Friday 26 November 2021

শুদ্রদম্পতির বেদ-ব্যাখ্যা।


 শুদ্রদম্পতির  বেদ-ব্যাখ্যা। 

ভূমিকা : সর্ব সাধারণের জন্য বেদ-বেদাঙ্গ পাঠ এমনকি শ্রবণ করাও নিষিদ্ধ। কারন ব্রহ্মজ্ঞান যার হয়নি তিনি এইসব শাস্ত্রের মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারবেন না। শুধু মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারবেন না তাই নয়,  শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা, এমনকি এর অপব্যবহার করবার সম্ভাবনা। দেহমন যার শুদ্ধ হয় নি, তার মধ্যে রাগ, দ্বেষ, ঘৃণা, লোভ, মোহ থাকা স্বাভাবিক। এমনকি যার মধ্যে ধীশক্তি স্তিমিত, যার মধ্যে স্মৃতিশক্তি পর্যাপ্ত নেই, তাকে এই বিদ্যা দান শুধু অপাত্রে দান নয়, পাত্রের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা। ঠান্ডা জিনিস প্রায় সব পাত্রে রাখা যায়, কিন্তু অতিরিক্ত গরম বস্তু যেখানে সেখানে রাখা, মানে নিরীহ মানুষের ক্ষতির সম্ভাবনা। বিদ্যুৎবাহীত তার মোড়কে ঢেকে পরিবেশন করতে হয়, নতুবা সাধকের  সমূহ বিপদ হতে পারে। 

কিন্তু এই বেদের জ্ঞান যখন লিপিবদ্ধ  আকারে প্রকাশ পেলো, তখন আর এঁকে গোপন রাখা গেলো না। আর এই কাজটি করেছিলেন, শ্রী কৃষদ্বৈপায়ণ, যার পিতা পরাশর  মুনি, মাতা এক মৎসকন্যা। জেলে নিষাদ পালিত  মেয়ে, সত্যবতী।  একসময় এই জ্ঞান ছিল, ঋষি পরম্পরায় তাঁদের স্মৃতিতে। মানুষ আবিষ্কার করলো, লিপি।  এখন এসে গেলো, ভূর্জপত্রে। কালে কালে বইয়ের পাতায়। তো জ্ঞান একসময় ছিল, অপরোক্ষ অনুভূতিতে, স্মৃতির ভাণ্ডারে, আজ তা গ্রন্থের ভাণ্ডারে। সত্যকামকে পরীক্ষা দিতে হয়েছিলো, তার বংশ পরিচয় দিতে হয়েছিল, গুরুকরণের জন্য। এখন আর বংশ পরিচয় দিতে হয় না।  এখন বাজারে গেলেই বই কিনতে পাওয়া যায়। সবাই এখন টাকায় বশ। কিন্তু বিষয়টি অন্য জায়গায়। 

জ্ঞান দুই প্রকার - বাহ্যজ্ঞান ও আন্তরজ্ঞান। বাহ্যজ্ঞানের অধিকার সবার  কিন্তু এই অধ্যাত্ম বা আত্মবিষয়ক জ্ঞান সবাই অধিগ্রহণে সমর্থ নয়। প্রজাপতি ব্রহ্মা বলেছিলেন, "দ" . তো কেউ ভাবলো দমন করো, কেউ ভাবলো দান করো। কেউ হা করলেই হাওড়া বুঝে যায়। কেউ আবার হা-হা কার বোঝে, হালিশহর বোঝে । আসলে প্রত্যেক ঘটনার পিছনে আরো একটা ঘটনা আছে, আবার প্রত্যেক বর্তমানের সামনে একটা ভবিষ্যৎ পরিণতি আছে। এটি বুঝতে গেলে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে হয়। তো বিষয়ের গভীরে যারা প্রবেশ করতে পারেন না, তাদের বর্তমান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা ভালো। আমরা কান দিয়ে শুনি, চোখ দিয়ে দেখি, মুখ দিয়ে কথা বলি, ত্বক দিয়ে অনুভব করি। কিন্তু সত্য হচ্ছে, কান শোনে না।  চোখ দেখে না।  মুখ কথাও বলতে পারে না। এই কানের পিছনে আছে আরো একটা শক্তি যা কানকে মাধ্যম করে শোনে।  চোখ দেখে না, চোখকে মাধ্যম করে অন্য কেউ দেখে। এই বোধ যার হয়নি, তার মধ্যে জ্ঞানের প্রবেশ ঘটলেও, কোনো কাজে আসবে না।  এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যাবে। তাই বলা হয়েছে বাহ্যজ্ঞান তো সবাই সংগ্রহ করতে পারে, কিন্তু আত্মজ্ঞানে সবার অধিকার নেই। নচিকেতাকে যমরাজ নানান ভাবে প্রলোভিত করে, পরীক্ষা নিয়ে ছিলেন। জিজ্ঞাসু নচিকেতাকে যমরাজ সহজে গোপনীয় জ্ঞান দান করতে সম্মত হননি। সমস্ত শাস্ত্রগ্রন্থের প্রতিটি শব্দের একটা নিগুড় অর্থ আছে। যার অন্তর স্বচ্ছ নয়, তার মধ্যে এই সত্য প্রকাশিত হয় না। এমনকি দেখবেন, অসময়ে কাউকে কিছু বললে, সে তা বুঝতে সক্ষম হয় না। একসময় মা-বাবা তার সন্তানের ভালোর জন্য সাবধানবানী উচ্চারণ করতেন,  উপদেশ দিতেন। তো সন্তানদের মধ্যে  কেউ শোনে কেউ শোনে না। কান দিয়ে তো সবাই শোনে, কিন্তু কাজের মধ্যে তা প্রকাশ পায় না। কিন্তু একটা সময় আসে, যখন মা-বাবার সেই কথার অর্থ সে হাড়ে হাড়ে টের পায় । শ্রুতি শাস্ত্রের গুরুগম্ভীর মর্মবাণী আমাদের প্রাচীন মুনি-ঋষিগণ  ব্যক্তির কল্যাণের জন্য,  সমাজের কল্যাণের জন্য, রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য পুরাণাদিতে প্রণয়ন করেছিলেন। এখনকার যুগে, এইসব শাস্ত্র গ্রন্থ সম্পর্কে পাঠকের কৌতূহল নেই তা নয়, কিন্তু কৌতূহল নিবৃত্ত করবার যথাযথ শিক্ষকের অভাব। আর জীবন এখন এতটাই দ্রুততার সঙ্গে ধাবিত হচ্ছে, যে মানুষের একজায়গায় বেশিক্ষন স্থির হয়ে বসে থাকবার সময় নেই। তাই তার সবকিছুর জন্য হাতে সময়ের স্বল্পতা। গাছে আর আম  পাঁকে না, আম  এখন পাকঁছে গুদাম-ঘরে, কার্বাইটের প্রভাবে । এখন এককালের দোফসলি জমি চার রকম ফসল দিতে বাধ্য হচ্ছে। প্রকৃতির নিয়মে যে গাছে ফল আসতে ৫/৬ বছর লাগার কথা, তা এখন ২ বছরে ফল দিতে বাধ্য হচ্ছে। এতে করে মানুষ খাবার তো পাচ্ছে, কিন্তু খাবারের মান নিম্নগামী হয়েছে। আর খাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে খাদকের সংখ্যা। যাদের জন্ম খাবারের জন্য, আবার মারা যায় সেই অখাদ্য কুখাদ্য খেয়েই। আজ দেহ-সর্বস্য জীবের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলছে। প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির যুদ্ধ আজও চলছে। পরমাত্মা আজও বিশ্বভুবন ব্যাপ্ত করে রেখেছে। আবার জীবের হৃদয়ে স্থিত হয়ে আছেন। অথচ দেখুন, অন্য সব বিষয় আমাদের ইন্দ্রিয়গোচর কিন্তু আত্মাকে জানবার জন্য, আমাদের কোনো বাহ্যিক ইন্দ্রিয় নেই। আবার সর্বকারনের কারন এই আশ্রয়-বস্তুটি আছে বলে, সমস্ত বস্তুর অস্তিত্ত্ব আমাদের  বোধগম্য হচ্ছে। সেই আত্মাকে অনুসরণ করেই সমস্ত প্রকাশ হচ্ছে। শাস্ত্র বলছে, বুদ্ধিতে প্রতিবিম্বিত সেই আত্মাকে যে ধীর ব্যক্তি সাক্ষাৎ করেন, তিনিই শান্তিতে থাকেন, বিষয়াসক্ত ব্যক্তি শান্তি লাভে অসমর্থ। 

মহাভারতের শান্তনু হচ্ছেন আত্মা।  আমরা জানি, শান্তনু মহারাজ প্রতীপের পুত্র, মহামতি ভীষ্মের পিতা।  শান্তনু শান্ত+অনু শান্তনু। অনু কথাটার অর্থ সেই বিন্দু যাকে আর বিভাগ করা যায় না। শান্ত অর্থাৎ স্থির,  শমতাপ্রাপ্ত যা শমগুনযুক্ত ।  তো স্থির অনু হচ্ছেন শান্তনু অর্থাৎ আত্মা। শান্তনু হচ্ছেন প্রতীপ-এর পুত্র।  প্রতীপ কথাটার অর্থ হচ্ছে বিপরীত মুখী কোনো গতি। তো পরমাত্মা থেকে বিচ্যুত হয়ে বিপরীতমুখী গতিতে যিনি জন্ম গ্রহণ করেছেন, তিনি রাজা প্রতীপ ।  ভীষ্ম হচ্ছে শান্তনুর পুত্র। ভীষ্ম হচ্ছে ভ্রম। জীবাত্মার ভ্রমাত্মক বোধ এই ভ্রমের সহজে নাশ হয় না। রাজা শান্তনুর দুই স্ত্রী, গঙ্গা ও সত্যবতী। গঙ্গা হচ্ছে আমাদের সুষুম্না নাড়ী - যা আসলে শক্তির আধার।  এই চেতন প্রকৃতি জগতের মূল উপাদান বা কারন স্বরূপ। সুষুম্নার অষ্টশক্তি, গঙ্গার আটটি পুত্র ।  সোম,ভব, ধ্রুব, বিষ্ণু, অনিল, অনল, প্রভুশ, প্রভব,  (সোম - চন্দ্র, ভব-পৃথিবী, ধ্রুব- গতিহীন,  , প্রভুশ- আকাশ, প্রত্যুষ বা প্রভব - সূর্য,  অপ বা বিষ্ণু - জল, অনিল-বাতাস, অনল- অগ্নি) এর মধ্যে প্রভব প্রত্যুষ বা সূর্য বা সূর্য হচ্ছে প্রকাশ স্থান। এঁকে অবলম্বন করেই জগৎ-লীলা চলছে। এরই নাম ভীষ্ম বা সত্যব্রত। এই সত্যব্রত-ই কুরুবংশকে বাঁচিয়ে রাখেন। অর্থাৎ সূর্য-ই কুরুবংশকে বাঁচিয়ে রাখেন।  কুরুবংশ অর্থাৎ কার্য্যশক্তি।  আভাস চৈতন্য ব্যাতিত এই কার্য্যশক্তি টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু এনার কোনো পুত্র নেই। অর্থাৎ আভাস চৈতন্য যদিও  জগতের অবলম্বন কিন্তু নিজে অসৎ বা অনিত্য  বলে এনার স্থায়ী বংশ থাকতে পারে না। এই আভাস চৈতন্যের অন্তরালে যার প্রতিবিম্ব তিনি নিত্য বিরাজমান। আমরা বেদের কথায় যাবো।  আমরা বেদের নাম  সবাই শুনেছি, কিন্তু বেদ অর্থাৎ সত্যজ্ঞান আমরা কোথায় পাবো ?....... হে ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন। 

শুদ্রদম্পতির  বেদ-ব্যাখ্যা।(২) ২৫.১১.২০২১

বেদ গ্রন্থ বাজার থেকে কিনে আপনি তা পড়তে পারেন। আবার বেদ-পাঠের ভিডিও বাজারে কিনতে পাওয়া যায়, বা ইউটুবে বেদ পাঠ যা ব্রাহ্মণ যুবকগণ করেছেন, তা আপনি শুনতে পারেন। এতে করে আপনার মধ্যে বেদ  সম্পর্কে আপনার একটা ধারণা অবশ্য়ই হতে পারে। কিন্তু বেদের সুফল পেতে গেলে, বেদ-আদিষ্ট  ক্রিয়া অনুষ্ঠান করতে হয়।

বেদ কথাটার সঙ্গে হিন্দু কথাটা, ব্রাহ্মণ কথাটা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আসলে বেদ  যাঁরা রচনা করেছিলেন, তাঁরা কিন্তু নিজেদেরকে হিন্দু বলে পরিচয় দিতেন না।  তাঁরা নিজেদেরকে বলতেন হয় আর্য নয় ব্রাহ্মণ। আবার ব্রহ্ম সন্মন্ধে আলোচনা যেখানে আছে, তাকে বলে বেদের ব্রাহ্মণ।  বেদের মধ্যে সাধন তত্ত্বের যে ব্যঞ্জনা আছে, তাকে প্রকাশ করা হয়েছে এই ব্রাহ্মনে। ব্রাহ্মণ শব্দ এসেছে ব্রহ্মন্ থেকে। ব্রহ্মবিদকে বলা হয় ব্রাহ্মণ। 

নিজেকে বিকাশ করবার প্রবৃত্তি মানুষের সহজাত। কিন্তু আমাদের চিত্ত বিক্ষিপ্ত। আমাদের সবার রুচি ও প্রকৃতিও  ভিন্ন ভিন্ন। তাই সমুদ্র মন্থনে অমৃত নিতে আমরা সবাই আগ্রহী, কিন্তু এর বিষ একমাত্র দেবাদিদেব  মহাদেব সহ্য করতে পারেন। আসলে বেদাঙ্গ-তত্ত্ব অনুশীলনের মাধ্যমে আমরা বেদ  পাঠের যোগ্য হতে পারি। এই বেদাঙ্গের মধ্যে আছে ছটি বিভাগ - শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ, ও জ্যোতিষ। এগুলো বুঝতে গেলে, শুধু বইয়ের সাহায্যে সম্ভব নয়। এরজন্য উপযুক্ত শিক্ষক অবশ্য়ই প্রয়োজন। দেখুন, গানের বই থেকে বা গানের স্বরলিপির বই দেখে আপনি গান শিখে যাবেন, এমনটা সম্ভব নয়। এই শিক্ষা যেমন সময়সাপেক্ষ তেমনি উপযুক্ত গুরু প্রয়োজন। আমাদের সেই সঙ্গতি নেই। তথাপি বেদের কথা শুনতে চাই। তাই বেদের মধ্যে যে শব্দ-সংগ্রহ  আছে, তার শব্দার্থ অর্থাৎ আভিধানিক অর্থ ও ভাবার্থ নিয়ে আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে। এই শব্দার্থও  প্রয়োগ ভেদে আলাদা আলাদা। আবার বেদের ভাষা হচ্ছে বৈদিক। যা প্রাণিজগতের ভাষার (বৈজিক)  দ্বিতীয় পুরুষ। তাই এর জটিলতা ভেদ করে এগুনো দুরূহ ব্যাপার। তাই বেদমাতা গায়ত্রী দেবীকে প্রণাম করে, আমাদের বিচার বুদ্ধির উপরে নির্ভর করে, আমরা সরাসরি বেদের অসীম জ্ঞানের গহ্বরে প্রবেশ করবো।  হে বেদমাতা আমাদের মধ্যে জ্ঞানের আলোকশিখা প্রজ্জ্বলিত করুন। 

বেদের বিভাগ করেছিলেন, মহামতি ব্যাসদেব। আমরা তাঁকে আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই। ইনি বেদকে চার ভাগে ভাগ করে চার শিষ্যকে এই বেদবিদ্যা সংরক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এইযে চারটি বিভাগ, এর নামকরণ হয়তো ব্যাসদেব-ই করেছিলেন। ঋক্বেদ-সংহিতা দিয়েছিলেন শিষ্য পৈল-কে, সামবেদ দিয়েছিলেন শিষ্য জেমিনিকে, যজুর্বেদ-সংহিতা দিয়েছিলেন বৈশম্পায়ন-কে, এবং অথর্ব সংহিতা দিয়েছিলেন শিষ্য সুমন্ত্রকে। আমরা এই চারজনকে আমাদের অবনতশীরে প্রণাম জানাই। 

এরপরে, এই বিদ্যা সহস্র মুনিঋষির হাত ঘুরে, আজ আমাদের কাছে এসেছেন। আমরা এই বিদ্যাকে আমাদের অন্তরে প্রবেশের পথ করে দিতে চাই। হে বেদমাতা আমাদের অন্তরে আপনি অবস্থান করুন। 

ঋক্বেদ : ঋক কথাটির অর্থ হচ্ছে স্তুতি - দেবতাদের স্তুতি। আর সুক্ত কথাটা অর্থ হচ্ছে প্রশস্তি।ঋকবেদে ১০ টি মন্ডল, ১০২৮ টি সুক্ত, আর ঋক আছে, ১০৫৫২-টি । কতকগুলো মন্ত্র (ঋক) সমষ্টিবদ্ধ ভাবে অবস্থিত এই সূক্তে। এক এক দেবতার মন্ত্রগুলোকে একত্রিত করে এক-একটি সুক্ত করা হয়েছে। কোনো কোনো সূক্তে অবশ্য একাধিক দেবতার স্তুতি পাওয়া যায়। এই সূক্তগুলো এক-এক ঋষির নামে প্রচারিত। অর্থাৎ এঁরা এই সুক্তের প্রবর্তক। এই ঋষি-মহর্ষিগণের সংখ্যা অগণ্য। অগস্ত্য, অদিতি, কশ্যপ, আঙ্গিরস, বিশ্বামিত্র, ভরদ্বাজ, নারদ, কন্ব, যযাতি, মান্ধাতা, প্রস্কন্ন, হিরণ্যগর্ভ ইত্যাদি বহু নামে হৃদের পরিচয় পাওয়া যায়। আবার নানান দেবতাদের নাম পাওয়া যায়। অগ্নি, অদিতি, ইন্দ্র, বায়ু, মরুৎ, বরুণ, দেব্যা, পৃথিবী, গঙ্গা, বিশ্বকর্ম্মা, প্রজাপতি, সবিতা, বিষ্ণু, প্রভৃতি হাজার হাজার দেবতাদের নাম পাওয়া যায়। এবার আমরা সরাসরি ঋক্বেদের শব্দভাণ্ডারে প্রবেশ করবো। 

আসলে বাকের উচ্চশক্তির  প্রকাশ দেখতে পাই আমরা এই বেদে। আর এই বাকের প্রেরণায় প্রাচীন ঋষিগণ তাদের হৃদয়-মন  হতে যা কিছু উৎসারিত করেছেন, তাকেই বলা হয় মন্ত্র। আর এই মন্ত্রগুলোকে আশ্রয় করে, জ্ঞানের বাহন বেদ আমাদের কাছে মধুময় হয়ে  উঠেছে। 

 প্রথম মন্ডল - প্রথম অষ্টক 

সুক্ত - ১ 

অগ্নিম ঈলে  পুরোহিতং। ...........

এই অগ্নি যজ্ঞের পুরোহিত, অগ্নি দীপ্তিমান, অগ্নি দেবতাগনের আহ্বাহক ঋত্বিক এবং প্রভূত রত্নধারী। আমি অগ্নির স্তুতি করি।  (১)

অগ্নি পুরাতন ঋষিদের স্তুতিভাজন ছিলেন, নতুন ঋষিদেরও স্তুতিভাজন।  তিনি দেবতাগনকে সঙ্গে করে এই যজ্ঞে আনুন। (২)

অগ্নিদ্বারা যজমান ধন লাভ করেন।  সেই ধন দিনদিন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, যশযুক্ত হয় এবং তা দিয়ে অনেক বীরপুরুষ নিযুক্ত করা যায়। (৩)

হে অগ্নি, তুমি যে যজ্ঞের চারিদিকে বেষ্টন করে থাকো, সেই  যজ্ঞ কেউ হিংসা করতে পরে না  এবং সেই  যজ্ঞ কেউ হিংসা করতে পারে না। এবং সেই যজ্ঞ নিশ্চিত দেবগনের নিকট গমন করে থাকে। (৪)

অগ্নি দেবগনের আহ্বানকারী।  সিদ্ধ-কর্ম্মা, সত্যপরায়ণ, ও প্রভূত ও বিবিধ কীর্তিযুক্ত। হে অগ্নিদেব, দেবগণকে সঙ্গে করে এই যজ্ঞে আগমন করুন। (৫)

হে অগ্নি, তুমি হব্যদাতা যজমানের যে কল্যাণ সাধন করবে, তা আসলে তোমারই কল্যাণ, হে অঙ্গিরা। (৬) 

আমরা তোমাকে দিনরাত নমস্কার করে তোমার কাছে এসেছি। (৭)

তুমি দীপ্যমান হও।  তুমিই যজ্ঞের রক্ষক, তুমিই যজ্ঞের দীপ্তি প্রদানকারী, তুমিই যজ্ঞস্থলে বর্ধমান। (৮)

সন্তানের কাছে, পিত যেমন অনায়াসে আস্তে পারে, হে অগ্নি তুমি আমাদের নিকট সেইমতো মঙ্গলার্থে আমাদের কাছে বাস করো। 

ঋক্বেদের প্রথম সুক্ত এটি। ঋক্বেদের এই সুক্তের দেবতা হচ্ছেন, অগ্নিদেব। আর এর রচয়িতা হচ্ছেন, মধুছন্দা ঋষি। গায়ত্রী ছন্দ, অর্থাৎ ২৪ অহ্মর বিশিষ্ট) এখানে অগ্নিদেবকে যজ্ঞের স্থলে আসবার জন্য স্তুতি করে আহবান করা হচ্ছে।  

বেদকে আমরা ধর্ম্মগ্রন্থ হিসেবে জানি। আর আমরা সবাই জানি, ধর্ম্মের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো, বিশ্বশক্তিকে শ্রদ্ধা, ভক্তিরূপ অর্ঘ প্রদান করা।  কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা ব্যবহারিক প্রয়োজনকে অগ্রাহ্যধিকার দেই। অর্থাৎ আর্ত বা অর্থার্থীর মনোভাব নিয়েই সেই দেবতাদের বা বিশ্বশক্তির পুজো-অর্চ্চনা করে থাকি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, আর্ত, অর্থার্থী, ভক্ত, ও জিজ্ঞাসু এই চার ধরনের মানুষ ভগবানের স্মরণ নিয়ে থাকে। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে, আমরা হয়, আর্ত নয় অর্থার্থী। তাই বেদের মধ্যেও সাধারনের মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য, নানান রকম স্তুতির সংকলন আমরা দেখতে পাই।

এখন কথা হচ্ছে, এই মন্ত্রটি শুনে আমাদের মনে হয়ে পারে, এটি যজ্ঞের অগ্নিকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে। অগ্নির উৎস হচ্ছেন সূর্যদেব। এই সূর্যদেবের মধ্যে যে দাহিকা শক্তি তার দাতা  হচ্ছেন, ব্রহ্ম। যিনি অগ্নিরূপে প্রকাশিত তার উপাসনা করার অর্থ সেই ব্রহ্মশক্তির  উপাসনা করা। এখানে অগ্নি নিমিত্ত মাত্র। --------------------- 

26.11.2021

আমরা যখন গান শিখতে চাই, তখন আমরা প্রথমে সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি, সা - এই সাতটি সুরের চর্চা দিয়ে শুরু করে থাকি। তেমনি স্বরবিদ্যা আয়ত্ত্বে আনতে  গেলে  আমাদের সাতটি স্বরের চর্চা দিয়ে শুরু করতে হয়। এই সাতটি  স্বর হচ্ছে - স, ঋ, গ, ম,প, ধ, নি। ষড়জ, ঋষভ,গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম,  ধৈবত, নিষাদ। বৈদিক আমলে এগুলো ছিল উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিৎ। যারা যথাযথ মন্ত্রের বই পড়েছেন, তারা দেখেছেন, কোনো কোনো বর্ণের নিচে একটা চিহ্ন (-) ,আবার উপরে একটা চিহ্ন (।), দেওয়া থাকে। এই চিন্হগুলো স্বরের  নির্দিষ্টকরণ  করে থাকে। বর্ণের নিচে (-) শায়িত চিহ্ন অনুদাত্ত স্বর।  আবার উপরে যে চিহ্ন (।) এটি উদ্বাত্ত স্বর।  যেখানে কোনো চিহ্ন নেই সেটি স্বরিৎ। আবার আমরা জানি হ্রস্ব, দীর্ঘ, ও প্লুত স্বর আছে।  যেমন বি, বী, বি-ই-ই, এগুলো আমরা জানি। এগুলো অবশ্য আমাদের শুধু বেদ পাঠ করতে গেলে শিখতে হবে, তা নয়, আমারা যখন কবিতা পাঠ করি, গান করি, এমনকি যেকোনো বই উচ্চস্বরে পাঠ  করতে গেলে, এই স্বরবিদ্যা আমাদের আয়ত্ত করে নেওয়া উচিত। আর এগুলো যেকোনো অভিজ্ঞ আচার্য্যের কাছ থেকে শিখে নিতে হয়। 

ছন্দ :  গায়ত্রী, উষ্ণিক,অনুষ্টুপ, বৃহতী, পংক্তি, ত্রিষ্টুপ, জগতি। চব্বিশ অক্ষরে বা স্বরবর্ণ তিন চরণে নিবদ্ধ হলে হয় গায়েত্রী ছন্দ। আঠাশটি অক্ষরে হয় উষ্ণিক, ৩২- অক্ষরে  অণুষ্টুপ, - ছত্রিশটি অক্ষরে  বৃহতী -  পংক্তি হচ্ছে চল্লিশটি অক্ষরে,  ত্রিষ্টুপ হচ্ছে চুয়াল্লিশটিতে  জগতি হচ্ছে আটচল্লিশটি অক্ষরে। এই ছন্দগুলোকে  আবার  দৈবিক চাঁদ বলা হয়ে থাকে। 

যাই হোক, আমরা পরবর্তী কথায় আসি। আমরা ঋক্বেদের প্রথম সুক্ত শুনেছি। এগুলো আসলে যজ্ঞের মন্ত্র। যজ্ঞে সাধারণত তিনটি জিনিস দরকার। প্রথম : যজমান, অর্থাৎ যিনি ঈশ্বরের কাছে কিছু নিবেদন করবেন, এবং ফলের ভাগিদার হবেন । দ্বিতীয় হচ্ছে একজন দেৱতা - যার কাছে নিবেদিত হবে এবং ফলদান করবেন । তৃতীয়তঃ পুরোহিত অর্থাৎ যিনি পুরবাসীর হিত কামনা করেন, এমন একজন ব্যক্তি, যিনি এই কাজে যজমান-কে সহযোগিতা করবেন। 

এখন দেখুন আপনি ভগবানকে কিছু দিতে চান। কিন্তু ভগবান-তো কোনো শরীর নয়। স্থুল বস্তু আমরা তাঁর কাছে  কিছুতেই দিতে পারি না। তো বৈদিক ঋষিগণ একটা বাস্তব-সম্মত পদ্ধতির মাধ্যমে এই স্থুলবস্তুকে ভগবানের কাছে পৌঁছে দেবার একটা ব্যবস্থা করলেন। মাধ্যম করলেন, অগ্নিকে। অগ্নি সমস্ত বস্তুকে তার উৎসে  ফিরিয়ে দেয়। সমস্ত বস্তু পঞ্চভূতের সমষ্টি।  এই ভূতগুলোকে আলাদা করতে পারে একমাত্র  অগ্নিদেব। তাই ঋষিগণ স্তুতি করে, প্রশস্তির গাঁথা দিয়ে অগ্নিদেবকে আহ্বান করছেন, ঋক বেদের প্রথম সূক্তে। 

ঋক সুক্ত-২ (১/১/২)

বায়বা যাহি। .......

এই সুক্তের দেবতা হচ্ছেন বায়ুদেব। ঋষি : মধুছন্দা।  ছন্দ : গায়ত্রী শ্লোক সংখ্যা - ৯

হে প্রিয়দর্শন বায়ুদেব, আপনি এই যজ্ঞে আগমন করুন।  এখানে বিশুদ্ধ সোমরস সংগ্রহ করা হয়েছে। এই সোমসুধা আপনি পান করুন।   

  

     

  



   

      

           




















Monday 22 November 2021

শব্দই ব্রহ্ম :

 


২৯.১০.২১ 

শব্দই ব্রহ্ম : অঽম ব্রহ্মস্মীন - আমি কিভাবে ব্রহ্ম থেকে এলাম ? 

 উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, "শব্দই ব্রহ্ম"।  শব্দ আমাদের কর্নেন্দ্রিয় দ্বারা গোচারীয়ভূত হয়। শব্দকে আমরা অনুভব করতে পারি। কিন্তু এই শব্দই ব্রহ্ম এই অনুভূতি আমাদের নেই। কেননা ব্রহ্ম আমাদের অনুভূতিতে আসে না। তাহলে কি যে শব্দ আমাদের অনুভূতিতে আসে, সেই শব্দ ছাড়াও  আলাদা কোনো শব্দ আছে, যাকে ঋষিগণ "ব্রহ্ম" বলছেন ? 
দেখুন শব্দ দুই প্রকার অনাহত, আর আহত। আঘাতের সাহায্যে যে শব্দের উৎপত্তি হয়, তাকে বলে আহত শব্দ, যা আমাদের  সাধারণ ভাবে শ্রুতিগোচর হয়। আর কোনো আঘাত ছাড়াই যে শব্দ প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হচ্ছে তাকে বলা হয় অনাহত শব্দ।  এই অনাহত শব্দকে ঋষিগণ বলছেন "নাদ"। এখন এই নাদ বা অনাহত শব্দকে কেন ব্রহ্ম বলছেন, সেটা আমরা একটু বুঝবার চেষ্টা করি। 

আমরা জানি আকাশের গুন্ হচ্ছে শব্দ। এই আকাশ বিশ্বচরাচর ব্যাপ্ত হয়ে আছে।  এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে আকাশ নেই। আকাশ নিত্য ও অনাদি। 

এখন শব্দ বলতে আমরা কি বুঝি ? যা শুনলে, বা যা উচ্চারিত হলে, আমাদের মধ্যে কোনো বস্তুর উপলব্ধি হয়, বা জ্ঞানের উদয় হয় তাকে আমরা শব্দ বলে থাকি। অর্থাৎ শব্দ আমাদের কাছে অর্থবোধক। শব্দ থেকেই আমাদের মধ্যে  বস্তুর বা ভাবের অর্থ বোধগম্য হয়।

এখন কথা হচ্ছে অর্থ বলতে আমরা কি বুঝি ? যা অর্থিত বা যাচিত তাই আমাদের কাছে অর্থ। অর্থাৎ শব্দের কাছে আমরা যা যাচ্ঞা করি, তাকেই শব্দের অর্থ বলা হয়ে থাকে। আর এই অর্থকে কে প্রকাশ করে, না অর্থকে প্রকাশ করে শব্দ। অতয়েব শব্দের সাথে অর্থের একটা সম্মন্ধ আছে। অর্থাৎ শব্দ হচ্ছে প্রকাশক, আর অর্থ হচ্ছে প্রকাশ্য। 

শব্দ আবার দুই প্রকার ধ্বনাত্মক ও বর্ণাত্মক। অর্থাৎ একটা হচ্ছে ধ্বনি, আর একটি হচ্ছে বর্ণ। আমাদের কন্ঠ-জিহবা-নাক-মুখ থেকে যে শব্দ বের হয়, তাকে বলা হয় বর্ণ। আর বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের থেকে শব্দের উদ্ভৱ হয়, তাকে বলা হয় ধ্বনি। এই দুই ধরনের শব্দই শ্রুতিগোচর। অর্থাৎ আমরা কান দিয়ে শুনতে পাই। শব্দের একটা শক্তি আছে, অর্থাৎ শব্দ যখন আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে, তখন কোনো না কোনো স্বরূপের প্রকাশ করে, অথবা কোনো না কোনো মানস ক্রিয়া বা জ্ঞান উৎপাদন করে থাকে।আবার  দেখুন, আমরা যখন হাসি, কান্নাকাটি করি, উদ্বেগ প্রকাশ করি, বা ভয় পাই, তখন আমরা বিভিন্ন ধরনের শব্দের সৃষ্টি করে থাকি, এর কোনো নির্দিষ্ট অর্থ নেই, কিন্তু এইসব শব্দ মাত্রেই একটা মানসিক বিকার বা অবস্থার প্রকাশ করে থাকে। অর্থাৎ এইসব শব্দের মধ্যে কোনো ছবি সংলগ্ন নেই কিন্তু একটা মানসিক অনুভূতির প্রকাশ হয়ে থাকে।  তেমনি, আমরা যখন বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি শুনি, তখনও আমাদের মনের মধ্যে একটা বিকার বা উৎফুল্ল ভাবের জন্ম হয়। 

বর্ণ বলতে আমরা সেই শব্দকে বুঝি তা মানুষের কন্ঠ থেকে বুদ্ধিসহযোগে নির্গত হয়। অর্থাৎ এর একটা অর্থ আছে। তা হতে পারে কোনো বস্তুর প্রতিচ্ছবি বা মনের ভাবের প্রতিচ্ছবি। তো ধ্বনি বা বর্ণ উভয়ই আহত শব্দ।  অর্থাৎ কোনো না কোনো আঘাতের ফলে এর জন্ম হয়েছে।

 কিন্তু আহত শব্দের অতীত এক প্রকার শব্দ আছে, যাকে  বলা হয় অনাহত  ধ্বনি। একে মহাত্মাগণ বলে থাকেন অশরীরি বাণী। এই অশরীরি বাণী আমাদের হৃদয় আকাশে উদ্ভূত হয়। আমাদের হৃদয় থেকে অনেক কথা বা বাণী আমরা শুনতে পাই। এই অশরীরি বাণী আমরা কানে শুনি না, কিন্তু উপলব্ধি করি।আবার আমাদের শরীর যখন বিভিন্ন তপঃ সাধনার দ্বারা শুদ্ধ হয়, মন যখন সংযত হয়, তখন আমাদের বুদ্ধির উৎকর্ষতা দেখা দেয়। আবার সাধক যখন ধ্যান সাধনা দ্বারা নিজেকে উচ্চস্তরে নিয়ে যেতে পারেন, তখন আমাদের মধ্যে সত্ত্বগুণের উৎকর্ষতার ফলে ও বুদ্ধি নির্মল হলে, সাধকের বহু ভাগ্যফলে, সাধকের দক্ষিণ দিকের কানে, এক অস্ফুট নাদধ্বনি প্রকাশিত হয়। যা তার একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি। শব্দ বা ধ্বনি অর্থাৎ আহত ধ্বনি আমরা সবাই যারা নির্দিষ্ট পরিসরে অবস্থান করছি, তারা সবাই শুনতে পাই। কিন্তু অনাহত ধ্বনি কেবল সাধক শুনতে পান। এইজন্য বলা হয়ে থাকে নাদধ্বনি কেবল সাধকের শ্রুতিগোচর হয়। 
  
এখন এই অনাহত ধ্বনির মধ্যে কি রহস্য আছে, যার জন্য স্বয়ং  "ব্রহ্ম"কে এই শব্দের মধ্যে অনুভব করা যায় ?

এখন পদ বা শব্দবোধ্য অর্থের নাম হচ্ছে পদার্থ। আবার বলি কথাটা, পদ+অর্থ = পদার্থ। বাক্যের অর্থের দ্বারা যাকে  প্রতিপন্ন করা হয়, তাকে বলা হয় পদার্থ। যেকোনো পদার্থকে আমরা শব্দের দ্বারা  বুঝি ও তাকে চিহ্নিত করি। বিষয়ের উর্দ্ধে অর্থাৎ বাক্যের অতীত যা তাকে বলা হয়ে অজ্ঞেয়। আর যা বাক্যের বিষয়ভূত অর্থাৎ যাকে  আমরা বাক্য দ্বারা প্রকাশ করতে পারি, তাকে বলা হয় জ্ঞেয়। অর্থাৎ যে বস্তু আমাদের জ্ঞানের-শক্তি মাধ্যমে  বাক্যের আকারে প্রকাশিত হয়,  আমরা তাকে জ্ঞেয়বস্তু বলে থাকি। জ্ঞেয়বস্তু আমাদের জ্ঞানের অধীন। অর্থাৎ যা কিছু আমরা চিন্তা করতে পারি, এবং বাক্যের দ্বারা প্রকাশ করতে পারি, তাকেই আমরা পদার্থ বলে থাকি।  জগতে এমন কোনো পদার্থ নেই, যার কোনো নাম নেই। নাম আর নামি তাই আমাদের কাছে একই। আমাদের স্বপ্ন, আমাদের কল্পনা, আমাদের চিন্তা, আমাদের অভাববোধ সবই আমরা বাক্যের দ্বারা প্রকাশ করতে পারি।  তাই এগুলো সবই পদার্থ। আঘাতের দ্বারা যে শব্দের উৎপত্তি হয়, তাকে বাচক বলা হয়ে থাকে। এই বাচক শব্দই  সংকেত বাহক। শব্দ  ও অর্থ দুই-এর প্রকারে  প্রকৃতির পরিনাম বা পরিণতি নির্মাণরূপ আবহের সাথে প্রতিনিয়ত গতিশীল হয়ে চলেছে। সুতরাং শব্দই পরিনাম বাচক। এই আকাশতত্ত্ব বা শব্দতত্ত্ব বিভক্ত হয়ে, মরুৎ বা বায়ু, তেজ, বা অগ্নি, অপ বা জল ক্ষিতি বা পৃথিবী - এই ভিন্ন ভিন্ন পদার্থরূপে অবস্থান করছে। প্রকৃতি যেমন শব্দময়, তেমনি শব্দও প্রকৃতিতে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। 

উপনিষদ বলছেন, শব্দ স্ব-প্রকাশ। শব্দ নিজেই নিজের প্রকাশক। আবার শব্দ অর্থের প্রকাশক । বলা হয়ে থাকে, প্রণব  শব্দ বিশ্ব প্রকাশক। বলা হয়ে থাকে শব্দশক্তির (প্রণব) মাধ্যমেই জগৎ প্রতিভাত হয়েছে। শব্দজ্যোতি যদি না থাকতো, তবে  ত্রিভুবন অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকতো। এখন আমাদের ধারণা  হচ্ছে, আলো বা আলোক রশ্মিই জগৎকে প্রকাশ করেছে। সূর্য্যের উদয়ে  সর্ব্ববস্তুর প্রকাশ হয়। আসলে শব্দ-ব্রহ্মই সূর্য্যের প্রকাশক। সূর্য জগতের অংশমাত্র।   শব্দ-জ্যোতির কারনে জগতের উদ্ভব হয়েছে। মহাত্মাগণ বলছেন,  শব্দই আমাদেরকে রাজা-প্রজা, মাতা-পিতা, ভাই-বোন ইত্যাদির বোধশক্তির জন্ম দিয়ে থাকে। আবার এই শব্দের মধ্যেই আছে সমস্ত জ্ঞানভাণ্ডার। আমাদের ইতিহাস বলুন, পুরাণ বলুন, বেদ বলুন, উপনিষদ বলুন সবই কেবল শব্দ ভান্ডার মাত্র। শব্দ না থাকলে, আমরা ধর্ম্ম-অধর্ম্ম, ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, কিছুই জানতে পারতাম না। শব্দই সমস্ত কিছুকে প্রকাশ করে থাকে। শব্দই আমাদের চেতনা বা জ্ঞানজ্যোতিঃ  দান করছে।  বলা হয়ে থাকে স্বয়ং ব্রহ্মের প্রকাশক হচ্ছে শব্দ।  অর্থাৎ শব্দই পরাব্রহ্ম। শব্দ থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, তেমনি শব্দেই তার স্থিতি, আবার শব্দেই বিলীন হয়ে যায়। শব্দই বিশ্বকে বন্ধনের দ্বারা আবৃত করে রেখেছে। শব্দ চক্রেই সমস্ত কিছু আবৃত হচ্ছে। 

পদার্থের বিভাজন পরিণতি হচ্ছে পরমাণু, আবার পরমাণুর একত্রীকরণ পরিণতি হচ্ছে পদার্থ। অতয়েব, পদার্থের যদি শব্দগুন্  থাকে তবে পরমাণুতেও  শব্দ গুন্ আছে। আবার পরমাণুর যে  কার্য্যশক্তি বা পরমাণুর যে কারণশক্তি তার মধ্যেও শব্দ আছে। বিন্দু বা পরমাণু হচ্ছে বস্তুর শেষ বিভাজ্য বস্তু।  অর্থাৎ যার আর বিভাজন করা যায় না। কাকে আমরা  বিন্দু বলি, যার অস্তিত্ত্ব আছে, কিন্তু তার আর ভাগ হতে পারে না। অর্থাৎ ভাগের অতীত এই পরমাণু। অন্য দিক থেকে বলা যায়, শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এই যে শক্তিগুন এর শেষ বিভাজ্য বস্তু হচ্ছে বিন্দু। 
 
এখন ব্রহ্ম কাকে বলে, যার বিভাজন নেই, যার ক্ষয় নেই, অর্থাৎ পদার্থের শেষ সীমায় যিনি অবস্থান করছেন তাকেই বলা হয়ে থাকে ব্রহ্ম।  অর্থাৎ সমস্ত সৃষ্টির কারন-রূপে  যিনি অবস্থান করছেন। যার সীমা নেই, যার ক্ষয় নেই, যাকে বিভাগ করা যায় না, তাকেই বলা হয় ব্রহ্ম। আবার এই পদার্থই কিন্তু এক এবং শব্দময়। সুতরাং বলা যেতে পারে, শব্দ, পরমাণু, বিন্দু, বা ক্ষণ সমস্তই এক ব্রহ্ম-পদবাচ্য। 

এখন কথা হচ্ছে, এই তিন  আলাদা ভাবে প্রত্যক্ষভূত নয়। কিন্তু সমষ্টিভূত অবস্থায় প্রতক্ষ্য-গোচর হয়, এবং আমাদের বুদ্ধির গোচর  হয় ।  যখন দুই বস্তুর সংঘাতে শব্দ শ্রুত হয়, তখন তা ব্রহ্ম অনুসৃত। অব্যক্ত অবস্থায় চেতনার মধ্যে ছিল, আবার অচেতনের মধ্যেও ছিল। এই  দুয়ের সংযোগে অব্যক্ত শব্দ ব্যক্ত হলো। এই ব্যক্ত শব্দই প্রণব মন্ত্র বা ওঙ্কার। 

বলা হয়ে থাকে, পরমেশ্বর জগৎরূপ ধারণ করবার সময় বিন্দু, নাদ ও বীজ এই ত্রিধা-বিভক্ত অবস্থায় ছিল। বিন্দু হচ্ছে শিব, বীজ হচ্ছে শক্তি, আর এই শিব ও শক্তির মিলনে হচ্ছে নাদ। অর্থাৎ নাদ শিব-শক্তি-আত্মক। আমরা জানি চাঁদ ও সূর্য যে-যে আধারে প্রতিবিম্বিত হয়, সেই আধারে তখন স্পন্দন ওঠে, আধার তখন চঞ্চল হয়ে ওঠে, আবার এই  শব্দ বা নাদতত্ত্ব হচ্ছে এই আধারের নির্মাতা। সমস্ত আধারে, তা সে পৃথিবী বলুন বা চন্দ্র-সূর্য বলুন, গ্রহ-নক্ষত্র বলুন, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত আধার এই শব্দব্রহ্ম থেকে সৃষ্ট। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডেরও  হয়তো সীমা  থাকতে পারে, কিন্তু শব্দের কোনো সীমা  নেই। শব্দ অনন্ত। বিশ্ব-জগৎ শব্দব্রহ্মের পরিনাম।  আদি অনাদিকাল থেকেই এই শব্দব্রহ্ম (প্রণব বা ওঙ্কার)   জগৎ-আকারে বিবর্তিত হয়ে চলেছেন। তাই উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, "শব্দই ব্রহ্ম"। বাক্যের মাধ্যমে অর্থাৎ শব্দের মাধ্যমে (ওঙ্কার) আমরা সেই পরমপুরুষের উপলব্ধি করতে পারি। এগুলো কোনো কল্পকথা নয়, এগুলো ভারতীয় মুনিঋষিদের অনুভূতিলব্ধ জ্ঞান। আজও এই সত্য অনড়। 

8.11.2021 অঽম ব্রহ্মস্মীন - আমি কিভাবে ব্রহ্ম থেকে এলাম ?

বৈদিক সাহিত্যে বলা হয়ে থাকে আমরা সবাই নাকি ব্রহ্মের অংশ।  আবার শব্দই নাকি ব্রহ্ম। তো তাহলে বলতে হয়, আমি শব্দ থেকে এসেছি। আমাদের অনেকের জপ ধ্যান করবার অভ্যাস আছে। এখানে আমাদের বলা হয়, একটা ধ্বনি বা শব্দের বারবার উচ্চারণ বা জপ করতে। আমরা জানি শব্দ চার প্রকার। পরা, পশ্যন্তি,  মধ্যমা, বৈখরী। এই পরাবাক একেই বলে শব্দব্রহ্ম। এই পরা বাকের স্ফূরণ তিন প্রকার, প্রথমে পশ্যন্তি রূপে, তারপর মধ্যমা রূপে, এবং সবশেষে বৈখরীরূপে। যোগীদের দৃষ্টিতে বিশ্বব্রহ্মান্ড তিন ভাগে বিভক্ত একটি শব্দ, একটি অর্থ, আর-একটি হচ্ছে জ্ঞান। অর্থ হচ্ছে পদার্থ, শব্দ ও অর্থের মধ্যে সম্মন্ধ হচ্ছে বাচ্য ও বাচক। জ্ঞান ও অর্থের মধ্যে সম্মন্ধ হচ্ছে বিষয় ও বিষয়ী। বৈখরী অবস্থায় শব্দ ও অর্থ পরষ্পর  ভিন্ন। শব্দ হচ্ছে বাচ্য, অর্থ হচ্ছে বস্তু বা বাচক । এই দুইয়ের ভেদ আছে। মধ্যমা অবস্থায় শব্দ ও অৰ্থের ভেদাভেদ সম্মন্ধ।  পশ্যন্তি অবস্থায় শব্দ ও অর্থের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। 

আমরা জানি, মন্ত্রদাতা গুরু শিষ্যকে গোপনে অর্থাৎ কানে কানে, মন্ত্রবিজ প্রদান করে থাকেন। তিনি আসলে দেন বিশুদ্ধ চৈতন্য কিন্তু একটা মোড়কে ঢাকা। আমরা যেমন কাউকে উপহার দিতে গেলে, সুন্দর একটা প্যাকেটে ঢেকে উপহার সামগ্রী প্রদান করে থাকি, তেমনি গুরুদেব চৈতন্যশক্তিকে শব্দের মোড়কে ঢেকে শিষ্যকে গোপনে প্রদান করে থাকেন। অর্থাৎ স্থুল বস্তু শব্দের আবরনে ঢেকে চৈতন্যশক্তির প্রবাহ শিষ্যের স্থূল শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেন। সাধক এই শব্দকে অবলম্বন করে, চৈতন্যের জগতে প্রবেশ করে। শিষ্যকে বলা হয়, নিরন্তর এই শব্দের ধ্যান করতে, বা উচ্চারণ করতে। আসলে বারবার এই শব্দকে আঘাত আঘাত করতে করতে, একসময় শব্দ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।  আর  চৈতন্যেরশক্তি  শব্দের আবরণ ভেঙে উন্মুক্ত হয়ে ওঠে শিষ্যের হৃদয়ে। এই চৈতন্য শক্তি জ্যোতিঃস্বরূপ। তাই জপের সাহায্যেই একসময় শিষ্যের চিত্ত জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে। একেই মহাত্মাগণ বলছেন চিত্ত শুদ্ধি। নিরবিচ্ছিন্ন জপ-এর আঘাতে গুরু প্রদত্ত মন্ত্রের বাহ্য আবরণ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়। আর এক অশ্রুতপূর্ব নাদের ধ্বনি শ্রুতিগোচর হয়। মন হয়ে যায় অন্তর্মুখী। জ্যোতির প্রভাবে ভৌতিক জগতের অনুভব লুপ্তপ্রায় হয়ে যায়। এই হচ্ছে  পশ্যন্তি অবস্থায় শব্দের খেলা। এই অবস্থাকে আপনি আত্ম-সাক্ষাৎকারের পূর্বাবস্থা বলতে পারেন। 
এইবার আমরা শব্দের আরো গভীরে প্রবেশ করবো। এই শব্দব্রহ্মের গর্ভে বিশ্ব অব্যক্ত অবস্থায় ছিলো, আবার এই শব্দের গর্ভে জগৎ প্রবেশ করবে। এই শব্দব্রহ্ম হচ্ছে ঈশ্বরের শক্তি-স্বরূপিণী। এরই আর এক নাম চিৎশক্তি। হিন্দু শাস্ত্রে বলছে, শিব-শক্তি। যিনি শিবরূপে শান্ত অক্ষয়-অব্যয়-নিস্পন্দ।  আবার শক্তিরূপে ইনিই ক্রিয়াশীল। এই শিব ও শক্তি সহযোগে আত্মা নিজেকে পূর্ন অহং রূপে গ্রহণ করে থাকেন। এই পূর্ন অহংভাবই পরমাত্মার পরম-স্বরূপ। এখানে কোনো আবরণ নেই।  এখানে জীব বা জগৎ বলে কিছুই নেই। আবার এই পূর্ন  অহং-এর সংকোচ-বশতঃ আবরনের সৃষ্টি হয়ে থাকে। এই আবরণ নিজের স্ব-রূপের আবরণ এবং এই আবরনের উর্দ্ধে উন্মুক্ত স্বরূপ সর্বদা বিরাজ  করছেন । এই আবরনের ফলে দুটো জিনিস সংগঠিত হয়। প্রথমত স্বরূপের বিস্মৃতি ; দ্বিতীয়ত এই আবরণকেই স্বরূপ বলে ধরে নেওয়া, বা গ্রহণ করা। উপনিষদ বলছে, লয় ও বিক্ষেপ। লয় তমোগুণের ক্রিয়া, আর বিক্ষেপ রজোগুণের ক্রিয়া। 

আত্মস্বরূপ যখন আবরনে ঢাকা পড়ে তখন একদিকে  মহাশূন্যের আবির্ভাব হয়, অন্যদিকে মায়ার উদয় হয় । একেই জীবাত্মা বা চিত্ত বলা হয়ে থাকে। শুদ্ধ দ্রষ্টা-স্বরূপ চিদাত্মক এই মায়িক প্রমাতাই জীবাত্মা। এই জীবাত্মা তখন মহাশূন্যে ভাসতে থাকে। মহাশূন্য তখন দৃশ্য, আর জীবাত্মা তখন দ্রষ্টা। এখন দ্রষ্টা অর্থাৎ জীবাত্মা তখন মহাশূন্যকে আর আপন বলে মনে করে না। শুরু হলো দ্বৈতভাবের। জীবাত্মা তখন গতিশীল জগতের অসংখ্য দৃশ্য দেখতে পায়। শুরু হলো অবিদ্যার বিক্ষেপশক্তির খেলা। জীবাত্মা  পরম-পুরুষ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলো। এরপর সংবিত বা উন্মনা ভাবের মধ্যে যখন প্রাণের আবির্ভাব হয়, তখন দৃশ্য সকলের মধ্যে কোনো একটিকে সে আপন করে গ্রহণ করে। তখন দৃশ্য ও দ্রষ্টার মধ্যে একাত্ত্ববোধ তৈরী হয়। একেই বলে অভেদতত্ত্ব। এখন তার দেহ তৈরী হয়।  এই দেহ স্থুল দেহ নয়।  এটি আত্মার প্রাক্তন কর্ম্মজনিত সংস্কারের উত্থান। আত্মা তখন এই দেহটি-সহ স্থুল  জগতে আসবার জন্য পথের অনুসন্ধান করে। এরপর কর্ম্ম-শক্তির প্রভাবে যোগ্য পিতা-মাতার সন্ধান পেলে, সে  মাতৃগর্ভে প্রবেশ করে। মাতৃগর্ভে সে মাতৃকাশক্তির দ্বারা স্থুল দেহের রচনা করে। ধীরে ধীরে মায়ের কাছ থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে, সে নিজেকে পুষ্টিবর্ধন করে। একসময় দেহের পরিপুষ্টির ফলে মায়ের গর্ভ থেকেই  কালের রাজ্যে প্রবেশ করে। ভূমিষ্ট হয়। একেই বলে প্রসব।

অর্থাৎ আমরা বা এই জগৎ একসময় শব্দব্রহ্মের গর্ভে অব্যক্ত অবস্থায় ছিল, ধীরে ধীরে শিব-শক্তির ক্রিয়ার  ফলে বা  রজঃ ও তমঃ গুনের  ক্রিয়ার ফলে জগৎ ব্যক্ত অবস্থায় প্রকাশিত হল । এ যেন একটা খেলা, এখেলা চলছে নিরন্তর।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

------------------------------------  

12.11.2021

শব্দই ব্রহ্ম, নাদব্রহ্ম । (পরিবর্ধিত অংশ)
মান্ডূক্য উপনিষদ-আগম  শুরুতে বলা হয়েছে - ওম  ইতি এতৎ অক্ষরম  ইদং সর্বং। ওম এই অক্ষরটিই এই সমস্ত। ব্রহ্মই অক্ষর কারন এতে কোনো ক্ষর বা ক্ষয় নেই। এই ওম্-কেই বলা হয়  নাদব্রহ্ম বা শব্দব্রহ্ম। 
শব্দব্রহ্মকে  বাক্যের দ্বারা বোঝানো সাহজসাধ্য নয়।   বলা যেতে পারে, অসম্ভব। কেননা বাক্যের মধ্যেই শব্দ, বর্ণ  ওতপ্রোত ভাবে মিশে আছে।  এঁকে আলাদা করা যায় না। আবার জগতের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন। তাই ভাষার মধ্যে আমাদের তাঁকে খুঁজতে হবে, কিন্তু এঁকে ভাষা থেকে  আলাদা করা যাবে না।

বলা হয়ে থাকে, যিনি যে ভাষা জানেন, তিনি সেই ভাষাতেই চিন্তা করেন। অর্থাৎ আমি যদি বাঙালি হই, তবে আমি বাংলাতেই চিন্তা করি।  আমি যদি মারাঠি বা গুজরাটি, ওড়িয়া, তেলেগু বা পাঞ্জাবি হই তবে আমার চিন্তাও সেইভাষাতেই সংগঠিত হবে। অর্থাৎ একজন বাঙালি কখনো ইংরেজিতে চিন্তা করতে পারে না। তো একজন বাঙালিকে যদি ইংরেজিতে কথা বলতে হয়, তবে তাকে বাংলা  চিন্তাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করতে হবে। 
 
আসলে চিন্তা কোনো ভাষাতে হয় না,চিন্তা হচ্ছে পদার্থ, যা আমাদের মনে চিত্র আকারে প্রকাশিত হয়। এবং পরবর্তীতে  চিন্তা ভাষাতে  রূপান্তরিত হয়। আর যে ভাষা সে জানে, সেই ভাষাতেই এই রূপান্তরন ঘটতে পারে। দেখুন, ভাষা সৃষ্টির আগেই চিন্তার অস্তিত্ত্ব ছিলো। ভাষা মানুষের সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আবিষ্কার হয়েছে। চিন্তার প্রকাশ ভাষাতে ঘটে থাকে। আজও ভাষা আমাদের সমগ্র চিন্তাকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে নি। ভাষার ক্রমোন্নতি বা রূপান্তর এখনো ঘটছে। 

আমাদের মনে যে ধারণা বা যে ভাবনার উদয় হচ্ছে শব্দ তার প্রতীক। আর প্রত্যেকটি শব্দ যা আমরা উচ্চারণ করি তার একটা অর্থ আছে। শব্দ হচ্ছে বাচ্য আর অর্থ হচ্ছে বাচক। একই শব্দ বিভিন্ন রকম অর্থের প্রকাশক হতে পারে।  যেমন "গো"   অর্থে আমরা গরু বুঝতে পারি, আবার গো অর্থে পৃথিবীতে বুঝতে পারি। গো-অর্থে গমন করা, অর্থাৎ যথেচ্ছ বিচরণকারীকে বোঝায়। সেই গো অর্থে সংস্কৃতে  পৃথিবী, চক্ষু, ইন্দ্রিয়, সূর্য, চন্দ্র, দিক, জল, কিরণ, ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থে এর বিরল প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়। তো একই শব্দ যেমন বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়। তেমনি একই বস্তুকে আমরা বিভিন্ন নামে  ডেকে থাকি।  যেমন জল, পানি, (হিন্দি) ওয়াটার (ইংরেজি) ভাসের (জার্মান), ল্যাটিন ভাষায় বলা হয়, একোয়া। কিন্তু এই সমস্তই সেই একই বস্তুর অর্থাৎ জলের ভিন্ন ভিন্ন নাম মাত্র। আমাদের মনে যে ধর্ণা বা ভাবনার জন্ম হয়, তার সঙ্গে ধ্বনির কোনো সম্পর্ক নেই। খ্রিস্টগন বলে থাকেন, "আদিতে ছিলো শব্দ, আর এই শব্দটি ছিলো, ঈশ্বরের সঙ্গে, আর শব্দটিই ছিলো ঈশ্বর". ( In the beginning was the WORD, and the WORD was with the GOD and the WORD was GOD" - John-I.

এখন কথা হচ্ছে, এই শব্দ থেকে কিভাবে এই হাড়-মাস-রক্তের  শরীর হতে পারে, এটা আমাদের কল্পনার বাইরে। এই ব্যাপারটা বুঝতে গেলে, আমাদের জ্ঞানের  অনেক দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হবে। এই একই ধারণা বা সিদ্ধান্ত ছিল, আমাদের সনাতন ধর্ম্মের বিভিন্ন শাস্ত্রে। আবার এই খ্রিস্ট ধর্ম্মের বহু পূর্বে, অর্থাৎ তখন খ্রিস্ট, ইসলাম, বৌদ্ধ ধর্ম্মের জন্ম হয় নি, তখনও  লোগসের ধারণা ছিলো। লোগস কথাটার অর্থ হচ্ছে শব্দ। এই শব্দ থেকেই আলোর সৃষ্টি হলো। এমন কথা শুধু ভারতের মুনি ঋষিগণ নয়, বাইবেলেও এই কথার প্রতিধ্বনি আমরা দেখতে পাই। সেখানে বলা হচ্ছে, প্রভু বললেন,  আলো  হোক, অমনি আলোর প্রকাশ হলো । অর্থাৎ শব্দ ব্রহ্ম এবং সেই শব্দব্রহ্ম থেকে আলোর সৃষ্টি হলো।  
এখন কথা হচ্ছে, আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আমাদের মনের মধ্যে যখন কোনো ভাবনার উদয় হয়, তখন সেই ভাবনাকে রূপদান করবার জন্য, আমরা উপাদান সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়ে থাকি ।  ধরুন আপনার মনের মধ্যে, বা মাথার মধ্যে    একটি বাড়ি তৈরীর ভাবনা এলো, তখন আপনি নিশ্চই এই বাড়ি তৈরির উপাদান সংগ্রহ করতে উদ্যোগী হবেন। এবং ভবিষ্যতে কোনো না কোনো একদিন, এই বাড়ির ভাবনা বাস্তবে ফুটে উঠবে। ঠিক তেমনি সমষ্টি মনে যখন কোনো ভাবনার উদয় হয়, তখন বিশ্বশক্তি একে রূপ দেবার জন্য, উপাদানকে আকর্ষণ করে থাকে। একটা কথা জানবেন, সৃষ্টির প্রথম থেকে যা কিছু এই অখিল মনে ছিল, অখিল মনে আদর্শ রূপে ছিল, সেই আদর্শেরই রূপ পরবর্তীতে প্রকাশ পেয়ে থাকে।  তো যে আদর্শ অখিল মনে চিরকাল বর্তমান থাকে, সেই আদর্শকে রূপ দান করবার সময় হলে,  সমস্ত উপাদান  একত্রিত হতে শুরু করে, এবং একসময় সেই আদর্শের প্রকাশ পায়।
 আবার একটা জিনিস জানবেন, সেই সমষ্টি মনে বা অখিল মনে এই আদর্শের কখনো বিলোপ ঘটে না। জগতের সমস্ত জীব জন্তু যদি মারা যায়, বা সমস্ত জীবজগতের যদি নাশ হয়ে যায়, তথাপি অখিল মনে এই আদর্শ বজায় থাকতে পারে। আর এই আদর্শের সঙ্গে যতক্ষন না বাস্তব রূপটি নিখুঁত  হয়, ততক্ষন এই সৃষ্টিতে ধংসলীলা ঘটতে থাকবে। অর্থাৎ শিল্পী যতক্ষন না তার মন মতো শিল্প সৃষ্টি করতে পারছেন, ততক্ষন তিনি এই ভাঙা-গড়ার কাজ থেকে বিরত হবেন না। আর ঠিক এই কারণেই আমরা চোখের সামনে সৃষ্টি-ধংশ হতে দেখছি।  আসলে ঈশ্বর তার মনের মতো আদর্শকে রূপায়িত করবার প্রয়াসের কোনো বিরতি রাখতে চান না। 

সমস্ত জীব-জগৎ, এমনকি এই পৃথিবী, চন্দ্র সূর্য, নক্ষত্র সবার ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য। বিশ্বশক্তি তার মনে অন্দরে যে রূপের ছবি এঁকেছেন, সেই রূপকে সে চাক্ষুস করতে চান। ধরুন, এই পৃথিবী একসময়, কালের প্রবাহে, বা হঠাৎ করে গ্রহ-নক্ষত্রের আঘাতে ধংশপ্রাপ্ত হলো, তথাপি, ঈশ্বরের মনের মধ্যে এই পৃথিবী মৌলিক অবস্থায় নীহারিকা পূঞ্জের  মতো বস্তুপিণ্ডে পরিণত হবে।  কিন্তু যে আদর্শ পৃথিবীকে নিয়ে অখিল মনে আছে, তা থেকে বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের কোথাও না কোথাও একই উপাদানে আরো একটি পৃথিবী বা আরো উন্নত পৃথিবীর জন্ম হবে। এবং এই ধারা চলতে থাকবে। সেখানেও হয়তো এইরকম বা আরো উন্নত জীব তৈরী হবে। 

পরা-বিদ্যাবিদগন বলছেন, এই পৃথিবীর আগে চন্দ্রে মানুষের অস্তিত্ত্ব ছিল।  তখন চন্দ্র ছিল, গ্রহ। ধীরে ধীরে কালের প্রবাহে, চন্দ্রের বিলুপ্তি ঘটতে চলেছে। চন্দ্র আজ গ্রহ থেকে উপগ্রহে রূপান্তরিত হয়েছে।   একসময় এই চন্দ্রের অস্তিত্ত্ব মহাবিশ্বের  মহাশূন্যে ছড়িয়ে পরবে।  তখন চন্দ্রকে আর চাক্ষুস করতে পারা  যাবে না। আবার এই পৃথিবীও একসময় চন্দ্রের অবস্থা প্রাপ্ত হবে। আবার এই পৃথিবীর ধংসের পরে বুধে জীবনের ক্রিয়া শুরু হবে। সেখানে এখন জীবনী শক্তির সৃষ্টির খেলা চলছে। জীব সৃষ্টির উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির কাজ চলছে। পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, এই মুহূর্তে শুক্রগ্রহ পৃথিবীর মানুষের থেকেও উন্নত ধরনের জীব বর্তমান। এই সব কথার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আজ গবেষণার বিষয়। ভবিষ্যৎ বলবে এইসব কথার মধ্যে কোনো সত্যতা আছে কি না। 

ঋকবেদে পড়ছিলাম, 
সূর্য-চন্দ্র-মসৌধাতা যথা-পূর্বম কল্পয়ৎ 
দিবং চ পৃথিবীং চ অন্তরিক্ষম অথো স্বাঃ।

কল্পের আরম্ভে বিধাতার মনে সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রাদি পূর্বকল্পে যেমন ছিল, তেমনই সৃষ্টি করলেন। বিধাতা প্রথম কল্পের ন্যায়ই পূর্ববৎ সূর্য, চন্দ্র, দিব্যলোক, পৃথিবীলোক, অন্তরীক্ষ ও লোকান্তর সৃষ্টি করেছেন।
তো একটা কথা আমরা মনে হয়, যা কিছু সৃষ্টি সবই সমষ্টি মনের খেলা। আর তার শুরুটা হয়েছে শব্দের মাধ্যমে। 

এখন কথা হচ্ছে, শব্দ থেকে কিভাবে এই জগৎ এমনকি জীব শরীর সৃষ্টি হলো। এই রক্ত-মাংসের দেহ কি শব্দ দিয়ে তৈরী করা সম্ভব ? জীব-জগতের সমস্ত দেহ হচ্ছে কতকগুলো কোষের সমষ্টি।  কোষের মধ্যে আছে নিউক্লিয়াস।  নিউক্লিয়াসের মধ্যে আসে নিউক্লিয়াস এসিড। 

বিজ্ঞান বলছে, আজ থেকে ৪৫০ কোটি বছর  আগে,  গ্যাসীয় পুঞ্জ ও ধূলি-বালিকণা ঘনীভূত হয়ে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল। ১৬০ কোটি বছর আগে, মৌল পদার্থগুলোর মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে, জল, মিথেন, এমোনিয়া, কার্বন-ডাইঅক্সাইড, হাইড্রোজেন সায়ানাইড ইত্যাদি অণুগুলো তৈরি হয়। এর পরে, তাপের বিকিরণের ফলে পৃথিবী ঠান্ডা হতে থাকে ও কিছু গ্যাস তরলে ও কিছু গ্যাস কঠিন পদার্থে রূপান্তরিত হয়। পৃথিবীর এই যে কঠিন রূপ তা হয়তো ৩০০ কোটি বছরের পুরানো। 

--------------------

নমস্তভ্যং বিরূপাক্ষ নমস্তে দিব্য চক্ষুষে। 

আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমাদের প্রাচীন মুনিঋষিগন সবাই কি দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন ? যোগগুরুগন বলে থাকেন, তোমার সাধনফল, তা সে অনুভূতি হোক, প্রতক্ষ্য দর্শন হোক, সেগুলোকে শাস্ত্রবাক্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখবে। যদি দেখো, সেখানে কোনো অমিল আছে, তাহলে জানবে, তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।  তখন নিজেকে সংশোধন করবার জন্য প্রয়াস করবে। অর্থাৎ জানবে শাস্ত্রবাক্যই ধ্রুবসত্য। শাস্ত্র নির্দেশিত পথই সত্যের পথ। কালের চক্রে পড়ে, নিজেকে ভুল পথে যেতে দিও না।  বলা হচ্ছে শিব দিব্যচক্ষু বিশিষ্ট। ইন্দ্রিয়াতীত তৃতীয়নেত্র বিশিষ্ট শিব, যার দৃষ্টি বিরূপের দিকে।  তাই শিব বিরূপাক্ষ। যে শিবলিঙ্গের আমরা পুজো করি,  এই শিবলিঙ্গ উর্দ্ধরেতা।  আর উর্দ্ধরেতা হলে বিন্দুর অধোগতি হয় না। তাই সৃষ্টি হয় না, হয় সংহার। তাই শিবকে বলা হয় সংহারকর্তা। আবার এই বিন্দুর গতি যখন অধোমুখী, তখন সৃষ্টি। অধোগতি কাম-জনিত, আর উর্দ্ধগতি প্রেমজনিত। স্থিতাবস্থায় না আছে কাম না আছে প্রেম। বিন্দুর অধোগতিতে রূপের প্রকাশ আর বিন্দুর উর্দ্ধগতিতে রূপ অন্তর্হিত হয়ে যায় । 

শক্তিবীনা বিন্দুর না আছে অধোগতি, না আছে উর্দ্ধগতি। শক্তির সংযোগে বিন্দু কম্পিত হয়।  শক্তিকে ধরতে চায় বিন্দু । শক্তির সঙ্গে এক হতে চায় বিন্দু ।  তাই ধাবিত হয়। বিন্দু যতক্ষন বাহ্য পদার্থের সঙ্গে মিশ্র অবস্থায় থাকে, ততক্ষন সে অশুদ্ধ। শুদ্ধ বিন্দু কল্পান্তরে জীবের বা বাইরের পরমাণু সংযোগে নেমে আসে। বা বলা যেতে পারে, পরমাণুসকল শুদ্ধবিন্দুকে টেনে নামিয়ে আনে। যতক্ষন বাইরের পরমাণুর সঙ্গে বিন্দু মিশ্রিত না হয়, ততক্ষন সে কেন্দ্রীভূত একক সত্ত্বা  বা অখন্ড থাকে। শক্তির সংযোগ হলে বিন্দুতে কম্পন ওঠে ও উর্দ্ধদিকে উঠতে থাকে। সাধকের এই সময় থেকে শিবভাবের প্রারম্ভিক অবস্থার তৈরী হয়। জমাট বাঁধে, তাই আর ভাঙে না, কিন্তু গলে যেতে পারে। আমরা জানি জমাট বস্তু আঘাতের শক্তিতে  ভেঙে  টুকরো টুকরো হয়ে যায়, কিন্তু অগ্নির স্পর্শে এলে সেই একই বস্তু গলে যায়, তরল হয়ে যায়। তখন আর তাকে কেটে ভাগ করা যায় না।  জলকে কাটা যায় না।  তখন সে শক্তির সাথে সমান স্বচ্ছ হয়ে যায়, একসময় আরো দাহিকার শক্তির প্রাবল্যে ব্যাপক আকার ধারণ করে, বাস্পে পরিণত হয়ে যায়। এইসময় সাধক নিজের পৃথক সত্ত্বাকে ধরে রাখে, কিন্তু শক্তি থেকে তাকে বিভাজ্য করা যায় না। 

বিন্দুর সাথে প্রকৃতির সম্মন্ধ হলে, বিন্দুকে জড়-পরমাণু ঘিরে ফেলে।  তাকে স্থুল করে নিচের দিকে টেনে নামায়। এর কারন হচ্ছে, বিন্দুতে আছে জড়-সংস্কার। আর প্রকৃতিতে আছে জড়ের আধিক্য। বিন্দুর সুপ্ত  জড়-সংস্কার আছে বলেই বাইরের জড়াংশ এসে তাকে বেষ্টিত করে জড়ের দেশে নিয়ে যায়। বিন্দু যখন জড়-সংস্কার রোহিত হয়, তখন কোনো প্রকৃতি সংযোগ ঘটিয়েও তাকে নিচে নামাতে পারে না। তখন জড়-সংস্কারবিহীন বিন্দু অধোগতি হয় না, বরং উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হয়। তাই সাধকের উচিত বিন্দুকে জমাট বাঁধানোর চেষ্টা করা। বিন্দু একবার কঠিন হয়ে গেলে, জমাট  বেঁধে গেলে, তা আর জড়-প্রকৃতির দ্বারা আকৃষ্ট হয় না।  এইজন্য বলা হয়ে থাকে, সাধকের প্রথম দিকে অবশ্যই প্রকৃতির সঙ্গ ত্যাগ করা উচিত। চিৎশক্তি যদি বিন্দুতে সঞ্চারিত হয়, তাহলে বিন্দুকে জমাট করে দেবে, কম্পনের সাহায্যে। হাতের মধ্যে কাদামাটি নিয়ে হাত ঘোরালে,যেমন, কাদা ধীরে ধীরে শক্ত-স্তূপে পরিণত হয়, তেমনি বিন্দু যখন চিৎশক্তির সংস্পর্শে আসে, তখন তার মধ্যে একটা কম্পন সৃষ্টি হয়, আর বিন্দু জমাট বাঁধতে শুরু করে। আর তখন বিন্দু উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হবে। 

প্রক্রিয়া ১ : স্থির হয়ে বসুন, শরীরকে অচঞ্চল করুন।  এইবার যেকোনো একটা শব্দ শুনতে থাকুন। এই প্রক্রিয়া গভীর রাতে অধিক ফলপ্রসূ হয়। কেননা এইসময় প্রকৃতির মধ্যে  বাহ্যিক আহত শব্দের পরিমান কমতে থাকে। মন দিয়ে শুধু এই শব্দকে শুনতে থাকুন। একাগ্রতা যত  বাড়বে, তত দেখবেন, শব্দ যেন সূক্ষ্ম হয়ে আসছে। এইসময় মন ও শব্দকে একত্রে রাখতে চেষ্টা করুন।  মন যেন এক মুহূর্তের জন্যও শব্দকে ছেড়ে না যায়। মনের একাগ্রতা কম থাকলে, মাঝে মধ্যে এই শব্দকে মন হারিয়ে ফেলবে। তখন আবার মনকে ধরে এনে শব্দের পিছনে বসিয়ে দিন।  শব্দকে ধরে এগুতে থাকুন। মনকে যদি শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন, তখন দেখবেন, শব্দ ধীরে ধীরে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম হচ্ছে, কখনো কখনো অধিক শক্তিশালী হচ্ছে, আর তখন মন আবার শব্দ থেকে নিবৃত্ত হবার চেষ্টা করবে। কিন্তু মনকে ধরে রাখুন, শব্দের সঙ্গে। 

এই যে শব্দকে আপনি শুনছেন, বা অনুসরণ করছেন, তা আসলে বৈখরী বা আহত শব্দ। এই শব্দ আপনি আপনার কর্ন  ইন্দ্রিয় দিয়ে শুনছেন। একটা সময় দেখবে, কানের সামর্থের বাইরে চলে গেছে, এই শব্দ। তখন যে শব্দ আপনি শুনে পাবেন, তাকে বলা হয় অনাহত শব্দ বা ওঙ্কার। একটা সময় এই শব্দ আর মন দ্বারা বা কান দ্বারা শ্রুতিগম্য থাকবে না। তখন যে অবস্থা থাকবে তা হচ্ছে চৈতন্য।  এইসময়  শব্দ চৈতন্যময় হয়ে উঠবে। এই অবস্থা হচ্ছে শব্দের পশ্যন্তি অবস্থা। এর পরে চৈতন্যের অবস্থিতি ক্ষীণ হয়ে আসবে।  চৈতন্য নেই বললেও বলা চলে।  একেই বলে শব্দের পরা অবস্থা। 

প্রক্রিয়া ২ : মূলাধারে আকাশের মধ্যে মনকে নিবিষ্ট করুন। আকাশ যার একমাত্র গুন্ হচ্ছে শব্দ। এখানে অবস্থান করছে পরাশব্দ। নাভিতে এসে এই শব্দ হলো পশ্যন্তি।  হৃদয়ে এসে হলো অনাহত মধ্যমা, কন্ঠে এসে হলো বৈখরী। এখানে এসেই বায়ু সাথে সংঘর্ষে নাদ বক্র আকার ধারণ করে। এবং শ্রুতিগোচর শব্দ বা ভাষারূপে পরিণত হয়। বাসনা থেকে বায়ুর গতি বক্র হয়। এখানেই বিষয়ের প্রথম স্তর। এই স্তরে শব্দ আঘাত পেয়ে বিষয়ে পরিণত হয়। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর দ্বারা যে শব্দ শুনি বা দেখি, সে সব এই স্থূল স্তরের অন্তর্ভাব সম্পন্ন। 

অবয়ব কিভাবে দৃশ্যমান হয় দেখুন। আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। আপনার চারিদিক থেকে চারটি আলো ফেলা হলো। তো আপনার চারটি ছবি দেওয়ালে বা মাটিতে দেখতে পারবেন। এইবার আপনি ভাবুন, আপনার চারিদিক থেকে অসংখ্য আলোর রশ্মি ফেলা হলো, তখন আপনার অসংখ্য ছায়া তৈরি হলো। এখন এই ছায়াকে যদি কোনো উপায়ে স্থুল করা যায়, তবে কিন্তু আপনার অসংখ্য মূর্তি তৈরী হতে পারে। আমাদের ধারনা  হচ্ছে, অন্তত বিজ্ঞান বলছে, বা আমরা প্রতক্ষ্য করছি, আলো  আসে সূর্য থেকে। কিন্তু উপনিষদ বলছে, আলো  আসে পরমাত্মা থেকে। এখন পরমাত্মা কোথায়  আছেন ? উপনিষদ বলছে, পরমাত্মা আছে, আমাদের সবার হৃদয়ে। জীবের  অন্তরাত্মাই পরমাত্মা। অতয়েব যতগুলো রশ্মি জীবাত্মা থেকে বের হবে, ততগুলো অবয়ব বা দেহ দেখা যাবে। এখন এই রশ্মিগুলোকে যদি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, তখন আর অবয়ব বা দেহ বলে কিছু থাকবে না। 

নিচ থেকে কোনো কিছুকে উপরে তুলতে গেলে, তাকে সূক্ষ্ম  করতে হয়। অর্থাৎ মূল সারবস্তু বাদে, সমস্তকিছুকে পরিত্যাগ করতে হয়। আর এই সার বস্তু সংগ্রহের জন্য, নিজেকে তাপিত করতে হয়। বায়ুকে উর্দ্ধগতি সম্পন্ন করতে গেলে, বায়ুকে তাপ দিতে হয়। মূলাধারে যে ব্রহ্মরন্ধ্র আছে, একমাত্র যেখান থেকে ব্রহ্মচক্রের মার্গ, সেখানে প্রবেশ করতে গেলে, আমাদের স্থুল বায়ু, যার সঙ্গে আছে প্রাণ, আছে  চৈতন্য, তাকে  সূক্ষ্ম-সারবস্তুতে রূপান্তরিত করতে হবে। বায়ুকে সরল গতি সম্পন্ন করতে হবে। ...................................  

দেহের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বিন্দুর আবির্ভাব হয়, আবার এই বয়সের সঙ্গে সঙ্গেই  বিন্দু অপ্রকট হয়। শক্তিবিহীন সার বস্তু গতিহীন। আমরা শুনেছি, সূর্য্যের যেমন রশ্মি আছে, তেমনি পরমাত্মার রশ্মি আছে। আসলে পরমাত্মা অর্থাৎ শব্দ-ব্রহ্ম  থেকে সূর্য তেজ সংগ্রহ করছে। আবার পরমাত্মাই জীবের অন্তরে জীবাত্মা রূপে বাস করছেন। 
অতয়েব যত  রশ্মি এই জীবাত্মা থেকে বার হবে, ততগুলো দেহ বা অবয়ব দেখা যাবে। আসলে সাকার-সিদ্ধি না হলে কায়ব্যূহ তৈরী হতে পারে না। আর প্রত্যেকটি রশ্মি তখনই সাকার হবে, যখন রশ্মির কেন্দ্রবিন্দু সাকার। রশ্মির কেন্দ্র নিরাকার হলে ব্যূহও নিরাকার অর্থাৎ পরিণতিও নিরাকার  হবে। সত্ত্বকে যখন শক্তি বিক্ষুব্ধ করে, তখন তা থেকে বিন্দু বের হয়ে কারণ-বারিতে পতিত হয়। কারন-বারি এই বিন্দুর স্পর্শে জড়-উপাদান থেকে উপাদান সংগ্রহ করে একত্রিত করে এবং দেহ নির্মাণ হয়।  আর সেই দেহে বিন্দুর একাংশ  অনুপ্রবিষ্ট হয়। যদিও দেহে বিন্দুর-অংশ প্রবিষ্ট হয়েছে, তথাপি বিন্দু থাকে নির্লিপ্ত। বিন্দুর এই নির্লিপ্ত অবস্থাই পরমাত্মার অবস্থা।  আর অপর অংশ অভিমানী জীবাত্মা। এই যে দেহ নির্মাণ হলো, একেই বলে লিঙ্গদেহ। এই লিঙ্গ দেহ দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়ে থাকে, চিরকাল নয় ।  যতদিন মুক্তি না হয়, অর্থাৎ চিৎবিন্দু যতক্ষন না এঁকে পুনরায়  আকৃষ্ট করে, ততদিন এই লিঙ্গদেহের স্থায়িত্ত্ব থাকে। একসময় এই লিঙ্গদেহ স্থুলতা প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ স্থুলের ছাঁচ নিয়ে যখন অধোগতি সম্পন্ন হয়, তখন স্থুল  আকার বিশিষ্ট হয়। কিন্তু নিম্নস্তরে অধঃপতিত হয়েও, স্বাভাবিক ভাবে পঞ্চভূতের দ্বারা আবৃত  হতে পারে না। স্থুল পিতা-মাতার মিলনে তেজের বিকাশ ঘটে। এই তেজ লিঙ্গ-কোষের বিকাশ সাধন করে থাকে। এই সময় যেমন যেমন ভাবনা থাকে, লিঙ্কদেহ  তদ্রুপ আকার ধারণ করে থাকে। আর ঠিক এইসময় বাহির থেকে তদ্রুপ ভাবাপন্ন লিঙ্গদেহ আকৃষ্ট হয় ও তাতে প্রবেশ করে।  এর পরে আরো অধোগতি, কালের রাজ্যে প্রবেশ, মৃত্যুপুরীতে প্রবেশ স্থূলতা প্রাপ্তি। তো এর থেকে আমার বুঝতে পারলাম, (১) চিদবীর্য হচ্ছে শুদ্ধসত্ত্ব বিন্দু স্বরূপ। (২) এইবার এই চিদবীর্যের সঙ্গে কারন-বারি সংযোগে লিঙ্গদেহ। (৩) এবার কারন-বারি, লিঙ্গদেহ ও পঞ্চভূত থেকে স্থূল দেহের উৎপত্তি। যা থেকে বা যে বিরাট সত্ত্ব থেকে শুদ্ধ সত্ত্ববিন্দু ক্ষরন হয়েছে, তিনি বিরাটপুরুষ ঈশ্বর। এই ঈশ্বর আমাদের  সবার মধ্যে অন্তর্যামীরূপে অবস্থান করছেন। আবার ইনি সাক্ষী-স্বরূপ অবস্থান করছেন।  (৪) আর এইসবের সঙ্গে সন্মন্ধাতীত চতুর্থ নির্গুণ ব্রহ্ম বা তূর্য্যাতীত। 

এই লিঙ্গদেহই পঞ্চভূতকে একত্রিত রাখে, এই লিঙ্গদেহ আলাদা হয়ে গেলে, পঞ্চভূতের বাঁধন ছিঁড়ে যায়। স্থুল দেহের বিনাশ সাধন হয়, যাকে  আমরা মৃত্যু বলে  থাকি । কিন্তু লিঙ্গদেহ তখনও থেকে যায়। এই লিঙ্গদেহ আবার পরবর্তীতে একই প্রক্রিয়ায় স্থুল দেহের নির্মাণ করে থাকে। একেই বলে পুনর্জন্ম। 

কিন্তু লিঙ্গদেহ থেকে সত্ত্ববিন্দু বের করে নিলে লিঙ্গদেহের বিনাশ সাধন হয়। তখন সত্ত্ববিন্দু সেই বিরাটসত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। লিঙ্গদেহের নাসের ফলে তন্মাত্র ইত্যাদি পরমাণু আকারে ছাড়িয়ে পড়ে । .............................  তাহলে আমরা শব্দ-ব্রহ্ম থেকে স্থুল দেহের নির্মাণ প্রক্রিয়ার একটা আভাস পেলাম। আবার কি করে সেখানে ফিরে যাওয়া যায়, সেই প্রক্রিয়ার কথাও ধীরে ধীরে শুনবো। আমরা যত  বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করবো, তত আমাদের আসা-যাওয়ার পথ আমাদের কাছে পরিষ্কার হবে। অর্থাৎ আমাদের সংযমশক্তি আমাদেরকে বিষয়ের গভীরে নিয়ে যাবে, আমরা নিশ্চই মার্গের সন্ধান পাবো।  ....................  

শব্দহীন শব্দকে শুনুন। (soundless sound)

আমার এক বন্ধু তার একটা ম্যাজিক-শো-তে আমাকে যেতে আমন্ত্রণ করেছিল। তো তার ইন্দ্রজাল দর্শন আমাকে অভিভূত করেছিল।  তো তাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, এটা কিভাবে করলে ? একথা শুনে সে আমাকে ইন্দ্রজালের একটা বই উপহার দিয়েছিলো, গণপতি সরকারের লেখা। তো বইটা পড়ে, আমার মনে হয়েছিল, এগুলোতো আমিও করতে পারি। শুধু আমি কেন, যেকেউ এটি করতে পারে। শুধু প্রক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞান আর অভ্যাস আমাদেরকে ম্যাজিক শেখাতে পারে। আমরাও পারি। ঠিক তেমনি ধ্যানের  জন্য, ঈশ্বরের অনুভূতি লাভের  জন্যও, আমাদের প্রাচীন মুনি ঋষিগণ কিছু প্রক্রিয়ার কথা দীর্ঘদিনের অভ্যাস ও অনুসন্ধানের ফলে জেনেছিলেন। আমরা যদি তাঁদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে, প্রক্রিয়াগুলোকে সঠিকভাবে অভ্যাসের মধ্যে আনতে  পারি, তবে আমরাও মুনিঋষিদের যে অনুভূতি তা আমাদের মধ্যেও অনুভব হতে পারে।    

আমাদের পাঁচ ইন্দ্রিয় দ্বারাই আমরা ধ্যানের  অভ্যাস করতে পারি।তবে, কান আমাদের এমন একটা ইন্দ্রিয় যার ক্রিয়া সহজে বন্ধ হয় না। এমনকি শ্রবণ ইন্দ্রিয় আমাদের এমন একটা ইন্দ্রিয় যা আমাদের ঘুমন্ত অবস্থাতেও সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। তো আজ আমরা কানের সাহায্যে কিভাবে ধ্যানের অভ্যাস করবো, সেই কথা শুনবো।  

শুধু শুনুন।  কিছুই করতে হবে না , শুধু বসে বসে মনোযোগ দিয়ে শুনুন।  আপনি সমুদ্রের গর্জন শুনুন।  আপনি নদীর কুল-কুল ধ্বনি শুনুন। আপনি পাখির গান শুনুন। আপনি ফ্যানের আওয়াজ শুনুন। আপনি ঘড়ির টিক টিক আওয়াজ শুনুন। আপনি বাতাসের শো-শো শব্দ শুনুন। শুধু শুনেই আপনি নিজের মধ্যে একটা শান্তির ভাব অনুভব করতে পারবেন। মুখ দিয়ে কথা বলা, বা চোখ দিয়ে দেখার চাইতে, কান দিয়ে শোনা অনেক সহজ। কান হচ্ছে একটা দরজা, যা খোলাই থাকে -  তাকে খোলাই থাকতে দিন, আর সজাগ থাকুন। 

নাদব্রহ্ম ধ্যান :

নাদব্রহ্ম এটি একটি বহু প্রাচীন তিব্বতীয় প্রক্রিয়া যা ভোরের দিকে অভ্যাস করতে হয়। খালি পেটে  এই  প্রক্রিয়ার অভ্যাস আপনি দিনের যে কোনো সময়, সমষ্টিগত ভাবেও করতে পারেন। এই প্রক্রিয়ার তিনটে ভাগ, (৩০-১৫-১৫)  মোট সময় এক ঘন্টা। 

প্রথম পর্যায় : চোখ বন্ধ করে বিশ্রামের ভঙ্গিতে বসুন। ঠোঁট-দুটো বন্ধ করুন। এইবার "ম্" বা ওঙ্কারের অনুনাসিক ধ্বনি  (ভ্রামরী) অর্থাৎ ভ্রমরের মতো করে আওয়াজ) এই ধ্বনি উচ্চস্বরে উচ্চারণ করতে থাকুন। এমন ভাবে উচ্চারণ করুন, যাতে আপনি ও আপনার পাশের সবাই এই ধ্বনি শুনতে পান। এই ধ্বনির দিকে মনকে নিবিষ্ট করুন। নিজের শরীরের মধ্যে একটা কম্পন আনতে চেষ্টা করুন। মনে করুন, যেন এই ধ্বনি আপনার নাভি প্রদেশ থেকে উৎসারিত হচ্ছে। পেটের  মধ্যে একটা কম্পন হচ্ছে, গলার মধ্যে একটা কম্পন হচ্ছে। মনে করুন, আপনি যেন একটা খালি  কলসি। আর কলসির ভিতর থেকে একটা ধ্বনি বেরিয়ে আসছে, আপনার কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কানের ভিতরে ধ্বনি প্রবেশ করছে না, কানের ভিতর দিয়ে ধ্বনি বেরিয়ে বাইরে বিস্তার লাভ করছে। এই প্রক্রিয়া করতে করতে একটা সময় মনে হবে, এই ওম (অনুনাসিক  ধ্বনি ) আপনি উচ্চারণ করছেন না, কেবল মাত্র উচ্চারিত হচ্ছে।  আপনি শুধু শ্রোতা হয়ে গেছেন। এই সময় আপনার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিন। এই অবস্থায় ত্রিশ মিনিট থাকুন, বা এই প্রক্রিয়া ত্রিশ মিনিট ধরে করুন।  

দ্বিতীয় পর্যায় :  এই প্রক্রিয়ার সময়কে আধা-আধি ভাগ করে নিন। অর্থাৎ ৭.৫ মিনিট - ৭.৫ মিনিট।  প্রথম সাড়ে-সাত মিনিট : বা  হাতের পাতাকে ডান  হাতের পাতার উপরে স্থাপন করে, নাভিমূলে স্থাপন করুন।  এবার হাতদুটোকে সামনের দিকে প্রসারিত করতে থাকুন। ঠিক  যেন নাভিমূল থেকে উৎসারিত ওঙ্কার আপনি কর্ণকুহর পথে বিশ্বজগৎকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। অর্থাৎ হাতদুটো দিয়ে দুটো গোল চক্রাকারে ঘুরিয়ে আবার নাভিমূলে স্থাপন করুন। অর্থাৎ এই অবস্থায় আপনি দুটো অদৃশ্য  গোল চক্র পরিক্রমা করছেন। এই কাজ করবার সময় ধীরে ধীরে করুন। এতটাই আস্তে হাতের বিস্তার করুন, যেন মনে হবে, হাতের কোনো মুভমেন্টই  হচ্ছে না। মনে মনে ভাবুন, আপনি বহির বিশ্বজগতে  অসীম অনাহত ধ্বনির শক্তি ছড়িয়ে দিচ্ছেন। 

এর পরে ধাপে হাত দুটোকে বিপরীত দিকে ঘোরাতে থাকুন।  অর্থাৎ এবার বহির্বিশ্বের সমস্ত ব্রহ্মশক্তি আপনার কানের ভিতর দিয়ে  নাভিপ্রদেশে প্রবেশ করছে। তো প্রথম পর্য্যায়ে হাতদুটো কে  এমন ভাবে  ঘোরাবেন যেন আপনি বাইরে ওঙ্কারের ধ্বনি ছড়িয়ে দিচ্ছেন, আবার বিপরীতক্রমে অর্থাৎ হাত দুটোকে উল্টোমুখী করে ঘোরান, যাতে মনে হয়, সমস্ত বিশ্বশক্তি আপনার ভিতরে প্রবেশ করছে। 

তৃতীয় পৰ্য্যায় : এবার স্থির হয়ে পাষাণবৎ অবস্থান করুন। নির্জনতাকে উপভোগ করুন।  এই অবস্থায় ১৫ মিনিট থাকুন। এইসময় খেয়াল করুন, প্রথম ৩০সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট আপনার স্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে।  এই ক্ষণকে ধরবার চেষ্টা করুন। -------------------
---------------------  
ওঙ্কার ধ্যান : 
শব্দের অর্থ যেমন আমাদের প্রভাবিত করে, তেমনি শব্দের ধ্বনি-তরঙ্গ আমাদেরকে প্রভাবিত করে।  আর তা শুধু মানসিক দিকে থেকে নয়, শারীরিক দিক থেকেও। বজ্রের শব্দে আমার শরীর কেঁপে ওঠে, কোকিলের মধুর ডাক আমাদের শরীরে এমনকি মনে হিল্লোল  তোলে। মেঝেতে  কাঁচ ঘসার আওয়াজ আমাদের শরীরে বিরক্তির  উদ্রেগ করে। আবার ওঙ্কারের গুরুগম্ভীর  ধ্বনি আমাদের শরীরের মধ্যে একটা পবিত্র স্নিগ্দ্ধ ভাবের আলোড়ন তোলে। আর যদি কোনো ভাগ্যবানের অস্ফূট অনাহত ইন্দ্রিয়াতীত ব্রহ্মধ্বনি শুনবার সৌভাগ্য হয়, তবে তিনি বুঝবেন, তিনি যেন পবিত্র থেকে পবিত্র আলোর তরঙ্গে অবগাহন করছেন। একটা শুদ্ধ মনের অধিকারী হচ্ছেন। 

স্বয়ং শিব বলছেন, আপনি যখন কোনো শব্দ সুর করে বারবার উচ্চারণ করছেন, যেমন ওম যখন আপনি বিশেষ সুরের সঙ্গে  আবৃত্তি করছেন, তখন আপনার ভিতরে সেই  শব্দময় ভাবের উদয় হচ্ছে। ধীরে ধীরে এই ওম উচ্চারণ করুন। সমস্ত শব্দের মূলীভূত কারণশব্দ হচ্ছে এই ওম।  অ, উ, ম - এই তিনটে অক্ষর বা ধ্বনি সংযুক্ত হয়ে ওম সংগঠিত হয়েছে। আর  সমস্ত ধ্বনি তৈরী হয়েছে এই  ওম থেকে। এই তিন ধরনের ধ্বনি (অক্ষর) দিয়েই সমস্ত ধ্বনির উৎপত্তি। বিজ্ঞান যেমন বলছে, ইলেক্ট্রন, নিউট্রন, ও প্রোটন সমস্ত পদার্থের মূল, তেমনি জগতের মূল হচ্ছে এই ওঙ্কার । 

এই ওঙ্কারের উপযোগিতা উপলব্ধি করতে গেলে, প্রথমে ওঙ্কারকে উচ্চস্বরে গাইতে হয়, যাতে পাশাপাশি সবাই এই ধ্বনি শুনতে পায়, আবার আপনিও শুনতে পান। আসলে আমরা যা কিছু মুখ দিয়ে উচ্চারণ করি, তা সবই অন্যকে শোনানোর জন্য। এটাই আমাদের অভ্যাস।অন্যরা বলে আমরা শুনি, আবার আমরা বলি, অন্যরা শোনে।   নিজেকে শোনানোর জন্য, সাধারণত কোনো শব্দের ব্যবহার করি না।আমরা যখন নিজের সাথে কথা বলি, তখন আমরা শব্দের উচ্চারণ সাধারণত করি না।  কিন্তু আমরা যখন মন্ত্র বা ঈশ্বরের স্তুতি উচ্চারণ করি, তা আমারা নিজের জন্যই উচ্চারণ করে থাকি। আসলে আমরা অন্যের সাথে কথা বলি।  আমরা কখনো নিজের সাথে কথা বলি না। কিন্তু এই মহামন্ত্র আমাদের নিজেদের সাথে কথা বলতে শেখায়। আর সমস্ত মন্ত্রের সর্বোচ্চ স্থান আছে এই ওম-এর মধ্যে। ওম একমাত্র ধ্বনি যা আমাদের নাভিমূল থেকে সরাসরি উঠে আসছে।  

এই ওঙ্কারের  যখন উচ্চারণ করবেন, তখন নিজেকে ওঙ্কারের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চেষ্টা করুন। নিজেকে ওম, এই ধ্বনি দিয়ে পূরণ করে তুলুন।  নিজেকে ওম-ময় করে তুলুন। ধীরে ধীরে ওম এই পবিত্র ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়ে যান। নিজের মধ্যে একটা রূপান্তর আনুন।  আর এটি খুই সহজ কাজ। ওম দিয়ে নিজের মনের মধ্যে আলোড়ন তুলতে পারেন, এমনকি আপনার শরীরের মধ্যেও একটা কম্পন তুলতে পারেন। আপনার সমস্ত তন্ত্রে, এই ধ্বনিকে ছড়িয়ে দিন। তখন আপনি ওম এর প্রতিধ্বনি শুনতে পারবেন। কেননা ধ্বনির স্বভাব হচ্ছে, আঘাত খেয়ে আবার উৎসে ফিরে আসা। তো আপনি যখন ওঙ্কারের ধ্বনি বারবার উচ্চস্বরে করতে থাকবেন, তখন তা আপনারই শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, স্নায়ুতন্ত্রে আঘাতের সৃষ্টি করবে। আর স্নায়ু, কলা ইত্যাদিতে আঘাত খেয়ে সেই  ধ্বনি আবার আপনার কাছে ফিরে ফিরে আসবে। সমস্ত শরীরের মধ্যে একটা কম্পনের অনুভব হবে। কারন এইসময় আপনার স্নায়ু তন্ত্র  শব্দের আঘাতে স্পন্দিত হচ্ছে।  এবং একই ধ্বনি বারবার অনুরণিত হচ্ছে। ফলত প্রতিধ্বনি যা আপনি শুনতে পাবেন, তা কিন্তু আপনার শরীরের ভিতর থেকেই  আসছে, এটা অনুভব করতে পারবেন।  

দেখুন শব্দ আর ধ্বনি যেমন আলাদা, তেমনি ধ্বনি ও সুর আলাদা। শব্দ অর্থবহ।  ধ্বনি অর্থবহ নয়। কিন্তু ভাবের বাহক। আবার দেখুন সুরকরে কোনো গান বা কবিতা উচ্চারিত হয়, তখন তা আরো বেশি অনুভূতি প্রবন হয়ে ওঠে। তো ধ্বনি থেকে সুর আরো বেশি অনুভূতি প্রবন। বেহালার সুরে কথা বা শব্দ থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে, কিন্তু সুর আপনাকে আরো বেশি করে টানবে। তাই ওঙ্কারকে বিশেষ সুরের সঙ্গে উচ্চারণ করতে বলা হচ্ছে। 

আবার ধ্বনি আপনার ভিতরে তৈরী হয়ে মুখগহ্বর থেকে নিঃসৃত হচ্ছে, আবার সেই ধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশ করে আপনার শরীরের সমস্ত কলা-তন্ত্রে স্পন্দন তুলছে। সেইজন্য মহাত্মাগণ বলছেন, নিজেকে শব্দময় করে তুলুন। তাহলে আপনি শব্দ ও নিজের মধ্যে একটা সাম্য অবস্থার জন্ম দিতে পারবেন। শরীরে একটা একতানতা অনুভব করবেন। একটা মধুর সুরধ্বনি আপনার মধ্যে গুঞ্জন তুলবে। তো ওঙ্কার আপনি যতবার সুর করে উচ্চারণ করতে থাকবেন, তত মধুর অনুভূতি আপনাকে ঘিরে ফেলবে। দেখুন কতকগুলো শব্দ বা ধ্বনি আছে, যা শ্রুতিকটু, কিছু শব্দ বা ধ্বনি আছে যা আমাদের বিরক্তির, বা ভয়ের উদ্রেগ করে থাকে ।  কিন্তু ওম এমন একটা মধুর ধ্বনি যা আমাদের শরীর ও মনে পবিত্রতার ভাব জাগিয়ে তোলে। দেহ মন শুদ্ধ বাতাবরণে ঢেকে যায়। তাই নিরন্তর ওম-এর উচ্চারণ আমাদের শরীরের মধ্যে একটা হারমোনি বা একতানতার সৃষ্টি করে। একটা হার্মলেস বা নির্দোষ শান্তির বাতাবরণ দিয়ে আমাদেরকে ঢেকে রাখে। 

যখন আপনি আপনার শরীরের মধ্যে এই একতানতার উপলব্ধি করতে থাকবেন, তখন ওঙ্কারের উচ্চারণ উচ্ছস্বরে না করে, মুখ বন্ধ করে মনে মনে করতে থাকুন। ঠোঁট বন্ধ করুন, চোখ বন্ধই থাকবে। মনে মনে এই উচ্চারণ অবশ্য়ই করতে থাকবেন, যাতে করে এই ধ্বনির রেশ আপনার সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে যায়। মনে করুন আপনার শরীর একটা বিশেষ বাদ্যযন্ত্র। যেখানে আপনার শিরা-উপশিরা হচ্ছে মনবীণার তার। সেখানে এই উচ্চকোটির ধ্বনির  আলোড়ন তুলছে। আর আপনার শরীরের মধ্যে একটা স্পন্দন উঠছে। এইসময় আপনি একটা নতুন জীবনের সন্ধান পাবেন। জীবনের উদ্দেশ্যকে খুঁজে পাবেন।  এইজন্য বলা হয়ে থাকে পবিত্র ধ্বনির মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে  দিন, আর একটা ভালোলাগা অনুভব করতে থাকুন। কিন্তু কথা হচ্ছে, কেন এইসময় আমাদের এতো ভালো লাগে ? আসলে আমরা এই সময় সুরের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। এখন সুর আপনার ভিতর থেকেই উৎসারিত হচ্ছে, আবার আপনার মধ্যে ধীরে ধীরে স্নায়ুতন্ত্রের সাহায্যে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। আনন্দের রেশটুকু আপনি উপভোগ করছেন।  এইসময় আপনি আপনার "আমি" কে হারিয়ে ফেলবেন।  আপনি তখন একটা চেতন সত্ত্বাতে পরিণত হয়ে যাবেন। আপনি যেন প্রাণহীন, শুধু চেতন সত্ত্বা।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম।        
    



             

      





















  

Wednesday 17 November 2021

কাশী-গয়া-বৃন্দাবন মুক্তির দ্বার ? KANSHI GAYA VRINDABAN


কাশী-গয়া-বৃন্দাবনে  মারা গেলে কি মুক্তি হয় ? 

কথায় বলে নিয়তি বধ্য়তে।  নিয়তিকে কেউ রোধ করতে পারে না। আমার এক প্রতিবেশী ভদ্রলোক ছিলেন। বয়স কত হবে, বড়োজোর ৬৫/৭০ বছর।  কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসে কাজ করতেন। অবসর নিয়ে আমাদের বাড়ির পাশে এসে বাড়ি করেন। সুখের সংসার ছিলো ।  একটি ছেলে।  ছেলেটি একটি পত্রিকা অফিসে কাজ করতো। ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন। একটি নাতনি হয়েছে। হঠাৎ একদিন শুনলাম, ভদ্রলোক পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে, ছেলে, বৌমা  ও নাতিটিকে   হারিয়েছেন। নিজের স্ত্রীকে আগেই হারিয়েছিলেন, এখন উনি পুরোপুরি একা  হয়ে গেলেন।

এখন ওর বাড়িতে একা  একা থাকতে ভয় করে। ভদ্রলোকের  টাকা পয়সার  অভাব ছিল না।  তো সে ঠিক করলো, সে কাশীতে গিয়ে বাস করবে। ও শুনেছিলো, কাশী  গিয়ে বাস করলে, ও সেখানে মৃত্যু হলে নাকি মুক্তি হয়। তো সেই উদ্দেশ্যে সে একদিন বেনারসের টিকিট কেটে গাড়িতে উঠে পড়লো। ট্রেনে যাবার পথে ধানবাদ থেকে এক ভদ্রলোক উঠলো। তিনি সাসারামে যাবেন।  সেখানেই তার ব্যবসা। স্টেশনের কাছেই তার দোকান। তো ভদ্রলোকের সাথে তার আলাপ জমে উঠলো।  তিনি তাকে তার বাড়িতে বেড়াতে যাবার জন্য নিমন্ত্রণ করলেন। যাইহোক, ভদ্রলোক কাশীতে গিয়ে  একটা ঘর ভাড়া করলেন । সেখানে একটা ছেলেকে সে সারাক্ষন কাজের জন্য রাখলো। মাঝে মধ্যে সে আমাদের এখানেও আসতেন। কারন এখানকার  বাড়িটিকে বেচে তিনি কাশীতে  পাকাপাকি ভাবে থাকতে চান। কিন্তু বাড়িটির খদ্দের হচ্ছিলো না। ওই সাসারামের ভদ্রলোকও দুই একবার ওনার সঙ্গে এসেছেন। সেই সূত্রে সাসারামের ভদ্রলোকের সঙ্গেও আমার আলাপ হয়। 

তো বছর দুই আগে, সাসারামের সেই ভদ্রলোক, আমার সাথে দেখা করতে এলেন। তার কাছে শুনলাম, ভদ্রলোক সাসারামে তার বাড়িতে আসবার সময়, রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির ধাক্কায় মারাত্মক ভাবে জখম হন।  হাসপাতালে তিনিই দেখাশুনা করতেন। সেখানে অনেক টাকা পয়সা খরচ হলেও, ভদ্রলোককে আর বাঁচানো যায় নি। আর মৃত্যুর আগে, বাড়ির দলিল ইত্যাদি তার কাছে রেখে গেছেন। এখন ওই বাড়িটি তিনি বিক্রি করে, টাকা সংগ্রহ করতে চান। 

সাসারামের ভদ্রলোক যখন আমাকে এইসব কথা বলছিলেন, তখন আমি ভাবছিলাম অন্য কথা।  ভদ্রলোক কাশীতে  গিয়েছিলো, মুক্তির আশায়। সেখানে দেহ রেখে তিনি চিরমুক্তি চেয়েছিলেন। কিন্তু কি থেকে কি হলো ? কাশীতে  গিয়েও তিনি মারা গেলেন সাসারামের হাসপাতালে। ঈশ্বর ওনার আত্মার শান্তি করুন। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কাশীতে মৃত্যু হলেই কি আমাদের মুক্তি হতে পারে ? আপনি হয়তো বলবেন, এটা আমাদের একটা সংস্কার, এই কথার মধ্যে কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু এই কথা  আমাদের হিন্দুশাস্ত্রেও বলা হয়েছে। তাহলে কি, বেনারাসকে বা কাশীর মাহাত্ম বৃদ্ধি  করবার জন্য, মানুষকে আকর্ষণ করবার জন্য, এইসব কথা পণ্ডিত ব্রাহ্মণগণ লিখে  রেখেছেন ? কাশীতে  মৃত্যু হলেই যদি মুক্তি হয়, তবে তো আমাদের কর্ম্মের কোনো গুরুত্ত্বই থাকে না।  সারাজীবন যাকিছু করি না কেন, মৃত্যুর আগে, কাশীতে গিয়ে দেহ ছাড়তে পারলেই, আমাদের মুক্তি অবশ্যাম্ভাবী।  এর জন্য আলাদা ভাবে  যোগ-সাধনার বা জ্ঞান সাধনার বা ভক্তি সাধনার কোনো দরকার নেই। আর আমাদের কৃত কর্ম্মের বা আমাদের দুষ্কর্ন্মের ফলও  ভোগ করতে হবে না। তাহলে পাপ-আত্মা আর পুন্য-আত্মার মধ্যে কোনো ফারাকও থাকবে না। তো একদিকে ঋষিগণ বলছেন, সাধনবিনা মুক্তি নেই, আবার শাস্ত্র বলছে কাশীতে দেহ রাখলেই সাত-খুন মাপ। তো সত্য কি ? আজ আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো। 

প্রথমে বলি, স্থান-মাহাত্ম-এর কথা আমরা সবাই বিচারবুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারবো, এমনটা নয়। আমাদের কাছে, বাহ্য দিক দিয়ে, কাশী-গয়া-বৃন্দাবন  আর দিল্লী-মুম্বাই-কোলকাতাতে কোনো লৌকিক পার্থক্য নেই। কিন্তু যদি একটু গভীরভাবে নিজেকে প্রশ্ন করেন, তবে দেখতে পারবেন, আপনার বাড়ির সমস্ত ঘর থেকে আপনার ঠাকুর ঘরের মধ্যে যেন আলাদা একটা প্রশান্তির ভাব আছে। শহর কলকাতা আর দক্ষিণেশ্বরের  মধ্যে, শ্যামবাজার আর কালীঘাটের মধ্যে কোথায় যেন একটা পার্থক্য অনুভব হয়। গঙ্গা নদীর তীরে, আর কাটাখালের পাড়ে কোথায় যেন একটা পার্থক্য আছে। এই অনুভূতি আমাদের ইন্দ্রিয়াতীত অনুভূতি।  এই অনুভূতি কাউকে বোঝানো যায় না, কিন্তু মোটামুটি আমরা সবাই এই পরিবেশের পার্থক্য ধরতে পারি। 

আমরা জানি, মৃত্যুকালীন অবস্থায়, আমাদের স্থুল শরীর ও সূক্ষ্ম শরীর আলাদা হয়ে যায়। এবং আমাদের সংস্কার  অনুযায়ী গতিপ্রাপ্ত হয়। যতক্ষন পর্য্যন্ত স্থুল শরীর ও সূক্ষ্ম শরীর আলাদা না হচ্ছে, ততক্ষন এই গতি দেখা যায় না। একমাত্র তথাকথিত মৃত্যুর  পরেই এই গতির শুরু হয়। এই গতি সবার ক্ষেত্রে একই রকম হয় না।  আমাদের কর্ম্ম সংস্কার অনুযায়ী এই গতি লক্ষিত হয়। উর্দ্ধগতি, অধোগতি, বা তির্য্কগতি - ইত্যাদি অনন্তপ্রকার জটিল গতি পরিলক্ষিত হয়। আর এই গতির পরিচালকশক্তি হচ্ছে আমাদের কর্ম্ম-সংস্কার। 

এখন কথা হচ্ছে, কাশী-গয়া-বৃন্দাবনে যখন স্থুল শরীর ও সূক্ষ্ম শরীর আলাদা হয়, তখন দেখা গেছে,সূক্ষ্ম শরীর বা লিঙ্গ শরীর আমাদের অন্নময় কোষ থেকে আলাদা হতেই এক তীব্র উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হয়। এই স্থানে প্রাকৃতিক ভাবেই হোক, বা এখানে বিভিন্ন রকম যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানের কারণেই হোক, বা এখানকার বাতাসে মন্ত্রশক্তির প্রভাবে হোক, একটা তীব্র উর্দ্ধগামী আকর্ষণ শক্তি বিরাজ করছে। এখন এই তিন স্থান ব্যাতিত অন্য কোথাও এই তীব্র উর্দ্ধগামী আকর্ষণ শক্তির প্রবাহ নেই। বা হয়তো আছে, যেখানকার সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। তাই বলা হয়ে থাকে কাশী-গয়া-বৃন্দাবনে জীব যখন স্থুল অন্নময় শরীর ছেড়ে সূক্ষ্ম শরীরসহ ভ্রাম্যমান হয়, তখন সূক্ষ্ম শরীর উর্দ্ধগতিসম্পন্ন হয়।  অর্থাৎ সূর্যমুখী হয়ে যায়। 

এখন কথা হচ্ছে, কথা হচ্ছে, এইসব কথার কোনো যুক্তি আছে কি না।  জ্ঞানী-অজ্ঞানী, পাপাত্মা-পুণ্যাত্মা, ভালো মানুষ খারাপ মানুষ, সবার কি একই গতি হয়, যদি যে কাশীবাসী হয়  ? সাধারণ মানুষ, অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টিতে যারা অজ্ঞানী তাদের গতি আর একজন জ্ঞানী বা যোগীপুরুষের গতি কি একই রকম হয় ? দেখুন এই সব কথা যুক্তি দিয়ে কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। এটি অনুভবলব্ধ  জ্ঞান। মৃত্যুর পরে কেউ এসে বলেনি যে আমার মৃত্যু কাশীতে  হবার ফলে আমার লাভ হয়েছে। দেখুন, গাছে ফল পাকলে, সাধারণত মাটিতে ঝরে পড়ে। অর্থাৎ পাঁকা ফলের গতি নিম্নমুখী। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু বাগানের মালিক যদি গাছ থেকে ফল নিজের হাতে পারেন, তবে, ফলের গতি মালির ইচ্ছেমতো হতে পারে। ঠিক তেমনি আমাদের প্রারব্ধ কর্ম্মের ভোগ সম্পন্ন হলেই আমাদের সূক্ষ্ম শরীর স্থুল শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায়। আবার যোগীপুরুষগন যোগবলে স্থুল  শরীর থেকে সূক্ষ্ম বা লিঙ্গ শরীরকে আলাদা করতে পারেন, নিজের ইচ্ছে অনুসারে, এই জীবিত অবস্থাতেই, জীবনকালেই । এবং দেখা গেছে, যোগীগণ যখন এই যোগক্রিয়া অনুষ্ঠান করেন, তখন স্থানে ভেদে এই কাজ সহজ অথবা কষ্টসাধ্য হয়ে থাকে। পাহাড়ে, নির্জনে, বা তীর্থক্ষেত্রে  এই কাজ যত  সহজে সম্পন্ন হয়, অন্যত্র এই কাজ সহজে আয়ত্ত্বে আসে না। যোগীগণ যখন এই কাজের অভ্যাস করেন, তখন তাঁরা দেখেছেন, লিঙ্গ বা সুক্ষ শরীরকে স্থুল  শরীর থেকে মুক্ত করে, যখন বাইরে আসেন, তখন বাহ্য জগতের বিচিত্র আকর্ষণ অনুভব করেন। আর এই যে আকর্ষণশক্তি এবং লিঙ্গশরীরে যে কর্ম্মসংস্কার এই দুয়ের মধ্যে প্রাধান্য হেতু, লিঙ্গশরীরের গতি নির্ধারিত হয়। যোগীপুরুষগন অনুভব করেছেন, স্থানবিশেষে এই যোগাভ্যাস কালে, লিঙ্গ শরীর অন্নময় শরীর থেকে পৃথক হবার সঙ্গে সঙ্গে অচিন্ত শক্তির আকর্ষনে উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হয়।  তখন যোগীর কর্ম্ম-সংস্কারও কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। এই অবস্থা হলে বুঝতে হবে, এখানে বা এই স্থানের কিছু বিশেষ মাহাত্ম আছে। বিশেষভাবে অনুভূতিসম্পন্ন যোগীপুরুষগন এই অচিন্ত্যশক্তির অনুভব এই কাশী-গয়া-বৃন্দাবনে বিশেষ ভাবে উপলব্ধি করেছেন। 

এইজন্য স্বীকার করতেই হয়, এইসব জায়গায় যখন আমাদের  স্থুল শরীর ত্যাগের ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়, অর্থাৎ আমরা যখন তথাকথিত মৃত্যু বরণ করি, তখন আমাদের সূক্ষ্ম শরীর স্বাভাবিক থেকে বেশী উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হয়।  আর চৈতন্যশক্তির অধিক সান্নিধ্য অনুভব করে থাকি। 

তবে একটা জিনিস জানবেন, কর্ম্মসংস্কার ভিন্ন অর্থাৎ যথাযথ জ্ঞানযোগ ভিন্ন উর্দ্ধগতি লাভ করা সম্ভব নয়।  তাই যথার্থ জ্ঞানযোগী যেখানেই স্থুল শরীর ত্যাগ করুন না কেন, তিনি অবশ্য়ই উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হবে।  আবার যাদের কৰ্ম্মসংস্কার যেমন তাদের তেমনই উর্দ্ধগতি বা তির্য্কগতি লাভ হবে। অজ্ঞান আমাদেরকে নিম্নগতির দিকে ধাবিত করে, আবার জ্ঞান আমাদের উর্দ্ধের দিকে আকর্ষণ করে। কাশীতে আসলে এই জ্ঞানের চর্চা যুগ-যুগ ধরে চলে আসছে।  বলা হয়ে থাকে কাশী জ্ঞানপীঠ। তাই কাশীতে শুধু শরীর নিয়ে বসবাস করলেই হবে না।  কাশীতে যে জ্ঞানের চর্চা আবহমান কাল ধরে হয়ে আসছে, তার সঙ্গে  নিজেকে সংযোগ করতে হবে। তবেই কাশীর এই বিশেষ মাহাত্ম আমরা অনুভব করতে পারবো।  আর এর উপযোগিতা উপলব্ধি করতে পারবো। শাস্ত্রকারেরা কি বলেছেন, সেটি বড়ো কথা নয়, শাস্ত্রকারীদের কথায়  বিশ্বাস স্থাপন করে, নিতান্ত সেখানে একটা বাড়ি করে বাস করলেই হবে না। তাই যদি হতো, তবে শিবলিঙ্গের পুজো না করে পাহাড়ের পুজো আরো ভালো ফল দিতে পারতো। পাহাড়ে গেলেই যদি সাধন হতো, তবে সমস্ত পাহাড়বাসীই উচ্চকোটির সাধক হতে পারতেন। তা কিন্তু নয়। আবার স্থান মাহাত্মের কথা আমাদের স্বীকার করতেই হয়।  বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ থাকে, খেলার মাঠে খেলার পরিবেশ থাকে। সিনেমা হলে বিনোদনের ব্যবস্থা  থাকে। এটা যেমন অস্বীকার করবার উপায় নেই, তেমনি বিশেষ বিশেষ স্থানে যোগের পরিবেশ আছে, বিশেষ বিশেষ স্থানে অধ্যাত্ম পরিবেশ আছে। আমাদের সেই পরিবেশেই বাঞ্চিত  শিক্ষা সহজে উপলব্ধ হতে পারে। তো কাশীতে  যে জ্ঞানের প্রবাহ চলছে, সেই জ্ঞানের প্রবাহে নিজেকে অবগাহন করতে  হবে। বৃন্দাবনে যে ভক্তির প্রবাহ চলছে, গয়াতে যে যোগের ঐশ্বর্যের প্রবাহ চলছে তার সান্নিধ্য আসতে  হবে।  তবেই আমার স্থান-মাহাত্ম হিসেবে কাশীর এই বিশেষত্ত্ব গ্রহণে সক্ষম হবো। 

সবশেষে বলি, আমাদের যে প্রারব্ধ কর্ম্ম তার ফল, তা সে সুখ হোক বা দুঃখ যাই হোক না কেন, আমরা যদি উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হই,  তাহলেও সেসব আমাদের ভুগতে হবে। তবে জ্ঞানের উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন কর্ম্মের জন্ম হয় না, নতুন কর্ম্মফল সঞ্চিত হয় না । পুরাতন কর্ম্মের ফল ভোগও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যায়। আর যখন জ্ঞানের পূর্নতা আসে, তখন মানুষ মুক্তির  অধিকারী হয়। এখানে কোনো বৈষম্য নেই। ঈশ্বরের কানুন সর্বত্র একই থাকে।  মুক্তি একমাত্র ভগৎকৃপাতেই ঘটে থাকে।  মানুষের কি সাধ্য আছে, মুক্তি লাভ করে ?

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  




 

      

           














Monday 15 November 2021

গায়ত্রীতত্ত্ব



 

গায়ত্রী মন্ত্রের গুহ্যতত্ত্ব

 ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং  ভর্গো দেবস্য ধীমহি। ধিয়ো যো নঃ প্রচদয়াৎ। ওং প্রচলিত গায়ত্রী মন্ত্র বলতে আমরা এই শব্দসমষ্টিকেই  জানি। 

কিন্তু এই মন্ত্রের যিনি দ্রষ্টা ঋষি বিশ্বামিত্র তিনি এই ঋকের   সঙ্গে আরো দুটো ঋক  উচ্চারণ করতেন, এবং ওং ভূর্ভুবঃ স্বঃ - এই শব্দ  সেখানে নেই  । মন্ত্রের প্রথম অংশ অর্থাৎ " ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ" আমরা পাই শুক্লযজুর্বেদের তৃতীয় অধ্যায়-এর ৫ নং শ্লোকে।  এটি ৫ নং শ্লোকের প্রারম্ভ মাত্র। যা আসলে আদিমন্ত্র। 

 আর মূল মন্ত্র বেদের বিভিন্ন জায়গায় আমরা দেখতে পাই।    

এক - ঋগ্বেদ সংহিতা-র তৃতীয় মণ্ডলের ৬২ সূক্ত ১০-তম ঋক। এই ঋক বা স্তূতি লিখেছেন বিশ্বামিত্র ঋষি, ত্রিষ্টূপ ছন্দে । এই ঋক, সবিতা দেবের উদেশ্যে গীত হয়েছে। বলছেন :   "তৎসবিতুর্বরেন্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি। ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ।" 
 ঋক-বেদের  সমস্ত শ্লোককেই ঋক বলা হয়।  ঋক  কথাটার মানে - দেবতাদের স্তূতি।  
 ঋগ্বেদ সংহিতা-র তৃতীয় মণ্ডলের ৬২ সূক্ত ১০-১২তম ঋকের দেবতা হচ্ছেন সবিতা। মন্ত্রগুলো এই রকম। 
 তৎসবিতুর্বরেন্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ।-৩/৬২/১০ 
-যিনি আমাদের ধীশক্তি প্রেরণ করেন ,আমরা সেই সবিতাদেবের সেই বরণীয় তেজ ধ্যান করি।  
দেবস্য  সবিভুর্বয়ং বাজয়ন্তঃপুরন্ধ্যা। ভগস্য রাতিমিমহে। -৩/৬২/১১
-আমরা অন্নাভিলাষী হয়ে স্তূতি করে সবিতাদেবের  ও ভগদেবের ধন দান যাচ্ঞা করছি।
দেবং নরঃ সবিতারং বিপ্রা যজ্ঞৈসুবৃক্তিভিঃ। নমস্যন্তি ধিয়েষিতাঃ।  -৩/৬২/১২  কর্মরতা মেধাবী অধ্বর্যুগন বুধিদ্বারা প্রেরিত হয়ে যজ্ঞ ও সুন্দর স্তোত্রদ্বারা সবিতা দেবতাকে  পূজা করেন। 

দুই  : শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতার ৩য় অধ্যায় ৩৫ নম্বরে  এবং ৩০তম  অধ্যায় শ্লোক নম্বর ২- এ  আমরা প্রথম  শ্লোকটি  দেখতে  পাই।
আপনারা জানেন, আমরা যে গায়ত্রী মন্ত্রের উপাসনা করি, তা আসলে ঋষি বিশ্বামিত্র আরাধিতা গায়ত্রী। অর্থাৎ বিশ্বামিত্র ছিলেন, এই মন্ত্রের দ্রষ্টা।  ঋষি বিশ্বমিত্র জন্মসূত্রে ছিলেন, ক্ষত্রিয়। এবং তিনি এই গায়ত্রী দেবীর  সাধনা করে, ব্রাহ্মণত্বে উত্তীর্ন হয়েছিলেন। তো বলা হয়ে থাকে যিনি ব্রাহ্মণ হতে চান, অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী হতে চান, তার অবশ্য়ই গায়ত্রী মন্ত্র জপ করা উচিত।

এখন এই গায়ত্রী মন্ত্রের উৎস কোথায় ? এই গায়ত্রী মন্ত্রের আদি দ্রষ্টা হচ্ছেন ব্রহ্মা। ব্রহ্মার নাভিদেশ থেকে স্ফূরিত হয়েছিল, এই মন্ত্র । আর নাভি দেশ থেকে স্ফূরিত হয়ে ব্রহ্মার হৃদয়ে স্থিত হয়েছিলেন । এর পরে, ব্রহ্মার পরমপ্রিয়  শিষ্য বশিষ্ট মুনিকে ব্রহ্মা  এই গায়ত্রীদেবীকে দান   করেছিলেন। এই বশিষ্ট মুনির কাছে, ইনি ছিলেন, কামধেনু রূপে। এর পরে,  রাজা বিশ্বামিত্র একে প্রথমে জোর করে অপহরণ করতে চেয়েছিলেন।  পরে, এই গায়ত্রী দেবীর উপাসনা করে, এঁকে  আয়ত্ত্বে এনেছিলেন। আমরা কিন্তু  এই বিশ্বামিত্রের কাছ থেকেই  এই গায়েত্রী মন্ত্রের কথা জানতে পারি - যা মহাত্মা ব্যাসদেব বেদের মধ্যে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। 

এখন কথা হচ্ছে, এই মন্ত্র যখন ব্রহ্মার নাভিদেশ থেকে স্ফূরিত হয়, তখন এটি ছিল, উন্মুক্ত আবরণহীন।  ব্রহ্মা একে মোড়কে আবদ্ধ করে, তার হৃদয়স্থলে লুকিয়ে রেখেছিলেন। আমরা যেমন কোনো মূল্যবান সামগ্রীর সুরক্ষার জন্য, একটা মোড়কে রেখে লোহার  আলমারিতে গচ্ছিত রাখি, তেমনি ব্রহ্মা এই অদৃষ্টপূর্ব অসীম শক্তিকে একটা মোড়কে ঢেকে, তার হৃদয়স্থলে লুকিয়ে রেখেছিলেন। এর পর এই মন্ত্র তিনি দান করেন, তার পরমপ্রিয় শিষ্য বশিষ্টমুনিকে। বশিষ্টমুনির কাছে, ইনি  ছিলেন কামধেনু রূপে। এখন রাজা বিশ্বামিত্র, বশিষ্টমুনির অসীম শক্তির উৎস হিসেবে এই কামধেনুকে জানতে পারেন আর  তাঁকে জোর করে, ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু অপহরণে অপারগ হয়ে, শেষে  তিনি এই গায়ত্রীদেবীর আরাধনা শুরু করেন। তো যে মন্ত্রে তিনি আরাধনা শুরু করেন, তা আমরা ব্যাসদেবের অনুগ্রহে,  বেদের মধ্যে লিপিবদ্ধ আকারে পাই। 

তো আমরা যেটা বলতে চাইছি, ঋষি বিশ্বামিত্র প্রদত্ত এই পবিত্র গায়ত্রী মন্ত্র তিনটি আবরণে ঢাকা। প্রথম আবরণ যা স্বয়ং ব্রহ্মা দিয়েছিলেন, দ্বিতীয় আবরণ বশিষ্ট মুনি দিয়েছিলেন, আর  তৃতীয় আবরণ বিশ্বামিত্র ঋষির দেওয়া। এই আবরণগুলোকে  উন্মোচন না করতে পারলে, আমরা গায়ত্রীদেবীর সান্নিধ্য লাভ করতে পারবো না। অর্থাৎ মন্ত্রের শাপমোচন করতে হবে। এই শাপমোচনের প্রক্রিয়া বা আবরণের উন্মোচনের প্রক্রিয়া হচ্ছে, নিরন্তর এই মন্ত্রের জপ। শব্দের মোড়কে ঢাকা এই দেবীশক্তি।  শব্দ যখন বারবার উচ্চারিত হয়, তখন এই শব্দের উপরে আঘাতের  ফলে শব্দ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, এবং একসময় আমাদের আরাধ্য দেবী গায়ত্রী আবরণ হীন  হয়ে পড়েন। তিনি তখন স্বরূপে প্রকাশিত হন। এবং আমাদের নিকট প্রকট হয়ে ওঠেন। 

এই গায়ত্রী দেবীর উপরে যেমন তিনটি আবরণ তেমনি জীবসত্ত্বার উপরে তিনটি আবরণ।  সেগুলো হচ্ছে, আণব, মায়া ও কর্ম্ম। আণব অর্থাৎ অতিসূক্ষ্ম কণা। অর্থাৎ একটা শক্তি যা এই কণাগুলোকে আকর্ষণ করে থাকে। মায়া - অর্থাৎ ব্রহ্মের  ঐশীশক্তি যার দ্বারা বিশ্ব পরিমিত হয়েছে, অবিদ্যা - ভ্রমাত্মক  শক্তি বা প্রকৃতি। সবশেষে কর্ম্ম - যা আমাদেরকে ফল প্রদান করে থাকে। এই তিনটি আবরণ উন্মোচন করতে পারলে, জীব শিবরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। এবারে মন্ত্রের কথায় আসি। 
           
ওং ভূর্ভুবঃ স্বঃ।  এরপরে ত্রিপদা গায়ত্রী যা ২৪ অক্ষর বিশিষ্ট। তারপরে  গায়ত্রীর শির।  
ওং - ওঙ্কার  হচ্ছে, শব্দব্রহ্মের স্বরূপ, যা আসলে বিশ্বসৃষ্টির মূল ধ্বনি। এর পরে তিনিটি ব্যাহৃতি বা আদিমন্ত্র যা আসলে  বিস্তারভূমি।  ভূঃ, ভুবঃ ও স্বঃ। মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে এই ভূমিতে বিস্তার করতে হয়। 

ভূর্ভুবঃ স্বঃ। অর্থাৎ এখানে  তিনিটি লোকের কথা বলা হচ্ছে। ভূ অর্থাৎ পৃথিবী, ভুবঃ অর্থাৎ অন্তরীক্ষ বা  পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ  থেকে যে লোকের শুরু যেখানে গ্রহ নক্ষত্র অবস্থান করছে, অর্থাৎ স্বর্গের নিম্নভাগ পর্যন্ত ভুব- লোকের বিস্তার। এর পরে বলা হচ্ছে, স্বর্গ লোকের কথা। যেটির অবস্থান এই  নক্ষত্রলোকেরও  উপরে ।   কিন্তু আমরা শুনেছি  লোক আছে ৭টি। ভূঃ ভুবঃ স্বঃ মহঃ জনঃ তপঃ ও সত্যম। কিন্তু এখানে কেবল মাত্র তিনটি লোকের কথা বলা হচ্ছে।  আসলে স্বর্গলোকের মধ্যেই  আছে বাকি চারটি লোক মহঃ জনঃ তপঃ সত্যম ।  তাই স্বঃ কথাটা দিয়ে মোট পাঁচটি  লোকের  কথাই  বলা হচ্ছে। 

এই ৭টি লোকের যিনি প্রসবকর্ত্রী তাকে বলা হয় সবিতা। সবিতা কথাটার অর্থ হচ্ছে, যিনি প্রসব করেন। সেই সূর্যদেবকে এখানে সবিতা বলা হচ্ছে। এখানে সূর্য হচ্ছেন পরমাত্মা পরব্রহ্ম-এর জ্যোতি স্বরূপ। এই জ্যোতি এসেছে শব্দ বা নাদব্রহ্ম থেকে। এই নাদব্রহ্ম সরাসরি ব্রহ্ম থেকে উৎসারিত। এই শব্দ অনাহত ধ্বনি। এখন এই অনাহত ধ্বনির ধ্যান আমাদের মতো সাধারনের পক্ষে হয়তো করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই অনাহত  ধ্বনি থেকে যে জ্যোতির উৎপত্তি হয়েছে, তার প্রতীক হচ্ছেন সূর্যদেব যা আমাদের সাধনা ব্যতিরেকেই দৃষ্টিগোচর হয়। এমনকি সূর্য্যের থেকে কিরণরাশি বিচ্ছুরিত হচ্ছে, তাও আমাদের উপল্বদ্ধিতে আসে। তাই ঋষিগণ এই সবিতাদেবকে আমাদের আরাধ্য করতে বলছেন।  
 
তৎ সবিতুর বরেণ্যম - সেই সবিতাকে আমরা বরণ  করছি। 

ভর্গো দেবস্য ধীমহি  এই সবিতার যে তেজ-স্বরূপ দেবতা  তাঁকে বরণ  করতে বলা হচ্ছে। ভর্গো কথাটার অর্থ হচ্ছে তেজঃশক্তি। তো সবিতাদেব থেকে বিচ্ছুরিত যে তেজ তার মধ্যে আছে শক্তি। অগ্নির  মধ্যে  আছে দাহিকা শক্তি।  তো প্রথমে আমরা চাক্ষুস সূর্যদেবের ধ্যান করছি, তার পরে আমরা সূর্য্যের তেজের ধ্যান করছি।  তার পরে আমরা তেজের মধ্যে যে শক্তি নিহিত আছে তাঁর ধ্যান করছি। অসংখ্য তেজরশ্মি, অসংখ্য গুনের অধিকারী। একেই আমরা দেবতা বলে থাকি। অসংখ্য রশ্মি তাই অসংখ্য আমাদের দেবতা। জ্যোতি আমাদের ভয় দূর করে, জ্যোতিঃর সাহায্যেই   ব্রহ্মদেব  জগৎকে  শুদ্ধিকরণ করে থাকেন। এই জ্যোতি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে জাগ্রত করতে পারে। তাই মন্ত্রে বলা হচ্ছে,    
ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ - আমাদেরকে ধীশক্তি প্রেরণ  করুন। 
 
সাধারণ ভাবে প্রচলিত গায়ত্রী এই তিনটি পাদ-এ বিভক্ত। এবং চব্বিশটি অক্ষর। গায়ত্রীর চতুর্থপাদ অত্যন্ত গুহ্য।  বলা হয়ে থাকে, প্রকৃত সন্ন্যাসী ভিন্ন অন্যের পক্ষে এই পাদ  শোনাই নিষেধ। সন্যাসী অর্থাৎ যার সমস্ত পাশের নাশ হয়েছে, তিনিই এই চতুর্থপাদের ধ্যান করতে সক্ষম।  কিন্তু আমাদের কাছে সমস্ত বিদ্যাই সমস্ত মানুষের অধিকার। কিন্তু আপনাকে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। অধিকারী হতে হবে। অধিকারী না হয়ে, এই বিদ্যার অনুশীলনী আপনাকে কোনো ফল প্রদান করে না। এতে আপনার মধ্যে অবিশ্বাস দানা বাধবে। আর আপনি অপপ্রচারের চেষ্টা করবেন।  যাইহোক,  এরমধ্যে আগেই এই চতুর্থপদের কথা বলে গেছি।  যারা বোঝার তারা বুঝে নেবেন। 

গায়ত্রী উপাসনায় কর্ম্ম-জ্ঞান-ভক্তি ও যোগের সমন্বয় ঘটে থাকে। গায়ত্রী উপাসনা আসলে সূর্য বা সূর্য্যের শক্তির উপাসনা। উপাসনা কথার অর্থ আমরা জানি কাছে আসন পাতা।  যেন উপাস্যের নিকট আমি আসন পেতে বসে আছি। 

গায়ত্রীকে বলা হচ্ছে, প্রসবকারী সূর্য বা সবিতা। ইনিই পরমাত্মা স্বরূপ। এই সূর্যদেবের অনন্ত শক্তি যেগুলোকে  বলা হচ্ছে ভর্গ অর্থাৎ জ্যোতিঃ।  এই জ্যোতির মধ্যে অনন্ত শক্তি বিরাজ করছে। এই শক্তি আমাদের কর্ম্মরাশিকে ভর্জন বা দগ্ধ করে। সাধক এই বরেণ্য শক্তিকে বা মহাশক্তিকে উপাসনা করে থাকেন। এই সবিতা দেবের উপাসনার ফলে সাধকের মধ্যে সবিতাদেবের স্বরূপকে হৃদয়ে স্থাপন করা সম্ভব হয়ে থাকে। আর এই ধ্যান যখন প্রসারিত হয়, তখন সাধকের হৃদয়ে একটা তেজোময়ী শক্তির প্রকাশ ঘটে থাকে। সাধকের জ্ঞান ও কর্ম্ম ক্ষেত্রে প্রেরণা দায়ক হয়ে থাকে। তখন আমাদের যে জ্ঞান ইন্দ্রিয় চক্ষু, কর্ন, নাসিকা জিহ্বা, ত্বক, সত্যিকারের জ্ঞানের পথে প্রেরিত হয়।  আবার আমাদের কর্ম্ম-ইন্দ্রিয় শুভ কর্ম্মের পথে ধাবিত হন।  ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ - নঃ অর্থাৎ আমিত্ব বিহীন আমাকে ধীশক্তি প্রেরণ করুন। এই ধীশক্তি যখন বৃদ্ধি পায়, তখন আমাদের মধ্যে অদ্বৈত জ্ঞান প্রাপ্ত হয়। আর এই অদ্বৈত জ্ঞান প্রাপ্ত হলে, সাধক পরাভক্তি লাভ করতে  সমর্থ হন।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

--------------------------     




       

Sunday 14 November 2021

সূর্য-বিজ্ঞান /SURYA VIGYAN

 


সূর্য-বিজ্ঞান -  শূন্য থেকে কি সৃষ্টি করা যেতে পারে ? -
মূলসূত্র : সূর্য্য বিজ্ঞান - গোপীনাথ কবিরাজ, পাতঞ্জল দর্শন, হঠযোগ প্রদীপিকা, ঘেরন্ড সংহিতা ও শিব-সংহিতা।   

যুঞ্জান প্রথমং মনস্তত্বায় সবিতা ধিয়ঃ
অগ্নের্জ্যোতি নির্চায্য পৃথিব্যা অধ্যাভরৎ।

যারা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ পড়েছেন, তারা জানেন, এই শ্লোকটি দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম শ্লোক।  এখানে বলা হচ্ছে, সবিতা বা সূর্য যেন কৃপা করে, আমাদের মন ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলোকে পরমাত্মার দিকে চালিত করেন। অগ্নেঃ জ্যোতিঃ নিচায্য অর্থাৎ অগ্নির আলোকপ্রদ শক্তি সংগ্রহ করে, পৃথিব্যা অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত কিছু থেকে আমাদের  মন অন্তর্মুখী হোক। 

এখন কথা হচ্ছে, সবিতাদেবে র কাছে আমাদের কেন এই প্রার্থনা। আসলে সূর্য আমাদের কাছে সমস্ত দৃশ্যমান বস্তুর মধ্যে বিশাল। আর এই সূর্য্যশক্তির সাহায্যেই পৃথিবীর সমস্ত জীবজগৎ জীবনধারণ করছে। এই দৃশ্যমান জগৎ আমাদের মনকে আকর্ষণ করছে।  যাতে এই জগৎ থেকে মনটা তুলে নিতে পারি, তার জন্য আমাদের সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা। পৃথিবীর তাবৎ মনুষ্যজাতি এই সূর্যদেবের কাছে ঋণী। জাত-ধর্ম্ম নির্বিশেষে আমরা তাই  সূর্য্যের উপাসক। 

বলা হয়ে থাকে এই সূর্যবিজ্ঞানের চর্চা হচ্ছে জ্ঞানগঞ্জে। বলা হয়ে থাকে এই জ্ঞানগঞ্জ কোনো ভৌতিক স্থান নয়, আবার এই  স্থুল জগতের সীমার মধ্যেও এই জ্ঞানগঞ্জের অবস্থান নয়।  বলা হয়, সময়-কাল ও স্থানের  উর্দ্ধে এর অবস্থান। এখানে সিদ্ধপুরুষগন অবস্থান করছেন। এই সিদ্ধাশ্রমের অবস্থান স্থুল  দৃষ্টিতে স্থুল আবার সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে সূক্ষ্ম। একজন সিদ্ধ সাধক যেমন আমাদের দৃষ্টিতে একজন রক্ত-মাংসের মানুষ, তেমনি আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে তিনি মহামানব,  মহানাত্মা। এঁদের অবস্থান, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে অসাধারন কিছু নয়, এঁরা  সবাই আমাদের মতো মুড়ি খায়, ঘুমায়, বাহ্য-ক্রিয়া করে। আবার কিছু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে এঁরা অন্য জগতের মানুষ।  অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি  অনুযায়ী আমরা এঁদের দর্শন করে থাকি । আমরা যেমন আমরা তেমনই দেখি।

প্রথমেই বলি, পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু  হয় না। আপনি যা কিছু দেখছেন, শুনছেন, সব সত্য আবার সত্য নয়। এমনকি আমরা  যাকিছু প্রতিদিন প্রতক্ষ্য করছি, তার কার্য্য-কারন সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নাও থাকতে পারে। তাই যাকিছু আমরা দেখছি, তা সাময়িক ভাবে আমাদের কাছে সত্য বলে প্রতিভাত হলেও, আসলে সেই ঘটনা সেই সময়ের জন্যই মাত্র সত্য। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে, ঘটনার ধারাবাহিকতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেখা সত্য অদৃশ্য হয়ে যাবে। 

আমরা জানি, দুধ থেকে দই হয়, কিন্তু দই থেকে কখনো দুধ হতে দেখি না। আমরা জানি মানুষের পেটে  মানুষ হয়, মানুষের পেটে  কখনো ছাগল হয় না।  আবার  ছাগলের পেতে ছাগল হয়, ছাগলের পেটে  কখনো মানুষ হয় না। কিন্তু এর যে অন্যথা হতে পারে, তার একটা গল্প মহাভারতে আছে  : মাছের পেটে নাকি ব্যাসদেবের মাতা সত্যবতীর জন্ম হয়েছিল। আমরা জানি, মানুষের মৃত্যুর পরে, মানুষকে পুড়িয়ে বা মাটিতে কবর দেওয়া হয়।  কিন্তু আগুন থেকে বা মাটি ফুড়ে মানুষের আবির্ভাব হতে দেখিনি। 
 কিন্তু মহাভারতের লেখক ঋষি ব্যাসদেব বলছেন, আগুন থেকেও মানুষের জন্ম হতে পারে। দ্রৌপদী, ধৃষ্টদ্যুম্ন অগ্নি থেকে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন । আমরা শুনেছি, বিষ্ণুর ব্রহ্মকমল থেকে ব্রহ্মার জন্ম হয়। ব্রহ্মকমল অর্থাৎ নাভি থেকে পদ্মের জন্ম এযুগে কেউ কখনো দেখেনি এমনকি শোনেও নি। কিন্তু গোপীনাথ কবিরাজ বলছেন (সূর্যবিজ্ঞান - পৃ : ৫৭) এযুগেও নাকি তিনি ব্রহ্মকমল দর্শন করেছিলেন। বলছেন, বাবা তখন কাশিতে, হনূমান ঘাটে অবস্থান করছেন। গুরুদেব তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে আছেন,  আমরা ৪/৫জন সেখানে উপস্থিত। তাকিয়ায় হেলান দিয়ে নিজের নাভি প্রদেশ খুলে দিলেন, নাভির উপরে হাত বুলাতে লাগলেন, প্রথমে নাভি প্রদেশে একটা গভীর খাদের সৃষ্টি হলো, তারপর নাভিমূল  রক্তবর্ণের হয়ে গেলো।  কিছুক্ষন পরেই এক-দেড় ফুট লম্বা একটা সুগন্ধ যুক্ত পদ্ম, নাভি থেকে বের হয়ে এলো। সুগন্ধিতে সারা ঘর ময়ময় করতে লাগলো। বাবা বললেন, এখন সূর্য্যের তেজ কম, তাই এটি  আর বড়ো  হবে না, নতুবা ছাদ পর্যুন্ত বড়ো  হওয়া সম্ভব ছিল। গোপীনাথ কবিরাজ বলছেন, আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এই অভূতপূর্ব দৃশ্যের সাক্ষী রইলাম।   

 মহাত্মাগণ বলছেন, এমনকি শূন্য থেকেও প্রাণের সৃষ্টি হতে পারে। এইসব অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনে ঘটেনি, তাই আমাদের কাছে এগুলো অবিশ্বাস্য। কিন্তু কিসে যে কি হয়, কে বলতে পারে ? ঘরের মধ্যে একটা টিনের পাত্রে চাল রাখা হয়েছিল। কিছুদিন পরে দেখা গেলো, চালের মধ্যে পোকার জন্ম হয়েছে।  বলা হয়ে থাকে প্রথমে খাদ্যের জন্ম তার পরে খাদকের জন্ম। খাদ্যের জন্ম হলেই জানবেন, খাদকের আবির্ভাব আসন্ন। মৃত শরীরে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পোকার জন্ম হতে আমরা সবাই দেখেছি।  তাই বলছিলাম, কিসে যে কি হয়, কে বলতে পারে ? গাছে ফুলের আবির্ভাব হলে, কোথা থেকে মধুমক্ষী আসে, আবার কোথায় বা চলে যায়, তা আমরা জানিনা।  তো আমরা জানিনা অনেক কিছু। গুরুদেব বলছেন, যা আমাদের বুদ্ধির অগোচর, যা আমাদের জ্ঞানের বাইরে, তাকে অস্বীকার করা সহজ, কিন্তু তার কারন অনুসন্ধান করা কঠিন। আমাদের দর্শনের বাইরে বা আমাদের জ্ঞানের বাইরে বুদ্ধির অগোচর অনেক কিছু ঘটছে, বা আমাদের দৃষ্টির বাইরে অনেক বস্তু আছে যাকে আমরা দেখতে পাইনা বটে, তার মানে এগুলো নেই তা নয়। মানুষ যাকিছু কল্পনা করতে পারে, এমনকি মানুষের কল্পনার অতীত অনেক কিছুই এই পৃথিবীতেই অবস্থান করছে, যা আমরা জানি না।  সমুদ্রের মধ্যে যে অসংখ্য জীব সংসার করছে, তার কতটুকুই বা জানি আমরা ।  পৃথিবীর মাটির গর্ভে অর্থাৎ পাতালপ্রদেশে অসংখ্য  প্রাণের অস্তিত্ত্ব আছে, তার খবর কি আমরা রাখি ? আমার চোখের সামনে অসংখ্য ভাইরাস জাতীয় সূক্ষ্ম পদার্থ ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদেরকে কি আমরা খালি চোখে দেখতে পাই  ? পাই না। তো আমরা দেখতে পাই না বলে তাদের অস্তিত্ত্ব বিলোপ হয়ে যায় না। তারা আছে, আমাদের অগোচরেই আছে। এই সত্য মেনে এদের অনুসন্ধান করলে, আমরা এদের সন্ধান পেতে পারি। 

পতঞ্জলির যোগশাস্ত্রে, এইসব অনেক বিভূতির কথা বলা আছে।  এমনকি এইসব যোগবিভূতি লাভের  উপায় আছে এই গ্রন্থে । এখন আর এইসব বিদ্যা, গোপন বিদ্যা নয়।  আপনি নিজে ইচ্ছে করলে, এইসব যোগশাস্ত্রে বই বাজার থেকে কিনে, যোগ পদ্ধতির অনুশীলন করে, এইসব যোগবিভূতির অধিকারী হতে পারেন। কিন্তু আবার এও মনে রাখতে হবে, ঋষি পতঞ্জলি  বলছেন, এইসব ক্রিয়া আসলে ঈশ্বর-অনুভূতি লাভের পথিকের  যাত্রাপথের দৃশ্যমাত্র।  এই দৃশ্য দেখে যারা ভুলে যায়, তারা কখনো মূল তীর্থে পৌঁছাতে পারে না। এগুলো ঈশ্বরলাভের পথের  বাধাস্বরূপ। আমরা জানি মন-মন ঘিও কেউ ঢালবে না, আর রাধাও নাচবে না। কিন্তু তাই বলে ঋষিবাক্য তাচ্ছিল্ল্য করা আসলে নিজের বুদ্ধির অসম্পূর্ণতা। এইখান থেকে  আসুন, আমরা বেরুতে চেষ্টা করি। 

ঠাকুর রামকৃষ্ণকে সবাই পরমহংস বলতেন। দুধ ও জল মিশ্রিত থাকলেও হাঁস  যেমন জল থেকে দুধকে আলাদা করে গ্রহণ করতে পারে, তেমনি যিনি বা যাঁকে পরমহংস বলা হয়, তিনি জগতের মধ্যে মিশ্রিত আত্মা ও অনাত্মা, নিত্য ও অনিত্যকে আলাদা করতে পারেন। এই অবস্থায় সাধকের জাগতিক সমস্ত দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে থাকে। আমাদের মধ্যে শুদ্ধবোধ ও অশুদ্ধ  বোধ আছে, আমাদের মধ্যে ভালো-মন্দ বিচার আছে, পরমহংস এই বিচারের উর্দ্ধে উঠে জগৎকে উপলব্ধি করে থাকেন। 

সূর্যবিজ্ঞান আসলে বাহ্যিক ভাবে  সূর্য্যের সাধন নয়।  আমাদের শরীরে আছে ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ী।  এই নাড়ী দুটোর মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করে থাকে, সূর্য্যশক্তি ও চন্দ্রশক্তি। আমাদের মধ্যে যে জ্ঞানের প্রকাশ, বিজ্ঞানের প্রকাশ, জীবনের প্রকাশ তা আসলে সূর্য-চন্দ্রকে আশ্রয় করেই ঘটে থাকে। এই জ্ঞানের প্রচারক বা সংকলক  ডাক্তার গোপীনাথ কবিরাজ। আর এই বিজ্ঞানের যিনি শিক্ষা দেন তিনি হচ্ছেন, যোগীরাজ বিশুদ্ধানন্দ। আসলে এই বিশেষ যোগপদ্ধতি ঋষি পতঞ্জলির যোগদর্শনে আমরা দেখতে পাই।  আমরা ধীরে ধীরে এইসব কথা শুনবো। আর শুনতে শুনতে দেখুন না, এই বিদ্যার অল্পবিস্তর আয়ত্ত্ব করে, নিজের জীবনে কোনো সুফল আনতে পারেন কি না। এই বিদ্যার অনুশীলনীতে আমাদের মন ও শরীর অবশ্য়ই সুস্থ থাকতে পারে - একথা হলফ করে বলা যায়। আমরা বলছি না যে আপনি রাতারাতি এই বিদ্যার দ্বারা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যাবেন।  সেই আশাকরাও আমাদের পক্ষে অনুচিত।  কেননা আমরা কেউ পুরোপুরি শুদ্ধ শরীর বা মনের অধিকারী নোই। তবে এই প্রক্রিয়ার অনুশীলনী আপনাকে একটা সুস্থ-সবল-নির্ভিক জীবনের অধিকারী করে দিতে পারে।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।
 
সূর্য-বিজ্ঞান - (২) - শূন্য থেকে কি সৃষ্টি করা যেতে পারে ? 

গুরুদেব বলছেন, পাতঞ্জলির সব সিদ্ধান্ত সত্য, অভ্রান্ত এবং পূর্ন। দেখো সব কিছুর মধ্যেই আছে পঞ্চভূত বা তার গুন্ ।  কিন্তু পরিমানের তারতম্যের জন্য তাদের মধ্যে বিভিন্নতা দেখা যায়। সব কিছুর মধ্যে সব কিছু আছে. কিন্তু এক-এক জিনিসের মধ্যে এক-একটি মূল ভূতের গুনের  পরিমানের  তারতম্যের জন্য, আকার প্রকার ও নামের ভেদ হয়ে থাকে। সমস্ত উদ্ভিদ মাটি থেকে রস বা জল সংগ্রহ করছে, সূর্য্য থেকে তাপ বা সূর্য্যরশ্মি সংগ্রহ করছে, এবং এইভাবেই তারা বেঁচে বেড়ে উঠছে, তথাপি দেখো, এক-এক গাছ এক-এক আকৃতির, ভিন্ন ভিন্ন রঙের ফুল ফুটছে। ভিন্ন ভিন্ন তার গুন্। ভিন্ন ভিন্ন ফল দান করছে।  

ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, 
পরিনাম একত্বাৎ বস্তুতত্ত্বম।  (কৈবল্যপাদ শ্লোক - ১৪) 

পরিণামের একত্ব হেতু তত্ত্বগত ভাবে সমস্ত বস্তুই এক। অর্থাৎ পরিণামে সবাই একই বস্তুতে পরিণত হবে। বর্তমানে ভিন্ন ভিন্ন, অন্তিমে সব এক।  সমস্ত বস্তুই ত্রিগুণাত্বক। তা সে জড় বা চেতন যাই হোক না কেন। ত্রিগুণের চঞ্চলতা হেতু বস্তুর সত্ত্বাকে আলাদা বলে মনে হয়। আর এই ত্রিগুণের মধ্যে হিল্লোলের ফলে তৈরী হয়েছে, পঞ্চভূত। পঞ্চভূতের পাঁচ রকম গুন্।  আবার করুর একটা গুন্ তো কারুর পাঁচটি গুন্। আকাশের একটা গুন্ শব্দ, আর পৃথিবীর পাঁচটি গুন্ - শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ। 

শিষ্য বলছেন, এগুলো তো তত্ত্ব কথা, কিন্তু কিভাবে এর প্রতক্ষ্য অনুভব হতে পারে ?  আমরা তো চোখের সামনে সবাইকে আলাদা আলাদাই দেখছি।  আমারদের দেখা কি তাহলে সত্য নয় ? 

এই কথা শুনে , গুরুদেব হাতে একটা গ্যান্ধা ফুল নিলেন।  বললেন, দেখো এটা একটা গ্যান্ধা ফুল। এই ফুলের মধ্যেই সমস্ত ফুল আছে। দেখো, একে  আমি গোপাল ফুল বানিয়ে দিচ্ছি। বলে, গ্যান্ধা ফুলটিকে হাতের মধ্যে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে, হাতটি খুললেন,, এবং দেখা গেলো, গ্যান্ধা ফুলটি গোলাপ ফুলে রূপান্তরিত হয়ে গেলো।  এর পরে আবার গোপাল ফুলটিকে হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে  আবার নাড়াচাড়া করে, এটিকে জবা  ফুলে পরিণত করে দিলেন। এর পর বললেন, সমস্ত বস্তুর ভিতরই সমস্ত বস্তু অল্পবিস্তর আছে। এবং এইসকল পরমাণুর আবির্ভাব এবং ত্যাগই সৃষ্টি-প্রকরণের প্রধান সহায়ক, যাতে একবস্তু থেকে অন্য বস্তুতে রূপান্তরিত হতে পারে। । সব কিছুর মধ্যে সমস্ত সত্ত্বা থাকলেও যে বস্তুর অংশ অধিক থাকে তার গুন্ ও ক্রিয়া তদ্রুপ অভিব্যক্ত হয়। এবং একটা বিশেষ রূপে প্রকাশ প্রাপ্ত হয়। 

দেখো একজন সাধুকে অসাধুতে পরিণত করা যায়, আবার একজন অসাধুকে সাধুতে পরিণত করা যায়। কেবল তার মধ্যে গুনের তারতম্য ঘটিয়ে এই কাজ করা যেতে পারে। আর একেই বলে সূর্যবিজ্ঞান। 

শিষ্য মনে মনে ভাবছেন, দেখলাম তো চোখের সামনে, গ্যান্ধা ফুল থেকে গোলাপ হলো, আবার গোলাপ থেকে জবাফুল হলো, কিন্তু হলো কিভাবে ? মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগ্রত হলো। ভাবলেন, সূর্য্যরশ্মির প্রভাবে ফুলের রঙ হয়। এটা আমরা শুনেছি। এই সূর্য্যরশ্মির প্রভাবেই কি তাহলে ফুলের আকৃতি ও গন্ধ উৎপাদন হয়ে থেকে ? তাহলে সূর্য্যরশ্মির বিশিষ্ট প্রক্রিয়ামূলক সংঘটন অর্থাৎ মিলন-বিচ্ছেদ প্রক্রিয়ার সাহায্যে এই  বস্তু উৎপন্ন, বা পরিবর্তিত রূপ পরিগ্রহ করতে  পারে ! কিন্তু এই রশ্মিগুলোকে কিভাবেই বা আলাদা করা যায় ? সূর্য্যরশ্মি গুলোর আলাদা রঙ আছে এর মধ্যে শ্বেতবর্ণ  প্রধান। তাহলেই এই সাদা রংটাই কি বিশুদ্ধ সত্ত্ব।  এই সাদা রঙের উপরে প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন রঙের রশ্মির উদ্ভাবন এবং সংযোজন করার পরেই এইসব বস্তুর আবির্ভাব হয়ে থাকে ? 

কিন্তু এই রশ্মিগুলোকে  কিভাবে পৃথক করা যায়, সেই বিদ্যা আমার জানা নেই। প্রত্যেক বস্তুর ভিতরে প্রত্যেক বস্তুর আবির্ভাব হয়, এটা না হয় মেনে নেওয়া গেলো, কিন্তু  এর মধ্যে যে অনু পরমাণু আছে, তার গতি প্রকৃতি কোন নিয়মের দ্বারা পরিচালিত হয় ? 

শিষ্য গুরুদেবকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রত্যেক জিনিসের মধ্যে  কিছু ভূত প্রবল আবার কিছু ভূত  দুর্ব্বল থাকে, অর্থাৎ কোনো গুনের আধিক্য, কোনো গুনের স্বল্পতা বর্তমান ।  কিন্তু যদি মূল ভূত কম-বেশি না থাকে, অর্থাৎ সমস্ত গুন্ বা বস্তু যদি সমান ভাবে থাকে তবে কি হয় ? 

গুরুদেব বললেন, সমস্ত মূলবস্তুর বা গুনের সমাহার যদি সমপরিমাণ হয়, তবে সেই বস্তু লয় প্রাপ্ত হয়। সৃষ্টি এবং সংহার পরম-সূক্ষ্ম অণুগুলোর খেলা বা বিচ্ছুরণ।  তাই সূর্য্যরশ্মির দ্বারা এইসব অণুগুলোর পরিচয় পাওয়া যায়। রশ্মি হচ্ছে ব্যঞ্জক অর্থাৎ যা রাঙিয়ে  তোলে, আর অনু হচ্ছে ব্যঞ্জ অর্থাৎ যাকে  রাঙিয়ে তোলে। এই রশ্মি বা ব্যাঞ্জকের আকর্ষনেই ব্যঞ্জ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে বা আবির্ভাব ঘটে। এই যে ব্যঞ্জকবর্ণের মিশ্রণ ক্রিয়া এর আলাদা আলাদা সূত্র আছে। 

জ্ঞানের উন্মেষ দ্বারা বিশেষ ক্রিয়ার মাধ্যমে এইসব উপাদানকে আকর্ষণ করতে  হয়। বিজ্ঞান প্রত্যেক বস্তুকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে,  তাকে টুকরো টুকরো করে থাকে। আবার  আকর্ষণ বিদ্যা দ্বারা  একত্রীকরণ  করতে হয়। এর মধ্যে একটা রহস্যঃ হচ্ছে, যতই আকর্ষণ করা হোক না কেন, মূল রশ্মি কিন্তু  আকর্ষিত হয় না, যতক্ষণ না সেই বস্তু বাহ্য দৃষ্টিতে সেই বস্তুর অভ্যাস পাওয়া যায়। মূলরশ্মি  বা অন্তিম রশ্মির আবির্ভাবের সাথে সাথে রশ্মির  ব্যঞ্জ উপাদানের আবির্ভাব হয়ে যায় এবং সেই বস্তু তখন সবার দৃষ্টিগোচর হয়।  এ এক অদ্ভুত ব্যাপার।  অন্তিম রশ্মিকে ছেড়ে শেষ রশ্মির স্থিতি দীর্ঘকাল রাখতে পারা  যায়। অন্যদিকে প্রয়োজন অনুসারে এক রশ্মির প্রভাবেই সেই বস্তুর আবির্ভাব বা দৃষ্টিগোচর হয়। এই বস্তু কল্পিত নয় বরং এই বস্তু শুদ্ধ। তাই এই বস্তু জাগতিক বস্তুর চেয়েও অধিক নির্মল ও স্থায়ী রূপে বিদ্যমান থাকে। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রশ্মির সংযোগ কিভাবে সম্ভব হতে পারে ? কারন প্রত্যেকটি রশ্মি ক্ষনিকের জন্য প্রকট হয়ে, আবার লীন  হয়ে যাচ্ছে। তো রশ্মির স্থায়িত্ত্ব নিতান্ত ক্ষনিকের জন্য হয়ে থাকে। তো এই স্বল্প সময়ের জন্য রশ্মিকে অনুর সঙ্গে যুক্ত  করা কিভাবে সম্ভব ? এই ব্যাপারটা রহস্যে ভরা। গুরুদেব বলছেন,  দেখো, সমস্ত রশ্মির মধ্যেই এক বিশুদ্ধ শুভ্র কিরণমালা থাকে।  আর এই কিরনের মধ্যে আছে তীব্র আকর্ষণশক্তি। আগেই বলেছি, সৃষ্টিতে রশ্মিতে শুভ্র শক্তির স্ফূরণ থাকে না। সমস্ত সৃষ্টির পৃষ্ঠভূমিতে থাকে এই শুভ্র শক্তি।  যেন একটা সাদা কাগজ, যাতে সমস্ত ছবি  স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এখানে এই সাদা বা শুভ্র কাগজ ছবি  নয়, কিন্তু ওই সাদা কাগজ ভিন্ন ছবি দৃশ্যমান থাকে না। তেমনি সৃষ্টিতে শুভ্র শক্তির স্ফূরণ থাকে না অথচ সৃষ্টির পৃষ্ঠভূমি হচ্ছে এই শুভ্রশক্তি। কিন্তু বিজ্ঞানবিদ খণ্ডরূপে তা প্রকটিত  করতে পারেন। এবং এর স্থিতিকালকেও বজায় রাখতে পারেন। এই রশ্মির সাথে কোনো কিছুর বিরোধ নেই, তার কারন হচ্ছে রশ্মি হচ্ছে স্নিগ্ধ  ও স্বচ্ছ। সুতরাং শুভ্র রশ্মির উপরে যে কোনো রশ্মির প্রতিফলন সম্ভব, এবং অন্যান্য রশ্মিও  আকৃষ্ট  হয়ে এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায় অর্থাৎ এর তিরোধান  ঘটে না ।

এইভাবে, ক্রমানুসারে, দ্বিতীয় রশ্মি এর সাথে আকর্ষণ শক্তির সাহায্যে মিলন ঘটে থাকে। এইরূপে রশ্মির মহামিলন ঘটে।   একই ভাবে, তৃতীয় রশ্মি, চতুর্থ রশ্মি  বা পঞ্চম রশ্মি-গুলোও একই ভাবে সংযোগ সাধন করে থাকে। সংযোগ সাধন অর্থাৎ ব্যঞ্জনের উপাদান সংযোগ সাধিত হয়। যখন অন্তিম উপাদান সংযোগ সাধন হয়, তখনই দ্রব্যের আবির্ভাব ঘটে। এই হচ্ছে সৃষ্টির রহস্যঃ। শেষে গুরুদেব বলছেন, অনুলোম ও বিলোম এই দুই প্রকার রশ্মি অর্থাৎ সূর্য ও চন্দ্র নাড়ীর ক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। দেখো, সূর্য্যবিজ্ঞানই সৃষ্টি তত্ত্বের মূল। সূর্য্যের নাম সবিতা অর্থাৎ প্রসবকারী  রাখা হয়েছে। এইভাবে চন্দ্র বিজ্ঞান, বায়ুবিজ্ঞান, নক্ষত্র বিজ্ঞান, ক্ষণ বিজ্ঞান প্রভৃতি বিশেষ জ্ঞানের বিষয় পরিলক্ষিত হয়। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম।  

সূর্যবিজ্ঞান - (৩) - কিরাত ধৌতি - দেহকে শূন্যে চালনা করা। 

অনিমা সিদ্ধি  সম্পর্কে : ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, 

কায়াকাশয়োঃ সম্মন্ধ -সংযমাৎ লঘু-তুল সমাপত্তেঃ চ আকাশ গমনম। (শ্লোক-৪২)

শরীর ও আকাশ এই দুটোর সন্মন্ধে সংযম করলে, শরীর তুলোর মতো হালকা অবস্থা প্রাপ্তি হয় আর আকাশ গমন সিদ্ধ হয়। 

 আবার অন্যদিকে গোপীনাথ কবিরাজ বলছেন,  কিরাত ধৌতিতে ধাতস্থ হলে, আকাশগমন সিদ্ধি লাভ করা যায়।  -সূর্যবিজ্ঞান পৃষ্ঠা -৪৭) 

 যোগবিভূতির কথা উঠতেই অনেকে বলে থাকেন, এগুলো বুজরুকি, বড়োজোর একে ম্যাজিক বলা যেতে পারে। এতে মানুষের কোনো উপকার হয় না। কথাগুলো সম্পূর্ণ সত্য না হলেও, আংশিক সত্য তো বটেই। তবে দেখুন, একে  আপনি জাদুবিদ্যা বলুন, বা যোগবিদ্যা বলুন, একথা মানতেই হবে, এটাও এক ধরনের বিদ্যা, যা অনেক দিনের অনুশীলনের ফলে আয়ত্ত্ব করা সম্ভব। এখন এই বিদ্যা আপনি কিভাবে ব্যবহার করবেন, সেটা আপনার উপরে নির্ভর করছে।  দেখুন, বুজরুকি মানুষকে  ধোঁকা দেয়, ঠকায়। কিন্তু ম্যাজিক মানুষকে বিনোদন এনে দেয়। আপনি যদি এই বিদ্যা প্রয়োগে কাউকে ঠকান সেটি অন্যায়।  কিন্তু এর দ্বারা যদি আপনি কারুর উপকার করতে পারেন, এমনকি বিনোদন দিতে পারেন, তবে সেটি মানুষের পক্ষে অবশ্য়ই ভালো বলতে হবে। 

দেখুন, পতঞ্জলির যোগসূত্রে যে যোগবিভূতির কথা বলা আছে, তা কিন্তু মানুষকে বিভ্রান্ত করবার জন্য নয়, বা কাউকে ঠকানোর জন্য নয়, এমনকি এর ব্যবহার সম্পর্কে ঋষি পতঞ্জলি নিজেই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছেন। এখন কথা হচ্ছে, যদি এগুলো নিষিদ্ধ বিদ্যা, তবে এর দরকার কি , বা এইসব বিদ্যার প্রচারের দরকার কি ? দেখুন পাহাড় খুব উঁচু জায়গা।  তো এখানে বা পাহাড়ের উচ্চ শিখরে আপনি যদি পৌঁছতে চান, তবে পাহাড়ি রাস্তায় আপনাকে একবার উঁচুতে একবার নিচুতে যেতে হবে। পাহাড়ী রাস্তার এটাই ধরন। আপনাকে উঁচুতে উঠতে গেলে, সময়ে সময়ে আপনাকে নিচুতেও  নামতে  হবে।  আপনি যদি বলেন, আমি নিচুতে যাবো না, তবে আপনার পাহাড়ের শিখরে ওঠা হবে না। ঠিক তেমনি, আধ্যাত্মিক জগতের উচ্চ শিখরে উঠতে গেলে, চড়াই-উৎরাই আছে। এই চড়াই -উৎরাই পথ ধরেই, আপনাকে এগুতে হবে।  ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, সাধন জগৎ বড্ড কঠিন যাত্রা।  এখানে নানান রকম, বাধা বিপত্তি পেরিয়ে, কঠিন অনুশীলনীর মাধ্যমে ধীরে ধীরে একটার পর স্তর  পেরুতে হয়। এই কঠিন পথেই একসময়, সাধকের অজ্ঞাতসারেই তার মধ্যে বিভিন্ন বিভূতির প্রকাশ ঘটে থাকে।  কিন্তু ঋষি পতঞ্জলি, সতর্ক  করে বলছেন, এগুলো থেকে সাধককে মুখ ঘুরিয়ে রাখতে হবে। তবেই লক্ষে পৌঁছনো যাবে।  কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, এই বিভূতি প্রদর্শনকে মহাত্মাদের মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করে থাকি। তাই এইসব নিয়ে আমাদের মধ্যে এতো আলোচনা। আসলে, সত্যিকারের সাধকের মধ্যে এই নিয়ে কোনো মাথা-ব্যাথা নেই। তারা এইসব বিভূতির প্রয়োগ সাধারণত করেন না। আর কেউ যদি এই বিভূতিকে প্রয়োগ করে, কিছু জাগতিক লাভ কুড়ুতে চান, তবে তার জন্য  সাধন জগতের দ্বার বন্ধ হয়ে যায়। তাই বিভূতি প্রদর্শন সাধকের কাজ নয়, কিন্তু অনেকসময় এই  তারমধ্যে এই বিভূতির প্রকাশ স্বতস্ফূর্ত ভাবেই ঘটে থাকে। কিন্তু তিনি এসবকে অগ্রাহ্য করে সাধন পথে এগিয়ে যান। 

 আসলে আত্মজ্ঞানের উন্মেষ না হলে, কখনোই যোগবিভূতির প্রকাশ হয় না। সুরেশ্বরাচার্য্য বলছেন, পুরুষ ধাবমান হলে যেমন তার ছায়া তাকে অনুসরণ করে, ঠিক তেমনি আত্মা বা ঈশ্বরের স্বরূপ উপলব্ধি হলে যোগ-ঐশর্য্য তার স্বাভাবিক ভাবেই প্রকটিত হয়।  এর জন্য তাকে আলাদা করে কোনো প্রয়াস করতে হয় না। আসলে  যোগৈশ্বর্য্যের আত্মা ভিন্ন কোনো অস্তিত্ত্ব নেই। যোগৈশ্বর্য্যকে বলা হয় আত্মার ছায়া। আমরা জানি ব্রহ্মচর্য্যের সাহায্যে আমাদের বিন্দু শোধন ও স্থির হয়ে থাকে। এই বিন্দুই জীবদেহের সত্ত্ব। এই বিন্দু শুদ্ধ ও স্থির হলে, অর্থাৎ সাধনবলে দেহ যখন  শুদ্ধ হয়, তখন সাধকের চিত্তশুদ্ধি ও ভূতসিদ্ধি আপনা থেকেই আয়ত্ত্ব হয়ে যায়।

আমরা আবার পুরানো কথায় ফিরে যাই, সাধক কি করে আকাশপথে গমন করতে পারেন। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, শরীর ও আকাশ এই দুইয়ের সংযম থেকে শরীরের তুলোর মতো হালকা অবস্থা প্রাপ্তি হয়।  আর এতে করে আকাশ গমন সিদ্ধ হয়। এখন কথা হচ্ছে, সংযম বলতে ঋষি পতঞ্জলি কি বলতে চেয়েছেন ? ঋষি বিভূতিপদে ৪ নং শ্লোকে বলছেন, "ত্রয়মেকত্র সংযমঃ" . তিনটিকে একত্র করলে সংযম হয়।  এই তিনটি হচ্ছে ধারণা, ধ্যান ও সমাধি - এই তিনটিকে একটি মাত্র বিষয়ে যুক্ত করতে পাড়লে সংযম হতে পারে। এই তিনটি বিষয় নিয়ে আমরা আগে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। চিত্তকে নিরালম্ব করবার জন্য, যে সব অভ্যাস ও চেষ্টা তার দ্বারা সাধক সম্প্রজ্ঞাত অবস্থা লাভ করে থাকেন। এই অবস্থায় সাধকের চিত্ত সংযমী হয়ে ওঠে। আর চিত্ত সংযমী হয়ে উঠলে, সাধকের মধ্যে কতকগুলো সিদ্ধি বা ঐশ্বর্যের উন্মেষ হতে দেখা যায়। তো প্রথমে আমাদের সংযমী হতে হবে, তবেই আমরা এইসব ঐশ্বর্যের অধিকারী হতে পারবো।   
এবার আমরা গোপীনাথ কবিরাজের কথায় আসবো। তবে তার আগে দুটো কথা শুনে নেই। 
 আপনারা নাসাপান  কথা হয়তো অনেকেই শুনেছেন। নাসাপান হচ্ছে, নাক দিয়ে জল পান করা। আবার মুখ দিয়ে সেই জল বের করে দেওয়া।  আমাদের নাসামুলে  যে  ইড়া  পিঙ্গলা ও সুষুম্নার মিলন স্থান আছে, সেখানে শ্লেষা সঞ্চিত হলে, এই তিন নাড়ীর ক্রিয়ার ব্যাঘাত উপস্থিত হয়। এতে করে অনেক সময় আমাদের নাক বন্ধ হয়ে আসে, এবং তখন আমরা মুখ দিয়ে স্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া করে থাকি। মুখ দ্বারা শ্বাস গ্রহণ করলে আমাদের ফুসফুসে ঠান্ডা লেগে, বিবিধ রোগের  সৃষ্টি হতে পারে। এইসব রোগ থেকে বাঁচার জন্য, নাসাপান আমাদের উপকার করতে পারে।  এছাড়া আছে নেতিযোগ বা নেতিধৌতি।  বারো আঙ্গুল পরিমান লম্বা  একটা সরু সুতোকে নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করিয়ে তাকে মুখ দিয়ে বার করতে হয়। ঋষি ঘেড়োন্ড বলছেন, এই ক্রিয়ার ফলে একদিকে যেমন কাফদোষ দূর হয়, তেমনি দুব্যদৃষ্টি জন্মায় (শ্লোক-৫১) হঠযোগে একপ্রকার ধৌতি-কর্ম্মের  কথা বলা হয়েছে।  বলছেন, দৈর্ঘে পনেরো হাত, চওড়া ৪ আঙ্গুল, একটা পাতলা কাপড় নিন. তাকে জলে ভিজিয়ে ধীরে ধীরে গিলে ফেলবেন, আবার ধীরে ধীরে সেটিকে পেট থেকে টেনে বার করুন।  আমাদের মধ্যে কেউ কেউ নাভি-ধৌতির কথা শুনেছি। এই নাভি ধৌতি দীর্ঘকাল অভ্যাসের ফলে রপ্ত হতে পারে।

 কিন্তু গোপীনাথ কবিরাজ বলছেন, কিরাত ধৌতির কথা। বলছেন, কিরাত ধৌতি আসলে নাভি ধৌতির উন্নত অবস্থা বিশেষ।  কিরাত ধৌতি বছরের পর বছর কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমেই কেবলমাত্র রপ্ত হতে পারে। 
কিরাত ধৌতি কিভাবে করবেন ?   একটা মখমল বা অন্যপ্রকার শুদ্ধ বস্ত্রের ২৫/৩০ হাত দীর্ঘ খন্ড  গলাদ্ধকরণ করে নাভি থেকে মুখ পর্যন্ত যথাবিধি অনুলোম বিলোম প্রণালীতে পুনঃ পুনঃ চালনা করতে হয়। এই ধৌতিক্রিয়ায় সাফল্য অর্জন করতে গেলে দীর্ঘকাল গুরুসান্নিধ্যে থেকে অভ্যাস করতে হয়। 

ফলাফল : এই কিরাত ধৌতি ক্রিয়ায় যিনি অভ্যস্ত হন, তিনি আকাশ গমনের ক্ষমতা অর্জন করেন। গোপীনাথ কবিরাজ বলছেন, কুম্ভকের দ্বারাও শূন্যে ওঠা যায় বটে, তবে এতে সাধক অনেক সময় বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, এমনকি এইসময় তিনি কথাবার্তা বলতে পারেন না। এছাড়া, উর্দ্ধ বায়ু মন্ডলে চলার কালে, অনেক সময় প্রতিকূল বায়ুর প্রভাব সহ্য করতে পারেন না।  ফলতঃ এই অবস্থায় পতনের ভয় থাকে। বলা হয়ে থাকে নাভি-ধৌতিতে পরিপক্কতা লাভ করলে দেহ শূন্যময় হয়ে যায়।  তখন সমগ্র দেহ সংকুচিত ও প্রসারিত করবার ক্ষমতার জন্ম হয়। এমনকি লোমকূপের মতো অতিসূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে বৃহৎ পদার্থ প্রবেশ করাতে পারা  যায়। শরীরের যে কোনো অংশকে তখন নিজে মর্জি-মাফিক ক্ষুদ্র বা বৃহৎ করতে পারা যায়। 

কিরাত ধৌতি  দ্বারা  দেহকে শুদ্ধ করে, দেহের কোনো অঙ্গে বায়ু পূর্ন করে রাখাকে বলে কিরাত-কুম্ভক। এই কিরাত-কুম্ভক দ্বারা শূন্যে উঠলে, তখন কথা বলতে কোনো বাধা থাকে না। এমনকি কথা বলতে বলতে শূন্যে ভ্রমন করা যায়। সাবাথেকে বিশেষ কথা হচ্ছে, এই সময় নিজের বাহ্যজ্ঞান থাকে কিন্তু বাহ্য বিষয়ে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ততা জন্মায়। অন্যের শরীরে প্রবেশ  বা অন্য-শরীর ধারণ করবার পক্ষেও এই কিরাত-কুম্ভক অধিকতর উপযোগী।  একবার কিরাত-কুম্ভক দ্বারা দেহকে শুদ্ধ করতে পারলে, এবং কিরাত কুম্ভকের দ্বারা দেহে বিশুদ্ধ বায়ু ভোরে নেওয়া যায়।  আর তখন কোনো কিছুই তাকে অভিভূত করতে পারে না। এই সময় অতি শক্তিশালী তেজোরাশির দর্শন ও তার সংস্পর্শে এলেও সাধকের জ্ঞানের বিলোপ হয় না। 

এই বিশেষ ক্রিয়া, নাভি-ধৌতি এবং  কিরাত-কুম্ভক স্বয়ং ভৃগুরাম পরমহংসদেবের কাছ থেকে শিখেছিলেন। এবং দীর্ঘকাল  অভ্যাসের ফলে এই ক্রিয়াতে তিনি রপ্ত হন।  গোপীনাথ কবিরাজ এই বিদ্যা নাকি তার কৈশোরেই দাদাগুরুর কৃপায়, অর্থাৎ শ্রীযুক্ত ভৃগুরাম স্বামীর অযাচিত কৃপায় নাভি-ধৌতি ক্রিয়া আয়ত্ত্ব  করতে পেরেছিলেন। তিনি আরো বলছেন, দেহকে ইচ্ছেমতো সংকুচিত ও প্রসারিত করতে পারলে, অনিমা মহিমা সিদ্ধি স্বাভাবিক হয়ে পরে। বাবাজি অর্থাৎ পরমহংস  ভৃগুরাম আকাশমার্গেই যাতায়াত করতেন। তিনি কখনো ভূমি স্পর্শ করেন না। স্থূল দেহ নিয়ে সূর্যলোকে গমন করবার ক্ষমতা তার ছিল। তার ছিল সিদ্ধ দেহ। গোপীনাথ কবিরাজের গুরুদেব, বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস এই কিরাত-যোগের অভ্যাস দ্বারা শরীরের লোমকূপের  মধ্যে স্ফটিকের খন্ড রেখে দিতেন। তাঁর মাথার মধ্যে বাণলিঙ্গ শালগ্রামশীলা বৃহৎ স্ফাটিকের মালা সাজানো থাকতো। এসব কবিরাজ মহাশয় নিজর চোখে দেখেছেন। এইসব অলৌকিক কান্ড-কারখানার কথা আমরা গোপীনাথ কবিরাজের কাছে আরো শুনবো। শুধু ঘটনার বিবরণ নয়, এই সব অদ্ভুত কার্যকলাপের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আমরা তাঁর কাছ থেকে শুনবো। তবে শেষ করবার আগে, আমরা আবার বলি, অলৌকিক বলে কিছু হয় না। সমস্ত ঘটনার আগে, তার কারন-ঘটনার জন্ম হয়েছে।  আমরা সেই সাবকারন ঘটনার কথাও শুনবো।  অর্থাৎ এই সব অবিশ্বাস্য ঘটনার কার্য্য-কারন ব্যাখ্যা শুনবো। তবে একটা কথা বলি, এই গুহ্যবিদ্যা হাজার হাজার  বই পড়ে কিন্তু আয়ত্ত্ব করা জয় না। এসব  আয়ত্ত্ব করতে গেলে, নিজেকে এই ক্রিয়ার অনুশীলনীর মধ্যে নিয়োগ করতে হবে।  আর তা করতে হবে, একজন যোগ্য গুরুর সান্নিধ্যে। তবেই এইসব বিদ্যার সুফল পাওয়া যেতে পারে।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম। 
    
সূর্য বিজ্ঞান : ৪ : যোগবিভূতির প্রসঙ্গে

 যোগ বিভূতি সম্পর্কে আমাদের অনেকে রকম  শুনে থাকি।  ভাগ্যক্রমে কেউ কেউ হয়তো দেখেও থাকতে পারি।  কিন্তু অবস্থায় যে কিভাবে পৌঁছানো যায়, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। এমনকি এই বিদ্যার যারা সমালোচক, তারাও এই বিদ্যা সম্পর্কে কিচুই জানেন না, একথা হলফ করে বলা যায়। আবার  আমাদের অনেকে, এই সব বিদ্যা যে থাকতে পারে, সেই সম্পর্কেও সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণের যাদের যোগবিভূতি সম্পর্কে কোনো প্রতক্ষ্য অভিজ্ঞতা নেই, তাদের মধ্যে  যোগবিভূতির প্রসঙ্গে আলোচনা কালে, দুটো প্রশ্ন মনের মধ্যে জেগে ওঠে। 

১. যোগবিভূতি দ্বারা যদি সমস্ত জাগতিক বস্তুর সৃষ্টি করা যেতে পারে, তবে মানুষের অভাব মোচনের জন্য, এই যোগবিভূতির ব্যবহার কেন করা হয় না ? মানুষের তো এতো অভাব, যোগের দ্বারা যদি, এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব, তবে মানুষ কেন যোগবিদ্যালয় স্থাপন করে যোগের শিক্ষা চালু করা যেতে পারে। তা কেন করা হচ্ছে না। 
তপোভূমি নর্মদা গ্রন্থে পড়েছি, লেখক যখন নর্মদা পরিক্রমা করতে করতে ক্ষুধা-তৃষ্ণায়  ক্লান্ত, তখন মা নর্মদার পুণ্যতোয়া জলে তৃষ্ণা নিবারণ করতেন। আর মহাত্মার কৃপায়, নর্মদার জলে ভেসে আসতো লুচি, মিষ্টি। অথবা নির্জন অরণ্যের মধ্যে মন্দিরে বাসকালীন এসে স্থানীয় কেউ না কেউ তাঁদের খাবারের যোগান দিতেন।   আর তা খেয়ে তিনি শারীরিক ক্ষুধা মেটাতেন। অনেক সাধু মহাত্মাদের ভান্ডারায় খাদ্যসামগ্রী কখনো শেষ হতো না, যতক্ষন অতিথি সমাগম হতো। শিরডির সাঁইবাবার  এই অপূর্ব লীলা আমরা বইতে পড়েছি। এমনকি এমন অনেক গল্প-কাহিনী লোকের মুখে মুখে ফেরে। এইসব সাধু-মহাত্মাগণ বিভিন্ন সময়ে,  বিভিন্ন সামগ্রী, এমনকি সোনাদানা দান করতেন, তাঁদের পছন্দমত শিষ্যদেরকে এই অলৌকিক ক্ষমতাবলে। 
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যাঁরা এইসব অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হতেন, বা ছিলেন, তাঁরাও কিন্তু দানসামগ্রী গ্রহণ করতেন, এমনকি আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করতে ভুলে যেতেন না।  আবার  অকাতরে সবাইকে এই বিভূতিলদ্ধ সামগ্রী দানও   করতেন না। তাহলে রহস্যটা কি ? 
ঠাকুর রামকৃষ্ণের কাছে, কেউ একজন এসে বলছিলো, অমুক সাধু জলের উপরে দিয়ে হেটে গঙ্গা পার হয়ে যেতে পারে। তো ঠাকুর তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই বিদ্যা আয়ত্ত্ব করতে কতদিন  লেগেছে ? তো তিনি বললেন, সারা জীবন ধরেই তিনি এই  বিদ্যার চর্চা করছেন। ঠাকুর আবার বললেন, দেখো, যেখানে দু পয়সায় গঙ্গা পার হওয়া যায়, সেখানে সারা জীবন লেগেছে, তার এই বিদ্যালাভ করতে। আমি তো দু পয়সায় গঙ্গা পার হয়ে যাই। 
আরো একটা গল্প, মহাত্মা বিশুদ্ধানন্দজী এই ধরনের অনেক অলৌকিক ঘটনা তার শিষ্যদের কাছে, উপস্থিত করতেন। তিনি যেন একটা ল্যাব, যেখানে সমস্ত যোগবিদ্যার প্রতক্ষ্য প্রয়োগ দেখা যেতো।  তো মা আনন্দময়ী এইসব দেখে তাকে বলেছিলেন, তুমি এইসব কি ছেলেমানুষি করছো ? আমি কিন্তু সব বুঝতে পারছি। এসব করে কি লাভ, তার চেয়ে, তোমার মধ্যে যে আসল বস্তুটি আছে, তা তুমি এদেরকে দাও। একথা শুনে বিশুদ্ধানন্দজী শুনে চুপ হয়ে গেছিলেন, আর অস্ফুট স্বরে বলেছিলেন, কেই বা 
নেয় ? 

২. শুনেছি, এই যোগৈশ্বর্য্য অকারনে এমনকি পার্থিব বস্তু লাভের  জন্য, ব্যবহার করা উচিত নয়। তো এইসব মহাত্মাগণ তাহলে, নিতান্ত মানুষকে চমকে দেবার জন্য, অথবা নিজের ক্ষমতা জাহির করবার জন্য, কেন এই সব যোগবিভূতির ক্ষমতা প্রদর্শন করে থাকেন ?   এতে তাঁদের সাধনার কোনো বিঘ্ন ঘটে কি না। আরো একটা কথা হচ্ছে,  যোগবিভূতি স্বতঃস্ফূর্ত হওয়ার কথা, এখানেও কি তাহলে ইচ্ছেশক্তি কাজ করে থাকে ? কারন ইচ্ছেশক্তির সাহায্যে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা যায় - এটা আমাদের অনেকের প্রতক্ষ্য অভিজ্ঞতা। 

আমরা এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো পরবর্তীতে।  

গোপীনাথ কবিরাজ একবার এই দ্বিতীয় ধরনের একটা প্রশ্ন করেছিলেন, তার গুরুদেবকে। বলেছিলেন, "যোগীদের নিজের নিজের শক্তি বা যোগবিভূতি বাইরে প্রকাশ করা উচিত কি না। " তাতে করে গুরুদেব যে  জবাব দিয়েছিলেন, তা আমরা আমাদের মতো করে বোঝার চেষ্টা করবো। 
 দেখো, যারা শিক্ষার্থী এবং যোগরাজ্যে সবেমাত্র নতুন প্রবেশ করেছে, তাদের পক্ষে যোগশক্তি বা যোগবিভূতি প্রদর্শন করা হানিকর। কারন এতে আসক্তি এবং অহংকার বৃদ্ধি পেতে পারে, এমনকি অতি নিকটতম ব্যক্তিকেও এইসব কথা বলতে নেই। তাদের এমন ভাবে থাকা উচিত, যাতে অন্যকেউ তার যোগবিভূতির কথা বুঝতে না পারে।  সুতরাং যথাসম্ভব যোগবিভূতি বা যোগ সম্পত্তি গুপ্ত রাখাই ভালো। 
তবে যিনি সিদ্ধ যোগী, যিনি অধিকারী, যিনি সামর্থবান, যিনি ঈশ্বরের মহাকৃপা লাভ করেছেন, তার জন্য কোনো নিয়ম নেই।  কারন, তাঁর অহংকার লোপ পেয়েছে, তাঁর অহংকার হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি নিজের জন্য এই শক্তি ব্যবহার করেন না, করার প্রয়োজনও নেই।  কেননা তিনি পরমপিতার  মহা করুনা  প্রাপ্ত হয়ে সমস্ত ভূতকে জয়লাভ করেছেনতাঁর  অতৃপ্তি বলে কিছু অবশিষ্ট নেই।
তোমরা যাকে  বলছো, জাহির করা, অর্থাৎ নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন, এই উদ্দেশ্যে এই ধরনের যোগবিভূতি প্রকাশ করা হয় না। তাহলে কেন এই যোগবিভূতি, যাকে ঋষি পতঞ্জলি নিষিদ্ধ করেছেন, তা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করা হচ্ছে ?। ঋষি পতঞ্জলি  বলেছেন, এই ক্ষমতা স্বাভাবিক ভাবে যোগীর  মধ্যে আসবে, কিন্তু এই ক্ষমতা প্রয়োগে, যোগীর ঈশ্বরপ্রাপ্তির বাধা সৃষ্টি হবে। তাই এইসব ক্ষমতাকে উপেক্ষা করতে হবে।   

তথাপি, কোনো কোনো যোগীপুরুষ এই ক্ষমতার প্রদর্শন করে থাকেন। এর কারন হচ্ছে, সত্যিকারের  জিজ্ঞাসুর মধ্যে বিশ্বাস জাগিয়ে তোলা। দেখো, তোমার মধ্যে যদি বিশ্বাস  না জাগে, তবে তুমি অনুসন্ধান কর্ম্মে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে পারবে না। ঈশ্বর আছেন, এই বিশ্বাস যার মধ্যে জাগ্রত হয়েছে, সে-ই ঈশ্বরের সন্ধানে সংসার ছেড়ে পাহাড়ে, জঙ্গলে, নির্জনে ঈশ্বরের সন্ধানে ঘুরে ফিরে মরে। যার মধ্যে ঈশ্বরে বিশ্বাস জাগ্রত হয়নি, সে কখনো সংসারের সুখ-স্বচ্ছন্দ ছেড়ে মরীচিকার পিছনে ধাবিত হতে পারে না। ঈশ্বর যে তোমার মধ্যে আছেন, সমস্ত ঐশ্বরিক ক্ষমতা যে তোমার মধ্যেই আছে, একমাত্র যোগীপুরুষের মধ্যে আছে, মানুষের মধ্যে আছে, মানুষ যোগের অনুশীলনীতে নিজেকে যোগ্য করে নিতে পারে, এই বিশ্বাস দৃঢ় করবার জন্য, যোগ্য জিজ্ঞাসুকেই কেবলমাত্র এই যোগবিদ্যার প্রয়োগ প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। এই রহস্যঃ কখনো বাক্যের সাহায্যে যথাযথভাবে বোঝানো যায় না। বস্তুর রহস্যঃ, বস্তুর তত্ত্ব বুঝতে গেলে, সংযম পালন করতে হয়। অর্থাৎ ধারণা-ধ্যান-সমাধিতে সিদ্ধ হতে হয়। দেহকে শুদ্ধ করতে হয়, মনকে পবিত্র করতে হয়। তাই বলছি, প্রথম প্রবেশার্থী, এবং যাকে  যোগ্য অধিকারী বলে মনে হয়, একমাত্র তাকেই এই যোগবিভূতি প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। দেখো, তুমি যাকে বা   যে কাজকে অসম্ভব বলে বিবেচিত করবে, তা কখনোই তোমার কাছে সম্ভব হতে পারে  না। তুমি যদি মনে করো, স্রোতস্বীনি গঙ্গা তুমি সাঁতার দিয়ে পার হতে পারবে না, তবে তুমি কখনোই এই কাজ করতে যাবে না। কিন্তু যদি তোমার মধ্যে যদি বিশ্বাস থাকে যে আমি ভালো সাঁতার কাটতে পারি, আমি অবশ্য়ই গঙ্গা পেরুতে পারবো, তবে তুমি আজ না হলেও কাল অবশ্য়ই গঙ্গা পার হতে পারবে। আবার  তোমার মধ্যে যখন বিদ্যাসাগরের মতো মায়ের ডাক শুনতে পাবে, তখন উত্তাল দামোদর পার হবার প্রবল ইচ্ছেশক্তি  তোমাকে উন্মত্তবৎ করে দেবে। আর তুমি হয়তো পার হয়েও যাবে। 

দেখো সিদ্ধ যোগীর কাছে, অসম্ভব বলে কিছু হয় না। শক্তির অধীনে সবকিছু। তাই শক্তি আয়ত্তে থাকলে সব কিছু হতে পারে। যা অন্যের কাছে অঘটন, অলৌকিক, অবাস্তব, তা যোগীপুরুষের কাছে বাস্তব সত্য। আর এই যোগমার্গে উন্নতিলাভ করতে গেলে, দরকার শ্রদ্ধা, ভক্তি, বিশ্বাস, সরলতা। এরপরে নিরন্তর অভ্যাস, ধৈর্য্য। গুরুর প্রতি যখন তোমার শ্রদ্ধা - বিশ্বাস জাগবে, তখন তার কথায় তুমি অবশ্য়ই প্রানপন শক্তি প্রয়োগে কর্ম্মে লিপ্ত হবে। আর যদি শ্রদ্ধা, ভক্তি বিশ্বাস না থাকে তবে দ্বন্দ্বের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে। আর হতাশ হয়ে তুমি একদিন কর্ম্মে বিরতি টানবে। কিন্তু অটল বিশ্বাস যখন তোমার মনের মধ্যে জাগ্রত থাকবে তখন   তোমাকে কেউ  কিছুতেই কর্ম্ম থেকে সরিয়ে রাখতে পারবে না।
দেখো গাছ লাগালে ফল হয়, এটা তুমি শুনেছ, বা দেখেছো। যদি তুমি শুধু কথাটা  শুনে থাকো, তাহলেও তোমার মধ্যে সামান্যতম হলেও অবিশ্বাস থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু যদি তুমি দেখে থাকো, তবে তোমার মধ্যে কখনো সন্দেহ দানা বাঁধতে পারবে না। 
  
 তাই আমরা যোগ্য অধিকারী, পেলে যোগ্য পাত্র পেলে, তাকে একটু আধটু যোগবিভূতি দেখিয়ে তাকে আকৃষ্ট করতে  চাই। বিদ্যা দানের পরম্পরা না থাকলে  যে বিদ্যা হারিয়ে যায়। বিদ্যা-দানের মধ্য দিয়েই, বিদ্যাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়।         
--------------------------
৭.১১.২০২১
আমাদের প্রথম প্রশ্ন ছিলো, যোগবিভূতির দ্বারা যদি সমস্ত দ্রব্য বা বস্তু তৈরি করা যায়, তবে মানুষের বৈষয়িক চাহিদা মেটানোর জন্য, এই প্রক্রিয়ার সাহায্য কেন নেওয়া হচ্ছে না ?  যোগবিভূতি দ্বারা যদি সমস্ত জাগতিক বস্তুর সৃষ্টি করা যেতে পারে, তবে মানুষের অভাব মোচনের জন্য, এই যোগবিভূতি-বিদ্যার  ব্যবহার কেন করা হয় না ?

দেখুন এই ব্যাপারটা বুঝতে গেলে, আমাদের আগে বুঝতে হবে, যোগীর বা সাধকের মধ্যে কখন যোগ বিভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ হয়ে থাকে।  অর্থাৎ কখন যোগী এ যোগৈশ্বর্য্যের অধিকারী হন ? এর উত্তর শুনবার আগে, আরো দুটি প্রাক-কথা আমরা একটু ধৈৰ্য্যধরে শুনে নেই। দেখুন যোগবিভূতির জন্য, আলাদা করে করে সাধন পদ্ধতির নির্দেশ বা পথ নেই।  যোগবিভূতির প্রকাশ তখনই সাধকের মধ্যে হয়, যখন তিনি সমাধিতে সিদ্ধি লাভ করেন।  আবার এই সাধক যখন কৈবল্য লাভের  উপযুক্ত হয়ে ওঠেন, তখন তার মধ্যে এই যোগৈশ্বর্য্যের বিলোপ সাধন হয়ে থাকে।  তখন তার মধ্যে আর এই যোগ ঐশ্বর্যের প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় না। আর তার মধ্যে এমন কোনো ইচ্ছেরও উৎপত্তি হতে পারে না। 

পাতঞ্জল-যোগদর্শনে যেসব যোগবিভূতির কথা বলা আছে, জানবেন তা সবই বিজ্ঞান সম্মত। এখন বিজ্ঞান বলছে, সমস্ত ঘটনার কারন আছে। কারন ভিন্ন কিছুই হয় না। আবার কারনেও কারন আছে। কিন্তু যোগীর কার্যের ভিতরে কারণের সন্ধান পাওয়া যায় না। আসলে যে কারনের  জন্য, বা যে মূল সত্তার জন্য সমস্ত ঘটনা ঘটে থাকে বা বস্তুর প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকে, তা যোগীর আয়ত্তাধীন। যে শক্তির বলে সমস্ত কার্য্য-উৎপাদন করতে পারা  যায়, তা যোগীর আত্ম-ভাবের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। যোগে পূর্ন-আত্মাতে স্বাত্মভাব প্রতিষ্ঠিত থাকে বলে, ইচ্ছামাত্রই কার্য্যের উৎপাদন হয়ে থাকে, এখানে উপাদানের অপেক্ষা থাকে না। যোগীর কাছে অপ্রাপ্ত বস্তু বলে কিছু নেই। আবার উপাদেয়ও কিছু নেই। 

দেখুন, মানুষের দেহের মধ্যে যা কিছু আছে, তার সৃষ্টি কর্তা  সে নিজেই। আমরাই আমাদের দেহের সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু কিভাবে সৃষ্টি করছি ? শূন্য থেকে কিছুই সৃষ্টি হচ্ছে না। উপাদান থেকে উৎপাদন করছি। খাদ্য, পানীয়, বাতাস, সূর্যালোক থেকে আমরা জীবাণুশক্তি সংগ্রহ করছি। এই পরিবেশ  থেকেই আমাদের শরীরে রক্ত, কোষ, স্নায়ুশক্তি তৈরী হচ্ছে। আমরা নিজেরাই এই কাজ করছি। এই কাজ অন্য কেউ এসে করে দিয়ে যাচ্ছে না। আবার আমরা সবাই আমাদের প্রবণতা অনুযায়ী জ্ঞান সংগ্রহ করছি। একটি শিশুও এই কাজটি করছে। যোগীগণ বলছেন, আমরা আমাদের যে সূক্ষ্ম দেহ আছে, তার যে অনু-পরমাণু আছে, তা বদলে ফেলে, আমরা নতুন আমি হয়ে যেতে পারি। যোগীগণ এইকাজটি জ্ঞাতসারে করছেন। আর আমাদের মতো সাধন মানুষও এই কাজ করছি, তা আমাদের জ্ঞাতসারে করি না। আমরা প্রতিদিন আমাদের শরীরে নতুন নতুন বস্তুকণা সৃষ্টি করছি। কিন্তু তা আমাদের জ্ঞাতসারে করি না বলে, আমরা এই পরিবর্তন আঁচ করতে পারি না। যদি আমরা এই কাজটি জ্ঞাতসারে করতে পারি, তবে আমরা আমাদের বিপুল ক্ষমতার কথা জানতে পারবো। আর এই পরিবর্তন তখন আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী করতে পারবো। যোগীদের ক্ষেত্রে তারা এই কাজটি জ্ঞাতসারে করেন বলে, তারা জীবনকে এমনকি শরীরকে ইচ্ছেমতো পরিচালনা করতে পারেন। যতদিন ইচ্ছে ততদিন বেঁচে থাকতে পারেন। আবার সজ্ঞানে শরীরে ছেড়ে চলে যেতে পারেন। আমরা আমাদের চারপাশ থেকে বস্তু কনা সংগ্রহ করে, যা চাই তাই তৈরী করে নিতে পারি। একটা জিনিস জানবেন, চিন্তার দ্বারা সব অবস্থার রূপান্তর ঘটানো সম্ভব। চিন্তাগুলিও বস্তু, তাদের বাস্তব সত্তা আছে। 

ঋষি পাতঞ্জল বলছেন, (বিভূতিপাদ- শ্লোক-৪৪)

"স্থুল-স্বরূপ-সূক্ষ্ম-অন্বয়-অর্থবত্ত্ব-সংযমাৎ-ভূত-জয়।" 

পৃথিবী আদির স্থুলতা, স্বরূপতা, সূক্ষ্মতা, অন্বয়িতা ও অর্থবত্ত্বা এই পাঁচরূপ বিশিষ্ট স্থূল ভূতগুলোতে সংযম থেকে যোগীর ভূত-জয় হয়ে যায়। 
স্থুল অর্থাৎ দৃশ্যমান রূপ, স্বরূপ অর্থাৎ স্বাভাবিক গুন্, সূক্ষ্ম অর্থাৎ পরমাণু ও তন্মাত্র, অন্বয় অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ, এই তিন গুনের সাথে বস্তুর অন্বয় ; অর্থবত্ত্ব অর্থাৎ ভোগ প্রদান-সামর্থ।

ঋষি আবার পারে শ্লোকে বলছেন : (বিভূতিপাদ শ্লোক - ৪৫)

"ততঃ-অনিমাদি-প্রাদুর্ভাবঃ কায়সম্পৎ তদ্-ধর্ম-অনিভিঘাতঃ চ।"

ভূতজয়ে অনিমা ইত্যাদি অষ্টসিদ্ধি উৎপন্ন হয়। কায় সম্পদ ও কায়ধর্মের বাধাশূন্যতা  সিদ্ধ হয়। 

যোগের অভ্যাস করে সিদ্ধি লাভ করলে, বিভূতি আপনা থেকেই প্রকাশিত হয়ে থাকে। আগুন জ্বলে উঠলে যেমন তাপ বিকিরণ হতে থাকে। তেমনি সাধন পথে অগ্রসর হলে, সিদ্ধি আপনা থেকেই আসে। 
এই সিদ্ধি কার না এসেছে ? ঠাকুর রামকৃষ্ণ থেকে শুরু করে, যীশুখ্রিষ্ট, গুরুনানক থেকে চৈতন্যদেব, গোরক্ষনাথ থেকে শঙ্করাচার্য্য সমস্ত মহাত্মার মধ্যেই এই অলৌকিক শক্তির স্ফূরণ দেখতে পাওয়া যায়।

একটা জিনিস জানবেন, আত্মসমর্পন না করতে পারলে, কোনো পদার্থেই স্থিতি লাভ করা যায় না। আমার, আপনার, সমস্ত জগতের যে উপাদান আছে, তা যেমন স্থুল আকারে আছে, তেমনি সূক্ষ্ম আকারে সমগ্র জগতে ছড়িয়ে আছে। আর তা যদি না থাকতো, তা হলে আমাদের কোনো স্থিতি বা অস্তিত্ত্বই  থাকতো না। আমরা এই উপাদানগুলোকে আকর্ষণের মাধ্যমে ঘনীভূত আকারে আকৃতি ধারণ করেছি। আবার এই উপাদানের একসময় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অর্থাৎ সাম্যাবস্থায় অবসান করবে।  তখন আর আমাদের দৃষ্টিগোচর থাকবে না। এই আকারের অবলুপ্তি ঘটবে। এখন এই উপাদানগুলোর উপরে একাগ্রতা বা সমগ্রতা উৎপাদনের ক্ষমতা অর্জনই সিদ্ধি। অর্থাৎ পরমার্থ বা চৈতন্যের উপরে পূর্নতা লাভ।  তাই বলা হয়ে থাকে বিক্ষিপ্ত চিত্ত আত্মসমর্পনে অধিকারী হতে পারে না।  কিন্তু চিত্ত যখন স্থির হয়, তখন আত্মসমর্পনের অধিকারী হওয়া যায়। আত্মসমর্পনের অধিকারী ব্যক্তি চৈতন্যের মধ্যে পূর্নতা লাভ করে। এই অবস্থা লাভ হলে তার কোনো কিছুরই অভাব থাকে না। তার ইচ্ছামাত্রই সমস্ত বস্তুর আবির্ভাব হয়। আর কে না জানে ঈশ্বরের ইচ্ছেতেই সমগ্র জগতের সৃষ্টি। আর সেই ঈশ্বরের এক ক্ষুদ্র সংস্করণ হচ্ছে এই মানবজাতি, মানব শরীর । আবার  মানব জাতির মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ হচ্ছেন আপনি। তাই বিশ্ব -ইচ্ছেশক্তির অংশ রয়েছে আমাদের সবার মধ্যে। তবে একটা কথা বলি, ইচ্ছে আর ইচ্ছেশক্তি এক নয়। ইচ্ছের সঙ্গে যখন ঈশ্বরের শক্তির সংযোগ ঘটে তখন  তা ইচ্ছেশক্তি।  নতুবা ইচ্ছে কেবল ইচ্ছেই থাকে।
..........................
১০.১১.২০২১

এখন কথা হচ্ছে, এই বিভূতির দ্বারা যে সব বস্তুর লাভ হয়, তা কি বাস্তবে সত্য, না আমাদের ভ্রম ?  আসলে জগতে সব বস্তুই  অনিত্য। সতত পরিবর্তনশীল বস্তুকে আমরা বাস্তবে নিত্য বস্তু বলে মনে করি। আর  আমাদের চোখে যা জড়বস্তু জ্ঞানীর চোখে তা চৈতন্যস্বরূপ। শক্তি যখন খণ্ডিত তখন জড়-অনিত্য।  আবার এই শক্তি যখন অখন্ড তখন তা নিত্য। 

বিশ্বের সমস্ত বস্তু, দেহ বা শরীর, এই তন্মাত্রের সমষ্টি। আর এই বস্তুর মধ্যে ভেদের কারন হচ্ছে তন্মাত্রের বিন্যাসের তারতম্য। তন্মাত্র অর্থাৎ সূক্ষ্মতম কনা বা পরমাণু। 
তন্মাত্র কথাটার অর্থ হচ্ছে, কেবলমাত্র সেই। সাঙ্খ্য দর্শনে বলাহচ্ছে সূক্ষ্ম অমিশ্র পঞ্চভূত। অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম - এই পাঁচ ভূতের স্বাধীন স্থিতি স্থান হচ্ছে তন্মাত্র ।   
ব্যাসভাষ্যে বলা হয়েছে, 
"তন্মাত্রং ভূত কারনং, তস্যৈকোঽবয়বঃ পরমাণুঃ সামান্য বিশেষ আত্মাঽযুত
সিদ্ধ-অন্বয়ব-ভেদ অনুগতঃ সমুদয় ইতি, এবং সর্ব-তন্মাত্রাণি। "

তন্মাত্রা হচ্ছে পঞ্চভূতের কারন, এই তন্মাত্রা অবিভাজ্য বা একাবয়ব, এর সময়দয় অতি সামান্য, বিশেষ অর্থাৎ একমাত্র বস্তু যা নানা স্থানে স্থিত আবার শূন্য বলে বিবেচিত হয়। এবং অযুতসিদ্ধভেদের অনুগত। অযুত সিদ্ধ অর্থাৎ যা যুত সিদ্ধ নয়।   যুত কথাটির অর্থ হচ্ছে, যাকে  বিভাজন করা যায়। ভাগ করা যায়। তো অযুতসিদ্ধ অর্থাৎ যাকে বিভাজন বা বিলি-বন্দোবস্ত করা যায় না। সব তন্মাত্রাই এইরকম। 
    
তন্মাত্রং ভূত কারনং, - তন্মাত্রই  পঞ্চভূতের কারন। 
তস্যৈকোঽবয়বঃ - তা অবিভাজ্য অর্থাৎ একাবয়ব। 
পরমাণুঃ - এর সমুদয় হচ্ছে পরমাণু 
সামান্য বিশেষ আত্মাঽযুতসিদ্ধ- - অর্থাৎ অতি সামান্য।  আত্মাঽযুতসিদ্ধ- অর্থাৎ সেই মূল বস্তু যা অযুত অর্থাৎ বিভাজনের অযোগ্য।  
অন্বয়ব-ভেদ অনুগতঃ - অর্থাৎ অভেদ সত্তার অনুগত। 
সমুদয় ইতি, এবং সর্ব-তন্মাত্রাণি। - এই সমস্তই তন্মাত্রা। 

আমার যদি আরো একটু গভীরে প্রবেশ করি তাহলে দেখতে পারবো, সমস্ত বস্তুর অবিভাজ্য কনা বা পরমাণু নয়, এটি  একটি তড়িৎ প্রবাহ। আমাদের এই স্থূল শরীরও এই তড়িৎশক্তির বা ইলেক্ট্রনের সমষ্টি। আমাদের যে চিন্তাশক্তি তাও আসলে একটা বিদ্যুৎ প্রবাহ। আর এই বিদ্যুৎ প্রবাহের দ্বারা বা চিন্তাশক্তির আমরা আমাদের শরীরের বিভিন্ন তন্ত্রে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারি।  চিন্তাকে একাগ্র করে, যদি  দেহের সমস্ত অনু-পরমাণুকে বিদ্যুৎ-বাহিত করতে পারি, তবে সেই বিদ্যুৎ প্রবাহ দ্বারা আমরা আমাদের বাঞ্চিত বা অবাঞ্চিত পরিবর্তনক্রিয়া উৎপন্ন করা সম্ভব। 

যোগক্রিয়া হচ্ছে এই বিন্যাসের কর্তা বা কারন উৎপাদক-শক্তি। আমরা এই চিন্তা বা বিন্যাসকর্তার দ্বারা আমাদের দেহের বিন্যাস করে নিতে পারি। এখানে আমি বা আমরা হচ্ছে আত্মশক্তি বা আত্মা। আমরা জানি আমাদের শরীরের প্রভু হচ্ছে মন, আর মনের প্রভু হচ্ছে আত্মা। আমরা আমাদের বিভিন্ন কোষ ও  স্নায়ুর নির্মাণকর্তা।  আমরা আমাদের রক্তে, মস্তিষ্কে কোষ তৈরী করছি। এমনকি স্নায়ুর সৃষ্টিকর্তা আমি নিজেই। কিন্তু এগুলো আমাদের নজরে আসে না। আমরা যে কে, তা আমরা বিস্মৃত হয়েছি। আমাদের স্বরূপকে আমরা ভুলে গেছি। আমরা ভাবি, আমার এই স্থুল দেহের নির্মাতা আমাদের মাতা-পিতা। কিন্তু আমরা যখন মাতৃদেহ থেকে নির্গত হয়েছি, তখন কে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে ? আমরা ভাবি, হয়তো ঈশ্বর বা প্রকৃতি বা অন্যকোনো অদৃশ্য শক্তি একে  নিয়ন্ত্রণ করছে। আসলে এইসবই নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের মধ্যে যে চিৎশক্তি আছে, বা যে পুরুষশক্তি আছেন, তিনিই এর নিয়ন্ত্রক। তিনিই আমাদের শরীরের সমস্ত কিছু, তা সে স্নায়ুর ক্রিয়া বলুন, তন্ত্রের ক্রিয়া বলুন, বা কলার ক্রিয়া বলুন, সবই পরিচালনা করছেন, এই পুরুষ যিনি আমাদের মধ্যে সদা বিরাজমান। তিনিই সবকিছুর সঙ্গে  সবকিছুর সমন্বয় সাধন করছেন।  

জগতে দুই বলে কিছু নেই। জগৎ এক। শক্তিও দুই নয়, অশুভ বা শুভ বলে আলাদা শক্তি নেই। একই শক্তি  সূক্ষ্মতম অবস্থা থেকে স্থুলতম প্রকাশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর স্থলতম প্রকাশের ফলে দৃশ্যমান এই দেহ বা বস্তু প্রতীয়মান হচ্ছে। সূক্ষ্মতম স্পন্দনের প্রকাশ হচ্ছে মন-বুদ্ধি।  নিজেকে জানলে, জগতের আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই। কিন্তু কথা হচ্ছে কি করেই বা জানবো ? এই জানার পদ্ধতিই হচ্ছে যোগক্রিয়া। ........................... এই যোগক্রিয়ার ফলেই  স্বাভাবিক ভাবেই  আসে বিভূতি, যা আমাদের আলোচ্য বিষয় । কিন্তু সাধকযোগী কখন এই ঐশ্বর্যের অধিকারী হন, সেই আলোচনায় আমরা ধীরে ধীরে আসবো। ...............  
---------
১০.১১.২০২১

আমরা বাইরের অনেককিছু দেখছি। এমনকি গুরুদেব কি করে, শূন্য থেকে বাঞ্চিত বস্তু এনে দিচ্ছেন, তাও অবাক হয়ে দেখছি।

গুরুদেব বলছেন, হাত মুঠো করো, এবার নিজের ইচ্ছে মতো কোনো জিনিষ চাও। দেখো হাতের মধ্যে সেই জিনিস এসেছে কি না। মুঠো খুলে দেখা গেলো, কিছুই আসেনি। গুরুদেব বললেন, আবার মুঠো বন্ধ করো। চোখ বুজে থাকো।  এবার হাতের মুঠো খুলে দেখো, তোমার চাওয়া বস্তু তোমার হাতের মধ্যে এসে গেছে।  অবাক কান্ড আমি যখন চেয়েছিলেন, তখন কিছুই আসেনি।  কিন্তু গুরুদেব যখন চাইলেন, তখন সেই বস্তু আমার হাতের মুঠোয়। এই বিদ্যা আমরা আয়ত্ত্বে আনতে  চাই। গুরুদেব যদি পারে, তবে আমরা কেন পারবো  না ? গুরুদেব বলছেন, আমরাই স্রষ্টা, আমরাই এই সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক। আর যখন আমরা আমাদের ইচ্ছেমতো সৃষ্টি করতে পারবো, তখন এমনকি আমরা আমাদের জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ, নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। 

কিন্তু যে নিজের সৃষ্টির রহস্যঃ অবগত নয়, সে অন্যকে সৃষ্টি করবে কি করে ? যে নিজেকে চেনে না, যে নিজের ভবিষ্যৎ জানে না, যে নিজের অতীত জানে না, সে তার বর্তমানকেও জানে না। তো আগে নিজেকে জানতে হবে, নিজেকে পরিবর্তন করতে শিখতে হবে, নিজের ভবিষ্যৎ গড়তে  জানতে হবে, তবেই বহিঃবিশ্বও তার নিয়ন্ত্রণে আসবে। 

আমাদের অবচেতন মন বা অন্তর্জ্ঞান, চেতন মনের বা সজ্ঞান মনের চাইতে অধিক শক্তিশালী। যদিও অবচেতন মনের এই অভিজ্ঞতা একসময় চেতন মনেই  ছিলো। আজ তা কালের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এই কালের নিয়ন্ত্রণে থাকা অন্তর্জ্ঞানকে আমাদের চেতন মনের স্তরে  নিয়ে আসতে  হবে। আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আস্তে হবে।  আর এর জন্য আমাদের অন্তরমনের গভীরে প্রবেশ করতে হবে।  সেখান থেকে সত্যকে তুলে আনতে  হবে। আর এই কাজে সমস্ত বাধাবিঘ্ন আমাদেরকে জয় করতে হবে। আমরাই স্রষ্টা। আমাদের এই সৃষ্টি আজ অন্যের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আমরা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়েছি। এখন এই সৃষ্টিকে অর্থাৎ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।  তবেই আমরা পারবো নিজেদের ইচ্ছেমতো সবকিছু তৈরী করতে। তখন আমাদের না থাকবে জন্ম না থাকবে মৃত্যু বলে কোনো বিভীষিকা। আমরা এই অবস্থাই লাভ করতে চাই। আর এইজন্য চাই, ধারণা, ধ্যান, সমাধি এবং সব শেষে কৈবল্য লাভের পথে নিজেকে নিয়োজিত করা। 

আর এইপথে এগুতে গেলে, আগে জানত হবে, এই পথের ক্লেশ বা বাধা কি আছে। আমাদের উচিত প্রকৃতির নিয়ম বুঝে নিয়ে পথ চলা শুরু করা।  আমাদের জানতে হবে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর জ্ঞান।  যা আসলে কারন অবস্থায় আছে, তার সন্মন্ধে জ্ঞান অর্জন করা। এইভাবেই আমরা আমাদের লক্ষবস্তু লাভ করতে পারি। 

মহাত্মাগণ বলে থাকেন, ঈশ্বর যেমন পূর্ণ আমরাও তেমনি পূর্ন। সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যেমন স্রষ্টা , সর্বোচ্চ,  আমরাও যখন পূর্নতা লাভ করবো তখন তেমনই হয়ে যাবো। তখন আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে অভিন্নতা প্রাপ্ত হবো। আসলে আমরা সবাই ঈশ্বর।  কিন্তু আমরা আমাদের সেই স্বরূপকে বিস্মৃত হয়ে অধঃপতিত হয়ে নিজেকে দুর্বল ভাবছি, হীনমন্যতায় ভুগছি। দেখো, এখনো আমরা কেউ ঈশ্বরের থেকে ভিন্ন নয়। কেবল আমরা দূরে সরে এসেছি, পরমপিতা থেকে দূরে সরে এসেছি। আর সেই দূরত্ত্ব যে কতটা তা আমরা কেউ জানি না। কারন, মানুষ যখন হারিয়ে যায়, মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যখন সে পথের হদিস পায়  না, তখন  সে এটাও বুঝতে পারে না, যে  মা-বাবা থেকে সে কতদূর চলে এসেছে। ঈশ্বর বৃহৎ আমরা ক্ষুদ্র। তবু আমাদের মধ্যেই আছে সেই ঈশ্বরের স্ফুলিঙ্গ, যা ক্ষুদ্র হলেও মূলত এক।  কেবল মাত্রাগত পার্থক্য, প্রকারগত নয়। 

দেখুন কাঠ পেলে একজন কাঠমিস্ত্রি টেবিল তৈরী করতে পারে, মাটি পেলে একজন কুমোর হাড়ি-কলসি তৈরী করতে পারে, সোনা পেলে একজন স্বর্ণকার অলংকার তৈরী করতে পারে, পাথর পেলে একজন শিল্পী শিব গড়তে  পারে। এইযে টেবিল, হাড়ি, অলংকার, শিবমূর্তি - এগুলো সবই একসময় নির্মাতার কল্পনার মধ্যে ছিলো। মূল-উপাদান ও শিল্পীর কুশলতা সহযোগে ক্রিয়া, একে বাস্তব রূপ দিয়েছে। ঠিক তেমনি যোগীপুরুষগন পরমাণুর সাহায্যে সমস্ত বস্তুর সৃষ্টি করতে পারেন, যা তিনি কল্পনা বা স্বপ্ন দেখতে পারেন। আমাদের তাই স্বপ্ন দেখতে হবে, একটা সুন্দর জীবনের জন্য।  আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে, যোগীপুরুষ হবার জন্য।  আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে সুখ-দুঃখের অতীতে যাবার জন্য। আর এই স্বপ্ন যখন যোগের সাহায্যে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠবে তখন আমাদের স্বপ্নের বস্তু আমাদের সামনে এসে যাবে। 

ঈশ্বর বৃহৎ আমরা ক্ষুদ্রতম। তবু আমাদের মধ্যেই আছে সেই চৈতন্যশক্তি, যা ঈশ্বরের মধ্যেও আছে। যদি বিশ্বকর্তা, বিশ্বস্রষ্টা সমস্ত উপাদান সংগ্রহ করে, এই চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী, গ্রহ, নক্ষত্র, উদ্ভিদকুল ও জীবকুল সৃষ্টি করতে পারেন, তবে আমরাও পরিবেশ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে, যেকোনো পদার্থে রূপান্তর করতে পারি। ............ 

১১.১১.২০২১

শ্রীমৎ ভগবতগীতার দশম অধ্যায়ের নাম হচ্ছে বিভূতিযোগঃ। আপনারা যাঁরা গীতার এই অধ্যায় পড়েছেন, তারা জানেন, যোগেশ্বর  শ্রীকৃষ্ণ এখানে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন। অর্থাৎ তিনি যে স্বয়ং ঈশ্বর, সেই পরিচয় দিচ্ছেন। বলছেন, আমার জন্ম বৃত্তান্ত কেউ জানে না। যদি কেউ জানেন, তবে তিনি মোহশূন্য হন। প্রাণীদের যে ভিন্ন ভিন্ন ভাব তার সবই আমা  হতে উৎপন্ন। আমি ছাড়া কোনো স্রষ্টা  নেই। আমি ছাড়া কোনো নিয়ন্ত্রকও নেই। এঁরা সবাই আমারই মানসজাত। যিনি আমার এই বিভূতি ও যোগৈশ্বর্য্য সম্পর্কে জানেন, তিনি আমাতে নিবিষ্ট চিত্ত হন। এদের আমি বুদ্ধিযোগ দান  করি, অন্তরে উজ্জ্বল জ্ঞান প্রদীপ দ্বারা এদের অজ্ঞান অন্ধকার দূর করি। 

অর্জুন বলছেন, হে পুরুষোত্তম, তুমি স্বয়ং আপন জ্ঞানে আপন স্বরূপ জানো। আমরা তোমাকে কিভাবে কোন পদার্থে চিন্তা করবো ?   

ভগবান বলছেন, সর্বভূতের হৃদয়স্থিত আত্মা আমি, (১০/২৫) আমিই সর্ব্ব ভূতের উৎপত্তি, স্থিতি ও সংহার স্বরূপ। আমিই চন্দ্র, আমিই সূর্য, আমিই মরুৎ - ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কথা বলেছেন।  যাতে করে আমাদের মনে হয়, তিনি সর্বোৎকৃষ্ট, তিনি বিরাট, তিনিই মহান, তিনি অনন্ত  ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষে এক জায়গায় এসে বলছেন আমিই প্রহ্লাদ (১০/৩০), আমিই অর্জুন, ব্যাসদেব, শুক্রাচার্য্য আবার আমিই বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ  (১০/৩৭)  

এখানে একদিকে বলছেন, আমিই শ্রীকৃষ্ণ আবার আমিই অর্জুন, অন্যদিকে বলছেন, আমি সর্বভূতের হৃদয়স্থিত আত্মা। আর আমরা সবাই জানি, আমাদের সবার ভিতরেই আছেন সেই পরমপুরুষ যার নাম আত্মা। 
আমরা যখন অষ্টাবক্র গীতা পড়ছিলাম, তখন দেখেছি, ঋষি অষ্টাবক্র তার শিষ্য রাজা জনককে বলছেন, হে শিষ্য ! তুমি পৃথিবী নয়, জল নয়, অগ্নি নয়, বায়ু নয়, আকাশ নয়, তুমি সকলের সাক্ষী সরূপ  আত্মা। অর্থাৎ দেহাত্মবোধে অধিষ্টিত আমরা নিজেকে দেহ বলেই ভেবে থাকি। বড়োজোর দেহের যে উপাদান অর্থাৎ পঞ্চভূত - এই অবধি আমাদের চিন্তা প্রসারিত হতে পারে। এই পঞ্চভূতের অতীত যে আত্মা আমাদের স্বরূপ, তা আমাদের সাধারনের চিন্তার মধ্যে আনতে পারি না। 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, আমিই সৃষ্টিকর্তা, আমিই নিয়ন্ত্রক। আমি সর্বভূতের যা বীজ স্বরূপ তাই আমি। অর্থাৎ আমা-ব্যাতিত উৎপন্ন হতে পারে, বিশ্বচরাচরে এমন কিছুই নেই। (১০/৩৯)

এখন কথা হচ্ছে আমি আত্মা এই  কথা আমাদের কাছে কথার কথা। এটা আমাদের উপল্বদ্ধিতে আসে না। কিন্তু কিভাবেই বা আমরা এই উপলব্ধি আমাদের অনুভূতির স্তরে নিয়ে আসতে  পারবো ? এর জন্য একটা প্রক্রিয়া আছে, যেটি প্রথমে শুনুন তারপরে অনুশীলন করুন।  তবে দেখবেই অচিরেই আপনার মধ্যে এই অনুভূতি জাগ্রত হবে। সঙ্গে লিংক দিলাম। https://www.youtube.com/watch?v=IjPU_yN4Iq8  
https://www.youtube.com/watch?v=NrlBPC0XDjs

-----------------------------

যোগৈশ্বর্য্য সম্পর্কে আলোচনা শুনতে শুনতে আমাদের মধ্যে  কিছু লোকের ধারণা  হয়েছে, যেন শশাঙ্ক শেখর কোনো মন্ত্র জানেন, যা দিয়ে পরশ পাথরের কাজ হতে পারে। লোহাকে সোনা বানানো যেতে পারে। 
       

    
   
   














হংস বা সোঽহং - স-কার হচ্ছে প্রাণের সঞ্চার  আর হ কার হচ্ছে অপান সঞ্চার।

মুক্তানন্দজী একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার জপের মন্ত্র কী ? আমি তো জপ করি না। জপের মন্ত্র গুরু-প্রদত্ব হয়ে থাকে বলে শুনেছি। তবে মাঝে মধ্যে আমি ওং নমঃ শিবায়ঃ, বা ওং শ্রী ভগবতে বাসুদেবায় নমঃ,  বলে