Saturday 7 January 2023

শরণাগতির সাধনা।


 ঋষি অরবিন্দ - শরণাগতির সাধনা। প্রথম পর্ব্ব 

শশাঙ্ক শেখর সঙ্কলিত শ্রীগীতা - যোগসাধনের গুহ্যতত্ত্ব কমিউনিটিতে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে ।  

শরণাগতির  সাধনা শুনতে যতটা সহজ বলে হয়, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই সহজ নয়। শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, "মামেকং শরণং ব্রজ" - একমাত্র আমার শরণ নাও। "নিরাশ্রয়ং মাং জগদীশ রক্ষ" -  আমি নিরাশ্রয় আমাকে রক্ষা করো।  ভগবান বুদ্ধ বলছেন, "শরণং গচ্ছামি"। 

জীবনের পদে পদে বিপদ। বিপর্যয় জীবনের সাথী। কি করলে যে ভালো হবে, কিসে যে আমাদের মঙ্গল হবে, কি করা উচিত, কি করা উচিত নয়, কি রাখা উচিত, আর কি ত্যাগ করা উচিত - আমরা তা বুঝে উঠতে পারি না। তাই মানুষ একটা আশ্রয় চায়। একজন অবিভাবক  চায়, একজন নির্ভরশীল গুরু চায়। আর খুঁজে নিতে চায়, সহজ জীবন পদ্ধতি। যতদিন  নিঃশর্ত ভাবে সে পিতা-মাতার উপরে নির্ভরশীল ছিল, ততদিন সে নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু একসময় বাহ্যজ্ঞান অৰ্জন করতে করতে, সে যে শিকড়বিহীন হয়ে গেছে। জীবনে বেঁচে থাকবার রসের সন্ধান পাচ্ছে না। কেবল আশঙ্কা -কি হয়, কি হয় !  যত  তার জ্ঞান বৃদ্ধি হয়েছে, ততই সে আঁকড়ে ধরতে চাইছে একটা আশ্রয় । একজন বিষয়ী লোটা-বোচকা, স্ত্রী বাচ্চা নিয়ে ট্রেনে উঠেছে। একহাতে সে বৌকে ধরেছে, একহাতে বোচকা সামলাচ্ছে।  বৌ একহাতে বাচ্চা ধরেছে, একহাতে সে স্বামীকে ধরেছে। তো এক স্বামিজি যাচ্ছিলেন, সেই ট্রেনে।  তিনি ভদ্রলোককে বললেন, জিনিসগুলো এখানে রেখে, সিটে  এসে বসুন। ভদ্রলোক স্বামীজিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে  দেখলেন, আর ভাবলেন, সঙ্গে তো কিছুই নেই, কেবল ল্যাঙট।  পড়তে আমার অবস্থায়, বুঝতে ঠেলা। স্বামীজী আবার মধুর কন্ঠে বললেন, ট্রেন আপনাকে গন্তব্য পৌঁছে দেবে, জিনিসপত্র মাথায় না রেখে, ট্রেনের বাঙ্কে   তুলে দিন। নিশ্চিত হয়ে বসুন। কিন্তু কে শোনে কার কথা ? ভদ্রলোক স্বামীজী থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। 

মহাত্মা  বলছেন, যতদিন দায়িত্বের বোঝা নিজের ঘাড়  থেকে না নামাতে পারবেন, যতদিন নিজের জন্য ভেবেভেবে জর্জরিত হওয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে না আনবেন, ততদিন আপনি আনন্দের সন্ধান পাবেন না। কিন্তু কথা হচ্ছে, নিজের জন্য না ভেবে উপায় কি ? আমার কথা আমি ছাড়া আর কে ভাববে ? সত্য বটে, তোমার কথা তুমি ছাড়া আর কে ভাববে ? আসলে আমরা সবাই যার উপরে নির্ভরশীল, যার জন্য আমরা সবাই  বেঁচে আছি, সেই বিশ্বশক্তি সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই   নেই। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো  কথা হচ্ছে, আমাদের বুকের মধ্যে চেপে আছে, একটা সন্দেহবোধ।  এই সন্দেহবোধ আমাদেরকে সব সময় মন্ত্রণা দিচ্ছে, বলছে, সাবধান, তুমি যদি নিজের সব ব্যাপারে মনোযোগী না হও তবে ভবিষ্যতে তোমার কপালে দুর্ভোগ আছে। নিজের উপরে নিজের যদি পাহারাদারী না করতে পারো, তবে তোমার কত কি যে হারিয়ে যাবে তার ঠিক নেই। আর আমরা সন্দেহের বসে চৌকিদার হয়ে বসে আছি। দুই চোখ কখনো এক করতে পারি না। 

মহাত্মাগণ বলছেন, তুমি যদি ভগবানের উপরে সব ভার ছেড়ে দিতে পারো, তবে সত্যিই তোমার কোনো বিপদের সম্ভাবনা থাকবে না। তোমার জীবন হবে সহজ-সরল দুশ্চিন্তামুক্ত। কপটতা-বিহীন শরণাগতি আর ভগবৎ-করুণা মানুষের জীবনকে সোনার ফসলে ভরিয়ে দিতে পারে। জীবনে যতই বাধাবিগ্ন, শোক-দুঃখ-বেদনা-অশান্তি আসুক না কেন, তা যদি আপনি শ্রী ভগবানের চরণে ফেলে দিয়ে বলতে পারেন, আমরা যাকিছু সবই তোমার, তা সে ভালো হোক, বা মন্দ হোক, পাপ হোক বা পুন্য হোক - তবে আপনি দেখতে পারবেন, ভগবানের অমোঘ করুণাশক্তি সেই মুহূর্তেই ক্রিয়াশীল হতে শুরু করেছে, আর আপনাকে কোনো কিছু নিয়েই মাথা ঘামাতে হচ্ছে না । একটা জিনিস জানবেন, এই জীবনগাড়ীর চালক আপনি নন, আপনি যাত্রী মাত্র। আপনার যাকিছু আছে, সবই আপনি সেই  গাড়ির মধ্যে রেখে নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ  করুন। শুধু ঠিক গাড়ির টিকিট কাটুন, আর ঠিক গাড়িতে চেপে পড়ুন, তবে জীবনগাড়ী আপনাকে লক্ষে পৌঁছে দেবে। যখনই কোনো প্রশ্ন মনের মধ্যে উদয় হবে, তখনই উত্তর মনের মধ্যে ভেসে উঠবে। মন যত  স্থির হতে থাকবে, মন যত অন্তর্মুখী হবে, ততই তোমার মধ্যে জ্যোতির প্রকাশ স্বচ্ছ থেকে স্বচ্ছতর হয়ে উঠবে। 

ভগবানকে সত্যই যদি কেউ চায়, তবে ভগবানই তার সব ভার নিজের  হাতে তুলে নেবেন।  তার মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই সাধনপ্রবৃত্তি জেগে উঠবে, সাধনার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঈশ্বর  উপলব্ধি-অনুভূতি দ্বারা সমৃদ্ধ করবেন। এটা তখন এমনি এমনি ঘটে থাকে।  কারন ভগবান যখন ভক্তের ভার গ্রহণ করেন, তখন সাধক তার নিজের প্রচেষ্টার উপরে নির্ভর না করে, ভগবানের শ্রীহস্তেই নিজেকে সমর্পন করে দিয়েছেন।  আর ভক্তের অগাধ বিশ্বাস, ও শ্রদ্ধাও তার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভগবানই আমাদের দেহশুদ্ধি করেন, ভগবানই আমাদের অন্তঃকরণ শুদ্ধি করেন, ভগবানই আমাদের হৃদয়কে শুদ্ধ করেন, ভগবানই আমাদের মধ্যে অন্তঃ-চেতনার  উন্মেষ করে থাকেন।  এমনকি আপনি যদি নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিতে নাও পারেন, তাহলেও আপনার মধ্যে অন্তর থেকে নির্দেশ আসবে, আর একটা বিশ্বশক্তির অনুভবও আপনি করতে থাকবেন। 

এইসব ভক্তদের তথাকথিত বাহ্যিক তপস্যার প্রয়োজন পরে না। শুধু অখন্ড বিশ্বাস, নির্ভরশীলতা সাধকের মনকে ঘুরিয়ে দেয়। আর এই মন যখন সম্পূর্ণরূপে ভগবত মুখী হয়, তখন ভগবানের প্রজ্ঞা শক্তি ও প্রেমের ধারা সেই মনের উপরে প্রভাব ফেলতে থাকে। তখন জীবনের সমস্ত ভ্রান্তধারনা দূর হয়ে একটা দিব্যজীবনের মধ্যে সাধক প্রবেশ করেন। 

তবে একটা কথা বলি, মুখে মুখে সারাক্ষন "শরনং গচ্ছামি" বললাম, আর অহং ভাবে ভাবিত হয়ে ইন্দ্রিয়সুখের দিকে  ধাবিত হলাম - এমনটা হলে জানবেন, আপনি  আত্মপ্রবঞ্চনা করছেন। অধ্যাত্ম জীবন ভগবানের শর্ত পূরণের জীবন, অধ্যাত্ম জীবন ভগবানের নির্দেশ পালনের জীবন, অধ্যাত্ম জীবনে কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার জীবন। গুরুমন্ত্র নিলাম, আর যেমন ইচ্ছে তেমন চললাম, যা ইচ্ছে তাই করলাম, - আমাকে গুরু রক্ষা করবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি ভেবে নিশ্চিন্ত রইলাম। দেখুন, গাধাকে পিটিয়ে গুরুদেব ঘোড়া  বানিয়ে দেখেন, ভগবান আপনাকে কান ধরে তাঁর দিকে টেনে নেবেন, এমনটা ভাবা  মানে মূর্খের স্বর্গে বাস করা। এই ধরনের ভ্রান্ত প্রত্যাশা মানুষকে আরো গভীর অন্ধকারে প্রবেশ করিয়ে দেয়। তাহলে কি ধরে নেবো গুরুর কোনো শক্তি নেই, ভগবানের কোনো শক্তি নেই, যে আমার মতো গন্ডমূর্খকে পন্ডিতে পরিণত করতে পারে । দেখুন, এর সঙ্গে গুরুর বা ভগবানের শক্তিমত্তার কোনো সম্পর্ক নেই, কেউ যদি যোগের শর্তপূরনে অস্বীকার করে, তবে ভগবানের বাপের সাধি নেই, গুরুদেবের গুরুরও সাধ্য নেই, আপনাকে উদ্ধার করে। শরণাগতির যোগের কিছু শর্ত  আছে, যা আপনাকে পালন করতে হবে। সমস্ত কাজে যেমন দুটো জিনিসের প্রয়োজন একটা হচ্ছে দৈব আর একটা হচ্ছে পুরুষকার। শরণাগতির উপাদান হচ্ছে শ্রদ্ধা-বিশ্বাস ও ঐকান্তিকভাবে ভগবানে সমর্পন। বিশ্বাসহীন মানুষের কাছে শরণাগতি সাধনা অলীক স্বপ্ন মাত্র। ভগবানের করুণাশক্তি অর্থাৎ দৈবকে নিজের অনুকূলে আনতে গেলে, বিশ্বাস হচ্ছে প্রথম ও অন্তিম সর্ত। প্রার্থনা যদি আন্তরিক না হয়, সেই প্রার্থনায় কোনো কাজ হয় না। প্রার্থনা উঠে আসবে হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে। বিশ্বাসকে সরিয়ে রেখে যে প্রার্থনা তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। একটা জিনিস জানবে, শুধু বিশ্বাস মানুষের মনের জোরকে বাড়িয়ে তুলতে অবিশ্বাস্য ভাবে কাজ করতে পারে। একজন বিশ্বাসীর  পক্ষে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। 

এখন কথা হচ্ছে, আমি যে বিশ্বাস করবো, তা কার উপরে হবে ? দেখুন ভগবানকে আমি চিনি না, জানি না, তো হতে পারে, তিনি সর্ব্বশক্তিমান, কিন্তু আমার সেই সর্ব্বশক্তিমানের সম্পর্কে কোনো ধারণা  নেই। আর যার সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা  নেই, তার প্রতি আমাদের অগাধ শ্রদ্ধা, বিশ্বাস কি ভাবে উৎপন্ন হবে ? তাই যদি হয়, তবে আপনাকে গুরুবাক্যে বা শাস্ত্র বাক্যে প্রথমে বিশ্বস স্থাপন করতে হবে। বিশ্বাসের পাঁচটি মুখ।  আপনাকে বিশ্বস করতে হবে - ১. একটা শক্তি আপনাকে সব সময় ঘিরে রেখেছে, যার শক্তিতে আপনার মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে - আপনি প্রাণবন্ত আছেন। ২. আপনার মধ্যে ভালোবাসার বীজ আছে। আপনি কারুর ভালোবাসা পেতে চান, আবার আপনি অন্যকে ভালোবাসতে চান। এই ভালোবাসার নিরাসক্ত অবস্থার নাম প্রেম, যার জন্য কোনো বাহ্যিক কারনের  প্রয়োজন পড়ে না। এই ভালোবাসা আপনার আমার সবার মধ্যেই আছে। ৩. ভগবান সর্ব্বশক্তিমান। আপনার মধ্যেও অনেককিছু করবার ক্ষমতা আছে। আপনার হয়তো দুটো পাখা নেই, আপনি হয়তো আকাশে উড়তে পারেন না, কিন্তু আপনি আপনার পুরুষকারের  জোরে উড়োজাহাজ বানাতে পারেন, আপনি মাছের মতো জলে ভেসে বেড়াতে পারেন, যখন আপনার পুরুষশক্তি আপনাকে নৌকো বা জল-জাহাজ বানিয়ে দিতে পারবে। ৪. আপনার মধ্যে একটা সঙ্কল্পঃশক্তি আছে, যার জন্য আপনি যাকিছু সংকল্প করতে পারেন। আসলে এই একই শক্তি আছে শ্রী ভগবানের মধ্যে - আর সেখান থেকেই আপনি এই শক্তি পেয়েছেন। ৫. আপনি কার নির্দেশে এই দেহে অবস্থান করছেন, অর্থাৎ কিভাবে আপনি এই মনুষ্য দেহ পেয়েছে, তা আপনি জানেন না। আবার একদিন আপনাকে এই দেহ ছেড়ে চলে যেতে হবে। দেহ শিশু থেকে রূপান্তরিত হতে হতে একদিন বৃদ্ধে  রূপান্তরিত হবে, এই অমোঘ সত্যকে আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। তো কেউ একজন এই পরিবর্তনের কাজটি আপনার অজ্ঞাতসারে করে চলেছে, তাকে আপনি জানেন না। সহজ ভাষায় বলতে গেলে এই বিশ্বশক্তিকেই ভগবান হিসেবে স্বীকার করে নিন। 

এবং একটা জিনিস জানবেন এই বিশ্বশক্তিই আপনাকে পরিচালনা করছে আপনার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের চিন্তার উদ্রেগ করছে। আপনার মধ্যে ভালোলাগা মন্দ লাগা, সুখ-দুঃখের উপলব্ধি করছে। তার ইচ্ছেতেই আজকের আপনি হয়েছেন। তিনি আপনাকে ভালোবাসেন, তিনি আপনার কাছাকাছিই আছেন।  তিনি আপনার মঙ্গল চান। সবকিছু ঘটিয়ে তোলার ক্ষমতা তার আছে।  ইনি ইচ্ছে করলে, আপনাকে দেহমানব থেকে দেবমানবে পরিণত করে তুলতে পারেন। .এবার মনে মনে ভাবুন, "আমি একান্তভাবেই তাঁর শুধু তারই"। 

এই পাঁচটি শর্তকে আপনি যদি মনে প্রাণে বুঝে থাকেন, যদি বিশ্বাস করেন, তবে জানবেন, শরণাগতি সাধনার পথে আপনার প্রথম পদক্ষেপ হয়েছে। 

এবার বলি আপনার মধ্যে যে সত্যি সত্যি বিশ্বাসের জন্ম হয়েছে, তা কি করে বোঝা যাবে ? তা না হলে আমরা নকল বিশ্বাসের কবলে পরে যাবো। আর নকল টাকা যেমন বাজারে নিয়ে গেলে, কোনো দ্রব্য খরিদ করা যায় না , তেমনি নকল বিশ্বাস নিয়ে সাধন জীবনেও কোনো প্রাপ্তি ঘটতে পারে না।

দেখুন বিশ্বাস হচ্ছে মনের একটা বিশেষ অবস্থা, যা ইচ্ছে করলেই জাগানো যায় না, এমনি বিচার বুদ্ধি দিয়েও জাগানো যায় না। খাঁটি বিশ্বাস আর বুদ্ধিমানের দৃষ্টি এক কথা নয়। বিশ্বাস, বর্তমানের দৃষ্টিশক্তির উপরে নির্ভরশীল নয়। ইন্দ্রিয়-উপলব্ধ সত্য অর্থাৎ যা বাস্তব তাকে দিয়ে বিশ্বাস অৰ্জন করা যাবে না। কেননা ভগবান আমাদের চোখের দৃষ্টির বাইরে, এমনকি পঞ্চ  ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। তো বিশ্বাসের সঙ্গে বুদ্ধিকে মেলাতে চাইবেন না। এমনকি বিশ্বাসের সঙ্গে চোখের দেখাকে গুলিয়ে ফেলবেন না। আপনার মধ্যে যদি কোনো বিষয়ে অবিশ্বাস থাকে, তবে আপনি যুক্তি বিচার দিয়ে বা বাহ্য চিহ্ন ও প্রমান খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। কিন্তু আপনাকে মনে করতে হবে, ভগবান তুমি আছো - এই আমার বিশ্বাস।  আমি তোমাকে দেখতে পারছি না, শুনতে পারছি না, এমনকি অনুভব করতে পারছি না, তথাপি তুমি আছো, এই মুহূর্তেই তুমি আছো, এবং আমার কাছেই আছো। জগৎকে অস্বীকার করতে বলছি না, কিন্তু মনে এটা ভাবতে শিখুন, এই জগৎ পরিবর্তনশীল।  প্রতিক্ষনে এর পরিবর্তন হচ্ছে, এমনকি আমাদের স্থুল দেহ মনের পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু আমি সেই একই আছি, ভগবানও সেই একই আছেন। তবে এটাও বিশ্বাস করুন, যা কিছু আমরা দেখছি, যাকিছু আমরা শুনছি, যা কিছু আমরা উপলব্ধি করছি, সবার মধ্যে সেই ভগবান আছেন বলেই সেটা সম্ভব হচ্ছে।  এর মধ্যে যদি সেই ভগবান না থাকতো, তবে যে সত্তার  পরিবর্তন হচ্ছে, বলে মনে হচ্ছে, তার কোনো অস্তিত্ত্ব থাকতো না। তাই, যা কিছু আমরা দেখছি, যাকিছু আমরা শুনছি, যা কিছু আমরা উপলব্ধি করছি, তার মধ্যে সেই পরমশক্তি  ভগবানই বিরাজ করছেন। এসবের মধ্যে সেই ভগবানই আছে।  ভগবান ভিন্ন কিছু নেই, ছিলোনা, থাকবে না। এইসব কথার যথার্থ বুদ্ধিগ্রাহ্য় যুক্তি হয়তো আমার আছে নেই, তবে এসব আমাদের মুনি-ঋষিদের  প্রতক্ষ্য সত্য। এবং তার কথায় বিশ্বাস করুন। একটা জিনিস জানবেন, আপনি যাকিছু মেনে নেবেন, তাই সত্য বলে প্রতিভাত হবে। এই বিশ্বাস আপনার মধ্যে যত  বাড়তে থাকবে, জানবেন, আপনার মধ্যেই ততই অধ্যাত্ম শক্তি বাড়তে থাকবে। আপনার মধ্যে যেমন যেমন বিশ্বাস বিরাজ করবে, আপনার মধ্যে ভগবানের ক্রিয়াশক্তিও ততটাই জাগ্রত হবে। বিশ্বাসী সাধকের কাছে সব সম্ভব।  তার কাছে অসম্ভব বলে কিছু হয় না। এই হচ্ছে খাঁটি বিশ্বাসের রূপ। 

এখন কথা হচ্ছে, ভগবানের দ্বারা সবকিছু সম্ভব। তার মানে কি শরণাগত ভক্তের  জীবনে  কোনো দুঃখ-বেদনা-শোক-তাপ  রইলো না ? তার জীবন থেকে সব বিপদ-আপদ কেটে গেলো ? না, ব্যাপারটা এমন নয়। তাহলে ? 

দেখুন, আমরা পৃথিবীর বুকে মনুষ্য শরীরে অবস্থান করছি। আলো  থেকে অন্ধকারে নেমে এসেছি। প্রকৃতির নিয়মে জাত জৈবিক শরীরের যা ভবিতব্য তা থেকে রেহাই পাবার কোনো উপায় নেই। আগুনে হাত দিলে হাত পুড়বে। তা সে আপনি ভগবানের পরমভক্ত হলেও হবে, আবার অজ্ঞান, অবুঝ হলেও হবে। দেখুন, শরীরের কষ্ট  থাকবে, এমনকি মনের কষ্টও থাকবে, কিন্তু আপনার মধ্যে চেতনশক্তির উন্মেষের ফলে আপনার মধ্যে একটা শান্তির ভাব বজায় থাকবে। যাত্রাপথ কখনও  সুগম হবে, কখনো দুর্গম হবে, কখনও  পাহাড়, কখনো জঙ্গল, কখনো অন্ধকার, কখনো আলোর দেখা  মিলবে। কিন্তু  মনে হবে, কেউ যেন আপনার হাতটি শক্ত করে ধরে আছেন, আপনার হারিয়ে যাবার কোনো ভয় থাকবে না। ভগবান যখন মনে করবেন, দুঃখ দেবার প্রয়োজন, তখন তিনি তাকে দুঃখ দেবেন। কাঠ কয়লা থেকে হিরে বের করতে গেলে, তাকে হাজার হাজার বছর অন্ধকার মাটির গর্ভে অশেষ যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়।  সোনা  থেকে সুদৃশ্য গয়না গড়তে  গেলে, সোনাকে আগুনে পড়াতে হয়।  লোহা থেকে বাসন বানাতে গেলে, লোহাকে হাতুড়ি দিয়ে পেটাতে হয়। তো দুঃখ আসলে সাধনপথে এগিয়ে যাবার সুবর্ণসুযোগ। দুঃখ-কষ্ট  জানবেন, আমাদের ঋণ পরিশোধের সময়। তাই একটা জিনিস জানবেনা, যতই দুঃখ আসুক না কেন, সেই দুঃখের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছেন, সেই মঙ্গলময় ভগবান।  তিনি দুঃখের দিনেও আমাকে ছেড়ে যাবেন না।  বরং দুঃখের দিনেই তাকে সহজে কাছে পাওয়া যায়। রাতের পরই দিন আসে। অন্ধকারের পরেই আলোর দেখা পাওয়া যায়। দহন  আছে তাই দীপের আলোর প্রকাশ হচ্ছে। ভক্ত জানেন, দুঃখ বেদনাই পরমেশ্বরের প্রকাশের কারন। খন্ডিত  চেতনার কাছে এসব হয়তো ধরা পরে না, কিন্তু ভক্ত যখন অখন্ড চৈতন্যের মধ্যে প্রবেশ করেন  তখন তিনি বেশ বুঝতে পারেন,  ভগবানের শুভ ইচ্ছে, ভগবানের মঙ্গলের ছোঁয়া। ভগবানের ইচ্ছেটা কি করে বুঝবো ? 

ওম  শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  

শরণাগতি সাধনা - দ্বিতীয় পর্ব্ব

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি ভক্ত সদা দুঃখকেই কামনা করবে ? আর দুঃখের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করে কাল্পনিক ভগবানের দয়া বলে মনে করে, সুখী এবং ভবিষ্যৎ আনন্দের জন্য অপেক্ষা করবে ? না ব্যাপারটা এমন নয়, আসলে ভক্ত সদা সত্যের সম্মুখীন হবে। সত্যকে এড়িয়ে যেতে চাইবে না। দুঃখ যদি সত্য হয়, তবে , দুঃখের মধ্যেই সে ভগবানের সন্ধান করবে। আবার সুখ যদি সত্য হয়, তবে সুখের মধ্যেও সেই একই ভগবানের সন্ধান করবে। অর্থাৎ জীবনের লক্ষ থেকে বিচ্যুত হবে না। জীবনের যেকোনো সময়ে বিশেষ করে দুঃসময়ে সে তখন ভগবানের সান্নিধ্য অনুভব করবে। তবে একথা ঠিক যে, আমরা কেউ কেবলমাত্র দুঃখের মধ্যে অন্তর্নিহিত মঙ্গলময় আছেন, ভেবে ক্ষান্ত হতে চাই না। আমরা চাই ভগবানের উপলব্ধি।

সেক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে,  শান্ত হয়ে ভগবানের নির্দেশের অপেক্ষা করতে হবে। প্রতি মুহূর্তে নিজের মধ্যে প্রশ্ন জাগিয়ে তুলুন, ভগবানের আজকের এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে আমাকে কিসের নির্দেশ পাঠাচ্ছেন ? এই নির্দেশ ও তার যথার্থতা, যতক্ষন  সাধকের মধ্যে জেগে না উঠছে, ততক্ষন  জানবেন, আপনার অধ্যাত্ম জীবনে কোনো উন্নতিই হয়নি।  আপনি যেখানে ছিলেন, সেখানেই স্থবির হয়ে বসে আছেন। মহাত্মাগণ বলছেন, মন-প্রাণকে শান্ত করে ভগবানের নির্দেশের অপেক্ষা করো। ভগবান তো সবার  হৃদয়ে অবস্থান করছেন, আমরা এই হৃদয়স্থিত ভগবানের কথা যদি না শুনতে পাই, তবে ধরে নিতে হবে, আমার মধ্যে অহর্নিশি কলরোল চলছে। এই কলোরোলকে উপেক্ষা করে, ভগবানের দিকে কান পেতে বসে থাকুন। আর তাহলে আগে বা পরে আপনি অবশ্য়ই ভগবানের নির্দেশ শুনতে পাবেন।

তো ভগবানের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটা ঠিক এই অপেক্ষাকালে অশুদ্ধ  মনের অঙ্গনে নানান রকম অবাঞ্চিত চিন্তা এসে ভিড় করবে।  নানান রকম কু-মতলব মাথা ছাড়া দেবে। ভগবানের নির্দেশ পাবার আগেই মন চঞ্চল হয়ে ভুল পথে চলতে শুরু করবে। এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে নৈরাশ্য ও হতাশা।  এই সময় মন বলে উঠবে, এইসব করে কিচ্ছু হবে না, এসব অহেতুক পন্ডশ্রম মাত্র। ভগবান বলে কিছু নেই। আর ভগবানের ইচ্ছে-টিচ্ছে বলেও কিছু নেই নেই।  যাকিছু করবার তোমাকেই করতে হবে। বৃথা অপেক্ষা না করে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়ে নাও। ভাবাভাবি নয়, কাজে লেগে পড়ো। হয়তো বলবে, কাজ না করলে ভগবান সাহায্য করবে না - পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ো - আশ্চার্য্য কিছু ঘটবে, ভগবান তোমার সঙ্গে আছেন। 

কিন্তু এই কুমন্ত্রণায় কান দিলে চলবে না। তাঁরই করুণাশক্তির উপর নির্ভর করে নিরুদ্বিগ্ন থাকতে হবে। একটা জিনিস জানবেন, উদ্বিগ্নতা যেখানে শুরু, বিশ্বাস সেখানে শেষ। আর বিশ্বাসের আবির্ভাবে উদ্বিগ্নতার তিরোভাব। জানবেন, এমন কোনো সমস্যা নেই, যা ভগবান সমাধান করতে পারবেন না। এমন কোনো পরিস্থিতি নেই যেখান থেকে ভগবান তার সাধককে বের করে আনতে  পারবেন না। ভক্ত সাধক কখনো ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা  করবে না। ভবিষ্যৎ একটা কল্পনা মাত্র। ভবিষ্যতে কি হবে, যদি এটা হয়, ওটা হয়, ভেবে নিজেকে নিজে বিব্রত করবেন না। জানবেন, ভবিষ্যতে এমন কিছু ঘটবে না, যা ভগবানের ইচ্ছে নয়। ভগবান এমন কিছু করবেন না, যা ভক্ত বহন করতে পারবে না। 

হ্যাঁ এই নিরুদ্বিগ্ন ভাব, ভগবানের উপরে নির্ভরশীলতা বজায় রাখা বিশেষ প্রয়োজন। দেখুন, একদিকে আমরা শরণাগতির সাধন করছি, আর অন্যদিকে আমাদের মধ্যে উদ্বিগ্নতার বিনাশ ঘটছে না, মনের মধ্যে থেকে ভয়ের ভাব কাটছে না,  এই দুটো একসঙ্গে চলতে পারে না। আর এই অবস্থা হলে, শঙ্কিত মন, উদ্বিগ্ন মন সাধকের শরণাগতির সাধনায় বাধা সৃষ্টি করবে। তখন ভগবানের যে করুণাশক্তি বিশ্বাসের অভাবে সেই করুণাশক্তি ঠিকঠিক মতো কাজ করতে পারবে না। 

কিন্তু কথা হচ্ছে, ভয় তো নিজে থেকে করি না এসে যায়, উদ্বিগ্নতা  তো নিজে থেকে করি না এসে যায়, দুশ্চিন্তা তো নিজে থেকে করি না, এসে যায়।  এখন থেকে বেরুবো কি করে ? 

১. ভাবতে শুরু করুন - চিন্তাপ্রবাহকে ঘুরিয়ে দিন।  ভাবুন, হে ভগবান, আমি তোমাকে ছাড়া কিছু জানি না, তোমাকে ছাড়া কিছু বুঝি না।  তুমি ছাড়া  কিছু নেই। তুমি আমার -আমি তোমার। তোমার আমার মাঝে অন্য কোনো কিছু নেই, থাকবে না। অন্তর থেকে এই বিশ্বাস জাগিয়ে তুলুন, যে আপনার সমস্ত কাজ ভগবানে নিবেদিত। ভগবানের জন্য, ভগবানের দ্বারা, ভগবানের শক্তিতেই সমস্ত কিছু হচ্ছে। আমি ভগবানের হাতের ক্রীড়নক মাত্র। 

২. জানবেন, প্রত্যেকটি দুঃখ-বেদনা আসবে একটা মহত্তর কল্যাণের কারন হয়ে। আর এই দুঃখ বেদনাকে যদি আপনি এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন, তবে জানবেন, আপনি ভগবান থেকে  বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। তবে একটা জিনিস জানবেন, মঙ্গলময় বিধাতা পুরুষ আপনার কপালে, এমন কোন দুঃখের কথা লিখে রাখেননি, যা আপনি সহ্য করতে পারবেন না। আপনাকে আপনার জন্ম-জন্মান্তরের কর্ম্মফল থেকে কেউ রেহাই দিতে পারবে না, কিন্তু একথা সত্য, যারা ভগবানের উপরে নির্ভরশীল, তাদের মধ্যে এমন শক্তি ভগবান দিয়ে রাখেন, যখন সেই দুঃখ-কষ্ট উপভোগের মধ্যে মনের মধ্যে একটা শান্তি বিরাজ করে। এবং জানবেন, এই ধ্রুব সত্য,  যে কষ্ট  আজ আপনাকে পেতে হচ্ছে, তা কেবল আপনার পূর্ব  কর্ম্মের ফল তা নয়, এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।  সেই মূল্যবান ধন লুকিয়ে আছে, যার উন্মোচনের জন্য আপনার জীবনে ঝড়ের বাতাস লাগছে।  এই ঝড় আসলে লুক্কায়িত মনি-মুক্তার ভান্ডারের দরজা উন্মুক্ত করে দেবার জন্য আবশ্যিক ।  তা না হলে, এই দরজা আপনার কাছে চিরতরে বন্ধই থাকতো। ভগবান কারু কাছ থেকে কিছু নেন না, তিনি তো দাতা, তিনি সবসময় আমাদের উজাড় করে দিতে চাইছেন। আমরা অবুঝ নিতে জানি না। তো দুঃখ আমাদের কাছে অবাঞ্চিত হয়, কিন্তু এই  দুঃখের মধ্যে লুকিয়ে আছে ভগবানের অসীম করুনা ভাণ্ডার।

৩. শরণাগতি সাধনার বিরতি টানলে চলবে না। শরণাগতির সাধন করতে এসে, যে বোঝা একবার  ঘাড়  থেকে নামিয়ে রেখেছেন ,  আর সে বোঝা  ঘাড়ে চাপাবেন না।  শয়তানের শতশত অনুরোধ উপরোধেও না। আবার এও ভাববেন না  যে দেখি না কিছু দিন করে, যদি সুফল পাই, তবে আবার পরবর্তীতে করা যাবে। পরীক্ষা করতে যাবেন না। করতে না চান করবেন না।  কিন্তু শরণাগতির সাধনার কোনো পরীক্ষা করতে যাবেন না। 

৪. ভগবানের ঐশ্বর্য্য নয়, ভগবানকে চান। আপনি চাওয়া পাওয়ার উর্দ্ধে উঠে নিশ্চিন্তে অবস্থান করুন। এই সাধনায় অন্যের সাহায্য এমনকি নিজের সাধ্যের কথাও  ভাবতে যাবেন না। শরণাগতের একমাত্র আশ্রয় হবে ভগবান। আপনার কাছে ভালো দিনগুলোও যা, তথাকথিত খারাপ দিনগুলোও তাই।  দুয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতে যাবেন না। আগে ভালো ছিলাম, কি খারাপ ছিলাম, সেই স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলুন। ভবিষ্যতে ভালো থাকবো কি খারাপ থাকবো, সেই ভাবনাও যেন মনের মধ্যে ভেসে না ওঠে। 

৫. প্রতিদিন নিয়ম করে, প্রার্থনা করুন। প্রার্থনা করছেন, আর মনের মধ্যে সন্দেহের উদ্রেগ হচ্ছে, এমন প্রার্থনা না করে ভালো। সন্দেহবাতিক মন নিয়ে ভগবানের কাছে প্রার্থনা বন্ধা, কোনো ফল প্রসব করে না। আরো একটা কথা হচ্ছে একবার কি দুবার প্রার্থনা করলাম, আর সেই প্রার্থনায় কোনো কাজ হলো না এই ভেবে, প্রার্থনা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবেন না। শরণাগতি সাধকের প্রার্থনা হবে একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। যতক্ষন সমাধান না আসছে, যতক্ষন ভগবানের নির্দেশ উপলব্ধি হচ্ছে, ততক্ষন প্রার্থনা চালিয়ে যান। প্রার্থনার বাক্য গুলো একটা কাগজে লিখে রাখুন, সংগোপনে যত্ন করে রেখে দিন । না এটা আপনার জন্য নয়, এই প্রার্থনার সঙ্গে আপনার জীবন কিভাবে পাল্টে যাচ্ছে, তা বুঝবার জন্য এটি সংগ্রহ করে রাখুন। প্রার্থনা যেন  ভাসাভাসা না হয়।  একটা জিনিস জানবেন, আপনি যা চাইছেন তাই পাবেন। এইজন্য প্রার্থনায় কোনো ফাঁক  রাখতে নেই। আরো একটা কথা প্রার্থনা সম্পর্কে মনে রাখতে হবে, আর তা হচ্ছে জাগতিক বস্তুর জন্য প্রার্থনা নয়, এমনকি জীবনের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রার্থনা নয়। এই সমস্যা তো মিটে যাবে, প্রার্থনা যখন সফল হবে, তখন  ভগবানের আলোকস্পর্শ আপনার হৃদয়কে ছুঁয়ে যাবে। প্রার্থনা হবে, ভগবানের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেবার, প্রার্থনা হবে দেবার জন্য, নেবার জন্য নয়। আমার সবকিছু তোমার, আমার সমস্ত কর্ম্ম তোমার, আমার সমস্ত পাপ-পুন্য তোমার। আমি তোমার। 

৬. সবশেষে বলি, প্রার্থনার পরে কিছুক্ষন নীরবে অপেক্ষা করুন - ভগবানের নিঃশব্দ বাণী শুনবার জন্য। ভগবানের আদেশ /নির্দেশ শুনবার জন্য। প্রার্থনা  করুন নীরবে, নিভৃতে। এই হচ্ছে শরণাগতির সাধন-নীতি। 

এবার আরো একটা কথা  শুনে রাখুন, ভগবানের কাছ থেকে আপনি নির্দেশ পাবেন, ভগবানের করুনা আপনার উপরে বর্ষিত হবে, অবশ্য়ই - কিন্তু ভগবানের আবির্ভাব, চেনা-জানা পথে নাও হতে পারে। ভগবানের অবতরণের কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। এনার কোনো রূপ না, আবার সমস্ত রূপ-ই তাঁর রূপ। এমনকি আপনাকে পরীক্ষা কোরবার জন্য কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও তার সাক্ষাৎ পেতে পারেন । তো যে রূপেই তিনি আসুন না কেন, তাকে মেনে নিন। পরীক্ষা করতে যাবেন না।  নিজের মনে এতটুকু সন্দেহ থাকলে, আপনি  তার সাক্ষাৎ থেকে অবশ্যই  বঞ্চিত হবেন ।  আর সন্দেহের উর্দ্ধে উঠতে পারলে, ভগবানের সাক্ষাৎ কেউ ঠেকাতে পারবে না। এসব আত্মবিশ্বাসীর কথা, সফল সাধকের   কথা,  সেইসব মহাত্মাদের কথা, যারা ভগবানের সান্নিধ্যে জীবন কাটিয়েছেন। 

আমাদের মধ্যে একটা ধারণা  আছে, ভগবান শুধুই কল্যাণকারী কিন্তু ভগবান যেমন মঙ্গলকারী তেমনি ভগবানই ধংশকারী।  ভগবান যদি ধংশের অনুপ্রেরণা দানকারী না হতেন, তবে পৃথিবী পাপাচারে ভরে  উঠতো। পুণ্যের পুণ্যফল যেমন ভগবানের দেন, তেমনি পাপের নিস্পত্তিও তাঁকেই করতে হয়। তিনি নিজে সমস্ত গুনের উর্দ্ধে হলেও, তাঁরই ত্রিগুণের  প্রভাবে সমস্ত শুভ ও অশুভ কর্ম্ম সম্পাদন হচ্ছে। আপনার কাজ হচ্ছে, ভগবানে চিত্ত সমাহিত রেখে সামনের দিকে এগিয়ে চলা। সাহস করে অন্ধকারে পথ চললে দেখবেন, সামনের আলোর সূর্য্য উদয় হচ্ছে। চলার পথ দুর্গম থেকে সহজ হচ্ছে। ভগবান কি করবেন, তার বিচার করতে যাবেন না, ভগবান যা করছেন, তা মেনে নিন। তবে একটা জিনিস জানবেন, ভগবানের পথে যিনি চলা শুরু করবেন, তার জীবন পথ কণ্টকমুক্ত হতে শুরু করবে।  শুধু অগাধ বিশ্বাসকে পাথেয়  করে, সামনের দিকে এগিয়ে যান। চলার গতি যেন না থামে। একদিন হঠাৎ নজরে পড়বে মন্দিরের দরজা খুলে গেছে।  আর ভগবান তার স্নিদ্ধ জ্যোতি দিয়ে আপনাকে আপ্লুত করেছেন । আর সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। 

সাধনজগতে একটা সময় আসে, যখন মনে হয়, আমাদের সামনে সমস্ত দরজা বন্ধ। কিন্তু এই অবস্থাতেও আপনাকে সাধনক্রিয়ার বিরতি দেওয়া চলবে না, এক মুহূর্তের জন্য নয়। পিছন ফিরে তাকাবার দরকার নেই।  সামনে এগিয়ে চলুন। আপনার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনার আত্মসমর্পন আপনাকে একদিন ঈশ্বরের কাছে অবশ্যই  পৌঁছে দেবে। জগতের সমস্ত কিছু নিয়মের অধীন। এই নিয়মের পথ ধরেই আমাদের এগুতে হবে।  কিন্তু জানবেন, এইসব নিয়মের উর্দ্ধে অবস্থান করছেন ভগবান। তিনি নিয়মের নিয়ামক, তিনি নিয়মের দ্বারাই জগৎ সংসারকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছেন।  কিন্তু তারজন্য কোনো নিয়ম নেই।  তিনি সব নিয়মের উর্দ্ধে। 

একটা সময় দেখবেন, প্রকৃতির সমস্ত বৃত্তি শান্ত হয়ে গেছে। আর চেতনার উন্মেষ হতে শুরু  করেছে। কল্পনার সৌধ নয়, আলেয়ার পিছনে ছোটা  নয়, ভাবাবেগ নয়, ভগবান স্বয়ংসিদ্ধ আনন্দ রসে ভরপুর। আর আপনার মধ্যেও সেই আনন্দস্বরূপ ভগবানের জয়গান শুরু হবে।  আপনি তখন শান্ত, নির্ভিক সত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন। সংসার তখন এক আনন্দপুরী হয়ে আপনার সম্মুখে উপস্থিত হবে। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম।                 

 শরণাগতির সাধনা। তৃতীয় পর্ব্ব 

ননীগোপাল, ছোট বেলা থেকেই, যেন একটু বোকা বোকা। কথাও স্পষ্ট নয়, জড়িয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই সে গেরুয়া বা লাল কাপড় পড়তে ভালোবাসতো । আমরা ওকে তাচ্ছিল্য করতাম। সেই ননীগোপাল আজ গেরুয়া নয়, শুভ্র শ্বেত বস্ত্র পরিধান করে।  গলায় তুলসীর মালা। একাদিক অঙ্গে চন্দনের প্রলেপ। এখনো মুখে তার কথা বেঁধে যায়। কিন্তু তার কাছে আজ গীতার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম।  আপনাদের সঙ্গে আজ সেই  ননিগোপালের কথাগুলোই শুনবো। 

ননীগোপাল শুরু করলো :

ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সারথি করে রথে চেপে অর্জ্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে এসে গেছে। যুদ্ধ যখন আসন্নপ্রায়, সবাই  যখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত তখন চারিদিকে আত্মীয়-স্বজনের সমাগম দেখে অর্জ্জুনের দেহমন অবসন্ন হয়ে গেলো। ধনুর্বান ত্যাগ করে রথের  উপরে  হাত-পা ছেড়ে বসে পড়লো। (১/৪৬)  চারিদিকে আত্মীয়স্বজন, শ্বশুর, মামা, ভাই, বন্ধু এমনকি স্বয়ং গুরুদেব ও পিতামহ ভীষ্ম তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন। যুদ্ধে এই স্বজনদের মেরে কোন মঙ্গলটা হবে, তা অর্জ্জুন ভেবে বের করতে পারলো না। বললেন, হায়, রাজ্যলাভের আশায় আমি আমার প্রিয়জনদের মেরে ফেলবার জন্য  উদ্যোগী হয়েছি ? এদের মারলে তো মহাপাপ হবে।  আর যাদের নিয়ে আমি রাজসুখ ভোগ করবো, তাদেরকেই যদি হারাই  তবে কি হবে এই রাজসুখ দিয়ে। (১/৩১) এর চেয়ে, হয় আমাকে দুর্যোধনরা মেরে ফেলুক, নতুবা আমি ভিক্ষা করে খাবো, সেও ভালো, কিন্তু স্বজনদের মেরে আমি পাপের  ভাগী  হতে চাই না। (২/৪৫)

ভগবান বললেন, বাহ্ রে বাহ্ ! এতদিন লাফাচ্ছিলে যুদ্ধ যুদ্ধ করে, আর এখন যুদ্ধক্ষেত্রে এসে, মহাধার্ম্মিক হয়ে গেছো ? তুমি তো দেখছি পণ্ডিত হয়ে গেছো। সব জেনে গেছো। কিসে কি হয়, তা কি তুমি জান ? কে কাকে মারে ? জন্মক্ষণেই সবার মৃত্যুর দিন ঠিক হয়ে যায়। একজনকে মেরে আর-একজন বেঁচে থাকে। এই তো সংসারের নিয়ম। আর অবিনাশী আত্মার কখনো না আছে জন্ম, না আছে মৃত্যু। (২/১১)

অর্জ্জুন : আত্মা অবিনাশী হোক, আর যাই হোক, হত্যা তো মহাপাপ।  আর এইসব মহাত্মাদের অর্থাৎ গুরু দ্রোণ, পিতামহ ভীষ্ম, এমনকি আমারি জ্ঞাতি গোষ্ঠী, যাদের নিয়ে আমাদের জীবন সুখে দুঃখে একত্রে থাকি, তাদেরকে  মারলে কোনো পাপ হবে না ? 

ভগবান : তুমি ক্ষত্রিয়, তোমার কর্তব্য যুদ্ধ করা। তুমি না চাইলেও, তোমার স্বভাব তোমাকে যুদ্ধক্ষেত্রে টেনে নিয়ে যাবে। আর ক্ষত্রিয়ের জীবনই যুদ্ধ। 

অর্জ্জুন :  সে না হয়, মেনে নিলাম, আমি ক্ষত্রিয়।  তাই বলে লোক হত্যায় পাপ হয় না। রাজ্যের বাইরের আক্রমন থেকে রাজ্যকে রক্ষা করা, রাজ্যের প্রজাদের রক্ষা করা, ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম।  লোক-হত্যা ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম নয়। আর রাজ্যলাভের কামনায় গুরুজনদের বধ করা নিশ্চই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম হতে পারে না। ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম্ম কি ? লোকহত্যা না লোকরক্ষা ? আমি আর ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছি না। আমি দিশেহারা, আমি বিমূঢ়চিত্ত।  আমাদের সদুপদেশ দিয়ে সাহায্য করো।  যা আমার পক্ষে ভালো, তা তুমি নিশ্চিত করে বলো।(২/৭) 

ভগবান : দেখো, তুমি যদি নিতান্ত রাজ্যলাভের বাসনায় যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও, তবে অবশ্য়ই তোমার কর্ম্মফল ভোগ করতে হবে। কিন্তু যদি তুমি যোগস্থ হয়ে কর্ম্ম করতে পারো,যুদ্ধের কি ফল হবে, কি লাভ-লোকসান হবে, সেসব ভুলে গিয়ে কেবল কর্তব্যবোধে যুদ্ধ করো, তবে তোমার সেই কর্ম্মফলের ভাগিদার হতে হবে না। 

অর্জ্জুন : যোগস্থ হয়ে কর্ম্ম করা, ব্যাপারটা কি ? 

ভগবান : সমত্বই যোগ। (২/৪৮) জয়-পরাজয়কে সমভাবে নিতে পারলেই  তোমার কর্ম্ম, যোগে পরিণত হতে পারে। সাম্যবুদ্ধিযুক্ত হয়ে কর্ম্ম করাকেই বলে নিষ্কাম কর্ম্ম। নিষ্কাম কর্ম্মে পরমপদ লাভ হয়। (২/৫০) নিষ্কাম কৰ্ম্মীর কর্ম্ম বন্ধন  নেই। বিক্ষিপ্ত বুদ্ধি যখন পরমেশ্বরে সমাহিত হয়, তখন বিষয়ের প্রতি আসক্তি দূর হয়ে প্রজ্ঞা স্থির হয় - আর ঠিক তখনি কেউ যোগে সিদ্ধ হতে পারে। (২/৫১-৫৩) যিনি ইন্দ্রিয় সংযম করতে পেরেছেন, যিনি বিষয়বাসনা ত্যাগ করতে পেরেছেন, যার আত্মাভিমান ও মমত্ববুদ্ধির লোপ সাধন  হয়েছে, যিনি কেবলমাত্র ঈশ্বরচিন্তায় একনিষ্ঠ হয়েছে, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির ইন্দ্রিয়সংযম থাকার ফলে, সংযমী ইন্দ্রিয়সকল দ্বারা কর্ম্ম করেও সে কর্ম্মফলে আবদ্ধ   হন না। একেই বলে ব্রাহ্মীস্থিতি।   (২/৫৫-৭২)

অর্জ্জুন : দেখো তুমি স্থিতপ্রজ্ঞার কথা বললে, সাম্যবুদ্ধির  কথা বললে, এমনকি ব্রাহ্মীস্থিতির কথা যা বললে, এসব আসলে তত্ত্বজ্ঞানের কথা। যদি এই তত্ত্বজ্ঞান লাভেই  মোক্ষলাভ হয়, যা জীবনের উদ্দেশ্য  তবে আমাকে কর্ম্মে প্রযুক্ত হতে কেন বলছো ? আবার এমন কর্ম্মের কথা বলছো, যা আসলে যুদ্ধ, যার ফল ভয়াবহ মৃত্যু। মোক্ষই যদি জীবনের লক্ষ হয়, তবে  আমাকে কেন জ্ঞান সাধনা করতে বলছো না ? জ্ঞানেই তো মোক্ষলাভ হতে পারে। তুমি একদিকে জ্ঞানের উপদেশ দিচ্ছ, আবার ভয়াবহ যুদ্ধ কর্ম্মে উদ্দীপ্ত করছো। এসব মিশ্রবাক্যে আমি বিভ্রান্ত হচ্ছি, আমাকে সঠিক ও একটা পথের  কথা বোলো, যাতে আমার শ্রেয় হবে। 

ভগবান : দেখো মোক্ষ লাভের  দুটো পথ। কৰ্ম্মীর  জন্য কর্ম্মযোগ।  আর ব্রহ্মচর্য্য সন্ন্যাসব্রত পালনের পর জ্ঞানযোগ অবলম্বন করতে হয়। আমি তোমাকে কর্ম্মযোগ অবলম্বনের কথা বলছি, তার কারন হচ্ছে এই কর্ম্মযোগের ভিত্তি হচ্ছে সাম্য়বুদ্ধি অর্থাৎ সমস্ত কামনা-বাসনার ত্যাগ করে সমত্ব জ্ঞান লাভ। দেখো প্রকতির গুনে সমস্ত দেহধারীকে কর্ম্ম করতেই হয়।  তো কর্ম্ম যদি করতেই হয়, তবে এমনভাবে কর্ম্ম করো যাতে কর্ম্ম বন্ধনের  কারন না হয়ে মোক্ষের কারন হতে পারে। মোক্ষের জন্য অহঙ্কারকে ত্যাগ করতে হয়, কর্ম্মফল  ত্যাগ করতে হয়, কিন্তু কর্ম্ম ত্যাগ করতে হয় না। তো ইন্দ্রিয়সংযম করে সেই ইন্দ্রিয় দ্বারাই কর্ম্ম করে মোক্ষলাভ সম্ভব। তাই আমি কর্ম্মমার্গ  শ্রেষ্ঠ বলছি। এতে বিষয়কর্ম্ম যেমন করা হবে, তেমনি নির্লিপ্তভাবে বিষয়ভোগও করা যাবে। 

অর্জ্জুন : দেখো তুমি বলছো, ইন্দ্রিয়ের অধীন না হতে। কিন্তু ইন্দ্রিয়ের রাগ-দ্বেষ তো অবশ্যম্ভাবী। ইচ্ছে থাকলেও ইন্দ্রিয়কে বশীভূত করা যায় না । বরং বলা যেতে পরে, কেউ একজন জোরকরে ইন্দ্রিয়ের বশীভূত করে থাকে আমাদেরকে । কিন্তু  কার প্রেরণায়, আমরা ইন্দ্রিয়ের বশীভূত হয়ে থাকি  ? (৩/৩৬)

ভগবান : প্রকৃতির রজোগুণ থেকে উদ্ভব হয়, কাম-কামনা-বাসনা। দেখো খেয়ে তৃপ্তি, আবার অতিরিক্ত আহারে  অতৃপ্তি। কামনা বাসনার কখনো তৃপ্তি হয় না, এ এতটাই উগ্র যে জোকের মতো লেগে থাকে। কোনো বিষয়ে অনুরাগ, আবার কোনো বিষয়ে বীতরাগ, এ জায়গা থেকে  সরে এসে নিলিপ্ত ভাবে বিষয়ভোগ করো, আবার বিষয়কর্ম্মও করো। 

অর্জ্জুন :  কাম-বাসনা দুর্জয় শত্রু, এর থেকে নিস্তার পাবো কি করে ? 

ভগবান : দেখো, কাম-বাসনা প্রথমে মনকে আশ্রয় করে সুখের কল্পনা করে থাকে। এর পরে বুদ্ধিকে আশ্রয়  করে নিশ্চিত নির্নয়  করে, এর পরে ইন্দ্রিয়সকলেকে আশ্রয় করে রূপ-রস ইত্যাদির ভোগ করে থাকে। তো কাম-বাসনার আশ্রয় হচ্ছে মন বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়। সুতরাং ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধির উর্দ্ধে যে স্বতন্ত্র আত্মা আছে, সে সম্পর্কে সচেতন হলে বিষয়-বাসনার নিবৃত্তি হতে পারে। অতএব চিত্তকে  আত্মস্থিত করো। আসলে কাম-বাসনা হচ্ছে রিপুর উৎপাত। যিনি আমার অনন্য ভক্ত, তিনি আমাতে চিত্ত সমাহিত করে অবস্থান করে থাকেন। (২/৬১) এতে করে চিত্ত নির্ম্মল হয়, ইন্দ্রিয়সংযম হয়, বিষয়ে অনুরাগ দূরীভূত হয়। তো আমাতে আত্মসমর্পন করতে পারলেই ইন্দ্রিয়-বিষয়ে রাগ-দ্বেষ লোপ পেয়ে থাকে। 

অর্জ্জুন : তুমি চিত্তকে আত্মস্থিত করতে বলছো, এতো জ্ঞানযোগের কথা, আবার তোমাতে চিত্তকে নিবিষ্ট করতে বলছো। দেখো কেউ যদি তোমার ব্যক্ত রূপের উপাসনা করে, আর কেউ যদি অব্যক্ত অক্ষরের উপাসনা করে - এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ সাধনা কোনটি ? 

ভগবান : যাঁরা আমাতে নিত্য যুক্ত হয়ে আমাকে শ্রদ্ধা সহকারে আমার উপাসনা করে,তারাই শ্রেষ্ঠ সাধক। দেখো,  যাঁরা অব্যক্ত অক্ষরব্রহ্ম-এর উপাসনা করে, তাঁরাও আমাকেই প্রাপ্ত হয়ে থাকে। দুটোতেই ফল একই। কিন্তু দেহাভিমানী জীবের পক্ষে অব্যক্তের উপাসনা করা কঠিন। (১২/৫) তো দেহাত্মবোধে যারা সীমাবদ্ধ হয়ে আছে, তাদের সমস্ত কর্ম্ম যদি তারা আমাতে সমর্পন করে, আমাতেই চিত্ত একাগ্র করে, আমাতে ধ্যানরত হয়ে আমার উপাসনা করে, সেই ভক্তকে  আমি সংসার সাগর থেকে উদ্ধার করে থাকি।  (১২/৭) তুমি আমাতে মন স্থাপন করো, আমাতে বুদ্ধি নিবিষ্ট করো, তাহলে তুমি আমাতেই স্থিতি লাভ করবে। অব্যাক্তের  উপাসনা দুঃসাধ্য, ব্যাক্তের  উপাসনা সহজসাধ্য। অতএব তুমি আমার এই ব্যক্ত স্বরুপেই চিত্ত স্থির করো। 

অর্জ্জুন : চিত্ত স্থির করাতো সহজ সাধ্য নয়। মন বায়ুর মতো চঞ্চল, একে  একটা বিষয়ের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা খুবই দুঃসাধ্য। 

ভগবান : যদি আমাতে চিত্ত স্থির করতে একবারে না পারো, তবে বার বার চেষ্টা করে অর্থাৎ অভ্যাসযোগের সাহায্যে চিত্তকে  আমাতে  সমাহিত করো।  চিত্ত বিক্ষিপ্ত এ কথা সত্য, কিন্তু বিষয় থেকে মনের পরিভ্রমনকে  প্রত্যাহার করে মনের মধ্যে  বারবার আমার স্মরণ আনতে  থাকো। আর এতেও যদি অসমর্থ হও মৎ-পরায়ণ হও, যা কিছু করছো,তা আমার প্রীতিরজন্য করো। এতেও তুমি সিদ্ধিলাভ করবে। তোমার সমস্ত কর্ম্মগুলো আমার দিকে ফিরিয়ে দাও। আমাকে স্মরণ করে সমস্ত কর্ম্ম করো। এইভাবে কর্ম্ম করলে, তুমি আমার সাথে যুক্ত হতে পারবে। জানবে, এই আমিই  সর্ব্ব-ভূতের মধ্যেই অবস্থান করে থাকি। 

অর্জ্জুন : দেখো, সংসারের নানান কাজের মধ্যে যদি তোমাকে ভুলে যাই, তুমি যে সমস্ত কর্ম্মের উদ্দেশ্য তা যদি সব সময় মনে না থাকে, তাহলে কি করবো ? 

ভগবান : যদি সমস্ত কর্ম্ম আমাকে স্মরণ করে না করতে পারো, তবে যাকিছু কর্ম্ম করবে, তা সে আহারাদি হোক, পুজো অর্চ্চনা হোক, এমনকি লৌকিক যাকিছু করো, একবারটি মনে করবার চেষ্টা কারো না কেন, যে যাকিছু আমি করছি, তা তুমিই করাচ্ছো।  তোমার ইচ্ছেতেই সব কিছু হচ্ছে, আমি কিছুই জানি না, আমি কিছুই চাই না, তুমি করাও তাই আমি করি। আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী ।  এই ভাব নিয়ে যখন তুমি কর্ম্ম সম্পাদন করবে, তখন সমস্ত কৰ্ম্মই আমাতে সমর্পিত হবে। এই কর্ম্মাপণ  যোগকে আশ্রয় করে সংযতচিত্তে কর্ম্মফলের আশা ত্যাগ করতে পারলেই হবে। 

দেখো, সংসার কর্ম্মক্ষেত্ৰ, আবার  এই দেহ কর্ম্মদেহ। তো এই দেহে, এই সংসারে থাকতে গেলে কর্ম্ম তোমাকে  করতেই  হবে।  সাংসারিক কর্তব্যবোধে কর্ম্ম করে যাও, কিন্তু এই কথাটা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করো যে কর্ম্মে তোমার অধিকার, ফলে তোমার কোনো অধিকার নেই।  তো এইভাবে  ফলাকাঙ্খ্যা রোহিত  হয়ে কর্ম্ম করো, কিন্তু কর্ম্মত্যাগে যেন  তোমার প্রবৃত্তি না হয়। ধ্যান যোগ বলো, জ্ঞান  যোগ বলো আর অভ্যাস যোগ বলো সবচেয়ে সহজ ও শ্রেষ্ঠ হচ্ছে কর্ম্ম যোগ। 

শোনো  সমত্ব বুদ্ধি দ্বারা কর্ম্মফলের কামনা ত্যাগ করো, আর শান্তি লাভ করো। দ্বেষ ত্যাগ করো, সর্বভূতে দয়াবান হও, সবাইকে ভালোবাসো।  আবার মমত্ববুদ্ধিশূন্য হও, আমার-আমার ভাব ত্যাগ করো। অহংকার শূন্য হও।. সুখ-দুঃখকে সমান জ্ঞান করো। যা পেয়েছো তাতেই সন্তুষ্ট থাকো। ক্ষমাশীল হও।  আত্মস্থিত থাকো।  আমাতে মন-প্রাণ সমর্পণ করো। হর্ষ-ক্রোধ-ভয়-উদ্বেগশূন্য হও। (১২/১৫)

যিনি শুদ্ধ মনের অধিকারী, কর্তাব্য-কর্ম্মে  অনলস, যিনি পক্ষপাতশূন্য, যার মনের মধ্যে কোনো প্রত্যাশা নেই, যিনি  ফলের আশায় কোনো  কর্ম্ম করেন  না, তিনিই  প্রকৃত ভক্ত। যিনি কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করে না, তা সে শুভ হোক বা অশুভ । আবার কোনো কিছু লাভেও যার মধ্যে উৎফুল্লতা আসে না, কোনোকিছু না পেলেও যার মধ্যে দুঃখ হয় না, যিনি কোনো কিছুর আকাংখ্যা করেন না তিনিই প্রকৃত ভক্ত। 

যার মধ্যে শত্রু-মিত্রে, মান -অপমানে, শীত-উষ্ণে, সুখ-দুঃখে সমান জ্ঞান, যিনি সর্ব্ব বিষয়ে আসক্তি শূন্য, স্তুতি ও নিন্দাতে যিনি বিচলিত হন না. যিনি কথা কম বলেন, যা-পান তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, যিনি বিষয়াদিতে এমনকি স্বজনাদিতে মমত্ত্বশূন্য, যার চিত্ত স্থির, তিনিই প্রকৃত ভক্ত। যারা আমার প্রতি শ্রদ্ধাবান, যারা মৎপরায়ণ, যাকিছু করেন, আমাকে স্মরণ করে করেন। তিনিই আমার প্রকৃত ভক্ত। 

এইসব বলে ননীগোপাল সাধু বললেন, শুধু কৃষ্ণ কৃষ্ণ বললে, হা ঈশ্বর হা ঈশ্বর বলে চোখের জলে বুক ভাসালে ভক্ত হাওয়া যায় না।  ঈশ্বরকে অন্তরে রেখে, যিনি সমস্ত কর্ম্ম করেন, যিনি নিজেকে পবিত্র করতে পেরেছে, যিনি মনকে শুদ্ধ করতে পেরেছেন, যিনি চিত্তকে  সংযত করে পেরেছেন, যিনি সমদর্শী হতে পেরেছেন,যিনি শুধুই কৃষ্ণপ্রীতি হেতু, পরহিতার্থে কর্ম্ম করছেন তিনিই প্রকৃত ভক্ত। যার চিত্ত ঈশ্বরমুখী হতে পারেনি, সে ভক্ত নয়, পাষন্ড, বৃথা তার কৃষ্ণ নামজপ। এই বলে ননীগোপাল জোড়হস্তে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রণাম করলেন। আমি ননিগোপালকে প্রণাম করি যার  মন আর কৃষ্ণপ্রীতিতে অটল, যার মন শুদ্ধ পবিত্রসেই পরম ভক্ত।  

ওম নমঃ শ্রী ভাগবতে বাসুদেবায়। 

শরণাগতির  সাধনা চতুর্থ পর্ব্ব।