Thursday 19 August 2021

ধ্যানময় জীবনই শান্তির পথ, সাফল্যের পথ ।


ধ্যানময় জীবনই শান্তির পথ, সাফল্যের পথ । 

সব কাজই হয়ে যাচ্ছে, করছো তুমি, নাম হচ্ছে আমার।  মস্তকে সদা তোমারই চিন্তা উদয় হচ্ছে। কর্নে তোমারই মধুর ধ্বনি শ্রুত হচ্ছে, নাসিকায় তোমারই সুগন্ধি বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে, মুখ সদা তোমারই কথা বলছে, কন্ঠে তোমারই সমধুর সুর ধ্বনিত হচ্ছে, হৃদয়কেন্দ্র তোমারই বাসস্থান - এই হৃদয় তুমি নির্মল  করেছো, পবিত্র করেছো। পিতৃমাতৃ প্রদত্ত পঞ্চভূতের এই শরীর তুমি শুদ্ধ করেছো, পবিত্র করেছো, নির্মল করেছো, নীরোগ করেছো। এই চিন্তাধারা যার মধ্যে সদা প্রবাহিত হচ্ছে, তার মন থাকে শান্ত। আর শান্ত মানুষের জন্য, আলাদা করে ধ্যানের  প্রয়োজন হয় না। 

আমরা বলি, আমার মন চঞ্চল, আমার মন অস্থির, আমি ধ্যান করবো কি করে ? আসলে যার মন যত  চঞ্চল,যার মন যত  অস্থির, তার তত বেশি ধ্যানের  প্রয়োজন। ধ্যান মানুষের মনকে শান্ত করে দেয়। আর শান্ত মনেই শান্তি বিরাজ করে থাকে। আমরা ভাবি, কিছু না করা মানেই বিশ্রাম। তাই  আমরা কিছু সময় কর্ম্ম থেকে বিরত থেকে, বিশ্রাম পাবার চেষ্টা করে থাকি। কিন্তু  সত্য হচ্ছে, আমরা আমাদের বিশ্রামের নামে  যা করি, তা আসলে আলস্য। আর এই আলস্য-কালীন সময়ে আমাদের মনে নানান রকম চিন্তার উদয় হতে থাকে। আর এই চিন্তার মধ্যে বেশিরভাগ চিন্তাই অহেতুক, অপ্রয়োজনীয়, এমনকি নঞৰ্থক চিন্তা। তাই আমাদের বিশ্রাম মানে বাজে চিন্তা করবার সময়। আমাদের অনেকের ধারণা  হচ্ছে, ক্ষনিকটা সময় আমোদ-প্রমোদের মধ্যে কাটাতে পারলে, আমাদের ক্লান্তির উপশম হবে, আমরা ভালো থাকবো।  কিন্তু সত্য হচ্ছে, যে বিশ্রাম আমাদের মধ্যে সজীবতার জাগরণ না ঘটাতে পারে, আমাদের মধ্যে জীবনীশক্তির বৃদ্ধি না করতে পারে, তাকে বিশ্রাম বলা যেতে পারে না।  সেই দিক থেকে দেখতে গেলে, সত্যিকারের বিশ্রামের উপায় হচ্ছে ধ্যান-জপ-প্রার্থনা। আর এই ধ্যান জপ প্রার্থনার মাধ্যমে আমাদের চঞ্চল মনের স্বাভাবিক গতি হতে পারে  উৎসমুখী। , সমস্ত তেজের উৎস, সমস্ত জীবনীশক্তির উৎস সেই আত্মার দিকে, তখন মন ধাবিত হয় ।  ধ্যান হচ্ছে সমস্ত কিছুর উৎসমুখ খুলে দেবার প্রক্রিয়া। 

প্রতিদিন, প্রত্যেকটি-সময় ধ্যানের  সময়।  তথাপি, আমাদের মতো সাধারনের জন্য, প্রতিক্ষণ ধ্যানের মধ্যে ডুবে থাকে সম্ভব নয়।  আর এই জন্য, দিনরাত্রির মধ্যে একবার-দুবার একটা  নির্দিষ্ট স্থানে, কিছুক্ষনের জন্য বসে থাকবার অভ্যাস করতে হয়। মন বা শরীর  যখন ক্লান্ত বোধ হবে, এমনকি শরীর -মন যখন সমস্যায় জর্জরিত হবে, তখন অবশ্যই কিছুক্ষনের জন্য, ধ্যান-জপ-প্রার্থনার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখুন। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করুন সমস্যা দূর করে দেবার জন্য। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করুন :

তেজোঽসি তেজো ময়ি ধেহি। 
বীর্যমসি বীর্যং ময়ি ধেহি। 
বলমসি  বলং ময়ি ধেহি। 
ওজোঽসি ওজো ময়ি ধেহি। 

হে ঈশ্বর তুমিই  সমস্ত তেজের উৎস। আমাদের তুমি তেজস্বী করো।  হে ঈশ্বর তুমিই  সমস্ত বীর্যের উৎস। আমাদের তুমি বীর্যবান  করো। হে ঈশ্বর তুমিই সমস্ত বলের উৎস।  আমাকে তুমি বলবান করো।  হে ঈশ্বর তুমিই  সমস্ত ওজঃশক্তির উৎস। আমাকে তুমি দীপ্তিমান করো। 

প্রার্থনায় আপনার যত মন বসবে, মন তত শান্ত হবে। শরীর ও মনের মধ্যে একটা সাম্যভাব আসতে  শুরু করবে। আর জানবেন, শরীর ও মন যখন একত্রে কোনো কাজের মধ্যে লিপ্ত হয়, তখন সেই কাজ নিপুন ভাবে সম্পন্ন হয়। মানুষের যে দক্ষতা আমরা দেখতে পাই, তা এই মন ও শরীরের সমতার জন্য হয়ে থাকে। আমাদের মনের মধ্যে যখন শান্তি  বজায় থাকে, তখন আমাদের মনের শক্তি বৃদ্ধি পায়।  আর মনের শক্তি যখন বৃদ্ধি পায়, জানবেন এই সময় প্রকৃতির সমস্ত শক্তি সেই শান্তমনের মধ্যে প্রভাব ফেলে। প্রকৃতি তখন আমাদের মানবিক দক্ষতার বৃদ্ধি ঘটিয়ে, আমাদের সমস্ত কাজ সঠিক ও উৎকৃষ্ট করে সম্পাদন করে থাকে ।  আমাদের যে দক্ষতা - তার  গূঢ়  রহস্য লুকিয়ে আছে এখানেই। 

সারাদিন যতই কাজের চাপ থাকুক, সারাদিন যতই ব্যস্ত থাকুন, দিনের শেষে, ঘুমুতে যাবার আগে, হাজার ক্লান্তি সত্ত্বেও স্বল্পক্ষন নিজেকে ঈশ্বরের চিন্তায় মগ্ন থাকতে দিন। অন্তত বার-দশেক কোনো নামের জপ করুন।  তারপর ঘুমুতে যান। আবার সকালে ঘুম থেকে উঠেই, বিছানায় বসেই, ১/২ মিনিট ঈশ্বরের চিন্তা করুন। ঈশ্বরের কাছে শক্তির জন্য প্রার্থনা করুন। আমরা আগে যে শুক্ল-যজুর্বেদের মন্ত্র শুনলাম, সেই মন্ত্রের যথাযথ অর্থ চিন্তন করতে করতে মন্ত্রটি পাঠ  করুন। দেখবেন কিছুদিনের মধ্যেই আপনার মধ্যে একটা নাটকীয় পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। যা আপনি অবশ্য়ই অনুভব করতে পারবেন। 

ধ্যান বললেই যে আমরা সবাই ধ্যান করতে পারবো, তা নয়, তবে আমরা একটা ধ্যান-ধ্যান খেলার অভ্যাস করতে পারি। একটা নির্জন জায়গা বেছে  নিতে পারি। সেখানটা পরিষ্কার-পরিছন্ন করে একটা আসন পাততে পারি। আর সেই আসনের উপরে বসে চোখ বুজে, ক্ষাণিক্ষণ সময় কাটাতে পারি। এতে করে, আমাদের স্থির হয়ে বসে থাকবার অভ্যাস তৈরী হবে।  যা ধ্যানের  জন্য ভীষণ দরকার। স্থির হয়ে শরীরকে নির্দিষ্ট আসনে বসিয়ে রাখারও একটা গুরুত্ত্ব আছে। আর মেরুদন্ড সোজা  করে রাখা, অর্থাৎ ঘাড়  মাথা সোজা করে রাখা, - এই ক্রিয়া অভ্যাসেই রপ্ত হতে পারে। তো এই অভ্যাস আমরা প্রথম দিকে শুরু করতে পারি।  
যখন আমাদের শরীর স্থির হবে, তখন দেখবেন, আমাদের মনও ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে। আসলে নীরব থাকা আর নির্জনে থাকা এক কথা নয়। নির্জনে নীরবতা বজায় থাকে ঠিকই, কিন্তু আমাদের মন যদি অশান্ত থাকে, শরীর  যদি অস্থির থাকে, রোগগ্রস্থ থাকে তবে আমরা অন্তরে শান্ত হতে পারি না। তো বাহ্যিক পরিবেশ শান্ত থাকলে   ভালো হয়, কিন্তু বাহ্যিক পরিবেশের প্রতি আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই অশান্ত বাহ্যিক পরিবেশের দোহাই দিয়ে যদি আমরা ধ্যানাদি থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখি, তবে আমাদের জীবন বাহ্যিক পরিবেশের মতোই অশান্ত থাকবে।  তাই আমাদের চেষ্টা করতে হবে, নিজের অন্তরের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে আনা।  এবং নিজের অন্তরের  মধ্যে শান্তির প্রতিষ্ঠা করা। আর এই শান্ত অন্তরে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা। 
একটা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কল্পচিত্র রচনা  করুন।  আর এই কল্প চিত্রকে নিজের হৃদয়কেন্দ্রে স্থাপন করুন। এইবার সেই কল্পিত সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সঙ্গে নিজেকে প্রতক্ষ্যভাবে যুক্ত করুন। অন্তত যুক্ত করবার চেষ্টা করুন। অবাঞ্চিত চিন্তা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে আনুন। ঈশ্বর চিন্তায় নিজেকে স্থির করুন। দেখুন বাহ্যিক চিন্তন আপনাকে বাহ্যিক জগতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করছে, আর সেটা বাহ্যিক পরিবেশ শান্ত থাকলেও হতে পারে। তাই নিজের মধ্যে নির্জনতা খুজুন, দেখবেন ভিতরের নির্জনতা  বাহ্যিক জগৎকে ভুলিয়ে দিয়েছে। জগৎ সত্য।  কিন্তু নিৰ্জনতাও সত্য। হাজার লোকের ভিড়ে আপনি একা।  এই সত্য উপলব্ধি করবার চেষ্টা করুন। এই জগৎ সত্য, কিন্তু এই জগতের মধ্যে আপনি নিতান্তই একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কিট  মাত্র। এই চিরন্তন সত্য, মনের মধ্যে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করুন। তবে দেখবেন, জগৎ আপনাকে বিড়ম্বনায় ফেলতে পারবে না। আপনি জানবেন, বিশ্বশক্তির এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শক্তি আপনি। এই বিশ্বশক্তির সঙ্গে নিজেকে একাত্মীভূত করবার চেষ্টা করুন। জানবেন, অন্তরের  নির্জনতা আপনাকে আপনার মন থেকে জগতবুদ্ধি লোপ করে দেবে, আর আপনি সেই বিশ্বশক্তির সঙ্গে লিন হতে পারবেন। 

চলবে। ........        

ধ্যানময় জীবনই শান্তির পথ, সাফল্যের পথ । (২)  

ওং দৌঃ শান্তিঃ 
ওং অন্তরীক্ষং শান্তিঃ 
ওং পৃথিবী শান্তিঃ 
ওং রোষধয়ঃ শান্তিঃ 
ওং  বনস্পতয়ঃ শান্তিঃ
ওং বিশ্বে দেবাঃ শান্তিঃ 
ওং ব্রহ্ম শান্তিঃ 
ওং সর্বং শান্তিঃ শান্তিরেব শান্তিঃ 
সা মা শান্তিরেধি।  যজুর্বেদ - ৩৬/১৭

দ্যুলোকের যে শান্তি, অন্তরীক্ষ লোকের যে শান্তি, পৃথিবী লোকের যে শান্তি, ঔষধির যে শান্তি, বনস্পতির যে শান্তি, সমস্ত দেবগনের যে শান্তি, ব্রহ্মের  যে শান্তি, সমস্ত শান্তি, এমনকি শান্তি-স্বরূপের যে শান্তি সেই  সমস্তই আমার হোক।   
 
ধ্যানময় জীবনের জন্য প্রথম কাজটি হচ্ছে, জীবনের একটা লক্ষ স্থির করা।  আর এই লক্ষ সম্পর্কে আমাদের একটা স্বচ্ছ ধারণা  রাখতে হবে। লক্ষ পূরণে মনকে দৃঢ় করতে হবে। লক্ষ পূরণের যোগ্যতা সম্পর্কে নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে।  আর এই লক্ষ পূরণের জন্য, নির্দিষ্ট কিছু কর্ম্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।  আবার এই কর্ম্মসূচি আমাদের অবশ্যই  পালন করতে হবে।
 জীবন একটা সাধনা।  আর আমরা সবাই সাধক। আর এই সাধকের প্রথম কাজ হচ্ছে, একটা নির্দিষ্ট কর্ম্মসূচি, যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মেনে চলা। আমরা অনেকে ভাবি, জীবন যদি কঠোর নিয়ম  শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়, তবে জীবন যন্ত্রবৎ হয়ে উঠবে, জীবন বিষময়  হয়ে উঠবে, জীবন যন্ত্রনাময় হয়ে উঠবে। এই ধারণা একেবারেই সত্য নয়। জীবন  তাচ্ছিল্যে কাটিয়ে  দেবার বিষয় নয়। জীবন কোনো খেলাঘর নয়, জীবন একটা শিক্ষাকেন্দ্র। এখানে আমরা লক্ষ পূরণের জন্য আসি।  এখানে আমরা  আত্ম-উপল্বদ্ধি করবার জন্য আমরা আসি।  কিন্তু আমাদের বিড়াম্বনা হচ্ছে, আমরা এখানে এসে আমাদের জীবনধারণের মূল উদ্দেশ্যকেই ভুলে যাই। আমাদের মধ্যে এমন অনেক অবাধ্য ইচ্ছে, বা অনেক অপরিণত ইচ্ছে জাগ্রত হয়, যাকে  আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।  এই অবাধ্য ইচ্ছেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনবার জন্য, জীবনে একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করতে হয়।  এটি কোনো শৃঙ্খল নয়, এটি জীবন-চৈতন্যকে জাগ্রত করবার প্রক্রিয়া মাত্র। নিজের অপরিণত বা ক্ষতিকারক ইচ্ছেগুলোকে দমিত করবার উপায় মাত্র। 
দেখুন আমার জীবন কিভাবে যাবে, এটা  আমিই ঠিক করবো।  চাকরি থাকতেই ঠিক করতে হয়, অবসরকালীন অবস্থায়, আমি কিভাবে কাটাবো। ছাত্রাবস্থাতেই ঠিক করে নিতে হয়, আমার কর্ম্মজীবন কেমন হবে। তো আপনি যখন চেতন থাকবেন, তখনই আপনি ঠিক করে নিন, আপনার ভবিষ্যৎ ভাগ্যরেখা। আপনি যখন চেতন থাকবেন, তখনই আপনি, লক্ষ স্থির করুন আর সেই লক্ষ পূরণের জন্য, নির্দিষ্ট কর্ম্ম সূচি ঠিক করে নিন । এমনকি আপনি কোন ধরনের চিন্তার জগতে বাস করতে চান, তাও আপনাকে সতর্কতার সঙ্গে ঠিক করে নিতে হবে। অর্থাৎ সতর্কতাই জীবনে সুখে শান্তিতে থাকবার উপায়।  ইচ্ছেমতো জীবন ধারনের উপায়। 

এর পরে আমাদের অভ্যাসের দিকে খেয়াল করে হবে। নিজের দিকে নজর দিলেই আপনি বুঝতে পারবেন আপনি কোন ধরনের মানুষ। আপনার কোন জিনিস, কোন কথা, কোন ভাব, ভালো লাগে। আর এই যে আপনার ভাব, এটি আপনার অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।  এই ভাব, আপনার কর্ম্মের দ্বারা আপনার কথার দ্বারা আপনার চিন্তার দ্বারা প্রকাশ পেয়ে থাকে। নিজেকে নিয়ে বসুন, নিভৃতে নির্জনে নিজের সাথে  কথা বলুন, একটু বিচার বিশ্লেষণ করুন। নিজের মধ্যে তাকান।  দেখুন, নিজের মধ্যে কোনো জঞ্জাল জমে আছে কি না  .যদি মনে করেন, আপনার মধ্যে অশুদ্ধ কিছু আছে, তবে তাকে শুদ্ধ করবার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের অধ্যাত্ম জীবন হবে সম্পূর্ণ ভাবে সচেতন ও সতর্ক।

আর একটা দিকে অবশ্য়ই আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে, সেটা হচ্ছে অবচেতন মন। চেতন মন কি চায়, তা আমরা অনায়াসে বুঝতে পারি, কিন্তু আমাদের অবচেতন মন কি চায়, তা বোঝার আগেই কার্যে পরিণত হয়ে যায়। তাই আমাদের অবচেতন মনের চিন্তা ও কাজকে প্রথমে কমিয়ে আনতে  হবে। অর্থাৎ আমি যা কিছু করবো, তা যেন আমার চেতন মনের কাজ হয়, অবচেতন মনের কাজ যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। আসলে অবচেতন মন কোনো যুক্তি-তর্কের ধার ধরে না। অবচেতন মন বিচারশীল নয়। তো অবচেতন মনের  বিচারহীন কর্ম্ম থেকে আমরা বিরত থাকবো। 

আর এর জন্য আমাদের নতুন নতুন অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সৎগ্রন্থ পাঠ, সৎসঙ্গ করা, ইত্যাদির অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আর এই অভ্যাসগুলোকে আমাদের সযত্নে রক্ষা করতে হবে। নিজেরই তৈরী  নির্দিষ্ট সময়সূচি যদি মেনে চলেন, তবে দেখবেন, অস্থির চিত্তেও আপনি ধ্যানে বসবার সময় আপনি ঠিক নির্দিষ্ট স্থানে, ধ্যানে বসে যাবেন। আপনার দৈনন্দিন কাজও সুষ্ঠূ ভাবে সময়মতো করে ফেলবেন। আমাদের আয়েসি ভাব আমাদের ত্যাগ করতে হবে। 

খাদ্য অভ্যাসের মধ্যে পরিবর্তন আনতে  হবে। সহজপাচ্য খাবার খেতে হবে। খাদ্যের পরিমানের দিকে নজর দিতে হবে। অসময়ে কোনো খাবার গ্রহণ করা চলবে না। আর এইসব করতে করতে একসময় দেখবেন, আপনার মন এই নিয়ম-মাফিক কার্যসূচিতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতে শুরু করবে।

 প্রার্থনা-ধ্যান-জপের জন্য একটা ন্যূনতম সময় নির্দিষ্ট করে নিন। এবং সেই ন্যূনতম সময়কে অবশ্য়ই গুরুত্ত্ব সহকারে বজায় রাখুন। আসলে সাধকের জীবন হওয়া উচিত, নীতির জীবন, নিয়মানুবর্তিতার জীবন। প্রকৃতিতে যেমন নিয়ম বহির্ভূত কিছু হয় না।  আপনি তেমনি জানবেন,  আমিও প্রকৃতির অংশ। আমার জীবনেও নিয়ম বহির্ভূত কিছু হতে দেবো  না। এই দৃঢ়তা আপনার মধ্যে একটা বিশেষ ব্যক্তিত্ত্ব গড়ে দেবে। এবং খেয়াল করবেন, আপনার এই বিশেষ ব্যাক্তিত্ত্বের জন্য, পরিবারের সবাই, পাশাপাশির সবাই,  আপনাকে আলাদা চোখে দেখতে শুরু করেছে। আপনিও তখন ব্যাক্তিত্ত্বকে ধরে রাখবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। এর পর সাধনার সময় ধীরে ধীরে বারবার চেষ্টা করতে হবে। 

আগেই বলেছি, আপনি আমি সবাই  এই বিশাল জগতের এক-একটি  কীটাণু কীট  মাত্র। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা জীবাণু। তো আমাদের ক্ষমতাও অতি সামান্য। নিজেকে যখন আপনি এই দীন  থেকে দীনতর ভাবতে শুরু করবেন, তখন আপনার মধ্যে একটা ভক্তির ভাব আসতে  শুরু করবে। বিশাল সমুদ্রের ঢেউ-এর সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকুন, কি বিশাল শক্তি এই সমুদ্রের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। বিশাল পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে ভাবুন, আমি কত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র।  অর্থাৎ বিশ্বশক্তির কাছে, আমরা যে অতি নগন্য, এই ভাব আপনার মধ্যে একটা ভক্তির ভাব জাগিয়ে তুলবে। এই ভাবটাকে পোষণ করবার চেষ্টা করুন।

নিজেকে অনুভূতি-প্রবন করে তুলবার  চেষ্টা করুন। প্রত্যেকের নিজস্ব জায়গায় নিজেকে রেখে তাকে বুঝবার চেষ্টা করুন। এই অবস্থায় আপনি থাকলে কি করতেন সেই কথা চিন্তা করুন। নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্যকে বুঝবার চেষ্টা করবেন না।  তার জায়গায় নিজেকে মনে মনে দাঁড় করিয়ে তাকে বিচার করবার চেষ্টা করুন। অসহায় ক্ষুধার্থ, রোগগ্রস্থ ব্যক্তি, অসহায় নিরন্ন মানুষের অবস্থা বুঝবার চেষ্টা করুন। আমাকে এক স্বামীজী বলেছিলেন, আপনি যদি রমতা  সাধু হতে চান, তবে বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বেরিয়ে, দুই একদিন বাইরে থাকবার চেষ্টা করে দেখুন, জ্বালাটা কোথায় ? আপনি রাস্তার পাশে গাছের তলায় রাত  কাটাতে পারেন কিনা, সেটা হাতে কলমে করে দেখুন।  আপনি কারুর কাছ থেকে চেয়ে খেতে পারেন কি না চেষ্টা করে দেখুন। আপনি ক্ষিদে সহ্য করতে পারেন কি না, সেটা পরীক্ষা করে দেখুন। গৃহস্থের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করা, যতটা সহজ মনে হয়, ব্যাপারটা কিন্তু অত  সহজ নয়।  আর এই পরীক্ষা করতে হবে, নিরালম্ব হয়ে। অর্থাৎ সত্যি সত্যি এই অবস্থায় পড়লে, আপনার মধ্যে কি হয়, পরীক্ষা করে দেখতে চেষ্টা করুন। ভুলে যান, আপনার একটা বাড়ি আছে, ভুলে যান আপনার বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন আছে।  ভুলে যান আপনি একজন শিক্ষিত ব্যক্তি। আপনার সম্পর্কগুলোকে যদি সত্যিই ভুলে যেতে পারেন, তখন দেখবেন আপনার মধ্যে ঈশ্বর নির্ভরতা উঠে আসবে। বাহ্যিক সম্পর্ক ভুলে যাওয়া, বাহ্যিক বিষয়-সম্পর্ক ভুলে যাওয়া যে কতো কঠিন, সেটা সেই অবস্থায় না পড়লে অনুভব করা যায় না। তাই  অধ্যাত্ম জীবনে এই অনুভূতি নামক অস্ত্রকে শান দিতে হবে।  অনুভূতিকে তীক্ষ্ণ করতে হবে। 
ঈশ্বরের কাছে নালিশ নয়, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা। ঈশ্বরের কাছে কষ্টের কথা নয়, ঈশ্বরের কাছে শক্তির প্রার্থনা। এইভাবে যদি মনকে তৈরী করা যায়, তখন আমাদের কাছে মৃত্যুভয়ও  বিচলিত করতে পারে না। 
সাধন জীবনে প্রবেশের প্রথম দিকে মন বিচলিত হবে, বার বার বিদ্রোহ করবে, বারবার নালিশ জানাতে থাকবে।  কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমি একটা উচ্চতম আদর্শের জন্য জন্ম গ্রহণ করেছি।  আমি আর পাঁচজন মানুষের মতো সাধারণ মানুষ নোই।  আমাকে আর পাঁচজনের মতো শারীরিক, মানসিক দুঃখ যন্ত্রনা  বিব্রত  করতে পারবে না। আমি ঈশ্বরের সবচেয়ে কাছের মানুষ।  ঈশ্বর সবসময় আমার সঙ্গে আছেন।  আমি ঈশ্বরের কোলে শান্তিতে আছি। এই অনুভূতি আমাদের মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে। তবেই জানবেন, আপনি সাধন জগতের প্রথম ধাপে প্রবেশ করেছেন। 

চলবে। ........... 

 ধ্যানময় জীবনই শান্তির পথ, সাফল্যের পথ । (৩)
ধ্যানের কথা বলা সহজ। কিন্তু ধ্যান করা সহজ  নয়। আসলে ধ্যান তো করা যায় না, ধ্যান হয়। তো প্রথমেই আমরা শুনেছি, ধ্যান না হোক ধ্যান- ধ্যান খেলা করতে শুরু করুন। ধ্যানে  ইন্দ্রিয়শক্তিকে মনের মধ্যে লয়  করতে হবে। কিন্তু ব্যাপারটা বলা যত  সহজ কাজটা তত সহজ মোটেই নয়।  ইন্দ্রিয় তার নিজের কাজ  করবেই। কান শব্দ  শুনবে না, তা হতে পারে না।  চোখ দেখবে না তা হতে পারে না। ত্বকের উপরে মশায় কামড়ালে, ত্বক তা টের পাবে না।  এটা হতে পারে না। তাই বলছি, ইন্দ্রিয়শক্তিকে মনের মধ্যে লয় করা, বলা যত  সহজ তা করে দেখানো সহজ নয়। আর এই কারণেই, আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে একাগ্রতা বাড়ানো। অর্থাৎ একের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আর আপনি যখন একের দিকে মনোযোগ বাড়াবেন, তখন দেখবেন মন ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে। একের দিকে মনোযোগ দিলে, সে আর অন্যের দিকে তাকাবে না।  ধ্যানে আমরা চোখ বন্ধ রাখতে পারি। এমনকি কান, মুখও কৃত্তিম ভাবে বন্ধ রাখতে পারি। কিন্তু প্রথমদিকে এতে কিছুটা কাজ হলেও, এর কোনো দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকে না। আর  আমরা জানি ইন্দ্রিয়গুলো আসলে মনের নির্দেশে চলে।  মন যদি আগ্রহ না দেখায়, তবে, ইন্দ্রিয়শক্তি কোনো কাজ করতে পারে না। তাই   প্রথম দিকে ইষ্টের দিকে গভীর একাগ্রতা আনবার চেষ্টা করুন। কতক্ষন ধ্যানের আসনে  বসে আছেন, সেটা বড়ো  কথা  নয়। ধ্যানের গভীরতা কতটা হচ্ছে সেটাই বড়ো  কথা। ধ্যানের উৎকর্ষতার দিকে আমাদের বেশি নজর দিতে হবে, সময়ের দিকে নয়। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা অভ্যাসের মাধ্যমে রপ্ত করা যেতে পারে, কিন্তু যার একাগ্রতা আসেনি, সে কখনো ধ্যানের  মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না।  তাই আমাদের উচিত প্রথমে একের দিকে আগ্রহ বাড়ানো।  অর্থাৎ একাগ্রতা বাড়ানো। আপনি যদি প্রথম দিকে মাত্র  কয়েক সেকেন্ড,, বেশি হলে এক মিনিট সত্যিকারের ধ্যানে বসে পারেন, তবে জানবেন আপনার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।  আপনি একদিন অবশ্য়ই ধ্যানী পুরুষ যোগী পুরুষ হতে পারবেন। 

ধরুন আপনি কোনো বই পড়ছেন, বা আপনি কারুর কথা শুনছেন, নিদেনপক্ষে আপনি হয়তো একটা সিনেমা দেখছেন। এমনকি আপনি সিগারেট খাচ্ছেন,  এই কাজটি আপনি গভীর একাগ্রতার সঙ্গে করুন। মনোযোগ দিয়ে করুন। এই একাগ্রতা বাড়াবার একটা উপায় হচ্ছে, নিজের মধ্যে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলা । ধরুন সিনেমা দেখছে, মনে মনে প্রশ্ন করুন, এর পরে কি হতে পারে ? মা কি তার হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে খুঁজে পাবে ?  আপনি যখন কারুর কথা শুনছেন, তখন মনোযোগ দিয়ে শুনুন। প্রয়োজনে নিজের কিছু প্রশ্ন তার কাছে আগে থেকে রাখুন। তবে দেখবেন, আপনার মধ্যে উত্তর শুনবার জন্য আগ্রহ থাকবে, আর আপনার কান সজাগ থাকবে।  আপনি বই হাতে নেবার আগে, ভাবুন, আপনি বই থেকে কি জানতে চান ? আর আপনার প্রশ্ন অনুযায়ী বই নির্বাচন করুন। আপনার প্রশ্ন অনুযায়ী বক্তা নির্বাচন করুন।  অর্থাৎ যার-তার কথা শুনতে যাবেন না, যেকোনো বই পড়তে যাবেন না। নিজের যে বিষয়ের উপরে আগ্রহ আছে, সেই বিষয় অনুযায়ী বই বা বক্তা নির্বাচন করুন। 

আপনি ধ্যানে বসছেন, আর ধ্যানের  নাম করে বসে বসে আপনি নানান রকম চিন্তা করছেন, এসব করা মানে সময়ের অপব্যবহার।  আর এর থেকে বোঝা যায়, আপনার মধ্যে ধ্যানের জন্য কতোটা আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। তার মানে আপনি লক্ষে স্থির নয়। ধ্যানে বসে জাগতিক বিষয়ের চিন্তা মানে আপনার মধ্যে জড়বুদ্ধি জাগ্রত হয়ে রয়েছে। অর্থাৎ আপনার মধ্যে রাজসিক বৃত্তি প্রবল। অথবা ধরুন আপনি ধ্যানের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছেন, অর্থাৎ আপনার মধ্যে  তামসিক বৃত্তি প্রবল হয়ে রয়েছে। এগুলো কোনো অন্যায় নয়।  কিন্তু এরকমটি যদি হয়, তবে আপনি ধ্যান থেকে উঠে বসে, কোনো ধর্ম্মগ্রন্থ, বা মহাপুরুষদের জীবনী গ্রন্থ পাঠ করতে শুরু করুন।  শরীর ক্লান্ত মনে হলে কিছুক্ষন ঘুমিয়ে নিন।  কিন্তু ধ্যানে বসে ঘুমুবেন না, বা বিষয়চিন্তা করবেন না। এই বিষয়ে নিজের মধ্যে একটা সংকল্পের বাতাবরণ আগে থেকে সৃষ্টি করে রাখুন। অর্থাৎ মনে মনে বলুন, আমি যখন ধ্যান করবো, তখন ধ্যানের বিষয় ভিন্ন অন্য কোনো চিন্তা মাথায় আসতে  দেব না। তো কখনো নিজের সঙ্গে প্রতারণা করবেন না। যা করবেন, তা নিজের ক্ষমতা ও বিশ্বাস অনুযায়ী করুন। আত্মপ্রবঞ্চনার মতো আত্মঘাতী কাজ আর কিছু নেই। আপনার মধ্যে যখন আধ্যাত্মিক ভাব আসবে, তখন আবার আসনে বসুন ধ্যান করবার জন্য। এর থেকে বেরুবার আরো একটা উপায় আছে, প্রথমদিকে কিছুক্ষন মন্ত্র পাঠ, বা কিছুক্ষন প্রাণায়ামের অভ্যাস অর্থাৎ রেচক-পূরক ও কুম্ভকের অভ্যাস করে নেওয়া। প্রাণায়াম,  প্রণব ও মন্ত্রপাঠ  এই অধ্যাত্ম-অসুখে খুব ভালো কাজ করতে পারে।

ধ্যানে বসে নিজের মনকে নির্লিপ্ত রাখবার চেষ্টা করুন। আপনি ধ্যানে বসেছেন, আপনার টেলিফোনটা বেজে উঠলো, একটা বিড়াল ডেকে উঠলো, কিম্বা  কেউ আপনাকে ডাকছে, বা  আপনাকে পিঁপড়ে বা মশা  কামড়াচ্ছে। এই অবস্থায়, প্রথমদিকে আপনি যেটা করতে পারেন, সেটা হচ্ছে শারীরিক প্রতিক্রিয়া না দেখানো।  অর্থাৎ বিড়াল ডাকছে, আপনি ধ্যান থেকে উঠে বিড়াল তাড়াতে গেলেন, টেলি ফোন বাজলে, টেলিফোনটা ধরতে গেলেন, মশায় কামড়াচ্ছে, হাত দিয়ে মশাকে মারতে গেলেন।  যেগুলো সাধারণত আমরা করে থাকি ।  ধ্যানের  সময় এইসব কাজ থেকে নিজে বিরত রাখুন। অর্থাৎ আপনি কোনো ধরনের শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। শরীর থাকবে আপনার স্থির। এখন কথা হচ্ছে, শরীরকে না হয়, জোর  করে স্থির করা গেলো, মশার কামড় না হয় সহ্য করা গেলো।  কিন্তু মনের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া তা-তো হয়েই চলেছে। এমনকি কিছুক্ষন পরে জানতে ইচ্ছে করে, ধ্যান আমার কতক্ষন হলো ? তো চোখ খুলে ঘড়ির দিকে তাকালেন।  এটাও আপনার শারীরিক প্রতিক্রিয়া, তো এই প্রতিক্রিয়া আপনার বাইরের বিষয় থেকে আসেনি। এসেছে আপনার মানসিক অস্থিরতা থেকে। মানসিক বৃত্তি থেকে। 

আসলে আপনার যে শারীরিক প্রতিক্রিয়া তার নির্দেশক হচ্ছে আপনার মন। আমাদের শরীরের সমস্ত প্রতিক্রিয়া এই মনের নির্দেশেই সংগঠিত হয়ে থাকে। এই মনের গতিক্রিয়া বা স্বাভাবিক ক্রিয়া   কখনো বাইরের বিষয়ের সংস্পর্শে এসে ঘটতে পারে, আবার আপনার ভিতরে যে সংস্কার আছে, তার থেকেও হতে পারে।  তো এই মনকে যখন আপনি বিষয়  থেকে নির্লিপ্ত রাখতে পারবেন, এবং ভিতরের সংস্কার থেকে অসম্পৃক্ত করতে পারবেন, তখন মন স্থির হবে। আর মন যখন স্থির হবে, তখন মনের দাদাগিরি বন্ধ হয়ে যাবে। মন শান্ত না হলে ধ্যানের গভীরে প্রবেশ করা যাবে না।  

চলবে। ......   

ধ্যানময় জীবনই শান্তির পথ, সাফল্যের পথ । (৪) 

ॐ भुर्भुब: स्वः। ॐ  ततसबिटुर बरेण्यं ।
भर्गो देबष्य धीमहि। धियो यो नः प्रोचोदयात ॐ ।। 

ওঁং ভূর্ভুবঃ স্বঃ।   তৎসবিতুর্বরেন্যং। 
ভর্গো দেবস্য ধীমহি। 
ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ।
 হে (ভূঃ-ভূবঃ-স্বঃ) ত্রিলোকেশ্বর ! সবিতাদেবের পরব্রহ্মাত্মক সেই বরণীয় তেজকে আমরা ধ্যান করি। সেই সবিতা আমাদের বুদ্ধি-বৃত্তিকে প্রেরিত করুন।

ধ্যানের উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যকে ধরা। সত্য যা অপরিবর্তনীয়। যা চিরকালের জন্য একই রকম থাকে। যা জানলে আর কিছু জানবার প্রয়োজন হয় না। যা পেলে আর কিছু পাবার প্রয়োজন হয় না। এখন কথা হচ্ছে সত্যকে ধরলে আমাদের  কি হবে ? আমাদের  উদ্দেশ্য হচ্ছে আনন্দকে লাভ করা। আমাদের উদ্দেশ্য জীবনে সাফল্য লাভ করা। তো ধ্যানের  মাধ্যমে সেটা কিভাবে সম্ভব ? আসলে সত্যকে ধরলেই যে আনন্দকে লাভ করা যায়, সফলতা অর্জন করা যায়, আমরা সেই কথায় আসবো।
 
তার আগে আমরা শুনে নেই,  ধ্যানে মনকে শান্ত কিভাবে করবো ? মন বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ঘুরে বেড়াতে চায়। এমনকি মন আমাদের সংস্কারের দ্বারা প্রভাবিত হয়। সেই অনুযায়ী আমাদের মনের মধ্যে চিন্তার উদয় হয়, এবং সবশেষে আমরা চিন্তা অনুযায়ী কার্যে লিপ্ত হই। মন শান্ত হলে ধ্যান হবে। তো 
মনকে শান্ত করতে গেলে, প্রথম কাজ হচ্ছে মনকে শুদ্ধ করা। মন অশুদ্ধ হলো কি করে ? মন অশুদ্ধ  হয়েছে, অজ্ঞানরূপ মলিনতার দ্বারা।  তো মনকে শুদ্ধ করতে গেলে, প্রথমে আমাদের মনকে অন্তরের-দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হবে, বুঝতে হবে। মনকে ঢেউ-শুন্য করতে হবে। আর এর জন্য, উত্তাল মন-নদীর পাড়ে আপনাকে দাঁড়াতে হবে। প্রথমে নিজেকে মনের দ্রষ্টা রূপে স্থাপন করুন।  তবেই আপনি মনকে দেখতে পারবেন, জানতে পারবেন। শরীর ও মন আলাদা, আবার মন ও আপনি আলাদা এই ভেদ বুদ্ধি আনতে  চেষ্টা করুন। অর্থাৎ নিজেকে শরীর ও মন থেকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করুন। শরীরের ক্ষুধা-তৃষ্ণা, বৃদ্ধি ক্ষয় আছে।  আবার মনের মধ্যে আছে সুখ-দুঃখ আশা নৈরাশ্য। আপনি নিজের এই শরীর ও মন থেকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করতে পারলে এইসব সুখ-দুঃখ, আশা-নৈরাশ্য, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, রোগশোক থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারবেন। তখন শরীর বা মন আপনাকে আর সীমাবদ্ধ করতে পারবে না। এই দুইয়ের অতীত আপনি তখন সীমাহীন, পরিবর্তনহীন, সদামুক্ত সদাশান্ত এক দিব্য  সত্ত্বায় প্রতিষ্ঠিত হবেন। এবার আপনি চির শান্তির অধিকারী হবেন।

ধ্যানে রপ্ত হতে গেলে, আগে আমাদের ধারণা  করতে হবে। ধারণা অর্থাৎ সত্য সম্পর্কে একটা প্রাথমিক জ্ঞান। প্রাথমিক জ্ঞান অর্থাৎ যে জ্ঞান আপনি প্রতক্ষ্য করেননি।  অর্থাৎ অপ্রতক্ষ্য জ্ঞান। আর এই জ্ঞান আহরণ করতে হলে  বিশেষ কিছু বোধবুদ্ধির জাগরণ ঘটাতে হয়। আর এই বোধ-বুদ্ধির সাহায্যে সত্য সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা করে নিয়ে হয়।   

উপনিষদ বলছেন, আনন্দ থেকেই সমস্ত ভূতবর্গ জাত  হয়। আবার এই আনন্দের দ্বারাই বর্ধিত হয়, রক্ষিত হয়, আবার শেষে আনন্দের অভিমুখে গমন করে থাকে। আর ইনি রয়েছেন, আমাদের হৃদয় আকাশে। 
......"আনন্দ উদ্ভব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে।  আনন্দেন জাতানি জীবন্তি। আনন্দং  প্রয়ন্তি অভিসংবিশন্তি ইতি। .......পরমে ব্যোমন্ প্রতিষ্ঠিতা। ........ 

বিষয়কে ভালো ভাবে বুঝতে গেলে, যেমন  বিষয়কে খন্ড খন্ড করতে হয়। তো আমরা আনন্দময় সত্ত্বা,  এই সত্যে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে, এটা বুঝতে গেলে, আমাদের বোধের মধ্যে যে আমি সত্ত্বা আছে, তাকে খণ্ডিত করতে হবে। 
প্রথমে দেহ, - আমাদের দেহের নিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে, আমার একটা হাত কেটে গেলে, আমার একটা পা কেটে গেলে, আমার চোখ, দাঁত , চুল পড়ে গেলেও আমি থাকি। তো দেহের পরিবর্তন হলেও, আমি অপরিবর্তিত থাকি।  তারপরে মন, মনেরও পরিবর্তন হচ্ছে। ছোটবেলায়, আমি যে মনের মানুষ ছিলাম, এখন আমি আর সেই আমি নেই। মনের মধ্যে নিয়ত উথালপাতাল হচ্ছে, যেমন হচ্ছে শরীরের মধ্যে হয়ে থাকে । তো শরীর ও মনের উর্দ্ধে আরো একটা সত্ত্বা আছে, যা বিনাশশীল নয়, যা অবিনাশী । আর সেই সত্ত্বা যখন শরীর ও মন  থেকে বেরিয়ে যান, বা এই শরীর-মন যখন সেই সত্ত্বা থেকে পৃথক হয়ে যায়, তখন আমাদের আদরের শরীর পচনশীল বস্তুতে পরিণত হয়। আর মনেরও বিলোপ ঘটে। শরীরের যেমন রোগ-ভোগ আছে, তেমনি মনের আছে সুখী-দুঃখী ভাব। শরীর থেকে মন শক্তিশালী বটে কিন্তু মনের মধ্যে আছে সংকল্প বিকল্প। 
তো এই মনের উর্দ্ধে আছে, আমাদের বুদ্ধি বা বিচার শক্তি। মন যেমন ইন্দ্রিয়গুলোকে পরিচালনা করে, তেমনি মনকে পরিচালনা করে থাকে এই বিচারবুদ্ধি নামক শক্তি। এইজন্য গায়েত্রী মন্ত্রে আমরা পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি, ধীশক্তি প্রেরণের জন্য। অজ্ঞান হচ্ছে আমাদের মলিনতা।  আর এই মলিনতাকে পরিষ্কার করবার জন্য দরকার আমাদের ধীশক্তি অর্থাৎ বুদ্ধি-বিচার। 

উপনিষদ বলছেন, এই আনন্দ সত্ত্বা আছে আমাদের হৃদয়কেন্দ্রে। সবার হৃদয়ে আছে এই আনন্দ। বিশ্বের সার বস্তুই আনন্দ। এই আনন্দের কাছে কোনো দুঃখ-যন্ত্রনা, ভয়, আতঙ্ক পৌঁছতে পারে না। আমাদের মনের মলিনতার জন্য, নির্মল এই আনন্দ আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। আমাদের মন যখন শান্ত থাকে তখন এই আনন্দের ক্ষীণতম অনুভূতি আমাদের অন্তর শান্তি ও খুশিতে ভরে  দেয় । সূর্য যেমন স্বাভাবিক উজ্বলতা কখনোই হারায় না, তা সে মেঘ বৃষ্টি যাই হোক না কেন।  মেঘ-বৃষ্টি কেবল আমাদের চোখের  সূর্যকে হারায়।  সূর্য কখনো হারায় না। তেমনি পরম আনন্দ আমাদের সবার অন্তরে এমনকি সমস্ত বস্তুতে মিশে থাকলেও, সর্বত্রগামী হলেও তার অন্তরতম নির্মলভাবটি সব সময় বজায় থাকে। এই আনন্দের অংশমাত্র অবলম্বনে জীব জীবন-ধারণ করে থাকে। আমাদের হৃদয়গুহাতে অবস্থিত এই অপরোক্ষ আনন্দই শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। 

কল্পনা করুন, আমাদের চারিপাশের পরিবেশে এই আনন্দ ছড়িয়ে আছে। নির্মল মধুর স্নিগ্দ্ধ বায়ু আমাদের প্রতিনিয়ত বলবান করছে।  আপনার দেহ যখন স্থির হবে, আপনার মন যখন শান্ত হবে তখন এই আনন্দ অনুভবে আসবে। এই আনন্দ-এর আরেক নাম আত্মা। আর এই আত্মার  প্রতিফলনেই শরীর আমাদের কাছে প্রিয়তম। সত্যকথা বলতে কি, আমরা আসলে কেউ শরীরকে অর্থাৎ এই হাড়-মাস-রক্তের শরীরকে ভালোবাসি না। আমরা ভালোবাসি সেই আত্মাকে যার প্রতিফলনে এই শরীর ক্রিয়াশীল বা জীবন্ত থাকে। শরীর যখন আত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন তাকে আমরা মৃত বলি। মৃৎ কথাটার অর্থ হচ্ছে মাটি। অর্থাৎ প্রাণহীন। আসলে আত্মার  প্রতিফলনে সমস্ত বস্তু প্রিয় হয়। অর্থাৎ সমস্ত আনন্দের উৎস হচ্ছে আত্মা। 

আমরা মনে করি, , বস্তুর সঙ্গে  ইন্দ্রিয়ের সংস্পর্শে আমাদের সুখ উদ্ভূত হয়। কিন্তু সত্য সেকথা বলে না। ইন্দ্রিয়গোচর যে অভিজ্ঞতা, যে চিন্তা, যে অনুভূতি, যে স্মৃতি অর্থাৎ যা থেকে আমরা সুখ পাই বলে মনে করি, সবই আত্মা থেকে আসছে।  সমস্ত আনন্দের উৎসই হচ্ছে আত্মা। আমাদের সবার মধ্যে এই আত্মা বিরাজ  করা সত্ত্বেও আমরা আমাদের সহজাত পবিত্র  আনন্দ অনুভব করতে পারি না, কারন এই আনন্দ নানাভাবে রঞ্জিত হয়ে যায়। সমস্ত সুখের উৎসই হচ্ছে আত্মা যা আপনার নিজের হৃদয়ের মধ্যেই বিরাজ করছে।  আনন্দের সাগর আপনার মধ্যেই বিরাজ করছে।  আপনি নিজেকে যত  অন্তরের  অন্তঃস্থলে নিয়ে যাবেন, তত আপনার মধ্যে জ্ঞান-ভক্তি-পবিত্রতা-প্রেম-শান্তি ইত্যাদি আপনার মধ্যে স্ফূরিত হতে থাকবে। সমুদ্রের মাছের কখনো তৃষ্ণার্ত হবার কথা নয়। তবু আমরা তৃষ্ণার্ত হই, কারন তৃষ্ণা নিবারনের জন্য যে জল দরকার সেই অমোঘ সত্য আমরা ভুলে গেছি। ধ্যান এই জ্ঞান এনে দেয়।  

চলবে।....... 

ধ্যানময় জীবনই শান্তির পথ, সাফল্যের পথ । (৫)

যো দেবানাং প্রভব উদ্ভব চ - যিনি দেবতাদের উদ্ভব ও প্রভাবের কারন 
বিশ্বাধিপ রুদ্রোঃ মহর্ষিঃ -  যিনি বিশ্বের অধিপতি রুদ্র-মহর্ষি 
হিরণ্যগর্ভং জনয়ামাস পূর্বং - যিনি পূর্বে  হিরণ্যগর্ভকে জনমানসে এনেছেন 
স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনক্তূ। - তিনি যেন আমাদের শুভবুদ্ধির সঙ্গে সংযুক্ত করেন।  - (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ - ৩/৪)

আমরা শুনছিলাম ধারণার কথা। ধ্যানের  আগে ধারণা  করে নিতে হয়। এই ধারণা আর কিছুই নয়,  সাধারণ জ্ঞান মাত্র। গভীর জ্ঞান বা নিজস্ব উপল্বদ্ধির জন্য আত্মজ্ঞ পুরুষের জ্ঞানকে পাথেয় করে ধ্যানের  পথে অগ্রসর হতে হয়। চারিদিকে মায়ার জাল বেছানো। আপনি আমি সবাই সম্মোহিতের ন্যায় চলাফেরা করি। একজন অদৃশ্য ম্যাজিশিয়ান আমাদেরকে সন্মোহিত করে রেখেছেন । আমরা যেন তাঁর  হাতের পুতুল। আর হাত পা মাথা সবকিছু সুতোয় বেঁধে তিনি আমাদের নাচাচ্ছেন।  আমরা নাচছি। তিনি যেমন চালাচ্ছেন, আমরা তেমনটি হাতপা নাড়ছি। কেউ হয়তো প্রশ্ন করবেন, কেন আমাদের তো স্বাধীন ইচ্ছে আছে। আমরা আমাদের কর্ম্মের দ্বারা নিজেকে ইচ্ছেমতো গড়ে তুলতে পারি। হ্যাঁ পারেন।  কিন্তু ততটুকুই পারেন, যতটুকু তিনি চাইবেন। আমরা যেন একটা  চিড়িয়াখানার পাখি। খাঁচার পাখির মতো সীমাবদ্ধ হয়তো আমরা নোই, কিন্তু সীমাবদ্ধ বটেই । আমাদের সবার একটা গন্ডি আছে।  তার বাইরে আমরা যেতে পারি না। 
আমরা যখন সৃষ্টির কথা বলি, তখন মনে হয়, নতুন কিছু করা গেলো। কিন্তু সত্য হচ্ছে, যা আগে ছিল না, তা ভবিষ্যতেও থাকবে না, এখনো নেই। সবই রূপান্তরিত হয়ে চলেছে মাত্র। ঠিক তেমনি আমি আগে ছিলাম না, তা নয়, আমি ভবিষ্যতে থাকবো না তাও নয়। আমি আছি-ছিলাম-থাকবো। এই চিরসত্য আমাদেরকে  বুঝতে হবে। এই সত্য সম্পর্কে আপনার মধ্যে একটা ধারণা করে নিতে হবে। যা কিছু দেখছেন, সবই আমার। আমি নয়। আমার হাত, আমার পা, আমার হৃদয়, আমার মন, আমার আত্মা, আমার ছেলে, আমার মেয়ে, আমার পরিবার, আমার প্রতিবেশী।  এগুলো কোনটা আমি নয়, সবই আমার।
 সেকি আমি আত্মা নোই ? তবে যে সবাই বলে, আমি শরীর  নোই, মন নোই, আমি আত্মা। দেখুন, আমি একবচন।  আমি বলতে এক ও অনন্য বোঝায়। আপনি যাকে আমি বা  আত্মা বলছেন, তা বহুবচন । অর্থাৎ একাধিক। আমি যদি আত্মা হই , তবে আপনিও অন্য একটি আত্মা। গরু, ছাগল, বাঘ, সিংহ, বাঁদর,  সবাই এক একটি জাতি। মনুষ্যও একটা জাতি মাত্র। আমরা সবাই এক কলসিভর্তি জলসম  সমুদ্রে অবস্থান করছি। আমার ভিতরেও জল, আবার বাইরেও জল।  আর কলসটি হচ্ছে ভূত। যা জলের মধ্যে সাময়িক একটা ভেদ রেখা টেনেছে মাত্র । আত্মা হচ্ছে আদি-বীজ। এই বীজ কোথেকে এলো ? গাছ থেকে।  তো গাছ থেকেই বীজ, আবার বীজ থেকেই গাছ। কখনো সূক্ষ্ম কখনো স্থুল। তো গাছটা বীজের মধ্যে লুকোনো ছিলো, আবার গাছের মধ্যেই বীজের জন্ম হয়েছে। ঠিক তেমনি আত্মা থেকে আত্মার জন্ম হতে পারে। কিন্তু আত্মা যখন সূক্ষ্ম থাকে তখন তা সমস্ত কিছুর কারনরূপে অবস্থান করে, আবার আত্মা যখন স্থুলরূপ নেয়, তখন তার একটা আলাদা নামকরণ হয়। তো সব কিছু আত্মা থেকে আসে, আত্মাতেই স্থিত হয়, আবার আত্মাতেই ফিরে যায়। তো "আমি" আত্মা তা নয়, "আমরা" আত্মা। বস্তুত সমস্ত বস্তুই আত্মা। জগৎ ব্রহ্মাণ্ডে আত্মা বই কিছু নেই। উপনিষদ আত্মাকে বলছেন ব্রহ্ম।  হ্যাঁ প্রতিফলনের মাত্রার ফারাক আছে। কোনো বস্তু সূর্য্যের আলোকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এমনকি সে ওই সূর্য্যের তেজকে বিচ্ছুরিত করতে পারে।  তখন তাকে জ্যোতিস্মান মনে হয়। কিন্তু ওই জ্যোতি সূর্য্যের তেজ বই কিছু নয়। সূর্য্যের আড়ালে একই বস্তু অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। লক্ষ কোটি আয়নায়, এই আত্মার জ্যোতি প্রতিফলিত হচ্ছে, তাই আমাদের কাছে, অসংখ্য আত্মা দৃশ্যমান হচ্ছে। কিন্তু মূলত আত্মা এক। আর এই এক আত্মাই আমি, আপনি, সবাই।    

এতো কথা বলবার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ধ্যানের আগে, সত্য সম্পর্কে একটা ধারণা করে নেওয়া। হয়তো এই সত্য আমাদের বোধে আসে না। কিন্তু আমরা জানিনা বলে, সত্য কখনো অসত্যে পরিণত হয়ে যায় না। বস্তুত, উপনিষদের বাক্য অনুযায়ী আমরা সবাই ব্রহ্ম। আমরাই ব্রহ্ম। আমরা সবাই দেবস্বভাব সম্পন্ন। শুধু এই কথাটা আমরা বিস্মৃত হয়েছি। কিন্তু একটু চেষ্টা করলেই, ধ্যানের গভীরে আমরা যখন প্রবেশ করবো, তখন আমাদের এই স্মৃতি জেগে উঠবে। তাই বলা হয়ে থাকে আমাদের মধ্যে যে সব ভুল ধারণা  আছে, তাকে দূর করবার জন্য আমাদের সবার ধ্যানের মধ্যে প্রবেশ করা উচিত। আমাদের মধ্যে অসীম শক্তি।  এই সত্যকে উপলব্ধি করবার জন্য, আমাদের ধ্যানের প্রয়োজন। কিন্তু তার আগে যেটা দরকার এটা হচ্ছে বোধ বুদ্ধিকে জাগ্রত করা। যথার্থ বোধকে উদ্দীপ্ত করা। ভাবাবেগকে পরিত্যাগ  করা।  

প্রত্যেকের জীবনে অপরিহার্য বস্তু হচ্ছে আমাদের যথার্থ বোধ। দ্বিধায় ভরা  আমাদের মন।  দ্বন্দে ভরা এই জগৎ। এখানে ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, নিত্য-অনিত্য ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এইজন্য জগৎ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা আমাদের অবশ্য প্রয়োজনীয়। আমাদের বোধ-বুদ্ধি অর্থাৎ স্বচ্ছ ধারণাশক্তি অতি আবশ্যক। অর্থাৎ যেকোনো বস্তু বা বিষয়কে যথার্থ   ভাবে বিশ্লেষণ ও তার যথার্থ মূল্য নির্ধারণ জীবনকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারে। কঠোপনিষদ বলছেন, শ্রেয় ও প্রেয়-কে আলাদা করতে শিখতে হবে। সার ও অসারের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। উত্তম ও মনোরমের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করতে হবে। কোনটা মুখ্য আর কোনটা গৌণ তা বুঝতে হবে। আর এই বিশ্লেষণ কাজে, বা নির্নয় ক্ষমতা আনতে  পারে আমাদের বোধবুদ্ধি বা বোধশক্তি। এই বোধশক্তি আমাদের বিভ্রান্তির অবসান ঘটিয়ে প্রত্যয়ের সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারে।  আমাদের অন্তর্চক্ষু খুলে দিতে পারে।  আমাদের আলোর দিশা দেখাতে পারে। আর এই বোধশক্তি জাগ্রত করবার জন্য দরকার আমাদের শান্ত মন। অশান্ত মন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আমাদের ভিতরে যে অসীম ক্ষমতা আছে, সেটা বুঝতে গেলেও আমাদের বোধশক্তির প্রয়োজন। আমাদের বোধের অভাবে, আমরা ক্ষমতাহীন মনে করি নিজেকে। এই বোধই আমাদের জাগতিক ধন-ঐশর্য্য এনে দিতে পারে। আবার এই বোধই আমাদের আধ্যাত্মিক জগতের শীর্ষে  পৌঁছে দিতে পারে। আসলে প্রত্যেকটি অবস্থায় ভালো থাকবার কৌশল আয়ত্ত্ব করবার কলা শিখিয়ে দিতে পারে এই বোধ শক্তি। এই বোধশক্তি আমাদের আমাদের সমস্ত বিপদ থেকে উদ্ধ্বার করতে পারে। সমস্ত প্রতিকূল অবস্থায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবার শিক্ষা দিতে পারে এই বোধ শক্তি। জানবেন, জীবনে এমন কোনো সমস্যা নেই যার সমাধান করা সম্ভব নয়। জীবনে এমন কোনো দুঃখ নেই যার থেকে আমরা পরিত্রান পেতে পারি না । সমস্ত দুঃখ, সমস্ত সমস্য থেকে মুক্তির রাস্তা দেখতে পারে এই বোধ শক্তি। কিন্তু কথা হচ্ছে এই বোধ শক্তি আমাদের কিভাবে জাগ্রত হবে ? 

দেখুন, শুদ্ধ মন হচ্ছে বোধশক্তির উদয় স্থল। শুদ্ধ মন কাকে বলে ? যে মন ব্রহ্মের অনুসন্ধানের প্রত্যাশী, যে মন পরম-পুরুষকে অনুভব করবার জন্য ব্যাকুল, সেই মনই শুদ্ধমন।  আসলে শান্ত মন আর বোধ শক্তি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তাই মন যতক্ষন শান্ত না হয়, ততক্ষন আমাদের বোধশক্তি কাজ করতে পারে না। আবার মনের পবিত্রতা এবং মনের শান্ত অবস্থা একই সঙ্গে বিরাজ করে। আমাদের ধ্যানে লিপ্ত হবার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মনকে শান্ত করা। 

চলবে। ....... 

ধ্যানময় জীবনই শান্তির পথ, সাফল্যের পথ । (৬) DHYAN, PEACE & SUCCESS IN LIFE 

শ্রীমৎ ভগবৎ গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, 

মচ্চিত্তা মদ্গতপ্রাণা, বোধয়ন্তঃ পরস্পরম,
কথয়ন্তশ্চ মাং নিত্যং তুষ্যন্তি চ রমন্তি চ। 
তেষাং সতত যুক্তানাং ভজতাং প্রীতিপূর্বকম 
দদামি বুদ্ধিযোগং তং যেন মাম উপযান্তি তে। - শ্রীমৎ ভগবৎ গীতা - ১০/৯-১০ 

যার চিত্ত আমাতে অর্পিত, যিনি আমাগত প্রাণ, সেই ভক্ত পরস্পরের সঙ্গে আমার সম্পর্কেই আলোচনা করে, আমারই গুনকীর্তন করে, সন্তোষ ও আনন্দ লাভ করে থাকে। 
যারা সবসময় আমাতেই যুক্ত হয়ে প্রীতিভরে আমারই ভজনা করে, সেইসব ভক্তগণকে আমি এমন বুদ্ধি দান  করি,  যার দ্বারা আমাকেই লাভ করে থাকে।  
        
দেখুন, শুদ্ধ মন হচ্ছে বোধশক্তির উদয় স্থল। কিন্তু শুদ্ধ মন কাকে বলে ? যে মন ব্রহ্মের অনুসন্ধানের প্রত্যাশী, যে মন পরম-পুরুষকে অনুভব করবার জন্য ব্যাকুল, সেই মনই শুদ্ধমন।  যে মনে যথার্থ বোধশক্তির উদয় হয়, তাকেই বলে শুদ্ধ মন। আসলে শান্ত মন আর বোধ শক্তি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তাই মন যতক্ষন শান্ত না হয়, ততক্ষন আমাদের বোধশক্তি কাজ করতে পারে না। আবার মনের পবিত্রতা এবং মনের শান্ত অবস্থা একই সঙ্গে বিরাজ করে। আমাদের ধ্যানে লিপ্ত হবার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মনকে শান্ত করা।

এখন  কথা হচ্ছে এই শুভ বুদ্ধির কি করে উদয় হবে ? শুভবুদ্ধির উদয় হতে পারে  প্রার্থনার মাধ্যমে। আমরা যখন চিন্তায়-বাক্যে-কর্ম্মে সর্বত  ভাবে পবিত্র থাকবার জন্য বিশ্বশক্তির কাছে প্রার্থনা করবো, তখন ঈশ্বরকৃপায় ধীরে ধীরে  আমাদের  মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হতে শুরু করবে। আর এই প্রার্থনায় সঠিক সাড়া পেতে গেলে, আমাদের আগ্রহ বাড়াতে হবে।  তবে তার আগে যেটা করা দরকার, ভগবান আমাদেরকে না চাইতেই যাকিছু দান  করেছেন, তার সদ্ব্যবহার  করতে হবে। মনে মুখে কাজে এক হতে হবে। একটা কথা জানবেন, যারা নিজেরা চেষ্টা করে, তাদেরই ভগবান সাহায্য করে থাকেন। আমাদের ক্ষমতা খুবই সীমাবদ্ধ।  আমরা বদ্ধ জীব। তো বদ্ধ জীব নিজেকে কিভাবে মুক্ত করবে ? মহাত্মাগণ বলে থাকেন, যে বদ্ধ তাকে বন্ধনমুক্ত করবার জন্য অন্যের সাহায্য প্রয়োজন। এই জন্য তাঁরা গুরু বা আচার্য্যের কথা বলে থাকেন। কিন্তু আমি বলি, আপনি যেহেতু নিজেকে নিজেই বদ্ধ করেছেন, তো বন্ধন কাটাবার জন্য আপনিই যথেষ্ট। অন্য কারুর সাহায্যের প্রয়োজন  নেই। হ্যাঁ যদি আপনাকে কেউ বদ্ধ করে থাকে, তবে সেই বাঁধন কাটাবার জন্য, আপনার অন্যের সাহায্য প্রয়োজন। আপনি জেল থেকে ছাড়া পাবেন না, যতক্ষন না আপনাকে কেউ সাহায্য করছে। কারন এখানে আপনাকে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।  কিন্তু আপনি সংসার বন্ধন থেকে ছাড়া পেতে পারেন, কারন এই সংসার বন্ধন আপনি নিজেই সৃষ্টি করেছেন। আচার্য্য বা গুরু খুঁজতে গিয়ে বরং প্রতারক-ঠকবাজ-এর পাল্লায় পরে গেলে আপনার আরো অধঃপতন হবার সম্ভাবনা আরো বেশি হয়ে যাবে। যাই যে কথা বলছিলাম -

যাইহোক, আমাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হতে পারে প্রার্থনার মাধ্যমে। আমাদের নৈতিক অপবিত্রতা, সত্যের আলোক জ্যোতিকে আড়াল করে রেখেছে।  আমাদের অসৎ প্রবৃত্তি, আমাদের ক্রোধ, ঘৃণা, লোভ, ঈর্ষা, ভয় সবশেষে আমাদের কামভাব ও আবেগ আমাদের মানসিক সাম্য নষ্ট করেছে। আমাদের যে ইচ্ছেশক্তি আছে, আমাদের যে বিচারশক্তি আছে, তাকে কাজে লাগিয়ে এগুলোকে তাড়াতে হবে। সুতরাং আমাদের মধ্যে শুভ বুদ্ধির উদয় ঘটাবার জন্য, আমাদের প্রতিনিয়ত বিশ্বশক্তির কাছে প্রার্থনা করতে হবে। প্রার্থনার মধ্যে এক অসীম শক্তি লুকিয়ে আছে। আগে একদিন আমরা আলোচনা করেছিলাম, প্রার্থনা কিভাবে কাজ  করে। তাই আজ আর সেই আলোচনায় যাবো না। আজ শুনবো কিভাবে আমরা প্রার্থনা করবো। প্রার্থনার খুঁটিনাটি সম্পর্কে শুনবো। 
আগেই বলেছি, আমাদের যা আছে, তাই দিয়ে আমাদের শুরু করতে হবে। প্রথমে শুনুন প্রার্থনা কে করে ? যে দুর্বল সেই প্রার্থনা করে। তো নিজেকে দুর্বল ভাবুন। এই বিরাট বিশ্বশক্তির কাছে, আমাদের সবার  সম্মিলিত শক্তিও নিতান্ত দুর্বল।  তো আমাদের একক শক্তিতো আরো দুর্বল। এই বোধ নিজের মধ্যে জাগিয়ে তুলুন, যে আমি দুর্বল। আপনি হয়তো অমনি বিবেকানন্দ-এর বাণী উদ্ধৃতি করে বলবেন, "যে নিজেকে দুর্বল ভাবে সেই দুর্বল হয়ে যায়, যে নিজেকে তেজস্বী ভাবে সেই তেজস্বী হয়।" একটা  কথা শুনুন মানুষ দৈবের অধীন। আপনি যতই নিজেকে বলশালী ভাবুন, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারবেন, কে যেন আপনার সমস্ত শারীরিক বল কেড়ে নিয়েছে। কে যেন আপনাকে ধীরে ধীরে মানসিক ভাবে, শারীরিক ভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। তো এমন একটা শক্তি আছে, যিনি একসময় আমাদের বল দান  করেছিলেন, আবার মেয়াদের শেষে সেই শক্তি আবার ফিরিয়ে নিয়েছেন। এই সত্যকে আপনার স্বীকার করতে হবে। আর মনে প্রাণে যদি নিজেকে দুর্বল ভাবতে পারেন, তবে আপনার মধ্যে একটা নির্ভরতার আকুতি জন্মাবে। আর যখন এই নির্ভরতার জন্য নিজের মধ্যে আকুলি-বিকুলি ভাব জেগে উঠবে, তখন আপনার প্রার্থনার শক্তি বেড়ে যাবে। প্রার্থনার মধ্যে একটা ঐকান্তিক ভাব জেগে উঠবে। একটা আত্মসমর্পনে ভাব জেগে উঠবে। 

যথার্থ বোধশক্তি ঈশ্বরের এক দুর্লভ উপহার। দুর্লভ এই বোধ শক্তি যত  বিকশিত হবে তত আপনার ভিতরে সত্যের সূর্য উদয় হতে শুরু করবে। একটা সময় আপনার বোধোদয় আপনাকে বলে দেবে ঈশ্বর ভিন্ন কিছু নেই। চারিদিকে, অন্তরে বাহিরে ঈশ্বর ভিন্ন কিছু নেই। ঘুচে যাবে সমস্ত পার্থক্য। সমস্ত কিছুর মধ্যে যথার্থ ঈশ্বরই বিরাজ  করছেন। তিনিই একমাত্র স্থির।  আর সব কিছু অস্থির।  এই আছে এই নাই। পরিবর্তনশীল জগতের মধ্যে সমস্ত বস্তুর আধার হচ্ছেন সেই সচ্চিদানন্দ। বিচিত্র এই বিশ্বে, অসীম এই চরাচরে, সর্বত্র বিরাজ করছেন সেই আত্মা ব্রহ্ম। ব্রহ্মেই বস্তু, ব্রহ্মেই জীবন, ব্রহ্মেই সমস্ত আলোক সম্পদ, ব্রহ্মেই শান্তি, ব্রহ্মেই মুক্তি। ব্রহ্মই ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান। 

শুভ বুদ্ধি জাগ্রত হলে আমরা শুধু ভগবানকেই খুঁজি। সমস্ত সম্পদ তা সে ঐহিক হোক বা পারত্রিক হোক , ইহলোকের হোক, বা পরলোকের হোক, জীবনের জন্য হোক, বা মৃত্যুর জন্য হোক, আমরা তখন তাঁকেই খুঁজি। তাঁর কাছে আমাদের সমস্ত প্রার্থনা, তাঁর কাছেই আমাদের সমস্ত কর্ম্ম, সমর্পন করি। তাঁকেই ভালোবাসি, তাঁকেই পূজা করি, তাঁরই দর্শন লাভ করতে চাই। আর তিনি আছেন বলেই সমস্ত বস্তু তখন আমাদের কাছে প্রিয়তম বোধ হয়। আমাদের সমস্ত জীবন, তাঁকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। শুভবুদ্ধি জাগ্রত হলে, আমরা শুধু তাঁর কথাই ভাবি, তাঁর কথাই বলি, তার প্রীতার্থে সমস্ত কর্ম্ম করি, তাকে ঘিরে জীবনধারণ করি,  তাকেই সমস্ত কর্ম্মফল সমর্পন করি। এই হচ্ছে ধ্যান। 

গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, তাকেই সমর্পিত  চিত্ত, তাঁকেই সমর্পিত প্রাণ, সমস্ত তত্ত্বকথা তাঁকেই  ঘিরে, তাঁরই  কীর্তনগান  আমাদেরকে সন্তুষ্ট করে, সুখী করে। ভগবান বলছেন, যিনি সর্বদা আমাতে আসক্ত চিত্ত, আমাতে সন্তুষ্ট, আমার ভজনাকারী,  বুদ্ধিযোগে তিনি আমাকেই প্রাপ্ত হন। তিনিই আমার অনুকম্পা বশতঃ, যে যেমন-চান, সেই ভাবেই তিনি  আমার ভাব প্রাপ্ত হন। তখন জ্ঞানালোকের বিকাশে অন্ধকারের বিনাশ হয়। এটাই ধ্যানের  প্রাপ্তি।  তখন জ্ঞানসূর্যের দীপ্তি, আমাদের হৃদয়ের মধ্যে যথার্থ বোধশক্তি জাগিয়ে তোলে। একটা দিব্যভাব, হৃদয়গুহা থেকে শান্তির আলো বিচ্ছুরিত করতে থাকে। 
এটাই ধ্যানের  প্রাপ্তি।  তাই বলছিলাম, আমাদের শুভ বুদ্ধিকে জাগ্রত করতে হবে। আর এই নির্মল শুভ বুদ্ধি আমাদেরকে নিয়ে যাবে, এক অপার  শান্তির রাজ্যে।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম তৎ-সৎ। 

চলবে।.......
 
ধ্যানময় জীবনই শান্তির পথ, সাফল্যের পথ । (৭) THE  DIVINE LIFE  

কথা হচ্ছিলো, ধ্যান নিয়ে। তো ধ্যান করতে গেলে, আমাদের শরীরকে স্থির করতে হবে, মনকে শান্ত করতে হবে। আর মনকে শান্ত করতে গেলে আমাদের মনকে শুদ্ধ করতে হবে। মনকে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন করতে হবে। এখন কথা হচ্ছে শুভবুদ্ধিটা দেবেন কে ? কার কাছে শুভ বুদ্ধি পাবো ? মনকে সুবুদ্ধি প্রদান করতে পারেন, একমাত্র পরমপিতা পরমেশ্বর। তো  মনকে শুদ্ধ করতে গেলে আমাদের সেই বিশ্বশক্তির কাছে প্রার্থনা করতে হবে। আর প্রার্থনায় গভীরতা আনতে  গেলে আমরা যাঁর কাছে প্রার্থনা করছি, তার প্রতি অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি নির্ভরশীলতা বোধ জাগাতে হবে।  এইজন্য বলা হয়, ধ্যানের  প্রস্তুতি পর্ব্ব  শুরু হয় প্রার্থনা দিয়ে।

ঈশ্বর অনুভূতি পেতে গেলে, আমাদের দুটো জিনিস দরকার, এক হচ্ছে জ্ঞান এবং অন্যটি ভক্তি। জ্ঞান সম্পর্কে  ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, "ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রম ইহ বিদ্যতে। তৎ স্বয়ং যোগ-সংসিদ্ধঃ কালেন  আত্মনি বিন্দতি। " শ্রীমৎ ভগবৎ গীতা - ৪/৩৮) ইহজগতে জ্ঞানের মতো পবিত্র আর কিছু নেই। যোগসিদ্ধ পুরুষ কালে কালে এই জ্ঞান লাভ করে থাকেন। ভগবান গীতার ৪/৩৭ নং শ্লোকে আরো বলছেন, "যথা এধাংশি সমিধঃ অগ্নি  ভস্মসাৎ কুরুতে অর্জুন। জ্ঞানাগ্নি সর্ব্ব কর্ম্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা। " অর্থাৎ হে অর্জুন, অগ্নি যেমন সমিধ কাঠরাশিকে ভস্মীভূত করে, যোগসিদ্ধ পুরুষ জ্ঞানের সাহায্যে তার সমস্ত কর্ম্মকে অর্থাৎ কর্ম্মফলকে ভস্মীভূত করে থাকেন। তো সাধনার পূর্বে আমাদের দরকার ঈশ্বর সম্পর্কে একটা সাধারণ জ্ঞান।  ভগবান বলছেন, এই জ্ঞান লাভ করতে গেলে, আমাদের মধ্যে তিনটে গুনের আবশ্যক।   আর তা হচ্ছে, শ্রদ্ধা, তৎপরতা এবং ইন্দ্রিয় সংযম। শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম, তৎপরঃ সংযত ইন্দ্রিয়ঃ।  (৪/৩৯)  শ্রদ্ধা বলতে বোঝায় গুরুবাক্যে বিশ্বাস, শাস্ত্রবাক্যে বিশ্বাস, সর্বোপরি নিজের প্রতি বিশ্বাস। তৎপরতা বলতে বোঝায়, আগ্রহ। জ্ঞান লাভের  জন্য, নিজেকেই  তৎপর হতে হবে। নিজের থেকে চেষ্টা করতে হবে। কেউ আপনার কাছে এসে, আপনাকে জ্ঞান দান  করে যাবে না। আপনাকেই চেষ্টা করে, জ্ঞান সংগ্রহ করতে হবে। তার জন্য আপনাকে জ্ঞানবান  পুরুষের কাছে যেতে হবে। আজকাল অবশ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা অনেক জ্ঞানের সন্ধান পেয়ে থাকি। কিন্তু এই জ্ঞান হচ্ছে পুঁথিগত বিদ্যার মতো, শুষ্ক জ্ঞান। এই জ্ঞান হচ্ছে তথ্যভিত্তিক জ্ঞান। এই জ্ঞানের অবশ্য়ই মূল্য আছে। আবার আমাদের পার্থিব জ্ঞান বা প্রাতিষ্ঠানিক  বিদ্যাও আমাদের স্কুল কলেজের শিক্ষকের সান্নিধ্যে অর্জন করে থাকি। তাই আধ্যাত্মিক বিদ্যা গুরুসান্নিধ্যে হয়ে থাকে।  গুরুমুখে শোনা, এবং সেই জ্ঞানের বিষয়কে নিজের জীবনে প্রয়োগ করা, গুরুসান্নিধ্যে হয়ে থাকে।  আপনি যদি নিজেই নিজের গুরু হতে পারেন, তবে পুঁথিগত বিদ্যা বা নেটের মাধ্যমে জ্ঞান সংগ্রহ করে নিজের জীবনে প্রয়োগ করে জ্ঞানের সাফল্য লাভ করতে পারেন। তবে সমস্ত শিক্ষা যেমন আচার্য্য বা শিক্ষকের কাছ থেকে পাওয়া সহজ হয়, অর্থাৎ তিনি আমাদের সমস্ত তত্ত্বকথার  অন্তর্নিহিত  অর্থ বুঝিয়ে দেন, তেমনি যোগ  গুরুসান্নিধ্যে অধিক ফলপ্রসূ হয়, এমনকি যোগের বিভিন্ন রকম  পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সমাধান একমাত্র গুরুদেবের নির্দেশে হতে পারে।  তেমনি জ্ঞান ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে একটা শৈথিল্যের ভাব থাকে। এই শিথিলতা গুরুদেব বিভিন্নভাবে কাটিয়ে দিতে পারেন। যাই হোক, জ্ঞানের শেষ নেই। আবার সৎগুরু পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার। তবে যে নিজের ভালো বোঝে না, তাকে কোনো গুরুর বাপের সাধ্য নেই ভালো করে। তাই সর্বাগ্রে দরকার, নিজের মধ্যে একটা শৃঙ্খলা আনা, নিজেকে নিয়মের মধ্যে বেঁধে রাখা।  নিজের বিবেকের নির্দেশে চলা। নিজের লক্ষ স্থির করা। আর সেই লক্ষে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হওয়া।    আপনি শুধু জেনে রাখুন আর দৃঢ়ভাবে  বিশ্বাস করুন,  জগৎ ব্রহ্ম বৈ কিছু নয়। জগতের সমস্ত বস্তুই ব্রহ্ম। তত্ত্বমসি - তিনিই সব। অহম ব্রহ্মাস্মিন - আমিই ব্রহ্ম।  শিবহম শিবহম। এইসব তত্ত্বকথা আমাদের অনুভূতির বাইরে হলেও এই ব্রহ্মবাক্যে বিশ্বাস রাখুন। ধীরে ধীরে এই সত্যকে নিজের অনুভূতির মধ্যে আনবার জন্য, নিজেকে তৈরী করুন। 

এবার আবার প্রার্থনার কথায় আসি।  প্রার্থনাই ধ্যান অভ্যাসের জন্য নিজেকে তৈরী করার উপায়। "আমি" "আমার" এই ভাব ত্যাগ করুন। দৈনন্দিন সমস্ত জাগতিক কর্ম্মকে মনে করুন, ঈশ্বরের কাজ করছেন।  আপনার বা অফিসের কাজ নয়।  আপনি কাজ করছেন, ভগবানের নির্দেশে।  এবং আপনি জানবেন, এই কাজের সমস্ত মালিকানা একমাত্র ঈশ্বর। আপনি তার বেতনভুক কর্ম্মচারী মাত্র । নিজের মধ্যে যে অহংকার আছে, তা ভগবানের নিকট সমর্পন করুন।  আর এই সমর্পনের ভাব নিয়েই সমস্ত কর্তব্যকর্ম সময়মতো সেরে ফেলুন। মনকে ঈশ্বরমুখী করে যখন আপনি আপনার সমস্ত কর্তব্য কর্ম্ম   করবেন, তখন দেখবেন, আপনার দৈনন্দিন সমস্ত কর্ম্মই ধ্যানে পরিণত হয়ে গেছে। 

প্রার্থনা অর্থাৎ পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা।  এই প্রার্থনা হচ্ছে পরমেশ্বরের কাছে আর্তি, বা তাঁর গুনগানসূচক কিছু বাক্যের উচ্চারণ। আর এই বাক্যের মধ্যে যে ভাবের প্রকাশ থাকে তা প্রার্থনাকারীর মনের মধ্যে এমনকি শরীরের মধ্যে একটা বৈদ্যুতিক তরঙ্গের হিল্লোল তোলে। যতবার আপনি ভগবানের উপাসনা করছেন, ততবার আপনার অন্তরে একটা ভক্তি ভাবের সঞ্চার হচ্ছে । এইসময় প্রার্থনাকারীর মন  ঈশ্বরমুখী হয়ে থাকে। আর একটা জিনিস জানবেন, আপনি যখন যার সঙ্গে মিশবেন, তখন তার একটা প্রভাব আপনার মধ্যে পড়বে। তার দোষ গুনের একটা প্রভাব আপনার মধ্যে পড়বে । ঠিক তেমনি আপনি যখন ঈশ্বরমুখী হবেন, তখন আপনার মধ্যে একটা পবিত্রভাব জেগে উঠবে। আপনি যখন সংসারী লোকের সঙ্গে মিশবেন, তখন আপনার মধ্যে সংসারের দিকে আকর্ষণ অনুভব করবেন।  আপনি যখন সাধু-সন্তের সঙ্গে মিশবেন, তখন আপনার মধ্যে সাময়িক ভাবে হলেও একটা প্রভাব আপনার মধ্যে পড়বে । তো ঈশ্বর হচ্ছেন,প্রেম-ভক্তি গুনের আধার।  আপনি যখন প্রার্থনা করবেন, তখনও আপনার মধ্যে এই প্রেম-ভক্তির উদয় হতে শুরু করবে।  ঈশ্বর হচ্ছেন পবিত্র।  তো আপনার মধ্যে শুদ্ধমনের বিকাশ ঘটবে। অর্থাৎ অন্তর শুদ্ধ করতে প্রার্থনার একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। আর এই শুদ্ধ মন আপনাকে ধ্যানের  পথকে প্রশস্ত করে দেবে। 

দেখুন ধ্যান মানে শুধু শরীরকে বিশেষ ভঙ্গিমায় স্থির করে রাখা নয়। আপনার মন যখন ঈশ্বর-ভক্তিতে পরিপূর্ন হবে, তখন আপনার মন শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর হতে থাকবে। আর এই শুদ্ধ মন-ই ধ্যানের  সহায়ক।  আসলে দৈনন্দিন জীবনে, আমরা যাকে  পছন্দ করি, যাকে  ভালোবাসি, তার কথা আমাদের বারবার মনের মধ্যে উদয় হয়। মা-বাবার কথা, স্ত্রীর কথা, ছেলেমেয়ের কথা, আমাদের মন থেকে সরিয়ে দিতে পারি না। এই সরল সত্য আমরা সবাই উপলব্ধি  করি। 

আধ্যাত্মিক জীবনেও এই সরল-সত্য খুবই কার্যকরী। আপনি যতক্ষন বিষয়-চিন্তায় মগ্ন থাকবেন, পার্থিব চিন্তায় নিজেকে যুক্ত করে রাখবেন, ততক্ষন আপনি ধ্যানে বা ঈশ্বরের প্রতি একাগ্রতা আনতে  পারবেন না। তো মোদ্দা কথা হলো, আপনি ভগবানকে চান কি চান না, সেই সিদ্ধান্ত আগে নিতে হবে।  অর্থাৎ আপনার লক্ষকে আগে স্থির করতে হবে। আপনি বিষয় ধ্যানে মগ্ন থাকুন, আপনার বিষয় লাভ হবে। আপনি পার্থিব বস্তুর ধ্যান করুন, দেখবেন অবশ্য়ই আপনার পার্থিব লাভ হবে। তো আপনি যদি  ভগবানকে লাভ করতে চান, তবে আপনাকে ভগবানের ধ্যান করতে হবে। ভগবানকে ভালোবাসতে হবে, ভগবানকে ভক্তি করতে হবে। দেখুন চালাকি দ্বারা কোনো মহৎ কাজ হতে পারে না। আপনি সত্যি সত্যি ভগবানকে চান কি না, সেই প্রশ্ন আগে নিজের কাছে রাখুন। এবং সেখান থেকে স্বীকৃতি পেলে তবেই আপনি ভগবানের প্রতি আকৃষ্ট হবেন। নতুবা লোক দেখানো ধ্যানে আপনার সময়ের অপচয় ছাড়া কিছুই  হবে না। বরং এইসময় আপনি পার্থিব চিন্তা করুন, আপনার পার্থিব বস্তু লাভ হবে। আর একটা কথা শুনুন, ভগবানকে লাভ করবার জন্য যেমন কোনো কৌশল হয় না, তেমনি সহজ কোনো রাস্তা নেই, যেখানে বিনা আয়াসে আপনি পৌঁছে যাবেন। বরং পার্থিব বস্তুর জন্য, আমাদের যত  কম প্রয়াসে সাফল্য মিলতে পারে, ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে গেলে, তার থেকে লক্ষ-কোটি গুন্ বেশি ত্যাগ করতে হয়। এমনকি আপনার মধ্যে আকুতি না থাকলে, স্বয়ং ভগবানও আপনাকে ভগবানের সান্নিধ্য লাভ করাতে পারবেন  না।  অনুকূল জাগতিক পরিবেশ পেলে যেমন গাছপালা-জীব-জীবাণুর জন্ম হয়, তেমনি আধ্যাত্মিক পরিবেশেই ঈশ্বরের আবির্ভাব হয়। আবার গাছের লালন পালন করলে, যেমন গাছ ফলপ্রসূ হয়, তেমনি আধ্যাত্মিক জীবন পদ্ধতি অনুসরণ করলে, এই গাছে শান্তির ফল প্রসব করে।  

চলবে।....  


 ধ্যানময় জীবনই শান্তির পথ, সাফল্যের পথ । (৮) DHYAN, PEACE & SUCCESS IN LIFE - WAY TO  DIVINE LIFE 

ভগবানের সান্নিধ্য পাবার জন্য আমরা ধ্যান করবো। কিন্তু ভগবানের সান্নিধ্য, ভগবানের সাক্ষাৎ, ভগবানের স্বরূপের উপলব্ধি কি সত্যিই সম্ভব। নাকি এগুলো আমাদের একটা ভ্রান্ত ধারণা। দেখুন ভ্রান্ত  আর অভ্রান্ত যাই হোক না কেন, একবার করেই দেখুন না, আমাদের মুনিঋষিগন যা বলে গেছেন, তা করে আপনার আমার কোনো লাভ হয় কি না। ধ্যান করার আগে আমাদের প্রার্থনা দিয়ে শুরু করতে বলেছেন। বাড়িতে একটা পূজা বা উপাসনার পরিবেশ গড়ে তুলে দেখুন না, আপনার সংসারে শান্তি আসে কি না। মনোযোগ দিয়ে প্রতিদিন প্রার্থনা করেই দেখুন না, আপনার সমস্যার সমাধান হয় কি না। আমরা কিছুই করবো না, পুজো-প্রার্থনার কথা শুনলে  তাচ্ছিল্য করবো, বা উপেক্ষা করবো। তাতে আপনার ক্ষতি না হোক লাভ কিছু হবে না, একথা হলফ করে বলা যায়। আর পুজোর উপাচারে হয়তো আর্থিক ক্ষতি হতে পারে। তো সেই আর্থিক ক্ষতিকে এড়িয়ে শুধু ঈশ্বরের উদ্দেশ্য একঘটি জল কোনো গাছের গোড়ায়, ঢেলে দেখুন না, আপনার মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয় কি না। শুধু ভক্তিভরে একঘটি জল ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে ঢেলে দিন।  দেখবেন, তাতেও আপনার মনে একটা শান্তির ভাব আসবে। 

ঈশ্বরের শরণে আমাদের মধ্যে থেকে ধীরে ধীরে সমস্ত ভয় দূর হয়ে যাবে। আমাদের সমস্ত দুর্গতির বিনাশ হয়ে যাবে। আমাদের মনের সংশয় কেটে যাবে। আমাদের ভ্রান্তির অবসান ঘটবে। আপনি দেখবেন, তখন আপনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারী হয়ে যাবেন । পরিবেশ আপনার অনুকূলে এসে যাবে। আপনার সমস্ত কাজ সহজ, সুন্দর, ও ফলপ্রসূ হয়ে উঠবে। এগুলো কোনো গল্প কথা নয়। মাত্র দুসপ্তাহ পর থেকেই এই সত্য আপনি  উপলব্ধি করতে পারবেন। দু সপ্তাহে যদি আপনার জীবনে কোনো পরিবর্তন না আসে, তবে না হয়, চেঁচিয়ে বলবেন, আমার এতে কিছুই হয়নি। আর এসব করে কিছু হয় না। তবে একটা কথা বলি, নিজেকে ফাঁকি দেবেন না। নিজের বিবেককে বোকা বানাবেন না। আত্মপ্রবঞ্চনা করবেন না। সত্যকে ধরে রাখুন। দেখবেন, সত্য আপনার জীবন বদলে দিয়েছে। 

দিনের শুরুতে - এক ঘাঁটি জল নিয়ে  ঢালতে ঢালতে বলুন, 
"যো দেবো অগ্নৌ, যো  অপ্ সু ,যো বিশ্বং ভুবনম অবিবেশ। 
য ঔষধিষু, যো বনস্পতিসু, তস্মৈ দেবায় নমো নমঃ।" (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ২/১৭)

হে স্বয়ংপ্রকাশ দেব, আপনি অগ্নিতে অবস্থিত, আপনি জলে অবস্থিত, আপনি ঔষধির  মধ্যে  অবস্থিত, আপনি বনস্পতির মধ্যে বিরাজ করছেন,  আপনি সমস্ত বিশ্বভুবনের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আছেন।  সেই স্বয়ংপ্রকাশদেবকে আমি পুনঃপুনঃ নমস্কার করি। 

একটা জিনিস জানবেন, আপনার জীবনে যদি এতটুকু আনন্দ কোনোদিন এসে থাকে তা সেই স্বয়ংপ্রকাশ বিশ্বশক্তির কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। তিনিই দাতা  তিনিই গ্রহীতা, তিনিই রক্ষক আবার তিনিই ভক্ষক। শরীরের সমস্ত শক্তি তা সে জ্ঞানেন্দ্রীয়ের শক্তি বলুন, কর্ম্ম-ইন্দ্রিয়ের শক্তি বলুন, এমনকি মন বুদ্ধির শক্তি বলুন, তা তিনি একসময় আমাদের দিয়েছিলেন, আবার সময় হলে সমস্ত শক্তি আমার কাছ থেকে চলে যাবে। শরীরের বয়স বাড়বার  সঙ্গে সঙ্গে এই উপলব্ধি আপনার মধ্যে একদিন অবশ্যই  আসবে। সমস্ত প্রাণী, সমস্ত জীবন এই সত্যের শাসনে প্রতিষ্ঠিত। আসলে আমরা যা পাই, তা আমরা বিশুদ্ধ ভাবে গ্রহণ করতে পারি না। কারন আমাদের মন মলিনতায় আচন্ন হয়ে আছে। আমাদের অহংকার, আমাদের অজ্ঞান, আমাদের মনকে অশুদ্ধ করে রেখেছে। আপনি শুধু নিরন্তর এই ভাবনার মধ্যে ডুবিয়ে রাখুন, যে আমি নিত্য, আমি শুদ্ধ, আমি বুদ্ধ, আমি মুক্ত। আমি এক পবিত্র আত্মা স্বরূপ। হে ভগবান, আমাকে সেই  ধীশক্তি দাও, যার দ্বারা আমি তোমাকে বুঝতে পারি। আমরা সবাই সেই জ্যোতিসমুদ্রের মধ্যে এক বিন্দু আলোর কনা। আমি সেই বিশাল জ্যোতি-সমুদ্রের মধ্যে একবিন্দু স্ফূরণ। আমার কাজ এই সত্যকে উপলব্ধি করা, যে সমর্পন-ই যথার্থ জীবনের উদ্দেশ্য। আমার কাজ শুধু তাকেই শরণ করা।  আমার কাজ তাঁরই  উপাসনা করা। তাহলে আমরা সবাই তার উদ্দেশ্যকে সার্থক করতে পারবো। তাঁরই উদ্দেশ্যে সমস্ত কর্ম্ম করা। নিজের সমস্ত ইচ্ছেশক্তিকে তাঁর চরণে সমর্পন করতে পারলে, দেখবেন জীবন হবে আনন্দময়, জীবন হবে শান্তিময়, জীবন সাফল্যের আলোতে ঝলমল করবে। 

নিত্যঃ অনিত্যানাং চেতনঃ অচেতনা নাম একো বহূনাং যো বিদধাতি কামান্। 
তম আত্মস্থং যে অনুপশ্যন্তি ধীরাঃ তেষাম শান্তিঃ শাশ্বতী ন ইতরেষাম্। কঠোপনিষদ - ২/২/১৩

সমস্ত অনিত্য বস্তুর মধ্যে যিনি নিত্য, সমস্ত চেতন বস্তুর মধ্যে যিনি স্বয়ং চৈতন্য স্বরূপ, একমাত্র যিনি সবার মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে সক্ষম, তিনিই পরমাত্মা। এই পরমাত্মাকে সমস্ত প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি নিজের আত্মা রূপেই দর্শন করে থাকেন। আর এই প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি, আত্মস্বরূপে অনুপ্রবিষ্ট থেকে পরম শান্তি লাভ করে থাকেন। আর অন্যরা এই শান্তি থেকে বঞ্চিত থাকেন। 

অচেতন বস্তু, অনিত্য বস্তু সবার মধ্যে যে কারন শক্তি আছে, সচেতন বস্তুর মধ্যে সেই এক ঐশী  শক্তি যাকে  বলা হয় চৈতন্য। সমগ্র বিশ্বে একই শক্তির দুই রূপ বর্তমান। একটা শান্ত স্থির - যার অবস্থান কেন্দ্রে।  আর একটি অস্থির অশান্ত যার অবস্থান বিস্তারের মধ্যে। এই যে স্থির শান্ত অবস্থা, যাকে  বলা হচ্ছে শক্তির কেন্দ্র, সেই শান্তিই জগতের সারবস্তু। সমস্ত বস্তু মায় প্রাণী জগৎ এতে জুড়ে আছে। তাই মহাত্মাগন বলে থাকেন, সমস্ত বস্তু আনন্দের সত্তায় অধিষ্টিত। আমাদের কাছে যে জগৎ দৃশ্যমান, এই জগৎ আসলে বিভাজনের জগৎ। যত  বিভাগ তত অস্থিরতা। তবে একথা সত্য, বিভাজন বৈষম্যের কারন হলেও, মূল সত্তাকে কেউ ছেড়ে যেতে পারে না। তাই বস্তুর বিভাগ যতই হোক না কেন, কারন সত্তা একই থাকে।  আবার প্রাণীর বিভাগ যতই হোক না কেন, চৈতন্য সত্তা একই থাকে। ভেদহীন ও বিভাগহীন এই মূল সত্তা সদা স্থির। আর সেই অপরিণামী সত্তায়  সবকিছুকে ধরে রেখেছে। আকার পরিবর্তন হয়, বস্তুর নয়।  একই মাটি দিয়ে, লক্ষ্মী, গনেশ, শিব দূর্গা, তৈরী হচ্ছে। আকার ও পরিণামের পার্থক্য মাত্র। তাই বলা হয়ে থাকে আকারের পরিবর্তন হয়, বোতলের পরিবর্তন হয়, ভিতরের বস্তু একই থাকে। এই সূত্রেই গ্রথিত আছে, সমস্ত মনুষ্য জাতি, সমগ্র জীবজন্তু, এমনকি বৃক্ষলতা, পাহাড় পর্বত, এমনকি সূর্য-চন্দ্র গ্রহ নক্ষত্র। 

এই জন্য গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সুতোয় গাঁথা মণিরত্নের মতো, সমস্ত জগৎ আমাতে বাঁধা আছে। "ময়ি সর্বমিদং প্রোতং সূত্রে মনিগনা ইব। " (৭/৭) এই চিরসত্য আমাদের বোধে আসে না। যদি এই বোধের সামান্যতম আমাদের অনুভূতিতে আসে, তাহলে আমরা যেমন এক অসীমের ছোঁয়া পেতে পারি, তেমনি আমরা সমস্ত জগতের মধ্যে নিজেকে একাত্ম অনুভব করতে পারি। আমারা তখন নিৰ্দিষ্ট দেহ, সম্পর্ক ইত্যাদির মধ্যে গন্ডিবদ্ধ থাকি না। তখন কোনো কিছুকেই আর বিজাতীয় বা দূরের বা নিকটের বলে মনে হয় না। আর একেই বলে সম দর্শন। সমদর্শনে প্রতিষ্ঠির হলে, আমাদের মন থেকে  ভেদবুদ্ধি, বিদ্বেষ, ঘৃণা, ভয় দূর হয়ে যাবে।  আর আমাদের হৃদয়ে তখন বিরাজ করবে একটা ভালোবাসা ও শান্তির জগতে। 
কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমরা সবাই নিজেকে  সবার থেকে আলাদা ভাবি। আর এই ভেদবুদ্ধি আমাদের মধ্যে ভয়, হিংসা, দ্বেষ, স্বার্থপরতার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু আলাদা না ভেবে উপায় কি ? আমার শরীর রক্ষার জন্য, আমাদের ক্ষুধা মিটাবার জন্য, আমাদের দেহের বাইরের বস্তু, উদ্ভিদ  বা প্রাণীর দেহের প্রয়োজন। আর এগুলো সংগ্রহ করতে গিয়ে, আমরা অন্যের ভীতির কারন হচ্ছি, অন্যকে সংহারের কারন হচ্ছি। নিজের মনকে স্বস্তি দিতে গিয়ে, অন্যের দুঃখের কারন হচ্ছি। এই বাস্তব সত্য আমরা অস্বীকার করি কি করে ? আর এই জৈবিক প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে, আমরা যদি ভেদবুদ্ধি পরিত্যাগ করি, তবে নিজের অস্তিত্ত্ব বিপন্ন হয়ে ওঠে। এখান থেকে বেরুবার উপায় কি ? 

এখান থেকে বেরুবার উপায় হচ্ছে শরণাগতি। অর্থাৎ আপনি প্রকৃতির নিয়ম মেনে, জীবিকা অর্জনের জন্য কাজ করছেন, কিন্তু জানবেন, এই কাজ নিজেকে রক্ষার জন্য নয়, প্রকৃতির নিৰ্দেশ পালনের জন্য। অর্থাৎ আপনি প্রকৃতির দাস।  আপনার যে শরীর, আপনার যে মন এসব জানবেন প্রকৃতি প্রদত্ত। আর প্রকৃতিই এই শরীরকে রক্ষা করবেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, তাহলে কি আমরা শুধু নিশ্চুপ হলে স্থবির হয়ে বসে থাকবো ? না মর্তধাম কর্ম্মক্ষেত্রও বটে। এখানে আপনি নিস্কর্মা হয়ে বসে থাকতে পারবেন না। আপনাকে কিছু না কিছু করতেই হবে।  শরীর  যতক্ষন কর্মক্ষম  থাকবে আপনাকে কর্ম করে যেতেই  হবে। এমনকি আমাদের কর্ম্ম-ইন্দ্রিয়ের যিনি রাজা, অর্থাৎ মন, তিনি আমাদেরকে সব সময় নির্দেশ পাঠাতে থাকবেন। অতয়েব কর্ম্ম থেকে আমাদের নিষ্কৃতি নেই।   আবার এও ঠিক আমরা সবাই সব সময় সঠিক কর্ম্ম বা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি এমন নয়। তাহলে আমাদের দ্বারা ভালো বা খারাপ উভয় ধরনের কর্মই, আমরা হয় জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে করেই যাবো। এই সত্যকে আমাদের বুঝতে হবে, ধরতে হবে। প্রথম কথা হচ্ছে অজ্ঞাতসারে আমরা যে কর্ম্ম করি, তা সে চিন্তা বলুন বা শারীরিক কর্ম্ম বলুন, সেখানে আমাদের চেতনাকে নিবদ্ধ করতে হবে।  আমরা যেন অজ্ঞাতসারে, না জেনে না বুঝে খেয়ালের বসে  কোনো কাজ তা সে আবেগের বসেই হোক, বা অন্যের প্ররোচনাতেই হোক, করে না বসি। অর্থাৎ আমরা যা কিছু করবো, তা আমাদের বিবেক বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হয়ে করবো। যা কিছু করবো, সচেতন ভাবে করবো। 
মনের মধ্যে একটা ভাবনা জাগিয়ে তুলুন -  সমস্ত বস্তুর মধ্যে এক এবং অদ্বিতীয় সত্তা অর্থাৎ দিব্য চৈতন্যের আলোকজ্যোতির সঙ্গে নিজেকে এমনকি সকলের সম্পর্ককে নির্ধারণ করবার চেষ্টা করুন। ভাবুন, আপনি নিজে শান্তিতে আছেন, সকলের সঙ্গেও  আপনার শান্তির সম্পর্ক। আপনার ভয়ে কেউ যেন ভীত না হয়, আবার আপনিও কারুর ভয়ে ভীত নন। আপনার চারিদিকেই একটা শান্তির পরিবেশ বিরাজ করছে। আপনি যে বায়ু গ্রহণ করছেন, তা আপনার দেহ মনকে শুদ্ধ করছে। চৈতন্যবান করছে। আপনাকে পবিত্র করছে। এতে করে আপনার দেহ-মন পবিত্রভাবে স্নাত হবে। আর এই পবিত্রতা থেকেই আপনার দেহ-মন শান্ত হবে।  হবেই। মন হবে অচঞ্চল। নিজের মনের দিকে তাকান। নিজের মনের চিন্তাকে ধরবার চেষ্টা করুন। কি ভাবছে মন ? এই মনকে নিজের সত্তার দিকে ফেরান। মন-নদীর পারে দাঁড়িয়ে মনকে দেখতে থাকুন। 

উপনিষদ বলছেন : 
যদা পশ্যঃ পশ্যতে রুক্নবর্ণং কর্তারমীশং পুরুষ্ং ব্রহ্মযোনিম।
তদা বিদ্বান পুন্য পাপে বিধূয় নিরঞ্জনঃ পরমং সাম্যমুপৈতি।  (মুণ্ডক উপনিষদ ৩/১/৩)

সাধক যখন এই জ্যোতির্ময়ের স্রষ্টা, ব্রহ্মার কারন, সেই পরমপুরুষ ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে পারেন, তখন তিনি পাপ পুণ্যের উর্দ্ধে চলে যান। একটা পবিত্র নির্লিপ্ত ভাব, তার মধ্যে বিরাজ করতে থাকে। তিনি উপলব্ধি করেন একটা সাম্যাবস্থা।  আর সবকিছুর মধ্যে একটা একাত্মতা অনুভব করেন। 

আমরা নিজেকে দুর্বল ভাবি। আমরা নিজেকে অসহায় ভাবি। কিন্তু আমরা যে সবাই দেবসম।  আমরা যে সবাই ঈশ্বর সম একথা আমরা কখনো মনের ভিতরে ঠাই দিতে পারি না। এমনকি কল্পনাও করতে পারি না। আমাদের মনে হয়, মানুষ কখনো ঈশ্বর হতে পারে না।  মানুষ কখনো দেবতা হতে পারে না। আমরা বলি হ্যাঁ পারে। আর হতে পারে এই কথার চাইতে বলা যেতে পারে, সমস্ত মানুষই   ঈশ্বরসম দেবতাসম। এই বোধ আপনার স্মৃতি থেকে চলে গেছে। কারন, জীবনকে আপনি শুধু সমস্যার মধ্যে দেখেছে, জীবনকে আপনি শুধু কষ্টের মধ্যে দেখেছেন। তাই ঘাত -প্রতিঘাতে আপনি নিজের স্ব-রূপকে ভুলে গেছেন। আর এই বোধ আপনার তখনি আসবে,  তখনই আবার জেগে উঠবে, যখন আপনি সত্যনিষ্ঠ হবেন, যখন আপনি পবিত্র হবেন, যখন আপনার মধ্যে আত্মসংযম আসবে। আর এগুলো  কেবল অনুশীলনের মাধ্যমেই  জেগে ওঠে। দেবভাব আপনার মধ্যেই আছে। ঈশ্বরত্ব আপনার ভিতরেই আছে। শুধু ঘুরে দেখা। বার বার অভ্যাসের মাধ্যমে নিজের মধ্যে পরিবর্তিত ভাবনাকে জাগিয়ে তোলা। আপনি যখনি ঘুরে দাঁড়াবেন, তখন আপনি দেখবেন, আপনারই হৃদয়গুহায় ঈশ্বর বিরাজমান। চিত্ত শুদ্ধি হলে এই ভাব আপনা আপনি ফুটে উঠবে। আর এই অবস্থায় আপনি সমস্ত দুঃখের পারে চলে যাবেন। এক অপার শান্তি তখন আপনাকে ঘিরে থাকবে। তখন আপনি স্বাধীন, মুক্ত।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।    

ধ্যানময় জীবনই শান্তির পথ, সাফল্যের পথ । (৯) DHYAN, PEACE & SUCCESS IN LIFE - WAY TO  DIVINE LIFE 

শরীরের পরিবর্তন হচ্ছে, মনের পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু আমি আছি। আমার মূলসত্তার কোনো পরিবর্তন নেই। আমি আছি, তাই আমার দেহ আছে, আমার মন আছে।  আমার অবর্তমানে সবই অদৃশ্য, মূল্যহীন, ছায়া মাত্র। আমি আছি, একমাত্র এই উপল্বদ্ধিতেই  মানুষ কৃতকৃত্য  হয়। উপনিষদ বলছেন, যিনি নিজেকে জানেন, আমিকে জানেন, তিনি ব্রহ্মকে জানেন। যিনি ব্রহ্মকে জানেন, তিনি ব্রহ্মই হয়ে যান।  কারন ব্রহ্মই মানুষের আত্মস্বরূপ। "ব্রহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি"। ব্রহ্ম  জ্ঞান যার হয়েছে, তিনিই ব্রহ্ম। 
কল্পনা করুন, আপনার অন্তরের অন্তঃস্থলে, হৃদয়কেন্দ্রে আত্মারূপ এক জ্যোতি বিকিরিত হচ্ছে। প্রথমে এটি কল্পনা করুন। মূলাধারের জাগরণের সময় যেমন বিভিন্ন চক্র সম্পর্কে একটা ধারণা  করে নিয়ে ধ্যান করতে হয়। এরপর একসময়  চক্রের সঠিক অবস্থান কেন্দ্রে একটা কম্পন অনুভূত হয়,  আর আমরা শরীরে চক্রের সঠিক অবস্থান উপলব্ধ করতে পারি। তেমনি হৃদয়কেন্দ্রের জ্যোতির দর্শন পেতে গেলে, প্রথমে আমাদের এই জ্যোতির্ময়ের কল্পনা করে নিতে হয়। 

আমরা কখনোই ভাবি না, এমনকি দৃঢ়ভাবে  বিশ্বাস করি না, যে আমাদের হৃদয়কেন্দ্রে সেই সর্ব্বশক্তিমান বিরাজ করছেন। লোকের কথা শুনে হয়তো একটা ভাসাভাসা ধারণা আছে মাত্র।  তার কারন হচ্ছে যে আমাদের সেই অভিজ্ঞতা কখনো হয় নি।   আর এই অবিশ্বাস, বা অজ্ঞতা আমাদের পরমপুরুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। মহাত্মাগণ বলছেন, আপনি তাঁকে কখনো চান নি, তাই আপনি তাঁকে পান নি। আমরা অজ্ঞানে আচ্ছন্ন। আর এই অজ্ঞানকেই আমরা সত্য বলে ধরে নিয়েছি। শরীরকে যেমন "আমি" ভাবি, যা সত্য নয়। তেমনি অজ্ঞানতা  বসে অহংকে আমরা আত্মা বলে মনে করি। আমাদের বর্তমান চেতন স্তরে আমরা বস্তুত শরীর-মন যুক্ত এক গন্ডিবদ্ধ সত্তা মাত্র  - যা আসলে জন্ম-বৃদ্ধি-ক্ষয়-মৃত্যুর চক্রের মধ্যে আবদ্ধ।  আমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা, শীত-গ্রীষ্ম, সুখ-দুঃখ, নিদ্রা-জাগরণ আমাদেরকে অধীন করে রেখেছে। বর্তমানে, এই অবস্থায় আমরা ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই শরীর  মনের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ  করে রেখেছি।  এখান থেকে আমরা বেরুতে পারি না। এমনকি  আমরা যে এখান থেকে বেরুতে পারি, আমরা যে এইসব ক্ষুধা-তৃষ্ণা, সুখ-দুঃখের মধ্যে আবদ্ধ  নোই, সেই ধারনাই  আমাদের লোপ পেয়ে গেছে। 
কিন্তু কথা হচ্ছে, এখন থেকে বেরুতে গেলে আমাদের কি করতে হবে ?  এখান থেকে বেরুতে গেলে আমাদের উপাসনার মধ্যে মন-প্রাণ ঢেলে দিতে হবে।  ঈশ্বরকে শরণ করতে হবে। তারই ধ্যানের  আশ্রয় নিতে হবে। 

প্রতিনিয়ত উপাসনার মাধ্যমে  আমাদের মনের গভীরে যখন ঈশ্বরবার্তা পৌঁছাতে থাকবে , তখন ধীরে ধীরে আমাদের মনে ঈশ্বরের ছোঁয়া লাগতে শুরু করবে। আর এর ফলে আমাদের অন্তরে ঈশ্বরের কৃপার অনুভব হতে লাগবে।  আমাদের মধ্যে আত্মজ্ঞানের আলো প্রজ্বলিত হতে থাকবে। প্রথমে একটা ক্ষীণ আলোর বিন্দু আমাদের মনশ্চক্ষুতে দেখতে পাবো। প্রথম দিকে এটি কল্পনা দিয়ে শুরু হলেও, এখন আপনি এই আলোর বিন্দু আপনার মনশ্চক্ষুতে দেখতে পারবেন।  সময়ের  সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বর্তমান অহং-চেতনার পরিবর্তন হতে থাকে।  নিজের সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন হতে থেকে। অজ্ঞানরূপ অন্ধকার দূর হতে থাকে। একটা জ্ঞানালোকের স্ফূরণ দেখতে পাওয়া যায়। এবার এই আলোর রেখা  দেখার সঙ্গে সঙ্গে ভাবুন, আপনি নিত্য, শুদ্ধ, মুক্ত এক পবিত্র আত্মা। আপনি কি নন অর্থাৎ আপনি  যে মন নন, আপনি যে শরীর  নন, এই ধরনের নঞৰ্থক চিন্তা করতে যাবেন না।  অর্থাৎ যা নয়, তা চিন্তা করতে যাবেন না।  আপনি সত্যিকারের যা, আপনি নিজেকে তাই ভাবতে শুরু করুন।  বার বার নিজের অন্তরের  মধ্যে একটা শুভ বার্তা পাঠাতে থাকুন, যে আমি এক শুদ্ধ আত্মা।  আমি ঈশ্বরের অংশ। আমি এক শুদ্ধ আত্মা।  আমি ঈশ্বরের অংশ। 

আপনি সেই জ্যোতির ধ্যান করুন, যা আপনার সত্তার গভীরতম প্রদেশ থেকে উৎসারিত হয়ে, আপনার শরীরের প্রতিটি অঙ্গে, অনু-পরমাণুতে, আপনার মনের গভীরে প্রবেশ করছে। ভাবুন, জীবাত্মা আর পরমাত্মার সঙ্গে কোনো প্রভেদ নেই। এই ভাবনা যখন আপনার মনের মধ্যে নিরন্তর চলতে থাকবে, তখন দেখবেন আপনার দেহ-মন-ইন্দ্রিয়ের উর্দ্ধে এক আনন্দময় সত্তার সঙ্গে আপনি একাত্ম বোধ করছেন। আপনি তখন এক অসীমতার উপল্বদ্ধিতে নিজেকে উন্মুক্ত করে ফেলবেন। 

এই  উপলব্ধি, পান্ডিত্য দিয়ে, বা আপনার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বিচার করতে যাবেন না। শুধু ঈশ্বরের অনুসন্ধিৎসু মন, আপনার বিশ্বাস, আপনার ভক্তি এই ধ্রুবসত্যকে আপনার উপলব্ধির  স্তরে নিয়ে আসবে। কেতাবি বিদ্যা দ্বারা এর বিচার করতে যাবেন না। বইপড়া বিদ্যা, বা কারুর কাছে শোনা বিদ্যা এমনকি গুরুমুখে বিদ্যা আপনাকে ঈশ্বর সম্পর্কে একটা পরোক্ষ জ্ঞান এনে দিতে পারে। কিন্তু ঈশ্বরের সন্ধানে যখন আপনার মন ব্যাকুল হয়ে পড়ে, এবং অহংবোধ যখন লুপ্তপ্রায় হয়ে যায়, তখন ঈশ্বরের একটা আভাস উপাসনার ও ধ্যানের মাধ্যমে আপনার হৃদয়ের মধ্যে ফুটে ওঠে।মন তখন ঈশ্বরে নিবদ্ধ হয়। আত্মার জ্যোতি অন্তরের সমস্ত অন্ধকার দূর করে, ঈশ্বরের একটা স্বচ্ছ রূপ প্রকাশিত হয়।  আর এইভাবে নিজেকে ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারলে, আমাদের অহংয়ের  লোপ পায়, আর আমরা আত্মাস্বরূপকে খুঁজে পাই।  হারিয়ে যাওয়া ছেলে খুঁজে পেলে যে আনন্দ হয়, বহুদিন পরে হারিয়ে  যাওয়া মাতা-পিতাকে খুঁজে পাওয়ার যে আনন্দ হয়, তার থেকেও অধিক আনন্দ হয়, এই আত্মস্বরূপের উপল্বদ্ধিতে। তো ধ্যান কোনো কাল্পনিক বিষয় নয়, উপাসনা কোনো আবেগের বিষয় নয়। ধ্যান বিজ্ঞান। উপাসনা নিজেকে উৎসর্গ করবার বিজ্ঞান। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 
 
        




























                        
     
 




    

          

 



 
       


     
       

 

 

   








         

     

            
















Friday 13 August 2021

বীজমন্ত্র বা ঈশ্বরের নামের মাহাত্ম্য (পুনঃমুদ্রন)

বীজমন্ত্র বা ঈশ্বরের নামের মাহাত্ম্য (পুনঃমুদ্রন)

রাম - কৃষ্ণ - শিব - কালী কোথায় থাকেন ? এঁদের সাথে কিভাবে সাক্ষাৎ করা যায় ? আমরা শুনেছি, ঠাকুর রামকৃষ্ণ মাকালীকে সাক্ষাৎ করেছিলেন। আমরা শুনেছি মীরা দেবী শ্রীকৃষ্ণকেই স্বামী বলে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। আমরা জানি ঠাকুর রামপ্রসাদ মায়ের সাথে কথা বলতেন। এসব কি সত্যি ? নাকি স্রেফ পাগলামি, বা স্নায়ুর দুর্বলতা বা বায়ুর দোষ থেকে এমন এমন বিষ্ময়কর বা উদ্ভট ঘটনা ঘটে থাকে।
আমরা যে নাম সংকীর্তন করি, বা বিভিন্ন নাম জপ্ করি, এর উৎস কোথায় ? আমরা কেউ কৃষ্ণ নাম করি, কেউ রাম নাম করি, কেউ শিবের নাম জপ্ করি। কেন করি ? সত্যিই কি এই নাম জপের কোনো গুরুত্ত্ব আছে ? কেউ বলেন, এই নামের মধ্যে ধ্বনির মাহাত্ম আছে । কেউ বলেন, মন্ত্রের অর্থ না বুঝে জপ্ করলে কিছু হয় না। কেউ বলেন, নির্দিষ্ট সংখ্যক জপ্ করলে তবে জপ্ সার্থক হয়। কালী কালী জপলেই কি মা-কালীকে পাওয়া যায় ? বা রাম -কৃষ্ণ-শিব বলে বার বার ডাকাডাকি করলেই সেই দেবতা বা দেবীকে পাওয়া যায় ? আজ আমরা সেই রহস্যঃ বোঝার চেষ্টা করবো।
আমরা সবাই জানি, আমাদের দেহের তিনটি ভাগ। স্থুল -সুক্ষ - কারন। সাধু-মহাত্মারা এটা অনুভূতিলব্ধ জ্ঞানের সাহায্যে উপলব্ধি করেছেন। তাঁরা স্থুল -সুক্ষ -কারন ভেদে দেহের অন্তর-পথকে তিনটি নামে উল্লেখ করেছেন। পিন্ডদেশ, অন্ডদেশ, এবং ব্রহ্মদেশ। আমাদের তিনটি জিনিস প্রধান - দেহ-মন-আত্মা। এছাড়া আছেন, পরমাত্মা। এখন পরমাত্মাকে অনুভব করতে গেলে, এই আত্মাকে দিয়েই অনুভব করা যায়। বিজ্ঞানীরা যেমন কোনো জিনিষকে বিশ্লেষণ করতে গেলে, বস্তূর স্থুলতা থেকে ধীরে ধীরে, সুক্ষ তত্বের দিকে এগিয়ে যান , তেমনি সাধু-মহাত্মারাও স্থুল থেকে সূক্ষ্ম দিকে এগিয়ে যান, সাধনার সাহায্যে। সাধু-মহাত্মারা, মূলাধার ইত্যাদি ছয়টি চক্র সমন্বিত দেবাদিলোককে বলছেন, পিণ্ডদেশ। প্রলয়ে এগুলোর লয় হয়। এর উপরে আছে অন্ডদেশ। এখানেও ছয়টি স্তর আছে। সেগুলো কাল বা সময় দ্বারা রচিত। প্রলয়কালে এগুলোরও লয় হয়। পিন্ড ও অণ্ডদেশের অতীত হচ্ছে ব্রহ্মান্ড। এই ব্রহ্মান্ডদেশ মহাকাল দ্বারা রচিত। এখানেও কিঞ্চিৎ মায়া বর্তমান। এখানেও ছটা স্তর আছে। সাধারণ প্রলয়ে এর লয় হয় না। কিন্তু মহাপ্রলয়ে এর লয় হয়। এই ব্রহ্মান্ড ভূমির অতীত হচ্ছে পরমভূমি, যাকে চৈতন্যভূমি বলা হয়। এখানে মায়ার লেশমাত্র নেই। সাধু-মহাত্মাদের মতে, প্রলয়কালে, এমনকি মহাপ্রলয়কালেও, এই পরমবস্তু ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। সাধু-মহাত্মাদের এখানেই গন্তব্য, এখান থেকেই আমরা আসি, এখানেই রক্ষিত আছে সমস্ত সৃষ্টির বীজ। এখানেই জীবের সত্যিকারের মুক্তি। পিন্ডদেশ : মূলাধার-স্বাধিষ্ঠান-মনিপুর-অনাহত-বিশুদ্ধ-আজ্ঞা ১. মূলাধার চক্র - এর অধিপতি হচ্ছেন শ্রী গনেশ। চতুর্দল পদ্ম ২. স্বাধিষ্ঠান চক্র - এর অধিপতি ব্রহ্মা। ষটদল পদ্ম। ৩. মনিপুর চক্র - এর অধিপতি বিষ্ণু - অষ্টদল পদ্ম। ৪. অনাহত চক্র - দ্বাদশদল পদ্ম - অধিষ্ঠাত্রী দেবী, কালী-দূর্গা ইত্যাদি শক্তি। ৫. বিশুদ্ধচক্র - ষোলো দল পদ্ম - এখানকার অধিপতি হচ্ছেন শিব। ৬. এর উপরের ভূমি আজ্ঞাচক্র - দ্বিদলপদ্ম - এর অধিপতি ব্রহ্ম। এখানে একটা জিনিস খেয়াল করুন, মূলাধারে শ্রীগণেশ। স্বাধিষ্ঠানে ব্রহ্মা, মনিপুরে বিষ্ণু, অনাহতে শক্তির দেবী - কালী-দূর্গা ইত্যাদি, বিশুদ্ধে শিব, এবং আজ্ঞাচক্রে ব্রহ্ম । অর্থাৎ এই শিবভূমির নিচে সমস্ত দেবতাদের অবস্থান বলে শিবকে বলা হয়েছে দেবাদিদেব মহাদেব। মহাদেবের উপরে অর্থাৎ বিশুদ্ধচক্রের উপরে আজ্ঞাচক্র যেটা ব্রহ্ম-ভূমির অন্তর্গত। পিণ্ডদেশের এই ছটা ভূমি অণ্ডদেশের অনুকরণে মায়া রচনা করেছে। যাতে সাধক প্রকৃত তত্ত্বের সন্ধান না পায়। অন্ডদেশ : এবার অণ্ডদেশ সম্পর্কে শুনুন। আসলে অন্ডদেশের অনুকরণেই তৈরী হয়েছে পিন্ডদেশ। অর্থাৎ আমরা আগে যেটা আলোচনা করলাম। এখানে আছে : ১. চতুর্দল কমল : - মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহংকার প্রভৃতির কেন্দ্রবিন্দু। ২. ষটদল কমল : - আমাদের থার্ড আই বা তৃতীয় নেত্রের ঠিক নিচে। এই শক্তিপ্রবাহ থেকেই আমাদের জন্ম, বেঁচেথাকা, বৃদ্ধি, ক্ষয়, ভবিষ্যৎ, এবং মৃত্যুর কাজ পরিচালিত হয়। ৩. অষ্টদল কমল : - আমাদের তৃতীয় নেত্রের মধ্যে অবস্থিত। পঞ্চতত্ব (ক্ষিতি, অপি, তেজ, মরুৎ , ব্যোম ) এবং ত্রিগুণের (সত্ত্বঃ, রজঃ, তমঃ) উৎপত্তি স্থান এটি। ৪. দ্বাদশদল পদ্ম : - এটি সহস্রদল কমলের অন্তর্গত। ৫. ষোলদল পদ্ম - শ্বেত শূন্য - এর প্রতিবিম্ব পিণ্ডদেশের বিশুদ্ধ চক্রে শেতাম্বর শিবস্থানে পড়েছে। ৬. দ্বিদল পদ্ম - এটি ত্রিকুটির নিম্নভাগে। এখানে কালের খেলা। উচ্চতর কেন্দ্রের ঠিক অবিকল চিত্র ফুটে উঠেছে নিম্ন কেন্দ্রে। এইজন্য সাধকরা এখানে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। এখানে অর্থাৎ পিন্ডদেশে এসেই, সাধক মনে করেন, উচ্চকেন্দ্রে অর্থাৎ অন্ডদেশে এসে গেছেন। ব্রহ্মান্ডদেশ : ব্রহ্মান্ডদেশ আজ্ঞাচক্র থেকে সহস্রার চক্রের মধ্যে। এই সহস্রার -ভূমির অধিপতি হচ্ছেন, পরমপুরুষ-নিরঞ্জন পুরুষ। এখান থেকে দশটি ধুন বা নাদ প্রকট হয়েছে। আসল বিষ্ণুভূমি, শিবভূমি, এবং ব্রহ্মভূমি এখানে। অর্থাৎ সহস্রদল পদ্মে এই তিন ভূমি অবস্থান করছে। এর উপরিভাগে আছে পরব্রহ্ম। পিন্ডদেশ ও অণ্ডদেশ হচ্ছে ব্রহ্মান্ড দেশের নকল, যা তৈরি করে রেখেছেন কাল এবং মায়া । কাল ও মায়া মিলে তৈরি করেছেন অন্ডদেশ, আর মায়া তৈরি করেছেন পিন্ডদেশ। সে যাই হোক, পিণ্ডদেশ ও অণ্ডদেশের আসল কেন্দ্র হচ্ছে ব্রহ্মান্ডভূমি। আর এই ব্রহ্মান্ডভূমি থেকে দশটি ধুন বা নাদ অর্থাৎ শব্দ তরঙ্গ বিভিন্ন দেশে এবং বিভিন্ন ভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, পরব্রহ্ম থেকেই সমস্ত নাদের উৎপত্তি। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় এসে, এই শব্দ তরঙ্গ বিভিন্ন ভাবে শ্রুত হচ্ছে, অর্থাৎ শব্দ তরঙ্গ পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন হচ্ছে, পরিবর্তন হচ্ছে তার শক্তিমত্তার । যেমন একই নদী বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধ্বনি উৎপাদন করে থাকে। উৎসে একরকম, পাহাড়ের গায়ে এক রকম, সমতল ভূমিতে একরকম, আবার সমুদ্রের নিকটে আরএক রকম। তাই একই ধ্বনি যখন প্রবাহিত হয়, কালক্রমে তার শক্তি ও পর্যায়ের পরিবর্তন হচ্ছে । আর এই ব্রহ্মান্ডদেশের সর্বোচ্চ ধাম থেকে যে ধ্বনি প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে, তা পিন্ডদেশের মূলাধার পর্য্যন্ত প্রবাহিত হচ্ছে। এবং বিভিন্ন স্তরে এসে তার শক্তি ও তরঙ্গের মাত্রার পরিবর্তন হচ্ছে। ব্রহ্মভূমিতে এটা হচ্ছে রাং বা ক্লিং ( কৃষ্ণের বাঁশির সুর ) দ্বিদলপদ্মে হচ্ছে প্রণব বা ওঙ্কার ( অনাহত নাদ ) ত্রিকূটি মন্ডলে অর্থাৎ ত্রিনয়ন স্থানে বেদের চারি মহাবাক্য রূপে চারিধারার প্রকাশ পাচ্ছে অর্থাৎ জ্ঞানের প্রকাশ । বিশুদ্ধ চক্র - অর্থাৎ শিবভূমিতে এসে বম্ বম্ ববম্ রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। অনাহত চক্রে - এই ধ্বনি হয়ে যাচ্ছে ক্রিং। মূলাধারে - গং গং রূপ পাচ্ছে। আর এই কারণেই আমরা দেখি শ্রীকৃষ্ণের বীজ মন্ত্র হচ্ছে ক্লীং। রামের বীজ মন্ত্র হচ্ছে রাং। ব্রহ্মের বীজ মন্ত্র হচ্ছে ওং বা ওঁ। মাকালীর বীজ মন্ত্র হচ্ছে ক্রীং। শ্রীগণেশের বীজ মন্ত্র হচ্ছে, গং। প্রসঙ্গত একটা কথা বলি, এই যে চক্রগুলোর কথা বলা হয়েছে, যা আমাদের শরীরের মেরুদণ্ডের বিভিন্ন অংশে অবস্থিত। এগুলো আর কিছুই নয়, গ্রন্থিচক্র, অর্থাৎ এই সব জায়গায়, বিভিন্ন গ্রন্থির বিভাগ স্থল। গ্রন্থিগুলো নেবে এসেছে উচ্চ মস্তিস্ক থেকে, এখানে গ্রাহক ও প্রেরক গ্রন্থির বিভাগ স্থল। এবং এই স্থলগুলোর আকার খানিকটা ওই বীজ অক্ষরের মত। অর্থাৎ দেবনাগরী ভাষায় যদি ওই মন্ত্রগুলো লেখা যায়, তা আমাদের গ্রন্থিচক্রের আকারের মতোই হবে। আমাদের ঋষিদের এ এক অদ্ভুত পর্যবেক্ষন। শরীরবিদ্যার বইতেও আজকাল এইসব গ্রন্থিচক্রের কথা লেখা আছে। তাই আমাদের কোনো দেবতাকে পেতে হলে সেই দেবভূমি হতে আগত তরঙ্গের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে হবে। ধ্বনিটা আসল। অর্থাৎ আমি যদি, মা কালীকে বা শক্তিদেবীকে অনুভব করতে চাই, তবে অনাহত চক্রে যে ক্রীং ধ্বনিত হচ্ছে, তার সঙ্গে আমাকে একাত্ম করতে হবে। শুধু মুখে বা মনে মনে মন্ত্র উচ্চারণ করলে হবে না। এই ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে হবে। অর্থাৎ আপনি যদি মাকালীকে পেতে চান তবে অনাহত চক্রে যে ধ্বনি ক্রীং ক্রীং ধ্বনি অনবরত ঝংকৃত হচ্ছে তার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে হবে। এই ধ্বনির তরঙ্গ প্রবাহ আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে মা কালির কাছে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ এই ক্রীং ক্রীং ধ্বনির সঙ্গে বা অনাহত চক্রের ধ্বনির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন বলে, তিনি মাকালীর দর্শন পেয়েছিলেন। ঠিক তেমনি ব্রহ্মান্ডভূমির মন্ত্র হচ্ছে বা ধ্বনি হচ্ছে ক্লীং। যিনি ব্রহ্মান্ডভূমির সঙ্গে বা কৃষ্ণের সঙ্গে যুক্ত হতে চান তাকে এই ব্রহ্মান্ড ভূমির ধ্বনির সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। আবার বিশুদ্ধ চক্রের যে ধ্বনি বম বম, তার সাথে যুক্ত হতে পারলে আপনি শিবময় হয়ে যাবেন। এখন কথা হচ্ছে, আমাদের লক্ষ্য কী হওয়া উচিত ? এইসব দেবদেবীর সাক্ষাৎ করাই কি জীবনের উদ্দেশ্য ? মহাত্মাগণ বলে থাকেন, দেব দেবীর সাক্ষাৎ তীর্থপথের দৃশ্য মাত্র। দেবদেবী হচ্ছেন, বিভিন্ন গুনের আধার মাত্র। দেবদেবী হচ্ছেন ঐশ্বর্যের অধিকারী। দেবদেবী হচ্ছেন, স্বর্গবাসী। অর্থাৎ এই অবস্থায় বা স্বর্গবাসে পরম আনন্দ লাভ করা যায়। কিন্তু এই দেবদেবী গন অর্থাৎ যাঁরা স্বর্গবাসী, তারাও তাদের সঞ্চিত পুন্য-কর্ম্মফল ভোগের শেষে আবার এই মৃত্যুপুরীতেই ফিরে ফিরে আসেন, কর্ম্মফল সঞ্চয়ের জন্য। স্বর্গে কখনো কর্ম্মফল সঞ্চিত হয় না। আসলে আমাদের লক্ষ হওয়া উচিত এই জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি। দেবদেবীর সান্নিধ্য বা দেবদেবীর কৃপা নয়।
আমাদের পিন্ডদেশ থেকে অণ্ডদেশে উত্তরণ করতে হবে নিজেকে এবং তার পরে অণ্ডদেশ থেকে ব্রহ্মান্ডদেশ-এ যেতে হবে। দেবভূমির তুলনায়, পরব্রহ্ম ভূমি অধিকতর চৈতন্যময়। এবং এটাই প্রকৃত অক্ষয় ধাম বা আনন্দ ধাম। এই নির্মল চৈতন্যদেশই আমাদের ইষ্ট , আমাদের মালিক, আমাদের উপাস্য। জীবের এটাই পরম পুরুষার্থ। এখান থেকে যে পবিত্র ধ্বনি উদ্গীত হচ্ছে তার সঙ্গে একাত্ম হতে হবে। এটাই সত্যিকারের নাম বা নামের উদ্দেশ্য, নাম্ জপের উদ্দেশ্য। ওম শান্তি, শান্তি, শান্তিঃ। হরি ওম।

Wednesday 11 August 2021

মন্ত্র-দীক্ষা - সত্যধর্ম ও আমি

মন্ত্র-দীক্ষা - সত্যধর্ম ও আমি

দীক্ষা নেবার জন্য গুরুর খোঁজ করছিলাম। গুরুর খোঁজ না পেয়ে এই প্রবন্ধ লিখতে বসেছি। । আসলে আমার একটা কৌতূহল ছিলো।  শুধু তাই নয় একটা আশ্রয় খুঁজছিলাম। কিন্তু আঙুরফল না পেলে যেমন - "আঙ্গুর ফল টক" - বলে  নিজেকে শান্তনা দেওয়া যায়। তেমনি গুরু না পেয়ে, গুরুমন্ত্র না  পেয়ে, নিজেকে শান্তনা দেবার পথ খুঁজছিলাম। তারই ফল এই প্রবন্ধ। 

বীজ মন্ত্র আর কিছু নয়  ঈশ্বরের গুনকীর্তন, বা  ঈশ্বরের বর্ণনা মাত্র। অথবা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা। এটি খুব কম শব্দে উচ্চারিত হয়। বা একক শব্দে উচ্চারিত হয়। বার বার এই মন্ত্র  উচ্চারণের ফলে শরীরে একটা মৃদু কম্পন অনুভূত হয়। মন্ত্রে তন্ময় হলে চিত্ত ঈশ্বরে নিবদ্ধ হয়। জপ্ করলে  বা বারবার একই মন্ত্র বা বিষয় বারবার উচ্চারিত হলে মন সেই বিষয়ে স্থির হয়। বাহ্যিক সুখ-দুঃখ থেকে, শরীরকে সাম্য অবস্থায় রাখা যায়।

গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন : উপাসনা বা গুনকীর্তন যেমন সাধারণ ভাষায় করা যেতে  পারে, তেমনি বৈজিক ভাষায় করা যেতে পারে। সাধারণ ভাষা অর্থাৎ বাংলা, সংস্কৃত, ইত্যাদি।  আর সব থেকে আদি ভাষা হচ্ছে বৈজিক  ভাষা। ভাষা সৃষ্টির ক্রোম এই রকম - বৈজিক -বৈদিক-সংস্কৃত-প্রাকৃত-বাংলা ইত্যাদি।

গুরুদেব বলছেন বৈজিক ভাষাই  মূল ভাষা। বৈজিক থেকে বৈদিক।  আর বৈদিক থেকে সংস্কৃত,গ্রিক,ল্যাটিন,আরবি, হিব্রু  প্রভৃতি উৎপন্ন হয়েছে। সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত তার পর বাংলার উৎপত্তি হয়েছে। অতএব  ভাষার মূল বা বীজভূত ভাষা হচ্ছে বৈজিক। এই ভাষাতেই জীব, জন্তু, পশু, পাখি কথা বলে। অতএব যদি  বৈজিক ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান থাকে তবে তুমি সবার কথা বুঝতে পারবে, তা সে দেবতার কথাই হোক আর পশু পাখির কথাই  হোক, আর মানুষের কথাই  হোক। বৈজিক ভাষায় উৎকৃষ্ট জ্ঞান থাকলে নিখিল ব্রহ্মান্ডের ভাষা বোঝা যেতে পারে।

বৈজিক  ভাষা হচ্ছে ভাব প্রকাশের সব চেয়ে সংক্ষিপ্ত ভাষা ।  শুধু সংক্ষিপ্ত  শব্দ নয়, বৈজিক ভাষার উচ্চারনে একটা মহৎ গাম্ভীর্য ভাব উৎপন্ন হবে।   গুরুদেব একটা উদাহরণ দিয়ে এটা বুঝিয়েছেন। যেমন ধরো আমাদের বলতে হবে  :

"হে জগদীশ্বর ! তোমার করুনার অন্ত  নেই, তুমি আমাদেরকে  যাবতীয় বিপদ হতে রক্ষা  .করছো এবং তোমার তুল্য মহৎ কেউ নেই. অর্থাৎ তুমি সর্ব জগতের মধ্যে মহিষ্ঠ, তোমাকে প্রণাম করি। "

এই একই কথা সংস্কৃতে বললে অল্প সময়ের মধ্যে বলা যাবে এবং তা হবে :

"অনন্ত-করুনং ব্রহ্ম রক্ষকং ত্বাং নমাম্যহম্"

গুরুদেব বলছেন ভাষার শক্তি দেখুন ; একই কথা সংস্কৃতে উচ্চারণ করলে যে মহান গাম্ভীর্যতা প্রকাশ পায়  তা বাংলায় হয় না।  আবার একই ভাব বা কথা যদি বৈজিক ভাষায় উচ্চারণ করা হয় তা হয়ে যাবে  এই রকম।

"ওঁং ক্রীং নমঃ"

 তাহলে দেখছেন বৈজিক ভাষা, বা  বীজ মন্ত্রের ভাষা কতটা সংক্ষিপ্ত ও গাম্ভীর্যপূর্ণ।

বৈজিক ভাষার আরো কিছু মন্ত্র অর্থ সহ বলছি :

হৌং  :  হ্ = শিব, ঔ=সদাশিব, ং=দুঃখহরণ ; সর্বদা মঙ্গলকারী শিব আমার দুঃখ হরণ  করুন।

দূঁ : দ্ = দুর্গা , ঊ = রক্ষা, ঁ = কর : হে জগৎ জননী দুর্গে ! আমাকে রক্ষা করো।

ক্রীঁ : ক্ = কালী , র্= ব্রহ্ম, ঈ = মহামায়া, ঁ = দুঃখ হরণ  : মহামায়া ব্রহ্মস্বরূপ জগৎ জননী কালী আমার দুঃখ হরণ  করুন।
গং :  গ = গনেশ , ং = দুঃখ হরণ।  গনেশ দুঃখ হরণ করুন।

ক্লীং : ক = কামদেব বা কৃষ্ণ  ল =  ইন্দ্র বা ঐশ্বর্য্যশালী , ঈ = তুষ্টি , ং = দুঃখ হরণ  : হে  ঐশ্বর্য্যশালী কামদেব বা কৃষ্ণ আমার তুষ্টি বিধান করুন, দুঃখ হরণ করুন।

এই রকম আরো বীজ মন্ত্র আছে : যেমন

হ্রীঁ - মহাদেবের শক্তি মহামায়া জগৎ জননী দুঃখ হর্ন করুন
শ্রীঁ - পরমেশ্বরী মহালক্ষ্মী আমাদের ধন ও পরম সন্তোষ প্রদান করুন এবং আমার দুঃখ হরণ  করুন।
ঐং - সরস্বতী দুঃখ হরণ  করুন।
হূঁ - মহাদেব যার ভৈরব, সেই পরমেশ্বরী আমার দুঃখ হরণ  করুন ।
স্ত্রীঁ - জগৎ জননী মহামায়া মোক্ষদা দুর্গোত্তারিণী তাঁরা আমার দুঃখ হরণ  করুন।

দ্রব্যের যেমন গুন্ বা শক্তি আছে, শব্দেরও তেমনি শক্তি আছে। ভালো সুর শুনলে আমাদের মন মোহিত হয়। আবার বাজির শব্দে বা বজ্রের শব্দে আমাদের মন চমকে ওঠে।
শব্দ দুই রকম : ধ্বনি ও বর্ণ। ধ্বনি অর্থবহ নয়। যেমন বিভিন্ন বাজনা। বজ্রের ধ্বনি। মেঘের ডাক। ইত্যাদি।
বর্ণ কিন্তু অর্থবহ। মানুষ এই বর্ণের সাহায্যেই কথা বলে।  তাই অর্থবহ। বর্ণ দুই প্রকার ব্যঞ্জন  বর্ণ ও স্বরবর্ণ। আমাদের মুনি ঋষিরা ধ্বনি ও শব্দের উভয়ের মাহাত্য দিয়েছেন। বেদে  ধ্বনির মাহাত্য।  এইজন্য বেদের সূক্ত বা শ্লোকের উচ্চারণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে।  এই জন্য এঁকে শ্রূতি   বিদ্যা বলা হয়েছে।
ধ্বনির সাথে সাথে বর্ণগুলিকে অর্থাৎ অ, আ - ক খ ইত্যাদি বর্নকে পর্যালোচনা করে, মুনি ঋষিরা  দেবতাবিশেষের জন্য বিশেষ বীজ মন্ত্র নির্দ্ধারণ করে গেছেন।

বীজমন্ত্র সঠিক ভাবে উচ্চারণ করা আবশ্যক। যেহেতু উচ্চারণ  বই পড়ে শেখা যায় না, তাই গুরুর কাছ থেকে এটা  শিখে নিতে হয়। তাই দেখবেন গুরু বীজমন্ত্র সবসময়  কানের কাছে মুখ নিয়ে উচ্চারণ করেন । এর সঠিক উচ্চারণ গুরুই শিখিয়ে দেন। তাই বীজ মন্ত্র গুরুপ্রদত্ত।

মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন : বৈজিক  ভাষা সাধারণকে  শেখানোর অনুমতি পান নি। আর তা ছাড়া  এই ভাষা আমরা শেখবার যোগ্য নোই, তাই গুরুদেব এই ভাষার সম্পর্কে বিশেষ কিছু শেখান নি। ওনার বই পড়ে আমার মনে হয়েছে গুরুদেব এই ভাষা জানতেন। অর্থাৎ তিনি জগতের সবার সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে পারতেন, তাদের ভাষা বা কথা বা ভাব বুঝতে পারতেন। এটা আমার কাছে বিস্ময়ের কিন্তু অবিশ্বাসের নয়।

গুরুদেব বলছেন : বৈজিক ভাষা উচ্চারনে (ভাব বিনিময়) যেরূপ সম্পূর্ণ হয়, অন্য কোনো ভাষায় তদ্রুপ হয় না। বৈজিক ভাষাই পূর্ণ ভাষা। বৈজিক ভাষায় নিখিল ভাষার মাতা-পিতা। বৈজিক ভাষাই সার্বভৌম, ও সর্বজীবের ভাষা। একারনে উন্নত মহাত্মারা এই অতি মহীয়সী ভাষায় যে সকল বীজ প্রদান করেন, তার উচ্চারণেই  অভিপ্রেত সিদ্ধি সম্পূর্ণ রূপে হয়ে থাকে। বীজ বিশেষের উচ্চারণে ভক্তি, একাগ্রতা বৃদ্ধিও হয়ে থাকে।

এখন এই বীজমন্ত্র উচ্চারণে আমাদের কি ভাবে উপকার হয়, সেই সম্পর্কে আলোচনা করবো।

গুরুদেব এক জায়গায় বলছেন :

মেরুদণ্ডের দুইদিকে ইড়া ও পিঙ্গলা নাম দুইটি নাড়ী আছে। এই ইড়ার দক্ষিণে ও পিঙ্গলার বামে অর্থাৎ ইড়া-পিঙ্গলার মাঝখানে সুষুম্না নাড়ী অবস্থান করছে। সুষুম্নার মধ্যে আবার বজ্রাখ্যা নাড়ী ও তার মধ্যে চিত্রিণী নাড়ী অবস্থান করছে। এর মধ্যে সাতটি স্থানে গ্রন্থি আছে।

মূলাধার -  পায়ুদেশের কিঞ্চিৎ উর্দ্ধ ভাগে।
স্বাধিষ্ঠান -  লিঙ্গমূলে
মনিপুর - নাভিমূলে
অনাহত - হৃদয়ে
বিশুদ্ধ -  কণ্ঠদেশে
আজ্ঞা - ভ্রূমধ্যে
সহস্রদল / সহস্রার -  মস্তকে

গুরুদেব যে জায়গার কথা বলছেন তার ঠিক বিপরীতে মেরুদণ্ডের মধ্যে এর অবস্থান। এইগুলোকে বলা হয় চক্র। এই সব চক্রের একটা করে  জাগরণ মন্ত্র  আছে।  গুরুদেব বলছেন এই মন্ত্রগুলো বৈজিক ভাষায় উচ্চারিত হয়। মন্ত্রগুলো হচ্ছে :

মূলাধার -  পায়ুদেশের কিঞ্চিৎ উর্দ্ধ ভাগে।  মন্ত্র - লং
স্বাধিষ্ঠান -  লিঙ্গমূলে  মন্ত্র - ৰং
মনিপুর - নাভিমূলে  মন্ত্র - রং
অনাহত - হৃদয়ে  মন্ত্র - যং (য়ং)
বিশুদ্ধ -  কণ্ঠদেশে  মন্ত্র - হং
আজ্ঞা - ভ্রূমধ্যে  মন্ত্র - ওংঁ (এটি আসলে মস্তিষ্কের মধ্যে -ভ্রূ সোজা কান বরাবর )
সহস্রদল / সহস্রার -  মস্তকে  মন্ত্র - সোহং  (ঠিক তালুর নিচে)

পণ্ডিত শ্রীরাম শর্মা আচার্য যিনি হরিদ্বারের শান্তিকুঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা বলছেন, :শরীর ও মনের মাঝে বিভিন্ন চক্র, গ্রন্থি ভেদ ও উপত্যকায় বিভিন্ন দিব্য  ক্ষমতা বিদ্যমান রয়েছে। সেগুলিকে জাগিয়ে তোলা গেলে অতীন্দ্রিয় - অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করা যায়। আমাদের মুখকে অগ্নিচক্র বলা হয়। মুখের আর এক নাম যজ্ঞকুন্ড।  এখানেই স্থুল রূপে পরিপাক, সুক্ষরূপে উচ্চারণ, ও কারন রূপে চেতনার দিব্য  প্রবাহ উৎপন্ন করার কাজ হয়। এখানেই আহত শব্দ উচ্চারিত হয়।  যা আমাদের তথ্য বিনিময় শুধু নয়  ভাব বিনিময়, সংবেদনশীলতার বিনিময়,প্রেরণার বিনিময় এবং শক্তির বিনিময় হয়ে থাকে। এজন্যই আমরা কোনো কথায় তথ্য পাই, কোনো কাঠি অন্যের মনের ভাব বুঝতে পারি। এবং আমার ভিতরে সংবেদনশীল হয়। বক্তার কথাতে বা তার শব্দ বা ধ্বনির  উচ্চারণের সাথে সাথে আমাদের অর্থাৎ শ্রোতার ভিতরে পরিবর্তন হয়। তাই আমরা কোনো কাঠি রেগে যাই, কোনো কথায় দুঃখ পাই, কোনো কথায়  আনন্দ পাই। কথা আমাদের বিচার ধারাকে বদলে দিতে পারে। আমাকে শক্তিহীন, ভীত, সাহসী করে দিতে পারে। কথাতেই মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব, শত্রুতা তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ আমাদের চেতনসত্বার মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

জপ্ যোগে এই শব্দশক্তির সর্বোচ্চম প্রভাব পরে । এর প্রভাবে সাধকের দেহে মনে এমন আলোড়ন সৃষ্টি করে যা অসীম আকাশে ব্যাপ্ত হয়ে আমাদের পরিবেশকে প্রভাবিত করে।

তাই মন্ত্র  চয়নে আমাদের মুনি ঋষিরা অর্থের থেকে ধ্বনির উপরে জোর দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে বলি গায়েত্রী মন্ত্র যা এখন রাস্তা ঘাটে শোনা যায়। এই একই ভাব কিন্তু অন্য্ ভাষা বা অন্য্ শব্দ চয়নে করা যে পারতো। কিন্তু উচ্চারণের তারতম্যের জন্য তার প্রভাব এতটা ফলপ্রসূ হতো না। অবশ্য এখন আর গায়েত্রী মন্ত্রের সেই তেজ দেখতে পাই না, তার কারন গায়েত্রী, মন্ত্রের সঠিক উচ্চারণ হয় না। এই উচ্চারণ শেখার জন্যই  উপযুক্ত গুরুকরন দরকার। 

হঠযোগীরা বলছেন : "শরীরামদ্যং খলু  ধর্মসাধনম্" . শরীরই সমস্ত সাধনার ভিত্তিভূমি। এই শরীর সুস্থ না থাকলে আপনার দ্বারা কোনো সাধনাই  হবে না। তা সে সূক্ষ্ম জগতের সাধনায় বলুন আর স্থুল জগতের সাধনায় বলুন। দেহটাই যন্ত্র।  আর দেহকে ধারণ করে আছেন আত্মারূপী যন্ত্রী। এই দেহই বলুন আর দেহে স্থিত মন, বুদ্ধি, অহংকার এগুলো আত্মার বিভূতি বা শক্তি। এই শক্তির খেলাই  চলছে নিরন্তর দেহ যন্ত্রের মধ্যে। দেহযন্ত্র ভালো বা শুদ্ধ থাকলে - এটা  হবে দেবভূমি।  আর দেহযন্ত্র ত্রূটি যুক্ত হলে হবে অসুরভূমি। এখন তোমার দেহকে দেবভূমি বানাবে না অসুরভূমি বানাবে তা তোমার উপরে। দেখো তোমার যদি ঠিকমতো হজম না হয়, অর্থাৎ তোমার দেহের যকৃতের ক্রিয়া যদি ঠিক না থাকে তবে তোমার মেজাজ খিটখিটে হবে।  তোমার সেক্স-গ্লান্ডসেক্স-(Sex gland)  বা পিতৃগ্রন্থি যদি ঠিক না থাকে তবে তুমি স্বার্থপর এবং কামুক হয়ে যাবে। তোমার থাইমাস (thymus ) বা মঙ্গলগ্রন্থি যদি ঠিক না থাকে তবে তুমি চোর-ডাকাত-বদমায়েশ হবে। শিবসতী গ্রন্থি  (Pituitary ) যদি ঠিক না থাকে তবে মানুষ ছোট্টমনের মানুষ হয়। পরের দোষ  দেখে বেড়ায়। ঘুষখোর হয়।

আসলে কোনো মানুষই খারাপ হয়ে জন্মায় না। সবার অন্তরে ভাগবত সত্ত্বা বিরাজ করছে। কিন্তু খাদ্যদোষে হোক আর প্রাকৃতিক কারণে হোক আমাদের শরীরে, রোগ বাসা বাঁধে। অর্থাৎ বিভিন্ন গ্রন্থির কাজ ঠিক ঠিক মতো হয় না। কোনো কোনো গ্রন্থি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। গ্রন্থির ক্রিয়া দোষযুক্ত হলে আমাদের মধ্যে কুচিন্তা ও কু  কাজ করবার প্রবৃত্তি জেগে ওঠে। তাই আমরা মানুষে মানুষে পার্থক্য দেখতে পাই। খেয়াল করবেন, মাংসাশী প্রাণী প্রায়শঃ হিংস্র হয়। তৃণভোজী প্রাণী নিরীহ হয়। দেহ শুদ্ধ হলে মন শুদ্ধ হবে। মন যার শুদ্ধ সে সর্বদা আত্মাস্বরূপে অবস্থান করে।  আনন্দে থাকে। পরহিতে নিযুক্ত থাকে।

হঠযোগীরা বলছেন আমাদের শরীরের ইড়া-পিঙ্গলার উপরে আধিপত্য বিস্তার করতে পারলে চিরদিন যেমন ব্যাধিমুক্ত থাকা যায় তেমনি মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। আত্মার আনন্দময় স্বরূপ, অনন্ত  স্বরূপ, আমরা আস্বাদন করতে পারি। এখন কথা হচ্ছে, এর সঙ্গে গুরুমন্ত্রের কি সম্পর্ক ?

মন্ত্র  হচ্ছে তরঙ্গ উৎপাদনের কারন। আমরা যখন শব্দ বলি বা ধ্বনির সৃষ্টি করি তা সে যে ভাবেই হোক, তা একটা বিশেষ তরঙ্গ সৃষ্টি করে। তরঙ্গই রূপ নেয়। যার জন্য বলা হয় সৃষ্টির আদি হচ্ছে প্রণব। প্রণব কথাটার মানে হচ্ছে নব নব রূপ পরিগ্রহ। আদি ধ্বনি ওঁম থেকেই সমস্ত সৃষ্টি। কাঁসর ঘন্টা, শঙ্খের  ধ্বনি ইত্যাদি প্রণব পুত।  তাই এই ধ্বনি শুভ ও মঙ্গলময় সৃষ্টির আদি। এখন এই বিশেষ ধ্বনি যে তরঙ্গের সৃষ্টি করে তা আমাদের শরীরের বিভিন্ন চক্রে  আঘাত করে, এবং সেখানে স্পন্দন তোলে, তাকে চঞ্চল করে তোলে, এবং ক্রিয়াশীল করে তোলে। বিশেষ বিশেষ ধ্বনি আমাদের বিশেষ বিশেষ জায়গায় বা গ্রন্থিতে আলোড়ন তোলার  সক্রিয় ভূমিকা নেয়। আর ওই গ্রন্থি যখন ক্রিয়াশীল হয়ে যায়, তখনি আজব ব্যাপার সংগঠিত হয়। মানুষের চিন্তা ধারার পরিবর্তন হয়। বিচারাধারার পরিবর্তন হয়। কর্মধারার পরিবর্তন হয়। মানুষ পাশবিক প্রবৃত্তি ত্যাগ করে, দেবমানব হয়ে যায়। এইখানেই মন্ত্রের কারিকুরি। প্রতিনিয়ত যখন বীজমন্ত্র জপ্ করছেন তখন আপনার  সমস্ত চক্র (১১৪) ক্রিয়াশীল হতে পারে। ১১৪টি চক্রের মধ্যে ১০৮টি চক্র ক্রিয়াশীল করা যায়। বাকি ছয়টি ক্রিয়াশীল হয় না। কিন্তু মাত্র ৭টি চক্র বা ১১টি স্পর্শকাতর জায়গায় আমরা যারা সাধারণ মানুষ, একটু চেষ্টা করলেই সেগুলিকে ক্রিয়াশীল করতে পারি।

এই এগারোটি জায়গা হচ্ছে :

মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধি, আজ্ঞা, সহস্রার, বিন্দু,  ভ্রূযুগল মধ্যে,নাসিকাগ্র এবং চিদাকাশ অর্থাৎ চোখ বুজলে যেখানে আমরা অন্ধকার দেখি । এগুলোর মধ্যে ৭টির জন্য বিশেষ মন্ত্র  আছে। যেমন
মূলাধারের জন্য লং, স্বাধিষ্ঠানের জন্য ৰং,মনিপুরের জন্য রং, অনাহতের জন্য যং (ইয়ং), বিশুদ্ধির জন্য হং, আজ্ঞাচক্রের জন্য ওং এবং সহস্রারের জন্য সোহং। এই মংত্র বা ধনীর সাহায্যে এই চক্র বা গ্রন্থিগুলিকে ক্রিয়াশীল করা যায়।

এখন এগুলোকে ক্রিয়াশীল করলে কি হয় ?

আমরা জানি সমগ্র ব্রহ্মান্ড সাতটি  লোক বা স্তরে  বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে : ভূ-লোক,ভুব-লোক,স্বঃ-লোক,মহঃ-লোক, জনঃ-লোক, তপঃ-লোক, এবং সত্যম বা  সত্য-লোক। আমাদের শরীরের মধ্যেও সপ্ত ধাতু আছে যেমন : শুক্র,শোনিত, মজ্জা, মেদ, মাংস, অস্তি , ত্বক। এই দেহের এক একটা স্থান এক একটা লোকের কর্ম কেন্দ্র। এই কর্মকেন্দ্রের নামই চক্র বা গ্রন্থি। এই গ্রন্থিগুলো বা এক একটা গ্রন্থি এক এক তত্ত্বের কর্ম কেন্ত্র।তত্ত্ব অর্থাৎ পঞ্চতত্ত্ব - ক্ষিতি, অপ, তেজ.মরুৎ , ব্যোম।  দেহের প্রধান প্রধান গ্রন্থি গুলির অন্তর্মুখী রস  নিঃসরণের ক্ষমতা আছে। এই অন্তর্মুখী রসই রক্তের সঙ্গে মিশে দেহের গঠন ও পালনপোষন করে। এমনকি মানসিক জীবন  বা মন গঠন করে। যার দেহে যে গ্রন্থির আধিপত্য বেশি বা যার দেহে যে গ্রন্থি অধিক ক্রিয়াশীল, তাকে সেই গ্রন্থিপ্রধান মানুষ বলা হয়।

যদিও সমস্ত গ্রন্থিই আলাদা আলাদা ভাবে সারা শরীরে ক্রিয়াশীল। তথাপি এক এক গ্রন্থির এক একটি প্রধান কার্যকেন্দ্র  আছে। এগুলো এই রকম :

কণ্ঠদেশে থেকে ললাটের মধ্যবর্তী অংশ   আকাশ তত্ত্বের কাজ করে। অর্থাৎ ব্যোম গ্রন্থি বলা যেতে পারে। এটি বিশুদ্ধি চক্রের স্থান।
এখানেই  ইন্দ্রগ্রন্থি ( THYROID) উপেন্দ্রগ্রন্থি (Para-Thyroid ), তালুগ্রন্থি (Tonsil ),  লালা গ্রন্থি (Salivary Glands ) ইত্যাদির  । এখান থেকেই যে অন্তর্মুখী রস  নিঃসৃত হয় আমাদেরকে সুস্থ থাকতে  সাহায্য করে।  এই গ্রন্থিগুলি  সুস্থ-সবল থাকলে - আমাদের স্নেহ, প্রীতি, ভালোবাসা, উচ্চ চিন্তা বা গভীর চিন্তা করার ক্ষমতা থাকে। আর গ্রন্থিগুলি  অতি সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে আমাদের বিষাদ, উচ্চ চিন্তার ক্ষমতা হ্রাস, হতদ্যম, আলস্য, কর্মবিমুখতা প্রভৃতি দেখা দেয়। ব্যোম তত্ত্বে সত্ত্বগুণের আধিপত্য। 

এখানে একটা কথা বলা প্রয়জন :: এই অন্তর্মুখী রস, অর্থাৎ প্রত্যেক চক্র বা গ্রন্থি  থেকে নিঃসৃত অন্তর্মুখী রসের সুক্ষ অংশ থেকে মন গঠিত হয়। এই কথাটা আর একবার একটু খেয়াল করুন - গ্রন্থি বা  চক্র থেকে  নির্গত অন্তর্মুখী রস আমাদের মনের গঠন করে।

এর পরে আসছে বক্ষ প্রদেশ।  এটি বায়ুতত্বের প্রধান কর্মকেন্দ্র। এখানে দুটো ফুসফুস, হৃদযন্ত্র, মঙ্গলগ্রন্থি (thymus ) এবং প্রাণকোষ নির্মাণকারী গ্রন্থি এবং অনেকগুলো উপগ্রন্থি এই বায়ু গ্রন্থির অন্তর্গত। বায়ুই দেহের প্রধান রক্ষক ও পরিচালক।

এই বায়ু গ্রন্থি ও তার তার অন্তর্গত গ্রন্থিগুলি সুস্থ-সবল থাকলে একদিকে যেমন দেহ সুস্থ থাকে তেমনি এই গ্রন্থিই মানুষকে ধীর-স্থির, শুদ্ধ-শান্ত, শ্রদ্ধাশীল, ও মহাকর্মী। বায়ু ঠিকমতো কাজ না করলে মানুষ অস্থিরমতি, অকৃতজ্ঞ, কৃতঘ্ন হয়।

এর পরে আসছে মধ্যপ্রদেশ অর্থাৎ পেট। এটি অগ্নিগ্রন্থির  অন্তর্গত। এখানে কি আছে এক বার দেখে নেই। প্লীহা,(Spleen ) যকৃৎ(liver ) অগ্ন্যাশয় (Pancreas ) শুক্রগ্রন্থি (Adrenal Gland )  প্রভৃতি গ্রন্থি অগ্নিগ্রন্থির প্রধান কর্মক্ষেত্র। অগ্নিগ্রন্থিই শরীরে তাপ প্রদান করে। প্রাণকে সঞ্জীবিত রাখে। এই অগ্নিগ্রন্থি থেকে যে রস  নিঃসৃত হয় তা Nitric Acid , Hydrochloric Acid, Sulphuric Acid প্রভৃতি দাহিকাশক্তি সম্পন্ন উপাদানের সমাহার। এই অগ্নিরসই পাচকরস, পিত্তরস, অম্লরস। এই অগ্নিরস অন্নকে দগ্ধ করে রসরক্তে পরিণত করে। দেহের মাংস মেদ অস্থি প্রভৃতি গঠনে সহায়তা করে।

এই অগ্নিপ্রধান লোকেরাই হয় মহাতেজস্বী, উদ্দমী  হয়।  নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা থাকে এঁদের। আর এই গ্রন্থি যদি ঠিক ঠিক মতো কাজ না করে তবে তারা হয় কামুক, ঝগড়ুটে, দাম্ভিক, অহংকারী, উগ্র, অস্থির, অসহিষ্ণু।

এর পরে আসছে নিম্নাঙ্গ। অর্থাৎ মূত্রগ্রন্থি,(kidney ), প্রজাপতি গ্রন্থি বা পিতৃগ্রন্থি (Testis ) কন্দর্প-গ্রন্থি (Prostate gland ), মদনগ্রন্থি (cowpers Gland ), মাতৃ গ্রন্থি (Ovary ) রতি গ্রন্থি,(Bartholins gland)  মিথুন  গ্রন্থি (Skenes gland ) . এগুলো সবই  বরুন গ্রন্থির অন্তর্গত। এই বরুণগ্রন্থির নিঃসৃত অন্তর্মুখী রসে সন্তান বীজ বা শুক্রকীট উৎপন্ন হয় ও সৃষ্টিধারাকে অব্যাহত রাখে। এই শুক্র হতেই দেহের সমস্ত উপাদান অর্থাৎ স্নায়ু, তন্তু  কোষ, মাংস, মজ্জা, অস্থি সমস্তই গড়ে ওঠে। বরুণগ্রন্থি হতে নিঃসৃত রসকে বলা হয় সোমরস।

ব্রুনগ্রন্থি প্রধান লোকেরা খুব সহৃদয় হয়। এদের মিষ্টি ব্যবহার, মিষ্টি কথা মানুষকে আকর্ষণ করে। এরা বৈষয়িক প্রতিষ্ঠা পায়। বারুণগ্রন্থি  ঠিক ঠিক মতো কাজ না করলে মানুষ স্বার্থপর, পরশ্রীকাতর, ক্রোধী ও কামুক হয়।

পৃথ্বি গ্রন্থি অস্তি ও মাংস উপাদানের কারন ক্ষেত্রে। পৃথ্বি গ্রন্থির শক্তি ও তার প্রকাশ সুপ্ত।
পৃথ্বি গ্রন্থিপ্রধান লোকেরা স্থুলদেহী হয়।  স্বভাব হয় উদার,ও সহিষ্ণু। এরা  সাধারণত ঝামেলা এড়িয়ে চলে। এই গ্রন্থির অসামাঞ্জস্যে মানুষ হয় ভোগী স্বার্থপর।

আধুনিক বিজ্ঞান  বলছে  : স্নায়ুতন্ত্র বা nurvas system আমাদের বাহির জগৎ ও অন্তর্জগতের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে।   এই স্নায়ুতন্ত্র গঠিত হয় স্নায়ু তন্তু অর্থাৎ সুতোর fibre-এর   মতো একপ্রকার পদার্থ দিয়ে। তন্তু গুলো বিভিন্ন আকারের হয়। সরু, মাঝারি,পাতলা। কর্ম অনুসারে এরা  তিন ধরনের হয়।  প্রথম গ্রাহক বা receptor, দুই প্রেরক বা বাহক conductor (Neurone ) এবং তিন কারক বা effector . এই তিন রকম কাজের সাহায্যে স্নায়ুতন্ত্র আমাদের অন্তর্জগৎ ও বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।

 আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি  অর্থাৎ চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিব্বা, ত্বক, এই  পাঁচটি ইন্দ্রিয় এবং দেহের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত গ্রাহক কোষগুলি বাইরের জগতের উদ্দীপনা বা ভৌত বা রাসায়নিক পরিবর্তন গ্রহণ করে। এইবার গৃহীত উদ্দীপনা সংবেদ স্নায়ু বা বাহক স্নায়ুর মাধ্যমে স্নায়ুকেন্ত্র অর্থাৎ মস্তিস্ক বা সুষুম্নাকাণ্ডে পাঠিয়ে দেয়।

এইবার মস্তিস্ক বা সুষুম্নাকাণ্ড অর্থাৎ স্নায়ু কেন্দ্র এই উদ্দীপনার বিশ্লেষণ করে এবং ক্রিয়া স্থান বা কারকে অর্থাৎ effective organ- এ বাহকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। 

এইবার স্নায়ু কেন্দ্র থেকে গৃহীত আদেশ অনুসারে ক্রিয়াস্থান বা কারকে কার্য সম্পাদিত হয়।

অতএব আমাদের কাছে একটা জিনিস পরিষ্কার : মস্তিস্ক হচ্ছে স্নায়ু কেন্দ্র।  এবং এখানেই সুষুম্না অর্থাৎ স্নায়ুতন্ত্রের প্রধান, এবং  এখান থেকেই বাহক তন্তুর সাহায্যে  সমস্ত নির্দেশ পাঠাচ্ছে। এবং সেই মত আমরা কাজ করছি বা আমাদের কার্য সম্পাদিত হচ্ছে।

আধুনিক বিজ্ঞান বলছে,  সুষুম্নাকাণ্ডের উভয়পার্শ্বে বিভিন্ন স্থান থেকে একাধিক স্নায়ু নির্গত হয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। এগুলো সবই জোড়া জোড়া। সাধারনতঃ এর মধ্যে একটি গ্রাহক অন্যটি বাহক হিসেবে কাজ করে। এই রকম ৩১ জোড়া স্নায়ু সুষুম্না থেকে নির্গত হয়েছে। এই যে ৩১ জোড়া স্নায়ু এর মধ্যে 

আট জোড়া স্নায়ু  গ্রীবা (survical ) থেকে অর্থাৎ কন্ঠের পিছনে অবস্থিত সুষুম্না নারি  থেকে নির্গত হয়েছে।  যাকে মুনি ঋষিরা বলছেন বিশুদ্ধ চক্র। 
বারো জোড়া স্নায়ু  বক্ষ (Thoractic) থেকে অর্থাৎ বুকের পিছনের সুষুম্না নারি থেকে বের হয়েছে।  যাকে ঋষিরা বলছেন অনাহত চক্র। 
পাঁচ জোড়া স্নায়ু কটিদেশ (Lumber)  বা নাভির বিপরীতে সুষুম্না নারি থেকে নির্গত হয়েছে।
যাকে সাধকরা বলছেন মনিপুর চক্র। 
আরো পাঁচজোড়া স্নায়ু নির্গত হয়েছে শ্রোণীদেশ (Sacral ) বা লিঙ্গমূল থেকে। যাকে  সাধকরা বলছেন স্বাধিষ্ঠান চক্র। 
আর একজোড়া স্নায়ু নির্গত হয়েছে পুচ্ছদেশ (Coceygeal) যাকে  ঋষিরা বলেছেন মূলাধার। 

ভাবতে অবাক লাগে, হাজার হাজার বাছারের পুরাতন ঋষিবিদ্যা কতটা বৈজ্ঞনিক সত্য ছিল। ১৯৫৬ এর আগে এগুলো নাকি কেউ পাশ্চ্য়ত্বে জ্ঞাত ছিল  না।         

অহং গ্রন্থি বা অহং তত্ত্বের স্থান ললাট বা আমাদের কপাল।  এই অহং গ্রন্থি আমাদের সমস্ত গ্রন্থির অর্থাৎ পঞ্চগ্রন্থির (ক্ষিতি, অপি, তেজ, মরুৎ, ব্যোম)  কর্তৃত্ব করে। আমাদের দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, চিন্তাশক্তি,বিচারশক্তি, স্মৃতিশক্তি, সমস্ত কিছুই অর্থাৎ পঞ্চইন্দ্রিয়শক্তির  (চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিব্বা, ত্বক) কর্ম পরিচালনা হয় এই অহং গ্রন্থি থেকে। এদের দোষ, ত্রূটি, দুর্বলতা সবই  যথাসাধ্য সংশোধন করে এই অহংগ্রন্থি।

এই অহংগ্রন্থি প্রধান লোকের ভিতর থেকেই বেরিয়ে আসে উচ্চ প্রতিভা, সাধু-মহাত্মা।  এই
অহংগ্রন্থি ক্রিয়াশীল না থাকলে দেখা দেয় হৃদয়হীনতা, নিচটা, দুসটুবুদ্ধি।

মহৎগ্রন্থি আমাদের ললাটের উপরে। অর্থাৎ অহংগ্রন্থির কিঞ্চিৎ উপরে অবস্থিত। এরই মধ্যে আছে সমগ্রন্থি,দেবক্ষগ্রন্থি (Pineal Gland ), রুদ্র গ্রন্থি, সহস্রার গ্রন্থি  প্রভৃতি। এই মহৎ গ্রন্থির অন্তর্মুখী রসের নাম সোমধারা। এই সমধারাই মাথা থেকে নেবে দেহের সমস্ত গ্রন্থিকে, সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ-সবল ও প্রাণবন্ত রাখতে সাহায্য করে।

এই মহৎ গ্রন্থি প্রধান লোকই মহাপুরুষ, অবতার রূপে পূজিত হন। পৃথিবীতে এঁরাই নরোত্তম। ভগবৎ প্রাপ্তির অপার্থিব অনাবিল আনন্দ এঁরাই আস্বাদন করেন।

মহৎগ্রন্থির ঠিক উপরে আছে ব্রহ্মরন্ধ্র, যা আমাদের দেহাকাশ ও দিব্যাকাশকে  যুক্ত রেখেছে। এই ব্রহ্ম বা সহস্রার প্রদেশেই চেতনার অনন্ত পারাবার, এই প্রদেশে গুণাতীত ভূমি। একেই কেউ বলে কৈলাস, পরমশিব ও পরমাশক্তির অধিষ্ঠান ভূমি।

গ্রন্থিকথা এবার শেষ করবো। এই গ্রন্থিস্রাব বা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালা আমাদের জীবন, আমাদের ব্যক্তিত্ব, আমাদের মন, আমাদের স্বভাব নিয়ন্ত্রিন করছে । জানিনা সম্পূর্ণরূপে এর নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি না। তবে এটা  ঠিক এই  ব্রহ্মান্ড বায়ু, অগ্নি, ও বরুন  দ্বারা লালিত হচ্ছেন, তেমনি এঁরা  কুপিত হলে, সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের দেহে অবস্থিত এই বায়ু,অর্থাৎ প্রাণক্রিয়া, অগ্নি দেহের তাপ  রক্ষা  ও জল অর্থাৎ রস রক্ত এর দেহের পালন হচ্ছে।  দেহের পুষ্টি সাধন হচ্ছে। এই তিন দেবতার প্রকোপেই দেহ অসুস্থ হয়, আমাদের মৃত্যু ঘটে।

প্রসঙ্গত বলি : ভূত তো পাঁচটি। তবে তিনটি ভূতের কথা হচ্ছে  কেন  ? আসলে  অতিসূক্ষ্ম আকাশভূতের ক্রিয়া আমাদের ইন্দ্রিয় গোচর হয় না। বায়ু  আকাশের মতো অতিসূক্ষ্ম না হলেও সূক্ষ্ম।  বায়ুকে আমরা চোখে দেখিনা বটে কিন্তু বায়ুর স্পর্শ আমরা অনুভব করতে পারি। তেজ বা অগ্নি বায়ুর মতো সূক্ষ্ম নয় আবার জল বা মাটির মতো স্থুলও নয়। আকাশের বিদ্যুৎ, আলো, জ্যোতি ইত্যাদি অগ্নির রূপ আমাদের চোখে পরে। সুতরাং অগ্নি স্থুল  ও সূক্ষ্মের মাঝামাঝি। জলের আবার পৃথিবীর মতো বা মাটির মতো স্থুল  না হলেও অর্ধস্থুল।  আবার মাঝে মাঝে বরফের আকার নিয়ে স্থুলে পরিণত হয়। পৃথিবীতে বা মাটিতে জড়ত্বের ভাব বেশি। তাই শক্তির প্রকাশ নেই। অর্থাৎ শক্তির প্রকাশ আছে বায়ু, অগ্নি ও জলে। তাই আমাদের দেহে ত্রিশক্তির আধিপত্য। আকাশ ও মৃত্তিকা ম্রিয়মান হয়েছে আছে আমাদের শরীরে।       

আসুন আমরা এই তিন দেবতাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য জপে প্রবৃত্ত হই। ধ্বনির সাধনায় লিপ্ত হই।  এই দেবতার সৃষ্টির কারন  সেই প্রণবের সাহায্য নেই। এবার আবার জপের কথায় আসি।

জপে যাবার আগে একবার মনটাকে একবার বুঝে নেই। আমরা অনেকেই জানি মন ত্রিস্তরীয় : চেতন - অবচেতন - অতিচেতন। হঠযোগীরা বলেন : দেহ শুদ্ধ হলেই মন শুদ্ধ হবে। এবং একমাত্র শুদ্ধ মনই আত্মউপলব্ধি করতে পারে। তো যার দ্বারা আত্মউপলব্ধি হবে তাকে একটু বুঝে নেই।

এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি :  এটি কোনো এক কবিগানের আসরে আমি শুনেছিলাম। ছেলে বলছে আমি কাঁঠাল খাবো। বাবা বাজার থেকে কাঁঠাল কিনে এনেছে। বাবা ছেলেকে কাঁঠালের পরিচয় দিচ্ছে। এই যে উপরের কাঁটা কাঁটা আস্তরণ দেখছিস  এঁকে বলে ছোবড়া। আস্তরণ ছাড়ালে কোয়া, কোয়ার ভিতরে আঁটি, আর এইযে কোয়ার বাইরে যে দেখছিস এটাকে বলা হয় ভুচরো।  আর ভেতরে মুগুরের মতো দেখছিস এটাকে বলে মোথা। ছেলে বলছে তো বাবা কাঁঠাল কোথা ?

তো মনকে খুঁজলে, দেহের মধ্যে কোথাও পাওয়া যাবে না। তবু আমাদের মনকে জানতে হবে।

যারা বিজ্ঞানের ছাত্র তারা জানে -  মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের কাজ কে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। একটা হচ্ছে সুষুম্না কান্ডীয় (Spinal Cord  Level ) , দ্বিতীয়টা হচ্ছে নিম্নতর মস্তিস্ক স্তর (Lower Brain Level) উচ্চতর মস্তিস্ক স্তর  (Upper Brain Level )

এই উচ্চতর মস্তিস্ক আমাদের মাথার সবচেয়ে বা আমাদের দেহের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ন অংশ। আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার সংগ্রহশালা হিসাবে কাজ করে। অতীতের অভিজ্ঞতার অধিকাংশ স্মৃতিই এখানে সঞ্চিত থাকে। এছাড়া আমাদের শরীরের যে প্রতিক্রিয়া হয় অর্থাৎ যাকে  আমরা চেতন মনের কাজ বলি, তার খবর এখানে সঞ্চিত থাকে। এবং নিজের ইচ্ছায় সে খাবরাখবরকে কাজে লাগিয়ে দেহের চেষ্টীয় প্রতিক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

নিম্নতর মস্তিস্ক দ্বারা দেহের অধিকাংশ অবচেতন কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। রক্তচাপ,শ্বাসক্রিয়া, ক্রোধ, উত্তেজনা, যৌনক্রিয়াকলাপ, যন্ত্রনা, আত্মতুষ্টি, এগুলো সবই নিম্নতর মস্তিষ্কের কাজ।  অতএব আমরা যাক অবচেতন মনের কাজ বলি তা এই নিম্নতর মস্তিস্ক করে থাকে।

দেহের ইন্দ্রিয়সকল দ্বারা গৃহীত সমস্ত সংবাদ বা উদ্দীপনা সুষুম্নাকাণ্ডে প্রেরণ করা হয়।  এবং সুষুম্নাকাণ্ড এই সংবাদের ভিত্তিতে সুষুম্না কাণ্ডের উদ্ভাবনী প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব হয়। এটা স্বয়ংক্রিয় এবং সংজ্ঞাবহ সংকেত সুষুম্নাকাণ্ডে যাবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায়। এটাই অতিচেতন মনের কাজ বলতে আমরা যা বুঝি তাই।

মন কোনো আলাদা বস্তূ  বা স্নায়ু নয়। বিভিন্ন স্নায়ুর ক্রিয়াকে আমরা মনের ক্রিয়া বলি। মন বলে কিছু নেই সবই স্নায়ুর খেলা।  আমাদের এই স্নায়ুর কেন্দ্রে যেতে হবে।  স্নায়ু যেখান থেকে  শুরু হয়েছে সেটা মস্তিস্ক। আর স্নায়ুর অবতরণ ক্ষেত্রে হচ্ছে সুষুম্না কাণ্ড। তাই সুষুম্না নাড়িকেই আমাদের আশ্রয় করতে হবে যদি আমরা আত্মউপলব্দ্ধি করতে চাই। এই স্নায়ুকেন্দ্রে প্রতিফলিত হবে আমাদের অধরা ঈশ্বর।আমাদের চেতন স্বরূপ।                


বীজ বিশেষের সজ্ঞা :

কুর্চ্চ  :            হুং 
কাম :             ক্লীং 
জয়দ :           ঐং
পৃথ্বী :              লং
প্রবন্ধ :           শ্ৰীং, হৌং
প্রাসাদ :         হৌং 
মায়া :            হ্রীং 
রক্ষা :            ওঁ
বাগ্ভব :       ঐং
শম্মরদ :        ক্রীং ক্রীং 
শাপহ :          হ্রীং