ঈশ্বর সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। সবাই ঈশ্বরের মধ্যে বা সবার মধ্যে ঈশ্বর। তাহলে ঈশ্বর-মানুষ বলে কিছু হয় নাকি ? মানুষ ঈশ্বর অর্থাৎ ঈশ্বরসম হয় তার কর্ম গুনে। তুমি যখন কোনো অসহায় মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধার করো - তখন তুমি তার কাছে ঈশ্বরসম। এখানে ঈশ্বর মানে মঙ্গলময়। আবার কাউকে যদি তুমি বিপদে ঠেলে দাও - তবে তার কাছে তুমি অমঙ্গলকারী বা সর্বনাশা শয়তান। দুটোই শক্তির খেলা। একটা শুভ কাজের জন্য, অপরটি অশুভ কাজের জন্য।
ঈশ্বর মানুষ হিসেবে জন্ম গ্রহণ করতে পারেন কি না বা করেন কি না, সেটা আমার প্রশ্ন নয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে ঈশ্বর-এর মনুষ্যাবতার গ্রহণ করার জন্য, বা মানুষ্য রূপ গ্রহণ করার জন্য কোনো বিশেষ পরিস্থিতির দরকার হয় কি না। অর্থাৎ এই যে বলছেন, যখন যেখানে ধর্মের গ্লানি হয়, সেখানেই আমি নিজেকে সৃষ্টি করি। নিজেকেই তো বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড হিসেবে সৃষ্টি করেছেন তিনি। তিনি ছাড়া তো কিছু নয়। ভালো মন্দ সব-ই তার। ধর্মের গ্লানি অর্থাৎ ভালোর অপমান যখন হয় তখন তিনি আসেন। তাহলে, এই যুগে অর্থাৎ যাকে আমরা কলি যুগ বলি, এখনই তো সবচেয়ে বেশি তার প্রয়োজন। এখন তিনি কোথায় ? নাকি এখনো তিনি আছেন। হ্যাঁ তিনি আছেন, আমাদের সবার অন্তরে আছেন। আগেও তিনি ছিলেন, এখনো তিনি আছেন। ভিতরের অশুভকে দমন করার জন্য তিনি সর্বদা জাগ্রত আছেন।
দুষ্টকে দমন করার জন্য বা সাধুদের পরিত্রানের জন্য তিনি আসেন ?
দুষ্টকে দমন করার জন্য তিনি আসেন। এই কথাটা লোকশিক্ষার জন্য প্রয়োজন। এতে দুষ্টেরা ভয় পাবে। কিন্তু সাধুদের পরিত্রানের জন্য তিনি আসেন, এই কথাটা আসলে তথাকথিত অসাধুদের জন্য, অর্থাৎ যারা নিজেদেরকে সাধু বলে পরিচয় দেন বা পরিচয় দিতে ভালো বাসেন, তাদের জন্য এটি একটি পরিহাস মাত্র। সত্যিকারের সাধুদের পরিত্রানের কোনো দরকার পরে না। সত্যিকারের সাধুরা সর্বকালে, সর্বত্র সুরক্ষিত। এরা পার্থিব সম্পদের অধিকারী নয়। এমনকি দেহকেও এরা অসত্য মনে করে। এঁরা অপার্থিব অর্থাৎ পরমার্থের অধিকারী, আর এই সম্পদ বাইরে থেকে নষ্ট করা যায় না, বাইরে থেকে রক্ষাও করা যায় না। তাই তথাকথিত সাধুরা যারা আসলে অসাধু, তারাই ভাবেন তাদের রক্ষার জন্য ভগবান আসবেন। এর থেকে হাস্যকর আর কি হতে পারে ? আমার জন্য সূর্য ওঠে, আমার জন্য চাঁদের উদয় হয়, আমার জন্য মৃদুমন্দ্র বাতাস বয়, আমার পা ধুয়ে দেবার জন্য সমুদ্র ঢেউ তোলে। এমনটি যারা ভাবে, তাদের মতো আহাম্মক আর কে আছে। আসলে সূর্য ওঠে তাই আমরা আলো পাই। আমরা বেঁচে থাকি। আমাকে বাঁচানোর জন্য সূর্য ওঠে না। সূর্য ওঠে তাই আমরা কিরণ পাই, বেঁচে থাকি। চাঁদ ওঠে তাই আমরা জ্যোৎস্না পাই। আমাদের জ্যোৎস্না দেবার জন্য চাঁদ ওঠে না। সমুদ্র আপন খেয়ালে দুলছে, ঢেউ উঠছে। আমি তাতে অবগাহন করি। আমাকে গন্ধ দেবার জন্য ফুল ফোটে না, ফুল ফোটে তাই আমরা গন্ধ পাই। ভগবান নরোত্তম হন, তাই আমরা তার সুফল পাই। কারুর জন্য ভগবান জন্মান না, তিনি তার আপন খেয়ালে ঘুরছেন। যেমন ইচ্ছে তেমন রূপ নিচ্ছেন। আমরা, নরাধমরা, ভাবি আমার জন্য আসেন।এর চেয়ে রসাত্মক কৌতুক আর কি হতে
পারে ?
আর দুষ্টের দমন, দুষ্টকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে হয় না। এই সত্য কৃষ্ণর মতো মহাপুরুষ ভালো ভৱেই জানতেন। আর যদি দুষ্ট দমন তাকে মেরে ফেলে হতো, তাহলে কৃষ্ণের দুষ্ট দমনের পর মহাভারতের যুদ্ধের পর আর দুষ্ট থাকতেই পারতো না। আসলে দুষ্টকে শোধরাতে হয়। আর এই শোধরানোর কাজ সাধুদের। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জানতেন, আত্মা মরে না। তাকে মারাও যায় না। দেহান্তরিত হয় মাত্র। অতএব দেহের নাশে কখনোই দুষ্টের নাশ হয় না। দুষ্টকে শোধরাতে হয় মাত্র। বিচার থেকেই দুষ্টামি আসে। সাধুদের কাজ সমাজের বিচারে সংশোধন আনা, মানুষের বিচারে সংশোধন করা । মানুষের বিচারে সত্য প্রতিষ্ঠা করা। এই কাজ যারা করে তারাই প্রকৃত সাধু। সাধু কারুর সুরক্ষার ধার ধরে না।তাঁদের সুরক্ষার জন্য কাউকেই, তা সে ভগবানই বলুন বা শয়তানই বলুন, কাউকেই আসার প্রয়োজন পারে না। এই উক্তি আসলে অসাধুদের উদ্দেশ্যে ভগবানের হাস্যস্কর কৌতক মাত্র।
আর একটা কথা হচ্ছে ভগবানের আসার জন্য কোনো পরিস্থিতির দরকার কিনা, অর্থাৎ এই যে বললেন যখন যখন ধর্মের গ্লানি হয় বা পতন হয় তখনি ভগবান আসেন। আমার মনে হয় ভগবানের আসার জন্য কোনো বিশেষ পরিস্থিতির দরকার হতেই পারে না। ভগবান যে কোনো সময় আসতে পারেন। পরিস্থিতি তার অনুকূল হয়ে যায়। ভগবান পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করেন না। ভগবান পরিস্থিতির জন্য জন্মান না। তার ইচ্ছাই তাকে দেহ ধারণ করায়। আর পরিস্থিতি তার পেছনে দৌড়োয়। যার জন্য আমরা দেখি, ভগবান যখন আসেন, তখন সমাজ সত্যের পেছনে ধায়। ভগবান যখন আসেন তখন সমাজে পরিবর্তন আসে। সমাজ পরিবর্তন করার জন্য তিনি আসেন না। কিন্তু ভগবান এলে সমাজ পরিবর্তিত হয়ে যায়। ভগবান বুদ্ধ যখন এসে ছিলেন তখন সমাজ দুঃখের নিবৃত্তির জন্য ছুটেছিলো। শান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। তিনি আপন খেয়ালে আসেন। আর তার পেছনে সমাজ দৌড়োয়। আমি নিজেকে সৃষ্টি করি, এ কথা ভগবানই বলতে পারেন। অথবা এ কথা বলা যায়, আমাদের বাসনাই আমাদের সৃষ্টি করে। আমাদের বাসনার পূরণের জন্য সেই মতো দেহ ধারণ করি। ভগবান ইচ্ছাপূরণের জন্য দেহ ধারণ করেন। নিজেকে আস্বাদন করার জন্য, রূপ পরিগ্রহ করেন। কাউকে রক্ষার জন্য, বা কাউকে মারার জন্য নয়। জন্ম মৃত্যু তো তারই খেলা। এর জন্য তাকে মানুষের দেহ ধারণ করতে হয় না। অলক্ষ্যেই সব নির্ধারণ করতে পারেন।
এখন ভগবান বা ঈশ্বর বলতে আমরা কি বুঝি ?
মহামুুনি ব্যাসদেব গীতায় পরম-আত্মা সম্পর্কে বলছেন :
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্নায়ং
ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ
অজো নিত্যঃ শাশ্বতো অয়ং পুরানো
না হন্যতে হন্যমানে শারীরে। (২/২০)
অর্থাৎ ইনি কখনো জন্ম গ্রহণ করেন না, মারাও যান না। তিনি জন্মেছেন অথবা ভবিষ্যতে তিনি জন্মাবেন না - এর কোনোটাই ঠিক নয়। তিনি অজ অর্থাৎ অজন্মা, নিত্য অর্থাৎ চিরকালই বর্তমান, শাশ্বত অর্থাৎ অতীতেও ছিলেন, বর্তমানেও আছেন আবার ভবিষ্যতেও থাকবেন। শরীর বিনষ্ট হয়, কিন্তু সেই তাঁর বিনাশ নেই।
মহর্ষি ব্যাসদেব আবার ওই একই গ্রন্থে অন্য জায়গায় বলছেন :
বহুনি মে ব্যাতীতানি জন্মানি তব চ-অর্জুন
তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ।
হে অর্জুন ! আমার এবং তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে। আমি সে সব জানি, কিনতু তুমি জান না।
তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে ? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, পরমাত্মা নন। তিনি পূর্ণ পুরুষ নন। শেষ আধার নন। যার বার বার জন্ম হয়, সেই তিনি অবশ্য়ই জীবাত্মা হতে পারেন পরমাত্মা নন।
আসলে ঈশ্বর কখনো মানুষ বা রূপ পরিগ্রহ করেন না। রূপ যেই পরিগ্রহ করলেন, তখনি তিনি আবদ্ধ হয়ে পড়লেন। প্রকৃতির উপর নির্ভর হয়ে পড়লেন। সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লেন। ঈশ্বর তিনিই যার কোনো নির্ভরতার দরকার নেই, তার নির্ভরতাও নেই। তিনিই সবার অর্থাৎ সমস্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের নির্ভরদাতা।
দেখো সবারই একটা নির্ভরতা দরকার। যার মধ্যে সে থাকবে। যার আশ্রয়ে সে থাকবে। নির্ভরতা বিহীন কেউ নয়। এই নির্ভরতাকেই বলে আধার। আধার বিহীন কেউ নেই, থাকতেও পারে না। সবারই আধার দরকার। গর্ভাবস্থায় মায়ের গর্ভ শিশুর আধার। মানুষের আধার পৃথিবী। পৃথিবীর আধার জল। জলের আধার তেজ। তেজের আধার বায়ু। বায়ুর আধার আকাশ। আকাশের আধার অব্যক্ত। এই আধারই আমাদের অবলম্বন । এই ভাবে করতে করতে এগিয়ে গেলে শেষ আধার যদি কিছু পাওয়া যায়, তবে সেটাই ঈশ্বর। আধারের মধ্যে আধার, আধারের বাইরে আধার। তাই আধারের সূক্ষতা ও সীমা নির্ধারণ করা যায় না।
তাই রামকৃষ্ণ বলেছেন ঈশ্বরের শেষ করতে নেই। পৃথিবী থেকে বায়ু সূক্ষ্ম, বায়ু থেকে আকাশ সূক্ষ্ম। এইভাবে সূক্ষ্ম থেকে অতিসূক্ষ্ম, সূক্ষ্মতম, সূক্ষ্মতর । আবার দেখো যত সূক্ষ্ম তত কম গুনের অধিকারী।
তুমি তো জানো - পৃথিবীর গুন্ - শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ। অর্থাৎ পাঁচটি গুন্। জলের গুন্ - শব্দ স্পর্শ, রূপ, রস। অর্থাৎ ৪টি গুন্। একটা কমে গেলো। বাতাসের গুন্ - শব্দ স্পর্শ, রূপ। আবার একটা কমে হলো তিন। তেজ বা আগুনের গুন্ দুটো - রূপ ও শব্দ। একদম শেষে, অর্থাৎ আমাদের উপলব্ধির শেষ আধার আকাশ। এই আকাশের গুন্ - শব্দ। অর্থাৎ মাত্র একটি গুন।
নির্গুণ আত্মার মধ্যে আছে আকাশ। এই নির্গুণ আত্মার কোনো আধার নেই। পন্ডিতরা বলে ব্যোম, আমি বলি শুন্য। আকাশের মধ্যে আছে বাতাস। বাতাসের মধ্যে আছে তেজ। তেজের মধ্যে আছে জল। জলের মধ্যে আছে পৃথিবী। পৃথিবীর মধ্যে আছে গাছপালা। এই গাছপালার মধ্যে আছে অন্ন। আর অন্নের মধ্যে আছে প্রাণী। অর্থাৎ প্রাণ বীজ আকারে অন্নের মধ্যে নিহিত।
একটু নিবিষ্ট চিত্ত হয়ে ভাব। তুমিতো জানো, এই পৃথিবীর ৭৫% ভাগ জল। ২৫% ভাগ স্থল। একটু চোখ বুজে কল্পনা করতো - বিশাল একটা পুকুর তার মধ্যে একটা মৃত্তিকা খণ্ড অর্থাৎ যে মাটির উপরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি বা বাস করছি। এই পুকুরটা নিচে তেজ। তেজের মধ্যে বায়ু অর্থাৎ তেজের উপরে পুকুরটা ভাসছে। আর বায়ুর নিচে আকাশ। অর্থাৎ এক খণ্ড আকাশের মধ্যে বায়ু, আবার বায়ুর মধ্যে জলাধার, আবার জলাধারের মধ্যে মাটির টুকরো। এই মাটির টুকরোর মধ্যে আছে গাছপালা। এই গাছপালার মধ্যে আছে অন্ন। আবার অন্নের মধ্যে প্রাণ। এই প্রান-ই সর্বজীবের আশ্রয়স্থল। প্রাণহীন জীবন নেই। এই তত্ত্বের মধ্যে ঢোকা বা বিশ্লেষণ করাই ঈশ্বরকে খোঁজা। অর্থাৎ নির্ভরতা খোঁজা নিজের উৎপত্তি খোঁজা। ঈশ্বর অর্থাৎ ঈশ + বর, ঈশ কথাটার মানে আধিপত্য করা আর বর কথাটার মানে বাঞ্ছিত সত্য বা ভালো কিছু। তাহলে কি দাঁড়ালো বাঞ্চিত সত্য বা ভালো সবকিছুর মধ্যে যিনি আধিপত্য করছেন তাকে আমরা ঈশ্বর বলি। প্রকৃত সত্যকে খোঁজাই ঈশ্বরকে খোঁজা।
ঈশ্বরকে খোঁজা মানে নিজের নির্ভরতাকে খোঁজা। আমি কার উপর দাঁড়িয়ে আছি। কে আমাকে নির্ভরতা দিয়েছে, তাঁকে খোঁজা।
ঈশ্বর সাকার কি নিরাকার ?
মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত-র লেখা তত্ত্বজ্ঞান পড়ছিলাম। ওঁনার বই পড়ে আমার মনে হয়েছে, উনি নিরাকার ঈশ্বরকেই যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে করতেন। আবার সাধনার জন্য, বা মহান সাধকদের সাকার সাধনাকে উপেক্ষা করতে পারেন নি। আসলে এটাই সত্য। সাধনার জন্য সাধ্যের দরকার সাধনার লক্ষ বা লক্ষবস্তু দরকার। তাই সাকারকে অবজ্ঞা করেন নি। কিন্তু মেনেও নেন নি। উনি নিরাকারের সাধনাকেই অর্থাৎ ঈশ্বরের গুনের সাধনাকেই যথাযথ বলে মনে করেছেন। আমি ওনার এই যুক্তিবাদী মনকে সমর্থন করি।
মহাত্মা গুরুনাথের দ্বারা প্রবর্তিত "সত্যধর্ম" কে যারা সাধন পথ বলে মেনে নিয়েছেন, তাদেরকেও দেখেছি, নিরাকারের উপাসনার নামে সাকারের উপাসনা করছেন। গুরুদেবের ফটো সামনে রেখে উপাসনা সঙ্গীত গাইছেন বা সাধনা করছেন। ভগবান বুদ্ধ নিরাকারেই বিশ্বাস করতেন, কিন্তু পরবর্তীকালে তার শিষ্যগণ বুদ্ধদেবের মূর্তি রেখে সাধন ভজন করছেন।