সাধন জগতে শয়তানের সন্ধানে / শয়তানের হাত থেকে বাঁচবেন কি কে ?
মূলসূত্র - যোগদর্শন সমাধিপাদ শ্লোক নং ৩০
DEVIL FORCE WITHIN ME
মানুষ ভাবে এক আর হয় আর-এক। মানুষ দুর্ভোগ চায় না, কিন্তু দুর্ভোগ এসে হাজির হয়, মানুষ মৃত্যু চায় না, কিন্তু মৃত্যুকে সে উপেক্ষা করতে পারে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুর্ভোগ, দুঃখ, কষ্ট, এমনকি মৃত্যু এসে হাজির হয়। মানুষ জরা-ব্যাধি চায় না, কিন্তু জরা-ব্যাধিকে সে দূরে রাখতে পারে না। মানুষ তো দূরে থাকুক,এমনকি ভগবান চাইছেন, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন। ভগবান চাইছেন, ধর্ম্মের রক্ষা আর অধর্ম্মের নাশ। কিন্তু হচ্ছে উল্টো, দুর্যোধন রাজার আসনে, পাণ্ডবেরা জঙ্গলে জঙ্গলে। দুষ্টের উদ্ভবের জন্য ভগবানের দরকার নেই, অধর্ম্মের উদ্ভবের জন্য ভগবানের দরকার নেই। তাহলে কি ভগবান থেকেও শক্তিশালী কেউ আছেন, যিনি এই অধর্ম্মের উদ্গাতা, দুষ্টের পালন কর্তা।
যাদের একটু আধটু যোগ-সাধন করবার অভ্যাস আছে, তাদের এই অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে, নানান রকম বীভৎস ভয়ংকর মূর্তি সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। এরা সব না চাইতেই আসছে, কিন্তু ভগবানের সৌম্য মূর্তি সহজে আসে না। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে মনের মধ্যে শান্তি আসে, কিন্তু অশান্তি সবসময় মনের মধ্যে খচখচ করছে।
ঋষি বিশ্বামিত্র শিবের সাধনা করছেন, আর সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে মেনকা-উর্ব্বশীর দল। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলছেন, "বেলতলায় ধ্যান করছি, পাপ-পুরুষ এসে কত রকম লোভ দেখাতে লাগলো।" কে এই পাপপুরুষ ? যাকে না ডাকলেও এসে যান।
আমাদের সবার মধ্যে যেমন সুপ্রবৃত্তি আছে, তেমনি আছে কু-প্রবৃত্তি। আর কে না জানে, এই সু-প্রবৃত্তির চাইতে কুপ্রবৃত্তি অধিক শক্তিশালী। রামচন্দ্রের মতো যুগাবতারের বৌ চুরি হয়ে যায়। আর তিনি সোনার হরিনের পিছে ছুটে বেড়ান। কে তাঁকে সোনার হরিণের ঋণের পিছনে চুটিয়ে নিয়ে বেড়ায় ?
আসলে একই মাতা-পিতার সন্তান এই দেবতা ও অসুর। শুভ আর অশুভের উৎস একই জায়গায়। সমুদ্র মন্থনে যেমন বিষকুম্ভ উঠে আসে, তেমনি উঠে আসে অমৃত-কলস। আর মন্থন ক্রিয়ার প্রথমেই আসে এই বিষকুম্ভ। আর বিষকুম্ভের বিষকে হজম না করতে পারলে, অমৃত কুম্ভের অমৃতের স্বাদ পাওয়া যাবে না। দুঃখকে সহ্য করতে না পারলে, সুখের সন্ধান পাওয়া যাবে না। একই মানুষের মধ্যে আছে শুভ বুদ্ধি, আবার অশুভ বুদ্ধি। অশুভ বুদ্ধিকে পরাস্থ করতে পারলেই , আমরাদের শুভবুদ্ধি কার্যকর হবে।
HRISHI AURABINDA SAYS : THE FORCES THAT STAND IN THE WAY OF SADHANA ARE THE FORCES OF THE LOWER MIND, VITAL AND PHYSICAL NATURE. BEHIND THEM ARE ADVERSE POWERS OF THE MENTAL, VITAL AND SUBTLE PHYSICAL WORLDS.
MOTHER SAYS : THERE ARE ALL THE DIFFICULTIES OF IGNORANCE OF THE DIFFERENT STATES OF THE BEING, TO WHICH ARE ADDEDED THE ENDLESS MALICE AND THE UNBONDED CUNNING OF THE HOSTILE FORCES IN THE WORLD.
হৃষি অরবিন্দ বলেছেন: যে শক্তিগুলি সাধনার পথে দাঁড়ায় সেগুলি হল নিম্ন মন, প্রাণশক্তি এবং শারীরিক বা প্রকৃতির শক্তি ৷ আর এদের পিছনে রয়েছে মানসিক, গুরুত্বপূর্ণ এবং সূক্ষ্ম শারীরিক জগতের প্রতিকূল শক্তি।
মা বলেছেন: সেখানে সত্তার বিভিন্ন অবস্থার অজ্ঞতার সমস্ত অসুবিধা রয়েছে, যার সাথে যুক্ত হয়েছে অন্তহীন পাপ এবং শত্রুপক্ষের অবাধ ধূর্ততা।
ঋষি পতঞ্জলি এই শয়তানের কয়েকটি রূপের কথা বলেছেন। ১. শারীরিক ব্যাধি, ২. মনের অবসাদ, ৩. সংশয়। ৪. চিত্তের উদ্যমহীনতা , ৫. আলস্য, ৬. বিষয়তৃষ্ণা, ৭. ভ্রান্তজ্ঞান ৮. অলবদ্ধভুমিকত্ব ৯. চিত্তের অস্থিরতা। আজ আমরা এই শয়তানদেরকে চিহ্নিত করে, তার থেকে নিজেকে বাঁচানোর উপায় সম্পর্কে শুনবো।
১. প্রথমত হচ্ছে শারীরিক ব্যাধি : শয়তানের প্রথম প্রভাব আমরা বুঝতে পারি, যখন আমাদের শরীর অসুস্থ হয়। আমাদের শারীরিক অসুস্থতায়, আমরা সবা থেকে বেশি বিড়াম্বনার শিকার হয় । শরীরের এই কষ্ট আমরা কেউ চাই না. তবু আসে। শরীর অসুস্থ হলে, আমরা কোনো কাজেই মনোযোগ দিতে পারি না।
এই শারীরিক অসুস্থতা নামক শয়তানকে তাড়াবার জন্য নানান উপায় আছে। মনে রাখবেন, শরীর একটা যন্ত্র মাত্র, আর একে আমরাই সৃষ্টি করেছি, কর্ম্ম নামক ফল উৎপাদনের জন্য। এই যন্ত্রের দ্বারাই আমরা জাগতিক সমস্ত কর্ম্ম সম্পাদন করে, ফলের জন্ম দিয়ে থাকি। আর এই কর্ম্মফল কাঁচা অবস্থায় ভীষণ টক, কিন্তু পাকলে ভীষণ মিষ্টি। ঠিক যেন আম। অর্থাৎ এই শরীর ও শরীরের কর্ম্ম আমাদের জাগতিক সুখ-দুঃখ প্রদান করে থাকে, আবার এই শারীরিক কর্ম্মই আমাদের ঈশ্বর-উপল্বদ্ধির জন্য শ্রেষ্ঠ যন্ত্র। তো আর সব যন্ত্রের থেকে এই যন্ত্র অধিক মূল্যবান। অতয়েব একে সুস্থ রাখতেই হবে।এই শরীরের মধ্যে দুটো অঙ্গ ভীষণ মূল্যবান, এক হচ্ছে মস্তিস্ক, র একটি হচ্ছে আমাদের স্নায়ুতন্ত্র। বিশুদ্ধ ও উপযুক্ত খাদ্য এবং আহারে, পানে ও বিহারে সংযম রক্ষা করতে পারলেই এই শরীররূপ যন্ত্র ঠিক থাকে। আপনারা যারা শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা পড়েছেন, তারা জানেন, সেখানে নানান সাধনপ্রণালীর বর্ননা আছে। সংক্ষেপে বলি, শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যারা বেশী পানাহার করে, খুব বেশি ঘুমোয়, খুব বেশি আমোদ-প্রমোদে আসক্ত থাকে, তাদের শরীর ব্যাধিগ্রস্থ হবে। আর ব্যাধিগ্রস্থ শরীরে কোনো কাজই সুষ্ঠ ভাবে হতে পারে না। তো আমাদের সংযম অভ্যাস করতে হবে। অর্থাৎ আমাদের মনে রাখতে হবে, শরীরের জন্য খাবার খেতে হবে, কিন্তু খাবারের ভান্ডার যেনা এই শরীর না নয়। যোগাচার্য্যগণ বলে থাকেন, রাজযোগ-অভ্যাস আমাদের শরীর ও মনের পক্ষে ভালো। আসলে শরীর ও মনের যে স্পন্দন তা সহজ ও সাবলীল হলে শরীর ও মন উভয়ই সুস্থ থাকে। আর এই বিপরীত হলে, মনের মধ্যে যেমন উদ্বিগ্নতা বাড়ে, তেমনি শরীর ব্যাধিগ্রস্থ হয়ে পড়ে । তো ব্যাধি নামক শয়তানকে আমাদের প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না, তাকে অবশ্যি তাড়াতে হবে।
২. এর পরে হচ্ছে চিত্তের অবসাদ। অনেক সময় দেখবেন, ঘুমের ঘোর যেন কাটছে না। আসলে মনের উদ্যমহীনতা আমাদের আলস্যকে ডেকে আনে। এই আলস্যকে বিদায় গেলে, আমাদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে, এই আলস্য কোথেকে আসছে, কি এর কারন ? আর যখনই তুমি এই কারনে দিকে খেয়াল করতে থাকবে, কারনে দিকে দৃষ্টি ফেরাবে, তখনি মনের এই জড়তা কেটে যাবে। এই যে জড়তা এটি আমাদের অনেক সময় অতিরিক্ত আহারের ফলে ঘটে থাকে, হজমের গোলমাল থেকে হতে পরে, আবার আমাদের মনের শক্তি যখন বেশি খরচ হয়ে যায়, তখন মন অস্থির হয়ে ওঠে। মন তখন আমাদের অধীনে বা আয়ত্ত্বে থাকতে চায় না। তখন হয়, মন চঞ্চল হয়ে ওঠে অথবা মন ঘুমিয়ে পড়ে। এই মনকে জাগিয়ে তোলার জন্যও রাজযোগের অভ্যাস, এবং সৎসঙ্গ ভীষণ ভাবে কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে।
৩. এর পরে হচ্ছে সন্দেহ। যাকিছু করছেন, বা করতে চাইছেন, সে সম্পর্কে যেন কোনো সন্দেহ না থাকে। আপনি হয়তো যোগক্রিয়া করতে চাইছেন, তো যোগ সম্পর্কে, বা যোগের কার্যকারিতা সম্পর্কে আপনার মনে যেন কোনো সন্দেহ না থাকে। যদি সন্দেহ থাকে, যা করতে চাইছেন, সে সম্পর্কে আপনার যদি অবিশ্বাস থাকে তবে তা দূর করবার জন্য, উপযুক্ত ব্যক্তি বা শাস্ত্র থেকে জেনে নিন। এর পরে নিঃসন্দেহে হয়ে সেই কাজে সর্ব্বশক্তি দিয়ে নেমে পড়ুন।
৪. জীবনের একটা লক্ষ ঠিক করুন, জীবনের একটা আদর্শ ঠিক করুন। কাউকে বিশ্বাস করবার আগে, এমনকি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করবার আগে, নিজেকে বিশ্বাস করতে হবে। নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। যার আত্মবিশ্বাস নেই, সে কাউকেই বিশ্বাস করতে পরে না - এমনকি ঈশ্বরকেও সে বিশ্বাস করতে পারে না। আর যার বিশ্বাস নেই, তার মধ্যে কর্ম্মের দৃঢ়তা আসে না। ফলত সে পদে পদে অসফল হয়। রামচন্দ্রের মনে সন্দেহ ছিলো, সে জানতো সোনার হরিণ বলে কিছু হয় না। তাই সীতার দৃষ্টিতে সোনার হরিণ থাকলেও, রামচন্দ্র কখনো সোনার হরিণকে খুঁজে পাননি।
৫. অন্ধবিশ্বাসকে প্রশ্রয় দেবেন না। ধরুন আপনি যোগক্রিয়া করে সাফল্য লাভ করতে চান। সেক্ষেত্রে যোগক্রিয়া সম্পর্কে যোগাচার্য্যের কাছ থেকে জেনে নিয়ে, কিছুদিন তার অভ্যাস করতে হবে। দিন কয়েক অভ্যাস করলেই দেখবেন, আপনার মধ্যে কিছু না কিছু পরিবর্তন হচ্ছে, কিছু দর্শন হচ্ছে, আর এইযে জ্ঞান তা আপনার উপলব্ধিগত সত্য। এই দর্শন যদি না হয়, বা আপনার ভিতরে যদি যোগের ফলে কোনো পরিবর্তন না আসে, তবে আপনার মধ্যে সত্যিকারের বিশ্বাস জাগবে না। এই বিশ্বাস লাভের জন্য তখন বিচারের দ্বারস্থ হন। নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকুন, কেন হচ্ছে না ? কোথাও আমার কাজের নিষ্ঠার অভাব হচ্ছে কি ? যোগবিজ্ঞান এমন একটা বিজ্ঞান, যা সাধকের মধ্যে বিশ্বাস আনতে একটা কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে।
৬. মনের মধ্যে উদ্যমহীনতা, কার্যফলে বাধা সৃষ্টি করে। এটি ঠিক শারীরিক আলস্য নয়, এটি মনের আলস্য। একে পরিহার করতে হবে।
৭. কোন কাজ অর্ধেক করে ছেড়ে দেওয়া, কোনো কাজের কথা নয়। অনেক সময় দেখা যায় আমরা যোগের পথে খানিকটা এগিয়ে আবার এসব করে কি হবে, ভেবে সেখান থেকে ফিরে আসি। এটি সাধনার পথে অন্তরায়।
৮. ভ্রমজ্ঞান - বিবেক বিচারের সাহায্যে আমাদের জ্ঞানের মধ্যে ভ্রান্ত ও অভ্রান্তের মধ্যে পার্থক্য করতে শিখতে হবে। তা না হলে আমরা ভ্রমজ্ঞানের প্রলোভনে পরে, সত্য কে মিথ্যা ভেবে, বা মিথ্যে কে সত্য ভেবে ভুল পথে চালিত হবো। এইজন্য যা কিছু জানবেন, তার সত্যতা সম্পর্কে যাচাই করে নিতে হয়।
৯. ঋষি পতঞ্জলির ভাষায় আরো একটা শয়তান আছে, র নাম হচ্ছে অলব্ধ ভূমিকত্ব। মন যখন আমাদের চঞ্চল থাকে, তখন মনকে একটি বিষয়ে একাগ্র করা যায় না। এই অবস্থায় আমাদের ধারণা প্রত্যাহার ও ঢংয়ের অভ্যাস করলে আমরা অবশ্যি সুফল পেতে পারি।
আসলে শয়তান বাইরে নয়, শয়তান আছে, আমাদের নিজেদের মধ্যে। , আর অশুভ শক্তি বলুন, ভালো বলুন আর মন্দ বলুন, সবই আমাদের নিজেদের তৈরী। অশুভ চিন্তা আমাদের শয়তানের জন্ম দেয়। আর শুভ চিন্তা আমাদের মধ্যে দেবতার জন্ম দিয়ে থাকে। চিন্তা বা ভাব মানুষের ভবিষ্যৎ তৈরী করে। চিন্তা হচ্ছে একধরনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব। যাদের কাজ হচ্ছে আমাদের চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া। আপনি যেমন চিন্তা করবেন, ধীরে ধীরে সেটি আপনার সামনে রূপ পরিগ্রহ করবে। তো আমাদের চিন্তাই শয়তান, আবার চিন্তাই দেবতা।
---------------------
No comments:
Post a Comment