Wednesday 26 October 2022

যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - পঞ্চম অধ্যায় - কর্ম্মসন্যাস যোগঃ

যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - পঞ্চম অধ্যায় - কর্ম্মসন্যাস যোগঃ
৬.৩.২০২২
ওঁং নারায়নং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্
দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদীরয়েৎ ওঁং।

যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - পঞ্চম অধ্যায় - কর্ম্মসন্যাস যোগঃ
শ্লোক নং ৫/১

আমরা এতদিন শ্রীগীতার মধ্যে নিহিত যোগবিদ্যার কথা শুনছিলাম। আমাদের মাঝে মধ্যে মনে হয়, যা কিছু বললাম, তা থেকে কি কিছু বোঝা গেলো ? কতকগুলো কথা বলা হলো সত্য, কিন্তু এই কথার মধ্যে দিয়ে কি কোনো সত্যের প্রকাশ করা গেলো ? কোনো প্রশ্নের মীমাংসা হলো কি ? কোন্ কথা সত্য, তা কে বলে দেবে ? আকাশ সর্বত্র, বিরাট, নিত্য, অবিনাশী। আবার এইযে কীটাণুকীট এর মধ্যেও সেই আকাশ, এইসব কথা বলে কি আকাশকে বোঝানো যায় ? গীতা মুখস্ত করে রাখা যায়, কিন্তু তাতে কি গীতার মর্মার্থ আমাদের মরমে প্রবেশ করে ? তবে একটা বুঝবার প্রয়াস প্রকাশ পেলো মাত্র। পণ্ডিত ব্যাক্তিগন হয়তো বলবেন, যা বোঝা যায় না, তা বোঝার জন্য বা বোঝাবার এতো প্রয়াস কেন ? কিন্তু আমাদের মতো অজ্ঞ মুঢ় ব্যক্তি এইসব কথায় কান দেয় না। কারন, পন্ডিতের নিষেধাজ্ঞায় মূর্খ কখনো কান দেয় না। পণ্ডিত তো সমুদ্রকে এতো জল ধরে রাখতে নিষেধ করেছে। ঝর্নাকে নিম্নগামী হতে নিষেধ করেছে, বায়ুকে যথেচ্ছ ভ্রমন করতে নিষেধ করেছে, ধোঁয়াকে উর্দ্ধগামী হতে নিষেধ করেছে, সূর্যকে আলো দিতে নিষেধ করেছে, মেঘকে বৃষ্টি দিতে নিষেধ করেছে, আপেলকে নিচে নামতে নিষেধ করেছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তাই আমরা বুঝি আর না বুঝি, আমরা বোঝাতে পারি, আর না পারি, বুঝবার প্রয়াস আমাদের জন্মগত। আমরা তাই কর্ম্ম ছাড়তে পারি না, স্বভাব ছাড়তে পারি না। আমাদের চেষ্টার তাই শেষ হয় না।

শ্রীগীতার এই পঞ্চম অধ্যায়ের নাম কর্ম্ম-সন্যাস যোগ। সন্যাস বলতে আমরা বুঝি সর্ব্ব পাশের নাশ। আবার কর্ম্ম-সন্যাস বলতে আমরা বুঝি সর্ব্বকর্ম্মের নাশ। এখন কথা হচ্ছে, একবার কর্ম্ম থেকে বিরতি বা নিষ্কৃতি, আবার যোগক্রিয়ার মধ্যে প্রবেশ। আমাদের মতো সাধারনের কাছে দুটোই ক্রিয়াপদবাচ্য। কর্ম্ম ত্যাগ করে কর্ম্মের মধ্যে প্রবেশ। এতো কান ছেড়ে মাথা ধরা। তাহলে ছাড়তে পারলাম কৈ ? যোগেশ্বর ভগবানের কথা শুনে, অর্জ্জুন আত্মকল্যানের জন্য কর্ম্ম ত্যাগকেই আপন বুদ্ধিতে বা নিজের সংস্কার অনুযায়ী শ্রেষ্ঠ পথ বলে ধরে নিয়েছে। এর আগের অধ্যায়ে (চতুর্থ অধ্যায়ে) ভগবানের শ্রীমুখে আমরা শুনেছি, সংশয়াত্মক লোকের অন্তিম পরিণতি বিনাশ। একথা শুনেও অর্জ্জুনের মন থেকে সংশয়ের নিরসন হয় নি। আসলে সংশয় লোপ পেতে পারে, দুটো উপায়ে, এক - যথার্থ জ্ঞানলাভ, আর একটি হচ্ছে সত্যিকারের আত্মসমর্পন। আমরা সবাই সবসময় সাফল্যের সহজ পথ ধরে চলতে চাই। কাজ করতে হবে শুনলে, আমাদের মন ব্যাজার হয়ে ওঠে। কিন্তু কাজ করতে হবে না, শুনলে আমাদের ভালো লাগে। পড়াশুনা করতে হবে না, শুনলে ভালো লাগে, কিন্তু অঙ্ক করতে হবে, শুনলে, মনে মনে মাস্টারমহাশয়কে গালি পারতে ইচ্ছে করে। আসলে আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার আমাদেরকে নিম্নমুখী করেছে। জলের গতি যেমন নিম্নমুখী, তেমনি আমাদের অশুভ সংস্কার আমাদের কে এই মৃত্যুপুরীতে টেনে নিয়ে এসেছে। আর নিচে নামতে ভালোই লাগে, উঁচুতে উঠতে গেলে পরিশ্রম করতে হয়। আমাদের স্বভাবের মধ্যে লুকিয়ে আছে, পারিশ্রম-বিমুখীনতা, তামসিকতা । তাই ভগবান যখন কর্ম্মফল ত্যাগের কথা বললেন, তখন আমরা কর্ম্ম-ত্যাগের কথা বুঝে নিলাম। এখান থেকে আমাদের বেরুতে হবে। নিজের বিচারবুদ্ধির উর্দ্ধে উঠে ভগবানের কাছে আত্মসমর্পন করতে হবে। তবেই ভগবান আমাদের সঠিক পথে নিয়ে যাবেন। আমাদের কাজ হচ্ছে, ভগবানের হাত ধরে রাখা। ভগবানের কথা মনোযোগ দিয়ে শুধু শোনা নয়, সংশয়াতীত হয়ে, তার উপদেশের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখা, এবং সেই অনুযায়ী যথাসাধ্য কর্ম্মে লিপ্ত হওয়া। প্রশ্ন ভিতরে জাগবে, কিন্তু সেই প্রশ্নের যথাযথ উত্তরে যেন আমাদের সন্দেহের উদ্রেগ না হয়। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, অর্জ্জুনের মতো ভাগ্যবান, যিনি সরাসরি ভগবানের সান্নিধ্যে আছেন, তার মধ্যে এতো সংশয়, তো আমাদের মতো সাধারণ জীবের কি অবস্থা। আসলে গীতা সার্ব্বজনীন। শ্রীগীতা সবার জন্য, তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন, সাধারনের মনের প্রশ্ন, দ্বিধা-দ্বন্দ অর্জ্জুনের মধ্যদিয়ে প্রকাশ করছেন। আমরা সবাই অর্জ্জুনের মতো ভাগ্যবান না হলেও, ভগবানের কাছে অর্জ্জুনের থেকে, আমরা কেউ কম কাছের নোই। তাই ভগবান আসলে অর্জ্জুনের মাধ্যমে আমাদেরকে শোনাচ্ছেন যোগের কথা। এবার আমরা অর্জ্জুনের প্রশ্নটা একবার শুনে নেই। অর্জ্জুন উবাচ : সন্যাসং কর্ম্মনাং কৃষ্ণ পুনর্যোগঞ্চ শংসসি যছ্রেয় এতয়োরেকং তস্মে ব্রূহি সুনিশ্চিতম্। (৫/১) অর্জ্জুন বললেন, হে কৃষ্ণ কর্ম্মসমূহের ত্যাগ করতে বলছো, আবার যোগের উপদেশ দিচ্ছ। এর মধ্যে যেটি শ্রেয় সেই একটি নিশ্চিত করে আমাকে বলো। অর্জ্জুন নাম্নী শরীরের তেজ দ্বারা অনুভব হচ্ছে, কর্ম্ম ত্যাগ আর কর্ম্ম করার মধ্যে, সন্যাস ধর্ম্ম আর যোগকর্ম্ম এর মধ্যে কোনটা ভালো ? শরীরে থাকলে কর্ম্ম করতে হবে। সংসারে থাকলে কর্ম্ম করতে হবে। কিন্তু কর্ম্ম বড়ো কষ্টকর, শ্রমসাধ্য। আবার কর্ম্মফল সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নোই। যুদ্ধে জিতবো, না হেরে যাবো, তা কে বলতে পারে ? সাধনক্রিয়ায় সাফল্য আসবেই, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কতদিনে সাফল্য আসবে, তা কে বলতে পারে ? আবার আমরা কেউ নিজশক্তিতে বলীয়ান নোই। এমনকি নিজ শক্তি সম্পর্কেও আমরা সম্পূর্ণরূপে জ্ঞাত নোই। কর্ম্ম ত্যাগ সহজ বলে মনে হয়, অর্থাৎ সন্যাস ধর্ম্ম সুখকর বলে মনে হয়। কিন্তু আত্মদর্শন কিসে হবে ? কর্ম্মত্যাগে না কর্ম্মযোগে ? সংসারের দুঃখ-কষ্ট থেকে রেহাই পাবার জন্য, যে বৈরাগ্য, তা আসলে বৈরাগ্যের ভান মাত্র। সংসারের অনিত্য অস্থায়ী সুখ পেতে গেলেও পরিশ্রম করতে হয়। বিনা আয়াসে কোনো কিছুই মেলে না। জ্ঞান-আত্মজ্ঞান যা চিরস্থায়ী আনন্দ দিতে পারে, তা পেতে গেলে আমাদের আরো বেশি পরিশ্রম করতে হবে। আরো বেশি ত্যাগ করতে হবে। পরিশ্রমবিমুখ তামসিক প্রকৃতির মানুষ, কখনও না পায় সংসারীক সুখ, না পায় আধ্যাত্মিক সুখ। গীতার দুটো পাতা মুখস্থ করে আমরা জ্ঞানী হতে চাই। কিন্তু জ্ঞানী সাজলেই জ্ঞানী হওয়া যায় না। জ্ঞানহীনের কর্ম্ম বৃথা, আবার কর্ম্মবিহীন জ্ঞানের কোন মূল্য নেই। জ্ঞানহীনের কর্ম্ম শুভফল দিতে অপারগ। আবার শুষ্কজ্ঞান নিষ্ফলা। যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন বলেন, "যোগম আতিষ্ঠ উত্তিষ্ঠ" যোগকর্ম্মকে আশ্রয় করে উত্তিষ্ঠ হও, তখন অর্জ্জুন দ্বিধায় পড়ে গেল। কেননা অর্জ্জুন জ্ঞানের প্রশংসা শুনে, সংস্কার অনুযায়ী শুষ্কজ্ঞানের আশ্রয়ে আসতে চেয়েছিলো। যা আসলে নিষ্ফলা। জ্ঞানহীনের সংসার নিবৃত্তি হয় না। আবার কর্ম্ম-সন্যাস ব্যাতিত কেউ জ্ঞানী হতে পারে না। কিন্তু জ্ঞান তা সে শুষ্ক হোক বা আদ্র হোক, জ্ঞানই ভালো মন্দ বুঝতে শেখায়। শুভ অশুভের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায়, জ্ঞান । আবার এই জ্ঞানই আমাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। তাই দ্বন্দ আমাদের মধ্যে প্রশ্নের জাগরণ ঘটে। তাই অর্জ্জুনের মনে যথার্থ ভাবেই প্রশ্ন জেগেছে, কোনটা ঠিক - জ্ঞান না কর্ম্ম ? এইসব কথা আমরা ধীরে ধীরে শুনবো।
---------------------------------

Sasanka Sekhar Peace Foundation
৭.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - পঞ্চম অধ্যায় - কর্ম্মসন্যাস যোগঃ
শ্লোক নং ৫/২-৩
শ্রীভগবান উবাচ :
সন্ন্যাসঃ কর্ম্মযোগশ্চ নিঃশ্রেয়সকরাবুভৌ
তয়োস্তু কর্ম্ম-সন্ন্যাসাৎ কর্ম্মযোগো বিশিষ্যতে। (৫/২)

শ্রীভগবান বললেন, সন্ন্যাস ও কর্ম্মযোগ উভয়ই মোক্ষপ্রদ। উভয়ের মধ্যে কর্ম্মসন্যাস অর্থাৎ কর্ম্ম ত্যাগ অপেক্ষা কর্ম্মযোগ শ্রেষ্ঠ।
আমরা শুনেছি, ধ্যান কখনও করা যায় না, ধ্যান হয়। আপনি জোর করে কাউকে ভালোবাসতে পারবেন না। ভালোবাসা এমনি এমনি হয়। তেমনি সন্ন্যাস নেওয়া যায় না, সন্যাসধর্ম্ম আপনা আপনি আসে। জোর করে কর্ম্ম ত্যাগ করা যায় সত্য, কিন্তু তাতে কোনো সুফল হয় না। আমাদের সংসার জীবনে দেখেছি, প্রথম জীবনে যারা সঠিক কর্ম্মে লিপ্ত থাকে, অর্থ সঞ্চয় করে, তাদের বৃদ্ধ বয়সে, অবসর মেলে। তখন অর্থকরী কর্ম্ম না করলেও চলে। তুলনামূলকভাবে নিশ্চিন্তে জীবন অতিবাহিত করা যায়। কর্ম্ম আমাদের জীবনে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করে দেয়, ফলস্বরূপ আমাদের জ্ঞানের প্রকাশ ঘটে । ঠিক তেমনি মুক্তিকামী সাধকের বিশেষ করে যারা সাধনক্রিয়ায় অনভিজ্ঞ এদের কর্ম্মযোগ অর্থাৎ ক্রিয়াসাধন অবশ্য কর্তব্য। সন্যাসের অবস্থায় পৌঁছতে গেলে আগে কর্ম্মসাধন করতে হয়। জপ করতে করতে একসময়, জপে সাধক স্থির হয়ে যায় , তখন আর সাধকের মুখ দিয়ে জপের শব্দ বের হয় না। প্রণবের ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে একসময় প্রণব স্বতঃস্ফূর্ত হয়। তখন আর প্রয়াস করতে হয় না। ভোগ না হলে নিবৃত্তি আসে না। তো সাধনার প্রারম্ভে অবশ্য়ই কর্ম্মসাধন করতে হবে। সাধনক্রিয়া না করে, সাধনার উচ্চ অবস্থায় পৌঁছনো যায় না। সিঁড়ি না ভাঙলে ছাদে স্থির হওয়া যায় না। প্রণব উচ্চারণ না করে, প্রথমেই প্রণবের ধ্বনি স্বতঃস্ফূরিত হবে, এমনটা ভাবা অলীক স্বপ্ন মাত্র।
এখন এই সাধনক্রিয়া করতে করতে একদিন সাধনার পরাবস্থা আসবে। তাই সাধনক্রিয়া আর সাধনার পরাবস্থাকে সমানভাবে গুরুত্ত্বপূর্ন বলা হয়েছে । দুটিকেই যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ মোক্ষপ্রদ বলছেন। এখন কেউ যদি জন্ম-জন্মান্তরের সাধক হন, তবে তাঁর মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই স্বল্প প্রয়াসে সাধনার পরাবস্থা দেখা দিতে পারে। এমন অনেক মহাপুরুষ সম্পর্কে আমরা শুনে থাকি, যারা জন্মসিদ্ধ। আমরা চোখ বুজে ধ্যানে বসলে, প্রথমে আমাদের সামনে অন্ধকার নেমে আসে। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ, চোখ বুজলেই আলোক জ্যোতিঃ দেখতে পেতেন, যা আমাদের কিছুদিন সাধনার পরে আসে। বিষয়ে বিরাগ না এলে, সন্যাসে সফলতা আসে না। সাধারনের বিষয় বৈরাগ্য আসা কতো কঠিন, তা সাধক মাত্রেই জানেন। কিন্তু যারা ঈশ্বরে মন-প্রাণ ঢেলে দিয়ে সংসারের সমস্ত কর্ম্ম করেন, যাঁরা প্রতিনিয়ত ঈশ্বরের কর্ম্মই করেন, সমুদয় কর্ম্মফল ঈশ্বরে সমর্পন করেন, তাঁদের কর্ম্মত্যাগ হয় না সত্য, কিন্তু কর্ম্মফল ত্যাগ হয়ে যায়। আর এই কর্ম্মফল যখন ত্যাগ হয়ে যায়, তখনই সন্যাস লাভ হয়। যিনি সমস্ত কর্ম্ম ভগবৎপ্রীতির জন্য সম্পাদন করেন, তাঁদের, কর্ম্ম স্পর্শ করতে পারে না, আবার ঈশ্বর থেকেও তাঁরা দূরে থাকেন না। তো সাধনক্রিয়া দিয়েই সন্ন্যাস হতে পারে। সাধনক্রিয়া ভিন্ন সন্যাসের চিন্তা আসতে পারে না। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কর্ম্মত্যাগ অপেক্ষা যোগকর্ম্ম অবশ্য়ই শ্রেষ্ঠ।
জ্ঞয়ঃ স নিত্যসন্যাসী যো ন দ্বেষ্টি ন কাঙ্ক্ষতি নির্দ্বন্দ্বো হি মহাবাহো সুখং বন্ধাৎ প্রমুচ্যতে। (৫/৩) হে মহাবাহো, যিনি কোনোকিছুর আকাঙ্খ্যা করেন না, যার মধ্যে কোনো দ্বেষ নেই, তাকেই নিত্য সন্যাসী বলে জেনো। যিনি দ্বন্দ্বশূন্য, শুদ্ধচিত্ত পুরুষ তিনি অনায়াসে সংসারবন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করেন।
এখানে সংসারবন্ধন থেকে মুক্তিলাভের যোগ্য পুরুষ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, তিনি আকাঙ্খ্যাহীন, দ্বেষরহিত, দ্বন্দশূন্য, শুদ্ধচিত্তের অধিকারী। আমরা সাধনক্রিয়া করতে গিয়েও আকাংখ্যা রোহিত হতে পারি না। সাধনক্রিয়া করতে গিয়ে আমরা ক্রিয়াসিদ্ধির কথা আকাংখ্যা করি। যদি কোনো গুরুভাই, গুরুসান্নিধ্য বেশি পায়, বা গুরুদেবর কৃপা বেশি পায়, তবে তার প্রতি আমাদের হিংসার ভাব না হলেও দ্বেষের ভাব পরিত্যাগ করতে পারি না। এগুলো অবশ্য়ই যোগীর পক্ষে বাধা স্বরূপ। গুরুবাক্যের প্রতি নিঃসন্দেহ হওয়া কর্তব্য। গুরুদেব যা বলছেন, তা সত্য না মিথ্যা তা আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে নেই। গুরুর নির্দেশ পালন করলেই, আমরা সত্যের সামনে উপস্থিত হতে পারি। তখন আমরা দ্বন্দ্বহীন হতে পারি। তাই ক্রিয়ার আগেই দ্বন্দ্বের মীমাংসা বা বিচার করতে গেলে, আমাদের সাধনক্রিয়া ব্যাহত হয়। কেননা আমরা অজ্ঞান, গুরুদেব আমাদের এই অজ্ঞানকে দূরীভূত করবার জন্য, জ্ঞানাঞ্জন শলাকা দিয়ে খোঁচাতে থাকেন। জ্ঞান শুধু উপদেশ নয়। জ্ঞান প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। আর এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা পেতে গেলে, আমাদের গুরুর নির্দেশে কর্ম্ম করতে হবে। বাহ্য দৃষ্টিতে সেই কর্ম্মের মধ্যে আমরা কোনো যুক্তি খুঁজে পাই না। তাই আমাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব জাগে। কিন্তু জানবেন, গুরুদেব এই রাস্তা ধরেই আজ গুরুর আসনে উপবিষ্ট হয়েছেন। হাজারো বিরূপতার মধ্যে দিয়ে তিনি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। আর এই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি একটা সিদ্ধান্তে এসেছেন। আমরা সেই স্বতঃসিদ্ধের অনুশীলনীতে যেন সন্দেহ প্রকাশ না করি। গাফিলতি না করি। তাই গুরু আদেশ পালন করে যাওয়াই, আমাদের মঙ্গলের পথে নিয়ে যেতে পারে। যথার্থ শিষ্য গুরুবাক্যে বিচলিত হন না। তার মনে কোনো দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় না। এই অবস্থায় শিষ্যের মধ্যে একটা নিশ্চিন্তভাব বজায় থাকে, আর গুরু-নির্দেশিত কর্ম্মে আরো বেশি মনোযোগী হতে পারে। ফলত সেইমতো কর্ম্মফল পেয়ে থাকে। ভালো ডাক্তারের নির্দেশে পরিমিত ঔষধ খেলে যেমন রোগ সারে, এর জন্য ঔষধের ক্রিয়াপদ্ধতি জানতে হয় না, তেমনি সাধন ক্রিয়া করলে, অর্থাৎ শাস্ত্র-বিধি মেনে বা গুরুনির্দেশ মতো, প্রাণায়াম-ইত্যাদি করলে, প্রাণবায়ু স্থির হয়। প্রাণবায়ু স্থির হলে, মনের চঞ্চলতা দূর হয়। মনের চঞ্চলতা দূর হলে বুদ্ধি প্রখর হয়। বুদ্ধি প্রখর হলে, সত্ত্বর জ্ঞানলাভ হয়। আর এই জ্ঞানলাভে সাহায্য করে প্রখর অনুভূতিশক্তি। অর্থাৎ আপনার মধ্যে অনুভূতিশক্তি যত বাড়বে, আপনার উপলব্ধি তত সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হবে। তখন আমরা প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অধিকারী হবো। আর এই প্রত্যক্ষ জ্ঞান আমাদের বিষয়ের ভীতি দূর করে দেবে। বিষয়ের দ্বন্দ্ব দূর করে দেবে। তখন আমরা দ্বন্দ্বহীন হয়ে, ভয়শূন্য হয়ে, নির্ভিক চিত্তে মাথা উঁচু করে, জগতে বিচরণ করতে পারবো। এই যে নিশ্চিন্ত ভাব একেই বলে সন্যাস। তো এই সন্যাস অবস্থা প্রাপ্ত হতে গেলে, আমাদের সাধনক্রিয়ায় সিদ্ধ হতে হবে।
৮.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - পঞ্চম অধ্যায় - কর্ম্মসন্যাস যোগঃ
শ্লোক নং ৫/৪-৫
সাংখ্যযোগৌ পৃথগ্ বালাঃ প্রবদন্তি ন পন্ডিতাঃ
একম--অপি-আস্থিতঃ সম্যগ-উভয়ো-বিন্দতে ফলম। (৫/৪)

বালসুলভ অজ্ঞ ব্যক্তি সন্যাস ও কর্ম্মযোগকে ভিন্ন বলে থাকে কিন্তু পন্ডিতগণ একথা বলেন না। এরমধ্যে যেকোনো একটির সম্যক অনুষ্ঠান করলে, উভয়েরই ফল পাওয়া যায়।

সাংখ্য কথাটার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান। তো সাংখ্যযোগী কথাটার অর্থ হচ্ছে জ্ঞানযোগী বা যিনি জ্ঞানের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে রেখেছেন। আসলে সন্যাস আর জ্ঞানযোগীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। শরীর ও শরীরের মধ্যে কূটস্থে স্থিত সেই শরীরীর জ্ঞান যার হয়েছে, তিনিই সাংখ্যযোগী। যারা সাংখ্যযোগ ও কর্ম্মযোগ এর মধ্যে পার্থক্য করেন, তারা বয়সে বা বুদ্ধিতে বড় হলেও, আসলে বালসুলভ অর্থাৎ অবুঝ। যিনি এই দুটোকে ঠিক ঠিক বুঝেছেন, তিনিই আসলে পণ্ডিত। দুটো অবস্থা : একটা হচ্ছে প্রাণে মন স্থির করে, তন্ময় হয়ে যাওয়া। তখন মন সেখানে (আত্মাতে) আটকে থাকে। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, কূটস্থে মনকে স্থির রেখে তন্ময় হলে, কূটস্থে স্থিত নাদবিন্দু ভেদ করে স্থিতিলাভ।এই দুইয়ের মধ্যে মূলত কোনো পার্থক্য নেই। সুতরাং জ্ঞানীর আর যোগীর প্রাপ্তিফল একই হয়। আর এই উভয় সাধনার মুলে প্রাণের আয়াম, বা প্রাণের স্থিরতা প্রাপ্তি ।
প্রাণায়ামের দ্বারা নাড়ীশুদ্ধি হলে, মনকে উর্দ্ধমুখী করে, সহস্রারে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া সহজ হয়। সুষুম্না নাড়ীর জাগরণ প্রাণায়াম দ্বারাই হয়ে থাকে। আর এর ফলেই মনের স্থিরতা আসে। দেখুন শাস্ত্রগ্রন্থ পড়ে বা যোগশাস্ত্র পড়ে যিনি পণ্ডিত ভাবছেন নিজেকে, তিনি প্রতক্ষ্য জ্ঞান থেকে বহু দূরে অবস্থান করছেন। কারন তার কাছে তত্ত্বজ্ঞান প্রত্যক্ষীভূত হয়নি। উভয়ের ফল হচ্ছে চিত্তের সাম্যাবস্থা। আর চিত্তের সামায়বস্থা থেকেই আসে পরমানন্দ। আত্মার স্থিতি যেমন নিত্য, তেমনি আনন্দ তার স্বভাব। প্রকৃত আত্ম জ্ঞানলাভ বা আত্মদর্শন উভয়পথেই হতে পারে।
প্রথমটিতে অর্থাৎ জ্ঞানযোগ বা সাংখ্যযোগের মাধ্যমে কূটস্থ-জ্যোতির মধ্যে প্রবেশ করে, নাদবিন্দু ভেদ করে পরাবস্থা লাভ করতে হয়। আবার যোগক্রিয়ার মাধ্যমে বা প্রাণায়ামের মাধ্যমেও এই একই অবস্থা লাভ করা যায়। প্রাণের নিরুদ্ধ অবস্থায়, স্বাভাবিক ভাবেই মন প্রাণে লয়প্রাপ্ত হয়। এই স্থিতিতে মন-প্রাণ পরমাত্মাতে প্রবেশ করে। তখন কর্তৃত্ত্বাভিমান বলে কিছু থাকে না। সাধক তখন নিষ্কাম, আকাঙ্খ্যারহিত, দ্বেষশূন্য হয়ে অবিচল স্থিতি লাভ করেন। অতএব একথা বলা যেতে পারে, জ্ঞানযোগ, বা যোগক্রিয়া উভয়ের সাহায্যেই সাধক একই স্থিতাবস্থা লাভ করে থাকেন।
যৎ সাংখ্যৈঃ প্রাপ্যতে স্থানং তদ যোগৈরপি গম্যতে একং সাংখ্যং চ যোগং চ যঃ পশ্যতি স পশ্যতি। (৫/৫) কর্ম্মত্যাগী সন্যাসীগন যে স্থান লাভ করেন, কর্ম্মযোগীগণ সেই একই স্থান প্রাপ্ত হন। যিনি কর্ম্মসন্যাস ও কর্ম্মযোগকে এক দেখেন - তিনিই তত্ত্বদর্শী। সান্যাসীগণ যে কারনে কর্ম্ম ত্যাগ করেন, কর্ম্মযোগীগণ এই একই কারনে যোগক্রিয়া করে থাকেন। এদের লক্ষে কোনো পার্থক্য নেই। ধ্যানে আবিষ্ট হয়ে, ষটচক্র ভেদ করে, সহস্রারে পৌঁছতে হয়। আবার বিভিন্ন আসন-মুদ্রার অভ্যাসের ফলে (শক্তিচালনী মুদ্রা, সূর্যভেদ, উজ্জায়ী, শীতলী, ভস্ত্রিকা, এবং মূলবন্ধ, উড্ডীয়ান বন্ধ, জালন্ধর বন্ধ ) সহস্রারে স্থিতি লাভ করা যায়। উভয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে সহস্রারে স্থিতি লাভ। যোগে ষটচক্রের প্রাধান্য দেওয়া হয়, আর আর সাংখ্যদর্শনে সহস্রারের প্রাধান্য দেওয়া হয়। এবং উভয়কেই ব্রহ্মরন্ধ ভেদ করতে হয়। ষটচক্রের ক্রিয়া দ্বারা নাড়ীচক্র শোধন হলে, ব্রহ্মনাড়ীর প্রকাশ ঘটে। অর্থাৎ ব্রহ্মরন্ধ্র উন্মুক্ত হয়। আর ব্রহ্মরন্ধ্রের মধ্যে দিয়ে উর্দ্ধমুখী প্রাণবায়ু সহস্রারে গিয়ে স্থিত লাভ করে। আর অন্যদিকে সাংখ্যক্রিয়া কালে যে প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়, তা সহস্রারেই হয়ে থাকে, সেখানে চিত্ত রোধ হলে ব্রহ্মনাড়ীর প্রকাশ ঘটে। সুতরাং সাংখ্য বা সন্ন্যাস এবং যোগক্রিয়ার ফল একই। যোগীগণ যাঁকে যোগবলে দর্শন করে থাকেন, সাংখ্যদর্শনের অনুসারীগণ তাঁকেই প্রাপ্ত হন। দুই ক্ষেত্রেই চিত্ত নিরোধের অবস্থায় পৌঁছলে তবেই দর্শন সম্ভব হয়। তবে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু জ্ঞানযোগের থেকে ক্রিয়াযোগের প্রসংসা করেছেন। কারন প্রাথমিক ভাবে ক্রিয়া না করে যারা নিস্কর্ম শুষ্কজ্ঞানের সন্ধান করছেন, তাদের প্রকৃত জ্ঞান হওয়া সম্ভব নয়। এর পরে শ্লোকে আমরা সেই কথা শুনবো।

৯.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - পঞ্চম অধ্যায় - কর্ম্মসন্যাস যোগঃ
শ্লোক নং ৫/৬-৭
সন্যাসস্তু মহাবাহো দুখম-আপ্তম-অযোগতঃ
যোগযুক্তো মুনির্ব্রহ্ম ন চিরেণ অধিগচ্ছতি। (৫/৬)

যোগব্যাতীত সন্যাস কেবল দুঃখের কারন হয়। অন্যদিকে যোগযুক্ত সাধক অচিরেই ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার লাভ করেন।
বিষয়ে বিরক্ত হয়ে, সংসারে বিরূপ হয়ে একসময় সন্যাস নিলাম। চঞ্চল মন নিয়ে ধ্যানস্থ হবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বিক্ষিপ্ত চিত্ত সেই বিষয়কে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চায় । সংসারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে জঙ্গলে গেলাম বটে, মন থেকে আত্মীয়-পরিজনের কথা ভুলতে পারলাম না। ফলত সংসার সান্নিধ্যে থেকে যদিওবা সুখ-দুঃখের মধ্যে দিন কাটতো, এখন দেখছি, বিরহ যন্ত্রনা সহ্যের অতীত হয়ে উঠছে। আসলে যোগব্যাতীত চিত্ত শুদ্ধি হতে পারে না। আর চিত্তশুদ্ধি না হলে জ্ঞানস্বরূপ যে সন্যাস তা লাভ করা সম্ভব হয় না। মনের মধ্যে কেবল হাজারো কামসংকল্পের উদয় হতে থাকে। কিন্তু যোগাভ্যাসের ফলে যে স্থিরতা আসে, তাতে আর কামসঙ্কল্প জাগ্রত হয় না, এতে করে বিষয় তৃষ্ণা ত্যাগ হয়ে যায়। সুতরাং যতক্ষন না আমাদের চিত্ত শুদ্ধি হচ্ছে, ততক্ষন আমাদের চিত্ত স্থির হতে পারে না। আর অস্থির চিত্তে যথার্থ জ্ঞান সঞ্চয় হতে পারে না। তাই সত্যিকারের সন্যাস বা জ্ঞানযোগ অবলম্বন করতে গেলে, আগে যোগাভ্যাস করতে হবে। যোগাভ্যাস করতে করতে একসময়, মন স্থির হবে, মন শুদ্ধ হবে, তখন বিষয় ত্যাগ আপনা থেকেই হবে। জোর করে সন্যাস নিলে, সেই সন্যাস আসলে আত্মপ্রবঞ্চনা মাত্র। যোগহীনের বিষয়গ্রহনের অভিলাষ কিছুতেই যায় না। এই অবস্থায় সন্যাস না নেওয়াই ভালো। যোগকর্ম্ম করতে করতে যখন আমাদের কর্ম্মাশয় নষ্ট হয়ে যাবে, তখন আমাদের আপনা থেকেই সন্যাস এসে যাবে। হুজুকে পড়ে প্রথাগত সন্যাস গ্রহণ আসলে নিজের সঙ্গে নিজের বিশ্বাসঘাতকতা । এতে করে ইহকাল-পরকাল দুইই নষ্ট হয়। বরং ভগবৎ শরণে এসে, সংসার ধর্ম্ম পালন করা অনেক ভালো।
প্রাণক্রিয়ার সাথে মনকে স্থির করতে পারলে, আমাদের বুদ্ধিও স্থির ও তীক্ষ্ণ হয়। তখন বিষয় জ্ঞান জন্মে। আর অনিত্য বিষয়ের জ্ঞান হলে বিষয়সঙ্কল্প মনের মধ্যে উদয় হয় না। এই পরিণতি প্রাণক্রিয়ার স্বাভাবিক ধর্ম্ম। প্রকৃত সন্যাসীর কর্ম্ম বলতে শরীর-মনের শুদ্ধিকরণ, ঈশ্বর ধ্যান, ভিক্ষান্ন ভোজন ও নিভৃতবাস। এই প্রকৃত সন্যাসের ধর্ম্ম। কখনোই স্বাভাবিক ভাবে বা জোর করে সন্যাস নেওয়া যায় না। আপনি মাত্র একটা দিন, কাউকে কিছু না বলে, খালি হাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে দেখুন। জগৎ সংসার কত কঠিন। একমুঠো অন্ন কারুর কাছ থেকে চেয়ে খেতে পারবেন না। একটা রাত নির্জনে কাটাতে পারবেন না। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, আপনার মন পড়ে থাকবে বাড়ির দিকে। আপনার স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে কি করছে, কি ভাবছে, সেই চিন্তা আপনাকে তাড়া করে নিয়ে বেড়াবে। তখন ঈশ্বরচিন্তা আপনার মনের মধ্যে উঁকিও দিতে পারবে না। তো সন্যাসী সাজলে হবে না। আগে যোগের সাহায্যে প্রাণ-মনকে স্থির করতে হবে। চিত্তকে স্থির করতে হবে, চিত্তকে শুদ্ধ করতে হবে। চিত্ত শুদ্ধ হলে আপনা থেকেই সত্যিকারের জ্ঞানের উন্মেষ হবে। তখন স্বাভাবিক ভাবেই আপনি জ্ঞানযোগের মধ্যে প্রবেশ করবেন। তখন আপনার মন সন্যাসধর্মে দীক্ষিত হবে। মন হবে ধ্যাননিষ্ঠ, কোলাহলবর্জিত, নিঃসঙ্গ। সন্যাস কোনো বহিরঙ্গের সাজ নয়। সন্যাস হচ্ছে মনের ধর্ম্ম। তাই ভগবান বলছেন, সন্যাসের প্রকৃত তাৎপর্য্য না বুঝে, যিনি সন্যাস গ্রহণ করতে চাইছেন, তিনি আসলে নিজের দুঃখ নিজেই ডেকে আনছেন। আর যোগযুক্ত সাধক অচিরেই সন্যাসপ্রাপ্ত হন, এবং ব্রহ্ম সাক্ষাৎ করে থাকেন।
যোগযুক্তো বিশুদ্ধাত্মা বিজিতাত্মা জিতেন্দ্রিয়ঃ
সর্ব্বভূতাত্ম-ভূতাত্মা কুর্ব্বন-অপি ন লিপ্যতে। (৫/৭)

যিনি যোগযুক্ত বিশুদ্ধ চিত্ত সংযতদেহ জিতেন্দ্রিয় সর্ব্বভূতাত্মার আত্মাস্বরূপ, তিনি কর্ম্ম করেও তাতে লিপ্ত হন না। আমরা জানি কর্ম্মই জীবের বন্ধনের কারন। এই কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য আমরা দেহ থেকে দেহান্তরে ঘুরে মরছি। কিন্তু প্রাণকর্ম্মরূপ যোগের অভ্যাস, আমাদের চিত্তকে নিরুদ্ধ করে দেয়। তখন চিত্তমধ্যে আর সংকল্পের উদয় হতে পারে না। আমাদের মন হয়, শুদ্ধ, নির্মল। এই নির্ম্মল মনেই আত্মসাক্ষাৎকার সম্ভব হয়ে থাকে। যোগীর যখন জিতেন্দ্রিয় হয়ে যান, অর্থাৎ সমস্ত ইন্দ্রিয় যখন মনের নিয়ন্ত্রণে আসে, আর মন যখন ব্রহ্মে স্থিত থাকে, তখন যোগীর ইন্দ্রিয়সকল স্থির মনের নিয়ন্ত্রণে থাকায়, তারা আর স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না। এইসময় যোগীর শরীর থাকে তাঁর নিষ্ক্রিয় মনের বশে। যোগী তখন সর্বভূতে আত্মাকেই দর্শন করে থাকেন। শরীর রক্ষার জন্য, বা প্রারব্ধ বশে হয়তো তার আবশ্যিক কর্ম্ম করতে হয়, কিন্তু কর্ম্মের প্রতি কোনো মোহ থাকে না। কর্ম্মের কোনো ছাপ তার মনের মধ্যে পড়তে পারে না। কেননা তার মন তখন ব্রহ্মে স্থিত। যোগীর চিত্ত শুদ্ধ, সঙ্কল্পশূন্য, তিনি জিতেন্দ্রিয়, তার অজ্ঞান দূর হয়ে যায়। তিনি সর্বভূতে আত্মাকেই দর্শন করেন। তা কর্ম্ম সংকল্প রোহিত, ফলাকাঙ্খ্যাহীন। তাই কর্ম্ম তাঁকে আবদ্ধ করতে পারে না। তিনি কর্ম্ম করেও, কোনো কর্ম্মেই লিপ্ত হন না।

১০.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - পঞ্চম অধ্যায় - কর্ম্মসন্যাস যোগঃ
শ্লোক নং ৫/৮-৯

নৈব কিঞ্চিৎ করোমীতি যুক্ত মন্যেত তত্ত্ববিৎ
পশ্যন্ শৃন্বন্ স্পৃশন্ জিঘ্রন-অশ্নন্ গচ্ছন্ স্বপন্ শ্বসন্। (৫/৮)

প্রলপন্ বিসৃজন্ গৃহ্ণন্ন-উন্মিষন্-নিমিষন্-অপি
ইন্দ্রিয়াণি-ইন্দ্রিয়ার্থেষু বর্তন্ত ইতি ধারয়ন্ । (৫/৯)

কর্ম্মে লিপ্ত তত্ত্ববিদ দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, ঘ্রান, ভোজন, গমন, নিদ্রা, স্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া, কথাবলা, ত্যাগ, গ্রহণ, উন্মেষ ও নিমেষে প্রভৃতি কাজ করেও, মনে করেন ইন্দ্রিয়গণই তাদের নিজেদের বিষয়ে প্রবৃত্ত হচ্ছে। আমি কিছুই করছি না। তোমার কর্ম্ম তুমি করো মা, লোকে বলে করি আমি । তত্ত্বদর্শী পুরুষ জগতের সমস্ত কাজ-কর্ম্মে নিযুক্ত থেকেও সমস্ত কর্ম্মে নির্লিপ্ত ও অনাসক্ত থাকেন। তত্ত্বদর্শী পুরুষের দেহে স্থিত ইন্দ্রিয়সকল নিরন্তর নিজ নিজ কাজ করে চলেছে, এমনকি বিষয়সেবায় নিযুক্ত হচ্ছে, কিন্তু এতেকরে কর্ম্মযোগীর মনে বা হৃদয়ে কোনো বিকার উৎপন্ন হচ্ছে না। দেহে যতক্ষন আমাদের অহংবোধ থাকে, ততক্ষন আমাদের কর্ম্ম সাধিত হয়। কর্ম্মফল সঞ্চিত হয়। যার মধ্যে আমি বোধ নেই, তার আবার কর্ম্ম কি ? আমরা শুনেছি, দেবদেহে, অথবা ইতরদেহে কোনো কর্ম্মফল সঞ্চিত হয় না। আত্মায় স্থিত স্থুলদেহ স্বভাববশতঃ কর্ম্ম করে থাকে। এই যে কর্ম্ম এসব আরোপিত কর্ম্ম, যা অধ্যাস ছাড়া কিছু নয়। অর্থাৎ স্থুল শরীর তৈরীর প্রক্রিয়ার কারণেই এই অধ্যাসরূপ কর্ম্ম স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ঘটে থাকে। আর এই অধ্যাস নাশের জন্য, সাধক সাধনা করে থাকেন। সাধন ক্রিয়া চলতে চলতে একসময় দেহাভিমান বা আত্মবোধ বিনষ্ট হয়। তো যতক্ষন দেহাভিমান থাকবে, ততক্ষন আমাদের কর্ম্মবন্ধন থাকবে। যাঁর দেহাভিমান নেই, যিনি দেহকে মনেপ্রানে ছেড়ে দিয়েছেন, তার দেহ কি করছে না করছে, তার খোঁজ ওই তত্ত্বদর্শী রাখেন না।এখন কথা হচ্ছে, দেহাভিমান নেই বলে দেহ তার অধ্যাসকে ত্যাগ করবে, তার কোনো মানে নেই। প্রকৃতির যে শক্তি স্বভাবসিদ্ধ ভাবে দেহের মধ্যে রয়েছে, সে তার ক্রিয়া থেকে বিচ্যুত হতে পারে না। স্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক ভাবেই বইবে। দেহের ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকবে। খাদ্য হজম হবে, বাহ্যক্রিয়া হবে। ঠিক তেমনি, গমন, শ্রবণ, কথন, ইত্যাদি ক্রিয়া চলতে থাকবে। এই শক্তি তো শরীর থেকে বিলুপ্ত হয় নি। এই সমস্ত প্রকৃতির কার্য্য। এখন কথা হচ্ছে, যতক্ষন আপনার মধ্যে দেহাভিমান থাকবে, আত্মাভিমান থাকবে, ততক্ষন এই প্রাকৃতিক কর্ম্মই বন্ধনের কারন হতে পারে। অজ্ঞান পুরুষের অভিমান থাকে। তাই আমি করছি, আমার কর্ম্ম ইত্যাদি ভাব থেকে সে মুক্তি পায় না। আত্মা নিজে অকর্তা হয়েও, এই কর্তৃত্বাভিমান হেতু বদ্ধ হন। আর এই আত্মা যখন অভিমানযুক্ত হন, তখন প্রকৃতির সাথে মনের উৎপন্ন হয়। এই মনের দ্বারা যাবতীয় ভোগ ইন্দ্রিয়দ্বারা গ্রহণ করে - আমি গ্রহণ করছি, আমি দান করছি, আমি কথা বলছি এইভাবে নিজেকে নিজেই মুগ্ধ করে। একেই আত্মার বদ্ধ অবস্থা বলা হয়ে থাকে । জড় প্রকৃতিতে এই ভাবেই চৈতন্যের স্ফূরণ ঘটে থাকে। আত্মাই প্রকৃতির মধ্যে প্রবেশ করে, যেন ক্রিয়া করছেন। প্রকৃতিও এই অহংরূপী আত্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে কর্ম্ম করে থাকে। ইন্দ্রিয়দ্বারা যে জ্ঞান সংগ্রহ হয়, তা অনিত্য বস্তুর উপরে আরোপিত ভ্রমাত্মক জ্ঞান। প্রকৃত জ্ঞানের উন্মেষ হলে, এই ভ্রমাত্মক জ্ঞানের নাশ ঘটে থাকে। তখন আত্মা স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন প্রকৃতির কার্য্যকে আর কোনো অভিমান থাকে না। আসলে তখন মনে হয়, সমস্ত কাজ করছো তুমি, আর নাম হচ্ছে আমার। আসলে অখন্ড ব্রহ্ম যখন খন্ডে খন্ডে প্রদর্শিত হয়, তখন আমাদের খণ্ডজ্ঞানের জন্ম হয়। এযেন নিজের শত শত প্রতিবিম্বের সঙ্গে খেলা। যতক্ষন ছায়াকে নিজের থেকে পৃথক বলে মনে হয়, ততক্ষন এই খেলা চলতে থাকে। যখন চারিদিকের আলো নিভে মাথার উপরে সূর্য্যের উদয় হয়, তখন আর ছায়া থাকে না। তখন ছায়ার সঙ্গে খেলা বন্ধ হয়ে যায়। জ্ঞানসূর্য্য প্রতিবিম্বকে মুছে ফেলে। সাধনার দ্বারা এই ভ্রান্তিরূপ ছায়ার বিলোপ হয়। তখন অনন্তবোধ, অখণ্ডবোধ, জেগে ওঠে। বস্তুর সঙ্গে আত্মার কোনো পার্থক্য নেই। আত্মার মধ্যেই সমস্ত বস্তু প্রবিষ্ট হয়ে আছে। আত্মাতে প্রকৃতি যখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, তখন অহং বলে কিছু থাকে না। আমি-তুমি বলে কিছু থাকে না। আসলে দুজন না হলে খেলা জমে না। যখন আমাদের মধ্যে দ্বৈতবোধ থাকে ততক্ষন জাগতিক সমস্ত ক্রিয়া সংগঠিত হয়ে থাকে। দ্বৈতবোধ চলে গেলে, অহংবোধ চলে গেলে, তখন যাকিছু হয়, তা ইচ্ছারহিত। আর ইচ্ছারহিত প্রকৃতির কর্ম্মসমস্ত ব্রহ্মে সমর্পিত হয়ে থাকে। আত্মার অঙ্গ হচ্ছে প্রকৃতি। তো অঙ্গরূপ প্রকৃতি যখন আত্মার মধ্যে প্রবেশ করে, তখন প্রকৃতি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। একেই অদ্বৈত জ্ঞান বলে। এই অদ্বৈত জ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সাধক, যোগীপুরুষ সমস্ত ক্রিয়াকে আত্মক্রিয়া বলে মনে করেন না। সমস্ত ক্রিয়া তখন প্রকৃতির বলে মনে হয়। প্রকৃতি একসময় নিজ চৈতন্যশক্তির সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। তখন যোগীপুরুষ স্ব-স্বরূপে অবস্থান করেন। এই হচ্ছে তত্ত্বদর্শীর স্বরূপ।
------ সংশোধন করা হলো।
১১.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - পঞ্চম অধ্যায় - কর্ম্মসন্যাস যোগঃ
শ্লোক নং ৫/১০-১১

ব্রহ্মণি-আধায় কর্ম্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা করোতি যঃ
লিপ্যতে ন স পাপেন পদ্মপত্রমিব-অম্ভসা। (৫/১০)

যিনি ব্রহ্মে সমস্ত কর্ম্ম সমুদয় স্থাপন পূর্বক আসক্তি ও কর্তৃত্ত্বাভিমান ত্যাগ করে কর্ম্ম করেন, তিনি পাপে লিপ্ত হন না, যেমন পদ্মপত্র জলসংস্পৃষ্ঠ হয়েও জল দ্বারা লিপ্ত হয় না।
পদ্মপাতা জলে ভাসে, এতে করে পদ্মপাতা সিক্ত হয় না। এমন ভাবে কর্ম্ম করতে হবে, যাতে কর্ম্মফল আমাদের সংসার বন্ধনের কারন না হয়। ব্রহ্মকে কর্ম্ম সমর্পন করে কর্ম্ম করতে হবে। এখন কথা হচ্ছে কর্ম্ম কিভাবে ব্রহ্মকে সমর্পন করা যায়। কর্ম্ম যখন ফলাকাঙ্খ্যা রোহিত হয়, কর্তৃত্বাভিমান রোহিত হয়, তখন কৃতকর্ম্মসকল ব্রহ্মে অর্পিত হয়। আমার কর্ম্ম আমি করছি, এই অভিমান যতক্ষন থাকে ততক্ষন কর্ম্ম যার যার তার তার। এই কর্ম্ম ব্রহ্মে অর্পণ করা হলো না। সত্যি কথা বলতে গেলে, কর্ম্ম প্রকৃতিজাত। প্রকৃতিই সমস্ত কর্ম্ম করছে। জীবাত্মা অধ্যাস বশত প্রকৃতির কর্ম্মকে নিজের কর্ম্ম ভেবে কর্ম্মবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। আবদ্ধ মানেই হলো, কর্ম্ম জনিত যে ফল, তা সে সুখ হোক, বা দুঃখ এটি আমি ভোগ করছি, এই ভাবের মধ্যে থাকা। আমি করছি, আমার কর্ম্ম, আমার সুখ, আমার দুঃখ, এই ভাব থেকে বেরিয়ে যেতে পারলেই, কর্ম্ম ব্রহ্মে অর্পিত হলো।
সাধনক্রিয়ার সাথে সাথে,মনের চঞ্চলতা দূর হয়। আর চিত্ত যখন শান্ত হয়, স্থির হয়, চিত্ত তত ব্রহ্মময় হয়। তখন কর্ম্মজনিত হর্ষ বা বিষাদ কোনোটাই কর্ম্মচারীকে প্রভাবিত করতে পারে না। নিষ্কাম কর্ম্মের মূল ভাবটাই থাকে এমন যেন, ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথায় - জেনেশুনে পরের ছেলেকে আদর করা। প্রভুর আদেশ পালন করা মাত্র। এই কর্ম্মে কোনো প্রত্যাশা থাকে না। কেবল প্রভুকে খুশি করবার জন্য কর্ম্ম সাধিত হচ্ছে। নিজের খুশির জন্য নয়। আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, প্রভুর কর্ম্ম সাধন করে, প্রভুকে খুশি করবার মাধ্যমেও নিজের মধ্যে একটা খুশির ভাব জেগে ওঠে। এইভাব থেকেও বেরিয়ে নির্লিপ্ত হয়ে কাজ করতে হবে। প্রভুকে খুশি করবার জন্য নয়, কেবল প্রভুর আদেশ অনুসারে কর্ম্ম করলে, কর্ম্মফলের আঁচ কর্ম্মচারীর গায়ে লাগতে পারে না। এই অবস্থায় কর্ম্মচারীর কোনো প্রত্যাশা থাকে না। আসলে এইসময় কর্ম্মচারীর ভাব হয় ক্রীতদাসের মতো। অর্থাৎ কোনো প্রত্যাশার বিনিময়ে নয়, কেবল প্রভুর নির্দেশ পালন। ভক্তকে ভগবানের আদেশ পালন করতে হবে। হতেপারে, সেই আদেশ বড়ো নিষ্ঠূর, হতে পারে কষ্টকর, কিন্তু প্রশ্নাতীত ভাবে গুরুর আদেশ পালন করে যেতে হবে। শুধু এইটুকু ভাব যদি মনের মধ্যে থাকে যে এতে আখেরে আমার ভালো হবে, এই বিশ্বাস যদি থাকে, গুরুর প্রতি এই শ্রদ্ধা, আস্থা যদি থাকে, তবে কর্ম্ম সম্পর্কে কোনো দ্বন্দ্ব মনের মধ্যে উদয় হবে না। গুরুর উপদেশ পেয়ে কাজ করতে করতে অনেক সময় মনে হয়, এতে আমার শান্তি হচ্ছে কোই ? এতে আমার লাভ হচ্ছে কোই ? এতো পরিশ্রম করছি, সুখ-স্বাচ্ছন্দ ত্যাগ করছি, তথাপি আমার যা পাওয়া উচিত, বা আমার যা হওয়া উচিত তা হচ্ছে কোই ? এই চিন্তা প্রকৃত গুরুভক্ত সাধকের হওয়া উচিত নয়। কেবলমাত্র গুরুর আদেশ পালনেই তার স্বস্তি, শান্তি। মনের মধ্যে কেবল এই ভাব থাকে যে গুরুর আদেশ ঠিকঠিক মতো পালিত হচ্ছে। আমার ভাবার কিছু নেই। এই সাধকই হচ্ছে প্রকৃত গুরুভক্ত, ঈশ্বরভক্ত, সমর্পিত প্রাণ। এদের জীবন ধারনের সমস্ত দায়িত্ত্ব জানবেন, শ্রীগুরুর উপরেই থাকে। স্বয়ং ঈশ্বরই এদের সমস্ত অভাব দূর করে থাকেন। এদের মধ্যে কর্তৃত্ত্বাভিমান না থাকার জন্য কার্য্যের সফলতা বা নিষ্ফলতা এদেরকে সুখী বা দুঃখী করতে পারে না। যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন - বলছেন, পদ্মপাতা সবসময় জলের মধ্যেই থাকে, কিন্তু জলদ্বারা কখনোই সিক্ত না। ব্রহ্মানন্দে যার মন মজেছে, বিষয়ানন্দ তাকে আকৃষ্ট করতে পারে না। বিষয় মনকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আকৃষ্ট করে। কিন্তু যে মন ব্রহ্মেস্থিত, সেই মনকে বিষয় আকৃষ্ট করতে পারে না। আসলে বিষয়ানন্দ স্থুল, আর ব্রহ্মানন্দ সূক্ষ্ম। বিষয়ানন্দ ভারী, আর ব্রহ্মানন্দ হালকা। তাই বিষয়ানন্দের উপরে ব্রহ্মানন্দ ভেসে থাকতে পারে। কিন্তু বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে না। তাই যে সাধক ব্রহ্মে স্থিত, যিনি ব্রহ্মানন্দ্ময়,, তার চিত্ত স্থির হয়েছে। সাধনক্রিয়ার সময় যখন এক-একটা চক্রকে ভেদ করে সুষুম্না নাড়ীর ভিতর দিয়ে সূক্ষ্ম নির্ম্মল বায়ু উর্দ্ধগামী হয়, তখন সর্ব্বকর্ম্ম ব্রহ্মে সমর্পিত হয়ে যায়। তখন আর সাধনলব্ধ বিভূতির দিকে খেয়াল থাকে না। আসক্তি বর্জিত, নিরহঙ্কারী এই সাধক নিশ্চিতভাবে ব্রহ্মে স্থিত থাকেন। তাঁর কোনো পাপবোধ থাকে না। কায়েন মনসা বুদ্ধ্যা কেবল্যৈঃ-ইন্দ্রিয়ৈঃ-অপি যোগিনঃ কর্ম্ম কুর্বন্তি সঙ্গং ত্যক্ত্বা-আত্মশুদ্ধয়ে। (৫/১১) কর্ম্মযোগীগণ ফলকামনা ও কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করে, চিত্ত শুদ্ধির জন্য কেবল শরীর মন ও বুদ্ধির দ্বারা কর্ম্ম করে থাকেন। আত্মশুদ্ধির জন্য, যোগীগণ যে যোগক্রিয়া করেন, সেই ক্রিয়া দ্বারা শরীর মন বুদ্ধি ইন্দ্রিয় ইত্যাদি সমস্তই শুদ্ধ হয়ে যায়। আসলে এই সাধন ক্রিয়ার লক্ষ হচ্ছে ঈশ্বরপ্রীতি। অর্থাৎ ঈশ্বর বা বিশ্বশক্তিকে ভালোবেসে এইসব সাধনক্রিয়া সম্পাদন করা হয়ে থাকে। এর সঙ্গে এমনকি ঈশ্বরকে পাবার জন্যও কোনো কামনা থাকে না। স্রেফ ঈশ্বরকে ভালোবেসে এই কাজ করতে হয়। তাই এই সাধন ক্রিয়ার ফলাফলের প্রতি যোগীর কোনো লক্ষ থাকে না। আর এই যে ক্রিয়া এসবই মন ও শরীরের ক্রিয়া। শরীরের মধ্যে যে অজস্র নাড়ীমণ্ডলী আছে, তার মধ্যে যে সূক্ষ্ম নালী আছে, আর নালীর মধ্যে যদি কোনো মল জমে থাকে তাকে পরিষ্কার করে এই সাধনক্রিয়া। শ্লেষ্যা-পিত্ত-কফ দ্বারা এই নাড়ী মধ্যস্থ নালী সকল রুদ্ধ থাকে। ফলত এই রুদ্ধ নাড়ীর মধ্যে প্রাণবায়ু চলাফেরা করতে পারে না। দেখুন আমাদের শরীরের সর্বত্র যদি বায়ুর চলাচল নিশ্চিত করা না যায়, তবে যে অঙ্গে বায়ুর গতাগতি রুদ্ধ থাকবে, সেখানে চৈতন্য শক্তি যা বায়ুর মধ্যেই মিশ্রিত আছে, সেই চৈতন্য শক্তি সেখানে পৌঁছাতে পারবে না। ফলত আমাদের সেই অঙ্গ অসার বা ক্রিয়াহীন হয়ে যাবে । তো চেতনশক্তি সমস্ত শরীরের মধ্যে সুষ্ঠভাবে প্রবাহিত করবার জন্য, আমাদের এই অজস্র নাড়ীকে শুদ্ধি বা নাড়ীর মধ্যে যে কফ -পিত্ত-শ্লেষ্যা জমে আছে, তাকে পরিষ্কার করে দিতে হবে। তা করতে পারে, এই বায়ুর বেগশক্তিকে বর্দ্ধিত করে, বায়ুকে শুদ্ধ বা সূক্ষ্ম করে। প্রাণ ও অপানের ঘর্ষনে প্রজ্বলিত বহ্নির উত্তাপ দিয়ে বায়ুকে সূক্ষ্ম ও উর্দ্ধ-গতিসম্পন্ন বা অধিক গতিশীল করা যায়। আর এই বিজ্ঞানের উপরে ভিত্তি করেই , আমাদের সাধন প্রণালী রচিত হয়েছে। সুতরাং যে পথে প্রাণশক্তিকে চালনা করা কঠিন হয়,সেইসব স্থানে প্রাণশক্তির সঞ্চালন করবার জন্য, প্রাণায়াম দ্বারা নাড়ী মল দূরীভূত করতে হয়। একেই বিশুদ্ধিকরন প্রক্রিয়া বা নাড়ীশুদ্ধি ক্রিয়া বলা হয়ে থাকে। আর নাড়ী সকলের মল যখন দূরীভূত হয়, তখন সুষুম্না নাড়ীর রন্ধ্রপথ খুলে যায়। আর এই পথে, প্রাণ প্রবিষ্ট হয়ে মনকে স্থির করে ফেলে। এই সময় যোগসাধকের মনে উন্মনী ভাবের জন্ম হয়। মনের এই নিশ্চল ভাবে বুদ্ধিও স্থির হয়। বুদ্ধির স্থিরতা আসলে, বিষয়ের গভীরে তা সে অন্তরের বিষয় হোক, বা বাহ্যিক বিষয় হোক, প্রবেশ সহজ হয়। জ্ঞান আহরণক্রিয়া-শক্তি বর্দ্ধিত হয়। তখন সাধক গাছের মধ্যে ফুল দেখে, ফুলের মধ্যে বীজ দেখে, জীবের শরীরের মধ্যে আত্মাকে দেখতে পায় । অর্থাৎ নিজের স্বরূপকে দেখতে পায় । আর এতে একটা আত্মতৃপ্তি লাভ হয়।
তাই যোগীপুরুষগন বলে থাকেন, আসন, মুদ্রা, প্রাণায়াম ইত্যাদি দ্বারাই সাধক নিজের মধ্যে নিজেকে প্রবেশ করাতে পারেন। এই সাধনক্রিয়ার অর্থাৎ প্রাণক্রিয়ার জন্য পবিত্র শরীর, আবার ধারণা-ধ্যান ইত্যাদির জন্য প্রয়োজন একটা শুদ্ধ মনের। আবার সমাধির জন্য দরকার শুদ্ধ মনের সঙ্গে সূক্ষ্ম বুদ্ধি অর্থাৎ জ্ঞান। এই সাধনক্রিয়ার সাহায্যে সাধক ক্রমশঃ বুদ্ধিকে স্থির করে, ইছারহিত হতে পারে। সুতরাং সাধনক্রিয়ার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বিক্ষিপ্ত মন যা বিষয়মুখী, সেই বিক্ষিপ্ত মনকে স্থির করে অন্তর্মুখী করে ব্রহ্মে স্থিত করা। আর এইসব ক্রিয়া করবার সময় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে, শরীরের রোগব্যাধি যেমন দূর হয়ে যায়, তেমনি শরীরের নানান ঐশীশক্তি যাকে যোগবিভূতি বলে, তার প্রকাশ স্বাভাবিক ভাবেই ঘটে থাকে। একে উপেক্ষা করাই প্রকৃত যোগীর কর্তব্য। এবং এই যোগবিভূতি অগ্রাহ্য করে, যোগীপুরুষ সত্যের সন্ধান পেতে পারেন। যাকে প্রকৃত জ্ঞান বলা হয়ে থাকে। এই জ্ঞানের উন্মেষে তার জগৎভ্রান্তি দূর হয়ে যায়। আপনাকে আপনি প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন। এইজন্য যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কর্ম্মযোগীগণ ফলকামনা ও কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করে, চিত্ত শুদ্ধির জন্য কেবল শরীর মন ও বুদ্ধির দ্বারা কর্ম্ম করে থাকেন।
Show less
১২.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - পঞ্চম অধ্যায় - কর্ম্মসন্যাস যোগঃ
শ্লোক নং ৫/১২-১৩
যুক্তঃ কর্ম্মফলং ত্যক্ত্বা শান্তিম-অপ্নোতি নৈষ্ঠিকীম
অযুক্তঃ কামকারেণ ফলে সক্তো নিবধ্যতে। (৫/১২)

যোগযুক্ত পুরুষ কর্ম্মফল ত্যাগ করে, পরম শান্তি লাভ করেন। অযোগী পুরুষগন কামনা দ্বারা ফলে আসক্ত হয়ে বন্ধন প্রাপ্ত হন।

নিরন্তর সাধনায় লিপ্ত থেকে, যোগীপুরুষ ধীরে ধীরে সাধনার উচ্চ অবস্থা লাভ করেন। আর সাধনার পরাবস্থায় শান্তি ভিন্ন কিছুই থাকে না। সংসারে বদ্ধজীব আমি আমার করতে করতে কর্ম্ম করে থাকে। যোগীপুরুষের মধ্যে যোগাবস্থায় এই আমি-আমার ভাব থাকে না। সুতরাং বিষয় বাসনা অন্তর থেকে বিসর্জিত হওয়ায় চাওয়া-পাওয়ার উর্দ্ধে উঠে যান। তখন একটা স্বস্তির ভাব আসে, যা পরমশান্তি দায়ক। সাধন ক্রিয়ার গভীরতার সঙ্গে সঙ্গে শান্তির পরাবস্থা প্রাপ্ত হন। কিন্তু যারা যোগক্রিয়া সম্পর্কে অনাগ্রহী, তারা এর সুফল সম্পর্কেও কোনো ধারণা করতে পারেন না। এদের চিত্ত বিষয়মুখী - বহুমুখী। এরা বিষয়ের প্রাপ্তিতে উচ্ছসিত হয়, আবার বিষয়ের অভাবে শোকগ্রস্থ হয়ে থাকেন। এই অবস্থাকেই জীবকুলের বদ্ধাবস্থা বলা হয়ে থাকে। তাই সাধনক্রিয়া ভিন্ন সংসারবন্ধন থেকে মুক্তিও নাই, আর পরম শান্তিও নাই।

সর্ব্ব কর্ম্মাণি মনসা সংন্যাস্য-আস্তে সুখং বশী নবদ্বারে পুরে দেহি নৈব কুর্ব্বন্ ন কারয়ন্ (৫/১৩) জীতেন্দ্রিয় পুরুষ মন দ্বারা সমস্ত কর্ম্ম পরিত্যাগ করে নটি দ্বারযুক্ত দেহপুরে কিছু না করে, এবং কাউকে কিছু না করিয়ে সুখে অবস্থান করেন। এই দেহের মধ্যে আছে কূটস্থ। আর এই কূটস্থের নটি দরজা সবসময় খোলাই থাকে। অদ্ভুত এই দেহরূপী ঘরখানি। চোখ (২) কান (২) নাক (২) মুখ-১, গুহ্যদ্বার-১ ও মূত্রদ্বার-১, এই মোট নটি দ্বার বিশিষ্ট এই অপরূপ দেহখানি। এছাড়া আছে আটটি কুঠুরি ১) মূলাধার, ২) স্বাধিষ্ঠান, ৩) মনিপুর, ৪) অনাহত ৫) বিশুদ্ধি ৬) আজ্ঞা ৭) সহস্রার ৮) বিন্দুঃ। এই দেহভান্ডের কূটস্থে যিনি অবস্থান করছেন, অর্থাৎ শরীরী তিনি কিছুই করেন না এবং কিছু করানও না। সাধনার দ্বারা মন যখন সঙ্কল্পরহিত হয়েছে, তখনও ইন্দ্রিয়সকল (জ্ঞান-ইন্দ্রিয়, কর্ম্ম-ইন্দ্রিয়) স্বভাবের বশীভূত হয়ে কর্ম্ম করে থাকে। যোগীপুরুষ বলুন, আর অযোগীপুরুষ বলুন, জ্ঞানী বলুন আর অজ্ঞানী বলুন, সন্যাসী বলুন আর সংসারী বলুন, তার চোখ দেখবে, কান শুনবে, শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রিয়া চলবে, বাহ্যক্রিয়া চলবে। কিন্তু যোগীপুরুষ আর অযোগী পুরুষের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, যোগীপুরুষের মধ্যে দেহাভিমান নেই আত্মাভিমান নেই, কিন্তু অযোগী পুরুষের মধ্যে দেহাভিমান, আত্মাভিমান আছে। প্রকৃতি প্রদত্ত এই দেহকৃত, সমস্ত কর্ম্মকে অযোগী পুরুষ নিজের কাজ বলে মনে করেন, আর যোগীপুরুষ এগুলোকে নিজের কাজ মনে করেন না। আপাতত মনে হতে পারে, পার্থক্যটা শুধু ভাবনায়। তো ভাবনার পরিবর্তন হলেই আমরা সবাই যোগী পুরুষের মতো ভাবনায় ভেসে শান্তিতে থাকতে পারি। কথাটা সত্য, কিন্তু ভাবনা আমাদের মনের ক্রিয়া। আর অস্থির অবস্থায় মন আর স্থির অবস্থায় মনের মধ্যে দুই ধরনের ক্রিয়া আমাদের একই মনে উদ্ভূত হচ্ছে। এই যে অস্থির মন আর স্থির মনের ভাবনার মধ্যে পার্থক্য হয়, তার কারন খুঁজতে গেলে বুঝতে পারবেন, সংসারীর মন সদা চঞ্চল, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর যোগীপুরুষের মন সদা শান্ত, তাঁর মন ইষ্টে প্রবিষ্ট হয়ে স্থির ভাবে অবস্থান করছে। দেখুন সবার শরীরই রক্ত মাংসে গড়া। তাহলে কারুর মন স্থির আর কারুর মন চঞ্চল কেন ? এর কারন হচ্ছে, সবার শরীরের বায়ুর সঞ্চালন সমানভাবে হয় না। এমনকি একই মানুষের বায়ুর গতাগতি বিভিন্ন অবস্থায়, বিভিন্ন রকম হয়। এই যে সাধনক্রিয়া যোগীরা করে থাকেন, তা আসলে এই বায়ুকে সঠিক পথে সঞ্চালন করবারবার উপায় মাত্র, যা সংসারী গন জ্ঞাত নন, অথবা জ্ঞাত হলেও, সে পথের পথিক নন। সাধন ক্রিয়ার মধ্যে তারা কখনো যান নি। এই না যাবার পিছনে অনেক কারন থাকতে পারে, কিন্তু সত্য হচ্ছে, বায়ুর সঞ্চালন ক্রিয়া বা প্রাণায়াম ইত্যাদি যারা করেন, তারা বায়ুকে যেমন ধীরগতি সম্পন্ন করতে পারেন, তেমনি বিভিন্ন অঙ্গে প্রয়োজন মতো বায়ুকে প্রবাহিত করতে পারেন, এমনকি স্থির করতে পারেন। আর বায়ু স্থির হলে মন স্থির হয়। আমরা জানি মন বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। আর স্থির মনে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির উদয় হয়। তো তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন মন সংকল্প শূন্য হয়ে যায়। তখন মনের ক্রিয়া বলে কিছু থাকে না। তখন তিনি পরমানন্দ স্বরূপ আত্মাতে স্থিত থাকেন। এই উচ্চ অবস্থায়, দেহের মধ্যে যে দেহি অবস্থান করছেন, তাঁর সামনে নয়টি দরজাই খোলা থাকে, অর্থাৎ সমস্ত দরজা দিয়েই বিষয়ের আগমন নির্গমন হচ্ছে। কিন্তু দেহি তখন থাকেন, নিরুত্তাপ, নিরুদ্বিগ্ন। স্বামী বিবেকানন্দ ধ্যানে বসেছেন, তাকে মশায় ঘিরে ধরেছে। স্বামীজীর এতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই । অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলোর কাজের মধ্যে মনের কোনো সম্পর্ক নেই। দেহের ইন্দ্রিয় কাজ করছে, কিন্তু দেহি না কাজ করছেন, না কাজ করাচ্ছেন। দেখুন সূর্য বা চন্দ্র স্থির, কিন্তু প্রতিবিম্বিত পাত্রের জল অস্থির হলে, মনে হয়, সূর্য বা চন্দ্র স্থির নয়। কিন্তু সত্য হচ্ছে সূর্য বা চন্দ্র স্থির। ঠিক তেমনি আত্মা স্থির, কিন্তু প্রকৃতির নির্মিত দেহের গতাগতি আছে, তাই মনে হয়, আত্মাও গতিসম্পন্ন হচ্ছে। তাই যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, জীতেন্দ্রিয় পুরুষ মন দ্বারা সমস্ত কর্ম্ম পরিত্যাগ করে নটি দ্বারযুক্ত দেহপুরে
নিষ্ক্রিয় হয়ে, সাক্ষী হয়ে সুখে অবস্থান করছেন।
১৩.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - পঞ্চম অধ্যায় - কর্ম্মসন্যাস যোগঃ
শ্লোক নং ৫/১৪
ন কর্ত্তৃত্বং ন কর্ম্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভুঃ
ন কর্ম্মফল-সংযোগং স্বভাবস্তুু প্রবর্ত্ততে। (৫/১৪)

ঈশ্বর লোকের না কর্তৃত্ব না কর্ম্মসমূহ না কর্ম্মফলের সংযোগ সৃষ্টি করেন কিন্তু স্বভাব (যা মায়ারূপ অবিদ্যা) প্রবৃত্ত হয়ে থাকে।

এবার আমরা একটা লোকাচার বিরুদ্ধ কথা শুনলাম, যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের কাছে। বলছেন, ঈশ্বর নাকি কোনো কর্ম্ম বা কর্ম্মফল দাতা নন। মায়ারূপ অবিদ্যা যা আমাদের স্বভাবের মধ্যে আছে, তার দ্বারাই এই কর্ম্ম ও কর্ম্মফল জাত হয়ে থাকে। আমরা শুনেছি, ঈশ্বরের ইচ্ছে ভিন্ন একটা গাছে পাতাও নড়ে না । আমরা শুনেছি, ভগবানের ইচ্ছেয় খোঁড়া গিরি-লঙ্ঘন করতে পারে। কিন্তু এখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ সেই লোকাচার বিরোধী, সত্যের উদ্ঘাটন করলেন।

ঈশ্বর জীবের কর্তৃত্ত্ব সৃষ্টি করেননি, ঈশ্বর জীবের কর্ম্ম উপাদান করেন নি। এমনকি কর্ম্মফল জনিত যে সুখ-দুঃখ তারও দাতা তিনি নন। সবশেষে বলা যেতে পারে, এই কর্ম্মফলের ভোক্তাও তিনি নন। এখন কথা হচ্ছে, ভগবান তো এইসব কথা বলে নিজের কাঁধ থেকে সমস্ত দায় সরিয়ে দিলেন। কিন্তু এই দায় কার ? জীবকুলের না স্রষ্টার ? দেখুন এই দেহ যদি চৈতন্যহীন হয়, তবে তা নিতান্ত জড়পদার্থ ভিন্ন কিছু নয়। তো জড় পদার্থের আবার কর্ম্ম বা কর্ম্মফল থাকতে পারে নাকি ? তো বলা যেতে পারে, দেহের কোনো কর্ম্ম নেই, ভালোমন্দ কিছুইর জন্য নির্বোধ দেহ দায়ী নয়। আবার বলা হচ্ছে আত্মা নির্লিপ্ত। তো যিনি নির্লিপ্ত তার কোনো কিছুর সঙ্গেই লিপ্ত থাকবার কথা নয়। তো তিনি কাজে বা কর্ম্মফলে লিপ্ত হবেন কিভাবে ? তো আত্মাও তাহলে আমাদের কর্ম্মের দায়িত্ত্ব নিতে নারাজ। তাহলে এই যে বিরাট কর্ম্মক্ষেত্ৰ মর্তভূমি, যেখানে চন্দ্র-সূর্য থেকে শুরু করে একটা কীটাণুকীট সারাক্ষন কর্ম্মের মধ্যে ডুবে আছে, তার দায় কার ? কে এর নিয়ন্ত্রক ? যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, " স্বভাবস্তুু প্রবর্ত্ততে" অর্থাৎ এই সমস্ত কিছুর প্রবর্তক হচ্ছে, স্বভাব। এই জায়গাটা আমাদের একটু ভালোভাবে বুঝবার চেষ্টা করতে হবে। আসলে সেই আদি-অনাদি অজ্ঞানতা জীবকূলকে তার পূর্বসংস্কার অনুযায়ী, অনুরূপ কার্য্যে প্রবৃত্ত করছে। এই যে আমাদের পূর্বপূর্ব সংস্কার আমাদেরকে কাজে নিযুক্ত করছে, এটা আমাদের বোধের অতীত। তুমি মানুষ হয়ে জন্মেছো, তোমার দুই পায়ে হাটতে হবে। তুমি চার-হাত-পায়ে হাটতে পারো না। তুমি পাখি হয়ে জন্মেছ, তোমাকে আকাশে উড়তে হবে। তুমি হাঁস হয়ে জন্মেছ, তোমাকে জলে সাঁতার কাটতে হবে। তুমি মাছ হয়ে জন্মেছ, তোমাকে জলে বাস করতে হবে। আমাদের মনে কোনোদিন এই প্রশ্ন জাগে না, কেন আমাকে এটা করতে হবে ? আর কোনো প্রশ্ন জাগে না বলে, আমরা এর জবাব কখনো পেতেও পারি না। আমরা অজ্ঞানতার কারনে, স্বভাব বশে প্রশ্নাতীত হয়ে সবকিছু করে থাকি। এমনকি আমাদের শরীরও এমনটি করবার উপযুক্ত করেই তৈরী হয়েছে। আমরা ধরেই নিচ্ছি, এটাই আমার কাজ। এমনটাই আমাদের করতে হবে। আমি এক সংসারী মহাপুরুষকে দেখেছিলাম। তিনি বাইরের ঘরে বসে ভক্তদের অনুগ্রহ গ্রহণ করতেন, ভক্ত চলে গেলেই, তাঁর বড়োবৌ ঘর থেকে বাইরের ঘরে এসে দানসামগ্রী সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। বড়োবউয়ের অভিযোগ এই সংসারী মহাপুরুষের নাকি কোনো বিষয়বুদ্ধি নেই। কি করে সংসার চলছে বা চলবে, তা নাকি সে জানেই না। সংসারে তিনি নাকি উদাসীন। তাই বড়বৌকেই এসব করতে হয়। এখন আমাদের বুঝতে হবে, বাস্তবিক পক্ষে ভোগ কার ? আদ্দিকালের সংস্কার জীবকূলকে কার্যক্ষেত্রে প্রবৃত্ত করিয়ে থাকে। কিন্তু এই কাজ বা কাজের ফল সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান না থাকার জন্য, সে এই কর্ম্মকে নিজের কাজ বলে মনে করে এবং অভিমানবশতঃ কর্ম্মফলে আবদ্ধ হয়। তাই ভূত-আবিষ্ট জীবাত্মা ভূতের কর্ম্ম প্রেরণাকেই নিজের কাজ বলে মনে করে। জীবাত্মার মধ্যে এই যে ভূতের আবির্ভাব, এই ভূতকে ছাড়িয়ে দিতে পারলেই, সমস্ত ঝামেলা মিটেে যেতে পারে। জীবাত্মাকে কেন ভূতে ধরে, সেই আলোচনা আজ নয়, তবে ভূতকে যে ছাড়ানো যেতে পারে, সেই আলোচনা গীতার মধ্যে নিহিত আছে। তো এটা বোঝাগেল, ভূত তার স্বভাববশতঃ সমস্ত কর্ম্মের প্রবর্তক। অনাদি কাল থেকে প্রবৃত্তিরূপ বাসনা তার স্বভাবকে সঙ্গে নিয়ে জীবের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছে। তাই আমরা দেখতে পাই, প্রত্যেকটি জীবের আলাদা আলাদা স্বভাব আছে। আর এই স্বভাবের বসেই জীব পরিচালিত হচ্ছে। এখন কথা হচ্ছে, পরমাত্মা স্বভাবশূন্য, আর জীবাত্মা স্বভাবযুক্ত কেন ? আমরা শুনেছি, ত্রিগুণের সমন্বিত মায়া হচ্ছে, ঈশ্বরের প্রকৃতি। এই ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতি না থাকলে জগতের সৃষ্টি হয় না। জীবের অনাদি বাসনাই তার প্রকৃতি। এই বাসনা না থাকলে, জীবের সংসার বলে কিছু হয় না। ঈশ্বরের সত্ত্ব, রজঃ, তম, এই তিন গুন্ থেকে জাত প্রকৃতি। আর এই প্রকৃতিই সমস্ত কর্ম্মের কর্তা। এই প্রকৃতিই সমস্ত কর্ম্ম করে থাকেন। তাহলে এটা বোঝা গেলো, জীবের পূর্বজন্মকৃত সংস্কার আর বর্তমান জন্মের বাসনা - এই দুটো হচ্ছে সমস্ত কর্ম্মের মূল। এখন কেউ যদি এটা বলতে পারে, যে কর্ম্মফলে আমার আসক্তি নেই, কর্ম্মফলে আমার স্পৃহা নেই, তাকে কখনো কর্ম্মফল বদ্ধ করতে পারে না। অর্থাৎ আমার যে অহঙ্কার, আমি করছি, আমিই কর্ম্মের কর্তা এই ভাবকে পরিত্যাগ করতে পারলে, আমাদের অহঙ্কার খসে পরে। ঈশ্বরের এই প্রকৃতি বিশ্ব সৃষ্টি করে চলেছে। কিন্তু ঈশ্বরের কোনো কর্তৃত্বাভিমান না থাকার জন্য, এই বিশাল কর্ম্ম-যজ্ঞে তার কোনো ভূমিকা নেই। তো জীবাত্মা বলুন, আর পরমাত্মা বলুন দুজনেরই স্বভাব অবশ্য়ই আছে, কিন্তু জীবের স্বভাব হচ্ছে, সে নিজেকে মনে করে কর্ম্মের কর্তা। জীব এই স্বভাবের সঙ্গে মিলিত হয়ে সে আত্মবিস্মৃত হয়েছে। আর প্রকৃতির কর্ম্মকে সে নিজের কর্ম্ম বলে মনে করছে। অন্যদিকে ঈশ্বর আপন স্বভাবের সাক্ষী বা দ্রষ্টা মাত্র। তিনি জ্ঞানস্বরূপ, তিনি জানেন, যাকিছু কর্ম্ম তা প্রকৃতি করছে। তাই জীব প্রকৃতির বশীভূত। মায়ার অধীন। আর ঈশ্বর হচ্ছেন মায়া বা প্রকৃতির অধীশ্বর। তাই ঈশ্বরেরই মায়া বা প্রকৃতি সমস্ত কাজ করছে, কিন্তু ঈশ্বর তাতে লিপ্ত নন। ঈশ্বর মায়াকে নিয়ে খেলা করছেন, আর জীবসকল এই খেলাকে বাস্তব মনে করে, নিজেকে খেলার ফলাফলের ভাগিদার করে, সুখ-দুঃখে নিপতিত হচ্ছে। এই অজ্ঞানই জীবকে প্রকৃতির দাস করেছে, বদ্ধ করেছে, আর বিপদে পড়ে জীব হা-হুতাশ করছে। এখন কথা হচ্ছে, এই আমি করছি ভাব, বা অহঙ্কার এর নাশ কি করে হবে ? যোগগুরুগন বলে থাকেন, সাধন ক্রিয়ার দ্বারা ক্রিয়ার পরাবস্থায় মগ্ন হয়ে গেলে দেখবে, জগৎব্যাপার আর তোমার কেশাগ্র ছুঁতে পারছে না। তখন এই জগৎক্রিয়াকে স্বপ্নের মতো মনে হবে। আর এই ৮০ বা ১০০ বছরের স্বপ্ন যখনই ভেঙ্গে যাবে, তখন তোমার এইযে দেহ, এই যে মন, এই যে আমি-আমার ভাব অর্থাৎ অহঙ্কার এগুলো সব তখন ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবে। সাধনক্রিয়ার উচ্চ অবস্থায় গেলে, নিজেকে জানতে পারবে, নিজেকে চিনতে পারবে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন, ঘুমিয়ে থাকলেও বাঘ, আবার জেগে থাকলেও বাঘ। ঘুমিয়ে থাকলে, তার ক্রিয়া থাকে না, তার হিংস্রতা থাকে না। কিন্তু জেগে উঠলেই প্রবৃত্তি ক্রিয়াশীল হয়ে যায়। তোমাকে কেবল ক্রিয়াকর্ম্মে প্রবুদ্ধ হতে হবে। নিরন্তর ক্রিয়ার মধ্যে ডুবে যেতে হবে। আর ক্রিয়ার পরাবস্থায়, এই জগৎস্বপ্ন একদিন ভেঙ্গে যাবে। বহুযুগের অন্ধকার ছোট্ট একটা মোমবাতির আলোতে যেমন এক মুহূর্তে কেটে যায়, তেমনি জন্ম-জন্মান্তরের অজ্ঞানতা আমাদের সাধন ক্রিয়ার ফলে কেটে যাবে। আসলে নিজের ভিতরেই আছে এই প্রদীপ, প্রাণ ও অপানের সংঘর্ষে এই আলোর রশ্মি স্ফূরিত হতে শুরু করবে। শরীরের মধ্যে এই যে ইন্দ্রিয়-মন এগুলো সবই জড়। এদেরকে চৈতন্যময় মনে হয় মাত্র। কূটস্থের জ্যোতিই এদেরকে আলোকিত করেছে, চৈতন্যবৎ করছে । কূটস্থের কর্ম্ম করা স্বভাব নয়। তিনি চৈতন্যস্বরূপ, আনন্দস্বরূপ, পরমপুরুষ। আর এই পরমপুরুষ থেকে চৈতন্য বিচ্ছুরিত হয়ে ইন্দ্রিয়াদি দ্বারা সকল কর্ম্ম সাধিত হচ্ছে। এই কূটস্থ সমস্ত কিছুকে সৃষ্টি করেন বটে, কারন এই কূটস্থের প্রকাশজ্যোতিতেই সমস্ত কিছু প্রকাশমান হচ্ছে, তা দেহ-মন যাই বলুন না কেন। আর প্রকাশরূপ প্রকৃতিই সমস্ত কর্ম্ম সম্পাদন করছে। এখন কথা হচ্ছে, তাহলে কি প্রকৃতি আর পুরুষ আলাদা ? না তা নয়। নদীতে যেমন নৌকা ভাসে, জলে যেমন তরঙ্গ ভাসে, তেমনি। আর প্রকৃতির স্বভাব হচ্ছে কর্ম্ম করা। পুরুষের নয়। জীবের জীবত্বের সঙ্গে স্বভাব মিশে আছে। স্বভাবযুক্ত আত্মভাবই জীবাত্মা। তো স্বভাবের অধীন জীবাত্মা, আর স্বভাবের উর্দ্ধে পরমাত্মা। জীবের জীবত্ব ঘুচে গেলে, জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। প্রকৃতিও আত্মার সঙ্গে বিলীন হয়ে যায়। তো আত্মা প্রকৃতির সঙ্গে মিশে জীবাত্মা হয়েছেন। তার এই যে প্রকৃতির বন্ধন, এখান থেকে বেরুবার জন্য, জীবের স্বাধীনতা আছে। নদীর একটা ধারা নদীর উপরে দেখতে পাওয়া যায়, আবার আরো একটা ধারা আছে, যা নদীর গভীরে অন্তঃসলিলে প্রবাহিত হচ্ছে। এটিকে বলে জ্ঞান প্রবাহ। উপরেরটি অজ্ঞান প্রবাহ। আমরা সাধনত অজ্ঞানপ্রবাহের মধ্যে বাস করি। অজ্ঞানপ্রবাহকেই আমরা দেখতে পাই। কিন্তু জ্ঞানপ্রবাহকে খুঁজে পেলেই, আমরা সাম্যাবস্থাতে পৌঁছতে পারি। সেখানে সব স্থির। সেখানে কর্ম্ম বা কর্ম্মফল বলে কিছু থাকে না। সাধন ক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের আত্মস্থ হতে হবে। স্বভাবের পরিবর্তন করতে হবে। তবেই জীবত্বের নাশ হয়ে শিবত্বের প্রকাশ হবে।
--------------------------------
১৪.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - পঞ্চম অধ্যায় - কর্ম্মসন্যাস যোগঃ
শ্লোক নং ৫/১৫-১৬

নাদত্তে কস্যচিৎ পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভুং
অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং তেন মুহ্যন্তি জন্তবঃ। (৫/১৫)

বিভু কারোর পাপ গ্রহণ করেন না, পুন্যও গ্রহণ করেন না । জীব অজ্ঞানদ্বারা আচ্ছন্ন থাকে বলেই মোহগ্রস্থ বা মুগ্ধ হয়।

এই শ্লোকেও যোগেশ্বর আমাদের প্রকৃত সত্যের সন্ধান দিচ্ছেন। দীক্ষার্থী দীক্ষা নিতে গেছেন, তো তাকে গুরুদেব বললেন, তুমি তোমার পাপ কর্ম্মের কথা মনে মনে বলে, পাপমুক্তির জন্য প্রার্থনা করো। তো দীক্ষার্থী বললো, আমি জ্ঞানতঃ কোনো পাপ করিনি। গুরুদেব বললেন, হ্যাঁরে নির্মল এ কাকে নিয়ে এসেছো ? যতসব অজ্ঞানের দল। তো গুরুদেব রেগেমেগে ভাবি শিষ্যকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন। এই গুরুদেব নাকি সমস্ত শিষ্যের পাপ গ্রহণ করে থাকেন। আমাদের একটা ধারণা হচ্ছে, গঙ্গাজলে স্নান করলে আমাদের সমস্ত পাপ ধুয়ে যায়। সত্যিই কি যায় ? যদি যায়, কে সেই পাপের বোঝা গ্রহণ করেন ? এখানে যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের প্রচলিত ধারণাকে নস্যাৎ করে বললেন - বিভু অর্থাৎ পরমেশ্বর কারুর পাপ বা পুন্য কিছুই গ্রহণ করেন না। তিনি পাপপুণ্য কাউকে দেনও না আবার নেনও না। জীবাত্মা আপনাতে আপনি না থেকে আসক্তিপূর্বক অন্যদিকে দৃষ্টি স্থাপন করে, মুগ্ধ হয়, আর পাপ-পুণ্যে জড়িয়ে পড়ে। এখন কথা হচ্ছে জীব আত্মচিন্তন না করে, অন্যদিকে দৃষ্টি দেয় কেন ? মুগ্ধই বা হয় কেন ? আসলে আত্মা যখন অজ্ঞান দ্বারা আবৃত হয়, তখন সে আপনাকে আপনি আর থাকতে পারে না। দেহের মধ্যে প্রবেশ করে, সে নিজেকে দেহ বলে ভাবতে শুরু করে। আর এই দেহাভিমান হেতু, আসক্তিপূর্বক সর্বত্র দৃষ্টি স্থাপন করে থাকে। এর ফলে তার মধ্যে যে সাম্যভাব ছিল, তা বিনষ্ট হয়। আর সে পাপ-পুন্য কর্ম্মে নিজেকে লিপ্ত করে ফেলে। দেহাভিমান জীবকে বহির্দৃষ্টি সম্পন্ন করে তোলে, সুতরাং সে নিজেকে ভুলে যায়, আত্মচিন্তন আর হয় না। যদিও বহু শাস্ত্রগ্রন্থে জীবের পাপ-পুন্য ভগবান প্রদত্ত বলে বলা হয়েছে, এবং সমস্ত কর্ম্ম আমাদেরকে ভগবানই করাচ্ছেন বলে বলা হচ্ছে। যদি শাস্ত্র গ্রন্থের এই সব কথা সত্য হয়, তবে পাপ বা পুন্য কোনো কর্ম্মের জন্যই জীবকূলকে দায়ী করা চলে না। এই দ্বন্দ্বের নিরসন হবে কি করে ? আত্মা নিষ্ক্রিয়, তাই কর্ম্মের জন্য আত্মাকে দায়ী করা চলে না। যোগেশ্বর বলছেন, কর্ম্ম প্রকৃতির, কর্ম্ম স্বভাবের । আবার প্রকৃতি ঈশ্বরের শক্তি ভিন্ন কিছু নয়। আর এই প্রকৃতি ঈশ্বরের ইচ্ছেতেই জাত। ঈশ্বরীয় মায়া হচ্ছে প্রকৃতি। ঈশ্বরের আত্মভাব স্থির। আবার ঈশ্বরের শক্তি প্রকৃতির ভাব বিক্ষেপ। এখন কথা হচ্ছে, মায়া বা প্রকৃতি ঈশ্বর থেকেও কি অধিক শক্তিশালী যে এই মায়ার দ্বারা আচ্ছন্ন জীবকে (জীবাত্মাকে) অজ্ঞানরূপ তমসা দ্বারা আবৃত করে রাখতে পারে। আসলে মেঘ কখনো সূর্যকে দীর্ঘকাল আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে না। তেমনি অজ্ঞানও জ্ঞানকে দীর্ঘকাল আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে না। সমুদ্রের বুদ্বুদ অস্থায়ী। অস্থির মেঘও সাময়িক। একসময় বুদ্বুদ সমুদ্রে মিশে যায়। মেঘ আকাশে বিলীন হয়ে যায়। আত্মাকে কর্ম্মের কর্তা বলা যায় না, কারন তিনি আপ্তকাম, তিনি বিভু। কিন্তু প্রকৃতিজাত মন যখন চঞ্চল হয়ে বাইরের দৃশ্যে মুগ্ধ হয়, তখন সে নিজের স্বরূপের কথা ভুলে যায়। একেই বলে অচিন্ত মায়ার প্রভাব। এই মায়ার প্রভাবেই জীবাত্মার আত্মবিস্মৃতি ঘটে। দেহাভিমান হয়। আর দেহাভিমান হলেই সমস্ত কর্ম্মের কর্তৃত্বাভিমান জন্মে। এই হচ্ছে সুখ-দুঃখ বা পাপ-পুণ্যের কারন। সাধনক্রিয়ার দ্বারা আত্মস্থ হতে পারলে, আত্মার বিভুস্বরূপ বা সর্ব্বব্যাপকত্ব অনুভবে আসে। তখন জগতের এই যে স্থুল প্রকাশ তা অনুভবের মধ্যে আসে না। তখন সর্বভূতে আত্মা এইমাত্র অনুভূত হয়। সর্বভূতে চিন্মাত্র স্বরূপ অনুভব হয়। এইঅবস্থায় যোগী পুরুষ দেহসন্মন্ধ রোহিত হয়ে আত্মাতে স্থিত হন। আর দেহাভিমান ত্যাগ হলেই, কর্ম্ম-অকর্ম্ম,পাপ-পুন্য বলে আর কিছুই থাকে না। এখন তিনি জ্ঞানজ্যোতির জগতে বিচরণ করেন, এখানে তামসিকতা বা অজ্ঞানের লেশ মাত্র থাকে না। এই জগৎকেই বলা হয়, বৈকুন্ঠ বা আমাদের স্বধাম। এখানে মায়ার প্রভাব থাকে না। এখানে উত্তরণের জন্যই যত সাধনক্রিয়া, সত্যের সন্ধান। বিঃদ্রঃ ভগবান বা বিভু কারোর পাপ গ্রহণ করেন না, পুন্যও গ্রহণ করেন না। এই ঈশ্বরবাক্যে আমরা আহত হয়েছি।রাজকর্ম্মচারীর হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে। অস্ত্র চালাচ্ছে রাজকর্ম্মচারী। কিন্তু এই শক্তি সে কোথা থেকে পেলো ? রাজার কাছ থেকে। রাজা নির্বিকার মানে এই নয়, রাজকর্ম্মচারীর কাজের কোনো দায়িত্ত্বই রাজার নয়। রাজকর্ম্মচারীর ভুল ত্রুটির জন্য, তিনি কর্ম্মচারীকে শাস্তি বা পুরস্কার তুলে দিতে পারেন। একথা যেমন সত্য, তেমনি কর্ম্মচারী যার নির্দেশে অস্ত্র চালাচ্ছে, সে তার দায়িত্ত্ব অস্বীকার করতে পারে না। সন্তানের কর্ম্মের জন্য, আইনত পিতা দায়ী নয়। কিন্তু একথা সত্য, সন্তানের কর্ম্ম পিতাকে অবশ্য়ই প্রভাবিত করে থাকে। এমনকি সন্তানের কর্ম্মফল পিতাকে ভোগ করতে হয়। তাই পরোক্ষভাবে, এমনকি নৈতিকতার দিক থেকে পিতা তার পুত্রের কর্ম্মের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেন না। বিভু নির্বিকার, নিষ্ক্রিয়। কিন্তু প্রকৃতি ঈশ্বর থেকেই জাত। ত্রিগুণের সমন্বয়ে প্রকৃতি সৃষ্টিকর্ম্মে লিপ্ত। তো চঞ্চল প্রকৃতি সমস্ত শক্তি প্রাপ্ত হয়েছে, সেই পরমপিতার কাছ থেকেই । শরীরের মধ্যে চৈতন্যের বিলোপ হলে, জড়প্রকৃতি কোনো কর্ম্ম সাধন করতে পারে না। তাই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যাই বলুন না কেন, "আমার কোনো কর্ম্ম নেই", "ন মাং কর্ম্মাণি লিম্পন্তি, ন মে কর্ম্মফলে স্পৃহা" তথাপি কর্ম্ম তাঁকেই করতে হয়। সমস্ত কর্ম্মের দায়িত্ত্ব অস্বীকার করা মানে, ঈশ্বরের সর্বশক্তিমান, ঈশ্বর সর্ব্বব্যাপী বিভু, এই উপাধি থেকে তবে বঞ্চিত হতে হবে। ব্রহ্ম অব্যক্ত হলেও ব্রহ্ম, ব্যক্ত হলেও ব্রহ্ম। সগুন হলেও ব্রহ্ম নির্গুণ হলেও ব্রহ্ম। আবার এই ব্রহ্মের মধ্যেই স্ফূরিত হচ্ছে জগৎ। তো ব্রহ্ম ভিন্ন কিছু নেই। তো ক্রিয়াশীল অবস্থা বা অক্রিয় অবস্থা সবই ব্রহ্মাবস্থা। তো জীব নিমিত্ত মাত্র সমস্ত কর্ম্ম ও কর্ম্মফল তাঁরই। আত্মাই ভোক্তা আবার আত্মাই উন্মনা। টাকার এপিঠ আর ওপিঠ, দুপিঠ মিলেই টাকা। তাই যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ যাই বলুন না কেন, সমস্ত কর্ম্ম প্রকৃতির সাহায্যে তিনিই করছেন, বা করাছেন, এবং সমস্ত কর্ম্মের দায়িত্ব অর্থাৎ ভালো মন্দ তাঁকেই নিতে হবে। নান্য পন্থা। জ্ঞানেন তু তদজ্ঞানং যেষা নাশিতম-আত্মনঃ তেষাম-আদিত্যবজ্ জ্ঞানংপ্রকাশয়তি তৎ পরম্। (৫/১৬) কিন্তু যাঁদের আত্মার জ্ঞান দ্বারা সেই অজ্ঞান নাশিত হয়, তাঁদের সেই আত্মজ্ঞান সূর্য্যের ন্যায় প্রকাশিত হয়। আত্মজ্ঞান যোগীন্দ্রের মধ্যে সূর্য্যের ন্যায় দীপ্তমান হয়। সাধন ক্রিয়ার দ্বারা আত্মস্থ হতে পারলে, অনাত্ম বিষয়সমূহ দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। আর এই অবস্থায় কূটস্থে কোটিসূর্য্যের আলোর প্রকাশ অনুভব হয়। আর এই প্রকাশ সমস্ত বিশ্বের সমস্ত বস্তুর মধ্যে একসত্য আত্মা নিহিত আছে, সেই জ্ঞানের উদয় হয়। বস্তুর উৎপত্তি স্থিতি ও পরিণতির জ্ঞান হয়। ভূত ভবিষ্যত কিছুই আর যোগীর অজানা থাকে না। এই অবস্থাকে সমাধির অবস্থা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু প্রথম দিকে এই সমাধি দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পরে। কখনো সমাধির স্তরে উত্তরণ, আবার কখনো সমাধি থেকে অবতরণ। আর এই অবতরনের ফলে, পুনরায় দেহাত্মবুদ্ধি জেগে ওঠে। তখন অজ্ঞান আবার দেহীকে বেস্টন করে ফেলে। জ্ঞান যেমন অনাদি, অজ্ঞানও অনাদি। আলো ও অন্ধকার পরস্পর মিলেমিশে বাস করে থাকে। আলোর আগমনে অন্ধকার দূরীভূত হয়, আবার আলোর নির্গমনে অন্ধকারের আগমন ঘটে থাকে। সংসার কর্ম্ম অজ্ঞান থেকেই জন্ম। আবার সাধনক্রিয়ার ফলে জ্ঞানের জন্ম হতে পারে। আসলে আসক্তিপূর্বক, অভ্যাসবশত যে কর্ম্ম, বারবার সেই কর্ম্মের ফলে সে কর্ম্মবন্ধনে জড়িয়ে পড়ে। এই কর্ম্ম যখন নিরাসক্ত ভগবত-অর্পিত হয়, তখন কর্ম্ম নৈস্কর্ম বা জ্ঞানে পৰ্য্যবসিত হয়। সাধনক্রিয়া করতে করতে একসময় ক্রিয়ার পরাবস্থা প্রাপ্ত হলে, চিত্ত শুদ্ধি হয়। আর কর্ম্ম-সান্যাসের জন্ম হয়। এই যে ত্যাগ দ্বারা অজ্ঞানরূপ অন্ধকারের নাশ হয়, একেই জ্ঞানসূর্য্যের প্রকাশ বলা হয়ে থাকে। আর জ্ঞানসূর্য্যের প্রকাশ হলে পরমার্থতত্ব জ্ঞাত হয়ে মুক্তিপদ প্রাপ্ত হাওয়া যায়।
-------------------------
১৫.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - পঞ্চম অধ্যায় - কর্ম্মসন্যাস যোগঃ
শ্লোক নং ৫/১৭-১৮

তদ্বুদ্ধয়ঃ-তদাত্মনঃ-তন্নিষ্ঠা-তৎপরায়ণাঃ
গচ্ছন্ত্য-অপুনরাবৃত্তিং জ্ঞান-নির্ধূত-কল্মষাঃ। (৫/১৭)

যাদের বুদ্ধি পরম-আত্মায় নিবিষ্ট, তাদের যাঁদের আত্মভাব এবং তাতেই যাদের নিষ্ঠা, তিনি যাঁদের পরমগতি ও অনুরাগের পাত্র - তাদের আর পুনরায় দেহ ধারণ করতে হয় না।

ঘরছাড়া হলেই, নানান রকম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়। যতদিন পিতামাতার আশ্রয়ে থাকি, ততদিন নিশ্চিত থাকি। যতদিন পিতা-মাতার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা, বিশ্বাস থাকে, ততদিন জীবন থাকে সুরক্ষিত । যেদিন থেকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই, সেইদিন থেকে পা ভেঙে যাবার ভয় তৈরী হয়। যেদিন থেকে নিজের মতো করে চলতে চাই, সেদিন থেকে মা-বাবা হাত ছেড়ে দেন। আর আমরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মোহের পিছনে দৌড়োতে থাকি। একসময় ক্লান্ত হয়ে অবসন্ন হয়ে, আবার ঘরে ফেরার কথা মাথায় আসে। কেন জন্ম গ্রহণ করেছি, তা আমরা জানি না। কেন এই কর্ম্ম-ব্যস্ততা তা আমরা জানিনা। লক্ষহীন এই জীবন একসময় দেহপাত করে। ভঙ্গুরদেহ ছেড়ে আবার নতুন দেহের সন্ধান করে। মোহের বশে ঘুরে মরি দেহ থেকে দেহান্তরে। যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যার বুদ্ধি পরমাত্মাতে স্থিত যিনি কূটস্থে বুদ্ধি-মনকে স্থির করে রাখেন, নিজ আত্মাতে যিনি স্থিত থাকেন, এবং সেখানেই নিঃশেষিত হয়ে যান, তাঁর আর পুনরায় দেহ ধারনের দরকার পড়ে না। জন্মান্তরের যে মূল কারন, সেই অজ্ঞান তখন নষ্ট হয়ে যায়। তখন আর কামনা-বাসনা-সংকল্প কিছুই থাকে না। তো যার কোনো সংকল্প নেই, তার কর্ম্ম করবার জন্য কোনো স্পৃহা থাকে না। কেননা, কর্ম্ম তো সংকল্প সাধনের নিমিত্ত। তো নিমিত্ত যার বিনষ্ট হয়েছে, তার এই কর্ম্মভূমিতে কর্ম্ম-দেহ ধারনের দরকার পরে না। তিনি মুক্তপুরুষ হয়ে সদানন্দ সাগরে অবগাহন করেন। তিনি স্বয়ং বিভুরূপে বিরাজ করেন।
বিদ্যা-বিনয়-সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি
শুনি চৈব শ্বপাকে চ পন্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ। (৫/১৮)

জ্ঞানবান ব্যাক্তিগন বিদ্যা-বিনয়-যুক্ত ব্রাহ্মনে, গাভীতে, হস্তীতে, কুকুরে, ও চণ্ডালে সমদর্শী হয়ে থাকেন।

ক্রিয়ার পরাবস্থাতে যোগীপুরুষ পাগলের মতো, মাতালের মতো, বিষয় বিবেচনার উর্দ্ধে অবস্থান করেন। এইসময় যোগী সবই ব্রহ্মময় দেখেন। জগৎ প্লাবিত হয়ে গেলে, কূপ-নদী-পুষ্করিণীর অস্তিত্ব কোথায় ? ঈশ উপনিষদে বলা হয়েছে, (শ্লোক নং ৫-৭) তিনি সচল আবার স্থির, তিনি দূরে আবার কাছে, তিনি ভিতরে আবার বাইরে। যিনি নিজের মধ্যে সকলকে দেখেন, আবার সকলের মধ্যে নিজেকে দেখেন, তিনি কোনোকিছুকে ঘৃণা করেন না। যখন কোন ব্যক্তি সব কিছুর মধ্যে এক আত্মাকেই দেখেন এবং জানেন যে তিনি নিজেই সবকিছু হয়েছেন, তখন তিনি কোনো কিছুকে ঘৃণাও করেন না বা কোনো কিছুর প্রতি আসক্ত হন না। যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, চণ্ডাল,ব্রাহ্মণ, গাভী, হাতি, কুকুরে সমদর্শী হয়ে থাকেন। সমদর্শী মানে এই নয়, যে তিনি ব্রাহ্মণকে কুকুর বা কুকুরকে ব্রাহ্মণ হিসেবে দেখেন। সমদর্শী কথাটার অর্থ হচ্ছে, যা যেমন তাকে তিনি তেমনই দেখেন। এখন কথা হচ্ছে, আমাদের দৃষ্টি আর ব্রহ্মজ্ঞানীর দৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য কি ? মুন্ডক উপনিষদ (১/১/৬) বলছে, জ্ঞানী ব্যাক্তিগন সর্ব্ববস্তুতে ও সর্বত্র ব্রহ্মকে দেখেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ থেকে শুরু করে কুকুর পর্যন্ত সবার মধ্যে যে মূলসত্ত্বা সেই ব্রহ্মকে ব্রহ্মজ্ঞানীগন দর্শন করে থাকেন। অর্থাৎ চণ্ডালের মধ্যেও যে আত্মা ব্রাহ্মণের মধ্যেও সেই আত্মা আবার কুকুরের মধ্যেও সেই একই আত্মা বিরাজ করছে। এখন কথা হচ্ছে, এই বোধ আমাদের জাগবে কি করে ? এই ব্যষ্টির ও সমষ্টির সংহতিতে পৌঁছাতে গেলে, আমাদের কি করতে হবে। আগে আমাদের ব্যষ্টিসত্তাকে প্রথমে চেতন কেন্দ্রে নিজেকে স্থাপন করতে হবে। এরপরে, আমাদের এই ব্যষ্টিসত্তাকে বিশ্বসত্তা বা সমষ্টির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। আমাদের এই ব্যষ্টিসত্তা বা আমাদের অহংকেন্দ্রটি অজ্ঞান দ্বারা আচ্ছাদিত। তাই পূর্নসত্ত্বা থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আমরা এই অহংকে বিরাটের সঙ্গে মেলাবো কি করে ? এর জন্য আমাদের ঈশ্বরীয় সত্তার ধ্যান-সাধনায় লিপ্ত হতে হবে। ধ্যানাদির দ্বারা আমরা যদি আমাদের আত্মায় এমন এক সুর-সংলাপ সৃজন করতে পারি, যাতে আমাদের ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্ব আমাদের ক্ষুদ্র অহঙ্কার, আমাদের ব্যক্তি চেতনার উর্দ্ধে উঠে যায়, তাহলে আমরা সেই বিরাট অহং-এর স্পর্শ অনুভব করতে পারবো। আর একবার এই বিশ্বচেতনার সঙ্গে সংহতি স্থাপন হলে, জীবাত্মা যদি সাধারণ চেতনাতেও অর্থাৎ দেহ-মনের রাজ্যে আবার ফিরে আসে, তাহলেও আধ্যাত্মিক অহং দেহ-মন সেই চেতনার সুরের সঙ্গে বাঁধা থাকে। রাবিয়া নামে এক সাধিকা ছিলেন। তাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, তুমি কি মন্দকে শত্রু বলে মনে করো ? রাবিয়া একটু হেসে জবাবে বলেছিলেন, আমি ভালোকে ভালোবেসেছি, তাই মন্দ সম্পর্কে আমি একটুও মাথা ঘামাই না। তো যার পরমাত্মার সাথে একবার যোগাযোগ হয়েছে, তিনি সমস্ত কিছুর মধ্যেই পরমাত্মাকে দেখতে পান। তখন ভালো মন্দ, শত্রুমিত্র, ব্রাহ্মণ শুদ্র, জ্ঞানী অজ্ঞানী, হাতি ঘোড়া সবার মধ্যেই তিনি একই আত্মাকেই দেখতে পান। আসলে চেতনাতীত অবস্থাতেই চৈতন্য হতে পারে।
-----------------
Show less
১৬.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - পঞ্চম অধ্যায় - কর্ম্মসন্যাস যোগঃ
শ্লোক নং ৫/১৯-২০

ইহৈব তৈর্জিতঃ সর্গো যেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ
নির্দ্দোষং হি সমং ব্রহ্ম তস্মাদ ব্রহ্মণি তে স্থিতাঃ। (৫/১৯)

যাদের মন সাম্যে স্থিত তাঁরা ইহলোকেই সংসারকে জয় করেন। ব্রহ্ম সম ও নির্দ্দোষ। এজন্য সমদর্শীগন সেই ব্রহ্মেই স্থিত থাকেন।

যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যাদের মন সাম্যে স্থিত। তো কাদের মন সাম্যে স্থির হতে পারে? প্রাণায়ামদি করতে করতে একসময় আমাদের প্রাণবায়ু স্থির হয়ে যায়। আর প্রাণবায়ু স্থির হলে মন স্থির হয়। আর মন স্থির হলে সমতা লাভ হয়। আর সমতাপ্রাপ্ত মন ব্রহ্মস্বরূপ হয়ে যায়। আর ব্রহ্মস্বরূপে দেহাভিমান নষ্ট হয়ে যায়। স্থির মন সাম্য-বুদ্ধি সম্পন্ন হয়। তখন তার মধ্যে বিষয়ের যে ভিন্নতা তা বোধের অতীত হয়ে যায়। তো দেহ-ইন্দ্রিয় জনিত যে সুখ বা দুঃখ তা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। এই সমতার অবস্থাকে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন সাধনার উচ্চ অবস্থা । কেননা এইসময় মন ব্রহ্মে স্থিত হয়। শ্রীকৃষ্ণ আবার বলছেন, ব্রহ্ম সম ও নির্দোষ। মন-প্রাণ স্থির হলে, দেহাভিমান নষ্ট হয়ে যায়। তখন সর্বত্র সমবুদ্ধি হয়, বিষয়ের ভিন্ন ভাব আর বোধের মধ্যে আসে না। একেই বলে নির্দোষ অবস্থা। এই নির্দোষ অবস্থায়, বিষয়জনিত সুখ-দুঃখ রূপ বিকার যোগীর ধারেকাছে আসতে পারে না। এই যে বিকার রোহিত অবস্থা একেই বলে নির্দোষ অবস্থা। সাধারনের দৃষ্টিতে প্রত্যেক জীবের আকারে, বুদ্ধিতে, পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। জড় বস্তুর সঙ্গে চেতন বস্তুর পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এই যে অনৈক্য, এই অনৈক্যের মধ্যেও একটা ঐক্য দেখতে পান, উচ্চকোটির সাধকগণ। এই ঐক্য আছে সমস্ত বস্তুর মূলীভূত সত্তার মধ্যে। সমস্ত বস্তুর কেন্দ্রে আছে সেই আত্মা। যাকে ঘিরে সৃষ্টিচক্র ঘুরছে। সেই মূলীভূত সত্তা নির্বিকার, অপরিবর্তনীয়। কিন্তু এঁকে ঘিরেই সমস্ত বিকার উৎপন্ন হচ্ছে। দেহাভিমান, অজ্ঞান ইত্যাদিও এই আত্মাকে ঘিরেই অবস্থান করছে। মহাত্মাগণ বলে থাকেন। আকাশ তিন প্রকার। একটা হচ্ছে, যে আকাশ আমাদের সবার অনুভবে আসে. অর্থাৎ বহিরাকাশ। আরো একটা আকাশ আছে, যা আমরা চোখ বুজলে দেখতে পারি, তাকে বলা হয়, চিত্তাকাশ। অজ্ঞানীর, সাধনবিমুখ মানুষের এই চিত্তাকাশ অন্ধকার। কিন্তু যাঁরা গুরুর নির্দেশে সাধন-ক্রিয়ার অভ্যাস করেন, তারা কিছু দিনের মধ্যেই তৃতীয় আকাশের সন্ধান পান, তাকে বলা হয় চিদাকাশ। অর্থাৎ চিত্তাকাশে উজ্বল আলোর আবির্ভাব হয়। এই চিদাকাশ জ্ঞানের আলো দ্বারা পরিপূর্ন। যার মন এই সাধনার দ্বারা চিদাকাশের সাথে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে, তাঁর আর পৃথক বস্তুজ্ঞান থাকে না। তাঁর কাছে সমস্ত জগৎ ব্রহ্মময়। সুতরাং শুচি বা অশুচি রূপ ভেদ জ্ঞান তার নিকট থাকতে পারে না। অজ্ঞানীর নিকট দ্বৈতরূপ ভ্রমজ্ঞান থাকলেও সমদর্শী যোগীপুরুষের কাছে, পৃথক-পৃথক বস্তু দৃষ্টিগোচর হয় না। তাঁর কাছে, সমস্ত বস্তু এক-অদ্বিতীয়। এই একত্ববোধ জ্ঞান সম্পন্ন পুরুষ ব্রহ্মযোনিতে অবস্থান করে থাকেন। আর ব্রহ্মযোনিই কূটস্থ। এই কূটস্থে যার মন-প্রাণ স্থির হয়েছে, তাঁর কাছে কোনো লৌকিক আচার অনুষ্ঠানের গুরুত্ত্ব থাকে না। তাঁর বুদ্ধিতে ভ্রান্তিদৃষ্টি বলে কিছু থাকে না। প্রপঞ্চময় এই জগৎ তাঁর দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সমদর্শী পুরুষের ব্রহ্মে স্থিত হয়। এঁদের সংসার বলে কিছু থাকে। সংসারের উর্দ্ধে এঁরা ব্রহ্মময় হয়ে অবস্থান করেন। ন প্রহৃষ্যেৎ প্রিয়ং প্রাপ্য নোদবিজেৎ প্রাপ্য চ অপ্রিয়ম স্থিরবুদ্ধি-অসংমুঢ়ো ব্রহ্মবিদ ব্রহ্মণি স্থিতঃ। (৫/২০) ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি স্থির বুদ্ধি, মোহবর্জিত এবং ব্রহ্মতেই স্থিত। তিনি প্রিয়বস্তু লাভে প্রসন্ন হন না আবার অপ্রিয় বস্তুতে আদৌ উদ্বিগ্ন হন না। সাধনক্রিয়ার দ্বারা প্রাণ-মন-বুদ্ধি স্থির হয়ে যায়। তখন যোগী ব্রহ্মে স্থিত হন। এই অবস্থায় যোগীপুরুষকে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ বলা হয়ে থাকে। এই অবস্থায় দেহাত্মবুদ্ধি থাকে না। অর্থাৎ আসক্তিশূন্য অবস্থায় অবস্থান করেন সাধক । ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের দৃষ্টি একমাত্র ব্রহ্মেই স্থিত থাকায়, তাঁরমধ্যে অন্য বিষয় সম্পর্কে আগ্রহ থাকে না। প্রিয়-অপ্রিয় বোধও থাকে না। আর যার মধ্যে প্রিয় বা অপ্রিয় বোধ থাকে না, তার মধ্যে সুখ বা দুঃখ, হর্ষ-বিষাদ বলে কিছু থাকে। স্বপ্নে আমাদের জাগ্রত অবস্থার দৃশ্য বিলুপ্ত হয়। আমাদের মরনে আমাদের পূর্বস্মৃতি কিছুই থাকে না। তেমনি যোগীপুরুষ যখন চিদাকাশে আলোকজ্যোতির মধ্যে বিলীন হয়ে যান, তখন সংসার বিস্মৃত হয়ে যান। চিদাকাশে জীবাত্মা নিজেকে আকাশরূপী জীব বিবেচনা করে, আধেয় হয়ে আধারে অবস্থান করেন। মর্তবাসী জীব যেমন কল্পনাবলে অন্তরীক্ষে নগর দর্শন করে, তেমনি ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ চিদাকাশে ব্যোম স্বরূপ সৃষ্ট দর্শন করে থাকেন। তখন দ্রষ্টা ও দৃশ্যবোধ থাকে না। এইসময় দেহাভিমান থাকলে, এই দৃশ্য দর্শনে প্রতিবন্ধক হয়। সমাধিস্থ অবস্থায়, স্থুল দেহ একস্থানে রেখে বিশুদ্ধ সত্য স্বরূপ চিত্ত মাত্র অবলম্বন করে, এই অবস্থায় পৌঁছানো যায়। এই পরমাকাশের আদি-অন্ত বলে কিছু নেই। পরমাকাশ সীমাহীন মহান পরমাত্মায় অবস্থিত। সাধক তখন মোহবর্জিত স্থির বুদ্ধিতে অবস্থান করেন।
----------------------------------------------
Show less
১৭.৩.২০২২
যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - পঞ্চম অধ্যায় - কর্ম্মসন্যাস যোগঃ
শ্লোক নং ৫/২১-২৩

বাহ্যস্পর্শেষু-অসক্তাত্মা বিন্দত্যাত্মনি যৎ সুখম
স ব্রহ্মযোগ-যুক্তাত্মা সূক্ষ্মম-অক্ষয়ম অশ্নুতে। (৫/২১)

বাহ্য বিষয়ে অনাসক্ত ও ব্রহ্ম-ভাবে সমাহিত ব্যক্তি আত্মাতে আনন্দ লাভ করেন। এই অবস্থায় তিনি অক্ষয় আনন্দ উপভোগ করেন।

আমরা সবাই বেঁচে থাকতে চাই। আমরা সবাই সুখে থাকতে চাই। এই যে আমাদের বাঁচার আকাঙ্খ্যা, সুখের আকাঙ্খ্যা, এর উপায় হিসেবে, আমাদের জ্ঞানলাভের প্রতি আগ্রহ তৈরী হয়। এই যে জ্ঞান ও আনন্দ এটাই হলো আমাদের প্রকৃত স্বরূপ। চারিদিকে যে ভৌত বস্তু আমরা দেখে থাকি, তারা প্রত্যেকে কারুর না কারুর কোনো না কোনো অভাব পূরণ করে থাকে। আবার এই বাহ্যজগতেকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তবে আমরা দেখতে পাবো, একই বস্তু সমস্ত ঘটনাবলীর পেছনে কারন হিসেবে কাজ করছে। সজীব নির্জীব বা চেতন ও অচেতন সমস্ত বস্তুকে আমরা উপলব্ধি করি চেতনার সাহায্যে। অর্থাৎ চেতনবস্তু ও অচেতনবস্তু দুটোকেই আলোকিত করে, এক জ্যোতিঃ বিশেষ। আবার উপলব্ধি করে থাকে এই চেতনশক্তি। এই চেতন শক্তির মাত্রা ভেদে যেমন বস্তুর মধ্যে পার্থক্য হয়, তেমনি এই চেতন শক্তির মাত্রাভেদে আমাদের উপল্বদ্ধির মধ্যে পার্থক্য ঘটে থাকে। ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষগুলো আমাদের মন আকর্ষণ করে, কারন সেগুলো থেকে আমরা কিছু না কিছু সুখ ভোগ করতে পারবো। অতয়েব একথা বলা যেতে পারে, বাহ্যবস্তুর মধ্যে আমাদের মনকে আকর্ষণ করবার সামর্থ্য আছে। কিন্তু এই যে বাহ্য বস্তু, এর প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। কেবল মাত্র তার নাম-রূপ আমাদের মনকে আকর্ষণ করে থাকে। এই নাম-রূপের পিছনে আছে, সৎস্বরূপ, যা সমস্ত বস্তুর মধ্যেই নিহিত আছে। এই যে সৎ বস্তু এটাই আমাদের অন্তর্জীবনের ও বাহ্য জীবনের ভিত্তি। একেই উপনিষদ বলছে আত্মা বা ব্রহ্ম। আমাদের সবার মধ্যে এই সৎ-স্বরূপ বা ব্রহ্মের সঙ্গে সংযোগের অর্থাৎ একাত্মতার এক অবচেতন অনুভূতি রয়েছে। সেটি হয়তো কারুর মধ্যে প্রবল আবার কারুর মধ্যে অস্ফুট। কিন্তু আছে সবার মধ্যেই। সাধন ক্রিয়ার উদ্দেশ্য হলো এই অস্পষ্ট-আত্ম-সচেতনাকে জাগিয়ে তোলা। আমাদের যে অহং চেতনা, এর পিছনেই আছে, সেই শক্তি। আমাদের যখন প্রাণ-অপানের কাজ চলতে থাকে, অর্থাৎ বাইরের বায়ু ভিতরে আবার ভিতরের বায়ু বাইরে, চলাচল করতে থাকে, তখন মন থাকে চঞ্চল। আর চঞ্চল মনের স্বভাব হচ্ছে বাহ্যবিষয়ে আসক্তি। কিন্তু জিতাত্মা পুরুষের বাইরের বায়ু বাইরেই থাকে আর ভিতরের বায়ু সূক্ষ্মভাবে প্রাণের ক্রিয়ায় রত থাকে। সাধন ক্রিয়া করতে করতে যাঁর এরূপ অবস্থা হয়েছে, অর্থাৎ সমাধির অসীম স্থিরতা লাভ করেছেন, তিনি পরমানন্দে ব্রহ্মে স্থির থাকার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। আনন্দ বিষয়ে নয়, আনন্দ বিরাজ করছে ব্রহ্মে। এখন কথা হচ্ছে আনন্দ যদি ব্রহ্মে থাকে তবে মন বিষয়ের পিছনে আনন্দের জন্য ঘোরে কেন ? একেই বলে অজ্ঞান। অর্থাৎ মন যে বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়, সেই বুদ্ধির স্থিরতা নেই, বুদ্ধির সূক্ষ্মতা আসেনি। প্রাণবায়ুকে নির্মল করে, চিত্তকে স্থির করা, বুদ্ধিকে সূক্ষ্ম করা, এই হচ্ছে সাধন-ক্রিয়ার উদ্দেশ্য। চিত্তের স্থির ভাবই জানবেন আনন্দ। বিষয়লাভে চিত্ত ক্ষনিকের তরে স্থির হয়। তাই আমরা বিষয়ে আনন্দ পাই। কিন্তু আনন্দ আসে চিত্তের স্থিরতা থেকে বিষয় থেকে নয়। তাই সাধন ক্রিয়া দ্বারা প্রাণবায়ুকে স্থির করতে পারলে, চিত্ত স্থির হবে। আর চিত্ত স্থির হলেই পরমানন্দ লাভ হবে। তখন আনন্দের জন্য আর বিষয়ের দরকার পড়বে না। বিষয়ের দ্বারা যে ক্ষনিকের সুখ অনুভব হয়, তা আসলে আমাদের স্বপ্নবৎ ভ্রমজ্ঞান। এই ভ্রমজ্ঞান যখন আমাদের দূর হবে, তখন আমরা বুঝতে পারবো, যে আসলে আনন্দ আছে আমাদের নিজেরদের স্থির চিত্তে, আর দুঃখ আছে আমাদের চঞ্চল চিত্তে। এখানে বিষয় একটা উপলক্ষ মাত্র। চিত্তের স্থিরতা জনিত যে আনন্দ তা যেমন বিষয়-বর্জিত, তেমনি কামবর্জিত। সাধক মনের নিশ্চল অবস্থায় শান্তিসিন্ধুর মধ্যে চিরদিনের জন্য নিমজ্জিত হন। তাই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, বাহ্য বিষয়ে অনাসক্ত ও ব্রহ্ম-ভাবে সমাহিত ব্যক্তি আত্মাতে আনন্দ লাভ করেন। এই অবস্থায় তিনি অক্ষয় আনন্দ উপভোগ করেন। যে হি সংস্পর্শজা ভোগা দুঃখযোনয় এব তে আদ্যন্তবন্তঃ কৌন্তেয় ন তেষু রমতে বুধঃ । (৫/২২) বিষয়ভোগ জনিত যে সুখ তা দুঃখের কারন এবং তা আদি ও অন্তবিশিষ্ট। জ্ঞানীব্যক্তি এতে প্রমত্ত হন না। বিষয়ভোগে একসময় আমাদের ইন্দ্রিয়সকল নিস্তেজ হয়ে পড়ে। চিত্তের চঞ্চলতা বুদ্ধিকে ম্লান করে দেয়। অন্তরাকাশ তমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। চঞ্চল চিত্তে ব্রহ্ম ধারণা সম্ভব নয়। মন যখন ভোগের দিকে ধাবিত হয়, তখন প্রাণও সেইদিকে আকৃষ্ট হয়। বস্তু দ্বারা ক্ষণিক সুখ আমাদের স্মৃতিতে সুখের অনুভূতি সঞ্চিত হতে থাকে। তো ক্ষনিকের সুখ একসময় ফুরিয়ে গেলেও, আমাদের স্মৃতিতে সেই সুখস্মৃতি থেকে যায়। তো আবার মন যখন সুখের জন্য লালায়িত হয়, তখন সে আবার বিষয়ের দিকেই ধাবিত হয়। কেননা এটাই তার সংস্কার, যা সে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সঞ্চয় করেছে। ভোগের ফলে ইন্দ্রিয়শক্তি একসময় নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু মনের ভোগতৃষ্ণা শেষ হয় না। ভোগস্পৃহার স্পন্দন শেষ হয় না। আবার ইন্দ্রিয়গনের ভোগ করবার ক্ষমতা যখন প্রকৃতিগত কারণেই শেষ হয়ে যায়, কিন্তু বিষয় তৃষ্ণা উন্মত্তবৎ হয়ে জীবকে চঞ্চল করে তোলে। এই বিষয় তৃষ্ণা অনন্তকাল ধরে চলতে থাকে। এমনকি দেহ থেকে দেহান্তরে প্রবেশ করে এই ভোগ-লালসা মিটাবার জন্য। কিন্তু কোনোদিনই এই ভোগ লালসার নিবৃত্তি হয় না। বরং দিন দিন বেড়েই চলে। এই জন্য যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, এই ভোগতৃষ্ণা যা আমাদের দুঃখের কারন, তার কোনো শেষ নেই, অনন্তকাল ধরেই চলতে থাকে। আসলে বিষয়ভোগে লিপ্ত জীব, ভোগেও তৃপ্তি পায় না, কারন একসময় বিষয়জনিত যে ইন্দ্রিয়সুখ তার লোপ পেতে থাকে। একসময় ইন্দ্রিয়সুখ লাভে অসমর্থ হয়ে পড়ে। রসোগোল্লা খেতে গিয়ে দেখবেন, প্রথম রসোগোল্লায় যে তৃপ্তি তা ১০-তম রসোগোল্লায় পাবেন না। ২৫-তম রসোগোল্লায় হয়তো বমি এসে যাবে। কিন্তু কিছুদিন পরেই, আবার রসোগোল্লা খাবার জন্য মন আনচান করবে। তো বিষয় পেলেও দুঃখ, আবার না পেলেও দুঃখ। তাই জ্ঞানী ব্যাক্তিগন শান্ত ভাবে বিচার করে এই বিষয় লালসা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করে রাখেন। যতক্ষন বিষয়ে আসক্তি থাকবে, ততক্ষন চিরস্থায়ী শান্তি আস্তে পারে না। কিন্তু প্রাণক্রিয়ার দ্বারা যখন আমরা প্রাণকে স্থির করতে পারি, তখন মন স্থির হয়ে যায়। বুদ্ধি প্রখর হয়। ফলে বিচার ক্ষমতা বাড়ে। তখন বিচার-বুদ্ধি দ্বারা আমরা বিষয়স্পৃহা থেকে নিবৃত্ত করতে পারি। সবশেষে আত্মস্থ হতে পারি। প্রাণের স্পন্দন-রোহিত অবস্থা না হলে, মনের স্থিরতা আসবে না। আর মন প্রাণ স্থির হলে, বিষয়ের মোহ বলে কিছু থাকবে না। আর যার বিষয়মোহ প্রাণক্রিয়ার দ্বারা নিঃশেষ হয়েছে, সেই ব্যক্তিই জ্ঞানী ব্যক্তি। সেই ব্যক্তিই ব্রহ্মে স্থিত থাকতে পারেন। এবং ব্রহ্মানন্দ লাভ করে চিরসুখী হতে পারেন। তাই যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, এই যে ভোগলিপ্সা এটি অনন্তকাল ধরে চলে। কিন্তু জ্ঞানীব্যক্তি এতে প্রমত্ত হন না। শক্নোতিহৈব যঃ সোঢ়ুং প্রাক শরীর বিমোক্ষনাৎ কাম ক্রোধ উদ্ভবং বেগং স যুক্তঃ স সুখী নরঃ। (৫/২৩) যে ব্যক্তি দেহত্যাগের পূর্বে এই সংসারে থেকেই কাম ক্রোধের বেগ সহ্য করতে পারেন, তিনি যোগী তিনিই সুখী। ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ের জন্য, মনের মধ্যে তীব্র আকাক্ষ্যা জাগে, তাকেই বলে কাম। আর এই কাম চরিতার্থ করবার কালে, যদি সে বাধাগ্রস্থ হয়, তবে তার মধ্যে ক্রোধের সৃষ্টি হয়ে থাকে। ফলত ক্রোধ কামের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক। মনের মধ্যে এই দুটো বেগ আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। আমরা সবাই বুদ্ধির দ্বারা এই ক্ষতিকর প্রবৃত্তিকে বুজতে পারি বটে, কিন্তু এর বেগ সামলানো সহজসাধ্য নয়। এই দুটোকে সামাল দিতে গেলে, আমাদের বৈরাগ্যের প্রয়োজন। কিন্তু সত্যিকারের বৈরাগ্য লাভ কঠিন থেকে কঠিনতর। আমরা যদি দেহ-মনে সাত্ত্বিকভাব গ্রহণ করতে পারি, তবে বিষয়ের প্রতি যে স্বাভাবিক আকর্ষণ তা হ্রাস পেতে পারে। পরে সাধন ক্রিয়ার সাথে সাথে আমরা যখন গুণাতীত অবস্থায় যাই, তখন কাম-ক্রোধের বেগ স্তিমিত হয়ে যায়। আমরা বারবার শুনেছি, প্রাণের গমনাগমন-এর সঙ্গে মনকে মিশিতে দিতে পারলে, এবং সাধনার সাহায্যে প্রাণকে স্থির করতে পারলে, মন স্থির হয়ে, বুদ্ধিকেও স্থির করে ফেলে। এই যে প্রাণ-মন-বুদ্ধির স্থির ভাব, এটাই সাত্ত্বিকতার লক্ষণ। এই স্থির ভাব গভীরতা প্রাপ্তিতে নিশ্চল অবস্থায়, সাধক একসময় গুণাতীত অবস্থায় পৌঁছে যায়। মনের অস্থিরতায় শরীরের ধাতুর ক্ষয় হয়। আর ধাতু ক্ষয় হলে, শরীরের বল লোপ পায় । আবার শরীরের শক্তি ক্ষয় হলে, সাধনক্রিয়া করা যায় না। তাই সাধকের সবসময় বিষয়সুখ যা আমাদের মনের চঞ্চলতা বাড়িয়ে তোলে, তার থেকে দূরে থাকা উচিত। মোদ্দা কথা হচ্ছে, আমাদের মনের যে লোভ-লালসা তা আমাদের বিক্ষিপ্ত মনের দ্বারা উৎপন্ন হয়ে থাকে। এই বিক্ষিপ্ত মনকে যদি শান্ত করা যায়, তবে এই লোভ-লালসা, কাম-ক্রোধ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। এখন মন স্বভাবগত ভাবেই চঞ্চল, এই চঞ্চল মনকে শান্ত করতে গেলে, তাকে একটা সুন্দর আসন দিতে হবে, যেখানে সে স্থিত হতে পারে । এই সুন্দর আসন হচ্ছে, কূটস্থ। এখানে প্রাণের গাড়িতে চড়িয়ে, যদি একবার মনকে নিয়ে যাওয়া যায়, তবে বাহ্য দৃশ্য, শব্দ মনকে বিরক্ত করতে পারবে না। কিন্তু কথা হচ্ছে, বাহ্যিক ভাবে দর্শন, বা শ্রবণ না হলেও, আমরা আমাদের মনের চিন্তা দ্বারা নানান রকম সংকল্প করতে পারি। এইযে বিষয় চিন্তা, একে দূর করবার মোক্ষম দাওয়াই হচ্ছে, প্রাণায়াম, যা সাধনার প্রাথমিক ক্রিয়া মাত্র। মাত্র ১০/১২ বার প্রাণায়াম অর্থাৎ পূরক-কুম্ভক-রেচক ক্রিয়া করলেই, মনের এই অনাহুত চিন্তা দূর হয়ে যাবে। তথাপি এককথায় ঠিক যে এই প্রক্রিয়ায় মনের বিষয়চিন্তা দুরিভূত হয় বটে, তবে তা স্থায়ী হয় না। কেননা জীব বিষয়ের সংস্পর্শে না এসে থাকতে পারে না। বিষয় সঙ্গ মন ও ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে হয়ে থাকে। যদি মন ইন্দ্রিয় থেকে আত্মার দিকে ধাবিত হয়, তখন মনের সঙ্গে বিষয়ের সংস্পর্শ কমতে থাকে। এই যে বিষয়-বৈরাগ্যযুক্ত সাধক, এঁরাই প্রকৃত সুখী। স্থুল শরীর পঞ্চভূতাত্মক। আর এই পঞ্চভূতের স্থান হচ্ছে, মূলাধার ইত্যাদি চক্রসমূহ। সূক্ষ্ম বায়ুর সঙ্গে মনকে চালিত করতে পারলে মনও সূক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন হয়। মন তখন প্রাণের সঙ্গে ধীরে ধীরে আজ্ঞাচক্রে স্থিতি লাভ করে। পঞ্চতত্ত্ব ছেড়ে যখন আজ্ঞাচক্রে স্থিত লাভ করে তখন ধীরে ধীরে দেহাভিমান লোপ পেতে থাকে। কিন্তু এই অবস্থায় পৌঁছনোর আগেই, সাধকের অনেক আনুসাঙ্গিক শক্তি লাভ হয়ে থাকে। এই সময় সাধকের মধ্যে ঐশ্বরিক শক্তির সঙ্গে সঙ্গে কাম-ক্রোধের বৃদ্ধি পাওয়াও অসম্ভব নয়। আজ্ঞাচক্রে প্রবিষ্ট হবার আগে, যদি সাধক এই কাম-ক্রোধকে সহ্য করতে না পারেন, তবে তিনি যোগভ্রষ্ট হন। এইজন্য, আমরা মাঝে মধ্যে অনেক যোগীপুরুষের কথা শুনি যারা নানান রকম অনৈতিক কাজে, নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন। তাই আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চয়ের সঙ্গে সঙ্গে, এই সময় আমাদের ভীষণ সতর্ক থাকতে হয়। যাইহোক, একসময় গুরুকৃপায়, ভগবৎ কৃপায়, চিদাকাশে জ্ঞানজ্যোতির প্রকাশ ঘটে। সেখানে সাধক মনকে বিলীন করে, চির সুখী হয়ে যান। একেই যোগযুক্ত অবস্থা বলা হয়ে থাকে ।
 

---------------------------- 

১৮.৩.২০২২

যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - পঞ্চম অধ্যায় - কর্ম্মসন্যাস যোগঃ
শ্লোক নং ৫/২৪-২৬
যঃ অন্তঃসুখঃ-অন্তরামঃ-তথা-অন্তর্য্যোতিঃ-এব যঃ
স যোগী ব্রহ্মনির্ব্বাণং ব্রহ্মভূত-অধিগচ্ছতি। ৫/২৪)

যাঁর আত্মাতেই সুখ, আত্মাতেই আরাম, আত্মাতেই যার জ্যোতি প্রকাশ হয়েছে, সেই যোগী ব্রহ্মভাব সম্পন্ন হয়ে ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করে থাকেন।

যিনি আত্মাতে মনবুদ্ধিকে স্থির করতে পেরেছেন, তিনি আনন্দে আছেন। আমরা আগে শুনেছি, কাম-ক্রোধের বেগ প্রশমিত করতে হবে। এবার শুনছি, আত্মাতেই সুখ, আত্মাতেই সমস্ত আরাম। আত্মাতেই জ্যোতি অর্থাৎ জ্ঞানজ্যোতির প্রকাশ। গুরুসান্নিধ্যে থেকে, গুরুসেবা করে, সাধন ক্রিয়া করতে করতে একটা সময় প্রাণ-মনের স্থিরতা আসে। এই স্থির মনে সংকল্প থাকে না। মনের যে বিস্তার ক্ষেত্র তা একসময় সংকুচিত হতে হতে হতে কেন্দ্রীভূত হয়। আত্মাতে মন বিলীন হয়ে যায়। তখন যে আনন্দসাগরে যোগী অবগাহন করেন, সেখানে বিষয়ানন্দ প্রবেশ করতে পারে না। আর বিষয়ানন্দ আত্মানন্দের তুলনায় নিতান্ত তুচ্ছ। আত্মাতে স্থিত মন এক অন্তর -জ্যোতির দর্শন পায়। এই অন্তর-জ্যোতির সাহায্যে সমস্ত সূক্ষাতিসূক্ষ্ম পরমাণু দৃষ্টিগোচর হয়। মন তখন যা কিছু জানতে চায়, তা সে দূরের হোক, বা কাছের, সবই সে জ্ঞাত হতে পারে। সকল বস্তুর অন্তরস্থিত যে রূপ তা তখন সাময়িক জ্ঞানের বিষয় হয়। এই অবস্থায় যোগীর যে অনুভব হয়, তাকেই ব্রহ্মানুভব বা ব্রহ্মপদ লাভ বলে। একেই ব্রহ্মনির্বাণ বলা হয়ে থাকে। এই স্থিতিতে যোগীপুরুষ সমাধিবান হন। আবার সমাধি থেকে বুত্থিত হলেও, এই অনুভবের রেশ চলতে থাকে। তাই সমাধি থেকে উত্থিত হয়েও যোগী পুরুষ বিষয়ের অনুগত থাকেন না। বিষয়জনিত সুখ-দুঃখের অনুভূতির বাইরে অবস্থান করেন।

লভন্তে ব্রহ্মনির্বাণং-ঋষয়ঃ ক্ষীণকল্মষাঃ ছিন্নদ্বৈধা যতাত্মনঃ সর্ব্বভূতহিতে রতাঃ। (৫/২৫) পাপ যাঁর ক্ষীণ হয়েছে, সংশয় যাঁর ছিন্ন হয়েছে, যাঁর চিত্ত সংযত, যিনি সর্বভূতে কৃপালু, সেই ঋষিগণ ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করেন। এই নির্ব্বানপদ যিনি লাভ করেছেন, তার ব্রহ্ম ভিন্ন অন্য কিছুতে মন যেতে পারে না। ব্রহ্ম থেকে বিচ্যুত হওয়াই পাপ। তো যিনি সদা ব্রহ্মে স্থিত আছেন, তার আবার পাপ কিসের ? এই পাপশূন্য অবস্থায় যথার্থ জ্ঞানের উদয় হয়। সাধনক্রিয়ার উচ্চ অবস্থায় সব একাকাকার হয়ে যায়। দ্বৈত ভাব থাকে না। আর দ্বৈত ভাব না থাকলে তাঁর মধ্যে কোনো সংশয়ের উদয় হতে পারে না। তখন সবই আত্মা বলে মনে হয়। নিজেকেও সেই আত্মা বলেই প্রতীয়মান হয়। চিত্ত তাঁর স্থির। ফলত তিনি সংযত চিত্তের অধিকারী। যাঁরা নিজেরা ঈশ্বর সান্নিধ্য লাভের জন্য ব্যাকুল, তাঁরা অন্যদের প্রতি কৃপালু হয়ে থাকেন। সাধন ভজনের দ্বারা যে জ্ঞান তিনি লাভ করেন, তা তিনি সবার মধ্যে বেটে দিতে চান। তিনি যে আনন্দের সওয়ার হয়েছেন, সেই আনন্দ তিনি সবার মধ্যে বিতরণ করতে চান। লোক কল্যানে রত থাকাটা উন্নত সাধকের স্বভাব। কাম-ক্রোধ-বিযুক্তানাং যতীনাং যতচেতসাম অভিতো ব্রহ্মনির্বাণং বর্ত্ততে বিদিতাত্মনাম। (৫/২৬) কাম-ক্রোধ-বিমুক্ত সংযতচিত্ত আত্মদর্শী যতিগনের ব্রহ্মনির্বাণ নিকটে ও চারিদিকে বিদ্যমান।
যাঁরা সংযত, অর্থাৎ লক্ষে স্থির। আর যাঁরা লক্ষে স্থির থাকেন, তাঁদের লক্ষে পৌঁছানো কেবল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। যার চিত্ত নির্ম্মল, যাঁর চিত্ত আত্মাতে স্থির ভাবে অবস্থান করছে, তাঁর দেহাভিমান থাকে না। ফলত তাঁরা কামনা বাসনার উর্দ্ধে অবস্থান করেন। আর যার মধ্যে কামনা বাসা বাঁধতে পারেনি, তিনি রাগ-দ্বেষাদির উর্দ্ধে। এঁরা সর্বত্র ও সদা নির্ভয়ে মুক্ত অবস্থায় বিচরণ করে থাকেন। আমাদের একটা ধারণা হচ্ছে, মানুষ মৃত্যুর পরে মুক্ত হন। কিন্তু সত্য হচ্ছে, যিনি দেহে থাকতে দেহাভিমান ত্যাগ করতে পারেন নি, রাগ-দ্বেষ ত্যাগ করতে পারেন নি, নিজেকে সংযত করতে পারেন নি, যার লক্ষ বিষয়ের দিকে, যার মন কখনো ব্রহ্মে স্থিত হতে পারেনি, তিনি মৃত্যুর পরেও উদবিগ্ন, আশঙ্কাযুক্ত থাকেন। কিন্তু দেহে থেকেও যিনি ব্রহ্মদৃষ্টি সম্পন্ন, তিনি ইহকালেই মুক্ত হয়ে যান। যাঁরা সাধনক্রিয়া পরায়ণ, যাদের গুরুসান্নিধ্যে গুরুর নির্দেশে সাধনক্রিয়ায় রত আছেন, তারাই মুক্তিপদ লাভ করে থাকেন। এর পরের দুটো শ্লোকেই যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ সেই গুহ্য ও অন্তরঙ্গ সাধনক্রিয়ার কথা বলছেন, আমরা শুনবো ।

১৯.৩.২০২২

যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব - শ্রীগীতা - পঞ্চম অধ্যায় - কর্ম্মসন্যাস যোগঃ
শ্লোক নং ৫/২৭-২৯
স্পর্শ্বান কৃত্বা বহির্বাহ্যাং-শ্চক্ষু-শ্চৈবান্তরে ভ্রুবোঃ
প্রাণাপানৌ সমৌ কৃত্বা নাসাভ্যন্তর-চারিণৌ (৫/২৭)
যতেন্দ্রীয়-মনো-বুদ্ধির্মুনির্মোক্ষ-পরায়ণঃ
বিগতেচ্ছা ভয়ক্রোধো যঃ সদা মুক্ত এব সঃ। (৫/২৮)
বাহ্য বিষয় সংস্পর্শ পরিহার করে, চক্ষুদ্বয়কে ভ্রুদ্বয়ের মধ্যে আবদ্ধ করে, যিনি ইন্দ্রিয় মন বুদ্ধিকে সংযত করেছেন, এবং যিনি ইচ্ছা ভয়, ক্রোধ বর্জ্জিত ও মোক্ষপরায়ণ তিনি সর্বদা মুক্ত।
রূপ-রস-গন্ধ ইত্যাদি বাহ্য বিষয় যখন মনের চিন্তনের বিষয় হয়, তখন অন্তরে বিষয়বিষ প্রবেশ করে। এই বাহ্য বিষয় চিন্তা পরিত্যাগ করে, চক্ষুদ্বয় মুদ্রিত করে, ভ্রূযুগলের মধ্যে বহির্মুখী দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে ভ্রূযুগলের মধ্যে স্থির ভাবে স্থাপন করে রাখতে হবে। তো এই সাধনপ্রক্রিয়ার প্রয়োগ করতে গেলে, প্রথমে প্রত্যাহারের সাহায্যে, মনকে বিষয় থেকে সরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু এই কাজ যখন করতে যাবেন তখন বুঝতে পারবেন, বিষয় থেকে মনকে সরিয়ে আনা কত কঠিন। তাই আমাদের প্রাণায়ামের সাহায্যে প্রাণ ও অপান বায়ুকে (শ্বাস-প্রশ্বাস) নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শ্বাস-প্রশ্বাস বায়ুকে নাসিকার অভ্যন্তরে আবদ্ধ করতে হবে। তার পরে যোগেশ্বর নিদিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রবেশ করা যাবে। নতুবা, বিষয় চিন্তা চলতেই থাকবে। এই অনুশীলনী চালিয়ে গেলে, একসময় যোগসাধকের মন-বুদ্ধি-ইন্দ্রিয় সহজে সংযত ও বশীভূত হয়ে আসবে।
আমরা জানি চক্ষু উন্মীলনে আমাদের বাইরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়, আবার চক্ষু নিমীলনে আমাদের নিদ্রা আসে। এই উভয়ের মাঝে অর্থাৎ চক্ষু অর্দ্ধ-নিমীলন দ্বারা বা অর্দ্ধ-উন্মীলন দ্বারা ভ্রূমধ্যে দৃষ্টি স্থাপন করে, শ্বাস বায়ুকে আহরণ পূর্বক স্তম্ভন অর্থাৎ শ্বাসের যে উর্দ্ধগতি বা অধোগতি তাকে নিরোধ করে, সমান বায়ুতে স্থির থাকতে হবে। তখন প্রাণ যাতে বাইরে না যায়, আর অপান যাতে ভিতরে প্রবেশ না করে, কিন্তু দুটো নাসিকার গহ্বরের মধ্যেই যাতে সঞ্চরণ বা চলাফেরা করে, এইভাবে ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে হবে। এইভাবে প্রাণ-অপান সমান করে, যিনি মন-বুদ্ধি-ইন্দ্রিয়কে সংযত করেছেন, মোক্ষপদ একমাত্র তাঁরই অধিগত হয়। এই মোক্ষপদ প্রাপ্ত যোগীর ভয়, ক্রোধ, এমনকি ইচ্ছা বিগতপ্রায় হয়ে যায়। এই অবস্থায় যোগী দেহে থেকেও অর্থাৎ জীবিত থেকেও মুক্তমনের অধিকারী হয়ে থাকেন।
বিষয় আমাদের অন্তরে প্রবেশ করে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সত্য, আবার এই ইন্দ্রিয়ের পরিচালক হচ্ছে আমাদের মন। তো মন যদি বিষয় চিন্তা না করে, তবে বিষয় অন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। এখন কথা হচ্ছে, গীতার এই কথা অধ্যায়ন করে, বা কারুর কাছ থেকে শুনে এই প্রক্রিয়ার সুবিধে পাওয়া যায় না। এর জন্য দরকার নিরন্তর বিধিসম্মত ভাবে যোগাভ্যাস। এই যোগ অভ্যাসই একসময় যোগীকে ব্রাহ্মনির্বাণ লাভ করাতে পারে।
প্রাণ-অপান-সমান-উদান-ব্যান এই পঞ্চবায়ু যথাক্রমে, হৃদয়ে, গুহ্য, নাভি, কন্ঠ, এবং সর্ব্বশরীর। এই পঞ্চবায়ুই আমাদে শরীরের যাবতীয় কর্ম্ম করে আমাদের শরীরকে রক্ষা করছে। এই যে হৃদয়স্থিত বাহ্যগতি সম্পন্ন প্রাণবায়ু এঁকে বহির্মুখী হতে না দিয়ে নিরুদ্ধ করতে হবে, গুহ্যস্থ অপানবায়ুতে এই প্রাণ বায়ুকে আনয়ন করতে হবে। এর পরে সুষুম্না নাড়ীতে এই বায়ু চালনা করতে হবে। এতে বায়ুর কুম্ভক ইত্যাদি কষ্টকর ক্রিয়া নেই। যোগী পুরুষ চিত্তের বিক্ষেপকারী যে শব্দ, স্পর্শ , রূপ, রস, গন্ধ - এদের গ্রহণ বিষয়ে সংযমী হতে হবে। ভ্রূমধ্যে দৃষ্টিকে সংযত রেখে এই প্রাণায়ামের অভ্যাস চালিয়ে যেতে হবে। এই অভ্যাসের ফলেই একসময় যোগীর প্রাণবায়ু সুষুম্না নাড়ীতে প্রবেশ করবে।
প্রাণায়াম করতে করতে একসময় আমাদের শ্বাস সরু সুতোর মতো হয়ে যাবে। শ্বাসবায়ুর প্রবাহ এতটাই ক্ষীণ হয়ে যাবে, যে বাইরে থেকে তা বোঝা যাবে না। কিন্তু বায়ু প্রবাহ চলতে থাকে। এই অবস্থায় প্রাণ-অপানের গতি সমান হয়ে যায়। তখন সাধকের মন-প্রাণ-বুদ্ধি-ইন্দ্রিয় সংযত হয়ে আসে। তখন আমাদের রাজসিক ভাব, বা তামসিক ভাব অন্তর্হিত হয়ে যায়। জোর করে সংযম আসে না। কিন্তু প্রক্রিয়ার দীর্ঘদিনের অনুশীলনী থেকে আপনা থেকেই সংযম এসে যায়। এই অবস্থায় অর্দ্ধউন্মীলিত চোখে কোনো পলক পড়ে না। একসময় শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি স্তিমিত হতে স্তব্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থা না জাগ্রত, না নিদ্রা, না স্বপ্ন। এই প্রাণক্রিয়ার ফলে মন-প্রাণ স্থির হয়। আর স্থির মন-প্রাণে এক সত্যের প্রকাশ ঘটে। তখন বৈরাগ্য আপনা থেকেই আসে। জ্ঞানালোকের প্রকাশ ঘটে।
এর পরে ষষ্ঠ অধ্যায়ে ধ্যানযোগের সম্পর্কে যোগেশ্বরের কাছে শুনবো।
ভোক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্ব্বলোক-মহেশ্বরম
সুহৃদং সর্ব্ব ভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিম-ঋচ্ছতি। (৫/২৯)
যোগসিদ্ধ মুক্ত পুরুষ আমাকে যজ্ঞ ও তপস্যার ভোক্তা, সর্ব্বলোকের মহা ঈশ্বর ও সর্ব্বলোকের সুহৃদ জেনে পরম শান্তি লাভ করেন।
এইযে সাধনক্রিয়ার কথা আমরা যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে শুনলাম, এর দ্বারা আমাদের কূটস্থের জ্ঞান হয়। তখন বুঝতে পারা যায়, তিনিই সর্বব্যাপী বিরাজ করছেন। তিনিই বিষ্ণুরূপে সমস্ত কর্ম্মের ফল ভোগ করছেন।বিষ্ণু অর্থাৎ পঞ্চভূতময় এই বিশ্ব যাতে প্রবেশ করছে। যোগী বিশ্বব্যাপী বলে, বিশ্বকে আর পৃথক বলে মনে হয় না। প্রাণক্রিয়ার দ্বারা বায়ুকে মস্তকে স্থির করলে, আপনাতে আপনি থাকা যায়।একটা জিনিস জানবেন, শ্রীকৃষ্ণকে এমনকি ঈশ্বরকে জানবার জন্য এই সাধনক্রিয়া নয়, নিজেকে জানবার জন্যই সমস্ত সাধনক্রিয়া। যখন নিজেকে জানতে পারবেন, তখন ঈশ্বরকেই জানা হবে। সমস্ত মানুষের মধ্যেই আছে এই কূটস্থ। যখন সর্ব্বের জ্ঞান হয়, তখনই কূটস্থ জ্যোতিরূপে যোগীর অনুভবে আসে। এক ও অখন্ড সত্তা। এই সত্তাই প্রাণরূপে এই দৃশ্যমান জগৎ প্রকাশিত হয়েছে। আবার তার মধ্যেই বাস করছে। এই জ্ঞানের উন্মেষ হলেই একটা শান্তির পরাবস্থা প্রাপ্ত হয়। তখন আমি বা আমার বলে কিছু থাকেনা। দেহাত্মবোধ থেকেই আসে আমি-আমার ভাব। সাধনক্রিয়ার ফলে এই দেহাত্মবোধ লোপ পায়। আর আমিত্ব বা আমার এই ভাব নির্মূল হয়ে যায়। মহাশূন্যই মহেশ্বর। তাঁর সত্তাতেই সমস্ত সত্তা। এই জ্ঞানের উন্মেষের সংযাগে সঙ্গে সমস্ত বেদনার পরিসমাপ্তি হয়।
ইতি শ্রীমদ্ভগবতগীতাসু উপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুন সংবাদে সন্ন্যাসযোগো নাম পঞ্চম-অধ্যায়ঃ।
বিঃদ্রঃ শ্রী গীতার পঞ্চম অধ্যায়ের শেষে, একটা কথা বার বার কে মনে হয়, সাধনতত্ত্ব পরমার্থ তত্ত্ব, অধ্যয়ন, মনন যেমন দরকার, তেমনি দরকার যোগাভ্যাস। কেননা যোগেশ্বর যে কথাগুলো বলছেন, সেগুলো শুধু বোঝার বিষয় নয়, এগুলো মুখস্ত করবার বিষয়ও হয়। এগুলো অবশ্য়ই একটা প্রয়োগবিধি। এই প্রয়োগবিধির কথা শুধু শুনে, পড়, এমনকি বুঝলেও আমাদের কোনো কাজে আসবে না। এই যোগের অভ্যাস না করলে আমাদের যে জন্ম জন্মান্তরের অভ্যাস বা সংস্কার তা বদলানো সম্ভব হয় না। কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মাৎসর্য এগুলোকে প্রথমে সহ্য করা বা হজম করা সহজসাধ্য নয়। আবার এগুলোকে বৰ্জন করাও সহজ সাধ্য নয়। ইন্দ্রিয়ের বহির্মুখী ভাবকে অন্তর্মুখী করতে হবে। ইন্দ্রিয়সুখে অনুরক্ত থাকলে চলবে না। স্বাভাবিক ভাবে জীবের শ্বাসক্রিয়া তার নিজস্ব নিয়মে চলতেই থাকে। এর জন্য আলাদা কোনো প্রয়াস করতে হয় না। এই শ্বাসক্রিয়ার শুরুতেই সংসার জীবনের শুরু। আবার এই শ্বাসক্রিয়ার শেষে জীবনের শেষ। এই প্রক্রিয়া জীবের জন্মসূত্রে পেয়ে থাকে। এখন মুক্তিকামী সাধকের এই পরম্পরা নিয়ে চললে, গতানুগতিক জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না, জন্ম-মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই মিলবে না । বহু সাধনার ফলে, বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে, আমাদের প্রাচীন মুনি ঋষিগণ আমাদের যে যোগক্রিয়ার কথা বলে গেছেন, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে নিহিত আছে, আমাদের স্বভাবকে পরিবর্তন করবার সহজসাধ্য উপায়। যদি আমরা এই সব যোগক্রিয়াকে অবহেলা করি, আর মনে মনে ভাবি, শুধু গীতা অধ্যায়ন করলেই, স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের চিরশান্তির পথে নিয়ে যাবেন, আমাদের উদ্ধার করবেন, তাহলে আমরা নিজেকে ঠকাবো। আমরা শুনেছি, এই স্থুল দেহের মৃত্যুর পরেও, আমরা সুক্ষ দেহে আমাদের মন-বুদ্ধি-সংস্কার নিয়ে বাস করে থাকি। এই জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কারের যতদিন না বিলোপ সাধন হয়, ততদিন আমাদের মুক্তি নেই। এই কথা মনের মধ্যে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করুন।
----------------------
Show less