Wednesday 29 August 2018




সর্ব ধর্ম্নান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। 

অহং ত্বাং সর্ব্বাপাপেভ্যো  মোক্ষয়িষ্যামি  মা শুচঃ। (১৮/৬৬)

ভগবান  শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে  বলছেন :
তুমি আমাগত চিত্ত হও। আমাকে ভক্তি করো। আমার পূজা করো।  আমাকে নমস্কার করো। তাতে আমার প্রসাদে আমাকেই প্রাপ্ত হবে। তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়। সে জন্য তোমার কাছে আমি সত্য অঙ্গীকার করছি যে, অবশ্যই তুমি আমাকে পাবে। 

তুমি সকল ধৰ্ম ত্যাগ করে একমাত্র আমারি শরণাপন্ন হও, আমি তোমার সকল পাপ মুক্ত করবো। 

সর্ব ধর্ম্নান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। 

অহং ত্বাং সর্ব্বাপাপেভ্যো  মোক্ষয়িষ্যামি  মা শুচঃ। (১৮/৬৬)

আমার ভিতরে  প্রশ্ন জাগে, অৰ্জুন কি ভগবান কৃষ্ণের প্রতি নিজেকে সমর্পন করেছিলো ? যদি করে থাকে তবে কি তার সব পাপের ভার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে ছিলেন ? অর্থাৎ  অৰ্জুন কি পাপমুক্ত অবস্থায় মৃত্যুর পরে, স্বর্গে গিয়েছিলো ? 



অর্জুন কি গীতার উপদেশ বুঝেছিলো ? তাতে কি তার উন্নতি হয়েছিল ? অর্জুন ছাড়া অন্যান্য যারা শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলে শ্রদ্ধা ভক্তি করতো, তাদের দশা কি হয়েছিল ?

এতদিন ধরে আমার ধারণা ছিলো - ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সব ধর্মমত অর্থাৎ হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলিম, জৈন, শিখ ইত্যাদি সব মত ছেড়ে শ্রীকৃষ্ণের পায়ে সমর্পন করো।  তবে তিনিই সব দায়িত্ব নেবেন। সমস্ত পাপ থেকে আমাদের মুক্তি দেবেন। এখন মনে হয় ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। 


তাহলে ব্যাপারটা কি ? 
প্রথমতঃ এখানে অর্থাৎ সমগ্র গীতাতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গুরুদের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। এবং অর্জুন তার শিষ্য। সাধারণত আমাদের সবার মধ্যেই একটা মান্যতা থাকে, যা আমাদের পূর্বের জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্চয় করি। আমার এই মান্যতার বিরুদ্ধে যখন কেউ কোনো কথা বলে তখন সেটা আমাদের সংস্কারে আঘাত করে।  এবং আমরা বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে আমার সে বিশ্বাসকে বাঁচাতে চেষ্টা করি। নতুন কোনো কিছু আমরা গ্রহণ করতে চাই না। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, তুমি গুরুদেবের স্মরণ নাও।  অর্থাৎ আমার কথা মতো চাল। তোমার ভেতরে যে পূর্ব সংস্কার আছে সে সব ধুয়ে মুছে আমার অর্থাৎ গুরুদেবের স্মরণ নেও। তুমি যদি তোমার পূর্ব সংস্কার আঁকড়ে থাকো, তবে তুমি সত্যে পৌঁছতে পারবে না। আসলে গুরুদেবের  কথার  প্রতি তোমার যদি সন্দেহ থাকে তবে তার কাছ থেকে তুমি কিছুই নিতে পারবে না। এই জন্য ভেতরটা খালি করে তবে গুরুদেবের কাছে যাও।  তাঁর কথা শোনো তার কথা অনুযায়ী কাজ করো।  গুরুদেব  যদি সৎ গুরু হয়, অর্থাৎ গুরুদেব যদি স্বয়ং ব্রহ্মজ্ঞানী  হন তার কথায় তোমার সম্পূর্ণ আস্থা রাখা উচিত।  তুমি বিভিন্ন কথা শুনে, বা বই পড়ে যে জ্ঞান সংগ্রহ করেছো, তা তোমাকে সত্যে পৌঁছেতে বাঁধা দিতে পারে। অতএব সব ছেড়ে গুরুর স্বরণাপন্ন হও।  এবং মুক্তির আস্বাদ গ্রহণ করো।

সব ধৰ্ম ছেড়ে দাও। অর্থাৎ তোমার ভেতরে পূর্বসঞ্চিত জ্ঞান সংস্কার পরিত্যাগ করো। তবেই তুমি গুরুপ্রদত্ব জ্ঞান গ্রহণ করতে পারবে।  নতুবা কিছুই হবে না। তাই গুরুদেব শ্রীকৃষ্ণ বলছেন : "সর্ব ধর্ম্নান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।"
   
দ্বিতীয়তঃ : জগতে ধর্ম্ম একটাই। আর সেটা হচ্ছে প্রকৃতির ধর্ম্ম। আর এই ধর্ম্ম সর্বত্র এক। সূর্যের কাজ আলো বিকিরণ , মেঘের কাজ  জল বিতরণ, এটা সর্বত্র সব কালে এক। ঈশ্বরও এক। কথাটা লক্ষ করুন "মামেকং" . অর্থাৎ আমি এক। কেউ কেউ এটাকে ব্যাখ্যা করেছেন মামেকং মানে  একমাত্র আমাকে অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে । আমি মনে করি, আমার স্মরণে এস মানে সেই একের স্মরণে যাও যা আমি। অর্থাৎ "আমির" স্মরণে যাও ।  অর্থাৎ নিজেকে স্মরণ করো।  তুমি কে তা বুঝতে চেষ্টা করো। এক মাস্টারমশায় ছাত্রকে ইংরেজি শেখাচ্ছেন।  MY HEAD  মানে আমার মাথা।  ছাত্র বলছে, মাই হেড মানে মাস্টার মশায়ের মাথা। শিক্ষক যত বলছেন MY HEAD  মানে আমার মাথা, ছাত্র তাতো বলছে MY HEAD  মানে মাস্টার মশায়ের  মাথা। শেষে শিক্ষক রেগে রেগে বললেন ময় হেড মানে তো মাথা। তো যেমন ছাত্র তেমন বোঝে আরকি। 


একবার ভাবুন তো , "আমি" যদি শ্রীকৃষ্ণ হয়, বা অন্য কেউ হয়, তবে সেটা তুমি হয়ে যাবে। আমি থাকবে না। আমি-তুমি বলে আসলে  কিছু নেই।  সবই  এক।  সেই একের স্মরণে যাও।  গভীর গুহ্যকথা রয়েছে এই শ্লোকটিতে। পন্ডিতেরা যেমন আমাদের বুঝিয়েছেন, আমরা তেমন বুঝেছি।  সেই মতো দেহধারী যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে আমরা পুজোপাঠ শুরু  করেছি। আমরা সবাই বৈষ্ণব বা বিষ্ণুর ভক্ত হয়ে পাপমুক্ত হতে চাইছি। এটা নিজেকে ধোঁকা দেওয়া ছাড়া কিছু নয়।  আসলে আমি তুমি বলে কিছু নেই। আমি তুমি বোধ লোপ না পেলে সেই একের সাথে মেলা যাবে না। একই বা বলবো কেন ? এক থাকলে তো দুই থাকে। দুই থাকলে এক থাকে। সেই তুলনারহিত তিনি অদ্বিতীয়।  দ্বিতীয় নাস্তি। সবই  তিনি। আসলে ভগবানের এই শ্লোকে স্মরণাগতির  কথা বলা হয়েছে। সেই পরমপিতা পরম-ঈশ্বরের স্মরণাগতির কথা বলা হয়েছে। মন বুদ্ধির উপরে উঠে একমাত্র ভগবানের স্মরণ নাও। সমস্ত জাগতিক সুখ দুঃখের উপরে যেতে চাইলে স্মরণাগতিই একমাত্র উপায়। 

দেহধারী কৃষ্ণ আসলে এক নাট্যমঞ্চের অভিনেতা।  তিনি ভগবানের অভিনয় করছেন। আমরা নাট্যমঞ্চের অভিনেতাকে যদি সত্যিকারের রাজা ভাবি তবে ব্যাপারটা খুব মজার হবে। অবশ্য ভারতবর্ষে এটাই চলছে। রাবনের চরিত্রে যিনি অভিনয় করছেন তিনি ব্রাত্য।  আর রামের চরিত্রে যিনি অভিনয় করছেন তিনি নমস্য। বিচিত্র এই দেশ। খেয়াল করুন ভগবান বলছেন সর্ব ধর্ম্মান  পরিত্যজ্য - অর্থাৎ সব ধর্ম্মকেই ত্যাগ কর।  ধর্ম্ম টর্ন্ম দিয়ে কিছু হবে না। সব কিছু ত্যাগ করে আমি ব্যাটাকে ধর । যে তোমাকে দিয়ে পাপ করাচ্ছেন । যিনি পাপ করাচ্ছেন তিনিই বিমোচন করতে পারেন। আমিকে ধরলেই অহং অর্থাৎ আমি পালাবে। সেদিন তুমি পাপ-পূন্যের উর্দ্ধে বৃহতে লয় হবে। অদ্ভুত এই শ্লোক। বিরল এই কথা। মহামুনি  ব্যাসদেবকে নমস্কার।