Monday 4 January 2021

অজপা গায়ত্রী জপ

 


অজপা গায়ত্রী জপ।

যাকিছু গায়ককে  ত্রাণ  করে, তাকেই বলে গায়ত্রী। আমাদের একটা সাধারণ ধারণা আছে, যে গায়ত্রী মন্ত্র বলতে প্রচলিত সাবিত্রী মন্ত্র বা ওম-ভূর্ভুবঃ স্বাহা তৎ সবিতুৰ বরেণ্যম। ...ইত্যাদি ইত্যাদি - একমাত্র মন্ত্র। আসলে সরস্বতী গায়ত্রী, গনেশ গায়ত্রী, প্রভৃতি বিভিন্ন দেবতার গায়েত্রী মন্ত্র আছে। যাইহোক, গতিশীল সমস্ত কিছুর একটা ধ্বনি আছে। এই ধ্বনি  সৃষ্ট হয়, বাতাসের সংস্পর্শে এসে। এমনকি বাতাসও  যখন গতিশীল হয়, তখনও একটা শব্দ তরঙ্গ  সৃষ্টি করে। তাই আমরা ঝাউ বনে দাঁড়িয়ে একটা শো-শো শব্দ শুনতে পাই। ঝড়ের সময় একটা শব্দ শুনতে পাই। 

আমাদের  জীবন গাড়িও  চলছে। সেই কবে কান্না দিয়ে শুরু করেছিলাম, আজো সেই গাড়ি চলছে, তার নিজস্ব গতিতে। এই চলার যেমন  একটা নিজস্ব গতি আছে, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটা গতিপথ আছে, তেমনি আছে, তার নিজস্ব ছন্দ, আছে নিজস্ব ভঙ্গি, আছে জীবনের গান। গান গাইতে গাইতে মাঝি নদী পার হচ্ছে। ছলাত ছলাত শব্দে মাঝির হাতের বৈঠা জলের সঙ্গে খেলা করছে। এই বৈঠা থেমে  গেলে নৌকা গতি হারিয়ে দিকশুন্য হয়ে যায়। আমরাও  যখন এই স্থূল শরীর নামক নৌকাটির সাহায্যে জীবন নদী বেয়ে চলেছি, তখন শ্বাসের বৈঠায় ঝঙ্কার তোলে।  একটু স্থির হয়ে কান পাতলে সেই মধুর ঝঙ্কার আমরা শুনতে পারি। মাঝির গানের সুরে, বৈঠা ও জলের মিলনে যে মধুর ধ্বনি তা হারিয়ে যায়। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই সেই শব্দ আমরা শুনতে পাই। ঠিক তেমনি   আমাদের  শ্বাসের বৈঠার সাহায্যে যে সুর তৈরী হচ্ছে, সেটি মধুর ঝংকার একটু খেয়াল করলেই শুনতে পাই। মাঝি মনের শান্তির জন্য,  অনেক ধরনের গান গায়,  আমরাও মনকে স্থির করবার জন্য অনেক গুরুপ্রদত্ব  বীজমন্ত্রের জপ করি। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই আমরা শুনতে পাবো, আমাদের মধ্যে অনবরত একটা মধুর বীজমন্ত্রের ধ্বনি ঝংকৃত হচ্ছে। এই মন্ত্রের একটা হচ্ছে ওম বা প্রণব, আর একটি হচ্ছে হংস বা উল্টো করলে হয় সোঽহং।  

আমরা একটু চেষ্টা করে, স্বতঃস্ফূর্ত এই অশ্রুতপূর্ব ধ্বনি শ্রবণ করে অপার্থিব আনন্দ উপভোগ করতে পারি। এমনকি  এই অজপা জপের সাহায্যে সাধকের ব্রহ্মজ্ঞান লাভও হতে পারে। আজ আমরা অজপা জপ পদ্ধতি সম্পর্কে শুনবো। 

প্রত্যেকটি মানুষ সাধারণ ভাবে দিনরাত মিলিয়ে ২১৬০০ বার শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রিয়া করে থাকে। আর প্রত্যেকবারই এই অশ্রুতপূর্ব মধুর ধ্বনি আমাদের মধ্যে অনুরণিত হচ্ছে। মহাত্মাগণ একেই জীবের স্বাভাবিক জপ বলে থাকেন।  এই জপই জীবজগৎকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই জপ-বিহীন কোনো জীব, জগতে বেঁচে থাকতে পারে না। ধ্বনিটি হচ্ছে সোঽহং। সঃবা সো  - আমরা যখন স্বাস ভিতরের দিকে নিচ্ছি, তখন জগতের শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ বাইরের থেকে ভিতরে চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দিচ্ছি। আবার হং শব্দের দ্বারা আমরা ভিতরের চেতনাকে বা সৎ-কে বাইরের জগতে ঢেলে দিচ্ছি। 

বলা হয়ে থাকে, এই হংস হচ্ছে জীবের জীবাত্মা। আমরা জানি শব্দ উত্থিত হয় মূলাধার থেকে। তো এই মূলাধার থেকে এই শব্দ উত্থিত  হয়ে ধীরে ধীরে অনাহত চক্রে  ধ্বনিত হয়। এখানে শব্দ আঘাতহীন। অর্থাৎ আমাদের যে সাধারণ ধারণা  তা হচ্ছে, আঘাতের ফলে ধ্বনির উৎপত্তি, এখানে আঘাত ছাড়াই ধ্বনি অনুরণিত হচ্ছে ।  এই অনাহত চক্র পর্যন্ত কিন্তু  আঘাতহীন ধ্বনির আবহ চলে। বায়ুর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে হংস নাসিকাপথ দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস রূপে গমন-নির্গমন করছে।  তাই বলা হয়ে থাকে প্রত্যেক জীব থেকেই এই হংসধ্বনি বহির্গত হচ্ছে - যা আসলে জীবাত্মা। 

এই অনাহত ধ্বনি সামান্য চেষ্টায় সাধকের কর্ণগোচর হতে পারে। অনাহত পদ্মে অর্থাৎ আমাদের হৃদয়চক্রে সাধক ঈশ্বর চিন্তা করে থাকে। প্রাণবায়ুর সঙ্গে চেতনা এই হৃদয়চক্রেই ঘোরাফেরা করে থাকে। আমাদের বিমূঢ় তমসাচ্ছন্ন  মন তা উপলব্ধি করতে পারে না। 

বলা হয়ে থাকে, অজপা-জপ সোঽহং জপ মোক্ষদায়ক। ভোরের ব্রাহ্ম মুহূর্তে অর্থাৎ সূর্য উদয়ের ১ ঘন্টা আগে থেকে ১ ঘন্টা পর পর্যন্ত এই  মন্ত্রের জপের মোক্ষম সময়। এছাড়া অভিজ্ঞতায় দেখেছি,গভীর রাতে কিছুক্ষন ধ্যানের অব্যবহিত পরে,  এই জপ খুবই প্রভাবশালী। এইসময় নিজেকে আলোক গোলকের মধ্যে অনুভব হয়। ফলত একটা অলৌকিক অনুভূতি লাভ হতে পারে।  

মেরুদন্ড সুোজা রেখে কম্বলের আসনে বসুন। ভক্তিভাবে নিজ গুরু ইষ্টদেবতার উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করুন। অনাহত পদ্মে বাণলিঙ্গ শিবের উপরে নিস্কম্প প্রদীপ শিখার  কল্পনা করুন। শিখার আলোতে হংস বা সোঽহং বীজ-অক্ষর  কল্পনা করুন। 

সহস্র্রারে তেজময় ইষ্টমূর্তি কল্পনা করুন। মূলাধারে তেজময় শক্তিমূর্তি কল্পনা করুন। আর অনাহতে জ্যোতিস্বরূপ বাণলিঙ্গ কল্পনা করুন।  এরপর নিজেকে এই তিন তেজের সাহায্যে তেজময় অভিন্ন জীবাত্মা রূপে কল্পনা করুন। এবার মনে মনে "সো" ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে দুই নাসিকা দিয়ে শ্বাস গ্রহণ করুন। এই সময় কল্পনা করুন, নাক দিয়ে বায়ু আকৃষ্ট হয়ে আজ্ঞাচক্র স্পর্শ করে নিচের দিকে ধাবিত হচ্ছে, বুক-পেট হয়ে মূলাধারে মিলিত হচ্ছে। সেখান থেকে স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা হয়ে বাইরের জগতে নির্গত হচ্ছে। আর যখন বাইরের দিকে নির্গত হচ্ছে "হং" ধ্বনি উচ্চারণ করুন । অর্থাৎ নাসিকায় যখন বায়ু প্রবেশ করছে, তখন "সো" ধ্বনি শুরু করুন, আবার মূলাধার থেকে যখন বায়ু উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হচ্ছে তখন "হং" ধ্বনি মনে মনে উচ্চারণ করতে থাকুন।  অর্থাৎ "হং" ধ্বনিযোগে বায়ু ত্যাগ করবেন, আর "সো" ধ্বনি সহযোগে বায়ু গ্রহণ করবেন। অর্থাৎ বায়ুর নিম্নগতিতে "সো" আর উর্দ্ধ গতিতে "হং" শব্দ উচ্চারিত হয়। যদিও এই ধ্বনি প্রতিনিয়ত আমাদের ভিতরে উদ্গীথ হচ্ছে। তথাপি আমরা তা খেয়াল করি না, আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। কানের মধ্যে জল গেলে আমরা আরো একটু জল কানের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে থাকি, কারন কানের মধ্যে যে জল প্রবেশ করেছে, তাকে বের করতে হবে। ঠিক তেমনি আমরা সোঽহং ধ্বনি শ্রুতিগোচর করবার জন্য, প্রথম দিকে আমাদের নিজের থেকে এই ধ্বনির স্মরণে যেতে হয়।  এইভাবে জপ করতে করতে একসময় দেখবেন, আপনার ভিতরে স্বাভাবিক ভাবে উদ্ভূত   এই নাদধ্বনি আপনি শুনতে পাচ্ছেন। আর একমনে এই ধ্বনি শুনতে শুনতে সাধক সোঽহং অর্থাৎ সে-ই  আমি বা আমিই ব্রহ্ম, এই জ্ঞানের আলোতে নিজেকে উদ্ভাসিত করতে পারবেন। 

এই জপ ব্যক্ত ও অব্যক্ত-কারনে দুই প্রকার। শ্বাস প্রশ্বাস গমন-নির্গমন কালে যেমন এই জপ করা যায়, ঠিক তেমনি, শ্বাস প্রশ্বাসের গতি রুদ্ধ করে, অর্থাৎ বাহ্য ও অন্তর কুম্ভক করেও এই জপ করা যেতে পারে। তবে শ্বাস-রুদ্ধ করে, না করাই নিরাপদ। এই জপের ফলে মনের মধ্যে  একটা অপার্থিব আনন্দ অনুভব করা যেতে পারে। এই ধ্যান নির্দিষ্ট আসনে, নির্দিষ্ট সময়ে প্রথমে অভ্যাসের করতে করতে একসময় দিবারাত্র সংসারের কাজ করতে করতেও "সোঽহং" জ্ঞানে নিমগ্ন থাকা যায়। ব্রহ্মানন্দে জীবন অতিবাহিত করবার এটি একটি উৎকৃষ্ট উপায়। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।       












  

    

   

Sunday 3 January 2021

ধ্যানযোগঃ (৬ - অধ্যায় )

গীতায় ধ্যানযোগঃ (৬ - অধ্যায় )

শ্রী ভগবান উবাচ :

অনাশ্রিতঃ কর্মফলং কার্য্যং কর্ম্ম করোতি যঃ
স সন্যাসী চ যোগী চ না নিরগ্নি ন চ অক্রিয়।  (১)

কর্মফলের আশা না রেখে যিনি কর্তব্য কর্ম করেন , তিনিই যোগী-সন্যাসী । যিনি অগ্নি স্পর্শ করেন না,  অর্থাৎ  বেদবিহিত কর্ম বা যজ্ঞ না করে কর্মহীন থাকেন বলেই তাকে যোগী বলা যায় না। অর্থাৎ কর্মহীন থাকাই যোগ নয়।যিনি কাজ করেন অথচ কর্ম্মফলের আশ্রিত নন তিনিই সন্যাসী, তিনিই যোগী। কর্ম্মহীন থাকা বা বেদবিহিত জাগযজ্ঞ করেও যোগী হওয়া যায় না।  

যং সন্ন্যাসম ইতি প্রাহুঃ যোগং তং বৃদ্ধি পাণ্ডব 
ন অসং ন্যস্ত সংকল্প যোগী ভবতি  কশ্চন। (২)

হে পাণ্ডব যাকে  সন্ন্যস বলে - তাকেই যোগ জেনো। সংকল্প ত্যাগ করতে না পারলে কেউ যোগী হতে পারে না।

আরুরুক্ষ মুনে যোগং  কর্ম্ম কারনম উচ্চতে 
যোগারুঢ়স্য তস্যৈব শমঃ   কারনম উচ্চতে।  (৩)

যোগ সাধনায় যিনি আরোহন করতে চান, সেই মুনি বা সাধকের পক্ষে নিষ্কাম কর্মই কারন বা অবলম্বন। যোগরূঢ় অবস্থায় চিত্তের সাম্য বা সমতাই সিদ্ধ যোগীর পরম আশ্রয়। 

যদা হি ন ইন্দ্রিয় অর্থেষু ন কর্ম স্ব অনুষজ্জতে
সর্ব সংকল্প সন্ন্যাসী যোগরূঢ় তদা উচ্চতে। (৪)

যখন  সাধক সব সংকল্প ত্যাগ করে রূপ রস ইত্যাদি ইন্দ্রিয় ভোগ্য বিষয়ে এবং কর্মে আসক্ত হন না তখন তিনি যোগরূঢ় বলে কথিত হন। 

উদ্ধরেৎ আত্মানম আত্মনা ন আত্মনাং অবসাদয়েৎ
আত্মৈব হি আত্ম্নো  বন্ধুঃ আত্মৈব রিপু আত্মনঃ।  (৫)  

আত্মাই আত্মার উদ্ধার সাধন করে। আত্মাকে কখনো অবসাদগ্রস্থ হতে দেবে না।  আত্মাই আত্মার বন্ধু।  আবার আত্মাই আত্মার শত্রু। 

বন্ধুঃআত্মন আত্মন তস্য যেন আত্মনা এব আত্মনা জিতঃ
অনাত্মানস্তু শত্রুত্বে