Monday 29 June 2020

উপাসনা - শশাঙ্ক শেখর শান্তি ধাম / বিপাশনা/খেচরী


উপাসনা - শশাঙ্ক শেখর শান্তি ধাম 

হরি স্মরণম শ্রী হরি স্মরণম।
গুরু স্মরণম সৎ গুরু স্মরণম।
শিব স্মরণম উমা শিব স্মরণম।
শ্যাম স্মরণম রাধে শ্যাম স্মরণম।

ওম সত্যম শিবম সুন্দরম।
ওম অসতো মা সৎ গময়।
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যুর মা অমৃতম গময়।

জয় জয় শ্রী রাধে কৃষ্ণের জয়।
জয় জয় দেবাদিদেব মহাদেবের জয়।

বিপাশনা ধ্যান 

জীবন হচ্ছে শ্বাসের খেলা। আর এই এই শ্বাসক্রিয়া আমাদের এমনি এমনি হয়।  এর জন্য আমাদের কোনো  চেষ্টা করবার দরকার পরে না। শ্বাস যেমন আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, ঠিক তেমনি আমরা যদি এই শ্বাসের দিকে একটু মনোযোগ দিতে পারি, তবে এই শ্বাসই আমাদের জীবন বদলে দিতে পারে। আজ আমরা সেই কথাই শুনবো। বিপাশনা ধ্যান। 

মহামুনি বশিষ্টদেব স্বয়ং শোকপাশে আবদ্ধ হয়ে  যে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, সেটি হচ্ছে বিপাশা। বিপাশনা মানুষকে পাশমুক্ত করতে পারে। বিপাশনা ধ্যান এমন একটা পদ্ধতি যা  যে কোনো মানুষ এমনকি একটা বাচ্চা ছেলেও করতে পারে। আর সত্যি কথা বলতে কি, এই বিপাশনা ধ্যানের মাধ্যমেই বেশিরভাগ সিদ্ধপুরুষ সিদ্ধিলাভ করেছেন। 

বিপাশনা ধ্যানে দুটো পদক্ষেপ : প্রথমত, আপনি যা কিছু করছেন, সে সম্পর্কে সচেতন থাকুন। তা সে শারীরিক কর্ম্ম হোক, বা মানসিক চিন্তা-ভাবনা, এমনকি হতে পারে আপনার হৃদয়ের আবেগ, ভালোবাসার মুহূর্ত বা আপনার দুঃখের মুহূর্ত। সবসময় আপনি চেতন থাকুন। আপনি সিগারেট খাচ্ছেন, মনোযোগ দিয়ে খান। আপনি কোনো খারাপ কাজ করছেন, তার মধ্যেও আপনি গভীর মনোযোগ দিন। আপনি মশা মারছেন সচেতন ভাবে মারুন। অর্থাৎ যা কিছু করছেন  আপনি তা জেনেবুঝে করুন। আপনি হাঁটছেন, আপনার পা-ই আপনাকে গতি দিচ্ছে, কিন্তু আপনি পা সম্পর্কে সচেতন নন।  এমনটা হতে দেবেন না। আপনি কিছু দেখছেন, হয়তো গাছের ডালে বসা পাখি দেখছেন, মনোযোগ দিয়ে দেখুন। আপনি কিছু শুনছেন, তা সে গান হোক, বা বক্তৃতা সব  মনোযোগ দিয়ে শুনুন। আপনি কোনো সুস্বাদু খাবার খাচ্ছেন, তাড়িয়ে তাড়িয়ে সেটা উপভোগ করুন। স্বাদ তো জিভে, খাবার যতক্ষন মুখে থাকে ততক্ষন তার স্বাদ পাওয়া যায়। অর্থাৎ হড়বড় করে কিছু করবেন না।  তাতে একটু সময় লাগে লাগুক, কিন্তু সিগারেটের শেষ টানটা পর্যন্ত উপভোগ করুন। আপনি প্রাতঃভ্রমনে বেড়িয়েছেন, আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ, আপনার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কি করছে, সেটা খেয়াল করুন। আপনার মন কি করছে কি ভাবছে, সেটা খেয়াল করুন, ঠান্ডা বাতাসের দোলায় আপনার মধ্যে যে আনন্দ অনুভব হচ্ছে, সেটাকে উপভোগ করুন। অর্থাৎ যাকিছু আপনি করছেন, তা সচেতন ভাবে করুন। 

এবার একটু নিজেকে আলাদা করুন, আপনার মনের মধ্যে যে চিন্তার স্রোত বইছে  সেটাকে আলাদা করে দেখতে থাকুন, আপনি হাঁটছেন, নিজেকে সামনে থেকে দেখুন। পেছন থেকে দেখুন,, ডান পাশ থেকে দেখুন, বাঁ পাশ থেকে দেখুন, উপর থেকে দেখুন, এমনকি নিচ থেকে দেখুন। অর্থাৎ যা কিছু আপনি ভাবছেন বা করছেন, তাকে বাইরের থেকে দেখুন। নিজেকে ওই কাজের মধ্যে বা ভাবনার মধ্যে,  জড়িয়ে ফেলবেন না। এই সময় এটা ভাববেন  না যে এটা ভালো হচ্ছে কি খারাপ হচ্ছে, অর্থাৎ আপনি বা আপনার শরীর -মন যা করছে, সেটা ভালো করছে কি মন্দ করছে, সেটা ভাবতে যাবেন না, আপনি শুধু দেখতে থাকুন ।

এর পরের  পদক্ষেপ হচ্ছে, শ্বাসপ্রশ্বাস। খেয়াল  করুন, আপনার নাকে ছিদ্র দিয়ে  শরীরে বাতাস ঢুকছে, আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। আপনি যখন শ্বাস  নিচ্ছেন, আপনার বুক-বা পেট ফুলে উঠছে। স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস  নিলে আপনার পেট উপরে উঠবে। চেতন ভাবে নিলে আপনার ইচ্ছে মতো বুক বা পেটে  নিতে পারেন। না আপনি স্বাসের স্বাভাবিক গতিকে পরিবর্তন করতে যাবেন না। পেটে  যাচ্ছে, পেটেই  যেতে দিন। 

এরপর পেটের দিকে খেয়াল করুন। দেখুন পেটটা একবার উপরের দিকে উঠছে, একবার নিচের দিকে নাবছে। শুধু খেয়াল করতে থাকুন। আসলে পেটের  সঙ্গে আমাদের চিরকালীন সম্পর্ক। পেটের সঙ্গেই আমাদের জীবনের সম্পর্ক। বস্তু থেকে জীবন তৈরির কারখানা হচ্ছে এই পেট। আমরা যখন বিন্দুর আকারে ছিলাম, যখন মাংসপিন্ড ছিলাম, এমনকি যখন আমাদের দেহে প্রাণ আসে, তখনও আমি এই পেটের  মধ্যে। এখনো আমরা এই পেটের  ক্ষুধা মেটাবার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছি। তাই পেট জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এই পেটের  দিকে খেয়াল করতে থাকুন। দেখুন পেট একবার উঠছে, একবার নাবছে। পেটের সঙ্গে আমাদের বেঁচে থাকার সম্পর্ক। পেট যখন উপরে উঠছে তখন আমরা  জীবনীশক্তি অর্জন করছি। পেট যখন নিচের দিকে নাবছে, জীবনীশক্তি বর্জন করছি।  

পুরো ব্যাপারটা আবার একবার আমরা ভালো করে বুঝে নেই। প্রথমে আমরা শরীর  সম্পর্কে সচেতন হবো, তার পরে আমরা মন সম্পর্কে সচেতন হবো। এর পর আমরা আমাদের আবেগ সম্পর্কে সচেতন হবো। এর পরের  পদক্ষেপ হচ্ছে, স্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে আমাদের পেটের ওঠা নাবার দিকে খেয়াল রাখবো। এইভাবে চলতে থাকলে আমরা একসময় দেখবো, আমাদের মধ্যে আবেগ বলে কিছু নেই। আমরা বাস্তবে চলে এসেছি। 

এর পরের পদক্ষেপ হচ্ছে, নাকে দিকে খেয়াল রাখা। শ্বাস নাক দিয়ে ঢুকছে, আবার বেরিয়ে যাচ্ছে, এটাকে ভালো করে খেয়াল করুন। শ্বাস কোথায় যাচ্ছে, অর্থাৎ পেটে যাচ্ছে, না বুকে যাচ্ছে, সেদিকে আমাদের নজর থাকবে না। আমরা শুধু দেখবো, শ্বাস নাক দিয়ে ঢুকছে, আবার নাক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। খুবই সহজ একটা পদ্ধতি। মেয়েদের পক্ষে এটা আরো সহজ।  কারন, মেয়েরা পেট সম্পর্কে আরো বেশি সচেতন। মেয়েদের শ্বাস বুক হয়ে পেটেই যায়, ।  কিন্তু স্বাস্থ্য সচেতন পুরুষের বুকের মধ্যে বাতাস প্রবেশ করে বুকের পাঁজরকে বর্ধিত করে, কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে তা হয় না। এইজন্য পুরুষের বুকের আকৃতি হয় বড়। এবং পেট সংকুচিত থাকে। অর্থাৎ সিংহের আকৃতি নেয়। যারা শারীরিক পরিশ্রম করে থাকে তাদের আকৃতি হয়, সিংহের মতো। পেটকে সংকুচিত করবার জন্য পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়। কিন্তু পেটকে বর্ধিত করবার জন্য, কিছুই করতে হয় না। এটা স্বাভাবিক। তাই শ্বাস-প্রশ্বাস পেটের ভিতরে অবধি যাতায়াত করা স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক। আমরা যখন  ঘুমিয়ে থাকি তখন আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস-এর গতিপথ পেট অবধি বিস্তৃত থাকে। এবং এইজন্য  রাতে বা বিছানায় শুয়ে থাকলে আমরা স্বাচ্ছন্দ বা আরামদায়ক বোধ করে থাকি। 

যাইহোক, আমাদেরএখন খেয়াল রাখতে হবে নাকের অগ্রভাগে, যেখান থেকে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহিত হচ্ছে। শুধু মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকুন, শ্বাস ঢুকছে, আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। শুধু শ্বাসের প্রতি ধ্যান দিয়ে বসে থাকুন। তখন মন শান্ত হয়ে যাবে, অহংভাব দূর হয়ে যাবে। আর এই আমিভাব যখন দূরীভূত হবে, তখন অধ্যাত্ম জগতের দরজা খুলে যাবে। যেকোনো মানুষের জীবনে এই সহজ প্রক্রিয়াতেই সমাধি সম্ভব। যখন একবার এই পথে আপনি নিবিষ্ট থাকবেন, যখন যথার্থ দ্রষ্টা হয়ে যাবেন , তখন আপনার জীবনে এক উজ্জ্বল দিব্যআলো আপনাকে পরিবর্তন করে দেবে। পুরাতন আপনি আর থাকবে না, এক নতুন মানুষের জন্ম হবে, আপনার ভিতরে । 

চল্লিশ থেকে ষাট মিনিট এই প্রক্রিয়ার অভ্যাস করুন। মেরুদন্ড সোজা করে বসুন। শরীরকে স্থির করবেন অবশ্যই । চোখ বন্ধ  করুন। আসন তখনই পরিবর্তন করবেন, যখন একান্তই প্রয়োজন হয়ে পড়বে , নতুবা এক আসনে বসে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চেষ্টা করুন। স্থির হয়ে বসে, প্রথমে পেটের  ওঠা-নাবা লক্ষ করতে থাকুন।  এটা কোনো মনোযোগের ব্যাপার নয়, শুধু মানশ্চোক্ষে  দেখতে থাকুন, পেটের  ওঠা নাবা। অর্থাৎ শুধু উপলব্ধি করুন , শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে আপনার পেট ওঠা-নাবা করছে। পনেরো মিনিট এই অবস্থায় থাকুন।  এর পরে নাকের দিকে নজর দিন। শ্বাস-প্রশ্বাসের গমন-নির্গমন লক্ষ করতে থাকুন। এই সময় আপনার মনের মধ্যে নানান রকম চিন্তার উদয় হবে। আপনি নিস্পৃহ থাকুন, শুধু শ্বাসের দিকে খেয়াল রাখুন। এতে করেই আপনি লক্ষ করবেন আপনার জীবনের গতি পরিবর্তন হয়ে গেছে। আপনি একজন নতুন মানুষ হয়ে গেছেন। এই অভ্যাস যত  দীর্ঘদিন করবেন, তত আপনার ভোগ-লালসা-রাগ-ভয় দূর হতে থাকবে। আপনি সমস্ত পাশমুক্ত এক মুক্ত মানুষ  হয়ে উঠেছেন। আর আপনার জীবনপথ  হবে মসৃন। আপনি এখন শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-চৈতন্য স্বরূপ ।    

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

খেচরী মুদ্রা :
আজ আমরা শুনবো, খেচরীমুদ্রা সম্পর্কে। আসলে আধ্যাত্মিক জগৎটাই খেচরী বিদ্যা। এবং খেচরী মুদ্রা তার একটা অঙ্গমাত্র। 
আমি তখন নেখড়িতে থাকি।  নেখড়ি হচ্ছে উত্তরাখণ্ডের  গাড়োয়াল অঞ্চলের তেহরির মধ্যে।  ওখানে একটা মায়ের মন্দির আছে, চন্দ্রবদনী মন্দির ।   একদম পাহাড়ের চূড়ায়। পাহাড়টি জঙ্গলে ঢাকা। এমনকি হিংস্র জীবজন্তুর বাস সেখানে। দিনের বেলায় ওখানে বাঘ দেখা যায়।  ওখানকার গ্রাম্য লোকগাঁথা অনুসারে ওখানে নাকি সতী মায়ের ধর পড়েছিল। ওই মন্দির কত পুরোনো, সে সম্পর্কে সঠিক কিঁছু না জানা থাকলেও, শোনা যায়, এখন যেখানে মন্দির সেটি আচার্য্য শংকর প্রতিষ্ঠা করেছেন। পাশেই  পাহাড়ের চূড়ায়, একটা মন্দিরের ধংসাবশেষ আছে, যেটা নাকি আসল স্থান।  এখন সেখানে কেউ যায় না। হিংস্র জন্তু জানোয়ারের ভয় আছে, এমনকি সেখানে দিনের বেলাতেও বাঘ দেখা যায়। আমি সেখানে খানিক্ষণের জন্য গিয়েছিলাম। চন্দ্রবদনী মন্দির দুপুরের পর থেকে ফাঁকা হতে থাকে। কেবলমাত্র পূজারী পুরোহিত, এবং দুই-একজন দোকানদার সেখানে রাতে বাস করে।  যাত্রীদের থাকবার জন্য সেখানে ব্যবস্থা আছে, তবে সাধারণত সেটি ফাঁকাই থাকে। আমি ওই মন্দিরে কয়েকটা  রাত কাটিয়ে ছিলাম।  ওই মন্দিরের ভিতরে একটা যন্ত্র আছে। যা বাইরে থেকে দেখা যায় না।  যন্ত্রের নিচে মায়ের একটা ছোট্ট মূর্তি, আর একপাশে একটা প্রদীপ আছে যা কবে জ্বালানো হয়েছে তা কেউ বলতে পারে না। ওই মন্দিরে মায়ের পাশে  বসে আমি ধ্যান করতাম। দিনের বেলা পূজা দেবার জন্য বহু লোক আসতো।  দুপুরের পর থেকেই জনশূন্য হয়ে যেত। যাই হোক এত কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে,  ওই সময় আমি একজন শিবভক্তের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম।সে যখন কথা বলতো, তার জিভটা বেরিয়ে আসতো ।  সে তার জিভ দিয়ে নাককে ছুঁতে পারতো। এবং সে বলতো, তার গুরুদেবের জিহ্বা নাকি কপাল স্পর্শ করে। ওদের ধারণা ছিল, যার যত  বড় জিহ্বা সে তত বড়ো  সাধক। প্রতিদিন দেখতাম, সে একটা তামার পাত  দিয়ে টেনে টেনে  জিভ পরিষ্কার করবার নামে জিভটাকে লম্বা করতো। ওর কাছেই প্রথম আমি খেচরী মুদ্রার কথা শুনি। তো এই মুদ্রা সম্পর্কে আমার নিজের কোনো আগ্রহ নেই।  কারন, ঈশ্বরের দেওয়া এই শরীরকে ছেদন করে, রসের স্বাদ নিতে হবে, এতে আমি বিশ্বাসী নোই। কিন্তু এই বিদ্যা সম্পর্কে জানতে আমার আগ্রহ আছে। তো এ সম্পর্কে হঠযোগ প্রদীপিকা যা বলছে, আমরা  আজ সেই কথাই শুনবো।   
   
"খ" কথাটির অর্থ আকাশ, খে অর্থাৎ আকাশে, চর অর্থাৎ যে গমন করে তাকে বলা হয় খেচর। তা সে পাখী  হতে পারে, বা চাঁদ-সূর্য-নক্ষত্র হতে পারে। খেচরী মুদ্রা হচ্ছে একটা প্রক্রিয়া যার সাহায্যে আমরা আমাদের চিত্তাকাশে বা মন-আকাশে, চিদাকাশে  ইচ্ছেমত বিচরণ করতে পারি। অনেকের ধারণা খেচরী মুদ্রা অভ্যাস করলে, আকাশে যত্র তত্র বিচরণ করা যায়, ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। 

হঠযোগীগণ বলে থাকেন, সাধক জিহ্বাকে বিপরীতমুখী করে, কপালরন্ধ্রে প্রবেশ করিয়ে স্থির দৃষ্টিতে  ভ্রূযুগলের মধ্যে দেখতে থাকবে। একেই খেচরী মুদ্রা বলে। 

খেচরী মুদ্রা সাধন করতে গেলে, জিহ্বাকে লম্বা করতে হবে।  আর এই জিহ্ববাকে লম্বা করবার জন্য জিহবার নিচের দিকে যে চামড়া আছে তাকে তীক্ষ্ণ ধারালো অস্ত্র দিয়ে কাটতে হবে।  ধীরে ধীরে কাটতে হবে। জিহবার মূল যে শিরা তাকে প্রথম দিন চুল  পরিমান কাটতে হবে। আর সাতদিন যাবৎ প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় সৈন্ধব চূর্ন ও হরিতকি দ্বারা ওই ছিন্ন স্থানে ঘর্ষন করতে  হবে। কেউ কেউ বলে থাকেন, সৈন্ধক না লাগিয়ে, খয়ের ও  হরিতকি চূর্ন  দিয়ে ঘর্ষণ করতে হবে। প্রতি ৭ দিন অন্তর এই ভাবে ছেদন করতে হবে আর খয়ের ও হরিতকি চূর্ন দিয়ে ঘর্ষণ করতে হবে।  এই ভাবে ছয়  মাস যাবৎ প্রতি সাত দিনে একবার করে লোম পরিমান জিহ্বার মূলগতা নাড়ী ছেদন করতে হবে। এভাবে ছেদন করতে করতে একসময় আমাদের জিহ্বার  মুলে যে কপালকুহরে রসনা সংযোগের প্রতি বন্ধকীভূত শিরা আছে, সেই নাড়ীর বন্ধন কেটে যাবে।  

এই খেচরী মুদ্রার অভ্যাস করতে গেলে, আমাদের আগে সিদ্ধাসন, পদ্মাসন বা বজ্রাসনে বসবার অভ্যাস করতে হবে। যে কোনো একটি আসনে বসে প্রথমে মহামুদ্রা, মহাবন্ধ , ও মহাবেধ মুদ্রার  অভ্যাস করতে হবে। এই যোগ তিনটি আমাদের প্রতিদিন, প্রতি প্রহরে একবার করে আট প্রহরে আটবার অভ্যাস করতে হবে। 

খেচরী মুদ্রার সাধক এই ছেদন কার্য্য করতে করতে  জিহবা বর্দ্ধিত হলে, সেই জিহ্বাকে বিপরীত অভিমুখী করে অর্থাৎ জিভ উল্টে দিয়ে  নাড়ীত্রয়ের সঙ্গমস্থলে অর্থাৎ ইড়া -পিঙ্গলা ও সুষুম্না নাড়ীর সঙ্গমস্থলে স্পর্শ করতে হবে। এই যে তিন নাড়ীর সঙ্গমস্থল একে বলে ব্যোমচক্র । হঠযোগীগণ বলে থাকেন, মাত্র একঘন্টা এই অবস্থায় থাকতে পারলে, জরা ব্যাধি মৃত্যুকে জয় করতে পারে।  এমনকি তাকে যদি বিষধর সাপে  কামড়ায় , তথাপি তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এতে করে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা এমনকি মূর্ছা থেকে  রেহাই পাওয়া যাবে । খেচরী মুদ্রার সাধককে কর্ম্মফল  দ্বারা  বাঁধা যায় না। অর্থাৎ সাধক কালের উর্দ্ধে উঠতে পারেন । এই মুদ্রা সাধনকালে সাধককে ভ্রূযুগলের মধ্যে মনকে আবদ্ধ   রাখতে হয়, ফলতঃ তিনি  সব সময় চিদাকাশে বিচরণ করে থাকেন । এমনকি এই অবস্থায় সাধকের রেতঃপাত হতে পারে না। অর্থাৎ স্বাভাবিক ভাবেই সে ব্রহ্মচারী হয়ে যায়। এই সময় চন্দ্রামৃত অর্থাৎ তালুস্থিত ছিদ্র দ্বারা গলিত সুধা পান করতে থাকেন । হঠযোগীগণ বলে থাকেন, যোগস্থ  সাধক ১৫ দিনের মধ্যেই মৃত্যুকে জয় করতে পারেন। যোগীগণ বলছেন, দীপশিখা যেমন তৈলপূর্ন বর্তিকা ত্যাগ করে না, অগ্নি কখনো কাঠকে ত্যাগ করে না, তেমনি জীবাত্মা চন্দ্রামৃত পুর্ন শরীর  ত্যাগ করে না।হঠযোগীগণ বলে থাকেন, নিত্য গোমাংস ভক্ষণ করবে, এবং অমর বারুনী পান করবে। এখানে গো শব্দের দ্বারা জিহ্বাকে বোঝায়। সেই জিহ্ববা তালুতে প্রবেশ করলে, গোমাংস ভক্ষণ হয়। জিহ্ববা তালুতে প্রবেশ করলে, দেহে তাপ  উৎপাদন হয়, এবং তার ফলে চন্দ্র হতে অর্থাৎ ভ্রূমধ্য থেকে যে সুধা বা রসামৃত ক্ষরিত হয়, তাকে অমরবারুনী বলে। 

খেচরী মুদ্রাকারীর জিহ্বা লম্বা হয়ে থাকে। আর সেই লম্বা জিহ্বার অগ্রভাগ নিরন্তর ক্ষার-কটু-অম্ল-মধু-ঘৃত ও দুধের ন্যায়  স্বাদ-বিশিষ্ট লালা ক্ষরণকারিনী হয়ে চুম্বনকারিনী অর্থাৎ স্পর্শ করে তার স্বাদ গ্রহণ করে থাকেন । যোগী উর্দ্ধমুখ হয়ে জিহ্বাকে কপাল কুহরে সংযত করে পরাশক্তিকে চিন্তা বা ধ্যান করতে করতে করতে প্রাণ বায়ুর দ্বারা মূর্দ্ধা থেকে গলিত রস আমাদের কন্ঠকে পূরণ করতে পারেন।  এই কণ্ঠদেশকে হঠযোগীগণ বলে থাকেন, বিশুদ্ধ চক্র যা ষোলোটি পাপড়ি বিশিষ্ট পদ্ম। এই রস যিনি পান করেন, তিনি সারাজীবন ব্যাধীশূন্য হয়ে কোমল পদ্মের ন্যায় দেহের অধিকারী হয়ে থাকেন। 

মেরু ও মুর্দ্ধা উভয়ের মধ্যে যে ছিদ্র বা আকাশ আছে, সেই আকাশে শীতল রস  আছে। সেখানে যে তত্ত্ব আছে অর্থাৎ ব্রহ্মতত্ত্ব আছে, তাকে ব্রহ্মের মুখ বা প্রধান স্থান বলা হয়ে থাকে। আমাদের দেহের বাম দিকে অবস্থিত প্রশস্ত ইড়া নাড়ী থেকে সেই রস  ক্ষরিত হয়। আর এই রসের দ্বারাই রোগ উৎপন্ন হয়ে অধোগামী মানুষের মৃত্যু হয়। অতএব হঠযোগীগণ এই খেচরী মুদ্রা দ্বারা শরীরে রোগের প্রবেশদ্বারকে বন্ধ  করে থাকেন । সুস্বাস্থের জন্য এ একটি উত্তম উপায়। 

যাইহোক, খেচরী মুদ্রা আসলে আমাদের অন্তর্জগতে নির্বিবাদে ভ্রমনের একটা যান। হঠযোগীগণ এমনি অনেক উপায় বা মুদ্রার কথা বলেছেন, যা আমাদের ভারতীয় আধ্যাত্মিক যোগবিদ্যার একটা অমূল্য সম্পদ। কিন্তু কথা হচ্ছে, এগুলো সবই গুরুবিদ্যা। গুরুর সান্নিধ্যে থেকেই এর চর্চা করতে হয়। আর এই গুরুদেবদের সন্ধান পাওয়া দুর্লভ। তবে নিজের শরীর  বুঝে একটু আধটু যোগক্রিয়ার অভ্যাস করলে, আমার এর সুফল অবশ্যই  অনুধাবন করতে পারবো।  এবং আমাদের মধ্যে এই বিদ্যাকে আয়ত্ত্ব  করবার একটা আগ্রহ জাগ্রত হতে পারে। তখন আমরা উপায়ও নিশ্চই খুঁজে পাবো। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  

  

 









  
















      















      



সর্ব্বম্ খলু ইদম্ ব্রহ্ম (ছান্দোগ্য - ৬/৭-ম অধ্যায়) / মাণ্ডূক্য

সর্ব্বম্ খলু ইদম্ ব্রহ্ম (ছান্দোগ্য উপনিষদ - ৭-ম অধ্যায়)

ওম আপ্যায়ন্তু  মম অঙ্গানি বাক-প্রাণশ্চক্ষুঃ শ্রোত্রম অথো
বলম-ইন্দ্ৰিয়ানি চ সর্বাণি। সর্বং ব্রহ্মৌপনিষদম। মাঽহং
ব্রহ্ম নিরাকুর্যাং, মা মা ব্রহ্ম  নিরাকরোৎ ;
অনিরাকরণমস্তু, অনিরাকরণং মেঽস্তু। তদাত্মনি নিরতে 
য উপনিষৎসু ধর্মাস্তে ময়ি সন্তু, তে ময়ি সন্তু। । 
ওং শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।      
পর্ব্ব - এক :
আমরা এখন ঘরবন্দি। আসুন উপনিষদের গল্প শুনি। আসলে বেদ যেন দুগ্ধবতী মাতাগাভি, আর উপনিষদ হচ্ছে দুগ্ধ। ব্রহ্মাপুত্র নারদ মহামুনি সনৎকুমারের  কাছে গিয়ে একদিন  বললেন, আমাকে শিক্ষা  দিন। তো সনৎকুমার বললেন, তুমি যা জান তা আমাকে বলো, তারপর আমি তোমাকে বলবো। শিক্ষা দানের এটাই রীতি। তুমি যা জান  তা আগে আমাকে বলো। তাহলে শিক্ষক বুঝতে পারবেন, ছাত্র কতদূর এগিয়ে আছে। এবং তারপর সেখান থেকে তাকে শেখাতে পারবেন। 

 তো নারদমুনি বললেন, আমি বেদ  অধ্যায়ন করেছি, ব্যাকরণ অধ্যায়ন করেছি। গণিতশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র, ভূতত্ত্ববিদ্যা, কলাবিদ্যা - এসব আমি জানি, পড়েছি। কিন্তু সত্য যা তা হচ্ছে, এইসব বইয়ের শব্দার্থ আমি জানি, কিন্তু আত্মাকে জানি না। আমি মহাত্মাদের কাছে শুনেছি, যাঁরা আত্মাকে জেনেছেন, তাঁরা শোকগ্রস্ত হন না।  আমি শোকগ্রস্ত, আপনি আমাকে শোকের পরপারে নিয়ে যান। নারদ বিভিন্ন শাস্ত্র-বিদ্যা আয়ত্ত্ব করেছেন , এবং এতে করে তিনি বুঝতে পেরেছেন, আত্মজ্ঞান না হলে অর্থাৎ আত্মাকে না জানলে এই  শাস্ত্রবিদ্যা অর্থ হীন। আসলে এই বোধ যতক্ষন না হয় - অর্থাৎ আত্মাকে না জানলে শোকের পরপারে যাওয়া যায় না - এই বোধ যতক্ষন না হয়, ততক্ষন আমরা শোকগ্রস্তই থাকবো।  এই বোধ জাগা দরকার। আর সেটা শাস্ত্র অধ্যানের মাধ্যমেই হতে পারে। নারদের সেটা হয়েছে। তাই তিনি সনৎকুমারের  কাছে এসেছেন, আত্মজ্ঞান লাভ করার বিদ্যা আয়ত্ত্ব করতে। আমরা ছোটবেলায় শুনতাম - লক্ষ্মী ও সরস্বতী এক জায়গায় থাকেন না। অর্থাৎ সনাতন যে বিদ্যা তা আমাদের অর্থ লাভের  সহায়ক হয় না। পরবর্তী কালে এই শিক্ষার পরিবর্তন হয়েছে। তখন বলা হতো, লেখাপড়া করে যেই, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে  সেই। অর্থাৎ লেখাপড়া করে, অর্থ উপার্জন করা যায়। কিছু দুষ্টু  মানুষ এটাকে বিকৃত করে বলতো, লেখাপড়া করে যেই, গাড়িচাপা পড়ে  সেই। অর্থাৎ লেখাপড়া করে কিছুই হবার নয়, বরং এইসব চিন্তা করতে করতে বাস্তব জীবনে  বিপদ ডেকে আনতে পারে। সত্যটা  কিন্তু লুকিয়ে আছে এখানেই। সত্যিকারের জ্ঞান আমাদের জ্ঞানতৃষ্ণা বাড়িয়ে দেয়। আমরা তখন শাস্ত্র অধ্যায়ন থেকে  মনন করতে শুরু করি। আসলে অপরা বিদ্যা হচ্ছে নিকৃষ্ট জ্ঞান  আর পরা বিদ্যা হচ্ছে উৎকৃষ্ট জ্ঞান। মহর্ষি নারদ তাই বললেন, এইসব শাস্ত্র পড়ে আমি কেবলমাত্র শব্দার্থ জানতে পেরেছি, আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারিনি। এবং শোকগ্রস্ত হয়ে আছি।  

সনৎকুমার বললেন, তুমি এত দিন যা শিখেছো, তা "নাম" মাত্র। নামমাত্র কথাটার দুটো অর্থ, একটা হচ্ছে কিঞ্চিৎ আর একটা হচ্ছে, প্রত্যেক বস্তুর একটা প্রতীকি নাম আছে, এমনকি গুণেরও একটা প্রতীকি নাম আছে। শাস্ত্রে যা আছে, বা পুস্তকে যা আছে, তাই এই নাম মাত্র। আর এই নাম তৈরি হয়েছে বর্ণমালা দিয়ে। তুমি এই নামের উপাসনা করো, অর্থাৎ শাস্ত্রে যা লেখা আছে, তা অর্থ বুঝবার চেষ্টা করো।  অর্থ বুঝবার পরে, অর্থ অনুধাবন করো। অর্থ অনুধাবন করে, বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ করো। যদি তুমি এই নাম-ব্রহ্মর উপাসনা করো, তবে তুমি নামের গতি যতদূর, ততদূর তুমি ইচ্ছে অনুযায়ী যেতে পারবে।

 তো নারদ ভাবলেন, সে না হয় বুঝলাম, নামের থেকে শ্রেষ্ট কি কিছু আছে? কেননা শাস্ত্র আমাদের শিক্ষা দেয়, অনুভূতি দেয়  না। শাস্ত্র অনুশাসন দেয় কিন্তু তা পালন করবার শক্তি দেয়  না। তাই বললেন, নামের থেকে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে কি ? সনৎকুমার বললেন, নাম অপেক্ষা বাক শ্রেষ্ঠ। আমাদের বাগিন্দ্রিয় আছে বলেই আমরা কথা বলতে পারি। আমাদের মধ্যে বাকশক্তি আছে বলেই, আমরা সব কিছুকে প্রকাশ করতে পারছি। যদি আমাদের বাকশক্তি না থাকতো তবে, সত্য-অসত্য ধর্ম্ম-অধর্ম্ম ভালো-মন্দ কিছুই প্রকাশ করতে পারতাম না। অতএব তুমি বাকের উপাসনা করো। বাককে উপাসনা করলে, বাক্যের গতি যতদূর, ততদূর তুমি ইচ্ছে করলেই যেতে পারবে। 

তো নারদ ভাবলেন, শব্দের গতি তো সীমাবদ্ধ, তো এই সীমাবদ্ধ-শক্তির থেকে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে কি ? মহামুনি সনৎকুমার বললেন, বাক ও নাম দুটোই গুরুত্ত্বপূর্ন, কিন্তু এরাই  সব নয়। এর দ্বারা আমরা বেশিদূর এগুতে পারি না। মন বাক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। মন-ই বাক ও নামকে ধরে রাখে। মন না চাইলে বাক-নাম কোনো কাজ করতে পারে না। তাই হে মহাত্মা নারদ তুমি মনের উপাসনা করো। যিনি মনকে উপাসনা করেন, তিনি মনের যতদূর গতি, ততদূর তিনি স্বছন্দে তিনি যেতে পারেন।

 নারদ জিজ্ঞেস করলেন, মন থেকে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে কি ? সনৎকুমার বললেন, হ্যাঁ মন থেকে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে সংকল্প বা ইচ্ছাশক্তি। মানুষ আগে সংকল্প করে, তরপর মনের সাহায্যে চিন্তা করে, তারপরে বাককে পরিচালিত করে থাকে। সবশেষে বাক নাম উচ্চারণ করতে প্রবৃত্ত হয়। সমস্ত মন্ত্র নামে এবং সমস্ত কর্ম্ম মন্ত্রে একীভূত হয়। নাম, বাক, মন এগুলো সবই সংকল্পে লয় প্রাপ্ত হয়। দ্যুলোক-ভূলোক সংকল্প করেছিল, বায়ু-আকাশ সংকল্প করেছিল, জল-তেজ সংকল্প করেছিল।  তাই এঁরা নিজ নিজ কাজ করে যাচ্ছে। এদের  সঙ্কল্পেই বৃষ্টি সংকল্প করে, আবার বৃষ্টির সংকল্পে অন্ন সংকল্প করে।  অন্যের সংকল্পে সমস্ত প্রাণ সংকল্প করে। প্রাণের সঙ্কল্পেই মন্ত্র সংকল্প করে, মন্ত্রের সংকল্পে কর্ম্ম সংকল্প করে, কর্ম্মের সংকল্পে কর্ম্মফল অর্থাৎ স্বর্গ-নরক সংকল্প করে। কর্মফলের সংকল্পে সমস্ত জগৎ সংকল্প করে থাকে।  হে নারদ তুমি সংকল্পের উপাসনা করো। যিনি সংকল্পের উপাসনা করেন, তিনি নিজে ধ্রুব   হয়ে ধ্রুবলোক প্রাপ্ত হন। যিনি সংকল্পের উপাসনা করেন, তিনি সংকল্পের যতদূর গতি, ততদূর তিনি ইচ্ছে করলে যেতে পারেন।

 তো নারদ বললেন, সংকল্পের থেকে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে কি ? সনৎকুমার বললেন, সংকল্পের চেয়ে চিত্ত (বুদ্ধি) অবশ্য়ই শ্রেষ্ঠ। একটু ভেবে দেখো, মানুষ প্রথমে অনুভব করে, তারপরে সংকল্প করে, তারপর বিষয়টির উপরে বার বার চিন্তা করে থাকে।  পরে, বাকশক্তি প্রয়োগ করে, এবং নাম উচ্চারণ করে থাকে। চিত্তই সংকল্প-মন প্রভৃতির গতি। চিত্ততেই এদের প্রতিষ্ঠা। কোনো মানুষ যতই জানুক না কেন, বিচার-বুদ্ধি না থাকলে তাকে নির্বোধ বলা হয়ে থাকে। আবার কেউ যদি অল্পও জানে, কিন্তু যদি বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন হয়, তবে তার কথা লোকে শ্ৰদ্ধার  সঙ্গে শুনতে চায়। এই চিত্তই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।  সুতরাং হে নারদ তুমি, চিত্তের উপাসনা করো। চিত্তকে ব্রহ্মরূপে  উপাসনা করো। তবে তুমি ধ্রুব-লোকে ব্যথাশূন্য হয়ে ব্যথা-রোহিত লোকের বাসিন্দা হতে পারবে। এবং চিত্তের গতি যতদূর, ততদূর তুমি ইচ্ছে করলে যেতে পারবে। 

মহাত্মা নারদের যেন নেশা পেয়ে গেছে। নারদ আবার বললেন, চিত্ত থেকে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে কি ? যদি থাকে অনুগ্রহ করে, আমাদে সেই বিষয় সম্পর্কে শিক্ষা দান করুন। মহামুনি সনৎকুমার বললেন, চিত্ত থেকে ধ্যান অবশ্যই  শ্রেষ্ঠ। দেখো, পৃথিবী  ধ্যান-মগ্ন। দ্যুলোক - অন্তরীক্ষ লোক ধ্যানমগ্ন। দেবতা এমনকি মহৎ মনুষ্যগণ ধ্যানমগ্ন। এমনকি পাহাড় -সমুদ্র সবাই ধ্যান-মগ্ন। আর এই ধ্যানের  ফলেই সবাই মহত্ত্ব লাভ করেছেন। যারা শ্রেষ্ঠ তারা সর্বদা ধ্যান অভ্যাস করেই শ্রেষ্টত্ত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন। সুতরাং  তুমি ধ্যানের  উপাসনা করো। যিনি ধ্যানকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তিনি ধ্যানের  গতি যতদূর, ততদূর পর্যন্ত ইচ্ছে করলে যেতে পারেন। 

নারদ আবার বললেন, ধ্যানের  থেকে শ্রেষ্ঠ আরো  কিছু আছে নিশ্চয়ই।  আপনি আমাদের সেই শ্রেষ্ঠ  সম্পর্কে কৃপা করে, শিক্ষা দান করুন। সনৎকুমার বললেন, ধ্যান থেকে বিজ্ঞান শ্রেষ্ঠ। শাস্ত্রের মর্মার্থ উপলব্ধি করাই বিজ্ঞান। দেখো যা কিছু অজ্ঞাত তা জানতে গেলে বিজ্ঞানের সাহায্যেই তা সম্ভব। তা সে পার্থিব বস্তু বলো, বা অপার্থিব বস্তু বলো। অপরা এমনকি পরাবিদ্যাও একমাত্র বিজ্ঞানের সাহায্যেই অনুধাবন করা যেতে পারে। অতএব বিজ্ঞানের উপাসনা করো। যিনি বিজ্ঞানকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তিনি জ্ঞানময়   ও বিজ্ঞানময় লোকসমূহ লাভ করে থাকেন। আর এর ফলে বিজ্ঞানের যতদূর গতি, ইচ্ছে করলে, তিনি ততদূর পর্যন্ত যেতে পারেন।
 
নারদ  বলছেন, বিজ্ঞানের থেকে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে কি ?  সনৎকুমার  বলছেন, হ্যাঁ অবশ্য়ই আছে, আর তা হচ্ছে বল বা শক্তি। একজন শারীরিক, মানসিক ও বৌদ্ধিক  দিক থেকে বলবান ব্যক্তি, উদ্দমশালী হতে পারে। বলহীন অর্থাৎ শক্তিহীন ব্যক্তির পক্ষে না পার্থিব জগতে না আধ্যাত্মিক জগতে - কোথাও সে সার্থক হতে পারে না। এমনকি তুমি যদি স্নায়ুবিক দুর্বল-ব্যক্তি হও তবে, শাস্ত্রের  অর্থও বুঝতে পারবে না। বল-ই সবকিছুর আশ্রয়। তাই হে নারদ তুমি বলের উপাসনা করো। বাস্তবিক পক্ষে সমস্ত প্রকৃতি, সবাই যে যার নিজের শক্তিতেই চলছে। এই শক্তি বাইরে থেকে ধার করা নয়। ঠিক তেমনি আত্মজ্ঞান লাভ করা যদি কারুর উদ্দেশ্য হয়, তবে তাকে অবশ্য়ই সমস্তদিক থেকে বলশালী হতে হবে। শক্তিহীনের প্রকৃতিতেও স্থান নেই। তাই হে নারদ, তুমি ব্রহ্মকে শক্তিরূপে উপাসনা করো। তাহলে তুমি ইচ্ছে করলে, বলের যতদূর গতি, ততদূর তুমি যেতে পারবে। 

নারদ বলছেন : বল থেকে শ্রেষ্ঠ কি কিছু আছে ?  মহামুনি সনৎকুমার বললেন : হ্যাঁ বল থেকে অন্ন শ্রেষ্ঠ। আমাদের শারীরিক শক্তি এই অন্নের আশ্রয়ে থাকে। যিনি অন্নকে ব্রহ্ম রূপে  উপাসনা করেন, তিনি অন্নের  গতি যতদূর, তিনি ততদূর ইচ্ছে করলে যেতে পারেন। 

নারদ জিজ্ঞেস করলেন, অন্ন থেকে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে কি ? যদি থাকে আপনি কৃপা করে তা আমাকে বলুন। সনৎকুমার বললেন, অন্ন থেকে শ্রেষ্ঠ জল। জল-বিনা প্রাণের উৎপত্তি হতে পারে না। শুধু প্রাণ নয়, অন্নও উৎপাদন হতে হতে পারে না।  বৃষ্টি না হলে, ফসল হবে না। আর জল-বৃষ্টি ভালো ভাবে হলে অন্নের অভাব হবে না।  আবার অন্নহীন প্রাণী কিছুদিন হলেও বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু জলবিনা মানুষ বাঁচতে পারে না। অতএব তুমি ব্রহ্মরূপে জলের উপাসনা করো। জলকে যিনি ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তার সকল বাসনা চরিতার্থ হয়, তিনি সুখী হন। 

নারদ বললেন, জলের থেকে শ্রেষ্ট কিছু আছে কি ? সনৎকুমার বললেন, জলের থেকে শ্রেষ্ট হচ্ছে তেজ। তেজ বায়ুর সাহায্যে আকাশকে তপ্ত করে থাকে। তেজই জলকে উর্দ্ধগামী করে, আবার তেজই বৃষ্টিরূপে নিম্নগামী করে।  ফলে অন্নের  সৃষ্টি হতে পারে। আসলে অগ্নিই জলরূপে নিজেকে প্রকাশ করে থাকে। তাই হে নারদ তুমি তেজকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করো।  যিনি তেজকে  ব্রহ্ম রূপে  উপাসনা করেন, তিনি তেজের   গতি যতদূর, তিনি ততদূর ইচ্ছে করলে যেতে পারেন। 

আসলে মহামুনি সনৎকুমার নারদের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন। ধীরে ধীরে স্থুল থেকে সূক্ষ্ম জ্ঞানের পথে আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন। আমরা তো স্থুলেই আছি। তো আমাদের যাত্রা শুরু করতে গেলে স্থূল থেকেই শুরু করতে হবে। কিন্তু সত্য সূক্ষ্মে প্রতিষ্ঠিত।  সেই ধারণা আমরা করতে পারি না।  কিন্তু আমাদের যদি ধীরে ধীরে স্থূল বিষয়ের প্রতি গভীর মনোনিবেশ করি, তবে স্থূলের মধ্যেই আমরা সূক্ষ্মের খেলা বুঝতে পারবো। পরবর্তীতে আমরা আরো গভীরে প্রবেশ করবো। মহর্ষি নারদ ও মহামুনি সনৎকুমার -এর আলোচনা শুনবো।  আজ বাক্যের বিরাম দিলাম। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  

সর্ব্বম্ খলু ইদম্ ব্রহ্ম (ছান্দোগ্য উপনিষদ - ৭-ম অধ্যায়) পর্ব্ব  - দুই 

আমরা শুনছিলাম  উপনিষদ থেকে ব্রহ্মকথা। আমরা শুনছিলাম মহর্ষি নারদ ও মহামুনি সনৎকুমারের  ব্রহ্মবিষয়ক আলোচনা।  আমরা এর মধ্যে শুনেছি, শাস্ত্র হচ্ছে কতিপয় মন্ত্রের সমাবেশ মাত্র। শাস্ত্রে যা আছে, তা বর্ণমালায় গ্রথিত নাম মাত্র। নামের চেয়ে শ্রেষ্ট হচ্ছে বাক, বাকের চেয়ে শ্রেষ্ট হচ্ছে মন, মনের চাইতে শ্রেষ্ট হচ্ছে সংকল্প, সংকল্পের চাইতে শ্রেষ্ট হচ্ছে চিত্ত। চিত্ত থেকে ধ্যান - ধ্যান থেকে বিজ্ঞান , বিজ্ঞান থেকে বল বা শক্তি ; শক্তি থেকে অন্ন, আবার অন্ন থেকে জল, জল থেকে তেজ শ্রেষ্ঠ। এবার আমরা আবার আলোচ্য বিষয়ে ফিরে যাবো। 

আমরা শুনছিলাম তেজের শ্রেষ্ঠতার কথা। প্রাচীন কাল থেকেই, সমস্ত বিশ্বে অগ্নিদেবতার পূজা শুরু হয়েছিল। এটা কেউ কাউকে দেখে শুরু করে নি। মানুষের ভিতর থেকেই মনে হয়েছিল, অগ্নির গতি উর্দ্ধমুখী, অগ্নি সবকিছুকে শুদ্ধ করতে পারে। অগ্নি উজ্জ্বল, অগ্নি বলশালী, অগ্নি তেজস্বী, অগ্নি দীপ্যমান। অগ্নি আমাদের জীবনের উৎস।  সূর্যই পারে, মাটির মধ্যে গ্রথিত বীজের মধ্যে যে সম্ভাবনা আছে, তাকে জাগ্রত করতে। মানুষের মধ্যে যিনি তেজস্বী তিনিই পারেন, অসম্ভবকে সম্ভব করতে।  অগ্নি আমাদেরকে শুদ্ধ-পবিত্র করতে পারে। অগ্নি সবকিছুকে প্রকাশ করে থাকে।  অগ্নি মলিনতাকে দূর করতে পারে। তাই আমরা সবাই জ্যোতির ধ্যান করে থাকি। অগ্নি জ্ঞানের প্রতীক। তমসো মা জ্যোতির্গময়। অন্ধকার থেকে যারা আলোতে যেতে চান, তাদের জ্যোতির সাহায্য নিতে হয়। আচার্য্য সনৎকুমার ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসু নারদকে আত্মজ্ঞানের দিকে নিয়ে চলেছেন। 

ঋষিবর সনৎকুমার বলছেন, তেজের থেকে আকাশ শ্রেষ্ঠ। দেখো, সূর্য-চন্দ্র-নক্ষত্রবৃন্দ-অগ্নি-বিদ্যুৎ আকাশকেই আশ্রয় করে থাকে। আকাশের সাহায্যেই একে  অপরকে আহ্বান করে থাকে, আকাশের সাহায্যেই শোনে। আকাশের মধ্যেই  জীবের জন্ম হয়।  শুধু জীব কেন, বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড আকাশেই স্থিত।  আকাশই সব কিছুর আধার। অগ্নি আকাশের দিকে ধাবিত হয়।  বৃক্ষ-লতা আকাশেই বেড়ে ওঠে। হে নারদ তুমি আকাশের উপাসনা করো।  আকাশই আমাদের জন্ম-বৃদ্ধি ও মৃত্যুকালীন আশ্রয়। তুমি ব্রহ্মরূপে  আকাশের উপাসনা করো। যিনি আকাশকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করে থাকেন, তিনি সীমাহীন, বাধাহীন, জ্যোতির্ময় লোকসুমহ  লাভ করে থাকেন। এবং আকাশের গতি যতদূর, তিনি ইচ্ছে করলে, ততদূর  পর্যন্ত যেতে পারেন। 

জিজ্ঞাসু নারদের আজ যেন  জিজ্ঞাসার শেষ নেই, তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আকাশের থেকে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে কি ? আচার্য্যদেব সনৎকুমার বললেন, হ্যাঁ আছে বৈকি, আর তা হচ্ছে স্মৃতি। আকাশের থেকে স্মৃতি শ্রেষ্ট। স্মৃতির দ্বারাই আমরা একে অপরকে চিনতে পারি। যার স্মৃতি নেই তার শ্রবণও নেই। যার স্মৃতি নেই, সে অন্যের কথাও বুঝতে পারে না। স্মৃতির সাহায্যেই আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের, মা-বাবাকে চিনতে পারি।  এমনকি এই যে আমি একটা ধারাবাহিকতা রেখে চলেছি, সেটিও আমরা স্মৃতির সাহায্যে বুঝতে পারি। ছোটবেলার আমি আর বৃদ্ধ আমি যে একই আমি তা আমরা স্মৃতির সাহায্যেই বুঝতে পারি। আমরা স্মৃতিভ্রষ্ট হবো, সেদিন আমরা আর আমি থাকবো না। আমরা যখন আচার্য্যের কাছ থেকে উপদেশ শুনি, তা আমরা স্মৃতির সাহায্যেই ধরে রাখি, বুঝতে পারি, চিন্তা করতে পারি, এবং বিষয়টি নিয়ে মনন করতে পারি। আচার্য্য সনৎকুমার বলছেন, যিনি স্মৃতিকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তিনি স্মৃতির যতদূর গতি, ততদূর পর্যন্ত ইচ্ছে করলে যেতে পারেন। 

তখন নারদ আবার বললেন, ভগবান, স্মৃতি অপেক্ষা শ্রেষ্ট কিছু আছে কি ? আচার্য্য বললেন, হ্যাঁ অবশ্য়ই আছে, আর তা হচ্ছে আশা। আশা মানুষের স্মৃতিকে উদ্দীপিত করে থাকে। এবং এই স্মৃতির সাহায্যেই মানুষ মন্ত্র পাঠ  করে থাকে। আশাই মানুষকে স্ত্রী-পুত্রের কামনা করায়, এমনকি ইহলোক-পরলোক সম্পর্কে জানতে উৎসাহ জোগায়। আশাই মানুষকে জাগতিক উন্নতিতে উদ্দমী করে থাকে।  আবার এই আশাই মানুষকে আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের অনুপ্রেরণা দেয়। আশাহীন জীবন জড়।  আশা নেই যার তার এমনকি বেঁচে থাকার ইচ্ছেও থাকে না। আশাই  মানুষকে অতৃপ্তি থেকে তৃপ্তি এনে দেয়। আশাই  মানুষের উন্নতির সোপান।  তাই  হে নারদ তুমি আশাকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করো। আশা দ্বারাই সমস্ত কামনা পূর্ন  হয়। সব প্রার্থনা অমোঘ হয়। যিনি আশাকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তিনি আসার গতি যতদূর, ততদূর তিনি ইচ্ছে করলে যেতে পারেন। 

নারদ জিজ্ঞেস করলেন, হে ভগবান, আশা থেকে শ্রেষ্ট কিছু আছে কি ? আচার্য্যদেব সনৎকুমার বললেন, আশা থেকে প্রাণ শ্রেষ্ঠ। রথের  চাকার শলাকাগুলো যেমন চাকার নাভিতে যুক্ত থাকে, তেমনি সবকিছু এই প্রাণেই নিহিত হয়ে আছে। প্রাণ, একমাত্র প্রাণই নিজস্ব শক্তিতে কাজ করে থাকে। প্রাণই প্রাণকে প্রাণের উদ্দেশ্যে দান করে থাকে। তাই প্রাণই মাতা, প্রায় পিতা, প্রাণই ভ্রাতা, প্রাণই ভগ্নি, প্রাণই আচার্য্য, প্রাণই ব্রহ্মন। আশার  চেয়ে প্রাণ বড়ো। প্রাণ না থাকলে, আশাই বলো, আর স্মৃতিই বলো - কিছুই নেই।  প্রাণই সব কিছুর আশ্রয়। বিশ্বব্রহ্মান্ড জুড়ে প্রাণ শক্তির খেলা চলছে। আমাদের মধ্যেও প্রাণের  এক ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অংশ বিরাজ করছে।  প্রাণের শক্তিতে আমরা সব কাজ করে থাকি। আমরা জানি ব্রহ্ম বাক্য -মনের অতীত। কিন্তু ব্রহ্ম যখন প্রাণের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন, তখনই জগতের খেলা শুরু হয়। শরীরের মধ্যে থেকে প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেলে, শরীরের কোনো অঙ্গ, কোনো ইন্দ্রিয় কাজ করতে পারে না। তেমনি সমষ্টি প্রাণ যদি নিজেকে জগৎ থেকে সরিয়ে নেয়, তবে জগৎ আর চলে না। জগতের সমস্ত কাজ তখন স্তব্ধ হয়ে যায়। এই জগৎ আসলে প্রানেরই প্রকাশ মাত্র। প্রাণ আছে, তাই প্রাণী আছে।  প্রাণই নানানরূপে বিশ্বজুড়ে ক্রীড়ারত। প্রাণ যাকে  ত্যাগ করেছে, বিশ্বভুবন তাকে ত্যাগ করে থাকে।  তাই  প্রাণহীন দেহ একটা পচনশীল বস্তু মাত্র।  তাই প্রাণহীন দেহ তা সে আমার যত  নিকট-জনেরই   হোক না কেন, এমনকি মা, বাবা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-ভ্রাতা-ভগ্নি সবাইকেই আমরা শীঘ্র ত্যাগ করে থাকি। প্রাণই সবকিছু হয়েছে। যিনি জগৎকে এই দৃষ্টিতে দেখেন, যিনি এইভাবে চিন্তা করে থাকেন, যিনি এইভাবে জগৎকে জানেন, তিনিই সর্বশ্রেষ্ট বক্তা হন। 

একজন সিদ্ধ পুরুষ যখন  কথা বলেন, তার প্রতিটি কথাই যথার্থ।  প্রতিটি কথাই অর্থবহ। তার প্রতিটি কথাই সত্য। যিনি সত্যকে জেনেছেন, সত্যকে যিনি অনুভব করেছেন, তার কথাবার্তায়, আচার অনুষ্ঠানে একটা প্রাণের ছোঁয়া পাওয়া যায়।  কারন তিনি প্রাণকে জেনেছেন। আমরা যখন কথা বলি, তখন তা প্রাণহীন।  আমাদের কথা কাকের কা-কা শব্দের মতো শোনায়, ঋষিবাক্য কোকিলের মধুর স্বর। উপনিষদের সত্যদ্রষ্টা ঋষিগণ উদাত্ব কন্ঠে ঘোষণা করছেন : হে অমৃতস্য পুত্র, শোনো, আমি সত্যকে জেনেছি।  যাঁকে   জানলে মৃত্যুকে অতিক্রম যায়।  শোক রোহিত হওয়া যায়, অমৃতের সন্ধান পাওয়া যায়। এই পথই সত্যের পথ। যাইহোক, এর পরের  দিন আমরা শুনবো, সত্যকে জানবার পথের  সন্ধান।  আজ ব্রহ্ম-বাক্যের বিরাম দিলাম। 

ওম  শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম। 

তত্ত্বমসি (ছান্দোগ্য উপনিষদ -ষষ্ঠ অধ্যায় )

ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র বলছেন , তার কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে বলছেন : নাবিক দস্যুদের  ভয়ে, দলবদ্ধ হয়ে যাতায়াত করা  সেকালের প্রথা। কিন্তু গভীর কুয়াশায় আকাশ আবৃত থাকায়, শেষ রাতে নাবিকরা দিক ঠিক রাখতে পারে নি। নৌকা কোথায় যাচ্ছে, তা তারা বুঝতে পারছে না। এদিকে নৌকার যাত্রী  প্রায় সবাই ঘুমিয়ে আছে। জেগে আছে, একজন প্রাচীন, আর এক জন যুবক। প্রাচীন বিষয় চিন্তায় মগ্ন। পচিঁশ বিঘা জমির ধান কাটতে হবে।  মাঝিদের জিজ্ঞেস করলো, আজ  কতদূর যেতে পারবি ? মাঝি বললো, বলতে পারবো না। প্রাচীন চেঁচামেচি জুড়ে দিলো। যুবক বললো, যা জগদীশ্বরের হাতে, তা পণ্ডিতেরাও বলতে পারে না, ওই মূর্খ মাঝি কি করে বলবে ? এই  যুবকের নাম বঙ্কিমচন্দ্র রেখেছেন  নবকুমার।
 তো নৌকা তীরে উপস্থিত হলো, কাঠের অভাবে রান্না হবে না, এতগুলো লোক না খেয়ে থাকবে, ভেবে, অন্য কাউকে না পেয়ে একাকী  নবকুমার সমুদ্রের পাড়ে গভীর জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহ করতে গেলো। এদিকে জোয়ার আসতেই, নবকুমারকে রেখে দিয়েই  নৌকা দেশের উদ্দেশ্যে পারি দিলো। নবকুমার জঙ্গলে নিঃসঙ্গ হয়ে অনিশ্চিত জীবনের পথে পা রাখলো। দেখা হলো, এক ভয়ঙ্কর কাপালিকের সঙ্গে। কাপালিক তাঁকে বলি দেবার  মানসে, আশ্রয় দিলো। এই সময় সে একদিন জঙ্গলের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে পথ হারিয়ে ফেলেছে। কাপালিকের আশ্রম কোনদিকে তা সে বুঝতেপারছে না। আর তার এই অসহায় ক্ষনে, মন যখন পথের  সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, তখন ওই গভীর জঙ্গলের মধ্যে এক অপূর্ব মূর্তি দেখতে পেলো নবকুমার।  অসংলগ্ন রাশীকৃত কেশভার যার সমস্ত অঙ্গ ঢেকে  রেখেছে। যেন  এক অপূর্ব ঝর্ণার শব্দ তার কানে এলো, "পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ ?" নবকুমারের  হৃদয়বিনা বেজে উঠলো। রমনী কন্ঠ সম্ভূত এই স্বর তার হৃদয়তন্ত্রে, বার বার ধ্বনিত হতে লাগলো।পথিক তুমি পথ হারাইয়াছো  ?  এই প্রশ্নের কি অর্থ, কি এর উত্তর হবে কিছুই সে মনে করতে পারলো না। প্রশ্নকর্ত্রী আবার বললেন, "এসো" .নবকুমার নিঃশব্দে কলের পুতুলের মতো সেই শুভ্র মেঘের অনুসরণ করতে লাগলো। এই গল্প আমরা অনেকবার পড়েছি।  আমরা সবাই এই গল্প সবাই জানি। পথ না হারালে, পথের সন্ধানের প্রশ্ন অবান্তর। আমি যে পথ হারিয়েছি, সেটাই আমরা বুঝতে পারি না। তো কে আমাদের পথের  সন্ধান দেবে ?

ঋষি  উদ্দালক পুত্র শ্বেতকেতুকে এমনই একটা গল্প বলেছিলেন। ( ছান্দোগ্য উপনিষদে ৬/১- শ্বেতকেতু নাম অরুণীর এক পুত্র ছিল ) গল্পটি  বলে তাকে বলেছিলেন, বুদ্ধিমান পুরুষ যখন আকস্মিকভাবে পথপ্রদর্শকের উপদেশ পান, এবং তার নির্দেশিত পথে গমন করেন, তখন তার সকল দুঃখ দূর হয়ে যায়, সে তখন অনুভব করে এক মিলনের আনন্দ। উদ্দালক ঋষি বলছেন, এবম এব ইহ আচার্যবান পুরুষো বেদ - এইভাবেই এই সংসারে, যে বুদ্ধিমান পুরুষ ভাগ্যগুনে আচার্যকে লাভ করেন, তিনিই সকল তত্ত্ব জানতে পারেন। আচার্য আমাদের পথ-প্রদর্শক।  আর এঁকে চাইলেই পাওয়া যায় না। আমাদের বহুজন্মের কর্ম্মফল, যাকে আমরা ভাগ্য বলে থাকি, সেই ভাগ্যক্রমে আচার্য লাভ করতেপারি।  আর আচার্য হচ্ছেন, পরম-তত্ত্বজ্ঞ পরম করুনাময় গুরু, তার প্রসাদেই অন্ধজীবগন সাধনার পথে চলে, জ্ঞান  লাভ করে, মোহমুক্ত হয়ে থাকেন। তত্ত্বমসি - তিনিই পরমাত্মা-ব্রহ্ম। হ্যাঁ তিনিই একমাত্র ব্রহ্ম। 

সবকিছুর মধ্যে যা সূক্ষ্মতম তাই সৎ। জগৎ বৈচিত্রে ভরা।  আমরা কাল যা দেখেছিলাম, আজ তা নেই, আজ যা দেখছি, কাল তা থাকবে না। এটাই সত্য। সব বস্তুর যা সার তার কোনো পরিবর্তন হয় না। আর সেই চিরন্তন সত্ত্বাই আমাদের স্বরূপ। তত্ত্বমসি, তুমিই সেই আত্মা - এই হলো বেদান্তের সার কথা। আমরা আজ হয়তো কাউকে একটা নামে  জানি, কাল সে তার না পাল্টে দিতে পারে। যাকে  আমি নান্টু বলে জানতাম, সে এখন মিস্টার নন্দকুমার সিংহ। যাকে  আমি, পাড়ার বকাটে ছেলে বলে জানতাম, সে এখন মন্ত্রী। তাই বেদান্ত বলছে, যাকে  আমি অতীতে সত্য বলে জেনেছিলাম, বর্তমানে তা সত্য নয়। আর আজ যা সত্য ভবিষ্যতে তা সত্য বলে থাকবে না। আর এই নাম ও রূপের থেকেই আমাদের সকল দুঃখের শুরু। আমরা নিজেকে দেহ বলে মনে করি, তাই নিজেকে সকলের থেকে আলাদা বলে মনে হয়।  আমি ব্রাহ্মণ, আমি বিদ্বান , আমি লম্বা, আমি ফর্সা। আমি ভালো, আমি পুরুষ, আমি  শক্তিশালী। বেদান্ত বলছে, ভুলে যাও  এসব। এগুলো আমাদের উপাধি মাত্র ।  ভুলে যায় এই উপাধি, তোমার প্রকৃত স্বরূপকে জানো। 

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় জাতিভেদ প্রথায় বিশ্বাস করতে না।  জাতিভেদকে তিনি ঘৃনাই করতেন। এ নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে তাঁর তর্ক  হতো। বলতেন, দেখো আমি কেমিষ্ট। আমি প্রমান করে দিতে পারি, ব্রাহ্মণের রক্ত ও শূদ্রের রক্তে কোনো তফাৎ নেই।  দুই-ই একই  উপাদানে তৈরি। আর তোমরা কি না বলো "এ ব্রাহ্মণ" "ও শূদ্র" এই ভেদ সত্য নয়, কল্পিত। এখন কথা হচ্ছে, তাহলে সত্য কি ? বেদান্ত বলছে, সত্য হচ্ছে আমরা সবাই এক, শুদ্ধ চৈতন্য। 

এখন শ্বেতকেতু এই কথাটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। তো পিতা তাকে বিভিন্ন উপমার মাধ্যমে বোঝাতে চেষ্টা করছেন।  এইরকম কয়েকটা উপমা আমরা আজ শুনবো। বলছেন, দেখো মৌমাছিরা গাছে-গাছে ঘুরে নানান গাছ থেকে মধু সংগ্রহ করে। বিভিন্ন গাছের রস সংগ্রহ ক'রে, তারা মধু প্রস্তুত করে।  সেই মধুর মধ্যে কোন্ কোন্ গাছের রস আছে, তাকে কি আলাদা করা যায় ? যায় না, আসলে সব রস একত্রে মিশে মধু হয়ে যায়। ঠিক তেমনি জীবাত্মা যখন সৎস্বরূপে মিলিত হয়, তখন সে জানতেও পারে না যে সে আগে আলাদা ছিল। মধুর  মধ্যে এক-এক ফোটা মধু, তারা একে অপরকে বলতে পারে না, যে আমি এই গাছের রস, আর তুমি ওই গাছের রস। আসলে তখন তাদের এই পৃথক অস্তিত্ত্ব বোধই  থাকে না। নানান ফুলের রস মিশ্রিত হয়ে মধুতে পরিণত হয়।  ঠিক তেমনি আমরা অন্তিমে বা প্রারম্ভে আমরা কখনোই আলাদা ছিলাম না।  মাঝে কয়েকদিনের জন্য, আমাদের এই ভেদবুদ্ধি জাগ্রত হয়, যখন আমরা নাম-রূপের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলি। আবার যখন আমরা স্বরূপে মিলিত হই , তখন আমাদের সব ভেদবুদ্ধি চলে যায়। তখন সব এক-অভিন্ন। 

উপনিষ বলছে, যতদিন না অজ্ঞানতা  দূর হচ্ছে, যতদিন না আমাদের আত্মজ্ঞান লাভ হচ্ছে, ততদিন আমাদের পৃথিবীতে বার বার ফিরে ফিরে আসতে  হয়। মৃত্যু যেন আমাদের গভীর নিদ্রায় অর্থাৎ সুসুপ্তিতে মগ্ন হওয়া।  আর  জন্ম গ্রহণ করা মানে আবার ঘুম থেকে  জেগে ওঠা। আমরা বার বার মারা যাই, বারবার জন্ম গ্রহণ করি।  যতদিন না আমাদের আত্মজ্ঞান লাভ হচ্ছে, ততদিন এই চক্র  চলতে থাকে। জ্ঞানলাভ হলেই  এই জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি। তত্ত্বমসি - তুমিই সেই -এই হলো মহাবাক্য। কিন্তু শ্বেতকেতু বুঝতে পারছে না। এবার উদ্দালক আবার আরো একটা উদাহরণ দিচ্ছেন। বলছেন। দেখো দেশে দেশে কত নদী।  তাদের উৎসও ভিন্ন ভিন্ন।  কিন্তু সব নদীই শেষপর্যন্ত সমুদ্রে মিশে যাচ্ছে। তখন আর নদীগুলোর আলাদা অস্তিত্ত্ব থাকে না। গঙ্গা, যমুনা সরস্বতী, গোদাবরী, দামোদর, নর্মদা - তখন সমুদ্র মাত্র। সমুদ্রের একফোটা জল  কি তখন বলতে পারে, এই আমি গঙ্গার জল।  পারে না। ঠিক তেমনি মৃত্যুর পরে, আমরাও সাময়িক ভাবে আমাদের অস্তিত্ত্ব ভুলে যাই। আবার দেখো, এই নদী কোথা থেকে আসে ? সমুদ্রের জল সূর্য্যের তাপে/টানে বাষ্পীভূত হয়ে আকাশে মেঘের আকারে ভাসতে থাকে। একসময় মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে  পৃথিবীতে, ধীরে ধীরে নদীর আকার নেয় , আবার সমুদ্রে গিয়ে মিশে যায়। আমরাও ঠিক  তেমনি শুদ্ধ চৈতন্য থেকে আসি, আবার সেখানেই ফিরে যাই। কিন্তু একথা  আমাদের স্মৃতিতে ধরা থাকে না। আমরা যখন জেগে উঠি তখন আমরা আমাদেরকে আলাদা ভাবতে থাকি, কিন্তু গভীর ঘুমে যখন আচ্ছন্ন থাকি তখন আমরা আমাদের নিজের আলাদা অস্তিত্ত্ব সাময়িক ভাবে ভুলে যাই। কিন্তু আমাদের অস্তিত্ত্ব থাকে, আমারা আমাদের সংস্কার ইত্যাদি নিয়ে  আবার জীবদেহ ধারন করি। কিন্তু শ্বেতকেতু এসব কিছু ধারণা করতে পারছে না। তাই উদ্দালক আবার তাকে একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছেন।  
 বলছেন, ধরো একটা বিশাল বটগাছকে কেউ আঘাত করলো, গাছটা তখন, বেঁচে থাকবে, কিন্তু আঘাতপ্রাপ্ত স্থান থেকে রস ক্ষরণ হতে থাকবে। কিন্তু জীবাত্মা যখন কোনো ডালকে ত্যাগ করে, তখন সেই শাখাটি শুকিয়ে যায়। জীবাত্মা যখন সমগ্র গাছটিকে ত্যাগ করে, তখন গাছটি শুকিয়ে যায়। অর্থাৎ উপনিষদ বলছে, জীবাত্মার শরীর  ত্যাগই তার মৃত্যুর কারন। শরীরের মৃত্যু মানে জীবাত্মার মৃত্যু নয়। অর্থাৎ জীবাত্মা যখন শরীর ত্যাগ করে, তখনই জীবের মৃত্যু হয়। আমরা যেমন আমাদের বাসস্থান ছেড়ে যাই, তখন বাড়িটা শূন্য পড়ে থাকে, কোনো কাজে লাগে না। ঠিক তেমনি আত্মা  দেহ ছেড়ে গেলে, দেহটা শূন্য ও অকেজো হয়ে যায়। ঋষি উদ্দালক বলছেন, জীবাত্মা দেহ ছেড়ে গেলে, দেহ তার মূল ভূতে ফিরে যায়। অর্থাৎ  আত্মা  যেন আঠা বা সিমেন্টের মতো, ভূতগুলোকে একত্রিত করে রেখেছিলো, যখন এই সিমেন্টরূপ আত্মা দেহকে ছেড়ে গেলো, তখন ইট খসে পড়তে লাগলো।  কিন্তু জীবাত্মা মরে  না। এইযে সূক্ষ্মতম বস্তু, এটাই সমস্ত জগতের আত্মা। ধরো একটা কাজ অসমাপ্ত রেখে তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো।  ঘুম ভাঙার পরে, তোমার সেই কাজটার কথা মনে পড়বে, আর কাজটা যেখানে শেষ করেছিলে, সেখান থেকে আবার শুরু করবে। জীব বার বার জন্মায়, তার কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য, কিন্তু আত্মা অবিকারী, আত্মার কোনো পরিবর্তন  নেই।

উদ্দালক বললেন, এই বটগাছ থেকে একটা ফল নিয়ে এসো, এটাকে ভাঙ, কি দেখতে পাচ্ছো ? শ্বেতকেতু বলছেন, অনুর মতো বীজ, পিতা বললেন, এটাকেও ভাঙো।  কি দেখতে পাচ্ছো ? শ্বেতকেতু বললো, কিছুই না। উদ্দালক বলছেন, হে পুত্র, এই যে বীজের সূক্ষ্ম অংশটাকে তুমি দেখতে পাচ্ছ না, কিন্তু এই সূক্ষ্ম অংশেই আছে, বিশাল বটগাছটা। তুমি আমার কথায়, বিশ্বাস করো, তুমি আমার কথায় শ্রদ্ধাবান হও। আসলে এই শ্রদ্ধাবান হওয়াটাই বড় কথা। আচার্য্যর কথাগুলো প্রথমে তোমার উপল্বদ্ধিতে আসবে না, কিন্তু যদি তাঁর কথায় তুমি বিশ্বাস করো, এবং এ বিষয়ে গভীর ধ্যান দিতে পারো, তবে ধীরে ধীরে, তোমার মধ্যেও আচার্য্যের কথার সত্যতা ফুটে উঠবে। অর্থাৎ তুমি যদি আন্তরিক  হও, নিজের চঞ্চল মনকে যদি, স্থির করে লক্ষের  দিকে ধাবিত করতে পারো, তবে তোমার কাছে, সত্য ধরা পড়বে। আর যদি, চঞ্চল ছেলের মতো, মনটাকে বিক্ষিপ্ত করে রাখো, তবে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে পারবে না। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন, আমাদের মনটা যেন সর্ষের একটা পুটলি, আর তা থেকে সর্ষেগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। এই সর্ষেরূপ মনটাকে গুটিয়ে এনে আত্মায় একাগ্র করতে হবে। সব কিছুর মধ্যে যা সূক্ষ্মতম তাই জগতের আত্মা। আর তোমার মধ্যেও যা সূক্ষতম তাই তুমি, তুমিই সেই আত্মা। 

এই বটগাছের উদাহরণ দিয়ে আত্মাকে বোঝাচ্ছেন, ঋষি উদ্দালক। হাজার হাজার বছর লেখা এই উপল্বদ্ধির কথা। আমার ভাবতে অবাক লাগে, তখন কি মানুষ জানতো যে গাছেরও প্রাণ আছে ? গাছেরও আত্মা বলে একটা কিছু আছে। ঋষি উদ্দালক বলছেন, বীজ থেকে যেমন বটগাছ, আত্মা থেকে তেমনি এই জগৎ।  কিন্তু এই কথা থেকে শ্বেতকেতুর মধ্যে স্পষ্ট কোনো ধারণা জন্মালো  না। তাই আবার বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে  বললেন। 

আসলে এই ব্যাখ্যাই চিরকাল চলে এসেছে,  এই বিচার বিদ্যাই শাস্ত্র আমাদের শোনায়। কিন্তু উপলব্ধি তো আমাদের নিজেদেরকে করতে হবে। আর তার জন্য দরকার যোগ। যতক্ষন আমরা যোগে প্রবৃত্ত না হচ্ছি, ততক্ষন আমরা সত্যে উপনীত হতে পারবো না। আর আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে, ধ্যান কাউকে শেখানো যায় না। ধ্যান ভিতর থেকে হয়, ধ্যান ঈশ্বরের কৃপায় হয়।

ঋষি উদ্দালক আবার বোঝাতে লাগলেন, একখন্ড লবনের টুকরো দিয়ে বললেন, এটি জলে রেখে দাও।  শ্বেতকেতু তাই করলেন।  সকালে, বললেন, ওই জলপাত্র নিয়ে এসো।  দেখো, লবন খণ্ডটি জলে মিশে গেছে। জলের উপর থেকে পান করো, কেমন লাগছে, লবনাক্ত। এর মাঝখান থেকে পান করো, কেমন লাগছে, লবনাক্ত।  নিচ থেকে পান করো, কেমন লাগছে, লবনাক্ত। আসলে লবন জলের সর্বত্র রয়েছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে না।  ঠিক তেমনি, আত্মা আমাদের দেহের সর্বত্র রয়েছেন, কিন্তু আমরা তাকে দেখতে পাচ্ছি না। তার মানে এই নয়, যে আত্মা নেই। আর সত্য হচ্ছে, লবন দৃষ্টিগোচর না হলেও, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য।  তাই তুমি জলের মধ্যে এর স্বাদ নিতে পেরেছো।  কিন্তু আত্মা আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। এমনকি মন দিয়েও তাকে ধরা যায় না। কারন আত্মা অতি সূক্ষ্ম। তাই আত্মাকে জানতে হলে এই আপেক্ষিক জগতের উর্দ্ধে উঠতে হবে। এই আপেক্ষিক জগতের উর্দ্ধে উঠতে গেলে আমাদের যোগে নিবিষ্ট হতে হবে। এর পরের দিন আমরা রাজযোগের ৫ম পর্ব্বের কথা শুনবো। যোগের মাধ্যমে, আমাদের সজ্ঞাকে তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর করতে হবে। তবেই আমরা আত্মাকে জানতে পারবো। আর এই পথ দেখাতে পারে, একমাত্র যোগাচার্য্যগন । তুমি যোগাচার্য্যের শরণ  নাও। একমাত্র যোগ্য গুরুই এই পথ দেখাতে পারে। কর্ম্ম বন্ধন  থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। তবে সহজে এই কর্ম্ম বন্ধন যায় না। ধনুক থেকে তীর বেরিয়ে গেলে তাকে আর ফেরানো যায় না। করাত দিয়ে গাছ কাটলেও গাছ ভুলুন্ঠিত হয় না, যতক্ষন না বাতাস তাকে নাড়া  দিচ্ছে। তেমনি জ্ঞান লাভ করো, কিন্তু ভেবোনা, জ্ঞান লাভ করলেই মুক্তি হবে, যতক্ষন না তোমার প্রারব্ধ কর্ম্ম নিঃশেষ হচ্ছে, ততক্ষন তোমাকে দেহেই বিচরণ করতে হবে । আর প্রারব্ধ ভোগ করতে হবে। জ্ঞানী ব্যক্তির একসময় এই প্রারব্ধ কর্ম্মবন্ধন শেষ হয়, এবং মুক্তি লাভ করে থাকেন। তুমি জ্ঞানী হও তবেই  তুমি মুক্তি পাবে। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  
        

মাণ্ডূক্য উপনিষদ 
ব্রহ্মের চার অবস্থা। 
আমরা শুনেছি, পরমাত্মা সর্বত্র। কিন্তু সত্যি সত্যি আমরা কি তা অনুভব করতে পারি ? পারি না। আত্মা যদি সর্বত্র তবে তাকে আমরা দেখতে পাই না কে ? আপনি বলবেন, তাঁকে এই চর্ম  চক্ষু দিয়ে দেখা যায় না। তো যাঁকে  চর্মচক্ষু দিয়ে দেখতে পাই না, যাঁকে অনুভব করতে পারি না, তা যে আছে, এই বিশ্বাস আমাদের হবে কি করে। আমরা অনেক সূক্ষ্মবস্তু বা গুন্ দেখতে পাই না কিন্তু অনুভব করি, যেমন বাতাস, আকাশ। ভালোবাসা, রাগ দ্বেষ, এগুলো আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু আমরা অনুভব করি।  কেউ কেউ  বলেন,  জীবের মধ্যেই একমাত্র আত্মা বা পরমাত্মা অবস্থান করেন। তাহলে আমরা পাথরের শিলাকে ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা করি কেন ? আর যদি জীবের মধ্যেই শুধু ঈশ্বর থাকেন তবে ঈশ্বর সর্বত্র এই কথা সত্য হয় কি ভাবে ?
এসব প্রশ্ন চিরকালীন। আজ আমরা এইসব প্রশ্নের জবাব খুঁজবো। এইসব প্রশ্নের জবাব আছে,  মাণ্ডূক্য উপনিষদে। আলোচনার শুরুতে আমরা মঙ্গলাচরণ করে নেই, অর্থাৎ প্রার্থনা দিয়ে শুরু করি।  

মঙ্গলাচরণ 

ওং ভদ্রং কর্নেভিঃ শৃনুয়াম দেবা 
ভদ্রং পশ্যেম অক্ষভিঃ যজত্রাঃ। 
স্থিরৈঃ অঙ্গৈঃ  তুষ্টুব্যাংসঃ  তনূভিঃ
ব্য়শেম দেবহিতং যদায়ুঃ।।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।

হে দেবগন আমরা যেন যা কিছু ভালো, তাই কান দিয়ে শুনি, চোখ দিয়ে যেন ভালো কিছু দেখি। প্রার্থনা করি, আমাদের আয়ু যেন তোমাদের ইচ্ছে মতো হয়, তার বেশি বা কম না হয়। আমাদের ত্রিবিধ শান্তি হোক।

আমরা মাণ্ডূক্য উপনিষদ-এর মধ্যে প্রবেশ করবো, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, আমাদের শরীর  মন যেন  সুস্থ  থাকে। আমরা যেন উপনিষদের বাণীর যথার্থ অর্থ বুঝতে সক্ষম হই। 

মাণ্ডূক্য উপনিষদ আসলে অথর্ব বেদের অন্তর্গত। এখানে মাত্র বারোটি শ্লোক আছে। এর মধ্যে আজ আমরা প্রথম দুটো শ্লোকের গভীরে প্রবেশ করবো। 
এখানে ওং (অউম) এই প্রতীকের সাহায্যে ব্রহ্মকে তুলে ধরা হয়েছে। ওম এর যেমন তিনটি ভাগ অ,উ,ম,  আর সব মিলিয়ে ওম। জীবের তেমনি তিনটি অবস্থা হচ্ছে, জাগ্রত-স্বপ্ন-সুষুপ্তি এবং সবশেষে তুরীয়। অর্থাৎ সমস্ত জগৎ ব্রহ্ম। আর ব্রহ্মেরও  চারটি অবস্থা।

মন্দিরে  পাথরের শিবলিঙ্গ আছে, নারায়ণ শিলা আছে।  এগুলোর পুজো হয়। আপনি কি মনে করেন, পূজারী এগুলোকে পাথর জ্ঞানে  পূজা করেন ? না, তিনি এই পাথরের আড়ালে তার আরাধ্য দেবতাকেই পূজা করেন। এই পাথরগুলো তার কাছে প্রতীক। ঈশ্বর যেহেতু সর্বত্র রয়েছেন, এবং তিনিই সবকিছু হয়েছেন, সেই হেতু যে-কোনো কিছুই ঈশ্বরের প্রতীক হতে পারে।  মাণ্ডূক্য উপনিষদ এই ওম বা অউম-কে ব্রহ্মের উপযুক্ত প্রতীক হিসেবে মনে করেছে। 

এখন কথা হচ্ছে, সবকিছু ছেড়ে, এই অউম-কে  প্রতীক হিসেবে ধরা হলো কেন ? 

আসলে সবকিছুই যদি ব্রহ্মের অন্তর্গত হয়, তবে সমগ্র ধ্বনিও ব্রহ্মের অন্তর্গত। উপনিষদ বলছে কার্য্য ও কারন উভয়ই ব্রহ্ম। এই দৃশ্যমান জগৎ হচ্ছে, ওম। যা কিছু অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই ওঙ্কার। ত্রিকালের অতীত যদি কিছু থেকে থাকে তাও ওঙ্কার। ওম পবিত্রতার প্রতীক। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ সবাই ওঁকারকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ওঙ্কারকে বলা হয়ে থাকে নাদব্রহ্ম বা শব্দব্রহ্ম। সমগ্র ধ্বনিজগৎ এই ওঙ্কারের অন্তর্গত। অ বর্ণ প্রধান স্বর, এটি নির্গত হয় গলদেশের পশ্চাৎ ভাগ থেকে। উ হচ্ছে মধ্যস্বর, এটি উচ্চারিত হয় ঠোঁট খোলা অথচ চঞ্চুর মতো  করে, ম হচ্ছে অন্ত স্বর, এটি ওষ্ঠ বর্ণ, আর উচ্চারিত হয় ঠোঁট বন্ধ করে। অর্থাৎ আমরা যখন কথা বলি, তখন মুখ-গহ্বর-এর যে যে অংশ বিভিন্ন শব্দ উচ্চারণ করতে কাজে লাগে, তার সমস্ত কিছু স্পর্শ করে এই ওঙ্কার।  

ব্রহ্ম হচ্ছেন অক্ষর অর্থাৎ যার ক্ষয় নেই, বিনাশ নেই। এই ব্রহ্মই বিভিন্নরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। এই প্রকাশের প্রকারভেদ আছে, জন্ম-মৃত্যু আছে, সৃষ্টি-বিনাশ আছে। কিন্তু ব্রহ্ম ব্রহ্মই থাকেন। ওম-এর মধ্যেই আছে ত্রিকাল, অর্থাৎ অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। তবে এইযে ত্রিকাল বলছি বটে আমরা, কিন্তু কালের কোনো ভাগ হয় না। আমরা বুঝবার জন্য, এই কালের ত্রিবিধ অবস্থার কথা বলেছি মাত্র । কিন্তু কাল চিরন্তন, কালের কোনো ক্ষয় নেই, কোনো সংযোজন নেই।  কাল একটা ধারা যা চির-বহমান। তেমনি ঈশ্বর বা ব্রহ্ম হচ্ছেন, দেশ-কালের অতীত একটা অবস্থা মাত্র। এই অবস্থা গুলোর পরিবর্তন হয়, কিন্তু ব্রহ্ম সত্বার কোনো পরিবর্তন হয় না। 

উপনিষদ বলছে, সর্বং হি এতৎ ব্রহ্ম, অর্থাৎ এইসবই ব্রহ্ম। ব্রহ্ম ছাড়া কিছু নেই। তা সে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হোক, বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য না হোক, স্থুল হোক বা সূক্ষ্ম হোক, গোচর হোক বা অগোচর হোক, জ্ঞাত হোক বা অজ্ঞাত  হোক, সবই ব্রহ্ম। আর এই ব্রহ্ম চতুষ্পাৎ। অর্থাৎ এই ব্রহ্মের চারটি অবস্থা। একই ব্রহ্মকে চার অবস্থায় দেখা যায়।
 প্রথম অবস্থা পরিদৃশ্যমান জগৎ। অর্থাৎ আমরা যা কিছু দেখছি,শুনছি, আস্বাদন করছি, সবই ব্রহ্মের প্রথমবস্থা। স্থুল  জাগতিক অবস্থা। আমরা যখন জেগে থাকি, তখন আমরা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে এই জগৎকে প্রতক্ষ্য করে থাকি। ঘুমিয়ে থাকলে এই দৃশ্যমান জগৎ আমাদের কাছে অদৃশ্য হয়ে যায়।  কিন্তু স্থুল জগৎ তখনও থাকে। 
 কিন্তু ঘুমের মধ্যে আমরা এই দৃশ্যমান জগতের মতোই আর একটা জগৎ দেখতে পাই, এটি আমরা মনের দ্বারা উপলব্ধি করে থাকি। ব্রহ্মের এই অবস্থাকে বলা হয়ে থাকে তৈজস। তৈজস কথাটার মানে হচ্ছে তেজবিকার। সূক্ষ্ম শরীরে উপস্থিত চৈতন্যের দ্বারা আমরা এটাকে অনুভব বা দেখতে পারি। আমাদের মানসিক জগতের কার্যকলাপ এই চৈতন্য প্রভাবে আমাদের কাছে  দৃষ্টিগোচর হয়। এটি আমাদের স্বপ্নাবস্থা।
এর পরবর্তী অবস্থা হলো সুষুপ্তি অর্থাৎ গভীর নিদ্রার অবস্থা। এই অখন্ড চৈতন্য অবস্থাকে বলা হয় প্রাজ্ঞ। প্রাজ্ঞ কথাটা মানে হচ্ছে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। কারন শরীরে উপস্থিত চৈতন্যে এই প্রাজ্ঞ অনুভূত হয়। সুসুপ্তির অবস্থায় যখন আমরা কারন শরীরে উপস্থিত থাকি, তখন অন্যান্য জ্ঞান সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ হয়ে যাই। কেবলমাত্র সুখানুভব করতে সমর্থ থাকি। এই অবস্থাকেই বলা হয় প্রাজ্ঞ। এই অবস্থা থেকে অর্থাৎসুষুপ্তি ভাঙার পরে, আমরা  কারন শরীরে থেকে,  আবার স্থূল শরীরে চলে আসি আমরা তখন খুব সতেজ  অনুভব করি। এই সুসুপ্তির অবস্থায়, আমরা যেন ঘন অন্ধকারে একটা বৈচিত্রহীন জগতে বাস করি। 
এর পরে আছে, তুরীয় অবস্থা। এই অবস্থায় আমরা চৈতন্যের সাথে এক হয়ে যাই। তখন আমরা ব্রহ্মের সাথে একাত্মতা অনুভব করি। এটি আসলে সমাধির  অবস্থা বিশেষ। মায়ার অতীত চতুর্থ অবস্থা। কথায় বলে, ক্ষীরোদ সাগরশায়ী কৃষ্ণ দর্শনে আছে মায়াগন্ধ, / তুরীয় কৃষ্ণতে নাহি মায়ার সন্মন্ধ। তো তুরীয় অবস্থা মায়ার অতীত একটা অনির্বচনীয় অবস্থা।    

উপনিষদে ব্রহ্মের এই চার অবস্থার কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু এই অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কি জীব বা জীবাত্মার কোনো পরিবর্তন হয় ? হয় না। সেই একই জীব, কখনো জেগে আছে, কখনো স্বপ্ন দেখছে, কখনো সুসুপ্তিতে আছে, আবার কখনো সমাধি অবস্থায় ব্রহ্মের সাথে এক হয়ে আছে। তাই জীবের বা জীবাত্মার যেমন চার অবস্থা, ব্রহ্মেরও  চার অবস্থা। উপনিষদ  বলছে এই এইযে জীব বা জীবাত্মা আর ব্রহ্ম বা পরমাত্মা এক ও অভিন্ন একটা ব্যষ্টি  আর একটা সমষ্টি। ব্রহ্মের মধ্যেই জগৎ। দৃশ্যমান জগৎ, এমনকি অদৃশ্যমান জগৎ, স্থুল  জগৎ আর সূক্ষ্ম জগৎ সবই ব্রহ্মময়।  ব্রহ্ম ভিন্ন কিছু নেই। অয়ম আত্মা ব্রহ্ম, এই আত্মাই ব্রহ্ম।  আমরা সবাই ব্রহ্ম বই কিছু নোই।  

আমাদের এই মাণ্ডূক্য উপনিষদ  কথা পরবর্তীতে আবার আমরা শুনবো।  আজ শব্দব্রহ্মের বিরাম দিলাম। 
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।

ওং ভদ্রং কর্নেভিঃ শৃনুয়াম দেবা 
ভদ্রং পশ্যেম অক্ষভিঃ যজত্রাঃ। 
স্থিরৈঃ অঙ্গৈঃ  তুষ্টুব্যাংসঃ  তনূভিঃ
ব্য়শেম দেবহিতং যদায়ুঃ।।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।

আমরা শুনছিলাম, মাণ্ডূক্য উপনিষদ কথা। এর আগের দিন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্লোক শুনেছিলাম।  আজ আমরা শুনবো তিন থেকে পাঁচতম  শ্লোক পর্যন্ত।  আমরা শুনেছিলাম, ব্রহ্মের চার অবস্থা। এর মধ্যে প্রথম অবস্থা হচ্ছে জাগ্রত অবস্থা। এই অবস্থায় আমরা বহির্জগৎ সম্পর্কে সচেতন থাকি। আর এই স্থূল জগৎকেই আমরা উপভোগ করে থাকি। তাই এই অবস্থায় আমরা স্থুলভূক। আর এই ভোগ হয়  আমাদের দেহ ও ইন্দ্রিয় দ্বারা। আমাদের দেহের  অঙ্গগুলো হলো  মাথা, চোখ, নাক, হাত, পা, মূত্রাশয়।  প্রথম হচ্ছে পাঁচটি জ্ঞানীন্দ্রিয়, পাঁচটি কর্ম্ম-ইন্দ্রিয়, এছাড়া আছে পঞ্চপ্রাণ। এগুলোর সঙ্গে আছে মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার। এগুলো সব আমরা জানি। এখানে একটা কথা বলা হচ্ছে, যে আমরা স্থুলভূক। অর্থাৎ এই সময় আমরা স্থূল বস্তুর ভোগ করে থাকি।

মহাত্মাগণ বলে থাকেন, ঈশ্বরকে বুদ্ধি দিয়ে, যুক্তিতর্ক দিয়ে বোঝা যায় না। এমনকি এই অব্যয় অক্ষয় শক্তিকে ভাষা দিয়ে  প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু মাণ্ডূক্য উপনিষদ এর রচনাকার এই অসাধ্য সাধানটি করেছেন । ঈশ্বরকে যে যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায়, তা এই উপনিষদ না পড়লে বোঝা যাবে না। মাত্র বারোটি শ্লোকে এই অমর কীর্তি রেখে গেছেন। আর আশ্চর্য্য হচ্ছে, আচার্য্য শঙ্করের গুরু গোবিন্দপাদের গুরু গৌড়পাদ এই ১২টি শ্লোকের  ব্যাখ্যা করতে দুশো শ্লোকের অবতারণা করেছেন। শঙ্করাচার্য্যও এই মাণ্ডূক্য উপনিষদএর  ব্যাখ্যা করেছেন। 
আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ধারণা হচ্ছে।  ব্রহ্ম, ঈশ্বর, ভগবান একই কথা। আর এই ভগবানের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, একমাত্র মানুষের হৃদয়ে। আর সব আমাদের কল্পনা। অর্থাৎ পাহাড়ের পাথরে, মন্দিরে, গির্জায়, বা কোনো পূজাস্থানে অর্থাৎ নির্জীব পদার্থে ঈশ্বরের কোনো অস্তিত্ত্ব থাকতে  পারে না। আসলে ভাগবত জ্ঞান যার হয়েছে, তিনি ভগবন।  আর এই ভগবন এর বহুবচন  হচ্ছে ভগবান অর্থাৎ যেসব মহান আত্মার প্রতক্ষ্য ভাগবৎ জ্ঞান হয়েছে, তাঁরাই ভগবান। পরমাত্মা যখন মায়ার বা প্রকৃতির সাহায্যে নিজেকে সৃষ্টি করেন, অর্থাৎ   ব্রহ্ম যখন ক্রিয়ারত হন, তখন তাকে বলা হয় ঈশ্বর। এটা ব্রহ্মার উপাধি বিশেষ। ঈশ কথাটার অর্থ আধিপত্য করা। ঐশর্য্য বিশিষ্ট সগুন ব্রহ্মের নাম হচ্ছে ঈশ্বর। তাই ঈশ্বরকে বলা হয়েছে, সর্বশক্তিমান। কিন্তু বিশ্বশক্তি  যখন নিষ্ক্রিয় তখন তিনি ব্রহ্ম। অর্থাৎ গুণাতীত বিশ্বশক্তি ব্রহ্ম।
ব্রহ্মের যে অংশ  সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়- এর  কর্তা তিনিই ঈশ্বর। মায়ার আধার হচ্ছে চৈতন্য। ব্রহ্মাদি এই সৃষ্টিশক্তির গুনবিশেষ থেকে উৎপন্ন। ব্রহ্ম আর ব্রহ্মা এক কথা নয়, ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয় কিন্তু ব্রহ্মা অসংখ্য।         
 
আমরা শুনেছি, জীব বা জীবাত্মা হচ্ছে ব্যষ্টি আর পরমাত্মা হচ্ছেন সমষ্টি। ব্যষ্টি হচ্ছে স্থুল বস্তু বা শরীর, আর সমষ্টি হচ্ছে সব মিলিয়ে এক ও অভিন্ন। বেদান্ত বলছে, সমগ্র জগতে একটা মাত্র সত্ত্বাই বিরাজ করছে, এগুলোই বিভিন্ন নাম, বিভিন্ন রূপে দেখতে পাচ্ছি। এবং বিভিন্ন নাম ও বিভিন্ন রূপ হবার জন্য, আমরা এদের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করছি, আসলে এই পার্থক্য হচ্ছে আপেক্ষিক। আমরা যে সমগ্র জগতের সঙ্গে এক, এই ধারণা করা আমাদের পক্ষে মুশকিল। আমরা কেউ ভাবি এই শরীরটা আমি, আবার মহাত্মাগণ বলছেন, আমি শরীর  নোই, আমি জীব আত্মা।  কিন্তু উপনিষদ বলছে, তুমি জীব আত্মা নও, তুমি পরমাত্মা। এই সত্যকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করো। আমাদের শরীর কতকগুলো অঙ্গের সমষ্টিমাত্র। আবার এই অঙ্গগুলোর মধ্যে যেমন আছে,রক্ত-রস, তেমনি আছে অসংখ্য কৃমিকীট, আছে অসংখ্য কোষ, এদেরও সবার প্রাণ আছে । এইসবে কিছুর  সমষ্টি এই দেহ, যাকে  আমরা "আমি" বলে চিনি। অঙ্গগুলোকে আলাদা করে, আমি ভাবি না। তখন অঙ্গগুলো আমার হয়ে যায়। অর্থাৎ আমার হাত, আমার পা, আমার মাথা, ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠিক তেমনি উপনিষদ বলছে, এই বিশ্বটি হচ্ছে একটা বিরাট পুরুষদেহ। এখানে সূর্য তার চোখ, বায়ু তার প্রাণ, জলরাশি হচ্ছে মূত্রাশয়, পৃথিবী তার পা, অগ্নি তার মুখ।  ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই উপনিষদ বলছে,  এই জগৎ একটা অখণ্ড সত্ত্বা।  আর একেই বলছে পরমাত্মা।

 এখন কথা হচ্ছে, আমরা এই বাইরের জগৎকে দেখতে পাই অর্থাৎ দৃশ্য, আর যে দেখতে পায় অর্থাৎ দ্রষ্টা, অর্থাৎ দৃশ্য ও দ্রষ্টাকে তো  পৃথক বলেই মনে হয় । এটা কেন হয় ? মহাত্মাগণ বার বার জোর দিয়ে বলছে, আমরা যে জগৎকে দেখছি, তার কোনো পৃথক সত্ত্বা নেই। পরমাত্মা আছেন বলেই এইসব পৃথক সত্ত্বা উপলব্ধ হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে পরমাত্মা। আর জগৎ-প্রপঞ্চ হচ্ছে পঞ্চভূতের সমাবেশ।  এই পঞ্চভূতের পরিমানের পার্থ্যক্যের জন্য, বিভিন্ন রূপ বিভিন্ন আকারের রূপ দৃশ্যমান হচ্ছে। যখন এই পঞ্চভূত তার মূল উৎসে বা মূল অবস্থায় ফিরে যাবে, তখন একাত্ত্বতা অনুভূত হয়। এটাই অদ্বৈত তত্ত্ব। যা উপনিষদের বাণী।  আমরা ধীরে ধীরে এই ব্যাপারটাকে ভালো ভাবে বুঝবার চেষ্টা করবো। 

এখন ধরুন, আমরা বিশ্বাস করেছি, যে  জীবজগৎ বা জগৎ পঞ্চভূতের সমষ্টি। এখন ধরুন কোনো কারনে এই পঞ্চভূত  তার মূল উৎসে  ফিরে গেল, তবে কি থাকবে, এই দৃশ্যমান জগৎ আর থাকবে না। থাকবে একমাত্র ব্রহ্ম। এখন কথা হচ্ছে তাহলে কি পঞ্চভূতের সমষ্টি ব্রহ্ম ? আসলে পঞ্চভূত হচ্ছে প্রকৃতি, বিরাট  পুরুষ এই পঞ্চভূতের সাহায্যে অর্থাৎ প্রকৃতির সাহায্যে ক্রিয়া করে থাকেন। অর্থাৎ সৃষ্টি করে থাকেন। এখন কথা হচ্ছে  শিশু আর শিশুর  খেলনা এক জিনিস নয়। শিকারী  আর শিকারীর  অস্ত্র এক জিনিস নয়। এগুলো তার অর্থাৎ ব্রহ্মের  অলঙ্কার বা গুন্। এই অলংকারগুলো ব্রহ্ম বা পরমাত্মা নন। এগুলো তার সৃষ্টি কার্য্যের সহায়ক মাত্র। আমাদের একটা ধারণা হচ্ছে, ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, ঈশ্বর দয়ালু। এগুলো আসলে আমাদের দ্বারা আরোপিত। আমরা যখন একজন সর্ব্বশক্তিমানকে খুঁজি, আমরা যখন একজন দয়ালুকে খুঁজি, তখন সর্বশক্তিমান হাজির হন, একজন দয়ালু হাজির হন আমাদের কাছে ঈশ্বর নামে। আসলে ব্রহ্ম নির্বিশেষ, অখন্ড।  ব্রহ্মের কোনো বিশেষত্ত্ব নেই। ব্রহ্মের কোনো আধার নেই। ব্রহ্মই সব কিছুর আধার। ব্রহ্ম আছেন বলেই সবকিছু আছে। সবকিছুই ব্রহ্ম, তাই ব্রহ্মকে আলাদা করা যায় না। 

নির্গুণ ব্রহ্মের মধ্যে যখন মায়ার প্রকাশ ঘটে তখন তা হলো ঈশ্বর। এখন কথা হচ্ছে, কথা থেকে আসে এই মায়া ? মায়া ব্রহ্মের ভিতরেই আছেন। এটি তার শক্তি।  আগুন ও তার দাহিকা শক্তি, জলের যেমন আদ্রতা, বাতাসের যেমন গতি, এই শক্তি থেকে মূল বস্তুকে আলাদা করা যায় না। এই শক্তিভিন্ন ব্রহ্ম নিষ্ক্রিয়। আচার্য্য শঙ্কর নদীতে স্নান করতে যাবেন, ঘটে মৃত স্বামীর দেহকে রেখে স্ত্রী বিলাপ করছে। আচার্য্য শঙ্কর মৃত দেহকে সরে যেতে বললেন। স্ত্রী বললেন, ও কি করে সরবে, ওর দেহে সেই শক্তি নেই। তো শক্তি বিহীন দেহ যেমন কোনো ক্রিয়া করতে পারে না। ঠিক তেমনি মায়া  বিহীন বা প্রকৃতি ছাড়া ব্রহ্ম নিষ্ক্রিয়। উপনিষদ বলছে এই সক্রিয় ব্রহ্ম হচ্ছেন, ঈশ্বর। যার ঐশর্য্য আছে তিনি ঈশ্বর। ব্রহ্ম এবং আমাদের ঈশ্বরের মধ্যে এখানে পার্থক্য। উপনিষদ মায়াযুক্ত ব্রহ্মকে বলছেন ঈশ্বর। অর্থাৎ সক্রিয় ব্রহ্ম। 

আমরা হিরণ্যগর্ভ-এর কথা শুনেছি। হিরণ্যগর্ভ হচ্ছে প্রথম প্রকাশ, যেখানে জগৎ সূক্ষ্মরূপে ছিল। তখন সেখানে আমরা অর্থাৎ সমস্ত জীব জগৎ সূক্ষ্ম অবস্থায় ছিলাম। এই হিরণ্যগর্ভকেই উপনিষদে বিরাট পুরুষ হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। আমরা ক্রমবিকাশের তত্ত্ব শুনেছি। সেখানে সূক্ষ্ম থেকে কিভাবে স্থুল  বিকাশ ঘটলো, সেটা শুনেছি, মাণ্ডূক্য উপনিষদ এই তত্ত্বকেই উল্টো দিক থেকে শোনাচ্ছেন, অর্থাৎ স্থুল  থেকে সূক্ষ্মের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের।জীবাত্মা ধীরে ধীরে ব্রহ্মে দিকে ধাবিত হচ্ছে, এবং শেষে ব্রহ্মে লিন হচ্ছে। অর্থাৎ ব্রহ্মের প্রথম অবস্থা হচ্ছে এই জড়জগৎ। যা আমরা জাগ্রত অবস্থায় দেখে থাকি। জেগে না থাকলে আমরা দেখতে পাই না। অর্থাৎ আমাদের মতো ব্যষ্টির কাছে বিশ্বজগৎ হচ্ছে ব্রহ্মের প্রথম অবস্থা  । 

এর পরের অবস্থা হচ্ছে তৈজস। আমরা যখন স্বপ্ন দেখি, তখন আমরা যা কিছু করি,বা দেখি  তা থাকে আমাদের মনে। স্বপ্ন কোনো বাহ্য বিষয় নয়। এটা পুরোপুরি আমাদের মনের ব্যাপার। আমরা জাগ্রত অবস্থায় যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে থাকি, যাকিছু বাসনা করে থাকি, তারই ফল স্বরূপ এই স্বপ্ন আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়। জাগ্রত অবস্থার মতো স্বপ্নে আমাদের সমস্ত অঙ্গ ও ইন্দ্রিগুলো যেখানে যেমন তেমনই থাকে, কিন্তু আমরা স্বপ্নে যে কাজ করে থাকি বা দেখি সবই আমাদের মনের দ্বারা হয়ে থাকে। এই অবস্থায় আমাদের সঙ্গে বাইরের জগতের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক থাকে না। এই আমাদের মানস অভজ্ঞতা এর অধিপতি হলেন দ্বিতীয় ব্রহ্ম। অর্থাৎ জাগ্রত অবস্থায় চেতন মন কাজ করতো, এখন আমাদের অবচেতন মন কাজ করছে। এই সময় আমাদের জ্ঞান হয় অন্তর্মুখী। এইসময় আমরা যাকিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি, সবই মনের সৃষ্টি। স্বপ্নে আমরা দেখি, শুনি, চলাফেরা করি, এমনকি খাওয়া দাওয়া করি, কিন্তু এসবই আমাদের মনের কল্পনা। এইসময় আমাদের যে সক্রিয়তা তা কোনো বাহ্যবস্তু দ্বারা প্রভাবিত হয় না। আমরা যখন কাজ করি, তা সে শারীরিক ভাবে হোক বা মানসিক ভাবে হোক, চিত্তে  তার একটা ছাপ পড়ে। চিত্তের  উপরে যেন একটা ছবি  আঁকা হয়ে যায়। অর্থাৎ আমরা যা কিছু করি, তা সে সৎচিন্তা হতে পারে, সৎ কর্ম্ম হতে পারে আবার অসৎ চিন্তা বা অসৎ কর্ম্ম হতে পারে, যা কিছুই আমরা করি না কেন, তার একটা ছাপ আমাদের চিত্তের  উপরে পড়বে। আর ছাপগুলোই পরে স্বপ্নে প্রকাশিত হয়। এইজন্য অধ্যাত্ম জগতে সৎকর্ম্মের উপরে যেমন গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে, তেমনি  সব সময় সৎ চিন্তা, করতে বলা হয়েছে। আপনি যদি অন্যায় কাজ করেন, তবে আপনার পুলিশের ভয় উৎপন্ন হবে। আর এই ভয় আপনাকে স্বপ্নে তারা করে নিয়ে বেড়াবে। এমনকি আপনি যদি অপমানিত হন, তবে আপনার মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা জাগ্রত হবে আর তা  স্বপ্নে দেখা দেবে, এবং আপনি স্বপ্নে তাকে গালাগাল দিতে পারেন। এইজন্য, মুনিঋষিগন আমাদেরকে নিস্পৃহ থাকতে বলেছেন। অর্থাৎ আপনার মান  বা  অপমান  যেন অন্যের কথার উপরে বা অন্যের কার্য্যের উপরে নির্ভরশীল না হয়। এক্ষেত্রে উপেক্ষাই শ্রেয়। এইজন্য বলা হয়েছে, অধ্যাত্ম জগতে ক্ষমাশীল হওয়া জরুরি। 

যাইহোক, আমরা আগে শুনেছিলাম, জাগ্রত অবস্থায় আমরা স্থুলভূক।  অর্থাৎ স্থূল বস্তু খেয়ে বেঁচে থাকি। কিন্তু স্বপ্নাবস্থায় আমরা প্রবিবিক্ত -ভূক। অর্থাৎ স্বপ্নাবস্থায় আমরা  সূক্ষ্ম বস্তু ভোগ করি। এই অবস্থায় আমাদের স্থুল দেহের প্রয়োজন পড়ে  না, আবার স্থুলবস্তু খাবার প্রয়োজন পড়ে  না। আমরা যে কামনা করি সেই কামনা দ্বারা আমাদের ভোগ সম্পন্ন হয়। এই ভোগ মানসিক, শারীরিক নয়। এই অবস্থায়ই  তৈজস। তৈজস কথাটির অর্থ হচ্ছে আলো বা চৈতন্য। আমাদের মনের চৈতন্য। আর এই স্বপ্নাবস্থা হচ্ছে ব্রহ্মর দ্বিতীয় অবস্থা, যাকে  বলা হয় তৈজস। 

পরবর্তী অবস্থা হচ্ছে সুষুপ্তি। আমরা যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন থাকি, তখন আমার মধ্যে কামনা বাসনা  থাকে না। আর আমি স্বপ্নও দেখি না। এইসময় আমাদের মন থাকে নিষ্ক্রিয়। তাই সুসুপ্তির সময় আমাদের মনের  কোনো ক্রিয়া থাকে না। মনের এই নিষ্ক্রিয় অবস্থার ফলেই  মনে কোনো কামনা বাসনা জাগ্রত হতে পারে না। জাগ্রত অবস্থায় আমরা জাগতিক বস্তু সম্পর্কে সচেতন থাকি, স্বপ্ন অবস্থায়  আমরা মানসিক কামনা বাসনা সম্পর্কে সচেতন থাকি, কিন্তু সুসুপ্তির অবস্থায়, আমরা বিষয় সম্পর্কে নিস্পৃহ থাকি। তাই বিষয়গত যে বৈষম্য বা বিষয়গত যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এগুলো থেকে নিষ্কৃতি পায়  মন। এই অবস্থাকে বলে প্রাজ্ঞ। অর্থাৎ এই অবস্থায় আমাদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি উপস্থিত থাকে। এইসময় আমাদের কোনো স্বপ্ন বা চিন্তা থাকে না। এই সময় থাকে শুধু চৈতন্য, অর্থাৎ চিদ্ঘন রূপ। আমরা যখন স্বপ্নাবস্থায় থাকি, তখন আমাদের যে চেতনা থাকে, তাকে আলাদা করা যায়, তখন বিশ্বের অনুরূপ আর একটা বিশ্বকে  দেখতে পাই। যা আমরা মনের মাধ্যমে অনুভব করি। কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় যে বিশ্বকে আমরা যা অনুভব করি, তা ইন্দ্রিয়সমূহ দিয়ে করে  থাকি। সুসুপ্তির অবস্থায় আমাদের ইন্দ্রিয় ও মন দুটোই নিষ্ক্রিয় থাকায়, এই জগতের উপলব্ধি থাকে না। তখন শুধু চৈতন্য বিরাজমান। এই চৈতন্য একটা প্রদীপের মতো, সবসময় জ্বলছে, তা কারুর কাজে লাগুক আর না লাগুক। 

কিন্তু কথা হচ্ছে, এই যে সুসুপ্তির অবস্থা, যা নিরবিচ্ছিন্ন চৈতন্যে সমাহিত ছিল, সেখান থেকে জাগ্রত অবস্থায় আসতে  গেলে একটা বিক্ষেপের প্রয়োজন হয়।  এই বিক্ষেপের কাজটি করে থাকে মায়া। অর্থাৎ  অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা।.জাগ্রত অবস্থা থেকে যখন আমরা স্বপ্নাবস্থাতে যাই তখন জগৎ মনে লিন হয়, আবার স্বপ্নাবস্থা থেকে যখন আমরা সুসুপ্তিতে যাই তখন মন চৈতন্যে লিন হয়। আবার আমাদের মধ্যে যখন  মায়ার প্রবেশ ঘটে, তখন আমরা আবার জাগ্রত অবস্থায় ফিরে আসি। সুসুপ্তিকে বলা হয় চেতোমুখ। অর্থাৎ চেতনার দ্বার, অর্থাৎ চেতনা মায়ার সাহায্যে এই দ্বার দিয়ে  বেরিয়ে আসে - মন ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে মিশে যায়। তাই সুসুপ্তিতে কোনো দ্বৈত ভাব থাকে না। থাকে শুধু এক অনুভূতি। 

 উপনিষদ বলছে, সুসুপ্তিতে আমরা আনন্দ-ভূক অর্থাৎ কেবলমাত্র আনন্দই ভোগ করে থাকি। সুষুপ্তি আমাদের পরমশান্তির  অবস্থা। কারন, মন ও ইন্দ্রিয় তখন কোনো কাজ করতে পারে না। তবে একটা কথা এই সুসুপ্তিতে আমরা যে আনন্দ অনুভব করে থাকি, সেই আনন্দ চিরস্থায়ী নয়। এই  আনন্দের অস্তিত্ত্ব সাময়িক। কেননা এই অবস্থাতে মায়া আমাদের দ্বাররক্ষক। আর এই মায়াই আমাদের আবার টেনে নিয়ে আসে, মন ও ইন্দ্রিয়ের কাছে। অর্থাৎ এই সময়ে আমরা অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত  নোই। তাই ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আবার এই দৃশ্যমান জগতের সম্মুখীন হই।  আবার আমরা সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে যাই। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম। 

ওং ভদ্রং কর্নেভিঃ শৃনুয়াম দেবা 
ভদ্রং পশ্যেম অক্ষভিঃ যজত্রাঃ। 
স্থিরৈঃ অঙ্গৈঃ  তুষ্টুব্যাংসঃ  তনূভিঃ
ব্য়শেম দেবহিতং যদায়ুঃ।।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।

আমরা আগেরদিন শুনেছিলাম, আমরা যখন গভীর নিদ্রামগ্ন থাকি, স্বপ্নাবস্থার উর্দ্ধে যখন থাকি তখন আমাদের মনে কোনো কামনা বাসনা থাকে না। আমাদের মন তখন নিষ্ক্রিয় থাকে। একেই বলে সুষুপ্তি। জাগ্রত অবস্থায় বা স্বপ্নাবস্থায়, আমরা বস্তু সম্পর্কে সচেতন থাকি। কিন্তু সুষুপ্তি অবস্থায় আমাদের কোনো বিষয় বা কোনো দ্বৈত দৃষ্টি থাকে না। তখন শুধুই এক।  কিন্তু এই অবস্থায় আমরা বেশিক্ষন থাকতে পারি না। এ যেন এমন একটা অবস্থা, মনে হয় আমরা লক্ষে পৌঁছে গেছি। কিন্তু সত্য হচ্ছে, এই অবস্থা থেকে আমাদের আবার ফিরে আসতে  হয়। যে অবস্থা থেকে আমাদের ফিরে আসতে  হয় সেই অবস্থা হচ্ছে আত্মার প্রাজ্ঞ - অবস্থা অর্থাৎ আমাদের তৃতীয় অবস্থা, বা সুসুপ্তির অবস্থা। 

এখন আমরা  মাণ্ডূক্য উপনিষদের  ষষ্ঠতম শ্লোক থেকে আলোচনা শুরু করবো। উপনিষদ বলছে,  প্রজ্ঞা হচ্ছে সমস্ত বস্তুর অধীশ্বর। এই প্রজ্ঞাই সর্বজ্ঞ, ইনিই অন্তর্যামী। সমস্ত বস্তু এই প্রজ্ঞা থেকে উৎপন্ন হয়, আবার প্রজ্ঞাতেই লিন হয়ে যায়। প্রজ্ঞাই সমস্ত কিছুর কারন। 

প্রজ্ঞার সমার্থক শব্দ হচ্ছে আত্মা।  অর্থাৎ আত্মাই সর্বেশ্বর। আত্মাই সব কিছুর অধীশ্বর। এবং আত্মাই সব কিছুর নিয়ন্তা। জাগ্রত স্বপ্ন বা সুসুপ্তির অবস্থাতে "আমি"ই সব কিছুর অধীশ্বর। আত্মা যেহেতু সমস্ত জ্ঞানের উৎস  তাই এঁকে  বলা হচ্ছে সর্বজ্ঞ। এই আত্মাই আমাদের অন্তরে নিহিত, যিনি অন্তর্যামী। এই আত্মা আমাদের সকলের হৃদয়ে বিরাজিত। ইনি সর্বত্র, সর্ব্ব বস্তুতে বিরাজ  করছেন। আত্মাই সব কিছুর কারন ও উৎস। এই আত্মাকেই উপনিষদ বলছে ব্রহ্ম, ব্রহ্ম ছাড়া কোনো কিছুর অস্তিত্ত্ব নেই। আত্মাই সমস্ত বস্তুর উৎপত্তি ও বিনাশের কারন। জন্ম ও মৃত্যুর জন্য ইনিই দায়ী। বলা হয়ে থাকে মৃত্যুর পর আমরা যেখান থেকে এসেছিলাম, সেখানেই ফিরে যাই, অর্থাৎ আত্মাতেই ফিরে যাই। বুদ্বুদ যেমন জলাধারে  তৈরী হয়, আবার  জলের সঙ্গে মিলিয়ে যায়, একই ভাবে প্রাণী বা ভূত বা সমস্ত বস্তু একই উৎস  থেকে আসে আবার একই উৎসে ফিরে যায়। 

উপনিষদ বলছে, সত্য এক ও অপরিবর্তনীয়। নাম ও রূপের ভিন্নতার জন্য আমরা বহু দেখি। অলঙ্কার ও সোনার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মাটি ও কলসির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দৃশ্যমান জগৎ ও আত্মার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ক্ষণস্থায়ী বস্তুর মধ্যে বৈচিত্র, চিরস্থায়ী বস্তুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এখন কথা হচ্ছে, কেমন করে আমরা বুঝবো যে আমরাই সেই পরম সত্য। বেদান্ত বলছে, তুমি যদি নিজের অস্তিত্ত্বে বিশ্বাস করো, আর পরম সত্য বলতে যদি এক ও অভিন্ন বুঝে থাকো, তবে জেনো তুমি নিজেকে কখনো আলাদা করতে পারো না সেই পরম-সত্য থেকে। আর শুধু  বিশ্বাস করলেই হবে না, আমরা যতক্ষন না সেই পরম সত্যের সঙ্গে একাকার হয়ে যাচ্ছি ততক্ষন আমাদের মূল অস্তিত্ত্বের বোধ জাগ্রত হবে না। এখন কথা হচ্ছে, এই অস্তিত্ত্বের বোধ জাগবে কি করে ? যে সত্য থেকে আমি নিজেকে পৃথক ভাবি, এই যে ভাবনা এটা আমাদের অজ্ঞান। এই অজ্ঞানতা  থেকেই আমাদের দ্বৈত ভাবনার শুরু। কিন্তু পরম সত্ত্বা কখনোই দুটি হতে পারে না। আমাদের সবার মধ্যে সেই একই সত্ত্বা বিরাজ  করছে। আর দ্বৈত ভাবনা থেকেই আমাদের সকল দুঃখের শুরু।  আমাদের ভেদ বুদ্ধি আমাদের যন্ত্রণার কারন। উপনিষদ বলছে জীবাত্মা ও পরমাত্মা এক ও অভিন্ন। 

 মাণ্ডূক্য উপনিষদ ৭ম শ্লোকে বলা হচ্ছে :  তুরীয় অবস্থা অন্তরস্থ ঘটনা সম্পর্কে সচেতন নন। তুরীয় তৈজস নন। তৈজস অর্থাৎ তেজবিকার যা রজোগুণ থেকে উৎপন্ন। বাইরের ঘটনা সম্পর্কে তুরীয় অবস্থা সচেতন নন। অর্থাৎ তুরীয় অবস্থায় আমাদের বাইরের বিশ্বের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকে না। এমনকি আমাদের জাগ্রত ও স্বপ্ন অবস্থার মাঝামাঝি কোনো কিছু সম্পর্কে সচেতন নন।  আবার সুসুপ্তির অবস্থার প্রাজ্ঞ নন। ইনি সর্বজ্ঞ নন আবার অচৈতন্য নন.. ইনি অদৃশ্য, লৌকিক ব্যবহারের অতীত। কর্ম্ম-ইন্দ্রিয় বা জ্ঞান-ইন্দ্রিয় এই দুইয়ের উর্দ্ধে। যিনি মনেরও অগোচর। এমনকি কোনো শব্দ দ্বারা যিনি নির্দেশিত নন। এই অবস্থায় অর্থাৎ তুরীয় অবস্থায় থাকে শুধু  আত্মার চৈতন্য, এখানে জগতের কোনো অস্তিত্ত্ব নেই। এখানেই শান্তি ও কল্যাণের মূর্ত প্রকাশ।  এই চৈতন্য এক, ও অদ্বিতীয়।  যারা প্রাজ্ঞ অর্থাৎ  তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন, আত্মজ্ঞান সম্পন্ন, তাঁরা  এঁকেই আত্মা বলে থাকেন। আর এই আত্মাকেই আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। 

আত্মাকে কখন আমরা উপলব্ধি করবো ? উপনিষদ বলছে,  "প্রপঞ্চ উপশমং" । অর্থাৎ যখন আমাদের প্রপঞ্চের উপশম হবে, তখন আমরা আত্মাকে উপলব্ধি করতে পারবো। ।  প্রপঞ্চ কথাটার মানে হচ্ছে এই অনিত্য দৃশ্যমান জগৎ, আর উপশমং কথাটার অর্থ হচ্ছে দূরীভূত হওয়া বা অস্বীকার করা।
 এই যে দৃশ্যমান জগৎ আমাদের সামনে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে  পরিস্ফুট হচ্ছে, এই যে পঞ্চভূতের গড়া জগৎ একে যখন আমরা অস্বীকার করতে পারবো, তখন আমরা আত্মাকে উপলব্ধি করতে পারবো। এই  জগৎ নাম-রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই নাম-রূপ বর্জিত হলে, অবশিষ্ট থাকে  একত্ত্ববোধ। এই একত্ত্ববোধেই শান্তি, আনন্দ - শান্তম  শিবম অদ্বৈতম। সাধারণ ভাবে আমরা একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত।  কিন্তু যেখানে দুই নেই সেখানে কোনো দ্বন্দ্ব নেই, সেখানে কেবল আনন্দ আর শান্তি। একেই বলে তুরীয় অবস্থা যা আমাদের চতুর্থ অবস্থা। ব্রহ্মের এই অবস্থায় আমাদের প্রকৃত অবস্থা। এই অবস্থাই আত্মার প্রকৃত অবস্থা।  এই অবস্থাকে আমাদের জানতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে। এখন কথা হচ্ছে জানবে কে ? উপলব্ধি করবে কে ? কোনোকিছু জ্ঞাত হতে গেলে একজন জ্ঞাতা  চাই, তো আমার যদি কোনো পৃথক সত্ত্বা না থাকে, তবে এই আত্মাকে বা জ্ঞেয় বস্তুর জ্ঞাতা  কে ? আচার্য্য শংকর বলছেন, আমরা যে নিজেরাই আত্মা এই জ্ঞান একমাত্র আত্মাতেই জ্ঞাত হতে পারে। আমাদের আত্মা সম্পর্কে অজ্ঞানতা দূর হলেই আত্মাকে জানা যাবে। গৌড়পাদ বলছেন, দ্বিতত্ত্বের ধারণা যখন দূরীভূত হয়, তখন আত্মা জ্যোতির্ময় রূপে প্রকাশিত হন। আর আত্মার জ্যোতিচ্ছটা দ্বারা সকল বস্তুর মধ্যে ঐক্য দর্শন সম্ভব হয়। মানুষ যখন  তুরীয় অবস্থায় উপনীত হয়, তার সমস্ত অজ্ঞান দূর হয়, তখন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দৃশ্যমান জগৎ মিলিয়ে যায়, আর ব্রহ্ম একীভূত অবস্থায় প্রকাশিত হয়। তাই তুরীয় অবস্থায় আমরা সবাই মুক্ত। তুরীয় অবস্থায় আমরা কোনো কিছুর সঙ্গে লিপ্ত থাকি না। তখন আমি অপরিবর্তনীয় স্বতন্ত্র অদ্বিতীয় সত্ত্বা। তখন মনে হয়, আমিই সকলের মধ্যে বিরাজিত এক ও অভিন্ন আত্মা। 

আজ এই পর্যন্ত।  পরবর্তীতে আমরা ৮ম শ্লোক থেকে শুনবো। আসলে এই বিষয়টি গম্ভীর। বিশেষ করে তুরীয় অবস্থা জ্ঞাত হওয়া বাইরের বিষয় নয়। এটি অন্তরের বিষয়। তাই আমাদের অন্তর যত  স্বচ্ছ হবে, তুরীয় অবস্থার চিত্র তত স্পষ্টভাবে  আমাদের অন্তরে ধরা পড়বে । নতুবা এই সব বিষয় আমাদের কাছে বিস্বাদ লাগবে। যাই হোক, আজ বাক্যের বিরাম দিলাম।  পরের  দিন আবার আমরা এই বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করবো। এপর্যন্ত যা শুনলাম, তা যেন আমরা মনন করতে থাকি।   

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

মাণ্ডক্য উপনিষদ (শ্লোক ৮-১২) ওঙ্কারের তিন মাত্রা চারপাদ। 

ওং ভদ্রং কর্নেভিঃ শৃনুয়াম দেবা 
ভদ্রং পশ্যেম অক্ষভিঃ যজত্রাঃ। 
স্থিরৈঃ অঙ্গৈঃ  তুষ্টুব্যাংসঃ  তনূভিঃ
ব্য়শেম দেবহিতং যদায়ুঃ।।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।

আমরা  শুনছিলাম মাণ্ডূক্য উপনিষ থেকে। এর আগের দিন আমরা সপ্তম শ্লোক অবধি  শুনেছিলাম। আজ আমরা অষ্টম শ্লোক থেকে শুনবো।  

আমরা শুনেছি, ব্রহ্ম বা  আত্মা চতুষ্পাদ, আর এই পাদগুলো হলো, ১) জাগ্রত অর্থাৎ বিশ্ব, ২)স্বপ্ন অর্থাৎ তৈজস, ৩) সুষুপ্তি বা প্রাজ্ঞ এবং ৪) তুরীয় বা শুদ্ধ চৈতন্য। তুরীয় অবস্থাই  আত্মার প্রকৃত অবস্থা। অর্থাৎ  আত্মার মাত্রা তিনটি জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি। 

আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল, ওঙ্কার বা প্রণব। এই ওঙ্কারের  আলোচনা করতে গিয়ে আমরা ব্রহ্মার বা আত্মার বা পরমাত্মার তিনটি  অবস্থার কথা শুনছিলাম। আসলে উপনিষদ উচ্চস্বরে ঘোষণা করছে, অহম  ব্রহ্মাস্মিন - আমিই ব্রহ্ম।  ওং তৎসৎ। ওঙ্কারই সত্য। তত্ত্বমসি - তিনিই সেই। 

অষ্টম শ্লোকে বলছেন :   জীবের যেমন বিভিন্ন অবস্থা, ব্রহ্মারও বিভিন্ন অবস্থা। ব্রহ্মা বা আত্মার তিনটি মাত্রা - বিশ্ব, তৈজস, ও প্রজ্ঞা।   ঠিক তেমনি ওঙ্কারের মাত্রা তিনটি অর্থাৎ অ,উ,ম। এখানেও অর্থাৎ ওঙ্কারেও সেই একই পরমাত্মা। আত্মার পাদসমূহ ওঙ্কারের মাত্রা। আবার ওঙ্কারের মাত্রাগুলোই আত্মার পাদ।  অকার, উকার, ও মকার এই তিনটি ওঙ্কারের মাত্রা। তুরীয় অবস্থা মাত্রার উর্দ্ধে।  কারন তুরীয় অবস্থা বর্ণনার উর্দ্ধে। 

নবম শ্লোকে বলছেন, জাগ্রত অবস্থায় বৈশ্বানররূপী যে পরমাত্মা তাকে "অ" এই বর্ণের দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। বৈশ্বানর এবং "অ" উভয়ই সর্বব্যাপী। বৈশ্বানর কথার অর্থ হচ্ছে বহ্নি, অগ্নি, অনল। বিশ্বনর অর্থাৎ বিশ্বরূপী যে বিরাট পুরুষ তার ভিতরে যে অগ্নি আছে, তাকেই বলা হচ্ছে "অ" । বিশ্বনরের  জঠরের ভিতরে যে অগ্নি বিরাজ করছে তাকে বলা হয় বৈশ্বানর। বিশ্ব প্রকাশিত হয়, অগ্নির সাহায্যে। অগ্নিবীণা জগৎ অপ্রকাশিত।  আর ব্রহ্মের প্রথম অবস্থা হচ্ছে, এই বিশ্বজগৎ। আর ওঙ্কারের প্রথম অক্ষর হচ্ছে "অ"  যা বর্ণমালার  প্রথম অক্ষর। অর্থাৎ আদ্য অক্ষর হচ্ছে "অ" । "অ" এর উচ্চারণ স্থান হচ্ছে কন্ঠ। তাই একে বলা হয় কন্ঠবর্ন। "অ" এর সতের রকমের অর্থ আছে। আমাদের বিচার্য্য এসব নয়। আমরা এখানে ওঙ্কারের "অ" নিয়ে সম্পর্কযুক্ত। "অ" এর অর্থ অনল বা অগ্নি। যা সমস্ত জগৎকে প্রকাশিত করেছে। আর এর প্রতীক হচ্ছে সূর্য। সূর্য্যই জীবজগৎকে  উদ্ভিদসমূহকে   এমনকি ব্রহ্মান্ডের সমস্ত কিছুকে প্রকাশিত করছে। উপনিষদ বলছে, শুধু এইটুকু যিনি জানতে পেরেছেন, তার সমস্ত কামনা বাসনা পূর্ন  হয়ে গেছে, অর্থাৎ তিনি  আপ্তকাম  হতে পেরেছেন।  তিনি মনুষ্য শ্রেষ্ট। 

দশম শ্লোকে বলছেন, স্বপ্নাবস্থায়, আমাদের অর্থাৎ আত্মার তৈজসে অবস্থান। ওঙ্কারের "উ" এর তুল্য ।
"অ" ও "ম" এর মধ্যবর্তী এর অবস্থান। আত্মার যে মাত্রা অর্থাৎ জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি এই তিনের মাঝখানে এর অবস্থান। স্বরবর্ণমালার পঞ্চমবর্ন এই "উ" । এই হ্রস্বস্বর-এর উচ্চারণ স্থান হচ্ছে ওষ্ঠ। ওষ্ঠদ্বয় সংকুচিত ক'রে, এবং সামনের দিকে লম্বালম্বি ক'রে, মুখবিবর ক্ষুদ্রতর ক'রে, এবং জিহ্বা খানিকটা সংকুচিত ক'রে, উচ্চারণ করতে হয়। "উ" শব্দে শিবকে বোঝায়। যেমন উমা অর্থাৎ শিবের স্ত্রী।  "উ" শব্দে ব্রহ্মাকেও বোঝায়। "উ" বিকারকালে "ও" উচ্চারণ হয়। যাইহোক ওঙ্কারের "উ" অক্ষরটি হলো তৈজস, যা আমাদের স্বপ্নাবস্থার সঙ্গে তুলনা করে যেতে পারে। এই স্বপ্নাবস্থাতে আমাদের চৈতন্য থাকে। জাগ্রত অবস্থা বলুন, আর স্বপ্নাবস্থা বলুন, উভয় অবস্থাতে ব্রহ্ম বিরাজ করছেন । উপনিষদ বলছে, যিনি এই তত্ত্ব উপলব্ধি করেছেন, তার বংশে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ জন্ম গ্রহণ করে থাকেন।

মাণ্ডক্য উপনিষদের ১১ তম শ্লোকে বলছেন, সুসুপ্তির অবস্থায়, আত্মা তথা প্রজ্ঞাকে ওঙ্কারের তৃতীয় অক্ষর "ম" এর দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। উপনিষদে বলা হয়েছে, যেখানে অ এর সাথে বিশ্ব এবং উ এর সাথে তৈজসের সমাপ্তি ঘটে সেখানেই প্রাজ্ঞ এবং "ম" উভয়ের অবস্থান। প্রাজ্ঞ এবং "ম" হলো একত্বে বিলীন হয়ে যাবার সিংহদ্বার। যিনি একথা জানেন, তিনিই এই জগৎকে যথাযথ ভাবে জেনেছেন, এবং জগৎ তাঁর কাছে একটা বিশ্রামস্থল হয়ে উঠেছে।  

 "ম" -  ব্যঞ্জন-বর্ণমালার পঁচিশতম বর্ণ হচ্ছে "ম" । এবং আমরা জানি ব্যঞ্জনবর্ণ কতকগুলো বর্গে বিভক্ত।  সেগুলো হচ্ছে ক,চ, ট, ত, প। "ম" হচ্ছে প-বর্গের পঞ্চম অনুনাসিক ওষ্ঠ বর্ণ। প্রত্যেক বর্গের চতুর্থ বর্ন উচ্চারণ কালে, মুখ দিয়ে সমস্ত বায়ু নিঃশেষিত হয়ে যায়, সুতরাং তার পরের অর্থাৎ পঞ্চম বর্ণের উচ্চারনে, যে অতি-অল্প-মুখ-মরুৎ অবশিষ্ট থাকে তার সাহায্যে ওষ্ঠ ভেদ করার শক্তি থাকে না তাই , বর্ণ তখন অনুনাসিক হয়ে পড়ে । এইজন্য, আমরা যখন রুগ্ন-দুর্বল হয়ে পড়ি, তখন আমাদের স্বর অনুনাসিক হয়ে পড়ে । অর্থাৎ আমাদের জীবনীশক্তি যখন প্রায়  নিঃশেষিত হয়ে যায়. তখন আমরা অনুনাসিক স্বরে কথা বলি। "ম" অর্থে শিব, ব্রহ্মা, যম, সময়, মরন ইত্যাদি বহু কিছু বোঝায়। 

আমরা মাণ্ডক্য উপনিষদের শেষ শ্লোকে চলে এসেছি। ১২তম অর্থাৎ উপনিষদের  অন্তিম  শ্লোকে বলছেন ওম অর্থাৎ অ-উ-ম এর সম্মিলিত ধ্বনি ওঙ্কার হচ্ছে আমাদের চতুর্থ অবস্থা।   বলা হয়, পরমাত্মার বা আত্মার চতুর্থ অবস্থা অর্থাৎ তুরীয় অবস্থা। আত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।  এই অবস্থায় ব্রহ্ম বা আত্মা অনন্ত।  বাক্য-মনের অতীত, অদ্বয় ও শিবস্বরূপ। এই অবস্থা হল শুদ্ধ চৈতন্য, ঈশ্বরাতীত। এখানে স্থুলজগতের কোনো অস্তিত্ত্ব থাকে না। সমগ্র জগৎ বা দ্বিতত্ত্ববোধ তখন লোপ পায়। তুরীয় অবস্থায় আত্মা বৈ কিছু নেই। সাধকের এই অবস্থায় মুক্ত অবস্থা। এখন থেকে আর পুনর্জন্ম হয় না।  

সবশেষে দু একটা কথা বলে ব্রহ্মবাক্যের সমাপ্তি টানবো। জীবের যে পরিক্রমা, তার এই চারটি বিশ্রামাগার। সাধারণের বেঁচে থাকা মানে জাগ্রত ও স্বপ্নাবস্থার মধ্যে যাতায়াত।এমনকি আমরা মৃত্যুর পরেও এই স্বপ্নাবস্থাতে অবস্থান করি।  কেউ কেউ এখন থেকেই আবার নতুন দেহ ধারণ করে থাকি। যাঁরা ধীর-স্থির-শান্ত স্বভাবের মানুষ তাঁরা তৈজস অবস্থা বা দ্বিতীয় অবস্থা অতিক্রম করে সাময়িক সময়ের জন্য, অর্থাৎ গভীর ঘুমে এই তৃতীয় অবস্থার বা প্রাজ্ঞ অবস্থার আনন্দ  গ্রহণ করতে পারেন।এঁরা মৃত্যুর পরে, হাজার হাজার বছর এই নিষ্ক্রিয় অবস্থায় অবস্থান করেন। এবং এঁরা সহজে দেহ ধারণ করে না। আর যাঁরা ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ  তাঁরা জীবিত অবস্থায় প্রারব্ধ কর্ম্মে লিপ্ত থাকলেও, তিনি জ্ঞানাতীত চতুর্থ অবস্থার অধিকারী হয়ে থাকেন। এঁদের আর  জন্ম মৃত্যু বলে কিছু থাকে না। তখন জীবাত্মাই পরমাত্মা হয়ে যান। এই অবস্থা আমাদের বোধগম্য নয়। কোটিতে গুটি মাত্র এই জ্ঞানাতীত আলোর সন্ধান পেয়ে থাকেন।

ওম সত্যম -শিবম-সুন্দরম। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ  . হরি ওম।  


Wednesday 10 June 2020

মানসিক ও শারীরিক শান্তির পথ - যোগ

মানসিক ও শারীরিক  শান্তির পথ - যোগ 

আমাদের জীবনের সবথেকে বড়  সমস্যা হলো আমাদের মানসিক অশান্তি । পৃথিবীর অনেক ঐশর্য্য আমাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে, জীবন এখন অনেক সুযোগ-সুবিধায় ভরপুর হয়ে গেছে। আমাদের এখন কাঠের উনুনে রান্না করতে হয় না। বাজার করবার জন্য, এমনকি বাজারেও যেতে হয় না। ঘরে বসেই সব কিছু পেতে পারি। শারীরিক চিকিৎসা-বিদ্যার  উন্নতি যেমন হয়েছে, চিকিৎসা সহজলভ্য হয়েছে। কিন্তু রুগীর সংখ্যা  কমেনি। এখনো রান্না করা খাবার খেতে হয় ।  মানসিক চিকিৎসার জন্য মনোবিদ্যার প্রসার ঘটেছে। কিন্তু মানসিক অশান্তিও বেড়েছে। আসলে যতদিন আমি আমাকে ভালো রাখার কৌশল আয়ত্ত্ব না করতে পারবো, ততদিন আমাদের এই বাইরের সুযোগ সুবিধা আমাকে ভালো রাখতে পারবে না। 
আর নিজেকে ভালো রাখার কৌশল হলো, নিজেকে জানা।  নিজের মনকে জানা। আর এই মনের মধ্যে দুটো জিনিষ আমাদের মনকে অশান্ত করে ফেলে, তার মধ্যে একটা হচ্ছে, রাগ, আর একটা হচ্ছে ভয়। তো আজ আমরা এই ভয় সম্পর্কে দুচার কথা শুনবো। 
দারিদ্রতার ভয় : দেখুন যে যাই বলুক না কেন, পেটের  জ্বালা বড় জ্বালা। কথায় বলে পেটে  দিলে পিঠে সয়। আর এই জ্বালা সমস্ত শরীরধারীর, সমস্ত জীবের। অথচ আশ্চর্য্য ব্যাপার হচ্ছে, পৃথিবীতে যেমন বাসস্থানের অভাব নেই, তেমনি খাদ্যের অভাব নেই। ভগবান এমন কোনো জীব সৃষ্টি করেন না, যার খাবার পৃথিবীতে নেই। ভগবান আগে সৃষ্টি করেন খাবার, তারপরে সৃষ্টি করেন জীব বা প্রাণী। তাই উদ্ভিদের জন্ম হয় আগে, তার পরে প্রাণীর।  সন্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মায়ের বুকে দুধ আসে। ফল পাঁকলে ফলের মধ্যে পোকা জন্মায়। আসলে পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সবার সঙ্গে খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক। তাই খাদ্য তৈরি হয় আগে, তারপরে খাদক।  আমার এই দেহ যখন প্রাণহীন হয়ে যাবে, তখন সেটা কারুর খাদ্য হয়ে যে পারে।  এমনকি আমি যে জীবিত আছি, এই অবস্থাতেই আমার শরীরে অসংখ্য কৃমিকীট আমাকে খেয়ে বেঁচে আছে। আসলে ভগবান আমাদের খাদ্যের অভাব রাখেননি। আমরাই কৃত্তিম অভাব তৈরি করেছি। এর প্রথম কারন হচ্ছে, সঞ্চয়, দ্বিতীয়তঃ খাদ্যের অপব্যবহার, তৃতীয়ত অসম-বন্টন ব্যবস্থা। আমাদের খাদ্য সংগ্রহশালায় বিপুল পরিমান, খাদ্য নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এক্শ্রেণীর মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে। এখন কথা হচ্ছে, এর থেকে পরিত্রানের উপায় কি ? আসলে আমাদের এই আলোচনা, সামগ্রিক সমস্যা মেটানো  নয়, আমাদের আলোচনা ব্যক্তির সমস্যা মেটানো।  আর ব্যক্তির সমস্যা মেটাতে পারলে, ধীরে ধীরে সামগ্রিক সমস্যাও মিটে  যেতে  পারে। 
দেখুন, আপনি গরিব হয়ে জন্মেছেন কি না, সেটা বড়  কথা নয়, আপনি গরিব হয়ে থাকতে চান কি না সেটাই  বড় কথা। আপনাকে প্রথমেই স্থির করতে হবে, আপনি বড়লোক হবেন কি না। আপনি গরিব থাকবেন কি গরিব থাকবেন না সেটা বড়  কথা নয়। আপনাকে ভাবতে হবে আপনি বড়লোক হবেন, কি হবেন না। দেখুন, আপনি যদি সামান্য আর্থিক ক্ষমতা অর্জন করতে না পারেন, তবে এটা নিশ্চিত যে আপনার অধ্যাত্ম জীবন কিছুতেই সম্পূর্ণ হতে পারেই না। তাই আমাদের উচিত অর্থ উপার্জনে মনোযোগ দেওয়া। আর এটা  করতে গেলে দরকার শুধু আপনার ভাবনার পরিবর্তন। আপনি আজ যাদের বড়োলোক দেখছেন, তারা সবাই অর্থচিন্তাতেই মগ্ন। আর আপনি আজ যা চিন্তা করবেন, ভবিষ্যতে আপনি সেটাই হবেন। অর্থ তার কাছেই আসে, যে সবছেড়ে  অর্থ চিন্তাতে  মগ্ন থাকে। তো আপনি সদর্থক ভাবে, ভগবানের কাছে চাইতে শিখুন। গরীব কেন গরীব থাকে জানেন, তারা সবসময় ভাবে আমরা গরীব।  আর এই ভাবনাই  তাকে চিরকাল গরিব করে রাখে। আমি বড়লোক  হবো, এই ভাবনা যখন তার মধ্যে আসবে, সেদিন থেকে তার পরিবর্তন  হতে থাকবে। আর বড়োলোক কখন গরীব হয় জানেন, যখন তার ভিতরে ধন হারানোর ভয় উৎপন্ন হয়। তো ভুলে যান আপনি গরিব ঘরে জন্মেছেন, ভুলে যান আপনি গরিব। আপনি যখনি বড়লোক হবার কথা ভাবতে শুরু করবেন , সেদিন থেকেই আপনার সামনে বড়লোক হবার উপায় এসে যাবে। আপনার কাজ হচ্ছে, সেই উপায় গুলোকে কার্যকরী করা। একটা কথা মনে রাখবেন, আজ আমরা যে অবস্থায় আছি, সেটা আমার পূর্ব্ব-পূর্ব্ব জীবনের ভাবনা ও কর্ম্মের ফল।  আর আজ আমি যা ভাববো, আজ আমি যা করবো, সেটা আমার ভবিষ্যৎ জীবন গড়ে দেবে । তাই অতীতে কি করেছিলাম, সে কথা ভুলে যান, কেবল সামনের দিকে নজর দিন। তাই আমি যদি ভবিষ্যতে ভালো থাকতে চাই, তবে আমাকে এখনই  তার ভীত গড়তে  হবে।ছোটবেলায় আমরা একটা খেলা খেলতাম, সেটা হচ্ছে, লাঠি দৌড়। প্রত্যেক দলে চারজন করে ছেলে থাকতো, লাঠি থাকতো একটা। তো একজন লাঠিটা নিয়ে একটা গোলাকার বৃত্তকে পাক দিয়ে, পরবর্তী জনকে দিয়ে দিতো, সে আবার বৃত্তকে পাক দিয়ে লাঠিটাকে পরের জনকে  দিয়ে দিত। জীবন একটা লাঠি দৌড়। আপনি আজ যা সংগ্রহ করছেন, তা আপনার পরবর্তী জীবনের জন্য সঞ্চয়। তা সে জ্ঞান সঞ্চয় বলুন, বা ধন সঞ্চয় বলুন। আমরা আগের জীবনে যা রেখে গিয়েছিলাম, আজ আমি সেখান থেকেই শুরু করবো। জ্ঞান সঞ্চয় আপনার সূক্ষ্ম শরীরের কাজে লাগবে। ধন আপনার স্থূল শরীরের কাজে লাগবে। তো আজ থেকেই শুরু করুন, আপনার ভবিষ্যতের সঞ্চয়। আপনি কি নিয়ে এসেছিলেন, সেটা ভুলে যান, আপনাকে কি নিয়ে যেতে হবে সেটার জন্য প্রস্তুত হোন।    
অসুস্থতার ভয় : শরীর  খারাপের ভয়। কিছু লোক আছেন, যারা সারাক্ষন কেবল শরীর  নিয়েই চিন্তা করতে ভালোবাসেন। বিশেষ করে, তারা সারাক্ষন তাদের অসুখ-বিসুখ নিয়ে কথা বলতে ভালো বাসেন। এরা  আসলে মানসিক রুগী। এরা সবসময় কল্পিত অসুস্থতার ভয়ে তটস্থ হয়ে আছেন। আর এই নেতিবাচক ভাবনা আমাদের শরীরকে অসুস্থ হবার রসদ যোগাচ্ছে । তবে, স্বস্তির কথা হচ্ছে, আমরা ছোটবেলায় শুনতাম, সব রোগের  ঔষধ আছে, মনের রোগের ঔষধ নেই। আর এই কারণেই আমাদের কুলগুরুরগন, একটা সন্মানীয় জায়গা পেতেন। কারন এই গুরুদেবের কাছেই, আমাদের মনের রোগের  ঔষধ অর্থাৎ সৎ-পরামর্শ পাওয়া যেত।  আজ অবশ্য সেই দিনটা পাল্টে গেছে। এখন কুলগুরুর সংখ্যা কমে গেছে, যদিও এখনো ধর্ম্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সেই কাজ করে যাচ্ছে। তবে, বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে, এখন ডাক্তাররাও শরীরের রোগের  সাথে সাথে মনের রোগের  চিকিৎসা শুরু করেছেন। এবং ডাক্তাররাই বলছেন, বা বুঝেছেন, আমাদের মানসিক দ্বন্দ্ব, আমাদের ভয়, আমাদের দুশ্চিন্তা নানান রোগের কারন। মাথাব্যথা, বদহজম, আলসার, চর্মরোগ, এমনকি বাতের বেদনা, আমাদের ক্লান্তি, অনিদ্রা, পেশির খিঁচুনি, আমাদের কিডনির অসুখ, এমনকি মানুষ যে পাগল হয়ে যায়, এগুলো সবই মানসিক ভারসাম্যহীনতা থেকে হয়ে থাকে। আর এই সব রোগ থেকে বাঁচতে গেলে, আমাদের তথাকথিত ডাক্তারের কাছে না যেয়েও আমরা শুধু আমাদের ভাবনার পরিবর্তনের সাহায্যে এইসব রোগের  নিরাময় করতে পারি।
আর এই পথের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে, আমরা যেন কেউ কাল্পনিক রোগ নিয়ে বাস না করি। আমরা যেন সব সময় নিজেদেরকে সুস্বাস্থের অধিকারী ভাবি। এমনকি আমরা যদি, কোনো আঘাতের সাহায্যে ক্ষতিগ্রস্থ হই, সেটা সারানোর জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়া নিশ্চই প্রয়োজন, তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমি যেন মানসিক দিক থেকে ভেঙে না পড়ি। আমি যেন নিজেকে বোঝাতে পারি, যে শরীর  থাকলে রোগ হতেই পারে। এর জন্য উদ্বিগ হবার কিছু নেই।  আর উদ্বিগ্ন হলেতো আমার অসুখ সেরে যাবে না। বরং উৎফুল্ল হলে শরীর নিরাময় সহজ হবে। ডাক্তারবাবু যখন আমাদের ইনজেকশন দিতে আসেন, ভয়ে আমাদের মাংশপেশী শক্ত হয়ে যায়। আর আমাদের মাংসপেশি যখন শক্ত হয়ে যায়, ডাক্তারবাবুর পক্ষে তখন ইনজেকশন দেওয়া কঠিন হয়ে যায়।  এমনকি আমাদের পেশী তখন ছিঁড়ে যায় আর  বেশী ব্যথা হয়। অর্থাৎ পেশী অনমনীয় হওয়ায় পেশী ছিঁড়ে যেতে পারে। ঠিক তেমনি, শরীর নিরাময়ের জন্য, আমাদের শরীরের ভিতরেই যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সংগঠিত হয়, সেই প্রক্রিয়ায় আমাদের সাহায্য করা উচিত। আমার যদি কোথাও কেটে যায়, আমি ডাক্তারের কাছে যাই না। আমার মনের ডাক্তারকে সেখানে পাঠিয়ে দেই, আর বিশ্বশক্তির কাছে নিরাময়ের দায়িত্ত্ব ছেড়ে দেই। আমি কাটা  স্থানে আমার নিজের মূত্র লাগিয়ে দেখেছি, রক্তপড়া তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে যায়। 
রোগ সারাবার সবচেয়ে বড় ঔষধ হচ্ছে, মনের জোর বা মনের বিশ্বাস।  আপনার যে ডাক্তারের প্রতি বিশ্বাস নেই, তার কাছে হার্গিস যাবেন না।  কারন তার কাছে আপনার অসুখ সারবে না। তার চেয়ে অচেনা ডাক্তারের কাছে যান। আপনি ঔষধ খাবার সঙ্গে সঙ্গে যদি বিশ্বাসকে দৃঢ় করতে পারেন, তবে আপনার শরীর সেই ঔষধের  ক্রিয়াকে সহযোগিতা  করবে।  এবং আপনি দ্রুত ভালো হয়ে যাবেন। 
আমরা আগেই শুনেছি , আপনার আমার শরীরে দুজন ডাক্তার আছেন। তারা হচ্ছে, আমাদের স্বাস-প্রশ্বাস। এই শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে  নিয়ন্ত্রণ করবার  বিদ্যা যার জানা আছে, তিনি সর্বদা সুস্থ থাকেন। সবশেষে বলি, অসুস্থতার কথা ভুলে যান। সমস্ত রোগ আপনি ডাক্তারকে দিয়ে দিন।  সমস্ত ঔষধ আপনি ড্রেনে ফেলে দিন, মন থেকে সমস্ত অসুখভীতি  দূর করে দিন। আপনি অবশ্য়ই সুস্থ থাকবেন। ভগবান আমাদের এই শরীর তৈরি করেছেন,  প্রকৃতিকে অবহেলা করলে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। আর এই অসুস্থতাকে কাটিয়ে উঠবার জন্যও তিনি আমাদের মধ্যেই নিরাময়ের ব্যবস্থা  দিয়েছেন। শুধু সেই ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখুন, ও আর আমাদের মুনি-ঋষিদের কথা অনুযায়ী জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করুন।  তাহলে আমাদের সমস্ত শারীরিক সমস্যা দূর হয়ে যাবে।  
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি  ওম। 

জীবন সমস্যার সমাধান। (১)

আমাদের শরীর খারাপ হলে শারীরিক চিকিৎসকের কাছে যাবো। মন খারাপ হলে মানসিক ডাক্তারের কাছে যাবো।এটাই বিজ্ঞানসম্মত। এর বাইরে জীবসমস্যার আর কোনো সমাধানের রাস্তা আছে, তা আমাদের জানা নেই। আজ আমরা সেইসব কথাই শুনবো।  প্রাচীন ভারতবর্ষে  বিজ্ঞান সম্মত আরো একটি রাস্তা ছিল, যা আসলে আজ লুপ্ত বিদ্যা, আজ আমরা সেই সব কথা শুনবো। 

আমার মাঝে মাঝে মনে হয়,  ভালো থাকার জন্য আমরা জন্মাই  না। আমরা কেবলমাত্র  সারা জীবন ভালো থাকার লড়াই করবার জন্য জন্মাই। আর এইজন্য সারা জীবন লড়াই করে করে ক্লান্ত হয়ে একসময় মৃত্যুর মুখে ঢোলে পড়ি। এই লড়াই থেকে আমাদের সরে দাঁড়াতে  হবে। মনে আছে, আমি একদিন নিজের মনে, রেলস্টশনে দিয়ে হেটে টিকিট কউন্টারের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি কিছু লোক হুড়মুড় করে দৌড়াচ্ছে। আমি পেছন দিকে তাকালাম, দেখি একটা শীর্ণকায়  পাগল হাতে একটা কাটারি নিয়ে দৌড়ে  আসছে। আমি ওর পথ ছেড়ে পাশে দাঁড়ালাম। পাগলটি আমাকে কিছু বললো না, কিন্তু যারা প্রাণভয়ে ছুটছে তাদের দিকে তারা করে এগিয়ে গেলো। আপনি বলতে পারেন, পাগলটা তো আপনাকেও মারতে পারতো। নিশ্চই পারতো, কিন্তু প্রথমত আমি জানতাম ও আমাকে মারবে না। কারন ওকে আমি খেপাইনি, আর ওকে আমি ভয় পাইনি। পাগল দুই ধরনের মানুষের দিকে তেড়ে যায়, যারা খেপায়, আর যারা ভয় পায়। তো আমি সেই দলের কেউ নোই। 

আসলে আমরা যারা ভীতু, আর যারা অন্যকে বিরক্ত করে বা বঞ্চিত করে  আনন্দ পাই,  তাদেরকে বিভিন্ন ভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।  ঠিক তেমনি, জীবনে যারা নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে দিয়ে চলেন, সময় থাকতে যারা সাবধান থাকেন, সময়মতো যারা কর্তব্য পালন করেন,  তাদের জীবনে আকস্মিক দুর্ঘটনা বলে কিছু হয় না। আসলে তারা  ভবিতব্য সম্পর্কে সম্যক  অবহিত থাকেন,  তাই ঘটনা তাদেরকে বিব্রত করতে পারে না। 

আমি লক্ষ করেছি, মানুষের মধ্যে একটা অসন্তোষ কাজ করছে। নিজে সম্পর্কে সে সন্তুষ্ট নয়, যাদের সঙ্গে সে মিশছে, তাদের প্রতি সে সন্তুষ্ট নয়, কর্ম্মস্থলে বসেদের প্রতি সে অসন্তুষ্ট, দেশনায়কদের প্রতি অসন্তুষ্ট, এমনকি নিজের স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে-আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি সে অসন্তুষ্ট। আর এই অসন্তোষ আমাদের মধ্যে একটা মানসিক সংঘাত একটা মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। আর এই মানসিক সংঘাত ও মানসিক চাপ আমাদের শারীরিক ভাবে অসুস্থ করে তুলেছে। তখন আমাদের জীবন  অর্থহীন ও উদ্দেশ্যহীন মনে হয়। যারা নিজেদের মধ্যে অসন্তোষের স্তুপ নিয়ে ঘুরছেন, তারা সময় সুযোগ পেলেই অসন্তুষের বোঝা অন্যের ঘরে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন। এটাই স্বাভাবিক। তাই অসন্তুষ্ট ব্যক্তির সংখ্যা যখন বেড়ে যায়, তখন অসন্তুষ্ট-বিশৃঙ্খল  সমাজের তৈরী হয়। অর্থাৎ শারীরিক রোগ  যেমন  সংক্রামক   হতে পারে, আমাদের মানসিকরোগও   তেমনি সংক্রামক হতে পারে।

আমরা বেকার থাকতে অসন্তোষের বোঝা নিয়ে ঘুরি।  যেকোনো চাকরির সুযোগ হাত ছাড়া করতে চাই না। কিন্তু চাকরিটা পেলেই, তার কাজের ধরণ, তার কাজের সময়, ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে নিজের মধ্যে একটা নিজস্ব  দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলি। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি, যখন ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করতে পারি না, তখন আমাদের মধ্যে আসে হতাশা। আর এই হতাশা থেকে তৈরী হয়, একধরনের ক্ষতিকর মনোভাব। আমাদের তখন মনে হতে থাকে, চারিদিকে আমাদের শত্রূ ঘোরাফেরা করছে। আর তখন শুরু হয়, এইসব কাল্পনিক  লড়াই, যাতে আমাদের  জীবনীশক্তি নষ্ট হয়। এইভাবে নিজেকে যেমন দুর্বল করে ফেলি, তেমনি আবার অন্যদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলি। এ থেকেই সৃষ্টি হয়, মানসিক রোগ, দুশ্চিন্তা, এমনকি এই মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে তৈরি হয়, নানান রকম শারীরিক রোগ। যা আমাদের জীবনকে শোচনীয় ভাবে পরাস্থ করে। 

এখন কথা হচ্ছে, এর প্রতিকার কি ? মনোবিজ্ঞানীগন বলবেন, মনঃ সমীক্ষার দ্বারা এই ধারণার পরিবর্তন সম্ভব। বুদ্ধিগম্য প্রশ্নের মাধ্যমে মনোবিজ্ঞনীগন আমাদের ব্যাক্তিত্ত্বের গভীরতা বুঝতে চেষ্টা করেন। আমাদের কাছে অজানা যে মানসিক জটিলতা আছে, তা তিনি আমাদের ধরিয়ে দিতে পারেন।  তিনি বলতে পারেন, আমাদের ভুল কোথায় ? আপাতত মনে হতে পারে, এই পদ্ধতি ঠিকই আছে।  কেউ কেউ উপকার পেয়েছেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, এই পদ্ধতিতে মনোবিজ্ঞানী  তার নিজের অভিজ্ঞতার সাহায্যে অপরের সন্মন্ধে জানতে চান। মানব মনের গভীরতায় তাদের পৌঁছনো সম্ভব নয়। তারা চেতন মন ও অবচেতন মনের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলছে, সেটাকে ধরে, আচরণের মধ্যে প্রকাশকে ধরতে চেষ্টা করেন। চেতন মনের চাহিদা ও অবচেতন মনের চাহিদার মধ্যে তারা পার্থক্য ধরে, মনোবিজ্ঞনী অবচেতন মনের চাহিদা পূরণের জন্য উপদেশ দিয়ে থাকেন। এতে ফল ভালো না হয়ে খারাপও হতে পারে। এখন তাহলে উপায় কি ?

এইখানেই ভারতের প্রাচীন যোগশাস্ত্র আমাদের সাহায্য করতে পারে। যোগ কখনো, অবচেতন মনের চাহিদা পূরণের কথা বলে না।  যোগ বলে অবচেতন মনের সংস্কারের শুদ্ধিকরণ। শুদ্ধিকরণ মানে পরিবর্তন নয়। শুদ্ধিকরণ মানে ঘষেমেজে পরিষ্কার করা  ও  আমাদের প্রকৃত স্বভাবকে পরিস্ফুট করা। পবিত্রতা মানুষের প্রকৃত স্বভাব। প্রত্যেক জীবের যেমন নিজস্ব স্বভাব আছে, ঠিক তেমনি মানুষেরও জাতিগত একটা স্বভাব আছে। আর তা হচ্ছে পবিত্রতা। এটাই মানব-আত্মার সত্যিকারের স্বভাব বা স্বরূপ। মানুষের এই প্রকৃত স্বভাবের সন্ধান পেয়েছিলেন আমাদের মুনিঋষিগন। বিজ্ঞান দুটো মনের সন্ধান জেনেছে। কিন্তু আমাদের মুনিঋষিগন আরো একটা মনের সন্ধান জানতেন।  আর তা হচ্ছে অতিচেতন মন। জাগ্রত অবস্থায় আমাদের চেতন মন কাজ করে, স্বপ্নাবস্থায় আমাদের অবচেতন মন কাজ করে, আর তুরীয় অবস্থায় আমাদের অতিচেতন মন কাজ করে। আর এই তুরীয় অবস্থার মাধ্যমেই আমরা আমাদের উচ্চতর মানবাত্মার সন্ধান পেতে পারি। এই অতিচেতন মন থেকেই আমাদের আত্মজ্যোতি প্রতিফলিত হয়। এই আত্মজ্যোতিস্বরূপ জ্ঞান আলোক আমাদের অবচেতন মনের মলিনতাকে দূর করতে পারে। আর তখনই চেতন মন ও অবচেতন মনের সঙ্গে সহযোগিতা গড়ে ওঠে। এবং আমাদের বিভিন্ন মনের যে দ্বন্দ্ব যা আমাদের মানসিক চাপ বলে মনে হয়, তা দূরীভূত হয়। অন্তরের  শান্তি  ও মনের সমন্বয় অর্জনের জন্য, মনের এই তুরীয় অবস্থার সন্ধান করতে হবে। আর জ্ঞানাতীত এই তুরীয় অবস্থা সন্ধানের নামই সাধনা। আর এই অবস্থায় পৌঁছলে আমাদের যে অনুভূতি হয়, তাকেই বলে আত্মোপলব্ধি। এই অবস্থা লাভের  ফলে আমাদের মনের সংহতি, শান্তি, সাম্যাবস্থা স্বাভাবিক  ভাবেই এসে যায়। 

কিন্তু কথা হচ্ছে, শারীরিক চিকিৎসার জন্য ডাক্তার, বা মনের চিকিৎসার জন্য মানসিক ডাক্তার আমরা সহজে পেতে পারি। কিন্তু আত্মউপল্দ্ধির জন্য সহায়ক আমরা কোথায় পাবো ? এর জন্য প্রথমদিকে আমাদের বিষয়গত তথ্য জানবার জন্য সৎ গ্রন্থ পাঠের প্রয়োজন। স্থুল জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন।  কিন্তু কেবল মাত্র বই পড়ে বা কারুর কাছ থেকে শুনে এই পথে বেশিদূর এগুলো যায় না। সঠিক পথ আপনাকেই বেছে  নিতে হবে। এর জন্য কিছু যোগক্রিয়া আছে, সেগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। সেগুলোর সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। দোকান থেকে ঔষধ কিনে খেতে পারি। কিন্তু রোগের  মাত্রা বুঝে  ডাক্তারবাবু যেমন ঔষধের মাত্রা ও প্রয়োগ বিধি  নির্দিষ্ট করে দেন, সেরকম আমাদের এই শাস্ত্র-প্রয়োগে যারা অভিজ্ঞ আমাদের তাদের কাছে যেতে হবে। আর এইজন্য বিভিন্ন আশ্রম আছে, যেখানে এই অভিজ্ঞ সন্তের সন্ধান পাবেন। আমরা যেমন ডাক্তারবাবুদের কাছে সমর্পিত হয়ে, ডাক্তারবাবুর চাহিদা পূরণ করে, তার উপদেশের  প্রত্যাশী হই। এবং তার নির্দেশ মতো ঔষধ সেবন করি এক্ষেত্রেও জীবন যন্ত্রনা  থেকে  রেহাই পাবার জন্য আমাদের সন্ত মহাত্মাদের আদেশ/নির্দেশ যাঞা করতে হবে। এবং সেইমতো কর্তব্য পালন করতে হবে। আর এই যোগক্রিয়া হচ্ছে কর্ম্মযোগ, রাজযোগ, ভক্তিযোগ, জ্ঞান যোগ। এগুলো সবই একটার সঙ্গে আর একটা সম্পর্ক যুক্ত। আমরা সব মানুষকে সমান বলি  বটে, কিন্তু বাস্তব হচ্ছে, পরিবেশ যেমন মানুষের স্বভাবের মধ্যে প্রভাব ফেলে, ঠিক তেমনি, আমরা সবাই এক-জন্মের মানুষ নোই। যে যত বেশি মনুষ্যজন্ম লাভ করবার সুযোগ পেয়েছেন, যত  বেশি জীবনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ পেয়েছেন , তার মানবাত্মার উন্নতির ধারাও সেইমতো প্রবাহিত হচ্ছে। তাই সব মানুষের চিন্তাধারার মধ্যে একটা পার্থক্য লক্ষ করা যায়। আর এই পার্থক্য অনুযায়ী যোগের ঔষধ প্রয়োগ করতে হয়। আমরা ধীরে ধীরে এইসব আলোচনা শুনবো।  আজ বাক্যের বিরাম দিলাম।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম।
  
 জীবন সমস্যার সমাধান ( ২) গূঢ় সাধন জীবন। 

প্রকৃতি বৈচিত্রময়।  প্রকৃতি রহস্যময়। এই রহস্যঃ, এই বৈচিত্র কেন ? বৈজ্ঞানিকের  বুদ্ধি দিয়ে বা পন্ডিতের পান্ডিত্য দিয়ে, এই সত্যের স্বরূপ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কেন ফুলে গন্ধ হয়, কেন বিভিন্ন ফুলে বিভিন্ন রকমের  গন্ধ   হয়, কেন ফুলের রং আলাদা আলাদা। কেন প্রত্যেক মানুষ আলাদা, কেন মানুষ হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকে না। এই রহস্যঃ উন্মোচন করবে কে ? বিজ্ঞান কেবলমাত্র কিভাবে হয়, সেটা বলতে পারে বড়োজোর। কিন্তু কেন হয় - সেকথা বলতে পারে না। ঘুমিয়ে থাকলে কেন আমরা ঠিক এমনিতর একটা বিশ্ব  দেখতে পাই।  ঘুম ভাঙলে কেন তাকে দেখতে পাই না। এইসব কথা পণ্ডিত বা বিজ্ঞানী বলতে পারে না। এর জন্য দরকার সূক্ষ্ম ও গূঢ় সাধন জীবন। শরীর - মন - বুদ্ধি - স্মৃতি আবার চারিদিকে এই যে বৈচিত্রময় জগৎ এ এক মাজার ব্যাপার। এসবের আদৌ কোনো অর্থ আছে কি ? নিরাকার থেকে সাকারের জন্ম। কিন্তু কথা হচ্ছে দরকারটা কি ? এর কোনো উত্তর নেই। মায়াশক্তির এইযে ভাঙা-গড়ার খেলা এর কোনো যুক্তিসংগত কারন নেই। জগৎ পরিবর্তনশীল, কিন্তু কেন পরিবর্তনশীল, তার কোনো জবাব নেই। কেউ বলে, ঈশ্বরের ইচ্ছে, কেউ বলে বলে এসবি ঈশ্বরের লীলা-খেলা। জগৎ কেন অনিত্য ? পঞ্চভূত কেন মিলিত হয়ে এই দেহ তৈরি করে থাকে ?এইসব কিছুর জবাব নেই।একটা কথা বলতে পারেন, মানুষ কেন ভালো থাকতে চাই ? এইসব প্রশ্নের ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তবে এই সব প্রশ্নের উর্দ্ধে ওঠা যায়। 

ঈশ্বর ঈশ্বর করে থাকি  আমরা অনেকেই। কিন্তু যে ঈশ্বরের অনুভূতি আমার মধ্যে জাগ্রত হয় নি, সে ঈশ্বরে আমার কি কাজ ? এইজন্য বলা হয়ে থাকে ঈশ্বর আছে কি নেই, এই সিদ্ধান্ত নেবার আগে, যারা ঈশ্বরকে অনুভব করেছেন, তাদের পথ অনুসরণ করে দেখো।  কিঁছু অনুভব করতে পারো কি না। আমরা আসলে যারা ঈশ্বর অনুভব করেন  নি, তাদের চতুর সুমধুর বাক্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আছি। আর আমরা ঈশ্বর থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আছি। ঈশ্বর কোনো কল্পনার বিষয় নয়, ঈশ্বর কোনো বুদ্ধির বিষয় নয়, ঈশ্বর কোনো যুক্তির বিষয় নয়, ঈশ্বর অনুভূতির বিষয়। আর স্বয়ং যতক্ষন না সেই অনুভূতির নাগাল পাচ্ছেন, ততক্ষন আমরা কেউ ঈশ্বর আছেন, এই কথা বলবার অধিকার আমাদের নেই। যোগবিদগন বলছেন, যোগের সাহায্যে এই অনুভূতির স্পর্শ অনুভব করা যায়। 

যোগাচার্য্য বলছেন, যোগের সাহায্যে আমরা এই জ্ঞানাতীত স্তরে উন্নীত হতে পারি।  আর এই জ্ঞানাতীর অনুভূতিই সমস্ত ধর্ম্মের মূল। এই জ্ঞানাতীর অনুভূতি লাভ করেই তথাকথিত শিক্ষা অর্জন না করেও ঠাকুর রামকৃষ্ণ, পরমহংস হয়েছিলেন। যিশুখ্রিস্ট লক্ষ-কোটি মানুষের প্রভু হতে পেরেছিলেন। মহম্মদ পয়গম্বর হয়েছিলেন। নিমাই হয়েছিলেন শ্রীশ্রী চৈতন্যদেব। এই জ্ঞানাতীত অবস্থায় যেতে গেলে, আমাদের অন্তরের অন্তস্থলে ডুব দিতে হবে। আমরা কেউ কেউ বিশ্বাস করি, মন্দিরে দেবতা  আছেন। এর কোনো সত্যতা আছে, তা আমরা জানি না।  ঠিক তেমনি মনে করুন না, দেহ-মন্দিরে মানব-আত্মা বা জীবাত্মা আছেন। আরো একটু এগিয়ে গিয়ে মনে করুন না আমাদের সবার অন্তরে ঈশ্বর বা পরমাত্মা আছেন। এইবার এর অনুসন্ধান করুন।  সত্যিই তিনি আছেন কি না। এই সন্ধানের পদ্ধতিই হচ্ছে যোগ। আমরা সবাই আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র দেখতে পাই। সেই দিক থেকে গেলে আমি একজন দ্রষ্টা। আবার কেউ কেউ আছেন, মানুষের মনের কথা জানতে পারেন, এই মনের কথা যিনি জানতে পারেন, তিনিও একজন দ্রষ্টা। তাহলে মনের ভিতরে দেখারও একটা চোখ আছে আমাদের সবার। এইবার মন থেকে সূক্ষ্ম হচ্ছে আমাদের অন্তর এই অন্তরকে যিনি পর্যবেক্ষন করতে পারেন তিনি  সত্যদৃষ্টা ঋষি। আর এই দৃষ্টিকেই বলা হয়ে থাকে দিব্যচক্ষুর দ্বারা দেখা। যা আমাদের সবার মধ্যে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। এই দিব্যচক্ষুকে আমাদের উন্মিলিত করতে হবে। তবেই আমরা ঈশ্বরকে দেখতে পারবো। তিনি কোথায় কি করছেন, সবই আমরা তখন দেখতে পারবো। আর এটাকেই বলে আত্মদর্শন। অর্থাৎ নিজেই নিজেকে দেখা। 

এখন কথা হচ্ছে, এই দিব্যচক্ষু উন্মিলিত করতে অসুবিধা কি ? বেদান্ত মতে এই অসুবিধা হচ্ছে, আমাদের অজ্ঞান, আমাদের অবিদ্যা। যা আমাদের দিব্যচক্ষুকে ঢেকে রেখেছে। তো আমাদের কাজ হচ্ছে , চোখের উপরথেকে এই অজ্ঞানস্বরূপ আভরণতাকে সরিয়ে ফেলা।  ব্যাস কেল্লা ফতে।  এইবার চোখ অর্থাৎ দিব্যচক্ষু তখন সবকিছুকে উদ্ভাসিত করে দেবে। যোগ দর্শন বলছে, অনিত্য, অপবিত্র, দুঃখকর পদার্থে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে, আর সেটাকেই আমরা সত্য বলে মনে করছি। এটি আসলে আমাদের ভ্রম। এই ভ্রম আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে।  তবেই আমরা সত্যের সন্ধান পাবো। 

এখন কথা হচ্ছে, কিভাবে এই অবিদ্যাকে অতিক্রম করে জ্ঞানাতীত অনুভূতি সম্পন্ন হবো ? আসলে উত্তমকুমারকে আমি সিনেমায় রাজা হিসেবে দেখছি। যতক্ষন আমি সিনেমা দেখছি, ততক্ষন আমি উত্তমকুমারকে রাজাই ভাববো। কিন্তু আমি জানি, উত্তমকুমার রাজা  নয়, এই সত্য তখনই আমার উপল্বদ্ধিতে আসবে, যখন আমি জানবো সে রাজা সেজেছে। উনি নিতান্তই আমার মতো সাধারণ প্রজা।
তো আমাদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে, সত্যিকারের রাজা কে, আর সাজানো রাজা কে ? আসলে অবিদ্যাকে অবিদ্যা রূপেই সহজে জানা যায় না। অর্থাৎ আমরা যখন সিনেমা দেখি, তখন যা কিছু দেখছি, সবই তখনকার মতো সত্য বলেই মনে হবে। অবিদ্যার প্রথম স্তর  হচ্ছে অহংকার যা আত্মাকে ঢেকে রেখেছে। এর আসে আসক্তি বা বাসনা। এদের যখন আপনি সরাতে যাবেন, তখন আসবে ক্রোধ অথবা ভীতি। আমরা অজ্ঞান জনিত অহংবোধ এবং এর সহজাত প্রবৃত্তির কারনে এই জগতে বদ্ধ অবস্থায় পরে আছি। আজকালকার মনোবিজ্ঞনীগন তিন রকম মানসিক জটিলতার কথা বলে থাকেন। কামানজনিত, অহংকারজনিত, এবং সম্প্রদায় বা গোষ্ঠিজনিত।  এই মানসিক জটিলতার থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। তবেই আমরা আধ্যাত্মিক জীবন শুরু করতে পারবো। এই মানসিক জটিলতা কাটিয়ে উঠবার জন্য আমাদের ভিতরে ভিতরে যে সংগ্রাম করতে হয়, তাকেই বলে আধ্যাত্মিক জীবনীর সংগ্রাম। এমন ভাবার কোনো কারন নেই, একদিনেই আমাদের এই জটিলতা দূর হয়ে যাবে।  দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে এই জটিলতা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারবো। তাই আমাদের সমগ্র ব্যক্তিত্ত্ব কে নতুন করে সাজাতে হবে। কিন্তু কিভাবে ? 

দেখুন ঈশ্বর, পরমাত্মা যাই বলুন না কেন, এঁকে যদি আমি আমার তীক্ষ্ণ স্বজ্ঞায় নিজের মধ্যে অনুভব না করতে পারি, তবে তা আমার অন্ধ বিশ্বাস বা কল্পনার বিষয় হিসেবে থেকে যাবে। আমাদের প্রাচীন মুনি ঋষিগন অথবা বলা যেতে পারে, হিন্দু ধর্ম্মের মহাত্মাগন এই অপরোক্ষ অনুভূতি লাভের  জন্য যোগ অভ্যাস করবার কথা বলেছেন।  এগুলো হলো, কর্ম্মযোগ, রাজযোগ, ভক্তিযোগ ও জ্ঞানযোগ। এর মধ্যে রাজযোগ যা আসলে ধ্যানের  পথ, আমাদের দৃষ্টিতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট, এবং  যেকোনো ধর্ম্ম বিশ্বাসী অনুসরণ করতে পারেন। এর পরের দিন আমরা রাজযোগ নিয়ে আলোচনা করবো। 

জীবন সমস্যার সমাধান ( ৩) - রাজযোগ - অনুশীলনী - ১ 

রাজযোগ :  যেহেতু চারটি রাস্তার মধ্যে থেকে একটি মাত্র পথ আমরা বেছে  নিচ্ছি, তথাপি আমাদের জানার জন্য, অন্যযোগগুলো সম্পর্কে  এক কথায়  শুনে নেবো। আসলে কর্ম্মযোগ অনাসক্ত কর্ম্মের উপরে জোর দিয়েছে। আবার  ভক্তিযোগে আমাদের সমস্ত ইচ্ছা ও উদ্দীপনাকে ঈশ্বরের দিকে ঘুরিয়ে দেবার কথা বলা হয়েছে। আর জ্ঞানযোগের পথে নিত্য ও অনিত্য বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের উপরে জোর দেবার কথা বলা হয়েছে।  এইবার আমরা রাজযোগের কথায় যাবো।

মহর্ষি পতঞ্জলির যোগসূত্র সমস্ত  যোগশাস্ত্রে মূল। বলা হয়ে থাকে সাংখ্যের দর্শন আসলে তত্ত্বশিক্ষার গ্রন্থ। আর মহর্ষি পতঞ্জলির গ্রন্থ সাধনকান্ড। আমাদের অনেকের ধারণা হচ্ছে, যোগক্রিয়া মানে কিছু শারীরিক ব্যায়াম ও শ্বাসপ্রশ্বাসের ক্রিয়া বা ধ্যানে লিপ্ত থাকা । আসলে কিন্তু ব্যাপারটা এমন নয়। আমাদের মনে যে ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়-এর চিন্তা ওঠে তাকে নিরোধ করা এবং মনকে উচ্চতর চিন্তার খাতে প্রবাহিত করা, এই যোগের উদ্দেশ্য। ঋষি পতঞ্জলি এই প্রক্রিয়াকে কয়েকটি ভাগে বা স্তরে ভাগ করেছেন। যম-নিয়ম-আসন-প্রাণায়াম-প্রত্যাহার-ধারণা-ধ্যান-সমাধি। আমাদের অনেকের ধারণা হচ্ছে, সরাসরি ধ্যানে বসে গেলেই হলো। বা রেচক-পূরক-কুম্ভক শুরু করলেই হলো। আর ধ্যানে বসলেই আমাদের সমাধি হয়ে যাবে। তাই  ধ্যানের আগে যে স্তরগুলো আছে, সেগুলোকে আমরা বিশেষ গুরুত্ত্ব দেই  না। আর এই কারণেই আমাদের লক্ষ পূরণ হয় না।  বরং আমরা এইসব করতে গিয়ে মানসিক ও শারীরিক জটিলতাকে আহ্ববান করি। একটা জিনিষ  শুনুন, আধ্যাত্মিক জীবন সাংসারিক জীবন থেকেও অনেক জটিল ও কঠিন।  ক্ষুরধার অস্ত্রের উপর দিয়ে হাটা। এই হাঁটার সাফল্যে   যেমন আনন্দ আছে, তেমনি বিপদের  সম্ভাবনা  আছে। তাই একটা একটা সিঁড়ি অতিক্রম করে পরের ধাপে পা দিন। লাফ  দিয়ে ছাদে উঠতে যাবেন  না। তাতে উদ্দেশ্যপূরন  তো দূরের কথা, বিপদের সম্ভাবনা বেশী। বহু ঔষধ আছে ভীষণ শক্তিশালী, কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া উচিত নয়। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। আমরা কয়েকটা ধাপে এই আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাবো। 

যেকোনো যোগ-সাধনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ত্বের প্রকাশ। আমাদের  সবার মধ্যে একটা বিশাল সম্ভাবনা আছে।  এই সুপ্ত সম্ভাবনাকে জাগ্রত করাই যোগের উদ্দেশ্য। রাজযোগ আমাদের পুরুষাকারকে ব্যবহার করে ব্যক্তিত্বের উন্মেষ ঘটায়। 

প্রথম অনুশীলন : কল্পনা করতে শিখুন। নিজে স্বপ্ন দেখতে শিখুন। আসলে কল্পনাই আমাদের সমস্ত ভাবনার মূল। জীবনে যে লক্ষ তা আমাদের ভাবনার ফল। আর ভাবনা থেকেই আসে কর্ম্ম করবার উৎসাহ, উদ্দীপনা। আর সফল কর্ম্ম আমাদের সাফল্যের শিখরে নিয়ে যেতে পারে। 

এইবার কল্পনার মধ্যে বিশুদ্ধতা আনুন। অর্থাৎ একদিকে অন্যের জন্য ক্ষতিকর চিন্তা যেমন করবেন না, তেমনি কল্পনায় নিজের ভবিষ্যৎ  জীবনকে একটা উচ্চপর্য্যায়ে নিয়ে যান। আপনি  চান, সেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করুন।  

সহ্য করবার ক্ষমতা, ধৈর্য্য ধরবার ক্ষমতা বৃদ্ধি করুন। বিপদের সময় মনকে স্থির রাখুন। বিচারশীল 
হোন। ভেঙে পড়বেন  না। নিশ্চিত সত্যকে মেনে নিতে শিখুন। যেমন আমি যেমন কর্ম্ম করেছি, তার ফল পেয়েছি। মৃত্যু একটা সত্য, প্রত্যেকের জীবনে আসবেই। একে এড়িয়ে যাওয়া   যাবে না, তাই একে  মেনে নিতে  শিখুন। প্রতিদিন একমিনিট মৃত্যু চিন্তা করুন। এবং  নিষ্ঠা সহকারে নিজের কাজ সময়মতো শেষ করুন। 

অধ্যাত্ম জীবনের প্রথম কাজই হচ্ছে  নিজের জন্য ক্ষানিকটা  সময় বেছে  নেওয়া। এইসময় আপনি নিজেকে ছাড়া অন্য কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করবেন না। এই সময়টা যদি ব্রাহ্মমুহূর্ত হয় তবে ভালো। যদি  না হয়, তবে স্নানের পরে, বা  ঘুমুতে যাবার আগে, একটা  সময় বেছে  নিয়ে, ৫-৪৫ মিনিট, যে যেমন সময় বার করতে পারবেন, সেইমতো প্রতিদিন সময়, একই আসনে,  মেরুদন্ড  সোজা রেখে একটা  জায়গায় বসুন। এইসময় আপনি নিজে কি চান, এবং সেটা কিভাবে পেতে পারেন, তার সম্ভাব্য উত্তর  খুঁজুন । নিজের কাজে কোনো ভূলত্রূটি হয়ে থাকলে, তাকে কিভাবে শোধরানো যায়, তার উত্তর খুজুন। প্রথম সাত দিন এই অভ্যাস চালিয়ে যান। 

এর পরের ধাপে মনকে শান্ত করতে হবে। ৫ মিনিট অনুলোম বিলোম  করুন। এবং আগে যা বলেছি, সেইমতো চিন্তা  করতে থাকুন। 

এর পরের ধাপে ৫ মিনিট অনুলোম বিলম্ব করুন, এবং পায়ের বুড়ো আঙ্গুল থেকে শুরু করে আপনার প্রতিটি অঙ্গের দিকে মন দিন। অর্থাৎ পায়ের আঙ্গুল-পায়ের পাতা-গোড়ালি-পায়ের নিম্নাঙ্গ-উর্দ্ধাঙ্গ-হয়ে নাভিমূলে নিজের মনকে স্থির করুন। নাভি থেকে পেট-বুক-কন্ঠ-নাক-চোখ-কপাল-কান-মাথা-মাথার তালু। প্রতিটি অঙ্গে ৩০ সেকেন্ড থামুন ও মনে করতে থাকুন, আমার অঙ্গ বিশ্বশক্তি সংগ্রহ করছে, আমি শুদ্ধ হচ্ছি, শক্তিশালী হচ্ছি। এই প্রক্রিয়া অর্থাৎ পায়ের বুড়ো আঙ্গুল থেকে মাথা আবার মাথা থেকে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল, তিন রাউন্ড করুন। ব্যাস এই প্রক্রিয়া ৭ দিন চলতে দিন। সাতদিন অতিবাহিত না হলে আমাদের পরবর্তী পর্ব্ব শুনবেন না। নিজের মধ্যে কোনো প্রশ্ন জাগ্রত হলে, নিজেকে প্রশ্ন করুন। বার বার শুধাতে থাকুন নিজেকে, আমি কি করবো ? জবাব অবশ্য়ই পেয়ে যাবেন। কেননা এই প্রক্রিয়া আপনার ধীশক্তিকে অর্থাৎ বিষয়ের গভীরে যাবার শক্তি দেবে। দেবেই দেবে।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম। 

জীবন সমস্যার সমাধান ( ৪) - রাজযোগ - অনুশীলনী - ১/১
 
আজ আমরা রাজযোগের প্রথম অনুশীলন সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে শুনবো। বিবেকানন্দ বলছেন, ব্যাক্তিত্ত্বের বিকাশ সাধনের জন্য, যোগের অভ্যাস করতে হবে। কল্পনাই প্রেরণার প্রবেশপথ।  কল্পনাই সমস্ত ভাবনার ভিত্তি। সমস্ত যোগী, বৈজ্ঞানিক অর্থাৎ আবিষ্কারকগন, এমনকি কবি, মাহাহাত্মাগণ অসীম  কল্পনা শক্তির অধিকারী ছিলেন। প্রকৃতির নিয়মের ব্যাখ্যা মানুষের শরীরের মধ্যেই পাওয়া যায়। মাধ্যাকর্ষণ নিহিত রয়েছে আমাদের দেহের মধ্যে, বহির্জগতে নয়। যোগীদের হতে হবে, স্বল্পাহারী কিন্তু উপবাসী নয়। নিদ্রাবিলাসী হলে চলবে না, আবার পরিমিত নিদ্রা অবশ্য়ই শরীরের জন্য দরকার। আমাদের অজ্ঞানতা কাটিয়ে উঠতে হবে। আমাদের স্থির হতে হবে। আমাদের হিংসা, অলসতা পরিত্যাগ করতে হবে। আমাদের লোভ-লালসা কাটিয়ে উঠতে হবে। তা না হলে আমরা যোগাভ্যাসের সুফল পাবো না। 
বিবেকানন্দ বলছেন, আমাদের  মানসিক ও শারীরিক বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে হবে। অপরিছন্ন মন, অপরিছন্ন শরীর, নোংরা পরিবেশ আমাদের মনকে নিম্নগামী করে। তাই এসবের দিকে খেয়াল রেখে চলতে হবে। দ্বিতীয়তঃ হচ্ছে আমাদের ধৈর্য্যধরে যোগের অভ্যাস করে যেতে হবে। প্রথমদিকে কিছু চিত্তাকর্ষক অনুভূতি হলেও, সেগুলোকে দূর করতে হবে। আমাদের দৃঢ়ভাবে লক্ষের  দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আর এতেকরে আমাদের অবশ্যই  সুফল মিলবে। তৃতীয়তঃ হচ্ছে, অধ্যাবসায়। সমস্ত কাজের মধ্যে, এমনকি অসুস্থ শরীরেও আমাদের নিষ্ঠাসহকারে অভ্যাস চালিয়ে যেতে হবে। একটা দিনও যাতে নষ্ট না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। 

আমরা আগেই শুনেছি, অভ্যাসের উৎকৃষ্ট সময় হচ্ছে, ব্রাহ্ম-মুহূর্ত । ব্রাহ্ম মুহূর্ত দিন ও রাতের সন্ধি-ক্ষণ । এই সন্ধি-ক্ষণে আমাদের দেহতরঙ্গ দিনের অন্যসময়ের তুলনায় বেশি শান্ত থাকে। দিন ও রাত্রি এই যে দুটি পৰ্য্যায় এর মধ্যিখানে অবস্থান ক্ষণে শুন্যবিন্দু বিরাজ করে। যদি এই ব্রাহ্ম মুহূর্তকে আমরা ব্যবহার করতে না পারি, তবে হয় বিছানা ত্যাগের পরে, অথবা বিছানায় যাবার আগে অর্থাৎ রাতে ঘুমের আগে, আমাদের এই অভ্যাস করা উচিত। স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, শরীরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, প্রতিদিন অবশ্য়ই ভালোভাবে স্নান করতে হবে। 

আমরা যখন আসনে বসবো, আমাদের শরীরের নাড়াচাড়াকে বন্ধ করতে হবে। পাথরের মতো অনড় করে রাখতে হবে শরীরকে। মাথা, দুই কাঁধ, এবং নিতম্বকে সমান্তরাল রাখতে হবে। মেরুদন্ডকে সহজ ও সরল রেখায় রাখতে হবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, এই মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়েই আমাদের সমস্ত শক্তি ওঠা-নামা  করছে, তো সমস্ত শক্তির বাহক এই মেরুদন্ডকে  দুর্বল করা চলবে না। 

আমাদের শরীরের সমস্ত অঙ্গ  তা সে পায়ের পাতা হোক বা মাথার তালু হোক, সমস্ত অঙ্গই পবিত্র, এবং এই কথাটা সব সময় মনে রাখতে হবে। নিচ থেকে উপরের দিকে সমস্ত অঙ্গের দিকে মনোযোগ দিতে হবে, আর তাকে পবিত্র নীরোগ ভাবতে হবে। প্রথমে যেমন আমরা অঙ্গগুলোকে আলাদা আলাদা ভাবে শুদ্ধ-পবিত্র-নীরোগ ভাববো, তেমনি সবশেষে আমাদের দেহকে অর্থাৎ অঙ্গ সমষ্টিকে একত্রে শুদ্ধ-পবিত্র-নীরোগ ভাববো। একটা কথা মনে রাখতে হবে, ঈশ্বর উপলব্ধি করতে হলে ঈশ্বর-প্রদত্ত এই দেহকে একটা যন্ত্র হিসেবে কল্পনা করতে হবে। একে   একটা নৌকা হিসেবে কল্পনা করতে হবে। এবং সত্য হচ্ছে, এই নৌকা-রূপ দেহের সাহায্যেই আমরা জগৎ-সমুদ্র পাড়ি দেব, আর চিরন্তন সত্যের সমুদ্রে উপনীত হবো। এইসব চিন্তা সমাপ্ত হলে, আমরা  নাকের দুই ছিদ্র  দিয়ে দীর্ঘ শ্বাস গ্রহণ করবো অর্থাৎ পূরক করবো, আবার রেচক করবো। তার পর যতক্ষন পারবো, শ্বাসক্রিয়া বন্ধ করে রাখবো। বিবেকানন্দ বলছেন, এইরকম চারবার শ্বাস গ্রহণ  করতে হবে, তারপর স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হবে। 
এইসংগে একটা জিনিস করতে হবে তা হচ্ছে প্রার্থনা, অর্থাৎ আমাদের জ্ঞানের উন্মেষ যাতে হয়, তার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে হবে। 

বিবেকানন্দের ভাষায় প্রার্থনা - "যিনি এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন, তার গৌরব-দ্যুতিকে আমি স্মরণ করি, তিনি আমার অন্তর্লোক উদ্ভাসিত করুন।" আসনে বসে দশ থেকে পনেরো মিনিট এই ধ্যানের অভ্যাস করতে হবে। 

এই অভ্যাস চলাকালীন, নিজের অভিজ্ঞতা গোপনে রাখুন। গুরুভিন্ন কাউকে এই কথা বলতে  যাবেন  না। কথা কম বলুন। সবসময় পবিত্র চিন্তায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখুন। একটা কথা মনে রাখবেন, আমরা যে যেমন চিন্তা করি, আমাদের মধ্যে আমাদের অজ্ঞাতসারেই সেইমতো হয়ে যাবার প্রবণতা তৈরি হয়। শুভ পুন্য চিন্তা আমাদের আমাদের মানসিক অপবিত্রতাকে দূর করে দেয়। বিবেকানন্দ বলছেন, যারা যোগী নয়, তার ইন্দ্রিয়ের দাস। নিজেকে মুক্ত করবার জন্য এই দাসপ্রথা থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে আসতে  হবে। 

বিবেকানন্দ বলছেন, পরমার্থের  সন্ধান আমরা সবাই পেতে পারি। ঈশ্বর যদি সত্য হন, তাহলে স্ট্যরূপেই আমরা তাকে উপলব্ধি করতে পারবো। যদি আত্মা বলে কিছু থাকে, তাহলে আমরা নিশ্চই সেই আত্মাকে প্রতক্ষ্য উপলব্ধি করবো। আর এই দর্শনের উপায় হচ্ছে দেহাতীত হয়ে যাওয়া। 

যোগীগণ আমাদের এই স্থূল দেহের অঙ্গকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন, একটা হচ্ছে অনুভূতির অঙ্গ আর একটা হচ্ছে জ্ঞান বা কর্ম্মের অঙ্গ। মনের চারটি স্তর - প্রথমত চিন্তা করবার ক্ষমতা বা চিন্তা শক্তি। সাধারণত এই শক্তিকে আমরা অপচয় করে থাকি। কারন আমরা আমরা আমাদের চিন্তাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। এই চিন্তাশক্তিকে আমরা যদি সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারি, তবে এই শক্তি বিষ্ময়কর ফল প্রদান করতে পারে। দ্বিতীয়তঃ হচ্ছে আমাদের বুদ্ধি বা ইচ্ছাশক্তি। তৃতীয়তঃ হচ্ছে আমাদের অহঙ্কার - আমাদের আত্মসচেতন অহংবোধ।  চতুর্থ হচ্ছে আমাদের চিত্ত  হচ্ছে সে পদার্থ যার মাধ্যমে  সমস্ত শক্তি কাজ করে থাকে। একে মনের মেঝে বলা যেতে পারে। অথবা চিত্ত হলো সমুদ্র এবং বিভিন্ন শক্তিগুলো হলো তরঙ্গরাশি। চিত্তে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শক্তি প্রবাহিত হচ্ছে। আর যোগ হচ্ছে এমন একটা বিদ্যা যার সাহায্যে এই চিত্তকে বিভিন্ন শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়াকে বন্ধ করতে পারে। বিবেকানন্দ বলছেন, সমুদ্রে চাঁদের ছায়া। ঢেউয়ের ওঠাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদকে কখনো অস্পষ্ট, কখনো খণ্ডিত দেখা যায়।  ঠিক তেমনি আত্মা বা আমাদের প্রকৃত সত্ত্বার যে প্রতিবিম্ব আমাদের মনের তরঙ্গে প্রতিফলিত হচ্ছে, মনের তরঙ্গ ভেদে সেই আত্মনকে কখনো খণ্ডিত, কখনো অস্পষ্ট লক্ষিত হচ্ছে। সমুদ্রের তরঙ্গ স্থির হলে, চাঁদকে স্পষ্ট দেখা যায়, ঠিক তেমনি আমাদের মনে চিন্তা তরঙ্গকে স্থির করতে পারলে চিত্তে আত্ম্যের ছায়া স্পষ্ট দেখতে পারা  যায়। 

আমরা জানি মন দেহ নয়, কিন্তু মনও একটা পদার্থ, সূক্ষতম পদার্থ। স্থুল দেহের সঙ্গে মন চিরকালীন ভাবে বাঁধা নয়। মাঝে মাঝে আমরা যখন স্থুল দেহের বন্ধন শিথিল করতে পারি, তখন এর উপলব্ধি হয় আমাদের। আমাদের অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ ক'রে, আমরা আমাদের মনকে ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। যখন এই কাজটি আমরা সম্পূর্ণ ভাবে করতে পারবো, তখন সমস্ত ব্রহ্মান্ডকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো।  আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো যা আমাদের সামনে তুলে  ধরে, তাকেই আমরা জগৎ বলি, যা আসলে পরিদৃশ্যমান জগৎ মাত্র। এর বাইরেও জগতের অস্তিত্ত্ব আছে, কিন্তু আমাদের ইন্দ্রিয় তা ধরতে পারে না। তাই সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। 

এই ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে যখন আমরা বেরিয়ে আসতে  পারবো, তখন আমাদের মধ্যে একটা পরিবর্তন আসবে, একেই বলে আধ্যাত্মিক জীবন। বিষয়ী মানুষ ইন্দ্রিয়ের দাস। আমাদের মনটাকে যদি আমরা বিভিন্ন তরঙ্গে খণ্ডিত হতে না দেই, তবে আমাদের দেহবোধ বিলুপ্ত হবে। 

লক্ষ লক্ষ বাছরের কঠিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আমাদের এই দেহ তৈরি হয়েছে। আর এই লড়াই করতে গিয়ে দেহ তৈরির যে মূলউদ্দেশ্য তা আমরা ভুলে গেছি। দেহের সঙ্গে থাকতে থাকতে, দেহের কথা চিন্তা করতে করতে আমরা নিজেদেরকে দেহ হিসেবেই ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ণ হয়ে ওঠা। কিন্তু দেহ তৈরিতে আমরা এতটাই মনোযোগ দিয়েছি যে আমরা আর পাল নেই, আমরা যেন হাড়ি কড়াই হয়ে গেছি।  আমরা আর শিল্পী নেই, আমরা যেন শিল্প হয়ে গেছি।  এই মোহ  থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। আমাদের আসল লক্ষের  দিকে  নজর দিতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে, আমরা দেহ নোই, আমরা দেহী, আমরা শরীর নোই, আমরা শরীরী। দেহ আমাদের উৎসে যাবার বাহন মাত্র। আমাদের অনন্ত যাত্রায়, দেহ আমাদের বিশ্রামাগার। দেহ আমাদের কর্ম্মক্ষেত্ৰ মাত্র।  আমি নোই। 
আমাদের মনকে ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে আসতে  হবে। মনকে দেহ থেকে আলাদা করতে হবে। দেহকে আমরা সর্ব্বশক্তি দিয়ে সমৃদ্ধ করি। তাই একেই আমরা সজীব ও আমাদের প্রকৃত সত্ত্বা হিসেবে চিন্তা করি। জন্ম থেকে জন্মান্তর ধরে আমরা নানান রকম দেহ ধারণ করেছি। তাই আমরা বিহুল হয়ে গেছি, দেহ আর আমি এক হয়ে গেছি, কিন্তু সত্য হচ্ছে দেহ আমি  নোই। দেহ আমার সম -গোত্রীয় নয়। রাজযোগ বা যোগ  এমনই একটা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি যা আমাদের দেহকে আমি থেকে আলাদা করে দেখতে বা ভাবতে সাহায্য করে। যোগী দেহকে তখন দাস ভাবতে পারে। এবং সেইমতো সে তার দেহকে পরিচালিত করতে পারে। আসলে মানসিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করাই যোগের লক্ষ। আত্মশক্তিকে যেকোনো বিষয়ে কেন্দ্রীভূত করার নামই যোগ। 
এই সম্পর্কে আমরা আরো শুনবো।  আজ বাক্যের বিরাম দিলাম। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  

 জীবন সমস্যার সমাধান ( ৪) - রাজযোগ - অনুশীলনী - ২
সূচনা : সমাধি লাভের  উপায়। 
যোগের উদ্দেশ্য সত্যকে উপলব্ধি করা। আর সত্যকে উপলব্ধি করতে হলে আমাদের যে অবস্থার মধ্যে প্রবেশ করতে হয়, তা হলো সমাধি। আজ আমরা সমাধি লাভের  বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে একটা সাধারণজ্ঞান নিয়ে নেবো। যোগের জগৎগুরু হচ্ছেন ঋষি পতঞ্জলি।  তিনি তার যোগদর্শন গ্রন্থে সমাধিপাদের ২০ নং শ্লোকে বলছেন, শ্রদ্ধা-ভক্তি, বীর্য অর্থাৎ কর্ম্মশক্তি, স্মৃতি অর্থাৎ ধ্যানশক্তি, মনের একাগ্রতা ও একতানতা  ও প্রজ্ঞা অর্থাৎ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি থেকে সমাধি লাভ সম্ভব। আসলে ভক্তিযোগ, কর্ম্মযোগ, জ্ঞানযোগ সবই সমাধি লাভের এক-একটি পথ। ঋষি পতঞ্জলি সমাধিপাদের ২৩ নং শ্লোকে বলছেন, ঈশ্বর-প্রণিধান দ্বারাও সমাধিলাভ সম্ভব। 
.আমরা শুনেছি সাংখ্য দর্শন হচ্ছে তত্ত্বকথা, আর যোগদর্শন হচ্ছে তত্ত্বের প্রয়োগ বিধি। সাংখ্য দর্শন ঈশ্বরের অস্তিত্ত্বে বিশ্বাস করে না। প্রকৃতির উপরে যিনি আধিপত্য বিস্তার করতে পারেন,  সেই পুরুষশক্তির অস্তিত্ত্বের কথাই  স্বীকার করে থাকেন মাত্র । ঋষি পতঞ্জলি মনে করেন, দুই ধরনের মানুষ আছেন, একদল জ্ঞানী ও আরেকদল অজ্ঞানী। প্রকৃতির উপরে আধিপত্য  বিস্তারকারী যোগীগনের  মন প্রকৃতিতে লিন থাকে, কিন্তু যখন তিনি আবার স্থূল দেহ ধারণ করেন, তখন এঁরা প্রকৃতির প্রভু রূপে মুক্ত  পুরুষ হয়েই অবস্থান করে থাকেন। এঁরাই যোগগুরু। সংসারী আত্মা যখন জ্ঞান ও বৈরাগ্য দ্বারা সর্বজ্ঞ-অনন্ত-জ্ঞানস্বরূপ হন, তখন তাঁরা মুক্ত পুরুষ  হিসেবে ইতস্তত বিচরণ করে থাকেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে যে সামান্য পার্থিব জ্ঞান, তাও এই অনন্ত জ্ঞানের কনাবিশেষ। গুরুদিগের গুরু হচ্ছেন ঈশ্বর। এই ঈশ্বর দেশ কালের উর্দ্ধে।  এই ঈশ্বরের আদি নেই অন্ত  নেই। 

ঋষি পতঞ্জলি, সমাধিপাদে, ২৭ নং শ্লোকে বলছেন, এই ঈশ্বরের নামই হচ্ছে প্রণব বা ওঙ্কার।  এই ওঙ্কারের অর্থ জেনে, এই ধ্বনির বারবার উচ্চারণ করলে সমাধি হয়। 

হঠযোগীগণ বলে থাকেন,  হঠযোগ সমাধি লাভের  শ্রেষ্ট উপায়। এই উদ্দেশ্যে, ঘটের সাধনা করতে হয়, সর্বাগ্রে। ঘট  অর্থাৎ শরীর। তারা বলেন, এই ঘটেই আছে, প্রাণ-অপান, নাদ , বিন্দু, জীবাত্মা ও পরমাত্মা। তাই হঠযোগীগণ শরীরকে দীর্ঘস্থায়ী ও রোগমুক্ত রাখবার জন্য শোধনক্রিয়া অর্থাৎ ধৌতি -বস্তি-লৌলিক-ত্রাটক-কপালভাতি এই ছয়টি শোধনক্রিয়া অভ্যাস করতে বলে থাকেন। এর দ্বারা আমাদের শরীরের মধ্যে একটা সাম্য  বজায় থাকে।  ধৌতি - শরীরের মল নাশ করে, বস্তি -  পেট সুস্থ  থাকে, নেতি - শ্লেষ্মা নিবারণ হয়,  লৌলিক -দেহের অগ্নি বৃদ্ধি পায়, ত্রাটক - দৃষ্টিশক্তি অক্ষয় থাকে, কপালভাতি - জরা ও বার্ধক্য নিবারিত হয়। বত্রিশটি আসন অভ্যাসের কথা বলেছেন।  এগুলো হচ্ছে,  সিদ্ধাসন, পদ্মাসন, স্বস্তিকাসন, বজ্রাসন,   ভদ্রাসন, মুক্তাসন, বিরাসন, গুপ্তাসন, সিংহাসন, মৃতাসন, ধনুরাসন, মৎস্যাসন, গুমুখাসন, মৎসেন্দ্রাসন, সংকটাসন, গোরক্ষাসন, উৎকটাসন, পশ্চিমোত্তানাসন, যোগাসন, ভূজঙ্গাসন উষ্ট্রাসন মকরাসন বৃষাসন গরুড়াসন শলভাসন মণ্ডূকাশন বৃক্ষাসন কূর্মাসন কুক্কুটাশন, ময়ূরাসন উত্তানকূর্মাসন উত্তমান্ডুকাসন। 

এছাড়া আমাদের শরীর  ও মনের স্থিরতা বজায় রাখবার জন্য, দেহমধ্যস্থ কুল-কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করবার জন্য ২৫টি মুদ্রার অভ্যাস করবার কথা বলে থাকেন হঠযোগীগণ । সেগুলো হলো,  মহামুদ্রা-নভোমুদ্রা-মাহমেধ-মহাবন্ধ-মূলবন্ধ-উড্ডীয়ান-জলন্ধর-খেচরী-যোনী-বিপরীতকরণী-বজ্রোলী-মান্ডবী-শক্তিচালনী-তরাগী-শাম্ভবী - ভুজঙ্গিনী-মাতঙ্গী-অস্বিনী-কাকী-পাশিনী-পার্থিবীধারনা-আন্তসীধারণা-বৈশ্বানরী ধারণা-বায়বীধারণা-আকাশীধারণা।

এদিকে রাজযোগীগণ বলেন, যতই তুমি চেষ্টা করো না কেন, শরীর নশ্বর, ধংশশীল। শরীরকে কোনো জীব এমনকি কোনো মানুষ চিরকাল রক্ষা করতে পারে না।  যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকেও দেহ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।ঋষি পাতঞ্জলকেও দেহ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।   এইজন্য আমাদের যেটা আদর্শ হাওয়া উচিত সে হচ্ছে সমাধিলাভের জন্য শরীরকে সুস্থ  ও সবল রাখা এবং মনকে বশীভূত রাখবার জন্য চেষ্টা করা। এইজন্য রাজযোগে শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য যতটা জোর দেওয়া হয়েছে, তার থেকে মনকে বশীভূত রাখবার জন্য অধিক গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে। আর এই মনকে বশীভূত রাখবার জন্য যুক্তির সাহায্য নেওয়া হয়েছে। মহর্ষি বশিষ্ঠ বলছেন, আধ্যাত্মিক বিদ্যা অর্জন করতে গেলে, আমাদের সাধু-সঙ্গ  করতে হবে, সম্পূর্ণভাবে বাসনা ত্যাগ করতে হবে এবং প্রাণবায়ুকে নিরোধ করতে হবে।  তবেই আমরা মনের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে  পারবো।  সমাধি লাভের  এটাই শ্রেষ্ঠ উপায়। 

ক্রিয়াযোগ ব'লে একটা কথা আমরা শুনে থাকি। ঋষি পতঞ্জলি যোগদর্শনের সাধনপদের ১ নং শ্লোকে বলছেন তপস্যা, স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বর-প্রণিধান অর্থাৎ  ঈশ্বরে আমাদের সমুদয় কর্ম্মফল সমর্পনই ক্রিয়াযোগ। আমাদের জড়তা, আমাদের শারীরিক রোগভোগ, আমাদের সন্দেহবাতিক মন , আমাদের উদ্দমহীনতা, আমাদের আলস্য, আমাদের বিষয় তৃষ্ণা, আমাদের অজ্ঞান, আমাদের অসংযত শ্বাস-প্রশ্বাস এগুলো আমাদের মনকে বিক্ষিপ্ত করছে। এইজন্য আমাদের যেমন আহারের প্রতি সংযম পালন  করতে হবে, তেমনি কঠোরতার সঙ্গে আমাদের নিয়মিতভাবে যোগের অভ্যাস করতে হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা একজন উপযুক্ত গুরুর সান্নিধ্যে থেকে এইসব কঠোর নিয়মের পালন করতে হবে। একমাত্র অভিজ্ঞ গুরুই পারেন যোগের সঠিক পদ্ধতি বলে দিতে। অনিয়মিত যোগের অভ্যাস বা সঠিক পদ্ধতিতে যোগের অভ্যাস না করায় আমাদের  শরীর  ও মনের উপরে যে চাপ সৃষ্টি হতে পারে, তা আমাদের স্বাভাবিক সামাজিক জীবনযাপনে বাধাস্বরূপ হতে পারে। একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, নিয়মিত শ্বাসপ্রশ্বাস জীবকে জীবন্ত করে রেখেছে, অনিমিয়ত শ্বাসপ্রশ্বাস আমাদের শারীরিক ও মানসিক দিকে থেকে অসুস্থ করে তোলে। আর শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি রুদ্ধ হয়ে গেলে এই শরীর মৃতদেহ বা শব মাত্র। চেতনাহীন  জীবন হয়, কিন্তু প্রাণহীন জীবন হয় না। তাই যোগ বিশেষ করে বায়ু রুদ্ধ করবার যে প্রক্রিয়া তা অভিজ্ঞ গুরুর সান্নিধ্যেই অভ্যাস করা উচিত।  অভিজ্ঞ গুরু সময়মতো সঠিক নির্দেশ দিয়ে, যোগের সাফল্য অনুভব করাতে পারেন। অন্যথা যোগ অধরা হয়েই থাকবে। আর সমাধির অভিজ্ঞতাও আমরা লাভ করতে পারবো না।   

এর পরের দিন আমরা স্বামী বিবেকানন্দের সাথে রাজযোগের দ্বিতীয় অনুশীলনের শিক্ষা নেবো।তথ্যসূত্রঃ বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ - প্রথম খন্ড - প্রবন্ধ - রাজযোগ সংক্রান্ত ছটি অনুশীলনী।  

সমাধি লাভের উপায় (২

জীব বহু-জন্মের সঞ্চিত সুকৃতির ফলে সমাধির সন্ধান পায়। আমরা মাণ্ডুক্য উপনিষদ আলোচনার সময় শুনেছি, ব্রহ্মর চার অবস্থা। জীব তিনটি অবস্থা নিয়ত ভোগ করে থাকে। জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি। এই তিনটি অবস্থা ছাড়া আর একটা অবস্থা আছে, যাক বলা হয় তুরীয়। এই তুরীয় অবস্থাই সমাধির অবস্থা। খুবই অল্প সংখ্যক  মানুষ এই সমাধি অবস্থার সন্ধান পেয়ে থাকেন। আমরা শুনেছি, জাগ্রত অবস্থায়, আমাদের মন, বুদ্ধি, চিত্ত অহংকার, পাঁচটি কর্ম্ম ইন্দ্রিয়, পাঁচটি জ্ঞান ইন্দ্রিয় ক্রিয়াশীল থাকে। যখন কর্ম্ম-ইন্দ্রিয়, জ্ঞান-ইন্দ্রিয় বাদে বাকি চারটি অর্থাৎ মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার ক্রিয়াশীল থাকে তাকে বলা হয় আমাদের স্বপাবস্থা। যখন এই চোদ্দটি করনই নিষ্ক্রিয় হয়, তখন আমাদের সুসুপ্তির অবস্থা।  এই সুসুপ্তির অবস্থায় আমরা "আমি"কে পর্যন্ত ভুলে যাই। তখন জগৎজ্ঞান এমনকি "আমি আছি"  এই জ্ঞানও আমাদের থাকে না। একে মৃতপ্রায় অবস্থা বলা যায়। এর পরের  স্তর হচ্ছে সমাধি। এই সমাধির অবস্থায়, আমাদের জগৎজ্ঞান থাকে না, কিন্তু আত্মসত্তাটি প্রবুদ্ধ থাকে। যাকে  বলা যেতে পারে জেগে ঘুমোনো। জগতভাবে আমরা নিদ্রিত, কিন্তু আত্মভাবে আমরা জাগ্রত বা প্রবুদ্ধ। একেই বলে সমাধি। রাজযোগের ফলে বা বুদ্ধির প্রভাবে, আমাদের চৈতন্যময় সত্তা মহাব্যোম মন্ডলে অবস্থান করতে অভ্যস্ত হবার পর, এই অবস্থা আপনা-আপনি উপস্থিত হয়। এটাই ব্রহ্মে স্থিতি বলা হয়ে থাকে । এটাই মায়ের কোল। যাঁরা ভক্তিরসে ধনবান, যাঁরা বুদ্ধিযুক্ত কর্ম্মফলে চিন্ময়-জ্যোতির্ধনে ধনবান, এই ধনবানদের কাছে সমাধির আবির্ভাব ঘটে । অষ্টাঙ্গ যোগের চরম অংঙ্গ এই সমাধি। আমরা জানি যোগশাস্ত্রে আটটি যোগের কথা বলা হয়েছে। এগুলো যে কেবল ভগবান লাভের  পক্ষে উপযুক্ত তাই নয়, যোগ ছাড়া জগতের কোনো ব্যাপারই নিস্পন্ন হতে পারে না। যোগ শব্দটির  অর্থ মিলন। তা সে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে মিলন হতে পারে। মনের সঙ্গে বুদ্ধির মিলন হতে পারে। আবার বুদ্ধির সঙ্গে আত্মার মিলন হতে পারে। জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন হতে পারে, ভক্তের সাথে ভগবানের মিলন হতে পারে। মায়ের সঙ্গে ছেলের মিলন হতে পারে। আটটি অঙ্গের সমষ্টি হচ্ছে যোগ। 

ধরুন আমি খেতে বসবো, এখন এই খাবার জন্য, আমাকে একটা মানষিক প্রস্তুতি দরকার। অর্থাৎ এখন খেতে হবে, এই ভাবনা।  একেই যোগের ভাষায় বলে যম।  অর্থাৎ অন্য সমস্ত কিছু থেকে নিবৃত্ত হয়ে আমি খাবার জন্য প্রস্তুত হবো। এখন ধরুন খাবার আগে হাতে পায়ে চোখে মুখে  জল দিয়ে পরিষ্কার করবো। এরই নাম নিয়ম। আমরা যখন খেতে বসবো, তখন একটা নির্দিষ্ট আসনে বসবো।  তা সে চেয়ারে হতে পারে, বা মাটিতে হতে পারে। এই যে একটা নিষদিস্ট আসনে বসা একেই যোগের ভাষায় আসন। এর পর প্রাণায়াম। যারা জানেন, তারা খাবার আগে ডান  নাসিকা দিয়ে, শ্বাস প্রবাহিত করতে চেষ্টা করেন, কারন এতে আমাদের হজম কার্য্য সহজে হতে পারে। অর্থাৎ যে কার্য্যের জন্য যেরূপ শ্বাস এর প্রয়োজন সেটা করতে হবে। এর পরে প্রত্যাহার। ইন্দ্রিয়বৃত্তিগুলোকে অন্যান্য বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে খাবার দিকে মনো নিবেশ করে প্রত্যাহার। এর পর ধারণা। আমাদের ক্ষুধা সম্পর্কে একটা ধারণা রাখতে হয়। আর সেই অনুযায়ী আমাদের খাবার খেতে হবে, আবার  খাওয়া  থেকে বিরত হতে হবে। চিত্তকে আহার গ্রহণ ও তারজন্য তৃপ্তি ও ক্ষুন্নি-বৃত্তির দিকে ধারণা করে রাখতে হয়। তাই ক্ষুধার তৃপ্তি বা নিবৃত্তি হলেই আমাদের খাবার কাজ শেষ করতে হয়। এই যে আহার বিষয়ে ধ্যান বা চিন্তা এবং তার জন্য আমাদের খুই অল্প সময়ের জন্য সমাধি হয়।  ক্ষণকালের জন্য, মন আজ্ঞাচক্র স্পর্শ করে আসে।  এবং এর ফলেই আহারকার্য্য নিস্পন্ন হয়ে থাকে। 

ঠিক তেমনি আমাদের সমস্ত কার্য্য। আমাদের সমস্ত কাজের ভিতর দিয়েই এই অষ্টাঙ্গযোগ সাধিত হচ্ছে। আসলে জাগতিক কাজগুলোতে আমরা এতটাই অভ্যস্ত যে প্রত্যেক কাজের মধ্যেই আমরা অষ্টাঙ্গযোগ সাধন করছি, কিন্তু তা আমরা ধরতে পারি না। অথচ এটা আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই হচ্ছে। 

আসলে সমাধি কোনো কাজ নিস্পন্ন করতে পারে না। মন যখন বুদ্ধিতে সংস্থাপিত হয়, তখন আমাদের সমাধি হয়। মন যখন নিশ্চয়াত্মিকা বৃত্তিতে সমাহিত হয়, তখন সমাধি হয়। গায়ে একটা মশা পড়লো বা মশায় কামড়ালো, ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে এই মশায় কামড়ানো ব্যাপারটা মনের কাছে উপস্থিত হয় । মন কিছু বলতে পারে না, সে আবার একে বুদ্ধির কাছে উপস্থিত করে, এই যে উপস্থিত করা এর নাম সমাধি। এই সময় মন আজ্ঞাচক্রে বুদ্ধির সাথে মিলিত হয়। আর বুদ্ধি বলে দেয়, এটা মশার কামড়। তাই যন্ত্রনা হচ্ছে। অমনি মন "উঃ মশা" বলে যন্ত্রনা অনুভব করে। এই খেলাই  সবসময়-সর্বত্র চলছে। আমরা ধরতে পারি না। এই যে মন ও বুদ্ধির মিলনরূপ, একেই বলে সমাধি। জাগতিক সমস্ত কাজের মূল হচ্ছে এই সমাধি। আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত এই সমাধির খেলা চলছে। অষ্টাঙ্গ যোগের খেলা চলছে। 

কিন্তু এই যে সমাধি, একে ধরবার জন্য যোগীদের প্রয়াস নয়। যোগীদের সমাধি হচ্ছে প্রজ্ঞার সাথে মনের মিলন। প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম। মন যখন প্রজ্ঞান আকারে আকারিত  হয়, অথবা মন যখন প্রজ্ঞায় বিলীন হয়ে যায়, তখনই যথার্থ সমাধি হয়। সমাধিতে জ্ঞান-জ্ঞাতা-জ্ঞেয়  তখন এক হয়ে যায়। এরই নাম অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি। সমাধি সমস্ত মিলনের দ্বার। জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলের নাম সমাধি। প্রতিনিয়ত জীব-চৈতন্যে পরম-চৈতন্যের আবির্ভাব ও তিরোভাব হচ্ছে, যতদিন আমরা এই আবির্ভাব ও তিরোভাব আমরা প্রতক্ষ্য করতে না পারি, যতদিন না উপলব্ধি করতে পারি, ততদিন আমাদের জীবসত্তা জন্ম-মৃত্যু- দুঃখ-কষ্ট , শোক-তাপ থেকে পরিত্রান পেতে পারে না।  সমাধি লাভই মানুষের জীবনের চরম ও পরম চরিতার্থতা। 

প্রথমদিকে সমাধি মলিন ভাবাপন্ন থাকে।  ধীরে ধীরে এই মলিন ভাব কেটে যাবে, আমাদের শোক-তাপ দূরীভূত হবে। দুরন্ত মন তখন শান্ত হবে। 

স্থুলদৃষ্টিতে আমাদের মনে হয়, যম-নিয়ম ইত্যাদি এক-এক অঙ্গগুলোর পরিপক্কতা অনুসারে অপরটি আবির্ভূত হয়।  ব্যাপারটা আসলে তা নয়। সমাধি আসবার সময় হলে, অন্যান্য যোগাঙ্গগুলো, যেন আপনা থেকেই সম্পন্ন হতে থাকে। সমাধি আসলে নীতিসিদ্ধ। সমাধি কোনো জড় পদার্থ নয়। ধ্যান হতে সমাধি আসে না। সমাধি আসলে ধ্যান সিদ্ধ  হয়। তথাপি আমাদের যম থেকেই শুরু করতে হয়, সমাধিতে শেষ হয়। 

যাইহোক, এর পরের দিন আমরা স্বামী বিবেকানন্দের সাথে রাজযোগের অনুশীলনের দ্বিতীয় ভাগের কথা শুনবো। যোগ সাধনের ক্রিয়াগুলোর মধ্যে প্রবেশ করবো। তথ্যসূত্রঃ বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ - প্রথম খন্ড - প্রবন্ধ - রাজযোগ সংক্রান্ত ছটি অনুশীলনী।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 
 
জীবন সমস্যার সমাধান ( ৪) - স্বামী বিবেকানন্দের সাথে রাজযোগ - অনুশীলনী - ২

রাজযোগ অষ্টমুখী যোগ। এগুলো হলো :  যম, নিয়ম, আসন,প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান, সমাধি। আমরা সংক্ষেপে এ সম্পর্কে শুনে নেবো। 
যম :  যমের কথা শুনলেই আমাদের মনে মৃত্যুর দেবতা এক ভীষণ আকৃতির শাক্তিশালী পুরুষের চিত্র ভেসে ওঠে আমাদের মনে। যম কথাটার অর্থ হচ্ছে সংযম বা সংযত হওয়া।  যম  আমাদের সবকিছু থেকে নিবৃত্ত করেন। আমাদের জীবনকে যদি সঠিক ভাবে পরিচালিত করতে হয়, তবে আমরা যমের সাহায্য নিতে পারি। তো কথা হচ্ছে, আমরা কিসের থেকে নিবৃত্ত 
থাকবো ? 
১. আমাদের চিন্তায়, আমাদের কথায়, আমাদের কাজে যেকোনো জীবের অনিষ্ট থেকে নিবৃত্ত থাকে হবে।
২. আমাদের সমস্ত লালসা থেকে নিবৃত্ত থাকতে হবে। 
৩. অসত্যকে বর্জন করতে হবে।  আমরা যেন কাজে, কথায়, চিন্তায় সত্যকে রক্ষা করে চলি। 
৪. কারুর জিনিস না বলে নেওয়া চলবে না।  অর্থাৎ চৌর্যবৃত্তি থেকে নিবৃত্ত থাকতে হবে। 
৫. দান  গ্রহণ করা থেকে নিবৃত্ত থাকতে হবে। 

নিয়ম : জীবনকে আমাদের একটা নিয়মের মধ্যে বেঁধে নিতে হবে। স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিতে হবে। নিয়মিত নিদ্রা, ও পরিমিত আহার গ্রহণ করতে হবে। 

আসন : আমি দেখেছি, বহু মানুষ মেরুদন্ড  সোজা রেখে  দাঁড়াতে চান না, এমনকি দুই পায়ে দাঁড়াতেও চান না। একপায়ে দাঁড়িয়ে অন্য পা-কে বিশ্রামে রাখেন। এইসব মানুষ মানসিক দিক থেকে দুর্বল। দৃঢ়চেতা মানুষ সব সময় মেরুদন্ড সোজা রেখে চোখে চোখ রেখে কথা বলে থাকেন। এই জায়গাটা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। আমরা যেন ত্রিভঙ্গ শরীরের অধিকারী  না হই। যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, মেরুদন্ড সোজা রাখুন। আমরা যখন ধ্যানে বসবো আমাদের নিতম্ব কাঁধ মাথা সোজা রাখতে হবে। 

প্রাণায়াম : প্রাণকে নিয়মিত আরামের মধ্যে রাখতে হবে। প্রাণের আয়াম হচ্ছে প্রাণায়াম। আমরা আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতি, যা আমাদের জীবনীশক্তি প্রদান করে, যা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে তার দিকে আমাদের কোনো যত্ন তো দূরের কথা খেয়ালই  রাখি না। শ্বাস কখন এলো, আবার কখন গেলো, সেটা আমাদের নজরে পড়ে না। আমরা ভাবি ওটাতো এমনি এমনি হয়। এর জন্য আমাদের কোনো প্রয়াস করতে হয় না। কিন্তু সত্য হচ্ছে, যিনি এই শ্বাস-প্রশ্বাসের গতির দিকে খেয়াল রাখতে পারেন, তিনি শুধু  শারীরিক দিক থেকে সুস্থ  থাকতে পারেন তাই নয়, তিনি উন্নত মানসিক চিন্তাধারার মানুষ হয়ে যান। এইজন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে। 

প্রত্যাহার : আমাদের মন স্বাভাবিক ভাবে বহির্মুখী। এই বহির্মুখী মনকে আমাদের অন্তর্মুখী করতে হবে। যে কোনো বিষয়কে যদি বুঝতে হয়, তবে সেই জিনিসের প্রতি বা বিষয়ের প্রতি আমাদের মনঃসংযোগ করতে হবে। আর অধ্যাত্ম সাধনা যেহেতু অন্তরের  বস্তুকে উপলব্ধির সাধনা, তাই আমাদের বহির্মুখী মনকে অন্তর্মুখী করার চেষ্টা করতে হবে।  একেই বলে প্রত্যাহার। 

ধারণা :  কোনো একটা বিষয়ে মনকে একাগ্র করা। অর্থাৎ বিষয়-বহির্ভূত চিন্তা মনে আনতে  দেওয়া চলবে না। 
ধ্যান : ধ্যান আর কিছু নয়, গভীর চিন্তন।  অর্থাৎ নির্দিষ্ট বিষয়ে গভীর চিন্তা করবার অভ্যাস করাই ধ্যান। 
সমাধি :সমাধি একটা বোধদয় অবস্থা। আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টার মূল লক্ষ হচ্ছে এই সমাধির অবস্থা।

ঘোড়া দাঁড়িয়ে ঘুমায়। ঘোড়ায় কামড়ালে সেখান থেকে মাংসের দলা নিয়ে তবে ছাড়বে। জোঁক একটা  গাছ আঁকড়ে ধরে তবে অন্য গাছ ছাড়বে। এর দ্বারা আমি বলছে চাইছি, যে - যে বিষয়টি আপনি ধরবেন, তার শেষ দেখে তবে ছাড়বেন। যতক্ষন বিষয়টি আপনার আয়ত্ত্বে না আসবে, ততক্ষন অন্য বিষয়ের দিকে নজর দেবেন না। আর এই যে পর্যায়গুলো আমরা আলোচনা করলাম, এর প্রত্যেকটি পর্যায় আপনাকে অনুশীলনের মাধ্যমে আয়ত্ত্বে আনতে  হবে। যম ও নিয়ম আমাদের সারা জীবন ধরে চর্চা করতে হবে। এর থেকে বিচ্যুত হওয়া মানে সাধন জীবন থেকে ছিঁটকে যাওয়া। 

এবার আমরা প্রাণের নিয়ন্ত্রণ বা প্রাণায়ামের সম্পর্কে শুনবো । স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, রাজযোগের মাধ্যমে শ্বাস আমাদের মনোজগতে প্রবেশ ক'রে আমাদের অতীন্দ্রিয় মার্গে উন্নীত করতে পারে। আমাদের সমস্ত দৈহিক গঠনতন্ত্রের পরিচালক হচ্ছে এই শ্বাস-প্রশ্বাস।  প্রাণায়াম প্রথমে ফুসফুসের উপরে কাজ করে। ফুসফুস প্রভাবিত করে হৃদপিন্ডকে। হৃৎপিন্ড প্রভাবিত করে আমাদের রক্ত চলাচল ব্যবস্থাকে। আবার রক্ত চলাচলের দ্বারা  প্রভাবিত হয় আমাদের মস্তিস্ক। মস্তিস্ক প্রভাবিত করে আমাদের মনকে। আমাদের যে ইচ্ছাশক্তি তা বাহ্যিক বিষয়ের অনুভূতিসম্পন্ন। আবার বাহ্যিক বিষয়ের অনুভূতি আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে জাগ্রত করতে পারে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ইচ্ছাশক্তি ভীষণভাবে দুর্বল। ইচ্ছাশক্তির অসীম ক্ষমতাকে আমরা উপল্বদ্ধি করতে পারি না। তার কারন হচ্ছে জড় জগতের বন্ধনীতে আমরা আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পরে আছি। আমাদের প্রায় সব কাজই বহির্জগতের প্রেরণায় ঘটে থাকে। আর বহির্বিশ্ব আমাদের অন্তরের ভারসাম্যকে নষ্ট করে থাকে। আমরা প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করতে পারি না, উপেক্ষাও করতে পারি না,যা আমাদের পারা  উচিত। আমাদের মধ্যে এক বৃহত্তর শক্তি আছে, যা আমাদের কাছে অজ্ঞাত ও নিষ্ক্রিয়। 

যোগ সাধনায় অভিজ্ঞ যোগীগণ আমাদের পথপ্রদর্শক। তাঁরা যোগসাধনার সাহায্যে এই ইন্দ্রিয়প্রসূত জগৎকে জয় করতে পেরেছিলেন। তাঁরা তাদের কথায় ও কাজে এই শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস-এর ক্রিয়াকে বা প্রাণায়ামকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ১. পূরক অর্থাৎ শ্বাস গ্রহণ, ২. কুম্ভক অর্থাৎ শ্বাসকে নিরুদ্ধ করা।  এই কুম্ভক আবার দুই রকম, অন্তর কুম্ভক অর্থাৎ বায়ুকে ভিতরে আটকে দেওয়া, আবার বাহ্য  কুম্ভক অর্থাৎ বায়ুকে বাইরে আটকে রাখা। ৩. রেচক অর্থাৎ শ্বাস ত্যাগ করা। 

এইবার বায়ুর গমন পথ সম্পর্কে একটু বুঝে নেই। আমাদের নাকে দুটো ছিদ্র আছে। ঠিক তেমনি আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে দিয়ে দুটি তরঙ্গ প্রবাহিত হয়। এই তরঙ্গদুটি নিম্নগামী হয়ে মেরুদণ্ডের দুই পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়।  এবং মেরুদণ্ডের কেন্দ্রবিদু স্পর্শ করে আবার মস্তিষ্কে ফিরে আসে। এই তরঙ্গ, দুটো নাড়ীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়। একটি সূর্য নাড়ী বা পিঙ্গলা নাড়ী। আর একটা চন্দ্র নাড়ী বা ইড়া নাড়ী। এই নাড়ীদুটোর গতিপথ বাংলা ৪ এর আর্দ্ধ্যাংশের মতো। আর এদের প্রবাহিত হবার সময় ৪ সংখ্যাটি সম্পূর্ণ হয়। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস যেমন দিবারাত্র প্রবাহিত হচ্ছে, ঠিক তেমনি এই তরঙ্গদুটো দিবারাত্রি প্রবাহিত হচ্ছে। আবার এই তরঙ্গ আমাদের মেরুদণ্ডের বিভিন্ন বিন্দুতে অর্থাৎ চক্রে জীবনীশক্তির একটা বিশাল ভান্ডার গড়ে তোলে। আমরা সাধারণত এই শক্তি সম্পর্কে সচেতন নোই। তাই একে আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। কিন্তু যদি আমরা এইসব চক্রে  মনঃসংযোগ করি, তবে এই শক্তিগুলোকে উপলব্ধি করতে পারি। এমনকি আমরা যদি আমাদের দেহের ভিতরের অঙ্গে একটু বেশি মনোযোগ দেই , তবে সেই  অঙ্গক্রিয়া   সম্পর্কেও আমাদের উপল্বদ্ধির মাত্রা বৃদ্ধি  পাবে। ইড়া  ও পিঙ্গলা নাড়ী দুটি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে নিবিড় ভাবে যুক্ত।  আর এই শ্বাস-প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ ক'রে আমরা আমাদের এই দেহযন্ত্রকে বশে  আনতে  পারি। 

যোগ আমাদের নৈতিক হতে সাহায্য করে। আর এই নৈতিকতার নিয়ন্ত্রক হচ্ছে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস। শ্বাস-প্রশ্বাস আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করে। তো শ্বাস-প্রশ্বাসকে যদি আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি, তবে আমাদের মন নিয়ন্ত্রণে থাকবে। যোগ আমাদের নিয়ন্ত্রণবিদ্যায় পারদর্শী করে তোলে। সমস্ত তরঙ্গগুলোকে যোগীগণ মেরুদণ্ডের বিভিন্ন চক্রে ধরে রাখেন, এবং নিজেদের ইচ্ছামত পরিচালিত করে থাকেন। এই তরঙ্গ তখন জ্ঞান তরঙ্গে পরিণত হয়।  যোগীগণ তাই জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ হয়ে থাকেন।

এবার আমরা তরঙ্গ  প্রবাহিত করবার সঠিক পদ্ধতির দিকে নজর দেবো। প্রথমেই বলি, এই পদ্ধতি সাধারণের জন্য নয়। যারা আমাদের আগের আলোচনা শুনেছেন, এবং সেইমতো নিজেকে প্রস্তুত করেছেন, তারাই একমাত্র এই পদ্ধতি অবলম্বন করবার যোগ্য বিবেচিত হবেন। আসলে আমাদের শ্বাস-প্রশাসকে ছন্দবদ্ধ করতে হবে। এর জন্য আমরা পূরক ও রেচকের সময় ১২৩৪ গুনতে পারি।  কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, এই সময়ে ওঁ এই ধ্বনি পরপর চারবার উচ্চারণ করতে পারি। আমরা জানি  বায়ু তরঙ্গের মধ্যে  ধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছে। আর সমস্ত শব্দ বা ধ্বনির  বীজ বা মূল  হচ্ছে এই ওঙ্কার বা  ওং।  তাই এই ওং ধ্বনির স্মরণ আমাদের দুই দিক থেকে লাভবান করবে। যাই হোক, ধর্মীয় দিক থেকে না দেখে আমরা যদি বিজ্ঞানের দিক থেকে দেখি তবে প্রণবের মাহাত্ম আমাদের শরীর  তরঙ্গে একটা প্রভাব ফেলছে, তা আমাদের স্বীকার করতে হয়।  যাই হোক এবার আমরা প্রাণায়ামের প্রক্রিয়ার কথা শুনবো, স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে।  

১. ডান হাতের  বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ডান নাকের নাসারন্ধ্র বন্ধ করুন। বা নাসারন্ধ্র দিয়ে ওং শব্দটি  চারবার মনে মনে  উচ্চারণ করতে করতে শ্বাস গ্রহণ করুন।  
২. এবার বামনাশা, তৰ্জনী বা অনামিকা দিয়ে বন্ধ করুন, অর্থাৎ এখন আপনার ডান নাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে বন্ধ, বাম  নাক অনামিকা দিয়ে বন্ধ। এবার  শ্বাসকে ধরে রাখুন বা অন্তর-কুম্ভক করুন  ও  আটবার মনে মনে  ওঁ শব্দটি উচ্চারণ করুন। 

৩. এবার ডান নাক  থেকে বুড়ো আঙ্গুল সরিয়ে নিঁশ্বাস ছাড়তে থাকুন।  এইসময় চারবার মনে মনে  ওং বলতে হবে।  শ্বাস পুরো ছেড়ে দেওয়া হলে তলপেট পিঠের দিকে অর্থাৎ ভিতরের দিকে টেনে নিন যাতে ফুসফুসে কোনো বাতাস না থাকে। এবার বাহ্য-কুম্ভক করুন সঙ্গে সঙ্গে ৮ বার ওং  উচ্চারণ করুন।
 
৪, এরপর বা নাকের নাসারন্ধ্র বন্ধ করে, ডানদিক দিয়ে গভীর শ্বাস নিতে হবে।  এইসময় চারবার ওং  বলতে হবে। শ্বাস নেওয়া পূর্ন হলে, অন্তরকুম্ভক করুন, এবং মনে মনে আটবার ওং  উচ্চারণ করুন।  
৫.. এবার ডান নাক বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বন্ধ করতে হবে বাম নাক দিয়েধীরে ধীরে  নিশ্বাস ছাড়তে হবে।  আবার 
বাহ্য-কুম্ভক করতে হবে, ও আটবার ওং উচ্চারণ করতে হবে।  

অর্থাৎ পূরক একবার ডান  নাকে একবার বা নাকে। রেচক ঠিক বিপরীত ভাবে একবার বাম নাকে একবার ডান নাকে। বাহ্য কুম্ভক একবার বাতাস বাইরে রেখে, অন্তর কুম্ভক একবার বাতাস ভিতরে রেখে। এই হচ্ছে এক রাউন্ড। এমনি চারবার করতে হবে। এই প্রক্রিয়া একসপ্তাহ করতে হবে। ৪:৮:৪:৮
অর্থাৎ শ্বাস ছাড়ার বা নেবার জন্য যে সময় নেবো তার দ্বিগুন সময় কুম্ভক করতে হবে। ধীরে ধীরে মাত্রা বাড়াতে হবে যেমন ৪ থেকে ৬ রেচক ও পুরকের  জন্য, এবং ৮ থেকে ১২ কুম্ভকের জন্য। তবে নিজের শরীর বুঝে এটা  করতে হবে। বেশিক্ষন কুম্ভক করলে মাথা ঘুরতে পারে। যাদের রক্তচাপ বা হার্টের সমস্যা আছে - তারা এসবের মধ্যে যাবেন না। তারা বরং অনুলোম বিলোম, কাপালভাতি ইত্যাদি করুন। 
স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, আসনে বসার  আগে, একবার প্রার্থনা করে নিতে হবে।  "ওম অসতো মা সৎ গময়। তমসো মা জ্যোতির্গময়। মৃত্যুর্মা অমৃতম্ গময়।   হে জগতস্রষ্টা আমরা সেই  জ্যোতিঃ ছটাকে ধ্যান করছি। তিনি আমাদের অন্তর্লোক উদ্ভাসিত করুন।  
তথ্যসূত্রঃ বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ - প্রথম খন্ড - প্রবন্ধ - রাজযোগ সংক্রান্ত ছটি অনুশীলনী।  
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম। 

রাজযোগ অনুশীলনী - ৩ - স্বামী বিবেকানন্দের সাথে :

আমাদের শরীরের  ত্রিকাস্থির কাছাকাছি,  একটা স্নায়ুকেন্দ্র আছে। যেখানে আমাদের সমস্ত জৈবশক্তি বলুন আধ্যাত্মিক শক্তি বলুন, অর্থাৎ পরা ও অপরা শক্তি এখানেই সুপ্ত অবস্থায় আছে। ত্রিক কথাটার মানে হচ্ছে মুরুদন্ডের নিম্ন প্রদেশ। আর অস্থি মানে হাড়। অর্থাৎ মেরুদণ্ডের নিম্ন ভাগে।  আসলে এটা  আছে, আমাদের গুহ্যদ্বার ও মূত্রদ্বারের মাঝামাঝি স্থানে। এই স্নায়ুকেন্দ্রকে সাধকগণ বলে থাকেন মূলাধার।  অর্থাৎ মূল বা প্রধান আধার। সাধন জীবনে এই স্থানটির গুরুত্ত্ব অপরিসীম। এই স্নায়ুকেন্দ্রটিকে প্রথম দিকে ধারণা করবার জন্য ত্রিকোণ হিসেবে কল্পনা করতে হয়, উলটো ত্রিভুজ এবং মনে করতে হয়, যে এখানে একটা ঘুমন্ত সর্প কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে । এটা নিছক আমাদের কল্পনা। কিন্তু যেটা গুরুত্ত্বপূর্ন সেটা হচ্ছে,  এই স্নায়ুকেন্দ্র সম্পর্কে আমাদের সর্বাধিক সচেতন থাকতে হবে। 

আমি আমাকে চিনিনা। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ  শরীরকেই "আমি" বলে ভাবি।  কেউ কেউ একে আত্মা বলে থাকি। যে যাই বলি না কেন, এর দ্বারা সত্যকে আমরা জানতে পারি না। শরীর বললে তবুও  একটা বস্তু আমাদের ধারণাতে আসে।  কিন্তু আত্মা বললে, আমরা কিছুই বুঝতে পারি না। প্রথমত আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে, আমরা কেউ শরীর নোই, আর আমরা সবাই অমর। সত্যিকারের আমার জন্ম-মৃত্যু বলে কিছু নেই।  ধরুন আমার নাম আত্মা।  এখন আত্মার স্বরূপ সম্পর্কে আমাদের বুঝতে হবে,  বা আত্মা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান সঞ্চয় করতে হবে। তবে একটা বলি, এই আত্মা সম্পর্কে আগে থেকে কোনো ধারণা করে নেবেন না। এই আত্মা যেমনই হোক, আমাদের উচিত হবে, আত্মাকে সেইভাবে উপলব্ধি করা। অর্থাৎ আত্মাকে আমাদের আত্মা রূপেই  অনুভব করতে হবে। তবেই  সত্য প্রকাশিত হবে।

আমরা যাকে মৃত্যু বলি, তা আসলে পরিবর্তন মাত্র। আর পরিবর্তনের অর্থ হচ্ছে কার্য্য কারণের দ্বৈততা। আমাদের দেহ একটা গতিশীল পদার্থ। দেহের এই যে সূক্ষ্ম  গতি এটা আমরা ধরতে পারি না।  তবে এটা আমরা বুঝতে পারি, আমাদের দেহ প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। আর  যাকিছু গতিশীল তা কখনো চিরস্থায়ী হতে পারে না। তাই গতিশীল এই জীবদেহ কখনো অমর হতে পারে না। এমনকি আমাদের যে মন, তার চঞ্চলতা আমরা উপলব্ধি করি, অর্থাৎ মন সদা পরিবর্তিত হচ্ছে। অতএব মনও চিরস্থায়ী বস্তু নয়। আমাদের দেহ যেমন স্থুল পদার্থ, তেমনি আমাদের মন সূক্ষ্ম পদার্থ। কিন্তু পরিবর্তনশীল এবং মরণশীল। 

তাহলে আমরা কি ? আমরা একটা শক্তি। আর এই শক্তি হচ্ছে চিরস্থায়ী। এই শক্তি সৃষ্টি করা যায় না। একে প্রকাশিত করা যায়। এই চিরসত্য শক্তি আমাদের অজ্ঞতার অন্ধকারে, অজ্ঞতার আবরনে ঢাকা পড়ে  আছে। আমাদের কাজ হচ্ছে এই অজ্ঞতার আবরণকে অপসারিত করে, সত্যকে উন্মোচন করা। দেহ হলো চিন্তার অভিব্যক্ত রূপ।  সূর্য ও চন্দ্র এই দুটি তরঙ্গ দেহের সমস্ত অঙ্গে শক্তি সঞ্চারিত করে। অতিরিক্ত শক্তি আমাদের মেরুদণ্ডের কয়েকটি চক্রে  বা কেন্দ্রে সঞ্চিত হয়। এগুলোকে স্নায়ুকেন্দ্র বলে। এই কেন্দ্রগুলোতে একটা ঝলক বা ঝিল্লি দেখা দেয়। এই ঝিল্লি মৃতদেহে দেখা দেয়  না। এই তরঙ্গগুলোও মৃতদেহের মধ্যে দেখা যায় না। একমাত্র যে দেহের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার দেখা যায়, সেখানে এই তরঙ্গ বা ঝিল্লির দেখা মেলে। আর যোগীগণ এই তরঙ্গগুলোকে শুধু উপলব্ধি করেন তাই নয়, এগুলোকে মানসচোক্ষে দেখতে পান। যোগীগণ এই তরঙ্গের গতাগতি, স্নায়ুকেন্দ্রে এর প্রভাব ইত্যাদি  উপলব্ধি করতে পারেন।

আমাদের কর্ম্ম দুই প্রকার।  এক হচ্ছে চেতন মনের কর্ম্ম, আর এক হচ্ছে অবচেতন মনের কর্ম্ম। যোগীগণের আর ধরনের কর্ম্ম আছে, যাকে  বলা হয় অতিচেতন মনের কর্ম্ম। এই যে অতিচেতন মনের কর্ম্ম এটাই আমাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উৎস। এই অতিচেতন অবস্থায় আমাদের কোনোরূপ ভ্রান্তি থাকে না। একেই বলে অপরোক্ষ অনুভূতি। 

অতিচেতন মনের কর্ম্ম আমাদের দৈব অনুপ্রেরণায় হয়ে থাকে। রাজযোগীগণ বলছেন, এই গুন্ সমস্ত মনুষ্যের মধ্যে বিদ্যমান। এঁকে সমস্ত মানুষই ব্যবহার করতে পারেন । এখন কথা হচ্ছে এর জন্য আমাদের কি করতে হবে ?

আমরা যে দুটো তরঙ্গের কথা বলছিলাম, অর্থাৎ সূর্য তরঙ্গ ও চন্দ্র তরঙ্গ এই দুটোকে আমাদের একটা নতুন পথে পরিচালিত করতে হবে। আর এই কাজটাই যোগীগণ করে থাকেন। আর সেই পথ হচ্ছে সুষুম্নার পথ। আমাদের কাজ হচ্ছে দুটো ১. সুষুম্না নাড়ীর দ্বার উন্মোচন করতে হবে। ২. বায়ুশক্তিকে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর করতে হবে অগ্নি-শক্তির  সাহায্যে। আর এই কাজটি যখন সম্পন্ন হবে, তখন মেরুদণ্ডের মধ্যবর্তী এই সুষুম্না নাড়ীপথ দিয়ে এই তরঙ্গ আমাদের মস্তিস্কগামী হবে, আর তখনি আমাদের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার ক্ষমতা জন্মাবে। 

প্রত্যেক মানুষের মধ্যে জৈবক্রিয়ার   মাধ্যমে নির্দিষ্ট বয়সে রজঃ ও শুক্রউৎপন্ন হয়, যাকে  আমরা যৌন শক্তি বলে থাকি । সাধারণের মানুষের এই শক্তি নিম্নগামী। এই শক্তি যখন সূক্ষ্ম হয় তখন তাকে বলে ওজঃশক্তি। রাজযোগীগণের মতে,  ঈশ্বরত্ব লাভের  প্রথম ধাপ হচ্ছে, এই যৌনশক্তিকে ওজ্সে রুপান্তরিত করা। তাই রাজযোগীগণ ওজস্বী হবার কথা বলেন, ওজস্বী ভাবে কথা বলেন, তাঁর বক্তব্যে সমগ্র পৃথিবী অনুপ্রাণিত হয়। 

রাজযোগী প্রথমে কল্পনার সাহায্যে, ভাবনার সাহায্যে এই শক্তি বা কুণ্ডলিনীকৃত সাপটাকে ধীরে ধীরে জাগ্রত করেন। এবং সুষুম্না নাড়ী দিয়ে ঊর্ধ্মুখে চালিত করতে পারেন। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা যেতে পারে, সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে আছে  বজ্রাক্ষা নাড়ী, আবার বজ্রাক্ষা নাড়ীর মধ্যে আছে চিত্রাণি নাড়ী। আমাদের ওজঃশক্তি যত  সূক্ষ্ম হবে, তত ধীরে ধীরে আমরা সুষুম্নার পরে, বজ্রাক্ষা, বজ্রাক্ষার পরে চিত্রাণি নাড়ী দিয়ে এই শক্তি চালিত করতে পারবো। কিন্তু আমাদের সাধন প্রক্রিয়া এই সুষুম্না নাড়ীতে কিভাবে এই চালিত করতে পারা  যায়, আমাদের আলোচনা তার মধ্যেই সীমিত থাকবে ।

আমরা আগেই শুনেছি, কোনো শক্তিই সৃষ্টি করা চলে না।  কিন্তু আমরা যেটা পারি সেটা হচ্ছে,  শক্তিকে আমাদের ইচ্ছে মতো পরিচালনা করতে। আর এই শক্তি সবার  মধ্যে আছে। সুতরাং আমাদের উচিত, এই বিরাট শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা। 

আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে পাশবিক কাজে না  লাগিয়ে, ইচ্ছাশক্তিকে আমাদের আধ্যাত্মিক কাজে নিয়োজিত করতে হবে। এই রূপান্তরের প্রক্রিয়াই আসলে ধার্মিকতা, যা আমাদের রাজযোগ শেখায়। তাই রাজযোগের প্রথম পাঠই হচ্ছে, নৈতিকতা, শুদ্ধতা। রাজযোগের ক্ষেত্রে ভাবনা-চিন্তায়, কথায়-কাজে আমাদের প্রশ্নাতীত পরিশুদ্ধি আনতে  হবে। এবং একমাত্র পরিশুদ্ধ জীবনেই ভগবৎ দর্শন সম্ভব। 

প্রাণায়াম যা আমরা আগে বলেছি, পূরক, রেচক, ও কুম্ভক  করবার ঠিক আগমুহূর্তে ওই ত্রিকোনটি কল্পনা করুন। যার মধ্যে একটি ঘুমন্ত সাপ কুণ্ডলিনী  পাকিয়ে অবস্থান করছে। আর এই ত্রিকোণের অবস্থান হচ্ছে আমাদের মেরুদণ্ডের মুলে। কল্পনা করুন, যেন একটা অগ্নি শিখা ওই ত্রিকোনটিকে ঘিরে রেখেছে। আর ছোট্ট সাপটি ত্রিকোণের মাঝখানে কুণ্ডলিনী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। যখন এই কুন্ডলিনীকে আপনি স্পষ্ট দেখতে পাবেন, তখন আপনার কাজ হবে আপনার সংযত নিঃশ্বাস ওই সাপটির মাথায় ফেলা। যাতে সে জেগে ওঠে। এসব প্রথমে আপনাকে কল্পনার সাহায্যেই করতে হবে। আর আপনার কল্পনা শক্তি যত  প্রবল হবে, যত  প্রখর হবে, তত তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া যাবে এবং এই শক্তি তখন জেগে উঠবে। যতক্ষন না এই জাগরণ হচ্ছে, ততক্ষন একে জাগ্রত রূপে কল্পনা করতে থাকুন। আপনার ভিতরে যে তরঙ্গ বইছে, তাকে অনুভব করবার চেষ্টা করুন। এবং সুষুম্নার মধ্যে দিয়ে একে চালিত করবার চেষ্টা করুন। স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, এতেই  দ্রুত ফল মিলবে। 
প্রার্থনা দিয়ে শুরু করুন, আবার প্রার্থনা দিয়ে প্রক্রিয়া সমাপ্ত করুন, ওম অসতো মা সৎ গময় ..........
তথ্যসূত্রঃ বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ - প্রথম খন্ড - প্রবন্ধ - রাজযোগ সংক্রান্ত ছটি অনুশীলনী।  
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

রাজযোগ অনুশীলনী - ৪ - স্বামী বিবেকানন্দের সাথে। 

ভারতবর্ষে এমন কিছু মানুষের কথা আমরা   শুনে থাকি, যারা তাদের জীবদ্দশাতেই মৃত্যুকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছেন । এই সব যোগীগণ স্ব-ইচ্ছায় স্বজ্ঞানে দেহ পরিত্যাগ করেছেন। না আত্মহত্যা নয়। এইসব যোগীমহাপুরুষগন সমাধি অবস্থায় অতিমানস চৈতন্যে স্থিত হয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ-ইন্দ্রিয়াদিতে পরিব্যাপ্ত যে শক্তি তাকে প্রত্যাহার করে  এমন কৌশলে দেহ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন, যেন সাপ  তার খোলস বদলাচ্ছে। যোগীগন তাদের আরব্ধ কাজ শেষ করে পরম-আনন্দে নির্ভয়চিত্তে দেহ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন, কিন্তু দেহ ত্যাগের আগে সকলকে জানিয়ে দেন।  এমনকি অন্তিমমুহূর্তের আগাম দিন-ক্ষণ বলে দিয়ে থাকেন। এখন কথা হচ্ছে এই কাজটা কিভাবে সম্ভব ? 

একটা কথা বলি কোনো মানুষ যখন স্বেচ্ছায় আত্মাকে বিমুক্ত করে বেরিয়ে যাবার যোগ্য হয়ে ওঠে, তখন বুঝতে হবে তিনি মৃত্যুর অনিত্যতার উপলব্ধি করেই মৃত্যুকে জয় করেছেন। আর এই মৃত্যুঞ্জয়ী হবার প্রয়াসে আমাদের কোনো উৎকট ধারণা, কোনো মতবাদ ও উৎকট পদ্ধতি আশ্রয় করবার প্রয়োজন নেই। রাজযোগ  সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান হলে আমরা দেখতে পাবো যে রাজযোগ কতদূর বিজ্ঞান সম্মত। রাজযোগ অভ্যাসের দ্বারা আমরা দেহ থেকে আত্মাকে প্রত্যাহার করে নিয়ে মরনের পারে চলে যেতে পারি। কোনো অবৈজ্ঞানিক কিম্ভুত বিশ্বাস বা পথ বা যুক্তিহীন ব্যক্তির প্রভাবে কিছুতেই আমরা মৃত্যুর রাজ্য অতিক্রম করতে পারবো না। আমাদের আত্মা যখন দেহ ও ইন্দ্রিয়গ্রাম পরিত্যাগ ক'রে পরিত্যক্ত দেহটির বাইরে সাক্ষী রূপে জাগ্রত থাকবে কেবল তখনই বুঝতে হবে যে আমাদের পক্ষে মৃত্যুকে জয় করা সম্ভব হয়েছে। এই অবস্থায় আমরা যখন পৌঁছুতে পারবো, তখন জগতের কারুর সাধ্য নেই যে আমাদের বিনাশ সাধন করে। 

আজ আমরা সেই রাজযোগের চতুর্থ পর্ব্বের কথা শুনবো। শুনবো স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে। আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু মনকে নিয়ন্ত্রণ করবার আগে যা  করতে হবে তা হচ্ছে, মনকে আমাদের নিরীক্ষণ করতে হবে। আমাদের মন অস্থির।  এই অস্থির মনকে স্থির করতে হবে। মনকে বন্দি করতে হবে। উদ্ভ্রান্ত এই মনকে বিভিন্ন বিষয় থেকে একটা নির্দিষ্ট ধারণায় স্থিরকৃত করতে হবে। প্রথম দিকে এটা অসম্ভব মনে হবে, কিন্তু বার বার এই চেষ্টা করতে হবে। আমাদের ইচ্ছাশক্তির দ্বারা নিশ্চই আমরা আমাদের মনকে আয়ত্তে আনতে  পারবো। চেষ্টা করতে হবে আমাদের মনকে স্থির করে ঈশ্বরের মহিমায় অনুধ্যানে যাতে  নিয়োজিত করতে পারি । মনকে আয়ত্ত্বে আনবার উপায় হলো, প্রথমে স্থির হয়ে বসে, মনকে স্বেচ্ছাচারী হতে দেওয়া। একান্ত ভাবে ভাবতে হবে, "আমি প্রতক্ষ্যদর্শী, আমার মনকে আমি বিকশিত হতে দেখছি। আমার সঙ্গে আমার মনের কোনো সম্পর্ক নেই।" .এর পর ভাবতে চেষ্টা করুন, আমি এবং আমার মন পৃথক সত্তা। নিজেকে ঈশ্বরের সমগোত্রীয় ভাবুন, আমি জড় নোই, আমি মন নোই।  এই ভাবে ভাবতে থাকুন। 

কল্পনা করুন, যে একটা শান্ত সরোবরের মতো আমর মন আমার সামনে প্রসারিত হয়ে আছে। আর যে সব চিন্তা এই মনে আনাগোনা করছে, সেগুলো যেন এই সরোবরের বুদ্বুদ। চিন্তারূপ বুদ্বুদ একবার জলের উপরে ভেসে উঠছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। চিন্তাগুলোকে দমন করবার কোনো দরকার নেই। সেগুলোকে শুধু নিরিক্ষন করতে থাকুন। এবং কল্পনায় সেই ভেসে বেড়ানো চিন্তাগুলোকে অনুসরণ করুন। এর ফলে দেখবেন চিন্তার পরিধি ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসছে। কারন মন চিন্তার বিস্তীর্ন গন্ডির মধ্যে ঘুরে বেড়ায় এবং এই গণ্ডিগুলো প্রসারিত হয়ে ক্রমবর্ধমান গন্ডিতে পরিণত হয়। পুকুরে ঢিল ছুড়লে যেমন ঢেউ ধীরে ধীরে ক্রমবর্ধমান গন্ডি সৃষ্টি করতে করতে একসময় মিলিয়ে যায়। আমরা এবার এই চিন্তারূপ ঢেউয়ের উল্টো দিক থেকে শুরু করবো। অর্থাৎ চিন্তারূপ যে গন্ডি আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে, সেই গণ্ডিটাকে ধীরে ধীরে ছোট করে আনবো। যতক্ষন না এই কেন্দ্রবিন্দুতে মনকে আবদ্ধ করতে পারছি, ততক্ষন আমরা চেষ্টা করে যাবো। এই সময় একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, যে আমি ও আমার মন আলাদা। আমি নিজেকে চিন্তা মগ্ন দেখছি, আমি আমার মনের ক্রিয়াকলাপ লক্ষ করছি। এইভাবে প্রতিদিন অভ্যাস করলে, নিজের সঙ্গে নিজের চিন্তার ও অনুভূতির একত্রীকরণের প্রয়াস কমে আসবে। যতক্ষন না, শেষ পর্যন্ত নিজেকে মন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করতে পারছেন, ততক্ষন চেষ্টা করতে হবে। যতক্ষন না আমাকে আমি আমার মন থেকে একটা পৃথক সত্তা বলে চিনতে পারছি, ততক্ষন আমাদের এই চেষ্টা করে যেতে হবে।  অর্থাৎ আমি এবং আমার মন সম্পূর্ণ আলাদা এই ভাবনায় নিজেকে দৃঢ় করতে হবে। 

স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, এই কাজ সম্পাদিত হলে, মন আপনার দাসে  পরিণত হয়ে যাবে। এবং আপনি তখন আপনার মনকে ইচ্ছেমত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। যোগী হবার প্রথম শর্তই   হলো, ইন্দ্রিয়ের বেড়াগুলোকে অতিক্রম করা। মন যখন সাধকের  বশীভূত হয়, তখন সাধক  তুরীয় অবস্থায় উন্নীত হয়। 

বিবেকানন্দ বলছেন, যতদূর সম্ভব এই অভ্যাস চলাকালীন সময় একাকী থাকুন।  আপনার আসনটি যেন আরামদায়ক দৈর্ঘের হয়। প্রথমে কুশাসন, তারপর ছালের  এবং পরে একটি রেশমের ঢাকনা পেতে নিন। আসনে হেলান দেবার ব্যবস্থা না থাকাই  ভালো। 

চিন্তাগুলো যেহেতু ছবির  মতো, সেহেতু আমরা তাদের সৃষ্টি  করবো না। সমস্ত চিন্তা আমাদের মন থেকে সরাতে হবে। মনকে সম্পূর্ণ শূন্য করতে হবে। যখনই চিন্তার উদ্রেক হবে, তখনই তাকে বিতাড়িত করতে হবে।  আর এই সামর্থ অর্জন করতে হলে, আমাদের জড়ের উর্দ্ধে উঠতে হবে। দৈহিক চেতনাকে অতিক্রমকরে যেতে হবে। প্রকৃত পক্ষে মানুষের সমস্ত জীবন এই কর্ম্ম সম্পাদনেরই প্রচেষ্টা স্বরূপ।

মনে করুন, বিশ্বচরাচর আমাদের দেহ, আর এই ক্ষুদ্র দেহ হচ্ছে একটা আয়না। আমিই বিশ্ব। আমি যা কিছু দেখছি, তা আমারই প্রতিচ্ছবি। সুপারিচালিত কল্পনাই আমাদের পরম বন্ধু। এই কল্পনা যুক্তির উর্দ্ধে, কিন্তু এটাই একমাত্র আলোকবর্তিকা যা আমাদের সত্যে উপনীত করবে । অন্তঃস্থল থেকে প্রেরণা অনুভব করুন। ঈশ্বরের ধ্যান করুন।  জ্ঞানদাতাকে আমরা জানতে পারি না, কিন্তু আমরা তারই অংশ, এই অনুভব দৃঢ় হোক আপনার মধ্যে।  

এর পরে আরো দুটো অনুশীলনী আছে, আমরা সেগুলো ধীরে ধীরে শুনবো।  আজ এই পর্যন্ত। তথ্যসূত্রঃ বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ - প্রথম খন্ড - প্রবন্ধ - রাজযোগ সংক্রান্ত ছটি অনুশীলনী।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম। 

রাজযোগ অনুশীলনী - ৫ - স্বামী বিবেকানন্দের সাথে।

আজ আমরা শুনবো, প্রত্যাহার ও ধারণা সম্পর্কে। ভগৱান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন "যে যেভাবেই হোক  যে মাধ্যমের সাহায্যেই হোক,  আমাকেই সে চায়, এবং সে আমার কাছেই পৌঁছবে। প্রত্যেক ব্যক্তি আমাতেই উপনীত হবে।
স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, প্রত্যাহার হলো মনকে আয়ত্তে আনার প্রচেষ্টা এবং কাঙ্খিত বিষয়ে মনকে নিয়োজিত করা। এর জন্য মনকে প্রথমে তার ইচ্ছেমতো ভাসতে দাও। এবং লক্ষ করো, মন কি ভাবছে।শুধু নীরব সাক্ষী হয়ে যাও। মন আসলে স্থুল পদার্থেরই সূক্ষ্মতম  রূপ। আমরা সবাই এই সূক্ষ্ম বস্তুটির অধিকারী।  এই মনকে স্নায়ুশক্তিগুলোর মধ্যে নিয়োজিত করতে হবে। আমরা যাকে  দেহ বলি সেটি হচ্ছে আমাদের মনের বিষয়মুখী রূপ। আমাদের আত্মা বা "আমি" আসলে এই দেহ ও মনের উর্দ্ধে। দেহ হচ্ছে, চিন্তার বিমূর্ত রূপ। এই আমি বা আত্মন শাশ্বত অপরিবর্তনশীল দর্শক মাত্র। 

আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস যখন বাম নাসারন্ধ্র দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন আমাদের বিশ্রামের সময়। এই শ্বাস-প্রশ্বাস যখন আমাদের ডান  নাক দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন আমাদের কাজ করবার সময়। আবার শ্বাস-প্রশ্বাস যখন আমাদের উভয় নাসিকা দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন আমাদের ধ্যানের সময়। অর্থাৎ বিশ্রাম, কাজ ও ধ্যানের সময়গুলোকে আমাদের খেয়াল করতে হবে, এবং সেইমতো আমাদের সময়কে ভাগ করে নিতে হবে। তো এইজন্য আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি প্রকৃতির দিকে খেয়াল রেখে জীবন ধারাকে পরিচালিত করতে হবে। যখন আমরা প্রশান্তিতে থাকি, তখন আমাদের দুই নাসারন্ধ্র দিয়েই সমান ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহিত হয়, এই সময়টা আমাদের ধ্যানের  পক্ষে আদর্শ সময়। স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, প্রথমেই মনঃসংযোগের চেষ্টা করা অর্থ হীন। চিন্তার সংযম নিজের থেকেই আসবে, যদি আমরা আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে ইচ্ছেমতো প্রবাহিত করতে পারি। এই ইচ্ছেমতো প্রবাহিত করবার জন্য, প্রথমে আমাদের হাতের তালু ও তর্জনী দিয়ে নাসারন্ধ বন্ধ করে অনুশীলনী চালিয়ে যেতে হবে।  এর পরে আমরা ইচ্ছেশক্তির দ্বারাই, শুধুমাত্র চিন্তার মাধ্যমে এই শ্বাস-প্রশ্বাসের গতির পরিবর্তনে সমর্থ হবো।শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি পরিবর্তনের জন্য এই ভিডিওটি দেখতে পারেন।  https://www.youtube.com/watch?v=464wi5sOWmA&t=681s

এর আগে যে পদ্ধতিতে প্রাণায়ামের কথা বলেছিলাম, এবার সেই প্রাণায়ামের সামান্য পরিবর্তন করতে হবে। সাধকের  যদি নির্ধারিত কোনো আদর্শ থাকে, অর্থাৎ যদি কোনো ইষ্ট  থাকে, বা কোনো বিশেষ মন্ত্র থাকে, তবে শ্বাস গ্রহণ ও শ্বাস ত্যাগের সময়, ওঁং এর  পরিবর্তে  সেটাকেই ব্যবহার করুন। কুম্ভক করবার সময় "হুম" এই ধ্বনিটি ব্যবহার করতে হবে। প্রত্যেকবার হুম ধ্বনিটি ব্যবহার করবার সময়, নিয়ন্ত্রিত শ্বাসকে জোরে কুন্ডলিনীর মাথায় ফেলতে হবে এবং ভাবতে হবে, এর ফলে কুন্ডলিনীর জাগরণ হচ্ছে। একটা ভাবনা সব সময় জাগিয়ে রাখতে হবে, যে আমরা সবাই ঈশ্বরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। 

কিছুক্ষন পরে, ভাবনার আবির্ভাব হবে। অর্থাৎ ভাবনার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবো। এবং আমরা আমাদের ভাবনার প্রারম্ভিক রূপের সঙ্গে পরিচিত হবো। এইবার আমাদের আগামী চিন্তাগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। তখন চিন্তা এবং আমি এই দুটোকে আলাদা করতে হবে। অর্থাৎ চিন্তা আমাদের সামনে সামনে চলছে, আর আমি তার পিছন পিছন চলছি।  এই ভাবে, আমাদের চিন্তা ও অমিকে আলাদা করতে হবে। অর্থাৎ এখন দুটি পৃথক সত্তা, একটা আমি, আর একটা আমার চিন্তা। চিন্তা এবং আমি যেন  গুলিয়ে না যায়। যখন এইভাবে আমি আমার চিন্তা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারবো, তখন আমাদের চিন্তাগুলো স্বাভাবিক ভাবেই অবলুপ্ত হয়ে যাবে। 

এইবার পুণ্যচিন্তা অর্থাৎ শুভ বা ভালো চিন্তাগুলোকে অনুসরণ করতে থাকো। এই শুভচিন্তাগুলো যখন তোমার আমির মধ্যে বিগলিত হবে, তখন তুমি ঈশ্বরের পদতলে উপনীত হবে। এইটাই হলো আমাদের অবচেতন অবস্থা। যখন ধারণা বিগলিত হয়, তখন তুমি তাকে অনুসরণ করো, এবং তুমিও বিগলিত হও। 
এইসময় যোগীগণ একটা জ্যোতি দেখতে পায় । কখনো কখনো একটা মুখ দেখে মনে হয়, যে উজ্জ্বল আলোর দ্যুতিটাকে ঘিরে রেখেছে। যেন  সূর্য্যের মধ্যে একটা মুখ। এই দ্যুতির মধ্যে যে মুখের অবয়ব দেখতে পাচ্ছ, তাকে চিনে নেবার চেষ্টা কর। নির্ভুল ভাবে তাকে বিশ্লেষণ কর। এই মুখটি তোমার  ইষ্ট হতে পারে। বা কোনো চিহ্ন হতে পারে, যা তুমি  ধ্যানের প্রথমে প্রতীক হিসেবে জেক  চিহ্নিত করেছিলে।

অর্থাৎ এখন তুমি তোমার  ইষ্টকে মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছ। অর্থাৎ ইষ্ট তোমার  সামনে দৃশ্য হয়ে উঠেছে। এইজন্য ইষ্ট নিদির্ষ্ট করবার আগেই আমাদের একটা নির্ভরযোগ্য প্রতীক ঠিক করতে হয়, যার উপরে আমি নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে পারি। যাতে আমি সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারি। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়েই যাঁকে  আমরা কল্পনা করতে পারি। 

আসলে সমস্ত চিন্তার একটা রূপ আছে। তাই আমাদের চিন্তার বস্তু যদি আমাদের ইষ্ট হয়, তবে সেই ইষ্ট আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা চোখের মাধ্যমে আমরা কল্পনা করি। আমরা যখন আমাদের গুরুদেবের কথা কল্পনা করি, তখন আমাদের চোখের সামনে গুরুদেবের অবয়ব ভেসে ওঠে। প্রত্যেক কল্পনাই অর্দ্ধবাস্তব। অর্থাৎ কিছু অলৌকিকের সংমিশ্রণ ছাড়া আমরা চিন্তা  করতে পারি না। আমাদের অনেকের মনে হয়, চিন্তা ও বাস্তবের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু আসলে বাস্তব হচ্ছে চিন্তার ফল মাত্র । 

যাইহোক, যোগে এই কল্পনাকে জীইয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে । কিন্তু সতর্ক থাকবে, যাতে কল্পনা আমাদের পবিত্র হয়, শুদ্ধ হয়। আমাদের প্রতীকের কল্পনা শক্তির একটা নিজস্বতা আছে।  যে পথটি তোমার  কাছে সবচেয়ে স্বাভাবিক মনে হবে, তুমি  সেটাকেই অনুসরন করবে । সেটাই তোমার  কাছে সহজ পথ হবে। 

দেখ, তুমি  বিশ্বাস কর আর না কর, পূর্ব-পূর্ব জীবনের কর্ম্মফল অনুযায়ী আমাদের পুনর্জন্ম হয়েছে। বৌদ্ধগণ বলে থাকেন, একটা প্রদীপ থেকে আর একটা প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হয়েছে। প্রদীপ একাধিক হলেও, আলো  কিন্তু একটাই। অতএব জানবেন, তুমি  একটি পবিত্র আত্মা। এই চিন্তাকে সদা মনের মধ্যে প্রবাহিত কর। নিজেকে উৎফুল রাখ, উদ্দমী রাখ, সাহসী রাখ। প্রতিদিন শরীর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখো । মনের চিন্তার মধ্যে সবসময় পবিত্রতা রাখ। ধৈর্য্যশীল হও । নিরন্তর সুচিন্তার অভ্যাসের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখ। পবিত্র গ্রন্থ পাঠ  কর। সৎ সঙ্গ কর। তাহলেই তুমি  প্রকৃত অর্থে যোগী হতে পারবে। কখনো ব্যস্ত হবে না। যদি কোনো উচ্চতর শক্তির সন্ধান পাও , তাহলেও নিজেকে বিচলিত হতে দেবে না।  জানবে, এই শক্তি মূলশক্তির  কনা  মাত্র, শাখা-প্রশাখা মাত্র । এই শক্তি অনেকসময় যোগীকে পথভ্রষ্ট করে দেয়।  তাই যোগীকে সবসময় সাবধান থাকে হয়। লক্ষে স্থির থকো , ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রাখ।  তুমি  জানবে, মূল লক্ষ হচ্ছে, ঈশ্বরকে অনুভব করা। একমাত্র চিরন্ত্রন সত্যকে উপলব্ধি করা।  যতদিন না আমার সে উপলব্ধি হচ্ছে, ততদিন আমি বিশ্রাম নেবো না। নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে, এই পথে অগ্রসর হবার জন্য। জাগতিক সমস্ত সংগ্রামের বিলুপ্তি ঘটবে, যদি আমরা পরম সত্তার উপলব্ধি করতে পারি। পরম সত্তায় বিলীন হয়ে যেতে পারি। পরম-সত্তাই সৎ-চিৎ-আনন্দম। তথ্যসূত্রঃ বিবেকানন্দ রচনাসংগ্রহ - প্রথম খন্ড - প্রবন্ধ - রাজযোগ সংক্রান্ত ছটি অনুশীলনী।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম। 

রাজযোগ অনুশীলনী - ৬ (শেষ)  - স্বামী বিবেকানন্দের সাথে।

স্বামী বিবেকানন্দ তার রাজযোগ সংক্রান্ত প্রবন্ধে ছয়টি অনুশীলনীর কথা বলেছেন।  এর মধ্যে সবশেষে বলেছেন, কুন্ডলিনীকে জাগ্রত করবার কথা, বলছেন, সুষুম্নার ধ্যান করা প্রয়োজন । সুষুম্নার কল্পনা মূর্তিও তুমি দেখতে পারো। আর এই কল্পনা মূর্তিতে দীর্ঘসময় ধ্যান করো। সুষুম্না নাড়ী অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও অত্যন্ত চমৎকার একটা তন্ত্রী। এটি মেরুদণ্ডের মধ্যবর্তী, যার মধ্য দিয়ে  কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণ হয়। যোগীর ভাষায়, সুষুম্নার দুই প্রান্তে দুটি পদ্ম।  নিচের দিকে আছে মূলাধারে, আর উপরেরটি আছে সহস্রারে। এই দুটির মধ্যে রয়েছে, আরো চারটি পদ্ম। তাই মোট ছটি  পদ্ম, মেরুদণ্ডের মূলভাগে মূলাধার, নাভির বিপরীতে আছে মনিপুর, এছাড়া আছে স্বাধিষ্ঠান যা এই মনিপুর ও মূলাধারের মাঝখানে, সেটা স্বামীজী উল্লেখ করেন নি। হৃদপিণ্ডের সমস্তরে আছে অনাহত, কণ্ঠনালির উপরিভাগে বিশুদ্ধ, দুই চোখের মাঝখানে, অর্থাৎ ভ্রূদ্বয়ের মাঝে,  এবং মস্তিষ্কে মূলগ্রন্থি সহস্রার। এগুলো আসলে আমাদের শরীরের খুব  স্পর্শকাতর জায়গা।    

এই কুণ্ডলিনীকে আমাদের জাগ্রত করতে হবে। অর্থাৎ এইগুলোর দিকে মনকে স্থির করতে হবে,  তার পর ধীরে ধীরে এক স্তর  থেকে আর এক স্তরে বা চক্রে  নিয়ে যেতে হবে যতক্ষন না সেটি আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছছে। প্রতিটি পৰ্য্যায়ের সঙ্গে মনের একটি নতুন স্তরের যোগসূত্র রয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ এই কুন্ডলিনীশক্তি সম্পর্কে এর বেশি কিছু বলেন নি । তবে সাধনার প্রথম দিকে এই চক্রগুলোকে কল্পনা করে নিতে হয়। সাধনার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই চক্রে একটা কম্পন অনুভূত হয়, এথেকে চক্রের নিদিষ্ট স্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা জন্মে। কুলকুন্ডলিনী সম্পর্কে আরো বিশদ যারা জানতে চান, তারা শশাঙ্ক শেখর পিস ফাউন্ডেশন এর লিংক ভিডিও  গুলো থেকে জেনে নিতে পারেন । এখানে আপনি সমস্ত চক্র সম্পর্কে একটা কাল্পনিক ধারণা পাবেন। যা আপনাকে কাল্পনিক চিত্রের  রসদ জোগাতে পারে।
  

রাজযোগের অনুশীলনী ষষ্ঠ পর্ব্বের সাথে রাজযোগের আলোচনার আজ সমাপ্তি হলো। এই অনুশীলনী একযোগে কয়েকজন মিলে  করতে পারলে ভালো হয়। ভালো থাকবেন। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

ভুলে যাওয়া রোগ নিরাময়  

আমরা ছোটবেলায়, মুখস্ত করা পড়া, পরীক্ষার হলে গিয়ে ভুলে যাই। একটু বয়স হলে চেনা মানুষের নাম ভুলে যাই। এখন এই বৃদ্ধ বয়সে, আমরা অনেকেই  মোবাইল, চশমা, গামছা, কোথায় রেখেছি ভুলে যাই। এই ভুলে যাওয়া রোগ থেকে আমরা কিভাবে ভালো থাকবো, বা  স্মৃতিশক্তি কিভাবে বাড়াবো ?
ছোটবেলার কথা বলছি, ষাটের দশকের প্রথম দিকের  কথা।  আমাদের প্রতিবেশী অসীমদার বাবা, তরনিকান্ত দাস, যার বয়স আশি  পেরিয়ে গেছে,  প্রতিদিন  ভোর বেলায়,উনি বেড়াতে বেরোন। তখন আমাদের লাইনে ইলেক্ট্রিক ট্রেন হয় নি। নটার কাছাকাছি শিয়ালদা থেকে  একটা স্টিম ইঞ্জিনের ট্রেন আসতো। ওই ট্রেনে খবরের কাগজ আসতো।  তো অসীমদার বাবা সকল নটা  অবধি সারা গ্রামে চক্কর দিতেন, আর নটার সময় রেললাইনের কাছে চলে যেতেন। রেলের কামরা থেকে হকার  যুগান্তর পত্রিকা  মুঠো করে, ছুড়ে  দিতেন, তরুণীবাবু, সেটি সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরতেন। এছিলো তার প্রতিদিনকার প্রাতঃকালের  রুটিন। রেললাইন থেকে বাড়ি ফিরবার পথে ছিল আমাদের বাড়ি।  তো একদিন, অসীমদার বাবা, আমাদের বাড়িতে এসে বারান্দার সিঁড়িতে বসলেন। বললেন, খাদ-দাও। তো আমরা বিশেষ করে আমার মা একটু অবাক হয়ে গেলেন।  তরনি বাবুর দুই ছেলে, এক মেয়ে। ইনি এক সময়, ল্যান্ড-রেভিনিউ বিভাগে চাকরি করতেন। পেনশন পান। তিন ছেলে-মেয়ে শিক্ষিত। অসীমদার  দাদা অমিত-দা আইএএস অফিসার। দিল্লিতে পোস্টিং। অসীমদা এম.এ. পাশ করে  বৌবাজারের একটা স্কুলে মাস্টারি করেন। জামাই, তখন জিপিও-তে সুপারিনটেনডেন্ট। এছাড়া বেশ কয়েক-বিঘা চাষের জমিও আছে। বাড়িতে পুকুর ভরা মাছ ।   অর্থাৎ আমাদের সেই  সময়ের শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবার। তো হঠাৎ করে তরনীবাবু আমাদের বাড়িতে এসে বলছেন, খাদ-দাও, অর্থাৎ খেতে দাও। এর অর্থ আমাদের পক্ষে বোঝা মুশকিল। আসলে তখন তরনীবাবুর  স্মৃতি ঠিকমতো কাজ করতো না। 

যাইহোক, এর পরেও আমরা দেখেছি, তরণীবাবু  নিজের বাড়ির রাস্তা ভুলে, অন্যের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন, সেখানে গিয়ে হঠাৎ করে হয়তো বললেন, চা হয়েছে ? অসীমদা ও তার পরিবারের সকলে এইসব দেখে শুনে, ও দেখে, লজ্জ্বা পেতেন।  শেষে তাকে পরিবারের লোকেরা বাড়ি থেকে বার হাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পাছে রাস্তা হারিয়ে  দূরে কোথাও চলে যান। 

প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে নতুন নতুন অনেক কিছু আসছে। এখন যেমন আমরা আর উপন্যাসের বই নিয়ে বসি না।  গুগুল বা ইউটুবে বিনোদন খুঁজি। আমাদের স্বছন্দের জন্য যেমন অনেক নতুন নতুন সামগ্রী বাজারে আসছে, তেমনি আসছে, নতুন নতুন রোগ। যার লেটেস্ট আইটেম হচ্ছে করোনা। আজ থেকে ৫০/৬০ বছর আগে আমাদের কাছে, এই ভুলে যাওয়া রোগ ছিল নতুন।  যার আধুলিক নাম হচ্ছে ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্ৰংশ। আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, এই স্মৃতিভ্ৰংশ রোগ থেকে কিভাবে আমরা রেহাই পেতে পারি। অবশ্য়ই কোনো ঔষধ না খেয়ে।

সাধারণত এই রোগটা হয়, একটু বেশি বয়েসে হয় । কিন্তু আজকাল দেখা যাচ্ছে কম বয়সের ছেলে-মেয়েদেরও এই রোগ দেখা দিচ্ছে। তো প্রথমে আমরা দেখে নেই   স্মৃতিভ্ৰংশ রোগটা কেন হয় ? 

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, আমাদের মস্তিষ্কে নার্ভকোষের মধ্যে আমাদের স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়ে থাকে।  বয়স বারবার সঙ্গে সঙ্গে বা অন্য কোনো রোগ সংক্রমণে, যেমন হার্টএটাক ইত্যাদির কারনে এই কোষগুলো শুকোতে শুরু করে।  এই কোষগুলো যদি একেবারেই শুকিয়ে যায়, তবে আমাদের আর কোনো স্মৃতি থাকে না। 

পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, চৈতন্য শক্তির সাথে আমাদের যত যোগাযোগ কমতে থাকে আমরা তত স্মৃতির ভান্ডার ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে উঠি। আসলে স্মৃতির ভান্ডার হচ্ছে বিশ্বশক্তি। বিশ্বশক্তি হচ্ছে সমুদ্র আর আমাদের মস্তিস্ক  হচ্ছে জলের কলসি মাত্র। কলসি থেকে আমরা জলকে ব্যবহারিক কাজে ব্যবহার করে থাকি। স্মৃতি বা আমাদের অভিজ্ঞতার ভান্ডার  কখনো নিঃশেষিত হয় না।  যেমন সমুদ্রের জলের ভান্ডার কখনো শেষ হতে পারে না। জল যেমন সমুদ্র থেকে মেঘে পরিণত হয়, আবার বৃষ্টির আকারে নদীর আকার নেয়, তেমনি আমাদের স্মৃতির ভান্ডার বা অভিজ্ঞতার ভান্ডার জন্ম জন্মান্তর ধরে বহন করে নিয়ে চলি। 

তাই উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে আমরা আমাদের স্মৃতিকে ফিরে পেতে অবশ্যই পারি। 

চিকিৎসা বিজ্ঞানীগন বলছেন, এই রোগ দুই ধরনের, ১. আলঝাইমার ডিমেনশিয়া, ২. ফ্রন্টটেমপোরাল ডিমেনশিয়া। দেখুন এই রোগ প্রাথমিক দিকে আমাদের ভুলে যাবার থেকে, আচরণের পরিবর্তন ঘটায় বেশি ।  অর্থাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়া, অকারণে উদ্বিগ্ন হওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। পরবর্তীতে ভুলে যাওয়া রোগটি দেখা যায়। চশমাটা কোথায় রাখলাম, মোবাইলটা কোথায় রাখলাম, নাম মনে করতে না পারা, এমনকি সকালবেলা খেয়েছিলাম কি না সেটাও ভুলে যেতে শুরু করে। এই রোগের  বাড়াবাড়ির পর্যায়ে যখন যায়, তখন কি করলে কি হবে সেটা ভুলে যেতে থাকেন।  যেমন চশমা পড়লে আমি ভালো দেখতে পাবো, বা খেলে আমার ক্ষুধা চলে যাবে, এই যে দৈনন্দিন সমস্যা ও তার সমাধান - এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি সচেতন থাকেন না। সমাধানসূত্র হারিয়ে যায়। এমনকি সময়মতো  বাহ্যক্রিয়া করতেও  ভুলে যান। 

এখন কথা হচ্ছে, এই রোগের চিকিৎসা কি ? মস্তিষ্কের কোষ যা শুকোতে শুরু করেছে, বা শুকিয়ে গেছে, সেগুলোকে আমাদের আবার সতেজ বা প্রাণবন্ত করতে হবে। এটি আসলে আমাদের বায়ুর ক্রিয়া। পৰ্য্যাপ্ত বায়ু মস্তিষ্কে সঞ্চালন করতে পারলে, আমরা এই রোগ থেকে মুক্ত হতে পারি। ধরুন একটা রাবারের পাইপ চিপসে গেছে। সেটিকে ধীরে ধীরে বাতাস দিয়ে পূরণ করতে পারলেই, আমাদের উদ্দেশ্য সার্থক হতে পারে। এখন শুকিয়ে গেছে যে কোষ বা পাইপ তাকে  প্রথমে একটু নাড়াচাড়া করতে হবে। এইজন্য আমাদের মস্তিষ্কেও কাজ বাড়াতে হবে। দাবা খেলা , লুডো খেলা, শব্দজব্দ খেলা  করতে হবে। দিনে অন্তত একঘন্টা হাটতে হবে। সবচেয়ে যেটা অবশ্য়ই করতে হবে, সেটা হচ্ছে প্রাণায়াম। বিশেষ করে অনুলোম-বিলোম।এর ফলে আমাদের মস্তিষ্কে প্রচুর অক্সিজেন যেতে থাকবে।ধীরে ধীরে ৫ মিনিট থেকে শুরু করে,  অন্তত আধাঘন্টা এই অনুলোম বিলম্ব করতে হবে। বায়ুকে দূষিত করতে পারে, এমন কোনো খাবার বা পানীয় গ্রহণ করা চলবে না। যেমন সিগরেট, মদ পান, জাঙ্কফুড, বেশি মসলাপাতি, ইত্যাদি বর্জন করতে হবে। মাছ-মাংস বর্জন করুন। শাকসবজি বেশি করে খান। সহজে হজম হয়, এমন খাদ্যই খান, দুধ হজম হলে অবশ্য়ই খাবার শেষে দুধ খান।  

এই রোগের মোক্ষম দাওয়াই হচ্ছে ধ্যান। নিয়মিত ধ্যান অভ্যাস করুন। দেখুন বায়ুর সঙ্গে মিশে আছে চৈতন্যশক্তি। এই চৈতন্যশক্তিকে ধরতে গেলে আমাদের নিয়ম করে প্রতিদিন একঘন্টা ধ্যান করতে হবে। ধ্যান আসলে মন-মস্তিষ্কের খেলা। ধ্যান যত গভীর হবে, মস্তিস্ক তত সক্রিয় হবে। আমাদের ধীশক্তি তত তীক্ষ্ণ হবে, আমাদের পূর্বস্মৃতি তখন জেগে উঠবে। আমরা তখন সব কিছু মনে করতে পারবো। এমনকি আমরা তখন বহু পুরো দিনের কথা মনে করতে পারবো। আর এই চিকিৎসা বছরের পর  বছর করতে হবে, এমন নয়।  মাত্র পনের দিন থেকে তিন মাসের মধ্যেই আপনার স্মৃতি আগের মতো তো বটেই, তার চেয়েও আরো বেশি ভালো হয়ে যাবে। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম।