Thursday 28 March 2019

নরেন ঠাকুরের গুরুলাভ


নরেন ঠাকুরের গুরুলাভ

পণ্ডিত উইলিয়ম  হেস্টি সাহেব ইংরেজী পড়াচ্ছেন।  কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর "একস্কার্শন" । কিভাবে প্রকৃতির সৌন্দর্য্য অনুধাবন করতে করতে কবির মন অতীন্দ্রিয় রাজ্যে চলে যায়। ছাত্ররা এই অতীন্দ্রিয় রাজ্যটা যে কি তা ধরতে পারছেন না। আর সেখানে কি বা কিভাবে অনুভূত হয়, সেটাও বুঝতে পারছিলো না। সাহেব মাস্টার,  রেগে গেলেন, ছাত্ররা বুঝতে পারছে না দেখে। বোঝাবার জন্য বললেন, আমি এই কলকাতায় এমন একজনকে দেখেছি, যিনি এই অনুভূতি সম্পন্ন। তিনি দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ পরমহংস। নরেন, সেই ক্লাসের ছাত্র, সেও কথাগুলো শুনছিলো। তারপর ভুলেও গেছিলো।

একদিন ১৮৮১ সালের নভেম্বর মাসে, সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়ি থেকে ডাক এলো, একটা ছোট্ট অনুষ্ঠানে গান করবার জন্য। আসলে সেখানে যার গান গাইতে আসার কথা ছিল, সে আসেনি।  তাই নরেনের ডাক পড়েছে। নরেনের গলা ভালো। গায়ও  ভালো। ও মাঝে মাঝে ব্রাহ্ম সমাজে গান গায়। তো নরেন  সেখানে একটা ভজন গাইলো। সেখানে হাজির ছিলেন, দক্ষিণেশ্বরের শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ। নরেনের গানের তন্ময়তা, আবেগ, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণকে আকৃষ্ট করলো। নরেন, হেস্টি সাহেবের দেখা শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসকে দেখলো। এই প্রথম দেখা। 

দক্ষিণেশ্বরে প্রথম দিন : 
এর পর ১৮৮১ পৌষ মাস, অর্থাৎ ডিসেম্বর-এর শেষ, নরেনের বয়স তখন সবে ১৮ । ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথায় (ভাষা লেখক স্বামী সারদানন্দ কর্তৃক মার্জিত) শুনুন, " পশ্চিমের (গঙ্গার দিক) দরজা দিয়ে নরেন্দ্র প্রথম দিন এই ঘরে, ঢুকেছিলো।  দেখলাম নিজের শরীরের দিকে লক্ষ্য নেই, মাথার চুল ও শরীরের বেশভূষার  পারিপাট্য নেই।  বাইরের কোনো পদার্থেই ইতর - সাধারণের মতো একটা আঁট নাই। সবই যেন তার আলগা, এবং চোখ দেখে মনে হলো, তার মনের অনেকটা ভেতরের দিকে কে যেন সর্বদা টেনে রেখেছে। দেখে মনে হল, বিষয়ী লোকের আবাস এই কলকাতা, এখানে এতবড় সত্ত্বগুণী আধার থাকাও সম্ভব ?গান গাইবার কথা জিজ্ঞেস করে জানলাম, বাংলা গান সে দুচারটি মাত্র শিখেছে, তাকে গাইতে বললাম।

এর পরে, নরেন কি বলছেন শুনুন, - গান তো গাইলাম, তারপরেই ঠাকুর উঠে আমার হাত ধরে, তার ঘরের উত্তরে যে বারান্দা আছে, সেখানে নিয়ে গেলেন। শীতকাল, উত্তরের হাওয়া নিবারণের জন্য, বারান্দাটি ঝাঁপ দিয়ে ঘেরা ছিলো, সুতরাং ভিতরে ঢুকে ঘরের দরজাটি বন্ধ করে দিলে, ঘরের ভিতরের বা বাইরের কোনো লোককে দেখতে পাওয়া যেত  না। বারান্দায় ঢুকে, ঠাকুর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন, ভাবলাম, আমাকে বুঝি  নির্জনে কিছু উপদেশ  দেবেন। কিন্তু যা বললেন, ও করলেন, তা আমার কল্পনার অতীত। সহসা আমার হাত ধরে, দরদরিতধারে, আনন্দ অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। এবং পূর্ব পরিচিতের ন্যায় পরম স্নেহে বললেন : এতদিন পরে আসতে হয় ? আমি তোমার জন্য কিভাবে প্রতীক্ষায় রয়েছি, তা একবার ভাবতে নেই ? বিষয়ী লোকের বাজে প্রসঙ্গ শুনতে শুনতে আমার কান ঝলসে যাবার উপক্রম হয়েছে। প্রাণের কথা কাউকে না বলতে পেরে, আমার পেট ফুলে রয়েছে - ইত্যাদি অনেক কথা বললেন, ও কাঁদতে লাগলেন। এর পরেই, আবার আমার সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে, দেবতার মতো আমাকে সম্মোধন করে বলতে লাগলেন, জানি আমি প্রভু, তুমি সেই সনাতন ঋষি নবরূপী নারায়ণ, জীবের দুর্গতি নিবারণ করতে, পুনরায় শরীর ধারণ করেছো। .......ইত্যাদি ইত্যাদি। .
স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন,  আমিতো তার এই আচরণে একেবারে নির্বাক-স্তম্ভিত। মনে মনে ভাবতে লাগলাম এ কাকে দেখতে এসেছি ? এতো একেবারে উন্মাদ। নাহলে বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র আমি, আমাকে এই সব কথা বলে ?...... যাইহোক,  খানিক্ষন পরে, ঘর থেকে বেরিয়ে মাখন, মিছরি ও কয়েকটা সন্দেশ এনে, আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে লাগলেন।  আমি যত বলি, খাবারগুলো আমাকে দিন, আমি সঙ্গীদের সাথে ভাগ করে খাইগে, তিনি আমার কথা শুনলেন  না। ওরা  খাবেখন, তুমি খাও। বলে সব খাবার আমাকে খাইয়ে তবে নিস্তার।

দক্ষিনেশ্বর-এ  দ্বিতীয় দিন :
বিবেকানন্দ বলছেন, জিজ্ঞেস করতে করতে দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছলাম এবং একেবারে ঠাকুরের গৃহে উপস্থিত হলাম। দেখলাম, তিনি ছোট খাটখানির উপরে, একাকী বসে আছেন।  নিকটে কেউ নেই। আমাকে দেখা মাত্র সাহ্লাদে নিকটে ডেকে,খাটের একপ্রান্তে এসে বসলেন।বসবার পরেই তিনি যেন কেমন ভাবে আবিষ্ট হয়ে পড়লেন।  এবং অস্পষ্টস্বরে নিজে নিজে কি বলতে বলতে স্থির দৃষ্টিতে আমাকে লক্ষ করে ধীরে ধীরে আমার দিকে সরে আসতে  লাগলেন।  বিবেকানন্দ বলছেন, ভাবলাম পাগল বুঝি আগের দিনের মতো আবার পাগলামি করবে।  এই ভাবতে ভাবতে তিনি সহসা আমার নিকটে এসে  নিজের ডান পা আমার অঙ্গে স্থাপন করলেন। সেই স্পর্শে, মুহূর্তের মধ্যে আমার এক অপূর্ব উপলব্ধি উপস্থিত হলো। চেয়ে দেখলাম দেয়ালগুলোর সাথে ঘরের সমস্ত বস্তু বেগে ঘুরতে ঘুরতে কোথায় লিন হয়ে  যাচ্ছে। সমস্ত বিশ্বের সাথে আমার আমিত্ব যেন এক সর্বগ্রাসী মহা শুন্যে একাকার হতে ছুটে চলেছে। তখন দারুন আতঙ্কে অভিভূত হয়ে পড়লাম। মনে হল , আমিত্বের নাশেই মরণ। সেই মরন আমার সামনে, অতি নিকটে। সামলাতে না পেরে চিৎকার করে উঠলাম। ওগো তুমি আমার এ কি করলে ? আমার যে বাপ্-মা আছেন।  বিবেকানন্দ বলছেন, অদ্ভুত পাগল আমার এই কথা শুনে, খিল খিল করে হেসে উঠলেন। এবং হাত দিয়ে আমার বুক স্পর্শ করতে করতে বললেন, তবে এখন থাক, একবারে কাজ নেই, কালে হবে।  আশ্চর্য্যের বিষয়, তিনি এইভাবে স্পর্শ করে ঐ কথা বলামাত্র আমার সেই অপূর্ব প্রত্যক্ষ একেবারে চলে গেলো। আমি প্রকৃতিস্থ হলাম। ঘরের ভেতরের  ও বাইরের সব জিনিষকে আবার আগের মতো অবস্থিত দেখতে পেলাম ।

একেই বলে জাগতিক অথচ অলৌকিক দীক্ষা। ভালোবাসা প্রেম ও আধ্যাত্মিকতার এক অপূর্ব মিশ্রণ।আমরা জানি স্বামী বিবেকানন্দ শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে সমস্ত বিশ্বে নিজেকে প্রতিভাত করেছেন। ভারতবাসীকে জগৎসভায় উচ্চ স্থান করে দিয়েছেন। শিবজ্ঞানে জীব সেবায় লক্ষ লক্ষ লোককে উদ্বুদ্ধ করেছেন।  আজ সেই ধারা সামনে চলছে।

কিন্তু বিবেকানন্দ কি ভেবেছিলেন বা তখন কি চিন্তা করেছিলেন, শুনুন - স্তব্ধ হয়ে ভাবতে লাগলাম, এটা কি হলো ? নিজেই দেখলাম তো, এই অদ্ভুত দর্শন,  এই অদ্ভুত পুরুষের প্রভাবে একবার সহসা উপস্থিত হলো, আবার সহসা লয়  হয়ে গেলো। মেসমেরিজিম বা মোহিনী বিদ্যা এবং হিপ্নোটিজম বা সন্মোহন বিদ্যা সন্মন্ধে পড়েছি। ভাবতে লাগলাম, এটা কি সেই রকম একটা কিছু ? কিন্তু ঠিক মেনে নিতে পারলাম না। কারন দুর্বলচিত্তর  মানুষের উপরেই এইসব বিদ্যা প্রয়োগ করা যায়। আমি তো দুর্বল নোই।  আমি তো বুদ্ধিমান, মানসিক বলসম্পন্ন।  সাধারণ মানুষেরা গুণশালী পুরুষের সঙ্গলাভে মোহিত হয়, এবং তাদের হাতের পুতুল হয়ে পড়ে, আমি তো তা নোই।  বরং প্রথম থেকেই এঁকে অর্ধউন্মাদ বলেই নিশ্চিত করেছি।  তাহলে এমনটি হবার কারন কি ? কিছুই ভেবে স্থির করতে পারলাম না। মনের মধ্যে প্রাণের মধ্যে একটা গোল বেঁধে রইলো। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করলাম, ভবিষ্যতে যেন আমার মনের উপরে, এই অদ্ভুত পাগল যেন প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। আবার ও ভাবলাম, ইচ্ছা মাত্রই এই পুরুষ যদি আমার মতো প্রবল ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন মানুষকে ভেঙেচুরে কাঁদার তালের মতো নিজের ভাবে ভাবিত করতে পারে, তবে এঁকে পাগলই বা বলি কি করে ?

তাহলে বুঝুন, বিশ্বনাথের শ্রেষ্ট সন্তান, যারা জন্ম নেন লোকশিক্ষার জন্য, তার মনেই গুরু সম্পর্কে সন্দেহ। ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষকে চেনা কত শক্ত।  তো শঙ্করাচার্য যে বলছেন, গুরু হবে ব্রহ্মজ্ঞানী।  তাকে চেনা আমাদের মতো সাধারণের পক্ষে কত শক্ত।

আরো  আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই বিবেকানন্দ একসময় পাওহারীবাবার  কাছে দীক্ষা নেবার জন্য গিয়েছিলেন। সেই ঘটনাটা একটু বলবো।

আমরা জানি শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের তিরোধানের পরে, স্বামী বিবেকানন্দ উত্তরভারতে বেশ কিছুদিন পরিভ্রমন করেছিলেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পারে, বিবেকানন্দের অন্তরে এক বিষম বিরহ জ্বালা ভোগ করছিলেন।  কোথাও শান্তি পাচ্ছিলেন না। ১৮৯০ সালের শীতকালে, একদিন স্বামীজী কাশী থেকে যাত্রা করে গাজীপুর পৌঁছলেন। উদ্দেশ্য পওহারী বাবার দর্শন। তখন উত্তর ভারতে  পওহারীবাবার খুব নামডাক।  স্বামীজীও ভাবলেন, যদি পওহারীবাবার চরণতলে বসে অমৃতময় জীবন লাভ করা যায়।

গাজীপুরে,সময় বিবেকানন্দ দশ/বারো দিন কাটানোর পরে, স্বামীজী লিখছেন, " বহু ভাগ্যফলে বাবাজির সাক্ষাৎ হয়েছে। ইনি অতি মহাপুরুষ - বিচিত্র ব্যাপার, এই নাস্তিকতার দিনে ভক্তি এবং যোগের অত্যাশ্চার্য্য ক্ষমতার নিদর্শন। আমি এনার শরণাগত হয়েছি, আমাকে আশ্বাসও দিয়েছেন, যা সকালের ভাগ্যে জোটে না। "

শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কথা পওহারীবাবা জানতেন। তারই  প্রধান শিষ্যকে পেয়ে, পওহারীবাবাও কম পুলকিত নন। কিছুদিনের মধ্যেই উভয়ের মধ্যে অন্তরঙ্গ ভাব  সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পওহারীবাবা  যে মাটির গুহার মধ্যে থাকতেন, তার সামনে গিয়ে বিবেকানন্দ বসে থাকতেন। আসলে অধ্যাত্ম জীবনে স্থিত হবার আগেই স্বামীজী ঠাকুরকে হারিয়েছেন।  ভাবছেন, নিশ্চয়, ঠাকুরের কৃপাতেই তার পওহারীবাবার  দর্শন হয়েছে। বাবাজির কাছে থেকে নিগূঢ় যোগ সাধনায় দিন কাটাবেন বলে ঠিক করে ফেললেন। দীক্ষার জন্য, বাবাজির কাছে নিবেদন করতে, বাবাজি রাজি হয়ে গেলেন। দিন ক্ষণ ঠিক হয়ে গেলো।
গভীর রাতে, স্বামীজী বাবাজির গুহাতে বসে ধ্যান ধারণা করতেন। কিন্তু নিজের মনের দ্বন্দ কাটেনি।  শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ না পওহারীবাবা ? কে পথ দেখাবে ? এমনি এক সন্ধ্যায় সহসা অন্ধকারময়  ঘর দিব্যালোতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো শ্রী শ্রী ঠাকুরের মুখখানি ।  স্বামীজী তাকিয়ে দেখলেন, শ্রীশ্রী ঠাকুরের মুখ অশ্রুসিক্ত। যেন ভর্ৎসনা করছেন। পরপর কয়েক রাতে, একই  দৃশ্য দেখতে লাগলেন তিনি। এর পর আর তার পওহারীবাবার  কাছ থেকে দীক্ষা নেওয়া হয়নি।  কিন্তু স্বামীজী পওহারীবাবাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন। এবং স্বামীজীর কাছে ঠাকুরের পরেই স্থান ছিল পওহারীবাবার।

যেটা বলছিলাম, দেহধারী গুরু পাওয়া যেমন ভাগ্যের ব্যাপার, তেমনি তাকে ঠিক ঠিক চেনা আমাদের কথা ছাড়ুন, বিবেকানন্দের মতো মহাপুরুষের পক্ষেও কতটা শক্ত ছিল, তা বুঝতে পারছেন নিশ্চয়।  তাই আমরা বলবো, বিবেকের নির্দেশে চলুন, পরমপিতা, আপনার বিবেকের মাধ্যেমেই গুরুবাক্য শোনাবেন। 

আজ এই পর্যন্ত।

ও নমঃ শিবায়ঃ, 
ওম নমঃ শ্রী ভাগবতে বাসুদেবায়ঃ, 
ওম পরমপিতা পরমেশ্বরায়ঃ নমঃ।      




 




















                


Wednesday 20 March 2019

সনাতন ক্ষত্রিয়দের বংশ রক্ষার ধৰ্ম কি ও কেন - দীর্ঘতমাঃ-র আখ্যান

Image result for sasanka sekhar peace foundationদীর্ঘতমাঃ-র আখ্যান 


সনাতন ক্ষত্রিয়দের  বংশ রক্ষার ধৰ্ম  কি ও কেন এই ব্যাপারে, মহাবীর ভীষ্ম কি বলেছিলেন, আমরা একটু দেখে নেবো। ভীষ্মের বিমাতা সত্যবতী, তার  পুত্র বিচিত্রবীর্যের যক্ষারোগের কারনে  মৃত্যুতে শোকাতুর হয়ে পড়লেন। শুধু শোকাতুর হয়ে পড়লেন না। কুরু বংশ কি ভাবে রক্ষা পাবে, সেই ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কেননা ভীষ্ম তো বিয়ে করবে না। বিচিত্রবীর্য অকালে মারা গেলেন। এখন কি হবে।  তাই অন্য কোনো উপায় না দেখে, ভীষ্মকে ভ্রাতৃবধূদের বিয়ে করে, সন্তান উৎপাদন করতে বললেন । কিন্তু  ভীষ্ম রাজি হন না। আর ভীষ্ম  রাজি না হওয়াতে  শেষমেশ সত্যবতী তার  কুমারী অবস্থায় পরাশরের বীর্যে  প্রথম পুত্র ব্যাসদেব বা দ্বৈপায়নকে  দিয়ে ধৃতরাষ্ট্র, পান্ডু, ও বিদুরের জন্ম প্রক্রিয়া চালালেন।

পরশুরাম কর্তৃক পৃথিবী  একুশবার নিঃক্ষত্রিয় হয়েছিল। বিনাশ-উন্মুখ এই ক্ষত্রিয়কূল কি ভাবে তাদের বংশ রক্ষা করেছিলো ? সেই গল্প শুনুন। মহাভারতের আদিপর্বে এই কাহিনীর উল্লেখ পাই।

পেটে সন্তান এলেই তা তার পানিগ্রহীতা স্বামীর সন্তান  বলেই গণ্য  হবে। এটাই সনাতন ধর্ম্ম। সেই সনাতন ধর্ম্ম স্মরণ করে ক্ষত্রিয়পত্নীরা ব্রাহ্মণদের সঙ্গে মিলিত হতেন।  আর এ ভাবেই, ক্ষত্রিয়দের পুনর্ভাব সম্ভব হয়েছে। এই নীতির কি ভাবে প্রচলন হলো সে সম্পর্কে একটা সুন্দর কাহিনী আছে।

পুরাকালে,  উতথ্য নামক  এক মহর্ষি ছিলেন। তার পত্নীর নাম মমতা। উতথ্যের  ভাইয়ের নাম ছিল বৃহস্পতি।  ইনি আবার দেবতাদের পুরোহিত। তিনি একদিন মদনাতুর হয়ে মমতার নিকট আসলেন। মমতা বললো, হে দেবর, আমি তোমার বড় ভাইয়ের দ্বারা গর্ভবতী হয়েছি। অতএব, তোমার এই রমনেচ্ছা সম্বরন করো। আমার পক্ষে, দুই সন্তানকে একসাথে গর্ভে ধারণ করা সম্ভব নয়। বৃহস্পতি, অর্থাৎ দেবপুরহিত মমতার অসম্মতিতেই বলপূর্বক ধর্ষণ করতে লাগলো। এখন গর্ভস্থ শিশু সন্তান, চেঁচামেচি শুরু করে দিলো। বললো আমি আগে এসেছি।  এই ছোট্ট কুক্ষিতে দুইজনের স্থান হবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা।  বৃহস্পতি তার রমন ক্রিয়া চালিয়ে যেতে লাগলো। এবং অবশেষে বীর্যপাত করে ফেললো। এদিকে, গর্ভস্থ সন্তান করলো কি, পা দিয়ে শুক্রের পথ অবরোধ করে বসলো। এখন শুক্র গর্ভে প্রবেশ পথ না পেয়ে, মাটিতে পড়ে গেলো। এই না দেখে, বৃহস্পতি, রাগে গড়গড় করতে লাগলো। আর এই সব ঋষিরা যা করে থাকে, তাই করলো অর্থাৎ অভিশাপ দিলো। বললো, তুই সারা জীবন অন্ধ হয়ে থাকবি। এই অন্ধ পুত্রর নাম  দীর্ঘতমাঃ, যিনি পরবর্তীকালে, প্রদ্বেষী নামে এক ব্রাহ্মণকন্যার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ও  গৌতম প্রভৃতি পুত্রের জন্ম দান করেন। এবং গোচারণে প্রবৃত্ত হলেন। এখন দীর্ঘতমাঃ যেহেতু গোচারনে লিপ্ত থাকে, ব্রাহ্মণরা তাকে পরিত্যাগ করলো। এমকি তার স্ত্রীও  তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে লাগলো। স্ত্রী প্রদ্বেষী, কেন খারাপ ব্যবহার করছে, সেকথা জিজ্ঞাসা করাতে, প্রদ্বেষী বললো - তুমি আমার, এবং পুত্রদের ভরণ পোষন করতে পারো না। সবই আমাকে করতে হচ্ছে। আমার দ্বারা আর  তোমার সন্তানদের দেখাশুনা করা সম্ভব নয়। এসব করতে গিয়ে আমি অত্যন্ত ক্লান্ত।  আর পারছি না। দীর্ঘতমাঃ এসব শুনে বুঝতে পারলো, ও এখন অন্য পুরুষের সঙ্গে থাকতে চায়। একথা শুনে, দীর্ঘতমাঃ খুব দুঃখ পেলো, ও স্ত্রী প্রদ্বেষীকে  অভিশাপ দিলো। বিধান দিলো - পতি জীবিত থাকতে, অথবা মারা গেলেও  যদি নারী অন্য পুরুষের ভজনা করে, তাহলে অবশ্যি সে পতিতা হবে। এবং স্বামীর সম্পত্তিতে তার কোনো অধিকার থাকবে না। একথা শুনে, প্রদ্বেষীর রাগ আরো বেড়ে গেলো। সে তার পুত্র গৌতম ইত্যাদিদের বললো ব্যাটা বুড়োকে দড়ি দিয়ে ভেলায় বেঁধে নদীতে বিসর্জন  দাও। লোভ মোহাভিভূত পুত্রগণ তাই করলো।

দীর্ঘতমাঃ ভেলাকে আশ্রয় করে ভাসতে ভাসতে চলতে লাগলো। এদিকে, পুত্রহীন রাজা বলি গঙ্গা স্নানে এসে দেখেন, ভেলায় বাঁধা এক অন্ধ পুরুষ। তার দয়া হয় এবং  দীর্ঘতমাকে সঙ্গে করে প্রাসাদে  নিয়ে যান।
সেখানে তিনি রানী সুদেষ্ণাকে তার সেবা যত্নের দায়িত্ব দিয়ে  রাখেন। একে অন্ধ, তার আবার বৃদ্ধ, সুদেষ্ণার একেবারেই পছন্দ নয়।  তিনি এক দাসীকে তার সেবা যত্নের জন্য রেখে দিলেন। এই শুদ্র দাসীর গর্ভে সন্তান এলো। রাজা ভাবলেন, এরা  সবাই সুদেষ্ণার  পুত্র। অর্থাৎ বলি রাজার বিবাহিত স্ত্রীর পুত্র। এই শুদ্রযোনিতে কার্ক্ষীবৎ প্রভৃতি এগারোজন পুত্রের জন্ম হয়েছিলো। রাজা বললেন, এরা আমার পুত্র। দীর্ঘতমাঃ বললো না এরা  তোমার পুত্র নয়। তখন রাজা বলি আবার সুদেষ্ণাকে ওই বৃদ্ধের কাছে  পাঠালো পুত্র উৎপাদনের জন্য। এবার সুদেষ্ণার গর্ভে যারা জন্ম নিলো তারা হলো অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র, ও  সুহ্ম।  এরা  যেখানে রাজত্ব করতো এদের নাম অনুসারে সেই পাঁচটি রাজ্যের নাম হয়েছিল - অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র ও সুহ্ম। এইভাবে বলি রাজার বংশ বিস্তার হয়েছিল। এবং ব্রাহ্মণগণ দ্বারাই  পৃথিবীতে ক্ষত্রিয় কুলের বিস্তার হয়েছিল।

মহাভারতের যুদ্ধের পরেও দেখি,

সমাপ্ত





 





















          

Sunday 17 March 2019

স্বর্গলোক - পরাবিদ্যা swrgalok o manab deh

স্বর্গলোক - পরাবিদ্যা 
ওঁ সহ নাববতু।  সহ নৌ ভুনক্ত্ু। সহ বীর্যং করবাবহৈ।
 তেজস্বি নাবধীতমস্ত্ু মা  বিদ্বিষাবহৈ।।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।
স্বর্গ বা স্বর্গলোক আমাদের কাছে  খুবই পরিচিত শব্দ। স্বর্গ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহও  কম নয়।
কিন্তু স্বর্গ আসলে ব্যাপারটা কি ও কেমন তা আমরা কেউ জানিনা। আজ আমরা সেই স্বর্গ সম্পর্কে শুনবো, পরাবিদ্যা-বিদদের কাছ থেকে। আমার মতো যারা অজ্ঞানী, অবিশ্বাসী, প্রতক্ষ্য জ্ঞানে যাদের আস্থা, তাদের অপেক্ষা করতে হবে মৃত্যু পর্যন্ত এই জ্ঞান পাবার জন্য।  মৃত্যুর পরেও তা অধরা  থাকবে।  শতকোটি জন্ম-মৃত্যুর পরে, এই জ্ঞান পাওয়া সম্ভব হতে পারে ।  এই দুর্লভ জ্ঞান আমরা পরাবিদ্যাবিদদের কাছ থেকে শুনবো।  

আমরা জানি, জানিনা বলা যেতে পারে শুনেছি, যে সাতটি  লোক আছে।  আর সেগুলো হচ্ছে,  ভুর্লোক , ভুবর্লোক  , স্বর্লোক, মহর্লোক, জনলোক, তপলোক ও সত্যলোক। এছাড়া সাতটি তল আছে।  অতল, বিতল, সুতল, তলাতল, রসাতল, পাতাল, মহাতল। এর মধ্যে আমরা যেখানে বাস করছি, অর্থাৎ ভূর্লোক বাদে আর সবই আমাদের কাছে অগোচর। 

আর এই ৭টি লোক এবং ৭টি  তলের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে স্বর্গলোক। আমাদের শোনা কথা হচ্ছে, সেখানে নাকি কোনো দুঃখ নেই। অপ্সরীরা সেখানে নেচে-গেয়ে স্বর্গাবাসীদের আনন্দ দেয়।  কল্পবৃক্ষ আছে  সেখানে, তার কাছে যা চাওয়া যায়, তাই পাওয়া যায়। শ্রীকৃষ্ণ এককালে, অর্জুনকে যুদ্ধে উৎসাহ দেবার জন্য, বলেছিলো, তুমি স্বর্গে যেতে পারবে না, যদি না তুমি যুদ্ধ করো। অর্থাৎ মানুষের কাছে এটা  একটা  লোভনীয় জায়গা। এখানে নাকি যুধিষ্ঠির এই সশরীরে  চলে গিয়েছিলো। যাই হোক আমরা এই স্বর্গ সম্পর্কে শুনবো, পরাবিদ্যা-বিদদের কাছ থেকে।

কিন্তু স্বর্গ সম্পর্কে বুঝতে গেলে আগে আমাদের এই দেহটাকে একটু বুঝতে হবে।

আমাদের এই দেহ অসংখ্য স্তরে বিভক্ত। অসংখ্য বলতে আমরা যেহেতু কিছুই বুঝতে পারি না।  তাই বুঝবার সুবিধার জন্য  এই দেহকে আমরা পাঁচটি ভাগে ভাগ করতে পারি। ১. অন্নময় , ২. প্রাণময়,
৩. মনোময়, ৪. বিজ্ঞানময়, ও ৫. আনন্দময়। এর মধ্যে অন্নময় দেহ স্থুল, প্রাণময় ও মনোময় সূক্ষ্ম। এই তিনটি দেহকেই একত্রে বলা হয় ভৌতিক দেহ। বিজ্ঞানময় ও আনন্দময় দেহ অভৌতিক দেহ। আমাদের স্বর্গ ব্যাপারটা বুঝতে গেলে প্রথম তিনটি দেহ অর্থাৎ অন্নময়, প্রাণময় ও মনময় দেহ সম্পর্কে একটু ভালোভাবে বুঝতে হবে।

অন্নময় দেহ   : আমরা আমাদের যে দেহটা দেখতে পাই সেটা অন্নময় অর্থাৎ খাদ্য দ্বারা গঠিত ও খাদ্যদ্বারা পরিপুষ্টি লাভ করে। এটি স্থূল দেহ।
এর পরে আছে প্রাণময় দেহ যা আমাদের বাতাস থেকে সংগৃহিত উর্জা শক্তি দ্বারা গঠিত। সবশেষে মনোময় দেহ যা আমাদের কামনা বাসনা আবেগ দ্বারা গঠিত। এই দুটো দেহকে সুক্ষ দেহ বা লিঙ্গদেহ  বলা হয়।
এর পরে আছে কারন দেহ অর্থাৎ বিজ্ঞানময় ও আনন্দময় দেহ। আত্মা সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই বললেই চলে। আত্মা আছে, এটা বুঝি বা স্বীকার করি, কিন্তু কি সে বস্তূ তা আমরা জানিনা। আমাদের বুঝবার সুবিধার জন্য একে আমরা জ্ঞান বা চৈতন্য বলতে পারি। এই আত্মার অবস্থানের জন্য বা বসবাস করবার জন্য, অদৃশ্য উপকরণে তৈরী, আমাদের একটি দেহ আছে, তাকে বলা হয় কারন দেহ। এই দেহ লিঙ্গহীন। আমাদের চিন্তা, মনের ভাব ইত্যাদির উৎপত্তি স্থান হচ্ছে এই কারন দেহ। মানুষের যে দেহ যখন সক্রিয় থাকে, তখন সে সেই ভাব পোষন করে। এবং কারন দেহে যিনি বাস করেন, তিনিই সেই অজর, অমর, শাশ্বত আত্মা। অর্থাৎ প্রতিবিম্বিত পরম-আত্মা। আবার বলি এই কারন দেহেই পরম-আত্মা প্রতিফলিত হন। সূর্য যেমন সৌরজগতের সবকিছুর মধ্যে প্রতিফলিত হন ও বিকশিত করেন, তেমনি পরম-আত্মা শতকোটি ব্রহ্মাণ্ডে প্রতিফলিত হচ্ছেন। শেষে একটা কথা বলি, আমাদের পাঁচটি দেহেরই উপকরণ সূক্ষ্ম। সূক্ষ্মের ঘনত্ত্ব যখন বৃদ্ধি পায় তখন তাকে আমরা স্থূল বলি, অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় ।

আমাদের স্থূল শরীর  যখন ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যায়, তখন আমাদের অহং অর্থাৎ আমরা  কামদেহে অবস্থান করি। অর্থাৎ স্থূল দেহের সাথে আমাদের অন্নময় ও প্রানময় দেহ লোপ পায় তখন আমরা কামদেহে অবস্থান করি। কামদেহ আর কিছু নয়, আমাদের মনোময় দেহের দুটি অংশ। একটা কামনাময় আর একটা বাসনাময়। কামদেহে আমরা ততক্ষনই অবস্থান করি, যতক্ষন আমাদের কামনা পূরণের প্রবৃত্তি থাকে।এই জগৎটাকে বলা হয় ভুবর্লোক। অর্থাৎ মৃত্যুর পরেই আমরা এই ভুবর্লোকে প্রবেশ করি।এই ভুবর্লোকের অবস্থান কাল শেষ হয়ে গেলে বা কামনা পূরণের অবস্থা না থাকলে, বা কামনা পূরণ  হয়ে গেলে, তবেই আমরা মনোময় শরীরের অন্য অংশের মধ্যে প্রবেশ করি। এই মনময় শরীরে সংকল্প সিদ্ধ করবার জন্য, অর্থাৎ বাসনা পূরণের জন্য আমাদের যে অবস্থা চলতে থাকে  তাকেই আমরা স্বর্গবাস বলি।

এখানে আমি দুটো শব্দ ব্যবহার করলাম, একটা হচ্ছে কামনা, আর একটা হচ্ছে বাসনা। আমাদের সাধারণের দৃষ্টিতে কামনা ও বাসনা একই অর্থ। আসলে কিন্তু তা নয়।  কামনা হচ্ছে আপন বা নিজের  সুখের নিমিত্ত ভোগে প্রবৃত্ত হওয়া।  আর বাসনা হচ্ছে সংকল্প বা কিছু করবার ইচ্ছে।

এবার আমরা মূল আলোচ্য বিষয়ে যাবো। পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন :

কামনার লোক হতে মানুষ  স্বর্গলোকে গমন  করে। 

আমাদের কামদেহ  যে স্তরে কাজ করে, তাকে বলা হয় কামলোক।  আর মানস দেহের্ যে অবস্থা  বা যে স্তরে সংকল্প  কাজ করে তাকে বলা হয় স্বর্গলোক। 

মানুষ মৃত্যুর পরে,   প্রথমে কিছুদিন কামলোকে বা ভুবর্লোকে বাস করেন।  সেখানকার স্থিস্তিকাল শেষ হলে, জীব তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়েন। কামলোকের কোনো স্পন্দন গ্রহণ করবার উপকরণ তার দেহে না থাকার জন্য তার সংবিৎশক্তি অধিক পরিমানে অন্তর্মুখী হয়। এর ফলে কামলোকে সন্মন্ধে তার আর কোনো জ্ঞান থাকে না। মনোময় দেহের উপকরণগুলি সজ্জিত হওয়ায় মানসদেহ পরিপুষ্ট হয়, এবং জীব তখন কামদেহ ত্যাগ করে, মনোময় দেহ ধারণ করে এবং মানস লোকে উপনীত হয়। এই অবস্থাই স্বর্গলোকের নিম্নতর স্তর। 

এইখানে আমরা আবার একবার বলি  - সেটা হচ্ছে 

আমাদের দেহ পাঁচ প্রকার। অর্থাৎ অন্নময়, প্রাণময়, মনময়, বিজ্ঞানময়, আনন্দময়।   এর মধ্যে একটা স্থূল, দুটি সূক্ষ্ম  (এদের বলে ভৌতিকদেহ) মানুষের যে দেহটা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়, তা আসলে অন্ন দ্বারা গঠিত, অন্ন দ্বারাই পরিপুষ্ট। একেই আমরা স্থুল  দেহ বলি। এই দেহই  আমাদের সকল দোষ-গুনের আধার, এর পরে আর কিছু নেই এমন  ধারণা কিন্তু ঠিক নয়।মৃত্যুর পরে, আমাদের দোষ-গুন্ শেষ হয়ে গেলো, এমনটা নয়। মৃত্যুর পরেও আমাদের কর্মফল, আমাদের জ্ঞান, আমাদের স্মৃতি অর্থাৎ আমাদের সঞ্চিত দোষগুণ বা অর্জিত সংস্কার, প্রারব্ধ রূপে  আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। এসব বুঝতে গেলে আগে আমাদের দেহকে আগে বুঝতে হবে।

আমরা সবাই জানি, পঞ্চভূতের তৈরী  এই দেহ।  এই দেহ বিনষ্ট হয়ে গেলে, পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে। আমাদের আর একটা দেহ আছে, সেটা হচ্ছে সূক্ষ্মদেহ বা লিঙ্গদেহ। এই দেহে স্থুল কোনো উপকরণ নেই। আমাদের আবেগ, কামনা, বাসনা, প্রভৃতি সূক্ষ্ম উপকরণে এই দেহ গঠিত।

এই সূক্ষ্ম দেহের ভেতরে আছে আর একটি দেহ  তার নাম মানস দেহ।

এই মানস দেহের অভ্যন্তরে অতি সূক্ষ্ম উপকরণে  তৈরী, আরও  একটি দেহ আছে তার নাম কারণদেহ। এটাই আমাদের মন, বুদ্ধির আধার।

 আমাদের দেহ আসলে পঞ্চকোষের সমষ্টি।  এগুলো হচ্ছে, অন্নময় , প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময়, এবং আনন্দময়। পরা-বিদ্যাবিদগন একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছন।

ধরুন  জলের মধ্যে একটা স্পঞ্জের বল - স্পঞ্জের বল হচ্ছে আমাদের এই স্থুলদেহ, আর স্পঞ্জের মধ্যে যে জল সেটা হচ্ছে সূক্ষ্ম দেহ, আর জলের মধ্যে যে বাতাস সেটা হচ্ছে মনোময় দেহ। বাতাসের মধ্যে যে ইথার আছে সেটা হচ্ছে বিজ্ঞানময় দেহ,  আর ইথারের মধ্যে আরো সূক্ষ্ম পদার্থ বা গুন্  আছে তাকে বলা হয় আনন্দময় দেহ । অর্থাৎ আমাদের শরীরের সর্বত্র পরস্পরের মধ্যে ওতপ্রোত ভাবে সব দেহ একত্রে অবস্থান করছে।

অন্নময় কোষ : অন্ন অর্থাৎ খাবার, অন্নময়  কোষ মানে খাবার দিয়ে  তৈরি যে কোষ রয়েছে আমাদের শরীরে। আমরা তৈত্তিরীয় উপনিষদে দ্বিতীয় অধ্যায়ে পাই : আমরা সংস্কৃত বলতে যাবো না। বাংলায় শুনবো।  এখানে বলছেন, এই জগতে যত  প্রাণী আছে, সব খাদ্য থেকে উৎপন্ন। খাদ্য দ্বারাই তারা পুষ্ট হচ্ছে আবার খাদ্যতেই বিলীন হচ্ছে।মৃত্যুর পরে আমরা সবাই খাদ্য হয়ে যাই।

প্রাণময় কোষ : অর্থাৎ উর্জা শরীর।  এই শরীর বায়ুর শক্তিতে তৈরী। খাদ্য দ্বারা তৈরী আমাদের যে শরীর তার ভিতরে প্রাণময় শরীর। এটি বায়ু দ্বারা গঠিত।  এর আকারও অন্নময় দেহেরই মতো। উপনিষদ এঁকে একটা পাখির সঙ্গে তুলনা করেছে।  প্রাণবায়ু, অর্থাৎ যে বায়ু আমরা গ্রহণ করছি সেটি হচ্ছে এই কল্পিত পাখির মাথা, ব্যান  বায়ু অর্থাৎ যে বায়ু আমাদের সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে আছে তা  হচ্ছে  ওই পাখির ডান ডানা, অপান  বায়ু অর্থাৎ যে বায়ু আমরা ছেড়ে দিচ্ছি বা নিশ্বাস  তা হচ্ছে পাখির  বাম  ডানা, এর পরে আছে সমান বায়ু বা  আকাশ যা আমাদের খাদ্য পরিপাক করে, তা আছে আমাদের পাখিটির  মধ্যে ভাগে, এবং সব শেষে উদান বায়ু  বা পৃথিবী যা আমাদের দেহের ভারসাম্য রক্ষা করছে তা হচ্ছে পাখিটির লেজ। প্রাণ আমাদের একটিমাত্র অংশে রয়েছে তা নয়। এর অবস্থান দেহের সর্বত্র। এই দেহ আমাদের প্রাণ বায়ুতে পূর্ন। 

মনময়  কোষ : অর্থাৎ মানসিক শরীর, মনের চিন্তার জগৎ । প্রাণময় কোষের ভিতরে আছে মনোময় কোষ অর্থাৎ মনের স্তর। প্রাণময় কোষ যেমন অন্নময় কোষকে পূর্ণ করে রাখে তেমনি মনময় কোষ প্রাণময় কোষকে পূর্ন করে রাখে।

এই তিন শরীরকে  ভৌতিক শরীর  বলে। অন্নময়  শরীর স্থূল।  প্রাণময় শরীর  সূক্ষ্ম  ও মনময়  শরীর অতি সূক্ষ্ম।  কিন্তু এই তিন শরীর-ই  ভৌতিক। এই তিন শরীরের উপরেই আমাদের কর্মের প্রভাব পড়বে। স্থূল শরীর  অর্থাৎ অন্নময় কোষ দ্বারা গঠিত শরীরের উপরে যেমন  কর্মের ছাপ পড়বে।  তেমনি প্রাণময় ও মনময় শরীরের উপরেও কর্মের প্রভাব আছে। কর্ম-বন্ধন  এই তিন শরীরকে জুড়ে রেখেছে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, সিমেন্ট বা আঠার মতো কর্ম এই তিন শরীরকে জুড়ে রাখতে সাহায্য করে। কর্ম বন্ধন এই তিন শরীরকে জুড়ে রাখে। অর্থাৎ আমাদের কামনা বাসনা থেকে উদ্ভুত কর্ম এই শরীরকে সজীব রেখেছে।

এর পরে আছে :
বিজ্ঞানময় কোষ (বুদ্ধির স্তর ): এটি ভৌতিক নয় কিন্তু ভৌতিক শরীরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। মনোময় কোষ আবার বিজ্ঞানময় কোষ দ্বারা পূর্ন। বিজ্ঞানময় কোষও মানব-আকৃতি সম্পন্ন। এই কোষ মস্তকের প্রতীক। এই কোষে আমাদের শ্রদ্ধা অর্থাৎ ঋষিবাক্যের প্রতি  শ্রদ্ধা, ঋষিবাক্যের অর্থ মনন করা, সত্যকে উপলব্ধি করা, এবং আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা এর কাজ। আত্মাকে উপলব্ধি করতে গেলে আমাদের এই বিজ্ঞানময় কোষকে পুষ্ট করতে হবে। বিজ্ঞানময় কোষ বলতে বুদ্ধির স্তরকে বোঝায়। এটি আমাদের সিদ্ধান্ত নেবার বা সংকল্প গ্রহণ করার স্তর। মনোময় স্তরে অর্থাৎ আমাদের মনে সবসময় "করবো কি করবো না " এই সংশয় বা দ্বিধা থাকে।  এখান থেকে আমাদেরকে  বের করে নিয়ে আসে, এই বিজ্ঞানময় কোষ অর্থাৎ বুদ্ধির স্তর।  কোনোকিছুর সঠিক তাৎপর্য আমরা বুদ্ধির দ্বারাই বুঝতে পারি। শ্রদ্ধা, আত্মবিশ্বাস, সত্য, ন্য়য়পরায়ণতা, এবং যোগ বা একাগ্রতা আর সবশেষে মহঃ, এগুলো বিজ্ঞানময় কোষের কাজ।

আনন্দময় কোষ :  পুরোপুরি অভৌতিক। বিজ্ঞানময় কোষের মধ্যে বুদ্ধিরূপ আত্মা আছেন। বিজ্ঞানময় কোষের অভ্যন্তরে আছে আনন্দময় কোষ। এখানেই আনন্দস্বরূপ আত্মা বিচরণ করছেন। বিজ্ঞানময় কোষ এই আনন্দময় কোষ দ্বারা পরিপূর্ন। উপনিষদ বলছেন, এই আনন্দময় কোষের আকৃতিও মনুষ্যদেহীর অনুরূপ। প্রিয় জিনিস দেখার আনন্দ, প্রিয় বস্তু লাভ করার আনন্দ, প্রিয় বস্তু ভোগ করার আনন্দ, এই বিশুদ্ধ অদ্বয় আনন্দই জীবাত্মা। এইখানেই পরমাত্মার প্রতিফলন। আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মের প্রকাশ এখানেই।

বিজ্ঞানময় শরীর যা আসলে অভৌতিক, এই আনন্দময় শরীরের অর্থাৎ অভৌতিক শরীর ও ভৌতিক (মনোময়) শরীরের  সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। তার মানে বিজ্ঞানময় কোষ নিজে অভৌতিক, কিন্তু তিনি ভৌতিক ও অভৌতিক শরীরের মধ্যে সম্পর্ক জুড়ে রাখে।

ভৌতিক শরীরের রূপ বা আকার আছে। অন্নময় শরীর অতি স্থূল, তাই আমরা দেখতে পাই। প্রাণময় ও মনময় সূক্ষ্ম কিন্তু আমাদের অনুভূতির বাইরে নয়। এদুটো আসলে আউড়া বা জ্যোতি। দেখতে না পেলেও আমরা এর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি। যোগীরা এই প্রাণময় ও মনময় দেহ অর্থাৎ জ্যোতি দেখতে পান।  আর এটি আমাদের স্থূল শরীরকে ঘিরে রেখেছে।

যদি ভৌতিক শরীর নষ্ট হয়ে যায়, তবে এই বিজ্ঞানময় শরীর আনন্দময় শরীরের সঙ্গে মিশে যায় ,এবং তৎপর  আনন্দময় শরীর বিশ্বব্রমান্ডের সাথে বিলীন হয়ে যায় বা একাত্বিভূত হয়ে যায়।

ভৌতিক শরীর পঞ্চভূতের মিশ্রণ।  মৃত্যুর পরে, আমাদের ভৌতিক শরীর পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের কর্মবন্ধন, আমাদের আবার দেহধারণের জন্য উদগ্রীব হয়। ও আমরা আবার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করি। যখন আমরা কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি তখন আমরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সাথে এক হয়ে যাই।  জন্মমৃত্যুর চক্রের থেকে মুক্ত হয়ে যাই। একে বলে, মুক্তি।  কেউ বলে সমাধি।

OM SHANTI

---------------

যাইহোক, আমাদের আলোচ্য বিষয় স্বর্গলোক। আমরা আবার সেই আলোচনায় ফিরে আসি। যে কথা বলছিলাম, জীব যখন কামদেহ  দেহ ত্যাগ কোরে  মানসদেহ ধারণ করে, তখন সে মানস লোকে উপনীত হয়। আর এটাই স্বর্গলোকের নিম্নতর স্তর। আমাদের পার্থিব জ্ঞান অনুযায়ী, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বা নিচ থেকে উপরে, বা কাছ থেকে দূরে যাবার কোনো ব্যাপার কিন্তু এর মধ্যে নেই। কারন সমস্ত লোকগুলোই ওতঃপ্রোত ভাবে জড়িত। জীব যেখানে স্থূল দেহ ত্যাগ করেছেন, এমন হতে পারে, সেখানেই সে ভুবর্লোকের স্থিতিকাল অতিবাহিত করেছেন , আবার সেখানেই সে স্বর্গলোক ভোগ করছেন ।  আবার এমনও হতে পারে, সে চন্দ্রলোকে চলে গেছেন । একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমরা যখন যে লোকে অবস্থান করি, সেই লোকের  বাইরে আমরা কিছু দেখতে পাই না। ভুবর্লোকে থাকবার সময় আমরা এমনিতে স্থুল জগতের কিছুই দেখতে পাই না। কেবলমাত্র সূক্ষ্ম  অনুকৃতি দেখতে পাই।  আমরা যখন স্বর্গলোকে চলে যাই, তখন এই স্থুললোকের সঙ্গে আমাদের সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়। পুনর্বার জন্মগ্রহণ না করা পর্যন্ত আমরা আর এ জগতের কোনোকিছু জানতে পারি না।

স্বর্গের উজ্বল চিত্র :

এখন প্রশ্ন হচ্ছে  এইসব কথা কি কেবল কবি কল্পনা ? না এর মধ্যে কোনো সত্য বলে কিছু আছে ? দেখুন, অতীন্দ্রিয় ব্যাপার, আমাদের ইন্দ্রিয় উপলব্ধ নয়। তাই আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান দিয়ে এগুলো বোঝার চেষ্টা না করা  ভালো। অতীন্দ্ৰিয় ব্যাপার আমরা কি ভাবে বুঝি ? আগমে যা পাওয়া যায়, অর্থাৎ প্রত্যক্ষদৃষ্টি সম্পন্ন মনীষিগণ যা দেখেছেন, বা উপলব্ধি করেছেন, আমাদের সেখান থেকে বুঝে নিতে হবে। আপনি বিশ্বাস করবেন কি করবেন না,সেটা আপনার ব্যাপার। আপনার আমার কাছে সবই শোনা কথা, উপল্বদ্ধির বিষয় নয়। এবং আমার আপনার সামান্য জ্ঞানের উর্দ্ধে এই বিষয়। আমাদের আগে পিছে, শব্দ/ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে একথা ১০০ বছর আগে কেউ বিশ্বাস করতো না। এখন করে, কিন্তু  যার কাছে রিসেপ্টর (TV) এবং প্রজেক্টর  বা গ্রাহক ও বাহক  যন্ত্র আছে সেই এটা  দেখতে পারে, দেখতে পারে । অন্যরা কেউ পারেনা।

যাই হোক,

কামলোকের ভোগ শেষ হলে, সে মূর্ছিত হয়ে পড়ে।  মূর্ছাভঙ্গের পরে, জীব  স্বর্গলোকে যায়, আর  তখন তার সামনে  যে মহিমময় দৃশ্য  সামনে ফুটে ওঠে, তা বর্ণনার অতীত। ভুবর্লোকের  দৃশ্য পার্থিব দৃশ্যের অনুরূপ হলেও বর্ণ ও আভার ছটায় সেগুলো অলৌকিক-ধর্ম্ম সম্পন্ন ছিলো, কিন্তু স্বর্গের দৃশ্যের সাথে তার তুলনা হতে পারে না।
মনোহারী সংগীতধ্বনি, অপরূপ আলোক ও জ্যোতিঃ, পুণ্যগন্ধ, স্নিগ্ধ শান্তির উপকরণ সব কিছু মিলে স্বর্গে যে দৃশ্যপট রচনা করা আছে তা অনির্বচনীয়, অপরিমেয়, অপরিসীম। আনন্দের সেখানে সীমা নেই। শান্তির কোনো অন্তরায় নেই। সুখ ও আনন্দের আকর, সেই চির শান্তিময়, সেই চির জ্যোতির্ম্ময় ধামের বর্ণনা করা মানুষের সাধ্য নয়। আসলে আমরা এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক অতি ক্ষুদ্র এক কীট। আমাদের ভাষার ক্ষমতাও সীমিত। স্বর্গ দূরে থাকুক,  অনেক সাধারণ জিনিসের সম্পর্কেও আমাদের জ্ঞানের বিষয় ভাষায় ব্যক্ত করতে পারি না। এমনকি ইন্দ্রিয়লব্ধ অনেক জ্ঞান বা অনুভূতি আমরা ভাষায় ব্যক্ত  করতে অক্ষম। আমরা যে ইন্দ্রিয়সুখ ভুগে করি, তা কি সব সময় ভাষায় বলতে পারি ? ফুলের গন্ধ কি ভাষা দিয়ে কাউকে বোঝানো যায় ? এমনকি রসোগল্লার স্বাদ কি কাউকে ভাষা দিয়ে বোঝানো যায় ?  স্বর্গলোকের সবকিছুর মাধুর্য্য মানুষ তো ছাড়ো, স্বয়ং সরস্বতীও ব্যক্ত করতে পারেন না।

স্বর্গ এক আনন্দময় স্থান (ভূমা-আনন্দ )  :

যাইহোক, ব্যক্ত  করার যোগ্য না হলেও, স্বর্গ যে পরম সুখের জায়গা তাতে আমাদের কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। একটা কথা বুঝতে হবে, আমরা আত্মাদ্বারা সুখ দুঃখ অনুভব করি।  ইন্দ্রিয় দ্বারা নয়।  ইন্দ্রিয় একটা মাধ্যম মাত্র। ইন্দ্রিয়গন "করন" মাত্র। ইন্দ্রিয়গণ বিষয়ের সঙ্গে জীবের বা জীবাত্মার সংযোগ সাধন করে মাত্র। এবং এই সংযোগের ফলে সুক্ষ দেহে স্পন্দন অনুভূত হয়। এই স্পন্দনের মাধ্যমে মন ও বুদ্ধি দ্বারা জীবের বিষয়ের অনুভূতি হয়। সুতরাং আমাদের স্থুল  দেহে, রূপ, রস , গন্ধ, স্পর্শ, প্রভৃতি থেকে যে সুখ বা দুঃখ অনুভব করা যায় তা দুটো বহির-আবরণের (ইন্দ্রিয়, মন-বুদ্ধি) ভিতর দিয়ে জীবের কাছে পৌঁছায়। সেজন্য,তার তীব্রতা কিছু পরিমানে হ্রাস পায়। মনোজগতে অর্থাৎ মানস দেহে  এই বিঘ্ন নেই। স্থুল শরীরের ও সূক্ষ্ম শরীরের বাধা সেখানে নেই,সুতরাং সুখের মাত্রা যে সেখানে বেশি হবে তাতে আশ্চর্য্য হবার কিছু নেই। অনুভূতি মনেরই কাজ। সুতরাং যেখানে অনুভূতি সাক্ষাৎ সন্মন্ধে মনের গোচর হয়, সেখানে তার পরিমান যে অধিক হবে, তাতে সন্দেহ কি ?

প্রিয়জনদের সাথে মিলন :

সোনালী রঙের কুয়াশার মধ্য দিয়ে সুখ-স্বপ্নে অভিভূত জীবের জ্ঞান সঞ্চারের সঙ্গে সঙ্গে তার অন্তর্দৃষ্টি যখন স্বর্গলোকের উপরে পড়ে তখন এক অনির্ব্বচনীয় পারিপার্শ্বিক সৌন্দর্য্য তাকে অভিভূত করে। সেই সঙ্গে তার প্রিয়জনের আনন্দ উদ্ভাসিত মুখগুলো তার দৃষ্টিগোচর হয়। স্বর্গে কোনো সুখের অভাব নেই। প্রিয়জনরাও সেখানে আছে। তবে কি তারা পৃথিবীতে নেই ?  তা নয়, তবে কি, স্বর্গবাসী জীব যখন যা ইচ্ছা করেন, সকলই তিনি মানসদৃষ্টিতে দেখতে পান। তিনি প্রিয়জনের কথা ভাবছিলেন তাই তারা উপস্থিত হয়েছেন। এ সবই তার মানস সৃষ্ট। তাদের যে রূপ, যে ভাব, যে মনোবৃত্তি স্বর্গবাসীর প্রিয় ছিল সেই ভাবেই তারা প্রকট হন। যে শুদ্ধ আত্মা স্বর্গীয় উচ্চ স্তরে বাস করেন, স্থুল  জগতের  জীবের চৈতন্যে যিনি আংশিক প্রকাশিত, তিনি এইসব চিন্তামূর্তিগুলির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে নেন।

এই প্রসঙ্গে ছান্দোগ্য উপনিষদে আমরা একই কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই।  সেখানে বলছেন :

স যদি পিতৃলোককামো  ভবতি সংকল্পাদেবাস্য পিতরঃ সমুৎতিষ্ঠন্তি তেন পিতৃলোকেন সম্পন্নো মহীয়তে  (ছান্দোগ্য : ৮/২/১) 
আত্মজ্ঞ সেই ব্যক্তি যদি পিতৃপুরুষদের সঙ্গ পেতে চান, তাহলে তার ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁরা তাঁর সামনে আবির্ভূত হন।  সেই লোকে পিতৃপুরুষদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি মহিমান্বিত হন।

অথ যদি মাতৃলোককামো ভবতি সঙ্কল্পাদেবস্য মাতরঃ সমুৎতিষ্ঠন্তি  তেন মাতৃলোকেন সম্পন্নো মহীয়তে।  (ছান্দোগ্য : ৮/২/২)
আবার তিনি যদি মায়েদের সঙ্গ পেতে চান, তার ইচ্ছা অনুযায়ী মায়েরাই তার সামনে আবির্ভূত হন।

পরবর্তী শ্লোক গুলোতে একই ভাবে বলা আছে : তিনি যদি ভাইদের বোনেদের, বন্ধুদের সঙ্গ পেতে চান তবে তিনি তাই পেয়ে থাকেন। ছান্দোগ্য উপনিষদ আরো বলছেন : তিনি যদি খাদ্য, পানীয়, পেতে চান তবে তিনি তাই পেতে পারেন। যদি গান শুনতে চান, যদি স্ত্রীলোক কামনা করেন, বা যে কোনো কাম্য বস্তু পেতে চান, তবে তিনি তাই পেতে পারেন। (ছান্দোগ্য : ৮/২/৩-১০) 

শ্রূতি বলছেন, যিনি এই জীবনে আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন, তিনি এই সত্যসঙ্কল্পের অধিকারী হন।  অর্থাৎ যা ইচ্ছে তাই পেতে পারেন। 
আর পরাবিদ্যাবিদগণ বলছেন জীব যখন স্বর্গবাসী হন তখন এই ক্ষমতার অধিকারী হন।    

------
স্বর্গে প্রিয়জনদের সাথে মিলন :

জীবের  যখন ভুবর্লোকে স্থিতিকালের শেষের দিকে মনোময় দেহ গঠন হয়, তখন সে সঙ্গাহীন হয়ে পড়েন এবং পার্থিব বিষয়ের কোনো কামনা তার মনে বিশেষ থাকে না। কিন্তু উচ্চবৃত্তিগুলো নষ্ট হয় না। ভালোবাসার উৎপত্তি-স্থান ভগবান। হৃদয়ের উচ্চ বৃত্তিগুলোর মধ্যে প্রেম সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে আছে। সুতরাং যে সব প্রিয়জনের কথা চিন্তা করতে করতে তিনি স্বর্গলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, সেখানে গেলে তিনি প্রথমে এই সব চিন্তনীয় ব্যাক্তিগুলি পাবেন। তাদের যে ভাব স্বর্গীয় আত্মার ভালো লাগে সেই ভাবেই তাঁদের দেখবেন।  যে মূর্তি তার ভালো লাগতো, তিনি সেই মূর্তিই দেখবেন। পৃথিবীর সঙ্গে তার আর কোনো সম্পর্ক রাখবেন না। কিন্তু অনন্ত সুখ-শান্তি ও অপার আনন্দে তিনি নিজের জগৎ নিজেই রচনা করতে থাকবেন। সত্যি কথা বলতে কি এই সব পদার্থ জীবের হৃদয়-আকাশে অবস্থিত আছে।  আমাদের অতীত ভবিষ্যৎ সবই আমাদের হৃদয়-আকাশে নিহিত আছে। জ্ঞানীগণ এসব দেখতে পান। আমরা যারা অজ্ঞান সে সব দেখতে পাই না। ভূগর্ভের উপর দিয়ে আমরা হেটে বেড়াই। কিন্তু ভূগর্ভে নিহিত রত্নরাজির খোঁজ আমরা কজন রাখি ? তেমনি আমাদের হৃদয়-আকাশে স্থিত আমাদের ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ আমরা দেখতে পাই না। আমাদের সবারই সুষুপ্তি হয়।  এই সুসুপ্তিতে আমরা অজ্ঞান  থাকি। তাই আমাদের সুসুপ্তির অবস্থায় আমাদের কি হয়, তা আমাদের মনে থাকে না। জ্ঞানীগণ ধ্যান অবস্থায় এই সুষুপ্তি লাভ করেন। এবং চেতন থাকেন, তাই তারা সব কিঁছু জানতে বা দেখতে পারেন। আমরা সুষুপ্তি কালে, অর্থাৎ স্বপ্নহীন নিদ্রায় আমরা স্বর্গাবাসীদের সাথে মিলিত হতে পারি, এমনকি মিলিত হই, কিন্তু নিদ্রাভঙ্গে আমাদের সে সব কথা মনে থাকে না। জ্ঞানীগণ যখন সমাধিস্থ হন তখন মৃত প্রিয়জনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ করেন। হৃদয়াকাশই ব্রহ্মপুর। সুসুপ্তিকালে জীব সেখানে যান বটে, কিন্তু কর্মসূত্র যুক্ত থাকে বলে, ব্রহ্মে লীন হয়ে যান না। নিদ্রাভঙ্গে আবার আত্মস্বরূপ প্রাপ্ত হন। এর পরে আছে তুরীয় অবস্থা। এই তুরীয় অবস্থায় মানুষ সমাধি লাভ করে। এই তুরীয় অবস্থাপ্রাপ্ত মানুষ আর দেহে থাকেন না।

স্বর্গে জীবের বিষয়ের স্মৃতি অক্ষুন্ন থাকে  -

স্বর্গলোকে যাবার পরে জীবের পার্থিব জীবনের সমস্ত কথাই মনে থাকে। কারুর পার্থিব জীবন যদি দীর্ঘ হয় তবে বিকশিত জীবনের কথা অনেকদিন পর্যন্ত তার স্মৃতি হতে বিলুপ্ত হয় না। কিন্তু সেখান থেকে পৃথিবীর সঙ্গে তার সংস্রব রাখা চলে না। পৃথিবীর আত্মীয়স্বজন সুসুপ্তিকালে তার কাছে আসতে  পারে মাত্র। স্বর্গবাসী মানে হচ্ছে মানস দেহধারী। আত্মা, বুদ্ধি ও মন এই তিন দ্বারা মানস দেহ গঠিত। আত্মা কোন ব্যক্তির নিজস্ব সম্পত্তি নয়।  সর্বভূতে একই আত্মা বিরাজিত। প্রত্যেক জীবের মধ্যে যা প্রবেশ  করে, তা ওই আত্মার জ্যোতিঃ রশ্মি মাত্র। সেই জন্য এক দেহের বিনাশে অন্য দেহের বিনাশ হয় না। একের কর্মফলও অন্যকে আশ্রয় করতে পারে না। এমনকি মিশ্রণ ঘটতে পারে না। বেদান্তেও আমরা দেখেছি, পরমাত্মা যখন জীবের মধ্যে প্রতিফলিত হয়, তাকে জীবাত্মা বলে। আবার সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডে যখন প্রতিবিম্বিত হয় তখন তাকে আমরা আত্মা বলি।  এগুলো আসলে সবই পরম-আত্মার  প্রতিবিম্ব মাত্র। যেমন সূর্য সবেতেই প্রতিফলিত হচ্ছে। তেমনি পরম-আত্মাও সবকিছুর মধ্যেই প্রতিবিম্বিত হচ্ছে এমনকি সূর্যের মধ্যেও প্রতিবিম্বিত হচ্ছে । এবং এই জ্যোতিঃ রশ্মিই  আমাদেরকে  ব্যক্ত করছে। আমাদের চেতন শক্তির বিকাশ এই জ্যোতিরশ্মি  থেকেই হয়। জীব যখন স্বর্গের নিম্নস্তরে বাস করে, তখন সে মায়ায় আচ্ছন্ন থাকেন। তার অতীত জীবনের কথাই তখন কেবল মনে  পড়ে । সেখানে যা তিনি অর্জন করেছিলেন, যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, সেগুলোই স্বর্গে এসে তিনি ভোগ করেন। স্বর্গলোক আসলে ভোগ ভূমি।  পৃথিবী যেমন কর্মভূমি স্বর্গ তেমনি ভোগ ভূমি। কর্মদ্বারা যে বীজ তিনি পৃথিবীতে বপন করে ছিলেন, স্বর্গে এসে তিনি তারই ফল ভোগ করেন। এই সময় তিনি কর্ম থেকে দূরে থাকেন। এবং স্বর্গ সুখ ভোগ করেন।

স্বর্গবাসী প্রিয়জনদের সঙ্গসুখ ভোগ করেন :

স্বর্গবাসী, জ্ঞানের উন্নত স্তরে বাস করেন। জীব যখন স্থূল দেহে বর্তমান  থাকেন, তখন কর্মের মাধ্যমে তিনি জ্ঞান সঞ্চয় করেন। কামলোকে তার বাসনাদেহ কাজ করে।অর্থাৎ এই বাসনা দেহে তিনি সুখ-দুঃখ ভোগ করেন।  এর পরে তিনি মানসলোকে, মানস দেহ অবলম্বন করেন। এই মানস দেহ দ্বারাই তখন তার সুখ ভোগ হয়। আমরা যারা বেঁচে আছি, তাদের সবারই এই তিন দেহ আছে। আমাদের প্রিয়জন বিয়োগে যে দুঃখ ভোগ করি, তা এই কামদেহের কাজ।  অর্থাৎ আমাদের প্রিয়জন বিয়োগ হলে কামদেহে এক তীব্র স্পন্দন আরম্ভ হয়, এটাই আমাদের দুঃখের কারন। মানস দেহ তখন স্থিতাবস্থায় থাকে।  সেখানে এই স্পন্দন পৌঁছায় না। তাই মানস দেহে আমাদের কোনো সুখ-দুঃখ অনুভূত হয় না। ধীরে ধীরে কামদেহের এই স্পন্দন মৃদু থেকে  মৃদুতর  হয় এবং শোকের প্রভাব চলে যায়। মানসদেহে কিন্তু সুখ-দুঃখের কোনো অধিকার নেই। সেখানে জ্ঞানের উন্নতস্তরে কোনো বিচ্ছেদ নেই, কোনো শোক নেই, কোনো দুঃখ নেই।  সেখানে আছে শুধু চির শান্তি, নির্মল আনন্দ।  তাই স্বর্গবাসী জীব তাঁর আত্মীয়-স্বজনের জ্ঞানের নিম্ন স্তরের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেন না।  তাই, পৃথিবীতে তারা যে ভাবেই থাকুক না কেন স্বর্গবাসী তা জানতেও পারেন না। জ্ঞানের উচ্চস্তরের সাথে তাদের সম্পর্ক থাকে। সেইজন্য স্বর্গবাসী সর্ব্বদা তার প্রিয়জনকে সুখ শান্তির মধ্যে অবস্থিত দেখেন।
স্বর্গবাসীরা মৃত্যু কি তা জানে না। তারা মানস দেহধারী। আর তাদের সম্পর্কও আমাদের মানসদেহের সঙ্গে। আর এই মানস দেহের কাছে মৃত্যু বলে কিছু নেই। আসলে স্থুল জড়ের আবরণ অনিত্য, বিনশ্বর।  এই অনিত্য বস্তুই আমাদের বিচ্ছেদের কারন। তাই অনিত্য বস্তুর যেখানে অস্তিত্ব নেই, সেখানে মৃত্যুও নেই। পুরানে আমরা দেখি নারদ ব্রহ্মার মানসপুত্র। এই মানসদেহের যেহেতু বিনাশ নেই, তাই নারদেরও  মৃত্যু নেই।

দাম্পত্য প্রেম সব বাসনার মূল :

পরম-আত্মা পরম-ঈশ্বর সমস্ত রসের উৎপত্তি স্থান।  তিনিই রস।  আমাদের মনের যে ভাব তাকে আমরা মনোভাব বলি। এই মনোভাবকেই বাক্যান্তরে বলা হয় রস। কথায় বলে "রসবৈ সঃ" অর্থাৎ তিনিই রস। ভালোবাসার মূল তো সেই অনন্ত অনন্ত অনন্ত পরম-ঈশ্বর পর্যন্ত বিস্তৃত।  এবং এই প্রেম রসের দ্বারা অনুপ্রাণিত। প্রেমই সংসার বন্ধনের প্রধান উপকরণ। কিন্তু সংসার ক্ষণস্থায়ী হলেও প্রেম ক্ষণস্থায়ী নয়। প্রেম অবিনশ্বর।  প্রেমের উপরে কালের কোনো আধিপত্য নেই। প্রেম সবকিছুকে জয় করতে পারে। মৃত্যুকেও সে জয়  করেছে। প্রেম শাশ্বত, অনন্তকালস্থায়ী। মানুষের এই স্থুল দেহের মৃত্যু হলেও আত্মাকে আশ্রয় ক'রে "প্রেম" তার নিজের ধর্ম রক্ষা করে। স্বর্গবাসীর প্রেমিক বা স্বজনদের সাথে মিলনের জন্য প্রেম সেতু হিসেবে কাজ করে। নির্মল, পবিত্র স্বার্থহীন প্রেমের কখনো ক্ষয় নেই। তা সে স্বর্গে গেলেও সেই প্রেম অক্ষুন্ন থাকে। তাই স্বর্গবাসী তার প্রেমাস্পদদের নিয়ে সেখানেও বাস করেন। এ কেবল কল্পনার কথা নয়।  স্বর্গবাসী মাতা তার সন্তানদের নিয়ে, অর্থাৎ মায়ের অন্তঃকরনে অনুভূত যে প্রেম, সেই প্রেমই সন্তানদের স্বর্গলোকে বাস্তব করে তোলে। একথা তো সত্য যে মাতা তখন স্থূল দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন, কিন্তু  মায়ের প্রকৃত সত্ত্বা সন্তান থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হয় না। কারুর কথাই তিনি ভোলেন না। স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, আত্মীয়স্বজন,  যখনই যার কথা তার মনে আসে, তখনি তাদের উপস্থিতি তিনি প্রত্যক্ষ করেন। আমাদের দাম্পত্য প্রেম নিতান্তই স্বার্থ জড়িত, এমন ভাবার কোনো কারন নেই। প্রেমই প্রেমের উৎস, প্রেমই প্রেম রাজ্যের অধীশ্বর। প্রেমের ফল স্বরূপ যে তথাকথিত ধর্মাবিরুদ্ধ কাম, তাও ভগবানের দেওয়া। স্বয়ং বিষ্ণু এই রসের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই আমাদের  পুত্র লাভের  ইচ্ছে জাগ্রত হয়। বিত্ত-কামনাও তারই ইচ্ছা। সেই বিরাট পুরুষ একাই ছিলেন। তার কামনার ফলে জায়া অর্থাৎ স্ত্রী  উৎপন্ন হল। আমাদের তিনটি কামনা - পুত্র, বিত্ত, ও হিত (নিজের ও অপরের )।  এর বাইরে কোনো কামনা নেই।

স্বর্গলোকের মিলন, হৃদয় ও মনের মিলনের উপর নির্ভর করে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, যাদের সঙ্গে অন্তরের সহানুভূতির অভাব বা কেলমাত্র বাহ্যিক বা দৈহিক সম্বন্ধ থাকে, তাদের সাথে স্বর্গে মিলনের কোনো সম্ভাবনা নেই। বিচ্ছেদ তাদের সাথেই হয়, যাদের সঙ্গে স্বর্গবাসীর সহানুভূতির অভাব ছিল।

স্বর্গের সাতটি  স্তর  :  

কামনার লোকের মতো বা কামলোকের মতো স্বর্গলোকেও সাতটি স্তর।  নিচের চারটি স্তরকে  বলে "রূপভূমি" । মানস দেহ ধারণ করে, জীব এখানে বাস করে।  এখানে তাদের মূর্তি আছে, স্ত্রী-পুরুষ ভেদ আছে।  পৃথিবীর আত্মীয়স্বজনদের এখানে এসে আমরা চিনতে পারি।  পৃথিবীর স্মৃতিও এখানে সম্পূর্ণ রূপে বজায় থাকে। সাধারণের স্তরের মানুষেরা সাধারণত এখানেই অতিবাহিত করে। উচ্চস্তরে যেতে পারে না। এছাড়া আছে "অরুপভূমি" । এই অরুপভূমিতে জীবের কোনো রূপ থাকে না। কারণ-দেহ অবলম্বন করে, জীব এখানে অল্প সময়ের জন্য বাস করে।  আমরা জানি, পরম-আত্মার জ্যোতি বা রশ্মি জীবের মধ্যে প্রবেশ করে, এবং একে আমরা চৈতন্য বলি। জীব যেখানেই যান না কেন, এই আত্মজ্যোতি তার সঙ্গে থাকে। পরম-আত্মা কিন্তু কোথাও যান না। জ্যোতি সর্বত্র। তাই "যথা জীব তথা জ্যোতিঃ"।

স্বর্গে পার্থিব জীবনের অভিজ্ঞতা শক্তিতে পরিণত হয়। 

স্বর্গে জীব কেবল সুখ ভোগ করে, তাই নয়।  পার্থিব জীবনে, যে অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান সে সঞ্চয় করেছিল, এখানে সেই জ্ঞান শক্তিতে পরিণত হয়। এই শক্তি নিয়েই পুনরায়  মানুষ হয়ে জন্ম গ্রহণ করে। মানুষের মধ্যে ৭টি বৈশিষ্ঠ দেখা যায়। ১. দর্শনিক ভাব  ২. বৈজ্ঞনিক ভাব ৩. কলাবিদ  ৪, ভক্তিভাব  ৫ অনুষ্ঠান প্রিয় ৬. তত্ত্বজিজ্ঞাসু ৭. বীর। মানুষের উন্নতির ধারা, এই ৭টি ভাব বা আদর্শের কোনো না কোনো একটিকে লক্ষ্য করে প্রভাবিত হয়। স্বর্গবাস কালে মানুষ তার অর্জিত জ্ঞান  ও বুদ্ধি দ্বারা চালিত হয়ে পরিণতি লাভ করবার শক্তি সঞ্চয় করে।

এবার আমরা স্বর্গের ৭টি স্তর সম্পর্কে আলোচনা করবো। কিন্তু তার আগে স্তর বলতে কি বোঝায় তা একবার একটু দেখে নেই। প্রাচীন মুনিঋষিগন দিব্যদৃষ্টি বলে  ত্রিলোক (স্বর্গ-মর্ত-পাতাল) এবং ত্রিলোকের বিষয় সম্পর্কে জানতে পারতেন। মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ হলে অনেক রকম বিভূতি লাভ সম্ভব হয়। পতঞ্জলি যোগসূত্রে আমরা সে সব পড়েছি। এই যুগেও অনেক মহাপুরুষ এই শক্তি লাভ করেছেন। তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানই পরাবিদ্যা। স্বর্গের সমস্ত স্তরের সমস্ত বিবরণ ভাষায় প্রকাশ করা শুধু কষ্টকর নয় অসম্ভব। অনির্বচনীয় ব্যাপার সকল বচন  দ্বারা ব্যক্ত  করা  যায় না। সুতরাং বিষয়টি বুঝতে গেলে বিষয়ের গভীরে আমাদের চিন্তাশক্তিকে প্রবেশ করাতে হবে। স্তর মানে একটার পর একটা সাজানো এমনটা নয়। ভিন্ন ভিন্ন লোক, ভিন্ন ভিন্ন দেহ, এগুলোকে আলাদা করা যায় না। সর্ব্বলোক, সর্ব্বস্তর, এবং সবকয়টি দেহ একে অন্যের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এক স্তর থেকে অন্য স্তরে যাওয়া মানে এই নয় যে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া। জ্ঞানের প্রসার-সংকোচ যেমন স্থানান্তর বা দেহের পরিবর্তন নয়, তেমনি এক স্তর থেকে অন্য স্তরে আমাদের যে জ্ঞান হয় তাকেই এক স্তর থেকে অন্য স্তরে যাওয়া বলে।

 প্রথম স্তর  : মানুষের কাম দেহ ত্যাগ করার পরে, তার স্ব-অর্জিত জ্ঞান ও কর্ম অনুসারে, স্বর্গের নির্দিষ্ট স্তরে গমন করে। মোটা মুক্তি ভাবে বলা যেতে পারে, যিনি সৎ ভাবে জীবন যাপন করেছেন।  নিজের কর্তব্য পালন করেছেন নিঃস্বার্থ ভাবে মানুষকে ভালো বসেছেন, তিনি স্বর্গের নিম্ন স্তরে, কিছুকাল অবস্থান করতে পারেন।  এখানে তিনি মাতৃ স্নেহ, পিতৃস্নেহ, দাম্পত্য জীবনের ভালোবাসা, উপভোগ করেন। এবং সংকল্প সিদ্ধির জন্য শক্তি সঞ্চয় করেন। পরবর্তী মানব জীবনে যা তার সহায় হতে পারে। নিতান্ত দুরাত্মা না হলে  স্বর্গের এই স্তরে সবারই আগমন ঘটে।

এইখানে একটা কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, এই সব স্বর্গবাসী অনেকসময় আমাদের মতো পার্থিব জগতের মানুষের কাছে ইষ্ট  হতে পারেন। আমরা অনেক সময় বাবা-মায়ের মূর্তি বা ছবি নিয়ে উপাসনায় বসতে পারি। এই সময় সেই অরূপ-স্তর স্বর্গবাসীর আত্মার যে বিকীর্ণ জ্যোতিঃ এই সব সংকল্পিত মূর্তি বা ছবিগুলোতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে। এবং আমাদের উপাসনায় তিনি অংশ গ্রহণ করেন।

স্বর্গে আমাদের পূর্বস্মৃতি অক্ষুন্ন থাকে এবং স্বর্গের নিম্নস্তরে তার পার্থিব দেহের অনুরূপ মানস দেহ থাকে। এই মানস দেহে স্বর্গবাসকালে মানুষ তার অর্জিত জ্ঞান ও বুদ্ধি সম্পদ স্বীয় স্বীয় আদর্শের পথে চালিত করে পরিণতি  লাভ করবার শক্তি সঞ্চয় করে। ভগবান কথিত গীতায় আমরা শুনেছি, যারা জ্ঞান মর্গে সাধনা করেছেন, বা ধ্যান মর্গে সাধনা করেছেন, তারা পরবর্তী জীবনে সেই জ্ঞান বর্ধিত করবার সুযোগ পায়। কিন্তু মানুষ যখন স্বর্গের উচ্চ স্তরে যায়, অর্থাৎ যখন তার জ্ঞান, কারন দেহকে আশ্রয় করে, তখন ব্যক্তিত্ব সত্ত্বায় পর্য্যবসিত  হয়। পুনরায় জন্ম গ্রহণ করবার অল্প আগে জীব এই অবস্থা প্রাপ্ত হয়। এখানে দিন রাতের কোনো প্রভেদ নেই।  কামলোকের ভোগ শেষ হয়ে গেলে, তার বাসনা দেহের সমাপ্তি হয়। তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, ও মানস দেহ আশ্রয় করে,স্বর্গলোকে উপস্থিত হয়। নতুন পারিপার্শ্বিক দেখতে পান এবং এক অনির্বচনীয় সুখের অনুভব হয়।  এই আনন্দের মধ্যেই তার স্বর্গের জীবন অতিবাহিত হয়।

স্বর্গবাসী ভাবের আদানপ্রদান করতে পারে।  কিন্তু তা আমাদের মতো বাক্যের দ্বারা নয়। চিন্তাই এই ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যম হয়। আমরা শুনেছি, এই পার্থিব জগতেও, চিন্তার মাধ্যমে মহাপুরুষগন ভাবের আদান প্রদান করে থাকেন।  ঠাকুর রামকৃষ্ণ যখন ত্রৈলঙ্গ স্বামীর সাথে দেখা করেছিলেন, তারা মৌন থেকে ভাবের আদান প্রদান করেছিলেন।

দ্বিতীয় স্তর  : স্বর্গের এই দ্বিতীয় স্তরে, ভক্তিমার্গের ভক্তরা বাস করেন। ইহলোকে যারা যে মূর্তিতে আকৃষ্ট ছিলেন, তা সে কৃষ্ণ, বিষ্ণু, শিব, বুদ্ধ, চৈতন্যদেব, বা অন্য যেকোনো মূর্তি হোক।  স্বর্গের এই দ্বিতীয় স্তরে নিজ নিজ উপাস্য দেবতার পূজায় ব্যাপৃত থেকে পরমসুখে সময় অতিবাহিত করেন। ভক্তিমার্গের লোকেরা, ধর্মের সূক্ষ্মতত্ত্ব জানবার দরকার মনে করেন না, এইজন্য তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি হয় না। কিন্তু স্বর্গলোকে স্বজনগনের সাথে পরম সুখে বাস করেন।  মূর্তিপূজা স্বর্গপ্রাপ্তির অন্তরায় নয়, বরং সাহায্য করে, কিন্তু আত্মার উন্নতির জন্য জ্ঞানমার্গের আশ্রয় নিতে হয়। যারা জড়বাদে বিশ্বাসী, তারা মহা জ্ঞানী হলেও স্বর্গলোকে তাদের জ্ঞানের উন্মেষ হয় না। জড়বাদী মৃত্যুর পরে, কোথায় গেছেন তা বুঝতে পারেন না। এসময় তার শুভানুধায়ী যদি কেউ থাকে, তারা এসে তাকে প্রকৃত অবস্থা বুঝিয়ে দেন। তাই জড়বাদ, স্বর্গবাস বা স্বর্গসুখের অন্তরায়।

তৃতীয় স্তর : যারা ইহলোকে ঈশ্বরে মন সমর্পন ক'রে, বিশ্বমানবের হিত  কামনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন, তারা স্বর্গের এই তৃতীয় স্তরে বাস করেন। বেঁচে থাকা কালীন অবস্থায়, তার যে সব পরিকল্পনা লোকহিতার্থে করবেন বলে ভেবেছিলেন, অথচ করে উঠতে পারেন নি, তার সেই কাজ তিনি এখানে বসে করতে পারেন। কারন সঙ্কল্প দ্বারা এখানে সব উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। এখানে বসে যে সব সংকল্প করবে, আগামী মনুষ্য জন্মে, স্থূল দেহে জগতে এসে তিনি তা সিদ্ধ করতে পারবেন। কলাবিদ্যার চর্চ্চাকারী  অর্থাৎ সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী এখানেই স্থান পান। অনুন্নত শ্রেণীর মধ্যে  যারা ধর্ম প্রচার করেন, বা অনুন্নত জাতির জন্য যারা প্রাণপাত করেন, তাঁরাও স্বর্গের এই তৃতীয় স্তরে বাস করার অধিকারী হন।

চতুর্থ স্তর :  স্বর্গের এই চতুর্থ স্তরে সাহিত্যিক আচার্য্য , বৈজ্ঞনিক, ঋষিগণ, কলাবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী, ভাস্করগন, এমনকি পরাবিদ্যা অনুশীলনকারী ছাত্র বা তাদের গুরুদেবগন এখানে বাস করেন। এখানে থেকে নিজ নিজ বিষয়ের অনুশীলনে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করছেন। যেসব ছাত্র গুরুকৃপা লাভ করেছেন, বা পৃথিবীতে বাসকালীন, চেষ্টা করেও গুরুকৃপা লাভ কৃপা লাভ করতে পারেন নি, এখানে এসে তাঁরা গুরুদেবের চরণতলে বসে জ্ঞানলাভ করতে পারেন।

পঞ্চম স্তর : এখানে সাধারণ মানুষের স্থিতিকাল অতি সামান্য। জ্ঞানমার্গীরাই এখানে আসতে  পারেন। পৃথিবীতে থাকার সময়, যে যতটুকু জ্ঞান সঞ্চয় করেছেন, এখানে তার অনুশীলন দ্বারা, অর্জিত জ্ঞানকে মানসিক শক্তিতে পরিণত করে, তিনি মানস দেহ ত্যাগ করে কারন দেহ ধারণ করেন। জ্ঞানী জীবের এটাই প্রকৃত বাসভূমি। কিন্তু যতদিন তাদের কর্ম-জীবনের অবসান না হয়, ততদিন এখানে বসবাসের কাল সীমিত থাকে। এখানে এসে জীব তার সমগ্র অতীত জীবনের দৃশ্যপট দেখতে পান। যুগ যুগান্তর ধরে, কি কাজ তিনি করেছে, কোন কোন জন্ম তিনি অতিক্রম করেছেন, তার সঞ্চিত কর্ম কত আছে, এবং তার জন্য তাকে কি করতে হবে, এসবই  অর্থাৎ তিনি তার নিজের অতীত, ভবিষ্যৎ সবই তিনি দেখতে পান। এবং এখানেই তার পুনর্জন্ম গ্রহণের সূচনা হয়। ইহলোকে যারা আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করেছেন, কেবলমাত্র তাঁরাই এখানে  কিছু সময় অতিবাহিত করতে পারেন। এখানে তাঁরা ভৌতিক দাসত্ত্ব মুক্ত হয়ে, মানব জীবনের প্রকৃত মূল্য বুঝে, তার সদ্ব্যবহার করেন।

এই পঞ্চম স্তরে, পৃথিবীর শুরু থেকে বা বলা যেতে পারে সৃষ্টির শুরু থেকে বর্তমান মানব জাতির ক্রমবিবর্তনে যে লক্ষকোটি জীব যোগদান করেছেন, তাদের প্রায় সকলকেই এখানে পাওয়া যায়।  স্বচ্ছ ডিম্বাকৃতি অতি সূক্ষ্ম পদার্থে নির্মিত এইসব জীব প্রথমে বর্নহীন থাকে।  ধীরে ধীরে জন্মে পর জন্ম গ্রহণ করে উন্নত হতে হতে ক্রমশঃ জ্যোতিস্মান হন।  যে সব মহাপুরুষ এই পঞ্চমস্বর্গের মহাপুরুষদের দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছেন, তাঁরা বলেন যে বর্ণনা দ্বারা সে জ্যোতির চ্ছটা বর্ণনা করা যায় না।

এই জ্যোতিই  উন্নত জীবের কারন দেহ । এই জ্যোতিই জীবের প্রকৃত স্বরূপ। এবং এই পঞ্চম স্তরই জীবের প্রকৃত বাসভূমি। স্বর্গের উচ্চস্তরের উপকরণ দ্বারা গঠিত এই কারনদেহধারী আত্মাই "জীব"  নামে  প্রসিদ্ধ। জ্যোতির্ময় আবেষ্টনের মধ্যে এই মানব দেহের আকৃতি দেখা  যায়। মাথা এবং কাঁধ সুস্পষ্ট  এবং পার্থিব জীবনের সুপরিচিত মুখখানি মহিমার আলোকে উদ্ভাসিত, নয়ন জ্যোতি কেন্দ্রীভূত, এবং বুদ্ধিও মানসিক শক্তির পরিচায়ক । এখানে এই পঞ্চম স্তরে, মনের সাথে মনের  অপূর্ব মিশ্রণ, একত্ত্ব-সম্পাদন, ভেদহীন-বিচ্ছেদহীন-বিরামহীন মিলনের চরিতার্থতা এই অরূপ স্বর্গে কারন দেহধারী জীবের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে থাকে।

ষষ্ঠ স্বর্গ  বা ষষ্ঠ স্তর : এখানে  কেবলমাত্র জ্ঞানমার্গে যারা উচ্চস্থান অধিকার করেছেন, তাঁদেরই এখানে সজ্ঞানে  থাকা সম্ভবপর। সাধারণ মানুষের এই স্তরে স্থিতিকাল অতি অল্প। তাছাড়া তাঁদের জ্ঞানের লক্ষ্মণ বিশেষ থাকে না। জ্ঞানীগণ এখানে তাদের সঞ্চিত কর্ম ও অতীত জীবন দেখে, ভাবি জীবনের পথ ঠিক করেন। এছাড়া, এখানে কিছু মহাত্মন আছেন, যারা এখানে দীর্ঘকাল বাস করেন, এবং যারা এখানে স্বল্প সময়ের জন্য আসতে পেরেছেন, তাদেরকে সুপথের নির্দেশ দিয়ে থাকেন।

সপ্তম স্বর্গ : সমস্ত স্বর্গলোকের  মধ্যে এটাই সর্ব্ব উচ্চ স্তর। আচার্য্যগণ ও তাদের দীক্ষিত ছাত্রদের আবাসস্থান। পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, দীক্ষা গ্রহণ না করলে, এখানে কেউ আসতে  পারে না।  জগতে যা কিছু উন্নত ভাব, উন্নত মানসিক শক্তি, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উৎকর্ষ তা এই সর্বোচ্চ  সপ্তম স্বর্গ থেকে উৎপন্ন।  এই স্তরবাসীগণ  মায়ার বন্ধন  অতিক্রম করেছেন। এঁরা  বার বার ইহলোকে  জন্ম গ্রহণ করলেও, এঁরা  অতীত বিস্মৃত হন না।

এতক্ষন আমরা স্বর্গে জীবের অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। কিন্তু আমরা তো শুনেছি, স্বর্গে সব দেবতা থাকে। স্বর্গের রাজা হচ্ছেন ইন্দ্র। এটা কি গল্পকথা ?  আট রকম  দৈব স্বর্গের কথা দর্শন শাস্ত্রে আমরা দেখতে পাই। এগুলো সাধারণের জন্য আলোচ্য বিষয় নয়।

জ্ঞানমার্গের  শীর্ষে যারা পৌঁছেছেন, যারা জ্ঞানমার্গের আচার্য্য, তারাই দেবযোনি প্রাপ্ত হন। জীব যখন সূক্ষ্ম দেহ ত্যাগ করে স্বর্গলোকে উপস্থিত হন তখন একটা বর্ণচ্ছটা দেখতে পান। এই বর্ণচ্ছটা আর কিছু নয় দেবতাদের ভাবের আদানপ্রদান জনিত বর্ণচ্ছটা।  এই বর্ণচ্ছটা বা রঙ্গিন আলোর আভা আর কিছুই নয়, দেবতাদের  ভাষা। এখানে আর একটা নীহারিকাপুঞ্জ দেখা যায়, যা আসলে স্বর্গাবাসীর চিন্তা বিশেষ।এগুলো জীবনীশক্তি বিশিষ্ট।  স্বর্গবাসী ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগে এই নীহারিকাপুঞ্জকে একত্রিত করে, মূর্তিতে রূপান্তরিত করে, এবং স্রষ্টার  প্রয়োজন সাধন করে।

স্বর্গলোকের প্রধান বৈশিষ্ঠ হচ্ছে, জীবজগতের সমস্ত অতীত ঘটনা এখানে অঙ্কিত থাকে। পৃথিবীর সমুদয় ইতিহাস এখানেই সংরক্ষিত আছে। আকাশ তো শুন্য, যাদের জ্ঞানচক্ষু খুলে গেছে, তারা একে প্রকৃতির স্মৃতিপট মনে করেন। মহর্ষিগন অতীত যুগের সমস্ত ঘটনা এখানে দেখতে পান। অতীত যুগের সমস্ত জ্ঞান এখানথেকে  থেকে সংগৃহিত হয়েছিল, এখনো হচ্ছে। কেবল মানুষ নয় সৃষ্টির প্রথম থেকে যত জীব, জন্তু, কীটপতঙ্গ, উদ্ভিদ ইত্যাদি জন্মেছে, প্রকৃতির এই জাদুঘরে সব সজ্জিত আছে। দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন মহাপুরুষ যে কোনো সময় ইচ্ছা করলে, এখান থেকে সমস্ত ঐতিহাসিক তত্ত্ব সংগ্রহ করতে পারেন।

পৃথিবীতে মানুষের স্থিতি কাল মোটামুটি ৮০ থেকে ১০০ বছর।  কামনা লোকে ২০ থেকে ৩০ বছর, কিন্তু স্বর্গলোকে সহস্র বা ততোধিক বছর অতিবাহিত করেন। কামনার লোকে জ্বালা যন্ত্রণার অবসানে, শান্তিতে দীর্ঘ সময় স্বর্গে বাস করেন। সাধারণ মানুষের এই স্বর্গলোকে অবস্থানের কাল খুব কম। কিন্তু যারা পৃথিবীটিতে থেকে জ্ঞানের উর্দ্ধসীমা বর্দ্ধিত করেছেন, তাদের স্বর্গবাসের সময়সীমা ততো বর্দ্ধিত হয়। এখান থেকে  জীব আবার নতুন যোনিতে ফিরে আসেন।

উদ্ভিদ থেকে মনুষ্যতর জীব ক্রমবিকাশ বলে মানব জন্ম প্রাপ্ত হয়।  মানব জন্মের অভিজ্ঞতা যাদের কম, তারা সাধারণত পাশবিক প্রবৃত্তি অর্থাৎ পূর্বাপর জীবনের প্রবৃত্তি  আঁকড়ে থাকে। ধীরে ধীরে, দীর্ঘকাল ধরে, বার বার মনুষ্য জন্ম লাভের  পর, তার সভ্য হতে পারে। এমনকি সিদ্ধ পুরুষ হতে পারে। আমাদের মধ্যে যারা হিংস্র স্বভাবের তার এই শ্রেণীর মানুষ। এই মানুষেরা স্বর্গের নিম্নস্তরে অধিক সময় অতিবাহিত করে।  এবং ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান সঞ্চয়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা উন্নত মানুষ হয়ে যায়। এই ক্রমবিকাশই সৃষ্টির ধর্ম। ঈশ্বরের রাজত্ত্বে সবারই উন্নত হতেই হবে।  এর কোনো অন্যথা হবে না।

এবার একটা গল্প দিয়ে শেষ করবো। এক বর্ব্বর  সারা দিন খাবার জোগাড় করতে না পেরে, তার স্ত্রীকে খুন করে, তার মাংস খাচ্ছিলো। একজন সভ্য মানুষ  তাকে তার জন্য তিরস্কার করাতে, সে  বলেছিলো, খারাপ কি হলো ? মাংস তো ভালো। তো ভাবুন, স্ত্রীর মাংস যে খাওয়া উচিত নয়, তাকে মারা যে উচিত নয়, এই ভালো মন্দ জ্ঞান ওই বর্ব্বরের নেই। পশুর যেমন ভালো মন্দ জ্ঞান থাকে না। মানুষেরও  জীবনের প্রথম দিকে এই জ্ঞান থাকে না। ধীরে ধীরে মানুষের জ্ঞান উন্মোচনের পরে, সে ভালো মন্দ বুঝতে পারে। সে বিচার করতে শেখে। এই বিচার শক্তি যার যত সূক্ষ্ম সেই-ই তত উন্নত মনুষ্য, সেই স্বর্গবাসের সুযোগ ও সময় বেশি পায়।

ওম সর্ব্বেসাম স্বস্তির ভবেতু। 
ওম সর্ব্বেসাম শান্তির ভবতু।  
ওম সর্ব্বেসাম পূর্নম ভবেতু। 
ওম সর্ব্বেসাম মঙ্গলম ভবতু। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম। ।            
 





           




        





















    

Thursday 7 March 2019

ধ্যান ও সাধনা - মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্তের বই - "তত্ত্বজ্ঞান-দ্বিতীয় খণ্ড- সাধনা " অবলম্বনে

ধ্যান ও সাধনা  



 মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্তের বই - "তত্ত্বজ্ঞান-দ্বিতীয় খণ্ড- সাধনা " অবলম্বনে

সাধনা - কথাটা খুবই প্রচলিত। কিন্তু সাধনা বলতে আমরা কি বুঝি ? মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন অভ্যাসকে সাধনা বলে।  যেকোনো সফলতার  পিছনে থাকে সাধনা। যে কোনো সফলব্যক্তির পেছেনে থাকে সাধনা। এই সাধনা বা অভ্যাস দুই প্রকার।  এক -পার্থিব বা বাহ্যিক জগৎ সম্মন্ধীয় সাধনা। আর দুই - আধ্যাত্মিক বা সূক্ষ্মাজগৎ সংক্রান্ত সাধনা। পার্থিব বা বাহ্যিক জগৎ সম্মন্ধীয় সাধনা দ্বারা আমরা পার্থিব জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন  করতে পারি। আমাদের জাগতিক জগতের উন্নতি এই সাধনবলেই সম্পন্ন হয়েছে। অন্যদিকে,  আধ্যাত্মিক বা সূক্ষ্ম জগৎ সংক্রান্ত সাধনা থেকে আমরা সূক্ষ্ম জগৎ সম্পর্কে জানতে পারি। পরিণামে,  ব্রহ্মজ্ঞানের প্রাপ্তি হয়ে থাকে। মহাত্মা বলছেন : যে অভ্যাস প্রভাবে মানুষের দোষরাশি গুণরাশিতে পরিণত হয়, আত্মার সতেজ দশা সংসাধিত হয়  এবং পরিশেষে জীব বা জীব-আত্মা পূর্ণস্বরূপ সৎ-চিদানন্দ  অনন্ত মহার্ণবে সুনিমগ্ন হয় - সেটাই আধ্যাত্মিক সাধনা। আসলে  গুরুদেবের লেখা পান্ডিত্যে ভরা। সহজ পাচ্য নয়। তাই আমরা  আমাদের মতো করে সহজ ভাষায় বিষয়ে প্রবেশ করবো।

গুরুদেব বলছেন, সাধনা এমন একটি বিষয় যে তুমি চাও বা না  চাও, ইচ্ছা করো বা না করো, তোমাকে কোনো না কোনো সাধনা করতেই হবে। এই যে ইচ্ছার উর্দ্ধে যে সাধনা, আমাদের আপনা আপনি হয়, তাকে বলে ব্যতিরেকি সাধনা। আসলে সেই মঙ্গলময় অনন্ত পুরুষ, পূর্ণ পুরুষ, তাঁর ইচ্ছে পূরণের জন্য, তিনি এই সাধনা আমাদের দিয়ে করান। তিনি চান তার অংশ সমূহকে কালে কালে অনন্ত শক্তি প্রদান করতে। তাই ব্যতিরেকি সাধনা, মঙ্গলময়ের নিয়মে, আপনা আপনি হয়, প্রাকৃতিক ভাবেই হয়।  এর জন্য আমাদের কোনো প্রয়াস করতে হয় না। এক টুকরো বীজ কোথাও পড়ে থাকলে, বিনা চেষ্টাতেই, অঙ্কুর উদ্গম হবে। কালে কালে গাছে বা বৃক্ষে পরিণত হবে। জীবের , শৈশব  থেকে কৈশোর, কৈশোর   থেকে যৌবন, যৌবন থেকে প্রৌঢ়, প্রৌঢ়  থেকে বৃদ্ধ - এই উন্নতি বা ক্রমবিকাশ আপনা আপনি হয়।  এর জন্য আমাদের কিছু করতে হয় না।এমন কি মৃত্যুর জন্যেও আমাদের কিছু করতে হয় না।    আমাদের হজম করার জন্য কিছু করতে হয় না। চোখের পাতা আপনা আপনি পড়ে। এর জন্য আমাদের আলাদা করে কিছু করতে হয় না। গুরুদেব বলছেন, এগুলো যদি তুমি সচেতন ভাবে করো, তবে তোমার মঙ্গল হবে। এবং এই সচেতন ভাবে করাকেই সাধনা বা ধ্যান বলে। ধ্যান অর্থাৎ মনোযোগ, বা চেতন বা জাগ্রত অবস্থায় কিছু করা। অমনোযোগী হয়ে করা  আর মনোযোগ সহকারে করার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে । যে কোনো কাজ মনোযোগ সহকারে করলে সেটা উৎকৃষ্ট ফল দেবে, আর মনোযোগ না দিয়ে করলে সেটা যেমন তেমন হবে।

তুমি  বাল্য অবস্থায় বৃদ্ধ আবার বৃদ্ধ অবস্থায় বালক হতে পারো, যদি তুমি চেষ্টা করো, সাধনা করো, সচেতন থাকো। চেষ্টা করলে যে কোনো অবস্থায় তুমি আনন্দে থাকতে পারো। আর চেষ্টা না করলে তুমি সময়ের দাস, পরিস্থিতির দাস হয়ে যাবে।  এবং পরিস্থিতি তোমাকে সুখ দুঃখের অনুভূতি দেবে। আর তুমি যদি সচেতন থাকো, তবে পরিস্থিতি তোমার দাস হয়ে যাবে। আর তুমি সাম্যাবস্থায় অবস্থান করবে। সাধনা করা আর না করার মধ্যে এখানেই পার্থক্য।

গুরুদেব বলছেন - যত প্রাতঃস্মরণীয় পুরুষ সবাই সাধনা করেই পাশমুক্ত হয়েছেন। তা সে দেবাদিদেব মহাদেব বলুন,  কার্ত্তিক - গনেশ বলুন  আর কংশ -ধ্বংস কারী কৃষ্ণ বলুন আর ধনুকধারী রাম
বলুন , সবাই সাধন বলেই শক্তি অর্জন করেছেন। বুদ্ধদেব বলুন আর যীশু বলুন, মোহাম্মদ বলুন আর মহাবীর বলুন সবাই সাধন বলেই শক্তি অর্জন করেছেন। অতএব সাধনাই শক্তি, জ্ঞান, প্রেম , পরমানন্দ লাভের একমাত্র ও অদ্বিতীয় পথ।

সাধনার বিভাগ :

আমরা আগেই বলেছি সাধনা দুই প্রকার : আধ্যাত্মিক ও পার্থিব।  আবার আধ্যাত্মিক সাধনা দুই রকম। এক - অন্বয়ি সাধনা  ; দুই - ব্যতিরেকি  সাধনা।

অন্বয়ি সাধনা  :  মহাত্মা বলছেন - সাধনীয় বিষয়ের অংশতঃ সাধনা-সহকারে সমুদায়ের সাধনা করা যার বিষয়, তাকে অন্বয়ি সাধনা বলে। মনে করো ধর্মে বিশ্বাস করতে হবে।  তাহলে ধর্মের উপকারিতা অল্প অল্প জ্ঞাত হয়ে, ধীরে ধীরে ধর্মের প্রতি বিশ্বাস, বা আগ্রহ বাড়িয়ে ধর্মে লিপ্ত হওয়াকে অন্বয়ি সাধনা বলে।  অর্থাৎ ধীরে ধীরে কোনো বিষয়ের প্রতি নিবিষ্ট চিত্ত হওয়াকে অন্বয়ি সাধনা বলে।

ব্যতিরেকি সাধনা : ধর্মাচরণ না করার ফলে যে অপকারিতা হয় তা পদে পদে অনুভব করে, বা দেখে  ধর্মে বিশ্বাস অর্জনকে ব্যতিরেকি সাধনা বলে।

আধ্যাত্মিক সাধনাকে আবার শ্রেয়ঃ ও প্রেয়ো ভেদে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সাংসারিক কাজ সম্পূর্ণ ভাবে পরিত্যাগ করে সাধনাকে শ্রেয়ঃ সাধনা বলা হয়। শ্রেয়ঃ সাধক বলেন সংসারে থেকে সাধন হয় না। তাই এখনই সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়ো। অন্যদিকে প্রেয়ো সাধক বলেন, সংসারে থেকেই  মাতা-পিতার সেবা করো, স্ত্রী-পুত্রের প্রতি কর্তব্য পালন করো, তাদের ভালোবাসলেই, ঈশ্বরের সেবা করা হবে । গুরুদেব বলছেন প্রথমে প্রেয় পথ পরে শ্রেয়ঃ পথ অবলম্বন করা কর্তব্য।

এ ছাড়া যোগ সাধনা, গুন্ সাধনা, মন্ত্র  সাধনা - অর্থাৎ যোগ সাধনা বা শারিরীক কসরত দ্বারা  শরীরকে সুস্থ রেখে ঈশ্বরে নিবিষ্টচিত্ত হওয়াকে যোগ সাধনা বলে। মংত্র সাধনা আসলে শব্দ বা ধনির সাহায্যে ঈশ্বর অনুভূতি বা সাক্ষাৎ লাভ। এর পর গুন্ সাধনা। ঈশ্বর  অনন্ত গুনের অধিকারী।  তাঁর সেই গুনের সাধনা অর্থাৎ অভ্যাস দ্বারা নিজেকে উন্নত করা, একেই গুন্ সাধনা বলে।

এর পর আছে , সশক্তিক সাধনা এবং নিঃশক্তিক সাধনা। অর্থাৎ ক্রমশঃ শক্তি সঞ্চয় করে নিজেকে পূর্ণব্রহ্মের অন্তর্গত হওয়াকে সশক্তিক সাধনা বলে। আর আমার কিছুই নাই , আমি সর্বশূন্য, সবই তুমি  এই ভাব অবলম্বন করে যে সাধনা তাকে নিঃশক্তিক সাধনা বলে।

এতক্ষন মহাত্মা গুরুনাথ সাধনার প্রকারভেদ বোঝাচ্ছিলেন।  এবার সাধকের কি কি করা উচিত সে সম্পর্কে বলছেন।

সত্য : গুরুদেব বলছেন, সাধককে সর্বদা সত্য পথে চলতে হবে।  সর্বদা  সত্যব্রত অবলম্বন করতে হবে। সত্য ভাষণ, সত্যপথে গমন এবং পরম অবলম্ব-বোধে সত্য গ্রহণ করতে হবে। মহাত্মা বলছেন, তোমার মধ্যে যখন অটলভাবে সত্য প্রতিষ্ঠা হবে, তখন তুমি যা বলবে তাই সত্য হবে। সাধক তখন রোগীকে রোগ মুক্ত করাতে পারবে। নির্ধনকে ধন লাভ করাতে পারবে। অভক্তকে ভক্তি লাভ করাতে পারবে। অর্থাৎসত্যেপ্রতিষ্ঠ  সাধক  মুখে যা বলবেন, বাস্তবে তাই হবে।

অহিংসা : অর্থাৎ হিংসা না করা। গুরুদেব বলছেন হিংসা দুই রকম - এক : প্রাণী বধ জনিত হিংসা ;
 দুই : প্রাণী পীড়ন জনিত হিংসা। অহিংস ব্যক্তি সদা আনন্দে থাকে। শুধু আনন্দে থাকে না, অহিংস ব্যক্তির আশেপাশে একটা অহিংস-পরিবেশ তৈরী হয়। ফলতঃ অহিংস ব্যক্তির আশেপাশে যারা থাকে এমনকি জীব জন্তুও অহিংস হয়ে যায়, এটা আপনা আপনি হয়ে পড়ে । হিংসা, হিংসাকে ডেকে  আনে।  আসলে তুমি যা দিচ্ছো - সেটা তরঙ্গ আকারে ছাড়িয়ে পড়ে।  ফলে অহিংস সাধককে ঘিরে  একটা অহিংসার  বাতাবরণ তৈরি হয়।
অহিংসার কথা বলতে গিয়ে গুরুদেব আমাদেরকে সতর্ক করেছেন : বলছেন আমরা অনেকে মনে করি : আমরা মাছ-মাংস খাই বটে, কিন্তু মাছ ধরি না, মারি না, রান্নাও করি না তবে আমরা কি ভাবে দোষী হবো ? গুরুদেব বলছেন : আহরণকারী - অনুমতিদায়ক - বধকারী -  ক্রয়-বিক্রয় কারী -সংস্কারকারী ও উপভোগকারী এই ছয়জনই খাদক। অতয়েব গুরুদেবের কথা অনুযায়ী এই সব বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, যদি কিনা আমরা সত্যিকারের সার্থক অহিংস-সাধক হতে চাই।

অস্তেয় : বা  চুরি না  করা, অর্থাৎ ধনস্বামীর অনিচ্ছায় বা অজ্ঞাতসারে তার ধন গ্রহণ করাকে চুরি করা বা স্তেয় বলে। শুধু চুরি করা না, চুরি করার কথা ভাবাও পাপ। গুরুদেব বলছেন : মানুষের মন থেকে যখন পরধন গ্রহণের ইচ্ছা সম্পূর্ণ ভাবে দূরীভূত হয়, তখন এক বিচিত্র ব্যাপার সংগঠিত হয়। যে ধনের জন্য মানুষ চৌর্য্য বৃত্তি অবলম্বন করে সেই  ধন-রত্ন রাশীকৃত রূপে সাধকের পদানত হয়।

ব্রহ্মচর্য্য :  ব্রহ্মচর্য কথাটির মানে বীর্যকে রক্ষা করা। বীর্য হচ্ছে রক্তের নির্যাস। দুধ থেকে যেমন ঘি মাখন হয় - তেমনি মানুষের রক্ত থেকে তৈরি হয় বীর্য। এই বীর্য ধী শক্তি বর্ধক।  প্রাণ সৃষ্টির পুরুষাকার, এই বীর্যের মধ্যে অবস্থান করে। এটি আমাদের লিঙ্গমূলে অবস্থান করে। এই শক্তি তমগুনে নিম্নগামী হয় হয়, অর্থাৎ প্রকৃতির দিকে ধাবিত হয়।  আবার রজ গুনে এই শক্তি ঊর্ধ্বগামী হয়। কুণ্ডলিনী জাগ্রত হওয়া মানে এই বীর্যের যে শক্তি অর্থাৎ ঊর্যাশক্তি সুষুম্না নারী বেয়ে উর্ধগামী হওয়া। অতএব  বীর্য রক্ষা করা মানে আপনার ঊর্যাশক্তি বৃদ্ধি পাওয়া। আপনার মন - শরীর এক অপূর্ব বলবতি-অনাবিল   আনন্দে চনমন করবে যদি আপনার ঊর্যাশক্তি বৃদ্ধি পায় । গুরুদেব বলছেন ব্রহ্মচর্য  পালন না করলে মানুষ কখনোই মহৎ কর্মে  সিদ্ধমনোরথ হতে পারে না।

অপরিগ্রহ : অপরিগ্রহ কথাটার মানে অন্যের কাছ থেকে কোনো দ্রব্য না নেওয়া। অর্থাৎ দান গ্রহণ না করা। আগে বলেছেন চুরি না করতে অর্থাৎ না বলে কিছু না নিতে, এবার বলছেন দান গ্রহণ না করতে। গুরুদেব বলছেন দান গ্রহণ করলে দাতার মধ্যে যে নিকৃষ্ট ভাব, গ্রহীতার মধ্যে সেটা চলে আসতে  পারে। এ ছাড়া  তুমি কারুর কাছ থেকে দান গ্রহণ করার ফলে  দাতার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বে। তোমার মন বিশুদ্ধ থাকবে না। তুমি দাতার অনুগ্রহের পাত্র হয়ে যাবে। মহাত্মারা সদা সর্বদা মাথা উঁচু করে বাঁচেন। কিন্তু পরিগ্রহ করলে অর্থাৎ দান গ্রহণ করলে তোমার মন বিশুদ্ধ থাকতে পারে না। আর মন যখন তোমার শুদ্ধ পথে চলবে তখনি তুমি মুক্তিপথে অগ্রগামী হতে পারবে। গুরুদেব বলছেন অপরিগ্রহে প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্ব জন্মের বিষয় জানা যায়।

শৌচ :  শৌচ অর্থাৎ শুচিত্ব। এটি দুই প্রকার।  একটা হচ্ছে বাহ্যিক শুচিত্ব - যা আমরা শরীর  পরিষ্কার, বেশভূষা পরিষ্কার ইত্যাদির মাধ্যমে রাখতে পারি।  আর একটা হচ্ছে আভ্যন্তরীণ শুচিত্ব যা আমাদের জ্ঞান ও তপস্যা দ্বারা করতে হবে। আসলে এটি অন্তঃকরণের শুদ্ধি। এই  অভ্যন্তরীণ শুচিত্বই প্রধান। এই অভ্যন্তরীণ শৌচ থেকেই মনের প্রফুল্ল্তা আসে, একাগ্রতা আসে,আমরা ইন্দ্রিয়কে জয়  করতে পারি অর্থাৎ জিতেন্দ্রিয় হতে পারি।  এবং সর্বপরি আমাদের আত্মদর্শনের ক্ষমতা জন্মে এই অভ্যন্তরীণ শুচিতা থেকেই। তাই আমাদের সর্বদা শৌচ বজায় রাখতে হবে তা সে শারীরিক হোক আর অন্তঃকরণের হোক। এটাই আমাদের আত্ম-দর্শনের পথ দেখাবে।

সন্তোষ :  বর্তমান বা উপস্থিত অবস্থাতে তৃপ্ত থাকা। এতেই পরম সুখ লাভ হবে। তোমার যা কিছু আছে তাতেই তুমি সুখী হও। ঈশ্বর যা কিছু দিয়েছেন তাতেই তুমি তৃপ্ত হও। আসলে ঈশ্বর প্রদত্ত সম্পদের পরিমাপ করতে পারিনা না বলে আমরা ভাবি কম পড়ে  গেল, আর এই কম পড়ার বেদনা আমাদেরকে  কস্তূরী  মৃগের মতো চঞ্চল করে তোলে। আমরা জাগতিক সুখের আশায় দাপাদাপি করি আর কষ্ট ভোগ করি। প্রকৃত জ্ঞান আমাদের সন্তোষ দিতে পারে।  তাই জ্ঞানী সর্বদা সন্তোষ লাভ করেন। আমরা যারা অজ্ঞান সর্বদা অতৃপ্তিতে ভুগি ও কষ্ট পাই।

তপস্যা : নিবিষ্ট চিত্তে, কঠোর ক্লেশ স্বীকার করে, নিজ নিজ কর্মে লিপ্ত থাকাকেই তপস্যা বলে। জঙ্গলে, পাহাড়ে, নদীর  পাড়ে একাকী বসে থাকাকেই তপস্যা বলে না। তপস্যা হচ্ছে, স্ব - স্ব -ধর্ম- কর্মে নিবিষ্ট চিত্ত  হওয়া, একাগ্র হওয়া, যা কিছু করছো তাতে সমস্ত শক্তি নিয়োগ করা। গুরুদেব বলছেন  এই তপস্যা বলেই মানুষ অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন হতে পারে। দূরশ্রবণ -দূরদর্শন  ক্ষমতা এই তপস্যা বলেই হতে পারে।

স্বাধ্যায় : বার বার একই জিনিস করাকে স্বাধ্যায় বলে। যে কোনো জিনিস বার বার করলে সেই কর্মের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। পাথরের উপরে মাটির কলসি রাখলে  কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে না।  কিন্তু  একই পাথরের উপরে প্রতিদিন কলসি  রাখলে দেখবেন সেখানে কলসির  পশ্চাৎদেশের আকার নেবে। প্রতিনিয়ত পাথরের উপরে জল পড়লে পাথর পর্যন্ত ক্ষয়ে যাবে।  তাই বার বার বীজ মন্ত্রের জপ্ করুন জপের সুফল অনুভব করবেন। বার বার করে ধর্মশাস্ত্রের পাঠ করুন, দেখবেন আপনার উপল্বদ্ধির স্তরে নতুন নতুন অনুভূতি দেবে।  আপনি আগে যা বোঝেননি , তা বুঝতে পারবেন। গুরুদেব বলছেন বেদই স্বাধ্যায় শব্দ বাচ্য।  মন্ত্র-উচ্চারণ বারবার করলে অভিলষিত দেবাদি দর্শন লাভ হয়। সৎশাস্ত্র পাঠে বহু বিষয়ে জ্ঞান জন্মে।

ঈশ্বর উপাসনা :  ঈশ্বরের কাছে উপবেশনই উপাসনা। প্রতিদিন নিয়ম করে উপাসনা করুন।  গুরুদেব বলছেন এই উপাসনার প্রভাবেই সত্য, অহিংসা, অস্তেয়  প্রভৃতি সহজেই প্রতিষ্ঠিত হয়। নিয়মিত যে উপাসনা করে তার শক্তির সীমা নেই। গুরুদেব বলছেন এই উপাসনা বলেই ধ্যান, ধারণা, সমাধি প্রভৃতি সহজেই আয়ত্ব করতে পারেন। আপনারা সবাই জানেন সত্যধর্মে উপাসনাকে সবথেকে বেশি  গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

প্রত্যাহার : প্রত্যাহার কথাটা মানে হচ্ছে ত্যাগ বা সরিয়ে দেওয়া। ইন্দ্রিয়গণ যখন তাদের স্বাভাবিক ধৰ্ম অর্থাৎ কান দ্বারা শব্দ গ্রহণ,ত্বক দ্বারা স্পর্শ গ্রহণ, চোখ দ্বারা রূপ গ্রহণ, জিব্বা দ্বারা রস গ্রহণ, নাক দ্বারা ঘ্রান গ্রহণ, এই সকল গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বিরত থেকে চিত্ত যখন  স্বরূপে অনুকরণ করে - তখন তাকে প্রত্যাহার বলে। ধ্যান করার যার অভ্যাস আছে তিনি বুঝতে পারবেন - প্রথম প্রথম ধ্যান করার সময়, নানান অবাঞ্চিত দৃশ্য, অবাঞ্চিত শব্দ ভেসে আসে। এই অবাঞ্চিত শব্দ-দৃশ্য উপেক্ষা করে চিত্তে মন স্থির করতে হয়। এই যে অবাঞ্চিত শব্দ-দৃশ্য-গন্ধ, এগুলোকে উপেক্ষা করাকেই বলে  প্রত্যাহার।

ধারণা :  মনকে বিষয়-বিশেষে বদ্ধ  রাখার নাম ধারণা।  প্রত্যাহারে আমাদের  ইন্দ্রিয়গণ বিষয় ত্যাগ করে চিত্তে লীন-প্রায় হয় , আর ধারণায় ইন্দ্রিয়ের চিত্তে লীনপ্রায় অবস্থায় মন সেই বিষয় বিশেষে নিযুক্ত থাকে। আমাদের  এই অবস্থায় আমাদের মন ও ইন্দ্রিয়গণ বিশেষ বিষয়ে অর্থাৎ ইস্টে নিযুক্ত বা আবদ্ধ হয়ে যায়। বাহ্যিক বিষয়বোধ প্রায়  লোপ পেয়ে যায় ।

ধ্যান : অনন্য  চিত্ত হয়ে লক্ষ্যে  বা ইস্টে স্থিতিই ধ্যান। অর্থাৎ যাকে  তুমি জানতে চাও তা সে সাকার-ই  হোক আর নিরাকার-ই হোক তার মধ্যে যখন চিত্ত  স্থির হয়, তখন তাকে ধ্যান বলে। এই সময়ে ইস্ট ভিন্ন অন্য কোনো কিছু চিত্তে প্রতিফলিত হয় না। কেবল ইস্ট চিন্তন থাকে, এবং এই ইস্ট চিন্তনকে ধ্যান বলে।

চিত্তকে কোনো পদার্থে বন্ধ রাখার নাম ধারণা।  আর সেই পদার্থে যদি জ্ঞানের তন্ময়তা হয় তবে তাকে ধ্যান বলে। অর্থাৎ ধারণা  থেকে ধ্যান আরো সূক্ষ্ম।

এই সূক্ষ্মতার তারতম্য অনুসারে ধ্যান ত্রিবিধ। স্থুল, জ্যোতির্ধ্যান, পর-ব্রহ্মের ধ্যান।  গুরুদেবের বা পিতামাতার,বা দেবদেবতার ধ্যানকে স্থুল  ধ্যান বলে। ধ্যানের সময় যখন শুধু জ্যোতি বর্তমান থাকে তখন জ্যোতির্ধ্যান বলে। আর কুণ্ডলিনী জাগ্রত হয়ে অর্থাৎ উর্জা শক্তি জাগ্রত হয়ে যখন সহস্রার বা বিন্দুতে মন স্থির হয়, তখন তাকে পর - ব্রহ্মের  ধ্যান বলে। ধ্যান দ্বারা বিভূতি জন্মে। বিভূতিকে উপেক্ষা করে ধ্যান প্রক্রিয়া চালিয়ে গেলে তত্বজ্ঞান জন্মে।

গুরুদেব বলছেন : ধ্যানের সাতটি পর্যায় : ঘোরতর অন্ধকার - তারপরে বিরল অন্ধকার - তারপরে মূর্তি দর্শন - তারপরে দেব-জ্যোতিঃ দর্শন - তার পরে বিভিন্ন দেবদেবতার সহিত কথাপোকথন - এর পরে ব্রহ্ম-তেজ মাত্র দর্শন  - একদম শেষে ব্রহ্ম দর্শন।

সমাধি : বিচ্ছেদ বিহীন ভাবে , অর্থাৎ নিরলস ভাবে ধ্যান প্রক্রিয়া চালিয়ে গেলে ধ্যান সমাধিতে পরিণত হয়। ধ্যানে বাহ্য জ্ঞানের আভাস থাকে। সমাধিতে বাহ্য জ্ঞান লোপ পায়। এই অবস্থা চলতে থাকলে তার শরীর  বোধ লোপ পায়, ক্ষুধা তৃষ্ণা বোধ থাকে না, কর্তব্য-অকর্তব্য বোধ থাকে না, বাহ্যিক হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে যান । এই সময় তার শরীর  রক্ষার জন্য অন্যের সাহায্য দরকার পড়ে। এই সময় তাকে ঘিরে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে যা সাধক উপেক্ষা করে, কিন্তু ঘটে। তিনি তখন ব্ৰহ্মময়, জগৎ অসত্য হয়ে যায়। শরীর  রক্ষার কোনো তাগিত না থাকায় অচিরেই তিনি দেহ ত্যাগ করেন।
ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ। .......

সাধনা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে গুরুদেব আরো দুটো কথা বলেছেন তার মধ্যে একটি হলো আসন ও অপরটি হলো প্রাণায়াম।

আসন : যেরূপ বসলে কোনো কষ্ট বোধ হয় না, অথচ শরীর  স্থির থাকতে পারে, তাকেই আসন বলে। যেমন পদ্মাসন , বীরাসন, স্বস্তিকাসন, ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যি কথা বলতে কি, আসনের সঙ্গে ঈশ্বরের সাধনার কোনো যোগ নেই। কিন্তু দেহভিন্ন যে হেতু সাধনা চলে না তাই আসনাদি অভ্যাস করে শরীরকে সাধনার উপযোগী করে রাখা জরুরী বলে হঠযোগীরা মনে করেন।আসলে ধ্যান আর আসন একসাথে উচ্চারিত হয়। ধ্যান করতে গেলে প্রাথমিক ভাবে স্থির আসনে বসা জরুরি। শরীর  অসুস্থ থাকলে চিত্ত-মন অস্থির হবে, আপনি স্থির হয়ে বসতেই পারবেন না। আপনার ধ্যান সমাধি কিছুই হবে না। তাই হঠযোগীরা সাধনা আরম্ভের শুরুতে এই আসন অভ্যাস করার পক্ষপাতী।

প্রাণায়াম : প্রাণ অর্থাৎ জীবনীশক্তির আয়াম অর্থাৎ বিস্তার যা থেকে হয় তাকে প্রাণায়াম বলে। বায়ু পূরণ, বায়ু ধারণ ও বায়ু রেচন অর্থাৎ পূরক, কুম্ভক , ও রেচক  এগুলো নির্দিষ্ট সময় ধরে করাকে প্রাণায়াম বলে। এই প্রাণায়ামের সাহায্যে মানুষ দীর্ঘজীবী হতে পারে। একটি নির্দিষ্ট সময়ধরে প্রাণ বায়ুকে নিয়ন্ত্রিত করাকেই প্রাণায়াম বলে।  গুরুদেব বলছেন ১২, ২৪, অথবা ৩৬ সেকেন্ড ধরে বায়ু নিন বা পূরণ করুন, এর পর এর চতুর্গুণ সময় ৪৮,৯৬, এবং ১৪৪ সেকেন্ড সময় ধারণ করুন অর্থাৎ কুম্ভক করুন। তার পরে ২৪,৪৮,৭২ সেকেন্ড ধরে রেচক করুন। এতে আপনার জীবনী শক্তি বৃদ্ধি পাবে। আপনার চেতন শক্তি বৃদ্ধি পাবে। এটি একটি শক্তিশালী প্রক্রিয়া।  গুরুর আশ্রয়ে থেকে এই প্রক্রিয়ার অভ্যাস করতে হয়। কেননা এই প্রক্রিয়ায় মানুষের শরীরের স্বাভাবিক স্পন্দন বাধাপ্রাপ্ত হয়। কখন এই প্রক্রিয়া করতে হবে, কতক্ষন করতে হবে, অস্বাভাবিক অবস্থায় কি করতে হবে, কখন বিশ্রাম  নিতে হবে, এগুলো শরীর  বুঝে করতে হবে। সবার জন্য যেহেতু সময়ক্রম একই রকম হবে না, তাই নির্দেশক বা গুরুর সাহায্য ছাড়া করা উচিত নয়। এতে মানুষ পাগল হয়ে যেতে  পারে।  এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তাই সাবধান থাকবেন।  নিতান্ত কৌতহলের বশে এই পথে পা দেবেন না।

গুরুদেব বলছেন এসব আসন-প্রাণায়াম করে কোনো লাভ নেই, বরং প্রকৃত গুরুর উপদেশ অনুসারে কাজ করলে আধ্যাতিক বিষয়ে উন্নতি লাভ সহজ হবে। তাই ঈশ্বর বিষয়ে অনুশীলন করো।  ধ্যান-ধারণায় প্রবৃত্ত হও।  ভক্তবৎসল দয়াময়ের দয়ায় জানতে পারবে তিনি জ্ঞান স্বরূপ।  এবং তিনিই একমাত্র জ্ঞান স্বরূপ। বাহ্য চেষ্টায় বহু বছরেও জ্ঞান লাভ হয় না, তার উপাসনা করো, তবে অতি অল্প সময়ে "ব্রহ্ম সত্যং জ্ঞানম্" এই উপলব্ধি  তোমার হবে। তিনি অনন্ত কিন্তু আনন্দ স্বরূপ।  তিনি প্রেমময়। গুরুদেব বলছেন তুমি উপাসনা ও ধ্যানে ব্যাপৃত থাকো - আর অনুভব করো - জগদীশ্বর সর্বশক্তিমান ; জগদীশ্বর সর্বব্যাপী ; জগদীশ্বর মঙ্গলময়। এই প্রত্যয়  সমস্ত সাধকের, সমস্ত সত্যধর্ম  অনুরাগীর মধ্যে  পরিস্ফুট হবে। অতএব গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথসেনগুপ্ত  বলছেন ধর্মার্থী  ও মোক্ষার্থী উভয়েরই প্রথম কর্তব্য উপাসনা ও ধ্যান।


ধ্যান 

এতক্ষন আমরা মহাত্মা গুরুনাথের বই "তত্ত্বজ্ঞান - সাধনা" বই থেকে সাধনা সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। এবার আমরা একটু  প্রাসঙ্গিক অন্য্ কথা আলোচনা করবো। সত্যধর্মের অনুষ্ঠানে গেলে প্রধানতঃ যা শুনতে পাওয়া যায়, বা দেখতে পাওয়া যায় তা হলো উপাসনা।  এই উপাসনায় গানই প্রধান অঙ্গ। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জাগে গুরুদেব কি শুধু উপাসনা করেই সাধনা সারতেন ? বা উপাসনা করেই জগদীশ্বরের সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন ? না কি অন্য্ কিছু করতেন ? গুরুদেবের জীবনীতে পড়েছি  তিনি কয়েকজন  বন্ধু মিলে নির্জন ঘরে ধ্যান করতেন। এবং এই ধ্যানেই মহাত্মাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন।  এবং তাদের কাছ থেকেই এই মহান ধর্মের বার্তা পেয়েছিলেন। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, উপাসনাই  ঈশ্বর সাধনার একমাত্র পথ নয়। গুরুদেব তার তত্ত্বজ্ঞান - উপাসনা বইয়ে একজায়গায় বলেছেন : নিষ্পাপ মহাত্মারা কোনো কারণে পাপস্পষ্ট হলে একমাত্র গুনকীর্তন দ্বারাই পাপমুক্ত হতে পারেন। অর্থাৎ গুণকীর্তনে এটি শক্তি। আর পাপাচারণ-শীলদিগের অর্থাৎ এখনো যারা পাপ আচরণ করে বেড়াচ্ছেন তাদের জন্য  গুনকীর্তন ও প্রার্থনা দুইই  করা দরকার। গুরুদেব বলছেন উপাসনা সাধারণ ভাষায় বা স্তোত্র দ্বারা অথবা সংগীত  সহযোগে করা যেতে পারে। অথবা এই মহান ব্যাপার ধ্যান করেও  সুসম্পন্ন করা যেতে পারে। যারা নিষ্পাপ স্থিরচিত্ত তাদের পক্ষে ধ্যানই প্রশস্ত। কিন্তু যারা পাপী ও চঞ্চল চিত্ত, তাদের পক্ষে গানই সর্ব্বপ্রধান উপাসনার উপায়। আমি মনে করি না যে সত্য ধর্মে যারা আছেন সবাই পাপী বা অস্থির চিত্ত। বরং আমি মনে করি আমরা সবাই নিষ্পাপ, ঈশ্বরের সন্তান।  সমস্ত সত্ সতীই পরম পিতা পরম-ঈশ্বরের অংশ।   এমন মানুষ নিশ্চই আছেন যারা ধ্যান করার যোগ্য। অর্থাৎ স্থির চিত্ত ও নিষ্পাপ।  তাদের কথা ভেবে আমরা এখন ধ্যান সম্পর্কে আলোচনা করবো। আর একটা কথা, চঞ্চল মনকে শান্ত করতে ধ্যানের থেকে উৎকৃষ্ট আর কিছু নেই। তাই ধ্যান করা  আমাদের সবার পক্ষেই ভালো এবং আমি মনে করি উৎকৃষ্ট ।


গুরুদেব বলছেন : ধ্যানের সাতটি পর্যায় : ঘোরতর অন্ধকার - তারপরে বিরল অন্ধকার - তারপরে মূর্তি দর্শন - তারপরে দেব-জ্যোতিঃ দর্শন - তার পরে বিভিন্ন দেবদেবতার সহিত কথাপোকথন - এর পরে ব্রহ্ম-তেজ মাত্র দর্শন  - একদম শেষে ব্রহ্ম দর্শন। গুরুদেব ধ্যান  সম্পর্কে এইযে ক্রোম-পর্যায় বলছেন এটি  সাধারণ ব্যাখ্যা মাত্র। আসলে এটা এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম হয়। বিবেকানন্দ চোখ বুজলেই জ্যোতি দেখতেন। আপনি ধ্যানে বসলে  আপনার সুখ দুঃখের স্মৃতি, আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা,  অবাঞ্চিত অজানা দৃশ্য, মূর্তি ইত্যাদি আপনার চিন্তায় আসতে  পারে। এই দর্শন বা চিন্তা এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম হয়। এগুলো নিয়ে আমরা পারে আলোচনা করবো।
ধ্যান সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণা আছে যে, এ সব সাধু মহারাজদের কাজ। আমরা যারা সংসারী তাদের জন্য ধ্যান নয়। আমাদের জন্য পূজা, অর্চনাই যথেষ্ট। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। বরং আমাদেরই বেশি করে ধ্যান করা উচিত। কারন সংসার করতে গিয়ে আমাদের অনেক মানসিক চাপে থাকতে হয়। আমাদের রোগ শোকও বেশী।  আমরা অল্পতে ভেঙে পড়ি। প্রথমেই বলি, ধ্যান করলে মন শান্ত হয়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে  নিয়মিত ধ্যান করলে হার্টের ছোটোখাটো রোগ ভালো হয়। রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে। শরীরে একটা ভারসাম্য বজায় থাকে।প্রচুর উর্জাশক্তি আহরণের এটি একটি উৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে ধ্যান ।   ফলে আমরা আনন্দে থাকতে পারি।  একটা বৈরাগ্যের ভাব আসে যা আমাদেরকে শান্তি এনে দেয়। তবুও বলি ধ্যানের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু এগুলো নয়।  ধ্যানের  মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে - সত্যকে জানা -সত্যে প্রতিষ্ঠিত হওয়া-সত্যকে আবিষ্কার করা। 

এতক্ষন আমরা ধ্যান করার কথা বলছিলাম, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি  ধ্যান করা যায় না, ধ্যান হয়।  ধারণা করা যায়।  ধ্যান করা যায় না। ধারণা, প্রত্যাহার, ও ধ্যান - ধ্যানের  এই তিনটি  ক্রম বা পর্যায়। মনে রাখবেন ধ্যানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যকে জানা। কি সেই  সত্য, যাকে আমাদের জানতে হবে ? আসলে আমি কে ? দৃশ্যমান জগৎ কি ? জগতের সঙ্গে আমার  সম্পর্ক কি ? এই সত্যকে আবিস্কার করাই ধ্যানের উদ্দেশ্য। আসলে, আমি কে - নিজেকে আগে জানতে হবে।  তার পর যাকে জানতে চাই তাকে জানতে হবে। তারপর  এই জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় এর মধ্যে কি সম্পর্ক তা জানতে হবে। এই জানার প্রক্রিয়াই ধ্যান।  আমরা ধ্যানের  তাত্বিক কথায় আজ  যাবো না। আমরা ধ্যানের প্রক্রিয়ার মধ্যে সরাসরি প্রবেশ করবো।  কারন এই প্রশ্নের উত্তর যদি আমি আপনাকে দিয়ে দেই তবে আপনার মধ্যে জ্ঞান হবে, কিন্তু সত্যকে যখন উপলব্ধি করবেন তখন এই জ্ঞান দিয়ে আপনি তাকে মেলাতে চাইবেন, বা মেলাতে চেষ্টা করবেন । এবং উপালবদ্ধজাত অনুভূতি আপনার বুদ্ধি দিয়ে সেঁকে তুলতে চাইবেন। তাই সেটা যথাযথ হবে না।

আর একটা কথা বলি - ধ্যান করতে গিয়ে সাধককে নানান বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। এক : শারীরিক বাঁধা - যেমন অসুস্থতা, আলস্য, আর সবথেকে বড়ো বাধা হচ্ছে ঘুম বা নিদ্রা।  আমি অনেককেই দেখেছি ধ্যানে বসে ঘুমুচ্ছে। ঘুমোলে কিন্তু ধ্যান হবে না।  তাই সচেতন থেকে, সজাগ থেকে আমরা ধ্যান করবো এটা মনে রাখতে হবে।  দুই : মানসিক বাঁধা অর্থাৎ অনিচ্ছা।  এ গুলোকে কাটিয়ে  উঠতে গেলে আপনাকে আসন, প্রাণায়াম অভ্যাস করতে হবে। প্রথমে ঘন্টা খানেক আসন-প্রাণায়াম করুন।  তারপরে ধ্যানে বসে যান। ধ্যান করার প্রথম শর্ত হলো শারীরিক অঙ্গ সঞ্চালন বন্ধ  করা। অর্থাৎ একভাবে দীর্ঘক্ষণ মেরুদণ্ড সোজা  করে  বসে থাকা। এর পর মনের চঞ্চলতাকে স্থির করা। এই মনের চঞ্চলতাকে স্থির করবার জন্য কোনো প্রয়াস না করে কেবল মনকে দেখতে থাকুন। অথবা কোনো বিষয়ের উপরে মনকে স্থির করুন। কিন্তু দেখবেন মন এক বিষয়ের উপরে স্থির থাকছে না। হঠাৎ খেয়াল করলেন, মন বিষয়ে নেই , তো তাকে আবার বিষয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসুন। এই যে আদিষ্ট বিষয় থেকে  বিষয়ান্তরে মন চলে যাচ্ছে, আর আপনি তাকে বিষয়ে নিয়ে আসছেন এই প্রক্রিয়ার নাম প্রত্যাহার। আর যে বিষয়কে আপনি আপনার লক্ষ করেছেন সেটি হচ্ছে ধারণা।

আপনারা যারা গুরুমন্ত্র জপ্ করেন তারা খেয়াল করবেন, আপনি হয়তো জপের মন্ত্র উচ্চারণ করে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনার মন  জপের মধ্যে নেই, অর্থাৎ জপ্-কে  যে মনন করা, তা হচ্ছে না। আবার হয়তো মনকে জপের মধ্যে নিয়ে এলেন।  যতক্ষন আপনার মন স্থির না হচ্ছে ততক্ষন এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এটাই প্রত্যাহার।  জপ্মন্ত্র  হচ্ছে আপনার ধারণার বিষয়। মন বিষয় থেকে বেরিয়ে যাওয়া -এটি আপনার দুর্বল ইচ্ছাশক্তির পরিচয়। এইখানে গুরু সহায়ক  হয়। প্রকৃত গুরুর কাছ থেকে যদি আপনি মন্ত্র  পান, তা সে আপনার জানা মন্ত্রই হোক, গুরু আপনার অবচেতন মনে মন্ত্রের মালা গেঁথে  দেবে। আপনার শরীরে মশা  পড়লে যেমন হাত আপনা থেকে এগিয়ে যায়, আপনার অজ্ঞাতসারেই এটা হয় ।  তেমনি আপনার জপ্ বন্ধ  হয়ে গেলে বা মন থেকে জপের মালা সড়ে গেলে, গুরুর ইচ্ছেই আপনার ইচ্ছে হয়ে যাবে, মন্ত্র আর মন এক হয়ে যাবে।  এর জন্য কোনো প্রয়াস করতে হয় না। এইখানেই গুরুকরণের সার্থকতা। মন্ত্র  তো আমরা বই পড়ে শিখে নিতে পারি।  কিন্তু গুরুপ্রদত্ত মন্ত্র, গুরুকৃপায় সর্বক্ষণ স্পন্দিত হতে থাকে। কিন্তু তাই বলে এটা ভাববেন না যে, নিরলস জপের মধ্যে আছেন বলে আপনি সত্যকে জেনে গেছেন। সত্য এখনো অনেক দূর।

মন যখন বিষয়ান্তরে চলে যাচ্ছে - আপনি আবার মনকে ধরে বিষয়ে নিয়ে আসছেন - এই প্রক্রিয়া বেশি দিন চলতে দেবেন না। মন যাক, আপনি এবার মনের সাক্ষী হয়ে যান। মন কি করছে শুধু তাই দেখতে থাকুন। ওকে ফেরাবার  চেষ্টা করবেন না। আপনি শুধু দেখতে থাকুন। একটা সময় মন হাঁপিয়ে উঠবে ও স্থির হয়ে যাবে। এইখানে একটা ব্যাপার খেয়াল করুন, আমি কে ? প্রথম প্রথম দেহকে আমি মনে হবে। তারপরে মনকে আমি মনে হবে। এইবার আমি যখন মনের সাক্ষী বা দ্রষ্টা হয়ে যাবো তখন বুঝতে পারবো, আমি না দেহ না মন, দেহ মন বাদে অন্য কিছু। এই অবস্থায়ই চলতে থাকুক।  আপনি শুধু দ্রষ্টা হয়ে যান।

এই অবস্থায় আপনি অনেক দৃশ্য, অনেক মূর্তি, দেখতে থাকবেন, এমনকি শব্দ শুনতে থাকবেন। এগুলো বিপর্যয় জ্ঞান। আপনার অনেক স্মৃতি ভেসে আসতে  থাকবে। আপনি অনাসক্ত থাকুন।

মাঝে মাঝে নিজের মধ্যে সন্দেহ জাগবে, আমি কি ভুল পথে যাচ্ছি ? মাঝে মাঝে ইচ্ছে হবে, এই অভিজ্ঞতা  অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে।  কিন্তু না গুরু ছাড়া অন্য কাউকে কিছু বলতে যাবেন না। নিজের মধ্যে রাখুন। প্রতিনিয়ত নিয়ম করে, নির্দিষ্ট জায়গায়, নির্দিষ্ট আসনে, ধ্যান প্রক্রিয়ার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখুন।পারলে খাতায় আপনার অভিজ্ঞাতার কথা লিখে রাখুন।  কিছুদিন পরে আপনার সন্দেহ কেটে যাবে। কোনো কিছুতে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস দুটোই ছেড়ে দিন।  আগে থেকে আপনার সঞ্চিত  জ্ঞান, বিচার বুদ্ধি দিয়ে মাপতে যাবেন না। শুধু দ্রষ্টা হয়ে যান।

এক স্বামীজীর মুখে শুনেছিলাম : ধ্যান হচ্ছে একটা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। মানুষই এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার আনন্দ গ্রহণ করতে পারে। অন্য কোনো জীব বা প্রাণী এই দুর্লভ আনন্দ পেতে পারে না। ধ্যান  হচ্ছে চূড়ান্ত ভাবে কিছুই না করা।  কোন কাজ নয় কোনো চিন্তা নয়, কোনো ভাবাবেগ নয়। কেবল তুমি আছো আর আছে পরম আনন্দ। কোথা থেকে এই পরম আনন্দ আসছে , যখন তুমি কিছুই করছো না ? এ কোনো জায়গা থেকে আসছে না। অথবা বলা যেতে পারে সব জায়গা থেকেই আসছে। এর কোনো কারন নেই।  আনন্দের মূল উপাদানই আনন্দ।

যখন তুমি কিছুই করছো না, মানসিক শারীরিক  অথবা অন্য কোনো ভাবে তুমি কিছুই করছো না, যখন তোমার সমস্ত কাজই  পরিত্যাগ করা হয়েছে, এবং তুমিই কেবল আছো, ঠিক এই অবস্থাকে বলে ধ্যান।  ধ্যান করা যায় না, ধ্যান অনুশীলনের দ্বারাও হয় না, কেবল অনুধাবন করতে হয়, উপলব্ধি করতে হয়, উপভোগ করতে হয়, অনুভব  করতে হয়।  যখনি তুমি সময় পাবে কিছুক্ষনের জন্য সমস্ত কাজ ছেড়ে দাও।  চিন্তা করাও  একটা কাজ, মনোনিবেশ করাও  একটা কাজ। অনুধাবন করাও  একটা কাজ।  যদি একটা মুহূর্তও তুমি কাজ না করে থাকতে পারো এবং নিজের কেন্দ্রে অবস্থান করো সমস্ত ছেড়ে দিয়ে তবেই হল ধ্যান। যদি এই কৌশল একবার আয়ত্ব করতে পারো - যতক্ষন ইচ্ছা তুমি এই অবস্থায় থাকতে পারবে।  অবশেষে তুমি এই অবস্থায় দিনে ২৪ ঘন্টা থাকতে পারবে। যখন তুমি নিজেকে অচঞ্চল বা শান্ত রাখার পদ্ধতিতে পরিপক্ক হয়ে উঠবে, তখনই কাজটা শুরু করতে পারবে, নিজেকে সম্পূর্ণ সচেতন রেখে, যে তুমি নিজে স্থির হয়ে গেছো।

ধ্যান কাজের বাঁধা নয়। ধ্যান এমন নয় যে জীবনের কঠিন কর্তব্য থেকে অব্যাহতি নেবার জন্য ধ্যান।  ধ্যান জীবনের এক নতুন অধ্যায়।  জীবনের এক নতুন ধারা। ঝড়ের কেন্দ্রে চলে যাও তুমি।  তোমার জীবন চলতে থাকবে।  আরো উপভোগ্য হয়ে উঠবে।  জীবন আরো আনন্দময় হয়ে উঠবে।  জীবনের এক নতুন দিক উন্মোচিত হবে।  অনেক দৃশ্যের পর্দা উঠে যাবে , জীবন হয়ে উঠবে আরো সৃষ্টিধর্মী। অথচ তুমি নীরব দর্শক হয়ে যাবে। যেন পাহাড় থেকে তুমি নিজেকে দেখছো। আকাশ থেকে তুমি নিজেকে দেখছো। তোমার পাশে কি সব ঘটছে, তুমি নিতান্তই সাক্ষী। তুমি জানলা মাত্র, তোমার ভেতর দিয়ে তোমাকেই তুমি দেখছো।  তুমি শ্রোতা মাত্র। এটাই ধ্যানের গোপন রহস্য। নিজের নিজের কাজ করে যাও, শুধু একটা কথা মনে রেখো নিজেকে কেন্দ্র থেকে সরিয়ে নিও না। কেন্দ্রে অচঞ্চল রেখে দাও নিজেকে।  এই জ্ঞান, সতর্কতা যেন মেঘাচ্ছন্ন না হয়, না বাধাপ্রাপ্ত হয়।

ধ্যান সম্পর্কে  কোনই এক স্বামীজীর মুখে  শোনা একটা কাহিনী বলি।

এক সাধু গভীর রাতে নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকে। এটা তার প্রতি রাতের নৈমিত্তিক ব্যাপার। কেননা রাতে নদী নির্জন থাকে, নীরব থাকে।  সাধু নদীর পাড়ে বালির উপরে বসে থাকে। কিছুই করে না। কেবল নিজেকে অনুধাবন করার জন্য নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকে।    রাত  শেষ হলে ফিরে আসে। একদিন, যখন সে ফিরে আসছিলো, একটা আমবাগানের পাশ দিয়ে, আমবাগানের প্রহরী যে বাগানের ফটকের পিছনে  দাঁড়িয়ে ছিলো, সে বেরিয়ে এলো। দারোয়ান আসলে কৌতূহলী  হয়ে গিয়েছিলো।  কারন প্রতিদিন গভীর রাতে এই সাধুটিকে আমবাগানের পাশ দিয়ে যেতে দেখে। আবার রাত  শেষ হলে ঠিক এই সময়ে ফিরে আসে। দারোয়ান ফটক থেকে বেরিয়ে এসে জিগ্যেস করলো - কিছু মনে করবেন না। বহুদিন থেকে দেখছি, গভীর রাতে আপনি এই বাগানের পাশ দিয়ে নদীর  দিকে যান, আবার ঠিক এই সময় ফিরে আসেন। আপনি কি করেন ? আপনি নদীতে কেন যান ? অনেকবার রাতে  আমি আপনাকে অনুসরণ করেছি, কিন্তু কিছুই দেখতে পাইনি। আপনি কেবল নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকেন ঘন্টার পর ঘন্টা। এবং সূর্য্য উঠলে স্নান করে আপনি ফিরে আসেন। সাধু বললো আমি জানি তুমি  আমাকে অনেকবার অনুসরণ করেছো।  কেনোনা রাতের গভীরতা এত নীরব যে তোমার পায়ের শব্দ আমি শুনতে পাই। আমি এও জানি তুমি ফাটকের পেছনে লুকিয়ে থাকো, যখন আমি ফটকের পাশ দিয়ে যাই। শুধু তুমি আমার সন্মন্ধে কৌতূহলী তা নয় আমিও তোমার সন্মন্ধে কৌতূহলী। তোমার কাজ কী ?

দাড়োয়ান বললো আমার কাজ ? আমি একজন সাধারণ দাড়োয়ান।  পাহারাদার।

সাধু বললো : আসল কথাটা শোনালে তুমি আজ  আমাকে। আমিও একজন পাহারাদার। দর্শক।

দারোয়ান বললো : ঠিক বুঝতে পারলাম না আপনি  যদি সত্যিই  দারোয়ান হন , তবে তো, রাতে আপনার  ডিউটি হওয়া উচিত, কিন্তু প্রতিদিন  রাতে আপনি  নদীর  পাড়ে বালির উপরে বসে আপনি  কি পাহারা দেন  ?
সাধু বললো : দেখো তোমার দেখাশোনা আর আমার দেখাশোনার  মধ্যে পার্থক্য আছে। তুমি আম বাগানের দেখাশোনা করো। তুমি বাইরের লোকের দিকে খেয়াল রাখছো। কেউ যাতে বাগানে প্রবেশ করতে না পারে।  আমি কেবলমাত্র এই দ্বাররক্ষীর দিকে খেয়াল রাখছি।  এই কথা বলে সাধু  নিজের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন। আমি আমাকেই দেখছি, কে এই আমি ? সারা জীবন ধরেই আমি আমাকেই দেখে চলেছি।

 দারোয়ান বললো : আশ্চর্য ব্যাপার তো। আজব ব্যাপার। আপনাকে  এই কাজের জন্য পয়সা দেয়
 কে ?

 সাধু বললো :  এটা একটা আনন্দ।  এটা এমন এক আনন্দ যা হাজার হাজার টাকা দিয়ে কেনা যায় না। কোনো ব্যাঙ্কে এত টাকা নেই যা দিয়ে এই আনন্দ কেনা যায়।

দারোয়ান বললো : আশ্চর্য ! আমি সারা জীবন ধরে দেখাশোনার কাজ করছি।  কিন্তু এমন সুন্দর অভিজ্ঞাতার সম্মুখীন হয়নি কখনো। আগামী কাল রাতে আমি আপনার  সাথে যাবো।  আমাকে একটু শিখিয়ে দেবেন । আসলে দেখাশোনার কাজটা আমি তো ভালোই পারি। আমাকে শুধু দেখিয়ে দেবেন  কাকে দেখতে হবে।

শুধু একটা মাত্র পদক্ষেপ, দৃষ্টিটা  ঘুরিয়ে দেওয়া।   চোখ খুললে আমরা বাইরেরটা দেখতে পাই।  চোখ বুজলে ভেতরটা। হয় আমরা বাইরের দিকে চোখ খুলে থাকতে পারি, আবার চোখের ভিতরের পর্দাটা খুলে দিতে পারি। সমস্ত চেতনাকে আমরা ভিতরে নিবদ্ধ করতে পারি। এর পরেই আসল জানার শুরু হবে।  তুমিই জ্ঞাতা, তুমিই জ্ঞান, তুমিই জ্ঞেয়। এসব হারাবার নয়।  চেষ্টা করেও হারাতে পারবে না। সমস্ত জ্ঞানই তোমার মধ্যে আছে।  তুমি শুধু একটু আলো  ফেলো।  দৃষ্টি নিবদ্ধ করো।  সমস্ত জ্ঞান তোমার কাছে উন্মোচিত হবে। তুমি তোমার নিজে বাড়ি দেখতে পারবে। পরমানন্দে উদ্বেল হয়ে উঠবে তোমার সমস্ত চেতনা।

ধ্যানের আসল উদ্দেশ্য, কি ভাবে যথার্থ দর্শক হওয়া যায়। ধ্যানের মূখ্য কাজই নিজেকে দেখার। দর্শকের আসনে নিজেকে বসিয়ে দেওয়ার। যথাযথ পর্যবেক্ষণের নামই ধ্যান। পর্যবেক্ষণের গুনই ধ্যান। সচেতন ভাবে পর্যবেক্ষণশীলতাই ধ্যান।  একটা কথা মনে রেখো - ধ্যানের  অর্থ অবগত হওয়া।  অবগত হওয়ার জন্য যা করতে হয় তাই ধ্যান। তুমি কি করছো সেটা বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা হচ্ছে তোমার কাজে তোমার গুন্ কতটা কাজে লাগছে। পদচারণাও ধ্যান হতে পারে যদি তুমি সচেতন ভাবে করো।  বসে থাকাও ধ্যান হতে পারে যদি নিজেকে সজাক  করে বসে থাকো।  বসে বসে হৃদ স্পন্দন অনুভব করাও  ধ্যান, যদি সতর্ক ভাবে করা হয়।

ধ্যানের  একটি বড় বাঁধা হলো তুষ্টি।  কেউ কেউ ধ্যানে জ্যোতিঃ  দর্শন  করে বা অনাহত ধ্বনি  শুনে ভাবেন অনেক উঁচুতে পৌঁছে গেছেন।  কিন্তু এগুলো প্রাথমিক স্তর  মাত্র। ধ্যানে ইস্ট মূর্তি দর্শন , অবিরাম জপ্ চলতে থাকা, এগুলোতে আটকে থাকলে অগ্রগতি রুদ্ধ  হয়ে যায়।

মনে রাখবেন ধ্যানের  উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যকে উপলব্ধি করা, আনন্দ নয়। শান্তি নয়।  এগুলোকে অতিক্রম করে উপরে উঠে যান।

আপনারা যারা সৎ সংগ করেন বা শাস্ত্র পড়াশুনা করেন তাদের নিজস্ব সংস্কার বা জ্ঞান অনুযায়ী ঈশ্বর সন্মন্ধে একটা ধারণা গড়ে নেন। ধ্যানের সময় ইস্ট মূর্তির দিকে নজর থাকে বেশী। মন যত শান্ত হতে থাকে, ততই ইস্ট মূর্তির চেয়ে তার গুনের ভাব জোরালো হতে থাকে। প্রথম দিকে সাধক মানস নেত্রে ইস্ট মূর্তি দেখতে থাকেন, আস্তে আস্তে সেটা ভাবে পরিণত হয়।  এই ভাবের অনুভব গভীর হলে তিনি নিজের মধ্যে এক জ্যোতির্ময় সত্তার অনুভব করতে থাকেন। এখন মনের জানলা খুলে গেছে। আস্তে আস্তে এই জ্যোতি চৈতন্যময় হয়ে যায়। সাধক তখন অনুভব করেন, এই চৈতন্যময় জ্যোতিই সব।  সাধক নিজে এই চৈতন্যময় জ্যোতির মধ্যে এক ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। এই অবস্থাতেও সাধকের অহং বোধ থাকে। নিজেকে জ্যোতির অংশ মনে করে। সাধনা আরো গভীর হলে এই জ্যোতিও মিলিয়ে যায়। থাকে শুধু চৈতন্য। এই অবস্থায় অহং বোধ লোপ পায়।  আমি বলে কিছু থাকে না। জ্যোতি পরিণত হয়ে যায় জ্যোৎস্নায়। সমস্ত দ্বৈত বোধের লোপ পায়। সাধক এতদিন অহংবোধে সাধনায় লিপ্ত ছিলেন। অহং বোধের বিলুপ্তিতে সাধক সত্যে প্রতিষ্ঠিত হন। এই উপল্দ্ধিই অদ্বৈত উপলব্ধি। আধ্যাত্বিক সাধনার চরম উপলব্ধি। আমিত্ব লোপ পেয়ে গছে। উৎসে ফিরে গেছেন। আপনি বিলীন হয়ে গেছেন। ...... সবশেষ - না সব প্রাপ্তি ?  জানিনা বুঝি না। ..............  ওম শান্তি ওম শান্তি ওম শান্তিঃ।