Wednesday 30 October 2019

মৃত্যুকে মানুষ কেন ভয় পায় ? আপনি কিভাবে মৃত্যুভয় থেকে দূরে থাকবেন ?


মৃত্যুকে মানুষ কেন ভয় পায় ? আপনি কিভাবে মৃত্যুভয় থেকে দূরে থাকবেন?

মৃত্যুকে মানুষ কেন এত ভয় পায় ? শুধু মানুষ কেন সমস্ত জীব মৃত্যুকে ভয় পায়। যারা পরলোকে বিশ্বাস করে, তাদের ব্যাপারটা তবু কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়। কারন  তারা ভাবে, মৃত্যুর পরে সে স্বর্গে না  নরকে যাবে, তা  সে জানে না। এই আস্তিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার মনে করে, তাকে নরক অবশ্য়ই ভোগ করতে হবে। যুধিষ্ঠিরের মতো সাক্ষাৎ ধর্মপুত্রের যদি নরক দর্শন অবশ্যম্ভাবী হয়, তবে আমাদের তো কথাই নেই।এতো  গেলো এসিডের কথা।  কিন্তু নাস্তিকেরা তো বিশ্বাস করে, মৃত্যুর পরে আর কিছু থাকে না। তবে তাদের এত মৃত্যুভয় হয় কেন ? তাই আস্তিক-নাস্তিক সবারই মৃত্যু ভয় আছে । কিন্তু কেন ?

আসলে মৃত্যুর পরে আমাদের কি হবে, তা আমরা কেউ  জানি না। আমরা সবাই অনিশ্চয়তাকে ভয় পাই। জীবনে যে নিশ্চিত নিরাপত্তা আমরা বহুকষ্টে গড়ে নিয়েছি, সেটা হারাতে আমরা ভয় পাই। দীর্ঘকাল ধরে আমরা একটা নির্ভরতার ভীত  গড়ে তুলেছি।  সেখানে আমরা নিরাপত্তা পাই, বা নিরাপত্তা দেই। আমরা একে  অপরের  উপরে নির্ভরশীল হয়ে  আছি । এই  নির্ভরতার অভ্যাস আমাদের জীবনে একটা ছন্দ এনেছে। পাছে মরন আমাদের এই জীবনের ছন্দকে ছিনিয়ে নেয়, এটা ভেবেই  আমাদের ভয় হয়। 

সত্যি কথা বলতে কি এই নির্ভরতা আমাদের আসক্তির জন্ম দিয়েছে। আমরা আমাদের স্ত্রী ছেলে-মেয়েদের প্রতি, আত্মীয়স্বজনদের প্রতি আসক্ত।  এমনকি আমার বাড়ি, গাড়ি, বিষয় সম্পত্তির প্রতি আমরা সবাই আসক্ত। একটা ছন্দময় জীবনে আমরা আবদ্ধ।  আর  বিশেষ ছন্দের এই জীবন, আমাদের  মৃত্যু এসে কেড়ে  নেবে, এই আশঙ্কায় আমাদের মনে ভয়ের উদ্রেগ হয় । আমরা সবাই নিরাপদে  থাকতে চাই। আর এই প্রত্যাশা থেকে আমাদের আমাদের চারিদিকে একটা কাল্পনিক নিরাপত্তার বলয়  তৈরি করে নিয়েছি আমরা । আর সত্য যেটা তা হচ্ছে,, স্থায়ী নিরাপত্তা বলে কিছু হয় না। 

ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কারনে আমাদের ভয়ের উদ্রেগ হয়।  আর ভয় থেকে হয় আমাদের দুশ্চিন্তা। আমরা কেন ভয় পাই ? ভয় আসলে আমাদের বিশেষ মানসিক অবস্থা বা অনুভূতি। আমরা সবাই সব সময় ভয়ে ভয়ে আছি। আমাদের মরে  ভয়, আমাদের লোকলজ্জ্বার ভয়, শরীর খারাপের ভয়, রাজরোষের ভয়, সম্মানহানির ভয় - সারাক্ষণই আমাদের কোনো না কোনো ভয় তাড়া  করে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আর এই ভয় থেকে বাঁচার জন্য আমরা একটা কৃত্তিম নিরাপত্তার কাল্পনিক বেড়া দিয়ে রেখেছি। রোগের  ভয় থেকে বাঁচার জন্য আমরা মেডিক্লাইম করে রেখেছি। ঔষধ খাচ্ছি, ব্যায়াম  করছি। অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য আমি ব্যাংকে টাকা জমাচ্ছি, জীবনবীমায় টাকা জমাচ্ছি।  কিন্তু এগুলোর কোনোটিই চিরস্থায়ী নিরাপত্তা দিতে  পারে না।  যতই মেডিক্লেম করুন, এমনকি প্রতিনিয়ত ডাক্তারকে দিয়ে শরীরকে চেক-আপ করুন, প্রকৃতির নিয়মেই আপনার শরীর খারাপ হবে, আপনি বৃদ্ধ হবেন। এমনকি  একদিন আপনি মারা যাবেন।  ব্যাঙ্কের টাকা আপনাকে বস্তূ বা মানুষের সেবা এনে দিতে পারে, কিন্তু আপনাকে কখনোই নিরাপত্তা দিতে  পারে না। 

ভয় আমাদের বর্তমান কালের ঘটনা। আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এর কারন লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের গর্ভে। আমরা ভবিষ্যতের জন্য বর্তমানকে বিসর্জন দিচ্ছি। ভবিষ্যতে কি হবে এটা যদি আমরা আগে থেকে জানতে পারি, তবে আমি তার জন্য নিজেকে সঠিক ভাবে প্রস্তুত করতে পারি। কিন্তু আমরা যা করে থাকি সেটা হচ্ছে আমরা আমাদের কাল্পনিক ভবিষ্যতের বিপদের আশঙ্কায়, বর্তমানের সুখকে বিসর্জন দিচ্ছি। 

যদি আমি একটু স্থির হয়ে চিন্তা করি, কেন আমি নিরাপত্তার জন্য বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থার কথা ভাবছি। কেন আমি বিশেষ বিশেষ মানুষের উপরে নির্ভর করছি, কেন আমি বিশেষ বস্তু বা ব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছি, তাহলে আমরা বুঝতে পারবো, আমরা কতকগুলো কাল্পনিক ব্যাপারকে বাস্তব বলে ভাবছি। এমনকি কিঁছু অপরিবর্তিনীয় সত্যকে আমি মেনে নেবার পরিবর্তে আমরা তাকে পরিবর্তন করতে চাইছি। তাকে থামিয়ে দিতে চাইছি।  

ভয় আমাদের মনের  অনুভূতি। আর এটি আসে অজানা থেকে।  আপনি যখনি ভয় পাচ্ছেন, তখনি আপনি ভয়ের করণগুলোর দিকে নজর দিন। যে চিন্তাস্রোত আপনাকে ভয় পাওয়াচ্ছে, আপনি তক্ষুনি সেই চিন্তাস্রোতকে দাবিয়ে রাখবার জন্য, আপনার ভিতরে অন্য চিন্তা স্রোত তুলুন। তখন দেখবেন, আপনি ভয় থেকে মুক্ত হয়ে গেছেন। নিজের কর্তব্য করুন। কিন্তু ভবিষ্যকে অন্ধকারময় বা আলোকময়,  সুখের বা দুঃখের কোনোটাই  কল্পনা করতে যাবেন না। ভবিষ্যৎকে তার মতো করেই আসতে  দিন। আপনার কল্পনার মোড়কে তাকে বাঁধবেন না। তাহলেই  আপনার মোহভঙ্গ হবে। 

মৃত্যু আমাদের সবার আসবে। তা সেই মৃত্যু ভালো হলেও আসবে, খারাপ হলেও আসবে। যা আপনি স্থগিত করতে পারবেনা না, তাকে তার নিজস্ব সময়, নিজস্ব রূপে আসতে  দিন। আর আপনার কাজ হচ্ছে তাকে স্বাগত জানানো। আর আপনি যখন নিশ্চিত যে মৃত্যু একদিন আপনার ঘরে আসবেই, তখন সম্ভব হলে মৃত্যুর রূপ সম্পর্কে আগে থেকে জানবার চেষ্টা করুন। 

বহু মহাপুরুষ মৃত্যুকে স্বাগত জানিয়ে থাকেন। কারন তিনি জানেন, তার লক্ষ পূরণের জন্য, বা সংকল্প পূরণের জন্য, এই দেহ আর কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারবে না। বা তার এই জীবনে যে লক্ষ ছিল, সেটা  লক্ষ পূরণ হয়ে গেছে, এখন আর এই লক্ষপূরণের যন্ত্রকে অর্থাৎ শরীরকে আর দরকার নেই, তখন তাকে ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন, অনন্ত যাত্রায়।  জীবন তো একটা যাত্রা। মৃত্যু সেই যাত্রাপথের একটা বাঁক  মাত্র। আমাদের এই অনন্ত যাত্রায় শরীর একটা অতিথি শালা।  এখানে আমরা কিছুক্ষনের জন্য, কয়েক  মুহূর্তের জন্য অবস্থান করেছিলাম।  এখন সকাল হয়েছে, সূর্য উঠেছে, আবার পথে পা বাড়াতে হবে। 

ধর্মকথা আসলে ব্যথা নিবারক ।  ডাক্তারবাবু, আমাকে ঘুমের ঔষধ দেন। এগুলো সবই সাময়িক। এর অ্যাকশন চলে গেলে আবার আমাদের কষ্ট  শুরু হয়। সমস্যার মুখোমুখি হওয়া, মায়াকে চিনতে পারা - সেটাই আসল। আর এগুলোকে যখনি আপনি চিনতে পারবেন, তখন দেখবেন আপনার সব ভয় দূর হয়ে গেছে। অর্থাৎ আপনার সত্যিকারের জ্ঞান আপনাকে নির্ভয় করবে। 

এখন কথা হচ্ছে মৃত্যুকে কারা ভয় পায় না ? বা আপনি কিভাবে মৃত্যুভয় থেকে দূরে থাকবেন। প্রথমতঃ এখন যেখানে আছেন, সেখান থেকে যদি লক্ষপূরণের জন্য, অন্যত্র যেতে হয়, তখন আপনি কি করেন ? অর্থাৎ আপনি ধরুন উচ্চশিক্ষা লাভের  জন্য বা চাকরি করবার জন্য বিদেশে যাবেন। তখন আপনি কি করেন, যেখানে যাবেন, সেখানকার সম্পর্কে আপনি একটা জ্ঞান লাভ করার চেষ্টা করেন। সেখানকার সম্পর্কে যিনি জানেন তার কাছ থেকে শুনে নেবেন, সেখানকার জলবায়ূ, সেখানকার থাকবার ব্যবস্থা, যাতায়াত ব্যবস্থা ইত্যাদি  ইত্যাদি । তো তাহলে আপনার ভয় থাকবে না। আবার একটা মেয়ে য্খন তার শ্বশুর বাড়ি যায়, তখন কি তার ভয় হয় ? না, তার কারন সে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে, তাকে একসময় শ্বশুরবাড়ী  যেতেই  হবে। ভালোমন্দ যাই হোক না কেন, সেটাই তার আসল বাসা। 

আসলে আপনাকে মানসিক দিক  থেকে প্রস্তুত হতে হবে, যেমন বিয়ের আগে মেয়েরা করে থাকে  এবং মহৎ আদর্শকে বা লক্ষ্যকে সামনে রাখতে হবে, এগুতে হবে এবং সেই উদ্দেশ্যে আগে থেকে অজানাকে জানতে হবে। তবে আমাদের ভয় দূর হবে। আমাদের মনের গভীরে যেকোনো অলীক কল্পনাই আমাদের ভয়ের কারন। আর নিজের মনকে বিশ্লেষণ করলে, সেই অলীক কল্পনা দূর হবে, আর  আমাদের ভয় দূর হবে। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি  ওম।     


Sunday 27 October 2019

শালগ্রাম শিলা

শালগ্রাম শিলা

শালগ্রাম শিলা 
আমি যে পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছি, তারা সবাই কৃষ্ণ ভক্ত। বাড়িতে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহের নিত্যপূজা হয়। এছাড়া বাড়িতে বিভিন্ন ঠাকুর দেবতার পূজা লেগেই থাকতো। এর মধ্যে সব থেকে বেশি হতো সত্যনারায়নের পুজো। তো সেখানে দেখতাম আমাদের পারিবারিক পুরোহিত  কালাঠাকুর, ভালো নাম শ্রী কালিপদ চক্রবর্তী, পুজো করবার সময়, লাল কাপড়ে মুড়ে, একটা কালো রঙের গোল মসৃন পাথরের টুকরো সঙ্গে করে  নিয়ে আসতো। এবং সমস্ত পুজোর আগেই এই কালো রঙের পাথরটিকে ফুল, জল, তুলসীপাতা দিয়ে পুজো করতেন। আবার পুজো শেষ হয়ে গেলে সেটি লাল কাপড়ে মুড়ে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। এই পাথরটির উপরে আমার একটা অদম্য আকর্ষণ ছিল। কিন্তু কালঠাকুর, এই পাথরটিকে কাউকে ছুতে দিতেন না। বলতেন, এটি স্বয়ং নারায়ণ।  এখন নিজেই একটা পাথর এক সাধুর কাছ থেকে কিনে নিয়েছি। বাড়িতে তার নিত্যপূজা হয়।

সাধারণ ভক্তের কাছে, এই শালগ্রাম শিলা পালনকর্তা বিষ্ণুর প্রতীক। দেবাদিদেব মহাদেবের প্রতীক যেমন শিবলিঙ্গ, বাণলিঙ্গ তেমনি শালগ্রাম শিলা নারায়ণের প্রতীক। বাণলিঙ্গ যেমন নর্মদা নদীর তীরে পাওয়া যায়, তেমনি এই শালগ্রাম শিলা গণ্ডকী নদীর  তীরে পাওয়া যায় । বাণলিঙ্গ যেমন প্রাকৃতিক  ভাবে নদীর স্রোতে পাথর কেটে তৈরী হয়, তেমনি শালগ্রামশিলা প্রাকৃতিক ভাবে তৈরী। তবে এই পাথরের একটা বৈশিষ্ঠ আছে। এবং এর পূজার প্রচলন শোনা যায়, আদি শঙ্করাচার্য্য প্রথম শুরু করেন। 

প্রথমে দেখে নেই শালগ্রাম বা শালিগ্রাম শিলা  কথাটা কি ভাবে এলো। এখন যেখানে গণ্ডকী নদী, তারই গর্ভে, গণ্ডকী নদীর জন্মের আগে, একসময় শালগ্রাম নামে এক প্রদেশ ছিল। সেখানকার পাষান বলে একে বলা হয় শালগ্রাম শিলা। এই পাষান আসলে একধরনের ammonoid fossils অমনোইড ফসিলস, যা পৃথিবীর গ্যাসীয় যুগে বর্তমান ছিল। বলা হয়ে থাকে ৪০০০ লক্ষ বছর থেকে ৬৬০ লক্ষ (৪০০-৬৬ million ) বছর আগে এই fossils -এর স্থিতিকাল ছিলো । এই পাষান আবার বজ্রকীট দ্বারা ক্ষোদিত বিভিন্ন দৃশ্য সহ।  খোদাইক্রিয়া  দেখতে নানান রকম। বজ্রকীট হচ্ছে একধরনের কৃমি জাতীয় জীব, যা হিমালয় সৃষ্টির ৫ কোটি বাঁচার আগে বর্তমান ছিল। আর তাদের অঙ্কন বড়ো  অদ্ভুত। কোনটা চক্রের মতো, কোনটা শাঁখের মতো।  কোনটা গদার মতো। এমনি ১৬ রকম চিন্হ দেখা যায়। প্রত্যেকটি শালগ্রাম শিলার মধ্যে আবার একটা ছিদ্র আছে।  অঙ্কনগুলো আবার এই ছিদ্রের মধ্যেও দেখা যায়।   এগুলোকেই বলে আসল শালগ্রাম শিলা। এখন কথা হচ্ছে এগুলো তো প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক কথা এর মধ্যে আধ্যাত্মিক কি আছে, যাতে মানুষ এগুলোর পুজো অর্চনা করে ?

দেখুন মানুষের শরীর  কোষের সমষ্টি ভিন্ন নয়। আর শালগ্রাম শিলা  হচ্ছে কতকগুলো এককোষী জীবের জীবাশ্ম। অর্থাৎ কত কোটি কোটি  বছরের ইতিহাস লেখা আছে এই শালগ্রাম শিলার মধ্যে, চিন্তা করুন । জীবের প্রথম পুরুষের অস্তি - আজ পাষাণে পরিণত হয়েছে। কত কোটি কোটি বছর ধরে এই জীবাশ্ম  বহন করে নিয়ে চলেছে, এই শালগ্রাম শিলা।

শালগ্রাম শিলার পূজা মানে আমাদের আদি পুরুষের পূজা। আদি পুরুষের অস্থি  আছে এই শালগ্রাম শিলার মধ্যে। আর আদি পুরুষ ছিল সৃষ্টিকর্তার সব থেকে কাছাকাছি। তাই এর মাধ্যমে আমরা আদি পুরুষের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারি। শ্রদ্ধা ভক্তি সহকারে, এই শালগ্রামের পূজা করলে যে যার বিশ্বাস ও কামনা অনুযায়ী ফল লাভ করতে পারেন। দেখুন, পূজা - বিশ্বাস, ভক্তি, ও  শ্রদ্ধা  দিয়েই শুরু হয়, আর বিশ্বাসেই মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।


    

Friday 25 October 2019

নিত্য ও অনিত্য।




নিত্য অনিত্য 

গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, এমন কোনো সময় ছিল না যখন আমি ছিলাম না। বা তুমি ছিলে  না, বা এই সমস্ত জনলোক ছিল না।  আবার এমন কোনো সময় হবে না যখন আমি থাকবো না, বা তুমি থাকবে না, বা এই সমস্ত রাজা-মহারাজারা, সমস্ত জনলোক  থাকবে না।

জগতে দুটো জিনিস সবসময় আছে, আর সে দুটো হচ্ছে, সৎ ও অসৎ। অর্থাৎ নিত্য ও অনিত্য। একটা শরীর যেটা পার্থিব বা  স্থুল  আর একটা শরীরী যেটা অপার্থিব। এই দুটোই সবসময় বর্তমান। শরীর কখনো স্থায়ী হয় না। কিন্তু  শরীরী কখনো অস্থায়ী হয় না।  দুটোই আছে। শরীরীর কখনো অভাব নেই। আর শরীরের অভাব যায় না কখনো।

আমাদের দৃষ্টিতে আমরা যারা রূপ পরিগ্রহ করে আছি, তারা একদিন ছিলাম না, আবার একদিন থাকবো না। আমাদের এই যে ধারণা বা জ্ঞান তা অসত্য। আর যারা অসাধারণ-মহাত্মা-জ্ঞানী তারা জানেন,  আমরা সবাই ছিলাম, আছি, থাকবো। এমনকি যাকে  আমরা অনিত্য বলছি, তারও কখনো বিনাশ নেই।

আমার আপনার সবার বহুবার জন্ম হয়েছে, সেগুলো আমরা জানি না। আবার আমাদের বহুবার জন্ম হবে, সেসবও আমরা জানি না। কিন্তু কৃষ্ণের মতো মহাপুরুষেরা জানেন। তাইতো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, আমি সেসব জানি, কিন্তু তুমি অর্জুন, অর্থাৎ অজ্ঞান  তুমি সেসব জান  না।

অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যে কোনো কালে, যে কোনো দেশে, যে কোনো পরিস্থিতিতে, যে কোনো অবস্থায়, এমনকি যেকোনো বস্তুতে নিত্য ও অনিত্য দুটোই বর্তমান।  ভবিষ্যতে আমাদের এই শরীর বা যেকোনো বস্তু আগের অবস্থায় থাকবে না। আবার এখন যে অবয়ব আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা ঠিক এই অবস্থায় আমাদের দৃষ্টিগোচর হবে না। কিন্তু আমরা অবশ্য়ই থাকবো। নিত্য - অনিত্য সবই থাকবে। এর কোনো অভাব হবে না। আর সত্যি কথা বলতে কি বর্তমান বলে কিছু হয় না। হয় অতীত নয় ভবিষ্যৎ কেবলমাত্র টিকে থাকে।  একটু গভীর ভাবে ভাবলে বুঝতে পারবেন, আমরা যে ভাবি আমরা বর্তমানকালে আছি, তা আসলে তিলেক ধারণা। তিল মাত্র সময় আমাদের এই শরীর বর্তমানে আছে। প্রতিমুহূর্তে এই শরীর বা যা কিছু আমরা দেখছি, সবই পরিবর্তন হয়ে চলছে। এইজন্য শরীরের বাইরে আমার যে পৃথক সত্ত্বা তাকেই আমাদের বর্তমানে অনুভব করা উচিত। অর্থাৎ অতীতে আমি সত্ত্বার (অহং হীন আমি) যেমন অভাব ছিল না, ভবিষ্যতেও আমার নিজ সত্ত্বার কোনো অভাব হবে না, এখনো তার অভাব নেই। এটা আমাদের গভীর ভাবে অনুভব করতে হবে।

জাগ্রত অবস্থায় আমি যেমন আছি, নিদ্রাকালীন স্বপ্ন অবস্থাতেও আমি ছিলাম। আবার নিদ্রা ভাঙার পরেও আমি থাকবো। আসলে আমাদের জ্ঞানের অভাব আমাদের এই ত্রিবিধ অবস্থার মধ্যে পার্থক্য দেখে। আসলে আমি একই থাকি। আমাদের সবার শরীর একটা সময় ছিল না, আবার একটা সময় থাকবে না, এমনকি এই মুহূর্তেও আমাদের শরীর নাশ হবার লক্ষে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু আমি থাকবো।

আসলে খটকা লেগেছে, এইখানে যে বর্তমানে আমি দৃশ্যমান। অর্থাৎ দৃশ্যটি আমাদের মন, বুদ্ধি, এবং ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু একটা কথা শুনুন, আমাদের মন বুদ্ধি, ও ইন্দ্রিয় এগুলোও নিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। দৃশ্য যেমন পরিবর্তন হচ্ছে, মন, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়সকলও পরিবর্তন হচ্ছে। তা আমরা ধরতে পারি না। দ্রষ্টা ও দৃশ্য কোনোটাই স্থায়ী নয়। যতক্ষন দ্রষ্টা ও দৃশ্যের মাঝখানে আধেয় অর্থাৎ প্রকাশক বা আলো না থাকলে দৃশ্যের কোনো অস্তিত্ত্ব থাকবে না। আর দৃশ্যের অস্তিত্ত্ব না থাকলে দ্রষ্টার কোনো অস্তিত্ত্ব থাকে না। শরীর হচ্ছে দৃশ্য আর শরীরী হচ্ছে দ্রষ্টা। মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার এগুলো মাধ্যম মাত্র ।  এরা দৃশ্যের প্রকাশ ঘটায়। তাই দ্রষ্টা দেখে। দৃশ্যের পরিবর্তন হচ্ছে, তার কারন মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকারের পরিবর্তন হচ্ছে অর্থাৎ দৃশ্যের যে প্রকাশ ঘটে তার পরিবর্তন ঘটছে। স্বল্প আলোতে আমরা ভালো দেখতে পাই না। অন্ধকারে আমরা দেখতে পাই না। আবার অতিরিক্ত আলোতেও  আমরা দেখতে পাই না। মধ্যাবস্থায় আমরা দেখতে পাই।

আমাদের শরীর একটা গতিশীল কম্পন মাত্র। এই গতিশীলতা বা পরিবর্তনই আমাদের শিশু থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, যৌবন থেকে প্রৌঢ়, প্রৌঢ় থেকে বৃদ্ধাবস্থা লাভ করে থাকি। এই স্থূল শরীরের যেমন পরিবর্তন আছে, তেমনি স্থুলদেহ  থেকে আমরা সূক্ষ্মদেহে  প্রবেশ করি। আর এটাকে আমরা বলি দেহান্তর প্রাপ্তি বা মৃত্যু। কিন্তু এটা শুধু একটা পরিবর্তন মাত্র। স্থূল শরীরের যেমন পরিবর্তন আছে, তেমনি আমাদের সূক্ষ্ম শরীরেরও  পরিবর্তন আছে। স্থূল শরীর সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বা ধারণা আছে, কিন্তু সূক্ষ্ম শরীর সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বা ধারণা নেই, তাই এই পরিবর্তন সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতে পারি না। স্থূল শরীরকে আমরা জাগ্রত অবস্থায় ধরতে পারি। সূক্ষ্ম শরীর আমরা স্বপ্নাবস্থায় ধরতে পারি। কারন শরীর আমরা সুষুপ্তির অবস্থায় ধরতে পারি। এই শরীরগুলো থেকে আমরা যখন বেড়িয়ে পড়তে পারি, তখন আমরা তুরীয় অবস্থায় পৌঁছাতে পারি।

আসলে শরীরগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে, সরে সরে যাচ্ছে, । আমি কিন্তু স্থির আছি। শরীরকে আশ্রয় করে আমার প্রকাশ হয়েছিল। আবার শরীরের পরিবর্তন বা বিলয়ের  সঙ্গে সঙ্গে আমি অপ্রকাশিত হয়ে যাচ্ছি।  কিন্তু আমি সর্বদা আছি।

এই শরীর সম্পর্কে একটা ধারণা করে নেই। অন্নদ্বারা পরিপুষ্ট শরীর হচ্ছে - অন্নময় শরীর, বায়ু বা প্রাণ দ্বারা পরিপুষ্ট শরীর হচ্ছে প্রাণময় শরীর, আমাদের মানসিক জগৎ হচ্ছে মনোময় শরীর। বিশেষ ধরনের জ্ঞান দ্বারা পরিপুষ্ট হচ্ছে আমাদের বিজ্ঞানময় শরীর। আর যে শরীরে আমাদের আনন্দ অনুভূত হয়, সেটি হচ্ছে আনন্দময় শরীর। এইসব শরীরের বাইরে আছি আমি।

এখন কথা হচ্ছে, এই পূর্বশরীর জ্ঞান আমাদের কেন থাকে না। আমাদের পূর্ব শরীরের বা পূর্বজন্মের জ্ঞান কেন আমাদের থাকে না। দেখুন, আমরা স্থূল শরীরে থাকাকালীন অবস্থাতেও আমাদের সমস্ত স্মৃতি থাকে না। আমরা ৭দিন আগে কি খেয়েছিলাম, সেটাই আমরা মনে রাখতে পারি না। কারন এগুলোকে আমরা গুরুত্ত্ব দিয়ে দেখি নি। অর্থাৎ ধ্যান দেই  নি। আসলে যে জিনিসের প্রতি আমরা ধ্যান না দেই সেটা আমারা  সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাই। কিন্তু যে ঘটনার প্রতি আমারা  বেশি বেশি ধ্যান দিয়েছিলাম, সেটি আমাদের বেশ মনে আছে। আমার সন্তানের জন্ম, আমার পিতা-মাতার মৃত্যু, এই সব দিনের কথা আমাদের বেশ মনে আছে। এছাড়া আর একটা দিক আছে, প্রাকৃতিক কারণে অর্থাৎ আমাদের শরীরের পঞ্চভূতের অসামঞ্জস্য যখন দেখা দেয়, তখনও আমাদের পূর্বস্মৃতি মনে করতে পারি না। মৃত্যুকালে, আমাদের আত্মীয়স্বজনকে চিনতে পারি না। অত্যধিক কষ্টের সময় আমরা পূর্বস্মৃতি হারিয়ে ফেলি। সংজ্ঞা হারালে  আমাদের কিছুই মনে থাকে না। সাধারণ মানুষের জন্ম মৃত্যু একটা অসহ্য কষ্টের সময়। এই সময় সে সংজ্ঞাহীন হয়ে যায়। এমনকি এক দেহ থেকে যখন আমরা অন্য দেহে স্থানান্তরিত হই তখনও আমরা সংজ্ঞাহীন হয়ে যাই।  তাই আমাদের পূর্বস্মৃতি থাকে না। কিন্তু মহাত্মারা এই অবস্থান্তরের অবস্থাতেও চেতন থাকেন। তাই তাঁরা পূর্ব স্মৃতি মনে রাখতে পারেন। এমনকি সাধারণ মানুষও যদি মৃত্যুতে কষ্ট  না পায়, অথচ অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে মারা যেতে হয়  তবে, তার পূর্বস্মৃতি থাকা সম্ভব। মহাভারতে (অ.প - ১৪৫) মহামুনি ব্যাসদেব বলছেন, যে ব্যক্তি সহসা মারা গিয়ে আবার সহসা কোথাও জন্ম গ্রহণ করেন, তার পুরাতন অভ্যাস বা সংস্কার কিছুকাল বজায় থাকে। তাই সে পূর্বজন্মের জ্ঞান নিয়েই ইহলোকে জন্মান, এবং এঁকেই জাতিস্মর বলে। কিন্তু সে যতো বয়োঃপ্রাপ্ত  হয়, ততই তার স্বপ্নের মতো পুরোনো স্মৃতি নষ্ট হতে থাকে।
তো সবশেষে বলি আমাদের কিছুই হারায় না, কিছুই বিনাশ প্রাপ্ত হয় না, অনিত্যের অবস্থান্তর ঘটে মাত্র।  আর  নিত্য অবিকার থাকে।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম। । 


মহাভারতের কথা অমৃত সমান।



মহাভারতের কথা অমৃত সমান। 
যে শোনেনি তার কথা, সে অতি ভাগ্যবান।।

মহাভারতের অনুশাসনিক পর্বের দশম অধ্যায় থেকে একটা গুরুত্ত্বপূর্ন উপদেশ শুনবো । 
ধর্মরাজপুত্র যুধিষ্ঠির গঙ্গাপুত্র ভীষ্মকে জিজ্ঞেস করছেন, হে পিতামহ, হীনজাতিকে সহৃদয় ভাবে, উপদেশ দান করলে শুনেছি দোষের ভাগীদার হয়, এ সম্পর্কে আপনি কিছু বলেন। 

গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম বললেন, হ্যাঁ ঠিকই শুনেছো। শাস্ত্র অনুসারে, হীনজাতিকে উপদেশ প্রদান করলে অপরাধী হতে হয়। এ সম্পর্কে তোমাকে একটা কাহিনী বলি। 

বহুকাল আগে, ব্রহ্মার আশ্রমের কাছে, একটা সুন্দর আশ্রম ছিলো। সেখানে মহা ঋষিগণ নিরন্তর বেদ পাঠ করতেন। একদিন এক পরম দয়াবান শুদ্র সেই আশ্রমে এসে উপস্থিত হলেন। তো সেখানকার মুনিদের অসাধারন তেজঃসম্পন্ন দেখে, তার তপস্যা করতে ইচ্ছে হলো। তো সেই আশ্রমবাসী কুলপতির চরণ ধরে, নিবেদন করলেন - হে ভগবন আমি শুদ্রবংশ সম্ভূত। ধর্মশিক্ষার মানসে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। আপনি যদি প্রসন্ন হয়ে আমাকে সন্যাস ধর্ম দেন, তবে আমি চরিতার্থ হই। আমি সারাজীবন আপনার সেবায় নিয়োজিত থাকবো। 

তখন সেই আশ্রমের কুলপতি বললেন, বৎস শূদ্রজাতির সন্ন্যাস ধর্মে অধিকার নেই। তবু যদি তোমার ধর্ম্মবুদ্ধি জেগে থাকে, তবে এক কাজ করতে পারো - তুমি এখানে আমাদের সেবাযত্নের কাজে লেগে পড়ো, এতেই তোমার উন্নতি হবে। 

তো শূদ্র ভাবলো, এখন কি করা উচিত ? কিছুক্ষন সে ভাবলো। ভেবে ঠিক করলো, স্থানটি বড় মনোরম। সাধন ক্ষেত্র হিসেবে এটি উত্তম বটে। অতএব, সে ওই আশ্রম থেকে একটু দূরে, একটা ছোট্ট পাতার কুটির তৈরি করলো। সেখানে একটা শোবার  জায়গা, একটা বেদি অর্থাৎ ধ্যান আসন পাতার জায়গা, আর একটা দেবস্থান তৈরি করলো।  সেখানে সে নিজেকে কিছু নিয়মের মধ্যে  আবদ্ধ করলো। নিজেকে সংযমী করলো, ফলমূল আহার করতে লাগলো, প্রতিদিন দেবতাদের অর্চ্চনা করতে লাগলো। ফলমূল দ্বারা অতিথিদের সৎকার করতে লাগলো। এইভাবে বহুদিন কেটে গেলো। এখন সে ঋষিসম তেজষ্মী। 

এমনি সময় এক মহর্ষি এলেন তার আশ্রমে। শুদ্রঋষি তাকে সৎকার করলেন। এতে করে ব্রাহ্মণ মহর্ষির খুব ভালো লাগলো। এবং মাঝে মধ্যে তার আশ্রমে আসতে  লাগলো। তার সঙ্গে একটা বন্ধুত্ব হলো। ধর্ম বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা চলতে লাগলো।

তো একসময় শূদ্রঋষি তার পিতার পারলৌকিক কাজ করবার বাসনা হলো । তিনি এই কাজের দায়িত্ব দিতে চাইলেন, ব্রাহ্মণহঋষীকে। কারন ব্রাহ্মণ ছাড়াতো পারলৌকিক কাজ করা যাবে না। ব্রাহ্মনঋষি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করলেন,  এবং তার নির্দেশ অনুযায়ী সবকিছু সম্পাদন করা হলো।

এখন কালের নিয়মে, দুইজনই এক সময় স্থুলদেহ ত্যাগ করলেন। এখন, ব্রাহ্মনঋষি পরবর্তী জন্মে পুরাহিতকুলে জন্ম গ্রহণ করলেন। আর শুদ্রঋষি রাজবংশে জন্ম গ্রহণ করলেন। দুজনেরই বয়স বাড়তে লাগলো। দুজনই বিদ্যাশিক্ষা লাভ করতে লাগলেন। ব্রাহ্মণঋষি বেদ, বেদাঙ্গ, জ্যোতিষশাস্ত্র ইত্যাদিতে বিশেষ জ্ঞান লাভ করলেন। আর সেই শুদ্রঋষি যিনি এখন রাজপুত্র তিনি যুদ্ধবিদ্যাতে পারদর্শী হয়ে উঠলেন। কিছুদিন পরে, রাজার মৃত্যু হলে, রাজপুত্র রাজা হলেন।  পুরোহিতকে রাজপুরোহিত নিযুক্ত করলেন। এবং পরমসুখে রাজ্যশাসন করতে লাগলেন। পুরোহিতের পরামর্শকেও যথেষ্ট গুরুত্ত্ব দিতেন। কিন্তু, একটা  বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, পুরোহিতকে দেখলেই রাজা উঁচুস্বরে হাসতেন। এতে পুরোহিত অপমানিত বোধ করতেন। এমনকি তার  রাগ হতে লাগলো।

তো একদিন, রাজাকে নির্জনে পেয়ে, তাকে জিজ্ঞেস করলেন। আপনি একটা সত্য কথা বলবেন, আপনি আমাকে দেখে অহেতুক হাসেন কেন ? আমি এতে অপমানিত বোধ করি। এর কারন কি জানতে পারি ?

নরপতি বললেন, শুনুন, আমি জাতিস্মর। আগের জীবনে যা কিছু ঘটেছিলো, আমি সে সব জানি। আপনি তা জানেন না। আমি আগের জন্মে শূদ্র তপস্বী ছিলাম।  আর তখন আপনি ছিলেন, ব্রাহ্মণ তপস্বী। আমার পিতৃদেবের পারলৌকিক কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন আপনি। আর সে সময় ভুল বসতঃ ব্রাহ্মণের আসন দক্ষিণ দিকে পশ্চিম শীর্ষ করে স্থাপন করে ছিলাম আমি ।  আপনি তখন সেটিকে সংশোধন  করার জন্য আমাকে আপনি উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, তুমি পূর্বশীর্ষ করে ব্রাহ্মণের আসন পাতো , আর উত্তরাস্য করে তোমার আসন স্থাপন করো।

আপনার সেই কর্মের জন্য আপনি আজ পুরোহিত হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছেন, আর আমি রাজা।  কালের কি আশ্চৰ্য্য মহিমা দেখুন।আপনি আমাকে শ্রাদ্ধ কার্য্যে  উপদেশ দিয়েছিলেন বলে, আজ আপনি পুরোহিত। হে দ্বিজবর, আপনি আমার গুরু, শ্রদ্ধার পাত্র।  আপনাকে অবজ্ঞা করে আমি হাসি না।  আমি শুদ্র থেকে  জাতিস্মর, আপনি মুনি হয়েও পুরোহিত হলেন। এতে আমার দুঃখ হয়। আপনি দয়াকরে, এই ধনরাশি গ্রহণ করে, পুন্কাযর্য্যের অনুষ্ঠান করেন। আর উত্তম যোনিতে জন্ম গ্রহণ করবার জন্য যত্নবান  হোন।

এই গল্পটি বলে, গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম বললেন, শোনো, নীচজাতিকে উপদেশ দেওয়া কখনো ব্রাহ্মণের কাজ নয়। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন বর্নকে ব্রাহ্মণ উপদেশ দিলে কোনো দোষ নেই। কিন্তু শূদ্রকে উপদেশ দেওয়া নিতান্ত অকর্তব্য। ধর্মের গতি নিতান্ত সূক্ষ্ম। এটি অনুধাবন করা শক্ত। অতএব নীচ জাতিকে উপদেশ প্রদান করা কোনোক্রমেই বিধেয় নয়।

ভাগ্যিস শশাঙ্ক শেখর মহাভারতটা পড়ে নি। তাহলে তাকে মৌন থাকতে হতো।

ওম শান্তি, শান্তি, শান্তিঃ।  হরি ওম।   


Sunday 20 October 2019

কুলকুণ্ডলিনী


কুলকুণ্ডলিনী শক্তি (তথ্যসূত্র : বাংলার বাউল ও বাউল গান - অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য অন্যান্য বই  )

কুল কথাটার আক্ষরিক অর্থ বংশ বা জাতি। কুন্ড কথাটার মানে গর্ত। কুলকুণ্ডলিনী, বলতে আমরা বুঝি একটা শক্তিকেন্দ্র যেখানে জীবসৃষ্টির সমস্ত শক্তি সুপ্ত অবস্থায় আছে। সমস্ত সাধকদের কাছে, এই কেন্দ্র খুবই গুরুত্ত্বপূর্ন। বিশেষকরে, তান্ত্রিকদের কাছে, এই চক্র বা কেন্দ্র সাধনভূমি। মানুষের মধ্যে একটি অতিশক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র আছে।  আমাদের যে বিন্দুকেন্দ্র যা আমাদের   সহস্রারের উপরে  অবস্থান করছে , সেখানে এই বিশ্বশক্তি আকৃষ্ট হয়, পুঞ্জীভূত হয়। এর পরে সেই শক্তি আমাদের মস্তিষ্কের ভিতর দিয়ে সুষুম্না নাড়ীতে প্রবেশ করে। সুষুম্না নাড়ীর সর্ব্বনিম্ন ভাগ অর্থাৎ মূলাধারে তখন এই শক্তি সঞ্চিত হয়। সাপ বা কুকুর যেমন কুণ্ডলী পাকিয়ে স্থির হয়ে থাকে তেমনি এই শক্তি আমাদের মূলাধারে নিস্পৃহ অবস্থায় অবস্থান করে। এই শক্তিকে বা বিশ্বশক্তিকে অনুভব করাই আসলে আমাদের সাধনা। আর এই সাধনা এমনকিছু কঠিন ব্যাপারও  নয়। আসলে এই ব্যাপারটায় আমরা ধ্যান দেই  না বলেই  এই বিশ্বশক্তি আমরা অনুভব করতে পারি না। দেখুন আমাদের দৃষ্টি শক্তি, ঘ্রান শক্তি, শ্রবণ শক্তি, স্পর্শশক্তি  ইত্যাদি অনুভব করি কি ভাবে ? আমরা জানি কান কিন্তু কিছুই  শোনে  না। নাক কিন্তু গন্ধ পায়  না।  চোখ কিন্তু কিছুই দেখে না। তো দেখে কে ? শোনে কে ? এই ইন্দ্রিয়গুলোর সাহায্যে দেখে আসলে  আমাদের মন। যতক্ষন আমাদের মন ইন্দ্রিয়গুলোর  উপরে ধ্যান দেয়, ততক্ষন ইন্দ্রিয়গুলোর  কার্যকারিতা আমরা অনুভব করি। যখনই এসব ইন্দ্রিয়গুলো থেকে আমার মন অন্যদিকে চলে যায়, তখন আমরা এই ইন্দ্রিয়গুলোর কাজ অনুভব করতে পারি না। আসলে এইসব ইন্দ্রিয়ের উপরে ধ্যান দেওয়া আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। তাই আলাদা করে চেতনমনকে সেখানে টেনে নিয়ে যেতে হয় না। এই কাজ আমাদের অবচেতন মনই করে থাকে।
কিন্তু বিশ্বশক্তির চেতনাকেন্দ্র সম্পর্কে আমাদের অবচেতন মনের কোনো ধারণা নেই।  তাই সেখানে সে মনোযোগ দেয়  না। আর  বিশ্বশক্তি আমাদের যে অঙ্গে প্রতিফলিত হচ্ছে, সেখানে আমাদের ধ্যান না থাকার জন্য এই বিশ্বশক্তির কার্যকারিতা সম্পর্কে আমরা কিছুই অনুভব করতে পারি না। তাই ঋষিগণ বলেছেন, এই সব অঙ্গে, যেখানে বিশ্বশক্তি প্রতিফলিত হয়, সেখানে  ধ্যান করবার জন্য। তাহলেই আমরা এই বিশ্বশক্তির আশ্চার্য্য  কার্যকারিতা অনুভব করতে পারবো। এবং এর থেকে আমাদের জীবন আরো উপভোগ্য হয়ে উঠবে। আর এই ধ্যানের কেন্দ্র হিসেবে ঋষিগণ ৭টি কেন্দ্রের কথা নির্দিষ্ট করেছেন।  সেগুলো হচ্ছে, মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধি, আজ্ঞা, এবং  সহস্রার। আর এই কেন্দ্রগুলোকে নির্দিষ্ট করার কারন হচ্ছে, এখানে আমাদের বিভিন্ন স্নায়ুর সংযোগস্থল। আর এই সব স্নায়ুর সংযোগস্থলে বিশ্বশক্তির গতি সাময়িক ভাবে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার ফলে, তার অবস্থানের সময় বৃদ্ধি পায়। তাই এই বিশ্বশক্তিকে এই সব কেন্দ্রের সাহায্যে অনুভব করা যায়। আজ আমরা ৭টি কেন্দ্রের মধ্যে শুধু মূলাধার নিয়ে আলোচনা শুনবো । অর্থাৎ আমাদের শরীরের সবথেকে নিচে যে কেন্দ্র আছে, সেটা নিয়ে আলোচনা শুনবো ।  ধীরে ধীরে উপরের কেন্দ্রগুলো সম্পর্কে শুনবো।

আর যেহেতু, তান্ত্রিকগন এই চক্রের উপরে সবথেকে বেশি মনোনিবেশ করেছেন , অর্থাৎ তাদের সাধন কেন্দ্র হচ্ছে, এই চেতনকেন্দ্র বা চক্র তাই  আমরা  তান্ত্রিকরা এই কেন্দ্র সন্মন্ধে কি বলছেন, সেটা ভালোকরে জেনে নেবো।

তান্ত্রিকরা বলছেন,  মূলাধার চক্র আমাদের  গুহ্যদেশ ও জনন-ইন্দ্রিয়ের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। অন্যান্য চক্রের মতো অর্থাৎ স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা, ও  সহস্রার চক্রের মতো এই মূলাধার বা কুলকুণ্ডলিনী  চক্রের মধ্যে একটি পদ্ম কল্পনা করা হয়েছে। এই পদ্মের চারটি পাপড়ি, এর মুখ নিচের দিকে, এই পদ্মের রঙ গাঢ় লাল বা রক্তবর্ণ। এই চারটি পাপড়িতে চারটি অক্ষর বা বৈচিকভাষায় চারটি  মন্ত্র কল্পনা করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে, বঁ, শঁ,ষঁ,সঁ অর্থাৎ তিনটি (স,শ,ষ) ও ল ও শ এর মাঝে যে ব যার উচ্চারণ "ওঁয়া" এই চারটি স্বর্ণ বর্ণের অক্ষর দক্ষিণাবর্তে অর্থাৎ ডানদিকে মুখ করে  সন্নিবিষ্ট আছে।

মূলাধার পদ্মের মাঝখানে উজ্জ্বল একটা চতুস্কোন ধরাচক্র। ধরাচক্র কথাটার অর্থ পৃথিবী, তাই
পৃথ্বী-চক্র অর্থাৎ যেখানে জীবের জন্ম-মৃত্যু হয়। তার চারিদিকে, আটটি শূলবেষ্টিত একটা স্থান শোভা পাচ্ছে। এই ধরাচক্রের মাঝখানে পীতবর্ণ ও বিদ্যুতের মতো কোমল অঙ্গ বীজমন্ত্র "লং" বিরাজ করছে। এই ধরাবীজ বা পৃথ্বী-বীজ চারটি হস্ত সমন্বিত। সমস্ত অঙ্গে অলংকার। হাতির পিঠে বসা। এই বীজের মাঝখানে আবার  বিন্দুস্থানে (অর্থাৎ লং অক্ষরের যে বিন্দু) সকালের সূর্য্যের মত রক্তিম-বর্ন শিশু-ব্রহ্মা বসে আছেন। তাঁর চারটি মুখ, এবং প্রত্যেক মুখে একটা করে বেদগ্রন্থ। এই শিশুব্রহ্মার চারটি হাত। একহাতে, দন্ড,একহাতে কমণ্ডলু, একহাতে রুদ্রাক্ষের মালা, আর অন্য হাত অভয়মুদ্রা ধারণ করে আছেন।

এই ধারা চক্রে, গাঢ় লাল রঙের ন্যায় অতি তেজস্বী সূর্য্যের মতো তেজঃপুঞ্জশালিনী ডাকিনি শক্তি বাস করেন। তিনি তাঁর চার হাতে, শূল, খট্টাঙ্গ,(মুগুর) খড়্গ ও চষক (পানপাত্র) ধারণ করে আছেন।
মূলাধার পদ্মের কর্ণিকা (বীজ) অভ্যন্তরে সুষুম্নার ভিতরে যে বজ্রাক্ষ নাড়ী আছে, তার মুখে একটি ত্রৈপুর নামে একটা ত্রিকোণ যন্ত্র অবস্থিত। এই ত্রিপুর যন্ত্র আসলে একটি আবাসস্থান। এই আবাসস্থল বিদ্যুতের মতো দীপ্তিশালী, অথচ ভীষণ কোমল স্থান। এই যন্ত্রের মধ্যেই জবা ফুলের মতো লাল রঙের কন্দর্প বায়ু ও কাম বীজ বিরাজ করছে। এই ত্রিকোণের ভিতরে, কচি পাতা-বর্ণের, গলানো সোনার মতো কোমল, পূর্ন চন্দ্রের জ্যোৎস্নার মতো উজ্জ্বল কান্তি বিশিষ্ঠ নদীর ঘূর্ণির মতো গোলাকার লিঙ্গরূপী স্বয়ম্ভূ  নিচের দিকে মুখ করে অবস্থান করছেন। এই স্বয়ম্ভূ লিঙ্গের উপরের দিকে রেশম সুতোর মতো অতিসূক্ষ্ম, কুণ্ডলিনী মুখ হা করে, ব্রহ্মনাড়ীর মুখ আচ্ছাদন করে, ব্রহ্মনাড়ী থেকে উৎসারিত সুধাধারা পান করছেন। যিনি সাপের মতো, স্বয়ম্ভূ লিঙ্গকে তিন পাকে আবদ্ধ  করে, স্বয়ম্ভূ লিঙ্গের মাথার উপরে ঘুমিয়ে আছেন। এই অতি বিচিত্র সাপ আমাদের মূলাধার কমলে অবস্থান করে, শ্বাসপ্রশ্বাস গমনাগমন ক্রিয়া পরিচালিত করছেন ও সমস্ত প্রাণীকে রক্ষা করছেন।

এগুলো সবই কল্পনাপ্রসূত চিত্র। তবে এই মত চিন্তা করতে পারলে, মূলাধারের শক্তি ও কার্যকারিতা সম্পর্কে আমাদের মনোনিবেশ সহজ হয়। মূলাধার যে বিশেষ শক্তির সূচক সেটা আমরা ভালোভাবে বুঝতে পারবো।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি  ওম। 

কুলকুণ্ডলিনী শক্তি (দুই ) 


স্বাধিষ্ঠান ও মনিপুর চক্র :

হিন্দু ভাবধারার আধ্যাত্মিক জগতে যারা বিচরণ করেন, তারা একটা জিনিস লক্ষ করেছেন, এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে সসীম থেকে অসীমে ঝাঁপ দেওয়া। আমরা কেউ আবেগপ্রবণ, কেউ বিচারপ্রবণ, কেউ আবার ইচ্ছেপ্রবণ । যে যেমনই হোন, আপনার যখন অদ্বৈত অনুভূতি উপলব্ধি হবে, তখনই একমাত্র অনন্তে পৌঁছাতে পারবেন।
এই ইচ্ছেপ্রবণ মানুষেরা কুণ্ডলিনীর উর্দ্ধগমনের মাধ্যমে যৌগিক সমাধি লাভ করে থাকেন। আবেগপ্রবণ মানুষেরা ভক্তির চর্চা করে থাকেন। ভক্ত তার সব কিছু ঈশ্বরের চরণে নিবেদন করেন। এইভাবে তিনি ঈশ্বরের সাথে একাত্ত্বতা অনুভব করেন। এটিকে বিশ্লেষণ করার ব্যাপারে গুরুত্ত্ব দেন না। আর যারা বিচার প্রবন, তাঁরা এই ব্যাপারটাকে বিশ্লেষণ করে দার্শনিক মত দান করে থাকেন।

আমাদের আলোচ্য বিষয় কুলকুণ্ডলিনীর অবস্থান। আজ আমরা আলোচনা শুনবো  স্বাধিষ্ঠান  ও মনিপুর চক্র  সম্পর্কে।

স্বাধিষ্ঠান চক্র :
আমরা জানি আমাদের যে সুষুম্না নাড়ী আছে, তার মধ্যে আছে, বজ্রাক্ষ নাড়ী।  আর এই বজ্রাক্ষ নাড়ীর মধ্যে আছে চিত্রিণী নাড়ী। তান্ত্রিক সাধকগণ বলছেন, আমাদের জনন-ইন্দ্রিয়ের মুলে সুষুম্নার মধ্যস্থ চিত্রিণী নাড়ীর মধ্যে সিঁদুরের মতো লাল রঙের  উজ্বল মনোহর কান্তি ছটি পাঁপড়ি  বা দল বিশিষ্ট অনুস্বরযুক্ত ব, ভ, ম, য়, র, ল, এই ছয়টি বৈচিক বর্ণ পরপর সন্নিবিষ্ট আছে।

এই স্বাধিষ্ঠান চক্রের মধ্যে যে যে পদ্ম আছে, তাতে ছয়টি পাঁপড়ি। এই পদ্মের মধ্যে সাদা রঙের বরুণচক্র। বরুণচক্র অর্থাৎ বাতাসের ঘূর্ণি। এই  বরুন মন্ডলের  মধ্যে অবস্থান করছে মকরবাহন (মকর হচ্ছে এমন একটা জীব যার মুখ কৃষ্ণসার হরিনের মতো, আর দেহ হচ্ছে মাছের মতো পুচ্ছ বিশিষ্ট ) বরুনবীজ "বং" (ওয়াং) এখানেই  বিদ্যমান।

এই বরুন বীজের কোলে নীল-পীতাম্বর অতি মনোহর এক নব্য যুবক শ্রীবৎস-কৌস্তভ মনি ভূষিত হয়ে গরুড় পাখির উপরে বসে আছেন। ইনি চতুর্ভূজ নারায়ণ। এনার চারি হস্তে শঙ্খ -চক্র -গদা-পদ্ম  শোভা পাচ্ছে।

এই বরুন চক্রে উন্মত্তচিত্ত রাকিনী শক্তি   বিরাজ করছেন। তাঁর চার হাতে, শূল-পদ্ম-ডমরু-টঙ্ক। ত্রিনেত্র ধারিণী এই দেবী দিব্য অলংকার দ্বারা সুশোভিত।  ইনি ভীষণদর্শন, রক্তধারা বিগলিত নাসা।

মনিপুর চক্র  :
স্বাধিষ্ঠান চক্রের  উপরে নাভিমূলে আছে মনিপুর চক্র। দশদল বিশিষ্ট এই মনিপুর চক্র।  গাঢ় মেঘের মতো নীলবর্ণ  এই মনিপুরপদ্ম। এই পদ্মের দশটি দলে, অনুস্বার বিশিষ্ট ড, ঢ, ণ, ত, থ, দ, ধ, ন, প. ফ এই দশটি বৈচিক বর্ণ যথাক্রমে সন্নিবিষ্ট আছে। এই পদ্মের অভ্যন্তর প্রভাতের সূর্য্যের মতো দীপ্তিশালী, রক্তিমবর্ন একটা ত্রিকোণ অগ্নিমণ্ডল বিরাজ করছে।

এই অগ্নি বীজ-এর মধ্যে চতুর্ভূজ বরাভয় বজ্রশক্তি নিহিত আছে। এই বীজের কোলদেশে মহাকাল বিরাজ করছেন। তার ভষ্মলিপ্ত দেহ, বিশুদ্ধ সিঁদুরের ন্যায় গাত্রবর্ণ। ষাঁড়ের উপরে অরূহ। এই পদ্মবীজের মধ্যে লাকিনি শক্তি বিরাজ করছেন। যিনি রক্তপদ্মের উপরে দন্ডায়মান শ্যামা মা। পিতাম্বরধারিনী বরাভয় করাল বদনী মত্তচিত্তা  চতুর্ভূজা।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।


কুলকুণ্ডলিনী শক্তি (তিন) 
অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা চক্র
এতক্ষন আমরা মনিপুর, স্বাধিষ্ঠান চক্রের  শুনছিলাম।   এর আগে আমরা মূলাধার সম্পর্কেও শুনেছি। এর পরে আমরা অনাহত চক্র  সম্পর্কে শুনবো।  তার আগে সাধকদের জন্য, কিছু গুরুত্ত্বপূর্ন কথা শুনে নেবো।
আমরা সবাই জানি, আমাদের এই স্থূল দেহ পঞ্চভূতের তৈরি। পঞ্চভূতের মধ্যে বায়ু প্রধান।  বায়ু দশ রকম বা বায়ুর দশটি গুন্ - প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান (এগুলো অর্থাৎ এই পাঁচটি  আমরা জানি ) এছাড়া আছে, নাগ, কূর্ম, কৃকর অর্থাৎ কয়ার পাখি, দেবদত্ত্ব (দেবতাদের কর্তৃক প্রদত্ত্ব ) ও ধনঞ্জয় (যিনি ধনকে জয় করেছেন)। এই মোট দশটি বায়ুর গুন্। প্রাণবায়ু আমাদের হৃদয়ে অবস্থিত। অপান আমাদের গুহ্যদেশে। নাভিদেশে আছে সমান, কন্ঠে উদানবায়ু, এবং সর্বশরীরে ছড়িয়ে আছে ব্যানবায়ু। এই পাঁচটি বায়ু প্রধান।  নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত্ব ও ধনঞ্জয় - এগুলো আমাদের নাড়ীতে অবস্থান করে। অর্থাৎ আমাদের শরীরে যে হাজার হাজার  নাড়ী  আছে, তার মধ্যে অবস্থান করে।  তবে প্রধানত পাঁচটি নাড়ী অর্থাৎ ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাক্ষ্যা ও চিত্রাণি এই পাঁচটি নাড়ীতে অবস্থান করে থাকে । আর এই বায়ুর সঙ্গে চৈতন্য শক্তি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। তাই সাধকগণ বায়ুর সাহায্যে চৈতন্যকে ধরতে চায়। পঞ্চবায়ুর মধ্যে নাভিদেশ থেকে নিচের দিকে  সমান বায়ুর কর্মক্ষেত্র। আর এই সমান বায়ু সব সময় নিম্নমুখী। এই সমান বায়ুর সাহায্যেই আমাদের বর্জ্যপদার্থ নিচের দিকে চলে যায়। সন্তানের জন্ম হয়। আমাদের বীর্য নিম্নগামী হয়ে সৃষ্টি রক্ষা করে। তাই এই তিনটি অঞ্চলে অর্থাৎ মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, ও মনিপুরে আমরা যদি বেশী  ধ্যান দেই তবে নিম্নগামী বিশ্বশক্তি আরো কার্যকরী হয়ে উঠবে। এবং আমাদেরকে  নিম্নগামী করবে। এবং আমরা লক্ষভ্রষ্ট হবো। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে, এই তিনটি কেন্দ্রে আমাদের ধ্যান যেন নামমাত্র হয়। আসলে অনাহত চক্র থেকে আমাদের ধ্যানের শুরু হবে, যদি আমরা ঈশ্বরের খেলা, বা বিশ্বশক্তিকে  অনুভব করতে চাই।

অনাহত চক্র : 
মনিপুর চক্রের উপরিভাগে দ্বাদশদল বিশিষ্ট অনাহত পদ্ম। আমাদের বুকের ভিতরে যে হৃৎপিন্ড আছে, ঠিক তার সোজাসুজি, মেরুদন্ডের মধ্যে আছে অনাহত চক্র। তান্ত্রিক সাধকগণ বলছেন,  আমাদের হৃদয় দেশে উজ্জ্বল লহিত বর্ণের এই বারোটি পাপড়ি বিশিষ্ট একটি  পদ্ম আছে । এই পদ্মের  প্রত্যেকটি পাপড়িতে সিঁদুর রঙের অনুস্বর যুক্ত ক, খ, অর্থাৎ কঁ,খঁ,গঁ,ঘঁ,ঙঁ, চঁ,ছঁ,জঁ,ঝঁ,ঞঁ,  টঁ,ঠঁ - এর অধিষ্ঠান । এই পদ্মের অভ্যন্তরে ধুম্র বর্ণের একটি ছয়কোন বিশিষ্ট বায়ুমণ্ডল শোভা পাচ্ছে। এই বায়ুমণ্ডলের মধ্যে ত্রিকোণ-যুক্ত কোটি বিদ্যুৎ-প্রভাযুক্ত সূর্য্যমন্ডল অবস্থান করছে। এইযে ছয়কোন যুক্ত বায়ুমণ্ডল, এর মধ্যে ধুম্রবর্ণের চতুস্কোন বায়ুবীজ "যং" বর্তমান। এই বায়ুবীজ "যং" আবার কৃষ্ণসার হরিনের পিঠে অবস্থান করছে। এই বায়ুবীজের মধ্যে স্থলে স্বয়ং ঈশ্বর ঈশান নামক শিব হয়ে অবস্থান করছেন। এই ঈশান শিব হাঁসের মতো শ্বেতবর্ণের। ইনি দ্বিহস্ত বিশিষ্ট।  বরাভয় মুদ্রায় অবস্থান করছেন। এনার তিনটি নেত্র।এই পদ্মে আরো অবস্থান করছেন কাকিনী শক্তি। যিনি বিদ্যুতের ন্যায় পীতবর্ণা। ইনি নানা অলংকার শোভিতা, চতুর্ভূজা, কঙ্কাল-মালা ধারিনী।  ইনি  আনন্দে উন্মত্ত। অমৃত রসে অভিষিক্ত হৃদয় সম্পন্ন। বরাভয়কারীনি ।এই পদ্মের মধ্যস্থ যে বীজ কোষ অর্থাৎ কর্ণিকা আছে তার  ত্রিকোণে অবস্থান করছেন, বাণলিঙ্গ শিব ও ত্রিনেত্রা নামের শক্তি বিরাজমান। এই বানলিঙ্গের মস্তক অর্ধচন্দ্র শোভিত। আর ত্রিনেত্রাদেবী  শক্তি কোটি-বিদ্যুৎ-তুল্য কোমলাঙ্গী।

বিশুদ্ধ চক্র :
গলায় আমাদের যে কন্ঠা আছে, তার ঠিক পিছনে, মেরুদণ্ডের মধ্যে অবস্থান করছে বিশুদ্ধ চক্র। এই বিশুদ্ধ চক্র ষোড়শদল পদ্ম বিশিষ্ট। এই পদ্ম ধোঁয়াটে রঙের। আর এই ষোলোটি পদ্মের মধ্যে লোহিত বর্ণের বিন্দু-যুক্ত ষোলোটি স্বরবর্ণ লিপিবদ্ধ আছে।  এই বর্ণগুলো হচ্ছে, অ, আ, ই, ঈ,উ,ঊ,ঋ,এ,ঐ,ও,ঔ, ঋ,ঌ,ৡ,এ,ঐ,ও,ঔ,অং,অঃ। এই পদ্মে পূর্ন চাঁদের মতো গোলাকার একটা নভোমণ্ডল আছে।  আর এই নভোমন্ডল মধ্যে একটা সাদা রঙের হাতির পিঠে ব্যোম বীজ হং অবস্থান  করছে। এটি পাশাঙ্কুশ  বরাভয় হস্ত বিশিষ্ট। অঙ্কুশ কথাটার অর্থ হচ্ছে, হাতিকে চালান করবার লৌহদণ্ড যার মুখটা সুচালু ও বাঁকা।  এই "হং" কারের যে গগনমণ্ডল তার মধ্যে অবস্থান করছেন, দশ হাত বিশিষ্ট, পাঁচটি মুখ বিশিষ্ট, তিনটি নেত্র বিশিষ্ট, বাঘের চামড়া পরিহিত অর্ধ-নারীশ্বর সদাশিব বিরাজ করছেন। তিনি বৃষপৃষ্ঠে আরোহন করে আছেন, তাঁর দক্ষিণভাগ শ্বেতবর্ণ আর বাম  ভাগ স্বর্ণবর্ন। তাঁর দশহাতে শুল,ডঙ্কা, খড়্গ, বজ্র, দাহন অর্থাৎ আগ্নেয়াস্ত্র, একটি বিশাল সাপ, ঘন্টা, অঙ্কুশ, পাশ ও অভয়মুদ্রা। এই পদ্মের কর্নিকায় অর্থাৎ পদ্মবীজে  শাকিনী শক্তি বিদ্যমান। ইনি শ্বেতবর্ণা, পিত-বসনা, চতুর হস্ত বিশিষ্ট। আর এই চার হাতে, শর, ধনু,পাশ, অঙ্কুশ ধারণ করে আছেন । এইবার কর্নিকার ভিতরে, আছে নিস্কলঙ্ক বিশুদ্ধ শশাঙ্ক মন্ডল।  এই শশাঙ্ক মন্ডলকেই মনে করা হয়, অতিশয় বিশুদ্ধ ব্যক্তির মুক্তিদ্বার  স্বরূপ।

আজ্ঞা চক্র :
আজ্ঞাচক্রের অবস্থান মেরুদণ্ডের মধ্যে নয়, এটির অবস্থান মাথায়।আমাদের ভ্রুদ্বয়ের পিছনদিকে মাথায় মধ্যে এর অবস্থান।  তন্ত্রমতে ভ্রূ-দ্বয়ের মধ্যে অবস্থান করছে, আমাদের আজ্ঞাচক্র। এখানে দ্বিদল বিশিষ্ট অজ্ঞাপদ্ম বিরাজ করছে। এই পদ্ম, শশধর সম উজ্বল শ্বেত বর্ণের।  এই দ্বিদল পদ্মের  দুটি পাপড়িতে আছে অনুস্বর-যুক্ত  হঁ ও ক্ষঁ। এই আজ্ঞা চক্রের মধ্যেই  আছে ষড়াননা। অর্থাৎ ছটি মুখ বিশিষ্ট মাতৃমূর্তি। যার প্রত্যেকটি আননে  অর্থাৎ মুখে তিনটি নয়ন, চারটি হাত।  এক হাতে বিদ্যামুদ্রা, এক হাতে ডমরু, একহাতে জপমালা, আর এক হাতে কপাল অর্থাৎ  মাথার খুলি। পূর্ন চন্দ্রের মতো শুভ্র জ্যোতিসম্পন্ন। এঁনাকে বলা হয় হাকিনী শক্তি। এই অক্ষি মধ্যস্থ  দ্বিদল যুক্ত পদ্মের মধ্যস্থলে বিরাজ করছেন, যোনি রূপিণী ত্রিকোণ।  যার প্রত্যেকটি কোনে ইতর-শিবলিঙ্গ বিদ্যমান। এই শিবলিঙ্গ তরিৎমালার মতো উজ্বল। এবং এই স্থানে বেদের প্রথম বীজ ওঁকার অবস্থিত। আর এই পদ্মের মধ্যে আমাদের সূক্ষ্মরূপী মন অবস্থান করছে। এই পদ্মের অন্তশ্চক্রে পরম শক্তি স্থলে ত্রিকোণে ভ্রূর ঠিক উপরে বিশুদ্ধ জ্ঞান ও জ্ঞেয়স্বরূপ অন্তরাত্মা অবস্থান করছেন। এই অন্তরাত্মা দীপ শিখার  ন্যায় উজ্বল আকৃতি বিশিষ্ঠ এবং প্রবনাত্মক। এই প্রণবের উর্দ্ধ ভাগে বিন্দু রুপি 'ম'কার। আর এই "ম"কারের আদিভাগে শুভ্রবর্ণ চাঁদের মতো নাদ অর্থাৎ শিবলিঙ্গ হাসিমুখে বিরাজ করছেন।
যেখানে অন্তরাত্মা অবস্থিত, সেখানে জ্বলন্ত দীপশিখার ন্যায় উজ্বল প্রভাত সূর্য্যের জ্যোতিঃ। এই জ্যোতিঃ আমাদের মাথা থেকে মূলাধার কমলের মধ্যস্থ ধরাচক্র পর্যন্ত বিস্তৃত আছেন। এখানেই সেই জ্যোতির্ময় সত্ত্বা, পূর্ন-ঐশ্বর্য্য অব্যয় ভগবানের সাক্ষাৎ  লাভ হয়। এই আজ্ঞাচক্র-এর দ্বিদলপদ্মে বায়ুর লয়স্থান।  তার উপরে মনশ্চক্র।  মনশ্চক্রের উপরে আছে সোমচক্র । এই সোমচক্রে হংস বীজ অধিষ্ঠিত। এই হংস বীজের কোলে অবস্থান করছেন, পরম-শিব। পরমশিবের বাম  দিকে আছেন নিত্যানন্দ স্বরূপিণী সিদ্ধকালী।
এই হলো মোটামুটি তন্ত্রমতে চক্রের অবস্থান বিবরণ। এর পরের  দিনে  আমরা সহস্রার চক্র-এর কথা শুনবো।
শেষ করার আগে, দু-একটা কথা বলি, তন্ত্রমতে এই যে বর্ণনা এগুলো আমাদের কাছে গভীর কল্পনার বিষয়, কিন্তু তান্ত্রিকদের কাছে, এগুলো স্পষ্টভাবেই  দৃষ্টিগোচর হয়। আমরা সাধারণত জ্ঞান বলে, আমরা দেখি কখন, যখন আলো কোনো বস্তুতে বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন তাকে আমরা দেখতে পারি। কিন্তু আসলে আমরা তখনই দেখি যখন আমরা দেখতে চাই।  আমাদের সামনে অসংখ্য ধূলিকণা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা তাদের দেখতে পাই না। কিন্তু যখন আলোর-রশ্মি ঘরের জানালার ক্ষুদ্র স্থান দিয়ে ধূলিকণার উপরে পড়ে, তখন ধূলিকণা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। এ এক ধরনের দেখা। আবার দেখুন, দুধের মধ্যে অসংখ্য পোকা কিলবিল করছে, আমরা তাদের দেখতে পাই না। কিন্তু যদি অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখি, তখন সেই পোকা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। তো একটা হচ্ছে,স্বাভাবিক ভাবে দেখা, যা আমরা দেখতে না চাইলেও দেখি, আর একটা তীব্র আলোক রশ্মির সাহায্যে দেখা, অর্থাৎ ধূলিকানাকে দেখা। আর একটা বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে দেখা। আরও একটা দেখা আছে।  দূরে সমুদ্রের মধ্যে একটা কলার খোলার মতো  নৌকা ভাসছে। বা দূর আকাশে একটা চিল  উড়ছে। কেউ আমাকে বললো, ওই দেখ একটা নৌকা ভাসছে, বা একটা চিল উড়ছে, তখন আমি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে দেখবার চেষ্টা করলে আমরা বুঝতে পারি যে হ্যাঁ  দূরে সমুদ্রের মধ্যে একটা নৌকা ভাসছে  বা দূরে আকাশের মধ্যে একটা চি ল ভাসছে। এই যে শেষের দেখা, চিল বা নৌকাকে দেখা, এটা  হচ্ছে, মনোযোগ দিয়ে দেখা। এই মনোযোগ যখন আরো গভীর হয়, তখন আমরা আমাদের ভিতরের জিনিসও  দেখতে পাই। এই দেখায় আমাদের চর্মচক্ষুর প্রয়োজন হয় না। তখন আমরা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পারি। আমাদের মনোযোগ যখন গভীর হয়, তখন আমাদের এই দর্শন শক্তি জাগ্রত হয় ,  এবং সেটা এই চোখের দেখার চেয়েও অধিকতর স্পষ্ট হয়ে যায়।  এটা কাউকে দেখানো যায় না, শুধু দেখা যায়। আমাদের মুনিঋষিরা তাদের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এই চক্রগুলোকে দেখেছিলেন।  আর তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনা আছে এই তন্ত্র  শাস্ত্রে। আমাদের অন্তর্দৃষ্টি যখন খুলে যাবে, তখন আমরাও  এসব দেখতে পাবো। প্রথমে একটু কল্পনা করে এগুতে হয়।  ধীরে ধীরে এই সব স্থানগুলোকে আমরা নির্দিষ্ট করতে পারি। আর সেখানে তখন একটা মৃদু কম্পন অনুভূত হয়।

আজ্ঞাচক্র কথাটার মধ্যে একটা একটা বিশেষত্ত্ব আছে।  আজ্ঞা কথাটার অর্থ নির্দেশ বা অনুশাসন। এই অনুশাসনের মাধ্যমেই আমরা আমাদের জীবনক্রিয়াকে সংগঠিত করছি। অর্থাৎ আমাদের ভিতরে একজন শাসক আছেন, যিনি প্রতিনিয়ত আমাদের নির্দেশ  দিচ্ছেন।  এই আজ্ঞাচক্রের নির্দেশেই আমাদের শরীরের সমস্ত অঙ্গ ক্রিয়াশীল হয়।  এমনকি আমাদের যে যৌন-ইন্দ্রিয় আছে, তাও এই আজ্ঞাচক্রের নির্দেশে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

কুলকুণ্ডলিনী শক্তি (চার ) 
সহস্রার  :
আমরা আলোচনা করছিলাম,  আমাদের শরীরে অবস্থিত নানান  চক্র সন্মন্ধে।  আমরা শুনে ছিলাম, হৃদয়-কেন্দ্র থেকে  উচ্চতর কেন্দ্রগুলো  মানুষের আধ্যাত্মিক   উপলব্ধির জন্য চিহ্নিত।   অর্থাৎ হৃদয়, কন্ঠ, ভ্রু-যুগল এবং শীর্ষদেশ আধ্যাত্মিক অনুভূতির কেন্দ্রস্থল। তবে একটা কথা বলি, এইসব কেন্দ্রগুলোকে শারীরবিদ্যার সাহায্যে না বোঝাই ভালো। তাহলে আমাদের সব গুলিয়ে যাবে। এগুলো আসলে অধ্যাত্ম চেতনার ভিন্ন ভিন্ন স্তরের দ্বার -স্বরূপ। বিশ্বশক্তির সঙ্গে আমাদের প্রতিনিয়ত একটা যোগাযোগের  একটা ধারাবাহিকতা চলছে। সেটা আমি বুঝি আর না বুঝি। বিশ্বশক্তি আমাদের আজ্ঞাচক্রের উপরিভাগে মহানাদ- রূপে এক শুন্যস্থান বিরাজ করছে। এই স্থানে কেবলমাত্র শুদ্ধবুদ্ধি প্রকাশমান। একে বলে নির্বাত স্থান। অর্থাৎ বায়ুহীন একটা স্থির অবস্থা। এর উপরে পরম ব্যোম। এই বায়ুহীনশূন্যস্থানে, শঙ্খিনী নাড়ীর মস্তকে বিসর্গ শক্তির নিচে, সহস্র পাপড়ি বিশিষ্ট পদ্ম বিরাজ করছেন। এই পদ্ম নিচের দিকে মুখ করে আছেন। এর কেশরগুলো, প্রভাতের সূর্য্যের মতো দীপ্তিশালী। এই পদ্মের দলগুলোতে পঞ্চাশটি  অক্ষর কুড়িবার ঘুরে ঘুরে আবর্তিত হচ্ছে। এই যে অক্ষর অর্থাৎ অ, আ, ক,খ, ... এগুলো আসলে বৈজিক বর্নমালা। এই সহস্রদল পদ্মমধ্যে নির্মল এক পূর্ণচন্দ্র তার জ্যোৎস্নাজাল বিস্তার করে, স্নিগ্ধ সুধাময় হাসির মতো শোভা পাচ্ছেন । এরই ভিতরে বিদ্যুৎরূপী অনির্বচনীয় বাক্য অর্থাৎ যা ভাষায় প্রকাশ যায় না, এমনি একটা ত্রিকোণ শোভা  পাচ্ছে। আর এই ত্রিকোণের মধ্যস্থলে মহাশূন্য-স্থানে অধিষ্ঠিত আছেন, সমস্ত দেবগন এবং কৌল সাধকগণের গুরুস্বরূপ মহাবিন্দু।

এই শূন্যস্থান পরম আনন্দময়। অতীব সূক্ষ্ম ও পূর্ন চন্দ্রসম দীপ্তি বিশিষ্ট। এখানেই আকাশরূপী পরম-আত্মা-স্বরূপ পরমশিব অবস্থান করছেন। এর অভ্যন্তর-স্থানের উপরিভাগে একটা দ্বাদশদল পদ্মে স্বয়ং গুরুদেব উপবিষ্ট আছেন। তিনিই পরম-শিব, পরম-আত্মা বা ব্রহ্ম।

এখানেই পূর্ন সূর্য্যের মতো অরুণবর্ন মৃনাল-তন্তুর শত ভাগের এক ভাগ সম স্থুলা, বিদ্যুতের ন্যায় দীপ্তিশালীনী "অমা" নাম্নী ষোড়শী কলা বিদ্যমান। এই "অমা" নাম্নী ষোড়শী কলা, সতত প্রকাশমানা ও অধোমুখী। আর এই মুখ থেকে নিরন্তর সুধা-রসধারা বিগলিত হচ্ছে।

এই "অমা"-কলার  ভিতরে, কেশাগ্রের সহস্র অংশের এক অংশ পরিমিত "নির্বাণ" নাম কলা বিদ্যমান আছে। এই কলা সমস্ত ভূতের দেবতা স্বরূপিণী, ইনিই তত্ত্বজ্ঞান। এঁনার আকৃতি অর্ধ-চন্দ্রের  ন্যায়, এনার প্রভা দ্বাদশ আদিত্যের মতো। ইনিই মহাকুণ্ডলিনী।

এই নির্বাণ কলার অন্তরে পরম-আশ্চর্য নির্বাণশক্তি। এই পরম-আশ্চর্য নির্বাণ শক্তি কেশাগ্রের কোটি-ভাগের এক-ভাগ সম সূক্ষ্ম এবং কোটি সূর্য্যসম দীপ্তিশালিনী।  ইনিই ত্রিভুবন জননী - নিরন্তর প্রেমসুধা বর্ষণ করছেন।

আবার এই নির্বাণশক্তির মধ্যস্থলে নিত্যানন্দ নাম্নী, সর্বশক্তি আধারস্বরূপ বিশুদ্ধ তত্ত্ব-জ্ঞান দাতা পরম-শিব অবস্থান করছেন ।

এই নির্বানকলার নিচের  দিকে অব্যক্ত আনন্দ স্বরূপিণী "নিবোধিতা" নামক অগ্নি প্রজ্বলিত। আবার এই  নির্বানকলার মধ্যে পরবিন্দু  বা শিব ও শক্তির মিলিত সত্তা অবস্থান করছেন।
সবশেষে বলি, এই স্থানই সমস্ত সাধকের পরম-স্থান। বৈষ্ণবেরা একে বলেন, বিষ্ণুর স্থান, শাক্তরা বলেন মহাদেবীর স্থান, আবার মুনি -ঋষিরা বলেন প্রকৃতি-পুরুষের মিলন স্থান।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

কুলকুণ্ডলিনী শক্তি (পাঁচ )

শরীরের বায়ু ও নাড়ীর ক্রিয়া :- 
আসলে কুণ্ডলিনী বুঝতে গেলে আমাদের শরীরের বায়ু ও নাড়ীর ক্রিয়া বুঝতে হবে। অর্থাৎ কুণ্ডলিনী শক্তি কি ও তার চলাচলের রাস্তাই বা কোথায় সে সম্পর্কে আমাদের বিষদ ভাবে বুঝতে হবে।  তো এই সম্পর্কে দুচার কথা বলি।

আসলে যোগের মূল ভিত্তি হচ্ছে, বায়ু। অর্থাৎ বায়ুকে চালনা করা। এখন কথা হচ্ছে বায়ুকে কোথায় চালান করবো ? বায়ুকে চালান করবো, নাড়ীর মধ্যে। নাড়ীর মধ্যে যে সুক্ষ সুড়ঙ্গ আছে, সেই পথে বায়ুকে চালনা করতে হয়। বায়ুকে দেহের নাড়ীসমূহের মধ্যে সঞ্চালন করে, উর্দ্ধগতি দান  করাই যোগের উদ্দেশ্য । আর এই উর্দ্ধগতি যখন হবে, বায়ু তখন  নির্মল হবে, শুদ্ধ হবে। অথবা উল্টো ভাবে বলা যায়, বায়ু যত  নির্মল হবে, বায়ু যত  শুদ্ধ হবে, বায়ু তখন স্বাভাবিক ভাবেই উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হবে। আমরা আগে শুনেছি, বায়ুর দশটি গুনের মধ্যে ৫টি গুন্ নাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করে।  আর সেগুলো হচ্ছে, নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত্ব ও ধনঞ্জয় - এগুলো আমাদের নাড়ীতে প্রবেশ করে।

মানব দেহে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নাড়ী।  এইসব নাড়ী  বা নাড়ীর  অভ্যন্তরস্থ ছিদ্র সাধারণত আমাদের পিত্ত -শ্লেষা দ্বারা ভরপুর থাকে।  তাই সেখান দিয়ে আমাদের বায়ু যাতায়াত করতে পারে না। তাই প্রথমে আমাদের দরকার আমাদের নাড়ী শুদ্ধি।  এই নাড়ীকে যথাযথ ভাবে শোধন করতে পারলে, নাড়ীতে বায়ুর প্রবেশ সুগম হবে। আমাদের এই নাড়ীমণ্ডলীর মধ্যে বায়ু যত সহজে সোজা রাস্তা ধরে এগুতে পারবে, তত বায়ু সূক্ষ্ম থেকে সুক্ষ গুন্ প্রাপ্ত হবে। এবং সাধক ততই যোগমার্গের উচ্চস্তরে উত্তীর্ন হতে পারবেন।  সুতরাং  আমাদের এই নাড়ীগুলো সম্পর্কে তাদের অবস্থান  সম্পর্কে  আমাদের যেমন  একটা স্পষ্ট ধারণা দরকার, তেমনি দরকার বায়ুর ক্রিয়া সম্পর্কে। তন্ত্র  শাস্ত্র মতে আমাদের শরীরে তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার নাড়ী আছে। এর মধ্যে চোদ্দটি নাড়ী প্রধান। ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, গান্ধারী, হস্তিজীহ্বা, কুহু, সরস্বতী,পূষা, শঙ্খিনী, পয়স্বিনী, বারুনী,অলম্বুষা, বিশ্বোদরী, ও যশস্বিনী। এই চোদ্দটা নাড়ীর  মধ্যে আবার তিনটি নাড়ী শ্রেষ্ঠ।  সেগুলো হচ্ছে ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না। এই তিনটি নাড়ীর মধ্যে আবার সুষুম্না নাড়ী প্রধান। আমাদের যোগক্রিয়ায় এই সুষুম্না নাড়ীকে অব্লম্বন করেই করতে হয়। আর এই সুষুম্না নাড়ীকে আশ্রয় করে, অন্যান্য নাড়ী অবস্থান করছে।

সুষুম্না নাড়ী আমাদের মেরুদণ্ডের মধ্যভাগে অবস্থিত। তাই একে মধ্যে-নাড়ীও বলা হয়ে থাকে। এই নাড়ী আমাদের মূলাধার থেকে শুরু করে, মাথার উপরে যে সহস্র দল পদ্ম আছে, সেখান পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি সূর্য ও বহ্নি রূপিণী। এটি সত্ত্ব-রজ-তম এই তিন গুনের আঁধার। এটি দেখতে খানিকটা প্রস্ফুটিত ধুতুরা ফুলের মতো। এই সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে আছে, বজ্রাক্ষা নাড়ী। বজ্রাক্ষা নাড়ীর মধ্যে আছে আবার চিত্রিণী নাড়ী।  আর এই চিত্রিণী নাড়ীর মধ্যে আছে ব্রহ্ম নাড়ী। চিত্রিণী নাড়ীর ভিতরে যে ব্রহ্ম পথ আছে, সেই ব্রহ্ম বিবর বেয়ে কুণ্ডলিনী শক্তি আমাদের সহস্রারে পৌঁছে, পরম-ব্রহ্মে মিলিত হন।

ইড়া নাড়ী অবস্থান মেরুদণ্ডের বাইরে বাম  ভাগে বিদ্যমান ।   কিন্তু সুষুম্না নাড়িকে চক্ৰে-চক্রে বেষ্টন  করে আমাদের ডান নাকের ছিদ্র দিয়ে আজ্ঞা চক্রে মিলিত হয়েছে। ঠিক একই  ভাবে পিঙ্গলা নাড়ী সুষুম্না   নাড়ীকে ধরে চক্রে চক্রে বেষ্টন  করে, আমাদের বাম নাসাপুট দিয়ে মুক্ত ত্রিবেণী স্থলে মিলিত হয়েছে।

 এই তিনটি নাড়ী অর্থাৎ ইড়া পিঙ্গলা ও সুষুম্না নাড়ী আমাদের মূলাধারে একত্রিত হয়েছে বলে, এই মূলাধারকে তিনটি নদীর সঙ্গম বা ত্রিবেণী বলা হয়ে থাকে। এখান থেকে এঁরা  আবার আলাদা হয়ে যায়  এবং পুনরায় ভ্রুদ্বয়ের নিম্নে অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রে মিলিত হয়। এইজন্য এই স্থানকেও ত্রিবেণী বলা হয়ে থাকে। প্রথমটি অর্থাৎ মূলাধারে যুক্ত ত্রিবেণী আর শেষেরটি অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রে মুক্ত-ত্রিবেণী।

সমস্ত নাড়ীর উৎপত্তি স্থান হচ্ছে মূলাধার পদ্ম। এই সব নাড়ী আমাদের জিহবা, পুরুষ-চিহ্ন, স্ত্রীচিহ্ন, পায়ের আঙ্গুল, নাক, চোখ, কান, কক্ষ,(বুকের উভয় পাশের মর্ম্মস্থল, বা প্রকোষ্ঠ )  কুক্ষি অর্থাৎ কোটর , পায়ু  অর্থাৎ সমস্ত অঙ্গ -প্রত্যঙ্গে গিয়ে, নিজ নিজ কাজ ক'রে,  আবার মূলাধারে ফিরে আসে।এই সব নাড়ী  থেকেই অসংখ্য শাখা - প্রশাখা যার সংখ্যা সাড়েতিন  লক্ষ যথাস্থানে আমাদের দেহে বিদ্যমান আছে। এইসব নারীকে ভোগবহা  নাড়ী বলে। এইসব নাড়ী দ্বারা আমাদের সমস্ত দেহে বায়ু সঞ্চারিত হয়। এবং সর্ব্বক্ষন এই বায়ু আমাদের দেহে ওতপ্রোত থেকে চৈতন্য শক্তি জাগ্রত রাখে।

মেরুদণ্ডের একদম উপরে, অর্থাৎ মেরুশৃঙ্গে ষোড়শ কলায় পূর্ণ চন্দ্রমা বিরাজমান রয়েছেন। এই চন্দ্রমা অধোমুখী হয়ে সর্বদা সুধা বর্ষণ করছেন। এই সুধামৃত দুই ভাগে ভাগ হয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অবস্থায় প্রবাহিত হতে থাকে। এর মধ্যে একভাগ অমৃত, শরীরের পুষ্টির জন্য ইড়া  নাড়ীতে প্রবেশ করে, মন্দাকিনী নদীর ন্যায় প্রবাহিত হতে থাকে। এই সুধাই জলরূপে আমাদের শরীরের পুষ্টি বর্ধন করে থাকে। এই সুধাময় কিরণ আমাদের শরীরের বাম  ভাগে সঞ্চারিত হচ্ছে। তার কারন হচ্ছে, ইড়া নাড়ী আমাদের বাম  পাশেই অবস্থান করে থাকে। আর দ্বিতীয়ভাগ  শ্বেতবর্ণ দুগ্ধের ন্যায় আমাদের আনন্দ প্রদান  করে থাকে। সৃষ্টি কার্য রক্ষার জন্য, এই অমৃতময় চন্দ্রমন্ডল জাত কিরণ আমাদের সুষুম্না
নাড়ী- পথ বেয়ে মেরুদণ্ডের নিচের দিকে গমন করে থাকে।

মূলাধারে দ্বাদশ-কলাযুক্ত প্রজাপতি সূর্য অবস্থান করছেন। এই সূর্য্যই উর্দ্ধ-রশ্মি হয়ে দাক্ষিন্মার্গে অর্থাৎ পিঙ্গলা নাড়ীতে প্রবাহমান হন। এবং নিজস্ব কিরণ-রশ্মি  দ্বারা,  চন্দ্রমন্ডলের অমৃতময় কিরণ  ও শরীরের ধাতুকে গ্রাস করতে থাকেন। এই সূর্য্যমন্ডল-ই আবার বায়ুমণ্ডল দ্বারা পরিচালিত হয়ে সমস্ত শরীরে বিচরণ করেন।

এই বিচরণকারী সূর্য আমাদের মেরুমন্ডল-স্থিত অপর একটা  মূর্তি। ইনিই লগ্ন-যোগে অর্থাৎ উপযুক্ত সময়ে দাক্ষিন্মার্গে অর্থাৎ পিঙ্গলা  নাড়ীতে সঞ্চালিত হয়ে, মুক্তিকাঙ্খীকে মুক্তি দান  করেন। আবার অন্য সময়ে,ইনিই সৃষ্ট সমস্ত বস্তুকে নাশ করে থাকেন।

সব শেষে বলি, আমাদের সমস্ত নাড়ীই বায়ু চলাচলের পথ স্বরূপ।  আমাদের মূলাধার থেকে মস্তক পর্যন্ত যত  নাড়ী  বিস্তৃত রয়েছে, এঁরা সবাই রস-রক্ত বাহক, রূপ-বাহক, শব্দ-বাহক এমনকি আমাদের মনেরও বাহক। আর এগুলো সবই প্রাণবাহী নাড়ী। আসলে নাড়ী মাত্রেই বায়ু চলাচলের রাস্তা স্বরূপ, এবং প্রানক্রিয়ার  সহায়ক হিসেবে কাজ করে থাকে।

আমাদের যা কিছু ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া, মনের ক্রিয়া, এমনকি বুদ্ধির ক্রিয়া,সবই এই বায়ুর স্পন্দন থেকে জাত। আর এগুলো নাড়ী-চক্রের দ্বারাই সম্পাদিত হচ্ছে। আমাদের জ্ঞানশক্তি, আমাদের ইচ্ছাশক্তি, এই বায়ুর স্পন্দনজাত।  বায়ুর স্থুলতা ও সূক্ষ্মতার উপরে নির্ভর করছে, নাড়ীর স্থূলতা বা সূক্ষ্মতা। সাধক বায়ুকে যোগক্রিয়ার দ্বারা ক্রমে সুক্ষ অবস্থা প্রাপ্ত হয়ে যখন নিরুদ্ধগতি হন, তখন নাড়ী-জাল ধীরে ধীরে গুটিয়ে আসে। তখন জ্ঞান ইত্যাদি যাবতীয় ব্যাপার নিরুদ্ধ হয়ে যায়। পতঞ্জলি যোগশাস্ত্রের মতে এই অবস্থাই চিত্ত বৃত্তির নিরুদ্ধ অবস্থা। এই সময় সাধকের দ্বন্দ্বাতীত অবস্থা হয়। পরম-সাম্য ভাবের উদয় হয়। এই বায়ুর নিবৃত্ত অবস্থাই নির্বাণ অবস্থা নামে খ্যাত।

সমস্ত সাধকের সাধনার অগ্রগতি নিভর করে, তার  ভিতরের বায়ুশুদ্ধির উপরে। বায়ুই আমাদের আধ্যাত্মিক পথের শক্তি। আর এই শক্তির গতিপথ নাড়ীর ভিতরে অবস্থান করছে। আর একটা কথা, আমাদের দেহে বা দেহভান্ডে  যেমন নাড়ীর জাল বিস্তার করে আছে, ঠিক তেমনি এই বিশ্বব্রহ্মান্ডেও একটা বিশাল নাড়ী-জাল বিস্তার করে আছে। আমাদের দেহে যেমন সূর্য্যরশ্মি বায়ুর সাহায্যে প্রবেশ করছে, ঠিক তেমনি এই বিশ্বব্রহ্মান্ডেও এই অনন্ত সূর্য্যরশ্মি ছড়িয়ে পড়ছে। জীবাত্মা স্থুলদেহের মৃত্যুকালে যখন এই মরদেহ ত্যাগ করে, তখন সে যে নাড়ী-দ্বারে নির্গত হয়, সেই নাড়ীই তাকে যথাস্থানে বহন করে নিয়ে যায়। এই সূর্য্যরশ্মি আসলে ব্রহ্মান্ডের নাড়িপথ। এই সূর্য্যরশ্মি বা ব্রহ্মান্ডের নাড়ী-পথ অবলম্বন করে, মহাত্মারা সূক্ষ্মদেহে ইতস্তত ভ্রমন করে থাকেন। এমনকি এই সূর্য্যরশ্মি অবলম্বন করে, মহাত্মারা পরদেহে প্রবেশ করতে পারেন। যেমন করেছিলেন, আচার্য্য আদি-শঙ্কর। বা গোরক্ষনাথ ও তাঁর  গুরুদেব মৎসেন্দ্রনাথ।   যোগাচার্য্যগণ নাড়ীমন্ডলীর মধ্যে বায়ুর স্থুলতা,সূক্ষ্মতা, ও বায়ুর নিরোধ অবস্থা পর্যবেক্ষন করে বুঝতে চেষ্টা করেন, তার যোগক্রিয়ার সাফল্য।

আমাদের যে মলনাড়ী আছে, তার মধ্যে যে বায়ু সঞ্চরণ করছে, সেই বায়ু স্থুল বায়ু এবং এর গতি বক্রাকার । এই স্থুলবায়ুকে জড় শক্তি বলা হয়ে থাকে। যোগীগণ যোগের সাহায্যে, এই বায়ুকে সরলরেখায় প্রবাহিত করবার প্রয়াস করেন, স্থুল থেকে সূক্ষ্মেপরিবর্তন করবার চেষ্টা করেন। আর তখন নাড়ী-মার্গ ক্রমে বিশুদ্ধ হয়, আর এই নাড়ীমার্গ যখন বিশুদ্ধ হয়ে যায়, তখন বায়ুর গমনপথ সরল-সোজা হয়ে যায়। এই সরল-পথ-ই হচ্ছে সুষুম্না নাড়ী। সাধক প্রথম অবস্থায়, সুষুম্না নাড়ীর সরলপথ অনুধাবন করতেও পারে না, উপল্বদ্ধিও করতে পারে না। আমরা জানি, সুষুম্নার মধ্যে আছে বজ্রাক্ষা নাড়ী, আর এই বজ্রাক্ষার মধ্যে আছে চিত্রিণী নাড়ী, আবার চিত্রিণী নাড়ীর মধ্যে আছে ব্রহ্মনাড়ী। যোগের সাহায্যে বায়ু শুদ্ধিকরণের সঙ্গে সঙ্গে বায়ু সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম হতে থাকে। আর এই বায়ু যত  সূক্ষ্ম হতে থাকবে, তত সে সুষুম্না থেকে ধীরে ধীরে ব্রহ্মনাড়ীতে প্রবেশের যোগ্য হয়ে উঠবে। অতএব, নাড়ীশুদ্ধিকরণের যেমন প্রয়োজন, তেমনি দরকার বায়ুকে স্থূল থেকে সূক্ষ্ম, সুক্ষ থেকে সূক্ষ্মতর, সূক্ষ্মতর  থেকে সূক্ষ্মতম করে তোলা। তবেই আমরা ব্রহ্মপথের সন্ধান পাবো।

একই শক্তির দুই অবস্থা, স্থুল ও সূক্ষ্ম। একই শক্তির দুই অবস্থা জড় ও চেতন। আমাদের সাধনার উদ্দেশ্য এই জড়কে চেতনে পরিণত করা। স্থুলকে সূক্ষ্মে পরিণত করা। আর এরই নাম যোগ সাধনা।আর এই যোগ সাধনা করতে গেলে আমাদের বায়ুকে যেমন বুঝতে হবে, তেমনি বুঝতে হবে বায়ুর গতিপথ অর্থাৎ নাড়ীকে।

এর পরের  দিন আমরা কুণ্ডলিনী শক্তির ক্রিয়া গতিপথ সন্মন্ধে আরো বিস্তারিত ও সূক্ষ্মতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করবো। কিন্তু আমরা বার বার বলছি, যোগক্রিয়া সাধারণের জ্ঞানের বিষয় নয়, এর জন্য চাই পাকা দেহ, এর জন্য চাই গভীর নিষ্ঠা, আত্মত্যাগ ও মানসিক পবিত্রতা। তবে আমরা বিশ্বাস করি, এগুলো অর্জন করার সাধ্য আমাদের সবার মধ্যেই নিহিত আছে। আর এই সজ্ঞা যতদিন না ভিতর থেকে জাগবে, ততদিন আমাদের প্রতীক্ষা করতে হবে।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

কুলকুণ্ডলিনী শক্তি  - ছয়

সুপ্ত কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণের পরে তার কি গতি হয় ?  
কুলকুণ্ডলিনী সম্পর্কে আজ আমরা সর্বোচ্চ পৰ্য্যায়ের জ্ঞানের কথা শুনবো। যোগের সাহায্যে বিশেষ করে আমরা যখন মহাবন্ধ মুদ্রা, ও মূলবন্ধ মুদ্রা বা মহাবেধ মুদ্রা, মহামুদ্রা যোগমুদ্রা, শক্তিচালনী  মুদ্রা   ইত্যাদি দ্বারা, বায়ুকে রোধ করতে পারি, বা বায়ুকে উর্দ্ধগামী করে কুম্ভক অবলম্বন  করতে পারি, তখন এই নিরুদ্ধ বায়ু আমাদের শরীরের অগ্নিস্থানের অগ্নিকে আঘাত দিয়ে জাগিয়ে তোলে। তখন এই উদ্দীপিত বহ্নি ও বেগবান বায়ু কুণ্ডলিনীকে প্রবুদ্ধ বা জাগ্রত করে। তখন অধোগামী অপানবায়ু উর্দ্ধগতিশীল হয়ে ওঠে, এবং নাভির নিচে যে মনিপুর চক্র আছে সেখানকার বায়ুমন্ডলে আঘাত করতে থাকে । আর এই আঘাতে সেখানে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে। এবং এই অগ্নি শিখা ও অপান  বায়ু তখন প্রণবায়ুকে স্পর্শ করে। তখন আমাদের সমস্ত শরীর-ব্যাপী অগ্নিময় হয়ে ওঠে। এই অগ্নিতাপে দগ্ধ হয়ে, সুপ্ত কুণ্ডলিনী ক্রিয়াশীল বা গতিশীল হয়ে ওঠে,  ও সুষুম্নার নাড়ীর মধ্যস্থ সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে। একেই  বলে কুণ্ডলিনী জাগরণ।

এই কুণ্ডলিনী অর্থাৎ বায়ুশক্তি যখন  জাগ্রত হয়, তখন এর গতি হয় উর্দ্ধ মুখী। আর এই কুণ্ডলিনী শক্তির সঙ্গে তখন  মিলিত হয়, মূলাধারের  মধ্যে ঘুমন্ত ব্রহ্মা, ডাকিনীশক্তি, এবং অন্যান্য দেবতা, চতুর্দলের চারটি বর্ণ ও গন্ধতত্ত্ব ধরাবীজ "লং"  এগুলো সবই তখন  মিলিত হয়ে, কুন্ডলিনীর দেহে লয় প্রাপ্ত হয়।

এই কুণ্ডলিনী শক্তি তখন মূলাধার-চক্র থেকে জীবাত্মাকে সঙ্গে নিয়ে স্বাধিষ্ঠান  চক্রে  প্রবেশ করে। আর ঠিক তখনই স্বাধিষ্ঠান  চক্রের যে পদ্মদল সেগুলো উর্দ্ধমুখী হয়ে যায়। এই স্বাধিষ্ঠান  চক্রের মহাবিষ্ণু, রাকিনি শক্তি, এবং অন্যান্য দেবতা পদ্মদলের ছটি বর্ণ এবং গন্ধতত্ত্ব তখন রস তত্ত্বে মিশে যায়। অর্থাৎ আমাদের মধ্যে যে পৃথ্বী তত্ত্ব অর্থাৎ মাটি আছে, তখন তা রসতত্ত্বে  মিশে যায়। আর কুণ্ডলিনী-দেহে যে পৃথ্বী বীজ অর্থাৎ লং আমাদের কারন শরীরে অবস্থান করছিলো, তা "বং" নামক বরুন বীজের সঙ্গে মিশে কুন্ডলিনীর দেহে বিলীন হয়ে যায়।

এর পরে এই রস-তত্ত্ব ও জীবাত্মাকে সঙ্গে নিয়ে কুণ্ডলিনী শক্তি মনিপুর চক্রে প্রবেশ করে। আবার এই মনিপুর চক্রে  অবস্থিত রুদ্রদেব, লাকিনি শক্তি, ও অন্যান্য দেবতা, দশদল পদ্মের দশটি বর্ণ  এবং রস-তত্ত্ব, রূপতত্ত্বে মিশে নয়। এইসময়, কুন্ডলিনীর দেহে সুক্ষভাবে অবস্থিত বরুন-বীজ "বং" তেজ-বীজ "রং" এর সাথে মিশে যায়। অর্থাৎ রসতত্ত্ব তখন অগ্নি তত্ত্বে মিশে যায়। এবং শেষেমেষ কুণ্ডলিনীর দেহে বিলীন হয়ে যায়।

এই মনিপুর চক্র হতে অনাহত-চক্রে  উঠতে গেলে সাধককে ব্রহ্ম-গ্রন্থি  ভেদ করতে হয়। এই ব্রহ্ম-গ্রন্থি ভেদ সাধকের পক্ষে একটা কঠিন পরীক্ষা। আসলে আমাদের মনিপুর চক্র পর্যন্ত জড়বস্তুর বিস্তার স্থান।  বা বলা যেতে পারে, প্রকৃতির জড় শক্তির অবস্থান কেন্দ্র এটি। এই জড়শক্তিকে শুদ্ধ ও সূক্ষ্ম না করতে পারলে, এখান থেকে উত্তরণ সম্ভব হয় না। তাই এই কাজ সাধকের পক্ষে প্রচন্ড দুরূহ।এই সময়টা সাধকের জীবনে সবথেকে কঠিন সময়। আসলে এই সময় আমাদের মধ্যে যে পশুত্ত্ব-ভাব আছে তা সমূলে উৎপাটন করতে হয়ে। এই পশুভাব দূর করতে না পারলে, সাধক ব্রহ্ম-গ্রন্থির সন্ধান পান না। আর ব্রহ্ম-গ্রন্থি ভেদও করতে পারেন না।

তবে যাদের বহু জন্মের সুকৃতি আছে, অথবা যাদের দৃঢ়তা আছে, তারা অবশ্য়ই প্রয়াসসাধ্যে  অনাহত চক্রে উত্তীর্ন হন। এবং কুণ্ডলিনী শক্তি যখন অনাহত চক্রে উপনীত হয়, তখন এখানকার ঈশ অর্থাৎ ঈশ্বরশক্তি শিব, ডাকিনী শক্তি, অন্যান্য দেবতা, অনাহত পদ্মের বারটি পাপড়ির বারোটি অক্ষর ও স্পর্শতত্ত্ব কূল কুণ্ডলিনীর মধ্যে বিগলিত হয়ে যায়। এই সময় কুণ্ডলিনী-দেহের রূপতত্ত্ব ও অগ্নি বীজ ও বায়ু বীজ তখন অনাহত চক্রের "যং" বীজমন্ত্রে মিশে যায়।  অর্থাৎ  অগ্নি তখন বাস্পে পরিণত হয়।  এবং শেষে এই সমস্ত কুল কুণ্ডলিনীর  দেহে বিলীন হয়ে যায়।

এবার অনাহত চক্র  থেকে বিশুদ্ধ চক্রে উত্তরণ করতে হবে। এই বিশুদ্ধ চক্রের আর একটা নাম বিষ্ণু গ্রন্থি। আমাদের যতক্ষন দ্বায়িত্বজ্ঞান বিলুপ্তি না হবে, ততক্ষন আমাদের এই বিশুদ্ধ চক্রে আরোহন সম্ভব নয়।  আর যখন কুণ্ডলিনী জীবাত্মাকে সঙ্গে নিয়ে, এই বিশুদ্ধ চক্রে প্রবেশ করে, তখন অর্ধনারীশ্বর সদাশিব, শাকিনীশক্তি, বিশুদ্ধ পদ্মের ষোলোটি পাপড়ির ষোলোটি বর্ণ ব্যোমতত্ত্বে বা শব্দতত্ত্বে পরিণত হয়। এবং কুণ্ডলিনী-দেহের বায়ু বীজ যং তখন আকাশ বীজ হং-এ মিশে যায়।  অর্থাৎ বাষ্প তখন শব্দ তরঙ্গে বা ইথারে পরিণত হয়। এবং শেষে এই শব্দতত্ত্ব কুণ্ডলিনীর দেহে বিলীন হয়।

এইভাবে কুন্ডলিনীর যাত্রা চলতে থাকে।  এর পর কুন্ডলিনী আজ্ঞাচক্রে প্রবেশ করে। এবং সেখানে আজ্ঞা চক্রে  স্থিত পর-শিব, হাকিনীশক্তি, ও অন্যান্য দেবতা, এবং  বর্ণ এবং কুন্ডলিনীর দেহের শব্দ-তত্ত্ব অহংকার তত্ত্বে মিশে গিয়ে কুন্ডলিনীর দেহে বিলীন হয়ে যায়।

এর পর শুরু হয়, সাধকের কঠিন পরীক্ষা। কুণ্ডলিনীকে সহস্রারে উত্তরণ। এখানে তাকে রুদ্রগ্রন্থির মোচন করতে হয়। এই রুদ্রগ্রন্থি ছেদন হলে তবে সাধকের কুণ্ডলিনী সাধকের সহস্রারে প্রবেশ করে। সহস্রারে কুণ্ডলিনী পরম-শিবের সঙ্গে আলিঙ্গনে অবাধ্য  হয়। আর এই আলিঙ্গন থেকেই অমৃতসুধা ধারা বা  আনন্দ ধারা বর্ষণ শুরু হয়। আর জীবাত্মা তখন এই অমৃতধারা পান করে, পরমতৃপ্তি লাভ  করে।
 এই কুণ্ডলিনী যখন উর্দ্ধদিকে ধাবিত হয়, তখন পদ্মের সমস্ত  পাপড়ি  তার সেই গতি অনুসারে উর্দ্ধমুখী হয়ে যায়। এবং অতি উজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করে। এইসময়, একটা চৌম্বকীয় শক্তি, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সমস্ত শক্তিকে চারিদিক  থেকে আকর্ষণ করে কুন্ডলিনীতে লীন  হয়।  এবং তিনটি শিব-লিঙ্গ অর্থাৎ মূলাধারের স্বয়ম্ভূ  লিঙ্গ, অনাহতের  বাণলিঙ্গ, এবং আজ্ঞাচক্রের ইতর লিঙ্গ সমস্ত শক্তিকে ভেদ করে পরমশিবের সঙ্গে মিলিত হন।
এই হচ্ছে কুন্ডলিনীর যাত্রা, যাত্রাপথের বিবরণ, পরম-শিবের সঙ্গে মিলন। এর পরে আমরা শুনবো সেই যোগ প্রক্রিয়া, যার সাহায্যে মুনিঋষিরা কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করতেন। এ যেন একটা খেলা, কুণ্ডলিনী হচ্ছে একটা চৌম্বকীয় শক্তি এবং এই শক্তি ধীরে ধীরে এক চক্র থেকে আর এক চক্রে  আরোহন করছে, স্থূল বস্তু ধীরে ধীরে আরো সূক্ষ্ম, সূক্ষ্মতর, সূক্ষ্মতম  হচ্ছে, আর শক্তিশালী হচ্ছে। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।  




Friday 18 October 2019

মনকে ধরবেন কি করে ?


মনকে ধরবেন কি করে ?
আমরা সবাই শুনেছি, গীতায়   অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বলছেন,  হে মধুসূদন তুমি যে যোগের কথা বললে, মনের চঞ্চলতা বশতঃ এই যোগে স্থায়ী হওয়া সম্ভব নয়। হে কৃষ্ণ মন তো  চঞ্চল, বলবান, ও লোহার মতো কঠোর। বায়ুকে নিরুদ্ধ করা যেমন দুঃসাধ্য, মনকে আটকে রাখা তেমনি সাধ্যের অতীত।  ( ৬/৩৩-৩৪) তো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে বলেছিলেন, অভ্যাস ও বৈরাগ্য দ্বারা মনকে বশে আনা  যায়।

এক রাজা একটা বলশালী অশ্ব খরিদ করেছেন। গায়ে হাত পড়লেই চিড়বিড় করে লাফিয়ে ওঠে ঘোড়াটি। বহু বলবান তাকে লাগাম পড়ানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু সবাই ব্যর্থ হলেন।  তো এক যুবক এসে বললেন, ঘোড়াকে আগে বশে আনুন, তারপরে লাগাম পড়ান । সবাই বললো, তাই হয় নাকি ? লাগাম না পড়াতে পারলে ঘোড়াকে বশে আনবো  কি করে ? তো প্রশ্নটা হচ্ছে, আগে লাগাম পড়ানো, না আগে বশে  আনা। তো যুবক ঘোড়াটিকে এক  বছর যাবৎ  নিজের কাছে নিয়ে নিলেন। তাকে পছন্দমত  খাওয়ানো, স্নান করানো, আদর করা, এমনকি তার সাথে যুবক খেলা করতে লাগলো। এখন ঘোড়া ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু মনিব ডাক দিলেই চলে আসে। এইবার যুবক যা বলে, ঘোড়া তাই শোনে। এবার তাকে লাগাম পড়ানো, বা ইচ্ছেমতো পরিচালনা করা, তার পক্ষে সহজ হয়ে গেলো।

আমরা আমাদের মনকে লাগাম পড়াতে চাই। কিন্তু যে আমার বশে নেই, তাকে লাগাম পড়াবো কি করে ? তো  আমার মন কি চায়, কি সে ভালোবাসে, তাই আমরা জানি না। তো তাকে আমরা নিয়ন্ত্রণ  করবো কি করে ? 

ধরুন আপনি ধ্যান করতে চান। কিন্তু ধ্যান-তো মনের সাহায্যেই করতে হবে। মনতো আপনাকে জিজ্ঞেস করবেই, কেন ধ্যান করবো। আপনি বললেন, ভগবান লাভ করবার জন্য। এখন এই ভগবান সম্পর্কে কিন্তু মনের কোনো ধারণা নেই।  কারন সে আগে কখনো ভগবানের  কথা শোনেই নি। ভগবানকে দেখেও নি। অর্থাৎ ইন্দ্রিয় লব্ধ যে জ্ঞান আমাদের মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে, তার মধ্যে ভগবানের কোনো দেখা নেই। তাই এ এব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাবে না। তার জন্য আপনাকে কি করতে হবে ? আপনাকে ভগবান সম্পর্কে শুনতে হবে, এসম্পর্কে  পড়াশুনা করতে হবে। তো এতে করে, আপনার মনে ভগবান সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে উঠবে। এবং এটি তখন আপনার কল্পনার স্তরে থাকবে। কারন এতো তার প্রতক্ষ্য জ্ঞান নয়, এটি একটি একপেশে ধারণা মাত্র। এমনকি এই ধারণাও এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম হবে। কারন, আপনার পড়াশুনা বেশি, বুদ্ধি বেশি  আপনার ধারণা হবে উচ্চস্তরের। আর আমার পড়াশুনা কম আমার বুদ্ধিও কম, আমার ধারণা হবে নিম্ন মানের। কিন্তু সত্য হচ্ছে, ভগবানের একটাই মান। এর কোনো উচ্চমান বা নিম্নমান হয় না।   আর এগুলো কোনো কল্পনা প্রসূত জ্ঞান নয়, এটি বাস্তব সত্য। আপনার শিক্ষা আপনার সংস্কৃতি, আপনি যে পরিবারে জন্মেছেন, সেই পরিবারের ঐতিহ্য, আপনার ব্যক্তিগত রুচি, ইত্যাদির উপর নির্ভর করে, আপনার মনে একটা ভগবান সম্পর্কে প্রতিচ্ছবি তৈরি হবে। আর এই প্রতিচ্ছবিটা সত্য নাও হতে পারে। আপনার বোঝাটা ভুলও হতে পারে। এইখানে একটা কথা খেয়াল করুন, আমি যখন শিশু ছিলাম, তখন ঈশ্বর সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা মনে ছিল না। ধীরে ধীরে, আমার মধ্যে আমার পরিবেশের ছোঁয়ায়, আমার জ্ঞানের ছোঁয়ায়, আমার মধ্যে একটা ধারণা জন্মেছে। আর এই ধারণা নিয়ে যদি আপনি ভগবানকে খুঁজতে যান, তবে রজ্জুতে সর্প ভ্রম হবে। এইজন্য আগে আমাদের সঞ্চিত জ্ঞান অর্থাৎ আমাদের সংস্কার সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করতে হবে। ভগবান সম্পর্কে আমাদের ধারণা, আর ভগবানের প্রকৃত সত্ত্বা এক নাও হতে পারে। তারকেশ্বরের স্বয়ম্ভূ শিবলিঙ্গের কাছে গেছেন কখনো ? ওখানে গেলে দেখবেন, খালি গায় যেতে হয়। আসলে ইটা একটা প্রতীক। সত্য হচ্ছে, ভগবানের কাছে যেতে হলে আমার সঞ্চিত জ্ঞান ব্যাড দিয়ে যেতে হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন,  সবধর্ম পরিত্যাগ করে, আমার স্বরনে এসো। অর্থাৎ এতদিন, ধর্ম বলতে যা তুমি বুঝেছো, অর্থাৎ কুলধর্ম, আচার বিচার সব ত্যাগ করে তবে তুমি আমার কাছে আসতে পারবে।   

আমার চেতন মন বুদ্ধির সাহায্যে যে ভগবানকে চাইছে, সেটা আমাদের ধারণা মাত্র। আর অবচেতন মন সত্যকে খুঁজছে, সেটা তার সংস্কার মাত্র । মনের এইযে দুটো ঢেউ, এই দুটোকেই শান্ত করতে হবে।
এই দুটো মনকে শান্ত করতে পাড়লে আমরা মনের তৃতীয় স্তরে পৌঁছতে পারবো। আর সেটা হচ্ছে অতিচেতন মন। এটি আমাদের সজ্ঞার স্থান। এখানেই সত্য দৃষ্ট হয়। 

এখন কথা হচ্ছে, চেতন ও অবচেতন মনকে শান্ত কি ভাবে করতে পারবো।  আমরা আগেই জেনেছি, মন হচ্ছে আমাদের চেতনকেন্দ্রের স্ফূরণ মাত্র। জ্ঞান আমরা দুই ভাবে গ্রহণ করতে পারি, এক - ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে জ্ঞাত অনুভবের সাহায্যে, আর একটা হচ্ছে, ইন্দ্রিয়াতীত অনুভূতি। যেটা আমাদের সজ্ঞা কেন্দ্রের কাজ। মাস্টারের কথা ছাত্র বুঝতে পারছে না - এটা মাস্টার মহাশয়  বুঝতে পারে। আমি আপনার কথা ভাবলে, আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, আপনার মধ্যে আমার ভাবনা ফুটে উঠবে। 
এটা আমাদের ইন্দ্রিয়াতীত সম্পর্ক স্থাপন। এই অভিজ্ঞতা আমাদের সবার কম বেশি হয়ে থাকবে। 

এখন কথা হচ্ছে, মনকে শান্ত করবার উপায় কি ? মনকে শান্ত করবার উপায় সম্পর্কে অনেক মহাত্মা অনেক প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন, সবগুলোর মধ্যে একটা জিনিস দেখতে পাবেন, আর তা হচ্ছে - শরীরকে স্থির করা, নিশ্বাস-প্রশ্বাস কে ধীর করা। 

কিন্তু আমরা  বলি, সবকিছু করুন, কিন্তু শুধু ভাবুন, আমি কিছুই করছি না। যার কাজ সেই করছেন। আমার শরীর সেই কাজে সাথ দিচ্ছে মাত্র। আমি কিছুই করছি না। আর প্রত্যক্ষ করুন, আপনার শরীর  মন শান্তই আছে। কেননা আপনি তো কিছুই করছেন না। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

মনকে বুঝুন :

মাথাটাকে বাদ  না দিলে মনটাকে  ধরা যাবে না। মাথাটাই যত নষ্টের গোড়া। আমি একবার এক আশ্রমে গিয়ে দেখি, সমস্ত সাধক মাথাকে কাপড়ের টুপি দিয়ে ঢেকে বসে আছে, এমনকি চোখ কান ঢাকা । আচার্য্যের কেবলমাত্র চোখ-কান খোলা।মাথাটা ঢাকা।  তো আমি আচার্য্যকে  জিজ্ঞেস করলাম। মাথায় টুপি পড়া অনেক সাধু মহাত্মাদের দেখি। কিন্তু আপনি তো দেখছি মুণ্ডুটাকেই ঢেকে দিয়েছেন,এর অর্থ কি ? তো তিনি একটা সত্য উদ্ভাসিত করলেন, আমার সামনে। বললেন, দেখুন মাথাটাই আসলে ঈশ্বর থেকে আমাদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। মানুষে মানুষে বিভেদের সৃষ্টি করেছে। মাথা দিয়ে বৈজ্ঞনিক তৈরি হয়। মাথা দিয়ে পণ্ডিত হয়। মাথা দিয়ে ঈশ্বরের ভক্ত হওয়া যায় না। মাথা দিয়ে অখন্ডকে বোঝা যায় না। মাথা বিভেদের সৃষ্টি করে। বৈজ্ঞানিক, পদার্থকে  টুকরো টুকরো করে, পরীক্ষা করে, সে,উৎসে যেতে চায়। পন্ডিতেরা বিচারের মাধ্যমে ঈশ্বরের খোঁজ করে। বিচারের মাধ্যমে ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে না। ঈশ্বর অখন্ড তাকে খণ্ডিত করা যায় না। ঈশ্বর বিচারের উর্দ্ধে।  আমরা বুদ্ধির মাধ্যমে যুক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরের খোঁজ করি। অর্থাৎ ঈশ্বরকে খন্ড খন্ড করে বুঝতে চাই। যা একেবারেই সম্ভব নয়। ঈশ্বরকে পেতে গেলে আমাদের মনকে বুঝতে হবে, মনকে মাথা থেকে হৃদয়ে নাবিয়ে নিয়ে আসতে  হবে। অশান্ত মনকে শান্ত করতে হবে। ভালোবাসা দিয়ে মনকে বুঝতে হবে। মন যতক্ষন মাথাতে থাকবে, ততক্ষন মন যুক্তির সাহায্য, বুদ্ধির সাহায্যে চলতে চাইবে। সেখান থেকে মনকে হৃদয়ের অনুভূতিতে নাবিয়ে আনতে  হবে।  

আমরা শারীরিক অস্বস্তি বা অসুখ বোধ করি কখন ? আমাদের শরীরের কোনো অঙ্গ বা তন্ত্র যখন ঠিক ঠিক মতো কাজ করে না। অর্থাৎ শরীরের তন্ত্রগুলোর মধ্যে সঙ্গতির অভাব। তেমনি মন চারটি স্তরে কাজ করে। চেতন - বা জাগ্রত অবস্থা, অবচেতন বা স্বপ্নাবস্থা, অতিচেতন বা তুরীয় অবস্থা, আর স্থির অবস্থা বা সুসুপ্তির অবস্থা। তবে আমাদের মত সাধারণ মানুষের মন দুটো স্তরে কাজ করে। একটা চেতন আর একটা অবচেতন। আগে এই দুটো মনকে আমরা একটু ভালোভাবে বুঝবার চেষ্টা করি আজ। 

আমি তখন দুর্গাপুরে অফিস করি। সপ্তাহান্তে বাড়িতে আসি।  সোমবার ভোরে, ৪-৩৫-এর ট্রেন ধরি। তো সকালে সময়মতো উঠবার জন্য, ফোনে  অ্যালার্ম দিয়ে রাখতাম। ফোনের রিং বেজে উঠলেই, আমার মনের মধ্যে একটা আতঙ্ক হতো। ভাবতাম আবার অফিস যেতে হবে ? একটু পরে   উঠি, বা ভাবতাম আজ আর অফিস যেয়ে কাজ নেই। আমার এই যে ভাবনা এটি আসলে অবচেতন মনের ভাবনা। তখন চেতন মন বলতো, না আজ সোমবার, অফিসে ভিড় হবে। আমি না গেলে, অন্যদের কষ্ট হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। .. . তো দেখুন এক মন বলছে, শুয়ে থাকো, আর এক মন বলছে, উঠে পরতে । এর পরে  যখন চেতন মনের তাগিদে, ঘুম থেকে উঠলাম, তখন একটা বিরক্তির ভাব। এবার দেখুন, ছুটির দিনে, সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে প্রাণায়াম-ধ্যান করতে ঠাকুর ঘরে চলে গেলাম। সেদিনও ভোর চারটেতে উঠলাম। কিন্তু কোনো বিরক্তি নেই। আজ ছুটির দিন। ছুটির দিনে আমাদের চেতন মনে ও অবচেতন মনে একই ধরনের বৃত্তি জেগে ওঠে, তাই চেতন মন   আর অবচেতন মন এক সঙ্গে কাজ করে, কিন্তু অফিসের দিন, আমাদের চেতন মন যা বলে অবচেতন মন সে কথা শুনতে চায় না। দুটো মনে, বা বলা যেতে পারে মনের দুটো স্তরে দুই রকম চিন্তা চলছে। বা দুই রকম চাহিদা। 

ধ্যান-জপের প্রথম দিকে মন কিছুতেই শান্ত হতে চায় না। আর আমরা দুটো মনের লড়াইয়ে ক্লান্ত  হয়ে যাই। চেতন মন যখন ধ্যান-জপ করতে চায়, অবচেতন মন তখন তার সুপ্ত সংস্কার নিয়ে বেরিয়ে আসে।  আর আমাদের ধ্যান-জপ থেকে বিরত রাখতে চায়। এইভাবে চেতন মন আর অবচেতন মন দ্বন্দে লিপ্ত হলে আমাদের মধ্যে চঞ্চলতা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ মনের ভারসাম্য নষ্ট হয়। 

এই জন্য উপনিষদ বলছে,  ভিদ্যতে হৃদয় গ্রন্থিঃ ছিদ্যন্তে  সর্ব সংশয়াঃ। হৃদয় গ্রন্থি ছিন্ন হলে সমস্ত সংশয় দূর হয়। মুণ্ডক উপনিষদ বলছে, ঋষিরা অর্থাৎ যারা আত্মাকে জেনেছেন,  তাঁরা আসক্তিশূন্য হন, তাদের মন তখন ধীর, স্থির, শান্ত হয়ে যায়। তাঁর মনে না আছে, কোনো উদ্বেগ, না আছে বিরোধ। তাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়, সংযত। বালসুলভ প্রফুল্লতা ও আনন্দে ভরপুর থাকেন। এদেরকে বুদ্ধি দিয়ে বিচার করা যায় না। 

আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা সব সময় বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হতে পারি না। অনেক সময় আমরা আবেগ দ্বারা পরিচালিত হই। অর্থাৎ আমাদের সচেতন মনের চেয়ে অবচেতন মন আমাদের তখন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আর অবচেতন মন পরিচালিত হয় আমাদের সংস্কার দ্বারা। এইজন্য আমাদের দরকার আমাদের অবচেতন মনে কি আছে, অর্থাৎ আমাদের সংস্কারগুলো কে, ও কেমন সেটা বোঝা ও  জানা। এবং এই অবচেতন মনের সংস্কারগুলোকে যদি আমরা ধরতে পারি, তবে, চেতন মন বার বার অভ্যাসের দ্বারা নতুন বোধ পাঠাতে পারে অবচেতন মনে। অর্থাৎ আমাদের যদি কিছু খারাপ সংস্কার থেকে থাকে, তবে তাকে প্রথমে চাপা, তারপরে, উৎপাটন করে দিতে পারি। এইজন্য আমাদের ধ্যান যত গভীর হবে, আমরা আমাদের অবচেতন মনকে  তত বেশিকরে বুঝতে পারবো, এবং অবচেতন মনের বৃত্তিগুলোকে সংশোধন করতে পারবো। 

প্রত্যেক মানুষের মনের একটা জগৎ আছে। সাধারণের মানুষের জগতের কেন্দ্র হচ্ছে, তার বিষয়াশয়, পরিবার-পরিজন আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদি। এগুলো নিয়েই সে অবিরত চিন্তা করছে। আর এই অনিত্য বস্তূতে যে পরিবর্তন হচ্ছে, সেই পরিবর্তনগুলো তাকে ভাবাচ্ছে। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রের অবস্থা, ছেলেমেয়ের চিন্তা, বাড়িঘরের চিন্তা, টাকাপয়সার চিন্তা এগুলোকে নিয়েই সে ঘুরপাক খাচ্ছে। এবং একটা থেকে আর একটায় তার চিন্তা সরে সরে যাচ্ছে। এখানেই সে সুখ-দুঃখ অনুভব করছে, কখনো সে অসহায় হচ্ছে, কখন তার রাগ হচ্ছে, কখনো তার হিংসা হচ্ছে।  এগুলোর উপরে তার মোহ জন্মাচ্ছে। এবং এইভাবেই সে তার মনের সমতা নষ্ট করছে।  

খেয়াল করে দেখবেন, ধ্যানের সময় যতক্ষন আমাদের মন শান্ত না হচ্ছে, অর্থাৎ চেতন ও অবচেতন মন একই দিকে ধাবিত না হচ্ছে, ততক্ষন আমাদের মনে নানান চিন্তা ভেসে উঠছে। তাই এই দুটো মনকে একজায়গায় আনবার জন্য, ধ্যানীরা একাধিক কাজ এক সময় করে থাকেন। অর্থাৎ জপ করবেন, আবার জপের সংখ্যা গুনে রাখবেন । এতে করে দুটো মন  ক্রিয়াশীল থাকায়, মনের দ্বন্দ্ব দূর হয়ে যাবে। অর্থাৎ মন এবার মাথা থেকে হৃদয়ে চলে আসবে। বুদ্ধি থেকে পরিশীলিত সংস্কারে নেবে আসবে।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

ধ্যানের উদ্দেশ্য - সত্যকে ধরা। 

ধ্যান আমাদের বন্ধন  মুক্তির পথ। আর এই বন্ধন আবার আমাদের স্বকীয়। কম্বলের লোভে আমি নদীতে ঝাঁপ দেই। আসলে যে ওটা ভাল্লুক তাতো আমি জানিও না, ভাবিওনি, এখন আমাদের যখন বন্ধন ছাড়ানোর ইচ্ছে জাগ্রত হয়, তখন দেখি আমি ছাড়লেও কম্বল আমাকে ছাড়ছে  না। কম্বল কল্পনা হলেও, বন্ধন আমাদের বাস্তব হয়ে যায়। তাই অবচেতন মনের সংস্কারগুলোকে যতক্ষন আমি না ধরতে পারবো, ততক্ষন  আমি সত্যের কাছাকাছি যেতে পারবো না। মিথ্যাকে মিথ্যা বলেই বুঝতে হবে। ভাল্লুককে যেন আমরা কম্বল না ভাবি।  ভাল্লুককে আমাদের ভাল্লুক বলেই চিনতে হবে। অর্থাৎ অবচেতন মনের সংস্কারগুলোকে ঠিক ঠিক ভাবে বুঝতে হবে। তার সংস্কার করতে হবে, সংশোধন করতে হবে,  তবেই আমরা আমাদের চেতন মনের উদ্দেশ্য অনুযায়ী অবচেতন মনকে পরিচালিত করতে পারবো। 

আমাদের মন অশান্ত বলেই আমরা কষ্ট পাই।  আবার আমরা কষ্ট  পাই বলেই আমাদের মন অশান্ত হয়। দেখুন, আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী জগৎ চলবে না। জগতের ইচ্ছে অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে। কিন্তু  আমরা করি উল্টো। অর্থাৎ আমি যা চাই তাই জগতের কাছ থেকে পেতে চাই। আর এটা হয় না বলেই, আমাদের দুশ্চিন্তা হয়। আর দুশ্চিন্তা থেকে আমাদের ভয়, আর ভয় থেকে দুঃখ পাই আমরা। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে আমাদের অতৃপ্তি আমাদের কষ্টের কারন। আর এই অতৃপ্তি আমাদের চিরকাল খেপা কুত্তার মতো তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। অথবা বলা যেতে পারে, আমরা মরীচিকার পিছনে ছুটছি। কিন্তু কেন এই অতৃপ্তি ?

সন্তোষ  যখন কর্মসূত্রে বাড়ির বাইরে আসে , তখন সে  মেসে থাকতো । একটা ঘরে ৪/৬ জন থাকতো । বছর  কয়েক পরে, একটাঘর ভাড়া নিলো, টালির ছাউনি। বর্ষাকালে চাল দিয়ে জল পড়তো। কিন্তু একটা ঘরে একাই থাকতো ।  বছর খানেক  পরে একটা প্লাস্টারবিহীন পাকা বাড়ি ভাড়া নিলো  । এর পরে একসময়  নিজেই বাড়ি কিনলো।  কিন্তু এসবেস্টস-এর ছাদ।  দুটো ঘর। কিন্তু তখন সে দুজন হয়ে গেছে । এর পরে বাড়ির ছাদ  হলো, ঘর  দুটো থেকে তিনটে হলো। ওরাও দুজন থেকে তিন জন হলো । এর পরে, বাড়ি দোতলা হয়েছে। ছটা ঘর হয়েছে। নিউটাউনে একটা আলাদা দু-কামরার ফ্লাট কিনেছে।   মানুষ কিন্তু  তিন থেকে, দুই হয়ে গেছে, কারন ছেলে কর্মসূত্রে বাড়ির বাইরে চলে গেছে। সন্তোষ এখন চাইছে,বোম্বেতে একটা ফ্লাট কিনতে, কারন ছেলে সেখানে ভাড়া বাড়িতে  থাকে। 

মানুষ সাফল্য চাইছে, সন্মান চাইছে, টাকা চাইছে, বাড়ি-গাড়ি চাইছে। বড় হতে চাইছে। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন, মানুষ এগুলো কেন চাইছে ? না আমি বলছিনা যে এই চাওয়াটা খারাপ, উচ্চাকাঙ্খা না থাকলে মানুষ বড়ো হতে পারে না। আসলে মানুষ পূর্ন হতে চায়। এবং সেটাই তার স্বভাব। কিন্তু এই পূর্নতা কিসে হবে, তা সে জানে না। তাই সবকিছুর মধ্যে আমিত্ত্বের প্রবেশ করাচ্ছে। আমার বাড়ি, আমার গাড়ি, আমার স্ত্রী, আমার ছেলে, আমার মেয়ে। আমাকে নিয়ে একটা জগৎ তৈরি করতে চাইছে।  অপূর্ন থেকে সে পূর্ন হতে চায়। কিন্তু যার মধ্যে সে আমিত্ত্বের প্রবেশ করাচ্ছে, সেটাকে সে কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে যাচ্ছে। তাই আবার হাহা-কার উঠছে তার মনে।  হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোনো খানে। তাই আবার সে পূর্ণতার খোঁজে বেরিয়ে পড়ছে। তাই সর্ব্বক্ষন সে অতৃপ্ত। আমার কল্পনার বস্তুতে আমি তৃপ্তি খুঁজছি। আমি ভাবছি, আমি এম.এ পাশ করলে  সুখী হবো।  চাকরি পেলে আমি সুখী হবো। একটা বাড়ি হলে আমি সুখী হবো। একটা গাড়ি পেলে আমি সুখী হবো। একটা ছেলে হলে আমি সুখী হবো। ধর্মশাস্ত্র মুখস্ত করলে  আমি সুখী হবো। এগুলো সবই আমার কল্পনা। বর্তমানে দাঁড়িয়ে আমি ভবিষ্যতের জন্য সুখী মনকে অভিক্ষেপন করছি। অর্থাৎ বর্তমানে আমি সুখী নোই। কল্পনাকে আশ্রয় করে, আমার মনকে ভবিষ্যতের  পথে যাত্রা করিয়ে দিচ্ছি, সুখী-গৃহ খুঁজবার পথে এগিয়ে দিচ্ছি। আসলে ভবিষ্যতের মধ্যে নিজেকে প্রস্থাপন করে, সুখের স্বপ্ন দেখছি।  

ধ্যানে, আমরা মনের এইযে প্রজেকশন বা অভিক্ষেপন সেটা আমরা ধরতে পারি। এইজন্যই ধ্যানের  প্রয়োজন। অর্থাৎ আমার অবচেতন মনের যে সংস্কার তাকে আমরা ভালোভাবে ধরতে পারি। এবং সেই অনুযায়ী চেতন মনের সাহায্যে সেই সংস্কার গুলোকে সংশোধন করতে পারি। অতীত জ্ঞান বা স্মৃতি  আমাদের ধারণা তৈরি করে। ধারণা আবার কল্পনা সৃষ্টি করে, নতুন জ্ঞানের আহরণের জন্য। 
তাই বলে ভাববেন না যে আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবা উচিত নয়। নিশ্চই আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবা উচিত। যে কোনো কাজ করতে গেলে আপনার যেমন পূর্বস্মৃতি সহায়ক হয়ে কাজ করে, তেমনি, আজকের অভিজ্ঞতা আপনার ভবিষ্যতের রূপরেখা তৈরি করতে পারে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা যেন আমাদের বাসনায় পরিণত না হয়। অর্থাৎ ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আর ভবিষ্যতের সুখপ্রাপ্তির কল্পনা এক নয়। তাই ভবিষ্যতের সুখপ্রাপ্তির কল্পনা  আমাদের ত্যাগ করতে হবে। স্মৃতিকে বা আমাদের পূর্ব-অভিজ্ঞতাকে আমাদের প্রয়োজন অনুসারে কাজে লাগাতে হবে। আমরা কখনোই কল্পনার স্রোতে ভেসে যাবো না। জ্ঞানীরা তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান, আর ভবিষ্যৎকে নিজের মতো চলতে সাহায্য করেন, এবং তার যথাযথতা সঠিক ভাবে ধরবার চেষ্টা করেন। আসলে আপনাকে সত্যকে ধরতে হবে। আপনার প্রজেক্টেড সত্য নয়। প্রতিষ্টিত সত্য। তাহলে আপনার অতৃপ্ততা বলে কিছু থাকবে না। আপনি যখন আপনার চিন্তার স্রোতকে বুদ্ধির সাহায্যে পরিচালিত করতে পারবেন, যখন আপনি ঘটনাকে যুক্তি দিয়ে উপস্থাপন করতে পারবেন, তখন যেকোনো অবাঞ্চিত ঘটনা আপনাকে বিচলিত করতে পারবে না। আপনি যখন আবেগ দ্বারা পরিচালিত হবেন , তখন আপনি অশান্ত হয়ে উঠবেন। আপনার মন বিশৃঙ্খল হবে। আর আপনি যখন বুদ্ধি দ্বারা যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হবেন , তখন আপনি সুশৃঙ্খল থাকবেন, শান্ত থাকবেন। 

শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।।  
   


Saturday 12 October 2019

ধরো - মারো - কাটো - খাও

ধরো - মারো - কাটো - খাও

একবার এক পাগলা সাধুর কাছে, জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সাধু জীবনের উদ্দেশ্য কি।  কিসে জীবন সার্থক হবে। তো পাগলা সাধু একটি আশ্চার্য্য জবাব দিয়েছিলো। সেটা হচ্ছে ধরো-মারো-কাটো-খাও।  সাধু যে সত্যি পাগোল, সেটা বুঝে নিয়ে তারা সবাই চলে গেল। পাগলের কাছ থেকে কিই বা আশা করা যেতে পারে ? সাধুকে পাগোল-ছাগল ইত্যাদি বলে গালাগাল দিতে দিতে তারা চলে গেল। সাধু হাসতে  লাগলো। 

একজন মূর্খ,  সাধুর কাছে বসে রইলো।  তো সাধু জিজ্ঞেস করলো।  তুই বসে আছিস কেন ? তো সে বললো আমি কিছু বুঝি নি তাই বসে আছি। আমি বোকা তো তাই কিছু বুঝিনি।   আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন। 

তো সাধু বললো, কে বললো তুই বোকা, তুই ব্যাটা আসলে চালাক। তাই এখনো বসে আছিস। যা ভাগ। তো মূর্খ বসেই থাকলো। সাধুকে তামাক সেজে দিলো। কল থেকে জল এনে দিলো।  বাড়ি থেকে খাবার এনে দিলো।

সাধু খুশি হয়ে বললো - শোন  ধরো-মারো-কাটো-খাও এর মানে হচ্ছে। যথার্থ গুরুকে ধরো। গুরুর কাছে মরার মতো পড়ে থাকো। কামনা বাসনাগুলোকে মারো। মায়ার বাঁধন কাটো। তার পরে পরমানন্দ ভোগ করো। মূর্খ সেই হয়, যে ঈশ্বর ছাড়া কিছু বোঝে না। পাগল সেই হয়, যে ঈশ্বরের প্রেম পেয়েছে। প্রেমেই তো মানুষ পাগল হয়।

আমাদের প্রেমের ধারাকে ঈশ্বরমুখী করতে হবে। 

এক ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে ভীষণ ভালো বসেন। এক মুহূর্ত তাকে কাছছাড়া করতে পারেন না। স্ত্রী বাপের বাড়ি গেলে, পিছন পিছন ভদ্রলোক চলে যান ।  এই নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে, কিন্তু ভদ্রলোকের  ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি এতে কোনো অপরাধ দেখতে পান না। কিন্তু স্ত্রীর  অস্বস্তি হয়।ভদ্রলোক স্ত্রীর প্রতি এতটাই মোহগ্রস্থ ছিলেন, যে একদিনের ছাড়াছাড়িও  সহ্য করতে পারতেন না। একবার হলো কি, দুপুরে স্ত্রী তার ভাইয়ের সাথে বাপের বাড়ি গছেন , আর রাতেই ভদ্রলোক গিয়ে উপস্থিত হলেন শ্বশুরবাড়ি। স্ত্রী বিরক্ত হলেন, ধমক দিয়ে বললেন, " আমার শরীরের প্রতি তোমার এত  আসক্তি, এইটুকু যদি তুমি ভগবানকে দিতে, তবে তোমার ভগবান লাভ হতো। লজ্বায় আমার মাথা কাটা যায়। দূর হও এখন থেকে।" - এই একটা কথায় ভদ্রলোকের অজ্ঞানের পর্দা ছিঁড়ে গেলো। জ্ঞান  ফিরে পেলেন। এবং সেই মুহূর্তেই তিনি  সংসার ত্যাগ করলেন, আর আধ্যাত্মিক পথে হাটা  শুরু করলেন। এই ভদ্রলোক আর কেউ নয় স্বয়ং তুলসীদাস। যার রামায়ন আমাদের  ঘরে ঘরে।

জীবন জিজ্ঞাসাই সঠিক ও পুন্য ভাবনা। কেবলমাত্র  শ্রবণ বা পাঠে পুন্য নেই।  পুন্য আছে অনুভবে।

যুদ্ধ করে করবি কি তাই বল। 

এক যুদ্ধবাজ রাজা। সে এক এক করে পৃথিবীর সমস্ত রাজ্য জয় করতে লাগলো। এদিকে যুদ্ধে প্রতিনিয়ত অসংখ্য সৈন্য নিহত হতে লাগলো। এবং প্রত্যেক যুদ্ধের শেষে সৈন্য সংগ্রহ করা একটা সমস্যা হতে লাগলো। রাজা নির্দেশ দিলেন, দেশে যত  যুবক আছে সবার সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করতে হবে। রাজার পেয়াদারা ছুটলো সৈন্য সংগ্রহ অভিযানে। দেশের  সমস্ত যুবক লুকিয়ে থাকতে লাগলো। ফলে সৈন্য সংগ্রহ করা দুস্কর, হয়ে পড়লো।

একযুবক রাস্তার পার্শে পায়ের উপরে পা দিয়ে বসে বসে হাসছিলো, আর রাজার কান্ড দেখছিলো। পেয়াদা এসে তাকে পাকড়াও করলো।  রাজার কাছে নিয়ে গেল। যুবক বললো, রাজামহাশয় আপনি যুদ্ধ করে কি করবেন তা আমাকে বলুন। রাজা বললেন, এক এক করে সমস্ত পৃথিবীটাকে আমি জয় করবো। যুবক বললো - তাই নাকি ? তো সমস্ত পৃথিবী যায় হয়ে গেলে তার পরে কি করবেন ? তার পরে আমরা সবাই পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে আনন্দ করবো।

যুবক জবাব দিলো, তো আমি তো এখনই তাই করছি।

স্বর্গ-মর্ত-পাতাল

কালকূটের একটা উপন্যাস আছে, নাম তার "শাম্ব" . সেখানে  স্বর্গ-মর্ত-পাতাল সম্পর্কে কি বলছেন দেখুন।
বলছেন : আমি সুত অর্থাৎ শুদ্র।  স্বর্গের ঠিকানা আমার জানা আছে। ভারতের উত্তরে হিমালয়। হিমালয়ের উত্তরে হেমকূট।  তার দক্ষিণে কিম্পুরুষবর্ষ। হেমকূটের উত্তরে হরিবর্ষ। হরিবর্ষের উত্তরসীমা নিষধ পর্বত। নিষধের উত্তরে ইলাবৃতবর্ষ ।এই ইলাবৃতবর্ষ  এখন মধ্যে এশিয়ায় অবস্থিত। এখানকার পামির পূর্বতুর্কিস্থান ইলাবৃতবর্ষ-এর  অন্তর্গত। এই ইলাবৃতবর্ষের  অপর নাম স্বর্গ।

একটা সময় এই ইলাবৃতবর্ষ  অত্যন্ত সমৃদ্ধ রাজ্য ছিল। পরে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে,নদ  নদী শুকিয়ে, সেখানকার সভ্যতা লুপ্ত হয়। সেখানকার জনসংখ্যা ছিল ৩৩ কোটি। এদেরই বলা হোতো দেবতা।  এই স্বর্গ থেকে অর্থাৎ ইলাবৃতবর্ষ থেকে  সেখানকার অধিবাসীরা দক্ষিণ  দিকে ছড়িয়ে পড়ে । একটা অংশ চলে আসে ভারতবর্ষে।

পুরান বলছে, বলিরাজা যজ্ঞ করেছিল,  ইলাবৃতবর্ষে।  এই স্থানই দেবতাদের জন্ম স্থান। দেবগন আধুনিক তুর্কিস্থান থেকে শুরু করে কাশ্মীর, পাঞ্জাব থেকে শুরু করে বিন্ধাচলের উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত অধিকার করে ফেলেন। তার পরে বিন্ধের দক্ষিণে অগ্রসর হন। ভারতীয় আর্যরা যেহেতু প্রথমে কাশ্মীর থেকে এসেছিলেন। এই কাশ্মীরকে বলা হয় অন্তরীক্ষ।  এটাকে আবার পিতৃলোকেও বলা হয়ে থাকে, কারন তার পিতৃপুরুষ এখান থেকে এসেছিলেন। এই রাজ্যের  মধ্যভাগ অন্তরীক্ষ, উত্তরে স্বর্গ,  আর দক্ষিণে পাতাল। স্বর্গের  রাজাকে বলা হতো  ইন্দ্র। এই ইন্দ্রের যিনি প্রতিভূ তার নাম প্রজাপতি বা মনু। ইলাবৃত বর্ষ যেহেতু আদি বাসস্থান, তাই একে পবিত্র তীর্থভূমি বলা হতো। আর এই যাতায়াতের রাস্তাকে বলা হতো দেবযান।

এর পরে এক ইন্দ্র অর্থাৎ দেবতাদের রাজা,  সামরিক কারণে স্বর্গে যাতায়তের রাস্তা অর্থাৎ দেবযান,বজ্র দ্বারা অর্থাৎ পাহাড় ধ্বসিয়ে বন্ধ করে দেয়।  এই পথ ছিল ভারত ও মধ্যে এশিয়ার বণিকদের যাতায়তের পথ। কিন্তু স্বর্গ দেখার বা স্বর্গে যাবার  বাসনা কমেনি। তাই এবার থেকে  বদ্রীনারায়ণ আর মানস সরোবরের পথে অনেকে স্বর্গে যেত। যুধিষ্ঠির এই পথে স্বর্গে গিয়েছিলো। এই পথ আবার কৈলাশপতি রুদ্র অর্থাৎ শিবের রাজত্ত্বের মধ্যে ।

স্বর্গেরও  উত্তরে কুরুতে ছিল ব্রহ্মলোক আর বিষ্ণুলোক। দেবতাদের কাছে এই ব্রহ্মলোক ও বিষ্ণুলোক ছিল তীর্থক্ষেত্র। এখন এই লোক কাস্পিয়ান সাগর বা সাইবেরিয়ায় পাওয়া যেতে পারে।

আগেই বলেছি, বিন্ধাচলের দক্ষিণ ভাগ হচ্ছে পাতাল। এই হলো স্বর্গ মর্ত পাতালের কাহিনী।
আমি যা জানি তুমি তাই জানো।
একজন প্রবুদ্ধ পুরুষ একবার আমাকে বলেছিলেন, মানুষ আমার কাছে আসে, প্রশ্ন করে, আর সে যা শুনতে চায়, তাই আমার মুখে বসাতে চায়। সে যা বিশ্বাস করে, সেই কথাই আমার কাছ থেকে শুনতে চায়।  আমি তখন তাদের উল্টো কথা বলি, আর তারা আমাকে গালি দেয়।  আমি উপভোগ করি।

মরন কালে কি হয়  ?

মানুষ যখন জন্ম গ্রহণ করে, তখন তার দেহের সঙ্গে মায়ের দেহের নাড়ির একটা যোগ থাকে। ধাঁই সেটাকে কেটে মায়ের দেহ থেকে শিশুর দেহকে বিচ্ছিন্ন করে। ঠিক তেমনি মানুষ যখন মারা যায় তখন তার দেহ থেকে একটা বাষ্পময় বস্তূ বেরিয়ে আসে। প্রথম দিকে তাকে দেখতে মৃত ব্যক্তির দেহের অনুরূপ দেখায়। এবং এই বায়বীয় দেহ ও  মৃত দেহের সঙ্গে একটা সুতোর সংযোগ থাকে। পরে বায়বীয় দেহ এই সুতোর সংযোগকে বিচ্ছিন্নকরে। ও বায়বীয় দেহ ইতস্তত ঘুরতে থাকে। জ্ঞানীরা মনে করেন, এই সত্য একদিন শক্তিশালী ক্যামেরায় ধরা পড়বে।  

ধর্ম কি ?
ধৰ্ম একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। নিজেকে জাগ্রত করবার প্রক্রিয়াকে বলে ধর্ম। আপনি যদি মানুষ হন তবে মনুষ্যত্ত্বকে জাগ্রত করা আপনার ধর্ম। দুনিয়াকে ধার্মিক করতে গেলে নিজেকে ধার্মিক হতে হয়। জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার নিয়ে আমরা জন্মেছি। আমরা মানুষ হয়ে জন্মাই  না, মানুষ  হবার জন্য জন্মাই।

ঈশ্বরে বিশ্বাস 
ধার্মিক ব্যক্তি কখনো ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন  না। কারন ঈশ্বরে বিশ্বাস তারাই করে, যারা ঈশ্বর সম্পর্কে শুনেছে মাত্র। ধার্মিক ব্যক্তি ঈশ্বরকে অনুভব করেছেনা।  তাই বিশ্বাস-অবিশ্বাস  নয়, এটা তার কাছে সত্য, জ্ঞানের বিষয় ।

হাড়ির মধ্যে জল।  টগবগ করে ফুটছে। কারন কী। কারন ওর পেছনে আছে আগুন। আর আগুনকে মদত যোগাচ্ছে  কাঠ।  মানুষ অসহ্য যন্ত্রনায় অস্থির কারন ওর পেছনে আছে  রাগ, দ্বেষ, মোহ। আর এর পেছনে আছে কামনা, বাসনা। এগুলোকে সরিয়ে দিলেই সব শান্ত।

ব্রাহ্মণ পন্ডিতের শাস্ত্রব্যাখ্যা : শিষ্য গুরুদেবকে স্নানের আগে, তেল মাখিয়ে দিচ্ছে। আর গুরুদেব ছান্দোগ্য উপনিষদ থেকে কঠিন শ্লোকের শব্দার্থ সহজ করে  বোঝাচ্ছে। "তস্য যথা কপ্যাসং পুন্ডরীকমেবাক্ষিনী (পুন্ডরীকম-এব-অক্ষিণী)"। এটি  একটি মন্ত্রের অংশ। গুরুদেব বলছেন, সূর্য্যমন্ডলের পুরুষের চক্ষুদুটি আরক্তিম, কেমন আরক্তিম না কপ্যাসং অর্থাৎ কপি মানে বানর অসং মানে পশ্চাৎভাগ। অর্থাৎ বাঁদরের পোঁদের  রঙ  যেমন  আরক্তিম, অর্থাৎ রক্তবর্ণ  ঠিক তেমনি পরমেশ্বরের চক্ষুদুটি বাঁদরের পোদের মতো লাল।

তো শিষ্য কাঁদতে লাগলেন। গুরু জিজ্ঞেস করলো তুই কাঁদছিস কেন ? শিষ্য বললো। ভগবানের রূপের বর্ণনায়,  বেদমধ্যে এমন নিকৃষ্ট উদাহরণ দিয়ে বোঝানো হয়েছে ?  গুরু বললেন - তো তাতে কি হয়েছে ? কাঁদার কি আছে ?
 শিষ্য বললেন : গুরুবাক্যের প্রতি অবিশ্বাস করা পাপ। কিন্তু একথা শুনতে আমার ভালো লাগে না। গুরু বললেন : শোন আচার্য্য শঙ্করও এইরূপ ব্যাখ্যা করেছেন।  এতে দোষের কি আছে  ?

এই গুরুদেব একসময় আচার্য্য শঙ্করের অনুগামী ছিলেন। আচার্য্য শঙ্করের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায়, তিনি এখন এক নতুন মত প্রবর্তন করেছেন। অথচ এখন তিনি আচার্য্য শঙ্করের দোহাই দিচ্ছেন।

শিষ্য বললেন, আমার ধৃষ্টতা মাপ  করবেন।  কপি অর্থে সূর্য। কপ্যাস শব্দের কং কথাটার মানে জল. আর পিবতি অর্থ যে পান করে বা যে আকর্ষণ করে। আর আস্ ধাতুর অর্থ রূপ অর্থাৎ বিকশিত। অর্থাৎ সূর্য্যের দ্বারা যে বিকশিত হয়।  অর্থাৎ পদ্ম। তাহলে এই শ্লোকের অর্থ হচ্ছে : সেই সুবর্ণবর্ন আদিত্যমন্ডল মধ্যবর্তী পুরুষের চক্ষু দুটি পদ্মের মতো।

গুরুদেব মনে মনে খুব রেগে গেলেন। কিন্তু মুখে শিষ্যের খুব প্রশংসা করতে লাগলেন। আর বললেন : তো আর তেল মাখাতে হবে না, আমি এখন স্নান করবো।

এই গুরুদেব হচ্ছেন : রামানুজের আচার্য্য যাদবপ্রকাশ। আর শিষ্য হচ্ছেন রামানুজ। পরে অবশ্য রামানুজকে যাদবপ্রকাশ তার টোল থেকে তাড়িয়ে দিয়ে ছিলেন। এমন শিষ্য কেউ রাখে ?

"আমার ভিতরে অসীম শক্তি আছে, সে সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা" - আমাদের শুধু এই ভাবনাই সেই অসীম শক্তিকে জাগ্রত করবার সোপান হতে পারে।

মানুষ রোগগ্রস্থ হয়ে মারা যায় না। মারা যাবার জন্য রোগগ্রস্থ হয়। যে সময় আমার মনে হবে, আমার রোগ হয়েছে, তখনই আমাদের রোগ আসবে। আমি ভালো আছি এই ভাবনা মানুষকে ভালো রাখে। আর আমার শরীরের সমস্ত দরজা খুলে যায়, বিশ্বশক্তি গ্রহণ করবার জন্য।

শবদেহ ছিঁড়ে খাচ্ছে শিয়াল-কুকুরে , পাগল বলছে - "নেই তাই খাচ্ছো, থাকলে কি খেতে ?"

জীবন একটা স্রোতস্বিনী নদী। এই নদী সর্বদাই বইছে। নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলছে এই দেহনদী। যা সরে সরে যায়, তাই সংসার। দেহ-নদীর পাঁচটি ধারা বা স্রোত। নদীর উৎস পঞ্চভূত। নদীর ঢেউ পঞ্চবায়ু । নদীর মূল পঞ্চজ্ঞানীন্দ্রিয়। নদীর ঘূর্ণি পঞ্চইন্দ্রিয়ের বিষয়। নদীর পাঁচটি বাঁক - জন্ম, ভূমিষ্ট, জ্বরা, ব্যাধি, মৃত্যু। পাঁচটি বাঁধ - অবিদ্যা, অহংকার, আসক্তি, দ্বেষ, অত্যুৎসাহ।

I am neither a Professor nor a Guru. I am just a Lecturer. What I share is the knowledge of Mahatmas (the sacred sole).You may hear it or not, you may accept it or not, it is upto you only. I donot want to disturb my inner-sence.The question raised in mine, and the solution given by Mahatmas are the topics of my lecture. I donot feel that the body, where I am living is the true "I". Hence someone who wants to contact with the Lecturer, may hear the lecture only, where the true contac may happen.

আমি অধ্যক্ষ নোই, আচার্য্য নোই, গুরুও নোই। আমি একজন বক্তা মাত্র। আমার মাধ্যমে যে বার্তা আপনাদের কাছে যাচ্ছে, তা সবই মহাত্মাদের জ্ঞান। আপনি এটাকে শুনতে পারেন, আবার নাও শুনতে পারেন। আপনি এটাকে গ্রহণ করতে পারেন, আবার নাও গ্রহণ করতে পারেন। আমার ভিতরে এক জিজ্ঞাসু প্রশ্ন তোলে। আর সেইসব প্রশ্নের উত্তর মহাত্মারা দিয়ে থাকেন। এটাই আমার বক্তব্যের বিষয়। আমি জানি, এই দেহ যেখানে আমি আপাতত আশ্রয় নিয়েছি, সেটা আসল আমি নোই। আমি আমার অন্তরাত্মার অর্থাৎ সত্যিকারের আমির চঞ্চলতা পছন্দ করি না। তাই কেউ যদি, আমার সাথে সত্যিকারের সাক্ষাৎ করতে চায়, তবে এই বক্তব্যের মধ্যেই আমাকে খুঁজে পাবে। কি দেখবেন এসে, রক্ত মাংসের শরীর, যা চামড়ার খোল দিয়ে ঢাকা ? মানুষ অনেক কিছু জানতে চায়। মানুষ বাইরে খোঁজে তার জবাব। জবাব তো তার ভিতরেই আছে। শুধু দৃষ্টিটাকে বাইরের থেকে ভিতরের দিকে নিবদ্ধ করুন। সবাই ভালো থাকুন - নমস্কার

আমাদের এই ভৌতিক দেহ একটা যন্ত্র বিশেষ। একে আমাদের কার্যক্ষম রাখতে হবে। এর প্রোগ্রামিং-গুলো ভালো করে জানতে হবে। এর ব্যবহার ভালো করে জানতে হবে। এটি একটি সুপার-কম্পিউটার। এই শরীর শুধু বিনোদনের জন্য নয়। ঘৃণার, বা অবহেলার  বস্তূ নয়।  আবার আবর্জনাও নয়। এর মধ্যে যে সুপ্ত অবিনাশী ঐশ্বরিক চৈতন্য-শক্তি আছে, তাঁকে খুঁজে বের করতে হবে। এবং তার দ্বারা যেমন বহির্জগৎকে জানতে হবে, তেমনি আপাততো অদৃশ্য যে ৫১ টি জগৎ আছে, তাকে জানতে হবে। এই ভ্রমন যেমন কষ্টদায়ক, তেমনি অসীম আনন্দের। এই ভ্রমণের জন্য সম্ভব হলে একজন গাইড নিন, তবে এই ভ্রমন অল্পসময়ে বেশী আনন্দদায়ক হবে, জ্ঞানদায়ক হবে । আর এই চৈতন্য শক্তির বিনাশ নেই, তাই কালের উর্দ্ধে উঠে নিজেকে উপলব্ধি করুন। তখন বুঝবেন, জন্ম-মৃত্যু বলে কিছু নেই।


কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, রাস্তাই  রাস্তা দেখাবে। যদিও প্রেক্ষাপটটা অন্য। পাণ্ডবেরা যখন স্বর্গারোহণে যান, তখন স্বয়ং ধর্মরাজ কুকুরের বেশে তাঁদের সঙ্গ দিয়েছিলেন। এগুলো পুরানের কথা।  এখন কি তা হয় ? উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কৈলাশ ভ্রমনে যাচ্ছেন, সঙ্গে গাইডও আছে, অন্য কিছু সহযাত্রীও আছে । কিন্তু তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে একটা অনাহূত কুকুর। কিছু দূর যাবার পরে, কুকুরটা পাহাড়ের রাস্তা থেকে কিছুটা নিচের দিকে একটা সরু রাস্তা বেয়ে নেবে, এগুতে লাগলো। উমাবাবুদের দল, গাইডের নির্দেশ নিয়ে, পাহাড়ের মূল রাস্তা দিয়েই এগুতে লাগলো। খানিকটা এগিয়ে দেখলো, রাস্তায় ধস নেবেছে। গাইড ফিরে এসে,উমবাবুদের নিয়ে আবার কুকুরের দেখানো রাস্তায় খানিকটা গিয়ে, কুকুরের মতো মূল রাস্তায় পড়লো। এগুলো কল্পনা নয়, সত্যি। গাইড ঘরে বসেও পাওয়া যায়। একা একা যারা বেরোতে ভয় পান, তারা কি করেন ? কন্ডাক্টেড টুরে যান। আমাদের যাত্রাতেও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে গাইড মেলে। আপনার আগ্রহ আপনাকে গাইড চিনে নিতে সাহায্য করবে। তবে যখন কৈলাশের পথ ধরবেন, তখন কুকুর এসেই যাবে, আপনাকে ডাকতে হবে না।
এই  "কুকুর" কে তা বোঝার চেষ্টা করুন। "কু" কথাটার মানে পৃথিবী, গোত্র বা কুল, আর কুর কথার মানে ত্যাগ করা।  তো যিনি পৃথিবীর ভোগ বিলাসকে ত্যাগ করেছেন, যিনি  গোত্রহীন, কূলহীন, তাকেই বলে কুকুর । "কু" কথাটার আর একটা মানে হচ্ছে, খারাপ। আর "কুর" মানে ত্যাগ করা অর্থাৎ খারাপকে যিনি ত্যাগ করতে পেরেছেন, অর্থাৎ মঙ্গলপথের যাত্রী। এটি আপনার বাড়ির সারমেয় নয়।
দেখি নাই কভু তোমারি মুরতি।
তবু গড়িয়াছি তোমারই আকৃতি।
ভেবেছিনু আমি সেই হবে তুমি।
চেয়ে দেখি, সে-তো তুমি নয়, আমি।

আজো,  বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত  পন্ডিতরা, পুঁথিপত্র ঘেঁটে আত্মার অস্তিত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করছে । হায়রে, কবে মানুষ অন্তরের দিকে দৃষ্টি ফেরাবে ?

পঞ্চ "ম" কার।

মৎস, মাংস, মদ, মৈথুন, মুদ্রা। এগুলোর অর্থ কি ?

মৎস : আমাদের শরীরে গঙ্গা যমুনা নদী আছে। যার আর এক নাম ইড়া-পিঙ্গলা। এর মধ্যে প্রাণ ও অপান বায়ু-রুপি মৎস সব সময় খেলা করছে। এই দুটিকে যিনি ধরতে পারেন,  অর্থাৎ প্রাণ-অপান এর ক্রিয়া যিনি নিরুদ্ধ করতে পারেন, তিনিই মৎস ভোজন করেন।

মাংস : কাম-ক্রোধ ইত্যাদি অসৎ পশুকে যিনি জ্ঞানরূপ অসি দিয়ে ছেদন করেন, এবং অবিষয় রূপ মাস যিনি ভোজন করেন, তিনি মাংস সাধক।

মদ : আমাদের ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে যে রসধারা প্রতিনিয়ত নেবে আসছে, তাকে বলে সোমধারা। এই সোমরস ধারা যিনি পান করেন, তার জ্ঞানসমাধি হয়। একেই বলে মদ্যপান।

মৈথুন : সাধকের দেহধারিনী কুণ্ডলিনীর সঙ্গে সহস্রার  পদ্ম কর্ণিকার অন্তর্গত যে বিন্দুর যে মিলন তাকে বলে মৈথুন।  অর্থাৎ শিব রুপি বিন্দু, আর তার শক্তিরূপী কুণ্ডলিনী - এর মিলনকে বলে মৈথুন।

মুদ্রা : অসৎ সঙ্গ মুদ্রণ অর্থাৎ অসৎ সঙ্গ পরিত্যাগ করার নাম মুদ্রা। যিনি সহস্রার মহাপদ্মে কোটি সূর্য্যের প্রভার সঙ্গে কুণ্ডলিনী থেকে আত্মাকে নিয়ে জ্ঞানাকাশে বিচরণ করতে পারেন, তিনিই মুদ্রাযোগী।

ঈশ্বরের নামের একটা অমোঘ শক্তি আছে। এই নাম যোগপথের নানা বাধা বিপত্তি দূর করে। আমাদেরকে  অন্তরাত্মার সম্পর্কে সচেতন করে। রোগ, শোক, সংশয়, ভয়, ইত্যাদি মনের বিক্ষেপ দূর করে। নামের প্রতিনিয়ত জপ, আমাদের শরীরের  তন্ত্রগুলোর মধ্যে একটা সমন্বয় এনে দেয়।  ফলে আমাদের মন শান্ত হয়। মনের শক্তিগুলোকে বাড়িয়ে তোলে। ধ্যান জীবনের গোড়ায়, এটা বোঝা যায় না। নামের জপ যত গভীর ও অবিচ্ছিন্ন হবে, তত আমরা সেটা অনুভব করতে পারবো।

একটা বাসনা আর একটা বাসনাকে নিয়ে আসে। শেষে তার সংখ্যা এত হয়ে যায়, যে তাদের আর নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। বর্তমান যেমন সত্য, ভবিষ্যতও তেমনি সত্য। মৃত্যুর পরে, আমাদের কি হবে ? বর্তমানের প্রতি অবশ্যই মনোযোগী হোন।  কিন্তু ভবিষ্যতের কথাও একটু ভাবুন। ভবিষ্যৎ তৈরি হবে আপনার বাসনা দিয়ে। তাই একে একটু মেজে ঘষে রাখুন।

সাধারণ মানুষের বিষয়ভোগেই আনন্দ।  আমরা মোক্ষ বা মুক্তির ধার ধারি না। বরং মৃত্যুর পরে , আবার জন্ম নেবার জন্য লালায়িত হই।  এইজন্য আমাদের আবার পুনর্বার জন্ম হবে কি না সেটা জানতে চাই। তবে এই ঘোর  আসক্তি বা অজ্ঞান অবস্থা মানুষের চিরকাল থাকে না। কারন আমাদের আসল স্বরূপের মধ্যে অজ্ঞান বা মোহের কোনো স্থান নেই। আমরা সবাই শুদ্ধ-মুক্ত-বুদ্ধ আত্মা। একদিন না একদিন আমাদের এই সত্যের উপলব্ধি আমাদের অবশ্যই হবে।  তা সে এই জন্মেই আর পরবর্তী জন্মে হোক। একদিন আমাদের বিষয়ের প্রতি বিরক্তি হবেই। একই জিনিসের প্রতি আমাদের আকর্ষণ যেমন চিরকাল থাকে না। ধীরে ধীরে আসক্তি কমে যায়, একসময় লুপ্ত হয়ে যায়। তেমনি কোনো এক শুভমুহূর্তে, আমাদের শুদ্ধ-বুদ্ধি আত্মস্থ হবেই। আর সেইদিন আমরা মহামুক্তির অধিকারী হবো।

যারা আমাকে (নিজেকে) জানতে চায়, তারা অহংকে (নিজেকে) গুরুত্ত্ব দেয়। তাই আত্মকে (নিজেকে) জানতে পারে না। যার আমি (অহং) বলে কিছু নেই, সেই নিজেকে জানতে পারে।

শক্তি তিনটি - সৎ-চিৎ-আনন্দ। সৎ ভাবে যিনি কাজ করেন, তিনি সৎ। আর এর ফলে তিনি হন প্রতাপশালী। চিৎ অর্থাৎ চেতনা বা জ্ঞান। এই শক্তির ফলে তিনি সত্য জ্ঞান  লাভ করেন। সবশেষে যে শক্তিতে যিনি নিজেকে আনন্দিত করেন, তাই আনন্দ। এই তিনকে  একসাথে বলে পরম-ঈশ্বর।

আগুন প্রজ্জ্বলিত হয় ইন্ধনের সাহায্যে, চাঁদ আলোকিত হয় সূর্য্যের আলোতে, সূর্য্য আলোকিত হয় হিলিয়াম গ্যাসের কারনে, আত্মাই একমাত্র যার নিজস্ব জ্যোতিঃ আছে। আসলে সব আলোর উৎসই আত্মা।

মৃত্যুতে আমাদের শুধু স্থুল দেহের নাশ হয়, পরিবেশের পরিবর্তন হয়। কিন্তু আমাদের  চেতনার কেন্দ্রবিন্দু অর্থাৎ ঈশ্বর সব সময় আমাদের মধ্যে আছেন। তাই ইহজন্মে আপনি যা কিছু আধ্যাত্মিক ধন সংগ্রহ করছেন, তা আপনার হারাবার নয়। সাধকের গতি সবসময় উর্দ্ধগতি হয়, আর সাধনলব্ধ জ্ঞান তাকে আধ্যাত্মিক সাধনার ধারা বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাই মৃত্যুর পরে, এমনকি অন্য শরীরে প্রবেশ করলেও তার তিনি ঈশ্বরের পাদপদ্মেই স্থিত থাকেন, আর আর সাধনক্রিয়া চলতেই থাকে। এটা একটা ধারা, যতই ঈশ্বরমুখী হয় ততই বাড়তে থাকে।

মন আমাদের চেতনকেন্দ্রের স্ফূরণ মাত্র  । প্রত্যেক সাধকের উচিত নিম্নতর চেতনকেন্দ্রের কাজ যথাসম্ভব বন্ধ করা আর উচ্চতর চেতনকেন্দ্রের উদ্দীপনা বৃদ্ধি করা। এবং সেটা করতে হবে আমাদের সচেতন ভাবে। বুদ্ধিযুক্ত চিন্তা যখন সচেতন ভাবে হয়, তখন আমাদের মধ্যে মনঃশক্তি প্রবাহের গতি দ্রুত বাড়তে থাকবে। এইজন্য, সচেতনভাবে নতুন ভাব আনার চেষ্টা করুন। এবং সেটা যেন হয় উচ্চতর চেতনকেন্দ্রে।

মা, আপনার যে অবস্থার কথা লিখেছেন, সেটা দুটো কারণে হতে পারে, ১. স্নায়ুর  দুর্বলতা থেকে ; এর জন্য, আপনাকে ডাক্তার দেখতে হবে। ২. ধ্যানের প্রক্রিয়া শুরু করবার আগে, শরীর ও মনের  ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য, যে প্রক্রিয়াগুলোর অনুসরণ করবার দরকার, তা না করার জন্য। সৎগুরুর আশ্রয়ে থেকে ধ্যান করাই উচিত ও শ্রেয় । উপযুক্ত শিক্ষক পেলে, আধ্যাত্মিক জীবন অবশ্যই সুখের হবার কথা, তা সে শারীরিক হোক বা মানসিক হোক। গোলমালটা কোথায়, সেটা নিজে ধরার চেষ্টা করুন, এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিন। দেরি না করা ভালো। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।মা একটা কথা শুনুন, আমি ডাক্তারও নোই, গুরু বা আচার্য্য নোই। আমি একজন বক্তা মাত্র। আমাকে ভুল বুঝবেন না, দয়াকরে।

একটা গুহ্য কথা বলি - জপ-ধ্যানের  ফল আমরা অবশ্যই পাবো।  কিন্তু এই ফলের জন্য আমরা যেন প্রত্যাশা না করি। ফল  সময়মতো ফলবে। কিন্তু এই ফলের জন্য আমরা যদি উদগ্রীব হই, তবে আমাদের আমাদের আধ্যাত্মিক সাধনার পথে অসম্পূর্ণতা থেকে যাবে। আপনি মাটি খুঁড়ে ফলের বীজ পুঁতেছেন।  এখন যদি প্রতিদিন একবার করে, বীজটা মাটি থেকে তুলে দেখতে যান, যে অংকুর হলো  কি না, তবে কি হবে ? কোনোদিন অংকুর হতে পারবে না। আর আপনি ভাববেন বীজ পুতলে গাছ হয় না। আধ্যাত্মিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ন বিষয় হচ্ছে আত্মসমর্পন। আপনার ক্ষুদ্র ইচ্ছেকে ভগবৎ ইচ্ছের সঙ্গে যুক্ত করতে শিখুন - তখনই সব  অলৌকিক ঘটনা ঘটতে থাকবে। একটা কথা মনে রাখবেন, আমাদের অন্তরাত্মার সঙ্গে সেই অনন্ত ঈশ্বরের অনন্ত সম্পর্ক চিরকালীন। আমাদের  কাজ অনন্যমনা হয়ে, ভক্তি সহকারে নিরন্তর অনুশীলনে রত থাকা।

প্রকৃত গুরু আমাদের সবার অন্তরেই অবস্থান করছেন। অধ্যাত্ম জীবনের প্রথমদিকে, আমরা দেহধারী  আচার্য্যের সাহায্য নিতে পারি।  কিন্তু অধ্যাত্ম জীবনে যত  আমরা অগ্রসর হবো, ততই আমরা দেখতে পারবো, আচার্য্যের কাছ থেকে আমরা যা শুনছি, তা আমাদের হৃদয়ের কথা। আমরা যদি অন্তরের গুরু বা দেহধারী  গুরুর কাছে আত্ম সমর্পন করি তবে তিনি আমাদেরকে নিম্নতর স্তরের অনুভূতি থেকে উচ্চতর স্তরের অনুভূতির দিকে নিয়ে যাবেন। এই অভিজ্ঞতা বাস্তবিক সবার হতে পারে। আমাদের কাজ হচ্ছে ঐকান্তিক ভাবে আধ্যাত্মিক পথে চলার শর্ত মেনে পা ফেলা।আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। সূক্ষ্ম ভাবাবেগ যেন আমাদের অকর্তব্য করিয়ে না নিতে পারে। আমরা যে কাজ করতে চাই, তা যেন প্রকৃত অনাসক্তি সম্পন্ন হয়। এই অনাশক্তিভাব না থাকলে আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের কথা না ভাবাই ভালো। সময় কাটাবার জন্য আধ্যাত্মিক জীবন নয়। সময়কে সঠিক  কাজে লাগাবার জন্য আধাত্মিক জীবন।

ত্বং স্বাহা ত্বঃ স্বধা ত্বং হি বষটকারঃ স্বরাত্মিকা
সুধা ত্বমক্ষরে নিত্যে ত্রিমাত্রাত্মিকা স্থিতা। (মার্কন্ডেয় দেবী মাহাত্ম শ্লোক-৫২)

হে মাতা, তুমি স্বাহা অর্থাৎ তুমি হবি গ্রহণের যোগ্য।এটি যজ্ঞের হবি প্রদানের মন্ত্র।  তুমি স্বধা - এটি পিতৃকার্য্যের মন্ত্র। আর বষটকার এটি সব মন্ত্রের উপলক্ষ্মণ।  স্বরাত্মিকা অর্থাৎ উদাত্তাদি স্বর বা উচ্চগ্রামে যে উচ্চারণ হয়।অর্থাৎ স্বরের সমস্ত মাত্রা (পরা-পশ্যন্তি-মধ্যমা-বৈখরী) এর মধ্যে আছে।   তুমি সুধা - অর্থাৎ মমতাময়ী। তুমি অক্ষরে অর্থাৎ পরমাত্মায় নিত্য স্থিত। আবার ত্রিমাত্রায় অর্থাৎ স্বর্গ-মর্ত-পাতাল  সর্বত্র স্থিত, অর্থাৎ তিনটি স্তরে অবস্থিত ।

মন্ত্রে যখন চেতনাশক্তি প্রবাহিত হয়, অর্থাৎ মন্ত্রে যখন ইষ্টদেব প্রতিষ্টিত হয় তখন তার উচ্চারনে দেবতা প্রত্যক্ষ হয়। ফুসকা কথাটা শুনলে আমাদের জিভে জল আসে, কারন ফুসকা সম্পর্কে আমাদের প্রত্যক্ষ জ্ঞান  আছে। অর্থবহ শব্দ চেতনকেন্দ্রে স্ফূরণ ঘটায়। আবার কতকগুলো শব্দ যার কোনো অর্থ নেই, যেমন বজ্রের ধ্বনি, আমাদের চেতনকেন্দ্রে  চমক আনে। এটি কেবলমাত্র ধ্বনির কার্যকারিতা।

অধ্যাত্ম জীবনে শরীর সম্পর্কে দুটো জিনিষ খেয়াল রাখতে হয়। এক হচ্ছে শরীরকে ভালোবাসা, আর একটি হচ্ছে শরীরকে অবহেলা করা। এই দুটোই ক্ষতিকর। শরীর হচ্ছে ঈশ্বরের মন্দির। তো মন্দিরের ইট-কাঠ-পাথর ঈশ্বর নয়। আবার মন্দিরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, কারন এখানেই ঈশ্বর অবস্থান করছেন।

ওঁ ভদ্রং কর্নেভিঃ শৃনুয়াম দেবা ভদ্রং পশ্যেম অক্ষভিঃ যজত্রাঃ।
স্থিরৈ অঙ্গৈ তুষ্টূবাংস তনুভিঃ ব্যশেম দেবহিতং যদায়ুঃ।।
 ওঁং শান্তি শান্তি শান্তিঃ।।

এটি একটি মঙ্গলাচরণ।  অর্থাৎ দেবতাদের কাছে, প্রার্থনা। সব উপনিষদের প্রারম্ভে এই ধরনের একটা না একটা প্রার্থনা সঙ্গীত থাকে। এইগুলো সবই অর্থবহ, এবং মন্ত্রের মতো কাজ করে। যথযথ অর্থ মননের ফলে, আমাদের মনের পবিত্রতা ও শক্তি বৃদ্ধি হয়, ভয় দূর হয় ।
 এখানে বলা হচ্ছে, হে পরমেশ্বর আমরা যেন যা কিছু ভালো, শুধু তাই-ই কান দিয়ে শুনি।  চোখ দিয়ে যেন শুধু ভালো কিছুই দেখি। কায়মনবাক্যে অর্থাৎ শরীর-মন ও বাক্য দ্বারা যেন সদা তোমারই জয়গান করি। আমাকে যে আয়ু দিয়ে এখানে পাঠিয়েছো, তা যেন বজায় রাখতে পারি। আমাদের শরীর ও মনের শান্তি বজায় থাকুক।  পরিবেশ ও প্রাকৃতিক শান্তি বজায় থাকুক।  জীব, কীটপতঙ্গ, ও হিংস্র প্রাণী হতে আমাদের রক্ষা করুন। 



অদ্বৈত তত্ত্বের ধারণা করা কঠিনতম। এই তত্ত্ব সুগভীর, অনাদি, অপরিবর্তনীয়, শুদ্ধ ও পরম সত্য। যিনি এই তত্ত্বকে বোঝার জন্য সর্ব্বশক্তি প্রয়োগ করেছেন, তাঁকে  প্রণাম। এই পরম সত্যতেই  সবার  শ্রদ্ধা জাগুক, প্রতিষ্ঠিত হোক  ।

গুরু বৃথাই শিষ্যকে উপদেশ দেন। কারন ঈশ্বরকে বাক্যের দ্বারা বোঝানো যায় না। তবু যদি কেউ ঈশ্বরকে কথা দ্বারা বোঝাবার চেষ্টা করে, বা বোঝবার চেষ্টা করে, তবে সেটা  অপব্যাখ্যাই হবে। তাই সৎগুরু বোবা। আর গুরুর কাছ থেকে শুনে ঈশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা করতে পারে না বলে, সত্যিকারের শিষ্য বোবা। সে শুধু গুরুমুখী হয়ে বসে থাকে। ঈশ্বর একমাত্র উপলব্ধি দ্বারা  অধিগম্য। গুরু-শিষ্যের মধ্যে অন্তরের আদান-প্রদান, শিষ্যকে ঈশ্বরের দিকে টেনে নিয়ে যায়।

সমস্যা যত গভীর, সমাধান তত সহজ। কেবল দেখতে থাকুন, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আপনার ছেলেটি, বা আপনার বাড়ির কাজের লোক, আপনার কথা শোনে না। মুখে মুখে তর্ক  করে , বড্ড বেয়ারা। কিছু বলার দরকার নেই তাকে। সতর্ক হয়ে, কেবল তাকে পর্যবেক্ষেপন করুন। গভীর মনোযোগ দিয়ে কেবল তাকে দেখতে থাকুন। অভিব্যক্তি বিহীন হয়ে দেখতে থাকুন। একটা কথা মনে রাখবেন, চোর যদি বুঝতে পারে, আপনি জেগে আছেন, তবে সে আপনার ঘরে ঢুকবে না। আপনি শুধু নিজের আলোটা আপনার ঘরে জ্বালিয়ে রাখুন। তবেই দেখবেন, আপনার চারিদিকে সবাই সতর্ক হয়ে গেছে।

স্বামী সোমেশ্বরানন্দের কাছে এক ভদ্রমহিলা এসেছিলেন কথা বলতে। তার মেয়ে বড় হয়েছে। বিয়ের চেষ্টা চলছে। কিন্তু কিছুতেই  বিয়ে হচ্ছে না। কোনো ছেলেকেই ভদ্রমহিলার পছন্দ হয় না। আর যাকে পছন্দ হয়, সেখানে কথা কিছুদূর এগিয়েও ভেঙে যায়। ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন, আমার মেয়ে কি পূর্বজন্মে কোনো পাপ করেছিল যে  এই জন্মে তার বিয়ে হচ্ছে না ?

স্বামীজী হেসে বললেন, দেখুন ম্যাডাম, আমিও বিয়ে করিনি। আমি তো মনে করি, আগের জন্মে আমি নিশ্চয়ই অ-নে-ক পুন্য করেছিলাম, যে জন্য এজন্যে বিয়ে করতে হয় নি।

ভগবান ওশো রাজনীশ।  পুনাতে যার আশ্রম আছে। যিনি নেশা ও নারীকে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন । তো তার কাছে এক ভদ্রলোক  এলেন। সে ত্রিশ  ধরে সিগেরেট খায়। এখন সে সিগেরেট ছাড়তে চায়, কিন্তু কিছুতেই পারছে না। এর জন্য তার নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে।

রাজনীশ বললেন - সিগারেটে ছাড়ার কথা আপনি ছেড়ে দিন।  কি হবে সিগারেটে ছেড়ে দিয়ে ? যার সঙ্গে আপনি দীর্ঘ ত্রিশ বছর  একসাথে আছেন ? আপনি ত্রিশ বছর  ধরে অভ্যাস করছেন, আপনি তো বিশাল যোগী।

ভদ্রলোক বললেন - সিগারেটে খাওয়া খুব খারাপ, আমার কাশি হচ্ছে। এতে আমার আয়ু কমে যাচ্ছে।

ওশো বললেন : ঠিক এটা সত্য। কিন্তু আপনি একে ছেড়ে দেবার কথা ভুলে যান। কি হবে,দীর্ঘদিন বেঁচে।  কি যায় আসে, আপনি আজ মরবেন কি কাল মরবেন  মানুষের রোগ-ভোগ নিত্যসঙ্গী। কে কবে এর থেকে রেহাই পেয়েছে ? বরং  এর পর থেকে আপনি সিগারেট নিয়েই ধ্যান করুন।

সিগারেটে দিয়ে ধ্যান ? আপনি কি আমার সাথে মশকরা করছেন।

না মোটেই না। জেন্ ধর্মাবলম্বীরা চায়ের আসরে মেডিডেশন করে। আপনি সিগারেটে নিয়ে মেডিটেশন করতে পারেন।

কি ভাবে ?

সিগারেটের সৌন্দর্য্য দেখুন। সিগারেটের গন্ধ নিন। ভগবানের এ এক অপূর্ব সৃষ্টি। সিগেরেট খাবার প্রতিটি মুহূর্ত আপনি সতর্ক থাকুন, তা সে প্যাকেট থেকে সিগেরেট বার করা থেকে শুরু করে, প্রতিটি টানে, আপনি ঈশ্বরকে স্মরণ করুন। ঈশ্বরকে উপলব্ধি করুন।

আপনি নিশ্চয়  আমার  সঙ্গে মশকরা করছেন।

দেখুন, আমি যখন মশকরা করি, তখনও আমি মশকরা করি না।

সাগর ও তার তরঙ্গ একই বস্তূ। সূর্য ও তার রশ্মি একই বস্তূ। যে কোনো বস্তূ ঈশ্বরের প্রতীক হবার যোগ্য, কেননা সমস্ত বস্তুই ঈশ্বর হতে সৃষ্ট। তবে একটা মনে রাখতে ঈশ্বরের প্রতীক আর ঈশ্বর এক নয়। তাই ধ্যানে আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে সেই শাশ্বত বস্তুতে, স্বয়ং জ্যোতিতে।