Tuesday 28 January 2020

নিত্য কথা (২৬.১১.২০১৯)

নিত্য কথা (২৬.১১.২০১৯)

দীক্ষা : ঠাকুর রামকৃষ্ণ স্বামী অভেদানন্দকে একসময় বলেছিলেন, তোমার এই অল্প বয়সে যোগ সাধন করার ইচ্ছে হয়েছে - এ খুব ভালো লক্ষ্মণ। তুমি পূর্বজন্মে একজন বড় যোগী ছিলে। এই তোমার শেষ জন্ম।  আমি তোমাকে যোগ শিক্ষা দেব। অভেদানন্দ বলছেন, পরের দিন সকালবেলায়, আমি তার কাছে গেলে, তিনি আমার দিকে সস্নেহে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কতদূর পড়েছো ? 
- আজ্ঞে আমি এন্ট্রান্স ক্লাসে পড়েছি। 
- সংস্কৃত জানো ? তুমি কোন কোন শাস্ত্র পড়েছো ?
- আমি রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, ভগবদ্গীতা পাতঞ্জল দর্শন, শিবসংহিতা পড়েছি। 
-  বেশ বেশ, বলে হাততুলে আশীর্বাদ করলেন। পরে, আমায় ঘরের উত্তরদিকের বারান্দায়  নিয়ে গেলেন।
সেখানে একটা তক্তপোষ পাতা ছিল।

সারাদিনের মধ্যে যে কোনো একটি ঘন্টা কাটানোর জন্য, একটা নির্জন জায়গা বেছে নিন। আপনি ২৪ ঘন্টার মধ্যে  মাত্র একঘন্টা সেখানে কাটান। যা ইচ্ছে তাই করুন। হাসুন, কাঁদুন, হাত পা ছুড়ুন, বা চুপ চাপ বসে থাকুন, বা যা ইচ্ছে তাই বলুন  ।  এর মধ্যে, শেষ ১৫ মিনিট, একটা সময় মনে করুন, আপনি মারা গেছেন। মাত্র ১৫ মিনিট মনে করুন, আপনি মারা গেছেন। মরার মতো পড়ে  থাকুন। আর দেখতে থাকুন আপনার চারিদিকে কি ঘটছে। শুধু দেখতে থাকুন।..... এটা করতে থাকলে, আপনার ভিতরে জীবন সম্পর্কে একটা বিশেষ সদর্থক  জ্ঞান হবে, যা আপনাকে ২৩ ঘন্টা বেঁচে থাকতে, শান্তিতে থাকতে অবশ্য়ই সাহায্য করবে।

জীবন তো শ্বাসের খেলা। আর এই শ্বাসের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন চৈতন্য। প্রতিনিয়ত তাঁর আসা যাওয়ার খেলা চলছে। মন-রে তুই দেখেও দেখছিস না। প্রতিনিয়ত কতবার, সে তোর সাথে লুকোচুরি খেলছে। তুই ধরতে পারছিস না। মন, একবার মনোযোগ দে, ওই শ্বাসের খেলায়। কত শ্বাস তুই হেলায় হারিয়েছিস। এবার তুই ঢুকে  পর শ্বাসের সঙ্গে, হৃদয়কেন্দ্রে।  আর চৈতন্যের নৃত্য দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যা। জীবন সার্থক কর্।

পাহাড়ে গিয়েছেন কখনো ? না গিয়ে থাকলে চলুন আজ আমার সঙ্গে কৈলাশে। প্রথমে মনে হবে, আপনি পৃথিবী নামক এক গোলাকার বলের উপরে  বসে আছেন। সন্ধ্যে হলে আপনার মনে হবে আপনি বিশাল ব্রহ্মান্ডের উপরে বসে আছেন। কারন আপনি নিচের দিকে তাকালেই দূরে শহরগুলোর আলোকে আপনার মনে হবে গ্রহ নক্ষত্র। মাঝে মধ্যে দেখবেন, নক্ষত্রগুলো ছুটে  চলেছে। আসলে ওগুলো রাস্তায় চলন্ত  গাড়ির হেডলাইট। রাত যত গভীর হবে, আপনি ঠান্ডায় কুঁকড়ে যাবেন। ঠান্ডায় আপনার শরীরবোধ চলে হবে। আপনার শরীরের উপর তুলোর মতো বরফের আস্তরণ জমতে শুরু করবে।  আর একটা উজ্জ্বল আলোর গোলক  আপনার নজরে পড়বে। আসলে ওটি দেবাদিদেবের তৃতীয় নয়ন। এটি  পাহাড়ের নিচ থেকে পক্ষকালে একবার দেখা  যায়। আপনি শরীরবোধ যত হারিয়ে ফেলবেন, তত আলোটিকে উজ্জ্বল মনে হবে, আর আপনার মনে হবে, আপনি কোনো শরীর নয়, আপনি শুধুই চৈতন্যশক্তি । রাতের শেষে আপনি ওই আলোর মধ্যে প্রবেশ করবেন। কেননা আপনি তো  তখন গরম খুঁজছেন। সীমাহীন চৈতন্যের সঙ্গে সীমাবদ্ধ চৈতন্য হারিয়ে যাবে।  নমঃ শিবায়।

যিনি দিনরাত ঈশ্বরকে ডাকছেন, ধ্যান জপ করছেন, তিনি ধার্মিক নাও হতে পারেন। কিন্তু যিনি ঈশ্বরের কথা শোনেন, এবং তার কথা অনুযায়ী কাজ করেন, তিনি অবশ্য়ই ধার্মিক।

ভগবান তো একজন, কিন্তু ভক্ত বহু। ভগবানের এক  ভাব, ভক্তের বহু ভাব। কেউ গরম দুধ পছন্দ করে, কেউ আবার ঠান্ডা দুধ পছন্দ করে। কেউ  দই  খায়, কেউ ছানা  বা সন্দেশ  খায়, .কেউ আবার ঘোল খায়।  কেউ ক্ষির খায়। কেউ মাখন খায়।  যার যা ভালো লাগে, সহ্য হয়, সে তাই খায় । খায় তো দুধই। যায়ও  তো একজায়গায়, সেই  পেটে । যে যে-ভাবে থাকে, সে সেই ভাবে ভগবানের উপাসনা করে, সাধন ভজন করে। সবাই-ই ঈশ্বরে প্রবেশ করে।

কে বলে টাকা পয়সায় কিছু হয় না, টাকা-পয়সায় অনেক কিছুই  হয়। নাম-যশ, বিদ্যা-বুদ্ধিতেও অনেক কিছু করা যায়। কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসাতে সবকিছু হয়। তাই আধ্যাত্বিক জীবনে প্রথমেই ভালোবাসার পাঠ নিতে হয়। সত্যিকথা বলতে কি, টাকা-পয়সা, নাম-যশ, বিদ্যা-বুদ্ধি সব বাইরে থেকে আসে। তাই আমরা এগুলোর জন্য, অন্যের প্রতি  নির্ভরশীল হয়ে যাই। আর ভালোবাসা নামক গুনটি আসে ঈশ্বরের কাছ থেকে, অর্থাৎ নিজের ভিতর থেকে । তাই ভালোবাসা নামক সম্পদের জন্য, আমাদের অন্য কারুর উপর নির্ভর করতে হয় না।

আমরা যেন কখনো আবেগ দ্বারা পরিচালিত না হই। আবেগকে চূর্ন করতে গেলে চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে। আর এই চেতনাকে অনন্ত অস্তিত্ত্বের সংস্পর্শে আনতে  হবে। যতদিন আমরা ঈশ্বর অনুভূতি চেতন স্তরে না পাই, ততদিন আমাদের এর কারন খুঁজতে হবে। আর এর কারন খুঁজতে গেলে আমরা দেখতে পাবো, আমাদের অবচেতন ও অচেতন স্তরে বাসা বেঁধে আছে প্রবল বাসনা। বাসনার এই বাসাগুলোকে উপড়ে ফেলতে হবে,  আমাদের সমস্ত চিন্তাকে ঈশ্বরমুখী করতে হবে,              তবেই আমরা ঈশ্বর-উপলব্ধি করতে পারবো।

এক দেখাই  জ্ঞান আর বহু দেখাই অজ্ঞান।
উপনিষদ বলছেন তিনি এক। কার্য্য ও কারণে ভাগ হয়ে যান বলে আমাদের কাছে বহু মনে হয়। সূর্য এক কিন্তু তার প্রতিবিম্ব বহু। সূর্য্য একজায়গায় আছেন , কিন্তু সব জায়গা থেকেই তার দর্শন মেলে। সব জায়গা থেকেই তার উপযোগিতা ভোগ করা যায়। প্রতিবিম্বগুলি বিভিন্ন পাত্রে প্রতিফলিত হয়। পাত্র অনুযায়ী প্রতিবিম্ব। এখন পাত্রগুলো যদি সরিয়ে নেওয়া যায়, তবে প্রতিবিম্বগুলো সূর্য্যেই ফিরে যায়। তখন সূর্য আর প্রতিবিম্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। তারা এক হয়ে যায়। এইজন্যই বলা হয়ে থাকে এক দেখাই  জ্ঞান আর বহু দেখাই অজ্ঞান।

যখন সাধকের উপলব্ধি হয়, যে এক আত্মা সর্বত্র রয়েছেন, তখন মন সম্পূর্ণ উদ্বেগশূন্য হয়। অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তনকে মেনে নিলে, অনাসক্তি আপনিই আসে। আবার মনের স্তরে মানুষ যখন একত্ত্ব অনুভব করে, তখন স্থূল দেহের স্তরেও এই একত্ত্বের অনুভূতি হয়। এসব  বোঝার জন্য, আমাদের সাধনার প্রয়োজন হয় না। দৈনন্দিন জীবনেই অনুভব করতে পারি। আমার সন্তানকে  যখন মাস্টারমশায় আমার সামনে পেটায়, কিম্বা আমার সন্তান যখন যন্ত্রনায় কাতরায়, তখন আমার অনুভূতি, বিশ্লেষণ করলেই আমরা সেটা বুঝতে পারি। এমনকি আমার সন্তানের মনের ভাবতরঙ্গ আমার   মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। সন্তানের পরীক্ষায় প্রথম হওয়া, সন্তানের সঙ্গে সঙ্গে আমাকে আনন্দে প্লাবিত করে। এসব  বোঝার জন্য কোনো সাধনার প্রয়োজন হয় না, শুধু একাত্মতা অনুভব করতে হয়। আপনার এই একত্ত্ব বোধ যখন ধীরে ধীরে  ছড়াতে শুরু করে,  তখনই আপনি অন্য মানুষ হয়ে যান।

আমাদের মধ্যে কেউ কেউ, ঈশ্বর আছেন ব'লে বিশ্বাস করেন। আবার এমন কেউ কেউ আছেন, যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। বিষয়টি সম্পর্কে কেউ যদি গভীরভাবে চিন্তা ক'রে, সিদ্ধান্ত নেয় যে ঈশ্বরের অস্তিত্ত্ব নেই।  সেটা বরং বোঝা যায়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ ঈশ্বর সম্পর্কে কোনো ভাবনা চিন্তা না করেই , অন্যের কথার উপরে ভিত্তি করে, বা অনুসন্ধানের  অনীহা থেকে,  সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন । এটা খুবই পরিতাপের বিষয়। এঁরা বিষয়টিকে এড়িয়ে চলেন। ফলে সত্য তাদের কাছে ধরা পড়ে না। এরা ঈশ্বর থেকে দূরে অবস্থান করেন। শেষে আবার ঈশ্বরকেই দোষারোপ করেন।


জলের মধ্যে আগুন আছে। কথাটা শুনলে আমাদের বিস্ময় জাগতে পারে। কিন্তু এটা আমরা তখন টের পাই, যখন দেখি মেঘে-মেঘে ঘর্ষনে বিদ্যুৎ চমকে  ওঠে। জলে যখন তীব্র স্রোত বয়, তখন আমরা বিদ্যুৎ পেতে পারি। বায়ুর মধ্যে অগ্নি আছে। এটা আমরা বুঝতে পারি, দেশলাই কাঠি যখন  জ্বালাই। খাদ্যের মধ্যে অগ্নি আছে, জল আছে, বায়ু আছে, । অগ্নির মধ্যে জল আছে।  আসলে সমস্ত পদার্থের মধ্যে আছে পঞ্চভূত।এক ভূতের  সঙ্গে  জড়িয়ে আছে আর এক ভূত। সাধনা আমাদের এই ভূতগুলোকে উপলব্ধি, এবং আলাদা  করতে সাহায্য করে। সাধক যখন নিজেকে জানতে পারেন, তখন তার কি অবস্থা হয় ? আত্ম-উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে সাধকের  ভিতরে যত  উপাদান ছিল, সেগুলো উৎসে ফিরে যায়। ইন্দ্রিয়গুলো নিষ্ক্রিয় থাকে। সাধক কেবলমাত্র শ্রদ্ধাতে অবস্থান করেন। আর শ্রদ্ধা অবস্থান করে প্রাণে। তখন নিজেকে প্রাণ ও চেতনার মিলিত সত্ত্বা মনে হয়।

এক ভদ্রলোক তার  ছেলেকে, তার ছোটবেলা থেকে ঈশ্বরের কাছে, মানে ঠাকুরঘরে গিয়ে প্রার্থনা করতে শিখিয়ে ছিল। তো ভদ্রলোক, তাকে জিজ্ঞেস করতো, আজ তুমি কি প্রার্থনা করলে ? সে তখন বাবার  কাছে, তার প্রার্থনার কথা বলতো। এবং যদি সম্ভব হতো, পরের  দিন বাবা  যত  তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে  সেটা এনে দেবার চেষ্টা করত। আসলে ভদ্রলোক  ভাবত, এতে করে ঈশ্বরের প্রতি তার বিশ্বাস বাড়বে। একজন শিশুর কাছে, প্রার্থনা মানে জাগতিক  বস্তু চাওয়া। আর সেই বস্তু পেয়ে, সে ঈশ্বরকে মহান বরদাতা, ইচ্ছেপূরণের বস্তু ভাবতে শিখলো। কিন্তু বড় হয়ে যখন দেখলো, ঈশ্বর এখন আর কিছু এনে দিচ্ছে না, এমনকি পরীক্ষায় পাশ করিয়েও দিচ্ছে না। তখন ঈশ্বরের প্রতি তার রাগ হতে লাগলো। ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসে চিড় ধরলো। আমরা যেন ঈশ্বরকে মহান বড়-দাতা না ভাবি। তাহলে ঈশ্বরের অস্তিত্ত্বে সন্দিহান হয়ে পড়বো।

আমাদের শরীরে যেমন  বিষক্রিয়া হয়, যেমন  রোগ-জীবাণুর আক্রমন হয়, ঠিক তেমনি আমাদের মন-ও আক্রান্ত হয় ক্ষতিকর আবেগের দ্বারা।  আমাদের মনের ভিতরে যে চিন্তা ভাবনা চলছে, তারই বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে, আমাদের কর্ম্ম। আমরা যদি আমাদের চিন্তাধারাকে বিচার বিশ্লেষণ দ্বারা পরিশোধিত  করতে পারি, আমরা যদি আমাদের চিন্তাকে শুদ্ধচিন্তায় পরিণত করতে পারি, তবে আমাদের কর্ম্ম ভালো হতে বাধ্য। আর আমাদের কর্ম্ম যদি ভালো হয়, তবে আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।  আবেগকে পরিহার করে , বিচার-বুদ্ধি দ্বারা চিন্তাকে পবিত্র করতে হবে আমাদের । এইভাবে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ জীবন উজ্জ্বল করে তুলতে পারি।

এক গ্রাম্যকবির রসাত্মক গল্প :

গ্রামের এক বুড়িমা, স্কুলের মাঠে ছাগল চড়াতে এসেছে। ক্লাসকক্ষ থেকে ভেসে আসছিলো, মাস্টার মহাশয়ের উক্তি : কত গরু-ছাগল মানুষ করলাম, তোকে পারলাম না।

লক্ষ্য ছাড়া জীবনের কোনো অর্থই  হয় না। কিন্তু কথা হচ্ছে আমরা এই লক্ষ্যে পৌঁছবো কি করে ? আর এই লক্ষ্য আমাদের কেমন হওয়া উচিত। আমি যাতে আনন্দ পাই, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হাওয়া উচিত। কিন্তু কথা হচ্ছে, লক্ষ্য যদি আনন্দ হয়, তবে তো আমরা বিষয়ভোগে আনন্দ পাই, অনেক সময় অন্যের ক্ষতি করেও  আনন্দ পাই। তবে কি সেই আনন্দ আমাদের খোঁজা  উচিত ? আসলে সত্যিকারের আনন্দ হয় আমাদের সৃজনশীলতা থেকে। ভগবানের এই সৃষ্টি লীলায়, আপনি যদি হাত লাগাতে পারেন, সৃষ্টিকে যদি রক্ষার দায়িত্ত্ব নিতে পারেন, তবে আনন্দই আনন্দ। আপনার আমার সবার মধ্যে এই সৃজনশীলতার ক্ষমতা আছে। শুধু নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, কি করতে আপনার ভালো লাগে। আর সেই কাজে মন প্রাণ ঢেলে দিন। তবে খেয়াল রাখবেন, অর্থ-পদ-সন্মান যেন আপনাকে আকর্ষণ না করে। কিছু না করতে পারেন, শুধু সবাইকে ভালোবাসুন। দেখবে, আপনি ভাল থাকবেন। আমাদের লক্ষ্য হোক সবাইকে  ভালোবাসা, তা সে মানুষ হতে পারে, জীব-জন্তু হতে পারে, পশু-পাখী হতে পারে। ভালোবাসা আপনাকে নির্ভয় করবে, আনন্দ দান করবেই করবে ।

প্রত্যেক মানুষ একটা নিজস্ব জগতে বাস করে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সেই  জগৎ দৃঢ় হতে থাকে। সেখানেই সে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে।  এবং সেখান থেকে সে কিছুতেই বেরুতে পারে না। বেরুতে চায়ও  না। আবার বয়সের সঙ্গে সঙ্গে, অন্ন গ্রহণের ক্ষমতা কমতে থাকে, আর  শরীর ও মনের দুর্বলতা বাড়তে থাকে। মানুষ তখন তার নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই নিরাপত্তার মধ্যেও, নিরাপত্তা হারানোর একটা কাল্পনিক  আশঙ্কা তৈরি হয়। এর থেকে তার মধ্যে একটা কাল্পনিক ভয়,  বাড়তে থাকে। এই অবস্থা  থেকে বেরুতে গেলে, আমাদের নিজস্ব জগতের গণ্ডিটাকে ভেঙে দিতে হবে। একটা কথা মনে রাখবেন, প্রজ্ঞা ও বধির স্বকীয় ঐশর্য্যে এই জীবন দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের কাল্পনিক নিরাপত্তা, বা কাল্পনিক ভয়, দূর করে দিন। পরম-পিতা আমাদের সর্বদা রক্ষা করছেন।  আপনার সমস্ত ভয়, সমস্ত আশঙ্কা তাঁকে ব্যক্ত করুন। তিনি যা কিছু করছেন, সবই মঙ্গলের জন্য। আমাদের অমঙ্গলের যে-কোনো আশঙ্কাই অমূলক।

পুনঃপ্রকাশিত : চিত্রগুপ্ত আমার  সম্পর্কে কিছু লিখে রেখেছেন কি না, তা আমি জানি না। ভগবানের কোনো তৈলচিত্র আকাশে আঁকা আছে কি না তা আমি কখনো দেখিনি। ঈশ্বরের মনে আমার সম্পর্কে সত্যিই কিছু আছে কি না তা আমি জানিনা। আমি আগের জন্মে কি ছিলাম তা আমি জানিনা। আমি ভবিষ্যতে কি হবো, তাও আমি জানিনা। কিন্তু আমি জানি  আমার "এখন"-কে। আমি চিনি আমার "এখন"-কে। আমি এখন যা বলি, তাই আমি। আমি এখন যা করি, তাই আমি। আমি যা স্থির করি, সেটাই আমার লক্ষ্য। আমার জীবন তেমনই হবে যেমন আমি রচনা করবো। আমার কর্ম্মের বিচার ভবিষ্যতে  হবে কি না তা আমি জানিনা। তাই আমি আমার জীবনচিত্র আঁকতে চাই। আমার জীবনী আমাকেই লিখতে হবে। অন্যকেউ আমার জীবনী কি করে লিখবে ? আমি আমার অতীতকে মুছে ফেলতে চাই। শুধু আমি অতীতের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে চাই, যে সে আমাকে এখানে পৌঁছে দিয়েছে। আমি ভবিষ্যতের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে চাই সামনের জীবনের জন্য। কিন্তু আমি আমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে চাই, আমার বর্তমান জীবনের জন্য। আর এই বর্তমানে আমি আনন্দে থাকতে চাই, সুখে থাকতে চাই। আর এই জন্য আমার যা ভালো লাগে আমি তাই করি। আমার যাতে আনন্দ হয়, আমি তাই করি। আমি যা বিশ্বাস করি, তাই আমি করি। আমি নিজেই নিজেকে সন্মান করি। নিজেই নিজের পিট চাপড়াই। নিজেই নিজেকে বকাবকি করি। আর আমি বিশ্বাস করি, আমার ঈশ্বর এতে সন্তুষ্ট হন। আমার ভিতরের ভগবান এতে খুশিতে থাকেন ।

আমি এক সর্বহারা সাধুকে  দেখেছি, তার কাজ হচ্ছে, টাকা জোগাড় করা। এই অদ্ভুত দর্শন সাধু এক জায়গায় বেশি দিন থাকেন না। আক্ষরিক অর্থে, ইনি যত্র তত্র ভোজন করেন। যদিও সারাদিনে একবার। আর রাতে শয়ন করেন, মন্দিরে বা মসজিদে । আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে,  সারারাত তিনি ধ্যান-মগ্ন থাকেন, সকালে প্রাতঃকৃত্য-স্নানাদি  সেরে আবার ধ্যানে বসে যান। এই সময় তিনি ঘন্টা তিনেক ধ্যান-আসনে  মন্দির বা মসজিদের সামনে অবস্থান করেন। কোনো কোনো জায়গায় ৫-৭ দিন থাকেন। আর ইনি যেখানেই যান, সেখানেই তার কাছে, টাকা-পয়সা আসতেই থাকে। অর্থাৎ ভক্তরা সকাল থেকে ভিড় করে আসে, তাকে দেখবার জন্য।  আর প্রণামী হিসেবে হাজার  হাজার টাকার স্তূপ জমতে থাকে। ধ্যান শেষে টাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে  শূন্যে একটা লাথি  ছোড়েন। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে যান। তো আমি তাকে একবার জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে লোকে এত টাকা দেয়, অথচ আপনি সেসব অবহেলায় ফেলে দিয়ে চলে আসেন। লোকে কেনই বা  আপনাকে টাকা দেয় ?
উনি আমাকে বললেন,  মশায়,  ধ্যানে বসলেই আমি টাকার স্তূপ দেখতে পাই, চোখের সামনে । ঈশ্বরকে দেখতে পাই না। আমি যাকে চাই না, তার চিন্তাই আমার মাথায় ঘুরছে । আমি এখান থেকে কিছুতেই বেরুতে পারছি না।

বছর দশ-বারো  আগেরকথা, আমার একবার কোমরে ভীষণ ব্যথা শুরু হলো। ভাবলাম, একাসনে রাতের পর রাত বসে থাকার জন্য, হয়েছে। বা পেট গরমের জন্যও হতে পারে।   বসলে, উঠতে খুব কষ্ট হতো। বহুদিন যাবৎ যেহেতু আমি ডাক্তারের কাছে যাই না। ডাক্তারের কাছে যেতে ভালোও লাগে না আমার । তাই আমি আয়ুর্বেদের বই পড়তে লাগলাম।  যদি কিছু ঔষধ খুঁজে পাই। বাড়িতে বাংলা পায়খানা। পায়খানা করা, একটা বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়ালো। বসলে দেওয়াল ধরে উঠতে হতো। আর ভীষণ কষ্ট হতো। তাই স্ত্রীর পরামর্শে একটা কমোট, বসাতে বাধ্য হলাম। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, ওই কমোটে আমাকে একবারও যেতে হয়নি। এখনো যাই না। আমি শুধু মনে মনে ভাবলাম, বিজ্ঞান বলছে, আমাদের দেহের কিছু অংশ প্রতিদিন বদলে যাচ্ছে। তো  ব্যাথার জন্য, যে কোষগুলো কষ্ট পাচ্ছে, তাকে তাড়াতাড়ি বিদায় দিতে হবে। ধ্যানে বসে, শুধু মনে মনে ভাবতে লাগলাম, যন্ত্রনাদায়ী কোষগুলো এক্ষুনি বেরিয়ে যাচ্ছে, আর বিশ্বশক্তি আমাকে নতুন সুস্থকোষ প্রদান করছে। আর এই প্রক্রিয়া আমাকে তিন দিনের মধ্যেই  সম্পূর্ণ ভালো করে তুললো। আর এর পর থেকে, কোমরে যন্ত্রনাতো দূরের কথা, আমার শরীর অসুস্থ হবার চেষ্টা করলেই, আমি সুস্থ শরীরের জন্য, একই প্রক্রিয়া করি। আর আমি সুস্থই থাকি। এখন  আমি মনে করি, এটা সম্ভব হচ্ছে কারন,  আমি অসুস্থতার থেকে নজর ঘুরিয়ে,  সুস্থ শরীরের দিকে নজর দিচ্ছি তাই ।

হে পরম-পিতা পরম-ঈশ্বর, তোমার মহত্ত্বের কথা কীর্তন করার জন্যই কি  এই কন্ঠস্বর সৃষ্টি
করেছো ?  হে পরম-পিতা  তুমি বিশ্রাম নেবার  জন্যই  কি এই হৃদয়কেন্দ্র গঠন করেছো ? হে পিতা,  হৃদয়কে আদ্র করবার জন্যই কি তুমি প্রেম সৃষ্টি করেছ ? মন থেকে সমস্ত ভাবনা-ভয় দূর করবার জন্যই কি তুমি শান্তিবারি ছিঁটিয়ে থাকো ? তুমি নিজেকে আচ্ছাদিত  করবার জন্যই কি  প্রাণ সৃষ্টি করেছো ? তাহলে আমাকে (অহং) কেন সৃষ্টি করেছো ? 

মানুষের জীবনে এত কষ্ট, এত অভাব, এত ব্যথা, এসব দেখে মনে হয়, পৃথিবীটা একটা অভিশপ্ত জায়গা। মানুষ বোধহয় এখানে এইসব দুর্ভোগ পোহাতেই আসে। কিছুলোক সাময়িক সুখ পায়, সত্য, কিন্তু সেসব কতক্ষণের  জন্য ? আবার তাকে অসুখী করে তোলে। এ যেন কেবল  নেই-নেই এর সংসার।  এখানে খালি অভাব। এখন থেকে আমরা কি ভাবে বেরোবো ?
আমরা আসলে ভাবি যে সবই আসছে বাইরে থেকে।  খাবার আসছে বাইরে থেকে, আরাম আসছে বাইরে থেকে। আসলে এ জগতে যা কিছু, দেখছেন, যা কিছু শুনছেন, এমনকি যাকিছু খাচ্ছেন, কোনোটাই বাইরের থেকে আসছে না। এসব আসছে আমাদের অন্তরের অনুভূতি ও ভাবনা থেকে। আমাদের মন-ই সব কিছুর সৃজনকারী। আমাদের মনের মধ্যেই আছে, সমস্ত সৃজনশক্তি। আর আমাদের মনের ক্ষমতা অসীম। আপনার কল্পনাও অসীম। আর যাকিছু আপনি কল্পনা করতে পারেন, তার সবই এই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও আছে।  আর আপনি চাইলেই সেটা আপনি পেতে পারেন। নিজের মনে অভাবের কথা বিসর্জন দিন,  প্রাচুর্য্যের কথা ভাবুন, প্রাচুর্য্যকে অনুভব করুন, সীমাহীন সুখের ভাবনা দিয়ে মনটাকে ভরিয়ে তুলুন। হোক না সেসব কল্পনা। এই কল্পনাই একসময় অবশ্যই বাস্তব রূপ নেবে।  অবশ্যই নেবে।

পুনঃ প্রকাশিত - রুগী দেখে, ডাক্তারবাবু বলছেন, ঔষধে কাজ করছে না। আপনারা এঁকে বাড়ি নিয়ে যান। ঔষধ হচ্ছে দ্রব্য বা দ্রব্যের মিশ্রণ। তো দ্রব্যের একটা গুন্ আছে। আর এই দ্রব্যগুন আমাদের শরীরে অবশ্যই ক্রিয়া করবে। তা আপনি জানেন আর না জানেন। বিষ যেমন আপনাকে রেহাই দেবে না। ঠিক তেমনি ঔষধ সেবনে আমরা ভালো থাকতে পারি।  তবে কেন ডাক্তারবাবু বলছেন, ঔষধে কাজ করছে না। তাহলে কি দ্রব্যগুন শেষ হয়ে গেলো ?

সাধারণভাবে আমাদের মনে হয়, বাহ্যিক বস্তু, অর্থাৎ  ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির আক্রমনে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমরা মনে করি, আমাদের অসুস্থ হবার এটাই কারন। আসলে কিন্তু আমাদের শরীরের প্রাণশক্তি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে, আমরা রোগাক্রান্ত হই। এই প্রাণশক্তি বহনকারী যে কোষ সেগুলো যখন ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তখন আমাদের মধ্যে প্রাণশক্তি বহনক্রিয়া ব্যাহত হয়। এই কোষ বাইরের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে, বাইরের বিরোধী শক্তির আক্রমনেও  হতে পারে। এখন কোষ যে কারণেই ক্ষতিগ্রস্থ হোক না কেন, এই কোষগুলোকে আমাদের সুস্থ  করে তুলতে হবে। ঔষধ, ম্যাসেজ, এমনকি তড়িৎশক্তি এই কোষগুলোকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। আর তখন কোষগুলোর মাধ্যমে আবার প্রাণশক্তি প্রবাহিত হওয়া শুরু করে। প্রাণশক্তির ছোঁয়ায় কোষগুলো আবার উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। এবং আমাদের শরীরের মেরামতির কাজ শুরু করে দেয় । এখন বস্তুচেতনা যতক্ষন মানুষের মনে উচ্চপর্য্যায়ে বিরাজিত থাকে, ততক্ষন আমাদের ঔষধে কাজ হতে পারে।বস্তু চেতনা যখন আমাদের কমতে থাকে, বা থাকে না, তখন আর ঔষধে কাজ করতে পারে না। এছাড়া, ঔষধ বাইরের থেকে প্রয়োগ করা হয়, তাই এর একটা সীমাবদ্ধতা আছে। আর ঔষধ বা বাহ্যিক ক্রিয়া, আমাদের রোগমুক্তি ঘটায়  না, রোগের উপশম করতে পারে মাত্র। তারা প্রাণশক্তিকে ক্ষতিগ্রস্থ বা রোগগ্রস্থ কোষে প্রাণশক্তি আসতে উদ্দীপ্ত বা প্রলুব্ধ করতে পারে মাত্র ।

 কিন্তু এই প্রাণশক্তিকে যদি আমরা আমাদের ভিতরের থেকে উজ্জীবিত করতে  পারি, তবে আমরা অভ্যন্তরীণ ভাবেও শরীরকে সুস্থ অবস্থায় রাখতে পারি। তাই প্রতিনিয়ত প্রাণের সাধনা করা মানুষেরা কখনো অসুস্থ হতে পারেন না। একমাত্ৰ ইচ্ছাশক্তি দ্বারা সে প্রাণশক্তিকে ইচ্ছেমতো কোষে প্রবাহিত করতে পারেন। এবং চিরকাল নীরোগ থাকেন। বস্তুচেতনা থেকে নিজেকে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। ঈশ্বরীয় চেতনায় নিজেকে উত্তরণ ঘটাতে  হবে, তবে আমরা ইচ্ছামৃত্য বরণ করতে পারবো।

১৮-ই মে ২০১৩ সালে সাপ্তাহিক বর্তমানে "চিঠি" বিভাগে একটা চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল।  আজকের দিনে সেটা খুব প্রাসঙ্গিক মনে করে, চিঠিটার কথাগুলো বলার লোভ সামলাতে পারছি না। চিঠিটির লেখক, শ্রী সাগরময় অধিকারী, ফুলিয়া, নদীয়া।
"........ আমি সম্প্রতি (৪.১০.২০১১ ) দুর্গাপুজোর মহাষ্টমীর দিন গেদে  বর্ডার  হয়ে দর্শনা থেকে বাসে করে বাংলাদেশ প্রথম যাই। .....উদ্দেশ্য বাপ্ ঠাকুরদার জন্মভিটে দেখতে যাওয়া। দর্শনা যাওয়ার বাস কখন আছে জানতে চাওয়ায় এক ভদ্রলোক কাকে যেন ফোনে কি বললেন, আমাকে বললেন .......... মজিদভাই  আপনার জন্য কুলপালা বাস স্টপেজে থাকবেন।..........কুলপালায় নাবলাম  - কাছের চায়ের দোকানে মজিদভাইয়ের দেখা পেলাম। তিনিও একপ্রস্থ আমি কেন এসেছি, কোথায় যাবো ইত্যাদি জানতে চাইলেন। চা-বিস্কুট খাওয়ালেন।  দাম দিতে গেলে বললেন, আপনি ইন্ডিয়া থেকে আসছেন,আপনি আমাদের মেহমান - দাম দেবেন কি করে ? ......মজিদভাই সারাক্ষন আমার সঙ্গে ছিলেন, মোটর ভ্যানে রুইথনপুর গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। নাজির অহমেদের বাড়িতে এলাম।  এটাই আমার ঠাকুরদার বাড়ি ছিলো। গ্রামের অনেক লোক আমাদে দেখতে এলেন। ...... যাত্রা শেষে আমি ভ্যানওয়ালাকে কত দেবো জানতে চাইলাম।মজিদভাই হাঁ হাঁ করে উঠলেন, কী করছেন আপনি - বলেছি না আপনি আমাদের মেহমান  - মেহমানের কাছ থেকে কি কেউ টাকা নেয় ? আমি অবাক। ......কী  ভাবছেন, এ তো আমি ইন্ডিয়া গেলে তখন আপনি কি করবেন ?

আজ থেকে ৬৫ বছর আগে আমার বাবা, জ্যাঠা মশাই এ দেশে চলে এসেছিলেন, - তারা আজ আর কেউ বেঁচে নেই। আমি ৬৫ বছর বয়সে যে বাংলাদেশ দেখে এলাম, ........ সাধারণ  মানুষের মনিকোঠায় তা বেঁচে থাকবে চিরকাল  - কোনো মৌলবাদী শক্তি হাজার সন্ত্রাস করলেও তাকে কবরে পাঠাতে পারবে না।

ভালো করো ভগবান - সবাইকে ভালো করো।
করুনা করো করুনাময়  - সবাইকে করুনা করো।
দয়া করো দয়াবান - সবাইকে দয়া করো।
কৃপা করো কৃপাময় - সবাইকে কৃপা করো।

আমাদের সব যন্ত্রণার মূল কারন শরীর নয় মন। মানসিক ভারসাম্য ঠিক থাকলে, শরীরের ভারসাম্য ঠিক থাকে। মানসিক যন্ত্রনা শুরু না হলে শরীরের যন্ত্রনা আসে না। বাইরের বস্তূ গ্রহণ করবার একটা স্বাভাবিক প্রেরণা আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। এই প্রেরণাই আমাদের প্রলোভন আকর্ষণ করে। কাজেই আমাদের দোষ-ত্রূটি বাইরে থেকে আসছে, সেটা  না ভেবে আমাদের ভাবা উচিত, দোষ-ত্রূটিগুলোকে আমরাই আকর্ষণ করছি। যখনই দোষত্রূটি আমাদের মধ্যে প্রবাহিত হবে, তখনই আমাদের উর্দ্ধমুখী মনোভাব আনতে  হবে।  যেখান থেকে প্রলোভন আসছে, সেই বিষয় বা ব্যক্তি থেকে দূরে সরিয়ে নিতে হবে নিজেকে। স্বজ্ঞানে সঙ্গ ছেদ  করতে হবে। মানুষের সংসারে নয়, মনে করুন, আমি ঈশ্বরের সংসারে বাস করছি। সবসময় পবিত্র চিন্তা ও ভাবের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখুন। কি করছেন, সেটা বড়  কথা নয়, কেন করছেন  সেটাই বড় কথা। ঈশ্বর সবসময় আপনার হাত ধরে আছেন, আপনাকে ভালো পথে নিয়ে যাবার জন্য, আপনাকে লক্ষে পৌঁছে দেবার জন্য। আপনি যদি, বাজারের দোকানের সামগ্রী-তে  আকৃষ্ট হন, হাত টানাটানি করেন, তবে আপনার লক্ষে পৌঁছতে দেরি হবে। তবে একটা জিনিস শুনে রাখুন, লক্ষে আপনাকে পৌঁছতেই  হবে।  ঈশ্বর আপনাকে সেখানে নিয়ে যাবেন অবশ্য়ই । যত আপনি ঈশ্বরের হাত ছাড়াতে গিয়ে দেরি করবেন, ততই রাস্তার ক্লান্তি,কষ্ট আপনাকে বিড়ম্বিত করবে। আপনি ঈশ্বরের ইচ্ছায় চলুন। জীবনে কোনো কষ্ট থাকবেই না।

প্রথমে বলি, মাথায় যন্ত্রণার কারন হচ্ছে, মাথার কোষে প্রাণপ্রবাহ অর্থাৎ পর্যাপ্ত অক্সিজেন না যাওয়া। আপনি অনুলোম-বিলোম করে দেখতে পারেন। তবে একটা কথা বলি, যোগ সব-সময় গুরুসান্নিধ্যে করতে হয়। আর যোগের প্রাথমিক স্তরগুলো না অতিক্রম করে, পরবর্তী ধাপে যাওয়া ঠিক নয়।অর্থাৎ শরীর যতক্ষন পাকা না হয়, ততক্ষন যোগে প্রবৃত্ত হওয়া যায় না। অর্থাৎ শরীরের খাদ্য পঞ্চভূত থেকে নেওয়া শিখতে হয়।    অধম ১৯৭০ সাল থেকে যোগের প্রক্রিয়ার সঙ্গে আছে। তথাপি যোগের সূক্ষাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি প্রবন হতে পারে নি। অধম ১০-১২ দিন শুধু জল খেয়ে বাঁচতে পারে, মাঝে মধ্যে থাকে। এটি আয়ত্ত্ব করতে মাসে পর মাস লেগেছে।  তাই আমি কাউকেই শুধু আমার কথাগুলো শুনে যোগে প্রবৃত্ত হতে বলি না। যোগ একটা উচ্চতর বিজ্ঞান।  এটি আয়ত্ত্ব করতে সময় ও নিষ্ঠা দরকার।  কৌতূহল মেটাতে যাবেন না।  সত্যি যদি যোগ সম্পর্কে আগ্রহ থাকে, তবে গুরুর সহায়তা নিন। শরীর সুস্থ রাখার জন্য, প্রাণায়াম ইত্যাদি করা অবশ্য়ই করা যেতে পারে , কিন্তু যোগ হচ্ছে ঈশ্বরের সাথে  মিলনের সোপান।  এটি  সময় সাধ্য, কষ্ট  সাধ্য।  উপযুক্ত গুরু কখনোই উপযুক্ত শিষ্য বিনা এই বিদ্যা দান করেন না। আপনি প্রথমে বাবা রামদেবের দেওয়া প্রাণায়াম দিয়ে শুরু করুন। আমিকে ধরার কথা  বলা যত  সহজ , তত  সহজে ধরা যায় না। তবে মানুষ চেষ্টা করলে অবশ্যই পারে।  এই বিশ্বাস আমি করি। আপনার মধ্যেও ধাপে ধাপে এই বিদ্যা আয়ত্ত্ব হবে।  নিরাশ হবার কিছু নেই। আমাকে প্রশ্ন করলে আমি বিব্রত বোধ করি, কেননা আমিতো কিছুই জানি না। শুধু জানবার চেষ্টা করছি মাত্র। আমি ছাত্র, মাস্টার নোই। ভালো থাকবেন।


উপনিষদ বলছে, জীবনের চরম লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে গেলে দুটো পথ : ১. শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে পূজা-অর্চনা করা।  ২. পরব্রহ্ম-এর ধ্যান। অধিকাংশ মানুষের জন্য, পূজা অর্চনা শ্রেয়। কারন যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, সে সম্পর্কে সাধারণের পক্ষে ধারণা করা সম্ভব নয়। বাক্য-মনের অতীত সেই নিরাকার ব্রহ্ম তাদের কাছে অর্থহীন।  নানারকমের বাসনা এদের তাড়া  করে নিয়ে বেড়ায়। সেই বাসনাগুলো চরিতার্থ হলেই তারা খুশী থাকেন। সকাম  উপাসনায় তারা তাদের অপূর্ন বাসনা চরিতার্থ করবার সুযোগ পায়। উপনিষদ বলছে, সকাম উপাসনা মানুষকে ধন,স্বাস্থ্য, ক্ষমতা, ইত্যাদি  এমনকি স্বর্গলাভ করিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এগুলো সবই অনিত্য , ক্ষণস্থায়ী। কোনো মানুষ যদি, শাশ্বত শান্তি পেতে চান, তবে তাকে এসব থেকে মুক্ত হতে হবে। আত্মজ্ঞানের জন্য সচেষ্ট হতে হবে। আত্মজ্ঞান লাভ হলে তার মৃত্যুভয় দূর হবে, নিজেকে মুক্তপুরুষ করা যাবে। এই আত্মজ্ঞান লাভই জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আর আত্মজ্ঞান লাভের যাত্রীকে প্রথমে উদ্গীথ উচ্চারণ ও প্রণবের ধ্যান করতে হবে। এতে ধীরে ধীরে মন শান্ত হবে। মন বশে  আসবে। তখন ব্রহ্ম বিষয়ক আলোচনায় অংশ নিতে হবে। ধীরে ধীরে ব্রহ্ম বিষয়ক আলোচনা করতে করতে ব্রহ্মজ্ঞান হবে। আর ব্রহ্মজ্ঞান মুক্তির দ্বার খুলে দেবে।

কম্বল উল্টো করে গায় দিলেও শীত চলে যাবে, সোজা করে গায়  দিলেও শীত চলে যাবে। আগে কম্বলটা গায়ে দিয়ে দেখুন। দস্যু রত্নাকর উল্টো করে গায়  দিয়েছিলেন, চৈতন্যদেবও  উল্টোকরে গায় দিয়েছিলেন। আপনি কিভাবে গায়  দেবেন, সেটা আপনার ব্যাপার। শুধু গায় দিন। এইসব করে সময় নষ্ট করবেন না। তাহলে শীত  যাবে না কোনোদিন।  সব প্রশ্নের উত্তর আপনার ভিতরেই আছে, নিজেকেই প্রশ্ন করুন। সব প্রশ্নের উত্তর আপনার ভিতরেই  আছে।

সাধনার দ্বারা, জ্ঞান-প্রেম-ভক্তি সঞ্চারের দ্বারা, ধীরে ধীরে আমাদের মনকে আধ্যাত্মিক জীবনের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। নিজ প্রয়োজন মতো বা হঠাৎ করে, নিজের ইচ্ছেপূরণের জন্য, মনকে আধ্যাত্মিক জগতের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা যায় না। এর জন্য যেমন সময় প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন উপযুক্ত সাধন-পথ অবলম্বন। লোভে পড়ে তাড়াতাড়ি আধ্যাত্মিক উন্নতি করতে চাইলে, সেটা হবে আত্মপ্রবঞ্চনা, ভাবের ঘরে চুরি । কিলিয়ে কাঁঠাল পাকালে, তা খাবার যোগ্য হবে না।

গাছে মুকুল ধরে, ফল হয়, ধীরে ধীরে ফল বড়ো হয়, আরো পরে ফল পাঁকে।  এর জন্য সময়ের প্রয়োজন। অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা, শিলাবৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে,তবে একটা ফল পাকার উপযুক্ত হয়। ইহ জগতে যেমন, তেমনি আধ্যাত্মিক জগতেও রূপান্তরের প্রক্রিয়া একটা বিশেষ নিয়মে বাঁধা। নিয়মের বিরুদ্ধাচরণ করলে, উদ্দেশ্য সিদ্ধ তো হয়ই না, বরংএতে ভগবান  আঘাত পান। ভগবান আপনার ভাবের দিকে দৃষ্টিপাত করে বসে আছেন। তিনিই আমাদেরকে উপযুক্ত বিবেচনা করে, যথাসময়ে কৃপা করবেন। একটা জিনিস জানবেন , ভগবানের কৃপা ভিন্ন ভগবানকে লাভ করা সম্ভব নয়। ফকির বাউল গাইছেন - আপন-জুতে  না পাকিলে কি,  গাছ-পাকা ফল  মিঠা হয় ?  কিলিয়ে পাকালে কাঁঠাল, সুমিষ্ট সে কভু নয়।

আমাদের মতো অজ্ঞানীরদের কাছে, সন্দেহ  জাগে,  মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কি আমাদের সব শেষ হয়ে যাবে ?  আমাদের মুনি-ঋষিগণ উদাত্ত্ব কন্ঠে ঘোষণা করছেন, না মৃত্যুতে তোমার সব শেষ হয়ে যাবে না। তোমার হতাশ হওয়ার কোনো কারন নেই। চিরকাল এই  বিষয়-বাসনা দ্বন্দ্বের  অধীন হয়ে থাকার জন্য তোমার জন্ম নয়। ব্যক্তি সত্ত্বার এক পরম রূপ সেই পরমসত্ত্বা আছে, যেখানে তুমি এই মর্ত বা  মৃত্যুপুরীর জীবনে থাকতে থাকতেই সেখানে পৌঁছাতে পারবে। এখানেই তুমি মরণোত্তর জীবনের সন্ধান পাবে।  তোমার আদর্শের পূর্ণতার প্রাপ্তি এখানেই ঘটবে। এখানেই তোমার জ্ঞানের পূর্নতা প্রাপ্তি ঘটবে। এখানেই তোমার প্রেমের পূর্নতা প্রাপ্তি ঘটবে।  এখানেই তোমার পূর্ন  বিশ্রাম, পূর্ন  শান্তি।এখানেই সেই চিরদীপ্তি উদ্ভাসিত হবে, যা কখনো নিষ্প্রভ হয় না। এখানেই সীমাহীন আনন্দ। কেমন করে মানুষের সেই অবস্থা প্রাপ্তি হয় ? মহর্ষিগন বলছেন, এই মরজীবনকে যদি আমরা নিয়ন্ত্রিত করতে পারি, তবেই সেই অমৃতত্ত্ব লাভ করতে পারি।

নদীতে বান  এলে  সব প্লাবিত হয়ে যায়। কিন্তু কখন যে বান  আসবে তা আমরা জানি না। আমার যদি তৃষ্ণা পায় তবে বসে না থেকে ধীরে ধীরে নদীর দিকে পা বাড়াতে হবে । নদী কখন আমার কাছে আসবে, তা আমি জানি না, সেই অপেক্ষায় বসে থাকলে  আমার তৃষ্ণা মিটবে না.।  নদীতে গেলে তৃষ্ণাও মিটবে, অবগাহনও করতে পারবো। বিবেকানন্দ প্লাবনে ভেসেছিলেন। বিবেকানন্দের মতো জন্ম- জন্মান্তের উচ্চকোটি সাধক, সেই প্লাবন সামলাতে না পেরে চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন, "ওগো তুমি আমার একি করলে ? আমার যে বাপ্-মা আছেন।" অদ্ভুত পাগল ঠাকুর রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের এই কথা শুনে খল খল করে হেসে উঠলেন, বললেন - "তবে এখন থাক, একেবারে কাজ নেই, কালে হবে।" তাই অপেক্ষা না করে নিজেকে তৈরি করুন, নদীর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলুন। নাহলে, না জানি কতদিন অপেক্ষা করতে হবে। আর তখন প্লাবন সামলাতে পারবো কি না।

আমাদের মধ্যে কেউ কেউ, বা হয়তো সবাই  বিশ্বাস করি, আমাদের সবার মধ্যে আত্মা আছেন। কিন্তু তাকে আমরা দেখা তো দূরের কথা, অনুভব করতেও পারি না। এর কারন  কি ? কারন হচ্ছে, আত্মা সর্বব্যাপী। কারন হচ্ছে, আমরা সবাই আত্মার মধ্যেই  অবস্থান করছি। আমি নিজেই আত্মা। অর্থাৎ যা আমি তাকে দেখবো কি করে। চোখ চোখকে দেখতে পায় না। হ্যাঁ, বলা যায়, আয়নার মধ্যে চোখ চোখকে দেখতে পায়। না আয়নার মধ্যেও চোখ, চোখকে দেখতে পায়  না। চোখের একটা অবয়ব দেখে মাত্র। এছাড়া আয়না আমাদের থেকে আলাদা বস্তু।  কিন্তু জগতে যেহেতু আত্মা ছাড়া কিছুই নেই, তাই আত্মা আত্মাকে দেখতে পায়  না। দেখা সম্ভবও নয়। আসলে  দেখতে গেলে দৃশ্য ও দ্রষ্টা দুইই দরকার। তো দ্রষ্টা ও দৃশ্য যদি এক হয়ে যায়, তবে কে কাকে দেখবে ?

তবে হয়, ব্যষ্টি  আমি সমষ্টি আমিকে  অনুভব করতে পারে। সেটা কি রকম। লবন যখন জলে গুলে যায় , আত্মা যখন পরমাত্মার সঙ্গে মিশে যায় অর্থাৎ একাত্ম বোধ করে,  তখন সে বাক্য  মনের অতীত, এক আপেক্ষিক জগতের উর্দ্ধে বাস করেন, সেটাই আত্মানুভূতি। এই অবস্থা দুর্লভতম।

মানুষের ভগবৎ অনুভূতি, একান্ত ভাবেই নিজস্ব অনুভূতি। এই অনুভূতি তার নিজের অন্তর থেকেই বিকাশ লাভ করে। আমাদের ঈশ্বর চেতনা  ও আমাদের ধর্ম্মবোধ দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্ত্বা। আমি হিন্দু জন্ম সূত্রে, আমি কৃষ্ণভক্ত পারিবারিক সূত্রে, এবং এসবের জন্য, আমার উপাসনা পদ্ধতি, আমার ধর্ম্ম সম্পর্কে মতামত, আমার আচার ব্যবহার, এমনকি আমার খাদ্যাভ্যাস আমাদের অজ্ঞাতসারেই গড়ে তুলেছি। কিন্তু সচেতনভাবে যেটা আমার মধ্যে গড়ে উঠেছে, সেটা হচ্ছে ঈশ্বর চেতনা। এই ঈশ্বর চেতনার সঙ্গে আমাদের পারিবারিক ধর্ম্মবোধের কোনো সম্পর্ক নেই। এর ভিত্তি হয়তো উপনিষদ। কিন্তু  আমার কল্পনা, আমার অন্তর্দৃষ্টি, আমার রসবোধ, আমার মনের সৃষ্টিকুশলতা, এগুলো আমাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করেছে। আমার অধ্যাত্ম চেতনা আমার একান্তই নিজস্ব, এবং   কোনো প্রচলিত ধর্ম্মপন্থার সঙ্গে হয়তো মিলবে না। তাই প্রত্যেক মানব হৃদয়ের সহজাত ভগবৎ প্রেমই আসলে  মানুষের ধর্ম্ম, মানবতার প্রকাশ, যা তথাকথিত  জাতিহারা, ধর্ম্মহারা।

প্রত্যেক মানুষের জীবনে এই ডাক অবশ্য়ই আসবে। যদি এ জীবনে না আসে তবে আগামী জীবনে আসবে। এটাই আমাদের জীবন জিজ্ঞাসা। এই  ডাক আসে মানসিক পূর্ণতার আকুতি নিয়ে। এই ডাকই মুক্তির ডাক, অন্য কোথাও  বেরিয়ে পড়ার  ডাক। নিশির ডাক শুনেছেন কখনো ? গভীর রাতে, নির্জন-নিশুতি রাতে, জীবনে যখন আমরা একা হয়ে যাই, তখন এই ডাক আসে। তখন অন্তরের গভীর থেকে একটা দীর্ঘ-শ্বাস বেরিয়ে আসে। কেন এসেছিলাম ? কেন বার বার আসতে  হয় ? কেন ভুলে যাই ? কেন কেউ কথা রাখে না। ছুটে  বেরিয়ে যাই এই দৃশ্যমান জগৎ থেকে। কোথায় ছুটে  চলেছি, তাতো জানিনা । কিন্তু অবিরাম এক অনন্তের  আকর্ষণ, দুর্নিবার এই আকর্ষণ। শঙ্খচিল ওই উর্দ্ধ-গগনে কিসের আশায় ঘুরে বেড়ায়।  মন কিসের আশায় ছুটছে, প্রান্ত থেকে দিগন্তে  ?  শুদু ছুটেই চলেছি, ছুটেই চলেছি। .. ......

যুক্তি-তর্ক  যতক্ষন জাগবে, ততক্ষন উটের কাঁটাগাছ খাওয়ার মতো হবে আমাদের। মনিবের কাজ ঘোড়াকে জলের কাছে নিয়ে যাওয়া। ঘোড়া যদি তৃষ্ণার্ত হয় সে অবশ্য়ই জলপান করা শুরু করে দেবে। কেননা সে-তো তৃষ্ণার্ত। জল পান-করা ঘোড়ার কাজ, মনিব কখনো জল-পান করাতে  পারে না। ইচ্ছে যত গভীর হবে, উপায় তত কাছে আসবে।  আসবেই।

বর্তমানে,  যোগ সম্পর্কে সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এছাড়া আছে প্রাচ্যের অধ্যাত্ম সাধন পথের  প্রতি পাশ্চাত্যের একটা আকর্ষণ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার মোহ, বস্তুতান্ত্রিক সংস্কৃতির আকর্ষণগত দোষ  পশ্চিমের মানুষকে ধীরে ধীরে উদাস করে দিচ্ছে। এর থেকে বেরিয়ে অসংখ্য পশ্চিমবাসী পুবের দিকে মুখ ঘোরাচ্ছে। ভাবছে, এত অভাবের মধ্যে থেকেও এঁরা, এই প্রাচ্যবাসী  শান্ত থাকে কি করে ?, এমনকি প্রাচুর্য থেকে বেরিয়ে এসে কিছু মানুষ অভাবকে বেছে  নিচ্ছে কেন ?  এই প্রাচ্যদেশবাসী কোন ভবিষ্যতের নতুন জীবনের দিকে ধাবিত হচ্ছে ? কোন সত্য তারা অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছে ? এই চিন্তাধারার নতুন জীবনের  একটা বৌদ্ধিক কারন তারা খুঁজতে চাইছে।
আবার কেউ কেউ অলৌকিক উদ্ভুতূড়ে তথাকথিত ধার্মিক কর্ম্মকান্ডের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে।
আবার অল্প  কিছু সংখ্যক  মানুষ আছেন, যারা খাঁটি তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে প্রবলভাবে ইচ্ছুক। তাঁরা আধ্যাত্মিক জগতের যথার্থ অনুভূতি লাভ না করে থামতে জানেন  না। আমরা সেই অপেক্ষাকৃত সংখ্যায় কম কিন্তু  সত্য সন্ধানী ও সাহসী  মানুষগুলোর পাশে আছি।

দেহ থাকলে দেহের কষ্ট থাকবে। কিন্তু দেহের কোনো কষ্টই সারাজীবন ভোগ করতে হয় না। শিশু থেকে বৃদ্ধ আমাদের হতেই হবে। দেহের কষ্ট নিরসন নিশ্চই জরুরী। কিন্তু মনের কষ্ট আমাদের সারাজীবন ভোগ করতে হয়। আমাদের মনে যে ঝড় বইছে, তার সঙ্গে দেহের কষ্টের কোনো তুলনাই  হয় না। যতদিন আমরা জীবনে সুখ চাইবো, ততদিন দুঃখ আমাদের কাছ  ছাড়া  হবে না। আমাদের নিজেদেরকে তৈরী হতে  হবে, ঈশ্বরের ভীষণ ও সুন্দর রূপ দুটোই পেরিয়ে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছনোর জন্য। তবেই আমরা সত্যিকারের শান্তি ও নির্মল আনন্দ ভোগ করতে পারবো।   সত্যের কাছাকাছি যখন আমরা পৌঁছবো, তার আগেই আমাদের মধ্যে সত্যের বিনাশ-ক্রিয়া শুরু হবে। আমাদের যে মিথ্যে আশা, আমাদের যে মিথ্যে একাত্ত্ববোধ, আমাদের যে আকাঙ্ক্ষা, আমাদের যে মিথ্যে মোহ, আমাদের যে মিথ্যে  ভালোবাসা এগুলো ধংশের একটা প্রক্রিয়া শুরু হবে। আর এই ধংশের পরেই সত্য   প্রকাশিত হবে। তাই আমাদের লক্ষে স্থির থাকতে হবে। আমাদের মায়া, মোহ, মিথ্যে ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষা সব, এই সত্যপথের দিশারী চিতায় তুলে দেবেন। আমাদের এর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এইসময় আমরা যেন বুদ্ধি দিয়ে ভোগকে সমর্থন করে না বসি। লক্ষ্যে স্থির থাকলে, আমরা অবশ্য়ই সত্যে স্থিত হবো। তখন সব কর্ম্ম-ই হবে ঈশ্বরের, তখন সব আকাঙ্ক্ষা হবে ঈশ্বরের, আমি নিমিত্ত্ব হয়ে, পরম-আনন্দ ভোগ করতে থাকবো।

এই  দৃশ্যমান জগৎ সত্য না মিথ্যা, এই অনুসন্ধান ক্রিয়া করতে গিয়ে আমাদের সময় নষ্ট করা উচিত নয়। যা আমাদের করা উচিত তা হচ্ছে, ঈশ্বরের সত্যতার উপরে জোর দেওয়া এবং ঈশ্বরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের  দৃঢ় অনুভবের জন্য সচেষ্ট হওয়া। 

আপনি কোন ধর্ম্মের মানুষ সেটা বড়ো  কথা নয়, আপনি কার উপাসনা করছেন, সেটাও বড়ো কথা নয়। আপনার চেতনা কতটা একাত্মতা অনুভব করছে সেটাই বড়ো কথা। আপনার এই একাত্মতার অনুভূতি সেই জ্ঞানাতীত নিরপেক্ষ অবস্থার দ্বার খুলে দেবে। আমি সেই মহৎ পুরুষকে অনুসরণ করবো, যার সঙ্গে আমার মানসিক প্রবণতার সাযুজ্য আছে, যিনি আমাকে আমার আদর্শ অনুযায়ী তৃপ্তি দিতে পারেন। ধর্ম্ম বিষয়ে যারা গোঁড়া  তারা সাধারণত এই গুরুত্ত্বপূর্ন সত্যটি উপলব্ধি করতে পারেন না।

আমাদের সুখ-নিদ্রার পর শরীরে ও মনে নতুন শক্তি, নতুন উদ্দমের বোধ হয়।  ঠিক তেমনি ঠিক ঠিক ধ্যানের  পরেও আমাদের এই রকম বোধ হবে, সঙ্গে যোগ হবে তীব্র সুখের অনুভূতি। মনের সংযম ও ধ্যান একসাথেই অভ্যাস করতে হবে। আপনি শুধু মনে মনে ভাবুন, আমি শুদ্ধ, আপনি শুধু মনে মনে ভাবুন, আমি পবিত্র। হোক না সেসব কল্পনা, আপনার এই ভাবনা আপনাকে সত্যি সত্যিএকদিন  শুদ্ধ ও পবিত্র করে তুলবে। আর আপনার ধ্যানের গভীরতাও বাড়তে থাকবে।

নিরাকারের উপাসনা শ্রেষ্ট, কিন্তু আমাদের অনেকের নাগালের বাইরে। আবার সাকারে আমাদের তত্ত্বান্বেষী মন কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারে না। এই জন্য, যারা সাকার ও নিরাকার অর্থাৎ উভয় পথ অবলম্বনের কথা বলে, সেখানে বেশিরভাগ মানুষ আকৃষ্ট হয়। এবং সেই সব ধর্ম্মীয় সম্প্রদায় বেশী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যোগেশ্বর  শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, অব্যক্তের উপাসনা কষ্টকর, এমনকি সময়সাপেক্ষ। কিন্তু  ভক্ত যখন সমস্ত কর্ম্ম তাঁর উদ্দেশ্যে করে, একাগ্রতার সঙ্গে তারই ধ্যান করে, তখন ভক্ত তাতেই গতিপ্রাপ্ত হয়। আবার খাঁটি ভক্ত আকৃতিবিশিষ্ট ঈশ্বরের উপাসনা করেই থামতে পারে না। তাঁর কাছে ক্রমশঃ এই আকার বা মূর্তি ঈশ্বরের গুণরাশিতে পরিণত হয়। তখন সে সর্বভূতে তাঁরই অধিষ্ঠান অনুভব করে। আর উচ্চারিত হয় "একম-এব-অদ্বিতীয়ম" ।

আমরা সাধারণত কারন ছাড়া কিছু করি না। আমরা যে হাসি তার একটা কারন আছে, আমরা যে কাঁদি তারও একটা কারন আছে।  আমরা যে কথা বলি তার একটা কারন আছে। আমরা যখন চচুপচাপ  থাকি তারও একটা কারন আছে। আমরা কারন ছাড়া কিছুই করি না। এই জায়গা থেকে ক্ষাণিকক্ষনের জন্য একটু বেরিয়ে আসার চেষ্টা করুন। আপনার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিন। আপনি নিজেকে ছেলেবেলায় নিয়ে যান। আপনি নিজেকে মায়ের কোলে নিয়ে যান। আর নিজেকে মনে করুন, আপনাকে মা বুকের দুধ খাইয়ে, আপনার সাথে কথা বলছেন, তার ভাষা আপনি কিছু বুঝছেন না, কিন্তু আপনি হাসছেন। আপনার গলা থেকে একটা অর্থহীন ধ্বনি বেরুচ্ছে।   আপনি হাত পা ছুড়ছেন। আপনার ভিতরে একটা আনন্দ হচ্ছে। আপনি এই অবস্থায় মায়ের আদরকে উপভোগ করতে থাকুন। হোক না এসব কল্পনা, হোক না এসব কৃত্তিম।  আপনি এটা করে দেখুন, নিজেকে খুঁজে পাবেন।

যোগ-সাধন দুই প্রকার। আক্ষরিক অর্থে দুটোই ক্রিয়া যোগ। একটা যোগে শরীর থেকে মনে যেতে হয়। আর একটা যোগ সরাসরি মন থেকেই ক্রিয়া শুরু করে। হঠ যোগ আসলে শরীর থেকে মনে যাবার পদ্ধতি। এর জন্য প্রাণায়াম,কুম্ভক, নির্জন বাস ইত্যাদি প্রয়োজন। আর একটা যোগ, শুধু মনের ভাবনাকে পরিবর্তন করবার পদ্ধতি। দুটোর জন্যই অভ্যাসের প্রয়োজন। অভ্যাসের মাধ্যমে যদি চিত্তে চিন্ময়মূর্তি প্রতিফলিত করতে পারা  যায়, যদি আমাদের সদবৃত্তিগুলোকে আলোচনা ও অনুশীলনের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করে তুলতে পারি, তবে আমরা তাৎক্ষণিক যোগ-সাধনের ফল পেতে পারি। তাই অষ্টাবক্র মুনি  বলছেন, মুক্তিম ইচ্ছসি চেত্তাত বিষয়ান্ বিষবৎ ত্যজ(১/২) – মুক্তির ইচ্ছা চিত্ততে জাগলে বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করো । 


পুঁথির পান্ডিত্য ধর্ম্মের ভেকধারী অন্তঃসারশূন্যতা জ্ঞান নিয়ে, মিথ্যে গায়ে ভষ্ম মেখে, মাথায় জটাভার  বহন করে, ঘরে প্রদীপ জ্বেলে, ঈশান কোনে বসে, মিথ্যে পূজার ভান করে। চোখদুটো স্থির করে, আসনবন্দী হয়ে, ধন্ধে পড়া মানুষগুলোর কানে ফিস্ ফিস্ করে মন্ত্র দেয়। এরা  শাস্ত্রের বাইরের দিকটা দেখে, তত্ত্ব রসামৃত পান করতে পারে না, সে সম্পর্কে চিন্তাও করতে পারে না। এরা সেই মৌমাছি, যারা পাকা বেলের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে বেলের চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরা নিজেরাও পথ খুঁজে পাচ্ছে না, অন্যকেও পথ দেখতে পারে না।

আমাদের সবার জীবনে অনেক সমস্যা আছে। তবে এটাও ঠিক, আমরা অনেক সময় ছোট খাটো সমস্যাকেও বড় করে ভাবতে ভালোবাসি। কোনো তুচ্ছ ঘটনাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে ভাবার একটা প্রবৃত্তি আছে, আমাদের মধ্যে। অফিসে যেতে দেরি হচ্ছে, বাসটা দেরি করেছে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আমরা আমাদের জীবন বিপন্ন করে ফেলি। ছেলেটার চাকরি হচ্ছে না, ভাবতে ভাবতে ছেলেটাকে গালাগাল করি। মেয়েটা কার সঙ্গে মিশছে, এই সন্দেহে গোয়েন্দাগিরি শুরু করি। অহেতুক মেয়েটাকে কষ্ট  দেই। মেয়েটা নিজের পছন্দের মত ছেলেকে বিয়ে করতে চায় শুনে, আমার বুকে ব্যথা শুরু হয়ে যায়। আমরা সবাইকে আমার মতো ভালো করতে চাই।
এই ভুলগুলো, আমাদের জীবনে অহেতুক বিপর্যয় ডেকে আনে। ছেলেটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।  মেয়েটা আত্মহত্যা করে। এখান  থেকে বেরিয়ে আসুন। সবাইকে তার মতো করে বাঁচতে দিন। আপনি আপনার মতো করে বাঁচুন । আপনার মনকে বিরক্ত করতে পারে, এমন চিন্তা থেকে দূরে থাকুন। আপনি তো সব সমস্যার সমাধানের দায়িত্ত্ব নিয়ে বসে নেই। বরং সাবধানী হন আর আপনার ভিতরে যে সৃজনশীল ক্ষমতা আছে, সেটিকে জাগিয়ে তুলুন। আপনার মনে দুশ্চিন্তা এলে, সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে, সেইমত কাজে নেবে পড়ুন। দুশ্চিন্তা দূর করবার, প্রথম উপায়, সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া, ও সময়মতো কাজে নেবে পড়া। ফল ভগবানের হাতে ছেড়ে দিন। ভগবান অলসকে সাহায্য করেন  না, ভগবান উদ্যোগীকে সাহায্য করেন । কাজের মধ্যে ডুবে থাকুন, দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যাবে। কিছু না পারেন, ভালো বই পড়ুন। বাগান করুন। গান করুন। আর সব সময় মনে রাখবেন, ভগবান সবসময় আপনাকে রক্ষা করছেন। অবশ্য়ই রক্ষা করছেন, তা না হলে আমরা কেউ বাঁচতেই পারতাম না।

উপনিষদ বলছেন - আত্ম-উপল্বদ্ধিহীন মানুষ মনে করেন, মন  কিছুতেই আত্মার উপরে নির্ভরশীল হতে পারে না। বরং মন হচ্ছে আত্মার মতোই স্বতন্ত্র একটা সত্তা। এঁদের জন্য, ভয় ও দুঃখকে দূর করবার উপায় হচ্ছে মনকে সংযত করা।  কারন অসংযত মন-ই সমস্ত দুঃখের কারন। যাদের বুদ্ধি ও বিবেক সামঞ্জস্যপূর্ন  নয়, মন তাদের অশান্ত হবেই। অন্যদিকে, আত্মজ্ঞানী মানুষের মন সম্পূর্ণ সংযত। কারন, তাঁরা নিশ্চিত রূপে জানেন, আত্মাই সত্য, মন বা ইন্দ্রিয় নয়। এঁরাই মোক্ষলাভে সমর্থ হন, শান্তিতে থাকেন। এঁরা  কোনো কিছুর উপরেই  নির্ভর করেন না।  কোনো আচার-অনুষ্ঠানের ধার ধারেন না। সকল কর্তব্য থেকেও এঁরা মুক্ত।

উপনিষদ বলছেন - তিনি তো নিত্যপ্রকাশ স্বরূপ। তিনি তো আমাদের সকলের হৃদয়গুহাতে বাস করেন। তিনিই সর্ব্বভূতের আশ্রয়। তিনি  সচল-অচল, সজীব-নির্জীব, স্পন্দন-স্পন্দনহীন সমস্ত কিছুতেই প্রতীয়মান। তিনি দৃষ্টিগোচর আবার অদৃশ্যও বটে। ইনি ইন্দ্রিয়গোচর নন। ইনিই সেই আত্মা, পরমজ্যোতি। তাঁকে দেখবার  জন্য কোনো আলোর প্রয়োজন পড়ে না, তাঁকে জানবার জন্য কোনো জ্ঞানের প্রয়োজন পড়ে না। আত্মার প্রকাশ অনাত্মাকে আচ্ছাদিত করে দেয়। অনাত্মা আর  আত্মাতে তখন কোনো বিভেদ থাকে না। তিনি সন্নিহিতম - পূর্ণভাবে বিরাজমান।

আমাদের  ভাবনা আমাদেরকে  গন্ডিবদ্ধ করে রাখে। কিছু মানুষ আছেন, যারা সংসার অর্থাৎ পরিবার পরিজনের  সম্পর্ককে আঁকড়ে বেঁচে থাকেন। তারা যা কিছু করেন, সবই হয় নিজের বা সংসারের সভ্যদের জন্য । আবার কিছু মানুষ আছেন, যারা গ্রামের মানুষের জন্য কিছু কাজ করেন। কিছু মানুষ আছেন তারা তার রাজ্যের জন্য চিন্তা করেন। কিছু মানুষ আছেন দেশের জন্য চিন্তা করে থাকেন। কিছু মানুষ আছেন, যারা পৃথিবীর মানুষের জন্য চিন্তা করে থাকেন। কিছু মানুষ আছেন, তারা শুধু মানুষ নয়, পশুপাখীর জন্যও চিন্তা করে থাকেন। আমাদের এই চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদেরকে সেই সীমাবদ্ধ গন্ডির একজন বলেই মনে করি, কিন্তু পরিসরের  ফারাক মাত্র, এঁরা  সবাই আসলে স্থুল  জগতেরই  বাসিন্দা। পার্থক্য শুধু চিন্তায় ও কার্যের পরিসরে।
এরও ঊর্দ্ধে একদল মানুষ আছেন, যারা ব্রহ্মান্ড সম্পর্কে চিন্তা করেন। যারা নিজেদেরকে অসীম ব্রহ্মান্ডের এক ক্ষুদ্র বাসিন্দা বলে করেন, এরাই আসলে  সূক্ষ্ম জগতের বাসিন্দা । এঁরাই প্রকৃত আমিকে, উপলব্ধি করেন। সবাই মানুষ, শুধু ভাবনার পার্থক্যের জন্য, আলাদা হয়ে যাই আমরা।
ক্ষমাপ্রার্থনা।
বিসর্গ বিন্দুমাত্রানি পদপাদাক্ষরানি চ।  ন্যূনানি চাতিরিক্তানি ক্ষমস্ব পরমেশ্বর। অপরাধ সহস্রাণি ক্রিয়ন্তে অহৰ্নিশং ময়া। তানি সর্বানি মে দেব ক্ষমস্ব পুরুষোত্তম।।
মধ্যে মন্ত্রতন্ত্র স্বরবর্ণ ধ্যাননিয়ম ন্যূনাতিরিক্ত লোপদোষ  প্রায়শ্চিত্তার্থং অচ্যূতানন্তগোবিন্দ নামত্রয় মহামন্ত্রজপং করিষ্যে।
অচ্যুতায় নমঃ।  অনন্তয়  নমঃ। গোবিন্দায় নমঃ। 
অচ্যুতায় নমঃ।  অনন্তয়  নমঃ। গোবিন্দায় নমঃ।
অচ্যুতায় নমঃ।  অনন্তয়  নমঃ। গোবিন্দায় নমঃ।
কায়েন বাচা মনসেন্দ্রিয়য়ৈর্বা বুদ্ধাত্মনা বা প্রকৃতেঃ স্বভাবাৎ। করোমি যদ্যৎ সকলং  পরস্মৈ   নারায়ণায়েতি সমর্পয়ামি।
ওং তৎসৎ।।

হে পরমেশ্বর, বিসর্গ, বিন্দু, মাত্র, পদ, পাদ, অক্ষর সমূহের অল্পতা ও অতিরিক্ততা ক্ষমা করো। আমা  কর্তৃক দিবারাত্র সহস্র সহস্র অপরাধ করা হচ্ছে, হে দেব, পুরুষোত্তম ! আমার তৎসমূহ ক্ষমা করো। মন্ত্রতন্ত্র মধ্যে স্বর, বর্ণ, ধ্যান নিয়মের অল্পতা, অতিরিক্ততা ও লোপ দোষ প্রায়শ্চিত্বের জন্য, অচ্যুত, অনন্ত ও গোবিন্দ এই নামাত্রয়রূপ মহামন্ত্র জপ করছি।
অচ্যুতকে নমস্কার। অনন্তকে নমস্কার। গোবিন্দকে নমস্কার।
অচ্যুতকে নমস্কার। অনন্তকে নমস্কার। গোবিন্দকে নমস্কার।
অচ্যুতকে নমস্কার। অনন্তকে নমস্কার। গোবিন্দকে নমস্কার।

কায়, বাক্য, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি দ্বারা অথবা প্রকৃতি স্বভাববশে  যা যা করছি তৎ সমুদয় পরমসত্তা নারায়ণকে সমর্পন করি।
ওং তৎ সৎ।

 কল্পনা করুন, শরীর একটা মন্দির। আর এই শরীরের হৃদয়দেশ হচ্ছে মন্দিরের গর্ভগৃহ। এই গর্ভগৃহে যেমন ভক্তকে দেখতে পাওয়া যায়, তেমনি দেখতে পাওয়া যায় দেবতাকে। আমাদের কাজ হচ্ছে এই দুইয়ের মিলন ঘটানো। আমাদের এই শরীর মন্দিরটি বড্ড অদ্ভুৎ। স্থুল এই শরীরে অনুরূপে প্রবিষ্ট হয়ে আছে সূক্ষ্ম শরীর। আর সূক্ষ্ম শরীরে প্রবিষ্ট হয়ে আছে জীবাত্মা। জীবাত্মাতে প্রতিফলিত হচ্ছেন পরমাত্মা। এই শরীরগুলো সম্পর্কে আমরা যখন সচেতন হবো, তখন আমাদের ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধি এই সূক্ষ্ম শরীরের সঙ্গে একাত্মবোধ করবে। এবং আমরা আমাদের অন্তরে বিভাসিত এক দিব্য  আলোকের আভাস পাবো। এইভাবে আমরা আমাদের হৃদয় গহ্বরে প্রবেশ করে পরমজ্যোতির আলোকে আলোকিত হয়ে উঠবো।

আমরা সবাই এক। পার্থক্য হচ্ছে আমাদের ভাবনায়। আর এই ভাবনাই আমাদেরকে নাম ও রূপের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে ফারাক করেছে। আমরা জানি, ভাবনা একটা তরঙ্গ  সৃষ্টি করে। আর যার যেমন ভাবনা সে সেই তরঙ্গে অবস্থান করেন । আমার ও আপনার মধ্যে যখন এই ভাবনার সাযুজ্য দেখা দেবে, তখন জানবেন, আমরা  একই  তরঙ্গে বা একই জগতে অবস্থান করবো। আর আমাদের ভালোলাগা মন্দলাগা, আমাদের উপলব্ধি-অনুভূতি সবই  এক হয়ে যাবে। তা সে আপনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন। আমার এই স্থুলদেহ  আপনি দেখতে পাচ্ছেন কি দেখতে পাচ্ছেন না, সেটা বড় কথা নয়। আমরা একজন আর একজনকে তখন বুঝতে পারবো। আর এক-আত্মা এক-প্রাণ হয়ে যাবো। আমরা এক, আমাদের মিলনও  শাশ্বত।  কারুর সাধ্য নেই আমাদের বিচ্ছিন্ন করে। শুধু ভাবনার জগৎ, শুধু ভাবনার তরঙ্গ যেন একই ধারায় প্রবাহিত  হয়।

১৭১২  কাছাকাছি একটা সময়।  ভদ্রলোক চায়ের দোকানে চা পান করবেন বলে বেঞ্চে বসে  আছেন। দোকানদার কেটলিতে করে, কাঠের উনুনে জল  জ্বাল দিচ্ছেন। হঠাৎ ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন, বাড়িতে যাবার জন্য দৌড়   লাগালেন।  চায়ের দোকানদার তো অবাক। পাগল নাকি ?  তো তিনি পরীক্ষাগারে গিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন, ..... আর আবিষ্কার করলেন, এক যুগান্তকারী জিনিষ,  বাষ্পচালিত ইঞ্জিন। যা মানুষের সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে চললো। ভদ্রলোকের নাম থমাস নিউকেন (Thomas Newcomen ) . চা তো আমরা প্রতিদিনই খাই,  কেটলিতে জল জ্বাল দিতেও দেখি।  জ্ঞান আমাদের কজনের হয় ? কিংবা গাছ থেকে আপেল পড়া বা আম পড়া আমরা প্রতিদিন দেখি কিন্তু কজন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কথা ভাবতে পারি ? আসলে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আমাদের মধ্যে আছে।  প্রশ্ন যত  গভীর হতে থাকে, উত্তর তত আলোকপ্রাপ্ত  হয়। আর একসময়, বিদ্যুতের ঝলকানির মত তা আমাদের মনের  পর্দায়  ভেসে ওঠে। এই ঝলকানিটাকে বলা হয় সজ্ঞা। পান্ডিত্য বাইরে থেকে সংগ্রহ করা যায়, কিন্তু সজ্ঞা আপনা-আপনি ভেসে ওঠে মনের গভীরে। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর প্রথম থেকেই আমাদের মনের গভীরে গ্রোথিত থাকে। কিন্তু তা আমাদের নজরে পড়ে  না।  কিন্তু মন যখন ধ্যানের  সাহায্যে একমুখী হয়, একাগ্র হয়, অমনি উত্তরটি আমাদের  চেতনার স্তরে ভেসে ওঠে। এই সজ্ঞাই  মুনিঋষিদের ঈশ্বর সম্পর্কে জ্ঞান লাভে একমাত্র অবলম্বন।

অধ্যাত্ম সাধকের তিনটে জিনিষ, নির্দিষ্ট করে নিতে হয়। এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে, চেতন-কেন্দ্র। প্রতিদিন নির্দিষ্ট চেতন কেন্দ্রেই ধ্যান করুন। সাধারণের জন্য হৃদয়কেন্দ্র বা অনাহত চক্র কার্যকরী ও নিরাপদ। দ্বিতীয় হচ্ছে, একটি পবিত্র রূপ তা সে আলোর বিন্দু হতে পারে, সূর্য্য হতে পারে, কোনো দেবমূর্তি হতে পারে, বা কোনো মহাত্মার রূপচিত্র হতে পারে। এই রূপের ধ্যান করুন, আপনার নির্দিষ্ট কেন্দ্রে। তৃতীয়তঃ একটি পবিত্র মন্ত্র ঠিক করুন, অর্থাৎ গুন্ বর্ণন বা স্তুতি বা প্রার্থনা । এই মন্ত্র বার বার আবৃত্তি করতে থাকুন। এবং মন্ত্রের  অর্থচিত্র মানসপটে আঁকুন।  এবং আপনার সেই পবিত্র রূপের মধ্যে আরোপ করতে থাকুন। মনকে স্থির রাখুন চেতনাকেন্দ্রে-রূপ-নামের মধ্যে। এতে করে মনকে স্থির ও শান্ত রাখা সম্ভব হবে, উদ্বেগ চলে যাবে, ভয় দূর হবে ।

সূক্ষ্ম শরীরের স্বপ্ন : পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, আমরা যে স্বপ্ন দেখি তা দুই রকম। এক স্থূল দেহের স্বপ্ন।  আবার সূক্ষ্ম  দেহের স্বপ্ন। স্থূল দেহের স্বপ্ন আমাদের শরীরকে ঘিরে হয়ে থাকে। আমাদের যদি পেট খারাপ হয়, তবে আমরা খাবার স্বপ্ন দেখতে পারি। স্বপ্ন দেখতে দেখতে বাচ্চারা হিসি করে দেয়। স্বপ্ন দেখছে, কেউ তাকে চেপে ধরেছে।

স্বামীজী বলছেন, আমাদের শরীর আসলে একটা আলোর তরঙ্গ।  নিজের ভিতরে একটা প্রদীপ শিক্ষা জ্বেলে দিন । আর মনে করতে থাকুন , দেহটা সেই প্রদীপের আভা। শুধু ভাবুন, আর সারাক্ষন এই ভাবনাটাকে জাগিয়ে রাখুন। সারাদিন, এই ভাবনার মধ্যে নিজে রেখে দিন। শুধু দিনের বেলা এটা  করতে থাকুন। তিন মাসের মধ্যেই, অন্যরা আপনার স্থুল দেহের চারিপাশে একটা আলোর আভা  দেখতে পাবেন । আপনি কাউকে কিছু বলতে যাবেন না।  যখন অন্যরা আপনার দেহের চারিপাশে এই আলোর আভা দেখতে পাবেন , তখন পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু করুন, আপনি যখন ঘুমুতে যাচ্ছেন, তখনও এই ভাবনাটাকে জাগিয়ে রাখুন। আর এই কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ুন। প্রথম প্রথম এই অবস্থায়, আপনি স্বপ্ন দেখবেন , আপনার ভিতরে একটা আলোর  শিখা। আর এতে করে আপনার ঘুম গভীর  হবে। এর পরে আপনার  স্বপ্নদেখা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু বুঝতে পারবেন, আপনার দেহ ঘুমিয়ে আছে, আর আপনি একটা আলোর "শিখা" জেগে আছেন। এই অবস্থাকে বলে তুরীয় অবস্থা। আপনি চেতন কিন্তু আপনার শরীর নিদ্রিত। এই অবস্থাকে গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সবাই যখন ঘুমায়, যোগী তখন জেগে থাকেন। আসলে শরীরের বিশ্রাম দরকার, শরীরের খাদ্য দরকার, চেতনার কোনো বিশ্রাম দরকার নেই, খাদ্যেরও দরকার নেই। এই অবস্থায়, আমাদের মনের অভাববোধ, মানসিক কষ্টবোধ, মানসিক অস্থিরতা দূর হয়ে হবে। আমাদের কর্ম্ম হবে নিরাসক্ত, প্রারব্ধ কর্ম্ম মাত্র।

আমার একসময় অনেক সাফাই কর্ম্মচারী বন্ধু ছিল। তারা প্রায়ই আমার কাছে দু-চার টাকা ধার চাইতো। আর যে ধার নিতো দুচার মাস সে আর আমার ধারে কাছে ঘেঁষতো না। তো যাকে  আমার ভালো লাগতো না, তাকেই আমি বেশি করে টাকা ধার দিতাম। তো একদিন হলো কি, এক অতি দুস্থ বন্ধু এলো আমার কাছে সাহায্যের জন্য। আমার কাছে সেদিন দেবার মতো টাকা ছিল না। তো আমি এক বন্ধুকে কিছু টাকা দিতে বললাম। সে তখন আমাকে একটা অদ্ভুত কথা জিজ্ঞেস করলো, "মরে যাবে না তো ?" তো আমি তাকে বললাম, বেঁচে থাকলে তুমি কি করবে ?  আমরা কাঁদতে কাঁদতে জন্মাই, আবার কাঁদতে কাঁদতে মরি।  আমরা ভালো জায়গা থেকে আসিও না, ভালো জায়গায় যাইও না। আমরা কতদিন বাঁচবো, কেন বাঁচবো, বেঁচে থেকে কি করবো, তা আমরা কেউ জানিনা। তবে তোমার টাকা তুমি আমার কাছে পেয়ে যাবে। এবং সেটা আমি মরবার আগেই, হয়তো কালই পেয়ে যাবে। তুমি টাকাটা পেয়ে কি করবেসেটা ভেবে রেখো, অবশ্য সেটা তোমার ব্যাপার।

আমাদের যার যেমন বুদ্ধি, যার যেমন ভাব, সেই মতো আমরা ঘটনার বিশ্লেষণ করি।  ঘটনা একই, কিন্তু তার প্রভাব আমাদের বিভিন্ন জনের মধ্যে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়। এর মধ্যে কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে  এর বিচার করা যায় না। ঠাকুর রামকৃষ্ণ অসুস্থ।  কতদিনে তাঁর শরীর সুস্থ  হবে, সেই নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। নাট্যসম্রাট মহাকবি গিরিশচন্দ্র ও তার কিছু ভক্ত ভাবতেন, যুগাবতারের দেহব্যাধি মিথ্যা ভান  মাত্র। বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, তিনি এইসব লীলার আশ্রয় নিয়েছেন।
অপর একদল বলতেন, যে জগদম্বার অভিপ্রায় অনুসারে ঠাকুর পরিচালিত হয়ে থাকেন, সেই মহামায়াই আপন গূঢ় উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য, ঠাকুরের শারীরিক ব্যাধি ঘটিয়েছেন। এবং জনকল্যাণসাধক সেই অভিপ্রায় সিদ্ধ হলে মা তাঁকে সুস্থ করে দেবেন। আর সেই তাৎপর্য হয়তো  ঠাকুরের কাছেও অজ্ঞাত।
আর একদলের মত, জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি প্রভৃতি দেহমাত্রেরই ধর্ম্ম। ঠাকুরের ব্যাধিও ও প্রাকৃতিক নিয়মেই উপস্থিত হয়েছে। এর মধ্যে কোনো রহস্য অনুসন্ধান করা বৃথা। এই মতের প্রবক্তা ছিলেন, নরেন্দ্রনাথ। এঁরা ঠাকুরকে সুস্থ করবার জন্য কোনো কাল্পনিক তত্ত্বের গোলকধাঁধায় না গিয়ে ডাক্তারের সাহায্য নিতেন। এবং সাধনমার্গে ঠাকুরের নির্দিষ্ট পন্থা অবলম্বন কর্তব্য বলে মনে করতেন।

অমরত্বের জন্য মানুষ যুগ যুগ ধরে সাধনা করে যাচ্ছে। কিন্তু অমরত্বের বর,  ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব   কেউ দিতে রাজি নয়। আসলে আমরা সবাই অমর। এই কথাটা আমরা জানিনা বলে, আমরা অমরত্বের জন্য লালায়িত। আমরা অজ্ঞতাবশতঃ নিজেদেরকে দেহ বলে মনে করি। আর দেহের নাশকে আমরা মৃত্যু বলে মনে করি। কিন্তু দেহ  আসলে আত্মায় আরোপিত একটা প্রাকৃতিক বস্তুর  সত্ত্বা মাত্র। আর প্রাকৃতিক বস্তু প্রতি নিয়ত পরিবর্তনশীল। এটাতো আমরা চাক্ষুস দেখতে পাচ্ছি। তাই  এই দেহবোধ থেকে নিজেকে যেদিন মুক্ত করতে পারবো, যেদিন আমরা নিজেদেরকে আত্মা বলে চিনতে পারবো, সেদিন আমরা জন্ম-মৃত্যুর পারে চলে যাবো। একেই বলে অমরত্ব।  অমরত্ব আমাদের স্বাভাবিক গুন। এর জন্য আমাদের কোনো প্রয়াস করতে হয় না। দরকার শুধু ধারণার পরিবর্তন।

এক বিখ্যাত মঠাধিস এসেছেন শহরে। তো স্বামীজীর ভক্তরা তাঁকে ধরে বসলেন,  ব্রহ্মবিদ্যার কথা শুনতে চান। স্বামীজী ঘাড়  নাড়লেন। ভক্তরা বুঝলো, স্বামীজী তাদের আবদারে রাজি হয়েছেন। তো সন্ধ্যে বেলা বিশাল হলঘরে সমাবেশ-এর ব্যবস্থা করা হলো। হাজার হাজার ভক্ত তার বাণী শুনবেন বলে দূর-দূরান্ত থেকে  সমবেত হলো। স্বামীজী সময়মতো স্টেজে এলেন। হাতে একটা গোলাপ ফুল। গোলাপের গন্ধ নিচ্ছেন বার বার। সবাই ভাবলো, স্বামীজিকে হয়তো কেউ গোলাপটা উপহার দিয়েছে। স্বামীজী হাসছেন, আর গোলাপের গন্ধ নিচ্ছেন। ৫মিনিট কেটে গেল।  স্বামীজী কোনো কথা বলছেন না।  গোলাপের গন্ধ নিচ্ছেন বার বার, আর হাসছেন। ১০ মিনিট কাটলো, স্বামীজী কথা বলছেন না। আধাঘন্টা কেটে গেল স্বামীজী কথা বলছেন না। সবাই বিরক্ত হলো। গুঞ্জন উঠলো। স্বামীজী এবার উঠলেন।  হাসতে হাসতে  বেরিয়ে গেলেন। এক শিষ্য স্টেজে এসে বললেন, বিষয় বড়ো গম্ভীর। ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

আজ একটা মজার খেলার কথা বলবো। বাড়িতে ঠাকুরঘর আছে ? নেই, ঠিক আছে, বাড়িতে কাঁসর-ঘন্টা আছে নিশ্চই।  তো কাঁসর ঘন্টাটি নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ান। ঠাকুরঘর থাকলে, ঠাকুরঘরেই কাসঁর ঘন্টা নিয়ে দাঁড়ান। কাঁসর ঘন্টা বাজাতে হবে। কিন্তু না এখনই নয়।  একটু অপেক্ষা করুন। মনে করুন, আপনি বাঘের সামনে পড়েছেন,  ৫-হাত দূরে বাঘটি ঘাপটি মেরে বসে আছে। আপনার ঘাড়  মটকে খাবে  বলে । আপনি কিংকর্তব্যবিমূঢ়  হয়ে গেছেন। আপনার সমস্ত মনোযোগ এখন বাঘের উপরে। বাঘটা কিছুই করছে না। কিন্তু আপনি মনে করছেন, বাঁচার উপায় নেই। মৌচাকের মধু নিতে এসেছিলেন, এখন আপনি স্বয়ং বাঘের পেটে  চলে যাবেন। আপনার সমস্ত চিন্তা এখন একমাত্র বাঘকে ঘিরে অবস্থান করছে। ভয়ে, আপনার চোখ বন্ধ হয়ে গেছে।  হাতের ঘন্টাটি ঠিক এই সময় বাজিয়ে দিন। ঢং ঢং ঢং ....  ঘন্টার ধ্বনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শুনতে থাকুন, আর আর ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে নিজের শরীরকে ঘোরাতে থাকুন। লক্ষ করুন, আপনার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সে ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে একবার করলে, কিছু  দিনের মধ্যেই আপনি অন্য মানুষ হয়ে যাবেন।

মানুষ যখন ভীষণ ভয় পায়, তখন সে চিন্তা রোহিত হয়ে যায়। আর এই চিন্তারহিত অবস্থায়, মানুষের সমস্ত শক্তি একত্রিত হয়। এবং সে অসীম শক্তিশালী হয়ে ওঠে । এই সময় সে এমন অনেককিছু করতে পারে, যা সে স্বাভাবিক অবস্থায় করতে পারতো না। ভয় পেলে মানুষের স্নায়ুর  ক্রিয়া, এমনকি হৃদ-স্পন্দন বেড়ে যায়।  ঘরে আগুন লাগলে, আপনি জানলা দিয়ে লাভ দিতে পারবেন, কিন্তু অন্য সময় পারবেন না। বাঘের কথা মনে করানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, নিজেকে চিন্তা রোহিত করতে হবে। তবে, আপনার ধ্বনি গ্রহণ ক্ষমতা, স্নায়ুর ক্রিয়া বেড়ে হবে  এবং ধ্বনির অসীম শক্তি তখন আপনার উপল্বদ্ধিতে আসবে। এবং ধ্বনির মধ্যে   যে অসীম গুন্শক্তি নিহিত আছে তা আপনার ভিতরে প্রবেশ করবে। এবং  আপনি অবশ্যই  এতে প্রভাবিত হবেন। আর কাঁসর ঘন্টার ধ্বনিতে নিহিত আছে  প্রণব মন্ত্র।

সচৈতন্য থাকে না ঘরে, ভ্রমে ঘুম ধরে।
আমার মা ঘুমালেন মূলাধারে, আমারে কোলে ক'রে।
সচৈতন্য রূপ হন যিনি, আঁধারে চৈতন্য-রূপিণী,
অচৈতন্যতে এই জগৎ সৃজন হয় জানি ;
যদি সচেতন সবাই হ'ল, তবে চেতন করায় কে কারে।

যদি অচেতনে হয় এই দেহ সৃজন, কিসে হবে সংশোধন,
চারিবেদ, চোদ্দ শাস্ত্র, নব ব্যাকরণ।
শব্দ-সন্ধি প'ড়ে সন্ধি পাওনি , বন্দি হবে ফন্দির ফেরে।

ক্ষ্যাপা গৌরচাঁদ কয়, বোবায় গান করছে,
কালা বসে তাই শুনছে, পঙ্গু উঠে নৃত্য করছে,
ঠুঁটোয় বাজাচ্ছে, কানায় বসে রঙ্গ দেখছে, হায় কি মজা এ সংসারে।

অধ্যাত্ম জগতে প্রবেশ করবার আগে, হাতে করে তিনটি জিনিষ সঙ্গে নিয়ে নিন। শ্রুতি, অনুভূতি ও যুক্তি। আপনি আত্মতত্ত্ব বিষয়ে আগে শুনুন, তারপরে সেই বিষয়ে ধ্যান করুন। শেষে অনুভব করুন। আচার্য্য না পেলে শাস্ত্র পাঠ করুন। শাস্ত্রের বিষয়ে গভীর ভাবে নিজের মধ্যে মনন করুন। অর্থাৎ ধ্যান করুন। তারপরে সত্য উপল্দ্ধির বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয় থাকুন। যোগ্য শিষ্য যোগ্য আচার্য্যের সন্ধান পান।  তার কাছে চকিতে সত্য প্রতিভাত হয়। কিন্তু সবার কাছে তো তা হয় না। কিন্তু অন্ধ বিশ্বাস বা অন্ধ অবিশ্বাস নিয়ে এগুতে যাবেন না। ধর্ম্ম যদি অনুভূতিতে না আসে, তবে তাকে আগে যাচাই করুন। তবু একটা কথা বলবো, আমাদের শাস্ত্র সত্যের সন্ধানের উপায়, ও সত্য সম্পর্কে যা কিছু আভাস  দিয়েছেন, সেগুলো পরীক্ষিত সত্য। এই আপ্তবাক্যে বিশ্বাস রাখুন। এবং যতক্ষন পর্যন্ত শাস্ত্র অনুযায়ী সত্যের অনুভূতি না আসছে, ততক্ষন দৃঢ় প্রত্যয় রেখে সত্যের উদ্দেশ্যে মনের ভিতরে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে রাখুন। সাধকের কাছে, সমস্ত বিশ্ব শিক্ষক হতে পারে।  প্রকৃতির সবকিছু  আপনাকে শিক্ষা  দিচ্ছে। আপনাকে শুধু ধ্যানস্থ হতে হবে।

শরীর নাশে,  আমাদের পরিবেশের পরিবর্তন হয়। কিন্তু ঈশ্বর অর্থাৎ চেতনার কেন্দ্রবিন্দু সব সময় আমাদের মধ্যেই থাকেন।  আমরা যে বয়েসেই থাকি, যে দেহেই থাকি, সেই অনন্ত আমাদের সঙ্গে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবেই সঙ্গ  দিচ্ছেন।  এই ভাবটি আমাদের দৃঢ় করতে হবে। আর এটা শুধু কল্পনা নয়, এটি  চরম সত্য। আমাদের বেঁচে থাকা বা মরে  যাওয়া কোনোটাকেই বেশি গুরুত্ত্ব দেওয়ার কিছু নেই। জন্ম-জীবন-মৃত্যু একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া মাত্র।  নদীর  স্রোতের মতো ভেসে চলেছে। বাঁধা দিয়ে বিপথগামী করা যায়, রুদ্ধ করা যায় না। তাই এগুলোকে অগ্রাহ্য করা  ভালো। কিন্তু আমাদের হৃদয়ে যেন ঈশ্বর বিরাজ করেন। তার আসন যেন  উপযুক্ত হয়। তার আসন যেন স্থির হয়। কারন আসন শান্ত না হলে, স্থির না হলে, তিনি স্থির হয়ে বসতে পারবেন না।  তবে,  থাকবেন তো অবশ্যেই। যতক্ষন ঘুম না আসে, যতক্ষন মৃত্যু না আসে, ততক্ষন যেন আমরা ঈশ্বরীয় ভাবে নিজেকে আবিষ্ট রাখি।

নিজেকে দেহ স্তর বা স্থূল থেকে মনের স্তরে বা চিন্তা-ভাবনার স্তরে উঠিয়ে নিয়ে আসবার চেষ্টা করুন। আমাদের চিন্তা যেন  মূলাধার স্বাধিষ্ঠান মনিপুর স্তর থেকে উপরের দিকে উঠে আসে। কথায় বলে গুরু শিষ্যকে মন্ত্র দেন কানে কানে। আর বিবেকগুরু মন্ত্র দেন ভক্তের হৃদয়ে। দীক্ষা তখনি হয়, যখন সাধকের মনে আধ্যাত্মিক চেতনা জাগ্রত হয়। গুরু সর্ব্বব্যাপী।  গুরু অন্তর্যামী গুরু সমস্ত জ্ঞানের আধার। গুরুই কারন। গুরু-শিষ্য একে অন্যের মধ্যে ঈশ্বরের দর্শন করেন। গুরু আমাদের জ্ঞানের কাজল পড়িয়ে দেন  চোখে। গুরু তিনি, যিনি আমাদের মধ্যে আত্মজ্ঞানের অগ্নি জ্বেলে দেন, যাতে আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের সঞ্চিত কর্ম্ম-বন্ধন পুড়ে ছাই হয়ে যায়। গুরু শিষ্যকে শিষ্য নয়, গুরু করে রেখে যান। তাই গুরু যার মধ্যে নিজেকে দেখেন তাকেই শিষ্যবলে স্বীকার করেন। নমস্কার  করি কল্যাণমূর্তি গুরুদেবকে। নমস্কার করি সেই শিষ্যকে যিনি গুরুমূর্তিকে হৃদয়ে ধারণ করে আছেন।

আমরা সবাই ত্রৈলঙ্গস্বামীর কথা শুনেছি। তিনি প্রায় ২৮০ বছর  বেঁচে ছিলেন। তাঁর প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র ছিল বারাণসী। গঙ্গা বক্ষে যিনি সন্তানের মতো নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকতেন। ওনার জীবন সম্পর্কে অনেক অলৌকিক কাহিনীর কথা মুখে মুখে ফেরে। কিন্তু তার সাধন পথ কি ছিল তা আমাদের অনেকের কাছেই অজানা। তার মুখনিঃসৃত বাণী আমাদের বিশেষ জানা নেই। তাঁর নিজের লেখা একটা বই আছে, তার নাম "মহাবাক্য-রত্নাবলী" । তার বাণী নিয়ে একটা বই আছে, যার নাম তত্ত্ববোধ। এই বইয়ের রচনা-সঙ্কলক   উমাচরণ মুখোপাধ্যায়   সেখানে তিনি বলছেন :
 " বিশ্বনাট্যের বিরাম স্থান শ্মশান।  অভিমান,গর্ব্ব, দুঃখ, শোক, তাপ, আধি, ব্যাধি, জ্বালা, যন্ত্রণার অবসান-নিকেতন।  ধনী, নির্ধন, দুঃখী, সুখী, রাজা, প্রজা ,দীন ভিখারি যেখানে সমভাব, তারই নাম শ্মশান। বিশ্ব একটা মহাশ্মশান, কেননা জগতে অদাহ স্থান নাই, তবে কেন শ্মশানের নামে  এত ভয় ? পৃথিবীতে যদি কোনো পবিত্র স্থান থাকে, তা এই শ্মশান। যে পুতধামে, পূতমনা সদানন্দে বিরাজিত, সেই স্থানের নাম শ্মশান।"

ঈশ্বর জগতের অধীশ্বর কি-না জানিনা। ঈশ্বর সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করেন কিনা জানিনা। ঈশ্বর মানুষের সমস্ত কিছুর নিয়ামক  কি না জানিনা।
সব ধর্ম্ম কিছু নীতিকথা শেখায়, ধর্ম্ম-ই নাকি শান্তি ও আনন্দের পথ। ঈশ্বরকে  তুষ্ট করতে পারলে, তিনি নাকি সবকিছু দিয়ে আমাদের ভরিয়ে দেবেন। আর তিনি অসন্তুষ্ট হলে আমাদের শাস্তি দেবেন। এমন একটা বিদঘুটে ভগবানের ধারণা আমাদের  পক্ষে মেনে নেওয়া  অসম্ভব। ভগবান কারুর ভাগ্য ফেরাতে পারেন না। ভগবান কি একজন ব্যক্তি, না তিনি নৈর্ব্যক্তিক। আমাদের কি ভাবে চলা উচিত, সে সম্পর্কে পুরোহিতগণ যা বলছেন, তাই শুনবো,  নাকি মহাপুরুষদের কথা শুনবো ? তথাকথিত
ধর্ম্মগ্রন্থ বলতে আমরা যা বুঝি, এগুলো নাকি ঈশ্বরেরই বাণী। ঈশ্বর কি কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের কল্পনা ? ভয়কে ধোঁকা দেবার জন্যই মানুষ ভগবানকে সৃষ্টি করেছেন ?
প্রশ্ন অনেক।  অজানা অনেক কিছুই।
তবু মনে হয়, প্রত্যেক ধর্ম্মে কিছু উন্নত চরিত্রের মানুষ আছেন, ছিলেন। এমনকি অসম্ভব প্রতিভার অধিকারী বিজ্ঞানীরাও ধর্ম্মপথে জীবন যাপন করে থাকেন।  এই বুদ্ধিমান মানুষেরা কেন ধর্ম্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন ?  তাহলে কি ধর্ম্ম অসার নয় ?
আসলে ঈশ্বর হলো একটা অবস্থা মাত্র। যার যেমন ভাব, তার কাছে, সেই  ভাবেই ঈশ্বর আসেন।ঈশ্বর   মানুষের উন্নতির একটা চরম অবস্থা মাত্র। যে স্তরে পৌঁছতে গেলে,  মানুষকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়। ধর্ম্ম মানুষের বিকাশ সাধনের একটা বিজ্ঞান। আর এখানে জ্ঞান  সংগ্রহ করতে হয়,  অন্তরিন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। সাধনার ফল উপলব্ধি হয় অন্তরে, আর বিকশিত হয় মানুষের জীবনে। তার চরিত্রে প্রতিফলিত হয়, এক উচ্চ ভাব। মানুষই মহামানব হয়, মানুষই দেবতা হয়, মানুষই ঈশ্বরসম হয়। আর এই মানুষ তখন শান্তি-প্রেম  ও আনন্দের ঘনীভূত মূর্তি হয়ে দেখা দেন ।

সূর্যকে পেছনে রেখে দাঁড়ান। সামনে নিজের প্রতিবিম্ব পড়েছে, দেখুন। সেই ছায়ার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকুন। এর পর আকাশের দিকে তাকান।  আকাশের দিকে তাকালে নিজের প্রতিবিম্ব বা আপনার প্রতিকৃতি আকাশে দেখতে পাবেন। স্থির দৃষ্টিতে নিজের এই প্রতিবিম্ব আকাশে দেখতে পাবেন,  দেখতে থাকুন।একেই ঈশ্বরের ছায়া জানবেন।   নিজের এই প্রতীক দর্শনকে প্রতীক-উপাসনা বলে। এর ফলে আপনার দেহ অবশ্য়ই পবিত্র হবে। এই সম্পর্কে কারুর সাথে আলোচনা করতে যাবেন না। শুধু নিজের সঙ্গে কথা বলুন। এই গুহ্য প্রক্রিয়া আপনার আয়ু বৃদ্ধি  করবে। এই প্রক্রিয়া কিছুদিন অভ্যাস করলে আপনি বায়ু জয়ী হবেন। পূর্ণানন্দে থাকবেন। অদ্বিতীয় সেই পরমাত্মাকে সর্ব্বক্ষন উপলব্ধি করবেন। এর পরে নিজের অন্তরে স্বপ্রতিক দর্শন করতে পারবেন। আপনার মন হবে সংযত। আপনি হবেন মুক্ত পুরুষ।

বহির্জগতে যত দ্বন্দ্ব দেখতে পাওয়া যায়, তা আমাদের মনের অভ্যন্তরে যাকিছু ঘটছে, তারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আমরা যদি আমাদের মনের ভাবনা-চিন্তাকে লাগাম পড়াতে পারি, যদি বিচার বিশ্লেষণ করতে পারি, তবে আমাদের দ্বারা কৃত কর্ম্ম কখনোই দুষ্কৰ্ম্ম হতে পারবে না। আমাদের মন যেন ক্ষতিকর আবেগের দ্বারা ক্লিষ্ট না হয়। আমরা নিজেরাই যেন আমাদের সমস্যার জন্য দায়ী না হোই। আমাদের সান্নিধ্য, আমাদের বক্তব্য, আমাদের স্পর্শ যেন তপ্ত-মনের মানুষের উপর শীতল বারিধারা  সিঞ্চন করে। সব মানুষের হৃদয়ে সাধকের ভাব জেগে উঠুক। সমাজ নামক এই মঠে শান্তি বিরাজ করুক।    

আত্ম-সাক্ষাৎকারের উপায় ও নাদ-অনুসন্ধানের উপায়।

শঙ্কর উবাচ - দুটো বুড়ো-আঙ্গুল দ্বারা দুটো কান বন্ধ  করুন। দুটো তর্জনী দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করুন। মাঝের দুটো আঙ্গুল দিয়ে নাক বন্ধ করুন। অনামিকা ও কনিষ্ঠ অঙ্গুলি দিয়ে মুখটাকে চেপে ধরুন। এবার বায়ুসাধন করতে থাকুন। তবে জ্যোতির্ময় আত্মাকে দর্শন করতে পারবেন।
যিনি ক্ষণকালমাত্র এই নির্মল জ্যোতি দর্শন করতে পারেন, তিনি উত্তম গতি লাভ করতে পারেন। এই যোগী নিজের দেহ বিস্মৃত হন, আত্মার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যান। এই সময় দেহাভিমান বলে কিছু থাকে না। এই গুপ্তযোগ ক্রমান্নয় অভ্যাসের ফলে নাদ উৎপন্ন হয়। নাদ  উৎপন্ন হলে, প্রথমে ভ্রমরের  গুঞ্জন, তারপরে বাঁশির সুর, এবং শেষে বিনার স্বর শুনতে পান। ক্রমাভ্যাসের ফলে, ঘন্টার ধ্বনি, মেঘের গর্জন  শুনতে পাওয়া যায়। আর ঘন্টাধ্বনিতে যিনি চিত্ত স্থাপন করেন, তার লয়  অবস্থা উৎপন্ন হয়। যোগী তখন আনন্দে মগ্ন  হন, বাহ্যজ্ঞান বিস্মৃত হয়ে নাদের সঙ্গে সুখে মিলিত হন, অর্থাৎ সমাধিস্থ হন। সাধক তখন চিদাকাশে বিলীন হন। - শিব-সংহিতা (শ্লোক- ২/৪০-৫০)

পৃথিবীতে কোনোকিছুই আমার নয়। সবই ভগবানের সম্পত্তি। তিনি আমাদের যাকে যতটুকু ভোগ করতে দিয়েছেন আমরা সেটুকুর সাময়িক অংশীদার মাত্র। আর এই সম্পত্তি থেকে যদি আমরা  অভাবীকে কিছু দিতে পারি, তবে নিজেরা  শান্তি পাই। আমাদের যত  জ্ঞান বিদ্যা - সেসবও  ঈশ্বরের দান। আর এই জ্ঞান দান সর্বোৎকৃষ্ট দান। অনেক গুহ্য জ্ঞান আছে, যা সাধারণের মধ্যে কখনো বিতরণ করা সম্ভব হয় নি। কিছু জ্ঞানী ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। পরিণামে  সেই জ্ঞানী ব্যক্তির দেহত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে সেই জ্ঞান হারিয়ে গেছে। পরাশর পুত্র  দ্বৈপায়ন প্রথম এই জ্ঞানের সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করেছেন। বেদকে বিভাজন করে, বেদব্যাস বা ব্যাসদেব  নাম ধারণ করেছেন। এই ব্যাসদেব এক না একাধিক তা আমরা জানিনা। কিন্তু এমনি এক উদার জ্ঞানী পুরুষ ভগবান  শ্রীকৃষ্ণের মুখ দিয়ে সেই পুরাতন জ্ঞানের কথা আমাদেরকে শুনিয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু শুধু অর্জুনকে গুহ্য বিদ্যা বা জ্ঞান দান করেছিলেন, তাই নয়, আমরা সবাই  সঞ্জয়ের মাধ্যমে সেই অমৃতকথা শুনেছিলাম। আজও সেই সব পুরাতন কালাতীত  জ্ঞানের কথা নবীনকে ঈশ্বরের দরজায় নিয়ে যায়। যারা জ্ঞানকে কুক্ষিগত করে রাখতে চায়,  অনাধিকারী বলে জাতপাতের তকমা লাগায়, তারা আসলে ভগবানের ইচ্ছেকে বুঝতে পারেন না। এমন-ও শোনা যায়, এঁরা নিজের সন্তানের জন্য, জ্ঞানের ভান্ডার উন্মুক্ত করেন, কিন্তু অন্য যোগ্য শিষ্যদের বঞ্চিত করেন।  ভগবান এদের সুমতি দিন। আর আমরা জ্ঞানের তল্লাসে থাকি।
তবে একটা কথা বলি, না খেয়ে যত লোক  মারা যায়, অখাদ্য খেয়ে বা অতিরিক্ত খেয়ে  তার চেয়ে বেশি লোক মারা যায়। তাই নিজের শরীর বুঝে খান। পেলাম তাই খাবো, তা নয়, আমার প্রয়োজন হলে তবে তা আমি গ্রহণ করবো। জ্ঞান সংগ্রহের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। মুনি ঋষিদের কথা আমরা আমাদের  জ্ঞান অনুযায়ী ব্যাখ্যা করবো। আপনি তাই কারুর ব্যাখ্যা নয়, মুনি-ঋষিদের মূল সুরকে ধরবার চেষ্টা করুন। গীতা আপনার ভিতরে আছে, বাইবেল আপনার ভিতরে আছে, কোরান আপনার ভিতরে আছে, আপনি সেই অন্তরের জ্ঞান-ভাণ্ডারে ঢুকে পড়ুন। আর ভগবানের কাছ থেকে জ্ঞান-ঐশ্বর্য্য  চেয়ে নিন। আর তখন দেখবেন, দ্রোণাচার্য্যেরা  বলাবলি করছে, একলব্য এইসব বিদ্য়া শিখলো কোথায় ? ঈশ্বর সবার মঙ্গল চান। আমরা যেন ঈশ্বরের  ইচ্ছেকে  সন্মান জানাই। - ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি  ওম।

কেউ ইচ্ছে করে করে, কেউ অনিচ্ছায় করে। যোগ আমাদের করতেই হয়। জীব নিদ্রার মাধ্যমে, জীবনীশক্তি আরোহন করে। নিদ্রাই আমাদের মতো  সাধারণ মানুষের যোগ। যোগে আমরা আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি ধীর করতে চাই। আর স্বাভাবিক ভাবেই নিদ্রাকালে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি ধীর হয়ে আসে। মানুষ নিজের অজ্ঞাতসারেই  এইভাবে যোগে লিপ্ত হয়। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি যার যত ধীর হয়, সে তত শান্ত স্বভাবের মানুষ হয়। সে তত বেশিদিন বেঁচে থাকে। কচ্ছপের শ্বাস-প্রশ্বাস মিনিটে চার বার। বানরের ৩২-৪০ বার। মানুষের ১২-১৮ বার। মানুষ উত্তেজিত হলে, বা যেকেউ উত্তেজিত হলেই তার স্বাশ-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে  যায়। দীর্ঘজীবী হতে চাইলে, শ্বাসের গতি ধীর করুন, এবং স্বাসের প্রতি প্রতিনিয়ত খেয়াল রাখুন।

একটা দিন সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলুন। একটা দিন ভালো মা-বাবা হয়ে যান। ছেলে-মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যান। ওদের নিজের হাতে খাইয়ে দিন। মাথায় বিলি কেটে দিন। একদিন ভালো স্বামী বা স্ত্রী হয়ে যান। রান্নার কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করুন।  স্ত্রীর মাথার জট ছাড়িয়ে দিন। স্বামীর মুখে ফেচ-পাউডার লাগিয়ে দিন। স্বামীর পায়ের পাতা  ভালো করে পরিষ্কার করে দিন।  স্বামী-স্ত্রীর কষ্টের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। একদিন  মৌন থাকুন। একদিন একটা ঘরে নির্জনে থাকুন। একদিন ভোলানাথ হয়ে যান। একদিন গোবিন্দ হয়ে যান। সব শেষে একদিন ভালো মানুষ হয়ে যান। হোক না এসব কৃত্তিম, তবু মাত্র একদিন তো, করেই দেখুন।

মন চঞ্চল থাকলে, ধ্যান করা যায় না। আর আশ্চর্য্য হচ্ছে, মুনিঋষিরা বলছেন, মন চঞ্চল বলে আমাদের আরো বেশি বেশি করে ধ্যান  করতে হবে। তো আমরা কি করবো ?
কাজের মধ্যে আমাদের বিশ্রাম নেওয়া জরুরী।  এই বিশ্রামটি আমরা সবাই নেবার চেষ্টা করি, যে যে অবস্থায়ই  থাকি না কেন। আর এই বিশ্রাম নেওয়া মানে  আমরা বুঝি, আলস্যে সময় কাটানো। আর এই আলাস্যে সময় কাটানোর সময়, আমরা উল্টোপাল্টা চিন্তা করতে থাকি। এটা না করে, আমাদের উদ্দেশ্য যদি বিশ্রাম নেওয়া হয়, তবে আমরা কোথাও চুপচাপ বসে থাকে পারি। আর এই সময় অবাঞ্চিত  চিন্তার প্রবাহকে যদি প্রার্থনার মধ্যে প্রবাহিত করতে পারি, তবে আমাদের বিশ্রাম, ক্লান্তির উপশম ও দেহের সমতা লাভের পথ সহজ হতে পারে। এইরকম একটা প্রার্থনা শুক্ল-যজুর্বেদে (১৯/৯) আছে।  আর তা হচ্ছে :
তেজোঽসি তেজ ময়ি ধেহি।
বীর্যমসি বীর্য্যং ময়ি ধেহি।।
বলমসি বলং ময়ি ধেহি।
ওজোঽসি ওজো ময়ি ধেহি।।
মন্যুরসি মন্যুং ময়ি ধেহি।
সহোঽসি সহোময়ি ধেহি। ।

অর্থাৎ হে ঈশ্বর, তুমিই তেজ, আমায় তেজ দিয়ে পূর্ণ  করো।  তুমিই বীর্যশক্তি, আমায় বীর্য দিয়ে পূর্ন করো। তুমিই বল, আমাকে বল দিয়ে পূর্ন করো। তুমিই ওজঃ-শক্তি, আমাকে ওজঃ দিয়ে পূর্ন করো। তুমিই, মনুষ্য-শ্রেষ্ঠ, আদি মনুষ্য, আমার মধ্যে মনুষ্যত্ব  স্থাপন করো।  তুমি সহস্বরূপ, আমায় সহ (বল) স্থাপন করো, তুমি সহায় স্বরূপ আমাকে সহায়তা দাও । তুমি কোপ-স্বরূপ অর্থাৎ আঘাত স্বরূপ, আমাকে আঘাতে আঘাতে শুদ্ধ করো।   আমি তোমারই চিন্তায় মগ্ন আছি সদা-সর্বদা। আমাকে পবিত্রতা দিয়ে পূর্ন করে দাও।
এই ভাবনা দিয়ে মনকে ভরিয়ে তুলুন। এতে আমাদের শরীরের ক্লান্তি দূর হবে, মনে যে সব অবাঞ্চিত চিন্তা  ভিড় করে ছিল, সেসব দূর হয়ে যাবে। আমরা খুব কম সময়ে সতেজ  হয়ে উঠবো।

ছোট থেকে বড়, মানুষ-পশু-পাখী-পোকা, স্থূল দেহ বা  সূক্ষ্ম দেহ, অর্থাৎ সমস্ত ভৌতিক দেহের মধ্যে একটা জিনিষ অবশ্য়ই বর্তমান আর তা হচ্ছে, প্রকৃতির আটটি গুন, ক্ষিতি, অপ, তেজঃ, মরুৎ, ব্যোম, মন, বুদ্ধি, ও অহংকার। আর সমস্ত জীব-ই  প্রকৃতির এইসব বৃহত্তর শক্তির  একটা  অতিক্ষুদ্র অংশ নিয়ে,  জীবনধারণ করে । আমাদের জীবনধারা আলাদা হতে পারে, কিন্তু আমরা সবাই একই বস্তুর সমাহার। আজ যাদের মানুষের চেহারায় দেখছি, তারাই কোনো না কোনো জন্মে পশু-পাখি-কীট-পতঙ্গ ছিল, হয়তো বা আবার  হবে। তাই কাউকেই, এমনকি পশু-পাখিকেও অবহেলা করা আমাদের উচিত নয়। কারন কোনো জন্মে  এরাই   হয়তো আমার বন্ধু ছিল, আমার আত্মীয়-স্বজন ছিল। আবার  হয়তো কোনো জন্মে এদের মতোই আমাদের দেহ হবে।  আসুন, সবাই সবাইকে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রাখি। তাহলে এরাও আমাদের অবশ্য়ই ভালোবাসবে।

কর্ম্মযোগ কথাটার সঙ্গে আমরা বিশেষভাবে পরিচিত। ঠিকঠিক ভাবে কর্ম্ম করার নামই কর্ম্মযোগ। আর কর্ম্মযোগ যিনি জানেন, তাঁর সঙ্গে কর্ম্মশক্তির নিয়ন্তার  সঙ্গে  সখ্যতা হয়। স অর্থাৎ সমান, খ্য অর্থাৎ জ্ঞান। বিশ্বশক্তি কি ভাবে বিশ্বকে পরিচালনা করতে চান, জীবকে কিভাবে পরিচালিত করতে চান, সে বিষয়ে যখন আমাদের জ্ঞান হয়, তখন আমরা বিশ্বনিয়ন্তার ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করতে পারি। একেই কর্ম্মযোগ বলা হয়। যোগের উৎস হচ্ছে, বাকশক্তি। অগ্নি ও বায়ুর মিথুনে বাকের  সৃষ্টি। বাকের উৎস হচ্ছে ঋতকর্ম্ম।  ঋত কথাটার অর্থ হচ্ছে, সত্য। অর্থাৎ সত্য কর্ম্ম-ই ঋতকর্ম্ম। সত্য-কর্ম্মে প্রতিষ্ঠিত হলে, সেই পরমা বাকের সন্ধান পাওয়া যায়। এই পরমা বাকের অন্যনাম অনাহত ধ্বনি। যে ধ্বনি কখনো বাধাপ্রাপ্ত হয় না, অর্থাৎ আহত হয় না, তাকেই বলে অনাহত ধ্বনি। আমাদের এই দেহের মধ্যে, এমনকি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে  প্রতিনিয়ত এই অনাহত ধ্বনি প্রণব বা ওঙ্কার  রূপে ধ্বনিত হচ্ছে। আসুন আমরা যোগের মাধ্যমে সেই পরমা ধ্বনির সঙ্গে মিলিত হই, আর পরম-ঈশ্বরের সঙ্গে সখ্যতা অনুভব করি।

আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা কি সূর্যপুত্র ? বিজ্ঞান বলছে, সৌর-জগতের সব গ্রহ-উপগ্রহ সূর্য থেকে জন্ম নিয়েছে। সূর্য্যের অংশ এগুলো। পৃথিবী সূর্য  থেকে জন্ম নিয়েছে। পৃথিবী থেকে গাছপালা, জীব-জন্তু সব সৃষ্টি হয়েছে। তো মানুষ যদি পৃথিবীর অংশ হয়, আর পৃথিবী যদি সূর্য্যের অংশ হয়, তবে মানুষ অবশ্য়ই সূর্যপুত্র। সূর্য ও তার শক্তির মিশ্রণ এই জীবজগৎ। যা কিছু একই বস্তু থেকে জন্মায়, তাদের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য -সহানুভূতি থাকে। তাপ-বায়ু-আশ্রয়,  যা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, তাতো এই পৃথিবী-সূর্য দিচ্ছেন। সূর্য আমাদের থেকে লক্ষ-যোজন দূরে থাকে। সত্যিই কি দূরে থাকে ? আমরা আমাদের প্রতিটি রোমকূপে সূর্য্যের সান্নিধ্য অনুভব করি। আমাদের রক্তে সূর্যতাপ। বেদে  তাই আমরা সূর্য উপাসনার এত আধিক্য দেখতে পাই । আসুন আমরা সূর্যদেবকে - অর্থাৎ আমাদের  মহাপিতাকে প্রনাম করি।

নমো মিত্রায় ভানবে মৃত্যোর্মা পাহি।
ভ্রাজিষ্ণবে বিশ্বহেতবে নমঃ
সূর্যাদ্ভভবন্তি ভূতানি সূর্যেণ পালিতানি তু।
সূর্যে লয়ং প্রাপ্নুবন্তি যঃ সূর্যঃ সোঽহমেব চ ।।

মিত্রকে (মিত্ররূপী সূর্যকে) নমস্কার।  ভানুকে (জ্যোতির্ময় সূর্যকে ) নমস্কার।  আমাকে মৃত্যু (দ্বৈত জ্ঞানরূপ) হতে রক্ষা করুন। প্রকাশশীল, বিশ্বের কারণকে  নমস্কার। জীবগন সূর্য হ'তেই  উৎপন্ন হয়ে থাকে, সূর্য্যের দ্বারা পালিত, সূর্যেই লয় প্রাপ্ত হয়। আমি সূর্যপুত্র, তবে আমিও সূর্য।

সাধক  যখন যোগের মাধ্যমে অনন্ত চৈতন্যকে উপলব্ধি করতে পারে, অর্থাৎ কুলকুন্ডলিনী শক্তিকে ব্রহ্ম বিবরের মধ্যে প্রবেশ করাতে  পারে, তখন সাধক  সব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যায় । তখন সাধকের  মনের মধ্যে, এমনকি শরীরের মধ্যেও এক উন্মাদ আনন্দের খেলা চলতে থাকে। একেই বলে শিব-শক্তির খেলা। আর এটা হয় তখনই, যখন সাধক  যোগের সাহায্যে দেহস্থিত অগ্নিকে প্রজ্বলিত করে, বায়ুশক্তিকে ঊর্ধ্বমুখী করে, চিত্রাণি নাড়ীর ভিতরে যে ব্রহ্মরন্ধ্র আছে তার মধ্যে প্রবেশ করাতে পারে। ধীরে ধীরে এই কুল-কুল্ডলিনী  শক্তি সহস্রার ভেদ করে বিন্দুতে  বিশ্বশক্তির সঙ্গে মিলিত হয়। এ এক অনির্বচনীয় অনুভূতি যা কোটি জন্মের সাধনার ফলেই হতে পারে। মন তখন শুদ্ধ চৈতন্যে অবস্থান করে, সাধক সমস্ত দুঃখের পারে চলে যায়। শান্তি কথাটার যথার্থ অর্থ তখন অনুভূত হয়। দেহবোধ বলে কিছু থাকে না। থাকে শুধু এক চৈতন্যানুভূতি।

অধ্যাত্ম জীবনের মূল লক্ষ হচ্ছে আমাদের ব্যক্তিসত্তাকে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করা। অংশকে পূর্ণের  সঙ্গে যুক্ত করা। আর এই পথে  আমরা যত  এগুতে থাকি, তত আমাদের মধ্যে উৎসাহ বাড়তে থাকে। নিজেকে মুক্ত মনে হতে  থাকে। আসলে এই পথে পা দিলেই প্রথম যেটা হয়, সেটা হচ্ছে, নিজের সম্পর্কে, অর্থাৎ আমাদের ব্যক্তিসত্তা সম্পর্কে যে চিরাচরিত ধারণা, সেটা পাল্টাতে থাকে। আমরা তো দেহের সঙ্গে নিজেকে একাত্মবোধ করে থাকি। আর এই দেহবোধ থেকেই জগৎ-সংসারের সঙ্গে আমরা সম্পর্কিত হই। আর এই সম্পর্কের টানা-পোড়নে আমরা সুখ দুঃখ ভোগ করি।
অন্যদিকে  আধ্যাত্মিক জগতে যখন আমরা যাত্রা শুরু করি, তখন আমরা   ধীরে ধীরে, এই সম্পর্কগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করি। না এই বিচ্ছিন্নতা জগৎ-বস্তু থেকে নয়, কেবলমাত্র চিন্তাধারার পরিবর্তন হতে শুরু করে। অর্থাৎ যাকে  আমি এতদিন আমি-আমার ভাবতাম সেই ভাবনা স্রোত বিপরীতমুখী হওয়া শুরু করে। যখন  এই চিন্তাস্রোত  তীব্র বেগ ধারণ করে তখন আমাদের  আগের চিন্তা ক্ষীণ হতে হতে মিলিয়ে যায়। আর আমিযে ঈশ্বরের সঙ্গেই আছি, সেই ধারণা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে থাকে। তখন  আমাদের সম্পর্কজনিত যে সুখ দুঃখ তা আমার অনুভবকে ব্যথিত করে না। বরং ঈশ্বর সান্নিধ্য, একটা সুরক্ষার জাল তৈরি করে দেয় আমাদের চারিদিকে। আমরা ভালো থাকি। ভালো থাকি। ভালো থাকি।

ঈশ্বরের কাছে যাবার জন্য আমরা যে যেখানে আছি, সেখান থেকেই শুরু করতে পারি। আমরা  যেমন তিন গুনের অধিকারী, আমাদের পদ্ধতিও তিন রকম হতে পারে। সত্যগুণের অধিকারীগণ ধ্যানে মগ্ন হতে পারেন। রজ গুনের অধিকারীগণ যাগযজ্ঞ, পূজা অর্চনা করতে পারেন। তমঃগুণের অধিকারীগণ প্রভুর নাম জপ কোরতে পারেন। যার যেটা ভালো লাগে, বা বলা যেতে পারে যে যেমন অবস্থায় আছেন, সেখান থেকেই শুরু করতে পারেন। যে যাই করুন না কেন, আজ যেখানে  আপনি আছেন, আগামীকাল যেন সেখান থেকে ঈশ্বরের আরো কাছে যেতে পারেন, সেই প্রয়াস যেন বজায় থাকে। এই তিনটি গুনই আমাদের সবার মধ্যে আছে, তবে যখন যার মধ্যে  যে গুনের আধিক্য থাকে, তাকে সেই গুনের অধিকারী বলা হয়। আমরা কেউ শুধু সত্ত্ব গুনের, বা শুধু রজঃ গুনের   বা শুধু তম গুনের অধিকারী নোই। আমরা এই তিন গুণেরই মিশ্র-সত্ত্বা। আমাদের ইচ্ছেশক্তি যখন প্রবল হয়, তখন আমাদের এই সুপ্ত ত্রিগুণের যেকোনোটিকে অবশ্য়ই জাগ্রত করতে পারি। আর এই ইচ্ছেশক্তি ভগবান আমাদের মধ্যে দিয়েছে, তাই আমরা মানুষ।

আমাদের জাগতিক চিন্তা-ভাবনাকে যতক্ষন না ঈশ্বরীয় ভাবনা দিয়ে প্রতিহত করতে পারছি, ততক্ষন আমাদের সেই চেষ্টা নিরন্তর চালিয়ে যেতে হবে। প্রবর্তক সাধকের পক্ষে মনকে শূন্য  করবার যেসব প্রক্রিয়া, তার মধ্যে প্রবেশ করলে, অবচেতন মন দ্বারা সে পরিচালিত হবে। এতেকরে সাধক চেতন মনের যে স্তরে আমরা থাকি, সেখান থেকে পিছলে গিয়ে সমূহ বিপদের সম্মুখীন হয়। তাই প্রথমে আমাদের শারীরিক পবিত্রতা, চিন্তাধারায় পবিত্রতা আনতে  হবে। এর পরে আমাদের নাড়ীশুদ্ধি করতে হবে, শরীরের ভিতরের শুদ্ধতা আনতে  হবে। তার পরেই আমরা মনকে শূন্য  করবার যেসব গুহ্য প্রক্রিয়া আছে, তার মধ্যে প্রবেশের জন্য, উপযুক্ত গুরুর আশ্রয়ে নিরন্তর অভ্যাসের মাধ্যমে প্রক্রিয়ার সঠিক প্রয়োগে সাফল্য পেতে পারি। অধ্যাত্ম জীবনে মেড-ইজি বলে কিছু হয় না। অবিদ্যার বিস্ময়কর স্বপ্ন নয়। কোনো কল্পনাও নয়। অধ্যাত্ম জীবন আসলে একটা উচ্চস্তরের জীবন ধারা। এটি ধাপে ধাপে অর্জন করতে হয়। আসলে ভবিষ্যতে আমরা কিছু গুহ্যসূত্র প্রকাশ করতে চলেছি, এটি তারই আগাম সতর্কতাবানী। জ্ঞানের পথেই জ্ঞানাতীত জীবন। শূন্যগর্ভ দূরকল্পনা বা অসার বাক্যবুলী দিয়ে এই পথে অগ্রসর হওয়া যায় না। কথাগুলো ভালো লাগুক আর না লাগুক বলতেই হলো।

আমাদের প্রত্যেকের জীবনে একটা আদর্শ থাকা উচিত। আর সেই আদর্শ যদি মানুষের মঙ্গল সাধন হয়, তবে সেটি অবশ্য়ই উচ্চ আদর্শ। তো এই উচ্চ আদর্শ সামনে রেখে, আমাদের ধাপে ধাপে এগুতে হবে। সেই আদর্শ পূরণের জন্য, প্রথমে জানা দরকার আমি কোথায় আছি। অর্থাৎ নিজেকে ভালোকরে চিনতে হবে, জানতে হবে।  যে নিজের মঙ্গল করতে পারে না, সে অপরের মঙ্গল কিভাবে করবে ? তাই আদর্শ পূরণ করতে গেলে বাস্তবোচিত হতে হবে। খুঁজে বার করতে হবে, আমার কাছে কি আছে, আর তার মধ্যে কোনটি অপরের মঙ্গলসাধন করতে পারে। প্রথমেই বলি,  ঈশ্বরের কাছ থেকে বা বলা যেতে পারে, মা-বাবার কাছ থেকে আমরা সবাই একটা ভৌত দেহ পেয়েছি। এই একটি যন্ত্র বিশেষ। একে সব সময় কার্যক্ষম ও  দক্ষ রাখতে হবে। একটা জিনিস মনে রাখবে, শরীর ঠিক না থাকলে সাধন-ভজনও করতে পারবেন না। শরীর সুস্থ না থাকলে, জীবন কর্ম্মহীন হবে। আমাদের দেহধারন তো কর্ম্ম করবার জন্য, তো সেই মহানকাজটি তখন আমাদের  দ্বারা হবে না। আর একটা কথা মনে রাখতে হবে, শরীর ভোগের জন্য নয়। ঐশ্বরিক চৈতন্য অনুভব করবার মন্দির এই শরীর। একে অবশ্যই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এবং ঈশ্বরকে থিতু হবার জন্য অনুকূল করতে হবে। তবেই আমাদের শরীর ধারণ সার্থক হবে। আর আপনার শরীরে যদি ঈশ্বরের আসন স্থির থাকে, তবে আপনার মধ্যে সবাই ঈশ্বরকেই  দেখতে পাবেন। আর তাতে সবার মঙ্গল হবে। আপনার উচ্চ-আদর্শ তখন বাস্তবায়িত হবে।                       

যতক্ষন আমাদের একত্ব ভাবের জ্ঞান না হচ্ছে, ততক্ষন সাধকের একত্ত্ব ভাবের একটা ধারণা করতে হবে। সৎবস্তু সম্পর্কে আমাদের একটা  প্রাথমিক ধারণা থাকলে, বিষয়ের সত্যনিষ্ঠতা আমাদের কাছে ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে থাকবে। তাই প্রথম দিকে সাধককে একটা কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়। আমাদের মনের মধ্যে যখন মন্দ ধারণা উঠবে, তখন আমাদের শুভ ধারণা দিয়ে, মন্দ ধারণাকে বিদায় করতে হবে। যদিও এটা কোনো সমাধান নয়, তবুও প্রাথমিক ভাবে, এটি উৎকৃষ্ট উপায়। চোরের ভয় করছে ?  আপনি একটা দারোয়ান রাখতে পারেন, বা একটা বাঘা কুকুর রাখতে পারেন। আপনার ভয় কমে যাবে। এ ঠিক তেমনি। কিন্তু আপনি যখন ঈশ্বর-পিতার আশ্রয়ে পৌঁছে যাবেন , তখন আর আপনার দারোয়ান বা কুকুরের দরকার পড়বে  না। তাই যতদিন না আমাদের ঈশ্বর উপলব্ধি হচ্ছে, ততদিন আমাদের শুভ কল্পনার আশ্রয় নিতে হবে। কিন্তু দেখতে হবে, এই শুভ কল্পনা যেন  অলীক না হয়। বিচার ও বৈরাগ্যের দ্বারা সত্যকে চিনে নিতে হবে। নিজের সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি আপনার যেমন হবে, অন্যের সম্পর্কেও আপনার দৃষ্টিভঙ্গি অনুরূপ হবে। আপনি যদি নিজেকে দেহ বা শরীর  ভাবেন, তবে অন্যকেও আপনি সেটাই ভাববেন। চারিদিকে আপনি দেহকেই দেখতে পাবেন। কিন্তু আপনি যদি নিজেকে জ্যোতির্ময় সত্ত্বা আর দেহ হচ্ছে তার আবরণ মাত্র, এমনি ভাবে ভাবতে পারেন, তখন চারিদিকে আপনি জ্যোতির্ময় সত্ত্বাকেই  দেখতে পাবেন। অলঙ্কার না দেখে সোনাকে দেখুন। জীবকে না দেখে জীবাত্মাকে দেখুন।  এইভাবে আমরা ধীরে ধীরে পরমাত্মাকেই দেখতে থাকবো।  আর সমস্ত বস্তুর সারবত্তা আমাদের কাছে উজ্বল থেকে উজ্বলতর হয়ে উঠবে। এইভাবেই আমাদের সমস্ত সমস্যার প্রকৃত সমাধান সম্ভব।

জ্ঞান, বৈরাগ্য ও ভক্তির অপূর্ব মিশ্রণ হচ্ছে সনাতন ধর্ম্ম। অন্য সব ধর্ম্ম মূলত ভক্তিকে আশ্রয় করে আছে। এই সনাতন ধর্ম্ম থেকে আমরা বিচ্যুত হয়ে কেউ  অজ্ঞান ভক্তির আশ্রয় নিয়েছি। কেউ মিথ্যে বৈরাগ্যের ভান  করি। আমরা যখন সত্যিকারের অধ্যাত্ম-জ্ঞানে সমৃদ্ধ হবো, তখন পৃথিবী থেকে ভেদাভেদ অন্তর্হিত হবে। জন্ম নেবে, কোটি কোটি বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, নানক, কবির, বুদ্ধ, কৃষ্ণ, খৃষ্ট। পৃথিবী হয়ে উঠবে দেবভূমি। যেখানে থাকবে না জরা-ব্যাধি-অকালমৃত্যু-দারিদ্র-হিংসা-দ্বেষ-স্বার্থপরতা। ভগবান সেই অপূর্ব লীলাক্ষেত্র তৈরীর  উদ্দেশ্যেই, আমাদের বার বার জীবন-মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমাদেরকে শুদ্ধ করে নিচ্ছেন। ধীরে ধীরে পৃথিবীর সমস্ত জীব ভাগবত-ভাবে জীবন্ত হয়ে উঠবেই উঠবে। আমরা বিশ্বাস করি ঈশ্বরের এটাই উদ্দেশ্য, একমাত্র উদ্দেশ্য। আমরা চাই বা না চাই,  বিশ্বশক্তির ইচ্ছেয় আমাদের সবাইকে  রূপান্তরিত হতেই হবে, আমাদের ভালো হতেই হবে।আমরা তখন আত্মস্বরূপের অমৃতসুধা পান করবো। ঘুচে যাবে সমস্ত  দ্বন্দ্ব।

আধ্যাত্মিক জগতে চলতে গেলে অন্যের কথায় কান দিলে চলবে না। অন্যরা আমার  সন্মন্ধে কি ভাবছে, সেটা নিয়ে ভাবলে চলবে  না। আমার গলায় অনেকগুলো রুদ্রাক্ষের মালা দেখে, অনেকে অনেক কথা বলে। আমি যখন ধ্যানে বসি, বা সকালবেলায় যখন প্রাতঃভ্রমনে বেড়াই  তখন মাথায় একটা গেরুয়া কাপড়ের টুকরো  বেঁধে নেই। এতে অনেকে চোখ কুঁচকোয়। আমার হাতে একটা পাহাড়ী গাছের ডাল থাকে, এতে অনেকের কৌতহল থাকে। আমার চুলে সব সময় চিরুনি পড়ে না।এতেও নাকি পাগলা পাগলা দেখতে লাগে।  আসলে আমি যে পথে চলছি,  তাতে কে কি ভাবলো তাতে আমার কিছুই  যায় আসে না। আমার আদর্শ, আমার ঈশ্বরের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস, আমার অনুভব, উপলব্ধি, সত্যের প্রতি নিষ্ঠা,  আমার  জীবনকে  প্রভাবিত করে। অন্যের বিশ্বাস বা অবিশ্বাস, বা তাদের ভ্রূ-কোঁচকানোতে আমার জীবনের সম্পদগুলোকে হারাতে চাই না। আমি জানি, আমি সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারবো না, আর তা আমি চাইও না। আমি আমাকে সন্তুষ্ট করতে চাই - অবশ্য়ই অন্যকে প্রভাবিত না করে। কিন্তু এও সত্য, আমি যখন আমার ভিতরের ঈশ্বরকে উজ্বলতর করতে পারবো, তখন অন্যরা আমার সন্মন্ধে মনোভাব আপনা আপনি পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। আমরা অপরের ভালো করতে চেষ্টা করবো, হবো স্বার্থশূন্য, হবো দৃঢ় মনোভাবের  পাষাণপ্রতিম শান্ত-শীতল চরিত্রের অধিকারী।

কোথা থেকে কি ভাবে শুরু করবো ? আসলে সূর্য্যের কাছে যাবার জন্য কোনো নির্দিষ্ট রাস্তা হয় না।  ঈশ্বরের কাছে যাবার জন্যও, নির্দিষ্ট কোনো রাস্তা নেই। জ্ঞানসূর্য্যের আলোক প্রাপ্ত হবার জন্য আপনাকে শুধু ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে  হবে, আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আপনি কোথায় আছেন, সেখান থেকেই শুরু করতে হয়। আমি কোথায় আছি, সেটা বুঝবার জন্য, নিজেকে ভালো করে জানতে হয়। আমার মধ্যে কি কি ভালো জিনিস আছে, আমার কি করতে ভালো লাগে সেখান থেকেই বোঝা যায়, আমি কোথায় আছি।  এবার সেই ভালো জিনিসগুলোকে বিকশিত করবার চেষ্টা করুন। এর পর নিজের মধ্যে যদি কিছু খারাপ থাকে তাকে দমন করবার চেষ্টা করুন। এর জন্য কোনো বিশেষ কোনো প্রক্রিয়া নেই। আপনার ইচ্ছে শক্তির সাহায্যে এগুলো করা সম্ভব। আপনার বিবেক-গুরুকে জাগ্রত করুন, সেই বিবেকগুরুর নির্দেশে কাজ করতে থাকুন, দেখবেন দৈহিকগুরুও একদিন আপনার কাছে এসে যাবেন। এর জন্য কোনো প্রয়াস করতে হবে না, গুরুই আপনাকে টেনে নিয়ে যাবেন, অধ্যাত্ম পথে, সৎপথে, আর আপনি পৌঁছে যাবেন ঈশ্বরের কাছে। গুরু এক নয়, একাধিক। প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ইত্যাদির শিক্ষক যেমন আলাদা আলাদা, ছাত্রও আলাদা। অধ্যাত্ম-বিদ্যালয়ের শিক্ষকও, শিষ্যের মান অনুযায়ী আলাদা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনার মানের পরিবর্তন হবে। শুধু নিজের মধ্যে ইচ্ছাশক্তির আলোকে নিজেকে জানতে থাকুন। নিজেকে জানাই ঈশ্বরকে জানা।

আমাদের হৃদয় যত  পবিত্র হবে, মনে তত  শুদ্ধ চিন্তা প্রবাহিত হতে থাকবে।  আর সত্য প্রতিফলিত হবে সেই শুদ্ধ হৃদয়ে। শুদ্ধ মনই আমাদেরকে ধীরে ধীরে উচ্চতর জীবন আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট করবে। আমাদের উপলব্ধি তত সূক্ষ্ম ও স্পষ্ট হবে। আর এই সময় মন ও হৃদয় এক চরম সত্যে লিন হতে থাকবে। আমরা যতই দাবি করিনা কেন, এই দেহ-রূপ পুতুলে আমরা যতদিন আকৃষ্ট থাকবো, ততদিন আমাদের ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুলতা গভীর হতে পারবে না। এই আসক্তি না ছাড়তে পারলে, ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুলতা আমাদের ভান  মাত্র হয়ে থাকবে । তবে সবার জীবনেই একটা সময় আসবে, যখন এই দেহ-পুতুলগুলো, তার মনোহারিত্ত্ব হারিয়ে ফেলবে, সংসার তখন অসার মনে হবে।  তখন আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য ব্যাকুলতা বাড়বে সত্য কিন্তু তখন অনুভবের ক্ষমতা যাবে হারিয়ে । তখন একটা আচ্ছন্ন ভাব, একটা অনীহা আমাদেরকে টেনে নিয়ে যাবে মৃত্যুর মুখে। আমরা আবার হাজার  হাজার বছর  অপেক্ষা করবো, নতুন শরীরের জন্য। সতেজ দেহেই সত্য অনুভব হয়, সত্য প্রতিফলিত হয়, জ্ঞান সংগ্রহ হয়। দেহরূপ স্বচ্ছ আয়নায় সত্য প্রতিফলিত হয়, ভাঙা-চোরা মলিন আয়নায় তা হতে পারে না। তাই যা করার সময় থাকতে করতে হবে। সময় গেলে সাধন হবে না।

আপনারা কি সেই চীনা সাধুর কথা জানেন, যিনি দুটি বীনার তার একই সুরে বাঁধলেন, একটা বীনা  হাতে তুলে নিলেন, আর একটা বীনা পাশে রেখে দিলেন। হাতের বীণায় টুং করে আওয়াজ তুললেন, আর অমনি অন্য বীণায় টুং করে আওয়াজ উঠলো। আপনারা কি সেই দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুরের কথা শুনেছেন, গঙ্গার মাঝে, নৌকার মধ্যে মাঝির পিঠে বৈঠার বাড়ি পড়তেই যার পিঠে দগদগে দাগ হয়ে গিয়েছিলো ? আমরা অনেক বড় বড় কথা বলতে পারি, অনেক শাস্ত্র পড়ে মুখস্ত করতে পারি,পড়াশুনা করে পণ্ডিত হতে পারি, কিন্তু যতক্ষন না পর্যন্ত আমরা পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার সুরকে এক তানে না বাঁধতে পারছি, ততক্ষন আমাদের কিছুই হবার নয়। সাধক তীব্র অনুভূতির জন্য সাধনা করবে, মনকে বাহ্য বিক্ষেপ থেকে অন্তরে নিক্ষেপ  করবে। আর এই গুহ্য কৌশল যখন আমাদের  আয়ত্ত্বে আসবে, তখন আমরা ঈশ্বরের কৃপার সংকেত বুঝতে পারবো। আমার অন্তর তখন সংগ্রাম-বিমুখ হয়ে যাবে। সত্য়বস্তু তখন আমার অন্তরের মধ্যে জেগে উঠবে। নিজের অন্তরেই দৈব সত্ত্বার অধিষ্ঠান সম্পর্কে সচেতন হবো। সব অধ্যাত্ম  সাধনার মূল উদ্দেশ্য  এটাই।

আমরা কতকিছু ত্যাগ করেছি, সেটা বড় কথা নয়, আমরা কার জন্য কতটুকু ত্যাগ করেছি, সেটাই বড় কথা।  আমরা  ভগবানের জন্য যদি এক কনাও  ত্যাগ করে থাকি, তবে ভগবানের   উপরে আমরা জোর খাটাতে পারি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের আছেই বা কি, ত্যাগ-ই বা কি করবো। যা আছে, তা হচ্ছে ভালোবাসা।  তাই   ভগবানকে যদি আমরা  ভালোবেসে থাকি, তবে ভগবানের কাছে আমরা আবদার করতে পারি।
সাধন পথে চলতে গেলে, প্রতিদিন মনটাকে খোঁচাতে হবে। কি করতে এখানে এসেছি ? কি করে দিন গেলো ? মন তো ফাঁকি দেবার চেষ্টা করবেই, তাই বলে মনটাকে ছেড়ে দিলে চলবে না। মনের গলা টিপে ধরতে  হবে, মন যাতে ফাঁকি না দিতে পারে। এই মনই আমাদের শত্রূ, আবার এই মনই আমাদের মিত্র। তাই নিরন্তর অভ্যাসের মাধ্যমে মনের গলদগুলোকে  খুঁজে বের করতে হবে। আর গলদ-গুলোকে টিপে টিপে মারতে হবে। মনতো স্থুল বিষয়ে ধাবিত হবেই,  আর আমাদের কাজ হবে মনকে ধরে এনে সূক্ষ্ম বিষয়ে বসিয়ে দেওয়া । এসব করতে পারলেই আমরা সাধন-রাজ্যে এগিয়ে যাবো। ভগবান আছে কি নেই, এই বাজে গল্পে সময় না কাটিয়ে, একবার অন্তরচক্ষু  খুলে দেখে নিলেই  ভ্রম ঘুঁচে যাবে। ভগবানের স্মরণ-মনন করলেই ধীরে ধীরে মায়ার পর্দা খুলে যাবে। তখন নিজের ভিতরে যে অদ্ভুত জিনিস আছে, তা সম্যক ভাবে দৃষ্টি-গোচর হবে।  স্ব-প্রকাশ হবো আমরা।

সাধকদের জীবনযাপন সম্পর্কে অবশ্য়ই সতর্ক থাকতে হবে। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, আমাদের  অনুভূতিকে  সজ্ঞা স্তরে নিয়ে যেতে হবে। পরোক্ষ অনুভূতি নয়, অপরোক্ষ অনুভূতি লাভ করতে হবে। আমরা  একদিকে কিছুক্ষন ধ্যান অভ্যাস করবো, আর অন্য দিকে অতিরিক্ত  ভোজন, নিদ্রা, পরিশ্রম, বকবক করা চালিয়ে যাবো, তাহলে আমাদের আধ্যাত্মিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা কিছুতেই পূরণ হতে পারবে না। নিয়মিত ভাবে সৎ-অভ্যাস পালনের জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করতে হবে। আমি লক্ষ করেছি, প্রথম দিকে সাধকের উৎসাহ খুব তরতাজা থাকে, কিন্তু ধীরে ধীরে, তা স্তিমিত হয়ে আসে। তখন গুরুর কঠোর শাসনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আবেগ নিয়ে সাধনা করা যায় না। মনের দৃঢ়তা ও কঠোর শৃঙ্খলা চাই। তাই প্রথম দিকে, সৎগ্রন্থ পাঠ, এবং গ্রন্থের বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করা, নিজের মধ্যে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলা, এবং আকুলতা নিয়ে  উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা, একটু আধটু জনসেবার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা, এমনকি প্রকৃতির মধ্যে থেকে শিক্ষা নেওয়া, আনন্দ আহরণ করা, এগুলো প্রাথমিক সাধককে সত্য অন্বেষণের জন্য, উপযুক্ত করে তোলে। আমাদের মাথায় যে চিন্তা স্রোত বইছে, সেটাকে ধরবার চেষ্টা করা দরকার। প্রথম দিকে একনাগাড়ে এক ঘন্টার বেশি ধ্যানে না থাকাই  ভালো ।

সাধন ভজনের উপযুক্ত সময় :  সাধন-ভজনের উপযুক্ত সময় হচ্ছে সন্ধ্যিক্ষণ। সূর্য্য যখন উদয় হয়, সূর্য যখন পাটে বসে, সূর্য যখন মধ্য গগনে উপস্থিত হয়। প্রকৃতি এই সময় শান্ত থাকে, তাই এই সময় ধ্যান- জপের  উপযুক্ত সময়। কিন্তু সতর্ক সাধক শ্বাসের দিকে খেয়াল রাখেন,  শ্বাস যখন দুই নাক দিয়ে সমান ভাবে যাতায়াত করে, অর্থাৎ সুষুম্না নাড়ী দিয়ে যখন শ্বাস কার্য্য চলে, তখন আমাদের মন শান্ত থাকে, আর যোগীপুরুষগন এইসময় সব কাজ ছেড়ে ধ্যানে বসে যাবেন।

আমাদের যুক্তিবাদী মন, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনায় কোনো কাজ করতে পারে, তা সে বিশ্বাস করে না। কিন্তু কিছু আত্মবিশ্বাসী মানুষ আছেন, যারা মন  বুদ্ধির অতীত যে শক্তি আছে, সেই শক্তির সঙ্গে আত্মবিশ্বাসের দীপ্তিমান আলোর সাহায্যে, নিজের মনের শক্তির সঙ্গে মেলাতে পারেন। এই  ধরনের মন প্রার্থনার বা প্রতিজ্ঞার মধ্যে দিয়ে সেই শক্তির সারা পেয়ে থাকেন। এই গুন্ তারা অর্জন করেছেন। এটা সত্য যে ভগবান আমাদের স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতা দিয়েছেন, স্বাধীন ভাবে কাজ করবার ক্ষমতাও দিয়েছেন। কিন্তু জীবনে সাফল্য পেতে গেলে নিজের সেই স্বাধীন চিন্তার সঙ্গে বিশ্বশক্তির ইচ্ছের সঙ্গে নিজের মনের  ইচ্ছেকে  সংযোগ ঘটাতে হয়। আর  এইখানেই জীবনের সাফল্যের গুপ্ত রহস্যঃ লুকিয়ে আছে।

আমাকে অনেক সময় প্রশ্ন করা হয়, আমি কেন শ্রোতাদের প্রশ্নের জবাব দেই না  ? এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি। এক স্বামীজী বিভিন্ন ধর্ম্ম সভায় বক্তৃতা দিয়ে  বেড়ান। তো তার ড্রাইভার প্রতিদিন তাকে ধর্ম্ম সভায় পৌঁছে দেবার জন্য তার সঙ্গে যান। সারাক্ষন বসে থাকেন।  আবার যখন বক্তৃতা শেষ হয়, তখন স্বামীজিকে নিয়ে গাড়িতে করে ঘরে  ফেরেন। তো যখন স্বামীজী বক্তৃতা করেন, তখন গাড়ির মধ্যে বসে বসে তার সব বক্তৃতা তিনি শোনেন। এবং খেয়াল করলেন, স্বামীজী একই কথা সমস্ত ধর্ম্মসভায় বলেন। আর হাততালি কুড়ান । ড্রাইভারের এই সব বক্তৃতা শুনতে শুনতে প্রায় মুখস্ত হয়ে গেছে।  তো ড্রাইভার একদিন, স্বামীজিকে, বললেন সব ধর্ম্ম সভায়, আপনি যা বলেন, সে সব আমিও বলতে পারি। কিন্তু তবুও আপনাকে সবাই সন্মান করে থাকে, আর আমি  ঘরের বাইরে  দাঁড়িয়ে থাকি। তো স্বামীজী বললেন, তাই ! তো কাল তুমি বক্তৃতা দেবে, আর আমি ঘরের বাইরে গাড়ির মধ্যে বসে থাকবো। এবার পরের  দিন ড্রাইভারকে স্বামীজীর গেরুয়া ড্রেস পড়িয়ে দেওয়া হলো।  স্বামীজী এবার ড্রাইভারের  বেশে। তো স্বামীজীর বেশে ড্রাইভার বক্তৃতা দিলো।  সবাই হাত তালি  দিলো। স্বামীজীও খুব খুশি হলেন।  কিন্তু সভার শেষে এবার প্রশ্ন-উত্তর পর্ব। লোকে একটার পর একটা প্রশ্ন করতে লাগলো। তো স্বামীজীর বেশে চালাক ড্রাইভার, এবার বললো, এসব প্রশ্নের জবাব খুবই সোজা, এসব প্রশ্নের জবাব আমার ড্রাইভার দিতে পারবে। আমি তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তো ড্রাইভার বেশে স্বামীজী এসে সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিলেন। লোকে  অবাক হয়ে ভাবলো, সঙ্গগুণে মানুষের কত উন্নতি হয়।           
আসলে আমি আর শশাঙ্ক শেখর আলাদা। আপনারা যা শোনেন, তা শশাঙ্ক শেখরের কথা।  আমি বক্তা মাত্র। আপনাদের প্রশ্নের জবাব শশাঙ্ক শেখরের কাছে হয়তো আছে।  কিন্তু আমি তা জানিনা। শশাঙ্ক শেখর যা বলেন, তা আমি শুনতে পাই।  কিন্তু আমি যা বলি, তা শশাঙ্ক শেখর শোনেন কি না  তা আমি জানিনা।

আরো একটা জিনিস মনে হয়, মানুষ নিজে যা বিশ্বাস করেন, তার সমর্থনে সে বক্তৃতা শুনতে ভালোবাসেন । অন্যথা হলে মুখ ব্যাজার করে, চলে যান । আমরা সবাই জানতে চাই না, জানাতে চাই। যে প্রশ্নের জবাব আমার কাছে, সেই প্রশ্নের জবাব চেয়ে, অন্যকে বিব্রত করতে আমরা ভালোবাসি। নিজেকে জাহির করতে ভালোবাসি। আমি এই অবস্থা থেকে মুক্ত থাকতে চাই। ভালো থাকবেনসবাই।

জীবনে এমন সময় আসে, যখন মানুষ দিশেহারা হয়ে কাতর হয়ে জিজ্ঞেস করে "পথ কোথায়"? এই জিজ্ঞাসার উত্তর সর্ব্ব শাস্ত্রে যেমন আছে, তেমনি আছে নিজের বিবেকেগুরুর  কাছে। আত্মানুসন্ধান করো।  আত্মানুসন্ধান করতে গেলে  প্রত্যেক  মানুষকে কিছু  প্রক্রিয়া-সাধন করার  দরকার  পরে , নতুবা  এই পথে বেশিদূর এগুনো যায় না। দুর্গম এই পথে অবসর সময়ে কিছুক্ষন মন্ত্র-জপ করলাম, বা কিছুক্ষন ধ্যানের চেষ্টা করলাম, বা কিছু প্রাণায়াম করলাম, এতে করে অবশ্যই কিছুটা লাভ তো হয়, কিন্তু এইসব প্রক্রিয়া, আধ্যাত্মিক  দুর্গম পথের সমতল পথ মাত্র। আসল পথ চড়াই-উৎরাই।  আর এই চড়াই-উৎরাই পথে অন্যের সাহায্য অবশ্য়ই দরকার। অন্যের সাহায্য ছাড়া এই পথে এগুনো যায় না। জলের দ্বারা শরীর  তো শুদ্ধ করা যায়, কিন্তু অন্তরাত্মা শুদ্ধ করা যায় না। ঠিক তেমনি, শুধু প্রক্রিয়া দ্বারা আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করা যায় না। এর জন্য যেমন আমাদের কঠোর সংকল্প সম্পন্ন  মন প্রয়োজন,  মনকে নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন, তেমনি দরকার একজন কঠোর ও উপযুক্ত শিক্ষক। যিনি এই দুর্গম পথে সাবলীলভাবে বার বার যাতায়াতের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। বিপদের সময়, ঝড়-ঝঞ্ঝায়, কখন কিভাবে, কোন পথে এগুতে হবে, তা যার অভিজ্ঞতার মধ্যে আছে।

সত্য কোনো বিশেষ ধর্ম্মের বিষয় নয়। সৎ চরিত্রের মানুষ, পবিত্র মনের মানুষ, দয়ালু মনের মানুষ,  কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এঁরা সর্ব্বকালের, এঁরা জগতের হিতের জন্য, কালে কালে মনুষ্য দেহ ধারণ করেন, এবং সময়-উপযুগী  উপদেশ দান  করে থাকেন। এঁরা সমাজ গড়েন না, সমাজ এঁদের অনুসরণ করে। এঁরা পরিস্থিতির দাস নয়, এদের উপস্থিতিতে পরিস্থিতি অনুকূল হয়ে ওঠে।   এই সব মহাপুরুষের দেহান্তের পরে, এঁরই বাণী প্রচারের নামে সম্প্রদায় গড়ে তোলে, তাঁরই অনুসরণের নামে। আর যত  দিন যায়, তত তারা বিভক্ত হতে থাকে। নিজেদের মধ্যে বিভেদের বীজ বপন করতে করতে এগুতে  থাকে। ফলে এই সম্প্রদায়গুলো  যা রেখে যায়, তা সমাজে ডেকে আনে  অশান্তি, অস্থিরতা। তখন আমাদের অপেক্ষায় থাকতে  হয়, কখন আবার  মহাপুরুষ আসবেন।

ভয় কখনো কখনো সংক্রামক ব্যাধিতে পরিণত হয়। এর কোনো ভিত্তি থাকে না। কিন্তু এই ভয় মানুষের মধ্যে আচার ব্যবহারে পরিবর্তন এনে দেয়। কোনো বিশেষ প্রজাতির  মশা  থেকে সংক্রমক ব্যাধির জীবাণু ছাড়াচ্ছে, জানতে পারলে  সমস্ত মশাকে আমরা মেরে ফেলার  ব্যবস্থা করি। যদি আমরা জানতে পারি, কুকুর থেকে সংক্রমণ হচ্ছে, তখন আমরা আমাদের গৃহপালিত কুকুরকেও সন্দেহের চোখে দেখি। আতঙ্ক আমাদের নির্দয় করে দেয়। এখন সারা পৃথিবীতে মানুষের   একটা "দূর হটো  দূর হটো  ভাব চলছে। আজ আমার পাশে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তাকে আমি ভয় পাচ্ছি, তিনিও আমাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। মারণ ব্যাধির ভয় আমাদের সন্দেহপ্রবন করে তুলেছে। সন্দেহ থেকে রাগ হচ্ছে। কেন লোকটা এত কাছে আসছে ? খেঁকিয়ে উঠছি, তফাৎ যাও। রাগ থেকে হিংসার জন্ম নেয়। আর হিংসার ফলশ্রুতি কিন্তু ধ্বংশ। মানুষের সমষ্টিগত ভয়, জাতির জীবন বিপন্ন করে তুলবে।  এই সময় আমাদের দরকার একজন মহান নেতা, যার আদর্শ, সৎসাহস, সহানুভূতি, পরাক্রম আমাদেরকে অভয় দান  করবে। একটা কথা শুনুন, মরার আগেই  সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলবেন না। মানুষই মানুষকে বাঁচাতে পারে। আজ যাকে আপনি দূর হটো  বলছেন, কে বলতে পারে, কাল তাকেই আপনার দরকার হবে। আজ যে স্বাস্থকর্মীকে আপনি বাড়ি ভাড়া দিতে চাচ্ছেন না, হাসপাতালে সেই  হয়তো আপনাকে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব নেবে। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। শারীরিক ভাবে, আপনি দুরত্ত্ব বজায় রাখুন, কিন্তু মন থেকে তাকে আরো কাছে ডাকবার সময় এটি। সহযোগিতা করুন, কেউ অচ্ছুৎ নয়।  কাউকে এড়িয়ে যাবার সময় নয় এটি। বরং আরো কাছেকাছে থাকবার সময়। মন থেকে উৎসারিত হোক, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহমর্মিতা। একটু দূর থেকেই বলুন, ভালো আছেন তো দাদা, সাবধানে থাকবেন। আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঘৃণা নয়, আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতিশীল হোন। জানবেন, কার কখন কি হবে তা আমরা কেউ জানি না। আপনি কি জানেন, আজ যিনি আক্রান্ত, তার রক্ত দিয়েই তৈরি এই মারণ-রোগের প্রতিষেধক ঔষধ, যা আমাদের ভবিষৎ কে সুরক্ষিত করবে  । অন্ধকার চিরকাল থাকে না। মহামারী এর আগে অনেক ভাবে, অনেকবার পৃথিবীতে এসেছে।  কিছু মানুষ সেই  সুযোগে শরীরের পরিবর্তন করে নিয়েছে। কিন্তু পৃথিবী শূন্য হয়ে যায় নি।  এবারও আমরা ঘুরে দাঁড়াবো। অবশ্য়ই  আমরা নতুন সূর্য্যের আলোতে স্নাত হবো।

বইয়ের অক্ষরগুলো ক্ষুদ্র হলেও, আতস কাঁচের সাহায্যে, বা চোখে চশমা লাগিয়ে, আমরা অক্ষরগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পারি। আমার  নিজের মুখ আমরা আয়নার সাহায্যে দেখে নিতে পারি। ঠিক তেমনি বুদ্ধির প্রভাবে সেই বৃহৎ ঈশ্বরকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি। - মহাভারত, শান্তিপর্ব্ব।

আমরা সবাই জানি পরনিন্দা-পরচর্চা ভালো নয়। বরং আত্মসমালোচনা করা ভালো। কিন্তু নিজের মধ্যে খালি দোষের খোঁজ করলে, একসময় দেখবেন,নিজের মধ্যে ভালো কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। আমি অনেককে দেখেছি, নিজের দুর্বলতাগুলো নিয়ে তা সে শারীরিক হোক বা মানসিক হোক - কথা বলতে ভালো বসেন। এর থেকে সে অন্যের সহানুভূতি পেতে চান তারা ।  নিজের দোষ সম্পর্কে সচেতন থাকা এক জিনিস, নিজের দোষত্রূটি সংশোধনের চেষ্টা করা এক জিনিস, কিন্তু সর্ব্বক্ষন যদি কেউ নিজের দোষ  খুঁজে বেড়ায়, তবে একটা সময় আসবে, যখন সে নিজের মধ্যে দোষ  ছাড়া আর কিছুই সে দেখতে পাবে না। এটা কিন্তু একটা মারাত্মক রোগ। এই আত্মহনন  থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। নিজের ভালো দিকগুলোর দিকে ভালো গুনগুলোর দিকে  বেশি নজর দিন। সেগুলোকে প্রকাশিত হবার সুযোগ করে দিন। আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর এটা মূলমন্ত্র। অন্যের প্রসংসা বা সহানুভূতি পাবার জন্য লালায়িত হবেন না। নিজের পিঠ নিজেই  চাপড়ান।

পরাবিদ্যা : আমাদের পূর্ব-পূর্ব জীবনের স্মৃতি কেন লুপ্ত হয় ? আবার কেউ কেউ কেন জাতিস্মর হয় ? সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয় -
আত্মা-বুদ্ধি-মন যুক্ত কারন-দেহ আমাদের স্মৃতির আঁধার। বারবার জন্ম গ্রহণের ফলে, আমাদের যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়, তা আমাদের কারন-দেহে সঞ্চিত থাকে। এবং আমরা যদি কারন-দেহের  উপকরণগুলোকে  যোগের সাহায্যে  মানস দেহে পরিস্ফুট  করতে পারি, তবে আমরা আমাদের পূর্ব জীবনের স্মৃতি ফিরে পেতে পারি। আসলে আমরা স্থূল দেহ ত্যাগের পরে, বহুকাল একাধিক লোকে বাস করে থাকি। বেশিরভাগ জীবাত্মা স্বর্গের নিম্ন স্তর থেকে আবার  ভুর্লোকে আসবার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। এবং নতুন মানসদেহ ধারণ করে। তখন পূর্বের-কারন-দেহ বর্তমান থাকলেও, মানসদেহ ও মস্তিস্ক অর্থাৎ স্থুল দেহ নতুন হওয়ায় এবং আমাদের সমস্ত পূর্বার্জিত জ্ঞান সূক্ষ্মে নিবদ্ধ হওয়ায় অতি সূক্ষ্ম কারন দেহের স্পন্দন আমাদের মস্তিষ্কে কোনো ক্রিয়া করতে পারেনা। এই কারণেই আমাদের মনে পূর্ব্ব জীবনের কোনো স্মৃতি উদয় হয় না। কিন্তু কখনো কখনো বিকারের ঘোরে বা শৈশবে অনেক সময় আমাদের এই জ্ঞানের স্বাভাবিক বিকাশ দেখতে পাওয়া যায়। আমরা যদি যোগ সাধনবলে, বর্তমানকে অতিক্রম ক'রে , চিত্তকে নির্মল ও প্রশান্ত করতে পারি, তবে কারনদেহের স্পন্দন  গ্রহণ করতে সমর্থ হবো।  এই অবস্থায় আমাদের পূর্ব-জীবনের স্মৃতি জেগে উঠবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমাদের কারন-দেহ চিরস্থায়ী ও লিঙ্গহীন কিন্তু মানুষেরই আকৃতি-বিশিষ্ঠ। ভগবান বুদ্ধদেব, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ  জাতিস্মর ছিলেন। আজও  অনেক যোগী-সাধক এই ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু তাঁরা তাঁদের ক্ষমতার প্রকাশ নিজের মধ্যেই রাখেন, বাইরে প্রকাশ করেন না। পতঞ্জলির যোগদর্শন বলছে - সংস্কার সাক্ষাৎ করণাৎ পূর্বজাতিজ্ঞানম।

নিত্যদিন কাজের মধ্যে নিজের মনকে দেখতে থাকুন। যা কিছু করছেন, সচেতন ভাবে করার চেষ্টা করুন। আপনি কি খেয়াল করেছেন, আপনি হাঁটছেন,  না আপনার পা হাটছে ? আপনি কথা বলছেন, না আপনার মুখ কথা বলছে ? আপনি শুনছেন, না আপনার কান শুনছে ? ট্রেনের মধ্যে বসে আছেন, খেয়াল করুন আপনার মন কি ভাবছে। যেকোনো সময়, যেকোনো কাজের ফাঁকে নিজের মনের দিকে একটু খেয়াল করুন। ভালো-মন্দ যে চিন্তাই আসুক না কেন, চিন্তাগুলোকে লক্ষ করতে থাকুন। এতে করে নিজেকে বিচার করতে পারবেন। আপনি লোকটা কেমন তা বুঝতে পারবেন।  নিজের অবচেতন মনের সংস্কারগুলোকে ধরতে পারবেন। এবং কিছুদিন এই অভ্যাস করলে, আপনার মনের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে একটা পরিবর্তন আসতে  থাকবে।  শুধু তাই নয়, আপনার মধ্যে খারাপ চিন্তা, অশুভ চিন্তা, বাজে চিন্তা ধীরে ধীরে কমতে কমতে একদম লোপ পেয়ে যাবে। আর সঙ্গে সঙ্গে আপনি শুভ-পবিত্র চিন্তার বাহক হয়ে যাবেন। আর এই পরিবর্তন শুধু আপনি নয়, আপনার চারিপাশে যারা আছেন, তারাও আপনার মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখতে পাবেন। বিশ্বাস করতে হবে না, করে দেখুন। নিজেকে পরিবর্তনের একটা সহজ অথচ কার্যকরী উপায়। এতে করে আপনার ধীশক্তিও বৃদ্ধি পাবে।

যোগিরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয় প্রায়ই সারারাত ধরে ক্রিয়াসাধন (বায়ুসাধন ক্রিয়া -হঠযোগ) করতেন।  এবং সকালবেলা রানামহল ঘাটে গঙ্গাস্নানে যেতেন। এইসময় অর্থাৎ গঙ্গাস্নানের সময় তার পরমভক্ত ও উচ্চস্তরের যোগী কৃষ্ণারাম তার সঙ্গে যেতেন। যোগিরাজ যখন গঙ্গাস্নানে যাবার জন্য রাস্তা দিয়ে হাটতেন, তখন তাঁর পা টলতো। দেখে  মনে হতো একজন মাতাল টলতে টলতে পথ চলছে। আসলে বায়ুসাধন আমাদের শরীরকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে চালনা করে। আমাদের অপান বায়ু নিম্নগামী। এই অপানবায়ুকে দেহ-অগ্নির সাহায্যে প্রজ্জ্বলিত করে সূক্ষ্মতর করে, উর্দ্ধগামী করাই বায়ু সাধনা। তো এই বায়ুসাধনার ফলে দেহের ভারসাম্য সাময়িক ভাবে নষ্ট হয়। তাই বায়ুসাধনার পরপর আসন ছাড়তে নেই। তো যাই হোক যোগীরাজ পথ চলছেন  টলতে টলতে।  তো যাত্রা পথের পাশেই ছিল এক পানের দোকান। তো পানের হিন্দিভাষী দোকানদার মশকরা  করে বলতো, "দেখো, বাঙালী বাবুকা  কাম। সুবা-সুবা কেতনা চড়লবা।" অর্থাৎ দেখো বাঙালিবাবুর কাজ, সকাল সকাল মদের নেশায় কত মত্ত হয়ে আছেন। যার যেমন বুদ্ধি আর কি ? কিন্তু আশ্চর্য্যের কথা হচ্ছে, সেই হিন্দুস্থানী পানওয়ালা  পরবর্তীকালে একদিন সেই যোগিরাজেরই  অনুগত ভক্ত হয়ে ছিলেন।  

ব্যক্তিপূজার দেশ ভারতবর্ষ। ধর্মের ক্ষেত্রে তো আছেই, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এখানে ব্যক্তিপূজার বাড়বাড়ন্ত। ব্যক্তিপূজা ভক্তদের নৈতিক চরিত্রকে যেমন দুর্বল করে, তেমনি তা দেশের ভবিষ্যতের পক্ষেও বিপদজনক। আমরা যেন তথাকথিত মহান ব্যক্তি সম্পর্কে সতর্ক থাকি। বিচার-বিশ্লেষণ পূর্বক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন - কৃতজ্ঞতার নিদর্শন। কিন্তু মানুষের উপর দেবত্ত্ব আরোপ করা, গুরুতর অপরাধ।  এর অর্থ মানুষকে তার মহৎ গুণাবলী থেকে বঞ্চিত করা। মানুষ যে সাধনার দ্বারা অলৌকিক শক্তি অর্জন করতে পারে, অবতারবাদ তাকে অস্বীকার করে। এতে মানুষের আত্মবিশ্বাস খর্ব করা হয়। সাধকের কষ্টার্জিত শক্তি থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়। এবং  অন্য কাল্পনিক শক্তির উপরে তা আরোপ করা হয় । ভাগ্যের উপরে নয়, আত্মশক্তিতে বিশ্বাসই মানুষের উন্নতির পথ। 

 পৃথিবীতে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছেন। তাদের জন্য, আমাদের কোনো দুঃখ অনুভব হয় না।  কিন্তু আমরা আমাদের প্রিয়জনের মৃত্যুতে কান্নাকাটি করি।  এর কারন কি ?  আসলে,আমরা আমাদের জীবনকে দাঁড়  করিয়েছি রেখেছি কতকগুলো পিলারের উপরে।  আমাদের মা-বাবা-আত্মীয়স্বজন এক-একটা পিলারের মতো। এই থামগুলোর উপরেই আমার জীবন, আমার মন দাঁড়িয়ে আছে। মানসিক দিকথেকে আমরা এইসব সম্পর্কিত লোকগুলোর উপরে দাঁড়িয়ে আছি। এদের উপরে নির্ভর করেই, আমি দাঁড়িয়ে আছি বা বাঁচার আনন্দ পেয়ে থাকি ।  এর মধ্যে কোনো একজন অর্থাৎ নিকট আত্মীয় মারা যাবার অর্থ আমার মানসিক নির্ভরতার একটা থাম ভেঙে গেলো। ফলে আমার মনের যে অংশটি ওই থামের উপরে দাঁড়িয়েছিল, সেই অংশটি নির্ভর করবার আর কিছু পায়  না। ফলে সেই  অংশটি যেন শুন্যে ঝুলতে থাকে। এই শূন্যতা বোধ দুঃখের আকারে প্রকাশিত হয়।  ফলে আমরা কান্নাকাটি জুড়ে দেই। যার প্রতি আমাদের যত বেশী নির্ভরশীল, তার বিয়োগে  আমাদের তত বেশি দুঃখ হয়। 
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------- 
করোনার আক্রান্ত হবার আশঙ্কায় আমরা ঘরবন্দি। ভারতের প্রায় ১৩৮ কোটি মানুষ ঘরবন্দি  যেটা পৃথিবীর সব দেশের থেকে বেশী সংখ্যা। এমনকি  যেখান থেকে কোরোনার উৎপত্তি সেই  চিনেও মাত্র ৭৬ কোটি মানুষকে ঘরবন্দি করা করা হয়েছে, অর্থাৎ সে দেশের অর্ধেকের কিছু বেশী।  কিন্তু আমাদের দেশে সবাইকেই এই আওতায় রাখা হয়েছে। কবে এই ঘরবন্দি অবস্থা কাটবে, কবে আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবো, তা আমরা জানি না।  কারন ঘরবন্দি অবস্থাতেও আমাদের দেশে সংক্রমণের সংখ্যা কমের দিকে এখনো যায় নি। কিন্তু এখন থেকেই আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে, লকডাউন তুলে নিলে, আমরা কি করবো। এখনো বাড়ির বাইরে আটকে আছেন, লক্ষ লক্ষ মানুষ। হাসপাতালে আটকে আছেন, হাজার হাজার স্বাস্থকর্মী। মানসিক দিক থেকে এরা  সবাই বিদ্ধস্ত।  জানিনা,  হাসপাতালগুলো কবে স্বাভাবিক হবে। হাসপাতালের ডাক্তার-কৰ্ম্মীদের উপরে যে ঝড় বয়ে গেলো, তার পরিনাম কি হবে।পরিবার ছেড়ে যারা হাসপাতালে বা কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বাধ্য হয়েছেন , তারা একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন। যা সে জীবনে কখনো ভাবেইনি।   আর্থিক দিক থেকে যা ক্ষতি হলো,  তা কবে পূরণ করা সম্ভব হবে, তা আমরা জানিনা । আশঙ্কা আরো বাড়িয়েছে,  কর্মী ছাঁটাই, মাস মাইনে  কমিয়ে দেওয়া। বর্ধিত মূল্যবৃদ্ধি ভাতা (DA) এর মধ্যেই বন্ধ করা হয়েছে।  এমনকি ভবিষ্যতে দৈনিক কাজের সময় বাড়ানো, হতে পারে । এই অবস্থায় আমাদের কি করণীয়। ভবিষ্যতে মানসিক রুগীর বাড়ার সম্ভাবনা। অফিসে কাজের চাপ বাড়লে, বাড়িতে অশান্তির সম্ভাবনা। এগুলো সম্ভাবনা বলছি বটে, তবে এগুলো অবধারিত। এর মধ্যে আমরা লক্ষ করেছি, মদের দোকানে  মানুষের  লম্বা লাইন। সবথেকে বড় কথা হচ্ছে, করোনার মতো সংক্রমক বস্তু নিয়েই আমাদের ঘর করতে হবে ভবিষ্যতে । এই অবস্থায় আমাদের কর্তব্য কি  হবে ?  

১. মানসিক দিক থেকে নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। আমরা যেন কিছুতেই মানসিক ভারসাম্য না হারিয়ে ফেলি। আমরা যেন কিছুতেই মাথা গরম না করি।  
২. ঘরবন্দি অবস্থায়, আমরা যে ভালো অভ্যাস করেছি, সেগুলো আমাদের ধরে রাখতে হবে। যেমন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, যেখানে সেখানে থু-থু না ফেলা, মুখে অন্তত একটা রুমাল বেঁধে রাখা। 
৩. শরীর সুস্থ রাখবার জন্য, খালিহাতে ব্যায়াম , প্রাণায়াম অবশ্য়ই করতে হবে। 
৪. লকডাউন-এর সময়েই যদি নিয়ম মেনে কিছু কাজ সেরে রাখা যায়, সেগুলো এখনই সেরে রাখুন। 
৫. পরিমিত ও সহজপাচ্য খাবার খান।
৬. মনে রাখবেন, করোনা - আর পাঁচটা রোগের জীবাণুর  মতোই আর একটা রোগজীবাণু। আমরা যেন এই জীবাণুর ভয়ে  নিজেকে গুটিয়ে না রাখি। মনে রাখবেন, সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের জন্য এটি নিতান্তই তুচ্ছ। 
৭. অহেতুক ভয় পাবেন না, ভয় দেবেন না। সাবধানতা আর ভয় পাওয়া এক জিনিস নয়। ভয় পেলে আমরা আরো দুর্বল হবো। যারা সারাক্ষন দুর্ঘটনার কথা ভাবে, তাদের সামনে দুর্ঘটনাই আসে। অতএব নির্ভয়ে থাকুন।
৮. রোগ থেকে দূরে থাকুন, রুগী থেকে নয়। নিজেকে বাঁচাতে অন্যকে বিপদের মধ্যে ঠেলে ফেলে দেবেন না। 

ভালো থাকুন, ভালো রাখুন, ভালোবাসুন। একমাত্র ভালোবাসাই পারে, জাতিকে উদ্ধার করতে, দেশকে উদ্ধার করতে। বিশ্ববাসীকে উদ্ধার করতে, পৃথিবীকে সংক্রমনহীন করতে। ভগবানের প্রতি ভরসা রাখুন,আপনি অবশ্য়ই ভালো  থাকবেন। সবশেষে বলি, ভগবান যাকিছু করেন, সব আমাদের ভালোর জন্য। আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে তা আমরা  বুঝতে পারি না। 

প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই বিশ্বশক্তি বিরাজ করছে। এই বিশ্বশক্তি আমাদের প্রাণশক্তির সংযোগে আমাদের মধ্যে কাজ করে থাকে। আমরা বেশিরভাগ মানুষ প্রাণশক্তিকে বহির্মুখী করে রেখেছি। আর এটি প্রকৃতির স্বাভাবিক ক্রিয়া। জল যেমন নিম্নগামী, অগ্নিশিখা যেমন উর্দ্ধগামী, তেমনি সাধারণের প্রাণশক্তি নিমগামী, প্রকৃতিমুখী। কিন্তু আধ্যাত্মিক তেজস্বী পুরুষ প্রাণশক্তিকে উর্দ্ধগামী করে থাকেন। সাধনার প্রথমদিকে এই উর্দ্ধগামী প্রাণশক্তি প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে, সাধকের মধ্যে অনেক অলৌকিক কাজ সম্পন্ন করবার শক্তি সঞ্চয় করে থাকে। এগুলো পরখ করে সাধক নিজে যেমন আশ্চর্য্য হয়, সাধারণ মানুষও আকৃষ্ট হয়। এর  দ্বারা আমরা জাগতিক বস্তু সংগ্রহ, বা জাগতিক দুঃখের নিবারণের চেষ্টা করে থাকি। তাই এই অলৌকিক শক্তি প্রদর্শনে যেমন  সাধকের খ্যাতি বাড়ে, ঠিক তেমনি সাধকের আধ্যাত্মিক উন্নতি ব্যাহত হয়। এমনকি এগুলো প্রদর্শন সাধককে নিচে নাবিয়ে নিয়ে আসে। এই প্রসঙ্গে উপনিষদের একটা গল্প বলি। এক সাধক সাধনার উদ্দেশ্যে বনে নিভৃতে বাস করতে থাকেন। একটা গাছের ছায়ায় বসে প্রতিদিন তিনি  ধ্যান-ধারণায় রত থাকতেন। তো ধ্যানস্থ অবস্থায়, গাছের উপর থেকে,  একটা বক সাধকের  শরীরে বিষ্ঠা  ছেঁটালো। তো সাধক, রেগে গিয়ে, যেইনা উর্দ্ধমুখী হয়েছেন, অমনি বকটি ছটফট করতে করতে মাটিতে পড়ে  মারা গেলো। এতে সাধক আশ্চর্য্য হয়ে গেলেন, নিজের মধ্যে যে অলৌকিক শক্তি আয়ত্ত্ব হয়েছে, সেটা ভেবে বেশ খুশি হলেন, এমনকি নিজের মধ্যে একটা অহংকার জন্ম হলো। এই সাধক প্রতিদিন শরীর নির্বাহের জন্য মাধুকরীতে যেতেন। তো পরদিন যখন ভিক্ষে করতে এক গৃহস্থের বাড়িতে গেলেন। সেখানে  গৃহিনী তাকে একটু দাঁড়াতে বলে, ঘরের ভিতরে  প্রবেশ করলেন। আর এর মধ্যেই গৃহস্থ এসে গৃহের ভিতরে প্রবেশ করলেন। তো গৃহিনী ভিক্ষা দিতে দেরি করছে বলে, সাধক মনে মনে ফুঁসতে লাগলেন। কিছুক্ষন পরে, গৃহিনী ভিক্ষা নিয়ে বাইরে এলেন। সাধক তখন রেগে-মেগে মুখ লাল করে বললেন, তুমি জানো, আমি কে ? আমাকে অবজ্ঞা করছো ? । গৃহিনী শান্ত ভাবে বললেন, স্বামী সেবা করছিলাম, তাই দেরি হয়ে গেছে। অপরাধ নেবেন না।  সাধক তো রেগে টং, বললেন, তুমি আমরা ক্ষমতা জানো  ? আমি ইচ্ছে করলে, তোমাকে এক্ষুনি ভষ্ম করে দিতে পারি। তো গৃহিনী শান্ত স্বরে  বললেন, জানি, তবে শুনে রাখুন, আমি কিন্তু বক নোই। একথায় সাধক অবাক হয়ে গেলো। আর মনে মনে ভাবতে লাগলো, এসব কথা ইনি জানলেন কি করে ? 
তো ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে, এখনও এমন অনেক সাধক সাধিকা আছেন, যারা অনেক কিছু জানেন।  কিন্তু আমরা তাদের জানিনা। এইসব ক্ষমতার মাধ্যমে আমরা সাধারণ মানুষকে মুগ্ধ করতে পারি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসবের কোনো উচ্চতর আধ্যাত্মিক মূল্য নেই।  অপ্রয়োজনে যাঁরা এই সব শক্তির ব্যবহার করেন, তারা আর যাই হোক, সাধনপথে অবশ্য়ই নিম্নগামী হয়েছেন। সত্য-সন্ধানের পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখছেন। এরা  নিজেদেরকে অহংসচেতন করে তুলছেন। যারা সত্যিকারের সাধন পথের  যাত্রী,  তাঁরা এসম্পর্কে অবশ্যই সতর্ক থাকবেন। সঠিক যোগে নিবদ্ধ থাকলে, এইসব শক্তি আপনি না চাইলেও আসবে। কিন্তু সাধু সাবধান।

এক মাতাল শহরের রাস্তায়, কুমির দেখে ল্যাম্পপোস্টে উঠে পড়েছে। কিন্তু পুলিশ তো ছাড়বার নয়, তক্ষুনি তাকে জোর করে নাবিয়ে, জেলে চালান করে দিলো। মাতাল বললো, ভালোই করেছো, এখন তো কুমিরে খেতে পারবে না। পরের দিন খবরের পাতায় - হেডলাইন "শহরের রাস্তায় কুমিরের ভয়ে মানুষ ল্যাম্পোস্টে" সঙ্গে সেই ছবি। মানুষ এবার দলে দলে শহর  ছেড়ে পালতে লাগলো।

 আমাদের মধ্যে মতবাদ সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্য সন্মন্ধে আংশিক জ্ঞানের জন্য। আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমরা সাধনার একটা স্তরে উঠে সেখান থেকে সত্যের একটা রূপ দেখে, ভেবে নেই এটাই চরম সত্য। আমাদের একথা মনে রাখতে হবে যে আমরা যা জানি, তা সত্যের নানান রূপের মধ্যে, এটি একটি রূপ  মাত্র। এই একদেশদর্শী রূপগুলো সচেতনতার কোনো একটা দিক থেকে সত্য হলেও, অন্য স্তর থেকে অন্যরূপে দৃশ্যমান হতে পারে। তাই সত্য যদিও এক ও অভিন্ন, কিন্তু আমাদের সচেতনতার মাত্রা অনুযায়ী, আমাদের সত্য দর্শনে ফারাক হতে পারে। একমাত্র জ্ঞানাতীত নিরেপক্ষ স্তরে উঠতে পারলে, প্রকৃত সত্যের স্বরূপ আমাদের কাছে উপলব্ধিতে আসবে। তাই অন্যের সত্য-দর্শনের সঙ্গে আপনার  সত্যদর্শনের অমিল থাকতেই পারে। কিন্তু দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে না। ধর্ম্মমতের সংকীর্নতা আধ্যাত্মিক জীবনের মৃত্যুর কারন। 

আমরা শুনে থাকি আমাদের নাকি তিন রকমের শরীর,  স্থুল-সূক্ষ্ম-কারন। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন,আমাদের পাঁচকোষের শরীর।  আমাদের সবার যে যে বিভিন্ন শরীর  আছে, সে সন্মন্ধে কি ধারণা করা সম্ভব ? হ্যাঁ সম্ভব হতে পারে, যদি আমরা একটু অন্তর্মুখীন হতে পারি। আসলে আমাদের স্থুল শরীরের অনুভূতি এত বেশি যে আমরা সূক্ষ্ম ও কারন শরীরের যে বোধ তা আমরা হারিয়ে ফেলি। যতক্ষন জীবতত্ত্ব শরীরের সঙ্গে যুক্ত থাকে, এর দ্বারা আমাদের প্রতিটি অনু প্রাণবন্ত হয়ে থাকে। স্থুল শরীরে আমরা এই শক্তি অনুভব করে থাকি। আর আমরা সবাই জানি শক্তি মানে হচ্ছে তেজ, যার ধর্ম্ম হচ্ছে কম্পন। সাধন জগতে একটু অগ্রসর হলেই, আমরা আর একরকম শক্তি বা কম্পনের  সংস্পর্শে আসি, যা  আমাদের চিন্তা  ও আবেগ। এইভাবে আমরা দেখতে পারি আমাদের ব্যক্তিত্ত্ব যেন কতকগুলো কম্পনের সমষ্টি। কখনো কখনো আমাদের মন অশান্ত হয়ে ওঠে, তখন আমাদের মনে এলোমেলো চিন্তারাশির উদয় হয়। এইসময় আমরা একটা দ্রুত কম্পন রাশির স্তুপের মতো একটা কিছু হয়ে পড়ি। মনে হয়, দ্রুততালে বয়ে যাওয়া  ঢেউয়ের উপরে এই শরীরটাকে স্থাপন করা হয়েছে। আমরা যদি আরো একটু অগ্রসর হতে পারি, আমাদের মনকে যদিআরো স্থির করতে পারি, তখন আমাদের চেতনা সম্পর্কে একটা বোধ উৎপন্ন হবে। এটি আসলে মিশ্র চেতনা। অর্থাৎ চেতনা যেন অহংয়ের সঙ্গে মিশে আছে। একে মনের বা ইন্দ্রিয়ের চেতনা থেকে আলাদা মনে  হবে। একেই বলে তৈজস।  অর্থাৎ মানসিক জগতের কার্যকলাপ এই চৈতন্য প্রভাবে প্রত্যক্ষীভূত হয়। এই সত্ত্বা থেকেও আলাদা ভাবে রয়েছে  শুদ্ধ চৈতন্য, বা শুদ্ধ ব্যষ্টি  চেতনা। এই ব্যষ্টি চেতনাই ইন্দ্রিয় সংবেদনের মাধ্যমে  নিজেকে বিকশিত করে সমস্ত বস্তুজ্ঞান দেন করে থাকে । একেই উপনিষদ বলছে প্রাজ্ঞ। 

তিনতলার ঘরে শোয়ানো পঁচাশি বছরের বৃদ্ধার নিথর দেহ। নিচে শববাহী গাড়ির লোকেরা ডাকাডাকি করছে। নব্বুইউর্দ্ধ বৃদ্ধ তিনতলা থেকে নাবলেন, এই বিপদের দিনের সাথীদের ডেকে নিতে। উপরে আত্মীয় স্বজন আছেন। আছেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ছেলেরা। কিন্তু তারা তখন করোনা-সচেতন পুরুষ। সামাজিক দূরত্ত্ব সচেতন মানুষ। তাইএরা কেউ নিয়ম ভাঙতে রাজি নয়। মৃত বৃদ্ধা মায়ের দেহ ছোঁয়া তো দূর অস্ত তার কাছে যেতেও পারবে না তারা।  অগত্যা শববাহী গাড়ির ড্রাইভার, ও তার সঙ্গীদের নিয়ে মৃতার দেহ নিচে নাবানো হলো। শ্মশানে যাবে কে ? আত্মীয়রা, এমনকি ছেলেরা কেউ রাজি নয় শ্মশানে যেতে।  অগত্যা নব্বুই উর্দ্ধ বৃদ্ধ স্বামী শ্মশানে চললেন, শববাহী গাড়ির সঙ্গে। মৃত বৃদ্ধার সুসন্তানগন  নিরাপদ দূরত্ত্ব অবশ্য়ই বজায় রাখলেন। আগে কোরোনার হাত থেকে  বাঁচতে হবে তো ! পিতা নব্বুই-উর্দ্ধ বৃদ্ধ শ্মশানে গেলেন, স্ত্রীকে দাহ  করলেন, শেষে ফিরেও এলেন। হায় ভগবান, আসুন, আমরা সবাই এইসব  সন্তানদের জন্য দুধ-ভাতের প্রার্থনা করি, সুস্বাস্থের কামনা করি। - তথ্যসূত্রঃ - আনন্দবাজার পত্রিকা -২/৬/২০২০  

 আমার এখন বাড়ির বাইরে বেরুতে রীতিমত ভয় হয়। না করোনার ভয়, বা মৃত্যুর ভয় নয়। আমাকে কাছে পেয়ে কারুর ভয় হচ্ছে, সেটা দেখে আমার খারাপ লাগে। আমারও যেন ভয় হয়। অপমানের ভয়। আমাকে দেখে কেউ আতঙ্কগ্রস্থ হচ্ছে, সেটা দেখে আমার ভীষণ খারাপ লাগে। শারীরিক দূরত্ত্ব বজায় রাখার কথা বলতে গিয়ে, আমরা সামাজিক দূরত্ত্বের কথা বলেছি, এখন সেটা মানসিক দূরত্ত্বের দিকে ধাবিত হয়েছে। বহুদিন পরে কাল আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা হলো। আমি সচেতন ভাবে লক্ষ করলাম, সে যেন আমাকে সন্দেহের চোখে দেখছে। একটু শারীরিক  দূরত্ত্ব বজায় রেখেই কথা বলছে, আমারো যেন মনে হচ্ছে, ওকে আমি চিনি না।  মুখে মাস্ক নামক ঠুলি পড়া, যা মুখাবয়বকে ঢেকে রেখেছে। সেই চেনা মুখ যেন অচেনা হয়ে গেছে। আমরা এখন রাস্তায় যাচ্ছি, বাজারে যাচ্ছি, কিন্তু কেউ কারুর বাড়ি যাচ্ছি না। যখন-তখন বাড়িতে যাওয়া অবশ্য আগেই বন্ধ গিয়েছিলো, টিভি-সিরিয়ালের দৌলতে। এখন যেন বাকি সময়টুকুও কেড়ে নিলো। বন্ধুটি বলছিলো, নিজের বাড়িতে ঢুলতে গেলে, জামা-প্যান্ট খুলে স্ত্রীর ছুঁড়ে দেওয়া গামছা পড়ে ঘরে ঢুকতে হচ্ছে।  সঙ্গে সঙ্গে ওয়াশরুমে গিয়ে স্নান করতে হচ্ছে। পত্রিকায় দেখলাম, এক ভদ্রলোক দীর্ঘ আটদিন মটর সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে এসেছেন, কিন্তু বাড়িতে মা-বৌ ঢুকতে দেয়নি। কিসের আশায় বাড়িতে আসা ?  আমার এক আত্মীয় সল্টলেকে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তো লকডাউনে আটকে পড়েছিলেন। এখন বাস চালু হতে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছিলেন, বড়রাস্তায় বাস থেকে নাবতেই, পুলিশ পাকড়াও করে। সঙ্গে সঙ্গে  স্কুলে অর্থাৎ কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রে নিয়ে তুললো। আর এক শহর-তলিতে  থাকা আত্মীয় গ্রামে থাকা মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে প্রাইভেট গাড়ি করে, মাকে দেখতে গিয়েছিলো। গ্রামের সচেতন প্রতিবেশীগণ  তাকে, বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। বাধ্য হয়ে, দূর থেকে মাকে দেখে, ফিরে এসেছে। আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে,বৃদ্ধা  মায়ের ডাক্তার-ঔষধ-পথ্য দেবার ব্যাপারে, তাদের উদাসীনতা লক্ষ করবার মতো। ভয় হচ্ছে আমরা  কোরোনার দোহাই দিয়ে সমাজকে কোথায় নিয়ে চলেছি। করোনা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথী হয়ে গেছে।  যেমন আগে এসে ছিল, বসন্ত, কলেরা, যক্ষা, কালাজ্বর, ইত্যাদি ইত্যাদি। করোনা আমাদের কাছে থাকবে, কিন্তু আমরা কোথায় থাকবো ? 

আমরা যে কাজ করি, তার প্রেরণা আসে ভবিষ্যতে সুখে থাকবার ইচ্ছে বা ভোগলিপ্সা থেকে। আমরা যে ভালো কাজ করি, তার পেছনে কাজ করে আমাদের পুন্য সঞ্চয় করবার ইচ্ছে। এমনকি আমরা যে দেব-দেবতার পূজা অর্চনা করি, তাও ভবিষ্যতে ভালো থাকবার আশায়। আমাদের প্রত্যেকটি কাজের পিছনে কাজ করে আমাদের কামনা। আমরা যে যাগযজ্ঞ করে থাকি, তা স্বর্গসুখ লাভের আশায়। মৃত্যুর পর স্বর্গে গিয়ে স্বর্গসুখ ভোগ করবো, এই আশায়। কিন্তু সত্য হচ্ছে, এই সমস্ত কর্ম্ম  আমাদের জন্ম-মৃত্যুর যন্ত্রনা থেকে বের করে আনতে  পারে না। ভালো-মন্দ সব কর্ম্মের ফল ভোগ করবার জন্য আমাদের বার বার জন্ম-মৃত্যুর চক্রে  ঘুরপাক খেতে হয়। কিন্তু আমরা এখান থেকে বেরুবো কি করে ? উদ্দেশ্যবিহীন কর্ম্ম করা যায় না। হ্যাঁ উদ্দেশ্য ছাড়া মানুষ কর্ম্ম করবেই বা কেন ? আর কর্ম্ম ছাড়াও মানুষ বাঁচতে পারে না। মানুষ যখন কর্ম্মক্ষম থাকে না বা মানুষ যখন কর্ম্মহীন হয়ে যায়, তখন মানুষের আর  বাঁচার ইচ্ছে থাকে না। তো তাহলে আমরা কি করবো ? দেখুন শ্রীকৃষ্ণ  কখনো কর্ম্ম হীন হয়ে বসে ছিলেন না।শ্রীকৃষ্ণ বার বার বহু অত্যাচারী রাজাকে বা দুরাচারীকে পরাজিত করেছেন।  কিন্তু সেই সব রাজ্যের রাজা হবার জন্য, তিনি এটা করেন নি। সেই রাজ্যের দায়িত্ত্ব তিনি পরাজিত রাজার সন্তানকে বা অন্যকাউকে দিয়েছেন। কখনো নিজের সন্তানদের জন্যও রাখেন নি।  নিজের জন্যও  কিছু রাখেন নি। অর্থাৎ কর্ম্মের ফল তিনি অন্যকে অর্পণ করেছেন। তাই কর্ম্মের ফল যদি অন্যকে অর্পণ করা হয়ে থাকে, তবে সেইসব ভালো-মন্দ কর্ম্মের ফল আমাকে ভোগ করতে হবে না। আমাদেরও উচিত, সমস্ত কর্ম্ম অন্যের জন্য করা, কর্ম্মফলও অন্যকে সমর্পন করা। আমরা অবশ্য অনেকে ভাবি, আমি যা কিছু করছি, সবই অন্যের জন্য, অর্থাৎ পরিবারের সদস্যদের জন্য, আমাদের সন্তানদের জন্য। এতে করে আপনি আপনার সন্তানদের বা যাদের জন্য করছেন, তাদেরকে ভোগাচ্ছেন। তাই আপনার কর্ম্মের জন্য আপনার সন্তানদের ভুগতে হচ্ছে। তাই,  আর কিছু না পারেন, মনে মনে ভাবুন, আমি যা কিছু কর্ম্ম করছি, সবই ঈশ্বরের কর্ম্ম।  আমি তার নির্দেশ পালন করছি মাত্র। আর এই কর্ম্মের ফল তা সে ভালো হোক বা মন্দ হোক, ঈশ্বরকেই ভোগ করতে হবে। আমি তো তার নির্দেশ  পালন করছি মাত্র ।  কর্তা  তিনি, আমি কর্ম্মচারী। তাই সুখভোগও  তাঁর আর  দুর্ভোগও তাঁর ।  ধর্ম্মকর্ম্মের এটাই মূলনীতি।

আমরা কি কখনো ভেবেছি, ডাক্তারেরা কাজ করবে, নার্সরা কাজ করবে, স্বাস্থ্য-কর্মীরা  কাজ করবে আর আমি ভালো থাকবো।  অন্যথা হলে তেড়ে যাবো, এটা কি করে হতে পারে ?  সাফাইকর্মীরা কাজ করবে, গ্যাস সরবরাহ ঠিক থাকবে, ইলেক্ট্রিক লাইন ঠিক থাকবে, ব্যাঙ্কের কর্মীরা কাজ করবে, দমকলকর্মীরা কাজ করবে আর আমি বাড়ি বসে কম্বল মুড়ি দিয়ে, করোনা করোনা বলে চিৎকার করবো। বাড়িতে পরিচারিকা না এলে, মাইনে  তো দেবই  না, বরং শাপশাপান্ত করবো, এটা কি হতে পারে ? ভিড় বাসে হুড়মুড়করে আমি উঠে যাবো, কিন্তু অন্যকে অবশ্য়ই ভিড় বাসে উঠতে বাঁধা দেবো।  এটা কি হতে পারে ? প্রত্যেক মানুষ অসুস্থ হলে অসহায় হয়ে যায়। এইসময় মানুষ আপনজনের সহায়তা কামনা করে। আপনজনও তাকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়।  এমনকি পশুদের মধ্যেও এই প্রবৃত্তি লক্ষিত হয়। আজ কিন্তু করোনা আক্রান্তদের আপনজন থেকে আলাদা করবার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। যেটা আসলে আমাদের সবাইকে অসহায় করে তুলবে। আমার যখন বসন্ত হয়েছিল, আমাকে বাড়িতে মশারির মধ্যে থাকতে বলা হতো। কিন্তু মা আমার সমস্ত কিছুর জন্য সহায়তা করতেন। এমনকি বোনেরাও আমার দেখাশুনা করতো। শুনেছি, জীবনে সবারই একবার না একবার হাম হয়। তো শরীর থাকলে রোগ থাকবে, রোগবিহীন শরীর হতেই পারে না। যারা আজকে নিজেকে নীরোগ  ভাবছেন, তাদেরও যদি পরীক্ষা হয়, তবে দেখা যাবে, নানান রোগ তার মধ্যে বাসা বেঁধে আছে। তথাপি তিনি ভালোই  আছেন। ডাক্তারেরা নিজেরা কি নীরোগ থাকতে পারেন ? আমার স্ত্রীকে পৰীক্ষা করার পরে রিপোর্ট আসে, তিনি থাইরয়েডে আক্রান্ত। যার নির্দেশে পরীক্ষা করা হয়েছিল, তিনি বললেন আর.এন  টেগোরে যেতে। সেখানে গেলে ডাক্তারবাবু বললেন, ফালতু রিপোর্ট, আপনার কিছু হয়নি। আমার স্ত্রী ভালোই আছেন। তো কাকে বিশ্বাস করবেন ? এমন রিপোর্টের খবর আমার কাছে অনেক আছে। কলকাতার রিপোর্টে আক্রান্ত, ভেলোর তা বিশ্বাস করে না।  দুনিয়াটা যেমন একটা আতুর ঘর, তেমনি পাশাপাশি আছে শ্মশান। আমি কিসে আক্রান্ত হয়ে দেহত্যাগ করবো, সেটা বড় কথা নয়। আমি যে দেহত্যাগ করবোই এটাই চরম সত্য। চিকিৎসা মানুষকে ব্যথা উপশমের দাওয়াই দেয়।  চিকিৎসা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখবার প্রতিশ্রুতি দেয়  না। আমরা অনেকে ভাবি, আমি সন্তানের  পিতা বা মাতা ।  আমি সন্তানকে জন্ম দিয়েছি। কিন্তু সত্য হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা তার নিজের খেয়ালে প্রকৃতির সাহায্যে জন্ম-মৃত্যুর লীলা করছেন। জীব কখনো কাউকে জন্ম দিতে পারে না, আবার কাউকে মারতেও পারে না। আমরা তাঁরই ইচ্ছেয় তাঁরই কর্ম্ম করবার জন্য দেহে আশ্রয় করেছি। দেহ অকেজো হয়ে গেলে, বা সংকল্প পূরণ হয়ে গেলে, দেহ ছেড়ে চলে যাবো। এই অমোঘ সত্য আমাদের স্মরণে রাখতে হবে। তো মৃত্যুভয়ে কর্ম্ম ত্যাগ নয়। কর্ম্মই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। কর্ম্মহীন জীবন অসম্ভব।  এই অসম্ভবকে যারা সম্ভব করতে চাইছেন, তারা অলীক স্বপ্নে বিভোর। ভগবান এদের সুমতি দিন।
১৯১৮-১৯২০ স্প্যানিশ ফ্লুতে গোটা বিশ্বে ৫ কোটি মানুষ মারা যান। এর মধ্যে কমবেশী ১.৫ কোটি মানুষ মারা যায় ভারতেই। যা ভারতের তখনকার জনসংখ্যার ৫ শতাংশ।   এইসময় আমাদের জাতির  জনক মোহনচাঁদ করমচাঁদ গান্ধীও  স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হন।  তাকে যথাযথ সেবা যত্ন করে বাঁচিয়ে তোলা হয়। কিন্তু লক্ষাধিক সহ-নাগরিক বাঁচেন নি। এরপরও   দিনের সঙ্গে সঙ্গে জনঘনত্ত্ব বেড়েছে বই কমেনি।

 জ্যান্তে - মরায় ধরুন। 
 এ এক অদ্ভুত সত্য। এই আছি এই নেই। জীব প্রতিনিয়ত জন্মাচ্ছে প্রতিনিয়ত মরছে। কেবল আমরা ধরতে পারছি না, বুঝতে পারছি না। আমরা জীবন নাট্যমঞ্চে অভিনয় করছি।   আমাদের সমাজ, আমাদের পরিবেশ, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের পরম্পরা, আমাকে একটা নির্দিষ্ট পাঠ দিয়েছে, আমি সেই মতো অভিনয় করে যাচ্ছি। এর থেকে   নিষ্কৃতি পাবার জন্য একটা উপায় বলি, আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে যে অন্তর বা গ্যাপ  আছে, সেই অন্তরটাকে ধরবার চেষ্টা করুন। কাজের মধ্যেই এটা করতে পারেন। শুয়ে-বসে এটা করতে পারেন। বাড়িতে-বাজারে যেকোনো অবস্থায় এটা করতে পারেন। তাহলেই দেখবেন জীবন চলতে শুরু করেছে। এর জন্য কোনো মনোযোগ দেবার দরকার নেই,শুধু খেয়াল করুন, আর যা ঘটছে আপনার ভিতরে সেটাকে  অনুভব করুন। এতেকরে আপনি নতুন মানুষ হয়ে যাবেন।  আপনার ভিতরে একটা নতুন মানুষের জন্ম নেবে।

স্বয়ং শিব বলছেন, একটা আনন্দোজ্জ্বল মুহূর্তের সন্ধান পাওয়া যাবে। এই অভিজ্ঞতা পাওয়া যেতে পারে শ্বাস ও প্রশ্বাসের সন্ধিক্ষনে। এই মুহূর্তটি ,হচ্ছে যখন আমাদের ভিতরে বায়ু প্রবেশ করছে, এবং বেরিয়ে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে। যখন বায়ু প্রবেশ করছে আপনি স্থির ভাবে অপেক্ষা করুন, এক-পলকের  হাজার ভাগের  একভাগ সময় আমাদের কোনো শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া সংগঠিত হয় না। বাতাস বেরিয়ে আসার ঠিক আগেরমুহূর্তে এই ক্ষণ। বাতাস ভেতরে ঢুকছে, ঠিক তার পরেই অর্থাৎ বাতাস বাইরে যাত্রা করবার  ঠিক আগে, একমুহূর্তের জন্য আমাদের  শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। আবার বাতাস যখন বাইরে বেরিয়ে যায়, এবং নতুন বাতাস ভিতরে আসবার জন্য প্রস্তুত হয় তখন আরো একটা ক্ষণ আসে যখন আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসের গতি রুদ্ধ থাকে। তার পরে আবার বাতাস ভিতরে প্রবেশ শুরু করে। অর্থাৎ বাতাস ভিতরে যাত্রা শুরু আগমুহূর্তে আবার বাতাস বেরিয়ে যাবার আগমুহূর্তে ক্ষনিকের জন্য বায়ু গতিহীন থাকে। এই মুহূর্তটাকে আমাদের ধরতে হবে। তবেই আনন্দব্যঞ্জক এই মুহূর্তের সন্ধান মিলবে। একটা কথা বুঝতে হবে, আমরা যখন শ্বাস গ্রহণ না করি, তখন আমরা কেউ আর জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখি না। আমি তখন জীবজগতের কেউ নোই। আপনি যখন শ্বাস নিচ্ছেন না, তখন আপনি মৃত। আপনার ধারা চলছে, কিন্তু আপনি নির্জীব, মৃত। এইযে স্বল্প মুহূর্ত, এটা আমরা কেউ খেয়াল করি না। শ্বাস  নিচ্ছি মানে আমি জীবিত হচ্ছি বা প্রাণ সংগ্রহ করছি, আর শ্বাস যখন আমরা ছেড়ে দিচ্ছি তখন প্রাণহীন হচ্ছি বা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। অর্থাৎ পুনরায় শ্বাস নেওয়া মানে পুনর্জন্ম  আর শ্বাস ছেড়ে দেওয়া বা বেরিয়ে যাওয়া  মানে আমাদের মৃত্যু। এই প্রক্রিয়া অহর্নিশি চলছে। এই জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যে একটা ক্ষীণ ক্ষণ আছে । এই ক্ষীণ ক্ষণকে অনুভব করতে হবে। তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন, আপনার চলার পথের পদক্ষেপ। আপনি রাস্তা দিয়ে হাটছেন , দুই পা দিয়ে হাটছেন , আপনি কি কখনো ভেবেছেন যে আপনি  একটা মুহূর্তের জন্য শূন্যে ভাসছেন । এটা আমরা ধরতে পারিনা।  কারন আমরা ভাবি, একপা শূন্য দিয়ে এগুচ্ছে তো আর একপায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি। না ব্যাপারটা তা হয় সামনের পা মাটিতে ছোয়ার ঠিক এক মুহূর্ত আগে পিছনের পা শূন্য চলে আসে। দৌড়োনোর সময় এটা ভালো ভাবে আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন। ঠিক তেমনি আপনার  শ্বাস ভিতরে যাওয়া ও বেরিয়ে আসার মধ্যে এক পলকের জন্য, বাতাসের গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। আবার ঠিক একই ভাবে বাতাস যখন বাইরে আসে এবং বাতাস ভিতরে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়, এই সময় একটা অন্তর থাকে। এই মুহূর্তকে আমাদের ধরতে হবে। তাহলেই আমরা একটা আনন্দোজ্জ্বল মুহূর্তের সন্ধান পাবো। এবং এই মুহূর্ত ক্ষনে ক্ষনে আসছে।  আমরা ধরতে চেষ্টা করি না।  তাই আমাদের বোধে সেটি আসে না। এই প্রক্রিয়ার জন্য, আপনাকে শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রিয়াকে রুদ্ধ করতে হবে না। শুধু স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াকে চলতে দিন আর আপনি ছিপ নিয়ে বসে থাকুন। ব্যাপারটা  সহজ-সরল । এটাই জ্যান্তে-মরা অবস্থা। অর্থাৎ না জীবিত না মৃত। আমরা জানি বাতাস আমাদের ভিতরে  আসে, আবার বাতাস বেরিয়ে যায়।  কিন্তু এই দুইয়ের  মধ্যে যে অন্তর আছে তা আমাদের উপল্বদ্ধিতে নেই। চেষ্টা করুন, হঠাৎ করে একসময় ঝলক এসে যাবে আপনার জীবনে। আপনাকে কিছু যোগ করতে হবে না - আপনাকে কিছু ত্যাগ করতে হবে না।  শুধু কান পেতে বসে থাকুন, শুধু স্থির হয়ে অপেক্ষা করুন। 

এটি অভ্যাস করতে গেলে, প্রথমে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতির দিকে খেয়াল রেখে চলতে হয়। বাতাস যখন আপনার নাকের ছিদ্র-ত্বক স্পর্শ করছে, সেটাকে উনুভবে আনুন। এইবার বাতাসকে ভিতরে যেতে দিন। কোন পথে ভিতরে যাচ্ছে সেটা খেয়াল করুন, কতক্ষন বাতাসের উর্দ্ধ গতি থাকছে, কোথা থেকে বাক নিচ্ছে, আবার  নিচের দিকে যাবার সময় আপনার কোন কোন অঙ্গ  স্পর্শ করছে, সেটাকে অনুভবে আনার চেষ্টা করুন। বাতাসকে একলা ছেড়ে দেবেন না। সঙ্গে থাকুন। বাতাসের আগে আগে যাবেন না, পেছন পেছন চলুন। শুধু চলুন, তাকে স্বাভাবিক গতিতে নিত্য  পথে যেতে দিন। আপনার ছায়ার স্পর্শও যেন বাতাসের গায়ে না লাগে। মনে রাখবেন, বায়ুর সঙ্গে চেতনা যাচ্ছে। আবার ফিরে যাচ্ছে, নিজেকে রাস্তা থেকে সরিয়ে রাখুন। যে মুহূর্তে সে বাঁক  নিচ্ছে, বেরিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, সেই মুহূর্তে সে ক্ষনিকের জন্য  স্থির হচ্ছে। এই স্থির সময়টাকে আমাদের ধরতে হবে। এই প্রক্রিয়া স্বয়ং বুদ্ধদেব অনুসরণ করতেন।  যার জন্য এই ক্রিয়াকে বুদ্ধ-যোগ বলা হয়ে থাকে। বুদ্ধদেবের জ্ঞানের  উন্মেষ এই প্রক্রিয়াতেই হয়েছিল। শ্বাস-প্রশ্বাস সম্পর্কে আপনার সচেতনতা যত বৃদ্ধি  পাবে, আপনি তত  বৌদ্ধিক হয়ে যাবেন। এবং অবশ্য়ই এই প্রাণের বিশ্রামের সময়টা ধরে ফেলবেন। আপনি যখন সেই মূল্যবান সময়টা অর্থাৎ  আপনার ভিতরে শ্বাস প্রশ্বাস আর প্রবাহিত হচ্ছে না, সেই সময়টাকে  ধরতে পারবেন  তখন  আপনার  মনে হবে, আপনি আর নেই।  আপনি তখন বিশ্বশক্তির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন। এটাই সমাধির অবস্থা।  
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।
------------------------
স্বামীজীর কাছে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আসেন। নানান রকম প্রশ্ন তাদের। তো এক বিদেশিনী যিনি বেশ কিছুদিন ধরে আশ্রমে এসে স্বামীজীর সেবা যত্ন করছেন, তিনি একদিন স্বামীজিকে বললেন, এইযে প্রচুর মানুষ সারাদিন ধরে আপনাকে বিরক্ত করে, আপনি এদের নিয়ে, বিকেলের দিকে ধর্ম্মশিক্ষা দিতে পারেন।  তাতে আপনার সারাটা দিন নষ্ট হয় না। 

তো স্বামীজী বললেন, দেখো ধর্ম্ম কাউকে শেখানো যায় না। ধর্ম্ম ভিতরে ধারণ করতে হয়। কতকগুলো শাস্ত্রবাক্য শোনানো ধর্ম্ম নয়। তুমি যদি হিন্দু ধর্ম্মের কথা বলো, যদি খ্রীষ্টান ধর্ম্মের কথা বলো, ইসলাম ধর্ম্মের কথা বলো, বৌদ্ধ ধর্ম্মের কথা বলো, তাহলে অবশ্য আলাদা কথা। ধর্ম্ম হচ্ছে একটা জীবনধারা। ধর্ম্ম হচ্ছে, প্রেম-প্রার্থনা-শ্রদ্ধা-আনন্দ। তুমি যদি নিজে ধর্ম্মিক হও, তবে তোমাকে সবাই ধরতে পারবে। তথাকথিত ধর্ম্ম শিক্ষা একটা মতবাদের কথা প্রচার করে মাত্র। আর এই তত্ত্বকথা মানুষকে ধর্ম্মিক করতে পারে না। যার ক্ষুধা পেয়েছে, তাকে রুটি দিতে হবে। যার তৃষ্ণা পেয়েছে তাকে জল দিতে হবে। এখন তুমি যদি রুটি রুটি করে চিৎকার করো, তবে কারুর পেট ভরবে না। গম তৈরির প্রক্রিয়া থেকে রুটি তৈরির প্রক্রিয়ার উপরে একঘন্টা বক্তৃতা দিলেও তাদের পেট ভরবে না। জল হাইড্রোজেন-অক্সিজেন দিয়ে তৈরি হয়েছে। জলের উৎস মেঘ, নদী, সমুদ্র ইত্যাদি ইত্যাদি বলে যদি বোঝাতে চেষ্টা করো, তবে তৃষ্ণার্তের তৃষ্ণা মিটবে না। এইসব তত্ত্বকথায় কারুর পেট ভরবে না। রাম রাম, কৃষ্ণ কৃষ্ণ, খ্রিষ্ট খ্রিষ্ট, আল্লা আল্লা বলে অহর্নিশি যন্ত্রের মতো রুটিন করে জপ করে গেলেও, তুমি ধর্ম্মিক হতে পারবে না। এগুলো আসলে বিভিন্ন ধর্ম্মমতের প্রচার মাত্র। কিছু বিধি-নিষেধের মধ্যে মানুষকে  বেঁধে ফেলার জন্য, পন্ডিতদের কৌশল। এই বিধি-নিষেধ শেখানো যায়, ধর্ম্ম কাউকে শেখানো যায় না। তুমি নিজে যতক্ষন ধর্ম্মিক না হতে পারছো, ততক্ষন তোমার ধর্ম্ম আলোচনা বৃথা। একটা বাচ্চাকেও  যখন তুমি ধর্ম্মশাস্ত্রের  কাহিনী শোনাবে, তখন সে হাসবে, কারন সে আমাদের থেকে অনেক বেশি কিছু জানে। কুমারীর গর্ভে সন্তান, প্রেমাস্পদকে পরিত্যাগ, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, একাধিক  স্ত্রী, একাধিক স্বামী, সান্তা-ক্লাউস-এর মিথ্যে  উপহার, আবার যীশুকে ক্রশবিদ্ধ করা, কোনটাকে তুমি শেখাতে চাও ?  

তার চেয়ে এসো, নিজে সৎ হই, উচ্চ-পবিত্র চিন্তা করি, পরিমিত আহার করি,  জীবন হোক অতি সাধারণ। পরের হিতে সময় ব্যয় করি। তখন দেখবে, তোমাকে কোনো ধর্ম্মেশাস্ত্রের কথা বলতে হবে না। তোমাকে দেখেই সবাই ধর্ম্ম  শিখবে। মন আর মুখ যার এক - সে মানুষকে টানে। তখন সময় নির্দিষ্ট করা যায় না। কথাও বসে থাকে না। চলতেই থাকে চলতেই থাকে।  

হাসি যখন ঔষধ। 
বোকার মতো হাসুন। হ্যাঁ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বোকার মতো হাসুন। নিজের মুখের দিকে তাকান দেখবেন, কেমন হাসি পাচ্ছে। একবার চোখটাকে কুঁচকে নিজেকে দেখুন, মুখটাকে বিকৃত করুন, আর হাসুন। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে নিজেকে দেখুন আর হাসুন।  বাচ্চা ছেলে-মেয়ে বিশেষ করে যারা সবে আধো আধো কথা বলতে শিখেছে, তার সঙ্গে কথা বলুন, দেখুন, কেমন হাসি পাচ্ছে। পোষা জীবজন্তুর সঙ্গে কথা বলুন, গাছপালার সঙ্গে কথা বলুন, আর হাসুন।  আমুদে-রসিক  লোকের সঙ্গে কথা বলুন, আর হাসুন। কোথাও হাসির কথা হলে, তা সে টেলিভিশনে হোক, বা যেকোনো জায়গায় হোক, হাসির খোরাক পেলেই হেসে নিন ক্ষাণিক্ষণ। হাসির বই পড়ুন, আর হাসুন। নিজের দেখা কোনো মজার ঘটনা, বা নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো মজার ঘটনা, মনে করুন আর হাসুন। 

শরীরের ক্লান্তি কাটাতে, মনের বিষন্নতা কাটাতে, দুশ্চিন্তা  কাটাতে, একাকীত্ত্ব কাটাতে, ভয় দূর করতে, অহেতুক আশঙ্কা দূর করতে, হাসির তুলনা নেই। 

ভাবছেন, লোকটা আমাদের পাগল ভেবেছে নাকি ? হ্যাঁ পাগল যদি না হতে চান, তবে হাসুন, আর মনের সমস্ত চাপ দূর করে দিন। কিভাবে ? 

আমরা যখন চাপের মধ্যে থাকি, তখন শরীরের মধ্যে স্ট্রেস হরমোনের পরিমান  বেড়ে যায়। আর  হাসিতে স্ট্রেস-হরমোনের পরিমান কমে যায়। ফলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। আমরা যখন হাসি, তখন আমাদের শরীরে, এন্ডরফিন নামে  এক রাসায়নিকের নিঃসরণ বাড়ে। এতে করে, শরীরের ব্যথা যন্ত্রনা থেকে সাময়িক মুক্তি ঘটে। অট্টহাসি আমাদের হৃদযন্ত্রকে সতেজ  রাখতে সাহায্য করে থাকে। হাসিতে রক্তনালীগুলোর মধ্যে রক্তচলাচল বাধামুক্ত হয়ে যায়। হাসতে  হাসতে  যদি কাশি আসে, বা হেঁচকি ওঠে তবে জানবেন, আপনার শ্বাসনালী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। হাসিতে আমাদের মুখের মধ্যে এক ধরনের লালা উৎপাদন হয়, আর এই লালা যখন শ্বাসনালীর মধ্যে প্রবেশ করে, তখন শ্বাসনালীর মধ্যে যদি কোনো জীবাণু থাকে তাকে এই লালা মেরে ফেলে। 

তাই বলছি, হাসুন আর ভালো থাকুন।