Sunday 28 May 2023

ঈশ উপনিষদ

ঈশ উপনিষদ 

- শশাঙ্ক শেখর শান্তি ধাম -


ঈশ উপনিষদ 

মঙ্গলাচরণ মন্ত্র :
ওঁ পূর্ণমদ  পূর্ণমিদং  পূর্ণাৎ  পূর্ণমুদচ্যতে
পূর্ণস্য  পূর্ণমাদায়  পূর্ণমেবাবশিষ্যতে। 
ওঁ শান্তিঃ  শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওঁং 

 ওঁ - পরমআত্মার  নাম বিশেষ 
পূর্ণমদঃ - পূর্নম-অদঃ - সর্বব্যাপী সেই 
পূর্ণমিদং - পূর্নম-ইদং - অনন্ত এই  
পূর্ণাৎ - পূর্ণ  থেকে 
পূর্ণমুদচ্যতে - পূর্ণম -উদচ্যতে - দৃশ্যমান জগৎরূপে প্রকাশিত হয়েছেন। 

পূর্ণস্য - পূর্ণের  
পূর্ণমাদায় - পূর্ণম -আদায়  - পূর্ণকে সরিয়ে দেওয়া হয় 
 পূর্ণমেবাবশিষ্যতে - পূর্ণমেব-অবশিষ্যতে - পূর্ণই অবশিষ্ট থাকে। 

এখানে পূর্ণ  কথাটা দিয়ে একদিকে পরমব্রহ্মকে বোঝানো হচ্ছে, আবার জগৎরূপ ব্রহ্মকে বোঝানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এই ব্রহ্ম অনন্ত, আবার এই জগৎরূপ ব্রহ্মও অনন্ত। এখন পরমব্রহ্ম থেকে যদি জগৎরূপ ব্রহ্মকে সরিয়ে নেওয়া হয়, তবে সেই অনন্ত ব্রহ্মই থাকেন। কারন হচ্ছে, জগৎরূপ যে ব্রহ্ম  তা সেই পরমব্রহ্ম-এর উপর আরোপ করা হয়েছে। 
এখানে দুটো শব্দ খুব গুরুত্বপূর্ণ - অদঃ ও ইদং -  উহা ও ইহা। একটা শিশু যখন জন্ম গ্রহণ করে তখন দুটো জ্ঞানেন্দ্রিয় প্রথমে সক্রিয় হয়, একটা হচ্ছে চোখ, আর একটা হচ্ছে কান। আর এর ফলে তার কাছে দুটো জিনিস স্পষ্ট হতে থাকে, একটা হচ্ছে শব্দ আর একটা হচ্ছে দৃশ্য। আর এই দুয়ের মাধ্যমে সে বহির্জগৎ সম্পর্কে সতর্ক হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে তার বাকি তিনটি জ্ঞানেন্দ্রিয় সজাগ হতে শুরু করে, অর্থাৎ নাসিকা, জিহবা ও ত্বক। আর এই পাঁচ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সে বাহির জগতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। কিন্তু এই যে জগৎ-দর্শন তা হয়ে ওঠে জানলার ছিদ্র দিয়ে বিশ্বজগৎ দর্শনেই মতো। এর দ্বারা সে সমগ্র জগতের দর্শন সে পায়  না। এই যে বহির্জগৎ একে  উপনিষদ "ইদম" শব্দটি দিয়ে বুঝিয়েছেন। ইদম অর্থাৎ ইহা। এটি স্থান, কাল, পাত্র সমন্বিত একটা নিয়ত পরিবর্তনশীল বস্তু বা জগতের প্রতীক। কিন্তু এই যে ইদম যা আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এর পিছনে আছে আরো এক জ্ঞান।  এই জ্ঞান ইন্দ্রিয়লব্ধ নয়। একেই বলা হচ্ছে অদঃ বা ঐ অর্থাৎ যা দূরে রয়েছে। আবার দেখুন ঐ  এবং এই দুটো শব্দ একটি আরেকটির উপরে নির্ভরশীল। এই দুটোকে আলাদা করা যায় না। ঐ - যা দূরে রয়েছে, তাকে আমি ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করতে পারছি না, তাই সেই দূরের অপরিবর্তনশীল বস্তুকে জ্ঞানাতীত  বলা হয়।  আসলে "এই" হচ্ছে কার্য্য আর "ঐ" হচ্ছে কারন। একটা দৃশ্য, আর একটা অদৃশ্য,একটা অভিজ্ঞতালব্ধ, আর একটা অভিজ্ঞতার বাইরে। ব্রহ্ম-এর পূর্ণ থেকেই জগতের পূর্নতা এসেছে।  

তিনবার শান্তিঃ  উচ্চারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের সকলের ত্রিবিধ (আধ্যাত্মিক - শারীরিক ও মানসিক, আধিদৈবিক - পরিবেশ ও প্রাকৃতিক, আধিভৌতিক - হিংস্র জীব-জন্তু থেকে যে বিঘ্ন) শান্তিঃ  হোক। 

আয়নায় প্রতিফলিত যে রূপ, জলের পাত্রে সূর্য্যের যে প্রতিচ্ছবি, এগুলো ততক্ষন সত্য যতক্ষন আকাশের সূর্য বা প্রতিফলনকারীর অবস্থান আয়নার উপরে থাকে। আয়না  সরে গেলে,  সূর্য্যের কোনো ক্ষয় বা বৃদ্ধিকিছুই হয় না। তেমনি এই যে জগৎ এটি পরমব্রহ্ম-এর  প্রতিফলন মাত্র। জগৎ নির্বাপিত হয়ে গেলেও, সেই অনন্ত সর্বব্যাপী নিত্য ব্রহ্মস্বরূপের কোনো পরিবর্তন হয় না। 

----------------------
ঈশ উপনিষদ

ঈশ উপনিষদ আসলে শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতার সবশেষ অধ্যায় (৪০-তম) থেকে নেওয়া। শুক্ল যজুর্বেদ আসলে কর্ম্মকান্ড নিয়ে আলোচনা।  কিন্তু এই অধ্যায়ে অর্থাৎ একদম শেষ (৪০) অধ্যায়ে এসে জ্ঞানের কথা বলা হচ্ছে। ঈশ  উপনিষদে মোট ১৮টি শ্লোক। কিন্তু শুক্ল যজুর্বেদের এই অধ্যায়ে  ১৭-টি শ্লোক আছে।  এর সঙ্গে আরো একটা শ্লোক যোগ করে মোট ১৮টি শ্লোক নিয়ে ঈশ উপনিষদ। আমরা শুধু এই শ্লোকগুলোর যথার্থ অর্থ এবং আমাদের জ্ঞানাকাশে  মন্ত্রের যে চিত্র ফুটে উঠছে, সেই দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবো। তাঁর কথা শুনবো, সেই ঈশ্বরের কথা শুনবো, যা কেবল আমাদের চিদাকাশে দৃশ্যমান হচ্ছে । 

ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎকিঞ্চিৎ জগত্যাং জগৎ। 
তেন  ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম।  (শ্লোক-১)

ঈশা বাস্যমিদং সর্বং  - ঈশ্বর কর্তৃক আচ্ছাদিত এই সবকিছু 
যৎকিঞ্চিৎ জগত্যাং জগৎ। - জগতের  মধ্যে যা কিছু জগৎ 
তেন  ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা - তাকে ত্যাগের দ্বারা পালন করো 
মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম।  - কারুর ধনের প্রতি লোভ করো না। 

এই সবকিছু  (জগৎ - অর্থাৎ যা কিছু দেখছো) ঈশ্বরের দ্বারা অভিব্যাপ্ত হয়েছে। এঁকে  নিষ্কাম ভাবের দ্বারা সেবন করো। কোনও ধনের প্রতি লালসা করো না। 

জগৎ প্রপঞ্চময়। এই আছে এই নেই।  জগৎ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। এই জগৎ এক মুহূর্তের জন্যও কোনো কিছুকেই  এক অবস্থায় ধরে রাখতে পারে না।  কিন্তু এই জগৎ যিনি ধরে রেখেছেন, তিনি অবিচল, অপরিবর্তনীয়, পরমেশ্বর। তিনিই এই জগতের সমস্ত কিছুর আশ্রয়। আমাদের  এই স্থূল দেহের প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে।  একদিন আমরা সবাই শিশু ছিলাম, ধীরে ধীরে আমরা কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে চলেছি।  কিন্তু যে আমি শিশুকালে ছিলাম, যৌবনেও সেই আমিই আছি।  আমার কোনো পরিবর্তন নেই। আজ আমি বৃদ্ধ হয়েছি, এখনো সেই আমিই আছি।  একদিন এই দেহের নাশ হবে, একসময় এই দেহ অগ্নিতে পুড়ে ছাই  হয়ে যাবে, বা কবরের মধ্যে গলে পচে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে, কিন্তু আমি থাকবো। এই সত্যকে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে।  এই দেহের প্রতি আমাদের আসক্তি ত্যাগ করতে হবে। অনিত্য বস্তুর প্রতি আমাদের আকর্ষণ ত্যাগ করতে হবে, আসক্তি ত্যাগ করতে হবে, বস্তুর প্রতি আমাদের লোভ-লালসা ত্যাগ করতে হবে। জগতের সমস্ত কিছুর মধ্যে একটা সত্য নিহিত আছে, যা অপরিবর্তনীয়, যা নিত্য, আর তাকেই উপনিষদ বলছে ব্রহ্ম। এই যে দৃশ্যমান জগৎ  একদিন ব্রহ্ম থেকেই এসেছিলো, ব্রহ্মতেই স্থিত আছে, আবার ব্রহ্মতেই ফিরে যাবে।  এই সত্য আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। আসক্তি, মোহ, মমতা সব একদিন দূর হয়ে যাবে - কারন যখন বস্তু আর এই আকারে থাকবে না, সেইদিন সেই বস্তুর প্রতি আমাদের আকর্ষণও শেষ হয়ে যাবে। তবে বস্তুর পরিণতি সম্পর্কে যদি সম্যক জ্ঞানের  উপলব্ধি থাকে, তবে এই আসক্তি, লোভ, মোহ এক্ষুনি দূর হয়ে যাবে। 
বুদ্ধদেবের আশ্রমে একজন শিষ্য দীর্ঘ দিন  একই এলাকায় ভিক্ষে করতে যেত। আর একই এলাকায় তার ভিক্ষেসামগ্রীর  প্রাপ্তি  দিন দিন কমে যেতে লাগলো।  বুদ্ধদেব লক্ষ করলেন, ছেলেটি বিমর্ষ হয়ে সারাদিন বসে থাকে। খবর নিতেই  জানতে পারলেন , ওই এলাকায় একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছে সে। তো ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করতেই সে তা স্বীকার করলো। কিন্তু বুদ্ধদেব বললেন, তুমি যার  প্রেমে পড়েছো, সে তো অনিত্য, আজ আছে কাল নেই। হে শিষ্য, আত্মস্থ হও।  আত্মার সাথে সম্পর্ক জোড়ো। কিন্তু যুবক এসব কথার অর্থ কিছুই বুঝতে পারলো  না। কিন্তু সর্বজ্ঞ বুদ্ধদেব জানতেন, মেয়েটি দুদিন বাদেই দেহত্যাগ করবে, কারন তার  কর্ম্ম শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সেসব কথা তিনি কিছুই বললেন না। শুধু বললেন, ৭দিন অপেক্ষা করো। ৭-দিন পরে, তোমার কাছে ওই মেয়েটিকে নিয়ে আসা হবে।  তখন যদি তোমার ইচ্ছে হয়, তবে তাকে বিয়ে করে সংসার করো। তো শিষ্য খুব খুশি হলো। কিন্তু নিয়তির পরিহাস, ৭-দিন পরে, ওই মেয়েটির মৃতদেহ, তার মা-বাবা বুদ্ধের আশ্রমে নিয়ে এলেন। ঘণ্টাকয়েকের মধ্যেই  মেয়েটির দেহে পচন  শুরু হলো। ছেলেটিকে প্রশ্ন করা হলো, তুমি কি এই দেহটিকে ভালো বেসেছিলে ? ছেলেটি উদাস হয়ে গেলো - আর বুদ্ধের পা জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। 

জগতের সমস্ত বস্তুই পরিবর্তনশীল, কিন্তু এই বস্তুর মধ্যে আছেন স্বয়ং ব্রহ্ম যিনি অপরিবর্তনীয়।  এখন কথা হচ্ছে বস্তুর পরিণতি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কি করে হবে ? উপনিষদ বলছে, নিজেকে  ব্রহ্মরূপে, বিশুদ্ধ চৈতন্য  রূপে চিন্তা করো। গভীরভাবে এই চিন্তা করতে করতে একদিন তোমার অনিত্য জগতের প্রতি আসক্তি দূর হয়ে যাবে। এই সত্যকে মনের মধ্যে দৃঢ় করো, যে জগৎ মায়া - এই জগৎ আমাদের অজ্ঞানের কারনে, আমাদেরই মনের ভ্রমজ্ঞান থেকে উৎপন্ন হয়েছে। মনের এই ভ্রমজ্ঞান কেটে গেলে, জগতের অস্তিত্ত্ব থাকবে না। যা ক্ষণস্থায়ী তার প্রতি লোভ করে কি হবে ? বরফ জলে পরিণত হয়েছিল, জল বাস্পে পরিণত হয়েছিল। বাষ্প মেঘে পরিণত হয়েছিল। মেঘ বৃষ্টিতে পরিণত হয়েছিল। বৃষ্টি নদীতে পরিণত হয়েছিল।  নদী সমুদ্রে মিশে গিয়েছিলো। এই সত্যকে ধরবার চেষ্টা করো। দৈহিক সুখ, ধনসুখ, সবই  ক্ষণস্থায়ী।  ব্রহ্ম চিন্তায় মগ্ন থাকো. ব্রহ্মই সত্য - আমিই ব্রহ্ম - এই জ্ঞান অন্তরে রেখে উদাসীন হয়ে জগতের সবকিছুকে লালন-পালন করো। কাউকে ছেড়েও দিও না, কাউকে ধরেও রেখো না।
--------------------------- 
 
ঈশ উপনিষদ শ্লোক নং -২

কুর্বন্নেবেহ  কর্মাণি জিজীবিষেচ্ছতং সমাঃ 
এবং ত্বয়ি নান্যথেতোহস্তি ন কর্ম লিপ্যতে নরে।  (শ্লোক-২)   

কুর্বন্নেবেহ - কুর্বন-এব -ইহ = এখানে করেই  
কর্মাণি = কর্ম্মসমূহ 
জিজীবিষেচ্ছতং  সমাঃ। জিজীবিষেৎ-শতং  সমাঃ -  যদি শত বৎসর বাঁচার  ইচ্ছে হয়  
 
এবং ত্বয়ি -এইভাবে তোমাতে  
নান্যথেতোহস্তি - অন্যথা-ন অস্তি -অন্য কোনো পথ নেই 
ন কর্ম লিপ্যতে - কর্ম্মফলে  লিপ্ত হবে না 
নরে। - ওহে মানুষ। 

এইভাবে (নিষ্কামভাবের দ্বারা)  কর্ম করে, (নির্লোভী হয়ে) মানুষ শতবৎসর জীবিত থাকবার ইচ্ছে করতে পারে। এই হচ্ছে মুক্তির পথ।  অন্য কোনো পথ নেই। ওহে মানুষ কর্ম্মফলে লিপ্ত হবে না। 

প্রথম শ্লোকে আমরা শুনেছি, "ঈশ্বরের দ্বারা জগৎ অভিব্যাপ্ত হয়েছে। এঁকে  নিষ্কাম ভাবের দ্বারা সেবন করো। কোনও ধনের প্রতি লালসা করো না।"  যজুর্বেদ সংহিতা আসলে কর্ম্মকান্ডের বিধি ও নিষেধের  গ্রন্থ। এখানে বিভিন্ন ধরনের ধর্ম্ম-কর্ম্মের মাধ্যমে জাগতিক দুঃখ নিবারণ ও সুখের আহরণের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু এই যজ্ঞাদি কর্ম্ম যা আসলে আমাদের জাগতিক কামনা-বাসনা পূরণের দাওয়াই তা কখনও আমাদের মুক্তির পথ দেখাতে পারে না। বৈরাগ্যই মুক্তি দিতে  পারে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমরা কর্ম্ম-দেহে অবস্থান করবো, আর সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে কেবল ব্রহ্ম  চিন্তন করবো, তা আমাদের পক্ষে যেমন সম্ভব নয়, এমনকি এতে করে আমাদের শরীর  রক্ষাও হবে না। এমনকি  ঈশ্বর সৃষ্ট এই জগতের তাতে কোনো উন্নতি হতে পারে না। তাই শুক্ল যজুর্বেদের  একদম শেষ অধ্যায়ে এসে বলছেন, কাজ তো করতেই হবে, দীর্ঘায়ুও অৰ্জন করতে হবে,  কিন্তু কাজ করলে তো ফল ভোগ করতে হবে। তাই  আমরা যদি ফলাকাঙ্খ্যা ত্যাগ করে কাজ করতে পারি, কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করে কাজ করতে পারি, তবে আমাদের চিত্ত শুদ্ধি হবে, বিবেকজ্ঞান বৃদ্ধি পাবে, এমনকি আমাদের  ইন্দ্রিয়সুখের স্পৃহা ধীরে ধীরে কমতে থাকবে।  অর্থাৎ আমরা যদি সমস্ত কর্ম্ম ঈশরের উদ্দেশ্যে করতে পারি, তবে কর্ম্মফল জনিত সুখ-দুঃখের  ভাগিদার হতে হবে না আমাদের। যদিও ত্যাগের পথই মুক্তি প্রদায়িনী, তথাপি নিষ্কাম কর্ম্মের পথ আমাদের উভয় লক্ষ্য পূরণ করতে পারে। তাই একদিকে দেহাদির ধর্ম্ম পালন হলো, ভূতাদির শান্তি করো। আবার ঈশ্বরের ইচ্ছেয় সমস্ত কর্ম্ম করো।  এবং কর্ম্মফল ঈশ্বরকেই অর্পণ করো। 

শ্রীমদ্ভগবৎ গীতাতেও আমরা এই বাণীর  প্রতিধ্বনি পাই। শ্রী গীতার ২/৫০ নং শ্লোকে বলা হচ্ছে, "বুদ্ধিযুক্ত কর্ম্মযোগী  এই লোকেই সুকৃত ও দুষ্কৃত উভয়ই ত্যাগ করেন, সেজন্য তুমি (অর্জুন) নিষ্কাম কর্ম্মযোগ অনুষ্ঠান করো। কর্ম্মযোগ হচ্ছে কর্ম্মের কৌশল। " এই বুদ্ধিযুক্ত অর্থাৎ অর্থ সমত্ব-বুদ্ধি যুক্ত। ২/৫১ নং শ্লোকে বলা হচ্ছে বুদ্ধিযুক্ত মনীষীরা কৰ্ম্মজাত ফল ত্যাগ করে জন্ম-বন্ধ-বিনির্মুক্ত হয়ে নিরুপদ্রব বিষ্ণুর পরমপদ  লাভ করেন। আবার শ্লোক নং ৫/১০, বলছেন, "যিনি ব্রহ্মে  কর্ম্মসকলের ফল ও আসক্তি ত্যাগ করেন, তিনি জলের দ্বারা পদ্মপত্রের ন্যায় পাপ-পুণ্যের দ্বারা লিপ্ত হন না।"


-----------  

ঈশ উপনিষদ শ্লোক নং -৩ 

অসূর্যা নাম তে লোকা অন্ধেন তমসাবৃতাঃ 
তাংস্তে প্রেত্যাভিগচ্ছন্তি যে কে চাত্মহন্যে জনাঃ।  (শ্লোক নং ৩) 

অসূর্যা নাম তে লোকা  - অসূর্য অর্থাৎ সূর্য্যহীন, বা অসুরচিত, নামে  যে লোক বা স্থান, 
অন্ধেন তমসাবৃতাঃ - অজ্ঞান অন্ধকারের দ্বারা আবৃত। 

তাং-তে প্রেত্যাভিগচ্ছন্তি -  সেই লোকে দেহত্যাগের পর গমন করেন 
যে কে চ-আত্মহন্যে জনাঃ - যিনি আত্মহত্যা করেন, অর্থাৎ যাদের আত্মজ্ঞান হয়নি। 

এমনসব লোক (স্তর বিশেষ) আছে, যা অজ্ঞান অন্ধকারের দ্বারা আচ্ছন্ন। একেই বলে অসূর্যঃ লোক বা অসুরলোক। অন্ধ ব্যক্তি যেমন তমসার দ্বারা আচ্ছন্ন, তেমনি জ্ঞানান্ধ ব্যক্তি  আত্মজ্ঞানের অভাবে অজ্ঞান-অন্ধকারের দ্বারা আবৃত। এইসব অজ্ঞান ব্যক্তি মৃত্যুর পরে  অসুরলোক বা সূর্য্যহীন লোক প্রাপ্ত হয় । 

বলা হয়, ৮৪ লক্ষ  (অর্থাৎ অসংখ্য) যোনি  ভ্রমনের পরে, জীবাত্মা এই মনুষ্য দেহ  প্রাপ্ত হয়। এসবই স্থূল দেহের ভেদ। স্থাবর, উদ্ভিদ, স্বেদজ, অন্তজ প্রভৃতি অবস্থাকে গ্রহণ ও পরিহার করে, ধীরে ধীরে স্রোতের শেষে  এসে জরায়ুজ শ্রেণী প্রাপ্ত হয়। এর পর এই জরায়ুজ শ্রেণীর উন্নত অবস্থায় এসে, একসময় এই দুর্লভ মনুষ্য    দেহ লাভ করে। নদী যেমন সাগর থেকে বাষ্প-মেঘ-বৃষ্টি-জল-পাহাড়-নদী, অর্থাৎ রূপান্তরিত হতে হতে   ধীরে ধীরে গ্রাম গঞ্জ ভেদ করে আবার সমুদ্রের দিকে ধাবিত হয়, তেমনি জীবাত্মা পরমাত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধীরে ধীরে আবার সেই  পরমাত্মার দিকে ধাবিত হয়। জীব একদিন প্রকৃতির গর্ভে পরমাত্মা কর্তৃক বীজ রূপে গ্রথিত হয়েছিল। এইজন্য  বীজরূপে জীব প্রকৃতির গর্ভ থেকে উদ্গমন শুরু করে, পরমাত্মারই  টানে। মাটিতে গ্রথিত বীজ থেকে যেমন সূর্য্যের টানে অঙ্কুর হয়ে উত্থিত হয়, তেমনি জীব লক্ষ-কোটি জন্মের পরে উৎকৃষ্ট দেহপ্রাপ্ত করে। বলা হয়, এই যে উত্থান এ তার কৃতকর্মের ফল নয়, এই প্রক্রিয়া বা পরিণতি প্রকৃতির স্বভাবজাত। প্রকৃতিতে কোনো কিছু এক জায়গায় এক মুহূর্তের জন্যও স্থির থাকতে পারে না। হয় ক্ষয় নয় বৃদ্ধি অথবা দুইই একই সঙ্গে চলতে থাকে। জন্ম-মৃত্যু একই সঙ্গে চলতে থাকে। এই যে মনুষ্য  দেহ, এই দেহের মধ্যেও প্রতি মুহূর্তে কেউ মারা যাচ্ছে কেউ জন্মাচ্ছে। কোনো কোষ জন্মাচ্ছে তো কোনো নতুন কোষের জন্ম হচ্ছে। এই জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে জীবন প্রবাহ চলছে। জীবন-নদী বেয়ে চলেছে। এসব প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটে থাকে।  এর জন্য আমাদের কারুর কোনো কিছু করবার দরকার পড়ে  না। 

আমাদের যতদিন না অহং ভাবের সৃষ্টি হচ্ছে, ততদিন  আমাদের কর্ম্মের অধিকার জন্মে না। অতএব  মনুষ্য  দেহ পাবার আগে পর্যন্ত আমরা যত  দেহ ধারণ করেছি, তা সে চুরাশি লক্ষ হোক বা তার কম-বেশি যাই হোক, সেখানে আমাদের কর্ম্ম-প্রেরণা বা ব্যক্তিগত ইচ্ছে-অনিচ্ছা বলে কিছু ছিল না। কিন্তু যখনই  আমরা এই মনুষ্য  দেহের সঙ্গে সংস্পর্শে এসেছি, সেই দিন থেকেই আমাদের কর্তৃত্বাভিমান উৎপন্ন হয়েছে এবং কর্ম্মের উৎপত্তি ও ফলভোগের উৎপাত শুরু হয়েছে। এইজন্য মনুষ্য দেহকে বলা হয় কর্ম্ম দেহ। এখানে কর্ম্ম কথা বলে, ভালো কর্ম্ম ভালো ফল দেবে, আর খারাপ কর্ম্ম খারাপ ফল দেবে। এটাও সেই প্রকৃতির নিয়ম। এখানেও পরমেশ্বরের কোনো হাত নেই। সাধন ক্রিয়া করতে করতে এক  সময় প্রকৃতির স্রোতের প্রভাব ধীরে ধীরে কমতে থাকে। যোগীপুরুষের মধ্যে প্রকৃতির প্রভাব থাকে না। জীব তার স্বকৃত কর্ম্মের ফল স্বরূপ, স্ব  স্ব লোক প্রাপ্ত হয়।  এই স্ব-কৃত কর্ম্মের ফলেই,  জীব অধোগতি বা উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হয়। প্রকৃতির গতিপথ সরল হলেও, কর্ম্মের গতিপথ চক্রাকার এবং অনন্ত বৈচিত্রে ভরা। মনুষ্য  দেহে অভিমানের বিকাশের ফলে অনন্ত প্রকার লীলার স্ফূরণ ঘটে থাকে। যতক্ষন এই অভিমানের নিবৃত্তি না হয়, ততক্ষন  সরল গতির সূত্রপাত হয় না। এই সরলগতি প্রাপ্ত হবার জন্য যত  সাধন-ভজন যোগাদির ক্রিয়াকলাপ। মনুষ্যদেহের এই যে বিচিত্র গতিপথ এসব কেবল মুক্ত পুরুষেরাই জ্ঞাত হয়ে থাকেন। 

মনুষ্যদেহ লাভের  পরেও যারা আত্মজ্ঞান লাভের  জন্য সচেষ্ট না হন, তারা  জানবেন আত্মঘাতী পুরুষ। এরা  জীবনের আসল উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে শরীরকে আমি ভেবে শরীরের সেবাযত্ন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে। আর ইন্দ্রিয় সুখে মগ্ন হয়ে আছে। জগতের বৈচিত্রে বিমোহিত। জীবনের উদ্দেশ্য ভুলে গেছে। নিজেকে ভুলে গেছে।  জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মসংযম।  এই আত্মসংযমের দ্বারা ব্রহ্ম বা আত্মার সঙ্গে একাত্মতা উপলব্ধি করতে হবে। সাধনক্রিয়ার সাহায্যে অন্তঃস্থিত সজ্ঞাকে  জাগ্রত করে, উপলব্ধি করতে হবে, আমিই সেই পরমাত্মা। আমি শুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ। আমি নিত্যমুক্ত, আমি নামরূপহীন।  আমি কোনো নিয়মের অধীন নয়। আমি আত্মা, আমি অপরিবর্তনীয়, আমি অনন্ত, সর্বব্যাপী, আমি বাক্য  মনের অতীত সেই সৎ সত্ত্বা। আমার না আছে জন্ম, না আছে মৃত্যু, আমি সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম। এই উপলব্ধিতে স্থিত হতে পারলে, তাঁর আর জন্ম-মৃত্যুর কবলে পড়তে হবে না। 
এই পথ যারা অবলম্বন না ক'রে, কেবলমাত্র দেহাভিমানী হয়ে, কর্ত্তৃত্বাভিমানী হয়ে ইন্দ্রিসুখের জন্য ছুঁটে  বেড়াচ্ছেন, তাদের ইহলোক, পরলোক দুই অজ্ঞান অন্ধকার দ্বার আবৃত। উপনিষদ-এর ঋষি বলছেন, এইসব অজ্ঞান ব্যক্তি মৃত্যুর পরে  অসুরলোক বা সূর্য্যহীন লোক প্রাপ্ত হন। 

----------------
শ্লোক নং -  ৪ ঈশ-উপনিষদ 

অনেজদেকং মনসো জবীয়ো নৈনদ্দেবা আপ্নুবন পূর্বমর্ষৎ
তদ্ধাবতোঅন্যানত্যেতি  তিষ্ঠৎ তস্মিন্নপো  মাতরিশ্বা দধাতি।  (৪)  

অনেজদেকং - অনেজৎ-একং -  নিশ্চল এক  
মনসো জবীয়ো - মনের চেয়ে বেশী  বেগবান 
নৈনদ্দেবা আপ্নুবন -  এনৎ-ন-দেবা - আপ্নুবন - ইন্দ্রিয়সমূহ এর নাগাল পায়  না।  
পূর্বমর্ষৎ - পূর্বম-অর্ষৎ - সকলের আগে 
 
তদ্ধাবতোঅন্যানত্যেতি - তৎ-ধাবতঃ-অন্যান্য-অতি-এতি - অন্য সকলকে অতিক্রমন করে যান  
তিষ্ঠৎ - স্থির  থেকেও  
তস্মিন্নপো - তস্মিন-অপঃ - তাঁর  অবস্থাতেই জলাদি  অর্থাৎ কর্ম্ম সমূহ   
মাতরিশ্বা - বায়ু বা জগৎ-বিধায়কসূত্রাত্মা বা  হিরণ্যগর্ভ 
দধাতি - ক্রিয়া করতে সমর্থ হন অর্থাৎ বিশেষ ভাবে পালন করেন। 

পরমাত্মা নিশ্চল অর্থাৎ গতিহীন। অথচ তিনি মনের থেকেও অধিক বেগশালী। তাঁর  সেই বেগের সাথে ইন্দ্রিয়-দেবতাগন  পা ফেলে চলতে পারে না। তিনি সব সময় যেন সবার আগেই চলছেন। তিনি নিজে স্থির থেকেও সকলকে অতিক্রম করেন। এই পরব্রহ্মে স্থিত হয়ে,  অন্তরীক্ষ  গামী (মাতরিশ্বা) পবন (বায়ু) জলকে ধারণ করে থাকে। 

ব্রহ্ম এক এবং নিশ্চল। ব্রহ্ম এমন একটা শব্দবন্ধ যার দ্বারা সবকিছুর মধ্যে যে মূলশক্তি তা সে সদর্থক হোক বা   ও নঞৰ্থক (নেগেটিভ ও পজেটিভ) হোক দুটো শক্তিকেই বোঝানো হচ্ছে। তিনি এক আবার বহু, তিনি নেই আবার আছেন, তিনি করেন না আবার করেন, তিনি স্থির আবার সর্বত্র। তিনি গতিহীন, আবার তাকে কেউ অতিক্রম করতে পারেন না। তিনি দেখেন না আবার দেখেন, তিনি শোনেন না আবার শোনেনা ইত্যাদি ইত্যাদি। জগতের সমস্ত কিছুই তিনি পরিচালনা করেন, আবার তিনি নিজে কিছুই করেন না। তিনি কার্য্য স্বরূপ আবার তিনিই কারন স্বরূপ। এইজন্য বলা হয়, ব্রহ্মকে বর্ণনা করা যায় না  বাক্য দিয়ে, আবার তাকে মন দিয়ে অনুভব করাও  যায় না, তাঁকে  বুদ্ধি দিয়ে বিচার করাও  যায় না। তিনিই আকার আবার তিনিই সাকার।  তিনি কোনো বস্তুতে নেই, আবার সর্ববস্তুতে আছেন। তাঁর কোনো নাম নেই, আবার সব নামই  তাঁর। বস্তুত তার সমকক্ষ কেউ নেই, তাই তাঁকে কারুর সঙ্গেই তুলনা করা যায় না।  তিনি অতুলনীয়, অবৰ্ণনীয়। 
এখন কথা হচ্ছে, পরষ্পর বিরোধী শক্তি বা  উপনিষদের মধ্যে ব্রহ্ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে যে পরস্পর বিরোধী উক্তি বিধৃত হয়েছে - এতে করে আমরা ব্রহ্ম সম্পর্কে কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না। তাহলে এতসব ব্রহ্মকথা কেন, যাঁকে বোঝা যাবে না, যাঁকে বাক্য  দিয়ে প্রকাশ করা যাবে না, যাঁকে মন উপলব্ধি করতে পারবে না, তাঁকে  নিয়ে আমরা কেন এতো সময় নষ্ট করতে যাবো ? তিনি আছেন কি নেই, তা নিয়ে এই পরস্পর বিরোধী বক্তব্য শুনে আমাদের কি লাভ ? তিনি থাকলে থাকুন, তিনি না থাকলে না থাকুন। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে লাভটা কি ? 

এইখানে উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, ব্রহ্ম-এর একটা স্থির অবস্থা, অব্যক্ত অবস্থা বা  নির্গুণ অবস্থা  আর একটা  হচ্ছে ক্ষুব্ধ, ব্যক্ত বা  সগুন অবস্থা। তিনিই আমাদের চৈতন্য স্বরূপ। তিনিই সচ্চিদানন্দ স্বরূপ।  তিনিই পরমাত্মা। তাঁকে  বাদ  দিয়ে জগৎ মিথ্যে। তাকে বাদ  দিলে,  দৃশ্য থাকবে না দ্রষ্টাও থাকবে না।  তাকে বাদ  দিলে জ্ঞাতা  থাকবে না জ্ঞেয়  থাকবে না। এমনকি তাঁকে বাদ  দিলে, আমি বলেও কিছু থাকবে না। তাঁর  অস্তিত্বেই আমার অস্তিত্ব। তাই তাঁকে  না বুঝলে, আপনাকে   (নিজেকে) চেনা যাবে না। তো আমরা কেউ অস্তিত্ববিহীন হতে চাই না।  আমরা সবাই আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর।  আমরা আমাকে জানতেও চাই।  তাই তাঁর কথাই আলোচ্য বিষয় হতে পারে, অন্য সব আলোচনা বৃথা। 

আমাদের মন, শরীর আসলে নিষ্ক্রিয় পদার্থ। মন-শরীর  তখনই  সক্রিয় হতে পারে, যখন আত্মা বা ব্রহ্ম  এই শরীর মনে প্রাণের সঞ্চার করেন । আত্মাই মনকে টেনে নিয়ে যায়, তাই মনকে আমরা দ্রুতগামী বলে থাকি। তিনি  সর্বত্র বিরাজ করছেন। শুধু মন নয়, এই যে শরীর, এই শরীরের যে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সবই এই আত্মার অস্তিত্বের কারনে  সক্রিয় হচ্ছে। প্রকৃতিতে যতসব উপাদান আছে, সবার সম্পর্কেই এই একই কথা প্রযোজ্য। এই শক্তিই সমস্ত কার্যের কারন। কারন না থাকলে যেমন কোনো কাজ হতে পারে না, তেমনি তিনি না থাকলে আমাদের কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে না। পঞ্চভূতের মধ্যে একটি হচ্ছে বায়ু।  এই বায়ু যখন আত্মার সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন তা আমাদের প্রাণশক্তিতে  রূপান্তরিত হয় , আর এই প্রাণ বায়ুই আমাদের জীবনীশক্তি প্রদান করে থাকে। শুধুমাত্র বায়ু আমাদেরকে রক্ষা করতে পারে না, যদি না এর মধ্যে আত্মার মিলন ঘটে। এই বায়ুকে বলা হয় মাতরিশ্বা । মাতর মানে শূন্য, শ্বা অর্থাৎ চলমান। এই বায়ু যখন পরমাত্মার সংস্পর্শে আসে, তখন সে গতিশীল হতে পারে। তাই বায়ুকে বলা হয় সূত্রাত্মা।  অর্থাৎ এই বায়ুকে যিনি সঠিক ভাবে আয়ত্বে আনতে  পারেন, এই বায়ুকে যিনি ধরতে পারেন, তিনি ব্রহ্মকে ধরতে পারেন। বায়ু হচ্ছে সুতো।  এই বায়ুরুপ সুতোই অব্যক্ত ব্রহ্ম আর ব্যক্ত ব্রহ্মের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী। এইজন্য যোগীপুরুষগন বায়ুর সাধন অর্থাৎ প্রানায়ামাদি ক্রিয়া করে থাকেন। ব্রহ্ম সমস্ত কার্য্যের কারন স্বরূপ, কিন্তু তিনি কিছুই করেন না। তাঁর  থেকেই সমস্ত জগৎ ব্যক্ত হয়েছে, বা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁকে  আশ্রয় করেই সমস্ত কিছু স্থিত হয়েছে - আবার ব্রহ্মতেই মিলিয়ে যাচ্ছে - এই প্রক্রিয়া প্রতিনিয়ত, প্রতিক্ষনে চলছে। এই প্রক্রিয়ার ফলে জগৎ প্রকাশিত হচ্ছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।  তাই আমরা সাবই  ব্রহ্ম থেকেই এসেছি, আবার একদিন ব্রহ্মতেই মিলিয়ে যাবো।  এই সত্যের উপল্বদ্ধিতে নিজেকে স্থাপন করতে হবে। 

----------- 

ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-৫)
 
তদেজতি তন্নৈজতি  তদ্দুরে তদ্বন্তিকে
তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যত । (শ্লোক -৫)  
  
তদেজতি - তৎ-এজতি  - তিনি চলেন 
তন্নৈজতি - তৎ  ন  এজতি - তিনি চলেন না 
তদ্দুরে -তৎ-দূরে - তিনি দূরে 
তদ্বন্তিকে- তৎ-উ-অন্তিকে - তিনি কাছেও 
তদন্তরস্য সর্বস্য - তৎ-অন্তঃ-অস্য সর্বস্য - তিনি এই (জগৎ) সবকিছুর অন্তরে 
 তদু - তৎ -উ  - তিনিই আবার 
সর্বস্যাস্য - সর্বস্য-অস্য - তিনিই আবার এর (জগতের) 
বাহ্যত - বাইরে। 

তিনি সচল, আবার অচল, তিনি দূরে আবার নিকটে, তিনিই জগতের সবকিছুর অন্তরে  ও বাহিরে। 

ব্রহ্ম বলতে আমরা একটা পরষ্পরবিরোধী ভাবকে বুঝি। আমরা যখন শ্রী গীতা পড়ছিলাম, সেখানেও দেখেছি, এই পরস্পর বিরোধী ভাবের প্রকাশ। শ্লোক নং ১৩/১৬ তে একই কথা বলা হয়েছে, তিনি অন্তরে -বাহিরে, তিনি চল -অচল, তিনি নিকটে আবার দূরে। আসলে ব্রহ্ম বিশ্ব  চরাচরের ভিতরে ও বাইরে বিদ্যমান।  তিনি যেমন আমাদের মন বুদ্ধি ইন্দ্রিয়ের ধারণার অতীত, তেমনি শ্রদ্ধালু বাল-সুলভ সাধকের কাছে তিনি নিকট থেকে নিকটতম। তিনি অভক্তের দৃষ্টিতে বহু দূরে, আবার ভক্তের নিকট তিনি অতি কাছে। তিনি অজ্ঞানীর নিকট বহু দূরে, আবার যথার্থ জ্ঞানীর নিকট, কাছে।  তিনি পার্থিব জ্ঞানীর কাছে বহু দূরে, তিনি প্রাজ্ঞ-ব্যক্তির নিকট, কাছে। তিনি ভক্তের কাছে রূপধারী চলমান শক্তি। অভক্তের কাছে তিনি নিশ্চল অব্যক্ত। অভক্তের কাছে তিনি জন্ম-মৃত্যু রূপ বিভীষিকা, আবার ভক্তের কাছে তিনি জন্ম-মৃত্যু রহিত পরমানন্দ স্বরূপ। এঁকে  বুঝতে গেলে, আমাদের এঁর মধ্যে প্রবেশ করতে হবে, তখন জ্ঞাতা-জ্ঞেয়-জ্ঞান সব এক হয়ে যাবে। 
----------------------
ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-৬-৭)

যস্তু সর্বাণি ভূতান্যাত্মন্যেবানুপশ্যতি 
সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো  না বিজুগুপ্সতে। (শ্লোক-৬(

যস্তু  - যঃ-তু  = কিন্তু যিনি বা যে ব্যক্তি  
সর্বাণি = সকল 
ভূতান্যাত্মন্যেবানুপশ্যতি - ভূতানি-আত্মনি-এব-অনুপশ্যতি = আত্মাকে সর্বভূতের মধ্যে দেখেন,
সর্বভূতেষু চ-আত্মানং = সর্বভূতের মধ্যে আত্মাকে
ততো  ন বিজুগুপ্সতে -- সেহেতু কাউকেই ঘৃণা করেন না। 

যিনি সকলের মধ্যে নিজেকে (আত্মাকে) দেখেন, আবার নিজের  মধ্যে সকলকে দেখেন, তার মধ্যে ঘৃণা থাকতে পারে না। 

আমরা সবাই স্বরূপত  এক। বিরাট থেকে ক্ষুদ্র, ধনী থেকে দরিদ্র, জ্ঞানী থেকে অজ্ঞানী, এমনকি মানুষ থেকে পশু, পাখী  থেকে কিট  পতঙ্গ, স্থাবর-জঙ্গম-উদ্ভিদ  সবার মধ্যেই একই সত্ত্বা বিরাজ করছে। পাত্র ভেদে আকার গ্রহণ করেছে। আবার গুন্ ভেদে স্বভাব হয়েছে, কিন্তু আমরা সবাই সেই এক আত্মার উপরে ভিন্ন ভিন্ন আবরণ দিয়ে ঢাকা। এই আবরণ বা মুখোশ বা পোশাক আলাদা হবার জন্য, আমাদেরকে আলাদা মনে হচ্ছে। আলাদা আলাদা নামে , ভিন্ন ভিন্ন রূপে আমাদের প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। পোশাকের ভিন্নতার কারনে, গুনের ভিন্নতার কারনে, আমরা কেউ রাজা, কেউ মহারাজা, কেউ সেপাই, কেউ বা দরবেশ সেজেছি। জগৎরূপ সংসারে খেলা করবার জন্য, জগৎমঞ্চে অভিনয় করবার জন্য, আমরা বিচিত্র সব পোশাক পড়ে আছি মাত্র।  ভিতরে আমাদের সবার একই সত্ত্বা বিরাজ করছেন। মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই একত্বকে উপলব্ধি করা।  এই সত্যকে অনুভব করা।  তাহলে আমাদের মধ্যে সমস্ত দ্বেষ, ঘৃণা, রাগ, দূর হয়ে জীবন হয়ে উঠবে প্রেমপূর্ণ। 

যস্মিন-সর্বাণি ভূতানি আত্মৈবাভূদ্বিজানতঃ 
তত্র  কো  মোহঃ কঃ শোক একত্বমনুপশ্যতঃ। (শ্লোক-৭) 

যস্মিন-সর্বাণি ভূতানি - যখন সর্বভূত সমূহ 
আত্মৈবাভূদ্বিজানতঃ - আত্মা-এব-অভূত-বিজানতঃ = আত্মাই হয়ে গেছে, এইরূপ জ্ঞাত হবে,  
তত্র  কো  মোহঃ কঃ শোক - সেখানে কোথায় মোহ, কোথায় শোক,
একত্বমনুপশ্যতঃ -  একত্বম-অনুপশ্যতঃ = একরূপে দেখেন যিনি। 

যখন কেউ সবকিছুর মধ্যে এক আত্মাকেই দেখেন, এবং এইরূপ যাঁর  জ্ঞান হয়েছে, তাঁর  মধ্যে কোনোকিছুর প্রতিই মোহ থেকে না।  অর্থাৎ তিনি কোনো কিছুইতেই আসক্ত হন না, আবার কোনো কিছুর জন্য শোক করেন না। 

আত্মজ্ঞ পুরুষ সব কিছুর সঙ্গে একাত্মতা উপলব্ধি করেন।  আত্মাই সর্বভূতে রয়েছে, আর আমিই সেই আত্মা। মানুষ যখন এই উপল্বদ্ধিতে আসে, তখন সব এক হয়ে যায়। তখন সব পার্থক্যবোধ বিলোপ হয়ে যায়। আসলে বাস্তব বা ব্যবহারিক জীবনে বৈচিত্রের সমাহার।  এই বৈচিত্রকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু মনের মধ্যে এই জ্ঞান যদি দৃঢ় হয়, যে এসব অজ্ঞান মনের কল্পনা বৈ  কিছু নয়, তখন সবকিছুর প্রতি যেমন একটা অনাসক্ত ভাব আসে, তেমনি হারানোর শোক থেকে রেহাই পাওয়া যায়। তখন দুঃখ বলে কিছু থাকবে না। 
--------
ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-৮)

সপর্যগাচ্চুক্রমকায়মব্রণমস্নাবিরং শুদ্ধমপাপবিদ্ধম
কবির্মণীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভুর্যাথাতর্থ্যতোঅর্থান্ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ। 

সপর্যগাচ্চুক্রমকায়মব্রণমস্নাবিরং - স পর্য্গাৎ-শুক্ৰম-অকায়ম-অব্রণম-অস্মাবিরম  = তিনি, প্রাপ্ত হন, পরম তেজময়, রূপহীন, অক্ষত, শিরাহীন 
শুদ্ধমপাপবিদ্ধম - শুদ্ধম-অপাপবিদ্ধম = পবিত্র দোষ  রোহিত 

কবির্মণীষী - কবিঃ-মনীষী = কবি অর্থাৎ প্রাজ্ঞ  মনের নিয়ন্তা 
পরিভূঃ - উত্তম, সবার উপরে যাঁর  স্থান  
স্বয়ম্ভুর্যাথাতর্থ্যতোঅর্থান্ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ - স্বয়ম্ভুঃ-যথাতথ্যতঃ-অর্থান-ব্যদধাৎ-শাশ্বতিভ্যঃ = যিনি স্ব ইচ্ছায় অবতীর্ন হন, যথাযথ রূপে, পদার্থসমূহকে বা কর্ম্ম ফল সমূহকে,  সৃষ্টি করে আসছেন, বা বিধান করেন, চিরন্তন।  
সমাভ্যঃ - কাল থেকে বা সমস্ত কাল ব্যাপী।  

তিনি (ব্রহ্ম)  সর্বব্যাপী, জ্যোতির্ময়, নিরাবয়ব, অক্ষত, অচ্যুত, নির্ম্মল, নিজ মনের নিয়ন্তা, সর্বোৎকৃষ্ট, স্বয়ম্ভু এবং চিরন্তন।  তিনিই সবার জন্য কর্তব্যের বিধান করেন। 

দেখুন, যতক্ষন আমাদের মধ্যে দ্বৈত বোধ থাকবে, ততক্ষন আমাদের মধ্যে আমি-তুমি, ভালো-মন্দ, শত্রু-মিত্র, অর্থাৎ দ্বিবিধ  বোধের স্থিতি থাকবে।  কিন্তু যখন এই দ্বৈতবোধের অভাব ঘটবে, তখন আমি-আমার বোধ চলে যাবে। মন তখন আকাশের মতো বিশাল, সবত্র সমদর্শী, উদার হয়ে উঠবে। তখন সমস্ত পৃথিবাসীকে, এমনকি সমস্ত ব্রহ্মান্ডকেই আমি বলে মনে হবে। সবই তখন নিজের বলে বোধ হতে থাকবে। আর আমি সকলের মধ্যেই আছি, এই বোধে যখন বোধিত হবো, তখন আমি মুক্ত, উদার, সর্বগ্রাহী হয়ে, মনের  শুদ্ধতম স্তরে স্থিত হতে পারবো। আত্মা কেবল সাক্ষী  মাত্র। দৃশ্যমান জগতের কোনো কিছুই আত্মা থেকে বাইরে নয়, আবার সবার মধ্যে সেই একই আত্মা বিরাজ করছেন। তাঁরই প্রভাবে জগতের সমস্ত কর্ম্ম সম্পাদন হচ্ছে, তাঁরই প্রভাবে সমস্ত কর্ম্মফল সংগঠিত হচ্ছে, কিন্তু তিনি স্বয়ং অকর্তা হয়ে বিরাজ করছেন। সমস্ত কর্ম্মফলের উর্দ্ধে নিস্কল হয়ে অবস্থান করছেন। আত্মার এই স্বরূপকে জানতে পারলে, স্বয়ং-কে  জানা হবে। পৃথিবী সবাইকে তা সে ভালো হোক, মন্দ হোক, সবাইকে আশ্রয় দিয়েছেন, সূর্য সবাইকে আলো বিতরণ  করছেন, নদী সবাইকেই জল দান  করছেন, বাতাস সবাইকেই প্রাণের স্পর্শ দিচ্ছেন।  এখানে কোনো ভেদ বিচার নেই। এবার আপনি আলোকে, জলকে, বাতাসকে, কিভাবে ব্যবহার করবেন - তাতে সূর্য, পৃথিবী, বরুন, এঁদের কিছুই এসে যায় না। আপনি জল দিয়ে নোংরা পরিষ্কার করছেন, তাতে জল কখনো নোংরা হয় না, আপনি অগ্নি দিয়ে আবর্জনা জ্বালিয়ে দিচ্ছেন, এতে করে অগ্নির মধ্যে আবর্জনা জমে না। আপনি পৃথিবীকে যতই অত্যাচার করুন না কেন,  তিনি প্রতিবাদ করেন না। তো আত্মার কোনো বিকার নেই। তিনি যেমন ছিলেন, তেমনই  আছেন। 
তিনি জ্যোতিঃস্বরূপ হয়ে সর্বত্র বিরাজ করছেন, তাঁর  কোনো আকার নেই, তিনি নিখুঁদ, তিনি কখনো নিজের স্থান থেকে চ্যুত হন না, তিনি সমষ্টি  মনের নিয়ন্তা, তাঁর  থেকে উৎকৃষ্ট কেউ নেই, তিনি স্বপ্রকাশিত, তিনি চিরস্থায়ী।  তিনিই সমস্ত কর্ম্মের ফল দাতা। তার বিধানেই সমস্ত জগৎ তটস্থ হয়ে আছে। তার ভয় সবাই ভীত হয়ে স্ব-স্ব কর্ম্ম করে চলেছেন। তত্ত্বজ্ঞ পুরুষ এই অক্ষয় পুরুষকে এইভাবেই জেনে থাকেন। 
---------------------  

ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-৯)

অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যে অবিদ্যামুপাসতে 
ততো ভূয় ইব তে তমো য উ'বিদ্যায়াং রতাঃ। (শ্লোক নং ৯)

অন্ধং - আত্মজ্ঞানের অভাবে  যিনি দৃষ্টিহীন 
তমঃ - অজ্ঞানের অন্ধকার 
প্রবিশন্তি - প্রবেশ করেন, 
যে - যাঁরা 
অবিদ্যামুপাসতে - অবিদ্যাম-উপাসতে = অবিদ্যাকে উপাসনা করেন। 
 
ততো ভূয় ইব -  তা থেকে আরো বেশী 
তে তমো - অন্ধকারের মধ্যে 
য উ'বিদ্যায়াং রতাঃ-- জ্ঞানাভিমানে রত (ব্যক্তি প্রবেশ করেন)  

যারা কর্ম্মবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞাত না হয়ে অজ্ঞানের  মতো  কর্ম্ম করেন, তাঁরা অজ্ঞান অন্ধকারের জগতে প্রবেশ করেন। কিন্তু সেই  ব্যক্তি আরো বেশী অন্ধকারের গভীরে প্রবেশ করেন, যিনি জ্ঞানী হয়েও অজ্ঞানীর মতো কাজ করেন।  

অন্ধং তমঃ - অর্থাৎ অজ্ঞানরূপ অন্ধকার। যারা অবিদ্যা বশতঃ অর্থাৎ অজ্ঞানীর মতো, নানান জাগতিক কর্ম্ম অর্থাৎ যজ্ঞাদি করেন, কেবলমাত্র কামনা বাসনা পূরণের জন্য, তাদের পক্ষে আত্মজ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। আবার উল্টো দিকে বলা যায়, যাদের আত্মজ্ঞান লাভ হয় নি, তারাই কেবল কর্ম্মের গতি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকবার জন্য, কামনা বাসনা পূরণের জন্য কর্ম্মাদির আশ্রয় নেন। এই ক্রিয়াকর্ম্মে  আসক্ত মানুষ আসলে নিজের সম্পর্কে অজ্ঞ। এঁরা অহং-এর বশবর্তী হয়ে কেবল আমি-আমার এই বোধে কর্তৃত্বাভিমানী হয়ে কর্ম্ম করে থাকেন।  আর ফল স্বরূপ তারা যুগ যুগ ধরে বাসনা পূরণের জন্য, জন্ম থেকে জন্মান্তরে পরিভ্রমন  করে থাকেন। অর্থাৎ সেই বক্র গতির বা পিতৃযানে  ভ্রমন করছেন।  

কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের কথা হচ্ছে, যারা জ্ঞানী, সব জেনেবুঝেও একই ধরনের কর্ম্ম অর্থাৎ জাগতিক কামনা বাসনা পূরণের জন্য কর্ম্ম করছেন, তারা আরো বেশি অজ্ঞান অন্ধকার জগতে প্রবেশ করছেন। যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একসময় অর্জ্জুনকে বলেছিলেন, তুমি আর্য হয়েও অনার্য্যের মতো আচরণ করছো। যাদের জন্য শোক করার প্রয়োজন নেই, তাদের জন্য তুমি শোক করছো, আবার পন্ডিতের ন্যায় কথা বলছো ? 

দেখুন যিনি শারীরিক দিক থেকে পঙ্গু, যিনি চোখে দেখতে পান না, কানে শুনতে পান না, তাকে যেমন পাহাড়ের শীর্ষে পায়ে হেটে উঠতে বলা বৃথা। তাকে  শাস্ত্র কথা শোনানো যায় না, তাকে  কৈলাশ পর্ব্বত দর্শন করানোও  যায় না। তার তীর্থ ঘরে বসেই হতে পারে। কিন্তু যিনি সক্ষম,  তার ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য নয়।  আমরা যখন বলি, "আমি-আমার" তখন আমরা এই দেহ-মনকেই  ইঙ্গিত করে থাকি । এই ধারণা ভুল বলেই  এদেরকে শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিতগণ  অজ্ঞানী বলে থাকেন।   এদের আচরণের মধ্যে দেহাভিমান থাকলে - সেটাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে হবে। 

কিন্তু একজন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত যখন নিজেকে আত্মা বলে পরিচয় দেন, আর  জাগতিক বিষয় সম্পদ আহরণের জন্য লালায়িত হন, এবং সামান্য শারীরিক সুখ-দুঃখে বিচলিত বোধ করেন, তাদের অপরাধ ক্ষমাহীন। এরা  কথা বলে পন্ডিতের মতো - কিন্তু কাজ করে মূর্খের মতো। 

দেখুন, জ্ঞান-হীন কর্ম্ম আমাদের মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য সফল করতে পারে না। আবার কেবলমাত্র শুষ্ক জ্ঞানের অধিকারী হয়ে, নিষ্কর্মা হয়ে ভোগের রাজত্বে বসে থাকা, বা জেনে বুঝে বাসনা পূরণের জন্য যজ্ঞাদি ক্রিয়া করা  বা দেবদেবীর পুজো অর্চ্চনা করা - অধিক অপরাধের। না বুঝে ভুল করা, আর জেনেবুঝে অপকর্ম্ম করা এক কথা নয়। যারা কর্ম্মের গতি সম্পর্কে অবহিত হয়েও সেই নিষ্কাম কর্ম্ম লিপ্ত হন না, তার আত্মঘাতী। 

অজ্ঞান মানুষ অবিদ্যা জনিত কারনে বিবিধ কর্মানুষ্ঠান করে, এরা সত্যকথা বলতে কি, নিজেরাই জানে না, এই কর্ম্ম তাকে কোন পথে নিয়ে যাবে। এরা  অজ্ঞান অন্ধকারে পথ খুঁজে ফেরে - আর এই পথের মধ্যেই একসময় শরীর  ছেড়ে দেয়। আর ফিরে ফিরে আসে, দেহ থেকে দেহান্তরে ঘুরে ঘুরে মরে। 

কিন্তু একদল মানুষ আছেন, এরা পন্ডিতের মতো কথা বলেন,  অন্যকে নৈতিক শিক্ষা দেন, আর নিজে অনৈতিক আচরণ করেন, তাদের মুক্তি আরো বেশি দূরে থাকে। তারা  জানে, যোগক্রিয়া দ্বারা সজ্ঞা লাভ হতে পারে,  ধ্যানাদি দ্বারা আত্ম-জ্ঞান লাভ হতে পারে, সকাম কর্ম্ম পরিত্যাগ করতে হবে, বৈরাগ্যবান হতে হবে  - এসব জেনেও তার অজ্ঞানীর মতো আচরণ করেন। অজ্ঞানী ব্যক্তিকে জ্ঞান দান  করা যায়, ক্ষুধার্তকে অন্ন দান  করা যায়, তৃষ্ণার্ত কে জল খাওয়ানো যায়। কিন্তু যার পেট হাবিজাবিতে ভর্তি হয়ে রয়েছে, তাকে কিছু দিলে, সে খেতে পারে না। এমনকি ভালো জিনিস দিলেও, তার বমি হয়ে যেতে পারে। সে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। তাই ঋষি বলছেন, অজ্ঞানীকে আত্মজ্ঞান দান  করা সহজ, কিন্তু অভিমানী পন্ডিতের কখনো আত্মজ্ঞান হয় না। 
---------------  

ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-১০)  

অন্যদেবাহুর্বিদ্যয়া অন্যদাহুরবিদ্যয়া 
ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে  । (১০) 

অন্যদেবাহুর্বিদ্যয়া - অন্যৎ-এব-আহু-বিদ্যয়া  = অন্য একরূপ ফল বলা হয়ে থাকে বিদ্যার যথার্থ অনুষ্ঠানে  
অন্যদাহুরবিদ্যয়া - অন্যৎ -অহু-অবিদ্যায়া = অন্য একরূপ ফল বলা হয়েছে অবিদ্যার অনুষ্ঠানে। 
ইতি শুশ্রুম = এইরূপ শুনেছি 
ধীরাণাং = ধীর পুরুষের নিকট থেকে 
যে = যাঁরা 
নস্তদ্বিচচক্ষিরে - নঃ-তৎ-বিচচক্ষিরে = আমাদেরকে সেই বিষয়টি ভালোভাবে বুঝিয়েছেন। 

ধীরব্যক্তি অর্থাৎ জ্ঞানী ব্যক্তিগন বলে থাকেন অবিদ্যার পথ ও বিদ্যার পথ ভিন্ন ভিন্ন ফল প্রদান করে থাকে। 
মূর্খের  কর্ম্ম আর পন্ডিতের  কর্ম্মের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। এই সব কর্ম্মের ফলও আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। এই বিষয়ে আমরা পরবর্তী শ্লোক  থেকে শুনবো।  তবে বিদ্যাই বলুন, আর অবিদ্যাই বলুন এর কোনোটিই আত্মজ্ঞান লাভের  সহায়ক নয়।  কারন অজ্ঞানের কর্ম্ম আর বিদ্বানের কর্ম্ম - দুইই ফলপ্রদ। অর্থাৎ এদের সমস্ত কর্ম্মই ফল প্রদান করে থাকে।  আসলে কর্ম্ম মাত্রেই ফল প্রদান করে থাকে। সকাম কর্ম্মফল সবাইকেই ভোগ করতে হয়। তা সে পুন্য কর্ম্ম হোক বা পাপ কর্ম্ম হোক। পুন্য কর্ম্মে জীবের সুখ ভোগ হতে পারে, আর পাপকর্ম্মে দুঃখ ভোগ হতে পারে। তাই বিচক্ষণ ব্যক্তি বিদ্যা জনিত কর্ম্ম বা অবিদ্যাজনিত কর্ম্ম দুইই পরিত্যাগ করে থাকেন। যাইহোক, কোনো কর্ম্মে কি ফল হয়, সে সম্পর্কে উপনিষদের ঋষিগন কি বলছেন, সেটা আমরা একবার দেখে নেই। 

বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ  যস্তদ্বেদোভয়ং  সহ
অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়াহমৃতমশ্নুতে। (১১) - শুক্ল যজুর্বেদে মন্ত্র নং ৪০/১৪

বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ - বিদ্যাং চ অবিদ্যাং চ = বিদ্যা বলুন আর অবিদ্যা বলুন 
যস্তদ্বেদোভয়ং  সহ - যঃ-তৎ-বেদ-উভয়ং সহ = যিনি উভয়কে একত্রে জানেন 
অবিদ্যয়া = অবিদ্যার দ্বারা (অবিদ্যাজনিত কর্ম্ম দ্বারা)
মৃত্যুং তীর্ত্বা = মৃত্যুকে  অতিক্রম করেন  
বিদ্যয়াহমৃতমশ্নুতে- বিদ্যয়া -অমৃতম-অশ্নুতে = বিদ্যা দ্বারা অমৃত লাভ করেন। 

যিনি অবিদ্যার কারনে যজ্ঞাদি কর্ম্ম করেন, তিনি যজ্ঞ দ্বারা  অমরত্ব  লাভ করেন, আবার বিদ্যা লাভের  ফলে উপাসনা ইত্যাদি করেন, এতে করে তিনি অমৃত বা আনন্দ লাভ করেন। 

কর্ম্ম রহস্যে ভরা। কর্ম্মের গতি কি, তা নির্ধারণ করা খুবই জটিল। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তিও এই কর্ম্মের রহস্যঃ উন্মোচন করতে অক্ষম। কিসে যে কি হয়, তা কে বলতে পারে ? বাস্তবিক পক্ষে এই রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে আচ্ছা আচ্ছা পণ্ডিতও ভুল করে বসেন। কর্ম্মরহস্যে যার জ্ঞান হয়নি, সেই জ্ঞানাভিমানী ব্যক্তি কর্ম্মকে ব্রহ্মজ্ঞানের বাধা বলে মনে করেন এবং কর্ম্ম থেকে দূরে থাকেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে কর্ম্মবিনা মুক্তি নেই। বাহ্যত জ্ঞানাভিমানী কর্ম্ম থেকে নিজেকে বিরত  রাখলেও, তার চিন্তনকর্ম্ম চলতেই থাকে। মনের মধ্যে নানান প্রশ্নের উদয় হয়, মনের মধ্যে নানান বাসনার উদ্রেগ হয়, আর এই প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে বা বাসনার নিবৃত্তির জন্য বিরূপ চিন্তন করতে থাকেন। কর্ম্মের পরিণতি বা নিস্কর্মের ফল সম্পর্কে অজ্ঞানতার কারনে, নিজেকে আলস্য, নিদ্রা ও প্রমাদের মধ্যে নিমজ্জিত করে, দুর্লভ মনুষ্য জীবনের অমূল্য সময় হেলায় অতিবাহিত করেন। 

এইজন্য তত্তজ্ঞ ব্যক্তি বলে থাকেন, জ্ঞান ও কর্ম্মের যথাযথ রহস্যের কথা সম্যকরূপে জেনে, এই  উভয়ের অনুশীলন চালিয়ে যেতে হবে। যারা কর্ম্মের রহস্য জেনেছেন, তাঁরা বাহ্যত শাস্ত্র বিহিত কর্ম্মকে ত্যাগ করেন না। কিন্তু সেই কর্ম্মে তাঁর  না থাকে কর্তৃত্বাভিমান, না থাকে কামনা-বাসনা পূরণের আকাংখ্যা।  তিনি  প্রারব্ধ বশে বা গুরুর নির্দেশে, ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে যন্ত্রবৎ কর্ম্ম করে যান। এই অবস্থায় তার জীবনযাত্রা চলতে থাকে সহজ-সরল-সাবলীল ভঙ্গিতে। তার না থাকে ত্যাগের মনোভাব, না থাকে ভোগের মনোভাব। তাঁর  না থাকে আসক্তি, না থাকে অনাসক্তি। তাঁর  সামনে যাকিছু  উপস্থিত হয়, তাই দিয়েই তিনি সন্তুষ্ট চিত্তে জীবন নির্বাহ করেন। এই অবস্থায় তার চিত্তে কোনো অতৃপ্তির ভাব না থাকার কারনে জীবন হয়, ছন্দময় পরমসুখের। নিরন্তর কর্ম্ম সাধন, বিবেক বৈরাগ্যের ফলে এবং ব্রহ্মবিচারে নিরন্তর বিচরনের ফলে, একসময় তাঁর  চিত্তে পরমেশ্বরের জ্ঞানালোকের ঝলক ভেসে ওঠে।  একসময় তিনি পরব্রহ্ম পরমেশ্বরকে অন্তরে উপলব্ধি করেন। এবং সেখানেই ব্রহ্মময় হয়ে অবস্থান করেন। এইজন্য বলা হয়, শ্রীগুরুর নির্দেশে, ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে  কর্ম্ম করা ও মনের মধ্যে নিরন্তর ব্রহ্ম চিন্তন করতে পারলে মোক্ষ ও পরমানন্দ দুইই  লাভ করা যেতে পারে । 

---------------  
ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-১২)

অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেহসম্ভূতিমুপাসতে
ততো ভূয় ইব তে তমো য উ সম্ভূত্যাং রতাঃ (১২) + শুক্ল যজুর্বেদে মন্ত্র নং ৪০/০৯

অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি = অন্ধ (জ্ঞানান্ধ) অন্ধকারে (অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে) প্রবেশ করে।
যেহসম্ভূতিমুপাসতে - যে-অসম্ভূতিম-উপাসতে = যিনি অব্যক্তকে উপাসনা করেন
ততো ভূয় ইব = তা হতে যেন অধিকতর
তে = তারা
তমো = অন্ধকারে
য উ সম্ভূত্যাং রতাঃ = তিনিও পরমেশ্বরে রত অর্থাৎ যিনি পরমেশ্বর নিয়ে মেতে আছেন।

যারা অব্যক্ত ঈশ্বরের উপাসনা করেন, তারা অন্ধের মতো অন্ধকারে প্রবেশ করেন। কিন্তু যারা ব্যাক্তের পূজাপাঠ করেন, তারা আরো গভীর অন্ধকারে প্রবেশ করেন।

ভারতীয় দর্শন কখনও শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে, একথা স্বীকার করেন না। ভারতীয় দার্শনিকগণ বলেন, শূন্য থেকে কখনো কোনো কিছুর সৃষ্টি হয় নি, আর হতেও পারে না। আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতাও একই কথা বলে। কারন ভিন্ন কার্য্য হতে পারে না। যেকোনো ঘটনার পিছনে একটা কারন অবশ্যই থাকবে। তো এই জগৎ যদি কার্য্য হয়, তবে অবশ্যই এই জগতের পিছনে একটা-না-একটা কারন অবশ্যই আছে। এখন আমরা অনেক সময় কারণকে বুঝতে পারি না বা ধরতে পারি না। তাই বলে কারনের অস্তিত্ত্ব নেই তা কিছু নয়। প্রকৃতির জগতে কারন ভিন্ন কোনো কার্য্য হয় না। সব কিছুর পিছনে একটা কারন আছে। একটা গাছ দেখলে বুঝতে হবে, একটা বীজ আছে। হ্যাঁ সেই বীজটাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না, কারন বীজ আমাদের চোখের আড়ালে আছে, মাটির নিচে আছে। কিন্তু ওই বীজ আছে বা ছিল বলেই, আজ এই গাছটিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। এখন গাছ ওই বীজের মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় ছিলো। এই বীজকে আশ্রয় করে, গাছের জন্ম হয়েছে। তো জগতের দুটো অবস্থা একটা ব্যক্ত আর একটা অব্যক্ত। উপনিষদের ভাষায় একটা সম্ভূতি, আর একটা অসম্ভূতি। দুইই এক। শুধু দুই নয়, আসলে আজ যাকে বহু বলে মনে হচ্ছে, তা আসলে সেই এক।

এখন কথা হচ্ছে, এই দুইয়ের যেকোনো একটিকে নিয়ে যারা মেতে আছেন,এরা সবাই সেই একই অজ্ঞানের অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। দেখুন অসম্ভূতি অর্থাৎ যার জন্ম হয়নি, সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না - অথচ তার উপাসনা করছেন, হয়তো ভয় বা কিছু পাবার আশায়। আবার যিনি সম্ভূতির অর্থাৎ নাম-রূপ আছে, এমন কারুর উপাসনা করছেন, তিনি সেই অনিত্য বস্তুর প্রতি নিষ্ঠা প্রদর্শন করছেন। যা প্রতিমুহূর্তে পাল্টাচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে, এমনকি একসময় ইন্দ্রিয়ের অগোচরে চলে যাচ্ছে, তাকে নিয়ে মেতে থাকা মানে পরিনামে হাতে থাকবে শূন্য। আর যা অব্যক্ত তার সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারনাই নেই, তিনি আছেন কি নেই সেই উপল্বদ্ধিও আমাদের নেই। তো যার সম্পর্কে কোনো জ্ঞান আমাদের নেই, তার উপাসনা কি করে হবে, আর তাকে প্রাপ্তই বা কিভাবে করা যাবে ?

আসলে উপনিষদের ঋষিগন বলতে চাইছেন, তু-হি। ত্ৎ ত্বম অসি - তুমিই সেই। বাইরেই বলো আর ভিতরেই বলো কেবল তুমিই আছো। স্বয়ংকে খোঁজো। স্বয়ং-এর উপাসনা করো। অতীত নয়, ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমানে এসো। তুমি, তোমার স্বরূপ সেই আত্মাই সব। এর বাইরে কিছু নেই। আর এই আত্মা তোমার হৃদয়গুহায় অঙ্গুষ্ঠ পরিমান, আলোকজ্যোতিঃ স্বরূপে অবস্থান করছেন । আর সেই আলোতেই জগৎ উদ্ভাসিত হচ্ছে। এই আলো নিভে গেলে, কোথায় জগৎ ? এই আলোর কারণেই সমস্ত কিছু প্রতিফলিত হচ্ছে। আর তুমি স্বয়ং সেই জ্যোতিঃ।
-------------
ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-১৩-১৪)

অন্যদেবাহুঃ সম্ভবাদন্যদাহুরসম্ভবাৎ 
ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে।  (১৩) শুক্ল যজুর্বেদে মন্ত্র নং ৪০/১৩

অন্যদেবাহুঃ - অন্যাৎ-এব-আহুঃ = অন্য ফলের কথা বলেন পন্ডিতেরা  
সম্ভবাদন্যদাহুরসম্ভবাৎ - সম্ভবাৎ-অন্যাৎ-আহুঃ অসম্ভবাৎ = ব্যক্ত প্রকৃতি থেকে অন্য বা ভিন্ন ফল অব্যক্ত প্রকৃতি থেকে।  
ইতি শুশ্রুম - এইরকম শুনেছি 
ধীরাণাং - ধীর বা জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছে 
যে - যাঁরা 
নস্তদ্বিচচক্ষিরে- নঃ-তৎ-বিচচক্ষিরে = আমাদেরকে সেইরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। 

পন্ডিতদের কাছে  জানা যায়,  ব্যক্ত (প্রকৃতি) ও অব্যক্ত (হিরণ্যগর্ভ)  অসম্ভূতি ও সম্ভূতির উপাসনা আলাদা আলাদা ফল প্রদান করে থাকে। 

বলা হয়, যিনি যার কথা চিন্তা করেন, ধীরে ধীরে তিনি সেই ধ্যেয় বস্তুর গুন্ লাভ করেন। যখন আপনি অব্যক্ত ঈশ্বরের উপাসনা করবেন, তখন আপনি সেই অব্যক্ত ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করবেন। আবার আপনি যদি এই ব্যক্ত প্রকৃতির উপাসনা করেন, অর্থাৎ ব্যক্ত প্রকৃতির ধ্যান করেন, তবে সেই ব্যক্ত বস্তুর গুনের আধারে পরিণত হবেন। 

(অ)সম্ভূতিং চ বিনাশং চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ 
বিনাশেন মৃত্যুং তীর্ত্বাহসম্ভূত্যাহমৃতমশ্নুতে (১৪) শুক্ল যজুর্বেদে মন্ত্র নং ৪০/১১

(অ)সম্ভূতিং চ - অব্যক্ত অবস্থাও  
বিনাশং চ - বিনাশ হবে, 
যস্তদ্বেদোভয়ং সহ - যঃ-তৎ  -বেদ -উভয়ং -সহ = যিনি উভয়কে জানেন 
বিনাশেন - বিনাশশীল অর্থাৎ ব্যাক্তের 
মৃত্যুং - মৃত্যুকে 
তীর্ত্বাহসম্ভূত্যাহমৃতমশ্নুতে - তীর্ত্বা-অসম্ভূত্যা-অমৃতম-অশ্নুতে = অব্যক্তের উপাসনার দ্বারা  অতিক্রম করে অমৃতত্ব লাভ করেন। 

যিনি সম্ভূতি ও অসম্ভূতি উভয়ের উপাসনা একসঙ্গে করেন, তিনি অব্যক্তের (অসম্ভূতি) উপাসনা দ্বারা অমৃতত্ব লাভ করেন, আবার ব্যাক্তের (সম্ভূতি) উপাসনা দ্বারা মৃত্যুকে জয় করেন। 

যা কিছু আজ ব্যক্ত হয়েছে, তা একসময় অব্যক্তে পরিণত হবে। আমরা জানি সত্য এক। এবং এই সব কিছু সেই এক-থেকেই এসেছে - আবার একদিন সেই একেই ফিরে যাবে। তো আমরা যেখান থেকে এসেছি, আবার সেখানেই ফিরে যাবো।  অর্থাৎ ব্রহ্ম থেকে সব কিছুর সৃষ্টি হয়েছে, আবার সবকিছু সেই ব্রহ্মতেই ফিরে যাবে। তাহলে ব্যক্ত আর অব্যক্তের মধ্যে মূলত কোনো পার্থক্য নেই। কোনো কিছুই নিঃশেষ হয়ে যাবে না। যা ছিলো  তাই থাকবে, যা ছিলো  না তা কখনো হবে না। তাই একদিকে জন্ম-মৃত্যু জাগতিক দিক থেকে যেমন সত্য, ঠিক তেমনি পারমার্থিক বিচারে, জন্ম মৃত্যু বলে কিছু নেই, এসব ভ্রম বই কিছু নয়। আসলে সবকিছুই পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে। কোনো কিছুই থেমে  নেই, তো চলমান জগৎ অরূপ ব্রহ্মের রূপ মাত্র। যা বিন্দুর মধ্যে বিক্ষুব্ধতার কারনে দৃশ্যমান হয়েছে। 
মূলত সম্ভূত আর অসম্ভুতের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমি-আপনি-এজগৎ কেউই এই রূপে ছিলাম না, আবার থাকবোও না। কিন্তু আমি (আত্মা) সত্ত্বার কখনো বিলোপ হবে না। 
তাই যে যারই উপাসনা করুন না কেন, উপাসনা কখনো বিফলে যাবে না। যখন আমরা অব্যক্তের উপাসনা বা চিন্তন করি, তখন আমরা অব্যক্তের সঙ্গেই চিরন্তন হয়ে উঠি। ব্যক্ত প্রকৃতি আর অব্যক্ত প্রকৃতির সঙ্গে মূলত কোনো পার্থক্য নেই।  আজ যা ব্যক্ত তা একদিন অব্যক্ত ছিল, আবার ভবিষ্যতে একদিন অব্যক্ত হয়ে যাবে। 

তাই আপনি কার উপাসনা করছেন, সেটা বড়ো  কথা নয়, কেন করছেন, সেইটাই বড়ো  কথা। কি করছেন, সেটা বড়ো  কথা নয়, কার উদ্দেশ্যে করছেন সেটাই বড়ো  কথা। আপনার লক্ষ যদি সেই এক সত্যের দিকে ধাবিত হয়, তবে জানবেন, এই সম্ভূতি, অসম্ভূতি, ব্যক্ত, অব্যক্ত, বিদ্যা, অবিদ্যা, জ্ঞান, অজ্ঞান, এরা  আলাদা কোনো প্রয়োজন সিদ্ধ করতে পারে না। কর্ম্মপাশ থেকে মুক্ত হতে হবে - সাধনা  হবে নিষ্কাম কর্ম্ম - প্রাপ্তি হবে আত্মজ্ঞান। আর তখন সব উপাসনার উর্দ্ধে আপনি আত্মজ্ঞানী মুক্ত পুরুষ, যাঁর কখনো বন্ধনই হয়নি। 
--------------------

ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-১৫)

হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম
তত্ত্বং পূষ্ন্নপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে। (১৫) শুক্ল যজুর্বেদে মন্ত্র নং ৪০/১৭


হিরণ্ময়েন পাত্রেণ - জ্যোতির্ময় (সোনার বরণ) পাত্রের দ্বারা
সত্যস্যাপিহিতং মুখম - সত্যস্য-অপিহিতম-মুখম = সত্যের মুখ আবৃত
তত্ত্বং - তৎ-ত্বং = তুমি তা
পূষ্ন্নপাবৃণু - - পূষন-অপাবৃণু = হে সূর্য, দয়া করে অনাবৃত করো
সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে = যাতে সত্যের অনুসন্ধানী দেখতে পায়।

সত্যের মুখ উজ্জ্বল সোনার পাত্রের দ্বারা আবৃত হয়ে রয়েছে। হে পূষন (অর্থাৎ জগতের সবকিছুকে যিনি পালন পোষন করেন, সেই সূর্যদেব ) তুমি এই আবরণকে দয়া করে সরিয়ে দাও, যাতে সত্য-সন্ধানী আমি সত্যকে দর্শন করতে পারি।

আমরা জানি, এই যে স্থূল জগৎ আমাদের চোখের সামনে ভাসছে, তার পালন-পোষন করতে হচ্ছেন, সূর্যদেব। জগতের যাবতীয় বস্তু ও জীবনের উৎস হচ্ছে সূর্য। সূর্য অগ্নির গোলক মাত্র। এই সূর্য যেন একটা উজ্বল সোনার পাত্র। এই সূর্য্যের রশ্মি, সমস্ত বস্তুকে আলোকিত করছে, প্রকাশ করছে। কিন্তু এই অতি-উজ্জ্বল সূর্য্যের দিকে আমরা চোখ রাখতে পারি না। সূর্য্যের দিকে তাকালে, আমরা যেন কিছুই দেখতে পাই না, সূর্য আমাদের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। এই উজ্জ্বল বর্ণের সূর্য্যের অন্তরালে কি এমন আছে, কোন সত্য লুকিয়ে আছে, যা আমাদেরকে বাঁচা-বাড়ার শক্তি যোগাচ্ছে ? আমরা সেই সত্যরূপ পরমব্রহ্মকে দেখতে চাই, কিন্তু আমরা তা দেখতে পাচ্ছি না, কারন তোমার (প্রখর তেজসম্পন্ন সূর্য্যের) দিকে তাকালে আমরা চোখে অন্ধকার দেখি। আমরা সেই সত্য-ব্রহ্মের সন্ধান করছি, যা তোমার প্রখরতার কারনে প্রত্যক্ষ করতে পারছি না। তাই আমরা সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা করছি, তোমার এই সোনার বরণ অতি উজ্বল ঢাকনা সরিয়ে নাও - যাতে আমরা সত্য ব্রহ্মের সাক্ষাৎ করতে পারি।

জগতের সমস্ত বস্তুই এই আলোর গোলকে ঢাকা। আমরা যা কিছু দেখছি, তা আসলে একটা আলোর মোড়কে ঢাকা। তাই আমাদের কাছে সত্য প্রতিভাত হচ্ছে না।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, বৃহদারণ্যক উপনিষদের কথা, সেখানে ঋষি বলছেন, যিনি সত্যব্রহ্ম ইনিই আদিত্য। এই আদিত্য পুরুষ রশ্মি অবলম্বন করে, অক্ষি পুরুষে (চোখে) প্রতিষ্ঠিত, আবার অক্ষিপুরুষ ইন্দ্রিয়সকলের সহায়ে আদিত্যপুরুষে প্রতিষ্ঠিত। জীবাত্মা যখন দেহত্যাগ উদ্যত হয়, তখন এই আদিত্যমন্ডলকে রশ্মিহীন দেখেন, তখন এই রশ্মিসকল এনার নিকটে আসে না।

এখনকথা হচ্ছে সত্যকে দেখবার জন্য, আলোর প্রয়োজন। আর এই আলো হচ্ছে, জ্ঞানের আলোক। এই জ্ঞান-আলোকের সাহায্যে আমাদের বিচারবুদ্ধি জাগ্রত হবে, আমাদের বিবেকজ্ঞানের উন্মেষ হবে। তখন সেই সত্য আমাদের কাছে উদ্ভাসিত হবে, যা অপরিবর্তনশীল, যা অক্ষয়, যা চিরন্তন, যা ধ্রুব। তাই উপনিষদে প্রার্থনা করা হচ্ছে, সত্য আমাদের কাছে প্রকাশিত হোক, আমরা যেন অজ্ঞান অন্ধকারের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে না ফেলি। সূর্যই আলো , জ্ঞানই আলো, যা সত্যকে আবরণহীন করে। হে সূর্যদেব, হে জ্ঞান, তুমি তোমাকে অবরণহীন করো, তুমি তোমার প্রখরতা স্তিমিত করো - যাতে আমরা সত্যকে প্রতক্ষ্য করতে পারি।
-------------------


ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-১৬)

পূষন্নেকর্ষে যম সূর্য প্রাজাপত্য
বূহ্য রশ্মীন সমুহ তেজঃ।
যত্তে রূপং কল্যানতমং তত্তে পশ্যামি
যোহসাবসৌ পুরুষঃ সোহহমস্মি (১৬) শুক্ল যজুর্বেদে মন্ত্র নং- ?

পূষন্নেকর্ষে - পূষন-একর্ষে = হে পূষন, অর্থাৎ জগতের পোষন কারী সূর্যদেব, একাকী বিচরণকরী
যম সূর্য প্রাজাপত্য - যম অর্থাৎ মৃত্যুর দেবতা বা সর্ব্বনিয়ন্তা, সূর্য প্রজাপতির প্রিয়
বূহ্য রশ্মীন সমুহ তেজঃ - এই রশ্মিসমূহকে, তেজকে সরিয়ে নিন।
যত্তে রূপং কল্যানতমং তত্তে পশ্যামি - যাতে তোমার যে কল্যাণময় রূপ তা আমি দেখতে পাই।
যোহসাবসৌ পুরুষঃ - যঃ-অসৌ-অসৌ - পুরুষঃ = যাতে সেই (সূর্য্যমন্ডলে ) সেই (ওই পরমপুরুষকে)
সোহহমস্মি - সঃ-অহম-অস্মি = তিনিই আমি হই।

হে জগৎ-পোষণকারী, নিঃসঙ্গ, হে সর্বনিয়ন্তা, হে প্রজাপতিপ্রিয় সূর্যদেব, দয়াকরে তুমি তোমার তেজঃরশ্মিকে সম্বরন করো। আমি তোমার কল্যানতম রূপ দেখতে চাই। আমিই সেই পুরুষ, যিনি তোমার মধ্যে রয়েছেন।

সূর্যই জগতের পালক-পোষক। এই পূষন-একর্ষ একাকী বিচরণকারী, সর্ববজ্ঞানের আধার। ইনি জগতের নিয়ন্তা তাই, এঁকে যম অর্থাৎ কল্যাণকারী বলা হচ্ছে। সমস্ত প্রাণী প্রজাপতি-ব্রহ্মা থেকে এসেছে, এই প্রজাপতির অত্যন্ত প্রিয় হচ্ছে, সূর্যদেব। এই সূর্য বাহ্যত আলোক প্রদান করে, আবার সূর্যতেজ হচ্ছে, ঈশ্বরের শুদ্ধিকরণ ঔষধ। সূর্যতেজ জগতের সমস্ত কিছুকে শুদ্ধ করে থাকে। কিন্তু এই সূর্য্যতেজ এতটাই প্রখর যে তা সাধারনের সহ্যাতীত। তাই উপনিষদের ঋষিগণ প্রার্থনা কছেন, যেন এই সূর্য্যের তেজ কিঞ্চিৎ সম্বরণ হলে, আমি সেই কল্যানতম রূপের দর্শন করতে পারি।
সূর্যকে হিন্দুশাস্ত্র ব্রহ্ম-এর প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। শুধু তাই হয়, যাঁরা দেব-দেবতার মূর্তিধ্যানের মধ্যে যেতে চান না, তাদেরকে এই জ্যোতিঃ বা প্রভাত সূর্য ধ্যানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সূর্য হচ্ছেন, প্রতক্ষ্য দেবতা। এই সূর্যের অসীম শক্তি ও স্বর্ণাভ সৌন্দর্য আমাদের উপল্বদ্ধির মধ্যে সহজেই জাগ্রত হতে পারে। আর এই সূর্য থেকে যদি আমরা তার কিঞ্চিৎ শক্তি, বা সৌন্দর্য্য প্রাপ্ত হতে পারি, তবে আমরা কৃতার্থ হয়ে যেতে পারি। এইপার্থিব সূর্য থেকে যে তেজঃরশ্মি প্রতিনিয়ত বিকিরিত হচ্ছে, তা যেমন জগতের শুদ্ধিকরনে সাহায্য করে, তেমনি আমাদের ভয়, আমাদের আশঙ্কা দূর করতে সাহায্য করে। এই সূর্যই জগতের প্রকাশক। এই সূর্য রশ্মির মধ্যেই অসংখ্য গুনের সমাহার। এই সূর্যই বীজকে অঙ্কুরে রূপান্তরিত করে। এই সূর্যই আমাদের জ্ঞানের আলোক প্রদান করতে পারে। সূর্য্যের প্রকাশের ফলেই আমাদের বিষয়জ্ঞান হচ্ছে। বলা হয়, জীব এই সূর্য্যরশ্মির সাহায্যেই লোক থেকে লোকান্তরে যাতায়াত করে থাকে। মৃত্যুকালে জীবাত্মা এই সূর্য্যরশ্মি, বা চন্দ্ররশ্মি-তে আরোহন করে, বাঞ্চিত লোকে গমন করে। এই সূর্য-ধ্যানের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সাধক নিজের স্ব-রূপের উপলব্ধি করতে পারে। অর্থাৎ আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারে। আত্মসংযম, বৈরাগ্য, ও সূর্য্-ধ্যান সাধককে আত্মস্থিত করতে পারে। তখন অনুভবে আসে যে, বিশ্ব-আত্মা ও জীবাত্মার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এ-দুটোই অভিন্ন।
----------------
ঈশ উপনিষদ -(শ্লোক নং-১৭-১৮)

বায়ুরনিলমমৃতমথেদং ভস্মান্তং শরীরম
ওঁ ক্রুতো স্মর কৃতং স্মর ক্রুতো স্মর কৃতং স্মর। শ্লোক-১৭ (শুক্ল যজুর্বেদে মন্ত্র নং- ১৭)

বায়ুরনিলমমৃতমথেদং ভস্মান্তং শরীরম - বায়ুঃ-অনিলম-অমৃতম - এখন আমার প্রাণবায়ু মহাবাযুতে (বিশ্বপ্রাণে) বিলীন হোক।
অথ-ইদং ভস্মান্তং শরীরম - এখন এই শরীর ভস্মিভূত হোক।
ওঁ -- ঈশ্বরের নাম
ক্রুতো স্মর - ভগবানকে স্মরণ করো,
কৃতং স্মর - নিজের কৃত কর্ম্মসমূহকে স্মরণ করো
ক্রুতো স্মর - স্মরণীয়কে স্মরণ করো
কৃতং স্মর - আবার নিজের কৃত কর্ম্মসমূহের স্মরণ করো।

(শেষ হয়ে এলো জীবন প্রবাহ ) এখন প্রার্থনা করি, আমার প্রাণবায়ু যেন বিশ্বপ্রাণের সঙ্গে বিলীন হয়ে যায়। এই দেহ যেন আগুনে পুড়ে ভষ্ম হয়ে যায়। যাকিছু তোমার দ্বারা কৃত হয়েছে তাকে স্মরণ করো। অক্ষর ব্রহ্মকে স্মরণ করো। বারবার নিজকৃত (শুভ) কর্ম্মের স্মরণ করো।

জীবন সায়াহ্নে এসে, আমরা যখন মৃত্যুর সম্মুখীন হই, তখন আমরা কত কিছুই না চিন্তা করি। কত কিছুই তো করা হলো না। কত কাজ বাকি রয়ে গেল। নাতির বিয়েটা দেওয়া হলো না। বিষয় আশয় যা কিছু সারা জীবন ধরে সংগ্রহ করেছি, তার রক্ষা কে করবে ? আমি চলে গেলে, এদের (ছেলে-মেয়ে-পরিবার) কি হবে। এমনি এ নানান চিন্তা মাথার মধ্যে এসে ভিড় করে। মন উতলা হয়ে ওঠে একসময় নিজেকে অসহায় বলে মনে হয়। কিন্তু চিন্তা ছাড়তে পারি না। অবশ্য চেষ্টাও করি না। উপনিষদের ঋষি বলছেন, মৃত্যুর সময় মানুষের মনের মধ্যে নানান চিন্তার উদ্রেগ হয়। কিন্তু এইসময় আমাদের কেবল সেই ভগবানের স্মরণ করা উচিৎ। সারা জীবন যা কিছুই করা হোক না কেন, জীবনের শেষে এসে, কেবল মাত্র শুভ চিন্তার উদ্রেগ করা উচিত। জগৎ যেমন ছিল তেমনই পরে রইবে, আমি চলে যাবো, কোথায় যাবো, তা আমরা জানি না। মহাত্মাগণ বলছেন, তুমি মৃত্যুকালে যেমন চিন্তা করবে, পরবর্তীতে তুমি সেইমতো লোক প্রাপ্ত করতে পারবে। তাই উপনিষদের বাণী হচ্ছে, মৃত্যু কালে আমাদের তাঁর অর্থাৎ সেই পরমপিতা-পরমেশ্বরের স্মরণাপন্ন হওয়া উচিত। বার বার চেষ্টা করে, বিষয় চিন্তা থেকে নিজেকে সরিয়ে ঈশ্বর চিন্তন করা উচিত। এমনকি আমরা যারা মৃত্যু পথযাত্রীর মৃত্যুশয্যার কাছে উপস্থিত থাকি, তাদেরও ঈশ্বরের কাছে আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থনা করা উচিত। প্রার্থনার বা গুণকীর্তনের মূল্য অপরিসীম।

অগ্নে নয় সুপথা রায়ে অস্মান
বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান ।
যুযোধ্যস্মজ্জুহুরাণমেনো
ভূয়িষ্ঠাং তে নম-উক্তিং বিধেম । শ্লোক-১৮ (শুক্ল যজুর্বেদে মন্ত্র নং- ১৬)

অগ্নে - হে অগ্নি,
নয় - নিয়ে যাও ,
সুপথা - সুপথে
রায়ে -- শুভ কর্ম্মফল লাভের উদ্দেশ্যে
অস্মান - আমাদেরকে
বিশ্বানি - সমস্ত
দেব - হে দেব
বয়ুনানি - কর্ম্মসকলকে
বিদ্বান - (আপনি) জ্ঞাত আছেন।
যুযোধ্যস্মজ্জুহুরাণমেনো - যুযোধি-অস্মৎ-জুহুরাণম-এনঃ = সকল অশুভ কর্ম্মের ফল আমার কাছ থেকে দূর করুন
ভূয়িষ্ঠাং তে নম-উক্তিং বিধেম = বারবার নমস্কার বচন উচ্চারণ করি ।

হে অগ্নি দেবতা, যা আমার পক্ষে হিতকর, সেই শুভফল লাভের উদ্দেশ্যে, অনুগ্রহ করে আমাকে সেই সুপথে চালিত করুন। আমার সমস্ত কৃতকর্ম্ম সমন্ধে আপনি জ্ঞাত আছেন । সকল অশুভ কর্ম্মের ফল আমার কাছ থেকে দূর করুন । বারবার আমি নমস্কার বচন উচ্চারণ করি ।

অগ্নিদেবের কাছে, আমাদের প্রার্থনা, আমরা জানি না, আমাদের পক্ষে হিতকর কোন পথ। আমাদের পক্ষে যা কিছু হিতকর, তা লাভের জন্য, আমাদেরকে সুপথে চালিত করুন। মৃত্যুর পরে, আমাদের এই স্থূল শরীর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, কিন্তু সূক্ষ্ম শরীর থাকবে। এই সূক্ষ্ম শরীরে আমাদের সূক্ষ্ম ইন্দ্রিসকল সহ কৃতকর্ম্ম সংস্কারের আকারে আমাদের মধ্যে থাকবে। এসবই জড় কিন্তু সূক্ষ্মরূপে অব্যক্ত অবস্থায় থাকবে। বলা হয়, যার যেমন কর্ম্মফল সঞ্চিত হয়েছে, তা তখন পূর্ব পূর্ব জীবনের প্রারব্ধর সঙ্গে মিশে আমার ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্দিষ্ট করবে, গন্তব্যলোক নির্দিষ্ট করবে। যার যেমন কর্ম্ম সেই অনুযায়ী জীবাত্মা হয় পিতৃলোক, নয় দেবলোকে প্রবেশ করবে। সেখানকার স্থিতিকাল শেষ হয়ে গেলে, আবার এই কর্ম্মদেহে কর্ম্ম লোকে প্রবেশ করবে। এই আসা যাওয়া চলতেই থাকে জন্ম থেকে জন্মান্তর যাবৎ। কিন্তু যেদিন মানুষের স্বরূপের জ্ঞান হয়, যেদিন সমস্ত কামনা বাসনার বিলোপ হয়, সেদিন জীবনের অসারতা উপল্বদ্ধিতে আসে। আর যে মুহূর্তে মানুষ সংসারের অসারতা বুঝতে পারে, সেদিন থেকে মানুষ ত্যাগ-বৈরাগ্যের পথ অবলম্বন করে, অপার্থিব জগতের বাসিন্দা হয়ে যায়। একদিন জীবাত্মা যেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কর্ম্ম জগতে প্রবেশ করেছিল, আবার সেই পরমাত্মায় বিলীন হয়ে সচ্চিদানন্দ স্বরূপ হয়ে যায়। এই হচ্ছে মুক্তি।
ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণ মুদচ্যতে
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওঁং

ওঙ্কাররূপ ব্রহ্ম অনন্ত এই জগৎও অনন্ত। এই জগৎ সেই ব্রহ্মের উপরে আরোপিত সত্য মাত্র। তো ব্রহ্ম থেকে জগৎকে সরিয়ে নিলে, সেই ব্রহ্ম অনন্তই থাকেন। আমাদের ত্রিবিধ শান্তি হোক।

ঈশ উপনিষদ বা ঈশাবাস্যঃ উপনিষদ সমাপ্ত হলো।












 

 

 
















   
 



Saturday 13 May 2023

অষ্টবক্র গীতা যথাযথ

 

তারিখ : ০৯-০৪-২০২৩ 


ভূমিকা : 

অষ্টাবক্র গীতা অদ্বৈতবাদের একটি প্রাচীন ও অদ্বিতীয় গ্রন্থ। হয়তো  মহাভারতের রচনাকালেরও আগে বা রামায়ণের সময়েরও পূর্বে এই অষ্টাবক্রমুনির জীবনকাল প্রবাহিত হয়েছিল। এমনও হতে পারে, মহাভারতকার ব্যাসদেবের সমসাময়িক বা  আরো বেশী বয়োবৃদ্ধ ছিলেন, এই অষ্টাবক্র মুনি। মহর্ষি ব্যাসদেবের পুত্র শুকদেবের গুরু ছিলেন,  ঋষি জনক। জানিনা ব্যাসদেব এক না একাধিক। এমনকি এই জনক নামের রাজা এক না একাধিক, তাও  বলা মুশকিল। কেননা শ্রীরাম-পত্নি সীতা ছিলেন রাজা জনকের কন্যা। এমনও হতে পারে, কোনো এক দেশের রাজার উপাধি ছিল, জনক অর্থাৎ পিতা। এই দেশের সমস্ত রাজাকেই হয়তো বলা হতো জনক। তো কোনো এক জনক রাজার শিষ্য ছিলেন, ব্যাসপুত্র শুকদেব। আর রাজা জনকের গুরু ছিলেন, অষ্টাবক্র মুনি। অষ্টাবক্রের পিতা ছিলেন, ঋষি কহোড়। মাতা সুজাতা। মাতামহ ছিলেন, ঋষি উদ্দালক। আর মাতুল ছিলেন, শ্বেতকেতু। অষ্টাবক্রের উপাখ্যান মহাভারতের বনপর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। 

যাইহোক, আমাদের উদ্দেশ্য স্রষ্টাকে  জানা নয়, সৃষ্টিকে জানা ।  তাই আমরা সরাসরি সৃষ্টির মধ্যে প্রবেশ করবো। অর্থাৎ অষ্টাবক্র গীতার মধ্যে প্রবেশ করবো। 
অষ্টাবক্র গীতা আসলে, গুরুশিষ্যঃ সংবাদ।  গুরু ঋষি অষ্টাবক্র,  শিষ্য রাজা জনক। শিষ্য গুরুকে প্রশ্ন করছেন।  হে গুরুদেব, আমার প্রভু, কিভাবে আমার তত্ত্বজ্ঞান লাভ হবে ? কিভাবেই বা আমার মুক্তি হবে ? কিভাবেই বা আমি বৈরাগ্য প্রাপ্ত হতে পারবো ? 
সরাসরি প্রশ্ন দিয়ে, অষ্টাবক্র গীতার শুরু। এই প্রশ্ন একেবারে আমাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভের প্রথম এবং শেষ প্রশ্ন। আমাদের সবার আকুল হৃদয়ের প্রশ্ন। আসলে সত্যিকারের জিজ্ঞাসুর মধ্যে  প্রশ্ন জাগে। আর আমরা প্রশ্ন করি।
--------------------------------------------------


শ্রীঅষ্টাবক্র গীতা। 

বিষয়সূচি :

প্রথম প্রকরণ : আত্মানুভব সম্পর্কে ঋষি অষ্টাবক্রের উপদেশ 
দ্বিতীয় প্রকরণ : আত্মানুভব সম্পর্কে রাজর্ষি জনকের উপলব্ধি 
তৃতীয় প্রকরণ : শিষ্যের আত্মজ্ঞানের পরীক্ষা 
চতুর্থ প্রকরণ : আত্মানুভবের কারনে রাজর্ষি জনকের উল্লাস  
পঞ্চম প্রকরণ : ঋষি অষ্টাবক্র উক্ত লয়-সাধনা 
ষষ্ঠ প্রকরণ : রাজর্ষি জনকের লয়-সাধনায় অভাববোধ 
সপ্তম প্রকরণ : রাজর্ষি জনকের লয়-সাধনার ফল অনুভব  
অষ্টম প্রকরণ :  অষ্টাবক্র উক্ত বন্ধ-মোক্ষ ব্যবস্থা নিরুপন 
নবম প্রকরণ : অষ্টাবক্র উক্ত নির্বেদ সাধনা 
দশম প্রকরণ : অষ্টাবক্র উক্ত বিষয়তৃষ্ণা উপশম সাধনা 
একাদশ প্রকরণ : অষ্টাবক্র উক্ত জ্ঞানসাধনা 
দ্বাদশ প্রকরণ :  রাজর্ষি জনক উক্ত জ্ঞানসাধনার স্বানুভব 
ত্রয়োদশ প্রকরণ : রাজর্ষি জনক উক্ত সাধনার ফল বিবরণ 
চতুর্দশ প্রকরণ : রাজর্ষি জনক উক্ত স্বকীয় প্ৰমানন্দের অবস্থা বর্ণন 
পঞ্চদশ প্রকরণ : অষ্টাবক্র উক্ত তত্ত্ব-উপদেশ 
ষোড়শ প্রকরণ : অষ্টাবক্র উক্ত তত্ত্বজ্ঞানের বিশেষ উপদেশ 
সপ্তদশ প্রকরণ : অষ্টাবক্র উক্ত তত্তজ্ঞ পুরুষের স্থিতি বর্ণন 
অষ্টাদশ প্রকরণ : অষ্টাবক্র উক্ত তত্তজ্ঞ পুরুষের শান্তিস্থিতি বর্ণন 
ঊনবিংশ প্রকরণ : রাজর্ষি জনক উক্ত কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন 
বিংশ প্রকরণ : রাজর্ষি জনকউক্ত  জীবনমুক্তি-দশা  বর্ণন।  
------------------------------
 

প্রথমং প্রকরণম - আত্মানুভব-উপদেশ বর্ণনং নামকং। 

জনক উবাচ :
যাইহোক, রাজা জনক বলছেন, 
কথম্ জ্ঞানম অবাপ্নোতি – জ্ঞান লাভের উপায় বলুন ।
কথম্ মুক্তির্ভবিষ্যতি – মুক্তি কি ভাবে হবে ?
বৈরাগ্যং চ কথম্ প্রাপ্তম – বৈরাগ্য-ই বা কি ভাবে প্রাপ্ত হয় ?
এতদ্ ব্রূহি মম প্রভো – আমার প্রভু, এই সমস্ত আমাকে বলুন ।

সরাসরি আধ্যাত্মিক প্রশ্ন দিয়ে অষ্টাবক্র সংহিতার শুরু। কোনো ভূমিকা নয়। সরাসরি প্রশ্ন : ১) হে প্রভু,জ্ঞান কি করে লাভ করা যায় দয়া করে বলুন। ২) মুক্তি কী ভাবে হবে ? ৩) বৈরাগ্য কি ভাবে পাওয়া যায় ?
ভগবৎ গীতা যাঁরা পড়েছেন, তারা দেখেছে,  - অর্জুনই প্রথম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জ্ঞান দেওয়া শুরু করেছিল। প্রথমে তো আদেশ - "হে অচ্যুত ! উভয় সেনার মধ্যে আমার রথ স্থাপন করো।" পরে কাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে তা দেখে, তার মধ্যে মায়া, মমতা, স্নেহ, শ্রদ্ধা, প্রভৃতি কমনীয় গুনের জাগরণ ঘটে। অহিংস সাত্বিক ভাব জেগে ওঠে। হিংসা ছেড়ে, যুদ্ধ ছেড়ে - বৈরাগী হতে  চাইলো। আর এর স্বপক্ষে নানান  যুক্তি খাড়া করে, কৃষ্ণকে বোঝাতে চেষ্টা করলো।  অর্জুনের আদৌ আধ্যাত্মিক জ্ঞান পাবার ইচ্ছেই ছিল না। তার জিজ্ঞাসার কোনো আধ্যাত্মিক দিকও  নেই। অর্জুন কেবলমাত্র নিজের সাময়িক অহিংস-নীতির পক্ষে শ্রীকৃষ্ণের সমর্থন চাইছিলো।

আবার  কঠোপনিষদ যেখানে আমাদের আত্মা সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য পাই, সেখানে দেখছি, গুরুদেব-যমরাজের  কাছে, নচিকেতা নিজের ইচ্ছেতেও যায় নি। এমনকি  সশরীরেও যমরাজের কাছে যেতে পারেনি। তার কোনো প্রশ্নও ছিলোনা। স্রেফ যমরাজ তিনটি বর দিতে চেয়েছিলো, তাই কি চাইবেন, কি চাইবেন ভেবে তিনটি বর প্রার্থনা করেছিল : ১) আমার পিতা যেন আমার সন্মন্ধে দুশ্চিন্তা না করেন  - আমার প্রতি যেন তার রাগ না থাকে - আমি আবার মানুষ হিসেবে ফিরে গেলে যেন আমাকে সবাই চিনতে পারে। ২) স্বর্গ প্রাপ্তি - অর্থাৎ দুঃখহীন ভোগের রাজত্বে যাবার রাস্তা বলে দাও। ৩) তিন নম্বর প্রশ্নটি ছিল আত্মার অস্তিত্ব - অনস্তিত্ব্য সম্পর্কে জ্ঞান। আসলে এই শেষ প্রশ্নটার জন্যই কঠোপনিষদ মান্যতা পেয়েছে। প্রথম  দুটো-তো আধ্যাত্মিক  প্রশ্ন,নয়, বরং বলা যেতে পারে, বৈষয়িক প্রত্যাশা পূরণ  । তৃতীয় প্রশ্নে  অধ্যাত্বিকতার ছোঁয়া থাকলেও যমরাজ নানান বাহানায় তাকে জবাব দিতে চাইছিলো না। নচিকেতাকে সে উপযুক্ত মনেই করছিলো না। যাক সে সব কথা -

রাজা জনক বলছেন, মুক্তি কিভাবে হবে ? অর্থাৎ রাজা জনক মুক্তির প্রত্যাশী। রাজা জনক ছিলেন, একজন স্বাধীন দেশের স্বাধীন রাজা। তো তাকে কে বেঁধে রেখেছে, যে তিনি মুক্তি চাইছেন ? আসলে আমরা যে বদ্ধজীব, আমাদের এই  ধারণাই নেই।   আমাদের মুক্তির ইচ্ছেও  জাগে না। বন্ধন হচ্ছে, ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে জীব বা জীবাত্মা ভাবা। বন্ধন  হচ্ছে দেহ শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়া, কর্ম্মবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। তাহলে কি স্থুল দেহত্যাগ বা মৃত্যুই  আমাদের মুক্তির পথ ?  না মুক্তি হচ্ছ অজ্ঞানতা  থেকে মুক্তি। আত্মজ্ঞানলাভই মুক্তি।  এই আত্মজ্ঞান লাভের জন্য ব্যাকুলতা জেগেছে, রাজা জনকের মধ্যে। আর ঋষি অষ্টাবক্র মোক্ষার্থীকে উপদেশ দিচ্ছেন। 
যোগাচার্য্য বলছেন : রাজর্ষি জনক ঋষি অষ্টাবক্রকে বলছেন : হে প্রভু, জ্ঞান লাভের উপায় বলুন, নিজেকে জানার উপায় বলুন। মুক্তি কি ভাবে হবে, অর্থাৎ বদ্ধ অবস্থা থেকে আমার কিভাবে মুক্তি হবে। বৈরাগ্য-ই বা কি ভাবে প্রাপ্ত হয় ?  বৈরাগ্য  অর্থাৎ বিয়ের প্রতি আমার কিভাবে বিরাগ উৎপন্ন হবে।  হে আমার প্রভু, এই সমস্ত আমাকে বলুন ।

অষ্টাবক্র উবাচ 
মুক্তিম ইচ্ছসি চেত্তাত বিষয়বান বিষবৎ ত্যজ 
ক্ষমা-আর্জব-দয়া-তোষ-সত্যং পীযূষবদ ভজ (১/২)

ঋষি অষ্টাবক্র বলছেন, মুক্তির ইচ্ছা চিত্ততে জাগলে বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করো। আর ক্ষমা-আর্জব-দয়া-তোষ-সত্য ইত্যাদি গুনগুলোকে অমৃতসুধা  মনে করে ভজনা করো।  

ন পৃথ্বী - ন জলং – ন অগ্নিঃ – ন বায়ুঃ – ন দৌঃ বা ভবান্
এষাং সাক্ষিনম্ আত্মানং চিদ্রূপং(চিৎ -রূপম) বিদ্ধি মুক্তয়ে (১/৩)।

হে শিষ্য, তুমি পৃথিবী (মাটি ) নয় - জল নয় - অগ্নি নয় - বায়ু নয় - আকাশ নয়। এ সকলের সাক্ষী আত্মাকে তুমি মুক্তি লাভার্থে চৈতন্য রূপে অবগত হও।

যদি দেহং পৃথক্ কৃত্য চিতি বিশ্রাম্য তিষ্ঠসি 
অধুনৈব সুখী শান্তো বন্ধমুক্তো ভবিষ্যসি। (১/৪)

যদি দেহাদি পৃথক করে, চৈতন্যে বিশ্রাম করিতে পারো, তবে এখনই সুখী, শান্ত, বন্ধনমুক্ত হতে পারো। 

ন ত্বং বিপ্রাদিকো বর্ণো ন আশ্রমী ন অক্ষগোচরঃ
অসঙ্গঃ অসি নিরাকারো বিশ্বসাক্ষী সুখী ভব। (১/৫)

তুমি ব্রাহ্মণ বা অন্যকোনো বর্ন (ক্ষত্রিয় , বৈশ্য , শুদ্র ) ভুক্ত নয় - আশ্রমী বা আশ্রমবাসী নও - চক্ষু দ্বারা গোচরযোগ্য নয় - নিরাকার - বিশ্বসাক্ষী - সুখী হও।

ধর্ম্মাধর্ম্মৌ সুখং দুঃখং মানসানি ন তে বিভো
ন কর্তা অসি ন ভোক্তা অসি মুক্ত এব অসি সর্বদা। (১/৬)

ধর্ম্ম-অধর্ম্ম, সুখ-দুঃখ মনের ধৰ্ম , বিভো-তে এসব নেই। (তুমি ) কর্তা নও ,ভোক্তা নও, সর্বদা মুক্ত।

একো দ্রষ্টাসি সর্বস্য মুক্ত প্রায়ঃ অসি সর্বদা
অয়মেব হি তে বন্ধো দ্রষ্টারং পশ্যসীতরম্। (১/৭)

তুমি সর্ব শরীরের একমাত্র ব্যাপক দ্রষ্টা, দেহাধ্যাস বসতঃ বদ্ধ  প্রতীয়মান হলেও তুমি আসলে মুক্ত। তথাপি আত্মাকে দেহাদি পরিচ্ছিন্নরূপেই তুমি জেনে থাকো, এটিই তোমার বন্ধন।

অহং কর্তা ইতি অহং মানো মহাকৃষ্ণ-অহি দংশিতঃ
নাহং কর্তেতি বিশ্বাস-অমৃতং পীত্বা সুখী ভব। (১/৮)

আমি কর্তা এই অহঙ্কাররূপ মহান কৃষ্ণ সর্প কর্তৃক দংশিত হয়েছে। আমি কর্তা নই এই বিশ্বাস রূপ অমৃত পান করে তুমি সুখী হও।

একো বিশুদ্ধ বোধঃ অহম ইতি নিশ্চয় -বহ্নিনা
প্ৰজ্বাল্য অজ্ঞানগহং বীতশোকঃ সুখী ভব। (১/৯)

-আমি এক ও বিশুদ্ধ, গভীর অজ্ঞান অরণ্যে, এই বোধ - বহ্নির ন্যায় প্রজ্জলিত করো - শোক রোহিত হও - সুখী হও।

 যত্র বিশ্বম ইদং ভাতি কল্পিতং রজ্জু সর্পবৎ
আনন্দ পরমানন্দঃ স বোধস্ত্যং সুখং চর। (১/১০)

রজ্জুসর্পের ন্যায় কল্পিত এই বিশ্ব যে বোধস্বরূপে প্রতিভাত হয়, সেই স্বতঃ নিত্য অনন্ত আনন্দ স্বরূপ চিদাত্মা তুমিই ; এইরূপ জেনে সুখে বিচরণ করো।

মুক্ত-অভিমানী মুক্তো হি বদ্ধো বব্ধ-অভিমানী অপি
কিংবদন্তি ইহ সত্যেয়ং যা মতিঃ সা গতির্ভবেৎ। (১/১১)

আমি মুক্ত - এইরূপ যার ভাবনা সেই মুক্ত আর আমি বদ্ধ এইরূপ যার ভাবনা সেই বদ্ধ। যার যেমন মতি তার তেমন গতি - এই কিংবদন্তী সত্য।

আত্মা সাক্ষী বিভুঃ পূর্ণ একো মুক্তঃ চিৎ অক্রিয়ঃ
অসঙ্গো নিঃস্পৃহঃ শান্ত ভ্ৰমাৎ সংসারবান ইব. (১/ ১২) 

আত্মা স্বভাবতই সাক্ষী, বিভু,পূর্ণ, মুক্ত চৈতন্য স্বরূপ , অক্রিয় , অসঙ্গ, নিস্পৃহ ও শান্তস্বরূপ। ভ্ৰম বশতঃ সংসারবান মনে হয়।

কূটস্থং বোধম অদ্বৈতম আত্মানং পরিভাবয়
আভাস অহং ভ্ৰমং মুক্তা ভাবং বাহ্যম অথান্তরম । (১/১৩)

আমি অহঙ্কাররূপ এই ভ্রম, দেহাদি আমার, এই বাহ্যভাবনা এবং আমি সুখী দুঃখী এই বিমূঢ়  ভাবনাসমূহ পরিত্যাগ করে অকর্তা অসঙ্গবোধস্বরূপ ব্যাপক অদ্বিতীয় আত্মাকে চিন্তা করো।

দেহ-অভিমান-পাশেন চিরং বদ্ধ -অসি পুত্রক
বোধঃ -অহং জ্ঞ্যান -খড়্গেন তন্নিঃকৃত্য সুখী ভব। (১/১৪)

দেহ -অভিমান পাশে চির আবদ্ধ হয়ে আছো আমার পুত্র। জ্ঞান খড়গ দ্বারা এই অহং-বোধ ছিন্ন করে তুমি সুখী হও।

নিঃসঙ্গো নিষ্ক্রিয় অসি ত্বং স্বপ্রকাশো নিরঞ্জনঃ
অয়মেব হি তে বন্ধঃ সমাধিম্ অনুতিষ্ঠসি। (১/১৫)
 
তুমি তো নিঃসঙ্গ, নিষ্ক্রিয়, স্ব-প্রকাশ নির্মল পরব্রহ্ম হয়েও তুমি যে সমাধিরূপ ক্রিয়া অনুষ্ঠান করছো, এটাই তোমার বন্ধন।

ত্বয়া ব্যাপ্তমিদং বিশ্বং ত্বয়ি প্রোতং যথার্থতঃ
শুদ্ধ-বুদ্ধ-স্বরূপ অস্ত্বং মা গমঃ ক্ষুদ্রচিত্ততাম্। (১/১৬)

তুমিই এই বিশ্বে ব্যাপ্ত, তোমাতেই এই বিশ্ব পরিব্যাপ্ত। তুমি সর্বত্র ওতপ্রোত হয়ে রয়েছো। তুমিই শুদ্ধ , বুদ্ধ , এ সবই তোমার স্বরূপ। তুমি ক্ষুদ্র-চিত্ত বা দীন-চিত্ত হয়ে যেও না।

নিরপেক্ষো নির্বিকারো নিৰ্ভয়ঃ শীতলাশয়ঃ
আগাধবুদ্ধি অক্ষুব্ধো ভব চিন্মাত্রবাসনঃ। শ্লোক নং : ১/১৭

তুমি নিরপেক্ষ অর্থাৎ পক্ষ রহিত, নির্বিকার অর্থাৎ বিকার রহিত, নির্ভরঃ অর্থাৎ কারো উপর নির্ভরশীল নয়, অতিশয় শীতল অর্থাৎ সদা শান্ত সুখ স্বরূপ। তোমার অগাধ বুদ্ধি, অক্ষুব্ধো অর্থাৎ কারুর প্রতি তুমি ক্ষুব্ধ নও, সর্ব ক্ষোভ-শুন্য। তুমি চৈতন্যমূর্তি, চৈতন্যেই তোমার বাস বা চৈতন্যেই স্থিতি, তুমিই চৈতন্য।

সাকারমনৃতং বিদ্ধি নিরাকারং তু নিশ্চলম
এতত্-তত্ত্ব-উপদেশেন ন পুনর্ভবসম্ভবঃ।শ্লোক নং ১/১৮ :

সমস্ত সাকার বস্ত অনৃত্য, (অনিত্য) মিথ্যা। তুমি নিরাকারে নিশ্চল হয়ে থাকো। এই তত্ব উপদেশ প্রাপ্ত হয়ে তুমি সেই অনিত্য বস্তূতে বিশ্রান্তি লাভ করলেই, পূনর্ভব অসম্ভব হবে,অর্থাৎ পুনরায় ভব সংসারে আসতে হবে না, বা মোক্ষ লাভ করতে পারবে। 

যথা-এব-আদর্শ-মধ্যস্থে রূপে-অন্তঃ পরিতঃ-তু সঃ
তথৈব অস্মিন্ শরীরে অন্তঃ পরিতঃ পরমেশ্বরঃ।শ্লোক নং ১/১৯ :

দর্পনে প্রতিবিম্বিত দেহাদির অন্তরে ও বাহিরে যেরূপ এক দর্পন পরিব্যাপ্ত হয়ে বিদ্যমান, আত্মাতে অধ্যস্থ এই স্থুল দেহাদির অন্তরে ও বাহিরেও তদ্রুপ এক চিদাত্মাই পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন।

একং সর্ব গতং ব্যোম বহিরন্তর্যথা ঘটে
নিত্যং নিরন্তরং ব্রহ্ম সর্বভূতগনে তথা।শ্লোক নং ১/২০ 

প্রলয় পর্যন্ত স্থায়ীরূপে নিত্য এক মহাকাশ যেরূপ ঘটের অন্তরে ও বাহিরে বিদ্যমান, অবিনাশী ব্রহ্মও তদ্রুপ সর্ব ভূতগনের অন্তরে ও বাহিরে সদা বর্তমান রয়েছেন।

প্রথমং প্রকরণম - আত্মানুভব-উপদেশ বর্ণনং নামকং অষ্টাবক্র গীতা সমাপ্তম।  

দ্বিতীয়  প্রকরণম - শিষ্য-উক্তম-আত্মানুভব-উল্লাস  নামকং। 

অহো নিরঞ্জনঃ শান্তো বোধঃ অহং প্রকৃতেঃ পরঃ
এতাবন্তম অহং কালং মোহেনৈব বিড়ম্বিতঃ। (২/১)

কি আনন্দ ! আমি নিরঞ্জনঃ অর্থাৎ শুদ্ধ নির্মল আত্মা। আমি শান্ত অর্থাৎ সর্ব বিকার রোহিত, সর্ব বিকারেরের উর্ধে। প্রকৃতির উর্ধে, সেই স্বপ্রকাশ চিৎস্বরূপ। এতকাল আমি দেহ ও আত্মার অভেদরূপ মোহে কি বিড়ম্বনাই না ভোগ করছিলাম।

যথা প্রকাশয়ামি একঃ দেহমেনং তথা জগৎ
অতো মম জগৎ সর্বমথবা ন চ কিঞ্চন। (২/২)

আমিই এই অচেতন জগতের প্রকাশক, আবার আমিই স্থুল দেহেরও প্রকাশক। অতএব দৃশ্যত এই দেহাদি সহ সর্ব জগৎ আমাতেই অধ্যস্ত। আমার দেহ বলে কিছু নেই, আমাতেই দেহ, আর জগৎ বলে কিছু নেই, আমাতেই জগৎ।

সশরীরম অহো বিশ্বং পরিত্যজ্য ময়াধুনা
কুতশ্চিৎ কৌশলাদেব পরমাত্মা বিলোক্যতে। (২/৩)

 কি আনন্দ ! এই যে শরীর, এই যে দৃশ্যমান জগৎ, এই সব ত্যাগ করে, এই সবের উর্ধে উঠে, গুরু প্রদত্ব চাতুরীর সাহায্যে, আমি পরমাত্মা এই অনুভবেই বিলোপ বা মগ্ন হয়েছি ।

যথা ন তোয়তো ভিন্নাঃ তরঙ্গাঃ ফেন - বুদ্-বুদাঃ
আত্মনো ন তথা ভিন্নং বিশ্বম-আত্ম-বিনির্গতম। (২/৪)

তরঙ্গ, ফেনা,বুদ্-বুদ্ যেমন জল থেকে ভিন্ন নয়, আত্মা হতে উৎপন্ন বিশ্বও তেমনি আত্মা হতে ভিন্ন নয়।
আমিতো সমুদ্রে উৎপন্ন বুদ্-বুদ্ মাত্র। এক অর্থে আমি তারই মধ্যে তারই সত্বা দিয়ে তৈরি, তারই অংশ মাত্র।

তনতু মাত্রো ভবেদেব পটো যদ্বদ্ বিচারিতঃ
আত্মা-তন্মাত্রমেমেদং তদ্বদ্ বিশ্বং বিচারিতম্। (২/৫)

বিচার করলে দেখা যাবে,পট, তনতু অর্থাৎ সূতা ছাড়া কিছুই নয়। তেমনি বিচার করলে দেখা যাবে বিশ্বও আত্মা মাত্র। 

যথা এব ইক্ষু রসে কল্পতা (কঌপ্তা) তেন ব্যাপ্তা এব শর্করা
তথা বিশ্বং ময়ি কল্পতং (কঌপ্তং) ময়া ব্যপ্তং নিরন্তরম্। (২/৬)

আখের রসে কল্পিত চিনি যেমন মধুর রসের দ্বারা সর্বত ভাবে ব্যাপ্ত হয়ে থাকে, তেমনি আমাতে (আত্মায়) কল্পিত বিশ্বও আমার দ্বারা ভিতরে-বাহিরে সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে।

আত্ম-অজ্ঞান-জগৎ-ভাতি আত্ম-জ্ঞানাৎ-ন ভাসতে
রজ্জু-অজ্ঞানাৎ-ভাতি তজ্ জ্ঞানাদ্ ভাসতে ন হি।(২/৭)

আত্ম বিষয়ক অজ্ঞানতা বশতই জগৎ প্রতিভাত বা দৃশ্যমান মনে হয়। রজ্জুর জ্ঞান হলে আর জগৎ দৃষ্টিগোচর হয় না।

প্রকাশো মে নিজং রূপং নাতিরিক্তো-অস্মি-অহং ততঃ
যদা প্রকাশতে বিশ্বং তাদাহং ভাস এব হি।

নিজের মধ্যেই নিজের রূপের প্রকাশ। এর অতিরিক্ত আমি কিছু নই। আমি আমাতেই প্রকাশিত। যখন বিশ্ব দৃষ্টিগোচর হয় তখন তা আমার দ্বারাই প্রকাশিত হয়ে থাকে।

অহো বিকল্পিতং বিশ্ব অজ্ঞান ময়ি ভাসতে
রূপ্যং শুক্তৌ ফনী রজ্জৌ বারি সূর্যকরে যথা। (২/৯)

অহো ! কাল্পনিক বিশ্ব অজ্ঞানতা বসত আমাতে প্রতিভাত হচ্ছে। ভুল বসত ঝিনুক (শুক্ত) যেমন রুপোর মতো লাগে, দড়ি যেমন সাপের মতো লাগে, সূর্য কিরণে যেমন জল প্রতিভাত হয়, আমিও তেমনি অজ্ঞানবলে কল্পিত এই বিশ্ব দেখছি।

মত্তো বিনির্গতং বিশ্বং ময্যেব  লয়মেষ্যতি
মৃদি কুম্ভো  জলে বীচিঃ কনকে কটকং যথা। (২/১০)

আমা-হতে উৎপন্ন এই বিশ্ব আমাতেই লয় প্রাপ্ত হবে। যেমন কলসি মাটিতে লয় প্রাপ্ত হয়, যেমন জলের মধ্যে বুদ্বুদ বা ঢেউ জন্ম নেয়, আবার জলেই লয় প্রাপ্ত হয়, স্বর্ণ থেকে বিচ্ছুরিত বলয় যেমন স্বর্নতেই বিলোপ প্রাপ্ত হয় - তেমনি আমার থেকে উৎপন্ন এই মায়া-বিশ্ব আমাতেই লোপ পেয়ে যাবে।


অহো অহং নমো মহ্যং বিনাশো যস্য নাস্তি মে
ব্রহ্মাদি-স্তম্ব-পর্যন্তং জগৎ-নাশে-অপি তিষ্ঠতঃ। (২/১১)

আহা ! কি আশ্চর্যরূপ আমি ! আমি সেই আমাকেই নমস্কার করি - যার বিনাশ নাই। ব্রহ্মা ইত্যাদি অচঞ্চল-সহ সর্ব জগতের বিনাশ কালে অর্থাৎ জগতের বিবর্তন কালেও আমি থাকি, আমার বিনাশ নাই সুতারাং এই আমি অবিনশ্বর,  আমাকে নমস্কার।

অহো অহং মহ্যং একঃ অহং দেহবান অপি
ক্বচিন্ন গন্তা নাগন্তা বাপ্য বিশ্বং অবস্থিতঃ। (২/১২)

আহা ! আমি দেহধারী হয়েও আমি এক -অদ্বিতীয়। কোথাও গমনাগমন নেই আমার। সর্ব বিশ্বে আমার অবস্থিতি।
অহো অহং নমো মহ্যং দক্ষো ন অস্তি মৎসমঃ
অসংস্পৃশ্য শরীরেণ যেন বিশ্বং চিরং ধৃতম। (২/১৩)

আহা ! আমি আমাকে নমস্কার করি। আমার মতো দক্ষ কেউ নেই। শরীরের সাথে কোনো সম্মন্ধ না থাকা সত্বেও বিশ্বকে আমি চিরকাল ধারণ করে আছি।

অহো অহং নমো মহ্যং যস্য মে নাস্তি কিঞ্চন
অথবা যস্য মে সর্বং যদ্-বাঙ-মনসঃ-গোচরং। (২/১৪)

আহা ! আমি আমাকে নমস্কার করি। যার কোনোকিছুর সঙ্গেই সন্মন্ধ নেই, আবার সে-ই সব। যাকে বাক্য - মন দ্বারা গোচর করা যায় না। অতএব সেই সর্বসম্বন্ধি আবার সর্ব-অসম্বন্ধি - আমাকে আমি নমস্কার করি।

জ্ঞানং জ্ঞেয়ং তথা জ্ঞাতা ত্রিতয়ং নাস্তি বাস্তবম্
অজ্ঞানাদ্ ভাতি যত্রেদং সঃ-অহম-অস্মি নিরঞ্জনঃ।(২/১৫)

জ্ঞান,জ্ঞেয়, জ্ঞাতা -এই তিনটি বাস্তবে নাই। অজ্ঞানপ্রভাবে এই ত্রিতয় প্রতিভাত হয়। আমিই সেই শুদ্ধ আত্মা, যে প্রপঞ্চরূপ সমস্ত কিছুর সঙ্গে সম্পর্কহীন।

দ্বৈতমূলম অহো দুঃখং ন-অন্য-তস্য-অস্তি ভেষজম
দৃশ্যং-এতৎ-মৃষা সর্বং একঃ-অহং চিদ্রসঃ-অমলঃ। (২/১৬)

আহা ! ভ্রম বসতঃ দ্বৈত ভাবনাই দুঃখের মূল । আমি এক অদ্বিতীয়, মায়া ও তৎকার্যের অতীত ও চিন্মাত্র স্বরূপ। প্রতীয়মান সব কিছু, সব জড়-পদার্থ একান্তই মিথ্যা। এই তত্বজ্ঞানই ত্রিবিধ দুঃখ উপশমের ঔষধ।

বোধ-মাত্রঃ-অহম-অজ্ঞানাৎ-উপাধিঃ কল্পিতো ময়া
এবং বিমৃশতো নিত্যং নির্বিকল্পে স্থিতির্মম। (২/১৭)

আমার অহং বোধ থেকেই আমার অজ্ঞান-উপাধিসমূহ কল্পিত হয়েছে। এটা বিস্মৃত হলেই আমি নির্বিকল্পে স্থিতি লাভ করবো।

ন মে বন্ধো-অস্তি মোক্ষো বা ভ্রান্তিঃ শান্তা নিরাশ্রয়া
অহো ময়ি স্থিতং বিশ্বং  বস্তুতো ন ময়ি স্থিতম্। (২/১৮)  

আমার না আছে আমার বন্ধন, না আছে  মুক্তি। আমাতেই বিশ্ব স্থিত আমি বিশ্বে স্থিত নোই। বিশ্ব আমাতে স্থিত হলেও কোনোকালে (কালত্রয়ে) উহা আমাতে আশ্রিত নহে। এইভাবে  বিচারকারী আমি - আমার নির্মূলা জগৎ ভ্রান্তি শান্ত হয়ে গাছে।

সশরীরম ইদং বিশ্বং ন কিঞ্চিৎ ইতি নিশ্চিতম
শুদ্ধ-চিন্মাত্র আত্মা চ তৎ কশ্মিন কল্পনা অধুনা। (২/১৯)

শরীর সহিত এই বিশ্ব কিছুই নহে (না অসৎ না সৎ) এটা নিশ্চিত। আত্মা শুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ মাত্র। সুতরাং অজ্ঞান নিবৃত্তি হলে, আর জগৎ কল্পনা কিসের উপর হবে ?

শরীরং স্বর্গ-নরকৌ বন্ধ - মোক্ষৌ ভয়ং তথা
কল্পনামাত্রম এব এতৎ কিং মে কার্যং চিদাত্মনঃ। (২/২০)

 শরীর, স্বর্গ, নরক, বন্ধ, মোক্ষ এবং ভয় - এই সকলই কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। অতএব চিদাত্মার কি করণীয় ? অর্থাৎ চিদাত্মার কিছুই করণীয় নাই।

অহো জনসমুহে-অপি না দ্বৈতং পশ্যতো মম
অরণ্যম-ইব সংবৃত্তং ক্ব রতিং করবানি-অহম্। (২/২১)

আহা ! জনসমূহের মধ্যেও দ্বৈত আর দেখতে পারছি না। যেন নির্জন অরণ্যের ন্যায় পর্যবসিত হয়েছে। তাহলে আমি কিসের উপর প্রীতি স্থাপন করবো।

নাহং দেহো ন মে দেহো জীবো নাহমহং হি চিৎ
অয়মেব হয় মে বন্ধ আসীদ্ যা জীবিতে স্পৃহা। (২/২২)

আমি শরীর নোই, শরীরও আমার নয়, (অন্তঃকরণবিশিষ্ট চিদাভাসরূপ ) জীবও আমি নহি। আমি কেবল বিশুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ। জীবন ধারনের স্পৃহাই আমার এতকালের বন্ধন ছিলো। (সচ্চিদানন্দস্বরূপ অনুভব-বলে সেই জীবন ধারনের ইচ্ছাও আর এখন আমার নেই। )

অহো ভুবন-কল্লোলৈঃ-বিচিত্রৈঃ-দ্রাক্ সমুত্থিতম্
ময়ি-অনন্ত-মহা-অম্বাধৌ চিত্তবাতে সমুদ্যতে। (২/২৩)

কি আশ্চর্য্য ! অপার মহা-সমুদ্ররূপ আমাতে চিত্তরূপ পবন উৎপন্ন হয়ে জগৎ-পরম্পরারূপ কতই না বিচিত্র তরঙ্গসমূহ প্রকটিত হয়েছে।

ময়ি-অনন্ত-মহা-অম্ভোধৌ চিত্তবাতে প্রশাম্যতি
অভাগ্যাৎ-জীব-বণিজঃ জগৎপোতো বিনশ্বরঃ। (২/২৪)

সর্ব ব্যাপক চিৎ সমুদ্র রূপ আমাতে সংকল্প বিকল্পাত্মক চিত্ত-পবন শান্ত হলে জীব রূপ বনিকের অভাগ্য অর্থাৎ প্রারব্ধ ক্ষয় বশতঃ দেহাদি বিশিষ্ট এই জগৎরূপ নৌকাও স্বতঃই বিনাশপ্রাপ্ত হয়।

ময়ি-অনন্ত-মহা-অম্ভোধৌ-আশ্চর্যং জীববিচয়ঃ
উদ্যন্তি ঘ্নন্তি খেলন্তি প্রবিশন্তি স্বভাবতঃ।(২/২৫)

আহা ! কি আশ্চর্য্য ! নিষ্ক্রিয় নির্বিকার অপার মহাসমুদ্র-রূপ চৈতন্যস্বভাব আমাতে অবিদ্যা কামকর্মাদি প্রভাবে জীবরূপী তরঙ্গসমূহ যেন কখনো উদয় হচ্ছে শত্রূভাবে কখনও বা পরস্পর তাড়না করছে, কখনো বা মিত্রভাবে খেলা করছে এবং কখনো বা অবিদ্যা কামকর্মাদির ক্ষয়ে  অধ্যাস  রোহিত হয়ে যেন আমাতেই পুনঃ প্রবেশ করছে অর্থাৎ বিলয় প্রাপ্ত হচ্ছে।

শিষ্য-উক্তম-আত্মানুভব-উল্লাস  নামকং দ্বিতীয় প্রকরণম  অষ্টাবক্র গীতা -  সমাপ্তম ।

তৃতীয় প্রকরণম - শিষ্য প্রত্যাক্ষেপদ্বার-উপদেশ নামকং )

অবিনাশিম্ আত্মানং একম্ বিজ্ঞায় তত্ত্বতঃ। 
তব-আত্মজ্ঞস্য ধীরস্য কথং-অর্থ-অর্জনে রতিঃ।। (০৩/০১)

অবিনাশী আত্মাই এক, এই তত্বে যিনি যথার্থরূপে বিজ্ঞ, সেই আত্মজ্ঞের কখনোই অর্থ অর্জনে রতি থাকার কথা নয়। 

আত্মা অজ্ঞানাৎ অহো প্রীতিঃ-বিষয়-ভ্রম গোচরে
শুক্তেঃ-অজ্ঞানতঃ লোভো যথা রজতবিক্রমে। (০৩/০২)

আহা ! আত্মা সম্পর্কে অজ্ঞানতার জন্যই প্রীতিকর বিষয়-ভ্রম গোচরে আসে। ঝিনুকের মধ্যে রুপোর অজ্ঞানই লোভ উৎপন্ন করে থাকে। 
   
বিশ্বং  স্ফূর্তি যত্রেদং তরঙ্গা ইব সাগরে। 
সঃ-অহম -অস্মি-ইতি বিজ্ঞায় কিং দীন ইব ধাবসি।। ০৩/০৩)

সাগর থেকে যেমন তরঙ্গের স্ফূরণ  হচ্ছে, তেমনি যার থেকে এই বিশ্বের প্রকাশ হচ্ছে সেই আমি, আমিই সেই। এই কথা যদি জেনে থাকো, তবে দীনের মতো কিসের পিছনে ধাবিত হচ্ছো ? 

শ্রূত্বা-অপি শুদ্ধ-চৈতন্যম-আত্মনাং-অতি-সুন্দরম্
উপস্থে-অত্যন্ত সংসক্তো মালিন্যম-অধি-গচ্ছতি। (০৩/০৪)

শুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ অতি সুন্দর আত্মার সম্পর্কে শোনা সত্বেও যা চোখের সামনে দেখা যাছে,  বা শোনা যাচ্ছে,  তাতেই আসক্ত হয়ে কোনো আত্মজ্ঞ পুরুষ মলিনতা প্রাপ্ত হতে পারে  না। 

সর্বভূতেষু চ-আত্মানং সর্ব-ভূতানি চ-আত্মনি
মুনেঃ-জানতঃ আশ্চর্য্যং মমত্বম-অনুবর্ততে। (০৩/০৫)

সর্বভূতে আত্মা, আত্মাই সর্বভূতে এই তত্ব জেনেও কোনো মুনির মধ্যে যদি মমত্ববোধ (অহং-বুদ্ধি ) দৃষ্টিগোচর হয় তবে তা বড়োই আশ্চর্যের।

আস্থিতঃ পরম-অদ্বৈতং মোক্ষার্থে-অপি ব্যবস্থিতঃ
আশ্চর্যং কাম-বশগো বিকলঃ কেলি-শিক্ষয়া। (০৩/০৬)

কি আশ্চর্য ! পরম উৎকৃষ্ট অদ্বৈত-তত্বে যিনি স্থিত । এর প্রতি যিনি  আস্থাবান, তিনি কাম-ক্রিয়া-বশীভূত হয়ে কি করে বিকলেন্দ্রিয় হবেন ?

উদভূতং জ্ঞান-দুর্মিত্রম-অবধার্য্য-অতি-দুর্বলঃ
আশ্চর্যং কামম্-আকাঙ্খেৎ কালম-অন্তং-অনুশ্রিতঃ ।    (০৩/০৭)

উদভূত কাম অর্থাৎ বিষয় চিন্তা অতি দুঃখের কারন, কিন্তু  মিত্রের মতো আচরণ করে এবং দুর্বল করে দেয়। এ সব জেনেও, জ্ঞানীজন মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে কামাকাঙ্খা বা বিষয় ভোগের ইচ্ছা কি ক'রে করে ? এটা বড়োই আশ্চার্য্য ?

ইহামূত্র বিরক্তস্য নিত্যানিত্য-বিবেকিনঃ
আশ্চর্যং মোক্ষ-কামস্য মোক্ষাৎ-এব বিভীষিকা। (০৩/০৮)

ইহা অমুত্র অর্থাৎ ইহলোক ও পরলোকের, যাবতীয় ভোগ্য পদার্থ বিষয়ে যিনি বিরক্ত বা  বৈরাগ্যবান , নিত্য অর্থাৎ আত্মা ও অনিত্য অর্থাৎ দেহাদি বিষয়ে সর্বদা বিচার-পরায়ণ এমন মোক্ষকামী জ্ঞানীরও দেহ ত্যাগের ভয়, ধনাদি বিয়োগের ভয় দৃষ্টিগোচর হয় - এ কি আশ্চর্য ? 

ধীরস্তূ ভোজ্য়মানোঃ অপি পীড্যমানঃ অপি সর্বদা
আত্মানং কেবলং পশ্যন্ ন তুষ্যতি ন কুপ্যতি। (০৩/০৯)

পরেচ্ছাবসে বিষয়ভোগ করেও - পরনিন্দা দ্বারা পীড়িত হয়েও জ্ঞানী সদা সুখ-দুঃখ রোহিত থাকেন। আত্ম-অনুভব বলে কখনো সন্তোষ বা ক্রোধাদি দ্বারা কুপিত হন না।

চেষ্টমানং শরীরং স্বং পশ্যতি অন্য্ শরীর বৎ
সংস্তবে চাপি নিন্দায়াং কথং ক্ষুভ্যেৎ মহাশয়ঃ।  (০৩/১০)

চেষ্টমান অর্থাৎ ব্যবহারিক এই নিজের শরীর ও অপরের শরীর যিনি একই দেখেন এবং আত্মাকে যিনি শরীর থেকে ভিন্ন রূপে দর্শন করেন এমন গম্ভীরাত্মা তত্ববিদ মহাপুরুষ স্তূতি বা নিন্দাতে বিক্ষুব্ধ  বা চঞ্চলতা প্রাপ্ত হতে পারেন ? পারেন না। 

মায়ামাত্রমিদং বিশ্বং প্শ্যন বিগত কৌতুকঃ
অপি সন্নিহিতো মৃত্যৌ কথং ত্রস্যতি ধীরধীঃ। (০৩/১১)

পরিদৃশ্যমান এই বিশ্ব জ্ঞানীর কাছে মায়ামাত্র। এর সম্পর্কে কোনো কৌতুহলই তার জাগে না। অতএব মৃত্যুর সম্মুখে  দাঁড়ালেও স্থিতধী পুরুষের কিসের ত্রাস ? কোনো ত্রাস নেই। 

নিঃস্পৃহং মানসং যস্য নৈরাশ্যে অপি মহাত্মনঃ
তস্য-আত্ম-জ্ঞান-তৃপ্তস্য তুলনা কেন জায়তে। (০৩/১২)

নিস্পৃহ অর্থাৎ স্পৃহা শুন্য যার মন সেই মহাত্মার আবার নৈরাশ্য কিসের ? তাঁর আত্মজ্ঞানেই সে তৃপ্ত। তার সঙ্গে কার তুলনা ? তিনি নৈরাশ্যের উর্দ্ধে, পরম-জ্ঞানী পুরুষ। 

স্বভাবাৎ-এব জানানো দৃশ্যমেতন্ন কিঞ্চন
ইদং গ্রাহ্যমিদং ত্যাজ্যং স কিং পশ্যতি ধীরধীঃ। (০৩/১৩)

দৃশ্যমান জগতের স্বভাব (প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল ) যে কিছুমাত্র জানে তার কাছে ত্যাজ্য বা গ্রাহ্য বলে কিছু থাকতে পারে কি ? মুক্ত পুরুষের কাছে, না আছে ত্যাগের স্পৃহা, না আছে গ্রহণ করবার বাসনা। তিনি এসবের উর্দ্ধে। 

অন্তঃ-ত্যক্ত-কষায়স্য নির্দ্বন্দ্বস্য নিরাশিষঃ
যদৃচ্ছয়া-আগতো ভোগো ন দুঃখায় ন তুষ্টয়ে। (০৩/১৪)

মুক্ত পুরুষ, অন্তরে কষায় অর্থাৎ বিষয় বাসনা রোহিত, নির্দ্বন্দ অর্থাৎ দ্বন্দ্বের অতীত, নিরাশিষ অর্থাৎ আশা নিরাশার অতীত - তাই, এমন ব্যক্তি যেমন ইচ্ছা ভোগ করুক না কেন তাতে তার দুঃখও নাই আবার কোনো তুষ্টি বা তৃপ্তিও নেই। 

 শিষ্য প্রত্যাক্ষেপদ্বার-উপদেশ নামকং তৃতীয় প্রকরণম অষ্টাবক্র গীতা  সমাপ্তম । 

চতুর্থ প্রকরণ :

শিষ্য -প্রোক্ত -অনুভব-উল্লাস-ষট্কনাম

এই চতুর্থ প্রকরণে মাত্র ছয়টি শ্লোক। এখানে আত্মজ্ঞ ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হচ্ছে। 

হন্ত-আত্নজ্ঞস্যঃ ধীরস্য খেলতো ভোগলীলয়া
ন হি সংসার-বাহীকৈঃ-মূঢ়ৈঃ  সহ সমানতা। (০৪/০১)

আ মরণ ! আত্মজ্ঞ ব্যক্তি, ধী সম্পন্য ব্যক্তি যতই ভোগ লীলায় রত থাকুন, তিনি কখনোই সংসার-আসক্ত মূঢ় ব্যক্তির সঙ্গে তুলনীয় হতে পারেন না ।

যৎপদং প্রেপ্সবো দিনাঃ শত্রু-আদ্যাঃ সর্ব-দেবতাঃ
অহো তত্র স্থিতো যোগী ন হর্ষম -উপগচ্ছতি। (৪/২)

যে পদ পাবার জন্য দেবগনকেও শত্রূ মনে করা হয়, আবার না পেলে নিজেকে দীনহীন মনে হয় - সেই পদ-অবস্থায় স্থিত থেকেও যোগী কখনও হর্ষান্নিত হন না।

তজ্জ্ঞস্য (তৎ-জ্ঞস্য) পুন্য-পাপাভ্যাং স্পর্শো হ্যন্তর্ন (অন্তঃ ন) জায়তে
ন হ্যাকাশস্য(হি-আকাশস্য) ধুমেন দৃশ্যমানা-অপি সঙ্গতিঃ। (০৪/০৩)

সেই অজ্ঞ পুরুষের অন্তরে পাপ পুন্য স্পর্শ করতে পারে না, যেমন দৃশ্যমান ধোঁয়ার সঙ্গে আকাশের কোনো সম্পর্ক নেই।

আত্মৈব-ইদং জগৎ-সর্বং জ্ঞাতং যেন মহাত্মনা
যদৃচ্ছয়া বর্তমানং তং নিষেদ্ধুং ক্ষমেত কঃ। (০৪/০৪)

সর্ব জগৎকে আত্মা রূপে জেনেছেন যে মহাত্মা, তিনি যেমন ইচ্ছা বর্তমান থাকুন - তার আবার কিসের নিষেধ ? তিনি ক্ষমারও উর্ধে।

আব্রহ্ম-স্তম্ব-পর্যন্তে ভূতগ্রামে চতুর্বিধে
বিজ্ঞস্য-এব হি সামর্থম-ইচ্ছা-অনিচ্ছা-বিবর্জনে। (০৪/০৫)

ইচ্ছা - অনিচ্ছা পরিত্যাগে অশক্ত ব্রহ্মা পর্য্ন্ত সমস্ত প্রাণিকুল (জলচর-স্থলচর-উভচর-আকাশচর)- এর মধ্যে একমাত্র বিদ্বান বা বিজ্ঞই এই ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিবর্তনের সামর্থ রাখে।

আত্মানম-অদ্বয়ং কশ্চিৎ-জানাতি জগদীশ্বরম্
যৎ-বেত্তি তৎ স কুরুতে ন ভয়ং তস্য কুত্র-চিৎ। (০৪/০৬)

আত্মা অদ্বিতীয়। এই জগদীশ্বরকে কশ্চিৎ জানা যায়। যিনি জেনেছেন, তিনি যা কিছু কর্তব্য বলে মনে করেন তাই করেন, তাতে না আছে কোনো ভয়, কেবল প্রারব্ধপালন ।


শিষ্য -প্রোক্ত -অনুভব-উল্লাস-ষট্কনাম চতুর্থ প্রকরণম অষ্টাবক্র গীতা সমাপ্তম 

আচার্য্য-উক্তম লয়-চতুষ্টয়ং নাম পঞ্চম প্রকরণ 

ন তে সঙ্গঃ-অস্তি কেন-অপি শুদ্ধঃ-ত্যাক্তুম-ইচ্ছসি। 
সংঘাত-বিলয়ং  কুর্বন-এব-এবম লয়ং ব্রজ।  (৫/১) 

তোমার কোনো সঙ্গী নেই। তাহলে তুমি কাকে ত্যাগ করতে ইচ্ছে করছো ? কার সঙ্গেই বা সংঘাত করবে ? এইভাবের  বিলয় অর্থাৎ নিরসন  করো।  

উদেতি  ভবতো বিশ্বং বারিধেরিব  বুদ্বুদঃ 
ইতি  জ্ঞাতা-একম-আত্মানমেবমেব লয়ং ব্রজ।  (৫/২)

জলের  মধ্যে বুদবুদ রাশির মতো, তোমাতে এই বিশ্ব  জাত  হচ্ছে। এই জ্ঞানে আত্মাকে জেনে, সেই আত্মজ্ঞানের মধ্যে নিজেকে বিলয় পসাধন  করো।  

প্রতক্ষ্যম-অপি-অবস্তুত্বাৎ-বিশ্বং ন-অস্তি-অমলে ত্বয়ি।  
রজ্জুসর্প ইব ব্যাক্তম-এবম-এব লয়ং ব্রজ। (৫/৩)

যেমন রজ্জুতে সর্পরূপ দৃষ্টিভ্রম হয়, ঠিক তেমনি অবস্তুর এই বিশ্ব প্রত্যক্ষবৎ  মনে হলেও, এর কোনো অস্তিত্ত্ব তোমার নির্মল চৈতন্য স্বরূপে নেই। এই কথা জেনে তুমি বিলয়প্রাপ্ত হও। 

সমদুঃখসুখঃ পূর্ণ আশা-নৈরাশ্যয়োঃ সমঃ 
সমজীবিতমৃত্যুঃ সন্নেবমেব লয়ং ব্রজ।  (৫/৪)

সর্ববিষয়ে সমভাব অর্থাৎ সুখ-দুঃখ, আশা নিরাশা, জীবিত বা মৃত যে কোনো অবস্থাতেই তুমি পূর্ন। এই কথা জেনে নিজেকে বিলয়প্রাপ্ত করো। 

 ইতি  অষ্টাবক্র সংহিতায়  আচার্য্য-উক্তম লয়-চতুষ্টয়ং নাম পঞ্চমং  প্রকরণ অষ্টাবক্র গীতা সমাপ্তম   
-------------

শিষ্য-উক্তম-উত্তর-চতুষ্কং  নাম - ষষ্ঠ প্রকরণ 

আকাশবৎ-অনন্তঃ-অহং  ঘটবৎ প্রাকৃতং জগৎ 
ইতি জ্ঞানং তথৈত্স্য ন ত্যাগো ন  গ্রহো লয়ঃ। (৬/১)

আমি আকাশবৎ অনন্ত, আবার প্রকৃতিতে দেহবৎ ঘটের মধ্যে আমার নিবাস। এই জ্ঞানের অনুভব হলে আমার ত্যাগ, গ্রহণ বা লয় - কিছুই সম্ভব নয়। 

মহা-উদধিঃ-ইব-অহং স প্রপঞ্চো  বীচি-সন্নিভঃ
ইতি জ্ঞানং তথৈ তস্য ন  ত্যাগো ন গ্রহো  লয়ঃ।  (৬/০২)

আমি মহাসমুদ্রস্বরূপ। এই প্রপঞ্চ (জগৎ) যেন লহরী। এই জ্ঞানের অনুভব হলে, আমার  ত্যাগ, গ্রহণ, বা লয় কিভাবে হবে ? 

অহং স শুক্তি-সঙ্কাশো রূপ্যবৎ-বিশ্ব কল্পনা 
ইতি জ্ঞানং তথৈতস্য  ন  ত্যাগো  গ্রহো  লয়ঃ। (৬/০৩)

আমি সেই শুক্তি, যাঁর মধ্যে কল্পিত বিশ্ব  যেন রুপোর মতো প্রতিভাত হচ্ছে। এই জ্ঞান যার অনুভবে এসেছে, তাঁর অর্থাৎ সেই আত্মাতে গ্রহ, ত্যাগ বা লয় কিছুই সম্ভব নয়। 

অহং বা সর্বভূতেষু সর্বভূতানি-অথো ময়ি 
ইতি  জ্ঞানং তথৈতস্য ন  ত্যাগো  গ্রহো  লয়ঃ। (৬/০৪)

সর্ব্ব ভূতে আমি আত্মা, আমাতেই সর্বভূত বিদ্যমান, এই জ্ঞান যাঁর অনুভবে এসেছে, সেই আত্মাতে গ্রহণ, ত্যাগ, লয়  কিছুই সম্ভব নয়। 

ইতি শিষ্য-উক্তম-উত্তর-চতুষ্কং  নাম - ষষ্ঠ প্রকরণং অষ্টাবক্র  সমাপ্তম ।  
--------------------------- 

অনুভব পঞ্চকং নাম - সপ্তম প্রকরণ 

ময়ি-অনন্ত-মহা-অম্ভোধৌ বিশ্বপোত ইতস্ততঃ 
ভ্রমতি স্বাস্ত-বাতেন ন মম-অস্তি-সহিষ্ণুতা। (৭/১)

আমি অনন্ত মহাসমুদ্র।  আমাতে এই জগৎরূপ নৌকা বায়ুদ্বারা তাড়িত হয়ে ইতস্তত ভ্রমন করছে। এতে আমার কোনো অসহিষ্ণুতা নেই। (৭/১)

ময়ি-অনন্ত-মহা-অম্ভোধৌ জগৎ-বীচিঃ স্বভাবতঃ
উদ্তুে বা-অস্তম-আয়াতু ন  মে বৃদ্ধির্ন চ ক্ষতিঃ । (৭/২)

আমি অনন্ত-মহাসমুদ্র। আমাতে জগৎরূপ ঢেউ দৃশ্যদি স্বভাব বশতঃ আবির্ভাব ও তিরোভাব হচ্ছে, তাতে আমার কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি হয় না। 

ময়ি-অনন্ত-মহা-অম্ভোধৌ বিশ্বং নাম বিকল্পনা 
অতিশান্তো নিরাকার এতৎ-এব-অহম-আস্থিতঃ (৭/৩)

আমি অনন্ত মহাসমুদ্র। আমাতে প্রতিভাত এই বিষয় বিরাট কল্পনা মাত্র। আমি অতিশান্ত, নিরাকার। এই আত্মজ্ঞানে আমি অবস্থিত।  (৭/৩)

ন-আত্মা ভাবেষু ন-ভাবঃ-তত্র-অনন্তে নিরঞ্জনে 
ইতি-অসক্তঃ-অস্পৃহঃ শান্ত এতৎ-এব-অহম-আস্থিতঃ। (৭/৪)

আত্মা কোথাও আশ্রিত নহে, দেহাদিভাবেও আশ্রিত নহে। আর এই দেহাদি পদার্থও আত্মাতে নেই। আমি সর্ব্ব সংসর্গ রহিত, স্পৃহাহীন, শান্ত।  এই আত্মজ্ঞানে আমি অবস্থিত।  (৭/৪)

অহো চিন্মাত্রম-এব-অহম-ইন্দ্রজাল-উপমং জগৎ 
অতো মম কথং কুত্র হেয়-উপাদেয়-কল্পনা। (৭/৫)

আহা ! আমি চিন্মাত্র স্বরূপ। এই জগৎ ইন্দ্রজালের মতো মিথ্যে। অতএব  আমার কোথায়, কোনবস্তুতে, কিভাবে ত্যাগ বা গ্রহণ কল্পনা হবে ? 

ইতি  অনুভব পঞ্চকং নাম - সপ্তম প্রকরণং অষ্টাবক্র গীতা সমাপ্তম  । 
----------------- 

গুরুপ্রোক্তং বন্ধ-মোক্ষব্যবস্থা -চতুষ্কং নাম অষ্টম প্রকরণম। 

তদা বন্ধো  যদা চিত্তং কিঞ্চিদ বাঞ্চতি  শোচতি
কিঞ্চিৎ-মুঞ্চতি গৃহ্ণাতি কিঞ্ছিদ  হৃষ্যতি কুপ্যতি। (৮/১) 

যেখানে চিত্ত সামান্যতম বাসনা, শোক, ত্যাগ, গ্রহণ,  হর্ষ , ক্ৰোধ, দ্বারা  বশীভূত হয়, সেখানেই জীবের বদ্ধাবস্থা। 

তদা মুক্তিঃ-যদা চিত্তং ন  বাঞ্ছতি   ন শোচতি 
ন মুঞ্চতি ন  গৃহ্নাতি ন হৃষ্যতি ন কুপ্যতি। (৮/২)

সেখানেই মুক্তি যেখানে চিত্ত সদা ইচ্ছে, শোক, ত্যাগ, গ্রহণ কিছুই করে না এবং হর্ষ, কোপের বশীভূত হয় না, সেই চিত্তের  অবস্থাই মুক্তির অবস্থা। 

তদা বন্ধো যদা চিত্তং সক্তং  কাসু-অপি দৃষ্টিষু
তদা মোক্ষো  যদা চিত্তমসক্তং সর্ব দৃষ্টিষু।  (৮/৩)

সেখানে বদ্ধ  অবস্থা, যেখানে চিত্তের দৃষ্টি অনাত্ম  বস্তুতে আসক্ত। চিত্ত যখন অনাত্ম-বস্তুতে  আসক্ত না হয়, তখন মোক্ষ অবস্থা। 

যদা ন-অহং তদা মোক্ষো  যদাহং বন্ধনং তদা   
মত্বা-ইতি হেলয়া কিঞ্চিৎ-মা গৃহাণ বিমুঞ্চ মা। (৮/৪)

যেখানে আমি বলে  কিছু নেই, সেখানেই মোক্ষ। যেখানে অহংকার সেখানেই বন্ধন। এইভাবে জেনে বিনা আয়াসে হেয় বা উপাদেয় বুদ্ধি রহিত হও। 

ইতি গুরুপ্রোক্তং বন্ধ-মোক্ষব্যবস্থা -চতুষ্কং নাম অষ্টম প্রকরণম সমাপ্ত। 
-----------------
  
অথ  গুরুপ্রোক্তং নির্বেদ অষ্টকং নাম নবমং  প্রকরণম 
এখন গুরুদেব অষ্টাবক্রউক্ত আটটি নির্বেদ (সংসারের অসারত্ব উপলব্ধি করে যে বিরক্তি জন্মে) নামক নবম অধ্যায়। 

কৃতাকৃতে  চ দ্বন্দ্বানি কদা শান্তানি  কস্য বা 
এবং জ্ঞাত্বেহ নির্বেদাদ ভব ত্যাগপরঃ-অব্রতী। (৯/০১)

কর্তব্য ও অকর্তব্য-এর যে দ্বন্দ্ব, সুখ শান্তির যে দ্বন্দ্ব তা কার কবে নিবৃত্ত হয়েছে ? এই কথা জেনে সংসারের সব ব্যাপারে আগ্রহ ত্যাগ করো। 

কস্যাপি তাত  ধন্যস্য লোকচেষ্টা-অবলোকনাৎ 
জীবিতেচ্ছা বুভুক্ষা চ বুভুৎসোপশমং  গতাঃ।  (৯/০২) 

লোক-চেষ্টা অবলোকন করে, জ্ঞানী ব্যক্তি  জীবিত থাকার ইচ্ছে, ভোগ করবার ইচ্ছে, এমনকি জ্ঞানের ইচ্ছে ত্যাগে সমর্থ  হয়ে থাকেন। 

অনিত্যং সর্বমেবেদং তাপত্রিয়-দূষিতম 
অসারং নিন্দিতং হেয়মিতি নিশ্চিত্য শাম্যতি। (৯/০৩)

অনিত্য  অসার এই বিশ্ব প্রপঞ্চ তাপত্রয় দ্বারা দূষিত।  একে হেয়  ও নিন্দিত মনে করে, জ্ঞানী সাম্য অবস্থা প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। 

কঃ-অসৌ  কালো বয়ঃ কিংবা যত্র দ্বন্দ্বানি নো নৃণাম 
তানি -উপেক্ষা যথাপ্রাপ্তবর্ত্তী সিদ্ধিমবাপ্নুয়াৎ । (৯/৪)

কোথায় সেই কাল, কোথায় সেই বয়স, যখন মানুষের সুখ-দুঃখ-দ্বন্দ্ব নেই ? তাই একে উপেক্ষা করে, অনাসক্ত  বা  প্রাপ্তভোগী হয়ে সিদ্ধি  প্রাপ্ত হও। 

নানা মতং মহর্ষিণাং  সাধুনাং যোগিনাং তথা 
দৃষ্ট্বা  নির্বেদম-আপন্নঃ কো ন শাম্যতি মানবঃ । (৯/৫)   

মহর্ষিগণের  নানান মত।  সাধু, যোগীও তদ্রুপ। এতে বিরক্ত হয়ে কেবল নির্বেদকে আশ্রয় করে শান্তি ও সুখ লাভ করো। 

কৃত্বা মূর্তি-পরিজ্ঞানং  চৈতন্যস্য ন  কিং গুরুঃ 
নির্বেদ সমতা-যুক্ত্যা যঃ-তারয়তি সংসৃতেঃ (৯/৬)

গুরু চৈতন্যের ঘন বিগ্রহ। এই জ্ঞানে যাঁর গুরুমূর্তি চৈতন্যে বিলীন হয়ে গেছে, এবং নিজেও চৈতন্য ছাড়া কিছু নয়, এই সমতা-বোধ যাঁর  মধ্যে এসেছে, তিনিই নিজেকে ও অপরকে সংসার বন্ধন থেকে তরাতে পারেন। 

পশ্য ভূত-বিকারাং  স্ত্বং ভূত-মাত্রান যথার্থতঃ 
তৎক্ষণাৎ-বন্ধ-নির্মুক্তঃ স্বরুপস্থো ভবিষ্যসি। (৯/৭)

ভূৎসকলের বিকার (এই দেহকে) তুমি ভূততত্ত্ব হিসেবেই দর্শন করো। তাহলে তৎক্ষণাৎ বন্ধন  থেকে মুক্ত হয়ে স্বরূপে (আত্মস্বরূপে) স্থিত হবে। 

বাসনা এব সংসার ইতি সর্বা বিমুঞ্চ তাঃ 
তত্ত্যাগো বাসনা-ত্যাগাৎ স্থিতিরদ্য যথা তথা। (৯/৮)

বাসনাই এই সংসার উৎপত্তির কারন। অতএব বাসনাসমূহ পরিত্যাগ করো। এই বাসনাকে ত্যাগ করলেই, তোমার স্বরূপে স্থিতি  হবে।  

ইতি  গুরুপ্রোক্তং নির্বেদ অষ্টকং নাম নবমং  প্রকরণম , অষ্টাবক্র গীতা সমাপ্তম। 
-------------- 


গুরুপ্রোক্তং উপশম  অষ্টকং নাম দশম প্রকরণম

এখন শ্রীগুরু খুশি হয়ে, বিষয়-তৃষ্ণার উপশমের স্তুতি করছেন। 
 
বিহায় বৈরিণং কাম-অর্থং চ অনর্থ সংকুলম 
ধর্মম-অপি-এতয়োঃ-হেতুং সর্বত্র-অনাদরং কুরু ।(১০/১)

জ্ঞানের শত্রু কাম, অর্থ অনর্থের কারন।  এই কাম ও অর্থের কারন যে ধর্ম্ম তাকেও সর্বত্র অনাদর করো। 

স্বপ্নেন্দ্রজালবৎ পশ্য দিনানি ত্রীনি পঞ্চ বা 
মিত্র-ক্ষেত্র-ধন-আগার-দার-দায়-আদি-সম্পদঃ। (১০/২)

স্বপ্ন ও  ইন্দ্রিজাল সম তিন বা পাঁচদিনের মিথ্যে এই মিত্র, ক্ষেত্র (শরীর) ধন, ঘরবাড়ি, স্ত্রী, দানে পাওয়া সম্পদ ইত্যাদি ।  

যত্র  যত্র ভবেৎ-তৃষ্ণা সংসারং বিদ্ধি তত্র বৈ 
প্রৌঢ় বৈরাগ্যম-আশ্রিত্য বীততৃষ্ণঃ সুখী ভব । (১০/৩)

যেখানে যেখানে বিষয়-তৃষ্ণা উৎপন্ন হবে, সেখানেই সংসারের উৎপত্তি  হবে। অতএব দৃঢ়ভাবে বৈরাগ্য আশ্রয় করে, তৃষ্ণারহিত হয়ে সুখী হও। 

তৃষ্ণা-মাত্র-আত্মকো  বন্ধ-তৎ-নাশো মোক্ষ উচ্চতে 
ভব-অসংসক্তি-মাত্রেণ প্রাপ্তি-তুষ্টিঃ-মুহুর্মুহুঃ । (১০/৪)

তৃষ্ণাই (বিষয়তৃষ্ণা) আত্মার বদ্ধদশা, এবং তৃষ্ণার নাশকে বলা হয় মোক্ষ। ভবের (জগতের) সঙ্গে সম্পর্ক রহিত হলে আত্মপ্রাপ্তি ও  তৎজনিত তৃপ্তি মুহুর্মুহু হয়ে থাকে। 

ত্বমেকঃ-চেতনঃ  শুদ্ধো জড়ং বিশ্বম-অসৎ-তথা 
অবিদ্যাপি ন কিঞ্চিৎ সা কা বুভুৎসা  তথাপি তে। (১০/৫)

একমাত্র তুমি চেতন ও শুদ্ধ।  এই বিশ্ব  জড় ও অসৎ। অবিদ্যার লেশ না থাকলে, তোমার বিষয়জ্ঞানের ইচ্ছে কোথা থেকে আসবে ?

রাজ্যং সুতাঃ কলত্রাণি শরীরাণি  সুখানি চ 
সংসক্তস্য-অপি  নষ্টানি তব জন্মনি জন্মনি।  (১০/৬)

এযাবৎ জন্ম জন্মান্তর ধরে, আসক্তিবশতঃ কত রাজ্যসুখ, স্ত্রী-পুত্র-শরীরসুখ  তোমার নষ্ট হয়েছে।  

অলম-অর্থেন কামেন সুকৃতেন-অপি কর্মণা 
এভ্যঃ সংসার-কান্তারে ন বিশ্রান্তম-ভুন্মনঃ।  (১০/৭) 

এই অর্থ, কাম, সুকৃতি সবই বৃথা। এগুলো থেকে তোমার মন বিশ্রাম (শান্তি) লাভ করতে পারে নি।



কৃতং না কতি জন্মনি কায়েন মনসা গিরা 
দুঃখম-আয়াস-দং কর্ম তৎ-অদ্য-অপি-উপরম্যতাম।  (১০/৮) 

বহু জন্মে কতকিছু না তুমি করেছো। শারীরিক, মানসিক, বাচিক কত কর্ম্মই না তুমি করেছো।  কিন্তু এতে অনর্থ ছাড়া আর কিছুই লাভ হয় নি। তাই এই কর্মানুষ্ঠান থেকে এখন বিরতি দাও। 

ইতি গুরুপ্রক্তো উপশম  অষ্টকং  নাম দশম প্রকরনং অষ্টাবক্র গীতা সমাপ্তম। 

----------------  

জ্ঞান-অষ্টকং নাম একাদশং প্রকরণম। 

সমস্ত ক্লেশের  উপশম আত্মজ্ঞানের দ্বারাই হতে পারে। তাই গুরুদেব এখানে জ্ঞানসাধনের  উপদেশ দিচ্ছেন। 

ভাব-অভাব-বিকারঃ-চ স্বভাবাৎ-ইতি নিশ্চয়ী 
নির্বিকারো গতক্লেশঃ সুখেন-এব -উপশাম্যতি । (১১/১)

ভাব অভাব এসব বিকারের স্বভাব, আত্মার নয়। তুমি নির্বিকার, ক্লেশরহিত।  তুমি চিত্তবিকার রোহিত হয়ে, ক্লেশ রোহিত হয়ে অনায়াসে উপশম (শান্তি) প্রাপ্ত হও। 

ঈশ্বরঃ সর্বনির্মাতা নেহান্য ইতি নিশ্চয়ী 
অন্তঃ-গলিত-সর্ব-আশঃ শান্তঃ ক্ব-অপি ন সজ্জতে। (১১/২)

ঈশ্বরই  সবকিছুর নির্ন্মাতা। অন্য কেউ নয়, এটা নিশ্চিত।  এই কথা জেনে এবার সমস্ত বিষয় আসক্তি (আশা) ত্যাগ করে, শান্ত হও। 

আপদঃ সম্পদঃ কালে দৈবাৎ-এব-ইতি নিশ্চয়ী 
তৃপ্তঃ স্বস্থ-ইন্দ্রিয়ো নিত্যং ন বাঞ্ছতি ন শোচতি। (১১/০৩)

আপদকাল বা সম্পদকাল,  সবই দৈব দ্বারা নিশ্চিত হয়ে থাকে। তৃপ্তব্যক্তি তিনিই যিনি  ইন্দ্রিয়সকলকে স্থির রেখে বাঞ্চিত বিষয়ে  আকাংখ্যা পরিত্যাগ করেছেন, আবার অপ্রাপ্ত বিষয়ে অভিলাষ বিনষ্ট করে,  শোক রহিত  হয়েছেন। 

সুখদুঃখে জন্মমৃত্যু দৈবাৎ-এব-ইতি নিশ্চয়ী 
সাধ্য-আদর্শী নিরায়াসঃ  কুর্বন-অপি ন লিপ্যতে। (১১/০৪)

সুখ-দুঃখ জন্ম-মৃত্যু, দৈব দ্বারা নিশ্চিত হয়ে থাকে। আদর্শ পুরুষ সাধ্য অনুযায়ী (প্রারব্ধ বশে ) কর্ম্ম করেও কর্ম্মফল ভোগে লিপ্ত হন না। 

চিন্তয়া জায়তে দুঃখং ন-অন্যথা-ইতি নিশ্চয়ী 
তয়া হীনঃ সুখী শান্তঃ সর্বত্র গলিতস্পৃহঃ। (১১/০৫)

চিন্তাই (বিষয়চিন্তা) দুঃখের জন্ম দিয়ে থাকে, অন্য কোনো কারন নেই - এটা নিশ্চিত করে জেনো। (বিষয়) চিন্তাহীন হয়ে, স্পৃহাহীন (ইচ্ছেরহিত) হয়ে সুখী, শান্ত  হও। 

নাহং দেহো ন  মে দেহো বোধঃ-অহম-ইতি নিশ্চয়ী
কৈবল্যম-ইব সং প্রাপ্তো ন স্মরতি-অকৃতং কৃতম। (১১/০৬)

আমি দেহ নোই, দেহও আমার নয়, আমি বোধস্বরূপ (চৈতন্যস্বরূপ) - একথা নিশ্চিত।  এই বোধ (জ্ঞান) যাঁর  হয়েছে, তিনি কৈবল্যপ্রাপ্ত (মুক্তি-প্রাপ্ত) হয়েছেন। সমস্ত কর্ম্ম-বিষয় তার স্মৃতি থেকে লোপ পেয়েছে।  

আ-ব্রহ্ম-স্তম্ব-পর্যন্তম-অহম-এব-ইতি নিশ্চয়ী 
নির্বিকল্পঃ শুচিঃ শান্তঃ প্রাপ্ত-অপ্রাপ্ত-বিনির্বৃতঃ।  (১১/০৭)

ব্রহ্ম (ব্রহ্মা) থেকে শুরু করে জগতের সমস্ত কিছুই আমি - এইরূপ যিনি জানেন, তিনি নির্বিকল্প (সংকল্প-বিকল্প রহিত) শুদ্ধঃ শান্ত। তিনি প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তিতে নিবৃত্ত থাকেন। 

নানা-আশ্চর্যম-ইদং বিশ্বং ন কিঞ্চিৎ-ইতি নিশ্চয়ী 
নির্বাসনঃ স্ফূর্তিমাত্রো ন কিঞ্চিৎ-ইব শাম্যতি। (১১/৮)

এইযে আশ্চর্য্যজনক নানা বৈচিত্রপূর্ন বিশ্ব, এটি   ব্রহ্ম  থেকে পৃথক নয় - একথা নিশ্চিত। নিবৃত্তি যোগে স্থিত পুরুষ সদা স্ফূর্তিতে (আনন্দে) থাকেন।  এতে তাঁর সাম্য (শান্তির অবস্থা) নষ্ট হয় না। 

ইতি  জ্ঞান-অষ্টকং নাম একাদশং প্রকরণম অষ্টাবক্র গীতা সমাপ্তম । 
-------------------  
     

এবমেব অষ্টাকং নাম দ্বাদশং প্রকরণম। 

কায়-মন-বাক্যে থেকে কিভাবে  নিবৃত্ত (বৈরাগ্য) থাকা যায়, সে সম্পর্কে শিষ্য রাজর্ষি জনক নিজের অনুভূতির কথা বর্ননা করছেন।  (সহজ-সমাধি, জ্ঞানসমাধি,  বর্ননা করা হচ্ছে।) 

কায়-কৃত্যা-সহঃ পূর্বং ততো বাগ-বিস্তর-অসহ
অথ চিন্তা-অসহঃ-তস্মাৎ-এবম-এব-অহম-আস্থিতঃ। (১২/০১)

আগে যেমন আমি শারীরিক (যোগক্রিয়া) ও বাচিক (জপ-ক্রিয়া) কর্ম্মে অসহিষ্ণু ছিলাম, এখন চিন্তাকর্ম্মেও  (মানসিক ক্রিয়া) অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছি। অতএব শারীরিক, বাচিক, ও মানসিক ক্রিয়া না থাকার জন্য আমি স্ব -স্বরূপে শান্তিতে অবস্থান করছি।  

প্রীতি-অভাবেন শব্দাদেঃ-অদৃশ্যত্বেন চ-আত্মনঃ 
বিক্ষেপ-একাগ্র-হৃদয় এবম-এব-অহম -আস্থিতঃ । (১২/০২)

শব্দাদির (কায়িক, বাচনিক) প্রতি আমার প্রীতির অভাব হয়েছে।  আবার অদৃশ্যত্ব হেতু মানসিক কর্ম্মের  (চিন্তা)  প্রতিও আমার প্রীতি নেই। এইভাবে বিক্ষেপ রহিত  হয়ে আমি স্ব-স্বরূপে শান্ত হয়ে অবস্থান করছি।  

সম-অধ্যাস-আদি-বিক্ষিপ্তৌ ব্যবহারঃ সমাধয়ে
এবং বিলোক্য নিয়মম-এবম-এব অহম-আস্থিত। (১২/০৩)

চিত্তের বিক্ষিপ্ত অবস্থাকে নিবারনের জন্য সমাধি-ইত্যাদির ব্যবহার করা হয়। সাধারণ লোকে এটাই জানে। কিন্তু আমাতে আমি শুদ্ধ আত্মা রূপে স্থিত। আমাতে কোনো অধ্যাস না থাকার ফলে আমি সমাধি ইত্যাদির অভ্যাস রহিত হয়েও আমি পরম আনন্দস্বরূপে বিরাজমান।  

হেয়-উপাদেয় বিরহাৎ-এবং হর্ষ -বিষাদয়োঃ 
অভাবাৎ-অদ্য হে ব্রহ্মন্ন-এবম-এব-অহম-আস্থিতঃ ।  (১২/০৪)

হে ব্রহ্মন, আমি ত্যাগ ও গ্রহণ রহিত  ব'লে, হর্ষ -বিষাদের অতীত। আমি আমাতেই স্থিত  হয়েছি। 

আশ্রম-অনাশ্রমং ধ্যানং চিত্ত-স্বীকৃত বর্জনম 
বিকল্পং মম বীক্ষ্যৈতৈর-এবম-এব-অহম-আস্থিতঃ  । (১২/০৫) 

আশ্রম, অনাশ্রম,  ধ্যান, চিত্তগ্রাহ্য বিষয়ের ত্যাগ - এসব সংকল্প-বিকল্পত্মক  বিক্ষেপের কারন জেনে, এগুলোকে  পরিত্যাগ করে, আমি আমাতে স্থিত হয়েছি। 

কর্মানুষ্ঠানম-অজ্ঞানাদ  যথৈবোপরমস্তথা 
বুদ্ধ্বা সম্যক--ইদং তত্ত্বম-এবম-এব-অহম-আস্থিতঃ। (১২/০৬)

কর্ম্মের অনুষ্ঠান বা কর্ম্ম-বিরতি অজ্ঞান থেকে হয়ে থাকে। এই জ্ঞান  সম্যক ভাবে অবগত হয়ে, এই দুইই  পরিত্যাগ করে আমি স্ব-স্বরূপে স্থিত হয়েছি ।   

অচিন্ত্যং চিন্তমানঃ অপি চিন্তারূপং ভজতি-অসৌ 
ত্যক্ত্বা তদ-ভাবনং তস্মাৎ-এবম-এব-অহম-আস্থিতঃ। (১২/০৭)

ব্রহ্ম  অচিন্ত্যনীয় - এই চিন্তা করতে করতেও সেই চিন্তারূপকেই ভজনা করা হয়। অতয়েব, আমি ভাবনাও পরিত্যাগ করে অর্থাৎ সর্ব্বভাবনা রহিত হয়ে নিজ-স্বরূপে স্থিত হয়েছি।

এবমেব কৃতং যেন স কৃতার্থো ভবেৎ-অসৌ 
এবমেব স্বভাবো যঃ স কৃতার্থো ভবেৎ-অসৌ।  (১২/৮)

এইভাবে যে সাধক সর্ব্বক্রিয়া রহিত  হয়ে স্ব-স্বরূপে স্থিত থাকেন, তিনি কৃতার্থ হয়ে থাকেন। এই স্ব-ভাবে স্থিতি  যাঁর স্বভাব তিনি কৃতার্থ হয়ে থাকেন।

ইতি এবমেব-অষ্টকং নাম দ্বাদশং প্রকরণম অষ্টাবক্র গীতা সমাপ্তম।  
-----------------

যথাসুখ সপ্তকং নাম - ত্রয়োদশ প্রকরণম। 

অকিঞ্চন-ভবং স্বাস্থ্যং কৌপীনত্বে-অপি দুর্লভম 
ত্যাগদানে বিহায়-অস্মাদ-অহম-আসে যথা সুখম। (১৩/০১)

সামান্য কৌপীনেও যদি আসক্তি থাকে, তবে স্ব-স্থিতির ভাব  দুর্লভ।  সর্ব বিষয়ে ত্যাগ ও গ্রহণক্রিয়া পরিত্যাগ করে আমার আমিতে পরম আনন্দে অবস্থান করছি। 

কুত্রাপি খেদঃ কায়স্য  জিহ্বা কুত্রাপি খিদ্যতে 
মনঃ কুত্রাপি তৎ-ত্যক্ত্বা পুরুষার্থে স্থিতঃ সুখম। (১৩/০২)

কায়িক (যোগক্রিয়া) পরিশ্রমে দেহ ক্লান্ত হয়, বাচিক (জপ) কর্ম্মে জিহ্বা পরিশ্রান্ত হয় ও মানসিক কর্ম্মে (ধ্যানাদিতে) মন অবসন্ন হয়ে পড়ে। অতয়েব এই ত্রিবিধ কর্ম্ম পরিত্যাগ করার ফলে আমি ক্লান্তিহীন পরমসুখে আমাতে স্থিত রয়েছি। 

কৃতং কিমপি নৈব স্যাদিতি সংচিন্ত্য তত্ত্বতঃ 
যদা যৎ কর্তুম-আয়াতি তৎ কৃত্বাসে যথা সুখম। (১৩/০৩)

(আমি আত্মা) আমার কিভাবে কর্ম্ম হবে ? দেহ-ইন্দ্রিয় দ্বারা কর্ম্ম সম্পাদিত হচ্ছে, এই কথা জেনে শরীর-মনে যাকিছু কর্ম্ম সামনে আসছে, তা (অহংকার রহিত হয়ে) সম্পাদন করে আমি আমাতে সুখে অবস্থান করছি। 

কর্ম্ম-নৈস্কর্ম্য নিবন্ধভাবা দেহস্থ যোগিনঃ 
সংযোগ-অযোগ-বিরহাৎ-অহম-আসে যথাসুখম।  (১৩/০৪) 

কর্ম্ম করা বা কর্ম্ম না করা - এই ভাব দেহাসক্ত যোগীগণের হয়ে থাকে।  দেহের সঙ্গে সংযোগ, বা অসংযোগ এই উভয় ভাবের বিয়োগ বশতঃ আমি আমাতে পরমসুখে অবস্থান করছি। 

অর্থ-অনর্থৌ ন মে স্থিত্যা গত্যা ন  শয়নেন বা 
তিষ্ঠন গচ্ছন স্বপন তস্মাদ-অহম-আসে যথা সুখম। (১৩/০৫)

গতি-স্থিতি, বা শয়ন কোনো কিছুতেই আমার  অর্থ-অনর্থ, (লাভ-ক্ষতি) নেই। তাই আমি  গমন, উপবেশন, বা শয়ন করেও আমাতেই পরমসুখে অবস্থান করছি। 

স্বপতো নাস্তি মে হানিঃ সিদ্ধিঃ-যত্নবতো ন  বা 
নাশ-উল্লাসৌ  বিহায়-অস্মাদ-অহম-আসে যথাসুখম। (১৩/৬)

যখন কিছুই করছি না (নিদ্রাঅবস্থা) তখন আমার কোনো হানি নেই, আবার যখন (জাগ্রতাবস্থা) সবকিছুই  করছি, তখনও আমার কোনো প্রাপ্তি নেই। তো প্রযত্নের অভাব, আবার প্রযত্নশীল, এই দুই ভাবের হর্ষ-বিষাদ উভয়কে পরিত্যাগ করে, আমি আমাতে সুখে অবস্থান করছি। 

সুখাদি-রূপ-অনিয়মং ভাবেষু-আলোক্য ভূরিশঃ 
শুভাশুভে বিহায়-অস্মাদ-অহম-আসে যথাসুখম। (১৩/০৭)

সুখ-দুঃখ ইত্যাদির যে নিয়ম অর্থাৎ অনিত্যতা পর্যবেক্ষন করে, শুভ-অশুভকে পরিত্যাগ করে আমি আমাতে সুখে  অবস্থান করছি। 
ইতি যথাসুখ-সপ্তকং নাম ত্রয়োদশং প্রকরণম অষ্টাবক্র গীতা সমাপ্তম। 
-------

শান্তি-চতুষ্টয়ং নাম চতুর্দশং প্রকরণম। 

প্রকৃত্যা শূন্যচিত্তো যঃ প্রমাদাদ ভাবভাবনঃ 
নিদ্রিতো বোধিত ইব ক্ষীণ সংস্মরণো হি সঃ। (১৪/০১)

যার চিত্ত বিষয়চিন্তা শূন্য, তিনি সংসারহেতু,  প্রারব্ধ বশতঃ  বুদ্ধি প্রয়োগে ক্রিয়া সম্পাদন  করলেও স্মরনাভাবহেতু জন্ম-মৃত্যুর সংসার থেকে চির মুক্ত থাকেন। 

যোগাচার্য্য বলছেন  :  যিনি মন, বুদ্ধি ও অহং ও  পঞ্চ উপাদানকে আঁকড়ে ধরে অন্তরের চঞ্চলতাকে বিলীন করেন এবং যিনি জাগ্রত অবস্থাকে উদাসীনতার সাথে দেখেন, জাগ্রত অবস্থাকে  মায়াময় স্বপ্নের অবস্থা বলে দেখেন, তিনি জাগতিক কামনা থেকে মুক্ত হন।

ক্ব ধনানি ক্ব মিত্রাণি ক্ব  মে বিষয়-দস্যবঃ 
ক্ব শাস্ত্ৰং ক্ব  চ বিজ্ঞানং  যদা মে গলিতা স্পৃহা।  (১৪/০২) 

কোথায়  ধন, কেই বা মিত্র, কোথায় বিষয়রূপ দস্যু,  কোথায় শাস্ত্র, কোথায় বিজ্ঞান, সবকিছুতে আমি স্পৃহাহীন। 

যোগাচার্য্য বলছেন  : ইচ্ছা বিলুপ্ত হলে সম্পদ, বন্ধু ও ক্ষণস্থায়ী জিনিস কোথায় থাকে? শাস্ত্র এবং উপলব্ধিই বা  কোথায়?

বিজ্ঞাতে সাক্ষীপুরুষে পরমাত্মনি চ-ঈশ্বরে 
নৈরাশ্যে বন্ধমোক্ষে চ ন চিন্তা মুক্তয়ে মম। (১৪/০৩) 

সাক্ষী পুরুষ পরমাত্মা তথা ঈশ্বরকে  জ্ঞাত হয়ে, বন্ধন বা মোক্ষে আমার নৈরাশ্য জন্মেছে। এখন আমার মুক্তির জন্যও  কোনো চিন্তা নেই। 

যোগাচার্য্য বলছেন  : আমি সেই ঈশ্বরকে উপলব্ধি  করেছি যিনি সব কিছুর শাশ্বত সাক্ষী। এখানে বন্ধন বা মুক্তির চিন্তার সুযোগ নেই। মুক্তি লাভের চিন্তা ভাবনাও  নেই। 

অন্তঃ-বিকল্প-শূন্যস্য বহিঃ স্বচ্ছন্দচারিণঃ 
ভ্রান্তস্যেব দশাস্তাস্তাস্তা-দৃশা এব  জানতে।  (১৪/০৪) 

অন্তরে যিনি সংকল্প-বিকল্প রহিত কিন্তু বাইরে স্বচ্ছন্দ বিচরণকারী, এই  জ্ঞানীপুরুষকে জানা একমাত্র তাঁর তুল্য জ্ঞানীগণের পক্ষেই সম্ভব।  

যোগাচার্য্য বলছেন  : ভিতরে ইচ্ছা বা অনিচ্ছা  নেই। শূন্যতাকে আঁকড়ে ধরে এবং এর সাথে একাত্ম হয়ে, মহাত্মা  যা কিছু করছেন বলে মনে হচ্ছে, সেই রহস্যকে বুঝতে গেলে, এই অবস্থার অভিজ্ঞতা যাঁর  হয়েছে, তিনিই তা সম্যকরূপে জানতে পারেন। 

ইতি শান্তি-চতুষ্টয়ং নাম চতুর্দশং প্রকরণম, অষ্টাবক্র গীতা সমাপ্তম । 

-------------------------

গুরুপ্রক্তো   তত্ত্ব-উপদেশ-বিংশতিকং নাম পঞ্চদশং  প্রকরণম

অষ্টাবক্র গীতা শ্লোক নং. ১৫/০১-১০

যথা-তথা-উপদেশেন কৃতার্থঃ সত্ত্ববুদ্ধিমান 
আজীবমপি জিজ্ঞাসু পরস্তত্র বিমুহ্যতি। (১৫/০১)  

সাত্ত্বিক বুদ্ধিমান ব্যক্তি  উপদেশ মাত্রই  (স্বল্প কথায়) কৃতকৃত্য  হয়ে যায়। কিন্তু জীবভাবে মলিনচিত্ত জিজ্ঞাসু বারংবার তত্ত্ব-উপদেশের মনন / অনুশীলন দ্বারা  অজ্ঞান অন্ধকার থেকে বিমুক্ত হতে পারে। 
যোগাচার্য্য বলছেন  : যিনি সত্যগুণ সম্পন্ন তিনি উপদেশ দ্বারা উপকৃত হতে পারেন, কিন্তু যিনি অনুসন্ধান করেন তিনি সহজেই মন্ত্রমুগ্ধ হন।

মোক্ষো বিষয়-বৈরস্যং বন্ধো বৈষয়িকো রসঃ 
এতাবৎ-এব বিজ্ঞানং যথেচ্ছসি তথা কুরু। (১৫/০২)

বিষয়ে বিরাগই মোক্ষ, আবার বিষয়ে আসক্তি বন্ধন। একথা জেনে তুমি যথা ইচ্ছে আচরণ করো। 

যোগাচার্য্য বলছেন  : যিনি বস্তুর প্রতি বৈরীভাব সম্পন্ন  তিনি মুক্ত, যিনি পার্থিব বস্তুর জন্য কামনা করেন তিনি বদ্ধ, অর্থাৎ বিষয়ের দাস  । এই বিশেষ বিদ্যা আয়ত্ত্ব করো , তারপর  তুমি  যা খুশি তাই করো । 

বাগ্মি-প্রাজ্ঞ-মহা-উদ্যোগং জনং -মূক -জড়-অলসম 
করোতি তত্ত্ব-বোধো-অয়ম-তস্ত্যক্তো বুভুক্ষুভিঃ । (১৫/০৩)

বাগ্মি  পুরুষ তত্ত্বজ্ঞান লাভে  মুক (বোবা) হয়ে যায়। বিষয়জ্ঞানী তত্ত্বজ্ঞানলাভে জড়বৎ হয়ে যায়। ক্রিয়া-অনুষ্ঠানকারী কৰ্ম্মী নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।  আর তাই   বিষয়ভোগী পুরুষ তত্ত্বজ্ঞানের অনাদর করে থাকে। 
 
যোগাচার্য্য বলছেন  : সত্যের সারমর্ম উপলব্ধি করতে পারলে, পণ্ডিতবাগ্মী   হয়ে ওঠে বাকহীন, বিষয়জ্ঞানী হয়ে ওঠে জড়ব্ৎ, গতিহীন এবং উদ্যমী পুরুষ হয়ে যায় প্রশান্ত। অন্যদিকে, পার্থিব বস্তুতে নিমগ্ন সমস্ত প্রাণীকুল পরমাত্মা  থেকে দূরেই  থাকে।

ন ত্বং দেহো ন তে দেহো ভোক্তা করতে ন  বা ভবান 
চিদ্রূপ-অসি সদা সাক্ষী নিরপেক্ষঃ সুখং চর।  (১৫/০৪)

না তুমি দেহ, না তোমার দেহ।  না তুমি কর্তা  না ভোক্তা। তুমি চৈতন্যস্বরূপ সাক্ষী মাত্র। অতয়েব তুমি নিরপেক্ষ হয়ে সুখে বিচরণ করো।  

যোগাচার্য্য বলছেন : তুমি  দেহ নয়, এবং তোমার  শরীর বলে কিছু নেই, তুমি  ভোগকারী বা কর্তাও নও তুমি অন্তর্নিহিত আত্মা, নিত্য সাক্ষীরূপে, কূটস্থে বিরাজ করছো । তাই সমস্ত অনিত্য  বস্তুর প্রতি  নিরুৎসাহিত হও এদের প্রভাবে দূষিত হয়ো না।  পরম আত্মায় বাস কর, সুখী হও ।

রাগ-দ্বেষৌ মনোধর্মৌ ন  মন্যতে কদাচন 
নির্বিকল্পো-অসি বোধ-আত্মা নির্বিকারঃ সুখং চর। (১৫/০৫)

রাগ,দ্বেষ মনের ধর্ম্ম - তোমার ধর্ম্ম নয়। এই মনও  তোমার নয় - মনের সাথে তোমার কোনো সন্মন্ধ নেই। তুমি নির্বিকল্প অর্থাৎ সমস্ত সংকল্প-বিকল্প রহিত চৈতন্যস্বরূপ। অতএব তুমি বিকার রহিত  হয়ে সুখে বিচরণ করো। 
  
যোগাচার্য্য বলছেন : যখন একটি ইচ্ছা অপূর্ণ হয়, তখন রাগ, দ্বেষ, ঘৃণা উৎপন্ন হয়।  এই যে বিষয়ে  আসক্তি এবং রাগ-দ্বেষ-ঘৃণা এসব  মনের প্রকৃতি বা স্বভাব । মন তোমার নয়। তথাপি মন-এর সঙ্গে  সংযুক্তির কারনে তোমার মধ্যে রাগ-দ্বেষ ঘৃণার উৎপত্তি হচ্ছে। এর  বাইরে যেখানে নির্বিকল্প সেখানে  হ্যাঁ বা না নেই। সাধনক্রিয়ার প্রভাবে, মন আত্মার মধ্যে মিশে যায় এবং অন্বেষণকারী সাধক  অনন্ত প্রশান্তি লাভ করে থাকে ।

সর্ব্বভূতেষু চ-আত্মানং সর্বভূতানি চ-আত্মনি 
বিজ্ঞায় নিরহংকারো নির্মমস্ত্বং সুখী ভব। (১৫/০৬)

সমস্ত ভূতে আত্মা, আবার সর্বভূতই আত্মা - এই জ্ঞানে নিশ্চিত হয়ে আমি-আমার এই অভিমান রহিত হও। আর  সুখী হও। 

যোগাচার্য্য বলছেন : তোমার  স্বয়ং প্রত্যেকের নিজের মধ্যে আছে। তাই প্রত্যেকের আত্মা  তোমার  নিজের মধ্যে আছে. আর তুমিই সকল প্রাণীর স্বয়ং এবং জগতের প্রভু। স্ব-জ্ঞান (আত্মজ্ঞান) লাভ করলে, তুমি  বুঝতে পারবে , যে একজনই  স্বয়ং সর্বক্ষেত্রে রয়েছে; একজনের মন জানতে পারলে  অন্যদের মনও জানা যায়। সর্বজ্ঞ হওয়ার কারণে, উপলব্ধিকৃত যোগী, সকলের মধ্যে প্রবেশ করেন এবং সকলের গুণ ও ক্রিয়া বা সকলের কর্ম ও ফলাফল জানেন। অহংকার করবার সুযোগ কোথায় যখন তুমি  জানবেন যে ক্রিয়া-পরবর্তী প্রভাবে সর্বশক্তিমান সবকিছু সম্পাদন করছেন এবং তুমি একটি পরমাণু ছাড়া কিছই নয়।  অতএব, যখন তুমি  অহংবোধ থেকে মুক্ত হবে  এবং স্বয়ং আপনাকে উপলব্ধি করবে  যে তুমি  কিছুই নয়, তোমার  কিছুই নেই, সেই সময়ে পরম আত্মার উপলব্ধি হয়।

বিশ্বং স্ফূরতি যত্রেদং তরঙ্গা ইব সাগরে 
তত্ত্বমেব ন সন্দেহঃ-চিন্মুর্তে বিজ্বরো ভব। (১৫/০৭)

সাগরে যেমন তরঙ্গ, তেমনি যে অধিষ্ঠানে বিশ্ব স্ফূরিত হচ্ছে সেই অখন্ড চৈতন্যস্বরূপ আসলে তুমি। এতে কোনো সন্দেহ নেই। হে চিন্ময়মূর্তি, তুমি স্ব-স্বরূপের উপলব্ধিবলে সন্তাপ রহিত হও। 
  
যোগাচার্য্য বলছেন : এই পৃথিবী যেন  সমুদ্রের ঢেউ। এটি তৈরি হয় এবং আবার এটি ধ্বংস হয়। তুমি যখন দুঃখ বা সুখ  অনুভব করো, জানবে তখনও তুমি যা উপলব্ধি করছো, তা তুমি  নিজেই তৈরী করেছো । নিজের  মধ্যেই তৈরী হচ্ছে এই সুখ-দুঃখ। এ সম্পর্কে  কোন সন্দেহ নেই। তুমি  আনন্দময় সত্ত্বা, এই ধ্রুবসত্য  উপলব্ধি করে,  দুঃখ থেকে মুক্ত থাকো । সুখ দুঃখের উর্দ্ধে আনন্দময় সত্ত্বায় (স্ব -স্বরূপে) বিরাজ করো। 

শ্রদ্ধস্ব তাত শ্রদ্ধস্ব নাতো মোহং কুরুস্ব ভোঃ 
জ্ঞানস্বরূপো ভগবানাত্মা ত্বং প্রকৃতেঃ পরঃ। (১৫/০৮)

শ্রদ্ধা সম্পন্ন হও। স্ব-স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত হও। মোহ দূরীভূত করো। প্রকৃতির উর্দ্ধে জ্ঞান-স্বরূপ সেই ভগবান-আত্মা স্বয়ং তুমি। 
যোগাচার্য্য বলছেন : তুমিই অন্তরে অন্তঃস্থিত অন্তরাত্মা,  তাই সম্মানিত কুটস্থ। আমি বারবার বলি কুটস্থকে শ্রদ্ধা করো। এই শ্রদ্ধা আত্মার   একটি ধর্ম্ম। আবার  শ্রদ্ধায় মুগ্ধ হবে না কারণ, তুমিই সন্মানীয়  কুটস্থ, তুমিই সেই অভ্যন্তরীণ প্রভু। এই আত্মজ্ঞান হচ্ছে, স্বয়ং প্রভুকে  বা নিজেকে জানা । তুমিই তোমার প্রভু। তুমি  পঞ্চ-উপাদান-ভূত, মন, বুদ্ধি এবং অহংকারকে অতিক্রম করে, স্ব-স্বরূপে স্থিত হও। 

গুণৈ  সংবেষ্টিতো  দেহস্তিষ্ঠ-আয়াতি যাতি চ 
আত্মা ন গন্তা নাগন্তা কিম-এনং-অনুশোচসি। (১৫/০৯)

গুন দ্বারা সন্নিবেষ্টিত দেহ আসা-যাওয়া ক্রিয়া করে থাকে। আত্মার না আছে যাওয়া, না আছে আসা। তাহলে (আত্মার অমূলক বিনাশ চিন্তায়) শোক কেন করছো ?

যোগাচার্য্য বলছেন : শরীরে অনেক উৎপত্তি, ক্ষয় ও বৃদ্ধির  উপাদান আছে।  এটি একটি সীমিত সময়ের জন্য অনেকগুলি গতিশীল  উপাদান দ্বারা পরিবেষ্টিত মূর্ত।  যেখানে আত্মা আসে এবং যায় বলে মনে হচ্ছে । আসলে আত্মা  শান্ত. আত্মাই স্বয়ং তুমি। তোমার আসা-বসা-যাওয়া বলে কিছু নেই।  তাই কেন নিজের থাকা না থাকার জন্য অনুতপ্ত হচ্ছো ?

দেহস্তিষ্ঠতু কল্পান্তং  গচ্ছতু-অদ্য এব বা পুনঃ 
ক্ব বৃদ্ধিঃ ক্ব  চ বা হানিস্তব চিন্মাত্ররূপিণঃ (১৫/১০)

এই দেহ কল্পের অন্ত  পর্যন্ত থাকুক, বা আজই বিনাশপ্রাপ্ত হোক, তাতে চৈতন্যস্বরূপ তোমার কোনো হানি বা বা বৃদ্ধি কিছুই হবে না। 

যোগাচার্য্য বলছেন : এই দেহ কল্পের শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকলো, বা  আজই মারা গেলো, তাতে ফারাকটা কী? তুমি তো  আত্মা, শাশ্বত চেতনা। তুমি জন্ম মৃত্যুরহিত। 

গুরুপ্রক্তো   তত্ত্ব-উপদেশ-বিংশতিকং নাম পঞ্চদশং  প্রকরণম
অষ্টাবক্র গীতা শ্লোক নং - ১৫/১১-২০

ত্বয়ি-অনন্ত মহা-অম্বাধৌ বিশ্ববীচিঃ স্বভাবতঃ 
উদেতু বা অস্তম-আয়াতু ন তে বৃদ্ধির্ন বা ক্ষতিঃ । (১৫/১১)

তোমার মধ্যে, অর্থাৎ এই অনন্ত মহা-চৈতন্যরূপ সমুদ্রে, এই জগৎরূপ লহরী স্বভাববশে উদয় হোক বা অস্ত যাক, তাতে তোমার বৃদ্ধি  বা ক্ষতি কিছুই নেই। 

যোগাচার্য্য বলছেন : স্বভাবতই পার্থিব সাগরের  অসীম ঢেউ আছে এবং সবই সমুদ্র থেকে সৃষ্টি হচ্ছে। আবার পরের মুহূর্তে তা সমুদ্রেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে।  ঠিক তেমনি তোমার থেকে এই বিশ্ব সৃষ্টি হচ্ছে। এক মুহুর্তের জন্য  তারা উদ্ভাসিত হয়, পরের মুহুর্তে তারা বিলীন হয়। এতেকরে, তোমার কোনো লাভ বা ক্ষতি নেই। 

তাত চিন্মাত্ররূপো-অসি না তে ভিন্নমিদং জগৎ 
অতঃ কস্য  কথং কুত্র হেয়-উপাদেয়-কল্পনা। (১৫/১২)

তুমি চৈতন্য স্বরূপ।  এই জগৎ তোমা থেকে ভিন্ন নয়। অতএব  কোথায়, কিভাবে, আর কাকেই বা তুমি হেয়  বা উপাদেয় বলে কল্পনা করছো ? অর্থাৎ কাকেই বা ত্যাগ করবে বা গ্রহণ করবে বলে কল্পনা করছো ?

যোগাচার্য্য বলছেন : তুমি  নিজেই চৈতন্যমাত্রস্বরূপ । তোমা থেকেই  সব ব্যাপ্ত হয়. তুমি ছাড়া পৃথিবী নেই। অতএব, কে ভালো বা  মন্দ এই ধারণাটি কল্পনা ছাড়া কিছু নয়।  তারা কোথায়? কোন প্রকৃতির? যখন সকলে, চূড়ান্ত আত্মার  সাথে এক হয়ে যায়, তখন সেখানে ভাল বা খারাপ বলে কিছুই থাকে না।

একস্মিন-অব্যয়ে শান্তে চিদাকাশে-অমলে ত্বয়ি 
কুতো  জন্ম কুতঃ কর্ম কুতো -অহঙ্কার এব চ ।  (১৫/১৩)

তুমি চিদাকাশে অমল, শান্ত একমাত্র অব্যয় (অজন্মা) - তো কোথায় তোমার জন্ম ? তোমাতে না আছে জন্ম, না আছে কর্ম, না আছে অহঙ্কার। 
যোগাচার্য্য বলছেন : গুরুর উপদেশ অনুযায়ী সাধন ক্রিয়ার প্রভাবে যখন সব  এক হয়ে যায়, তখন সকলেই অক্ষয়, চিরন্তন, চেতনার শান্ত আকাশমাত্র । তুমি  অমর। তোমার  জন্ম, কর্ম এবং অহঙ্কার কোথায় আছে ? 

যৎ-ত্বং পশ্যসি তত্র-একঃ-তম -এব প্রতিভাসসে 
কিং পৃথক ভাসতে স্বর্ণাৎ কটক-অঙ্গদ-নূপুরম। (১৫/১৪) 

যাকিছু কার্যরূপ তুমি দেখতে পাচ্ছো, তাতে সর্বত্র  কারণরূপ তুমিই প্রতিভাসিত হচ্ছে। হাতের বালা, বাহুতে অঙ্গদ, পায়ের নুপুর পৃথক বলে মনে হলেও, সবই  সেই সোনা।
যোগাচার্য্য বলছেন : তুমি যা কিছু দেখতে পাচ্ছ, তা সবই  সেই এক ব্রহ্ম। যেমন সমস্ত অলংকারের মধ্যে সেই এক  স্বর্ণ। 

অয়ং সো-অহম-অয়ং  নাহং বিভাগম-ইতি সন্ত্যজ 
সর্বম-আত্মা-ইতি নিশ্চিত্য নিঃসঙ্কল্পঃ সুখী ভব। (১৫/১৫)

এটা  আমি, ওটা আমি নোই, (আত্মা আমি, জগৎ আমি নোই) এই বিভাগজ্ঞান ত্যাগ করো।  সবকিছুই এক আত্মা - এটা নিশ্চিতরূপে জেনে সঙ্কল্পবিহীন হয়ে সুখী হও। 
যোগাচার্য্য বলছেন : "আমি এটি এবং আমি এটি নই" এই  ধারণাগুলো  ছেড়ে দাও । নিখুঁতভাবে বিচার করলে, বুঝতে পারবে,  যে সমস্ত কিছুই "আমি" এবং  এই সত্যের চূড়ায় পৌঁছে,  আত্মার  সাথে নিখুঁতভাবে এক হও।

তবৈব-অজ্ঞানতো বিশ্বং ত্বমেক  পরমার্থতঃ  
ত্বত্ত্বো-অন্যো নাস্তি সংসারী নাসংসারী চ কশ্চন। (১৫/১৬) 

তোমার এই অজ্ঞানতা বিশ্বভাতির  কারন।  তুমিই একমাত্র পরমার্থ। তোমা থেকে ভিন্ন না আছে সংসারী, না আছে অসংসারী। 
যোগাচার্য্য বলছেন : যখনই তুমি নিজেকে জগতের মধ্যে আঁকড়ে রাখো, তখনই জগৎ প্রকাশিত, আর  তুমি জগতের অংশ বলে নিজেকে মনে করো  ।  কিন্তু তুমি  যখন নিজেকে ধরে রাখো, তখন তুমিই স্বয়ং তোমার  প্রভু।  তুমি ছাড়া আর কিছুই নেই। তুমিই  কখনও গৃহকর্তা আবার তুমিই গৃহত্যাগী। কখনো সংসারী, কখনো সন্ন্যাসী। 

ভ্রান্তি-মাত্রম-ইদং বিশ্বং চ কিঞ্চিৎ-ইতি নিশ্চয়ী 
নির্বাসনঃ স্ফূর্তিমাত্রো ন কিঞ্চিৎ-ইব শাম্যতি। (১৫/১৭) 

এই বিশ্ব ভ্রান্তিমাত্র, বিষয় বলে কিছু নেই ।  একথা  নিশ্চিত বলে জেনে, বাসনারহিত হয়ে চৈতন্যে স্থির হয়ে শান্তি লাভ করো। 
যোগাচার্য্য বলছেন : জগৎটি কেবল বিভ্রম। এটি নিশ্চিতভাবে জানো । এটা কিছুই না. সবকিছু তোমার  ইচ্ছা দ্বারা তৈরি করা হচ্ছে. তুমি  তখনই খুশি হবে যখন তুমি  ইচ্ছা থেকে মুক্ত হবে। এই জগৎ কিছুই নয়, কারণ সবই স্বয়ং পরম-ব্রহ্ম।  ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নেই। তাহলে তুমি  কি চাও ? যখন সকলে ব্রহ্মের সাথে এক হয়ে যায়, তখন কেবল পরমব্রহ্ম, সবই ব্রহ্মময়।  তখন সাধক-ব্যক্তি চেতনার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা লাভ করে।

এক এব ভব-অম্বোধৌ-এব-আসীত-অস্তি ভবিষ্যতি 
ন  তে বন্ধো-অস্তি মোক্ষো বা কৃত-কৃত্য সুখং চর । (১৫/১৮)

অতীতে তুমি একাই  ছিলে , ভবিষ্যতে তুমি একাই  থাকবে। তোমার না আছে বন্ধন, না আছে মোক্ষ।  সুতরাং কৃত-কৃত্য হয়ে সুখে বিচরণ করো। 

যোগাচার্য্য বলছেন : এই জগৎ ব্রহ্মারই প্রকাশ যা অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। এটা উপলব্ধি করার পর, তোমার কোন বন্ধন নেই, মুক্তিও নেই। তুমি  সুখে বাস করো এবং শান্ত থাকো। 
মা সংকল্প-বিকল্পাভ্যাং  চিত্তং ক্ষোভয়  চিন্ময় 
উপশাম্য সুখং তিষ্ঠ স্বাত্মনি-আনন্দ-বিগ্রহে  (১৫/১৯)

সংকল্প ও বিকল্প দ্বারা চিত্তকে ক্ষোভিত করো না। শান্ত হও, আত্মাতে তিষ্ঠ হও, আনন্দস্বরূপে স্থিতি লাভ করো। 

যোগাচার্য্য বলছেন : তুমি  কুটস্থ-চৈতন্য, চূড়ান্ত স্বয়ং সর্বত্র, সর্ব্বকালে পরিব্যাপ্ত। আমি তোমাকে  জিজ্ঞাসা করি কেন তুমি  মনের সংকল্প ও বিকল্পের অর্থাৎ প্রত্যাশা ও  প্রত্যাখ্যানের কারণে ভুগছো ? দূর করে দাও মনের এই বিকাররূপ  সংকল্প বিকল্পের খেলা । দুঃখ বিলুপ্ত করে এবং কামনা ও সংযুক্তি ত্যাগ করে, ব্রহ্মকে ধারণ করো  এবং বিবেকের সুখময় অবস্থা উপভোগ করো ।

ত্যজৈব ধ্যানং সর্বত্র মা কিঞ্চিদ হৃদি ধারয়
আত্মা ত্বং মুক্ত এবাসি কিং বিমৃশ্য করিষ্যসি।  (১৫/২০)

(বিষয়) ধ্যান পরিত্যাগ করো। হৃদয়ে কোনো ধারণা (ঈশ্বর-চিন্তন) করবারও  দরকার নেই। তুমি আত্মা, তুমি সদাই মুক্ত। তোমার নতুন করে কিছু লাভ করবার নেই। 

যোগাচার্য্য বলছেন : ধ্যানের নাম করে, হৃদয়ে কিছু ধারণ করে রাখবার দরকার নেই। কাকে ধারণ করবে ? তোমার ইষ্ট  তুমি। তুমিই তোমার ঈশ্বর। তুমি আবার মুক্তিকামী হবে কি করে ? তুমি সদাই মুক্ত। এই কথাটা মনে রেখো যে তুমি স্বয়ং আত্মা, তুমি সদা  মুক্ত। তাই মুক্তির চিন্তা করে কাকে তুমি মুক্ত করবে  ?  

ইতি তত্ত্ব-উপদেশ বিংশতিকং নাম পঞ্চদশ প্রকরণম অষ্টাবক্র গীতা সমাপ্তম। 
----------------------

বিশেষ-উপদেশক্যং নাম ষোড়শং প্রকরণম। 

শ্রীগুরু অষ্টাবক্র ঋষি বলছেন : 

আচক্ষ্ব শৃণু বা তাত  নানাশাস্ত্রাণি-অনেকশঃ   
তথাপি ন  ভব স্বাস্থ্যং সর্ব-বিস্মরণাৎ-ঋতে। (১৬/০১) 

তুমি নানাশাস্ত্রকথা কানে শোনো বা মুখে বলো - অর্থাৎ শাস্ত্রবাণী গুরুমুখে শোনো, বা তুমি তোমার শিষ্যদেরকে বলো, কিন্তু যতক্ষন  তুমি এই প্রপঞ্চময় জগৎকে ভুলে যেতে না পারছো, ততক্ষন তোমার শ্রেয় হবে না। 

যোগাচার্য্য বলছেন : তুমি  হাজার বার ধর্মগ্রন্থগুলি পড়তে এবং শুনতে পারো, কিন্তু এটি তোমাকে  ভাল রাখতে পারবে না।   সাধন ক্রিয়ার বা গুরুবাক্যের পরবর্তী প্রভাব-স্থিতিকে মনের মধ্যে ধরে না রাখলে বিশ্বকে বিলীন করা সম্ভব নয়।

ভোগং কর্ম সমাধিং  বা কুরু বিজ্ঞ  তথাপি  তে 
চিত্তং নিরস্ত-সর্ব-আশং-অতি-অর্থং রোচয়িষ্যতি । (১৬/০২)

তুমি ভোগ করো, কর্ম করো বা সমাধির অভ্যাস  করো, অর্থাৎ যাই করো না কেন,  প্রথমে সবকিছু ভুলে যাও, তোমার স্মৃতি থেকে সবকিছু বিস্মৃত হোক,  তোমার চিত্ত থেকে  সমস্ত তৃষ্ণার অবসান হোক, আর সদা  স্ব-স্বরূপে স্থিত থাকবার জন্য রুচিশীল হও। 
যোগাচার্য্য বলছেন : তুমি  আনন্দের জন্য বা সমাধি লাভের জন্য যে কাজই করো  না কেন তা ফলদায়ক হবে না, যতক্ষন না তোমার  হৃদয় কামনা থেকে মুক্ত হচ্ছে ।

অয়াসাৎ সকলো দুঃখী নৈনং জানাতি কশ্চন 
অনেন-এব -উপদেশন ধন্যঃ প্রাপ্নোতি নির্বৃতিম। (১৬/০৩)

আয়াস সকল দুঃখের কারন- একথা কেউ কখনো  জানে না। কিন্তু  আয়াস সর্বদুঃখের জনক, এই উপদেশ প্রাপ্ত হয়ে বৃত্তিহীন হয়ে তুমি সুখের ভাগী  হও । 
যোগাচার্য্য বলছেন : কেউই জানে না যে কেবল পছন্দের জিনিসের আকাংখ্যা দ্বারাই  দুঃখকে আকর্ষণ করা হচ্ছে।   যিনি এই উপদেশের দ্বারা কামনাহীন অবস্থা লাভ করেন তিনি ধন্য।

ব্যাপারে খিদ্যতে যস্তু নিমেষ-উন্মেষোয়ঃ-অপি 
তস্য-আলস্য-ধুরীণস্য সুখং নান্যস্য কস্যচিৎ। (১৬/০৪)

সমস্ত ব্যপারে, এমনকি চোখের পাতা  উন্মেষ বা নিমেষের ব্যাপারেও যিনি কষ্ট  বোধ করেন, সেই অলস-ধুরন্ধর ব্যক্তির  সুখে হয়ে থাকেন  । অন্যদের এই সুখ হয় না। 
যোগাচার্য্য বলছেন : যিনি কাজ করতে অস্বীকার করেন, যিনি চোখ বুজতে  দেন না এবং যিনি চোখ খুলতেও চান না তিনি শান্ত এবং জ্ঞানী মানুষ। তাকে দেখতে অলস লোকের মতো লাগে বটে ৷ কিন্তু তিনিই  স্বয়ংকে  ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, আর তাঁর চেয়ে বড় জ্ঞানী আর  কেউ নেই। অন্য ভাবে বলতে গেলে বলতে হয়,  যিনি সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছেন,  তিনি একজন সত্যিকারের সুখী ব্যক্তি।

ইদং কৃতমিদং নেতি দ্বন্দ্বৈঃ-মুক্তং যদা মনঃ 
ধৰ্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষেষু নিরপেক্ষং তদা ভবেৎ।  (১৬/০৫)

এটা করা হয়েছে, এটা করা হয়নি,  এই দ্বন্দ্ব থেকে মন যখন মুক্ত হয়, তখন ধর্ম্ম-অর্থ-কাম -মোক্ষ ইত্যাদি থেকেও মন নিরপেক্ষ হয়ে যায় ।  
যোগাচার্য্য বলছেন : যখন কেউ চিন্তার দ্বন্দ্ব  থেকে মুক্ত থাকে অর্থাৎ  "এই কাজটি সম্পন্ন হয়েছে" বা এই কাজটি এখনও সম্পূর্ণ হয়নি" এই দ্বন্দ্ব  থেকে মুক্ত থাকে, তখন জানবে তাঁর মুক্তি অর্জিত হয়েছে । তখন তিনি  একজন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ অর্থাৎ তাঁর  মন সংকল্প-বিকল্প রহিত হয়ে  ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ-এর অধিকারী হয়েছেন। 

বিরক্তো বিষয়দ্বেষ্টা রাগী বিষয়-লোলুপঃ
গ্রহ-মোক্ষ-বিহীনস্তু ন বিরক্ত ন রাগবান। (১৬/০৬)

বিষয়ে যিনি বিরক্ত তিনি বিষয়দ্বেষী, বিষয়ে যিনি লোভাতুর তিনি রাগী  পুরুষ। গ্রহণ ও মোক্ষ (ত্যাগের) ইচ্ছেবিহীন  পুরুষ না বিরক্ত না রাগবান। অর্থাৎ তিনি সর্বদা নিরপেক্ষ। 
যোগাচার্য্য বলছেন : যিনি  বাহ্য বস্তুকে ঘৃণা করেন  তিনি  বাহ্যবস্তু থেকে নিজেকে  বিচ্ছিন্ন করে রাখেন । আর  যিনি  বাহ্যিক জিনিসের প্রতি আগ্রহী তিনি  লোভের সাথে তাদের গ্রহণ করতে চান । যিনি নিজেকে এই বাহ্য বস্তু থেকে  বিচ্ছিন্ন করার  অবস্থা অর্জন করতে পেরেছেন, বা করেছেন এবং বিচ্ছিন্ন হতে বা সংযুক্ত হতে আর  আগ্রহী নন তিনি  প্রকৃত স্ব-স্বরূপের (সত্য বস্তুর) সন্ধান পেয়ে পরাবস্থায় উপনীত হয়েছেন। অন্যদের কাছে  এই উপদেশটি  কেবল কথার কথা   বা কেবল শোনা কথা হয়েই থাকবে, উপল্বদ্ধিতে আসবে না। 

হেয়ো-উপাদেয়তা তাবৎ সংসার-বিটপ-অঙ্কুরঃ 
স্পৃহা জীবতি যাবদ্বৈ নির্বিচার-দশা-আষ্পদম।  (১৬/০৭)

হেয় ও উপাদেয় ভাব অর্থাৎ গ্রহণ ও ত্যাগের স্পৃহা যতদিন থাকবে, ততদিন সংসার বৃক্ষবীজে অঙ্কুর  উদ্গমন হতে থাকবে। নির্বিচারের  দশাই  সংসার বৃক্ষবীজের অনুৎপাদনের কারন হতে পারে।
যোগাচার্য্য বলছেন : যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ ভাল-মন্দ ভেদাভেদ নিয়ে ব্যস্ত থাকে,  ততক্ষণ সে প্রপঞ্চময় এই সংসার  গাছের বীজ লালন-পালন  করে। তাই বৈষম্যের ঊর্ধ্বে যে অবস্থা, ভালো-মন্দের উর্দ্ধে যে অবস্থা,  এবং কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে যে স্থিতি তা  অস্থিরতা  উদ্ভূত দুঃখ-কষ্ট  থেকে মুক্ত একটা বিশেষ অবস্থা । সত্যিকথা বলতে কি, এটি অনন্যভাবে এক  বিস্ময়কর অবস্থা, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না । কেবল এই অবস্থায় পৌঁছলেই, এর মাহাত্ম বোঝা যায়। 

প্রবৃত্তৌ জায়তে রাগো নিবৃত্তৌ দ্বেষ এব হি 
নির্দন্দ্বো বালবৎ ধীমান-এবম-এব ব্যবস্থিতঃ।  (১৬/০৮)

প্রবৃত্তি থেকে রাগের জন্ম হয় আবার নিবৃত্তি  থেকে দ্বেষের জন্ম হয়। ধীমান ব্যক্তি বালকের ন্যায় নির্দ্বন্দ্ব হয়ে অবস্থান করেন। 
যোগাচার্য্য বলছেন : আসক্তি,  উপভোগ করার অনুভূতি থেকে বিকশিত হয়।  আবার  ঘৃণা, উপভোগ বা সংযম না করার অনুভূতি থেকে বিকাশ লাভ করে। অতএব, যোগীপুরুষ   প্রবৃতি এবং নিবৃত্তি এই দুইয়ের  বাইরে থেকে নিরালম্ব হয়ে অবস্থান করেন ।

হাতুম-ইচ্ছতি সংসারং রাগী  দুঃখ জিহাসয়া 
বীতরাগো হি নির্দুঃখঃ-তস্মিন ন অপি ন  খিদ্যতি। (১৬/০৯)

বিষয়াসক্ত রাগী পুরুষ দুঃখ থেকে পরিত্রানের ইচ্ছেয় সংসার পরিত্যাগ করবার ইচ্ছে করে। কিন্তু বীতরাগ ব্যক্তি সংসারে থেকেও নির্দুঃখী থাকেন, কখনো খেদ করেন না। 
যোগাচার্য্য বলছেন : দুঃখ দূর করার জন্য যে সংসার ত্যাগ করে সে নিবৃত্তির দাসত্বে আছে। যে এই সংসারে  থেকে   সমস্ত কামনা-বাসনাকে অতিক্রম করেছে , সেই মুক্ত পুরুষ, তাঁর  কোন কষ্ট নেই।

যস্য-অভিমানো মোক্ষে-অপি দেহে-অপি মমতা তথা 
ন চ জ্ঞানী ন  বা যোগী কেবলং দুঃখভাগসৌ ।  (১৬/১০)  

যিনি মোক্ষাভিমানী, তিনি জ্ঞানী নয়, যিনি দেহের প্রতি মমতাশীল সেই যোগী নন। এরা  কেবল দুঃখের ভাগিদার হয়ে থাকে। 
যোগাচার্য্য বলছেন : যে মুক্তি পেতে চায় তার মধ্যে অহংবোধ বা ব্যক্তিত্বের অনুভূতি থাকে। অতএব, তিনি যথার্থ জ্ঞানী বা যথার্থ যোগী নন। তিনি কেবল ভুক্তভোগী।

হরো যদ্যুপদেষ্টা তে হরিঃ কমল-জঃ-অপি বা 
তথাপি ন  ভব স্বাস্থ্যং সর্ববিস্মরণাৎ-ঋতে।  (১৬/১১)

হরে, অর্থাৎ মহেশ্বর, হরি অর্থাৎ বিষ্ণু, কমলজ অর্থাৎ কমলজাত ব্রহ্মা।  এঁরা সবাই যদি  তোমার উপদেষ্টা (গুরু) হন তথাপি যতক্ষন তোমার সংসার-বিস্মৃতি  না হচ্ছে, ততক্ষন তুমি স্ব-স্বরূপে স্থিত হতে পারবে না। 
যোগাচার্য্য বলছেন :  তুমি ব্যক্তিগত   ইচ্ছা বা অনিচ্ছার  ঊর্ধ্বে না উঠতে পারলে, তুমি ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব, ইত্যাদি অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি  ও সংহার কর্ত্তার  কাছ থেকে সরাসরি উপদেশ পেলেও তোমার শান্তি আসবে না। তাই আগে নিজেকে ইচ্ছেরহিত করো। 
 
ইতি বিশেষ-উপদেশকং নাম ষোড়শং প্রকরণং অষ্টাবক্র গীতা সমাপ্তম।  
---------------------

তত্ত্বজ্ঞ স্বরূপ বিংশতিকং নাম - সপ্তদশং প্রকরণম। 

তত্ত্বজ্ঞ পুরুষের স্থিতি সম্পর্কে ঋষি অষ্টাবক্র বলছেন : 

তেন জ্ঞানফলং প্রাপ্তং যোগাভ্যাসফলং তথা 
তৃপ্তঃ স্বচ্ছেন্দ্রিয়ো নিত্যম-একাকী রমতে তু  যঃ।  (১৭/০১)

যোগ-অভ্যাসের ফলে  যিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন, অর্থাৎ যোগের পরাবস্থায় যিনি পৌঁছতে পেরেছেন, তিনি ইন্দ্রিয়াতীত হয়ে নিত্য আপনাতে আপনি রমন করছেন। 

যোগাচার্য্য বলছেন :  যার মন যোগাভ্যাসের জ্ঞান ও ফল লাভ করেছে, তিনি  ক্রিয়ার পরবর্তী প্রভাবে সন্তুষ্ট।  অতএব, তার ইন্দ্রিয়সকল শুদ্ধ  এবং স্বচ্ছ (সূক্ষ্ম অনুভূতিলাভে সক্ষম).তিনি  চিরকাল একাকী অবস্থান করেন।  

ন কদাচিৎ-জগতি-অস্মিন তত্ত্বজ্ঞো হন্ত খিদ্যতি 
যত একেন তেনেদং পূর্ণং ব্রহ্মান্ড-মন্ডলম। (১৭/০২)

তত্ত্বজ্ঞ পুরুষ নিজে পূর্ন। তিনি  একাকী এই ব্রহ্মাণ্ড-মণ্ডল ব্যাপ্ত হয়ে আছেন। তাঁর  কাছে দ্বিতীয় কোনও সত্ত্বার উপস্থিতি নেই।  তাই তাঁর  মধ্যে কোনো খেদ অর্থাৎ ঘাত -প্রতিঘাত জনিত কোনো পরিতাপ নেই। 
যোগাচার্য্য বলছেন : যিনি এই জগতে পরমআত্মা ব্রহ্মের শাশ্বত উপলব্ধি লাভ করেছেন, তিনি তুচ্ছ বিষয়ানন্দ ত্যাগে  বিষণ্ণ হন না; তাঁর জন্য, সমগ্র জগৎ এক ব্রহ্মে স্থিত। তিনি ব্রহ্মময়, স্বয়ং  পরমআত্মা। 

ন জাতু বিষয়াঃ কে-অপি স্ব-আরামং হর্ষয়ন্তি-অমী 
সল্লকী পল্লব প্রীতমিবেভং  নিম্ব-পল্লবাঃ । (১৭/০৩) 

যে হাতি বাবলা (সল্লকী) গাছের স্বাদ পেয়েছে, সে আর  নিমপাতার রসে  স্বাদ পায়  না। ঠিক তেমনি প্রতক্ষ্যদৃষ্ট এই রূপ-রসাদি বিষয়ে সে (যোগী) আনন্দ পায়  না, যাঁর (স্বাত্মারাম) মধ্যে স্ব-আত্মার স্বাদ উপলব্ধ হয়েছে। 

যোগাচার্য্য বলছেন : সুস্বাদু  গাছের পাতা-প্রিয় হাতির বাচ্চা কখনও আর নিম পাতা খেতে চায় না।  একইভাবে যারা ব্রহ্মের চিরন্তন উপলব্ধি করেছেন, পরম আত্মাকে অর্জন করেছেন তাঁরা পার্থিব   বিষয়  উপভোগ করতে পছন্দ করবেন না।

যস্তু ভোগেসু ভুক্তেষু  ন  ভবতি-অধিবাসিতঃ
অভুক্তেসু নিরাকাঙ্খী তাদৃশো ভব-দুর্লভঃ।  (১৭/০৪)

যেখানে ভোগ-বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই, অভুক্ত বিষয়েও কোনো আকাংখ্যা  নেই, সেই আত্মতৃপ্ত পুরুষ সংসারে বিরল।
যোগাচার্য্য বলছেন : যিনি ভোগ করতে চান না আবার  ভোগহীন অবস্থা লাভের আশাও  করেন না, তিনি অত্যন্ত বিরল ব্যক্তি।

বুভুক্ষঃ-ইহ সংসারে মুমুক্ষঃ-অপি দৃশ্যতে 
ভোগ-মোক্ষ-নিরাকাঙ্খী বিরলো হয় মহাশয়ঃ।  (১৭/০৫)

এই সংসারে বুভুক্ষু (ভোগে-ইচ্ছুক) আবার মুমুক্ষু  (মোক্ষে ইচ্ছুক) এই উভয় ধরনের লোকই দেখা যায়। কিন্তু ভোগ-মোক্ষ উভয়ে ইছারহিত মহানপুরুষ বিরল। 
যোগাচার্য্য বলছেন : একদল আছে, যারা ভোগ করতে চায়, আবার আরেকদল আছে, যারা মুক্তি চায়, এই দুটি দলই সাধারণত পৃথিবীতে পাওয়া যায়। কিন্তু এমন কিছু মহাত্মা আছেন, যাঁরা  ভোগও  করতে চান না আবার  মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও করেন না, এঁরা  অত্যন্ত বিরল মানুষ, এঁরা  সত্যই মহাত্মা, মহান পুরুষ, এঁরাই  মহান আশ্রয়।

ধর্ম-অর্থ-কাম -মোক্ষেষু জীবিত মরণে তথা 
কস্য -অপি-উদার-চিত্তস্য হেয়ো -উপাদেয়তা ন  হি। (১৭/০৬)

ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ এই চারটে  পুরুষার্থ, জীবনে অথবা মরনে হেয় বা উপাদেয় মনে করে না, এমন উদারচেতা  পুরুষ জগতে বিরল। 
যোগাচার্য্য বলছেন : তিনি ধর্ম, সমৃদ্ধি, ভোগ, মুক্তি, জীবন-মৃত্যু এমনকি  ভালো-মন্দ সব ক্ষেত্রেই সমানভাবে উপস্থিত। এই হচ্ছে  একজন আত্ম-উপলব্ধি সম্পন্ন মানুষের হৃদয়ের অবস্থা।

বাঞ্ছা ন  বিশ্ব-বিলয়ে ন দ্বেষস্তস্য চ স্থিতৌ 
যথা-জীবিকয়াতস্মাদ ধন্য আস্তে যথাসুখম। (১৭/০৭)

বিশ্বের বিলয়ে যাঁর বাঞ্ছা  নেই, আবার বিশ্ব স্থিতিতেও যাঁর দ্বেষ নেই এমন পুরুষ যিনি যা পাওয়া যায় তাতেই জীবিকা নির্বাহ করেন, তিনি পরমসুখে অবস্থান করেন। 
যোগাচার্য্য বলছেন : তিনি এই পৃথিবীকে বিলীন করতে চান না বা এর বর্তমান অবস্থাকেও  ঘৃণা করেন না, তিনি জীবনকে যেমন আছে তেমনই বজায় রাখেন, অর্থাৎ তিনি যেমন-যেমন  জিনিসগুলি পাওয়া যায় তেমনই  খান  এবং তেমনই পরিধান করেন । এই ধরনের মহান যোগীপুরুষ যথার্থ ধনী এবং সুখী।

কৃতার্থো-অনেন জ্ঞানেন-ইতি-এবং গলিতধীঃ কৃতী
পশ্যন শৃন্বন স্পৃশন জিঘ্রন-অশ্নন-আস্তে যথাসুখম। (১৭/০৮) 

অদ্বৈত জ্ঞানে   যিনি কৃতার্থ, স্ব-স্বরূপে যিনি সদা নিবিষ্টচিত্ত, সেই  মহাজ্ঞানী  (বাহ্য-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা)   দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শন, অঘ্রান, ভোজন ইত্যাদি ব্যাপারে লিপ্ত হয়েও সুখে অবস্থান করেন। 
যোগাচার্য্য বলছেন : যাঁর বুদ্ধি ও কর্ম এই আত্মজ্ঞান লাভে ধন্য হয়, তিনি চোখে তো দেখেন, কান দিয়ে শোনেন, ত্বক দিয়ে স্পর্শ করেন, নাক দিয়ে  ঘ্রাণ নেন,   এবং মুখ দিয়ে খান, অর্থাৎ সবকিছুই সাধারনের মতোই  করছেন, তথাপি তিনি স্ব-স্থিত থাকায় স্বয়ং কিছুই করেন না, যা কিছু হচ্ছে তা কেবল দেহাদি-ইন্দ্রিয়ক্রিয়া বিশেষ। এই মহাত্মন যথার্থ সুখে অবস্থান করেন। 

শূন্যে দৃষ্টির্বৃথা চেষ্টা বিকলান-ইন্দ্রিয়ানি চ
ন স্পৃহা ন  বিরক্তির্বা ক্ষীণ-সংসার-সাগরে (১৭/০৯)

সংসার-সাগর যাঁর  কাছে শুকিয়ে গেছে, তাঁর সাংসারিক বিষয় লাভে  ইচ্ছে বা বিরক্তি কোনোটাই নেই।  তাঁর  দৃষ্টি শূন্যে (মন সংকল্প-বিকল্প শূন্য), ইন্দ্রিসকল যেন ক্রিয়াহীন বিকল। 
যোগাচার্য্য বলছেন : যোগীপুরুষ যখনই চোখ দিয়ে দেখেন, তখন তা না দেখার সমান  । কারণ তার দৃষ্টি বাহ্য বিষয়ে নিষ্ফল। তার দৃষ্টি থাকে ব্রহ্মদেশে। আর যাঁর দৃষ্টি  ব্রহ্মদেশে থাকে  তার ইন্দ্রিয়ের প্রচেষ্টা নিষ্ফল হয়। কারণ তার দৃষ্টি ব্রহ্মের/কূটস্থের  উপর স্থির । তিনি স্বয়ং ব্রহ্ম, তিনি পরমআত্মা। জাগতিক  কোনো বস্তুর প্রতি তার কোনো আকাঙ্ক্ষা বা ঘৃণা নেই।

ন জাগর্তি ন নিদ্রাতি ন-উন্মীলতি  ন মীলতি
অহো পরদশা ক্বাপি বর্ততে মুক্তচেতসঃ।  (১৭/১০)

তিনি না জেগে আছেন, না নিদ্রা গিয়েছেন । তাঁর চোখ  না বন্ধ  না খোলা। মুক্ত-চেতন পুরুষের এই উৎকৃষ্ট অবস্থা হয়ে থাকে।    
যোগাচার্য্য বলছেন : তিনি  জাগ্রতও নয়, আবার ঘুমিয়েও নেই, তার চোখ খোলাও  নেই, আবার বন্ধও নেই। এমন বিচরণশীল অবস্থা তাঁরই হয় যাঁর  হৃদয় জাগতিক আসক্তি থেকে মুক্ত। এটা খুব বিস্ময়কর অবস্থা, যাঁর  কাছে এটা ঘটেছে, তিনি একাই, কেবলমাত্র তিনিই  এই অবস্থা জানেন।

সর্বত্র দৃশ্যতে স্বস্থঃ সর্বত্র বিমল-আশয়ঃ 
সমস্ত-বাসনা-মুক্তো মুক্তঃ সর্বত্র রাজতে।  (১৭/১১)

স্ব-স্থিত (তত্ত্বজ্ঞ) পুরুষ সবত্র সমদর্শী হন।  সমস্ত বাসনামুক্ত হয়ে সর্বাবস্থাতেই তিনি রাজা হয়ে, রাজত্ব করেন। 
যোগাচার্য্য বলছেন : আত্মজ্ঞানের  উপলব্ধি যাঁর হয়েছে, সেই  মানুষকে  সর্বত্র একই  অবস্থায় দেখা যায় এবং তিনি  শুদ্ধ, সরল মনের। তিনি  সর্বাবস্থায়  বাসনার বাইরে থাকেন ।

পশ্যন শৃন্বন স্পৃশন জিঘ্রন-অশ্নন গৃহ্ণন বদন ব্ৰজন 
ঈহিত-অনীহিতৈঃ-মুক্তো মুক্ত এব মহাশায়ঃ (১৭/১২)

দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শন, ঘ্রান, ভক্ষণ, গ্রহণ, বদন, গমন ইত্যাদি বাহ্য ইন্দ্রিয়ের ব্যাপার সম্পন্ন করেও, ইচ্ছে-দ্বেষ রহিত হয়ে থাকেন এবং সদা  এই আত্মনিষ্টচিত্ত পুরুষ মনের সমস্ত বিকার রহিত  হওয়ায় নিত্যমুক্ত অবস্থায় বিরাজ করেন ।  
যোগাচার্য্য বলছেন : আত্মজ্ঞানী  মানুষও দেখেন , শোনেন , কথা বলেন , হাসেন , খাবার খান, গ্রহণ করেন । কিন্তু তিনি যেখানেই বিচরণ করেন, এই সমস্ত কাজ তাঁর ইচ্ছার বাইরে প্রতিষ্ঠিত হয়েই অনুষ্ঠিত  হয়। এই  মুক্ত এবং সত্যিকারের মহাত্মা, মহান।

ন নিন্দতি ন  চ স্তৌতি হ হৃষ্যতি  ন কুপ্যতি 
ন দদাতি ন গৃহ্নাতি মুক্তঃ সর্বত্র নীরসঃ ।(১৭/১৩) 

তিনি (আত্মজ্ঞানী ) না করেন নিন্দা, না করেন স্তুতি, না হৃষ্ট হন, না কুপিত হন, না দান  করেন, না গ্রহণ করেন, যিনি সর্ববিষয়ে অনাসক্ত এই পুরুষই মুক্ত। 
যোগাচার্য্য বলছেন : স্ব-উপলব্ধি সম্পন্ন  মানুষ অন্যদের প্রশংসা বা ঘৃণা করেন  না। তিনি  আনন্দিতও হন  না, রাগান্বিতও হন  না, তাঁর  না আছে কিছু দেওয়া, না আছে কিছু পাওয়া, তিনি দেনা-পাওনার উর্দ্ধে। এমন ব্যক্তিই  জীবন্মুক্ত  পুরুষ।  কোনো কিছুতেই তাঁর  কোনো আগ্রহ নেই, আবার অনাগ্রহও নেই। কারণ, তিনি উপলব্ধি করেছেন যে জাগতিক রস বা ভোগগুলি সত্যই মূল্যহীন কারন তিনি ব্রহ্ম, বা সর্বোত্তম যোগাবস্থা  অর্থাৎ  অমৃতের সাথে এক হয়েছেন।

স-অনুরাগং স্ত্রিয়ং দৃষ্টবা মৃত্যুুং বা সমুপস্থিতম 
অবিহ্বল-মনাঃ স্বস্থো মুক্তো এব  মহাশয়ঃ। (১৭/১৪)

তাঁর দৃষ্টিপথে কামাতুরা কামিনী বা সাক্ষাৎ মৃত্যু দর্শনেও যার চিত্তে কোনো ক্ষোভ উৎপন্ন হয় না, তিনি স্ব-স্থিত মুক্ত মহাপুরুষ। 
যোগাচার্য্য বলছেন : কামনার বস্তু সামনে দেখে, তার মধ্যে কাম-ভাবনা জাগে না, কারন তিনি আপনাতে  আপনি রমন করছেন। ভয়ার্ত অবস্থা এমনকি মৃত্যুকে সামনে দেখেও, তার মধ্যে কোনো বিকার আসে না।  কারণ, তিনি নিজের মধ্যেই ক্রিয়া-পরবর্তী প্রভাবে মৃত্যুর উর্দ্ধে জীবনমুক্ত হয়ে অবস্থান করছেন।  এমন একজন মানুষই যথার্থ  মুক্ত এবং মহাত্মা।

সুখে দুঃখে নরে নার্যাং সম্পৎসু চ বিপুৎসু চ 
বিশেষো নৈব ধীরস্য সর্বত্র সমদর্শিনঃ।  (১৭/১৫)

সুখে বা দুঃখে, নর বা নারীতে, সম্পদে বা বিপদে, যার ধীরতা বজায় থাকে তিনি সর্বত্র সমদর্শী।   
যোগাচার্য্য বলছেন : তিনি তাঁর  স্বাভাবিক (যোগের উচ্চতম অবস্থায়) অবস্থায় সুখ বা দুঃখের জন্য বিচলিত হন  না, পুরুষ বা মহিলাকে আলাদা দৃষ্টিতে দেখেন না, সচ্ছল অবস্থায় বা দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থাতেও কোনো ফারাক দেখেন না। আসলে তিনি কূটস্থে  স্থির হয়ে, ক্রিয়া-পরবর্তী-স্থিরতাকে  ধারণ করে প্রশান্ত।  তিনি সর্বত্র-সর্ব্বদা  প্রশান্তি বা সাম্য দেখতে পান।

না হিংসা নৈব কারুণ্য নৌদ্ধত্যং ন  চ দীনতা 
ন -আশ্চর্যং নৈব চ ক্ষোভঃ ক্ষীণ-সংসরণে-অনরে (১৭/১৬)

হিংসা, করুনা, ঔদ্ধত্ব, দীনতা, ক্ষোভ, বিস্ময়   ইত্যাদি (মানবীয় গুন) এই  সংসারক্ষীন মানুষটির মধ্যে নেই।    
যোগাচার্য্য বলছেন : যোগীপুরুষের কোনো অসহিষ্ণুতা  নেই কারণ তিনি নিজেকে ব্রহ্মন  বলে উপলব্ধি  করেন। সর্ব বিষয়ে এই মহাত্মা সমদর্শী। তিনি কখনও করুণা করেন না। না তিনি তাঁর  সম্পদের অহংকার করেন  না, তিনি হিনমন্যতায় ভোগেন । তিনি কোন কিছু সম্পর্কে বিস্মিত বোধ করেন না বা তিনি কোন কিছুর জন্য অনুশোচনাও  করেন না।  অন্য কথায়, তার জন্য বিশেষ কোনো মানবীয় গুনের বা নির্গুণের প্রয়োজন নেই। তিনি সবকিছুর মধ্যেই শান্ত, স্থির অবস্থায় অবস্থান করেন। 

ন মুক্তো বিষয়দেষ্টা ন  বা বিষয়লোলুপঃ 
অসংসক্তমনা নিত্যং প্রাপ্তং প্রাপ্তম-উপাশ্নুতে।  (১৭/১৭)

যার বিষয়ের প্রতি লোভ আছে, বা যার বিষয়ের প্রতি দ্বেষ আছে, (তিনি না তত্ত্বজ্ঞ না জীবনমুক্ত). কিন্তু  তত্বজ্ঞ জীবনমুক্ত পুরুষ বিষয়ে অনাসক্ত মন নিয়ে প্রারব্ধ বশতঃ নিত্য ভোগক্রিয়া  করে থাকেন। 
যোগাচার্য্য বলছেন : তিনি পৃথিবীর কোনও বস্তুকে আকাঙ্খ্যা  করেন না বা ঘৃণা করেন না। তিনি কোনো  কিছুর প্রতি লোভী নন।  অন্য কথায়, তাঁর  সবকিছুই  আছে, অথচ তিনি আসক্তি থেকে মুক্ত।  কিছু পেলে তিনি উপভোগ করেন, কিছু না পেলেও তিনি উপভোগ করেন।

সমাধান-অসমাধান-হিত-অহিত-বিকল্পনাঃ 
শূন্যচিত্তো ন জানাতি কৈবল্যম-ইব-সংস্থিতঃ।  (১৭/১৮)

শূন্যচিত্ত পুরুষ যিনি কৈবল্যে স্থিত হয়েছেন, (অর্থাৎ সংকল্প-বিকল্প রহিত হয়েছেন) তাঁর কাছে বাহ্য সমস্যার  সমাধান বা অসমাধান, বাহ্য   বিষয়ের হিত  বা অহিত তাঁর  কল্পনাতেও আসে না। 
যোগাচার্য্য বলছেন : তিনি কোনো কাজের  সমাপ্তি হওয়া  বা কাজ সমাপ্ত না হওয়ার দ্বারা বিরক্ত হয় না।  তিনি ভালো  বা খারাপ ঘটনা দ্বারা বিচলিত বোধ করেন না। কোন  কিছুই তার হৃদয় স্পর্শ করতে পারে না, কারণ তার হৃদয় শূন্য-ব্রহ্ম, পরম আত্মার উপর স্থির। এই  স্থায়ী স্থিতিরূপ   প্রশান্তি, কেবলমাত্র সাধনক্রিয়ার অভ্যাসের  দ্বারা ক্রিয়া-পরবর্তী প্রভাব-বশতঃ  হয়ে থাকে। এই  স্থিতি বা শান্তির অবস্থায় কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। 

নির্মমো নিরহঙ্কারো ন কিঞ্চিৎ ইতি নিশ্চিতঃ 
অন্তঃ-গলিত-সর্ব-আশঃ কুর্বন্নপি করোতি  ন । (১৭/১৯)

মমতা-রহিত, নিরহঙ্কারী, বাহ্যজগৎ সত্য নয় - এব্যাপারে যিনি নিশ্চিত, অন্তরে যাঁর সর্ববিষয়ে আশা পরিত্যাগ হয়েছে, সেই মহাত্মন বাহ্যত সমস্ত ক্রিয়া করেও, কার্যতঃ কিছু করেন না, কারন তিনি তখন কর্তৃত্বাভিমান রহিত হয়ে অবস্থান করছেন। 
যোগাচার্য্য বলছেন :যিনি নিজেকে সাধনক্রিয়ার পরা-অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, "আমি কিছুই নই এবং আমার কিছুই নেই" এই উপলব্ধি করেছেন, তিনি  অকর্ত্তা ভাবে সমস্ত কামনা-বাসনা অতিক্রম করে, সমস্ত  কর্ম সম্পাদন করেন, অথচ তিনি কিছুই করেন না, তার কোনো কর্ম্মফলও সঞ্চিত হয় না ।

মনঃ প্রকাশ সংমোহ স্বপ্ন-জাড্য-বিবর্জিতঃ 
দশাং কামপি সংপ্রাপ্তো ভবেদ গলিত-মানসঃ । (১৭/২০)

মনের প্রকাশ মোহরহিত, স্বপ্নের ন্যায় বিপরীত কল্পনারহিত, সুসুপ্তির অজ্ঞানতা বিবর্জিত যে  তত্তজ্ঞ পুরুষ তিনি এক অনির্বচনীয় দশা  প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। 
যোগাচার্য্য বলছেন : যার আসক্তি, স্বপ্ন, অলসতা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করা হয়েছে এবং যিনি এই রহস্যময় অবস্থা অর্জন করেছেন, তিনি ব্রহ্মের সাথে একাত্ম, কারণ তার মন ব্রহ্মে, পরম আত্মায় মিলিত হয়েছে।

ইতি তত্ত্বজ্ঞ-স্বরূপ বিষতিকং নাম সপ্তদশং  প্রকরণং অষ্টাবক্র গীতা সমাপ্তম।  

শান্তিশতকং নাম অষ্টাদশং প্রকরণম 

যস্য বোধদয়ে তাবৎ স্বপ্নবদ ভবতি ভ্রমঃ 
তস্মৈ সুখ-এক-রুপায় নমঃ শান্তায় তেজসে। (১৮/০১)

জ্ঞান (আত্মজ্ঞান) উদয়ের ফলে যাঁর  কাছে এই ভ্রমাত্মক সংসার স্বপ্নের ন্যায় হয়ে গেছে,  সেই শান্ত, সর্বসুখী তত্ত্বজ্ঞ পুরুষকে আমি প্রণাম করি। 
যোগাচার্য্য বলছেন : সাধনক্রিয়ার পরাবস্থায়, একটি সূক্ষ্ম  শান্তি-প্রবাহ চলতে থাকে। তখন জগৎ সংসারের    সবকিছুই স্বপ্ন বলে মনে হয়। এই উপলব্ধির স্তরটি  ক্রিয়া-পরবর্তী প্রভাবের  ফলে হয়ে থাকে। সাধনার উত্তম অবস্থা আসলে  আত্মার অন্তরীণ  উপলব্ধির সময় অর্জিত হয়। আমি সেই চেতনার রাজ্যের কাছে প্রণাম করি যেখানে সমস্ত শক্তির সর্বত্র প্রকাশিত হয় এবং যেখানে "আমি"বলে কিছু  নেই।  সেখানে "আমি" চূড়ান্ত আত্মার  সাথে একীভূত হয়ে মিশে গেছে, সেই অবস্থাটিই হল...শুদ্ধ  শান্তির অবস্থা। 

অর্জয়িত্বা-অখিলান-অর্থান ভোগান-আপ্নোতি  পুষ্কলান  
ন  হি সর্ব-পরিত্যাগম-অন্তরেণ সুখী ভবেৎ। (১৮/০২)

অঢেল ধন অৰ্জন করে সাময়িক ভোগসুখ প্রাপ্ত হওয়া যায়।  কিন্তু সবকিছু ত্যাগ করে, সংকল্প-বিকল্প রহিত হলে,  অন্তরে যে চিরন্তন সুখ হয়, তা পার্থিব বস্তুতে পাওয়া যায় না। 
যোগাচার্য্য বলছেন : একজন পাথির্ব সম্পদ সংগ্রহ করে, তার থেকে সাময়িক সুখ ভোগ করতে পারে, কিন্তু অপার্থিব অন্তরাত্মায় যে সুখ আছে, তার আস্বাদ সে গ্রহণ করতে পারে না। 

কর্তব্য-দুঃখ-মার্তন্ড জ্বালা-দ্বগ্ধ-অন্তরাত্মনঃ  
কুতঃ প্রথম-পীযুষ ধারা-অসারং-ঋতে সুখম।  (১৮/০৩) 

কর্তব্য করার জন্য যে দুঃখ তা প্রখর-সূর্য্যের তাপের মতো অন্তরাত্মাকে দগ্ধ  করে।  আর সংকল্প-বিকল্প রহিত পুরুষের দ্বারা কৃত কর্ম্ম অমৃত-সুখ-ধারা বর্ষণ করে। 
যোগাচার্য্য বলছেন :  স্ব-স্বরূপে স্থিত হতে না পারলে, যা আসলে একমাত্র যোগের উত্তম অবস্থাতেই ঘটে থাকে, স্ব-স্বরূপের আনন্দ কিভাবে ভোগ করবে ? যতদিন স্বরূপ থেকে দূরে অবস্থান করবে, ততদিন এই সংসারের দুঃখ- তাপ তাকে দদ্ধ  করতে থাকবে। 

ভাবো-অয়ং ভাবনামাত্রো ন  কিঞ্চিৎ পরমার্থতঃ 
ন অস্তি-ভাব স্বভাবানাং ভাব-অভাব-বিভাবিনাম । (১৮/০৪)

এই সংসার মনের ভাবনা মাত্র - এর মধ্যে পরমার্থ কিছু নেই। ভাব ও অভাবরূপে অর্থাৎ সৎ-অসৎ রূপে স্থিত। আর এই পার্থিব পদার্থে স্ব-ভাব বলে কিছু নেই। 
যোগাচার্য্য বলছেন : প্রপঞ্চময় এই জগতের কোনো নিত্যসত্ত্বা নেই। মনের ভাবনার সঙ্গে এগুলো মনের মধ্যে প্রতিভাসিত হচ্ছে। যোগী যখন সাধনক্রিয়ার বলে  নিজের মধ্যে প্রবেশ করে, তখন এই প্রপঞ্চময় জগৎ তার দৃশ্যপট থেকে দূর হয়ে যায়। 

ন  দুরং ন চ সংকোচাৎ-লব্ধমেব-আত্মনঃ পদম 
নির্বিকল্পং নিঃ-আয়াসং নির্বিকারং নিরঞ্জনম। (১৮/০৫) 

আত্মার স্বরূপ দূরে নয়, কেবল সংকুচিত। সর্ব বিকল্প, আয়াস ও বিকার রহিত হলেই এই নিত্যাত্মা প্রাপ্ত হওয়া যায়। 
যোগাচার্য্য বলছেন : আত্মা দূরে নয়, কিন্তু তা এতটাই সূক্ষ্ম যে তা আমাদের অনুভবে আসে না। কিন্তু যোগক্রিয়ার ফলে যখন আমাদের অনুভব শক্তির বৃদ্ধি হয়, তখন সেই নিত্য-শুদ্ধ-চৈতন্য আমাদের চেতনার মধ্যে ধরা পড়ে । 

ব্যামোহ-মাত্র-বিরতৌ স্বরূপ-আদান-মাত্ৰতঃ 
বিতশোকা বিরাজন্তে নিঃ-আবরণ-দৃষ্টয়ঃ ।(১৮/০৬) 

প্রপঞ্চভ্রান্তি যখন দূর হয়ে যায়, তখন স্ব-স্বরূপে স্থিতি হয়। আর স্ব-স্বরূপে স্থিত তত্ত্বদর্শী পুরুষ শোকরহিত  হয়ে নিরাবরণকে (মায়াহীন চৈতন্য) দর্শন করেন। 
যোগাচার্য্য বলছেন : সংসার বন্ধন  থেকে মুক্ত হওয়ার পরে, একজন স্বয়ং চূড়ান্ত আত্মার  রূপ নেয়। চেতনার এই উচ্চ অবস্থায় সমস্ত দুঃখ-কষ্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবেই  ত্যাগ করা হয়।  পরম আত্মাকে আঁকড়ে ধরার সময় কোন পর্দা রাখতে নেই। 

সমস্তং  কল্পনা-মাত্ৰম-আত্মা মুক্তঃ সনাতনঃ 
ইতি বিজ্ঞায় ধীরো হি কিম-অভাস্যতি বালবৎ  (১৮/০৭)

সমস্ত জগৎ কল্পনা মাত্র। আত্মা মুক্ত ও সনাতন - এই সত্যকে জ্ঞাত হয়ে জ্ঞানী-পুরুষ বালকের ন্যায় কর্ম্ম প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকেন। 
যোগাচার্য্য বলছেন : যাকিছু দেখা যায় তা কল্পনা মাত্র। নিজেকে চির মুক্ত বলে জেনে শান্ত হও । কেন তুমি  একটি যুবকের মত শরীরচর্চ্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে ? বরং বালকের মতো নিজের সঙ্গে, নিজের মধ্যে, নিজে ক্রিয়া করো। 

আত্মা ব্রহ্মেতি নিশ্চিত্য ভাব-অভাবৌ চ কল্পিতৌ 
নিষ্কামঃ কিং বিজানাতি কিং ব্রূতে  চ করোতি কিম। (১৮/০৮)

আত্মা ব্রহ্ম, এটা নিশ্চিত জেনে, পদার্থের ভাব ও অভাব সবই কল্পিত - একথা  নিশ্চিত জেনে, তিনি কি-ই বা আবার   জানবেন, কি-ই  বা বলবেন, কি-ই বা করবেন, এই ভেবে নিষ্কাম স্বরূপে  অবস্থান করেন।
যোগাচার্য্য বলছেন : ভাব  এবং অভাব  কেবল মনের অভিনব কল্পনা । নিজেকে পরম আত্মাতে  স্থির করো  এবং ফলাফলের প্রত্যাশা ত্যাগ করে, ইচ্ছার বাইরের অবস্থাকে ধরে রাখো । তখন না থাকবে কিছু জানার, না থাকবে  কিছু বলার, না থাকবে  কিছু করার। 

অয়ং সো-অহম-অয়ং নাহমিতি ক্ষীণা বিকল্পনাঃ 
সর্বম-আত্মেতি নিশ্চিত্য তৃষ্ণীম্ভুতস্য যোগীনঃ। (১৮/০৯)

সবই  আত্মা, আমিও  আত্মা, আত্মা ছাড়া কিছু নেই, বিকল্প শূন্য হয়ে সবেতে আত্মা এটা নিশ্চিত হয়ে যোগী তৃষ্ণা নিবারণ করেন। 
যোগাচার্য্য বলছেন : যারা যোগী তারা ক্রিয়ার পরবর্তী প্রভাবে উপলব্ধি করেছেন, যে "আমি" বলে কিছু নেই , 
সবই  সেই এক আত্মার মুর্ত্ত প্রতীক। তাদের এই স্থির সিদ্ধান্ত তাদেরকে শান্তির সাগরে স্থির করেছে। 

ন বিক্ষোপো ন চ-একাগ্র্যং ন  অতিবোধো  ন  মূঢ়তা  
ন সুখং ন  চ বা দুঃখম-উপশান্তস্য যোগিনঃ । (১৮/১০) 

স্ব-স্থিত শান্ত যোগীর না আছে মনের বিক্ষেপ, না আছে বিষয়-ব্যগ্রতা, না আছে অতিবোধ, না আছে মূঢ়তা, না সুখ না দুঃখ  - কিছুই নেই।  
যোগাচার্য্য বলছেন : ক্রিয়া-পরবর্তী প্রভাবে শান্তি ভোগীর জন্য না থাকে কোন বিভ্রান্তি, না থাকে কোন একাগ্রতা, না থাকে কোন যন্ত্রণা, না থাকে কোন মূর্খতা, না  সুখ না  কোন দুঃখ, কেবল একটা সাম্যাবস্থা। 

স্বঃ-রাজ্যে ভিক্ষ্যবৃত্তৌ  চ লাভালাভে জনে বনে
নির্বিকল্প-স্বভাবস্য ন  বিশেষঃ-অস্তি যোগিনঃ। (১৮/১১)

নির্বিকল্প অবস্থায় যোগীপুরুষের, স্বর্গরাজ্যে মতো ভোগপ্রাপ্তিতে, বা প্রারব্ধ বশে  শরীরে ধারণ করে ভিক্ষাবৃত্তিতে, লোকালয়ে বা নির্জনে, কোথাও কোনো অবস্থাতেই  বিশেষ কোনো পার্থক্য অনুভব করেন না।  
যোগাচার্য্য বলছেন :  যোগী যোগাভ্যাসের ফলে একটা সময় প্রশান্তিতে অবস্থান করে। এইসময় তার নির্বিকল্প অবস্থা -  না তিনি  রাজা বা না ভিক্ষারী,  কোনোটাই নয়। না তিনি বনে, জঙ্গলে, বা জলে।  এইসময় তার হারানোর কিছু নেই, কেবল একটা বিশেষ প্রশান্তির মধ্যে যেন তিনি নিদ্রিত।  

ক্ব ধর্মঃ ক্ব চ বা কামঃ ক্ব চ-অর্থ ক্ব বিবেকিতা 
ইদং কৃতমিদং নেতি দ্বন্দ্বৈঃ-মুক্তস্য যোগিনঃ। (১৮/১২)

দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত যোগীর মধ্যে ধর্ম-অর্থ-কাম-বিবেক, করা বা না করার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।
যোগাচার্য্য বলছেন : কর্ম, আকাঙ্ক্ষা এবং বিবেক বা যুক্তি তার কাছে অর্থহীন,  যিনি ক্রিয়ার ঊর্ধ্ব প্রভাবকে ধরে রাখেন।  যিনি  চিন্তার দ্বৈতবাদ থেকে মুক্ত, তার কর্ম সম্পাদন বা  তার কর্ম  অসম্পাদন - এর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। 

কৃত্যং কিমপি নৈবাস্তি ন কাপি হৃদিরঞ্জনা 
যথা জীবনম-এব-ইহ জীবন্মুক্তস্য যোগিনঃ।  (১৮/১৩)

জীবনমুক্ত পুরুষের সঙ্কল্পঃহেতু কিছুই করবার নেই। তার হৃদয়ে কোনো অনুরাগ নেই। তথাপি জীবনের জন্য যা কিছু তিনি করেন, তা কেবল মাত্র প্রারব্ধ বশে  ঘটে থাকে। 
যোগাচার্য্য বলছেন : যখন আমি ক্রিয়া-পরবর্তী প্রভাবে মুক্ত থাকি তখন আমি মনে করি না যে "আমি কিছু করেছি"। কিছু করার জন্য আমার হৃদয়ে কোন ইচ্ছাই  জন্মায় না। এইসময়  যোগী তার হাতের কাছে যা আসে তার দ্বারাই সে  নিজেকে বজায় রাখে, জীবন নির্বাহ করে থাকে ।

ক্ব মোহঃ ক্ব  চ বা বিশ্বং ক্ব তদ-ধ্যানং ক্ব  মুক্ততা 
সর্বসংকল্প সীমায়াং বিশ্রান্তস্য মহাত্মনঃ। (১৮/১৪)

সর্ব সংকল্পের সীমা  যিনি অতিক্রম করেছেন, তার কাছে কোথায় মোহ, কোথায় বা বিশ্ব , কোথায় বা বিষয়ধ্যান কোথায় বা মুক্তি - এসবের উর্দ্ধে তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। তিনিই মহাত্মন। 
যোগাচার্য্য বলছেন : যোগীর  কাছে কোথায় পৃথিবী ? কোথায় সংসার বা তার বন্ধন,  কোথায় ধ্যান, আর কোথায়ই  বা  মুক্তি ? এগুলো সবই  সীমিত সংকল্প, বৈ  কিছু নয় । সাধনার চরম-উপলব্ধিকৃত ব্যক্তিরা ক্রিয়ার পরবর্তী প্রভাব-ভঙ্গিকে  ধরে রাখেন  এবং অনন্তকাল প্রশান্তিতে বিরাজ করেন। 

যেন বিশ্বমিদং দৃষ্টং স ন-অস্তি-ইতি করোতু বৈ 
নির্বাসনঃ কিং কুরুতে পশ্যন-অপি ন  পশ্যতি।  (১৮/১৫)

এই যে বিশ্ব  দৃষ্ট হচ্ছে, আসলে তার কোনো অস্তিত্ত্ব নেই। বহির্জগৎ ইন্দ্রিয়লব্ধ হলেও, এসব কল্পনা মাত্র। এসব আমা  হতে পৃথক কিছু নয়।  এরূপ জ্ঞাত হয়ে তত্ত্বপুরুষ কী বা দেখবেন, আর কী বা করবেন ? 
যোগাচার্য্য বলছেন : সাধন-ক্রিয়ার উত্তম অবস্থার মধ্যে অর্থাৎ  পরম আত্মার মধ্যে বিলীন হওয়ার আগে, যে "আমি" জগতকে দেখেছিলাম এখন সেই  "আমি" আর নেই। তো যখন আমি নেই, তাহলে আর কে  বাকী থাকে? এখন সমগ্র বিশ্বকে পরমস্বরূপে দেখা হয়। শুধুমাত্র পরমআত্মা  স্বয়ং তিনিই বিদ্যমান তাই সব একত্বে মিশে গেছে।  যোগী এখন পরমাত্মা ভিন্ন আর কিছু  দেখতে পায় না। যোগী স্বয়ং ব্রহ্ম, জগৎ ব্রহ্মময়। 

যেন দৃষ্টং পরম ব্রহ্ম সো-অহং ব্রহ্ম-ইতি চিন্তয়েৎ 
কিং চিন্তয়তি নিশ্চিন্তো দ্বিতীয়ং যো ন  পশ্যতি।  (১৮/১৬)

যিনি ব্রহ্মকে পৃথকরূপে চিন্তা করছে, তিনি নিজেকে ব্রহ্ম  অর্থাৎ "আমি ব্রহ্ম" এইভাবে চিন্তা করুক।  কিন্তু যিনি দ্বিতীয় কোনোকিছুকেই দর্শন করছেন না, সেই চিন্তারহিত পুরুষ আর কার চিন্তা করবেন ? 
যোগাচার্য্য বলছেন : যিনি পরম আত্মকে উপলব্ধি করেছেন,  তিনি নিজেকে চূড়ান্ত আত্মা  বলেই  মনে করেন। সাধন ক্রিয়ার উত্তম অবস্থায়  কোন "আমি" বাকি নেই, তাই ভাবার আর কে আছে ? তাই আমি প্রশান্তি অনুভব করি । আমি অদ্বিতীয়,পরমসত্য । কোন দ্বৈত নেই, আমি শুধু  নিজেকেই  দেখতে পাচ্ছি। 

দৃষ্টো যেন-আত্ম-বিক্ষেপো নিরোধং ত্বসৌ 
উদারস্তু ন বিক্ষিপ্তঃ সাধ্য-অভাবাৎ করোতি কিম ।(১৮/১৭)  

যিনি নিজের মধ্যে নানান চিন্তার কারনে বিক্ষেপ দর্শন করছেন, তিনি চিত্তকে  নিরোধের প্রয়াস করুন । কিন্তু যিনি সর্বত্র এক ও অদ্বিতীয় আত্মদর্শী, যাঁর  মধ্যে কোনো বিক্ষেপ নেই, তিনি  চিত্ত-নিরোধের প্রয়াস কেন করবেন ?
যোগাচার্য্য বলছেন : যার চিত্ত  অস্থির   সেই  নিজেকে সংযত বা চিত্তকে স্থির করার চেষ্টা করে এবং ধীরে ধীরে নিজেকে অন্তর্মুখী করে তোলে। কিন্তু সাধন-ক্রিয়া-পরবর্তী ভঙ্গিতে যে হৃদয় উদাসীন হয়, তার মন কখনও  বিচলিত হয় না। এই অবস্থায়  তার আর কোন সাধনা বা ধ্যান ইত্যাদি অনুশীলনের প্রয়োজন নেই। তথাপি প্রশান্তিতে প্রতিষ্ঠিত তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছেন। আসলে তাঁর আর কি করার আছে? সবই অর্জিত হয়েছে। তাঁর  আর কোনো প্রচেষ্টার প্রয়োজন নেই।

ধীরো  লোক-বিপর্যস্তো বর্তমানঃ-অপি  লোকবৎ  
ন  সমাধিং  ন  বিক্ষেপং ন  লেপং স্বস্য পশ্যতি।  (১৮/১৮)

ধীর পুরুষ (আত্মনিষ্ট পুরুষ) প্রারব্ধ বশতঃ  সাধারণ লোকের মতো ব্যবহার করলেও,  তিনি সদা  আত্ম-স্থিত হওয়ায় সমাধিস্থ। তাঁর মধ্যে  কোনো বিক্ষেপ, বা  তৎকৃত কোনো লেপ (বন্ধন)  দর্শন হয় না। 
যোগাচার্য্য বলছেন : প্রশান্ত মানুষ আসক্তির বাইরের জগতে বাস করেন । তিনি সমাধি বা সংযুক্তির জন্য কোন প্রচেষ্টা করেন না। তিনি বিভ্রান্ত নন। তার মন খারাপ হয় না। তিনি নিজেকে কোনো কিছুর সঙ্গে লিপ্ত করেন না।  তার মধ্যে থেকে স্থূল ভাবের  বিলোপ হয়েছে, তিনি সূক্ষ্মভাবে স্থিত।  ক্রিয়ার পর-প্রভাব ভঙ্গিতে তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সংসারে আসেন, আবার চলে যান। (এ আসলে অবতার রূপ যোগেশ্বরের  অবস্থা)

ভাব-অভাব-বিহীনো যঃ-তৃপ্তো নির্বাসনো বুধঃ 
নৈব কিঞ্চিৎ কৃতং তেন লোক-দৃষ্ট্যা বিকুর্বতা। (১৮/১৯)

যিনি ভাব-অভাব বিহীন, অর্থাৎ আত্মতৃপ্ত, যিনি বাসনা রহিত সেই বুদ্ধ পুরুষ লোকদৃষ্টিতে কর্ম্মের অনুষ্ঠান করছেন  বলে মনে হলেও, তিনি (কর্তৃত্ব বিহীন হওয়ায়) কিছুই করছেন না। 
যোগাচার্য্য বলছেন : যিনি  তত্ত্বজ্ঞ তিনি  তার মনোযোগ এখানে এবং সেখানে ছড়িয়ে দেন  না। তিনি একটি নির্দিষ্ট অবস্থা অর্থাৎ স্ব-স্থিতাবস্থা  ধরে রাখার জন্যও  কোন প্রচেষ্টা করেন না। যে ব্যক্তির বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ দিকে মনোযোগ দেওয়ার আগ্রহ নেই কিন্তু কেবল ক্রিয়া পরবর্তী প্রভাবের ভঙ্গি ধরে রাখেন তিনি  সন্তুষ্ট এবং ইচ্ছার বাইরে থাকেন । প্রত্যক্ষদর্শী তাঁকে হয়তো  কিছু করতে দেখেন বটে , কিন্তু বাস্তবে তিনি কিছুই করছেন না।

প্রবৃত্তৌ বা নিবৃত্তৌ বা নৈব ধীরস্য দুর্গ্রহঃ
যদা যৎ কর্তুম-আয়াতি তৎ-কৃত্বা তিষ্ঠতঃ সুখম। (১৮/২০)

প্রবৃত্তি বা নিবৃত্তি বিষয়ক কর্তব্য সামনে এলেই তা তিনি অনুষ্ঠান করেন। কিন্তু কর্তৃত্বাভিমান না থাকায়, ধীর ব্যক্তি  সুখেই অবস্থান করেন। 
যোগাচার্য্য বলছেন : প্রশান্তিতে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির মন বাহ্যিক কোনো  কিছুতে আগ্রহী  হয় না। এমনকি  সংযত হতেও  আগ্রহী নয়। তাঁর কাছে যা কিছু আসে, তিনি তাই  করেন। আর এইগুলো  সম্পাদন করার আগে বা পরেও তিনি শান্তই  থাকেন, আর চূড়ান্ত আত্মকে (নিজেকে) ধরে রাখেন, অর্থাৎ স্ব-স্বরূপে স্থিত থাকেন । 

নির্বাসনো নিরালম্বঃ স্বচ্ছন্দো মুক্ত-বন্ধনঃ 
ক্ষিপ্তঃ সংস্কার-বাতেন চেষ্টতে শুষ্ক-পর্ণবৎ। (১৮/২১)

বাসনারহিত,  অবলম্বনহীন, রাগদ্বেষহীন স্বছন্দ ব্যক্তির না আছে বিক্ষোভ, না আছে মুক্তি না আছে বন্ধন।   পবন তাড়িত শুকনো পাতা যেমন ইচ্ছে-অনিচ্ছার উর্দ্ধে ইতস্তত ঘোরাফেরা করে, তেমনি তত্ত্বজ্ঞ পুরুষ সংস্কারের দ্বারা তাড়িত হয়ে  প্রারব্ধ হেতু কর্ম্ম-প্রচেষ্টা করে থাকেন। 
যোগাচার্য্য বলছেন : ইচ্ছেরহিত পুরুষ, এমন  একজন মানুষ যাঁর  যা-কিছু ঘটতে দেওয়ার ইচ্ছা আছে। তিনি  কিছুই ধরে রাখেন  না। সাধন ক্রিয়ার প্রভাবে,  তিনি সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হন। আর এই কারণেই,  তাঁকে  যা কিছু করার জন্য দেখা যায়।  বাতাসের দ্বারা এদিক-সেদিক বয়ে যাওয়া  শুকনো পাতার মতো তত্তজ্ঞ পুরুষ  ইচ্ছেরহিত হয়ে, ক্রিয়ার পরবর্তী প্রভাব-ভঙ্গিও (নিষ্ক্রিয়)  ধরে রাখেন না। অর্থাৎ, তখন তাঁর সমস্ত কর্ম সংস্কার  অনুসারে, বা অন্তর্নিহিত প্রবণতা অনুসারে সম্পাদিত হয়।

অসংসারস্য তু  ক্বাপি ন  হর্ষো ন বিষাদতা 
স শীতলমনা নিত্যং বিদেহ  ইব রাজতে। (১৮/২২)

সংসার-রহিতের কোথায় হর্ষ  বা বিষাদ ? তিনি শান্তচিত্ত নিত্য, দেহাত্ম-বোধের অতীত  হয়ে সমস্ত কাজ করে থাকেন।  
যোগাচার্য্য বলছেন : তত্তজ্ঞ পুরুষ শুকনো পাতার মতো  এই পৃথিবীতে বাস করে সুখীও নয়, আবার অসুখীও  নয়। ক্রিয়া-পরবর্তী প্রভাবে তাঁর মন সর্বদা শুদ্ধ, নির্ম্মল  । তার অবস্থা এমনই যে তিনি যেন অবশ দেহে অবস্থান করছেন। 

কুত্রাপি ন  জিহাসা-অস্তি নাশো বা-অপি ন  কুত্র-চিৎ 
আত্মা-আরামস্য ধীরস্য শীতল-অচ্ছতর-আত্মনঃ।  (১৮/২৩) 

আত্মারাম, ধীরব্যক্তি, নির্ম্মল অন্তঃকরণ বিশিষ্ট তত্ত্বজ্ঞ পুরুষের রাগ-দ্বেষ ইত্যাদি না থাকায় বাহ্য  বিষয়ে ত্যাগ বা গ্রহণের ইচ্ছে থাকে না। সমস্ত অনর্থের হেতু যে অজ্ঞান, সেই অজ্ঞানের অভাবে  তিনি  অনর্থের প্রাপ্ত-বোধ করেন না।  
যোগাচার্য্য বলছেন : তিনি সৃষ্টি  বা ধ্বংস কোনোটাই করতে চান না।  প্রকৃতপক্ষে তিনি শান্ত, নিষ্ক্রিয় ।

প্রকৃত্যা শূন্যচিত্তস্য কুর্বতঃ-অস্য যদৃচ্ছয়া 
প্রাকৃতস্য-এব ধীরস্য ন  মানো ন-অবমানতা। (১৮/২৪)

শূন্যচিত্ত পুরুষ অর্থাৎ যিনি নির্বিকার আত্মনিষ্ট, তিনি প্রারব্ধ বসে সাধারণ অজ্ঞানীর মতো কন্মের অনুষ্ঠান করলেও, তার মধ্যে মান-অপমান বোধের উৎপত্তি হয় না। 
যোগাচার্য্য বলছেন : যাঁর হৃদয় সর্বদা শূন্য স্ব-রূপে পরম-আত্মায়  থাকে, তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। অথচ  তিনি কখনোই  বিরক্ত বোধ করেন না। কারুর কাছ থেকে  সম্মানও  কামনা করে না। কে সন্মান করলো, কে তাচ্ছিল্য করলো, সেদিকে তাঁর  ভ্রূক্ষেপ নেই। 

কৃতং দেহেন কার্মেদং  ন ময়া শুদ্ধরূপিণা
ইতি চিন্তানুরোধী যঃ কুর্বন্-অপি করোতি ন।  (১৮/২৫)

কর্ম্ম দেহ দ্বারা কৃত হচ্ছে, আমি শুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ, আমার কোনো কর্ম্ম নেই - এই চিন্তাকে যিনি আশ্রয় করেছেন, তিনি সমস্ত কর্ম্মের কর্তত্ত্ববিহীন জ্ঞানে কর্ম্ম-রহিত হতে পেরেছেন। 
যোগাচার্য্য বলছেন : যিনি উপলব্ধি করেছেন,  যে কর্ম কেবল দেহ দ্বারা কৃত হয়ে থাকে,  আমার (আত্মার) দ্বারা নয়, তিনি  সবকিছু করেও কিছুই করেন  না। কারন তিনি (আমি) তো দেহ নয়, তিনি স্বয়ং  আত্মা। 

অ-তদ-বাদী-ইব কুরুতে ন ভবেৎ-অপি বালিশঃ 
জীবন্মুক্তঃ সুখী শ্রীমান সংসরন -অপি শোভতে। (১৮/২৬)

"আমি এটা করবো"- এমনটা না ভেবেই জীবন্মুক্ত পুরুষ কর্ম্ম করে থাকেন। প্রারব্ধবশে  কর্ম্ম করলেও, তত্ত্বজ্ঞানীর অন্তরে জ্ঞানের আলো থাকায়, তিনি কখনো অজ্ঞানকে আশ্রয় করেন না।  সংসারে থাকলেও , তিনি সংসারে স্থিত হন না। অন্তরে সুখী ও প্রসন্নচিত্তে সংসারে শোভা পান।
যোগাচার্য্য বলছেন : সাধন-ক্রিয়ার পরাবস্থায়, যখন প্রশান্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উৎপন্ন হয়, তখন যুক্তি  অর্থাৎ বুদ্ধিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায় সাধক  পরম আত্মকে ধরে রাখেন  এবং সমস্ত কর্ম যন্ত্রের মতো সম্পাদন  করে থাকেন । অর্থাৎ   তিনি যেন  কিছুই করেন না।  একটি শিশুর মতো তিনি পরম আত্মার জ্ঞানপ্রভাবে  শান্ত ও বিশুদ্ধ থাকেন ।

নানাবিচার সুশ্রান্তো ধীরো বিশ্রান্তিম-আগতঃ 
ন  কল্পতে  ন  জানাতি ন শৃনোতি ন পশ্যতি।  (১৮/২৭)

আত্মনিষ্ট জ্ঞানী ব্যক্তি নানা-বিচার থেকে নিবৃত্ত থেকে আত্মাতেই বিশ্রাম লাভ করেন। তাঁর  না আছে কল্পনা, না আছে জ্ঞানের পিপাসা, না তিনি শোনেন, না দেখেন। 
যোগাচার্য্য বলছেন :এইরকম একজন মানুষ, বা যোগী যিনি সাধনক্রিয়ার পরাবস্থায় স্থিত হতে পেরেছেন, তার না আছে কোনো বিষয় কল্পনা, না তিনি বিষয়কে দেখেন, বিষয় সম্পর্কে শোনেন, বা বিষয়জ্ঞান সংগ্রহ করেন।  অর্থাৎ যোগের উত্তম অবস্থায় তিনি বিষয়-রহিত হয়ে শান্তিতে অবস্থান করেন। 

অসমাধের-বিক্ষেপান্ন মুমুক্ষুর্ন  চেতরঃ
নিশ্চিত্য কল্পিতং পশ্যন ব্রহ্মৈব-অস্তে মহাশয়ঃ।  (২৮/২৮)

তত্তজ্ঞ ব্যক্তি সমাধির অভ্যাস করেন না, তাই তিনি মুমুক্ষ নন। তিনি বিক্ষেপ রহিত তাই তিনি বদ্ধ  নন। নির্বিকার-চিত্ত  এই জ্ঞানী পুরুষ সংসারকে মিথ্যা, কল্পিত একথা নিশ্চিত জেনে স্বভাব বসে কেবল দর্শন  করেন।  তিনি সদা ব্রহ্মতেই স্থিত থাকেন। তিনি ব্রহ্মজ্ঞ। 
যোগাচার্য্য বলছেন : যিনি  সাম্যাবস্থায় আছেন  এবং বহিঃপ্রকাশের ঊর্ধ্বে, তার মুক্তি লাভের কোনো ইচ্ছা নেই। তিনি বিশ্রামে আছেন। হয়তো  তিনি একসময় কল্পনার জগৎ (প্রপঞ্চময় সংসার) দেখেছিলেন। এখন তিনি  নিজেকে ধরে রেখেছেন । এমন ব্যক্তি মহাশয়। 

যশ্যান্তঃ স্যাৎ-অহঙ্কারো ন  করোতি করোতি  সঃ 
নিরহঙ্কার ধীরেণ ন কিঞ্চিৎ-কৃতং কৃতম। (১৮/২৯)

যার অন্তঃকরণে  অহঙ্কার তিনি বাহ্য  দৃষ্টিতে কিছু না করলেও, মনের মধ্যে সংকল্প ইদ্যাদি করে থাকেন। অন্যদিকে নিরহঙ্কারী ব্যক্তি  লোকদৃষ্টিতে সবকিছু করেও স্ব-দৃষ্টিতে কিছুই করেন না। 
যোগাচার্য্য বলছেন : যার মন অহংকারী সে বাহ্যত কিছু না করলেও, মনে মনে নানান কাজ করে চলেছে । কিন্তু যিনি অহংবোধ থেকে মুক্ত তিনি শান্ত ব্যক্তি, তিনি সব কিছু করলেও  কর্ম্ম তাকে স্পর্শ করতে পারে না। 

ন-উদ্বিগ্নং  ন চ সন্তুষ্টম-অকর্তৃ স্পন্দ-বর্জিতম 
নিরাশং গত সংদেহং চিত্তং মুক্তস্য রাজতে।  (১৮/৩০)

তত্ত্বজ্ঞানীর চিত্ত উদ্বিগ্ন নয়, না তিনি সন্তুষ্ট, না তিনি কৰ্ত্তা, না তিনি নিরাশ, না তিনি সন্দেহপ্রবন, তিনি মুক্ত হয়ে বিরাজ করেন। 
যোগাচার্য্য বলছেন : সাধন ক্রিয়ার পরবর্তী ভঙ্গিতে যার হৃদয় মুক্ত থাকে,  তিনি তখন কোনো কিছু দ্বারা বিচলিত হন  না আবার কোনো  কিছুতেই খুশিও  হন  না। তিনি  নিজেকে অ-কর্ত্তা  মনে করেন । তিনি কর্ম, ইচ্ছা ও সমস্ত দ্বন্দ্ব  থেকে মুক্ত থাকেন। 

এখান থেকে ধীরে ধীরে  ঋষি অষ্টাবক্র যোগাদি ক্রিয়ার উর্দ্ধে বিচরণ করেছেন - তাই যোগাচার্য্য এখন মৌন হয়ে গেলেন। শুধু বললেন, এই অবস্থা আসলে বাক্য-মনের অতীত, অনির্বচনীয়। 

নির্ধ্যাতুং চেষ্টিতুং বাপি যৎ-চিত্তং ন প্রবর্ততে 
নির্নিমিত্তম-ইদং কিন্তু নির্ধ্যায়তি বিচেষ্টতে। (১৮/৩১)

তত্ত্বজ্ঞ পুরুষ কখনো সংকল্প-বিকল্প উদয়ের জন্য চেষ্টা করেন না, আবার বিরোধও করেন না।  সংকল্প বিকল্প উদয়ের যে নিমিত্ত অর্থাৎ বিক্ষিপ্ততা, তাকে উপেক্ষা করে তিনি নিশ্চল ভাবে স্বরূপে অবস্থান করেন।  . আর নিমিত্ত ব্যতিরেকেই  অর্থাৎ নিশ্চল অবস্থাতেই তাঁর বিবিধ কর্ম্মপ্রচেষ্টা হয়ে  থাকে। 

তত্ত্বং যথার্থং-আকর্ন্য মন্দঃ প্রাপ্নোতি মূঢ়তাম 
অথবা যাতি  সংকোচং-মূঢ়  কঃ-অপি মূঢ়বৎ।  (১৮/৩২) 

তত্ত্বং অর্থাৎ তৎ এবং ত্বং - দুই-ই  এক, (তুমিই সেই)  এইরূপ শ্রুতিবাক্যঃ শ্রবণ করে, বিমূঢ় ব্যক্তি শাস্ত্র বাক্যের অর্থ সম্যক ভাবে উপলব্ধি করবার জন্য সমাধির অনুষ্ঠান করে থাকেন । কিন্তু কেউই মোহ-বর্জ্জিত হয়ে বোকা হতে চান না। 

একাগ্রতা নিরোধো বা মূঢ়ৈঃ-অভাস্যতে  ভৃশম 
ধীরাঃ কৃত্যং ন পশ্যন্তি সুপ্তবৎ স্বপদে স্থিতাঃ।  (১৮/৩৩)

মূঢ়  ব্যক্তি, অর্থাৎ যার আত্মসাক্ষাৎকার হয়নি, একাগ্রতা অভ্যাসের দ্বারা চিত্ত বৃত্তি নিরোধের প্রয়াস করে থাকে। কিন্তু ধীর-ব্যাক্তিগন স্ব-স্বরূপে সদা  স্থিত থেকে দেহাতীত (দেহ-বোধের অতীত) হয়ে সুখে সুসুপ্তির নিদ্রায় মগ্ন থাকেন।  

অপ্রযত্নাৎ প্রযত্নাৎ-বা মূঢ়ো নাপ্নোতি নির্বৃতিম 
তত্ত্বনিশ্চয়-মাত্রেণ প্রাজ্ঞো ভবতি নির্বৃতঃ।  (১৮/৩৪)

মূঢ় ব্যাক্তিগন প্রযত্নসাধ্য বা অপ্রযত্নসাধ্য চিত্ত নিরোধ বা তদ্রুপ কর্ম্মসাধন থেকে পরমানন্দ লাভ করতে পারেন না। কিন্তু প্রাজ্ঞ ব্যক্তি জ্ঞানের আলোক দ্বারা অজ্ঞানকে দগ্ধ  করে,  সমাধির ইত্যাদির অনুষ্ঠান ছাড়াই তত্ত্বজ্ঞ হয়ে কৃতার্থ হয়ে যান। 

শুদ্ধং বুদ্ধং প্রিয়ং পূর্নং নিষ্প্রপঞ্চং নিরাময়ম 
আত্মানাং তং জানন্তি তত্র-অভ্যাসপরা জনাঃ। (১৮/৩৫)

শুদ্ধ (মায়াতীত), বুদ্ধ (স্ব-প্রকাশ), প্রিয় (সুখপ্রদ) পূর্ন নিষ্প্রপঞ্চ (সম্পূর্ণভাবে বিষয়-ত্যাগী)  নিরাময় (দুখরহিত) সেই আত্মাকে অজ্ঞান সমাধিবান ব্যক্তি জানেন না। 

নাপ্নোতি কর্মণা মোক্ষং বিমূঢ়ো-অভ্যাসরূপীণা   
ধন্যো বিজ্ঞানমাত্রেণ মুক্তস্তিষ্ঠত্যবিক্রিয়ঃ। (১৮/৩৬)

যে বিমূঢ় ব্যক্তি আত্মা-অনাত্মা  সম্পর্কে অজ্ঞ তিনি যোগাভ্যাস রূপ কর্ম্মের দ্বারা মোক্ষ লাভ করতে পারেন না। কিন্তু যিনি শুধুমাত্র জ্ঞানের দ্বারা অবিদ্যাররূপ  কাম-সংকল্পকে নিরাস করতে পেরেছেন, তিনি ধন্য, তিনি মুক্ত। 

মূঢ়ো নাপ্নোতি তদব্রহ্ম যতো ভবিতুম-ইচ্ছতি 
অনিচ্ছন-অপি ধীরো হি পরব্রহ্ম-স্বরূপভাক। (১৮/৩৭)

অজ্ঞানী চিত্ত নিরোধের দ্বারা ব্রহ্মলাভ করতে ইচ্ছে করেন, কিন্তু সফলকাম হন না। কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তি ইচ্ছে রহিত হয়ে পরমব্রহ্ম স্বরূপেই অবস্থান করেন। 

নিরাধারা গ্রহব্যগ্রা মূঢ়া সংসার-পোষকাঃ 
এতস্য-অনর্থ-মূলস্য মূলচ্ছেদঃ কৃতো বুধৈঃ । (১৮/৩৮)  

অজ্ঞান ব্যক্তি চিত্ত নিরোধের দ্বারা মোক্ষলাভ করতে ব্যগ্র হয়, এতে করে আসলে সে সংসারের ক্রিয়াকেই পরিপোষন করে থাকে। জ্ঞানী ব্যাক্তিগন এই অনর্থরূপ সংসারের মূল উৎপাটন করে থাকেন। 

ন  শান্তিং লভতে মূঢ়ো যতঃ শমিতুম-ইচ্ছতি 
ধীরস্ততত্ত্বং বিনিশ্চিত্য সর্বদা শান্তমানসঃ।  (১৮/৩৯)

মূঢ়  ব্যক্তি কখনোই শান্তি পেতে পারে না, যতক্ষন না সে ইচ্ছেকে দমন করতে পারছে। ধীর ব্যক্তির, তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তির   তত্ত্বজ্ঞান প্রভাবে অজ্ঞান নিবৃত্ত হওয়ায় সর্বদা শান্ত-মানস  হয়ে থাকেন । 

ক্ব-আত্মনো দর্শনং তস্য যদদৃষ্টম-অবলম্বতে 
ধীরাস্তং তং ন পশ্যন্তি পশ্যন্তি-আত্মানং-অব্যয়ম।  (১৮/৪০) 

এই দৃশ্যমান জগৎকে অবলম্বন করে,  আত্মজ্ঞান লাভ কি করে হবে ? ধীরব্যক্তি এই দৃশ্যমান পদার্থকে দেখতেই  পান না, কেবল অব্যয় আত্মাকে দর্শন করেন।
 
ক্ব নিরোধো বিমূঢ়স্য  যো নির্বন্ধং করোতি বৈ 
স্বারামস্য-এব ধীরস্য সর্বদা-অসৌ-এব-অকৃত্তিমঃ।  (১৮/৪১)

যে মূঢ় ব্যক্তি  চিত্ত  নিরোধের জন্য ক্রিয়াদির অনুষ্ঠান  করে, তার চিত্ত-নিরোধ হয় না। অন্যদিকে যিনি আত্মারাম ধীর ব্যক্তি তার চিত্ত স্বাভাবিক ভাবেই নিরুদ্ধ হয়ে থাকে। 

ভাবস্য  ভাবকঃ ক্বশ্চিন্ন কিঞ্চিৎ-ভাবকঃ-অপরঃ 
উভয়াভাবকঃ কশ্চিৎ-এব-এবম নিরাকুলঃ  । (১৮/৪২)

কেউ এই জগৎপ্রপঞ্চকে স্বীকার করেন, আবার কেউ কেউ করেন না। এরা  সবাই জগৎ-প্রপঞ্চ নিয়েই চিন্তাকরেন। কিন্তু ধীর ব্যক্তি প্রপঞ্চের ভাব বা অভাব নিয়ে চিন্তা করেন না এবং নিরুদ্বিগ্ন থাকেন । 

শুদ্ধম-অদ্বয়ং-আত্মানং ভাবয়ন্তি কুবুদ্ধয়ঃ 
ন তু জানন্তি সন্মোহাৎ-জাবৎ-জীবম-অনির্বৃতাঃ। (১৮/৪৩)

কুবুদ্ধি সম্পন্ন মূঢ় মানুষও  শুদ্ধ-অদ্বয়-আত্মার   চিন্তা করে। কিন্তু মোহ  বশতঃ সারা জীবন সেই দ্বৈত অনাত্ম ভাবেই সন্মোহিত হয়ে থাকে।  

মুমুক্ষোঃ-বুদ্ধিঃ-আলম্বম-অন্তরেণ  ন  বিদ্যতে 
নিরালম্বৈব নিস্কামা বুদ্ধিঃ মুক্তিস্য সর্বদা।  (১৮/৪৪)

মুমুক্ষ ব্যক্তির বুদ্ধি বিষয়কে অবলম্বন না করে থাকতে পারে না।  কিন্তু নিরালম্ব, নিষ্কাম পুরুষের বুদ্ধি মুক্ত অর্থাৎ অবলম্বন হীন  হয়ে থাকে। 

বিষয়-দ্বীপিনো বিক্ষ্য চকিতাঃ শরণার্থিনঃ 
বিশন্তি ঝটিতি ক্রোড়ং নিরোধৈকাগ্র-সিদ্ধ্যয়ে  । (১৮/৪৫)

মূঢ়  ব্যাক্তিগন বিষয়ের বীভৎসরূপ  ব্যাঘ্র দর্শনে চঞ্চল বা ভীত  হয়ে আত্ম-রক্ষা করবার উদ্দেশ্যে, দ্রুততার সঙ্গে চিত্তের নিরোধ-একাগ্রতা (সমাধি) যোগসিদ্ধি ইত্যাদির কোলে আশ্রয় নেয়। 

নির্বাসনং হরিং দৃষ্টবা তূষ্ণীং বিষয়দন্তিনঃ 
পলায়ন্তে ন শক্তান্তে সেবন্তে কৃতচাটবঃ। (১৮/৪৬) 

যিনি নির্বাসন ব্রত অবলম্বন করেছেন, এমন তত্তজ্ঞ পুরুষসিংহকে দেখে বিষয়গ্রাহ্যরূপ ইন্দ্রিয়সকল ভীত হস্তির মতো নীরবে পলায়ন  করে। অথবা সেই পুরুষসিংহের  চাটুকারিতা করে। 

ন মুক্তি কারিকাং  ধত্তে নিঃশঙ্কো যুক্তমানসঃ
পশ্যন শৃন্বন স্পৃশন জিঘ্রন-অশ্নন-অস্তে যথাসুখম। (১৮/৪৭)

ধীর, নিঃশঙ্ক, তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি  মুক্তির উদ্দেশ্যে মোক্ষকারক যম-নিয়ম ইত্যাদির যোগক্রিয়ার অভ্যাস করেন না। তিনি কর্তৃত্ত্বরহিত হয়ে  সুখে দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শন, জিঘ্রেন, ভোজন করে থাকেন। 

বস্তু শ্রবণ মাত্রেণ শুদ্ধবুদ্ধিঃ নিরাকুলঃ 
নৈব-আচারম-অনাচরম-ঔদাস্যং বা প্রপশ্যতি। (১৮/৪৮)

সৎ-বস্তুর  (আত্মস্বরূপের)  কথা শ্রবণ করা মাত্র যিনি শুদ্ধবুদ্ধি সম্পন্ন (আত্মস্থ) হন, তিনি  নিরাকুলে  (স্বস্বরূপে) অবস্থান করেন। আর এই আত্মস্থ পুরুষের শুভ বা অশুভ কর্ম্ম বা নিস্কর্ম উভয়ের প্রতিই উদাসীন দৃষ্টি সম্পন্ন হন।

যদা যৎ-কর্তুম-আয়াতি তদা তৎ কুরুতে ঋজুঃ
শুভং বাপ্যশুভং বা-অপি তস্য চেষ্টা হি  বালবৎ  । (১৮/৪৯) 

তত্ত্বজ্ঞের কাছে যখন যে কর্ম্ম উপস্থিত হয়, তা সে শুভ হোক বা অশুভ, তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে (প্রারব্ধ বশতঃ) অনুষ্ঠান করেন। তাঁর এই কর্মানুষ্ঠানের প্রচেষ্টা বালকের মতো হয়ে থাকে। 

স্বাতন্ত্র্যাৎ সুখম-আপ্নোতি  স্বাতন্ত্র্যাৎ-লভতে পরম 
স্বাতন্ত্র্যাৎ- নিবৃত্তিং গচ্ছেৎ স্বাতন্ত্র্যাৎ পরমং পদম। (১৮/৫০)

স্বতন্ত্র পুরুষ অর্থাৎ রাগদ্বেষাদি থেকে মুক্ত পুরুষ সুখে অবস্থান করেন। স্বাতন্ত্রতার  ফলেই তিনি পরম-জ্ঞান লাভ করেন, স্বাতন্ত্রতার  ফলেই চিরস্থায়ী  আনন্দ লাভ করেন, এবং সবশেষে পরম-পদ লাভ করে, চিরবিশ্রামে অবস্থান করেন। 

অকর্তৃত্বম-অভোক্তৃত্বং স্বাত্মনো মন্যতে যদা 
তদা ক্ষীণা ভবন্ত্যেব সমস্তাঃ-চিত্তবৃত্তয়ঃ।  ১৮/৫১) 

যখন স্বচিত্তে অকর্তৃত্ত্বের ভাব ও অভোক্তৃত্বের ভাব দৃঢ় হয়, তখন চিত্তবৃত্তি সমূহের ক্ষীনভাব প্রাপ্ত হয়। 

উশৃঙ্খলা-অপি-অকৃতিকা স্থিতিঃ-ধীরস্য রাজতে 
ন  তু সস্পৃহ-চিত্তস্য শান্তিঃ-মূঢ়স্য কৃত্ৰিমা।  (১৮/৫২)

ধীর ব্যক্তির আচরণ অশান্ত হলেও অকৃত্তিম হয়ে থাকে।  কিন্তু মূঢ় ব্যক্তির আচরণ সংসার-আসক্তি কারনে শান্ত হলে, কৃত্তিম হয়ে থাকে। 

বিলসন্তি মহাভোগৈঃ-বিশন্তি গিরি-গহ্বরান 
নিরস্ত-কল্পনা ধীরা  অবদ্ধা মুক্ত-বুদ্ধয়ঃ।  (১৮/৫৩)

ধীর, বন্ধনহীন, মুক্ত জ্ঞানী পুরুষ  কখনও  বিলাসবহুল ভোগ-ঐশর্য্য বেষ্টিত হয়ে  থাকেন,  কখনও  গিরি-গুহায় (নির্জনে)  অবস্থান করেন। 

শ্রোত্রিয়ং দেবতাং তীর্থম-অঙ্গনাং ভূপতিং প্রিয়ম 
দৃষ্টবা সম্পূজ্য ধীরস্য ন  কাপি হৃদি বাসনা। (১৮/৫৪)

শ্রুতিধর (শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত), দেবতা, বা তীর্থ-অঙ্গন, রাজা, বা প্রিয়পরিজনদের দর্শন করেও পূজনীয় ধীর ব্যক্তির হৃদয়ে কখনো কামনা-বাসনার উদয় হয় না। 

ভৃত্যৈঃ পুত্রৈঃ কলত্রৈঃ-চ  দৌহিত্রঃ-চ-অপি গোত্রজৈঃ 
বিহস্য ধিক্কৃতো যোগী ন যাতি বিকৃতিং  মনাক। (১৮/৫৫)

ভৃত্যবর্গ, পুত্ৰসকল, স্ত্রীসকল, কন্যাসকল, অথবা সগোত্রীয় পরিজনদের কাছ থেকে নিন্দাবাদ প্রাপ্ত হয়েও  যোগী পুরুষের মনে  কখনো বিকার (বিক্ষেপ) উৎপন্ন হয় না। 

সন্তুষ্টঃ-অপি ন সন্তুষ্টঃ খিন্নঃ-অপি ন চ খিদ্যতে 
তস্য-আশ্চর্য-দশাং  তাং তাং  তাদৃশ্য এব জানতে। (১৮/৫৬) 

সন্তুষ্ট হয়েও তিনি সন্তুষ্ট নন, ক্ষুন্ন  হয়েও তিনি অসন্তুষ্ট নন। তাঁর  এই আশ্চর্য্য দশার কথা   কেবলমাত্র  তাঁর  মতো সদৃশ পুরুষের পক্ষেই  জানা সম্ভব। 

কর্তব্যতা-এব সংসারো ন তাং পশ্যন্তি সূরয়ঃ 
শূন্যকারা নিরাকারা নির্বিকারা নিরাময়াঃ।  (১৮/৫৭)

সংসারে  কেবলই  কর্তব্য, কর্তব্যই সংসার। কিন্তু ধীরব্যক্তির মধ্যে কোনো কর্তব্য/সঙ্কল্প নেই, তিনি  শূন্যকার, নিরাকার, নির্বিকার, নিরাময়।  

অকুর্বন-অপি সংক্ষোভাৎ-ব্যগ্রঃ সর্বত্র মূঢ়ধীঃ 
কুর্বণ-অপি তু কৃত্যানি কুশলো  হয় নিরাকুলঃ।  (১৮/৫৮)

অজ্ঞান ব্যক্তি কিছু কর্ম্ম না করেও, মনের মধ্যে সংকল্পরহিত না হবার কারনে একাগ্র হতে পারে না। কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তি কর্ম্ম করেও, মনের মধ্যে সঙ্কল্পরহিত হবার কারনে নিশ্চল, নিরাকুল অর্থাৎ আকুলতাবিহীন চিত্ত হয়ে থাকেন । 

সুখমাস্তে সুখং শেতে সুখম-আয়াতি যাতি চ
সুখং ব্যক্তি সুখং ভুঙক্তে ব্যবহারে-অপি শান্তধীঃ। (১৮/৫৯)

শান্তধী অর্থাৎ আত্মস্থ পুরুষ প্রারব্ধ বশতঃ বা সংস্কারের দ্বারা তাড়িত  হয়ে,  আত্মসুখে নিবিষ্ট চিত্ত হয়ে, অবস্থান, শয়ন, গমন-আগমন, কথোপকথন, ভোজন ইত্যাদি ব্যবহারিক কাজ করে থাকেন। 

স্বভাবাৎ-অস্য ন-এব-আর্তি-লোকবৎ-ব্যবহারিণঃ 
মহাহ্রদ  ইবাক্ষোভ্যো গতক্লেশঃ সুশোভতে।  (১৮/৬০) 

তত্ত্বজ্ঞের ব্যবহার সাধারণ লোকের মতো হলেও, তার মধ্যে কোনো আর্তি বা অভাববোধ নেই। তিনি ক্লেশরহিত হয়ে  শান্ত সমাহিত  মহাহ্রদের মতো শোভা পান। 

নিবৃত্তিঃ-অপি মূঢ়স্য প্রবৃত্তিরূপ-জায়তে 
প্রবৃত্তিঃ-অপি ধীরস্য নিবৃত্তিফল-ভাগিনী।  (১৮/৬১)

মূঢ়  ব্যক্তির নিবৃত্তি প্রবৃত্তিরূপেই বিদ্যমান থাকে। কিন্তু ধীর ব্যক্তির প্রবৃত্তিও নিবৃত্তির ফল প্রদান করে থাকে। 

পরিগ্রহেষু বৈরাগ্যং প্রায়ো মূঢ়স্য দৃশ্যতে 
দেহে বিগলিতাশস্য  ক্ব রাগঃ ক্ব বিরাগতা। (১৮/৬২)

মূঢ় ব্যক্তির পরিগ্রহে (দান  গ্রহণে) অনেক সময় বিরাগ দেখা দেয়।  কিন্তু যাঁর  মধ্যে দেহ-অভিমানের অভাব হয়েছে, তাঁর না আছে রাগ, না আছে বিরাগ। 

ভাবনা-অভাবনাসক্তা দৃষ্টিঃ-মূঢ়স্য সর্বদা 
ভাব্যভাবনয়া সা তু স্বস্থস্য-অদৃষ্টিরূপিণী।  (১৮/৬৩)

মূঢ়ব্যক্তি - হয় কখনও ভাবনা চিন্তা করছে, নতুবা ভাবনা চিন্তা করছে না - এমনটা মনে করছে। কিন্তু স্ব-স্থিত পুরুষ নিজে কখনো ভাবনা-চিন্তাকে এই দৃষ্টিতে দেখেন না। অদৃষ্টের খেলা ভেবে, অকর্তা হয়ে  থাকেন।

সর্বারম্ভেষু নিষ্কামো যঃ-চরেৎ-বালবৎ-মুনিঃ 
ন লেপঃ-তস্য শুদ্ধস্য ক্রিয়মাণে-অপি কর্মণি।  (১৮/৬৪)

নিষ্কাম পুরুষ  বালকের ন্যায় সমস্ত কর্ম্মে প্রবৃত্ত হন।  শুদ্ধ অবস্থায় অর্থাৎ আত্মস্থ অবস্থায় তিনি যা কিছু করেন, তাতে তার কর্তৃত্ত্ববোধ (অহংবোধ) থাকে না। 

স এব ধন্য আত্মজ্ঞঃ সর্ব-ভাবেষু  যঃ সমঃ 
পশ্যন শৃন্বন স্পৃশন জিঘ্রন-অশ্নন-নিস্তর্ষ-মানসঃ।  (১৮/৬৫)

সেই আত্মজ্ঞ পুরুষ ধন্য, যিনি সবকিছুতেই সমভাবাপন্ন হয়েছেন।  যিনি  শ্রবণ-স্পর্শ-ঘ্রান-ভোজন সবেতেই নিস্তর (মুক্ত) মনের। 

ক্ব সংসারঃ ক্ব চ-আভাসঃ ক্ব সাধ্যং ক্ব চ সাধনম 
আকাশস্য-এব ধীরস্য নির্বিকল্পস্য সর্বদা। (১৮/৬৬) 

কোথায় সংসার,  কোথায়  বা তার আভাস, কোথায় সাধ্য, কোথায় সাধনা ?  ধীরব্যক্তি সর্বদা নির্বিকল্প (সংকল্প-বিকল্প রহিত)  অবস্থায় আকাশের মতো অবস্থান করেন। 

স জয়তি-অর্থসন্যাসী পূর্ন স্বরস বিগ্রহঃ 
অকৃত্রিমঃ-অনবচ্ছিন্নে সমাধি-যস্য-বর্ততে। (১৮/৬৭)

তাঁরই জয় হয়, যিনি অর্থ-সন্যাসী, যিনি পূর্ণানন্দ বিগ্রহ স্বরূপ।  তিনি অকৃত্রিম, তিনি অনবিচ্ছিন্ন সমাধিতে অবস্থান করছেন। 

বহুনাত্র কিমুক্তেন জ্ঞাততত্ত্বো মহাশয়ঃ
ভোগ-মোক্ষ-নিরাকাঙ্খী সদা  সবত্র নীরসঃ। (১৮/৬৮)

তত্ত্বজ্ঞ  মহাত্মন  সম্পর্কে অধিক  কি আর বলব, ভোগ বা মোক্ষ সম্পর্কে তিনি নিরাকাঙ্খী। আর এই কারণেই তত্ত্বজ্ঞ  পুরুষ ভোগ বা মোক্ষ উভয় সাধনের প্রতিই অনুরাগবিহীন। 

মহৎ-আদি জগৎ-দ্বৈতং নামমাত্র-বিজৃম্ভিতম 
বিহায় শুদ্ধ-বোধস্য কিং কৃত্যম-অবশিষ্যতে।  (১৮/৬৯)

মহৎ ইত্যাদি জগৎ (ভুঃ ভুবঃ স্বঃ মহঃ জনঃ তপঃ সত্যম) দ্বৈত নামমাত্র ভেদে (আসলে একই) ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রতিভাত হচ্ছে। শুদ্ধবোধে এর কোনো বাস্তবিক সত্তা নেই। তাই শুদ্ধবোধ সম্পন্ন ব্যক্তির অর্থাৎ সেই  চিন্ময় পুরুষের কোনো কর্তব্যই অবশিষ্ট থাকে না। 

ভ্রমভূতং-ইদং সর্বং কিঞ্চিৎ-ন-অস্তি-ইতি নিশ্চয়ী 
অলক্ষ্যস্ফুরণঃ শুদ্ধঃ স্বভাবেন-এব শাম্যতি। (১৮/৭০)

অতএব এই জগৎ চিন্ময় পুরুষের কাছে ভ্রমবশতঃ  কল্পিত মাত্র ।  এর কোনো বাস্তবিক অস্তিত্ত্ব নেই।  এইভাবে নিশ্চিত হয়ে তিনি  অলক্ষ্যস্ফুরণঃ অর্থাৎ চিন্মাত্র-প্রতিভাসবান, আর এই কারণেই তিনি স্বভাবতই শান্ত অবস্থায় অবস্থান করেন। (আত্মজ্ঞানে অধিষ্ঠিত  পুরুষের শান্তির জন্য আলাদা করে কিছু করবার প্রয়োজন পড়ে  না। )

শুদ্ধ-স্ফুরণরূপস্য দৃশ্যভাবম-পশ্যতঃ 
ক্ব বিধিঃ ক্ব চ বৈরাগ্যং ক্ব ত্যাগ  ক্ব শমঃ-অপি বা।  (১৮/৭১)

শুদ্ধ  স্ফুরণ রূপ অর্থাৎ যিনি স্বয়ং নিজেকে প্রকাশ করেন, তাঁর কাছে দৃশ্যভাবময় পদার্থ বলে কিছু থাকে না। তিনি কোনো নিয়মের দ্বারা আবদ্ধ  নন, তার কাছে বৈরাগ্য (বিষয় গ্রহণে বিরাগ) বলে কিছু থাকতে পারে না। আবার বিষয় ত্যাগ বলেও কিছু থাকতে পারে না। এমনকি আলাদা করে সংযমের (শম) অভ্যাস করবার  দরকার পড়ে  না। 

স্ফুরতঃ-অনন্তরূপেণ প্রকৃতিং চ ন  পশ্যতঃ 
ক্ব বন্ধঃ ক্ব চ বা মোক্ষঃ ক্ব হর্ষঃ ক্ব বিষাদিতা ।(১৮/৭২) 

অনন্ত রূপে যিনি নিজেই স্ফুরিত হচ্ছেন, এবং প্রকৃতির রূপ যাঁর  কাছে দৃশ্যমান নয়, তাঁর  কাছে বন্ধন বা মোক্ষ, হর্ষ  বা বিষাদ বলে কিছু থাকে না। 

বুদ্ধিপর্যন্ত-সংসারে মায়া-মাত্ৰং বিবর্ততে
নির্মমো নিরহঙ্কারো নিষ্কামঃ শোভতে বুধঃ । (১৮/৭৩) 

বুদ্ধি অর্থাৎ আত্মজ্ঞান হলে এই সংসার অর্থাৎ জগৎ মায়ামাত্ররূপে বিবর্তিত ৯নিত্য-পরিবর্তন) হয়। অতয়েব বুদ্ধিমান/জ্ঞানী ব্যক্তি  নিষ্কাম, নিরহঙ্কারী, দেহাদির প্রতি  নির্মম হয়ে এই জগতে শোভয়মান হন। 

অক্ষয়ং গতসন্তাপং-আত্মানং পশ্যতো মুনেঃ 
ক্ব বিদ্যা চ ক্ব বা বিশ্বং ক্ব দেহঃ-অহং মমেতি  বা। (১৮/৭৪)

অক্ষয় সন্তাপরহিত আত্মজ্ঞানী মুনি-পুরুষের কাছে আত্মা ভিন্ন কোথায় বিদ্যা-অবিদ্যা, কোথায় বিশ্বজগৎ কোথায় বা এই দেহাত্মবোধ ? অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মান্ড বলুন, শাস্ত্রাদি বলুন, বা এই দেহের প্রতি আমি-আমার ভাব বলুন, এসবের কোনো অস্তিত্ত্বই  নেই। 

নিরোধাদীনি কর্মাণি জহাতি জড়ধীর্যদি 
মনোরথান  প্রলাপান-চ কর্তুম-আপ্নোতি-তৎক্ষণাৎ। (১৮/৭৫)

জড় বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তির চিত্ত নিরোধের ক্রিয়া ত্যাগ হলেই, অর্থাৎ সমাধি থেকে বুত্থিত  হলেই, আবার মনোরথ পূরণের জন্য সমস্ত ব্যপারে সচেষ্ট হয়। অতয়েব এই মূঢ়ব্যক্তির চিত্তনিরোধ ক্রিয়া শুধু অকিঞ্চিৎকর নয়, এই চিত্তনিরোধের ক্রিয়া ব্যর্থ হয়ে যায়।

মন্দঃ  শ্রুত্বাপি  তদ্বস্তু ন  জহাতি বিমূঢ়তাম
নির্বিকল্পো বহিঃ-যত্নাৎ-বিষয়-লালসঃ । (১৮/৭৬) 

মন্দ ব্যক্তি  সেই আত্ম-বস্তু সম্পর্কে শুনেও, নিজের বিমূঢ়ভাবকে ত্যাগ করতে পারে না। আর এই কারণেই বিমূঢ় ব্যক্তির বাহ্য-প্রচেষ্টার দ্বারা নির্বিকল্প সমাধি হলেও অন্তরে লালসার অবসান হয় না। 

জ্ঞানাৎ-গলিতকর্মা যো লোকদৃষ্ট্যাপি কর্মকৃৎ
ন-আপ্নোতি-অবসরং কর্তুং বক্তুমেব ন কিঞ্চন। (১৮/৭৭)

আত্মজ্ঞানীর কর্ম্মক্ষয়  হওয়ায়, তিনি লোকদৃষ্টিতে কর্ম্ম করলেও  কর্তৃত্ব ভাবের অভাব হেতু কিছু করবার অবসর পান না। অর্থাৎ কিছু করছেন বলে মনেই করেন না। 

ক্ব তমঃ ক্ব  প্রকাশো  বা হানং ক্ব চ ন কিঞ্চন 
নির্বিকারস্য ধীরস্য নিরাতঙ্কস্য সর্বদা। (১৮/৭৮)

ধীর, নির্বিকার, পুরুষের কাছে কোথায় অন্ধকার, কোথায় প্রকাশ ? কালের অতীত হওয়ায় আতঙ্করহিত রহিত।    তাঁর গ্রহণ না থাকায়, কিছু হারাবার  সম্ভাবনাও নেই। 

ক্ব ধৈর্যং ক্ব বিবেকিত্বং ক্ব  নিরাতঙ্কতা-অপি বা 
অনির্বাচ্য-স্বভাবস্য নিঃস্বভাবস্য যোগিনঃ । (১৮/৭৯) 

যোগী পুরুষের স্বভাব বা নিঃ-স্বভাব-এর  কথা ভাষায় প্রকাশ যায় না, অনির্বচনীয় ।  এই তত্ত্বজ্ঞ পুরুষের ধৈর্য্য বলুন, বিবেক বলুন, আতঙ্কহীন ভাব বলুন, কোনো কিছুরই যেন অস্তিত্ত্ব নেই তাঁর বোধের মধ্যে।  

ন স্বর্গো  নৈব নরকো জীবনমুক্তিঃ-ন  চ-এব হি। 
বহুনা-অত্র কিম-উক্তেন যোগদৃষ্ট্যা ন কিঞ্চন। (১৮/৮০)

 তত্ত্বজ্ঞ পুরুষের কাছে, না আছে স্বর্গ, না আছে নরক, এমনকি জীবন্মুক্তি বলেও কিছু নেই। অধিক কি, তাঁর  কাছে কোনো কিছুরই অস্তিত্ত্ব নেই - (কেবল তিনিই সেই সৎপুরুষ).

নৈব প্রার্থয়তে লাভং ন-অলাভেন-অনুশোচতি 
ধীরস্য শীতলং চিত্তম-অমৃতেন-এব পূরিতম। (১৮/৮১)

তত্তজ্ঞ পুরুষ কখনও  লাভের  জন্য প্রার্থনা করেন না। আবার লাভ  না হলেও কোনো অনুশোচনা করেন না। ধীরব্যক্তির  চিত্ত শীতল অমৃত সম্ভারে পরিপূর্ন। 

ন শান্তং স্তৌতি নিষ্কামো ন দুষ্টমপি নিন্দতি   
সমদুঃখসুখ-তৃপ্তঃ কিঞ্চিৎ কৃত্যং ন  পশ্যতি।  (১৮/৮২)

তত্তজ্ঞ নিষ্কাম ব্যক্তি শান্ত ব্যক্তির স্তুতি করেন না। আবার দুষ্টব্যক্তির  নিন্দাও করেন না। স্বয়ং তৃপ্ত হওয়ায় তিনি  সুখে-দুঃখে সমভাব  পোষন করেন। তিনি কর্তব্যবোধের উর্দ্ধে অবস্থান করেন। 

ধীরো ন  দ্বেষ্টি সংসারম-আত্মানং না দিদৃক্ষতি 
হর্ষামর্ষ-বিনির্মুক্তো ন মৃতো ন  চ জীবতি। (১৮/৮৩)

ধীর তত্তজ্ঞ ব্যক্তি সংসারকে সত্যরূপে দেখেন না, সংসারের প্রতি বিদ্বেষভাবও  পোষন করেন না। হর্ষ  বা বিমর্ষ ভাব থেকে মুক্ত, তিনি  না  মৃত না জীবিত, অর্থাৎ  জীবনমুক্ত অবস্থায় বিরাজ করেন । 

নিঃস্নেহ পুত্র-দারাদৌ নিষ্কামো বিষয়েষু চ 
নিশ্চিন্তঃ স্বশরীরে-অপি নিরাশঃ শোভতে  বুধঃ। (১৮/৮৪) 

স্ত্রী-পুত্রদের প্রতি স্নেহহীন, বিষয়ের প্রতিও কামনারহিত। নিজের শরীরের রক্ষার ব্যাপারেও নিশ্চিন্ত, অর্থাৎ কোনো চিন্তা করেন না। এই জ্ঞানী  আশা-নিরাশার উর্দ্ধে শোভয়মান ।

তুষ্টিঃ সর্বত্র ধীরস্য যথা-পতিতবর্তিনঃ 
স্বচ্ছন্দং চড়তে-দেশান-যত্র-অস্তমিতশায়িনঃ। (১৮/৮৫)

ধীর ব্যক্তি সবকিছুতেই সন্তুষ্ট। পতির  অনুগামী হয়ে পত্নী যেমন  স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, তেমনি জ্ঞানী ব্যক্তি  প্রারব্ধকে অনুসরণ ক'রে,  সমস্ত অবস্থাতেই, তা সে যেকোনো দেশে, যেকোনো সময়, সূর্য অস্তগেলেই  নিশ্চিন্তে নিদ্রা যান। অর্থাৎ কোনো অবস্থাতেই তার আত্মতুষ্টি ব্যাহত হয় না। 

পততু-উদেতু  বা দেহো ন-অস্য চিন্তা মহাত্মনঃ 
স্বভাব-ভূমি-বিশ্রান্তি-বিস্মৃতাশেষ-সংসৃতেঃ । (১৮/৮৬) 

দেহের বৃদ্ধি  হোক বা ক্ষয় হোক, অর্থাৎ দেহের জন্ম-মৃত্যু উভয়ক্ষেত্রে মহাত্মন চিন্তাশূন্য থাকেন। স্বভাব-ভূমি অর্থাৎ স্ব-স্বরূপে অবস্থান ক'রে, তিনি সংসারকে বিস্মৃত হন। 

অকিঞ্চনঃ কামচারো নির্দ্বন্দ্বঃ-ছিন্নসংশয়ঃ
অসক্তঃ সর্বভাবেষু কেবলো  রমতে বুধঃ । (১৮/৮৭) 

তত্তজ্ঞ পুরুষ অকিঞ্চন অর্থাৎ কোনো কিছুর জন্য  প্রত্যাশী নন। নিজের ইচ্ছে মতো  বিচরণ করেন। তিনি দ্বন্দ্বাতীত, সংশয়শূন্য, সমস্ত বিষয়ে আসক্তিবিহীন। জ্ঞানী ব্যক্তি কেবল আত্মাতেই রমন করছেন। 

নিৰ্মমঃ শোভতে ধীরঃ সমলোস্ট্রাশ্মকাঞ্চনঃ 
সুভিন্ন-হৃদয়গ্রন্থিঃ-বিনির্ধূত-রজস্তমঃ ।১৮/৮৮) 

মমতারহিত ধীর ব্যক্তি, লোষ্ট্র  (মাটির ঢেলা) অশ্ন  (পাথরের টুকরো ) বা কাঞ্চন অর্থাৎ  সোনার প্রতি সমদৃষ্টি সম্পন্ন।  যাঁর  হৃদয়গ্রন্থি ছিন্ন হয়েছে, তাঁর  বৃত্তিসমূহ ধৌত  হবার ফলে নির্ম্মল চিত্ত বিশিষ্ট হয়েছেন। 

সর্বত্র-অনবধানস্য ন কিঞ্চিৎ-বাসনা হৃদি 
মুক্তাত্মনো বিতৃপ্তস্য তুলনা কেন জায়তে।  (১৮/৮৯)

তত্তজ্ঞ পুরুষের হৃদয়ে বাসনার লেশ  মাত্র নেই, তাই সর্ববিষয়ে অমনোযোগী। যিনি  মুক্তাত্মা পরিতৃপ্ত পুরুষ তার সঙ্গে কারুর তুলনা  করা যায় না। 

জ্ঞানন্নপি ন  জানাতি পশ্যন-অপি ন পশ্যতি   
ব্রুবন্নপি ন চ ব্রুতে কঃ-অন্যো  নির্বাসনাৎ-ঋতে। (১৮/৯০)

তত্ত্বজ্ঞ পুরুষ চোখে দেখেও  আসলে দেখেন না, মুখে কথা বলেও যেন কিছুই বলেন না। অন্যকে জ্ঞাত হওয়া জ্ঞানী ভিন্ন অন্য কারুর পক্ষে সম্ভব নয়। অর্থাৎ কেবলমাত্র আত্মজ্ঞ পুরুষই  সমস্ত কিছুই জ্ঞাত আছেন । আর যিনি সমস্ত কিছুই জ্ঞাত হয়েছেন, স্ব-স্বরূপে যার স্থিতি  তার কোনো কিছুই বলার নেই, দেখার নেই, বোঝার নেই। 

ভিক্ষুর্বা ভূপতিঃ-বা-অপি যো নিষ্কামঃ স শোভতে
ভাবেষু গলিতা যস্য শোভন-অশোভনা মতিঃ। (১৮/৯১)

যাঁর  বিচারে শোভন অশোভন বলে কিছু নেই,  তিনি ভিক্ষুক (সন্যাসী) বা ভূপতি (রাজা) হলেও, বিষয়ের প্রতি নিষ্কাম অবস্থায় শোভয়মান থাকেন। 

ক্ব স্বাচ্ছন্দ্যং ক্ব সঙ্কোচঃ ক্ব  বা তত্ত্ব-বিনিশ্চয়ঃ 
নির্ব্যাজ-আৰ্জব-ভূতস্য চরিতার্থস্য যোগিনঃ।  (১৮/৯২)

তত্তজ্ঞ পুরুষের না আছে সংকোচ, না আছে স্বাছন্দ্যবোধ।  তত্ত্ব-বিচারের ইচ্ছের উর্দ্ধে অর্থাৎ বিষয় বিচারের উর্দ্ধে   । তাঁর  না আছে আর্জবৃত্তি (প্রার্থনা করবার প্রবৃত্তি ), না প্রার্থনা থেকে  দূরে থাকেন তিনি। সমস্ত সাফল্য ছাপিয়ে যোগীর অবস্থান। 

আত্ম-বিশ্রান্তি-তৃপ্তেন নিরাশেন গতার্তিনা 
অন্তর্যৎ-অনুভুয়েত তৎ কথং কস্য কথ্যতে।  (১৮/৯৩)

আত্ম-স্বরূপে স্থিতির কারনে  যিনি বিশ্রান্তি লাভ করেছেন, আশা-নিরাশার মধ্যে যার গতাগতি নেই,  তিনি তাঁর  অন্তরের অনুভূতির কথা কাকেই বা বলবেন, আর কিভাবেই বা বলবেন ? 

সুপ্তঃ-অপি ন সুষুপ্তৌ চ স্বপ্নে-অপি শায়িতো ন চ 
জাগরে-অপি ন জাগর্তি ধীরঃ-তৃপ্তঃ পদে পদে । (১৮/৯৪) 

তত্তজ্ঞ পুরুষ  জাগ্রত অবস্থায় জেগে থাকেন না,   স্বপ্নাবস্থায় স্বপ্ন দেখেন না,  সুষুপ্তির (গাঢ় ঘুমের) অবস্থায় অজ্ঞান থাকেন না। ধীর ব্যক্তি প্রতিপদে পরিতৃপ্ত, অর্থাৎ পরমানন্দে থাকেন। 

জ্ঞঃ সচিন্তঃ-অপি নিশ্চিন্তঃ সেন্দ্রিয়ঃ-অপি নিঃ-ইন্দ্রিয়ঃ 
সুবুদ্ধিঃ-অপি নির্বুদ্ধিঃ সাহঙ্কারঃ-অনহংকৃতিঃ । (১৮/৯৫) 

তত্তজ্ঞ পুরুষ চিন্তাশীল হয়েও চিন্তাহীন, ইন্দ্রিয়যুক্ত হয়েও ইন্দ্রিয়কর্ম্ম  রহিত, বুদ্ধিমান হয়েও নির্বুদ্ধি পরায়ন, অহঙ্কার  যুক্ত হয়েও নিরহঙ্কারী। অর্থাৎ মনের কর্ম্ম - চিন্তা, ইন্দ্রিয়কর্ম্ম - বিষয়কর্ম্ম, বুদ্ধির কর্ম্ম - বিচার, এবং  অহংকারের কর্ম্ম অর্থাৎ কর্তৃত্বাভিমান  ইত্যাদি থেকে পৃথক। 

ন  সুখী ন  চ বা দুঃখী ন  বিরক্তো ন  সঙ্গবান 
ন  মুমুক্ষুর্ন বা মুক্তো ন কিঞ্চিৎ-ন  চ কিঞ্চন।  (১৮/৯৬)

তিনি সুখীও নন, তিনি দুঃখীও  নন। তিনি কারুর প্রতি বিরক্তও নন আবার অনুরক্তও নন। তিনি না মুক্তির পিয়াসী না নিজেকে মুক্ত ভাবেন।  তিনি না সামান্য পুরুষ না অসামান্য। 

বিক্ষেপে-অপি ন  বিক্ষিপ্তঃ সমাধৌ  ন  সমাধিমান  
জাভ্যে-অপি ন জড়ো  ধন্যঃ পাণ্ডিত্যে-অপি ন পণ্ডিত (১৮/৯৭) 

তত্ত্বজ্ঞ পুরুষকে আপাতদৃষ্টিতে বিক্ষিপ্ত বলে মনে হলেও, তিনি বিক্ষিপ্ত  নন। তাঁকে  সমাধিস্থ মনে হলেও তিনি সমাধিবান নন। লোকদৃষ্টিতে জড়বৎ মনে হলেও তিনি বস্তুতঃ জড় নন। সাধারণ দৃর্ষ্টিতে তাঁর  মধ্যে পান্ডিত্য দেখা দিলেও, তিনি পণ্ডিত-অভিমানী  নন।  

মুক্তো যথাস্থিতি স্বস্থঃ কৃত-কর্তব্য-নির্বৃতঃ  
সমঃ সর্বত্র বৈতৃষ্ণ্যাৎ-ন স্মরত্যকৃতং কৃতম। (১৮/৯৮)

মুক্ত পুরুষ-এর স্থিতি যথাস্থানেই হয়ে থাকে, অর্থাৎ তিনি স্ব-স্থিত। কৃত কর্তব্য থেকে নিরত ।  কৃত  অর্থাৎ প্রারব্ধ কর্ম্ম ও কর্তব্য অর্থাৎ বর্তমান কর্তব্য - এই উভয় থেকেই তাঁর চিত্ত  নিবৃত্ত থাকেন।  সর্বত্র সমদর্শী, তৃষ্ণা রহিত, স্মৃতির কারনে অর্থাৎ কেবল সংস্কারবশে তার দ্বারা  ক্রিয়া সম্পাদিত হয়। 

ন  প্রীয়তে বন্দ্যমানো নিন্দ্যমানো ন কুপ্যতি 
ন-এব-উদ্বিজতি মরণে জীবনে ন-অভিনন্দতি।  (১৮/৯৯)

আত্মজ্ঞানী  পুরুষ অন্যের বন্দনায় প্রীতিলাভ করেন না, আবার অন্যের দ্বারা নিন্দিত হলেও কুপিত হন না। মরণকালেও তাঁর নিরুদ্বিগ্ন চিত্ত, আবার জীবিত কালকেও তিনি অভিনন্দন করেন না। 

ন  ধাবতি জনাকীর্ণং ন-অরণ্যং-উপশান্তধীঃ 
যথাতথা যত্রতত্র সম এব-অবতিষ্ঠতে। (১৮/১০০)

আত্মজ্ঞানী  পুরুষের  জনবহুল স্থানে ধাবিত হন না, আবার অরণ্যের (নির্জনের) আকাঙ্খ্যাও  করেন না। তাঁর স্ব-স্থিত চিত্ত সর্বত্র সমভাবে অবস্থান করে। 

ইতি শান্তি-শতকং  নাম অষ্টাদশং প্রকরণম অষ্টাবক্র গীতা সমাপ্তম। 


আত্ম-বিশ্রান্ত-অষ্টকং নাম ঊনবিংশ প্রকরণম। 

তত্ত্ব-বিজ্ঞান-সন্দংশম-আদায় হৃদয়-উদারাৎ 
নানাবিধ-পরামর্শ-শল্যোদ্ধারঃ কুতো ময়া  (১৯/০১) 

(হে গুরুশ্রেষ্ঠ) আপনার কাছ থেকে তত্ত্বজ্ঞানের উপদেশ সন্দেশ প্রাপ্ত হয়ে আমি আমার হৃদয় হতে বিচার-বুদ্ধি থেকে  উদ্ভূত  নানাবিদ পরামর্শ পরিত্যাগ করেছি। 

ক্ব ধর্মঃ ক্ব চ বা কামঃ ক্ব চ-অর্থ ক্ব বিবেকিতা 
ক্ব  দ্বৈতং ক্ব চ বা-অদ্বৈতং স্বমহিম্নি স্থিতস্য মে । (১৯/০২)

রাজর্ষি জনক বলছেন, কোথায় ধর্ম্ম, কোথায় বা কামনা বাসনা, কোথায় অর্থ, কোথায় বিবেকবুদ্ধি, কোথায় দ্বৈত, কোথায় বা অদ্বৈত, আমার  স্ব-মহিমায় অর্থাৎ আত্মস্বরূপে স্থিতিলাভ  হয়েছে।  

ক্ব ভূতং ক্ব ভবিষৎ-বা বর্তমান-অপি ক্ব  বা 
ক্ব  দেশঃ  ক্ব  চ বা নিত্যং স্বমহিম্নি স্থিতস্য মে। (১৯/০৩) 

আমার মধ্যে আমি স্থিত। আমি কালের উর্দ্ধে অর্থাৎ আমার কাছে না আছে অতীত, না আছে ভবিষ্যৎ, এমনকি বর্তমান-ই বা কোথায় ? আমি নিত্য স্বরূপে স্থিত, আমার কাছে কোথায় দেশ ? অর্থাৎ রাজর্ষি বলছেন,  আমি কালের উর্দ্ধে, দেশের উর্দ্ধে স্থিত হয়েছি। 

ক্ব  চ আত্মা ক্ব  চ বা অনাত্মা ক্ব শুভং ক্ব অশুভং তথা 
ক্ব  চিন্তা ক্ব  চ বা-অচিন্ত স্বমহিম্নি স্থিতস্য মে।(১৯/০৪) 

আমি স্বমহিমায় স্থিত হয়েছি। এখন আমার কাছে না আছে আত্মা, না অনাত্মা, না শুভ  না অশুভ, এমনকি চিন্তা ও অচিন্তা  বলেও কিছু নেই। আমি আমাতেই স্থিত। 

ক্ব  স্বপ্নঃ ক্ব সুষুপ্তিঃ বা  ক্ব চ জাগরণং তথা 
ক্ব তুরীয়ং ভয়ং বা-অপি স্বমহিম্নি স্থিতস্য মে।  (১৯/০৫)

আমি স্ব মহিমায় স্থিত হয়েছি। আমার কোথায় জাগ্রত অবস্থা, কোথায় স্বপ্নাবস্থা, কোথায় সুসুপ্তির অবস্থা, কোথায় তুরীয় অবস্থা।  আমার কিসের ভয় ? আমি কালের উর্দ্ধে আমাতেই স্থিত। 

ক্ব দূরং ক্ব সমীপং বা বাহ্যং ক্ব-অভ্যন্তরং ক্ব  বা 
ক্ব  স্থূলং ক্ব চ বা সূক্ষ্মং স্বমহিম্নি স্থিতস্য মে। (১৯/০৬) 

আমি স্ব মহিমায় স্থিত হয়েছি। কোথায় দূর, কোথায় নিকট, কোথায় বাহির, কোথায় অভ্যন্তর, কোথায় স্থূল কোথায় বা সূক্ষ্ম ? আমি দেশের উর্দ্ধে আমাতেই স্থিত। 

ক্ব  মৃত্যু-জীবিতং বা ক্ব  লোকাঃ ক্ব অস্য ক্ব  লৌকিকম 
ক্ব  লয়ঃ ক্ব  সমাধিঃ বা স্বমহিম্নি স্থিতস্য মে। (১৯/০৭) 

আমি স্ব  মহিমায় স্থিত। কোথায় জীবন ,কোথায় মৃত্যু ,কোথায় লোকাদি (ভূ , ভূব, স্ব, মহঃ  জনঃ তপঃ সত্যম), কোথায় লোকাদি ক্রিয়া কর্তব্য, কোথায় আমার লয় হবে, কোথায় বা সমাধি - এসবের কোনো অস্তিত্ত্ব নেই।  আমি সবকিছুর উর্দ্ধে আমাতেই স্থিত। 

অলং ত্রিবর্গ-কথয়া যোগস্য কথায়া-অপি-অলম 
অলং বিজ্ঞান-কথয়া বিশ্রান্তস্য মম-আত্মনি।  (১৯/০৮)

ত্রিবর্গ (ধর্ম্ম-অর্থ-কাম) সম্পর্কে কথা অনেক হয়েছে, যোগের কথাও অনেক হয়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথাও অনেক হলো, এবার আমি আত্মস্বরূপে বিশ্রাম নিয়েছি । 

ইতি আত্ম-বিশ্রান্ত-অষ্টকং নাম ঊনবিংশ প্রকরণম - অষ্টাবক্র গীতা সমাপ্তম  


শিষ্যপ্রোক্তং জীবন্মুক্তি চতুর্দশকং  নাম বিংশতিকং প্রকরণম।
 
আত্মবিশ্ৰান্ত-অভিব্যক্ত-স্বভাবং মুক্তিশালিনীম 
জীবনমুক্তি দশাং শিষ্যঃ চতুর্দশভিঃ অব্রবীৎ ।

অষ্টাবক্র শিষ্য রাজর্ষি জনক, আত্মবিশ্রান্তির ফল স্বরূপ তত্ত্বজ্ঞের স্বভাবসুলভ জীবনমুক্তির-দশা চোদ্দটি শ্লোকে বর্ননা করছেন। 

ক্ব ভূতানি ক্ব  দেহো বা ক্ব  ইন্দ্রিয়ানি ক্ব বা মনঃ 
ক্ব  শূন্যং ক্ব  চ নৈরাশ্যং মৎস্বরূপে নিরঞ্জনে। (২০/০১)

মৎ-স্বরূপে স্থিত হয়ে অর্থাৎ নিজের মধ্যে নিরঞ্জনে (অসঙ্গ হয়ে)  এই দেহ ইন্দ্রিয়, মন  এমনকি পঞ্চভূতের (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম)  অস্তিত্ত্ব  বিহীন আমি।  এমনকি শূন্য বা নৈরাশ্যের অস্তিত্ত্বও নেই। অর্থাৎ এখন আত্মাভিন্ন কোনো  কিছুর অস্তিত্ত্ব নেই।  

ক্ব  শাস্ত্ৰং ক্ব আত্ম-বিজ্ঞানং ক্ব  বা  নির্বিষয়ং মনঃ 
ক্ব  তৃপ্তিঃ ক্ব  বিতৃষ্ণত্বং গতদ্বন্দ্বস্য মে সদা ।(২০/০২)

কোথায় ধর্ম্মশাস্ত্র, কোথায় আত্মবিজ্ঞান, কোথায় বা বিষয়-বিহীন মন, কোথায় তৃপ্তি, কোথায় বিতৃষ্ণা, সব দ্বন্দ্বের উর্দ্ধে আমি আত্ম-বিশ্রান্তিতে আছি। 

ক্ব বিদ্যা ক্ব চ বা অবিদ্যা ক্ব অহং ক্ব  ইদং মম ক্ব  বা 
ক্ব  বন্ধঃ ক্ব চ বা মোক্ষঃ স্বরূপস্য ক্ব  রূপিতা। (২০/০৩) 

আমার মধ্যে কোথায় বিদ্যা, কোথায় বা অবিদ্যা, কোথায় অহং কোথায় ইদং জ্ঞান ? কোথায় বন্ধ, কোথায় বা মোক্ষ। স্বরূপের আবার  রূপ কি হবে ?  

ক্ব প্রারব্ধানি কর্মাণি জীবনমুক্তিঃ-অপি ক্ব বা
ক্ব  তৎ-বিদেহ-কৈবল্যং নির্বিশেষস্য সর্বদা।  (২০/০৪)

নির্বিশেষে স্বরূপে যাঁর সদা অবস্থান, তাঁর  কোথায় প্রারব্ধকর্ম্ম, কোথায় জীবনমুক্তির অবস্থা, কোথায় বিদেহ  কৈবল্য অবস্থা ? 

ক্ব  কর্তা ক্ব  চ বা ভোক্তা নিষ্কৃয়ং স্ফূরণং ক্ব বা 
ক্ব-অপরোক্ষং ফলং বা ক্ব নিঃস্বভাবস্য মে সদা । (২০/০৫)
 
আমার্  সদা  নিঃস্ব-ভাব।  আমাতে কোথায় কর্তাভাব, কোথায় ভোক্তাভাব, আর স্ফূরণই বা কোথায় ? কোথায় অপরোক্ষ জ্ঞানের ফল, অর্থাৎ বিষয় জ্ঞান কোথায় ? 

ক্ব  লোকঃ ক্ব  মুমুক্ষুঃ বা ক্ব  যোগী জ্ঞানবান ক্ব  বা 
ক্ব  বদ্ধঃ ক্ব চ বা মুক্তঃ স্ব-স্বরূপে অহম-অদ্বয়ে। (২০/০৬)

আমার  অদ্বয়রূপ আত্মস্বরূপে অবস্থান।  এই অবস্থায় কোথায় লোকসকল, কোথায় মুমুক্ষ, কোথায় যোগীর  যোগ-জ্ঞান, কোথায় বদ্ধ , কোথায়ই বা মুক্তাবস্থা ? আমি সদা স্ব-স্বরূপে স্থিত।

ক্ব  সৃষ্টিঃ ক্ব চ সংহারঃ ক্ব  সাধ্যং ক্ব  চ সাধনম 
ক্ব  সাধকঃ ক্ব সিদ্ধিঃ বা স্ব-স্বরূপে অহম-অদ্বয়ে। (২০/০৭)

আমার অদ্বয়রূপ স্ব-স্বরূপে অবস্থান।  এখানে না সৃষ্টি না সংহার, না সাধ্য না সাধন।  এখানে কোথায় সাধক, কোথায় সিদ্ধি। আমি সদা স্ব-স্বরূপে স্থিত।

ক্ব  প্রমাতা প্রমানং বা ক্ব  প্রমেয়ং  ক্ব  চ প্রমা 
ক্ব  কিঞ্চিৎ ক্ব ন কিঞ্চিৎ-বা সর্বদা বিমলস্য মে।  (২০/০৮)

 আমি মলরহিত, আমারই মধ্যে শুদ্ধতা। তো কোথায়  প্রমাতা (শুদ্ধ চিত্তবৃত্তি), কোথায়  প্রমান (সাক্ষী) কোথায় প্রমেয় (জ্ঞেয়) কোথায় প্রমা (বিশুদ্ধজ্ঞান) ? আমার মধ্যে কিঞ্চিৎ পদার্থেরও  অভাব। অর্থাৎ জ্ঞাতা , জ্ঞেয়, জ্ঞান সবই আমি। 

ক্ব  বিক্ষেপঃ ক্ব  চ একাগ্র্যং ক্ব  নির্বোধঃ ক্ব মূঢ়তা 
ক্ব  হর্ষঃ ক্ব বিষাদো বা সর্বদা নিষ্ক্রিয়স্য মে।  (২০/৯)

আত্মস্থিত পুরুষ নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে অবস্থান করেন। তাঁর  মধ্যে  কোথায়  বিক্ষেপ, কোথায় তাঁর  চিত্তের একাগ্রতা, কোথায় নির্বুদ্ধিতা, কোথায় অজ্ঞান, কোথায় হর্ষ কোথায়ই বা বিষাদ ? 

ক্ব  চ এষ ব্যবহারো বা ক্ব  চ সা পরমার্থতা 
ক্ব সুখং ক্ব  চ বা দুঃখং নির্বিমর্শস্য মে সদা।  (২০/১০) 

আমার মধ্যে নির্বিমর্শস্য অর্থাৎ বৃত্তিজ্ঞান রহিত অবস্থা বিরাজ করছে। অতএব কোথায় এই বিষয় ব্যবহারের বৃত্তি, আর কোথায়ই বা পরমার্থ ভাব ? কোথায় (বিষয়) সুখ, কোথায় (বিষয়) দুঃখ ? 

ক্ব  মায়া ক্ব চ সংসারঃ ক্ব প্রীতিঃ-বিরতিঃ  ক্ব বা 
ক্ব জীবঃ ক্ব  চ তদব্রহ্ম সর্বদা বিমলস্য মে। (২০/১১)

সর্ব্ব-উপাদিরুপ-মল বিরোহিত হয়ে আমার অবস্থান।  তো কোথায় মায়া (অজ্ঞানরূপ জগৎ) কোথায় সংসার (পরিবর্তনশীল জগৎ) কোথায় প্রীতি-বৈরাগ্য থাকবে ? কোথায়ই জীবভাব, কোথায়ই বা ব্রহ্মভাব ?  না আছে  জীবত্বের লক্ষণ না আছে ব্রহ্মত্বের লক্ষণ। 

ক্ব প্রবৃত্তিঃ-নিবৃত্তিঃ বা ক্ব মুক্তিঃ ক্ব চ বন্ধনম 
কূটস্থ নির্বিভাগস্য স্বস্থস্য  মম সর্বদা। (২০/১২)

সর্বদা আমার  স্বস্থিতির অবস্থা।  কোথায় প্রবৃত্তি কোথায় বা নিবৃত্তি কোথায় মুক্তি কোথায় বা বন্ধন। আমি বিভাগহীন কূটস্থ। 

ক্ব-উপদেশঃ ক্ব বা শাস্ত্ৰং ক্ব  শিষ্যঃ ক্ব  বা গুরুঃ 
ক্ব চ অস্তি পুরুষার্থো   বা নিরুপাধেঃ শিবস্য মে । (২০/১৩) 

উপাধিহীন শিবত্বে আমার উপস্থিতি, উপদেশ-ক্রিয়া কোথায়, শাস্ত্রই বা কোথায় ? কোথায় শিষ্য কোথায় গুরু কোথায়ই  বা পুরুষার্থঃ ? 

ক্ব চ অস্তি ক্ব  চ বা নাস্তি  ক্ব অস্তি চ একং ক্ব  চ দ্বয়ম 
বহুনা-অত্র কিম-উক্তেন কিঞ্চিৎ-ন উত্তিষ্ঠতে মম। (২০/১৪) 

কোথায় (সত্যের) অস্তিত্ব, কোথায় (সত্য) অস্তিত্বহীন, কোথায় একের অনুভব, কোথায়ই বা   দ্বৈত-অনুভব।  বেশি কথা আর কি বলবো, আমার কাছে, কোনো কিছুই প্রতিভাত হচ্ছে না। কেবল চৈতন্যস্বরূপে স্থিতি। 
সৎ-চিৎ-আনন্দম। সচ্চিদানন্দ স্বরূপে আমার চিরস্থিতি ।  

ইতি শিষ্যপ্রোক্তং জীবন্মুক্তি চতুর্দশকং  নাম বিংশতিকং প্রকরণম, অষ্টাবক্র গীতা সমাপ্তম ।

সমাপ্ত হলো গুরু-শিষ্যে প্রবচন, আত্মজ্ঞানের সর্বোচ্চ উপলব্ধির প্রকাশলিপি  স্বরূপ - শ্রীঅষ্টাবক্র গীতা। 

নমস্কার করি রাজর্ষি জনক ও তৎগুরু সৎগুরু জগৎগুরু ঋষি অষ্টাবক্র মুনিকে। 
সবশেষে নমস্কার করি সমস্ত পাঠককূলকে। 

 পুনশ্চ : আমার মাঝে মধ্যে জানতে ইচ্ছে করে, অষ্টাবক্র সংহিতার মতো বুদ্ধির অগম্য  শাস্ত্র আমরা কেন শুনি ? যার মধ্যে এতটুকু বুদ্ধির জাগরণ হয়েছে, তার কাছে অষ্টাবক্র সংহিতা দুর্বোধ্য। স্বামীজীর কাছে, এক ঈশ্বর জিজ্ঞাসু এসেছেন। তার জিজ্ঞাসা হচ্ছে, ঈশ্বরকে কি করলে জানা যাবে। তো স্বামীজী বলছেন, ঈশ্বর কোনো জানার বস্তু নয়। ঈশ্বর উপল্বদ্ধির বিষয়।  আর ঈশ্বরকে উপলব্ধি করবার জন্য, কিছু করতে হয় না। তোমার যখন পেটব্যথা হয়, তোমার যখন বাহ্য-প্রস্রাব পায়, তোমার যখন ক্ষিধে পায়, ইত্যাদি বুঝবার জন্য, তোমাকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করতে হয় না।  তোমার নিজের মধ্যেই একটা বোধ জাগ্রত হয়, যা থেকে তুমি এই বিষয়গুলো সম্পর্কে  জানতে পারো। এটা তোমার স্বভাবের মধ্যেই আছে। আমরা গুরুদেবের কাছে যাই, কিছু ক্রিয়া শিখবার জন্য। আমাদের একটা ধারণা  হচ্ছে, জাগতিক বস্তু পাবার জন্য, যেমন আমাদের অনেক কায়িক পরিশ্রম করতে হয়, তেমনি ঈশ্বরকে জানবার জন্যও আমাদের কিছু না কিছু করা উচিত। তা সে যাগ-যজ্ঞ,  দান-ধ্যান-জপ-তপ  যাই হোক না কেন, কিছু না করলে কিছু পাওয়া যায় না। এবং আমাদের সমস্ত ধর্ম্ম গ্রন্থ, আমাদেরকে কিছু না কিছু করবার জন্য নির্দেশ-উপদেশ দিয়ে গেছেন। আর সেই নির্দেশ অনুযায়ী ঈশ্বরকে পাবার জন্যও আমরা নানাবিধ ক্রিয়া কর্ম্মে লিপ্ত হয়ে থাকি।  ঋষি অষ্টাবক্র মুনি এই দিকে থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তিনি বলছেন, তুমিই ঈশ্বর, তোমার ভিতরেই ঈশ্বর, ঈশ্বরকে খুঁজতে হয় না, শুধু নিজের দিকে তাকাও, অন্তর্মুখী হও। চোখের ভিতরের পাতা খুলে দাও । তাই অষ্টাবক্র সংহিতা আমাদের কাছে দুর্বোধ্য। কিছু না করে সবকিছু পাওয়া যায়, এমন কথা তো কখনো কেউ বলেন  না।