যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (৭)
শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ১১-১৪
অয়নেষু চ সর্ব্বেষু যথাভাগম অবস্থিতাঃ
ভীষ্মমেবাভিরক্ষন্তু ভবন্তঃ সর্ব্ব এব হি। (১.১১)
এখন আপনারা সকলে ব্যুহ প্রবেশপথে নিজ নিজ বিভাগ অনুসারে অবস্থিত হয়ে আপনারা সকলে ভীষ্মকেই রক্ষা করতে থাকুন।
আমরা জানি ভীষ্ম হচ্ছেন আমাদের ভ্রমাত্মক জ্ঞান। এই ভ্রমাত্মক জ্ঞান যতক্ষণ বজায় থাকে ততক্ষন আমাদের কর্ম্মের মধ্যেও সেই ভ্রমের প্রতিফলন হবে। তাই দুর্ম্মতির প্রথম কাজ ও কর্তব্য হচ্ছে এই ভ্রমরূপ ভীষ্মকে রক্ষা করা। তাই দুর্ম্মতিরূপ দুর্যোধন সমস্ত নিজপক্ষীয়দের নির্দেশ দিচ্ছেন, এই ভ্রমকে রক্ষা করতে। জ্ঞানের উন্মেষ হলে আমাদের ভয় দূরীভূত হয়ে যায়। তাই ভয়কে বজায় রাখতে গেলে ভ্রমজ্ঞানকে রক্ষা করা আবশ্যক। অস্মিতার কাজ হচ্ছে ভয় পাওয়া। চিদাভাসকে ঘিরে ভয় কাজ করে থাকে। আমরা সবাই ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখি। কখনো সমাজের ভয়, কখনো সুখ-স্বাছন্দের অভাবের ভয়, কখনো শরীর নাশের ভয়। এই ভয়কে দূর করতে না পারলে, সাধনপথে এগিয়ে যেতে পারবো না। আর এই ভ্রম থেকে উৎপন্ন ভয়কে যখন আমরা দূর করতে পারবো, তখন আমাদের মধ্যে সাধনের উৎসাহ আসবে এবং আমরা সাধনার রস আস্বাদন করতে পারবো। তো যোগীর প্রথম কাজ হচ্ছে যোগ সম্পর্কে যে ভ্রমাত্মক জ্ঞান আছে, তাকে সত্যজ্ঞানের সাহায্যে উৎপাটন করা। কিন্তু আমাদের অস্মিতা এই ভ্রমজ্ঞানকে সহজে ছাড়তে চায় না। বরং এই ভ্রমকে বজায় রেখে অশাস্ত্রীয় যুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে ইন্দ্রিয়সুখে জীবন অতিবাহিত করতে চায়। আমাদের সংস্কার রূপ দ্রোণ এই কাজে সাহায্য করে থাকে। আমাদের ভ্রমাত্মক জ্ঞান আমাদেরকে ভ্রমের মধ্যে নিমজ্জিত করে রাখে। আর আমরা অর্থাৎ আমাদের দুর্ম্মতি সংস্কারের আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে ।
তস্য সংজনয়ন হর্ষং কুরুবৃদ্ধ পিতামহঃ
সিংহনাদং বিনদ্য় উচ্চৈঃ শঙ্খং দধ্নৌ প্রতাপবান। (১.১২)
মহা প্রতাপশালী কুরুবৃদ্ধ পিতামহ তাঁর হর্ষ উৎপাদন করে উচ্চ সিংহনাদ পূর্বক শঙ্খধ্বনি করলেন।
ভ্রমরূপ ভীষ্ম দুর্ম্মতির হর্ষ উৎপাদন করে, উচ্চস্বরে শঙ্খধ্বনি করলেন। আমরা জানি, ধ্বনি যেমন আমাদের আনন্দের কারন হতে পারে, আবার এই ধ্বনি আমাদের ভয়ের উদ্রেগ করতে পারে। ধ্বনির মধ্যে সমস্ত কিছুর সৃষ্টি লুকিয়ে আছে, আবার এই ধ্বনির মধ্যেই লুকিয়ে আছে ধংসাত্মক শক্তি। এই ধংসাত্মক শক্তি আমাদের মধ্যে ভয়ের উদ্রেগ করে থাকে। আর ভয় যদি পিছনে লাগে, তবে সাধকের পক্ষে সাধনা করা সম্ভব নয়। দুর্ম্মতিকে সাহস দেবার জন্য, ভীষ্ম শংখধ্বনি করলেন। অর্থাৎ ভ্রম-জাত ভয় যেন বিজয় ঘোষণা করলেন, "আমি একাই সমস্ত শুভশক্তিকে দুর্বলচেতা করে সাধন-বিমুখ করে দেবো"।
ততঃ শঙ্খাশ্চ ভের্য্যশ্চ পণবানকগোমুখাঃ
সহসা এব অভ্যহন্যাস্ত স শব্দ তুমুলঃ অভবৎ। (১৩)
ততঃ শ্বেতৈ হয়ৈঃ যুক্তে মহতি স্যনন্দে স্থিতৌ
মাধবঃ পাণ্ডবশ্চৈব দিব্যৌ শঙ্খৌ প্রদধ্নতুঃ। (১৪)
তারপর শঙ্খ ও ভেরী সহযোগে পণব (মাদল), আনক (ডঙ্কা), গোমুখ (শিঙ্গা), প্রভৃতি রণবাদ্য বেজে তুমুল ধ্বনির সৃষ্টি হলো। (১৩)
এরপর, পান্ডব সৈন্য গনের মধ্যে যুদ্ধের উৎসব শুরু হয়ে গেলো। শ্বেত অশ্বযুক্ত বিশাল রথে সানন্দে মাধব ও অর্জুন দিব্য শঙ্খধ্বনি করলেন। (১৪)
ভ্রম ও তৎজনিত ভয় প্রবৃত্তি পক্ষের সেনাপতি। অকারনে আমাদের ভূতের ভয়, জুজুর ভয় আবহমান কাল থেকেই চলে আসছে। সেই ভয় (ভীষ্ম) যখন তুমুল উৎসাহ দেখালেন, যখন প্রকাশ্যে এলেন, তখন সবাই ভাবলো, আর ভয় কি ? ভীষ্ম সহজে কারুর আয়ত্ত্বে আসবে না। অতয়েব সুমতিকে আর ভয় কিসের। অর্থাৎ আমাদের যখন ভয়ের আভাস দেখা যায়, তখন আমাদের শ্বাসক্রিয়ার মধ্যে চঞ্চলতা দেখা যায়। শরীরে একটা কম্পনের প্রভাব দেখা গেলো। ফলত শরীর মধ্যে একটা ভীষণ উথালপাতাল হতে লাগলো।
এখানে আমরা মাধব বলে একটা নতুন চরিত্র পেলাম। কে এই মাধব ? মা অর্থাৎ লক্ষ্মী ধব অর্থাৎ স্বামী। তো মাধব কথাটার অর্থ হচ্ছে মাতা শ্রীলক্ষ্মীর প্রতি। অর্থাৎ বিষ্ণু। যাঁকে হিন্দুমতে জগতের পালন কর্তা বলা হয়।এর পরে পান্ডব সৈন্যদের মধ্যেও যুদ্ধের আলোড়ন শুরু হলো। এইসময় সাদা ঘোড়ার রথে চেপে এলেন মাধব যাঁকে আমরা শ্রীকৃষ্ণ বলে জানবো, আর সঙ্গে এলেন শ্রীকৃষ্ণ-সখা পাণ্ডুপুত্র অর্জুন। তখন শরীরের মধ্যে দিব্য শংখধ্বনি বাজতে লাগলো। দুর্ম্মতির পক্ষের প্রবৃত্তি রন-ডঙ্কা যা যেন চিৎকার-চেঁচামেচি, গলাবাজি মাত্র। কিন্তু নিবৃত্তি পক্ষের যে শঙ্খধ্বনি তা যেন মধুর পল্লবিত ধ্বনি। এই শঙ্খধ্বনি যখন আমাদের হৃদয়ে বাজে, তখন আমাদের চিত্তবেগ শান্ত হয়ে আসে। প্রাণবায়ু যোগপ্রভাবে যখন গতিহীন হয়ে যায়, বেগরহিত হয়ে যায়, তখন সাধক এই শান্তির ধ্বনি শুনতে পায়। শ্বেতাশ্ব যুক্ত রথ অর্থাৎ শ্বেত বর্ণের অগ্নির্জ্যোতিঃ। এই দেহরূপ রথে যিনি রথী এ জ্যোতি তাঁরই। এই জ্যোতির মধ্যে দেখা যায়, কৃষ্ণবর্ণের মণ্ডলাকার মাধব। মা অর্থে লক্ষী বা প্রকৃতি। এই জ্যোতি স্থুল প্রকৃতির জ্যোতি। এই জ্যোতির বক্ষস্থলে কৃষ্ণবর্ণের মাধব। অর্থাৎ যিনি এই জ্যোতিস্বরূপের স্বামী। এই জ্যোতির্ময় মন্ডল দর্শন আমাদের মনে আনন্দের সঞ্চার করে, প্রাণ-মন তখন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। মনে এই শান্ত অবস্থায় যে ধ্বনির সঞ্চার হয়, তা আমরা পরবতীতে শুনবো।
---------------------------
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (৮)
শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ১৫
পাঞ্চজন্যং হৃষীকেশো দেবদত্তং ধনঞ্জয়ঃ
পৌণ্ড্রং দধ্নৌ মহাশঙ্খং ভীমকর্ম্মা বৃকোদরঃ। (১/১৫)
শ্রীকৃষ্ণ পাঞ্চজন্য, ধনঞ্জয় দেবদত্ত, ভীমকর্ম্মা বৃকোদর (ভীমসেন) পৌন্ড্র নামক মহাশঙ্খ বাজালেন। (১/১৫)
আগে শুনেছিলাম, মাধব, এবার শুনলাম হৃষীকেশ। হৃষীকেশ কথাটির অর্থ কুঞ্চিত কেশ।
আবার হৃষীক+ইশ। হৃষীক কথাটার অর্থ হচ্ছে ইন্দ্রিয়ের, ঈশ কথাটার অর্থ ঈশ্বর। অর্থাৎ পরমাত্মা। আবার হৃষীকে অর্থে ইন্দ্রিয়, আর ঈশ অর্থে নিয়োগকর্তা, অর্থাৎ যিনি ইন্দিয়গুলোকে কার্য্যে নিয়োগ করেন। আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়কে যিনি স্ব-স্ব কার্য্যে নিযুক্ত করেন তিনিই হৃষীকেশ। এই হৃষীকেশ আমাদের কূটস্থ চৈতন্য স্বরূপ। এই চৈতন্য-এর অবস্থান আমাদের আজ্ঞাচক্রে। এখন কথা হচ্ছে, এই হৃষীকেশকে কেন কূটস্থ বলা হচ্ছে। কুট কথার অর্থ সাধারণ ভাবে আমরা জানি যারা বাইরে একরকম আর ভিতরে আর-এক রকম। বাইরে গুণী বা সরল মনে হলেও ভিতরে কিন্তু দোষ বা গরলে পরিপূর্ন। আবার জগতের যিনি কারন তাকেও কুট বলা হয়ে থাকে। দেখুন, এই যে মায়া রূপ জগৎ যা আমাদেরকে মোহিত করছে, যা মিথ্যা হলেও সত্যবৎ প্রতীয়মান হয়, একেই বলা হয়ে থাকে কুট। আর এই মায়ার যিনি সাক্ষী, তিনি কুটে স্থিত বা কূটস্থ। যিনি অবিদ্যাবশত অনর্থের সংসারের বীজ বহন করে থাকেন, তিনি মায়া। যিনি এই মায়ার অধিষ্ঠাত্রী তাঁকে বলা হয় কূটস্থ। ত্রিগুণের (সত্ত্ব রজঃ তম) সমাহার এই অবাস্তব বহির্জগৎ। কিন্তু যার গুনে এই অবাস্তবকে বাস্তব বলে মনে হয়, তিনিই কূটস্থ। ইনি নির্বিকার, অর্থাৎ বিকারগ্রস্থ নয়। ইনিই আমাদের সকলের হৃদয়ে বিরাজ করছেন। এঁকে তাই বলা হয় হৃদয়েশ্বর। তিনি আছেন তাই ইন্দ্রিয়সকল বিষয় গ্রহণে সমর্থ। এই যে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ আমাদেরকে আনন্দ প্রদান করছে, আমাদেরকে মুগ্ধ করছে তা আসলে এই ব্রহ্ম বা আত্মা থেকেই উৎসারিত হচ্ছে। আর এই আনন্দের আকর্ষণেই জীবকুল অবিশ্রান্ত ছুটে চলেছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই সে জড়িয়ে ধরে আনন্দের সন্ধান করছে। তো যিনি আমাদের আকর্ষণ করছেন অর্থাৎ আনন্দের উৎস তিনি হচ্ছে কৃষ্ণ অর্থাৎ আকর্ষক। তিনি আমাদের ইন্দ্রিয়ের অধীশ্বর, তিনিই আমাদের বুদ্ধিতে স্থিত, তিনিই আমাদের হৃদয়ে স্থিত। ইনিই দিব্যজ্যোতিঃ স্বরূপ। এখন কথা হচ্ছে, তিনি যদি নিত্য, তিনি যদি সত্য, তিনি যদি সবত্র, তবে আমরা তাকে উপল্বদ্ধিতে আন্তে পারি না কেন। তিনি কেন আমাদের ইন্দ্রিয়গোচারীয়ভূত হন না ? এর জন্য দরকার আমাদের দিব্যদৃষ্টি। আর এই দিব্যদৃষ্টি আমাদের তখনই উন্মোচন হতে পারে, যখন আমাদের চিত্ত জ্যোতিমধ্যে সমাধিস্থ হয়। তখন তার প্রকাশ আমাদের হৃদয় ঊদ্ভাসিত করে দেয়। আমাদের জীবন কৃতার্থ হয়ে যায়। যাইহোক, এসব অমৃতকথা আমরা ধীরে ধীরে শুনবো। চিত্তকে সমাহিত করুন এইসব ব্রহ্মকথায়।
ইনি পাঞ্চজন্য শঙ্খের ধ্বনি উৎপন্ন করেন। পাঞ্চজন্য অর্থাৎ পাঁচ প্রাণ অর্থাৎ প্রাণ, অপান, ব্যান, সমান, উদ্যান এই পঞ্চবায়ুর মিলনে এই শব্দ বা ধ্বনি উৎপন্ন হয়ে থাকে। পঞ্চবায়ু যখন রুদ্ধ বা গতিহীন হয়ে একত্রে অর্থাৎ প্রাণবায়ুতে মিলিত হয়, তখন অভূতপূর্ব এই ধ্বনি ধ্বনিত হতে থাকে। "পাঞ্চজন্যং হৃষীকেশো" ।
ধনঞ্জয় কথাটার অর্থ যিনি ধনকে জয় করেছেন। আমাদের মতো সাধারনের কাছে ধনকে জয় করা মানে ধনকুবের হওয়া। আধ্যাত্মিক জগতে ধনকে জয় করা মানে যোগবিভূতি বা যোগৈশ্বর্য্যকে জয় করা। এই ধনে যিনি ধনী তিনি জন্মমৃত্যু, সুখদুঃখ, ক্ষুধা-তৃষ্ণা প্রভৃতিকে যিনি জয় করতে পেরেছেন। যিনি জাগতিক সমস্ত ধনকে অগ্রাহ্য করতে পেরেছেন তিনিই ধনঞ্জয়। এই তেজঃশক্তি না থাকলে সাধনক্রিয়ায় সাফল্য আসে না। এই তেজঃশক্তি আমাদের মনিপুর চক্রে অবস্থান করে। ইনিই উপনিষদের বৈশ্বানর, জীবকুলের জীবনীশক্তি। বলা হয়ে থাকে অগ্নি বা তেজঃশক্তি হচ্ছে দেবতাদের মুখ। যার সাহায্যে দেবতাগণ যজ্ঞের আহুতি গ্রহন করে থাকেন। এই মনিপুর বা নাভিচক্র থেকেই নাদধ্বনি উঠে আসে। একেই বলে দেবদত্ত শংখ। বীনার সুর ধ্বনিত হয় এই দেবদত্ত সঙ্খে। "দেবদত্তং ধনঞ্জয়ঃ"
বৃকোদর কথাটা অর্থ হচ্ছে "অগ্নি" . আমাদের পেটের মধ্যে বা উদরে যে অগ্নি প্রতিনিয়ত প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে, যা আমাদের খাদ্যকে হজম করছে, তাকে বলা হয় বৃকোদর। আমরা জানি বায়ু থেকেই অগ্নির উৎপত্তি। আবার বায়ুর মধ্যেই অগ্নি লয় প্রাপ্ত হয়ে থাকে। এই বায়ুতত্ত্বকেই বলা হয় বৃকোদর। অনাহত চক্র হচ্ছে বায়ুর প্রাথমিক মিলন স্থান। এই হৃদয়কেন্দ্র বা অনাহত চক্র থেকেই দীর্ঘ ঘন্টাধ্বনির মতো একটা শঙ্খধ্বনি সাধক শুনতে পান।
ভীমের শঙ্খ ধ্বনি হচ্ছে পৌন্ড্র। পুন্ড অর্থাৎ পীড়ন করা। এই পুন্ড শব্দ থেকেই এসেছে পৌন্ড্র। সাধক যখন প্রাণায়ামের সাহায্যে প্রাণবায়ুকে পীড়ন শুরু করেন, তখন যে মহানাদ সাধকের শ্রুতিগোচর হয়, তাকে বলে পৌণ্ড্র ধ্বনি । বলা হয়ে থাকে এই পীড়নক্রিয়ার জন্য বল প্রয়োগ করতে হয়। এই বল প্রয়োগ না করলে, বায়ু স্থির হয় না।
আমাদের মস্তিষ্কের যে কেন্দ্রস্থল তাকে বলা হয় সুমেরুর শিখরদেশ। সাধন হেতু প্রাণবায়ু সেই সুমেরু ভেদ করে সহস্রারে প্রবেশ করে। মেরুদণ্ডের যে অস্থিভাগ মস্তিষ্ককে ধরে রেখেছে, মাথার সেই অস্থিখন্ডকে বলা হয় মহাশঙ্খ। এই মহাশঙ্খের নাদ-ধ্বনিতে সাধকের মন স্থির হয়ে যায়। সাধকের মনে আনন্দের সঙ্গে আশার সঞ্চার হয়। আর নাদধ্বনি রিপুসকলের কাছে বা দুর্ম্মতির কাছে ভীতিপ্রদ। এই ধ্বনি যখন সাধকের শ্রুতিগোচর হয়, তখন বিষয় বাসনা থেকে তার নিবৃত্তি ঘটে।
এই প্রসঙ্গে আরো একটা কথা আমাদের জেনে রাখা ভালো, আর তা হচ্ছে, আমরা শুনেছি যুদ্ধে যিনি স্থির তিনি যুধিষ্ঠির। এই যুধিষ্ঠিরের জন্ম আকাশ তত্ত্ব থেকে। আকাশতত্ত্ব অচঞ্চল। এঁকে সহজে কেউ চঞ্চল বা অস্থির করতে পারে না। এই আকাশ তত্ত্বের স্থান হচ্ছে বিশদ্ধচক্র যা আমাদের কণ্ঠস্থিত।
এখান থেকে যে ধ্বনি উৎসারিত হয়, তাকে বলে অনন্তবিজয় ধ্বনি বা বিজয় ভেরি। প্রাণবায়ু স্থির হলে এক ধরনের ভীষনরব-এর উৎপত্তি হয়। এই ধ্বনি যখন সাধকের শ্রুতিগোচর হয়, তখন জানতে হবে সাধকের সমাধির অবস্থা আসন্নপ্রায় হয়েছে।
----------------------------------
৫.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (৯)
শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ১৬-১৮
অনন্ত বিজয়ং রাজা কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ
নকুলঃ সহদেবশ্চ সুঘোষ মনিপুষ্পকৌ। (১৬)
কাশ্যশ্চ পরমেষ্বাসঃ শিখন্ডি চ মহারথঃ
ধৃষ্টদুম্মো বিরাটশ্চ সাত্যকি চ অপরাজিতঃ (১৭)
দ্রুপদো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব্বশঃ পৃথিবীপতে
সৌভদ্রশ্চ মহাবাহুঃ শঙ্খান দধ্নূঃ পৃথক্ পৃথক্। (১৮)
কুন্তীপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির অনন্তবিজয় নামক সঙ্খধ্বনি করলেন। নকুল সুঘোষ ও সহদেব মণিপুষ্পক নামক শঙ্খধ্বনি করলেন।(১৬)
হে পৃথ্বীপতে অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্র, মহাধনুর্দ্ধর কাশীরাজ, মহারথী শিখন্ডি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, অপরাজেয় সাত্যকি, দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পুত্রগণ ও মহাবাহু অভিমন্যু সবাই পৃথক পৃথক শঙ্খধ্বনি করলেন।
এখানে আগের মতো আমরা আরো কিছু শঙ্খের কথা শুনলাম।
প্রথমত : অনন্তবিজয় - ব্যোম অর্থাৎ আকাশতত্ত্ব থেকে প্রতিনিয়ত ওঙ্কার বা প্রণব ধ্বনি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সেই ধ্বনির ঢেউ বায়ুর সাহায্যে আমাদের রক্তমাংসের শরীরে আলোড়ন তুলছে, বা স্পন্দিত হচ্ছে। একেই যুধিষ্ঠিরের অনন্তবিজয় শঙ্খধ্বনি বলা হয়ে থাকে।
সুঘোষ - নকুল, অপ বা জল -তত্ত্ব থেকে উদ্ভূত। আমাদের লিঙ্গমূলে উপরে আছে স্বাধিষ্ঠান চক্র। এখন থেকে একটা সুমধুর ধ্বনি, বেনুর বাজনা, বাঁশির সুর প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হচ্ছে একেই বলে সুঘোষ।
মণিপুষ্পক - সহদেব হচ্ছে পৃত্থিতত্ত্ব তত্ত্ব থেকে উদ্ভূত। আমাদের মূলাধার চক্রে এর স্থান। এই কুণ্ডলিনী আবার প্রাণশক্তির আধার। এইজন্য যোগের বোধন বা শুরু এখান থেকেই করতে হয়। মধু খেয়ে ভ্রমর যখন পাগল হয়ে যায়, তখন সেই মত্তভৃঙ্গ অনবরত যে আওয়াজ তোলে তা এই মণিপুষ্পক শঙ্খ থেকে উৎসারিত।
এছাড়া কাশীরাজ, শিখন্ডি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, সাত্যকি, দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পুত্রগণ ও অভিমন্যু সবাই পৃথক পৃথক শঙ্খধ্বনি করলেন। এই যে ছটি নির্দিষ্ট শঙ্খ বাদে অন্য শঙ্খ-এর কথা বলা হলো, এগুলো আসলে মিশ্রিত ধ্বনি। বিভিন্ন রঙ-এর অনুপাতের ভিন্নতা হেতু যেমন একটা আলাদা রঙের দেখা মেলে, তেমনি ৫টি শঙ্খধ্বনি থেকে আলাদা আলাদা ধ্বনির উৎপত্তি হয়। আবার এই পাঁচটি শংখধ্বনি একত্রে তৈরী হয় পঞ্চজন্য শঙ্খ ।
আসলে আমাদের দেহে যে পঞ্চপ্রাণ (প্রাণ, অপান, ব্যান, সমান, উদান) - তা এই পাঁচটি শঙ্খ। অনন্তবিজয় - আছে যুধিষ্ঠিরের হাতে, সুঘোষ আছে নকুলের হাতে, মণিপুষ্প আছে সহদেবের হাতে, দেবদত্ত আছে ধনঞ্জয় বা অর্জুনের হাতে, এবং পৌন্ড্র আছে ভীমের হাতে আর পাঁচটি শঙ্খ একত্রে পাঞ্চজন্য শঙ্খ যা আছে হৃষীকেশের হাতে।
প্রাণায়ামের দ্বারা শরীরে যখন সমস্ত বায়ুর মধ্যে একটা সমতা আসে তখন এই ধ্বনিগুলো শুনতে পাওয়া যায়। আর এই নাদ-ধ্বনি যখন শ্রুতিগোচর হয়, তখন মন শান্ত হয়ে যায়, চিত্ত স্থির হয়ে যায়। মনের মধ্যে আর কোনো সংকল্প-বিকল্প উঠতে দেখা যায় না।
শরীরের চার তত্ত্বে (ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ) মন স্থির থাকে কিন্তু মন সজাগ হয়ে থাকে। কিন্তু শেষতত্ত্ব অর্থাৎ ব্যোম তত্ত্বের ধ্বনিতে মন লয় হয়ে যায়। আর এই ব্যোম তত্ত্বকে বলা হয় যুধিষ্ঠির বা যুদ্ধে যিনি স্থির। তখন সব থেকেও যেন কিছুই নেই - এই বোধে স্থির হয় মন। সাধক এখানে থেমে থাকবেন না। এই তত্ত্বেরও অতীতে উঠতে হবে তাকে। পর-ব্যোম -এ পৌঁছতে হবে. এখানেই অর্থাৎ পরব্যোম অবস্থা। কিন্তু ব্যোম তত্ত্বকেই বলা হয় পরমাত্মার প্রথম আভাস ক্ষেত্র বা পরমাত্মার পাদপীঠ। ব্যোম-তত্ত্বে সাধক যখন স্থির হয়, এই অবস্থাকে বলা হয় সবিকল্প সমাধি। আর পরব্যোম অবস্থা হচ্ছে নির্বিল্প সমাধি, অর্থাৎ সাধক সমস্ত পাঁচ তত্ত্বের বাইরে অবস্থান করেন। এখানেই অদ্বৈত অবস্থা।
এখন কথা হচ্ছে এখানে বা এই পরব্যোম তত্ত্বের আগে সাধককে এক এক কর তত্ত্বের অপসারণ করতে হবে। আবার জানবেন, এই ব্যোম আবার পাঁচ প্রকার - আকাশ, মহাকাশ, পরাকাশ, তত্ত্বাকাশ ও সূর্য্যাকাশ। এখন কথা হচ্ছে এই তত্ত্বগুলোতে কার স্থিতি হয় ? এই স্থিতি হয়, পঞ্চপ্রাণের। একেই কেউ বলেন, "মা-তারা"। কেউ বলেন, কৃষ্ণ। একটা শক্তি একটা আকর্ষণ শক্তি যা সব সময় সাধকের মনকে আকর্ষণ করছে। এই আকাশ শূন্য আবার শূন্য নয়। এই আকাশেই চলছে মহামায়ার খেলা, মহাপ্রকৃতির খেলা, মা আদ্যাশক্তির খেলা। সাধকের হৃদয়াকাশে তাঁকে কূটস্থের জ্যোতির অভ্যন্তরে দেখা যায় কৃষ্ণবর্ণের শুন্য বিন্দু। এঁকে পার হতে পারলেই সাধক পরব্যোম অবস্থায় স্থিত হন।
এখানে সুমতি অপরাজেয়। সুমতির আছে সদ্বুদ্ধি। সাধকগন জানেন, সাধনার প্রথমে আসে জ্যোতি, তার পরে বিচিত্র চিত্র। এই জ্যোতির মধ্যেই থাকে শুভ্রজ্যোতির রেখা। এই শুভ্র জ্যোতিতে মন স্থির হলে, এগুলোকে প্রথমে স্থূল বলেই মনে হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে এর মধ্যে একটা অসীম শক্তির আভাস মেলে। কিন্তু এই জ্যোতি আসলে চৈতন্য, যা এই এই স্থুল জ্যোতিকে আশ্রয় করে দৃশ্যমান হচ্ছে। এইজন্য এঁকে বলা হয় শিখন্ডি। অর্থাৎ নিমিত্ত্ব মাত্র। এই শিখন্ডি আসলে শক্তির কর্তৃত্ত্ব পদ-জ্ঞান। এইজন্য শিখণ্ডীকে বলা হয়েছে মহারথঃ অর্থাৎ শিখন্ডী রূপ রথে তিনি আরোহন করে থাকেন।
এই জ্যোতির মধ্যে যে শক্তির কর্তৃত্ত্ব এই জ্ঞান যখন হয় তখন কখনোই আর নিঃশেষিত হয় না। একটা কথা জানবেন, এই শক্তি সেই অন্তর্যামী প্রভুর বা আত্মার। এইসময় সাধকের অন্তঃকরণ নির্মল হয়ে ওঠে। আসলে এই শক্তি আমাদের সকলের মূলাধারে সুপ্ত অবস্থায় আছে। যোগক্রিয়া করতে করতে সাধকের নিষ্ঠা ও ক্ষমতা অনুসারে একসময় যোগীর জ্ঞান-গোচর হয়ে ওঠে। কিন্তু কখন এটি হয় ? এটি তখনই হয়, যখন জীব-চৈতন্য আমাদের সহস্রারে পৌঁছয়। অর্থাৎ আমাদের শ্বাস উত্তপ্ত হয়ে যখন আমাদের মস্তিস্ক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে তখন এই দশ প্রকার শব্দ, (৫+১+৪) যা আসলে নাদ-ধ্বনি তা পৃথক পৃথক ভাবে শুনতে পাওয়া যায়।
যেখানে মন রাখলে আমাদের সমস্ত কিছুর জ্ঞান আপনা-আপনি হয়, তাকে বলা হয়, কাশীক্ষেত্র। এখানে সবকিছু প্রকাশমান। এখানেই মহৎজ্যোতি বা শিখন্ডি স্থূল রূপ ধারণ করে। তেজঃস্বরূপ এই জ্ঞান থেকেই আমাদের ভ্রমাত্মক জ্ঞান অর্থাৎ ভীষ্মকে নিধনে সমর্থ হয়। এই অবস্থায় সাধকের মধ্যে বা যোদ্ধার মধ্যে আর কোনো আশঙ্কার কারন থাকে না। নির্ভিক চিত্তে যুদ্ধে বা সাধন-সমরে সাধক উপস্থিত হতে পারেন।
---------------------
৬.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (১০)
শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ১৯-২১
স ঘোষো ধার্ত্তরাষ্ট্রাণাং হৃদয়ানি ব্যদারয়ৎ
নভশ্চ পৃথিবীঞ্চৈব তুমুলঃ অভ্যনুনাদয়ন (১৯)
অথ ব্যবস্থিতান দৃষ্ট্বা ধার্ত্তরাষ্ট্রান কপিধ্বজঃ
প্রবৃত্তে শস্ত্রসম্পাতে ধনুরুদ্যম্য পাণ্ডবঃ
হৃষীকেশং তদা বাক্যম ইদং আহ মহীপতে। (২০
অর্জুন উবাচ :
সেনয়োরুভয়ো-মধ্যে রথং স্থাপয় মে অচ্যুত। (২১)
সেই তুমুল শব্দ (শঙ্খধ্বনি) আকাশ ও পৃথিবী প্রতিধ্বনিত করে ধৃতরাষ্ট্র পুত্রগণের হৃদয় বিদীর্ন করতে লাগলো । (১৯)
মহাশব্দ স্তিমিত হলে, ধার্তরাষ্ট্রগণকে যুদ্ধে উদ্দত দেখে, এবং শস্ত্র নিক্ষেপে প্রবৃত্ত দেখে, অর্জুন ধনুক উত্তোলন করে, হৃষিকেশকে বললেন। (২০)
হে অচ্যুত, উভয় সেবার মধ্যে আমার রথ স্থাপন করো। (২১)
ভগবানের সঙ্গে কথা শুরু হলো। এতক্ষন আমরা সঞ্জয়ের মুখ থেকে শুনছিলাম, যে কথা ধৃতরাষ্টকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছিলো । এবার অর্জুন কথা বলে উঠলেন, এবং এই উক্তি অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়, স্বয়ং ভগবানকে উদ্দশ্য করে। যদিও এখনো ব্যাসদেবের কলমে শ্রীকৃষ্ণ ভগবান নন। তিনি অর্জুনের যুদ্ধ-রথের সারথী মাত্র। বড়োজোর সখা।
যে শব্দ থেকে সাধকের হৃদয় বিদীর্ন হয়, তা আসলে আমাদের মূলাধার থেকে ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। আমাদের জানি পৃত্থি তত্ত্ব আমাদের মূলাধার আর আকাশ তত্ত্ব আমাদের ব্রহ্মরন্ধ্র। এই সূক্ষ্ম গতিপথ একসময় নাদধ্বনিতে ঝংকৃত হয়ে ওঠে। আর এই শব্দই আমাদের সাধন-সমরের শত্রুপক্ষ অর্থাৎ কাম-ক্রোধ-লোভ প্রভৃতি অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। এই ধ্বনি যখন অনুরণিত হতে থাকে, তখন আমাদের মন হয় বিবশ আর শরীর হয় অবশ। আর এই ধ্বনিতেই আত্মসংযোগ ঘটে। চিত্ত হয় নিস্তরঙ্গ। হৃদয়ের মধ্যে শুরু হয়, একটা আকুলি বিকুলি ভাব। যেন মনে হয় হৃদয়গ্রন্থি ছিঁড়ে যাবে। কিন্তু হৃদয়গ্রন্থি ভেদের এটি প্রাথমিক পর্যায় মাত্র । এই পর্যায়ে হৃদয়গ্রন্থি ভেদ হয় না।
সাধক যখন সাধন করবার উদ্যোগ করেন, যখন তিনি মেরুদন্ড সোজা করে, সিদ্ধাসনে উপবেশন করেন। ঠিক সেই মুহূর্তের জন্য আমাদের দুর্ম্মতি এমনকি সুমতিও শান্ত থাকে। দুর্ম্মতি খোঁজে সাধন থেকে বেরিয়ে যাবার রাস্তা, আর সুমতি তখন সাধনে স্থিত হবার জন্য উন্মুখ হয়। বিশুদ্ধি চক্র থেকে আজ্ঞাচক্র পর্যন্ত অর্থাৎ আমাদের গলার পিছনে যে মেরুদন্ড আছে সেখান থেকে ভ্রূযুগলের ঠিক পিছনভাগ পর্যন্ত মেরুদণ্ডের যে অবস্থান তা খানিকটা ধনুকের কাঠের মতো বাঁকা। গুন্ অর্থাৎ ধনুকের যে দড়ি ধনুকের কাঠ/বাঁশের দুই দিকের অগ্রভাগে টানটান করে বাঁধতে পারলে, বান নিক্ষেপে সুবিধা হয়। ঠিক তেমনি আমাদের বায়ুসাধন ক্রিয়ার সাহায্যে সুষুম্নার মধ্যে উত্তপ্ত বায়ু অর্থাৎ চেতনশক্তি প্রবেশ করলে, আমাদের মেরুদণ্ডের মধ্যে একটা টানটান ভাবের অনুভব হয়। আর আমরা জানি, যে কোনো ধ্যানাসন মানেই মেরুদন্ড অবশ্যই সোজা বা টানটান থাকলে তবেই এই অনুভূতি জগতে পারে। সেই কারনে সিদ্ধাসন, পদ্মাসন, সুখাসন যাই হোক না কেন, মেরুদন্ড সোজা রেখে বসতে হয় । একেই ধনুক ওঠানো বলা হয়ে থাকে। ধনুক ওঠানো অর্থে মেরুদন্ড সোজা করে সাধনের জন্য প্রস্তুত হওয়া । এই অবস্থানে থেকে দৃঢ়চিত্তে সাধন করতে পারলে, প্রাণবায়ু সহজেই সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করে।
এই অবস্থা আসলে সাধনক্রিয়ার উদ্যোগ মাত্র। এই ধনুকের ও তার টানটান ছিলার সাহায্যেই প্রতিপক্ষককে পরাজিত করা যায়। তাই এই ধনুক নিজের হাতে তুলে নিতে হয় , অর্থাৎ নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। মেরুদন্ড যখন সোজা তখন শরীর সুমতির নিয়ন্ত্রণে। মেরুদন্ড যখন যথেচ্ছ তখন তা প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণে। এই হচ্ছে অর্জুনের গান্ডীব তুলে হাতে নেওয়া।
হৃষিকেশের কথা আমরা আগে শুনেছি, এখানে শ্রীকৃষ্ণকে অর্জুন অচ্যুত বলে সম্মোধন করছেন। অচ্যুত কথার অর্থ হচ্ছে - যিনি কোনো কিছু থেকে বিচ্যুত হন না। এই অচ্যুত এখন দেহরথের সারথী। অর্জুন আমাদের তেজের প্রতীক। এই তেজ যখন সক্রিয় হয়, গতিশীল হয়, তখনও অচ্যুত তাঁর স্বীয় স্বভাব অনুযায়ী কূটস্থ থাকেন। তিনি নির্বিকার। দেহরথের এই সারথী আমাদের সমস্ত উৎপাত নিঃশব্দে সহ্য করে থাকেন। আমরাও তাঁকে অবোধের মতো নির্দেশ জারি করি, এতই আমাদের স্পর্ধা। আর তিনি নিজের কোনো প্রয়োজন না থাকলেও, সমস্ত প্রয়োজনের উর্দ্ধে শাশ্বত কালের কালের জন্য বিধান দিয়ে থাকেন। ভক্তের ঔদ্ধত্য ভগবানকে কুপিত করে না।
ভগবান আমাদের সবার হৃদয়ে বিরাজ করছেন। ভক্তের ভালো মন্দ সমস্ত নির্দেশ তিনি নির্বিকার ভাবে রক্ষা করেন। সাধন করবার ইচ্ছে, বা সাধন না করবার ইচ্ছে, কোনো ইচ্ছেতেই তিনি বাধা দেন না। আসলে ভক্ত যতক্ষন নিজের নির্দেশে চলতে চায়, ততক্ষন ভগবান নীরব সাক্ষী থেকে ভক্তকে ভক্তের ইচ্ছে মতো চলতে দেন। সাধন করা বা না করা আপনার ইচ্ছে। এই ইচ্ছে শক্তিও ভগবানেরই দেওয়া। তথাপি ভগবান ভক্তের ইচ্ছে-শক্তির উপরে কোনো নিয়ন্ত্রণ করেন না। একেই আমরা পুরুষকার বলে থাকি।
জীবের চিত্ত দ্বিধা বিভক্ত। জীবের মন সন্দেহাতীত নয়। এমনকি সাধন ক্রিয়া করতে করতে আমাদের অনুভবের মধ্যে সামান্য পরিবর্তন এলেও, আমাদের মন থেকে সন্দেহের নিরসন হয় না। তখনও আমরা একে সাধনার ফল না ভেবে, স্বাভাবিক বলেই ধরে নেই। যার মনে যেমন ইচ্ছে জাগ্রত হয়, ভগবান সেই ইচ্ছেকেই সিদ্ধ করে থাকেন। ভগবানের ইচ্ছে বলে কিছু থাকে না। আপনি ক্রিয়াশীল থাকলেও ভগবান সেই অবস্থায় আপনার সঙ্গে থেকে মদত দেবেন, আবার আপনি ক্রিয়াহীন হয়ে থাকতে চাইলেও, ভগবান আপনাকে বাধা দেবেন না। যতক্ষন আপনি নিজেকে ভগবানের কাছে সমর্পন না করবেন, ততক্ষন ভগবান আপনার ইচ্ছেকেই কার্য্যে পরিণত করে দেবেন। তাই বলা হয়ে থাকে, জীবের ইচ্ছে-শক্তি প্রবল হলে ভগবান সেই ইচ্ছে পূরণ করে দেন। তাই অর্জুন যখন ভগবানকে নির্দেশ দিচ্ছেন, রথকে উভয় (প্রবৃত্তি-নিবৃত্তি) সেনার মধ্যে স্থাপন করতে বললেন, তখন ভগবান তা বিনা প্রতিবাদে, নীরবে শুনলেন।
------------------------
৭.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (১১)
শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ২২-২৩
যাবৎ এতান নিরীক্ষে অহম যোদ্ধুকামান অবস্থিতান
কৈর্ন্ময়া সহ যোদ্ধব্যম অস্মিন রণ সমুদ্যমে। (২২)
যতক্ষন আমি যুদ্ধকামনায় অবস্থিত বীরগনকে নিরীক্ষণ করি। এই যুদ্ধের আরম্ভে কাদের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করতে হবে। (২২) অর্থাৎ কাদের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করতে হবে, বা কাদেরকে আমাকে ছেড়ে দিতে হবে তাদেরকে একবার চোখে দেখে নেই।
যাঁরা যুদ্ধ করতে উদ্যত অর্থাৎ কোন কোন প্রবৃত্তিগুলোর সাথে প্রতিযুদ্ধ করতে হবে, তাদেরকে একবার দেখে নেবার ইচ্ছে সাধনার প্রারম্ভে সাধকের মনে হওয়া স্বাভাবিক। আমরা যখন চাকুরীর জন্য দূরদেশে যাই, এমনকি আমরা যখন মৃত্যুর পথে পা বাড়াই, তখন আমাদের প্রিয়জনকে একবার দেখতে ইচ্ছে করে। সাধক সাধন জগতে নিজেকে সঁপে দেবার প্রাক্কালে, একবার তার মনে বিষয় চিন্তা জেগে ওঠে। সাধারণ সংসারীর মধ্যে সহজে বিষয়চিন্তা যায় না। সন্যাস নেবার আগেও একবার ছেলে-মেয়েদের দেখে বিষয়রক্ষার দায়িত্ত্ব বুঝিয়ে দিতে চায়।
কিন্তু সাধন জগতের বিষয় চিন্তা বা বিষয়ের প্রতি আসক্তি থাকলে আর সন্যাস নিতে ইচ্ছে করে না। কেননা বিষয়ের মোহ, সন্মন্ধের বাঁধন সাধন জগতের প্রধান বাধা। কিন্তু যার সঙ্গে ভগবান আছেন, তিনি ভগবানের প্রতি আকর্ষণ বশতঃ সাধন সমরে অগ্রসর হতে বাধ্য। তথাপি তার মধ্যে থেকে সংশয় যায় না, প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠতে থাকে মনে। এক-একবার মনে হয় এইতো ভালো আছি, সংসারে থেকেই তো সাধন ভজন করা যেতে পারে। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে বিষয়ের প্রতি আসক্তি যতক্ষন না যায়, ততক্ষন সাধনায় সুফল আসতে পারে না। আর আমাদের মধ্যে এই মানসিক দ্বন্দ্বের অবসানের জন্য অচ্যুত অর্থাৎ যিনি কখনো চ্যুত হন না, তিনি গুরুদেবের ভূমিকায় অবতীর্ন হন। এসব কথা আমরা ধীরে ধরে শুনবো।
যোৎ স্যমানান অবেক্ষে অহং যএতে অত্র সমাগতাঃ
ধার্ত্তরাষ্ট্রস্য দুর্ব্বুদ্ধে যুদ্ধে প্রিয়চিকীর্ষবঃ। (২৩)
এই যুদ্ধে দুর্ব্বুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রের হিতকামনায় যেসব যুদ্ধার্থী এই যুদ্ধে সমাগত হয়েছেন, সেই সব যোদ্ধাগনকে আমি একবার ভালো করে দেখে নেই।
আসলে সাধন পথে পা দেবার প্রাথমিক দিকে আমাদের যেসব প্রবৃত্তি বাধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায় তাদেরকে পর্যবেক্ষন করা অবশ্য কর্তব্য। কেননা শত্রুকে চিহ্নিত না করতে পারলে, যুদ্ধজয় অসম্ভব। যুদ্ধপ্রিয় এই প্রবৃত্তি শক্তি আমাদের কোন কোন মনোবৃত্তিতে প্রবল তাদের একবার দেখতে ইচ্ছে করে। চঞ্চল এই দুর্ম্মতি সবসময় বিষয় কামনায় চঞ্চল। একে পরাজিত না করতে পারলে, বা বলা যেতে পারে, এদেরকে জয় করতে না পারলে, আমাদের মন শান্ত হতে পারবে না। বিষয়-প্রবৃত্তি বিষয়ের দিকেই প্রলোভিত করবে। তাই সাধকের উচিত একবার নিজেকে বিশ্লেষণ করা। একবার নিজের দিকে দৃষ্টিপাত করা। কোন প্রবৃত্তি প্রবল আর তাকে কিভাবেই বা দমন করা যায়, সেই ভাবনা জাগানো দরকার।
-------------------------------
৮.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (১২)
শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ২৪-২৭
সঞ্জয় উবাচ :
এবম উক্তো হৃষীকেশো গুড়াকেশেন ভারত
সেনয়োঃ উভয়োঃ মধ্যে স্থাপয়িত্বা রথোত্তমম। (২৪)
হে ভারত, গুড়াকেশ (অর্জুন) হৃষীকেশকে এই কথা বললে, হৃষিকেশ উভয় সেনাদলের মধ্যস্থলে উত্তমরথ স্থাপন করে (বললেন)।
গুড়াকা কথাটার অর্থ নিদ্রা। এই নিদ্রার যিনি ইশ অর্থাৎ জয়ী তিনি গুড়াকেশ। অর্থাৎ যিনি নিদ্রাকে জয় করেছেন। সাধনার প্রাক্কালে যেসব বৃত্তি বা স্বভাব আমাদের বাধা সৃষ্টি করে তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে নিদ্রা। এই নিদ্রাকে জয় করতে হবে।
হৃষিকেশ কথাটার অর্থ যিনি সমস্ত ইন্দ্রিয়ের রাজা।
ভীষ্ম দ্রোণ প্রমূখতঃ সর্বেষাং চ মহীক্ষিতাম
উবাচ পার্থ পশ্যৈতান সমবেতান কুরুন ইতি। (২৫)
হে পার্থ এই সমবেত কৌরবদল ভীষ্মদ্রোন-প্রমুখ সকল রাজগনকে সম্মুখ থেকে নিরীক্ষণ করো।
পার্থ কথাটার অর্থ পৃথী-র পুত্র। পৃথী অর্থাৎ কুন্তী। এখানে পার্থ কথাটার দ্বারা তার মধ্যে যে স্ত্রীসুলভ মাতৃসুলভ, কোমল স্বভাবের তার ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। আমরা জানি স্ত্রী-স্বভাবের মধ্যে আছে শোক-মমতা। তো অর্জুন এখন এই স্ত্রী-সুলভ স্বভাবের বাহক।
তত্রাপশ্য়ৎ স্থিতান পার্থঃ পিতৃনথ পিতামহান
আচার্য্যান মাতুলান ভ্রাতৃন পুত্রান পৌত্রান সখীনস্তথা
শ্বশুরণ সুহৃদঃ চ এব সেনয়োঃউভয়োঃ অপি। (২৬)
অনন্তর অর্জুন সেখানে উভয় সেনের মধ্যে মধ্যে অবস্থিত পিতৃব্য, পিতামহ, আচার্য্য, মাতুল, পুত্র, পৌত্র, শ্বশুর ও সুহৃদগণকে দেখলেন।
তান্ সমীক্ষ্য স কৌন্তেয়ঃ সর্ব্বান বন্ধুন অবস্থিতান
কৃপয়া পরয়াবিষ্টো বিষীদন ইদম অব্রবীৎ। (২৭)
সেই কুন্তীপুত্র অর্জুন, (যুদ্ধার্থে) অবস্থিত সেই সমস্ত বন্ধুগণকে দেখে পরম কৃপাপরবশ ও বিষণ্ণ হয়ে এইরূপ বললেন।
এখন আবার বললেন, কৌন্তেয় অর্থাৎ কুন্তীপুত্র। এই সম্মোধন দ্বারা অর্জুনের মধ্যে এই মুহূর্তে যে বৃত্তিগুলো প্রধান তার উল্লেখ করা হচ্ছে। কৌন্তেয় অর্থাৎ স্ত্রী স্বভাবগ্রস্থ শোক-মোহ-গ্রস্থ অর্জুনের স্বভাব সম্মদ্ধ রয়েছে। আবার কুন্তী হচ্ছেন হৃষিকেশের পিসি, আবার অর্জুনের মাতা। তো এই যে পারিবারিক সম্মন্ধ, এর জন্য একটা বন্ধন মায়া-মোহের বন্ধন আছে অর্জুনের মধ্যে।
আমরা সঞ্জয় অর্থাৎ সংযমীপুরুষের ধ্যানস্থ অবস্থার দৃশ্য বর্ণনা শুনছি। এই দৃশ্যে এবার আমরা কূটস্থে অবস্থিত তেজশক্তিকে ক্রিয়া বন্ধ করে উত্তম-অধম উভয় দলের মধ্যে স্থিত হতে দেখছি। এই কূটস্থে যে দৃশ্যপট ভেসে উঠছে, তার যথার্থ বর্ননা আছে এখানে। সাধন জগতে প্রবেশদ্বারে পৌঁছে আমাদের মনের মধ্যে এই দৃশ্যপট ভেসে ওঠে। ধ্যানে বসলে, আমাদের প্রথম দিকে আমার দৈনন্দিন কাজ-কর্ম্মের মধ্যে যে সব চরিত্র থাকে তাদের দৈহিক চেহারা ভেসে ওঠে। এমনকি তাদের সঙ্গে যে সব সম্পর্কের টানাপোড়ন তার কথা বারবার মনের দৃশ্যতে ভেসে উঠতে থাকে। কার সাথে কেমন ব্যবহার করেছিলাম, কে আমাকে কষ্ট দিয়েছে, কে আমাকে শান্তনা দিয়েছে, কে আমাকে ভালো বেসেছে, সমস্ত দৃশ্যই মনের মধ্যে ভেসে আসতে থাকে। আর গুরুদেবের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা তখন প্রত্যাহারের ক্রিয়া করতে হয়। এবং ইষ্টে মন দেবার চেষ্টা করতে হয় । আসলে এইসব দৃশ্য আমাদের সাধনপথের স্বাভাবিক বাধা। কিন্তু আমাদের সাধন পথে দৃঢ়তা ও সাধনপথের রূঢ়তার মধ্যে একটা টালমাটাল অবস্থা চলতে থাকে। মন কখনো চঞ্চল কখনো স্থিত হতে থাকে। কখনো সুমতি, কখনো দুর্ম্মতি - মনের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে থাকে।
সাধনপথের রূঢ়তা আবার রুঢ়তাজনিত ভয় থেকে আমাদের নিষ্কৃতি পেতে হবে। একটা কথা বলি, প্রথমে আমরা অনেকে অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে সাধনায় আকৃষ্ট হই। সোজা কথায় বলা যায়, অনেকে হুজুকে পড়ে আশ্রমে আসে, সাধনার নাম ক'রে। এর পরে যখন সে দেখে আমাদের অভ্যস্ত জীবন থেকে এই জীবন সম্পূর্ণ আলাদা, এমনকি এই জীবন অনেক অনেক কষ্টের জীবন, তখন সে বিস্মিত শুধু নয়, হতাশ হয়ে যায় । এমনকি আমি এমন অনেককে দেখেছি, কিছুদিন সাধনা করবার পরেও, তার মধ্যে প্রশ্নের উদয় হয়, এইসব করে কোনো লাভ আছে কি ? এতে করে আমার দৈনন্দিন জীবনে যে সুখ স্বাচ্ছন্দ ছিলো, তা না হয় বিসর্জন দেওয়া গেলো, কিন্তু এখান থেকে কোনো প্রাপ্তি হতে পারে কি ? নাকি শুধুই অন্ধকারের পিছনে ছোটা ? খাবার কষ্ট, শোবার কষ্ট, এমনকি এখনকার যুগে এটি একটি অপমানিত জীবন যাত্রা। কেননা এখানে থাকতে গেলে, খাওয়ার জন্য, গৃহস্থের দ্বারে দ্বারে অর্থের জন্য হাত পাততে হয়। সবথেকে বড়ো কথা যা কিছু সে করছে, তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সে সন্দিহান হয়ে ওঠে। মনে হয়, যা করছি, যা দেখছি, সব ঠিক তো ? নাকি আমার মানসিক বিকার এগুলো ? এইসময় আমাদের পূর্ব পূর্ব সংস্কার ভোগ্য বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সিগারেটে একটা টান দিতে ইচ্ছে করে। একদিন একটু মাংস-ভাত খেতে ইচ্ছে করে। একটু ভালো জামা-কাপড় পড়তে ইচ্ছে করে। বিষয় ভোগের জন্য মনটা আনচান করে। এমনকি নিজের মা-বাবার কথা চিন্তা করে সে কষ্ট পেতে থাকে। নিজের প্রিয়জনের কথা ভেবে তার মনের মধ্যে একটা হা-হা-কার, একটা অভাববোধ, একটা যন্ত্রনা শুরু হয়। এইযে মনের মধ্যে দ্বন্দ, এইযে মনের মধ্যে প্রশ্ন এগুলোর জবাব দেবার জন্য যদি কাছে কোনো দেহধারী গুরু না থাকেন, তবে এই জীবন অসহ্য হয়ে ওঠে। একেই বলে বিষাদ যোগ। এই বিষাদ-মনের মধ্যে সাধন জীবন না সংসার জীবন, কোনটি ভালো, কোন পথে শান্তি আছে, এর উত্তর সে খুঁজে বেড়ায়। এই প্রশ্নের বান যতক্ষন তার মনের মধ্যে না জাগছে, মন যতক্ষন না উঠল-পাতাল করছে, ততক্ষন সে যোগের পথে পা রাখতে পারে না। এই সময় যথার্থ গুরু যা কিছু বলেন, সেই কথা গুলোই আছে শ্রীগীতায়। এই শ্রী গীতার কথা যিনি অন্তরে অনুভব করতে পারবেন, তিনি সাধন পথে ঠিক পদক্ষেপ করেছেন, একথা নিশ্চিত করে বলা যায়।
----------------------
9.12.2021
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব।শ্রীগীতা - শ্লোক নং (১৩)
শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ২৮
অর্জুন উবাচ :
দৃষ্ট্বেমান স্বজনান কৃষ্ণ যুযুৎসূন সমবস্থিতান
সীদন্তি মম গাত্রাণি মুখঞ্চ পরিশুষ্যতি। (২৮)
হে কৃষ্ণ যুদ্ধাভিলাষী আমার স্বজনদের সামনে দেখে আমার হাত-পা কাঁপছে, ও ঘাম বেরুচ্ছে, মুখ শুকিয়ে আসছে।
এখানে একটা নাম নতুন করে শুনলাম তা হচ্ছে "কৃষ্ণ"। কৃষ্ণকে কথা দিয়ে বাঁধা যায় না। আবার কৃষ্ণ কথাতেই আটকে থাকে। এই কৃষ্ণ সম্পর্কে আমরা শুনবো, তার আগে সাধনার কথা একটু শুনে নেই।
সাধনার পরিণতির কথা শুনে তো ভালোই লাগছিলো, কিন্তু মনের মধ্যে যখন বিষয়ভোগের ত্যাগের কথা মনে হলো, তখন মনে সেই তেজ থাকলো না। মন বিষাদে আচন্ন হয়ে গেলো। আর মন যখন বিষণ্ণ হয়, তখন শরীর অবসন্ন হয়, মুখের জল শুকিয়ে আসে। মনের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা পাক খায়, এ কি করছি আমি ? এইসব সাধন ভজন করে কি লাভ হবে ? সাধন ভজন, বর্তমানে তো দূরের কথা ভবিষ্যতে এমনকি পরকালে বা পরবর্তী জীবনেও কোনো লাভ হবে কিনা তা জানিনা। কিন্তু আপাত সুখের জীবন ছেড়ে আসতে হবে। এই কঠোর সাধন প্রক্রিয়া কি আমি বেশিদিন চালাতে পারবো ? যদি না চালাতেই পারি, তবে তো এখনকার এই পরিশ্রম বৃথা হয়ে যাবে। এই সব দুশ্চিন্তা নবীন সাধকের শরীর অবসন্ন করে তোলে, মুখের স্বাভাবিক জল নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়।
সত্যি কথা বলতে কি, যতক্ষন আমাদের ইন্দ্রিয় ভোগের প্রতি আসক্তি থাকবে, ততক্ষন আমাদের সাধনের কথা শুনলেই ভয়ের উদ্রেগ হবে। আসলে আমাদের ভাবনার মধ্যে এই সত্য যতক্ষন না রক্ষিত হয়, যে আত্মাই আমাদের সর্বস্য, আর সেই আত্মাকে দর্শনের জন্য আমাদের প্রয়াস করতে হবে, আমাদের জাগতিক সমস্ত সুখ পরিত্যাগ করতে হবে, এই ভাবনা যতক্ষন না আমাদের মনের মধ্যে দৃঢ় হয়, ততক্ষন আমরা সাধন পথে দৃঢ় পদক্ষেপ রাখতে পারবো না। মনের মধ্যে এতটুকু সন্দেহ থাকলে, আমরা এই পথে স্থিত হতে পারবো না।
এবার শ্রীকৃষ্ণের কথায় আসি। আমরা জানি এই অনবদ্য অমৃতবাণীর লেখক কৃষ্ণ, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, যার গায়ের রঙ কালো । আবার এইসব কালজয়ী কথার নায়ক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যার গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ । আবার বাসুদেবের পুত্র বাসুদেবকে বলা হয় কৃষ্ণ। আমাদের মতো সন্দেহবাতিক-গ্রস্থ মানুষের কাছে, শ্রীকৃষ্ণ না ঐতিহাসিক পুরুষ, না কোনো দেহধারী মহাপুরুষ। শ্রীকৃষ্ণ নেহাত একটা গল্পের নায়ক। লেখকের কল্পিত নায়ক চরিত্র। আসলে শ্রীকৃষ্ণ না কল্পিত, না ঐতিহাসিক। কেননা ঐতিহাসিকের চরিত্রের একদিন সমাপ্ত হয়। আবার গল্পের একটা শেষ আছে। সেখান থেকে চরিত্র হারিয়ে যায়। শ্রীকৃষ্ণ একটি ব্রহ্মবাচক শব্দ। শব্দব্রহ্ম। যেমন ওঙ্কার একটি ব্রহ্মবাচক শব্দ। আমাদের মতো অতি-চালাক মানুষ তাঁকে মনুষ্যদেহধারী মনে করে, অবজ্ঞা করে থাকি। আমরা তাঁকে ঠিক ধরতে পারি না। আজও এই মনুষ্য-দেহ ধারণ করে অনেক মহাপুরুষ পৃথিবীতে বিরাজ করছেন, কিন্তু আমরা তাদের চিনতে অপারগ। আমাদের চোখে বা আমাদের কাছে, মনুষ্যদেহকে আশ্রয় করে, অতিমানব পুরুষ বাস করতে পারেন, সেই বিষয়টি আমাদের বুদ্ধিগম্য নয়। আমরা ভগবানকে রক্ত-মাংসের শরীরের মধ্যে দেখতে পাইনি, আবার পাইও না, তাই তাঁকে দেখা যায় বলে মনেও করি না। আমাদের মতো সাধারণের চক্ষে সমস্ত স্থুল-দেহধারীকে আমরা সামান্য মানুষ বলেই ভাবি।
আসলে মায়ার অতীত সেই পরমপুরুষকে জানতে গেলে, নিজেকেও প্রাকৃত-গুন্-রোহিত হতে হবে। নতুবা তাকে জানা যাবে না। অর্জুনের সাথে ভগবানের জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। তথাপি অর্জুন তাকে চিনতে পারে নি। ভগবান স্বয়ং বলছেন, তুমি আমাকে দেখোনি। আমাকে দেখবার শক্তিও তোমার নেই। ভগবত কৃপায়, অর্জুন দিব্যদৃষ্টি লাভ করে, ভগবানকে দর্শন করেছিলেন।
আমরা জানি, একই আত্মা সর্বভূতে বিরাজ করছেন। তিনি সার্বিব্যাপী। আবার তিনিই আমাদের অন্তরাত্মা। সর্বকর্ম্মের সাক্ষী স্বরূপ এই চেতনসত্ত্বা সর্বগুনের অতীত। এখন কথা হচ্ছে কৃষ্ণ শব্দ ব্রহ্মবাচক কেন ? "কৃষ্ণ" এই শব্দটি এসেছে, "কৃষ্" ধাতু থেকে। কৃষ কথাটার অর্থ হচ্ছে আকর্ষণ করা। কাকে আকর্ষণ করছেন ? বিষয়াসক্ত জীবকে আকর্ষণ করছেন। কোথায় আকর্ষণ করছেন ? না নিজের কাছে আকর্ষণ করছেন। এইযে আকর্ষণ - এটি তাঁর স্বভাব। আমরা বিষয়-ভিন্ন ক্ষণকাল থাকতে পারি না। আবার দেখুন, জীব একই বিষয়ে বেশিক্ষন লেগে থাকতে পারে না। ক্ষনে ক্ষনে সে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই বিষয়াসক্ত জীবকে যিনি টেনে বুকে জড়িয়ে নেন, চরণপদ্মে আশ্রয় দেন,কলুষমুক্ত করেন, তিনিই সেই সচ্চিদানন্দ পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ।
কিন্তু কথা হচ্ছে, জীব কেন এই বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ভ্রমন করছে ? আসলে সে আনন্দের খোঁজ করেছে। মধুমক্ষী যেমন ফুল থেকে ফুলে গাছ থেকে গাছে ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করছে। তেমনি জীবাত্মা আনন্দের আশায় ছুটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কোথায় সেই আনন্দ ? কোথাও সেই তৃপ্তি নাই। এই কারনে অতৃপ্ত মন পুনঃ পুনঃ ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। একসময় সে হতাশ হয়ে, ক্লান্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। একসময় অবসন্ন হয়ে ফুলের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। মন প্রাণ তার অবসন্ন যায়। ঠিক তখন তার ভিতরের থেকে ডাক আসে, অন্তরাত্মা পরমপুরুষ বলে ওঠে "আমি তোমাতেই আছি" । আমি বাইরে নয়, ভিতরেই আছি। জ্ঞান সাধনে যাঁকে জানা যায়, তিনি গোবিন্দ। এই গোবিন্দের ভজনা না করলে, অর্থাৎ জ্ঞানের সাধনা না করলে, কেউ পরমানন্দের সাক্ষাৎ লাভ করতে পারে না। সমস্ত আনন্দের যিনি উৎস তিনি আত্মা। তো মানুষ তার প্রবৃত্তি অনুসারে আনন্দের অনুসরণ করে। এই আনন্দের উৎস হচ্ছে আত্মা। এক অর্থে আমরা সবাই সেই আত্মার সন্ধান করছি। প্রথমে সে বিষয়ের মধ্যে আনন্দের সন্ধান করে। কিন্তু যখন সে বুঝতে পারে, বিষয়ের মধ্যে যে আনন্দ আছে, তা সাময়িক, ক্ষণস্থায়ী। বিষয় আনন্দে তৃপ্তি নেই। আর অন্তরাত্মার ডাক যখন সে শুনতে পায় তখন সে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আনন্দই আত্মার স্বরূপ। আবার মানুষ এই আনন্দের সন্ধানে ঘুরছে। আত্মাতে আনন্দ ব্যাতিত কিছু নেই। আনন্দের প্রতি যেমন সমস্ত জীবের স্বাভাবিক আকর্ষণ। তেমনি আত্মার স্বাভাবিক ধর্ম্ম হচ্ছে নিগুড় আনন্দ। তাই আত্মার প্রতি জীব আকর্ষণ বোধ করে থাকে। এই আনন্দের উৎস আত্মা সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা আমাদের সমস্ত সুখ-দুঃখের কারন। সংসারেও আত্মাই আছেন, তাই সংসারের প্রতি আমাদের এতো আকর্ষণ। কিন্তু এই সংসার মায়ার প্রকাশ। এর মধ্যেই অন্তস্থ হয়ে আছেন সেই আত্মা। যা আনন্দের একমাত্র উৎস। সর্ব্বঘটে এই আত্মারই প্রকাশ দেখতে পাই আমরা। শরীরের মধ্যে আত্মা আছেন, তাই শরীর আমাদের কাছে প্রিয়। আত্মাবিহীন শরীরের কোনো দাম নেই আমাদের কাছে। আত্মা যাঁকে ছেড়ে গেছে, সে জড়বস্তু। আর জড়বস্তু আত্মার আবরণ মাত্র। ভূত্সকল আত্মার একপাদ মাত্র। অতয়েব আত্মাই সমস্ত বিশ্বের মূল। আমি যে আমাকে ভালোবাসি, তাও এই আত্মার অবস্থিতির জন্য হয়ে থাকে। তো প্রিয়বস্তু মাত্রেই একমাত্র আত্মা। নিজের প্রতি নিজের যে এই আকর্ষণ তা আসলে আত্মার জন্যই হয়ে থাকে। মোহবশত আমরা আমাদের দেহকে, স্ত্রী, পুত্র, আত্মীয়-স্বজনেই প্রতি আকর্ষণ বোধ করে থাকি। এই যে আকর্ষণ তা আমাদের কামনা প্রসূত। এই আকর্ষণ যখন ঈশ্বরের প্রতি হয়, তখন তাকে বলে প্রেম। কিন্তু আমাদের গতি, হৃদয়ের বেগ যে দিকেই ছুটুক না কেন, তিনি সবসময় আমাদের আকর্ষণ করছেন, নিজের দিকে। এই আকর্ষণ আসলে জগতের মোহনশক্তি। যা আমাদের মোহিত করছে। তাই আমরা আমাদের নিজ নিজ অভীষ্ট বস্তুতে আকৃষ্ট হচ্ছি। অর্থাৎ আমাদের কাম্য বস্তুর মধ্যেও সেই মোহনীয় রূপকে সেই সুন্দরকে অনুভব করতে চাই। একেই বলে মদন-মোহনের প্রতি আকর্ষণ। জগতের সমস্ত বস্তুই এক ও অভিন্ন। সবই এক আত্মা। কেবল যেটি যে মোড়কে ঢাকা, তাকে আমরা সেই নামে জেনে থাকি। কিন্তু সেই বস্তুর মধ্যেও আছে আমাদের আকৃষ্ট করবার আনন্দস্বরূপ আত্মা। এই অনুভূতিশক্তি যখন আমাদের মধ্যে প্রকাশিত হয়, তখন আমরা সেই বস্তুর মধ্যে আশ্রয়ের সন্ধান পাই। আমাদের মুনি ঋষিগণ আনন্দঘন মূর্তিকেই উপাস্য রূপে দেখেছেন। এই আনন্দঘন মূর্তি আমাদের চিত্তকে আকর্ষণ করে থাকে। সাধক তখন তার হৃদয়ের অভ্যন্তরে সেই মূর্তিকেই প্রকট করে। জল যখন বাষ্প আকারে থাকে, যখন বাষ্প জলে পরিণত হয়, আবার জল যখন বরফে পরিণত হয়, তখন জলের রূপ ও আকারের পরিবর্তন হয় সত্য, নামের পরিবর্তন হয়, কিন্তু জল জলই থাকে। তথাপি জল অর্থাৎ আকারই আমাদের দেহাকারে তৃপ্তি সাধন করে থাকে। আসলে আপনি যখন যে অবস্থায় আছেন, জানবেন , আত্মাও তখন সেই আকারের মধ্যেই আছেন। তো আপনি সেই আকারের মধ্যে প্রবেশ করুন, তাঁকেই দেখতে পারবেন। মন যখন যখন বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে, তখনও সে আত্মারই প্রকাশ দেখতে পায়।
---------------------------
১০.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (১৪)
শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ২৯-৩১
বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে
গাণ্ডীবং স্রংসতে হস্তাৎ ত্বক চৈব পরিদহ্যতে। (২৯)
আমার শরীর কাঁপছে, শরীরে রোমাঞ্চ হচ্ছে, হাত থেকে গান্ডীব খসে পড়ছে, আমার শরীরের ত্বক জ্বলছে।
আমাদের মনে যখন দুশ্চিন্তা উপস্থিত হয়, তখন আমরা সাধনায় স্থির হতে পারি না। মন যখন দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়, তখন আমাদের শরীরের মধ্যেও নানান রকম উৎপাত শুরু করে দেয়। শরীরের দৃঢ়তা নষ্ট হয়, শরীর এলিয়ে পড়ে। আর শরীর যখন এলিয়ে পড়ে, তখন আমাদের মেরুদন্ড বেঁকে যায়। এই মেরুদণ্ডই হচ্ছে গান্ডীব, যার সাহায্যে আমাদের সাধন-সমরে লড়াই করতে হবে। তো মেরুদন্ড যদি সোজা না থাকে, মেরুদন্ড যদি শিথিল হয়, তবে শরীরের যে আঁটোসাঁটো ভাব তা নষ্ট হয়ে যায়। আর এই অবস্থায় সাধনা দূরে থাকুক, স্বাভাবিক কর্ম্মও করা সম্ভব নয়।
ন চ সক্লমি অবস্থাতুং ভ্ৰমতীব চ মে মনঃ
নিমিত্তানি চ পশ্যামি বিপরীতানি কেশব। (৩০)
হে কেশব, আমি স্থির থাকতে পারছি না। আমরা মন অস্থির হচ্ছে। আমি অনিষ্টসূচক দুর্লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি।
এখানে আরো একটা নাম পেলাম "কেশব"। সাধারণ ভাবে কেশব মানে যার মনোহর কেশ আছে। আবার ক্ কথাটার অর্থ হচ্ছে ব্রহ্মা, অ অর্থাৎ বিষ্ণু আর ইশ কথাটার অর্থ হচ্ছে মহাদেব। এই তিনি মিলে (ক+অ+ইশ) কেশ। তো ব্রহ্মা বিষ্ণু মহাদেব যার বশে থাকেন, তিনি কেশব। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন কেশী নামক অসুরকে যিনি বধ করেছিলেন, তিনি কেশব।
সে যাই হোক, আমাদের মনের তেজ যখন কমে যায়, আমাদের চিত্তে তখন বিভ্রান্তি দেখা যায়। আর এই সময় সাধনায় অগ্রসর হাওয়া সম্ভব নয়। ভয়ে মানুষ অস্থির হয়ে ওঠে, এমনকি সে এক জায়গায় বসে থাকতেও পারে না। তখন তার শরীর মন দুইই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। শরীর কাঁপতে থাকে। মন ইতস্তত ঘুরতে থাকে। যে সাধনায় ঋষিগণ সমস্ত জ্ঞান সংগ্রহ করেছিলেন, যে সাধনায়, মুনিঋষিগন মহা আনন্দে থাকতেন, শান্তিতে থাকতেন, সেই সাধনার প্রতি তখন, আমাদের কাম-দুষিত চিত্তে আমাদের ভয়ের উৎপন্ন করে থাকে। আর বারবার মনে হয়, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। সাধনার দরকার নেই। সংসারের কর্দম অনেক আরামদায়ক স্থান। এমনকি এই সময় মানুষ যেখানে সাধনার কথা আলোচনা হয়, সেখানেও বসে থাকতে পারে না। যেখানে শাস্ত্রকথা আলোচনা হয়, সেখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। ভালো কথা ভাল্লাগে না।
ন চ শ্রেয়ঃ অনুপশ্যামি হত্বা স্বজনম আহবে
না কাঙ্খ্যে বিজয়ং কৃষ্ণ না চ রাজ্যং সুখানি চ। (৩১)
হে কৃষ্ণ, যুদ্ধে আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করার মধ্যে আমি কোনো মঙ্গল দেখতে পাচ্ছি না। বিজয় আকাংখ্যাও আমি করি না, রাজ্যও আমি চাই না, রাজসুখও আমি চাই না।
এতদিন যাদের আমি আপনজন ভেবে এসেছি, আজ সাধনার প্রাঙ্গনে তাদেরকেই হত্যা করতে হবে ? মানুষ জন্মের পর থেকেই শরীরের সেবা করে এসেছে, তাকেই সে ভালোবেসে এসেছে। ধীরে ধীরে ইন্দ্রিয়সুখ উপলব্ধি করতে শিখেছে। কিন্তু এখন সাধন করতে এসে দেখছি, এইসব ইন্দ্রিয়সুখ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এদেরকে পরিত্যাগ করতে হবে। রাজ্য অর্থাৎ স্থুল শরীর, আর রাজসুখ হচ্ছে শারীরিক সুখ, বা ইন্দ্রিয়সুখ। আমরা কেউ এই দুটোকে ত্যাগ করতে চাই না।
যদিও এটি আমাদের ভুল ধারণা যে সাধন করতে গেলে সবাইকে পরিত্যাগ করতে হবে। আমাদের অজ্ঞান এইসব ধারণার মধ্যে নিমজ্জিত। আসলে দেখবেন, সাধন সমরের শেষেও এই শরীর থাকবে। এই ইন্দ্রিয়শক্তিরও বিশেষ পরিবর্তন হবে না। শুধু যেটা করতে হবে, তা হচ্ছে সংযম। অসংযমী জীবন মোটেই সুখের নয়। অসংযমীরা ধীরে ধীরে সমস্ত সুখ থেকে অচিরেই অক্ষম ও বঞ্চিত হয়ে যায়। এমনকি শরীরের ব্যাধির কারন হচ্ছে অসংযম। তাই আমাদের সংযম পালন করতে শিখতে হবে। এটাই সাধনা। আহারে বিহারে আমাদের সংযম পালন করতে হবে। সংযম মানে উপবাস নয়, সংযম মানে পরিমিত আহার। সংযম মানে সংসার ত্যাগ নয়, সংযম মানে সংসারের অসারতা উপলব্ধি করা। ইন্দ্রিয়গুলো বিষয়ের দিকে আকৃষ্ট হবে, এটাই তাদের ধর্ম্ম । চোখ দেখবে, কান শুনবে, মুখ কথা বলবে, ত্বকে স্পর্শ অনুভব হবে। কিন্তু আমাদের যেটা করতে হবে, তা হচ্ছে, এই বিষয় থেকে প্রয়োজনীয়টুকু রেখে বাকিটা পরিত্যাগ করা। সংযম মানুষকে দেবমানবে পরিণত করতে পারে। লোভ থাকবে, হিংসা থাকবে, স্বার্থপরতা থাকবে, কিন্তু সাধকের কাজ হচ্ছে, এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। নিজের কর্তব্য কর্ম্ম পরিহার নয়, বরং নিজের কর্তব্য কর্ম্ম আরো সুনিপুন ভাবে পালনের ক্ষমতা লাভ হতে পারে, যদি আমরা সংযমী হতে পারি। আমাদের ধীশক্তি, আমাদের দূরদৃষ্টি-শক্তি বেড়ে যাবে, যদি আমরা সংযমী হতে পারি।
------------------------
১১.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (১৫)
শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ৩২-৩৪
কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দং কিং ভোগৈ জীবিতেন বা
যেষামর্থে কাঙ্খিতং নো রাজ্যং ভোগাঃ সুখানি চ। (৩২)
হে গোবিন্দ আমাদের রাজ্যে কি প্রয়োজন ? ভোগ বা জীবনে কি প্রয়োজন ? যাদের জন্য রাজ্য ও সুখের কামনা করি। (৩২)
এখানে নতুন একটা নাম আমরা পেলাম তা হচ্ছে গোবিন্দ। গো+বিদ+অ = গোবিন্দ। গো কথাটার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান। বিদ কথাটার অর্থ হচ্ছে লাভে বা প্রাপ্তিতে। অ অর্থে সর্বব্যাপী। তো মহাজ্ঞানের দ্বারা যে সর্ব্বব্যাপী সত্ত্বাকে পাওয়া যায়। তো জ্ঞানের প্রকাশ হলে কি হয়, আমাদের চৈতন্য হয়। তো যিনি চৈতন্যের আধাঁর তাকে কেউ বলেন, শ্রীকৃষ্ণ, কেউ বলেন বিষ্ণু। আসলে আমাদের শরীরের ভিতরে বাইরে যে চৈতন্যশক্তি বিরাজ করছে, জ্ঞানের মাধ্যমে সেই চৈতন্য শক্তি আমাদের অন্তরে প্রকাশমান হয়। একেই বলে গোবিন্দ।
ত ইমে অবস্থিতা যুদ্ধে প্রাণাং চ ত্যাক্ত্বা ধনানি চ
আচার্য্যাঃ পিতরঃ পুত্ৰস্তথৈব চ পিতামহাঃ। (৩৩)
সেই আচার্য্য, পুত্র পিতামহগন ধন ও জীবনের আশা পরিত্যাগ করে এই যুদ্ধে অবস্থিত। (৩৩)
মাতুলাঃ শ্বশুরাঃ পৌত্রাঃ শ্য়ালাঃ সন্মন্ধিন স্তথা
এতান্ ন হন্তং ইচ্ছামি ঘ্নতঃ অপি মধুসূদন। (৩৪)
মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক ও বৈবাহিকগন উপস্থিত হয়েছেন। হে মধুসূদন আমি নিজে হত হলেও, এদের নিধন করতে আমি ইচ্ছে করি না। (৩৪)
দেখুন সাধনার দ্বারা আমাদের বাসনার জয় হয়, ইন্দ্রিয় জয় হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে এই ইন্দ্রিয়জয় করে, বা বাসনার ত্যাগের মাধ্যমে আমরা কি পাবো - যার জন্য সাধনা করবো ? বিষয়সুখ ভোগের জন্যই তো জীবন। বিষয়সুখ থেকে নিস্পৃহ থেকে - জড়বৎ জীবন যাপনে কি লাভ ? এই জীবনের কোনো অর্থ হয় না।
আমাদের অনেকের ধারণা হচ্ছে, যোগসাধন করলে আমাদের মধ্যে অনেক অলৌকিক ক্ষমতা লাভ হবে, আমরা অনেক অনেক বিভূতির অধিকারী হতে পারবো। যা কেউ শুনতে পায় না তাই আমি শুনতে পারবো, আমরা আকাশমার্গে ভ্রমন করতে পারবো। ইচ্ছেমতো দেহকে স্ফিত করতে পারবো, সংকুচিত করতে পারবো। ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছু শক্তি আমাদের লাভ হবে। কিন্তু সাধনক্ষেত্রে গুরুবানী শুনে যখন জানতে পারে, এই সব অলৌকিক ক্ষমতা অর্জনের জন্য সাধনা হয়, বরং ইন্দ্রিয়গুলোকে সংযমী রাখা ও চিত্তবৃত্তিকে নিরোধ করাই যোগের উদ্দেশ্য তখন নবীন সাধকের মধ্যে হতাশা আসে। আমরা সবাই কর্ম্মে লিপ্ত হই কিছু পাবার আশায়, এখানে যোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে ত্যাগে সাফল্যতা অর্জন করা। আগে শুনেছিলাম, যোগের মাধ্যমে অনেক কিছু পাওয়া যায়, পরমানন্দ পাওয়া যায়। বিচিত্র সব ক্ষমতা যা সাধারণ মানুষের নেই, সেই সব ক্ষমতা লাভ করা যায়। এখন দেখছি, যোগের মাধ্যমে ত্যাগের প্রক্রিয়া শিখতে হয়। এখন সাধন করতে এসে আমাদের বৃত্তির নাশ তা সে শুভ হোক, বা অশুভ, যার সাহায্যে আমি দেখে-শুনে আনন্দ লাভ করবো, অর্থাৎ মন, ইন্দ্রিয়সকল যদি যুদ্ধে পরাভূত হয়ে পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হয়, তবে এই সুখভোগ আমি কার সাহায্যে করবো ? তাই মনে হয়, এই সাধনরূপ যুদ্ধ না করা ভালো। আবার এই ইন্দ্রিয়ের হাতে নিজেকে সমর্পন করলে, তারা সকলে আমাকে মেরে ফেলবে, কারন সাধনা হচ্ছে আত্মসমর্পন। আর আত্মসমর্পন না করলে আত্মচৈতন্যের বিকাশ থাকবে না। মানুষ যখন ভোগের মধ্যে ডুবে যায়, যা তার করতে বা শুনতে ভালো লাগে, তা করতে করতে সে মাত্রাতিরিক্ত ভোজন, বা মাত্রাতিরিক্ত সম্ভোগের মধ্যে একটা তৃপ্তি পেয়ে থাকে। এবং তখন তার মনে হয়, যা হয় হোক, মারা যাই যাবো, তথাপি আমি ৪০টা রাসগল্লা খাবোই, ১ কেজি মাংস খাবোই। এই সাময়িক সুখ, যার আসল পরিণতি দুর্ভোগ এমনকি ধংশ, সেই বোধ তখন তার মধ্যে থাকে না। অজ্ঞানবশতঃ বিচার-বুদ্ধির অভাবে এইসব করে থাকে।
অজ্ঞানতা বশতঃ অথবা লাভের আশায়, অথবা বিচারবুদ্ধির অভাবে আমাদের মনের মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্মে যে সাধনমাত্রই ইন্দ্রিয় নিগ্রহ। হ্যাঁ সাধন প্রক্রিয়া অবশ্য়ই ইন্দ্রিয় নিগ্রহ কিন্তু সাধনার প্রতক্ষ্য ফল হচ্ছে ইন্দ্রিয়ের তেজ বৃদ্ধি। ইন্দ্রিয়গুলো তখন ভোগের নিমিত্ত লালায়িত থাকে না। বরং এই শক্তিধর ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই আমরা তখন অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারি। এমনকি অনেক জটিল সাংসারিক সমস্যা সমাধানের সহজ রাস্তার সন্ধান আমরা পেয়ে থাকি।
-------------------------
১২.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (১৬)
শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ৩৫-৩৭
অপি ত্রৈলোক্য রাজ্যস্য হেতোঃ কিং নু মহীকৃতে
নিহত্য ধার্ত্তরাষ্ট্রান নঃ কে প্রীতিঃ স্যাৎ জনার্দ্দন। (৩৫)
হে জনার্দ্দন পৃথিবীর রাজত্বের দূরে থাকুক ত্রৈলোক্যরাজ্যের জন্যও ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রগনকে বধ করে আমাদের কি সুখ হবে।
পাপম এবং আশ্রয়েৎ অস্মান হত্বা এতান আততায়িনঃ
তস্মাৎ ন অর্হাঃ বয়ং হন্তুং ধার্তরাষ্ট্রান সবান্ধবান।
স্বজনং হয় কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব। (৩৬)
এইসব আততায়ীদের হত্যা করলে, আমাদের পাপই হবে. তাই আমাদের বন্ধুগনসহ ধৃতরাষ্টপুত্রদেরকে আমাদের হত্যা করা উচিত নয়। হে মাধব, স্বজনবৃন্দ-কে হত্যা করে কিভাবে সুখী হবো ?
শ্লোকে শ্লোকে পার্থক্য খেয়াল করুন। প্রথমে অর্জুন নিজের মত প্রকাশ করছিলেন, অর্থাৎ এদের মেরে আমাদের কোনো লাভ হবে না, পাপ হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এবার অর্জুন প্রশ্ন ছুড়ে মারছেন। কার দিকে প্রশ্ন ছুড়ছেন ? না ভাবি গুরুদেবের উদ্দেশ্য। এটাই আমাদের ক্ষেত্রে হয়, আমরা যখন গুরুদেবের কাছে যাই, তখন আমরা নিজেরদের মধ্যে অনেক ভ্রান্তজ্ঞান নিয়ে, গুরুদেবের কাছে যাই। সেখানে নিজের জ্ঞানের পরিচয় দিয়ে, গুরুদেবের মতের অপেক্ষায় থাকি। তার সমর্থনের অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু গুরুদেব যখন কোনো উত্তর না দিয়ে নীরবতা রক্ষা করেন, তখন তাকে আমরা প্রশ্ন করতে শুরু করে দেই। এটাই অর্জুন শুরু করেছেন। বলছেন এদের মেরে কি আমাদের সুখ হবে ? এদের মেরে আমরা কিভাবে সুখী হবো ?
প্রবৃত্তির নাশে আমরা সংশয়-শূন্য হতে পারি না। কেননা আমরা তো প্রবৃত্তির দাস। ধৃতরাষ্ট্র অর্থাৎ আমাদের মন। এই মন আমাদের হাজার বছরের সংস্কার যা আমাদের প্রবৃত্তির মধ্যে মিশে আছে, যার আছে ১০০ সন্তান, তাদেরকে নিয়েই এতদিন পথ চলেছি। এদেরকে মেরে, বা এদেরকে বাদ দিয়ে আমরা কিভাবে সুখী হতে পারবো। এঁরাই আমাকে এতদিন সুখ-দুঃখের মধ্যে লালনপালন করেছে। এদের সুখে আমি সুখী, এদের দুঃখে আমি দুঃখী। তো এদের সাথে আমাদের হাজার বছরের সম্পর্ক। এদেরকে বাদ দিয়ে আমরা সুখের কথা কল্পনাও করতে পারি না। তাই ভাবি গুরুদেবের কাছে, তার প্রশ্ন এদেরকে মেরে কি আমার সুখ হবে ? এদেরকে মেরে আমি কিভাবে সুখী হবো ?
আমাদের মনের স্বজন হচ্ছে আমাদের ইন্দ্রিয়সকল। এই ইন্দ্রিয়গুলো আমাদের মনকে বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ক'রে, এই ইন্দ্রিয়গুলো আমাদের বিষয় ভোগ করায়। এই ইন্দ্রিয়গণ যেমন আমাদের সাধন পথের কাঁটা, তেমনি সাধনার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের যে বিভূতির লাভ হয়ে থাকে, তা সবই ইন্দ্রিয়ভোগ্য। তো আমাদের মনে হয়, এই ইন্দ্রিয়গুলো ধংশপ্রাপ্ত হলে, আমাদের সাধনার উন্নতির ফল ভোগেও আমরা অক্ষম হয়ে যাবো। সুতরাং মনের সন্তানগণ অর্থাৎ ধার্তরাষ্ট্রগন, যদি সাধন-সমরে মারাই যায়, তবে আমাদের মনে কোনো সুখের আশা করতে পারি না। কেননা সন্তানহীন আমাদের মন তখন ম্রিয়মান, শোকাচ্ছন্ন হয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়বে । তাই আর সুখের আশা করা বৃথা।
যদ্যপি এতে ন পশ্যন্তি লোভোপহত চেতসঃ
কুলক্ষয় কৃতং দোষং মিত্রদ্রোহে পাতকম। (৩৭)
লোভে অভিভূত চিত্ত হওয়ায়, ওরা কুলক্ষয়জনিত ও মিত্রদ্রোহজনিত পাপরাশি দেখতে পাচ্ছে না।
আমরা মনের আবেগে যা কিছু করি না কেন, তাতে করে আমাদের শরীর ও ইন্দ্রিয়শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। আমরা বৃথা কাজে আমাদের আয়ুক্ষয় অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের অপব্যবহার করছি। যোগক্রিয়ার দ্বারা অর্থাৎ আসন-প্রাণায়াম দ্বারা আমরা আয়ুক্ষয়জনিত শ্বাস-ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এতে করে আমাদের পরমায়ু বৃদ্ধি পেতে পারে। আমাদের দুর্ম্মতি ইন্দ্রিয়সকলকে নিয়ে ভোগ-লালসায় লিপ্ত থেকে আসলে নিজেই ক্ষয়বৃদ্ধি করছে। আমরা তা বুঝতে পারি না। আমাদের শুভ বাসনা বা অশুভ বাসনা এই সমস্তই আমাদের সংস্কারজাত অর্থাৎ কুলসম্ভূত স্বভাব। এসবই আমাদের মন-বুদ্ধি থেকেই উৎপন্ন। এই মন-বুদ্ধিই আমাদের সংসারে আবদ্ধ করে রাখে, আবার এই মন-বুদ্ধিই আমাদের সংসার থেকে মুক্ত করতে পারে।
---------------------------
১৩.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (১৭)
শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ৩৮-৪১
কথং ন জ্ঞেয়ম অস্মাভিঃপাপাৎ অস্মাৎ নিবর্ত্তিতুম
কুলক্ষয় কৃতং দোষংপ্রপশ্যদ্ভিঃ জনার্দ্দন। (৩৮)
হে জনার্দ্দন, কুলক্ষয় জনিত পাপ লক্ষ করেও কেন আমাদের তা থেকে নিবৃত্তি হবার জ্ঞান হবে না ?
খেলাল করুন, আমরা যখন স্বেচ্ছায় সাধন করবার জন্য, ভাবি গুরুর কাছে উপস্থিত হই, তখন আমাদের আচরণ যেমন যেমন হয়ে থাকে, এখানে অর্জুনের মধ্যেও সেই একই উদ্বেগের কথা শোনা যাচ্ছে। নিজেই গুরুদেবকে প্রশ্ন করছে, আর গুরুদেবের নীরবতা হেতু, ভাবি শিষ্য তার নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই দিচ্ছেন ।
শরীরের যে সব সৈন্যদল এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে, অর্থাৎ আমাদের ললাট, মস্তক , স্তন, অঙ্গুলি, কান, উরু, কেশ, পার্শ্ব, মুখ, নখ, নিতম্ব, পৃষ্ঠ, গ্রীবা, নাভি, নয়ন, বাহু, নাসিকা, কুক্ষি, উদর, পদ, যোনী, চিবুক, শ্বাস, জানু, জঙ্ঘা, ভ্রু, ভ্রূমধ্য, গুল্ফ, কেশ, গ্রীবা, মস্তক, কর, কন্ঠ, বাক, দাঁত, মাংস, ত্বক, অস্থি, শিরা, নাড়ী, ইত্যাদি ইত্যাদি অর্থাৎ শরীরের সমস্ত কোষাদি এই যুদ্ধের সৈন্যবল।
এই নাড়ী সমূহের মধ্যে প্রধান দশটি হচ্ছে :
ইড়া - আমাদের মেরুদণ্ডের বাম পার্শ্বে
পিঙ্গলা - মেরুদণ্ডের ডান পার্শ্বে
সুষুম্না - মেরুদণ্ডের মধ্যে
হস্তিনী - ডান কানে,
গান্ধারী - বাম কানে
কুহু - গুহ্যদ্বারে
সরস্বতী - জিহ্বা মুলে
বারুনী - লিঙ্গমূলে
পুষ্পনাশা - বাম চোখে
অলম্বুষা - ডান চোখে।
অর্থাৎ জিহ্বায় একটি, কানে দুটো, চোখে দুটো, মেরুদণ্ডে তিনটি, গুহ্যদ্বারে একটা লিঙ্গমূলে একটা।
এদের সবাইকে নিয়েই সাধন সমর। তো সাধন করতে গিয়ে যদি আমাদের ইন্দ্রিয়শক্তি শরীরের শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তবে এই সাধনার দরকার কি ? এই প্রশ্ন সমস্ত নবীন সাধকের মানের মধ্যে উদয় হাওয়া স্বভাবিক। আবার এই প্রশ্নের উত্তর সে নিজেই খুঁজে নেয়। এবং সাধন ক্ষেত্র থেকে নিষ্কৃতি পেতে চায়। কিন্তু সে তো এখন ভাবি গুরুদেবের কাছে বসে। আসলে ভোগে আমাদের ইন্দ্রিয় বা শরীর যত দুর্বল বা শক্তিহীন হয়, সাধন ক্রিয়াতে তা হয় না। হ্যাঁ পরিমিত আহার ও কৃষ্র সাধনের ফলে হয়তো শরীর কৃশ হতে পারে, কিন্তু শরীরের ভিতরের জীবনীশক্তি, প্রাণশক্তি, উর্যাশক্তি বৃদ্ধি পায়। যারা সাধনা করেননি, তারা এই সত্য না জানার ফলে ভয়ে পিছিয়ে আসতে চায়। সাধনক্রিয়াতে আমাদের সহ্যশক্তি বৃদ্ধি পায়। সংযম সাধনার প্রাথমিক শর্ত। আহার-বিহারে সংযম অপরিহার্য।
কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্ম্মাঃ সনাতনাঃ
ধর্ম্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নং অধর্ম্ম অভিভবতি উত। (৩৯)
কুলক্ষয় হলে সনাতন কুলধর্ম্ম বিনষ্ট হয়, আর ধর্ম্ম নষ্ট হলে অধর্ম্ম সমস্ত কুলকে অভিভূত করে ফেলে।
আমরা পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত আচার-ব্যবহার মেনে চলে থাকি। কিন্তু আমরা জানিনা এই আচার-কাণ্ডের কি উদ্দেশ্য বা কিভাবে এইসব কুলকান্ড ক্রিয়া করে থাকে। আমরা এইসব আচার যা আমাদের পরম্পরা আমাদের মনের মধ্যে একটা চিরস্থায়ী বাসা করে নিয়েছে। আমাদের একটা অন্ধবিশ্বাস জন্মেছে, যে এইসব আচার না মানলে অমঙ্গল হবে। অথচ আমরা জানিনা, কিভাবে এসব আমাদের অমঙ্গল বা মঙ্গল করতে পারে। সাধন জগতে নবীন সাধকের মনেও অনেক প্রশ্ন জাগে, সাধন করতে গেলে যদি আমাদের ইন্দ্রিয় বিকল হয়ে যায়, যদি বিকারগ্রস্থ হয়, তবে আমাদের কি উপায় হবে ? আমরা বিষয়ভোগ করি, বা আমরা সাধনক্রিয়া করি, উভয় ক্ষেত্রেই ইন্দ্রিয়শক্তি সতেজ থাকা দরকার। আমাদের যে পাঁচ ইন্দ্রিয়, পাঁচ প্রাণ, মন, বুদ্ধি এগুলো না থাকলে বা এগুলো শক্তিশালী না থাকলে, বিষয়ভোগ বলুন, বা সাধনফল বলুন, কোনো কিছুই লাভ হবে না। এই শক্তিগুলোকেই বলা হয় কুল, অর্থাৎ জন্মসূত্রে প্রাপ্ত এই কুলশক্তি । এই ইন্দ্রিয়শক্তি আসলে আমাদের মেরুদণ্ড ও মস্তিষ্কের মধ্যে অবস্থিত। এইজন্য মেরুদন্ডকে বলা হয় কুলবৃক্ষ। সাধন সংগ্রামে এই কুলশক্তির ব্যবহার করতে হয়। কুলশক্তি নষ্ট হলে, জীবের প্রাণ, মন, ইন্দ্রিয় সবই ম্রিয়মান হয়ে যায়। ফলত সাধনার অগ্রগতি হয় না।
অধর্ম্ম অভিভবাৎ কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি কুলস্ত্রীয়ঃ
স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণশঙ্করঃ। (৪০)
হে কৃষ্ণ, কুল অধর্ম্মে অভিভূত হলেই কুলস্ত্রীগন ব্যভিচারিণী হয়। হে বৃষ্ণি বংশধর, কুলনারীগণ পতিতা হলেই বর্ণশঙ্কর উৎপন্ন হয়।
সঙ্করো নরকায় এব কুলঘ্নানাং কুলস্য চ
পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্ত পিণ্ডোদক ক্রিয়াঃ।(৪১)
বর্ণশঙ্কর কুলের এবং বংশ নাশকগণের নরকে গতি হয়। শ্রাদ্ধ-তর্পন বর্জিত হওয়ায় তাদের পিতৃপুরুষগণ নরকে পতিত হন।
এখানে একটা বিশেষ বিজ্ঞানের কথা বলা হচ্ছে। আমরা জানি পঞ্চভূতের মিশ্রণ হচ্ছে এই জীবজগৎ। তো মিশ্রণ জগৎ সৃষ্টির কারন। সোনার সঙ্গে খাদ মিশিয়ে গহনা তৈরী হয়। খাঁটি সোনায় গহনা হয় না। আবার কোনো কোনো মিশ্রণ বিস্ফোরকে পরিণত হয়। দুধের সঙ্গে ঝাল লবন মেশালে তা অখাদ্য, হয়ে যায়। রান্নার সময় পরিমিত মশলা (তেল, লবন, ঝাল) দিলে রান্না করা খাবার সুস্বাদু হয়। আবার মিশ্রনের তারতম্যে খাদ্য গ্রহণযোগ্য বা গ্রহণের অযোগ্য হয়ে যায়।
এই শরীর পঞ্চভূতের মিশ্রণ বৈ কিছু নয়, কিন্তু এই পঞ্চভূতের তারতম্যের জন্য, মানুষের মধ্যে বিভিন্ন গুনের সৃষ্টি হয়। শরীরে একটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। এই ভারসাম্যের অভাব হলে, শরীর অসুস্থ হয়, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়। আর শরীর ও মন যদি ব্যাধিগ্রস্থ হয়, তবে আমাদের কুণ্ডলিনী শক্তি বা শরীরে যে ব্রহ্মজ্যোতি আছে তার অপ্রকাশ হয়ে যায়। তখন সহস্রার পদ্ম থেকে সুধাক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং সাধনকালে যে অনুভূতি হবার কথা তা আর হয় না। তো আমাদের শরীর মন ভারসাম্যহীন হলে সদ্ভাবের অভাব ঘটে। সাধনায় যে আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশ হবার কথা তা ধীরে ধীরে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে একসময় লোপ পেয়ে যায়।
আমাদের শরীর মাতৃশক্তি ও পিতৃশক্তির মিশ্রণ। অর্থাৎ পিন্ডদেহ ও ভাণ্ডদেহ। আমাদের তথাকথিত মৃত্যুর পরে, এই মাতৃজ দেহ বা ভান্ড দেহ দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু পিতৃজ বা পিন্ডদেহ সহজে নষ্ট হয় না। এই পিতৃজ দেহ স্থুল নয়, আবার সূক্ষ্মও নয়। সূক্ষ্ম ও স্থূলের মাঝামাঝি। এই পিতৃৰ দেহ মাঝে মধ্যে দৃশ্যমান হয়ে থাকে। আবার ভান্ডদেহ না থাকলে জীব-আত্মা পিন্ডদেহে অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। এইসময় তার স্থূল দেহের চাহিদা থাকে। এমনকি সে ক্ষুধা- তৃষ্ণা অনুভব করে থাকে। আত্মীয় স্বজনদের দেখতে ইচ্ছে করে। তাদের কান্নাকাটি দেখলে, তার নিজের মধ্যেও কষ্ট লাগে। আবার ভান্ডদেহ না থাকায়, সে কোনো কাজ করতে পারে না। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে এই দেহ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। লঘু এই দেহে নানান রকম কষ্ট হতে থাকে। দুর্ঘটনায় মৃত্যু, আত্মহত্যা, যুদ্ধে মৃত্যু হলে জীবাত্মার এই অবস্থা হয়ে থাকে। এই দেহ প্রায় ১ বৎসরকাল সচল থাকে। এইসময় সে নানান রকম কষ্টের মধ্যে দিনযাপন করে থাকে।
হিন্দুশাস্ত্রে এই দেহ থেকে নিষ্কৃতি দেবার জন্য, পিন্ডদানের ব্যবস্থা আছে। এই পিন্ডদান সাধারণত পুত্র করে থাকে। কারন হচ্ছে, এই পিন্ডদেহের উপাদান বা মিশ্রণ আর পুত্রের পিন্ডদেহের মিশ্রণ একই বা কাছাকাছি থাকায়, মৃত ব্যক্তির সঙ্গে তার পুত্রের সান্নিধ্য অনুভব হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, মৃত পিতা যদি পুত্রের কাছ থেকে পিণ্ডোদক না পায়, তবে হয়তো দীর্ঘকাল এই পিন্ডদেহে অবস্থান করে থাকে। যদিও একসময় কালের নিয়মে ও প্রকৃতির নিয়মে এই দেহের বিনাশ ঘটে থাকে। কিন্তু পিন্ডদান এই পিন্ডদেহের বিলুপ্তিতে দ্রুত সাহায্য করে থাকে।
পিন্ডদেহ নষ্ট হয়ে গেলে, জীবাত্মা নিজ নিজ কর্ম্ম অনুসারে ভোগদেহ লাভ করে থাকে। এই ভোগদেহে তাকে কর্ম্ম অনুযায়ী কর্ম্মফল ভোগ করতে হয়। একেই বলা হয়ে থাকে স্বর্গ-নরক। এরপরে ভোগ শেষ হয়ে গেলে, জীবাত্মা আবার কর্ম্মক্ষেত্ৰ মর্তলোকে প্রবেশ করে থাকে, এবং মনুষ্যদেহে স্থিত হয় ।
পূর্বপূর্ব জীবনে অপূর্ন বাসনা, বা সংকল্প পূরণের নিমিত্ত সে আবার সেইমতো মাতা-পিতা নির্বাচন করে থাকে। অনেকের ধারণা মৃত্যুর পরে, পরবর্তী জীবনে সে আবার মানুষ হয়ে জন্ম গ্রহন করবেই তার কোনো মানে নেই। ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়, দেহ সে মানুষেরই পাবে, তবে পূর্ব-জীবনের সাধনার উন্নতির সুফল অনুযায়ী সে মাতা-পিতা ও তাদের দেহের আকৃতি পাবে।
এইখানে আরো একটা গুহ্য কথা বলে রাখি, সেটি হচ্ছে, মৃত্যুর পরে আমাদের যে পিন্ডদেহ বর্তমান থাকে, তাকে যোগীপুরুষগন উপেক্ষা করতে পারেন । বেঁচে থাকতে আপনারা দেখেছেন সন্নাসীগণ এই পিণ্ডোদক ক্রিয়া করে থাকেন। যোগসাধনায়, পিণ্ডোদক ক্রিয়ার কথা বলা আছে। এই পিন্ড দেওয়া হয় সাধনার দ্বারা। যোগের কথায় কুল্ডলিনী শক্তির আর-এক নাম হচ্ছে পিন্ড। ইনিই জীবাত্মার চৈতন্যশক্তি। যোগের নিরন্তর অভ্যাস দ্বারা মূলাধারের এই শক্তিকে চৈতন্যযুক্ত করতে হয়। এই শক্তি যখন চৈতন্যযুক্ত হয়, তখন এই শক্তি সুষুম্নারন্ধ্রে প্রবেশ করে, ধীরে ধীরে এই শক্তি একেকটি চক্র ভেদ করে আজ্ঞাচক্র হয়ে সহস্রারে প্রবেশ করে। এবং সেখানে এই শক্তি স্থিত হয়। এই আজ্ঞাচক্রে কুণ্ডলিনী শক্তির স্থিতিতে পিন্ডদান সম্পন্ন হয়। এই আজ্ঞাচক্র হচ্ছে বিষ্ণুপাদ। এই অবস্থায় জীব ত্রিকালজ্ঞ হয়ে যায়। পরমজ্ঞান লাভ হয়। আর এই জ্ঞানের দ্বারাই জীব উন্মুক্ত অবস্থা লাভ করে থাকে। না হলে জীবের পুনঃ পুনঃ জন্ম অবধারিত। দেহে থেকে দেহান্তরে গমন চলতেই থাকে।
১৪.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (১৮)
শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ৪২-৪৬
দোষৈঃ এতৈঃ কুলঘ্ননাং বর্ণসঙ্করকারকৈঃ
উৎসাদ্যন্তে জাতিধৰ্ম্মাঃ কুলধর্ম্মাঃ চ শাশ্বতাঃ। (৪২)
কুলনাশকারীদের এসব বর্ণসঙ্কর দোষ দ্বারা শাশ্বত জাতি-ধর্ম্ম ও কুলধর্ম্ম নষ্ট হয়।
বক ও কচ্ছপের মিলনে অদ্ভুত বকচ্ছপ হতে হতে পারে। ঘোড়া ও গাধার মিলনে খচ্চর হতে পারে। কিন্তু তখন আর বক বা কচ্ছপ, কিংবা ঘোড়া আর গাধা বলে কিছু থাকে না। এখন তো অনেক শঙ্কর গাছের উৎপাদন হচ্ছে, যা অধিক ফলদায়ক । দাসীপুত্র বিদ্বান বিদুরের জন্ম হতে পারে।তো শঙ্কর মানেই খারাপ এমন নয়। কিন্তু এতে করে মূল জাতির বিলোপের সম্ভাবনা। আমাদের সাধন জগতেও আজ বহু বর্ণশংকরের জন্ম হতে দেখা যাচ্ছে। কিছুদিন ভারত সেবাশ্রমে, কিছুদিন রামকৃষ্ণ মিশনে, আবার সব ছেড়ে দিয়ে, পাহাড়ে কোনো সাধুর মধ্যে বিভূতির যোগ দেখে, তাতে আকৃষ্ট হওয়া। আসলে স্থিরতা না থাকলে সাধনপথে বেশিদূর এগুলো যায় না। আসলে একটা ধারাবাহিকতা ভালো। প্রথমে কর্ম্মযোগ, তারপরে জ্ঞানযোগ, তারপরে ভক্তিযোগ। কেউ বলেন, আগে জ্ঞানযোগ তারপরে কর্ম্মযোগ তারপরে ভক্তি যোগের সাধনা ভালো। কিন্তু আমরা দেখেছি, কেউকেউ কর্ম্ম ও জ্ঞান বাদ দিয়ে হরিনামের মাধ্যমে সরাসরি ভক্তিযোগে গা ভাসতে চান। শ্রীশ্রী চৈতন্যদেব সংসার করেছেন, জ্ঞান সংগ্রহ করেছেন। তিনি ছিলেন সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিত। তার পরে তিনি ভক্তির সাগরে ডুব দিয়েছেন।
আমি দেখেছি, জ্ঞান লাভের জন্য, আমাদের প্রয়াস কম। অথচ ভগবানকে পাবার জন্য, কিছুদিন যোগক্রিয়া আরাম্ভ করে দিলেন। কিছুদূর অগ্রসর হবার পর, এমনকি সামান্য বিভূতি লাভের পর, আসল লক্ষের থেকে বিচ্যুত হয়ে, বিভূতি নিয়ে মেতে রইলেন। যেজন্য সাধন আরম্ভ করেছিলেন, সেসব ভুলে সাধনার বিকৃত অবস্থায় নিজেকে নিয়োগ করলেন। এই বিরোধীভাবেই বলা হয় ব্যভিচার। আর এই ব্যভিচারের ফল জন্ম-জন্মান্তর ধরে ভোগ করতে হয়।
উৎসন্ন কুল ধর্ম্মানাং মনুষ্যানাং জনার্দ্দন
নরকে নিয়তং বাসো ভবতি ইতি অনুশুশ্রুম। (৪৩)
হে জনার্দ্দন, যাদের কুল ধর্ম্মাদি নষ্ট হয়ে গেছে, সেইসব মানুষের চিরদিন নরকবাস হয়ে থাকে - এইরকমই আমরা শুনেছি।
আমরা কুল-ধর্ম্ম বলতে বুঝি আমাদের পারিবারিক ধারা। কিন্তু সাধন জগতে যোগীর ধর্ম্ম হচ্ছে সর্বদা আত্মাতে স্থিত থাকা। আবার যিনি সদাই আত্মাতে স্থিত থাকেন, তার পক্ষে বাইরের কুলধর্ম্ম পালন সবসময় শুধু অসম্ভব নয়, অপ্রয়োজনীয়ও বটে। সাধনায় যাঁরা মশগুল থাকেন, তাদের বাহ্যিক ক্রিয়াকর্ম্ম এমনকি জীবধর্ম্মও ঠিক ঠিক ভাবে রক্ষিত হয় না। তিনি যে এগুলোকে ইচ্ছে করেন, বা অশ্রদ্ধা ভ'রে করে থাকেন, তা নয়। আসলে এই অবস্থায়, কোনো কুলধর্ম্মই পালনের অবস্থায় তিনি থাকেন না। জ্ঞানী পুরুষের এই স্বভাব। তিনি ইন্দ্রিয়াদি সংযমের মাধ্যমে বাহ্যিক ক্রিয়াহীন হয়ে অবস্থান করেন। এই অবস্থায় বাক-সংযম হয়ে থাকে। তাই তিনি কথা কম বলেন, এইসময় তাঁর ক্ষুধা-তৃষ্ণা রোহিত হয়ে যান। তিনি তখন অমৃতসুধা অর্থাৎ সাহস্রদল কমল থেকে নিঃসৃত সুধা পান করতে থাকেন। এসময় তার মধ্যে উন্মনা ভাবের উদয় হয়। অথাৎ তাঁর সুষুম্না রন্ধ্রে প্রাণবায়ু সহজগতি প্রাপ্ত হয়। মনের স্থিরতা আসে। ইন্দ্রিয়সকল বাইরে বিচরণ না করে, অন্তরে মধ্যে স্থিত হয়। বুদ্ধি প্রয়োগের ইচ্ছে থাকে না। বিষয়ভোগ বা তদজনিত চিন্তা থাকে না।
অহোবত মহৎ পাপং কর্ত্তুং ব্যবসিতা বয়ম
যৎ রাজ্যসুখলোভেন হন্তুং স্বজনং উদ্যতাঃ। (৪৪)
হায়, আমরা রাজ্সুযখ লোভে স্বজনগনকে বিনাশ করতে উদ্যত হয়ে মহাপাপে প্রবৃত্ত হয়েছি।
অর্জুনের মনে হচ্ছে, রাজসুখ লাভের জন্য স্বজনদের বধ করবার মতো কোনো উদ্যোগ নেওয়া উচিত নয়। এতে মহাপাপ হবে। আমরা জানি, সাধনার ফলে আমাদের অনেক যোগৈশ্বর্য্য লাভ হবে ঠিকই কিন্তু এতে দেহের ভোগ বা পার্থিব সুখভোগ করবার স্পৃহা নষ্ট হয়ে যাবে। তো সাধন ক্রিয়াতে লিপ্ত হলে, আমাদের সংসারসুখ দেহসুখ, ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টিতে যা সুখ সেই সুখের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। তাই আমাদের মতো সাধারন মানুষের সাধনক্রিয়া শুরুর প্রথমেই এইসব বিপরীত বুদ্ধি এসে উপস্থিত হয়।
যদি মাং অপ্রতিকারম অশস্ত্রং শস্ত্রপানয়ঃ
ধার্ত্তরাষ্ট্রা রণে হনু তৎ মে ক্ষেমতরং ভবেৎ। (৪৫)
যদি প্রতিকারে উদ্দম রোহিত হয়ে নিঃশস্ত্র অবস্থায় আমাকে শাস্ত্রধারী ধৃতরাষ্ট্র পুত্রগণ হত্যাও করে, তাতে আমার অধিকতর মঙ্গলই হবে।
ইন্দ্রিয় ধর্ম্মে আসক্তি জনিত সুখ জীবের চরম প্রাপ্তি। আমরা টাকা পয়সা, ধন দৌলত, স্ত্রী-পুত্র,আত্মীয় পরিজন নিয়ে সুখে ঘরকন্না করতে চাই। মনের নানান রকম চাহিদা পূরণ হলেই আমাদের ভালো লাগে। লোভ-লালসা-বাসনা-কামনা-সংকল্প-বিকল্প ইত্যাদি বিষয়গুতে আমাদের আত্মসমর্পন করতে আমাদের ভালো লাগে। তখন মনে হয়, গোল্লায় যাক এই কঠোর সাধন জীবন। এগুলোকেই বদ্ধ জীবে হিতকর বলে মনে করে। আমাকে অনেকেই বলেছেন, আমি ভগবানকে চাই না, কিসে টাকা-পয়সা আসবে সেটা বলুন। পেতে ক্ষিদে নিয়ে ভগবানের পাশে বসে থাকে কার ভালো লাগে ? তো এটাই বদ্ধ জীবের দশা। এটাই ইন্দ্রিয়শক্তির মহিমা। এখন থেকে বেরুনো কঠিন।
সঞ্জয় উবাচ :
এবম উক্ত অর্জুনঃ সংখ্যে রথোপস্থ উপাবিশৎ
বিসৃজ্য সশরং চাপং শোক-সংবিগ্ন-মানসঃ। (৪৬)
সঞ্জয় বললেন :
শোকাকুল অর্জুন এই কথা বলে ধনুর্বান ত্যাগ করে রথের উপরে বসে পড়লেন।
মনের মধ্যে যখন শোক, উদ্বিগ্নতা বাসা বাধে তখন সাধনার কথা ভালো লাগে না। সাধনে স্থির হওয়াও যায় না। এইসময় মেরুদন্ড শিথিল হয়ে যায়। উৎসাহে ভাটা পড়ে। মন হয় বিক্ষিপ্ত। আর মেরুদন্ড যখন শিথিল হয়, তখন প্রাণবায়ু ঠিক পথে পরিচালিত না হয়ে অর্থাৎ উর্দ্ধগামী না হয়ে নিমাভিমুখী হয়ে যায়। একেই বলে হাত থেকে ধনুক খসে পড়া। শোক হচ্ছে আমাদের তমঃগুণের কাজ। তমোগুণের বৃদ্ধি হলে শোক, নিদ্রা, আলস্য শঙ্কা চিত্তকে ঘিরে ধরে। এইসময় গুরুকৃপা আবশ্যক। ভাগ্যবানের গুরু জোটে, আর দুর্ভাগার গতি হয় নিম্নগামী। জন্ম-জন্মান্তর ধরেই জীব এইভাবের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে।
শ্রীমদ্ভগবৎ গীতার প্রথম অধ্যায় বিষাদযোগে এখানেই শেষ হলো।
----------------------------------