Wednesday 31 October 2018

সত্যধর্মের আলোতে গুরুতত্ব -৫



সত্যধর্মের আলোতে গুরুতত্ব -৫



এতক্ষন আমরা কথা বলছিলাম ভক্তির বহিরঙ্গ সাধনা নিয়ে।  অর্থাৎ গুরুজনদের প্রতি ভক্তি নিয়ে। আসলে গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথ  সাধনার কথা  বলতে গিয়ে, তিনটি জিনিসের উপরে খুব জোড় দিয়েছেন।  সেটা হচ্ছে প্রেম, ভক্তি ও একাগ্রতা। ভক্তির কথা যখন উঠেছে, তখন আমরা ভক্তির বহিরঙ্গ সাধনার সঙ্গে সঙ্গে , ভক্তির অন্তরঙ্গ সাধনার কথাও একটু আলোচনা করতে চাই।

আপনারা যারা গীতা পড়েছেন, তারা জানেন, এই ভক্তির উপরে গীতায় একটা পুরো অধ্যায়  আছে। গীতার  দ্বাদশ অধ্যায়, এর নাম-ই হচ্ছে "ভক্তিযোগঃ" । এখানে কুড়িটা শ্লোক আছে।

 ১৪ নং শ্লোকে যোগেশ্বের বলছেন, : 

সন্তুষ্টঃ সততং যোগী যতাত্মা দৃঢ় নিশ্চয়ঃ 
ময়ি অর্পিত মনোবুদ্ধিঃ যঃ মদ্ভক্তঃ স মে প্রিয়ঃ।

যে  যোগী  সদা সন্তুষ্ট, যিনি আমাতে দৃঢ় নিশ্চয়, যার মন ও বুদ্ধি আমাতে অর্পিত এইরূপ আমার ভক্ত, আমার প্রিয়। 

১৬ নং শ্লোকে বলছেন :

অনপেক্ষঃ শুচির্দক্ষ উদাসীনো গতব্যথঃ 
সর্বারম্ভ পরিত্যাগী যে মদ্ভক্ত স মে প্রিয়ঃ। 

যিনি সব বিষয়ে অনপেক্ষ অর্থাৎ নিস্পৃহ বা সব বিষয়কেই যিনি উপেক্ষা করতে পারেন, যিনি শুচি, অর্থাৎ শুদ্ধ, সর্ব কর্মে যিনি দক্ষ, যিনি সব সময় অর্থাৎ সুখে দুঃখে উদাসীন, যিনি কোনো কিছুতে ব্যথিত হন না,  যিনি কোনো কাজের সৃষ্টি করেন না, এইরূপ আমার ভক্ত, আমার প্রিয়।

এমনিতর আরো কতকগুলো শ্লোক আছে, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যিনি আমাপরায়ন সেই ভক্ত আমার প্রিয়। কেমন ভক্ত তিনি চান, অর্থাৎ ভক্তের গুন্ বা স্পষ্টীকরন করেছেন।  কিন্তু ভক্তি কাকে বলে।  সেব্যাপারে গীতায় কিছু নেই। 

এইবার আমরা মহাত্মা গুরুদেবের "সত্যধর্ম" বইটা একটু দেখি। গুরুদেব বলছেন " ভয়ে ভয়ে ভালোবাসাকে ভক্তি বলে। " অর্থাৎ ভয় থেকে ভক্তি। কিন্তু সঙ্গে  থাকবে ভালোবাসা। এখন ভয় আমরা কাকে করি। যিনি আমাদের থেকে শক্তিশালী। যিনি আমাদের থেকে উন্নত। তাকেই আমরা ভয় করি। গুরুদেব আবার বলছেন  "প্রেমের সীমাবদ্ধ ভাবকে ভক্তি বলে।" অর্থাৎ একটু প্রেম একটু ভয় - এর থেকেই ভক্তির উৎপত্তি। আমরা এর আগে আলোচনা করেছি গুরুজনদের প্রতি ভক্তি। গুরুজন সব সময় ভালোবাসার পাত্র নাও হতে পারে, কিন্তু সত্য কথা বলতে কি গুরুজনদের প্রতি আমাদের  একটু একটু ভয় থাকে। পিতা মাতাকে আমরা  ভয়ও করি আবার ভালোও বাসি। এইখানেই ভক্তির উদ্রেক। এই ভয় ও ভালোবাসাই মিশ্রিত অবস্থাই  ভক্তি। গুরুদেবদের ক্ষেত্রেও তাই,  একটু দূরে দূরে থাকি, আবার ভালোও লাগে।  এটাকেই ভক্তি বলে। 

এখন ভক্তির কি ভাবে উৎপত্তি হয় ? 
গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথ  বলছেন,  যেখানে নিজের স্বার্থের জন্য নির্ভরতা আছে, আবার একটু অনুরাগ বা আসক্তিও আছে, সেখানেই ভক্তির সৃষ্টি।
গুরুদেব বলছেন ছোট বেলায় আমাদের ভক্তি শ্রদ্ধা বলে কিছু থাকে না। ভালো মন্দ জ্ঞান থাকে না। ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে ভেদ জ্ঞানের সঞ্চার হয়। আমার খিদে পেলে যে আমাকে খেতে দেয়, আমি ব্যথা পেলে যে আমাকে  আদর করে,
আমার অস্বস্তি হলে যে আমাকে স্বস্তি এনে দেয়, তারসঙ্গে  তখনআমার, আমি-আমার বলে একটা মমতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। আমি তোমার, তুমি আমার। এখান থেকেই ভক্তির উৎপত্তি হতে আরম্ভ করে। এখন এটা কেন হয় ? গুরুদেব বলছেন : ১. করুন রস অর্থাৎ  আমি যার কাছ থেকে করুনা চাই,  মমতা চাই, তার প্রতি আমাদের ভক্তির ভাব জন্মায়।  
২.এছাড়া, স্বভাবজাত ভাবে উৎপাদকের প্রতি অর্থাৎ আমাদের জন্মদাতার প্রতি, পালনকর্তার প্রতি, আমাদের একটা স্বাভাবিক কৃতজ্ঞতা আপনা থেকেই জন্মায় । 
৩. আমার নির্ভরতা - অর্থাৎ আমার বেঁচে থাকাটা যার উপরে নির্ভর করে, তার প্রতিও আমাদের স্বাভাবিক ভক্তি জন্মায়। 
৪. যিনি আমাকে স্নেহ করেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা থেকেই আমার ভিতরে ভক্তির উৎপন্ন হয়। 
গুরুদেব বলছেন, ভক্তি দুই প্রকার : পার্থিব ভক্তি ও ঈশ্বর ভক্তি। পার্থিব ভক্তি অর্থাৎ মাতাপিতা, গুরুজন, গুরুদেব প্রভৃতিদের প্রতি ভক্তিই পার্থিব ভক্তি।  যা নিয়ে আমরা আগে আলোচনা করেছি। এবার আমরা ঈশ্বর ভক্তি নিয়ে  কিছু আলোচনা করবো। 
বহিরঙ্গ ভক্তি থেকেই অন্তরঙ্গ ভক্তির উদ্রেক হয়। অর্থাৎ আধ্যাত্বিক জগতে যিনি আমাদের হাত ধরে নিয়ে যান, অর্থাৎ গুরুদেব আমাদের ভক্তিভাজন। এই গুরু ভক্তি স্বাভাবিক ভাবেই হওয়ার কথা।  অর্থাৎ যার গুন্ তোমাকে আকর্ষণ করে, তার উপর স্বাভাবিক ভাবেই ভক্তি জন্মায়। আসলে গুরুদেবরা ভীষণ স্নেহপ্রবণ হন, নিঃস্বার্থ হন, এবং তারা ঈশ্বর ভক্তিতে আপ্লুত থাকেন, তাই   স্বাভাবিক ভাবেই তাদের প্রতি একটা শ্রদ্ধা ভক্তি আমাদের ভিতরে জেগে ওঠে। আমাদের ভিতরে একটা ব্যাকুলতা জন্ম নেয়। এটা আপনা আপনি হয়। এই ব্যাকুলতা যখন বৃদ্ধি পায়, অর্থাৎ এক এক সময় মনে হয়, গুরুদেব কেন এত ভালো, কেন এতো আকর্ষণীয়, গুরুদেব কেন এত স্নেহশীল, অর্থাৎ তার এই গুন্ আমাদেরকে ভাবায়, আমাকে ব্যাকুল করে তোলে, আর যখন আমরা বুঝতে পারি যে ঈশ্বর জ্ঞান, ঈশ্বর অনুভূতি, গুরুদেবকে আমার মনের  মতো করে তুলেছে,  তখন আমরা তার সন্ধানে বের হই।  গুরুদেবের স্বরণাপন্ন হই, এবং সেই অসীম-অনন্ত-করুনাময়-পরমপিতার আশ্রয়ে যেতে ইচ্ছে করে। তাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।  এই ভালোবাসা প্রেমে পরিণত হয়।  আমরা ঈশ্বরময় হয়ে যাই। গুরুদেব বলছেন, এই ঈশ্বরপ্রেম পূর্ণ ভাবে কখনো হয় না, এবং ঈশ্বর ভক্তির কখনো লয়  হয় না। পার্থিব ভক্তি এক সময় চলে যায়, কিন্তু ঈশ্বর ভক্তি বাড়তেই থাকে। গুন্ সাধনা যত বৃদ্ধি পায়, আমাদের মধ্যে অনন্ত  বিষ্ময়  মুহুর্মুহু বাড়তে থাকে আর ভক্তি বাড়তে থাকে। জন্ম জন্মান্তর ধরে আমাদের এই ভুবুক্ষা ঈশ্বর-প্রেম সাধনায় লিপ্ত করে। মানুষ্য জীবন এই প্রেম সাধনার জন্য। 

সবশেষে বলি, পার্থিব ভক্তিকে ধীরে ধীরে, মোড় ঘুরিয়ে, ঈশ্বরের দিকে দেবার উপরে জোড় দিতে হবে।  জগতের প্রতি ভালোবাসাকে, ভক্তিকে ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা, ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিতে পরিণত করতে হবে।  ত্যাগের দ্বারা ঘৃনাকে জয়  করতে হবে।  ঈশ্বরে আত্মসমর্পন দ্বারা ভয়কে জয়  করতে হবে। এর সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরের স্মরণ-মনন চাই।  এর জন্যই গুরুদেব যেমন বীজ মন্ত্রের সাহায্য নিতে বলেছেন, তেমনি ভক্তিমূলক সঙ্গীত ও প্রার্থনাকে সহায় করতে বলেছেন। আধ্যাত্মিক জীবনে সকল বাধা দূর হয়ে যাবে, যদি গুরুদেবের অর্থাৎ মহাত্মা গুরুনাথের কথা মতো কাজ করা যায়। এর ফলে আধ্যাত্মিক জীবনে সব বাধা দূর হয়ে ঈশ্বর দর্শন সম্ভব হবে।    
  
মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্তের পরবর্তী নির্দেশ :

৩) সর্বদা সত্য কথা বলবে। 
আমরা অনেক সময় শুনি, সাধন ভজন তো করছি কিন্তু আমাদের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে একটা সুন্দর গল্প আছে। গল্পটা রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন। এক চাঁদনী রাতে কয়েকজন মাতাল নৌকা-বিহারে যাবে বলে ঠিক করলো। সেই মতো নৌকায় উঠে দাঁড় বাইতে লাগলো। সারারাত ধরে দাঁড় বাইতে লাগলো। কিন্তু আশ্চার্য্য ব্যাপার হচ্ছে, নদীর পাড়ের তালগাছটা নাকি ওদের সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। ওরা খুব মজা পেল, আরো জোরে,বৈঠা চালাতে লাগলো,  তালগাছটাকে  ছাড়িয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু তালগাছ ওদের সঙ্গ ছাড়লো না। এই করতে করতে সকাল হয়ে গেলো। নেশাও কেটে গেলো। আর দেখলো নৌকাটা বাঁধা  আছে তালগাছের সঙ্গে। আসলে আমরা সাধন ভাজন করি, সাধুসঙ্গ করি, কিন্তু আমাদের জীবনের নৈতিকতার গুরুত্ব দেই  না। উপাসনার আসর থেকে বেরিয়েই আমরা বিষয় চিন্তায় মগ্ন  হই। সাধনপথে  নৈতিক শৃঙ্খলা জরুরী। সত্যে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে নিজেকে। সত্য বচন , সত্য চিন্তন, সত্য কার্যে আমাদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যোগঋষি পতঞ্জলি বলছেন - সত্যবাদিতার প্রতিষ্ঠার দ্বারা যোগী ক্রিয়া ছাড়াই ক্রিয়াফল লাভের শক্তি সঞ্চয় করে। কেবল নিজের জন্য নয়, সকলের জন্যেই। স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, তোমার মধ্যে যখন সত্যের শক্তি অধিষ্ঠিত হবে, এমনকি স্বপ্নেও কখনো অসত্য উচ্চারণ করবে না, যখন তুমি চিন্তায়, কথায়, কর্মে সত্যবাদী হবে তখন তুমি যা বলবে তাই সত্য হবে. তখন যদি তুমি কাউকে বলো, "তুমি সুস্থ  হও" তৎক্ষনাৎ  সে সুস্থ  হয়ে উঠবে। অর্থাৎ সত্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির কথা  কখনো অন্যথা হবে না। মহাত্মা গুরুনাথ ও  সে কথাই বলেছেন। সত্য বলে বলতে এমন অবস্থা হয়, তিনি যা কিছু বলেন সব সত্য হয়ে ওঠে।  এইজন্য সত্যে প্রতিষ্ঠ ব্যক্তিকে সব সময় সজাগ থাকতে হয়, যাতে অমঙ্গলসূচক কোনো কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে না পরে। এঁরা সর্বদা স্বল্পভাষী হন। তো আধ্যাত্মিক জীবনে পবিত্রতা দরকার। আর এই পবিত্রতা অর্জন করতে গেলে, আমাদের সত্যবাদী হতে হবে। সত্য চিন্তন করতে হবে। চিত্ত শুদ্ধির জন্য, মনের পবিত্রতার জন্য, নিজেকে সত্যে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।  নতুবা ধ্যান জ্ঞান যাই করো সবই বৃথা।       
     
৪) পরের দ্রব্য হরণ করবে না।

মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন পরের  দ্রব্য হরণ করবে না বা হরণ করার চিন্তাও করবে না।   


৫) জিতেন্দ্রিয় হবে।


রামকৃষ্ণদেব যুবকদের বলতেন, কামিনী কাঞ্চন থেকে দূরে থেকো। মেয়েদের বলতেন, পুরুষ মানুষের ফাঁস থেকে সর্বদা সাবধান থাকবে - তা সে নিকট আত্মীয় হলেও। চিন্তায় কথায় কাজে যদি নিজেকে পবিত্র না করা যায় তবে কেউ আধ্যাত্মিক জীবনে উন্নতি করতে পারে না। নিজের পূর্ন সত্ত্বার রূপান্তরের আগে, কামিনী-কাঞ্চনে সতর্ক থাকতে হবে। আমরা অনেক সময় কর্তব্যের দোহাই দিয়ে, দয়ার দোহাই দিয়ে, সেবা করার নামে, আমাদের সুপ্ত বাসনাকে তৃপ্তি দিয়ে থাকি। এখান থেকে আমাদের বেরোতে হবে। আমাদের এমন স্তরে যেতে হবে যেখানে কোনো লিঙ্গভেদ নেই। জীবনের প্রথম স্তরে আমাদের এই লিঙ্গভাব থাকে। এখান থেকে আমাদের বেরোতে হবে। আমাদের ইন্দ্রিয় সংযম আনতে হবে। ধীরে ধীরে অনুশীলনের মাধ্যমে, আমাদের অহং পবিত্র ব্যাক্তিত্ত্বের উদার গুণগুলি গ্রহণ করতে থাকবে।  আমরা রূপান্তরিত হবো। আমরা নিজেরদেকে পুরুষ বা নারী ভাবতে অভ্যস্ত। সেখানথেকে বেরিয়ে আমাদের মানুষ হতে হবে। ভেদাভেদ মুছে যাক। কামনা বাসনা, আধ্যাত্মিক যজ্ঞে বিসর্জন দাও। 


যদিও আমরা জানি, এগুলো পরিত্যাগ করা অত সহজ নয়। তাই মহাত্মা গুরুনাথ  বাস্তব কথা বলছেন।  তিনি বলছেন এগুলো সীমিত রাখো। সংযমে রাখো। ইন্দ্রিয় সুখে ইন্দ্রিয় সংযম হারিয়ো না।   


৬) আত্মহত্যা বা নরহত্যা করবে না।

কখনো আত্মহত্যার  কথা চিন্তা করবে না।  অকারণে কোনো জীবহত্যা করবে না। 


৭) যাতে বুদ্ধি বাড়ে, তার জন্য চেষ্টা করবে।

গুরুপ্রবচন শ্রবণ , ও অধ্যয়ন মানুষকে সৎবুদ্ধি প্রদান করে। প্রতিনিয়ত নিয়ম করে গুরুপ্রবচন শোনা উচিত।  অথবা গুরুগ্রন্থ পাঠ  করা উচিত। শুধু শ্রবণ বা অধ্যয়ন  নয়, মনন করা উচিত। অর্থাৎ কথাগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত। গূঢ়ার্থ বোঝার চেষ্টা করা উচিত। এবং নিজের জীবনে সেগুলোর প্রয়োগ করা উচিত। 

  
৮)  ধৈর্য্য ও ক্ষমা গুনের সাধনা করবে।

তুমি যদি ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে চাও, তবে ধৈর্য সহকারে, নিরন্তর অনুশীলনী চালাতে হবে। অধৈর্য হলে হবে না। ধৈর্য্য -চ্যুতি হলে চলবে না। ঠিক সময়ে অবশ্যই তোমার ঈশ্বর-উপলব্ধি হবে। 


৯) শরীর ও মন পবিত্র রাখবে। 

অধ্যাত্ম জীবনে শরীর  ও মন দুটোকেই পবিত্র রাখতে হবে। দেখো, শরীর ছাড়া কোনো সাধনা সম্ভব নয়। তাই,  শরীর যাতে সুস্থ থাকে, তার জন্য নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। খাবারের বিষয়ে যেমন নিয়ম মেনে চলতে হবে, অর্থাৎ অতিরিক্ত খাওয়া বা অতি অল্প আহার, দুটোকেই বর্জন করতে হবে। পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। তোমার শরীরে যেটা সহ্য হয় সেই অনুযায়ী আহার নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে লোভ বর্জন করতে হবে। সব অঙ্গের কিছু কিছু ব্যায়াম নিয়ম করে, করতে হবে। কোনো কোনো সাধক আছেন, তারা শরীরকে  গুরুত্ত্ব দেন না। তারা অচিরেই শরীর পাত করেন।  এবং আবার তাদের শরীর ধারণ করতে হয় - সাধনার ক্রমোন্নতির জন্য। শরীরকে ভুলতে চাইলেও শরীর সুস্থ রাখতে হবে। তোমার কোনো অঙ্গে বেদনা হলে, তোমার মন সেদিকে চলে যাবে, সাধনার ব্যাঘাত হবে। তাই শরীরকে সুস্থ রাখা অবশ্য কর্তব্য। 


শুধু শরীরকে সুস্থ রাখা নয়।  তোমার মনকেও সুস্থ রাখতে হবে। শরীর ও মনের সমন্বয় সাধন হলে তবেই আধ্যাত্মিক পথে এগোনো যাবে। কেউ কেউ বলেন, পরমাত্মা তো শরীর,  মন বুদ্ধির ওপারে। তো শরীর, মন -এর ওপারে যেতে গেলে তো মনটাকেও ডিঙোতে হবে।আসলে শরীরকে যদি ভুলে থাকতে চাও, তবে শরীরকে সুস্থ অবস্থায় রাখতে হবে। তুমিতো, একচোটে ছাদে যেতে পারবে না। তোমাকে সিড়ি পেরোতে হবে। সিড়ি যদি শক্ত না হয়, তবে ভর দিলেই তা ভেঙে পড়বে।  অতএব শরীর, মন সবাইকে শক্ত করতে হবে। কঠোপনিষদ বলছে - শরীর হচ্ছে রথ। ইন্দ্রিয় হচ্ছে ঘোড়া।  মন হচ্ছে লাগাম।  বুদ্ধি হচ্ছে সারথি। আত্মা হচ্ছে রথস্বামী।  এগোতে গেলে এদের সবার ভালো থাকা দরকার। সতর্ক থাকার দরকার। যাতে বিপদ না ঘটে।  রথস্বামী(আত্মা) যেন জাগ্রত থাকে, সারথী (বুদ্ধি) যেন সতর্ক থাকে, মন (লাগাম) যেন ইন্দ্রিয়গুলোকে (ঘোড়া) বশে রাখে। তবেই রথ  ঠিক মতো চলবে। 


মনকে সুস্থ রাখতে গেলে আমাদের প্রাণায়াম অভ্যাস করতে হবে।  কিছু আসনের অভ্যাস করতে হবে। এগুলো প্রতিনিয়ত করলে, ব্যষ্টিমন ও সমষ্টিমন -এর মধ্যে একটা যোগাযোগ সংগঠিত হয়। এবং সাম্যাবস্থা বজায় থাকে। শরীর ও মন ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ। শরীরে ব্যাধি  হলে,  মন বিক্ষুব্ধ হবে। মন চঞ্চল হলে,মন অস্থির হলে, জগদীশ্বরের উপাসনাও হবে না।  মন সংযত না হলে ধ্যানও  হবে না। আবার ধ্যান না করলে মনও  সংযত হবে না। তাই মন ঠিক রাখতে, একদিকে যেমন প্রাণায়াম করবে, তেমনি প্রাণায়ামের পরে ধ্যান করবে।   

১০) প্রতিদিন গুরুমূর্তি ধ্যান করবে।

ধ্যান হলো নিজের মনে নিরবিচ্ছিন ভাবে ঈশ্বর সন্মন্ধে একনিবিষ্ট চিন্তা চালাতে থাকা। এটি তিন ভাবে করা যেতে পারে : ১) নিরাকারের ধ্যান ২) প্রতীকের ধ্যান  ৩) সাকারের ধ্যান। প্রথম দিকে সাধকের পক্ষে নিরাকারের ধ্যান এমনকি প্রতীকের ধ্যানও সম্ভব হয় না। সাকারের ধ্যান করা  সহজ।  অর্থাৎ কোনো দেবতার মূর্তির ধ্যান। কিন্তু এই দেবতা সন্মন্ধে তোমার কোনো ধারণা নেই। তার যে মূর্তির পূজা তুমি দেখেছো, বা তার যে গুন্ তুমি শুনেছ সেটুকুই তোমার সঞ্চয়। কিন্তু দেহধারী গুরুকে তুমি চাক্ষুস দেখেছো, তার গুন্ সম্পর্কে তোমার সম্যক  ধারণা আছে। তাই  মহাত্মা গুরুনাথ, প্রথমে গুরুমূর্তি ধ্যান করতে বলছেন। আসলে প্রথমে, গুরুমূর্তির ধ্যান  - তারপরে গুরুদেবের গুনের ধ্যান করতে হয়। ধীরে ধীরে অনন্তের গুনের ধ্যানের যোগ্য হয়ে উঠতে পারি আমরা।   


প্রাথমিক এই উপদেশগুলি যে কোনো আধ্যাত্মিক সাধকের অবশ্য পালনীয়। মহাত্মা গুরুনাথ, ধর্মার্থীদের কর্তব্য সম্পর্কে  আরো অনেক কথা বলেছেন।  সেই সব বিস্তারিত আলোচনা না করে, আসুন আজ থেকে আমরা এই দশটা কর্তব্য কর্ম পালন করি।