Monday 27 December 2021

যথার্থ গুরু দুর্লভ কেন ? গুরুধ্যান / শাম্ভবী মুদ্রা

 


যথার্থ গুরু দুর্লভ কেন ? 

আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক, তার স্ত্রীর অনুপ্রেরণায়, কয়েকদিন দীক্ষা নেবার কথা ভাবছিলেন, আর গুরুদেবের চরণে দেবার জন্য দানসামগ্রী কিনে রেখেছিলেন। কিন্তু কোনো কারনে সে আর হয়ে ওঠেনি। তো কিছুদিন আগে সেই  সুযোগ এলো।  তাই অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে  দীক্ষা নিতে গিয়েছিলেন। আমাদের বাড়ির কাছে একটা রাম ঠাকুরের আশ্রম আছে। সেখানে নাকি ত্রিপুরা থেকে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন, দীক্ষা দেবার জন্য। তো একটা ঘরে, প্রায় ২০০ লোক (যার মধ্যে বেশিরভাগ মহিলা) জড়ো হয়েছেন, দীক্ষা নেবার জন্য।  ভদ্রলোক ঘন্টা দুই ধরে, নানান  নীতিবাক্যের কথা শোনালেন। শেষে যখন ভক্তমন্ডলী বিরক্ত হয়ে উঠে যাবার মুখে, তখন দীক্ষা ক্রিয়া আরম্ভ করলেন ।  মাইকে দীক্ষামন্ত্র শোনালেন। দুই মিনিটে দীক্ষা হয়ে গেলো। আমার পরিচিত ভদ্রলোক, বলছেন, এইভাবেই দীক্ষা হয় নাকি ? আমি তো শুনেছিলাম, কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে, গুরুদেব মন্ত্র শোনান। আর দীক্ষামন্ত্র নাকি সারাজীবন গোপন রাখতে হয়। মন্ত্রের কথা কাউকে বললে নাকি মন্ত্রের শক্তি নষ্ট  হয়ে যায়। ভদ্রলোককে  বিমর্ষ মনে হলো।   আমি বললাম, একেই হয়তো বলে নির্বীজ দীক্ষা।  অর্থাৎ যে বীজে কখনোই গাছ হতে পারে না। এইসব দীক্ষা সাধারণত দেওয়া হয়, বালক, মূর্খ, বৃদ্ধ, স্ত্রী, ও ব্যাধিগ্রস্থদের। এরা শাস্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞ। এদের আচার-নিয়ম পালনেও অনীহা। এদের আছে কেবল  গুরুভক্তি সম্বল । এই গুরুভক্তিও  আসলে অন্ধভক্তির নামান্তর। এদের দিয়ে যেটা হয়, সেটা হচ্ছে, সংগঠনের সদস্য সংখ্যাবৃদ্ধি। এদের কাছ থেকে অল্পবিস্তর টাকা-পয়সাও পাওয়া যায়, যা সাংগঠনিক কাজে, মন্দির ইত্যাদি নির্মাণের কাজে  লাগতে পারে।    

 দেখুন, সমস্ত শিক্ষার জন্য যেমন শিক্ষক প্রয়োজন, তেমনি আধ্যাত্মিক জীবনে উন্নতি করতে গেলে আচার্য্য প্রয়োজন।  কিন্তু আচার্য্য ও গুরুদেব এক নয়। দেহধারী আচার্য্য আবশ্যক।  কিন্তু দেহধারী গুরু আবশ্যক নয়।  ভাগ্যক্রমে যদি কেউ পেয়ে যান দেহধারী গুরু, তো ভালো, কিন্তু পেতেই হবে এমনটি নয় । জীব ও শিব অভিন্ন। ভগবান স্বয়ং জীব সেজে মায়ার জগতে আত্মপ্রকাশ করেছেন। কিন্তু জীবের  বিড়াম্বনা হচ্ছে,  জীব স্বভাবতঃ বহির্মুখী। জীবের নিত্যস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে জ্ঞানগুরু, বা যোগগুরু, যিনি প্রতক্ষ্য জ্ঞানের অধিকারী। এই নির্মল জ্ঞানের প্রাপ্তিতে সাধকের কর্ম্ম-বাসনার বিনাশ হয়। আর বাসনার বিলুপ্তিতে কর্ম্মফল সঞ্চয় হয় না। কিন্তু এতেকরে পরমাত্মার সাথে আত্মার যোগসাধন হয় না। পরমাত্মার সাক্ষাৎ পেতে গেলে প্রকৃত দীক্ষার  প্রয়োজন। এই দীক্ষা দিতে পারেন, একমাত্র শিবস্বরূপ সৎগুরু। যিনি নিজে জীবন্মুক্তির রস আস্বাদন করেন। বাসনার ত্যাগে ও প্রারব্ধ কর্ম্মফল ভোগের শেষে মানুষের পৌরুষজ্ঞানের উদয় হয়। তখন তিনি বাস্তবিক শিবস্বরূপে স্থিতি লাভ করেন। এই পৌরুষজ্ঞানের উদয় হতে পারে, একমাত্র ষট্চক্র ভেদের ফলে। এইজন্য যোগক্রিয়া আবশ্যক। যোগক্রিয়া ব্যাতিত শরীর শুদ্ধ হতে পারে না। আর শরীর শুদ্ধ না হলে কোনো গুরুর সাধ্য নেই আপনার মধ্যে দীক্ষার মাধ্যমে চৈতন্যশক্তি সঞ্চালন করে দেবে। যে কোনো শিক্ষক  তার অর্জিত জ্ঞানের সামান্যই ছাত্রের  মধ্যে বিতরণ করতে পারেন। কেননা ছাত্রের গ্রহণ ক্ষমতা শিক্ষকের মতো নয়, আবার শিক্ষকের মধ্যেও সীমাবদ্ধতা আছে।  কিন্তু ছাত্র একসময় শিক্ষক হতে পারে, নিজের চেষ্টায়। তাই নিচেষ্ট হয়ে আধাত্মিক জগতের সুফল শুধু গুরুকৃপাতে হয়ে যাবে এমন ভাবার কোনো কারন নেই।

দীক্ষা দুই প্রকার।  বাহ্যদীক্ষা ও অন্তর দীক্ষা। যোগের বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেখানোকে বাহ্যদীক্ষা বলা হয়। আবার অন্তরে জ্ঞানের উন্মেষ ঘাঁটানোকে অন্তরদীক্ষা বলা হয়। এই অন্তরদীক্ষা আবার বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। দৃষ্টিদিক্ষা, স্পর্শদীক্ষা, শব্দদীক্ষা, ধ্যান দীক্ষা ইত্যাদি ইত্যাদি। দৃষ্টিদ্বারা তেজের সঞ্চার, স্পর্শদ্বারা তেজের সঞ্চার, মন্ত্রদ্বারা তেজের সঞ্চার, মৌনথেকে তেজের সঞ্চার। এই দীক্ষা তাদেরই দেবার ক্ষমতা আছে, যারা সিদ্ধিলাভ করেছেন, এবং নিজের শক্তিকে সঞ্চালিত করবার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।  তাই শুধু সিদ্ধিলাভ করলেই দীক্ষা দেবার ক্ষমতা অর্জিত হয় না। শক্তি সঞ্চালন করবার ক্ষমতা অর্জন করতে হয়। আপনি হয়তো ৬০ কেজি মাল মাথায় নিতে পারেন, কিন্তু আপনি ইচ্ছে করলেই  আপনার শক্তি ৫ বছরের সন্তানের মধ্যে সঞ্চালন করে, তাকে ৬০ কেজি বহন  ক্ষমতা রাতারাতি বাড়িয়ে দিতে পারেন না। তেমনি যিনিই সিদ্ধি লাভ করেছেন, তিনিই এই অন্তর দীক্ষা দেবার  অধিকারী নাও হতে পারেন। যিনি গুরুপদে আসীন হবেন, তিনি অবশ্য়ই জগৎগুরুর সঙ্গে নিজের অভিন্নতা অনুভব করবেন। এবং একমাত্র এই অবস্থায়, স্বয়ং শিব   দেহধারী গুরুর মধ্য দিয়ে জগৎগুরু ক্রিয়া করে থাকেন। কিন্তু যার মধ্যে এই তদাত্মবোধ জাগ্রত হয়নি, তার পক্ষে গুরু হবার প্রয়োজন নেই। মানুষের কি সাধ্য আছে  পরমাত্মাকে শিষ্যের মধ্যে সঞ্চালিত করবার, যদি না তিনি স্বয়ং নিজেকে প্রকাশ করেন।  তো এই ধরনের তথাকথিত গুরুর খপ্পরে পড়ে নিজের অগ্রগতির পথ রুদ্ধ  হয়ে যায়। কেননা, গুরু কাজ হচ্ছে শিষ্যের হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তো গুরু না এগুতে পারলে, শিষ্যের এগোনো হয় না। এছাড়া তথাকথিত গুরু শিষ্যের দল ভারী করে, নিজেই আর এগুতে পারেন না। ফল হয়, গুরু শিষ্যের উভয়ের অধঃপতন । 

দিব্যজ্ঞান পরমশিবে নিত্য বিরাজ করছে। এর কণামাত্র সিদ্ধপুরুষগন পেয়ে থাকেন। এই সিদ্ধগুরু স্থূল দেহে অবস্থান করেন না। এর পরে দেহধারী মনুষ্যগুরু। পরমেশ্বর থেকে যে জ্ঞান দিব্যপুরুষের মধ্যে সঞ্চার হয়, তারই একটা অংশ মনুষ্যগুরুর মধ্যেও  সঞ্চারিত হয়ে থাকে।  গুরুশক্তি যদিও এক কিন্তু মাত্রাভেদ আছে। কিন্তু গুরু আলাদা হলেও  জানবেন, জ্ঞান কিন্তু একই। মৎস্যেন্দ্রনাথের গুরু গোরক্ষনাথ।  আচার্য্য শংকরের গুরু গোবিন্দপাদ, গোবিন্দপাদের গুরু গৌড়পাদ, গৌড়পাদের গুরু স্বয়ং শুকদেব। এই শুকদেব ছিলেন, সিদ্ধগুরু। শুকদেবের গুরু রাজা জনক, রাজা জনকের গুরু ঋষি অষ্টাবক্র। অষ্টাবক্রের গুরু ছিলেন, ঋষি উদ্দালক। তো এটা একটা পরম্পরা। আর ভগবত ইচ্ছাতেই আসে এই পরম্পরাক্রম। 

আসলে, শ্রীভগবানই গুরু। তিনিই জীবের উদ্ধারকর্তা। তিনিই জীবকে মায়াপাশ  থেকে উদ্ধার করে, পরম্পদে স্থাপিত করতে সমর্থ। এই সামর্থ আর কারো নেই। পাতঞ্জল  যোগসূত্রেও ঈশ্বরকে পূর্বগুরুবর্গেরও গুরু বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনিই অনাদি গুরুতত্ত্ব। এই কথাগুলো শুনে ভদ্রলোক নিষ্প্রভ হয়ে গেলেন। কথাগুলো না বললেই হয়তো ভালো হতো। কিন্তু বিশ্বাস করুন, কথাগুলো বেরিয়ে গেলো, আমি বলতে চাইনি। 

------------------ 

মহাত্মা রামঠাকুরের সাধনপ্রক্রিয়া : গুরুধ্যান 

 আমার সেই পরিচিত ভদ্রলোক, যিনি রামঠাকুরের কাছ থেকে মন্ত্র দীক্ষা নিয়েছিলেন, তিনি মাঝে মধ্যে আমার কাছে আসেন, বসেন। কিছু প্রশ্ন করেন না। তার এই নীরবতা আমাকে  একদিন মুখ খোলালো। তো তাকে একদিন সাধন সম্পর্কে  কিছু বলতেই হলো। 

প্রথমেই বলি, আমি রামঠাকুরের সাধন পথের  পথিক নোই।  আসলে শ্রীশ্রী রামঠাকুরের আশ্রিত একজন মহাপুরুষ ছিলেন, তাঁকে সবাই জানতো  মাধব পাগলা নামে । এই মাধব পাগলাকে শ্রীশ্রী রামঠাকুর যেভাবে সাধনার ক্রমের  কথা বুঝিয়ে বলেছিলেন, সেই ক্রম অনুসারে, এই সাধন পদ্ধতি।  এগুলো তার বিভিন্ন বাংলা চিঠিতে প্রকাশিত হয়েছিল।  এই মাধব পাগলা ঠাকুর একসময় কাশীর পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন। তো তার কাছ থেকে  সংগ্রহ করে, ড. গুপীনাথ কবিরাজ এই সাধন প্রক্রিয়ার কথা লিখে গেছেন। 

ভদ্রলোককে বললাম দেখুন, যেকোনো সাধন পথে দৃঢ়বিশ্বাস, গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা, আর ভগবানের প্রতি ভক্তি থাকা চাই। এই তিনটি সাধন জীবনের পাথেয়।  যেকোনো সাধন পথেই আপনি যান, সেই সাধন পথের  যিনি প্রবর্তক তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা থাকা আবশ্যিক। আপনি  নিশ্চই শ্রীশ্রী রামঠাকুর প্রতি শ্রদ্ধাবান। তা যদি না হতো তবে আপনি নিশ্চই রামঠাকুরের আশ্রমে যেতেন না। যাই হোক তার প্রবর্তিত সাধন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনার মন্ত্রদাতা গুরুদেব কিছু বলেছেন কিনা জানি না। তবে আমি আপনাকে সেই প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনাকে কিছু কথা বলি। আপনার যদি ভালো লাগে, তবে এই পথে আপনি গুরুদেবকে যথাযথ সন্মান করতে পারবেন। 

মহাত্মা রামঠাকুরের সাধনপ্রক্রিয়া : গুরুধ্যান 

প্রথম প্রক্রিয়া :  শ্রীশ্রী রামঠাকুরের  মূর্তি, বা গুরুমূর্তি একটা উত্তম স্থানে স্থাপন করুন। প্রতিদিন নিয়ম করে, গন্ধ-পুষ্পাদি দ্বারা নানা উপাচার্যের মাধ্যমে সাধ্য অনুসারে পূজা পাঠ করুন।  কিছু স্তোত্র পাঠ করুন। প্রথম দিকে এসব কাজে আপনার শরীর সাধ নাও দিতে পারে। দৈহিক ক্লেশ অনুভব করতে পারেন ।  এমনকি আপনার মধ্যে যে মানসিক চাঞ্চল্য আছে, বা বিষয়চিন্তা আছে সেগুলো নিশ্চই আপনার ভিতর থেকে সহজে যাবে না, মাঝে মধ্যেই এগুলো আপনার মনে জেগে উঠবে।  কিন্তু তার জন্য বিচলিত হবার কিছু নেই।  আপনি শুধু প্রথম দিকে, যন্ত্রের মতো নিয়ম রক্ষা করে যান। অর্থাৎ নিয়ম করে, গুরুপূজো শুরু করুন।  গুরুপূজো হয়ে যাবার পরে, গুরুমূর্তির প্রতি একদৃষ্টিতে কিছুক্ষন দর্শন করুন।  আর মনে মনে আপনি যে মন্ত্র পেয়েছেন, তার জপ্ করতে থাকুন। 

সাংসারিক  সমস্ত কাজ কর্ম্মের মধ্যেই গুরুদেবকে স্মরণ করতে থাকুন। শ্রীগুরুর আশ্রিতরূপে নিজেকে ভাবতে থাকুন। মনে মনে ভাবুন সমস্ত কাজই গুরুদেবের নির্দেশে সম্পাদিত হচ্ছে। আপনি নিমিত্ত মাত্র। এইভাবে সংসারের প্রতিটি কাজের মধ্যে গুরুদেবকে অর্থাৎ রামঠাকুরকে দেখতে থাকুন।তার চরণ বন্দনা করুন। তার অবয়বের ধ্যান করুন। গুরুদেবের চরণকমল থেকে শুরু করে, গুরুদেবের মুখমন্ডলের ধ্যান করতে থাকুন। এইভাবে ধ্যানের একটা অভ্যাস গড়ে তুলুন। হোক না তা ৫-১০ মিনিট।  সকাল-সন্ধ্যা একটা নির্জন স্থানে গুরুদেবের মূর্তির সামনে বসে মেরুদন্ড সোজা করে এই ধ্যানের  অভ্যাস করতে থাকুন। কিছুদিনের মধ্যেই দেখবেন, এই ধ্যান অভ্যাস আপনার নেশায় পরিণত হয়ে গেছে।  তখন ধ্যান না করে আপনি থাকতে পারবেন না। একদিন ধ্যানে ব্যাঘাত হলে, আপনার মনে কীযেন হয়নি - কীযেন হয়নি বলে মনটা আনচান করতে থাকবে। এইভাবে ধ্যান যখন পরিপক্কতা লাভ করবে, তখন আপনি দ্বিতীয় পদক্ষেপ নিন।  

দ্বিতীয় পর্যায় : এই পর্যায় গুরুদেবের পূর্ণস্বরূপের চিন্তন ও জপ-ধ্যান করা আবশ্যক। এই ধ্যানের অভ্যাস করতে করতে একদিন দেখবেন, একটা শব্দ তা সে শো-শো শব্দ হতেপারে, শঙ্খধ্বনি হতেপারে, মধুর বাঁশির ধ্বনি হতেপারে, ঘন্টার ধ্বনি হতেপারে। এই ধ্বনি শুনতে শুনতে আপনার ভিতরে কান্না পেতে পারে। আপনার চোখ দিয়ে আনন্দ-অশ্রু নিঃসরণ হতে পারে। শরীরের মধ্যে একটা কম্পন হতে পারে, এইসময় একটা পুলক অনুভব হতে পারে। এগুলোকে অস্বাভাবিক ভাববার কোনো কারন নেই। এগুলো শারীরিক কোনো রোগও নয়। বরং এইসব লক্ষণ আপনার আধ্যাত্মিক উন্নতির লক্ষণ। এইসময় শ্রীগুরু মূর্তি মানসপটে স্থায়ীরূপে রাখবার চেষ্টা করুন। এইভাবে শ্রীগুরুমূর্তিতে মন স্থির হলে, তৃতীয়  স্তরে যেতে পারবেন। 

তৃতীয় পর্যায় : এইবার  শরীরকে শ্রীগুরুর ইচ্ছেতে চলতে দিন। শরীরের বাইরে ভিতরে শ্রীগুরুকে দর্শন করতে থাকুন। এতে আপনার বিষয়াশক্তি ক্রমশ লোপ পেতে থাকবে। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, হিংসা, দ্বেষ, ভীতি, ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকবে। মন হবে শান্ত।  মনের মধ্যে একটা প্রসন্নতার ভাব জেগে উঠবে। সাংসারিক ভাবগুলোর প্রাধান্য কমতে থাকবে। আর শ্রীগুরুর উপরে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা স্থায়ী ও দৃঢ় হবে। গুরুকৃপার সফলতা স্বরূপ,  চিত্তের মধ্যে, অন্তরের  অন্তঃস্থলে  চিন্ময়সত্তার আবির্ভাব অনুভব হতে থাকবে। সমস্ত পঞ্চতত্ত্ব, সমস্ত জ্ঞান ইন্দ্রিয়, সমস্ত  কর্ম্মেন্দ্রিয় গুরুশক্তির প্রভাবে চলতে থাকবে। নিজের মধ্যে কোনো কর্তৃত্ববোধ থাকবে না। চিত্ত তখন নাদবোধে স্থিতি  লাভ করবে। গুরু ও শিষ্যের মধ্যে একটা অভেদভাবের উদয় হবে। এর পরে এই অভেদতত্ত্ব বা গুরুদেবের সঙ্গে একাত্মবোধের ফলে গুরুর মধ্যে নিজেকে অভেদ বলে প্রত্যক্ষ করবেন। এইসময় যে কোনো সাংসারিক দায়িত্ব, আনন্দের  সঙ্গে সুসম্পন্ন হবে। নিজেকে মুক্ত পুরুষ, নির্ভিক পুরুষ, বলে মনে হবে। পৃথিবীর বুকে তখন আপনি নির্ভিক নিঃসংশয় হয়ে বিচরণ করতে পারবেন।   তখন ধর্ম্ম-অধর্ম্ম, পান-পুন্য, সুখ-দুঃখ এমনকি আপনার যে পূর্বার্জিত  সংস্কারও  আপনাকে বিচলিত করতে পারবে না। তখন আপনি অর্থাৎ সাধক সমস্ত কর্তব্য, সমস্ত দায়িত্ব গুরু চরণে সমর্পন করে, জীবন ধারণ করতে থাকবেন। 

এই অবস্থা প্রাপ্তির পর, শাম্ভবী মুদ্রার অভ্যাস শুরু  করুন। শাম্ভবী মুদ্রা সম্পর্কে পরে একদিন বলবো। নামজপ যেমন চলছিল, তেমনি চলতে থাকুক। এতে করে আপনার দেহাভিমান দূর হয়ে যাবে।  অর্থাৎ আপনি যে গুণাতীত সেই  সৎ- পুরুষ,  আপনার ভিতরে সেই জ্ঞানের উদয় হবে। 

এই অবস্থায় স্বয়ং গুরুদেব আপনার ভিতরে প্রবেশ করবেন। এবং নানান প্রকার অলৌকিক কার্য্য আপনার দ্বারা সংগঠিত হতে থাকবে। যার  কোনো ব্যাখ্যা আপনি জানেন না, এমনকি এটি যে কিভাবে আপনার দ্বারা হচ্ছে, তাও আপনি বুঝতে পারবেন না। কিন্তু হয়তো দেখবেন, আপনার মুখ দিয়ে যা কিছু বেরুচ্ছে,, তা বাস্তবে ঘটে যাচ্ছে, এমনকি আপনার কথায়, অসুস্থ মানুষ সুস্থ  হয়ে উঠছে, আপনার করুণাদৃষ্টি যার উপরে পড়ছে, তিনি অভিভূত হচ্ছেন। এই অবস্থায়, আপনার মধ্যে একটা অহংকারের উৎপত্তি হবে। আর অহংকার আপনার আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।  সুতরং এই বিষয়ে বিশেষ সাবধানতা ও সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। এই অহংকার কাটিয়ে উঠতে পারলেই, আপনি পরবর্তী পর্যায়ে  উন্নীত হতে পড়বেন। 

চতুর্থ পর্যায় : এই অহংকারকে অতিক্রম করতে গেলে, আপনাকে গুরুভজন করতে হবে। আর জানবেন, এই ভজন আপনার গুরুশক্তি দ্বারাই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।  এইসময় সাধকের জীবসত্ত্বার নিজস্ব  সংস্কার লোপ পায়  না। তাই সংস্কার বা সাধকের ভাব অনুযায়ী তা প্রকাশ হতে থাকে। এই ভাবরস চিত্তকে  আনন্দ দান করে। আবার এই আনন্দ গুরুতেই বা ইষ্টেই অর্পিত হয়ে যায়। অর্থাৎ সাধক এইসময় ইষ্টদেব, বা গুরুদেবের দর্শন অনুভব করেন। এইসময় নিজস্ব  কোনো সত্ত্বা থাকে না। তখন শুধু ইষ্টসত্ত্বাতে সাধক স্ফূরিত হতে থাকে। আর ইষ্টপ্রীতির জন্য তখন সমস্ত ইন্দ্রিয় উদ্দীপ্ত হয়।  সমস্ত ক্রিয়া তখন ইষ্টপ্রীতির জন্যই সম্পাদিত হয়ে থাকে। মন, বুদ্ধি, জ্ঞান, অহংকার ইত্যাদি আমাদের পূর্বপূর্ব সংস্কার ছেড়ে ইষ্টের অনুসন্ধানে লীন হয়ে যায়। যতক্ষন  শরীর থাকে, ততক্ষন পর্য্যন্ত স্মরণ মনন থাকে। একেই পরাভক্তি বা ঈশ্বর  ভক্তি বলা হয়ে থাকে। এই তীব্র ঈশ্বরপ্রেম তখন বাইরে স্বপ্নবৎ, আর ভিতরে অখণ্ড দিব্যজ্যোতি রূপে প্রকটিত থাকে। তখন সাধক চিন্ময় রস-বিগ্রহ বা সচ্চিদানন্দ স্বরূপ হয়ে যান। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

(মূলসূত্র : সাধুদর্শন ও সৎপ্রসঙ্গ - ৩ খন্ড - ডঃ গোপীনাথ কবিরাজ। পৃষ্ঠা ৮১) 

শাম্ভবী মুদ্রা 

শাম্ভবী মুদ্রা একদিকে যেমন গুহ্যবিদ্যা  অন্য দিকে এই বিদ্যা গুরুবিদ্যা।  আমরা যে স্বামী বিবেকানন্দের যোগমূর্তি দেখি, বা ঠাকুর রামকৃষ্ণের যে সমাধি মূর্তি দেখি, বা বাবা লোকনাথের যে ধ্যানস্থ মূর্তি দেখি, তা আসলে এই শাম্ভবী মুদ্রা করা ছাড়া আর কিছু নয়। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, যে অবস্থায় যোগীর মন অন্তরের  দিকে  লক্ষ্য রাখে এবং বহির্জগতের দিকে যোগী উদাসীন থাকে, তাকেই শাম্ভবী মুদ্রা বলে ।  এই সময় অপলক দৃষ্টিতে যোগী  তাকিয়ে থাকে, কিন্তু বাহ্য  জগতের থেকে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে তিনি অন্তর্মুখী হয়ে থাকেন। যোগীর বাহ্যদৃষ্টি তখন নিম্ন মুখী, চোখের তারা নিশ্চল।  এইসময় মন ও প্রাণবায়ু সুষুম্নাতে লীন করে দেন। এই মুদ্রা গুরুকৃপাধন। এই অবস্থায় যোগী বহির্জগৎ সন্মন্ধে সর্বভাবনা শূন্য এবং অন্তর্জগৎ ব্রহ্মভাবনায় পরিপূর্ন থাকে। চোখের  দৃষ্টি নাসিকার অগ্রভাগে, স্থাপন করতে হবে। মনকে জ্যোতিযুক্ত করে, ভ্রূযুগলকে কিঞ্চিৎ উর্দ্ধে তুলে, শিবনেত্রের  অবস্থায়, নাকের ডগায় দৃষ্টি স্থাপন করতে হবে। 

যারা সাধনার মধ্যে লিপ্ত আছেন, তারা চোখ  বুজলেই জ্যোতি দর্শন করে থাকেন।  এই জ্যোতি প্রথম দিকে ক্ষণস্থায়ী, আবার অস্থির থাকে। নাকের ডগায় দৃষ্টি  নিবদ্ধ করে, জ্যোতিকে স্থির করতে হয়। কিছুক্ষনের মধ্যে মনের গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। মন তখন উন্মনা অবস্থায় হৃত হয়। 

শাস্ত্র বলছে, যে যোগী অর্থ-উন্মিলিত লোচনে, স্থির মনে, নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্ট স্থির রেখে ইড়া  ও পিঙ্গলা  দ্বারা প্রবাহিত বায়ুকে লীন করে নিঃশব্দে অবস্থান করেন, তিনি অনন্ত-বিশ্ব-বীজ স্বরূপ শ্রেষ্ট জ্যোতির্ময় তত্ত্বকে প্রাপ্ত হন। সেই বস্তুই শ্রেষ্ঠ ব্রহ্ম। ইড়া ও পিঙ্গলায় যতক্ষন বায়ু প্রবাহিত হয়, ততক্ষন এই জ্যোতির্ময় ব্রহ্মের ধ্যান নিষিদ্ধ। সর্বাগ্রে ইড়া-পিঙ্গলার বায়ু প্রবাহকে রুদ্ধ  করে, সুষুম্না নাড়ীতে প্রবাহিত করতে হবে তারপরেই এই শাম্ভবী মুদ্রা বা এই জ্যোতির্ময় ব্রহ্মের ধ্যান হতে পারে।             

শাম্ভবী মুদ্রার কথা যোগগুরুগন সযত্নে কুলবধূর ন্যায় রক্ষিত করে থাকেন। 

আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোর অর্থাৎ চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা,ত্বক - এই ইন্দ্রিয়গনের রাজা হচ্ছেন আমাদের মন। মনের নির্দেশ ব্যাতিত আমরা কোনোকিছুই দেখতে শুনতে পাই না।   আবার মনের প্রভু হচ্ছেন প্রাণবায়ু। তাই প্রাণবায়ু স্থির হলে, আমাদের মন স্থির হয়ে যায়। এই প্রাণের প্রভু হচ্ছে লয় অর্থাৎ কালের নিবিচ্ছিন্ন গতি, বা নিবৃত্তি। এই লয়ের স্থানকে বলা হয়, ব্রহ্মস্থান। আর এই লয়ের প্রভু হচ্ছে, নাদ। এই কারনে লয় নাদব্রহ্মকে অবলম্বন করেই অবস্থান করে থাকে। মন-প্রাণে লয় হলে,  একপ্রকার আনন্দের উৎপন্ন হয়। লয় শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক ক্রিয়াকে দূর করে।  বিষয়বুদ্ধিকে নষ্ট করে। এমনকি বৈষয়িক উন্নতির ব্যাপারে, কোনো প্রকার কায়িক চেষ্টা থাকে না। মন বিষয়ের ব্যাপারে নির্বিকার হয়ে যায়। যোগীগণ এই লয়ের  সাধনা করে থাকেন। এই লয় অবস্থা একমাত্র যোগীপুরুষই  উপভোগ করে থাকেন।  এই অবস্থার কথা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। সংকল্পের উচ্ছেদ হলে, কায়িক ও বাচনিক সমস্ত চেষ্টার নিঃশেষে হলে, তবেই এই ধরনের লয়-অবস্থা দৃষ্ট হয়। প্রাণ ও মনের লয় না হলে, সাধনায় সিদ্ধিলাভ হতে পারে  না। প্রাণের লয় হলে মনের লয়সিদ্ধি আপনা-আপানি এসে যায়। 

এখন কথা হচ্ছে, কিভাবে প্রাণের লয় হতে পারে ? দেখুন, প্রথমেই দরকার আমাদের একটা ধর্ম্মিক পরিবেশ। তারপরে দরকার উপযুক্ত সাধুসঙ্গ।  এর পরে দরকার উপযুক্ত গুরু। উপযুক্ত গুরুর সন্ধান পেলে, তারই অনুগ্রহে তারই আদেশে আমাদের এই ইড়া-পিঙ্গলায় প্রবাহিত বায়ু, সুষুম্নার মধ্যগত ব্রহ্মরন্ধ্র পথে নিরুদ্ধ হবে। এইভাবে প্রাণবায়ুকে নিরুদ্ধ করতে পারলেই, প্রাণের লয় সম্ভব হয়। আর প্রাণের লয়  হলেই মনেরও লয় হয়ে থাকে। যোগগুরুগন বলে থাকেন, যোগ-অভ্যাস দ্বারা প্রাণবায়ু সুষুম্না নাড়ী দ্বারা সঞ্চরণ করে ব্রহ্মরন্ধ্রে স্থিত হলে মন প্রশান্ত হয়ে যায়।  একেই যোগ গুরুগন নির্বাণ বলে থাকেন। 

বলা হয়ে থাকে, যিনি প্রাণকে লয় করতে পেরেছেন, তিনি কালকেও পরাজিত করতে পেরেছেন। বাহ্যিক জগতে যেমন চন্দ্র সূর্য কাল ধারণ করছে, তেমনি আমাদের শরীরের মধ্যে সূর্য নাড়ী ও চন্দ্র নাড়ী কালকে ধারণ করছে।  আর সুষুম্না নাড়ীরুপা সরস্বতী নদী সেই চন্দ্র-সূর্য-কৃত দিবারাত্রি স্বরূপ কালকে গ্রাস করে থাকেন। যখন সূর্য নাড়ীর মধ্যে প্রাণবায়ু  প্রবাহিত হয়, তখন দিন, আর যখন চন্দ্র নাড়ী দ্বারা স্বাসবায়ু  প্রবাহিত হয়, তখন রাত্রি। লৌকিক দিবারাত্রির অর্থাৎ ২৪ ঘন্টার মধ্যে যোগের দৃষ্টিতে ১২টি দিবারাত্র হয়ে থাকে। এইভাবে কাল অনুসারে, জীবের আয়ু পরিমাপ করা হয়।

যখন সুষুম্না নাড়ীমার্গে প্রাণবায়ু ব্রহ্মরন্ধ্রে বিলীন হয়, তখন দিবারাত্রি স্বরূপ কালের অভাব বশতঃ সুষুম্নাকে কালভোক্ত্রী বলা হয়ে থাকে। সুতরাং যতক্ষন ব্রহ্মরন্ধ্রে প্রাণবায়ু লিন থাকে, ততক্ষন জীবের জীবনকাল বা আয়ু  বৃদ্ধি পায়। দীর্ঘকাল সমাধির অভ্যাস করলে, যোগীপুরুষ আগে থেকে আয়ুষ্কাল নির্নয় করতে সক্ষম হন।  এবং ব্রহ্মরন্ধ্রে প্রাণবায়ুকে স্থাপন করে কালকে রুখে দিতে সক্ষম হন। তখন  আপন ইচ্ছে অনুযায়ী দেহত্যাগ করতে পারেন। 

পাখির বাসার মতো এই শরীরে, আত্মা বাস করে থাকেন। এখানে অসংখ্য, বা বলা হয়,  ২২ হাজার নাড়ীর সমাবেশ।  এর মধ্যে সুষুম্না নাম্নী নাড়ীর মধ্যে শাম্ভবী শক্তি অর্থাৎ শিব-শিবা অর্থাৎ শম্ভূ শক্তি নিহিত আছে। এই শক্তি ভক্তদের সুখ প্রদান করে থাকেন ।  কেউ বলেন, চিৎস্বরূপ আত্মার অভিব্যক্তির স্থান, এই সুষুম্না নাড়ী । অর্থাৎ এখানেই ধ্যানের মাধ্যমে আত্মসাক্ষাৎকার হয়ে থাকে। আমাদের ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ী এই সুষুম্না নাড়ীর সঙ্গে সংযোগ করতে পারে, যদি আমরা এই শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে পারি। আর এটি কেবলমাত্র নিরন্তর অভ্যাসের দ্বারাই সম্পন্ন হতে পারে।  প্রাণ বায়ু যখনই সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে প্রবাহিত হতে শুরু করে, তখনই সাধকের মধ্যে উন্মনা ভাবের উদয় হয়। এইসব গুহ্যতত্ত্ব গুরুমুখে শুনে, নিজের নিরন্তর অভ্যাসের মাধ্যমে  উপলব্ধ হতে পারে।  নতুবা  এসব কথা  শোনা কথা হয়েই থাকবে। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

-------------------                


  


















   

       

   

Monday 13 December 2021

আমিত্বের বিনাশ



আমিত্বের বিনাশ হবে কি করে ?

ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলছেন, আমি মো'লে ঘুচবে জঞ্জাল। আমরা মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমি যদি মরেই গেলাম, তাহলে আর থাকলো-টা  কি ? এই যে ঠাকুর বলছেন, আমি  মো'লে, এই অমিটা  কে ? আবার সমস্ত ধর্ম্মের মূল কথাই হচ্ছে, অহংকার বা আমিত্বের বিনাশ ক্রিয়াই আসলে ধর্ম্ম-কর্ম্ম। এখানে আবার কথা হচ্ছে আমিত্ব ঠিক আমি নয়। তো আমি আর আমিত্বের মধ্যে পার্থক্যটা কি ? প্রথমে বুঝে নেই "আমি"টা  কে ? "আমি" হচ্ছে এই শরীর মন ও আত্মা। তো এই শরীর না থাকলে আমি বলে কিছু থাকে না। আবার ধরুন শরীর আছে কিন্তু তার মধ্যে চেতনশক্তি নেই, তাহলেও আমি বলে কিছু থাকে না। আবার শুধু আত্মা অর্থাৎ শরীর মন বিহীন একটা আত্মা - এখানেও আমি বলে কিছু থাকে না। তো আমি বলতে বুঝি শরীর মন ও আত্মার বা  চেতনশক্তির একটা মিশ্রিত সত্ত্বা । 

এবার আমিত্ব মানে আমার-আমার  এই বোধশক্তি। অর্থাৎ আমার শরীর, আমার মন, আমার আত্মা।  আমার ছেলে-মেয়ে-মা-বাবা-আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব।  আবার আমার বাড়ি-গাড়ি-বিষয়-সম্পত্তি ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার আমার জ্ঞান, আমার বুদ্ধি, আমার চেতনা। এগুলো সবই আমার যা আমাদের আমিত্ব বোধ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তো আমির মধ্যে আছে দুটো বোধশক্তি।  একটা হচ্ছে "আমি" আর একটা হচ্ছে "আমার আমিত্ব"। এই দুটো বোধশক্তি ঘিরেই আমার এই বর্তমান অস্তিত্ত্ব ঘুরপাক খাচ্ছে। আর এই আমিকে পরিতৃপ্তি দেবার জন্য, তার ইচ্ছেকে পরিপূর্ন করবার জন্য, তার খেয়ালখুশীকে চরিতার্থ করবার জন্য আমরা বেঁচে আছি। আমরা সবাই যেন এই "আমি"র দাস।  আর তাকে খুশি করবার জন্য আমার জন্ম।  আমি আমার দেহকে ভালো রাখতে চাই। আমরা জিহ্বা-কে  খুশি করতে চাই, আমরা কানকে খুশী  করতে চাই, আমরা আমাদের পেটকে খুশি রাখতে চাই।  আমরা আমার চোখকে খুশি করতে চাই। এমনকি আমি আমার মনকে খুশি রাখতে চাই। সবশেষে বলা চলে আমরা সবাই আমার আত্মাকে খুশি করবার জন্য যেন বেঁচে আছি।  আমার কাজই  হচ্ছে এদেরকে খুশি রাখা, ভালো রাখা।

তা না হয় হলো, কিন্তু কেই এই দাস বা দস্যু যার কাজ হচ্ছে খুশি করা। আর কেই বা প্রভু যাকে খুশি করা দস্যু বা  দাসের কাজ ? মানুষ  ভাবে , সে তার সন্তান-স্ত্রী-বন্ধু -বান্ধবদের ভালোবাসে। কিন্তু সত্যিই কি সে এদের ভালো বাসে ? নাকি অন্য কোনো খেলা আছে এর মধ্যে ? আমরা দেখেছি, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা হচ্ছে না।  পিতা পুত্রের মধ্যে বনিবনা হচ্ছে না। আর যখনই বনিবনার অভাব হচ্ছে, তখনই ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে। পুত্র তার স্ত্রীকে নিয়ে বাবা মা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। স্বামীকে ছেড়ে স্ত্রী চলে যাচ্ছে। স্ত্রীকে ছেড়ে স্বামী চলে যাচ্ছে। তো, তবে সে কাকে ভালোবেসেছিলো ? কারজন্য সে প্রাণপাত পরিশ্রম করতো ?  শরীরকে সে ভালোবাসে, শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রতঙ্গকে সে ভালোবাসে। কিন্তু সেই  শরীরের পায়ে বা হাতে যখন পচন  ধরে, যখন অসার হয়ে যায়, এমনকি শরীরের কিডনি যখন কাজ করতে পারছে না, তখন সে নিজেকে বাঁচানোর জন্য এই অঙ্গগুলোকে শরীর থেকে সে  আলাদা  করে দিতে দ্বিধা করে না। তো কাকে সে ভালোবেসেছিলো ? কাকে নিয়ে সে বাঁচতে চায় ? আসলে সে নিজেকে ভালোবাসে। এই নিজ হচ্ছে আমাদের অহংবোধ।  

আসলে সে তার অহংকে  ভালোবাসে। এই অহংকে ভালোবেসেই সে ভালো মন্দ সব করে থাকে। আর এই অহংয়ের মধ্যেই ভেসে ওঠে আমি-আমার ভাব। এই অহংকে নিয়েই আমাদের পথচলা।  এই অহংকে নিয়েই গড়ে ওঠে তার ব্যক্তিত্ত্ব।  এই অহংকে ঘিরেই সে বেঁচে থাকতে চায়। এই অহংই স্বার্থপর করে তোলে, জীবকূলকে । সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, এই অহংই জীবের  আশ্রয়স্থল। এখান থেকে বিচ্যুত হতে চায় না সে । এই অহংই সেই শুদ্ধ আত্মার অশুদ্ধ রূপ। তাহলে কি আত্মা অশুদ্ধ হয় ? না  আত্মা কখনো অশুদ্ধ হয় না। সোনা সোনাই থাকে, কেবল নোংরার আবরণ সোনাকে সাময়িক ভাবে অশুদ্ধ করে তোলে। এই আবরণ-এর উৎপাটন হলেই শুদ্ধ আত্মা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। আত্মাকে যখন জীবসত্ত্বা ঘিরে ফেলে তখন আত্মা অশুদ্ধ বলে প্রতীয়মান হয়। একেই বলে অহং যা আসলে একটা স্বার্থপর "আমি" . তাই ঠাকুর বলছেন, আমি মো'লে ঘুচবে জঞ্জাল। ব্যক্তির যত সমস্যা। সমষ্টির যত  সমস্যা। পরিবারের যত  সমস্যা, সমাজের যত সমস্যা, রাষ্ট্রের যত সমস্যা সবই এই অহং-এর স্বার্থ রক্ষা করার জন্য। অর্থাৎ স্বার্থপরতা। সবাই চাইছে তার অহংকে খুশি করতে । আর এটা জীবের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু এক অহংকে খুশি করতে গিয়ে যখন অন্যের অহংয়ের আঘাত হানে তখন শুরু হয় দ্বন্দ, তখন শুরু হয় দুঃখ-কষ্ট। একে  নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে, মানুষ ধীরে ধীরে মহামানবে পরিণত হতে পারে ।এই স্বার্থপরতাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করাই  সভ্যসমাজের কাজ। এই কারণেই রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে থাকে। এই কারণেই  ধর্ম্মে নীতিকথার প্রয়োজন হয়। একারনেই যুগযুগ ধরে অবতারপুরুষ আসেন, আমাদের নীতিকথা শোনাতে। মানুষ যত নিঃস্বার্থ হতে পারবে, মানুষ তত সভ্য হতে পারবে, মহামানব হতে পারবে । 

যারা গায়ত্রী মন্ত্রের যথার্থ অর্থ জেনে গায়ত্রী মন্ত্রের মনন করেন, তারা জানেন, এই মন্ত্রে একবার মনকে বহির্মুখী বিশ্বসত্ত্বার (ভূর্ভুবঃ স্বঃ) সঙ্গে বিলিয়ে দিতে হয়, আবার একবার অন্তর্মুখী ঈশ্বর সত্ত্বার (ভর্গো) সঙ্গে মিলিয়ে দিতে হয়। আর নিরন্তর এই জপের অভ্যাস  মানুষের মনকে অহং থেকে বিশ্বব্যাপী করে তোলে, আবার অন্তরীণ করে তোলে।  আমি বলে আর কিছু থাকে না তখন। ধর্ম্ম বলে থাকে, অহংকে সরিয়ে দিয়ে, ঈশ্বরকে বসাও। শুধু আমি নয়, তুমি। তত্ত্বমসি। তুমিই সেই। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে মহত্তম সত্ত্বা আছে সেটাই ঈশ্বর। সেই মহত্তম সত্ত্বার কাছে নিজেকে সমর্পন করো। মন,প্রাণ, ইচ্ছে,স্বার্থ, ভালো-মন্দ সব সমর্পন করো। যিনি প্রতিনিয়ত এই চিন্তন করতে পারেন, নিরন্তর  অভ্যাস করতে পারেন, তিনি একসময় অহং-এর মধ্যেই  ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে পারেন। যাকিছু মহত্তম যা  কিছু শ্রেষ্ট যা কিছু ভালো, সবই সেই ঈশ্বরের প্রতীক। যিনি ভূতেরও ভূত, যিনি কারণেরও কারন, যিনি প্রাণেরও প্রাণ, যিনি আত্মারও আত্মা তিনিই পরমাত্মা। এই মহতের মধ্যে মনকে নিবিষ্ট করলে, মানুষ সুখ-দুঃখের অতীতে পৌঁছে যান। সবার সুখে তার সুখ, সবার দুঃখে তার দুঃখ।  একেই হয়তো  বলে মুক্তি। কেননা তখন আমার আমি বলে কিছু থাকে না। ব্যক্তিসত্ত্বা বলে কিছু থাকে না। বিচ্ছিন্নতাবোধ বলে কিছু থাকে না। সকলের সঙ্গে তিনি একাত্ম অনুভব করেন। একেই বলে আমিত্বের বিনাশ। এক অদ্বৈত অনুভূতি। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

------------------------ 

দুটো পাখির গল্প 

উপনিষদের এই গল্প আমাদের সবার জানা। একই গাছে দুটো পাখি বসে আছে। একটি অন্তর্মুখী নির্বিকার, নিষ্ক্রিয়, অন্তর্মুখী, শান্ত, দ্রষ্টা মাত্র। কিন্তু সচেতন। আর একটা বহির্মুখী, চঞ্চল, সক্রিয়। একই গাছে থাকে কিন্তু দ্বিতীয় পাখিটি ঘুরে ঘুরে গাছের ফল আস্বাদন করে। গাছের ফল কখনো কষা, কখনো টক, কখনো মিষ্টি। আর এই দ্বিতীয় পাখিটি গাছের ফল খেয়ে, কখনো খুশি, কখনো বিরক্ত , কখনও সুখী কখনো দুঃখী। তো সুখ-দুঃখের দোলায়, ভালোলাগা মন্দলাগা অনুভূতিতে তার মেজাজ কখনো খুশ তো কখনো দুরমুশ। প্রথম পাখিটি কিন্তু স্থির অচঞ্চল, বাইরের কোনো কিছুই তাকে প্রভাবিত করতে পারে না। 

গল্প তো গল্পই হয়। কিন্তু এই গল্পের মধ্যে একটা বিশেষ তাৎপর্য্য আছে। এই একটা গল্পই মানুষের অন্তরের শান্তির পথকে বিশ্লষণ ক'রে, শান্তিপথ নির্দেশ দিয়েছে। 

আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, মানুষ একটা অভিশপ্ত জীব।  আমরা বিভিন্ন পুরান কাহিনীতেও দেখি অমুক এই কাজ করে, অমুক দেবতা,  স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, আর এই মৃত্যুপুরীতে জন্ম নিয়েছেন। আর এই পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করে, অসহ্য কষ্ট সহ্য করে, শেষে ভগবৎ কৃপায়, ইহ জীবন থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছেন। মানুষের মধ্যে যেমন ভগবান  অনেক ক্ষমতা দিয়েছেন, তেমনি দিয়েছেন অনেক অক্ষমতা, সিমাবদ্ধতা।  এই সীমা  সে অতিক্রম করতে পারে না। মানুষ যেমন নিজের চেষ্টায়, নিজের ক্ষমতায়, বাড়ি তৈরী করেছে, গাড়ি বানিয়েছে, শীত-তাপ থেকে নিজেকে রক্ষার ব্যবস্থা করেছে, বিজ্ঞানের প্রয়োগে বিবিধ স্বাছন্দের ব্যবস্থা করেছে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ছুটছে, তবু তার অভাব মেটেনি। কোথায় যেন একটা আশঙ্কা, কোথায় যেন একটা ভয়, কোথায় যে একটা অতৃপ্তি ।  মৃত্যুকে সে জয় করতে পারে নি,  শারীরিক ব্যাধি-যন্ত্রনা  থেকে সে মুক্ত নয়।  এমনকি বার্ধক্য থেকেও তার রেহাই নেই। জীবন অনেক আরামপ্রদ হয়েছে, কিন্তু তার তৃপ্তি নেই, সে সর্বতঃ সুখী নয়। 

কিন্তু কিসের অভাব ? কিসের অতৃপ্তি ? আর এই অভাব বা অতৃপ্তির কারনই বা কি ? আমরা আজ এই প্রশ্নের জবাব খুঁজবো। আসলে এই প্রশ্নের জবাব আছে ওই দুটি পাখির গল্পে। মানুষ সর্বদা বহির্মূখী ওই দ্বিতীয় পাখিটির মতো। মানুষকে হতে হবে অন্তর্মুখী ওই প্রথম পাখিটির মতো। আমরা পৃথিবীর বহির্জগতের পরিবর্তন নিয়ে ব্যস্ত।  আমরা অন্তরের  দিকে ফিরেও তাকাই না। আমরা যদি অন্তর জগতের পরিবর্তন করতে পারতাম, তবে হয়তো  সম্পূর্ণ সুখী হতে পারতাম। সভ্যতার বিকাশ হয়েছে, কিন্তু মানুষ যেন আরো বর্বর হয়েছে। আদিম যুগের মানুষটির মধ্যে যেন কোনো পরিবর্তন হয় নি। অথবা হলেও  যা হবার কথা তা হয় নি।  আরো যেন বহির্মুখী হয়ে  উঠেছি আমরা।  

তাই আমাদের বহির্জগতের পরিবর্তন হলেও, আমাদের অন্তর্জগতের কোনো উন্নতি হয়নি। আজ মানুষের ক্রোধ, ঘৃণা, ঈর্ষা, ভয়, স্বার্থপরতা মনুষ্য সমাজকে ঘিরে রেখেছে। সাম্যবাদের মতো কিছু গালভরা বুলি হয়তো এসেছে, কিন্তু এগুলো মেনে চলবার লোক নেই বললেই চলে। দেখুন শত্রু মিত্রর সঙ্গে সমব্যবহার করা সহজ  কথা নয়। জ্ঞানী অজ্ঞানীর সঙ্গে একই কথা বলা যায়  না।  সবল দুর্বলের মধ্যে পার্থক্য না করে পারা  যায় না। বৈষম্যই জগতের বাস্তব। এখনও  ধনী-গরিব আছে, শিক্ষিত-অশিক্ষিত আছে, উন্নত-অনুন্নত আছে। তো আমরা সবাই সমান এই কথাটার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। কিন্তু এই অসাম্যের পুঁথি দিয়েই আমাদের মালা গাঁথতে হবে। অনৈক্যের মধ্যে ঐক্য আনতে  হবে। এই ঐক্যবোধ যখন জাগবে, তখন দেখবেন একের আঘাত অন্যকে পীড়া দিচ্ছে। কার উপরে আপনি রাগ করবেন ? কাকে আপনি ঘৃণা করবেন ? কাকে আপনি দূরে সরিয়ে দিতে চাইছেন ? আসলে কার কত সম্পদ আছে, বা কে কত শিক্ষিত হয়েছে, তার উপরে আমাদের শান্তি নির্ভর করে না। আপনি পদের দৌলতে, সম্পদের গর্বে, শারীরিক ক্ষমতায়  বলীয়ান হয়ে অন্যের উপরে প্রভুত্ত্ব করছেন। কিন্তু মনে মনে আপনি অসহায়। সম্পদ হারাবার ভয়, সন্মান হারাবার ভয়, শারীরিক অসুস্থতার ভয়, আপনাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আর এর ফলে আপনি নিজের উপরেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে অসহায় হয়ে গেছেন। মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই ক'রে, দুর্বলের সঙ্গে লড়াই ক'রে, অশিক্ষিতের সঙ্গে লড়াই ক'রে, নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমান করতে ব্যস্ত।  কিন্তু সে নিজের সঙ্গে লড়াই করে না। নিজের সঙ্গে সে যদি লড়াই শুরু করতে পারে, তবে সে বুঝতে পারবে সে কতটা  অসহায়  হয়ে রয়েছে। সে ভিতরে ভিতরে কতটা দুর্বল। 

এইখানে ধর্ম্মের একটি ভূমিকা আছে। ধর্ম্ম এমন কতকগুলো নীতির উপরে প্রতিষ্ঠিত যা মেনে চললে, একটা নির্দিষ্ট লক্ষে পৌঁছানো যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে,  এই নীতিগুলো মূলত এক হলেও, বিভিন্ন মহাপুরুষ বিভিন্ন প্রতীকের মাধ্যমে, আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এগুলোকে ব্যক্ত করেছেন। একের সঙ্গে অন্যের ভেদ আছে। কিন্তু এই তথাকথিত ধর্ম্মের গভীরে আছে একটা অতী-ইন্দ্রিয় অনুভূতির জগৎ। এই জগতে কেউ কাউকে নিয়ে যেতে পারে না। এখানে সাধক নিজেই নিজের প্রভু। ধর্ম্মে একটা বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে নিজেকে নিয়ন্ত্রিত করতে হয়। ধর্ম্ম মানুষকে কতকগুলো মতবাদ, বিশ্বাস ও প্রতীকের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে।  এতে করে মানুষ সংঘবদ্ধ ও একসূত্রে বাঁধা  থাকতে পারে। কিন্তু মানুষ যখন অধ্যত্ম অনুভূতির জগতে চলে যায়, তখন তার কাছে   কোনো নিয়মের বেড়া থাকে না। এখানে সে অনবদ্য। এখানে তিনি আমাদের দৃষ্টিতে শিশু, উন্মাদ, পাগল। তিনি নিজের খুশিতে চলেন। কাউকে তোয়াক্কা করেন না। কে তার সাথে ভালো বা খারাপ ব্যবহার করলো, তাতে তার কিছুই যায়-আসে না। আবার  তিনি কার সাথে কেমন ব্যবহার করলেন, তার আপাত-ব্যাখ্যা আমরা খুঁজে পাই না। তিনি কখনো উদাসীন।  কখনো তার ব্যবহার অতি-আশ্চর্য্য। কেউ তার মিত্র নয়, কেউ তার শত্রু নয়।  কাউকে তিনি আঘাত করেন না। তার ন্যায়-অন্যায়  বোধের মাপকাঠি আমাদের মতো নয়। তিনি কোনো পরিবারের নয়, তিনি কোনো রাষ্ট্রের নয়, তিনি কোনো জাতির নয়, তিনি কোনো ধর্ম্মের নয়, তিনি একজন স্বতন্ত্র সত্ত্বা।  তিনি সবার আবার তিনি কারুর নয়। তিনি বিশ্বের আবার তিনি বিশ্বাতীত।  সব কিছুর অতীত। তিনি সকলের মঙ্গল কামনা করেন। তিনি কোনো ধর্ম্মম্ত প্রচার করেন না। তিনি কারুর আচার্য্য বা শিক্ষক নয়।  আবার তিনিই আমাদের অনুসরণীয়। তিনিই মহাত্মা। এই মহাত্মা আমাদের গল্পের প্রথম পাখি।

------------- 


 

               

      .

          











Sunday 12 December 2021

শ্রীমদ্ভগবৎ গীতার গুহ্য যোগ-বিদ্যা প্রথম অধ্যায় - বিষাদযোগঃ


শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা - গুহ্য যোগশাস্ত্র। 

:(তথ্যসূত্রঃ শ্রীমদ্ভগবতগীতা - শ্রী ভূপেন্দ্র নাথ সান্যাল,   শ্রী শ্রীমদ্ভগবৎগীতা - স্বামী অদৈতানান্দ ও অন্যান্য গ্রন্থ ) 
যা কখনো প্রকাশ পেতো না। যা সর্বসাধারণের জন্য কখনো প্রচার করা হয়নি।
 
ওঁং নারায়নং নমস্কৃত্য  নরঞ্চৈব নরোত্তমম
দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদীরয়েৎওঁং  

হে শব্দব্রহ্ম, নাদব্রহ্ম নারায়ণ, নরোত্তম, দেবী সরস্বতী, হে ব্যাসদেব, আপনাদের জয় হোক।   

২৭.১১.২০২১

যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব । 

সমস্ত ঘটে ঈশ্বর বিরাজ করছেন। তো আমার আপনার শরীরেও নিশ্চই ঈশ্বর বিরাজ করছেন, কিন্তু কোথায় সেই ঈশ্বর ? শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, এই শরীর-ই ক্ষেত্র। এখানেই সমস্ত কর্ম্ম করতে হয়। এখানেই আছেন, ক্ষেত্রজ্ঞ। 

আমাদের মাথার মধ্যে যে ব্রহ্মরন্ধ্র আছে, তার মধ্যে চৈতন্যের প্রকাশ আছে। এই চৈতন্য প্রকাশের কারণেই প্রাণশক্তি ক্রিয়াশীল। আর এই প্রাণশক্তি আমাদের হাজার হাজার নাড়ীর  মধ্য দিয়ে, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে মায়  আমাদের সমস্ত শরীরকে চেতনা-যুক্ত করছে। এই প্রাণশক্তির প্রধান প্রবাহ আমাদের মেরুদণ্ডের মধ্যেই  বর্তমান।  এই মেরুদণ্ডের মধ্যে আছে সুষুম্না নাড়ী যা প্রাণশক্তির প্রধান আশ্রয়। সুষুম্না নাড়ী থেকেই প্রাণশক্তি শরীরের সবত্র সঞ্চালিত হচ্ছে।  প্রথমে অর্থাৎ ভূমিষ্ট হবার আগে, এই প্রাণশক্তি ইড়া ও পিঙ্গলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুষুম্না নাড়ীতে প্রবেশ করতো । এর পর, ভূমিষ্ট হবার সময় থেকে,  আমাদের সুষুম্না নাড়ীর মুখ বন্ধ হয়ে যায়। আর ইড়া ও পিঙ্গলা দিয়ে প্রাণের প্রবাহ চলতে থাকে। এই সুষুম্না নাড়ীর অবস্থান হচ্ছে আমাদের মেরুদণ্ডের মধ্যস্থলে।  এই সুষুম্না নাড়ীর বিস্তার হচ্ছে গুহ্যদেশ থেকে মস্তিস্ক পর্যন্ত। আবার ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ীদ্বয় মূলাধারস্থ সুষুম্নার মুখের বাম  ও  ডান দিক থেকে উত্থিত  হয়ে আবার মস্তিষ্কে ভ্রূমধ্যস্থ -কপালদেশে  আজ্ঞাচক্রে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিত হয়। ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী দিয়েই প্রাণ-প্রবাহ আমাদের দেহকে বাঁচিয়ে রাখে, এবং ভ্রমাত্মক জ্ঞানের উদয় এখান থেকেই ঘটে থাকে। এইসময় আমাদের বৃত্তিসকল  বহির্মুখী  হয় এবং আমরা সংসারমুখী হয়ে জীবনধারণ করে থাকি। এইসময় আমাদের দেহবুদ্ধি জাগ্রত হয়। কিন্তু এই প্রাণপ্রবাহ যখন আবার সুষুম্নামুখী হয়, তখন আমাদের দিব্যজ্ঞানে উদয় হয় বা বলা যেতে পারে, আমাদের প্রকৃত জ্ঞান ফিরে আসে। 

একারনেই যোগীপুরুষগন যোগের সাহায্যে দেহমধ্যস্থ প্রাণবায়ুকে যাতে পুনরায় সুষুম্নার মধ্যে সঞ্চরণ করতে পারেন, তার চেষ্টা করে থাকেন। আমরা যখন মায়ের গর্ভের মধ্যে অবস্থান করি, তখন  এই ইড়া - পিঙ্গলার মধ্যে প্রাণবায়ুর প্রবাহ থাকে না। তখন আমাদের সুষুম্না নাড়ী খোলা থাকে। শিশু যখন মায়ের গর্ভ থেকে বিচ্যুত হয়ে ভূমিষ্ট হয়, তখন তার প্রাণের ধারা ইড়া-পিঙ্গলায়  এসে পড়ে, এবং সুষুম্নার পথ কফ, শ্লেষা, পিত্ত দ্বারা অবাদ্ধ হয়ে যায়। যতদিন যায়, তত এগুলো কঠিন আকার ধারণ করে থাকে। তাই আমরা যদি অল্প বয়স থেকেই যোগের অভ্যাস করি, তবে আমাদের সুষুম্নার গতিপথ সহজে খুলে যেতে পারে, নতুবা আমাদের বেশি বয়সে অধিক কষ্ট সহ্য করতে হয়। 

যোগীগণ যখন প্রাণ ও মনকে সুষুম্না পথে প্রবেশ করাতে পারেন, তখন তিনি দিব্যজ্ঞান সম্পন্ন হয়ে যান ।  প্রাণের চঞ্চলতা দূর হয়ে প্রাণ স্থির হয়ে যায়। আর প্রাণ রুদ্ধ হওয়া মানে শ্বাসরোধের মতো অবস্থা। বাহ্যিক ভাবে যদি আমরা শ্বাসকে রোধ করি, তবে একটা অসহনীয় কষ্টের অবস্থার সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রাণ যখন সুষুম্নাকে অবলম্বন  করে, সহস্রারে পৌঁছয়, তখন সব স্থির হয়ে যায় সত্য, কিন্তু কোনো কষ্টদায়ক ঘটনা ঘটে না।  বরং মন পরমানন্দে ডুব দেয়। একেই বলে জন্ম-মৃত্যু রোহিত অবস্থা। এইসময় থেকেই সাধকের মধ্যে বিভিন্ন সিদ্ধি স্বাভাবিক ভাবে  প্রকট হতে দেখা দেয়। এরপর বৈরাগ্য যত  বাড়তে থাকে তত নির্বিকল্প সমাধির দিকে এগিয়ে যায়। 

আমরা জানি মেরুদণ্ডের মধ্যে ছয়টি  বিশেষ কেন্দ্র আছে, যেখানে অনেকগুলো নাড়ী এসে মিলিত হয়েছে। সুষুম্না নাড়ী এই কেন্দ্রগুলোকে ভেদ করে চলে গেছে। এইসব  কেন্দ্রে মোট  ৩২ জোড়া নাড়ী আছে।  এগুলোর মধ্যে একটি বাহক (গ্রাহক) একটি প্রেরক নাড়ী। অর্থাৎ আমাদের শরীরের সংবেদন ক্রিয়া সংগঠিত করে থাকে এই নাড়ীগুলোর মাধ্যমে । মূলাধারে আছে ৪, মনিপুরে ১০, অনাহতে আছে ১৬, আজ্ঞাচক্রে ২। এর উপরে মস্তিষ্কে আছে সহস্রদল  পদ্ম। এগুলো কোনো কল্পনা হয়, চিকিৎসা বিজ্ঞান একই কথা বলে থাকে। 

এই সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে আছে বজ্রাক্ষা নাড়ী।  বজ্রাক্ষা নাড়ীর মধ্যে আছে অতিসূক্ষ্ম  চিত্রাণি নাড়ী ।  এইজন্য বলা হয়ে থাকে সুষুম্না নাড়ী ত্রিস্তরীয়। সুষুম্না বজ্রাক্ষা ও চিত্রাণি  নাড়ীকে একত্রে  কেউ কেউ ব্রহ্মনাড়ী বলে থাকেন। এইযে বজ্রাক্ষা নাড়ী এটি স্বাধিষ্ঠান চক্র  থেকে উত্থিত এবং চিত্রাণি নাড়ী মনিপুর চক্র থেকে উত্থিত। তাই  এর অস্তিত্ত্ব মূলাধারে লক্ষ করা যায় না। 

এই সাতটি স্থানে প্রাণের ও মনের যাতায়াত নিশ্চিত করাই  আসলে যোগক্রিয়া। এই সপ্তম স্থানে মন প্রবিষ্ট হলে, সাধকের  মধ্যে একটা তৎগত ভাবের উদয় হয়। দৈবশক্তির প্রকাশ অনুভব হয়। যোগদর্শন  বলছে, এই যে প্রকাশ বা শক্তি এটি আমাদের সংস্কার ও অজ্ঞান বা অবিদ্যা আবৃত ছিল। আসলে এই যে প্রকাশ এই প্রকাশ হচ্ছে স্বয়ং আত্মার প্রকাশ।  আবরনের ক্ষয় হয়ে গেলে, সর্ব্বত্র এই প্রকাশই আমাদের অনুভবে আসে। তখন আত্মার অস্তিত্ত্ব উপলব্ধি হয়।  তো প্রাণ হচ্ছে আত্মার প্রকাশ শক্তি।  এতদিন এই প্রাণ বহির্মুখী থেকে আত্মার আবরক  ছিল, আবার প্রাণায়ামের দ্বারা প্রাণ যখন শুদ্ধ, নির্মল, হয় তাফন প্রাণ হয়  উর্দ্ধমুখী,  তখন আত্মার আবরণ খসে পড়ে। 

এই প্রাণের প্রসংসা সবত্র। প্রাণ-সাধনা দ্বারা প্রাণের স্থিরতা নিশ্চিত হলে, প্রাণের অপূর্ব অন্তঃশক্তির বিকাশ হয়। প্রাণ একসময় আত্মার সঙ্গেই ছিল, কিন্তু কালের প্রভাবে প্রাণ ভূতগণ দ্বারা আবৃত হয়ে আত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, এখন আবার আত্মার সঙ্গে প্রাণ একত্র  হয়ে গেলো। এই হচ্ছে শিব-শক্তির মিলন। আমাদের "আমি"-কে  আশ্রয় করেই যাবতীয় জ্ঞান সাধন শুরু হয়। "আমি"-র  বিলোপ সাধনে সাধনার সমাপ্তি হয়।  

-----------------------------    

মহাভারতের যুদ্ধ আসলে আমাদের সাধন সংগ্রাম ।

মহাভারতের শান্তনু হচ্ছেন আত্মা।  আমরা জানি, শান্তনু মহারাজ প্রতীপের পুত্র, মহামতি ভীষ্মের পিতা।  শান্তনু শান্ত+অনু শান্তনু। অনু কথাটার অর্থ সেই বিন্দু যাকে আর বিভাগ করা যায় না। শান্ত অর্থাৎ স্থির,  শমতাপ্রাপ্ত যা শমগুনযুক্ত ।  তো স্থির অনু হচ্ছেন শান্তনু অর্থাৎ আত্মা। শান্তনু হচ্ছেন প্রতীপ-এর পুত্র।  প্রতীপ কথাটার অর্থ হচ্ছে বিপরীত মুখী কোনো গতি। তো পরমাত্মা থেকে বিচ্যুত হয়ে বিপরীতমুখী গতিতে যিনি জন্ম গ্রহণ করেছেন, তিনি রাজা প্রতীপ ।  ভীষ্ম হচ্ছে শান্তনুর পুত্র। ভীষ্ম হচ্ছে ভ্রম। জীবাত্মার ভ্রমাত্মক বোধ এই ভ্রমের সহজে নাশ হয় না। রাজা শান্তনুর দুই স্ত্রী, গঙ্গা ও সত্যবতী। 

গঙ্গা হচ্ছে আমাদের সুষুম্না নাড়ী - যা আসলে শক্তির আধার।  এই চেতন প্রকৃতি জগতের মূল উপাদান বা কারন স্বরূপ। সুষুম্নার অষ্টশক্তি, গঙ্গার আটটি পুত্র ।  সোম,ভব, ধ্রুব, বিষ্ণু, অনিল, অনল, প্রভুশ, প্রভব,  (সোম - চন্দ্র, ভব-পৃথিবী, ধ্রুব- গতিহীন,  , প্রভুশ- আকাশ, প্রত্যুষ বা প্রভব - সূর্য,  অপ বা বিষ্ণু - জল, অনিল-বাতাস, অনল- অগ্নি) এর মধ্যে প্রভব প্রত্যুষ বা সূর্য  হচ্ছে প্রকাশ স্থান। এঁকে অবলম্বন করেই জগৎ-লীলা চলছে। এরই নাম ভীষ্ম বা সত্যব্রত। এই সত্যব্রত-ই কুরুবংশকে বাঁচিয়ে রাখেন। অর্থাৎ সূর্য-ই কুরুবংশকে বাঁচিয়ে রাখেন।  কুরুবংশ অর্থাৎ কার্য্যশক্তি।  আভাস চৈতন্য ব্যাতিত এই কার্য্যশক্তি টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু এনার কোনো পুত্র নেই। অর্থাৎ আভাস চৈতন্য যদিও  জগতের অবলম্বন কিন্তু নিজে অসৎ বা অনিত্য  বলে এনার স্থায়ী বংশ থাকতে পারে না। এই আভাস চৈতন্যের অন্তরালে যার প্রতিবিম্ব তিনি নিত্য বিরাজমান।

শান্তনুর দ্বিতীয়  স্ত্রী সত্যবতী। সত্যবতী কথাটার অর্থ হচ্ছে সত্য না হয়েও সত্যের মতো প্রতীয়মান। ইনি সুন্দরী কিন্তু মৎসগন্ধা। সংসারে বাহ্যিক সৌন্দর্য্যময় শরীর  আমাদের নজরে পড়ে।  কিন্তু এই দেহের মধ্যে আছ পুঁতিগন্ধময় মল-মূত্র-ঘাম-শ্লেষ্মা। এমনকি চুল। যা শরীরের সঙ্গে মিশে থাকলে আমরা এর দুর্গন্ধ, বিরূপ ভাব দেখতে পাই না। আছে কাম-ক্রোধ-লোভ যা আমাদের দুস্কর্মের প্রবৃত্তিজাতক। এই আপাতমোহময় রূপে আমরা প্রলুব্ধ হই।  কিন্তু মহাপুরুষগন একে এড়িয়ে চলেন। এই অবিদ্যাশক্তিই আবার জগতের বন্ধনকারী শক্তি। গুরুকৃপায়, যখন এই অবিদ্যার নাশ হয়, তখন এই পূতিগন্ধময় শরীর মুক্তির কারন হতে পারে। সদ্গুরুর উপদেশে যখন আমরা শরীরের সংস্থান সম্পর্কে অবগত হই আর ধ্যানাদির সোপানে আরোহন করি, তখন এই শরীর মোক্ষের কারন হতে পারে। ঋষি পরাশরের প্রভাবে মৎগন্ধা হয়ে ওঠে পদ্মগন্ধা, যোজনগন্ধা। তখন এই শরীর থেকেই জন্ম হয় কৃষ্ণদ্বৈপায়ন। কৃষ্ণবর্ণের জ্যোতির্ময় পুরুষ। তখন হৃদয়ের জ্যোতির্ময় মন্ডলের  মধ্যে উপলব্ধ হয় কূটস্থ কৃষ্ণবর্ণ স্বরূপ পরমপুরুষ। 

সত্যবতীর দুই সন্তান - চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য্য। আসলে প্রকৃতির দুই সন্তান : ১. পঞ্চভূতাত্মক জড় দৃশ্য - যাকে  বলা হয় চিত্রাঙ্গদ।  আর দ্বিতীয় বিচিত্রবীর্য্য - বিচিত্র হয়েছে যার বীর্য্য।  বিষ্ময়কর নানা বর্ণ যুক্ত  অর্থাৎ সুখ-দুঃখ অনুভব শক্তি সম্পন্ন জ্ঞাণাত্মিকা মনোবৃত্তি। পঞ্চভূত, পাঁচ জ্ঞান-ইন্দ্রিয়, পাঁচ-কর্ম্ম-ইন্দ্রিয়, পাঁচ তন্মাত্র (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ), পাঁচ জ্ঞানত্মিকা মনোবৃত্তি  (ইচ্ছে, দ্বেষ, সুখ, শরীর  চেতনা) মন ও ধৈর্য্য। 

এই জ্ঞাণাত্মিকা মনোবৃত্তি থেকেই জন্ম হয়, ধৃতরাষ্ট্র অর্থাৎ সংকল্পাত্মক মন, পান্ডু অর্থাৎ মনের নিশ্চয়াত্মিকাবৃত্তি। ধৃতরাষ্ট্র যিনি এই প্রকৃতির রাজ্যকে ধরে রেখেছেন অর্থাৎ মন।  এই মন-ই আমাদের দেহ-রাজ্যের রাজা কিন্তু এর সৎ-অসৎ বিচার শক্তি নেই।  ইনি জন্মান্ধ। আমাদের মনের মধ্যে সব সময় সংশয়, মন আমাদের চঞ্চল। 

পান্ডু কথাটা এসেছে পন্ডা থেকে।  পণ্ডা কথাটার অর্থ হচ্ছে জ্ঞানউজ্জ্বল বুদ্ধি। যিনি বর্নহীন তাই নির্মল।  পান্ডুর দুই সহধর্ম্মিণী - কুন্তী ও মাদ্রী।  কুন্ ধাতু থেকে কুন্তী। কুন্ কথাটার অর্থ হচ্ছে, আহবান করা। যে সাধন শক্তি দিয়ে দেবতা বা দিব্যশক্তিকে আহবান করা যায়। আবার মদ ধাতু থেকে মাদ্রী। যাকিছু আমাদের বুদ্ধিকে মত্ত করতে পারে, বিষয়ভোগ করায় তাই মাদ্রী। 

আমাদের শরীরের মধ্যে যে সুষুম্না নাড়ী সেটাই আমাদের বুদ্ধির ক্ষেত্র বা সহধর্মিনী বা স্ত্রী। এই সুষুম্না উর্দ্ধ ও অধঃগতি সম্পন্ন। নাভি বা মনিপুর এর কেন্দ্রবিন্দু।  এখান থেকে একটা গতি নিম্ন মুখী, আবার নাভি থেকে একটা গতি উর্দ্ধমুখী। 

আমরা জানি নাভি থেকে উর্দ্ধ স্থানগুলো হচ্ছে, দৈব শক্তির কেন্দ্র, আর নাভি থেকে গুহ্যদ্বার পর্যন্ত হচ্ছে জড়শক্তি সম্পন্ন। দৈব শক্তি থেকে উদ্ভূত হয় যুধিষ্ঠির।  মনের স্থির সংকল্প - ধর্ম্ম যুদ্ধে বা সংগ্রামে যিনি স্থির, তিনি যুধিষ্ঠির। ব্যোমতত্ত্ব বা কন্ঠের বিশুদ্ধ তত্ত্ব থেকে যুধিষ্ঠির। 

এবার বায়ু  তত্ত্ব থেকে উদ্ভূত হয়েছেন, ভীম। অর্থাৎ কন্ঠের বিশুদ্ধ তত্ত্ব থেকে নিচের দিকে অনাহত চক্র থেকে  ভীমের জন্ম হয়ে থাকে। মনিপুরে আছে তেজতত্ত্ব।  এখান থেকে জন্ম অর্জুনের। এই তেজ, বায়ু ও ব্যোম - এখন থেকেই সাধকের আধ্যাত্মিক জীবন শুরু হয়। এরপর কুন্তী দেবী তার দৈব শক্তিকে মাদ্রীর কাছে প্রেরণ করেন। অপতত্ত্বে অর্থাৎ স্বাধিষ্ঠান চক্রে নকুল, আর পৃথ্বী তত্ত্বে স্হদেবের জন্ম। 

এইযে পঞ্চতত্ত্ব শক্তি সাধকের সাধন বলে যখন একত্রিত হয়ে যায়, তখন তার উর্দ্ধগতি লাভ হয়। আমাদের ডান  দিকে ইড়া বাম দিকে পিঙ্গলা, মেরুদণ্ডের ভিতরে মধ্যস্থলে সুষুম্না। ( ইড়া নাড়ী দেহের মেরুদণ্ডের বাইরে বাম ভাগে বিদ্যমান এবং সুষুম্না নাড়ীকে আলিঙ্গন  করে চক্রে চক্রে বেষ্টন করে দক্ষিণ নাসা দিয়ে আজ্ঞা চক্রে একত্র হয়েছে। ঠিক তেমনি মেরুদণ্ডের দক্ষিণভাগে পিঙ্গলা নাড়ী অবস্থিত।  এই নাড়ীও সুষুম্না নাড়ীকে আলিঙ্গন পূর্বক চক্রে চক্রে বেষ্টন করে বাম -নাসাপুট দিয়ে আজ্ঞাচক্রে ত্রিবেণী স্থলে সম্মিলিত হয়েছে। - শিব সংহিতা দ্বিতীয় পটল শ্লোক ১৩/১৪/১৫/১৬ ) বাংলার বাউল - উপেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য্য।  তো সামনে যেটি ডান পিছনে সেটি বাম, আবার সামনে যেটি ডান পিছনে সেটি বাম। আরো একটা কথা বলি, সুষুম্নার মধ্যে বজ্র, বজ্রের মধ্যে চিত্রিণী, চিত্রিণী নাড়ীর মধ্যে ব্রহ্ম নাড়ী।  কিন্তু কেউকেউ সুষুম্না-বজ্র-চিত্রিণী নাড়ীকে একত্রে ব্রহ্মনাড়ী বলে থাকেন। সবই ঠিক, সাধনার  সঙ্গে সঙ্গে সুক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর অনুভূতি এলে, এগুলো নিজের কাছে পরিষ্কার হয়। আমি কোথায় অবস্থান করছি, তার উপরে আমার ডান-বাম নির্ভর করে থাকে। আপনি ভালো থাকবেন অবশ্য়ই ।)    আর এগুলো সবই আমাদের শরীরের পিছনে অবস্থিত।  আসলে আমরা সামনের দিকে দৃষ্টিসম্পন্ন। জগৎ আমাদের সামনের দিকে উদ্ভাসিত হয়।  আমরা আকৃষ্ট হই  সামনের  দিকে। তাই সামনের দিকে আমাদের প্রবৃত্তি ধাবিত হয়। এই আমার শরীর পিছন দিকে সক্রিয় হয়, তখন আমাদের মধ্যে নিবৃত্তির প্রভাব পরে। সাধনার প্রথম দিকে এই পঞ্চতত্ত্ব শক্তি যখন ক্রিয়াশীল হয়, তখন শরীরের সামনের দিক, অথাৎ মনের প্রবৃত্তি পক্ষীয় বৃত্তিগুলো মহাসমরে লিপ্ত হয়। একেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বা দেবাসুরের যুদ্ধ বলা হয়ে থাকে। 

বিষয় লোভাতুর আমাদের মন দশ দিকে ধাবিত হয়। প্রত্যেক দিকের আবার দশ রকম গতি। সব মিলিয়ে ১০০ রকম মনের গতি। আমাদের সহস্রদলে একত্ত্বে বা কেন্দ্রে আছে ৫০ রকম বায়ু, আবার এই সহস্রদল পদ্মকে ঘিরে রেখেছে ৫০ রকম বায়ু।  সব মিলিয়ে আছে ১০০ রকম বায়ু। এই বায়ুর বিক্ষিপ্ততার কারনে মন চঞ্চল।  প্রাণায়ামের সাহায্যে এই বায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে যোগের উদ্দেশ্য। প্রাণায়ামের সঙ্গে সঙ্গে ধ্যান  অর্থাৎ  মনের একাগ্রতা আমাদের প্রবৃত্তির নিবৃত্তি ঘটে থাকে। ধ্যানের আগে প্রাণায়াম, আর প্রাণায়ামের পরে ধ্যান আমাদের নিরালম্ব হতে সাহায্য করে থাকে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আসলে এই প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির যুদ্ধ। ক্ষেত্র অর্থাৎ এই শরীর। তো এই শরীরের মধ্যে যুদ্ধ সংগঠিত করতে হবে। এটাই যোগ, এটাই যুদ্ধ। 

২৯.১১.২১

যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (২)

শ্রীমৎ ভগবৎগীতার প্রথম শ্লোকের ব্যাখ্যা :

কথাতো পুরাতন কিন্তু চিরনবীন। গীতার ছত্রে ছত্রে এই যোগের কথা। এইসব গুহ্য কথা নাকি ভগবান একসময় সূর্যদেবকে শুনিয়েছিলেন। আজ বিদুরের পুত্র, সঞ্জয়ের মাধ্যমে আমরা শুনছি। বিদুর অর্থাৎ বিশেষভাবে অন্তরে স্থিত যিনি। সঞ্জয় অর্থাৎ যিনি সংযমী হয়েছেন। তো যখন মানুষ সংযমী হতে পারে, তখন তার অন্তরে স্থিত বিদুর পুত্র সঞ্জয়ের অর্থাৎ সংযমী পুরুষের মাধ্যমে এই যোগের কথা পরিস্ফুট করে দেন। 

আমাদের প্রতিটি শাস্ত্রে দুই প্রকার ভাবের সমাহার। একটা বাহ্যিক দিক যা সহজেই আমাদের বোধগম্য হয়ে থাকে। আর একটা সাধনার  নিগূঢ় দিক, যেখানে সাধনার সংকেত আছে। যোগারূঢ় ব্যক্তি, এই সংকেত অনুযায়ী অন্তর-লক্ষ্যের অভিপ্রায় জ্ঞাত হয়ে সাধন পথে এগিয়ে যান । এই সংকেত বা  আভাস না ধরতে পারলে, শাস্ত্রের গোপন রহস্য, যা আসলে সাধন পদ্ধতি, অর্থাৎ প্রকৃত উদ্দেশ্য তা বোঝা সম্ভব নয়। এখন কথা হচ্ছে, কেন এই গোপনীয়তা ? কারন হচ্ছে, অধিকারী ও অনধিকারীর মধ্যে বিদ্যার প্রয়োগের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। অস্ত্র প্রয়োগে কেউ মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পারেন, আবার অস্ত্র প্রয়োগে কেউ মানুষের জীবনপাত ঘটাতে পারেন। এই জন্য বলা হয়ে থাকে যার যেমন ভাব, তার তেমন লাভ। আর শাস্ত্রে রূপক গল্পের সমাহার।

শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা ছোট্ট একখানা বই। লেখা যদিও সংস্কৃত ভাষায়, তথাপি বলা যেতে পায়ে, এই বইয়ের ভাষা খুবই প্রাঞ্জল,এমনকি সহজবোধ্যও বটে। আবার এই গীতার মর্ম্মকথা বুঝাবার জন্য, ভারতের এমনকি পৃথিবীর বহু মনিষী প্রয়াস করেছেন। সকলে তার নিজ-নিজ ভাব অনুসারে গীতার কথা বলেছেন। আচার্য্য শঙ্কর,গীতার মধ্যে অদ্বৈতবাদের সন্ধান পেয়েছেন। রামানুজ, শ্রীধর স্বামী, স্বামী বাসুদেবানন্দ, স্বামী অদ্বৈতানন্দ,  এমনিতর হাজার হাজার মনিষী গীতার ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ এখানে দ্বৈতবাদের সন্ধান পেয়েছেন, কেউ অদ্বৈতবাদের সন্ধান পেয়েছেন, কেউ বিশিষ্টাদ্বৈত বাদের সন্ধান পেয়েছেন,  কেউ ভক্তিবাদের সন্ধান পেয়েছেন, কেউ আবার কর্ম্মযোগের সন্ধান পেয়েছেন। কেউ আবার জ্ঞানযোগের সন্ধান পেয়েছেন।  তো সবাই তার মতো করে গীতার ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু আমি যখন গীতার মধ্যে প্রবেশ করবার চেষ্টা করি, তখন একটা জিনিস আমার নজরে পরে, সেটা হচ্ছে, গীতা একটা যোগশাস্ত্র। গীতাগ্রন্থের নায়ক শ্রীকৃষ্ণকে  বলা হয় যোগেশ্বর। তো যিনি যোগেশ্বর তিনি অবশ্যই যোগের কথাই  বেশি করে বলবেন।  তো যোগ বলতে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের কথা বোঝায়। আবার  জীবাত্মা জীব-শরীরে অবস্থিত, পরমাত্মা সর্বব্যাপী। তো জীবদেহে কিভাবে পরমাত্মার আস্বাদ পেতে পারি, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি গীতার মধ্যে প্রবেশ করবার চেষ্টা করি। 

গীতা সত্যি কথা বলতে গেলে, সবার।  তিনি জ্ঞানীদের জন্য, তিনি কৰ্ম্মীর  জন্য,  তিনি ভক্তের জন্য, তিনি সংসারীর জন্য, তিনি সন্যাসীর জন্য। গীতা সার্বভৌম গ্রন্থ। গীতার শ্রীকৃষ্ণকে বলা হয়েছে পরমাত্মা পরমেশ্বর।  তো যিনি পরমাত্মা পরমেশ্বর, তিনি শুধু একটি সম্প্রদায়ের কথা বলবেন, তা হতে পারে না। তাই গীতা আমাদের সবাইকে বিস্মিত করে, গীতা সার্বজনীন গ্রন্থ । শ্রীগীতার এখানেই বৈশিষ্ঠ। আমরা সামগ্রিক যোগের দৃষ্টিতে গীতার কথা শুনবো। 

প্রথম অধ্যায় - বিষাদযোগঃ 

ধৃতরাষ্ট্র উবাচ : 

ধৃতরাষ্ট্র বলছেন, 

ধর্ম্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিম কুর্ব্বত সঞ্জয়। (গীতা-১.১)

শ্রীগীতার প্রথম সংলাপ। বক্তা ধৃতরাষ্ট্র । শ্রোতা সঞ্জয়। ধৃতরাষ্ট্র, বলছেন : 

হে সঞ্জয়, ধর্ম্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে আমার পুত্রগণ ও পাণ্ডবেরা সমবেত হয়ে কি করলেন ?        

ধৃতরাষ্ট্র, অর্থাৎ রাষ্ট্রকে যিনি ধরে রেখেছেন অর্থাৎ এই দেহকে যিনি পরিচালিত করেন,  অর্থাৎ আমাদের মন প্রথম কথা বলছে। অর্থাৎ মনের মধ্যে জিজ্ঞাসা জেগেছে। শ্রীগীতায় প্রথম সংলাপে এই মনের জিজ্ঞাসাই  ফুটে উঠেছে।  

ধর্ম্মক্ষেত্ৰ কুরুক্ষেত্র। কুরুক্ষেত্র অর্থাৎ যেখানে কর্ম্ম সম্পাদিত হয়, আবার ধর্ম্মক্ষেত্ৰ যেখানে ধর্ম্মকর্ম্ম সম্পাদিত হতে পারে। এই যে দেহ তা আসলে আমাদের কর্ম্মক্ষেত্ৰ আবার ধর্ম্মক্ষেত্ৰ। কর্ম্মের মাধ্যমে এখানে ধর্ম্ম সম্পাদিত হতে পারে। এখন ধর্ম্মকর্ম্ম  বলতে আমরা কি বুঝি ? সমস্ত ভূতের প্রতি দয়া  প্রদর্শনই ধর্ম্ম। এখন ভূত বলতে আমরা  বুঝি, পঞ্চভূত অর্থাৎ ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ ব্যোম। এখন ফলাকাঙ্খ্যা রোহিত হয়ে আমরা যে কর্ম্ম করি, সেই কর্ম্ম যা আমাদের স্বাভাবিক ধর্ম্ম যার দ্বারা আমাদের শরীর রক্ষিত হয়, যার দ্বারা আয়ু বৃদ্ধি পায়, একেই বলে দয়া। তো আগে নিজের শরীর রক্ষা করতে হবে, তারপরে অন্যের শরীর রক্ষা করতে হবে, একেই বলে দয়া। ধর্ম্মক্ষেত্ৰ - ক্ষেত্র হচ্ছে শরীর।  ক্রিয়া করবার জন্য এই শরীর।  এই শরীরের মধ্যেই আছেন জীবাত্মা যা আসলে পরমাত্মার অংশবিশেষ। এই শরীর পঞ্চতত্বের সমষ্টি। পঞ্চতত্ত্বের রূপক হচ্ছে পঞ্চপাণ্ডব। আকাশ তত্ত্ব থেকে যুধিষ্ঠির, বায়ুতত্ত্ব থেকে ভীম, তেজতত্ত্ব থেকে অর্জুন, জল তত্ত্ব থেকে নকুল, আর মাটি তত্ত্ব থেকে সহদেব। 

আমরা জানি সঞ্জয় দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন। এখন এই দিব্যদৃষ্টি, অর্থাৎ যার দৃষ্টি সর্বদা  দিব্যপুরুষের প্রতি অর্থাৎ যিনি ধ্যানরত। এখন কথা হচ্ছে, এই ধ্যানাবস্থায়, কেমন অনুভব হচ্ছে, তা মন জানতে চাইছে। 

আমারা ইন্দ্রিয়সর্বস্ব জীব। আমাদের যত  ইন্দ্রিয় আছে,  সবাই একটা উদ্দেশ্য নিয়ে কর্ম্মে লিপ্ত হয়। কিন্তু প্রাণের অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস-জনিত যে কর্ম্ম তার কোনো কাম-সংকল্প নেই। এখন এই প্রাণের মতো আমাদের মন যদি কাম-সঙ্কল্পবিহীন হয়ে কাজ করতে  পারে,  তখন  সে ফলাকাঙ্খ্যা শূন্য হয়ে কাজ করতে পারবে। এই প্রাণকর্ম্মের উপদেশ দানই প্রকৃত জিবে দয়া।  প্রকৃত গুরুবানী। দেখুন বাহ্যিক দিক দিয়ে দান বলতে আমারা বুঝি অন্ন দান, ধন দান বা বস্তু দান ইত্যাদি। যদিও এগুলোও দয়ার মধ্যেই পড়ে। তথাপি এই দানে গ্রহীতার চাহিদা পূরণ হয় না।  খাবার খাওয়ার একটু পরেই আবার ক্ষিদে পায়। বাসনারূপ ক্ষুধা হচ্ছে, আমাদের ভবরোগ। আর জ্ঞান হচ্ছে ভবরোগের  ঔষধ। এই জ্ঞানের প্রকাশ দেখা যায় তখনই যখন মানুষ মন ও বুদ্ধিকে স্থির করতে পারে। আমাদের মনের মধ্যে প্রতিনিয়ত বাসনারূপ অম্ল (এসিড) জন্ম নিচ্ছে, আর অতৃপ্ত বাসনা মনকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। মন ছটফট করে এধার থেকে ওধারে ঘুরে ঘুরে মরছে। তো এই ছটফট করা মনকে শান্ত করতে হবে।  কিন্তু কিভাবে ? 

শাস্ত্রে বলছে, আমাদের প্রাণবায়ু চঞ্চল হলে আমাদের চিত্তও চঞ্চল হয়ে ওঠে। এইজন্য আমাদের উচিত প্রাণের সাধনা করে প্রাণবায়ুকে স্থির করা। আর প্রাণবায়ু স্থির হলে আমাদের মন-বুদ্ধিও স্থির হয়ে যাবে। কিন্তু প্রাণবায়ু তো শরীরভিন্ন হতে পারে না।  তাই প্রাণের সাধন করতে গেলে, আমাদের শরীর থাকাও আবশ্যক। তাই শরীরের মাধ্যমেই আমাদের ধর্ম্ম পালন করতে হবে। 

অদ্ভুত এই ক্ষেত্র-শরীর। এখানেই নিত্যসুদ্ধ পরমাত্মা, আবার এখানেই জীবাত্মা। এখানেই প্রাণের খেলা চলছে। জীবাত্মাকে জেনে জীব কৃতার্থ হয়। আবার এই দেহের দ্বারা অনেক অপকর্ম্মও সাধিত হতে পারে। আবার দেখুন, এই দেহের মধ্যেই আছেন আমাদের বিবেক গুরু, যিনি জগৎগুরুর অংশ। তো এই বিবেকগুরুর কৃপায়, সাধনা-রত  দেহে বিবেকগুরু যখন জ্ঞানের  আলোক হস্তে হাজির হন, তখন আমাদের দেহধারন সফল হয়ে যায়। একটা কথা মনে রাখতে হবে, ধর্ম্ম সাধনের জন্য আমরা দেহ ধারণ করেছি, সেই উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যদি পশুবৎ অর্থাৎ ভোগের নিমিত্ত শরীরকে ব্যবহার করি, তাহলে আমাদের বার বার এই  দেহেই  ফিরে ফিরে আসতে  হবে। আর জন্ম-মৃত্যুর যন্ত্রনা সহ্য করতে হবে। 

আমাদের অহং-কে আশ্রয় করেই আমাদের সব জ্ঞান। এই দেহকে আশ্রয় করেই আমাদের আত্মবোধ জাগতে পারে, আবার অনাত্মবোধও থাকতে পারে। আমাদের দেহত্ব বোধ হচ্ছে অবিদ্যা।  আবার আমাদের আমি দেহ নোই, আমি চিদাত্মা, এই হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞান। আবার দেখুন, দেহজ্ঞানই আমাদের প্রথম জ্ঞান। দেহজ্ঞান না হলে আমরা অহং-এর সাথে পরিচিত হতে পারি না। একেই আত্মার বদ্ধ অবস্থা বলা হয়ে থাকে। আবার সোঽহং - "সে-ই আমি" এই ভাবের মাধ্যমে আমরা চিরমুক্ত ঈশ্বর-স্বভাব হয়ে যেতে পারি। আমরা সব সময় "আমি"  "আমি" করি বটে কিন্তু "আমি"-কে আমরা জানিনা, চিনিনা। দেহের অভিমান মুক্ত হয়ে যখন আমরা "সেই-আমি" কে খুঁজি তখন স্বয়ং তিনি আমাদের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে যান। আর তখনই আমাদের ব্রহ্মজ্ঞানের উৎপত্তি হয়। আর ব্রহ্মজ্ঞানের উদয় হলে, আমাদের জীবসত্ত্বার বিলোপ সাধন হয়। জীব-লীলার অবসান ঘটে। এই দুয়ের মিলনই যোগ। যা সব সাধনার লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে পৌঁছোনর জন্যই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। যুদ্ধ আসলে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা, যুদ্ধ আসলে সত্যে প্রতিষ্ঠিত হবার সংগ্রাম। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দুটো উদ্দেশ্য, এক ধর্ম্মের প্রতিষ্ঠা দুই অধর্ম্মের নাশ করা। এখানে দুটো পক্ষ এক - আমাদের প্রবৃত্তি, আর এক নিবৃত্তি। এক আমাদের শুভ বুদ্ধি, আরেকটি আমাদের অশুভ বুদ্ধি। 

আমাদের মহাভারত-রুপ এই শরীরকে ব্যাখ্যা করেছেন দুটো  বৃক্ষরূপে - প্রথম বৃক্ষে ধৃতরাষ্ট্র এই বৃক্ষের মূল। দুর্যোধন কান্ড। কর্ন বৃক্ষের শাখা, শকুনি প্রশাখা, দুঃশাসন ইত্যাদি ফুল-ফল।

দ্বিতীয় বৃক্ষে মূল স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। কান্ড হচ্ছে - যুধিষ্ঠির। অর্জুন এই গাছের শাখা, ভীম তার প্রশাখা, নকুল-সহদেব ফুল-ফল।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  

--------------------            


৩০.১১.২১

যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (3)

বলা হয়ে থাকে বেদের নির্যাস আছে শ্রীমৎ ভগবৎ গীতায়। মহাত্মাগণ বলে থাকেন,  বেদ হচ্ছে সর্বোচ্চ জ্ঞান। যদিও আমাদের মতো সাধারনের দৃষ্টিতে বেদের মধ্যে আছে, শুধু দেবতাদের স্তুতি ও দেবতাদের কাছে প্রার্থনা।  আবার খেয়াল করলে দেখবেন, গীতায় সমস্ত অধ্যায়কে বলা হচ্ছে যোগ। বিষাদযোগ, সংখ্যযোগ, কর্ম্ম-যোগ, জ্ঞানযোগ, কর্ম্ম-সন্যাস যোগ, ধ্যানযোগ, জ্ঞানবিজ্ঞান যোগ, অক্ষর-যোগ,রাজ-গুহ্যযোগ, বিভূতি যোগ, বিশ্বরূপ দর্শন যোগ, ভক্তিযোগ, ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ বিভাগযোগ,গুণত্রয় বিভাগযোগ, পুরুষত্তম যোগ, দৈবাসুর সম্পদ বিভাগ যোগ, শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগযোগ, এবং মোক্ষযোগ।  

 প্রথমেই বিষাদ যোগ। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে যতক্ষন না বিষাদের ছায়া দেখা যাচ্ছে, সংকট না দেখা যাচ্ছে ততক্ষন গীতার যোগের কথা শুরু হয় না। মানুষের সংকটের মধ্যেই শ্রীগীতার জন্ম হতে পারে।  যার মধ্যে সংকট দেখা দেয়নি, তার মধ্যে জীবন  জিজ্ঞাসা জাগতে পারে না। আর সংকট মানুষকে তার জন্ম জন্মান্তরের সংস্কারের কাছে নিয়ে যায়। সংস্কারের মাধ্যমে সে বিজিত হতে চায়। 

শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা (শ্লোক ১.২)  

সঞ্জয় উবাচ : 

দৃষ্ট্বা তু পাণ্ডবানীকং ব্যূঢ়ং দুর্যোধনস্তদা
আচার্য্যম উপসঙ্গম্য রাজা বচনম অব্রবীৎ। (১/২)

সঞ্জয় বললেন, পাণ্ডব সৈন্যগণকে বুহ্য রচনায় ব্যবস্থিত দেখে রাজা দুর্য্যোধন আচার্য্যের  নিকট  গিয়ে এই কথা বললেন।

এখানে আমরা সঞ্জয়ের মুখ দিয়ে দুটো চরিত্রের কথা শুনলাম।  এক - দুর্যোধন, দুই - আচার্য্য। আচার্য্য অর্থাৎ দ্রোণ। আর বুহ্য অর্থাৎ সৈন্য সমাবেশ। 
দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই হচ্ছে সৈন্য। হাত, পা, নাক, কান, মুখ, চোখ, মাথা, এমনকি দাঁত, নখ, চুল, অস্থি, শিরা নাড়ী, মায় শরীরের সমস্ত কোষকলা সবই সৈন্য। আর এই সৈন্যদলের  পরিচালক হচ্ছে মন। সাধন সংগ্রামে এরা  সবাই সৈনিক-পুরুষ। এরাই আমাদের বিষয় সংগ্রহের জন্য চেষ্টা করে থাকে মনের নির্দেশে। আবার এরাই আমাদের ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যেতে পারে, সেই একই মনের নির্দেশে। 
দুর্জয় কামরূপ দুর্ম্মতি  হচ্ছে দুর্যোধন। আর এই দুর্ম্মতি সমস্ত ভোগ তৃষ্ণার হেতু। এই কামরূপ দুর্ম্মতি স্বরূপ দুর্যোধন, যা আমাদের প্রবৃত্তি, সারাক্ষন নিবৃত্তি-পক্ষীয়দের সাথে শত্রুতা সাধন করে থাকে এবং তাদের পরাভূত করবার চেষ্টা করে থাকে। প্রথমে জীব মাত্রেই ভোগাসক্ত থাকে। এর পরে ভোগে অপারগ হলে, অথবা সদ্-বিচারবুদ্ধি জাগ্রত হলে, জীব ভোগ আকাঙ্খ্যার  অসারতা বুঝতে পারে। আর তখন ভোগ থেকে নিবৃত্তি চেয়ে থাকে। আর যখনই কেউ ভোগ থেকে নিবৃত্তি চায়, তখন আমাদের শম দম ইত্যাদিকে  বুদ্ধি বেষ্টন করবার চেষ্টা করে, তখন প্রবৃত্তি পক্ষ সতর্ক হয়ে যায়। এদের মধ্যে দুর্ম্মতি যখন দেখে নিবৃত্তি পক্ষ যুদ্ধ করবেই, তখন সেও আচার্য্যের খোঁজ করে। এবং সাধন-সমরে তাকে পরাজিত করবার জন্য রণক্ষেত্রে উপস্থিত হয়। 
এই আচার্য্য  হচ্ছে আমাদের সংস্কার। এই সংস্কার আসলে আমাদের সুকর্ম্মে বা দুষ্কৰ্ম্মে প্রবৃত্ত করে থাকে, সমস্ত কর্ম্মের  শিক্ষাদাতা এই সংস্কার-রূপ আচার্য্য । আমাদের ভালো মন্দ উভয় কর্ম্মের  গুরু হচ্ছে আমাদের সংস্কার। আমরা জানি দ্রোণ কথাটার অর্থ হচ্ছে কলসি। অর্থাৎ একটা জলাধার। আবার আমরা জানি  "দ্রু" ধাতু থেকে দ্রোণ।  "দ্রু" কথাটার অর্থ হচ্ছে গমন করা। তো যা আমাদের সাথে সাথে গমন করে, তাকে বলা হয়, সংস্কার। জন্ম জন্মান্তর ধরে আমরা আমাদের কর্ম্ম সংস্কার বহন করে নিয়ে চলেছি। তো আমাদের দুর্ম্মতি যখন দেখে বেটা  সাধু (স্ব-অধীন) হবার চেষ্টা করছে, অর্থাৎ আমাদের নিবৃত্তি পক্ষীয়রা কোমরবেঁধে লেগেছে, যুদ্ধ করবে বলে,  আর আমাকে (দুর্মতি)এই ক্ষেত্র থেকে এখন তাড়িয়ে দিতে চাইছে, তখন সে সংস্কারের কাছে ছুটে যায়। আর এই সংস্কার হচ্ছেন, আচার্য্য অর্থাৎ শিক্ষক দ্রোণ। আর প্রত্যেক মানুষের সংস্কার বড্ড জেদি হয়, একগুঁয়ে গোছের হয়। আমরা কেউ সংস্কারকে সহজে ছাড়তে পারি না। আবার সংস্কারও আমাদেরকে ছেড়ে সহজে যায় না।
 আমাদের দুর্ম্মতি চায়, সবসময় ভোগ সুখে আসক্ত থেকে দিনযাপন করতে। ধ্যান সাধনা তার ধাতে সয়  না। ধ্যান সাধনার কথা মনের মধ্যে উঠলেই, আমরা নানান রকম বাহানা করতে থাকি।  আমার এখন সময় কোথায় ? এসব বৃদ্ধ বয়সের কাজ। এসব করে কি হবে ? ইত্যাদি ইত্যাদি নানান রকম বাহানা করতে থাকে।  এবং নিজের মধ্যে যে সংস্কার আছে, তার কাছে উপস্থিত হয়ে, তার সহযোগিতা পেতে চায়। এই দুর্ম্মতি যাদের সক্রিয় থাকে, তারা কখনো ভালো কথা শুনতে চায় না। বরং নানান রকম যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করে, যে প্রবৃত্তির দাস হয়ে থাকতে ভালোবাসে। দুর্ম্মতি  সংসার সাগরে ভেসে ভেসে চলতে চায়। সে তার নিজের দুর্বুদ্ধিকেই শ্রেষ্ট বুদ্ধি বলে মনে করে। সে যা কানে শোনে, যা সে চোখে দেখে  তাই সে গ্রহণ করে। তার বাইরে কোনো কিছুকে সে অগ্রাহ্য করে থাকে। কারো কাছে সে মাথা নত  করতে চায় না। এই ক্ষেত্র বা শরীরের রাজা থাকতে চায়। এখানে সে অন্য কারুর ভাগ দুর্ম্মতি পছন্দ করে না। 

হঠাৎ একদিন সুবুদ্ধি রূপ, নিবৃত্তিরূপ, যাকে সে পদদলিত করে রেখেছিলো, বা পদদলিত করে  রাখতে চায়, সে যখন এই ক্ষেত্রের বা শরীরের ভাগ চায়, তখন সে সহ্য করতে পারে না। আমাদের বিষয়াসক্ত মন সুবুদ্ধির আশ্রয় নিয়ে, দুমিনিট সাধুসঙ্গ করতে চায়, ধ্যান-সাধনা করতে চায়, তা দুর্ম্মতির  কাছে অসহ্য বোধ হয়। দুর্ম্মতির কাছে এসব বেয়াদপি। বলে ওঠে নাহি দিব সুচাগ্র মেদিনী। সে চায় লড়াই হোক। আর সুমতিকে সে দেহ-মনের রাজ্য থেকে বের করে, নিরাশ্রয় করে দিতে চায় ।

 তাই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আয়োজন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে এসে যখন সে দেখে, ব্যাটা সুমতি তার দলবল নিয়ে অর্থাৎ সদ্বুদ্ধির বুহ্য রচনা করছে, তখন সে আমাদের সংস্কাররূপ দ্রোণাচার্য্যের কাছে ছুটে যায়।
মনে মনে ভাবে, সংস্কার আমার পক্ষে , সংস্কার সবচেয়ে বলবান। সংস্কারের কাছে গিয়ে সে বলে, দেখুন আপনি হচ্ছেন সংস্কার ওরা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। এরা আপনার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে, আপনার বিরুদ্ধেই  লড়াইয়ে নেমেছে।  আপনাকেই পরাজিত করতে চাইছে। এদের স্পর্দ্ধাটা একবার দেখুন।
 আসলে আমরা সবাই আমাদের ভোগরাজ্যকে সুরক্ষিত রাখতে চাই।  এটাই আমাদের প্রবৃত্তি। এখান থেকে বেরিয়ে যদি আপনি আপনার ভোগের সামগ্রীকে বিলিয়ে দেবার চেষ্টা করেন, অর্থাৎ ভোগ থেকে নিবৃত্তির জন্য সচেষ্ট হন, তখন আপনার ভিতর থেকেই দুর্ম্মতি বলে উঠবে, করছোটা  কি ? আমাদের একটা বংশ মর্যাদা আছে। বুদ্ধদেব যখন আলোকপ্রাপ্ত হয়ে, রাজার দরবারে ভিক্ষে করতে এসেছিলেন, তখন রাজা শুদ্ধোধন বলেছিলেন, আমাদের একটা বংশ মর্যাদা আছে।  তুমি রাজার ছেলে হয়ে, দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে জীবন নির্বাহ করবে ? বুদ্ধদেব বলেছিলেন, তোমার বংশ আলাদা, আমার বংশ আলাদা। তো দুর্ম্মতির ভাব আর সুমতির ভাব আলাদা কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, রাজা দুর্ম্মতি শক্তিশালী, ধনবান। দুর্যোধনের সৈন্যসংখ্যা অনেক তার দলে আছে মহামতি ভীষ্ম, (ভ্রমাত্মক জ্ঞান) আছে কৃপাচার্য্য, (মোহে আবদ্ধ কৃপা-দৃষ্টি) আছে, দ্রোণাচার্য্য জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার), তাই  দুর্ম্মতিরূপ দুর্যোধনের  বল বেড়ে যায়, জেদ  বেড়ে যায় । আবার সংস্কারের মধ্যেও আছে জেদ। তাই দুর্ম্মতির জেদ আর সংস্কারের জেদ আমাদেরকে পরিচালিত করে থাকে। শম, দম, বৈরাগ্য, সাধন, ভজন, এগুলো মাত্র কতিপয় জন্ম-জন্মান্তরের সাধকের মধ্যে থাকে। আর সবাই এই সংস্কারের ও দুর্ম্মতির কাছে মাথা নত করে ভোগ রাজ্যেই বিচরণ করে, ও দুর্ভোগের শিকার হয়। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 
-------------------------  
  ১.১২.২০২১                  
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (4)

পশ্যৈতাং  পাণ্ডুপুত্রানাম আচার্য্য  মহতীং চমূম্
ব্যুঢ়াং দ্রুপদ পুত্রেণ তবে শিষ্যেণ ধীমতা। (গীতা-শ্লোক-১.৩)

হে আচার্য্য, আপনার ধীমান শিষ্য দ্রুপদপুত্র কর্তৃক বুহ্যবদ্ধ  পাণ্ডবগণের  এই বিশাল সেনাদল দেখুন।  

এখানে আমরা আরো একজন নতুন চরিত্রের নাম শুনলাম। দ্রুপদপুত্র অর্থাৎ ধৃষ্টদ্যুম্ন। আমাদের চিদাকাশে বা কূটস্থে সাধনকালে বিচিত্র দৃশ্যের সমাবেশ হয়ে থাকে। এই জ্যোতিকে অবলম্বন করে সাধক সাধনার অনুকূল বৃত্তি সমূহ রক্ষা করে থাকেন। যারা সাধন জগতের লোক, তারা জানেন, এই জ্যোতিকে লক্ষ করে,মন যখন অনুসন্ধানে লিপ্ত হয়, তখন অনেক ঘটনার কথা জানা যায়। ইনিই দ্রুপদপুত্র।  দ্রুপদ কথাটার অর্থ হচ্ছে, দ্রুতগতি। মন  যখন অন্তর্যামীরূপে ধাবমান হন তখন তাকে দ্রুপদ বলে। মনের  এই অন্তর্যামিত্ব শক্তি দ্বারা সাধক  অনেক অজানা তথ্য জানতে পারেন। একে ঠিক দিব্যদৃষ্টি বলা যায় না। এটি একটি আধ্যাত্মিক শক্তি। তো আমাদের এই অন্তর্যামিত্ব  শক্তির থেকে উদ্ভূত ক্ষুদ্র শক্তিকে বলা হচ্ছে দ্রুপদপুত্র। ধৃষ্টদ্যুম্ন কথাটা  এখানে ব্যবহার করা হয় নি। তথাপি জেনে রাখা ভালো যে ধৃষ্টদ্যুম্ন কথাটার  অর্থ হচ্ছে - মহান নির্লজ্জ। ধৃষ্ট অর্থাৎ লজ্জাহীন দ্যুম্ন অর্থাৎ মহা।
   
পাণ্ডব অর্থাৎ শরীরের পঞ্চতত্ব। এই পঞ্চতত্বের সেনাপতি হয়েছেন ধৃষ্টদুম্ম, অর্থাৎ তেজঃশক্তি থেকে যার জন্ম । ধৃষ্টদুম্মের জন্ম হয়েছে অগ্নিতত্ব থেকে। এই অগ্নিতত্ব বা তেজ পঞ্চতত্বকে  রক্ষা করে থাকে।  ইনিও একরোখা। অগ্নি যেমন কাউকে রেয়াত করে না, তেমনি সাধন জগতের সাধকগণ একরোখা মনোভাব নিয়েই সাধনায় রত হন। এই অগ্নিতত্ত্ব জাগ্রত না হলে, সাধক সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে পারেন না।  যাঁরা সাধন জগতের মানুষ তারা জানেন, প্রাণবায়ুতে অগ্নির সংযোগ করেই তাকে উর্দ্ধগামী করা হয়ে থাকে। আর কূটস্থে (কূট = দৃঢ়, স্থ = স্থিত) অর্থাৎ নির্বিকার, সর্বাবস্থায় স্থিত সেই পরমাত্মার  বিচিত্রসব  দৃশ্যের উদ্ভব হয়ে থাকে। শব্দ, স্পর্শ ও রূপবিশিষ্ট বলে অগ্নিকে  বলা হয় ত্রিগুণাত্বক। সাধন জগতে তেজের মহিমা অপরিসীম। ইনি  উর্দ্ধগামী। এবং সকলকে উর্দ্ধগামী করে থাকেন। কূটস্থের মধ্যে যখন এই তেজঃশক্তির স্ফূরণ ঘটে তখন নানান রকম দৃশ্যপট সামনে ফুটে ওঠে। আর এই বিচিত্র চিত্র দেখতে পেলে, সাধকের মনে উৎসাহের সঞ্চার হয়ে থাকে। এইজন্য দুর্ম্মতিরূপ দুর্যোধনের এঁকে  খুব ভয়। পাছে  সাধক এই কূটস্থের আকর্ষনে বিমহিত হয়ে যায়। ধৃষ্টদ্যুম্ন  সেই দ্রোণাচার্য্যের শিষ্য। ফলত একরোখা সংস্কারের শিক্ষা আছে এর মধ্যে। . তাই দেখা যায়, মানুষ যখন একবার সাধনার মধ্যে একরোখা ভাব সম্পন্ন হয়ে যায়, তখন তাকে সাধন অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনা  যায় না। তাই দুর্ম্মতি দুর্য্যোধনের  এঁকে  খুব  ভয়। যার শরীরে এই তেজতত্ত্বের প্রভাব বেশী তারাই জীবনে সাফল্য পেয়ে থাকেন, তা সে আধ্যাত্মিক জগতে বলুন, বা স্থূল জগতে বলুন। 
আমরা দেখেছি, বহু সার্থক যোগীপুরুষ, ছোটবেলা থেকে একরোখা হয়ে থাকেন । আচার্য্য শংকর ছোটবেলা থেকে তেজস্বী।মায়ের শত অনুরোধ সত্ত্বেও সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন।  বহু সাধক এই অগ্নিতত্ত্বের প্রভাবেই একগুঁয়ে হয়ে সাধন পথের  মতো দুর্গম রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন। কোনো পিছুটান তাঁকে রোধ করে পারেনা । তাই যার শরীরে অগ্নিতত্ত্বের প্রভাব বেশী তিনি মহাত্মা এমনকি স্থূল জগতেও নির্ভিক ও নির্ভরশীল চরিত্র।   এটি আমাদের শরীরে অর্থাৎ পঞ্চতত্ত্বে অগ্নিতত্ত্বের প্রভাবের কারনে হয়ে থাকে। তাই পাণ্ডব অর্থাৎ পঞ্চতত্ত্বের সেনাপতি হচ্ছেন ধৃষ্টদুম্ম অর্থাৎ অগ্নিতত্ত্ব।
------------------------ 
১.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (৪/১)

শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ৪-৬

অত্র শূরা মহেস্বাসা ভীম-অর্জুন-সমা  যুধি 
যুযুধানো বিরাটশ্চ দ্রুপদশ্চ মহারথঃ। (৪)
ধৃষ্টকেতুঃ চেকিতানঃ কাশীরাজশ্চ বীর্য্যবান 
পুরুজিৎ কুন্তিভোজশ্চ শৈব্যশ্চ নরপুঙ্গবঃ। (৫)
যুধামন্যুশ্চ বিক্রান্ত উত্তমৌজাশ্চ  বীর্যবান 
সৌভদ্রো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব্ব এবং মহারথাঃ। (৬)

এখানে সেনামধ্যে আছেন, মহা-ধনুর্ধারী বীরগন। ভীম অর্জুনের তুল্য মহারথী, সাত্যকি, বিরাট, দ্রুপদ, বীর্যবান ধৃষ্টকেতু, চেতিয়ান, ও কাশীরাজ।  আছেন পুরুজিৎ, কুন্তিভোজ ও শৈব্য, বিক্রমশালী যুধামন্যু, পরাক্রান্ত রাজা উত্তমৌজাঃ, সুভদ্রা-নন্দন ও দ্রৌপদীর পুত্রগণ। এঁরা  সকলেই মহারথী। 

যাদের নাম করা হয়েছে তারা সবাই মহারথী। যিনি একাই দশ হাজার ধনুর্ধারীর সাথে যুদ্ধ করতে পারেন, তিনি মহারথী । যুদ্ধে-শাস্ত্রে যিনি অভিজ্ঞ। যিনি অসংখ্য সৈন্যের সাথে যুদ্ধ করতে সক্ষম তিনি অতিরথ। 
এবারে আমরা দেখে নেই, পান্ডবপক্ষে যুদ্ধের জন্য কে-কে উপস্থিত হয়েছেন। একটা কথা জানবেন, সাধন সমরে নামতে গেলে, আমাদের সর্ব্ব শক্তি নিয়োগ করতে হয়। এখানে দেখুন কে কে এসেছেন : 

১. ভীম - অর্জুন তুল্য যোদ্ধাগন  : ভীম অর্থাৎ বায়ুতত্ব অর্থাৎ প্রাণবায়ু,  অর্জুন অগ্নিতত্ত্ব অর্থাৎ আমাদের জঠরাগ্নি । অগ্নিতত্ত্ব ও বায়ুতত্ত্বের যোগ সাধন হলেই ঐশ্বর্যের উৎপত্তি হয়। 
২. প্রথমে সাত্যকি অর্থাৎ আমাদের সুমতি। যতক্ষণ আমাদের মধ্যে সুমতির জাগরন না হয়, ততক্ষন আমাদের সাধনায় মতি আসে না। অতয়েব সাত্যকি সাধন জগতের প্রথম সোপান। 
২. বিরাট - আমরা চোখ বুজলেই অন্ধকার দেখি। কিন্তু কিছুদিনের সাধনাতেই আপনি চোখের সামনে একটা আলোর অভ্যাস দেখতে পারবেন। বা কিছু চিত্র দেখতে পারবেন। এই চিত্র আপনার কল্পনা প্রসূত হতে পারে, অর্থাৎ আপনার যে ইষ্টদেব, তার প্রতিচ্ছবি হতে পারে, বা অন্য যেকোনো কিছু যা আপনি দেখতে চাইবেন, তাই আপনি দেখতে পারবেন। বিরাট কথাটার অর্থ হচ্ছে, সাধক যা ইচ্ছে করে তা তার কূটস্থের সম্মুখে দেখতে পায়। 
৩.দ্রুপদ - আমার সবার একটা অন্তর্যামিত্ব শক্তি আছে, একেই দ্রুপদ বলা হয়ে থাকে। 
৪.ধৃষ্টকেতু : এই যে অন্তরের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে একটা প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়, একই বলে ধৃষ্টকেতু। 
৫. চেকিতান  : শব্দব্রহ্ম, যা আমাদের চেতনা জোগায়।  সেই ওঙ্কার ধ্বনিকে বলা হয়, চেকিতান । 
৬. কাশীরাজ : কাশীর যিনি রাজা,  মহৎ জ্যোতিঃরূপ শিব-শক্তি । । 
৭.পুরজিৎ : পুরোজিৎ কথাটার অর্থ অবরোধ করা অর্থাৎ কুম্ভক। সাধনার সময় প্রানের যখন স্থিরতা আসে, যখন শ্বাস আর বাইরে আসে না, মন তখন স্থির ও স্পন্দনহীন হয়ে যায়।  এই অবস্থা সাধনার শেষ ফল। 
৮. কুন্তিভোজ : সাধনার উচ্চ অবস্থায় প্রবেশ কালে অর্থাৎ উচ্চ অবস্থায়র দ্বারে পৌঁছলে, একটা আনন্দের অনুভব হয়, একেই বলে কুন্তিভোজ। 
৯ শৈব্য : সাধনার শেষে আসে ব্রহ্মানুভূতি।  একেই বলে শৈব্য। 
১০. যুধামন্যু : সাধনার বিঘ্ন স্বরূপ যে ভ্রান্তিদর্শন একে বলে যুধামন্যু। 
১১.উত্তমৌজা : যে আদ্যাশক্তি কুণ্ডলিনীশক্তিকে জাগিয়ে তোলে,  তাকে বলা হয় উত্তমৌজা। 
১২. অভিমন্যু : সাধকের মনোরথ পূরণ করবার জন্য যে শক্তির উদয় হয়, তাকে বলা হয় সিদ্ধিশক্তি। ইনিই অভিমন্যু। 

তো বায়ুরূপ প্রাণশক্তি অর্থাৎ ভীম ও অগ্নিরূপ অর্জুন-এর ইচ্ছামাত্র এই সিদ্ধি লাভ হয়ে থাকে। সাধনায় কেউ অন্তর্যামীর অনুভব করছে, কারো স্ব;-প্রকাশ অনুভব হচ্ছে, কেউ ওঙ্কারের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন, কেউ মহা-জ্যোতিঃ দেখতে পাচ্ছেন, কেউ বা বসে বসে আনন্দ অনুভব করছেন, কেউ বা মনকে ব্রহ্মে স্থিত রেখে সমস্ত পর্যবেক্ষণ করছেন। কেউ আদ্যশক্তিকে জাগ্রত করে মূলাধারের উর্জ্বাকে উর্দ্ধগতি সম্পন্ন করছেন ।এঁরা, এই সাধকগণই  নরশ্রেষ্ট।  আসলে এগুলো সবই যোগৈশ্বর্য্য। 

উপস্থিত সৈন্যদের বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথমে পান্ডবদের  কথা উল্লেখ করা হয়েছে।  কারন হচ্ছে, সাধনবল এখান থেকেই আসে। এঁরা সবাই যদিও সাধনার শেষপর্যন্ত টিকে থাকবেন এমনটা নয়, এইসব শক্তিধর একসময় সাধনযুদ্ধের মধ্যেই  বিলুপ্ত হয়ে যাবেন। কিন্তু সাধক যখন সাধনার জন্য প্রস্তুত হন, তখন এইসব শক্তি সাধনার উৎসাহদায়ক। এদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান হচ্ছে সাত্যকি, অর্থাৎ আমাদের শুভ-ইচ্ছে। এই শুভ ইচ্ছের জাগরণ না ঘটলে, কারুর পক্ষেই সাধনক্ষেত্রে আসবার প্রবৃত্তি আসে না। আমাদের যে অশুভবৃত্তি , এই অশুভ প্রবৃত্তির প্রধান প্রতিপক্ষ  হচ্ছে আমাদের শুভবৃত্তি।
বিরাট অর্থাৎ যার ইষ্টমূর্তি আমাদের অভিলাষ করি, যোগজ সিদ্ধিবলে, কূটস্থের সামনে তিনিই এসে উপস্থিত হন। দ্রুপদ হচ্ছে, দ্রুতগতি সম্পন্ন আমাদের অন্তর্যামিত্ব শক্তি।
ধৃষ্টকেতু হচ্ছে, আমার আমাকে অনুভব।  নিজেকে অনুভব হলে, আমাদের চাঞ্চল্য, আমাদের পাপক্রিয়া, আমাদের বিষয়াসক্তি ইত্যাদি দূর হয়ে যায়। 
চেকিতান হচ্ছে প্রণব-এর ধ্বনি। সাধক প্রথম প্রথম যখন এই প্রণবের অস্পষ্ট ধ্বনি শুনতে পান, তখন ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের মতো শোনায়। 
কাশীরাজ, জ্ঞানজ্যোতির প্রকাশস্বরূপ হচ্ছে এই কাশীরাজ। 
পুরোজিৎ - আমরা জানি,  চিত্ত বৃত্তির নিরোধ ব্যাতিত  সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোকে অবরোধ করা যায় না। আর এই ইন্দ্রিয় অবরোধের কাজ সম্পন্ন না হলে সমাধিলাভ সম্ভব নয়। পুরোজিৎ  কথার অর্থ অবরোধ। 
কুন্তিভোজ : আনন্দই দিব্যের  আরাধনা শক্তি। সাধনায় যখন আনন্দের স্ফূরণ হয়, সাধনার কাজে উৎসাহ আসে। আর এই দৈব আরাধনার মাধ্যমে অনেক দৈবশক্তি লাভ হয়ে থাকে। যাঁকে  আমরা যোগবিভূতি বলে থাকি। 
শৈব্য : শিব কথাটা থেকে এসেছে শৈব্য। শিব কথাটার অর্থ হচ্ছে মঙ্গলময়।  ব্রহ্মজ্ঞানের মতো কল্যাণকর মঙ্গলময় আর কিছু হতে পারে না। তাই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষই হচ্ছেন,  শৈব্য। 
যুধামন্যু : যুধা অর্থাৎ যুদ্ধে, মন্যু অর্থাৎ দৈন্যতা।  তো যুদ্ধে যার দৈন্যতা আছে বা ভ্রান্ত-জ্ঞান আছে, তিনি যুধামন্যু। এই যুধামন্যু অবস্থা সমস্ত সাধকের ক্ষেত্রে প্রথম প্রথম হয়ে থাকে। সাধনার সেই বাধা পেরিয়ে সাধককে এগিয়ে যেতে হয়। 
উত্তমৌজাঃ উত্তম ওজঃ শক্তি যার মধ্যে বিদ্যমান। কুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করবার যে শক্তি, তাকেই বলে উত্তমৌজাঃ বা আদ্যাশক্তি।  
সৌভদ্র - সুভদ্রার পুত্র সৌভদ্র বা অভিমন্যু। যা থেকে জীবের বা জগতের মঙ্গল হয়ে থাকে।  ভদ্র কথাটার অর্থ ভালো, সুভদ্র মানে খুব ভালো। তো ভালো  থেকেই জগতের মঙ্গল হতে পারে। 
দ্রৌপদেয় : অর্থাৎ দ্রৌপদীর পুত্র। দ্রুত স্বস্থানে যিনি নিয়ে আসেন, তিনি দ্রৌপদী। আমরা জানি দ্রৌপদী অগ্নি থেকে জাত। সেই অগ্নির স্ফুলিঙ্গ হচ্ছে দৌপদীর পুত্রগন। সাধনার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সাধকের মধ্যে তন্মাত্রের জ্ঞান হয়, অর্থাৎ শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এর অনুভবশক্তি প্রবল আকার ধারণ করে, এমনকি সাধকের মধ্যেও গন্ধ, তেজ ইত্যাদির প্রকাশ লক্ষ করা যায়। নাসিকাগ্রে চিত্ত সংযমের মাধ্যমে দিব্য গন্ধের  অনুভব হয়, জিহ্বায় দিব্য রস বা অমৃতর অনুভব হয়। তালুতে  চিত্ত সংযম করলে আমাদের রূপজ্ঞান হয়। অর্থাৎ রূপ-রস ইত্যাদির অনুভব থেকে নিজের মধ্যে সাধনালব্ধ ফলের প্রতি শ্রদ্ধা উৎপন্ন হতে থাকে। 

যদিও সাধনার যত  অগ্রগতি হতে থাকে অর্থাৎ সাধন সমর চলতে চলতেই এই সব শক্তির বিলোপ হতে থাকে। কিন্তু এই অবস্থায়, সাধনা থেকে স্খলিত হবার সম্ভাবনা থাকে না। 

এখন কথা হচ্ছে, এদের সবার উপস্থিতি দেখে, দুর্ম্মতির মধ্যে যে আশঙ্কার উৎপত্তি হয়েছে, তার জন্য, সে সংস্কার নামক দ্রোণের  কাছে গিয়ে তাকে বিপক্ষীয়দের সন্মন্ধে সাবধান করে দিচ্ছেন। এই হচ্ছে সার কথা। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। 
২.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (৫)

শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ৭-৮

অস্মাকন্তু বিশিষ্টা যে তন্নিবোধ দ্বিজত্তম 
নায়ক মম সৈন্যস্য সংজ্ঞার্থং তান ব্রবীমি তে। (১.৭)
ভবান ভীষ্মশ্চ কর্ণশ্চ কৃপশ্চ সমিতিঞ্জয়ঃ 
অশ্বত্থামা বিকর্ণশ্চ সৌমদত্তির্জযয়দ্রথঃ। (১.৮) 

হে দ্বিজোত্তম, আমাদের পক্ষে যারা বিশিষ্ট নায়ক, তাদের সম্পর্কে  শুনুন। আপনার গোচরার্থেতাদের নাম বলছি। 
সমরবিজয়ী আপনি, ভীষ্ম, কর্ন, কৃপাচার্য্য, অশ্বত্থামা, বিকর্ন, সোমদত্ত-তনয় ও জয়দ্রথ। 

এখানে আমরা দুর্যোধনের পক্ষে অর্থাৎ আমাদের দুর্ম্মতির পক্ষে যারা সাধন-সমরে উপস্থিত আছেন, তাঁদের নাম শুনছি, দুর্ম্মতির মুখ দিয়েই। আমাদের অশুভবুদ্ধি যে আমাদের মধ্যকার শুভবুদ্ধি সম্পর্কে সম্যকরূপে অবহিত তা আমরা শুনেছি, আগের শ্লোকে, অপর পক্ষের শক্তিধরদের বর্ণনার মাধ্যমে। কিন্তু তাই  বলে আমাদের দুর্ম্মতি কিন্তু নিজেকে মোটেই দুর্বল ভাবে না। সুমতির দলের  বল অবগত হয়েও, সে নিজের দলের  প্রতি অটুট বিশ্বাস রাখে।  এবং মনে করে, সে নিবৃত্তি পক্ষীয়দের অনায়াসেই পরাভূত  করতে পারে। অর্থাৎ আমাদের সুমতির চাইতে দুর্ম্মতির প্রভাব ও আত্মবিশ্বাস প্রথম দিকে বেশিই থাকে। যাইহোক  এখানে আমরা নতুন কয়েকটি চরিত্রের সন্ধান পেলাম।  ভীষ্ম, কর্ন, বিকর্ন, কৃপাচার্য্য, অশ্বত্থামা, ভূরিশ্রবা ও জয়দ্রথ, যাঁরা দুর্ম্মতির পক্ষে যুদ্ধ করবেন বলে উপস্থিত হয়েছেন। 

ভীষ্ম : আমাদের ভ্রমাত্মক জ্ঞানই ভীষ্ম। দেখুন অজ্ঞানতার জন্য, আমাদের মধ্যে যেমন ভয় ও সংশয়ের উপস্থিত হয়, তেমনি এই ভয় ও সংশয় আমাদের অনেক দুষ্কর্ন্মের হাত থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। আবার সুকর্ম্মের হাত থেকেও নিজেকে গুটিয়ে রাখে।  কিজানি যোগ-অভ্যাস করলে যদি কোনো শারীরিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হই। কিজানি, কালীপূজা করতে গিয়ে যদি কোনো ভুলত্রুটি হয়, তবে তো সর্ব্বনাশ। তার চেয়ে না করা  ভালো। যেমন আছি তেমন থাকায় ভালো। ইনি খারাপ কাজেও যেমন বাধা দেন, তেমনি ভালো কাজেও সংশয় উপস্থিত করে, ক্রিয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। কিন্তু প্রবৃত্তি যখন প্রবল হয়, তখন তিনি প্রবৃত্তিকে সাহায্য করতে বাধ্য হন। তাই ভীষ্ম দুর্ম্মতির প্রধান সেনাপতি। এনার মনে দ্বিধা, দ্বন্দ। আবার  সবসময়  ভয়ে ইনি জড়সড় হয়ে থাকেন। আর ভয় আমাদের সাধনপথের প্রথম বাধা। 
 কর্ন  ও বিকর্ন : যা কিছু কানে শুনলাম, চোখে দেখলাম, তাকে সহজেই বিশ্বাস করে নেওয়া। আবার কানে না শুনে, বা চোখে  না দেখে অবিশ্বাস করা। তাই আমাদের অবিশ্বাস হচ্ছে, বিকর্ন, আর বিশ্বাস হচ্ছে কর্ন। এই বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের মধ্যে সত্যাসত্য বিচার নেই। কর্ন - বিকর্ন তাই দুর্যোধনের পক্ষে। দেখুন, যোগক্রিয়ায় বিশ্বাস অবিশ্বাস বলে কিছু নেই। সত্যকে আবিস্কার করাই যোগের উদ্দেশ্য। অনেক সময় ইন্দ্রিয় আমাদেরকে ধোঁকা  দেয়। যা আমরা অনেক পরে অনুসন্ধানের ফলে  বুঝতে পারি। তো যোগ সাধনে আমাদের এই বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের কোনো ভূমিকা নেই।  তথাপি সাধনপথে এরা বাধা সৃষ্টি করবার অন্যতম নায়ক হতে পারে। দেখুন শ্রদ্ধা না থাকলে, কোনো আধ্যাত্মিক কর্ম্ম এমনকি জাগতিক কর্ম্মে সাফল্য আসতে  পারে না।  আর এই শ্রদ্ধা একদিনে আসে না।  বিষয়ের জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করতে পারলে, ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে শ্রদ্ধার উদ্রেগ হতে পারে। শ্রদ্ধা বিহীন অবস্থায় হরিনাম-সংকীর্তনের আসরে নেচে গেয়ে কোনো লাভ হয় না।  হয়তো সাময়িক বিনোদন মিলতে পারে, তার বেশি কিছু নয়। তো যোগের উদ্দেশ্য সত্যকে আবিষ্কার করা, এখানে কর্ন-বিকর্ন রূপ সংস্কার আমাদের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। 

কৃপাচার্য্য : কৃপ কথাটার অর্থ হচ্ছে পালিত। শ্বরদান ঋষির পুত্র। রাজা শান্তনুর কৃপায় পালিত। আবার     কৃপা বলতে আমরা বুঝি দয়া, করুণা ।  আর দয়া করি আমরা দুর্বলকে। এটি আমাদের তামসিক বৃত্তি। মোহজনিত দয়া দিয়ে কারুর ভালো করা যায় না। আমরা দয়া বলতে বুঝি ক্ষুধার্তকে অন্নদান, তৃষ্ণার্তকে জল দান, ধনহীনকে ধন দান। দেখুন দেয়া দেখিয়ে কারুর রোগ সরানো যায় না। বিশুদ্ধ দয়ার সঙ্গে এই প্রাথমিক দয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। একটা কথা জানবেন, শুধু শরীর নিয়ে বেঁচে থাকা বা এইধরনের বেঁচে থাকতে সাহায্য করা, ইতরশ্রেণীর জীবের লক্ষণ। মানুষ যাতে ভব-যন্ত্রনা  থেকে মুক্তি পায়, তার জন্য কাউকে সাহায্য করাই প্রকৃত অর্থে দয়া। তপস্যা টপস্যা করে কিছু লাভ নেই বাপু, খাও-দাও মস্তি করো। ইন্দ্রিয়সুখই বড় সুখ।  না খেয়ে শুকিয়ে মারা  গিয়ে কার ভালো হয়েছে ? আর এসব সবার সহ্য হয় না। ইত্যাদি ইত্যাদি। এই দয়ারূপ কৃপা। দ্রোণাচার্য্যের মতো কৃপাচার্য্যও সুমতি ও  দুর্ম্মতির উভয়ের গুরু। ইনি জ্ঞানী, সিদ্ধপুরুষ। তথাপি এনার মধ্যে থেকে দয়ার ভাব যায়নি।  ইনি  সতত  কৃপা করতে উদ্দত থাকেন। আসলে সিদ্ধপুরুষের মধ্যে, মোহজনিত দয়া থাকে না। থাকে জীব-উদ্ধারের জন্য সাত্ত্বিক কৃপা। এইজন্য বলা সাধনযুদ্ধ জয়ী পুরুষের  কৃপার ধরনের  পরিবর্তন হয়, কিন্তু কৃপার কখনো মৃত্যু হয় না।

অশ্বত্থামা : যুদ্ধক্ষেত্রে অশ্বের ন্যায় যার বল ও দ্রুতগতিকে বলে অশ্বত্থামা । দ্রোণাচার্য্য ও কৃপীর গর্ভে যার জন্ম। আমাদের মধ্যে যে বাসনা আছে, যে কল্পবৃক্ষ আছে, সেখানে প্রতিনিয়ত কেবলই কাম-সংকল্প জন্ম নিচ্ছে। তাই জীবকুলের  কর্ম্ম ও তজ্জনিত ভোগ চক্রাকারে ঘুরছে।  এই সঙ্কল্পেরও শেষ নেই।  তাই অশ্বত্থামাও অমর। আর আমরা সবাই জানি, এই কাম-সংকল্প সাধকের সাধনার বিঘ্ন স্বরূপ। এর সহজে নাশ হয় না। 

ভূরিশ্রবা : ভূরিশ্রবণ অর্থাৎ যে যা বলছে, তা শ্রবণ করা। আর ভালো মন্দ সমস্ত কিছু শ্রবনের মধ্যে নিজের বিচার বুদ্ধিকে ঠিক ঠিক মতো কাজে লাগাতে না পারলে, সাধকের মধ্যে নানান রকম সংশয়ের সৃষ্টি হয়।  একবার মনে হয়, ইনি  যা বলছেন, সেটা সত্য, আবার উনি যা বলেছেন, সেটাকে অস্বীকার করি কি করে ? তো নিজের মধ্যে একটা দোলাচল অবস্থা তৈরী হয়। এক্ষেত্রে সঠিক সাধনপথ বেছে নেওয়া যায় না। অমুক গুরু ভালো, তো তমুক গুরু হয়তো আরো ভালো, কিন্তু উনি আবার নারীবেষ্টিত। তো যোগের পথে সংশয়ের তুল্য শত্রু আর কেউ নেই। যারজন্য কৃষ্ণ-ভক্তগন  বলে থাকেন, যেখানে কৃষ্ণ কথা হয় না সেখানে যেওনা। যোগের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যোগগুরুর নির্দেশ একমাত্র পাথেয়। নান্য পন্থা।  অন্য সব পন্থা তা সে ভালো না মন্দ তা বিচার করতে যাবেন না। কথায় কথা বাড়ে, ভোজনে ভরে পেট। তাই ভূরিশ্রবা  দুর্ম্মতির সহায়। সাধন পথের বিঘ্ন-স্বরূপ। 

জয়দ্রথ : জয়দ্রথ হচ্ছে দুঃসাহস। দুর্যোধনের ভগ্নি দুঃশলার পতি। ইনি একবার পঞ্চ পান্ডবের পত্নী আমাদের সাধন-শক্তি  দ্রৌপদীর দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন।  অর্থাৎ জয়দ্রথ হচ্ছে, আমাদের দুঃসাহসের প্রতীক। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত না হয়ে, দুঃসাহসের সঙ্গে জালে ঝাঁপ দেওয়া। এদের কাজ হচ্ছে, সহজ সরল মানুষকে, বা অজ্ঞ মানুষকে যা-নয় তাই বলে, ঘাবড়িয়ে দেওয়া।  এর আছে  একটা কুট-কুশল কর্ম্মবিদ্যা । সমস্ত কুকৰ্ম্মে এরা  অতি দুঃসাহসের পরিচয় দিয়ে থাকে। দেখুন সাহস ভালো কিন্তু দুঃসাহস ভালো না। সাহসের সঙ্গে সাধন  পথে এগিয়ে যাওয়া ভালো, কিন্তু অত্যুৎসাহী হয়ে, গুরুদেবের নির্দশকে অমান্য করে, অতিরিক্ত ক্রিয়া আমাদেরকে যোগের অন্ধকার পথে  প্রবেশ করাতে পারে। প্রত্যেকটি জীবন দায়ী ঔষদের যেমন সঠিক প্রয়োগে জীবন রক্ষা হতে পারে।  তেমনি সেই একই ঔষধ অপপ্রয়োগে আমাদের জীবন যন্ত্রনা বাড়তে পারে।  যোগ আমাদের মোক্ষদায়িনী শক্তি।  এর প্রয়োগ যথাযথ গুরু নির্দেশিত পথেই সুফল মিলতে পারে। 

এঁরা   সবাই দুর্ম্মতির সহায় সেনাপতি। আপনি যদি নিজের দিকে দৃষ্টিপাত করেন, তবে দেখতে পারবেন, এই ধরনের সমস্ত শুভ ও অশুভ শক্তি আমাদের সবার মধ্যে বিরাজ করছে, অর্থাৎ আমাদের যেমন আছে সুমতি তেমনি আছে দুর্ম্মতি । আমাদের দুর্ম্মতিকে ছেড়ে সুমতিকে আশ্রয় করে যোগের পথে এগুতে হবে। এটাই সাধন-সমরের প্রস্তুতি, প্রথম কর্তব্য। 
 সাধনপথে এধরনের নানান বাধাবিঘ্ন পদে পদে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তাইবলে সাধন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবেন না।  সাধনহীন মানুষ ইতরশ্রেণী বিশেষ, পশুবৎ।  আসলে  আমাদের সাধনপথের শত্রু আমাদের মধ্যেই বিরাজ করছে। এদেরকে জয় করতে না পারলে, ইন্দ্রিয়গুলোকে জয় করতে না পারলে, সাধন পথে অগ্রসর হওয়া দুরূহ শুধু নয়, বলা যেতে পারে অসম্ভব। তাই যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। 
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  
                             
৩.১২.২০২১
 যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (৬)

 শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ৯-১০

অন্যে চ বহবঃ শূরা মদর্থে ত্যাক্ত জীবিতাঃ 
নানাশস্ত্র-প্রহরণাঃ সারবে যুদ্ধ বিশারদাঃ।  (১.৯)
অপৰ্য্যাপ্ত তদস্মাকং বলং ভীষ্মাভিরক্ষিতম 
পৰ্য্যাপ্তং ত্বিদমেতেষাং বলং ভীমাভিরক্ষিতম। (১.১০)

দুর্যোধন আচার্য্য দ্রোণকে  সম্মোধন করে বলছেন : আরও অনেক বীর আছেন, যাঁরা আমার জন্য প্রয়োজনে জীবন ত্যাগ করতে কৃতসংকল্প।  নানা অস্ত্র-শস্ত্রধারী যুদ্ধবিশারদ বীর আছেন।(৯) ভীষ্ম কর্তৃক  রক্ষিত সেই সৈন্য অপরিমিত এবং ভীম কর্তৃক রক্ষিত পাণ্ডবসৈন্য পরিমিত।(১০)

আমাদের মধ্যে এমন অনেক প্রবৃত্তি  আছে, যার জন্য আমাদের  শুভ ক্রিয়াতে অনিচ্ছা, আবার অশুভ কর্য্যে প্রাণ ত্যাগ করতেও রাজি হয়ে যাই আমরা।  এসব আসলে আমাদের অজ্ঞানতার কারনে হয়ে থাকে। এটি ঠিক অজ্ঞানতাও নয়, এটি আমাদের ভ্রমজ্ঞান। ভুল তথ্যে এদের মাথা ভর্তি  হয়ে আছে। এরা শাস্ত্ররূপ অস্ত্র দিয়ে তর্কযুদ্ধ করতে ওস্তাদ। এঁরা সবাই আসলে আমাদের দুর্ম্মতির সহায়ক। সত্যি কথা বলতে কি এই সব প্রবৃত্তি যথেষ্ট প্রভাবশালী, সামর্থবান। এই সব প্রবৃত্তি আমাদের সাধন পথের  কাঁটা। সংসার পাঁকে আবদ্ধ  করে, জীবসত্ত্বাকে মুক্তির পথের বাধা হিসেবে কাজ করতে সমর্থবান । কিন্ত এরা সাধনার ক্রিয়ারূপ শুভ  কর্ম্মকে নাশ করবার জন্য এমনকি নিজের অস্তিত্ব পর্যন্ত লোপ করতে প্রস্তুত থাকে। এঁরা  ভালো কাজের সময় নিস্পৃহ, নির্বাক, কিন্তু খারাপ কাজের সময় এদের তেজ দেখা যায়।  এঁরা আসলে অবিশ্রান্ত ইন্দ্রিয়ভোগের করতে করতে  একসময় ইন্দ্রিয়ভোগেরও অযোগ্য হয়ে যায়। তবু এদের মধ্যে বিষয়ের প্রতি আসক্তি নিঃশেষ হয় না। এই প্রবৃত্তিজাত ব্যক্তিগণই সাধককে নানান তর্কজালে বাকযুদ্ধে পরাস্থ করতে সক্ষম। এঁরা  শাস্ত্রের ভুল বা অপব্যাখ্যা করতে ওস্তাদ। এই প্রবৃত্তি যাদের প্রবল তারা হয় শাস্ত্রের গূঢ় মর্ম কথা জানে না, নতুবা জানলেও এঁরা সমাজকে শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে, ভুল পথে পরিচালিত করে থাকে। এরাই সতীদাহ প্রথার কথা বলে, এরাই জাতপাতের সৃষ্টিকর্তা।  এরাই বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে শাস্ত্রব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। এঁরা একসময় বহুবিবাহের পক্ষে সওয়াল করতো। এরাই এখনো ঈশ্বরের নামে মানুষকে শোষণ করে, এরাই মাটির প্রতিমার সামনে জীব-বলি দিয়ে থাকে। এঁরা তপস্যারূপ কৃচ্ছ সাধনে বাধাস্বরূপ।  এরাই নিবৃত্তির প্রধান ও শক্তিশালী বিরুদ্ধপক্ষ। 

কিন্তু সত্য হচ্ছে এরা ভ্রমাত্মক জ্ঞান।   ভীষ্মের ছত্রছায়ায় যুদ্ধ করতে আসে। এঁরা নারীর অসম্মানের সময় নির্বাক, নিস্পৃহ হয়ে বসে থাকে।  এঁরা  সবাই সমর্থ বীর হলেও, এদের সঙ্গে যথেষ্ট পরিমান সৈন্যদল থাকা সত্ত্বেও ভীম অর্থাৎ বায়ু বা প্রাণ কর্তৃক রক্ষিত সৈন্যদের  কাছে, অসহায় বোধ করেন । 

দুর্ম্মতি কখনো নিজেকে অসমর্থ মনে করতেই পারে না। আর দুর্ম্মতির দলে সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে সৈন্যসংখ্যা  অবশ্য়ই অধিক। আমাদের সুবুদ্ধির চাইতে দুর্বুদ্ধি সাময়িক ভাবে হলেও অধিক শক্তিশালী। তবুও যিনি অধার্ম্মিক, তিনি মনে মনে অবশ্যই  জানেন তিনি অধার্ম্মিক। তাই সমর্থ হয়েও অসমর্থ। আর এই কারণেই ভীত-ব্যাকুল চিত্তে সে গুরুর কাছে ছুটে যায়, গোপন থাকে না চিত্তের উদ্বিগ্নতা। 

আমাদের দুর্ম্মতিরূপ প্রবৃত্তি সব সময় শঙ্কা দ্বারা সংরক্ষিত।  আর নিবৃত্তি আমাদের প্রাণবায়ু দ্বারা সংরক্ষিত, প্রাণবন্ত থাকে । যখন সুমতি সজাগ হয়ে সাধন সমরে উপস্থিত হয়,  এই অবস্থায় অর্থাৎ দুর্যোগকালে, দুর্ম্মতি গুরু অর্থাৎ নিজ সংস্কারের কাছে ছুটে  যায়।  আসলে সংস্কার আমাদের প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির আচার্য্য।  সত্য সাধনায় প্রবৃত্তির ভয়। আর সাধনকালে ভয়ের উদ্রেগ  হলেই শঙ্কা  জেগে উঠলেই সাধনার পথে কেউ পা বাড়াবে না। আমাদের এই বিষয়-ভোগের যে প্রবৃত্তির, যে শক্তি বা বল তা আমাদের ভয়রূপ দ্বারা সংরক্ষিত। এরা  ভয়ের দ্বারা আবৃত।  অন্যদিকে সাধনপথের সহায়ক হচ্ছে বিবিধ বায়ু, যার মধ্যে প্রধান হচ্ছে প্রাণ-অপান বায়ু।  এই প্রাণবায়ু দ্বারা সংরক্ষিত আমাদের সুমতি ।  আমাদের কাম-ক্রোধ-মোহ যতই ভীষণ হোক না কেন, মন দিয়ে কিছুক্ষন প্রাণায়াম করলেই সমস্ত কর্ম্ম ইন্দ্রিয় শান্ত স্থির ও নিয়ন্ত্রণে চলে  আসে। এই হচ্ছে যোগ।    
--------------------------- 
         
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (৭)

 শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ১১-১৪

অয়নেষু চ সর্ব্বেষু যথাভাগম  অবস্থিতাঃ 
ভীষ্মমেবাভিরক্ষন্তু ভবন্তঃ সর্ব্ব এব হি। (১.১১)

এখন আপনারা সকলে ব্যুহ প্রবেশপথে নিজ নিজ বিভাগ অনুসারে অবস্থিত হয়ে আপনারা সকলে ভীষ্মকেই রক্ষা করতে থাকুন। 

আমরা জানি ভীষ্ম হচ্ছেন আমাদের ভ্রমাত্মক জ্ঞান। এই ভ্রমাত্মক জ্ঞান যতক্ষণ বজায় থাকে ততক্ষন আমাদের  কর্ম্মের মধ্যেও সেই ভ্রমের প্রতিফলন হবে। তাই দুর্ম্মতির প্রথম কাজ ও  কর্তব্য হচ্ছে এই ভ্রমরূপ ভীষ্মকে রক্ষা করা। তাই দুর্ম্মতিরূপ দুর্যোধন সমস্ত নিজপক্ষীয়দের  নির্দেশ দিচ্ছেন, এই ভ্রমকে রক্ষা করতে। জ্ঞানের উন্মেষ হলে আমাদের ভয় দূরীভূত হয়ে যায়। তাই ভয়কে বজায় রাখতে গেলে ভ্রমজ্ঞানকে রক্ষা করা আবশ্যক। অস্মিতার কাজ হচ্ছে ভয় পাওয়া। চিদাভাসকে ঘিরে ভয় কাজ করে থাকে। আমরা সবাই ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখি। কখনো সমাজের ভয়, কখনো সুখ-স্বাছন্দের অভাবের ভয়, কখনো শরীর নাশের ভয়। এই ভয়কে দূর করতে না পারলে, সাধনপথে এগিয়ে যেতে পারবো না। আর এই ভ্রম থেকে উৎপন্ন ভয়কে যখন আমরা দূর করতে পারবো, তখন আমাদের মধ্যে সাধনের উৎসাহ আসবে এবং আমরা সাধনার রস আস্বাদন করতে  পারবো। তো যোগীর প্রথম কাজ হচ্ছে যোগ সম্পর্কে যে ভ্রমাত্মক জ্ঞান আছে, তাকে সত্যজ্ঞানের সাহায্যে উৎপাটন করা। কিন্তু আমাদের অস্মিতা এই  ভ্রমজ্ঞানকে সহজে ছাড়তে চায় না। বরং এই ভ্রমকে বজায় রেখে অশাস্ত্রীয় যুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে ইন্দ্রিয়সুখে জীবন অতিবাহিত করতে চায়। আমাদের সংস্কার রূপ দ্রোণ এই কাজে সাহায্য করে থাকে। আমাদের ভ্রমাত্মক জ্ঞান আমাদেরকে ভ্রমের মধ্যে নিমজ্জিত করে রাখে।  আর আমরা অর্থাৎ আমাদের দুর্ম্মতি  সংস্কারের আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে ।    

তস্য সংজনয়ন হর্ষং কুরুবৃদ্ধ পিতামহঃ
সিংহনাদং বিনদ্য় উচ্চৈঃ শঙ্খং দধ্নৌ প্রতাপবান। (১.১২)

মহা প্রতাপশালী কুরুবৃদ্ধ পিতামহ তাঁর হর্ষ উৎপাদন করে উচ্চ সিংহনাদ পূর্বক শঙ্খধ্বনি করলেন।

ভ্রমরূপ ভীষ্ম দুর্ম্মতির হর্ষ উৎপাদন করে, উচ্চস্বরে শঙ্খধ্বনি করলেন। আমরা জানি, ধ্বনি যেমন আমাদের আনন্দের কারন হতে পারে, আবার এই ধ্বনি আমাদের ভয়ের উদ্রেগ করতে পারে। ধ্বনির মধ্যে সমস্ত কিছুর সৃষ্টি লুকিয়ে আছে, আবার এই ধ্বনির মধ্যেই লুকিয়ে আছে ধংসাত্মক শক্তি। এই ধংসাত্মক শক্তি আমাদের মধ্যে ভয়ের উদ্রেগ করে থাকে। আর ভয় যদি পিছনে লাগে, তবে সাধকের পক্ষে সাধনা করা সম্ভব নয়। দুর্ম্মতিকে সাহস দেবার জন্য, ভীষ্ম শংখধ্বনি করলেন। অর্থাৎ ভ্রম-জাত  ভয় যেন বিজয় ঘোষণা করলেন, "আমি একাই সমস্ত শুভশক্তিকে দুর্বলচেতা করে সাধন-বিমুখ  করে দেবো"।

ততঃ  শঙ্খাশ্চ ভের্য্যশ্চ পণবানকগোমুখাঃ 
সহসা এব অভ্যহন্যাস্ত স শব্দ তুমুলঃ অভবৎ। (১৩)
ততঃ শ্বেতৈ হয়ৈঃ যুক্তে মহতি স্যনন্দে স্থিতৌ
মাধবঃ পাণ্ডবশ্চৈব  দিব্যৌ শঙ্খৌ প্রদধ্নতুঃ। (১৪) 

তারপর শঙ্খ ও ভেরী সহযোগে পণব (মাদল), আনক (ডঙ্কা), গোমুখ (শিঙ্গা), প্রভৃতি রণবাদ্য বেজে তুমুল ধ্বনির সৃষ্টি হলো।  (১৩)

এরপর, পান্ডব সৈন্য গনের মধ্যে যুদ্ধের উৎসব শুরু হয়ে গেলো। শ্বেত অশ্বযুক্ত বিশাল রথে সানন্দে মাধব ও অর্জুন দিব্য শঙ্খধ্বনি করলেন। (১৪)

ভ্রম ও তৎজনিত ভয় প্রবৃত্তি পক্ষের সেনাপতি। অকারনে আমাদের ভূতের ভয়, জুজুর ভয় আবহমান কাল থেকেই চলে আসছে। সেই ভয় (ভীষ্ম) যখন তুমুল উৎসাহ দেখালেন, যখন প্রকাশ্যে এলেন, তখন সবাই ভাবলো, আর ভয় কি ? ভীষ্ম সহজে কারুর আয়ত্ত্বে আসবে না। অতয়েব সুমতিকে আর ভয় কিসের। অর্থাৎ আমাদের যখন ভয়ের আভাস দেখা যায়, তখন আমাদের শ্বাসক্রিয়ার মধ্যে চঞ্চলতা দেখা যায়। শরীরে একটা কম্পনের প্রভাব দেখা গেলো। ফলত শরীর মধ্যে একটা ভীষণ উথালপাতাল হতে লাগলো। 
এখানে আমরা মাধব বলে একটা নতুন চরিত্র পেলাম।  কে এই মাধব ? মা অর্থাৎ লক্ষ্মী ধব অর্থাৎ স্বামী। তো মাধব কথাটার অর্থ হচ্ছে মাতা শ্রীলক্ষ্মীর প্রতি। অর্থাৎ বিষ্ণু।  যাঁকে হিন্দুমতে জগতের পালন কর্তা  বলা হয়।এর পরে পান্ডব সৈন্যদের  মধ্যেও যুদ্ধের আলোড়ন শুরু হলো। এইসময় সাদা ঘোড়ার রথে চেপে এলেন মাধব যাঁকে  আমরা শ্রীকৃষ্ণ বলে জানবো, আর সঙ্গে  এলেন শ্রীকৃষ্ণ-সখা পাণ্ডুপুত্র অর্জুন। তখন শরীরের মধ্যে দিব্য শংখধ্বনি বাজতে লাগলো। দুর্ম্মতির পক্ষের প্রবৃত্তি রন-ডঙ্কা  যা যেন চিৎকার-চেঁচামেচি, গলাবাজি মাত্র। কিন্তু নিবৃত্তি পক্ষের যে শঙ্খধ্বনি তা যেন মধুর পল্লবিত ধ্বনি। এই শঙ্খধ্বনি যখন আমাদের হৃদয়ে বাজে, তখন আমাদের চিত্তবেগ  শান্ত হয়ে আসে। প্রাণবায়ু যোগপ্রভাবে যখন গতিহীন হয়ে যায়, বেগরহিত হয়ে যায়, তখন সাধক এই শান্তির ধ্বনি শুনতে পায়। শ্বেতাশ্ব যুক্ত রথ অর্থাৎ শ্বেত বর্ণের অগ্নির্জ্যোতিঃ।  এই দেহরূপ রথে যিনি রথী এ জ্যোতি তাঁরই। এই জ্যোতির মধ্যে দেখা যায়, কৃষ্ণবর্ণের মণ্ডলাকার মাধব। মা অর্থে লক্ষী বা প্রকৃতি। এই জ্যোতি স্থুল প্রকৃতির জ্যোতি। এই জ্যোতির বক্ষস্থলে কৃষ্ণবর্ণের মাধব। অর্থাৎ যিনি এই জ্যোতিস্বরূপের স্বামী। এই জ্যোতির্ময় মন্ডল দর্শন আমাদের মনে আনন্দের সঞ্চার করে, প্রাণ-মন তখন প্রফুল্ল হয়ে  ওঠে। মনে এই শান্ত অবস্থায় যে ধ্বনির সঞ্চার হয়, তা আমরা পরবতীতে শুনবো। 
---------------------------

যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (৮)

 শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ১৫

পাঞ্চজন্যং হৃষীকেশো দেবদত্তং ধনঞ্জয়ঃ 
পৌণ্ড্রং দধ্নৌ মহাশঙ্খং  ভীমকর্ম্মা বৃকোদরঃ। (১/১৫)

শ্রীকৃষ্ণ পাঞ্চজন্য, ধনঞ্জয় দেবদত্ত, ভীমকর্ম্মা বৃকোদর (ভীমসেন) পৌন্ড্র নামক মহাশঙ্খ বাজালেন। (১/১৫)
আগে শুনেছিলাম, মাধব, এবার শুনলাম হৃষীকেশ। হৃষীকেশ কথাটির অর্থ কুঞ্চিত  কেশ। 
আবার হৃষীক+ইশ।  হৃষীক কথাটার অর্থ হচ্ছে ইন্দ্রিয়ের, ঈশ কথাটার অর্থ ঈশ্বর। অর্থাৎ পরমাত্মা। আবার হৃষীকে অর্থে ইন্দ্রিয়, আর ঈশ অর্থে নিয়োগকর্তা, অর্থাৎ যিনি ইন্দিয়গুলোকে কার্য্যে নিয়োগ করেন। আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়কে যিনি স্ব-স্ব কার্য্যে নিযুক্ত করেন তিনিই হৃষীকেশ। এই হৃষীকেশ আমাদের কূটস্থ চৈতন্য স্বরূপ। এই চৈতন্য-এর অবস্থান আমাদের আজ্ঞাচক্রে। এখন কথা হচ্ছে, এই হৃষীকেশকে কেন কূটস্থ বলা হচ্ছে। কুট কথার অর্থ  সাধারণ  ভাবে আমরা জানি যারা বাইরে একরকম আর ভিতরে আর-এক রকম। বাইরে গুণী  বা সরল মনে হলেও  ভিতরে কিন্তু দোষ বা গরলে পরিপূর্ন। আবার জগতের যিনি কারন তাকেও কুট বলা হয়ে থাকে। দেখুন, এই যে মায়া  রূপ জগৎ যা আমাদেরকে মোহিত করছে, যা মিথ্যা হলেও সত্যবৎ প্রতীয়মান হয়, একেই বলা হয়ে থাকে কুট। আর এই মায়ার যিনি সাক্ষী, তিনি কুটে স্থিত বা কূটস্থ। যিনি অবিদ্যাবশত অনর্থের সংসারের বীজ বহন করে থাকেন, তিনি মায়া। যিনি এই মায়ার অধিষ্ঠাত্রী তাঁকে বলা হয় কূটস্থ। ত্রিগুণের (সত্ত্ব রজঃ তম)   সমাহার এই অবাস্তব বহির্জগৎ।  কিন্তু যার গুনে এই অবাস্তবকে বাস্তব বলে মনে হয়, তিনিই কূটস্থ। ইনি নির্বিকার, অর্থাৎ বিকারগ্রস্থ নয়। ইনিই আমাদের সকলের হৃদয়ে বিরাজ করছেন। এঁকে  তাই বলা হয় হৃদয়েশ্বর। তিনি আছেন তাই ইন্দ্রিয়সকল বিষয় গ্রহণে সমর্থ। এই যে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ আমাদেরকে আনন্দ প্রদান করছে, আমাদেরকে মুগ্ধ করছে তা আসলে এই ব্রহ্ম বা আত্মা  থেকেই উৎসারিত হচ্ছে। আর এই আনন্দের আকর্ষণেই জীবকুল অবিশ্রান্ত ছুটে  চলেছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই সে জড়িয়ে ধরে আনন্দের সন্ধান করছে। তো যিনি আমাদের আকর্ষণ করছেন অর্থাৎ আনন্দের উৎস তিনি হচ্ছে কৃষ্ণ অর্থাৎ আকর্ষক। তিনি আমাদের ইন্দ্রিয়ের অধীশ্বর, তিনিই আমাদের বুদ্ধিতে স্থিত, তিনিই আমাদের হৃদয়ে স্থিত। ইনিই দিব্যজ্যোতিঃ স্বরূপ। এখন কথা হচ্ছে, তিনি যদি নিত্য, তিনি যদি সত্য, তিনি যদি সবত্র, তবে আমরা তাকে উপল্বদ্ধিতে আন্তে পারি না কেন।  তিনি কেন আমাদের ইন্দ্রিয়গোচারীয়ভূত হন না ? এর জন্য দরকার আমাদের দিব্যদৃষ্টি। আর এই দিব্যদৃষ্টি আমাদের তখনই উন্মোচন হতে পারে, যখন আমাদের চিত্ত জ্যোতিমধ্যে সমাধিস্থ হয়। তখন তার প্রকাশ আমাদের হৃদয় ঊদ্ভাসিত করে দেয়।  আমাদের জীবন কৃতার্থ হয়ে যায়। যাইহোক, এসব অমৃতকথা আমরা ধীরে ধীরে শুনবো। চিত্তকে  সমাহিত করুন এইসব ব্রহ্মকথায়।         
 ইনি পাঞ্চজন্য শঙ্খের ধ্বনি উৎপন্ন করেন। পাঞ্চজন্য অর্থাৎ পাঁচ প্রাণ অর্থাৎ প্রাণ, অপান, ব্যান, সমান, উদ্যান এই পঞ্চবায়ুর মিলনে এই শব্দ বা ধ্বনি উৎপন্ন হয়ে থাকে।  পঞ্চবায়ু যখন রুদ্ধ বা গতিহীন হয়ে একত্রে অর্থাৎ প্রাণবায়ুতে মিলিত হয়, তখন অভূতপূর্ব এই ধ্বনি ধ্বনিত  হতে থাকে। "পাঞ্চজন্যং হৃষীকেশো" ।  
ধনঞ্জয় কথাটার অর্থ যিনি ধনকে জয় করেছেন। আমাদের মতো সাধারনের কাছে ধনকে জয় করা মানে ধনকুবের হওয়া।  আধ্যাত্মিক জগতে ধনকে জয় করা মানে যোগবিভূতি বা যোগৈশ্বর্য্যকে জয় করা। এই ধনে যিনি ধনী তিনি জন্মমৃত্যু, সুখদুঃখ, ক্ষুধা-তৃষ্ণা প্রভৃতিকে যিনি জয় করতে পেরেছেন।  যিনি জাগতিক সমস্ত ধনকে অগ্রাহ্য করতে পেরেছেন তিনিই ধনঞ্জয়। এই তেজঃশক্তি না থাকলে সাধনক্রিয়ায় সাফল্য আসে না। এই তেজঃশক্তি  আমাদের মনিপুর চক্রে অবস্থান করে। ইনিই উপনিষদের বৈশ্বানর, জীবকুলের জীবনীশক্তি। বলা হয়ে থাকে অগ্নি বা তেজঃশক্তি হচ্ছে দেবতাদের মুখ।  যার সাহায্যে দেবতাগণ যজ্ঞের আহুতি গ্রহন করে থাকেন। এই মনিপুর বা নাভিচক্র থেকেই নাদধ্বনি উঠে আসে। একেই বলে দেবদত্ত শংখ। বীনার সুর ধ্বনিত হয় এই দেবদত্ত সঙ্খে। "দেবদত্তং ধনঞ্জয়ঃ" 

বৃকোদর কথাটা অর্থ হচ্ছে "অগ্নি" . আমাদের পেটের  মধ্যে বা উদরে যে অগ্নি প্রতিনিয়ত প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে, যা আমাদের খাদ্যকে হজম করছে, তাকে বলা হয় বৃকোদর। আমরা জানি বায়ু থেকেই অগ্নির উৎপত্তি। আবার বায়ুর মধ্যেই অগ্নি লয় প্রাপ্ত হয়ে থাকে। এই বায়ুতত্ত্বকেই বলা হয় বৃকোদর। অনাহত চক্র হচ্ছে বায়ুর প্রাথমিক  মিলন স্থান। এই হৃদয়কেন্দ্র বা অনাহত চক্র  থেকেই দীর্ঘ ঘন্টাধ্বনির মতো একটা শঙ্খধ্বনি সাধক শুনতে পান। 

ভীমের শঙ্খ ধ্বনি হচ্ছে পৌন্ড্র। পুন্ড অর্থাৎ পীড়ন করা। এই পুন্ড শব্দ থেকেই এসেছে পৌন্ড্র। সাধক যখন প্রাণায়ামের সাহায্যে প্রাণবায়ুকে পীড়ন শুরু করেন, তখন যে মহানাদ সাধকের শ্রুতিগোচর হয়, তাকে বলে পৌণ্ড্র ধ্বনি । বলা হয়ে থাকে এই পীড়নক্রিয়ার জন্য বল প্রয়োগ করতে হয়।  এই বল প্রয়োগ না করলে, বায়ু স্থির হয় না। 

আমাদের মস্তিষ্কের যে কেন্দ্রস্থল তাকে বলা হয় সুমেরুর শিখরদেশ। সাধন হেতু প্রাণবায়ু সেই সুমেরু ভেদ করে সহস্রারে প্রবেশ করে।  মেরুদণ্ডের যে অস্থিভাগ মস্তিষ্ককে ধরে রেখেছে,  মাথার সেই অস্থিখন্ডকে বলা হয় মহাশঙ্খ। এই মহাশঙ্খের নাদ-ধ্বনিতে সাধকের মন স্থির হয়ে যায়। সাধকের মনে আনন্দের সঙ্গে আশার সঞ্চার হয়। আর নাদধ্বনি রিপুসকলের কাছে বা দুর্ম্মতির কাছে ভীতিপ্রদ। এই ধ্বনি যখন সাধকের শ্রুতিগোচর হয়, তখন বিষয় বাসনা থেকে তার নিবৃত্তি ঘটে। 

এই প্রসঙ্গে আরো একটা কথা আমাদের জেনে রাখা ভালো, আর তা হচ্ছে, আমরা শুনেছি যুদ্ধে যিনি স্থির তিনি যুধিষ্ঠির। এই যুধিষ্ঠিরের জন্ম আকাশ তত্ত্ব থেকে। আকাশতত্ত্ব অচঞ্চল। এঁকে  সহজে কেউ চঞ্চল বা অস্থির করতে পারে না। এই আকাশ তত্ত্বের স্থান হচ্ছে বিশদ্ধচক্র যা আমাদের কণ্ঠস্থিত। 
এখান থেকে যে ধ্বনি উৎসারিত হয়, তাকে বলে অনন্তবিজয় ধ্বনি বা বিজয় ভেরি। প্রাণবায়ু স্থির হলে এক ধরনের ভীষনরব-এর  উৎপত্তি হয়। এই ধ্বনি যখন সাধকের শ্রুতিগোচর হয়, তখন জানতে হবে সাধকের সমাধির  অবস্থা আসন্নপ্রায়  হয়েছে।
----------------------------------          
৫.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (৯)

শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ১৬-১৮

অনন্ত বিজয়ং রাজা কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ 
নকুলঃ সহদেবশ্চ সুঘোষ মনিপুষ্পকৌ। (১৬)
কাশ্যশ্চ পরমেষ্বাসঃ শিখন্ডি চ মহারথঃ 
ধৃষ্টদুম্মো বিরাটশ্চ সাত্যকি চ অপরাজিতঃ (১৭)
দ্রুপদো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব্বশঃ পৃথিবীপতে  
সৌভদ্রশ্চ মহাবাহুঃ শঙ্খান দধ্নূঃ পৃথক্ পৃথক্। (১৮) 
 
কুন্তীপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির অনন্তবিজয় নামক সঙ্খধ্বনি করলেন।  নকুল সুঘোষ ও সহদেব মণিপুষ্পক নামক শঙ্খধ্বনি করলেন।(১৬)
হে পৃথ্বীপতে অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্র,  মহাধনুর্দ্ধর কাশীরাজ, মহারথী শিখন্ডি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, অপরাজেয় সাত্যকি, দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পুত্রগণ ও মহাবাহু অভিমন্যু সবাই পৃথক পৃথক শঙ্খধ্বনি করলেন। 

এখানে আগের মতো আমরা আরো কিছু শঙ্খের কথা শুনলাম। 

প্রথমত : অনন্তবিজয় - ব্যোম অর্থাৎ আকাশতত্ত্ব থেকে প্রতিনিয়ত ওঙ্কার  বা প্রণব ধ্বনি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সেই ধ্বনির ঢেউ বায়ুর সাহায্যে আমাদের রক্তমাংসের শরীরে আলোড়ন তুলছে, বা স্পন্দিত হচ্ছে। একেই যুধিষ্ঠিরের  অনন্তবিজয় শঙ্খধ্বনি বলা হয়ে থাকে। 

সুঘোষ - নকুল, অপ বা জল -তত্ত্ব থেকে উদ্ভূত। আমাদের লিঙ্গমূলে উপরে আছে স্বাধিষ্ঠান চক্র। এখন থেকে একটা সুমধুর ধ্বনি, বেনুর বাজনা, বাঁশির সুর প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হচ্ছে একেই বলে সুঘোষ।

মণিপুষ্পক - সহদেব হচ্ছে পৃত্থিতত্ত্ব তত্ত্ব থেকে উদ্ভূত। আমাদের মূলাধার চক্রে এর স্থান। এই কুণ্ডলিনী আবার প্রাণশক্তির আধার। এইজন্য যোগের বোধন বা শুরু এখান থেকেই করতে হয়। মধু খেয়ে ভ্রমর যখন পাগল হয়ে যায়, তখন সেই মত্তভৃঙ্গ অনবরত যে আওয়াজ তোলে তা এই  মণিপুষ্পক শঙ্খ  থেকে উৎসারিত। 

এছাড়া  কাশীরাজ,  শিখন্ডি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট,  সাত্যকি, দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পুত্রগণ ও  অভিমন্যু সবাই পৃথক পৃথক শঙ্খধ্বনি করলেন। এই যে ছটি নির্দিষ্ট শঙ্খ বাদে অন্য শঙ্খ-এর কথা বলা হলো, এগুলো আসলে মিশ্রিত ধ্বনি। বিভিন্ন রঙ-এর অনুপাতের ভিন্নতা হেতু যেমন একটা আলাদা রঙের দেখা মেলে, তেমনি ৫টি শঙ্খধ্বনি থেকে আলাদা আলাদা ধ্বনির উৎপত্তি হয়।  আবার এই পাঁচটি শংখধ্বনি  একত্রে তৈরী হয় পঞ্চজন্য শঙ্খ ।  

আসলে আমাদের দেহে যে পঞ্চপ্রাণ (প্রাণ, অপান, ব্যান, সমান, উদান)  - তা এই পাঁচটি শঙ্খ। অনন্তবিজয় - আছে যুধিষ্ঠিরের হাতে, সুঘোষ আছে নকুলের হাতে,  মণিপুষ্প আছে সহদেবের হাতে, দেবদত্ত  আছে ধনঞ্জয় বা অর্জুনের হাতে,  এবং পৌন্ড্র  আছে ভীমের হাতে  আর পাঁচটি শঙ্খ  একত্রে পাঞ্চজন্য শঙ্খ যা আছে হৃষীকেশের হাতে। 

 প্রাণায়ামের দ্বারা শরীরে যখন সমস্ত বায়ুর মধ্যে একটা সমতা আসে তখন এই ধ্বনিগুলো  শুনতে পাওয়া যায়। আর এই নাদ-ধ্বনি যখন শ্রুতিগোচর হয়, তখন মন শান্ত হয়ে যায়, চিত্ত স্থির হয়ে যায়। মনের মধ্যে আর কোনো সংকল্প-বিকল্প উঠতে দেখা যায়  না।      
  
শরীরের চার তত্ত্বে (ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ) মন স্থির থাকে কিন্তু মন সজাগ হয়ে থাকে।  কিন্তু শেষতত্ত্ব অর্থাৎ ব্যোম তত্ত্বের  ধ্বনিতে মন লয় হয়ে যায়। আর এই ব্যোম তত্ত্বকে বলা হয় যুধিষ্ঠির বা যুদ্ধে যিনি স্থির। তখন সব থেকেও যেন কিছুই নেই - এই বোধে স্থির হয় মন। সাধক এখানে থেমে  থাকবেন না।  এই তত্ত্বেরও অতীতে উঠতে হবে তাকে।  পর-ব্যোম -এ পৌঁছতে হবে. এখানেই অর্থাৎ পরব্যোম অবস্থা।  কিন্তু ব্যোম তত্ত্বকেই বলা হয় পরমাত্মার প্রথম আভাস ক্ষেত্র বা পরমাত্মার পাদপীঠ। ব্যোম-তত্ত্বে সাধক যখন স্থির হয়, এই অবস্থাকে বলা হয় সবিকল্প সমাধি। আর  পরব্যোম অবস্থা হচ্ছে নির্বিল্প সমাধি, অর্থাৎ সাধক সমস্ত পাঁচ তত্ত্বের বাইরে অবস্থান করেন। এখানেই অদ্বৈত অবস্থা। 

এখন কথা হচ্ছে এখানে বা এই পরব্যোম তত্ত্বের আগে সাধককে এক এক কর তত্ত্বের অপসারণ করতে হবে। আবার জানবেন, এই ব্যোম আবার পাঁচ প্রকার - আকাশ, মহাকাশ, পরাকাশ, তত্ত্বাকাশ ও সূর্য্যাকাশ। এখন কথা হচ্ছে এই তত্ত্বগুলোতে কার স্থিতি হয় ? এই স্থিতি হয়, পঞ্চপ্রাণের। একেই কেউ বলেন, "মা-তারা"। কেউ বলেন, কৃষ্ণ। একটা শক্তি একটা আকর্ষণ শক্তি যা সব সময় সাধকের মনকে আকর্ষণ করছে। এই আকাশ শূন্য আবার শূন্য নয়।  এই আকাশেই চলছে মহামায়ার খেলা, মহাপ্রকৃতির খেলা, মা আদ্যাশক্তির  খেলা। সাধকের হৃদয়াকাশে তাঁকে কূটস্থের জ্যোতির অভ্যন্তরে দেখা যায় কৃষ্ণবর্ণের শুন্য বিন্দু। এঁকে পার হতে পারলেই সাধক পরব্যোম অবস্থায় স্থিত হন। 

এখানে সুমতি অপরাজেয়। সুমতির আছে সদ্বুদ্ধি। সাধকগন জানেন, সাধনার প্রথমে আসে জ্যোতি, তার পরে বিচিত্র চিত্র। এই জ্যোতির মধ্যেই থাকে শুভ্রজ্যোতির রেখা। এই শুভ্র জ্যোতিতে মন স্থির হলে, এগুলোকে প্রথমে স্থূল বলেই মনে হয়।  কিন্তু ধীরে ধীরে এর মধ্যে একটা অসীম শক্তির আভাস  মেলে। কিন্তু এই জ্যোতি আসলে চৈতন্য, যা এই এই স্থুল জ্যোতিকে আশ্রয় করে দৃশ্যমান হচ্ছে।  এইজন্য এঁকে   বলা হয় শিখন্ডি।  অর্থাৎ নিমিত্ত্ব মাত্র। এই শিখন্ডি আসলে শক্তির কর্তৃত্ত্ব পদ-জ্ঞান। এইজন্য শিখণ্ডীকে বলা হয়েছে মহারথঃ অর্থাৎ শিখন্ডী রূপ রথে তিনি আরোহন করে থাকেন। 

এই জ্যোতির মধ্যে যে শক্তির কর্তৃত্ত্ব  এই জ্ঞান যখন হয় তখন কখনোই আর নিঃশেষিত হয় না। একটা কথা জানবেন, এই শক্তি সেই অন্তর্যামী প্রভুর বা আত্মার। এইসময় সাধকের অন্তঃকরণ নির্মল হয়ে ওঠে। আসলে এই শক্তি আমাদের সকলের মূলাধারে সুপ্ত অবস্থায় আছে। যোগক্রিয়া করতে করতে সাধকের নিষ্ঠা ও ক্ষমতা অনুসারে একসময় যোগীর জ্ঞান-গোচর  হয়ে ওঠে। কিন্তু কখন এটি হয় ? এটি তখনই হয়, যখন জীব-চৈতন্য আমাদের সহস্রারে পৌঁছয়। অর্থাৎ আমাদের শ্বাস উত্তপ্ত হয়ে যখন আমাদের মস্তিস্ক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে তখন এই দশ প্রকার শব্দ, (৫+১+৪) যা আসলে নাদ-ধ্বনি তা পৃথক পৃথক ভাবে শুনতে পাওয়া যায়। 

যেখানে মন রাখলে আমাদের সমস্ত কিছুর জ্ঞান আপনা-আপনি হয়, তাকে বলা হয়, কাশীক্ষেত্র। এখানে  সবকিছু প্রকাশমান।  এখানেই মহৎজ্যোতি বা শিখন্ডি স্থূল রূপ ধারণ করে। তেজঃস্বরূপ এই জ্ঞান থেকেই আমাদের ভ্রমাত্মক জ্ঞান অর্থাৎ ভীষ্মকে নিধনে সমর্থ হয়। এই অবস্থায় সাধকের মধ্যে বা যোদ্ধার মধ্যে আর কোনো আশঙ্কার কারন থাকে না। নির্ভিক চিত্তে যুদ্ধে বা সাধন-সমরে সাধক উপস্থিত হতে পারেন। 

---------------------          
৬.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (১০)

শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ১৯-২১

স ঘোষো ধার্ত্তরাষ্ট্রাণাং হৃদয়ানি ব্যদারয়ৎ
নভশ্চ পৃথিবীঞ্চৈব তুমুলঃ অভ্যনুনাদয়ন (১৯)
অথ ব্যবস্থিতান দৃষ্ট্বা ধার্ত্তরাষ্ট্রান কপিধ্বজঃ 
প্রবৃত্তে শস্ত্রসম্পাতে ধনুরুদ্যম্য পাণ্ডবঃ 
হৃষীকেশং তদা বাক্যম ইদং আহ মহীপতে। (২০
অর্জুন  উবাচ : 
সেনয়োরুভয়ো-মধ্যে রথং স্থাপয় মে অচ্যুত।  (২১)

সেই তুমুল শব্দ (শঙ্খধ্বনি) আকাশ ও পৃথিবী প্রতিধ্বনিত করে ধৃতরাষ্ট্র পুত্রগণের হৃদয় বিদীর্ন করতে লাগলো । (১৯)

মহাশব্দ স্তিমিত হলে, ধার্তরাষ্ট্রগণকে যুদ্ধে উদ্দত দেখে,  এবং শস্ত্র নিক্ষেপে প্রবৃত্ত দেখে, অর্জুন ধনুক উত্তোলন করে, হৃষিকেশকে বললেন।  (২০) 
হে অচ্যুত, উভয় সেবার মধ্যে আমার রথ স্থাপন করো। (২১)

ভগবানের সঙ্গে কথা শুরু হলো। এতক্ষন আমরা সঞ্জয়ের মুখ থেকে শুনছিলাম, যে কথা ধৃতরাষ্টকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছিলো । এবার অর্জুন কথা বলে উঠলেন, এবং এই উক্তি অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়, স্বয়ং ভগবানকে উদ্দশ্য করে।  যদিও  এখনো ব্যাসদেবের কলমে  শ্রীকৃষ্ণ ভগবান নন। তিনি অর্জুনের যুদ্ধ-রথের  সারথী  মাত্র। বড়োজোর সখা।

যে শব্দ থেকে সাধকের হৃদয় বিদীর্ন হয়, তা আসলে আমাদের মূলাধার থেকে ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। আমাদের জানি পৃত্থি তত্ত্ব আমাদের মূলাধার আর আকাশ তত্ত্ব আমাদের ব্রহ্মরন্ধ্র।  এই সূক্ষ্ম গতিপথ  একসময় নাদধ্বনিতে ঝংকৃত হয়ে ওঠে। আর এই শব্দই আমাদের সাধন-সমরের শত্রুপক্ষ অর্থাৎ কাম-ক্রোধ-লোভ প্রভৃতি অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। এই ধ্বনি যখন অনুরণিত হতে থাকে, তখন আমাদের মন  হয় বিবশ আর শরীর হয় অবশ। আর এই ধ্বনিতেই আত্মসংযোগ ঘটে।  চিত্ত হয় নিস্তরঙ্গ। হৃদয়ের মধ্যে শুরু হয়, একটা আকুলি বিকুলি ভাব। যেন মনে হয় হৃদয়গ্রন্থি  ছিঁড়ে  যাবে।  কিন্তু হৃদয়গ্রন্থি ভেদের এটি প্রাথমিক পর্যায় মাত্র । এই পর্যায়ে হৃদয়গ্রন্থি ভেদ হয় না। 

সাধক যখন সাধন করবার উদ্যোগ করেন, যখন তিনি মেরুদন্ড সোজা করে, সিদ্ধাসনে উপবেশন করেন।  ঠিক সেই মুহূর্তের জন্য আমাদের দুর্ম্মতি এমনকি সুমতিও শান্ত থাকে। দুর্ম্মতি খোঁজে সাধন থেকে বেরিয়ে যাবার রাস্তা, আর সুমতি তখন সাধনে স্থিত হবার জন্য উন্মুখ হয়। বিশুদ্ধি চক্র থেকে আজ্ঞাচক্র পর্যন্ত অর্থাৎ আমাদের গলার পিছনে যে মেরুদন্ড আছে সেখান থেকে  ভ্রূযুগলের ঠিক পিছনভাগ পর্যন্ত মেরুদণ্ডের যে অবস্থান তা খানিকটা ধনুকের কাঠের  মতো বাঁকা। গুন্ অর্থাৎ ধনুকের যে দড়ি ধনুকের কাঠ/বাঁশের দুই দিকের অগ্রভাগে টানটান করে বাঁধতে পারলে, বান নিক্ষেপে সুবিধা  হয়।  ঠিক তেমনি আমাদের বায়ুসাধন ক্রিয়ার সাহায্যে  সুষুম্নার মধ্যে উত্তপ্ত বায়ু অর্থাৎ চেতনশক্তি প্রবেশ করলে, আমাদের মেরুদণ্ডের মধ্যে একটা টানটান ভাবের অনুভব হয়। আর আমরা জানি, যে কোনো ধ্যানাসন মানেই মেরুদন্ড অবশ্যই  সোজা বা টানটান থাকলে তবেই এই অনুভূতি জগতে পারে। সেই কারনে  সিদ্ধাসন, পদ্মাসন, সুখাসন যাই হোক না কেন, মেরুদন্ড সোজা রেখে বসতে হয় । একেই ধনুক ওঠানো বলা হয়ে থাকে। ধনুক ওঠানো অর্থে মেরুদন্ড সোজা করে সাধনের জন্য প্রস্তুত হওয়া । এই অবস্থানে থেকে দৃঢ়চিত্তে সাধন করতে পারলে, প্রাণবায়ু সহজেই সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করে। 
এই অবস্থা আসলে সাধনক্রিয়ার উদ্যোগ মাত্র। এই ধনুকের ও তার টানটান  ছিলার সাহায্যেই প্রতিপক্ষককে পরাজিত করা যায়। তাই এই ধনুক নিজের হাতে তুলে নিতে হয় , অর্থাৎ নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে  হয়। মেরুদন্ড যখন  সোজা তখন শরীর  সুমতির নিয়ন্ত্রণে। মেরুদন্ড যখন যথেচ্ছ তখন তা প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণে।  এই হচ্ছে অর্জুনের গান্ডীব তুলে হাতে  নেওয়া।

হৃষিকেশের কথা আমরা আগে শুনেছি, এখানে শ্রীকৃষ্ণকে অর্জুন অচ্যুত বলে সম্মোধন করছেন। অচ্যুত কথার অর্থ হচ্ছে - যিনি কোনো কিছু থেকে বিচ্যুত  হন না। এই অচ্যুত এখন দেহরথের সারথী। অর্জুন আমাদের তেজের প্রতীক। এই তেজ যখন সক্রিয় হয়, গতিশীল হয়, তখনও অচ্যুত তাঁর স্বীয় স্বভাব অনুযায়ী কূটস্থ থাকেন।  তিনি নির্বিকার। দেহরথের এই সারথী আমাদের সমস্ত উৎপাত নিঃশব্দে সহ্য করে থাকেন। আমরাও তাঁকে অবোধের মতো নির্দেশ জারি করি, এতই আমাদের স্পর্ধা। আর তিনি নিজের কোনো প্রয়োজন না থাকলেও, সমস্ত প্রয়োজনের উর্দ্ধে শাশ্বত কালের কালের জন্য বিধান দিয়ে থাকেন। ভক্তের ঔদ্ধত্য ভগবানকে কুপিত করে না। 

ভগবান আমাদের সবার হৃদয়ে বিরাজ করছেন। ভক্তের ভালো মন্দ সমস্ত নির্দেশ তিনি নির্বিকার ভাবে রক্ষা করেন। সাধন করবার ইচ্ছে,  বা সাধন না করবার ইচ্ছে,  কোনো ইচ্ছেতেই তিনি বাধা দেন না। আসলে ভক্ত যতক্ষন নিজের নির্দেশে চলতে চায়, ততক্ষন ভগবান নীরব সাক্ষী থেকে ভক্তকে ভক্তের ইচ্ছে মতো চলতে দেন। সাধন করা বা না করা আপনার ইচ্ছে।  এই ইচ্ছে শক্তিও ভগবানেরই  দেওয়া।  তথাপি ভগবান ভক্তের ইচ্ছে-শক্তির উপরে কোনো নিয়ন্ত্রণ করেন না। একেই আমরা পুরুষকার বলে থাকি। 
জীবের চিত্ত দ্বিধা বিভক্ত। জীবের মন সন্দেহাতীত নয়। এমনকি সাধন ক্রিয়া করতে করতে আমাদের অনুভবের মধ্যে সামান্য পরিবর্তন এলেও, আমাদের মন থেকে সন্দেহের নিরসন হয় না। তখনও আমরা একে সাধনার ফল না ভেবে, স্বাভাবিক বলেই  ধরে নেই। যার  মনে যেমন ইচ্ছে জাগ্রত হয়, ভগবান সেই ইচ্ছেকেই সিদ্ধ করে থাকেন। ভগবানের ইচ্ছে বলে কিছু থাকে না। আপনি ক্রিয়াশীল থাকলেও ভগবান সেই অবস্থায় আপনার সঙ্গে থেকে মদত দেবেন, আবার আপনি ক্রিয়াহীন হয়ে থাকতে চাইলেও, ভগবান আপনাকে বাধা দেবেন না। যতক্ষন আপনি নিজেকে ভগবানের কাছে সমর্পন না করবেন, ততক্ষন ভগবান আপনার ইচ্ছেকেই কার্য্যে পরিণত করে দেবেন। তাই বলা হয়ে থাকে, জীবের ইচ্ছে-শক্তি প্রবল হলে ভগবান সেই ইচ্ছে পূরণ করে দেন।  তাই অর্জুন যখন ভগবানকে নির্দেশ দিচ্ছেন, রথকে  উভয় (প্রবৃত্তি-নিবৃত্তি) সেনার মধ্যে স্থাপন করতে বললেন, তখন ভগবান তা বিনা প্রতিবাদে, নীরবে শুনলেন। 
------------------------   

৭.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (১১)

শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ২২-২৩

যাবৎ এতান নিরীক্ষে অহম যোদ্ধুকামান অবস্থিতান 
কৈর্ন্ময়া সহ যোদ্ধব্যম অস্মিন রণ সমুদ্যমে। (২২) 

যতক্ষন আমি যুদ্ধকামনায় অবস্থিত বীরগনকে নিরীক্ষণ করি। এই যুদ্ধের আরম্ভে কাদের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করতে হবে। (২২) অর্থাৎ কাদের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করতে হবে, বা কাদেরকে আমাকে ছেড়ে দিতে হবে তাদেরকে একবার চোখে দেখে নেই। 

যাঁরা যুদ্ধ করতে উদ্যত অর্থাৎ কোন কোন প্রবৃত্তিগুলোর সাথে প্রতিযুদ্ধ করতে হবে, তাদেরকে একবার দেখে নেবার ইচ্ছে সাধনার প্রারম্ভে সাধকের মনে হওয়া স্বাভাবিক। আমরা যখন চাকুরীর জন্য দূরদেশে  যাই, এমনকি আমরা যখন মৃত্যুর পথে পা বাড়াই, তখন আমাদের প্রিয়জনকে একবার দেখতে ইচ্ছে করে। সাধক সাধন জগতে নিজেকে সঁপে দেবার প্রাক্কালে, একবার তার মনে বিষয় চিন্তা জেগে ওঠে। সাধারণ সংসারীর মধ্যে সহজে বিষয়চিন্তা যায় না। সন্যাস নেবার আগেও একবার ছেলে-মেয়েদের দেখে বিষয়রক্ষার দায়িত্ত্ব বুঝিয়ে দিতে চায়। 
কিন্তু সাধন জগতের বিষয় চিন্তা বা বিষয়ের প্রতি আসক্তি থাকলে আর সন্যাস নিতে ইচ্ছে করে না। কেননা বিষয়ের মোহ, সন্মন্ধের বাঁধন সাধন জগতের প্রধান বাধা। কিন্তু যার সঙ্গে ভগবান আছেন, তিনি ভগবানের প্রতি আকর্ষণ বশতঃ সাধন সমরে অগ্রসর হতে বাধ্য।  তথাপি তার মধ্যে থেকে সংশয় যায় না, প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠতে থাকে মনে। এক-একবার মনে হয় এইতো ভালো আছি,  সংসারে থেকেই তো সাধন ভজন করা যেতে পারে। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে বিষয়ের প্রতি আসক্তি যতক্ষন না যায়, ততক্ষন সাধনায় সুফল আসতে  পারে না। আর  আমাদের মধ্যে এই মানসিক দ্বন্দ্বের অবসানের জন্য অচ্যুত অর্থাৎ যিনি কখনো চ্যুত হন না, তিনি গুরুদেবের ভূমিকায় অবতীর্ন হন। এসব কথা আমরা ধীরে ধরে শুনবো।  

যোৎ  স্যমানান অবেক্ষে অহং যএতে অত্র সমাগতাঃ
ধার্ত্তরাষ্ট্রস্য দুর্ব্বুদ্ধে যুদ্ধে প্রিয়চিকীর্ষবঃ। (২৩)

এই যুদ্ধে দুর্ব্বুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রের হিতকামনায় যেসব যুদ্ধার্থী এই যুদ্ধে সমাগত হয়েছেন, সেই সব যোদ্ধাগনকে আমি একবার ভালো করে দেখে নেই। 

আসলে সাধন পথে পা দেবার প্রাথমিক দিকে আমাদের যেসব প্রবৃত্তি বাধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায় তাদেরকে পর্যবেক্ষন করা অবশ্য কর্তব্য। কেননা শত্রুকে চিহ্নিত না করতে পারলে, যুদ্ধজয় অসম্ভব। যুদ্ধপ্রিয় এই প্রবৃত্তি শক্তি আমাদের কোন কোন মনোবৃত্তিতে  প্রবল তাদের একবার দেখতে ইচ্ছে করে। চঞ্চল এই দুর্ম্মতি সবসময় বিষয় কামনায় চঞ্চল। একে পরাজিত না করতে পারলে, বা বলা যেতে পারে, এদেরকে জয় করতে না পারলে, আমাদের মন শান্ত  হতে পারবে না। বিষয়-প্রবৃত্তি বিষয়ের দিকেই প্রলোভিত করবে। তাই সাধকের উচিত একবার নিজেকে বিশ্লেষণ করা।  একবার নিজের  দিকে দৃষ্টিপাত করা। কোন প্রবৃত্তি প্রবল আর তাকে কিভাবেই বা দমন করা যায়, সেই ভাবনা জাগানো দরকার। 
-------------------------------

 ৮.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (১২)

শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ২৪-২৭

সঞ্জয় উবাচ :
এবম  উক্তো হৃষীকেশো গুড়াকেশেন ভারত 
সেনয়োঃ উভয়োঃ মধ্যে স্থাপয়িত্বা রথোত্তমম। (২৪)

হে ভারত, গুড়াকেশ  (অর্জুন) হৃষীকেশকে এই কথা বললে, হৃষিকেশ উভয় সেনাদলের মধ্যস্থলে উত্তমরথ  স্থাপন করে (বললেন)। 
গুড়াকা কথাটার অর্থ নিদ্রা। এই নিদ্রার যিনি ইশ অর্থাৎ জয়ী তিনি গুড়াকেশ। অর্থাৎ যিনি নিদ্রাকে জয় করেছেন। সাধনার প্রাক্কালে যেসব বৃত্তি বা স্বভাব আমাদের বাধা সৃষ্টি করে তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে নিদ্রা। এই নিদ্রাকে জয় করতে হবে। 
হৃষিকেশ কথাটার অর্থ যিনি সমস্ত ইন্দ্রিয়ের রাজা।   

ভীষ্ম দ্রোণ প্রমূখতঃ সর্বেষাং চ মহীক্ষিতাম
উবাচ পার্থ পশ্যৈতান সমবেতান কুরুন ইতি। (২৫)

হে পার্থ এই সমবেত কৌরবদল ভীষ্মদ্রোন-প্রমুখ সকল রাজগনকে সম্মুখ থেকে নিরীক্ষণ করো। 
পার্থ কথাটার অর্থ পৃথী-র পুত্র। পৃথী অর্থাৎ কুন্তী। এখানে পার্থ কথাটার দ্বারা তার মধ্যে যে স্ত্রীসুলভ মাতৃসুলভ, কোমল স্বভাবের তার ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে।  আমরা জানি স্ত্রী-স্বভাবের মধ্যে আছে শোক-মমতা। তো অর্জুন এখন এই স্ত্রী-সুলভ স্বভাবের বাহক।    

তত্রাপশ্য়ৎ স্থিতান পার্থঃ পিতৃনথ পিতামহান 
আচার্য্যান মাতুলান ভ্রাতৃন পুত্রান পৌত্রান সখীনস্তথা 
শ্বশুরণ সুহৃদঃ চ এব সেনয়োঃউভয়োঃ অপি। (২৬)

অনন্তর অর্জুন সেখানে উভয় সেনের মধ্যে মধ্যে অবস্থিত পিতৃব্য, পিতামহ, আচার্য্য, মাতুল, পুত্র, পৌত্র, শ্বশুর ও সুহৃদগণকে দেখলেন। 

তান্ সমীক্ষ্য স কৌন্তেয়ঃ সর্ব্বান বন্ধুন অবস্থিতান 
কৃপয়া পরয়াবিষ্টো বিষীদন ইদম অব্রবীৎ। (২৭)

সেই কুন্তীপুত্র অর্জুন, (যুদ্ধার্থে) অবস্থিত সেই সমস্ত বন্ধুগণকে দেখে পরম কৃপাপরবশ ও বিষণ্ণ হয়ে এইরূপ বললেন।
এখন আবার বললেন, কৌন্তেয় অর্থাৎ কুন্তীপুত্র। এই সম্মোধন দ্বারা অর্জুনের মধ্যে এই মুহূর্তে যে বৃত্তিগুলো প্রধান তার উল্লেখ করা হচ্ছে।  কৌন্তেয় অর্থাৎ স্ত্রী স্বভাবগ্রস্থ শোক-মোহ-গ্রস্থ অর্জুনের স্বভাব সম্মদ্ধ রয়েছে। আবার কুন্তী হচ্ছেন হৃষিকেশের পিসি, আবার অর্জুনের মাতা।  তো এই যে পারিবারিক সম্মন্ধ,  এর জন্য একটা বন্ধন মায়া-মোহের বন্ধন আছে অর্জুনের মধ্যে।  

আমরা সঞ্জয় অর্থাৎ সংযমীপুরুষের ধ্যানস্থ অবস্থার দৃশ্য বর্ণনা শুনছি। এই দৃশ্যে এবার আমরা কূটস্থে অবস্থিত তেজশক্তিকে ক্রিয়া বন্ধ করে উত্তম-অধম উভয় দলের মধ্যে স্থিত হতে দেখছি। এই কূটস্থে যে দৃশ্যপট ভেসে উঠছে, তার যথার্থ বর্ননা আছে এখানে। সাধন জগতে প্রবেশদ্বারে পৌঁছে আমাদের মনের মধ্যে এই দৃশ্যপট ভেসে ওঠে। ধ্যানে বসলে, আমাদের প্রথম দিকে আমার দৈনন্দিন কাজ-কর্ম্মের  মধ্যে যে সব চরিত্র থাকে তাদের দৈহিক চেহারা ভেসে ওঠে। এমনকি তাদের সঙ্গে যে সব সম্পর্কের টানাপোড়ন  তার কথা বারবার মনের দৃশ্যতে ভেসে উঠতে থাকে। কার সাথে কেমন ব্যবহার করেছিলাম, কে আমাকে কষ্ট  দিয়েছে, কে আমাকে শান্তনা দিয়েছে, কে আমাকে ভালো বেসেছে, সমস্ত দৃশ্যই মনের মধ্যে ভেসে আসতে  থাকে। আর গুরুদেবের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা তখন প্রত্যাহারের ক্রিয়া করতে হয়।  এবং ইষ্টে মন দেবার চেষ্টা করতে হয় । আসলে এইসব দৃশ্য আমাদের সাধনপথের স্বাভাবিক বাধা।  কিন্তু আমাদের সাধন পথে দৃঢ়তা ও সাধনপথের রূঢ়তার মধ্যে একটা টালমাটাল অবস্থা চলতে থাকে। মন কখনো চঞ্চল কখনো স্থিত হতে থাকে। কখনো সুমতি, কখনো দুর্ম্মতি - মনের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে থাকে। 

সাধনপথের রূঢ়তা আবার রুঢ়তাজনিত ভয় থেকে আমাদের নিষ্কৃতি পেতে হবে। একটা কথা বলি, প্রথমে আমরা অনেকে অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে সাধনায় আকৃষ্ট হই।  সোজা কথায় বলা যায়,  অনেকে হুজুকে পড়ে আশ্রমে আসে, সাধনার নাম ক'রে। এর পরে যখন সে দেখে আমাদের অভ্যস্ত  জীবন থেকে এই জীবন সম্পূর্ণ আলাদা,  এমনকি এই জীবন অনেক অনেক কষ্টের জীবন, তখন সে বিস্মিত শুধু নয়, হতাশ হয়ে যায় । এমনকি আমি এমন অনেককে দেখেছি, কিছুদিন সাধনা করবার পরেও, তার মধ্যে প্রশ্নের উদয় হয়, এইসব করে কোনো লাভ  আছে কি ? এতে করে আমার দৈনন্দিন জীবনে যে সুখ স্বাচ্ছন্দ ছিলো, তা না হয় বিসর্জন দেওয়া গেলো, কিন্তু এখান থেকে কোনো প্রাপ্তি হতে পারে কি ? নাকি শুধুই অন্ধকারের পিছনে ছোটা ? খাবার কষ্ট, শোবার কষ্ট, এমনকি এখনকার যুগে এটি একটি অপমানিত জীবন যাত্রা।  কেননা এখানে থাকতে গেলে, খাওয়ার  জন্য,  গৃহস্থের দ্বারে দ্বারে অর্থের জন্য হাত পাততে হয়। সবথেকে বড়ো কথা যা কিছু সে করছে, তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সে সন্দিহান হয়ে ওঠে। মনে হয়, যা করছি, যা দেখছি, সব ঠিক তো ? নাকি আমার মানসিক বিকার এগুলো ? এইসময় আমাদের পূর্ব পূর্ব সংস্কার ভোগ্য বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সিগারেটে একটা টান  দিতে ইচ্ছে করে।  একদিন একটু মাংস-ভাত খেতে ইচ্ছে করে। একটু ভালো জামা-কাপড় পড়তে ইচ্ছে করে। বিষয় ভোগের জন্য মনটা আনচান করে। এমনকি নিজের মা-বাবার কথা চিন্তা করে সে কষ্ট  পেতে থাকে। নিজের প্রিয়জনের কথা ভেবে তার মনের মধ্যে একটা হা-হা-কার, একটা অভাববোধ, একটা যন্ত্রনা শুরু হয়।   এইযে মনের মধ্যে দ্বন্দ, এইযে মনের মধ্যে প্রশ্ন এগুলোর জবাব দেবার জন্য যদি কাছে কোনো দেহধারী গুরু না থাকেন, তবে এই জীবন অসহ্য হয়ে ওঠে। একেই বলে বিষাদ যোগ। এই বিষাদ-মনের মধ্যে সাধন  জীবন না সংসার জীবন, কোনটি ভালো, কোন পথে শান্তি আছে, এর উত্তর সে খুঁজে বেড়ায়।  এই প্রশ্নের বান যতক্ষন তার মনের মধ্যে না জাগছে, মন যতক্ষন না উঠল-পাতাল করছে, ততক্ষন সে যোগের পথে পা রাখতে পারে না। এই সময় যথার্থ গুরু যা কিছু বলেন, সেই কথা গুলোই আছে শ্রীগীতায়। এই শ্রী গীতার কথা যিনি অন্তরে অনুভব করতে পারবেন, তিনি সাধন পথে ঠিক পদক্ষেপ করেছেন, একথা নিশ্চিত করে বলা যায়।
----------------------                   
9.12.2021
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব।শ্রীগীতা - শ্লোক নং (১৩)  

শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ২৮

অর্জুন উবাচ :

দৃষ্ট্বেমান স্বজনান কৃষ্ণ যুযুৎসূন সমবস্থিতান 
সীদন্তি মম গাত্রাণি মুখঞ্চ পরিশুষ্যতি। (২৮)

হে কৃষ্ণ যুদ্ধাভিলাষী আমার স্বজনদের সামনে দেখে আমার হাত-পা কাঁপছে, ও  ঘাম বেরুচ্ছে,  মুখ শুকিয়ে আসছে। 

এখানে একটা নাম নতুন করে শুনলাম তা হচ্ছে "কৃষ্ণ"। কৃষ্ণকে কথা দিয়ে বাঁধা যায় না। আবার কৃষ্ণ কথাতেই আটকে থাকে।  এই কৃষ্ণ সম্পর্কে আমরা শুনবো, তার আগে সাধনার কথা একটু শুনে নেই।   

সাধনার পরিণতির কথা শুনে তো ভালোই লাগছিলো, কিন্তু মনের মধ্যে যখন বিষয়ভোগের ত্যাগের কথা মনে হলো, তখন মনে সেই তেজ থাকলো না। মন বিষাদে আচন্ন হয়ে গেলো। আর মন যখন বিষণ্ণ হয়, তখন শরীর অবসন্ন হয়, মুখের জল শুকিয়ে আসে। মনের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা পাক খায়, এ কি করছি আমি ? এইসব সাধন ভজন করে কি লাভ হবে ? সাধন ভজন, বর্তমানে তো দূরের কথা ভবিষ্যতে এমনকি পরকালে বা পরবর্তী জীবনেও কোনো লাভ হবে কিনা তা জানিনা। কিন্তু আপাত সুখের জীবন ছেড়ে আসতে  হবে। এই কঠোর সাধন প্রক্রিয়া কি আমি বেশিদিন চালাতে পারবো ? যদি না চালাতেই পারি, তবে তো এখনকার এই পরিশ্রম বৃথা হয়ে যাবে। এই সব দুশ্চিন্তা নবীন সাধকের শরীর অবসন্ন করে তোলে, মুখের স্বাভাবিক জল নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়। 

সত্যি কথা বলতে কি, যতক্ষন আমাদের ইন্দ্রিয় ভোগের প্রতি আসক্তি থাকবে, ততক্ষন আমাদের সাধনের কথা শুনলেই ভয়ের উদ্রেগ হবে। আসলে আমাদের ভাবনার মধ্যে এই সত্য যতক্ষন না রক্ষিত হয়, যে আত্মাই আমাদের সর্বস্য, আর সেই আত্মাকে দর্শনের জন্য আমাদের প্রয়াস করতে হবে, আমাদের জাগতিক সমস্ত সুখ পরিত্যাগ করতে হবে, এই ভাবনা যতক্ষন না আমাদের মনের মধ্যে দৃঢ় হয়, ততক্ষন আমরা সাধন পথে দৃঢ় পদক্ষেপ রাখতে পারবো না। মনের মধ্যে এতটুকু সন্দেহ থাকলে, আমরা এই  পথে স্থিত হতে পারবো না। 

এবার শ্রীকৃষ্ণের কথায় আসি। আমরা জানি এই অনবদ্য অমৃতবাণীর লেখক কৃষ্ণ, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, যার গায়ের রঙ কালো । আবার এইসব কালজয়ী কথার নায়ক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যার গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ । আবার বাসুদেবের পুত্র বাসুদেবকে বলা হয় কৃষ্ণ। আমাদের মতো সন্দেহবাতিক-গ্রস্থ মানুষের  কাছে, শ্রীকৃষ্ণ না ঐতিহাসিক পুরুষ, না কোনো দেহধারী মহাপুরুষ।  শ্রীকৃষ্ণ  নেহাত একটা গল্পের নায়ক। লেখকের কল্পিত  নায়ক চরিত্র। আসলে শ্রীকৃষ্ণ না কল্পিত, না ঐতিহাসিক।  কেননা ঐতিহাসিকের চরিত্রের একদিন সমাপ্ত হয়।  আবার  গল্পের একটা শেষ আছে। সেখান থেকে চরিত্র হারিয়ে যায়। শ্রীকৃষ্ণ একটি ব্রহ্মবাচক শব্দ। শব্দব্রহ্ম।  যেমন ওঙ্কার একটি ব্রহ্মবাচক শব্দ। আমাদের মতো অতি-চালাক মানুষ তাঁকে মনুষ্যদেহধারী মনে করে, অবজ্ঞা করে থাকি। আমরা তাঁকে ঠিক ধরতে পারি না। আজও এই মনুষ্য-দেহ ধারণ করে অনেক মহাপুরুষ পৃথিবীতে বিরাজ করছেন, কিন্তু আমরা তাদের চিনতে অপারগ। আমাদের চোখে বা আমাদের কাছে, মনুষ্যদেহকে আশ্রয় করে, অতিমানব পুরুষ বাস করতে পারেন, সেই বিষয়টি  আমাদের বুদ্ধিগম্য নয়। আমরা ভগবানকে রক্ত-মাংসের শরীরের মধ্যে দেখতে পাইনি, আবার পাইও না, তাই তাঁকে দেখা যায় বলে মনেও করি না।  আমাদের মতো সাধারণের চক্ষে সমস্ত স্থুল-দেহধারীকে  আমরা সামান্য মানুষ বলেই ভাবি। 

আসলে মায়ার অতীত সেই পরমপুরুষকে জানতে গেলে, নিজেকেও প্রাকৃত-গুন্-রোহিত হতে হবে। নতুবা তাকে জানা যাবে না। অর্জুনের সাথে ভগবানের জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক।  তথাপি অর্জুন তাকে চিনতে পারে নি। ভগবান স্বয়ং বলছেন, তুমি আমাকে দেখোনি। আমাকে দেখবার শক্তিও তোমার নেই। ভগবত কৃপায়, অর্জুন দিব্যদৃষ্টি লাভ করে, ভগবানকে দর্শন করেছিলেন। 

আমরা জানি, একই আত্মা সর্বভূতে বিরাজ করছেন। তিনি সার্বিব্যাপী। আবার তিনিই আমাদের অন্তরাত্মা। সর্বকর্ম্মের সাক্ষী স্বরূপ এই চেতনসত্ত্বা সর্বগুনের অতীত। এখন কথা হচ্ছে কৃষ্ণ শব্দ ব্রহ্মবাচক কেন ? "কৃষ্ণ"  এই শব্দটি এসেছে, "কৃষ্" ধাতু থেকে।  কৃষ কথাটার অর্থ হচ্ছে আকর্ষণ করা। কাকে আকর্ষণ করছেন ? বিষয়াসক্ত জীবকে আকর্ষণ করছেন। কোথায় আকর্ষণ করছেন ? না নিজের কাছে আকর্ষণ করছেন। এইযে আকর্ষণ - এটি তাঁর  স্বভাব। আমরা বিষয়-ভিন্ন ক্ষণকাল থাকতে পারি না। আবার দেখুন, জীব একই বিষয়ে বেশিক্ষন লেগে থাকতে পারে না। ক্ষনে ক্ষনে সে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই বিষয়াসক্ত জীবকে যিনি টেনে বুকে জড়িয়ে নেন, চরণপদ্মে আশ্রয় দেন,কলুষমুক্ত করেন, তিনিই সেই সচ্চিদানন্দ  পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ। 

কিন্তু কথা হচ্ছে, জীব কেন এই বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ভ্রমন করছে ? আসলে সে আনন্দের খোঁজ করেছে।  মধুমক্ষী যেমন ফুল থেকে ফুলে গাছ থেকে গাছে ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করছে।  তেমনি জীবাত্মা আনন্দের আশায় ছুটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কোথায় সেই আনন্দ ? কোথাও সেই তৃপ্তি নাই। এই কারনে অতৃপ্ত মন পুনঃ পুনঃ ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের প্রতি  আকৃষ্ট হচ্ছে। একসময় সে হতাশ হয়ে, ক্লান্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস  ছাড়ে। একসময় অবসন্ন হয়ে ফুলের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। মন প্রাণ তার অবসন্ন যায়। ঠিক তখন তার ভিতরের থেকে ডাক আসে, অন্তরাত্মা পরমপুরুষ বলে ওঠে "আমি তোমাতেই আছি" । আমি বাইরে নয়, ভিতরেই আছি। জ্ঞান সাধনে যাঁকে  জানা যায়, তিনি গোবিন্দ। এই গোবিন্দের ভজনা না করলে, অর্থাৎ জ্ঞানের সাধনা না করলে, কেউ পরমানন্দের সাক্ষাৎ লাভ করতে পারে না। সমস্ত আনন্দের যিনি উৎস তিনি আত্মা। তো মানুষ তার প্রবৃত্তি অনুসারে আনন্দের অনুসরণ করে। এই আনন্দের উৎস হচ্ছে আত্মা।  এক অর্থে আমরা সবাই সেই আত্মার সন্ধান করছি।   প্রথমে সে বিষয়ের মধ্যে আনন্দের সন্ধান করে।  কিন্তু যখন  সে বুঝতে পারে, বিষয়ের মধ্যে যে আনন্দ আছে, তা সাময়িক, ক্ষণস্থায়ী। বিষয় আনন্দে তৃপ্তি নেই। আর অন্তরাত্মার ডাক যখন সে শুনতে পায় তখন সে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আনন্দই আত্মার স্বরূপ।  আবার মানুষ এই আনন্দের সন্ধানে ঘুরছে। আত্মাতে আনন্দ ব্যাতিত কিছু নেই। আনন্দের প্রতি যেমন সমস্ত জীবের স্বাভাবিক আকর্ষণ।  তেমনি আত্মার স্বাভাবিক ধর্ম্ম হচ্ছে নিগুড় আনন্দ। তাই আত্মার প্রতি জীব আকর্ষণ বোধ করে থাকে। এই আনন্দের উৎস আত্মা সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা আমাদের সমস্ত সুখ-দুঃখের কারন। সংসারেও আত্মাই  আছেন, তাই সংসারের প্রতি আমাদের এতো আকর্ষণ। কিন্তু এই সংসার মায়ার প্রকাশ।  এর মধ্যেই অন্তস্থ হয়ে আছেন সেই আত্মা।  যা আনন্দের একমাত্র উৎস। সর্ব্বঘটে এই আত্মারই প্রকাশ দেখতে পাই আমরা। শরীরের মধ্যে  আত্মা আছেন, তাই শরীর আমাদের কাছে প্রিয়। আত্মাবিহীন শরীরের কোনো দাম নেই আমাদের কাছে। আত্মা যাঁকে  ছেড়ে গেছে, সে জড়বস্তু। আর জড়বস্তু আত্মার আবরণ মাত্র। ভূত্সকল আত্মার একপাদ মাত্র। অতয়েব আত্মাই সমস্ত বিশ্বের মূল। আমি যে আমাকে ভালোবাসি, তাও এই আত্মার অবস্থিতির জন্য হয়ে থাকে। তো প্রিয়বস্তু মাত্রেই একমাত্র আত্মা। নিজের প্রতি নিজের যে এই আকর্ষণ তা আসলে আত্মার জন্যই হয়ে থাকে। মোহবশত আমরা আমাদের দেহকে, স্ত্রী, পুত্র, আত্মীয়-স্বজনেই প্রতি আকর্ষণ বোধ করে থাকি। এই যে আকর্ষণ তা আমাদের কামনা প্রসূত। এই আকর্ষণ যখন ঈশ্বরের প্রতি হয়, তখন তাকে বলে প্রেম। কিন্তু আমাদের গতি, হৃদয়ের বেগ যে দিকেই ছুটুক না কেন, তিনি সবসময় আমাদের আকর্ষণ করছেন, নিজের দিকে। এই আকর্ষণ আসলে জগতের মোহনশক্তি। যা আমাদের মোহিত করছে। তাই আমরা আমাদের নিজ নিজ অভীষ্ট বস্তুতে আকৃষ্ট হচ্ছি।  অর্থাৎ আমাদের কাম্য বস্তুর মধ্যেও সেই মোহনীয় রূপকে সেই সুন্দরকে অনুভব করতে চাই। একেই বলে মদন-মোহনের প্রতি আকর্ষণ। জগতের সমস্ত বস্তুই এক ও অভিন্ন। সবই এক আত্মা।  কেবল যেটি যে মোড়কে ঢাকা, তাকে আমরা সেই  নামে জেনে থাকি। কিন্তু সেই বস্তুর মধ্যেও আছে আমাদের আকৃষ্ট করবার আনন্দস্বরূপ আত্মা। এই অনুভূতিশক্তি  যখন আমাদের মধ্যে প্রকাশিত হয়, তখন আমরা সেই বস্তুর মধ্যে আশ্রয়ের  সন্ধান পাই। আমাদের মুনি ঋষিগণ আনন্দঘন মূর্তিকেই উপাস্য রূপে দেখেছেন। এই আনন্দঘন মূর্তি আমাদের চিত্তকে  আকর্ষণ করে থাকে।  সাধক তখন তার হৃদয়ের অভ্যন্তরে সেই মূর্তিকেই  প্রকট করে। জল যখন বাষ্প আকারে থাকে, যখন বাষ্প জলে পরিণত হয়, আবার জল যখন বরফে পরিণত হয়, তখন জলের রূপ ও আকারের পরিবর্তন হয় সত্য, নামের পরিবর্তন হয়, কিন্তু জল জলই থাকে। তথাপি জল অর্থাৎ আকারই  আমাদের দেহাকারে তৃপ্তি সাধন  করে থাকে। আসলে  আপনি যখন যে অবস্থায় আছেন, জানবেন , আত্মাও তখন সেই আকারের মধ্যেই  আছেন। তো আপনি সেই আকারের মধ্যে প্রবেশ করুন, তাঁকেই দেখতে পারবেন। মন যখন যখন বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে, তখনও সে আত্মারই প্রকাশ দেখতে পায়।  

--------------------------- 

১০.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (১৪)

শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ২৯-৩১

বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে 
গাণ্ডীবং স্রংসতে হস্তাৎ ত্বক চৈব পরিদহ্যতে। (২৯)

আমার শরীর কাঁপছে,  শরীরে রোমাঞ্চ হচ্ছে, হাত থেকে গান্ডীব খসে পড়ছে, আমার শরীরের ত্বক জ্বলছে। 

আমাদের মনে যখন দুশ্চিন্তা উপস্থিত হয়, তখন আমরা সাধনায় স্থির হতে পারি না। মন যখন দুশ্চিন্তাগ্রস্থ  হয়, তখন আমাদের শরীরের মধ্যেও নানান রকম উৎপাত শুরু করে দেয়। শরীরের দৃঢ়তা নষ্ট হয়, শরীর এলিয়ে পড়ে।  আর শরীর যখন এলিয়ে পড়ে, তখন আমাদের মেরুদন্ড বেঁকে যায়। এই মেরুদণ্ডই হচ্ছে গান্ডীব, যার সাহায্যে আমাদের সাধন-সমরে লড়াই করতে হবে। তো মেরুদন্ড যদি সোজা না থাকে, মেরুদন্ড যদি শিথিল হয়, তবে শরীরের যে আঁটোসাঁটো ভাব তা নষ্ট হয়ে যায়।  আর এই অবস্থায় সাধনা দূরে থাকুক, স্বাভাবিক কর্ম্মও করা সম্ভব নয়। 

ন চ সক্লমি অবস্থাতুং ভ্ৰমতীব চ মে মনঃ 
নিমিত্তানি চ পশ্যামি বিপরীতানি কেশব। (৩০) 

হে কেশব, আমি স্থির থাকতে পারছি না।  আমরা মন অস্থির হচ্ছে। আমি অনিষ্টসূচক দুর্লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। 

এখানে আরো একটা নাম পেলাম "কেশব"। সাধারণ ভাবে কেশব মানে যার মনোহর কেশ আছে। আবার ক্ কথাটার অর্থ হচ্ছে ব্রহ্মা, অ অর্থাৎ বিষ্ণু আর ইশ কথাটার অর্থ হচ্ছে মহাদেব।  এই তিনি মিলে (ক+অ+ইশ) কেশ। তো ব্রহ্মা বিষ্ণু মহাদেব যার বশে থাকেন, তিনি কেশব। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন কেশী নামক অসুরকে যিনি বধ করেছিলেন, তিনি কেশব। 
সে যাই হোক, আমাদের মনের তেজ যখন কমে যায়, আমাদের চিত্তে তখন বিভ্রান্তি দেখা যায়। আর এই সময় সাধনায় অগ্রসর হাওয়া সম্ভব নয়। ভয়ে মানুষ অস্থির হয়ে ওঠে, এমনকি সে এক জায়গায় বসে থাকতেও পারে না। তখন তার শরীর  মন দুইই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। শরীর কাঁপতে  থাকে।  মন ইতস্তত ঘুরতে থাকে। যে সাধনায় ঋষিগণ সমস্ত জ্ঞান সংগ্রহ করেছিলেন, যে সাধনায়,  মুনিঋষিগন মহা আনন্দে  থাকতেন, শান্তিতে থাকতেন, সেই সাধনার প্রতি তখন, আমাদের কাম-দুষিত চিত্তে আমাদের ভয়ের উৎপন্ন করে থাকে। আর বারবার মনে হয়, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। সাধনার দরকার নেই। সংসারের কর্দম অনেক আরামদায়ক স্থান। এমনকি এই সময় মানুষ যেখানে সাধনার কথা আলোচনা হয়, সেখানেও বসে থাকতে পারে না।  যেখানে শাস্ত্রকথা আলোচনা হয়, সেখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। ভালো কথা ভাল্লাগে না।
 
ন চ শ্রেয়ঃ অনুপশ্যামি হত্বা স্বজনম আহবে 
না কাঙ্খ্যে বিজয়ং কৃষ্ণ না চ রাজ্যং সুখানি চ। (৩১)

 হে কৃষ্ণ, যুদ্ধে আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করার মধ্যে আমি কোনো মঙ্গল দেখতে পাচ্ছি না। বিজয় আকাংখ্যাও আমি করি না, রাজ্যও আমি চাই না, রাজসুখও আমি চাই না।

এতদিন যাদের আমি আপনজন ভেবে এসেছি, আজ সাধনার প্রাঙ্গনে তাদেরকেই হত্যা করতে হবে ? মানুষ জন্মের পর থেকেই শরীরের সেবা করে এসেছে, তাকেই সে ভালোবেসে এসেছে। ধীরে ধীরে ইন্দ্রিয়সুখ উপলব্ধি করতে শিখেছে। কিন্তু এখন সাধন করতে এসে দেখছি, এইসব ইন্দ্রিয়সুখ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।  এদেরকে পরিত্যাগ করতে হবে। রাজ্য অর্থাৎ স্থুল শরীর, আর রাজসুখ হচ্ছে শারীরিক সুখ, বা ইন্দ্রিয়সুখ। আমরা কেউ এই দুটোকে ত্যাগ করতে চাই না।  

যদিও এটি আমাদের ভুল ধারণা  যে সাধন করতে গেলে সবাইকে পরিত্যাগ করতে হবে। আমাদের অজ্ঞান এইসব ধারণার মধ্যে নিমজ্জিত।  আসলে দেখবেন, সাধন সমরের শেষেও এই শরীর থাকবে। এই ইন্দ্রিয়শক্তিরও বিশেষ পরিবর্তন হবে না। শুধু যেটা করতে হবে, তা হচ্ছে সংযম। অসংযমী জীবন মোটেই সুখের নয়। অসংযমীরা ধীরে ধীরে সমস্ত সুখ থেকে অচিরেই অক্ষম ও বঞ্চিত হয়ে যায়। এমনকি শরীরের ব্যাধির  কারন হচ্ছে অসংযম। তাই আমাদের সংযম পালন করতে শিখতে হবে।  এটাই সাধনা। আহারে বিহারে আমাদের সংযম পালন করতে হবে। সংযম মানে উপবাস নয়, সংযম মানে পরিমিত আহার। সংযম মানে সংসার ত্যাগ নয়, সংযম মানে সংসারের অসারতা উপলব্ধি করা। ইন্দ্রিয়গুলো বিষয়ের দিকে আকৃষ্ট হবে, এটাই তাদের ধর্ম্ম । চোখ দেখবে, কান শুনবে, মুখ কথা বলবে, ত্বকে স্পর্শ অনুভব হবে। কিন্তু আমাদের যেটা করতে হবে, তা হচ্ছে, এই বিষয় থেকে প্রয়োজনীয়টুকু রেখে বাকিটা পরিত্যাগ করা। সংযম মানুষকে দেবমানবে পরিণত করতে পারে।  লোভ থাকবে, হিংসা থাকবে, স্বার্থপরতা থাকবে, কিন্তু সাধকের কাজ হচ্ছে, এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। নিজের কর্তব্য কর্ম্ম পরিহার নয়, বরং নিজের কর্তব্য কর্ম্ম আরো সুনিপুন ভাবে পালনের ক্ষমতা লাভ হতে পারে, যদি আমরা সংযমী হতে পারি।  আমাদের ধীশক্তি, আমাদের দূরদৃষ্টি-শক্তি বেড়ে যাবে, যদি আমরা সংযমী হতে পারি। 
------------------------    
১১.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (১৫)

শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ৩২-৩৪

কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দং কিং ভোগৈ জীবিতেন বা
যেষামর্থে কাঙ্খিতং নো রাজ্যং ভোগাঃ সুখানি চ। (৩২) 

 হে গোবিন্দ আমাদের রাজ্যে কি প্রয়োজন ? ভোগ বা জীবনে কি প্রয়োজন ? যাদের জন্য রাজ্য ও সুখের কামনা করি।  (৩২)

এখানে নতুন একটা নাম আমরা পেলাম তা হচ্ছে গোবিন্দ। গো+বিদ+অ = গোবিন্দ। গো কথাটার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান। বিদ কথাটার অর্থ হচ্ছে লাভে বা প্রাপ্তিতে। অ অর্থে সর্বব্যাপী। তো মহাজ্ঞানের দ্বারা যে সর্ব্বব্যাপী সত্ত্বাকে   পাওয়া যায়।  তো জ্ঞানের প্রকাশ হলে কি হয়, আমাদের চৈতন্য হয়। তো যিনি চৈতন্যের আধাঁর তাকে কেউ বলেন, শ্রীকৃষ্ণ, কেউ বলেন বিষ্ণু। আসলে আমাদের শরীরের ভিতরে বাইরে যে চৈতন্যশক্তি বিরাজ করছে, জ্ঞানের মাধ্যমে সেই চৈতন্য শক্তি আমাদের অন্তরে প্রকাশমান হয়।   একেই বলে গোবিন্দ।  

ত  ইমে অবস্থিতা যুদ্ধে প্রাণাং চ ত্যাক্ত্বা ধনানি চ
আচার্য্যাঃ পিতরঃ পুত্ৰস্তথৈব  চ পিতামহাঃ। (৩৩)

সেই আচার্য্য, পুত্র পিতামহগন ধন ও জীবনের আশা পরিত্যাগ করে এই যুদ্ধে অবস্থিত। (৩৩)

মাতুলাঃ শ্বশুরাঃ পৌত্রাঃ শ্য়ালাঃ সন্মন্ধিন স্তথা 
এতান্ ন হন্তং ইচ্ছামি ঘ্নতঃ অপি মধুসূদন। (৩৪)

মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক  ও বৈবাহিকগন উপস্থিত হয়েছেন।   হে মধুসূদন আমি নিজে হত হলেও, এদের নিধন করতে আমি ইচ্ছে করি না। (৩৪) 

দেখুন সাধনার দ্বারা আমাদের বাসনার জয় হয়, ইন্দ্রিয় জয় হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে এই ইন্দ্রিয়জয় করে, বা বাসনার ত্যাগের মাধ্যমে আমরা কি পাবো - যার জন্য সাধনা করবো ? বিষয়সুখ ভোগের  জন্যই তো জীবন।  বিষয়সুখ থেকে নিস্পৃহ থেকে - জড়বৎ জীবন যাপনে কি লাভ ? এই জীবনের কোনো অর্থ হয় না। 

আমাদের অনেকের ধারণা  হচ্ছে, যোগসাধন করলে আমাদের মধ্যে অনেক অলৌকিক ক্ষমতা লাভ হবে, আমরা অনেক অনেক বিভূতির অধিকারী হতে পারবো।  যা কেউ শুনতে পায়  না তাই  আমি শুনতে পারবো, আমরা আকাশমার্গে ভ্রমন করতে পারবো। ইচ্ছেমতো দেহকে স্ফিত করতে পারবো, সংকুচিত করতে পারবো।  ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছু শক্তি  আমাদের লাভ হবে। কিন্তু সাধনক্ষেত্রে গুরুবানী শুনে যখন জানতে পারে, এই সব অলৌকিক ক্ষমতা অর্জনের জন্য সাধনা হয়, বরং ইন্দ্রিয়গুলোকে সংযমী রাখা ও চিত্তবৃত্তিকে নিরোধ করাই  যোগের উদ্দেশ্য তখন নবীন সাধকের  মধ্যে হতাশা আসে। আমরা সবাই কর্ম্মে লিপ্ত হই কিছু পাবার আশায়, এখানে যোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে ত্যাগে সাফল্যতা  অর্জন করা। আগে শুনেছিলাম, যোগের মাধ্যমে অনেক কিছু পাওয়া যায়, পরমানন্দ পাওয়া যায়। বিচিত্র সব ক্ষমতা যা সাধারণ মানুষের নেই, সেই সব ক্ষমতা লাভ করা যায়। এখন দেখছি, যোগের মাধ্যমে ত্যাগের প্রক্রিয়া শিখতে হয়। এখন সাধন করতে এসে আমাদের বৃত্তির নাশ তা সে শুভ হোক, বা অশুভ, যার সাহায্যে আমি দেখে-শুনে আনন্দ লাভ করবো, অর্থাৎ মন,  ইন্দ্রিয়সকল যদি যুদ্ধে পরাভূত হয়ে পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হয়, তবে এই সুখভোগ আমি কার সাহায্যে  করবো ? তাই মনে হয়, এই সাধনরূপ যুদ্ধ না করা  ভালো। আবার এই ইন্দ্রিয়ের হাতে নিজেকে সমর্পন করলে, তারা সকলে আমাকে মেরে ফেলবে, কারন সাধনা হচ্ছে আত্মসমর্পন। আর আত্মসমর্পন না করলে আত্মচৈতন্যের বিকাশ থাকবে না। মানুষ যখন ভোগের মধ্যে ডুবে যায়, যা তার  করতে বা শুনতে ভালো লাগে, তা করতে করতে সে মাত্রাতিরিক্ত ভোজন, বা মাত্রাতিরিক্ত সম্ভোগের মধ্যে একটা তৃপ্তি পেয়ে থাকে। এবং তখন তার মনে হয়, যা হয় হোক, মারা  যাই যাবো, তথাপি আমি ৪০টা  রাসগল্লা খাবোই, ১ কেজি মাংস খাবোই। এই সাময়িক সুখ, যার আসল পরিণতি দুর্ভোগ এমনকি  ধংশ, সেই বোধ তখন তার মধ্যে থাকে না। অজ্ঞানবশতঃ বিচার-বুদ্ধির অভাবে এইসব করে থাকে। 

অজ্ঞানতা বশতঃ অথবা লাভের আশায়, অথবা বিচারবুদ্ধির অভাবে আমাদের মনের মধ্যে এমন একটা ধারণা  জন্মে যে সাধনমাত্রই ইন্দ্রিয় নিগ্রহ। হ্যাঁ সাধন প্রক্রিয়া অবশ্য়ই ইন্দ্রিয় নিগ্রহ কিন্তু সাধনার প্রতক্ষ্য ফল হচ্ছে ইন্দ্রিয়ের তেজ বৃদ্ধি। ইন্দ্রিয়গুলো তখন ভোগের নিমিত্ত লালায়িত থাকে না। বরং এই শক্তিধর ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই আমরা তখন অনেক অসাধ্য সাধন  করতে পারি। এমনকি অনেক জটিল সাংসারিক সমস্যা সমাধানের সহজ রাস্তার সন্ধান আমরা পেয়ে থাকি। 
-------------------------
১২.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (১৬)

শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ৩৫-৩৭

অপি ত্রৈলোক্য রাজ্যস্য হেতোঃ কিং নু মহীকৃতে 
নিহত্য ধার্ত্তরাষ্ট্রান নঃ কে প্রীতিঃ স্যাৎ জনার্দ্দন। (৩৫)

হে জনার্দ্দন পৃথিবীর রাজত্বের দূরে থাকুক ত্রৈলোক্যরাজ্যের জন্যও ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রগনকে বধ করে আমাদের কি সুখ হবে। 

পাপম এবং আশ্রয়েৎ অস্মান হত্বা এতান আততায়িনঃ 
তস্মাৎ ন অর্হাঃ  বয়ং হন্তুং ধার্তরাষ্ট্রান সবান্ধবান। 
স্বজনং হয় কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব। (৩৬)

এইসব আততায়ীদের হত্যা করলে, আমাদের পাপই হবে. তাই আমাদের বন্ধুগনসহ ধৃতরাষ্টপুত্রদেরকে আমাদের হত্যা করা উচিত নয়। হে মাধব, স্বজনবৃন্দ-কে হত্যা করে কিভাবে সুখী হবো ? 

শ্লোকে শ্লোকে পার্থক্য খেয়াল করুন। প্রথমে অর্জুন নিজের মত প্রকাশ করছিলেন, অর্থাৎ এদের মেরে আমাদের কোনো লাভ হবে না, পাপ হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এবার অর্জুন প্রশ্ন ছুড়ে মারছেন। কার  দিকে প্রশ্ন ছুড়ছেন ? না ভাবি গুরুদেবের উদ্দেশ্য।  এটাই আমাদের ক্ষেত্রে হয়, আমরা যখন গুরুদেবের কাছে যাই, তখন আমরা নিজেরদের মধ্যে অনেক ভ্রান্তজ্ঞান নিয়ে, গুরুদেবের কাছে যাই। সেখানে নিজের জ্ঞানের পরিচয় দিয়ে,  গুরুদেবের মতের অপেক্ষায় থাকি। তার সমর্থনের অপেক্ষায় থাকি।  কিন্তু গুরুদেব যখন কোনো উত্তর না দিয়ে নীরবতা রক্ষা করেন, তখন তাকে আমরা প্রশ্ন করতে শুরু করে দেই। এটাই অর্জুন শুরু করেছেন। বলছেন এদের মেরে কি আমাদের সুখ হবে ? এদের মেরে আমরা কিভাবে সুখী হবো ? 

প্রবৃত্তির নাশে আমরা সংশয়-শূন্য হতে পারি না।  কেননা আমরা তো প্রবৃত্তির দাস। ধৃতরাষ্ট্র অর্থাৎ আমাদের মন।  এই মন আমাদের হাজার বছরের সংস্কার যা আমাদের প্রবৃত্তির মধ্যে মিশে আছে, যার আছে ১০০ সন্তান, তাদেরকে নিয়েই এতদিন পথ চলেছি। এদেরকে মেরে, বা এদেরকে বাদ  দিয়ে আমরা কিভাবে সুখী হতে পারবো। এঁরাই আমাকে এতদিন সুখ-দুঃখের মধ্যে লালনপালন করেছে।  এদের সুখে আমি সুখী, এদের দুঃখে আমি দুঃখী।  তো এদের সাথে আমাদের হাজার বছরের সম্পর্ক। এদেরকে বাদ  দিয়ে আমরা সুখের কথা কল্পনাও করতে পারি না। তাই ভাবি গুরুদেবের  কাছে, তার প্রশ্ন এদেরকে মেরে কি আমার সুখ হবে ? এদেরকে মেরে আমি কিভাবে সুখী হবো ?

আমাদের মনের স্বজন হচ্ছে আমাদের ইন্দ্রিয়সকল। এই ইন্দ্রিয়গুলো আমাদের মনকে বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ক'রে, এই ইন্দ্রিয়গুলো আমাদের বিষয় ভোগ করায়। এই ইন্দ্রিয়গণ যেমন আমাদের সাধন পথের কাঁটা, তেমনি সাধনার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের যে বিভূতির  লাভ হয়ে থাকে, তা সবই ইন্দ্রিয়ভোগ্য। তো আমাদের মনে হয়, এই ইন্দ্রিয়গুলো ধংশপ্রাপ্ত হলে, আমাদের সাধনার উন্নতির ফল ভোগেও আমরা অক্ষম হয়ে যাবো। সুতরাং মনের সন্তানগণ অর্থাৎ ধার্তরাষ্ট্রগন,  যদি সাধন-সমরে মারাই  যায়, তবে আমাদের মনে কোনো সুখের আশা করতে পারি না। কেননা সন্তানহীন আমাদের মন তখন ম্রিয়মান, শোকাচ্ছন্ন হয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়বে । তাই আর সুখের আশা করা বৃথা।

যদ্যপি এতে ন পশ্যন্তি  লোভোপহত চেতসঃ 
কুলক্ষয় কৃতং দোষং মিত্রদ্রোহে পাতকম।  (৩৭)

লোভে অভিভূত চিত্ত হওয়ায়, ওরা কুলক্ষয়জনিত ও মিত্রদ্রোহজনিত পাপরাশি দেখতে পাচ্ছে না। 
আমরা মনের আবেগে যা কিছু করি না কেন, তাতে করে আমাদের শরীর ও ইন্দ্রিয়শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। আমরা বৃথা কাজে আমাদের আয়ুক্ষয় অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের অপব্যবহার করছি। যোগক্রিয়ার দ্বারা অর্থাৎ আসন-প্রাণায়াম দ্বারা আমরা আয়ুক্ষয়জনিত শ্বাস-ক্রিয়াকে  নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এতে করে আমাদের পরমায়ু বৃদ্ধি  পেতে পারে। আমাদের দুর্ম্মতি ইন্দ্রিয়সকলকে নিয়ে ভোগ-লালসায় লিপ্ত থেকে  আসলে নিজেই ক্ষয়বৃদ্ধি করছে। আমরা তা বুঝতে পারি না। আমাদের শুভ বাসনা বা অশুভ বাসনা এই সমস্তই আমাদের সংস্কারজাত অর্থাৎ কুলসম্ভূত স্বভাব। এসবই আমাদের মন-বুদ্ধি থেকেই উৎপন্ন। এই মন-বুদ্ধিই আমাদের সংসারে আবদ্ধ  করে রাখে, আবার এই মন-বুদ্ধিই আমাদের সংসার থেকে মুক্ত করতে পারে।   

  ---------------------------

 ১৩.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (১৭)

শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ৩৮-৪১

কথং ন জ্ঞেয়ম অস্মাভিঃপাপাৎ অস্মাৎ নিবর্ত্তিতুম 
কুলক্ষয় কৃতং দোষংপ্রপশ্যদ্ভিঃ জনার্দ্দন। (৩৮) 

হে জনার্দ্দন, কুলক্ষয় জনিত পাপ লক্ষ করেও কেন আমাদের তা থেকে নিবৃত্তি হবার জ্ঞান হবে না ?
খেলাল করুন, আমরা যখন স্বেচ্ছায় সাধন করবার জন্য, ভাবি গুরুর কাছে উপস্থিত হই, তখন আমাদের আচরণ যেমন যেমন হয়ে থাকে, এখানে অর্জুনের মধ্যেও সেই একই উদ্বেগের কথা শোনা যাচ্ছে। নিজেই গুরুদেবকে প্রশ্ন করছে, আর গুরুদেবের নীরবতা হেতু, ভাবি শিষ্য তার নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই দিচ্ছেন ।
 শরীরের যে সব সৈন্যদল এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে, অর্থাৎ আমাদের ললাট, মস্তক , স্তন, অঙ্গুলি,  কান, উরু, কেশ, পার্শ্ব, মুখ, নখ, নিতম্ব, পৃষ্ঠ, গ্রীবা, নাভি, নয়ন, বাহু, নাসিকা, কুক্ষি, উদর, পদ, যোনী, চিবুক, শ্বাস, জানু, জঙ্ঘা, ভ্রু, ভ্রূমধ্য, গুল্ফ, কেশ, গ্রীবা, মস্তক, কর, কন্ঠ, বাক, দাঁত, মাংস, ত্বক, অস্থি, শিরা, নাড়ী, ইত্যাদি ইত্যাদি অর্থাৎ শরীরের সমস্ত কোষাদি এই যুদ্ধের সৈন্যবল। 
 
এই নাড়ী সমূহের মধ্যে প্রধান দশটি  হচ্ছে : 

ইড়া - আমাদের মেরুদণ্ডের বাম  পার্শ্বে 
পিঙ্গলা - মেরুদণ্ডের ডান পার্শ্বে 
সুষুম্না - মেরুদণ্ডের মধ্যে 
হস্তিনী - ডান  কানে, 
গান্ধারী - বাম কানে 
 কুহু - গুহ্যদ্বারে 
সরস্বতী - জিহ্বা মুলে 
বারুনী - লিঙ্গমূলে 
পুষ্পনাশা - বাম  চোখে  
অলম্বুষা - ডান চোখে। 

অর্থাৎ জিহ্বায় একটি, কানে দুটো, চোখে দুটো, মেরুদণ্ডে তিনটি, গুহ্যদ্বারে একটা লিঙ্গমূলে একটা। 
এদের সবাইকে নিয়েই সাধন সমর।  তো সাধন করতে গিয়ে যদি আমাদের ইন্দ্রিয়শক্তি শরীরের শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তবে এই সাধনার দরকার কি ? এই প্রশ্ন সমস্ত নবীন সাধকের মানের মধ্যে উদয় হাওয়া স্বভাবিক।  আবার এই প্রশ্নের উত্তর সে নিজেই খুঁজে নেয়। এবং সাধন ক্ষেত্র থেকে নিষ্কৃতি পেতে চায়। কিন্তু সে তো এখন ভাবি গুরুদেবের কাছে বসে। আসলে ভোগে আমাদের ইন্দ্রিয় বা শরীর যত  দুর্বল বা শক্তিহীন হয়, সাধন ক্রিয়াতে  তা হয় না। হ্যাঁ পরিমিত আহার ও কৃষ্র সাধনের ফলে হয়তো শরীর কৃশ হতে পারে, কিন্তু শরীরের ভিতরের জীবনীশক্তি, প্রাণশক্তি, উর্যাশক্তি বৃদ্ধি পায়। যারা সাধনা করেননি, তারা এই সত্য না জানার ফলে ভয়ে পিছিয়ে আসতে চায়। সাধনক্রিয়াতে আমাদের সহ্যশক্তি বৃদ্ধি পায়। সংযম সাধনার প্রাথমিক শর্ত। আহার-বিহারে সংযম অপরিহার্য।        

কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্ম্মাঃ সনাতনাঃ
ধর্ম্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নং অধর্ম্ম অভিভবতি উত। (৩৯)

কুলক্ষয় হলে সনাতন কুলধর্ম্ম বিনষ্ট হয়, আর ধর্ম্ম নষ্ট হলে অধর্ম্ম সমস্ত কুলকে অভিভূত করে ফেলে। 

আমরা পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত আচার-ব্যবহার মেনে চলে থাকি। কিন্তু আমরা জানিনা এই আচার-কাণ্ডের কি উদ্দেশ্য বা কিভাবে এইসব কুলকান্ড ক্রিয়া করে থাকে। আমরা এইসব আচার যা আমাদের পরম্পরা আমাদের মনের মধ্যে একটা চিরস্থায়ী বাসা করে নিয়েছে। আমাদের একটা অন্ধবিশ্বাস জন্মেছে, যে এইসব আচার না মানলে অমঙ্গল হবে। অথচ আমরা জানিনা, কিভাবে এসব আমাদের অমঙ্গল বা মঙ্গল  করতে পারে। সাধন জগতে নবীন সাধকের মনেও অনেক প্রশ্ন জাগে, সাধন করতে গেলে যদি আমাদের ইন্দ্রিয় বিকল হয়ে যায়, যদি বিকারগ্রস্থ হয়, তবে আমাদের কি উপায় হবে ? আমরা বিষয়ভোগ করি, বা আমরা সাধনক্রিয়া করি, উভয় ক্ষেত্রেই ইন্দ্রিয়শক্তি সতেজ  থাকা দরকার। আমাদের যে পাঁচ ইন্দ্রিয়, পাঁচ প্রাণ, মন, বুদ্ধি এগুলো না থাকলে বা এগুলো শক্তিশালী না থাকলে,  বিষয়ভোগ বলুন, বা সাধনফল বলুন, কোনো কিছুই লাভ হবে না। এই শক্তিগুলোকেই বলা হয় কুল, অর্থাৎ জন্মসূত্রে প্রাপ্ত এই কুলশক্তি । এই ইন্দ্রিয়শক্তি আসলে আমাদের মেরুদণ্ড ও মস্তিষ্কের  মধ্যে অবস্থিত।  এইজন্য মেরুদন্ডকে বলা হয় কুলবৃক্ষ। সাধন সংগ্রামে এই কুলশক্তির ব্যবহার করতে হয়। কুলশক্তি নষ্ট হলে, জীবের প্রাণ, মন, ইন্দ্রিয় সবই ম্রিয়মান হয়ে যায়। ফলত সাধনার অগ্রগতি হয় না।   

অধর্ম্ম অভিভবাৎ কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি কুলস্ত্রীয়ঃ
স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণশঙ্করঃ। (৪০)

হে কৃষ্ণ, কুল অধর্ম্মে অভিভূত হলেই কুলস্ত্রীগন ব্যভিচারিণী হয়।  হে বৃষ্ণি বংশধর, কুলনারীগণ পতিতা হলেই বর্ণশঙ্কর উৎপন্ন হয়। 

সঙ্করো নরকায় এব কুলঘ্নানাং কুলস্য চ 
পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্ত পিণ্ডোদক ক্রিয়াঃ।(৪১) 

বর্ণশঙ্কর কুলের এবং বংশ নাশকগণের নরকে গতি হয়।  শ্রাদ্ধ-তর্পন বর্জিত হওয়ায় তাদের পিতৃপুরুষগণ নরকে পতিত হন। 

এখানে একটা বিশেষ বিজ্ঞানের কথা বলা হচ্ছে। আমরা জানি পঞ্চভূতের মিশ্রণ হচ্ছে এই জীবজগৎ। তো মিশ্রণ জগৎ সৃষ্টির কারন। সোনার সঙ্গে  খাদ মিশিয়ে গহনা তৈরী হয়। খাঁটি সোনায় গহনা হয় না। আবার কোনো কোনো মিশ্রণ বিস্ফোরকে পরিণত হয়। দুধের সঙ্গে ঝাল লবন  মেশালে তা অখাদ্য, হয়ে যায়। রান্নার সময় পরিমিত মশলা (তেল, লবন, ঝাল) দিলে রান্না করা খাবার সুস্বাদু হয়।  আবার মিশ্রনের তারতম্যে খাদ্য গ্রহণযোগ্য বা গ্রহণের অযোগ্য হয়ে যায়। 
এই শরীর পঞ্চভূতের মিশ্রণ বৈ কিছু নয়, কিন্তু এই পঞ্চভূতের তারতম্যের জন্য, মানুষের মধ্যে বিভিন্ন গুনের  সৃষ্টি হয়। শরীরে একটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলে।  এই ভারসাম্যের অভাব হলে, শরীর অসুস্থ হয়, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়। আর শরীর ও মন যদি ব্যাধিগ্রস্থ হয়, তবে আমাদের কুণ্ডলিনী শক্তি বা শরীরে যে ব্রহ্মজ্যোতি আছে তার অপ্রকাশ হয়ে যায়। তখন সহস্রার পদ্ম থেকে  সুধাক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং সাধনকালে যে অনুভূতি হবার কথা তা আর হয় না। তো আমাদের শরীর  মন  ভারসাম্যহীন হলে সদ্ভাবের অভাব ঘটে। সাধনায় যে আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশ হবার কথা তা ধীরে ধীরে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে একসময় লোপ পেয়ে যায়। 

আমাদের শরীর মাতৃশক্তি ও পিতৃশক্তির মিশ্রণ। অর্থাৎ পিন্ডদেহ ও ভাণ্ডদেহ।  আমাদের তথাকথিত মৃত্যুর পরে, এই মাতৃজ দেহ বা ভান্ড দেহ দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু পিতৃজ বা পিন্ডদেহ সহজে নষ্ট হয় না। এই পিতৃজ দেহ স্থুল নয়, আবার সূক্ষ্মও নয়। সূক্ষ্ম ও স্থূলের মাঝামাঝি। এই পিতৃৰ দেহ মাঝে মধ্যে দৃশ্যমান হয়ে থাকে। আবার ভান্ডদেহ না থাকলে জীব-আত্মা পিন্ডদেহে অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। এইসময় তার স্থূল দেহের চাহিদা থাকে।  এমনকি সে ক্ষুধা- তৃষ্ণা অনুভব করে থাকে। আত্মীয় স্বজনদের দেখতে ইচ্ছে করে। তাদের কান্নাকাটি দেখলে, তার নিজের মধ্যেও কষ্ট  লাগে। আবার ভান্ডদেহ না থাকায়, সে কোনো কাজ করতে পারে না। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে এই দেহ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। লঘু এই দেহে নানান রকম কষ্ট হতে থাকে। দুর্ঘটনায় মৃত্যু, আত্মহত্যা, যুদ্ধে মৃত্যু হলে জীবাত্মার এই অবস্থা হয়ে থাকে। এই দেহ প্রায় ১ বৎসরকাল সচল থাকে। এইসময় সে নানান রকম কষ্টের মধ্যে দিনযাপন করে থাকে। 

হিন্দুশাস্ত্রে এই দেহ থেকে নিষ্কৃতি দেবার জন্য, পিন্ডদানের ব্যবস্থা আছে। এই পিন্ডদান সাধারণত পুত্র করে থাকে।  কারন হচ্ছে, এই পিন্ডদেহের উপাদান বা মিশ্রণ  আর পুত্রের পিন্ডদেহের মিশ্রণ একই বা কাছাকাছি থাকায়, মৃত ব্যক্তির সঙ্গে তার পুত্রের সান্নিধ্য অনুভব হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, মৃত পিতা যদি পুত্রের কাছ থেকে পিণ্ডোদক না পায়, তবে হয়তো দীর্ঘকাল  এই পিন্ডদেহে অবস্থান করে থাকে। যদিও একসময় কালের নিয়মে ও প্রকৃতির নিয়মে এই দেহের বিনাশ ঘটে থাকে। কিন্তু পিন্ডদান এই পিন্ডদেহের বিলুপ্তিতে দ্রুত সাহায্য করে থাকে। 

পিন্ডদেহ নষ্ট হয়ে গেলে, জীবাত্মা নিজ নিজ কর্ম্ম অনুসারে ভোগদেহ লাভ করে থাকে। এই ভোগদেহে তাকে কর্ম্ম অনুযায়ী কর্ম্মফল ভোগ করতে হয়। একেই বলা হয়ে থাকে স্বর্গ-নরক। এরপরে ভোগ শেষ হয়ে গেলে, জীবাত্মা আবার কর্ম্মক্ষেত্ৰ মর্তলোকে প্রবেশ করে থাকে, এবং মনুষ্যদেহে স্থিত হয় । 

পূর্বপূর্ব জীবনে অপূর্ন বাসনা, বা সংকল্প পূরণের নিমিত্ত সে আবার সেইমতো মাতা-পিতা নির্বাচন  করে থাকে। অনেকের ধারণা মৃত্যুর পরে, পরবর্তী জীবনে সে আবার মানুষ হয়ে জন্ম গ্রহন করবেই তার কোনো মানে নেই।  ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়, দেহ সে মানুষেরই পাবে, তবে পূর্ব-জীবনের সাধনার উন্নতির সুফল অনুযায়ী সে মাতা-পিতা ও তাদের দেহের আকৃতি পাবে।
 
এইখানে আরো একটা গুহ্য কথা বলে রাখি, সেটি হচ্ছে, মৃত্যুর পরে আমাদের যে পিন্ডদেহ বর্তমান থাকে, তাকে যোগীপুরুষগন  উপেক্ষা করতে পারেন । বেঁচে থাকতে আপনারা দেখেছেন সন্নাসীগণ এই পিণ্ডোদক ক্রিয়া করে থাকেন। যোগসাধনায়, পিণ্ডোদক ক্রিয়ার কথা বলা আছে। এই পিন্ড দেওয়া হয় সাধনার দ্বারা। যোগের কথায় কুল্ডলিনী শক্তির আর-এক নাম হচ্ছে পিন্ড। ইনিই জীবাত্মার চৈতন্যশক্তি।  যোগের নিরন্তর অভ্যাস দ্বারা মূলাধারের এই শক্তিকে চৈতন্যযুক্ত করতে হয়। এই শক্তি যখন চৈতন্যযুক্ত হয়, তখন এই শক্তি সুষুম্নারন্ধ্রে প্রবেশ করে, ধীরে ধীরে এই শক্তি একেকটি চক্র  ভেদ করে আজ্ঞাচক্র হয়ে সহস্রারে প্রবেশ করে।  এবং সেখানে এই শক্তি স্থিত হয়। এই আজ্ঞাচক্রে কুণ্ডলিনী শক্তির স্থিতিতে পিন্ডদান সম্পন্ন হয়। এই আজ্ঞাচক্র হচ্ছে বিষ্ণুপাদ। এই অবস্থায় জীব ত্রিকালজ্ঞ হয়ে যায়। পরমজ্ঞান লাভ হয়। আর এই জ্ঞানের দ্বারাই জীব উন্মুক্ত অবস্থা লাভ করে থাকে। না হলে জীবের পুনঃ পুনঃ জন্ম অবধারিত।  দেহে থেকে দেহান্তরে গমন চলতেই থাকে।                      
১৪.১২.২০২১
যোগ-সাধনার গুহ্যতত্ত্ব। (১৮)

শ্রীমদ্ভবৎ গীতা প্রথম অধ্যায় শ্লোক নং - ৪২-৪৬
       
 দোষৈঃ এতৈঃ কুলঘ্ননাং  বর্ণসঙ্করকারকৈঃ 
উৎসাদ্যন্তে জাতিধৰ্ম্মাঃ কুলধর্ম্মাঃ চ শাশ্বতাঃ। (৪২)

কুলনাশকারীদের এসব বর্ণসঙ্কর দোষ  দ্বারা শাশ্বত জাতি-ধর্ম্ম ও কুলধর্ম্ম নষ্ট হয়।

বক ও কচ্ছপের মিলনে অদ্ভুত বকচ্ছপ হতে হতে পারে। ঘোড়া ও গাধার মিলনে খচ্চর হতে পারে। কিন্তু তখন আর বক বা কচ্ছপ, কিংবা ঘোড়া আর গাধা বলে কিছু থাকে না। এখন তো অনেক শঙ্কর গাছের উৎপাদন হচ্ছে, যা অধিক ফলদায়ক । দাসীপুত্র বিদ্বান বিদুরের জন্ম হতে পারে।তো শঙ্কর মানেই খারাপ এমন নয়।  কিন্তু এতে করে মূল জাতির বিলোপের সম্ভাবনা। আমাদের সাধন জগতেও আজ বহু বর্ণশংকরের জন্ম হতে দেখা যাচ্ছে।  কিছুদিন ভারত সেবাশ্রমে, কিছুদিন রামকৃষ্ণ মিশনে, আবার সব ছেড়ে দিয়ে, পাহাড়ে কোনো সাধুর মধ্যে বিভূতির যোগ দেখে, তাতে আকৃষ্ট হওয়া। আসলে স্থিরতা না থাকলে সাধনপথে বেশিদূর এগুলো যায় না। আসলে একটা ধারাবাহিকতা ভালো।  প্রথমে কর্ম্মযোগ, তারপরে জ্ঞানযোগ, তারপরে ভক্তিযোগ।  কেউ বলেন, আগে জ্ঞানযোগ তারপরে কর্ম্মযোগ তারপরে ভক্তি যোগের সাধনা ভালো। কিন্তু আমরা দেখেছি, কেউকেউ  কর্ম্ম ও জ্ঞান বাদ  দিয়ে হরিনামের মাধ্যমে সরাসরি ভক্তিযোগে গা ভাসতে চান। শ্রীশ্রী চৈতন্যদেব সংসার করেছেন, জ্ঞান সংগ্রহ করেছেন। তিনি ছিলেন সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিত।  তার পরে তিনি ভক্তির সাগরে ডুব দিয়েছেন। 

আমি দেখেছি, জ্ঞান লাভের  জন্য, আমাদের প্রয়াস কম। অথচ ভগবানকে পাবার জন্য, কিছুদিন যোগক্রিয়া আরাম্ভ করে দিলেন। কিছুদূর অগ্রসর হবার পর, এমনকি সামান্য বিভূতি লাভের পর, আসল লক্ষের থেকে বিচ্যুত হয়ে, বিভূতি নিয়ে মেতে রইলেন। যেজন্য সাধন আরম্ভ করেছিলেন, সেসব ভুলে সাধনার বিকৃত অবস্থায় নিজেকে নিয়োগ করলেন। এই বিরোধীভাবেই বলা হয় ব্যভিচার। আর এই ব্যভিচারের  ফল জন্ম-জন্মান্তর ধরে ভোগ করতে হয়। 

উৎসন্ন কুল ধর্ম্মানাং মনুষ্যানাং জনার্দ্দন 
নরকে নিয়তং বাসো ভবতি ইতি অনুশুশ্রুম। (৪৩) 

হে জনার্দ্দন, যাদের কুল ধর্ম্মাদি নষ্ট হয়ে গেছে, সেইসব মানুষের চিরদিন নরকবাস হয়ে থাকে - এইরকমই আমরা শুনেছি। 

আমরা কুল-ধর্ম্ম  বলতে বুঝি আমাদের পারিবারিক ধারা। কিন্তু সাধন জগতে যোগীর ধর্ম্ম হচ্ছে সর্বদা আত্মাতে স্থিত থাকা। আবার যিনি সদাই আত্মাতে স্থিত থাকেন, তার পক্ষে বাইরের কুলধর্ম্ম পালন সবসময় শুধু অসম্ভব নয়, অপ্রয়োজনীয়ও বটে। সাধনায় যাঁরা মশগুল থাকেন, তাদের বাহ্যিক ক্রিয়াকর্ম্ম এমনকি জীবধর্ম্মও ঠিক ঠিক ভাবে রক্ষিত হয় না। তিনি যে এগুলোকে ইচ্ছে করেন, বা অশ্রদ্ধা ভ'রে করে থাকেন, তা নয়। আসলে এই অবস্থায়, কোনো কুলধর্ম্মই পালনের অবস্থায় তিনি থাকেন না। জ্ঞানী পুরুষের এই স্বভাব। তিনি ইন্দ্রিয়াদি সংযমের মাধ্যমে বাহ্যিক  ক্রিয়াহীন হয়ে অবস্থান করেন। এই অবস্থায় বাক-সংযম হয়ে থাকে।  তাই তিনি কথা কম বলেন, এইসময় তাঁর ক্ষুধা-তৃষ্ণা রোহিত হয়ে যান। তিনি তখন অমৃতসুধা অর্থাৎ সাহস্রদল কমল থেকে নিঃসৃত সুধা পান করতে থাকেন। এসময় তার মধ্যে উন্মনা  ভাবের উদয় হয়। অথাৎ তাঁর সুষুম্না রন্ধ্রে প্রাণবায়ু সহজগতি প্রাপ্ত হয়। মনের স্থিরতা আসে। ইন্দ্রিয়সকল বাইরে বিচরণ না  করে, অন্তরে মধ্যে স্থিত হয়। বুদ্ধি প্রয়োগের ইচ্ছে থাকে না। বিষয়ভোগ বা তদজনিত চিন্তা থাকে না।    

অহোবত মহৎ পাপং কর্ত্তুং ব্যবসিতা বয়ম 
যৎ রাজ্যসুখলোভেন হন্তুং স্বজনং উদ্যতাঃ। (৪৪) 

হায়, আমরা রাজ্সুযখ লোভে স্বজনগনকে বিনাশ করতে উদ্যত হয়ে মহাপাপে প্রবৃত্ত হয়েছি।

অর্জুনের মনে হচ্ছে, রাজসুখ লাভের জন্য স্বজনদের বধ করবার মতো কোনো উদ্যোগ নেওয়া উচিত নয়।  এতে মহাপাপ হবে। আমরা জানি, সাধনার ফলে আমাদের অনেক যোগৈশ্বর্য্য লাভ হবে ঠিকই কিন্তু এতে দেহের ভোগ বা পার্থিব সুখভোগ করবার স্পৃহা নষ্ট হয়ে যাবে। তো সাধন ক্রিয়াতে লিপ্ত হলে, আমাদের সংসারসুখ দেহসুখ, ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টিতে যা সুখ সেই সুখের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। তাই আমাদের মতো সাধারন  মানুষের সাধনক্রিয়া শুরুর প্রথমেই এইসব বিপরীত বুদ্ধি এসে উপস্থিত হয়। 
            
যদি মাং অপ্রতিকারম অশস্ত্রং শস্ত্রপানয়ঃ
ধার্ত্তরাষ্ট্রা রণে হনু তৎ মে ক্ষেমতরং ভবেৎ। (৪৫) 

দি প্রতিকারে উদ্দম রোহিত হয়ে নিঃশস্ত্র অবস্থায় আমাকে শাস্ত্রধারী ধৃতরাষ্ট্র পুত্রগণ হত্যাও করে, তাতে আমার অধিকতর মঙ্গলই হবে। 
 ইন্দ্রিয় ধর্ম্মে আসক্তি জনিত সুখ জীবের চরম প্রাপ্তি। আমরা টাকা পয়সা, ধন দৌলত, স্ত্রী-পুত্র,আত্মীয় পরিজন নিয়ে সুখে ঘরকন্না করতে চাই। মনের নানান রকম চাহিদা পূরণ হলেই আমাদের ভালো লাগে। লোভ-লালসা-বাসনা-কামনা-সংকল্প-বিকল্প ইত্যাদি বিষয়গুতে আমাদের আত্মসমর্পন করতে আমাদের ভালো লাগে। তখন মনে হয়, গোল্লায় যাক এই কঠোর সাধন জীবন। এগুলোকেই বদ্ধ জীবে হিতকর বলে মনে করে। আমাকে অনেকেই বলেছেন, আমি ভগবানকে চাই না, কিসে টাকা-পয়সা আসবে সেটা বলুন। পেতে ক্ষিদে নিয়ে ভগবানের পাশে বসে থাকে কার ভালো লাগে ? তো এটাই বদ্ধ জীবের দশা। এটাই ইন্দ্রিয়শক্তির মহিমা। এখন থেকে বেরুনো কঠিন।   

সঞ্জয় উবাচ : 
এবম উক্ত অর্জুনঃ সংখ্যে রথোপস্থ উপাবিশৎ  
বিসৃজ্য সশরং চাপং শোক-সংবিগ্ন-মানসঃ। (৪৬)

সঞ্জয় বললেন : 
শোকাকুল অর্জুন এই কথা বলে ধনুর্বান ত্যাগ করে রথের  উপরে বসে পড়লেন। 

মনের মধ্যে যখন শোক, উদ্বিগ্নতা বাসা বাধে তখন সাধনার কথা ভালো লাগে না। সাধনে স্থির হওয়াও যায় না। এইসময় মেরুদন্ড শিথিল হয়ে যায়। উৎসাহে ভাটা  পড়ে। মন হয় বিক্ষিপ্ত। আর মেরুদন্ড যখন শিথিল হয়, তখন প্রাণবায়ু ঠিক পথে পরিচালিত না হয়ে অর্থাৎ উর্দ্ধগামী না হয়ে নিমাভিমুখী হয়ে যায়। একেই বলে হাত থেকে ধনুক খসে পড়া। শোক হচ্ছে আমাদের তমঃগুণের কাজ।  তমোগুণের বৃদ্ধি  হলে শোক, নিদ্রা, আলস্য শঙ্কা চিত্তকে  ঘিরে ধরে। এইসময় গুরুকৃপা আবশ্যক। ভাগ্যবানের গুরু জোটে, আর দুর্ভাগার গতি হয় নিম্নগামী। জন্ম-জন্মান্তর ধরেই জীব এইভাবের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। 

শ্রীমদ্ভগবৎ গীতার প্রথম অধ্যায় বিষাদযোগে এখানেই শেষ হলো। 
----------------------------------