দেহতত্ত্ব ও লিঙ্গ সাধনা - ১ SADHANA ON SUBTLE BODY (সূত্র : পরমার্থ প্রসঙ্গে - ১০ম খন্ড, ১০ অধ্যায়।)
হে বন্ধু, আমি কারুর গুরু নোই, কেউ আমার গুরু নয়। সবাই আমার নমস্য, আবার কেউ আমার নমস্য নয়। আমি আমাকেই প্রণাম করি, আমি আমাকেই শ্রদ্ধা করি, আমাকেই ভালোবাসি। আমি পঞ্চভূতের এই দেহ নোই। আমি আত্মা। আমার না আছে, মৃত্যু না আছে জন্ম। আমি অজন্মা। আমাতেই মৃত্যু আমাতেই জন্ম। আমি অমর আত্মা। আমি না ব্রাহ্মণ, না শুদ্র। আমি আমাতেই স্থিত - কখনও অস্থির কখনও স্থির। যখন অস্থির তখন আমি ক্রিয়াশীল। যখন স্থির তখন নিষ্ক্রিয়। আমি কারুর বন্ধু নোই, আমি কারুর শত্রু নোই। আবার আমি নিরপেক্ষও নোই। আপনি আমার খুবই কাছে থাকেন, আমি তা জানি, কিন্তু আপনি তা জানতে পারেন না। আমি আপনার সঙ্গেই আছি, আমি আপনার ভিতরেই আছি, শুধু একবার চোখদুটো মুদ্রিত করে অন্তরের দিকে তাকিয়ে দেখুন। আমি আপনার মধ্যে উপস্থিত থেকে আপনার দ্বারা আমার উদ্দেশ্য সাধন করছি। একবারটি ভাবুন, "আমি কিছুই করছি না। যা কিছু হচ্ছে, তা কেবল আমার দ্বারা সাধিত হচ্ছে। আমি আমার মধ্যেই নিরন্তর ক্রিয়ারত।" আমার ও আপনার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আপনি ভাবছেন, আমি ভাবাচ্ছি । যেদিন ভাবনা দূরীভূত হয়ে যাবে, সেদিন উপল্বদ্ধিতে আসবে জগৎ আপনার ভাবনা ছাড়া কিছুই ছিল না। আমি-তুমি বলে কিছু হয় না। সবই সেই এক সত্তা - যা আমার ভেদবুদ্ধির কারনে ভিন্ন ভিন্ন প্রতীয়মান হচ্ছে। সবার কল্যাণ হোক, সবার মঙ্গল হোক, সবার শান্তি হোক, সবাই নিরুদ্বিগ্ন হোক। ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওঁ।
----------------------
কথায় বলে "শরীরমাদ্যং খলু ধর্মসাধনম"- শরীর ছেড়ে সাধনা করা যায় না। যে কোনো কারণেই হোক, একদিন সেই অনির্বচনীয় শক্তির প্রভাবে আমরা সবাই এই সংসারপাশে আবদ্ধ হয়েছি। সেই দিন থেকেই দেহকে আশ্রয় করে অভিব্যক্ত হয়েছি। আর ধীরে ধীরে নিজের স্বরূপ ভুলে গেছি। দেহের মধ্যে থাকতে থাকতে একদিন নিজেকে দেহ বলেই মেনে নিয়েছি। মহাত্মাগন বলছেন, আমরা সবাই আসলে বিশুদ্ধ চেতনা, কিন্তু দেশ-কাল-পাত্র ও কার্য্য-কারণের অধীন হয়ে, আত্মবিস্মৃত হয়েছি। যতই আমাকে বলা হোক না কেন, দেহ অনিত্য, দেহ নশ্বর, আমরা কেউ দেহ নই , তথাপি প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবের কারনে আমাদের দেহাত্মবোধ কিছুতেই যাবে না। রক্ত-মাংসের এই অনিত্য দেহ, আর নিত্য আত্মা এই দুইকে পৃথক ভাবে অনুভব করা সহজ সাধ্য নয়। সাধারণ মানুষ তো-ছাড়, অনেক পণ্ডিত মহারাজ স্থূল দেহ থেকে বিচ্ছেদ না হলে, দেহ থেকে সে যে একটা স্বতন্ত্র সত্ত্বা - তা সে বুঝতেই পারে না। কিন্তু আরো অদ্ভুত সত্য হচ্ছে, সে তখন স্থূল দেহ ছেড়ে সূক্ষ্ম দেহে অবস্থান করছে। সেটাও সে বুঝতে পারেনা। দেহকে সহজে ছাড়া যায় না, এই সত্য বুঝতে গেলেও হাজার বছর লেগে যাবে আমাদের । কেননা, কত হাজার বছর ধরে যে আমরা এই দেহ থেকে দেহান্তরে ভ্রমন করছি, তা কে বলতে পারে ? আমার চৈতন্য সত্ত্বা আর দেহের মধ্যে আমরা নিজেকে গুলিয়ে ফেলেছি।
দেখুন, পার্থিব জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের পক্ষে জীবের যে বিশুদ্ধ জড় অথবা বিশুদ্ধ চেতন সত্তা আছে তার কোনোটাই আশ্রয় করা সম্ভব নয়। তথাকথিত মৃত্যুর পরেও, বস্তুর স্থিতি সম্পর্কে ধারণা করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। দেহ বললে, সাধারণ মানুষ যা বোঝে তা এই স্থূল দেহের প্রকারভেদ মাত্র। বস্তুতঃ দেহ কেবলমাত্র তত্ত্বের ভৌতিক প্রকাশ ছাড়া কিছু নয়। রজঃ বীর্য্যের সংযোগে অথবা সংযোগ ছাড়াই যখন ভৌতিক বস্তুর ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র রূপ অর্থাৎ অনুরাশি যখন কোনো একটা বিশিষ্ট স্থানে বিন্দুভাব প্রাপ্ত হয়, তখন যা হয়, তা এই স্থূল দেহের বীজ বুঝতে হবে। এই দেহবীজ বাহ্য উপাদান সংগ্রহ ক'রে, পুষ্টিলাভ ক'রে থাকে। এবং কালের প্রভাবে কার্যক্ষম রূপে অভিব্যক্ত হয়। রজঃ এবং বীর্যরূপ রক্ত এবং শুক্ল বিন্দুদ্বয় প্রাকৃতিক ভাবে অথবা কামের প্রভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে পরষ্পর মিলিত হয় এবং বীজরূপে আত্মপ্রকাশ করে। যতক্ষন মানুষ বা জীবকুল এই স্থিরবীজকে উর্দ্ধগামী না করতে পারে, ততক্ষন এর স্বাভাবিক গতি থাকে নিম্নগামী। সাধারণ মানুষের বীর্য্যের গতি তাই অধোমুখী। এই বিন্দুসত্ত্বা বাষ্পরাশির সংঘাতে উৎপন্ন ঘনীভূত ভাব প্রাপ্ত হয়, এবং ধীরে ধীরে তৈজস ও তরল অবস্থায় নাভির নিম্ন প্রদেশে এসে জমা হয়। সেখান থেকে রেতবহা নাড়ীর সাহায্যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে বাইরে বেরিয়ে আসে। এই হচ্ছে প্রাকৃত কাম ও দেহ সৃষ্টির রহস্যের গূঢ় কথা।
এখন কথা হচ্ছে, দেহ তৈরিতে শুক্র-শোণিতের মিলন আবশ্যক। তবে সাধারণ মানুষের ধারণা হচ্ছে, যোনিভিন্ন জন্ম সম্ভব নয়। ব্যাপারটা আদৌ কিন্তু তেমন নয়। মহাত্মনযোগীপুরুষগন বলে থাকেন, শুদ্ধ সংকল্প যখন পরমাণুকে আকৃষ্ট ক'রে কোথাও স্থিত করে, তবে সেখানেও অযোনিসম্ভূত দেহ উৎপন্ন হতে পারে। দ্রোণাচার্য কলসির মধ্যে জন্মেছিলেন। কৃপা ও কৃপি শরদ্বানের মধ্যে, সীতা পৃত্থির মধ্যে, দ্রৌপদী যজ্ঞাগ্নির মধ্যে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। এমনকি ধৃতরাষ্ট্রের একশত পুত্র ও এক কন্যা মাটির পাত্রে জন্ম গ্রহণ করেছিল। আমরা সবাই মহর্ষি ভৃগুর নাম শুনেছি। মহাভারতে বলা হচ্ছে, স্বয়ং ব্ৰহ্মা একদিন বরুনের যজ্ঞ করছিলেন, সেই যজ্ঞাগ্নি থেকে নাকি মহর্ষি ভৃগু সমুত্থিত হয়েছিলেন । অর্থাৎ শুদ্ধ সংকল্প পরমাণু দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে, কোথাও স্থিত হলে, সেখানে দেহ উৎপন্ন হতে পারে। পৃথিবীতে প্রথম দেহ এইভাবেই উৎপন্ন হয়েছিল। প্রাচীন কালে মুনি-ঋষিরা এইভাবে প্রজা সৃষ্টি করতে পারতেন এবং করতেন। বাহ্য দৃষ্টিতে সৃষ্টি যেভাবেই হোক না কেন, আসলে শুক্র ও শোণিতের মিলন আবশ্যক। সাধারণ মানুষের ধারণা হচ্ছে, কামনাজনিত মৈথুন হচ্ছে সৃষ্টির কারন। কিন্তু মহামহোপাধ্যায় শ্রী গোপীনাথ কবিৰাজ বলছেন, যোগীগণ যোগপ্রভাবে শুদ্ধ কামের আশ্রয় নিয়ে কেবল নাভি, হৃদয় অথবা মস্তক প্রভৃতিতে আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিয়ে নারীদেহে গর্ভ সঞ্চার করতে পারে। আমাদের এই অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু মহাপুরুষদের কথা অস্বীকার করি কি করে ? কবিরাজ মহাশয় বলছেন, এমনকি কোনো দেহ সন্মন্ধ ছাড়াই রজবীর্য্যের সংঘাতের প্রক্রিয়া সংগঠিত করতে পারেন। এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত সূক্ষ্ম। এক্ষেত্রে কেবলমাত্র দর্শন বা চিন্তার সাহায্যে দেহ সৃষ্টি করতে পারেন। এটি হচ্ছে শুদ্ধতম দেহ । আসলে দেহ পাঁচ প্রকারের হয়ে থাকে। তো স্থূল দেহ সৃষ্টির প্রক্রিয়া কেবলমাত্র মৈথুন সংযোগে হয়ে থাকে এমন ধারণা ঠিক নয়, মৈথুন বিনা এমনকি দেহাতীত হয়েও দেহকে সৃষ্টি করা যায়।
১. যাইহোক, এই কামাদি ও মৈথুনের প্রভাবে যে দেহ হয়, সেই দেহ অশুদ্ধ , অশুচি। একেই বলে সাধারণ স্থূল দেহ, যাকে যোগীরা বলেন প্রথম শ্রেণীর দেহ। এই দেহ মূলতঃ ভোগ ও বৈষয়িক কর্ম্ম সম্পাদনের জন্য হয়ে থাকে । এই দেহে সাধনক্রিয়া হয় না। তো কামের প্রভাবে এই যে অশুদ্ধ দেহের উৎপন্ন হয় তা সাধন জগতে বিশেষ কোনো কাজে লাগে না। এইজন্য শরীরকে শুদ্ধ করতে গেলে, সাধন জগতে কামের প্রভাব থেকে মুক্ত হবার কথা বলা হয়ে থাকে। উর্দ্ধরেতা স্থূল দেহই সাধনার সর্বোচ্চ ক্ষেত্র। অশুদ্ধ দেহে সাধনা হয় না।
২. আবার উর্দ্ধরেতা জীবের (ঋষি-মুনির) সংকল্প প্রভাবে কামাদির অধোগতির ফলে যে দেহ উৎপন্ন হয়, তা দ্বিতীয় শ্রেণীর স্থূল দেহ। এই দেহ কিছুটা বিশুদ্ধ হলেও, মলিন। কেননা এখানেও মৈথুন ক্রিয়া হয়ে থাকে। অর্থাৎ সাধারণ জীবের কামনা জনিত মৈথুনে যে শরীর হয়, তাকে অশুদ্ধ দেহ বলে, আবার উর্দ্ধরেতা মুনি ঋষির মৈথুনে যে দেহ উৎপন্ন হয়, তা দ্বিতীয়শ্রেণীর দেহ, কিছুটা শুদ্ধ ।
৩. আবার স্ত্রীর নাভি, হৃদয়, মস্তক ইত্যাদির স্পর্শে যে স্থূল দেহের উৎপন্ন হয়, তা তৃতীয় শ্রেণীর দেহ। এক্ষেত্রে কেবল, দর্শন, স্পর্শন, এমনকি কি স্পর্শন ছাড়াও কেবল মাত্র দর্শন দ্বারাও গর্ভ সঞ্চার হতে পারে। এই দেহ তৃতীয় শ্রেণীর স্থূল দেহ। অর্থাৎ মৈথুন বিনা কেবল দর্শনে বা স্পর্শে যে দেহ উৎপন্ন হয় তাকে বলে তৃতীয় শ্রেণীর দেহ।
আর সমষ্টি মনের ইচ্ছেশক্তি প্রভাবে যে দেহ জন্মে তাকে বলা হয় চতুর্থ শ্রেণীর দেহ বা অতি শুদ্ধ দেহ। প্রথম ও তৃতীয় ও চতুর্থ স্থূল দেহ মৈথুনের কারনে উৎপন্ন না হবার ফলে, এই দেহ হয় শুদ্ধ। যদিও তৃতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণীর দেহ অধিক শুদ্ধ।
পঞ্চম শ্রেণীর দেহ : এছাড়া আরো একপ্রকার দেহ আছে, যেখানে গর্ভ সঞ্চারের জন্য স্ত্রী-দেহ অথবা গর্ভস্থানের আবশ্যক হয় না। সেই দেহ আরো অধিক পবিত্র। তবে একটা কথা বলি, সেখানেও সূক্ষ্ম যোনির সহায়তা দরকার। যোনিপীঠ সহ শিব লিঙ্গের প্রচলন করা হয়েছে এই কারণেই। অর্থাৎ যোনি ভিন্ন শুধু লিঙ্গ জ্যোতি সৃষ্টিকে সম্পূর্ণ করতে পারে না। তবে যোনির প্রকার ভেদ আছে, স্থূল যোনী যেমন মাতা-পিতার অনুরূপ দেহ তৈরী করে, তেমনি সুক্ষ যোনি থেকে জাত দেহ স্রষ্টার মনের মতো দেহ তৈরী করতে পারে। সূক্ষ্ম যোনীজাত দেহই দেবতা হয়ে থাকে।
এখন কথা হচ্ছে, যোনি বলতে আমরা কি বুঝি ? সাধারনতঃ যোনি বলতে আমরা একটি নলাকার প্রণালী। যা ভগৌষ্ঠদ্বয় থেকে জরায়ু পর্যন্ত বিস্তৃত। একেই আমরা যোনি বলে জেনে থাকি। কিন্তু এছাড়াও এই যোনি বহুপ্রকারের হয়ে থাকে। প্রেতযোনি, দেবযোনি, পশুযোনি সবশেষে ব্রহ্মযোনি। এখন কথা হচ্ছে ভগৌষ্ঠ কথাটার অর্থ কি ? ভগপীঠ থেকে দুদিকে দুটো ত্রিকোণ কোমল চামড়া নিম্ন ও পশ্চাৎগামী হয়ে মলদ্বারের একইঞ্চি সামনের দিকে পরস্পর মিলিত হয়। এর সামনের দিকে স্থূল ও পশ্চাৎ দিকে ক্ষীণ। এতো গেলেও সাধারণ দৃষ্টিতে যোনির কথা। আমাদের শরীরের মধ্যে রো একটা যোনি আছে, তাকে বলা হয় ব্রহ্মযোনি। ব্রহ্ম কথাটির একটা অর্থ হচ্ছে জ্যোতিঃ। ব্রহ্মতালু মধ্যস্থ ছিদ্রপথকে বলা বা ব্রহ্মরন্ধ্র বা ব্রহ্মযোনি। এটি হচ্ছে ব্রহ্মের স্থিতি স্থান। আমাদের যিনি স্রষ্টা হিন্দু মতে ব্রহ্মা এই স্থান দিয়ে জীবদেহের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে থাকেন। যোগশাস্ত্র মতে এই ব্রহ্মযোনি থেকেই বিশুদ্ধ জ্ঞান দেহের সৃষ্টি হয়। যদিও এই জ্ঞানদেহও একপ্রকার স্থূল দেহ। লোকিক স্থূল দেহ যেমন অন্ন দ্বারা পরিপুষ্ট হয়, তেমনি এই জ্ঞানদেহ জ্ঞানজ্যোতিঃ দ্বারা পরিপুষ্ট হয়।
------------------------------
দেহতত্ত্ব ও লিঙ্গ সাধনা - ২ অদ্ভুত জন্মকথন
আমাদের একটা ধারণা হচ্ছে একটা দেহ উৎপাদনের জন্য পিতা ও মাতা উভয়ের প্রয়োজন। কিন্তু সত্য হচ্ছে, ভগীরথের জন্মের জন্য কোনো পিতার দরকার হয় নি।
যারা মহাভারত পড়েছেন তারা খেয়াল করেছেন, সেখানে অদ্ভুত অদ্ভুত সব জন্ম বৃত্তান্তের কথা লেখা আছে। এইসব জন্ম-প্রথা বা জন্ম পদ্ধতি এখন আর শোনা যায় না। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, এই জন্ম বৃত্তান্তের মধ্যে কি কোনো গুহ্য তত্ত্ব কথা লুকিয়ে আছে। নাকি কেবল কল্প-কাহিনী ? এগুলো কি আদৌ সম্ভব ? আমরা যে দেহ পাই, তা আমাদের মা-বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। এই স্থূল দেহ তৈরিতে মা এবং বাবার আমার অনুরূপ একটা দেহ অবশ্যই চাই। মানুষের পেটে মানুষ হয়, বাঘের পেটে বাঘ হয়। পাখীর ডিমে পাখী হয়, গাছের বীজে অনুরূপ একটা গাছ-ই হয়। আম গাছে জাম ফলে না, মানুষের পেটে গাধা হতে পরে না। অথচ দেখুন, আমরা সবাই হয়তো একই জাতের খাবার গ্রহণ করছি, অর্থাৎ একটা কুকুর বিড়াল, যা খাচ্ছে, মানুষও হয়তো তাই খাচ্ছে, তথাপি কুকুরের পেটে কুকুর হচ্ছে, বিড়ালের পেটে বিড়াল হচ্ছে, মানুষের পেটে মানুষ হচ্ছে।
আবার গাছের জন্মের জন্য যেমন একটা বীজ, ও জল-হাওয়া, তাপ, মাটি ইত্যাদি দরকার, তেমনি জীবের জন্মের জন্য ডিম্ব ও শুক্রের একটা মিলন স্থান দরকার, যাকে আমরা বলি গর্ভাশয়। এই গর্ভাশয়ের মধ্যেই আমাদের অজ্ঞাতসারে একটা জীবদেহ, বা মাতা-পিতার রূপ পরিগ্রহ করে। এই গর্ভদ্বারকে বলা হয় যোনী। এই যোনিদ্বার ভেদ করেই জীবের আসা-যাওয়া। এখন কথা হচ্ছে এই যোনি বা গর্ভদ্বার ও গর্ভাশয় ভিন্ন কি কোনো জীবের দেহ তৈরী হতে পারে ? আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো। তার আগে আমরা কয়েকটা মহাভারত থেকে কয়েকটা জন্ম-বৃত্তান্ত শুনে নেই। এর পরে আমরা বোঝার চেষ্টা করবো, এইসব কাহিনীর মধ্যে সত্য বা বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা কিছু আছে কি না।
আমরা শুনেছি, সগর রাজার ছিল ষাট হাজার পুত্র। রাজা সগরের পত্নী নাকি একটা লাউ প্রসব করেছিলেন। এই লাউ হয়তো একটা মাংস খন্ড। দৈব বাণী শুনে এই লাউকে ষাট হাজার ভাগে ভাগ করে ঘৃত-পূর্ন কলসিতে রেখে দেওয়া হলো এর পরে প্রত্যেকটি লাউ থেকে একজন করে মোট ষাট হাজার সন্তানের জন্ম হলো।
ভগীরথের আমি আমরা সবাই শুনেছি। এই ভগীরথ, সগর রাজার বংশধর রাজা দিলীপের পুত্র। এনার জন্ম বৃত্তান্ত অদ্ভুত। বলা হচ্ছে, রাজা দিলীপ একসময় রাজ্যের বাইরে ছিলেন, সেই সময় তার দুই স্ত্রী সমকামীতায় জড়িয়ে পড়েন। আর এই সমকামিতার ফলে নাকি এক স্ত্রী গর্ভবতী হয়ে পড়েন। আর একসময় একটা মাংসপিন্ড প্রসব করেন। বলা হচ্ছে, মাংসপিন্ডটি রাস্তার পাশে আবর্জনার স্তুপে ফেলে দেওয়া হয়। এখন ঋষি অষ্টাবক্র মুনি সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঋষি অষ্টাবক্র খেয়াল করলেন, মাংস খণ্ডটি নাড়াচাড়া করছে। অর্থাৎ এর মধ্যে প্রাণের স্পন্দন হচ্ছে। ঋষি অষ্টাবক্র ভাবলেন, এই মাংস খণ্ডটি তাকে বিদ্রুপ করছে। আসলে নিজের মধ্যে দুর্বলতা থাকলে যা হয়। ঋষি অষ্টাবক্রের শরীর যেহেতু আটটি জায়গায় অস্বাভাবিক ছিল, তাই তিনি এঁকেবেঁকে চলাফেরা করতেন। এতে করে অনেকে তার শরীর নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতো। এই ধর্ণা থেকেই তিনি ভাবলেন, এই মাংসখণ্ড জড় মধ্যে প্রাণ আছে, তা তাকে বিদ্রুপ করছে। কিন্তু সেটা তার কাছে স্পষ্ট ছিল না। তাকে বললেন, যদি তুমি আমাদে দেখে বিদ্রুপ করে থাকো, তবে তোমার এক্ষুনি মৃত্যু হবে। আর যদি বিদ্রুপ না করো, তবে তোমা থেকে একসুন্দর শক্তিশালী যুবকের জন্ম হবে। জানি না, আশীর্বাদের ফলে কি না, হয়তো ঋষি অষ্টাবক্রের সেবা শুশ্রূষায় একদিন ভগীরথের জন্ম হয়েছিল।
মহর্ষি ভৃগু : আমরা সবাই মহর্ষি ভৃগুর নাম শুনেছি। মহাভারতে বলা হচ্ছে, স্বয়ং ব্ৰহ্মা একদিন বরুনের যজ্ঞ করছিলেন, সেই যজ্ঞাগ্নি থেকে নাকি মহর্ষি ভৃগু সমুত্থিত হয়েছিলেন । অর্থাৎ যিনি যজ্ঞের অগ্নি থেকে দেহলাভ করেছিলেন।
দ্রৌপদী ও ধ্রুপদ : মহর্ষি উপযাজের সহায়তায় রাজা দ্রুপদ পুত্র কামনায় যজ্ঞ শুরু করেন। যজ্ঞে আহুতি প্রদান করতেই যজ্ঞাগ্নি থেকে এক সুকুমার পুত্রের আবির্ভাব হলো। এই অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করে উপস্থিত সবাই বিস্মিত হলেন। কিচুক্ষন পরে সর্বাঙ্গসুন্দরী এক কুমারী যজ্ঞবেদী মধ্য থেকে উত্থিত হলেন। এই সুকুমার বালকের নাম রাখা হয় ধৃষ্টদ্যুম্ন, কুমারী কন্যার নাম রাখা হয় দ্রৌপদী।
গান্ধারীর শতপুত্র : দুর্যোধন দুঃশাসন ইত্যাদি জন্ম কথা শুনুন। মহাভারতে বলা হচ্ছে, একদিন মহর্ষি দ্বৈপায়ন, অর্থাৎ এই মহাভারত গ্রন্থটির লেখক, ক্ষুধা তৃষ্নায় ক্লান্ত হয়ে, ধৃতরাষ্ট্রের ভবনে আসেন, সেখানে গান্ধারীর সেবা শুশ্রূষায় সন্তুষ্ট হয়ে বার দিতে চাইলে, গান্ধারী বললেন, আমার গর্ভে যেন আমার স্বামীর সমান বলশালী সৎপুত্র জন্মে। ব্যাসদেব "তথাস্তু" বলে চলে গেলেন। এই অবধি ঠিকই ছিল, যদিও আমরা এখনো জানিনা, শুধুমাত্র বরপ্রদান করে, কাউকে গর্ভবতী করা যায় কি না। যাই হোক, ধৃতরাষ্ট্র সহযোগে গান্ধারী গর্ভবতী হলেন। কিন্তু দুই বৎসর অতিক্রান্ত হয়ে গেলো, তিনি কোনো সন্তান প্রসব করলেন না। অর্থাৎ যে কাজটি ১০ মাস ১০ দিনে হবার কথা, বর্তমান মতে ২৭৮ দিনের কাছাকাছি সময়ে হবার কথা তা হলো না। এদিকে খবর এলো, ধৃতরাষ্ট্রের ভাই পান্ডুর একটি পুত্র সন্তান লাভ হয়েছে, তখন তিনি রেগে গিয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে কিছু না জানিয়ে জোর করে গর্ভপাত ঘটালেন। দেখা গেলো, তাঁর পেট থেকে একটা মাংসখন্ড বেরুলো। এখন এই মাংসখন্ডকে যখন ফেলে দেবর উদ্যোগ করছেন, তখন স্বয়ং ব্যাসদেব আবার তার গৃহে এসে উপস্থিত হলেন। ব্যাসদেব গান্ধারীকে একটু বকাবকি করলেন, এবং ,মাংসপিণ্ডে জল সিঞ্চন করে, একটা গোপন স্থানে একশত কলসির মধ্যে ওই মাংসখন্ডকে টুকরো করে ঘিয়ের মধ্যে ভিজিয়ে রাখতে বললেন। এদিকে গান্ধারী মনে মনে ভাবতে লাগলেন, একটা কন্যা সন্তান হলে, কি না ভালো হতো। গান্ধারীর মনোস্কামনা জ্ঞাত হয়ে, মাংসখন্ডগুলোকে ১০১টি খন্ডে বিভক্ত করে দিলেন।১ গান্ধারী মাংসখন্ডে জল সিঞ্চন করতেই মাংসের খন্ডটি ১০১ টুকরো হয়ে গেলো। এবং তিনি এগুলোকে ১০১ ঘিয়ের কলসির মধ্যে ভাগ ভাগ করে রেখে দিলেন। এর দুই বৎসর পরে, নাকি প্রথমে দুর্যোধনের জন্ম হয় - ওই কলসির মাংসপিন্ড থেকে। এর পরে ধীরে ধীরে আরো ৯৯ জন পুত্র সন্তান এবং একটি কন্যা সন্তান ওই কলসি থেকে জন্ম গ্রহণ করে।
কুন্তীপুত্র - কর্ন হচ্ছে কুন্তীর প্রথম পুত্র। এই সন্তান কুন্তীর বিয়ের অনেক আগেই নাকি জন্ম গ্রহণ করে। শ্রীকৃষ্ণের ঠাকুরদার নাম ছিল শূর। এই শূর-এর কন্যা হচ্ছে কুন্তী। কিন্তু কুন্তীকে কুন্তিভোজের কাছে লালিত পালিত হন। কুন্তী পিতৃগৃহে (পালক-পিতার) থাকাকালীন, অতিথি পরিচর্য্যায় সুনিপুনা ছিলেন। একদিন দুর্ব্বাসা মুনি এই কুন্তিভোজের গৃহে এলে, তাকে সেবা দ্বারা কুন্তী সন্তুষ্ট করেন। তো দুর্ব্বাসা মুনি কুন্তীকে একটা মহামন্ত্র দান করেছিলেন। এই মহা মন্ত্র পাঠ করে যে কোনো দেবতাকে আহবান করলেই নাকি সেই দেবতার প্রভাবে কুন্তীর গর্ভে সন্তান এসে যেতো। এখন অল্পবয়সের কুন্তী পরীক্ষার ছলে সূর্য্য দেবতাকে আহবান করতেই সূর্যদেব, এসে কুন্তীর সঙ্গে সহবাস করেন। আর এর ফলে তার এক জন্ম হয়। আর কুন্তী সমাজ-লজ্জ্বার ভয়ে সন্তানকে জলের মধ্যে নিক্ষেপ করেন।
এর পরে, কুন্তীর সঙ্গে পান্ডুর বিয়ে হয়। পান্ডু এক ঋষির অভিশাপে সহবাস করতে অক্ষম হলে, কিন্তু তার সেই মহামন্ত্র যা তিনি দুর্বাসা মুনির কাছ থেকে পেয়েছিলেন, তার প্রয়োগ করে, প্রথমে ধর্ম্ম দেবতা থেকে যুধিষ্ঠির, বায়ু দেবতা থেকে ভীম, দেবরাজ ইন্দ্রের কাছ থেকে পেলেন অর্জ্জুনকে।
এর পরে একটা অদ্ভুত কথা আমরা দেখলাম, মহাভারতে - আর সেটি হচ্ছে, পান্ডু তিন পুত্র পাবার পরেও আরো পুত্র কামনা করতে লাগলেন। তখন কুন্তী বলছেন, আমাকে আর পুরুষান্তর সংসর্গের অনুরোধ করবেন না। শাস্ত্রে নাকি আছে, আপৎকাল উপস্থিত হলে, স্ত্রীলোক তিনবার পরপুরুষের দ্বারা সন্তান উৎপাদন করতে পারে। তিন বারের বেশি নাকি পুরুষান্তর সংসর্গ করা উচিত নয়। পাঁচবার এই কাজ করলে নাকি সে বেশ্যা পদবাচ্য হয়ে থাকে। এর পরে পান্ডুর অনুরোধে ও মাদ্রীর সম্মতিতে অশ্বিনীকুমারকে স্মরণ করলেন, আর অশ্বিনীকুমার মাদ্রীর সঙ্গে সহবাস করে যমজ পুত্রের জন্ম দিলেন। এদের নাম রাখা হয়, নকুল ও সহদেব।
ব্যাসপুত্র শুকদেবের জন্ম বৃত্তান্ত : ব্যাসদেবের যখন প্রায় ১০০ বছর বয়স, তখন তার মনের মধ্যে একজন উত্তরাধিকারীর প্রয়োজন অনুভব করেন। আর তাই যজ্ঞের আগুনে লাঠি দিয়ে উস্কে শুকদেবের জাগরণ ঘটিয়েছিলেন। অন্যমতে শুকদেবের মাতা ছিলেন, জাবালি ঋষির কন্যা পিঞ্জালী। এই শুকদেব ছিলেন শ্রুতিধর। যা কিছু শুনতেন, তা হুবহু পুনরাবৃত্তি করতে পারতেন। অন্য একটা কাহিনী আছে। আর তা হলো ঘৃতাচী নামে এক অপ্সরা তোতাপাখির মতো সুন্দর রূপ নিয়ে ঋষি ব্যাসদেবের সামনে দিয়ে চলে যায়। এতে করে, ব্যাসদেব কামার্ত হয়ে পড়েন। তাঁর বীর্যস্খলন ঘটে। এই বীর্য কিছু যজ্ঞকাষ্ঠের (লাঠির) উপরে পরে। সেখান থেকে জন্ম হয় শুকদেবের। )
কৃপা ও কৃপী : শরদ্বানের একদিন অশেষ রূপলাবণ্যযুক্ত একবসনা ললনাকে দেখে, উত্তেজিত হয়ে পড়েন। আর এই মদনবিকারের ফলে একসময় তার রেতঃ স্খলন হয়ে যায়। এবং এই রেতঃ গিয়ে পড়ে শরস্তম্ভে। সেখানেই নাকি জন্ম হয়, কৃপা ও কৃপীর।
দ্রোণ : শরদ্বানের মতোই ঋষি ভরদ্বাজ একদিন অপ্সরা ঘৃতাচীকে দেখে রেতঃ স্খলন করে ফেলেন। এই রেতঃকে তিনি একটা কলসিতে যত্ন সহকারে রেখে দেন। এবং সেখানেই নাকি জন্ম হয় দ্রোণের।
এমনিতর বহু বিচিত্র জন্মকথা আমাদের পৌরাণিক কাহিনীতে লেখা আছে।
--------------------
দেহতত্ত্ব ও লিঙ্গ সাধনা - ৩
আমাদের পৌরাণিক কাহিনীতে যা আছে, তার সত্য নির্ধারণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। অ-যোনি সম্ভূত দেহ সম্পর্কে যা কিছু বলা হোক না কেন, সুক্ষ অর্থে বিচার করলে আমরা দেখতে পাবো, দেহ কখনো যোনিভিন্ন উৎপন্ন হতে পারে না। যা কিছু রান্না করুন না কেন, একটা রান্নার পাত্রের অর্থাৎ হাড়ি-কড়াইয়ের অবশ্যই দরকার। কিন্তু যোগীপুরুষগন অন্য কথা বলে থাকেন, যোনী দুই প্রকার - উর্দ্ধমুখী, অধোমুখী। বিন্দু যখন অধোগতিশীল হয়, তখন তা প্রাকৃত যোনির মধ্যে প্রবেশ করে সৃষ্টির বিকাশ ঘটায়। কিন্তু এই বিন্দু যোগপ্রবাহে যদি উর্দ্ধগতিশীল হয়, তখন বিশুদ্ধ দেহের উদ্ভব হয়। এই নিম্ন যোনি যেমন মানুষের দেহের নিম্ন ভাগে স্থিত, তেমনি মানুষের শিরোদেশে আরো একটা যোনি আছে, তাকে বলা হয় ব্রহ্মযোনি। এই যোনি থেকে বিশুদ্ধ জ্ঞানদেহের সৃষ্টি হতে পারে। যদিও এই জ্ঞানদেহও একপ্রকার স্থূল দেহ। তেমনি এই বিশ্বজগৎরূপ যে বিরাট পুরুষ, তাঁর শরীরে অসংখ্য যোনি। আমরা সেই আলোচনায় যাবো না।
লৌকিক যে দেহ অর্থাৎ আমাদের স্থূল দেহ রচনায় পঞ্চভূতের আদিপত্য থাকে, আর এই দেহে পৃত্থি তত্ত্বের প্রভাব বেশি। তাই একে পার্থিব দেহ বলা হয়। এই দেহ সন্মন্ধে না আসতে পারলে আমাদের কর্তৃত্ত্ব ও ভোগত্ব সম্পাদন হতে পারে না। অর্থাৎ স্থূল দেহেই আমাদের কর্ম্মে অধিকার, এমনকি স্থূল বিষয়কে ভোগের অধিকার জন্মে। যতদিন আমাদের এই স্থূল দেহাভিমান থাকে, ততদিন আমাদের মধ্যে কর্তৃত্ত্ববোধ, এবং ভোগত্ববোধ থাকে। এই দুইয়ের মধ্যে অর্থাৎ কর্তৃত্ব ও ভোগত্ব - এই দূর মধ্যে একটা সন্মন্ধ আছে। যদি কোনো কারনে আমাদের দেহাভিমান নষ্ট হয়ে যায়, তখন কর্তৃত্বাভিমান বা ভোগত্বের অভিমানও নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের দেহাভিমান নষ্ট হয়ে গেলে, আমাদের দৈহিক সুখ-দুঃখ ভোগের সমাপ্তি ঘটে। এইজন্য স্থূল দেহকে বলা হয় ভোগায়তন দেহ। অর্থাৎ কর্ম্ম ও তার ফল ভোগ এখানেই ঘটে থাকে।
এই স্থূল দেহের উৎপত্তির একটা ধারাবাহিক ক্রোম আছে, স্বেদজ, জলজ, অন্তজ, প্রভৃতি প্রক্রিয়ার শেষে এসে জরায়ুজ দেহপ্রাপ্তি ঘটে থাকে। এই জরায়ুজ শ্রেণীর মধ্যে উৎকৃষ্ট দেহ হচ্ছে মনুষ্য দেহ। এক-এক জন্মে এক এক শ্রেণীর দেহ প্রাপ্তি ঘটে থাকে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই এই দেহের রূপান্তর ঘটে থাকে। হিন্দুশাস্ত্র একেই বলে চুরাশি লক্ষ যোনি ভ্রমন। নদী যেমন পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে সমুদ্রমূখী হয়ে থাকে, তেমনি দেহস্রোত পরমপুরুষ দিকে ধাবিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ সমুদ্র থেকে মেঘ, মেঘ থেকে জল, বৃষ্টির আকারে পাহাড়ে পতিত হয়, তেমনি পরমাত্মা জীবাত্মারূপ বীজ হয়ে প্রকৃতির গর্ভে আবির্ভূত হয়। এবং ধীরে ধীরে কালের প্রবাহে উৎকৃষ্টতর দেহপ্রাপ্ত হতে থাকে। যেকোনো কৃত কর্ম্মের ফল নয়, প্রকৃতির কোলে এ হচ্ছে স্বাভাবিক পরিণতি। যতদিন এই দেহের মধ্যে অহংভাবের স্ফূরণ না হচ্ছে, ততদিন জীবের কর্ম্মে অধিকার জন্মে না। অতয়েব এই যে চুরাশি লক্ষ যোনি ভ্রমন এ কেবল প্রাকৃতিক ব্যাপার। এর সঙ্গে কর্ম্মের কোনো সম্পর্ক নেই। আর অহংভাব না জাগা পর্য্যন্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছে অনিচ্ছারও কোনো জায়গা নেই। এই জরায়ুজ দেহ উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃত্বাভিমানের উৎপত্তি হয়। আর কর্ম্মদেহ উৎপাদন না হলে যেমন কর্ম্মে অধিকার জন্মে না, তেমনি কর্ম্মফল ভোগেরও দরকার পড়ে না। এই জরায়ুজ দেহ আবার তিন প্রকার - ১. ভোগদেহ, যেমন দেবতার দেহ, এখানে শুধু ভোগ সম্পাদিত হতে পারে, ২. কর্ম্মদেহ যেমন পশুকুল, ৩. আর মনুষ্য দেহ অর্থাৎ যেখানে ভোগ ও কর্ম্ম দুইই সম্পাদিত হতে পারে। দেবতাদের ভোগ দেহ, পশুকুলের কর্ম্ম দেহ কিন্তু মানুষই কেবল কর্ম্ম ও ভোগ উভয়ের অধিকারী। এখন প্রশ্ন হতে পারে, দেবতাদের কিভাবে জরায়ুজ দেহের অধিকারী বলা হচ্ছে ? আসলে এদেরও মাতা-পিতা বা কেবল মাত্র পিতা বা কেবল মাত্র মাতা আছে। এদের দেহ সূক্ষ্ম কিন্তু স্থূল। এদের জন্ম বৃত্তান্ত দেখলে বুঝতে পারবেন , এঁরা কেউ পিতা মাতা হীন নয়। তবে এদের মধ্যে কামনার প্রভাব আছে।
যাইহোক, দেহের এই যে বৈচিত্র, এসব আমাদের যোগীপুরুষের সূক্ষ্ম দর্শন দ্বারা দৃষ্ট হয়ে থাকে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে এসব কেবল শোনা কথা। দেখুন এই যা কিছু দেখছেন , সবই সেই শক্তির প্রকাশ। এই মূলশক্তি কিন্তু অব্যক্ত। আবার পরম-পুরুষও অব্যক্ত। যতক্ষন বিক্ষুব্ধ ভাব না আসছে, ততক্ষন জগৎ অপ্রকাশিত। কিন্তু যখন শক্তির মধ্যে যখন স্ফূরণ ঘটে, তখন শক্তি পুরুষকে ঢেকে ফেলে। পুরুষ অর্থাৎ চৈতন্যশক্তি তখন জড় প্রকৃতির গর্ভে প্রবেশ করে। আবার এর থেকে যখন বের হয়, তখন তখন জড় সত্ত্বার অংশকে আকর্ষণ করে প্রকাশিত হয়। প্রবল ঝড়ের সময় আমরা ধুলো বালির মধ্যে আটকে যাই। আবার যখন ঝড় থেমে যায়, তখন আমার শরীর এই ধুলোবালি দিয়ে ঢাকা এক কিম্ভুত-কিমাকার বেরিয়ে আসে । তখন আর আমি আমাকে চিনতে পারি না।
তো চৈতন্যশক্তি যখন বাহ্য প্রকৃতির সাথে যুক্ত হয়, অর্থাৎ ঝড়ের মধ্যে শুকনো পাতা যেমন দিকবিদিক শূন্য হয়ে ঘুরতে থাকে, তেমনি পরমপুরুষ জড়শক্তির প্রভাবে আপন সত্ত্বাকে ভুলে যায়, আর ইতস্তত পরিভ্রমন করতে থাকে। প্রাণ, মন, বুদ্ধির বিকাশের এই হচ্ছে মূল সূত্র। এর ফলে সৃষ্টি হয়, তিনটি সূক্ষ্ম কিন্তু স্থূল শরীর বা কোষ । আর তা হচ্ছে, প্রাণময়, মনময়, ও বিজ্ঞানময়। অনন্ময় শরীর যেমন পার্থিব, তেমনি প্রাণময়, মনময় শরীরও পার্থিব। কিন্তু বিজ্ঞানময় শরীর পার্থিব না হলেও আমাদের পার্থিব ও অপার্থিব (আনন্দময়) কোষের সঙ্গে এই বিঘ্নময় দেহ যোগাযোগ রাখে। অর্থাৎ এই বিজ্ঞানময় দেহ আমাদের মূলসূত্র যাঁকে ধরে আমরা আনন্দময় দেহ বা আমাদের মূল সত্ত্বার সন্ধান পেতে পারি।
আমরা যে স্থূল দেহ দেখে থাকি, এর পিছনে আছে একটা মূল-পরিচালক শক্তি। এই পরিচালনাশক্তির দ্বারাই স্থূল দেহের জ্ঞান-ইন্দ্রিয়, কর্ম্ম-ইন্দ্রিয় পরিচালিত হয়ে থাকে। এই যে জ্ঞানশক্তি ও ক্রিয়াশক্তি এই দুটোই আমাদের অন্তঃকরনে সম্মিলিত ভাবে অবস্থান করছে। আর এই শক্তিধারা আমাদের শরীরের ভিতরে যে সব নাড়ীপথ আছে, তার ভিতরে বায়ুতত্ত্বকে আশ্রয় করে ঘোরাফেরা করছে। আর এই বায়ুতত্ত্বকে আশ্রয় করেই, সমস্ত কর্ম্ম সম্পাদন করছে। এখন কথা হচ্ছে এই যে ইন্দ্রিয়সকল কাজ করছে যে শক্তির প্রভাবে, সেই শক্তি কিন্তু আমাদের এই স্থূল শরীরের অংশ নয়। এটি আসলে লিঙ্গ শরীরের অংশ। কেননা আমাদের যখন মৃত্যু হয়, অর্থাৎ আমরা যখন স্থূল শরীর ত্যাগ করি, তখন আমরা লিঙ্গ শরীরে আশ্রয় নেই। এই লিঙ্গ শরীরে আমাদের ইন্দ্রিয়শক্তি বর্তমান থাকেন। অর্থাৎ আমরা শুনে পাই, দেখতে পাই, কথা বলতে পারি ইত্যাদি ইত্যাদি। তো আমাদের ইন্দ্রিয়শক্তি আসলে তেজঃশক্তির প্রকাশ মাত্র। স্থূল দেহের সাথে যখন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকে তখন আমরা ইন্দ্রিয়গুলোর ক্রিয়া দেখতে পারি, আবার যেখান এই তেজশক্তি আমাদের স্থূল দেহ ছেড়ে লিঙ্গশরীরে আশ্রয় করে, তখন স্থূল শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়।
এই তেজশক্তি আশ্রয় করেই, সাধন জগতে এগুতে হয়। দেখুন কাঠের মধ্যে আগুন আছে, এমনকি আমাদের চারিদিকে আগুন আছে, কিন্তু তাকে আমরা অনুভব করতে পারি না। কিন্তু দেশলাই কাঠির সাহায্যে যখন এই কাঠে অগ্নি সংযোগ করি, বা কাঠে কাঠে যখন ঘর্ষণ করি, তখন কাঠের মধ্যে যে তেজঃশক্তি তার প্রকাশিত রূপ দেখতে পারি। এবং এই তেজশক্তি বা অগ্নি তখন আমাদের ব্যবহারিরক কাজে লাগতে পারে। ঠিক তেমনি বিশেষ সাধন প্রক্রিয়ার সাহায্যে বা গুরুদেবের সান্নিধ্যে এসে, আমরা আমাদের মধ্যে যে তেজশক্তি আছে, তার ব্যবহারিক দিককে ক্রিয়াশীল করতে পারি। যোগীপুরুষগন বলে থাকেন, এই যে লিঙ্গশরীর এটি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের শুদ্ধ নয়। আমাদের নানান রকম সংস্কার, যা আমরা জন্ম-জন্মান্তর ধরে সংগ্রহ করেছি, এছাড়া আছে, আমাদের বর্তমান জীবনের কামনা বাসনা, যা অপূর্ন। এই কামনা-বাসনা এবং সংস্কার আমাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। মনের মধ্যে অস্থিরতা তৈরী করে।
এখন আমাদের কাজ হচ্ছে, আমাদের এই সংস্কারগুলোকে বিশ্লেষণ করা। কামনা বাসনাকে সমূলে উৎপাটন করা। বাহ্য বিষয়ের প্রতি চিত্তের যে স্বাভাবিক আকর্ষণ, তাকে প্রতিহত করা। এগুলোকে দূর করতে পারলেই আমরা শুদ্ধ মনের অধিকারী হতে পারবো। অর্থাৎ আমাদের মনোময় দেহ তখন শুদ্ধ হবে। বিচারের দ্বারা আমরা আমাদের জ্ঞানকে শুদ্ধ করতে পারি। অর্থাৎ আমাদের বিজ্ঞানময় দেহকে শুদ্ধ করতে পারি। আর এই দুই দেহের শুদ্ধিকরণ করতে গেলে, আমাদের আগে করতে হবে প্রাণময় দেহের শুদ্ধিকরণ। অর্থাৎ আমাদের দেহের মধ্যে যে বায়ুর প্রবাহ চলছে, তার মধ্যে একটা ছন্দের সৃষ্টি করা। বাদ্যযন্ত্র সবাই যে যার মতো করে বাজাচ্ছে, তাই বেসুরো ঝঙ্কার জীবনকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে। কিন্তু সবার মধ্যে অর্থাৎ স্থূল-সুক্ষ-কারন দেহের মধ্যে যদি সাম্যতা বজায় রাখা যায়, তবে অশান্তি দূর হয়ে যাবে। আবার এই প্রাণময় দেহকে শুদ্ধ করতে গেলে, আমাদের আগে স্থূল অন্নময় দেহকে শুদ্ধ করতে হবে। স্থূল দেহের শুদ্ধি আসলে আমাদের আহারশুদ্ধির দ্বারা হতে পারে।
তো প্রথমে আহার শুদ্ধি, পরে প্রানশুদ্ধি, তারপর জ্ঞানশুদ্ধি। আর এটি করতে হবে, এই স্থূল দেহের অবস্থান কালেই। দেখুন আমাদের এই দেহ থেকেই, যা আসলে লিঙ্গদেহ থেকে প্রতিনিয়ত একটা আলোকরশ্মি নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সাধনক্রিয়া কৌশল আয়ত্ত্ব করে, নিরন্তর অভ্যাসের দ্বারা আমরা এই নিরন্তর বিচ্ছুরিত আলোক-রশ্মিকে যদি স্থিরতা দান করতে পারি, তাহলে এই বিচ্ছুরিত আলোক রশ্মি শান্ত হয়ে একটা আলোর গোলকে পরিণত হবে। তখন তার মধ্যে যে চঞ্চলতা ছিল, তা নষ্ট হয়ে যাবে।
দেখুন, লিঙ্গদেহ আর কিছু নয়, এটি আমাদের চিন্তা দেহ। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের চিন্তার স্ফুলিঙ্গ এই দেহ থেকে উৎপন্ন হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু সাধারণ মানুষের চিন্তা বিষয়কেন্দ্রিক, তাই আমাদের চিত্তের উপাদান হয়ে ওঠে বিষয়। কিন্তু বিষয়চিন্তার মধ্যে প্রতিক্ষণেই পরিবর্তন লক্ষিত হয়। মন এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে ধাবিত হয়। তো মনের এই যে বিষয় থেকে বিয়ান্তরে গমন এর ফলে মনের দুর্বলতার প্রকাশ ঘটছে। এসব আমাদের দুর্বল মনের লক্ষণ। কেননা সে একটা বিষয়কে সে ধরে রাখতে পারছে না। কিন্তু যখন সাধনক্রিয়ায় কোনো একটি বিশেষ বিষয়কে আশ্রয় করে চিন্তা করতে বলা হয়, তখন মন স্থির হতে শুরু করে। তো তখন চিত্তের আকারের বিশেষ পরিবর্তন হয় না। একসময় মনের চঞ্চলতা দূরীভূত হয়ে স্থিরতা প্রাপ্ত হয়। এই সময় দ্বৈতের স্থিতি থেকে ধীরে ধীরে অদ্বৈতে স্থিতি হয়। চিত্তের এই স্থির অবস্থায় সাধকের মধ্যে সময়জ্ঞানও লোপ পায়। অর্থাৎ কখন সে ধ্যানে বসেছিল, আর কত সময় অতিবাহিত হলো, সে সময়জ্ঞান তার থাকে না।
লিঙ্গ সাধনার প্রথম অবস্থা হচ্ছে জ্যোতির সাধনা বা জ্যোতিঃসিদ্ধি। একটা জিনিস জানবেন, এই যে জগৎ আপনার চোখের সামনে ভাসছে, তা আসলে আলোর খেলা ছাড়া কিছু নয়। তো এই আলোক বা জ্যোতি প্রথম দিকে দেবতার দেবজ্যোতি বলে কল্পনা করে নিতে হয়। এবং সাধনার সঙ্গে সঙ্গে তা বাস্তব হয়ে ফুটে ওঠে।
ধরুন আপনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একান্ত ভক্ত। তো নিরন্তর আপনি শ্রীকৃষ্ণের ভাবনা করছেন। গুরুপ্রদত্ত কৌশলের সাহায্য নিয়ে, আপনি কৃষ্ণ ভাবনায় রত হয়েছেন। এই ভাবনা ধীরে ধীরে গভীরতা প্রাপ্ত হবে। অর্থাৎ আপনার ভাবনার বিষয় ও আপনি একসময় একাকার হয়ে যাবেন। তখন আপনার চিত্তে কৃষ্ণ ভিন্ন অন্য কোনো কিছুর ভাবনা উদয় হতে পারবে না। এইসময় আপনার চিত্তের আকার শ্রীকৃষ্ণময় হয়ে উঠবে। এবং সাধনার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই কৃষ্ণময় চিত্ত স্থায়ী হতে শুরু করবে। একেই যোগীপুরুষগন বলছেন, সাযুজ্য-মুক্তি। এইসময় তার সামনে যে শ্রীকৃষ্ণের ছবি ভাসবে, তা সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণ নয়, কিন্তু আপনার চিত্তে যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ ব্যাতিত কিছু নেই, তাই আপনার কাছে এই প্রতক্ষ্য সত্য বলে মনে হবে। আপনার চিত্ত যে আকারের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল, আপনার চিত্ত সেই আকারে পর্যবেশিত হয়েছে। এর সঙ্গে দ্বাপর যুগের শ্রীকৃষ্ণের কোনো সম্পর্ক নেই।
----------------
দেহতত্ত্ব ও লিঙ্গ সাধনা - ৪
লিঙ্গ সাধনা আসলে আমাদের জ্ঞানজ্যোতির সাধনা। জ্ঞানদেহের সাধনা। আগেই বলেছি এই যে জগৎ আমাদের চোখের সামনে ভাসছে, এ আসলে আলোর খেলা। এই আলো ভিন্ন ভিন্ন রঙের সমাহার। আর এই আলোক-লোক যখন আপনার চিত্তে প্রতিফলিত হবে, তখন আপনি এই আলোক-লোকের বাসিন্দা হয়ে যাবেন। এই আলোক-লোকই দেবতাদের বাসস্থান।
এর আগে আমরা শুনেছি, কৃষ্ণ ভাবনায়, ভাবিত হয়ে আমাদের চিত্ত যখন কৃষ্ণময় হয়ে যায় তখন এক কৃষ্ণের দর্শন মেলে। এই কৃষ্ণ না তো ভগবান, না তো দ্বাপরযুগের বসুদেব পুত্র বাসুদেব, দেবকী নন্দন । এই কৃষ্ণ আসলে সাধকের নিজস্ব মনের কল্পনা বিশেষ। যা সে নিরন্তর ভাবছিলো। যা সে নিরন্তর ভাবছে, তাই সে দেখতে পাচ্ছে, এমনকি নিজেকে সে তাই ভাবছে। আসলে চোরের মন পুলিশ পুলিশ। বিনা টিকিটের যাত্রী কালো কোট পরিহিত কাউকে দেখলেই ভাবে, এ নিশ্চই টিকিট চেকার হবে। এর সঙ্গে আসল টিকিট চেকারের কোনো সম্পর্ক নেই। সত্য হচ্ছে, আপনার মন যা চাইছে, বা যার সম্পর্কে আপনি বেশি চিন্তা করছেন, সব কিছুর মধ্যে বা সাদৃশ্যমূলক যা কিছু সে দেখছেন তাকেই আপনি আপনার মনের আয়নায় দেখতে পাচ্ছেন । এর সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কোনো সম্পর্কে নেই। সত্য কখনও কল্পনার ধার ধারে না। সত্যকে ধরতে গেলে, আগে থেকে কোনো ধারণা না করা ভালো। তা না হলে, আপনি আপনার মনের কল্পনা আর সত্যকে গুলিয়ে ফেলবেন। এইযে ভাবতে ভাবতে শ্রীকৃষ্ণ দর্শন, এই দর্শন সত্য কিন্তু এই শ্রীকৃষ্ণ আদৌ ভগবৎসত্ত্বা নন। ইনি কেবলই আপনার কল্পনা প্রসূত শ্রীকৃষ্ণ।
এই ধরনের লোককে আধুনিক মনো বিজ্ঞান বলছে, ভ্রান্ত্র দর্শনের (HALLUCINATION) রুগী। এরা যেমন ভ্রান্ত দর্শন, এমনকি ভ্রান্ত স্পর্শন, ভ্রান্ত শ্রবণ, এমনকি ভ্রান্ত উপল্বদ্ধির শিকার হয়ে থাকেন। মনো বিজ্ঞান বলছে, একজন মানুষের মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু কোষকে নিস্তেজ রেখে, এই ধরনের অনুভূতি, বা দর্শন, শ্রবণ ইত্যাদি হতে পারে। যথার্থ সাধককে এই ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
মনো বিজ্ঞান বলছে, এই ধরনের রুগী, কোনো বস্তুকে যা নয়, তাই দেখে, যা নয় তাই উপলব্ধি করে, যা নয় তাই শোনে। আপনি শিউলি গাছের ছায়ায় বসে আছেন। গাছ থেকে কিছু একটা পড়লো। আপনি হয়তো ভাবলেন, শিউলি গাছে শুঁয়াপোকা হয়, নিশ্চয়ই আপনার গায়ে শুয়োপোকা পড়েছে। আপনি শিউরে উঠলেন। পরে দেখলেন, এটি শুঁয়াপোকা নয়, গাছের পাতা। একে বলে ভ্রান্ত স্পর্শ অনুভূতি।
আপনি মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করছেন, আপনার সামনের রাস্তায় দুম করে একটা আওয়াজ হলো। আপনি ভাবলেন, এইরে ব্যোম পড়েছে। পরে বুঝলেন, পাথরের দোকানে, লরি থেকে পাথর নামাচ্ছে। অথবা হঠাৎ আপনার মনে হলো, কেউ আপনাকে ডাকছে, দরজায় টোকা মারছে। কিন্তু দরজা খুলে কাউকে দেখতে পেলেন না। এটি ভ্রান্ত শ্রবণ অনুভূতি।
আমরা কত কিছু দেখছি, তা সত্য নয়। আমরা দেখছি, সূর্য পুবের আকাশে উদয় হচ্ছে, আর পশ্চিম আকাশে অসৎ যাচ্ছে, অর্থাৎ গতিশীল । আসলে সূর্য কখনো উদয় হয় না, আবার অস্তও যায় না, সূর্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। । আমরা দেখছি, পৃথিবীর উপরে ভূমি সোজা সরল, আসলে এই ভূমি বাঁকা। এসব আমাদের ভ্রান্ত্র দর্শনের নমুনা। এমনকি এক গ্লাস জলের মধ্যে একটা চামচিকে আপনি বাঁকা দেখছেনা, যা সত্য নয়।
জ্বরের পরে, আমাদের জিভে সব কিছু তেতো লাগছে - কিছুই খেতে পারছি না। যে খাবার আমার প্রতিদিন সুস্বাদু লাগতো, তা আজকে জ্বরের কারনে বিস্বাদ লাগছে। এটি ভ্রান্ত স্বাদের লক্ষণ।
এমনি আমাদের ভ্রমাত্মক ঘ্রানের অনুভূতিও হয়ে থাকে। রাতের দিকে বাড়িতে পায়েস রান্নার গন্ধ পেলেন। পায়েস আপনার খুব প্রিয়। কিন্তু পরে জানলেন, বাড়িতে আদৌ পায়েসের রান্না হয় নি। আসলে এ একধরনের পশু, গন্ধবকূলের নামক প্রাণীর গায়ের গন্ধ।
আসলে আমাদের জ্ঞানেন্দ্রিয়, যার দ্বারা আমরা বিষয়ের সংস্পর্শে আসি, তা আমাদের মাঝে মধ্যে ধোঁকা দেয়। কিন্তু সেই ভ্রমাত্মক জ্ঞানও সেই মুহূর্তে আমাদের কাছে সত্য বলে মনে হয়, এবং সেই মতো আমাদের শরীর মন, প্রতিক্রিয়া শুরু করে দেয় । এইসব ভ্রান্ত জ্ঞান থেকে সাধককে সাবধান থাকতে হবে।
এবারে আরো একধরনের অনুভূতির কথা বলি।
আপনারা সবাই শুনেছেন, ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা। একদিন দক্ষিণেশ্বরে নদীতে দুই মাঝির মধ্যে ঝগড়া লাগে। একজন আরেকজনকে বৈঠা দিয়ে পিঠে আঘাত করতে থাকে। এদিকে ঠাকুর চিৎকার করতে থাকেন। আর তার পিঠে সেই আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। লুকিয়ে কেউ একদিন ঠাকুরের বিছানায় টাকা রেখে দিয়েছিলো। ঠাকুর বিছানায় শরীর রাখতেই, তাঁর মধ্যে অস্থিরতা শুরু হলো। তিনি ছটফট করতে লাগলেন। আসলে মনি কাঞ্চন তিনি নাকি সহ্য করতে পারতেন না। ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের জীবনীতেও বলা হচ্ছে তিনি নাকি একদিন কুষ্টিয়ায় ঘোড়ার গাড়িতে চেপে যাচ্ছিলেন। সহিস ঘোড়াকে চাবুক মারতেই নাকি ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের গায়ে চাবুকের দাগ ফুটে উঠেছিল। এসবের সঙ্গে আধ্যাত্মিক জগতের কোনো সম্পর্কে নেই। এই অনুভূতি আসলে আমাদের মনের গভীরে যা কিছু চলছে, তার শারীরিক প্রতিক্রিয়া। এ এক ধরনের মানসিক রোগ - যা একসময় শরীরের মধ্যে ফুটে ওঠে। বেশি দুশ্চিন্তা করলে, আমাদের আলসার হতে পারে, আমাদের সুগার প্রেসার বেড়ে যেতে পারে,এই আলসার বা প্রেসার সুগার অসত্য নয়, কিন্তু এর সঙ্গে আত্ম্যত্মিকতার কোনো সম্পর্ক নেই।
আসলে মানুষ যখন জীবন-সংগ্রামে প্রতি আক্রমনের সম্মুখীন হয়, অথবা প্রতি আক্রমনের আশঙ্কা করে, তখন তার মধ্যে যে চিন্তার উদয় হয়, তাকে বলে দুশ্চিন্তা। এই দুশ্চিন্তা আসলে আশঙ্কা ছাড়া কিছু নয়। ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা থেকে এই আশঙ্কার উদয় হয়, যা অনেক সময়ই অমূলক। আমি বেঁচে থাকবো কি থাকবো না, এই চিন্তাটাই অমূলক। একটা জিনিস জানবেন, আমরা কেউ আমার ইচ্ছেমতো চিরকাল বেঁচে থাকতে পারবো না, এমনকি আমি যতই ভালো কাজ করি না কেন, আমি চিরকাল সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকবো এমনটা কিছুতেই হবে না। প্রত্যেকের জীবন এক অমোঘ শক্তি দ্বারা পরিচালিত। তার শক্তিতেই আমাদের শক্তি, আমাদের নিজস্ব কোনো শক্তি নেই, যা আমাকে চিরকাল সুখে রাখতে পারে। আবার আমাদের মধ্যে এমন কোনো শক্তি নেই, যা আমাকে চিরকাল দুঃখী করে রাখতে পারে। জীবন যেমন কর্ম্মফল ভোগের জন্য, তেমনি এই কর্ম্ম আমাদের পূর্ব নির্দিষ্ট। এর থেকে বেরিয়ে আসবার সাধ্য কারুর নেই। প্রারব্ধ কর্ম্ম থেকে কারুর রেহাই, নেই, আবার সঞ্চিত কর্ম্ম আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে থাকে। কেবলমাত্র এই সঞ্চিত কর্ম্ম সংরক্ষণ থেকে রেহাই পাবার জন্য যত সাধনক্রিয়া। যাইহোক, আমাদের আলোচ্য বিষয় ব্রহ্মানুভূতি।
ব্রহ্ম আমাদের ইন্দ্রিয় (পঞ্চ) অনুভূতির বিষয় নয়। ব্রহ্ম ইন্দ্রিয়াতীত। তিনি যেমন বাক্যের অতীত, তিনি আমাদের মনের অতীত। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে প্রতিনিয়ত একটা ভাবের উদয় হচ্ছে। এই যে ভাব এর সঙ্গে আমাদের মন, প্রাণ ইত্যাদির এবং আমাদের শরীরে যে নাড়ী আছে, তার সঙ্গে এর একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে। নাড়ী সমূহের সন্ধিস্থলে, যে রসের সঞ্চরণ হচ্ছে, তার মধ্যে যখন স্পন্দন উঠছে, তার কারনে যে কার্য্য সম্পাদন হচ্ছে তাকে আমরা বলি মনের ক্রিয়া, বা মনের চিন্তা। আর এই যে রসের মধ্যে স্পন্দন উঠছে তা আসলে প্রাণের অস্থিরতার কারনে হয়ে থাকে। দেখুন সমুদ্রের যে ঢেউ তা আসলে বাতাসের প্রবাহের কারনে হয়ে থাকে। তেমনি আমাদের নাড়ীর সন্ধিস্থলে রসের মধ্যে যে ঢেউ ওঠে তাও এই বায়ুর প্রবাহের কারনে হয়ে থাকে। এখন নাড়ী-বিশেষের মধ্যে যে বায়ুর সঞ্চালন, তার গতি অনুসারে আমাদের মধ্যে ভাবের উদয় হয়ে থাকে। অর্থাৎ বায়ুর অস্থির গতি, বা স্থির গতির প্রভাবে আমাদের ভাবকার্য্য বা মনের মধ্যে চিন্তার সমাবেশ হচ্ছে। তো ঋষি প্রদত্ত কিছু যৌগিক ক্রিয়া, আসন মুদ্রা, প্রাণক্রিয়া ইত্যাদি দৈহিক ও প্রাণীক প্রয়াস বা চেষ্টা দ্বারা মনের ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করা যায়। সাধারণ মানুষ এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞাত নয়, কিন্তু যোগাচার্য্যগন বা যোগীপুরুষগন এসম্পর্কে জ্ঞাত আছেন।
শ্রীমদ্ভগবৎ গীতায়, অষ্টম অধ্যায়ে(শ্লোক- ৯-১০) এই সম্পর্কে বলা হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে, সেই পরম পুরুষ সর্বজ্ঞ, অনাদি, সর্ব্বনিয়ন্তা, সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম, সবার বিধাতা, অচিন্তনীয়, আদিত্যববৎ স্বপ্রকাশ এবং প্রকৃতির উর্দ্ধে। যিনি মৃত্যুকালে মনকে একাগ্র করে, ভক্তিযুক্ত চিত্তে যোগবলে সাহায্যের প্রাণকে ভ্রূযুগলের মধ্যে ধারণ পূর্ব্বক তাঁকে স্মরণ করেন, তিনি সেই দিব্য পরামপুরুষকে প্রাপ্ত হন।
আবার আরো স্পষ্ট করে এই একই অধ্যায়ে (শ্লোক - ১২-১৩) বলছেন, সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সংযত করে, মনকে হৃদয়ে নিরুদ্ধ করে, প্রাণকে বৃযুগলের মধ্যে সম্যকরূপে ধারণ করে, "ওঁ" এই পরম পবিত্র একাক্ষর প্রণব মন্ত্র জপ করতে করতে যিনি দেহ ত্যাগ করেন, তিনি সেই পরমগতি প্রাপ্ত হন। ৪
--------------------------
যাইহোক, গীতোক্ত সাধন পদ্ধতি সম্পর্কে এবার আমরা একটু বিস্তারিত আলোচনার মধ্যে প্রবেশ করবো। এইজন্য অষ্টম অধ্যায়ের সেই চারটি শ্লোক আমরা আরো একবার একটু শুনে নেবো।
কবিং পুরাণম অনুশাসিতারম অনোঃ অনীয়াংসম অনুস্মরেদ যঃ
সর্ব্বস্য ধাতারম অচিন্তরূপম আদিত্য বর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ (গীতা- ৮/৯)
সেই পরম পুরুষ সর্বজ্ঞ অনাদি, সর্বনিয়ানটা, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম, সবার বিধাতা, অচিন্তনীয়, আদিত্যবৎ স্বপ্রকাশ, এবং প্রকৃতির অতীত।
প্রয়াণকালে মনসাহচলেন ভক্তা যুক্তো যোগবলেন চৈব
ভ্রুবোর্মধ্যে প্রনাম-আবেশ্য সম্যক স তং পরং পুরুষম-উপৈতি দিব্যম । (গীতা- ৮/১০)
অর্থাৎ যদি কেউ মৃত্যুর সময় ভক্তিযুক্ত স্থির চিত্তে যোগবলের সাহায্যে প্রাণকে ভ্রূযুগলের মধ্যে ধারণ ক'রে, তাঁকেই স্মরণ করেন, তবে তিনি সেই দিব্য পরম পুরুষকে প্রাপ্ত হতে পারেন।
যদক্ষরং বেদবিদো বদন্তি বিশন্তি যদযতয়ো বীতরাগাঃ
যৎ-ইচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্য্যং চরন্তি তৎ তে পদং সংগ্রহেণ প্রবক্ষ্যে । (৮/১১)
-----------------
দেহতত্ত্ব ও লিঙ্গ সাধনা - ৫ SADHANA ON SUBTLE BODY -5
দেখুন আমাদের তথাকথিত মৃত্যুর সময় কি হয়, জীবাত্মা স্থূল দেহ করে, তার সমস্ত সংস্কার, এবং সুক্ষভূতগুলোকে সঙ্গে নিয়ে, সুক্ষ বা লিঙ্গ শরীরে স্থিত হয়। আসলে জীবিত অবস্থাতেও আমাদের এই যে সংস্কার বা সূক্ষ্মভুত সকল এরা নিজ নিজ সুক্ষদেহেই অবস্থান করে। যেমন মনের ভাবসকল মনোময় দেহে অবস্থান করে, তেমনি জ্ঞানসকল বিজ্ঞানময় দেহে অবস্থান করে। এখন স্থূল দেহ ত্যাগের সময় আমাদের যে সংস্কার অথবা ভাব প্রবল থাকে তাকেই পূর্বসঞ্চিত অন্য ভাবগুলোকে উদ্বুদ্ধ করে নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। অর্থাৎ প্রারব্ধ কর্ম্মের একটা পুঞ্জিকরন ঘটে। এবং সেই অনুসারে জীবের পরবর্তী গতিপথ নির্দিষ্ট হয়। আর এই প্রারব্ধ কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্যই পুনরায় উপযুক্ত স্থূল দেহ ধারণ করতে হয়।
অসত্যের রূপ অনেক, কিন্তু সত্যের রূপ একটাই হয়ে থাকে। সাধন জগতে সাধন পদ্ধতির অভাব নেই। যে যেমন ভাবের মানুষ, তার পথও সেই মতো হবে। উপনিষদে সাধন জগতে ওঙ্কারের গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে ওঙ্কারের উচ্চারণের আগে যেটা দরকার সেটি হচ্ছে সংযম। নবদ্বার সম্পন্ন এই শরীরে যে ছিদ্র আছে, তাকে বন্ধ না করতে পারলে, ওঙ্কারের সাধনা ফলপ্রসূ হয় না। এই নবদ্বারকে বন্ধ করতে গেলে, আমাদের বিভিন্ন বন্ধক্রিয়ার অভ্যাস করতে হয়। দেখুন মৃত্যুর সময় এই নবদ্বারের কোনো না কোনো একটা দ্বার দিয়েই শরীর থেকে জীবাত্মা নির্গত হয়ে থাকে। তো দ্বারবন্ধ প্রক্রিয়া আয়ত্ব করা ভিন্ন প্রণব উচ্চারনে বাঞ্চিত ফল, অর্থাৎ মৃত্যুহীন জগতের সন্ধান পাওয়া যায় না। এই বন্ধ ক্রিয়া গুলো সম্পর্কে যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিশেষ কিছু বলেন নি। এই বন্ধক্রিয়াগুলো সম্পর্কে হঠযোগ প্রদীপিকাতে বলা হয়েছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে বই পড়ে বা কারুর কাছ থেকে শুনে এইসব প্রক্রিয়ার অভ্যাস আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে ব্যহত করতে পারে। আর এই অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য যে সব ক্রিয়া করতে হয়, তা রুগী বা যোগী ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। বহুদিনের অভিজ্ঞতার দ্বারা এই বিদ্যা আয়ত্বে আসতে পারে। দেখুন, যোগক্রিয়া করবার জন্য, স্থান, কাল, আহার, ইত্যাদির একটা প্রভাব আছে। এছাড়া নাড়ীশুদ্ধি করবার পরেই কুম্ভক ক্রিয়া অর্থাৎ বন্ধক্রিয়া করতে হয়। এর পরে ধীরে ধীরে স্থূল ধ্যান, জ্যোতির ধ্যান, সূক্ষ্ম ধ্যান, সব শেষে সমাধির অভ্যাস করতে হয়। এই সমাধির মধ্যে আবার ধ্যানযোগ সমাধি, নাদযোগ সমাধি, রসানন্দ যোগসমাধি, লয়সিদ্ধিযোগ সমাধি, সবশেষে ভক্তিযোগ সমাধির কথা বলা হয়ে থাকে ।
যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং আমাদের উপনিষদের ঋষিগণ এই নাদযোগ সমাধির উপরে বিশেষ গুরুত্ত্ব দিয়েছেন। আমরা এই নাদযোগ সমাধির কথা শুনবো। তার আগে প্রারম্ভিক কিছু কথা আমরা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনে নেবো। দেখুন কিছুদিন পর্য্যন্ত মহাবন্ধ মুদ্রার অভ্যাস করলে, এক বিশেষ আবেশের ভাব, অর্থাৎ একটা অবশ অবস্থার সৃষ্টি হয় শরীরের মধ্যে। এই আবেশের ফলে শরীরের বাহ্যজ্ঞান লোপ পেয়ে যায়। তখন আমাদের ইন্দ্রিসকলের ঘরে তালা লেগে যায়। একেই বলে ইন্দ্রিয়ের প্রত্যাহার। কুম্ভকক্রিয়া ভালো ভাবে করতে পারলে, বায়ু স্তম্ভিত হয়ে সমান বায়ুর তেজকে বৃদ্ধি করে। আর এই সমান বায়ুর দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে দেহস্থিত সমস্ত নাড়ীসকল সুষুম্নায় একীভূত হয়ে যায়। এবং আমাদের শরীরের সমস্ত নাড়ীর মধ্যে যে বায়ু প্রবাহিত হচ্ছিলো তা প্রাণবায়ুতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। একেই বলে নাড়ীর রসের সাম্যাবস্থা। এই প্রাণবায়ু তখন সুষুম্না বাহিত হয়ে উর্দ্ধমুখী হয়। কিন্তু নাড়ীর মধ্যে যেখানে যেখানে গ্রন্থিচক্র আছে, সেখানে গিয়ে উর্দ্ধমুখী বা সরল রেখার বায়ুকে কুটিল বা বক্রাকার ধারণ করতে হয়। কিন্তু উত্তপ্তবায়ুকে নিম্নমুখী অত্যন্ত শক্তিসাধ্য। ফলত যখনই কোনো চক্রে গিয়ে প্রাণবায়ু দাঁড়িয়ে যায়, তখন শরীরের মধ্যে তাপপ্রবাহ বাড়তে বা কমতে থাকে। আর আমরা জানি, শরীরের তাপ অতিরিক্ত বেড়ে গেলে, বা শরীরের তাপ অতিরিক্ত কমে গেলে, অর্থাৎ শরীর অতিরিক্ত গরম হয়ে গেলে, বা অতিরিক্ত ঠান্ডা হয়ে গেলে, শরীর রক্ষা করা সম্ভব হয় না। এই অবস্থায় যদি কোনো ইন্দ্রিয়দ্বার খোলা থাকে তবে প্রাণবায়ু সেখান দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে দেহের নাশ ঘটিয়ে থাকে। এইজন্য বলা হয়, উপযুক্ত গুরুভিন্ন এই প্রক্রিয়ার অভ্যাস শুধু ক্ষতিকারক নয়, এতে দেহনাশের সম্ভাবনাও প্রবল।
যাইহোক, ইন্দ্রিয়সংযম হলে, তবেই আমাদের মনের সংযম অর্থাৎ মনের যে বহির্মুখী ভাব, তার নিবৃত্তি আপনা থেকে হয়ে যায়। আসলে ইন্দ্রিয়গুলোই মনকে বহির্মুখী করেছিল। এখন ইন্দ্রিয়সকল রুদ্ধ হওয়াতে মন নিষ্ক্রিয় হয়ে অবস্থান করছে। এখন কথা হচ্ছে, মন যে নিরোধ হলো, এই মনের অবস্থান কোথায় ? এই মনের অবস্থান হয়, তখন হৃদয়-আকাশে। আর এই হৃদয় আকাশে মন যখন স্থির হয়, তখন আমাদের সংস্কারগুলো দৃশ্যমান হয়ে স্বপ্নের মতো মনঃচক্ষুর সামনে ভাসতে থাকে। মন তখন সূক্ষ্ম প্রাণের সাথে আমাদের বাসনার রাজ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকে। আর এই বাসনা দৃশ্য অনুযায়ী মনের মধ্যে বিভিন্ন ভাবের উদয় হতে থাকে। এইসময় সাধকের মধ্যে কোনো বাহ্য-জগতের অনুভূতি থাকে না। কেবল মনঃজগতের দর্শন হয়ে থাকে। এখন কথা হচ্ছে, সাধককে এই অবস্থা থেকে অর্থাৎ মনকে এই সংস্কারের জগৎ থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু কিভাবে ?
এই অবস্থায়, মনকে হৃদয় থেকে প্রাণবায়ুর বাহনে চাপিয়ে আজ্ঞাচক্রে নিয়ে আসতে হবে। আজ্ঞা চক্র অর্থাৎ ভ্রূমধ্য থেকে মূর্ধা পর্যন্ত যে স্থান, সেখানে নিয়ে আসতে হবে। এই কাজ অত্যন্ত কঠিন। কারন মন এইসময় কিছুতেই হৃদয়-আকাশ থেকে অর্থাৎ সংস্কারের জগতের দৃশ্য-মাধুর্য্য থেকে বেরিয়ে আসতে চায় না। আর যে আসতে চায় না, তা তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া শুধু কঠিন নয়, অনেকসময় অসম্ভব হয়ে ওঠে। এইসময় সৎগুরু তার শিষ্যকে দৈহিক নির্যাতন করে থাকেন।
যাইহোক, ইন্দ্রিয় দ্বার সংযম, ও মনকে নিরুদ্ধ করা সম্পর্কে আমরা একটা আভাস পেলাম। এইসময় প্রাণের বহুমুখী ধারা একত্র হয়ে মিলে যায়। অর্থাৎ সুষুম্নাবাহিত হয়ে ভ্রূমধ্যে মিলিত হয়। এবং এখানে স্থির হতে শুরু করে। অর্থাৎ যে ধারা ছিলো একসময় মূলাধারস্থিত ত্রিবেণী সঙ্গমে, এখন সেই ধারা ভ্রূমধ্যের ত্রিবেনীতে এসে মিশেছে। তো প্রথমে সে মূলাধার থেকে হৃদয় আকাশে এসেছিলো, এখন সে নিরুদ্ধ হয়ে আজ্ঞাচক্রে মিলিত হলো। এই অবস্থা সাধকের জড়বৎ অবস্থা। এইসময় জ্ঞান বা অজ্ঞান কিছুই থাকে না। জ্ঞান ও অজ্ঞানের মাঝামাঝি অবস্থায় অবস্থান করে। যদিও দেহ ধারনের উপযোগী শ্বাসক্রিয়া অর্থাৎ প্রাণক্রিয়া চলতে থাকে। কিন্তু মন যেমন স্থির হয়েছে, তেমনি প্রাণ তার নিজের কাজ থেকে অব্যাহতি নিয়ে আজ্ঞাচক্রে স্থির হয়ে গেছে। অর্থাৎ আমাদের কর্ম্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয় এমনকি প্রাণের নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়ার দরুন, শরীর শব-অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছে। যদিও এই যে স্থিরতা এটি তমোগুণের প্রভাবে ঘটে থাকে। এর পরে ধীরেধীরে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের রাস্তা আপনা থেকেই খুলে যায়। সেই আলোচনা আমরা পরবর্তী দিন করবো।
-------------------
দেহতত্ত্ব ও লিঙ্গ সাধনা - ৬ SADHANA ON SUBTLE BODY -৬
ওঙ্কারের সাধনা করতে গেলে, আগে সাধনা ও ওঙ্কার দুটোকেই আমাদের একটু বুঝে নিতে হবে। ওঙ্কার হচ্ছে ধ্বনি বা শব্দ। আর সাধন হচ্ছে, এই ওঙ্কারের ধ্বনিকে বোধের মধ্যে জাগিয়ে তোলা। তো ধ্বনি আসলে একটা গুন্, আর সেই গুনকে নিজের মধ্যে জাগিয়ে তোলাই হচ্ছে সাধনা। এই শব্দ হচ্ছে আকাশের গুন্। তো শরীররূপ এই আকাশের মধ্যে তরঙ্গের মতো প্রবাহিত হচ্ছে বায়ু ও জল ইত্যাদি চতুর্ভূত। আবার বায়ু ও জল ও তেজ তিনি মিলে জীবনীশক্তি, বা প্রাণশক্তি উৎপন্ন হচ্ছে। পৃত্থি দেয় পুষ্টি। অন্যদিকে ব্রহ্মের দ্বারপাল হচ্ছে চেতনা। এই চেতনার একটা অংশ আমরা ইন্দ্রিয়ের ভিতরে পেয়ে থাকি। বলা হয়, ব্রহ্ম ইন্দ্রিয়ের অতীত। কিন্তু আমাদের চেতনশক্তি ইন্দ্রিয়লব্ধ। তাই ব্রহ্মকে আমরা যেমন ইন্দ্রিয়ের অতীত অবস্থায় পেতে চাই, তেমনি তাঁকে ইন্দ্রিয় দিয়েও পেতে হবে। ইন্দ্রিয়গুলোকে বাদ দিয়ে যে অনুভূতি তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। তাই ব্রহ্মকে যদি বাস্তবের জগতে টেনে নামাতে হয়, তবে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে বাদ দিয়ে তা সম্ভব নয়। এই ইন্দ্রিয় আমাদের দুই ধরনের এক- ৫টি কর্ম্মেন্দ্রিয়, দুই- ৫টি জ্ঞানেন্দ্রিয়। এর সঙ্গে আছে মন নামক অন্তরেন্দ্রিয়। ঋষিগণ ব্রহ্মসন্ধানে এর মধ্যে পাঁচজনকে বিশেষ গুরুত্ত্ব দিয়েছেন। বলছেন, এরাই ব্রহ্মকে পাহারা দিচ্ছেন। এই পাঁচজন হচ্ছেন, বাক, চক্ষু, শ্রোত্র ,প্রাণ ও মন। এই পাঁচজনকে নিয়ে আমাদের সাধন সমরে নামতে হবে। এই পাঁচজনকে পরাজিত করতে হবে।
প্রাণের স্পন্দন হেতু জীবনবোধের জাগরণ হচ্ছে। এই যে জীবনবোধ একেই বলা হচ্ছে ব্রহ্মের প্রকাশ। এই প্রাণকে উর্দ্ধস্রোতা করতে হবে। হৃদয় থেকে প্রাণের স্রোত যখন মস্তক দেশে এসে উপস্থিত হয়, তখন প্রাণ সপ্তধা বিস্তীর্ন হয়। ৭টি ইন্দ্রিয় দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে, এই ৭ টি হচ্ছে, দুটো কানের ছিদ্র, দুটো চোখের ছিদ্র, দুটো নাকের ছিদ্র, এবং একটা মুখ।
তো হৃদয় স্থিত প্রাণ মস্তকে গিয়ে সেখান থেকে নিজেকে প্রকাশ করবার জন্য, সাতটি ধারায় বিকিরিত হচ্ছে। দুটি ধারা চক্ষু প্রদেশে এসে বিশ্ব জগৎ দর্শন করছে । দুটো নাসারন্ধ্র দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস রূপে ব্যাষ্টিপ্রাণের রূপ নিয়েছে। দুটি ধারা কর্ণকুহরে এসে শ্রবন শক্তি রূপে শব্দব্রহ্ম-এর আস্বাদন করছে, একটি ধারা বাকে অর্থাৎ মুখে প্রকাশ হচ্ছে।
দেখুন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে বায়ু মন্ডল সে বায়ুমণ্ডল আমার শরীরে প্রবেশ ক'রে, একটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যষ্টিপ্রাণের রূপ নিয়েছে। বায়ু যখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ব্যাপ্ত হয়েছিল, তখন ছিলো ব্যাপক, অনন্ত বা বলা যেতে পারে প্রাণের একটা সম্মিলিত অবস্থা। আর এই বায়ু যখন আমার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করলো, তখন হয়ে উঠলো, সমষ্টি প্রাণ থেকে আলাদা একটা স্বতন্ত্র সত্ত্বা। অধ্যাত্ম দৃষ্টিতে প্রাণ হচ্ছে একটা অমৃত ধারা যা জীবনকে রসময় করে তুলেছে। উপভোগ্য করে তুলেছে। যদি কখনো এই দেহে প্রাণের এই অমৃত ধারার স্রোত উন্মুক্ত হয়ে যায়, অর্থাৎ প্রাণের ফোয়ারার মুখ খুলে যায়, তখন তা হয়, ব্রহ্ম সংস্পর্শ। এই যে প্রাণের বিশেষ ধারা একে যোগীপুরুষগন বলে থাকেন ব্যান বায়ু। যাইহোক, এই প্রাণ ও প্রজ্ঞা আসলে এক। প্রজ্ঞা অর্থাৎ প্রতক্ষ্য উপলব্ধি। প্রাণ ও প্রজ্ঞা যতক্ষন আলাদা থাকে, ততক্ষন আমাদের সাধন ভজন প্রাণহীন। প্রানহীনের উপলব্ধি বলে কিছু থাকে না। তো প্রাণ ও প্রজ্ঞা (প্রজ্ঞা হচ্ছে সত্যিকারের উপলব্ধ জাত জ্ঞান) যখন এক হয়ে যায়, তখন সাধনা সার্থক হয়। অর্থাৎ আমাদের প্রতক্ষ্য উপল্বদ্ধির যে নির্যাস সেটাকে যদি সাধক দেহ-মনে নামিয়ে না আনতে পারে, তাহলে উপলব্ধি কিছুতেই সম্পূর্ণ হতে পারে না। তো ভূত প্রাণ ও প্রজ্ঞা। ভূত অর্থাৎ শরীর, প্রাণ অর্থাৎ জীবনীশক্তি, আর প্রজ্ঞা অর্থাৎ প্রতক্ষ্য অনুভূতি এই তিন যখন একত্রিত হয়, তখন হয় ভূতশুদ্ধি। অর্থাৎ এমন একটা দেহ-মন হবে, যেখানে ব্রহ্মানুভূতি সতত বিরাজ করবে।
যদিও আমাদের এই যে দেহ, এ আসলে সাধনার সহায়ক মাত্র, সাধক নয়। সত্যিকারের সাধক হচ্ছে আমাদের মন। এই মনকে আপনি বলতে পারেন যজমান। এই যে মনের কথা বলা হচ্ছে, এটি কোনো ইন্দ্রিয় নয়, এটি আসলে একটা বোধশক্তি। মনের মধ্যে পাওয়া, হৃদয়ের মধ্যে পাওয়া আর প্রাণের মধ্যে পাওয়া আসলে একই কথা। দেখুন বিচারের দ্বারা যাকে পাওয়া যায়, তা আসলে সত্যিকারের পাওয়া নয়। কিন্তু হৃদয় বোধে যখন আসে, তখন সেই সাধনা জীবন্ত হয়ে ওঠে, প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। একটা কিছু পাওয়া, যা আমাকে পেয়েছে। ঈশ্বর বা ভগবান কোনো কল্পিত বস্তু নয়, ঈশ্বর উপল্বদ্ধির বিষয়। আর এই উপল্বদ্ধিতেই মন প্রসন্ন হয়। সমস্ত ইন্দ্রিয়সকল প্রসন্ন হয়।
আপনি হয়তো বলবেন, যা ইন্দ্রিয়গোচর নয়, তাকে ইন্দ্রিয় দিয়ে পাওয়া কি করে সম্ভব ? দেখুন ব্রহ্ম হচ্ছেন, বৃহৎ একটা চেতন শক্তি যা সূর্য্যের মতো চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে। আমাদের যে আত্মচেতনা, বা ব্যষ্টি চেতনা, তা আসলে সেই সমষ্টি চেতনার একটা অংশ মাত্র। সূর্য থেকে যেমন রশ্মি, অগ্নি থেকে যেমন স্ফুলিঙ্গ, তেমনি চেতনা থেকে স্ফূরিত হচ্ছে জ্ঞানরশ্মি বা চেতন রশ্মি। এই চেতন রশ্মি যখন আমাদের শরীরের মধ্যে স্ফূরিত হচ্ছে, আর তা পরিণত হচ্ছে বাক-এ। আমরা যে শব্দ ধ্বনি বা বাক্য শ্রবণ করছি তাকে বলা হয়, বৈখরী। এই বাক একসময় থাকে আমাদের ভাবনার মধ্যে। এই ভাবনাকে যদি আমরা ধরতে পারি, তবে সাধনার প্রথম পাদ সিদ্ধ হয়। একেই বলে মধ্যমা। এই মধ্যমাকে ধরতে পারলে, তখন আমাদের মধ্যে একটা ভাবের প্রবাহ, স্মৃতির প্রবাহ চলতে থাকে। এই সময় মন বা সাধকের বাহ্যত কিছুই করবার থাকে না, কিন্তু মন কাজ করে। এই যে ভিতরে ভিতরে একটা বাকের প্রবাহ একে বলে পশ্যন্তি। বৈখরীতে নাম-রূপ। জপ থেমে গেলে, মধ্যমাতে হয় ধ্যান, এর পরে পশ্যন্তিতে হয় দর্শন, শেষে পরায় হয় স্থিতি। অর্থাৎ পশ্যন্তি থেকে বাক যখন গভীরে প্রবেশ করে, তখন মহাশক্তির একটা স্পন্দন অনুভব হয়, একেই বলা হয়, পরাবাক। বৈখরী থেকে পরাবাক - এ স্থিতি মানে একটা মহাশক্তিকে অনুভব করা।
এই ব্যাপারটা আমরা আরো একবার একটু বুঝে নেই। বাক যখন প্রকাশিত হয় অর্থ আকারে, তখন তা বৈখরী। এই বৈখরী একসময় থাকে মনের মধ্যে চিন্তন আকারে তখন তা মধ্যমা । এই চিন্তা যখন দৃশ্যের আকার নেয়, তখন তা পশ্যন্তি। এই দৃশ্য তৈরির পিছনে যে গুহ্য রহস্যঃ তা হচ্ছে পরাবাক । চৈতন্য পুরুষের পরাশক্তি হচ্ছে পরাবাক। এই পরাবাকের মধ্যে যখন বিক্ষুব্ধ ভাব বা গতি এলো, তখন তা পশ্যন্তি বাক, সেই দৃশ্য যখন ভাব রূপে অভিব্যক্ত হলো, তখন তা শক্তি ও বিষয়ের মাঝামাঝি এলো, তখন তা মধ্যমা। আর এই শক্তি যখন জামট বাধ্লো, তখন হয়ে উঠলো, বাইরের এই জগৎ, একেই ঋষি গন বলছেন, বৈখরী।
ওঙ্কারকে উদ্গীথ রূপে সাধনা করবার কথা বলা হয়েছে, আমাদের উপনিষদে। উদ্গীথ হচ্ছে বাকের মূল সুরকে আবিস্কার করা। বৃহতের বীজমন্ত্র সেই ওঙ্কার থেকেই বাকের স্ফূর্তি। এই স্ফূর্তিকে অনুভব করাই, বাকসাধনার উদ্দেশ্য। অন্তর্মুখী হয়ে শূন্য হৃদয়ে সেই স্পন্দনকে অর্থাৎ উদ্গীথ-এর সুরকে অনুভব করতে হয়। একে আবিষ্কার করতে হয়। তখন ওঙ্কারের সুরের ছন্দে ছন্দে একটা হিল্লোল ওঠে। এই হিল্লোলের সঙ্গে নিজেকে হিল্লোলিত করাই বাক-সাধনা।
এবার আমরা ওঙ্কারের সাধনার গভীরে প্রবেশ করবো।
দেহতত্ত্ব ও লিঙ্গ সাধনা - ৭ ভাব শরীরের সাধনা - বাউল সাধনার ভীত - SADHANA ON SUBTLE BODY - SEVEN PARTমূলসূত্র : বাংলার বাউল - অধ্যাপক উপেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য্য।
বাংলার গ্রামে গঞ্জে যাদের বাস তাদের এই অভিজ্ঞতা হয়তো আজও হয়। শীতের সকালে যখন সারা গ্রাম লেপের তলায় গুটিশুটি মেরে আছে , তখন এক বাউল দম্পতি এক হাতে দোতারা বা খঞ্জনি বা করতাল বাজিয়ে পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নেচে গেয়ে পাড়ার লোকের ঘুম ভাঙাতো। আজও এই গ্রামের দিকে এই দুর্লভ মুহূর্ত হয়তো অধরা নয়। আমার গ্রামেও ছোটবেলা এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিযে ভালো লাগতো তা ভাষায় বলা সম্ভব নয়। নিঃশব্দ গ্রামে এই মধুর ধ্বনি আমার মন কেড়ে নিতো। এঁরা কখনও দেহতত্ত্বের গান, কখনো রাধা কৃষ্ণের বা গৌড় লীলা সঙ্গীত গেয়ে মাধুকরী করতো। এদের চাহিদা ছিল, অতি সামান্য। এঁরা গ্রামের মানুষের কাছে অপরিচিত নয়। যেন কতো আপনার লোক ছিল এঁরা। ভিক্ষা করেই এরা জীবন ধারণ করতো।
পরে বড়ো হয়ে বুঝেছি, এঁরা নিতান্ত আর পাঁচজন ভিখারীর মতো নয়, এরা একটা বিশেষ ধর্ম্ম সম্প্রদায়ের লোক। এদের একটা সাধন জীবন আছে, আর এদের সাধন পদ্ধতি গূঢ় রহস্যে ভরা। এরা না হিন্দু না মুসলমান। এঁরা সবার কাছে সমাদর পেয়ে থাকেন । এদের সাধন পদ্ধতি প্রকাশে আলোচিত হয় না। কেবল গানের মধ্যে ভাসা ভাসা একটা আভাস দেওয়া হয়। এদের গানগুলো, আমাদের কাছে পরিচিত, কিন্তু অর্থ পরিষ্কার নয়। খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়, বাড়ির কাছে আরশীনগর, এক পড়শী বশত করে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে, ও সে কথা কয় রে দেখা দেয় না।
একটা গানের কথা খুব মনে পরে,
"এই মানুষে মানুষ আছে,
করণ ধরে নাওগো বেছে
অটল মানুষ যে ধরেছে,
তার কি আছে তুলনা।
খেলছে মানুষ বাঁকানলে
দুলছে মানুষ হৃদকমলে,
অটল মানুষ উজান চলে,
দ্বিদলে তার যায় গো জানা।"
এসব গান কে লিখেছেন , কেইবা সুর দিয়েছেনা তা আমার জানা নেই। তবে এইসব গানের মধ্যে একটা মাদকতা আছে, একটা গূঢ় রহস্য, একটা গভীর তত্ত্বকথা লুকিয়ে আছে, তা আমাকে বিস্মিত করতো। যাইহোক, এখন বুঝি -
এই স্থূল মানুষের মধ্যে আরো একটা সূক্ষ্ম মানুষ আছে। একে কেউ বলে আত্মা, কেউ বলে ব্রহ্ম, কেউ বলে মনের মানুষ। এই মানুষই আসল আমি। এই মানুষ সবার মনের মধ্যে অবস্থান করছেন । কেউ বলেন, হৃদয়ের মধ্যে এর অবস্থান । চার যুগ ধরে কত মুনি ঋষি, সাধু সন্ন্যাসী, বাউল ফকির, জ্ঞানী অজ্ঞানী, ভালো মন্দ সবাই এই মানুষটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এঁকে আমরা সবাই বুঝতে পারি, কিন্তু জানতে পারি না। কেউ কেউ এঁকে দেখতে পারেন, কিন্তু হাতের নাগালে আনতে পারেন না। বেদ-বেদান্তে এর কথা আছে, কিন্তু আমাদের কাছে এসব কল্প-কথা মাত্র। কেউ কেউ এই মনের মানুষের অপূর্ব লীলা প্রতক্ষ্য করেছেন। এই মনের মানুষই কখনো, পিতা-মাতা, কখনো স্বামী-স্ত্রী কখনো পুত্র-কন্যা কখনও সখা রূপে আস্বাদিত হয়। এই ভিতরের মানুষটাই বাইরের মানুষটাকে অভিব্যক্ত করছে। এর মধ্যে দিয়ে কখনো শাস্তি, কখনো শান্তি উপভোগ করছে। এঁকেই কেউ বলেন, শ্রীকৃষ্ণ, কেউ বলেন কেউ বলেন বিষ্ণু, কেউ বলেন পূর্ণব্রহ্ম, কেউ বলেন পরমাত্মা।
তো দুটো মানুষ আছেন, কেউ এঁকে বলেন রাধাকৃষ্ণ, কেউ বলেন হর-পার্বতী, কেউ বলেন লক্ষ্মী-নারায়ণ। এই এক মানুষের মধ্যেই দুটো মানুষ আছেন । যার জ্ঞান উন্মীলন হয়েছে, তার কাছে এই দুটো মানুষ দৃশ্যমান হয়। একটা স্থূল রূপে আছে, আর একটা ছায়া রূপে আছে। এই ছায়া কখনো দেখা যায়, আবার কখনো মিলিয়ে যায়। দেহের মধ্যেই ঘর বেঁধে দুজনেই বাস করছে। একজন নিভৃতে একজন প্রকাশ্যে। এইযে মনের মানুষ ইনি যোগের সময় আবির্ভূত হন। শুদ্ধ দেহধারী, শান্ত স্থিতপ্রজ্ঞ পুরুষ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তাঁকে দেখতে পান। এই মানুষ কখনো মূলাধারে, কখনো আজ্ঞাচক্রে লীলা করছেন। আর এই আজ্ঞা চক্র থেকে মূলাধারে যাতায়াতের সময় তিনি, কখনো মনিপুরে, কখনো অনাহতে, কখনো বিশুদ্ধে সাময়িক সময়ের জন্য থেমে যান। সুষুম্না নাড়ীতে গমনাগমন ক'রে নানান লীলা প্রদর্শন করেন। কেবল যোগক্রিয়া দ্বারাই এই লীলা উপল্বদ্ধিতে আসে। এই মেরুদন্ডস্থিত সুষুম্না নাড়ীকে ইড়া পিঙ্গলা নামক দুটো নাড়ী বেষ্টন করে আছে। এই যে তিনটি নাড়ী অর্থাৎ ইড়া পিঙ্গলা ও সুষুম্না নাড়ী বেষ্টন করে আছে, এটি যেন একটা বেণী - ত্রিবেণী। এই নাড়ী সকল মেরুদন্ড দিয়ে এঁকে বেঁকে উঠেছে, আবার এর মধ্যে আছে সূক্ষ্ম ছিদ্র, তাই বাউলরা বলেন, বাঁকানল।
মনের মানুষকে ধরবার এই সাধনা গোপন। তথাপি আভাসে ইঙ্গিতে বাউলদের গানে এই সাধনপদ্ধতির কথা প্রকাশ পেয়েছে। সাংকেতিক ও ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় এই গোপন সাধনকথা আলোচিত হয়েছে। আমরা এই অতিগোপন সাধনপদ্ধতির একটা অস্পষ্ট রূপ আকবার চেষ্টা করবো। তবে একটা কথা বলি, মেঘের মধ্যে যে ছবি ভেসে উঠছে, তাকে ধরবার জন্য একটা ভাবুক চোখের দরকার পড়ে। এই ভাবুক চোখ যার নেই, তার পক্ষে মেঘের মধ্যে শিবকে বানর হিসেবে দেখা অসম্ভব কিছু নয়। এই জন্য এই বিদ্যাকে বলা হয়, অতি গোপন বিদ্যা। কথায় বলে, "আপন ভজন কথা, না কহিবে যথাতথা, আপনাকে আপনি হবে সাবধান।" বাউল কবি পদ্মলোচন বলছেন "যে জানে না উপাসনা, সে যেন পদ্মলোচনের পদ শোনে না।" এই সাধন ক্রিয়া পদ্ধতির কথা শুনলে, মনের মধ্যে জাগতে পারে ঘৃণা, নিন্দা। তাই এই পথের সাধক ভিন্ন অন্য কেউ এই গোপন কথা যেন না
শোনেন ।
দেহকে কেন্দ্র করেই এই সাধনা। এঁরা বলে থাকেন "যা নেই ভান্ডে, তা নেই ব্রহ্মাণ্ডে।" আবার সাধন ভজন হবে, বর্তমানে, সাধনার না আছে, ভবিষ্যৎ, না আছে অতীত। এখানে সবই বর্তমান। এখানেই এক্ষুনি, এই দেহেই সাধন করে মনের মানুষকে ধরতে হবে। ঈশ্বর আছে, এই দেহের মধ্যে, বাইরের ঈশ্বরের খোঁজ করে কি হবে ? আর যদি এই দেহের মধ্যে ঈশ্বরকে না পাওয়া যায়, তবে জানবেন, কোথাও আপনি ঈশ্বরকে খুঁজে পাবেন না। যাইহোক, আমরা সাধনার বিস্তারে যাবো না। কারন এই সাধনা শ্রীগুরু সান্নিধ্যে করতে হবে। গুরুবিনা এই সাধনা নিষিদ্ধ। তথাপি এই সাধনার একটা আভাস আমরা শুনে নেবো।
বলা হচ্ছে, পরমাত্মা পরব্রহ্ম প্রথমে এক ছিলেন। এইসময় তিনি রস আস্বাদন করতে পারছিলেন না। তাই তিনি নিজেকে প্রকৃতি ও পুরুষ রূপে দ্বিধা বিভক্ত করলেন। এই যে প্রকৃতির সৃষ্টি এঁকে উপনিষদ বলছে প্রজাপতির রমন-ইচ্ছে থেকে এই প্রকৃতির উদ্ভব। এখন কথা হচ্ছে, কী সেই রস যা তিনি আস্বাদন করতে চেয়েছিলেন ? এই রস হচ্ছে শৃঙ্গার রস। যা সমস্ত রসশ্রেষ্ঠ। প্রকৃতি হচ্ছে মধুর রসের আধার। প্রকৃতির মধ্যে এই যে মাধুর্য্যরস, তার স্থূল প্রকাশ হচ্ছে রজঃ। এই রজঃই পুরুষ থেকে প্রকৃতিকে আলাদা করেছে। এই রজঃশক্তির কারনেই প্রকৃতি সৃষ্টির যে মূলতত্ত্ব সেই রতিবিলাস ঘটে থাকে। আর এই কারনেই প্রকৃতি একাধারে জননী (সৃষ্টিশক্তি) অন্য দিকে আনন্দ-লীলা প্রদায়িনী (রমণী)
এই যে এক ব্রহ্ম, প্রকৃতি ও পুরুষ রূপে দ্বিধা বিভক্ত হলেন, এর কোনো অংশ অন্য অংশ থেকে পৃথক নয়, উভয়ের মধ্যে উভয়ের অংশ রয়েছে। পুরুষের দেহে শুধু পুরুষ নয়, এর মধ্যে আছে প্রকৃতির অংশ। আবার প্রকৃতির মধ্যেও আছে সেই পুরুষের অংশ। তো পুরুষ যেমন দুই তত্ত্বের আধার, তেমনি প্রকৃতিও দুই তত্ত্বের অভিন্ন আধার। সেই এক পরম পুরুষ দুই দেহে প্রচ্ছন্ন থেকে লীলা-রস আস্বাদন করছেন।
তো প্রকৃতির সত্তা যেমন রজে, পুরুষ সত্তা তেমনি শুক্রে বা বীজে। এই রজঃ-বীর্যের মিলনে সৃষ্টি। আবার এই রজঃ-বীর্যের মিলন ক্রিয়াই শৃঙ্গার-বিলাস। আমাদের দেহের মস্তিষ্কে সহস্রদল পদ্মে বীজরূপে পরমাত্মা অবস্থিত। স্বরূপত তিনি স্থির, অচঞ্চল, নিস্তরঙ্গ। কিন্তু তিনিই আবার লীলাকারী বলে বীজরূপী পরমপুরুষ রজরূপী প্রকৃতির সঙ্গে মিলিত না হয়ে থাকতে পারেন না। তাই রজঃ প্রবর্তনের তিন দিন তিনি মস্তক থেকে নেমে, রজের সঙ্গে মিলিত হয়ে, প্রকৃতির মূলাধারে আত্মপ্রকাশ করেন। রজের সঙ্গে তিনি মিলিত হন বটে, কিন্তু রজঃ ও বীর্যের স্বরূপ থাকে ভিন্ন মুখী। রজঃ অগ্নিময়ী, সৃষ্টি রূপিণী, আকর্ষণকারিনী, কাম-স্বরূপিণী। কিন্তু বীজ অচঞ্চল প্রেম স্বরূপ। জল ও দুধের মিলনের মতো কাম ও প্রেমের মিলন। এই কাম-প্রেমের মিশ্রনে জীব। এখন এই কাম ও প্রেমকে আলাদা করতে হবে। জল হচ্ছে কাম, আর দুধ হচ্ছে বীজ। এই যে অচঞ্চল বীজ একেই বলে মনের মানুষ। কেউ বলেন সহজ মানুষ। তো মনের মানুষের আবির্ভাব আছে প্রকৃতির রজঃশক্তিতে। প্রকৃতির দেহ আঁধারে প্রতিমাসে তিন দিনের জন্য এই আবির্ভাব ঘটে থাকে। আবার চতুর্থ দিনে তিনি তার নিত্যধামে প্রত্যাবর্তন করেন।
এই তিন দিন সাধক মনের মানুষকে ধরবার জন্য সাধনা করে থাকেন। তিন দিন হচ্ছে মনের মানুষ ধরবার সাধনার উৎকৃষ্ট সময়। এইসময় সাধকের অনুভূতিতে সহজ বা মনের মানুষের স্বরূপ ধরা পড়ে, যা সাধকের নিজস্ব অনুভূতি। শৃঙ্গার কালে বীজ উদ্ভূত আনন্দের অনুভূতি, আর এই আনন্দের অনুভূতিকে যোগক্রিয়ার দ্বারা ক্রমাগত উর্দ্ধমুখী ক"রে, দ্বিদল পদ্ম পর্যন্ত ওঠাতে পারলে, নিস্তরঙ্গ বীজরূপী ঈশ্বর-রুপের সঙ্গে অর্থাৎ লীলাময় সহজ মানুষের শৃঙ্গার-আনন্দের অনুভূতি জাগে। তো পরমতত্ত্ব স্বরূপ সেই পরমাত্মা এই প্রকৃতি-পুরুষ মিলন ক্ষনে মহা উল্লাসে অবস্থান করেন। এই অবস্থাতেই পরমতত্ত্বের সঙ্গে নিজেকে একাত্মবোধ হয়। একেই বলে আত্মপলব্ধি। আত্মজ্ঞানের অবস্থা।
বাউলদের সাধনার গুহ্যতত্ত্ব আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়, কারন এই তত্ত্ব কথা এঁরা সাধারনের সম্মুখে আলোচনা করেন না। যদিও বাঁকা কথায় গানের মধ্যে এই গুহ্যতত্ত্ব লুকিয়ে আছে। অধ্যাপক উপেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য্য প্রায় কুড়ি বৎসর এদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে এই তত্ত্বকথা লিপিবদ্ধ আকার দিয়েছেন। আমরা তাঁর সেই বই অর্থাৎ বাংলার বাউল ও বাউল গান গ্রন্থ থেকে তত্ত্বকথার নির্যাস টুকু শুনবার চেষ্টা করবো। এই পথে হাত কিছু সহজ সাধ্য নয়, এর জন্য দরকার যেমন উপযুক্ত গুরু তেমনি একজন সাধন সাথী। এর কোনোটাই আমাদের নেই, তাই আমরা কেবল গল্পের মতো করে শুনবো সেই গোপন বিহার।
প্রথমে আমরা কিছু সাংকেতিক শব্দের কথা শুনে নেই।
মহাযোগ : প্রকৃতির তিন দিনের রজঃপ্রবৃত্তিকে এঁরা বলেন মহাযোগ। এই সময় এঁদের মানুষ ধরবার সাধনকাল। কেউ এই সময়টাকে বলে অমাবস্যা, অম্বুবাচী ইত্যাদি।
ত্রিবেণী : গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী এই হচ্ছে তিনটি নদী বা নাড়ী। অর্থাৎ আমাদের শরীরে যে ইড়া পিঙ্গলা ও সুষুম্না নাড়ী আছে - তার যে মিলন স্থান অর্থাৎ গ্রন্থিচক্রকে এঁরা বলেন ত্রিবেণী।
ফুল : যাঁরা যোগশাস্ত্র পড়েছেন, তাঁরা জানেন, আমাদের মাথা থেকে মেরুদন্ড বাহিত হয়ে গুহ্যদ্বার পর্যন্ত বিভিন্ন চক্র আছে, যেগুলো আসলে বিভিন্ন নাড়ীর সন্ধিস্থল। এর মধ্যে সর্ব্বনিম্নে আছে মূলাধার। এই মূলাধারে অর্থাৎ যেখানে রজের আবির্ভাব হয়, তখন এই স্থানকে বলে ফুল। কেউ বলেন, যোনি পদ্ম, কেউ বলেন রাধা পদ্ম।
নির ও ক্ষীর : রজঃ আসলে জলীয় পদার্থ। কেউ বলেন, কারন বারি। এই কারণ বারিতেই আছে সৃষ্টির বীজ। সমস্ত জীব সৃষ্টির মুলে আছে এই রজঃ ও বীর্য বা শোণিত ও শুক্র। সমস্ত স্থূল দেহের মূল উপাদান এটি। শোণিত হচ্ছে মাতৃশক্তি, আর শুক্র হচ্ছে পিতৃশক্তি। এই দুই শক্তির মিলিত সত্তাকে বলে মানবসত্তা। এই মানব সত্তাকেই বাউলদের কাছে অধরা মানুষ, সহজ মানুষ ইত্যাদি ইত্যাদি। বাউলরা এই শুক্রকেই বলে ক্ষীর আর রজঃকে বলেন, নীর। বাউলরা বলে থাকে এই নীর ও ক্ষীরে সহজ মানুষ লীলা করছেন। নীর হচ্ছে শক্তিরূপিণী, মায়া, মহামায়া, মূলা, প্রকৃতি। এই শক্তি যখন কুন্ডলিনীতে ক্রিয়া করে, তখন তাকে বলে রতি। এই রতিতে আছে দেহাকর্ষণ রূপ কাম। এই কাম চঞ্চলমতি . অন্যদিকে ক্ষীর হচ্ছে অচঞ্চল আনন্দময় প্রেমের অবস্থা। তো এই কাম ও প্রেম, অর্থাৎ নীর ও ক্ষীর একাধারে একত্রে মাইল মিশে একাকার হয়ে আছে। যেমন দুধে-জলে মিশে আছে। একে সহজে পৃথক করা যায় না। তার জন্য হয় আপনাকে রাজহংস হতে হবে, নতুবা অগ্নির সাহায্য নিতে হবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে অগ্নির সাহায্য নিয়ে দুধ পাওয়া গেলেও জলকে আর পুরের ন্যায় তরল অবস্থায় পাওয়া যাবে, তখন জল বাষ্পীভূত হয়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যাবে। তাই হতে হবে রাজহংস। বাউল সাধকগণ ত্রিবেণীর সঙ্গমে এই নির-ক্ষীর নদীর তীরে একাগ্র চিত্তে অপেক্ষা করেন।
প্রকৃতির এই কারণবারিতে আছে রাগ রূপ কাম। তো এই কামের রাস্তা ধরে যে সাধনা তাকেই বলে বাউল সাধনা। তাই বাউলরা সাধনাকে বলে রাগের ভজন। মনের মানুষকে তারা তাই বলে রাগের মানুষ।
চন্দ্র : অর্থাৎ শুক্র বা সহজ মানুষ বা প্রেম ইত্যাদি বোঝায়। পঞ্চভূতের সম্মেলনে এই দেহ ব্রহ্মান্ড। এই পঞ্চভূতের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে উদ্ভূত হচ্ছে, মল, মূত্র, শুক্র, রজঃ ও শোনিত। এ সবই রস ছাড়া কিছু নয়। এই রসের ভিয়ান করাই বাউল সাধনার প্রধান কাজ।
দেহের মধ্যে যে রসের খেলা চলছে তা বাউলদের চঞ্চল করছে। কখনো কটু, কখনও কষা, কখনো তিক্ত কখনো লবনাক্ত, কখনো অম্ল কখনো মধুর। এই রাসের খেলা চলছে শরীরে, কখনো হাসি, কখনো কান্না, কখনো বিস্ময়, কখনো ভয়, কখনো আশঙ্কা, কখনো অহঙ্কার।
বাউলদের এই দেহ সাধনা অদ্ভুত। দেহের প্রতিটি অঙ্গের সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করে একাত্ম হয়ে তারা প্রাকৃত মিলনকে অপ্রাকৃত মিলনে পরিণত করেছে। মনের থেকে প্রাকৃত দেহ যখন মিলিয়ে যায়, তখন এক ভাবদেহের মধ্যে তারা বিচরণ করেন। এই ভাবদেহেই প্রকৃত মিলন হয়ে থাকে।
----------
বাউল সাধনার তিনটি ধাপ - প্রবর্ত, সাধক ও সিদ্ধি।
বাউল সাধনার গোপন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, ভুল বোঝার সম্ভানা প্রবল। আসলে প্রকৃতিতে ভালো বা মন্দ বলে কিছু হয় না। আমরা আমাদের বিচার শক্তি দিয়ে, এই ভালো বা মন্দের বিচার করে থাকি। শুদ্ধ মনে শুদ্ধ চিন্তা আর অশুভ মনে নানান শঙ্কা। তো আমাদের মন যতক্ষন না শুদ্ধ হচ্ছে, যতক্ষন আমাদের বিচারবুদ্ধির উন্নতি হচ্ছে, যতক্ষন না আমাদের মধ্যে থেকে ভেদবুদ্ধির নাশ হচ্ছে, ততক্ষন আমাদের মধ্যে ভালো বা মন্দের ভাব উদয় হবে। আমাদের মনের মধ্যে অনেক ভাবের উদয় হয়, যা প্রকাশ করলে, আমরা নিজেরাই লজ্বিত হবো। আর আমার মনের সমস্ত ভাব যদি আমি কার্য্যে পরিণত করতে চাই, তবে সমাজে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। তাই মুনি ঋষিগণ প্রার্থনা সংগীতে বলে থাকেন, যা কিছু শুভ হিতকর তাই যেন আমি দেখি, তাই যেন আমি শুনি, তাই যেন আমি বলি।
প্রবর্ত অবস্থায়, অর্থাৎ প্রাথমিক অবস্থায় বাউল সাধককে নামকে বা মন্ত্রকে আশ্রয় করে চলতে হয়। এই নামকে আশ্রয় করবার জন্য দরকার গুরুকরন। এই গুরুই প্রথমে নাম দান করেন। অর্থাৎ সহজ সরল "হরি" বা হরিনাম মহামন্ত্র অর্থাৎ ষোলো নাম বত্রিশ অক্ষরের নিরন্তর জপ করতে বলেন। এই মন্ত্র প্রথমে বাচিক, তারপরে উপাংশু, শেষে মানসজপ করতে বলা হয়।
এর পরে, অর্থসহ বীজমন্ত্রে দানের প্রথা আছে। এইসময়, তাকে স্নানবিধি, ভোজন বিধি, শয়নবিধি, স্ত্রীসংসর্গবিধি, ক্ষৌর বিধি, নতুন বস্ত্র পরিধান বিধি শৌচক্রিয়া বিধি, শিখা বন্ধন বিধি, স্নানবিধি, তিলক ধারণ বিধি ইত্যাদি খুঁটিনাটি লোকাচার সম্পর্কে অবহিত করা হয়।
এর পরে গুরুমন্ত্র, গুরুগায়ত্রীমন্ত্র, ও দীক্ষামন্ত্র প্রদান করা হয়।
এই গুরুমন্ত্র অর্থাৎ গুরু ও কৃষ্ণকে এক ভেবে মন্ত্র জপ করতে বলা হয় যেমন "ক্লিং গুরুদেবায় কৃষ্ণ বৈষ্ণব স্বরুপায় সর্ব্বশক্তি পদ্মায় নমঃ" .এই মন্ত্রের নিঃশব্দে চিন্তন ও মনন করতে হয়।
এর পরে গুরু গায়ত্রী।
"গুরুদেবায় বিদ্বহে কৃষ্ণরূপায়
ধীমাহে তন্নো দেবো প্রচোদয়াৎ। "
স্ত্রীগুরু স্ত্রোত্রম।
"অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জনশলাকয়া
যয়া চক্ষুরুন্মীলিতং স্ত্রীগুরুবে নমঃ"
এর পরে দীক্ষা মন্ত্র :
"ওঁ ক্লীং কৃষ্ণায় গোবিন্দায় গোপীজন বল্লভায় স্বাহা ।"
সাধাকের যখন এই সব আচরণ আয়ত্বে আসে, তারপর ভাব-আশ্রয়ের সময় আসে। এবার সাধকের সাধনার সূত্রপাত। তখন প্রকৃতিকে আশ্রয় করে রাগ-অনুরাগের ভজন আরম্ভ হয়।
বলা হয় পঞ্চ নামের সঙ্গে প্রকৃতি সাধনের ইঙ্গিত আছে। এই পঞ্চনাম হচ্ছে, "কৃষ্ণ-কৃষ্ণ-গোবিন্দ-রাধা-কৃষ্ণ।" প্রথম কৃষ্ণ - অনুরাগ বা আকর্ষণ, দ্বিতীয় কৃষ্ণ - বাহ্য কামের পরিত্যাগ, গোবিন্দ - প্রকৃতির দেহ গ্রহণ, রাধা - শৃঙ্গার, অন্তিম কৃষ্ণ- সম্মিলিত সত্তার একাত্ম অনুভূতি।
এই যে নাম,বা মন্ত্র, ইত্যাদির কথা বলা হলো, এটি আসলে হিন্দু বৈষ্ণব বাউলদের মধ্যে প্রচলিত। যারা মুসলমান বাউল, তারা আনুষ্ঠানিক ভাবে এসব পালন করেন না। এরা কেবলমাত্র, "আলেখজান" "মুরশিদজান" বা "খোদা নিরঞ্জন" ইত্যাদি নামের উচ্চারণ করেন। জপের অনুষ্ঠান নাও করতে পারে। তবে এরা শ্বাসের ক্রিয়া অভ্যাস করে।
বাউল সাধকদের দুটো সাধন, এক দমের সাধন, আর বানের সাধন।
শ্বাসের ক্রিয়াকে এঁরা বলেন, দমের ক্রিয়া। এই শ্বাসের ক্রিয়া অর্থ, পূরক, রেচক, কুম্ভক এবং মূত্রদ্বারের সংকোচন প্রসারণ শিক্ষা করতে হয়। একেই বাউলরা বলেন দমের সাধন। বলা হয়, এই দমের সাধনায় সিদ্ধিলাভ না হলে, বাণক্রিয়া বা গুনক্রিয়ায় সাফল্য আসে না। এখন কথা হচ্ছে এই বাণক্রিয়া বা গুনক্রিয়া ব্যাপারটা কি ? আসলে এই বাণক্রিয়া ও গুনক্রিয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বান কথাটার অর্থ হচ্ছে পুরুষের শক্তি, আর গুন্ হচ্ছে প্রকৃতির শক্তি। মূলত এটি লিঙ্গ ও যোনী। বাউলরা বলে থাকেন, এই গুনে বান যোজনা করে, উর্দ্ধদিকে ছেড়ে লক্ষ্যভেদ করতে হবে। বাউল কবি পঞ্চানন দাস বলছেন, "গুনে বাণে হয় রসিকের করণ / পঞ্চবাণেতে তাঁহারা করেন সাধন।" বাউলেরা বলে থাকেন এই মিলন ক্রিয়ায় মদন, মাদন আর শোষণ স্তম্ভন, সন্মোহন ইত্যাদির গুরুত্ব অনেক বেশি। আসলে এই মিলন ক্রিয়ায় বাউলরা প্রকৃতি-পুরুষের শরীর তত্ত্ব আর মনস্তত্ত্ব দুইই গুরুত্বপূর্ণ। তো দেহ ও মনের সর্বাঙ্গীন মিলনেই রজঃ-বীর্যের মধ্যে সাম্যরসের উদ্ভব হবে। এই মিলন না হলে সাধনার যে প্রকৃত উদ্দেশ্য তা সিদ্ধ হবে না। এইখানে আরো একটা কথা খুবই গুরুত্ত্ব পূর্ন, আর সেটি হচ্ছে, এইসময় প্রথমে কিছুক্ষন বাম নাসিকায় শ্বাস গ্রহণ করে, ধীরে ধীরে এই শ্বাস দক্ষিণ নাসিকা দিয়ে প্রবাহিত করতে হয়। আমাদের এই যে দক্ষিণ নাসিকা আসলে পিঙ্গলা বা সূর্যনাড়ীর স্থান, যা আমাদের চঞ্চল অবস্থা। তাই দক্ষিণ হচ্ছে কামের অবস্থা। এবার বাউল সাধককে, দক্ষিণ নাসিকা থেকে বাম নাসিকায় স্বাস প্রবাহিত করতে হবে। এই বাম নাসিকা হচ্ছে ইড়া বা চন্দ্র নাড়ীর স্থান। তো সামান্য কিছু ক্ষনের জন্য ডান নাসিকায় শ্বাস প্রবাহিত করে, ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এই শ্বাসবায়ুকে বাম নাসিকায় নিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ প্রথমে কামের বৃদ্ধি করতে হবে। এই কামের বৃদ্ধিতে বিলাস পূর্নতা লাভ করবে। এর পরে বাম নাসিকায় শ্বাস প্রবাহিত করে, স্থির হয়ে অবস্থান করতে হবে। অর্থাৎ কাম-বিলাস যোগে পরমপুরুষ ভেসে উঠবেন। এইজন্য প্রথমে কামের প্রয়োজন হয়।
বাউল সাধনার মধ্যে বিশেষ কিছু যোগমিলন ক্রিয়ার প্রচলন আছে। আমরা সেই আলোচনার মধ্যে যাবো না। তবে তাদের এই যে দমের সাধনা এই সাধনার মধ্যে যোগসাধনার মিল লক্ষ করা যায়।
গুরুর উপদেশ অনুসারে তারা যেমন জপের অভ্যাস করেন, তেমনি প্রাণায়ামের অভ্যাস করেন। প্রথমে বাম নাসিকা দিয়ে বায়ু টেনে কিছুক্ষন ধারণ করে, অর্থাৎ কুম্ভক করে, তার পরে ডান নাসিকা দিয়ে শ্বাস ত্যাগ করেন। প্রথমে আটবার, তারপরে ষোলবার , তার পরে বত্রিশবার তারপরে চৌষট্টিবার এই প্রাণায়ামের অভ্যাস করেন। এতে করে কুম্ভক বা শ্বাসকে ভিতরে ধরে রাখবার শক্তি অৰ্জন হয়। এই কুম্ভক ক্রিয়াতে নাড়ীশুদ্ধি হয়। বায়ু সূক্ষ্ম হয়ে সুষুম্না পথে বিচরণ করতে শুরু করে। আর এই বায়ু প্রবাহ যখন সুষুম্না পথে চলতে শুরু করে তখন বিন্দু স্থির হয়। এই স্থির বায়ুকে উর্দ্ধগতি সম্পন্ন ক'র। বাউলদের ভাষায় একেই দমসাধনা বলে, যা সাধকের সিদ্ধি লাভের সহায়ক।
এই দম সাধনার পরে বান সাধনা
এই বানের ক্রিয়ার জন্য বিশেষ যোগ-অভ্যাসের প্রয়োজন। যারা বজ্রোলী মুদ্রা সম্পর্কে জানেন, তারা এই ব্যাপারটা সহজে ধরতে পারবেন। লিঙ্গ নাল দিয়ে প্রথমে জল শোষণ, তারপরে দুধ শোষণ। সবশেষে মিলন-ক্রিয়ার সময় রূপ-রতি-রস শোষণ। রূপ অর্থাৎ রজঃ, রতি অর্থাৎ স্ত্রীবীর্য আর রস বলতে শুক্রকে বোঝানো হয়েছে। মন্থনে বিচলিত-বিন্দু, প্রকৃতির মধ্যে ক্ষরিত বিশেষ রস, এবং রজের কিছু অংশ সাধক শোষণবানে আকর্ষণ করে থাকে।
এর পরে স্তম্ভন। এই স্তম্ভন হচ্ছে রসের স্থিরকরন প্রক্রিয়া। এর পরে সন্মোহন বা মোহন। এই অবস্থায় দেহস্মৃতি লুপ্ত হয়ে যায়। কেবল বিপুল আনন্দের একটা তরঙ্গায়িত চেতনা অনুভূত হয়। একেই বাউলরা বলেন জ্যান্তে মরা। এখানে, দেহভোগের কোনো অবস্থা নেই, পুরুষ প্রকৃতির অবস্থা নেই। কেবল বিপুল দেহাতীত আনন্দ। এই হচ্ছে কাম থেকে প্রেম উদ্ভবের স্বরূপ। এই অনুভূতিকেই ক্রমান্বয়ে উর্দ্ধ গতি সম্পন্ন করা হয়। অর্থাৎ এই অনুভূতিকে ক্রমান্বয়ে নাভিপদ্ম থেকে হৃদয়পদ্মে, হৃদয়পদ্ম থেকে আজ্ঞাচক্রে ওঠাতে হয়। হৃদয়পদ্মে নানা সুমধুর ধ্বনি বা নাদের ধ্বনি শ্রুতিগোচর হয়ে থাকে। আর আজ্ঞাচক্রে মহাভাবের অবস্থা হয়। এই হচ্ছে বাউলদের সাধনার একটা ভাষা ভাষা আভাস।
শেষের দুটো কথা বলি। কামের পথ ধরেই আমাদের পৃথিবীতে যাতায়াত করতে হয়। তো যে পথ দিয়ে এসেছি, আমাদের সবার কাছেই সেই পথ হয়তো খুবই চেনা হয়ে থাকবে। আর এই কারণেই বাউলরা কামের পথ ধরে প্রেমের সন্ধান করে থাকেন।
বাউলদের আরো কিছু বিচিত্র ক্রিয়া কলাপ আছে, যা আমাদের না জানলেও চলবে।
এর পরের দিন আমরা ওঙ্কারের সাহানার মধ্যে প্রবেশ করবো।
----------
ওঙ্কারের সাধনা : লিঙ্গ কথাটার অর্থ হচ্ছে যার লয় হয় না। লিঙ্গ শরীর অর্থাৎ যার লয় নেই।
ওঙ্কারের ধ্যানের একটা সহজ পদ্ধতির কথা বলেছেন। বলছেন, মেরুদন্ড সোজা রেখে যে কোনো সম এর অভ্যাস করা যেতে পারে। তবে সকাল ও সন্ধ্যা বা গভীর রাতে এই ওঙ্কারের ধ্যানের উপযুক্ত সময়। যেকোনো জায়গায়, তবে নির্জন স্থান উপযুক্ত, পূর্ব মুখী হয়ে বা উত্তর-মুখী হয়ে বসে, মায়েরা পেট ভোরে, আর পুরুষ সাধক বুক ভোরে শ্বাস গ্রহণ করুন। মনটাকে শ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে নিন। শ্বাস কোথায় যাচ্ছে, কোন পথে যাচ্ছে, সেখানে কতক্ষন থাকছে, আবার কোন পথে বেরিয়ে আসছে, মনটাকে এই কাজে লাগিয়ে দিন। এবার সশব্দে ওঙ্কার উচ্চারণ করতে করতে শ্বাস ছাড়তে থাকুন। বারবার এই ওঙ্কারের উচ্চারণ করতে করতে স্বাসবায়ু ছাড়তে থাকুন। সশব্দে উচ্চারণ করতে হবে। এর পরে, ধীরে ধীরে দেখবেন, একসময় মুখ দিয়ে আর শব্দ করতে ইচ্ছে করছে না, বা সশব্দে উচ্চারণ করবার শক্তি যেন হারিয়ে গেছে। তখন কানে আর কোনো বাহ্য সব শোনা যাচ্ছে না, কিন্তু ওঙ্কার ধ্বনিত হচ্ছে আর কেবল ঠোঁট স্পন্দিত হচ্ছে। এর পরে একসময় ঠোঁটের স্পন্দনও থেমে যাবে, তখন কেবল মনের মধ্যে এই ধ্বনির উচ্চারণ ধ্বনিত হতে থাকবে। এই অভ্যাস দিন-রাতের এক নির্দিষ্ট সময়ে শুরু করতে হবে। শেষের কোনো সময়সীমা রাখবেন না। পানের মিনিটথেকে শুরু করুন, এক ঘন্টা দু ঘন্টা বা যতক্ষন সম্ভম এই ধ্বনির মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখুন। ওঙ্কারের উচ্চারণ সম্পর্কে মহাত্মাগণ বলে থাকেন, ওম। ....এই ম -বা চন্দ্রবিন্দু , বা অনুস্বর এর উচ্চারণ মুখ বন্ধ অবস্থায় নাক দিয়ে করতে হবে । আর এই অনুনাসিক স্বরকে টেনে যতটা সম্ভব দীর্ঘায়িত করতে হবে।
আরো একটা গুহ্য রহস্যের কথা বলেছেন, যোগাচার্য্য, সেটি হচ্ছে ওং উচ্চারণের শুরুটা হবে, শ্বাসের উপরে একটা চাপ সৃষ্টি করে। অর্থাৎ ওঁং এর পরে অনুস্বর ও চন্দ্রবিন্দুর উপরে জোর দিতে হবে। তবে এই প্রক্রিয়া প্রথম দিকে না করে ভালো। যাদের শরীর মন পবিত্র নয়, যাদের নাড়ীশুদ্ধি হয়নি, তাদের পক্ষে এটি উপযুক্ত নয়। তথাপি কেবলমাত্র জানবার জন্য শুনে রাখুন। যদি কোনোদিন পূরক-কুম্ভক-রেচকের দ্বারা নাড়ীশুদ্ধি করে নিতে পারেন, আহারে শুদ্ধতা আনতে পারেন, সংযমী জীবন যাপন করতে পারেন, তবে এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন। এতে খুব শীঘ্র আশ্চর্য জনক ফল পাবেন। কারন এই প্রক্রিয়ার অভ্যাসে সহজেই মূলাধারের শক্তি উর্দ্ধগামী হতে শুরু করে, তখন শরীরে নানান রকম উপসর্গ দেখা যায়। এই জন্য গুরুর নির্দেশ ব্যতিরেকে, বা স্বাভাবিক উচ্চারণের অভ্যাস করে, যখন শরীরও এই ওঙ্কারে অভ্যস্থ হয়ে যাবে, অর্থাৎ এই ধ্বনির সঙ্গে যখন নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারবেন, তখন এই পদ্ধতির অভ্যাস শুরু করা যেতে পারে। এরজন্য কারুর ক্ষেত্রে তিন মাস বা কারুর ক্ষেত্রে এক বছরও লেগে যেতে পারে। ওঙ্কারের অভ্যাসে শরীর হালকা বোধ হবে, মনের মধ্যে একটা শান্ত ভাব বজায় থাকবে। সুখ-দুঃখের অনুভূতি তখন মনকে বিচলিত করতে পারবে না। এই ওঙ্কারের সাধনা সমাজের এক বিশিষ্ঠ শ্রেণীর মধ্যে কুক্ষিগত করে রাখা হয়েছিল। এখনো স্ত্রীজাতি শূদ্র জাতিদের ওঙ্কারের উচ্চারনে নিষেধ জারি করা হয়। তারা বলবে নমঃ। আমরা চাই সাধারনের কাছে এই অমূল্য ধন বিতরণ হোক।
ওঙ্কারের সাধনা হচ্ছে পরমাত্মার পরমেশ্বের সাধনা। ওঙ্কার হচ্ছে পরমাত্মার প্রতীক। প্রথমে আমরা একটু বুঝে নেই, পরমাত্মা ব্যাপারটা কি ? পরম কথাটার অর্থ প্রধান, উত্তম বা শ্রেষ্ঠ। আত্মন কথাটার অর্থ জ্যোতি বিশেষ। এই জ্যোতি হচ্ছে জ্ঞানজ্যোতি। যিনি সকল জ্ঞানের উৎস স্বরূপ সেই পরমাত্মার প্রতীক হচ্ছে ওঙ্কার বা প্রণব। এই প্রণব বা ওঙ্কারকে লেখা হয়, চার ভাবে - ওম, ওং, ওঁ, ওঁং । এটি একটি শব্দ বা ধ্বনি বিশেষ। ইনি অক্ষর ব্রহ্মের প্রতীক ।
ঋষি পতঞ্জলি বলছেন,
তস্য বাচকঃ প্রণবঃ। (সাধনপদ ১/২৭)
তজ্জ পস্তদর্থভাবনম। সাধনপাদ - (১/২৮)
তস্য বাচকঃ প্রণবঃ। প্রণব হচ্ছে তাঁর বাচক। এই তাঁর কে ? তাঁর অর্থাৎ পরমেশ্বর বা পরমাত্মার। বাচক অর্থাৎ শব্দ। আমরা জানি শব্দ হচ্ছে মনের ভাবের প্রকাশ স্বরূপ। আমাদের যে ভাবনা তাকে বলে বাচ্য। আর যখন তা প্রকাশিত হয় তখন তাকে বলে বাচক। আমরা যত শব্দ উচ্চারণ করি, তার একটা অর্থ আছে। এই অর্থ-ই ভাবনা বা বাচ্য। এখন কথা হচ্ছে এই যে শব্দার্থ এটি কিন্তু শব্দের নিজস্ব নয়, এটি শ্রোতার বা বক্তার নিজস্ব। যেমন ধরুন আপনি বললেন, গো, তো এতে করে সাধারণ মানুষ কেউ বুঝলেন গরু, পণ্ডিত বুঝলেন, পৃথিবী, জ্ঞানী বুঝলেন জ্ঞান, ইংরেজ বুঝলেন বুঝলেন যাওয়া বা গতি । তো একই শব্দ ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করছে, আবার একই জিনিস ভিন্ন ভিন্ন শব্দে প্রকাশ হচ্ছে, কেউ বলছেন জল, (বাংলা) কেউ বলছেন পানি (হিন্দি) কেউ বলছেন acqua (ইটালিয়ান) , কেউ বলছেন, ভাসের (জার্মানি) . তাই বলা হয়, আমরা যদি শব্দ ও অর্থের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য খোঁজার চেষ্টা করি, তাহলে দেখতে পারবো, শব্দ ও অর্থের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে ঠিকই, কিন্তু স্রোতার বা বক্তার মনের ধারণার সঙ্গে এই শব্দার্থ পাল্টে যেতে পারে।
এই শব্দ আদিতে ধ্বনিরূপে ছিলো, যা অর্থবোধক ছিল না। বলা হয় ওঙ্কার থেকেই এই জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। এখন কথা হচ্ছে এই সব বা ধ্বনি কিভাবে এই হাড়-মাসের দেহের আকৃতি নিলো ? বৈদিক যুগে এই ধারণা অনেক বেশি স্পষ্ট ছিলো।যদিও এই ধারণা বা জ্ঞান কেবল মাত্র ভারতবর্ষের মুনি হৃদের মধ্যেই ছিল তা হয়, এই ধারণা বা জ্ঞান পৃথিবীর সমস্ত প্রাচীন জ্ঞানীদের মধ্যেই ছিলো। খ্রিস্টজন্মের পাঁচ শতাব্দী আগে গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাস এই শব্দকে বা ওঙ্কারকে "লোগস" হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এই লোগস অর্থ ভাবনা-চিন্তা-যুক্তি। জগৎ সৃষ্টির প্রারম্ভে এই ওঙ্কার-এর বাচ্য ভাবটি সমষ্টি মনে অর্থাৎ হিরানিগর্ভে বর্তমান ছিল। ঈশ্বর বললেন, "আলো হোক" অর্থাৎ এই আলোর ভাবনা প্রথমে সমষ্টি বা অখিল মনের ভাবনা। এই ভাবনাই ধ্বনি আকারে ব্যক্ত হয়েছিল। প্রত্যেকটি ভাবনার একটি রূপ আছে, আকার আছে। তো যাকিছু অকারিত তা প্রথমে অখিল মনে বর্তমান ছিল। এই মানুষ সৃষ্টির পূর্বেও সেই অখিল মনের মধ্যে মানুষের একটা ভাবনা ছিলো। যখনই এই অখিল মনের ভাবনা অভিব্যক্ত হবার সময় হয়, তখন সেই ধারণা কল্পনার স্তরে রূপ পরিগ্রহ করে। আর এই রূপ তখন উপযুক্ত পরিবেশে অভিব্যক্তির ধারায় বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করে।
ভারত সেবাশ্রমের সান্যাসীগণ যখন যখন সন্ধ্যা আহ্নিক করেন, তখন তাঁরা ঋক-বেদ (১০/১৯০/৩) থেকে একটা শ্লোক উচ্চারণ করেন।
"সূর্যা চন্দ্রমসৌ ধাতা যথা পূর্বম কল্পয়ৎ। দিবং চ পৃথিবীং অন্তরীক্ষমথো স্বঃ " অর্থাৎ যেমন যেমন অখিল মনে পূর্বে কল্পনা করা হয়েছিল, তেমন তেমন চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্রাদি সৃষ্টি করলেন।
ঠিক তেমনি অখিল মনে মানুষের অনুরূপ একটা আদর্শ চিত্র কল্পিত হয়েছিল সেই কল্পিত আদর্শরূপে বর্তমান বা আদিম মানুষ গঠিত হয়েছে। বৈজ্ঞানিকগণ যা কিছু কল্পনা করেন, এমনকি শিল্পীর মনে যা কিছু কল্পনা আকারে আসে, তাকেই তিনি বাস্তবে রূপায়ণ করেন। এমনকি সাধারণ মানুষও তার ভবিষ্যৎ কল্পনা করে। এবং সেই মতো সে তার ভবিষতের রূপরেখা তৈরি করে। আবার ঈশ্বরকে আমরা আমাদের থেকে ভিন্নরূপে কল্পনা করি। আর এই কারণেই আমরা ঈশ্বর থেকে দূরে দূরে থাকি। আমা থেকে যখন ঈশ্বরকে ভিন্ন রূপে কল্প করি, তখন ঈশ্বর আমাদের সেই কল্পিত রূপের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যান। তো ঈশ্বর হচ্ছে, মানুষের কল্পিত শব্দ বা ধ্বনি। আবার অখিল মনের কল্পনা থেকে যে শব্দ ভেসে আসে, তা মানুষ হিসেবে রূপায়িত বা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এখন কথা হচ্ছে শুধু কল্পনা করলেই তো হবে না, দরকার উপাদান। শিল্পীর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে গেলে চাই জল, মাটি, তেজঃ বাতাস ইত্যাদি । জল মাটি দিয়ে রূপদান করা যেতে পারে, কিন্তু তেজ ও বাতাস না থাকলে এ মূর্তি পরিণতির যোগ্য হতে পারে না। বাতাস ও তাপ মূর্তিকে পরিণত করে অর্থাৎ শুকিয়ে একে আপাত স্থিতিশীল করতে পারে।
তো যাকিছু চিন্তা ভাবনা তার প্রকাশ হচ্ছে এই শব্দের বাচ্য। অর্থাৎ জগতের বিকাশ, সৌরমণ্ডলের উদ্ভব প্রাণিকুল, উদ্ভিদকুল অর্থাৎ যা কিছুর উদ্ভব হয়েছে সবকিছুই সেই অখিল মনের কল্পনাপ্রসূত। এখন কথা হচ্ছে অখিল মনেযে তত্ত্বের উদয় হয়েছিল, তাকে আমাদের জানতে হবে। অখিল মনের সমগ্র ভাব ধ্বনির অন্তর্গত। কিন্তু আমরা যে ধ্বনি বা শব্দ ব্যবহার করি, তা কোনটি সেই পরমেশ্বরকে বোঝাতে সাহায্য করতে পারে না। তাই আমরা এমন একটি ধ্বনি চাই যা অখিল মনের ভাবকে প্রকাশ করতে পারে। আমরা এমন একটা ধ্বনি চাই যা সমস্ত শব্দের মূল। এই মূল শব্দটি ভারতবর্ষের প্রাচীন ঋষিদের কাছে দৃশ্যমান হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। আর এই সাংকেতিক শব্দটি বা ধ্বনিটি হচ্ছে ওঙ্কার।
বলা হয়, এই ওঙ্কারে আছে তিনটি বর্ণ। অ , উ , ম। এই তিন বর্ণের একত্রে "ওঁ" ওং, ওম, ওঁং । অ অর্থাৎ প্রথম বর্ণটি মুখ খুললেই উচ্চারিত হয় । আবার মুখ বন্ধ করলে যে ধ্বনিটি উচ্চারণ হয় তা হচ্ছে "ম" অর্থাৎ শেষ বর্ণ। তো ম-কার উচ্চারিত হয়, ওষ্ঠ দ্বারা আর অ-কার উচ্চারিত হয় কন্ঠ দ্বারা। এইসময় জিহ্বা ও তালূমুল সম্পূর্ণ খুলে রাখতে হয়। এই দুই বর্ণের অর্থাৎ "অ" এবং "ম" এর মাঝখানে যতকিছু উচ্চারণ হয়, অর্থাৎ আমরা যাকিছু উচ্চারণ করি তা এই অ ও ম-এর অন্তর্বর্তী। অর্থাৎ আমরা মুখটাকে অর্দ্ধেক খুলে এই "উ" এর উচ্চারণ করে থাকি। বলা হয়, পশুকুল এই মধ্যবর্তী ধ্বনির উচ্চারণ করে থাকে। আর মনুষ্যকুল এই বর্ণত্রয়ের উচ্চারণ করে থাকে। তো মানুষ যত ভাব, বা কল্পনা তার প্রকাশ ঘটে থাকে এই ত্রিবর্ণাত্মক ধ্বনি দ্বারা। এই ওঙ্কারের উচ্চারনে সকল ধ্বনির জ্ঞান হয়। অর্থাৎ আমাদের ভাষায় যা কিছু প্রকাশ করছি, তা এই ত্রিবর্ণের বা ধ্বনির সংযোগমাত্র। তো সমস্ত শব্দের আধার হচ্ছে এই ওঙ্কার। ওঙ্কারের এই মাহাত্ম যার জানা আছে, তিনি ওঙ্কারের মধ্যে সেই পরমেশ্বরের স্পন্দন অনুভব করতে পারবো। এই ধ্বনি যতবার আমরা উচ্চারণ করি, তত আমরা সেই অখিল মনের নিকটবর্তী হতে থাকি। এই ধ্বনি সকল শব্দ, সকল ভাব, সকল কল্পনার আধার। এঁকে আশ্রয় করেই আমাদের সমস্ত ভাবের প্রকাশ ঘটছে। এমনি অখিল মনের সমস্ত ভাবের প্রকাশ ঘটছে। আর এই ওঙ্কারের উচ্চারণের সাথে সাথে আমরা সেই অখিল মনের সান্নিধ্য অনুভব করতে পারি।
ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, তস্য বাচকঃ প্রণবঃ । প্রণব কথাটার অর্থ প্রতিনিয়ত নতুন। তো যতবার এটি উচ্চারিত হচ্ছে, ততবার নতুন নতুন সৃষ্টি সংগঠিত হচ্ছে।
ওঙ্কারের ধ্যানের একটা সহজ পদ্ধতির কথা বলেছেন। বলছেন, প্রথমে ওঙ্কার বারবার উচ্চারণ করতে হবে। সশব্দে উচ্চারণ করতে হবে। এর পরে, ধড়িরে ধীরে দেখবেন, একসময় মুখ দিয়ে আর কোনো বাহ্য সব শোনা যাচ্ছে না, তখন কেবল ঠোঁট স্পন্দিত হচ্ছে। এর পরে একসময় ঠোঁটের স্পন্দন থিম যাবে, তখন কেবল মনের মধ্যে এই ধ্বনির উচ্চারণ ধ্বনিত হতে থাকবে।
এখন কথা হচ্ছে এই ওঙ্কারের জপের রয়োজন হয় কেন ? কারন আমাদের সমস্ত ভাবনা চিন্তার বাহক হচ্ছে এই শব্দ বা ধ্বনি। আপনি মনকে যদি বিশেষ বস্তুকে ধরে রাখতে চান, তবে নাম উচ্চারণ করতে হয়। আর নাম একসময় রূপে পরিবর্তন হয়। আপনি গুরুদেবের নাম উচ্চারণ করতে গেলেই, আপনার মনের মধ্যে গুরুদেবের পার্থিব দেহের চিত্র ভেসে উঠবে। আপনি যখন ওঙ্কারের উচ্চারণ করবেন, তখন আপনার মনের মধ্যে সেই অখিল মনের অধিকারীর চিত্র ফুটে উঠবে। এই অখিল মন সর্বশক্তিমান। বিশ্বে যা কিছু দেখছেন, সবই সেই অখিল মনের ভাবনা। তো আপনি যখন অখিল মনের ভাবনার মধ্যে প্রবেশ করবেন, তখন আপনি সমস্ত বিশ্বমধ্যে বিধৃত হয়ে যাবেন। এ কেবল অভ্যাস ও একাগ্রতার ফলেই ঘটে থাকে। আবার নিরন্তর অভ্যাস একাগ্রতাকে বাড়িয়ে তোলে।
একটা জিনিস জানবেন, আমাদের মনের মধ্যে যত দুঃখের উদয় হয়, তা কেবল মনের স্পন্দনের কারনে ঘটে থাকে। অথবা বলা যেতে পারে, মনের স্পন্দনই দুঃখ। চঞ্চল মনই দুঃখের কারন। তো যখন আমরা দুঃখের মধ্যে পড়ি, বা যখন আমাদের জীবনে অপ্রীতিকর কিছু ঘটে, তখন কোথাও স্থির হয়ে বসে ও ওঙ্কারের জপ করলে, মনের এই স্পন্দন স্তিমিত হয়ে আসে। মন শান্ত হয়, মন প্রসন্ন হয়। এই ওঙ্কারের জপ, আপনার মধ্যে নানান ধ্বনির শ্রবণ, বা নানান দৃশ্যের দর্শন করাবে। এমনকি আপনার মনের মধ্যে নানান ভাব উদীপ্ত হয়ে উঠবে। ঋষিগন বলে থাকেন, যে উপাসনায় আত্মা দ্বারা আত্মার পূজা করা হয়, তা আশ্চার্য্য ফল প্রদান করে থাকে। কিন্তু যাকিছু আপনি করবেন, তা আগে বিচার করে নেবেন, যা আপনার কাছে যুক্তিপূর্ন নয়, তার চিন্তা আপনাকে কোনো সুফল প্রদান করতে পারবে না। তাই যা কিছু করবেন, তাকে আগে জানুন, বুঝুন, দৃঢ়ভাবে নিজের মধ্যে যুক্তি দিয়ে বিচার করে, তবে সেই কাজে প্রবৃত্ত হোন। তখন দেখবেন এক আশ্চর্য্য ফলের অধিকারী হয়ে উঠবেন আপনি। নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি যা করছেন, তা কেন করছেন ? এতে করে কি আপনার উদ্দেশ্য বা লক্ষ পূরণ হবে ? সেই বিষয় সম্পর্কে যদি আপনার কোনো জ্ঞান না থাকে, তবে এই বিষয়ে যিনি জ্ঞানী তার কাছে জেনে নিন। তার পরে নিরন্তর অভ্যাসের মাধ্যমে নিজেকে ফল পাওয়ার যোগ্যতা অৰ্জন করুন। যা কিছু আপনি পেতে চান, তারজন্য নিজেকে আগে যোগ্য করে তুলতে হবে। আর নিজেকে যোগ্য করে তোলাই সাধনা। তবে জ্ঞানহীন সাধনা দ্বারা কোনো ফল প্রাপ্তি ঘটে না। তাই আগে জ্ঞান সঞ্চয় করে, সাধনার মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করুন।
এর পরের দিন আমরা ওঙ্কারের আরো গভীরে প্রবেশ করবো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।
ওঙ্কার থেকে নাদব্রহ্মের সাধনা
মুক্তানন্দ বলছিলেন, অনন্ত কোটি জগৎ। অনন্ত অতীত, অনন্ত ভবিষ্যৎ কেবল ক্ষনিকের জন্য বর্তমান। কালের শেষ কোথায় কে বলতে পারে ? সর্বত্র মহা চৈতন্য ভাসছে। এই চৈতন্য স্বপ্রকাশ। উন্মনা না হলে এই অবস্থা বোধের বাইরে থাকে।
প্রণবের প্রশংসা শুধু বাকেরশক্তির অসাধ্য নয়, মনেরও নাগালের বাইরে। প্রণব একটা শুদ্ধ বিদ্যা, শুদ্ধ মার্গ। এই প্রণবের পথ ধরেই পূর্ণত্ব লাভ করা যায়। পূর্ণত্ব অর্থাৎ পূর্ন সত্যে পৌঁছনো। বিশ্বরূপকে ধরে বিশ্বাতীত হয়ে যাওয়া। বৰ্ণাত্মক থেকে ধ্বনাত্মকে পাড়ি দেওয়া।
এক যুবক শিষ্য সাধক গুরুদেবের কাছে, জ্ঞানগঞ্জ দর্শনের বায়না ধরলেন। গুরুদেব পাহাড়ের পর পাহাড় ডিঙিয়ে নিয়ে চললেন, যুবককে জ্ঞানগঞ্জের পথে। একটা পাহাড়ের চূড়ায় এসে বললেন, ওই যে সামনে একটা পাহাড়ের চূড়া দেখতে পারছো, সেখানে আমাদের যেতে হবে। তো এখান থেকে রাস্তা শেষ, লাফ দাও এখান থেকে। যুবক শিষ্য বললেন, সে কি ? এখান থেকে লাফ দিলে তো আমি মারা যাবো। সামনে বিশাল শূন্য। আমিতো হারিয়ে যাবো। একথা শুনে গুরুদেব শূন্যে মিলিয়ে গেলেন। যুবক শিষ্য গুরুদেবকে আর দেখতে পেয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিলো। এই নিৰ্জন জনমানব শূন্য দুর্গম পাহাড়ের চূড়ায়, দাঁড়িয়েযুবকের মধ্যে ভয়ের উদ্রেগ হলো, যুবক ভয় পেয়ে গেলো, নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হলো। বুকের ভিতরে একটা হাহাকার উঠতে লাগলো। গুরুদেব আপনি কোথায়, আমাকে বাঁচান। ইত্যাদি বলে চিৎকার করতে লাগলো। গুরুদেব আবার নিজমূর্তিতে যুবক শিষ্যকে দেখা দিলেন। বললেন, গুরুবাক্যে যার বিশ্বাস নেই, গুরুর কথায় যার সন্দেহ, তার জ্ঞানগঞ্জ কেন, সে মুন্সিগঞ্জেও (মনের জগতেও) পৌঁছুতে পারে না।
গুরুভিন্ন প্রণবের সাধনা করা যায় না। গুরুকৃপা ভিন্ন সাধনসমরে জয়লাভ করা যায় না . এই সত্য কোনো চতুর ব্রাহ্মণের উক্তি নয়। এ হচ্ছে দৈববাণী। দৈব কৃপা ভিন্ন পূর্ণত্ব লাভ করা যায় না। প্রণব সাধনায় প্রথমে শব্দ। শব্দ থেকে জ্যোতি, জ্যোতি থেকে রূপ, দৃশ্য, প্রভৃতি আবির্ভূত হতে থাকে। তো শব্দ সাধনা না করে, ওঙ্কারের সাধনা না করে, এই জ্যোতির রাজ্যে প্রবেশ করা যায় না। আমাদের যে সংকল্প-বিকল্প, আমাদের যে চিন্তা, আমাদের যে কল্পনা, আমাদের যে স্মৃতি, এগুলো সব জাগতিক বৃত্তির কারনে হয়ে থাকে। আর এসব চঞ্চল মনের খেলা। মনের এই বিক্ষুব্ধ অবস্থায় অশুদ্ধ শব্দের ক্রিয়া চলতে থাকে। ক্রমশঃ এই অশুদ্ধ শব্দ এই বিশুদ্ধ আলোর অনলে দগ্ধ হয়ে যায়। শুদ্ধ শব্দের শুরু হয়, তখন জ্যোতির অতিরিক্ত অভিব্যক্তি শুরু হয়। এই জ্যোতির আলোক প্রভাবে শব্দভাব ক্ষীণ হয়ে আসে। একটা সময় আসে, যখন আর শব্দ শুনতে পাওয়া যায় না। তখন একমাত্র জ্যোতির রাজ্য দীপ্তমান হয়ে ওঠে। এই আলোকদৃশ্য জ্যোতির দ্বারাই গঠিত। জ্যোতি ঘনীভূত হয়ে দৃশ্যরূপে পরিণত হয়েছে। তো বাইরের জ্যোতি ম্লান না হলে, ভিতরের জ্যোতি ঘনীভূত হয়ে দৃশ্যমান হতে পারে না। এই ঘনীভূত দৃশ্যই মন্দির, মসজিদ, গির্জা, মূর্তি, পাহাড় পর্বত, সমুদ্র, অরণ্যাদি রূপে প্রকাশ পেতে থাকে। এই যে দৃশ্য তা আসলে জ্যোতি বটে, কিন্তু তা বুঝতে পারা যায় না। এই জ্যোতিও ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে। একসময় লুপ্ত হয়ে যায়। তখন কেবলমাত্র অনন্ত আকাশ। আর এই আকাশের মধ্যে চিদানন্দ। এর পরে আকাশও অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন থাকে শুধু আত্মা, সাধকের স্বরূপ। এই যে পূর্ণত্ব এর প্রদর্শক একমাত্র গুরু, আর এই গুরুদেব স্বয়ং আমার মধ্যেই বিরাজ করছেন। তাঁর কৃপাভিন্ন এই পরাবস্থায় পৌঁছনো যায় না।
ভ্রুদ্বয়ের মধ্যবর্তী একটা শূন্য স্থান আছে, যাকে বলা হয় চিদাকাশ। এই চিদাকাশ থেকে উদ্ভূত হয়ে নাদধ্বনি তরঙ্গ আকারে প্রবাহিত হচ্ছে। চিৎশক্তির আঘাতেই এই চিদাকাশে নাদের উৎপত্তি হচ্ছে। এই ঘটনা মহাশক্তির বা বিশ্বশক্তির মহাকৃপা ছাড়া কিছু নয়। মহাশক্তির কৃপাবশতঃ এই নাদের অভিব্যক্তি হলেও, মন যতক্ষন না এর সঙ্গে যুক্ত হয়, ততক্ষন এই নাদধ্বনি শ্রুতিগোচর হয় না। প্রবল ইচ্ছাশক্তি, ও ওঙ্কারের সাধনার ফলে মন যখন অন্তর্মুখী হয়, তখন এই নাদধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। এখানে মন আকৃষ্ট হলে, মনের একাগ্রতা বৃদ্ধি পায়। নাদধ্বনি যেমন চিদাকাশ থেকে উদ্ভূত হচ্ছে, তেমনি আবার এই নাদধ্বনি সেই চিদাকাশেই মিলিয়ে যাচ্ছে। নাদধ্বনি যখন চিদাকাশে ফিরে যায়, তখন সাধকের মনকে এই শক্তি অর্থাৎ নাদতরঙ্গের টানে মন ঐস্থানে অর্থাৎ চিদাকাশে পৌঁছে স্থিরতা লাভ করে। মনের চঞ্চলতা দূর হয়ে মন স্থির হয়। একেই বলে চৈতন্যে মনের স্থিতি । . মন এই সময় স্বাতন্ত্রতা বজায় রাখে ঠিকই অর্থাৎ এই অবস্থায় মনের লয় হয় না ঠিকই তবে মনের শীতল স্থির কারনে সাধকের মধ্যে প্রজ্ঞার জন্ম হয়। তো নাদের আশ্রয় না পেলে মন এই স্থিতি লাভ করতে পারে না। এই অবস্থা সুসুপ্তির মতো হলেও, এটি আসলে জাগ্রত অবস্থা। মনকে এই অবস্থায় নিয়ে যেতে হলে, যে রাস্তাকে অবলম্বন করতে হয়, তাকে বলে নাড়ী পথ। সুষুম্না নাড়ী পথ। বিন্দু থেকে অসংখ্য বিশ্বশক্তির রশ্মি নির্গত হচ্ছে। বিন্দু অর্থাৎ মস্তিষ্কের তালুর মধ্যস্থলে, যে সূক্ষ্ম ছিদ্র আছে, যেখান দিয়ে স্থূল শরীর বিশ্বশক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। বিশ্বশক্তিও এইভাবে স্থূল শরীরের সমস্ত নাড়ীপথ ধরে শরীরের মধ্যে আলোড়ন তুলছে। এই নাড়ীর গতিপথে মনকে নিবিষ্ট করতে পারলে, মন উজান বাইতে শুরু করে। অর্থাৎ মন তার উৎসমুখের দিকে ধাবিত হয়। গঙ্গা তার উৎসমুখে অর্থাৎ সে যেখান থেকে এসেছে, সেই উর্দ্ধমুখী গঙ্গোত্রীতে যাত্রা শুরু করে। ওঙ্কার সাধনার ফলে যে নিবৃত্তি ধারা শুরু হয়, সেই নিবৃত্তিধারা ধরে মন বিন্দুস্থানে যেতে থাকে।
ওঙ্কারের সাধনা ছাড়া এই অবস্থায় উপনীত হওয়া যায় না তা নয়, তবে, সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি কোটিতে একটি হবে কিনা সন্দেহ। মহাকাশে যে শব্দ-তরঙ্গ উত্থিত হয়, তা আমাদের ভেদ জ্ঞানের কারন ও জীবের বন্ধনের কারন । চিৎশক্তি সরাসরি মায়াতে আসেন না। চিৎশক্তির একটা প্রতিফলন মায়াতে দৃষ্ট হয়ে থাকে। আরো গভীর ভাবে পর্যবেক্ষন করলে বোঝা যায়, আসলে মহামায়াতে প্রতিফলিত চিৎশক্তি আবার মায়াতে প্রতিফলিত হয়। আর এই কারনে জীব বিভ্রান্ত হয়। এই বিভ্রান্তিই আমাদের ভেদজ্ঞান বা অজ্ঞানের কারন।
বর্নমালা হচ্ছে, মাতৃচক্ররূপ বিলকল্পময়ী বৃত্তি। এই বৃত্তিকে ধারণ করে আছে বলেই জীব বদ্ধ। এই মায়াজাল থেকে মুক্ত হবার জন্য, ওঙ্কারের সাধনা। প্রথমে শুদ্ধ শব্দকে আশ্রয় করতে হয়, তারপর নাদ-ধ্বনিকে আশ্রয় করতে হয়। ওঙ্কার আমাদের অশুদ্ধ শব্দ তরঙ্গকে ভেঙে শুদ্ধ ধ্বন্যাত্মক নাদে পরিণত হয়। বর্নরূপী যে শব্দ তা যতক্ষন-না ভেঙে বিগলিত হচ্ছে, ততক্ষন নাদরূপী ধ্বনির উপলব্ধি হয় না। আর নাদের উপলব্ধি না হলে বিন্দুর উপলব্ধি হওয়া সম্ভব নয়। বলা হয় প্রণব পুটিত মন্ত্র , বা একমাত্র ওঙ্কারই জাগ্রত মন্ত্র। তো আমাদের বর্ণাত্মক শব্দ তরঙ্গ থেকে ধন্যাত্মক নাদ তরঙ্গে প্রবেশ করতে হবে। দেখুন রেখা যখন গতিহীন হয়, তখন তা বিন্দু। তেমনি নাদ যখন গতিহীন হয়, তখন তা বিন্দুরূপে পরিণত হয়। এই বিন্দুই আত্মজ্যোতিঃ। আত্মস্বরূপের উপলব্ধি এই আত্মজ্যোতিতে হয়ে থাকে।
সৎগুরু যখন দীক্ষা দান করেন তখন থেকেই এই আমাদের এই অশুদ্ধ শরীর বিশুদ্ধকায়ে পরিণত হতে শুরু করে। এই বিশুদ্ধকায় হচ্ছে সাধকের প্রকৃত অবস্থা। সাধকের স্ব-দেহ। বীজ যেমন একসময় অংকুরিত হয়, ধীরে ধীরে একসময় বিশাল গাছে পরিণত হয়, এবং পরিণত গাছে যেমন ফুল-ফলের দেখা মেলে, তেমনি গুরুপ্রদত্ত বীজ শিষ্যের হৃদয়ে একসময় অঙ্কুরিত হয়। যথা-বিহিত ভাবে বীজ বপন হলে, ক্ষেত্র প্রস্তুত থাকলে, আজ হোক বা কাল শিষ্যের হৃদয়ে একটা জ্ঞানদেহের উৎপন্ন হবে। বীজ তখন অন্তর্হিত হবে - বীজকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আবার এই অঙ্কুরকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে, বাইরের পরিষেবা। ঠিক তেমনি গুরুপ্রদত্ত বীজ গুরুশক্তি বা চৈতন্যশক্তির প্রভাবে উপযুক্ত শিষ্যের হৃদয়ে বা ক্ষেত্রে রোপিত হয়ে আপনা আপনি বিকশিত হতে শুরু করে। এই যে বাইরে থেকে পরিকর্ম্ম অর্থাৎ গুরু নির্দিষ্ট পথে সাধকের সাধনা, সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে অপসারণ করে থাকে। বীজ আপনা থেকে অভিব্যক্ত হয়ে ওঠে। মাটিতে গ্রথিত বীজ যেমন আমরা কেউ টেনে অঙ্কুরে পরিণত করতে পারি না, তেমনি গুরুপ্রদত্ত বীজ শিষ্যের হৃদয়ে স্বাভাবিকভাবেই বিকশিত হতে শুরু করে। এর জন্য কেবল ধৈর্য্যধরে অপেক্ষা করতে হয়। কবে বীজ থেকে অঙ্কুরের উদ্গমন হবে, তা আমরা কেউ জানি না, তেমনি ওঙ্কাররূপ বীজ থেকে কোন প্রক্রিয়ায়, কিভাবে, বা কবে চৈতন্যশক্তির জগরন ঘটবে, তা আমরা কেউ জানি না। এই প্রক্রিয়ায় কেবল মাত্র চেতন শক্তিই ক্রিয়া করে থাকে। সাধক শুধু বেড়া দিতে পারে, গুরু শুধু নির্দেশ দিতে পারেন, কিন্তু অঙ্কুরের উদ্গমন হবে একমাত্র চৈতন্য শক্তির প্রভাবে। মহাত্মাগণ বলছেন, যতক্ষন সাধকের মধ্যে কর্তৃত্বাভিমান থাকে, আমি আমার ভাব থাকে, আমি করছি - আমিই সবকিছুর কর্ত্তা, এই ভাব যতক্ষন না সাধকের মধ্যে থেকে দূর হচ্ছে, যতক্ষন সাধক মনেপ্রাণে গুরুরদেবের উপরে নির্ভর করছে, ততক্ষন জীব সাধন-ভজন করতে সমর্থ হয় না। আপনি পূজাপাঠ করতে পারেন, আপনি মন্দির-মসজিদে-গির্জায় যেতে পারেন, আপনি মন্দির ইত্যাদি নির্মাণ করতে পারেন, আপনি মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, কিন্তু যতক্ষন না চেতনশক্তি আপনার ভিতরে ক্রিয়া শুরু করছে, ততক্ষন সবই বাহ্য আড়ম্বর মাত্র।
এখন কথা হচ্ছে, শব্দমার্গে যাত্রা শুরু করতে গেলে, প্রথম দিকে সাধকের প্রয়াস অবশ্যই দরকার, কিন্তু বীজ গ্রথিত করে দেবেন গুরু, তিনি দেহধারী হতেও পারেন, আবার দেহধারী নাও হতে পারেন। আসলে গুরুশক্তি আপনার নিজের মধ্যেই সুপ্ত আছে, দেহধারী গুরুর কাজ হচ্ছে, সাধকের মধ্যে থেকে সেই গুরুশক্তির ঘুম ভাঙ্গানো, তাকে জাগিয়ে তোলা। তাই সৎগুরু কাউকে শিষ্য করেন না, তিনি শিষ্যের মধ্যে থেকে শ্রীগুরুশক্তিকে জাগিয়ে তোলেন।এইজন্য শিষ্যের মধ্যে থাকা চাই তীব্র ব্যাকুলতা, চাই উৎকট ইচ্ছেশক্তি, চাই বৈরাগ্য, চাই ভগবত ভক্তি, চাই জ্ঞান, তবেই চৈতন্যশক্তি বা গুরুশক্তি শিষ্যের মধ্যে ক্রিয়া করতে শুরু করে।
নাদতত্ত্ব বুঝতে গেলে, আমাদের প্রাণগত উচ্চারের রহস্য সম্পর্কে একটা জ্ঞান থাকা আবশ্যক। প্রাণের স্বাভাবিক ধর্ম্ম হচ্ছে উচ্চার। উৎ অর্থাৎ অতিশয় চর অর্থাৎ গমনে। তো বায়ুর গতিবেগ, গতিপথ সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা আবশ্যক।
উচ্চারের দুটো বৃত্তি - একটা স্পন্দনাত্মক আর একটা বিশিষ্ট। এই বিশিষ্ট উচ্চার আবার প্রাণ-অপান-সমান-উদান-ব্যান ভেদে পাঁচপ্রকার।
শরীরে পঞ্চবায়ুর গতাগতি সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার। দেখুন উদান বায়ু উদ্গার তুলছে, অপান নিম্নগামী হয়ে মলদ্বার থেকে নিঃসরণ করছে। এই সমান বায়ু শরীরে রক্ত চলাচলে সাহায্য করে। তো এই বায়ু শরীরকে আত্মসাৎ করে আছে বলেই, অচেতন এই দেহকে চেতনবৎ বোধ হচ্ছে।
প্রাণাত্মক উচ্চারে একটি অব্যাক্ত ধ্বনি নিরন্তর স্ফূরিত হচ্ছে। একেই বলে অনাহত নাদ। .সমস্ত প্রাণীর হৃদয়ে এই নাদধ্বনি স্বাভাবিক ভাবেই স্ফূরিত হচ্ছে, বা উচ্চারিত হচ্ছে। প্রাণক্রিয়ার মধ্যে যখন একটা ছন্দ আসে, অর্থাৎ ইড়া -পিঙ্গলার বায়ু প্রবাহ যখন মন্দীভূত হয়ে আসে, তখন নানান প্রকার শ্রুতিমধুর ধ্বনি শ্রুতিগোচর হয়। এই ধ্বনি ভিন্ন ভিন্ন স্তর থেকে উদিত হয়। এদের সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এই ধ্বনি স্থূলনাদ নামে পরিচিত। এই ধ্বনি অনাহত নাদ নয়। এই স্থূল ধ্বনিকে পরিহার না করতে পারলে, প্রকৃত নাদধ্বনি যা আসলে চেতনার প্রকাশ, তা বোধে আসে না। তাই স্থূল ধ্বনি যাকে নাদ ব'লে ভ্রম হচ্ছে, তাকে পরিহার ক'রে, অপেক্ষা করতে হবে। একদিন দৈব কৃপায়, বা বলা যেতে পারে গুরুকৃপায়, একদিন এই অনাহত নাদ সর্বপথে অর্থাৎ শাব্দিক থেকে ভেসে আসে। তখন আর সেই সব অবান্তর ধ্বনি, যা আগে শোনা গিয়েছিলো তা আর শুনতে পাওয়া যায় না।
তো আমার আগেই শুনেছি, শব্দ থেকে জ্যোতি, জ্যোতি থেকে রূপ, রূপ থেকে দৃশ্য ইত্যাদির আবির্ভাব ঘটে থাকে। আর এই সবকে আশ্রয় করেই জ্যোতির রাজ্যে প্রবেশ ঘটে। আমাদের সংকল্প-বিকল্প, মনের চিন্তা-ভাবনা, আমাদেরকে ঘিরে রেখেছে। এই যে চিন্তা ইত্যাদি এসব আমাদের মনের মলিনতার কারনে ঘটে থাকে। যেদিন মনের মালিন্য শব্দ থেকে উদ্ভূত তাপ এই মনের মালিন্য শুকিয়ে শুদ্ধ করে দেবে, সেইদিন শুদ্ধ শব্দের একটা অস্পষ্ট আলোকপিন্ড অথবা আলোকরেখা দেখতে পাওয়া যায়। এই অস্পষ্ট আলো একসময় স্পষ্ট হতে থাকে। তখন আর শব্দ শুনতে পাওয়া যায় না। কেবলমাত্র জ্যোতির্ময় একটা আলোকখন্ড দেখতে পাওয়া যায়। এই আলোকখন্ড একসময় ঘনীভূত হয়ে দৃশ্যমান হয়, আর এর মধ্যে নানান রূপ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এই দৃশ্য বহু প্রকারের হতে পারে।
এই ঘনীভূত দৃশ্যই মন্দির, মূর্তি, পাহাড় পর্বত, সমুদ্র, অরণ্যাদি রূপে প্রকাশ পেতে থাকে। এই যে দৃশ্য তা আসলে জ্যোতি বটে, কিন্তু তা বুঝতে পারা যায় না। এই জ্যোতিও ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে। একসময় লুপ্ত হয়ে যায়। তখন কেবলমাত্র অনন্ত আকাশ। আর এই আকাশের মধ্যে চিদানন্দ। এর পরে আকাশও অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন থাকে শুধু আত্মা, সাধকের স্বরূপ। এই যে পূর্ণত্ব এর প্রদর্শক একমাত্র গুরু, ইনি আমার মধ্যেই বিরাজ করছেন। তাঁর কৃপাভিন্ন এই পরাবস্থায় পৌঁছনো যায় না। তখন সেই মুক্তানন্দের কথায়, অনন্তকোটি জগৎ, অনন্ত ভূত, অনন্ত ভবিষৎ , অনন্ত কাল কেবল মহাচৈতন্যের আকাশে মেঘের মতো ভেসে বাড়াচ্ছে।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
------------
নবদ্বার কিভাবে বন্ধ করবেন ?
জীবন হচ্ছে প্রাণের খেলা। প্রাণের প্রবেশে জীবনের শুরু, আবার প্রাণের উৎক্রমনে জীবন শেষ । পঞ্চভূতের মিশ্রণ এই পচনশীল জড় দেহ প্রাণের স্পন্দনের কারনে ধীরে ধীরে বর্ধিত হচ্ছে, ঘুরছে, ফিরছে, খাচ্ছে, শুচ্ছে। এই প্রাণের স্পন্দন থেমে গেলে, জড় দেহ আবার সেই পচনশীল জড় পদার্থে পরিণত হয়ে যাবে। এই প্রাণ প্রতিনিয়ত আমাদের নাক দিয়ে ঢুকছে, আবার সে নাক দিয়েই বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। তো নাকের ছিদ্র যদি বন্ধ করে দেওয়া যায়, তাহলে প্রাণের আসা যাওয়া থাকবে না। কিন্তু এছাড়া আরো একটা পথ আছে, অর্থাৎ মুখ দিয়েও আমরা শ্বাস প্রশ্বাস চালাতে পারি। ঘুমের মধ্যে আমরা মাঝে মধ্যে এই মুখ দিয়েই শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে থাকে। সে যাই হোক, বেরিয়ে যাবার সময় তাহলে, এই নাক বা মুখ দিয়েই, আমাদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ হয়, এটা আমরা ধরে নিতে পারি। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, নাক মুখ আমাদের দিয়ে,আমাদের পায়ু দিয়েও বায়ু নিঃসরণ হতে পারে। অন্য কোথাও দিয়ে এমনটি হতে পরে বলে আমরা জানি না।
কিন্তু উপনিষদের ঋষিগণ বলছেন, প্রাণ বেরুনোর জন্য নাকি আমাদের শরীরের নয়টি দ্বার আছে। অর্থাৎ আপনি যদি নাক ও মুখ বন্ধ করে বসে থাকেন, তবে প্রাণ বেরুতে পারবে না, আর আপনি চিরকাল প্রাণবন্ত থাকবেন, এমনটা হতে পারে না। এই প্রাণকে শরীরের মধ্যে ধরে রাখতে গেলে, ৯ টি দ্বার বন্ধ করতে হবে। ঋষিগণ বলছেন, আপনি এই নয়টি দ্বার বন্ধ করলেও, আরো একটি দ্বার আছে, যাকে বলা হয় ব্রহ্মরন্ধ্র - সেখান দিয়ে প্রাণ বেরিয়ে যাবে। তবে এই ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে প্রাণ বেরিয়ে গেলে, আর আপনি নতুন কোনো দেহ পাবেন না। কিন্তু নয়টি দ্বারের যেকোনো একটি দিয়ে বেরুলে, আপনাকে আবার এই মর্তভূমিতে অন্য শরীরে আসবার অনুমতি দেওয়া হবে। আর ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে যদি প্রাণ একবার বেরুতে পারে, তবে আর আপনি এই ইহজগতে ফিরে আসতে পারবেন না। তাহলে এটাই হবে আপনার শেষ যাত্রা , বা শেষ জীবন। তো শেষ যাত্রার যাত্রী হতে গেলে, আপনাকে নবদ্বার বন্ধ করবার প্রক্রিয়া শিখতে হবে। কিন্তু কিভাবে ? সেসব গুহ্য কথার কিছু আজ আমরা শুনবো।
নবদ্বার বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু করবার আগে আমাদের জেনে নেওয়া দরকার, এই নবদ্বার বলতে আমরা কি বুঝি , আর এগুলোকে কেনই বা বন্ধ করতে হবে ? আর এই দ্বারের রক্ষক কে ?
প্রথমেই বলি, আমাদের শরীরের মধ্যে যতগুলো ছিদ্র আছে, তাকেই বলে শরীরের দ্বার। এই দ্বারের সংখ্যা কেউ বলেন , দশ, কেউ বলেন, নয়টি। যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, দ্বার নয়টি, আর তা হচ্ছে, চোখ-২, কান-২, নাক-২, মুখ-১, পায়ু-১, উপস্থ -১। কেউ কেউ এর সঙ্গে আরো একটি দ্বারের কথা বলেছে, যা আমাদের মস্তিষ্কের তালুর মাধ্যস্থলে, জেক বলে ব্রহ্মরন্ধ্র । তো সেই দিক থেকে দেখতে গেলে, আমাদের শরীরে মোট ১০টি দ্বার আছে। নবদ্বারের বন্ধ ক্রিয়া মানে এই নয়, যে কানে তুলো গুঁজে দিলাম, চোখে কাপড় বেঁধে দিলাম, মুখ বন্ধ করে, ঠোঁটে সেলোটেপ মেরে নিলাম। আসলে এগুলোকে সংযম করাই এই বন্ধক্রিয়ার উদ্দেশ্য। এর মধ্যে কিছু হচ্ছে আমাদের জ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ন, নাসিকা,) কিছু আমাদের কর্ম্মেন্দ্রিয় (অর্থাৎ বাক, পায়ু, উপস্থ). প্রাণ ও মনের কারণেই এগুলো ক্রিয়াশীল হয়েছে। তো প্রাণ ও মন হচ্ছে এই নবদ্বারের পাহারাদার। সোজা কথায়, আমাদের ইন্দ্রিয় সংযম হলেই, এই নবদ্বার সমূহ বন্ধ হয়ে যাবে।
মহাত্মাগণ বলছেন, ওঙ্কারের উচ্চারণের আগে, যেটা দরকার সেটা হচ্ছে, এই নব-দ্বারের সংযম, হৃদয় দেশে মনকে নিবিষ্ট করা, আর আজ্ঞাচক্রে অর্থাৎ ভ্রু-দ্বয়ের মাঝে প্রাণকে স্থির করা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে নবদ্বার গুলোকে কেন বন্ধ করতে হবে ? মহাভারতের শান্তিপর্বে ২৯৮ অধ্যায়ে বলা হচ্ছে, মৃত্যুর সময়, উদান বায়ুর সাহায্যে এই নবদ্বারের যে কোনো একটি দ্বার দিয়ে প্রাণশক্তি বাইরে বেরিয়ে যায়। "যাঁরা কেবল পুণ্যকর্মে নিরত থাকেন, তাঁদের প্রাণ উর্দ্ধদেশ, যারা পাপ ও পুন্য উভয়বিধ কর্ম্মে নিরত থাকেন, তাদের প্রাণ মধ্যদেশ, এবং যারা কেবল পাপকর্ম্মে নিরত থাকেন, তাদের প্রাণ অধোদেশ ভেদপূর্বক বহির্গত হয়ে থাকে। (মহাভারত - শান্তিপর্ব্ব- অধ্যায়- ২৯৮)
তো নিজ নিজ কর্ম্ম অনুসারে, পুণ্যবান পুরুষ উপরের দ্বার দিয়ে, পাপী পুরুষ নিম্নের দ্বার দিয়ে, আর মধ্যম শ্রেণীর মানুষ মধ্যম দ্বার দিয়ে, বাইরে বেরিয়ে যায়। প্রশ্ন উপনিষদের প্রবক্তা, ঋষি পিপ্পলাদ এই একই কথা বলছেন, কোনো মানুষ যদি পুন্য কর্ম্ম করেন, তবে তিনি মৃত্যুকালে উদান বায়ুর সাহায্যে সুষুম্না নাড়ীপথ ধরে পুণ্যলোকে গতি প্রাপ্ত হন। আবার যদি কেউ পাপ কর্ম করে, তবে তাকেও এই উদান বায়ু পাপ লোকে নিয়ে যায় । আবার কেউ যদি পাপ-পুন্য উভয় কর্ম্ম করে থাকেন, তবে তিনি মনুষ্য লোকে যান।
"অথ একয়া উর্দ্ধ উদানঃ পুন্যেন পুণ্যং লোকং নয়তি পাপেন পাপম উভাভ্যাম এব মনুষ্যলোকম। "(০৩/০৭)
তো জীব যে দ্বারপথে বাইরে বেরিয়ে যায়, পরবর্তীকালে তার গতিও সেইমতো হয়ে থাকে। তবে যোগী মহাত্মাগণ একটা বলে থাকেন, যে দশম দ্বার অর্থাৎ ব্রহ্মদ্বার দিয়ে কেউ বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে না। এই দশম দ্বার বা ব্রহ্মরন্ধ্র পথে কোনো ভাগ্যবান ব্যক্তি যদি বাইরে বেরিয়ে যেতে পারেন, তবে তার আর পুনরায় মানব-আবর্তে ফিরে আসতে হয় না। তো মৃত্যুকালে আমরা কেউ এই ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে বেরুতে পারি না, বাকি নটি দ্বারের যে কোনো একটি দিয়ে বেরিয়ে যাই, আর এই কারণেই, আমাদের আবার এই মৃত্যুলোকে ফিরে ফিরে আসতে হয়।
যোগীপুরুষগন বলছেন, মৃত্যুকালে এই নয়টি দ্বার বন্ধ করে দিলে, আমাদের ব্রহ্মরন্ধ্রপথ খোলা সহজ হয়ে যায়। তখন ব্রহ্মদ্বার দিয়ে প্রাণ বেরিয়ে যেতে পারে। এই জন্যআমাদের নবদ্বারকে বন্ধ করা জন্য সবার সচেষ্ট হওয়া উচিত।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এই নবদ্বার যে কিভাবে বন্ধ করা যাবে, এই সম্পর্কে কেউ কিছু খুলে বলতে চান না। এমনকি শ্রীমদ্ভগবৎ গীতাতেও এই সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট উপদেশ দেওয়া হয় নি। যোগীপুরুষগন বলে থাকেন, যদিও নবদ্বারের মধ্যে যেকোনো একটা দ্বারকে অবলম্বন করে বিশেষ ক্রিয়া করলে, সমস্ত দ্বারকেই বন্ধ করে দেওয়া যায়। আবার বিশেষ কিছু মুদ্রা আছে যার দ্বারা এই দ্বারগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া যায়। কিছুদিন এই মুদ্রার অভ্যাস করলে, শরীরের ও মনের মধ্যে একটা বিশেষ আবেশের ভাব উৎপন্ন হয়, তখন সাধকের বাহ্য জ্ঞান লুপ্ত হয়ে যায়। আর তাহলেই, ক্রিয়ার ফল সহজেই উপল্বদ্ধিতে আসে। সমস্ত দ্বারপথে তালার মতো লেগে যায়। একেই কেউ কেউ বলেন প্রত্যাহার, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের প্রত্যাহার, কেউ বলেন বন্ধক্রিয়া ।
এইসব মুদ্রার অনুশীলনীর পূর্বে রেচক, কুম্ভক-এর অভ্যাস জরুরি। বায়ুকে রুখে দেবার পরেই এই মুদ্রার অভ্যাস করতে হবে। কুম্ভকের অভ্যাস করতে করতে এই কুম্ভকের সময়সীমা ২০ সেকেন্ড থেকে ধীরে ধীরে ৬০ সেকেন্ড পর্যন্ত বাড়িয়ে নিতে হবে। এই কুম্ভকের ক্রিয়া ঠিক ঠিক মতো রপ্ত হলে, সমান বায়ুর তেজ বৃদ্ধি পাবে। তখন তেজঃপূর্ন সমান বায়ুর দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে শরীরের সমস্ত নাড়ীর বায়ুরস সুষুম্না নাড়ীতে একীভূত হয়ে যায়। এইযে সমস্ত নাড়ীর রস একীভূত হয়ে সুষুম্নায় প্রবাহিত হতে শুরু করে। অর্থাৎ তখন সমস্ত নাড়ীতে সঞ্চরণরত বায়ু এবং রস একত্র হয়ে প্রাণরূপে পরিণত হয়। একেই বলে সামরস। এই সামরস তখন সুষুম্না নাড়ীপথ ধরে উর্দ্ধমুখী হয়ে বইতে থাকে।
মহামহোপাধ্যায় শ্রী গোপীনাথ কবিরাজ মহাশয় বলছেন, এই নবদ্বার বন্ধক্রিয়াকে বলছেন বহিরঙ্গ সাধনা। এর পরে অন্তরঙ্গ সাধনা করতে হয়। অর্থাৎ ধ্যানের আগে যেমন আসন, প্রাণায়াম, ধারণা, ধ্যান সমাধির একটা ধারাবাহিকতা থাকে, তেমনি এই নবদ্বার বন্ধ ক্রিয়া যা আসলে, প্রত্যাহারের নামান্তর। প্রত্যাহারে মনকে ইন্দ্রিয়সকল থেকে আলাদা করতে হয়। নবদ্বার ক্রিয়াতে এই মন এমনকি প্রানকেও ইন্দ্রিয়সকল থেকে আলাদা করতে হয়। অর্থাৎ আমাদের মনের সঙ্গে সংযোগ না থাকলেও, ইন্দ্রিয়সকল নিজ নিজ ক্রিয়া করবে। কান, শুনবে, চোখ দেখবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যখন প্রাণের সঙ্গে ইন্দ্রিয়সকলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবে, তখন ইন্দ্রিসকল সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। অর্থাৎ এইসময় আপনি বাইরের কোনো শব্দ শুনতেই পারবেন না, কোনো দৃশ্য দেখতে পারবেন না। অর্থাৎ ইন্দ্রিয় সকল সাময়িক সময়ের জন্য বিকল হয়ে যাবে।
যাইহোক, প্রথম দিকে এই অবস্থাটা মনের মধ্যে ভাবনা করতে হয়। শ্বাস নিতে নিতে মনে মনে ভাবুন, সুষুম্না নাড়ী নাভি (মনিপুর) থেকে শুরু করে ব্রহ্মরন্ধ্র (সহস্রার) পর্যন্ত বিস্তৃত। এবার কুম্ভক করুন। এই ভাবনা ও কুম্ভকের ফলে, সমস্ত সামরস সুষুম্না বাহিত হয়ে উপরের দিকে বইতে শুরু করবে। অনাহত (হৃদয়) বিশুদ্ধি (কণ্ঠদেশ) আজ্ঞা (ভ্রুদ্বয় মধ্যে) ভেদ করে সহস্রারের দিকে ধাবিত হবে। এই হচ্ছে বহিরঙ্গ দ্বার সংযম ক্রিয়া। আসলে প্রত্যেক ভাবের উদয়ের সঙ্গে মন, প্রাণাদির অবস্থা এবং নাড়ী বিশেষের ক্রিয়ার সম্মন্ধ আছে। এই ভাবনার সাহায্যে মন-প্রাণ আদিকে নির্দিষ্টি প্রকারে স্পন্দিত করতে পারলে, এবং নাড়ী বিশেষকে সঞ্চালিত করতে পারলে, সেই অনুসারে ভাবের উদয় হয়। ফলতঃ গতির উপর এর প্রভাব কাজ করে।
আবার আসন, মুদ্রা, প্রাণক্রিয়া প্রভৃতির দৈহিক ও প্রাণীক চেষ্টায় মনের ক্রিয়া ও ভাবাদির নিয়ন্ত্রিত হয়। এই বিশেষ ক্রিয়া সকল আজও তিব্বতে বহুসাধক প্রয়োগ করে। হঠযোগ প্রদীপিকাতে যোগী আদিনাথ, দশটি মুদ্রার অভ্যাসের কথা বলেছেন। এই ক্রিয়াগুলো হচ্ছে, মহামুদ্রা, মহাবন্ধ , মহাবেধ, খেচরী, উড্ডান, মুলবন্ধ , জালন্ধর , বিপরীতকরণী, বজ্রলী , শক্তিচালন, এই দশটি মুদ্রা। এই মুদ্রার সঠিক অভ্যাসে এই দ্বারবন্ধন ক্রিয়া ফলপ্রসূ হয়। এই মুদ্রাগুলো সম্পর্কে আমার সংক্ষেপে শুনে নেবো। যদিও এই সব বন্ধ ক্রিয়া কেবলমাত্র গুরু সান্নিধ্যে করাই বিধেয়। গুরুভিন্ন এইসব ক্রিয়ার অনুশীলন, ঝুঁকিপূর্ণ, স্বাভাবিক জীবনকে এইক্রিয়া ব্যাহত করতে সক্ষম। তাই গুরুসান্নিধ্য ছাড়া এই মুদ্রা করবার অনুমতি নেই। তথাপি আমরা আমাদের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য, এইসব মুদ্রার কথা সংক্ষেপে হঠযোগ পুস্তক থেকে শুনে নেবো।
মহামুদ্রা : বাম গোড়ালির দ্বারা লিঙ্গ ও গুহ্যদেশের মধ্যবর্তী স্থানে চেপে ধরে ডান পা-কে প্রসারিত করে, দুই হাতে দ্বারা দৃঢ় ভাবে ধরে রাখবে। এবার কন্ঠনালী রুদ্ধ করে, শ্বাসবায়ুকে নিচের দিকে যেতে না দিয়ে উর্দ্ধ গতিশীল করবে। এর পরে কোনো বেগ না দিয়ে ধীরে ধীরে রেচন করবে। একেই বলে মহামুদ্রা।
মহাবন্ধ : বাম পায়ের গোড়ালিকে আবার লিঙ্গ ও গুহ্যদেশের মধ্যবর্তী স্থানে চেপে শরীরের মধ্যে বায়ুকে টেনে নিয়ে কুম্ভক করবে। যথাসম্ভব কুম্ভকের পরে, রেচন করবে। এবার ঠিক উল্টো করে, অর্থাৎ ডান পায়ের গোড়ালিকে চেপে ধরে একই ভাবে পূরক কুম্ভক রেচক করতে হবে। কিন্তু এখানে কন্ঠবন্ধের প্রয়োজন নেই। সম্ভব হলে আলাজিহ্বা দ্বারা প্রাণবায়ুকে রুদ্ধ করা ভালো।
মহাবেধ : মহাবন্ধে স্থিত সাধককে একাগ্র চিত্তে পূরক করে দুই হাত সমান ভাবে মাটিতে রেখে, পাছায় থাপ্পড় মারতে হবে।
খেচরী মুদ্রা : আমাদের নাসারন্ধ্র দিয়ে যেমন গলার নিচে একটা সুড়ঙ্গ চলে গেছে, তেমনি গলার উর্দ্ধ দিকেও একটা গর্ত আছে। সেই গর্তকে বলে কপালকুহর। জিহ্বাকে উল্টো করে, এই কপালকুহরে প্রবেশ করতে হবে। এবং ভ্রূমধ্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে।
উড্ডীয়ান বন্ধ ক্রিয়া : পেটের মধ্যে যে বায়ু তাকে পিঠের দিকে টেনে নিতে হবে। অর্থাৎ পেটকে সংকুচিত করে, পিঠের দিকে টেনে নিয়ে নাভির বায়ুকে উর্দ্ধমুখী করতে হবে।
মূলবন্ধ : গুহ্যদেশ ও লিঙ্গের মধ্যবর্তী স্থানে গোড়ালিকে চেপে ধরে গুহ্যদ্বারকে সংকুচিত করে অপান বায়ুকে উপরের দিকে আকর্ষণ করতে হবে। বারবার এই এই গুহ্যদ্বারকে আকুঞ্চন করলে, অপান বায়ু উর্দ্ধমুখী হয়ে যায়।
জালন্ধর বন্ধ : কণ্ঠকে আকুঞ্চন করে, চিবুককে বক্ষস্থলে স্থাপন করতে হবে।
বিপরীতকরণী মুদ্রা : অল্প কিছুক্ষনের জন্য পাদুটো উপরের দিকে, আর মাথা নিচের দিকে রাখতে হবে।
বজ্রোলি : মৈথুন কালে বীর্য যাতে নিম্ন গতি সম্পন্ন না হয়ে উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হয়, তার প্রক্রিয়াকেই বলে বজ্রোলি। বজ্রোলি অভ্যাসকারী লিঙ্গ দিয়ে দুধ শুক্র টেনে থাকে।
শক্তি চালনা মুদ্রা : বজ্রাসনে বসে, ডান নাসিকা দিয়ে বায়ু টেনে নাভি মন্ডল পর্যন্ত পূরক করতে হয়। এর পরে যথা সম্ভব কুম্ভক করে, ধীরে ধীরে বাম নাসিকা দিয়ে রেচক করবেন।
এই হচ্ছে বন্ধ ক্রিয়া। কিছুদিন এই মুদ্রার অভ্যাস করলে, শরীরের ও মনের মধ্যে একটা বিশেষ আবেশের ভাব উৎপন্ন হয়, তখন সাধকের বাহ্য জ্ঞান লুপ্ত হয়ে যায়। আর তাহলেই, ক্রিয়ার ফল সহজেই উপল্বদ্ধিতে আসে। সমস্ত দ্বারপথে তালার মতো লেগে যায়। একেই কেউ কেউ বলেন প্রত্যাহার, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের প্রত্যাহার, কেউ বলেন বন্ধক্রিয়া ।
--------------------
No comments:
Post a Comment