Tuesday 29 September 2020

হরিনাম মহামন্ত্র - ৩২ অক্ষর বা বর্ণের তাৎপর্য্য


                                             হরিনাম মহামন্ত্র - ৩২ অক্ষর বা বর্ণের  তাৎপর্য্য 

 আজ থেকে, ৫৫০ বছর আগে হরিনাম সংকীর্তন অর্থাৎ "হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে"  এই নাম-রূপ-মন্ত্র  প্রচার করেছিলেন  চৈতন্য মহাপ্রভু। বেদ  মন্ত্রে অধিকারী ভেদ ছিল অর্থাৎ  বেদ মন্ত্র উচ্চারনে  সাধারণের  অধিকার ছিল না। চৈতন্য মহাপ্রভু, পতিত উদ্ধারে, ভেদহীন  এই মহামন্ত্রে সবাইকে উজ্জীবিত করেছিলেন।        

 এই মন্ত্রে চারবার "কৃষ্ণ", চারবার "রাম",  আটবার "হরে" আছে । অর্থাৎ ষোলোটি শব্দ আছে। আর এই ষোলোটি শব্দের মধ্যে আছে বত্রিশটি অক্ষর বা বর্ণ বা অন্য অর্থে  রঙ  । আমরা এই মহামন্ত্রে স্থূল থেকে সূক্ষ্ম তাৎপর্য্য বুঝবার চেষ্টা করবো। এই শব্দগুলোর অভিধানগত অর্থই বা কী ? 

প্রথমে জেনে নেই, এই বর্ণ বলতে আমরা কি বুঝি ? 

বর্ণ বলতে যেমন আমরা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য শূদ্র বুঝি, তেমনি বর্ণ বলতে আমরা বুঝি যার দ্বারা স্তব করা হয়। অর্থাৎ মনের ভাব প্রকাশ করা হয়। যা আমাদের কন্ঠ, তালু, মুর্দ্ধা ইত্যাদি থেকে নির্গত হয়। আমাদের বোধশক্তি যখন কন্ঠে সংকেত দেয়, তখন আমরা তাকে অক্ষর বলি। আমাদের উদানবায়ু যখন কন্ঠনালী হতে নিঃসৃত হয়ে শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের গ্রাহ্য শব্দের উৎপাদন করে, তখন তাকে আমরা বলি ধ্বনি। এই ধ্বনির স্ফুট অবস্থার নাম বর্ণ। এই বর্ণের সাংকেতিক চিহ্ন আমাদের দর্শন ইন্দ্রিয়ের বিষয়। একে বলা হয় লিপি। একই বর্ণের বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন লিপির প্রচলন দেখা যায়।

 বর্ণের আর একটা অর্থ হচ্ছে রং।  সাদা, কালো, লাল, ইত্যাদি। আমরা জানি সূর্য্যের সাতটি রং বা বর্ণ । লোহিত বা লাল, কপিল অর্থাৎ কমলা, পীত অর্থাৎ হলুদ, হরিৎ অর্থাৎ সবুজ, নীল, মহানীল অর্থাৎ গাঢ় নীল, এবং ধুম্র বা ধোঁয়াটে। এছাড়া বিভিন্ন শাস্ত্রে আরো কিছু রঙ-এর কথা বলা আছে, যেমন, শ্বেত বা সাদা, কৃষ্ণ বা কালো, অরুন অর্থাৎ স্বর্ণাভ, পান্ডুর বা হলদেটে, ধূসর অর্থাৎ ছাইরং, শুক্লাভ বা গাঢ় সবুজ, গাঢ়  লাল, এছাড়া বিভিন্ন রঙের অল্প বা অধিক মিশ্রনের জন্য অসংখ্য বর্ণের উৎপত্তি হতে পারে। তাই মিশ্র বর্ণ আসলে অসংখ্য। কিন্তু মূল বর্ণ মাত্র সাতটি যা সূর্য থেকে এসে থাকে । 

আমরা এই বর্ণের সাহায্যে কথা বলি, বা মনের ভাব প্রকাশ করে থাকি। আমরা যখন কথা বলি, তখন বাতাসের মধ্যে একটা তরঙ্গ  সৃষ্টি হয়। এবং তরঙ্গগুলো আমাদের কানের পর্দায় কম্পন তোলে। তাই আমরা শুনতে পাই। এই যে তরঙ্গ এগুলো আসলে বিভিন্ন বর্ণের বা নানান রঙের তরঙ্গ। 

পরা- বিদ্যাবিদগন বলে থাকেন,  দেবতাগণ যখন কথা বলেন, বা ভাব বিনিময় করেন, তখন এই রঙের তরঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়। সূক্ষ্ম জগতের জীবাত্মাগণ আমাদেরকে বা স্থুলদেহকে ঘনীভূত বিভিন্ন রঙের তরঙ্গ সদৃশ্য দেখতে পান। আমরা যখন কথা বলি, তখন এই বর্ণ আমাদের শ্রুতিগোচর হয় বটে, কিন্তু রঙতরঙ্গ  আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। 

এই মহামন্ত্রে আছে ষোলোটি শব্দ। বৈষ্ণবগন এসম্পর্কে বলে থাকেন -  হরে আটবার - চন্দ্রাবলী,  প্রেমময়ী শ্রীরাধা, সুভাষিণী, সিংহাসন, সুদর্শন ,শেষদেব, সাবিত্রী, ও রেবতী। কৃষ্ণ চারবার  : . পরমব্রহ্ম শ্রীগোবিন্দ,, বাসুদেব, জগন্নাথ, ও কৃষ্ণ-বলভদ্র। রাম চারবার :  শ্রীরাধিকা, শ্রীলক্ষ্মী, শ্রীসরস্বতী, ও শ্রীমতি সুভদ্রা।

 এখন আমরা শুনবো, "হরে" কথাটার তাৎপর্য্য কী ?  

হ+র+এ  = হরে। 

 হ - ছোটবেলায় দেখেছি, গরু, মহিষ কে অর্থাৎ যে আমার ভাষা বোঝে না, তাকে দাঁড় করবার জন্য, "হ" "হ" করতে, আর এই হ-হ করলে, গরু মহিষ দাঁড়িয়ে যেত। হ হচ্ছে ব্যঞ্জনবর্ণ মালার একটা বর্ণ। কেউ কেউ অবশ্য একে ব্যঞ্জন বর্ণ বলে মনে করেন না। কারন হচ্ছে, যে বর্ণ অন্যের সাহায্য নিয়ে উচ্চারণ করে, তাকে ব্যঞ্জন বর্ণ বলে।  কিন্তু হ উচ্চারণ করবার জন্য, কারুর সাহায্য নেবার দরকার পড়ে  না। এটি আসলে অ উচ্চারণ করতে গেলে শ্বাসবায়ু যখন প্রায় নিঃশেষিত হয়, তখন অবশিষ্ট বায়ু গলা থেকে জোরে বের করলেই হ উচ্চারণ হয়। এইজন্য হ-কে অ-এর মহাপ্রাণ উচ্চারণ বলা হয়ে থাকে। হ বর্ণের দ্বারা শিব, বিষ্ণু,চন্দ্র, স্বর্গ, মঙ্গল, রক্ত, শূন্য বা আকাশ, ব্যাপক  অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

র- এটি ব্যঞ্জন বর্ণ। উচ্চারণ স্থান হচ্ছে মূর্দ্ধা। র যখন অন্য বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন র ফলা, যেমন বজ্র, ভদ্র,  আবার মস্তকে বসলে রেফ, যেমন  পূর্ন, স্বর্গ, বর্ণ, কর্ম  ইত্যাদি। "র" বর্ণের অর্থ হচ্ছে বিরত হওয়া। 

এ- এটি স্বরবর্ণ। এর উচ্চারণ হচ্ছে কন্ঠ ও তালু। এটিকে সন্ধ্যক্ষর বলে। কারন এ আসলে অ + ই = এ। এ কথাটার অর্থ হচ্ছে ইহা। অর্থাৎ নিকটস্থিত বা সন্মন্ধযুক্ত বিষয়। 

তাহলে হরে - কথাটা কথাটার অর্থ হচ্ছে, হে পরমাত্মা। অর্থাৎ কারনের  কারন। যিনি ভৌতিক অভৌতিক সবকিছুর উদ্গাতা। হরে কথাটা যখন আমরা উচ্চারণ করি, তখন আমাদের শ্বাসবায়ু জোরে বের করে দিতে হয়, কন্ঠ, তালু ও মুর্দ্ধা স্পর্শ করে বায়ুকে দ্রুত নিঃশেষিত করতে হয়।  ফলত আমাদের যে বিশুদ্ধ চক্র  থেকে শুরু করে, মা সরস্বতীর স্থান হয়ে বহির্বিশ্বে গমন করে। তো বিশুদ্ধ চক্র  ক্রিয়াশীল করতে "হরে"  কথার গুরুত্ত্ব অপরিসীম । পুনঃ পুনঃ হর বা হরে উচ্চারনে আমাদের বিশুদ্ধ চক্র ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।

 হ-কার হিঙ্গুল বর্ণের প্রতীক। হিঙ্গুল অর্থাৎ পারদবহুল ঘোর  লোহিত(রক্ত)বর্ন খনিজ পদার্থ বিশেষ। পারদ যেমন বিষ বিশেষ আবার পারদ ঔষধ বিশেষ। "রে" বলতে রক্তবর্ণ গোপালকে বোঝায়। পাপক্ষয়ে বা বিষক্ষয়ে "হরে" মহাঔষধি হিসেবে কাজ করতে পারে।  

শ্রী শ্রী চৈতন্যদেব যে নামকীর্তনের প্রচলন করেছিলেন, তাতে হরে কথাটা আটবার আছে। বৈষ্ণব পন্ডিতগণ  এই হরে বলতে বোঝাচ্ছেন -     ১)   চন্দ্রাবলী,  ২) প্রেমময়ী শ্রীরাধা, ৩)সুভাষিণী, ৪) সিংহাসন, ৫) সুদর্শন ,৬) শেষদেব, ৭)সাবিত্রী, ও ৮) রেবতী। এঁরা  সবাই কৃষ্ণসখী বা রাধাসখী। অর্থাৎ যে সম্মিলিত প্রেমশক্তি স্বয়ং ভগবানকে বা  নির্গুণ ব্রহ্মকে  টেনে নিয়ে আসতে  পারে।

হ-কার হিঙ্গুল বর্ণের প্রতীক। হিঙ্গুল অর্থাৎ পারদবহুল ঘোর  লোহিতবর্ন খনিজ পদার্থ বিশেষ। পারদ যেমন বিষ বিশেষ আবার পারদ ঔষধ বিশেষ। "রে" বলতে রক্তবর্ণ গোপালকে বোঝায়। পাপক্ষয়ে বা বিষক্ষয়ে "হরে" মহাঔষধি হিসেবে কাজ করতে পারে।  

কৃষ্ণ বলতে কি বা কাকে বোঝায় ? আমরা জানি শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন, বিষ্ণুর অবতার। বসুদেব ও দেবকীর পুত্র। বৈষ্ণব মতে কৃষ্ণ চারবার  অর্থাৎ  : . পরমব্রহ্ম শ্রীগোবিন্দ, বাসুদেব, জগন্নাথ, ও কৃষ্ণ-বলভদ্র।

কৃষ্ণ - কৃষ্+ন। কৃষ্ কথাটার অর্থ  আকর্ষণ করা। ন অর্থাৎ আত্মা। যিনি আত্মাকে আকর্ষণ করেন।আবার কেউ কেউ কৃষ্ণকে সন্ধি বিচ্ছেদ করেছেন এইভাবে। কৃৎস্ন + ন।  যিনি জীববৃন্দের আত্মা স্বরূপ। কৃৎস্ন (কৃত+স+ন) কৃত অর্থাৎ করা যিনি কর্ম্ম জগতে প্রবেশ করেছেন, যে আত্মা কর্ম্মের উদ্দেশ্যে শরীরের মধ্যে স্থিত হয়েছেন বা শরীর ধারণ করেছেন। অর্থাৎ জীবাত্মা। 

আবার ক + ঋ + ন = কৃষ্ণ। ক - হচ্ছে ব্রহ্ম, ঋ হচ্ছে অনন্ত শিব। ন হচ্ছে নিবৃত্তি বাচক। তো যিনি ব্রহ্মরূপে সৃষ্টি করেন, যিনি অনন্ত, যিনি শিব রূপে সংহার করে থাকেন। তিনিই কৃষ্ণ।  যিনি বিষ্ণুর অবতার। বৈষ্ণবদের আরাধ্য বা ইষ্টদেবতা । যদুপতি। 

কৃ - কাজল বর্ণের প্রতীক। গতি শক্তি, রতি, প্রেম এ থেকেই এসে থাকে।  ষ্ণ -কার লোহিত বর্ণের প্রতীক। লোহিত বর্ণ আবার নরকের প্রতীক। তো লোহিতবর্ন স্বরূপ নরক  থেকে যে নাম জীবকূলকে উদ্ধার করে থাকে, তাঁকে  বলা হয় কৃষ্ণ। বারবার কৃষ্ণ ধ্বনি উচ্চারনে আমাদের হৃদয়কেন্দ্র, অর্থাৎ অনাহত চক্র ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। 

রাম :  আমরা জানি দশরথ পুত্র রাম।  যাঁকে বিষ্ণুর অবতার বলা হয়ে থাকে। আবার রাম  শব্দে বলা হয়ে থাকে, রময়তি যে স রাম।  অর্থাৎ যিনি ঈশ্বরের সাথে রমন করছেন।  রাম চারবার অর্থাৎ  :  শ্রীরাধিকা, শ্রীলক্ষ্মী, শ্রীসরস্বতী, ও শ্রীমতি সুভদ্রা।

 রাম = র+আ+ম। র - এটি ব্যঞ্জন বর্ণ। উচ্চারণ হচ্ছে মূর্দ্ধা।  র ধ্বনিকে বলা হয়ে থাকে একাক্ষর কোষ। অবিরামতা বোঝাতে র-এর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন বকর-বকর, ঘ্যানর ঘ্যানর ইত্যাদি। অবস্থিতিকর বা অপেক্ষাকর অবস্থা বোঝাতে র-এর ব্যবহার করা হয়ে থাকে।   

আ - এ-এর উচ্চারণ স্থান হচ্ছে, কন্ঠ। জিহ্বা মুখের নিচের দিকে রেখে মুখ খুলে উচ্চারণ করতে হয়। আ শব্দের প্রথমে ব্যবহার হলে "আ" থাকে মাঝে ব্যবহার হলে "া" আকৃতি নেয়, আবার শেষে ব্যবহার হলে "য়া" রূপে দেখা যায়। আ কথাটার অর্থ স্মরণ যেমন আ ! কি আরাম।  অর্থাৎ আরামের স্মরণ। 

অর্থাৎ  "রা" (র+আ) কথাটি দিয়ে বারবার স্মরণ বোঝাচ্ছে।

ম - এটি অনুনাসিক ওষ্ঠ বর্ণ। অর্থাৎ বর্ণের উচ্ছারণকালে যখন ওষ্ঠ ভেদ করবার শক্তি না থাকে তখন ধ্বনি নাক দিয়ে বের হয়। তাই রুগ্ণ ব্যক্তি নাকি স্বরে  কথা বলে থাকে। র-এর মতো ম একাক্ষর কোষ। এর অর্থ মধুসূদন শিব, চন্দ্র, ব্রহ্মা, যম, সময়, বিষ, মধুসূদন, কোমল। ম অর্থে ভবিষ্ৎকাল বোঝায়। ম অর্থে মন্থন করা, মা অর্থে মৃত্যু। অনুনাসিক বর্ণের উচ্চারনে জীবের সমস্ত দুঃখ নাশ হয়ে থাকে। 

তো সার্বিক অর্থ দাঁড়ালো, (র+আ+ম) র-বারবার,  আ - স্মরণ ম  - ব্রহ্মা - তো বারবার প্রজাপতি ব্রহ্মার স্মরণ। রা অর্থাৎ চন্দ্রজ্যোতি ম অর্থাৎ নিস্কলঙ্ক। তো নিস্কলঙ্ক চন্দ্রজ্যোতি-সম ঈশ্বরের স্মরণ। রাম কথাটির দ্বারা এক স্নিগ্ধ  জ্যোতিঃ রঙের প্রকাশ ঘটে। পুনঃ পুনঃ রাম  ধ্বনি উচ্চারনে আমাদের চিদাকাশে জ্যোতিদর্শন হয়ে থাকে। 

তো হরের্ণাম সংকীর্তন কতকগুলো বর্ণ-সমষ্টির অর্থাৎ এক অদ্ভুত রঙের তরঙ্গ সৃষ্টি করে থাকে।  আর তা হলো, স্নিগ্ধ নির্মল জ্যোতি, কাজলবর্ন, এবং লোহিত বর্ণের স্তর বিশিষ্ট। যা আমাদের চিদাকাশে ভেসে ওঠে।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

দুর্গতিনাশিনী দুর্গা মন্ত্রের অর্থ  ও প্রয়োগ : প্রার্থনা  মন্ত্র হচ্ছে - ওঁ দুর্গে দুর্গে রক্ষণি স্বাহা, ওঁ হ্রীং দূর্গায়ৈ নমঃ।

 দুর্গামন্ত্রের যথার্থ অর্থ 

১৪/১৫ বছরের একটি মেধাবী ছেলে অঙ্ক করতে করতে হঠাৎ একদিন পাগল হয়ে গেলো।  পিতা নিজে ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও, তাকে ভালো করবার জন্য, অসহায়ের মতো, যে যা বলছেন, তাই করছেন।  পরিচিত সমস্ত ডাক্তারদের কাছে ছুটলেন। কিন্তু কোনো কিছুতে কিছু হচ্ছিলো না।  দিন দিন তার পাগলামির মাত্রা বাড়তে লাগলো। বাড়ির কুল পুরহিত একটা মাদুলীর ব্যবস্থা দিলেন। আর পিতা-মাতাকে বললেন, দূর্গা নাম জপ করতে।   কিসে কি হলো বলা মুশকিল, ছেলেটি বছর -খানেক বাদে ধীরে ধীরে  ভালো হয়ে গেলো। ছেলেটি মেধাবী। এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ। এইসব মাদুলিত-ফাদুলিতে তার কোনো আস্থা নেই।  বিজ্ঞানে যার  বিশ্বাস, নিজে মাদুলিতে হাতে ঘুরে বেড়াবে, এটা তার একদমই ভালো লাগে না।  একদিন সে মাদুলীর ভিতরে কি আছে, সেটা দেখবার জন্য, মাদুলিটাকে হাত থেকে খুলে নিলো।  কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য, মাদুলিটাকে  ভেঙে দেখলো কি আছে, এর ভিতরে । দেখলো একটা ভূর্জপত্রে লাল রঙে ওং হ্রীংঁ  দুর্গায়ৈ নমঃ  - ওং হ্রীংঁ  দুর্গায়ৈ নমঃ  - কথাটি বার-বার  ১০৮ বার লেখা আছে। আর সেই  ভূর্জ গাছের  পাতাটি মুড়ে মাদুলীর মধ্যে রেখে মোম দিয়ে মুখটা ঢেকে দেওয়া হয়েছে।

কী  আছে এই দূর্গা  মন্ত্রে ?  এতে আদৌ কোনো উপকার হয়কি ? নাকি আমাদের মানসিক ভ্রম ? মন্ত্র জপ করলে, ধ্বনির তরঙ্গে আমাদের মধ্যে আলোড়ন তুলতে পারে, কিন্তু এই তাবিজ কবজে আদৌ কোনো উপকার হতে পারে কি ? 

প্রথমে দেখে নেই এই মন্ত্রের অর্থ কি ?

ওং - আদি ধ্বনি। প্রত্যেক মন্ত্রের এটি  বাঁধন। ওং ত্রিকালেশ্বর - ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব-এর মিলিত  শক্তি।  

"হ" অর্থে শিব, "র্" অর্থাৎ প্রকৃতি, "ঈ" অর্থাৎ মহামায়া, ঁ অর্থাৎ দুঃখরণ। সামগ্রিক ভাবে "হ্রিংঁ" এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, হে মহাদেবের শক্তি মহামায়া জগৎজননী  আমাদের দুঃখ হরণ  করুন।  

দুর্গায়ৈ অর্থাৎ দুর্গাকে, - দুর কথাটার অর্থ দুঃখ গম অর্থাৎ গমন করা, অ, দুর্গ এর সঙ্গে যোগ করা হয়েছে স্ত্রীলিঙ্গ সূচক আ, = দুর্গা।  যাকে  দুঃখে জানা যায়। কিংবা যিনি দুর্গ অর্থাৎ সঙ্কট থেকে ত্রাণ  করেন। তন্ত্র  মতে দ্ হচ্ছে  দৈত্য নাশ সূচক, উ বিঘ্ননাশ সূচক, র রোগ-বিঘ্ন বাচক , গ - পাপ বিঘ্ন বাচক, আ হচ্ছে শত্রূনাশ বাচক।  বলা হয়েছে, দুর্গ নামক অসুর বিশেষ, আ অর্থাৎ বধ-কর্ত্রী।  অর্থাৎ যিনি দুর্গ নামক অসুর বিনাশ করেছিলেন। ইনিই পরমাপ্রকৃতি।  বিশ্বের আদি কারন। শিব-পত্নী।   

বলা হয়ে থাকে,  সত্যযুগে রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্য, এর পুজো ধরাধামে প্রচার করেন। এবং তিন বছর ধরে আরাধনা করেছিলেন। ত্রেতা যুগে রাবন - বসন্তকালে এই পুজো করতেন। যাকে  বাসন্তী পুজো বলা হয়ে থাকে।  আবার এই ত্রেতা যুগেই রামচন্দ্র অশ্বিন মাসে অর্থাৎ শরৎ  কালে এই পুজো করেছিলেন। আবার দ্বাপর যুগে গোপ-কুমারীরা শ্রীকৃষ্ণকে পতি হিসেবে পাবার কামনায়, অগ্রহায়ন মাসে অর্থাৎ হেমন্ত কালে এই পুজো করেছিলেন। কলিযুগে এই তিন ঋতুতেই মা-দুর্গার পুজো হয়ে থাকে। 

বলা হয়ে থাকে আমাদের বর্নমালার প্রত্যেকটি বর্ণ এক-একটা ভাবের প্রতীক। দেবতাগণ যখন কথা বলেন, তখন নাকি এই বর্ণের ছটা দৃশ্যমান হয়।  এমনকি আমরা যখন কথা বলি, তখনও বিভিন্ন বর্ণের ছটা ছাড়িয়ে পড়ে, যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। প্রত্যেকটি বর্ণের একটা আকর্ষণী-বিকর্ষণী ক্ষমতা আছে। আর "দ" বর্ণটি ব্যতিক্রমী।  "দ" মধ্যমনি হিসেবে কাজ করে থাকে। অর্থাৎ আকর্ষণ-বিকর্ষণ এর মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে। 

মানুষ যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে, বা কোনো বিপদে পড়ে, তখন তার মনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। তার শ্বাসের গতিও বেড়ে যায়। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাঝে যে অন্তর সেটা বেশ কমে যায়। এই অবস্থায় "দ" অক্ষরটি বারবার উচ্চারণ করলে তার মনের ভারসাম্য ফিরে আসে। আর এই মনের ভারসাম্যের গতি ফেরানোর কাজ ত্বরান্বিত করবার জন্য "উ" যোগ করা হয়।  স্বরবর্ণ আকর্ষনাত্মক। "গ" হচ্ছে গাম্ভীর্যের প্রতীক, "র" তেজের প্রতীক = দুর্গ।  এর সঙ্গে আ অর্থাৎ স্ত্রীলিঙ্গবোধাত্মক আকার যোগ করলে হয়, দুর্গা। এই মন্ত্র উচ্চারনে, স্মরণে-মননে মানুষের মধ্যে নিষ্ঠা ও তেজের সঙ্গে লড়াই করবার শক্তি জন্মায়। মানুষের মধ্যে উদ্দোম ফিরে আসে।     

আসলে দুর্গাশক্তির বীজমন্ত্র হচ্ছে "দূঁ" .দ বর্ণে দুর্গা,  ঊ অর্থে রক্ষা আর ঁ অর্থে করো।  অর্থাৎ হে  জগৎজননী দুর্গে ! আমাকে রক্ষা করো। 

মা দুর্গার ধ্যান মন্ত্র হচ্ছে - ওঁ দুর্গে দুর্গে রক্ষণি স্বাহা, ওঁ হ্রীং দূর্গায়ৈ নমঃ।      

 

    


  

 






  

 

 

  


Wednesday 23 September 2020

মানসপূজা বা উপাসনা।

 


মানসপূজা বা উপাসনা। 

আমরা ঈশ্বরের কাছ থেকে যা পাই তাই দিয়ে ঈশ্বরের পুজো করে থাকি। মানস পুজো অর্থাৎ মনকে ঈশ্বরের পায়ে নিবেদন করা। উপাসনা কথাটার অর্থ হচ্ছে, ঈশ্বরের নিকট উপবেশন। আমরা ফুল, ফল, জল, প্রদীপ, গন্ধ, পাতা, যখন যাকিছু আমাদের হাতের কাছে থাকে, তাই দিয়ে আমরা ঈশ্বরের পুজো করে থাকি। আর সত্য হচ্ছে এগুলোর কোনোটাই আমরা সৃষ্টি করি না। তো যিনি যা দিয়েছেন, তাকে তাই নিবেদন করার মধ্যে আমাদের কৃতিত্ত্ব কোথায় ? এগুলো তো তাঁরই।  তাঁর জিনিস তার পায়ে নিবেদন করে  আত্মতৃপ্তি লাভ করে থাকি । আমাদের মাঝে মাঝে মনে হয়, এই নিবেদন একটা হাস্যস্কর ব্যাপার। কিন্তু সত্য হচ্ছে, ঈশ্বর যাকিছু আমাদের দেন, তা  যদি আমরা ঈশ্বরের জন্যই রেখে দেই, এবং নিজেকে শুদ্ধ বোধ করতে পারি, তবে, আমাদের সত্ত্বা প্রসারতা লাভ করতে পারে। তুমি যাকিছু  নিজের কাছে সরিয়ে রাখবে, তত তোমার মধ্যে ভয়, ও মনের সংকীর্নতা বৃদ্ধি  পাবে। আর ঠিক এই কারণেই, হিন্দুদের মধ্যে নিবেদন করবার একটা প্রথা  বহু পুরোনো যুগযুগ ধরে চলে আসছে।  আমাদের বাড়িতে একটা নতুন কিছু এলে, তা সে একটা গাছের ফল হোক, একটা জামা-কাপড় হোক, বা গাড়ি-ঘোড়া হোক, সবকিছুই আমরা ঈশ্বরকে নিবেদন করে তারপর আমরা ব্যবহার করে থাকি। এতে করে আমাদের মনে, একটা নিবেদনের শুদ্ধতা আসে, ত্যাগের ভিত্তিভূমি তৈরি হয়, এই অভ্যাস থেকে । এমনকি আমরা খেতে বসে, প্রথমে ঈশ্বরকে নিবেদন করে থাকি। এইসব প্রথার পিছনে লুকিয়ে আছে মহৎ চিন্তা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিবেদন, কিন্তু হাজারবার নিবেদনের ফলে, তা সঞ্চিত হয়ে, বিরাট আকার ধারণ করতে পারে। ভক্তিপথের যারা পথিক, তারা দরিদ্র নারায়ণ সেবা, সাধুসেবা, ন্যাংটা সেবা, বালক ভোজন, ইত্যাদি নাম নানান অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, ঈশ্বরের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে নেন। 

কিন্তু  দ্রব্য দেন না হয়, বোঝা গেলো, মানস পুজো বা উপাসনা বলতে আমরা কি বুঝি ? মানস পুজো অর্থাৎ মনে মনে পুজো। আচার্য্য শংকরের একটা মানস পুজোর স্তুতি আছে।  





    

Friday 18 September 2020

নিদ্রা-রহস্যঃ


                                                               নিদ্রা-রহস্যঃ ধ্যান ও ঘুম 

আধ্যাত্মিক জীবনে, বিশেষ করে যারা ধ্যানের  অনুশীলন করতে চান, তাদের সব সময় ঘুম সম্পর্কে সতর্ক  থাকতে হয়। ধ্যানে বসলেই আমাদের ঘুম পায়।  ধ্যানের  প্রধান শত্রূ  হচ্ছে ঘুম। তাই ঘুম সম্পর্কে আমাদের সবার একটা সাধারণ জ্ঞান থাকা আবশ্যক। 

 আমরা শুনেছি, সুনিদ্রা সুস্বাস্থের লক্ষণ। শুধু শরীরের নয় মানসিক স্বাস্থ্য এতে করে ভালো থাকে। কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও আমাদের জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় আমরা ঘুমিয়েই  কাটাই। ঘুম যদি আমাদের ঠিক-ঠিক মতো না হয়, তবে আমরা  নানান রোগের শিকার হই - যেমন মাথাধরা, রক্তচাপ, খিটখিটে মেজাজ, এমনকি আমাদের স্মৃতিশক্তি হ্রাস হতে পারে, যদি ঘুম আমাদের ঠিক ঠিক মতো না হয়। বিজ্ঞানীগন বলে থাকেন, সারাদিনের ক্লান্তি দূর করবার জন্য আমরা ঘুমাই। কিন্তু ঘুম কি শুধু শরীরের ক্লান্তি দূর করবার জন্য, নাকি আমাদের মানসিক অবসাদ দূর করবার জন্য আমরা ঘুমাই ? নাকি অন্য কোনো কারন আছে  ? কেন ঘুমাই আমরা ? 

বেশিরভাগ মানুষ বলে থাকেন, আমরা যতক্ষন জেগে থাকি, ততক্ষন আমাদের শরীরে অবক্ষয় চলতে থাকে। শারীরিক পরিশ্রম  আমদের দেহকোষকলায়, ক্ষয় ঘটায়। নিদ্রা আমাদের কাছে, সম্পূর্ণ বিশ্রাম। আর এই বিশ্রামের মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের ক্ষয় ক্ষতি পুষিয়ে নেই। এখন কথা হচ্ছে, শরীরের কোন অংশ বা আমাদের কোন শারীরবৃত্তীয় আমাদেরকে ঘুম পাড়ায় ?

একসময় বলা হতো, শরীরের অভ্যন্তরে, আমাদের বিপাকীয় কাজকর্ম্মের ফলে একধরনের রস  বা সামগ্রী উৎপাদিত হয়, এই রসই আমাদের ঘুমের কারন। কেউ কেউ মনে করতেন, খাবার পরে আমাদের পাকস্থলীতে জমে এক ধরনের উষ্ম বাষ্প। সেই উষ্ম বায়ু  যখন উর্দ্ধমুখী হয়, তখন আমাদের ঘুম পায়। এইজন্য খাবার পরে, আমাদের  ঝিমুনি আসে। এই উষ্ম বায়ু  আবার আমাদের খাদ্য সামগ্রী হজম করায়।

 কেউ কেউ আবার মনে করতেন, মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরনের ফলে আমাদের নিদ্রার আগমন ঘটে।এই  ধারণা  থেকে, মাথায় বালিশ দিয়ে ঘুমুনোর প্রচলন শুরু হয়েছিল মাথায় মোটা বালিশ দিয়ে ঘুমোলে, মাথা থেকে অতিরিক্ত রক্ত নেবে যাবে ।

 কেউ কেউ আবার উল্টোটা ভাবতেন, তার বলতেন, মস্তিষ্কে রক্তের অভাবেই  আমাদের নিদ্রা এসে থাকে। শরীর তার মস্তিষ্কের রক্ত টেনে নিয়ে অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে, তাই আমাদের ঘুম পায়।  অর্থাৎ বালিশ  মাথায় দিয়ে শুলে, রক্ত চলাচল ব্যাহত হবে, তাই শোবার  সময় বালিশের ব্যবহার না করে ভালো।

 নানা মুনির নানা মত. কেউ বলে থাকেন, আমরা দৈনন্দিন কাজকর্ম্ম থেকেআমাদের শরীর  উদ্দীপিত হয়। আর এই উদ্দীপনা আমাদের জেগে থাকতে বাধ্য করে। এই উদ্দীপনা যখন শেষ হয়, অর্থাৎ আমাদের কাজকর্ম্ম যখন শেষ হয়, তখন আমরা ঘুমের কোলে ঢোলে  পড়ি। 

যতক্ষন সূর্য্যের আলো, ততক্ষন আমাদের কাজ। যতক্ষন কাজ ততক্ষন আমাদের কোনো ঘুম নেই। কাজ ফুরোলো, তো আমরা ঘুমের কোলে আশ্রয় নেই - বিশ্রাম নেই। এই তত্ত্ব সমস্ত জীবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমরা ছুটির দিনে, বর্ষার দিনে, অলস দিনে বেশি ঘুমোই। কিন্তু কথা হচ্ছে, তাহলে আমাদের কাজ করতে করতে আমাদের কেন ঘুম পায় ? কারু ক্ষেত্রে দেখা যায়, সারা দিনের পরিশ্রমের পরেও  চোখের পাতা এক করতে পারছেন না। এর কারন কি ? 

আজকাল বলা হচ্ছে, এইসব উদ্দীপনা টুদ্দীপনা কিছু নয়, ঘুম আমাদের শারীরবৃত্তের একটা ঘটনা। খাদ্যের বিপাকীয় কাজকর্ম্মের   জন্য, আমাদের শরীরে জমে অপ-দ্রব্য অর্থাৎ জলীয় পদার্থ যা আসলে বিষ    । এদের মধ্যে আছে, ল্যাট্রিক এসিড, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কোলেস্টোরল ইত্যাদি।  এটি আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এই ক্ষতিকর অপ-পদার্থ যাতে আমাদের শরীরে জমে না থাকে, তার জন্য সাহায্য করে ঘুম। যাদের ঘুম না হয়, তাদের এই ক্ষতিকর পদার্থগুলো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, ঘুম পড়ানোর জন্য। এটাকেই বলে ঘুমের ঔষধ। যার জন্য বলা হয়ে থাকে ঘুমের ঔষধ বেশি খাওয়া উচিত নয়। 

ঘুম দুই প্রকার।  REM SLEEP এবং NON -REM SLEEP .রেম  স্লীপ -  ঘুমুচ্ছে কিন্তু চোখের পাতা নড়ছে। আসলে এই সময় ঘুমন্ত ব্যক্তি স্বপ্ন দেখছে। আর নন-রেম-স্লীপ হচ্ছে গভীর ঘুম। আসলে ঘুম কেন হয়, কিভাবে হয়, তা এখনো সঠিক ভাবে বোঝা সম্ভব নি । 

আর একটা কথা হচ্ছে, ঘুম মানুষের রোগযন্ত্রণার উপশম ঘটায়। রোগযন্ত্রনায় মানুষ যখন ছটফট করে,  তখন তাৎক্ষণিক  উপায় হিসেবে, ঘুমের ঔষধ বা ইনজেকশন দেওয়া হয়। বাচ্চা যখন কান্নাকাটি করে তখন  তাকে আমরা ঘুম পড়ানোর চেষ্টা করি। তাহলে কি ঘুম আমাদের সমস্ত জাগতিক যন্ত্রণার উপশম ঘটাতে পারে ? আবার দিনের বেলা ঘুমুলে, আমাদের শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, জ্বর থেকে যখন সবে সেরে উঠেছি, তখন ডাক্তার বাবু আমাদের দিনের বেলায় ঘুমুতে নিষেধ করতেন।  দিনে ঘুমুলেই আমাদের আবার জ্বর আসতো। ঈশ্বরের লীলা যেমন বোঝা  দায় ,ঘুমের গতি-প্রকৃতি আমরা এখনো   উঠতে পারি নি।  অথচ ঘুম আমাদের নিত্য ও অপরিহার্য  সঙ্গী।  ঘুমের বিচিত্র গতি।  কে যে এর নিয়ন্ত্রক তা এখনো  সঠিক ভাবে নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয় নি। তবে, মানুষ নিশ্চয়ই একদিন এই গভীর-তত্ত্ব আবিষ্কার করবে।  

এখান থেকেই, আমাদের আধ্যাত্মিক যাত্রা শুরু। গভীর ঘুমে আমরা বাহ্য চেতনাহীন হয়ে পড়ি। জগতের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক থাকে না। কিন্তু তন্দ্রা বা স্বপ্নাবস্থায় আমরা বাহ্যিক জগতের মতোই আর একটা জগতে ঘোরাফেরা করে থাকি। ঘুম যখন আমাদের গভীর হয়, অর্থাৎ গাঢ়  ঘুমে আমাদের এই স্বপ্ন-জগতের বিলুপ্তি পায়। এই অবস্থাকে সাধক বলে থাকেন, সুসুপ্তির অবস্থা। এই অবস্থায় আমাদের মনের কাজ সাময়িক ভাবে লোপ পায়। অর্থাৎ মন তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে  যায়। কিন্তু শরীরের স্বাভাবিক যে কাজ কর্ম্ম অর্থাৎ শ্বাস-প্রশাস, রক্তচলাচল ইত্যাদি ঠিক ঠিক চলতে থাকে। এবং আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোও সজীব-সতর্ক থাকে। হঠাৎ কেউ ডাক দিলে বা পিঁপড়ে কামড়ালে, বা মশায় কামড়ালে আমরা উঠতে পারি। সুসুপ্তির অবস্থা থেকে আমরা যখন জেগে উঠি, তখন ক্ষনিকের জন্য, আমরা বিমূঢ় অবস্থায় থাকি, হঠাৎ বুঝতে পারি না, এটা কি সকাল না বিকেল। কেউ যেন  ডাকলো,কিন্তু কে ডাকলো, তা আমরা ধরতে পারি না। 

এই অবস্থার পরেই আর একটা অবস্থা আছে, যাকে  বলে তুরীয় অবস্থা। ধ্যান আসলে বিভিন্ন ঘুম-প্রায় অবস্থার মধ্যে দিয়ে বিচরণ করা। ঘুমের জগতে বিচরণ করা। আমরা যখন সঙ্গাহীন থাকি, তখন আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক যে চেতনা, তা সে শারীরিক হোক বা মানসিক হোক, তা লোপ পায়। কিন্তু জীবনের ক্রিয়া বজায় থাকে। অর্থাৎ আমাদের ফুসফুসের ক্রিয়া চলছে। কিন্তু সাধক যখন তুরীয় অবস্থায় যায়, তার এই শারীরিক ক্রিয়া সাময়িক ভাবে অবরুদ্ধ থাকে। 

এক মহাত্মা আমাকে  বলেছিলেন, এ এক নিশ্চল অবস্থা, খাচ্ছি  কিন্তু খাচ্ছি না, দেখছি কিন্তু দেখছি না। অর্থাৎ সমস্ত ইন্দ্রিয়, অর্থাৎ চক্ষু কর্ন নাসিকা জিহ্বা ত্বক সবাই থেকেও নেই। মন-বুদ্ধি বিলোপ হয়ে গেছে। অন্যকোনো বিশ্ব-শক্তির নিয়ন্ত্রণে আমরা যেন আলোর সমুদ্রে ভাসছি। 

তো আমরা যেটা বলছিলাম, ঘুম আমাদের ধ্যানের প্রধান শত্রূ। আসলে ধ্যান ও ঘুম দুটো সমান্তরাল রাস্তা। আমরা ঘুমের পথে না হেটে ধ্যানের  পথে হাটবো। কিন্তু অচেতন ভাবেই আমারা  এই যাত্রাকালে  মাঝে মধ্যে ধ্যানের  পথ ছেড়ে ঘুমের পথে চলে  যাই। আরো গভীর ভাবে যখন আমরা বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ করবো, তখন আমরা বুঝতে পারবো , ঘুম প্রত্যেক মানুষকে ঈশ্বরের সাথে বা বিশ্বশক্তির সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করিয়ে দেয়, আমাদের বেঁচে থাকবার শক্তি যোগায় । আমরা তা ধরতে পারি না। উদ্দেশ্যহীন ভাবে, অজ্ঞাতসারে  আমরা তাঁর সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছি।অন্যদিকে ধ্যান  আমাদের ঈশ্বরের সাথে বা বিশ্বশক্তির সাথে  যোগাযোগ করাচ্ছে, যেটা আমরা ধরতে পারি।  ঘুমের মধ্যে  আমরা ঈশ্বরের সাথে সচেতন ভাবে যোগাযোগ রাখছি। তাই ঘুম আমাদের শত্রূ  নয়। চেতন মানুষের জন্য ধ্যান আর অচেতন মানুষের জন্য ঘুম।  দুটোর উদ্দেশ্য এক। ঈশ্বর থেকে শক্তি আহরণ। আমাদের যখন স্বাভাবিক মৃত্যু আসন্ন হবে, তখন আমরা দেখতে পারবো, আমাদের ঘুম স্বাভাবিকের থেকে বেড়ে গেছে।  একটা স্বপ্নের জগতে, একটা সঙ্গাহীন অবস্থায় আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করছি, তখন জগতের সমস্ত কিছু, কেমন আবছা হয়ে আসছে, সূক্ষ্ম জগতে যারা বাস করছেন, অর্থাৎ আগেই যারা জড় শরীর  ছেড়েছেন, তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ হচ্ছে। ঘুমের পথেই আমরা শরীর ছাড়ি আবার ঘুমের মধ্যেই আমরা শরীর ধারণ করি। আমরা জন্মের সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকি, আবার মৃত্যুর ঠিক  পূর্ব মুহূর্তে  আমরা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে  যাই। ঘুম বা তন্দ্রাবস্থা আমাদের স্থুল থেকে সূক্ষ্মে, এক সূক্ষ্ম শরীর  থেকে আরেক সূক্ষ্ম শরীরে প্রবেশ করি।   তো ঘুম আমাদের শত্রূ নয়। ঘুমই আমাদের অনন্ত যাত্রার সঙ্গী।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।