Monday, 17 July 2023

মাণ্ডুক্য উপনিষদ রহস্যঃ

 মাণ্ডুক্য উপনিষদ রহস্যঃ

শশাঙ্ক শেখর শান্তি ধাম 

মঙ্গলাচরণ :

ওঁ ভদ্রং কর্নেভিঃ শৃনুয়াম দেবা 
ভদ্রং পশ্যেম অক্ষভিঃ  যজত্রাঃ। 
স্থিরৈঃ অঙ্গৈঃ তুস্তুবাংসঃ তনুভিঃ 
ব্যশেম দেবহিতং যদাযুঃ । 
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।

হে দেবগন যাকিছু ভালো, তাই যেন আমরা কান দিয়ে শুনতে পাই, চোখ দিয়ে যা কিছু ভালো তাই যেন দেখতে পাই।  স্থির শরীর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারা যেন তোমার স্তুতি করতে পারি। দেবগন যে আয়ু বিহিত করেছেন, যা যেন আমরা লাভ করতে পারি। 
আমাদের ত্রিবিধ শান্তি  প্রদান করুন । 

ভূমিকা :

আমরা মাণ্ডুক্য উপনিষদের মধ্যে প্রবেশ করতে চলেছি। এই সূক্ষ্ম পথের যাত্রা যেন আমাদের সুস্থ  শরীর ও মনের সাহায্যে করতে পারি। হে ঋষিগণ আমাদের ধীশক্তি বৃদ্ধি  করুন, আপনাদের শ্রীমুখ নিঃসৃত সমস্ত  শব্দের মর্মার্থ যেন আমরা ধরতে পারি, উপলব্ধি করতে পারি, এবং সেইমতো যেন জীবনকে পরিচালিত করতে পারি। 

মাণ্ডুক্য উপনিষদ অথর্ব বেদ  থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে ওঙ্কার, প্রণব, বা ওম-কে ব্রহ্মের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে, ব্রহ্মজ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। আমাদের যে জাগ্রত-স্বপ্ন-সুসুপ্তির অবস্থা, একেই অ-উ-ম হিসেবে বর্ননা করা হয়েছে। প্রথমে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে এই বিরাট জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান, তার পরে দেহকে নিষ্ক্রিয় রেখে মনের জগৎ অর্থাৎ সূক্ষ্ম অবস্থার  জ্ঞান, এবং সব শেষে দেহ-মন-ইন্দ্রিয়কে নিষ্ক্রিয় রেখে ইন্দ্রিয়াতীত জ্ঞানের দিকে ধাবিত হতে হবে। দেখুন, আমরা যা কিছু চিন্তা করি, তাই একসময় আমাদেরকে কর্ম্মে উদ্দীপ্ত করে। আর এই কর্ম্মের মাধ্যমে আমাদের চিন্তা একসময় বাস্তবিক রূপ গ্রহণ করে। আবার আমরা ইন্দ্রিয়সকল দ্বারা যে বিষয়ের অনুভব করি, তা আমাদের মনের মধ্যে একটা ছাপ ফেলে। এই যে মনের চিন্তার  ছাপ তা আমাদের অনেক সময় স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্নজগতে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এই যে দুটো জগৎ অর্থাৎ স্বপ্ন জগৎ ও জাগতিক জগৎ এ ছাড়াও আরো জগৎ আছে, যা আমাদের বাহ্য  ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উপলব্ধ নয়। এই জগৎ ইন্দ্রিয়াতীত - কিন্তু এই জগতের বাসিন্দা আমরাই। আমরা যখন সুসুপ্তিতে অর্থাৎ গাঢ়  ঘুমে অবস্থান করি, তখন একটা জগতের মধ্যে প্রবেশ করি। স্বপ্ন জগতের কথা বা দৃশ্য আমরা স্বপ থেকে  জেগে উঠলেও  মনে রাখতে পারি, অর্থাৎ আমাদের স্মৃতিতে থাকে।  কিন্তু এই সুসুপ্তির জগতের কথা আমাদের স্মৃতিতে থাকে না।  তাই এই জগতের কথা অর্থাৎ গাঢ় ঘুমের মধ্যে আমরা কিছু দেখেছিলাম কি না, বা আমরা কিছু করেছিলাম কি না, তা আমাদের মনে পড়ে না কারন সেটি আমাদের স্মৃতি অর্থাৎ স্থূল ও সূক্ষ্ম শরীরের মস্তিষ্কে যে স্মৃতির ভান্ডার আছে, তাতে গচ্ছিত থাকে না। এটি থাকে আমাদের কারন শরীরে।  সাধন জগতের মহাত্মাগণ ইচ্ছে করলেই, এই জগতের মধ্যে বিচরণ করতে পারেন। তাঁরা কিভাবেই বা পারেন, সেই  সব কথা আমরা ধীরে ধীরে শুনবো। কিন্তু উচ্চতর বোধে যেতে গেলে , আমাদের শরীর-মনকে স্থির করতে হবে।  এইজন্যই আমরা আলোচনার শুরুতে দেবতাদের কাছে, প্রার্থনা করেছি। যা কিছু ভালো, তাই যেন আমরা শুনি, দেখি, বলি । অর্থাৎ আমাদের চিন্তার মধ্যে যেন শুদ্ধতা আসে, আমাদের বোধ শক্তি যেন আরো বেশি গভীর হয়, এই প্রার্থনা দিয়েই মাণ্ডুক্য উপনিষদ শুরু হয়েছে।  
------------ 

মাণ্ডুক্য উপনিষদ - আগম  প্রকরণ - শ্লোক ০১/০১-০২

"ওম ইতি এতৎ অক্ষরম ইদং সর্বং তস্য উপব্যাখ্যানং ভূতং ভবৎ ভবিষ্যৎ ইতি সর্বম ওঙ্কারঃ এব। যৎ চ অন্যৎ ত্রিকালাতীতং তৎ  অপি ওঙ্কারঃ এব।" (০১/০১)

"ওম" এই বিশেষ অক্ষরটি এই সমস্ত কিছু। সেই ওঙ্কার ব্রহ্মের নিকটবর্তী মহিমার নিদর্শক হওয়ায়, বলা হয় ভূত-ভবিষ্যৎ ও বর্তমান, এমনকি যা ত্রিকালের অতীত তাও এই ওঙ্কারই। 

মন্ডুক কথাটার অর্থ ব্যাঙ। আমরা জানি ভেকের ডাক বর্ষনের বার্তা বহন করে। আর এই বর্ষণ ক্ষেত্রকে উৎপাদনের উপযোগী করে তোলে। পৃথিবী উর্বরা হয়ে উদ্ভিদকুল, জীবকূলকে পুষ্টি প্রদানের জন্য অন্নাদির উৎপাদন করে থাকে। তো মুন্ডক উপনিষদে এমন একটা ধ্বনির ইঙ্গিত আছে, যা আমাদের এই শরীররূপ ক্ষেত্রকে উর্ব্বরা করে ব্রহ্ম সান্নিধ্যে এনে দিতে পারে।  
আবার এই মন্ডুক একজন ঋষির নাম  বিশেষ, যিনি এই বিশেষ ধ্বনিকে আমাদের সামনে এনে, এর উর্বরাশক্তি সম্পর্কে জ্ঞাত করাচ্ছেন, যা আমাদের ব্রহ্মানুভূতি এনে দিতে পারে । 

আর এই ধ্বনি হচ্ছে ওঙ্কার - যা সৃষ্টির ইঙ্গিত বহন করে। হিন্দু শাস্ত্রমতে এই ওঙ্কার  হচ্ছে  সৃষ্টির মূল। ঋষি বলছেন, এই ওঙ্কার কার্য্য ও কারনে প্রতীক। এই যে দৃশ্যমান জগৎ, এ ওঙ্কার ছাড়া কিছু নয়। এই যে কাল, অর্থাৎ অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ এমনকি এই কালের অতীত যদি কিছু থেকে থাকে তাও এই ওঙ্কার। অর্থাৎ এটি নিত্য সত্য।  এই  ওঙ্কারকে  বলা  হয় শব্দব্রহ্ম বা নাদব্রহ্ম। উপনিষদে আত্মা আর ব্রহ্ম  সমার্থক শব্দ। এই যে ওঙ্কাররূপ ধ্বনি এটি সমস্ত ধ্বনিজগতের মূল। সমস্ত ধ্বনিজগৎ এই ওঙ্কারের অন্তর্গত। আর এই ধ্বনি বিশ্বব্রহ্মান্ড ব্যাপী বিস্তার করে আছে। এই ওঙ্কারকে  বলা হয়, এর কখনো ক্ষয় নেই, তাই  এঁকে  বলা হয় অক্ষর। ওঙ্কার ধ্বনি সম্পর্কে বলা হয়, এটি আমাদের নাভিমূল থেকে অন্যমতে এটি আমাদের মূলাধার থেকে উৎসারিত হয়ে শরীরের নাভি, হৃদয়, কন্ঠ, ওষ্ঠ বাহিত হয়ে শেষে ঠোঁট বন্ধ  অবস্থায় অনুনাসিক স্বর হিসেবে নির্গত হয়। অর্থাৎ এই ধ্বনি যেমন সমস্ত শরীরকে আঘাত করে উজ্জীবিত করে, তেমনি এই দৃশ্যমান জগতকে প্রকাশিত করছে এই ওঙ্কার বা ওম।
-------------

"সর্বং হি  এতৎ ব্রহ্ম অয়ম আত্মা ব্রহ্ম সঃ অয়ম আত্মা  চতুষ্পাৎ। " (০১/০২)

এইসকল অর্থাৎ সমগ্র এই জগৎ ব্রহ্ম। এই যে আত্মা (জীবাত্মা) তাও  ব্রহ্ম। এই আত্মার চারটি পাদ বা অবস্থা। 

স্থূল জগৎ বলুন, সূক্ষ্ম জগৎ বলুন, এসব ব্রহ্মের বিশেষ স্থিতি  মাত্র। যা কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, আবার যাকিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, অথচ আমাদের উপলবদ্ধিতে  আসে, আবার এমন সবকিছু যে আমাদের উপল্বদ্ধিতেও  আসে না, সবই সেই এক ব্রহ্ম। এই যে জীবাত্মা যিনি আমাদের এই শরীর মনের ধারক, তিনিও এই  ব্রহ্ম  বৈ কিছু নয়। তো যা কিছুর অস্তিত্ত্ব আছে, সবই ব্রহ্ম। ব্রহ্ম  ভিন্ন কোনোকিছুর অস্তিত্ত্ব নেই। 

এই যে জীব, বা এই যে জগৎ, এর মধ্যে কোনো পার্থক্য  নেই। এই দুইই  সেই এক ব্রহ্ম। এই যে বিরাট বিশ্ব আর এই যে ক্ষুদ্র জীব অর্থাৎ সমষ্টি ও ব্যষ্টি  এসবই এক ব্রহ্ম। আমাদের দেহের ভিতরে যে অগ্নি, আর সূর্য্যের  ভিতরে যে অগ্নি, এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এই যে অনন্ত  আকাশ আর আমাদের শরীরের মধ্যে যে আকাশ, এই  দুই আকাশের  মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমার আপনার শরীরের মধ্যে যে জল, বায়ু ইত্যাদি আছে, তার সঙ্গে এই বায়ুমন্ডলের বা সমুদ্রের জলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তো আমার আপনার মধ্যে যে ব্রহ্ম  আছেন, আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে ব্রহ্ম আছেন, তার মধ্যেও কোনো পার্থক্য নেই। এই সত্যকে উপলব্ধি করা সহজ না হলেও অসম্ভব  নয়। আর এই কারণেই উপনিষদের  ঋষিগণ  বারবার বলছেন,  তুমি জানো  আর না যেন, তুমিই ব্রহ্ম। তুমিই ব্রহ্ম।  তুহি তুহি। 

আমরা দেহাভিমানী জীব, তাই আমরা আমাদের দেহকে ঘিরে আমিত্বের বোধ করে থাকি। কিন্তু এই দেহতো আমি নোই, এই দেহে আমি বাস করছি মাত্র। এই দেহ আমার আবরণ মাত্র। এই আবরণ খুলে ফেললে, আমি আমাতেই স্থিত হবো।  অর্থাৎ যখন আমাদের দেহাভিমান চলে যাবে, তখন আমি আমার স্বরূপে স্থিত হবো।  আর আমার এই স্বরূপ হচ্ছে ব্রহ্ম, যা উপনিষদ বার বার করে উচ্চারণ করছেন, উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করছেন । 

এখন ঋষি মন্ডুক বলছেন, এই যে ব্রহ্ম  বা আত্মা ইনি  চতুষ্পাদ।  অর্থাৎ এনার চারটি পা, বাচারটি  অবস্থা বিশেষ। তো ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন কিন্তু এনার চারটি অবস্থা। 

মাণ্ডুক্য উপনিষদ - আগম  প্রকরণ - শ্লোক-২

প্রথম হচ্ছে, এই যে দৃশ্যমান জগৎ, যা আমরা জাগ্রত অবস্থায় প্রতক্ষ্য করে থাকি। একে  বলে জাগ্রত অবস্থা।  এই জাগ্রত অবস্থায় এই জগৎকে উপলব্ধি করি কিভাবে, আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে। অর্থাৎ চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহবা, ত্বক এই পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রীয়ের সাহায্যে এই জগৎ বিষয়  আমাদের উপলব্ধি হয়ে থাকে। যদি কোনো কারনে এই ইন্দ্রিসকল নিষ্ক্রিয়  হয়ে যায়, তবে এ জগৎ আমার চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে যাবে। 

দ্বিতীয় অবস্থা হচ্ছে আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি, অর্থাৎ আমাদের স্বপ্নাবস্থা। এই অবস্থায় আমাদের জ্ঞানীন্দ্রিয় সকল, এমনকি সমস্ত শরীর স্থির, নিষ্ক্রিয়  হয়ে থাকে।  তখন আমরা আর চর্ম্ম  চক্ষু দিয়ে দেখতে পারি না, কান  দিয়ে শুনতে পারি না, মুখ দিয়ে কথা বলতে পারি না, জিভ দিয়ে স্বাদ গ্রহণ করতে পারি না। কিন্তু আশ্চর্য্যের কথা হচ্ছে, তখনও আমরা এই স্থূল জগতের অনুরূপ আরো একটা জগতের মধ্যে বিচরণ করে থাকি ।  সেখানে অর্থাৎ এই স্বপ্নের জগতে  আমরা শুনি, দেখি, কথা বলি, এমনি খাবার খাই, ইত্যাদি ইত্যাদি।  এইসময় আমাদের বাহ্য  ইন্দ্রিয় নিষ্ক্রিয় থাকে, তথাপি এই সূক্ষ্ম জগতের স্বাদ নিতে আমাদের কোনো অসুবিধা হয় না। এই অবস্থা আমাদের এমনকি সুখ-দুঃখের অনুভূতি গ্রহণ করে থাকি। তো এই সময় যে অবস্থা আমাদের হয়, তাকে বলে তৈজস অবস্থা। অর্থাৎ আমাদের শরীরের তেজঃশক্তি মনের সাহায্যে সমস্ত ক্রিয়া সম্পাদন করে থাকে। এমনকি বিষয় অনুভূতি এনে দেয়। 

তৃতীয় অবস্থা হচ্ছে আমাদের গাঢ়  ঘুমের অবস্থা। একে উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, সুসুপ্তির অবস্থা।  এই অবস্থায় আমাদের ইন্দ্রিয় সকল তো বটেই, এমনকি আমাদের মন নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে। এই অবস্থায় আমাদের যে কি হয়, তা আমরা জানি না। কিন্তু এইখান থেকে যখন বেরিয়ে আসি, অর্থাৎ যখন আমাদের  গাঢ়  ঘুম ভেঙে যায়, তখন আমরা অনেক বেশি সতেজ ভাব  অনুভব করি। স্বপ্নাবস্থায় যা কিছু হয়, তার একটা রেশ আমরা জাগ্রত অবস্থায় অনুভব করি। এমনকি স্বপ্নে দেখা ভয়ের দৃশ্য আমাদের জাগ্রত অবস্থাতেও  মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।  কিন্তু গাঢ়  ঘুমের পরে অর্থাৎ সুষুপ্তি থেকে জেগে উঠে আমরা কেবলমাত্র সতেজতা অনুভব করি। এমনকি দেখা যায়, ক্ষনিকের জন্য আমরা বাহ্যজ্ঞান রোহিত হয়ে বিমূঢ় অবস্থায় থাকি। যদিও  এই অবস্থা বেশিক্ষন থাকে না, মুহূর্তের মধ্যেই আমরা আবার বাহ্য  জগতের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেই, তথাপি মুহূর্তের জন্য, আমরা যেন একটা অন্য জগতে থাকি।  এই জগৎ সম্পর্কে  আমাদের কোনো স্মৃতি থাকে না। থাকে  কেবল একটা সতেজ  ভাব।

চতুর্থ অবস্থাকে উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, তুরীয় অবস্থা। অর্থাৎ ব্রহ্মের  চতুর্থ অবস্থা। বলা হয়, এই অবস্থায় মানুষ চৈতন্যের সঙ্গে অবস্থান করেন। তখন আমরা ব্রহ্মেের সঙ্গে বা আত্মার সঙ্গে আরো একটু গভীর ভাবে বলতে গেলে, বলতে  হয়, আমি তখন "আমার" সঙ্গে অবস্থান করি।  অর্থাৎ আমি স্বরূপে স্থিতি  লাভ করি। আর আমার এই স্বরূপ হচ্ছে স্বয়ং ব্রহ্ম।  আমি ব্রহ্ম বৈ  কিছু নয়।  

এখন কথা হচ্ছে, জীবকুলের এই যে চারটি অবস্থা এতে করে জীবের মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয় না। আমরা ঘুম থেকে উঠে আবার এই জগতের একজন হয়ে যাই।  আবার সেই দেহাভিমানী হয়ে সংসারকাজে লেগে পড়ি।  আবার সেইসুখ-দুঃখের, মায়ার সংসারে নিজেকে আবদ্ধ  করে ফেলি। যেখানে যে কাজ ফেলে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সেখান থেকে আবার কাজ শুরু করি।   তো আমরা কখনো জেগে আছি, কখনো ঘুমিয়ে আছি, কখনো পাতলা ঘুমের মধ্যে আছি, কখনও গাঢ়  ঘুমের মধ্যে আছি, কিন্তু আমি সেই একই আছি। তো এতে করে আমার কোনো পরিবর্তন হয় না। আমি ঘুমের আগেও যা ছিলাম, ঘুমের পরেও সেই আমিই থাকি, হয়তো একটু সতেজ  থাকি, তার  বেশি কিছু নয়। একই আমি কখনও বাইরের ঘরে, কখনও  পড়ার ঘরে, কখনও   শোবার  ঘরে, কখনও  বা ঠাকুর ঘরে। 

এবার একটু ভাবুন,  আমার যেমন ব্যষ্টি  শরীর  আছে, ব্যষ্টি  মন আছে, ব্যষ্টি  ইন্দ্রিয় আছে, তেমনি  জগতের সমস্ত জীবের মনকে, শরীরকে, ইন্দ্রিয়কে একত্র করলে যে বিরাট শরীর হতে পারে, আবার সমস্ত বস্তুকে একত্র করে যেমন যে বিশাল ব্রহ্মান্ড হতে পারে, তা যাঁকে  আশ্রয় করে অবস্থান করছে তাকেই  বলা হচ্ছে ব্রহ্ম। এইজন্য ঋষি বলছেন, এই আত্মাই ব্রহ্ম। সমগ্র এই জগৎ ব্রহ্ম। ব্রহ্মের বাইরে কিছু নেই ।
---------------------

মাণ্ডুক্য উপনিষদ - শ্লোক ০১/০৩

"জাগরিত স্থানঃ বহিঃ প্রজ্ঞঃ সপ্তাঙ্গ একোনবিংশতি মুখঃ  স্থূলভূক বৈশ্বানরঃ প্রথম পাদ।" (০১/০৩)

জাগরিত অবস্থায় বহির্জগৎ সম্পর্কে জীবরুপি ব্রহ্ম  সচেতন থাকেন  ।  তখন সাতটি অঙ্গবিশিষ্ঠ উনিশটি মুখ বিশিষ্ঠ স্থূলভূখ বা স্থূল বিষয়ের ভোক্তা হচ্ছেন বৈশ্বানর।  এই তাঁর (আত্মার) প্রথম পাদ। 

পরমাত্মার ক্ষুদ্র সংস্করণ হচ্ছে জীবাত্মা। পরমাত্মা হচ্ছে সমষ্টি আর জীবাত্মা হচ্ছেন ব্যষ্টি। তেমনি সমস্ত ব্যষ্টি শরীর  মিলিয়ে এই বিশ্ব। 
এই যে স্থূল জগত এর  ভোক্তা হচ্ছে এই শরীর। এই শরীর  ভিন্ন স্থূল জগৎকে ভোগ করা যায় না। আবার এই শরীর হচ্ছে তিন প্রকার। স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারন। এই তিনটে মিলে একটা  শরীর। এই তিন  শরীর  কিন্তু আলাদা নয়, এই তিনটে শরীর একের সঙ্গে অন্যটি  ওতপ্রোতভাবে জড়িত।  এইব্যাপারটা আমরা একটু ভালোভাবে বুঝে নেই।

দৃশ্যমান এই যে মানব দেহ বা  কর্ম্ম দেহ, এটি খাদ্য বা অন্ন দ্বারা গঠিত। এবং খাদ্য দ্বারাই পুষ্টি লাভ করে থাকে। আমাদের একটা ধারণা  হচ্ছে, এই স্থূল দেহই সমস্ত গুনের আধার। ব্যপারটা কিন্তু এমন নয়। এই যে স্থূল দেহ তা ভৌতিক উপকরণে তৈরী। দেহের মৃত্যু কালে এই দেহের সমস্ত উপাদান আবার পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে। এই দেহের ভিতরে এবং কিছুটা বাইরে আরো একটা দেহ আছে, যা অতি সূক্ষ্ম পদার্থে নির্মিত। এই দেহকে বলা  হয় সূক্ষ্ম দেহ বা লিঙ্গ দেহ। এখানে স্থূল উপকরণ কিছু নেই, অতিসূক্ষ্ম পদার্থে নির্মিত। এই সূক্ষ্ম দেহের অভ্যন্তরে আরো একটা দেহ আছে, তাকে বলা হয় মনোময় দেহ বা মানস দেহ। এই মনোময় দেহই আসলে আমাদের মন-বুদ্ধির আধার। এই যে তিনটে দেহ অর্থাৎ স্থূল, সূক্ষ্ম ও সূক্ষ্মতর এই তিনটে দেহই পার্থিব দেহ। একেই বলে অন্নময়, প্রাণময়, ও মনময় দেহ। অন্নময়  দেহ স্থূল, প্রাণময় দেহ সূক্ষ্ম, আর মনোময় দেহ সূক্ষ্মতর। এই তিনটে দেহই পার্থিব। 
এ ছাড়া আমাদের আরো দুটো দেহ আছে, একটি বিজ্ঞানময় আরেকটি আনন্দময় দেহ। এই দুটো দেহ পার্থিব নয়। এই দেহ অভৌতিক অর্থাৎ পঞ্চভূতের তৈরী নয়।  একেই বলে কারন দেহ।  
দেখুন আত্মা সম্পর্কে যত কথাই বলি না কেন, এই সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কেবলমাত্র পুঁথিগত। আমরা মেনে নিয়েছি, আত্মা (জীবাত্মা) বলে একটা কিছু আছে, কিন্তু সেটা যে কি বস্তু, তা আমরা বলতে পারবো  না।  বুঝবার সুবিধের জন্য একে  মহাত্মাগণ বলে থাকেন চৈতন্য। পরা-বিদ্যাবিদগণ বলে থাকেন,  এই আত্মার একটা দেহ আছে, যা অদৃশ্য উপকরণে তৈরী। দেহের আকৃতি অনুসারে এই আত্মার (জীবাত্মা) একটা আকৃতিও আছে। যদিও এই দেহ লিঙ্গহীন। যখন যেমন দেহে অবস্থান করে, তখন সেই লিঙ্গ ধারণ  করে। আমাদের চিন্তা, মনের ভাব, ইত্যাদি কার্য্যের উৎপত্তি স্থান হচ্ছে এই কারন দেহ। এই কারন দেহে যিনি বাস করেন, তিনিই আত্মা, যিনি অজর, অমর শ্বাশত। কিন্তু কালের গতিতে এই আত্মার (জীবাত্মার) ক্ষমতার  হ্রাস-বৃদ্ধি  আছে। আর এই ক্ষমতার হ্রাস বা বৃদ্ধির কারন হচ্ছে আমাদের জ্ঞান অভিজ্ঞতা।  এই জ্ঞান-অভিজ্ঞতাই আত্মাকে অধোগামী বা উর্দ্ধগামী করে থাকে। এতো কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, উপনিষদের এই শ্লোকে বলা হচ্ছে এই জীবাত্মাই আসলে ভোক্তা।  তিনি এই দেহাদির মাধ্যমে ভোগ সম্পাদন করে থাকেন।  

এই ভোগের প্রথম অবস্থা হচ্ছে, জাগ্রত অবস্থা । এই অবস্থায় আমরা ইন্দ্রিয় সকলের দ্বারা এই জগৎকে উপলব্ধি করে থাকি। এই ইন্দ্রিয়সকলের দ্বারাই আমরা বহির্জগৎ-এর সঙ্গে  সম্পর্কযুক্ত থাকি।  এই ভোগ হচ্ছে স্থূলের ভোগ। তাই একে  বলা হচ্ছে স্থূলভূক। আমাদের সবার, এমনকি সমস্ত জীবকুলের এই স্থূলভোগের অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। আর এই ভোগ হয়ে থাকে আমাদের দেহ ও তৎসংলগ্ন ইন্দ্রিয়ের দ্বারা। উপনিষদের ঋষি বলছেন, এর সাতটি  অঙ্গ  অর্থাৎ সাতটি লোক - ভূঃ  ভুবঃ স্বঃ মহঃ  জনঃ  তপঃ সত্যম।  উনিশটি মুখ, এগুলো হচ্ছে পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচ কর্ম্মেন্দ্রিয়, পাঁচ প্রাণ , এবং মন, বুদ্ধি চিত্ত অহংকার। মোদ্দা কথা হচ্ছে, জাগ্রত অবস্থায় আমরা স্থূল জগতের ভোক্তা। একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, জাগ্রত অবস্থায় আমরা স্থূলরূপে ব্রহ্মকে দেখতে পাচ্ছি, অনুভব করতে পারছি। এই হচ্ছে ব্রহ্মার প্রথম পাদ বা প্রথম প্রকাশ। ওঙ্কারের প্রথম মাত্রা "অ".

আসলে জগৎ কিছু স্থূল থেকে  শুরু হয়নি, বরং বলা যায়, ব্রহ্মর প্রকাশ স্থূলে  এসে পরিণতি প্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞাতায় যেহেতু প্রথমেই স্থূলের অনুভূতি হয়ে থাকে, তাই উপনিষদের আলোচনা এখান থেকেই শুরু হয়েছে। বৈশ্বানর কথাটার অর্থ হচ্ছে বিশ্ব  এবং নর। আমাদের যেমন তিনটে  শরীর  (স্থূল, সূক্ষ্ম, কারন) তেমনি আমাদের তিন অবস্থা অর্থাৎ জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি। তো এই যে বৈশ্বানর ইনি অগ্নি বিশেষ। আমাদের শরীরে যে খাদ্য হজম প্রক্রিয়া তা এই বৈশ্বানর অগ্নির সাহায্যেই হয়ে থাকে। অর্থাৎ খাদ্য থেকে যে সূক্ষ্ম বস্তুকে আলাদা করা হয়, তা এই বৈশ্বানর রুপী ব্রহ্ম করে থাকেন।  তো স্থূল বস্তুকে বৈশ্বানর নামে সেই পরমেশ্বর ভোগ করছেন। 
------------------- 
এই প্রসঙ্গে দেহভান্ড সম্পর্কে একটা বিশেষ প্রবন্ধ পুনঃপ্রচার করা হলো।      

স্থুল মানব দেহ-ভাণ্ড ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড HUMAN BODY & SPACE

মানবদেহ এক বিস্ময়। কত যে কারিকুরি আছে এই দেহে, তার ইয়ত্ত্বা নেই। বিজ্ঞান এখনো দেহের সমস্ত অঙ্গের কার্যকারিতা সম্পর্কে অবহিত নয়। আবার আমাদের এই স্থুল দেহই চৈতন্যের আবাসস্থল। তাই আমাদের এই মনুষ্য জীবন ও মানুষের এই স্থূল দেহ আমাদের সাধনার মূল আশ্রয়। বহু জন্ম অতিক্রান্ত করে, লক্ষ লক্ষ যোনি ভ্রমণের পর আমরা এই মনুষ্যদেহ প্রাপ্ত হয়েছি। একমাত্র মনুষ্যদেহেই আমাদের কর্ম্মফল সঞ্চিত হয়। তাই আমরা সবাই আবার মনুষ্যদেহ প্রাপ্ত করতে চাই।
মনুষ্যদেহ ভিন্ন সাধন সম্ভব নয়। তাই মানব জীবন  আমাদের কাছে, অতি মূল্যবান। আমাদের এই দেহকে ভালো করে জানতে হবে। আমরা জানি আমাদের এই  দেহ কতকগুলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমাহার মাত্র । এই দেহকে শারীরবিদগন এক রকম ভাবেই  দেখেছেন।  অধ্যাত্ম পথের  পথিকরা এই দেহকে অন্য ভাবে দেখেছেন। তারা মনে করেন, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনুরূপ একটি ব্রহ্মান্ড, হচ্ছে আমাদের এই দেহ । আমরা আজ সেই কথাই  শুনবো।

বাউল লালন ফকির বলছেন :
দেব-দেবতাগন / করে আরাধন / জন্ম নিতে মানবে।।
কত ভাগ্যের ফলে না জানি / মন রে পেয়েছো এই মানব তরণী।
বেয়ে যাও ত্বরায় সুধারায় / যেন ভারা  না ডোবে।।
এই মানুষে হবে মাধুর্য-ভজন / তাইতো মানুষরূপ গড়লে নিরঞ্জন।
এবার ঠকলে আর না দেখি কিনার / অধীন লালন তাই ভাবে।।

বেশিরভাগ ধর্ম্মপ্রান মানুষ অল্পবিস্তর যোগের ক্রিয়া করে থাকেন। অর্থাৎ তাঁদের সাধনকেন্দ্র এই দেহ। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, জৈন, মুসলমান, সবাই কিঁছু না কিছু শারীরিক ক্রিয়া অবশ্যই  করে থাকেন। অর্থাৎ দেহের মাধ্যমেই আমাদের সাধন ভজন।  আমরা সবাই মনে করি, ঈশ্বর যেমন বাইরে আছেন  বৃহৎ আকারে, তেমনি আমাদের দেহে আছেন ক্ষুদ্র আকারে । এই দেহের মধ্যেই আছেন পরমতত্ত্ব, বা পরমাত্মা। দেহের বাইরে যেমন আছে পঞ্চতত্ত্ব, সপ্তলোক, নদী, সাগর, দ্বীপ, পর্বত। তেমনি আমাদের শরীরকে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ বলে কল্পনা করা হয়েছে। তাইতো একটা প্রচলিত কথা আছে যে, যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে এই দেহ-ভান্ডে।

আমরা জানি আমাদের মেরুদণ্ডকে আশ্রয় করে, ছটি চক্র আছে। এর মধ্যে সবথেকে নিচে, যে মূলাধার চক্র আছে সেখানে কুণ্ডলিনী শক্তি, অর্থাৎ সৃষ্টিশক্তি সুষুপ্ত অবস্থায় আছেন। এই কুণ্ডলিনীকে প্রাণ-অপান বায়ুর সাহায্যে ক্রিয়া দ্বারা  জাগ্রত করে, সুষুম্নার ভিতর দিয়ে উর্দ্ধগতি করাতে পারলে, সেই বায়ু সূক্ষ্ম অবস্থায় সহস্রারে অর্থাৎ পরমশিবের সাথে মিলিত হন । মানুষ তখন, ত্রিগুণাতীত ব্রাহ্মীস্থিতি লাভ করতে পারেন ।

তাই দেহকে অবলম্বন করেই সাধনা। তা সে হিন্দু, বৌদ্ধ, তান্ত্রিক, যোগী, বৈষ্ণব, বাউল, সুফি, যাই বলুন না কেন, সবাই এই দেহকে অবলম্বন করেই সাধনা করছেন। আমরা সবাই  জানি, পঞ্চভূতের এই দেহ। এই পঞ্চভূত কি ভাবে আমাদের দেহে অবস্থান করছেন দেখুন।

ক্ষিতি অর্থাৎ কঠিন পদার্থ বা পৃথিবী : আমাদের শরীরে, অস্থি, চর্ম, নাড়ী, লোম ও মাংস এই পাঁচটি পৃথিবীর গুন্, বা বিকার অবস্থা।
অপ অর্থাৎ তরল পদার্থ বা জল : মল, মূত্র, শুক্র, শ্লেষ্মা ও শোনিত - এই পাঁচটি হচ্ছে জলের গুন্।
তেজ অর্থাৎ তাপ বা অগ্নি : ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, মোহ, ক্ষান্তি (ক্ষমা বা তিতিক্ষা) - এই পাঁচটি হচ্ছে তেজের গুন্।
মরুৎ  অর্থাৎ বায়বীয় পদার্থ বা বাতাস  :  বিরোধ, আক্ষেপন, আকুঞ্চন, ধারণ ও তৃপ্তি - এই পাঁচটি হচ্ছে বায়ুর গুন্।
ব্যোম অর্থাৎ বিশাল বা আকাশ : রাগ, দ্বেষ, মোহ, ভয় ও লজ্বা - এই পাঁচটি হচ্ছে আকাশের গুন্।

পঞ্চভূতের মধ্যে বায়ু প্রধান।  তাই আমরা বায়ু সম্পর্কে এবার আমরা আরো একটু গভীরে যাবো। বায়ু দশ রকম বা বায়ুর দশটি গুন্ - প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান (এগুলো অর্থাৎ এই পাঁচটি  আমরা জানি ) এছাড়া আছে, নাগ, কূর্ম, কৃকর অর্থাৎ কয়ার পাখি, দেবদত্ত্ব( দেবতাদের কর্তৃক প্রদত্ত্ব ) ও ধনঞ্জয় (যিনি ধনকে জয় করেছেন)। এই মোট দশটি বায়ুর গুন্। প্রাণবায়ু আমাদের হৃদয়ে অবস্থিত। অপান আমাদের গুহ্যদেশে। নাভিদেশে আছে সমান, কন্ঠে উদানবায়ু, এবং সর্বশরীরে ছড়িয়ে আছে ব্যানবায়ু। এই পাঁচটি বায়ু প্রধান।  নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত্ব ও ধনঞ্জয় - এগুলো আমাদের সমস্ত  নাড়ীতে অবস্থান করে। অর্থাৎ আমাদের শরীরে যে ৭২০০০ নাড়ী  আছে, তার মধ্যে অবস্থান করে।  তবে প্রধানত পাঁচটি নাড়ী অর্থাৎ ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাক্ষ্যা ও চিত্রাণি এই পাঁচটি নাড়ীতে অবস্থান করে। কেউকেউ বলে থাকেন, ললাট, উরঃ, স্কন্ধ, হৃদয়, নাভি, ত্বক ও অস্থিতে এই পাঁচ নাগাদি বায়ু অবস্থান করে।

আমরা যে সাতটি তল ও  লোকের কথা জানি, সেগুলোর অবস্থান এই রকম :
লোক :ভূর্লোক  নাভিদেশে, ভুবর্লোক হৃদয়ে, স্বর্লোক আমাদের কন্ঠে, মহর্লোক আমাদের চক্ষুদ্বয়ে।  ভ্রূদ্বয়ে আমাদের জনলোক, ললাটে তপোলোকে, সহস্রারে সত্যলোক।
তল:তল সাতটি।  তাদের অবস্থান এই রকম : পাদের আধোভাগ হচ্ছে অতল, পাদের উর্ধভাগ হচ্ছে বিতল।জানুদ্বয়ে সুতল, সন্ধি-রন্ধ্রে হচ্ছে তল, গুদমধ্যে বা গুহ্যমধ্যে তলাতল, লিঙ্গমূলে রসাতল,পাদের অগ্রভাগ ও কটির সন্ধি-স্থলে পাতাল।
পর্বত :আমাদের মূলাধার চক্রে একটা ত্রিকোণ কল্পনা করা হয়েছে। এটি পর্বতের বিশেষ অবস্থান কেন্দ্র। ত্রিকোণের উর্দ্ধকোনে  মন্দর  পর্বত। ডানকোনে কৈলাশ পর্বত। বামকোনে হিমালয়। এছাড়া ত্রিকোণের উর্ধভাগে বিন্ধ্য ও বিষ্ণু পর্বত। এছাড়া আছে ত্রিকোণে মেরু পর্বত। এই মোট সাতটি পর্বতের অবস্থান কেন্দ্র।
দ্বীপ :আমাদের দেহের অস্থিতে অবস্থান করছে জম্বুদ্বীপ, মাংসে কুশদ্বীপ, শিরা সমূহে ক্ৰৌঞ্চদ্বীপ, রক্তে আছে শাকদ্বীপ।  আমাদের শরীরের উর্ধভাগে সমস্ত সন্ধিদেশে শাম্বলি দ্বীপ, লোমপূর্ন স্থানে প্লক্ষদ্বীপ এবং নাভিতে পুস্কর দ্বীপ।
সমুদ্র :লবন সমুদ্র আমাদের মূত্র। শুক্র হচ্ছে ক্ষীরোদসাগর। মজ্জা হচ্ছে দধিসাগর। চর্ম হচ্ছে ঘৃতসাগর। বসা অর্থাৎ আমাদের অবস্থিতি বা আধার হচ্ছে  জল সাগর। কটিরক্তে ইক্ষুসাগর। এবং শোনিতে সুরাসাগর অবস্থিত।
গ্রহ :নাদচক্রে সূর্য অবস্থিত। বিন্দুচক্রে চন্দ্র। মঙ্গল আছে আমাদের চক্ষুতে। হৃদয়ে আছে বুধ।  পেটে বা উদরে আছে বৃহস্পতি। শুক্রে আছে শুক্রগ্রহ। নাভিচক্রে শনি, মুখে আমাদের রাহু আর নাভিতে কেতু।

ঈশ্বরের প্রকাশ স্বরূপ এই ব্রহ্মান্ড। আর এই ব্রহ্মান্ডের ক্ষুদ্র সংস্করণ হচ্ছে আমাদের এই মানবদেহ। এর মূল্যশুধু  অসীম নয়, এটি একটি দুর্লভ বস্তূ। আমরা কেবল বাইরে আমার স্বামীকে খুঁজছি। স্বামীতো ঘরেই আছেন। অশরীরী আমাদের শরীরেই লুকিয়ে আছেন। এই দেহের মধ্যেই গঙ্গা-যমুনা। এখানেই মিলনক্ষেত্র গঙ্গাসাগর। এখানেই প্রয়াগ, হরিদ্বার, বারাণসী। এটাই তীর্থক্ষেত্র। এটাই পীঠস্থান। রত্নসার বলছে :
ভান্ডকে জানিলে জানি ব্রহ্মাণ্ডের তত্ত্ব।
ভান্ড বিচারিলে জানি আপন মাহাত্ম।

বহু ধর্মমতে আমাদের এই দেহের মধ্যেই ঈশ্বরের বাসস্থান কল্পনা করা হয়েছে। এটা  শুধু কল্পনা নয়, এটি বাস্তব সত্য। প্রথম দিকে এই কল্পনা নিয়ে এগুতে হয়। ক্রমে ক্রমে এই সত্য সাধকের উপল্বদ্ধিতে আসে। এমনকি কিছু কিছু সূক্ষ্মতত্ত্ব সামনে আসে, যখন মনে ঈশ্বর সম্পর্কে দৃঢ়তা আসে। এমনকি ঈশ্বরের সঙ্গে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রতিনিয়ত ঈশ্বরের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। সমস্ত সাধনাই আত্মউপলব্ধির সাধনা। এবং একমাত্র দেহকে অবলম্বন করেই আমরা স্থূল থেকে সূক্ষ্মে অগ্রসর হয়ে, সবশেষে আত্মার স্বরুপত্বে পৌঁছানো যায়। স্থুল থেকে সূক্ষ্মে অগ্রসর হওয়া মানে, সৃষ্টিধারার বিপরীত গতিতে অগ্রসর হওয়া। জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন দুটো ভাবে হতে পারে, এক যদি পরমাত্মা স্বেচ্ছায় জীবাত্মার কাছে আসেন, আর জীবাত্মা যদি তার গতি পরমাত্মমুখী করেন। তো দেহের সাধন দ্বারা  মানুষের সহজাত স্বাভাবিক অবস্থা লাভ করা। এই অবস্থাতেই মানুষ ব্রহ্ম-স্বরূপত্ত্ব লাভ করে। তাই তন্ত্রমতে চক্রভেদ, বা পাতঞ্জল মতে অষ্টাঙ্গ যোগাভ্যাস, বেদান্তের পঞ্চকোষ-বিবেক  সাধন, বৌদ্ধদের কায়-বাদ, বৈষ্ণবদের ভক্তিসাধন, বাউলদের সহজিয়া সাধন, মূলত একই পথের প্রকারভেদ মাত্র। তাই লালন বলছেন, একবার আপনারে চিনলে, পরে যায় অচেনারে চেনা।
-----------------


মাণ্ডুক্য উপনিষদ শ্লোক : ০১/০৪-৫
 
"স্বপ্নস্থানঃ অন্তঃ প্রজ্ঞঃ সপ্তাঙ্গ একোনবিংশতি মুখঃ 
প্রবিবিক্ত ভূক তৈজসঃ দ্বিতীয়ঃ পাদঃ"। (০১/০৪) 

স্বপ্ন জগতে যখন   স্থান হয়, তখন অন্তরেন্দ্রীয়ের অর্থাৎ অন্তঃকরণ-এর জ্ঞান হয়।  তখন সাত অঙ্গবিশিষ্ঠ ও ঊনিশ মুখ তৈজস বিশিষ্ঠ পুরুষ সূক্ষ্ম জগতের ভোক্তা হয়ে থাকেন।  একেই  পরমাত্মার দ্বিতীয়পাদ বলে। 

জাগ্রত অবস্থায় আমরা যেমন বাহ্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা স্থূল জগৎবিষয়ের জ্ঞান হয়, তেমনি স্বপ্নাবস্থায় আমাদের অন্তর ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অর্থাৎ মনের দ্বারা আমাদের  সূক্ষ্ম জগতের জ্ঞান হয়। জাগ্রত অবস্থায় আমরা বহির্মুখী থাকি, কিন্তু স্বপ্নাবস্থায় আমরা অন্তর্মুখী হয়ে যাই। এই অবস্থাতেও আমাদের পূর্ব-উক্ত সাতটি অঙ্গ ও উনিশটি ইন্দ্রিয় অটুট থাকে। 
সাতটি লোক - ভূঃ  ভুবঃ স্বঃ মহঃ  জনঃ  তপঃ সত্যম। ভূর্লোক  নাভিদেশে, ভুবর্লোক হৃদয়ে, স্বর্লোক আমাদের কন্ঠে, মহর্লোক আমাদের চক্ষুদ্বয়ে।  ভ্রূদ্বয়ে আমাদের জনলোক, ললাটে তপোলোক, সহস্রারে সত্যলোক।উনিশটি মুখ, এগুলো হচ্ছে পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়, (চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক)  পাঁচ কর্ম্মেন্দ্রিয় (হাত, পা, বাক, পায়ু, উপস্থ )  পাঁচ প্রাণ ( প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান) এবং মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার। 

তো জাগ্রত অবস্থায় আমরা স্থূলভূক আর স্বপ্ন অবস্থায় আমরা প্রবিবিক্ত ভূক। প্রবিবিক্ত কথাটার অর্থ হচ্ছে সূক্ষ্ম। প্রবিবিক্ত কথাটার আরো একটা অর্থ আছে, "যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে"।  অর্থাৎ যাকিছু আমরা জাগ্রত অবস্থায় দেখি, শুনি, বলি, বা চিন্তা করি, তা আমাদের প্রথমে মনের উপরে ছাপ  ফেলে, এবং কখনো কখনো তা স্বপ্নাবস্থায় দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।  আসলে আমরা যাকিছু কামনা করি, সেই কামনা দ্বারাই আমরা উপভোগ্য বস্তুর নিকট উপস্থিত হই। এবং সেই মতো শারীরিক ভোগ হয় জাগতিক অবস্থায়, আর মানসিক ভোগ হয় স্বপ্নাবস্থায়। তো স্বপ্নাবস্থায় আমাদের মনের দ্বারা ভোগকর্ম্ম সম্পাদন হয়ে থাকে।  আমাদের মনের যে কামনা বাসনা, এবং আমাদের যে অতীত অভিজ্ঞতা তারই ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের স্বপ্নাবস্থায়। 
   
এই শ্লোকে উপনিষদের ঋষি পরমাত্মার দ্বিতীয় পাদের কথা বলছেন। এই স্বপ্নাবস্থাকেই  বলা হচ্ছে দ্বিতীয়পাদ। এখানেই সেই সাত অঙ্গ যুক্ত এবং উনিশটি মুখ সম্পন্ন অভিমানী জীবাত্মা সূক্ষ্ম বিষয়ের উপভোগ করেন। জাগ্রত অবস্থায় স্থূল শরীরে যেমন তিনি স্থূল জগতের জ্ঞান অৰ্জন করেন, তেমনি সূক্ষ্ম শরীরে স্বপ্নাবস্থায় সূক্ষ্ম বিষয়কে উপভোগ করেন। এই জগতেরই নিয়ন্তা বা জ্ঞাতা বা ভোক্তা  হচ্ছেন, একই পরম-আত্মা । এই স্বপ্নের জগৎকে উপনিষদ বলছেন, তৈজস অবস্থা অর্থাৎ পরম-জ্যোতির অবস্থা। তেজঃ থেকে তেজসঃ - তৈজসঃ । ওঙ্কারের এটি দ্বিতীয় মাত্রা "উ" . জাগ্রত অবস্থায় চৈতন্যের  খেলা চলে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে, আর স্বপ্নাবস্থায় চৈতন্যের খেলা চলে অন্তরেন্দ্রিয় মনের মাধ্যমে। 
--------------------

মাণ্ডুক্য উপনিষদ শ্লোক নং ০১/০৫

"যত্র সুপ্তো ন  কঞ্চন কামং কাময়তে ন কঞ্চন স্বপ্নং পশ্যতি তৎ সুষুপ্তম ।  সুষুপ্তস্থান একীভূতঃ প্রজ্ঞানঘন এব  আনন্দময়ো  হি আনন্দভুক চেতমুখঃ প্রাজ্ঞঃ তৃতীয়ঃ পাদঃ । "(০১/০৫) 

স্বপ্নহীন  গভীরঘুমের অবস্থায় যখন মনের মধ্যে  কামনা বাসনা সুপ্ত থাকে, মন নিষ্ক্রিয় হয়ে অবস্থান করে, সেই অবস্থাকে বলা হয় সুষুপ্তি। সুসুপ্তির অবস্থায় মনের সঙ্গে আত্মার মিলন হয়, তখন কেবল ঘনীভূত চৈতন্য।  আর কিছুই থাকে না। এই ঘনীভূত চৈতন্য-এর স্বরূপ হচ্ছে আনন্দ। এটি তুরীয় অবস্থার নিকটবর্তী -চেতমুখঃ । এই অবস্থাকে বলা হয় প্রাজ্ঞ, যা আত্মার তৃতীয় অবস্থা। আত্মা এখানে আনন্দভূক। 

জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি এই তিন অবস্থা সম্পর্কেই  আমাদের একটা অভিজ্ঞতা আছে। জাগ্রত ও স্বপ্ন অবস্থা অর্থাৎ এই যে স্থূল জগৎ (যা আমরা জাগ্রত অবস্থায় অনুভব করে থাকি) ও অনুরূপ একটা সূক্ষ্ম জগৎ (যা আমরা স্বপ্নাবস্থায় অনুভব করে থাকি),  তা আমরা ওই  অবস্থা থেকে ফিরে এসে রোমন্থন করতে পারি। কিন্তু সুসুপ্তির অবস্থায় কি ঘটে থাকে তা আমরা মনে  করতে পারি না।  আসলে সুসুপ্তির অবস্থায় থাকে কেবল চৈতন্য, যা বিষয় রহিত। এই যে চৈতন্যের কথা বলা হলো এটি কিন্তু আমাদের জাগ্রত অবস্থায় আছে, স্বপ্নাবস্থায়ও আছে, কিন্তু তা বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত।  কিন্তু সুসুপ্তির সময় চৈতন্য বিষয় রহিত হওয়ায়, তখন কোনো বিষয় বোধ থাকে না। চৈতন্য হচ্ছেন দ্রষ্টা, কিন্তু যেখানে দৃশ্য নেই, সেখানে কেবলই  চৈতন্যের প্রকাশ। 

মাণ্ডুক্য উপনিষদ - আগম  প্রকরণ - শ্লোক-০৫-০৬

এই অবস্থাটা বোঝা আমাদের পক্ষে একটু কষ্টকর। ধরুন অমাবশ্যার রাত, ঘরের মধ্যে গাঢ় অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তো ঘনীভূত অন্ধকারে সব যেন একাকার মনে হয়। ঘন অন্ধকারে ভিন্ন ভিন্ন  বস্তু বা পদার্থের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না। যখন আলোর মধ্যে এলাম, বা আলো জ্বালালাম, তখন আমি চেয়ার, টেবিল, বিছানা, আলমারীকে আলাদা ভাবে দেখতে পেলাম।  যতক্ষন ঘন অন্ধকার ছিল, ততক্ষন আমার কাছে ঘরের মধ্যে সব কিছুই যেন এক বলে মনে হচ্ছিলো। সব আছে, জগৎ আছে, চেয়ার টেবিল আছে, কিন্তু অন্ধকার এমনভাবে আমাকে চেপে বসেছে, যে আমি আর কাউকে আলাদা করতে পারছিলাম না। আমার মধ্যে জগতের বস্তুগত অনুভূতি তখন লোপ পেয়েছে। এইসময় আমাদের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে। আর এই যে ভয় এটি  জ্ঞানের বা আলোর অভাবে হয়ে থাকে। ঠিক তেমনি  সুষুপ্তি হচ্ছে এমন একটা  অবস্থা যেখানে কেবলমাত্র চৈতন্য অবস্থান করছে, এখানে জগৎ লোপ পেয়ে গেছে। আসলে  জগতের জায়গায় জগৎ আছে, কিন্তু আমার অনুভূতিতে নেই।  এই সুষুপ্তি থেকে যখন আমরা  আবার জেগে উঠি, তখন একটা আনন্দানুভূতির রেশ থেকে যায়। অন্ধকারে যেমন অকারনেই আমাদের ভয় করে, তেমনি সুসুপ্তিতে আমাদের অকারনেই আনন্দ হয়। আবার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলে যেমন ধীরে ধীরে আমাদের ভয় কেটে যায়,  এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসি, তেমনি সুষুপ্তি থেকে জেগে উঠে আমরা আবার নিজেকে জগতের সঙ্গে  মানিয়ে নেই।  পূর্বাবস্থায় ফিরে আসি। 

এই যে সুসুপ্তির অবস্থা এঁকে উপনিষদের ঋষি বলছেন, চেতমুখঃ।  অর্থাৎ চেতন ভান্ডারের মুখ।  অর্থাৎ এখান  থেকেই যেন চেতনা স্ফূরিত হচ্ছে, বা বেরিয়ে  আসছে এবং স্বপ্ন ও  জাগ্রত  অবস্থাযা এসে অনুভূতি  গ্রহণ করছে, অর্থাৎ ভোগ সম্পাদন করছে ।  তো চৈতন্য যখন সুসুপ্তির মধ্যে ছিল, তখন কোনো দ্বৈত ভাব ছিল না, কিন্তু একটা অনুভূতি ছিল, আর তা হচ্ছে আনন্দ। এইজন্য এই অবস্থায় আত্মাকে  বলা হচ্ছে আনন্দভূক। তো আত্মা  জাগ্রত অবস্থায় স্থূলভূক, স্বপ্নাবস্থায় প্রবিবিক্ত ভূক বা সূক্ষ্মভূক, আর সুসুপ্তির অবস্থায় আনন্দভূক। 

এখন কথা হচ্ছে, এই সুসুপ্তির অবস্থায় আমরা কেবল মাত্র আনন্দ ভক্ষণ করি।  তাহলে তো এখানে আমরা দীর্ঘকাল  থাকতে পারি।  এই গাঢ়  ঘুম থেকে কে আমাদের জাগিয়ে তোলে ? এই অবস্থা থেকে জাগিয়ে তোলে আমাদের অজ্ঞান বা অবিদ্যা। আরো একটা কথা হচ্ছে, এই যে আনন্দ এটি কিন্তু চিরস্থায়ী আনন্দ নয়, আনন্দের একটা স্ফুলিঙ্গ মাত্র । এইজন্য আমরা সুসুপ্তিতে আমরা বেশিক্ষন থাকতে পারি না। এই সুসুপ্তির অবস্থাতেও আমাদের  অজ্ঞান থাকে । যার জন্য আমরা ঘুম থেকে জেগে উঠে আবার এই অজ্ঞানরূপ মায়ার সংসারে বদ্ধ হয়ে যাই। কখনো সুখ, আবার কখনো দুঃখের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি। তো যার মধ্যে ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে, অর্থাৎ উচ্চকোটির যোগীপুরুষগন যখন ধ্যানের গভীরতার মধ্যে ডুবে থাকেন, তখন এই আনন্দকে তাঁরা দীর্ঘায়িত করে অবস্থান করেন। পরম-আত্মার এই তৃতীয় অবস্থাকে অর্থাৎ সুসুপ্তির অবস্থাকে বলা হচ্ছে ওঙ্কারের তৃতীয় পাদ "ম".

তো প্রথমে আমরা স্থূল শরীরে, জাগ্রত অবস্থায় বাহ্য জগতের উপলব্ধি করি। দ্বিতীয় অর্থাৎ স্বপ্নাবস্থায় আমরা সূক্ষ্ম  মানসিক শরীরে সূক্ষ্ম জগতের অনুভব করি।  এবং সুসুপ্তিতে আমরা কারন শরীরে আনন্দ জগতের বাসিন্দা হয়ে যাই। এই হচ্ছে আত্মার তিন-অবস্থা। 
------------------------- 

মাণ্ডুক্য উপনিষদ শ্লোক ০১/০৬

এষ সর্বেশ্বর এষ  সর্বজ্ঞ এষ অন্তর্যামী এষ যোনিঃ সর্বস্য প্রভব-অপ্যয়ৌ হি ভূতানাম। (০১/০৬) 

এষ অর্থাৎ আগে যে আমরা তিনপাদের কথা শুনেছি, এই তিন পাদে যিনি অবস্থান করেছেন, তিনি সর্বেশ্বর, বা  ঈশ্বরেরও ঈশ্বর তিনিই সর্বজ্ঞ, তিনিই অন্তর্যামী। তিনিই যোনী অর্থাৎ কারন বা উৎপত্তি স্থান আবার লয়ের স্থান।প্রভব-অপ্যয়ৌ অর্থাৎ জন্ম ও মৃত্যুর  কারণ । ভূতানাম অর্থাৎ সর্ব্ব ভূতের কারন স্বরূপ  বর্ধনশীল ও বিনাশকারী। 

তো প্রথমে আমরা জাগ্রত অবস্থায় বৈশ্বানর, পরে স্বপ্নাবস্থায় তৈজস, শেষে সুসুপ্তির অবস্থায় প্রাজ্ঞ নামে আত্মার উপস্থিতির কথা শুনেছিলাম। এই তিন অর্থাৎ বৈশ্বানর, তৈজস ও প্রাজ্ঞ এই তিন নামই এক পরমাত্মার  নাম। এখন কথা হচ্ছে, এই যে বৈশ্বানর ইনি আমাদের বহিরেন্দ্রীয়ের  দ্বারা স্থূল জগতের বিষয়কে  ভোগ করেন, স্বপ্নাবস্থায় তৈজস ইনি মন নামক অন্তরেন্দ্রীয়ের দ্বারা সূক্ষ্ম জগতের বিষয় ভোগ করেন, কিন্তু সুসুপ্তির অবস্থায় প্রজ্ঞা কার দ্বারা আনন্দকে ভোগ করেন ? উপনিষদ বলছেনা, এই আনন্দ কোনো কিছুর উপরে নির্ভরশীল নয়, তাই এই আনন্দ ভোগের জন্য বাহ্য  বা অন্তর ইন্দ্রিয়ের প্রয়োজন হয় না। 

মাণ্ডুক্য উপনিষদ - আগম  প্রকরণ - শ্লোক-০৬-০৭

আত্মাই যেহেতু সমস্ত জ্ঞানের উৎস তাই তিনি সর্বজ্ঞ । তিনি সকলের  অন্তরে স্থিত, হয়ে দ্রষ্টা স্বরূপ অবস্থান করছেন, তাই তিনি অন্তর্যামী। এই আত্মাই সর্বস্য যোনি অর্থাৎ সমস্ত কিছুর কারন বা উৎস। এই আত্মাই সমস্ত বস্তুর উৎপত্তি ও বিনাশের বা জন্ম মৃত্যুর কারন।  আবার জন্মের আগে, এবং জন্মের পরে যেহেতু এই আত্মাতেই সবকিছু বিলীন হচ্ছে তাই তিনি ভূতানাম। 

এখন কথা হচ্ছে, আমরা সবাই সেই আত্মা থেকে এসেছি, আবার আত্মাতেই ফিরে যাবো। এমনকি আমি নিজে স্বয়ং আত্মা এই ব্যাপারটা আমরা বুঝবো কি করে ? এই প্রসঙ্গে উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, প্রথমে তুমি  তোমার নিজের অস্তিত্ত্বে বিশ্বাসী হও। নিজের দিকে তাকালে বুঝতে পারবে, প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল এই দেহ মনের একটা সত্ত্বা তুমি। যা কখনোই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। শিশু অবস্থায়, যে তুমি ছিলে যুবক অবস্থাতেও সেই একই তুমি আবার বৃদ্ধাবস্থাতেও সেই একই তুমি। তুমিই শিশু, তুমিই যুবক, আবার তুমিই বৃদ্ধ। এই যে তিন অবস্থার তুমি ইনি কে ? একি কেবলই তোমার ব্যক্তি সত্ত্বা ? না অভিন্ন কোনো সত্ত্বা যা সমস্ত জগৎ ব্যাপী, আবার সমস্ত ব্যক্তি সত্ত্বার মধ্যে বিরাজকারী একজন অপরিবর্তনীয় নিত্যসত্ত্বা। যদি এই নিত্য সত্ত্বাকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনীয় সত্ত্বা থেকে  আলাদা করতে পারো, তবে তুমি সেই পরম-সত্ত্বার সন্ধান পেতে পারো। আর তখন বুঝতে পারবে এই নিত্যসত্ত্বা দুটি নয়, একটি। আর এই একটি সত্ত্বাই সবার মধ্যে বিরাজ করছে। তখন তোমার মধ্যে থেকে ভেদবুদ্ধি চলে যাবে। তখন জীবাত্মা ও পরমাত্মা যে এক, সেই  উপলব্ধিতে  তুমি  উদ্বেল হয়ে সমস্ত সুখ-দুঃখের পারে, আনন্দ সাগরে ভাসতে পারবে। এই কথাগুলোই উপনিষদের ঋষিগণ আমাদের মনের মধ্যে মনন করবার জন্য, সত্যকে উপলব্ধি করাবার  জন্য  বারবার একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন।
--------------  

"ন অন্তঃ প্রজ্ঞং ন বহিঃ প্রজ্ঞং ন উভয়ঃ  প্রজ্ঞং ন প্রজ্ঞানঘনং ন প্রজ্ঞং ন অপ্রজ্ঞম। অদৃষ্টম অব্যবহার্যম অগ্রাহ্যম অলক্ষণম অচিন্তম অব্যাপদেশ্যম একাত্ম প্রত্যয়সারং  প্রপঞ্চ উপশমং  শান্তং শিবম অদ্বৈতং চতুর্থং মন্যন্তে স আত্মা স বিজ্ঞেয়ঃ।"  (০১/০৭) 

তুরীয় অবস্থায় যে পরমাত্মা তিনি অন্তরস্থ অর্থাৎ স্বপ্নাবস্থার ঘটনা সম্পর্কে সচেতন নয়, আবার বাইরের জগতের ঘটনা সম্পর্কেও সচেতন নন, অর্থাৎ  এই  দুই অবস্থার ঘটনা সম্পর্কেও সচেতন নন। আবার  সুসুপ্তির  অবস্থার  প্রজ্ঞা তিনি  নন আবার "ন  অপ্রজ্ঞং" অর্থাৎ অসচেতনও  নন।  

তিনি অদৃষ্ট, অর্থাৎ দৃষ্টির অগোচর, ব্যবহারের যোগ্য নন, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন,  তিনি সকল জ্ঞানের অতীত বা অলক্ষনম অর্থাৎ তার কোনো লক্ষণ বা উপাধি নেই , তিনি চিন্তার অতীত, তিনি  বর্ণনার অতীত। এক আত্মাই সার।  এই  ভৌতিক  জগতের তখন অবসান হয়। এখানে শান্তি, শিবম অর্থাৎ সর্বমঙ্গলময়, অদ্বিতীয়  চৈতন্য থাকে এই চতুর্থ বা তুরীয় অবস্থায়। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি এই তূরীয়কেই  আত্মা বলে জানেন। এই আত্মাই একমাত্র জ্ঞানের বিষয়। 
তাঁকেই, একমাত্র  তাঁকেই  জানতে হবে অর্থাৎ কেবল পরমাত্মাকে  উপলব্ধি করতে হবে। এই হচ্ছে সাধকের উদ্দেশ্য। পরমাত্মার সম্পর্কে  কোনো কথা না  বলাই শ্রেয়। জাগ্রত অবস্থায় যিনি বহিঃপ্রজ্ঞং , স্বপ্নাবাস্থায় যিনি  অন্তঃপ্রজ্ঞং,  সুষুপ্তির অবস্থায় যিনি  প্রজ্ঞানঘনং,  আবার পরমআত্মা এই তিন অবস্থার উর্দ্ধে তিনি "একাত্মপ্রত্যয়সারং" - আমাদের অহংবোধ। 
কিন্তু আমাদের এই যে অহংবোধ এতো আমাদের দেহ মনের সঙ্গে অভিন্ন। এই দেহ-মন চলে গেলে আমাদের এই অহং থাকে কোথায় ? নাকি আমাদের দেহ-মন চলে গেলে, আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না ? উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, তুমি ব্রহ্ম, আমি ব্রহ্ম, আমরা সবাই ব্রহ্ম। সবাই আমরা এই অহং-এর আশ্রয়ে আছি।  আমার এই অহংবোধ চলে গেলে, আর কিছু থাকে না। আমরা যখন সব কিছুকে ছেড়ে এই অহংকে আশ্রয় করতে পারি তখন, কেবল একটাই সত্ত্বা থাকে আর তা হচ্ছে অহং। মহৎ-অহং, সমষ্টি  অহং, নাম রূপ বর্জ্জিত কেবলই অহং। অহং যখন দেহ-নাম-রূপ-বস্তু কেন্দ্রিক ততক্ষন এই অহং-এর মধ্যে ভিন্নতা।  যখন এই দেহ-নাম-রূপ-বস্তু-বিষয় বর্জ্জিত হবে, তখন যে অহং থাকবে, তা বিশ্বব্যাপী একটাই সত্ত্বা। 

একেই উপনিষদের ঋষিগণ  "একাত্মপ্রত্যয়সারং" - একত্ববোধ। তখন কেবল শান্তম, শিবম, অদ্বৈতম, অর্থাৎ শান্তি, আনন্দ, এবং একত্মবোধ। একেই বলে পরমাত্মার চতুর্থ অবস্থা - তুরীয় অবস্থা - ত্রিমাত্রা যুক্ত ওঙ্কার। 

এই অবস্থায় প্রপঞ্চের উপশম হয় - প্রপঞ্চ - উপশমং - প্রপঞ্চ হচ্ছে মায়া। মায়া রূপ পঞ্চভূতের দ্বারা গঠিত এই যে জগৎ তাকে উপেক্ষা বা অস্বীকার করতে পারলেই আমরা এই অদ্বৈত সত্ত্বাকে উপলব্ধি করতে পারি। 

মাণ্ডুক্য উপনিষদ - আগম  প্রকরণ - শ্লোক - ০৭-০৯

ঋষি বলছেন, "সঃ বিজ্ঞেয়" - এঁনাকেই জানাতে হবে, ইনিই জানবার একমাত্র বিষয়।  ইনিই আত্মা, পরমাত্মা। এখন  কথা হচ্ছে, জানতে তো হবে, জানবে কে ? আত্মা যদি একমাত্র জ্ঞেয় বস্তু হন, তবে জ্ঞাতা কে হবে ? আসলে জানবার কিছু নেই, কেবল অজ্ঞানকে দূর করতে হবে। লোকে বলে অন্ধকার দূর করতে গেলে, আলো  জ্বালতে  হবে।  পন্ডিতরা বলেন, অজ্ঞানকে দূর করতে গেলে, জ্ঞানের আলো  জ্বালতে  হবে।  উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, আলো  নিভিয়ে দাও,  এই আলো তো কৃত্তিম, অন্ধকারই সত্য। অন্ধকারই অসীম। আলো সীমাবদ্ধ। আমরা যাকে  জ্ঞান বলি, তা তো বিষয় নির্ভর অজ্ঞান মাত্র। এই অজ্ঞানের আলোটাকে নিভিয়ে দিলেই সত্য উদ্ভাসিত  হবে। জ্ঞাতা, জ্ঞেয়, জ্ঞান এই তিনিই এক। ব্রহ্ম সেই একজনই যাঁকে  তোমরা খুঁজছো। ব্রহ্ম স্বয়ং তুমি যাঁকে তুমি খুঁজছো। বহির্মুখী দৃষ্টি অন্তর্মুখী হোক, আর নিজেকে জেনে সুখী ভব। 

তো আমরা চারটি অবস্থার কথা শুনলাম, প্রথম তিনটি হচ্ছে বিশ্ব, তৈজস, ও প্রাজ্ঞ, চতুর্থটি হচ্ছে নিরপেক্ষ, বা তুরীয়। প্রথম তিনটি অজ্ঞানের অবস্থা। চতুর্থ অবস্থা হচ্ছে চৈতন্য স্বরূপ। এই অবস্থায় আনুষঙ্গিক সমস্ত বিষয় দূরীভূত হয়ে যায়।  

সুষুপ্তি ও তুরীয় অবস্থার মধ্যে পার্থক্যটা আরো একবার বুঝবার চেষ্টা করি। জাগতিক অবস্থায়, আমাদের দেহ মন ইন্দ্রিয়সকল সক্রিয় থাকে, স্বপ্নাবস্থায় আমাদের দেহ  নিষ্ক্রিয় থাকে কিন্তু অন্তর-ইন্দ্রিয় মন সক্রিয় থাকে। সুসুপ্তির অবস্থায় দেহ-মন-ইন্দ্রিয় সবকিছু নিষ্ক্রিয় হয়ে অবস্থান করে। কিন্তু এই  সুসুপ্তির অবস্থায় আমরা অচেতন হয়ে পড়ি। অর্থাৎ অজ্ঞান থাকি, একটু ঘুরিয়ে বলা যায়,  আমাদের চৈতন্য বলে কিছু থাকে না। যার জন্য আমরা যখন আবার  ঘুম থেকে জেগে উঠি, তখন পূর্বাবস্থায় ফিরে যাই। অর্থাৎ বদ্ধ অবস্থায় ফিরে যাই। কিন্তু তুরীয় অবস্থায় আমাদের এই অজ্ঞানতা থাকে না। তাই বলে কি জ্ঞান হয়, না তাও নয়, তখন না জ্ঞান না অজ্ঞান, তখন নিরপেক্ষ দ্রষ্টা মাত্র। তখন একটা অদ্বিতীয় স্বতন্ত্র অবস্থা। তখন  তুমি সেই অপরিবর্তনীয় নিত্য-সত্য স্বরূপ। যার কথা আমরা আগে শুনেছিলাম।  তখন তুমিই সর্বজ্ঞ পুরুষ। তখন একটাই বোধ  তা হচ্ছে আমিই অভিন্ন আত্মা যা সকলের মধ্যে বিরাজ করছে। তুরীয় অবস্থায় কেবলই জ্ঞান, না জ্ঞাতা  না জ্ঞেয়।  এই অবস্থা কার্য কারনে অধীন নয়। আর সমস্ত অবস্থাই কার্য কারনে অধীন। 

এখন কথা হচ্ছে এই তুরীয় অবস্থাই  যদি আমাদের লক্ষ্য হয়, তবে সেখানে যাওয়া  কিভাবে সম্ভব ? এই পথে যেতে বাধা কি ? এসব কথা আমরা ধীরে ধীরে শুনবো, উপনিষদের ঋষিগণের কাছ থেকে। 

------------------- 
মাণ্ডুক্য উপনিষদ - আগম  প্রকরণ - শ্লোক - ০৮-১১
        
সঃ অয়ম  আত্মা অধ্যাক্ষরম ওঙ্কার অধিমাত্রম পাদা মাত্রা মাত্রাশ্চ পাদাঃ  অকার উকারো  মকার  ইতি। (০১/০৮)

এই অধি-অক্ষর ওঙ্কারই আত্মা। মাত্রাগুলো তাঁর  পাদ (জাগ্রত-স্থান - বৈশ্বানর, স্বপ্ন-স্থান তৈজস, সুষুপ্ত-স্থান  প্রাজ্ঞ)। অর্থাৎ আত্মার পাদসমূহ ওঙ্কারের মাত্রা। অকার উকার মকার  এরাই প্রণবের মাত্রা।

তিন মাত্রাযুক্ত ওঙ্কার পরমেশ্বর বাচক। ওঙ্কার যেমন তিন মাত্রার উচ্চারনে পরে নিজেকে পূর্ণ করেন, বা যথার্থ ভাবে ধ্বনিত হন । তেমনি পরমাত্মা তিন অবস্থার পারে এসে প্রকৃত অবস্থায় অবস্থান করেন। অর্থাৎ তুরীয় অবস্থা আত্মার প্রকৃত অবস্থা।   


"জাগরিত স্থানো বৈশ্বানর অকারঃ প্রথমা মাত্রা আপ্তেঃ আদিমত্বাৎ বা অপ্নোতি হ বৈ সর্বান কামান আদিঃ চ ভবতি যঃ এবং বেদ । " (০১/০৯) 

জাগ্রত অবস্থায় বৈশ্বানর রুপি "অ" প্রথম মাত্রা কারন এটাই প্রথম।  বৈশ্বানর ও অ-বর্ণ দুটোই সর্বব্যাপী। যার এই নিশ্চিতজ্ঞান হয়েছে, তিনি সমস্ত কাম্য বস্তু পেয়েছেন, এবং তিনি সমস্ত কাম্যবস্তু লাভ করে সর্ব মান্যতা লাভ করেন। 

"অ" বর্ণটি জাগ্রত অবস্থায় বৈশ্বানর। সব শব্দের  মধ্যে যেমন আছে অকার, সব বর্ণের প্রথমে আছে যেমন অকার, তেমনি বিশ্বের মধ্যেই প্রথম ব্যাপক সেই ঈশ্বরের অবস্থান। এইজন্য ঋষিগণ প্রথমে বিশ্বকেই (স্থূল জগৎ) জ্ঞাত হতে বলছেন। আর এই বিশ্বকে সম্যকরূপে জ্ঞাত হতে পারলে, তিনি জাগতিক সমস্ত কামনা বাসনা পূরণে সক্ষম হন।  আর এই পুরুষই জগৎ সংসারে শ্রেষ্ঠ হয়ে থাকেন। সবার কাছে তিনি মান্যতা পান। দেখুন নাম ও নামি একই, তেমনি প্রতীক ও যাঁর  প্রতীক, এই দুইই এক ও অভিন্ন। তো বৈশ্বনারের প্রতীক যেহেতু অকার,  তাই এই অকার ও বৈশ্বানর  এক এবং অভিন্ন। এই জ্ঞান যার হয়েছে, তিনিই আপ্তকাম পুরুষ। ইনি  সকলের মধ্যে প্রধান ও সর্বমান্য হয়ে থাকেন।    
----------

"স্বপ্নস্থানঃ তৈজস উকারো দ্বিতীয়া মাত্রা উৎকর্ষাৎ উভয়ত্বাৎ উৎকর্ষতি হ বৈ জ্ঞান সন্ততিম সমানঃ  চ ভবতি ন  অস্য ব্রহ্মবিৎ কূলে ভবতি য এবং বেদ। " (০১/১০) 

স্বপ্নস্থান তৈজস হচ্ছে ওঙ্কারের দ্বিতীয় মাত্রা উ-কার। যিনি এইরূপ জানেন, তিনি অবশ্যই জ্ঞানের পরম্পরাকে উন্নত করেন , এবং সাম্য ভাব যুক্ত হন। এনার  বংশে অব্রহ্মবিৎ জন্মান না। 

উকার হচ্ছে তৈজসের প্রতীক। এই উকার ওঙ্কারের মধ্যবর্তী অক্ষর। আমাদের বিজ্ঞানময় শরীর  যেমন  অপার্থিব, কিন্তু পার্থিব ও অপার্থিব শরীরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, তেমনি উকার,  অকার (বিশ্ব) ও মকার (প্রজ্ঞা) এই উভয়ের মধ্যবর্তী হয়ে, দুয়ের সঙ্গেই যোগাযোগ রক্ষা করছেন। যার মধ্যে এই জ্ঞান হয়েছে, বুঝতে হবে তাঁর বোধশক্তি, বিচারশক্তি তীক্ষ্ণ। তিনি জাগ্রত  ও সুসুপ্তির পার্থক্য ধরতে পেরেছেন। তাঁর অনুভূতিতে ব্রহ্ম ধরা পড়েছে। উপনিষদ বলছেন, এই ব্রহ্মবিদের কূলে কখনো অব্রহ্মবিদ জন্ম গ্রহণ করেন না। আসলে এই কথার মাধ্যমে ব্রহ্মজ্ঞানের প্রসংসা করা হয়েছে। এককালে এমনকি এখনো হয়তো বিদ্যা কেবলমাত্র বংশগত হয়ে থাকে।  কবিরাজের পুত্র কবিরাজ হন, পালের পুত্র পাল হন, গায়কের বংশে গানের কদর, তেমনি বিদ্বানের পুত্র বিদ্বান হয়ে থাকেন।  ঋষিকুল যেহেতু  বিদ্যাদানে বংশ পরম্পরাতে অধিক গুরুত্ত্ব দিতেন, তাই উপনিষদে এই ধারার সম্মতিসূচক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।   

"সুষুপ্তস্থানঃ প্রাজ্ঞো মকারঃ তৃতীয়া মাত্রা মিতেঃ অপিতের্বা মিনোতি  হ বা ইদং সর্বম  অপ্রীতিঃ চ ভবতি য এবং বেদ ।" (০১/১১) 

সুষুপ্তির অবস্থায় প্রাজ্ঞ হচ্ছে ওঙ্কারের তৃতীয় মাত্রা ম-কার। বৈশ্বানর ও তৈজসের কাল শেষ হলে ম-কার বা প্রাজ্ঞ অবস্থায়  আত্মার কারন শরীরের  মিলন  হয়।  এইরূপ যিনি জানেন, তিনি অবশ্যই সম্পূর্ণ কারন জগৎকে জানেন, এবং সবকিছু নিজের মধ্যে লীন করে নেন। 

সুষুপ্তি বা প্রাজ্ঞ অবস্থাকে, প্রতীক ওঙ্কারের ম-এর দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। তো বিশ্বজগৎ বা স্থূল জগৎ সূক্ষ্মের সঙ্গে বিলীন হয়, সূক্ষ্ম আবার কারনে সঙ্গে বিলীন হয়। এই কারন স্থির শান্ত। এখানে এসে দ্বৈত জ্ঞানের সমাপ্তি ঘটে থাকে।  অ  এবং উ  উভয় এখানে এসে ম-এর সঙ্গে বিলীন হয়।  মানুষ তৈজস অবস্থায় স্বপ্নের জগতে বিচরণ করে, জাগ্রত অবস্থায় স্থূল জগতের বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে, কিন্তু প্রাজ্ঞ বা সুসুপ্তির অবস্থায় মানুষ মৃতবৎ হয়ে যায়।  তখন তার মধ্যে কোনো জ্ঞান থাকে না। এইসময় মানুষ কিছুই জানতে পারে না। কারন এইসময় মানুষের দেহ-ইন্দ্রিয়-মন সব নিষ্ক্রিয়  হয়ে থাকে।  তো ম-কার প্রাজ্ঞ অবস্থার প্রতীক। এই অবস্থায় না থাকে দৃশ্যের  অনুভূতি, না থাকে শব্দের অনুভূতি। সব তখন একাকার হয়ে অনুনাসিক হয়ে যায়। 
----------------- 

মাণ্ডুক্য উপনিষদ শ্লোক ০১/১২ অন্তিম শ্লোক।  

অমাত্ৰঃ চতুর্থ অব্যবহার্য্যঃ প্রপঞ্চ উপশমঃ শিবঃ অদ্বৈত এবম ওঙ্কার আত্মৈব সংবিশতি আত্মনা আত্মনং য এবং বেদ।  (০১/১২) 

আত্মার চতুর্থ অবস্থা অমাত্ৰ, (মাত্রাহীন, অর্থাৎ অসীম)।  ইনি  অব্যবহার্য্য অর্থাৎ ব্যবহারযোগ্য নয়। সেখানে প্রপঞ্চের উপশম হয়, অর্থাৎ জগৎ হারিয়ে যায়। শিবঃ অদ্বৈত অর্থাৎ অদ্বিতীয় শিবস্বরূপের   অবস্থা । এইরূপ ওঙ্কারই অদ্বৈত আত্মা ছাড়া কিছু নয়, যিনি এইভাবে জানেন, তিনি স্বয়ং পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যান, অর্থাৎ আর ফিরে আসেন না। 

মাণ্ডুক্য উপনিষদের এই শেষের পাঁচটি  শ্লোক ব্যাখ্যা শুধু দুরূহ নয়, অসম্ভব। এই জ্ঞান কেবলমাত্র উপল্বদ্ধির বিষয়। আসলে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে সবকিছুর বিচার করি। যা আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে কোনোদিন আসে নি, তার সম্পর্কে ধারণা করা  সম্ভব নয়। যিনি কোনোদিন রসোগোল্লার  খান নি, তাকে রসোগোল্লার রচনা পড়ে, রসোগোল্লার আস্বাদন করানো যাবে না। এর জন্য আমাদের সেই ময়রার কাছে যেতে হবে, যিনি শুধু রসোগোল্লা খেয়েছেন তাই নয়, তিনি এটি হাতে ধরে আপনাকে খাওয়াতেও পারেন। যার কোনোদিন পেটব্যথা হয়নি, তাকে কখনোই ভাষা দিয়ে পেটব্যথা বোঝানো সম্ভব নয়। "চীন চীন করে ব্যাথা করছে," এই  কথার  দ্বারা আসলে কিছুঁই  বোঝানো যায় না। তথাপি এর দ্বারা হয়তো কিছু বুঝি। ভাবের বিনিময় করি। এর বেশি কিছু নয়। 
আমরা জপ-ধ্যান করি।  বলা হয়, একলক্ষ বার  এই মহামন্ত্র  জপ করুন। এইবার এই একলক্ষ বার জপের পরে, কিন্তু সবার মধ্যে একই অনুভূতি হয় না। এই যে অনুভূতি এটি একাগ্রতার উপরে নির্ভর করে, সংস্কারের উপরে নির্ভর করে, এমনকি ঐকান্তিকতার উপরেও নির্ভর করে। আর এই যে একাগ্রতা, ঐকান্তিকতা, এসব বাইরে থেকে পরিমাপ করবার যন্ত্র এখনো আবিস্কার হয় নি।  তো যা ইন্দ্রিয়াতীত, যা বাক্য মনের অতীত, যা সীমাহীন, তাকে বাক্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না। 
 
আমরা এর আগেই শুনেছি, আত্মা  চতুষ্পাদ অর্থাৎ জাগ্রত অবস্থায় বৈশ্বানর, স্বপ্নাবস্থায় তৈজস ও সুসুপ্তির অবস্থায় প্রাজ্ঞ, এবং তুরীয় অবস্থায় শুদ্ধ চৈতন্য।  তেমনি ওঙ্কারের প্রথম যে তিনটি মাত্রা অর্থাৎ অ - উ - ম  এই তিনটি  হচ্ছে আত্মার প্রথম তিন পাদ। তুরীয় অবস্থাকে এই মাত্রার বাইরে রাখা হয়েছে, অর্থাৎ এই তুরীয় অবস্থা অমাত্ৰ। 

তো বিশ্ব  হলো প্রথম অবস্থা,  আবার বর্নমালার প্রথম অক্ষর, বলা হয়, এই প্রথম অক্ষরটি প্রতিটি বর্ণের মধ্যেই রয়েছে। "অ" হচ্ছে স্থূল জগতের প্রতীক। তাই অকার বা বিশ্ব সর্বব্যাপী। 
উ-আর হচ্ছে ওঙ্কারের মধ্যম মাত্রা। উ-কার হচ্ছে অ এবং ম এর মধ্যবর্তী অক্ষর। অর্থাৎ তৈজস বা স্বপ্নাবস্থা হচ্ছে প্রাজ্ঞ ও বৈশ্বানরের মধ্যবর্তী। আবার ম-কার বা আত্মার তৃতীয় অবস্থা হচ্ছে প্রাজ্ঞ যা আত্মার চূড়ান্ত নিষ্ক্রিয়  অবস্থা।
তো প্রথমে আমরা দেহ-মন-ইন্দ্রিয় দ্বারা সবকিছু উপলব্ধি করছিলাম। এর পরে স্বপ্নাবস্থায় এসে, দেহকে নিষ্ক্রিয় রেখে মন নামক অন্তর-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আমরা  সূক্ষ্ম জগতের সবকিছু  উপলব্ধি করতে  লাগলাম।  এর পরে কারন অবস্থায় চলে গেলাম।  এখানে সব কিছু স্থির হয়ে গেলো। এই ব্যাপারটা যেমন ব্যষ্টির ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি সমষ্টির ক্ষেত্রেও সত্য। তো প্রথমে স্থূল সমস্ত-দেহ, তারপরে সমষ্টি-সূক্ষ্ম মন, তার পরে সমষ্টি-কারন শরীর  . এই তিন অবস্থার মধ্যে আমি আত্মা আছি। 

উপনিষদের ঋষিগন  বলছেন, যিনি এই জ্ঞানের অধিকারী হয়েছেন, তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয়। কারন কি ? কারন হচ্ছে, এই  অবস্থায় অদ্বৈতের অনুভূতি হয়। আর অদ্বৈতের অনুভূতি হলে, মানুষের মধ্যে থেকে ভেদ বুদ্ধি চলে যায়। যখন সব কিছুই আমি, যখন নিজেকে সমষ্টির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিতে পারি, যখন স্থূল থেকে সূক্ষ্মে, সূক্ষ্ম থেকে কারনে নিজেকে নিয়ে যেতে পারি, তখন আমরা তুরীয় অবস্থার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই। আপনি যত সুক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর অবস্থার মধ্যে যেতে পারবেন, বা বৃহৎ থেকে বৃহত্তর অবস্থার মধ্যে নিজেকে নিয়ে যেতে পারবেন , তত আপনার মধ্যে ভিন্নতা-বোধ দূর হতে থাকবে। আকাশের উপরে দিকে যত  উঠবেন, পৃথিবীর মানুষদের আর আপনি আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারবেন না। মানুষের অন্তরে যখন প্রবেশ করতে পারবেন, তখন আপনি সবার অন্তরস্থ হয়ে যাবেন। 

প্রণব বা ওঙ্কার হচ্ছে, পরমাত্মার স্বাভাবিক নাম। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, "শব্দ জ্ঞানানুপাতী বস্তুশূন্যো বিকল্প"  - শব্দই জ্ঞানের অনুধাবনকরী। শব্দ থেকে জ্ঞানের উৎপন্ন হয়। কিন্তু বস্তুর অস্তিত্ত্ব যদি না থাকে, তাহলে বুঝতে হবে এই জ্ঞান ভ্রম ছাড়া কিছু নয়।  এখন পরম পুরুষ চৈতন্য স্বরূপ। তো চৈতন্য হলো পরমপুরুষেের স্বরূপ। জাগ্রত ও স্বপ্নের অভাবে যে অবস্থার জ্ঞান হয়, তাকে আশ্রয় করে যে বৃত্তি, তা হলো সুসুপ্তির নিদ্রা। এই সুসুপ্তির অবস্থায় যা থাকে তা হচ্ছে অজ্ঞান। এর পর অজ্ঞানও  যখন দূরীভূত হয়ে যায়, তখন আসে তুরীয় অবস্থা। এই তুরীয় অবস্থায় কেবল চৈতন্য বর্তমান থাকে। এখন প্রশ্ন হলো তাকে কিভাবে জানা যায় ? 

ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, "তস্য বাচক প্রণবঃ" - ঈশ্বর প্রণবের বাচ্য। এই বাচ্য কথাটার অর্থ হলো জ্ঞেয় বস্তু। তো প্রণব হচ্ছে জ্ঞেয়  ঈশ্বর। আবার প্রণবই জ্ঞেয়  বস্তুর অবগতি মাধ্যম। কঠোপনিষদে বলা হচ্ছে, এই ওঙ্কার উপাসনায় পুরুষ ব্রহ্মলোকে মহিয়ান হন।  (কঠোপনিষদ - ১/২/১৭) . তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হচ্ছে, "ওমিতি ব্রহ্ম" . আমরা যখন মাণ্ডুক্য উপনিষদ শুরু করেছিলাম, তখনও শুনেছি, "ওম ইতি এতৎ অক্ষরম ইদম"। 

তো আমরা বুঝি আর  না বুঝি, ওঙ্কার সাধনাই আমাদেরকে ব্রহ্ম উপলব্ধি এনে দিতে পারে - একথা আমাদের  মুনিঋষিগন বারবার ঘোষণা করেছেন।  এখন এই প্রণবের উপাসনা হবে কি ভাবে ? এর আভাস  আছে ঋষি পতঞ্জলির যোগদর্শনে। 

প্রণবের জপ হলো, প্রণবের অভিধেয় বাচ্য  ঈশ্বরের ভাবনা করা। "তজ্জপ তদর্থ ভাবনম।" (সমাধি - ২৮)  কোনো প্রাণীর গুনগত, রূপগত, আকারগত লক্ষণ দেখা যায়, তার চিত্তে আরোপিত ভাবনার উপরে। তো ঈশ্বর যিনি শুদ্ধ সত্ত্ব, যিনি দিব্য , পবিত্র, অমূর্ত মুক্ত পুরুষ, তাঁর  চিন্তন-মাধ্যম হচ্ছে ওঙ্কার। সাধক  যখন তার সার্বিক সত্তার চিন্তনে  ঈশ্বর-পুরুষের সত্তা আরোপিত করে, তখন সেই পরম-পুরুষের মধ্যে শুদ্ধত্ব, পবিত্রত্ব, দিব্যত্ব ইত্যাদি সত্তা সেই সাধকের মধ্যে আরোপিত হয়। আর এটি তখনই  সম্ভব যদি কিনা ওঙ্কার মন্ত্র জপের সময় মন্ত্রের লক্ষিত ঈশ্বরের মধ্যে নিস্কম্প দীপশিখার  মতো স্থির ভাবে চিন্তা করতে পারেন। 
-----------------
মাণ্ডুক্য উপনিষদের রহস্যঃ কথা এখানেই শেষ হলো।     

  


 


  
    



 




























       

1 comment:

  1. অসাধারণ লাগছে পড়ে

    ReplyDelete