Thursday 29 July 2021

যোগের জন্ম বৃত্তান্ত । THE SECRET SCIENCE OF YOG

 


যোগের জন্ম বৃত্তান্ত । (১) THE SECRET SCIENCE OF YOG

যোগ কথাটার অর্থ হলো মিলন। পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার মিলন। পতঞ্জলি বলছেন, "যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ" -  তো যোগ হচ্ছে চিত্তবৃত্তির নিরোধ। সদা চঞ্চল আমাদের চিত্ত। এক বিষয় থেকে আরএক বিষয়ে নিয়ত ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এই চিত্ত চঞ্চল কেন ? ঋষিগণ বলছেন, আমাদের নানাবিধ কামনা বাসনার ফলেই চিত্ত স্বভাবত চঞ্চল বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। যার মধ্যে কামনা বাসনার বিলোপ সাধন সম্ভব  হয়েছে, তার চিত্ত শান্ত হয়েছে। কিন্তু এই কামনা বাসনা পূরণের জন্যই আমরা দেহধারন করে থাকি। যার কামনা বাসনা নেই, সে-তো জড়। তার মধ্যে প্রাণের খেলার স্পন্দন অনুভূত হয় না। হ্যাঁ ঠিকই সংকল্প বাসনা পূরণের জন্য, আমরা দেহ ধারণ করে থাকি । এই সংসার রূপ সমুদ্রে সঙ  সেজে ঘুরে বেড়াই। আর নিজেদেরকে হাজার হাজার বাসনারূপ দড়ির  জালে গুটিপোকার মতো নিজেকে আবদ্ধ করে রাখি।  মাকড়শা দেখেছেন, নিজের মুখের লালা দিয়ে জাল বুনে জালের এককোনে ঘাপটি  মেরে বসে থাকে।  শিকার পেলেই দৌড়ে গিয়ে শিকার ধরে। তো জীবাত্মাও তেমনি পঞ্চভূতের এই শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে, নিজের কামনা, বাসনা, সংকল্প পূরণ করে থাকে। মহাত্মাগন বলছেন, বাসনার নিবৃত্তি হলেই আমরা মুক্ত হতে পারবো।  আমাদের সমস্ত দুঃখের অবসান হবে। কিন্তু আমরা জানি বাসনার শেষ নেই, একটা পূরণ হয় তো আর-একটা আসে। এখন কথা হচ্ছে যা অফুরন্ত, তাকে বিলোপ করবো কি ভাবে।  আর সবচেয়ে বড়ো  কথা হচ্ছে এই বাসনার বিলোপের দরকারটা কি ? আমাদের বাসনা পূরণে  সাময়িক হলেও একটা তৃপ্তি তো আমরা পাই। থাক না বাসনা।  বাসনাবিহীন জীবন - সে-তো  বিস্বাদ। মহাত্মাগণ বলছেন, বাসনার বিলোপ হলে, আমরা জন্ম মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাবো। সমস্ত দুঃখের ওপারে চলে যাবো।  কিন্তু কথা হচ্ছে, জন্ম মৃত্যু থাকলে  ক্ষতিটা কি ? সুখ-দুঃখ থাকলে ক্ষতিটা কি ? সুখ-দুঃখের দোলনায়, একটা শিহরন আছে, একটা আনন্দ আছে।  একথা তো অস্বীকার করবার উপায় নেই। 

আসলে আমরা সবাই এই জন্ম-মৃত্যুর দোলায় দুলতে চাই। আরো ভালো হয়, যদি আমাদের জীবনে আর মৃত্যু না আসে। তাই আমরা দেখেছি, মানুষ অমর হবার অর্থাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচবার জন্য, বছরের পর বছর ভগবানের কাছে হত্যে দিয়েছে। কেউ সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার কাছে বর প্রার্থনা করেছে, কেউ দেবাদিদেব শিবের সাধনা করেছে। যুগের পর যুগ  বছরের পর বছর  মানুষ এই সাধনাই করে এসেছে।  এমনকি বিজ্ঞান মানুষের পরমায়ু বাড়াবার  জন্য, গবেষণা চালিয়ে গেছে। মানুষকে স্বস্তি দেবার জন্য, আনন্দ দেবার জন্য  প্রচেষ্টা আজও  সমানে চলছে। 

আরো একটা কথা হচ্ছে, মানুষ শুধু বেঁচে থাকতে চায় না, সে সুখে বাঁচতে চায়। আনন্দে বাঁচতে চায়। আর এই কারণেই সে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য  বাহ্যবস্তুর মধ্যে সুখের সন্ধান করছে। এই সুখের সন্ধান দিতে গিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, (গীতা-৫/২১) - বাহ্যবিষয়ে অনাসক্ত অন্তঃকরনের সাধক, আত্মায় যে আনন্দ আছে, তা লাভ করে থাকেন। এবং ব্রহ্মে অভিন্নচিত্ত পুরুষ অক্ষয় আনন্দ লাভ করে থাকেন। কাজেই এই অক্ষয় আনন্দ লাভ করবার জন্য, মানুষ জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনের বিজ্ঞান বা উপায় আবিষ্কার করবার চেষ্টা করেছিল। বলা হয়ে থাকে যোগবিজ্ঞান বহু গবেষণার দ্বারা এই আবিষ্কার অর্থাৎ দীর্ঘজীবী হওয়া ও অফুরন্ত আনন্দের অধিকারী হওয়ার বিজ্ঞানকে বা উপায়কে খুঁজে বের করেছেন। জড় বিজ্ঞানের আবিষ্কারের যে উৎস, অর্থাৎ প্রকৃতি, তার  মধ্যে থেকেই যোগ সম্মন্ধীয় তত্ত্বগুলোকে আবিষ্কার করা হয়েছে। জড় বিজ্ঞানের মুলে যেমন প্রথমে থাকে কৌতূহল, উৎসাহ, একাগ্র চিন্তা, নিষ্ঠা ও পর্যবেক্ষন এবং সবশেষে সত্য দর্শন।  এখানেও ভারতীয় মুনিঋষিগন দীর্ঘদিনের  পর্যবেক্ষনের ফলে জানতে পারলেন দুটো জিনিস ১) বায়ু আমাদের শরীরে কিভাবে ক্রিয়া করে। বায়ু কিভাবে জীবকূলকে তার জীবনকাল বা আয়ু দীর্ঘ বা হ্রাস করে থাকে। ২) মুদ্রা বা পোজ মানুষকে কিভাবে শারীরিক রস নিঃসরণে সাহায্য করে থাকে। তাঁরা দেখলেন, জীবের মধ্যে কচ্ছপ দীর্ঘজীবী। ব্যাঙ সাপ ইত্যাদি প্রাণী দীর্ঘদিন না খেয়ে থাকতে পারে ।

ঋষিগণ অনুভব করলেন, আমাদের চারিদিকে বিপুল বায়ুর ভান্ডার। এই বায়ু আমরা ফুসফুসের সাহায্যে হৃদয়কেন্দ্রে টেনে নিচ্ছি।  সেখানে  অম্লজান (oxygen) মিশ্রিত বায়ু  শ্বাসের মধ্যে দিয়ে, ফুসফুসে আসছে।  এই অম্লজানই শরীরের অভ্যন্তরস্থ মলিন রক্ত কনা গুলিকে দহন করে। আর এই দহনক্রিয়ার জন্যই আমাদের শরীরে উত্তাপ, রক্ত শোধন, খাদ্যের পরিপাক ক্রিয়া ইত্যাদি - এককথায় মানুষের জীবনীশক্তির পোষন হচ্ছে।  এই অম্লজানের একটা  সূক্ষ্ণ অংশ আমাদের মস্তিষ্কের কোষের মধ্যে পারমানবিক কম্পনের সাহায্যে বিদ্যুতের সৃষ্টি করে থাকে। আর মস্তিস্ক কোষের মধ্যে এই কম্পনের ফলে সৃষ্ট গতি স্নায়ুকেন্দ্রের মধ্যে যে রস নিঃসৃত হয়ে থাকে তার মধ্যেও ঢেউ তোলে।  আর এর ফলেই আমাদের মধ্যে চিন্তা বা চিত্তবৃত্তির উদয় হচ্ছে।  

আবার এই রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে বা দহন ক্রিয়ার ফলে যে অঙ্গারিকাল্ম বা কার্বনডাই-অক্সাইড তৈরী হয়, তা প্রশ্বাস আকারে বেরিয়ে যায়। আর প্রশ্বাসের ফলেই মানুষের শরীরের ক্ষয় অনুভূত হয়, আর একেই আমরা বলি ক্ষুধা। অতএব ঋষিগণ সিদ্ধান্তে এলেন, আমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ফলে জীবের জীবন রক্ষা হচ্ছে, জীবের মধ্যে চিন্তার উদয় হচ্ছে, আবার জীবনের ক্ষয় ক্রিয়া চলছে, অর্থাৎ আয়ু নাশ হচ্ছে । তো এই ক্রিয়াকে অর্থাৎ শ্বাসক্রিয়াকে যদি নিয়ন্ত্রণে আনা  যায়, তবে চিত্তবৃত্তির চঞ্চলতাকে আয়ত্ত্বে আনা  যায়, সহজ করে বলতে গেলে বলতে হয়, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে ধীর বা রোধ করতে পারলে, বিশেষ করে প্রশ্বাস অর্থাৎ শ্বাস ছাড়ার প্রক্রিয়াকে আমরা যদি ধীর করতে পারি, তবে আমাদের শরীরের বা জীবনীশক্তির ক্ষয় সীমিত হবে। আর এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয়ে থাকে যোগ।   এইজন্য যোগে কুম্ভকের উপরে গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ বায়ুকে ভিতরে ধরবার সময়কে বাড়িয়ে দিতে বলা হয়েছে। এই শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ বা নিরোধ-ই প্রাণায়াম। আর ধ্যান-ধারণা ইত্যাদি হচ্ছে প্রাণায়ামের প্রকারভেদ মাত্র। সমাধি হচ্ছে বায়ু সংযমের পরিনাম। 

চলবে.......... 

যোগের জন্ম বৃত্তান্ত । (২) 

সত্যি কথা বলতে কি কোনো মানুষই মরতে চান না।  কোনো মানুষই দুঃখে থাকতে চান না। কিন্তু ধ্রুব সত্যি হচ্ছে, মানুষকে মরতে হয়, মানুষকে দুঃখ সহ্য করতে হয়। তা সে জ্ঞানী বলুন, অজ্ঞানী বলুন, ভালো বলুন মন্দ বলুন। রাজা বলুন, ফকির বলুন, শক্তিশালী বলুন, আর দুর্বল বলুন সবাইকেই,  এই পরিণতির  প্রক্রিয়ার মধ্যে কেউ একজনতার  অজ্ঞাতসারেই প্রবেশ করিয়ে দেয়।  আর এর জন্য তাকে কিছুই করতে হয় না।  মানুষ শিশু থেকে দিনে দিনে কৈশোর, যৌবন, বৃদ্ধ, অবস্থার মধ্যে প্রবেশ করে। কোন্ শক্তি এই কাজ করে থাকে। উপনিষদ বলছেন, এই শক্তিই হচ্ছে প্রাণ শক্তি। এই প্রাণশক্তিই আমাদেরকে এক দেহ থেকে আর দেহে, শিশু থেকে কৈশোরে, কৈশোর থেকে যৌবনে, যৌবন থেকে বার্ধক্যে প্রবেশ করিয়ে দেয় । শরীরের মধ্যে এই যে গতিপ্রক্রিয়া একে চালনা করছে প্রাণশক্তি। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই প্রাণ শক্তির নিয়ন্ত্রক কে ? এই প্রাণশক্তির নিয়ন্ত্রক হচ্ছে আত্মা। প্রাণ হচ্ছে আত্মার ছায়া মাত্র। 

আমরা আগেই শুনেছি, বায়ুশক্তির সংযমের পরিনাম হচ্ছে সমাধি।  আর সেই কারণেই বৃত্তিকে নিরোধ করা, ও আমাদের শরীরের ক্ষয় নিবারনের দিকে যোগীপুরুষগন এতো মনোযোগী হয়েছিলেন। তারা উপলব্ধি করেছিলেন,  খাদ্যসামগ্রীকে পরিপাক করবার জন্য শরীরে অম্লজানের প্রয়োজন। কিছু সহজপাচ্য  খাদ্যসামগ্রী আছে, যা হজম করবার জন্য, অল্পপরিমান অম্লজানেই সম্পন্ন হতে পারে। আবার কিছু গুরুপাক খাদ্যসামগ্রী আছে, যাকে পরিপাক করতে গেলে, অধিক পরিমান অম্লজানের প্রয়োজন।  ঠিক যেমনটি আমরা দেখতে পাই  খাবার রান্না করবার সময়।  কতকগুলো সামগ্রী আছে, যা সিদ্ধ হতে অধিক সময় লাগে না, আবার কিছু সামগ্রী আছে, যা সিদ্ধ হতে বেশি সময় লাগে, বা জোরে জ্বাল দিতে হয়। অর্থাৎ কিছু সামগ্রীর জন্য ফুয়েল বা অগ্নিশক্তির বেশি ব্যবহার করতে হয়। ঠিক তেমনি আমরা যা কিছু আহার গ্রহণ করছি, সেগুলো যদি সহজপাচ্য না হয়, তবে আমাদের ভিতরে হজম করতে বেশি অম্লজান খরচ করতে হয়।   তো ঋষিমুনিগন সেইজন্য  আহার গ্রহণ সম্পর্কে  বললেন, যা হজম করতে আমাদের কম অম্লজান ব্যবহার করতে হয়, সেই সব আহার গ্রহণ করতে । এছাড়া তারা এটাও লক্ষ করলেন, যে বিশেষ বিশেষ স্থানে, বা পরিবেশে  ক্ষুধা তৃষ্ণার বেগ কম হয়, তো তারা সেই সব জায়গায় বাস করতে লাগলেন। অর্থাৎ গুহার মধ্যে যেখানে না শীত, না উষ্ণ প্রবাহ থাকে।  এইসব প্রক্রিয়া আর কিছু নয়, শরীরকে সুস্থ দীর্ঘজীবী করবার প্রক্রিয়া বা উপায় মাত্র। 

এছাড়া তাঁরা এটাও খুঁজতে লাগলেন, যে জীবজগতের মধ্যে এমন কোনো প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যায় কি না, যা কিনা স্বভাবগত ভাবেই সমাধিবান। কারন তাঁরা এটা অনুভব করেছিলেন, সমাধিস্থ প্রাণীর দৈহিক ক্রিয়াগুলো আয়ত্ত্ব করতে পারলে, জরা ব্যাধির কবোল থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে। আর এই গবেষণার ফলেই তারা সন্ধান পেলেন, সাপ, ব্যাঙ, এবং একজাতীয় কচ্ছপের।  এরা শীতকালে, নাতিশীতোষ্ণ গুহার মধ্যে প্রবেশ ক'রে, তালু-কুহরে জিহ্বা দিয়ে নিশ্বাস বন্ধ রেখে, সমাধির অবস্থায় থাকে। আর এই সমাধিস্থ অবস্থায়, তাদের হৃদযন্ত্র বা ফুসফুসের ক্রিয়া অর্থাৎ শ্বাসযন্ত্রের ক্রিয়া প্রায় থাকেনা বললেই চলে। এইসময় তারা বাহ্যজ্ঞানশূন্য অবস্থায় বিরাজ করে। অর্থাৎ বৃত্তির নিরোধ অবস্থা। এইসময় তাদের শরীরের ক্ষয়ঃবৃদ্ধি হয় না। এমনকি মলমূত্র নিঃসরণ হয় না। এমনকি তাদের শরীরে লালা স্বেদ উত্তাপ ইত্যাদি কিছুই থাকে না। এইসময় এরা শরীরকে একটি বিশেষ ভঙ্গিমায় অবস্থান করে থাকে। 

এখন ঋষিগণ ভাবতে লাগলেন, কোন কৌশলে মানুষও এইরকম সমাহিত অবস্থায়, চিত্তবৃত্তি শূন্য হয়ে অবস্থান করতে পারে। তারা নিরন্তর ভাবতে লাগলেন।  বিশেষ বিশেষ  জীবের শারীরিক গঠনের দিকে খেয়াল করতে লাগলেন। তাদের জীবনযাত্রা, অভ্যাস, আচরণ ইত্যাদির উপরে খেয়াল করতে লাগলেন। দেখলেন, এইসব জীবজন্তুর রক্ত তুলনামূলক ভাবে ঠান্ডা। শ্বাসপ্রশ্বাসের মাত্রা কম। দৃষ্টি পলকশূন্য।  স্বল্পাহারী , জিহ্বা দীর্ঘ এবং জিহ্বার অগ্রভাগ দ্বিখণ্ডিত। গভীর ভাবে এদের পর্যবেক্ষন করতে লাগলেন। এদের  বসার কায়দা, থেকেই বিভিন্ন আসনের প্রচলন করলেন।  যেমন ব্যাঙের বসবার ভঙ্গিমা  থেকেই পদ্মাসন, সিদ্ধাসন, ইত্যাদির প্রচলন  শুরু হলো । এদের জিহ্বা তালু-কুহরে অবস্থান থেকেই প্রচলিত হলো খেচরী মুদ্রা।

চলবে। ..... 

যোগের জন্ম বৃত্তান্ত । (৩) 

যাঁরা চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্র তাঁরা জানেন, মৃত্যপ্রায় অর্থাৎ apparent death  বা suspended animation বলে একটা কথা আছে।  জলে ডোবা মানুষ, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট মানুষ, বজ্রাঘাত প্রাপ্ত মানুষ, - এদের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্রিয়া এতটাই কমে যায়, যে মনে হয় মারা গেছে। এই অবস্থা বেশিক্ষন চলতে দিলে, মানুষটি সত্যি-সত্যি মারা যান। কিন্তু সময়মতো চিকিৎসার সুযোগ  পেলে তিনি বেঁচে যেতে পারেন। 

পেশায় ডাক্তার এমন একজন শিষ্য তার গুরুদেবকে নির্বিকল্প সমাধি সন্মন্ধে জানতে চেয়েছিলেন।  তো গুরুদেব বললেন, শ্বাস প্রশ্বাসের বিশেষ কিছু ক্রিয়ার সাহায্যে কুণ্ডলিনী শক্তি মূলাধার থেকে উদ্দীপ্ত হয়ে সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে দিয়ে  বিভিন্ন চক্র অতিক্রম করে, সহস্রারে পৌঁছায়।  এখানে অর্থাৎ এই সহস্রারে,  জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন হয়। শাস্ত্রমতে একে  বলে শিব ও শক্তির মিলন। যোগীর এই অবস্থায় ব্রহ্মদর্শন ঘটে থাকে।  এতো গেলো যোগশাস্ত্রে বিবরণ। কিন্তু শিষ্য তো বিজ্ঞানের ছাত্র, ডাক্তার। তো ডাক্তার বললেন - এইসময় আপনার শরীরের মধ্যে কি পরিবর্তন হয়, সেটা আমি পরীক্ষা করে দেখবো। কুণ্ডলিনী বা মূলাধার বলে শরীরের মধ্যে  কোনো জায়গা ডাক্তারিশাস্ত্রে পাওয়া যায়নি। তো এই যোগের সময় আপনার শরীরের মধ্যে কি কি পরিবর্তন হয়, তা আমি বিজ্ঞানসম্মত ভাবে পরীক্ষা করে দেখবো। তো   এইসব কাজে সাধারণত কোনো যোগীপুরুষ রাজি হন না।  কিন্তু গুরুদেব শর্ত সাপেক্ষে  এই পরীক্ষার জন্য রাজি হলেন। সর্তগুলো  হলো :  শোনো যোগের জন্য, স্থান ও সময়ের  একটা গুরুত্ত্ব আছে, তো আমার নির্দিষ্ট স্থানেই এই ক্রিয়া আমাকে করতে দিতে হবে। ২. যোগক্রিয়ার সময় আমার কাছে কেউ থাকবে না। ৩.আমাকে নির্জনে অন্ধকার স্থানে  বসবার ব্যবস্থা করতে হবে। ৪.আমার পছন্দের একজন ব্যক্তি আমার আশেপাশে থাকবে। যে ধ্যানস্থ ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট সময়ের পরে, প্রয়োজনে জাগিয়ে তুলতে পারে।৫. উচ্চস্বরে  কথা বা কোনো শব্দ করা চলবে না।৬. পরীক্ষার সময় আমার মেরুদণ্ডে কোনোমতেই হাত দেবে না। মেরুদন্ড বাদে আমার শরীরের যেকোনো স্থানে হাত দিতে পারবে। কিন্তু আমাকে ধাক্কা দিতে পারবে না। ৭. সমস্ত পরীক্ষা তোমাকে কম্বলের আসনের উপর দাঁড়িয়ে করতে হবে। 

ডাক্তারশিষ্যঃ : কিন্তু আমি আপনার নারীর গতি, রক্তচাপ পরীক্ষা করতে চাই।  আপনার ব্লাডসুগার পরীক্ষা করতে চাই, আর এর জন্য আমি আপনার আঙুলে সুঁচ ফোটাবো। আপনার চোখে টর্সের আলো ফেলবো। আপনার চোখের পর্দা খুলে দেখবো।   

গুরুদেব :- শরীর নড়ে যায়, এমন কিছু করবে না, শরীরকে অবশ্যই  ধাক্কা দেবে না। । আওয়াজ করবে না যা কিছু করবে, নীরবে করবে। আমি ধ্যানে বসবার দুঘন্টা পরে আমাকে পরীক্ষা করতে আসবে, তার আগে নয়। 

তো নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট স্থানে গুরুদেব ধ্যানে বসলেন। আর তার ঠিক দুঘন্টা পরে ডাক্তার শিষ্য এলেন তাকে পরীক্ষা করতে। ঘরে এসেই একটা সুগন্ধ পেলেন। গুরুদেবের মুখে টর্সের আলো  ফেললেন, দেখলেন, চক্ষু মুদ্রিত, মুখে স্মিত হাসির রেখা। পদ্মাসনে আসীন। মেরুদণ্ডে সোজা। গুরুদেবের শরীর স্থির। এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য যে বুক-পেটের ওঠা নামা তার কোনো চিত্র দেখা গেলো না। ডাক্তার স্টেথো বের করে গুরুদেবের বুকে বসালেন। প্রায় দশ মিনিট পরীক্ষার পর, ডাক্তার বুঝতে পারলেন, গুরুদেবের শরীরে শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়নি, চলছে তবে অতিমাত্রায় ধীর গতিতে।  ঘড়িধরে পরীক্ষা করে বোঝা গেলো, তিন মিনিটে একবার শ্বাস নিচ্ছেন, এর পর শ্বাস বন্ধ থাকছে তিন মিনিট, আবার শ্বাস ছাড়ছেন তিন মিনিট সময় নিয়ে। অর্থাৎ একবার শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া সংগঠিত হচ্ছে৩+৩+৩ = ৯ মিনিট ধরে। যেখানে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ এই শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ৪ সেকেন্ডে। গুরুদেবের হৃদস্পন্দন মিনিটে ১০ বার মাত্র, যেখানে সাধন মানুষের ৭২ বার।  এবার প্রেসার মেপে দেখা গেলো, ৭০/৫০, যেটা সাধারণ মানুষের থাকে ১২০/৮০. শরীরের উষ্ণতা স্বাভাবিকের চাইতে অনেক কম।  থার্মোমিটার ছিল না তাই মাপা গেলো না। আনুমানিক ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। যা সাধারনের দেহে ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হবার কথা। আঙুলের থেকে রক্ত নিয়ে গ্লুকোমিটারে ব্লাডসুগার মাপা হলো, ৩৩২ যা সুগারের রুগীর লক্ষণ। স্বাভাবিক ব্লাড-সুগার হচ্ছে, ৮০-১২০ mg/dl  হাত ও পায়ের পেশী টিপে দেখলেন, তুলতুলে - যা মৃত মানুষের লক্ষণ।  হাত পা ঠান্ডা কিন্তু মাথার উষ্ণতা স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি। আঙ্গুল দিয়ে চোখের পাতা খুলে, টর্স-এর আলোতে দেখা গেলো, চোখের মনি স্থির।  মনের মধ্যে pupil এর আকার অন্ধকারে বড়ো থাকে, আলোতে ছোট হয়ে যায়, কিন্তু গুরুদেবের চোখের pupil আলোর মধ্যেও চওড়া রয়েছে। যা মৃত মানুষের লক্ষণ। চোখের পাতা খুলে, চোখের কর্নিয়া  cornea তুলো দিয়ে সামান্য স্পর্শ করে দেখা গেলো, চোখের পাতা বন্ধ করবার চেষ্টা করলেন না। সাধারণত এইসময় স্বাভাবিক ভাবেই চোখ বন্ধ করবার চেষ্টা করে থাকে সবাই।  

পরীক্ষা শেষ করে ডাক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মনে মনে ডাক্তার ভাবতে লাগলেন, গুরুদেব মৃত নয়, কিন্তু মৃতপ্রায়, অর্থাৎ apparant death . এখানে রুগী যদি যোগীপুরুষ  না হতেন, তবে ডাক্তার একে clinically dead বলতে এতটুকু দ্বিধা করতো না। (তথ্যসূত্র : ব্রহ্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞান - ডাঃ ইন্দ্রনীল আইচ)

 আসলে যোগী পুরুষ যোগের সময় কি করেন ?

 যোগের সময় যোগী-পুরুষ   গভীরভাবে যোগক্রিয়ার মধ্যে মনোনিবেশ করেন। দেখুন আমরা যখন আমাদের ভালোবাসার কাজে, অর্থাৎ যে কাজে আমাদের  স্বাভাবিক আগ্রহ আছে, সেই কাজে আমরা বেশি মনোযোগ দেই, আর তখন আমরা সেই কাজে  তন্ময় হয়ে থাকি। বাইরের কোনো কিছুর দিকে তখন আমাদের খেয়াল থাকে না।  এমনকি তখন অন্য কাজকে আমরা সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখি। এই যোগকালেও  যোগীর মনোযোগিতার  গভীরতা এমনই যে, রাস্তা দিয়ে মিছিল চলে গেলেও যোগী টের পান না। ঘরে আগুন লেগে গেলেও তিনি টের পাবেন না। 

 গল্পটি আপনা সবাই জানেন, আচার্য্য দ্রোণ  একবার কুরু-পান্ডবের সন্তানদের একটা গাছে বসা পাখী  দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কি দেখতে পাচ্ছো ?  তো কেউ গাছে বসা একটা পাখী  দেখতে পাচ্ছিলো, কেউ শুধু পাখী  দেখতে পাচ্ছিলো, কেউ পাখীর  মাথা দেখতে পাচ্ছিলো। অর্জুন কিন্তু শুধু পাখীর  চোখ দেখতে পাচ্ছিলো। এখন কথা হচ্ছে, আচার্য্য কিন্তু গাছে বসা পাখীটাকে   দেখতে  বলেছিলো, তো সবাই সেটি দেখতে পাচ্ছিলো, কিন্তু অর্জুন পাখীর  চোখ দেখতে পাচ্ছিলো। এতে পার্থক্যটা কি হলো ?  তাদের কিন্তু আচার্য্য পাখীর চোখ দেখতে বলেননি।   বললে হয়তো সবাই চোখই  দেখতে পেতো।  আচার্য্য বলেছিলেন, গাছে বসা পাখীটাকে দেখতে। 

তো  আমরা যখন কোনো মানুষকে দেখি, তখন তার চোখ-মুখের  দিকে তাকাই।  তার কারন হচ্ছে, চোখ-মুখ হচ্ছে মানুষের মনের আয়না।  বিশেষ করে চোখ হচ্ছে সমস্ত জগতের আয়না।  এখানেই এই চোখের মধ্যেই সমস্ত জগৎ প্রতিফলিত হচ্ছে। উপনিষদ বলছেন, চোখের মধ্যে সেই পুরুষ বাস করেন। আর চক্ষু-ইন্দ্রিয় সহ সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কর্তা হচ্ছে আমাদের মন। তো আপনি যদি গভীর ভাবে কারুর চোখের প্রতি দৃষ্টি দেন, চোখের মধ্যে পর্যবেক্ষন করেন, তবে তার কর্তাকে অর্থাৎ মানুষটির মনটাকে ধরতে পারবেন। এখন কথা  হচ্ছে, এর সঙ্গে যোগের কি সম্পর্ক ? যোগের সঙ্গে এর সম্পর্ক হচ্ছে, গভীরভাবে পর্যবেক্ষনের ক্ষমতা। আমরা যখন ধ্যানে বসি, তখন আমাদের মন বিক্ষিপ্তভাবে বিষয়ান্তরে ঘোরাফেরা করে। শুধু তাই নয়, বিষয়ের কেন্দ্রে আমরা প্রবেশ করতে পারি না। কিন্তু সত্যিকারের  যোগীপুরুষগন বিষয়ের কেন্দ্রে স্থিত হন। এই কেন্দ্রে স্থিত হতে পারাই যোগস্থিতি। এই ক্ষমতা ছিলো, অর্জুনের মধ্যে। এই জ্ঞান অর্জিত নয়, এই জ্ঞান অধীত।

তো যোগীপুরুষ দুটো প্রক্রিয়াতে ধ্যানাবিষ্ট হন। এক নিজেকে গুটিয়ে আনা।  অর্থাৎ সমস্ত ইন্দ্রিয়শক্তিকে নির্লিপ্ত করে, মনের মধ্যে লয় করে দেওয়া। আর একটি হচ্ছে, নিজেকে প্রসারিত করা। অর্থাৎ ভূ-ভুব-স্বঃ এই তিন-ভূবনের মধ্যে নিজেকে বিস্তার করে দেওয়া। এইসময় যোগীপুরুষ এক দেহ থেকে আর-এক দেহে গমন করে থাকেন।  অর্থাৎ স্থূল দেহ সূক্ষ্ম, সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর দেহে বিচরণ করে থাকি।  স্থুল থেকে মানস দেহে, মানস  দেহ থেকে বিজ্ঞানময় দেহে, বিজ্ঞানময় দেহ থেকে আনন্দময় দেহে।  ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এই সময় আমরা এই বাহ্যিক জগতের মতোই অনুরূপ একটা জগতে বিচরণ করে থাকি। এবং এই জগৎ এতটাই  স্পষ্ট ভাবে দৃশ্যমান  ও  আমরা এই জগতে সঙ্গে এতটাই সম্পৃক্ত থাকি, যে বাহ্যিক জগতের কথা বেমালুম ভুলে থাকি।  

আবার   যোগীপুরুষ  যখন শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে ধ্যান দেন, তখন শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি ধীর হতে থাকে অর্থাৎ শান্ত হতে থাকে। বায়ু তখন দৌড়ঝাঁপ বন্ধ রাখে। আর যোগী অন্তর্মুখী হতে থাকেন। শরীরের ক্রিয়ার সঙ্গে নিজেকে নির্লিপ্ত  করা।  আর আমরা জানি, বায়ুর ঘর্ষনেই আমাদের শরীরে তাপ উৎপন্ন হয়। প্রাণবায়ু ও অপান বায়ুর ঘর্ষনে আমাদের শরীরে উত্তাপ সৃষ্টি হয়। এই উত্তাপের ফলে উদানবায়ু প্রাণবায়ুকে উর্দ্ধমুখী করে তোলে।   তো অভ্যাসের মাধ্যমে যোগীপুরুষগন শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি এতটাই ধীর করে ফেলেন, যে সমগ্র শারীরিক ক্রিয়ার জন্য, যে পরিমান উত্তাপ আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজন, তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। আপনি যদি কখনো জল দিয়ে আগুন নেভাতে যান, তবে খেয়াল করবেন, সেই আগুনের শিখা আরো বেশি উর্দ্ধগামী হয়ে ওঠে।  আমরাও যখন শ্বাসের গতি রুদ্ধ করে রাখি, তখন বায়ুর ঘর্ষনে যে তাপ উৎপন্ন হচ্ছিলো, তা উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হয়ে যায়। সমস্ত শরীর অর্থাৎ নিমাঙ্গ  ধীরে ধীরে ঠান্ডা হতে থাকে।  কিন্তু দেখবেন এইসময়  আমাদের মস্তিষ্কের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। সমস্ত শরীরের ক্রিয়া স্তিমিত হয়ে যাওয়ার ফলে, মস্তিষ্কের ক্রিয়াশক্তি বৃদ্ধি পায়। আমাদের চেতন-শক্তিও তখন উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হয়। মস্তিষ্কের তালুতে হাত রাখলে বুঝতে পারবেন, যেন আগুন  বেরুচ্ছে। 

আরো একটা কথা হচ্ছে, আমাদের  তখন শরীর-বোধ অর্থাৎ স্থুল শরীর-বোধ ক্ষীণ হতে হতে একসময় লোপ পেয়ে যায়।  কারন এই সময় যোগী  প্রথমদিকে শুধু চিন্তার জগতে বাস করেন, অর্থাৎ  মানস শরীরে অবস্থান করেন । একসময়  মানস  শরীর ছেড়ে যোগী  বিজ্ঞানময় শরীরে প্রবেশ করেন । অর্থাৎ চিন্তা থেকে যোগী  জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করেন । তাই বলে ভাববেন না যে  এইসব শরীর স্থুল শরীর থেকে পৃথক। আমাদের সমস্ত শরীর একের সঙ্গে আরেকটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। তো এইসময় আমাদের চেতনশক্তি মস্তিষ্কে ক্রিয়াশীল থাকে। যদি  মস্তিষ্কের ক্রিয়া যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন তাকে বলে ব্রেন ডেথ। 

এই সময় আমাদের শরীরে কি হয় ?  আমাদের শরীরে যে হাজার হাজার নাড়ী আছে, তার মধ্যে বায়ুর ক্রিয়া স্তিমিত হয়ে আসে।কোষের মধ্যে অক্সিজেন-এর মাত্রা কমে যাবার ফলে, আমাদের শারীরিক ক্রিয়া ধীরে ধীরে কমতে থাকে।   শেষের  দিকে ৭২ হাজার নাড়ীর মধ্যে কেবলমাত্র পাঁচটি নাড়ী অর্থাৎ ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্না-চিত্রাণি ও বজ্রাক্ষ্যা  নাড়ীর মধ্যে বায়ুর ক্রিয়া চলতে থাকে।  এরও  পরে ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ীর ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে অবস্থান করে চিত্রাণি ও বজ্রাক্ষ্যা নাড়ী, এই সুষুম্না নাড়ীই একমাত্র ক্রিয়াশীল থাকে । সাধারণ মানুষের এই তিনটি নাড়ীর  মধ্যে বায়ুর প্রবেশ করতে পারে না, কারন এখানে নানান রকম শ্লেষ্যা-পিত্ত  জাতীয় রসালো পদার্থে ভর্তি থাকে।  আমরা জানি এই সুষুম্না সহ এই পাঁচ  নাড়ীর অবস্থান হচ্ছে মেরুদণ্ডের মধ্যে।  মূলাধার থেকে মধ্যে মস্তিক পর্যন্ত এর বিস্তার। আর এই কারণেই এই সময়, অর্থাৎ গভীর ধ্যানে, যোগীর শারীরিক অবস্থা এমন হয়, যেন একটা লৌহদন্ডের বা মেরুদণ্ডের  উপরে মস্তিষ্ক বসানো আছে। একেই বলে ক্লিনিকাল ডেথ - মৃতপ্রায় অবস্থা। এইসময়   শরীরের ব্যালান্স বা ভারসাম্য বলে কিছু থাকে না।  তাই এইসময় তার শরীরকে কেউ সামান্য ধাক্কা দিলেই শরীর এলিয়ে পড়বে। অথবা মেরুদন্ড হেলে গেলেই, চেতনাহীন হয়ে, মৃত্যুমুখে পতিত হবে। 

তাই এইসময় তার শরীর রক্ষার জন্য, কাউকে একজন পাশে রাখতে হয়। অর্থাৎ বাইরের কোনো আঘাত যেন না আসে। এমনকি বাইরের কোনো শব্দ যাতে  শরীরে কম্পন সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। আর ঠিক এই কারণেই, যোগীপুরুষ, বিশেষ করে যারা সমাধি বা কৈবল্য অবস্থায় প্রবেশের যোগ্য, তাদের একান্ত  নির্জনে অথচ সুরক্ষিত স্থানে ধ্যানাবিষ্ট হওয়া উচিত। 

                

যোগের জন্ম বৃত্তান্ত । (৪) THE SECRET OF YOGA 

বিভিন্ন আসন গুলোর নাম থেকে বুঝতে পারবেন, বিভিন্ন জীবজন্তু থেকে এগুলোর নামকরণ করা হয়েছে।  সিংহাসন, গোমুখাসন, মৎস্যাসন,  ময়ূরাসন, কূর্মাসন, বৃষাসন, মকরাসন,ভূজঙ্গাসন ইত্যাদি ইত্যাদি। শোনা যায়, খেচরী মুদ্রায় যোগী হরিদাস সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।  তিনি ৩০০ বছর স্থূল শরীরে অবস্থান করেছিলেন। বাবাজি কত বৎসর বেঁচেছিলেন, তা জানা যায় না। গুরুগোবিন্দপাদ শুনা যায়, ঋষি পতঞ্জলির দেহে অবস্থান করেছিলেন, শঙ্করাচার্যকে দীক্ষা দেবার জন্য।  বাবাজি অপেক্ষা করেছিলেন, লাহিড়ী মহাশয়কে দীক্ষা দেবার জন্য । যোগী গোরক্ষনাথ মৎস্যেন্দ্রনাথ বহু বৎসর বেঁচেছিলেন। এই মৎস্যেন্দ্রনাথই হঠযোগের প্রচলন করেছিলেন। ঋষি পতঞ্জলির যোগদর্শনে, শিবসংহিতায়, ঘেরন্ডসংহিতায় আমরা এই যোগক্রিয়ার বর্ননা পাই।    যাইহোক, প্রাচীন কালে, মুদ্রা ও আসনগুলো অভ্যাসের দ্বারা যোগীপুরুষগন  ধীরে দিয়ে অনুধাবন করলেন, বিভিন্ন প্রাণী ও মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিপ্রকৃতি। মানুষ বা অন্য জীবজন্তু কে কতবার প্রতিমিনিটে শ্বাস নিচ্ছে বা কে কতবার শ্বাস ছাড়ছে, তা তারা নির্ভুলভাবে গণনা  করে ফেললেন। 

মানুষ - একমিনিটে ১২ বার, ঘোড়া - একমিনিটে - ১৬ বার, কচ্ছপ - মিনিটে ৩ বার এমনিতর বহু জীবজন্তুর শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রাকে পর্যবেক্ষন করতে লাগলেন। এমনকি তারা এও লক্ষ করলেন, মানুষের বিভিন্ন সময় শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বাড়া কমা চলতে থাকে।  মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন তার শ্বাস প্রশ্বাসের মাত্রা বেড়ে যায়। মানুষ যখন রেগে যায়,  বেশি পরিশ্রম করে, এমনকি  মিথুনের সময় তার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি দ্রুততালে বইতে থাকে। ভয় পেলে, বায়ু রুদ্ধ হয়ে আসে। জোরের কাজ করতে গেলে, বায়ু রুদ্ধ  হয়ে আসে।  আরো লক্ষ করলেন, কখনো মানুষের শ্বাস ডান নাক দিয়ে বেশি প্রবাহিত হচ্ছে, কখনো বাম নাক দিয়ে বেশি প্রবাহিত হচ্ছে, কখনো দুই নাকে সমান ভাবে শ্বাস প্রবাহিত হচ্ছে। দুই নাকে সম-মাত্রায় বায়ু প্রবাহিত হলে, তার মন স্থির থাকে।  এই শ্বাস বায়ু শরীরের তাপ উৎপাদন করছে, শরীরের ক্ষুধার উদ্রেগ  করছে। শরীর থেকে অপ্রোজনীয় বস্তু ঘাম, মল, প্রচ্ছাপ ইত্যাদি আকারে বের করে দিচ্ছে।  এমনকি আমাদের হিক্কা, হাঁচি, সমস্ত কিছুই  এই শ্বাসবায়ুর ক্রিয়া। 

যোগীপুরুষগন লক্ষ করলেন, যাদের শ্বাস বায়ু ধীর অর্থাৎ কার্বনডাইঅক্সাইড নিঃসরণ কম, তাদের জীবনীশক্তির ক্ষয় কম এবং  দীর্ঘজীবী। তাই কচ্ছপ  দীর্ঘজীবী।  মোদ্দাকথা বায়ুই জীবনী শক্তির উৎস। আবার বায়ুই জীবনীশক্তির নাশ করছে। তো দীর্ঘজীবী হতে গেলে, আমাদের যেমন আসনের অভ্যাস করতে হবে, তেমনি শ্বাস বায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

যোগীগণ কেন দীর্ঘজীবন চান ?  মানুষ  কেন দীর্ঘদিন বাঁচতে চায় ? দেখুন, এই কথা বুঝতে গেলে, আমাদের বুঝতে হবে আমরা কেন জন্মাই  ? আমরা কেন এই স্থূল দেহ ধারণ করি।  আমরা কেউ এই দেহ নোই. আমরা আত্মা।  আর আত্মা হচ্ছে এক শক্তি মাত্র। আর এই শক্তি বিশ্বশক্তির একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ মাত্র।  এই শক্তি যখন যার মধ্যে প্রবেশ তখন সে তাই হয়ে যায়। অর্থাৎ এই শক্তি যখন স্থূল শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে তখন সে নিজেকে দেহ মনে করে।  যখন সে মনুষ্য দেহের মধ্যে প্রবেশ করে, তখন সে নিজেকে এই দেহধারী  মানুষ মনে করে।  এই নিরপেক্ষ শক্তির মধ্যে যখন ইচ্ছেশক্তি জাগ্রত হয়, তখন এই বিশ্বশক্তি বিশ্বজগতের প্রকাশ করে থাকেন। যাকে  আমরা বলি প্রকৃতি। এই প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষ খেলায় মত্ত। ঠিক তেমনি মনুষ্য শরীরের মধ্যে যে আত্মশক্তি আছে, তার মধ্যে যখন ইচ্ছেশক্তি জাগ্রত হয়, তখন আমরা দেহ ধারণ করে থাকি। আর এই দেহ অর্থাৎ সংকল্প বাসনা  পূরণের জন্য একটা আধার। যার মধ্যে যেমন বাসনা বা সংকল্প জাগরণ হয়, তার সেই মতো দেহ প্রাপ্তি হয়ে থাকে। আর এই দেহ আর কিছুই নয়, জড়-প্রকৃতি মাত্র। প্রাণ ও চেতনার স্পর্শে এই জড়দেহে জীবনের শক্তি জাগ্রত হয়।  এই প্রকৃতি একসময় ছিল জড়। ধীরে ধীরে জড়ের মধ্যে প্রাণের স্পন্দন দেখা দিলো। শুরু হলে জীবজগৎ। জীবজগতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ট প্রাণী হলো মনুষ্য দেহ। এগুলো সবই সেই পরব্রহ্মের খেলা। দেখুন চেতন শক্তি সর্বত্র বিরাজ করছে, আবার বায়ুশক্তি বা প্রাণশক্তিও সর্বত্র বিরাজ করছে।  তবু দেখুন, আমরা প্রতিনিয়ত বায়ুর মাধ্যমে প্রাণশক্তিকে গ্রহণ করছি, আবার ছেড়ে দিচ্ছি।  আবার  এই বায়ুর মধ্যদিয়েই আমাদের চেতনশক্তি প্রবেশ করছে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। এই যে ক্রিয়া এটাকেই বলে খেলা। নিজের সঙ্গে নিজের খেলা। ভানুর কথা নিশ্চই শুনেছেন, "ফুটবল খেলা দেখে ভানু বলেছিলো, ওরা একটা বল লইয়া সবাই লাফালাফি মারামারি  করে কেন ? সবাইরে একটা কইরা বল দিয়া দিলেই তো হয়।" আসলে বল সবাইকে একটা করে দিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু তাহলে আর খেলা হবে না।  শ্বাস  নেওয়াটাই যদি জীবন হয়, তবে শ্বাস  নিয়ে বসে থাকলেই  হতো।  ছেড়ে দেবার কি দরকার ? আসলে এই ছাড়া-ধরাই খেলা। বল নিয়ে বসে থাকলে আর যাই হোক, খেলা  হয় না। 

প্রকৃতি নিয়মে আবদ্ধ।  প্রকৃতিতে নিয়ম বিরুদ্ধ কিছু হয় না। পুরুষ নিয়মের উর্দ্ধে। আপনি যখন যোগের গভীরে প্রবেশ করবেন, তখন আপনার মধ্যে এই বোধের স্ফূরণ হবে। একেই বলে সজ্ঞা। অর্থাৎ স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান। এগুলো কাউকে বলে বোঝানো বিড়ম্বনা মাত্র। একটা শক্তি যাকে   ইচ্ছেশক্তি বলছি, তা আপনার আমার সবার মধ্যেই কাজ করছে।   এই ইচ্ছেশক্তিই আপনাকে আমাকে কাজের অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। এই জন্ম-মৃত্যুর কারণও এই ইচ্ছে শক্তি। দীর্ঘজীবী হবার জন্য যে বাসনা আমাদের মধ্যে কাজ করে, তাও এই ইচ্ছেশক্তির ক্রিয়া। আসলে বাসনার তৃপ্তি, সংকল্প সাধন যেমন এই দেহ ধারনের কারন, তেমনি সংকল্প-বাসনা পূরণ না হাওয়া পর্যন্ত আমরা এই আধারেই তিষ্ঠোতে চাই। কিন্তু বিড়াম্বনা হচ্ছে, এই শরীরতো পঞ্চভূতের অর্থাৎ প্রকৃতির নিয়মে চলে। এই নিয়মের উলঙ্ঘন হলে, বা প্রকৃতির নিয়মেই এই দেহের নাশ হয়ে থাকে। তো প্রকৃতির নিয়মকে বোঝা, সেই নিয়ম অনুযায়ী দেহকে স্থিত করাই যোগের উদ্দেশ্য। এই যোগের উদ্দেশ্য যদি সিদ্ধ হয়, তবে আমরা এক জীবনেই আমাদের জীবন ধারনের যে মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ আত্ম -উপলব্ধি সেই স্তরে আমরা পৌঁছতে পারবো।  এর এর অন্যথা হলে, আমাদের বারবার জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হতে হবে। সবার পক্ষে অর্থাৎ একজীবনে আত্মউপলব্ধি সম্ভব নয়। বহু জন্মের সাধনায় অর্থাৎ বারবার জন্ম-মৃত্যুর কষ্ট  সহ্য করে, আমাদের এখানে পৌঁছতে হয়।  আর এই কারণেই যোগের সাহায্যে আমরা একজীবনে এই কাঙ্খিত স্তরে পৌঁছতে চাই । অর্থাৎ দীর্ঘজীবী হতে চাই। যাই হোক,    

ঋষিগণ আবিষ্কার করলেন, এক মিনিটে তিন বার নিঃশ্বাসে ৩৬৪.৮৬ গ্রেন  অঙ্গার নির্গত হয়। ১২ বাড়ে ২৭৯৮ গ্রেন অঙ্গার নির্গত হয়। ২৪ বাড়ে ৪৫.০১.১৩ গ্রেন অঙ্গার নির্গত হয়। অতয়েব শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়ার হ্রাস অনুসারে আমাদের শরীরের ক্ষয় হ্রাস হতে পারে।  আর ক্ষয় হ্রাস হলে, আমরা দীর্ঘ জীবন লাভ করতে পারি। আর এর থেকেই যোগীপুরুষগন দীর্ঘজীবন লাভের  জন্য, শ্বাসের নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ প্রাণায়ামের প্রচলন করেন। 

এমনকি যোগীগন আমাদের  প্রশ্বাসের দৈর্ঘ মাপতে শুরু করলেন। এবং দেখলেন, স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের সাধারণ সময়ে প্রশ্বাসের দৈর্ঘ হয় ৯ ইঞ্চি মতো।  কিন্তু এই মানুষের নিদ্রা কালে প্রশ্বাসের দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ৭৫ ইঞ্চি। কথা বলবার সময় ১৩.৫, দৌড়াবার সময় ২৫.৫ ইঞ্চি।  তাই যোগীগণ দেখলেন, যারা ঘুমকাতুরে, তারা স্বল্পায়ু। এই শ্বাসের এই দৈর্ঘতা যদি কমিয়ে আনা যায়, তবে মানুষ বেশি দিন বাঁচতে পারে।  এর ফলে তারা আবিষ্কার করলেন, নাসাগ্রে দৃষ্টি স্থাপন, শ্বাস-রোধ অর্থাৎ কুম্ভক ইত্যাদি ক্রিয়া কৌশল। 

চলবে। ....

যোগের জন্ম বৃত্তান্ত । (৫) THE SECRET OF YOGA

দেখুন যোগের  ঐশর্য্য কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়। যোগ একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মাত্র । আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসের ক্রিয়া হ্রাস অনুসারে শারীরিক ক্ষয়ের হ্রাস হয়। এই সত্য যোগীগণ দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে উপলব্ধি করেছিলেন। শুধু দীর্ঘ জীবন নয়, নীরোগ দীর্ঘজীবন লাভের  জন্য শ্বাস নিয়ন্ত্রণকারী প্রাণায়াম পদ্ধতি, তারা আবিষ্কার করেছিলেন। এর মধ্যে অবৈজ্ঞানিক বা অলৌকিক বা বুজরুকির কোনো স্থান নেই। "স্বরোদয় যোগ" বা স্বরের রহস্য যারা জেনেছেন, তাদের কাছে এই জ্ঞান প্রস্ফুটিত হয়েছে। আমাদের শরীর থেকে  নিঃসৃত কার্বনডাই-অক্সাইড যদি কোনো ভাবে কমিয়ে আনতে  পারি তবে আমরা দীর্ঘজীবী হতে পারি।  নাসাগ্রে একাগ্রতা স্থাপন, সাপ-ব্যাঙের মতো শ্বাস রোধ করে রাখতে পারি, তবে জীবনী শক্তির ক্ষয় অবশ্যই রোধ করতে পারি।  আর এর পরিণতি হচ্ছে দীর্ঘজীবন। তো শ্বাসবায়ু অধিক গ্রহণ করলেই হবে না,  আমরা যদি শ্বাস ত্যাগ প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তবে আমাদের শরীর নীরোগ ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, এই জ্ঞান আমাদের প্রাচীন যোগীগণ আবিষ্কার করেছিলেন। 

যোগ কোনো বিশেষ ধর্ম্মের জন্য নয়, যোগ কোনো ধর্ম্মিক ক্রিয়া অর্থাৎ  যাগযজ্ঞ বা পূজা-অর্চনা  নয়। যোগ একটা বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতি  যা মানুষকে সুস্থ, সবল, ও দীর্ঘজীবন লাভের  সহায়তা করতে পারে। এই দৃষ্টিতে আমরা যোগীদেরকে বৈজ্ঞানিক বলতে পারি।  কেননা তারা দীর্ঘকাল বিভিন্ন জীবের শারীরিক ক্রিয়াকে পর্যবেক্ষন করে, যোগের দাওয়াই দিয়ে ছিলেন। আজ যে সব তত্ত্ব পদার্থবিদ বা রাসায়নবিদগন আবিষ্কার করছেন, বহু আগেই ভারতীয় যোগবিজ্ঞানীগন আবিষ্কার করেছিলেন। এবং এও সত্য এখনো এমন কোনো নতুন তত্ত্ব আধুনিক বিজ্ঞানীগন দিতে পারেননি, যাতে আমাদের যোগীপুরুষের তত্ত্বের সত্যকে অবহেলা করা যায়।  

যোগীপুরুষগন আরো বললেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের হ্রাসবৃদ্ধির  ফলে মানুষের শুধু  নীরোগ দেহ বা দীর্ঘস্থায়ী জীবন লাভ হতে পারে তাই নয়, এতে করে আমাদের আরো অনেক কিছু লাভ হতে পারে, যা আমাদের জীবনে বহু আকাঙ্খিত। যেমন : আমরা শুনেছি, মানুষের স্বাভাবিক শ্বাস ৯ইঞ্চি দীর্ঘ। কিন্তু যোগের দ্বারা আমরা যদি এটাকে কমিয়ে আনতে  পারি তবে কি হয় দেখুন : 

৮.২৫ ইঞ্চির মধ্যে রাখতে পারলেই, আমরা জিতেন্দ্রিয় হতে পারি। 

৭.৫ ইঞ্চির মধ্যে রাখতে পারলে, আমাদের মধ্যে একটা অহেতুক বিষয়-বহির্ভূত আনন্দ লাভ করতে পারি। 

৬.৭৫ ইঞ্চি হলে আমাদের মধ্যে কবিত্বশক্তির প্রকাশ হতে পারে। 

৬ ইঞ্চি হলে - আমরা ভবিষ্যৎ  ঘটনার কথা উপলব্ধি করতে পারি। 

৫.২৫ ইঞ্চি করতে পারলে, আমরা সূক্ষদৃষ্টি সম্পন্ন হতে পারি। 

৪.২৫ ইঞ্চি হলে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অনুভব হয়, আমরা আসন থেকে শূন্য উঠে যেতে পারি। 

৩.৭৫ ইঞ্চি হলে আমরা  দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হতে পারি। 

৩ ইঞ্চি হলে আমাদের অনিমা-লাঘিমা  শক্তি অর্থাৎ নিজেকে বর্ধিত করা, বা সূক্ষাতিসূক্ষ করার শক্তি  লাভ করতে পারি। 

২.২৫ ইঞ্চি হলে আমরা সুক্ষ জগতের বাসিন্দাদের অস্তিত্ত্ব অনুভব করতে পারি। 

১.৫ ইঞ্চি হলে আমাদের মধ্যে দেবত্ব শক্তির বিকাশ ঘটে, আমরা তখন সুক্ষ শরীরে যত্র-তত্র বিচরণ করতে পারি। 

.৭৫ ইঞ্চিতে নামাতে পারলে, আমাদের ব্রহ্মানুভূতি লাভ হয়।  

আর যদি শ্বাস-প্রশ্বাস যদি নাকের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে, তবে, নির্বাণ লাভ হয়ে থাকে।

-------- চলবে। ....

যোগের জন্ম বৃত্তান্ত । (৬) THE SECRET OF YOGA.

আমি আপনি সবাই জানি ভগবান নিজের হাতে কিছু করেন না। অথচ  ভগবানের সহস্র লোচন, ভগবানের সহস্র হস্ত-পদ, অর্থাৎ আপনার কাছে যে দুটো হাত আছে, সেই হাত দিয়েই তিনি কাজ করেন। আপনার যে দুটো পা আছে, সেই পা দিয়েই তিনি চলাফেরা করেন, আপনার কান দিয়েই তিনি শুনতে পান, আপনার চোখ দিয়েই তিনি দেখতে পান, আপনার মুখ দিয়েই তিনি আহার গ্রহণ করেন, আপনার ত্বক দিয়েই তিনি স্পর্শসুখ পান। আপনার ইচ্ছেশক্তি, আপনার মন, আপনার চিন্তা, সবই ঈশ্বর প্রসূত। 

আপনারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনেছেন। এই শ্রীকৃষ্ণের একজন সখা  ছিল, তার নাম অর্জুন। ভগবান বারবার অর্জুন-সখাকে  বলছেন, যুদ্ধ করো, যুদ্ধ করো। তিনি নিজে সেই যুদ্ধে সারথী, অর্থাৎ রথের  পরিচালক হয়েছেন, নিজে একজন  বীরযোদ্ধা হয়েও, অর্জুনকে নির্দেশ দিচ্ছেন, যুদ্ধ করো যুদ্ধ করো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রতিজ্ঞা করে বসে আছেন, যুদ্ধ তিনি করবেন না। এই যুদ্ধে দুরাত্মা দুর্যোধন ও তার দলবলকে অর্থাৎ অশুভ শক্তিকে পরাজিত করা, তার উদ্দেশ্য এমনকি কর্তব্য, কিস্তু নিজে যুদ্ধ থেকে বিরত থেকে সখা অর্জুনকে বারবার উস্কাচ্ছেন, যুদ্ধ করো, যুদ্ধ করো। 

গীতার সমস্ত অধ্যায় হচ্ছে যোগ। একটা জিনিস জানবেন, সুষ্ঠূ ভাবে সমস্ত কর্ম্ম সম্পাদন করার নামই যোগ। আর নিপুণভাবে যিনি কর্ম্ম করতে জানেন, তিনি বিশ্বের সমস্ত  কর্ম্মের যিনি নিয়ন্তা সেই ভগবানের সখা হন। ভগবান এই সখার  সাহায্যেই  সমস্ত কর্ম্ম নিপুণভাবে সম্পাদন করে থাকেন। আপনি অসুস্থ হলে ডাক্তার আপনাকে বাঁচান। ভগবান স্বয়ং এই ডাক্তারের সাহায্যেই আপনাকে সুস্থ করে তোলেন। ভগবানের সমস্ত কথায় যিনি সায় দেন তিনি  ভগবানের সই।   যার সমান জ্ঞান হয়েছে, সে-ই সখা । কেউ যদি, বিশ্বশক্তি কিভাবে জীবজগৎকে পরিচালনা করতে চান, এবং সে বিষয়ে তিনি  জ্ঞান লাভ করেন, সবশেষে  সেই অনুযায়ী যিনি কর্ম্ম করে থাকেন, তবে জানবেন তাঁর  সঙ্গে বিশ্বাত্মার সখ্য হয়েছে।  বিশ্বাত্মার সখ্য লাভ করার অর্থই পরম-যোগ।

যোগের সাহায্যে যেসব ঐশ্বর্য্য  লাভ করা যায়, তাকে বলে রাধস। এইজন্য, সাধনার সিদ্ধি মানে রাধাকে পাওয়া। আর এই রাধস অর্থে  যোগ-ঐশ্বর্য্য। আবার এই যোগ-ঐশ্বর্য্যের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে মিশে আছে রাধাপতি অর্থাৎ বিশ্বের নিয়ন্তা। 

আমাদের মধ্যে সবসময় দুটো শক্তি  নিরন্তর কাজ করছে, প্রকৃতি পুরুষ। আবার ভালো-মন্দ, নিত্য-অনিত্য, জ্ঞান-অজ্ঞান, পাপ-পুন্য ইত্যাদি ইত্যাদি, সবই একই আধারে বিদ্যমান । এই দুই শক্তির উর্দ্ধে আছে, এক এবং অদ্বিতীয়  শক্তি। যা আসলে এই দুইশক্তির মিলিত সত্ত্বা। আমাদের নিজেদের এই যে দুটো সত্ত্বা, এই দুটো সত্ত্বার লড়াই, আসলে কুরু-পান্ডবের লড়াই, রাম -রাবনের লড়াই, দেবাসুরের লড়াই।   অর্থাৎ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। এই লড়াই-এর ময়দান হচ্ছে এই স্থুল শরীর। আর এই লড়াইয়ের কৌশল আয়ত্ত্ব করাই যোগশিক্ষা।  আত্মার সঙ্গে আত্মার মিলনকেই বলা হয় যোগ। জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনকেই বলা হয় যোগ, পূর্ণের সঙ্গে অংশের মিলনকে বলে যোগ।

 প্রথমে শরীরকে দিয়ে শুরু করতে হয়, ধীরে ধীরে মন, আর মন থেকে চেতনার স্তরে নিজেকে উন্নীত করাই যোগ। যখন আমরা নিজেকে একটা চেতনসত্ত্বা হিসেবে পর্যবেক্ষন করতে পারবো, তখন আমাদের বিশ্বচেতনার উপলব্ধি হবে। আর বিশ্বচেতনার উপল্বদ্ধিতে আমাদের সমস্ত কর্ম্ম চেতনশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হবে।  তখন আমাদের সমস্ত কর্ম্মই হবে যোগ। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনসখাকে এই যোগে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আমাদের সমস্ত কর্ম্মে নৈপুন্ন অর্জন করাই  যোগের ফল। 

সমাপ্ত।  

সূত্রঃ - বৈদিক ভারত -শ্রী শৈলেন্দ্রনারায়ণ ঘোষাল শাস্ত্রী ও অন্যান্য যোগশাস্ত্র।  



         

  

                














           

Friday 2 July 2021

বিশ্বাস অবিশ্বাস

 


ধর্ম্ম ও বিজ্ঞান

বিশ্বাস অবিশ্বাস

অবিশ্বাস, সন্দেহ বিজ্ঞানীর ধর্ম্ম।  বিজ্ঞান বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে পারে। তার নাড়ি-নক্ষত্র জানতে পারে। এমনকি এই খবর সে অন্যকে  জানাতে পারে। আজকের সভ্যতা বিজ্ঞানের সভ্যতা।  আর এই কারণেই চারিদিকে সন্দেহ। নগর সভ্যতা সন্দেহের সভ্যতা।  বিজ্ঞান বিষয়কে নিজের অধীনে নিয়ে আসে। এমনকি প্রকৃতিকে সে নিজের বসে নিয়ে আসতে  পারে। একমাত্র সন্দেহ প্রবন মানুষ, অবিশ্বাসী মানুষ বিজ্ঞানী হতে পারে। আবার বিশ্বাস আমাদেরকে  ধর্ম্মপথে নিয়ে চলে। বিশ্বাসই ধর্ম্মের মূল কথা। ধর্ম্ম   আমাদের অস্তিত্ত্বের অভিজ্ঞতা প্রদান করে থাকে। বিষয়ের উপরে, বিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গি ও একই বিষয়ের উপরে ধার্ম্মিকের  দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা। এদের দুজনের সঙ্গে আদৌ কোনো সংযোগ নেই। অবিশ্বাসী  কখনো ধার্ম্মিক হতে পারে না। আর যার মধ্যে সন্দেহ নেই, সে কখনো বিজ্ঞানী হতে পারে না। মহাত্মা বলছেন, এদের দুজনের সাথে কখনো মিলন হতে পারে না কারন এরা  দুজনই এক। মুদ্রার এপিঠ ও পিঠ মাত্র। দুটোই পর্যবেক্ষন।  তো যার মধ্যে কোনো ফারাক নেই, তাদের মধ্যে কোনো সাঁকো তৈরী হতে পারে না। সাঁকো তৈরী করতে গেলে, দুজনকে আলাদা করতে হয়। 

কিন্তু কথা হচ্ছে, বিশ্বাস তো অজ্ঞানতায় ঢাকা। বিশ্বাস কখনো সত্যকে জানতে চায় না। বিশ্বাস আপনাকে একটি বিশেষ  মতবাদকে অযৌক্তিকভাবে দৃঢ় করে দেবে। বিশ্বাস  আপনাকে একটা জ্ঞানের বিভ্রম ঘটাবে। এই ভ্রমাত্মক জ্ঞানের অধিকারী হয়ে আপনি নিজেকে মিথ্যে জ্ঞানী ভাবতে শুরু করবেন।  কেবলমাত্র বিশ্বাসের উপরে যা কিছু প্রতিষ্ঠিত তা সবই মেকি, বাজে। তথাকথিত ধর্ম্ম তাই বার বার করে  বিশ্বাসের  কথা বলে থাকে। আর অন্যদিকে বিজ্ঞান সব কিছুকে সন্দেহের চোখে দেখে, বিস্ময়ের চোখে দেখে,  জিজ্ঞাসার চোখে  দেখে, প্রশ্নের সম্মুখীন করে দেয়  সব কিছুকে। তাই বিজ্ঞান যতদিন সন্দেহ না ছাড়তে পারবে, আর ধর্ম্ম যতদিন শুধু অন্ধ বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকবে, ততদিন বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্ম্মের মিলন হতে পায়ে না। জল থেকে ডাঙায় যাবার জন্য কোনো সাঁকো হতে পারে না।  ডাঙা থেকে  ডাঙায় যাবার জন্য ব্রিজ তৈরী করা যেতে পারে । 

আমাদের দৃষ্টিতে দুটোই বিজ্ঞান। বিজ্ঞান  অর্থাৎ বিশেষ জ্ঞান। আবার অধ্যাত্ম জগতে একটা কথা আছে প্রজ্ঞা, যার অর্থ হচ্ছে, প্রকৃষ্ট জ্ঞান। এই প্রকৃষ্ট জ্ঞানের সাধনায় করে থাকেন যোগীপুরুষগন। জ্ঞানযোগের কথা আমরা সবাই শুনেছি, যা আসলে প্রকৃত ধার্ম্মিকদের লক্ষ।  বিজ্ঞানের দৃষ্টি বাইরের দিকে। বাইরের জগতের দিকে।  আর ধর্ম্মের গতি অন্তরের  দিকে, অন্তর্জগতের দিকে। একজনের দৃষ্টি কর্তার  দিকে আর একজনের দৃষ্টি কর্ম্মের দিকে। তাই যিনি সত্যিকারের  ধর্ম্মিক তাকেও সন্দিহান হতে হবে, বিজ্ঞানীর মতো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছিলেন, যথার্থ গুরুর সেবা করবে, গুরুদেবকে শ্রদ্ধা করবে, কিন্তু গুরুদেবকে সদা প্রশ্নের সম্মুখীন করে দেবে ।  তাকে প্রশ্ন করে, জবাব নিয়ে নেবে। ধর্ম্ম মানে শুধু অন্ধ বিশ্বাস বা অন্ধ অবিশ্বাস নয়, ধর্ম্ম মানে নিজেকে জানা। ধর্ম্ম মানে অন্তর জগতের জ্ঞান। 

বিজ্ঞান ও ধর্ম্ম দুটোই মহৎ। দুটোই আলাদা আলাদা ভাবে সৌন্দর্যে ভরপুর। বয়সের ভারে যিনি জ্ঞানবৃদ্ধ হয়েছেন, আর যে যুবক বুকের মধ্যে অজস্র প্রশ্ন নিয়ে ছটফট করছেন, দুজনের পরিণতি একই। একটা শিশু যখন জন্ম গ্রহণ করে, তখন সে কোনো বিশ্বাস নিয়ে জন্মায় না।  বরং শিশু জন্ম থেকেই প্রশ্ন করতে থাকে। সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকে বিস্ময় প্রকাশ করে থাকে। শিশু কখনো সে বিশ্বাসের কথা বলে না। সন্দেহ, প্রশ্ন আমাদের জন্মগত।   আর বিশ্বাস হচ্ছে পিতা-মাতা-সমাজ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-আর তথাকথিত ধর্ম্ম দিয়ে থাকে। এঁরা  সবাই আমাদের অজ্ঞানের শিক্ষা দিচ্ছে। এরা  সবাই আমাদের বোকা বানিয়ে রাখতে চাইছে। এরা মানবতাকে অন্ধকারে ঢেলে দিচ্ছে। এর অবশ্য একটা কারন আছে, যার বাস্তব জ্ঞান নেই, তাকে ঠকানো  সহজ। নির্বোধকে শোষণ করা সহজ। দাস বানিয়ে রাখা সহজ। গরিবকে, দুর্বলকে, অজ্ঞানীকে  সমস্ত ভাবে নিজের কাজে লাগানো যায়, এই সত্যটি আমাদের তথাকথিত ধর্ম্মিকব্যক্তিগন আয়ত্ত্ব করতে পেরেছিলেন।হাজার বছরের পুরাতন এই তথাকথিত নিতান্ত বিশ্বাসের ধর্ম্ম সত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তারা সত্যের নামে সত্য থেকে আমাদেরকে দূরে নিয়ে যেতে চায়। এবং বলা যেতে পারে, এখনো পর্যন্ত তারা এই কার্য্যে সার্থক। কিন্তু সময় এসেছে, সত্যকে খুঁজে বের করবার। এবং তথাকথিত মেকি ধর্ম্মকে কবর দেবার সময় এসেছে। আর যত  তাড়াতাড়ি এটা করা যায়, ততই মানব জাতির মঙ্গল। 

প্রথম কথা কেন আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে ? আপনি আপনার চোখের সামনে যা কিছু দেখছেন, আপনি যা কিছু  শুনছেন, সে-তো সত্য। আপনি যে ফুলের গন্ধ   অনুভব করেছেন,  সে সম্পর্কে কেউ যদি  আপনাকে প্রশ্ন করে  যে এই ফুলের গন্ধ আপনি বিশ্বাস করেন কি না। তবে সেই প্রশ্ন আপনার কাছে হবে হাস্যস্কর।  এখানে বিশ্বাসের কোনো প্রশ্ন ওঠেই  না। জ্ঞান কখনো বিশ্বাসের অপেক্ষা করে না।  অনুভব কখনো বিশ্বাসের অপেক্ষা রাখে না। বধির শব্দকে বিশ্বাস করে, অন্ধ আলোকে বিশ্বাস করে, রঙকে বিশ্বাস করে। আপনি শুনে আশ্চর্য্য হবেন, অন্ধ শুধু আলোকে  বিশ্বাস করে না, সে অন্ধকারকেও বিশ্বাসই  করে থাকে। কারন সে আলো বা অন্ধকারকে কাউকেই সে  দেখতে পায়  না। আমরা ভাবি, অন্ধ বোধহয় অন্ধকারকে দেখে থাকে।  কিন্তু সত্য হচ্ছে দেখতে গেলে চোখ লাগে। অন্ধকারকে দেখতে গেলেও চোখ লাগে। চোখের ধর্ম্ম হচ্ছে দেখা। যার চোখ নেই সে আলোও দেখতে পায়  না অন্ধকারও  দেখতে পায়  না। আলো ও অন্ধকার আসলে একই বস্তুর এপিঠ ওপিঠ। যার চোখ নেই, সে অন্ধকার বা আলো  কোনোটাই দেখতে পায়  না।  সে শুধু বিভ্রমের মধ্যে হাতড়ে বেড়ায়। 

অন্ধকার বা আলো কেউই সম্পূর্ণ নয়। আলোর বিপরীতে অন্ধকার অবস্থান করছে। আলোর পরিমান কমে গেলে, আমাদের অন্ধারকার লাগে, আবার অন্ধকারের পরিমান কমে গেলে আমরা  আলোর দেখা পাই।  কেবলমাত্র ডিগ্রির পার্থক্য। আমাদের চোখের একটা নির্দিষ্ট পরিসর আছে। আলোর তীব্রতা বেড়ে গেলে আমরা দেখতে পাই না। আবার অন্ধকারের তীব্রতা বেড়ে গেলে আমরা দেখতে পাই না। ঠিক তেমনি আলোর তীব্রতা কমে গেলেও  আমরা দেখতে পাই না, বা অন্ধকারের মধ্যেও  আমরা দেখতে পাই  না। আমাদের সামনে অসংখ্য ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে, বা অসংখ্য রেডিও তরঙ্গ বেসে বেড়াচ্ছে। যা আমরা দেখতে বা শুনতে পাচ্ছি না। রেডিও তরঙ্গকে শুনতে গেলে শুধু কান তা পারবে না।  এর জন্য দরকার রেডিও। আবার ছবির  তরঙ্গ দেখতে গেলে আমাদের দরকার দূরদর্শন যন্ত্র। এই রেডিও বা দূরদর্শন এমন কারিগরি দিয়ে তৈরী, যা সে শব্দকে   আমাদের কান দ্বারা শুনবার উপযোগী করে দেয়, আবার চোখ দ্বারা  ছবিকে দেখবার উপযুক্ত করে দেয়।  ঠিক এই প্রক্রিয়াটাই আমাদের অনুভূতির জগতে কাজ করে থাকে। 

অন্ধ মানুষকে জোর করে বিশ্বাস করানো হয়, যে আলো  বা অন্ধকার আছে। আসলে যে দেখতেই পায়  না, সে আলোকেও দেখতে পায়  না, আবার অন্ধকারকেও দেখতে পায়  না। কেবল বিশ্বাস করে। তার এই অন্ধ বিশ্বাসকে দূর করতে গেলে দরকার একজোড়া চোখ।  হাজার-এক বক্তৃতা, গুরুগম্ভীর জ্ঞান তাকে কখনোই আলো  বা অন্ধকার সম্পর্কে জ্ঞাত করাতে পারবে না। কোনো দর্শন শাস্ত্র তাকে এই চোখ দিতে পারবে না এর জন্য দরকার চিকিৎসক, চোখের চিকিৎসক । আলো আছে, বা অন্ধকার আছে, এই বিশ্বাস তাকে কখনোই দর্শনশক্তি এনে দিতে পারবে না। অন্ধের  দর্শনশক্তি এনে দিতে পারে, একমাত্র চক্ষুচিকিৎসক, উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে ।  

যেকোনো বিষয়ে কেবলমাত্র অন্ধ  বিশ্বাস, সেই বিষয়ে আপনার অজ্ঞানতার পরিচারক। আত্মা আছে, ভগবান আছেন, স্বর্গ আছে, নরক আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি সম্পর্কে যে বিশ্বাস আপনার মধ্যে গড়ে উঠেছে, সেগুলো আসলে এই বিষয়ের উপরে আপনার অজ্ঞানতা ছাড়া কিছু নয়। ভগবান আছেন,  এই বিশ্বাস তথাকথিত ধর্ম্মিক ব্যক্তিগন সমাজকে যুগ যুগ  ধরে বলে এসেছে। আর এই কথা  বারবার শুনতে শুনতে আমাদের মধ্যে ভগবান সম্পর্কে একটা কাল্পনিক ধারণার   জন্ম দিয়েছে। যার সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান হতে পারে নি, অথচ বিশ্বাস জন্মে গেছে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, যারা বলছেন, ভগবান আছেন, তারা নিজেরাও কোনোদিন সেই ভগবানের মুখ-দর্শন করেন নি। তারাও গুরু-পরম্পরায় শুনে এসেছেন, ভগবান আছেন। ভগবান সম্পর্কে সত্যিকারের খোঁজও তারা কোনোদিন করেন নি। আরো একটা কথা হচ্ছে, যার সম্পর্কে বলা হচ্ছে, অর্থাৎ ভগবান, সেই ভগবানও কখনো এগিয়ে এসে বলেননি, যে দেখো আমি আছি, বা আমি নেই। ভন্ড ধর্ম্মিক  বলছে, জগৎ মিথ্যা। ভগবান সত্য। কিন্তু যাকিছু আপনি দেখছেন, যাকিছু আপনি শুনছেন, যাকিছু আপনি স্পর্শ করছেন, তা ভগবান বই কিছু নয়। কিন্তু আমরা মানুষের মধ্যে ভগবানকে খুঁজি না। আমরা জগতের মধ্যে ভগবানকে খুঁজি না। আমরা নিষ্ফলা অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে মরছি। 

আসলে আমরা খোঁজ করতে ভয় পাই। কেননা খোঁজ করতে গেলে আমাদের অনেক পরিশ্রম করতে হবে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। যত  সহজে বিশ্বাসে  ভগবানকে পাওয়া যায়, খোঁজ করতে গেলে তত সহজে পাওয়া যায় না। বিশ্বাস ছাড়া যদি ভগবানকে পাওয়া যেত, তবে সমস্ত তথাকথিত ধর্ম্মিক ব্যক্তি বলতেই পারতেন, অনুসন্ধান করে দেখো। তথাকথিত ধর্ম্মিক ব্যক্তি কখনো এই খোঁজের কথা বলবেন না।  কিন্তু সত্যিকারের ধর্ম্মিকব্যক্তি ভগবান আছেন কি নেই সেই কথা কখনো বলেন না, বলেন, তুমি খুঁজে দেখো। আর খোঁজার কাজটি করে থাকে বিজ্ঞান, বৈজ্ঞানিক, যিনি সত্যিকারের সাধক। সমস্ত ধৰ্ম এই খোঁজার কথা বলতে গিয়ে, নিজেরাই পথ হারিয়েছে। কেউ বলছেন, এদিক দিয়ে যাও , তো কেউ বলছেন, না-না ওদিকে নয় এইদিকে। এই দিকভ্রষ্ট ধার্ম্মিকগন নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে দিয়েছেন।  আর তাই আমরা দেখতে পারি, হাজার এক সম্প্রদায়, হাজার হাজার মতবাদ। সবাই বলছেন, আমার মতই উৎকৃষ্ট।  আমার মতই শ্রেষ্ট। তাই আমরা দেখতে পাই, তথাকথিত ধর্ম্ম বিজ্ঞানকে ভয় পায়, CBI-কে ভয় পায়।  কেননা পাছে ভগবানের খোঁজ শুরু হয়ে যায়। এইসব ভন্ডরা  জানে, আমরা যে পথের  কথা বলেছিলাম, আমরাও সেই পথে কোনোদিন পা রাখিনি, এই পথের কথা গুরু-পরম্পরায় আমি শুনেছি মাত্র।  কোনোদিন সেপথে যাবার কথা মনেই আসেনি।

মাঝে মাঝে মনে হয়, তথাকথিত ধর্ম্মিকগন যেমন করুনার পাত্র, তেমনি বিজ্ঞান  ততোধিক অবজ্ঞার বিষয়, কেননা  এই বিজ্ঞান যতনা বাইরের বস্তুর দিকে নজর দিয়েছে, নিজের দিকে তত অন্ধ থেকেছে। বৈজ্ঞানিক  সবকিছুকে জানতে চায়, কেবল নিজেকে ছাড়া। বিজ্ঞান সব কিছু নিয়ে অনুসন্ধান করে থাকে, কিন্তু নিজের ধর্ম্ম বিষয় নিয়ে সে কখনো অনুসন্ধান করে না। বিজ্ঞান বহির্জগৎ সম্পর্কে অনুসন্ধানে ব্যস্ত, অন্তর্জগৎ সম্পর্কে উদাসীন। পরীক্ষাগারে বসে জিজ্ঞাসু সমস্ত বদ্ধমূল পুরোনো  ধারণাকে পাশে সরিয়ে রেখে,   বস্তুর পরীক্ষা করছে। কিন্তু কখনো তার মধ্যে প্রশ্ন জাগেনি, যে কে এই পরীক্ষা করছে ? কিন্তু নিজেকে সেই বদ্ধমূল ধারণার মধ্যেই আবদ্ধ রাখছে, যে সত্য বাইরে লুকিয়ে আছে। সত্য বাইরে নয়, সত্য আছে ভিতরে। সত্য বিজ্ঞানে নয়, সত্য আছে বিজ্ঞানীর মধ্যে। বিবেকানন্দ বলছেন, বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি  কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর ? জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। বিবেকানন্দ আরো বলছেন,  বিশ্বাস একটা সুন্দর অন্তর্দৃষ্টি এবং এটাই একমাত্র ব্যাপার যা মানসিক প্রশান্তিকে রক্ষা করতে পারে।  ... কিন্তু এর মধ্যে একটা বিপদ নিহিত আছে, যা কিনা ধর্ম্ম-উন্মত্ততা সৃষ্টি করে ও উন্নয়নে বাধা প্রদান করে।  

তো অন্ধ বিশ্বাস যদি করতেই হয়, তবে বিশ্বাস  করুন, আমরা প্রত্যেকেই সেই মহান সত্তার অংশ।  আমরা সবাই ঈশ্বরের প্রতিনিধি। আত্মায় আত্মায় কোনো পার্থক্য নেই, পার্থক্য শুধু অজ্ঞানতার - কারন জ্ঞানের সূর্য  আমরা অন্ধ বিশ্বাস বা অন্ধ অবিশ্বাসরূপ মেঘ দিয়ে ঢেকে রেখেছি। আপনি বস্তুবাদী হন, বা দার্শনিক হন, বিজ্ঞানী হন বা আধ্যাত্মিক হন, জানবেন, আমরা সবাই এই সমাজের অংশ, তাই সমাজের উন্নতিতেই আপনার আমার উন্নতি। পা ফুললে জানবেন, গোদ হয়েছে, পেট ফুললে জানবেন, চর্বি হয়েছে, - এর কোনোটাই সুস্বাস্থের লক্ষণ নয়। শরীরের সর্বত্র রক্তের প্রবাহ ছড়িয়ে দিতে হবে, তবেই স্বাস্থ ভালো হবে।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।