Monday 24 December 2018

শিবভক্ত, মূলনিবাসী,আত্মবিশ্বাসী - শ্রীকৃষ্ণ

শিবভক্ত, মূলনিবাসী,আত্মবিশ্বাসী - শ্রীকৃষ্ণ

জিজ্ঞাসু : হে সদাশিব গুরুদেব ভগবান  শ্রীকৃষ্ণ তো আমাদেরই লোক। তিনি তো  শিবভক্ত ছিলেন। 

গুরুদেব : কেন একথা বলছো কেন ?

জিজ্ঞাসু : সুদর্শন চক্র, অর্থাৎ যে অস্ত্র সব থেকে মোক্ষম , যার দ্বারা শ্রীকৃষ্ণ সবাইকেই পরাস্থ করতে পারতেন, সেই সুদর্শন চক্র তিনি তো দেবাদিদেব  মহাদেবের কাছ থেকেই পেছিলেন।

গুরুদেব : কিভাবে পেলেন ?

জিজ্ঞাসু : শুনেছি, ভগবান বিষ্ণু হচ্ছেন, জগতের  পালনকর্তা। তখনকার দিনে সুর ও অসুরেরা সর্বদা স্বর্গ দখলের জন্য যুদ্ধে লিপ্ত থাকতো। এমনি একবার, সুর অসুরের যুদ্ধে সুরেরা পরাজিত হলেন। এখন  সুর-দের প্রতিনিধি অর্থাৎ মর্তের ঋষি-মুনিরা দেবতাদের অর্ঘ প্রদান করেন, ফলতঃ অসুরেরা এতে বিরক্ত হন। এবং তাদের অর্ঘপ্রদান কার্যে বাধা দিতে থাকেন। তো মুনি ঋষিরা তখন সমবেত ভাবে, পালনকর্তা বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হয়ে আবেদন নিবেদন করতে লাগলেন, দুঃখ জানাতে লাগলেন। এখন বিষ্ণু জানতেন, অসুরেরা সবাই মহাদেবের সাধনা করে বড় লাভ করে, এই অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে।  তখন উপায় না পেয়ে, তিনিও তখন মহাদেবের পুজো করতে লাগলেন। মহাদেবের স্তুতি করতে লাগলেন। মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন।মহাদেবের লিঙ্গকে গঙ্গাজল দিয়ে অবহাগন করাতে লাগলেন।   একশত একটি পদ্মফুল সংগ্রহ করে, তা দিয়ে দেবাদিদেবকে  অর্ঘ প্রদান করতে লাগলেন। দেবাদিদেবকে  সন্তুষ্ট করতে  লাগলেন।  এদিকে মহাদেব মজা করে, একটা পদ্মফুল ওখান থেকে সরিয়ে রাখলেন। ভগবান বিষ্ণু যখন দেখলেন, একটি পদ্মফুল কম, আর তা কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তখন নিজের পদ্মাক্ষ অর্থাৎ নিজের চোখ দিয়ে অর্ঘ প্রদান করতে উদ্দত হলেন। মহাদেব এতে আরো খুশি হলেন। এবং বাঞ্চিত ফল প্রদান করতে চাইলেন। আসলে বিষ্ণুত নিজের জন্য কিছু চান না। তিনি অসুরদের পরাস্ত করার উপায়, ও মহাদেবের সহযোগিতা চাইছিলেন। মহাদেব খুশি হয়ে তখন তাঁকে এই দিব্য অস্ত্র প্রদান করেন, যার নাম সুদর্শন চক্র। এই সুদর্শন চক্রের এমনই  ক্ষমতা, যার দ্বারা পৃথিবীতে কেউ অবধ্য় থাকবে না । সেই থেকে ভগবান বিষ্ণু, তার ভক্তদের রক্ষার জন্য, ও অভক্তদের বিনাশের জন্য এই মহার্ঘ অস্ত্রের ব্যবহার করতে লাগলেন, ও অপরাজেয় হয়ে ওঠেন। আসলে মহাদেবের কৃপাতেই বিষ্ণুর আধিপত্য জগতে বিস্তার লাভ করলো।    

জিজ্ঞাসু : এছাড়া শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন, পূর্বজন্মে নারায়ণ ও নর ছিলেন। সেই জনমে, তাঁরা, এখন যেখানে নর-নারায়ণ পর্বত সেখানে  শিবের আরাধনা করতেন। এই সময় ইন্দ্র তাদের ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য, মেনকা, উর্বশীদের পাঠিয়েছিল। কিন্তু, তাঁরা শিব পূজায় এতটাই নিমগ্ন ছিলেন, যে ওই সব নর্তকীরা তাদের সাধনায় বিঘ্ন ঘ পারেনি। এইভাবেই নর ও নারায়ণ শিব ভক্তির জোরে, স্বয়ং ভূতনাথের কৃপায়  প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন।

গুরুদেব, আমি এও শুনেছি যে, শ্রীকৃষ্ণ যখনই অসহায় হতেন, তখনই মহাদেবের স্মরণ নিতেন। এমনি একবার, অর্জুনপুত্র অভিমন্যুর বধকারী জয়দ্রথকে পরাস্ত করবার জন্য, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং অর্জুনকে নিয়ে দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে গিয়েছিলেন। সেখানে মহাদেব অর্জুন ও  শ্রীকৃষ্ণকে নর ও নারায়ণ বলে সম্মোধন করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ সেখানে, মহাদেবের একটা অভূতপূর্ব স্তোত্র পাঠ  করেছিলেন। যা থেকে বোঝা যায়, তিনি একজন মহাদেবের পরম ভক্ত  ছিলেন।

গুরুদেব : স্তোত্রটা জানো ?

জিজ্ঞাসু : হ্যাঁ মহাভারতে আছে, সেখানে বলা হচ্ছে - ধর্মাত্মা বাসুদেব সেই শরাসনধারী  ভূতনাথ ভবানীপতিকে দেখে সনাতন ব্রহ্মনাম  উচ্চারণ করে, পার্থের সাথে ভূমিষ্ট হয়ে প্রণাম করলেন। এবং স্তব শুরু করলেন - যে মহাত্মা সকল লোকের  আদি, অজন্মা, ঈশান, অব্যয় মনের পরম কারন আকাশ ও বায়ু স্বরূপ, সমস্ত জ্যোতির যিনি আধার, পরব্রহ্ম, ব্ৰহ্মজ্ঞদিগের আশ্রয়, চরাচরের স্রষ্টা ও প্রতিহর্ত্তা, এবং বীরত্ব ও প্রচন্ডতার উদয় স্থান, সূক্ষ্ম অধ্যাত্ম পদলাভার্থী  জ্ঞানীগণ যাঁকে প্রাপ্ত হন এবং সংহারকালে যাঁর কোপের উদয় হয়, সেই মহাত্মাকে বাসুদেব  বাক্য-মন-বুদ্ধি ও কর্ম্ম দ্বারা বন্দনা করছেন।এই সময় অর্জুনও  দেবাদিদেব মহাদেবকে ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানের কারন জেনে বারবার অভিবাদন করতে লাগলেন। এইভাবে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন উভয়েই সেই কারণস্বরূপ, আত্মাস্বরূপ মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন ও ভূমিষ্ট হয়ে প্রণামরত থাকলেন।

তখন দেবাদিদেব মহাদেব প্রসন্ন মনে, সহাস্য বদনে স্বাগত প্রশ্ন করলেন।  হে নর-নারায়ণ, হে নরোত্তম বীরদ্বয়, তোমরা গাত্রোত্থান করো।  তোমাদের ক্লেশ দূর হউক।  তোমাদের অভিলাষ ব্যক্ত করো, তোমরা যে জন্য এসেছো আমি তা সম্পাদন করবো।  তোমরা নিজেদের কল্যান প্রার্থনা করো, আমি তা প্রদান করবো।

একথা শুনে, বাসুদেব ও অর্জুন উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে, মহাদেবের স্তব শুরু করলেন।

"হে দেব, তুমি ভব, শর্ব্ব, রুদ্র, বরদ, পশুপতি, উগ্র, কপর্দ্দী, মহাদেব, ভীম, ত্র্যম্বক, শান্ত, ঈশান, ও মখঘ্ন, তুমি অন্ধকঘাতী, কার্তিকের পিতা, নীলগ্রীব  ও বেধাঃ, তুমি পিনাকী, হবিষ্য়, সত্য, বিভু, বিলোহিত, ধুম্র, ব্যাধ ও অপরাজিত, তুমি নিত্য, নীল, শিখন্ডী, শূলধারী, দিব্যচক্ষুঃ, হর্ত্তা, পাতা, ত্রিনেত্র ও বসুরেতাঃ, তুমি অচিন্ত্য, অম্বিকানাথ, সর্ব্বদেবস্তুত, বৃষধ্বজ, মুন্ড, জটিল ও ব্রহ্মচারী।  তুমি সলিল  মধ্যস্থ তপস্বী, ব্রহ্মণ্য, অজিত, বিশ্বাত্মা, বিশ্বস্রষ্টা ও বিশ্বব্যাপী, তুমি ভূতগনের সেবনীয়, প্রভু ও বেদমুখ, তুমি সর্ব্ব শঙ্কর ও শিব, তুমি বাক্যের পতি, প্রজাপতি, বিশ্বপতি, ও মাহাতের পতি, তুমি সহস্রশিরাঃ, সহস্রভূজ, সহস্রনেত্র, সহস্রপাদ ও অসংখ্যেয়কর্ম্মা, তুমি সংহর্তা, হিরণ্যবর্ণ, হিরণ্যকবচ ও ভক্তানুকম্পী, তোমাকে নমস্কার।  হে প্রভো ! আমাদের বাঞ্ছা  পরিপূর্ন করো। এই ভাবে, শ্রীকৃষ্ণ মহাদেবকে প্রসন্ন করতে লাগলেন। .......       

গুরুদেব : এটা তুমি কোথায় পেলে ?

জিজ্ঞাসু : এটা মহাভারতের দ্রোণপর্ব্বে আছে।
এমনকি মহাভারতে পড়েছি, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বানাসুরকে বধ করবার জন্য, অর্থাৎ তার অহংকারকে বিনষ্ট করবার জন্য, যখন সুদর্শন চক্র দিয়ে তাকে বধ করবার জন্য উদ্দত হয়েছিলেন, তখন শিবের নির্দেশে সুদর্শন চক্রকে বিরত করেছিলেন।এবং তার নাতি অনিরুদ্ধের সাথে বাণাসুরের মেয়ে ঊষার বিয়ে দিয়েছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবাদিদেব শিবকে  ভীষণ মান্য  করতেন ।

অতয়েব হে সদাশিব গুরুদেব ! শ্রীকৃষ্ণ বা নারায়ণ, বা বিষ্ণু আসলে দেবাদিদেব মহাদেবের পরম ভক্ত, এবং মহাদেবের শক্তিতেই বিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণের শক্তি এই কথাটা সত্য। আর তিনি সত্যিকারের আমাদেরই লোক।


---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------   

জিজ্ঞাসু :হে গুরুদেব !  ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বেদ বিরোধী ছিলেন, সেইজন্য তাঁকে  আস্তিক বলা যেতে পারে। 

গুরুদেব : কেন একথা বলছো কেন ?

জিজ্ঞাসু : হে গুরুদেব ! বেদে যাদের বিশ্বাস নেই তাদেরকেই বলা হয় আস্তিক। আর দেবতাদের প্রতি  যাদের বিশ্বাস নেই তাদেরকে বলা হয় আস্তিক। ভগবানের মুখনিঃসৃত গীতায়  দেখছি, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, বেদের কর্মযজ্ঞ, জ্ঞানযজ্ঞ, করে কিছু হবে না। তার চাইতে ভক্তিযোগ অনেক ভালো ও সহজ। 

বেদে আমরা দেখেছি, ইন্দ্রের স্তূতিতে ভরা।বিভিন্ন দেব দেবতার স্তূতিতে ভাড়া এই বেদ।  অর্থাৎ বেদ-অনুসারীরা ইন্দ্র, বরুন, অগ্নি  ইত্যাদি দেবতার পূজা করতেন, বা তাদের স্তূতি গানে ভরা  এই বেদ । কিন্তু  শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পালক-পিতাকে অর্থাৎ নন্দকে  ইন্দ্রের পূজা করতে নিষেধ করেছিলেন। শুধু তাই নয় তার প্রকোপ থেকে বাঁচাতে, পর্বতকে তুলে ধরে, তার নিচে গোকুলবাসীদের নিরাপত্তা দিয়েছিলেন, তবু ইন্দ্রের পূজা হতে দেন নি।

আস্তিকেরা ঈশ্বর মানেন। নাস্তিকেরা ঈশ্বর মানেন না। শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে ভগবান বলে মনে করতেন। অন্য কারুর পূজা বা আরাধনা না করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেকেই  পূজা করার কথা বলেছেন। অন্য সব তথাকথিত ধর্ম ত্যাগ করতে বলেছেন।        


জিজ্ঞাসু : হে সদাশিব ! ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আসলে  মূলনিবাসী অর্থাৎ অনার্য ছিলেন। সেইজন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে  আসলে মূল ভারতবাসী বলা যেতে পারে। তিনি গ্রিক থেকে আসেননি।  

গুরুদেব : কেন একথা বলছো কেন ?

জিজ্ঞাসু : শ্রীকৃষ্ণের পিতা ও তার পূর্বপুরুষ এখানকার এলাহাবাদে তখনকার প্রয়াগে রাজত্ত্ব করতেন। 
শ্রীকৃষ্ণের ছত্রিশটি পূর্বপুরুষ কেউ বাইরে থেকে অর্থাৎ গ্রীক  থেকে ভারতে  আসেন নি। তাঁরা সবাই এই ভারতবর্ষের অধিবাসী। তাহলে বলা যেতে পারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মূলনিবাসী ছিলেন। অর্থাৎ ভারতবাসী ছিলেন। তাঁর গায়ের রং  দেখুন কেমন কালো।  আর্যদের গায়ের রং তো কালো ছিল, তাই  না। তাই তিনিতো আমাদেরই  লোক। 

শ্রীকৃষ্ণ বাণাসুরের মেয়ে ঊষার সাথে অনিরুদ্ধের বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। আবার অর্জুনের সাথে তার বোন উত্তরার বিয়ে দিয়েছিলেন।  এ থেকে বোঝা যায়, তিনি আর্য্য - অনার্য্যে কোনো ভেদ করতেন না। মহামুনি উত্তঙ্গকে শিক্ষা দেবার জন্য, এক চণ্ডালের হাতে অমৃত বারি পাঠিয়েছিলেন। ভৃগুপুত্র উত্তঙ্গ চণ্ডালের হাতে সেই অমৃতবারি গ্রহণ করতে রাজি না হওয়ায়, সে অমৃতবারি থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। এসব থেকে মনে হয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জাত -পাতের উর্দ্ধে ছিলেন।

অতএব হে সদাশিব গুরুদেব ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদেরই লোক। তাকে আমাদের প্রণাম করা উচিত।

ওঁং নমঃ শ্রী ভাগবতে বাসুদেবায়।  ওঁং নমঃ শিবায়ঃ।

গুরুদেব :  হে পুত্র ! শ্রীকৃষ্ণ একটা আয়না। তার সামনে দাঁড়ালে, তোমার স্বরূপেই তিনি প্রকাশ হবেন। তুমি যা চাও, তুমি যা দেখতে চাও, তুমি তাই দেখবে। অর্থাৎ তুমি যা, তুমি তাই দেখবে, তুমি সরে  গেলে,  আয়না আবার স্বচ্ছ হয়ে যাবে।
এই প্রসঙ্গে শ্রী রামকৃষ্ণের বলা একটা গল্পের কথা বলি। 

নদীর পারে, একটা উইয়ের ঢিপি।  তো অন্ধকারে, সন্ধ্যার সময় এক মাতাল এলো। উইয়ের ঢিপিটাকে দেখে ভাবলো, ব্যাটা কেমন সন্ধে থেকে মাল খেয়ে ভুর হয়ে আছে দেখো। আসলে মাতাল উইয়ের ঢিপিটাকে ভেবেছে আর একটা মাতাল।  গভীর রাতে এক চোর এলো, সে উইয়ের ঢিপি দেখে ভাবলো একটা চোর। মনে মনে বললো : ব্যাটা সব কাজ সেরে এখানে বসে আছো ? আমার এখনো কিছুই হলো না। এবার শেষ রাতে এলো সাধু, সাধু উইয়ের ঢিপি দেখে ভাবলো, এ একজন বারো সাধু, ব্যাটা কেমন সমাধিতে বিভোর হয়ে গেছে, আমি এখনো ধ্যানেই  বসতে পারলাম না। 
আসলে আমরা যা,  তাই দেখি।   
শ্রীকৃষ্ণের নিজের কোনো ব্যক্তিত্ব নেই। তিনি কোনো ব্যক্তিও নন।  তিনি এক পূর্ণ পুরুষ।  তিনি আকর্ষক।  তিনি কালো, অন্ধকার। অর্থাৎ সৃষ্টির আঁতুরঘর। আবার শূন্য।  শুন্য, অর্থাৎ তার কাছে সব আছে আবার কিছুই নেই। শুন্য সদাই পূর্ন। শূন্য কখনো অপূর্ন হয় না। শুন্য কখনো  ভগ্নাংশ হয় না। আর সব সংখ্যার ভগ্নাংশ হয়।  শুন্যের ভগ্নাংশ হয় না।  শুন্য থেকে শুরু আবার শূন্যতেই শেষ। শ্রীকৃষ্ণ কিছুই নয়। শ্রীকৃষ্ণের কোনো মূল্য নেই। শুন্যের কোনো মূল্য নেই, সংখ্যার ডান দিকে বসলে, সংখ্যার গুরুত্ত্ব বাড়ে। অদ্ভুত ব্যাপার। যাঁকে সদ্ভাবে নিলে, যে নেয় তার গুরুত্ত্ব বাড়ে। আর যে অসৎ ভাবে নেয়, অর্থাৎ বা দিকে নিলে তার কোনো গুরুত্ত্বের হেরফের হয় না। তুমি যেমন শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে চাও তেমনি তাকে দেখতে পাবে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এস ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করি। 

ওঁং নমঃ শ্রী ভাগবতে বাসুদেবায়।  ওঁং নমঃ শিবায়ঃ।
     


Sunday 23 December 2018

মানুষের আসা যাওয়া (চার) - পরাবিদ্যা - সৃষ্টিরহস্য

 মানুষের আসা যাওয়া (চার)- পরাবিদ্যা - সৃষ্টিরহস্যঃ


মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত তার সত্যধর্ম বইটির  মুখবন্ধে বলছেন : সত্যধর্ম, আত্মাকর্ষণ ধর্ম বা  স্পিরিচুয়ালিস্ট ধর্ম  থেকে  আলাদা।  কারন এই ধর্মে, অর্থাৎ স্পিরিচুয়ালিস্ট ধর্ম  কতকগুলি বৈজ্ঞানিক বিষয়ের সাদৃশ্য-প্রদর্শন আছে মাত্র। এখানে মহাত্মাদের উপদেশ নেই। অর্থাৎ পারলৌকিক মহাত্মাদের উপদেশ ছাড়া আর সব কথা সেখানে আছে, যা সত্যধর্ম বিশ্বাস করে, বা সত্যধর্মে আছে। এটা দেখে আমার স্পিরিচুয়ালিস্ট-দের সম্পর্কে আমার জানবার আগ্রহ জাগে। কি আছে সেখানে ? সেই ভাবনা থেকেই, মানুষের আসা যাওয়া সম্পর্কে জানতে গিয়ে আমি এই পরাবিদ্যার বই-এর সন্ধান করি। এবং সেখানে আমি কিছু অদ্ভুত ব্যাপার জানতে পারি। সেই সব নিয়ে আমরা আলোচনা করবো।
 আর একটা কথা মহাত্মা গুরুনাথের বই পরে জানতে পারি, উন্নত সাধকরা সূক্ষ্ম দেহে বিচরণ করতে পারেন। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে যেতে পারেন। সেখানকার সব কিছু জানতে পারেন। তাই যদি হয়, তবেতো তারাই  বলতে পারেন, কোন গ্রহের কি অবস্থা, এবং সেখানে কোনো মানুষ আছেন কি না। তবে বৈজ্ঞানিকদের   সন্ধানকাজ  অনেক সহজ হয়। তারা তা হলে এসব বলছেন না কেন ? আমার মতো অবিশ্বাসী মনে এই রকম নানান সন্দেহ দানা বাধে। সেই সন্দেহ নিরসনের জন্য সন্ধানে রত হই। এই সব করতে গিয়ে আমি একটা বইয়ের সন্ধান পাই, যেটি ১৯৪৩ সালে লেখা শেষ হয়।   অর্থাৎ প্রায় ৭৫ বছর আগে লেখা  একটা বইয়ের সন্ধান পাই। বইটি শ্রী ক্ষিতিনাথ  ঘোষ-এর লেখা, এবং ১৯৫২ সালে কমলা বুক ডিপো, কোলকাতা থেকে প্রকাশিত। এই বইটির প্রথম ১০০ কপি বিনা মূল্যে শোকার্ত্ত ভাই-বোনদের মধ্যে বিতরন করা হয়। এই বইয়ের সবই বিষ্ময়কর । যেমন, এই পৃথিবীর আগে নাকি চাঁদ ছিলো মানুষের বাস ভূমি। আর এখনো নাকি শুক্রগ্রহে আমাদের  থেকে উন্নত মানুষ বাস করেন। পৃথিবীর পরে, বুধ গ্রহে জীবনের সঞ্চার হবে, এমনি আরো সব নতুন নতুন তথ্য আছে, যেমন প্লুটো আবিষ্কার হয় (১৯৩০)সালে, অথচ এই বইয়ের তথ্য সংগ্রহ হয় ১৯৩০ সালের আগে। এবং সেখানে বলা হয়, আরো দুটো গ্রহ আছে যা আবিষ্কার হয় নি।  আজ কিন্তু হয়েছে। এছাড়া আরো অনেক গ্রহ আছে যার আবিষ্কার হয়েছে আরো পরে,  যাদের  নাম দেওয়া হয়েছে সেরাস (cerus), চরণ (charon ), এবং  ২০০৩UB ৩১৩   ইত্যাদি ইত্যাদি। ..এমনি সব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা . 
যাই হোক আসল কথায় আসি।        

Spritulist দের বলা হয়  পরাবিদ্যা বিজ্ঞানী। পরাবিদ্যা মানে উচ্চ বিদ্যা। বিদ্যা দুই রকম  পরা ও অপরা। স্থূল জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান হচ্ছে অপরাবিদ্যা আর সূক্ষ্ম জগৎ সম্পর্কে জ্ঞানকে বলে পরা বিদ্যা।

আমার উদ্দেশ্য মানুষের আসা যাওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা। পরাবিদ্যা জ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের আসা যাওয়া সম্পর্কে জানতে গেলে, সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। পরাবিদ্যবিদগন বলছেন : আমাদের সৌরজগতে দশবার ক্রমবিকাশ শক্তি আবির্ভূত হয়ে, প্রাথমিক অবস্থা থেকে আরম্ভ করে পরিপূর্নতা লাভ করবে, এবং পরে লয় প্রাপ্ত হবে। সাতটি গ্রহ নিয়ে একটা শৃঙ্খল।  এর মধ্যে অনেকগুলি গ্রহ অদৃশ্য। জীবন-তরঙ্গ বা জীবনী শক্তির বিকাশ যতদিন যে গ্রহে বা যে  জগতে থাকবে তার নাম সেই গ্রহের জগৎকাল। এই সময়ের মধ্যে সাতটি প্রথম মানবজাতি জন্ম গ্রহণ করবে।  প্রত্যেক প্রধান জাতির সাতটি  শাখাজাতি থাকবে।  প্রত্যেক শাখাজাতি থেকে আবার সাতটি প্রশাখাজাতি উৎপন্ন হবে। এই ভাবে সাতটি গ্রহের জগৎকাল একত্র করলে তাকে বলা হয় একটা প্রদক্ষিণকাল।  এইরকম সাতটি প্রদক্ষিণকাল একত্রে এক মন্বন্তর হয়। অর্থাৎ স্থিতিকাল। এমনি সাতটি মন্বন্তর একত্রে একটা ক্রমবিকাশকাল নির্ণীত হয়। 

সৌর জগতে এমনি দশটি ক্রমবিকাশের শৃঙ্খল আছে। বর্ত্তমানে পৃথিবীতে জীবনতরঙ্গের চতুর্থ প্রদক্ষিণ কাল চলছে। এবং আমরা, এই সাতটির মধ্যে  পঞ্চম মূল প্রধান জাতির অন্তর্গত। জীবনী শক্তি যখন যে গ্রহে বা জগতে কাজ করতে থাকে, তখন সেখানেই জীবজন্তু ও উদ্ভিদাদি আবির্ভূত হয়। এর দৃষ্টান্ত আমাদের পৃথিবী। পৃথিবী যখন, উত্তপ্ত তরল পিণ্ডাকার পদার্থ ছিল, তখন চন্দ্রলোকে জীবনী শক্তি কাজ করছিলো। এখন সেখানে জীবনীশক্তির কোনো কাজ নেই। এখন পৃথিবীতে এই জীবনীশক্তির বিকাশ হয়েছে। পৃথিবীতে আরো দুটি মূল জাতির অভ্যুদয় হবে।  তাদের জীবনী শক্তির কাজ এখানে অর্থাৎ পৃথিবীতে  শেষ হয়ে গেলে, পরে বুধ গ্রহে এই জীবনী শক্তির কাজ আরম্ভ হবে। চন্দ্রলোকে যখন জীবনীশক্তির কাজ শেষ হয় তখন সেখানে অনুন্নত জাতি, জন্তু, উদ্ভিদ ছিল এবং অনেক উন্নত শ্রেণীর জীবও  ছিলেন। সিদ্ধ মহাপুরুষেরাও ছিলেন। তারা সকলের সহিত এই পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করেছেন। লোকশিক্ষার জন্য, অনেক সিদ্ধপুরুষ পৃথিবীতে মানুষ হয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। 

বিজ্ঞান এখনো পৃথিবী ছাড়া অন্য কোনো গ্রহে মানুষের মত দেহধারী প্রাণীর সন্ধান পায়নি। পরাবিদ্যা বলছে,  সৃষ্টির ক্রমবিকাশ শক্তি সর্বত্র কাজ করছে। মানুষের ন্যায় রক্তমাংসের দেহ অন্য গ্রহে নেই, কিন্তু  অন্য প্রকার প্রকৃতি বিশিষ্ট জীব আছেন। পরাবিদ্যা বলছে, ৭টি গ্রহ নিয়ে একটা শৃঙ্খল।আর এগুলো হচ্ছে মঙ্গল, পৃথিবী, বুধ হচ্ছে ভৌতিক অন্য চারটির মধ্যে দুটি সূক্ষ্ম অর্থাৎ অভৌতিকদেহ বিশিষ্ট, এবং অন্য দুটি অতিসূক্ষ্ম মানসদেহ বিশিষ্ট।  এইরকম দশটি ক্রমবিকাশ শৃঙ্খল।  অর্থাৎ ৭০-টি গ্রহ আছে। 

বৈজ্ঞানিকগণ এখনো ১০/১২টি গ্রহের সন্ধান দিতে পেরেছে। এই কয়দিন আগে ছিল মাত্র ৯ টি। এই বই যখন লেখা হয়, তখন বিজ্ঞানের দ্বারা আবিষ্কৃত গ্রহ ছিল মাত্র ৭টি (বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহিস্পতি,ও শনি,ইউরেনাস,) এর পরে   নেপচুন, প্লুটো আবিষ্কার হয় (১৯৩০)। এখন বলাহচ্ছে,  আরো তিনটি গ্রহের নাম - সেগুলো হচ্ছে  সেরাস (cerus), চরণ (charon ), এবং  ২০০৩UB ৩১৩।    

পরা বিদ্যাবিদগণ বলছেন, অন্য গ্রহ গুলি ভৌতিক দেহ সম্পন্ন নয়।

এখন আমাদের আলোচ্য বিষয় যে হেতু পৃথিবী যে শৃঙ্খল-এ আছে সেই শৃঙ্খল, সেজন্য প্রথমে এই শৃঙ্খলের ৭টি গ্রহের অবস্থা নিয়ে কথা বলবো। এই ৭টির মধ্যে তিনটি অর্থাৎ বুধ, পৃথিবী, ও মঙ্গল-এর ভৌতিক দেহ আছে।  এবং প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম গ্রহগণের স্থূল দেহ নেই। আমাদের পৃথিবীর অবস্থান চতুর্থ। জীবনী শক্তি পর্যায়ক্রমে, প্রথম গ্রহ থেকে আরম্ভ করে, এখন চতুর্থ গ্রহে অর্থাৎ এখন পৃথিবীতে কাজ করছে। এইভাবে সাতটি গ্রহ প্রদক্ষিণ করে এলে , একটা প্রদক্ষিণ কাল হয়। তিনবার এই ভাবে প্রদক্ষিণ করা হয়ে গেছে। এখন চতুর্থ বারের কাজ চলছে। এইভাবে, সাতবার প্রদক্ষিণ কাজ শেষ হলে একটা শৃঙ্খলকাল হবে। একে বলে মন্বন্তর। পরাবিদরা বলছেন, এখন চতুর্থ মন্বন্তর চলছে।

( সাতটি প্রদক্ষিণকালে এক শৃঙ্খল কাল হয়। সুতরাং পৃথিবীশৃঙ্খল বা চতুর্থ শৃঙ্খলে সাত বার পৃথিবীতে জীবনী শক্তির বিকাশ হবে। প্রত্যেক বারে সাতটি  মূল জাতির আবির্ভাব ও তিরোধান হবে।  ক্রমবিকাশ যখন সাতবার প্রদক্ষিণ করবে, তখন পৃথিবী-শৃঙ্খল সাতবার কাজ করবে। অর্থাৎ ৪৯-বার পৃথিবীতে জীবনীশক্তির আবির্ভাব ও তিরোভাব হবে। ) 

সুতরাং আমরা যে ক্রমবিকাশ শক্তির অন্তর্গত  তার মধ্যে স্থূল গ্রহ - মঙ্গল, পৃথিবী,বুধ। বাকি চারটি অদৃশ্য। আর আমরা ক্রমবিকাশ শক্তির চতুর্থ শৃঙ্খলের, চতুর্থ প্রদক্ষিণকালের চতুর্থ গ্রহ, এবং পঞ্চম মূল জাতির অন্তর্গত। পরাবিদগন বলছেন, পৃথিবীতে এখন পঞ্চম ও ষষ্ঠ শাখাজাতি বর্তমান আছে।      যতদিন যাবে, ততই পৃথিবীতে সর্ববিধ উন্নতির বিকাশ দেখা যাবে। ষষ্ঠ ও সপ্তম মূল জাতির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে  বর্তমান জগতের শিক্ষিত ব্যক্তিগণ, ক্রমশ ধর্মবুদ্ধি লাভ ক'রে, সিদ্ধ শ্রেণীভুক্ত হবেন। সপ্তম মূল-জাতির অস্তিত্ব শেষ হতে কত লক্ষ বৎসর লাগবে, তা বলা যায় না। 

পৃথিবী শৃঙ্খল শেষ হলে, নতুন গ্রহকে অবলম্বন করে পঞ্চম শৃঙ্খলের কাজ আরম্ভ হবে। আর তখন asteroids নামক যে গ্রহপুঞ্জ দেখতে পাওয়া যায়, সেটা পিণ্ডীভূত হয়ে একটা বড়ো গ্রহ হবে। এবং ছয়টি অদৃশ্য গ্রহকে নিয়ে, পঞ্চম শৃঙ্খলের কাজ আরম্ভ হবে।

পৃথিবী তখন, জরাজীর্ন ও ক্ষুদ্রাকার হয়ে, নতুন গ্রহের উপগ্রহ রূপে গণ্য  হবে। 

প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় শৃঙ্খলের কাজ শেষ হয়ে গেছে। একমাত্র চাঁদ ছাড়া, আর কোনো গ্রহের চিন্হ নেই। চাঁদও  কালক্রমে জ্যোতির্ময় কুয়াশায় পরিণত হবে। চন্দ্রলোকে যারা জন্তু ছিলো, তারা এখন মানুষ হয়ে জন্মেছে, আর চাঁদে যারা উদ্ভিদ ছিল তারা এখন জন্তু হয়ে জন্মেছে। পৃথিবীর শৃঙ্খলকাজ শেষ হলে, এখানেও এই প্রকার ঘটবে। যে নতুন গ্রহে, পঞ্চম শৃঙ্খল-এর  কাজ আরম্ভ হবে সেখানেও এই প্রকার হবে। আমাদের উদ্ভিদ ওখানে জন্তু হবে, আমাদের জন্তু ওখানে মানুষ হবে, কিন্তু অপেক্ষা করতে হবে, যতদিন না মানুষ সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি হয়।  আর যে সব মানুষ পৃথিবীতে আত্মউন্নতি লাভ করতে পারবে না, তাদের তাদেরও  অপেক্ষা করতে হবে, যতদিন না ওখানে মানুষের আবির্ভাব হয়। এই অপেক্ষাকাল হবে, দীর্ঘ থেকে  দীর্ঘতর। এটাকে বিচারাধীন কাল (Aeoniam  Condemnation Period  ) বলা যেতে পারে।

বর্তমান সৌরজগতে, ক্রমবিকাশ শক্তি বিকাশের সাতটি ক্ষেত্রে আছে। 

প্রথম ক্ষেত্র এখন অদৃশ্য। এই  ক্ষেত্রের সাতটি গ্রহের মধ্যে ভালকান গ্রহ  হার্শেল দেখেছিলেন। এখন আর দেখা যায় না। বাকি ছয়টি  গ্রহ কখনো দেখা যায় নি। 

দ্বিতীয় ক্ষেত্র শুক্র গ্রহকে অবলম্বন করে আরো ছয়টি অদৃশ্য গ্রহ যুক্ত। 

তৃতীয় ক্ষেত্রে মঙ্গল, বুধ, পৃথিবী এবং অন্যান্য চারটি অদৃশ্য গ্রহ। 

চতুর্থ ক্ষেত্রে আছে বৃহস্পতি, ও ছয়টি অদৃশ্য ক্ষেত্র। 

পঞ্চম ক্ষেত্রে আছে শনি, ও অনান্য ছয়টি অদৃশ্য ক্ষেত্র। 

ষষ্ঠ ক্ষেত্রে হচ্ছে  ইউরেনাস ও অন্যান্য ছয়টি অদৃশ্য ক্ষেত্র। 

সপ্তম হচ্ছে নেপচুন ও অন্য ছয়টি অদৃশ্য গ্রহ।

সকল ক্ষেত্রে ক্রমবিকাশ সমান ভাবে অগ্রসর হয় নি। পৃথিবীতে চতুর্থ শৃঙ্খল চলছে। শুক্রগ্রহে পঞ্চম শৃঙ্খলকাল চলছে। 

চন্দ্রলোকে, তৃতীয় শৃঙ্খলের কাজ শেষ হওয়ার পরে, চাঁদ বৃদ্ধ ও জরাগ্রস্থ হয়ে যায়। 

পৃথিবীর এখন যৌবনকাল চলছে। স্থূল বিষয়েও পূর্নতা এসেছে। ভবিষ্যতে সূক্ষ্মতার পথে অগ্রসর হতে হবে, সবাইকেই । মানুষের মধ্যে ক্রমশ আধ্যাত্বিক ভাবের উন্মেষ ঘটবে।

পারবিদ্যাবিদগণ বলেন মানুষের মধ্যে যিনি পরিপূর্নতা লাভ করেন তার, সামনে সাতটি পথ উপস্থিত হয় : 
১. তিনি মানুষের সঙ্গে থেকে মানুষের নৈতিক উন্নতিতে সাহায্য করতে পারেন। 
২.বিদেহী কামবর্জিত জীব রূপে অবস্থান করতে পারেন। 
৩. পৃথিবীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে, ইচ্ছা মূর্তি ধারণ করে, মানুষের সাহায্য করতে পারেন। 
৪.দেবত্ত্ব লাভ করতে পারেন। 
৫. অন্য জগতের শাসন কার্যে নিযুক্ত থাকতে পারেন। 
৬.পরবর্ত্তী শৃঙ্খলে কি কাজ হবে, তার ব্যবস্থা করতে পারেন। 
৭ আর সব শেষে,.নির্ব্বান  লাভ করতে পারেন।

চন্দ্রলোকেও অনেক উন্নত শ্রেণীর  জীব ছিলেন। পৃথিবীতে জীবনের বিকাশ আরম্ভ হলে তারা এখানে এসেছেন। মানুষের হিতকর ব্যাপারে লিপ্ত, তারাই আমাদের পথপ্রদর্শক। যুগে যুগে জ্ঞানের আলো  জ্বেলেছেন। ভ্রান্ত মানুষকে সত্যের সন্ধান দিয়েছেন, এবং এখনো  দিচ্ছেন। 

পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, শুক্রগ্রহে জীবনী শক্তির  অনেক উন্নতি লাভ করেছে। সেখান হতেও অনেক মহাপুরুষ পৃথিবীর সৃষ্টি রক্ষার জন্য এসেছেন।

ব্যাপারগুলো সবই  অলৌকিক। এই সব ব্যাপারে আলোচনা করতে গেলে সময় সন্মন্ধে একটা জ্ঞান থাকা দরকার। যুগ, কল্প, মন্বন্তর ইত্যাদি সম্পর্কে মোটামুটি একটা জ্ঞান থাকলে, ক্রমবিকাশ শক্তির ব্যাপকত্ত্ব বুঝতে সুবিধা হয়। 

১ দিন - পৃথিবী তার নিজের কেন্দ্রে একবার ঘোরাকে বলা হয় একদিন। 
১ মাস - পৃথিবীর চারিদিকে চাঁদের একবার ঘোরাকে বলে একমাস। 
১ বছর - পৃথিবী যখন সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে। 

মহাযুগ - যুগ চারটি, সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর-কলি।  এই চার যুগের সমষ্টিকে বলে মহাযুগ। 

সত্যযুগ -              ১৭,২৮,০০০ বছর। 
ত্রেতাযুগে -          ১২,৯৬,০০০ বছর। 
দ্বাপরযুগ -             ৮,৬৪,০০০ বছর।
কলিযুগ  -               ৪,৩২,০০০ বছর। 
মহাযুগ -               ৪৩,২০,০০০ বছর। (চার যুগের সমষ্টি)

এক মনুর রাজত্বকাল :                ৩০,৬৭,২০,০০০ বছর। (৭১-টি মহাযুগ = এক মনুর রাজত্ত্ব কাল। )

১৪-জন মনুর মোট 
রাজত্বকাল  :                            ৪,২৯,৪০,৮০,০০০  বছর  (১৪*৩০৬৭২০০০০)
(১৪*৩০,৬৭,২০,০০০)
৬ মহাযুগ মনুসন্ধি কাল :              ২,৫৯,২০,০০০    বছর
এক কল্প অর্থাৎ 
১০০০টা মহাযুগ :                     ৪৩২,০০,০০,০০০    বছর  (ব্রহ্মার এক দিবস) -চারশত বত্রিশ কোটি বছর 

ব্রহ্মার এক দিনরাত্রি :              ৮৬৪,০০,০০,০০০   বছর। - আটশত চৌষষ্টি কোটি বছর।   .

ব্রহ্মার এক বছর  :           ৩১,১০,৪০,০০,০০,০০০    বছর। - তিন লক্ষ এগারো হাজার চল্লিশ কোটি বছর। 

মহাকল্প - ব্রহ্মার জীবন ৩,১১,০৪,০০,০০,০০,০০০   বছর।  - ৩১ লক্ষ ১০ হাজার ৪০০ কোটি বছর। 
(শত বৎসর)
__________________________________________________________________________
__________________________________________________________________________

এবারে আমরা আসল কথায়  যাবো। 

আগের কথায়  আমরা বুঝতে পারলাম  যে, আমাদের এই সৌরজগতে, ৭ বা ১০টি ক্ষেত্র বা শৃঙ্খল আছে যেখানে জীবনের ক্রমবিকাশ চলছে।  আর প্রত্যেক শৃঙ্খলে ৭টি গ্রহ আছে। এর মধ্যে কেউ কেউ দৃশ্যমান বা স্থূল, আবার কেউ কেউ অদৃশ্য বা সূক্ষ্ম। কেউ ভৌতিক কেউ অভৌতিক। জীবনের উন্মীলনের জন্য, জীবন-তরঙ্গ ক্রিয়াশীল। প্রত্যেক ক্ষেত্রে যে সাতটি জগৎ আছে, অর্থাৎ যে সাতটি গ্রহ আছে তার সব কয়টিতেই একটার পর একটায় জীবন প্রবাহ প্রকাশ হবে। আমাদের বা পৃথিবীকে নিয়ে যে শৃঙ্খল বা ক্ষেত্র তাতেও ৭টি গ্রহ আছে। তার মধ্যে মঙ্গল, পৃথিবী, ও বুধ ভৌতিক। অর্থাৎ প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম গ্রহ অভৌতিক, এবং এদের কোনো নাম নেই ,ও তৃতীয় -মঙ্গল, চতুর্থ -পৃথিবী ও পঞ্চম-বুধ এগুলো ভৌতিক। যা আমাদের দৃষ্টিগোচর। অভৌতিক গ্রহগুলোর মধ্যে আবার দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ গ্রহ সূক্ষ্মজগৎ  এবং প্রথম ও সপ্তম গ্রহ  অতিসুক্ষ বা  মনোজগৎ। প্রত্যেক মন্বন্তরে প্রত্যেক ক্ষেত্রে জীবন প্রবাহ ৭বার প্রবাহিত হয়। একটিতে কাজ শেষ হলে অপরটিতে কাজ করে। আমাদের পৃথিবী যে ক্ষেত্রের  অন্তর্গত তাতে বর্তমান মন্বন্তরে তিনবার জীবনপ্রবাহ প্রদক্ষিণ কার্য্য সম্পূর্ণ করেছে। চতুর্থবার প্রদক্ষিণকার্য্য চলছে। এবং চতুর্থ-জগৎ অর্থাৎ পৃথিবী এর  কার্যক্ষেত্র। ৭বার কোনো ক্ষেত্রকে প্রদক্ষিণ করলে, এক শৃঙ্খলকাল বা মন্বন্তর হয়।  বর্তমানে চতুর্থ মন্বন্তর চলছে। অর্থাৎ আরো তিনটি মন্বন্তর ধরে এই পৃথিবীতেই জীবনী শক্তির বিকাশ ঘটবে । এবং তারপরে, অর্থাৎ পৃথিবীতে জীবনপ্রবাহ শেষ হলে, বুধে এই জীবনপ্রবাহ চলে যাবে। পৃথিবী তখন নিদ্রিত অবস্থায় থাকবে। অর্থাৎ পৃথিবীতে জীবনী শক্তির কোনো চিন্হ থাকবে না।  কিন্তু পৃথিবী গ্রহটি থাকবে। এক মন্বন্তরের মধ্যে ছয়বার এরূপ ঘটবে, কিন্তু সপ্তমবার জীবনপ্রবাহ শেষ হবে। তখন প্রলয় শুরু হবে। পরে আবার নতুন মন্বন্তর আরম্ভ হলে এক এক করে আবার সাতটি  গ্রহ উৎপন্ন হবে। এবং পর্যায়ক্রমে সব পুরাতন  গ্রহের সঙ্গে নতুন গ্রহের সম্মন্ধ বর্তমান থাকে। 

এতক্ষন আমরা চতুর্থ মন্বন্তরের কথা আলোচনা করছিলাম। চতুর্থ মন্বন্তরে সাতটি গ্রহে বা জগতে জীবনী শক্তি কাজ করছে। এটা একটা ক্ষেত্র। এইরকম সাতটি বা দশটি ক্ষেত্র আছে। 

এই ক্ষেত্রের বা গ্রহের   অবস্থা তৃতীয় মন্বন্তরে অন্য রকম ছিল। তখন চতুর্থ গ্রহ ছিল চন্দ্র।  এবং মঙ্গল ও বুধের স্থানে দুটি সূক্ষ্ম গ্রহ ছিল।  এবং প্রথম ও সপ্তম স্থানে ছিল অতি সূক্ষ্ম অর্থাৎ মনোজগৎ-এর উচ্চতর অবস্থা। এবং দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ ছিল নিম্নতর অবস্থা।  তৃতীয় মন্বন্তর শেষ হলে, চাঁদ ক্রমশ লয়প্রাপ্ত হচ্ছে।  ক্রমশঃ এই চাঁদ যাঁকে  আমরা এখন পৃথিবীর উপগ্রহ বলছি, নীহারিকারুপ জ্যোতির্ময় বলয়ে পরিণত হয়ে যাবে। 

আবার চতুর্থ মন্বন্তর শেষ হলে, মঙ্গল, পৃথিবী ও বুধের সাথে অন্য যে চারটি অদৃশ্য গ্রহ আছে তাও লয়  প্রাপ্ত হবে। এবং আবার নতুন করে  সাতটি গ্রহের উৎপত্তি হবে। এই সাতটি গ্রহ তখন তৃতীয় মন্বন্তরের গ্রহগুলির অনুরূপ হবে। তখন চাঁদ যেমন ছিল স্থূল গ্রহ তেমনি পঞ্চম মন্বন্তরে একটি স্থূল গ্রহ হবে। গ্রহাণুগুলো (Asteroids ) মিলিত হয়ে এই গ্রহটি উৎপাদন করবে। আমাদের পৃথিবী তখন সেই নতুন গ্রহের উপগ্রহে পরিণত হবে। 

পরাবিদ্যাবিদগন বলছেন, শুক্রগ্রহে বর্তমানে, পঞ্চম মন্বন্তরের সপ্তম প্রদক্ষিণকার্য্য চলছে। সুতরাং সেখানকার বর্তমান অবস্থা আমাদের পৃথিবী থেকে অনেক উন্নত। শুক্র গ্রহে এখন উন্নত শ্রেণীর জীব ও উন্নত শ্রেণীর জীবনীশক্তির আবাসভূমি। আমাদের পৃথিবী ক্ষেত্রে যখন চতুর্থ মন্বন্তর আরম্ভ হয় এবং চতুর্থবার জীবনীশক্তির বিকাশের সূত্রপাত হয় তখন শুক্র গ্রহ থেকে উন্নত পুরুষগন এই জীবনীশক্তি পরিচালনা করতে এসেছিলেন। তাঁরা এখনো আছেন। চন্দ্রে যখন তৃতীয় মন্বন্তরের কাজ শেষ হয়েছিল তখনও ওখানকার জীব-জন্তু, উদ্ভিদাদি পৃথিবীতে এসেছিলো। পৃথিবীতে এখন পঞ্চম মূল জাতির বিস্তার হচ্ছে। এর পরে আরোদুটো মূল জাতি উৎপন্ন হবে। সপ্তম জাতির অস্তিত্ব শেষ হলে, পৃথিবীতে জীবনের লোপ পাবে। এবং নতুনকরে, জীবনী-শক্তির  কাজ বুধ গ্রহে শুরু হবে। 

মন্বন্তরের মধ্যে জগৎ  অর্থাৎ গ্রহগুলি থাকবে।  কিন্তু নতুন মন্বন্তরে বর্তমানের সাতটি গ্রহের স্থানে অন্য সাতটি গ্রহ উৎপন্ন হবে। এইভাবে সাতটি বা ততোধিক মন্বন্তরের এক একটা ক্ষেত্রে কাজ শেষ হবে। সপ্তম মন্বন্তরের পরে কি অবস্থা হবে, তা মানুষের জ্ঞানের অতীত। হয়তো সমুদয় সৌরজগৎ মৌলিক নীহারিকাপুঞ্জে বিলীন হবে। 

প্রত্যেক মন্বন্তরের পরে নতুন সৃষ্টি আরম্ভ হয়। এই পৃথিবীতে চতুর্থ মন্বন্তরএর শুরুতে জীবনীশক্তির প্রথম আবির্ভাবে যে জীব সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল আকৃতিবিহীন, ধোঁয়ার মতো সূক্ষ্ম-কণিকাপুঞ্জ মাত্র।
ক্রমশঃ উন্নত হতে হতে তৃতীয়বার জীবনীশক্তির  আবির্ভাবে, জীবদেহ মানুষের আকৃতি ধারণ করে। এবং ক্রমশ স্ত্রী-পুরুষ ভেদ হওয়ায় স্ত্রী-পুরুষের মিলনে বংশ বিস্তার ঘটছে।এর আগে স্ত্রী-পুরুষ ভেদ ছিল না। এমিবার মধ্যে আমরা যেমন নির্দিষ্ট সময়ের পরে দ্বিখণ্ডিত হতে দেখি, সেই ভাবেই জীবের বংশ বিস্তার হতো। এইভাবেই জীবের ক্রমোন্নতি সাধিত হচ্ছে। আমরা আবার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়ে যাবো, কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তি আমাদের ক্রমশ উন্নত হবে। 

চতুর্থ জাতির বিকাশকালে, শুক্রগ্রহ থেকে যে সব মহাত্মারা পৃথিবীতে এসেছিলেন, তারা আমাদের প্রভূত উপকার সাধন করেছেন। তারা সবাই অশরীরী দেবাত্মা। জীবনী শক্তির চতুর্থ আবর্তনে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির উন্মেষ হবার কথা নয়। কিন্তু সেই সময়, ওই সব মহাপুরুষদের কৃপায় আমরা বুদ্ধিবৃত্তিতে উৎকর্ষ লাভ করেছি। হয়তো সপ্তম জাতির অভ্যুদয়ের আগেই, বর্তমান যুগের অনেক মানব দেবত্ব প্রাপ্ত হবে। আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আকৃতির উন্নতি  হচ্ছে। শুক্রগ্রহ থেকে যে সব মহাত্মারা এসেছিলেন, তারাই আমাদের উন্নতির কারন। তাদের মধ্যে যারা এখনো আমাদের পৃথিবীতে আছেন, তাদের দ্বারাই এই জগতের কাজ চলছে। এই মন্বন্তর শেষ হবার আগেই যারা অর্থাৎ যে সকল মানুষ সিদ্ধি লাভ করতে না পারবেন, তারা নতুন মন্বন্তরের আবির্ভাবে জীব সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত পরলোকেই বাস করবেন। এই সময়টা সব থেকে কষ্টদায়ক ও দীর্ঘ।  একেই কেউ কেউ বলেন নরক,  বা অনভিপ্রেত অপেক্ষমান কাল।  একে Aeonian Condemnation বলা যেতে পারে। 

বর্তমান সৌরজগতে যে দশটি ক্রমবিকাশ-ক্ষেত্র আছে, তার মধ্যে তিনটি ক্ষেত্রে  কোনো স্থূল-জগৎ নেই। সুতরাং সেই তিনটি সূক্ষ্ম জগৎ বাদ  দিয়ে ৭টি ক্রমবিকাশ ক্ষেত্র মনে করা যেতে পারে। 

পৃথিবী ও নেপচুন ক্ষেত্রে চতুর্থ মন্বন্তর চলছে। শুক্রে পঞ্চম মন্বন্তর এর সপ্তম আবর্তন চলছে। অন্য সব ক্ষেত্রে তৃতীয় মন্বন্তরের কাজ  চলছে।  নেপচুন-এর সঙ্গে আরো দুটি স্থূল জগৎ আছে , এর মধ্যে একটা প্লুটো যা কিছুদিন আগে আবিষ্কার হয়েছে। অন্যটি এখনো আবিষ্কৃত হয় নি।  ( এখন আবিষ্কার হয়েছে - আর তা হচ্ছে সেরাস (cerus), এছাড়া আরো দুটি গ্রহ আবিষ্কার হয়েছে আর তা হচ্ছে : চরণ (charon ), এবং  ২০০৩UB ৩১৩। ) উত্তাপের অভাবে বা অন্য্ প্রাকৃতিক কারণে এই সব ক্ষেত্রে মানুষের ন্যায় জীবের অস্তিত্ব সম্ভবপর নয়, তবুও সূক্ষ্মলোকের জীবগন, সেখানে থেকে ক্রমবিকাশের পথে অগ্রসর হচ্ছেন। এভাবেই সৃষ্টির উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে। 

মানুষ ক্রমশঃ উন্নতির পথে চলছে। ক্রমবিকাশের রীতি এই যে সূক্ষ্ম হতে স্থুল, স্থুল থেকে স্থুলতম এবং তারপরে, আবার ক্রমশঃ সূক্ষ্ম হতে  আরাম্ভ করে ও প্রাথমিক অবস্থায় পরিণত হয়। সর্বত্রই এই নিয়মে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের নিয়ম লক্ষিত হয়। পৃথিবীই স্থুলতম জগৎ।  চতুর্থ মূল-জাতি জড়বাদীর চরম অবস্থায় পৌঁছাবে। পঞ্চম জাতিতে আধ্যাত্মিক বিকাশ শুরু হয়েছে। পরাবাদীরা  বলছেন, সাত/আট  শত বছর পরে, ষষ্ঠ-মূল জাতির অভ্যুদয়  হবে।  জ্ঞান, বুদ্ধি, ধর্ম সব বিষয়ে পৃথিবীতে তারা যে উৎকর্ষ লাভ  করবেন, তা মানব জাতির পরম গৌরবের বিষয়। 

সৃষ্টি-তত্ত্ব সমাপ্ত।  
এর পরে আমরা আবার "মানুষের আসা যাওয়া" নিয়ে  আলোচনা করবো।           
           


  


   


    
   





     



সত্যধর্মের ধর্মের আলোতে গুরুতত্ব (সাত)

সত্যধর্মের ধর্মের আলোতে গুরুতত্ব (সাত)

মানুষের জীবনে এমন সময় আসে যখন মানুষ আকুল হয়ে ঈশ্বরের খোঁজ করে। এবং সেইজন্য সে মহাজনের পথ অনুসারে কাজ করে যায় । গুরুর খোঁজে বেরিয়ে পরে, গুরু সাক্ষাৎ লাভ করে, এবং  দীক্ষা গ্রহণ করে। গুরুর উপদেশ অনুযায়ী কাজ করে।

 কিন্তু আত্মানুসন্ধান ব্যতীত বেশিদূর অগ্রসর হওয়া যায় না। দুর্গম এই পথ। অবসর সময় কিছুক্ষন গুরুমন্ত্র জপ্ করলাম, তাতে কাজের কাজ কিছু হয় না।  গুরুলাভের জন্য চেষ্টা করতে হবে না।  নিজেকে উপযুক্ত করে তুলতে পারলে গুরু দর্শন পাওয়া যাবে। সুতরাং উপযুক্ত হওয়া বা নিজেকে উপযুক্ত করা  অনেক বেশি গুরুত্ত্বপূর্ন। এবং তার জন্য বিশেষ চেষ্টা আবশ্যক। জলের দ্বারা অন্তরাত্মা শুদ্ধ হয় না। মালা পড়লে সাধু হওয়া যায় না। তিলক লাগালে দেহশুদ্ধি হয় না। এবং এই সব করে আর যাই হোক আধ্যাত্মিক উন্নতি করা সম্ভব  সম্ভব নয়। 

আধ্যাত্মিক উন্নতি করতে গেলে,  চারটি জিনিসের অবশ্য প্রয়োজন।  

প্রথমতঃ সৎ ও অসৎ এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। যা নিত্য, চিরস্থায়ী, আধ্যাত্মিক জগতে সেটাই একমাত্র সৎ বস্তু। আর সব কিছু অসৎ এবং তাকে অগ্রাহ্য করতে হবে। আত্মার উন্নতি করতে গেলে চরিত্র শোধন  ও বস্তুর স্বরূপ দর্শন অবশ্য প্রয়োজন। নিজেকে সংস্কারমুক্ত হতে হবে।সর্বদা এই সৎ বস্তুর সেবা করতে হবে। অন্য সব কিছু অগ্রাহ্য করতে হবে।

দ্বিতীয়তঃ : অনাসক্তি।  কামনার স্রোতে নিজেকে ভাসালে চলবে না। সংসারে স্নেহ, মমতা, স্বার্থপরতা বন্ধন এগুলো থাকবে, কিন্তু মনকে সেখান থেকে ঘুরিয়ে প্রবৃত্তিকে পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের চিরাচরিত ধারণা, যা আমাদের ব্রাহ্মণ্যবাদ সমাজ শিখিয়েছে, সেগুলোকে পরিত্যাগ করে,অনুভূতির দ্বারা সত্যকে উপলব্ধি করতে হবে। প্রেমের আকর পরম-আত্মা, পরম-ঈশ্বর। আমাদের স্বার্থ-জড়িত যে প্রেম যার মুলে জৈবিক ধর্ম ধারণ করে আছে, তারও উৎপত্তি ঈশ্বর থেকে। পতি-পত্নীর যে প্রেম তারও  উৎপত্তি ঈশ্বর থেকে।  আমাদের পরস্পরের মধ্যে যে ভগবান আছেন, এই দাম্পত্য প্রেম যেন সেই উদ্দেশ্যে ধাবিত হয়। প্রত্যেক ব্যক্তির ভিতরে যে অন্তর-আত্মা আছে আমাদের তথাকথিত প্রেম যেন সেই বস্তুর দিকে প্রসারিত হয়। বার বার চেষ্টা করে, ক্রমশঃ কামনার বস্তুকে উপেক্ষা করে, বস্তুর মধ্যে যে পরমধন আছে, সেই দিকে ধাবিত হতে হবে। ভগবানকে লাভ করতে গিয়ে, ভগবানের তৈরি বস্তুতে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। আর সেই পবিত্র প্রেমের বন্ধনে জগৎকে বাঁধতে পারলেই ভগবত প্রাপ্তি। আর তার জন্য প্রেমের মধ্যে যে স্বার্থের সন্মন্ধ সেটাকে মুক্তি দিতে হবে।

তৃতীয়তঃ : শারীরিক সংযম, চিত্ত সংযম, বিশ্বাস, ধৈর্য্য এগুলোই মানুষের সম্পদ। এই সম্পদের বৃদ্ধি করতে হবে। মনকে প্রিয় বস্তুর দিকে ধাবিত হতে না দিয়ে, শ্রেয় বস্তুর দিকে লাগামের সাহায্য নিয়ে যেতে হবে। আমাদের কর্মকে সুনিয়ন্ত্রিত করতে হবে। সহ্য করতে শিখতে হবে। শতশত দুঃখেও অবিচল থাকতে হবে। মনে দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে যে এই দুঃখই আমাকে ভগবৎ  অনুভূতি এনে দেবে।

চতুর্থতঃ : ভগবানের সাথে মিলিত হবার জন্য, নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে।আধ্যাত্মিক জীবনে পূর্ন ব্যাকুলতা ছাড়া এগুবার কোনো উপায় নেই।  একথা সদা সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, সর্ব্বভূতে ভগবান আছেন,  অতএব সর্বভূতে সমবুদ্ধি সম্পন্ন হতে হবে।

দীক্ষা নিতে গেলে আমাদের এই চারটি সোপান পেরিয়ে যেতে হবে। যারা এটাকে অতিক্রম করতে পেরেছেন, গুরুদেব স্বয়ং তার কাছে  উপস্থিত হন। উপযুক্ত গুরুকে খুঁজতে হয় না। উপযুক্ত গুরু উপযুক্ত শিষ্যকে খোঁজেন, তাকে শিষ্য বানাবার জন্য নয়, তাকে প্রকৃত গুরু বানাবার জন্য।
রামকৃষ্ণকে গুরু খুঁজতে হয় নি।  একাধিক গুরু তার কাছে এসেছিলো তাকে শিষ্য হিসেবে পেতে। রামকৃষ্ণ কিন্তু শিষ্য হয় নি, তিনি আসলে গুরু হয়েছিলেন।  সন্দেহ, কুসংস্কার, এবং পৃথক-ভাব পরিত্যাগ করতে পারলে, গুরুকে আপনজন মনে হয়। শত্রু, মিত্র, আত্মীয়,অনাত্মীয়, আপন-পর  সবার মধ্যেই আমি আছি।  কেবল দেহগুলো পৃথক, এই ভাব যখন মনে  স্থায়ী হয়, তখন উপযুক্ত দীক্ষা হয়। একটা কথা মনে রাখবেন,  ঈশ্বর সর্বত্র আছেন, কিন্তু গুরুদেবকে সর্বত্র পাওয়া যায় না, গুরু সুদুর্লভ। সূক্ষ্ম দেহের উন্নতির দ্বারা যিনি সুখে-দুঃখে অবিচল, মান-অপমান বোধ বর্জিত,, প্রিয় বা অপ্রিয় বলে যার কাছে কিছু নেই। যিনি সব সংগ  ত্যাগ করেছেন, তাকে শিষ্য করবার জন্য গুরুদেবরা সর্বস্য দিয়ে থাকেন।  তিনিই উপযুক্ত শিষ্য। সুতরাং শিষ্য হওয়াই সাধনা।

ওঁং শান্তি শান্তি শান্তিঃ।

সমাপ্ত  











       

Monday 17 December 2018

মানুষের আসা যাওয়া - জন্ম-মৃত্যু রহস্যঃ(তিন)




এই পৃথিবীর পান্থশালায় কেহ আসে কেহ যায়। কেই বা আসে, কেই বা যায়। কোথা থেকে আসে কোথায় যায়। কথায়  বলে জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে। অর্থাৎ এইসব ঘটনা বিধি-নির্দিষ্ট। এতে আমাদের কোনো হাত নেই। আমি কারুর মৃত্যু হলে বলি, কর্ম শেষ তাই চলে গেলেন। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জাগে কর্ম কখন শুরু হলো ? কবেই বা শেষ হলো ? সত্যই কি কর্ম শেষ হলো ? আমি অনেক মানুষকে মরতে দেখেছি, কতকিছু করবে বলে ভেবেছিলো।  সব ভাবনা রেখে দিয়ে চলে গেল। অসময়ে  চলে গেলো। পরিণত বয়সে অর্থাৎ বৃদ্ধ বয়সে মারা গেলে ঠিক ছিলো, কিন্তু এতো আগে আগে চলে গেলো। কাল পূর্ন  হলে মানুষের মৃত্যু হয়। নিয়তি যখন প্রবল হয় তখন মানুষের বুদ্ধিভ্ৰষ্ট হয়। 
আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, সুতিকা গৃহে দোয়াত  কলম রাখা হতো।  বিধাতা শিশুর ভাগ্যলিপি লিখে রেখে যাবেন । জন্মের পরে, তুমি যতই ভালো কাজ করো আর খারাপ কাজ করো, যতই তুমি জ্ঞান অর্জন করো, আর অজ্ঞানী হও, যতই তুমি ধর্মকার্য্য কারো, আর অধার্মিক হও, বিধির লেখা একটা অক্ষরও কাটা যাবে না। কাল পূর্ন হলে তোমাকে চলে যেতে হবে। নিয়তি যখন প্রবল হয় তখন মানুষের বুদ্ধিভ্ৰষ্ট হয়। বিচারশক্তি ক্ষীণ হয়। আত্মরক্ষার ক্ষমতা থাকে না। কত মানুষ অসময়ে সামান্য কারণে মারা যায়। আবার কত মানুষ মরতে মরতে বেঁচে যায়। কোন শক্তি তাকে বাঁচায়, আর কেনই বা বাঁচায়। আবার কোন শক্তি তাকে মেরেফেলে। বোঝা দায়।  এই না বোঝাকেই আমরা বলি অদৃষ্ট । অদৃষ্ট মানে না এমন কোনো মানুষ নেই। সব যুক্তির উর্দ্ধে এই অদৃষ্ট বা ভাগ্য । 

দার্শনিকরা বলেন, মানুষ যে কাজ করে, চিত্তে তার ছাপ  পড়ে । একে বলে সংস্কার। জন্ম-জন্মান্তর ধরে, মানুষ এই সংস্কার অর্জন করছে, আবার ক্ষয় করছে।  ফলপ্রদান উন্মুখ এই সংস্কারপুঞ্জ জীব দেহকে আশ্রয় করে, ফল প্রদান করে। এটাই জীবের জন্মের কারন। আমাদের ভোগ ও আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করে,এই সংস্কারপুঞ্জ। 
শ্রূতিশাস্ত্র আবার অন্য কথা বলে। তারা বলেন, পরম-ঈশ্বরের নির্দেশেই সব কার্য্য হচ্ছে। তাঁর ভয়ে চন্দ্র, সূর্য,  নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুরছে। বায়ু, অগ্নি নিজের কাজ করছে। জগতের সমস্ত কার্য্য তার নির্দেশেই হচ্ছে। একটা পাতাও পড়তে পারে না, তার নির্দেশ ছাড়া।  এমনকি মৃত্যুও তার নির্দেশেই সংগঠিত হচ্ছে। ভগবানের সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টিই হচ্ছে এই জীব জগৎ। তো তার থাকা না থাকা, অবশ্যি তারই নির্দেশেই চলছে। উৎপত্তির কারণও তিনি আবার লেয়ার কারণও তিনি। তিনিই সর্বময়। তিনি সৃষ্টিকালে সৃষ্টি করেন, সংহারকালে সব আত্মস্যাৎ করেন। ঈশ্বরই জগৎ কারন। 

উপনিষদ বলছে : জীব জন্ম গ্রহণ কোরে যতক্ষন দেহে অবস্থানযোগ্য কর্ম থাকে সেই পর্যন্ত জীবিত থাকে।  কর্মক্ষয় হলে সে মারা যায়। কর্মরাশি যতদিন ভোগের দ্বারা ক্ষয়িত না হচ্ছে ততদিন তার জীবন থাকে। কর্মের ভোগ শেষ হয়ে গেলে তার মৃত্যু হয়। অতএব মানুষের জীবন হচ্ছে, প্রারব্ধ বা ফল-উন্মূখ  কর্মের সমষ্টি মাত্র। তাই আমাদের কাজ ফুরুলেই চলে যেতে হবে। এমনকি আত্মজ্ঞান সম্পন্ন মানুষও তার  প্রারব্ধ কর্ম অর্থাৎ যে কর্মভোগ হেতু জন্ম গ্রহণ করেছেন, বা দেহ উৎপন্ন হয়েছে, সেই সকল কর্ম উপভোগের দ্বারা যতক্ষন ক্ষয়প্রাপ্ত না হচ্ছে, ততক্ষন তার মোক্ষলাভ হয় না। জ্ঞান দ্বারা তিনি সঞ্চিত কর্ম বা ক্রিয়মান কর্ম ক্ষয় করতে পারেন, কিন্তু প্রারব্ধ কর্ম ভোগ  তাকে করতেই হবে। 

অতয়েব আমরা বুঝতে পারছি, প্রারব্ধ কর্মের ফল ভোগ করার জন্য আমাদের জন্ম নিতে হয়। তাই জন্মকালেই আমাদের জীবিত-কাল বা আয়ুষ্কাল নির্দিষ্ট হয়ে যায়। 



         


Saturday 15 December 2018

শ্রাদ্ধ কর্মে উপাসনা বা প্রার্থনা করার উপকারিতা


শ্রাদ্ধ কর্মে উপাসনা বা প্রার্থনা করার উপকারিতা


 সমস্ত ধর্মীয়  ভাই-বোনদের মৃত্যুর পরে , শ্রাদ্ধ-কর্মাদির সঙ্গে আমরা উপাসনা বা প্রার্থনা করতে দেখি। এর দ্বারা কি উপকার হয় ? যদি হয় কার উপকার হয়?
একটা কথা মনে রাখা দরকার আমাদের এই পার্থিব জগতে বা দৃশ্যমান জগৎ যেমন নিয়মে বাঁধা অর্থাৎ প্রত্যেক কাজের একটা কারন আছে, তেমনি পরলোকেও একটা নিয়ম শৃঙ্খলা আছে। নিতান্ত খেয়ালের উপরে কোনো কিছু হয় না। জগতের সমস্ত ঘটনাই নিয়মের অধীন। এবং মনে রাখবেন, ঈশ্বর আমাদের মঙ্গলের জন্যই সমস্ত ঘটনা ঘটাচ্ছেন। আমাদের উচিত অদৃশ্য শাসন-কর্তাকে সাহায্য করা। আমরা অজ্ঞতা বশতঃ অনেক সময় বিপরীত কাজ করে থাকি। এইসব ভুল পদক্ষেপ যেমন আমাদের নিজেদের পক্ষে ক্ষতিকারক, তেমনি আমাদের নিকটজনের জন্যও ক্ষতিকারক।

আমাদের সবারই অভিজ্ঞতা বলে, কেউ মারা গেলে আমরা শোক করি, কান্নাকাটি করি। কিন্তু এটা আমাদের করা উচিত নয়।  এতে আমাদের যিনি মারা গেছেন, তাঁর অর্থাৎ দেহ-মুক্ত জীবাত্মার ক্ষতি করি। এতে করে, সেই জীবাত্মার  কামলোকে অবস্থানের মেয়াদ বেড়ে যায়। তাই আমাদের শোক ত্যাগ করে, আমাদের ভাবা উচিত, কি ভাবে  আমাদের সেই স্নেহের পাত্র বা শ্রদ্ধার পাত্র যিনি দেহ থেকে মুক্ত হয়ে গেছেন, তিনি পরলোকে কিভাবে  সুখে শান্তিতে থাকতে পারেন।  এবং সেই উদ্দেশ্যেই আমাদের উচিত তার আত্মার শান্তির জন্য  পরমেশ্বর-এর কাছে প্রার্থনা করা  বা উপাসনা করা , এমনকি তার উদ্দেশে যদি আমরা ধ্যান করি, তাহলেও  পরলোকগত আত্মার শান্তি হয়।

"উপাসনা" সর্বদাই মঙ্গলময় বাসনা বা মঙ্গলমায়ের কাছে আবেদন  ছাড়া আর কিছু নয়। এর মধ্যে স্বার্থের লেশ মাত্র থাকা উচিত নয়। কিছু প্রত্যাশা করা  উচিত নয়। নিঃস্বার্থ শুভইচ্ছা প্রদান, গভীর ভাবে তার শুভ  চিন্তায় মগ্ন থাকলে তার উপকার হয়। এবং এই শুভকর্ম  করলে, তা কখনোই নিষ্ফল হয় না।

আমরা জানি, চিন্তার একটা আকার আছে, চিন্তা মাত্রেই বস্তূ, তা সে সুচিন্তাই হোক বা কুচিন্তাই  হোক। আমাদের স্বার্থহীন কল্যাণ  চিন্তা  অব্যর্থ ভাবে সেই অদৃশ্য সেই বিদেহী আত্মার কাছে বা বস্তূর কাছে, আমাদের চিন্তার প্রবাহ বা স্রোত   অবশ্য়ই পৌঁছাবে  । এবং তার কল্যাণ হবে। আমরা শুধু শ্রাদ্ধ শান্তি করে, নিয়ম রক্ষা করতে পারি। নিজেরা তৃপ্ত হতে পারি। কিন্তু তাতে তার কোনো মঙ্গল হয় না। বরং আমরা যদি পরম-ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, হে প্রভু তোমার এই পুত্রকে  " চির শান্তি দাও তারে, রেখো তারে আনন্দ পাথারে" - এই চিন্তা করে, দৈনিক কয়েকবার স্থির চিত্তে পরম-ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে পারি, তবে পরলোকগত আত্মার কল্যাণ  সাধিত হয়। আমাদের যে সব নিকট আত্মীয়, পরলোকে বাস করছে, তারা সবাই তখন এসে নবাগতকে অভ্যর্থনা করে। নতুন জগতের সব কিছু তাকে বোঝায়, এবং সাহায্য করে। তা না করে যদি আমরা শোকাচ্ছন্ন হয়ে থাকি, কান্নাকাটি করি, তবে মৃত ব্যক্তির আত্মা একটা দোটানায় পরে যায়, এবং অকুল পাথারে দুলতে থাকে। এবং এর ফলে, যে মৃত্যু তাকে এক আনন্দময় উজ্বল জীবনের সন্ধান দিতে পারতো, তাঁকে সে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে পারে না। ফলে আমাদের কান্নাকাটি, শোক, এগুলো মৃত আত্মার উন্নতির অন্তরায় হয়ে যায়। এবং নতুন জীবনে অভ্যস্ত হতে তার দেরি হয়। মৃত আত্মার প্রকৃত মঙ্গল সাধন করতে হলে তন্ময় চিত্তে প্রতিদিন, মৃত আত্মার জন্য প্রার্থনা করা কর্তব্য। একটা সুন্দর প্রার্থনার কথা আমি অনেক দিন আগে এক ব্রাহ্মণ পন্ডিতের কাছে শুনেছিলাম, জানিনা কার লেখা, সেটা বলি :

ঈশো দিশতু কল্যানং সর্ব্ব অশুভ নিবর্তকম।
নির্মল আনন্দ সন্দোহং শাশ্বতং তে প্রযচ্ছতু। ।

হে ঈশ্বর, সমস্ত অশুভকে দূর করে,  কল্যাণ  করুন। শাশ্বত নির্মল আনন্দ যথেষ্ট পরিমানে প্রদান করুন।

শান্তি নির্বাণ-পরমা ব্রহ্ম সংস্থা সদা অস্তু তে।
ভূয়াৎ চিরন্তনী তৃপ্তিঃ প্রীতির ঐকান্তিকী পরা। ।

পরম-নির্বাণ শান্তি স্বরূপ ব্রহ্মে স্থিতি যেন বিধেয় হয়।  তৃপ্তি ও প্রীতি যেন চিরস্থায়ী হয় ও ঐকান্তিক হয় ।

সৎ কৃপাবারি বর্ষৈস্তে ত্রিতাপানল সঞ্চয়াঃ।
চিরায় প্রশমং যান্তু-মাঙ্গল্যম ঈদম অর্থয়ে। ।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি  ওঁং

ত্রিতাপ জ্বালা নিবারণের জন্য তোমার সৎ কৃপাবারি সদাই বর্ষাতে  থাকুক। অমঙ্গল প্রশমিত হোক চিরতরে। এই আমাদের প্রার্থনা। 

আমাদের মধ্যে কারুর কারুর ধারণা, উপাসনাতে, বা প্রার্থনাতে, পরলোকগত আত্মার কি  আসে যায়  ? বরং বলা যেতে পারে, যারা এই উপাসনা, বা প্রার্থনা করে, তাদের এতে লাভ হয়। মনের শান্তি আসে। মৃত ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা আমাদের পক্ষে আরো বেশি জরুরী।  কিন্তু তারা যেটা জানে না, সেটা হচ্ছে, জীবের মৃত্যু কিংবা জীবিত থাকা প্রকৃত পক্ষে অর্থহীন বাক্য। জীব যখন, আনন্দলোক থেকে বেরিয়ে আসে, তার পর থেকে সে ঘুরতে থাকে, কখনো স্থুল শরীর  ধারণ করে, যাকে  আমরা জীবিত বলি,  আবার কখনো সূক্ষ্ম শরীর ধারণ করে, তখন তাকে আমরা মৃত বলি। আসলে আমরা যেমন, তেমনই  আছি।  যখন আমরা মনুষ্য শরীরের মধ্যে প্রবেশ করি তখন মানুষ  হয়ে যাই।  আসলে আমি যার মধ্যে যখন প্রবেশ করি, তখন আমাকে তাই মনে হয়। আমি মানুষের মধ্যে প্রবেশ করলে আমি মানুষ হই , আবার যদি কোনো জীব অর্থাৎ গরু গাধা, বাঘ, হাতি যার মধ্যেই প্রবেশ করি, তখন আমি তাই হয়ে যাই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, আমাদের বাসনার তৃপ্তি সাধনের সমাপ্তিতে,  আবার সেখান থেকে বেরিয়ে নিজ ধামে ফিরে আসি।  এটাই মোক্ষ।  এটাই মুক্তি। আসলে আমি যা তাইই  থাকি। আমি যার মধ্যে প্রবেশ করি, সেটার লয় মানে আমার লয়  নয়।  এই সত্য আমাদের বুঝতে হবে।

তথাকথিত মৃত্যু আর কিছুই নয়, শরীরের পরিবর্তন, অর্থাৎ স্থূল থেকে সূক্ষ্ম শরীরে গমন। জীবিত মানুষের ক্ষেত্রে যেমন ভালো কথা, ভালোবাসার কথা আমাদের আনন্দ দেয়, ঠিক তেমনি বিদেহীর পক্ষে, তার সম্পর্কে প্রেমাত্মিকা চিন্তা, তার কাছে  উপাদেয়, বা উপভোগ্য। আমাদের শুভ চিন্তা যত  ঐকান্তিক হবে যত  গভীর হবে, ততই অধিক ফলবতী হবে।  আর একই জিনিস যদি সমবেত ভাবে করা যায়, অর্থাৎ উপাসনা যদি সমবেত ভাবে করা যায়, তবে সেটা আরো বেশি ফলপ্রসূ, আরো বেশি আনন্দ দায়ক হবে। আর বিদেহীর  আত্মউন্নতির পথে সহায়ক হবে। আত্মীয়স্বজন যদি একসঙ্গে, একই সময়ে একত্রে মিলিত হয়ে প্রতিদিন শুভচিন্তা প্রেরণ করে তার চেয়ে ভালো কিছু আর হয় না। যদি সবাই একই সময় এক জায়গায় মিলিত হতে নাও  পারেন, তথাপি, একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই শুভ চিন্তার অনুষ্ঠান করতে পারেন, তবে সেটাও খুব ফলপ্রসূ হবে। সুতরং আমাদের চিন্তাশক্তির এই শুভ দিকটি যদি আমরা সম্মিলিত ভাবে কাজে লাগাতে পারি, তবে শুধু পারলৌকিক আত্মাদেরই শান্তি হবে তাই নয়, আমাদেরও সর্বাঙ্গীন শান্তি লাভ হবে।

শোক আসলে স্বর্থের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।  আমরা মনে করি,  যে এত স্নেহ, মমতা, প্রেম, ভালোবাসা, সবই  জীবনের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায়। আমি তো জানিনা যে আমার শেষ নেই। নতুন ভাবে আমি পরলোকে বিকশিত হই।  পরলোকে তো জন্ম মৃত্যু নেই সেখানে আমরা আবির্ভূত হই, আবার সময় শেষ হয়ে গেলে আমরা সেখান থেকে প্রস্থান করি। অর্থাৎ হয় উচ্চতর স্তরে অথবা আবার মৃত্যুপুরীতে চলে আসি। কারুর সঙ্গেই আমার বিচ্ছেদ হয় না। পরলোকে বসে আমরা সব দেখতে শুনতে পাই শুধু আদান প্রদান পার্থিব ভাবে করতে পারি না। কিন্তু ভাবনা-চিন্তা আমাদের মিলনের সেতু হতে পারে। পুত্র যখন দূর দেশে চাকরি করতে যায়, তখন আমরা কান্নাকাটি করি, এগুলো ঠিক নয়। এতে দুরদেশবাসী আমার আত্মীয়ের বা পুত্রের  মানসিক যন্ত্রনা হয়।এতে তারা  সেখানকার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে না। আমরা সেটা বুঝতে পারি না। তেমনি পরলোকবাসীর জন্য আমরা যদি শোক করি, তাতে তাদের কষ্ট  হয়। এবং তাদের স্বাভাবিক উন্নতিতে বাধা হয়। কামনার লোকে তাদের বাসের সময় দীর্ঘায়িত হয়। সেটা আমাদের একদম অনুচিত। আমাদের নিকটজন বাড়ির বাইরে গেলে এক অশুভ আশঙ্কা আমাদের ঘিরে থাকে, এই বুঝি তার কোন খারাপ কিছু হলো। আসলে স্নেহ ভালোবাসা, আমাদের অনিষ্টের আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে। তাই শোক করা, বা অনিষ্টের আশঙ্কা থেকে আমাদের চিন্তাকে দূরে রাখতে হবে। শুভ চিন্তা-ভাবনা নিয়ে উপাসনা করুন, শুধুই উপাসনা করুন। আমাদের শুভভাবনার এক অলৌকিক ক্ষমতা আছে, সেটা প্রতক্ষ্য করুন।

            
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ

Friday 14 December 2018

ভক্তিযোগ ও শ্রীকৃষ্ণ-গীতা




ভক্তিযোগ  ও   শ্রীকৃষ্ণ-গীতা 


শুধুমাত্র অনন্যা ভক্তি থাকলেই আমাকে জানা যায়, বোঝা যায়। আমার জন্য যে ব্যক্তি কর্ম  করেন, যিনি আমার শরণাপন্ন ও আসক্তিশুন্য,সর্বভূতে শত্রূ শুন্য, ইনিই আমাকে প্রাপ্ত হন।  ১১/৫৫.........

মৎ কর্ম কৃৎ মৎ পরমঃ মৎ ভক্তঃ সঙ্গবর্জিতঃ। 
নির্বৈরঃ সর্বভূতেষু যঃ স মাম এতি পাণ্ডব। ।  


ভগবান কথা : ১৪/০৬/২০১৭ (ভক্তিযোগ)

পরম শ্রদ্ধা সহকারে যাদের মন আমাতে নিবিষ্ট করে আমাকে উপাসনা করেন, তারাই শ্রেষ্ট যোগী।

যাঁরা  সর্বদা সমবুদ্ধি যুক্ত, সর্ব ভূতে হিতে রত, সর্বত্র গমনকারী, অব্যক্ত, কূটস্থ, অচল, অচিন্তনীয়, ধ্রূব, ক্ষয়োদয় রোহিত, ব্রহ্মের উপাসনা করে তারাও আমাকে প্রাপ্ত হয়। অব্যক্ত বা নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসকদের মুক্তিলাভ কষ্টকর  হয়। কারণ, দেহধারীর নির্গুণ ব্রহ্মলাভ খুবই কষ্টসাধ্য। 
কিনতু যাঁরা আমাপরায়ণ হয়ে, সর্ব কর্ম আমাতেই  সমর্পন করে, স্থির চিত্তে, আমাকেই চিন্তা করতে করতে আমার উপাসনা করে, সেই সকল সাধককে আমি মৃত্যুপূর্ণ সংসার সমুদ্র হতে অচিরেই রক্ষা করি। আমাতেই মন নিবিষ্ট কর।  আমাতেই বুদ্ধিযুক্ত হও, তাহলে দেহান্তে আমাকেই প্রাপ্ত হবে। স্থির ভাবে আমাতে চিত্ত স্থির করতে যদি সমর্থ না হও, তা হলে অভ্যাসের সাহায্যে আমাকে পেতে চেষ্টা করো। যদি অভ্যাসেও সামর্থ না হও, তাহলে আমার কাজে চিত্ত স্থির করো। আমার প্রীতির জন্য কর্ম করলেও তুমি সিদ্ধি লাভ করবে। তাও যদি সম্ভব না হয়, তবে আমার শরণাপন্ন হয়ে, সংযত চিত্ত হয়ে, সমস্ত কর্মফল ত্যাগ করো। অভ্যাস থেকে জ্ঞান শ্রেষ্ট - জ্ঞান হতে ধ্যান শ্রেষ্ট - কর্মফল ত্যাগ ধ্যান হতেও শ্রেষ্ট।  ত্যাগেই পরম শান্তি। 
যে ব্যক্তি সর্বভূতে হিংসা শূন্য, মৈত্রী ভাব সম্পন্ন, সবাকার প্রতি করুণা, মমতা শূন্য, অহংকার শূন্য, সুখ-দুঃখ সমান জ্ঞান করেন, ক্ষমাশীল, সর্বদা তুষ্ট,দৃঢ় বিশ্বাসী, মন বুদ্ধি যার আমাতে অর্পিত - সেই যোগী আমার ভক্ত ও প্রিয়। 
যার দ্বারা উদ্বেগ প্রাপ্ত হয় না, নিজেও কারো ব্যবহারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন না, অপরের আনন্দ লাভে যিনি অসহিষ্ণু নহেন, ভয় ও উদ্বেগ শূন্য - সে-ই  আমার প্রিয়। ১২/১৬.....

যে  ব্যক্তির আনন্দের প্রকাশ নেই, চিত্ত ক্লেশ শূন্য, কামনা হীন, শুভ অশুভ ফল ত্যাগী সে ভক্তই আমার প্রিয়। যিনি শত্রূ-মিত্র, মান-অপমানে, শীত-গ্রীষ্মে, সুখে-দুঃখে অবিচলিত, সর্ব বিষয়ে আসক্তিহীন, নিন্দা প্রসংশায় সম জ্ঞানকারী, স্থির চিত্ত, নির্দিষ্ট বাসস্থান শুন্য, সেই ভক্তই আমার প্রিয়। যারা ভক্তি পূর্বক মৎপরায়ণ হয়ে, এই ধর্ম-অমৃত পান করেন, তারাই আমার অত্যন্ত প্রিয়। 

১২/২০.........

আমি এই ভক্তি যোগটা একটু ভালো করে বোঝার চেষ্টা করবো :

এই ভক্তিযোগ অর্থাৎ দ্বাদশ অধ্যায়ে মাত্র কুড়িটা শ্লোক আছে। 

এখানে প্রথমেই অর্জুন প্রশ্ন করছে :

এবং সততযুক্তা যে ভক্তাঃ ত্বাং পর্যা-উপাসতে
যে চ অপি অক্ষরম-অব্যক্তং তেষাং কে যোগবিত্তমা।

অর্থাৎ  যে ভক্ত তোমাতে সততযুক্ত হয়ে তোমার (রূপের) উপাসনা করে আর যারা তোমার অব্যক্ত অক্ষর রূপের সাধনা করে, তাদের মধ্যে শ্রেষ্ট যোগবিদ কে ?


ভগবান তার উত্তরে বলছেন :

ময়ি-আবেশ্যমান যে মাং নীতিযুক্ত উপাসতে 
শ্রদ্ধয়া পরয়া-উপেতা-অস্তে মে যুক্ততমা মতাঃ।

যারা আমাতে মন নিবিষ্ট করে, আমাতে নীতিযুক্ত হয়ে আমার উপাসনা করে, আমার মতে  তারাই শ্রেষ্ট।


শুনলে মনে হয়, এতো  অহংকারের কথা। এ কথা হয় বুদ্ধু  বলতে পারেন নতুবা বুদ্ধ বলতে পারেন। ভগবান আগেই বলেছেন ঈশ্বর  অব্যক্ত। এই অব্যক্ত ঈশ্বরের কথা পুরাতন ব্রহ্মবিদগণ, বেদবিদগণ বলে গেছেন।  তো যারা অব্যক্ত পরম-ঈশ্বরের সাধনা করছে, তাদের থেকে তোমার এই মনুষ্যরূপী শ্রীকৃষ্ণের সাধনা করা, কি করে শ্রেষ্ট হয়। তাছাড়া এই শ্রীকৃষ্ণের জন্মের আগেও  ঈশ্বর ছিলেন, এবং তার উপাসক-ও  ছিলেন , তবে তারা সবাই নিকৃষ্ট সাধনা করে ছিল ? আর শ্রীকৃষ্ণের আমলেও তো শ্রীকৃষ্ণের পূজা হতো না। কেউ কেউ হয়তো তাকে ভগবানের অবতার বলে স্বীকার করতো। কিনতু তখনও  শ্রীকৃষ্ণকে  ঘিরে সাধন পদ্ধতির উদ্ভব হয় নি। তাহলে শ্রীকৃষ্ণ এসব কি বলছেন ?

এইখানেই গীতার সংযোজন। এর আগে বেদ-নির্দিষ্ট পথে সাধন হতো।  বেদে কর্মকাণ্ড অর্থাৎ জাগযজ্ঞ করবার পদ্ধতি ছিল।  আর ছিল জ্ঞান কাণ্ড, অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা। চিত্ত-নিরোধের পদ্ধতি যা পতঞ্জলি প্রবর্তন করেছেন -  আশ্রমীদের এই চিত্তনিরোধের পদ্ধতি বা অষ্টাঙ্গ যোগ করতে দেখা গেছে। 

শ্রীকৃষ্ণ এসে জ্ঞানযোগের সঙ্গে যোগ করলেন নিষ্কাম কর্মযোগ। 

অর্থাৎ বাসনাহীন বা আসক্তিহীন  কর্ম। আর একটা নতুন পদ্ধতি তা হলো ভক্তিযোগ। আশ্রমীদের মধ্যে গুরুভক্তি আগেও ছিল, কিনতু  ভগবানে ভক্তি কথাটার প্রচলন ছিল না, নির্ভরতা ছিল।  আর দেবতা বলতে ছিল প্রকৃতি।  বিশেষ করে আর্যদের মধ্যে নিরাকার সাধনাই প্রচলিত ছিল। শ্রীকৃষ্ণ এসে এই ভক্তিযোগ চালু করলেন। এবং এটা ভারতবর্ষের আবিষ্কার। শ্রীকৃষের আবিষ্কার। ব্যাসদেবের আবিষ্কার।  অন্য কোনো ধর্মে এই ভক্তিবাদ আজও আসেনি। এবং এই ভক্তিবাদের আকর্ষণেই লক্ষ লক্ষ্য বিদেশী হিন্দু-ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। আশ্চার্য্য ব্যাপার হচ্ছে এই ভক্তি আমাদের অন্তরে জন্ম থেকেই আছে।  এটা জাগ্রত করার জন্য শুধু বলছেন শ্রীকৃষ্ণ। নতুন কিছু সংগ্রহ নয়।  

এখন সাধন পদ্ধতি দুই প্রকার - দ্বৈতবাদ আর অদ্বৈতবাদ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই দ্বৈতবাদের আবিস্কারক। শ্রীকৃষ্ণ একদিকে বলছেন ঈশ্বর অব্যক্ত, আবার বলছেন : যারা আমাতে মন নিবিষ্ট করে,আমাতে নিত্যযুক্ত হয়ে ঐকান্তিক ভক্তি সহকারে আমার উপাসনা করে, তারাই শ্রেষ্ট। এখন কেন  শ্রেষ্ট ? প্রশ্ন এখানেই। আর একটা প্রশ্ন শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে ভগবান বলছেন, এটা কি তার অহমিকা নয় ? নিজেকে জাহির করা নয় ?  তিনি যদি ভগবান হন তবে তার কর্মেই আমরা তার ভগবানত্ব বুঝবো বা দর্শন করবো। নিজেকে কেন বলতে হবে আমি ভগবান, আমার পূজা করো। এর থেকে আমরা কি শিখবো ? আমরা কি নিজের ঢাক নিজে পেটাতে শিখবো না ? 

এই প্রসঙ্গে আমি দুটো উদাহরণ দেই।  এক : স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজ, ভারত সেবাশ্রম এর প্রতিষ্ঠাতা। ইনি একটা সময়ে, তার শিষ্যদের কাছ থেকে আক্ষরিক অর্থে পূজা গ্রহণ করতেন। স্বামীজী আসনে বসতেন, ভক্তরা তাকে মালা পড়াতেন, ভোগ দিতেন, ফুল, বেলপাতা , ধুপ, প্রদীপ দিয়ে তার পূজা করতেন, আরতি  করতেন। প্রণবানন্দজি নিজেকে শিব ভাবতেন। আর শিষ্যদের বলতেন পূজা করতে।  এখন, তার সমবয়সী যে সব সন্যাসী, যারা তার মানবসেবা কর্মের সহযোগী ছিলেন, তাদের কাছে এটা অশোভন লাগতে লাগলো। তারা একদিন, একথা স্বামী প্রনাবনান্দকে বললেন। প্রণবানন্দ তাদের বলে ছিলেন : দেখো, মা বাবাকে যদি পূজা করা যায়, তবে আমার পূজায় দোষ  কোথায় ? আমি যেটা বলতে চাইছি - মহাপুরুষরা নিজের পূজার প্রচলন নিজেরাই করেছেন। পূজা পাবার জন্য অনেক দেবতা, নানান ভাবে ভক্তদের বিড়ম্বনায় ফেলতো, এমন গল্পতো বহু আছে। 

আর ঠাকুর রামকৃষ্ণ নিজেকে অবতার বলে প্রচারের ভাগিদার ছিলেন। ভৈরবী যজ্ঞেশ্বরী  যখন তাকে অবতার বলে প্রচার করতে চেয়েছিলো, এবং পান্ডিত্সভা ডাকবার জন্য বলছিলেন।  তখন ঠাকুর  রামকৃষ্ণই মাথুরবাবুকে এই পান্ডিত্সভা ডাকবার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা। তাহলে এও তো এক প্রকার নিজেকে ভগবানের অবতার বলে প্রচার করা , এবং সেটা  নিজে থেকেই করা। আসলে ভগবানকে আমরা তো চিনি না। তাই ভগবানরাও নিজেকে ভগবান বলে প্রচার করে।  আবার ভন্ডরাও নিজেকে ভগবান বলে প্রচার করে। কালের গতিতে ভগবান বেঁচে থাকে, ভন্ডরা হারিয়ে যায়। শ্রীকৃষ্ণের আমলেও দ্বিতীয় বাসুদেব ছিল পৌন্ড্র।  ইনি আসামের দিকে কোনো রাজ্যের রাজা ছিলেন, তার কাকার পুত্রের নাম ছিল বলরাম।  তার সুদর্শন চক্র ছিল।  নিজেকে বাসুদেব বলে প্রচার করতেন। অতএব  শ্রীকৃষ্ণ একা নিজেকে ভগবান বললেন, বা নিজের প্রচার নিজেই করেছেন এমন নয়। এইরকম প্রচার আকছার এখনো হচ্ছে।  আগেও হয়েছে। যাই হোক এখন আমরা অদ্বৈত বাদ সম্পর্কে আলোচনা করবো।  

যারা অদ্বৈতবাদের সাধনা করেন, তারা নিজেরা জানেন এটি একটি সময়সাপেক্ষ, এমনকি জন্ম জন্মান্তর লেগে যেতে পারে, এই উপলব্ধিবোধের চূড়ান্তে পৌঁছাতে। এছাড়া ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষ আর তথাকথিত পাগলের মধ্যে প্রায়শই কোনো পার্থক্য থাকে না। একজন চৈতন্যবান পুরুষ আর একজন চৈতন্যহীন। যার জন্য ঠাকুর রামকৃষ্ণের মতো ব্রহ্মজ্ঞানীকে তখনকার অনেক পণ্ডিত পাগল বলতো।  যার যেমন জ্ঞানের বহর আর কি ? তবুতো রামকৃষ্ণ দ্বৈত - অদ্বৈত দুরকম সাধনা করেছিলেন। 
অষ্টাবক্র তার সংহিতায় ব্রহ্মজ্ঞানী সম্পর্কে এক জায়গায় বলছেন :

নির্বাসন নিরালম্বঃ স্বচ্ছন্দো মুক্তবন্ধনঃ। 
ক্ষিপ্তঃ সংস্কারবাতেন চেষ্টতে শুস্কপর্নবৎ।

অর্থাৎ বাসনারাহীত, কর্তব্যবুদ্ধিবিহীন, রাগদ্বেষের অনধীন বন্ধনহেতু অজ্ঞানশূন্য জ্ঞানী প্রারবদ্ধকর্মরুপ বায়ুদ্বারা প্রেরিত হয়ে পবন-সঞ্চালিত শুস্কপত্রের ন্যায় কর্ম প্রচেষ্টা করে থাকেন। 

তাহলে ভাবুন তো এই ব্রহ্মজ্ঞানী কেমন আছেন। ব্রহ্মবিদ তো জড়বৎ। না আছে দুঃখ না আছে আনন্দ।  না আছে কর্তব্যকর্ম। না আছে দ্বেষ, না আছে রাগ, না আছে মমতা, না আছে স্নেহ।  উনি কাঁদেন না, হাসেন না।  অথবা ওনার হাঁসা-কাঁদার সাধারণ মানুষ কি বোঝে ? ওনার থাকা না থাকা সমান। উনি স্ব -স্বরূপে স্থিত। 

তাহলে ব্রহ্মজ্ঞানী হতে সময় লাগে, আর তার পরে যা হয় তা আর  কোনো কম্মে লাগে না। তাহলে অদ্বৈতপথে এই ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে কি লাভ ? যার দেহ জ্ঞান থাকে না। 

আর ভক্তিযোগের সাধনার ফল আলোচনার আগে আমরা সাকার সাধনা আর নিরাকার সাধনার পার্থক্যটা একবার আমরা বুঝে নেই। 

ঈশ্বর নিরাকার, নির্গুণ, অব্যক্ত, অব্যয়, সর্বত্র। কয়েকজন লোক নির্বাক হয়ে আকাশ দেখছে। কেউ আকাশে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কেউ আকাশের নীল বর্ণ দেখছে।  কেউ আকাশের ক্ষনে ক্ষনে পরিবর্তিত মেঘ দেখছে। কেউ সে মেঘের মধ্যে শিবের মূর্তি দেখছে, কেউ শিব লিঙ্গ দেখছে,  কেউ ইস্ট মূর্তি দেখছে, কেউ হাতি  দেখছে। আবার কেউ  কিছুই দেখছে না, শুধুই মেঘ দেখছে, আর  সে বিরক্ত হচ্ছে। যে মেঘ দেখছে, সে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছে। যে ইষ্টমূর্তি দেখছে সে আনন্দে আত্মহারা হচ্ছে। আপনি কি বিরক্ত হতে চান ? ধৈর্য্য হারাতে চান ? নাকি আনন্দ পেতে চান ? আনন্দ আকারেই দিতে পারে।  নিরাকারে আনন্দ সুদুর্লভ। 

ঈশ্বরকে কি দেখা যায় ? কিভাবে দেখা যায় ? ঈশ্বর কি আকার নেয় ?

ঈশ্বরকে অবশ্যিই দেখা যায়। কিভাবে ঈশ্বরকে দেখা যায় না,  সেটা আগে ভাবুন।  তবেই ঈশ্বরকে দেখতে পারবেন। ঈশ্বরকে না দেখার কোনো উপায় নেই। বরং ঈশ্বরকে দেখতে না পারাটাই আশ্চর্য্য। ঈশ্বর অবশ্যই  আকার নেন।  আপনি যেমন তাকে দেখতে চান, তেমন ভাবেই তিনি আপনাকে দেখা দেবেন। আপনি দেখছেন কিনতু সনাক্ত করতে পারছেন না।  তাই ভাবছেন আমি দেখতে পারছি না। আসলে ঈশ্বর আপনি, আপনার ভিতর, বাহির, সর্বত্র যা কিছু দেখছেন সবই ঈশ্বর। তবে আমি দেখছি না, এটা কত বড়ো ভুল, বুঝতে পারছেন ? ঈশ্বর-সমুদ্রের মধ্যে বুদ্-বুদ্ আমি।  এখানেই জন্ম, এখানেই লয়। মানুষের শরীরের  মধ্যে যেমন অসংখ্য কোষ, আমিও তেমনি ঈশ্বরের বিরাট শরীরের কোষ মাত্র।  শরীরেই জন্ম, শরীরেই মৃত্যু। যতদিন বাঁচি, ঈশ্বর থেকেই খাদ্য সংগ্রহ করি, বা ঈশ্বরই  খাদ্য যোগায়। এক সময় ঈশ্বরেই লয়  প্রাপ্ত হই। আমি বা অহং বলে কিছু নেই।  এগুলো  মন-বুদ্ধির খেলা। মন বুদ্ধির ওপারে আমি বলে কিছু থাকে না।

নিরাকারই সাকার হয়।  আবার সাকার থেকে নিরাকার। জলের তিন রকম অবস্থা। বায়বীয়, তরল, কঠিন।তাপমাত্রার তারতম্যে এই প্রকারভেদ।  বায়বীয় জল সর্বত্র। তরল জল নদী, নালা, পুকুরে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পৃথিবীর মধ্যেও পাওয়া যায়। কঠিন জল আমরা বরফের আকারে দেখতে পাই। বায়বীয় জল আমাদের ভোগ্য বস্তু নয়। কঠিন জলের আইচক্রীম খাই, তরল জলে তৃষ্ণা মেটাই। বায়বীয়  জলে আমাদের তৃষ্ণা মেটায় না।  বাহ্যিক কোনো কাজ বায়বীয় জলে আমাদের হয় না। অর্থাৎ নিরাকারে আমরা আনন্দ পাই না। কোনো কাজে লাগে না। তৃষ্ণা পেলে, হা করে থাকলে বায়বীয় জল, আপনার তৃষ্ণা মেটাবে ? তাহলে বায়বীয় জল সত্য কিনতু আনন্দ দেয় না। তাই ঈশ্বর সাধনায় যদি আনন্দ পেতে চান তবে সাকারের সাধনা করুন। 

নিরাকারের শক্তি সাকারের মধ্যেই প্রকাশ পায়। আকাশের একটা গুন্ - শব্দ, বাতাসের দুটো গুন্  - শব্দ, স্পর্শ। আগুনের তিনটি গুন্ শব্দ, স্পর্শ, রূপ। জলের চারটি  গুন্ -শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস।  মাটির পাঁচটা  গুন্ - শব্দ, স্পর্শ, রূপ,রস, গন্ধ।  তাহলে দেখতে পাচ্ছেন, নিরাকার থেকে সাকারের দিকে যত  যাচ্ছে তত তার গুন্ বেড়ে যাচ্ছে। এবং আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো এই গুন্ গুলো থেকেই জ্ঞান সংগ্রহ করছে। কান দিয়ে আমরা শব্দ  শুনছি। চোখ দিয়ে আমরা রূপ দেখছি। নাক দিয়ে আমরা গন্ধ শুঁকছি। মুখ দিয়ে আমরা রসের আস্বাদন করছি। ত্বক দিয়ে আমরা স্পর্শ করছি। এ সবই  আমাদের সুখ ও দুঃখের আস্বাদন করাচ্ছে। এ থেকেই আমরা সুখ দুঃখের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছি আমাদের অজ্ঞাতসারে। দৈহিক সুখ দুঃখের কারন এই ইন্দ্রিয়গুলো। তাই মহাপুরুষগন  বলছেন, ইন্দ্রিয়গুলোকে সংযমী করো, যদি সুখী  হতে চাও। যাক অন্য্ কথায়  চলে যাচ্ছি। আমাদের মূল আলোচনা ভক্তিবাদ, এবং সে প্রসঙ্গে সাকার, নিরাকার ঈশ্বর। 

আপনি আগুন চান। আগুন পেতে গেলে আপনাকে একটা মাধ্যম করতে হবে। আগুন সবত্র আছে। কিনতু  কাঠি/কাঠ  চাই। আর চাই বারুদ।  এই বারুদ দেন গুরুদেব।  মাধ্যম ছাড়া আগুনের প্রকাশ হয় না। তেমনি  ঈশ্বরের  প্রকাশ যদি দেখতে চান তবে মাধ্যমকে আশ্রয় করুন। আর নিজেকে তৈরি করুন। অপেক্ষা করুন আকুলতা নিয়ে।


আজও  নাকি শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি শোনা যায়, বৃন্দাবনে। আপনি কি বলবেন সত্যিই শোনা যায় ? আপনি বলবেন - পাগল ? আজও রাশলীলা দেখা যায়।  আপনি কি বলবেন - পাগল ? আপনার এক্সপোজারে যদি ব্যাটারি বা ইলেকট্রিসিটি থাকে, অর্থাৎ আপনার মধ্যে যদি ভক্তি থাকে, অনুরাগের সুইচ দিয়ে দিন।  ঠিক দেখতে পাবেন রাসলীলা , শুনতে পাবেন বাঁশি । আপনার আগে পিছনে সর্বত্র, গান ভেসে বেড়াচ্ছে। নাচের ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। কিনতু আপনার যদি এক্সপোজার অর্থাৎ টিভি থাকে তাতে যদি ইলেকট্রিসিটি থাকে, সুইচটা অন করে দিন আপনি সব দেখতে পাবেন। এক্সপোজারের মধ্যে কিনতু  কিছু নেই। ওটা ভেঙে ফেললেও ভিতরে ছবি পাবেন না. গান পাবেন না। গান আছে সর্বত্র,ছবি আছে সর্বত্র। আপনার এন্টেনা ঠিক করুন, নিজেকে যোগ্য করুন, ব্যাকুল হন, নিরন্তর তৎগতপ্রাণ হন , তবেই তাকে দেখতে পারবেন তার বাঁশি  শুনতে পাবেন। 

আপনি  ফল খেতে চান ?  ফলের স্বাদ আপনি কান্ডে  পাবেন না। বীজ তো বিস্বাদ। ভক্তিবাদীরা ফল খায়। নিরাকারবাদীরা মাটির মধ্যে উৎস খোঁজে,মাটির মধ্যে  স্বাদ খোঁজে। আপনি কোনটা  চান ?

একটা ঘটনা বলি।  শিরডির সাঁইবাবা - নাম শুনেছেন নিশ্চই।  তো  তাকে এক ভদ্রলোক দুপুরে খাবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছেন।  খাবারের সমস্ত  আয়োজন সম্পূর্ণ।  ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন। এই বুঝি বাবা আসে। বাবা আর আসছেন না।   দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। বাবা আর আসেন না। সন্ধ্যে হয়ে গেল।  বাবা আর আসেন না। একটা কুকুর ঘুর ঘুর করছে। ভদ্রলোক  খাবার রেখে উঠতে পারছেন না। কুকুরটাকে যতই তাড়ানো হচ্ছে,  কুকুরটা একটু দূরে গিয়ে অপেক্ষা করছে।    ভদ্রলোক, লোক পাঠালেন, বাবার কাছে। বাবা বললেন - আমিতো গেছিলাম রে। কিন্তু তোর  মনিব তো লাঠি দিয়ে তারা করলো। লোকটি বললো - সে কি বাবা কখন গেছিলেন ? আমার বাবু তো সারাক্ষন আপনার অপেক্ষায় বসে আছেন।  বাবা বললেন - তোর  বাবুতো  লাঠি নিয়ে বসে আছে।  আমি যাই কি করে ? খাই-ই  বা কি করে ? 


ভগবানকে না চিনলে এই হয় দশা। ভগবান এসে বসে থাকে।  আর আমি লাঠি নিয়ে বসে থাকি। ভগবান আসতে  চায়, আমরা তাকে তাড়াতে চাই।


অতএব  শ্রীকৃষ্ণ বলছেন : আমার মতে  তারাই শ্রেষ্ট যারা ভক্তি সহকারে আমার উপাসনা করে। ভক্তিবাদেই আনন্দ, জ্ঞানী নিরস।



দুধের মধ্যে মাখন আছে, দই আছে। আপনি যদি ফেলে রাখেন , দুধ দই হয়ে যাবে। আর যদি ঝাঁকান তবে মাখন পেতে পারেন। তখন জলে ভাসতে পারবেন। না হলে জলে মিশে যাবেন। নিজেকে ঝাঁকান-ঝাঁকান, আরো জোরে, আরো জোরে নিজেকে ঝাঁকান, তবে আপনি নিজেকে মাখন করতে পারবেন।  নতুবা একদিন জলে মিশে যাবেন। তাই ভগবান বলছেন ভক্তিবাদ-ই শ্রেষ্ট।
এবার একটু অন্য্ কথা বলি। ধ্যানে সাধকেরা তার ইষ্ট  বা গুরুদেবের প্রতিচ্ছবি কল্পনা করে ধ্যান করেন। তখন গুরুদেবকে বা তার ইষ্টকে জ্যান্ত বলে  মনে হয়। তখন সেই ইষ্টদেবতার সঙ্গে বা গুরুদেবের সঙ্গে কথা বলা যায়। এবং কথা বলেন সাধক।  সেই প্রতিচ্ছবিও কথা বলে। আপনারা নিশ্চয় শুনেছেন আমাদের আজ্ঞা চক্র বা তৃতীয় নয়ন বলে একটা কথা আছে। এটি একটি শক্তিশালী বার্তা প্রেরণ কেন্ত্র। বিশ্বাস করতে হবে না, এই বার্তা প্রেরণ কেন্দ্রে নিজের মনকে স্থির করে  আপনি যদি কাউকে আদেশ বা নির্দেশ দেন, তবে সে তা পালন করতে বাধ্য হবে। এটা আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। এটি একটি অসাধারন গতিশীল শক্তি। কোনো ব্যক্তির ছবি, বা প্রতিমাকে মনের মধ্যে রেখে, তার ক্ষুদ্র প্রতিমাকে ধ্যানে নিয়ে আজ্ঞা চক্র থেকে যদি ভিজা মাটির মূর্তির উপরে, বা ছবির  উপরে নিবিষ্ট করা যায় তবে সেই মাটির মূর্তি আর সাধারণ থাকে না। সেটা আপনার আজ্ঞা দ্বারা সঞ্চারিত চলমান শক্তিতে পরিণত হয়ে যায়। তখন আপনি যা স্নরন করবেন, সেটা গতিশীল হয়ে যাবে। মূর্তিপূজা এই প্রক্রিয়ার গভীর প্রয়োগ ।  আমি মনে করি, ঈশ্বর তো বিরাট। আর এই সর্বত্র বিরাজমান  বিরাটের কাছে  পৌঁছেতে আমরা মূর্তির মাধ্যমে যেতে পারি। একটা কথা আছে, যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে এই ভান্ডে অর্থাৎ মানব শরীরে।  এবং শুধু তাই আছে না, সেই  প্রপোরশনে অর্থাৎ সেই  ভাগে আছে। অর্থাৎ জল ৭৫%, আকাশ ____, বায়ু _____ অগ্নি _____ মৃত্তিকা  _____ । আপনার মস্তিস্ক আর পরমাত্মার মস্তিষ্কের সঙ্গে একটা সম্পর্ক আছে। এই দুই সন্মন্ধকে যুক্ত করার জন্য একটা সেতু চাই। এই সেতু নির্মিত হতে পারে মূর্তি দিয়ে। কেননা আপনি নিরাকার কিছুর সঙ্গে সোজা সুজি সম্পর্ক স্থাপিত করতে পারবেন না। আপনি আকারে বর্তমান।  নিরাকার সম্পর্কে তো আপনার কিছু জানা  নেই। তাই যে যাই বলুক না কেন পরমাত্মা নিরাকার, অপ্রকাশিত।  সেটা শুধু শুধু কথার কথা হয়ে যাবে আপনার কাছে। আপনার অনুভবের মধ্যে কিন্তু আসবে না। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের মস্তিষ্কের  মধ্যে যত  অনুভব আছে, সেগুলোর সবই  আকৃতির অনুভব। রূপের অনুভব। আমাদের কারুর মধ্যে নিরাকারের একটাও অনুভব নেই। কারুর কথা ভাবা মানে তার রূপের কথা। অবয়বের কথা। তার সূক্ষ্ম গুনের কথাতেও আমরা রূপ কল্পনা করি। আর যার সন্মন্ধে কোনো ধারণা নেই তার সম্পর্কে কোনো শব্দ আপনাকে তার স্মরণ করাতে পারবে না। তাই আপনি নিরাকারের কথা বলতে থাকবেন আর সাকারের মধ্যে বাস করবেন। যদি সত্যি সত্যি আপনি নিরাকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চান তবে আপনাকে এমন একটি মূর্তি নির্মাণ করতে হবে যার একদিকে সাকার আর এক দিকে নিরাকার। এটা একটা অসম্ভব রহস্যময় মূর্তি হবে। একটু ভাবুন, আমরা যেখানে রয়েছি, সেখানে তার সীমা  প্রকাশিত। আর অন্যদিকে পরমাত্মা যেখানে আছেন সেটা সীমাহীন অপ্রকাশিত। তাই মূর্তিকে দুটো কাজ করতে হবে আমরা যেখানে সেখানে সে প্রকাশিত হবে, আর পরমাত্মা যেখানে আছেন সেখানে নিরাকারের মধ্যে হারিয়ে যাবে। এই ধরনের  কথা হয়তো কখনো শোনেননি।

একটা কথা শুনুন যে ব্যক্তি পূজা করে, সে ওই মাটির মূর্তিকে পূজা  করে না। সে ওই ছবিকে পূজা করে না। সে পূজা করে ওই ছবির  মধ্যে তার পিতাকে, মাতাকে, গুরুকে  ।  দেবতাকে।  ইষ্টকে। পরমাত্মাকে।  মূর্তির কখনো পূজা হয় না। মূর্তির মধ্যে আমি যাকে  দেখতে চাই তার পূজা করা হয়। আর যার কাছে মূর্তি দৃশ্যমান, সে কখনো পূজা শেখেনি, সে পূজা করে না। তার পূজা সম্পর্কে  কোনো ধারণাই  নেই। পূজা আর মূর্তি দুটো আলাদা কথা। পূজা মূর্তির হয় না, পূজা হয় ভাবনার। যে পূজা করে, সে কখনো মূর্তি দেখতে পায়  না। যে মূর্তি দেখতে পায়, সে কখনো পূজা  করে না। পূজা মূর্তিকে মুছে ফেলার কৌশল। আমরা তো আকৃতি সম্পন্ন, সেই আকৃতিকে মুছে ফেলার কৌশলই পূজা।দেহাতীত হয়ে যাওয়াই পূজা।  পূজায় দৃশ্যমান আকৃতি, আকৃতিবিহীন হয়ে যায়। তবেই পূজা সম্পন্ন হয়। প্রকাশিত অংশে পূজা আরম্ভ হয়, অপ্রকাশিতে পূজা সম্পন্ন হয়। পূজা সাধককে গ্রাস করে নেয়। যারা পূজা করেনি তারা ভাবে পাথর রেখে কি হবে ? আর যারা পূজা করেছে তাদের পাথর হারিয়ে যায়, সীমা হারিয়ে যায়, অসীমে প্রবেশ করে আর তখন পরমাত্মা  প্রকট হয়ে যায়।
ভগবান শ্রীচৈতন্য যখন দুহাত তুলে কৃষ্ণনাম করে, মিরা যখন পূজার ছলে  নাচ করে, মতুয়ারা যখন হরিবোল হরিবোল করে তখন তারা নিজেরা পূজার মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।  এদের জন্য সেখানে কোনো মূর্তির অস্তিত্ব থাকে না। পূজা শুরু হলে মূর্তি বিলীন হয়ে যায়।  মূর্তি তো প্রারম্ভ মাত্র।  আমরা যারা পূজার কিছু বুঝি না, তারা মূর্তি দেখতে পাই। তাই আমার মনে হয় - সত্যিকারের পূজা যত কমতে থাকবে, মূর্তি তত  বাড়তে থাকে, পূজা শুরু হলে মূর্তি অন্তর্হিত হবে।

মূর্তি তো পরমাত্মাকে দেখবার জানলা মাত্র। আমি দেহের মধ্যে থেকে পরমাত্মাকে দেখতে চাই।  আমার তো দেহ আছে।  অর্থাৎ আমি আকৃতি সম্পন্ন। তো জালনা ও তো আকৃতি সম্পন্ন হবে , কিন্তু জানলা খুলে যখন আকাশের দিকে তাকাবো তখন নিরাকারের মধ্যে প্রবেশ করবো। এই দেহের মধ্যে জানলা আছে, সেটাকে খুলতে হবে। আকাশকে দেখতে হবে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে জানলা ছোট্ট।  কিন্তু আকাশ তো বড়ো। কিন্তু ছোট্ট জানলা দিয়েইতো বড়ো আকাশকে দেখা যায়। এটা বোঝানো কঠিন কিন্তু সত্যি। যে জানলা কখনো খোলেনি, যুক্তি দিয়ে তাকে বোঝানো কঠিন হবে যে বৃহৎ আকাশকে, আয়তনে ছোট্ট জানলা দিয়েও দেখা যায়। মূর্তি পূজা এই জানলা খোলার প্রক্রিয়া। আপনি মন্দিরের কাছে যেতে পারেন। মূর্তির কাছে যেতে পারেন।  কিন্তু পূজার কাছে যেতে পারেন না।  কতকগুলো বিষয় আছে যার অভিব্যক্তি সম্ভব নয়। এগুলো অন্তরের ব্যাপার। আন্তরিক বস্তু প্রদর্শন সম্ভব নয়।

সাকার নিরাকার দুটি পৃথক নয়। একটি অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। যাকে  আমরা সাকার বলি সেটা নিরাকারের অংশ।  আবার যাকে  আমরা নিরাকার বলি সেটিও সাকারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আমরা সাকারে আছি। আমার দেহ সাকার। আমরা সম্পর্ক গড়ি সাকারের সঙ্গে। এই সত্য তো অস্বীকার করলে চলবে না যে আমরা সাকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। আর আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমাদের সেখান থেকেই যাত্রা  শুরু করতে হবে। যেখানে আমাদের যাওয়া  উচিত, সেখান থেকে যাত্রা শুরু করা যায় না। যেখানে আছি সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে হয়। যেখানে আমরা নেই সেখান থেকে যাত্রা শুরু করা যায় না। আমরা যা কিছু জেনেছি আকারের মধ্যেই জেনেছি। আমরা প্রেম করেছি - আকারে। আমরা রাগ করেছি আকারে।  আমরা ঘৃণা করেছি আকারে। আসক্ত হয়েছি তাও আকারে। বন্ধুত্ব করেছি আকারে।  শত্রূতা করেছি তাও আকারে। ঈশ্বরের নিরাকারত্ব যেমন সত্য। আমাদের আকারত্ব তেমনি সত্য। আমাদের মন যখন কিছু ধরে রাখে সেটা আকারেই ধরে রাখে।

তাই শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ বা কথা  যখন আমরা স্মরণ করি, তার গুনের কথা যখন আমরা স্মরণ করি, তখন তার আকারের কথাই আমাদের চোখে ভাসে। আর এই জন্য নিরাকারের দিকে যদি যাত্রার জন্য  আমাদের বেরোতে হয়, তবে আমাদের নিরাকারের জন্য আকার সৃষ্টি করতে হবে।এই আকারটা যদি শ্রীকৃষ্ণের হয়, বা অন্য্ কারুর হয় তবে আমাদের সাধনপথ সহজ হবে।                      

Thursday 13 December 2018

মানুষের আসা যাওয়া-জন্মান্তর (এক)

মানুষের আসা  যাওয়া (এক)



মানুষের আসা  যাওয়া, এ এক অদ্ভুত রহস্য। কে আসে ? কে যায় ?কোথা থেকে আসে আর কোথায়-ই বা যায় ? কেউ বলে মনুষ্য জন্ম বিরল। এর পরে আর কবে হবে, তার কথা কেউ বলতে পারে না। তাই ঈশ্বরকে পেতে হলে এই মনুষ্য জন্মেই সচেষ্ট হও।  
যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, অর্জুন তোমার আমার বহু জন্ম ব্যতীত হয়েছে। আমি জানি, কিন্তু তুমি  তা জান  না। এই জন্মে যারা তোমার মাতা পিতা কে বলতে পারে তাদের সঙ্গে আগের জীবনে কোনো সম্পর্ক ছিল কি না ? 
একদিন  সময় বুঝে এক জিজ্ঞাসু গুরুদেবকে  জিজ্ঞেস করে বসলো:
হে গুরুদেব জীবের আসা যাওয়া সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। দয়া করে পুনর্জন্ম সম্পর্কে আপনি যদি কৃপা করে কিছু বলেন। 
গুরুদেব  : হে পুত্র  ! এই সৃষ্টির পেছনের কাহিনী অতি সরল আবার জটিল। সহজ করে যদি বলতে হয় তবে বলি প্রাণীদের নিজ নিজ কর্ম অনুসারে, প্রথমে পরলোকে গিয়ে, কিছু সময় কাটাতে হয়। সেখানে সে আগের জন্মের করা পাপকর্ম অথবা পুণ্যকর্মের ফল ভোগ করে। এর পরে যখন ওর পাপ পুণ্যের ফল ভোগ  সম্পূর্ণ হয়ে যায়, তখন আবার সে এই মৃত্যুলোকে জন্ম গ্রহণ করে, তার বাসনা পূরণের জন্য । এই মৃত্যুলোককে আবার কর্মলোকও বলে। কারন এই লোকে প্রাণীদের কর্ম করবার অধিকার প্রদান করা হয়। 
জিজ্ঞাসু : আমাদের পৃথিবীকে মৃত্যুলোক কেন বলা হয় ?
গুরুদেব : কারন এখানেই জীবের জন্ম মৃত্যু হয়।
জিজ্ঞাসু : তাহলে কি অন্যকোনো লোকে জন্ম বা মৃত্যু হয় না ?
গুরুদেব : না পুত্র, ওই সব লোকের বাসিন্দার না হয় জন্ম, না হয় মৃত্যু। তুমি তো জানো মৃত্যু কেবল এই শরীরের হয়। আত্মা কখনো জন্মায় না, মরেও না। আত্মা জন্ম মৃত্যু রোহিত।
জিজ্ঞাসু : আপনি তো আগে বলেছিলেন, যে আত্মার কোনো সুখ-দুঃখ হয় না। এখন বলছেন, পান-পুন্য ভোগ করার জন্য, অর্থাৎ শাস্তি - বা পুরস্কার ভোগের জন্য অন্য লোকে যেতে হয়। সেখানে তো শরীর  যায় না নিশ্চই । আত্মাই যায়। তবে সেখানে নিশ্চই আত্মাই সুখ দুঃখ ভোগ করে। তাহলে আপনি বলছেন, শরীর  শুধু  সুখ-দুঃখ ভোগ করে না।  আত্মাও সুখ দুঃখ ভোগ করে ?
গুরুদেব : না পুত্র। আত্মাকে কোথাও কোনো স্থানেই সুখ অথবা দুঃখ ভোগ করতে হয় না। সুখ দুঃখ আত্মাকে ছুঁতেও পারে না। আত্মাতো পরম-ঈশ্বরের রূপের প্রকাশ। পরম-ঈশ্বর কারুর অধীন নয়। সুখ দুঃখ তো মায়ার খেলা। আর মায়ায় আবদ্ধ হয়ে জীব সুখ দুঃখ ভোগ করে। সুখ দুঃখ কেবল শরীরের ভোগ। আত্মার নয়। 
জিজ্ঞাসু : হে গুরুদেব, আমাকে আপনি দ্বিধায় ফেলে দিলেন। একবার বলছেন,শরীর  ত্যাগের পর মানুষ অন্য লোকে গিয়ে সুখ-দুঃখ ভোগ করে। সেখানে তো শরীর থাকে না। থাকে আত্মা। আত্মার যদি সুখ-দুঃখ ভোগ না থাকে বা না হয়,তাহলে সেখানে  কে সুখ-দুঃখ ভোগ করে ? 
গুরুদেব : জীবাত্মা। বা সূক্ষ্ম শরীর।  
জিজ্ঞাসু : এই জীব-আত্মা বা সূক্ষ্ম শরীর আবার কি ?
গুরুদেব : দেখো, জীবের শরীর একটি নয়, তিনটি। তুমি যে শরীরটাকে দেখতে পারছো, সেটা হচ্ছে স্থুল শরীর, তোমার আরো দুটো শরীর আছে। অর্থাৎ শরীর তিনটি।  স্থুল, সূক্ষ্ম ও কারন  শরীর।
কারন শরীরে আত্মা অপ্রকাশিত, অর্থাৎ আছে কিন্তু বোঝা যায় না ।   যেমন দুধের মধ্যে মাখন। বিশেষ প্রক্রিয়ার সাহায্যেই পাওয়া যায় মাত্র।  নতুবা নেই বলে মনে হয়।  মুখে নিলেও বোঝা যায় না।
কিন্তু   সূক্ষ্ম শরীরে আত্মা সূক্ষ্মরূপে আছেন। যেমন লবনাক্ত জল।দেখা যায় না। মুখে দিলে বোঝা যায়। সূক্ষ্ম শরীর আর কিছু নয় আমাদের ভাবনার জগৎ। আমাদের চিন্তার জগৎ।
আর হচ্ছে স্থূল শরীর যা পঞ্চভূতের তৈরী।  অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম এই পাঁচ ভূতের সংমিশ্রণ মাত্র। 
যখন কারুর মৃত্যু হয় তখন এই যে বাইরের স্থুল  শরীর, তারই মৃত্যু হয়। অর্থাৎ পঞ্চভূতে অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম -এ  মিশে যায়।
স্থুল শরীর-এর ভিতরে যে সূক্ষ্ম শরীর আছে তার মৃত্যু হয় না। ওই সূক্ষ্ম শরীর আত্মার প্রকাশকে নিজের সাথে নিয়ে, মৃত্যু লোক থেকে বেরিয়ে অন্য লোকে চলে যায়। ওই সূক্ষ্ম শরীরকে জীবাত্মা বলে। আর এটি আমাদের চিন্তার জগৎ, ভাবনার জগৎ মাত্র। তাই সূক্ষ্ম শরীরেই আমাদের কর্মফল, বা সংস্কার সঞ্চিত থাকে।
স্থুল  শরীরে আমরা বাহ্যিক সুখ-দুঃখ ভোগ করি। আমাদের শরীর খারাপ এই স্থূল শরীরের হয়।  এটা বুঝতে নিশ্চয়ই অসুবিধা হয় না। জন্ম মৃত্যু বলতে আমরা যা বুঝি তা এই স্থুল শরীরের ক্রিয়া।
শরীর যেমন আমাদের তিন রকম, ভোগ আমাদের তিন রকম। একটা শারীরিক, যা এই স্থূল শরীরে ভোগ করতে হয়। একটা মানসিক - যা আমাদের সুক্ষ শরীরে ভোগ করতে হয়।  আর একটা হচ্ছে আধ্যাত্মিক যা আমাদের কারন শরীরে হয়।
এইবার আমরা  জন্ম-মৃত্যু, বা আসা যাওয়ার খেলাটা একটু দেখে নেই। আমাদের দেহ অর্থাৎ স্থুল দেহ  পঞ্চভূতের সংমিশ্রণ। পুরুষ-প্রকৃতির খেলাতেই এই সংমিশ্রণ ঘটে।  প্রথমে মাংসপিন্ড, পরে ধীরে ধীরে জন্মদাতার-জন্মদাত্রীর আকার গ্রহণ।  এটি তখন দেহ মাত্র। এই দেহে ৪৪ থেকে ৪৮ দিনের মধ্যেই প্রাণের গমন নির্গমন গুরু হয়। তবে সেটা মায়ের প্রাণের অংশ মাত্র। সব থেকে বেশি হলে ৮৪ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হওয়া চাই।  এই সময় থেকেই আমরা মায়ের দেহের মধ্যে সন্তানের নাড়াচাড়া টের পাই। যদি না হয় জানবে কিছু গোলমাল আছে।  অর্থাৎ যে দেহটি তৈরি হচ্ছে সে মায়ের প্রাণের গতি গ্রহণ করছে পারছে না। এমনটি হলে জানবেন কিছু গড়বার আছে।    যখন সে মায়ের দেহ থেকে আলাদা হয়ে যায় তখন মায়ের প্রাণের সঙ্গে তার বিচ্ছিন্নতা ঘটে।  । তখন তার নিজস্ব প্রাণক্রিয়া,  অর্থাৎ  প্রাণের গমন-নির্গমন শুরু হয়। এবং সেটা যদি তাৎক্ষণিক ভাবে শুরু না হয় তখন সন্তানকে এই প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে ধাঁই। সে তখন ফুসফুসকে উল্টে-পাল্টে ক্রিয়াশীল করে তোলে। বাচ্চা কেঁদে ওঠে। শুরু হলো জীবনের খেলা। 
এইবার চলে যাবো মৃত্যু প্রক্রিয়ায়। জীবন হচ্ছে শ্বাসের খেলা। এই শ্বাসের মাধ্যমেই আমাদের সমস্ত প্রক্রিয়া চলে। পঞ্চভূতের মধ্যে  মরুৎ অর্থাৎ বায়ু সবথেকে শক্তিশালী ও সংযোগকারী। উপনিষদে একে ব্রহ্ম বলে আখ্যা  দেওয়া হয়েছে। প্রাণ শরীরের কোনে কোনে পরিব্যাপ্ত হয়।
 শরীরের কৰ্মইন্দ্রিয় (বাক,পানি,পাদ, পায়ু,উপস্থ ) জ্ঞান ইন্দ্রিয় (কর্ন, চর্ম, চক্ষু, জিহবা, ও নাসিকা) অর্থাৎ কান, ত্বক, চোখ, জিভ, নাক, মুখ, হাত,পা, মলদ্বার, ও লিঙ্গ, তখন ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।   আমাদের  স্বাস প্রক্রিয়ার জন্য দুটো ইন্দ্রিয় কাজ করে, এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে নাক।  যদি কোনো কারণে নাক বন্ধ  হয়ে যায় মুখ দিয়ে আমরা এই স্বাস প্রক্রিয়া চালাই । একমাত্র স্বাস প্রক্রিয়ার জন্য দুটো অঙ্গ বা দুটো ইন্দ্রিয় ব্যবহার করতে পারি।  শরীরের অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো বিশ্রাম নিলেও, নিদ্রা গেলেও এই প্রাণশক্তির ক্রিয়া চলতে থাকে।  কখনই বিশ্রাম নিতে পারে না। দিন-রাত অনবড়ত  কাজ করতে থাকে। যতক্ষন এই প্রাণশক্তি প্রবাহমান থাকে ততক্ষনই আমাদের আয়ু থাকে। প্রাণ যতক্ষন কর্মক্ষম থাকে ততক্ষনই আমাদের জীবিত বলা হয়।  এই প্রাণশক্তির কাজ শেষ হয়ে গেলে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। এই প্রাণের শক্তিতেই দৃষ্টি-শক্তি, এই প্রাণের শক্তিতেই শ্রবণ শক্তি, এই প্রাণের শক্তিতেই ঘ্রান শক্তি, বাক শক্তি, জ্ঞানশক্তি, পাচন  শক্তি। প্রাণের ক্রিয়া শুরুতে জীবন শুরু হয় - আবার প্রাণের ক্রিয়া শেষে জীবনের শেষ হয়। ত্রিলোকে যা কিছু বর্তমান সবই প্রাণের অন্তর্গত। 
এবার আমরা যাবো আর একটু গভীরে। প্রাণ তো দেহটা কে বাঁচিয়ে রাখে। সবার মধ্যেই প্রাণ।  তাহলে "অমি"  কে ? এই দেহ যখন অকেজো হয়ে যায়, তখন তাকে আমরা পুড়িয়ে ফেলি, কবর দেই।  এর সঙ্গেই "আমি"  শেষ হয়ে গেলাম ? "আমি" যদি শেষ হয়ে গেলাম, তবে আর পুনর্জন্ম বলে কিছু থাকে কি ? "আমি" বলে কিছু আছে কি ? তাহলে কি, জগৎ সত্য, আমি মিথ্যা। 
এখান থেকেই ধোঁয়াশার শুরু। এই জায়গাটা উপল্বদ্ধির জায়গা। এই জায়গাটা বুদ্ধি দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে, বেশিদূর এগোনো যায় না।  মৃত্যুর পরে কেউ ফিরে আসেনা। এসে কেউ পরপারের কথা, পরপারের বর্ণনা দিতে পারে না।  এখানেই চতুর পন্ডিতরা গল্প ফাঁদে। স্বর্গ, নরকের গল্প ফাঁদে। যে যত রসালো গল্প বলতে পারে তাকে আমরা ততো বড় সাধক ভাবি। আসলে কল্পনা শক্তি, আমাদের ভাবের জগতে নিয়ে যায়। আমরাও আমাদের একটা কাল্পনিক ভাবের জগৎ তৈরি করি। কিন্তু বাস্তব  অন্য কথা বলে। সব ভাষায় বলা যায় না। কাউকে সেখানে নিয়ে যাওয়া যায় না।
এই খান থেকেই শুরু হয় আমাদের সূক্ষ্ম শরীরের খেলা। 
তাই বলছিলাম : 
আমাদের স্থুল শরীরের মতো  আর একটা শরীর  আছে, তাকে বলে সূক্ষ্ম শরীর।  এই শরীরেরও সুখ দুঃখ ভোগ আছে। খেয়াল করো - তুমি ঘুমিয়ে আছো।  স্বপ্ন দেখছো। তোমাকে স্বপ্নে ষাঁড়ে তারা করেছে, তুমি ভয় পাচ্ছো।  তুমি সমুদ্রে সাঁতার কাটছো।  বা পাখির মতো আকাশে উড়ছো। বা বহু সোনাদানা পাচ্ছো। এসবই কিন্তু ওই মুহূর্তের জন্য তোমার কাছে সত্যি। এবং এর জন্য তোমার স্থুল  শরীরেও ভয়, আনন্দ, উদ্বেগ অনুভূত হচ্ছে। অথচ তোমার স্থূল শরীর  কিন্তু বিছানায় পরে আছে। এই সূক্ষ্ম শরীরেই   আমাদের সংস্কার বাসা বাঁধে। স্থুল শরীরের মৃত্যুর পরে এই সূক্ষ্ম  শরীর তার স্থূল শরীরের কর্ম অনুসারে, ভাবনা অনুসারে, চিন্তা অনুসারে যে সংস্কার তৈরী সেই  সংস্কারকে নিয়ে ঘুরতে থাকে। একেই আমরা জীবাত্মা বলি।
এর পরে আছে কারন শরীর। এই শরীরেই ব্রহ্মানন্দ উপলব্ধি হয়। এই শরীর  আমাদের সুসুপ্তির সময় কাজ করে। সুসুপ্তিতে আমাদের সুখ দুঃখ উপলব্ধি থাকে না। শুধু সাম্যাবস্থা বজায় থাকে। গভীর ঘুমে আমরা বাহ্যিক সমস্ত কিছু ভুলে যাই।  কোথায় থাকি তা আমরা বুঝতে পারি না।  আমরা অজ্ঞান তাই এই অবস্থা সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা নেই । যারা জ্ঞানী তারা এই সুসুপ্তির অবস্থায় চেতন থাকতে পারেন। ধ্যানে এই সুষুপ্তি লাভ করা যায়।  আর সুসুপ্তির পরে আমাদের শরীর  মন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। প্রত্যেকটি মানুষেরই এই তিন অবস্থাই হয় বা আছে।
জিজ্ঞাসু : তার মানে, যখন আত্মা এক স্থুল শরীরকে ছেড়ে যায়, তখন সূক্ষ্ম শরীর জীবাত্মাকে বা সুক্ষ শরীরকে  সঙ্গে নিয়ে যায় ?
গুরুদেব : না পুত্র ! ব্যাপারটা এত সরল নয়। দেখো, সমুদ্রের মধ্যে জলের এক বুঁদ।  সমুদ্র থেকে ওই বুঁদ আলাদা নয়।  ওই মহাসাগরের এক অংশ মাত্র। ওই বিন্দু সাগরের বাইরে যায় না। হ্যাঁ কেউ যদি সমুদ্র থেকে একটা পাত্রে করে জল নিয়ে যায়, তবে ওই জল সমুদ্র থেকে আলাদা দেখা যায় মাত্র। ওই জল কিন্তু সমুদ্রের অংশ।  আবার এও ঠিক ওই জল এক দিন না একদিন সমুদ্রে মিশে যাবে , এটা নিশ্চিত। ওই রকম সূক্ষ্ম শরীর রুপী জীবাত্মা, ওই আত্মজ্যোতি-খন্ড নিজের মধ্যে রেখে, সঙ্গে করে নিয়ে যায়। এটাই জীব-আত্মার যাত্রা। যা এক শরীর  থেকে অন্য শরীরের মধ্যে, যা এক যোনি থেকে অন্য যোনিতে বিচরণ করে বেড়ায়। 
হে পুত্র ! জীবাত্মা যখন এক শরীর ত্যাগ করে অন্য শরীরে প্রবেশ যাত্রায় বেরিয়ে পরে, তখন ওর সাথে ও ওর পুরোনো শরীরের বৃত্তি, ওর সংস্কার, অর্থাৎ প্রারব্ধ সূক্ষ্ম রূপে সাথে করে  নিয়ে যায়। 
জিজ্ঞাসু : হে পিতা : মানুষ শরীর ত্যাগ করার পরে, জীবআত্মা কোথায় যায় ?  
গুরুদেব : মানুষ স্থুল  শরীর ত্যাগের পরে, মানুষ তার প্রারব্ধ অনুসারে, নিজের পাপ ও পুন্য ভোগ করতে হয়। এর জন্য ভোগযোনি  তৈরী হয়েছে।  যা দুই প্রকার। উচ্চযোনি ও নীচযোনি।  মানুষ অর্থাৎ জীবাত্মা  তার পাপ পুন্য অনুসারে উচ্চযোনিতে  অর্থাৎ স্বর্গে থেকে নিজের পুন্য ভোগ করে। বা নীচযোনিতে অর্থাৎ নরকে থেকে নিজের পাপ ভোগ করে। এই স্বর্গ নরক আর কিছুই নয় আমাদের সংস্কার। আমাদের ভাবনা। সুক্ষ শরীর তার পূর্বকর্মের পাপপুণ্য উপলব্ধি করে।  এবং পাপের জন্য নিজেকে দগ্ধ করে।  এটাই নরক যন্ত্রনা। আর  ভালো কর্মের স্মৃতি তাকে উৎফুল্ল করে।  এটাই স্বর্গভোগ।  
তাহলে বুঝতে পারছো - স্থুল শরীর পঞ্চভূতের তৈরী। সূক্ষ্ম শরীর আমাদের ভাবনা বা সংস্কার দ্বারা তৈরী। আর কারন শরীর হচ্ছে শরীর তৈরির অব্যক্ত উৎস। 
জিজ্ঞাসু : এই স্বর্গ নরক কোথায় ? উচ্চযোনি বা নীচযোনিই বা কি ?
গুরুদেব :এই স্বর্গ নরক আর কোথায়ও নয়। এই পৃথিবী। এখানেই আমাদের শারীরিক, মানসিক, ও আধ্যাত্মিক ভোগ করতে পারি। যদি আমরা স্থূল দেহ থাকা কালীন ভোগ সম্পূর্ণ না করতে পারি, তখন আমাদের সুক্ষ দেহে এই ভোগ করতে হয়। এই সূক্ষ্ম দেহের ভোগকেই আমরা স্বর্গ সুখ, বা নরক যন্ত্রনা বলে  থাকি।  
জিজ্ঞাসু : এখানেই স্বর্গ নরক  ? এটা কেমন ? 
গুরুদেব : একটা উদাহরণ দিয়ে বলি তোমায়। আসলে পাপ-পুণ্যময় এই জীবন। অর্থাৎ সুকর্ম, দুস্কর্ম, আর নিস্কর্ম নিয়েই আমাদের জীবন। সুকর্মের জন্য সুখ, দুস্কর্মের জন্য দুঃখ, আর নিস্কর্মের জন্যও একটা ফল আছে সেটা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দুঃখ, আবার সুখও আছে। 
ধরো এক সম্পন্ন গৃহস্থ। বিশাল বাড়ী, গাড়ী, দাস দাসী।  কোনো কিছুর অভাব নেই। তার একটি সুসন্তান। পিতা মাতার বাধ্য সন্তান। জোয়ান ছেলে। যাকে ঘিরে, গৃহস্থ ভবিষ্যতের সুখের কল্পনায় হাবুডুবু খাচ্ছে। নিজেকে সবচেয়ে ভাগ্যশালী মানুষ মনে করে। কিন্তু একদিন  ওঁর ওই জোয়ান ছেলে আকস্মিক দুর্ঘটনায় মারা গেলো। দুঃখের পাহাড় ওর উপরে ভেঙে পরে। সংসারের সমস্ত বস্তু ওর কাছে থাকা সত্ত্বেও ও দুঃখীই থাকে। এবং যতদিন বেঁচে থাকে নিজের পুত্রের মৃত্যুশোক, তাকে ঘিরে থাকে। ওই গৃহস্থ পুত্রের জোয়ান হাওয়া পর্যন্ত যে সুখ ভোগ করেছিল সেটা ওর স্বর্গ সুখ।  আর পুত্রের মৃত্যুর পরে যে দুঃখ ভোগ করেছিল সেটা ওর নরক যন্ত্রনা। এই ভাবে মানুষকে এই জীবনেই তার প্রারব্ধ অনুসারে সুখ দুঃখ ভোগ করতে হয়। 
এবার তোমাকে বলি উচ্চ যোনি ও নিচ যোনির কথা। উচ্চযোনি আর কিছুই নয় শ্রেষ্ট মনুষ্য ঘরে জন্ম গ্রহণই উচ্চ যোনি জাত।  অর্থাৎ সেখানে সে  সর্ব সুবিধা পাবে। এবং মোক্ষের পথে এগিয়ে যাবে। আর নিচ যোনী মানে হিনতর প্রাণিকূলে জন্ম গ্রহণ।  যেখানে সে সাধনমার্গে যাবার চিন্তা রোহিত হবে। 
আবার কেউ কেউ বলেন, পুণ্যবান মনুষ্য নিজের পুণ্যে কিন্নর, গান্ধর্ব, অথবা দেবতাদের যোনি ধারণ করে স্বর্গলোকে অবস্থান করবে, যতক্ষন না তার অর্জিত পুন্য ক্ষয় হচ্ছে। পুন্য ক্ষয় হয়ে গেলে আবার তাকে পৃথিবী লোকে তাকে  জন্ম গ্রহণ করতে হবে ।
জিজ্ঞাসু : স্বর্গলোকে মানুষের পুন্য কেন শেষ হয়ে যায় ? স্বর্গ থেকে যদি ফিরেই আসতে  হবে, তবে স্বর্গে গিয়ে কি লাভ ? শুনেছি স্বর্গে তারাই যায়. যারা ভালো কাজ করেছিল।  আর স্বর্গে গিয়েও তো তার পুন্য অর্জন হবে। তবে সে আবার পৃথিবীলোকে ফিরে আসবে কেন ?
গুরুদেব : উচ্চ যোনিতে বা দেবতা হয়ে অর্থাৎ অশরীরী হয়ে  কেউ  কোনো কাজ করতে পারে না। তাই তার কোনো ফলও  হয় না।  তেমনি নিচ যোনিতে জন্ম গ্রহণ করে সে যে কাজ করে তার কোনো ফল হয় না।  এই জন্য এগুলোকে ভোগ-যোনি  বলা হয়। এই ভোগযোনিতে কেবল ভালো কর্ম বা খারাপ কর্মের জন্য সুখ বা দুঃখ ভোগ করতে পারে।  এই সময় তার কোনো কর্মফল সঞ্চয় হয় না।
অর্থাৎ কোনো পশু যদি কাউকে হত্যা করে, তবে তার পাপ হবে না।  আবার নিরীহ প্রাণী, যারা ঘাসপাতা খায় কাউকে  হিংসা করে না তাদেরও কোনো পুন্য হবে না। তাই বাঘ কাউকে মারলে যেমন কোনো পাপ হবে না, তেমনি ছাগল বা হরিণ ঘাসপাতা খায়, হিংসা করে না বলে তাদের কোনো পুন্য হবে না।  
হে পুত্র।  কেবল মনুষ্য জন্মেই  কর্মফল সঞ্চয় হয়। নিকৃষ্ট বা উৎকৃষ্ট যোনিতে কর্মফল  সঞ্চয় হয় না। অর্থাৎ দেবতা বা পশু, কোনো জন্মেই কর্মফল সঞ্চয় করা যায় না। আর এই কর্মই মানুষকে মোক্ষ বা জন্ম-মৃত্যু চক্র থেকে বের করে আন্তে পারে।  পরম-পিতার ধামে পৌঁছে দিতে পারে। তাই দেবতা বলো, আর গান্ধর্ব, কিন্নর বলো সবাই মানুষ হয়ে জন্মাতে চায়।  তাইতো বলা হয় দুর্লভ এই মানুষ্য জীবন।
হে পুত্র ! সমস্ত লোকের মধ্যে এই পৃথিবী লোকে, আর সমস্ত জীবের মধ্যে কেবলমাত্র মানুষেরই বিবেক আছে। যে খারাপ ভালো বোঝে।  অন্য কোনো প্রাণী ভালো মন্দ বিচার করতে পারে না। সে কেবল নিজের রক্ষা করতে ব্যস্ত। তা সে দেবতা বলো আর পশু  বলো, সবাই খালি নিজেরটা বোঝে। ভালো মন্দো বোঝে না। তাই জানোয়ার যখন জানোয়ারকে মারে, বা অদিতির পুত্র যখন দিতির পুত্রদের মারে, বা উল্টোটা যখন হয় তখন তাদের কোনো পাপ লাগে না। পাপ-পুণ্যের লেখাজোকা কেবল মানুষের জন্য। তাই মানুষই পশু হয়ে জন্মায় দুর্ভোগ পোহাবার জন্য, আবার মানুষই দেবতা হয়ে জন্মায় পুন্য ভোগ করার জন্য। ভোগ শেষে  আবার মনুষ্য।  এই চক্রে আবর্তিত হচ্ছে  জীব জগৎ। 
জিজ্ঞাসু : এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে গেলে আর মৃত্যু পুরীতে ফিরে আসতে  হয় না ? আর জন্ম-মরন চক্র শেষ হয়ে যায় ? 
গুরুদেব : হ্যাঁ সেই স্থানই  পরমধাম। পরমাত্মার ধাম। যেখানে গেলে কাউকে ফিরে আসতে   হয় না। একেই বলে মোক্ষ। 
হে পুত্র ! মনুষ্য জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য মোক্ষপ্রাপ্তি করা। আর এই মোক্ষ কেবল মনুষ্যযোনি দ্বারাই প্রাপ্ত হতে পারে। এই জন্য মানুষের শরীরকে মোক্ষপ্রাপ্তির দ্বার বলা হয়ে থাকে। হে পুত্র মানবশরীর বড়ো  দুর্লভ। কত জন্মের সাধনার ফলে, কত কঠিন সাধনার ফলে এই মানব শরীর প্রাপ্ত হয়েছো।  এঁকে অবহেলায় কাটানো উচিত নয়। দেবতারাও মানব শরীরের আকাঙ্ক্ষা করে। কিন্তু মানুষের বিড়ম্বনা এই যে মানুষ তার মূল্যবান শরীরকে অর্থাৎ মোক্ষপ্রাপ্তির সুযোগকে অবহেলা করে।জাগতিক ভোগ বিলাসে, অনিত্য বস্তুতে মগ্ন থাকে।   এমনকি শরীর  ছাড়ার যখন সময় আসে, তখনও বাসনা তার পিছন ছাড়ে  না। হে পুত্র মৃত্যুর সময় যে বাসনা মানুষের মনে দৃঢ় থাকে, মানুষ সেইমত পরবর্তী জীবন প্রাপ্ত হয়। 
হে পুত্র ! প্রাণী সারা জীবন যেমন-ই  কাটাক, অন্তত অন্তঃকালে যদি একাগ্র মনে কেবল পরম-পিতার  ধ্যান করে, এবং তৎক্ষণাৎ শরীর  ত্যাগ করে তবে সে সোজা পরমধামে পৌঁছে যায়।  সেখান থেকে ওর আর ফিরে আসতে  হয় না। আর এই অন্তঃকালে পরম-পিতার ধ্যান তখনই সম্ভব, তাদের পক্ষেই সম্ভব, যারা সারা জীবন তাঁরই ধ্যানের অভ্যাস করে। তাই তোমাকে বলি, সব ছেড়ে, তার ধ্যান করো, আর মোক্ষলাভ করো।
আজ বাক্যকে বিরাম  দিলাম।  
ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ