Monday 31 July 2017

সৃষ্টি প্রকরণ - মহাত্মা গুরুনাথ - তত্বজ্ঞান -উপাসনা



সৃষ্টি প্রকরণ - মহাত্মা গুরুনাথ -


তত্বজ্ঞান -উপাসনা


তাং - ২৪/০৭/২০১৭


আমাকে সৃষ্টি তত্ব সম্পর্কে বলতে বলা হয়েছে। বিষয়টি আমার মতো অজ্ঞানীর পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। যে নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে কিছু জানেনা, তার পক্ষে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির রহস্য খুঁজে বের করা, এক প্রহেলিকা মাত্র।


নরেন-এর (বিবেকানন্দ) বিয়ে ঠিক হয়েছে। রামকৃষ্ণ ভাবলেন, বিয়ে হয়ে গেলে, নরেন -এর মধ্যে যে সম্ভাবনা আছে, তা বন্ধনে জড়িয়ে যাবে। রামকৃষ্ণ নানান ভাবে চেষ্টা করতে লাগলেন যাতে, নরেন বিয়ে না করে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখে, একদিন রামকৃষ্ণ নরেন-এর হাতে একটা বই দিয়ে বললেন, এটা আমাকে একটু পরে শোনা। বইটা ছিলো "অষ্টাবক্র সংহিতা" । নরেন বললেন - ও সব ছাই ভষ্ম আমি পড়বো না। রামকৃষ্ণ জানতেন, নরেনকে এই বই পড়তে বললে ও পড়তে চাইবে না। তাই বললেন, তোকে পড়তে বলছি না। তুই আমাকে একটু পরে শোনা। যারা অষ্টাবক্র পড়েছেন তারা জানেন এই বই অধ্যাত্বিকতার শেষ কথা। এই বই শুধু পড়তে হয় - বুঝতে হয়, কিছু করতে হয় না। নরেন বিবেকানন্দ হয়েছিল শুধু অষ্টাবক্র পড়ে, আর রামকৃষ্ণের আশীর্বাদে।


মহাত্মা মানস পাণ্ডে, আমাকে একদিন বললেন, সৃস্টিতত্ব সম্পর্কে কিছু বলতে হবে, তুমি গুরুদেবের তত্ত্বজ্ঞান - উপাসনার

সৃষ্টি-প্রকরণ অধ্যায়টি একটু পড়ে নিও। আমি তারই আলোয় যা দেখেছি, যা পেয়েছি,তাই আপনাদের সাথে আজ ভাগ করে নেবো।




সৃষ্টিপ্রকরণ আলোচনায় মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত প্রথমেই


বলছেন : "প্রথমে একমাত্র ঈশ্বর ছিলেন"। আসলে উঁনি এর আগে ঈশ্বর সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তাই এখন বলছেন প্রথমে একমাত্র ঈশ্বর ছিলেন।






আমরা, আমাদের বোঝার সুবিধার জন্য, ঈশ্বর থেকে শুরু না করে, এই আলোচনটা "আমি" থেকে শুরু করতে চাই। আমি কে ? কোথা থেকে এলাম, এটা যদি বুঝতে পারি তবে সৃষ্টির রহস্যটাও আমাদের বোধগম্য হবে। "আমি" যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে দুটো রাস্তা গেছে। একটা হচ্ছে, আমি কোথায় যাবো ? আর একটা হচ্ছে আমি কোথা থেকে এসেছি ? প্রশ্ন দুটো - উত্তর কিন্তু একটাই -অর্থাৎ আমি যেখান থেকে এসেছি, সেখানেই ফিরে যাবো। একটা হচ্ছে ভবিষ্যৎ, আর একটা হচ্ছে অতীত। ভবিষ্যৎ-তো, কল্পনা। সেখানে সত্য কোথায় ? কিন্তু অতীত-তো কল্পনা নয়। এক সময়ের বর্তমানই আজকের অতীত। তাহলে অতীতকে জানবার জন্য আমরা একটু অতীতের পাতা ওল্টাই।


আমার এই রক্ত মাংসের শরীর। প্রতিদিন পরিবর্তন হচ্ছে। আজকের আমি আর ৫০ বছর আগের আমি এক নোই। কিন্তু তখনও আমি ছিলাম, এখনো আমি আছি। এই শরীর এক সময় মায়ের পেটে ছিল। মায়ের পেটে এলো কোত্থেকে ? বাবার শুক্র আর মায়ের ডিম্বাণু। X Y ক্রোমোজমের মিশ্রনে এই শরীর । এই X Y এলো কোথেকে ? খাদ্যকণা বা অন্ন থেকে। খাদ্যকণা কিসের তৈরী ?

খাদ্যকণা পঞ্চভূতের তৈরী। এই পঞ্চভূতটা কি ? পঞ্চভূত হচ্ছে - ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম।


গুরুদেব বলছেন : এই পঞ্চভূতটা একটু ভালো করে বোঝার দরকার। তত্বজ্ঞানের উপাসনা খন্ডে ১২৫ পাতায় গুরুদেব বলছেন :

"ব্যোম হইতে পরমপুরুষ-যোগে বায়ু, ঐ রূপে বায়ু হইতে তেজঃ, তেজ হইতে জল অর্থাৎ তরল পদার্থ, তরল পদার্থ হইতে ভূমি অর্থাৎ কঠিন পদার্থ উৎপন্ন হইলো। পরে ব্যোমাদি ভূতপঞ্চক পঞ্চীকৃত হইল। এই পঞ্চীকৃত পঞ্চভূত হইতেই জড় জগতের সৃষ্টি হইয়াছে।"


এবার আমরা ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম এই পঞ্চভূতের তত্ব সন্মন্ধে আলোচনা করবো। পরে আমরা পরমপুরুষের কথায় যাবো।


আমরা আগে দেখেছি অন্ন বা খাদ্যকনা থেকে আমাদের সৃষ্টি। অন্ন অর্থাৎ খাদ্য এসেছে ঔষধি অর্থাৎ গাছপালা থেকে। ঔষধি অর্থাৎ গাছপালা আমরা কোথায় দেখি ? ক্ষিতি অর্থাৎ মাটি বা পৃথিবীতে। অর্থাৎ ক্ষিতি থেকেই ঔষধি অর্থাৎ গাছপালা আদি সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষিতি অর্থাৎ পৃথিবী বা মাটি এসেছে কোথেকে ? অপ অর্থাৎ জল থেকে। অপ অর্থাৎ জল বা জীবন এসেছে কোথেকে ? তেজ থেকে বা উত্তাপ আলোক। উত্তাপ বা আলোক এসেছে কোথেকে ? মরুৎ অর্থাৎ বায়ু বা বাতাস থেকে। মরুৎ এসেছে কোথেকে ? ব্যোম অর্থাৎ আকাশ বা শুন্য থেকে। আকাশ বা শূন্য অর্থাৎ ব্যোম এসেছে কোত্থেকে ? নির্গুণ আত্মা বা অব্যক্ত অব্যয় থেকে।


তাহলে আমরা দেখলাম পঞ্চ তত্ব থেকে সৃষ্টি সম্পাদিত হয়েছে। এই পাঁচ তত্বের উপরে যে তত্ত্ব তিনিই পরমপুরুষ। আর পঞ্চভূতের একীকৃত সমষ্টিই চৈতন্য। চৈতন্যই ভগবানের সত্তা।


এবার আমরা পঞ্চভূতের গুনের ও তার সৃষ্টির কথা আলোচনা করবো।


ব্যোম : অর্থাৎ আকাশের একটা মাত্র গুন্। - শব্দ - ইনি কারো আশ্রয়ীভূত নহেন। এনাকে আশ্রয় করে সবাই থাকেন। আকাশ বা ব্যোম থেকেই কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, লজ্জ্বা, প্রভৃতির সৃষ্টি ও অবস্থান। আকাশের স্থিতি আমাদের কর্নে অর্থাৎ আকাশের যে গুন্ - শব্দ, তা আমরা কান দ্বারাই উপলব্ধি করতে পারি।


মরুৎ (বাতাস) : শব্দ, স্পর্শ এই দুটি মাত্র গুন্। । ধারণ, চালন, ও সঙ্কোচ, প্রসারণ, ক্ষেপন ইহাই বায়ুর সৃষ্টি। বায়ুর যে গুন্ শব্দ-স্পর্শ তা আমরা ত্বক বা চামড়া দ্বারা উপলব্ধি করতে পারি।


তেজ (আলোক) : শব্দ, স্পর্শ, রূপ এই তিনটি গুন্ । ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, আলস্য এগুলো তেজের সৃষ্টি। তেজ বা আলোক-এর যে গুন্ রূপ তা আমরা চক্ষু দ্বারা উপলব্ধি করতে পারি।


অপ (জল): শব্দ, স্পর্শ,রূপ, রস। শুক্র, শোণিত, মল, মূত্র,মজ্জা, প্রভৃতি জলের সৃষ্টি। জল বা রস আমরা জিহ্বা আমরা উপলব্ধি করতে পারি।


ক্ষিতি(মাটি) : শব্দ,স্পর্শ,রূপ, রস , গন্ধ। অস্থি, মাংস, নখ, রোম, চর্ম প্রভৃতি পৃথ্বী থেকেই সৃষ্টি। মাটি বা পৃথিবীর স্থিতি নাসিকায় বা নাকে, অর্থাৎ পৃথিবীর যে বিশেষ গুন্ গন্ধ তা আমরা নাক দ্বারা উপলব্ধি করতে পারি।


পঞ্চভূত-ই সৃষ্টির মূল, মধ্য, শেষ। ইহাই ভগবানের বিভূতি, এর সংযোগেই চৈতন্য, আর বিয়োগেই মৃত্যু।


এই পঞ্চভূত যখন একত্রিত হয় তখন তিনটি গুনের সমাবেশ হয়। যার জন্য গুরুদেব বলছেন : প্রকৃতি ত্রিবিধ গুন্ সম্পন্না। সত্ত্ব, রজ, ত্বম।

গুরুদেব বলছেন : সত্ত্বগুণ সুখাত্বক, স্বচ্ছ, লঘু, ও প্রকাশক। রজোগুন দুঃখাত্মক, চঞ্চল ও চালক (প্রবর্তক) । তমোগুণ মোহাত্মক, গুরু, আবরক ও নিয়ামক।


এই ত্রিগুণের সমন্বয়েই অহংবোধের সৃষ্টি। এই অহংবোধই আবরণ। যা সত্যিকারের অামিকে বা পরমাত্মাকে ঢেকে রেখেছে।


এবারে আমরা আরো গভীরে প্রবেশ করবো, অর্থাৎ পরমাত্মাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করবো।


প্রথমে বলি, পরমাত্মাকে জানার জন্য কোনো পূর্বসঞ্চিত জ্ঞান নিয়ে এগোনো যায় না। তাহলে যাকিছুই আপনি দেখবেন তাতে আপনার জ্ঞানের প্রতিফলন ঘটবে। এটির জন্য আপনাকে ধ্যানস্থ হতে হবে। আমি দেখিয়ে দেব আর আপনি দেখবেন, এমনটা হয় না। পরম-আত্মাকে জানা যায় না শুধু মিলে যেতে হয়। শুধু এক হয়ে যেতে হয়। এসব কথা বলা যায় না। বলা মানে বিচ্ছিন্ন হওয়া।


মহর্ষি অষ্টাবক্রর দুই একটা শ্লোক না বলে পারছি না।


মহামুনি অষ্টাবক্র বলছেন : ন পৃথ্বী - ন জলং – ন অগ্নিঃ – ন বায়ুঃ – ন দৌঃ বা ভবান্। আমি পৃথিবী বা মাটি নই - আমি জল নই - আমি অগ্নি নই - আমি বায়ু নই - আমি আকাশ নই। তা হলে আমি কে ? উনি বলছেন : এষাং সাক্ষিনম্ আত্মানং চিদ্রূপং(চিৎ -রূপম) বিদ্ধি মুক্তয়ে। অর্থাৎ আমি একজন সাক্ষী, আমার নাম আত্মা, আমি চৈতন্য স্বরূপ - আচার্য বলছেন মুক্তি লাভার্থে তুমি এইরূপ বোধ করো। বোধ করা কি এতই সোজা ? কষ্টকল্পনা করা যায় মাত্র, তার বেশি নয়। আমার স্বরূপ হচ্ছে চৈতন্য। চৈতন্য আবার স্বরূপ হয় নাকি? চৈতন্য হচ্ছে একটা উপলব্ধির নাম মাত্র। তার আবার স্বরূপ কি ? চৈতন্য যদি আমার স্বরূপ হয় তাহলে তার আবার মুক্তি কি ? চৈতন্যতো সর্বত্র-সর্বদা মুক্ত।


শ্লোক নং (১২) তে অষ্টাবক্র মুনি বলছেন :


আত্মা সাক্ষী বিভুঃ পূর্ণ একো মুক্তঃ চিৎ অক্রিয়ঃ

অসঙ্গো নিঃস্পৃহঃ শান্ত ভ্ৰমাৎ সংসারবান ইব.


- আত্মা স্বভাবতই সাক্ষী, বিভু,পূর্ণ, মুক্ত চৈতন্য স্বরূপ , অক্রিয় , অসঙ্গ, নিস্পৃহ ও শান্তস্বরূপ। ভ্ৰম বশতঃ সংসারবান মনে হয়।


আত্মা সাক্ষী। আত্মার স্বভাবই সাক্ষী যেমন। অর্থাৎ উনি কিছু করেন না। শুধু দেখেন। উনি বিভু, উনি পূর্ণ। উনি মুক্ত। উনিই চৈতন্য স্বরূপ। কোনো কাজ করেন না। কোনো সঙ্গী সাথী নাই। উনি স্পৃহ নন, শান্ত, ভুল বসত তাকে সংসারে সংসারবান মনে হয়।





চলুন অন্য কথা বলি। গুরুদেব বলছেন : পঞ্চভূতের পঞ্চ সত্ত্বাংশ দ্বারা জ্ঞান-ইন্দ্রিয় পঞ্চকের উৎপত্তি হয়েছে। রজ গুনাংশ দ্বারা কৰ্মইন্দ্রিয় পঞ্চকের উৎপত্তি হয়েছে।


অর্থাৎ পাঁচটি জ্ঞান ইন্দ্রিয় : চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক - এই পাঁচটি জ্ঞান ইন্দ্রিয় পঞ্চভূতের পঞ্চ শতাংশ দ্বারা উৎপত্তি হয়েছে । আর পাঁচটি কর্মেইন্দ্রিয় অর্থাৎ বাক্, পাণি, পাদ,পায়ু, ও উপস্থ - এগুলির উৎপত্তি হয়েছে রজ গুনাংশ দ্বারা।


জ্ঞান ইন্দ্রিয় :

চোখ - ইনি রূপ, আকৃতি প্রভৃতি গুন্ জ্ঞান করেন।

কান - যিনি শব্দাদি গুন্ জ্ঞান করেন।

নাক - যিনি সুগন্ধ, দুর্গন্ধাদি গুন্ জ্ঞান করেন।

জিভ - ইনি তিক্ত, মিষ্টাদি গুন্ জ্ঞান করেন।

চামড়া - ইনি শীত, উষ্ণাদি স্পর্শগুন জ্ঞান করেন।


কর্ম ইন্দ্রিয় :


বাক্ - যিনি কথা বলেন।

হাত - যিনি দ্রব্যাদি ধারণ করেন।

পা - যিনি গমনাগমন করেন।

পায়ু - যিনি মলাদি ত্যাগ করেন।

উপস্থ - যিনি শুক্র, মূত্রাদি ত্যাগ করেন।


অন্তঃকরণ :


গুরুদেব বলছেন : পঞ্চভূতের সত্বাংশ ও রজো-অংশ দ্বারা উপরের দশটি বাহির-ইন্দ্রিয়ের উৎপত্তি হয়েছে বটে, কিনতু ওই সত্বাংশ-সমূহ দ্বারা সমষ্টি-ভাবে অন্তঃকরণ উৎপন্ন হয়েছে। এই অন্তঃকরণ চার ভাগে বিভক্ত। মন, বুদ্ধি, অহংকার, চিত্ত। বুদ্ধি নিশ্চয়াত্মিকা,মন সংশয়াত্মক, অহংকার দর্প বিষয়ক, চিত্ত স্মরণ বিষয়ক।


প্রাণ :


গুরুদেব বলছেন : পঞ্চভূতের সমষ্টি ভাবে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে। যথা - প্রাণ, অপান, সমান, উদ্যান, ব্যান . এদের অবস্থান সম্পর্কে গুরুদেব বলছেন : প্রাণ থাকে হৃদয়ে। অপান থাকে মলদ্বারে। সমান থাকে নাভি দেশে। উদ্যান থাকে কণ্ঠদেশে। এবং ব্যান সর্ব শরীরে অবস্থান করে।


এরপর গুরুদেব বলছেন : শরীর ত্রিবিধ । স্থুল শরীর, সুক্ষ শরীর, ও কারণ শরীর। স্থুল শরীর প্রত্যক্ষ করা যায়। ভোগের নিমিত্ত এই স্থুল শরীর। স্থুল শরীর সূক্ষ শরীর থেকে উৎপন্ন। সূক্ষ শরীর কারন শরীর থেকে উৎপন্ন। ক্রিয়া বা কর্ম-শক্তি হতে সূক্ষ শরীর। সূক্ষ শরীরের অপর নাম লিঙ্গ শরীর। জ্ঞান শক্তি থেকে কারন শরীর।


আমার যা মনে হয় : গুরুদেব বলছেন শরীর ত্রিবিধ। আমার মনে হয় - এই স্থুল শরীরের সঙ্গে অনেক সূক্ষ শরীর আছে। এদের মধ্যে যে সবচেয়ে কাছে আছে তার গভীরতা সবচেয়ে বেশী। এদের

রঙ-ও আছে। কিনতু এদের অস্তিত্ব স্থুল শরীরকে ঘিরে। স্থুল শরীরের অবসানে এরা মিলিয়ে যায় । এরা আমাদের কাছাকাছি সর্বক্ষণ থাকে, কারণ এরা আমাদের থেকে খাদ্য বা রস সংগ্রহ করে। এরা অন্ধকারে স্পষ্ট হয়। আলোতে মিলিয়ে যায়, বা গভীরতা কমে যায়। তাই গভীর ধ্যানে থাকলে, আস্তে আস্তে দেহ হালকা হতে থাকে। এবং ধীরে ধীরে দেহবোধ চলে যায় তখন এদের উপস্থিতি টের পাওয়া করা যায়। কখনো কখনো ধ্যানমগ্ন ব্যক্তিকে ঘিরে যে জ্যোতির আভা দেখা যায়, সেটা এই সুক্ষ শরীর। এটা আমার অনুভব, কোনো কল্পনা নয়। প্রত্যক্ষ অনুভব লব্ধ সত্য। অসুবিধা হচ্ছে, এটা আমি ইচ্ছা করলেই অনুভব করতে পারি না। কোনো কোনো দিন এটা হয়, আমি না চাইতেই হয়। তখন দেহবোধ থাকে না। নিজেকে হালকা মনে হয়। তবে অহং বোধ থাকে। তাই বলছিলাম - দেহ ত্রিবিধ নয় - অনেক, রূপ কিনতু দেহের আকৃতির মতোই। রং অনেক। এটা আয়নাতেও দেখা যায় বা ধরা পরে। অবশ্য এর সঙ্গে পরম আত্মার কোনো সম্পর্ক নেই।










































Wednesday 19 July 2017

সত্যধর্ম - একজন কৌতূহলীর দৃষ্টিতে


সত্যধর্ম - একজন কৌতূহলীর দৃষ্টিতে 


সত্যধর্মের প্রবর্তক মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত। পিতা রামনাথ সেনগুপ্ত, মাতা গৌরী দেবী, অর্থাৎ বৈদ্য ব্রাহ্মণ। 
জীবনের অভিজ্ঞতায় যাদের আমি দূরের মানুষ মনে করি। এদের কুটিল  জ্ঞানের প্রভাবে, ভারতের জনসংখ্যার মাত্র  ১৫% হওয়া সত্বেও ৮৫% ভাগ সম্পদের অধিকারী। এরা  আমাদের পূর্বপুরুষদের  বঞ্চিত করেছে। এদের আমরা গুরু হিসেবে চাই, কিনতু  এরা আমাদের শিষ্য হিসেবে চায় না। একলব্য চেয়েছিলো কিনতু দ্রোণাচার্য্য চায় নি। তাই ব্রাম্মণদের সংগঠন থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলি।
সুতপার সঙ্গে  বিয়ে হওয়ার পর জানতে পারলাম, আমার স্ত্রী মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্তের প্রবর্তিত সত্য-ধৰ্মের সন্যাসীদাদার (হরিশ চন্দ্র বিশ্বাস) কাছ থেকে দীক্ষিত । মেনে নিতে পারিনি। বাড়িতে কৃষ্ণমন্দির। বাড়িতে কৃষ্ণা পূজা হয়। শ্বশুরবাড়িতে মহাত্মাগুরুনাথের ছবির সামনে  ১-টাকা (অর্থাৎ ১৬ আনা) দিয়ে, বললাম, তোমার শিষ্যা ডলি-কে আমাকে দিয়ে দাও। কিছু মনে করো না।
না কোনো ধৰ্মগুরুর প্রতি আমার বিরূপতা নেই। জানবার আগ্রহ আছে। কে কি বলছে সেটা জানবার চেষ্টা করি। সে আগ্রহ থেকেই
মহাত্মা গুরুনাথের লেখা "সত্য-ধৰ্ম" ১৯৯৫ সালে প্রথম পড়ি। এর পর তত্ত্বজ্ঞান-সাধনা ও তত্ত্বজ্ঞান -উপাসনা, এবং আরো কিছু বই ভক্তদের লেখা - আমার পড়বার সুযোগ হয়। না তাতে যে আমার কিছু পরিবর্তন হয়েছে তা নয়।  
বাড়িতে আমার শাশুড়ীমায়ের  উদ্যোগে উপাসনা হয়েছে।  উপাসনা গুলি আমার ভালো লেগেছে। এই পর্যন্তই। 

 মহাত্মা গুরুনাথের জীবনী পরে আমার মনে হয়েছে, দেহধারী গুরু ছাড়াও, সাধনা হয়। মহাত্মা গুরুনাথতো পেরে ছিলেন। মহাত্মাগুরুনাথের প্রতি আমার প্রথম আকর্ষণ এখানে। 

মহাত্মা গুরুনাথের বাবা ছিলেন ব্রাহ্মণ কবিরাজ। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঔষধ, এক অর্থে ফেরি করতেন। খুবই গরিব। ধার্মিক ছিলেন কিনতু  গোড়া ছিলেন - এমন কথা কোথাও পাইনি।  -  গ্রহণযোগ্যতার দ্বিতীয় দিক। 

মহাত্মা গুরুনাথ বিয়ে করেন বরিশাল জেলার শৈলা গ্রামের রামচন্দ্র দাসের কন্যা আদরিনী  দেবীকে । দাস নিশ্চই ব্রাহ্মণ নয়।  অতএব ধরে নিতে পারি এঁরা গোড়া ব্রাহ্মণ  নয়। - তৃতীয় দিক 

মহাত্মা গুরুনাথের জীবনীতে পাই (পৃ ৩০৬) : 

"সহসা তাহার সমস্ত ইন্দ্রিয়, প্রাণ মন চকিত হইয়া উঠিল  -  সম্মুখে তিনি ইসলাম ধৰ্ম প্রবর্তক মহাপুরুষ মহম্মদকে দেখিতে পাইলেন এবং তাহাকে অমৃতায়মান  বচনে বলিতে শুনিলেন - সত্বর প্রস্তূত হও, অনতি  বিলম্বে  তোমার নিবিড় অভীষ্ট পূর্ণ হইবে। ক্রমে  আরো বহু অত্যুন্নত সাধক সাধিকাকে দর্শন করিলেন। ......তখন বাংলা ১২৯৫ সালের বৈশাখ মাস, ইংরেজি ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দ।" এটা যদি সত্যি হয় তবে তার ধর্মের সংকীর্ণতা নেই - এ কথা ভাবতেই পারি।  -  চতুর্থ দিক 

দীক্ষা দানের বীজ মন্ত্র বৈজিক  ভাষায় লেখা।  এই ভাষাতেই নাকি পশু পাখিরা কথা বলে।জানিনা এই ভাষা জানার কোনো উপায় আছে কি না।  - এটা  আমাকে আকর্ষণ করে। 

গুরুকরন পদ্ধতি : আমরা সাধারণত জানি, গুরু মানেই নমস্য, তিনি বিচারের উর্দ্ধে - সাক্ষাৎ ভগবানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করেন।  গুরুবাক্য অলংঘনীয়।গুরুই  ব্রহ্মা,বিষ্ণু, মহেশ্বর। মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন :পারলৌকিক মহাত্মারাই এই ধর্মের প্রচারক। সুতরাং তাহারাই এই ধর্মের দীক্ষা দাতা। তবুও প্রচলিত পদ্ধতির মতো এখানেও গুরুবাদ স্বীকৃত। এখানে নাকি দীক্ষাদানের পদ্ধতি অদ্ভুত।  এখানে গুরুর মধ্যে অহংভাব থাকবে না আমিত্ববোধ থাকে না ।  গুরু-শিষ্যের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ভাব বজায় রাখতে হয়। 
এখানে - দীক্ষাদানের সময়,দীক্ষার্থীর করযুগল, গুরু তার নিজ করে ধারণ করে প্রেম, ভক্তি, শ্রদ্ধা সহকারে দীক্ষাদাতা (গুরু) বলবে যে, : হে অসীম, অনন্ত গুণধাম প্রভু দয়াময় পিতা ! আজ থেকে আমার সহোদর প্রতিম অমুককে   তোমার পথাবলম্বী হতে ব্যাকুল অন্তঃকরণে যাচ্ঞা করাতে, তাকে তোমার চরণে সমর্পন করলাম। " এর পর পরস্পর পরস্পরের হাতে চুম্বন করবে। - জানিনা এতে শিষ্যের অহমিকা যায় কি না, কিনতু  গুরুকে যে অহমিকা শূন্য হতে হবে এটা পরিষ্কার।  

গুরু সম্পর্কে আর একটা কথা বলা আছে -  গুরুকে জ্ঞানের দিক থেকে কুলীন হতে হবে, অর্থাৎ পঞ্চভূত,প্রকৃতি তত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, কাল ও দিক প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। 

এই সত্য-ধর্মে আর একটা নতুন দিক আছে। ইহলোকের অর্থাৎ পৃথিবীর বাইরে পরলোকের অবস্থান।  এটাকে অধিকাংশ লোক কল্পনা বলে। সত্যধর্ম বলছে ইহলোকে অবস্থান  করেও, পরলোকে যাওয়া সম্ভব।  সেখানকার তথ্যাদি জানা যেতে পারে। 

সত্যধর্ম উপাসনা ভিত্তিক। উপাসনার প্রথম পর্যায়ে গান যাকে ঈশ্বরের  গুনকীর্তন বলা হয়। গুণকীর্তনের পর পরম পিতার কাছে পাপ স্বীকার। এটি খ্রিস্টীয় ধর্মের মতো মনে হয়। এর পর ঈশ্বরের
 কাছে  প্রার্থনা।

সত্য-ধর্মে গুন্ সাধনা অন্যতম। গুন্ বলতে : প্রেম, একাগ্রতা,আকুলতা, শুদ্ধ ভক্তি।  এগুলোর সাধনা দ্বারা নিজের উন্নতি সাধন। ভক্তির কথা বলতে প্রথমে  মা, বাবা, তারপরে গুরু বা দীক্ষা গুরু, এর পর উন্নত আত্মাদের প্রতি ভক্তি।  এটাই গুন্ সাধনা। 
শেষ করছি আবার জাতের কথা দিয়ে।  তথাকথিত ব্রাহ্মণদের মধ্যে এই ধর্মের প্রাধান্য নেই।  তার কারন মহাত্মা গুরুনাথের প্রথম ও প্রধান শিষ্য মহাত্মা নিবারণ চন্দ্র পাণ্ডে, যিনি নমঃশূদ্র। এই নমঃশুদ্ররাই এই সত্যধর্মের ধারাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এমন কি ও শুনেছি, মহাত্মা গুরুনাথের  অনেক বংশধররাও এই ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী নয়, অবশ্যই  সব বংশধররা নয়। বাড়িতে একটা ছবি টাঙিয়ে রেখেছে এই মাত্র।

সবশেষে যে কথাটা মনে আসে সেটা হলো, স্রষ্টাকে-তো ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করতে পারি না।  তার সৃষ্টিকে পারি। যার সৃষ্টি এতো সুন্দর না জানি সে কত বড়ো শিল্পী আরো কত সুন্দর। সত্য-ধর্মের সৎ-সতীদের দেখে মনে হয় মহাত্মা গুরুনাথের মৃত্যুর ১০০ বছর  পরেও আপনারা যে ভাবে তার আদর্শকে সামনে রেখে, প্রেম ভালোবাসা বিলিয়ে চলছেন তা আমাকে আপ্লূত করে, আপনাদের দেখে আমার ভালো লাগে।  
পরম পিতা পরমেশ্বরকে  প্রণাম করি।  সমস্ত উপস্থিত মহাত্মাকে আমার শ্রদ্ধা জানাই।     

সমাপ্ত  (১৯/০৭/২০১৭)