Saturday 18 November 2017



তুহি তুহি।তুহি তুহি।তুহি তুহি।তুহি তুহি। .............


তুমিই সব - তুমিই শব

তুমিই সব - তুমিই শব

তুমিই সব - তুমিই - তুমিই শব


১ তুমিই আত্মা - তুমিই অনাত্মা

২ তুমিই জীবাত্মা - তুমিই পরমাত্মা

৩ তুমিই অখণ্ড - তুমিই খণ্ড

৪ তুমিই ভান্ড - তুমিই ব্রহ্মান্ড

৫ তুমিই ভালো - তুমিই মন্দ

৬ তুমিই দয়া - তুমিই দন্ড

৭ তুমিই জ্ঞান - তুমিই অজ্ঞান

৮ তুমিই মান - তুমিই অপমান


৯ তুমিই জ্ঞাতা - তুমিই জ্ঞেয়

১০ তুমিই অসীম - তুমি অজ্ঞেয়

১১ তুমিই ক্ষেত্ৰ - তুমিই ক্ষেত্রজ্ঞ

১২ তুমিই অভিজ্ঞ - তুমিই অনভিজ্ঞ

১৩ তুমিই অধিকারী - তুমিই অনধিকারী

১৪ তুমিই ত্রিশূলধারী - তুমিই বংশীধারী

১৫ তুমিই গুরু - তুমিই শিষ্য

১৬ তুমিই দেবতা - তুমিই মনুষ্য




তুমিই সব ...... তুমিই শব




১৭ তুমিই শান্ত - তুমিই অশান্ত

১৮ তুমিই অন্ত - তুমিই অনন্ত

১৯ তুমিই ধীর - তুমিই অস্থির

২০ তুমিই গতি - তুমিই স্থীর

২১ তুমিই আনন্দ - তুমিই নিরানন্দ

২২ তুমিই হাসি - তুমিই কান্না

২৩ তুমিই কাছে - তুমিই দূরে

২৪ তুমিই ভিতরে - তুমিই বাহিরে




২৫ তুমিই জন্ম - তুমিই মৃত্যু

২৬ তুমিই নিত্য - তুমিই অনিত্য

২৭ তুমিই বৃহৎ - তুমিই ক্ষুদ্র

২৮ তুমিই ব্রাহ্মণ - তুমিই শুদ্র

২৯ তুমিই কর্ম - তুমিই কর্তা

৩০ তুমিই (কর্ম) ফলদাতা - তুমিই ফলভোক্তা

৩১ তুমি আমার - আমি তোমার

৩২ তুমি না কার - তুমি সবার


তুমিই।...... তুমিই। .............




৩৩ তুমিই পবিত্র - তুমিই অপবিত্র

৩৪ তুমিই অন্তর্হিত - তুমিই সর্বত্র

৩৫ তুমিই নিরাকার - তুমিই সাকার

৩৬ তুমিই মনুষ্য - তুমিই অবতার

৩৭ তুমিই জড় - তুমিই চৈতন্য

৩৮ তুমি তুলনারহিত - তুমি অনন্য

৩৯ তুমিই সাক্ষ - তুমিই সাক্ষী

৪০ তুমিই রক্ষক - তুমিই রক্ষী


৪১ তুমিই ভোক্তা - তুমিই ভোগ্য

৪২ তুমিই কর্তা - তুমিই কর্তব্য

৪৩ তুমিই মাতা - তুমিই পিতা

৪৪ তুমিই বনধু - তুমিই সখা

৪৫ তুমিই মরন - তুমিই জীবন

৪৬ তুমিই স্থুল - তুমিই কারন

৪৭ তুমিই জ্যান্ত - তুমিই মরা

৪৮ তুমিই যৌবন - তুমিই জ্বরা


তুমিই আমি - ন আমি।




৪৯ তুমিই ভক্তি - তুমিই ভক্ত

৫০ তুমিই আসক্তি - তুমিই আসক্ত

৫১ তুমিই দাতা - তুমিই গ্রহীতা

৫২ তুমিই ভীতিপ্রদ - তুমিই অভয়দাতা

৫৩ তুমিই বদ্ধন - তুমিই মুক্তি

৫৪ তুমিই শাক্ত - তুমিই শক্তি

৫৫ তুমিই বারি - তুমিই বুঁদবুঁদ

৫৬ তুমিই পাঁচকোষ - তুমিই পাঁচভূত


৫৭ তুমিই পুরুষ - তুমিই প্রকৃতি

৫৮ তুমিই মানব - তুমিই মানবী

৫৯ তোমাতেই সৃষ্টি - তোমাতেই লয়

৬০ তোমাতেই তুমি - তোমাতেই রয়

৬১ কোথায় জন্ম - কোথায় মৃত্যু

৬২ কোথায় মিথ্যে - কোথায় সত্যি

৬৩ তোমাতেই তুমি - তোমাতেই আমি

৬৪ তোমাকেই আমি - কোটি কোটি নমি




তুমিই আত্মা - তুমিই অনাত্মা

তুমিই জীবাত্মা - তুমিই পরমাত্মা


তুমিই সব - তুমিই শব

তুহি - তুহি - তুহি - তুহি।

















Monday 6 November 2017


তুমি সচ্চিদানন্দম - ৪

তুমি ন অগ্নি তুমি ন বায়ুম
তুমি ন পৃথ্বী  - তুমি ন জলম
তুমি সচ্চিদানন্দম ২

তুমি ন দেহ তুমি ন মনম
তুমি ন চিত্ত তুমি ন  বুদ্ধিম
তুমি সচ্চিদানন্দম ২

তুমি ন বিপ্র তুমি ন শুদ্রম
তুমি ন ধর্ম তুমি ন অধর্মম
তুমি সচ্চিদানন্দম ২

তুমি ন বন্ধ তুমি ন মুক্তম
তুমি ন ভোক্তা তুমি ন ভোক্তম
তুমি সচ্চিদানন্দম  ২

তুমি ন শুদ্ধ তুমি ন  বিশুদ্ধম
তুমি ন সুখং তুমি ন দুঃখম
তুমি সচ্চিদানন্দম  ২

তুমিই  - সাক্ষী, তুমিই  পূর্ণ
তুমিই  এক, তুমিই  শুন্য
তুমি অক্রিয়, তুমি নিঃস্পৃহ
তুমি অসঙ্গ, তুমিই  শান্তঃ

তুমি সচ্চিদানন্দম  ৪








Tuesday 3 October 2017

সত্য-ধর্ন্ম মহাত্মা গুরুনাথ - অন্যভাবে দেখা


সত্য-ধর্ম্ন

কলুষ-অনল-দগ্ধানাং শান্তয়ে-অমৃত বারিভিঃ ।
প্রকাশ্যতে  মুক্তয়ে মুক্তি-কাঙ্ক্ষিণাম ।।

(কলুষ অগ্নিতে দগ্ধ মনুষ্যকে  শান্ত করতে অমৃতবারি স্বরূপ সত্য-ধর্ম্ম প্রকাশিত হচ্ছে, যা মুক্তিকাঙ্খীকে মুক্ত করবে ) 


- মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত


মুখবন্ধ 
গুরুদেব  :-

আহা ! জগতের আজ কি শুভ দিন ! কি আনন্দময় দিন !! কি অমৃতময় দিন !!! কোটি কোটি মানবের উদ্ধারের  পথ  আজ প্রকাশিত হলো। পাপপূর্ণ জগৎ আজ পরিত্রানের পথ প্রাপ্ত হতে চললো। এর চেয়ে সুখের-আনন্দের  আর কি হতে পারে ??? হে মানবগন  তোমরা প্রস্তুত হও ; তোমাদিগের পরিত্রান করিতে পরম পিতা আজ উদ্যত হয়েছেন।

বুদ্ধি :

মহাত্মা গুরুনাথ  তাঁর সত্য-ধর্ম্ম গ্রন্থের শুরুতে মুখবন্ধ লিখতে গিয়ে এই ভাবেই শুরু করে ছিলেন। পড়তে পড়তে আমার ছোটবেলায় দেখা একটা পাগলের কথা মনে পরে গেলো।  আমি তখন  স্কুলের ছাত্র। রাস্তায় যেতে যেতে একটা পাগল, আমরা যাকে  গোপাল নাম ডাকতাম - পেয়ে গেছি,  পেয়ে গেছি, বলে চিৎকার করতো । উলঙ্গ গোপাল, কখনো বা  হাত দুটো মুঠো করে, দৌড়োচ্ছে আর চিৎকার করছে -   পেয়ে গেছি ,  পেয়ে গেছি। আমরা কয়েকজন হাফ-প্যান্ট পড়া  স্কুল ছাত্র, গোপালের পিছনে দৌড়াতাম। গোপাল খানিক দৌড়ে, থেমে  যেত, আর খিল খিল করে হাসতো। আমরা তার হাতের মুঠো জোর করে খুলে দেখতাম - কিছুই নেই।
কখনো গোপাল, আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো।  হাসতো, হাত তালি  দিতো।  আমরা ভাবতাম, নিশ্চই ও কিছু একটা দেখছে। আমরাও আকাশের দিকে দেখতাম। কিন্তু ও কি দেখছে তা বুঝতেও পারতাম না - দেখতেও পারতাম না। পাগল কোথাকার।
আমার কি আজও  সেই পাগলের পিছনে দৌড়ানোর  নেশা কাটে নি ?

বিবেক  :
চিরকাল এমনতরো কিছু মানুষ থাকে, যারা পাগল আর ব্রহ্মজ্ঞানীর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। রামকৃষ্ণদেবের আমলেও এমন মানুষ ছিল। রামকৃষ্ণকে তারা পাগল বলতো।এখন আর তাকে কেউ পাগল বলে না, বলে অবতার। কত জায়গায় যে তার পূজা হয় তার ইয়ত্বা নাই. বিবেকানন্দ যখন আমেরিকা গিয়েছিলো, তখন রাস্তার লোকেরা তাকে পাগল  ভাবতো।  তার পাগড়ি ধরে টানাটানি করতো। একবার তো তাকে তাড়া-করে মারতে গিয়েছিলো। এখন বিবেকানন্দ একজন সর্বজনগ্রাহ্য় মহাপুরুষ।  ত্রৈলঙ্গ স্বামীকে অনেকে জড়-ভরত ভাবতো। অতএব তুমি কি ভাবছো, সেটা বড় কথা নয়। তিনি কি ছিলেন সেটাই বড় কথা।
ভগবান শঙ্করাচার্য তার বিবেক চূড়ামণি গ্রন্থে ৫৩৩ নম্বর শ্লোকে বলছেন :

দেবদত্তো-অহম-ইত্যে-তদ্-বিজ্ঞানম নিরপেক্ষম
তদ্বদ্ব্রহ্ম বিদো-অপ্যস্য ব্রহ্মা-হমিতি বেদনম।

অর্থাৎ আমি দেবদত্ত এই বোধ কোনো দেশ-কালাদির অপেক্ষা রাখে না। সেরূপ ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষে আমি ব্রহ্ম এই অনুভবও স্বত-ই হয় অর্থাৎ এ জন্য কোনো কিছুরই  বিন্দু মাত্র অপেক্ষা রাখে না।
রাজা জনকেরও, আচার্য অষ্টাবক্রমুনির কাছ থেকে আত্ম-জ্ঞান লাভের পর এই উল্লাস হয়েছিল। এটাই স্বাভাবিক।  সাধারণে বুঝতে পারে না। ভাবে পাগল।  তুমিও কি তাই ভাবছো ?

গুরুদেব :
সত্য ধর্ম্মের যথাযথ বিবরণ এই গ্রন্থের প্রকরণ বিশেষে বিবৃত হবে। মুখবন্ধে এই মাত্র বলা যাচ্ছে যে, নিরাকার, (ফুটনোটে বলছেন : নিরাকার বললেও ঐশ্বরিক ভাব কিছুই বোঝা যায় না। এ কারন "উপাসনা" নামক গ্রন্থে ঈশ্বরের স্বরূপ পাঠ  করো ) অদ্বিতীয়, সর্ব্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান, অনাদি-অনন্ত, অসীম,অনন্ত- গুণ- নিধান পরম পিতার উপাসনা করবে।

বুদ্ধি :
ছোটবেলা থেকে পুজো পাঠ করেছি তা নয়। তবে বাড়িতে পুজো-অনুষ্ঠান  হলে, আমাদের কাছে উৎসব উৎসব লাগতো। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসতো।  বেশ ভালো লাগতো। এই পর্যন্ত-ই । বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, পুজো পাঠ  একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।  ভালো লাগে তাই করি। ভালো হয় কি না তা জানিনা। এখানেও গুরুদেব উপাসনা করতে বলছেন।  কেন উপাসনা করবো তা বলেন নি। আর ঈশ্বরের যে বর্ণনা উনি দিচ্ছেন - তাতে আমার মনে হয়,  সীমাহীন অনন্ত-কে ভাষায় ব্যক্ত করতে চাইছেন। এর দ্বারা না কিছু বোঝা যায় - না কিছু বোঝানো যায়। অন্তত আমিতো কিছু বুঝতে পারি নি।

বিবেক :
গুরুদেব এক কথায় ঈশ্বরের স্বরূপ বলে দিলেন।  এবং এক মাত্র উপাস্য যে তিনিই, সেটাও বলে দিলেন। তুমি কি বুঝলে, বা মানলে সেটা বড়ো কথা নয়। সত্য কি ? কর্তব্যই বা  কি ? তা এক কথায়  বলে দিলেন।  যদি তোমার জ্ঞান ভাণ্ডারে জঞ্জাল জমে না থাকে, তবে এই সার সত্য জ্ঞান ভাণ্ডারে রেখে দাও।  যখন সময় হবে ঠিক বুঝতে পারবে। পরিবেশ পেলে এখান থেকেই কল্পতরু জন্ম নেবে। তুমি শুধু অপেক্ষা কারো।

 গুরুদেব আবার বলছেন :
 মানুষ স্ব-কৃত কর্মানুসারে আত্ম প্রসাদ বা আত্ম  গ্লানি ভোগ করে, দেহ-ত্যাগান্তে  পরলোকে অবস্থিতি করে,  আর পরলোক-গতদিগের মধ্যে কতকগুলি আত্মা , পুনরায় জন্ম গ্রহণ করে থাকেন, কেহ কেহ আর জন্ম গ্রহণ করেন না।

বুদ্ধি :
একথাগুলো যুক্তি ছাড়া। কল্পনার জগতে যারা বাস করেন, তারা এই সব কথা বলে, মানুষকে কল্যানমুলক কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। বা অনিষ্টকর কাজ থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করেন। আমি মনে করি না যে মানুষ, শুধু তার নিজের কাজের জন্য ভালো থাকে, বা খারাপ থাকে। এই ভালো থাকা বা খারাপ থাকার জন্য অনেকগুলো উৎপাদক-শক্তি কাজ করে। এই আলোচনা পরে করবো।
দেহ ত্যাগের পরে আত্মা পরলোকে অবস্থান করে।  এ সব-ই  কল্পনা মাত্র। দেহ ত্যাগের পরে,কেউ ফিরে আসেনি। বা  কেউ এসে বলতে পারেনি,  যে, আমি দেহ ত্যাগের পরে  এখানে ছিলাম, বা এই রকম ছিলাম। এগুলো কষ্ট কল্পনা মাত্র। এর মধ্যে কোনো সত্যতা নেই।  আজগুবি গল্প কথা। শুনতে ভালো লাগে। তাই আমরা শুনি।  আর আত্মতৃপ্তি বা আত্মগ্লানি ভোগ করি। ভুতের গল্প আর কি !
আমি উপনিষদে পড়ছিলাম, মানুষ যদি উত্তরায়ণে মারা যায়, তবে আর ফিরে আসে না। আর যদি দক্ষিণায়নে মারা যায়, তবে আবার জন্ম গ্রহণ করে।  আবার কেউ কেউ বলেন, বাসনার তৃপ্তি না হলে, মানুষ আবার ফিরে আসে। হিন্দু শাস্ত্রে পুনর্জন্ম স্বীকার করা হয়েছে। আমি এর মধ্যে কোনো যুক্তি খুঁজে  পাইনি। তাই যেটা জানিনা - সেটা মানিও না।  তবে পুনর্জন্ম সন্মন্ধে আমার কিছু ধারণা আছে। সে গুলো উপযুক্ত সময়ে আলোচনা করবো।

গুরুদেব  :
এই বিশুদ্ধ ধর্ম্মের  মতে  সাকার উপাসনা নাই। (ফুটনোটে :সাকারের উপাসনা নাই, কিন্তু অর্চনা আছে। এর বিস্তৃত  বিবরণ "উপাসনা" নামক গ্রন্থে দেখো।)  যোগ সাধন নাই। জাতিভেদ নাই। এবং নির্বাণ( ঈশ্বরে লিন হওয়া )নাই। (ফুটনোট : স্ব-প্রযত্নে যে কেহ লীন হতে পারে না ,এটাই এর উদ্দেশ্য।  ঈশ্বরের ইচ্ছা হলে যে কেহ লীন হতে পারে। ) সত্য-ধর্মের মতে গুন্ সাধন সর্ব প্রধান কার্য। সুতরাং ঈশ্বর উপাসনা ও গুনের অভ্যাস একমাত্র কার্য।
 এই ধৰ্ম্ন  অনুসারে  জগতের সমস্ত ণর নারীকে সহোদর ও সহোদরের ন্যায় জ্ঞান করতে হয়। এই অভেদ ভাব অবশেষে সমস্ত চেতন পদার্থে পরিণত হয়। 
এই ধর্ম্ম অবলম্বনার্থে হিন্দুশাস্ত্রোক্ত চতুর্বিধ আশ্রমের বিশেষ কোনো আশ্রম প্রয়োজনীয় নহে। সকল আশ্রমীই এই ধর্ম্ম অবলম্বন করতে পারেন। সত্য ধর্মের আশ্রয় হৃদয়, যাতে পরমাত্মা আসীন থাকেন। আশ্রম গ্রহণ করো বললে বুঝতে হবে যে হৃদয়ে জগদীশ্বরকে স্থান দাও। যে নিরাশ্রমী তার হৃদয় নেই তাতে পরমাত্মা বসতে পারেন না। কেবল উপরি উপরি রক্ষা করেন।, কিন্তু পরিত্যাগ করেন না। 
মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন : সত্য-ধর্ম্ম  যে পৃথিবীর সমস্ত  প্রচলিত ধর্ম্ম অপেক্ষা সত্য ও উৎকৃষ্টতম, তা প্রথম পরিচ্ছেদে বর্ণিত হবে। এখন কেবল, এই ধর্ম্ম যে অন্যান্য প্রচিলিত ধর্ম্ম  অপেক্ষা বিভিন্ন তা প্রদর্শিত হচ্ছে। 
১. সত্য ধর্ম্মে সাকার উপাসনা নাই।  সুতরাং সমস্ত সাকারবাদপূর্ণ  ধর্ম্ম হতে এই ধর্ম্ম বিভিন্ন।
 ২. এতে হঠ যোগাদির ন্যায় কোনো প্রকার যোগ সাধনা নাই। এবং পদ্মা-আসনাদির  ন্যায়, কোনো প্রকার আসন সিদ্ধিও নাই।  সুতরাং এই ধর্ম্ম সমস্ত যোগ-সাধন ধর্ম্ম ও আসন -সাধন ধর্ম্ম হতে বিভিন্ন।
৩.  নিরাকারবাদী বেদান্ত প্রতিপাদ্য ধর্ম্ম ও স্বল্পকাল প্রচলিত ব্রাহ্ম ধৰ্ম হতেও এই ধর্ম্ম বিভিন্ন।  কারন বেদান্তের অতি  ভীষণ অহংকারময় অন্যায্য "সো-অহং" (সোহহং) প্রভৃভাবেও এই ধর্ম্ম দূষিত নয়। এবং ব্রাহ্ম-ধর্ম্মের  ন্যায় "একবার মাত্র মনুষ্য জন্ম গ্রহণ করে " ইত্যাদি অদূরদর্শিতায়ও এই সত্যধারনম মহত্মাশূন্য নয়। 
৪. পরম পিতার সহিত "পুত্র ও পবিত্র আত্মার" অভেদ জ্ঞান প্রযুক্ত খ্রিস্টীয় ধর্ম্ম হতে সত্য-ধর্ম্ম  বিভিন্ন।  মহম্মদীয় ধর্ম্মে নর হত্যার বিধি দেয়।  সত্য ধর্ম্ম নরকে জীবন দান করে।   
৫. বৌদ্ধেরা যদিও পরম সত্য অহিংসা বিষয়ে সত্য-ধর্ম্মের  কিছুটা কাছের, কিন্তু ঈশ্বর জ্ঞান, পরলোক ও মুক্তি প্রভৃতির পরিস্ফুট  বোধ এবং উপাসনা প্রভৃত দূরস্থিত ও নিম্নস্থিত। সুতরাং সত্য ধর্ম্ম বৌদ্ধ ধর্ম্ম থেকেও আলাদা। 
৬. সত্য-ধর্ম্ম আধুনিক "থিওজফিস্ট-ধর্ম্ম" হতেও বিভিন্ন। কারন পারলো ও পুনর্জন্মদি বিষয়ে এর সাথে ঐক্য নাই। আর থিওজফিস্ট ধর্ম্মে কোনো কোনো গুনের উন্নতির বিধি  থাকলেও, এখানেও "সোহহং" এই ভীষণতম অহংকার পূর্ণ ভাবে কলুষিত। 
৭. সত্য-ধর্ম্ম সাধারণ আত্মা আকর্ষণ (আমেরিকাদি মহাদেশে প্রচলিত  স্পিরিচুয়ালিস্ট ) ধর্ম্ম অপেক্ষা বিভিন্ন। কারন এই ধর্ম্মে অত্যুন্নত মহাত্মা দিগের উপদেশ নাই। কেবল কতকগুলি বৈজ্ঞানিক বিষয়ের সাদৃশ্য প্রদর্শন মাত্রা আছে।  
উপরে যা যা লেখা হলো তাতে, এ কথা বিশদ রূপে প্রদর্শিত হয়েছে যে, সত্য-ধর্ম্ম অন্যান্য প্রচিলিত ধর্ম্ম থেকে বিভিন্ন। এর সর্বউৎকৃষ্টতার ও সত্যতার বিষয়ও আনুষঙ্গিক কিছু কিছু লিখিত হয়েছে বটে, কিন্তু এসব বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ সত্য-ধর্ম্ম বইয়ের প্রথম পরিচ্ছেদে লেখা হবে। ধর্ম্মার্থী সহজেই জিজ্ঞেস করতে পারেন যে, যদি তোমাদের এ ধর্ম্ম অন্য কোনো প্রচলিত ধর্ম্মতুল্য অকিঞ্চিৎকর  নয়, তবে এই অমূল্য রত্ন তোমরা পেলে কোথায় ? এই প্রশ্নের উত্তর দান এই মুখবন্ধের আর একটা উদ্দেশ্য। 
এখন, বক্তব্য এই যে, আমরা আত্মা-আকর্ষণরূপ উৎকৃষ্ট উপায় দ্বারা পারলৌকিক মহাত্মাদিগের নিকট থেকে  এই ধর্ম্ম  প্রাপ্ত হয়েছি। ( যে সকল পারলৌকিক আত্মারা অনন্ত গুণধাম পরম পিতার সান্নিধ্য-নিবন্ধন অতুল আত্মপ্রসাদ সাগরে ভাসমান,   তাদেরকে পারলৌকিক মহাত্মা  বলে। ) যেমন প্রদীপ হতে যে আলোক প্রাপ্ত হওয়া যায় , তা সামান্য ও সহজে নির্বাণ হয়, কিন্তু সূর্যের আলোক বিশ্ব ব্যাপী ও অনির্বাপনীয়,  তদ্রুপ, কালে অর্থাৎ ভবিষ্যতে জগতের সমস্ত ধর্ম্মার্থীর হৃদয় হতে অন্যান্য ধর্মপ্রদীপ  (যা এই সত্য ধর্ম্মের অংশের কণিকামাত্র ) নির্ব্বাপিত হয়ে দূরীভূত হবে ; এবং সত্য-ধর্ম্মরূপ মহা জ্যোতিঃ চির বিরাজিত থাকবে। 

বুদ্ধি :
নিজের ঢাক তো নিজেই পিটিয়ে গেলেন। সব ধর্মের থেকে সত্য-ধর্ম্ম শ্রেষ্ট। অন্য সব ধৰ্ম লোপ পেয়ে যাবে। শুধু এই ধর্ম অর্থাৎ সত্য-ধর্ম্ম মহা জ্যোতি রূপে চির বিরাজিত থাকবে। মহাত্মা গুরুনাথ  এই ধৰ্ম প্রচার শুরু করেছেন কবে ? ১৮৪৭ সালে জন্মে ছিলেন।  যখন বয়স তার চল্লিশ /বেয়াল্লিশ তখন তিনি এই ধৰ্ম সন্মন্ধে জ্ঞাত হয়েছেন।  অর্থাৎ প্রায় ১২৫ বছর  হয়ে গেছে, এই ধর্মের প্রকাশ কাল থেকে। এর মধ্যে কটা ধৰ্ম লোপ পেয়ে গেছে ? আর সত্য-ধর্ম্মই বা কত প্রসার পেয়েছে ? পৃথিবীতে কজন এই সত্য-ধর্ম্ম  সন্মন্ধে জানে ? কেন প্রচার হচ্ছে না ? নিশ্চয় কোনো দুর্বলতা আছে। এতটা আবেগ তাড়িত হয়ে কথা না বললে, তিনি  অসত্য ভাষণের জন্য দায়ী হতেন না। ভবিষ্যতের গর্ভেই তো বর্তমান আছে। একদিন তো ভবিষ্যৎ বর্তমান রূপে প্রকটিত হবে। জ্ঞানীরা ভবিষ্যৎ দেখতে পান। শুধু স্বপ্ন দেখাবার জন্য ভবিষ্যৎকে বিকৃত করা কি উচিত ? 

বিবেক
মহাত্মা গুরুনাথ প্রথমে অন্য্ ধর্ম্ম থেকে সত্য-ধর্ম্মের পার্থক্যটা বুঝিয়ে গেছেন। সেটা তো সত্য। আর নিজের প্রচারিত ধর্ম্ম-মত  শ্রেষ্ট, এটা  যদি কেউ মনে প্রাণে বিশ্বাস না করে, তবে তার সেই ধর্ম্ম-মত প্রচার করাই  উচিত নয়। উনি যেটা পেয়েছেন, যেটা আমাদেরকে দিয়েছেন, সেটা শুধু অলৌকিক নয়, একটা পরিশীলিত ধর্ম্ম-মত, যেটা সত্য এবং কল্যাণকর। ঈশ্বর পাবার জন্য সাধনা নয়, ঈশ্বরের গুনের সাধনাই মানুষের উন্নতির পথ।  ভালো থাকার পথ।  
আর কে না নিজের ধর্ম্মমত প্রচারে একটু বেশি বেশি বলেছেন ?  শ্রীকৃষ্ণ তো নিজেকেই  ভগবান বলে প্রচার করেছেন।  আচার্য শঙ্কর নিজেকে ভগবান বলে আক্ষা  দিয়েছেন। এই কয়দিন আগে রজনীশ হয়েছেন ভগবান ওশো।  মহাত্মা গুরুনাথ তো তবু নিজেকেই ভগবান বলেন নি। তিনি কেবল নিজের ধৰ্ম-মতকে শ্রেষ্ট বলেছেন। 
আর ধৰ্ম লোপ পাবার কথা বলছো ? ব্রাহ্ম-ধর্ম্ম আছে ? থিওজফিস্ট আছে ? বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার তো দূরের কথা নিজেরেই মারামারি করে মরছে। খ্রিস্টানরা ধর্ম্ম দিয়ে নয়, টাকা দিয়ে লোক জোগাড় করছে। মুসলমানরা ভয় দেখিয়ে লোক জোগাড় করছে। মারামারিতে মুসলমানরাই এখন এক নম্বরে আছে। এরা  তো মানবতার ধর্ম্মও ভুলে গেছে।  আর সত্যি কথা বলতে কি, এখন তো অধর্ম্মের রমরমা। সব-ধৰ্মই  তো লোপ পেয়ে গেছে। তাহলে ? গুরুদেব যে বলেছিলেন,  সব তথাকথিত ধর্ম্মের লোপ পাবে - সেটাই তো হয়েছে। এবার কি বিশ্বাস হলো ?
ধর্মের প্রচার হয় উপযুক্ত শিষ্যের দ্বারা। রামকৃষ্ণকে কেউ চিনতো না, যদি বিবেকানন্দ না থাকতো। নিবারণ বাবুর অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। তৎ সত্বেও ধর্মটা যে একশো পঁচিশ বছর  ধরে একটু একটু করে বাড়ছে, সেটা এই ধর্ম্মের গুনগত মানের জন্য। আরো বাড়বে দেখে নিও।

সমাপ্ত        



     
    

      

  





  

Monday 21 August 2017

অষ্টাবক্র সংহিতা-দ্বিতীয়


                                                 




অষ্টাবক্র সংহিতা-দ্বিতীয় (মহর্ষি অষ্টাবক্র ও রাজা জনক)

নিজেকে খুব জানতে ইচ্ছে  করে।


   জগতে অপরিবর্তনশীল বলে কিছু আছে কি ? আমি  বলে কেউ  আছে কি ?  এই জিজ্ঞাসা থেকেই বই-এর পাতা  উল্টাই । সংসারত্যাগী  মানুষ দেখলে জানতে চাই । দুঃখের কথা -কোথায় পাবো, কার কাছে পাবো , তাতো জানি না । বেশিরভাগ মানুষ এক মান্যতা নিয়ে চলছে । উপলব্ধি আছে কী  ? উপলব্ধিহীন মানুষের কথায় মান্যতা পাই না । সত্য কোথায় ? যার কাছে সত্যতা/সত্য আছে সে কি মৌন ?আমি কে ? আমি এই সংসারে কেনএসেছি ? এই সংসার কে বানিয়েছে ? কেনো বানিয়েছে ? এখানে এসে আমার কর্তব্য কী ? আমার কেনো দুঃখ হয় এই সংসারে ? আমার কল্যাণ কিসে হবে ? এইসব প্রশ্ন চিরকালীন। এই সব প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন গ্রন্থ আছে, বিভিন্ন মত আছে। পাশ্চাত্য দেশে ভোগবাদে বিশ্বাস করে। প্রকৃতিকে মানুষের নাগালে আনার জন্য বিজ্ঞান চর্চা করে। বিবর্তনবাদ-ই  সৃষ্টির মূলকথা বলে তারা মনে করে। আমাদের দেশেও অনেক মত প্রচলিত। কেউ অদ্বৈতবাদ-এ বিশ্বাস করে কেউ দ্বৈতবাদে বিশ্বাস রাখে।  কেউ ভৌতিকবাদে বিশ্বাস করে। এর মধ্যে কোনটা সত্য, কোনটা অর্ধ-সত্য, আর কোনটাই বা মিথ্যা। কে বলে দেবে ? বহু বই বাজারে পাওয়া যায়। কোনোটাকে বলে স্মৃত,(অনুভূতি লব্ধ জ্ঞান ) কোনটা স্মৃতি,(বেদ - বেদান্ত) কোনটা বিনির্গত ,(পুরান, রামায়ণ , মহাভারত ) আবার কোনটা কৃৎ-গ্রন্থ(উপলব্ধিহীন মানুষের লেখা) বাজারে মহারাজ-এর অভাব নেই, গুরুদেবদের সংখ্যা কম নয়। জিজ্ঞাসু মানুষের প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য তারা সংগঠন খুলে বসে আছে।  আশ্রম-এর নামে কেউ কেউ ব্যবসাও করছে।  অবিশ্বাসী, সন্দেহ প্রধান মন আমার।  বিশ্বাস নেই  কিন্তু জানতে চায়।  শ্রদ্ধা নেই বরং শ্রাদ্ধ  করার দিকে ঝোক বেশি। 

এমন সময় হাতে এলো স্বামী ধীরেশানন্দের অনুবাদ করা  অষ্টাবক্র গীতা । উদ্বোধন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত।  গুরু শিষ্য  সম্বাদ । এর আগে কঠোপনিষদ্ পেয়েছি ।  সর্বধর্ম সার ভগবৎ গীতা পড়েছি।  গীতাভাষ্য পড়েছি।  কিন্তু রাজা জনকের প্রশ্ন আমাকে আকর্ষন করলো  সত্য কি ?
কথম্ জ্ঞানম অবাপ্নোতি – জ্ঞান লাভের উপায় বলুন ।
কথম্ মুক্তির্ভবিষ্যতি – মুক্তি কি ভাবে হবে ?
বৈরাগ্যং চ কথম্ প্রাপ্তম – বৈরাগ্য-ই বা কি ভাবে প্রাপ্ত হয় ?
এতদ্ ব্রূহি মম প্রভো –  আমার প্রভু, এই সমস্ত আমাকে বলুন 
সরাসরি আধ্যাত্মিক প্রশ্ন দিয়ে অষ্টাবক্র সংহিতার শুরু। কোনো ভূমিকা নয়।  সরাসরি প্রশ্ন  : ১) হে প্রভু,জ্ঞান কি করে লাভ করা যায় দয়া করে  বলুন। ২) মুক্তি কী  ভাবে হবে ? ৩) বৈরাগ্য কি  ভাবে পাওয়া যায়।
অষ্টাবক্র গীতা পড়ে আমার মনে হয়েছে - এখানে কোনো অপ্রয়োজনীয় শব্দ নেই। অষ্টাবক্র সংহিতায় যা আছে, তার কোনো শব্দ যেমন বাদ  দেওয়ার উপায় নেই - তেমনি এর সঙ্গে কিছু জোড়ারও  কোনো সুযোগ  নেই। সবচেয়ে বড় কথা এঁর   কথায়  কোনো দ্বৈত ভাব নেই। গীতার অনেক শ্লোকের  ব্যাখ্যা ভাষ্যকাররা তাদের মতো করে করেছেন।  সবগুলোই ঠিক।  

ভগবৎ গীতায় -অর্জুনই প্রথম ভগবান  শ্রীকৃষ্ণকে জ্ঞান দেওয়া শুরু করেছিল।  প্রথমে তো আদেশ - "হে অচ্যুত ! উভয় সেনার মধ্যে আমার রথ  স্থাপন করো। " পরে কাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে তা দেখে, তার মধ্যে মায়া, মমতা, স্নেহ, শ্রদ্ধা, প্রভৃতি কমনীয় গুনের জাগরণ ঘটে।  অহিংস  সাত্বিক ভাব জেগে ওঠে।  হিংসা ছেড়ে, যুদ্ধ ছেড়ে - চলে যেতে চাইলো। আর এর স্বপক্ষে অনেক যুক্তি খাড়া করে,কৃষ্ণকে বোঝাতে চাইলো। অর্জুনের আদৌ আধ্যাত্মিক জ্ঞান পাবার ইচ্ছেই ছিল না। তার জিজ্ঞাসার  কোনো আধ্যাত্মিক  দিক নেই। অর্জুন কেবলমাত্র নিজের সাময়িক অহিংসনীতির পক্ষে শ্রীকৃষ্ণের সমর্থন চাইছিলো।

আর ক্ষেত্রটাও যুদ্ধ-ক্ষেত্র।  এখানে কোনো আধ্যাত্মিক  আলোচনা চলতেই পারে না।   
কঠোপনিষদ - এ নচিকেতা  যমরাজের কাছে নিজের ইচ্ছেতেও যায় নি। আর তার কোনো প্রশ্নও ছিলোনা। স্রেফ যমরাজ  তিনটি বর দিতে চেয়েছিলো, তাই কি চাইবেন, কি চাইবেন ভেবে তিনটি বর প্রার্থনা করেছিল : ১)আমার পিতা যেন আমার সন্মন্ধে দুশ্চিন্তা না করে - আমার প্রতি যেন তার রাগ না থাকে  -  আমি আবার মানুষ হিসেবে ফিরে গেলে যেন আমাকে সবাই চিনতে পারে।  ২)স্বর্গ প্রাপ্তি - অর্থাৎ দুঃখহীন ভোগের রাজত্বে যাবার রাস্তা বাতলে দাও।  ৩) তিন নম্বর প্রশ্নটি ছিল আত্মার অস্তিত্ব - অনস্তিত্ব্য সম্পর্কে জ্ঞান। আসলে এই প্রশ্নটার জন্যই  কঠোপনিষদ মান্যতা পেয়েছে।  প্রথম প্রশ্ন দুটোতো একেবারেই ফালতু প্রশ্ন।  তৃতীয় প্রশ্নে খানিকটা অধ্যাত্বিকতার ছোঁয়া থাকলেও যমরাজ নানান বাহানায় তাকে জবাব দিতে চাইছিলো না।  নচিকেতাকে সে উপযুক্ত মনেই করছিলো না। যাক সে সব কথা -
জনক রাজার প্রথম তিনটি প্রশ্নই আমাকে নাড়া দিয়েছে। আত্মকথা জানার জন্য - আকুল হৃদয়ের প্রশ্ন।  যুদ্ধ থেকে রেহাই পাবার জন্য নয় - আবার পড়ে পাওয়া চোদ্দআনা নিতেও চাই না।  
    
মূল বিষয়ে যাবার আগে,  সংহিতা রচনার প্রেক্ষাপটটা একবার  দেখে নি ।

বিদেহি রাজা, জনক দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে দিবানিদ্রা গিয়েছেন । স্বপ্ন দেখছেন – দ্বারপাল ত্রস্ত্র  হয়ে এসে খবর দিলো মহারাজা শিঘ্র
উঠুন । রাজ্য আক্রান্ত । যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে । মাহারাজা তরিঘড়ি করে
উঠে , যুদ্ধ করতে ছুটলেন । স্বল্প প্রস্তুতি । ষুদ্ধে হেরে গেলেন । বিপক্ষ রাজা, বৃদ্ধ-জনক রাজাকে রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে বললেন । জনক রাজা মৃত্যু ভয়ে শঙ্কিত হয়ে  রাজ্য ছেড়ে পালাতে লাগলেন । ছুটতে ছুটতে,ক্ষুধা-তৃষ্নায় ক্লান্ত হয়ে  পড়লেন । খাদ্যের সন্ধানে ক্লান্ত পদে
এগোতে লাগলেন । কোথাও খাবার নাই, কোথাও জল নাই । সামনে একটা পুকুর দেখে দাঁড়ালেন । একটু জল পান করলেন । পুকুরের অপর প্রান্তে মন্দির নজরে এল । পায়ে পায়ে হেঁটে গেলেন মন্দিরে । দেখলেন, মন্দিরে প্রসাদ বিতরন হচ্ছে । দীর্ঘ লাইন । জঠড় জ্বালা নিবৃওির  জন্য রাজা জনক সাধারনের মতো লাইনে দাড়ালেন। অদম্য ক্ষুধা নিয়ে যখন প্রসাদ পাত্রের কাছে এলেন, দেখলেন প্রসাদ শেষ ।

বিষাদে মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো । ক্ষুধার্থ রাজা জনক, কাতর কন্ঠে পুজারি ব্রাম্হনকে, প্রসাদ অবশিষ্ট  দেবার  জন্য মিনতি জানালেন । পূজারীর ,যাচ্ঞাকারীকে  দেখে দয়া হ্‌ল, একটু অপেক্ষা করতে বললেন ।  প্রসাদ-পাত্রে লেগে থাকা অংশ একত্রিত করে, পাতায়  করে , রাজা জনককে দিলেন । ভূখা রাজার মন আনন্দিত হ’ল ।  যতই ক্ষুধা পাক, রাজা-তো । ভাবলেন স্নান করে, তবে খাবেন । এই ভেবে রাজা স্নান করতে নাবলেন পুকুরে । প্রসাদ/খাবার রইল পুকুর পাড়ে । কোত্থেকে হঠাৎ এক কাক উড়ে এসে ছোঁ মারল প্রসাদের পাতায়। ছড়িয়ে গেলো ধুলি মধ্যে সমস্ত প্রসাদকনা । ক্ষুধার্থ রাজা জনক হা হা কার করে উঠলেন । হে ভগবান-হে ইশ্বর .........
হঠাৎ প্রহরীর ডাকে জেগে উঠলেন রাজা । “রাজা মশায় উঠুন – বেলা যে যায়”
ঘেমে নেয়ে একাকার রাজা । উঠেই দেখলেন – নাঃ সবই তো ঠিক আছে । তবে ? এতক্ষন যা দেখছিলাম সেটা ঠিক, না এখন যা দেখছি
এটা ঠিক ? রাজা সত্য – না ভিখারী সত্য ? আমি কে ?
মহারাজা জনক তিনটে প্রশ্ন করছেন। প্রথম প্রশ্ন  - কথম জ্ঞানম ? কি ভাবে জ্ঞান হবে।  হে প্রভু,জ্ঞান কি করে লাভ করা যায়, দয়া করে  বলুন। দ্বিতীয় প্রশ্ন : মুক্তি কী  ভাবে হবে ? তৃতীয় প্রশ্ন : বৈরাগ্য কি  ভাবে পাওয়া যায়।

মহর্ষি অষ্টাবক্র প্রথম প্রশ্নের উত্তর না বলে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন । তা হলে কি রাজা জনকের প্রশ্নক্রম ঠিক ছিল না? ঠিক।  আমার মনে হয় রাজা  জনক আত্মজ্ঞান লাভের জন্য এতটাই ব্যাকুল ছিলেন যে এক নিঃশ্বাসে পরপর তিনটি প্রশ্ন করেছেন কিনতু  উত্তর তো একটাই।  তাই   মহর্ষি অষ্টাবক্র বলছেন –
মুক্তিম ইচ্ছসি চেত্তাত বিষয়ান্ বিষবৎ ত্যজ – মুক্তির ইচ্ছা চিত্ততে জাগলে বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করো ।
ক্ষমা-আর্জব-দয়া-তোষ-সত্যং পীযূষবৎ ভজ –
ক্ষমা,আর্জব(আবেদন),দয়া,  সন্তোষ,ও সত্য ইত্যাদি গুণগুলি-কে ভজনা করো  ।
হাজারো  বছরের পুরাতন, কিন্তু চির নবীন এই কথা । কে এই মহর্ষী ?
উজ্জানক (উজ্জয়িনী-?) নামক স্থানে ভৃগুতুঙ্গ নামক মহাগিরি । বুকচিরে
বয়ে চলেছে বিতস্তা নদী । নদীর তীরে বহু আশ্রম । মুনিদের তপভুমি । এখানেই এক সময় বাস করতেন মহর্ষি উদ্দালক । তাঁর পুত্র শ্বেতকেতু,
কন্যা সুজাতা, জামাতা কহোড়  , মহর্ষি উদ্দালকের আশ্রমেই বেদ আধ্যায়ন করতেন ।
এখানেই মহর্ষি শ্বেতকেতু মনুষ্যরূপধারিনী সাক্ষাৎ সরস্বতীকে সন্দর্শন করে ছিলেন । মহাভারতের  বন – পর্বে  এই কাহিনীর উল্লেখ আছে ।
কহোড়, মহর্ষি উদ্দালকের খুব প্রিয় ছিলেন । তার সেবায় ও নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে উদ্দালক সমস্ত শ্রুতিবিদ্যা (বেদ) তাকে দান করে ছিলেন । এমনকি নিজ কন্যা সুজাতার  সাথে তার বিবাহ দিয়ে ছিলেন । একে বেদ বিদ্যার অধিকারী তায় মহর্ষি উদ্দালকের মত মহান ঋষির জামাতা  হয়ে কহোড়ের অহংকার বেড়ে গেলো । আশ্রমের আচার্য্যর পদে আসিন হয়ে গুরু হয়ে বসলেন । সুজাতাকে নিয়ে সুখে সংসারধর্ম পালন করতে লাগলেন । সুজাতা গর্ভ ধারন করলো । এই গর্ভস্থ সন্তান-ই মহর্ষি অষ্টাবক্র নামে বিখ্যাত । অষ্টাবক্রের আসল নাম কৌশকেয়। কিনতু শারীরিক অঙ্গ বিকৃতির জন্য তিনি অষ্টাবক্র নামেই খ্যাত।  তাই আমরাও তাকে অষ্টাবক্র বলে উল্লেখ করবো। 
আমরা সংহিতায় ফিরে যাব -
 মুক্তিম ইচ্ছসি চেত্তাত বিষয়ান্ বিষবৎ ত্যজ – মুক্তির ইচ্ছা চিত্ততে জাগলে বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করো ।
যে চিত্তে মুক্তির ইচ্ছা জাগে সে বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করে । এখন মুক্তি কি ?  -  দুঃখনিবৃত্তিই মুক্তি । দুঃখপ্রাগভাবে স্থিতিই মুক্তি । অহংনাশই মুক্তি । আত্মজ্ঞানলাভই মুক্তি ।
বিষয় কি ? -  তন – মন - ধন -  এই তিনটিই বিষয় । আচার্যদেব তো সোজা বলে দিলেন বিষয়-কে বিষবৎ ত্যাগ করো।  ব্যাপারটা কি এতই সোজা ? ধন ছাড়া তো মানুষের এক মুহূর্ত বাঁচার উপায় নাই। সংসার ত্যাগ করে যারা সন্যাস নিচ্ছেন, তারাওতো ধনের মোহে পড়ে যাচ্ছেন।  এ প্রসঙ্গে একটা গল্পো মনে পরে গেলো। রাধারমণ নামে এক ব্যক্তি সংসারের উপর বিরক্ত হয়ে চন্দ্রকুট পাহাড়ের কোলে এক গুহায় ঈশ্বর সাধনার জন্য বাস করতে লাগলেন। 
ওখানে শাকালুর মতো এক ধরনের গাছ ছিল।  খুবই রসালো।  খেলে তৃষ্ণাও যায় আবার পেট-ও ভরে।  দিনরাতের বেশিরভাগ সময় ধ্যান-এর চেষ্টা করতো বা ঘুমোতো।  খিদে পেলে ওই শাঁকালু তুলে এনে খেতো।এই ভাবেই চলছিল। একদিন দেখে একটা গাই কি ভাবে যেন ওখানে চলে এসেছে।  সম্ভবত পাহাড়ের কোলে যারা গরু চড়াতে আসতো  তাদেরই একটা গরু দল ছুটে হয়ে এসে  পড়েছিল। দুধেল গরু। 
পুরুষ্ট বান।  বোঝাই যায় - গরুটি এখনো দুধ দেয়। রাধারমণ, ওখানে কাছাকাছি জলের যোগান না থাকার জন্য জল খেতে পারতো না, স্নান করা তো দূরের কথা।  রাধারমণ গরুটাকে দেখে ভাবলো গরুটা যদি এখানে থাকে তো ভালো।  অনেক দিন দুধ খাইনি। দুধ শরীরের পক্ষেও খুব ভালো।
তাই গরুটাকে কাছে গিয়ে আদর করতে লাগলো।  গলায় হাত বোলাতে লাগলো। গরুটা মানুষ পেয়ে , আদোর পেয়ে ওখানেই থাকতে লাগলো। রাধারমণ স্নান করে না, দাঁড়ি -চুল  কাটে না।  ফলত মাথায় জট হলো, দাঁড়ি বড়ো হলো। রীতিমতো দর্শনধারী সাধু বনে গেল. এদিকে রাখাল খুঁজতে খুঁজতে একদিন রাধারমণ-এর কাছে পৌঁছালো।  এসে দেখে তার গরু রাধারমণ-এর গা চেঁটে দিচ্ছে। ভাবলো এ নিশ্চই কোনো বড়ো সাধু হবে।  না হলে গরুটা কেন ওর গা চেটে দেবে! রাখাল ওর শিষ্য হয়ে গেল। রাখাল গরুটার জন্য বনের গাছ গাছালি দিয়ে একটা গোয়াল তৈরি করলো।বনের শুকনো কাঠ পাতা জোগাড় করে বসবাসের জন্য ঘর তৈরি করলো। গ্রামে গ্রামে খবর হয়ে গেল একজন বড়ো সাধুর পাহাড়ে এসেছে। গ্রাম থেকে ভেট আসা শুরু হলো।  সাধু এখন আর শাকালু খায় না, গ্রামের লোকদের দেওয়া ফলমূল, মিষ্টি, দুধ, ঘি  খেতে লাগলো। আস্তে আস্তে পাকা মন্দির হলো।  মন্দিরে সোনার প্রতিমা বসলো। এদিকে সরকারের লোকেরা খবর  পেয়ে, ট্যাক্স ধার্য্য করলো। সাধু ট্যাক্স না দেওয়ার জন্য আছিলা  খুঁজতে লাগলো।  সাধু আস্তে আস্তে ওখানেই সংসারের বন্ধন-এ জড়িয়ে পড়লো। আমি যখন ওই চন্দ্রকুট পাহাড়ে যাই (২০১৪ সালে ) তখন সাধু একদিন কথায় কথায় আমাকে তার সমস্যার কথা জানালো এবং বললো আমার এই মন্দির, আশ্রম কে রক্ষা করবে ? একজন উপযুক্ত গৃহত্যাগীর  সন্ধান জানতে চাইলেন। এবং এটাও বললেন আশ্রমে যারা আছেন তারা নাকি সবাই ধান্ধায় আছে। 
হায় ভগবান, সংসার ছেড়ে  আবার সেই সংসারের-ধনের বন্ধন। তা হলে কেনোই-বা সংসার ছাড়া? 
 আবার একবার শ্লোকটা পড়ি : মুক্তিম ইচ্ছসি চেত্তাত বিষয়ান্ বিষবৎ ত্যজ – মুক্তির ইচ্ছা চিত্ততে জাগলে বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করো । এখানে একটা কথা লক্ষ্য করুন অষ্টাবক্র বিষয়কে  ত্যাগের কথা বলছেন কি ? তাহলে-তো সোজা বলতেই পারতেন বিষয়কে ত্যাগ করো তা কিন্তু বলেননি।  বলছেন বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করো অর্থাৎ বিষয় যদি বিষবৎ হয় তবে তাকে অবশ্যই ত্যাগ করো। জীবনের জন্য বিষয় বিষ নয়।  বিষয়ের জন্য জীবন বিষ। তাই বেচে থাকার প্রয়োজনে বিষয় - কে রাখো।  কিন্তু বিষয় ভোগের জন্য বিষয়কে রেখো না। আর একটা আমার মনে হয়, বিষয় এবং বিষ  কথাটা খুব কাছাকাছি - বিষ  খেলে মানুষ মারা  যায়। বিষয়ে খেলে কি হয় ? পলে পলে মরে।  আমরা জানি মানুষ প্রতিনিয়ত মরছে। শৈশবের বিনয় মারা গেছে - কৈশোরের বিনয় মারা গেছে  - যৌবনের বিনয় মারা গেছে - প্রৌঢ় বিনয় মারা গেছে -এখন বেঁচে আছে বৃদ্ধ বিনয়।  এর পর বৃদ্ধ বিনয়ও  মারা যাবে।  এই বিষয় খেতে খেতে, বিষয় ভোগ করতে করতে বিনয়  মারা যাবে। এটা তো ধ্রুব সত্য। তাহলে বিষয় ত্যাগ করলে কি বিনয় বেঁচে থাকবে ? তাতো নয় বলেই মনে হয়।  তাহলে সত্য কি ?      
পরের  লাইনে বলছেন :           
 ক্ষমা-আর্জব-দয়া-তোষ-সত্যং পীযূষবৎ ভজ 
ক্ষমা,আর্জব(আবেদন),দয়া,  সন্তোষ,ও সত্য ইত্যাদি গুণগুলি-কে ভজনা করো  ।   
বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করতে বললেন এখন বলছেন কয়েকটা গুনের ভজনা বা সাধন করতে বলছেন। আমার মনে হয় এই গুনের সাধনাই মানুষকে মহামানব করে তোলে।  মানুষকে দেবতা করে তোলে এই গুনের সাধনা।  তাই অষ্টাবক্র মুনি গুনের সাধনা করতে বললেন। 
 প্রথমটি হলো "ক্ষমা " : ক্ষমা অর্থাৎ সহ্য করা। শক্তি থাকতেও অপরাধীর অপরাধের মার্জনা করা। ক্ষমা গুনের অধিকারী ব্যক্তি সর্বদাই প্রসন্ন থাকেন।
চোর ধরতে গেলে নিজেকেও দৌড়াতে হবে।  চোরকে তার অপরাধের জন্য দণ্ড  দিতে গেলে নিজেকে আরো জোরে দৌড়তে হবে।  জীব অপরাধ করে দুটি কারণে।  এক: নিজের অভাব পূরণের জন্য। দুই:স্বভাবের তৃপ্তির জন্য।  অভাব পূরণের জন্য যারা অপরাধ করে তারা ক্ষমার যোগ্য। এদের ক্ষমা করে দেওয়া  উচিত।  যারা অহংকারের তৃপ্তির জন্য অপরাধ করে তারা ক্ষমার অযোগ্য। অহংকারীর অহংকার নাসের জন্য, অপরাধ থেকে বিরত  থাকার জন্য তাদের শিক্ষা দান করা উচিত। এটাই জ্ঞানী বা শক্তিশালী মহাপুরুষরা করে থাকেন। জ্ঞান মহাপুরুষের শক্তি- ক্ষমা তার গুন্। আমরা গুন্ থেকেই দ্রব্য চেনা যায়।  আমরা গুন্ থেকেই সাধারণ পুরুষ ও মহাপুরুষের মধ্যে পার্থক্য নির্নয় করতে পারি। অতএব তুমি যদি সাধারণ পুরুষ থেকে উত্তম পুরুষ হতে চাও তবে যে সব গুনের সমৃদ্ধি দরকার তার মধ্যে একটা হলো ক্ষমা।  তুমি ক্ষমা গুনের সাধনা করো। 

ক্ষমা করতে শেখো।  ধন্যবাদী হয়ে বাঁচো। যে তোমার জন্য এতটুকু

করেছে তাকে ধন্যবাদ দাও। যে তোমার জন্য কিছুই করেনি 
তাকেও ভালোবাসো। যে তোমার ক্ষতি করেছে তাকে ক্ষমা করে 
দাও।  যার জন্য তুমি অনেক করেছো, অথচ সে তোমাকে চিনতে
 পারছে না - তাকেও  তুমি ক্ষমা করে দাও।  তার জন্য ঈশ্বরের 
কাছে মঙ্গল প্রার্থনা করো।

দ্বিতীয়টি হলো আর্জব  : আর্জব কথার অর্থ হলো আবেদন। জ্ঞানী সর্বদা বৃহতের কাছে আর্জি করেন। নিজের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে বৃহতের সঙ্গে একাত্বতা অনুভব করবার মানসে আবেদন করেন। নিজের ক্ষুদ্রত্ব স্বীকার করা।  নিজের ক্ষুদ্রত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকা।  এবং ক্ষুদ্রত্ব কাটিয়ে বৃহতের সঙ্গে মিলিয়ে যাওয়া। আকুল ভাবে আবেদন  করো। তিনিই কাছে টেনে নেবেন। তার সমস্ত কিছু তোমাকে দেবার জন্য তিনি ব্যাকুল।  শুধু তোমার আকুলতা বাড়াতে হবে।  আকুল হয়ে প্রার্থনা করতে হবে। 


তৃতীয়টি হলো দয়া : পার্থিব, অপার্থিব সবই তার।  তারই দয়ায় আমরা সবাই বেঁচে আছি।  এই আকাশ, বাতাস, পৃথিবী, সূর্য, চন্দ্র, পাহাড়, সমুদ্র, নদী, গাছপালা  -  সবাই আমাদের নিঃশর্ত ভাবে দয়া করছেন। তারই দয়ায় আমরা সবাই বেঁচে আছি। আমাদেরও উচিত পাত্রা-পাত্র বিচার না করে সবাইকে দয়া করা। 


চতুর্থ হলো তোষ - অর্থাৎ সন্তোষ। সন্তুষ্ট হয়ে বাঁচা।    

 ধন্যবাদী হয়ে বাঁচো।  ভগবানকে ধন্যবাদ দাও। 
"ভগবান তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ।  যা তুমি দিয়েছো তাতো অনেক। তোমার দেওয়ায় কিছু কমতি নেই।  কমতি আমার সামলানোর শক্তি। ভগবান তোমাকে লাখ লাখ প্রণাম। তোমার দানেই আমার জীবন। তোমার দানেই আমার রক্ষা।  তোমার দানেই আমার সমৃদ্ধি।তোমার দেওয়া দান তো আমার কাছে প্রসাদ। প্রসাদ কম হোক, বেশী হোক, প্রসাদ তো প্রসাদই। তোমাকে আমার সহস্র কোটি প্রণাম।  তোমার দেওয়া জমি, তোমার দেওয়া অন্ন ,তোমার দেওয়া প্রাণবায়ু, তোমার দেওয়া এই শরীর  - কোথাও তো তুমি কম দাওনি। কমতি হলো আমার প্রাণের আকুলতা - যা তোমাকে আমার দেওয়া উচিত। হে ঠাকুর, বাহ্যিক ধন কামাতে আমি মনের শান্তি নষ্ট করেছি।  আমাকে ক্ষমা করো।  কোলে তুলে নাও। "
ধন্যবাদী হয়ে যাও। যা কিছু পেয়েছো তাতেই সন্তুষ্ট  থাকো।   
পঞ্চমটি হচ্ছে সত্য :  জীবনের সত্যকে জানো। জীব পরিবর্তনশীল। জীবন পরিবর্তনশীল।  সত্য স্থির। জীবনের সত্যকে বোঝার চেষ্টা করো।  অর্থাৎ নশ্বরতাই  জীবন।  এই সত্য উপলব্ধি করো। তুমি অবিনশ্বর। এই সত্যকে বোঝার চেষ্টা করো। আসলে নিজেকে 
জীবনের ওপারে নিয়ে যাও। যেখান থেকে তুমি এসেছো, সেই স্মৃতি জাগিয়া তোলো।  স্বপ্ন ভেঙে যাক।  জেগে ওঠো। সত্যকে উপলব্ধি করো।  এই জীবন তো স্বপ্ন।  এ তো সত্য নয়। আমরা রাতে স্বপ্ন দেখি। সকালে ভুলে যাই।  বাস্তবে চলে আসি। স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। এই রাতের স্বপ্ন বড়জোর ছয় বা আট ঘন্টা  পরেই আমরা বুঝতে পারি যে এতক্ষন স্বপ্নে ছিলাম। এই জীবনটাও একটা স্বপ্ন।  কেবল পার্থক্য হচ্ছে এই স্বপ্ন ভাঙতে আমাদের আশি বা একশো বছর  লাগে। আসলে আমরা যাকে  মৃত্যু বলি সেটাই জেগে ওঠা। স্বপ্ন ভেঙে জেগে ওঠা। এই সত্যকে স্বীকার কারো - উপলব্ধি করো।    
   
আচার্য্যদেব  এর পর বলছেন –
ন পৃথ্বী - ন জলং – ন অগ্নিঃ – ন বায়ুঃ – ন দৌঃ বা ভবান্       
এষাং সাক্ষিনম্ আত্মানং চিদ্রূপং(চিৎ -রূপম) বিদ্ধি মুক্তয়ে ।
- হে  শিষ্য,  তুমি পৃথিবী (মাটি ) নয় - জল  নয় - অগ্নি  নয়  - বায়ু  নয় - আকাশ  নয়।  এ সকলের সাক্ষী  আত্মাকে তুমি মুক্তি লাভার্থ  চৈতন্য রূপে অবগত হও। 

পঞ্চ ভূতের (ক্ষিতি ,অপ , তেজ , মরুৎ , ব্যোম ) তৈরি  এই শরীর। আত্মার  পঞ্চবিধ  আবরণ -   ১) অন্ন -বিকারজ  স্থুল শরীর  বা  অন্ন-ময়  কোষ, ২)পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সহিত  পঞ্চ প্রাণ  বা  প্রাণময়  কোষ  ৩) মনের  আশ্রিত  ইন্দ্রিয়গনের  সহিত মন  বা মনোময়  কোষ   ৪)জ্ঞানের  আশ্রিত  ইন্দ্রিয়গণ  ও  জ্ঞান  বা  জ্ঞানময়  কোষ  ৫) অবিদ্যার  আশ্রিত  অহঙ্কারাদি  বা  আনন্দময়  কোষ।  
তুমি  এই  দেহ  নও।  তুমি চৈতন্য।  দেহের  কারণও  তুমি নও।  তুমি কোষ  নও। কোষ তোমাকে  আশ্রয়  করেছে  মাত্র। 
আমরা জানি পিতৃ-মাতৃ প্রদত্য পঞ্চভূতের এই শরীর। আমাদের মৃত্যুর পরে আমাদের দেহ পঞ্চভূতে মিশে যাবে। এটা  বৈজ্ঞানিক সত্য। আর এই দেহের সঙ্গে আমি অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত।  এই দেহ ভিন্ন আমি এটা আমাদের কল্পনার বাইরে। এইযে অষ্টাবক্র আমাদের জ্ঞান দান করছেন ইনিও একজন দেহধারী মহাপুরুষ।  যাকে জ্ঞান দান করছেন তিনিও একজন দেহধারী মানুষ  যার নাম  রাজা জনক।  মহামুনি অষ্টাবক্র বলছেন :  ন পৃথ্বী - ন জলং – ন অগ্নিঃ – ন বায়ুঃ – ন দৌঃ বা ভবান্। আমি পৃথিবী বা মাটি নই - আমি জল নই - আমি অগ্নি নই - আমি বায়ু  নই - আমি আকাশ নই।  তা হলে আমি কে ? উনি বলছেন : এষাং সাক্ষিনম্ আত্মানং চিদ্রূপং(চিৎ -রূপম) বিদ্ধি মুক্তয়ে।  অর্থাৎ আমি একজন সাক্ষী, আমার নাম আত্মা, আমি চৈতন্য স্বরূপ -  আচার্য বলছেন মুক্তি লাভার্থে তুমি এইরূপ বোধ করো। বোধ করা কি এতই  সোজা ? কষ্টকল্পনা করা যায় মাত্র,  তার বেশি নয়।  আমার স্বরূপ হচ্ছে চৈতন্য।  চৈতন্য আবার স্বরূপ হয় নাকি? চৈতন্য হচ্ছে একটা উপলব্ধির নাম মাত্র। তার আবার স্বরূপ কি ? চৈতন্য যদি আমার স্বরূপ হয় তাহলে তার আবার মুক্তি কি ? চৈতন্যতো সর্বত্র-সর্বদা মুক্ত। তাহলে কি আমার ধারণার  মুক্তি চাই? অর্থাৎ আমি যে ধারণা করে বসে আছি অর্থাৎ  - আমি বিনয় রায়, এই আমার দেহ, এই ধারণাটাই ভুল?     

একটা গল্প  শুনেছিলাম বন্ধন  ও  মুক্তি  প্রসঙ্গে। গল্পটা বলি  -
এক রাখাল বালক প্রতিদিন গঙ্গার তীরে গোরু  চড়াতে  যায়।  দড়ি  বেধেঁ  গরুগুলোকে নিয়ে  যায়।  গঙ্গার  তীরে গিয়ে দড়ি  খুলে গোরুগুলোকে  ছেড়ে  দেয় , চড়ে  খাবার  জন্য।  আবার  দিনের  শেষে  গোরুগুলোর  গলায়  দড়ি বেঁধে   নিয়ে  আসে।  এক দিন  হলো  কি - রাখাল বালক দুপুরে যখন গাছতলায় ঘুমুচ্ছিলো তখন তার দড়িগুলো  চুরি হয়ে  যায়।  এইবার, সন্ধ্যাবেলায় যখন গরুগুলোকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে, তখন আর গরুগুলো আসতে  চায় না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে জাবর  কাটছে।  নট নড়নচরণ।  রাখাল বালক যতই  গরুর লেজ মুচড়ে  দিচ্ছে,  চল-চল বলছে গোরুগুলো  কিন্তু ঠায়  দাঁড়িয়ে আছে।   বিরক্ত হয়ে লাঠি দিয়ে দু-এক ঘা মেরেও  দিলো।  তথাপি  গোরুগুলো মাঠ ছেড়ে যেতে চাচ্ছে  না।  অগত্যা রাখাল বালক হাল  ছেড়ে দিয়ে  বসে পড়েছে।  এ দিকে সন্ধ্যা হয়ে  আসছে।  ভাবছে কি করা যায়  ? 
গঙ্গার তীরে এক সাধু মাটির-কুটির বেঁধে সাধন ভজন করত।  রাখাল বালক অনেক আশা নিয়ে সাধুর  কাছে গেল, যদি সাধুর কাছে দড়ি পাওয়া যায়।   সাধুকে দড়ির কথা বলতেই , সাধু বললো - আমার কাছে দড়ি তো নেই কিন্তু তোমার সমস্যাটা কী। রাখাল বালক তখন তার দড়ি চুরি যাবার ঘটনা বললো এবং দড়ি ছাড়া গরুগুলোকে কি ভাবে মাঠ  থেকে নিয়ে যাওয়া যায় - তা জিজ্ঞেস করলো।  সব চেয়ে বড়ো  সমস্যা হচ্ছে  গরুগুলো মাঠ  থেকে এক পা-ও যেতে  চাইছে না। 
সাধু জিজ্ঞাসা করলো - কেনো যেতে চাইছে না ? 
রাখাল বললো  -  তাতো জানিনা।  গরুগুলো বাঁধা নেই।  সব গুলোই ছাড়া। সাধু  বললো  - অন্যদিন কি ভাবে নিয়ে যাও  ?
রাখাল বললো - অন্য দিন তো  বাড়ি নিয়ে যাবার আগে  দড়ি  দিয়ে বেঁধে নেই।  আজ তো দড়ি  হারিয়ে গেছে,  তাই  বাঁধতে পারছি না।  দড়ি ছাড়া গরু নিয়ে যাওয়া সমস্যা বটে।  অন্যের জমির ফসল খেয়ে নেবে।  কিন্তু তার চাইতে সমস্যা হচ্ছে , গরুগুলো নড়ছেই  না। 
সাধু বললো -  এক কাজ কারো।  তুমি অন্য দিন যেভাবে দড়ি দিয়ে  গরুগুলোকে বাঁধো,  আজ মিথ্যে মিথ্যে দড়ি ছাড়াই গরুগুলোকে বাঁধো  অর্থাৎ দড়ি বাঁধার   অভিনয় করো।  দেখবে গরুগুলো ঠিক হাটা  দেবে। 
আর বাড়ি চলে যাবে। 
রাখাল ভাবলো সাধু আমার সাথে মজা করছে।  ও এদিক ওদিক দেখতে লাগলো।  কোথাও যদি  দড়ি  পাওয়া  যায়। 
সাধু বললো - কিগো যাও , যা বলছি করো।  দেখোনা তোমার কাজ হয় কি না। 
রাখাল বললো - আপনি  আমার সাথে মজা করছেন না তো  ?সাধুবাবা হাসলো।  রাখাল তখন অনন্যউপায় হয়ে  বললো - ঠিক আছে বলছেন যখন করে দেখি। 
এইবার রাখাল সন্দেহজনক  মন  নিয়ে মাঠে ফিরে  এলো।  এবং দড়ির কোনো ব্যবস্থা  না করতে পেরে  বাধ্য হয়ে  সাধুর কথা মতো দড়ি দিয়ে গরু বাঁধার  অভিনয় করতে লাগলো। আশ্চর্যের ব্যাপার অভিনয় হয়ে গেলে গরুগুলো বাড়ির পথে হাটা  দিলো।  রাখালের মন আনন্দে ভরে গেল।  গরু নিয়ে সাধুর কুটিরের সামনে দিয়ে যাবার সময় সাধুকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেলো। 
সাধু রাখালকে বললো বাড়ি নিয়ে আবার গোয়াল ঘরে  দড়ি বাঁধার অভিনয় করো।  না হলে গরু বাইরে বেরিয়ে যাবে।  রাখাল তাই করলো।  
পরদিন সকালে আবার যখন গরুগুলোকে গঙ্গার তীরে মাঠে নেবার জন্য 
চেষ্টা করলো, গরুগুলো গোয়াল থেকে বেরোতে চাইলো না।  বাঁধন খোলার অভিনয় তো করা হয় নি। রাখালের মনে সন্দেহ হলো গরুগুলোকে সাধুবাবা তুকতাক  করেনি তো ?  না  হলে গরু কেনো গোয়াল থেকে বের হতে চাইছে না।  ওদের তো বাঁধন নেই।  তবে ?
ও আবার সাধুবাবার কাছে দৌড়ে গেল।  বললো সাধুবাবা গরুগুলো সব গোয়াল থেকে বের হতে চাইছে না।  সব গরুই ছাড়া , অথচ  গোয়াল থেকে বের হচ্ছে না।  কি করবো ?
সাধুবাবা একটু  হাসলো।  বললো আবার দড়ি খোলার  অভিনয়  করো। দেখবে সবাই তোমার কথা শুনছে। 
রাখাল বাড়ি এসে তাই করলো।  আশ্চর্যের ব্যাপার, সঙ্গে সঙ্গে  সব গরু রাখালের কথামতো মাঠের উদ্দেশ্যে হাটা  দিলো।
গল্পকথা - কিন্তু আমরা কি ওই গরুগুলোর মতো  অভ্যাসের বাঁধনে
আবদ্ধ  ? আমি তাহলে বিনয় নোই ? এটা  আমার বহু দিনের অভ্যাস 
মাত্র ? তাইতো, আমার বাবা-মা যদি আমাকে বিনয় না বলে শশাঙ্ক বলে ডাকতো তাহলে শশাঙ্কই হতাম। আর আমার নামকরণের আগে আমি কি ছিলাম ? একটা মাংসপিণ্ড ছাড়া কিছুতো  নয়। তার আগে কি ছিলাম ? মাতৃ গর্ভে  এক্স - ওয়াই ক্রোমোজমের মিশ্রণ।  পিতৃ-মাতৃ শক্তির মিশ্রিত সত্বা এই শরীর।  এই শক্তি কোথায় ছিল ? খাদ্যকণা থেকেই এই শক্তি উৎপণ্য হয়েছে। খাদ্যকণা আবার পঞ্চভূতের সৃষ্টি। পঞ্চভূত এলো কথা থেকে ? এখান থেকেই ধোঁয়াশার শুরু।  শব্দ(ওম) থেকেই পঞ্চভূতের সৃষ্টি। সৃষ্টির পর্যায়ক্রম - আকাশ -বায়ু -অগ্নি-জল-পৃথিবী। আকাশের একটি গুন্ - শব্দ; বায়ুতে দুটো গুন্ - শব্দ ও স্পর্শ ; অগ্নিতে তিনটি গুন্ - শব্দ স্পর্শ ও রূপ ; জলে চারটি গুন্ - শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রস :পৃথিবীর পাঁচটি গুন্ : শব্দ, স্পর্শ, রূপ  রস ও  গন্ধ। এক্ষেত্রে শব্দগুন সবার মধ্যে বর্তমান।   এর পরে এলো ঔষধি -গাছপালা। ধীরে ধীরে জলজ প্রাণী-উভচরপ্রাণী - আকাশচারীপ্রাণী -মৃত্তিকাচারীপ্রাণী। তাহলে আমি কি শব্দ ? শব্দব্রহ্ম ? শব্দের আগে কিছু ছিল কি ? শব্দতো  একটা গুন্। তাহলে এর ধারক বা কর্তা  কে ? ইচ্ছা শক্তি ? ইচ্ছা শক্তিও তো একটা গুন্। তাহলে কর্তাকি মহাশুণ্য নাকি বিভূতি ? মহাশুন্য যাকে বিগব্যাং তত্ত্ব   বলছে ব্ল্যাক হোল।   
মহর্ষি অষ্টাবক্র চতুর্থ শ্লোকে বলছেন  :
যদি দেহং পৃথক্  কৃত্য চিতি বিশ্রাম্য তিষ্ঠসি -
যদি দেহাদি পৃথক করে, চৈতন্যে বিশ্রাম করিতে পারো 
অধুনৈব সুখী শান্তো বন্ধমুক্তো  ভবিষ্যসি। 
এখনই  সুখী, শান্ত, বন্ধনমুক্ত হতে পারো                      
 মহর্ষি অষ্টাবক্র কত কঠিন কথা কত  সহজ ভাবে বলে দিলেন।  শুধু মান্যতা।  এক্ষুনি  এই মুহূর্তেই  মুক্তি। এই জীবদ্দশাতেই মুক্তি। শুধু দেহাতীত হয়ে , তোমার আসল সত্বা  চৈতন্যে  অবস্থান করো। এক কথায় মুক্তির পথ বলে দিলেন। তুমি কে তা বলে দিলেন।  আত্মজ্ঞান  দান করলেন। কোনো সাধনপথ  নয় ,যোগক্রিয়া  নয় , সোজা শিখরে নিয়ে গেলেন।  সোজা কৈলাশ।  পাহাড়ের দুর্গম পথের  বর্ণনা নয়।  পূর্ব , পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ - কোনো দিক নয়।  সোজা স্বয়ং  এর কাছে নিয়ে গেলেন। এখানেই অষ্টাবক্রের বিশেস্বতঃ।  এখানেই অষ্টাবক্রর  সাফল্য। সোজা বলে দিলেন দেহাতীত হয়ে চৈতন্যে বিশ্রাম লও। 
মহারাজ জনক ব্রহ্মজ্ঞানের উপযুক্ত অধিকারী ছিলেন।  জ্ঞান সংগ্রহের সমস্ত যোগ্যতা তার ছিলো।  অশ্বারোহণ কালে এক রেকাবে এক পা ন্যস্ত করে দ্বিতীয় পা অপর রেকাবে রাখার জন্য যে অতি  অল্প  সময়ের প্রয়োজন  তার মধ্যেই  গুরুর উপদেশে তিনি ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার করেছিলেন।  যেমন গুরু তার তেমন শিষ্য।  
হাজার বছরের  অন্ধকার, এক ঘষাতেই পরিষ্কার।  দেশলাই আর কাঠি যদি শুকনো থাকে তবে এক ঘষাতেই আলো।  বহু যুগের অন্ধকার এক মুহূর্তেই দূর হয়ে যায়। 
রাজা জনক সংশয়ে  পড়েছেন - রাজা সত্য - না ভিক্ষারী  সত্য।  যেসব ব্রাহ্মন  কুলগুরু  তার দরবারে নিত্য শাস্ত্রব্যখ্যান শোনাতেন  তারা কোনো উত্তর দিতে পারছেন না। মহর্ষি অষ্টাবক্রের কাছে সংবাদ গেল।  তিনি রাজদরবার -এ  এসে  বললেন - তুমিই সত্য আর সব মিথ্যা।  কথাটা বিদেহ মহারাজের মনে ধরলো।  তিনি  মহর্ষির  কাছে ব্রহ্ম উপদেশ প্রার্থনা করলেন।  আচার্য বললেন - তুমি রাজা , সিংহাসনে বসে আছো।  আমি আচার্য তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।  তোমার যদি ব্ৰহ্ম জ্ঞান পাওয়ার বাসনা হয় তবে নিচে নেবে এস। আমি তোমার যোগ্যতা পরীক্ষা করবো। তারপর যদি উপযুক্ত মনে করি তবেই ব্রহ্ম-উপদেশ দান  করবো। উপদেশ প্রদানের এটাই  শাস্ত্রীয় বিধি। 
মহারাজা জনক তাই করলেন।  নেবে এলেন নিচে।  মহর্ষি অষ্টাবক্র রাজাকে বললেন চলো বনে , চলো নির্জনে।  রাজা সম্মত হয়ে অশ্বারোহনে বনে  চললেন  আচার্যকে সঙ্গে নিয়ে।  গভীর জঙ্গলে এলে অষ্টাবক্র মুনি অশ্ব থামাতে বললেন।  নেবে এস সওয়ারী। জনক ঘোড়ার  পিঠ  থেকে নামলেন।  না এখানে নয়।  আরো গভীর জঙ্গলে যেতে হবে। বলতেই রাজা  আবার অশ্বের পিঠে  উঠবার জন্য রেকাবিতে পা রাখলেন। যেই না  দ্বিতীয়  পা উঠাতে যাবেন, অষ্টাবক্র মুনি ধমক  দিয়ে  বলে উঠলেন - হে রাজন ! দ্বিতীয়  পা উঠাবার আগে আমার এক প্রশ্নের উত্তর দাও। - 
 বিদেহ  রাজ্ !  তুমি কি জানোনা,  ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করতে গেলে  গুরুকরণ করতে হয়? আর তুমি যদি আমাকে গুরুপদে অভিষিক্ত করতে চাও, শাস্ত্র অনুসারে গুরুদক্ষিণা দেওয়াও তোমার কর্তব্য। মহারাজা জনক বললেন - হ্যাঁ গুরুদেব আমার তন্,মন,ধন সবই আমি আপনার চরণে সমর্পন করলাম। এখন আপনি আমাকে কৃপা করে ব্রহ্ম-উপদেশ দান  করুন।  এ কথা শুনে মুনি দূরে এক গুহায় প্রস্থান  করলেন। 
কিছুক্ষন  পরে  মুনি এসে  জনক রাজা-কে ঘোড়সওয়ারুনমুখ  অবস্থায় আগের মতো দেখে জিজ্ঞেস করলেন - এমনতরো গতিহীন নিস্পন্দ হয়ে  দাঁড়িয়ে  আছো কেন ? রাজা উত্তরে  বললেন - গুরুদেব এই হাত, এই পা, এই শরীর , এই মন , সমস্ত ঈন্দ্রিয়াদি কিছুই তো আর এখন আমার নয়। এতদিন যা কিছু আমার ভাবতাম এমনকি  বিদেহ-রাজের   রাজ্য, সবই আপনাকে সঁপেছি। এখন আপনার আদেশ ছাড়া আমি আর কিছুমাত্র করতে সমর্থ  নই। আচার্য অষ্টাবক্র মুনি, জনকের কথা শুনে খুশি হলেন এবং ব্রহ্মজ্ঞান দিতে উদ্যোগী হলেন। অষ্টাবক্র সংহিতা জনক রাজার প্রতি প্রদত্ত  এই ব্রহ্ম-জ্ঞান। 
আচার্যদেব  পরবর্তী শ্লোকে বলছেন :
ন ত্বং  বিপ্রাদিকো বর্ণো  ন আশ্রমী  ন অক্ষগোচরঃ
অসঙ্গঃ অসি নিরাকারো বিশ্বসাক্ষী সুখী ভব। 
- তুমি ব্রাহ্মণ বা অন্যকোনো বর্ন (ক্ষত্রিয় , বৈশ্য , শুদ্র )ভুক্ত নয়  - আশ্রমী  বা আশ্রমবাসী নও - চক্ষু দ্বারা গোচরযোগ্য  নয় - নিরাকার - বিশ্বসাক্ষী - সুখী হও। 
বর্ণাশ্রম বন্ধনে যে আবদ্ধ , আশ্রমের বিধি বন্ধনে  যে আবদ্ধ  সে তো তুমি নয়।  তূমি  নিরাকার, অগোচর, অসঙ্গ ( কেউ  তোমার সঙ্গী নয় , কারুর তুমি সঙ্গী নয়), সমস্ত  চলমান এই বিশ্বের তুমি সাক্ষি।  তুমি তো           চির - সুখী। 
আমি শুনেছি , ঠাকুর রামকৃষ্ণ, মহাত্মা বিবেকানন্দ-কে অষ্টাবক্র সংহিতা পড়তে দিয়ে ছিলেন।  বিবেকানন্দ পড়তে  চায় নি।  রামকৃষ্ণ বলেছিলেন , তুই আমাকে পড়ে  শোনাও ।  রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দকেই কেন অষ্টাবক্র সংহিতা পড়তে দিয়েছিলেন ?  কেউ কেউ বলেন অষ্টাবক্র সংহিতা - আধ্যাত্বিক দিক থেকে যারা অগ্রসর ব্যক্তি - তারাই এই বই পড়তে পারে। কেননা এখানে অধ্যাত্বিকতার  শেষ  কথাটা বলা আছে। তাই সাধারণ সাধক এই বই পড়ে, মর্মার্থ  উদ্ধার  করতে পারবে না।  আমার মনে হয়  -  অষ্টাবক্র সংহিতা এমন একটা   বই  - যা পড়লে আর কিছু পড়তে হয় না।  যা পড়লে আর কিছু করতে হয় না।  রামকৃষ্ণ দেখেছিলেন বিবেকানন্দের প্রতিভা।  রামকৃষ্ণ দেখেছিলেন বিবেকানন্দের  মধ্যে সম্ভাবনার বীজ। বিবেকানন্দের বিবাহের  তোড়জোড়  চলছিলো।  সেখান থেকে বিবেকানন্দকে ফিরিয়ে  আনতে  গেলে মোক্ষম ঔষধ  ছিলো  অষ্টাবক্র গীতা।  ঔষধে  কাজও হয়ে ছিলো।  বিবেকানন্দ  সন্ন্যাস নিয়েছিলেন।  নরেন হয়েছিল বিবেকানন্দ।  
শ্রীমদ্ভগবৎ  গীতা  পড়তে গিয়ে ভগবান  শ্রীকৃষ্ণ -এর প্রথম শ্লোকেই  ধাক্কা খেয়ে ছিলাম। 
 "কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম 
  অনার্য্যজুস্টমস্বর্গ্যম কীর্তিকরম অর্জুন। "

ভগবান  তাঁর  প্রথম কথাতেই অর্জুনকে অনার্যের মতো কথা বলার জন্য বিস্নয় প্রকাশ করলেন যা স্বর্গ প্রাপ্তির অনুকূল নহে।  আমার মাথার মধ্যে এলো না, এখানে অনার্য কথাটা কেনো বললেন। আর্য্য  বলতে আমরা গ্রীকবাসী  বুঝি আর অনার্য্য  বলতে ভারতবাসী বুঝি। আর আর্য্যদের দৃষ্টিতে   এই ভারতবাসী - অসাধু , অভদ্র, অধম।  আর কর্তব্যকর্ম  তা সে যতই নির্মম ও নৃশংস হোক, তা না করলে, মানবতার কথা বললে , যুদ্ধ না করলে স্বর্গ লাভ হবে না। এ সব কথার  সঠিক মানে আমি বুঝি না।  স্বর্গ-তো নির্ভ্যজাল সুখ ভোগের জায়গা হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে। অর্জুন কি মৃত্যুর পরে স্বর্গে সুখভোগ  করতে গেছে ?

ভগবান   আবার    অন্য  সময়ে বললেন :
"চাতুর্ব্বন্যং ময়া সৃষ্ট্ং গুনকর্ম্মবিভাগশঃ 
তস্য কর্ত্তারমপি  মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম।."
গুন্ ও কর্ম     অনুসারে আমি মানুষকে চার ভাগে  ভাগ করেছি।  কিসের ভাগ ? কার ভাগ ? দেহের ভাগ ?ভগবান  শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন : তুমি দেহ নও, তুমি আত্মা। আমি যদি আত্মা হই তবে আত্মার আবার ভাগ কেমন করে হবে ? বিভূতির আবার ভাগ কী  ?অব্যয়, অব্যক্ত, বিভূতি নির্গুণ - তার গুনের সীমা করা যায় না।   ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কোন বর্ণের ? তিনিতো ক্ষত্রিয় বংশে জন্ম গ্রহণ করে ছিলেন। তবে কি তিনি ক্ষত্রিয় ? একই পিতার(ব্যাস) ঔরসে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন  বিদুর, ধৃতরাষ্ট্র  ও পান্ডু। তবে বিদুর ব্রাত্য কেন ? তার কি যোগ্যতা কি কম ছিলো ?  তাই গীতা আমি বুঝি না। 
অষ্টাবক্র কিন্তু সমাজের প্রচলিত ধারণাকে নষ্ট করে বললেন  তুমি স্বয়ং বিভু -  তুমি না বিপ্র অর্থাৎ ব্রাহ্মণ  না আশ্রমবাসী সাধক।  তুমি বনাশ্রমের উর্ধে। তুমি  না কারোর সঙ্গী না কেউ তোমার সঙ্গী।  তুমি আকারবিহীন , তুমি কেবল সাক্ষী।  এ সব কথা শোনার  পরে মনে হয় - আমি উম্মুক্ত। পৃথিবীর পৃষ্ঠে কিলবিল করা দেহ আমি নোই।  আমি পূর্ণ। আমি সর্বত্র। আমি বিরাট।  আমি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। আমি ছোট নোই।  আমি বড়ো  নোই। 
           
আচার্যদেবের পরবর্তী শ্লোক  :(৬)
সুখং দুঃখং মানসানি  ন তে বিভো 
ন কর্তা  অসি ন ভোক্তা অসি মুক্ত এব  অসি  সর্বদা। 
-  ধৰ্ম-অধর্ম-সুখ-দুঃখ মনের ধৰ্ম , বিভো - তে এসব  নেই।   
(তুমি )  কর্তা  নও ,ভোক্তা নও , সর্বদা  মুক্ত।
সত্যিইতো, ধৰ্ম, অধর্ম,সুখ, দুঃখ  - এ গুলো তো মনের ব্যাপার। আর মনটা তো খাদ্যকণার সৃষ্টি। খাদ্য না পেলে ও ব্যাটা মারা পড়বে।  উল্টো পাল্টা খেলে, মনের মধ্যে ওলট - পালট  হবে। কিছু দুঃখ অবশ্য শারীরিক। সেটার উপশম  কি ভাবে হবে।  শরীর  বোধের উর্ধে ওঠা যায় না।  বড়জোর উপেক্ষা করা যায় মাত্র।  
আমি কর্তা  নোই।  আমি ভোক্তা  নোই।  সর্বদা মুক্ত। কর্তারাই ভোক্তা আবার ভোক্তারাই কর্তা  হয়। আমি যদি কর্তা -ভোক্তা না হই  তবে তো আমি মুক্ত। আমি সদাই মুক্ত। আমার মুক্তি পাবার কী আছে।  যার বাঁধন আছে  তার মুক্তি আছে. যার বাঁধন-ই  নেই তার আবার মুক্তি কি ?  

অষ্টাবক্র  মুনি  পরবর্তী (৭) শ্লোক-এ  বলছেন :

একো  দ্রষ্টাসি সর্বস্য  মুক্ত প্রায়ঃ অসি  সর্বদা 
অয়মেব  হি তে বন্ধো দ্রষ্টারং পশ্যসীতরম্। 
- তুমি সর্ব শরীরের একমাত্র ব্যাপক দ্রষ্টা, দেহাধ্যাস বসতঃ বন্ধ প্রতীয়মান হলেও তুমি আসলে মুক্ত। তথাপি আত্মাকে দেহাদি পরিচ্ছিন্নরূপেই তুমি জেনে থাকো, এটিই তোমার বন্ধন। 
মহামুনি এবার, মানুষ  নিজেকে  কিভাবে বন্দী করে ফেলে, সেটাই বলছেন। আমরা আত্মাকে দেহ ভাবি।  গুটিপোকা যেমন নিজ মুখ নিঃসৃত লালা থেকে নিজেকে আছন্ন  করে ফেলে, তরল  লালা আস্তে আস্তে কঠিন পদার্থের রূপ নেয় , জীব তেমনি বাসনা বা ইচ্ছা রূপ লালা দিয়ে নিজেকে আছন্ন  করে ফেলে।  এই বাসনাই আস্তে আস্তে রূপ পরিগ্রহ করে। এবং অজ্ঞানতাবশে  দেহ -কেই আত্মা  মনে করে. এবং দেহে অবস্থিত ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধ সুখ দুখঃ নিজের বলে ভাবতে শুরু করে।  সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গুটি পোকা যেমন বাসা কেটে বেরিয়ে  পড়ে, আত্মাও  তেমনি দেহ থেকে বেরিয়ে পড়ে।  একেই আমরা মৃত্যু বলি।  জন্মই  বন্ধন - মৃত্যুই মুক্তি।  দেহের মধ্যে থেকেও  যিনি স্বয়ংকে কে জ্ঞাত  হন  বা থাকেন  তিনিই দেহাতীত মুক্ত পুরুষ।  
আমরা এবার  পরবর্তী শ্লোকে  যাবো -(৮)
অহং কর্তা  ইতি  অহং মানো মহাকৃষ্ণ-অহি দংশিতঃ
নাহং কর্তেতি  বিশ্বাস-অমৃতং পীত্বা  সুখী ভব। 

-আমি  কর্তা এই অহঙ্কাররূপ মহান কৃষ্ণ সর্প কর্তৃক দংশিত  হয়েছে। 

আমি কর্তা  নই এই বিশ্বাস রূপ অমৃত পান করে তুমি সুখী হও।

শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ বলতেন : "যতক্ষন অহংকার ততক্ষন অজ্ঞান। অহংকার থাকতে মুক্তি নাই।  গরুগুলো হাম্মা হাম্মা করে, আর ছাগলগুলো ম্যা ম্যা করে।  তাই ওদের এত যন্ত্রনা। কষায়ে কাটে চামড়া দিয়ে জুতো বানায় ঢোলের চামড়া তৈরি  করে, যন্ত্রনার শেষ নাই। হিন্দিতে হাম মানে আমি আর ম্যায় মানেও আমি।  আমি আমি করে বলে কত কর্ম ভোগ।  শেষে  ধুনুরীর  তাঁত  তৈরি করে। তখন ধুনীর হাতে তুঁহু  তুঁহু  বলে , অর্থাৎ তুমি তুমি।  তুমি তুমি বলার পরে তবে নিস্তার। (শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত  পৃ : ১৪)   


পরবর্তী শ্লোক   (৯)


একো  বিশুদ্ধ বোধঃ অহম ইতি নিশ্চয় -বহ্নিনা 

প্ৰজ্বাল্য অজ্ঞানগহং বীতশোকঃ সুখী ভব। 

-আমি এক ও  বিশুদ্ধ,  গভীর অজ্ঞান  অরণ্যে, এই বোধ - বহ্নির ন্যায়  প্রজ্জলিত  করো - শোক রোহিত  হও - সুখী হও। 


শ্লোক  নং - ১০ :


যত্র  বিশ্বম  ইদং  ভাতি কল্পিতং রজ্জু সর্পবৎ 

আনন্দ পরামানান্দঃ স  বোধস্ত্যং   সুখং চর। 

 রজ্জুসর্পের ন্যায় কল্পিত এই বিশ্ব যে বোধস্বরূপে প্রতিভাত হয় ;

সেই স্বতঃ নিত্য অনন্ত  আনন্দ স্বরূপ চিদাত্মা তুমিই ; এইরূপ জেনে সুখে বিচরণ করো।  

অসম্ভব অনুভূতি সম্পন্ন এই মহামুনি অষ্টাবক্র জন্ম জন্মান্তের পণ্ডিত।  জন্মের আগেই মাতৃগর্ভে তার বেদজ্ঞান  হয়েছিল।  পিতা ও পিতামহ যখন বেদবিদ্যা ছাত্রদের  শেখাতেন  তা শুনে শুনে অষ্টাবক্র বেদবিদ্যা আয়ত্ব করে ছিলেন।ফলে  পিতা কাহোড় যখন  বেদমন্ত্র উচ্চারণে ত্রূটি করতেন তা অষ্টাবক্রের কাছে স্পষ্ট হয়ে যেত। মাতৃগর্ভে থাকাকালীন , একদিন পিতা  যখন শিষ্যদের বেদ  পাঠ  করে শোনাচ্ছিলেন  তখন মাতৃ-গর্ব্ভ  হতে অষ্টাবক্র বলে উঠলেন  : হে পিতঃ, আপনার কৃপায় আমি মাতৃ গর্বে বসেই সমস্ত বেদ  ও সমস্ত শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করেছি। বেদমন্ত্র  উচ্চারণে আপনার 

ত্রূটি হচ্ছে। প্রথমে কেউ বুঝতে  পারেনি কে এই সাবধান বাণী উচ্চারণ করছে।  কোথা থেকে ভেসে আসছে এই শাসনবাণী। যখনি কহোড় বেদমন্ত্র উচ্চারণে ত্রূটি  করছিলেন তখনি অষ্টাবক্র ত্রূটি সংশোধন করে দিচ্ছিলেন। অহংকারী পণ্ডিত শাস্ত্রজ্ঞ কহোড় শিষ্যসম্মুখে এই বেদ উচ্চ্চারণের ত্রূটি প্রদর্শন ভালোভাবে নিতে পারলেন না।  যখন বুঝতে পারলেন সুজাতা গর্ভস্থ শিশুই এই অনাধিকার চর্চা করছে, তখন আর ধৈর্য্য রাখতে পারলেন না।.........


"আমারি ভবিষ্যৎ সন্তান, যে এখনো পৃথিবীর আলো  দেখেনি তার এতো স্পৰ্ধা -  আমাকে,পণ্ডিত কহোড়কে বেদমন্ত্র উচ্চারণের ত্রূটি শোনাতে চাইছে ? ও জানেনা আমি কত বড়  পণ্ডিত, কতবড় শাস্ত্রজ্ঞ্।  সর্বপরি আমি ওর পিতা. জন্মের আগেই আমাকে অপমান করার সাহস ও পায়  কোত্থেকে ?"

রেগে গেলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না. কহোড়মুনি রেগে গিয়ে অভিশাপ দিলো  : " রে মূর্খ, তুই যতবার আমাকে মন্ত্র  উচ্চারণের ত্রূটি শোধরাবার মতো দঃসাহস দেখিয়েছিস তোর অঙ্গ ততো জায়গায় খণ্ডিত হোক "

অভিশাপ ফলে গেল -যে হেতু আট বার সাবধান বাণী উচ্চারণ করে ছিলেন তাই - দেখা গেল অষ্ট -অঙ্গ  বিকৃতি নিয়ে সুজাতার সন্তান হলো। এই অষ্ট - অঙ্গ বিকৃতির কারণেই তার নাম অষ্টাবক্র বলে  প্রখ্যাত হলো।আমার মনে প্রশ্ন জাগে মানুষের কি তাহলে ভ্রূণ  অবস্থা থেকেই শিক্ষা শুরু হয়ে  যায় ? শুনেছি - মা-বাবার মিলনক্ষন, উন্মত্ত অবস্থায় মিলন, মিলন ও গর্ভকালীন সময়ে মায়ের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা সন্তানের উপরে প্রভাব ফেলে। অষ্টাবক্রর ক্ষেত্রে এই প্রভাব কতটা সত্য ?   

পরবর্তী শ্লোক (১১) :


মুক্ত-অভিমানী মুক্তো হি বদ্ধো বব্ধ-অভিমানী অপি 

কিংবদন্তি ইহ সত্যেয়ং যা মতিঃ সা গতির্ভবেৎ।  

আমি মুক্ত - এইরূপ যার ভাবনা সেই মুক্ত আর আমি বদ্ধ  এইরূপ যার ভাবনা সেই বদ্ধ। যার যেমন মতি  তার তেমন গতি - এই কিংবদন্তী সত্য। 


ঠাকুর রামকৃষ্ণ একদিন মাস্টারকে বললেন -"দেখো অষ্টাবক্রসংহিতায় অত্মজ্ঞানের  কথা আছে. আত্মজ্ঞানীরা বলে, 'সোহহম ' অর্থাৎ 'আমিই সেই পরমাত্মা'. এসব বেদান্তবাদী সন্যাসীর মত,....... আমি মুক্ত এ অভিমান খুব ভালো।  "আমি মুক্ত " এ কথা বলতে বলতে সে মুক্ত হয়ে  যায়। আবার "আমি বদ্ধ" 

" আমি বদ্ধ "বলতে বলতে সে ব্যক্তি বদ্ধই হয়ে যায়।  যে কেবল  বলে আমি পাপী সে শালাই পড়ে  যায়।  বরং বলতে হয়  আমি তাঁর  নাম করছি , আমার আবার পাপ কি , বন্ধন  কি ! (পৃ -৯৪ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত )  
কথায় আছে দশচক্রে ভগবান ভূত। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেলিন -  "তুমি যাহা চিন্তা করিবে তুমি তাহাই হইয়া যাইবে, তুমি যদি নিজেকে তেজস্বী ভাব তবে  তেজস্বী হইবে , যদি তুমি নিজেকে দুর্বল ভাবো তবে দুর্বল হইয়া যাইবে "
ভাবনা, মান্যতা, একটা বড়  ব্যাপার। মানুষ যা ভাবে সেই ভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করে।  এবং এই ভাবেই মানুষের রূপান্তর ঘটে। শুনেছি ঠাকুর রামকৃষ্ণ একবার সুফী সাধনা করতে গিয়ে নিজেকে মেয়েমানুষ বলে ভাবতেন।  আশ্চর্য়র ব্যাপার হলো তিন মাস পড়ে নাকি তার স্তন বৃদ্ধি হয়ে ছিলো।  ছয় মাস পড়ে মাসিক হতে শুরু করে।  আমার এই উপলব্ধি নেই।  কিন্ত অস্বীকার করি কি করে ?

এ ছাড়া সেই বিখ্যাত গল্পোতো  সবার জানা। ব্রাহ্মণের  কেনা ছাগল, দুষ্টূ ছেলেদের পাল্লায় পড়ে, কেমন  কুকুর ভ্রম-হলো  আর ব্রাম্মন বেটা কুকুর ভেবে ছাগল ফেলে পালালো। তো একটা কথা বার বার শুনতে শুনতে আমরা সেটাই সত্য বলে মনে করি।  ছোটবেলা থেকেই শুনছি আমি বিনয়, এই আমার বাবা, এই আমার ভাই, এই আমার মা, এই আমার বাড়ি, এই আমার দাদা, এই আমার দিদি। এই আমার দেহ।  এই দেহই আমি।  আমাকে তো এটি শেখানো হয়েছে। এর বাইরে বা ভেতরে অন্য কিছু আছে, তাতো আমি জানিনা। জানার কিছু আছে তাইই  তো জানিনা।  এখন এই বয়সকালে মনে প্রশ্ন জেগেছে - আমি আসলে কী বা কে ? আমার সারা জীবনের শিক্ষা আমাকে বহির্মুখী করেছে।  আজ ভিতরের দিকে তাকিয়ে, অন্তর্মুখী হবার চেষ্টা করছি।  তাও সেই মনের সাহায্যে।  যেটা দেহেরই অঙ্গ। মনের দ্বারা কি বোঝা যাবে ? শাস্ত্র বলছে : মনের র্উর্দ্ধে  সেই আমি।  তবে সে কোথায়? কীভাবে 

জানবো ? কেই বা জানবে ? কেই বা জ্ঞাতা  ? কেই বা জ্ঞেয়  ? এগুলো সব কষ্ট কল্পনা নয়তো ? আমার কাজ পথ চলা।  চরৈবতি-চরৈবতি।  অষ্টাবক্র সংহিতার সমুদ্রে ডুব দাও। 

শ্লোক নং (১২) :
আত্মা সাক্ষী বিভুঃ পূর্ণ একো মুক্তঃ চিৎ অক্রিয়ঃ
অসঙ্গো নিঃস্পৃহঃ শান্ত ভ্ৰমাৎ সংসারবান ইব.

- আত্মা স্বভাবতই সাক্ষীবিভু,পূর্ণ, মুক্ত চৈতন্য স্বরূপ , অক্রিয় , অসঙ্গ, নিস্পৃহ ও শান্তস্বরূপ। ভ্ৰম  বশতঃ সংসারবান মনে হয়।


আত্মা সাক্ষী।  আত্মার স্বভাবই সাক্ষী যেমন। অর্থাৎ উনি কিছু করেন না।  শুধু দেখেন। উনি বিভু, উনি পূর্ণ। উনি মুক্ত। উনিই চৈতন্য স্বরূপ। কোনো কাজ করেন না। কোনো সঙ্গী সাথী নাই। উনি স্পৃহ নন, শান্ত, ভুল বসত তাকে সংসারে সংসারবান মনে হয়। 


আত্মা বিভু, অর্থাৎ যা থেকে বিভিন্ন বস্ত্ূর উৎপত্তি হয়। অর্থাৎ ইনিই কারন। 


পূর্ণ অর্থাৎ এনার কোনো কিছুর অভাব নেই। যিনি স্বরূপেই পূর্ণ। 


প্রত্যেক উপনিষদের প্রথমে একটা শান্তিপাঠ আছে। ঈশোপনিষদ-এর প্রথমেও এমনি একটা শান্তি মন্ত্র  আছে।  তাতে বলছেন :


 ওঁ পূর্নমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে

পূর্ণস্য পূর্ণমাদায়  পূর্নমেবাবশিষ্যতে 
ওঁ  শান্তিঃ  শান্তিঃ শান্তিঃ। 

অদভুত মন্ত্র।  প্রথম যে দিন আমি এই মন্ত্র  পড়ি সেদিন আমার মনে হয়েছিল, আমাদের ঋষিদের কি গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল। ওঁ, উহা পূর্ণ, ইহাও পূর্ণ।  পূর্ণ হতে পূর্ণ উদগত হন। পূর্ণের পূর্ণত্ব গ্রহণ করলে পূর্ণই মাত্ৰ অবশিষ্ট থাকে। 


শূন্য থেকে শূন্য নিলে শূন্যই অবশিষ্ট থাকে। কি অসীম জ্ঞানের ভান্ডার ছিল। 


এর পরে বলছেন : আত্মা এক অর্থাৎ ভেদরহিত  অদ্বিতীয় ; মুক্ত অর্থাৎ ময় বা তার কার্যের অতীত ; চিদরূপ অর্থাৎ চৈতন্য স্বরূপ, স্ব-প্রকাশিত ; অক্রিয় অর্থাৎ সমস্ত ক্রিয়াহীন ; অসঙ্গ অর্থাৎ সর্বসন্মন্ধের উর্ধে ; নিঃস্পৃহ অর্থাৎ কোনো কিছুতেই স্পৃহা নেই ;

শান্তস্বরূপ অর্থাৎ সমস্ত প্রবৃত্তির উর্ধে তিনি। 

শ্লোক নং (১৩) :

কূটস্থং বোধম অদ্বৈতম আত্মানং পরিভাবয়
আভাস অহং ভ্ৰমং  মুক্তা ভাবং  বাহ্যম অথ অান্তরম্। 

-আমি অহঙ্কাররূপ  এই ভ্রম, দেহাদি আমার, এই বাহ্যভাবনা এবং আমি সুখী দুঃখী এই মূঢ় ইত্যাদি ভাবনাসমূহ পরিত্যাগ করে অকর্তা  অসঙ্গবোধস্বরূপ ব্যাপক অদ্বিতীয় আত্মাকে চিন্তা করো। 


আমি আমি এই ভাবনা, এই বোধ  ত্যাগ করে কূটস্থ অর্থাৎ পরমাত্মাকে  চিন্তা করো। অহং-এ র অভ্যাস, এটা  তো আমাদের  ভ্রম। এই ভ্রম থেকে  অন্তরে বাহিরে মুক্ত হও।  তবেই তুমি সুখী হতে পারবে।  


শ্লোক নং  (১৪) :

দেহ-অভিমান-পাশেন চিরং বদ্ধ -অসি পুত্রক 
বোধঃ -অহং জ্ঞ্যান -খড়্গেন  তন্নিঃকৃত্য সুখী ভব। 

দেহ -অভিমান পাশে চির আবদ্ধ হয়ে আছো আমার পুত্র।  জ্ঞান খড়গ দ্বারা এই অহং-বোধ   ছিন্ন  করে তুমি সুখী হও।  


 -হে পুত্রসম শিষ্য  ! সুদীর্ঘকাল যাবৎ তুমি দেহাত্ম-অভিমানে বদ্ধ 

হয়ে আছো, সুতরাং "আমি শুদ্ধচৈতন্যস্বভাব"  এই ভাবনারূপ খড়গ দ্বারা দেহাত্ম-অভিমান নিঃশেষে ছিন্ন করে সুখী হও। 

শ্লোক নং  - (১৫) :

নিঃসঙ্গো নিষ্ক্রিয় অসি ত্বং স্বপ্রকাশো নিরঞ্জনঃ 
অয়মেব হি তে বন্ধঃ সমাধিম্ অনুতিষ্ঠসি।

তুমি তো নিঃসঙ্গ, নিষ্ক্রিয়, স্ব-প্রকাশ  নির্মল পরব্রহ্ম হয়েও তুমি যে সমাধিরূপ ক্রিয়া অনুষ্ঠান করছো, এটাই তোমার বন্ধন। 


 তুমি নিঃসঙ্গ অর্থাৎ সর্বসন্বন্ধ শুন্য, নিষ্ক্রিয় অর্থাৎ সর্ব ক্রিয়া রোহিত, স্বপ্রকাশ অর্থাৎ স্বয়ং প্রকাশ ও  সর্ব অজ্ঞান এবং তাৎকার্যরূপ কালিমাবিহীন হয়েও যে বৃত্তি-নিরোধাত্মক  সমাধির অনুষ্ঠান, এটাই  তোমার বন্ধন। 


শ্লোক নং : ১৬

ত্বয়া ব্যাপ্তমিদং বিশ্বং ত্বয়ি প্রোতং যথার্থতঃ 
শুদ্ধ-বুদ্ধ-স্বরূপ অস্ত্বং মা গমঃ ক্ষুদ্রচিত্ততাম্। 

তুমিই এই বিশ্বে ব্যাপ্ত, তোমাতেই এই বিশ্ব পরিব্যাপ্ত।  তুমি সর্বত্র ওতপ্রোত হয়ে রয়েছো। তুমিই শুদ্ধ , বুদ্ধ , এ সবই  তোমার স্বরূপ।  তুমি ক্ষুদ্র-চিত্ত বা দীন-চিত্ত  হয়ে যেও  না। 


শ্লোক নং : ১৭ 

নিরপেক্ষো নির্বিকারো নিৰ্ভয়ঃ শীতলাশয়ঃ
আগাধবুদ্ধি অক্ষুব্ধো ভব চিন্মাত্রবাসনঃ।

তুমি নিরপেক্ষ অর্থাৎ পক্ষ রহিত, নির্বিকার অর্থাৎ বিকার রহিত,

নির্ভরঃ অর্থাৎ কারো উপর নির্ভরশীল নয়, অতিশয় শীতল অর্থাৎ সদা শান্ত সুখ স্বরূপ। তোমার অগাধ বুদ্ধি, অক্ষুব্ধো অর্থাৎ কারুর প্রতি তুমি ক্ষুব্ধ নও, সর্ব ক্ষোভ-শুন্য। তুমি চৈতন্যমূর্তি, চৈতন্যেই তোমার বাস বা চৈতন্যেই স্থিতি, তুমিই চৈতন্য। 

শ্লোক নং ১৮ :

সাকারমনৃতং বিদ্ধি নিরাকারং তু নিশ্চলম
এতত্-তত্ত্ব-উপদেশেন  ন পুনর্ভবসম্ভবঃ। 

সমস্ত সাকার বস্ত অনৃত্য, (অনিত্য) মিথ্যা। তুমি নিরাকারে নিশ্চল হয়ে থাকো। এই তত্ব উপদেশ প্রাপ্ত হয়ে তুমি সেই বস্তূতে  বিশ্রান্তি লাভ করলেই, পূনর্ভব অসম্ভব হবে,অর্থাৎ  পুনরায় ভব সংসারে আসতে  হবে না, বা  মোক্ষ লাভ করতে পারবে। 


শ্লোক নং ১৯ :

যথা-এব-আদর্শ-মধ্যস্থে রূপে-অন্তঃ পরিতঃ-তু  সঃ
তথৈব অস্মিন্ শরীরে অন্তঃ পরিতঃ পরমেশ্বরঃ। 

দর্পনে প্রতিবিম্বিত দেহাদির অন্তরে ও বাহিরে যেরূপ এক দর্পন পরিব্যাপ্ত হয়ে বিদ্যমান, আত্মাতে অধ্যস্থ এই স্থুল দেহাদির অন্তরে ও বাহিরেও তদ্রুপ এক চিদাত্মাই পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন। 


শ্লোক নং  ২০ :


একং সর্ব গতং ব্যোম বহিরন্তর্যথা ঘটে 

নিত্যং নিরন্তরং ব্রহ্ম সর্বভূতগনে তথা। 

প্রলয় পর্যন্ত স্থায়ীরূপে নিত্য এক মহাকাশ যেরূপ ঘটের অন্তরে ও বাহিরে বিদ্যমান, অবিনাশী ব্রহ্মও তদ্রুপ সর্ব ভূতগনের অন্তরে ও বাহিরে সদা বর্তমান রয়েছেন। 


অষ্টাবক্র সংহিতার প্রথম অধ্যায়,আত্মানুভবোপদেশ  (আত্ম-অনুভব-উপদেশ) এখানেই শেষ। 


কিনতু আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে যাবার আগে প্রথম অধ্যায় আবার একবার সংক্ষেপে আলোচনা করে নেবো। 


প্রথম প্রকরণ-এর সংক্ষিপ্তসার  :


রাজর্ষি জনক তিনটি  প্রশ্ন করেছিলেন : ১. কিভাবে জ্ঞান লাভ হবে ?২. মুক্তি কি ভাবে হবে ? ৩. বৌরাগ্য কি ভাবে লাভ হবে ?


আমরা এবার দেখে নেবো এই তিনটি প্রশ্নের উত্তরে মহর্ষি অষ্টাবক্র মুনি কি বললেন।


১. প্রথমে তিনি বললেন : তোমার যদি মুক্তির ইচ্ছে জাগে তবে বিষয়কে বিষবৎ ত্যাগ করো। ক্ষমা করতে শেখো।বৃহতের কাছে আবেদন করতে শেখো।  দয়া করতে শেখো। সন্তুষ্ট থাকতে শেখো। 

২. আমি কে, তা না বলে বললেন, আমি কে নোই।  অর্থাৎ আমরা যে জানি, আমরা পঞ্চভূতের তৈরি, সেটা ভুল। তিনি বললেন আমরা পাঁচভুও নোই আবার পঞ্চভূতের তৈরিও নোই। আমি চৈতন্য। এইভাবেই আমাকে জানো। 
৩. আমি দেহ, এই ভাবনা বা বোধ থেকে নিজেকে আলাদা করো। যদি দেহ ভাবনা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারো তবেই সুখী ও বন্ধন  মুক্ত হতে পারবে। 
৪. তুমি মনুষ্যকৃত বর্ণবাদে বিশ্বাস করো না। তুমি আসলে নিরাকার। তুমি এদের, যাদের তুমি আপন ভাবছো, তাদের কেউ নও, তোমারও  কেউ নয়। এটা  জেনে নিজেকে সুখী হও। 
৫. ধৰ্ম, অধর্ম, সুখ-দুঃখ, এগুলো সব মনের ভাবনা। মন-তো  দেহের অঙ্গ। দেহাতীত হয়ে গেলে, তোমার কর্তাবোধ চলে যাবে, ভোগ-দুর্ভোগ চলে যাবে। এসব পার্থিব বস্তূ নিজেকে মুক্ত করো।  আর সুখে থাকো। 
৬. তুমি আসলে দ্রষ্টা। দ্রষ্টার কোনো বাঁধন নেই। তুমি আসলে আত্মাকে দেহ ভেবে নিয়েছো, তাই নিজেকে মুক্ত ভাবতে পারছো না। 
৭. তোমার মধ্যে অহংকার রয়েছে। আমি কিছুই করছি না, অর্থাৎ আমি কর্তা নোই , এই বোধ তোমার মধ্যে জাগুক, তাহলেই  তুমি পরম-আনন্দ লাভ করতে পারবে। 
৮. তুমি স্ব-প্রকাশ চিদ-আত্মা, এই দৃঢ় নিশ্চয় বোধ তোমার মধ্যে জেগে উঠুক, তাহলে তোমার শোক-ও হবে না, রাগ-ও হবে না।
 ৯. অজ্ঞানবশতঃ কল্পিত বিশ্ব তোমার বোধকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আসলে আনন্দস্বরূপ চিদাত্মা তুমি।  এটা জান এবং সুখী হও। 
১০. তোমার ভাবনায় পরিবর্তন আনো।  আমি বদ্ধ, এই ভাব ত্যাগ করো। তুমি যেমন ভাববে তুমি তেমন-ই  হয়ে যাবে। তোমার মুক্তির চেষ্টাই তোমার বন্ধনের লক্ষ্মণ।  

১১. আত্মা বিভু, সাক্ষীর ন্যায় থাকেন। আত্মা এক এবং  পূর্ণ, মুক্ত ও ক্রিয়াহীন। তিনি নিস্পৃহ, অসঙ্গ, শান্তস্বরূপ। 

১২. অহং-ভাবই ভ্রম। আমি দেহ - এটা বাহ্য ভাবনা। আমি সুখী বা দুঃখী এটা অন্তর্ভাবনা।  এসব পরিত্যাগ করে এক-অদ্বিতীয় আত্মার কথা ভাব। 
১৩. দেহাত্ম-অভিমানে বদ্ধ হয়ে আছো। তোমার বোধোদয় হোক। জ্ঞান-অস্ত্র  দ্বারা অভিমান ছিন্ন করো।  তবেই তুমি যে সুখী, ইটা অনুভব করতে পারবে। 
১৪. তুমি যে সমাধির অনুষ্ঠান করছো - এটাতেই বোঝা যাচ্ছে তুমি ভাবনায়-বদ্ধ।  তুমি তো সর্ব সম্মন্ধ শূন্য, তুমি সর্ব ক্রিয়া রোহিত। তুমি নিজে থেকেই প্রকাশিত পরমাত্মা। 
১৫. তোমারই  ব্যাপ্তি সারা বিশ্বে।  তুমি সর্বত্র ওতপ্রোত হয়ে আছো। তুমি শুদ্ধ, বুদ্ধ।  তোমারি রূপ সর্বত্র। নিজেকে ক্ষুদ্র চিত্ত করো না। 
১৬. তুমিতো নিরপেক্ষ, নির্বিকার, চিদ্ঘনস্বরূপ, শীতলচিত্ত। অর্থাৎ তুমি সুখের  স্বরূপ।  তুমি বাসনাহীন, চিন্ময়।  তোমার কোনো ক্ষোভ নেই। তোমার বুদ্ধির কোনো সীমা পরিসীমা নেই।
১৭. তুমি দেহ ইত্যাদি সমস্ত সাকার বস্তু মিথ্যা বলে জানো। এবং সেহেতু এসব ত্যাগ করো ও নিরাকারে স্থিত হও।  এই উপদেশ প্রাপ্ত  হয়ে, তুমি জন্ম মৃত্যু রোহিত হও। 
১৮.মাধ্যমে প্রতি-বিম্বিত  শক্তি মাধ্যমের আকার নেয়। মাধ্যম এই পরম শক্তি নয়। মাধ্যমে শক্তি নিহিত মাত্র।  তেমনি তোমার শরীর  একটা মাধ্যম, তাই  তোমার শরীর-এর অন্তর ভিতর  আত্মারই প্রতিবিম্বিত  ।
১৯. ঘটের ভিতরে বাইরে যেমন আকাশ বিদ্যমান।  নিত্য ব্রহ্ম সর্বদা সর্ব ভূতের ভিতরে বাইরে সদা বর্তমান।  

মহর্ষি অষ্টাবক্র কৃত  আত্ম-অনুভব উপদেশ এখানেই বিশ্রাম নিলেন।    

           
  



দ্বিতীয়ং প্রকরণম্


এইবার শিষ্য অর্থাৎ বিদেহ রাজা জনক, আত্ম উপলব্ধি হেতু উল্লাস ব্যক্ত করছেন। ( শিষ্যোক্তমাত্মানুভবোল্লাসনামকং)


প্রথম শ্লোক  :দ্বিতীয়ং প্রকরণম্


অহো নিরঞ্জনঃ শান্তো বোধঃ অহং প্রকৃতেঃ পরঃ 

এতবন্তম  অহং কালং মোহেন এব বিড়ম্বিতঃ।

কি আনন্দ ! আমি নিরঞ্জনঃ অর্থাৎ শুদ্ধ নির্মল আত্মা। আমি শান্ত অর্থাৎ সর্ব বিকার রোহিত, সর্ব বিকারেরের উর্ধে। প্রকৃতির উর্ধে, সেই স্বপ্রকাশ চিৎস্বরূপ।এতকাল আমি দেহ ও আত্মার অভেদরূপ মোহে কি বিড়ম্বনাই না  ভোগ করছিলাম।


শ্লোক নং ২ :দ্বিতীয়ং প্রকরণম্

যথা প্রকাশয়ামি একঃ দেহমেনং  তথা জগৎ 
এত মম জগৎ সর্বমথবা  না চ কিঞ্চন। 

আমিই এই অচেতন জগতের প্রকাশক,  আবার আমিই স্থুল  দেহেরও প্রকাশক। অতএব দৃশ্যত এই দেহাদি সহ 

সর্ব জগৎ আমাতেই অধ্যস্ত।   আমার দেহ বলে কিছু নাই, আমাতেই দেহ, আর জগৎ বলে কিছু নাই, আমাতেই জগৎ।

এতো ঈশ্বরের সংজ্ঞা হয়ে গেল মনে হচ্ছে। জনক নিজেকেই ঈশ্বর ভাবছে। এতো সূর্যকে আয়নার মধ্যে দর্শন। বাটির জলে চাঁদ দর্শন।

তাহলে কি আমি বলে কিছু নেই ? সবই  তিনি। তার সব গুন্ ক্ষুদ্রাকারে আমার মধ্যে।  অতএব আমিই ঈশ্বর। সমুদ্রের জল যখন সমুদ্রে থাকে, আর সমুদ্র থেকে জল নিয়ে যখন  একটা  কলসি ভরাট  করা হয় তখন কলসিটা  কি সমুদ্র হয়ে যায় ? ঈশ্বরের বিরাটত্ব/বিশালত্ব  গুনতো কলসির জলে হওয়া অসম্ভব। তাহলে "অহম তত্ত্বমসি" আমিই সেই - কথাটা কি ভুল নয় ?

তৃতীয় শ্লোক  :দ্বিতীয়ং প্রকরণম্

সশরীরম  অহো বিশ্বং পরিত্যজ্য ময়াধুনা 
কুতশ্চিৎ কৌশলাদেব  পরমাত্মা বিলোক্যতে। 

কি আনন্দ ! এই যে শরীর, এই যে দৃশ্যমান জগৎ, এই সব ত্যাগ করে, এই সবের উর্ধে  উঠে,গুরু প্রদত্ব চাতুরীর  সাহায্যে,আমি পরমাত্মা এই অনুভবেই বিলোপ বা মগ্ন হয়েছি ।


চতুর্থ শ্লোক  : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্

যথা ন  তোয়াতো ভিন্নাঃ তরঙ্গাঃ ফেন - বুদ্-বুদাঃ
আত্মনো ন তথা ভিন্নং বিশ্বম-আত্ম-বিনির্গতম। 

তরঙ্গ,ফেনা,বুদ্-বুদ্  যেমন জল থেকে ভিন্ন নয়, আত্মা হতে উৎপন্ন বিশ্বও তেমনি আত্মা হতে ভিন্ন নয়। 


সেই আমার কথাতেই এসে গেল। আমিতো সমুদ্রে উৎপন্ন বুদ্-বুদ্ মাত্র। এক অর্থে আমি তারই মধ্যে তারই সত্বা দিয়ে তৈরি, তারই অংশ মাত্র। এখন এতে যদি নিজেকে ঈশ্বর ভাবি তা হলে ভুল হবে না কি ? সেই টুনটুনি আর রাজার গল্প মনে পরে গেলো। রাজার অঢেল ধন থেকে  এক টুকরো, টুনটুনি ঠোঁটে করে, তার বাসায় নিয়ে গিয়ে  রাখলো । আর গান গাইতে লাগলো এই বলে যে  - রাজার ঘরে যে ধন আছে আমার ঘরেও সে ধন আছে। টুনটুনির যেমন বুদ্ধি। 


 পঞ্চম  শ্লোক  : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্ 

তনতু  মাত্রো ভবেদেব পট যদ্বদ্ বিচারিতঃ
আত্মা-তন্মাত্রমেমেদং তদ্বদ্ বিশ্বং বিচারিতম্। 

বিচার করলে দেখা যাবে,পট-তনতু অর্থাৎ সূতা  ছাড়া কিছুই নয়। 

তেমনি বিচার করলে দেখা যাবে বিশ্বও আত্মা মাত্র। 

  ষষ্ট শ্লোক  : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্ 

যথা এব ইক্ষু রসে কল্পতা (কঌপ্তা) তেন  ব্যাপ্তা এব শর্করা
তথা বিশ্বং ময়ি কল্পতং (কঌপ্তং) ময়া ব্যপ্তং নিরন্তরম্।

আখের রসে কল্পিত চিনি যেমন মধুর রসের দ্বারা সর্বত ভাবে ব্যাপ্ত হয়ে থাকে, তেমনি আমাতে (আত্মায়) কল্পিত বিশ্বও আমার দ্বারা ভিতরে-বাহিরে সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে।


সপ্তম  শ্লোক  : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্ 

আত্ম-অজ্ঞান-জগৎ-ভাতি আত্ম-জ্ঞানাৎ-ন ভাসতে 
রজ্জু-অজ্ঞানাৎ-ভাতি তজ্  জ্ঞানাদ্ ভাসতে ন হি। 

আত্ম বিষয়ক অজ্ঞানতা বশতই জগৎ প্রতিভাত বা দৃশ্যমান মনে হয়। রজ্জুর জ্ঞান হলে আর জগৎ দৃষ্টিগোচর হয় না।


 উপরি-উক্ত শ্লোকে মনে হচ্ছে রাজা জনক আচার্য  বনে গেছেন।দৃশ্যমান এই জগৎ আত্মা থেকে কেন ভিন্ন মনে হয় এই প্রশ্ন বা নিজের ভেতরে উঠা শঙ্কার উত্তর নিজেই দিচ্ছেন। একে কি বলবো পোঁদ  পাকামো  না উচাঙ্গের শিষ্য। দেখা যাক। 


অষ্টম  শ্লোক  : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্

প্রকাশো মে নিজং রূপং নাতিরিক্তো-অস্মি-অহং ততঃ
যদা প্রকাশতে বিশ্বং তাদাহং ভাস এব হি। 

নিজের মধ্যেই নিজের রূপের প্রকাশ।  এর অতিরিক্ত আমি কিছু নই। আমি আমাতেই প্রকাশিত। যখন বিশ্ব দৃষ্টিগোচর হয় তখন তা আমার দ্বারাই  প্রকাশিত হয়ে  থাকে।


নবম শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্

অহো বিকল্পিতং বিশ্ব অজ্ঞান ময়ি ভাসতে 
রূপ্যং শুক্তৌ ফনি রজ্জৌ বারি  সূর্যকরে যথা। 

অহো ! কাল্পনিক বিশ্ব অজ্ঞানতা বসত আমাতে প্রতিভাত  হচ্ছে। ভুল বসত ঝিনুক (শুক্ত) যেমন রুপার মতো লাগে, দড়ি যেমন সাপের মতো লাগে, সূর্য কিরণে যেমন জল প্রতিভাত হয়, আমিও তেমনি অজ্ঞানবলে কল্পিত এই বিশ্ব দেখছি। 


দশম  শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্

মত্তো বিনির্গতং বিশ্বং মর্যেব লয়মেষ্যতি
মৃদি কুম্ভ জালে বীচিঃ কনকে কটকং যথা। 

আমা-হতে উৎপন্ন এই বিশ্ব আমাতেই লয় প্রাপ্ত হবে। যেমন কলসি মাটিতে লয় প্রাপ্ত হয়, যেমন জলের মধ্যে বুদ্বুদ বা ঢেউ জলেই লয় প্রাপ্ত হয়, স্বর্ণ থেকে  বিচ্ছুরিত বলয় যেমন স্বর্নতেই বিলোপ প্রাপ্ত হয় - তেমনি আমার থেকে উৎপন্ন এই মায়া-বিশ্ব আমাতেই লোপ পেয়ে যাবে।

একাদশ   শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্ 

অহো অহং নমো  মহ্যং বিনাশো যস্য নাস্তি মে 

ব্রহ্মাদি-স্তম্ব-পর্যন্তং জগৎ-নাশে-অপি  তিষ্ঠতঃ।

আহা ! কি আশ্চর্যরূপ আমি ! আমি আমাকেই নমস্কার করি -যার বিনাশ নাই। ব্রহ্মা ইত্যাদি অচঞ্চল-সহ সর্ব জগতের বিনাশ কালে অর্থাৎ জগতের বিবর্তন কালেও আমি থাকি, আমার বিনাশ নাই সুতারং এই আমাকে নমস্কার।


দ্বাদশ  শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্

অহো অহং হ্যংএকঃ অহং  দেহবান অপি 
ক্বচিন্ন গন্তা নাগন্তা বাপ্য বিশ্বং অবস্থিতঃ।

 আহা ! আমি দেহধারী হয়েও আমি এক -অদ্বিতীয়, কোথাও গমনাগমন নেই আমার।  সর্ব বিশ্বে আমার অবস্থিতি। 


ত্রয়োদশ  শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্

অহো অহং নমো মহ্যং দক্ষো ন স্থিত মৎসমঃ
অসংস্পৃশ্য শরীরেণ যেন বিশ্বং চিরং ধৃতম। 

অাহা ! আমি আমাকে নমস্কার করি। আমার মতো দক্ষ কেউ নেই। শরীরের সাথে কোনো সম্মন্ধ না থাকা সত্বেও বিশ্বকে আমি চিরকাল ধারণ করে আছি। 


চতুর্দশ  শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্ 

অহো অহং নমো মহ্যং যস্য মে নাস্তি কিঞ্চন 
অথবা যস্য মে সর্বং যদ্-বাঙ-মনসঃ-গোচরং। 

আহা ! আমি আমাকে নমস্কার করি। যার কোনোকিছুর সঙ্গেই সন্মন্ধ নেই,  আবার সে-ই সব।  যাকে বাক্য - মন দ্বারা গোচর করা যায় না। অতএব সেই সর্বসম্বন্ধি আবার সর্ব-অসম্বন্ধি - আমাকে আমি নমস্কার করি।


 পঞ্চদশ শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্ 

জ্ঞানং  জ্ঞেয়ং তথা জ্ঞাতা ত্রিতয়ং নাস্তি বাস্তবম্ 
অজ্ঞানাদ্ ভাতি যত্রেদং সঃ-অহম-অস্মি নিরঞ্জনঃ। 

জ্ঞান,জ্ঞেয়,জ্ঞাতা -এই তিনটি বাস্তবে নাই। অজ্ঞানপ্রভাবে এই ত্রিতয় প্রতিভাত হয়। আমিই সেই শুদ্ধ আত্মা, যে প্রপঞ্চরূপ সমস্ত কিছুর সঙ্গে সম্পর্কহীন। 


 ষোড়শ শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্ 


দ্বৈতমূলম অহো দুঃখং ন-অন্য-তস্য-অস্তি ভেষজম 

দৃশ্যং-এতৎ-মৃষা সর্বং একঃ-অহং চিদ্রসঃ-অমলঃ। 

আহা !  ভ্রম বসতঃ দ্বৈত ভাবনাই  দুঃখের মূল । আমি এক অদ্বিতীয়,মায়া ও তৎকার্যের অতীত ও চিন্মাত্র স্বরূপ। প্রতীয়মান সব কিছু, সব জড়-  পদার্থ একান্তই মিথ্যা। এই তত্বজ্ঞানই ত্রিবিধ দুঃখ উপশমের ঔষধ। 

 সপ্তদশ  শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্
     
বোধ-মাত্রঃ-অহম-অজ্ঞানাৎ-উপাধিঃ কল্পিতো ময়া
এবং বিমৃশতো নিত্যং নির্বিকল্পে স্থিতির্মম। 
আমার অহং বোধ থেকেই আমার অজ্ঞান-উপাধিসমূহ কল্পিত হয়েছে।  এটা বিস্মৃত হলেই আমি নির্বিকল্পে স্থিতি লাভ করবো। 

অষ্টাদশ  শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্ 


ন মে বন্ধো-অস্তি মোক্ষো বা ভ্রান্তিঃ শান্ত নিরাশ্রয়া 

অহো ময়ি স্থিতং বিশ্বং বস্ত্ুতো  ন ময়ি স্থিতম্। 

না আছে আমার বন্ধন, না আছে আমার মুক্তি।  আমাতেই বিশ্ব স্থিত আমি বিশ্বে স্থিত নোই। বিশ্ব আমাতে স্থিত হলেও কোনোকালে (কালত্রয়) উহা আমাতে আশ্রিত নহে। এইরূপ বিচারকারী আমি - আমার নির্মূলা জগৎ ভ্রান্তি শান্ত হয়ে গাছে। 


ঊনবিংশতি তম   শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্ 


সশরীরম ইদং বিশ্বং ন কিঞ্চিৎ ইতি নিশ্চিতম 

শুদ্ধ-চিৎ-আত্মা চ তৎ কাশ্মিন কল্পনা অধুনা। 

শরীর সহিত এই বিশ্ব  কিছুই নহে (না অসৎ না সৎ )এটা নিশ্চিত। 

আত্মা শুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ মাত্র। সুতরাংঅজ্ঞান নিবৃত্তি হলে, আর জগৎ কল্পনা কিসের উপর হবে ?

বিংশতি তম   শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্ 


শরীরং স্বর্গ-নরকৌ বন্ধ - মোক্ষৌ ভয়ং তথা 

কল্পনামাত্রম এব এতৎ কিং মে কার্যং চিদাত্মনঃ। 

শরীর,স্বর্গ,নরক, বন্ধ, মোক্ষ এবং ভয় - এই সকলি কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। অতএব চিদাত্মার কি করণীয় ? অর্থাৎ চিদাত্মার কিছুই করণীয় নাই। 


এক বিংশ তম   শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্ 


অহো জনসমুহে-অপি না দ্বৈতং পশ্যতো মম 

অরণ্যম-ইব সংবৃত্তং ক্ব রতিং করবানি-অহম্। 

আহা ! জনসমূহের মধ্যেও দ্বৈত আর দেখতে পারছি না।  যেন নির্জন অরণ্যের ন্যায় পর্যবসিত হয়েছে। তাহলে আমি কিসের উপর প্রীতি স্থাপন করবো। 


দ্বিবিংশ তম   শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্


নাহং দেহো ন মে দেহো জীবো নাহমহং হি  চিৎ

অয়মেব হয় মে বন্ধ আসীদ্ যা জীবিতে স্পৃহা। 

আমি শরীর নহি, শরীরও আমার নয়,(অন্তঃকরণবিশিষ্ট  চিদাভাসরূপ ) জীবও আমি নহি। আমি কেবল বিশুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ। জীবন ধারনের স্পৃহাই আমার এতকালের বন্ধন ছিলো। (সচ্চিদানন্দস্বরূপ অনুভব বলে সেই জীবন ধারনের ইচ্ছাও আর এখন আমার  নেই। )


ত্রয়োবিংশতিতম  শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্ 


অহো ভুবন-কল্লোলৈঃ-বিচিত্রৈঃ-দ্রাক্ সমুত্থিতম্

ময়ি-অনন্ত-মহা-অম্বাধৌ চিত্তবাতে সমুদ্যতে। 

কি আশ্চর্য্য ! অপার মহা-সমুদ্ররূপ আমাতে চিত্তরূপ পাবন উৎপন্ন হয়ে জগৎ-পরাম্পরারূপ কতই না বিচিত্র তরঙ্গসমূহ প্রকটিত হয়েছে। 


 চতুর-বিংশতি তম  শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্ 


 ময়ি-অনন্ত-মহা-অম্ভোধৌ চিত্তবাতে  প্রশাম্যতি

অভাগ্যাৎ-জীব-বণিজঃ জগৎপোতো বিনশ্বরঃ। 

সর্ব ব্যাপক চিৎ সমুদ্র রূপ আমাতে সংকল্প বিকল্পাত্মক চিত্ত-পবন শান্ত হলে জীব রূপ বনিকের অভাগ্য অর্থাৎ প্রারব্ধ ক্ষয় বশতঃ দেহাদি বিশিষ্ট এই জগৎরূপ নৌকাও স্বতঃই  বিনাশপ্রাপ্ত হয়। 

  
পঞ্চ-বিংশতি তম  শ্লোক : দ্বিতীয়ং প্রকরণম্

ময়ি-অনন্ত-মহা-অম্ভোধৌ-আশ্চর্যং জীববিচয়ঃ 

উদ্যন্তি ঘ্নন্তি খেলন্তি প্রবিশন্তি স্বভাবতঃ। 

আহা ! কি আশ্চর্য্য ! নিষ্ক্রিয় নির্বিকার অপার মহাসমুদ্র-রূপ চৈতন্যস্বভাব আমাতে অবিদ্যা কামকর্মাদি প্রভাবে জীবরূপী তরঙ্গসমূহ যেন কখনো উদয় হচ্ছে শত্রূভাবে  কখনও বা পরস্পর তাড়না করছে, কখনো বা মিত্রভাবে খেলা করছে এবং কখনো বা অবিদ্যা কামকর্মাদির ক্ষয়ে অধ্যস রোহিত  হয়ে যেন আমাতেই পুনঃ প্রবেশ করছে অর্থাৎ বিলয় প্রাপ্ত হচ্ছে। 


দ্বিতীয় প্রকরণের সমাপ্ত।

       
আমরা আবার অষ্টাবক্র মুনির জীবন কাহিনীর মধ্যে যাই। অষ্টাবক্র গীতার শ্লোক ব্যাখ্যা করার কিছু নাই। আর আমার জ্ঞানই  বা কতটুকু যে মহামুনির শ্লোক ব্যাখ্যা করবো। নিজেকে একটু হালকা করার জন্য, তার  আশ্চর্য জীবন সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, সে- টুকু জেনে নেই।
অষ্টাবক্র তখন মাতা সুজাতার গর্ভে।  একদিন সুজাতা কহোড়কে (অষ্টাবক্রর পিতা),ডেকে প্রসন্ন করে বললো - হে স্বামীন আমি  এখন দশ  মাসের গর্ভবতী। খুব তারাতাড়ি আমাদের সন্তান ভূমিষ্ট হবে।  এতদিন তো পিতার আশ্রমে, পিতার আশ্রয়ে আমাদের চলেছে। এখন আমাদের নিজেদের সন্তান আসছে। হে মহর্ষে, এখন আমাদের নিজেদের আয়ের পথ দেখা উচিত।আপনি সমস্ত শাস্ত্রে পারঙ্গম। বেদবিদ্যা আপনার অধিগত।  শুনেছি রাজা জনক জ্ঞানীদের খুব সমাদর করেন। আপনি যদিএকবার রাজার কাছে আপনার অধিত জ্ঞানের প্রদর্শন করতে পারেন তবে তিনি নিশ্চয়ই আপনাকে অনেক অর্থসম্পদ দিয়ে সমাদর করবেন।
কহোড় মুনি স্ত্রী-বাক্যে যুক্তি দেখে, একদিন ধনের আশায়,
শাস্ত্র-জ্ঞানের  অহংকারকে সাথী করে রাজা জনকের কাছে রওনা হলেন। 
রাজা জনকের রাজসভায় বন্দি নাম এক ব্রাহ্মণপণ্ডিত ছিলেন। ইনি বরুন দেবতার পুত্র।  প্রতাপশালী এই ব্রাহ্মন পণ্ডিত, জনক রাজার দরবারে আগত ধন-প্রার্থী পন্ডিতদের শাস্ত্রজ্ঞানের পরীক্ষা নিতেন।
তখনকার দিনে প্রত্যেক রাজসভাতে এমন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি থাকতেন, তার কাজ হতো ধন-প্রার্থী পন্ডিতদের শাস্ত্রজ্ঞান পরীক্ষা করা।  এবং রাজার কাছে সুপারিশ করা।  রাজা পন্ডিতের যোগ্যতা অনুসারে দান  সামগ্রী প্রদান করতেন। রাজা জনকের এই সভা- পণ্ডিত "বন্দি" শাস্ত্রজ্ঞানী পন্ডিতদের তর্কে আহ্বান করতেন এবং শর্ত  দিতেন যদি তর্কে পরাজিত হন তবে জলসমাধি নিতে হবে। এই শর্তে বদ্ধ হয়ে ধনের আশায় আসা বহু পণ্ডিত বন্দির কাছে পরাজিত হয়ে জলসমাধি প্রাপ্ত হন। অষ্টাবক্রের পিতা কহোড়-ও বন্দির কাছে পরাজিত হয়ে জলসমাধি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। এই ভাবেই অষ্টাবক্র পিতৃহীন হলেন।
মাতা সুজাতা অনোন্য-উপায় হয়ে পিতার গলগ্রহ হয়ে রয়ে গেলেন পিতৃগৃহে।  পিতামহ উদ্দালকের গৃহেই অষ্টাবক্র মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীর মুখ দেখলেন। অষ্টাবক্রের জন্মের কিছুদিন আগেই মহর্ষি উদ্দালকের এক পুত্র জন্ম গ্রহণ করেন।  তার নাম শ্বেতকেতু। অষ্টাবক্র ও শ্বেতকেতু কাছাকাছি বয়েসের হওয়ায়, দুজনেই একসাথে মহর্ষি উদ্দালকের আশ্রমে, উদ্দালকের স্নেহছায়ায় বড় হতে লাগলেন। শ্বেতকেতু  যেহেতু উদ্দালককে পিতা বলে সম্মোধন করতেন, অষ্টাবক্রও উদ্দালককে পিতা বলেই সম্মোধন করতেন। 

(এমনটা আমি নিজেও দেখেছি আমাদের এক সহকর্মী একান্নবর্তী পরিবারে থাকতেন - অরুন দাসগুপ্ত - আমার বস ছিলেন।  ওনার  মেয়ে ওনাকে কাকু আর মা-কে কানি (কাকী) বলে ডাকতো। ভাইপো - ভাইঝি-রা যেমন ডাকতো আরকি। ) 


একদিন অষ্টাবক্র, মহর্ষি উদ্দালকের ক্রোড়ে বসে দাদুর সাথে খেলছিল।  হঠাৎ শ্বেতকেতু-র অভিমান হলো। বাবার কোল থেকে  

অষ্টাবক্রকে টেনে নাবাতে লাগলো - আর বলতে লাগলো নেবে আয় আমার বাবার কোল থেকে। সরলমতি অষ্টাবক্র উদ্দালকের কোল থেকে নাবতে  চাইলো না। শ্বেতকেতু বলতে লাগলো - আমার বাবার কোলে কেন বসেছিল ? তুই তোর বাবার কোলে যা।  উনি আমার বাবা।  তোর বাবা কোথায় ? তার কাছে যা। উদ্দালকও অষ্টাবক্রকে কোল থেকে নাবিয়ে শ্বেতকেতুকে কোলে নিলো। অষ্টাবক্রর মনে খুব ব্যাথা  হলো। তাহলে এতদিন যাকে  সে পিতা ভেবে এসেছে সে তার পিতা নয় ? তবে কে তার পিতা ?  মাতা সুজাতার কাছে অশ্রূ -পূর্ণ  নয়নে কাতর  ভাবে বললো - মা আমার পিতা কে ? আমি বাবার কোলে বসে ছিলাম। কিনতু  শ্বেতকেতু যেতেই বাবা আমাকে কোল থেকে নাবিয়ে শ্বেতকেতুকে কোলে নিলো। আর বললো উনি আমার পিতা নন। তাহলে কে আমার পিতা ?

 আদিম কালের প্রশ্ন। পিতা কে ? সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার মনেও প্রশ্ন জেগেছিলো - কে আমার জন্ম দাতা ? পিতার সন্ধানে পদ্মনালের মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন। অষ্টাবক্রর মনেও প্রশ্ন জেগেছিলো - আমার পিতা কে ?এতদিন যাকে  পিতা বলে সে জানতো সে তার পিতা নয়।  তাহলে পিতা কে ? ছোট্ট ছেলে অষ্টাবক্র অবাক হয়ে গিয়েছিলো।  উদাস হয়ে গিয়েছিলো।  আনমনা হয়ে গিয়েছিলো। নিজের উৎস সন্ধানের আগ্রহ তাকে চঞ্চল করে তুললো। সন্তানের মনমরা অবস্থা দেখে মা চিন্তিত হলেন।  জিজ্ঞাসা  করলেন - কি হয়েছে তোমার ? বালক অষ্টাবক্র মাকে  প্রশ্ন করলো - আমার পিতা কে ?

দেবাদিদেব মহাদেবকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল আপনার পিতা
কে ? মহাদেব বললেন আমার পিতা ব্রহ্মা । ব্রহ্মার পিতা কে ? মহাদেব জবাব দিলেন  - বিষ্ণু।    বিষ্ণুর পিতা কে ? বিষ্ণুর পিতা আমি স্বয়ং। কে কার পিতা ? সবাই সবার পিতা।  চক্রাকারে চলছে। এই জনমে আমি যার সন্তান - কয়েক জন্ম আগে আমি যে তার পিতা ছিলাম না তা কে বলতে পারে ?

সন্তানের প্রশ্ন শুনে সুজাতার স্বামীঃস্মৃতি ভেসে উঠলো। সেই মুখ, আনন্দের দিন গুলির  কথা মনে হতে লাগলো। চোখে অশ্রূ পরিপূর্ণ হয়ে গেল।  চোখ মুছে মা বললেন মহর্ষি উদ্দালকই তোমার পিতৃসম।  উনিই তোমার পালক পিতা। অষ্টাবক্রর মনে আশঙ্কা হলো।  কোথাও একটা লুকোছাপার ব্যাপার আছে। মা-কে জড়িয়ে ধরে অষ্টাবক্র কাঁদো কাঁদো স্বরে বলতে লাগলো -মা তুমি সত্য বলো -আমার পিতা কে ? কোথায় তিনি ? তখন সুজাতা আর লুকোতে পারলো না। বললো দেখো বাবা, তোমার জন্মের আগেই তোমার পিতা গত হয়েছেন।  আমারই  দোষে তিনি মারা গেছেন। তুমি ভূমিষ্ট হবার আগে আমি তোমার  পিতাকে পাঠিয়ে ছিলাম জনক রাজার কাছে।  শুনেছিলাম, জনক রাজা বেদজ্ঞ পন্ডিতদের ধন দৌলত দান করছেন। তোমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে, তোমার বাবাকে আমি পাঠিয়েছিলাম জনক রাজার দরবারে। শুনেছি সেখানে বন্দি নাম এক মহাপন্ডিত তোমার বাবাকে তর্কে পরাজিত করেন - এবং তর্কের শর্ত অনুসারে জল-সমাধি গ্রহণ করেন - এই বলে সুজাতা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। 

অষ্টাবক্রের মন উথালপাতাল হতে লাগলো।  কে এই বন্দি 
পণ্ডিত ? কিছুদিনের মধ্যেই মামা শ্বেতকেতুকে সঙ্গে নিয়ে অষ্টাবক্র চললো রাজ দরবারে। জনক রাজার পণ্ডিত সভায়।  এর পরের ঘটনা আবার পরে হবে। আমরা এখন অষ্টাবক্র সংহিতার মধ্যে প্রবেশ করবো।  

তৃতীয় অধ্যায়/প্রকরণম্ (প্রত্যাক্ষেপদ্বার-উপদেশ)


ব্রহ্ম-জ্ঞান সম্পন্ন শিষ্যকে, তার  জগৎব্যবহার নিরত কথাবার্তা শুনে, পরীক্ষার নিমিত্ত অথবা তার জ্ঞানের দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য, জাগতিক ব্যবহারের প্রতি আক্ষেপ করে আত্মা অনুভবকে সমৃদ্ধ করবার জন্য উপদেশ দান করছেন।  আমরা অনেক সময় মুখে বড় বড় কথা বলি, কিনতু  যখন কার্যক্ষেত্রে তার প্রয়োগের সময় আসে তখন  ব্যর্থ হই। এতো মিথ্যা জ্ঞান। রাজা জনক যদিও তদ্রুপ নয়, তবুও যখন সে তার ব্যবহারিক জগতে প্রবেশ করবে, তখন তার আচরণ কি ধরনের হওয়া উচিত সে সম্পর্কে উপদেশ দিচ্ছেন।  

আমি অনেক ভাগবত পাঠককে দেখেছি - শাস্ত্র আলোচনা করবার সময় সর্বত্যাগের পন্ডিতি বাগাড়ম্বর।  আবার দৃষ্টি-মন অর্থের দিকে, দাক্ষিনার দিকে। এমনকি এই অর্থ বৃদ্ধির জন্য কটু বাক্য প্রয়োগেও বিচলিত হন না। ধিক্ এই সব তথাকথিত পন্ডিতদের। মুখে এক আর মনে এক।  

প্রথম শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্


অবিনাশিম্ আত্মানং একম্ বিজ্ঞায় তত্ত্বতঃ 

তব-আত্মজ্ঞস্য ধীরস্য কথং-অর্থ-অর্জনে  রতিঃ। 

 অবিনাশী আত্মাই এক এবং অদ্বিতীয় এই তত্বে যিনি যথার্থরূপে  বিজ্ঞ, সেই আত্মজ্ঞের কখনোই অর্থ অর্জনে রতি থাকার কথা নয়।


দ্বিতীয় শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্


আত্মা অজ্ঞানাৎ অহো প্রীতিঃ-বিষয়-ভ্রম গোচরে 

শুক্তেঃ-অজ্ঞানতঃ লোভো যথা রজতবিক্রমে। 

আহা ! আত্মা সম্পর্কে অজ্ঞানতার জন্যই প্রীতিকর  বিষয়-ভ্রম গোচরে আসে। ঝিনুকের মধ্যে রুপোর অজ্ঞানই লোভ উৎপন্ন করে থাকে।    


তৃতীয় শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্


বিশ্বং স্ফ্ুরতি  যত্রেদং তরঙ্গা ইব সাগরে

সঃ-অহম -অস্মি-ইতি  বিজ্ঞায় কিং দীন ইব ধাবসি। 

সাগর থেকে যেমন তরঙ্গের  স্ফ্ুরন হচ্ছে, তেমনি যার থেকে এই বিশ্বের প্রকাশ হচ্ছে সেই-ই আমি, আমিই সেই। এই কথা যদি জেনে থাকো, তবে দীনের মতো কিসের পিছনে ধাবিত হচ্ছো ?


চতুর্থ শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্

   
শ্রূত্বা-অপি শুদ্ধ-চৈতন্যম-আত্মনাং-অতি-সুন্দরম্
উপস্থে-অত্যন্ত সংসক্তো মালিন্যম-অধি-গচ্ছতি। 

শুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ অতি  সুন্দর আত্মার সম্পর্কে শোনা সত্বেও

যা দেখছো (সমীপবর্তী বিষয়ে ) তাতেই আসক্ত হয়ে   কোনো আত্মজ্ঞ পুরুষ  মলিনতা প্রাপ্ত হতে পারে ?

পঞ্চম  শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্


সর্বভূতেষু চ-আত্মানং সর্ব-ভূতানি  চ-আত্মানি 

মুনেঃ-জানতঃ আশ্চর্য্যং মমত্বম-অনুবর্ততে। 

সর্বভূতে আত্মা, আত্মাই সর্বভূতে  এই তত্ব জেনেও  কোনো মুনির মধ্যে যদি মমত্ববোধ (অহং-বুদ্ধি ) দৃষ্টিগোচর হয় তবে তা বড়োই আশ্চর্যের। 


ষষ্ঠ শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্ 


আস্থিতঃ পরম-অদ্বৈতং মোক্ষার্থে-অপি ব্যবস্থিতঃ

আশ্চর্যং কাম-বশগো  বিকলঃ কেলি-শিক্ষয়া। 

কি আশ্চর্য ! পরম উৎকৃষ্ট অদ্বৈত-তত্বে যিনি স্থিত । এর প্রতি যে আস্থাবান, তিনি কাম-ক্রিয়া-বশীভূত হয়ে কি করে বিকলেন্দ্রিয় হবেন? 


 সপ্তম শ্লোক : তৃতীয় প্রকরণম্   


 উদভূতং জ্ঞান-দুঃ-মিত্রম-অবধার্য্য-অতি-দুর্বলঃ 

আশ্চর্যং কামম্-আকাঙ্খেৎ কালম-অন্তং-অনুসৃতঃ। 

উদভূত কাম অর্থাৎ বিষয় চিন্তা অতি  দুঃখের কারন, কিনতু  মিত্রের মতো আচরণ করে এবং দুর্বল করে দেয়।  এ সব জেনেও, জ্ঞানীজন মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে কামাকাঙ্খা বা বিষয় ভোগের ইচ্ছা কি কোরে করে ? এটা  বড়োই  আশ্চার্য্য ?   


আমরা প্রতিদিন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলছি। আর একটু গভীর ভাবে ভাবলে আমরা বুঝতে পারবো মৃত্যু আমাদের শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে। যে কোনো সময় আমাদের কান ধরে টেনে নেবে। একটু বেচাল দেখলে তো যে কোনো সময় নিয়ে নেবেই । বেচাল না দেখলেও সময়মতো নিয়ে নেবে।  আর এই সময়মতো মানে প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী আমরা মৃত্যুর কোলে শুয়ে পড়বো। তৎ সত্বেও  দেখুন আমরা কেমন মোহগ্রস্থ। প্রতিনিয়ত বিষয় চিন্তায় মগ্ন আছি।  সব বুঝি। আবার বুঝি না।


 অষ্টম শ্লোক  : তৃতীয় প্রকরণম্


ইহামূত্র বিরক্তস্য নিত্যানিত্য-বিবেকিনঃ 

আশ্চর্যং মোক্ষ-কামস্য মোক্ষাৎ-এব বিভীষিকা। 

ইহা অমুত্র অর্থাৎ ইহলোক ও পরলোকের, যাবতীয় ভোগ্য পদার্থ বিষয়ে যিনি বিরক্ত অর্থাৎ বৈরাগ্যবান , নিত্য অর্থাৎ আত্মা ও অনিত্য অর্থাৎ দেহাদি বিষয়ে সর্বদা বিচার-পরায়ণ এমন মোক্ষকামী  জ্ঞানীরও দেহ ত্যাগের ভয়, ধনাদি বিয়োগের ভয় দৃষ্টিগোচর হয় - এ কি আশ্চর্য ? 

  
 নবম  শ্লোক  : তৃতীয় প্রকরণম্  
   
ধীরস্তূ ভোজ্য়মানোঃ অপি পীড্যমানঃ অপি সর্বদা 
আত্মানং কেবলং পশ্যন্ ন তুষ্যতি  ন কুপ্যতি। 

পরেচ্ছাবসে  বিষয়ভোগ করেও - পরনিন্দা দ্বারা পীড়িত হয়েও জ্ঞানী সদা সুখ-দুঃখ রোহিত থাকেন।  আত্ম-অনুভব বলে কখনো সন্তোষ বা ক্রোধাদি দ্বারা কুপিত হন না।  

         
দশম  শ্লোক  : তৃতীয় প্রকরণম্

চেষ্টমানং শরীরং স্বং পশ্যতি অন্য্ শরীর বৎ 

সংস্তবে চাপি নিন্দায়াং কথং ক্ষুভ্যেৎ মহাশয়ঃ

চেষ্টমান  অর্থাৎ ব্যবহারিক এই নিজের  শরীর ও অপরের  শরীর যিনি একই দেখেন এবং আত্মাকে যিনি শরীর  থেকে  ভিন্ন রূপে দর্শন করেন এমন গাম্ভীরাত্মা তত্ববিদ মহাপুরুষ স্তূতি বা নিন্দাতে বিক্ষুব্দ বা চঞ্চলতা প্রাপ্ত হতে পারেন ?


একাদশ শ্লোক  : তৃতীয় প্রকরণম্


মায়ামাত্রমিদং বিশ্বং প্শ্যন  বিগত কৌতুকঃ

অপি সন্নিহিতো মৃত্যৌ কথং  ত্রস্যতি ধীরধীঃ।

পরিদৃশ্যমান এই বিশ্ব   জ্ঞানীর কাছে মায়ামাত্র। এর সম্পর্কে কোনো কৌতুহলই তার জাগে না। অতএব মৃত্যুর সম্মেখে দাঁড়ালেও স্থিতধী পুরুষের  কিসের ত্রাস ? 

    
দ্বাদশ  শ্লোক  : তৃতীয় প্রকরণম্

নিঃস্পৃহং মানসং যস্য নৈরাশ্যে অপি মাহাত্মনঃ 

তস্য-আত্ম-জ্ঞান-তৃপ্তস্য তুলনা কেন জায়তে। 

নিস্পৃহ অর্থাৎ স্পৃহা শুন্য যার মন সেই  মহাত্মার আবার নৈরাশ্য কিসের ? তাঁর আত্মজ্ঞানেই  সে তৃপ্ত।  তার সঙ্গে কার তুলনা ?


ত্রয়োদশ  শ্লোক  : তৃতীয় প্রকরণম্

স্বভাবাৎ-এব জানানো দৃশ্যমেতন্ন  কিঞ্চন 
ইদং গ্রাহ্যমিদং ত্যাজ্যং স কিং পশ্যতি  ধীরধীঃ। 

দৃশ্যমান জগতের স্বভাব (প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল ) যে  কিছুমাত্র জানে তার কাছে ত্যাজ্য বা গ্রাহ্য বলে কিছু থাকতে পারে কি ?


চতুর্দশ  শ্লোক  : তৃতীয় প্রকরণম্


অন্তঃ-ত্যক্ত-কষায়শ্য নির্দ্বন্দ্বস্য নিরাশিষঃ

যদৃচ্ছয়া-আগতো ভোগো ন দুঃখায় ন তুষ্টয়ে। 

অন্তরে কষায় অর্থাৎ বিষয় বাসনা রোহিত, নির্দ্বন্দ অর্থাৎ দ্বন্দ্বের অতীত, নিরাশিষ অর্থাৎ আশা নিরাশার অতীত - এমন ব্যক্তি যেমন ইচ্ছা  ভোগ করুক না কেন তাতে তার দুঃখও নাই আবার কোনো তুষ্টি বা  তৃপ্তিও  নেই।   



তৃতীয় প্রকরণের সমাপ্ত।


চতুর্থ প্রকরণ  - শিষ্য -প্রোক্ত -অনুভব-উল্লাস-ষট্কনাম


প্রথম  শ্লোক  : চতুর্থ  প্রকরণম্


হন্ত-আত্নজ্ঞস্যঃ ধীরস্য খেলতো ভোগলিলয়া

ন হি  সংসার-ৰাহিকৈঃ-মূঢ়ৈ সাহা সমানতা।

আ মরণ !  আত্মজ্ঞ  ব্যক্তি, ধী সম্পন্য ব্যক্তি যতই ভোগ লীলায় রত থাকুন, তিনি  কখনোই সংসার-আসক্ত মূঢ় ব্যক্তির সঙ্গে তুলনীয় হতে পারেন  না । 


 দ্বিতীয়  শ্লোক  : চতুর্থ  প্রকরণম্


যৎপদং প্রেপ্সবো দিনাঃ শত্রু-আদ্যাঃ সর্ব-দেবতা 

হো তত্র  স্থিত  যোগী ন হর্ষম -উপগচ্ছতি।

যে পদ পাবার জন্য দেবগনকেও শত্রূ মনে করা হয়, আবার না পেলে নিজেকে দীনহীন মনে হয় - সেই পদ-অবস্থায় স্থিত থেকেও  যোগী কখনও হর্ষান্নিত হন না। 


 তৃতীয় শ্লোক  : চতুর্থ  প্রকরণম্


তজ্জ্ঞস্য (তৎ-জ্ঞস্য) পুন্য-পাপাভ্যাং স্পর্শ হ্যন্তর্ন (অন্তঃ ন) জায়তে 

ন হ্য়াকাশস্য(হি-আকাশস্য) ধুমেন দৃশ্যমানা-অপি সঙ্গতিঃ।

সেই অজ্ঞ পুরুষের অন্তরে  পাপ পুন্য স্পর্শ করতে পারে না, যেমন দৃশ্যমান ধোঁয়ার সঙ্গে আকাশের কোনো সম্পর্ক নেই। 


চতুর্থ  শ্লোক  : চতুর্থ  প্রকরণম্


আত্মৈব-ইদং জগৎ-সর্বং জ্ঞাতং যেন মাহাত্মনা 
যদৃচ্ছয়া বর্তমানং  তং  নিষেদ্ধ ুং ক্ষমেত কঃ। 

সর্ব জগৎকে আত্মা রূপে জেনেছেন যে মহাত্মা, তিনি  যেমন ইচ্ছা বর্তমান থাকুন - তার আবার কিসের  নিষেধ ? তিনি ক্ষমারও  উর্ধে।


পঞ্চম  শ্লোক  : চতুর্থ  প্রকরণম্


আব্রহ্ম-স্তম্ব-পর্যন্তে  ভূতগ্রামে চতুর্বিধে 

বিজ্ঞস্য-এব হি সামর্থম-ইচ্ছা-অনিচ্ছা-বিবর্জনে। 

ইচ্ছা - অনিচ্ছা পরিত্যাগে অশক্ত ব্রহ্মা পর্য্ন্ত সমস্ত প্রাণিকুল (জলচর-স্থলচর-উভচর-আকাশচর)- এর মধ্যে একমাত্র বিদ্বান বা বিজ্ঞই এই ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিবর্তনের সামর্থ রাখে। 


ষষ্ঠ শ্লোক  : চতুর্থ  প্রকরণম্


আত্মানম-অদ্বয়ং কশ্চিৎ-জানাতি  জগদীশ্বরম্

যৎ-বেত্তি তৎ স কুরুতে ন ভয়ং তস্য কুত্র-চিৎ। 

আত্মা অদ্বিতীয়। এই  জগদীশ্বরকে কশ্চিৎ জানা যায়। যিনি জেনেছেন, তিনি যা কিছু  কর্তব্য বলে মনে করেন তাই করেন তাতে না আছে কোনো ভয় না প্রারব্ধ। 



চতুর্থ প্রকরণম সমাপ্ত

     

এবার একটু অন্য কথায় যাই। আসলে অষ্টাবক্র সংহিতা সত্য কথাটা এতো সহজে অবলীলায় বলে চলেছেন।  এটাতে বোঝার কিছু নেই। আমরা আসলে কোনো কিছু শুনলে, দেখলে আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞাতা, আমাদের সঞ্চিত জ্ঞান দিয়ে বিচার করে নেই, বুঝতে চাই। এ ক্ষেত্রে বোঝার কিছু নেই। শুধু মেনে নেওয়া। আগে  কি দেখেছো, আগে  কি শুনেছ সব ভুলে যাও । এই দেখো তাজমহল। বাবার মুখে শোনা বর্ণনা দিয়ে কল্পনার রঙে আঁকা তাজমহল নয়।  তুমি  কি ভেবেছো তা নয়। যা সত্যি তাই দেখো। 
অনির্দিষ্ট যাত্রা নয়। আকাশ ছুঁয়ে দেখবার জন্য, পৃথিবীর পূর্বে একবার, পশ্চিমে একবার।  যেখানেই যাই আকাশ দূরে চলে যায়। অষ্টাবক্র কোনো কল্পনার জাহাজে চাপান নি। ঈশ্বর পুরুষ না স্ত্রী, মা না বাবা, খ্রিস্টের  মতো না কৃষ্ণের মতো  শিবের  মতো না বিষ্ণুর মতো। সব কিছুর ঊর্ধে।  রামকৃষ্ণের মতো আয়  দেখবি আয়। রামকৃষ্ণের বেলায় মুশকিল হচ্ছে ওনার তিরোধানের পর আর কেউ বলতে পারে না আয়  দেখবি আয়। 

অষ্টাবক্রের কথা আবার একবার শুনে নেই।  অষ্টাবক্রের তখন বারো বছর  বয়স।  মায়ের মুখে পিতা  কহোড়ে অন্তর্দ্ধান রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য মামা শ্বেতকেতুকে নিয়ে জনক রাজার দরবারে চললেন। এই কাহিনী আমি মহাভারতের বনপর্বে পড়েছি। রাজার প্রাসাদের কাছে কাছে আসতেই রাজার সাথে অষ্টাবক্রের সাক্ষাৎ ঘটলো। রাজা জনক বোধ হয় প্রাতঃভ্রমনে বেরিয়ে ছিলেন।

অষ্টাবক্র বললেন - হে রাজন ! পথে যতক্ষন না ব্রাহ্মনের সাথে দেখা না হয় ততক্ষন অগ্রে অন্ধ তার পরে বধির - স্ত্রী  -  ভারবাহী - এবং সর্ব শেষে রাজা ক্রমান্নয়ে পথ চলবে। কিনতু  যদি ব্রাহ্মণ থাকে তবে ব্রাহ্মণ সর্বাগ্রে থাকবে।  এটাই পথ চলার নিয়ম।
বাপ্ কা বেটা।  যেমন বাপ্ তার তেমন বেটা। অগ্নি পরিমানে ছোট হলেও তার দাহিকা শক্তি হ্রাস পায় না।   অষ্টাবক্রর পিতা কহোড় একবার এমনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন - রাস্তায় দেখা এক চণ্ডালের সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে অহংকারী পণ্ডিত মহর্ষি কহোড়, চণ্ডালকে রাস্তা ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলেন। চণ্ডাল  তো আর বিনয়ী ছিল না।  সে বললো - কিসের পণ্ডিত হে তুমি ? জন্ম সূত্রে কেউ ব্রাহ্মণ হয় না, পণ্ডিত ও হয় না।  এতো অহংকার কিসের তোমার ? দু  পাতা পুঁথি পড়ে আর উদ্দালকের জামাই হয়ে তোমার খুব বার বেড়েছে। ব্যাটা শ্বশুর-পোষ্য। যদি তোর  এতো জ্ঞানের অহংকার তবে হোক লড়াই। তবে  শোন্  লড়াইয়ে যে হারবে তাকে দু পায়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। যদি শর্তে রাজি হোস তবে প্রশ্ন কর। নতুবা রাস্তা দিয়ে সরে  দাড়া আমি চলে যাই, তবে তুই যাবি।পণ্ডিত কহোড় ভাবলো - ব্যাটা মূর্খ, অস্পৃশ্য , অচ্ছুৎ  - এত বড়ো  কথা। ঠিক আছে।  তুই প্রশ্ন কর।  আমি তার জবাব দিচ্ছি।  চণ্ডাল বললো দিক কয়টি ? কোন দিকে কার অবস্থান ? কহোড় বললো এই কথা ? শোন্ দিক চারটি - পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ। পূবেও সূর্য পশ্চিমেও সূর্য উত্তরে হিমালয় দক্ষিণে  সমুদ্র। এবার আমি প্রশ্ন করি !
 চণ্ডাল বলে উঠলো রে মূর্খ - এতদিন তুই  তোর শ্বশুর-এর অন্ন ধংশ করেছিস।  এই তোর জ্ঞানের বহর। তারপর চণ্ডাল বলতে লাগলেন -শোন, দিক দশটি - পূর্ব,পশ্চিম,উত্তর,দক্ষিণ,ঈশান,অগ্নি,নৈঋত,বায়ু,ঊর্ধ, অধ। 

পূর্বদিকে  ইন্দ্র দেবতা। পশ্চিমে বরুন। উত্তরে কুবের। দক্ষিণে যম দেবতা। ঈশান অর্থাৎ উত্তর-পূব কোন পঞ্চমুন্ডি শিবের অবস্থান। অগ্নি অর্থাৎ দক্ষিণ-পূব কোন অগ্নি দেবতার অবস্থান। নৈঋত বা দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে অপদেবতা বা শয়তানে অবস্থান।  বায়ু কোনে অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম কোন ভগবান বিষ্ণুর অবস্থান। ঊর্ধে ব্রহ্মাণী, অধে বৈষ্ণবী। আরো শোন্ -ঊর্ধলোকে সাতটি স্তর বা লোক আছে। ভূঃ, ভুবঃ,স্বঃ,মহঃ, জনঃ, তপঃ, সত্যম। অধোদিকেও এমনি সাতটি স্তর  আছে। এর নাম হলো তল, অতল,সুতল,তলাতল,মহাতল, রসাতল,পাতাল। বুঝেছেন ঘরজামাইবাবু ?

কহোড় অপমানে লাল হয়ে গেলো। এবং  চণ্ডালের ধৃষ্টতা ও জ্ঞান দেখে ভীত  হলো। কিংকর্তব্য-বিমুখ হয়ে ছুট লাগালো।
রাজা জনক-তো চণ্ডাল নয়।
 তিনি অষ্টাবক্রের কথাটা শুনলেন।  তাকিয়ে দেখলেন একজন পঙ্গু কিশোর তাকে ধরে ধরে আর এক কিশোর পথ চলছে। বিনয়ী রাজা জনক কোনো বাত -বিতন্ডার মধ্যে গেলেন না।  শুধু  বললেন - যাও - আমি তোমাকে পথ প্রদান করলাম। 
রাজা তো রাস্তা ছেড়ে দিলেন কিনতু দ্বারপাল তো রাজা নয়। সে তো আর রাস্তা ছাড়ছে না। রাজ্সভায় যেতে গেলে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। অষ্টাবক্র বলছে আমরা বিদ্বানদিগের যজ্ঞ সভায় যাবো।

 বিদ্বানদিগের সভায় যেতে গেলে প্রথমত বিদ্বান হতে হবে। অন্তত চেহারায় তো  কম সে কম বিদ্বান হতে হবে। একে দুবলা পাতলা বারো বছরের শিশু।  তায় আবার পঙ্গু। চেহারা দেখে তো মনে হয় পণ্ডিত তো দূরের কথা - পণ্ডিত  হওয়া মতো বয়সই হয় নি। পঙ্গু হওয়াতে আরো তাচ্ছিল্যের চেহারা হয়েছে। 


দ্বারপাল বলছে - হে ব্রাহ্মণ আমরা বন্দির আজ্ঞাকারী। এখানে বৃদ্ধ ও বিদগ্ধ পন্ডিতদেরই প্রবেশ করার অনুমতি আছে। বাচ্চাদের খেলবার জায়গা এটা নয়। 


অষ্টাবক্র বলছে - হে দ্বারপাল এখানে যদি জ্ঞানবান বৃদ্ধদের প্রবেশের অধিকার থাকে তো আমারও প্রবেশের অধিকার আছে। 

কেননা আমিও জ্ঞানী-বেদজ্ঞ-জিতেন্দ্রিয়। অতএব আমাকে বালক জেনে অবজ্ঞা করোনা। 

দ্বারপাল বলছে : দেখো বাপু আমি এত  কিছু বুঝি না। আমরা বন্দির অাজ্ঞাধারী। বন্দি বলে দিয়েছে  কেবলমাত্র পন্ডিতদেরই এখানে প্রবেশ করার অনুমতি দিতে। তুমি তো পণ্ডিত নও। তুমি বাপু বৃথা কেনো নিজেকে জাহির করছো? বিদ্বান অতি দুর্লভ। বিদ্যা অর্জন করতে করতে মানুষ বৃদ্ধ হয়।  এবং বৃদ্ধদের  মধ্যে কেউ কেউ জ্ঞানী হয়। তুমি বাপু বালক। এত অল্প বয়সে জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। কেবল অকাল-পক্কের মতো কথা বলছো। 


তখন অষ্টাবক্র বললেন - হে দৌবারিক ! কেবল পলিত হলেই বৃদ্ধ হয় না। বালক হয়েও যে প্রজ্ঞাবান হয় তাকেই স্থবির বলা হয়। কি বয়স, কি পলিত, কি ঐশ্বর্য্য, কি বনধু , এ সব কিছুই কাউকে জ্ঞানবৃদ্ধ করতে পারে না। কেবলমাত্র সাঙ্গবেদসম্পন্ন্ ব্যক্তিই মহান। তুমি সময় নষ্ট না করে আমাকে তোমার আজ্ঞাকারী বন্দির কাছে নিয়ে চলো।  নতুবা রাজা জনকের কাছে নিয়ে চলো। আমি বন্দিকে দেখবার মানসে  এখানে এসেছি। তুমি অবশ্যই দেখবে আজ আমি পণ্ডিতদের  সাথে  শাস্ত্র বিচারে ও বাদে বন্দিকে নিশ্চয় পরাজিত করবো। তারপর দেখো জনক সহো সমস্ত পণ্ডিতগণ, আমার উৎকর্ষের  প্রশংসা করবে। তুমি  শুধু আমাকে বিদ্বানসভায় নিয়ে চলো। 


দ্বারপাল দেখলো এ ছোকরা  ছাড়বার পাত্র নয়। বললো ঠিক আছে আমি তোমাকে কৌশলে বিদ্বানদিগের যজ্ঞসভায় নিয়ে যাচ্ছি। তুমি শুধু আমাকে অনুসরণ করো।  যা বলছি তাই করো।

 এর পর দ্বারপাল অষ্টাবক্রকে কোথায় নিয়ে গেল বা সেখানে কি  হলো সে কথা বলার আগে আমরা অষ্টাবক্র সংহিতার পরবর্তী শ্লোক  আর একটু দেখে নেই। 


  
         
পঞ্চম প্রকরণ -  আচার্য উক্ত লয়চতুষ্টয় 

  

প্রথম শ্লোক : পঞ্চম প্রকরণ   

ন তে সঙ্গো অস্তি কেনাপি শুদ্ধঃ ত্যক্ত ুম্ ইচ্ছসি

সংঘাত-বিলয়ং কুর্বন-এবম-এব লয়ং ব্রজ। 

তোমার সঙ্গে কেউ নেই, না তুমি কারুর সঙ্গে আছো।  তবে হে শুদ্ধ,  তুমি কাকে ত্যাগ করার ইচ্ছে করছো ? সংঘাত অর্থাৎ যোগ, বা বিলয় অর্থাৎ নিরসন, তোমাতে কি ভাবে হবে ? মোটকথা তোমার ত্যাজ্য বা গ্রাহ্য কিছুই নাই। 


দ্বিতীয় শ্লোক : পঞ্চম প্রকরণ :


উদেতি ভবতো  বিশ্বং বারিধেরিব  বুদবুদঃ

ইতি জ্ঞাত্বা-একম্-আত্মানম-এবম্-এব লয়ং ব্রজ। 

তোমা হতেই জগৎ উদভূত হচ্ছে। যেমন সমুদ্র হতে বুঁদবুঁদ। আত্মাকে এই ভাবে জেনে আত্মজ্ঞানরূপ বিলয় প্রাপ্ত হও। 


তৃতীয় শ্লোক : পঞ্চম প্রকরণ 


প্রত্যক্ষম-অপি-অবস্ত ুতাৎ-বিশ্বং ন-অস্তি-অমলে ত্বয়ি

রজ্জুসর্প ইব ব্যক্তম-এব-এবম লয়ং ব্রজ।   

অবস্তূ  স্বরূপ এই বিশ্ব যা তুমি প্রতক্ষ্য করছো এর কোনো অস্তিত্ব তোমার নির্মল চৈতন্যস্বরূপে নেই। রজ্জুতে সর্পের মতোই ব্যক্ত হয়েছে মাত্র। এই দ্বৈতের অভাবরূপে তুমি বিলয়-প্রাপ্ত হও।     


চতুর্থ শ্লোক :  পঞ্চম প্রকরণ 


সম-দুঃখ-সুখঃ পূর্ণ আশা-নৈরাশ্যয়োঃ সমঃ 

সমজীবিতমৃত্যুঃ সন্-এব-এবম্ লয়ং ব্রজ। 

সুখ ;দুঃখে ;আশা; নিরাশায় ;জীবন ;মৃত্যু-  সব বিষয়ে সম ভাব রেখে ( আত্মাতে ) লয় হয়ে যাও। 


মহর্ষি অষ্টাবক্র পঞ্চম প্রকরণে বলছেন - তুমি কোনো  কিছুর সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত নও। এই বিশ্ব তোমা হতেই উদভূত  হচ্ছে আবার তোমাতেই লয় প্রাপ্ত হচ্ছে। যা কিছুকে তুমি আলাদা ভাবছো - এটা  তোমার ভ্রম। আসলে কিছুই আলাদা নয়।  সবই  তুমি। এই বিশ্ব বা জগৎ তো বটেই এমন কি এই  দেহ, এই মন,  এই সব কিছুই তোমার মধ্যে জাগছে, তোমাতেই অবস্থান করছে আবার তোমাতেই মিশে যাচ্ছে।  অজ্ঞান এগুলোকে আলাদা ভাবছে। এটাই ভ্রম। এই ভ্রম থেকে তুমি জেগে ওঠো। না - কোনো কিছুকে তোমার  ছাড়তে হবে না - কোনো কিছুকে তোমার ধরারও নেই।  তুমি যা - সেই সত্যটা শুধু জান। তুমি ভিন্ন কিছু নেই। তুমিই সব।  তোমাতেই সব। তোমাতেই জন্ম, তোমাতেই বিচরণ, আবার তোমাতেই লয়। যা কিছু দেখছো সবই ছবি  মাত্র। যা কিছু চলতে দেখছো সবই  চলমান চিত্র মাত্র।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তোমাতেই মিশে যাবে।  শুধু তুমিই থাকবে,  তুমিই ছিলে ,  তুমিই আছো। তোমাতে ছবি  পড়েছে বলে তোমাকে দেখা যাচ্ছে না।বুদ্বুদে সমুদ্র পূর্ণ - তাই মনে হচ্ছে বুদ্বুদি সব। সিনেমার পর্দায় যখন ছবি দেখায় - তখন মনে হয়  আসল।   নড়েচড়ে -কথা বলে - গান গায়।  আম গাছে আম হয়েছে - নদীতে জল বয়ে যায়। ওই গাছের আমে পেট ভরে না -  নদীর জলে তৃষ্ণা যায়  না।  তবু মনে হয় সত্য। ফোকাচিং বন্ধ হয়ে  গেলে সত্য ভেসে ওঠে - কেবল সাদা পর্দা। পর্দাতেই সব কিছু ভাসছে। সত্য কেবল আমি, আমাতেই সব ভাসছে -দুলছে -ভাঙছে -গড়ছে। দুই বলে কিছু নেই। এক এক এক .....  একম এবম অদ্বিতীয়ম। তুমি  তো আসলে নির্বিকার।  তোমার স্বভাব-ই তাই। তুমি আত্মানন্দে বিভোর। তোমার কোনো প্রাপ্তি-সুখ নেই, তোমার অপ্রাপ্তির দুঃখ নেই। তোমার পাওয়ার কিছু নেই আবার হারানোরও কিছু নেই।তোমার আশাও নেই আবার নিরাশায় নেই। তোমার জন্মও নেই আবার মৃত্যুও নেই। তুমি সুখ দুঃখের অতীত। তুমিতো স্বয়ং আনন্দ - তুমি তো স্বয়ং নির্বিকার - তোমার চলনও নেই - আবার স্থিতিও নেই - তুমি তো চিরস্থায়ী। তুমিই তো সর্বত্র - অতএব তোমার কোথাও যাবার নেই। এটাই সত্য - এইরূপ সর্বত্র ব্রহ্ম-দৃষ্টিরূপ  বিলয় প্রাপ্ত হও। সবই তো বুঝলাম, কিনতু  কম্বল কি আমাকে ছাড়বে ?    

        
পঞ্চম প্রকরণ সমাপ্ত 


ষষ্ঠ প্রকরণ  (শিষ্য উক্তম উত্তর  চতুষ্কম )


প্রথম শ্লোক : ষষ্ঠ  প্রকরণ 


আকাশবৎ-অনন্তঃ-অহং ঘটবৎ প্রাকৃত জগৎ 

ইতি জ্ঞানং তথৈত্স্য  ন ত্যাগো নঃ গ্রহ লয়ঃ। 

আকাশের মত অনন্ত আমি। ঘটের মধ্যে যেমন জগৎ। (আমার মধ্যেই অনন্ত আকাশ।  যেমন ঘটের মধ্যে অনন্ত জগৎ। ) এই জ্ঞানই  যথাযথ। এতে না আছে গ্রহণ,না ত্যাগ না লয়।


 দ্বিতীয়  শ্লোক : ষষ্ঠ  প্রকরণ 


মহা-উদধিঃ-ইব-অহং  স প্রপঞ্চো বীচি-সন্নিভঃ

ইতি জ্ঞানং তথৈত্স্য ন ত্যাগো ন গ্রহো  লয়ঃ। 

আমি আত্মা মহাসমুদ্র স্বরূপ।   আর দৃশ্যমান এই প্রপঞ্চ আমাতে যেন লহরী সদৃশ। এই জ্ঞানই যথাযথ। অতএব এতে  (আত্মাতে) না আছে গ্রহণ, না ত্যাগ,না লয়। 


 তৃতীয় শ্লোক : ষষ্ঠ  প্রকরণ 

 অহং স শুক্তি-সঙ্কাশো রুপ্য-বৎ বিশ্ব-কল্পনা 
ইতি জ্ঞানং তথৈত্স্য ন ত্যাগো ন গ্রহো  লয়ঃ। 

আমি (আত্মা) যেন  শুক্তিকা-তুল্য ও এই কল্পিত বিশ্ব যেন  আমাতে প্রতিভাত হচ্ছে। এই জ্ঞানই যথাযথ। অতএব এতে  (আত্মাতে) না আছে গ্রহণ, না ত্যাগ,না লয়।


 চতুর্থ  শ্লোক : ষষ্ঠ  প্রকরণ 


অহং বা সর্বভূতেষু সর্বভূতান্যথো ময়ি
ইতি জ্ঞানং তথৈত্স্য ন ত্যাগো ন গ্রহো  লয়ঃ। 

আমি (আত্মা) সর্বভূতে।  সর্বভূত আমাতে। এর অন্যথা নাই।   এই জ্ঞানই যথাযথ। অতএব এতে  (আত্মাতে) না আছে গ্রহণ, না ত্যাগ,না লয়।



ষষ্ঠ প্রকরণ সমাপ্ত 

আমরা আবার অষ্টাবক্র মুনি ও  জনক রাজার কথা শুনে নেবো। দ্বারপাল অষ্টাবক্রকে মহারাজ জনকের কাছে নিয়ে গেলো। বন্দির কাছে অর্থাৎ পণ্ডিত সভায় না নিয়ে রাজসভায় নিয়ে গেল। কারন দ্বারপাল জানতো বন্দি খুব রাগী ব্রাহ্মণ। কি থেকে কি হয় ? তখনকার দিনে ব্রাহ্মণদের সবাই খুব ভয় করতো।  এরা কথায় কথায় অভিশাপ দিয়ে দিতো। এবং অষ্টাবক্রকের কথাও সে অমান্য করতে পারলো না তার কারণও সেই ব্রাহ্মণ-অভিশাপ। অষ্টাবক্রও  ব্রাহ্মণ সন্তান। অষ্টাবক্রর বাণীতেও তেজ ছিলো। তাই অষ্টাবক্রকে নিয়ে সে রাজা জনকের সভায় গেলো। 

অষ্টাবক্র রাজা জনককে সম্বোধন করে বললো - হে জনকবংশাবতংস মহারাজ। 
 ( জনক কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি নয়।  আসলে জনক একটি বংশ।  ওই বংশের যারাই রাজা হতেন তিনিই জনক নামে রাজ্ করতেন। তাই আমরা দেখতে পাই ব্যাসদেব পুত্র শুকদেবকে তার পিতা, রাজা জনকের কাছে পাঠিয়ে ছিলেন ব্রহ্মাবিদ্যা লাভের জন্য। আবার রামপত্নী সীতার পিতাও ছিলেন রাজা জনক। ) 
আপনি সম্রাট।সর্ব্বৈশ্বর্য-সম্পন্ন ; আপনি যজ্ঞীয় কর্মানুষ্ঠান বিষয়ে পূর্বতন রাজা যযাতির  ন্যায় প্রশংসা ভাজন। একটু তেল মাখিয়ে দিলেন আর কি ! কারুর কাছ থেকে কাজ হাসিল করতে গেলে তার যথাযথ প্রশংসা করেই শুরু করতে হয়। এবং তার জন্য তার সম্পর্কে আগেই  খোঁজ খবর নিয়ে নিতে হয়। অষ্টাবক্র সেটাই করলেন। এর পর আসল কথায়  এলেন।
শুনেছি আপনার পণ্ডিত সভায় বন্দি নামক সর্বশাস্ত্রজ্ঞ মহা পণ্ডিত  প্রভূত বিদ্যাসম্পন্ন। তিনি অন্যান্য বিদ্বানদিগকে বিদ্যাপরীক্ষায় পরাজিত করে জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলে। হে রাজন ! আমি এই কথা শুনে ব্রাহ্মণসমীপে অদ্বৈত ব্রহ্মের কীর্তন করতে এসেছি। আপনার বন্দি কোথায় ? আমি তাকে তারই উপায় অবলম্বনে বিনাশ করতে এসেছি। 
রাজা জনক দেখলেন - অষ্টাবক্র যদিও ব্রাহ্মণ কিনতু  নিতান্তই বালক।  তিনি সহানুভূতির সঙ্গে বললেন -হে ব্রাহ্মণ বালক ! তুমি বন্দির  বাক্যবল  সম্পর্কে কিছুই না জেনে তাকে পরাজয়ের বাসনা করছো।  এটা  ঠিক নয়। তার প্রভাব তুমি জানোনা।  জানলে এমনটা বলতে পারতে না। বহু বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ তার বাক্যশক্তি সন্মন্ধে জানেন। যারা জানেন না, সেই সব বিজ্ঞানমত্ত মনীষীগণ তার নিকট পরাজিত হয়েছেন। পন্ডিতগণ বন্দির সাথে তর্ককালে এতটাই অপ্রতিভ হয়ে যান যে সাধারণ সৌজন্যবোধও হারিয়ে ফেলেন।  এমনকি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। 

অষ্টাবক্র এসব কথায় পিছিয়ে যাবার ছেলে নয়। তার জ্ঞান থেকেও বড় জোর পিতা হারানোর  আগুন। যা তার ভিতরে জ্বলছে। সেই প্রদীপ্ত অগ্নিই তাকে সাহস যোগাচ্ছে। তাই অষ্টাবক্র বললেন - হে রাজন ! আমি ঠিক বুঝতে পারছি - আমার মতো ব্রহ্মবিদের সাথে তার সাক্ষাৎ হয় নি। খাটাস বনে শিয়াল রাজা। শিয়াল হয়ে নিজেকে সিংহ ভাবছে। আসল সিংহের গর্জন তো শোনেনি। এবার সে বুঝতে পারবে। ব্যাটা খালি কলসি শব্দ করে বেশী । 

রাজা দেখলেন - একে বিরত  করা যাবেনা। তাই অষ্টাবক্রের পান্ডিত্যে সন্দিহান রাজা জনক তাকে কয়েকটি  প্রশ্ন করে তার অজ্ঞানতা যাচাই করতে চাইলেন। 

রাজা প্রশ্ন করলেন  - আচ্ছা বলতো দ্বাদশ অংশ ; চতুর্বিংশতি  পর্ব ; ষষ্ঠ্যধিক ত্রিশত অরসংযুক্ত  পদার্থের অর্থ কী ?
অষ্টাবক্র বললেন - হে রাজন ! চতুর্বিংশতি পর্ব্ব, ছয় নাভি, দ্বাদশ নেমী ও ষষ্ঠ্যধিক ত্রিশত অরযুক্ত সেই সদা গতি চক্র আমাকে রক্ষা করুন। (ব্রহ্মাস্ত্র)
রাজা বললেন - যে দুই পদার্থ বড়বাদ্বয়ের সংযুক্ত ও শ্যেন পাখির ন্যায় পতনশীল ; দেবগনের মধ্যে কে এই দুই পদার্থ প্রসব করেন এবং এই পদার্থদ্বয় বা কি প্রসব করে ?
অষ্টাবক্র উত্তর দিলেন -এই দুই পদার্থ যেন  কারুর  শত্রূর গৃহেও না হয়।  মেঘ এই দুই পদার্থের প্রসবিতা এবং এরাও মেঘ উৎপাদন করেন। (বজ্র এবং বিদ্যুৎ )
জনক জিজ্ঞাসা করলেন - কে চোখ না মুদে নিদ্রা যায়  ? কে জন্মিয়া স্পন্দিত হয় না ? কার হৃদয় নেই ?কোন বস্তূ  বেগে বর্ধিত হয় ?
অষ্টাবক্র জবাব দিলেন - মাছ চোখ না বুজে ঘুমায়। ডিম্ জন্মে স্পন্দিত হয় না। পাথরের হৃদয় নেই। নদী বেগে বর্ধিত হয়। 
এবার রাজা বিস্মিত হলেন।  স্বীকার করলেন এবং বললেন -হে ব্রাহ্মন কুমার তোমাকে সাধারণ বালক বোধ হচ্ছে না। আমি তোমাকে জ্ঞানবৃদ্ধ বলে জানলাম। তোমার জ্ঞান এবং বাকশক্তির  প্রশংসা করছি। এস আমার সঙ্গে পণ্ডিত সভায় । এই দেখো বন্দি - ভালো করে দেখো।
আমরা আবার অষ্টাবক্র সংহিতায় যাবো।

সপ্তম প্রকরণ - অনুভব পঞ্চকং নাম

প্রথম শ্লোক : সপ্তম প্রকরণ 

ময্যনন্ত-মহা-অম্ভোধৌ বিশ্ব-পোত ইতস্ততঃ 
ভ্রমতি  স্বান্ত বাতেন ন    মম-অস্তি-অসহিষ্ণুতা। 

মহা সমুদ্র সদৃশ আমাতে (আত্মাতে ) এই বিশ্ব, মন - রূপ বায়ুর দ্বারা তাড়িত হয়ে  ইতস্তত ভ্রমন করছে। এতে আমি কিছুমাত্রও  অসহিষ্ণু নই। 
দ্বিতীয় শ্লোক : সপ্তম প্রকরণ 

ময্যনন্ত-মহা-অম্ভোধৌ জগৎ-বীচিঃ স্বভাবতঃ 
উদেতু বাস্তম -আয়াতু ন মে বৃদ্ধির্ন চ ক্ষতিঃ।

অনন্ত মহাসমুদ্রারূপ আমি (আত্মা)  - আমাতে জগৎরূপ লহরির উদয়-অস্ত   হচ্ছে - তাতে আমার কোনো বৃদ্ধি বা ক্ষতি  হয় না। 

তৃতীয় শ্লোক : সপ্তম প্রকরণ :

ময্যনন্ত-মহা-অম্ভোধৌ বিশ্বং নাম বিকল্পনা 
অতিশান্তো নিরাকার এতৎ-এব-অহম-আস্থিতঃ

অসীম সমুদ্ররূপ আমাতে প্রতিভাত এই বিশ্ব কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। আমি আত্মা  শান্ত, নিরাকার - এটাই আমার অস্তিত্ব। 

 চতুর্থ শ্লোক : সপ্তম প্রকরণ : 
 ন আত্মা ভাবেষু ন ভাবস্তত্র-অনন্তে নিরঞ্জনে 
ইতি-অসক্ত -অস্পৃহ শান্ত এতৎ-এব-অহম-অস্থিতঃ  

আত্মা কোনো ভাবে নেই।  আবার কোনো ভাব-ই আত্মার মধ্যে নেই। আমি (আত্মা)অসক্ত অর্থাৎ  অনাসক্ত বা নির্লিপ্ত। আমি অস্পৃহ অর্থাৎ আমার কোনো স্পৃহা নেই। আমি শান্ত।এটাই আমার অস্তিত্ব। 

পঞ্চম শ্লোক : সপ্তম প্রকরণ 

অহো  চিন্মাত্রম্-এব-ইন্দ্রজাল-উপমং জগৎ 
অতো   মম কথং কুত্র  হেয়-উপাদেয়-কল্পনা।আহা ! আমি চিন্মাত্র স্বরূপ। অলৌকিক ইন্দ্রজাল সম এই জগৎ। অতএব আমার কোথাও বা কখনো - হেয় বা উপাদেয় -কল্পনা মাত্র। 

সপ্তম প্রকরণ  সমাপ্ত 

   অষ্টম প্রকরণ (গুরুপ্রক্তংবন্ধ-মোক্ষ-ব্যবস্থা  চতুস্কং)

প্রথম শ্লোক- অষ্টম প্রকরণ 

তদা বন্ধো যদা চিত্তং কিঞ্চিদ্ বাঞ্ছতি শোচতি। 
কিঞ্চিৎ মুঞ্চতি গৃহ্ণাতি কিঞ্চিদ হৃষ্যতি কুপ্যতি। 

চিত্ত যখন কোনো বিষয়ের চিন্তা (শোচ)করে  বা ইচ্ছা করে, বা আকাঙ্ক্ষা করে , এবং তৎ জনিত হর্ষ ক্রোধাদির বশীভূত হয় তখনি জীবের  বন্ধন  বা বদ্ধ অবস্থা হয়। 

দ্বিতীয় শ্লোক - অষ্টম প্রকরণ 

তদা মুক্তির্যদা চিত্তং না বাঞ্ছতি ন শোচতি 
ন মুঞ্চতি  ন গৃহ্ণাতি ন হষ্যতি ন কুপ্যতি। 

তখন অর্থাৎ সেই অবস্থায় চিত্ত ইচ্ছা, শোক, ত্যাগ, গ্রহণ কিছুই করে না এবং হর্ষ ও কোপের বশীভূত হয় না সেই অবস্থাই  অর্থাৎ চিত্তের বিষয় অভিলাষাদি বিকারাতীত অবস্থাই মুক্তি নামে প্রসিদ্ধ। 

তৃতীয় শ্লোক - অষ্টম প্রকরণ 


তদা বন্ধো যদা চিত্তং সক্তং কাস্বপি(কাসু -অপি) দৃষ্টিষু

তদা মোক্ষো যদা চিত্তম-অসক্তং সর্ব দৃষ্টিষু। 

চিত্ত যখন  (আত্মা ভিন্ন) কারুর  দৃষ্টিতে আসক্ত হয় - সেটাই বন্ধ। 

আবার চিত্ত যখন কারুর দৃষ্টিতে আসক্ত না হয় -সেটাই মোক্ষ। 

আসক্তি-ই বন্ধের  কারন। এই বাহ্যিক বিষয়ে আসক্তিই বন্ধের কারন। এই আসক্তিই আমাদের ঈশ্বর বিমুখ করেছে। আপন স্বত্বাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। আসলে জন্মের পর থেকেই আমরা বহির্মুখী। বহির্বিশ্ব আমাদের প্রতিনিয়ত আকর্ষণ করে চলেছে। আমরা অন্তরের আকর্ষণ অনুভবের শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। তাই মহর্ষি অষ্টাবক্র বলছেন - আসক্ত-চিত্ত বন্ধের  কারণ।  


চতুর্থ শ্লোক - অষ্টম প্রকরণ


যদা ন অহং তদা মোক্ষ  যদা অহং বন্ধনং তথা 

মত্বা-ইতি হেলয়া কিঞ্চিৎ মা গৃহাণ বিমুঞ্চ মা। 

যেখানে অহং নেই সেখানেই মোক্ষ। যেখানে অহং আছে সেখানেই বন্ধন। এইমতো  জেনে, হেলায় অর্থাৎ বিনা আয়াসে হেয়-উপাদেয় বুদ্ধি রোহিত হও। 


এক স্বামীজিকে  অনুরোধ করা হয়েছিল -" আমি কে " - এর উপরে আমাদেরকে একটু বলুন।  তার উত্তরে তিনি মজা করে বলেছিলেন- তুমি কে এটা  আমি কি করে বলবো ? আধার কার্ড বা ভোটার কার্ড দেখলেই তো হয়।  তাহলেই জানা যাবে আমি কে ? পরে অবশ্য তিনি বুঝিয়ে বলেছিলেন - এই দেহ তুমি নও  -   তুমি আত্মা - তুমি এই দেহে বাস করো মাত্র। 

এখন মহর্ষি অষ্টাবক্র বলছেন - যেখানে অহং নেই সেখানেই মুক্তি। যেখানে অহং আছে  সেখানেই  বন্ধন। তাহলে এই অহং কী  ?

ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন -জীবের অহংকারই  মায়া। এই মায়া বা অহং যেন মেঘের স্বরূপ। এই অহংকার সব আবরণ করে রেখেছে। সামান্য মেঘের জন্য সূর্যকে দেখা যায়  না। মেঘ সরে গেলেই সূর্যকে দেখা যায়। আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল। যদি গুরুর কৃপায় একবার অহং বুদ্ধি ঘুঁচে যায় তাহলে ঈশ্বর লাভ হয়।


অহং ঘুচে যাওয়া কি এত সোজা ? এই অহং নিয়েই তো সব। আমি এইযে অষ্টাবক্র সংহিতা বোঝার চেষ্টা করছি - সেও তো সেই অহং। অহং যদি না থাকে তবে কে বুঝতে চাইবে এই সংহিতা ? ঠাকুর রামকৃষ্ণের মতো এতো বড় মহাপুরুষ - যাকে  আমরা অবতার বলে মানি -স্বামী বিবেকানন্দের মতো মানুষ যার শিষ্য - তাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল আপনার সমাধি অবস্থায় একটুও কি অহং থাকে না ? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন -হ্যাঁ, আমার প্রায় একটু অহং থাকে। তাহলে অষ্টাবক্রর কথা রাজা জনক অনুসরণ করবেন কি করে ?  এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে - ঠাকুর রামকৃষ্ণ যেমন সহজ সরল মানুষ ছিলেন, সত্য বৈ  মিথ্যা বলতেন না।  তেমনি অষ্টাবক্রও সত্য বলেছেন - আমরা  কি করতে পারবে কি করতে পারবো না - সেটা পরের কথা। সত্য এটাই - যদা ন অহং তদা মোক্ষ - যেখানে অহং নেই সেখানেই  মোক্ষ  

      


অষ্টম প্রকরণ সমাপ্ত 

নবমং প্রকরণ  (নির্বেদ অষ্টকং - ত্যাগরূপ বৈরাগ্য )

প্রথম শ্লোক (নবম প্রকরণ )

কৃতাকৃতে  চ দ্বন্দ্বানি কদা শান্তানি  কস্য বা 
এবং জ্ঞাত্বা-ইহ নির্বেদাদ্ ভব ত্যাগপরঃ-অব্রতী। 

কৃতাকৃত অর্থাৎ কর্তব্য-অকর্তব্য বিষয়ে এবং সুখ-দুঃখ বিষয়ে  যে দ্বন্দ্ব  তার কখনো- কাহারো  নিবৃত্ত হয়েছে কি ? তা যদি না হয় তবে আগ্রহ-ত্যাগ-রূপ ব্রতধারী তুমি এ সব ব্যাপারে ব্রতী হয়ো না। 

দ্বিতীয় শ্লোক (নবম প্রকরণ )

কস্যাপি তাত ধন্যস্য লোক-চেষ্টা-অবলোকনাৎ
জীবিতেচ্ছা বুভুক্ষা চ বুভুৎসা-উপশমং গতাঃ।
হে তাত !(সর্ববিধ লোক ব্যবহারই উৎপত্তি ও বিনাশশীল।)  কদাপি কোনো বিরল মহাজন প্রচলিত লোকব্যবহার বিচার সহায়ে এইরূপ জ্ঞানের  বলেই, জীবনেচ্ছা, ভোগেচ্ছা এবং জ্ঞানেচ্ছাও ত্যাগে সমর্থ হয়ে থাকে।    


তৃতীয  শ্লোক (নবম প্রকরণ )

অনিত্যং সর্বমেব ইদং তাপত্রিতয়দূষিতম্
আসারং নিন্দিতং হেয়ম্-ইতি নিশ্চিত্য শাম্যতি। 

এ সবই (যা কিছু দেখা যাচ্ছে ) অনিত্য,ত্রিতাপদূষিত(আধ্যাত্মিক,আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক), অসার, নিন্দিত, হেয় - এইরূপ জেনে জ্ঞানী শান্তি লাভ করে। 
চতুর্থ শ্লোক (নবম প্রকরণ )

কঃ-অসৌ কালো বয়ঃ কিংবা যাত্রা দ্বন্দ্বাণি নো নৃণাম্
তানি-উপেক্ষা যথা-প্রাপ্ত-বর্তী সিদ্ধিম-অবাপ্নুয়াৎ। 

এমন বয়সকাল কোথায় - যেখানে সুখ-দুঃখাদি দ্বন্দ্ব নেই।  অতএব এটাকে উপেক্ষা করে, যথাপ্রাপ্তবর্তী সিদ্ধ পুরুষ মুক্তি লাভ করেন। 

পঞ্চম  শ্লোক (নবম প্রকরণ )

নানা মতং মাহর্ষীণাং সাধুনাং যোগিনাং তথা 
দৃষ্ট্বা নির্বেদম্-আপন্নঃ কো ন শাম্যতি মানবঃ। 

নানা মতাবলম্বী মাহর্ষিগন, সাধুগণ, যোগীগণ, দেখে ভেদবুদ্ধিহীন বুদ্ধিমান মানুষ   কেবল নিষ্ঠা সহকারে আত্মার অনুসন্ধানে করে,কি শান্তি লাভ করেন নি ?

 ষষ্ঠ শ্লোক (নবম প্রকরণ )

কৃত্বা মূর্তি-পরিজ্ঞানং চৈতন্যস্য নঃ কিং গুরুঃ
নির্বেদ-সমতা-যুক্ত্যা যঃ-তারয়তি সংসৃতেঃ। 

গুরু,  চৈতন্যের ঘনবিগ্রহ মাত্র, অন্য্ কিছু নয়। এই জ্ঞান লাভ করে ভেদহীন সাম্যে  যুক্ত হয়ে অর্থাৎ যিনি  গুরুশিষ্য এক হয়ে গেছেন এমন মহাজন-ই নিজেকে এবং অপরকে চিরমুক্ত করে থাকেন। 

সপ্তম শ্লোক (নবম প্রকরণ )

পশ্য  ভূত-বিকারাং স্ত্বং ভূত-মাত্রান্ যথার্থাতঃ
তৎক্ষণাৎ -বন্ধ-নির্মুক্তঃ স্বরুপস্থো ভবিষ্যসি।

নিজেকে অর্থাৎ দেহকে  (পাঁচ) ভূতের বিকার মাত্র মনে করো। আসলে তুমি ভূত-ই। এইরূপ করলে তৎক্ষণাৎ তুমি বন্ধন-মুক্ত হবে এবং স্বরূপে স্থিস্ত হবে। 

অষ্টম  শ্লোক (নবম প্রকরণ )

বাসনা এব সংসার ইতি সর্বা বিমুঞ্চ তাঃ 
তত্ত্যাগো বাসনা-ত্যাগাৎ স্থিতিঃ অদ্য  যথা তথা।  

(বিষয়) বাসনাই  সংসার। অতএব বাসনাসমূহ পরিত্যাগ করো। তত্বজ্ঞ বাসনা ত্যাগ করে যথা-তথাতে আজ  স্থির হয়। 
নবম প্রকরণ সমাপ্ত 
দশম প্রকরণ :
গুরুপ্রক্তম-উপদেশম-অষ্টকম 

প্রথম শ্লোক - দশম প্রকরণ 

বিহায় বৈরিণং কামমর্থং চানর্থসংকুলম 
ধর্মমপ্যেতয়োর্হেতুং সর্বত্র-অনাদরং কুরু। 

(জ্ঞানের) শত্রূ কামকে, (সকল প্রকার) অনর্থ (দুঃখ) সংকুল  (যুক্ত) অর্থকে, এবং (এই কাম ও অর্থের) কারণ  ধর্মকেও ত্যাগ করে, তুমি সর্ব বিষয়ে উপেক্ষা-বুদ্ধি অবলম্বন করো।

দ্বিতীয় শ্লোক : দশম প্রকরণ 


স্বপ্ন-ইন্দ্রজাল-বৎ পশ্য দিনানি ত্রীনি পঞ্চ বা 

মিত্র-ক্ষেত্র-ধন-আগার-দার-দায়-আদি-সম্পদঃ। 

তিন দিন বা পাঁচ দিন স্থায়ী এই মিত্র-ক্ষেত্র-ধন-গৃহ-স্ত্রী এই সমস্ত ঐশর্য্য স্বপ্ন এবং ইন্দ্রজাল-সম।


তৃতীয়  শ্লোক : দশম প্রকরণ 


যত্র যত্র ভবেতৃষ্ণা সংসারং বিদ্ধি যাত্রা বৈ 

প্রৌঢ়-বৈরাগ্যম-আশ্রিত্য বীত-তৃষ্ণঃ সুখী ভব। 

যেখানে(বিষয়) তৃষ্ণা আছে -সেখানেই সংসার। প্রৌঢ় অর্থাৎ দৃঢ় বৈরাগ্য আশ্রয় করে তৃষ্ণা বিমুখ হয়ে সুখী হও। 


চতুর্থ  শ্লোক : দশম প্রকরণ 


তৃষ্ণা-মাত্র-আত্মকঃ বন্ধ-তৎ-নাশো মোক্ষ উচ্যতে 

ভবা-অসং-সক্তি-মাত্রেণ প্রাপ্তি-তুষ্টি-ম্হুর্মুহুঃ। 

তৃষ্ণার উদ্রেক মাত্রই স্বরূপের  বন্ধন। তৃষ্ণা নাশকেই  মোক্ষ  বলা হয়।  ভবাসক্তি অর্থাৎ  দেহাদি বিষয়ে আসক্তি  যখন কেটে  যায়, তখন আত্মপ্রাপ্তির তৃপ্তি পুনঃ পুনঃ বা প্রতিনিয়ত অনুভব হয়। 


পঞ্চম শ্লোক : দশম প্রকরণ 

ত্বম-একঃ-চেতনঃ শুদ্ধো জড়ং বিশ্বম-অসৎ-তথা 

অবিদ্যাপি ন কিঞ্চিৎ সা কে বুভুৎসা তথাপি তে। 

তুমিই একমাত্র শুদ্ধ চেতন। জড় জগৎ অসৎ। সেইরূপ অবিদ্যা কিছুই নয়।  তথাপি তোমার বুভুৎসা অর্থাৎ এতে জানার  ইচ্ছেটা কী ?


ষষ্ঠ  শ্লোক : দশম প্রকরণ


রাজ্যং সুতঃ কলত্রাণি শরীরাণি সুখানি চ 

সংসক্তস্য-অপি নষ্টানি তব জন্মনি জন্মনি।

রাজ্য, স্ত্রী-পুত্র, শরীরের  প্রতি আসক্ত হয়ে জন্মে জন্মে  কত কলহ করেছো,কত সুখ নষ্ট  করেছো।  


সপ্তম   শ্লোক : দশম প্রকরণ


অলম-অর্থেন কামেন সুকৃতেন-অপি কর্মণা 

এভ্যঃ সংসার-কান্তারে ন বিশ্রান্তম-অভূৎ-মনঃ। 

অর্থ, কাম, সুকৃতি সবই  বৃথা, কারন এই সংসারে তোমার মন এগুলি থেকে বিশ্রাম অর্থাৎ  শান্তি লাভ করতে পারে নাই।


অষ্টম   শ্লোক : দশম প্রকরণ


কৃতং ন কতি জন্মনি কয়েন মনসা গিরা

দুঃখম-আয়াস-দং কর্ম তৎ-অদ্য-অপি-উপরম্যতাম। 

বহুল প্রয়াস ও দুঃখপ্রদ শারীরিক, মানসিক ও বাচিক কত কর্মই না  তুমি জন্মে জন্মে করেছো! কিনতু  তাতে কিছুই লাভ হয় নাই।     



    দশম প্রকরণ সমাপ্ত 

আমরা আবার রাজা জনকের পণ্ডিত সভায় যাবো। 
মহর্ষি অষ্টাবক্র ও শ্বেতকেতুকে নিয়ে  রাজা জনক যখন পণ্ডিত-সভায় প্রবেশ করলেন - অষ্টাবক্রের বিকৃত চলন ও চেহারা দেখে সভায় হাস্যরোল উঠলো। পণ্ডিত অষ্টাবক্র জানেন, যারা যে ভাষা বোঝে তাদের  সেই ভাষাতেই জবাব দিতে হয়। অষ্টাবক্র খানিকক্ষণ পণ্ডিতদিগের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।  হাসির রোল উত্তরোত্তর বাড়তে দেখে - অষ্টাবক্র উচ্চেস্বরে হাসতে  লাগলেন । এবার সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন - এবং চুপ হয়ে গেলেন। 
মহারাজ জনক অষ্টাবক্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন - হে ব্রাহ্মন বালক ! পন্ডিতদের বিকৃত আনন্দের কারন তো বুঝতে  পারলাম কিনতু তোমার আনন্দের কারন তো বুঝতে পারলাম না। 
মহর্ষি অষ্টাবক্র বললেন - এই চামারগুলোকে দেখে আমার বিকৃত আনন্দই হচ্ছে। এটা  পণ্ডিত সভা না চর্মকারদের সভা ? আমি তো শুনেছিলাম আপনি একটা পান্ডিত্সভা বসিয়েছেন।  যেখানে বিদ্বজন আসেন।  যেখানে ব্রহ্মবিদ্যা, বেদজ্ঞান বিতরণ হয়। কিনতু 
এতো দেখছি চামারদের সভা।
সবাই থ হয়ে গেল।  পন্ডিতগণ এ-ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলো। 
অষ্টাবক্র আবার শুরু করলেন - আত্মানুসন্ধানীরা সর্বত্র আত্মাকে দেখেন। চর্মকারদের দৃষ্টি থাকে চামড়ার দিকে। চামড়া দেখে তারা চরিত্র বিচার করে। চর্মকাররা জুতো দেখে বুঝে যায় - ব্যক্তির আর্থিক, সামাজিক, শিক্ষা-র অনুমান করে নেয়। দর্জি যেমন একজনের জামা কাপড় দেখে তাকে বিচার করে। 
আপনার এখানে দেখছি চামারে পরিপূর্ণ।  এরা তো হাড়-মাস-সার এই শরীরের উপরে উঠতে পারে নি। এরা ব্রহ্মবিদ্যার  কি জানবে ?
অন্তরের আত্মাকে কি ভাবে দেখবে ?

অষ্টাবক্রের কথাতে সবাই লজ্জায় পড়ে গেলো। বুঝতে  পারলো, যা ভেবে ছিল তা নয়। এতো তাল দিয়ে মাখানো। তাল দিয়ে মাখানো বোঝেন তো ! একজন, বারান্দায় বসে তাল দিয়ে ভাত মাখছিলো। সামনে ছিল একটা কুকুর - লোকটা দেখলো কুকুরের জিভ দিয়ে লালা ঝরছে। কুকুরটা ভেবে ছিল  মানুষ্য-বিষ্ঠা। তাই লোভে  তার জিভ দিয়ে লালা বেরোচ্ছিল। লোকটা বুঝতে পেরে - কুকুরটাকে বললো - যা ভেবেছো  তা নয়। তাল দিয়ে মেখেছি। পন্ডিতরাও অষ্টাবক্রের অষ্টভঙ্গ মূর্তি আর তার এঁকেবেঁকে চলন দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি চেপে রাখতে পারেনি। প্রবৃত্তি যাবে কোথায় ?


এবার অষ্টাবক্র আসল কথাটায়  আসলেন - তোমাদের মধ্যে 

বন্দি কে ? আমি তো তাকে চিনতে পারছি না। হে মহারাজা জনক -আপনি বন্দিকে আমার সম্মুখে উপস্থিত করুন। বন্দি রাগে হুঙ্কার ছাড়তে লাগলো। ভাবখানা এমন যেন এক্ষুনি ভস্মীভূত করে দেব। 
কিনতু  এতো জ্বলন্ত অগ্নি।  এতো জ্বালাতে এসেছে। অগ্নিশর্মা মূর্তি দেখে মহর্ষি অষ্টাবক্র বুঝতে পারলো - এই ব্যাটাই বন্দি। 

অষ্টাবক্র বললো - হে বন্দিন্ ! শোনো - আমি যে প্রশ্ন করবো তুমি তার উত্তর দেবে।  আর তুমি যা প্রশ্ন করবে আমিও  তৎক্ষনাৎ তার উত্তর দান করবো।   বাপের ব্যাটা হও তো - শীগ্র প্রশ্ন করো। 

এই প্রশ্ন-উত্তর মহাভারতের বন্পর্বে আছে। 

বন্দি - এক অগ্নি বহু প্রকারে প্রদীপ্ত হয়। এক সূর্য এই সমস্ত লোকে আলোক প্রদান করে।  এক বীর দেবরাজ আরিকুলের  নিহন্তা ও এক যম পিতৃগণের ঈশ্বর।


অষ্টাবক্র বললেন - ইন্দ্র ও অগ্নি এই দুই সখা একত্র ভ্রমন করেন ; নারদ ও পর্বত এই দুই জন মহর্ষি ;অশ্বিনী-কুমারেরা দুই জন; রথের চক্র দুইখান ; বিধাতৃবিহিত জায়া  এবং পতিও দুই। 


বন্দি - লোক স্ব-স্ব কর্ম অনুসারে ত্রিবিধ জন্ম গ্রহণ করে।  তিন বেদ একত্র হয়ে সমগ্র বাজপেয় সুসম্পন্ন করে। অধ্বর্য্যুগন ত্রিবিধ স্নানের বিধি বিধান করেন; লোক তিন প্রকার এবং জ্যোতিও তিন প্রকার। 


অষ্টাবক্র বললেন :  ব্রাহ্মণগনের আশ্রম চার রকম, চারিবর্ণ জ্ঞান যজ্ঞের অধিকারী ; দিক চারি ; বর্ণ চতুষ্টয় ও গাভী চতুষ্পদা। 


বন্দি  : অগ্নি পঞ্চপ্রকার ; পংক্তি-ছন্দ পঞ্চপদযুক্ত ; যজ্ঞ  পঞ্চবিধ ; ইন্দ্রিয় পঞ্চ ;বেদে অনুসন্ধান আত্মিকা  চিত্তবৃত্তি  পঞ্চপ্রকার ;পবিত্র পঞ্চ-নদ লোকমধ্যে খ্যাত। 


অষ্টাবক্র : অগ্নাধানে দক্ষিনা স্বরূপ ছয়টি গো-দান করে থাকেন ; ছয়টি ঋতু ;ইন্দ্রিয় ছয়টি ; কৃত্তিকা ছয় ; ছয়  সাদ্যস্ক নামক যজ্ঞ সর্ব বেদে বিহিত আছে। 


বন্দি : গ্রাম্য পশু সপ্তবিধ ; বন্য পশু সপ্তবিধ ;সপ্ত ছন্দ এক জাজ্ঞা সম্পন্ন করে ; সপ্তর্ষিমণ্ডল লোকে বিখ্যাত ; অহর্না সপ্ত  প্রকার ; বিনা সপ্ততন্ত্রী। 


অষ্টাবক্র : আটটি গোনী শত  পরিমিত দ্রব্য ধারণ করে। অষ্টপদ শরভ সিংহকে বিন্যাস্ত করে থাকে ; দেবগন মধ্যে অষ্টবসু প্রসিদ্ধ্ অষ্ট কোনাবিশিষ্ট যুপ  সর্ব্ব  যজ্ঞেই বিহিত হয়ে থাকে। 


বন্দি : পিতৃযজ্ঞে সামধেনি মন্ত্র  নববিধ ও ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতি অবান্তর গুনভেদে নয় প্রকার হয়ে বিবিধ সৃষ্টি সম্পন্য করে ;বৃহতী নাবাক্ষরা ও একাদি নয় পর্যন্ত নয়টি অংকদ্বারা সমুদায় গণনা  সম্পন্ন হয়ে থাকে। 


অষ্টাবক্র : দশ  দিক ; দশ সংখ্যা দশ গুনিটা হলে সহস্র হয় ; স্ত্রীগণ দাস মাস গর্ব্ভ ধারণ করে থাকে ;দশ জন তত্বের উপদেষ্টা ;দশ জন দ্বেষ্টা ও দশ জন অধিকারী। 


বন্দি : প্রাণীদিগের ইন্দ্রিয় বিষয় একাদশ ;এই একাদশ বিষয়ই তত্বজ্ঞানের প্রতিবন্ধক ; ইন্দ্রিয়াবিকার একাদশ প্রকার ও স্বর্গে একাদশ রুদ্র সুপ্রতিষ্ঠিত আছেন। 


অষ্টাবক্র : দ্বাদশ মাসে সংবৎসর হয় ;জগতী ছন্দের  প্রত্যেক পাদে দ্বাদশ অক্ষর ; প্রাকৃত যজ্ঞ দ্বাদশ দিনে সম্পন্ন হয় ; দ্বাদশ আদিত্য ত্রিলোক  বিখ্যাত। 


বন্দি : ত্রয়োদশ তিথি প্রশস্ত বলে উক্ত আছে; পৃথিবী ত্রয়োদশ

 দ্বীপাবিশিষ্ট। 

বন্দি এই অবধি বলে নীরব হলেন।  একটু খেয়াল করুন - প্রতিটি সংখ্যার সঙ্গে কমপক্ষে চারটি  উদাহরণ দিয়ে সংখ্যা মাহাত্য বোঝানো হচ্ছিলো।  কিনতু  বন্দি ত্রয়োদশ সংখ্যায় এসে পাঁচটি উদাহরণ টানতে পারলেন না। দুটি উদাহরণ দিয়ে ক্ষান্ত হলেন।  


অষ্টাবক্র এবার ত্রয়োদশ সংখ্যার বাকি দুইটি উদাহরণ দিচ্ছেন। 

আত্মা বিষয় ইন্দ্রিয় সন্মন্ধরূপ ত্রয়োদশ প্রকার ভোগে আসক্ত হন ;
ধর্মাদি সমুদায়  বুদ্ধ্যাদি  ত্রয়োদশের নাশক। 

উপরের বিষয়ে বিস্তারিত জানার ইচ্ছা রইলো।  পরে কোনো এক সময়ে এগুলো সম্পর্কে তথ্য  খুঁজবো।


এবারে আমরা আবার অষ্টাবক্র সংহিতায়  মনোযোগ দেবো।  আসলে অষ্টাবক্র-উপদেশ বড্ডো তেতো ঔষধ। গেলা বড্ডো কঠিন। যুক্তি-তর্কের  ঊর্ধে। শুধু সত্য মেনে নেওয়া।  এ যেন আকাশ ছুঁতে যাওয়া।মনে হয় দূর দিগন্তে আকাশ পৃথিবীর সঙ্গে মিশেছে।  কিনতু  যতই এগোও - আকাশ আরো দূরে চলে যায়। আকাশ এখানেই আছে।  শুধু অনুভব করো।  প্রথমে মেনে নিও।  তারপর শুধু একাত্ম  হয়ে যাও।  তবেই আকাশের উপস্থিতি টের পাবে। কেউ তোমাকে দেখাতে পারবে না।  তুমিও দেখতে পারবে না। শুধু মেনে নাও আর ডুবে যাও। আকাশ এখানেই আছে, দূরেও আছে, তোমার ভেতরেও, বাইরেও  আছে। তুমি শুধু বিশ্বাস করো, তারপর লয় হয়ে যাও। 

 না ফাঁকা জায়গা মানেই আকাশ তা কিনতু  নয়। সবকিছু যার মধ্যে আছে তাই আকাশ। আবার সব কিছুর মধ্যেই আকাশ। সব চৈতন্য, সব জ্ঞান, সব রূপ, সব অরূপ, সব গুন্, সব অগুন যার মধ্যে আছে তিনিই আকাশ। এই বিশ্বব্রহ্মান্ড যার মধ্যে আছে তিনিই আকাশ। সবাইকে যিনি আশ্রয় দিয়েছেন তিনিই আকাশ। ব্ৰহ্মাণ্ডর বাইরে যদি কিছু থাকে তাও তারই মধ্যে। তিনিই সর্বত্র। এটা  শুধু বোধের ব্যাপার।  বোঝানোর ব্যাপার নয়। শুধু মেনে নাও আর আনন্দে ভেসে যাও।  চিরস্থায়ী এই সত্য।  তোমার কিছু করতে হবে না। কিছু বুঝতে হবে না।  কোথাও যেতে হবে না।  এখানেই বসে শুধু মেনে নাও আর উপলব্ধি করো।  মানো না মানো  এটাই সত্য। মানলে ডুব দাও।  ডুব-ই  বা কেন দেবে ? তুমি ডুবেই আছো।  শুধু উপভোগ করো।

একাদশ প্রকরণ  : জ্ঞান-অষ্টকম 

          
 প্রথম শ্লোক :   ১১- প্রকরণ 

ভাব-অভাব-বিকারশ্চ স্বভাবৎ-ইতি নিশ্চয়ী 

নির্বিকারো গত-ক্লেশঃ  সুখেন-এব-উপশাম্য়তি। 

কখনো ভাব - কখনো  অভাব - কখনো বিকার - এটাই তো স্বভাব (এই জগতের যাবতীয় পদার্থের তা সে সূক্ষ হোক বা স্থুল ) এটা নিশ্চিত জেনে তুমি নির্বিকার, ক্লেশহীন হয়ে, সুখে উপবেশন করো, বা শান্তি প্রাপ্ত হও। 


দ্বিতীয় শ্লোক : ১১-প্রকরণ 


ঈশ্বরঃ সর্ব নির্মাতা নেহান্য(ন অন্য্ ) ইতি নিশ্চয়ী 
অন্তঃ-গলিত-সর্ব-আশঃ শান্তঃ ক্বাপি না সজ্জতে। 

ঈশ্বর-ই সব কিছুর নির্মাতা - অন্যথা নয়। অন্তর থেকে গলে পড়া সমস্ত আশাই  শান্ত করে নিজেকে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সজ্জিত করো।


তৃতীয়  শ্লোক : ১১ প্রকরণ 

আপদঃ সম্পদঃ কালে দৈবাৎ-এব-ইতি নিশ্চয়ী 
তৃপ্ত স্বস্থ্যেন্দ্রিয়ো  নিত্যং ন বাঞ্ছতি ন শোচতি। 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপদ বা সম্পদ দৈব প্রভাবেই  হয়। এই রকম
 নিশ্চিত হয়ে ইন্দ্রিয় উপশম দ্বারা তৃপ্ত হয়ে নিত্য অবস্থান কারো।   অতএব  বাঞ্ছা অর্থাৎ আকাঙ্খা করোনা, আবার  শোকও  করো না।

চতুর্থ শ্লোক : ১১ প্রকরণ 

সুখদুঃখে জন্মমৃত্যু দৈবাৎ-এব-ইতি নিশ্চয়ী 
সাধ্য-আদর্শীঃ নিরায়াসঃ কুর্বন্নপি  ন লিপ্যতে। 

সুখ-দুঃখ, জন্ম-মৃত্যু সবই দৈব নির্দেশে হয়। এইরূপ যে জানেন  তিনি নিরায়াস অর্থাৎ শ্রমহীন থাকেন এবং কোনো কিছুতেই  লিপ্ত হন না। 


পঞ্চম শ্লোক : ১১ প্রকরণ 


চিন্তয়া জায়তে দুঃখং অন্যথা-ন-ইতি নিশ্চয়ী 

তয়া  হীনঃ সুখী শান্তঃ সর্বত্র গলিতস্পৃহঃ। 

চিন্তা দুঃখের জন্ম দেয়, এ ছাড়া অন্য কিছু নয়। এইরূপ যে জেনেছে তিনিই  সব স্পৃহা ত্যাগ করে শান্ত সুখী হন ।      

       

ষষ্ঠ শ্লোক : ১১ প্রকরণ 

নাহং দেহো ন মে দেহো বোধ-অহম-ইতি নিশ্চয়ী 
কৈবল্যমিব সংপ্রাপ্তো ন স্মরতি-অকৃতং কৃতম।                 

আমি দেহ নোই, দেহও আমার নহে  - এই বোধের উপরে নিশ্চয় থেকে কৈবল্য প্রাপ্ত হও। কি করা হয়েছে আর কি করা হয় নাই - এই সব স্মরণ করতে যেও না। 


সপ্তম শ্লোক : ১১ প্রকরণ 


আ-ব্রহ্ম-স্তম্ব-পর্যন্তম্-অহম-এব-ইতি  নিশ্চয়ী 

নির্বিকল্পঃ শুচিঃ শান্তঃ প্রাপ্ত-অপ্রাপ্ত বিনির্বৃতঃ। 

ব্রহ্ম হতে আরম্ভ করে তৃণ পর্য্ন্ত সবই  আমি - এইরূপ নিশ্চিত হয়ে নির্বিকল্প অর্থাৎ বিকল্প রোহিত হয়ে যাও।  প্রাপ্ত-অপ্রাপ্তর বিচার ছেড়ে শুচি-শান্ত  হয়ে যাও। 


অষ্টম শ্লোক : ১১ প্রকরণ 


নানা-আশ্চর্যম-ইদং বিশ্বং ন কিঞ্চিদিতি নিশ্চয়ী 

নির্বাসনঃ সফুর্তি-মাত্রো  ন কিঞ্চিৎ -ইবা শাম্যতি। 

নানা আশ্চার্যরূপ এই বিশ্ব আসলে কিছুই নয়। এইরূপ জেনে বাসনা রোহিত হও আর ফুর্তি করো। এতে প্রবিষ্ট হওয়ার কিছু নেই।    

একাদশ প্রকরণ সমাপ্ত 

দ্বাদশ প্রকরণ - এবমেবাষ্টকং 



প্রথম শ্লোক - দ্বাদশ প্রকরণ 

কায় - কৃত্যা - অসহঃ পূর্বং ততো বাক্-বিস্তর-অসহঃ
অথ  চিন্তা-অসহঃ-তস্মাৎ-এবম -এব -অহম -আস্থিত।

পূর্বেই  আমি দেহাদি কর্মে অসহ্য হয়ে উঠেছিলাম। বাচিক জপাদি কর্মেও অসহিষ্ণু ছিলাম।  এখন চিন্তাতেও আমি অসহ্য হয়ে পড়েছি। এইভাবে আমি সর্ব ব্যাপার রোহিত হয়ে সুখে অবস্থান করছি। 


দ্বিতীয় শ্লোক - দ্বাদশ প্রকরণ 


প্রীতি-অভাবেন শব্দাদেঃ-অদৃশ্য-ত্বেন চাত্মনঃ

বিক্ষেপ-একাগ্র-হৃদয় এবম-এব-অহম-আস্থিতঃ। 

শব্দাদির প্রতি আমার প্রীতি নেই। আত্মা অদৃশ্য। মন  বিক্ষিপ্ত । হৃদয় একাগ্র করে আমি স্ব-স্বরূপে অবস্থান করছি।


তৃতীয়  শ্লোক - দ্বাদশ প্রকরণ 


সম্-অধ্যাস-আদি বিক্ষিপ্তৌ ব্যবহারঃ সমাধয়ে 

এবং বিলোক্য নিয়ম-এবম-এব-অহম-আস্থিতঃ।

বিক্ষিপ্ত ব্যবহার অর্থাৎ চিত্ত চাঞ্চল্য দূর করার জন্য সমাধির আশ্রয় করা হয়। আমার যেহেতু কোনো চাঞ্চল্য নেই, তাই আমি সমাধি আদি অভ্যাস রোহিত হয়ে, আমি আমাতেই অবস্থিত আছি।


চতুর্থ শ্লোক - দ্বাদশ প্রকরণ 


হেয়-উপাদেয় বিরহাৎ-এবং হর্ষবিষাদয়োঃ

অভাবাদ -অদ্য হে ব্রহ্মন্নেবমেবা-অহম অাস্থিতঃ।

হে ব্রহ্মন্ !  আমি  হেয় -উপাদেয়  রোহিত, হর্ষ  বিষাদের অতীত।  স্বরূপেই  স্থিত। 


পঞ্চম শ্লোক - দ্বাদশ প্রকরণ  


আশ্রম-অনাশ্রমং ধ্যানং চিত্ত স্বীকৃত বর্জনম্ 

বিকল্পং  মম  বিক্ষ্য-এতৈঃ-এবম-এব-অহম-আস্থিতঃ .

আশ্রম অনাশ্রম, ধ্যান, চিত্ত-স্বীকৃত (বস্তূর ) ত্যাগ বা বর্জন - এ সবই  বিকল্পত্বাক বিক্ষেপের হেতু জেনে এগুলো পরিত্যাগ পূর্বক আমি আমাতেই স্থিত হয়েছি। 



ষষ্ঠ  শ্লোক  -দাদ্বশ প্রকরণ 


কর্মানুষ্ঠানম-অজ্ঞানাদ যথৈবোপরমস্তথা 

বুদ্ধা সাম্যগ-ইদং তত্বম -এবম -এব অহম আস্থিত। 

কর্মানুষ্ঠান বা তার থেকে বিরতি দুটোই অজ্ঞান থেকে হয়ে থাকে। এ সম্পর্কে সম্যক  অবগত হয়ে  এ দুটোই পরিত্যাগ করে আমি স্বরূপে স্থিত আছি।


সপ্তম শ্লোক : দ্বাদশ প্রকরণ 


অচিন্ত্যং চিন্ত্যমান-অপি চিন্তারূপং ভজতি-অসৌ 

ত্যক্ত্বা তদ্ভাবনং তস্মাদ-এবম-এব-অহম-আস্থিতঃ।

অচিন্তকে (ব্রহ্ম) চিন্তা করতে করতে - সেই চিন্তারূপতাই প্রাপ্ত হয়। অতএব এই ভাবনা ত্যাগ করে সর্ব ভাবনা রোহিত হয়ে আমি স্বরূপে স্থিত হয়েছি। 


অষ্টম শ্লোক : দ্বাদশ প্রকরণ প্রথম শ্লোক 



এবম -এব কৃতং যেন স কৃতার্থ ভবেদ -অসৌ 

এবম -এব  স্বভাবো যঃ স কৃতার্থো ভবেদ -অসৌ। 

যিনিএইভাবে সর্ব-ক্রিয়া   রোহিত হয়ে হয়ে স্ব -স্বরূপে স্থিত হন  তিনিই  কৃতার্থ। এমনটি  যার স্বভাব তিনি কৃতার্থ।           



ত্রয়োদশ প্রকরণ -যথা সুখ সপ্তকং নাম


প্রথম শ্লোক : ত্রয়োদশ প্রকরণ 

অকিঞ্চন ভবং স্বাস্থ্যং কৌপীনত্বে অপি দুর্লভম 
ত্যাগদানে বিহায় অষ্মাৎ অহম আসে যথা সুখম।

অকিঞ্চন এই ভবে, কৌপীন মাত্রে আসক্তি থাকলেও স্ব-স্থিতি আসবে না। এই মানুষ  দুর্লভ।অতএব ত্যাগ ও গ্রহণ বিষয়ে সব রকম আসক্তি পরিত্যাগ করে আমি পরম সুখে অবস্থান করছি। 

দ্বিতীয় শ্লোক : ত্রয়োদশ প্রকরণ 

কুত্রাপি খেদঃ কায়স্য জিহ্বা কুত্রাপি খিদ্যতে 
মনঃ কুত্রাপি তৎ -ত্যক্তা পুরুষার্থে স্থিতঃ সুখম। 

কায়িক পরিশ্রমে দেহ ক্লান্ত  হয়। বাচিক কর্মে জিহ্বা পরিশ্রান্ত হয়। ধ্যান বা মানসিক কর্মে মন অবসন্ন হয়ে পড়ে। তাই এই ত্রিবিধ কর্ম পরিত্যাগ করে আমি পরম সুখে স্ব-স্বরূপেই  স্থিত আছি।


তৃতীয় শ্লোক : ত্রয়োদশ প্রকরণ 


কৃতং কিমপি নৈব স্যাদিতি সংচিন্ত্য তত্ত্বতঃ 

যদা যৎ কর্তুম-আয়াতি তৎ কৃত্বাসে যথা সুখম। 

দেহ-ইন্দ্রিয়াদি (তত্ত্বতঃ অর্থাৎ পঞ্চ ভূত তত্বের তৈরী ) কৃত কর্ম আসলে আত্মা দ্বারা কৃত নয় - এই সত্য মনে দৃঢ় রেখে শরীরাদির যে কোনো কাজ যখনই  সামনে আসে আমি তাই অহংকার রোহিত হয়ে করি - এবং পরম আনন্দে থাকি। 


চতুর্থ শ্লোক : ত্রয়োদশ প্রকরণ 

কর্মনৈস্কর্ম্য নির্বন্ধভাবা দেহস্থ যোগিন
সংযোগাযোগ-বিরহাৎ-অহম -আসে যথা সুখম। 

কর্ম বা নিস্কর্মতা এই ভাবনাটি দেহাসক্ত যোগীদেরই হয়। সংযোগ অথবা বিযোগ উভয়ের বিয়োগ বসতঃ আমি পরম সুখে অবস্থান করছি। 

পঞ্চম শ্লোক : ত্রয়োদশ প্রকরণ 

অর্থ-অনর্থৌ ন মে স্থিত্যা গত্যা না শয়নেন বা 
তিষ্ঠন গচ্ছন স্বপন তস্মাদহমাসে  যথা সুখম। 

অর্থ, অনর্থ আমাতে স্থিত নয়। গতিতেও নয় শয়নেও  নয়। তাই তিষ্ঠ অর্থাৎ অবস্থান, গমন , শয়ন বা স্বপ্নেও কর্ম  করে আমি পরম সুখে অবস্থান করছি। 

ষষ্ঠ শ্লোক : ত্রয়োদশ প্রকরণ 

স্বপতো নাস্তি মে হানিঃ সিদ্ধি-যত্নবতো ন বা 
নাশ-উল্লাসৌ বিহায়-অষ্মাৎ- অহম-আসে যথা-সুখম। 

স্বপ্নেও আমার কোনো হানি নাই। জাগ্রত অবস্থায় আমার কোনো সিদ্ধি নাই। আমার না আছে বিষাদ না আছে উল্লাস - এগুলো ত্যাগ করেই আমি পরম সুখে আছি।

সপ্তম শ্লোক : ত্রয়োদশ প্রকরণ 


সুখাদিরূপ-অনিয়মং ভাবেস্বালোক্য ভূরিশঃ
শুভাশুভে বিহায়াস্মাদহমাসে যথাসুখম।

এই ভব লোকের পদার্থে সুখ-দুঃখ অনিত্য। এই সব দেখে আমি শুভ অশুভ পরিত্যাগ পূর্বক সুখে অবস্থান করছি। 



ত্রয়োদশ প্রকরণ সমাপ্ত


চতুর্দশ প্রকরণ - শান্তি চতুষ্টয় 

প্রথম শ্লোক : চতুর্দশ প্রকরণ :

প্রকৃত্যা শূন্যচিত্তো যঃ প্রমদাদ ভাব-ভাবনঃ 
নিদ্রিতো বোধিত ইব ক্ষীণ  সংস্মরনো হয় সঃ।

প্রকৃত পক্ষে যিনি শুন্য চিত্ত ; এই ভব সংসারকে যিনি প্রমাদ
 ভাবেন ; নিদ্রিত অবস্থা বলে বোধ করেন - এইরূপ পুরুষ সংসারহেতু বিষয় স্মরণ অভাব বসতঃ, সংসার হতে চির মুক্ত থাকেন। 

দ্বিতীয় শ্লোক : চতুর্দশ প্রকরণ

ক্ব ধনানি ক্ব মিত্রাণি ক্ব  মে  বিষয়-দস্যবঃ 
ক্ব  শাস্ত্ৰং ক্ব চ বিজ্ঞানং যদা মে গলিতা স্পৃহা। 

কি বা ধন, কি বা মিত্র, কি বা দস্যুরূপ বিষয়, কি শাস্ত্র, কি বিজ্ঞান - কোনো কিছুতেই আমার স্পৃহা নেই। 

তৃতীয় শ্লোক : চতুর্দশ প্রকরণ 

বিজ্ঞাতে সাক্ষিপুরুষে পরমাত্মনি চ-ঈশ্বরে
নৈরাশ্যে বন্ধমোক্ষে চ ন চিন্তা মুক্তয়ে মম।

সাক্ষীপুরুষ, পরম-আত্মা বা ঈশ্বর, বন্ধন, মোক্ষ এই সব বিষয়ে আমি নৈরাশ্য অনুভব করছি।  এসব বিষয়ে আমার কোনো চিন্তা নেই, এমন কি মুক্তির চিন্তাও  নেই। 

চতুর্থ শ্লোক : চতুর্দশ প্রকরণ 

আন্তঃ-বিকল্প-শূন্যস্য বহিঃ স্বচ্ছন্দচারিণঃ
ভ্রান্তস্য়েব দশাঃ-তাঃ-তাঃ-তাদৃশাঃ এব জানতে। 

অন্তরে বিকল্পশুন্য বাইরে স্বচ্ছন্দ বিচরণকারী।অজ্ঞ বা জ্ঞানী পুরুষের এই অবস্থা জ্ঞানীগণই  জানতে পারে ।           
   

চতুর্দশ প্রকরণ সমাপ্ত 

পঞ্চদশ প্রকরণ : গুরুপ্রক্তং তত্বোপদেশ

প্রথম শ্লোক : পঞ্চদশ  প্রকরণ 

যথা-তথা-উপদেশন কৃতার্থঃ সত্ত্ব-বুদ্ধিমান
আজীবমপি জিজ্ঞাসুঃ পরস্তত্র বিমুহ্যতি। 

যথাযথ উপদেশে কৃতার্থ হয়ে যায় সত্ব গুণধারী বুদ্ধিমান। কিনতু মলিন চিত্ত পুরুষ যাবৎ জীবন জিজ্ঞাসু হয়েও ; বহু তত্ব উপদেশ পেয়েও মুহ্যমান হয়ে থাকে। 

দ্বিতীয় শ্লোক : পঞ্চদশ প্রকরণ 


মোক্ষো বিষয়-বৈরস্যনং বন্ধো বৈষয়িকো রসঃ

এতাবদেব বিজ্ঞানং যথেচ্ছসি তথা কুরু। 

বিষয়ে অনাসক্তিই (বিরস ) মোক্ষ। বিষয় রসেই  বন্ধন। এটাই বিশেষ জ্ঞান। এই জ্ঞানে জ্ঞানান্বিত হয়ে তুমি যা ইচ্ছে তাই করো। 


তৃতীয় শ্লোক :  পঞ্চদশ প্রকরণ 


বাগ্মি-প্রাজ্ঞ-মহা-উদ্যোগং জনং মূক-জড়-অলসম 

করোতি তত্ব-বোধঃ-অহং-অতঃ-ত্যক্ত বুভুক্ষুভিঃ।

সুবক্তা বা বাচাল, পণ্ডিত ব্যক্তি, উদ্যোগী জন (এই তত্ব জ্ঞান লাভে)

বোবা এবং ক্রিয়াহীন হয়ে যান। ভোগবিলাসীরা  একে
(এই  তত্ত্বজ্ঞান) ত্যাগ করে।  

চতুর্থ শ্লোক : পঞ্চদশ প্রকরণ 


ন ত্বং দেহো ন তে দেহো ভোক্তা করতে ন বা ভবান 

চিদ্ রূপঅসি সদা সাক্ষী  নিরপেক্ষঃ সুখং চর।

তুমি দেহ নও।  তোমাতে দেহ নেই। তুমি ভোক্তা নও।  তুমি কর্তা  নও। তুমি এই সকলের সাক্ষী চৈতন্যস্বরূপ, নিরপেক্ষ।

তাই তুমি সুখে বিচরণ করো। 

পঞ্চম শ্লোক : পঞ্চদশ প্রকরণ 


রাগ-দ্বেষৌ মনধর্মৌ ন মনস্তে কদাচন 

নির্বিকল্প-অসি বোধাত্মা নির্বিকারঃ সুখং চর। 

রাগ, দ্বেষ  এগুলো মনের ধর্ম। মন কখনো তোমার নয়। তুমি নির্বিকল্প বোধে আত্মা, নির্বিকার।সদা সুখে বিচরণ করো। 


ষষ্ঠো শ্লোক : পঞ্চদশ প্রকরণ 


 সর্ব-ভূতেষু চ আত্মানাং সর্ব ভুতানি চ আত্মনি

বিজ্ঞায় নিরহংকারো নি-মম-ত্বং সুখী ভব। 

সর্ব ভূতে আত্মা ; আত্মাতেই সর্ব ভূত  ; এই জ্ঞানে তুমি নিরহংকারী 

হও।  তুমি এই দেহ বোধের আমি নয় - এটা  জেনে তুমি সুখী হও। 

সপ্তম শ্লোক : পঞ্চদশ প্রকরণ 


বিশ্ব স্ফ ুরতি যত্রেদং তরঙ্গা ইব সাগরে 

তত্ত্বমেব ন সন্দেহঃ-চিন্মূর্তে বিজ্বরো ভব। 

যাতে বিশ্বের বিকাশ,  আনন্দ খেলা বা প্রকাশ

যেমন সাগরে তরঙ্গ।সন্দেহাতীত সেই চিন্ময় স্বরূপ ই তুমি।  
অতএব  স্বরূপের তত্ত্ব জেনে, সন্দেহের উর্ধে উঠে টু সর্ব সন্তাপরহিত হও। 

অষ্টম শ্লোক : পঞ্চদশ প্রকরণ 


শ্রদ্ধস্ব তাত শ্রদ্ধস্ব নাত্র মোহং কুরুস্ব ভোঃ

জ্ঞান স্বরূপো ভগবান  আত্মা  ত্বং প্রকৃতেঃ পরঃ। 

শ্রদ্ধা সম্পন্য হও।  শ্রদ্ধার বিপরীত ভাবনারূপ মোহ কোরো  না। প্রকৃতির ঊর্ধে   জ্ঞানস্বরূপ ভগবানত্মা তুমি।


নবম শ্লোক : পঞ্চদশ প্রকরণ 


গুনৈঃ সংবেষ্টিতা দেহঃ-তিষ্ঠটি-আয়াতি যাতি চ 

আত্মা ন গন্তা নগন্তা কিম-এনং-অনুশোচসি। 

গুনের সন্নিবেষ্টিত এই দেহ - আসে যায়। আত্মা আসেও না যায়ও না। অতএব কিসের অনুশোচনা !


দশম শ্লোক :পঞ্চদশ প্রকরণ 


দেহ-তিষ্ঠতু কল্প-অন্তং গচ্ছতু-অদ্য-এব বা পুনঃ 

ক্ব বৃদ্ধি ক্ব চ বা হানিস্তব চিন্মাত্র-রূপিণঃ। 

দেহ - কল্পের শেষ পর্যন্ত থাকুক বা আজই চলে যাক তাতে চৈতন্য-স্বরূপের কোনো হানি  বা বৃদ্ধি হয় না। 


একাদশ শ্লোক : পঞ্চদশ প্রকরণ 


ত্বয্যনন্ত (তয়ি-অনন্ত) মহা-অম্ভাধৌ  বিশ্ব-বিচীঃ স্বভাবতঃ 

উদেতু ব-অস্তং-আয়াতু ন তে বৃদ্ধির্ন বা ক্ষতিঃ। 

তুমি অনন্ত   চৈতন্য মহা সমুদ্র। এই  জগৎরূপ লহরী তার  স্বভাব বলে তোমাতে উদয় হোক বা অস্ত যাক তাতে তোমার কোনো বৃদ্ধি বা ক্ষতি  নাই। 


দ্বাদশ শ্লোক : পঞ্চদশ প্রকরণ 


তাত  চিন্মাত্র-রূপ-অসি না তে ভিন্নং-ইদং জগৎ 

অতঃ কস্য কথং কুত্র হেয়-উপাদেয়-কল্পনা। 

হে তাত ! তুমি চৈতন্য মাত্র স্বরূপ। না, এই জগৎ তোমা হতে  ভিন্ন নয়। অতএব কোথায় কিভাবে কাকেই বা ভালো অথবা মন্দ কল্পনা করবে ?


ত্রয়দশ  শ্লোক : পঞ্চদশ প্রকরণ 


একস্মিন-অব্যয়ে  শান্তে চিদাকাশে-অমলে ত্বয়ি

কুতো জন্ম কুতঃ কর্ম কুতঃ অহংকার এব চ। 

তুমি এক , অব্যয়, শান্ত, চিদাকাশরুপী অমল। তোমার আবার কি জন্ম কি মৃত্যু  কিসেরই বা অহংকার !


চতুর্দশ শ্লোক : পঞ্চদশ প্রকরণ 


যত্ত্বং পশ্যসি তত্র-একঃ-ত্বম-এব  প্রতিভাসসে 

কিং পৃথক্ ভাসতে স্বর্ণাৎ কটক-অঙ্গদ-নুপুরম্।  

যে দিকে তাকাও সেখানেই তুমি একা প্রতিভাত হচ্ছে। কটক অর্থাৎ হাতের বালা,অঙ্গদ অর্থাৎ অলংকার, নুপুর  ইত্যাদির মধ্যে সোনা ছাড়া আর পৃথক কিছু দেখতে পাও কি ?


পঞ্চদশ শ্লোক : পঞ্চদশ প্রকরণ 


অয়ং সঃ-অহম নাহং বিভাগম-ইতি সন্ত্যজ

সর্বম-আত্মা-ইতি নিশ্চিত্য নিঃসঙ্কল্পঃ সুখী ভব। 

সেই আত্মাই আমি, এই জগৎ আমি নোই -এই বিভেদ-বুদ্ধি পরিত্যাগ কারো। সবই  আত্মা - এটা নিশ্চিত হয়ে নিঃসঙ্কল্প ও সুখী হও। 


ষষ্ঠদশ  শ্লোক : পঞ্চদশ প্রকরণ 


তব-এব-অজ্ঞানতো বিশ্বং ত্বমেকঃ পরমার্থতঃ

ত্বত্ত্বঃ-অন্যো  নাস্তি সংসারী নাসংসারী চ কশ্চন।

তোমার এই অজ্ঞান থেকেই তোমার বিশ্ব।  পরমার্থ এক এবং অদ্বিতীয়।  অন্য কিছু নেই। তোমা হতে ভিন্ন সংসারী ও অসংসারী বলে কিছু নেই।


সপ্তদশ শ্লোক : পঞ্চদশ প্রকরণ 


ভ্রান্তিমাত্রম-ইদং বিশ্বং ন কিং-চিৎ-ইতি নিশ্চয়ী 

নির্বাসনঃ স্ফ ূর্তি মাত্রো ন কিঞ্চিৎ-ইব শাম্যতি। 

এই বিশ্ব ভ্রান্তি মাত্র। চিৎ-ভিন্ন কিছু নেই - নিশ্চয় জেন। বাসনারাহীত বিকাশ মাত্র। এর মধ্যে অন্য কিছু নেই।


অষ্টাদশ শ্লোক : পঞ্চদশ প্রকরণ  

এক এব ভব-অম্ভধৌ-এব-আসীৎ-অস্তি ভবিষ্যতি 
ন তে বন্ধঃ-ন-অস্তি মোক্ষো বা কৃতকৃত্যঃ সুখং চর। 

ভব -সাগরে একমাত্র তুমিই ছিলে-আছো এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। অতএব তোমার না আছে বন্ধন না আছে মোক্ষ।  সুতরাং কৃতকৃত্য হয়ে তুমি সুখে বিচরণ করো।  

ঊনবিংশ শ্লোক : পঞ্চদশ প্রকরণ 

মা-সংকল্প-বিকল্পভ্যাং চিত্তং ক্ষোভয় চিন্ময় 
উপশাম্য সুখং তিষ্ঠ স্বাত্মনি-আনন্দ-বিগ্রহে। 

সংকল্প বিকল্প জালে ছিটকে ক্ষোভিত করো না। এ গুলোর উপশম করে শান্ত হও। আনন্দ বিগ্রহে স্থিত হও। 

বিংশ শ্লোক : পঞ্চদশ প্রকরম 

ত্যজৈব ধ্যানংসর্বত্র মা কিঞ্চিদ হৃদি ধারয় 
আত্মা  ত্বং মুক্ত এবাসী কিং বিমৃশ্য করিষ্য়সি। 

যে কোনো বিষয়ে ধ্যান ত্যাগ করো।  হদয়ে(চিত্তে) কোনো চিন্তা ধারণ কোরো না। তুমি আত্মা মুক্ত। অতএব এসব করে কিই বা নতুন লাভ করবে ?


পঞ্চদশ প্রকরণ সমাপ্ত  
  


ষোড়শ  প্রকরণ  ( বিশেষ উপদেশকং)

প্রথম শ্লোক : ষোড়শ  প্রকরণ 

আচক্ষ্ব শৃণু বা তৎ নানা-শাস্ত্রাণি-অনেকশঃ
তথাপি ন তব স্বাস্থ্যং সর্ব-বিস্মরণাৎ-ঋতে। 

হে তাত ! তুমি শাস্ত্র শোনো বা ব্যাখ্যা করে কাউকে শোনাও, তথাপি অর্থাৎ যাই  করো না কেন, সব কিছু ভুলে স্ব-স্থিত যদি না হতে পারো তবে শ্রেয়ো লাভ কখনো হবে না। 

  দ্বিতীয় শ্লোক : ষোড়শ  প্রকরণ 

ভোগং কর্ম সমাধিং বা কুরু বিজ্ঞ তথাপি তে 

চিত্তং নিরস্ত-সর্ব-আশম-অতি-অর্থং রোচয়িষ্যতি। 

হে বিজ্ঞ ! ভোগ, কর্ম, বা সমাধি  যাই করো - তথাপি চিত্ত সর্ব তৃষ্ণা রোহিত হয়ে  স্ব-স্বরূপে রুচি উৎপন্ন করো। 


তৃতীয় শ্লোক : ষোড়শ প্রকরণ 


অায়াসাৎ সকলো দুঃখী নৈনং জানাতি কশ্চন  

অনেন-উপদেশেন ধন্যঃ প্রাপ্নোতি নির্বৃতম্। 

আয়াস অর্থাৎ প্রচেষ্টাই সকল দুঃখের কারন - একথা কেউ জানে না। আয়াসই  সর্ব দুঃখের কারণ -  এই উপদেশ লাভেই নিবৃত্তির প্রয়াস প্রাপ্ত হয়। 


চতুর্থ শ্লোক : ষোড়শ প্রকরণ 


ব্যাপারে খিদ্যতে যস্ত্ু নিমেষ-উন্মেষয়োঃ-অপি 

তস্য-আলস্য-ধুরীনস্য সুখং নান্যস্য কস্যচিৎ। 
    
 সমস্ত ব্যাপারে এমন কি চোখের পাতা উন্মেষ নিমেষ  করতেও যিনি খিদ বা দুঃখিত বোধ করেন, সেই অলস-ধুরন্ধরেরই সুখ হয়ে থাকে - অন্য কারো নয়। 

পঞ্চম শ্লোক : ষোড়শ  প্রকরণ 


ইদং কৃতমিদং নেতি দ্বন্দ্বৈর্মুক্তং যদা  মনঃ

ধর্মার্থ-কাম-মোক্ষেষু নিরপেক্ষ্যং তদা ভবেৎ।

এটা করা হয়েছে - এটা করা হয় নি এইসব চিন্তা-দ্বন্দ্ব হতে মন  যখন মুক্ত হয়, তখন-ই  ধৰ্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ প্রভৃতি হতে নিরপেক্ষ হয়ে যায় পুরুষ। 


ষষ্ঠ শ্লোক : ষোড়শ প্রকরণ 


বিরক্তো বিষয়-দ্বেষ্টা  রাগী বিষয়লোলুপঃ

গ্রহ-মোক্ষ-বিহীনঃ-তু ন বিরক্ত ন রাগবান্।

যে  বিষয়-দ্বেষ্টা তাকেই বিরক্ত বলা হয়।  যে বিষয়-লোলুপ তাকে রাগী বলা হয়। গ্রহণ-ত্যাজ্য বিহীন তুমি বিরক্ত-ও নও আবার রাগবান-ও  নও। 


সপ্তম শ্লোক : ষোড়শ প্রকরণ 


হেয়-উপাদেয়তা তাবৎ সংসার-বিটপ-অংকুরঃ

স্পৃহা জীবতি  যাবৎ-বৈ নির্বিচার-দশা-অষ্পদম্। 

যতদিন নির্বিচার দশা আষ্পদম অর্থাৎ আসা যাওয়া করবে; স্পৃহা অর্থাৎ বিষয় তৃষ্ণা জীবিত থাকবে ততদিন ভালো মন্দের এই সংসারবৃক্ষের শাখায় অংকুর  উৎপত্তি হতেই  থাকবে। 


অষ্টম শ্লোক : ষোড়শ প্রকরণ 


প্রবৃত্তৌ জায়তে রাগো নিবৃত্তৌ দ্বেষ এব হি 

নিঃ-দ্বন্দ্ব বালবৎ ধীমান-এবম-এব ব্যবস্থিতঃ। 

প্রবৃত্তি অর্থাৎ বিষয় প্রবৃত্তি থেকে রাগ জেগে ওঠে।  আবার বিষয় নিবৃত্তি থেকে দ্বেষ জেগে ওঠে।দ্বন্দ্বহীন বালকএর মতো বুদ্ধিমান হও এবং স্বস্থিত থাকো। 


নবম শ্লোক : ষোড়শ প্রকরণ 


হাতুম-ইচ্ছতি সংসারং রাগী দুঃখ জিহাসয়া 

বীতরাগো হি নিঃ-দুঃখ-তস্মিন-অপি ন খিদ্যতি।

রাগী পুরুষ  দুঃখ পরিহারের জন্য সংসার ত্যাগের ইচ্ছা করে। কিনতু  বীতরাগ পুরুষ দুঃখের সংসারে থেকেও কোনো খেদ প্রাপ্ত হন না। 


দশম শ্লোক : ষোড়শ প্রকরণ  


যস্য-অভিমানো মোক্ষে অপি মমতা তথা 

ন  চ জ্ঞানী না বা যোগী কেবলং দুঃখভাগসৌ। 

যার মোক্ষাভিমান হয়েছে - তিনি জ্ঞানী নন। দেহের  প্রতি যার মমতা রয়েছে - তিনিও যোগী নন। কেবল দুঃখের-ই  ভাগিদার। 


একাদশ শ্লোক : ষোড়শ  প্রকরণ


হরো যদি-উপদেষ্টা তে হরিঃ কমল-জঃ-অপি বা 

তথাপি ন তব স্বাস্থ্যং সর্ব-বিস্মরণাৎ-ঋতে। 

তোমার উপদেষ্টা যদি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর (কমল-জাত,  হরি , 

হরো ) হয় তথাপি সব কিছু অর্থাৎ সংসার  বিস্মৃতি না হলে তোমার স্বরুপস্থিতি লাভ করা হবে না।


ষোড়শ প্রকরণ সমাপ্ত

আমরা আবার রাজা জনকের সভায় যাবো। সেখানে বন্দি, মহর্ষি অষ্টাবক্রের সঙ্গে বিতর্কে হেরে গেছেন। আমরা এবার  গল্প শুনবো। সভা স্থল নিস্তব্ধ।  বন্দি অধোমুখ। অষ্টাবক্রের বাগাড়ম্বরে সভাস্থ পন্ডিতদের মধ্যে একটা সন্তুষ্টির গুঞ্জন শোনা গেলো। ধীরে ধীরে সেই গুঞ্জন কলরবে পরিণত হলো। তটস্থ ব্রাহ্মণগণ  অষ্টাবক্রের জয়ধ্বনি করতে লাগলেন। 

অষ্টাবক্র বললেন : এই বন্দি বহু ব্রাহ্মণ পন্ডিতকে তর্কে পরাজিত করে সলিল মধ্যে নিমগ্ন করেছেন।  এখন এই বন্দির জল সমাধির সময় হয়েছে।  একে জলে নিমগ্ন করো। 

বন্দি ভয়ে কাঁপতে লাগলো। ধীরে ধীরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন : আমি বরুন রাজের  পুত্র। বরুন রাজ জনক রাজার ন্যায় দ্বাদশ বার্ষিক যজ্ঞ আরম্ভ করেছেন। সেজন্য আমি সেই  যজ্ঞ স্থানে ব্রাহ্মন পণ্ডিত গনকে পাঠিয়েছি।  তারা সেখানে যজ্ঞ দেখছেন। তাঁরা সবাই ফিরে আসছেন। আমি আমার পিতা বরুনের কাছে চলে যাচ্ছি। 

মহর্ষি অষ্টাবক্র বললেন : বন্দি যেমন ভাবে তার তীক্ন বাক্য ও মেধা দ্বারা ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের পরাজিত করেছে এবং তাদের জলে ডুবিয়ে  মেরেছে, আমিও নিজের মেধা ও বাক্য দ্বারা বন্দিকে পরাজিত করেছি। আপনারা নিশ্চয় সেটা দেখলেন, শুনলেন, এবং বিচক্ষণ লোকেরা বুঝলেন। কোনো পণ্ডিত সে যদি ভালো মানুষ হয় তবে  এই ভাবে স্বগোত্রীয় পন্ডিতদের পরাজয়ের ছলে, মেরে ফেলতে পারতো না। এছাড়া কোনো বয়স্ক জ্ঞানী  ব্যক্তি বালকের বাক্যে অপমান বোধ করে না। কিনতু  এই পাষন্ডের সেই জ্ঞানও  নেই। বালকের কথাতেই নেচে উঠেছে। হে বন্দি আমার কথা কি তোমার কানে যাচ্ছে ?

রাজা জনক  দেখলেন ব্যাপারটা ভালো হচ্ছে না। পরিবেশ সামাল দিতে তিনি বললেন : হে ব্রাহ্মণ কুমার ! আমি তোমার দিব্য বাক্য শুনে বুঝতে পারলাম - তুমি দেব স্বরূপ। তুমি বিবাদে বন্দিকে পরাজিত  করেছো।  অতএব তোমার ইচ্ছা অনুসারে বন্দি অবশ্য-ই  কর্ম করবে। তুমি উত্তেজিত হয়ো না। 

অষ্টাবক্র বললেন : হে রাজন ! বন্দি যদি বরুনের পুত্র হয়।  তবে এক্ষুনি ওকে জলে ডুবিয়ে দেওয়া হোক। এতে তো কোনো অসুবিধা নেই।  আর তা ছাড়া বন্দিকে বাঁচিয়ে রেখে, আমার কি উপকার 
হবে ?

বন্দি এবার মৃদু স্বরে বললেন : আমি বরুন রাজ্যের পুত্র।  জলমগ্ন হতে আমার বিন্দুমাত্র শঙ্কা নেই। তবে শোনো অষ্টাবক্র, যদি তুমি তোমার পিতা সহ অন্যান্য পন্ডিতদের জলউত্থিত করে বাঁচাতে চাও তবে আমি বেঁচে থাকতেই সেটা করা সম্ভব। দেখো তুমি - তোমার পিতাকে দেখো - সমগ্র বিপ্রগণকে দেখো। দেখতে দেখতে সমস্ত ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ জল থেকে উঠে পড়লেন। জনক রাজ্যের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। 

রাজা জনকের সামনে উপস্থিত হয়ে - অষ্টাবক্রের পিতা কহোড় বললেন : লোকে এই জন্যই পুত্রের কামনা করে। অবলের বলবান পুত্র হতে পারে। অজ্ঞানীর জ্ঞানী  পুত্র জন্মাতে পারে।  অবিদ্বানের বিদ্বান পুত্র জন্মাতে পারে। দেখুন, আমি যা পারিনি - আমার পুত্র সেটাই অনায়াসে করে দেখালো। হে জনকরাজ্ আপনার যজ্ঞ সার্থক।

এই ভাবে সমস্ত জলনিমগ্ন ব্রাহ্মণগন আগের থেকে আরো বেশি প্রভা সম্পন্ন হয়ে জলাশয় থেকে উত্থিত হলেন।  বন্দি, মিথিলা রাজ্যের অনুমতিক্রমে সাগর জলে প্রবিষ্ট হলেন। 

অষ্টাবক্র নিজের পিতাকে পূজা করলেন। অন্যান্য সকলে অষ্টাবক্রের জয়ধ্বনি করতে লাগলো। এইভাবে পিতাপ্রাপ্ত হয়ে অষ্টাবক্র মামা শ্বেতকেতু সহ মামা বাড়ির দিকে রওনা হলেন। 

মহর্ষি উদ্দালকের আশ্রমে এসে - মাতা সুজাতাকে প্রনাম করলেন। আশ্রমে আনন্দের অশ্রূ বইতে লাগলো। কহোড়মুনি পুত্রকে সমঙ্গা নদীতে স্নান করে আসতে  বললেন।  সমঙ্গা নদীতে স্নান করার পরে অষ্টাবক্রের অঙ্গবিকৃতি ঠিক হয়ে গেল। অষ্টাবক্র থেকে কৌশকেয় হলেন। কিনতু কৌশকেয় নামে কেউ তাকে চিনলো না।  তিনি  অষ্টাবক্র নামেই তার কীর্তি রেখে গেলেন।  আজ এই পর্যন্ত।  এর পরে আমরা আবার সংহিতায় প্রবেশ করবো। এবার সতেরো-তম অধ্যায়। 

সপ্তদশ প্রকরণ : তত্বজ্ঞস্বরূপ 

প্রথম শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ

তেন জ্ঞানফলং প্রাপ্তং যোগাভ্যাস ফলং তথা  

তৃপ্তঃ স্বচ্ছ-ইন্দ্রিয়ো নিত্যম একাকী রমতে তু যঃ।

তাঁর জ্ঞান ফল প্রাপ্ত হয়েছে।  যোগ অভ্যাসের ফল প্রাপ্ত হয়েছে। তাঁর স্বচ্ছ  ইন্দ্রিয় তৃপ্ত। তিনি একাকীই রমন করছেন। 


দ্বিতীয় শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ 


ন কদাচিৎ-জগতি-অস্মিন তত্ত্বজ্ঞ হন্ত খিদ্যতি 

যত একেন  তেনেদং পূর্নং ব্রহ্মাণ্ড-মণ্ডলম। 

জগতে তত্ত্বজ্ঞ কখনো খেদ করেন না। যেহেতু তিনি একাই ব্রহ্মাণ্ড মন্ডলে ব্যাপ্ত হয়ে আছেন। 


তৃতীয় শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ 


ন জাতু বিষয়াঃ কে-অপি স্বারাম  হর্ষয়ন্ত্যমী

সল্লকি পল্লব প্রীতম-ইব-ইভং নিম্ব-পল্লবাঃ। 

সল্লকি  অর্থাৎ বাবলা গাছের পাতা যার পছন্দ সেই হাতি যেমন নিম পাতা খেয়ে আনন্দ পায়  না - তেমনি আত্মারাম বিষয় সমূহে আনন্দ পায় না। 


চতুর্থ শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ 


যস্ত ু ভোগেষু ভুক্তেষু ন ভবতি-অধিবাসিতঃ

অভুক্তেষু নিরাকাঙ্খী তাদৃশো ভব-দুর্লভঃ।

যার মধ্যে  ভুক্ত বিষয়ে আসক্তি নেই , অভুক্ত বিষয়েও যিনি নিরাকাঙ্খী অর্থাৎ আকাঙ্খা নেই এমন মানুষ ভবসংসারে দুর্লভ। 


পঞ্চম শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ 


বুভুক্ষঃ-ইহ সংসারে মুমুক্ষঃ-অপি দৃশ্যতে 

ভোগ-মোক্ষ-নিরাকাঙ্ক্ষী বিরলো হয় মহাশয়ঃ। 

এই সংসারে  ভোগে ইচ্ছুক  এবং মোক্ষে ইচ্ছুক মানুষ দেখা যায়। কিনতু ভোগ-মোক্ষে নিরাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি বিরল। 


ষষ্ঠ  শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ 


ধৰ্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষেষু জীবিতে মরণে তথা 

কস্য-অপি-উদারচিত্তস্য হেয়-উপাদেয়তা  ন হি। 


কোথায় সেই উদার চিত্ত !যার ধৰ্ম, অর্থ, কামনা, মোক্ষ, জীবনে, এমনকি মরনে - হেয়, উপাদেয় ভাব নেই ?  


সপ্তম শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ 


বাঞ্ছা  ন বিশ্ব-বিলয়ে ন দ্বেষঃ-তস্য চ স্থিতৌ 

যথা-জীবিকয়া তস্মাদ্ ধন্য আস্তে যথাসুখম্। 

বিশ্বের বিলয়ে যিনি বাঞ্ছাহীন, স্থিতিতেও যার দ্বেষ নেই,যা পাচ্ছেন তাতেই যার  জীবিকা, তিনিই স্বরূপে স্থিত হয়ে ধন্য ও যথাযথ সুখ ভোগ করছেন। 


অষ্টম  শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ 


কৃতার্থঃ-অনেন-জ্ঞানেন-ইতি-এবং  গলিতধীঃ কৃতী

পশ্যন্ শৃন্বন্ স্পৃশন্  জিঘ্রন্-অশ্নন্-আস্তে  যথা-সুখম। 

এই অদ্বৈত আত্ম-জ্ঞান প্রভাবে কৃতার্থ ও স্ব-স্বরূপে যিনি বিগলিত হয়ে আছেন - তিনি  বাহ্য ব্যাপারে দর্শন -শ্রবণ -স্পর্শন-ঘ্রান গ্রহণ  বা ভোজন ইত্যাদি বাহ্যিক ব্যাপারে লিপ্ত থেকেও তিনি যথাযথ সুখেই অবস্থান করছেন। 


নবম শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ 


শূন্যা দৃষ্টির্বৃথা চেষ্টা বিকলানি-ইন্দ্রিয়ানি চ

ন স্পৃহা ন  বিরক্তির্বা ক্ষীণ-সংসার-সাগরে।

ক্ষীণ সংসার সাগরে যিনি শুন্যদৃষ্টি হয়ে গেছেন অর্থাৎ দেখেও দেখেন না।   ইন্দ্রিয় বিকলবৎ, চেষ্টা রোহিত। কোনো স্পৃহা নেই আবার কোনো বিরক্তিও নেই। 


দশম শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ 


ন জাগর্তি ন নিদ্রাতি ন-উন্মীলতি ন মীলতি  

অহো  পরদশা  ক্বাপি বর্ততে মুক্ত-চেতসঃ।

তিনি জেগে থাকেন না, আবার ঘুমিয়েও থাকেন না। তার (চোখে) উন্মিলনও নেই আবার মিলনও  নেই। আহা  কি পরম দশা বর্তায় এই মুক্ত-চৈতন্যে।  


 একাদশ  শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ 


সর্বত্র দৃশ্যতে  স্বস্থঃ সর্বত্র বিমলাশয়ঃ

সমস্ত-বাসনা-মুক্তো মুক্তঃ সর্বত্র রাজতে। 

তিনি সর্বত্র নিজেকে স্থিত দেখছেন। সর্বত্র মলিনতাহীন দেখছেন। সমস্ত বাসনা থেকে মুক্ত।  মুক্ত অবস্থাতেই তিনি সর্বত্র রাজ্ করছেন। 


দ্বাদশ শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ 


পশ্যন্ শৃন্বন্ স্পৃশন্ জিঘ্রন্-অশ্নন্ গৃহ্নন্ বদন্ ব্রজন্ 

ঈহিত-অনিহিতৈঃ-মুক্তঃ মুক্ত এব মহাশয়ঃ। 

দর্শন, শ্রবণ,স্পর্শন,ঘ্রান,ভক্ষণ,গ্রহণ,বদন, গমন ইত্যাদি করেও হিত-অহিত থেকে মুক্ত। এইরূপ মহাশয় পুরুষ নিত্যমুক্ত।


ত্রয়োদশ শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ


ন  নিন্দতি ন চ স্তৌতি  না হৃষ্যতি না কুপ্যতি 

ন দদাতি ন গৃহ্নাতি মুক্তঃ সর্বত্র নিরসঃ।

তিনি কারো নিন্দা করেন না।  কারো স্তূতি করেন না। হর্ষ প্রাপ্ত হন না, আবার কারো প্রতি কুপিত হন না। দেন ও করেন না বারবার গ্রহণ করেন না। সর্ব বিষয়ে নীরস - এই পুরুষই মুক্ত। 


চতুর্দশ শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ 


সানুরাগাং স্ত্রিয়ং দ্রষ্ট্বা মৃত্য়ুং বা সমুপস্থিতম 

অবিহ্বল মনাঃ স্বস্থো মুক্ত এব মহাশয়ঃ। 

অনুরাগী স্ত্রীলোক, বা মৃত্যু সম্মুখে দেখলেও বিহ্বল না।এইরূপ  

স্ব -স্থিত পুরুষই মুক্ত।  

পঞ্চদশ শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ


সুখে দুঃখে নরে নার্য্যং সম্পৎসু চ বিপুৎসু চ 

বিশেষো নৈব ধীরস্য সর্বত্র সমদর্শিনঃ

সুখে, দুঃখে, স্ত্রী বা পুরুষে, সম্পদে বা বিপদে,সর্বত্র সমদর্শী জ্ঞানীর কোনো ভেদ বুদ্ধি উৎপন্ন হয় না। 


ষোড়শ  শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ


ন হিংসা নৈব কারুণ্যং নৌদ্ধত্যং না চ দীনতা 

ণাশ্চর্যম নৈচ ক্ষোভঃ ক্ষীণ-সংসরণে-অনরে। 

না  হিংসা, না করুনা, না ঔদ্ধত্ত, না দীনতা, না আশ্চর্য বোধ করা, না কোনো ক্ষোভ, সব কিছুর উর্দ্ধে অনড় থেকো সংসারে। 


সপ্তদশ শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ 


ন মুক্তো বিষয়-দ্বেষ্টা ন বা বিষয়-লোলুপঃ

অসংসক্ত-মনা নিত্যং প্রাপ্তং প্রাপ্তম্-উপাশ্ন্ুতে। 

মুক্ত পুরুষ কখনো বিষয়কে দ্বেষ করেন না অথবা বিষয়-লোলুপও হন না। অনাসক্ত মন সহায়ে নিত্য প্রাপ্ত অর্থাৎ প্রাবদ্ধ হেতু প্রাপ্ত  বিষয় ভোগ করে থাকেন। 


অষ্টাদশ শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ 


সমাধান-অসমাধান-হিত-অহিত-বিকল্পনাঃ 

শূন্য চিত্তো ন জানাতি কৈবল্যম-ইব সংস্থিত। 

শুনি চিত্ত।  সমাধান বা অসমাধান,হিত বা অহিত কল্পনা রোহিত চিত্ত। কৈবল্যম অর্থাৎ বিদেহ স্ব-স্বস্থিত। 


ঊনবিংশ শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ 


নির্মমো নিরহঙ্কারো ন কিঞ্চিদ -ইতি নিশ্চিতঃ

অন্তর্গলিত-সর্ব-আশঃ কুর্বন-অপি করোতি ন। 

মমতা রোহিত, অহংকার রোহিত, দৃশ্য প্রপঞ্চ কিছুই সত্য নহে। এইরূপ দৃঢ় নিশ্চয় হয়ে, অন্তরে সর্ব বিষয় আশা পরিত্যাগী পুরুষ, সর্ব কর্ম করেও কিছুই করেন না।


বিংশতম শ্লোক : সপ্তদশ প্রকরণ 


মনঃ প্রকাশ সংমোহ স্বপ্ন-জাড্য-বিবর্জিত 

দশাং কামপি সংপ্রাপ্তো ভবেদ্ গলিত মানসঃ। 

মনের প্রকাশে যে  মোহ  উৎপন্ন হয় ,স্বপ্নে যে কল্পনা সৃষ্টি হয়,  - সমস্ত দশা  রোহিত হয়ে,  সুসুপ্তির অজ্ঞানতা বিহীন তত্ত্বজ্ঞ পুরুষ, নিজেকে প্রাপ্ত হয়ে অনির্বচনীয় কামনারহিত দশা প্রাপ্ত হন।   



সপ্তদশ প্রকরণ সমাপ্ত


অষ্টাদশ প্রকরণ - শান্তিশতকং 

প্রথম শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

যস্য বোধোদয়ে তাবৎ স্বপনবদ্ ভবতি  ভ্রমঃ 
তস্মৈ সুখৈক-রূপায় নমঃ শান্তায় তেজসে। 

যার (যে জ্ঞানের) বোধোদয়ে সমস্ত সংসারভ্ৰম  স্বপ্নবদ মনে হয় সেই সুখ-স্বরূপ, শান্ত অথচ তেজস্বীকে  আমি প্রণাম করি।

দ্বিতীয় শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

অর্জয়িত্বা-অখিলান্-অর্থান্ ভোগান-আপ্নোতি পুষ্কলান্ 
ন হি সর্ব পরিত্যাগম-অস্তরেণ সুখী ভবেৎ। 

অখিল (অ অর্থাৎ নাই ; খিল অর্থাৎ শুন্য ) বা  অন্তসারশুন্য অর্থ অর্জন করে   লোকের   বহুবিধ ভোগই প্রাপ্ত হয়। কিনতু  সর্ব সংকল্প-বিকল্প পরিত্যাগ বিনা কেউই সুখী  হতে পারে না। 

তৃতীয় শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

কর্তব্য-দুঃখ-মার্তণ্ড  জ্বালা-দগ্ধ্-অন্তঃ-আত্মনঃ 
কুতঃ প্রশম-পীযুষ ধারা-অসারম-ঋতে সুখম। 

কর্তব্য জনিত দুঃখরূপ সূর্যের খরতাপ দগ্ধ অন্তর আত্মা কোথায় প্রশমিত হবে ?সংকল্প-বিকল্প রোহিত শান্তির  অমৃত ধারা বর্ষণ বিনা সুখ কি প্রকারে হতে পারে ?  

চতুর্থ শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ    

ভাবঃ-অয়ং ভাবনা-মাত্রো ন কিঞ্চিৎপরমার্থতঃ
নাস্ত্যভাব স্বভাবানাং ভাব-অভাব-বিভাবিনাম্। 

এই ভবসংসার মনের ভাবনা মাত্র। পরামর্থের কিছুমাত্র নয়। ভাব অভাবরূপে অর্থাৎ সৎ অসৎ রূপে স্থিত পদার্থ সমূহের স্বভাবের 
কখনো অন্যথা হয় না। 

পঞ্চম শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 


ন দূরং ন চ সংকোচাৎ-লব্ধম-এব-আত্মনঃ পদম্

নির্বিকল্পং নিরাসয়ং নির্বিকারং নিরঞ্জনম্। 

আত্মার স্বরূপ দূরে নয়। আত্মার স্বরূপ সংকুচিত অর্থাৎ পরিচ্ছন্ন নয়। সর্ব বিকল্প, আয়াস ও বিকাররহিত এই আত্মা নিত্য প্রাপ্ত।


ষষ্ঠ  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ


ব্যামোহ-মাত্র-বিরতৌ স্বরূপ-আদান-মাত্রতঃ

বীতশোকা বিরাজন্তে নিরাবরণ-দৃষ্টয়ঃ।

নিরাভরণ হলেই দেখা যাবে। ব্যামো বা অসুস্থ হলে বিরত বা নিশ্চল হয়ে যাবে। স্বরূপে বিশ্রাম নিলে শোকরহিত অবস্থা বিরাজ করবে। 


সপ্তম শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ


সমস্তং কল্পনা-মাত্রম-আত্মা মুক্তঃ সনাতনঃ

ইতি বিজ্ঞায় ধীর হি কিম-অভ্যস্যতি বালবৎ।  

সমস্ত জগৎ কল্পনা মাত্র। আত্মা মুক্ত ও সনাতন।  এইভাবে জেনে জ্ঞানী পুরুষ বালকের ন্যায় কি অভ্যাস করবে ?( অর্থাৎ তার কিছুই করণীয় থাকে না।)


অষ্টম শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 


আত্মা ব্রহ্মেতি নিশ্চিত্য ভাবাভাবৌ চ কল্পিতৌ

নিষ্কামঃ কিং বিজানাতি কিং ব্রূতে চ করোতি  কিম। 

আত্মাই ব্রহ্ম এটা  নিশ্চিত।  ভাব  অভাব সবই কল্পিত। ফলত কামনাবিহীন স্বরূপের কী বা জানার আছে, কী বা বলার আছে, কী বা করার  আছে ?


নবম শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 


অয়ং সো-অহম-অয়ং নাহমিতি ক্ষীণা বিকল্পনাঃ 

সর্বম আত্মা-ইতি নিশ্চিত্য তুষ্ণীম্-ভূতস্য  যোগিনঃ

আমি সেই, সেই আমি, আমি ক্ষণস্থায়ী বিকল্প নোই। সবই  আমি আত্মা এটা  নিশ্চিত। ভূত তৃষ্ণার যোগানকারী। অর্থাৎ সমস্ত ভূত আমাতেই সৃষ্ট। 


দশম শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 


ন বিক্ষেপো ন চৈকাগ্র্যং নাতি বোধ ন মূঢ়তা 

ন সুখং  ন চ বা দুঃখম-উপশান্তস্য় যোগীনঃ।

না বিক্ষেপ, না ব্যগ্রতা, না বোধ, না মূঢ়তা, না সুখ,না দুঃখ শান্ত-স্বরূপ উপবিষ্ট যোগীন।


একাদশ শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 


স্বারাজ্যে  ভৈক্ষাবৃত্তৌ চ লাভালাভে জনে বনে 

নির্বিকল্প-স্বভাবস্য ন বিশেষো-অস্তি যোগিনঃ। 

যোগী,স্ব-দেশে ভিক্ষাবৃত্তি, বা লাভ-অলাভ তা সে লোকালয়ে বা নির্জনে, সব ক্ষেত্রেই তিনি নির্বিকল্প স্বভাবে স্থিত থাকেন। অবস্থা ভেদের  কোনো বিশেষতঃ থাকে না যোগীর কাছে।


দ্বাদশ শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 


ক্ব ধৰ্মঃ ক্ব চ বা কামঃ ক্ব চ অর্থ ক্ব বিবেকিতা 

ইদং কৃতম-ইদং নেতি দ্বন্দ্বৈ-মুক্তস্য  যোগিনঃ। 

কোথায় ধৰ্ম, কামনাই  বা কোথায়, অর্থই বা কি, কোথায় বিবেক, এইভাবে নেতি  নেতি  করে,  দ্বন্দ্বের উর্ধে উঠে, যোগী বা জ্ঞানী সর্বদা মুক্ত থাকেন। 


ত্রয়োদশ শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ  


কৃত্যং কিমপি ন-এব-অস্তি ন কাপি হৃদি-রঞ্জনা 

যথা জীবনমেবেহ  জীবনমুক্তস্য যোগিনঃ।  

জীবন-মুক্ত জ্ঞানী কী-ই  বা করবে ? কিছুই তো করার নাই। কোনো বিষয়ের প্রতি অনুরাগ নেই। তথাপি জীবন নির্বাহ করবার জন্য সব কাজ-ই  তার হয়ে যাচ্ছে।


চতুর্দশ শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ  


ক্ক মোহঃ ক্ক চ বা বিশ্বং ক্ক তদ্-ধ্যানং ক্ক  মুক্ততা 

সর্ব-সংকল্প সীমায়াং বিশ্রান্তস্য়  মহাত্মনঃ। 

কোথায় মোহ  ? কোথায়ই বা  বিশ্ব ? তার ধ্যানই কোথায় ? তার মুক্তিই বা কি ? সর্ব-সংকল্প-সীমার বাইরে মহাত্মা বিশ্রান্তিপ্রাপ্ত। 


পঞ্চদশ শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 


যেন বিশ্বম-ইদং দৃষ্টং স ন-অস্তি-ইতি করোতু বৈ 

নির্বাসনঃ কিং কুরুতে পশ্যন্-অপি ন পশ্যতি।

এই যে বিশ্ব দেখা যাচ্ছে - এর কোনো অস্তিত্ব নেই। এর কোনো অস্তিত্ব নেই - বার বার এইরূপ জ্ঞান আবৃত্তি করতে থাকো। নির্বাসনঃ অর্থাৎ বাসনা রোহিত মহাত্মা  করেও করেন  না।  দেখেও দেখেন না। 


ষোড়শ শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 


যেন দৃষ্টং পরং ব্রহ্ম স-অহং ব্রহ্মেতি চিন্তয়েৎ 

কিং চিন্তয়তি নিশ্চিন্তো দ্বিতীয়ং যো ন পশ্যতি।

যিনি পরব্রহ্মকে দেখেছেন, সে আমি ব্রহ্ম এই  চিন্তা করতে পারে। যিনি কোনো  দ্বিতীয় বস্তূই দর্শন করেন না, সে আবার কি চিন্তা করবে ? 


সপ্তদশ শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 


দৃষ্টো যেন-আত্ম-বিক্ষেপো নিরোধং ত্বসৌ 

উদারস্তূ ন বিক্ষিপ্ত সাধ্য-অভাবাৎ করোতি কিম্।

যে, চিত্তে নিজের বিক্ষেপ দর্শন করে, সে চিত্ত নিরোধের প্রয়াস করুক। উদার পুরুষের কোনো বিক্ষেপ নেই। সুতারং বিক্ষেপ নিবৃত্তিরূপ সাধ্যের অভাববশতঃ তিনি চিত্তনিরোধ-কার্য কেন করবেন ?  


অষ্টাদশ শ্লোক  : অষ্টাদশ প্রকরণ 


ধীরো লোক-বিপর্যস্তো বর্তমান-অপি লোকবৎ 

ন সমাধিং ন বিক্ষেপং ন লেপং স্বস্য পশ্যতি।      

ধীর অর্থাৎ সর্ববিক্ষেপ রোহিত পুরুষ বিপর্যস্থ হয়ে অর্থাৎ প্রারব্ধ বসে সাধারণের ন্যায় বিদ্যমান থাকলেও, তিনি নিজের  মধ্যে কখনো সমাধি অথবা উল্টোটা অর্থাৎ বিক্ষেপ অথবা তৎকৃত কোনো লেপ অর্থাৎ আবরণ দর্শন করেন না।


ঊনবিংশ শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 


ভাব-অভাব-বিহীনো যস্ত্ৃপ্তো নির্বাসনো বুধঃ 

নৈব কিঞ্চিৎ কৃতং  তেন লোকদৃষ্ট্যা বি-কুর্বতা। 

যে বুদ্ধিমান, ভাব-অভাব বিহীন, বাসনাবিহীন, সর্বদা তৃপ্ত  তার আবার কি করার আছে ? লোকদৃষ্টিতে তাকে কর্মানুষ্ঠানরত বলে মনে হয় মাত্র ।  


বিংশ শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 


প্রবৃত্তৌ বা নিবৃত্তৌ বা নৈব ধীরস্য দুর্গ্রহঃ 

যদা যৎ কর্তুম-আয়াতি তৎ-কৃত্বা তিষ্ঠতঃ সুখম্। 

 যখন যেমন  কর্তব্য বা কর্ম আসে,তা অনুষ্ঠান করে তিনি সুখে অবস্থান করেন। প্রবৃত্তি বা নিবৃত্তিতে কোনো দুরাগ্রহ অর্থাৎ কর্তৃত্ত্ব-অভিমান  থাকে না। 


একবিংশ শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ  


নির্বাসনো নিরালম্বঃ স্বচ্ছন্দো মুক্তবন্ধনঃ

ক্ষিপ্তঃসংস্কার-বাতেন চেষ্টতে শুস্কপর্ণবৎ। 

বাসনারাহীতঅবলম্বনহীন, স্বচ্ছন্দ, বন্ধন-মুক্ত, সংস্কাররূপ বায়ু দ্বারা প্রেরিত শুস্কপত্রের ন্যায়, কর্ম প্রচেষ্টা করে থাকেন। 


দ্বাবিংশ শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ  


অসংসারস্য তু  ক্কাপি ন হর্ষো ন বিষাদতা

স শীতলমনা নিত্যং বিদেহ ইব রাজতে।

সংসার-রোহিত পুরুষের কোথায় হর্ষ, না আছে বিষাদ। তিনি শান্ত চিত্ত।  তিনি নিত্য বিদেহমুক্তের ন্যায় কাজ করেন। 


ত্রয়ঃবিংশ শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ  


কুত্রাপি ন জিহাস-অস্তি নাশো বাপি  ন কুত্রচিৎ

আত্মারামস্য ধীরস্য শীতল-অচ্ছতর-আত্মনঃ। 

আত্মারামের,  ধীর, শান্ত, নির্মল অন্তঃকরন।  না আছে গ্রহণ ইচ্ছা, না আছে ত্যাগের ইচ্ছা। 


চতুর্বিংশ শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 


প্রকৃত্যা শূন্য-চিত্তস্য কুর্বত-অস্য যদৃচ্ছয়া 

প্রাকৃতস্য-এব ধীরস্য ন মানো ন-অবমানতা। 

প্রকৃতপক্ষে তিনি শূন্য চিত্ত। এই ধীর পুরুষ প্রাকৃতিক কারণে যা-তাই করুন না কেন, তার না আছে ম্যান, না আছে অপমান। 


পঞ্চবিংশতি শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ


কৃতং দেহেন কর্মেদং ন ময়া শুদ্ধরূপিণা

ইতি চিন্তা-অণুরোধী যঃ কুর্বন্নপি করোতি ন। 

দেহেরই কর্ম।  শুদ্ধরূপ আমা দ্বারা কখনো কৃত নহে। এইরূপ চিন্তার আশ্রয়ে যিনি আছেন, তিনি করেও কিছু করেন না। 


ষষ্ঠবিংশতি শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 


অ-তদ্-বাদী-ইব কুরুতে ন ভবেদপি  বালিশঃ 

জীবন্ম্ুক্তঃ সুখী শ্রীমান্ সংসরন্নপি শোভতে।      
        
 "আমি এ সব করবো " না বলেও জীবন-মুক্ত কর্ম করেন, তথাপি তিনি  বালিশঃ অর্থাৎ  মূর্খ  নন।  সংসারে থাকলেও তিনি সুখী হিসেবে শোভা পান।

সপ্তবিংশতি শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 


নানাবিচার সুশ্রান্তো ধীরো বিশ্রান্তিম-আগতঃ

ন কল্পতে ন জানাতি ন শৃণোতি ন পশ্যতি। 

নানা বিচারেও  তিনি শান্ত, ধীর, এবং বিশ্রামেই সমাগত থাকেন। 

তিনি না করেন কল্পনা, না তার জানা,শোনা, দেখা আছে। 

অষ্টবিংশতি শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 


অসমাধেঃ-বিক্ষেপান্ন মুমুক্ষুর্ন চেতরঃ

নিশ্চিত্য কল্পিতং পশ্যন্ ব্রহ্ম-এব-আস্তে মহাশয়ঃ। 

সমাধি করেন না বলে জ্ঞানী মুমুক্ষু নয়। বিক্ষেপ-রোহিত অর্থাৎ দ্বৈতভ্ৰমরাহিত্যবশতঃ তিনি বন্ধ নন। নির্বিকার চিত্ত সেই জ্ঞানী সাদৃশ্য কল্পিত, মিথ্যা এইরূপ নিশ্চিন্ত রূপে জেনেও ব্যাধিতানুবৃত্তি বলে, তা কেবল দর্শন করেন মাত্র। তিনি কিনতু সদা ব্রহ্মেই স্থিত থাকেন।          


ঊনত্রিংশতি শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ


যস্য-অন্তঃ স্যাৎ-অহংকারো ন করোতি  সঃ
নিরহঙ্কার ধীরেণ ন কিঞ্চিদ-কৃতং কৃতম্। 

যার অন্তঃকরণে অহঙ্কার সে বাহ্যত কিছু না করলেও কর্তৃত্বাভিমান  বশতঃ সঙ্কল্পদি করে থাকেন। অহংকারহীন ব্যক্তি লোক দৃষ্টিতে কর্মা করলেও বস্তূত তিনি কিছুই করেন না। 

ত্রিংশতি শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

ন-উদ্বিগ্নং ন চ সন্ত্ুষ্টম -অকর্তৃ স্পন্দ-বর্জিতম্
নিরাশং গত-সন্দেহং চিত্তং মুক্তস্য রাজতে। 

জ্ঞানীর চিত্ত উদ্বিগ্ন নয়। আবার সন্তোষরোহিত, কর্তৃত্ত্ব- অভিমান শূন্য, স্পন্দন-বর্জিত, সর্ব-আশা বর্জিত, সর্ব সন্দেহ বিরহিত।  চিত্ত তাহার মুক্তিতে রাজত্য করে।    
       
এক-ত্রিংশতি শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

নির্ধ্যাতুং চেষ্টিতুং বা-অপি যচ্চিত্তং  ন প্রবর্ততে 

নির্নিমিত্তমিদং কিনতু নির্ধ্য়ায়তি বিচেষ্টতে ।

জ্ঞানীর যে চিত্ত, তা  নিশ্চেষ্ট ভাব অবলম্বন করে অবস্থান করে; যা  কোনো নিমিত্তেই সচেষ্ট হয় না, কিনতু নিশ্চল ভাবে অবস্থান করে। কোনো নিমিত্ত ব্যতিরেকেই সচেষ্ট থাকে। 


দ্বি- ত্রিংশতি শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ


তত্ত্বং যথার্থম-আকর্ন্য মন্দঃ প্রাপ্নোতি মূঢ়তাম্ 

অথবা যাতি সঙ্কোচমমূঢ় কঃ-অপি মূঢ়বৎ।

মন্দবুদ্ধি ব্যক্তিগণ তৎ এবং ত্বং (
তত্ত্বং) অর্থাৎ তিনিই  তুমি, এই অভিন্নতার কথা শুনেও অসম্ভব বা বিপরীত ভাবনারূপ দ্বন্দ্বে বিমূঢ় হয়ে পড়ে।  অথবা সংকোচ বশতঃ মূঢ়ের মত ব্যবহার করে
।   


ত্রি ত্রিংশতি শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ


একাগ্রতা নিরোধো বা মূঢ়ৈ-অভ্য়স্যতে ভূশম 
ধীরাঃ কৃত্যং ন পশ্যন্তি সুপ্তবৎ  স্বপদে স্থিতাঃ। 

একাগ্রতা ও নিরোধ মূঢ়গন অভ্যাস করে থাকে।  ধীর ব্যক্তিগণ  
এসব কিছুই করেন না।  তিনি সদা স্বরূপে স্থিত হয়ে সুসুপ্তিতে অবস্থান করেন। 

চতুর্ত্রিংশতি শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ

অপ্রযত্নাৎ প্রযত্নাৎ-বা মূঢ়ো নাপ্নোতি নির্বৃতিম 
তত্ত্ব-নিশ্চয়-মাত্রেণ প্রাজ্ঞো ভবতি নির্বৃতঃ। 

যত্নের দ্বারাই হোক আর যত্নের অভাবেই হোক, মূঢ় কখনো নিবৃত্তির পথে যেতে পারে না। কিন্তু প্রাজ্ঞ ব্যক্তি তত্ব নিশ্চয় জেনে সদা নিবৃত্ত থাকেন। 


পঞ্চ-ত্রিংশতি শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 


শুদ্ধ বুদ্ধং প্রিয়ং পুর্ণং নিষ্প্রপঞ্চং নিরাময়ম্

আত্মানং তং জানন্তি তত্রা-অভ্যাসপরা জনাঃ।

শুদ্ধ অর্থাৎ মায়ামলাতীত, বুদ্ধ অর্থাৎ স্বপ্রকাশ,প্রিয় অর্থাৎ সুখ স্বরূপ,পূর্ণ অর্থাৎ নিষ্প্রপঞ্চ এবং নিরাময় অর্থাৎ দুখঃ  সম্মন্ধ রহিত  আত্মাকে, সে-ই  (জ্ঞানী)  জানে, অভ্যাস দ্বারা একে  জানা জয় না।    
ষষ্ঠ-ত্রিংশতি শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ

নাপ্নোতি কর্মণা মোক্ষ্যাং বিমূঢ়-অভ্যাসরূপিণা
ধন্যো বিজ্ঞান-মাত্রেণ মুক্তঃ-তিষ্ঠতি -অবিক্রিয়ঃ। 

বিমূঢ় ব্যক্তির (যোগ) অভ্যাসরূপ কর্মের দ্বারা মোক্ষ লাভ হয় না। ধন্য সেই ব্যক্তি যিনি এই সব অভ্যাসের কাছে বিক্রি না হয়ে বিশেষ-জ্ঞান লাভের  দ্বারা নিজেকে মুক্ত করে,  অবস্থান করছেন। 

সপ্ত-ত্রিংশতি শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ

মূঢ়ো নাপ্নোতি তদ্-ব্রহ্ম যতো ভবিতুম ইচ্ছতি 

অনিচ্ছন্-অপি ধীরো হয় পরব্রহ্ম-স্বরূপভাক্। 

মূঢ় অর্থাৎ অজ্ঞানী সেই  ব্রহ্মকে ইচ্ছেমতো দেখতে চায়। কিনতু  পায়  না। ধীর-জ্ঞানী ইচ্ছা-রোহিত হওয়ায়,  পর-ব্রহ্ম তার কাছে  স্বরূপে প্রতিভাত হয়। 


অষ্ট-ত্রিংশতি শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ  

   
নিরাধারা গ্রহব্যগ্রা মূঢ়া সংসার-পোষকাঃ
এতস্য-অনর্থমূলস্য মূলোচ্ছেদঃ কৃত বুধৈঃ। 

চিত্ত নিরোধের দ্বারা মোক্ষ লাভে ব্যগ্র মুঢ়গন সংসারেরই পরিপোষণ করে থাকে। জ্ঞানীগণ অনর্থের মূল এই সংসারের মূলোচ্ছেদ করে থাকে। 

ঊনচত্বারিংশতি  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

ন শান্তিং লভতে মূঢ়ো যতঃ শমিতুম-ইচ্ছতি 
ধীরস্ত্ত্ত্বং বিনিশ্চিত্য সর্বদা শান্তমানসঃ। 

মূঢ় যতই শান্তি লাভের ইচ্ছা করুক না কেন, সে  কখনো শান্তি লাভ করতে পারে না। কিনতু  ধীর ব্যক্তি, তত্ত্বেই স্থিত থাকে, তাই না চাইলেও, স্বভাবতই শান্তিমানস হয়ে সর্বাবস্থায় বিরাজ করেন। 

চত্বারিংশতি  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

ক্কাত্মনো  দর্শনং তস্য যদ্-দৃষ্টম-অবলম্বতে 
ধীরাস্তং  তং  ন পশ্যন্তি পশ্যন্তি-আত্মানম-অব্য়য়ম। 

এই দৃশ্যমান জগৎকে অবলম্বন  করে কে  আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারে ? ধীর ব্যক্তিগণ এসব দেখতে পান না। কেবল অব্যয় আত্মাকেই দেখতে পান। 

এক-চত্বারিংশতি শ্লোক অষ্টাদশ প্রকরণ 

ক্ক নিরোধো বিমূঢ়স্য যো নির্বন্ধং করোতি  বৈ
স্বারামস্য-এব  ধীরস্য সর্বদা-অসৌ-অকৃত্রিমঃ। 

যে মূঢ় নির্বন্ধ করে, তার  নিরোধ  কোথায় ?  আত্মারাম জ্ঞানী সর্বদা অকৃত্রিম নিরোধেই অবস্থান করে। 

দ্বি-চত্বারিংশতি শ্লোক অষ্টাদশ প্রকরণ 

ভাবস্য ভাবকঃ ক্কশ্চিন্ন কিঞ্চিৎ-ভাবক-অপরঃ 

উভয়াভাবকঃ কশ্চিৎ-এবম-এব নিরাকুলঃ। 

ভাবুকের ভাব আছে। অভাবুকের ভাব নেই। আত্মানুভবের ভাবও  নেই অভাবও নেই, সদা নিরুদ্বেগ থাকেন।


ত্রি-
চত্বারিংশতি শ্লোক অষ্টাদশ প্রকরণ

শুদ্ধম-অদ্বয়ং-আত্মানং ভাবয়ন্তি কুবুদ্ধয়ঃ

ন তু জানন্তি সংমোহাৎ-যাবৎ-জীবম -অনির্বৃতাঃ।

অজ্ঞানীগন,  শুদ্ধ এবং অদ্বয় আত্মাকে চিন্তা করে সত্য, কিনতু মোহ বশতঃ তাকে অনাবৃত দেখতে পায় না।  


চতুর্থ-চত্বারিংশতি শ্লোক অষ্টাদশ প্রকরণ

মুমুক্ষো-বুদ্ধি-আলম্বম-অন্তরেণ ন বিদ্যতে 

নিরালম্বৈব  নিষ্কামা বুদ্ধিঃ-মুক্তস্য সর্বদা। 

মুমুক্ষ ব্যক্তির  বুদ্ধি অন্তরকে  অবলম্বন না করে থাকতে পারে না। নিষ্কাম ব্যক্তির বুদ্ধি অবলম্বনহীন এবং সর্বদাই মুক্ত।


পঞ্চম -
চত্বারিংশতি শ্লোক অষ্টাদশ প্রকরণ

বিষয়-দ্বীপিন বীক্ষ্য চকিতাঃশরণার্থিনঃ 

বিশন্তি ঝটিতি ক্রোড়ং নিরোধ-একাগ্র-সিদ্ধয়ে। 

বিষয়রূপ বাঘ দর্শন করে, মূঢ় ব্যক্তিগণ আত্মাকে রক্ষা  করবার জন্য চটজলদি  চিত্তনিরোধের কোলে আশ্রয় নেয়। (জ্ঞানীগণ এই রূপ করেন না। ) 

   
ষষ্ঠ -চত্বারিংশতি শ্লোক অষ্টাদশ প্রকরণ

নির্বাসনং হরিং দৃষ্ট্বা তূষ্ণীং বিষয়-দন্তিনঃ 

পলায়ান্তে ন শক্তাস্তে সেবন্তে  কৃতচাটবঃ। 

নির্বাসনা অর্থাৎ বাসনাহীন হয়েছেন এইরূপ পুরুষ সিংহকে দেখে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়রূপ হস্তিসমূহ, পালাতে থাকে। অথবা সেই বাসনাহীন পুরুষসিংহকে চাটুকারীদের মতো সেবা করে।  


 সপ্ত-
চত্বারিংশতি শ্লোক অষ্টাদশ প্রকরণ

ন মুক্তি কারিকাং ধত্তে নিঃশঙ্কো যুক্তমানসঃ

পশ্যন্ শৃন্বন স্পৃশন জিঘ্রন-অশ্নন-আস্তে  যথাসুখম। 

নিঃশঙ্কোচ অর্থাৎ নিশ্চল জ্ঞানী মুক্তিকারক কোনো কাজ করেন না। দেখা, শোনা, স্পর্শ করা, ঘ্রান গ্রহণ, ও ভোজন করে যথাসুখে অবস্থান করেন। 


অষ্ট-চত্বারিংশতি শ্লোক
 অষ্টাদশ প্রকরণ


বস্তূ-শ্রবণ-মাত্রেণ শুদ্ধ-বুদ্ধিঃ নিরাকুলঃ 

নৈব-আচরম-অনাচারম-ঔদাস্যং বা প্রপশ্যতি। 

বস্তূ (চিৎস্বরূপ আত্মা) - এর কথা শোনা মাত্র নিরাকুল, শুদ্ধবুদ্ধি হন। এর না আছে কোনো আচার না আছে কোনো অনাচার।  সর্বদা উদাসীনতাই দেখা যায়। 


ঊনপঞ্চরিংশতি   শ্লোক
 অষ্টাদশ প্রকরণ


যদা যৎকর্তুম-আয়াতি তদা তৎ-কুরুতে  ঋজুঃ

শুভম বাপ্যশুভং ব্যাপী তস্য চেষ্টা হি বালবৎ।

যখন যেমন কর্তব্য, তা সে শুভ বা অশুভ যাই হোক না কেন,

তিনি সরল বালকের মতো তাই অনুষ্ঠান করেন। 

পঞ্চরিংশতি   শ্লোক
 অষ্টাদশ প্রকরণ


স্বাতন্ত্র্যাৎ সুখম-আপ্নোতি স্বাতন্ত্র্যাৎ-লভতে  পরম 

স্বাতন্ত্র্যাৎ-নির্বিৃতিং গচ্ছেৎ স্বাতন্ত্র্যাৎ পরমং পদম্। 

স্বতন্ত্র পুরুষ সুখে থাকেন, স্বতন্ত্র পুরুষ পরম জ্ঞান লাভ করেন। 

স্বতন্ত্র পুরুষই বৃত্তিহীন গমন করেন। স্বতন্ত্র পুরুষই পরম পদ লাভ করেন। 
এক পঞ্চরিংশতি   শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ

অকর্তৃত্বং অভোর্তৃত্বং স্বত্মনো মন্যতে যদা 

তদা ক্ষীণা ভবন্ত্যেব সমস্তাঃ-চিত্ত বৃত্তয়ঃ। 

যখনি স্বচিত্তে অকর্তৃত্তের ও  অভোক্ত্ৃত্বের বোধ দৃঢ় হয়, সেই ক্ষণেই সমস্ত চিত্ত বৃত্তি সমূহ ক্ষয় প্রাপ্ত হয়। 


 দ্বি - পঞ্চরিংশতি   শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ  

উশৃঙ্খলা-অপি-অকৃতিকা স্থিতিঃ-ধীরস্য রাজতে 

ন তু সস্পৃহ-চিত্তস্য শান্তিঃ-মূঢ়স্য কৃত্ৰিমা। 

ধীর ব্যক্তি উশৃঙ্খল আচরণ করলেও অকৃত্তিম অবস্থায় স্থিত থাকেন। কিনতু মূঢ় ব্যক্তি কৃত্তিম ভাবে চিত্তকে স্থির রেখেও শান্তিতে থাকেন না। 


ত্রি  -
 পঞ্চরিংশতি   শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

বিলসন্তি মহাভাগৈঃ-বিশন্তি গিরি-গহ্বরান্  

নিরস্ত-কল্পনা ধীরা অবদ্ধা মুক্ত-বুদ্ধয়ঃ। 

বন্ধনমুক্ত ধীর পুরুষ কখনো ভোগ-ঐশ্বর্য বিলাসে  থাকেন, কখনো বা  গিরিগুহায় বন্ধনহীন নির্জনে  অবস্থান করেন। তিনি নিত্য মুক্ত।


 চতুর   -
 পঞ্চরিংশতি   শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

শোত্রিয়ং দেবতাং তীর্থম-অঙ্গনাং ভূপতিং প্রিয়ম্

দৃষ্ট্বা সম্পূজ্য ধীরস্য ন কাপি হৃদি বাসনা। 

শ্রূতিধর বা বেদবিদ, দেবতা, তীর্থাঙ্গম, ভূপতিদের দেখে অথবা তাদের দ্বারা পূজিত হয়েও জ্ঞানীর হৃদয়ে কোনো বাসনা জাগে না। 


 পঞ্চ - পঞ্চরিংশতি   শ্লোক :  অষ্টাদশ প্রকরণ 


ভৃৃত্যৈঃ পুত্রৈঃ কলত্রৈশ্চ দৌহিত্রৈঃ-চ -অপি গোত্রজৈঃ

বিহস্য ধিকৃতো যোগী ন যাতি বিকৃতিং মনাক্। 

ভৃত্যগণ, পুত্রগণ, স্ত্রীগণ, কন্যাগন, অথবা স্বগোত্রীয় দ্বারা ধিকৃত বা নিন্দা শুনেও যোগীর চিত্তে কোনো বিকৃতি দেখা যায়  না। 


 ষষ্ঠ  - পঞ্চরিংশতি   শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

সন্ত্ুষ্ট অপি  ন  সন্ত্ুষ্ট  খিন্নঃ অপি ন চ খিদ্যতে 
তস্য-আশ্চর্য-দশাং তাং তাং তাদৃশা এব জানতে। 

জ্ঞানীপুরুষ আমাদের দৃষ্টিতে সন্তুষ্ট মনে হলেও তিনি সন্তুষ্ট নন।  আমাদের দৃষ্টিতে খেদযুক্ত বা দুঃখিত মনে হলেও, আসলে তিনি এসবের অতীত। তার (জ্ঞানীর) এই আশ্চর্যজনক অবস্থার কথা, তার মতো জ্ঞানীগণই জানতে পারে। 

 সপ্ত - পঞ্চরিংশতি   শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ

কর্তব্যতা-এব  সংসারো ন তাং  পশ্যন্তি সূরয়ঃ 
শূন্যকারা নিরাকারা নির্বিকারা নিরাময়ঃ। 

কর্তাব্যের সংকল্পই  এই সংসারের হেতু। জ্ঞানীগণ কর্তব্যের সংকল্প করেন না। এই জন্য তারা শূন্যকার, নিরাকার, নির্বিকার,এবং নিরাময়।

 অষ্ট  - পঞ্চরিংশতি   শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

অৰ্কুবন-অপি সংক্ষোভাৎ-ব্যগ্রঃ সর্বত্র মূঢ়ধীঃ
কুর্বন-অপি তু  কৃত্যানি কুশলো হি নিরাকুলঃ। 

মূঢ় ব্যক্তি সর্বত্র কর্ম না করেও ব্যগ্র, অর্থাৎ চঞ্চল চিত্ত। কিনতু লোকদৃষ্টিতে কর্তব্যকর্মরত অবস্থাতেও কুশল অর্থাৎ জ্ঞানী ব্যক্তি আকুলতা-হীন,  নিশ্চল চিত্ত থাকেন।

  ঊন -ষষ্ঠরিংশতি  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

সুখম-আস্তে সুখং শেতে সুখম-আয়াতি যাতি চ  

সুখং ব্যক্তি সুখং ভুঙক্তে ব্যবহারে-অপি শান্তধীঃ। 

শান্তধী অর্থাৎ আত্মনিষ্ঠ ব্যক্তি সর্বদা সুখে অবস্থান করেন।  শয়ন, গমনা - গমন,  কথোপথন , ভোজন, প্রভৃতি ব্যাপারাদি সুখেই করে থাকেন। 


ষষ্ঠ
রিংশতি  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

স্বভাবাদ্যস্য ন-এব-আর্তি-লোকবৎ ব্যবহারিণঃ

মহাহ্রদ ইবাক্ষোভ্যো গতক্লেশঃ সুশোভতে। 

সাধারণ লোকের মতো ব্যবহারকারী জ্ঞানী নিত্যানন্দ অন্যদের ন্যায় খেদ প্রাপ্ত হন না। তিনি গতক্লেশ ক্ষোভ-রহিত মহাহ্রদের ন্যায় শোভায়মান  হন।


       

এক-ষষ্ঠরিংশতি  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

নিবৃত্তিরপি মূঢ়স্য প্রবৃত্তিরূপজায়তে 

প্রবৃত্তিরপি  ধীরস্য নিবৃত্তিফলভাগিনী। 

মূঢ় ব্যক্তির (অহংকার-আদির) নিবৃত্তি না হওয়ায় তা প্রবৃত্তি রূপেই বিদ্যমান থাকে। ধীর ব্যক্তির প্রবৃত্তি নিবৃত্তির ফল প্রদান করে। 


দ্বি-ষষ্ঠ
রিংশতি  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

পরিগ্রহেষু বৈরাগ্যং প্রায়ো মূঢ়স্য দৃশ্যতে 

দেহে বিগলিতাশস্য ক্ব রাগঃ ক্ব বিরাগতা। 

মূঢ় ব্যক্তির অর্থাৎ দেহাভিমানীর, দেহের প্রয়োজনে পরিগৃহীত ধন-গৃহাদির  প্রতি বৈরাগ্য দৃষ্ট হয়। কিনতু দেহাভিমান যায় না। অন্যদিকে দেহের প্রতি যিনি আসক্তিহীন, সেই জ্ঞানীর কি বা রাগ, কি বা বিরাগ ?


 ত্রি -ষষ্ঠ
রিংশতি  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

ভাবনা-অভাবনাসক্তা দৃষ্টি-মূঢ়স্য সর্বদা 

ভাব্য-ভাবনয়া  সা  তু  স্বস্থস্য-অদৃষ্টিরূপিণী। 

মূঢ় ব্যক্তির দৃষ্টি সর্বদা ভাবনা বা অভাবনা-তে নিবদ্ধ। অর্থাৎ আমি চিন্তা করছি বা আমি চিন্তা করছি না। স্বস্থ অর্থাৎ যিনি নিজেতেই স্থিত, তার ভাবা বা  না-ভাবাতে  কোনো দৃষ্টি নেই।  তিনি অদৃষ্টিরূপী। 


চতুর  -ষষ্ঠ
রিংশতি  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

সর্বারম্ভেষু নিষ্কামো যশ্চরেদ্বালবঃ-মুনিঃ

ন লেপস্তস্য শুদ্ধস্য ক্রিয়মানে-অপি কর্মণি।

শিশুর ন্যায় নিষ্কাম মুনি  ব্যক্তি  সব কাজ-ই করেন কিনতু শুদ্ধ কর্ম রূপায়ণে তার কর্তৃত্বরূপ লেপন থাকে না। 


পঞ্চ-ষষ্ঠ
রিংশতি  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

স এব ধন্য আত্মজ্ঞঃ সর্বভাবেষু  যঃ সমঃ 

পশ্যন্ শৃন্বন স্পৃশন্ জিঘ্রন্-অশ্নন্-নিস্তর্ষমানসঃ। 

তিনিই ধন্য, যে আত্মজ্ঞানী সর্ব ভাবেই  সাম্যাবস্থায় থাকেন। দেখা, শোনা, স্পর্শ করা, ঘ্রান গ্রহণ করা, ভোজন করা, সব অবস্থাতেই যিনি সমভাবাপন্ন ।  


ষষ্ঠ -ষষ্ঠ
রিংশতি  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ

ক্ব সংসারঃ ক্ব চ-আভাস ক্ব সাধ্যং ক্ব চ সাধনম্

আকাশস্য-ইব ধীরস্য নির্বিকল্পস্য সর্বদা।    

আকাশের মতো ধীর, নির্বিকল্প সর্বদা। তার কাছে কিসের ই বা সংসার, অভ্যাস অর্থাৎ প্রতিভাসিত রুপই বা কোথায় ? সাধ্যই বা কি, অর্থাৎ কিসের চেষ্টা ? কিসেরই বা সাধনা ?


সপ্ত  -ষষ্ঠ
রিংশতি  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ

স জয়ত্যর্থসংন্যাসী পূর্ণ-স্বরস-বিগ্রহঃ
অকৃত্তিম-অনবচ্ছিন্নে সমাধির্যস্য বর্ততে। 

পূর্ণ রস বিগ্রহ সেই অর্থ-সন্যাসীর জয় হোক। যিনি অকৃত্তিম, অনবিচ্ছিন্ন সমাধিতে রত আছেন।  

অষ্ট -ষষ্ঠরিংশতি  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ

বহুনাত্র কিমুক্তেন জ্ঞাততত্ত্বো মহাশয়ঃ
ভোগ-মোক্ষ-নিরাকাঙ্খী সদা সর্বত্র নীরসঃ। 

আত্মজ্ঞানী ও মহাশয় সম্পর্কে বেশি কিছু কি আর বলার
আছে ? ভোগ, মোক্ষ, নিরাকাঙ্ক্ষী সদা সর্বদা  নিরনুরাগী।

ঊন-সপ্ত-রিংশতি  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ

মহদাদি জগৎ-দ্বৈতং নামমাত্র-বিজৃম্ভিতম 

বিহায় শুদ্ধ-বোধস্য কিং কৃত্যম-অবশিষ্যতে। 

আদি মহৎ-এর দ্বিতীয় রূপ জগৎ নাম মাত্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রতিভাত হচ্ছে। এতে শুদ্ধ বোধের কী অবস্থিতি আছে ?


 সপ্ত-রিংশতি  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ

ভ্রম-ভূতম -ইদং সর্বং কিঞ্চিৎ-ন-অস্তি-ইতি নিশ্চয়ী 

অলক্ষ্য-স্ফ্ূরণঃ শুদ্ধঃ স্বভাবে-নৈব শাম্যতি। 

ইদং অর্থাৎ এই জগৎ সবই ভ্রম, কল্পিত।  এর কোনো অস্তিত্ব নেই।এটা নিশ্চিত। শুদ্ধ স্বভাবের মধ্যে এই স্ফ্ূরণ লক্ষ্য করা যায়  না।

     
এক - সপ্ত-রিংশতি  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ

শুদ্ধ-স্ফ্ূরণ-রূপস্য দৃশ্য-ভাবম-পশ্যতঃ

ক্ব বিধিঃ ক্ব চ বৈরাগ্যং ক্ব ত্যাগঃ ক্ব শমঃ-অপি বা। 

যে শুদ্ধ ব্যক্তি এই স্ফ্ূরণ রূপকে ছবির মতো দেখেন, তার কিসের জন্য বিধি-বিধান প্রয়োজন ? কোন্ বিষয়েই  বা তার বৈরাগ্য প্রয়োজন ? কিই বা তিনি ত্যাগ করবেন ? তার কিসেরই বা 

উপশম  ? 

দ্বি - সপ্ত-
রিংশতি  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ

স্ফ্ূরতো-অনন্ত-রূপেণ প্রকৃতিং চ ন পশ্যতঃ 

ক্ব বন্ধঃ ক্ব চ বা মোক্ষঃ ক্ব হর্ষঃ ক্ব বিষাদিতা। 

অনন্ত রূপের   স্ফ্ূরণ এই  প্রকৃতি যার নিকট প্রতিভাত হচ্ছে না অর্থাৎ যিনি  এ সব কিছুই দেখছেন না, তার নিকট কিসের বন্ধন, কিসের-ই বা মোক্ষ, কিসের-ই বা হর্ষ, কিসের-ই  বা বিষাদ ?

ত্রি - সপ্ত-
রিংশতি  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ

বুদ্ধি-পর্যন্ত-সংসারে মায়া-মাত্রং বিবর্ততে 

নির্মমো নিরহঙ্কারো নিষ্কামঃ শোভতে বুধঃ। 

বুদ্ধিতে  আত্ম-জ্ঞান হলে  এই সংসার মায়ামাত্র, বিবর্তরূপে  প্রতিভাত হয়। কিনতু বুদ্ধের মধ্যে, নির্মম, নিরহঙ্কার, নিষ্কাম শোভা  পায়। 


চতুর- সপ্ত-
রিংশতি  শ্লোক : অষ্টাদশ প্রকরণ 

অক্ষয়ং গত-সন্তাপম-আত্মানং পশ্যতো মুনেঃ

ক্ব বিদ্যা চ ক্ব বা বিশ্বং ক্ব দেহো-অহং মমেতি বা। 

অক্ষয়ং অর্থাৎ অবিনাশী সন্তাপহীন আত্মাকেই মুনি দেখে থাকেন। কিসের বিদ্যা, কোথায় বা বিশ্ব কোথায় বা এই দেহ - আমি ভাবেরও কোনো অস্তিত্ব নেই। 


পঞ্চ-সপ্ত-
রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ 

নিরোধাদীনি কর্মাণি জহাতি জড়ধীর্যদি

মনোরথান্ প্রলাপাংশ্চ কর্তুম-আপ্নোতি-অতৎক্ষনাৎ। 

স্বাস-প্রশ্বাস নিরোধ কর্ম ত্যাগ করলেও জড়-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি তার মনোরথ পূরণে সচেষ্ট হয়।  এই মূঢ় ব্যক্তির চিত্ত নিরোধাদি কর্মও ব্যর্থ হয়।  


ষষ্ঠ-সপ্ত-
রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ  

মন্দঃ শ্রূত্বাপি তদ্-বস্তূ ন জহাতি  বিমূঢ়তাম 

নির্বিকল্প বহির্যত্নাৎ-অন্তর্বিষয়-লালসঃ। 

বিমূঢ় ব্যক্তি আত্মতত্ব বিষয়ে শ্রবন করেও মলিন চিত্ততা হেতু নিজের মূঢ়তাকে ত্যাগ করে না। বহির্দৃষ্টিতে নির্বিকল্প হলেও অন্তরে লালসা বিদ্যমান থাকে। 


 সপ্তম-সপ্ত-
রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ  

জ্ঞানাৎ-গলিত-কর্মা  যো লোক-দৃষ্ট্যাপি  কর্মকৃৎ 

নাপ্নোতি-অবসরং কর্তুং বক্ত্ুমেব ন কিঞ্চন।

জ্ঞানে যার কর্মক্ষয় হয়েছে, তিনি লোক দৃষ্টিতে কর্মরত হলেও, "আমি কর্ম করছি" এইরূপ বলবার অবসর পান না।


অষ্ট-সপ্ত-
রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ

ক্ব তমঃ ক্ব প্রকাশো বা হানং ক্ব চ ন কিঞ্চন 

নির্বিকারস্য ধীরস্য নিরাতঙ্কস্য সর্বদা। 

 নির্বিকার, ধীর বা জ্ঞানী, নিরাতঙ্ক  ব্যক্তির কাছে অন্ধকার বা প্রকাশ অর্থাৎ আলোর অস্তিত্ব নেই। তার ত্যাগ-ও নেই, গ্রহণ-ও নেই। 


ঊন-অষ্ট-
রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ 

ক্ব ধৈর্যং ক্ব বিবেকীত্বং ক্ব  নিরাতঙ্কতা-অপি বা 

অনির্বাচ্য-স্বভাবস্য নিঃস্বভাবস্য যোগিনঃ।   

যোগীর স্বভাব নিঃস্ব-ভাব, অনির্বাচ্য। এইরূপ জ্ঞানীর পক্ষে ধৈর্য, বিবেকিত্ব, ভয়শুন্যতা ইত্যাদির অস্তিত্ব কোথায় ? 


অষ্ট-
রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ

ন স্বর্গো নৈব নরকো জীবন-মুক্তিঃ-ন চৈব হি 

বহুনাত্র কিম-উক্তেন যোগদৃষ্ট্যা ন কিঞ্চন।

জ্ঞানীর নিকট স্বর্গ নরকের অস্তিত্ব নেই।  জীবন-মুক্তিও নেই। অধিক কি, তাঁর কাছে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই।   

           
এক-অষ্ট-রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ

নৈব প্রার্থয়তে লাভং ন-অলাভেন-অনুশোচতি 

ধীরস্য শীতলং চিত্তম-অমৃতেন-এব পুরিতম ্।

জ্ঞাণীপুরুষ লাভের জন্য প্রার্থনা করেন না। লাভ না হলেও  অনুশোচনা করেন না। ধীর ব্যক্তির চিত্ত শীতল, অমৃত  পূর্ণ। 


দ্বি-অষ্ট-
রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ

ন শান্তং স্তৌতি  নিষ্কামো ন দুষ্টম-অপি নিন্দতি 

সম-দুঃখ-সুখ-স্ত্ৃপ্তঃ কিঞ্চিৎ কৃত্যং ন পশ্যতি। 

শান্ত ব্যক্তির নিন্দা করেন না আবার দুষ্ট ব্যক্তির নিন্দাও করেন না। সুখদুঃখে সমভাবে তৃপ্ত থাকেন।  কোনো কর্তব্য-করণীয় বোধ  বলে তার মধ্যে কিছু দেখা যায় না।  


ত্রি-অষ্ট-
রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ  

ধীরো ন দ্বেষ্টি সংসারম-আত্মানং ন দিদৃক্ষতি  

হর্ষামর্ষ-বিনির্মুক্তো ন মৃত ন চ জীবতি। 

ধীর ব্যক্তি সংসারকে আত্মা (সত্য) বলে দেখেন না। তিনি আনন্দ-নিরানন্দ থেকে মুক্ত, না জীবিত না মৃত। 


চতুর -অষ্ট-
রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ 


নিঃস্নেহ  পুত্রদারাদৌ নিষ্কামো বিষয়েষু চ 
নিশ্চিন্তঃ স্বশরীরে-অপি নিরাশঃ শোভতে বুধঃ। 

পুত্র-পত্নীর প্রতি স্নেহশূন্য।  বিষয়ের প্রতি কামনাহীন। স্বশরীরে ভোজনাদি চিন্তা রোহিত।  বুদ্ধ বা জ্ঞানীকে  এইরূপ শোভায়মান দেখা যায়।   

পঞ্চ -অষ্ট-
রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ

তুষ্টিঃ সর্বত্র ধীরস্য যথা-পতিত-বর্তিন 

স্বচ্ছন্দং চরতে-দেশান্-যত্র-অস্তমিতশায়িনঃ। 

ধীরব্যক্তি  সর্বদাই যা কিছু পান তাতেই  তুষ্ট, যেন পড়ে থাকা বাসন। 

দেশে দেশে স্বচ্ছন্দে চরে বেড়ান। যেখানে অস্ত যায় সেখানেই শয়ন করেন।

ষষ্ঠ অষ্ট-
রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ  

পততুদেতু বা দেহো নাস্য চিন্তা মহাত্মনঃ 

স্বভাব-ভূমি-বিশ্রান্তি-বিস্মৃতাশেষ-সংসৃতে।

মহাত্মন তার দেহ অকেজো থাকুক বা নাস হয়ে যাক, এ নিয়ে তিনি চিন্তা করেন না। তিনি তার স্বভাব ভূমিতে, সব বিস্মৃত হয়ে,  বিশ্রম করেন।

    
সপ্ত-অষ্ট-রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ 

অকিঞ্চনঃ কামচারো নির্দ্বন্দ্বশ্ছিন্ন-সংশয়ঃ

অসক্তঃ সর্বভাবেষু কেবলো রমতে বুধঃ। 

বুদ্ধ অর্থাৎ জ্ঞানী অকিঞ্চন অর্থাৎ তার পরিগ্রহ করবার কিছু নাই। তিনি কামচারো অর্থাৎ ইচ্ছে অনুযায়ী বিচরণ করেন। তিনি সমস্ত দ্বন্দ ও সংশয়ের উর্দ্ধে।  তিনি অসক্ত, অর্থাৎ নমনীয়, ইচ্ছে মতো নিজেকে পরিচালিত করতে পারেন। সমস্ত ভাবে কেবল নিজেকে উপলব্ধি করছেন জ্ঞানী বুদ্ধ। 


অষ্ট -অষ্ট-
রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ

নির্মমঃ শোভতে  ধীরঃ সম-লোষ্ট্রাশ্ম-কাঞ্চনঃ
সুভিন্ন-হৃদয়গ্রন্থি-বিনির্ধূত-রজস্তমঃ। 

ধীর ব্যক্তি মমতা রোহিত। লোষ্ট্র,(মাটির ঢেলা ) অশ্ম(পাথর ) ও কাঞ্চন অর্থাৎ সোনাদানার প্রতি সম-দৃষ্টি সম্পন্ন। তার হৃদয়গ্রন্থি ছিন্ন হয়ে গেছে। রজ ও তম গুন্ ধুয়ে গেছে। 

ঊন -নব-রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ

সর্বত্র-অনবধানস্য ন কিঞ্চিৎ-বাসনা-হৃদি 
মুক্তাত্মানো বিতৃপ্তস্য তুলনা কেন জায়তে। 

সর্বত্র মনোনিবেশ রোহিত জ্ঞানীর হৃদয়ে বাসনার লেশ মাত্র নেই। মুক্তপুরুষের  আত্মাতৃপ্তির সঙ্গে কার তুলনা করা যেতে পারে ?

নব-রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ

জানন্নপি ন জানাতি পশ্যন্নপি ন পশ্যতি 
ব্রূবন্নপি ন চ ব্রূতে কঃ-অন্যো নির্বাসনাৎ-ঋতে।

তিনি জেনেও জানেন না, দেখেও দেখেন না, বলেও বলেন না,  ইনিই বাসনা রোহিত  জ্ঞানী ঋষি। 

এক - নব-রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ

ভিক্ষুর্বা ভূপতিঃ-বা-অপি  যো নিষ্কামঃ স শোভতে
ভাবেষু গলিতা যস্য শোভনাশোভনা মতিঃ। 

যার ভাবে শোভন অশোভন লোপ পেয়ে গেছে, সেই   
জ্ঞানী ভিক্ষারী, বা রাজা, যেমন হন না কেন, নিষ্কাম হিসেবেই তিনি  সুশোভিত। 

দ্বি-নব-রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ

ক্ব  স্বাচ্ছন্দ্যং ক্ব সংকোচঃ ক্ব বা তত্ত্ব-বিনিশ্চয়ঃ
নির্ব্যাজ-আর্জব-ভূতস্য  চরিতার্থস্য যোগিনঃ। 

যোগী নিস্কপট ও সরলমতি, তার জীবনের অর্থ পূর্নতঃ সিদ্ধ হয়েছে। তার কাছে স্বাচ্ছন্দ্যই বা কি সংকোচই বা কি ? তার তত্ব নিশ্চ্যের ইচ্ছাই বা কোথায় ?   


ত্রি -
নব-রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ

আত্ম-বিশ্রান্তি-তৃপ্তেন নিরাশেন গতার্তিনা 
অন্তঃ-যৎ-অনুভূয়েৎ তৎ কথং কস্য  কথ্যতে। 

আত্মস্বরূপে বিশ্রাম লাভ করে যিনি তৃপ্ত, নিরাশা যার গত হয়েছে, তিনি অন্তরে যা অনুভব করেন, তিনি সে কথা কোথায় বলবেন, কাকেই বা বলবেন ? 


চতুর -
নব-রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ

সুপ্তঃ-অপি ন সুষুপ্তৌ চ স্বপ্নে-অপি শয়িতো ন চ 
জাগরে-অপি ন জাগর্তি ধীরস্ত্ৃপ্তঃ পদে পদে। 

জ্ঞানী গভীর নিদ্রাতেও নিদ্রিত নন, স্বপ্নেও শায়িত নন, জাগরণেও জাগ্রত নন। এই কারণেই তিনি পদেপদে অর্থাৎ সর্বক্ষণ তৃপ্ত।  


 পঞ্চ-
নব-রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ

জ্ঞঃ সচিন্তো-অপি নিশ্চিন্তঃ সেন্দ্রিয়ঃ-অপি নিরিন্দ্রিয়ঃ
সুবুদ্ধিরপি নির্বুদ্ধিঃ সাহঙ্কারো-অনহংকৃতিঃ। 

জ্ঞানী চিন্তা করেও নিশ্চিন্ত। ইন্দ্রিয়াযুক্ত হয়েও ইন্দ্রিয়া ক্রিয়া হীন।  বুদ্ধিমান হয়েও নির্বোধ।  অহংকারে থেকেও নিরহঙ্কারী।    


ষষ্ঠ -
নব-রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ


ন সুখী ন চ দুঃখী ন বিরক্তো ন সঙ্গবান্। 
ন মুমুক্ষু-ন বা মুক্তো ন কিঞ্চিন্ন চ কিঞ্চিন। 

জ্ঞানী না সুখী, না দুঃখী,না বিরক্ত, না সঙ্গবান, না মুমুক্ষ, না মুক্ত, তিনি না এরূপ না ঐরূপ - কোনোটাই তিনি নয়।  
সপ্ত - নব-রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ

বিক্ষেপে-অপি ন বিক্ষিপ্তঃ সমাধৌ ন সমাধিমান্
জাড্যে-অপি ন জড়ো  ধন্য পান্ডিত্যে-অপি  ন পণ্ডিত। 

তিনি বিক্ষেপে থেকেও বিক্ষিপ্ত নয়, সমাধিতে থেকেও সমাধিবান নয়, জড়বৎ হয়েও জড়  নন, পান্ডিত্য থাকলেও পণ্ডিত নয়, ধন্য তিনি।  


অষ্ট - 
নব-রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ

মুক্তো যথাস্থিতি-স্বস্থঃ কৃত-কর্তব্য-নির্বৃতঃ
সমঃ সর্বত্র বৈতৃষ্ণ্যান্ন স্মরতি-কৃতং  কৃতম্।  

তিনি মুক্ত এবং আত্ম-স্থিত, ক্রিয়া কর্ম থেকে নিবৃত্ত, তৃষ্ণা রোহিত তাই  সর্বত্র সমদর্শন, কৃতকর্মের কোনো স্মরণ থাকে না তার । 


নব  - 
নব-রিংশতি  শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ

ন প্রিয়তে বন্দ্যমানো  নিন্দ্যমানো ন কুপ্যতি 

ন-এব-উদ্বিজতি মরণে জীবনে ন-অভিনন্দতি। 

বন্দনায় প্রীতি লাভ করেন না, নিন্দাতেও কুপিত হন না। মরণে উদ্বিগ্ন হন না, জীবনেও কোনো অভিনন্দন নেই। 


এক শতকম শ্লোক   :  অষ্টাদশ প্রকরণ


ন  ধাবতি জনাকীর্নং ন-অরণ্যম-উপশান্তধীঃ

যথাতথা যত্রতত্র সম এবাবতিষ্ঠতে। 

তিনি জনাকীর্ণ প্রদেশের অনুধাবন করেন না, আবার অরণ্য প্রদেশের আকাঙ্ক্ষা করেন না। যেমন আছেন তেমনি থাকেন, যেখানে আছেন সেখানেই সমভাবে অবস্থান করেন।   

ইতি শান্তি শতকং।  অষ্টাদশ প্রকরণ সমাপ্ত



ঊনবিংশ প্রকরমং - আত্মবিশ্রান্ত্যষ্টকং

প্রথম শ্লোক : ঊনবিংশ প্রকরণ

তত্ব-বিজ্ঞান-সন্দংশম-আদায়  হৃদয়োদরাৎ
নানাবিধ-পরামর্শ-শল্য-উদ্ধারঃ কৃতো ময়া। 

হে গুরুদেব -
আপনার কাছ থেকে তত্ব-বিজ্ঞান উপদেশরূপ সংদংশ( অর্থাৎ সাঁড়াশি) পেয়ে আমি  স্বীয় হৃদয় হতে নানাদিধ কীলক সকল থেকে উদ্ধার প্রাপ্ত হয়েছি।


দ্বিতীয় শ্লোক   : ঊনবিংশ প্রকরণ

ক্ব ধৰ্ম ক্ব চ বা কামঃ ক্ব চ-অর্থ ক্ব বিবেকিতা 
ক্ব দ্বৈতং ক্ব চ বা-অদ্বৈতং স্বমহিম্নি স্থিতস্য মে। 

কিসের ধৰ্ম,  কিসের কামনা, অর্থই বা কি  ? বিবেকই বা কোথায়  আমার ?  দ্বৈত-অদ্বৈত  বা কোথায় ? স্ব-মহিমায় আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত  আমি।   
    
তৃতীয়  শ্লোক   : ঊনবিংশ প্রকরণ

ক্ব ভূতং ক্ব ভবিষ্যদ্বা বর্তমানম-অপি ক্ব বা 

ক্ব দেশঃ ক্ব চ বা নিত্যং স্ব-মহিম্নি স্থিতস্য মে। 

আমার কোথায় ভূত, কোথায়  ভবিষৎ , কোথায়ই  বা বর্তমান ? কোথায়ই বা দেশ ? আমি স্ব-মহিমায় নিত্য প্রতিষ্ঠিত  হয়ে, অস্তিত্বহীন হয়ে গেছি। 


 চতুর্থ  শ্লোক  : ঊনবিংশ প্রকরণ


ক্ব চ আত্মা ক্ব চ বা-অনাত্মা ক্ব শুভং ক্ব অশুভং তথা 

ক্ব চিন্তা ক্ব চ বা-অচিন্তা  স্ব-মহিম্নি স্থিতস্য মে।

আমার আত্মা কোথায়, অনাত্মাই বা কোথায় ? আমার কোথায় শুভ, কোথায়ই বা অশুভ ?  আমার কোথায় চিন্তা, কোথায়ই বা অচিন্তা  ?আমি স্ব-মহিমায় নিত্য প্রতিষ্ঠিত  হয়ে, অস্তিত্বহীন হয়ে গেছি।


পঞ্চম শ্লোক  : ঊনবিংশ প্রকরণ


ক্ব স্বপ্ন ক্ব সুষুপ্তির্বা ক্ব চ জাগরণং তথা 

ক্ব তুরীয়ং ভয়ং বাপি স্ব-মহিম্নি স্থিতস্য মে।

আমার কোথায় স্বপ্ন, কোথায়ই বা  সুষুপ্তি,  জাগরণই  বা  

কোথায় ? কোথায় তুরীয় ? কোথায় ভয় ? আমি স্ব-মহিমায় নিত্য প্রতিষ্ঠিত  হয়ে, অস্তিত্বহীন হয়ে গেছি।


ষষ্ঠ শ্লোক  : ঊনবিংশ প্রকরণ

ক্ব দুরং ক্ব সমীপং বা বাহ্যং ক্ব-অভ্যন্তরং ক্ব বা 

ক্ব স্থুলং ক্ব চ বা সূক্ষ্মং স্ব-মহিম্নি স্থিতস্য মে।

কোথায় দূর, কোথায় নিকট, কোথায় বাহির, কোথায় ভিতর, কোথায় স্থুল, কোথায় সূক্ষ্ম ? আমি স্ব-মহিমায় নিত্য প্রতিষ্ঠিত  হয়ে, অস্তিত্বহীন হয়ে গেছি।


সপ্তম শ্লোক  : ঊনবিংশ প্রকরণ


ক্ব মৃত্যুজীবিতং বা ক্ব লোকা ক্ব-অস্য ক্ব লৌকিকম্

ক্ব লয়ঃ ক্ব সমাধির্বা স্ব-মহিম্নি স্থিতস্য মে। 

আমার জীবন নাই, আমার মরন নাই, কিসের লোক ? কিসেরই বা লৌকিকতা ? কোথায় আমার লয় ? কিসেরই  বা  সমাধি ?  আমি 

স্ব-মহিমায় নিত্য প্রতিষ্ঠিত  হয়ে, অস্তিত্বহীন হয়ে গেছি।

অষ্টম শ্লোক  : ঊনবিংশ প্রকরণ


অলং ত্রিবর্গ-কথয়া যোগস্য কথয়াপ্যলম্

অলং বিজ্ঞান-কথয়া বিশ্রান্তস্য মম-আত্মনি। 

হে গুরুদেব :


ত্রিবর্গপ্রসঙ্গ  অর্থাৎ ধৰ্ম, অর্থ, কামপ্রসঙ্গ কথা অনেক হয়েছে। যোগের অভ্যাস কথা অনেক হয়েছে, জ্ঞান বিজ্ঞান কথা যথেষ্ট হয়েছে। আমার আত্মা এখন বিশ্রামে গেছে। আমার আর কিছুর প্রয়োজন নেই। 



ইতি শ্রী মদ্বিশ্বেশ্বর তথা পণ্ডিত পিতাম্বরকৃত আত্মবিশ্রান্ত্যষ্টকং নামৈকোনবিংশতিকং প্রকরণম। 



বিংশতিকং প্রকরণম  (জীবনমুক্তি )



প্রথম শ্লোক : বিংশতিকং প্রকরণম

ক্ব ভূতানি ক্ব দেহো বা ক্ব-ইন্দ্রিয়ানি  ক্ব  বা মনঃ
ক্ব শূণ্যং ক্ব চ নৈরাশ্যং মৎস্বরূপে নিরঞ্জনে। 

হে গুরুদেব :

কোথায় ভূতাদি অর্থাৎ পঞ্চভূত ? দেহ, ইন্দ্রিয়, বা মনই বা কোথায় ?
কোথায় শূন্য ? নৈরাশ্যই বা কোথায় ? আমি মৎ-স্বরূপে ডুব দিয়েছি।  




দ্বিতীয় শ্লোক : বিংশতিকং প্রকরণম

ক্ব শাস্ত্ৰং ক্ব-আত্ম-বিজ্ঞানং ক্ব বা  নির্বিষয়ং মনঃ
ক্ব তৃপ্তি ক্ব বিতৃষ্ণত্বং গত দ্বন্দ্বস্য মে সদা। 

কোথায় শাস্ত্র, কোথায় আত্মবিজ্ঞান, কিসেরই বা বিষয়হীন মন, কিসেরই বা তৃপ্তি, কিসেরই  বা বিতৃষ্ণা ? আমি সমস্ত দ্বন্দ্বের   অতীত।

 তৃতীয় শ্লোক : বিংশতিকং প্রকরণম


ক্ব বিদ্যা ক্ব চ বা-অবিদ্যা ক্ব-অহং ক্ব-ইদং মম ক্ব বা 

ক্ব বন্ধঃ ক্ব  চ বা মোক্ষ স্বরূপস্য ক্ব রূপিতা। 

হে গুরুদেব :

কোথায় বিদ্যা, কোথায়-ই বা অবিদ্যা ? কোথায়  অহঙ্কার ?   আমার মধ্যে এসব কোথায় ? কোথায় বন্ধন, কোথায়ই বা মোক্ষ ? স্ব-রূপে স্থিতের কী রূপ থাকে পারে ?

 চতুর্থ  শ্লোক : বিংশতিকং প্রকরণম


ক্ব প্রারব্ধানি কর্মাণি জীবন্মূক্তিরপি  ক্ব বা

ক্ব তদ্বিদেহ-কৈবল্যং নির্বিশেষ্য সর্বদা। 

আমার আবার প্রারব্ধকর্ম  কি ? জীবনমুক্তি বা বিদেহ কৈবল্য (এই সব বিশেষ ধৰ্ম-অবস্থা )সদা নির্বিশেষ আমাতে কোথায় ? 


পঞ্চম শ্লোক : বিংশতিকং প্রকরণম


ক্ব কর্তা ক্ব চ বা ভোক্তা নিষ্ক্রিয়ং স্ফ্ূরণং ক্ব বা 

ক্ব-অপরোক্ষং ফলং বা ক্ব নিঃস্বভাবস্য মে সদা।

সদা নিঃস্বভাব আমাতে কোথায় কর্তা কোথায় ভোক্তা ? তাদের  স্ফ্ূরণই বা কোথায় ? অপরোক্ষ ফল বৃত্তিরূপ জ্ঞানী বা কোথায় ?



ষষ্ঠ শ্লোক : বিংশতিকং প্রকরণম


ক্ব লোকঃ ক্ব মুমুক্ষূর্বা ক্ব যোগী জ্ঞানবান্ ক্ব বা 

ক্ব বদ্ধঃ ক্ব বা মুক্তঃ স্ব-স্বরূপে-অহম-অদ্বয়ে। 

আমি স্ব-স্বরূপে অদ্বয়ে স্থিত।  এই অবস্থায় লোকসকল কোথায় ?মুমুক্ষু কোথায় ? কোথায় যোগী ? জ্ঞানী কোথায় ? বদ্ধ কোথায় ? মুক্তই  বা কোথায় ?  



সপ্তম  শ্লোক : বিংশতিকং প্রকরণম


ক্ব সৃষ্টি ক্ব চ সংহারঃ ক্ব সাধ্যং ক্ব চ সাধনম্

ক্ব সাধকঃ ক্ব সিদ্ধির্বা স্ব-স্বরূপে-অহম-অদ্বয়ে।

আমি স্ব-স্বরূপে অদ্বয়ে স্থিত। এই অবস্থায় কোথায় সৃষ্টি, কোথায় সংহার ? কোথায় সাধ্য আর কোথায়ই বা সাধক ? কিসেরই বা সাধন, কারই  বা সিদ্ধি ?


অষ্টম শ্লোক : বিংশতিকং প্রকরণম


ক্ব প্রমাতা প্রমানং বা ক্ব প্রমেয়ং কেউ চ প্রমা 

ক্ব কিঞ্চিৎ ক্ব ন কিঞ্চিৎ-বা সর্বদা বিমলস্য মে।

আমি সর্বদা বিমলেই অর্থাৎ স্বরূপেই আছি। আমার আবার প্রমাতা অর্থাৎ প্রমাণকারী কি ? আমার আবার প্রমান অর্থাৎ সাক্ষী বা সমর্থক কিসের  ? আমার আবার প্রমেয় অর্থাৎ জ্ঞেয় কে ? আমার আবার প্রমা অর্থাৎ সত্য জ্ঞান কি ? আমাতে কোনকিচি নাই আবার কোনোকিছুর অভাব নেই।  আমি সর্বদা বিমলে  আত্মস্থ। 


নবম শ্লোক : বিংশতিকং প্রকরণম


ক্ব বিক্ষেপঃ ক্ব  চ-একাগ্রং ক্ব নির্বোধঃ ক্ব মূঢ়তা 

ক্ব হর্ষ ক্ব বিষাদো বা সর্বদা নিষ্ক্রিয়স্য মে। 

আমি সর্বদা নিষ্ক্রিয়তার মধ্যেই অবস্থান করছি।  আমার আবার কিসের বিক্ষেপ ? একাগ্রতাই বা কোথায় ? বোধের অভাব ই

 কোথায় ? কোথায়ই বা মূঢ়তা ? কোথায় হর্ষ, কোথায় বিষাদ ?  আমি সর্বদা নিষ্ক্রিয়।

দশম  শ্লোক : বিংশতিকং প্রকরণম


ক্ব চ-এষ ব্যবহারো বা ক্ব চ সা পরমার্থতা 

ক্ব সুখং ক্ব চ বা দুঃখং নির্বিমর্শস্য মে সদা। 

নির্বিমর্শ অর্থাৎ বিশেষ বৃত্তি-জ্ঞান রোহিত আমি।  আমাতে ব্যবহারিক পদার্থ সকলের জ্ঞান কোথায় ? পারমার্থিক জ্ঞানই বা কোথায় ? কোথায় সুখ ? কোথায় দুঃখ ? আমি নির্বিমর্শ অর্থাৎ যুক্তি তর্কের ঊর্ধ্যে সদা অবস্থান করছি। 


একাদশ শ্লোক : বিংশতিকং প্রকরণম


ক্ব মায়া ক্ব চ সংসারঃ ক্ব প্রিতির্বিরতিঃ ক্ব বা 

ক্ব জীব ক্ব চ তদ্ব্রহ্ম সর্বদা বিমলস্য মে। 

কিসের  মায়া ? কিসের সংসার ? কোথায় প্রীতি ও বৈরাগ্য ?

জীব ভাব-ই বা কি ব্রহ্মভাবই  বা কোথায় ? আমি সর্বদা বিমলে  আত্মস্থ।

দ্বাদশ  শ্লোক : বিংশতিকং প্রকরণম 


ক্ব প্রবৃত্তি-নিবৃত্তি-বা  ক্ব মুক্তি ক্ব চ বন্ধনম্

কূটস্থ-নির্বিভাগস্য স্বস্থস্য মম সর্বদা। 

সর্বদা স্ব-স্থিত আমাতে কোথায় প্রবৃত্তি, কোথায়ই বা নিবৃত্তি? কোথায় মুক্তি, কোথায় বন্ধন ? কূটস্থ অর্থাৎ আত্মস্থ নির্বিভাগস্য অর্থাৎ ভেদহীন আমি স্ব-রূপে স্থিত।    


ত্রয়োদশ শ্লোক : বিংশতিকং প্রকরণম 


ক্ব-উপদেশঃ ক্ব বা শাস্ত্ৰং ক্ব  শিষ্য ক্ব চ বা গুরুঃ

ক্ব চ-অস্তি পুরুষার্থো বা নিরুপাধেঃ শিবস্য মে। 

কিসের উপদেশ ? কিসের বা শাস্ত্র ? কোথায় শিষ্য, কোথায় গুরু ? যিনি নির্গুণ  শিবস্বরূপ তার আবার পুরুষার্থ  কি ?


চতুর্দশ শ্লোক : বিংশতিকং প্রকরণম 


ক্ব চ অস্তি ক্ব  চ বা নাস্তি ক্ব অস্তি  চ  একং ক্ব চ দ্বয়ম 

বহুনাত্র কিম-উক্তেন কিঞ্চিৎ ন উত্তিষ্ঠতে মম।

কি আছে কি নাই, একের অস্তিত্ব না দুইয়ের,  নাকি বহুর ? এত  কথার কিছুমাত্র আমার ভিতরে উঠছেই না।


     

বিংশতিকং প্রকরণ সমাপ্তম 


সমাপ্তোয়ম অষ্টাবক্র গীতা


নমঃমহর্ষি বিদেহ  রাজা জনকঃ

নমঃ দেবর্ষি মহামুনি অষ্টাবক্রঃ