Monday 18 July 2022

আনাপান ধ্যান- স্মৃতি ভাবনা

 শান্তি ব্যাপারটা আত্মার নিজস্ব। আনাপান ধ্যান- স্মৃতি ভাবনা  

আমরা মুখে  এক, আর মনে আর এক। আমরা ভিতরে এক আর বাইরে এক। আমরা বাইরে সবার সঙ্গে থাকি, কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমরা সবাই একা। আমরা অনেক ভালো কথা শুনি, এমনকি বুঝিও কিন্তু তা আমরা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারি না। আমরা  কেউ কেউ প্রযুর্য্যের মধ্যে থাকি, কিন্তু শান্তিতে থাকি না। আবার কেউ অপ্রাচুর্য্যের মধ্যেও শান্তি খুঁজে নিতে পারি। আমরা ভালো ভালো কথা শুনি, আমরা ভালো ভালো বই পড়ি, কিন্তু সেই সব কথা আমরা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারি না।  এমনকি আমরা ভালো ভালো কথা বলতেও পারি, কিন্তু সেই কথা আমরা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে অক্ষম হয়ে যাই।  বন্ধুর বাবা যখন অকালে মারা গেলেন, তখন বন্ধুকে আমি কত আশ্বাস বাণী শুনিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য তার মনটাকে একটু শান্ত করা।  কিন্তু আমার ছোট ভাইটি যখন অকালে  মারা গেলো, তখন আমি শোকের সাগরে ভেসে গিয়েছিলাম। তো অনেক কথা আমরা  বলি যা আসলে কথার কথা, মন থেকে বলি না। অর্থাৎ আমাদের মনের কথা আর মুখের কথা এক হয় না। আমরা শ্রীমৎ ভগবৎ গীতা পড়ি, আর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন বলেন, শোক করা বৃথা তখন আমরা ভগবানের কথায় বিশ্বাস করি, কিন্তু আমার জীবনে যখন মৃত্যুর আঘাত আসে, তখন আমি নিজেকে বলতে পারি না যে শোক করা বৃথা। আমরা স্বনির্ভরতার কথা বলি, সদর্থক চিন্তার কথা বলি, নিজেকে পরিবর্তনের কথা বলি, নিজেকে উন্নতির কথা বলি, এগুলো বলতে আমি খুবই পারি, কিন্তু নিজেকে পরিবর্তন করতে পারি না।  নিজেকে উন্নত করতে পারি না। আমরা রাগ দ্বেষ, ঘৃণা ভয়, দূর করবার কথা বলি, কিন্তু নিজের জীবন থেকে তা দূর করতে পারি না। আমি ছেলেকে ভালোকরে পড়াশুনা করতে বলি, স্ত্রীকে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করি, কিন্তু আমি নিজের কাজটা ঠিক সময়ে ঠিকঠিক মতো করি না, এমনকি এই ছেলেমেয়ে-স্ত্রী-র জন্য আমি দুশ্চিন্তাও  করি। আমার অসুস্থতার সময় যখন স্ত্রী সারা-রাত  জেগে  আমার সেবা যত্ন করে, তখন তাকে আমি ঘুমুতে বলি, আর স্ত্রীর অসুখের সময় আমার ঘুম আসে না। আমরা বইতে পড়ি, বা মহাত্মাদের কাছে শুনি, সুখ আছে অন্তরে, বাইরে নয়। তথাপি আমরা সেই সুখ খুঁজি বাইরে। অন্যের অস্স্থুতায়, তাকে সহ্য করতে বলি, নিজের অসুস্থতা আমাদের অসহ্য  মনে হয়। আমরা সবাই বলি, আমাদের ধর্ম্মত ভালো, কিন্তু আমি ধর্ম্মিক হতে পারি না।  

আসলে আমাদের একটা পরম্পরা আছে, আমাদের একটা বিশ্বাস আছে, যা আমাদের বহু জনমের সম্পদ।  এই বিশ্বাস এই পরম্পরাকে আমরা কিছুতেই পরিবর্তন করতে পারি না। আপনি যতই বলুন, বাড়ি-গাড়ি-স্ত্রী-পুত্র-সংসারের সুখ নেই, তথাপি এখানেই আমরা সবাই সুখের সন্ধান করে থাকি ।  এর বাইরে যাবার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা  গুরুদেবের আশ্রমে যাই, গুরুদেবের কথা শুনি,এমনকি ভালো ভালো শাস্ত্র গ্রন্থ পড়ি, এবং যখন সেই সব অমৃতকথা শুনি, বা শাস্ত্র গ্রন্থ পাঠ করি, তখন আমরা বিশ্বাস করি, যে গুরুদেব যা বলছেন, তা সত্য, শাস্ত্র গ্রন্থে যা লেখা আছে, তা সত্য, এই সব কথার সঙ্গে  নিজে সহমত পোষন করি, কিন্তু আমি যখন গুরুদেবের আশ্রম থেকে বেরিয়ে আসি, বা  যখন বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলি, তখন মনে হয়, এইসব কথা কাজে লাগানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মনে মনে ভাবি, গুরুদেবের তো স্ত্রী-ছেলে-মেয়েদের খাওয়া -পরার জোগাড় করতে হয় না, তার পক্ষে এসব কথা বলা সম্ভব, কিন্তু আমার পরিস্থিতিতে পড়লে, তখন এই শুকনো কথায় চিরে ভিজতো না। আমার পরিস্থিতিতে এইসব কথা মেনে চলা সম্ভব নয়। আসলে আমাদের মধ্যে সেই উদ্দম আসে না, যাতে আমরা একটু চেষ্টা করবো। গুরুদেবের কথা অনুযায়ী চলবো। আমাদের মধ্যে সেই উৎসাহের অভাব, যাতে ভালো কাজ করবার জন্য আমরা দৃঢ় হতে পারি, তার জন্য আমাদের কোনো প্রয়াস নেই । আমরা ভাবি, এগুলো সব হয়তো এমনি এমনি হয়ে যাবে। আমরা শুনে থাকি, রাগ মানুষকে ধংশ করে দিতে পারে।  গুরুদেব বলেছেন, রাগ দ্বেষ-ঘৃণা-ভয় তোমার স্বরূপ নয়, এগুলো তুমি তোমার ভিতরে তৈরী করছো।  আর এগুলো যদি তুমি তৈরী করতে না জানতে, বা না তৈরী করতে, তবে এগুলো তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারতো না। এমনকি আমরা এটাও ভাবি, ঠিক আছে, এবার অসতর্ক মুহূর্তে আমার রাগ হয়েছে, এর পরের থেকে আমায় রাগ করবো না, শান্ত থাকবো। কিন্তু কাজের সময় সেই প্রতিজ্ঞার কথাবেমালুম ভুলে যাই। 

দেখুন, আমরা সবাই শান্তির পিয়াসী। আমরা সবাই শান্তি চাই। আর এই শান্তির জন্য আমরা অহর্নিশি বাইরের বিষয়ের দিকে দৌড়োচ্ছি। আমরা ভালোবাসা চাই, আর এই ভালোবাসা পাবার জন্য, আমি স্ত্রী-পুত্রের দিকে চেয়ে আছি। আসলে ভালোবাসা আছে, আমার ভিতরে, ভালোবাসা আছে আমার অন্তরে। ভালো বাসা বাইরে থেকে আসে না।  স্ত্রী-পুত্র থেকেও আসে না। ভালোবাসা আসে, নিজের অন্তরের  অন্তঃস্থল থেকে। আমি যখন নিজের অন্তরের  দিকে দৃষ্ট ফেরাবো, তখন সেই ভালোবাসার স্থির সমুদ্রে উথালপাথাল শুরু হবে। আমরা ভুলে গেছি, ভালোবাসার বোঝা  মাথায় নিজে আমি ভারাক্রান্ত হয়েছি। আমি যদি ভালোবাসার ডালিকে মাথা থেকে নামিয়ে হৃদয়ে নিয়ে আনতে  পারতাম,  আর শ্বাস-রূপ চাবি দিয়ে যদি খুলে ফেলতে  পারতাম, তবে জীবকুল  আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠতে পারতো।  আপনি সারা বিশ্বের কোনায় কোনায় এই শান্তিকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। শুধু এই চাবিটার  দিকে একটু খেয়াল করুন। আপনি সবত্র খুঁজছেন, সেই শান্তিকে, শুধু সে যেখানে আছে সেখানে ছাড়া। আমরা সেই আলোর সন্ধান করি, যে আলোতে সবকিছু খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু সেটি যেখানে  রয়েছে, যেখানে সেটি হারিয়েছে, সেখানে আলো ফেলি না। একজন রাস্তায় কিছু খুঁজছে, তো তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, কি খুঁজছেন, বললো, আমার সুজটি হারিয়েছে। তো ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় হারিয়েছে ? তিনি বললেন, হারিয়েছে তো ঘরের মধ্যে। তিনি বললেন, ঘরের মধ্যে হারিয়েছে, কিন্তু রাস্তায় খুঁজছেন কেন ? ভদ্রলোক বললেন, ঘরের মধ্যে তো আলো নেই. তাই যেখানে আলো আছে, সেখানে খুঁজছি। আসলে, আলোর মধ্যে খোজ সহজ। অন্ধকারে আমরা কিছুই দেখতে পাই না। তাই আলোর মধ্যে সবকিছুর সন্ধান করি। আমরা সবাই, খুব ভালোভাবে জানি, শান্তি আছে আমাদের নিজেদের অন্তর গুহায়।  তবু আমরা বাইরে বিষয়ের মধ্যে আনন্দ খুঁজি। আমরা জানি, পৃথিবীতে আমরা কিছুই নিয়ে আসিনি, কিছু নিয়েও যেতে পারবো না, তবুও বিষয়ের প্রতি আগ্রহ আমাদের যায় না। 

ভগবান বুদ্ধ তার পুত্র রাহুলকে একদিন বলেছিলেন। দেখো প্রথিবীতে তুমি কিছুই নিয়ে আসোনি। এমনকি এই যে তোমার শরীর যাকে তুমি আমি ভাবছো, এই শরীরও তোমার নয়। এই শরীর কিছু ধাতুরসমষ্টি মাত্র। হে রাহুল, আমাদের শরীরের যা কিছু কঠিন, কোমল বস্তু যেমন, চুল, লোম, নখ, চর্ম্ম, মাংস, অস্থি, চর্বি, মজ্জা, শিরা-উপশিরা, যকৃৎ, প্লীহা, উদর, ফুসফুস,অন্ত্র ,নাক, কান, চোখ, মুখ, হৃদয়, মস্তিস্ক, যা  কিছু দেখছো, এগুলো নাম-রূপ ছাড়া কিছুই নয়। এগুলো সবই ধাতু বা উপাদান মাত্র। বিশেষ ধাতুর বিশেষ পরিমাণগত মিশ্রনে  এই নাম-রূপের সৃষ্টি হয়েছে। এর কোনোটাই যেমন তুমি নয়, আবার এর কোনোটাই তোমার নয়। শরীরের বাইরের দিকে  যা কিছু দেখছো, সে সব ক্ষিতি ধাতু। সুতরাং এটি তুমি নয়, তোমার  নয়। এই সত্য উপলব্ধি করো। এই শরীর অন্ন দ্বারা গঠিত আবার অন্নে পরিণত হয়ে যাবে। 

যাকিছু নিক্ষেপ করা যাক না কেন,  তাতে পৃথিবীর কিছুই যায় আসে না। তুমি পৃথিবীর মতো নিজেকে নির্লিপ্ত করো। সুখ দুঃখের অনুভূতি থেকে নিশ্চল থাকো। দেখো, জলের দ্বারা সমস্ত নোংরাকে ধৌত করা হয়, এতে করে জলের কিছুই আসে যায় না। অগ্নিতে সমস্ত কিছুই দগ্ধ করা হয়, তাকে অগ্নির কিছুই যায় আসে না। বায়ু কঠিন-কোমল সব কিছুর মধ্যেই প্রবাহিত হয়। কিন্তু এতে করে বায়ুর কিছুই এসে-যায় না। আকাশ সমস্ত কিছুকে বক্ষে ধারণ করে আছে।  ভালোকেও ধারণ করে আছে, আবার মন্দকেও  ধারণ করে আছে। তুমিও এইসব ধাতুর মতো ভালো-মন্দে উদাসীন হও। তাহলেই তুমি তোমাকে জানতে পারবে। 

হে রাহুল, তোমার শরীরে যে রক্ত, মূত্র, কফ, শ্লেষ্মা, পুঁজ পিত্ত, ঘাম, অশ্রু, থুথু, লালা, স্রাব, এসব আসলে অপ বা জল ছাড়া কিছু নয়। এগুলো তুমি নয়, এগুলো তোমার নয়। এগুলো যেখান থেকে এসেছে, সেখানেই চলে যাবে। 

হে রাহুল, আমাদের শরীরে, যে অনুরাগ, ক্রোধ, হিংসা বল, বীর্য, আছে, তা আসলে তেজ বা অগ্নি ধাতু বিশেষ।এই ধাতুও তোমার নয়, তুমি নয়। এই সত্য যদি উপলব্ধি করতে পারো, তবে এর থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারবে। 

হে রাহুল, তুমি যে শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়ার ফলে শরীরকে বাঁচিয়ে রেখেছো, তুমি যে উদ্গার তুলছো, তুমি যে বায়ু নিঃসরণ  করছো, তোমার মধ্যে যে প্রাণ, অপান, সমান, ব্যান, উদান বায়ুর খেলা চলছে, সবই বাইরের বস্তু। এগুলো যেখান থেকে এসেছে সেখানেই  চলে যাচ্ছে।  এই বায়ু তুমি নও, আর এগুলো তোমারও নয়।  এই সত্যকে উপলব্ধি করো। তবে নিজেকে খুঁজে পাবে। 

তোমার শরীর-মধ্যে যে নবদ্বার বিশেষ ছিদ্র আছে, (নাক-২, মুখ-১, কান-২ চোখ-২, পায়ু,-১ উপস্থ-১ ) এগুলো আকাশ ধাতু  মাত্র। এইসব  আকাশ থেকে এসেছে, আবার আকাশেই ফিরে যাবে। এগুলো তুমি নও. এগুলো তোমারও নয়। এই সত্যকে উপলব্ধি করো, তাহলে তুমি নিজেকে আলাদা করতে পারবে। 

তো রাহুল, মানুষের শরীর ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম থেকে তৈরী হয়েছে। এই সমস্ত ধাতুর গুনের কারনে, তোমার মধ্যে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধের উদ্ভব হয়েছে।  এর কোনোটাই তুমি নয়, বা তোমার নয়। এই সত্যকে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করো। 

হে রাহুল, তোমার  মধ্যে যে ভাবনার উদয় হচ্ছে,  তাও  আসলে তুমি নয়, তোমার নয়। আসলে এই পঞ্চভূতের শরীরে রসের মধ্যে, স্নায়ুর মধ্যে যে কম্পন উঠছে, সেই কম্পন তোমার ভাবনার কারন।  এই ভাবনা আসলে তুমি নয়, তোমার নয়।  এই সত্যকে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করো। 

দেখো, এই পৃথিবী সর্বংসহা।  এই পৃথিবীতে যেমন রাহুল, দয়া, করুনা, মৈত্রেয়ী ভাব তোমার নিজস্ব - এই ভাবের প্রকাশ হতে দাও।  তবেই তুমি নিজেকে প্রকাশ করতে পারবে। হে রাহুল, তুমি সদা আত্মতৃপ্ত থাকো - কেননা তোমার কোনো কিছুর ভাব-অভাব নেই। তোমার না আছে, গ্রহণ, না আছে ত্যাগ। তুমি নির্লিপ্ত হও। 

তো রাহুল বললেন, সবই আমি বুঝি।  কিন্তু বুঝেও বুঝতে পারি না। নিজের জীবনে এসব তত্ত্বকথার প্রয়োগ করতে পারি না।  

ভগবান বুদ্ধ বললেন, তুমি আনাপান ধ্যানের  অভ্যাস করো। 

নিৰ্জনে, মেরুদন্ড সোজা করে পদ্মাসনে বসো। চোখদুটি মুদ্রিত অবস্থায় রাখো।  এবার সচেতন ভাবে শ্বাস প্রশ্বাসের দিকে মনোযোগ দিয়ে শ্বাসের আসা যাওয়া দেখতে থাকো। শ্বাস যখন ভিতরে যাচ্ছে, সচেতন ভাবে খেয়াল করো, কোথায় যাচ্ছে। কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। কোথায় গিয়ে স্থির হচ্ছে, আর কোথা থেকেই বা আবার শ্বাস ফিরে আসছে। শুধু সচেতন ভাবে অনুভব করবার চেষ্টা করো, শ্বাস ভিতরে যাচ্ছে, ক্ষনিকের জন্য স্থির হচ্ছে, আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। এতে করে, ধীরে ধীরে তোমার দেহের অনুভূতি লোপ পেয়ে যাবে। তখন থাকবে শুধু শ্বাস-প্রশ্বাস। সচেতন ভাবে এই শ্বাস-প্রশ্বাস-এর সাক্ষী হয়ে যাও। সচেতন ভাবে খেয়াল করবার চেষ্টা করো, কে দেখছে, শ্বাসের গতাগতি। এই যে দ্রষ্টা, অবয়ব হীন, শরীর  বিহীন, পঞ্চভূতের উর্দ্ধে এই দ্রোষ্টাই জীবাত্মা। এই উপলব্ধি কে করছে, সেটাকে ধরবার চেষ্টা করো। এই উপলব্ধি করছে একটা শক্তি, যার নাম চেতন শক্তি।  এই চেনশক্তিই আত্মা।  তুমিই  আত্মা, এই সত্যকে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করো । এই ক্রিয়াটি নিষ্ক্রিয় হয়ে, নিঃসঙ্গ হয়ে, নিরন্তর অভ্যাস করো, একদিনের জন্যও যেন বিরাম না হয় । একেই বলে আনাপান স্মৃতি ভাবনা। তা তোমাকে নিজের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেবে।  তুমি আত্মাতে স্থিত হবে। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 


ভগবান বুদ্ধ প্রদত্ত ধ্যানক্রিয়া  - যা তিনি পুত্র রাহুলকে করতে উপদেশ দিয়েছিলেন। 

আনাপন ধ্যান। 

ভগবান বুদ্ধের পুত্র ছিলেন রাহুল।  এই রাহুলের দীক্ষাগুরু ও শিক্ষক ছিলেন সারিপুত্থ। একদিন রাহুল ভিক্ষায় যাবার পথে মনের বিক্ষিপ্ততা হেতু, রাস্তায় গাছের নিচে বসে পড়লেন। ভাবলেন, আজ আর ভিক্ষায় যাবো না। রাহুলের মনের এই সিদ্ধান্তহীনতা পর্যবেক্ষন করে তার দীক্ষাগুরু সারিপুত্থ, তাকে বললেন, রাহুল তুমি আনাপান ধ্যানে রত হও। 

হে রাহুল, নির্জনে বা অরণ্যে কোনো বৃক্ষমূলে পদ্মাসনে শরীর সোজা করে বসে এই ধ্যান করতে হবে। সচেতন ভাবে শ্বাস নেবে, আবার সচেতনভাবে শ্বাস ছাড়বে। প্রথমে দীর্ঘ সময়ে নিয়ে শ্বাস গ্রহণ ও বর্জন করবে। শ্বাস নেবার সময় সচেতন থাকবে।     

 

ষোলকলা : আমাদের এই পৃথিবী ঘোরে সূর্যের চারিদিকে, আর চন্দ্র ঘোরে পৃথিবীর চারিদিকে। সূর্যের আলো আছে কিন্তু চন্দ্রের নিজস্ব কোনো আলো নেই। সূর্যের আলো চন্দ্রের উপর পড়লে সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে এসে পড়ে। এ কারণেই আমরা চন্দ্রকে দেখতে পাই। চন্দ্র পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরার সময় টাইডাল লকের কারণে আমরা চন্দ্রের শুধুমাত্র একটা পার্শ্ব দেখতে পাই। চন্দ্রের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে এর দৃশ্যমান পার্শ্ব বিভিন্নভাবে সূর্যের আলোতে আলোকিত হয়। এই আলোকিত অংশের পরিমাণ শূন্য হতে বৃদ্ধি পেতে পেতে একসময় চন্দ্রের সেই পৃষ্ঠ শতভাগ আলোকিত হয়, তখন বলা হয় পূর্ণিমা। আর আলোকিত অংশের পরিমাণ কমতে কমতে চন্দ্র অদৃশ্য হয়ে গেলে বলা হয় অমাবশ্যা। চন্দ্রের আলোকিত অংশের এই হ্রাসবৃদ্ধির এক একটি অধ্যায়কে বলা হয় কলা বা চন্দ্রকলা। কলার সংখ্যা ষোলোটি। ষোলোটি কলাকে একত্রে বলা হয় ষোলোকলা। এই প্রতিটি কলার আলাদা আলাদা নাম আছে। কলাগুলি হলো - অমৃতা, মানদা, পূষা, তুষ্টি, পুষ্টি, রতি, ধৃতি, শশিনী, চন্দ্রিকা, কান্তি, জ্যোৎস্না, শ্রী, প্রীতি, অক্ষদা, পূর্ণা এবং পূর্ণামৃতা। ষোলটি কলা পূর্ণ হলে তবেই চন্দ্রের পূর্ণিমা ও অমাবশ্যা হয়। চন্দ্রের এই ষোলোটি কলা থেকেই 'ষোলোকলা' শব্দের উৎপত্তি । কারো পতন হলে বলা হয়ে থাকে পাপের ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে। 

      








   

    








Saturday 16 July 2022

মাণ্ডূক্য উপনিষদ (শ্লোক ৪৫-৭১)

আমার না আছে জন্ম, না আছে মৃত্যু। 

মূলসূত্র: মাণ্ডূক্য উপনিষদ (শ্লোক ৪৫-৭১)

আমার না আছে জন্ম না আছে মৃত্যু - আমি শুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ । আপনি কি এই কথাগুলো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন ? 

আমরা এই ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা করবো। আমরা অনেকে সেই বিখ্যাত বৈদিক মন্ত্রটির কথা জানি, 

"অহং দেবো ন চান্যোস্মি ব্রহ্মৈবাষ্মিন ন শোকভাক
সচ্চিদানন্দ রুপোঽস্মি নিত্য মুক্ত স্বভাববান।"

আমি দেহ নোই, আমার জন্ম, জরা, মৃত্যু নেই, আমি নিত্য শুদ্ধ আত্মা। 

এই মন্ত্রটি আমরা অনেকেই প্রাতঃকালে পাঠ করে থাকি।  কিন্তু এর মর্মার্থ আমরা জানি না। এই সম্পর্কে আমরা মাণ্ডূক্য উপনিষদ থেকে শুনবো। আসলে, যারা অদ্বৈত বাদে বিশ্বাসী, তাঁরা এই দৃশ্যমান জগৎকে কিছুতেই সত্য বলে মেনে  নিতে চান না। তাঁরা মনে করেন, সমগ্র দৃশ্যমান এই যে জগৎ, তা সর্বৈব মিথ্যা, সত্য হচ্ছে শুধু  শুদ্ধ চৈতন্য।  কিন্তু কথা হচ্ছে, চৈতন্য বা আত্মার না আছে জন্ম না আছে মৃত্যু।  তো এই জগৎ বা আমাদের তো দেহধারীর তো জন্ম মৃত্যু আছে। চৈতন্য বা আত্মা নাকি অক্রিয় অর্থাৎ কিছুই করেন না।  কিন্তু এই জগৎ তো ক্রিয়াশীল। বলা হয়ে থাকে চৈতন্য অনাদি অনন্ত।  কিন্তু এই দৃশ্যমান জগৎ তো অনাদি অনন্ত নয়। বিশেষ করে যে সকল জীবকুল সামান্যতম হলেও  চৈতন্যের অধিকারী, তারা তো কেউ  অনাদি অনন্ত জগতের বাসিন্দা নয়।  এমনকি আমাদের পৃথিবীর উপগ্রহ, চাঁদে গেলেও এদের দেখা মিলবে না। শুধু তাই নয়, হয়তো বরফের জগতে বা মাটির নিচে, অথবা সমুদ্রের গভীরে হয়তো কোনো চৈতন্যবান জীবের, বা কোনো মানুষের  দর্শন পাবেন না। 

অদ্বৈতবাদী  পুরুষগন বলছেন, চৈতন্যের জন্ম হয় না তবু মনে হয়, জন্ম হয়েছে। যেমন আপনার একটি ছেলে হলো, তার নাম রাখলেন, চৈতন্যদেব। আসলে চৈতন্যদেবের জন্ম হয়নি, শুধু এখানে চৈতন্যদেব নাম-রূপের  জন্ম হয়েছে । লোকে মনে করে, একটা নতুন মানুষের জন্ম হয়েছে। জাদুকরের জাদুবিদ্যা প্রদর্শন দেখেছে ? সেখানে জাদুকর একটা সুন্দর ফুল, বা একটা খরগোশের দেহ ধরে আনলেন, শূন্য থেকে । কিন্তু এই যে জন্ম তা সত্য নয়।  একটু পরে, আমরা দেখছি, সেই খরগোশ মঞ্চের মধ্যে হেটে চলে বেড়াচ্ছে। আপনার ছেলে চৈতন্যদেবও হেটে চলে বেড়াচ্ছে।  আসলে দেহস্থিত শুদ্ধ চৈতন্য  হেটে চলে বেড়াচ্ছে।  আপনার ছেলের দেহের পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু শুদ্ধ চৈতন্যের পরিবর্তন নেই। যা ছিল তাই আছে। আসলে, চৈতন্যদেবের যে পরিবর্তন তা এই শুদ্ধ-চৈতন্যের উপরে আমরা আরোপ করছি। এই হলো মায়ার কার্যপ্রণালী। এই সত্য যারা জেনেছে, তারাই অদ্বৈতবাদী। এঁরা কখনও মায়ার দ্বারা অভিভূত হন না। 

মাণ্ডূক্য উপনিষদ, এই বিষয়কে একটা সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন। বলছেন, আলোর রেখা সবসময় সোজা।  কিন্তু যখন আলোর উৎস সেই মশালকে যদি ঘোরানো হয়, তখন আলোর রেখার অন্য রকম দেখায়।  কিন্তু তার মানে এই নয়, যে আলোর রেখা বক্র হতে পারে। আসলে  আলোর রেখার যে ধর্ম্ম অর্থাৎ সোজা থাকা, তার কিন্তু কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। কিন্তু আলোর রেখার মধ্যে যে পরিবর্তন আমাদের মনে হচ্ছে, যা আমাদের ভ্রান্ত দর্শন। একই চৈতন্য কখনো জ্ঞাতা, কখনো জ্ঞেয়, কখনো দ্রষ্টা কখনো দৃশ্য, কখনো কার্য্য কখনো কারন। এই ভাবে জন্ম-মৃত্যু আসলে আরোপিত সত্য, প্রকৃত সত্য নয়। আলো যখন স্থির তখন সেই আলোকে দেখতে পাই না।  যখন যে বস্তুতে প্রতিভাত হয়, তখন সেই বস্তু দেখি মাত্র। আমরা আলোকে দেখতে পাই না। এই যে আলোর রশ্মি, এর মধ্যে কোনো বস্তু নেই। এই আলো  কোনো বস্তু বা বাতি থেকে উৎপন্ন হতে পারে না। আমরা যে সিনেমা দেখি, এগুলো আসলে আলোর প্রতিফলন মাত্র।  এর মধ্যে  কোনো আকার থাকতে পারে না।  কিন্তু আমাদের মন এই আলোর মধ্যে দৃশ্যের এমনকি চরিত্রের কল্পনা করে, বিষয় উপভোগ করছে। এগুলো সবই আমাদের চোখের ভ্রম বৈ  কিছু নয়।  মনের কল্পনা বৈ কিছু নয়। সমস্ত বস্তু সম্পর্কেও এই একই কথা প্রযোজ্য।  আমরা মনে করছি, এগুলোর অস্তিত্ত্ব আছে, তাই সেগুলো আছে। মনের এই রচনা যখন থাকে না তখন সমস্ত বস্তুর অস্তিত্ত্ব বিলোপ হয়।  সাধনক্রিয়ার উচ্চ অবস্থা যাঁরা প্রাপ্ত করেছেন, অর্থাৎ আত্মজ্ঞানী পুরুষ  আত্মার বা চৈতন্যের অপ্রকাশিত অবস্থা সম্পর্কে অর্থাৎ আত্মার স্বরূপকে জানতে পারেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা জানি, কারন বিনা কার্য্য হতে পারে না।  মানুষ থেকে মানুষের জন্ম  হয়, গাছ থেকে গাছের জন্ম হয়, মাছ থেকে মাছের জন্ম হয়। তো একমাত্র বস্তু থেকে আর একটি বস্তুর উৎপত্তি হতে পারে। তো আত্মা বা চৈতন্য থেকে কিভাবে বস্তুর উৎপন্ন হলো ? তো আত্মার স্রষ্টা কে ? আত্মা নিশ্চই আত্মাকে সৃষ্টি করেন নি। আবার বাহ্য বস্তু থেকেও আত্মার সৃষ্টি হয় নি। দেখুন, যতক্ষন আমরা কার্য্য-কারন সম্পর্ককে  গুরুত্ত্ব দেই, ততক্ষন এই যে কার্য-কারন সম্পর্ককে  সত্য বলে মনে হয়। এই কার্য্য-কারন সম্পর্ককে যারা সত্য বলে মনে করেন, তাঁরা দ্বৈতবাদী। কিন্তু সত্য হচ্ছে,  সৃষ্টির গোড়ার দিকে যদি আমরা একটু  দৃষ্টিপাত করি, তবে আমরা স্বীকার করতে বাধ্য হবো, যে একটা সময় ছিল, যখন এই মনুষ্যকুল, জীবকুল, উদ্ভিদকুল, কিছুই ছিল না। তো তখন তাদের অর্থাৎ দ্বৈতবাদীর  দৃষ্টিতেও  নিশ্চয় কিছুই ছিল না। তো এলো কোথেকে ? কাজেই  আমাদের স্বীকার করতেই  হবে, আমাদের স্মরণে আনতেই   হবে, যে একটা সময় ছিল, যখন এক বৈ দুই ছিলই না। আর সেই এক হচ্ছে ব্রহ্ম বা আত্মা বা চৈতন্য, যে নামেই আপনি তাকে ডাকুন না কেন. সেই এক বৈ দুই অবশ্য়ই ছিল না।  

যতক্ষন আমাদের দ্বৈত-বোধ থাকবে, ততদিন দ্বন্দ থাকবে, ততদিন দুঃখ থাকবে। ততদিন আমাদের আসক্তিও  থাকবে। .আর অজ্ঞানতার কারনে,  এই দ্বৈতবোধের ভ্রমজ্ঞান  যখন আমাদের মন থেকে দূর হয়ে যাবে, তখন আমরা সুখী হবো। আর জীবনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে,  এই আত্মজ্ঞান লাভ। 

অজ্ঞ মানুষ মনে করে, মানুষ জন্ম গ্রহণ করে।  আর মানুষ যদি জীবাত্মা হয়, তবে অবশ্যই  জীবাত্মা জন্ম গ্রহণ করে থাকে। আর এই জীবাত্মার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কেননা আমাদের চোখের সামনে জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। এইসব ঘটনা বাহ্যিক ভাবে সত্য হলেও, এ আসলে সেই ভোজবাজির খেলা। জীবাত্মার কখনো জন্ম হয় না। সুতরাং জীব  মরণশীল, বা কেউ অমর এই কথাগুলোর কোনো সত্যতাই  নেই। 

দেখুন, স্বপ্নে আমরা অনেক কিছু দেখি, শুনি।  কিন্তু সেখানে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। এখানে একই মন দুই বা ততোধিক দেখছে। ঠিক তেমনি আমরা জাগ্রত অবস্থায় অবিদ্যার প্রভাবে দুই বা ততোধিক দেখছি। এই দেখার মধ্যে কোনো সংশয় জাগে না।  তো স্বপ্ন  বা জাগ্রত অবস্থায় আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়, তা আসলে দৃষ্টিভ্রম ছাড়া কিছু নয়। 

আমরা বিশ্বাস করি, স্বপ্নে আমরা যা কিছু প্রতক্ষ্য করছি, তা মিথ্যা, কারন জেগে উঠে আমরা আর সেগুলোকে  দেখতে বা শুনতে পাই না। তাই স্বপ্নে দৃষ্ট ঘটনা সহজেই অবাস্তব বলে মনে করতে পারি। এগুলোকে আমরা আমাদের মনের ভ্রম, বা আমাদের মনের সৃষ্টি বলে উড়িয়ে দিতে পারি। ঠিক তেমনি জাগ্রত অবস্থায় আমরা যা কিছু দেখছি, বা শুনছি, তা কেবল মাত্র জাগ্রত ব্যক্তিরাই দেখতে বা শুনতে পারেন। এইসব ঘটনা বা দৃশ্য কেবলমাত্র জাগ্রত ব্যক্তিই  দেখতে পারেন। একটা ঘরের মধ্যে, এক বিছানায়, আপনি ভাইকে নিয়ে  শুয়ে আছেন। আপনার চোখে ঘুম আসছে না।  আপনার ভাই ঘুমিয়ে পড়েছে।   আপনার ভাই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে, যা আপনি একই বিছনায় শুয়ে থাকলেও দেখতে পারছেন না। কেননা আপনার চোখে ঘুম নেই।  আবার আপনি চেয়ে চেয়ে যে কড়িকাঠ দেখছেন, তা আপনার ভাই দেখতে পারছে না। তো দেখুন, একই বিছানায় শুয়ে আছেন দুইজন। কিন্তু দুজনের দর্শন-অভিজ্ঞতা দুই রকম। জাদুকর একজনকে অস্ত্র দিয়ে দুই টুকরো করে দিলো।  ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে বেরুচ্ছে। দর্শকের আসনে আপনি বসে প্রত্যক্ষ করছেন।  জাদুকর এমনকি জাদুকরের সঙ্গীরা সবাই জানে। যাকিছু দেখছি, তা সত্য নয়। কাউকে মারা বা কাটা হয়নি, আর রক্তও বেরুচ্ছে না। কিন্তু আপনার কাছে, সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছে সব সত্যি। 

তো আমরা পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে যাকে  মারা যেতে দেখছি, বা জন্মাতে দেখছি, তা সত্য নয়। আসলে আমরা যে জন্ম-মৃত্যু পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে জাগ্রত অবস্থায় দেখছি, তা আসলে সত্য নয়। এই জন্ম-মৃত্যু কৃত্তিম, জাদুকরের ভেলকি মাত্র - যা আমাদেরকে বিব্রত করছে, দুঃখী করছে, বা সুখী করছে। বস্তুত কেউ জন্মায় না, কারুর জন্মাবার সম্ভাবনা নেই, বস্তুত কোনো কিছুর জন্ম হবার সম্ভাবনাই নেই। এই হলো পরম সত্য।  আর যার জন্ম নেই, তার মৃত্যুও হতে পারে না। এই হচ্ছে পরম-সত্য। এই চরম সত্যকে উপলব্ধি করতে সাধক যোগক্রিয়াতে লিপ্ত হন। 

সবশেষে ঠাকুর রামকৃষ্ণের একটা গল্প দিয়ে শেষ করি।  এক চাষীর একমাত্র ছেলে মারা গেছে।  স্ত্রী অঝোরে কাঁদছে। চাষী কিন্তু নির্বিকার। তো সবাই জিজ্ঞেস করলো, তোমার মনটা তো শক্ত, তোমার একমাত্র ছেলে মারা গেছে, বাড়ির সবাই শোকাহত, এমনকি পাড়ার সবাই হা হুতাশ করছে, আর তোমার চোখে জল নেই ? কি পাষন্ড তুমি ! তো চাষী বললো, দেখো, ঘুমের মধ্যে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম, আমার ৭/৭টি জোয়ান ছেলে, আর আমি এক মস্তবড়ো  দেশের রাজা। তো হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেলো, চোখ মেলে দেখি, কোথায় আমার রাজত্ব, কোথায় আমার সেই সৎগুণের অধিকারী, যুবক ৭টি ছেলে ? ঘুম ভেঙে গেলো, স্বপ্ন ভেঙে গেলো, এখন আমি কার জন্য কাঁদবো ? একটা পুত্রের জন্য না ৭টি পুত্র আর রাজ্ বৈভবের জন্য। আসলে, জ্ঞানীর কাছে, স্বপ্ন আর জাগ্রত অবস্থার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দুটোই মিথ্যে।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

----------------       

 










   

Friday 15 July 2022

শান্তি ব্যাপারটা আত্মার নিজস্ব

 এক রাজাকে এক পণ্ডিত ব্রাহ্মণ প্রতিদিন দক্ষিণার বিনিময়ে শাস্ত্রপাঠ করে শোনাতো। শাস্ত্রপাঠ শেষে সে রাজাকে প্রশ্ন করতো, রাজামহাশয় বুজেছেন তো ? বিষয়ে আসক্ত জীবের সুখ-দুঃখের অনুভূতি হয়। বিষয়ে অনাসক্ত জীব আনন্দে থাকে।  তো রাজা তার প্রতি-উত্তরে বলতেন- তুমি বুঝেছো তো ? তুমি আগে বোঝো। এখন রাজার এই কথায়, পণ্ডিত ব্রাহ্মণ কেমন যেন অপমানিত বোধ করতো।  মনে মনে ভাবতো, সংসারের জন্য, যদি অর্থের প্রয়োজন না হতো, তবে আর সে রাজাকে শাস্ত্রপাঠ করে শোনাতো না। কেননা, শাস্ত্র কথা যে শুধু শোনে, কিন্তু গ্রহণ করতে চায় না, তাকে শাস্ত্রকথা শোনানো বৃথা।  এ যেন ভষ্মে ঘি ঢালা। 









ekশান্তি ব্যাপারটা আত্মার নিজস্ব সম্পদ। আমরা সবাই পরিবেশের দাস। 


আমি তখনই সুখী হয়, যখন মাস্টার মহাশয় আমাদের অনেক নাম্বার দেন।  যখন মাস্টার মহাশয় আমাকে প্রশংসা করেন। আমরা তখন সুখী হই, যখন আমার বাড়ি গাড়ি থাকে। যখন আমার হাতে টাকা পয়সা থাকে। যখন সবাই আমার প্রসংসা করে, তখন আমি সুখী হয়। আমি তখন সুখী হয়, যখন আমার শরীর স্বাস্থ ভালো থাকে। আবার এর উল্টোটা হলেই আমরা দুঃখী হয়ে যাই। আমরা গাড়িতে কেউ আঘাত করলে, আমার শরীরে কেউ আঘাত করলে, এমনকি আমার স্ত্রী-পুত্রকে কেউ আঘাত করলে, আমরা দুঃখী হয়ে যাই। তো আমার সুখ-দুঃখ ওই গাড়ি, বাড়ি, স্ত্রী, পুত্র, শরীর ইত্যাদির উপরে নির্ভর করছে। আমি বিশ্বাস করি, বা বলা যেতে পারে, আমার মধ্যে এক বদ্ধমূল ধারণা  হচ্ছে, এগুলোর মধ্যেই আমার সুখ-দুঃখ নিহিত আছে। তাই এগুলোকে নিয়ে আমি বাঁচতে চাই, এগুলোকে সুরক্ষিত করবার জন্য, আমার স্বাভাবিক আগ্রহ ও চেষ্টা থাকে। এগুলোকে ছাড়া আমি বাঁচতে জানি না। এখন কথা হচ্ছে, মহাত্মাগণ বলছেন, তোমার এই যে বিষয়কে ঘিরে যে সুখ-দুঃখের অনুভূতি হচ্ছে, এটি  আসলে সত্য নয়। দেখো, তুমি ধরো একটা ভালো কিনেছো, সেই গাড়ির ভিতরে তুমি বসে আছো, একটা আরাম অনুভব করছো।  এই যে আরাম তোমার শরীরকে জুড়িয়ে দিচ্ছে। আসলে আমি যখন নিজেকে শরীর বলে মনে করি, তখন শরীরের সুখকে আমি আমার সুখ বলে মনে করি।