Friday 9 April 2021

বৃহদারণ্যক উপনিষৎ


 বৃহদারণ্যক উপনিষৎ

আত্মার সন্ধানে - জ্যোতি ব্রাহ্মণ (চতুর্থ অধ্যায় তৃতীয় পর্ব) অনুসরণে

আত্মজ্যোতি দর্শন। 
 
আপনাদের যাদের একটু আধটু ধ্যানাদি করবার অভ্যাস আছে, তারা লক্ষ করেছেন, ধ্যানের সময়ে আমরা চিদাকাশে  একটা জ্যোতির আভাস দেখতে পাই।  স্বামী বিবেকানন্দ চোখ বুজলেই বা ঘুমুতে গেলেও এই জ্যোতির দর্শন পেতেন। এই জ্যোতির প্রকৃত স্বরূপ কি ? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজবো আমরা বৃহদারণ্যক উপনিষৎ থেকে। আমরা উপনিষদের গল্পে শুনেছি, দেবতাগণ যখন বিজয়উল্লাসে মেতে ছিলেন, যখন নিজেদেরকে সর্বশক্তিমান মনে করে, অহমিকায় মত্ত হয়েছিলেন, তখন তারা এক জ্যোতির দর্শন করেছিলেন। এই স্বয়ংজ্যোতি তাদেরকে শক্তি পরীক্ষায় পরাস্থ করে, অন্তর্দ্ধান করেছিলেন। কে এই জ্যোতির্ময় সত্ত্বা ? 

পুরাকালে বৈদেহ জনক নামক এক রাজা ছিলেন। তিনি ব্রহ্মজ্ঞান পিপাসু ছিলেন। তার আমলে ঋষি যাজ্ঞবল্ক নামে  এক মহামুনি ছিলেন। তিনি ব্রহ্মজ্ঞানী ছিলেন। তো ঋষি যাজ্ঞবল্ক বৈদেহ জনককে ব্রহ্মজিজ্ঞাসু দেখে, তাকে বলেছিলেন, তুমি ব্রহ্ম সম্মন্ধীয়  যাকিছু প্রশ্ন করবে, আমি তার জবাব দেবো।  তুমি নির্দ্বিধায় তোমার মনের সমস্ত প্রশ্ন আমাকে করতে পারবে।

তো একদিন রাজা জনকের দরবারে, যাজ্ঞবল্কের উপস্থিতি দেখে, তাকে সমাদর করে, যথাবিহিত সম্মানিত করে, তাকে প্রশ্ন করলেন। হে মহামুনি, কোনো শক্তি আমাদের ক্রিয়াদির সহায়ক হয় ? আমরা কোন শক্তিবলে সমস্ত কার্যাদি করতে পারি।  কোন জ্যোতি পুরুষের সমস্ত কার্য্যের সহায়ক হয় ? 

যাজ্ঞবল্ক  রাজাকে যথাযথ সন্মান প্রদর্শন করে বললেন, হে সম্রাট  এই শক্তি হচ্ছে আদিত্যজ্যোতি। মানুষের সমস্ত ক্রিয়াশক্তি এই আদিত্যজ্যোতির সাহায্যে প্রাপ্ত হয়ে থাকে। মানুষ এই সূর্যালোকের সাহায্যেই গমনাগমন শক্তি প্রাপ্ত হয়ে থাকে। সমস্ত কার্য করবার শক্তি এই সূর্যালোকের সাহায্যেই সে প্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাই প্রত্যেক মানুষ সূর্য-উদয়ের মুহূর্ত থেকে কর্ম্মে উদ্দীপ্ত হয়। আবার সূর্য-অস্ত গেলে, সে স্তিমিত হয়ে থাকে। ন্যুইস্টেজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। 

জনক : কিন্তু কিছু মানুষ এমনকি কিছু জীবজন্তু রাতেও সক্রিয় থাকে, তখন কে তাকে সাহায্য করে থাকে ?  
যাজ্ঞবল্ক : সূর্য অস্তাচলে গেলে, চন্দ্র এই কাজ করে থাকে। কারন, সূর্য্যের জ্যোতি চন্দ্রের উপরে প্রতিফলিত হয়ে সে তখন সূর্য্যের মহিমা প্রাপ্ত হয়। আর এই চন্দ্রালোকের সাহায্যে জীব বা মনুষ্য বিভিন্ন ক্রিয়াদি সম্পন্ন করে থাকে। 
জনক : কিন্তু অমাবস্যা  রাতে চন্দ্র থাকে না। তখন কিভাবে কার সাহায্যে মানুষ কার্য করতে সক্ষম হয় ?
যাজ্ঞবল্ক : সূর্য অস্তমিত হলে, চন্দ্রিমা অস্তমিত হলে, অগ্নিই এর জ্যোতি হয়।  তখন অগ্নিপ্রভার সাহায্যে মানুষ সমস্ত কর্ম্ম করে থাকে। 
জনক : সূর্য ও চন্দ্র অস্তমিত হলে, এমনকি অগ্নি নির্বাপিত হলে, কোন জ্যোতি মানুষের সহায়ক হয় ? 
যাজ্ঞবল্ক : শব্দই তখন জ্যোতি স্বরূপ হয়।  মানুষ তখন শব্দের  সাহায্যে বসে, চলে, কর্ম্ম করে, আবার ফিরে আসে। এইজন্য মানুষ যখন নিজের হাত পর্যন্ত ভালোকরে দেখতে পায়  না, তখন যেখানে  শব্দ  হয়, সেখানে সে উপস্থিত হতে পারে। 
জনক : শব্দও যদি নিরুদ্ধ হয়, তখন কোন জ্যোতি মানুষের সহায়ক হয় ?

যাজ্ঞবল্ক : তখন আত্মাই এর জ্যোতি হিসেবে কাজ করে থাকে।  আত্মজ্যোতি-সহায়ে মানুষ তখন বসে, চলে, কর্ম্ম করে, আবার ফিরে আসে। 

মন্তব্য : এই পর্যন্ত যা আলোচনা হলো, তাকে আমরা বুঝতে পারলাম, সমস্ত লোকব্যবহার আলোক সাপেক্ষ। সুতরাং আমরা অনুমান করতে পারি, যে যেখান  আমাদের দেহাদি কর্ম্ম আছে, সেখানে আলোকের সহযোগিতা দরকার, এমনকি যেখানে মনের কার্য্য আছে, সেখানেও আলোক অবশ্যই  আছে। কিন্তু আমরা জানি, মানুষ কর্ম্ম সম্পাদন করে থাকে তার দেহ-ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে।  কিন্তু ঋষি যাজ্ঞবল্ক বলছেন, এই দেহ-ইন্দ্রিয় যা কিছু করে থাকে, তার জন্য আলোকশক্তির প্রয়োজন। আর একটা গভীর তত্ত্ব হচ্ছে, দেহ-ইন্দ্রিয় আমাদের জাগ্রত অবস্থায় কার্য সম্পাদন  করে থাকে। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের বা জীবের এই জাগ্রত অবস্থা বাদেও আমাদের এমন ব্যবহার স্থল বা অবস্থা আছে, যেখানে আপাতত কোনো আলোক নেই।  যেমন স্বপ্নাবস্থা, বা সুসুপ্তির অবস্থা। সেখানে কি আদৌ কোনো আলো  আছে ? 
ঋষি যাজ্ঞবল্ক প্রথমে আমাদের জাগরণ-কালীন ক্রিয়া সম্পাদনের জন্য দেহ-ইন্দ্রিয় ছাড়াও যে একটা আলোক যা আমাদের ক্রিয়া সম্পাদন করে থাকে তার কথা বললেন, অর্থাৎ দিন, রাত্রি, ও অগ্নির কথা বললেন, এবং শেষে শব্দ-রূপ আলোর কথা বললেন, তাহলে কি আমরা ধরে নেবো, যে স্বপ্নাবস্থায় আমরা যে কার্য্য করে থাকি, সেখানেও তেমনি কোনো আলোর সাহায্য আমরা পেয়ে থাকি ? জাগরনে আমরা বাহ্যজ্যোতির সাহায্য পেতে পারি, কিন্তু স্বপ্নে বা সুসুপ্তিতে এই বাহ্যজ্যোতির সাহায্য পাওয়া সম্ভব নয়। অথচ এই স্বপ্নাবস্থাতেও আমরা বিভিন্ন ক্রিয়া সম্পাদন করে থাকি। আবার সুসুপ্তিতে আমাদের সুখের নিদ্রা হয়ে থাকে। সুতরাং এই অবস্থাতেও নিশ্চই কোনো জ্যোতি সাহায্য করে থাকে বা সাক্ষী হিসেবে থাকে। তিনি কে ? আমরা ধ্যান করবার সময়ও বিভিন্ন দৃশ্য দেখে থাকি।  এখানেও কি কোনো জ্যোতি বর্তমান থাকে ? 
ঋষি যাজ্ঞবল্ক বলছেন, এই জ্যোতিই অন্তর-জ্যোতি। এই জ্যোতি আমাদের দেহ, ইন্দ্রিয় এমনকি অন্তঃকরণ থেকেও ভিন্ন অথচ আরোপিত দীপ্তি অর্থাৎ অবভাসক। ঋষি যাজ্ঞবল্ক বলছেন, আত্মাই এই অন্তর-জ্যোতি। এই অন্তর-জ্যোতি দেহ, ইন্দ্রিয় ও আমাদের অন্তঃকরণ হতে ভিন্ন।  এই জ্যোতি স্বয়ং কারুর দ্বারা অবভাসিত হন না। আমাদের সমস্ত বাহ্য  কর্ম্ম বস্তুত এই অন্তর-জ্যোতির দ্বারাই সম্পাদিত হয়ে থাকে। আমাদের কাছে সাধনার প্রথম দিকে এই গূঢ়  তত্ত্ব  একটা ধারণা  মাত্র। কিন্তু তত্ত্বজ্ঞ পুরুষের কাছে, জ্ঞানের বিষয়। এই জ্ঞানের অন্নেষন ক্রিয়াই সাধনা।

এখন রাজা জনক প্রশ্ন করছেন,  আত্মা কোনটি ?

ঋষি যাজ্ঞবল্ক বলছেন,   যিনি আমাদের বুদ্ধিতে উপস্থিত তিনি আত্মা !  ইন্দ্রিয়ে যিনি উপস্থিত তিনি আত্মা ! 

রাজা জনক প্রশ্ন করছেন, বুদ্ধির অভ্যন্তরস্থ জ্যোতিঃপুরুষই আত্মা! সূর্য  সমজাতীয় বস্তুকে প্রকাশ করেন, আবার ইন্দ্রিয় সমজাতীয় ইন্দ্রিয়গুলোকে উদ্ভাসিত করেন। আবার সকল ইন্দ্রিয় জ্ঞান আহরণ করছে, কিন্তু  এর মধ্যে সত্যিকারের আত্মা কোনটি ? 
যাজ্ঞবল্ক বলছেন,  বুদ্ধিতে আরোপিত আত্মা বুদ্ধিস্বরূপ মনে হয়। কিন্তু সত্য হচ্ছে, বুদ্ধি, প্রাণ, মন, ও ইন্দ্রিয়গুলোকে যিনি চেতনপ্রায় করে তোলেন তিনিই আত্মা।
  
শিষ্য :হে গুরুদেব মানুষ মৃত্যুর পরে কোন লোক প্রাপ্ত হয় ? 
 
গুরুদেব : প্রত্যেকটি মানুষ মৃত্যুর পরে ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়। 

শিষ্য : ব্রহ্মলোকে তো ব্রহ্মা থাকেন।  তো আমরা কিভাবে সেখানে স্থান পাবো।  শুনেছি, মহাভাগ্যবান, এই ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। 

গুরুদেব : তুমিও ব্রহ্ম। আর তুমি ব্রহ্মলোকেই বিরাজ করছো।  কিন্তু তা তুমি জান  না।  অজ্ঞান বশত, অবিদ্যা বশত নিজেকে মর্তলোকের বাসিন্দা ভাবছো।  আসলে মর্তলোকে হচ্ছে সেই লোক, যেখানে এলেই মৃত্যুবরণ করতে হয়। প্রতিনিয়ত যেখানে মৃত্যু হচ্ছে সেটাই মৃত্যু লোক।  এখানে সবকিছু পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনশীল ক্রিয়ার সাহায্যে যখন কোনো বস্তু আমাদের দৃষ্টিগোচর থাকে না, তখন তাকে আমরা মৃত্যু বলে থাকি। দেখো এ সবই জ্যোতির খেলা। তুমি নিজেও জ্যোতির্বিন্দু বই বেশি কিছু নও।  

শিষ্য : সে কিরকম ? 

গুরুদেব : এই জগৎ ততক্ষনই আমাদের কাছে দৃশ্যমান, যতক্ষন জ্যোতি আছে। জ্যোতিই সমস্ত কিছুকে চলমান করে রাখে।  সৌর জগতে সূর্যই এই জ্যোতির উৎস। সূর্য যখন অস্তাচলে চলে যায়, তখন  চন্দ্রজ্যোতি জগৎকে দৃশ্যমান করে থাকে।  অমাবস্যা রাতে অগ্নি জগৎকে দৃশ্যমান করে থাকে। আবার দেখো, যখন সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি নির্বাবিত হয়, তখন শব্দ জ্যোতি এই জগৎকে দৃশ্যমান করে রাখে। আবার শব্দজ্যোতি যখন বিলোপ প্রাপ্ত হয়, তখন আত্মাই জ্যোতি রূপে প্রতিভাত হয়। আর এই আত্মজ্যোতি প্রভাবে জগৎ দৃশ্যমান থাকে। অর্থাৎ সবই আলোক সাপেক্ষে বর্তমান থাকে। 

শিষ্য : আত্মা কি ?

গুরুদেব : তোমার বুদ্ধিতে যা উপস্থিত তাই আত্মা। তোমার বুদ্ধিতে কি উপস্থিত ? জ্ঞান।  আর এই জ্ঞান তুমি তোমার পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে পেয়ে থাকো। আর এই জ্ঞান যখন তোমার লোপ পেয়ে যায়, তখন আর তুমি তোমার "আমি"-কে  বুঝতে জানতে বা উপল্বদ্ধিতে আনতে  পারো  না। আসলে বুদ্ধিতে উপস্থিত থাকে আত্মজ্যোতি। এই জ্যোতিই আত্মা, জ্যোতিই ব্রহ্ম।  বুদ্ধি আত্মা নয়, কিন্তু আত্মা তোমার মধ্যে বুদ্ধি স্বরূপ। কাঁচের ডুমের মধ্যে আলো যেমন তার চারিপাশের বস্তুকে জ্যোতির্ময় করে, আত্মজ্যোতিও তেমনি বুদ্ধি, মন, প্রাণ, ইন্দ্রিয়গুলোকে সচেতনপ্রায় করে তোলে। আসলে এঁরা  নিজ-নিজ গুনে চেতন নয়, জ্যোতি এদের চৈতন্যপ্রায় করে তোলে। রঙ্গিন কাঁচ আর তার রঙ্গিন আলো যেমন পৃথক করা যায় না, তেমনি বুদ্ধির সাথে আত্মজ্যোতিকে অভিন্ন বলেই মনে হয়। বুদ্ধিতে প্রতিফলিত আত্মা বুদ্ধিকে অবলম্বন করে দেহের ইন্দ্রীয় সকলের মধ্যে প্রতিফলিত হন। আর সেইজন্য ইন্দ্রিয়গুলোকেও ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। আত্মার কোনো ক্রিয়া নেই। কিন্তু বুদ্ধি ক্রিয়ার জনক। এইভাবে বুদ্ধির সাথে আত্মার সহযোগে ব্রহ্মার স্বপ্ন, জাগরণ, সুষুপ্তি  হয়। 

জাগরনে যিনি বুদ্ধিকে উদ্ভাসিত করেন, স্বপ্নে জাগ্রত অবস্থার অতীত হয়েও, তিনিই স্বপ্নাবস্থায় বুদ্ধিকে উদ্ভাসিত করে থাকেন। এই জ্যোতি বা আত্মা জন্মগ্রহণকালে অর্থাৎ শরীর  ধারণ কালে, দেহের ইন্দ্রিগুলোর সঙ্গে  সংযুক্ত হন আবার মরণকালে ইন্দ্রিয়সকল ত্যাগ করে থাকেন। আমাদের  জাগরনে এই বুদ্ধিযুক্ত  আত্মা দেহকে গ্রহণ করে থাকেন আবার স্বপ্নে দেহকে ত্যাগ করেন।  আবার মরণকালে ও জন্মগ্রহণকালে এই একইভাবে আগমন ও নির্গমন হয়ে থাকে। 

জাগরনে আমরা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বিষয় সংযোগ করে থাকি।  অর্থাৎ কান দিয়ে শুনি, চোখ দিয়ে দেখি, ত্বক দিয়ে স্পর্শ করি, মুখ বা জিহ্বা  দিয়ে কথা বলি, বা আস্বাদ গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু এই একই কাজ অর্থাৎ আস্বাদন, শ্রবণ, দর্শন ইত্যাদি করে থাকি স্বপ্নাবস্থায়, কিন্তু সেখানে আমাদের কোনো ইন্দ্রিয় ক্রিয়াশীল  থাকে না। এমনকি দেহের  সবকিছু নিষ্ক্রিয় থাকে। তো কান নেই অথচ শুনছি, চোখ নেই তথাপি দেখছি, এমনকি আমরা স্বপ্নে সুখ-দুঃখ অনুভব করছি। তো এই সব হচ্ছে কিভাবে ? হচ্ছে আত্মার উপস্থিতির জন্য। 

আসলে গমনশীল আত্মার দুটো স্থান।  এক হচ্ছে ইহলোক, আর একটি  হচ্ছে পরলোক। কিন্তু স্বপ্ন নামক যে তৃতীয় স্থান এটি একটি সংযোগ স্থান। এই সংযোগস্থলে থেকেও আত্মা ইহলোক ও পরলোক দুটোই দেখে থাকেন।  স্বপ্নাবস্থাতে আত্মা তার ভূত ভবিষ্যৎ  দেখতে পান। অর্থাৎ তার সঞ্চিত জ্ঞান-কর্ম্ম-সাধনফল যা তিনি আশ্রয় করেছেন, অর্থাৎ পাপফল ও পুণ্যফল এই দুইপ্রকার ফলই দর্শন করে থাকেন। আত্মা যখন স্বপ্নের জগতে বিরাজ করেন, তখন তিনি সর্বপালক এই দেহ-ইন্দ্রিয়ের সংঘাতের একাংশ গ্রহণ ক'রে, নিজেই এই দেহকে বিনাশ ক'রে একটা স্বপ্নদেহ নির্মাণ ক'রে স্বীয় জ্যোতি দ্বারা প্রকাশিত স্বয়ং প্রকাশ রূপে অবস্থান করে থাকেন, এবং স্বপ্ন দর্শন করেন। 

আসলে আমরা যাকে  জাগ্রত অবস্থা বলে থাকি, সেটিও একপ্রকার স্বপ্নাবস্থা। আমরা যে স্বপ্নের কথা বলে থাকি, তা আমাদের ছয় বা আট ঘন্টার পরেই আমরা অনুভব করতে পারি। কিন্তু আমরা জেক জাগ্রত বলছি, তাও একপ্রকার স্বপ্ন বই কিছু নয়, যেখান থেকে বেরিয়ে আসতে  গেলে আমাদের জীবিতকালে অর্থাৎ আশি থেকে একশত বৎসর লাগে।    এই অবস্থায়, আমাদের সংস্কার অনুযায়ী স্বপ্ন দর্শন হয়। কিন্তু আমরা যাকে স্বপ্নদর্শন বলে থাকি, সেখানে যে দর্শন বা সুখ-দুঃখের অনুভূতি হয়, তা শুধু ইহজন্মে সংস্কার - একথা বলা যায় না। এখানে স্বপ্নদর্শন আমাদের পূর্বজন্মের সংস্কারসকল অনুভবের কারন বলা যেতে পারে। এ থেকে আমরা পরলোকের অস্তিত্ত্ব সম্পর্কে একটা প্রমান পেতে পারি।  স্বপ্নে আমরা পূর্বপূর্ব জীবনের ধর্ম্ম-অধর্ম্ম কর্মফলজনিত সুখ দুঃখীর অনুভব করে থাকি। আবার অদৃষ্টবশে কিংবা দেবানুগ্রহে আমরা ভাবি-জন্মের আভাস পেতে পারি। 

জাগ্রত অবস্থায়, অদৃষ্টের ভোগ ক্ষয় থেকে দেহ ও ইন্দ্রিয় সকলের যে বিশ্রাম, তাকেই আমরা মৃত্যু বা স্থুল দেহের নাশ বলে থাকি। আবার এই অদৃষ্ট  বসেই আমাদের স্বপ্ন-দেহ নির্মিত হয়, এবং স্বপ্নদেহে আমরা স্বপ্ন দর্শন করে থাকি। এই বিনাশ ও নির্মাণ আসলে আত্মকৃত। স্বপ্নে আমাদের মন বাহ্য বিষয় থেকে বিরত থাকে। কিন্তু বাহ্য বিষয় যখন আমাদের বাসনার আকার নেয়, তখন আত্মা এই বাসনাময়  অন্তঃকরণবৃত্তি রূপে প্রকাশিত থাকেন। আত্মা যখন বাসনাময় অন্তঃকরণবৃত্তি রূপে প্রকাশিত থাকেন, এই থাকাকে উপনিষদ বলছে মূলে  "স্বেন ভাসা" । এই স্বপ্ন অবস্থায় সাক্ষীভূত আত্মজ্যোতি আমাদের বৃত্তিসকলকে প্রকাশ করে থাকেন। একেই বলা হয় "স্বেন-জ্যোতিষা"।

আমাদের যে স্বপ্নের অনুভব হয়, সেখানে না আছে কোনো সূর্য্যের আলোক, না আছে কোনো ইন্দ্রিয়সকল। এখানে আছে আত্মার জ্যোতি। আত্মার আলোক। আত্মা আসলে কাউকেই সৃষ্টি করেন না, কর্ম্মফলই সৃষ্টির কারন। তথাপি বলা হয়ে থাকে, আত্মাই কর্ম্মফলের হেতু। জাগরনেও তিনি কর্তা নন, তিনি কিছুই করেন না, কিন্তু তাঁর জ্যোতির দ্বারা আভাসিত হয়ে আমাদের দেহ-ইন্দ্রিয়সকল কর্ম্মে ব্যাপৃত হয় বলে তাঁহাতে কর্তৃত্ব আরোপিত হয়। কথায় বলে জ্যোতির্ময় এবং নিঃসঙ্গ পূর্ণাত্মা স্বপ্নাবেশে স্থূল শরীরকে নিশ্চেষ্ট রেখে অথচ স্বয়ং অসুপ্ত থেকে ও ইন্দ্রিয়সকলের জ্যোতিস্মান মাত্রা সকলকে নিয়ে স্বপ্নাবস্থায় বাসনাময়  বিষয়গুলোকে প্রকাশ করে থাকেন। এরপর তিনিই আবার জাগ্রত অবস্থায় ফিরে আসেন। 

জ্যোতিময়-একাকি-সঞ্চারী এবং অমর এই পূর্ণাত্মা নিকৃষ্ট বাসস্থানকে প্রাণের দ্বারা রক্ষা করে স্বয়ং এই ভিতরে-বাহিরে বিচরণ করেন।  সেই অমর পুরুষ বিভিন্ন বিষয়-বাসনার অনুগমন করে থাকেন। আমরা জানি আমাদের স্বপ্নাবস্থায় আত্মা দেহেই থাকেন। তৎ সত্ত্বেও দেহের মধ্যে অবস্থিত যে আকাশ, এই আকাশ যেমন দেহের সঙ্গে সম্মন্ধযুক্ত নয়, এই আকাশ দেহের ভিতরে এবং বাইরে অবস্থান করছে, ঠিক তেমনি দেহ-সম্মন্ধ শূন্য আত্মা দেহের ভিতরে বাইরে অবস্থান করছে। কর্ম্মফল বশতঃ যে সব কামনা-উদ্ভূত বৃত্তি হয়, সেই বৃত্তি বাসনার  আকারে পরিণত হলে তিনি সেই বিষয় অনুভব করে থাকেন। 

এই আত্মজ্যোতি স্বপ্নে অনেক বাসনাকার বস্তু নির্মাণ করেন। সেইমতো তিনি উচ্চ-নিচ যোনী প্রাপ্ত হন, যেন স্ত্রী হাস্যরসে মজে যান, আবার তিনিই ভয়ানক বস্তুসকল দর্শন করে থাকেন। জীব স্বপ্নের মধ্যে এই ক্রিয়া দর্শন করে থাকেন, কিন্তু ক্রিয়াসম্ভোগকারীকে দেখতে পান না। 

আমরা কেউ ঘুমুলে হঠাৎ করে ডাকতে নেই।  কারন হচ্ছে, এইসময় আমরা ইন্দ্রিয়াতীত হয়ে বিচরণ করে থাকি। তো হঠাৎ সেখান থেকে টেনে-হিচড়ে নিয়ে আসলে, এমনটা হতে পারে, যে তিনি তখন কোনো না কোনো ইন্দ্রিয়কে প্রাপ্ত না হয়েই ফিরে আসতে  পারেন।  এই অবস্থায় আমরা কোনো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারি।  কেউ আবার বলেন, জাগ্রত অবস্থা হচ্ছে আত্মার স্বপ্ন, কারন জাগ্রত অবস্থাতে তিনি যা কিছু দেখেন, স্বপ্নেও তিনি তাই দেখেন। যদিও এই ধারণা  ঠিক নয়, আমাদের স্বপ্নে পুরুষ স্বয়ংজ্যোতি হন। তাই ধ্যানে চোখ বুজলে আমরা আত্মজ্যোতিকে দেখতে পাই, জাগ্রত অবস্থায় তাকে হারিয়ে ফেলি। (বৃহদারণ্যক উপনিষৎ - ৪/৩/১ থেকে ৪/৩/১৪)

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

 

,      
 

 













      


























   

Saturday 3 April 2021

পতঞ্জলি যোগসাধনা - সাধন পাদ/


 পতঞ্জলি যোগসাধনা - সাধন পাদ 

ঈশ্বরের দুই রূপ - প্রকৃতি ও পুরুষ। একজন নিষ্ক্রিয় অপরজন সক্রিয়। একজন জড়ানো, একজন ছড়ানো। একপ্যাঁচে বন্ধন  উল্টো প্যাঁচে মুক্তি। একদিকে চঞ্চল আর একদিকে শীতল। এই দুইকে স্বরূপে জানাই সাধনা। কথায় বলে, সে বড়ো  কঠিন ঠাঁই গুরু শিষ্যে দেখা নাই। সাধন পথের  কথা অবোধ্য, দুর্বোধ্য। যার সাধন নেই, তাকে সাধন কথা বোঝানো বিড়ম্বনা। যেখানে ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধি লোপ পেয়ে গেছে,  সেখানে প্রবেশের অধিকার নেই আমাদের। স্বয়ং প্রকাশ, নিজেকে নিজের মধ্যে প্রকাশ করা, এই চূড়ান্ত উপল্বদ্ধির জন্য সাধনা।  

যোগের ভিত্তি দুটো পিলারের উপরে - প্রকৃতি ও পুরুষ। এই দুই তত্ত্বের চরম উপলব্ধি যোগের সাহায্যে হতে পারে। পুরুষকে স্বরূপে চিনতে হবে।  কারন, পুরুষের কোনো পরিনাম নেই, কোনো রূপান্তর নেই। তাই পুরুষ বোধের কোনো বদল হয় না, বিলোপ হয় না। পুরুষ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, প্রকৃতির দিকে, যেখানে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটে চলেছে। চিত্তে বা মনে যত  বৃত্তি, সব এই  পুরুষের জ্ঞানের বিষয়। চিত্ত বা মন চৈতন্যের আলোতে আলোকিত। চৈতন্যের আলোকে আড়াল করে, চিত্তের কোথাও কিছু ঘটে এমনটা সম্ভব নয়। তাই ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, 

সদা জ্ঞাতা চিত্তবৃত্তয়ঃ তৎপ্রভোঃ পুরুষস্য অপরিনামিত্বাৎ। (৪/১৮ কৈবল্যপাদ)

চিত্তের প্রভু পুরুষের অপরিণামত্ব হেতু চিত্তবৃত্তিগুলো সর্বদাই জ্ঞাত। 

পুরুষ নিজে জ্ঞানশক্তি সম্পন্ন।  তাঁর কোনো বিকার নেই। চিত্ত তার বৃত্তির মাধ্যমে প্রকাশমান ও অপ্রকাশ্য। কিন্তু পুরুষের কোনো প্রকাশ বা অপ্রকাশ নেই। চিত্ত, বিষয় সংযোগে  সক্রিয় হয়, শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ  ইত্যাদির মাধ্যমে। এটাই চিত্তের বিষয় জ্ঞান। বিষয়ের দ্বারা রঞ্জিত হয়ে, চিত্ত বিকারপ্রাপ্ত হয়, পরিনাম প্রাপ্ত হচ্ছে।  কিন্তু পুরুষ কখনো পরিণামপ্রাপ্ত হন না। 

আমরা সবাই প্রকৃতির কোলে অবস্থান করছি। প্রকৃতি চিরচঞ্চল, অস্থির রূপ। অথচ আমাদের চর্ম্মচক্ষে এই চঞ্চলতা ধরা পড়ে  না। পৃথিবী ঘুরছে, পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে  আমরাও ঘুরছি। কিন্তু আমাদের অনুভবে তা ধরা পড়ে না। আমাদের মনে হয়, পৃথিবী স্থির। প্রকৃতি স্থির। জীবন একটা নদী। আমরা জানি, নদীর  উপাদান জল। আর জল সদা প্রবাহমান।  তেমনি  জীবনের উপাদান চিরবহমান। জীবন নদী কখনো থামতে জানে না। অথচ নিরন্তর বহমানতা আমাদের উপল্বদ্ধিতে আসে না। জীবন নদীতে ভাসতে ভাসতে একসময় বৃদ্ধ বয়সে এসে মনে হয়, কত কিছু ছেড়ে এসেছি, কতকিছু হারিয়ে গেছে। কোথায় সেই শৈশবের দিনগুলো, কৈশোরের দিনগুলো, যৌবনের দিনগুলো ? এই ক্রোম-পরিণামের জন্য আমাদের রকমফের হয়েই চলেছে। 

পরিনাম বিচিত্র, পদার্থ এক। একই মাটি দিয়ে তৈরী হচ্ছে, কত বিচিত্র পুতুল, হাড়ি কড়াই, সরা, কলসি। মাটির রূপ একটাই , মাটির লক্ষণ একটাই, মাটির গুন্ অপরিবর্তিত। মাটি যখন বিশেষ রূপের মধ্যে আবদ্ধ  হলো, তখন তার ধর্ম্ম হলো, তখন তার লক্ষণ হলো। কলসি যখন তৈরী হয়নি, তখন সে অনাগত, যখন কলসি তৈরী হলো তখন সে আগত বা বর্তমান।  আবার কিছুদিন পরে কলসি ভেঙে গেলো, তখন সে অতীত। একটু যদি গভীর ভাবে চিন্তা করি, তখন আমরা বুঝতে পারবো, জগতের সমস্ত বস্তুরই এই তিনটি পরিনাম। পরিনাম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমানের পরিবর্তন হয়। যে মুহূর্তে কলসিটি তৈরী হলো, তখন সে বর্তমান নতুন।  কিন্তু পরমুহূর্তেই সে পুরাতন হলো, কিন্তু বর্তমান থাকলো, নতুন কলসি হলো অতীত। কলসির অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে, সময়ের নয়।মাটি থেকে কলসির রূপ ফুটে ওঠার ক্ষণ থেকে আবার মাটিতে মিলিয়ে যাবার ক্ষণ পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া। সারা সৃষ্টি ধরে চলছে, এই পরিণামের ত্রিধারার (অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ) প্রবাহ। এযেন ক্ষনের মালা  গাঁথা। সময়ের মালা গাঁথা। আমি আমার বুদ্ধি আমার কল্পনার সুতোয় মালা গেথে চলেছি। ভাবছি, ক্ষণ চলে গেলো, আসলে ক্ষণ দাঁড়িয়ে। আমরা ক্ষনের পরে ক্ষনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।  আমাদের ক্ষনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। তবে আমরা বস্তুর পরিনাম বুঝতে পারবো। কালকে সংকুচিত করতে করতে আমরা ক্ষনের কাছে পৌঁছে যেতে পারি। বস্তু ভাঙতে ভাঙতে যেমন আমরা পরমাণু পাই, তেমনি কাল ভাঙতে ভাঙতে আমরা  ক্ষণ পেতে পারি। পরমাণু জড়ো করতে করতে যেমন আমরা বস্তু পেতে পারি, তেমনি ক্ষণগুলোকে পরপর দাঁড় করিয়ে আমরা কালের কল্পনা করে থাকি। বস্তুকে বুঝতে যেমন আমাদের পরমাণুর কাছে যেতে হবে, তেমনি কাল বুঝতে গেলে আমাদের ক্ষনের কাছে যেতে হবে। অর্থাৎ স্থূল থেকে সূক্ষ্মে। সূক্ষ্ম  থেকে তন্মাত্রে, তন্মাত্র থেকে অহংকারে, অহংকার থেকে মহত্তত্ত্বে , সেখান থেকে প্রকৃতির   অলিঙ্গে - যেখানে  লিঙ্গ নেই। সৃষ্টির মূল। যেখানে আর কোনো মূল নেই। সর্ব কারনে কারন।  কারনে অবসান। এহলো প্রকৃতির অলিঙ্গে  দাঁড়িয়ে সৃষ্টিজোড়া প্রকৃতিকে খোঁজা।   

অন্যদিকে পুরুষের সন্ধান করতে গেলে, সবকিছু থেকে বিযুক্ত হতে হবে, তবেই পুরুষ শক্তির সন্ধান করা যাবে । পুরুষ কার্য্য-কারন  শৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে  না। পুরুষ সৃষ্টির উপাদান-কারন নয়। পুরুষ নিমিত্ত মাত্র। পুরুষের নিমিত্তই সৃষ্টির উপাদান জোগাচ্ছেন প্রকৃতি। পুরুষ আছেন, তাই প্রকৃতির উৎসাহ। প্রকৃতি পুরুষের জন্যই বিশাল আয়োজনে ব্যস্ত। স্ত্রী মৌমাছির টানে যেমন পুরুষ  মধু সংগ্রহ করে নিয়ে আসে, বাসা বাঁধে, তেমনি পুরুষের টানে প্রকৃতি সৃষ্টির উপাদান সংগ্রহ করে থাকে। বিপুল সেই আয়োজন। দেখবেন পুরুষ, ভোগ করবেন পুরুষ, ভালো-মন্দ বুঝবেন তিনি, তৃপ্ত বা অতৃপ্ত হবেন তিনি, সুখী বা অসুখী হবেন তিনি সেই আশায় প্রকৃতির বিশাল আয়োজন। কারন চেতনা তো তারই সম্পদ। কিন্তু হায়, পুরুষ উদাসীন, নির্লিপ্ত। পুরুষই, ভোক্তা, ভর্তা, দৃষ্টা , মালিক।  পুরুষ-মালিককে খুশি করবার জন্য, দাসী-প্রকৃতির ব্যস্ততা। পৃকৃতি গাইছে, নাচ্ছে, পুরুষ দেখছে, শুনছে। কখনো তৃপ্ত, কখনো বিরক্ত। বিরক্ত পুরুষ একসময় উঠে পরে, আসন ছেড়ে চলে যায়। যখন উঠে যায়, তখন নাচ-গান থেমে  যায়। কার জন্য নাচ-গান, যদি দ্রষ্টা-শ্রোতা-সমঝদার না থাকে ?  এই সমজদার পুরুষই পরমাত্মা। বোঝার, দেখার, শোনার, ভোগ করবার, ক্ষমতার যোগ যিনি করতে পারেন,  তিনিই পরমাত্মা। প্রকৃতির দ্বারা নির্মিত এই দেহে সেই পুরুষেরই বাস। এই পুরুষের সন্ধানই যোগ। শুরু হয়, প্রাকৃতিক দেহকে অবলম্বন করে, শেষ হয়, পুরুষ-চেতনায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে। জাতি-দেশ-কাল-সময় থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে চেতন-মৌন হয়ে যাওয়া। 

ম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

পাতঞ্জল দর্শন - সাধন পাদ -২

ঋষি পতঞ্জলি তার পাতঞ্জল যোগদর্শনে বলছেন, (শ্লোক-১) তপঃ-স্বাধ্যায়-ঈশ্বর-প্রণিধানানি ক্রিয়াযোগঃ। তপস্যা, স্বাধ্যায়ঃ ও ঈশ্বর-প্রণিধান, একেই বলে ক্রিয়াযোগ। এখন  কথা হচ্ছে, তপস্যা, স্বাধ্যায়, ঈশ্বর-প্রণিধান বলতে আমরা কি বুঝি ? 

তপস্যা : আমাদের বিচিত্র বাসনা।  আর এই বাসনা পূরণ করবার জন্য আমরা কর্ম্মের ক্লেশ সহ্য করি। বিষয়ের ভোগের নিমিত্ত  চিত্তকে অশুদ্ধ করে ফেলি। এইযে চিত্তমল, ও কর্ম্মক্লেশ এগুলো আমাদের সাময়িক সুখ দুঃখের কারন। তপস্যা যোগীর চিত্তে বাধাহীন ভাবে প্রসন্নতা আনতে  পারে।

স্বাধ্যায় : হলো, বিভিন্ন পবিত্র ধর্ম্মগ্রন্থ যা মোক্ষের সন্ধান দিতে পারে, এমন গ্রন্থ পাঠ ও পাঠ্য বিষয়ে মনের গভীরে চিন্তন করা। যথার্থ পন্ডিতদের বাণী শ্রবণ, মনন করা। 

ঈশ্বর-প্রণিধান : অর্থাৎ ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পন করা। নিজের সমস্ত কর্ম্মফল ঈশ্বরে কাছে নিবেদন করা। 

এগুলো সবই ক্রিয়াযোগের অঙ্গ। এখন কথা হচ্ছে ক্রিয়াযোগ করলে কি হয় ? ঋষি বলছেন, (শ্লোক-২) সমাধি-ভাবনার্থঃ-ক্লেশ-তনুকরণ-অর্থশ্চ। অর্থাৎ সমাধি-ভাবনার জন্য,  এবং আমাদের ক্লেশ গুলোকে ক্ষীণ করবার জন্য, ক্রিয়াযোগের অনুষ্ঠান করা কর্তব্য।  সমাধি হচ্ছে একটা উচ্চ ভাবনার স্তর একটা উচ্চ  চেতন  স্তরে নিজেকে উন্নীত করা। আর এটি করতে গেলে, নিজের মধ্যে যত ক্লেশ/কষ্ট আছে,  চিত্তে যত মল জমা আছে, তাকে পরিষ্কার করতে হবে। এখন কথা হচ্ছে এই ক্লেশগুলো কী ? 

ঋষি বলছেন, (শ্লোক-৩) অবিদ্যা-অস্মিতা-রাগ-দ্বেষ-অভিনিবেশাঃ পঞ্চক্লেশাঃ। অর্থাৎ অবিদ্যা-অস্মিতা-রাগ-দ্বেষ-অভিনিবেশ - এই পাঁচপ্রকার ক্লেশ। অবিদ্যা অর্থাৎ মিথ্যাজ্ঞান, বা বিপরীত ভাবনা, মিথ্যা সংস্কার। অস্মিতা হচ্ছে আমিজ্ঞান - মিথ্যা আমিজ্ঞান -অহংকার। রাগ হচ্ছে আসক্তির অপূর্ণতার পরিণতি। দ্বেষ হচ্ছে অন্যের প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়া,  আর অভিনিবেশ হচ্ছে মৃত্যুভয়। এই পাঁচ ধরনের প্রভাব আমাদের চিত্তকে মলিন করে রাখে। এমনকি নিজের সত্ত্বার বিস্মৃতি ঘটায়। এবং এই কারণেই আমরা আমাদেরকে ভুলে আছি।

ঋষি বলছেন, (শ্লোক-৪) অবিদ্যা ক্ষেত্রম-উত্তরেষাং প্রসুপ্ত-তনু-বিছিন্নম-উদারাণাম্। অবিদ্যার উদরেই   জন্ম নেয়, অস্মিতা-রাগ-দ্বেষ-অভিনিবেশ ইত্যাদি ক্লেশ।  এই অবিদ্যা আবার প্রসুপ্ত, তনু, বিচ্ছিন্ন ও উদার এই চার ভেদে অবস্থিত। এখন কথা হচ্ছে প্রসুপ্তি কি ? আমাদের চিত্তে শক্তির আশ্রয়মাত্র একটা বীজ ভাবের উদয় হয়। এই বীজ হচ্ছে প্রবোধ। প্রবোধ অর্থাৎ সন্তুষ্টি। এই প্রবোধের সাহায্যে ক্লেশবিজ দগ্ধ হতে থাকে। যার জন্য সচেতন পুরুষের মধ্যে  বিষয় বাসনা জাগতে পারে না। তাই যোগী পুরুষের মধ্যে যদিবা ক্লেশ থাকে তা ক্ষীণমাত্র। আর পুড়ে যাওয়া বীজের মধ্যে থেকে যেমন অংকুর-উদ্গমনের সম্ভাবনা ক্ষীণ, তেমনি যোগী পুরুষের মধ্যে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগ সত্ত্বেও কোনো ক্লেশের জাগরণ ঘটতে পারে না। 

তনু কথাটার অর্থ আমরা জানি  অঙ্গ বা দেহ। তনু কথাটার আর একটি অর্থ হচ্ছে সূক্ষ্ম। বিপরীত ভাবনায় অভিভূত যে ক্লেশ তনু অর্থাৎ ক্ষীণ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ যে ভাবনায় ক্লেশ উৎপন্ন হচ্ছে, তার বিপরীত ভাবনায়, ক্লেশের নিস্পত্তি হতে পারে। আর বারবার একই ভাবনা উদয় হতে থাকলে, তখন ক্লেশ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। চিত্ত যখন কোনো কিছু দ্বারা আসক্ত হয়, তখন সেই রঙে  রঞ্জিত হয়ে থাকে। ভবিষ্যতে যদি বিষয়ান্তর ঘটে, তবে পূর্ববর্তী বিষয় রঙ ত্যাগ করে নতুন রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নেয়। তখন লদ্ধ বৃত্তির উদর হিসেবে কাজ করে থাকে। 

আসলে যে ভাবনা আমাদের মনে কষ্ট বা ক্লেশ উৎপন্ন করে, বিপরীত ভাবনায় সেই ক্লেশের নাশ হতে পারে। অর্থাৎ নিবৃত্তি মার্গ অবলম্বন করতে পারলে, আমরা চিত্তেরপরিবৃত্তি  বৃত্তিগুলোকে পরিবর্তন করতে পারবো। তাই বলা হচ্ছে অবিদ্যা, বা অজ্ঞান আমাদের ক্লেশের কারন। অবিদ্যাই  সমস্ত ক্লেশের গর্ভ বা  সৃষ্টিভূমি।

এখন কথা হচ্ছে  অবিদ্যা ব্যাপারটা কি ? কোনটি অবিদ্যা, আর কোনটিই বা সঠিক বিদ্যা ? ঋষি পতঞ্জলি বলছেন (শ্লোক - ৫) অনিত্য-অশুচি-দুঃখ-অনাত্মাসূ নিত্য-সূচি-সুখ-আত্মখ্যাতিঃ-বিদ্যা। অনিত্য, অশুচি, দুঃখজনক, অনাত্ম অর্থাৎ যা আমি নোই, নিজেকে তাই মনে করা, হচ্ছে অবিদ্যা।  আর, যে জ্ঞান  নিত্য-সুখজনক, আত্মজ্ঞান জনক, তা হলো বিদ্যা। যে জ্ঞান এক বস্তুতে অন্য বস্তুর ধারনা করায় তাকেই অবিদ্যা বলা হয়ে থাকে। অবিদ্যা কিন্তু বিদ্যার অভাব নয়, বরং বলা যেতে পারে বিদ্যার বিপরীত বা ভ্রমজ্ঞানহচ্ছে অবিদ্যা । আর এই বিদ্যা ও অবিদ্যা চিত্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত। চিত্তবৃত্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত। অবিদ্যাজনিত চিত্ত বৃত্তির বিপরীত হচ্ছে বিবেক নামে খ্যাত। বিদ্যা ও অবিদ্যা উভয়ই  অনন্ত কিন্তু নাশ্য। অর্থাৎ অবিদ্যার যেমন নাশ হতে পারে, বিদ্যার উদয় হলে, তেমনি বিদ্যার নাশ হতে পারে অবিদ্যার উদয়ে। অর্থাৎ বিবেক যখন জাগ্রত হয়, তখন আমাদের ভ্রম দূর হয়ে যায়, আবার বিবেক যখন নিষ্ক্রিয় থাকে তখন আমাদের অবিদ্যার উদয় হয়। 

ঋষি এবার অস্মিতা অর্থাৎ অহং সম্পর্কে বলছেন। বলছেন (শ্লোক-৬) দৃকশক্তির ও দর্শনশক্তির একতানতাই অস্মিতা। "দৃকদর্শনশক্তোঃ একাত্মতা ইব অস্মিতা" । অর্থাৎ পুরুষের দৃকশক্তি, আর বুদ্ধির দর্শনশক্তি - এই দুইয়ের একতানতাই অস্মিতা বা আমাদের অহংবৃত্তি। এখন কথা হচ্ছে এই পুরুষের দৃকশক্তি আর বুদ্ধির দর্শনশক্তি বলতে কি বোঝায়। দৃকশক্তি অর্থাৎ যার দ্বারা আমাদের জ্ঞানলাভ হয়, অর্থাৎ চৈতন্য। আর বুদ্ধির দর্শনশক্তি অর্থাৎ বুদ্ধির বিচার করবার শক্তি। উভয়ই  চৈতন্যের কাজ - কিন্তু আমাদের জ্ঞানচক্ষু ও চর্ম্ম  চক্ষু যেমন আলাদা তেমনি পুরুষের দৃকশক্তি ও বুদ্ধির দর্শনশক্তি আলাদা। বুদ্ধির দর্শনশক্তি মোহদ্বারা আবৃত হওয়া সম্ভব কিন্তু পুরুষের দৃকশক্তি মোহমুক্ত। 

ঋষি বলছেন, "সুখানুশয়ী রাগঃ" (শ্লোক - ৭) অর্থাৎ সুখের আশায় যে কর্ম্ম করা হয়, তাকে বলা হয় রাগ বা আসক্তি। এখানে রাগ মানে ক্রোধ নয়, এখানে রাগ কথাটার দ্বারা বোঝানো হচ্ছে পীড়া, আসক্তি, কাম। সুখ-সাধনের  যে স্পৃহা, বা তৃষ্ণা ও লোভ তা হলো রাগ বা আসক্তির কারন । 

আবার "দুঃখানুশয়ী দ্বেষ" (শ্লোক-৮) অর্থাৎ দুঃখজনক কৃতকর্ম্মের অনুস্মরণ হলো দ্বেষ। আমরা জন্ম- জন্মান্তরে বহু দুঃখ ভোগ করেছি। এই দুঃখের স্মৃতি আমাদের সংস্কারের মধ্যে রয়ে গেছে। এই যে দুঃখের স্মৃতি এর স্মরণে আমাদের মধ্যে ক্রোধ বা দ্বেষ বাসা বাঁধে। ধরুন আমরা আগের জন্মে মৃত্যু যন্ত্রনা ভোগ করেছি। আর এই মরণযন্ত্রণার স্মৃতি আমাদের মধ্যে সংস্কারের মধ্যে গেঁথে আছে। তাই মৃত্যুর-স্মরন মাত্রেই আমাদের ভয়, দ্বেষ, রাগ উৎপন্ন হয়। 

"স্বরসবাহি বিদূষঽপি তথা রূঢ়ঃ অভিনিবেশঃ" (শ্লোক - ৯) স্বরসবাহী অর্থাৎ নিজের অধিকারে থাকা রস অর্থাৎ সংস্কার,    বিদূষঽপি অর্থাৎ বিদ্বানদেরকেও আবার অবিদ্বানদেরকেও,  তথা রূঢ়ঃ অভিনিবেশঃ অর্থাৎ, মৃত্যুভয় আঁকড়ে থাকে। দেখুন, বিদ্বান বলুন, অবিদ্বান বলুন, মানুষ বলুন, জীবজন্তু বলুন, কীট বলুন, বা কীটাণু বলুন - যাবৎ জীবকুল, মৃত্যুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে, তাই প্রত্যেক জীবকেই মৃত্যুভয়ে আতঙ্কগ্রস্থ হতে দেখা যায়, মৃত্যু থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য বিভিন্ন রকম উপায় অবলম্বন  করতে দেখা যায়। আর এটা নিশ্চিত, যে তার এই মৃত্যুজনিত অভিজ্ঞতা সে এই জীবনে সঞ্চয় করেনি। তাহলে কোথা থেকে তার মধ্যে এই মৃত্যুভয় জনিত আতঙ্ক তৈরী হলো ? তাই ঋষি বলছেন, এগুলো আমাদের সংস্কার যা আমরা জীবন থেকে জীবনে বহন করে নিয়ে চলেছি। 

ঋষি এরপর বলছেন, "তে প্রতিপ্রসবহেয়াঃ সূক্ষ্মঃ" । তে অর্থাৎ এই পঞ্চক্লেশ ক্ষীণ হলে প্রতিপ্রসব হেতু তা সূক্ষ্ম হয়। প্রতিপ্রসব অর্থাৎ পুনরায় জন্ম। তো আমাদের মধ্যে সংস্কার রূপে যা কিছু আছে, আমাদের চিত্তে যদি তার বিপরীত  প্রভাব ফেলতে পারি, নতুন সংস্কারের জন্ম দিতে পারি, তাহলে আমাদের এই পুরোনো সংস্কারকে নাশ করতে পারি।

আসলে ঋষি বলতে চাইছেন, ক্রিয়ার মাধ্যমে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার যোগ হতে পারে।  নিষ্কাম ক্রিয়াতে চিত্তশুদ্ধি হয়। আর শুদ্ধ চিত্তে মায়ার আধিপত্য স্থির হয়, শান্ত হয়, তাকে ক্রমোন্নতির পথে নিয়ে যায়। যোগ সাধন আমাদের বিচার শক্তিকে জাগ্রত করে, বৈরাগ্যের ভাবনা জাগ্রত হয়, অহং-এর  বিলোপ সাধন করে, রাগ-দ্বেষ এমনকি মৃত্যুভয় নাশ হয়। আর এই সব অবিদ্যার অন্তর্ধানে আমাদের চিত্ত নিজ কারন-স্বরূপে বিলীন হয়ে যায়। 

এর পরের দিন আমরা শুনবো, ঋষি পতঞ্জলি বলছেন ধ্যানের দ্বারা চিত্তের ক্লেশবীজ নাশের কথা। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

----------------------- 

পাতঞ্জল যোগদর্শন - সাধনপাদ - ৩ 

মানুষ ছুটছে, একদল ভোগের জন্য, আর একজন মুক্তির জন্য। প্রকৃতি নিজের জন্য কিছু করে না। আকাশ-বাতাস-চন্দ্র-সূর্য কেউই নিজের জন্য কিছু করছে না। প্রকৃতি সবসময় পুরুষের সন্তুষ্টির জন্য ব্যস্ত। পুরুষ কখনো ভোগরূপে আবার কখনো মুক্তি রূপে আস্বাদন করছে । সমাধি সাধকের মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে পায়ে প্রজ্ঞা। সমাধি  আলাদাভাবে চিনিয়ে  দেবে এই দুই তত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য। প্রকৃতির পরিনাম সম্পর্কে জ্ঞান হয় বিবেকের সাহায্যে। যোগদর্শন দুটো জ্ঞানের উপরে প্রতিষ্ঠিত একটা হচ্ছে বিবেকজ্ঞান আর একটি হচ্ছে বিবেকজ-জ্ঞান। বিবেকজ্ঞানে প্রকৃতি উন্মোচিত হয়। আর বিবেকজ-জ্ঞানে স্বরূপ দর্শন হয়। বিবেকজ জ্ঞানে প্রকৃতির স্বরূপ উপলব্ধি হয়। বিবেকের একদিকে পুরুষ আর একদিকে প্রকৃতি। বিবেকজ্ঞানের ফলে এই দুইয়ের বিচ্ছিন্নতা ঘটে থাকে। যোগসাধক এই জ্ঞানের সন্ধানে, সমস্ত কিছু থেকে নিবৃত্ত হয়ে থাকেন। আর সমাধি নিবৃত্তির পরিনাম।    

"ধ্যানহেয়া তদবৃত্তয়ঃ"   - শ্লোক - ১১

ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, আমাদের চিত্তে যে ক্লেশ বীজ রূপে অবস্থান করছে, ধ্যানের  দ্বারা সেই বীজগুলোকে বিনাশ করতে হবে। আমরা আগেই শুনেছি  অবিদ্যা-অস্মিতা-রাগ-দ্বেষ-অভিনিবেশ - এই পাঁচপ্রকার ক্লেশ। অবিদ্যা অর্থাৎ মিথ্যাজ্ঞান, বা বিপরীত ভাবনা, মিথ্যা সংস্কার। অস্মিতা হচ্ছে আমি-জ্ঞান - বা  মিথ্যা আমিজ্ঞান অর্থাৎ অহংকার। রাগ হচ্ছে আসক্তির অপূর্ণতার পরিণতি। দ্বেষ হচ্ছে অন্যের প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়া,  আর অভিনিবেশ হচ্ছে মৃত্যুভয়। এই পাঁচ ধরনের প্রভাব আমাদের চিত্তকে মলিন করে রাখে। এমনকি নিজের সত্ত্বার বিস্মৃতি ঘটায়। এবং এই কারণেই আমরা আমাদেরকে ভুলে আছি। এখান থেকে বেরুতে গেলে আমাদের ধ্যানে প্রবিষ্ট হতে হবে। এখন কথা হচ্ছে ধ্যান কি ? ধ্যান হচ্ছে আত্মার সঙ্গে মনের  একতানতা। আমাদের মনের মধ্যে যে সংকল্প-বিকল্প আছে, তার প্রতি একাগ্র হওয়া। মনকে স্থির করা। বিবেকের সাহায্যে ক্লেশবৃত্তিগুলোকে ত্যাগ করতে হবে। যোগের মধ্যে বিচার-জ্ঞানের  সাহায্যে ক্লেশ-বৃত্তিগুলোকে ত্যাগ করতে হবে। আমরা জানি ক্রিয়াযোগ হচ্ছে, তপস্যা, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর প্রণিধান। ক্রিয়াযোগ অভ্যাসে ক্লেশগুলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে। একসময় ক্লেশবীজ জ্বলে-পুড়ে ভস্মে পরিণত হয়। ক্লেশ গুলো যখন ভষ্মে পরিণত হয়, তখন বোঝা যায় ধ্যানের প্রারম্ভ হলো। মন তখন অবিচল হয়ে যায়, শান্ত হয়ে যায় । আর আমাদের বৃত্তিগুলোও তখন ধংশ হয়। মনে রাখতে হবে, স্থূল ক্লেশগুলো আমাদের শত্রূ, কিন্তু সূক্ষ্ম ক্লেশগুলো আমাদের মহাশত্রূ। যখন এই ক্লেশ গুলো পুড়ে ছাই  হয়ে যাবে, তখন সাধকের  যোগজ সমাধি হবে।    

ক্লেশমূলঃ কর্মাশয়ো দৃষ্টাদৃষ্ট জন্ম বেদনীয়ঃ - শ্লোক-১২ 

কর্মাশয় হচ্ছে ক্লেশের  মূল। আর এই কর্ম্ম সংস্কারই জন্ম-জন্মান্তরে ফল প্রদান করে থাকে। 

ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, কর্ম্মাশয় হচ্ছে ক্লেশগুলোর  মূল। কর্মাশয় বা কর্ম্মসংস্কার  আমাদের কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ ইত্যাদি থেকে উৎপন্ন হয়ে থাকে। আর এই কর্ম্মসংস্কার আমাদের জন্ম-জন্মান্তর ধরে ফল প্রদান করে থাকে। আমরা যা কিছু করি, দেখি, শুনি, এমনকি যে সম্পর্ক গড়ে তুলি,  এগুলো সবই আমাদের চিত্তে ছাপ ফেলে। আর এই ছাপগুলোকেই বলা হয়, সংস্কার। এই সংস্কার দুই প্রকার, নির্বীজ ও সবীজ। অর্থাৎ একটা থেকে ফল উৎপাদন হতে পারে, আর অন্যটি থেকে নতুন-ফল উৎপাদন হয় না। আবার সংস্কারকে   অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে, দুই রকম যেমন - কোনো সংস্কার ভালো ফল প্রদান করে থাকে, আবার কোনো সংস্কার  খারাপ ফল প্রদান করে থাকে। কিন্তু খারাপ-ভালো যে  ফলই প্রদান করুক না কেন, এই ফল ভোগ করবার জন্য, আমাদের পুনঃপুনঃ জন্ম গ্রহণ করতে হবে বা সংস্কার অনুযায়ী দেহও  ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ যে দেহ যেমন ভোগের অনুকূল, সেইমতো দেহ ধারণ করতে হবে। । এই কথাই ঋষি পরবর্তী শ্লোকে বলছেন। বলছেন -   

সতি মুলে তৎ বিপাকো জাতি-আয়ু-ভোগাঃ (শ্লোক ১৩) 

সতি অর্থাৎ ক্লেশ গুলো থাকলে পর; মুলে অর্থাৎ কর্ম্মের মুলে ; তদ্বিপাকো অর্থাৎ সেগুলো (কর্ম্মফল) কর্মাশয়ে রান্না হতে থাকে, বিপাক হতে থাকে । জাতি-আয়ু-ভোগাঃ, -  জাতি অর্থাৎ মনুষ্য জাতি ইত্যাদির আয়ুষ্কাল ও ভোগ প্রাপ্ত হয়ে থাকে। 

কর্মের মুলে যে ক্লেশ থাকে, সেগুলোই আমাদের আয়ু, জাতি, ও ভোগরূপে তার পরিনাম প্রকটিত হয়। আসলে ক্লেশজনিত সংস্কারের জন্য কর্ম্মের উৎপত্তি আবার কর্ম্মের জন্য আমাদের জন্ম-মৃত্যুর খেলা। এই কর্ম্মফল ভোগ নিমিত্ত পুরুষের নির্দিষ্ট শরীরে জন্ম ও আয়ু নির্ধারিত হয়ে থাকে। আসলে এই কর্ম্মের খেলা বোঝা খুব শক্ত। কেননা কর্ম্মফল ভোগের জন্য শরীর-ধারন। আবার শরীর-রক্ষার জন্য কর্ম্ম।  আবার কর্ম্মফল ভোগের জন্য জন্ম। এই যে কর্ম্মচক্র - এর মধ্যে আবদ্ধ জীবকুল। প্রারব্ধ কর্ম্মফল ভোগের জন্য জন্মগ্রহণ, আবার এই জীবনে যে কর্ম্ম সম্পাদন করা হলো, তা  আমাদের  সঞ্চিত কর্ম্ম হিসেবে থেকে গেলো। তাহলে এর শেষ কোথায় ? এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কর্মসংস্কার  আমাদের অনাদিকাল থেকে চলে আসছে। আবার সংস্কার আমাদের অগুনতি, বহু। আবার বলা হয়ে থাকে আধার অনুযায়ী, কর্মফলের ভোগ হয়ে থাকে। আবার এক জীবনের কর্ম পরবর্তীতে কি এক জীবনেই ভোগ সম্ভব ? কেননা আমরা এক জীবনেই  অনেকের সাথে কর্ম-সন্মন্ধে জড়িত হয়ে থাকি।  তো এক জন্মে সবার সাথে সেই কর্ম্মফল ভোগ সম্ভব নাও হতে পারে। তাহলে একজীবনের কর্ম্ম আমাদের কি অনেক-অনেক জন্মের কারন হয়ে উঠতে পারে ?  যাইহোক, আমাদের আলোচ্য বিষয় পতঞ্জলির যোগসূত্র।  এখানে যা কিছু ঋষি পতঞ্জলি বলেছেন, সেই সব কথার মধ্যে আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো।  

 শ্লোক - ১৪ - তে হ্লাদ-পরিতাপ-ফলাঃ পুন্যাপুন্যহেতু ত্বাৎ। 

সেই জাতি-আয়ু-ও ভোগরূপ কর্ম্ম বিপাকগুলো পুন্য হেতুতে সুখফল ও অপূণ্য  হেতু দুষ্ফল প্রদান করে থাকে। 

ঋষি বলছেন, পুণ্যকর্মে সুখকর ফল, আবার অপূণ্য কর্ম্ম আমাদের আমাদের পরিতাপের বিষয় হয়ে থাকে। এখন কথা হচ্ছে, পুন্য কর্ম কাকে বলে, আর অপূণ্য কর্মই বা কি ? গৌড়পাদজি তার পতঞ্জলি-দর্শনের ভাষ্যে বলছেন, যম-নিয়ম-দয়া-দান এগুলো হচ্ছে পুণ্যকর্ম।  আর এর বিপরীত হচ্ছে অপূণ্য কর্ম। আবার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সত্ত্বগুণের দ্বারা করা কর্ম্ম হচ্ছে দৈবসম্পদ লাভের  উপায়। অর্থাৎ পুণ্যকর্ম আমাদের সত্ত্বগুণের দ্বারা সম্পাদিত হতে পারে।  আবার রজঃ ও তমঃ-গুণের দ্বারা করা কর্ম হচ্ছে, আসুরি কর্ম। অর্থাৎ এতে পরিতাপ বা দুঃখের উৎপত্তি হয়ে থাকে। 

পরিনাম-তাপ-সংস্কার দুঃখগুন্-বৃত্তি বিরোধাৎ চ দুঃখমেব সর্বং বিবেকিনঃ। (শ্লোক - ১৫)

ঋষি বলছেন, পরিনাম, তাপ ও  সংস্কার এই তিন রকম দুঃখ বর্তমান থাকবার জন্য, এবং তিনটি গুনের বৃত্তির মধ্যে পরস্পর বিরোধের কারনে বিবেকীদের কাছে সবই দুঃখজনক। 

এবার ঋষি বলছেন, যারা বিবেকবান, তারা তিনটি গুন-জাত কর্মকেই দুঃখের কারন হিসেবে নির্নয় করেছেন। এখন কথা হচ্ছে, যা সাধারনের কাছে সুখকর-কর্ম্ম বা পুন্য-কর্ম্ম  তা বিবেকীদের কাছে, কিভাবে দুঃখজনক বা অপূণ্য কর্ম্ম  হতে পারে ? দেখুন সংসার থেকে সরে পড়তে গেলে, বা সংসার থেকে নিষ্কৃতি পেতে গেলে, সংসারের যাবতীয় সুখ-দুঃখ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে হবে। সুখ ও দুঃখ পরস্পর বিরোধী কিন্তু  দুটোই  ভোগ। তো সমস্ত ভোগ তা সে দুঃখ-ভোগ হোক আর সুখ-ভোগ হোক,  ভোগ থেকে নিজেকে আলাদা না করতে পারলে, সংসার নিগড় থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। আর এই ভোগের মুলে আছে আমাদের সংস্কারের শৃঙ্খল। আবার  এই সংস্কার হচ্ছে আমাদের অবিদ্যার ফল।  অবিদ্যার কারণেই সংস্কারের জন্ম হচ্ছে। তাই বিবেকীগণ সমস্ত কর্ম্মের মধ্যেই দোষ দর্শন করে থাকেন। আর অষ্টমার্গের পথে নিজেকে পরিচালিত করে থাকেন। নিজের মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসা, জাগিয়ে তোলেন।  ঈশ্বর জিজ্ঞাসা জাগিয়ে তোলেন। আর একটা কথা হচ্ছে, সংসারে দুঃখের ভোগ কমাতে গেলে, দুঃখকেই ভোগ করতে হবে।  তবেই দুঃখের নিস্পত্তি। সংসারে সুখ-দুঃখের আদান-প্রদান চলতেই থাকে। হয় সুখ না হয় দুঃখ। এই জায়গা থেকে বেরুতে গেলে নিবৃত্তি মার্গ অবলম্বন  ভিন্ন অন্য পথ নাই। তাই বিবেকীগণ, ত্রিতাপ-জ্বালা থেকে মুক্তির জন্য, ত্রিতাপ-জ্বালাতেই নিজেকে পুড়িয়ে ছাই  করে থাকেন। আর এর থেকেই আসে মুক্তির আকাঙ্খ্যা। ধর্ম্ম-অধর্ম্ম সব পরিত্যাগ করতে হবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, হে অর্জুন তুমি এতদিন ধর্ম্ম-অধর্ম্ম বলতে যা কিছু বুঝেছো, সমস্ত কিছু পরিত্যাগ করে, আমরা স্মরণ নাও। বিবেকবান পুরুষ সেই কাজটিই করে থাকেন। 

হেয়ং দুখম-অনাগতম - (শ্লোক ১৬)  

অনাগত অর্থাৎ যে দুঃখ এখনো আসেনি, অর্থাৎ যে ক্লেশ, বীজরূপে চিত্তভূমিতে দেখা দিয়েছে, তাকেও পরিত্যাগ করতে হবে। 

ঋষি বলছেন, বর্তমানের সুখ-দুঃখে যেমন নির্বিকার থাকতে হবে, পরিত্যাগ করতে হবে, তেমনি যে সুখ-দুঃখ ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করা আছে, তাকেও আমাদের পরিত্যাগ করতে হবে। হেয় অর্থাৎ হীনভাবে ত্যাগ করতে হবে। অর্থাৎ ভবিষ্যতের যে সুখের আশায় আমি অপেক্ষমান হয়ে আছি, সেই জায়গায় থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে আসতে  হবে। তাই সমস্ত সুখ-দুঃখ তা সে অতীতের  স্মৃতি হোক, বর্তমানের ভোগ হোক, বা ভবিষ্যতের ভোগ হোক, সবই মনেপ্রাণে আমাদের ত্যাগ করতে হবে।  তবেই, আমাদের মধ্যে মুক্তির আকাঙ্খ্যা জাগতে পারে।  আর নিজের মধ্যে যখন এই আকাংখ্যা পরিপুষ্ট লাভ করবে, তখন আমরা অষ্টমার্গের পথে নিজেকে নিয়োজিত করতে সক্ষম হবো। 

 দৃষ্ট দৃশ্যয়োঃ সংযোগো হেয়হেতু (শ্লোক ১৭) 

দ্রষ্টা ও দৃশ্য এই দুইয়ের সংযোগ, হেয় অর্থাৎ ত্যাজ্যের  হেতু। 

দ্রষ্টা হচ্ছে আমাদের বুদ্ধিতে প্রতিবিম্বিত স্বচ্ছ পুরুষ।  আর দৃশ্য হচ্ছে বুদ্ধি। এই দ্রষ্টা ও দৃশ্যের মিলনে বা সংযোগে যে ফল উৎপাদন হয়, তা দুঃখজনক। তাই ঋষি পতঞ্জলি দ্রষ্টা-দৃশ্য অর্থাৎ প্রতিবিম্বিত পুরুষ, যা পুরুষের ছবি  মাত্র, আসল পৌরুষ নয়, এবং যাতে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে অর্থাৎ আমাদের বুদ্ধি, এর  যে সংযোগ একে ঋষি  পতঞ্জলি পরিত্যাগ করতে বলছেন। অর্থাৎ বুদ্ধি ও বুদ্ধিতে প্রতিবিম্বিত পুরুষ এই দুইকে পরিত্যাগ করতে হবে।  কারন, এগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে আয়না, যাতে প্রতিবিম্বিত হয়, আর আয়নার ভিতরে ছায়া, যা আসল পুরুষ নয়, এই দুইকেই পরিত্যাগ করে, সত্যের পথে সাধককে পরিচালিত করতে চাইছেন ঋষি পতঞ্জলি । অর্থাৎ যথার্থ পুরুষকেই অবলম্বন করতে বলছেন। 

ওম  শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

------------------------------------------- 

প্রকাশ-ক্রিয়া-স্থিতিশীলং ভূতে-ইন্দ্রিয়াত্মকং ভোগ-অপবর্গ-অর্থং দৃশ্যম। (শ্লোক-১৮) 

প্রকাশ, ক্রিয়া ও স্থিতি নিজ নিজ স্বভাবের কারনে ভূত ও ইন্দ্রিয়ের পরিনাম প্রাপ্ত হয়। আর এই পারিনামত্ব আসলে পুরুষের ভোগ ও অপবর্গের প্রয়োজন সাধন করে।

 

বিশেষ-অবিশেষ-লিঙ্গমাত্র-অলিঙ্গানি গুনপর্বাণি (শ্লোক-১৯)

বিশেষ-অবিশেষ-লিঙ্গমাত্র-অলিঙ্গানি  এগুলো হচ্ছে গুনের অবস্থা ভেদ, গুনের বিভিন্ন পর্ব।  বিশেষ মানে পঞ্চভূতবর্গ ও ইন্দ্রিয়গুলো ; অবিশেষ অর্থাৎ তন্মাত্রা ও অস্মিতা বা অহং ; লিঙ্গমাত্র মহত্তত্ত্ব আর অলিঙ্গ বলতে বোঝায় প্রকৃতি। 

এখানে পুরুষ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, তিনি কোনো তত্ত্ব নন, তাই ত্রিগুণাত্ত্বক নন, তার কোনো পরিনাম নেই। 

দ্রষ্টা দৃশিমাত্রঃ শুদ্ধঽপি প্রত্যয়ানুপশ্যঃ। (শ্লোক-২০)

দ্রষ্টা দৃশি মাত্র। দ্রষ্টা অর্থাৎ পুরুষ।  দৃশি কথাটা অর্থ চৈতন্য, যার দ্বারা দেখার কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে। দ্রষ্টা শুদ্ধ। দ্রষ্টা প্রত্যয়ানুপশ্যঃ।  প্রত্যয় অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তি, যা সাক্ষীভাবে দর্শন করে মাত্র। অর্থাৎ দ্রষ্টাই চৈতন্য, দ্রষ্টা শুদ্ধ, সমস্ত ধর্মাধর্ম্ম রোহিত, বুদ্ধির সম্যক  অনুভবী। 

তদর্থ এব দৃশ্যস্য আত্মা। (শ্লোক ২১) .

তদর্থ ;  তদ + অর্থ  তার অর্থ তার এখানে পুরুষের আর অর্থ হচ্ছে বিষয়। দৃশ্যস্য অর্থাৎ বুদ্ধিরূপ দৃশ্যের, আত্মা আর নিজ স্বরূপ। অর্থাৎ পুরুষের বিষয় হলো দৃশ্যের স্বরূপ। 

কৃতার্থং প্রতি  নষ্টম অপি অনষ্টম তদন্য-সাধারণত্বাৎ।  (শ্লোক - ২২)

কৃতার্থ পুরুষের কাছে নষ্ট হলেও তা অন্য সাধারনের কাছে অনেস্ট অর্থাৎ নষ্ট নয়।

স্ব-স্বামিশক্তোঃ স্বরূপ উপলব্ধি হেতুঃ সংযোগঃ। (শ্লোক-২৩)

সংযোগ হলো স্বশক্তির ও স্বামীশক্তির স্বরূপ উপল্বদ্ধির  হেতু। 

 তস্য হেতুরবিদ্যা (শ্লোক -২৪)

সেই সংযোগের হেতু হলো অবিদ্যা। 

তদ অভাবাৎ  সংযোগ-অভাবো হানং তদ্দৃশ্যেঃ কৈবল্যম্। (শ্লোক ২৫)

অবিদ্যার অভাব থেকে সংযোগ অভাব, তা হলো হান, আর তা হচ্ছে দ্রষ্টার কৈবল্য। 

বিবেক খ্যাতি-অবিপ্লবা হানোপায়ঃ। (শ্লোক-২৬)

ছেদবিহীন বিবেকখ্যাতি হানের উপায়।  হানের অর্থাৎ অবিদ্যা নাসের উপায়।

তস্য সপ্তধা প্রান্তভূমিঃ প্রজ্ঞা (শ্লোক-২৭)

তস্য অর্থাৎ যাঁর বিবেকখ্যাতি জন্মেছে এমন যোগীর সাত প্রকার প্রজ্ঞা জাগে।

 
পতঞ্জলি যোগসাধনা : কৈবল্যপাদ 

বাবা অনেক কিছু জানেন, যা আমি জানিনা।  আমার মা সব কিছু জানেন, কিন্তু আমি জানিনা। আমার মাস্টার মহাশয় শুধু অনেক কিছু জানেন, তিনি অনেক কিছু করতে পারেন, আমি পারি না।  মাস্টার মহাশয় অংক  করতে পারেন, আমি পারি না। গুরুদেব অনেক কিছু জানেন, আমি জানিনা। কেন এমন হয় ? আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগে,  আমি যে বস্তু সম্পর্কে অজ্ঞ থাকি, সেই জ্ঞানের অগোচর বস্তুর গতি কি হয় ? বস্তুর জ্ঞান কি চিত্তের অধীন ? বস্তু কি কোনো নির্দিষ্ট চিত্তের অধীন হয়।  জ্ঞান কি কোনো বিশেষ বিশেষ চিত্তের অধীন ? আমরা এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো।

আপনি হয়তো বলবেন, বাবা-মা আমার থেকে বয়সে অনেক বড়ো।  তারা জীবনে অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে, আজ অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। মাস্টার মহাশয় অনেক বই পড়াশুনা করেছেন, অনেক অঙ্ক শিখেছে, করেছেন, তাই তিনি অনেক কিছু জানেন। গুরুদেব, তার গুরুদেবের কাছ থেকে অনেক কিছু জেনেছেন, শিখেছেন, তাই তিনি অনেক কিছু জানেন। কিন্তু সত্যিই কি তাই ? বয়স তো অনেকের হয়েছে, সবাই কি আমার মা-বাবার মতো ? সব শিক্ষক বা সব ছাত্র কি সমান ? আমার গুরুদেবের মতো গুরুদেব কি আর একজন আছেন ? না নেই, এঁরা সবাই সতন্ত্র, ের সাবি সবার থেকে আলাদা আলাদা। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, :  

শ্লোক : ১৭ - তদ-উপরাগ-আপেক্ষিতাৎ চিত্তস্য জ্ঞাত-অজ্ঞাতম। 

বিষয় দ্বারা রাঙিয়ে দেওয়ার অপেক্ষায় থাকা বস্তু, চিত্তের জ্ঞাত বা অজ্ঞাত হয়। 

বস্তু যে চিত্তের অধীন হয়, তাহলে চিত্তের অন্যমনস্কতায় বা বৃত্তি শূন্যতায়, বস্তুর স্বরূপ-সম্মন্ধ  বিষয়মুখী না হওয়ায়, বিষয়ীভূত হতে পারে না। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, বিষয় দ্বারা চিত্ত যখন রঞ্জিত হয়, তখন সেই বস্তুর জ্ঞান জন্মে আমাদের চিত্তে। বিষয় আমাদের আকৃষ্ট করবার জন্য শৃঙ্গার করছে।

 চিত্ত হচ্ছে লৌহ। আর বস্তু হচ্ছে চুম্বক। চিত্তকে বস্তু সবসময় আকৃষ্ট করছে। চিত্তকে বিষয়বস্তু আকৃষ্ট করে তার রঙে  রাঙিয়ে নিচ্ছে। চিত্ত, যখন যে বিষয়ে  উপরঞ্জিত তখন, সে সেই বিষয়ে জ্ঞাত। আর যার আকর্ষণ সে অনুভব করেনি, সেই বিষয়-বস্তু তার কাছে অজ্ঞাত। এই যে বস্তুর জ্ঞান ও অজ্ঞান স্বরূপতঃ চিত্ত সেই পরিনাম প্রাপ্ত হয়। 

আসলে চিত্ত ও বস্তু দুটো আলাদা। কিন্তু দুটোই বস্তু। এখন আমাদের জ্ঞান ইন্দ্রিয়গুলোর সাহায্যে শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ দ্বারা  আমাদের ভিতরে প্রবেশ করছে এবং চিত্তকে আকর্ষণ করছে। আর চিত্ত তখন পরিনাম প্রাপ্ত হয়। পরিনাম প্রাপ্ত চিত্ত বৃত্তিতে বাহ্য  বিষয়ের উৎপন্নে ভোগকার্য্য চলে।  অন্তর্মুখীতায় পরিণামপ্রাপ্ত চিত্ত অন্তর্মুখী হয়।  এই ভাবে চিত্ত পরিনাম প্রাপ্ত হয়ে থাকে। 

এখন কথা হচ্ছে এই অন্তর্মুখীনতা ব্যাপারটা কি। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, যম-নিয়ম ইত্যাদি অভ্যাসের দ্বারা এবং বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্ত তাদের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে পুরুষ ও চিত্তের নিজের সঙ্গে পৃথকতার পরিচয় করিয়ে দেওয়াই অন্তর্মুখীনতা। শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ এগুলো আমাদের কাছে কখনো জ্ঞাত কখনো অজ্ঞাত। কিন্তু পুরুষগত চিত্ত সবসময় জ্ঞাত। অপবর্গ লাভ অর্থাৎ জীবাত্মার সঙ্গে পরম-আত্মার যতক্ষন মিলন না হচ্ছে, ততক্ষন চিত্ত পুরুষকে জড়িয়ে রেখে ভ্রান্ত ধর্ণা করিয়ে নিজেও বিষয় উপভোগে পুরুষকে জড়িয়ে ফেলছে। এতে করে চিত্ত যেন পুরুষের বিষয় হয়ে যায়।      

  

        


    

 






   

    .












     

                                                                                   



      

Friday 2 April 2021

জ্ঞানগঞ্জের রহস্যঃ

 


জ্ঞানগঞ্জের রহস্যঃ  

জ্ঞানগঞ্জ নিয়ে আমাদের কৌতূহলের শেষ নেই। অনেক কল্প কাহিনী শোনা যায়, এই জ্ঞানগঞ্জ নিয়ে। কিন্তু আসলে এই জ্ঞানগঞ্জ কোথায়, কিভাবে সেখানে যাওয়া যায়, আর সেখানে গেলে কিই বা পাওয়া যায়, - এই সম্পর্কে আজ আমরা শুনবো।  

জ্ঞানগঞ্জ কোথায় ? 

বলা হয়ে থাকে, বিন্ধাচল থেকে ১৬ মাইল দূরে তিব্বত সীমান্তে  অবস্থিত একটি আশ্রম। এ এক অদ্ভুত সাধন রাজ্য। বহু শক্তিধর দন্ডি সন্যাসী, পরমহংস-দের এ এক মিলনক্ষেত্র। এই স্থানটির ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে কেউ নির্দিষ্ট করে কিছু বলেন নি। রহস্যে ঢাকা এই স্থান। যারা এখানে অলৌকিক ভাবে গিয়েছিলেন , এবং আবার আমাদের কাছে ফিরে এসেছিলেন, তারাও কেউ এই রহস্যঃ উন্মোচন করেন নি। তারা বলছেন, এখানে সাধারণ ভাবে আসার কোনো উপায় নেই। কোনো উচ্চ কোটির সাধক কৃপা করে নিয়ে না গেলে, সেখানে কেউ যেতে পারেন না। ত্রৈলঙ্গস্বামী, লোকনাথ ব্রহ্মচারী, রামদাস কাঠিয়াবাবা, রামঠাকুর, বাবাজি মহারাজ,  শ্যামাচরণ লাহিড়ী ইত্যাদি ব্যতিক্রমী কিছু মহাত্মা এই সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন বলে শোনা যায়।

 কেউ কেউ বলে থাকেন, জ্ঞানগঞ্জ আসলে একটা সাধন ক্ষেত্র, একটা বিশ্ববিদ্যালয় ।  বা বলা যেতে পারে, যোগীমহারাজদের বিচরণ ক্ষেত্র। এই জ্ঞানগঞ্জ মঠের দুটো প্রধান বিভাগ, একটা হচ্ছে বিশুদ্ধ জ্ঞানযোগ সম্মন্ধীয়, আর একটা হচ্ছে যোগ বিজ্ঞান। এই যোগবিজ্ঞনের ষোলোটি বিভাগ আছে, তার মধ্যে সৌরবিজ্ঞান, সূর্যবিজ্ঞান, নক্ষত্রবিজ্ঞান, কাল বা সময়বিজ্ঞান, ক্ষনবিজ্ঞান, বায়ুবিজ্ঞান, চন্দ্রবিজ্ঞান ইত্যাদি ইত্যাদি।  প্রত্যেক বিজ্ঞানের শিক্ষা আলাদা আলাদা ভাবে দেওয়া হয়।  সংসারে যার যে বিজ্ঞান শিক্ষার যোগ্যতা আছে, তাদেরকে খুঁজে নিয়ে এই বিষয়েই শিক্ষা দেওয়া হয়।  এছাড়া আছে কয়েকটি তান্ত্রিক মঠ।  এখানে উচ্চকোটির শক্ত সাধকগণ বাস করে থাকেন। এঁরা অলৌকিক শক্তিধর, এঁরা কালজয়ী, এঁরা আকাশপথে গমন করে থাকেন। এঁরাই যোগ্য ছাত্রের সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমন করেন।  এবং নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে ভৌতিক জগতে বিচরণ করে থাকেন।   

 এখানে বহু সাধক আছেন, যারা বছরের পর বছর সাধনা করছেন।  এখানকার প্রাকৃতিক জল-হাওয়া এমনিই যে   এখানে  মানুষের শরীরের পরিবর্তন হয় না।  এখানে কেউ কিছু না খেয়েও বেঁচে থাকতে পারেন ।  অর্থাৎ এখানে বাতাস ও সূর্য থেকে  থেকে শরীরের জন্য আহার সংগ্রহ করা যেতে পারে। তাই এখানে বসবাসকারীর  বয়সের কোনো গাছ পাথর নেই।

 বলা হয়ে থাকে, এই অবস্থা আপনি প্রতক্ষ্য করতে পারবেন, যদি আপনি কৈলাশ পর্বতের কাছাকাছি কিছুদিন বাস করেন। এখানে শোনা যায়, নখ ও চুলের বৃদ্ধি পায়  অতি দ্রুত। কৈলাশ পর্বতেও আজ অবধি কেউ পৌঁছুতে পারে নি। তার কারন হচ্ছে, সেখানকার আবহাওয়া মানুষের বেঁচে থাকবার উপযুক্ত নয়।  আর এ জ্ঞানগঞ্জ কৈলাশ থেকেও আরো উত্তর-পূর্ব কোনে এক দুর্গম স্থান।  এখানে এমনকি উড়োজাহাজে করেও পৌঁছনো যায় না। 

আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, এটি আসলে যোগের একটা উচ্চ অবস্থা মাত্র। এই স্তরে সাধক  উন্নীত হলে, সাধকের মধ্যে জ্ঞানের উন্মেষ আপনা-আপনি হয়। এই সময় সাধকের মধ্যে নানান রকম বিভূতির প্রকাশ হতে থাকে। আর এই বিভূতি নিয়ে যারা মেতে থাকেন, তাদের সাধন-জীবন এখানেই সমাপ্ত হয়ে যায়। এই বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনার শেষে দুচার কথা শুনবো।  

যাইহোক, বলা হয়ে থাকে জ্ঞানগঞ্জ একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। জ্ঞানগঞ্জের প্রধান জায়গাটি হচ্ছে মনোহর তীর্থ। অতি রমণীয় কিন্তু দুর্গম স্থান। ব্রহ্মর্ষি মহাতপার আসন এখানে। এখানে যোগাযোগের রাস্তা হচ্ছে আকাশপথে, যোগ-বিভূতিমার্গে।  

সাংগ্রীলা  ঘাঁটি : এই জ্ঞানগঞ্জের সঙ্গে আরো একটা জায়গার কথা শোনা যায়।  আর তা হচ্ছে সাংগ্রীলা। সাংগ্রীলা ঘাঁটি সম্পর্কে জানতে গেলে, আগে জ্ঞানগঞ্জ সম্পর্কে একটা প্রতক্ষ্য জ্ঞান থাকা দরকার। তিব্বত ও অরুনাচল সীমা থেকে শুরু হয়েছে এই সাংগ্রীলা ঘাঁটি। এই সাংগ্রীলা ঘাঁটি অগম্য স্থান। ব্যাপক ভূমিহীনতা এবং চতুর্থ আয়াম বা forth dimension দ্বারা প্রভাবিত।  তাই সাংগ্রিলা ঘাঁটি শুধু অগম্য নয়, এটি রহস্যময়। অন্তঃরীক্ষের অন্যকোনো লোকের সঙ্গে এই সাংগ্রীলা  মঠের প্রতক্ষ্য সম্মন্ধ রয়েছে। এখন কথা হচ্ছে এই ভূমিহীনতা ব্যাপারটা কি ? লামা যুৎসুং বলছেন, বায়ু মন্ডলের মধ্যে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে বায়ুশূণ্যতা বিরাজ করছে। তেমনি এই বিশ্বে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে ভূমিহীন।  এই বায়ুশূন্য স্থান ও ভুশুন্য স্থানগুলো ফোর্থ ডাইমেনশন বা চতুর্থ আয়ম দ্বারা প্রভাবিত। আর এই জায়গাগুলো দেশ কাল নিমিত্তের উর্দ্ধে। তাই কোনো বস্তু বা প্রাণী যদি নিজের অজ্ঞাতসারে এই চতুর্থ আয়ামে প্রবেশ করে, তবে তৃতীয়আয়াম  জগতের দৃষ্টিতে তার সত্তা অদৃশ্য অথবা লুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু তার অস্তিত্ত্ব যেমন ছিল, তেমনই  থাকবে। তবে ভবিষ্যতে কবে তার অস্তিত্ত্ব আবার তৃতীয় আয়ামে বা আমাদের এই জগতে প্রকট হবে, বা আদৌ প্রকট হবে কি না, তা বলা যায় না। একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের এই জগৎ যা আমাদের কাছে দৃশ্যমান, তা তৃতীয় আয়ামে বাঁধা। আমাদের বিশ্বের যে ভূমি, তা বাঁকা। যদি কোনো বস্তু শূন্যতা বা ভূমিহীন জায়গায় চলে যায়, তবে তার এই বক্রতার  পরিসমাপ্তি ঘটবে। এমনকি তার স্মৃতিতে আগের জগৎ সম্পর্কে সমস্ত জ্ঞান লোপ পেয়ে যাবে। সে বুঝতেই পারবে না যে সে একটা নতুন জগতে প্রবেশ করেছে এবং এই জগতে কালের প্রভাব অতি নগন্য। এই নতুন জগতে তার বুদ্ধি ও মনের শক্তি, বিচার শক্তি, শারীরিক ক্ষমতা, জীবনীশক্তি, এমনকি মানসিক চেতনা আশাতীত ভাবে বেড়ে যাবে। এই জায়গায় সে নিজেকে প্রফুল্ল, তরতাজা অনুভব করতে থাকে। এখানে শরীরের উপরে কালের কোনো প্রভাব পড়তে পারে না। এখানে যদি কুড়ি  বছরের এক যুবক-দেহ প্রবেশ করে, তবে বহু বছর  ধরে, ওই কুড়ি বছরের যুবকই আছে। আবার সংযোগ বশতঃ যদি কোনো কারনে ওই যুবকের দেহ ফোর্থ ডাইমেনশন প্রভাবিত এলাকা ছেড়ে থার্ড ডাইমেনশন স্তরে প্রবেশ করে, তাহলে সেই বৃদ্ধি হওয়া আয়ুর প্রভাব তৎক্ষণাৎ তার শরীরের উপরে পড়তে শুরু করবে। তখন  তার জীবনীশক্তি ক্ষীণ হয়ে যাবে। এমনকি সে মারাও যেতে পারে।  এই হচ্ছে সাংগ্রিলা ঘাঁটির বাতাবরণ যা আমাদের কাছে অবৈজ্ঞনিক না হলেও অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। সাংগ্রীলা ঘাঁটি একটা স্বর্গীয় বাতাবরণে ডুবে থাকে। এক অদ্ভুত আলোর আভায় পরিপূর্ন এই অবিশাস্য স্থান। এখানেই অদৃশ্যরূপে অবস্থান করছে বহু যোগাশ্রম, সিদ্ধাশ্রম ও তন্ত্র সাধনার মঠ। এখানেই উচ্চকোটির ক্ষমতাসম্পন্ন কালজয়ী সাধকগণ অবস্থান করে থাকেন। এরা  সূক্ষ্ম দেহে আকাশপথে বিচরণ করে থাকেন। এরাই ইচ্ছেমতো শিষ্যদের দর্শন দিয়ে থাকেন। সাধন নির্দেশ দিয়ে থাকেন। অনেকের ধারণা মহাভারত বা তার আগের যুগের অনেক সাধক এখনো এখান থেকেই সাধকদের বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করে থাকেন। বলা হয়ে থাকে সত্যিকারের যোগীদের কাছে অসম্ভব বলে কোনো কথা নেই। এইসব যোগী-মহাপুরুষ দেবলোকে সরাসরি আসা যাওয়া করে থাকেন।  এদের দেহ আলোকময়-অবিনশ্বর।

জ্ঞানগঞ্জের স্থিতি - সময় ও স্থানের উর্দ্ধে এখানে একটা কথা বলা যেতে পারে, এই বিশাল পৃথিবীর মধ্যে এমন  কিছু রহস্যময় স্থান আছে, যা সময়সীমার বাইরে। এখন কথা হচ্ছে সময় কাকে বলে ? আসলে ব্রহ্মান্ডের সমস্ত কিছুই চলমান। স্থির হচ্ছে একমাত্র সময়। সময়ের পরিমাপ করা যায় না।  কিন্তু আমাদের ধারণা  হচ্ছে, সময় বয়ে চলেছে, স্রোতস্বীনি নদির মতো। আসলে আমাদের সামনে যা কিছু দেখছি, সবই ক্ষয়িষ্ণু পদার্থ। যেমন ধরুন, আমার এই দেহ, এটি একসময় শিশু ছিলো, তো সেটা আমার শিশুকালীন সময়, আবার আমি কৈশোরে যখন পা দিলাম, তাকে বলা হচ্ছে আমার কৈশোরকালীন সময়। আবার আমার যৌবন কালীন সময়, আমার বৃদ্ধকালীন সময়, এমনকি আমার মৃত্যুকালীন সময় ইত্যাদিকে আমরা একটা সাল তারিখ দিয়ে চিহ্নিত করে রেখেছি ।  আবার আমার একসময় মৃত্যু হলো, তো ক্যালেন্ডারের পাতা দেখিয়ে বলা যেতে পারে, আমি খ্রিস্টপূর্ব এতো সাল  থেকে এতো খ্রিস্টাব্দ   পর্যন্ত আমি বেঁচেছিলাম।  আসলে আমার জীবনকালকে চিহ্নিত করবার জন্য, বা কোনো ঘটনাকে নির্দিষ্ট করবার জন্য, আমরা সময়কে মেপে থাকি, বা চিহ্নিত করে থাকি। এখন কথা হচ্ছে সময় কিন্তু আমার জন্মের আগেও ছিল, আবার সময় আমার মৃত্যুর পরেও থাকবে, এমনকি এই পৃথিবীর জন্মের আগেও সময় ছিল, আবার এই পৃথিবী বা ব্রহ্মান্ডের ধংশ হয়ে গেলেও সময় থাকবে। আসলে সময় হচ্ছে সাক্ষী। ব্রহ্মান্ডের যাবতীয় ঘটনার এমন কি  ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির আগে থেকেই এই সময়ের উপস্থিতি ছিল।  আবার ভবিষ্যতেও থাকবে।  তো সময় হচ্ছে সাক্ষী। এখন কথা হচ্ছে সব কিছুর সাক্ষী হচ্ছে সময় কিন্তু এমন কোনো ঘটনা বা জায়গা আছে কি যা সময়ের সাক্ষী হতে পারে ? এর সহজ উত্তর হচ্ছে না। 

এখন বলা হচ্ছে বিন্ধগিরির ১৬ মাইল দূরে এই জ্ঞানগঞ্জ।  আর এই জ্ঞানগঞ্জ হচ্ছে, সময়ের বাইরের এলাকা। তো সময়ের বাইরে কে আছেন, ব্রহ্ম। বিন্ধ কথাটার অর্থ হচ্ছে, ছিদ্র। অর্থাৎ শূন্য স্থান। আর বিন্ধ্য কথার অর্থ হচ্ছে বিরুদ্ধ চিন্তন। সূর্য্যের গতিকে রুদ্ধ করবার জন্য, যিনি বিপরীত বা উন্নত হতে কামনা করেছিলেন, বিন্ধ্যপর্বত বা বিন্ধ্যগিরিমালা। এটি পুরাতন ভারতবর্ষের আর্য্যাবর্ত ও দক্ষিণাবর্তকে বিভক্ত করেছে। পূরাণ মতে অগস্ত মুনি হচ্ছেন এই বিন্ধ্যগিরির গুরু। আবার বান রাজার মাতা হচ্ছেন, এই বিন্ধ্যগিরিমালা। 

আবার দেখুন আমাদের শরীরের মেরুদণ্ডের মধ্যে আছে সুষুম্না নাড়ী। এই সুষুম্না নাড়ীর  মধ্যে আছে ব্রহ্মরন্ধ্র। এই ব্রহ্মরন্ধ্র ধরে আমরা যখন উপরের দিকে উঠে যাই, তখন আমরা ব্রহ্মলোকে উপস্থিত হই। এই ব্রহ্মলোকের উপরে আছে বিন্দু। এই বিন্দুর সাহায্যেই আমরা বাহ্যিক জগতের সঙ্গে অন্তর্জগতের যোগাযোগ করতে পারি।  বা করে থাকি। এইসময় আমাদের যে জ্ঞানালোকের উৎপত্তি হয়, তাকে বলা  হচ্ছে জ্ঞানগঞ্জ। এই হচ্ছে জ্ঞানগঞ্জের আসল স্থিতি।  এটিকে আমরা রূপকের সাহায্যে ব্যক্ত করে থাকি। 

জ্ঞানগঞ্জে কিভাবে বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস গিয়েছিলেন  ?

জ্ঞানগঞ্জে গিয়েছিলেন, বেশকিছু যোগী মহাপুরুষ। এরমধ্যে ত্রৈলঙ্গ স্বামী, বাবাজি মাহারাজ, বাবা লোকনাথ, শ্রীশ্রী রামঠাকুর, বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। 

এই বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস পূর্বাশ্রমে ছিলেন ভোলানাথ নামে পরিচিত ছিলেন। ইনি কৈশোরেই এই জ্ঞানগঞ্জে যাবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন।  এবং পরবর্তীতে আবার সংসারে ফিরে এসেছিলেন। তো তিনি কিভাবে সেখানে গিয়েছিলেন, সেটা আমরা একবার শুনে নেই। 

 ভোলানাথের কোষ্ঠিতে নাকি তার পরমায়ু লেখা  আছে মাত্র বাইশ বছর। ভোলানাথের মা তা জানতেন, তাই ভোলানাথ কিশোর বয়সে যখন সংসার ছেড়ে সন্ন্যাস নিতে চাইলেন, তার মা আর আপত্তি করলেন না। তো কিশোর ভোলানাথ তার ছোটবেলায় দেখা এক মহাপুরুষের খোঁজে চললেন ঢাকা। সঙ্গে তার আর এক বন্ধু, হরিপদ বন্দোপাধ্যায়।  সেখানে অনেক ঘোজাখুঁজির পরে,  ঢাকার উপকন্ঠে রমনা নামক জঙ্গল ঘেরা শক্তিসাধনার পীঠস্থানে সেই মহাপুরুষের সাক্ষাৎ পেলেন। তো একদিন গভীর রাতে রমনার জঙ্গলে যখন অন্ধকার নেমে এসেছে, তখন সাধু মহারাজ দুই কিশোরের হাত দুটোকে চেপে ধরে, বনপথ দিয়ে হাটতে শুরু করলেন। এর পরে, একসময় সাধুমহারাজ দুই কিশোরের চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলেন। এবার দুই কিশোর, সাধু মহারাজের হাত ধরে, মোহাচ্ছন্নের মতো পথ চলতে লাগলো। পরদিন সকালে তাদের চোখের কাপড় খুলে দেওয়া হলো। এবং তারা আশ্চার্য্য হয়ে দেখলেন, পাহাড়ের উপরে এক মন্দিরে তারা দাঁড়িয়ে আছেন। স্থানীয় লোকজনদের কাছে জিজ্ঞেস করে জানলেন, এই জায়গায়র নাম বিন্ধাচল। তো ঢাকা থেকে এই বিন্ধাচল প্রদেশের দূরত্ত্ব ছয়শত মাইল। আর  যোগীপুরুষের সাহায্যে একরাতে, এই ছয়শত মাইল পথ অতিক্রম করতে পেরে, তারা যোগীপুরুষের অলৌকিক সামর্থের কথা অনুভব করতে পারলেন। এর পরে এই একই প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ যোগশক্তি বলে যোগী মহারাজ বালক দুইজনকে নিয়ে হিমালয় অতিক্রম করে তিব্বতের দুর্গম এক মালভূমিতে এনে উপস্থিত করলেন। এ এক অদ্ভুত সাধনরাজ্য। শক্তিধর বহু সাধক এখানে মিলিত হন, সাধনা করবার জন্য। এই স্থানটির নাম জ্ঞানগঞ্জ। এই  ভোলানাথ হচ্ছে, উত্তরকালের বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস। আর ওই মহাপুরুষ হচ্ছেন স্বামী নিমানন্দ পরমহংস।

জ্ঞানগঞ্জে কিভাবে যাওয়া যায় ? 

আমরা আগে শুনেছি, ভোলানাথ গুরুদেবের হাত ধরে আকাশমার্গে সেখানে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ গুরুদেব যার হাত ধরেন, বা যিনি সৎগুরুর হাত ধরতে পারেন, সেই ভাগ্যবানই জ্ঞানগঞ্জের সন্ধান পান, সেখানে পৌঁছতে পারেন।  তো এই সৌভাগ্য আমাদের সবার হবে তা সম্ভব নয়। এইখানে মহাত্মা  যুৎসুং লামা  বলছেন, জ্ঞানগঞ্জে তুমি মুক্তির স্বাদ পাবে। নিজেকে আগে সূক্ষ্ম ধ্যান-জপে মগ্ন রাখো। নিজেকে গুটিয়ে আনো।  লোকালয় এড়িয়ে চলো। ঈশ্বর আর তোমার মাঝে কোনো বাধা আসতে  দিও না। পথনির্দেশ যথা-সময়ে তুমি পেয়ে যাবে। শুধু ঈশ্বর সেবাতে নিজেকে নিযুক্ত রাখো। অ-শেষের জন্য যাত্রা শুরু করো।  তিন অক্ষরি মন্ত্র জপ করো।  জ্ঞানগঞ্জে যাবার সিদ্ধান্ত যদি নাও, তবে সূর্য উদয় হবার আগেই স্নান সেরে নাও, পরিষ্কার বস্ত্র পরিধান করো।, ঠাকুর ঘরের সব দরজা-জানলা বন্ধ করে দাও, মেঝেতে আসন পেতে উত্তরমুখে পদ্মাসনে  বসো, এবার জপ শুরু করো।  জপের সংখ্যা গুনে রাখো।  প্রতিদিন ১০০১ বার এই তিন অক্ষর মন্ত্র জপ করবে।  জপ শেষ হবার আগে  কোনোভাবেই   আসন ছেড়ে উঠবে না। জপ শেষ হয়ে গেলে, তোমার গুরুদেবকে বা তোমার ইষ্টদেবকে যা জানাতে চাও, তা মনে মনে বলবে। একটা জিনিস জেনে রেখো, গুরুদেব যেখানেই থাকুন না কেন, তিনি তোমার মনের কথা জেনে যাবেন। এর পর গুরুদেবের কাছ থেকে অবশ্য়ই নির্দেশ আসবে, তোমার কাছে। আর তুমি সেটা আসনে বসেই জেনে যাবে।  তবে এই বীজ মন্ত্র কখনো প্রকাশ ও অপব্যবহার করবে না। 

জ্ঞানগঞ্জে  গেলে কি হয়  ?

জ্ঞানগঞ্জে এসে,  স্বামী নিমানন্দ পরমহংসের গুরুদেব স্বামী মহাতপার কাছে থেকে নবীন দুই সন্ন্যাসী দীক্ষা লাভ করে।  প্রায় বারো বৎসর তিনি এখানে থেকে যোগশিক্ষা আয়ত্ত্ব করেন। এর পরে আরো দুই  বছর তন্ত্রসাধনা ও যোগসাধনা চলতে থাকেন । এই যোগশিক্ষা দান  করেন, আচার্য্য ভৃগুরামস্বামী এবং শ্যামানন্দ স্বামী। এতে করে তাদের মধ্যে যোগবিভূতির প্রকাশ হয়। এবং গুরুর আদেশে গৃহাশ্রমে ফিরে আসেন।

 এই বিশুদ্ধানন্দ অনেক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। এনাকে গন্ধবাবা নামেও ডাকা হতো।  কারন, ইনি, বিভিন্ন গন্ধ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম ছিলেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন রুগীকে একলহমায় ভালো করতে পারতেন, সাধারণ জিনিস থেকে তুলো একটি আতস  কাঁচের সাহায্যে   সোনাদানা, স্ফটিক, বা মূল্যবান পাথর তৈরী করতে পারতেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশুদ্ধানন্দের কাছে, এই বিভূতি প্রদর্শন একটা খেলা। তিনি খেয়াল-খুশি মতো, পরমাণুর রূপান্তর ঘটিয়ে হীরা, প্রবাল সোনা, রুপো তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু এইসব ক্রিয়া দেখানোর আগে, কুমারী ভোজনের নাম করে, উৎসাহী দর্শনার্থীর কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিতে ভুল করতেন না। ইনি কুমারী ভোজন করাতেন।  এ সন্মন্ধে তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন,  "বিভূতি দেখানো তো অপরাধ"! তাই এই অপরাধ থেকে রেহাই পাবার জন্য, কুমারী ভোজন করিয়ে থাকি। 

তো একবার হলো কি, বিশুদ্ধানন্দের আশ্রমে এলেন, মা আনন্দময়ী। আনন্দময়ীর সামনেই একটা ফুল থেকে স্ফটিক তৈরী করছেন বিশুদ্ধানন্দ ।  এতেকরে মা আনন্দময়ী খিলখিল করে হেসে উঠলেন। বললেন, বাবা তুমি যা করছো, মেয়ে কিন্তু সব বুঝতে পারছে। বাবা তুমি এসব কি দেখাও ? এর চেয়ে তোমার ভিতরে যে দুর্লভ বস্তু আছে, তা তুমি এদের কেন দিচ্ছ না ? বিশুদ্ধানন্দ কেমন যেন শান্ত হয়ে গেলেন, বললেন, "নেয় কে ?"  অর্থাৎ এইবস্তু নেবার লোক কোথায় ? 

স্বামীজীর এক প্রিয় শিষ্য ছিলেন, গোপীনাথ কবিরাজ।  তো মা আনন্দময়ী তাকে ডেকে বললেন, "বাবা তোমাদের খেলা দেখিয়ে ভুলিয়ে রেখেছেন। এঁর থেকে আসল বস্তু তোমরা আদায় করে নাও। আসলে শাস্ত্র মিথ্যা নয়, যোগ মিথ্যা নয়, কিন্তু যোগের ফল, বিভূতিতে শেষ হয়ে যায় না। বরং বিভূতি প্রদর্শন সাধককে সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। 

জ্ঞানগঞ্জে গেলে আমাদের মধ্যে বিভূতির প্রকাশ ঘটতে  পারে বা ঘটে, কিন্তু জ্ঞানগঞ্জে যাবার উদ্দেশ্য তা নয়। জ্ঞানগঞ্জ আসলে আমাদের শরীরেই অবস্থিত। যোগের সাহায্যে জ্ঞানের উন্মেষ সাধন হচ্ছে জ্ঞানগঞ্জ ভ্রমন।  যিনি যে ধরনের সাধনায় লিপ্ত, তার সেই বিষয়ে সর্বোচ্চ জ্ঞানের উন্মেষ হয়ে থাকে। একেই জ্ঞানগঞ্জ ভ্রমন বলা হয়ে থাকে।   

ই প্রসঙ্গে আমরা ঋষি পতঞ্জলির একটি উক্তি শুনবো।                 

 ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, (বিভূতিপাদ- ৪৪)  স্থুলস্বরূপ-সূক্ষ্ম-অন্বয়-অর্থবত্ত্ব সংযম-উদ্ভূত-জয়ঃ।

পৃথিবীর আদি  স্থুলতা, স্বরূপতা, সূক্ষ্মতা, অন্বয়িতা, ও অর্থবত্ত্বা এই পাঁচরূপ বিশিষ্ট স্থূল ভূতগুলিতে সংযম করলে যোগীর ভূতজয় হয়ে যায়। ভূত সমষ্টি দুই রকম। স্থুল ও সূক্ষ্ম। প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব ধর্ম্মের সীমানাতে নিজেরা প্রতিষ্ঠিত। ভূতের এই যে ধর্ম্ম একে  বলা হয় স্বরূপ। এগুলোর উপরে সংযম করলে, আমাদের বুদ্ধি সত্ত্বের আবরণ উন্মোচন হয়। প্রথম অবস্থায়, অর্থবত্ত্ব।  অর্থাৎ প্রথম অবস্থায়, এই ভূত গ্রহণের দ্বারা আমাদের ভোগায়তন শরীর  হয়, আর এই শরীর যখন বৈরাগ্যের দ্বারা অপবর্গ হয়, তখন সাধকের আকাঙ্খ্যা পূরণ হয়। পঞ্চভূতের স্থুল রূপ হচ্ছে, ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। আর এর সূক্ষ্ম রূপ হচ্ছে,শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ। আর এই পঞ্চভূতের স্বরূপ বা ধর্ম্ম হচ্ছে, ক্ষিতির- কঠিনতা, জলের আদ্রতা বা স্নেহত্ব, তেজের উষ্ণতা, বায়ুর চঞ্চলতা, আকাশের সর্বগতত্ত্বা এগুলোকে সুক্ষ অর্থে বলা হয়, তন্মাত্র। আবার এর   প্রকাশ, ক্রিয়া, ও স্থিতি হিসেবে সত্ত্ব, রজঃ ও তমো এই তিন গুন্ সম্পন্ন। এই পঞ্চভূতের সাধনা করলে, বা সংযম করলে, এই মহাভূতগুলো সাধকের বশীভূত হয়। একেই বলে বিভূতি। এই বিভূতি মানুষকে আকাশপথে গমনে সমর্থ করে থাকে বা অনেক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী করতে পারে।  কিন্তু  আর এই বিভূতিকে অগ্রাহ্য করতে পারলে, তবেই সাধক শুদ্ধজ্ঞানের অধিকারী হতে পারেন। এই শুদ্ধ-জ্ঞানের রাজ্যই জ্ঞানগঞ্জ বা সাংগ্রীলা মঠ।     


ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

তথ্যসূত্রঃ  ত্রৈলঙ্গস্বামী সমগ্র   - অপূর্ব চট্টোপাধ্যায় ,


গল্প না সত্যি  ? 

জ্ঞানগঞ্জে মানস-ভ্রমন 

আজ যাঁর কথা আমরা শুনবো, তার নাম প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আছে। শুধু নাম নয়, তার লিখিত বক্তব্যের মধ্যেও কিছু কিছু কথা সর্বসাধারণের মধ্যে প্রকাশের ক্ষেত্রেও কড়া নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গেছেন তিনি । শুধু এইটুকু বলা যেতে পারে, যিনি একজন সংসারী সাধক।   তাই আমরা তার লিখিত কথাগুলো নিষিদ্ধ অংশ বাদ  দিয়ে নির্বাচিত কিছু অংশ শুনবো। 

"ঘটনা সত্য নয়, কিন্তু দেখাটা সত্য। আপনি এই ঘটনাকে ভ্রমাত্মক জ্ঞান বলতে পারেন। কিন্তু ওই মুহূর্তের জন্য, সেই জ্ঞান জ্ঞাতার কাছে সত্য বলেই প্রতিভাত হয়েছিল। আলো-আঁধারি রাতে যখন  দড়িকে  সাপ  বলে মনে হয়. তখন দ্রষ্টার কাছে সেই সত্যকে অস্বীকার করবার উপায় থাকে না। এমনই একটা ঘটনার কথা আজ বলবো । 

"আসলে গত কয়েকদিন যাবৎ অলৌকিক জ্ঞানগঞ্জের কথা চিন্তা করছিলাম। সেখানে নাকি অনেক  উচ্চকোটির মহাত্মাগণ বাস করেন। বিভিন্ন রকমের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা আছে সেখানে। এইসব সাধকগণ নাকি কালজয়ী, বয়সের গাছ পাথর নেই, এঁরা নাকি আকাশচারী, ইত্যাদি ইত্যাদি।  এঁরা নাকি যোগ্য ছাত্রের খোঁজে লোকালয়ে ভ্রমন করে থাকেন। এখানে লামাদের অনেক তন্ত্র সাধনার মঠ আছে। এমনসব গল্পকথা আমি স্বয়ং গুরুদেবের মুখ থেকে শোনার সৌভাগ্য পেয়েছিলাম  ।আর সেখানে  পৌঁছোবার জন্য, তিন-অক্ষরি মন্ত্র নিয়ম করে জপের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেইমতো নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম।   

"ঠাকুর ঘরে গভীর রাতে ধ্যান করা আমার একটা আবশ্যিক কাজ। প্রথমে এটি গুরুদেবের নির্দেশ পালনের জন্যই শুরু করেছিলাম বটে, তবে এখন সেটা  নেশার মতো।  আর এই ধ্যানের  সময়, আমি সিদ্ধাসনে বসে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা।  গভীর রাতে ধ্যান একটু গভীর হলে, আমি বেশ বুঝতে পারি, আমার শরীরের চারিদিকে একটা আলোর আভা ঘিরে ফেলে। এই আলোর আভার রঙ নীলাভ ।  এটা ধ্যানের সময় আমি প্রতক্ষ্য করে থাকি। না এটি আমার কোনো বিশেষ ধ্যানের  ফলে হয় তা নয়, বিজ্ঞান বলছে, সমস্ত জীব-জন্তু-উদ্ভিদ এমনকি সমস্ত বস্তুকে ঘিরে রেখেছে একটা আউড়া অর্থাৎ একটা জ্যোতির্পূঞ্জ। তাই এটাকে কোনো অলৌকিক ভাবার কারন নেই। আসলে ধ্যান যখন গভীর হয়,  কেবল তখনই এই আলোক পুঞ্জ ঘনীভূত হবার ফলে, এটি আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয়ে থাকে। এই অবস্থা নিশ্চয়ই বহু সাধকের হয়ে থাকতে পারে। 

"কিন্তু সেদিন এক অদ্ভুত দৃশ্যের সম্মুখীন হলাম। জীবনে একটা নতুন অভিজ্ঞতা। প্রথমে চোখে একটা আলোর ঝলকানি এলো। এবং আমি আলোর ঝলকানির আকস্মিকতায়, চোখ খুলে ফেললাম।  চেয়ে দেখলাম, দুটি আলোকপুঞ্জ আমাদের ঠাকুরঘরে প্রবেশ করেছে। আমি অবাক বিস্ময়ে সেই আলোর গোলাকে দেখতে লাগলাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, সেই আলোর গোলা দুটি দুজন মানুষের আকৃতি ধারণ করলো।  না স্বাভাবিক নয়, সেই মূর্তি। গায়ের রং শ্বেতশুভ্র। মাথায় পাকা চুল। মুখে পাকা দাড়ি।  গায়ে এবং পরনে শ্বেত বর্ণের কাপড়। আমার তখন কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে গেলাম। আমার শরীর তখন স্থবির হয়ে গেছে। নিজেকে হালকা বোধ হতে লাগলো। নিজেকে শরীরের বাইরে অনুভব করতে লাগলাম। এরপর আমার বাহ্যিক জ্ঞান লোপ পেয়ে গেলো। আমি আছি আবার নেই। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। শরীরে নেই, কিন্তু আমি আছি। আমার শরীরকে আমি বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছি। শরীরের পিছনটা সাধারণত আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু এখন একটা সিদ্ধাসনে বসা শরীর আমি চতুর্দিক  থেকে স্পষ্ট   দেখতে পাচ্ছি। 

"এক মহাত্মা যেন আমাকে ইরাসৱায়, বললেন, এসো। কিন্তু একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছিলাম না, যে আমি যাবো কি করে ? এছাড়া আমি কোথায় যাবো ? কেন যাবো, তা কিছুই জানতে ইচ্ছে বা শক্তি তখন আমার ছিল না।  শুধু এক গম্ভীর নির্দেশ, আমাকে চঞ্চল করে তুললো,  যে নির্দেশ অমান্য করে কার সাধ্যি।  আমার পক্ষেও  অমান্য করা সম্ভব নয়।  কিন্তু আমার শরীরতো চলৎশক্তিহীন। আমি যেতে চাইলেও আমার শরীর তো যেতে পারছে না।  এটা কি করে হয় ? আমার এই মনের কথা হয়তো, মাহাত্মন বুঝতে পারলেন, মাহাত্ম্য অন্য একজন মাহাত্ম্যকে দেখিয়ে বললেন, "তোমার শরীর রক্ষা করবার জন্য উনি থাকছেন, তুমি চলো। তাঁর কথা বলা শেষ হতে না হতেই সেই আলোক পুঞ্জসদৃশ্য মহাপুরুষ  উর্দ্ধমুখী হয়ে আকাশপথে বায়ুর মধ্যে দিয়ে দ্রুতবেগে রওনা হলেন, আমি কিছু বোঝার আগেই, লক্ষ করলাম, আমি যেন সেই ঘর্ণিঝড়ের মধ্যে লাটখাওয়া শুকনো ঘাস-পাতার মতো ছুটে  চললাম, সেই অসীম শক্তির পিছন পিছন। আমি যাচ্ছি তা নয়, আমাকে টানছে, একটা অসীম শক্তি  প্রবাহ। জোৎস্না-স্নাত আকাশের মধ্যে দিয়ে অসীম দিগন্তে দ্রুতগামী একটা আলোর গোলক আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে। এর পরে একসময় সেই আলোর গোলক স্থির হয়ে  গেলো। আমিও দ্রুতগতিতে গিয়ে সেই আলোর তরঙ্গে মিলিয়ে গেলাম। নারদকে  মেঘের মধ্যদিয়ে ভ্রমন করতে দেখেছি সিনেমায়। স্বর্গে-মেঘের জগতে স্বর্গের নর্তকীদের নাচ দেখেছি, আলোকচিত্রে। আজ যেন আমি সেই আলোর জগতের মধ্যে প্রবেশ করলাম। মেঘের জগতে প্রবেশ করলাম। চারিদিকে একটা শুভ্র আলোর রশ্মি। চারিদিক নিঝুম।  কোনো জনপ্রাণীর দেখা নেই।  যতদূর নজরে আসছে, শুধু আলোর আভা। ধীরে ধীরে আমার সামনে এক-এক করে একটা স্বপ্নের জগৎ সৃষ্টি হতে লাগলো।  আমার নিচে যে মাটি বলে কিছু নেই, তা বুঝবার মতো ক্ষমতা  আমার  ছিল না।  নিজেকে হালকা একটা বায়বীয় পদার্থ মনে হচ্ছিলো। চারিদিকে হালকা কমলা ধোঁয়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কমলা রঙের এই ধোঁয়া গতিশীল। এই ধোঁয়ার মধ্যে থেকেই আমি দেখতে পেলাম একটা মন্দিরের চূড়া।  ধীরে ধীরে আলোর মেঘ কেটে যেতে বুঝলাম, এটি একটি আশ্রম। যার চারিদিকে সুন্দর সুন্দর লতাগুল্ম-ফুল, মঠকে ঘিরে রেখেছে ।  শুধু কমলা রং নয়, বিভিন্ন রঙের মেঘের খেলা  চলছে এখানে।

"এই স্থান যেন একটা স্বপ্নপুরী। স্নিগ্ধ আলোর মধ্যে যেন আনন্দের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। বিচিত্র সব রঙের খেলা। কেউ যেন বিভিন্ন রঙের আলোর আবির ছিটিয়ে রেখেছে। এই আলোর মেঘ আমার দৃষ্টিপথকে আটকাতে পারে নি। ধীরে ধীরে নজরে এলো, মন্দিরে পুজো দেবার জন্য, কিছু গন্ধর্ব নারী-পুরুষ হাতে পূজার ডালা নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করছে। কেউ একজন যেন আমাকে বললো, জানো এই স্থান যেখানে তুমি অবস্থান করছো, তা একজন যোগীপুরুষের ইচ্ছাশক্তি প্রসূত। আর এটি ব্রহ্মান্ডের সবত্র বিরাজ করছে। শুধু যোগীমহারাজের ইচ্ছেশক্তি জাগ্রত হলে এটি দৃশ্যমান হয়ে থাকে। আমি তন্ময় হয়ে এই অপূর্ব দৃশ্যের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছিলাম, যে আমি কোনো দেহ নোই, তবু আমি বলে কোনো একটা সত্ত্বা আমাকে স্বতন্ত্র রেখেছে। এই সব অলৌকিক দৃশ্যের দ্রষ্টা হয়ে বিরাজ করছি। মন্দিরে চারিদিক  থেকে বিভিন্ন রঙের স্ফুলিঙ্গ প্রস্ফুটিত হচ্ছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। এ যেন বাজির খেলা। আলোর খেলা। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এখানে কোনো ধ্বনি বা শব্দ নেই। হঠাৎ লক্ষ করলাম, অগ্নি-স্ফুলিঙ্গগুলো ধীরে ধীরে ঘনীভূত হলো।  আর তার মধ্যে একটা আকার প্রকটিত হতে লাগলো। আমি লক্ষ করলাম, এই আকার আর কারুর নয়, ঠাকুর ঘরে দেখা, সেই শ্বেতশুভ্র কমনীয় মূর্তি। 

"আমাকে ইঙ্গিতে  নির্দেশ দিলেন, তার কাছে যাবার জন্য। আমি নির্বাক অবস্থায়, সেই মহাপুরুষের পিছন পিছন চলতে লাগলাম।  আসলে আমি যাচ্ছি তা বলা যা না, বরং বলা যেতে পারে, আমাকে কোনো অদৃশ্য শক্তি, হতে পারে, মহাপুরুষের সেই আলোক স্বরূপ  শক্তি আমাকে টেনে নিয়ে চললো।

"স্বল্প পরেই, আমরা আরো একটা মঠে প্রবেশ করলাম।  এটিকে মঠ না বলে একটা মেঘে ঢাকা পাহাড় বলা যেতে পারে। এই মঠের মধ্যে অবস্থান করছে  সুড়ঙ্গ পথ। সেই সুড়ঙ্গপথ দিয়ে আমি একটা আলোর শক্তির টানে ভিতরে প্রবেশ করলাম। এখানে আসার পরে আমি যেন লক্ষ করলাম, আমার একটি মনুষ্যবৎ  অবয়ব বা শরীর আছে। এখানে অসংখ্য গুহার অবস্থান।  আর প্রত্যেকটি গুহাতে এক-একজন ধ্যানস্থ পুরুষ অবস্থান করছেন। কিন্তু  গুহার মুখ   কুয়াশার পর্দা দিয়ে ঢাকা, ভিতরে কি আছে বোঝা যায় না। 

"আমি যার টানে এখানে এসেছি, তিনি আমার সামনে  সামনে চলছেন। আমি তাকে অনুসরণ করছি। হঠাৎ মনের মধ্যে জিজ্ঞাসা উঠলো, এরা  কারা ? কেনই বা এখানে বসে আছেন। উত্তর ভিতর থেকেই জেগে উঠলো, এঁরা সবাই যোগীপুরুষ। 

"মহাপুরুষ যিনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন, তিনি গম্ভীর অথচ মৃদু স্বরে বললেন। শরীর কর্ম্ম করবার জন্য ধারণ করতে হয়।  কার্য্য দ্বারা জ্ঞান সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু জ্ঞান সংগ্রহ হয়ে গেলে, শরীর ছেড়ে দিতে হয়। তখন জ্ঞানের মধ্যে বাস। জ্ঞান আনন্দের উৎস  স্বরূপ। জ্ঞানবৃক্ষে যখন আনন্দরূপ পুষ্পের জন্ম হয়,  তখন জ্ঞান ছেড়ে দিতে হয়। তখন আনন্দের মধ্যে বাস। একসময় আনন্দ মিলিয়ে যায়। থাকে শুধু ব্রহ্ম। যোগ এই জ্ঞানভূমির দর্শন।  যোগ এই জ্ঞানভূমি পর্যন্ত নিয়ে আসতে  পারে। তাই এঁরা  সবাই যোগে আবিষ্ট। জ্ঞানভূমি থেকে আনন্দে উত্তরণ ঘটাতে পারে একমাত্র ইচ্ছেশক্তি। এই ইচ্ছেশক্তিই বিশ্বশক্তি। সমস্ত জগতের কারন। 

"আমার মধ্যে প্রশ্ন জেগে উঠলো, এই কুয়াশার মতো আলোকপুঞ্জ যা আমি গুহার বাইরে দেখেছিলাম, তা আসলে কি ? মহাত্মা বললেন, এগুলো সব আত্মশরীর। যাকে  তুমি আলোর মেঘ ভেবেছো, এগুলো সবই যোগীর আলোকদেহ। তুমি এখানে ধ্যানে বসো, বলে একটা শুন্য গুহা দেখিয়ে দিলেন। আমি মহাপুরুষের নির্দেশ মেনে, গুহার  মধ্যে প্রবেশ করলাম।  একটা সুগন্ধ নাকে এলো। আমি ধ্যানে আবিষ্ট হয়ে, নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। কতক্ষন এই অবস্থায় ছিলাম জানিনা। কিন্তু যখন সম্বিৎ ফিরে এলো, তখন আমি ঠাকুর ঘরে ধ্যানাসনে অবস্থান করছি। ভোরে আলো  ফুটেছে।  ভাবতে লাগলাম, আমি কি স্বপ্ন  দেখছিলাম ? 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।