকে জল উৎপন্ন হলো। এখন কথা হচ্ছে এই সৎ-পুরুষ  কে ?  শাস্ত্র বলছে, এই সৎ-পুরুষ  হচ্ছেন  একটা অপরিবর্তনীয় অবিনাশী সত্ত্বা যার নাম দেওয়া হয়েছে ব্রহ্ম। তো ব্রহ্ম চিন্তা করলেন, সংকল্প করলেন, আমি বহু হবো। এর পর তেজ বা অগ্নির সৃষ্টি হলো। অগ্নি থেকে আবার জলের সৃষ্টি হলো। কিন্তু কথা হচ্ছে, ব্রহ্ম চিন্তা করলেন।  তো কে চিন্তা করতে পারে, যার মধ্যে চেতনা আছে। তাহলে কি ব্রহ্ম মানে একটা চেতন সত্ত্বা।  আবার  এই চেতন সত্ত্বা থেকে যা সৃষ্টি হলো অর্থাৎ তেজ বা জল এরা  তো চেতন সত্ত্বা নয়। উপনিষদ বলছে, ব্রহ্ম শুধু চেতন নয়, শুদ্ধ চৈতন্য। আর শুদ্ধ চৈতন্য থেকে যাকিছু এসেছে, সবই চেতনা সম্পন্ন। তাই অগ্নি, জল, অন্ন বা পৃথিবী সবই চেতনা সম্পন্ন। এই কথাটা আমাদের বোধগম্য নয়। অগ্নির মধ্যে, বা বায়ুর মধ্যে, পৃথিবীর মধ্যে চেতনা শক্তি আছে, এটা  আমাদের বোধের বাইরে। এই ব্যাপারে আমরা ধীরে ধীরে বুঝবার চেষ্টা করবো। 

যাইহোক,  প্রাণীর জন্মের  মধ্যে তিনটি প্রকার দেখতে পাওয়া যায় অর্থাৎ তিন ভাবে প্রাণীর জন্ম হয়ে থাকে। এক হচ্ছে বীজ থেকে অর্থাৎ উদ্ভিদ, দ্বিতীয়  হচ্ছে ডিম্ থেকে  অর্থাৎ অন্ডজ, আর একটা হচ্ছে  জীবজ অর্থাৎ মাতার জরায়ু থেকে। উপনিষদ একটা অদ্ভুত কথা বলছে।  বলছে, রূপ হচ্ছে তিন রঙের খেলা। লাল, সাদা, ও কালো। সাদা হচ্ছে জল, লাল হচ্ছে অগ্নি, আর কালো হচ্ছে প্রথিবী। এই তিন দেবতাকে বলা হয় মহাভূত। এখন ভূত বলতে  আমরা জানি, পাঁচটি। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। বাকি দুটো  আসলে মরুৎ হচ্ছে গতিশক্তি , আর ব্যোম হচ্ছে আশ্রয় স্থল । 

আমারা জানি, খাদ্যই আমাদের দেহ ও মনকে পুষ্টি যোগাচ্ছে। বেদান্ত এই দুটোকেই (দেহ-মন) জড়পদার্থ বলে থাকে। আমরা যে খাবার খাই, তা আমাদের শরীরে গিয়ে নানাভাবে শরীরকে পুষ্ট  করে থাকে। এরমধ্যে যে স্থূল অংশ আছে, তা আমাদের মল আকারে বাইরে বেরিয়ে যায়। সুক্ষ অংশ থেকে মাংস ইত্যাদি তৈরী হয়, আর সূক্ষ্মতম অংশ থেকে মন তৈরী হয়। মন কাজ করে হিতা নামক স্নায়ুতন্ত্রের ভেতর দিয়ে। তাই অন্ন বা খাদ্য ছাড়া আমরা কেউই  বাঁচতে পারি না। 

আবার জল যা আমরা গ্রহণ করছি,  তার স্থূলতম অংশ শরীরের বর্জ্য পদার্থকে বহন করে মূত্রের আকারে বেরিয়ে যাচ্ছে।  আর সূক্ষতম অংশ রক্তে পরিণত হচ্ছে। আর জলের সূক্ষ্মতর অংশ প্রাণ বা প্রাণবায়ুতে রূপান্তরিত হয়। তাই  জল ছাড়াও  আমরা বাঁচতে পারি না। 

আবার আমরা যখন তেজস্কর খাদ্য যেমন ঘি, মাখন ইত্যাদি খাবার খাই তা আমাদের শরীরে গিয়ে তিন ভাবে ভাগ হয়ে যায়।  স্থূল অংশ দিয়ে তৈরী হয় হাড়, মধ্যম অংশ  দিয়ে তৈরী হয় মজ্জা আর সূক্ষ্মতম অংশ দিয়ে তৈরী হয় আমাদের বাক। তো শরীর ও মন আমাদের খাদ্য দ্বারা পুষ্টি লাভ করে, প্রাণ বায়ুর দ্বারা পুষ্ট বা গতিশীল  হয়, এবং বাক পুষ্টি লাভ করে তেজের দ্বারা। 

উপনিষদে এই কথাগুলো একটা একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো হয়েছে। 

 আমরা জানি দধিকে যদি মন্থন করা হয়, তবে তার সূক্ষ্ম অংশ উপরে উঠে আসে যাকে  আমরা বলি মাখন।  ঠিক তেমনি খাদ্যের সূক্ষ্মতম অংশ যখন উপরে উঠে আসে, তখন তাকে বলা হয় মন। আবার আমরা যে জল পান করি, তার সূক্ষ্মতম অংশ উপরে উঠে আসে, তাকে বলা হয় প্রাণ। আবার আমরা যখন তেজস্কর পদার্থ খাই, তার সূক্ষতম অংশ উপরে উঠে আসে, তাকে বলা হয় বাক। 

 আমরা জানি মানুষের শরীরে ষোলোটি কলা আছে। খাবার না খেলে শরীরের ১৫টি  কলাই  স্তিমিত হয়ে যায়।   কেউ যদি আহার না করে, অথচ শুধু জল পান করে তবে তার সহজে প্রাণবিয়োগ হয় না ঠিকই  কিন্তু এইসময় শরীর ও মন স্তিমিত হয়ে যায়। এইসময় আমাদের কোনো কাজ করবার শক্তি এমনকি জ্ঞান সংগ্রহ করবার শক্তি থাকে না।  এইসময় যদি কাউকে বেদ অধ্যায়ন   করতে বলা হয়, তবে সে বলবে, আমার কিছুই মনে থাকছে না। কোনো কাজ করতে বললে, বলবে আমার শরীর কাজ করতে পারছে না। 

 দেখো, বিশাল প্রজ্বলিত অগ্নি থেকে  একখন্ড স্ফুলিঙ্গ নিয়ে তার দ্বারা কোনো বস্তু দাহ করা যায় না। কিন্তু যদি সেই অগ্নিতে আবার কিছু জ্বালানি দেওয়া হয়, তবে আবার সেই আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে। পনের দিন না খেয়ে থাকলে, অর্থাৎ শরীরে যদি ইন্ধন না দেওয়া হয়, তবে শরীর -মন কাজ করতে পারে না। কিন্তু যদি তুমি আবার আহার করো, তবে তোমার শরীর-মন আবার ক্রিয়াশক্তি ফিরে পাবে। এমনকি যে সামান্য অগ্নির স্ফুলিঙ্গ নিয়ে যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা হয়েছে, তা কিন্তু জ্বালানির প্রভাবে আগের থেকে বেশি শক্তিশালীও হয়ে উঠতে পারে। এবং আগের  থেকে আরো বেশি কাজও  করা যেতে পায়ে। 

তো ইন্ধন না জোগালে যেমন অগ্নি নিভে যায়, তেমনি শরীর-মনকে খাদ্য না দিলে শরীর মন কাজ করতে পারে না। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। 

এখন কথা হচ্ছে, সারা জীবন ধরেই আমরা খেয়েই চলেছি । কিন্তু পেটের  ক্ষিদে আমাদের মেটে  না। এমনকি শরীরও একটা বয়সের পড়ে যতই খাই না কেন, শরীর  আর  বাড়ছে না।  হয়তো সারা জীবনে আমরা  কয়েক হাজার কিলোগ্রাম খাদ্য খেয়েছি। কিন্তু আমার শরীর সেই ৬০/৬৫ কিলোর বেশি আর হলো কৈ ? আবার তৃষ্ণাও আমাদের মেটে না সারা জীবনে যে কত পরিমান জল খেয়েছি, তার হিসেবে কে রাখে ?  কিন্তু তথাপি ক্ষুধা তৃষ্ণার ফিরে ফিরে আসে। এর কারন কি ? এর কারন হচ্ছে, এই খাবার যেখান থেকে এসেছিলো, সেখানেই চলে গেছে। আগে যা খেয়েছি, জল সেসব বহন করে যথা স্থানে নিয়ে গেছে। আমরা যাকিছু খাবার খেয়েছি, তা মধ্যে থেকে সামান্যই এই শরীরে থাকছে, বাকিটা জল বহন করে নিয়ে যথা স্থানে রেখে দিচ্ছে। ফলে মানুষের আবার ক্ষুধা  পাচ্ছে। তো এই দেহ অন্ন-জল দ্বারা তৈরী। এর যে কোনো  এটিকে বাদ  দিলে আমাদের দেহ বিনষ্ট হয়ে যাবে। তো খাদ্য-জল হচ্ছে দেহের প্রধান  উৎস। আবার খাদ্যকে জল বহন করে যথাস্থানে নিয়ে বলেই আমাদের ক্ষুধা পায়। 

এখন কথা হচ্ছে, আমরা জানি মানুষের তৃষ্ণা পায়। অর্থাৎ আমাদের জল পান করতে হয়।   তো তৃষ্ণা কখন পায় ? মানুষের শরীরে যে জল ছিল তা যদি অগ্নি বা তেজ বহন  করে নিয়ে যায়, তবেই আমাদের তৃষ্ণা পায় । অর্থাৎ সে যে জল পান করেছিলো, তা যখন তেজ বহন করে যথা স্থানে নিয়ে যায়, তখন তার তৃষ্ণা পায় । 

তো খাদ্যকে  নিয়ে যাচ্ছে জল, আবার জলকে নিয়ে যাচ্ছে তেজ। তো এই তেজের উৎসে আমরা যদি যেতে পারি, তবে একটা সৎ বস্তুর সন্ধান পেতে পারি, আর সেই সৎ বস্তুকে আশ্রয় করেই স্থিত হচ্ছে  এই দেহ।

দেখুন, আমাদের যখন মৃত্যু হয়, তখন প্রথমে আমাদের খাদ্য গ্রহণের স্পৃহা কমে যায় আর ধীরে ধীরে আমাদের বাক শক্তি লোপ পায়, অর্থাৎ বাকশক্তি মনঃশক্তিতে লয় হয়ে হয়। বাকশক্তি মনের মধ্যে মিশে গেলেও, আমরা কথা বলতে না পারলেও, আমরা কিন্তু তখন চিন্তা অর্থাৎ মনের যা কাজ তা চলতে থাকে।  অর্থাৎ আমাদের তখনও চিন্তা শক্তির লোপ পায়  না। এইসময় মনে হয়, তিনি কিছু বলতে চাইছেন, কিন্তু বাকশক্তির স্বল্পতে হেতু, কিছুই বলতে পারছেন না। আবার, ধীরে ধীরে এই মনের ক্রিয়াও  একসময় থেমে  যায়। কিন্তু মন কার সঙ্গে লয় হয় ? মন প্রাণের সঙ্গে লয় হয়। অর্থাৎ বাকশক্তি ও মনঃশক্তির নাশ হলেও, মানুষের শ্বাস প্রশ্বাস চলতে থাকে। একসময় এই শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এই শ্বাসপ্রশ্বাস অর্থাৎ যার শক্তিতে আমাদের শরীরের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার দেখা যাচ্ছিলো, সেই প্রাণশক্তি কোথায় যায় ? সেই প্রাণশক্তি তখন তেজঃশক্তির সঙ্গে মিলিয়ে যায়। এই তেজশক্তি হচ্ছে আমাদের শরীরের উত্তাপ। আমরা জানি শরীর  যতক্ষন গরম থাকে ততক্ষন তাকে মৃত বলা যায় না। এইজন্য দেখবেন, মৃত্যু আসন্ন দেখলে, ডাক্তারবাবু এই তেজঃশক্তিকে ধরে রাখবার জন্য, কোরামিন ইনজেকশন দিয়ে থাকেন।, যাতে শরীরের উত্তাপশক্তি মিলিয়ে না যায়। শরীর ঠান্ডা হয়ে গেলে সব শেষ। অর্থাৎ তখন জীবাত্মা সেই সৎস্বরূপে অর্থাৎ নিজের সঙ্গেই   মিলিত হয়ে গেছেন। 

এখন কথা হচ্ছে, আমাদের মধ্যে ভিন্নতা কেন দেখা যায় ?  মৌমাছিরা গাছে গাছে ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করছে। আমের মুকুল,  সর্ষের ফুল, গোলাপফুল, রজনীগন্ধা, শিউলি ফুল, সবার কাছ থেকে মধু সংগ্রহ করছে।    এই যে গাছ থেকে মধু বা রস যখন মৌমাছির চাকে সঞ্চয় হচ্ছে, তখন আর মধুর মধ্যে গাছের ভিন্নতা লক্ষিত হয় না। মধুর মধ্যে কোনো  পার্থক্য থাকে না।  অর্থাৎ একফোটা মধুর মধ্যে কোন্ কোন্ গাছের রস মিশ্রিত হয়ে আছে, তাকে আর আলাদা করা যায় না। মধুর মধ্যেও  পৃথক অস্তিত্ত্ব বোধ, আমি অমুক গাছের বা ফুলের রস, তুমি অমুক গাছের বা ফুলের রস, সেই বোধ  আর থাকে না। 

আমরা যখন নিদ্রামগ্ন থাকি, আমরা যখন স্বপ্নের জগতে থাকি, তখন আমরা না জানি কতকিছু দেখি, কতকিছু খাই, কতকিছু সংগ্রহ করি, কিন্তু নিদ্রা ভেঙে গেলেই আবার যে ভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সেই ভাবেই ফিরে আসি। একদিক  থেকে দেখতে গেলে, আমাদের মৃত্যু যেন গভীর  নিদ্রা, আমরা বার বার গভীর নিদ্রাতে মগ্ন থাকি, অর্থাৎ বারবার মারা যাই, আবার ফিরে ফিরে আসি, অর্থাৎ আবার জন্ম গ্রহণ করে থাকি। যদিও আত্মজ্ঞান লাভ হলে আমাদের আর পৃথিবীতে অর্থাৎ এই মৃত্যুপুরীতে আর ফিরে আসতে  হয় না। তবে কতজনেরই বা সেই সৌভাগ্য হয়ে থাকে। 

ঋষি উদ্দালক তার পুত্র/শিষ্য শ্বেতকেতুকে বলছেন, তুমিই সেই।  "তৎ ত্বম্ অসি".  উপনিষদের এই বাণী আমরা বহুবার শুনেছি। কিন্তু এই মহাবাক্যের উপলব্ধি আসে কৈ ? আসলে বহু দিনের সাধনার ফলে, বহু বছরের কঠোর সাধনার ফলে,  আমাদের  যখন চিত্ত শুদ্ধি হয়, যেদিন আমাদের মধ্যে থেকে অহংবুদ্ধি মুছে যায়, সেদিন আমাদের মনটা স্বচ্ছ হয়। তখন এই পরিষ্কার আয়নায় আমরা নিজেকে দেখতে পারি, আমরা বুঝতে পারি আমি কে। তখন এই ঋষিবাক্য "তৎ ত্বম্ অসি".কথার অর্থ ধরতে পারি। 

পাহাড় থেকে কত নদীর জন্ম হয়। সবাই একদিন সমুদ্রে মিশে যায়।  তার আর আলাদা   নাম বা রূপ বলে কিছুই থাকে না। সমুদ্রে লিন হয়ে যায়।  কিন্তু যতদিন না সে সমুদ্রে মিলিত না হচ্ছে, ততদিন তার নাম বা রূপ আলাদা আলাদাই  থাকে। কখনো গঙ্গা, কখনো যমুনা, কখনো সরস্বতী, নর্মদা, মহানন্দা ইত্যাদি ইত্যাদি। জীবাত্মা দেহ ছেড়ে চলে গেলে দেহের নাশ হয়, কিন্তু জীবাত্মার মৃত্যু হয় না। 

 ধরো তুমি কোনো একটা কাজ অসমাপ্ত  রেখে ঘুমিয়ে পড়েছো।  ঘুমের সময় তোমার সেই কাজটির কথা মনেই  ছিল না। কিন্তু ঘুম ভাঙার পরেই তোমার সেই কাজটির কথা আবার মনে পরবে । আর যেখানে কাজটি শেষ করেছিলে, তোমাকে সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। তাই জীব সকল বারবার জন্মায়। তার কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য জন্মায়, বা অসমাপ্ত কাজ শেষ করবার জন্য ।  আবার সে নতুন কর্ম্মফল  সঞ্চয় করে দেহত্যাগ করে।  কিন্তু আত্মার কোনো পরিবর্তন হয় না। 

দেখো বীজের মধ্যেই আছে সেই বিশাল বৃক্ষ ।  কিন্তু সেই বীজের মধ্যে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেই গাছ তুমি খুঁজে পাবে না। ঋষি উদ্দালক পুত্র শ্বেতকেতুকে বলছেন, আমার কথায় তুমি শ্রদ্ধাবান হও আর বিশ্বাস করো যে তোমার মধ্যেই আছে ঈশ্বররূপ বীজ অর্থাৎ জীবাত্মা। শরীরের মধ্যে তন্ন তন্ন করে খুঁজে কিন্তু আমরা এই জীবাত্মাকে খুঁজে পাবো না। তথাপি জানবে তোমার মধ্যেই সেই জীবাত্মা অবস্থান করছেন। এখন কথা হচ্ছে, তাহলে আমরা কিভাবে সেই জীবাত্মাকে খুঁজে পাবো ? মহাত্মাগণ বলছেন, আত্মাই একমাত্র সত্য। এই ধ্রুববাক্যকে আগে দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করো। মনের মধ্যে গেঁথে নাও, যে আত্মাই একমাত্র সত্য। এবার মনকে এই ভাবনার মধ্যে সংযম করো। সংযত মনে তখন সত্য নিজেকে প্রকাশ করবে।  শাস্ত্রের সূক্ষ্মতত্ত্ব তখন তোমার কাছে ধরা পড়বে। আমরা যখন আন্তরিকভাবে কোনো বিষয়ে আগ্রহী হই , যখন আন্তরিকভাবে কোনো কিছুতে জানতে চাই, তখন মনটা বিভিন্ন দিকে ছোটাছুটি না করে, সেই বিষয়ের দিকে ধাবিত হয়। 

সমস্ত কিছুর মধ্যে যে সূক্ষ্ম তত্ত্ব তাকেই বলে আত্মতত্ত্ব। আবার এই সূক্ষ্ম তত্ত্ব-ই আত্মা। 

উদ্দালক বলছেন, একখন্ড লবন জলে রেখে দাও। এবার অপেক্ষা করো। এবার জল থেকে লবণকে তুলে নিয়ে এসো।  শ্বেতকেতু জলের মধ্যে লবণকে খুঁজে পেলেন না।  উদ্দালক বললেন, জল  পান করো।  কেমন লাগছে ? শ্বেতকেতু বললেন, লবনাক্ত। তো দেখো, জলের মধ্যে লবনের অস্তিত্ত্ব খুঁজে না পেলেও, তুমি জানো  যে জলের মধ্যে লবন আছে।  তেমনি শরীরের মধ্যে আত্মাকে খুঁজে না পেলেও জানবে আত্মা আছে। এখন কথা হচ্ছে, জলের লবনাক্ত ভাব আমাদের জিভ  টের পায়। তাই তুমি এটাকে সহজে বিশ্বাস করতে পারছো, যে জলের মধ্যে লবন আছে। কিন্তু আত্মা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তাই ইন্দ্রিয়শক্তি দিয়ে, একে  উপলব্ধি করতে পারবে না। আমাদের ইন্দ্রিয়শক্তির একটা সিমাবদ্ধতা আছে। ইন্দ্রিয়ক্ষমতা আত্মার অস্তিত্ত্ব সম্পর্কে কোনো উপলব্ধি দিতে পারে না।  

এই আত্মাকে জানতে গেলে আমাদের আপেক্ষিক জগতের উর্দ্ধে উঠতে হবে। আমরা অজ্ঞ আমরা অন্ধ এই আপেক্ষিক জগৎ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা  নেই। এইজন্য দরকার এমন একজন ঋষিপুরুষ যাঁর  এই আপেক্ষিক জগতের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, সেই ঋষিপুরুষ আমরা পাবো কি করে ? কোথায় পাবো তার সন্ধান ? আর এই মহাপুরুষ কেমন করে আমাদের সেই জগতের সন্ধান দেবেন ? 

উপনিষদ বলছে, কর্ম্মফল, আমাদের প্রারব্ধ কর্ম্মফল এই সুযোগ এনে দিতে পারে। আমাদের প্রারব্ধ কর্ম্মই আমাদের তাঁর কাছে টেনে নিতে পারে। এই ঈশ্বরপুরুষগন সর্বদা অপরের কল্যাণের জন্য বা লোক-হিতার্থে কর্ম্মে লিপ্ত থাকেন।  ঠাকুর রামকৃষ্ণের কাছে সে-যুগের সবাই যেতে পারেনি।  যারা গিয়েছিলেন, তারাও  সবাই যে তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন, এমন কথা বলা যায় না। শ্রীকৃষ্ণকে সেযুগের সবাই চিনতে পারেন নি। গুটিকয় মানুষই তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন। আজও শোনা  যায়, নর্মদার তীরে, পাহাড়ের জঙ্গলে, অনেক মহাপুরুষ আছেন, যাদের কাজই হচ্ছে লোক কল্যাণ। 

যাইহোক, আমরা আগেই শুনেছি, আত্মা থেকে তেজ, তেজ থেকে প্রাণ, প্রাণ থেকে মন, আর মন থেকে বাকের উৎপন্ন হয়েছে। আবার এগুলো বিপরীত মুখী হয়ে অর্থাৎ বাকশক্তি মনের মধ্যে, মনঃশক্তি প্রাণে, প্রাণশক্তি তেজে, তেজঃশক্তি আত্মাতে ফিরে যায়। এই হচ্ছে জন্ম মৃত্যুর চক্র। 

আমরা একজন মরণাপন্ন মানুষের গতি দেখলেই বুঝতে পারবো, যখন  সে রোগগ্রস্থ হয়, তখন সে শরীরের যে ইন্ধন অর্থাৎ অন্ন গ্রহণ করতে অনীহা প্রকাশ করে, অথবা অন্ন গ্রহণে অপারগ হয়ে যায়। পাশে কোনো আত্মীয়স্বজন থাকলে তাকে চিনতে পারে না, কথা বলতে পারে না, শেষে শরীর ঠান্ডা হতে শুরু করে। একসময় আত্মা দেহ ছেড়ে অনন্তের পথে যাত্রা  করে। বাসনা পূরণের জন্য, সংকল্প পূরণের জন্য, আমাদের দেহের দরকার পড়ে।  কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে যখন শরীর অকেজো হয়ে যায়, বাসনা পূরণের অযোগ্য হয়ে যায়, অথবা আমাদের বাসনার পূরণ হয়ে যায়, তখন আমরা দেহ ছেড়ে নিজভূমিতে চলে যাই। 

সবশেষে একটা কথা বলি, বুঝুন আর না বুঝুন, উপলব্ধি করতে পারেন আর না পারেন, ভারতের মুনি-ঋষিদের এই কথাটা শুধু বিশ্বাস করুন যে আমরা সবাই মূলতঃ এক সেই আত্মা, আমরা কেউ আত্মা থেকে ভিন্ন নোই।  আমাদের সবার মধ্যেই সেই একই আত্মা বিরাজ করছেন।  শুধু এই চিন্তাই করতে থাকুন, এই কথাটার মনন করতে থাকুন, দেখবেন একসময় আপনার জীবনে একটা আমূল পরিবর্তন হয়ে যাবে। তখন সবার প্রতি একটা গভীর ভালোবাসা জাগ্রত হবে, সবাইকে ক্ষমা করতে কোনো দ্বিধা আসবে না, কারুর প্রতি কোনো রাগ, দ্বেষ হিংসা থাকবে না। দুদিনের এই জীবন - এতো স্বপ্ন বই কিঁছু নয়। এই  স্বপ্নের ঘোর কেটে গেলে আমরা সেই পরমাত্মাতেই ফিরে যাবো। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।          

 মানুষের আসা যাওয়া  

 


  

      


  












পশুর দেহে কি মনুষ থাকতে পারে ?


পশুর দেহে  কি মানুষ থাকতে পারে ?

মনুষ্য দেহ ধারন করবার পরেও, আমাদের অনেকের মধ্যে থেকে পশুবৃত্তি লোপ পায়নি। আর  এটা আমরা প্রতিদিন মানুষের আচরণ দেখলেই ধরতে পারি। কিন্তু পশুর মধ্যে কি কখনো মানুষের বৃত্তি দেখতে পাওয়া যায় ?  আমরা মহাভারতের গল্পে পড়েছি, মানুষ বা দেবতাগণ নাকি কখনো কখনো মানুষের দেহ প্রাপ্ত হন, আবার মানুষ কখনো কখনো  পশুর দেহ প্রাপ্ত হন । রাজা ভরত নাকি  হরিণ হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। ভাগবতে আছে, কুবের পুত্র নলকুবর ও মণিগ্রীব, নারদের সাথে অসম্মানজনক ব্যবহার  করবার ফলে, এই দুজন গাছ হয়ে জন্মেছিলেন। শেষে শিশু ভগবান  শ্রীকৃষ্ণের হাতে তাদের উদ্ধ্বার হয়েছিল। আবার  আমরা অনেক সময় দেখেছি, কোনো কোনো পশু বা বৃক্ষ মনুষ্যেতর ভিন্ন  দেহে অবস্থান করেও, তাদের মধ্যে উচ্চভাবের লক্ষণ প্রকাশ পায়। হরিনাম সংকীর্তনের  আসরে অনেক সময় কুকুর এসে, চুপচাপ বসে থাকে। এইযে পশু হয়েও, মানুষের বিভিন্ন ধর্ম্মকর্ম্মে নিজেকে নিযুক্ত করা, এর মধ্যে কি কোনো কারন আছে, নাকি এগুলো আমাদের নিতান্তই ভ্রম দর্শন ? 

আমাদের বাড়িতে দুটো বিড়াল আছে, একটা কুকুর আছে ।  যাদেরকে আমার স্ত্রী খুবই যত্ন আত্তি করে থাকে। ধনীর ঘরে কুকুরের যত্ন দেখলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন । কি না খেতে দিচ্ছে তাকে। প্রতিদিন তার জন্য সুস্বাদু পুষ্টিকর খাবার চাই। কতই না আদরে রাখা হয়েছে  এই কুকুরগুলোকে।    আবার কুকুরের জন্য, নিয়মিত ডাক্তার আসেন বাড়িতে। যা ভারতের বেশিরভাগ শিশুর কপালে জোটে না। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, এরা মানুষের সন্তানের চেয়ে  অনেক বেশি পুণ্যবান, ভাগ্যবান। আমার ভাবতে অবাক লাগে, এরা  মানুষের ভাষা বোঝে। আমি অনেক সাধু সন্ন্যাসীদের দেখেছি, পশুদের সাথে মানুষের মতো আচরণ করতে।  তাদের সাথে কথা বলছেন, তাদের আদরযত্ন করছেন। এই পশুগুলোও সাধুর নির্দেশ উঠছে বসছে।  এমনকি এরা সাধারণ  মানুষের নির্দেশেও  কাজ করে থাকে ।  এমনকি মানুষের  বিপদে আপদে এরা রক্ষকের কাজ করে থাকে।  আমরা বরং এদেরকে মাঝে মধ্যে বুঝতে পারি না।

 আপনারা সেই সাপ ও বেজীর গল্পটা জানেন।  এক দম্পতি  একটা ছোট্ট  বেজী পুষেছিলো । বেজীটা খুবই উপকারী  ছিলো। ওই দম্পতির একটি শিশুপুত্র ছিল। তো একদিন ঘুমন্ত  শিশুপুত্রের ঘরে যখন একটা সাপ শিশুটিকে ঘিরে ধরে, তখন বেজীটি সাপটিকে মেরে শিশুটিকে রক্ষা করে। দম্পতি বেজিটিকে শিশুর ঘর থেকে হাত-মুখে  রক্তমাখা অবস্থায় বেরিয়ে আসতে  দেখে, রাগের চোটে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে, বেজিকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে।  আর ঘরের মধ্যে এসে যখন দেখে তার শিশু পুত্রের কাছে খন্ড-খন্ড সাপের দেহ, তখন তারা আপসোস করতে থাকে। তো আমরা সবসময় পশুদের বুঝতে পারি না। তাই আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, পশুর মধ্যেও  কি মানুষ  আছে ?   

মহাত্মাগণ বলছেন, এই প্রশ্নের উত্তর বুঝতে গেলে, আমাদের জীবের বা প্রকৃতির ক্রমবিকাশের ধারাকে বুঝতে হবে। আমাদের শাস্ত্রে আছে, চুরাশি লক্ষ যোনি ভ্রমনের পরে, জীবের মনুষ্য দেহ প্রাপ্তি হয়ে থাকে । এটি আসলে সৃষ্টির ক্রমবিকাশের ধারা। এর সঙ্গে আমাদের কর্ম্মের কোনো সম্পর্ক নেই। বস্তু থেকে ভাইরাস, ভাইরাস  থেকে এককোষী প্রাণী।  এককোষী থেকে বহুকোষী প্রাণী। ধীরে  ধীরে মনুষ্য দেহ ধারণ। এই যে প্রক্রিয়া, এটি প্রকৃতির স্বাভাবিক বিবর্তনের নিয়মেই ঘটে থাকে।  মনুষ্যদেহ যেমন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, যৌবন থেকে প্রৌঢ়, প্রৌঢ় থেকে বার্ধক্য পৌঁছে যায়, এর সঙ্গে কর্ম্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ঠিক  তেমনি এই প্রকৃতির ক্রমবিকাশের ধারা অনুযায়ী স্থাবর থেকে জঙ্গম, জঙ্গম থেকে অধিক বিকাশশীল জীবের উৎপত্তি, যার পরিণতি আজ মনুষ্য দেহ। এমনও হতে পারে, পৃথিবীর বাইরে যদি কোথাও জীবন প্রকাশের খেলা চলে, তবে  সেখানে মানুষের থেকেও আরো উন্নত ধরনের  জীব অন্যগ্রহে বিরাজ করতে পারে। কেননা প্রকৃতির বিকাশের কোনো সীমা থাকতে পারে না। আসলে কোটি কোটি বছর ধরে, প্রকৃতির মধ্যে এই  বিবর্তন ক্রিয়া চলছে।  আর প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রকৃতি বিকশিত হচ্ছে।

আমরা পঞ্চকোষের কথা শুনেছি।  অর্থাৎ অনন্ময়, প্রাণময়, মনোময় কোষ, বিজ্ঞানময় কোষ, ও আনন্দময় কোষ, এদের কথা আমরা শুনেছি । বলা হয়ে থাকে, পঞ্চকোষের সমষ্টি  এই মনুষ্যদেহ। এর মধ্যে অনন্ময়, প্রাণময়, ও মনোময় দেহ পার্থিব।  আর বিজ্ঞানময় ও  আনন্দময় দেহ অপার্থিব। আবার অন্য দিক থেকে দেখতে গেলে দেহ তিন প্রকার। স্থুল,  সূক্ষ্ম,  ও কারন। এই যে স্থুল  ও সূক্ষ্ম দেহ এরা পরিবর্তনশীল। কিন্তু কারনদেহ অপরিবর্তনীয়। এই যে দেহের পরিবর্তন এর কারন দ্বিবিধ।  এক প্রকৃতিজাত, আর একটি কর্ম্ম বা চিন্তাপ্রসূত কর্ম্মজাত। আমরা যে শিশু  থেকে বৃদ্ধ হচ্ছি, তা প্রকৃতি জাত।  আবার আমরা যে অজ্ঞানী থেকে জ্ঞানী হচ্ছি, আমরা যে নিরানন্দ থেকে আনন্দের মধ্যে প্রবেশ করছি, তা আমাদের চিন্তাজাত কর্ম্ম প্রসূত।    

প্রকৃতির রাজ্যে, অনন্ময় কোষের বিকাশের পরে, প্রাণময় কোষের বিকাশ হয়। অনন্ময় কোষ অর্থাৎ যে শরীর অন্নদ্বারা পুষ্টি লাভ করে। আবার প্রাণময় কোষ যা প্রাণবায়ুর দ্বারা পুষ্টি  লাভ করে থাকে। এইসময় পর্যন্ত, অর্থাৎ একটা সময় ছিল, যখন  মনোময় কোষের আবির্ভাব হয়নি। প্রাণময় কোষের পরে, মনোময় কোষের বিকাশ হতে শুরু করে। আর এই মনোময় কোষের  ক্রমবিকাশের ফলে, ধীরে ধীরে অনন্ত প্রকার বৈচিত্র সংগঠিত হতে থাকে, যাকে  আমরা মনের ক্রিয়া বলে থাকি ।  মনোময় কোষ হওয়ার পর, একদিকে যেমন মনের আবির্ভাব হয়, তেমনি কর্ম্মের অধিকার জন্মে। মনোময় কোষের নিচে যে স্তরগুলো আছে, তার  কোনো কর্ম্মসত্তা নেই। এইজন্য পশু দেহে কর্ম্মের প্রভাব নেই। কর্ম্মের জন্য এদের অধোগতি বা উর্দ্ধগতি লাভ হয় না। এইজন্য হরিণ, গরু, ছাগল ঘাসপাতা খায় বলে,  হিংসা করে না বলে তাদের পুন্য সঞ্চয় হচ্ছে এমনটা নয়।  আবার হিংস্র বাঘ-সিংহ, হিংসা করে বলে, তাদের পাপ হবে এমনটাও  নয়। যাদের মনোময় দেহ নেই, তাদের প্রকৃতির অভিব্যক্তি অনুসারে অগ্রগতি সম্পন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু মনোময় কোষে কর্ম্মের প্রভাব থাকার দরুন, প্রাকৃতিক স্বাভাবিক অভিব্যক্তিকে, কর্ম্ম এসে বাধা দেয়। এই মনোময় কোষ বৈচিত্রপূর্ণ হয়ে থাকে। মানুষের মধ্যে মনোময় কোষের প্রাধান্য হেতু, মানুষ নিজের কর্ম্ম প্রভাবে অধোগতি বা উর্দ্ধগতি লাভ করতে  পারে। এই অবস্থায় কর্তৃত্বাভিমান থাকে, এবং কর্ম্মফল ভোগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে থাকে। 

সুতরাং কর্ম্ম অনুসারে, এবং মৃত্যুকালীন চিন্তার প্রভাবে কেউ মনুষ্য দেহ থেকে পশুপাখির দেহ অর্থাৎ  আদি যোনিতে জন্ম গ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ  দেবতা বা পশু যোনিতে জন্ম গ্রহণ করতে পারে। একেই বলে কর্ম্মজাত দেহ লাভ। এইজন্য যে আত্মসত্তাকে   আমরা কুকুরের শরীরে দেখছি, বা পশুর শরীরে দেখছি, এমনকি যাকে  আমরা মানুষের শরীরে দেখছি, সে আসলে মানুষ না পশু তা নির্ণয় করা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। এইজন্য শরীর দেখে, কে মহাপুরুষ, আর কে পশুসুলভ চরিত্র তা নির্ণয় করতে যাবেন না। এরা, যাদের আপনি আজ পশু দেখছেন, তাদের মধ্যে এমন কেউ থাকতে পারে যিনি কর্ম্মজাত, আবার কেউ থাকতে পারে যিনি প্রকৃতিজাত। মনুষ্য-জন্মের কর্ম্ম প্রভাবে বা অন্তিমকালের চিন্তা অনুসারে, সে এই  দেহ প্রাপ্ত হয়েছে। এই কর্ম্মজাত যে শরীর এরা মৃত্যুর পরে, আবার মনুষ্যদেহ ধারণ করবে, বা স্বমহিমায় ফিরে যাবে। এই দেহ আসলে প্রকৃতির ক্রমবিকাশের ধারা অনুযায়ী অনুসৃত নয়। এই অধোগতি বা উর্দ্ধগতি প্রকৃত অর্থে  প্রকৃতির নিয়মের বাইরে ঘটে  থাকে। অথবা বলা যেতে পরে, এটা  প্রকৃতির নিয়ম বহির্ভূত হলেও, প্রকৃতির মধ্যে ইটা ঘটে থাকে । 

প্রকৃতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যে শুদ্ধতত্বের উদয় হয়, সেটাই আসল অভিব্যক্তি। এর থেকেই মনোময় কোষ ভেদ হয়ে যায়। আর যে নতুন কোষের জন্ম হয়, তাকে বলে বিজ্ঞানময়কোষ। বিজ্ঞানময় কোষে কর্ম্ম থাকে না। মহাত্মাগণ বলছেন, মানুষকে লক্ষ-লক্ষ বছর এই মনোময় কোষে অবস্থান করতে হয়। 

 তাই বলা হয়ে থাকে, এইযে বাহ্যজগতে যা কিছু আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, তাতে তার সঠিক স্বরূপ প্রকাশিত নয়। একটা কুকুর, বা একটা গাছ, বা একটা মানুষ - যে দেহ ধারণ করে আছে, সেই দেহ তার প্রকৃতি লব্ধ  হতেও পারে,আবার তার কর্ম্ম জনিত কারণেও হতে পারে। প্রকৃতির ক্রমবিকাশের নিয়মে যে দেহ প্রাপ্তি হয়, তা স্বাভাবিক। কিন্তু কর্ম্মজনিত যে দেহ তা তার উপার্জিত ধন। কর্ম্ম অনুযায়ী দেহত্যাগের পর পুনরায় মনুষ্যদেহে প্রত্যাগমন করে, ও  প্রকৃতির বিকাশ অনুসারে গতিলাভ করে,বলা যেতে পারে। 

এখন কথা হচ্ছে, এই দেহের স্বরূপকে কি চেনা যায় ? অর্থাৎ কে আসলে কি, সেটা কি বোঝা যায় ? যায়, তবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়।  কেননা আমরা জীবাত্মাকে দেহের অতিরিক্ত কিছু অনুমান করতে সক্ষম নোই।  কিন্তু যারা যোগী পুরুষ, জ্ঞানী পুরুষ তারা জীবসত্ত্বাকে চিহ্নিত করতে পারেন।  তাই দেখবেন, যোগীপুরুষ কাউকে কাছে টেনে নেন, হতে পারে সে পশুর দেহধারী, আবার কাউকে দূরে সরিয়ে  দেন, হতে পরে সে মনুষ্যদেহ ধারী। এমনকি আমাদের মতো সাধারণ  মানুষও অনেক সময় আমাদের থার্ড-সেন্স দিয়ে বুঝতে পারি, লোকটা ভালো কি মন্দ। আবার কোনো-কোনো পশুকে আমরা ঘরের মধ্যে আশ্রয় দিয়ে থাকি। এর কারন হচ্ছে, এদের সঙ্গে কোথাও যেন একটা সাদৃশ্য অনুভব হয় নিজের মধ্যে।  অথবা এদের প্রতি যেন একটা করুনার উদ্রেগ  হয়। এর কারণই হচ্ছে, আমাদের সূক্ষদৃষ্টি বলে দিচ্ছে, একে কাছে টান, বা একে দূর করে দাও। তবে একথা ঠিক, কর্ম্মফল ভোগান্তে এরা  আবার প্রকৃতির কোলে ফিরে যাবে, এবং প্রকৃতি প্রদত্ত শরীর ফিরে পাবে। জ্ঞানীর চোখে  এসব ধরা পড়ে ।

এইযে ভোগজনিত দেহ সেখানে যার যে স্বাভাবিক কোষ অর্থাৎ মনোময় কোষ এটি দেবদেহেও থাকে আবার মনুষ্য ও পশু-পাখির দেহেও থাকে কিন্তু থাকে একটু অন্তরালে। যে স্তরে এরা  বাস করে, সেই স্তরের অন্তরালে, পূর্বজন্মের স্বাভাবিক  সত্তাটা অভিব্যক্ত থাকে। কিন্তু প্রাকৃতিক কারনে যাদের মধ্যে মনোময় কোষের জন্ম হয়নি, তাদের সম্পর্কে এই কথা খাটে না। 

যাইহোক, মনুষ্য শরীর মাত্রেই বিজ্ঞানময় কোষের  বিকাশ  আছে, এমনটা নাও হতে পারে। তবে মনোময় কোষ অবশ্য়ই আছে। তবে সবার মনোময় কোষের বিকাশও সবার ক্ষেত্রে  সমান হয় না ।  আবার পশু মাত্রেই মনোময় কোষ নেই তা নয়। তবে তার বিকাশ নানান করনে সুপ্ত থাকতে পারে। 

সবশেষে বলি, ধর্ম্মরাজ একসময় কুকুরের বেশে যুধিষ্ঠিরকে স্বর্গের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কাউকেই অবহেলা করা একদম উচিত নয়। কার মধ্যে কে বাস করছে, কে বলতে পারে ?  

-ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি  ওম।