Tuesday 25 June 2019

সংস্কার রহস্যঃ


সংস্কার রহস্যঃ

আমরা সবাই সংস্কার বদ্ধ জীব। পূর্ব্ব জীবনের সংস্কার নিয়ে আমাদের এই জীবন শুরু করেছি। হাঁস জন্ম থেকেই সাঁতার কাটতে শুরু করে দেয়। গাভীবৎস জন্মের কিছক্ষন পরেই, হাটতে শুরু করে দেয়। এগুলো নাকি সবই তাদের  পূর্ব্ব জীবনের সংস্কার। মনুষ্য শিশু জন্ম থেকেই নাকি  মায়ের দুধ খোঁজে। কি অদ্ভুত। কিন্তু সংস্কার ব্যাপারটা কি ? কিভাবে এই সংস্কারের জন্ম হয় ? সংস্কার কিভাবে আমাদের প্রতি প্রভাব খাটায় ? সংস্কার কোথায় থাকে ? ইত্যাদি নানান প্রশ্ন নিয়ে আজ আমরা শুনবো। 
প্রথমে শুনবো সংস্কার কাকে বলে ? 
সংস্কার আর কিছুই নয়, সংস্কার হচ্ছে আমাদের স্মৃতি, বা আমাদের কর্ম্ম থেকে উদ্ভুত  অভিজ্ঞতার ছাপ, যা আমাদের মনে গেথে রয়েছে। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। ধরুন, আপনার জন্ম দিনে আপনাকে আপনার মা পায়েস খেতে দিলেন । আপনি খেলেন, মাকে প্রণাম করলেন, তার পরে কাজে বেরিয়ে গেলেন। অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সাময়িক ভাবে, এই  ঘটনার কথা ভুলেও  গেলেন। কিন্তু সত্যিই কি ভুলে গেলেন ? 

পরের বছর, জন্ম দিনে আপনি বদলি হয়ে বোম্বে চলে গেছেন। জন্ম দিন এলো, অফিসের সবাই আপনাকে মিষ্টি বা কেক খাওয়ালো। যখন এই ঘটনাটা  ঘটেছিলো, তখন আপনার মনে, মায়ের কথা মনে পড়ছিলো, পায়েসের কথা মনে পড়ছিলো। মায়ের মুখখানা মনে পড়ছিলো। আপনার মনে তখন এক বিশেষ ধরনের অনুভূতি বা তরঙ্গ বা বৃত্তি  উঠছিলো। কেন এমন হয় ?

আসলে, মায়ের পায়েস খাওয়ানো, আশীর্বাদ, ইত্যাদি যখন ঘটেছিলো তখন আপনার মনে এক ভালোলাগার অনুভূতি বা আপনার গ্রন্থি চক্রে এক তরঙ্গের সৃষ্টি করেছিল। এই তরঙ্গ উঠেছিল আপনার  চেতন স্তরে বা উর্দ্ধতন মস্তিষ্কে। এর পরে আপনি অন্য কাজে চলে যান। তখন অন্য চিন্তা আপনার আগের তরঙ্গকে চেতন স্তর  থেকে অবচেতন স্তরে বা নিম্নতর মস্তিষ্কে পাঠিয়ে দিয়েছে। এবং তখন  সেটা স্মৃতিতে পরিণত হয়ে গেল। পরে কোনো কারণে  পরবর্তী জন্মদিনে অর্থাৎ অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে স্মৃতির স্তর থেকে অর্থাৎ অবচেতন মনের স্তর থেকে চেতন মনের স্তরে উঠে এলো।

এই ধরনের অসংখ্য স্মৃতি বা সংস্কারে ভরা  আমাদের মন। এই সংস্কারের দুটো দিক একটা ভাবগত, আর একটি বস্তুগত। পায়েসের স্মৃতি বস্তুগত।  আর মায়ের সান্নিধ্য স্নেহ-আচরণ ভাবগত। 

সংস্কার কি ভাবে কাজ করে ? 
সংস্কার নিজে থেকে কোনো কাজ করতে পারে না। এর জন্য দরকার আমাদের ইচ্ছাশক্তি। ইচ্ছাশক্তি আবার কাজ করে, আমাদের ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। এই ভাবনার মধ্যে  একটা বিশেষ রূপ হচ্ছে বাসনা। দেশের বাড়ি যাচ্ছি। স্টেশনে নেবে হাটছি, হঠাৎ দেখি মাধবমামার মিষ্টির দোকান। এক সময় এখানে মিষ্টি দই আর রসোগোল্লা মিশিয়ে খেতাম। সেই স্মৃতি ভেসে উঠলো মনে, মাধবমামার দোকান দেখে, এই মুহূর্তে আমার চেতন স্তরে মাধবমামার দোকান, সেখানে তরঙ্গ উঠতেই, আমার অবচেতন স্তর থেকে, পুরোনো দিনের সেই স্মৃতি ভেসে উঠলো। এই হলো সংস্কারের ক্রিয়া। এখন আমি কি করবো ? যদি আমার ইচ্ছা প্রবল ইচ্ছা হয়, তবে আমি মাধব মামার দোকানে ঢুকতে পারি। দই-মিষ্টি খেতে পারি। এই যে তীব্র ইচ্ছা একেই বলে বাসনা। এখন আমার ইচ্ছাশক্তি যে দিকে ঝুঁকবে, অর্থাৎ যদি বাসনার দিকে ঝোকে, তবে আমি মামার দোকানে ঢুকবো। এইসময় কোনো কোনো সময় ঢুকে পড়ে বিবেক, বিবেক বলতে থাকে, এখন  মিষ্টি খাবার সময় নয়। এই বয়সে মিষ্টির প্রতি লোভ ভালো নয়। ...ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন আর আমি মিষ্টির দোকানে ঢুকবো না।  তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম, সংস্কার হচ্ছে পূর্ব্ব স্মৃতি।  আর বাসনা হচ্ছে, একটা শক্তি, যা আমাদের কর্মে, বা লক্ষ্যপূরণে  উদ্দীপ্ত করে। স্মৃতি অতীত অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত।  আর বাসনা বর্তমান উদ্যোগের জননী, যা আমার ভবিষ্যৎ গড়ে দেবে। অর্থাৎ আমাকে সুখ বা দুঃখ ভোগ করাবে। 

অভ্যাসের মাধ্যমে আমরা আমাদের সংস্কারকে বদলাতে পারি। যেমন খাওয়ার পরে, আমার একটু দুধ খাওয়া আমার অভ্যাস। এখন খাওয়ার পারে, যদি দুধ না পাই পেট ভরে গেলেও আমার মন  খুঁত খুঁত করে।  বা খাওয়ার পরে, একটা সিগারেট খাওয়া আমার অভ্যাস বা সংস্কার।  সিগারেট না খেতে পারলে, কেমন যেন একটা নাই নাই ভাব। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে, অর্থাৎ , যেখানে আমি দুধ পাই না। বা  আমি যখন পাহাড়ে যাই, সেখানে আমি দুধ পাই না, আবার আশ্রমে সিগারেট নিষিদ্ধ ।  সেখানে আমি মাসের পর মাস দুধ না পাবার জন্য, দুধ না খেয়েই থাকি। সিগারেটটাও বন্ধ থাকে।   তাতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু আবার যখন বাড়িতে আসি, আমি আবার দুধের ভক্ত হয়ে যাই। সিগারেট খেতে শুরু করি।  তাই অভ্যাস ও ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে, সংস্কার থেকে উদ্ভূত বাসনাকে যেমন বাড়ানো যায়, তেমন কমানো যায়। আশ্রমে বেশিরভাগ সময় শাস্ত্র আলোচনা, ধ্যানধারণা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। খাবার ব্যাপারটা তখন গৌণ। তা সে দুধ বলুন বা সিগারেট। তখন মনেই হয় না, যে এগুলো দরকার।  আসলে তখন আমার স্নায়ু তরঙ্গে অধ্যাত্ম্যিকতার ঢেউ, বা বলা যেতে পারে, ভালো সংস্কার, খারাপ সংস্কারকে চেপে রেখেছে। আর যদি ক্রমাগত এই অভ্যাস রপ্ত করা যায়, তবে ভালো সংস্কারগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে, আর খারাপ সংস্কারগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। 

ঠিক একই ভাবে আমরা বাসনাকেও দুর্বল করে দিতে পারি। বাসনার সঙ্গে সংস্কারের একটা সম্পর্ক আছে। বাসনা না জাগলে যেমন সংস্কার কোনো কাজ করতে পারে না, তেমনি আমাদের সংস্কার যতই ভালো বা খারাপ হোক না কেন, বাসনার গুনগত পরিবর্তনের  মাধ্যমে আমরা আমাদের  শুভ সংস্কার গড়ে তুলতে পারি।

সংস্কার কি ভাবে গড়ে ওঠে ?
আমাদের প্রত্যেকটি কাজ, তা সে আমি নিজে থেকেই করি, বা অন্যের নির্দেশে করি, সবই আমাদের মনে একটা ছাপ ফেলে। অর্থাৎ ছোটবেলা থেকেই আমাদের সংস্কার তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়। একটি শিশুর মা-বাবা যখন  তাকে শিক্ষা দীক্ষা দিয়ে বড়  করে তোলেন,  তখন তাকে ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পারিবারিক রীতি নীতি, পারিবারিক ধর্মীয় বিশ্বাস, দেশাচার, দেশের নীতি বা আইন ইত্যাদি সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করে দেন। এর পরে, যখন সে স্কুল কলেজে পড়াশুনা করতে গেল, সেখানেও সে কিছু জ্ঞান ও আদবকায়দা শিখলো। এগুলো তার মনে গভীর ছাপ তৈরী করে দিলো। এছাড়াও, তার নিজের বিচারবুদ্ধি, রুচি-অরুচি, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আশা-আকাঙ্খা এসবই তার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। এই ভাবেই একটা মানুষের ব্যক্তিত্ত্ব গড়ে ওঠে। একজন ব্যক্তি মানুষের দুটি সত্ত্বা।  একটা তার বিশ্বাস আর একটা তার অভ্যাস। আর এ দুটো জিনিসই তার কর্ম্মকে প্রভাবিত করে। তার খাদ্যাভ্যাস, তার ধর্মীয় বিশ্বাস, তার রাজনৈতিক বিশ্বাস বা মত, দেশাত্ত্ববোধ ইত্যাদির অধিকারী হয়ে,  সে পরিণত হয়  এক স্বতন্ত্র মানুষে।   আবার বিশেষ পেশায় যখন সে আসে, সেই পেশাও তাকে তার ব্যক্তিত্ত্ব গড়ে তুলতে প্রভাবিত করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে যেমন সংস্কার-আবদ্ধ মানুষে পরিণত হয়ে যায় তেমনি, সে একটা নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ হয়ে দাঁড়ায় । তখন, যা কিছু তার গোচরে আসে, তাকে সে তার পূর্ব্ব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বিচার করতে চায়। একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সে সব কিছুর বিচার করে। এইটাই বদ্ধ জীবের লক্ষণ। সব ঘটনাকে, সব মানুষকে সে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করতে আরম্ভ করে। এখন সে আর শিশুদের মতো প্রশ্ন করে না, জানতে চায় না, ঘটনার বিচার করতে শুরু করে দেয়। আসলে সে এখন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চায়।  জীবন সম্পর্কে সে তখন একটা নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি বেছে নিয়েছে। কোনটা প্রয়োজনীয়, আর কোনটা অপ্রোজনীয়, সেটা সে তার নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছে। এইভাবে সে তার অভ্যাস ও বিশ্বাসের আবর্তে বাধা পরে যায়। মন  তখন তার অভ্যাস আর বিশ্বাসে ভরে গেছে।  নতুন কিছু আর তাকে আকর্ষণ করে না। নতুন চিন্তা বা উদার চিন্তা উদার দৃষ্টিভঙ্গি তাকে আর আকর্ষণ করে না। এখন সে নিজেকে আমি বলে ভাবতে শুরু করেছে। এইযে আমি বা অহং, এগুলো সংস্কারের প্রভাব। আমি এবং আমার সংস্কার তখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাই আমরা যাকে  "আমি" বলি সেগুলো হচ্ছে আমাদের সংস্কার, আমাদের অভ্যাস, আমাদের বিশ্বাস, ইত্যাদির একটা মিশ্রণ মাত্র। আমরা যে চেতন সত্ত্বা তা আমরা একদম ভুলেই গেছি। 

এখন  আমরা আলোচনা করবো, সংস্কার কি ভাবে আমাদের এক জন্ম থেকে আর এক জন্মে প্রবাহিত হয়। সেখানে তো আমাদের নতুন দেহ তৈরি হয়।  নতুন মা-বাবা পাই। নতুন পরিবেশ পাই। তাহলে গত জন্মের সংস্কার আমাদের কি ভাবে প্রভাবিত করে ? 

এটা বুঝতে গেলে আমাদের এই পঞ্চভূতের দেহের বিনাশের পরে, কি হয় সেটা একটু সংক্ষেপে বুঝে নিতে হবে । আমাদের তিনটি দেহ।  স্থুল, সূক্ষ্ম, ও কারন।  স্থূল দেহ পঞ্চভূতের তৈরি। আমাদের দেহের মৃত্যুর পরে, এই দেহ, পঞ্চভূতে বিলীন  হয়ে যায়। বাকি থাকে সূক্ষ্ম দেহ ও কারন দেহ। সুক্ষ দেহ অর্থাৎ মানস দেহও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিলোপ প্রাপ্ত হয়। বাকি থাকে কারন দেহ। এই কারন দেহের বিলোপ হয় না।   এই কারন দেহই সংস্কারের মূল আধার। অর্থাৎ আমাদের কর্ম্ম অভিজ্ঞতা স্থূল দেহ থেকে  সূক্ষ্ম দেহে এবং সূক্ষ্ম  দেহ থেকে কারন দেহে স্থানান্তরিত হয়। বার বার জীবের জন্ম গ্রহণের ফলে, জীবের যত অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছিল, পুনর্জন্মের সময় এই কারন দেহ তা সঙ্গে করে নিয়ে আসে। মানসলোকে এসে জীব নতুন মানসদেহ ধারণ করে। সুতরাং আগের মানসদেহে  যেসব  অভিজ্ঞতা বা সংস্কার সঞ্চিত ছিল নতুন মানসদেহে সে সব কিছুই থাকে না। অর্থাৎ নতুন  মানস দেহে পূর্ব্ব স্মৃতি কিছুই থাকে না। এই মানসদেহ সম্পূর্ণ নতুন উপকরণে তৈরি। কিন্তু কারন দেহ চিরস্থায়ী। সেখানে সকল স্মৃতি সঞ্চিত থাকে। জীব যখন নতুন দেহ ধারণ করে,তখন সেই একই কারন দেহ বর্তমান থাকলেও মানস দেহ ও স্থূলদেহ নতুন হওয়ায়  এবং জীবের জ্ঞান স্থুলে নিবদ্ধ হওয়ায়, অতি সূক্ষ্ম কারনদেহের স্পন্দন তার মস্তিষ্কে কোনো ক্রিয়া উৎপন্ন করতে পারে না। সেজন্য তার মনে কোনো পুরোনো স্মৃতি উদয় হতে পারে না। 

কিন্তু যে সব সংস্কার আমরা আমাদের কারন দেহের  সঙ্গে করে এই জগতে নিয়ে এসেছি, সেগুলো আমাদের অজ্ঞাতসারে অনুভব করে থাকি। অনেক সময়, আমাদের পূর্বজন্মের বাঞ্ছিত  বস্তুর কথা আমাদের  স্মরণে আসে। আবার বিশেষ গুনের স্বল্প স্বাধ্যায়ে সংস্কারের সাহায্যে সেই গুনের উন্মোচন ঘটে অত্যধিক মাত্রায়। এগুলো সবই আগের জীবনের কর্ম-অভিজ্ঞতার  জন্যই হয়ে থাকে।  ধ্যান সাধনার সাহায্যে যে সব মহাত্মা, এই সুক্ষ ও কারন দেহের উপস্থিতি অনুভব করেন, তারা তাদের পূর্ব জীবনের কথা জানতে ও বলতে পারেন। যেমন জানতেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান বুদ্ধ ইত্যাদি মহাপুরুষেরা।  

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ - হরি ওম  















   




















       

  
























  





























       

Sunday 23 June 2019

সাধন - আমরা কেন পুতুল পুজো করি ?

সাধন - পথ সাকার না নিরাকার ? আমরা কেন পুতুল পুজো করি ?

 গীতায় দেবকীনন্দন শ্রীকৃষ্ণ তিন/চারটি ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।   গীতার প্রারম্ভে তিনি অর্জুনের সখা। তারপরে গুরু, তারপরে স্বয়ং ভগবান। প্রথম ও শেষ অবধি  তিনি ছিলেন, সারথি। মহামুনি ব্যাসদেব অর্জুনের মুখ দিয়ে নানান সন্দেহ, প্রশ্ন, ছুড়ে দিয়েছেন, শ্রীকৃষ্ণের কাছে। যে সব প্রশ্ন আমাদের সবার, এবং সর্বকালের। এইরকম একটি অসাধারন প্রশ্ন করছেন অর্জুন । বলছেন :   

যে ভক্ত তোমাতে সততযুক্ত হয়ে তোমার (রূপের) উপাসনা করে, আর যারা তোমার অব্যক্ত অক্ষর রূপের সাধনা করে, তাদের মধ্যে শ্রেষ্ট যোগবিদ কে ? অর্থাৎ সাকারের উপাসনা ভালো না নিরাকারের উপাসনা ভালো ? আর এই প্রশ্নটি করেছেন তখন, যখন অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ বিশ্বরূপ দেখানো হয়ে গেছে।  

ভগবান তার উত্তরে বলছেন :
যারা আমাতে মন নিবিষ্ট করে, আমাতে নীতিযুক্ত হয়ে আমার উপাসনা করে, আমার মতে  তারাই শ্রেষ্ট। অর্থাৎ সাকারের উপাসনা ভালো। এবং সেটা একমাত্র আমার, অর্থাৎ পরম-পিতার পরম-ঈশ্বরের।  

শ্রীকৃষ্ণ গীতার প্রারম্ভে বলেছেন ঈশ্বর  অব্যক্ত। এই অব্যক্ত ঈশ্বরের কথা পুরাতন ব্রহ্মবিদগণও,  বলে গেছেন।  বেশিরভাগ বিশ্ববাসী বলেন, ঈশ্বর নিরাকার, নিরালম্ব, নির্বিকার, অব্যক্ত ।   তো যারা অব্যক্ত পরম-ঈশ্বরের সাধনা করছে, তাদের থেকে মনুষ্যরূপী শ্রীকৃষ্ণের সাধনা করা, কি করে শ্রেষ্ট হয়। এবং আমরা এও দেখতে পাই, সারা ভারতবর্ষে, এমনকি ভারতবর্ষের বাইরেও মূর্তিপূজার প্রচলন আছে। 

আমরা আজ এই প্রশ্ন-উত্তরের আলোচনায় যাবো।  
ভগবান যে জবাব দিয়েছেন -  অর্থাৎ যারা আমাতে মন নিবিষ্ট করে, আমাতে নীতিযুক্ত হয়ে আমার উপাসনা করে, আমার মতে  তারাই শ্রেষ্ট।
এই কথাটার দুটো অর্থ হতে পারে। প্রথমতঃ - পরম-ঈশ্বর নিরাকার। মানুষ ভগবানেরই অংশ বিশেষ। মানুষই ভগবানের শ্রেষ্ট সৃষ্টি। তো মানুষ যদি মানুষের প্রতি মনোনিবেশ করে, তার সেবা যত্ন করে , মানুষের উন্নতির জন্য চেষ্টা করে তবে সত্যিকারের ঈশ্বরের আরাধনা করাই হবে। আর একটা কথা হচ্ছে, আমাতে মন নিবিষ্ট করো।  অর্থাৎ যে কেউ যদি নিজের মধ্যে অর্থাৎ স্বয়ং-দিকে আত্ম জ্ঞান লাভের চেষ্টা করে, তবে সে জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পাবে।

অন্য একটা দিক হচ্ছে   
আমরা জানি  সাধন পদ্ধতি দুই প্রকার - দ্বৈতবাদ আর অদ্বৈতবাদ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই দ্বৈতবাদের আবিস্কারক। শ্রীকৃষ্ণ একদিকে বলছেন ঈশ্বর অব্যক্ত, আবার বলছেন : যারা আমাতে মন নিবিষ্ট করে,আমাতে নিত্যযুক্ত হয়ে ঐকান্তিক ভক্তি সহকারে আমার উপাসনা করে, তারাই শ্রেষ্ট। এখন কেন  শ্রেষ্ট ? প্রশ্ন এখানেই। একজন জ্ঞানী, যিনি নিরাকার ব্রহ্মের  সাধনা করেন, আর এক জন  ভক্ত যিনি আকারের সাধনা করেন, এর মধ্যে শ্রেষ্ট কে ?  

অষ্টাবক্র তার সংহিতায় ব্রহ্মজ্ঞানী সম্পর্কে এক জায়গায় বলছেন :

নির্বাসন নিরালম্বঃ স্বচ্ছন্দো মুক্তবন্ধনঃ। 
ক্ষিপ্তঃ সংস্কারবাতেন চেষ্টতে শুস্কপর্নবৎ।।

অর্থাৎ বাসনারহীত, কর্তব্যবুদ্ধিবিহীন, রাগদ্বেষের অনধীন বন্ধনহেতু অজ্ঞানশূন্য জ্ঞানী প্রারবদ্ধকর্মরুপ বায়ুদ্বারা প্রেরিত হয়ে পবন-সঞ্চালিত শুস্কপত্রের ন্যায় কর্ম প্রচেষ্টা করে থাকেন। 

তাহলে ভাবুন তো এই ব্রহ্মজ্ঞানী কেমন আছেন। ব্রহ্মবিদ তো জড়বৎ। তার না আছে দুঃখ না আছে আনন্দ।  না আছে কর্তব্যকর্ম। না আছে দ্বেষ, না আছে রাগ, না আছে মমতা, না আছে স্নেহ।  উনি কাঁদেন না, হাসেন না।  অথবা ওনার হাঁসা-কাঁদার সাধারণ মানুষ কি বোঝে ? ওনার থাকা না থাকা সমান। উনি স্ব -স্বরূপে স্থিত। 

তাহলে ব্রহ্মজ্ঞানী হতে সময় লাগে, আর তার পরে যা হয় তা আর  কোনো কম্মে লাগে না। তাহলে অদ্বৈতপথে এই ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে কি লাভ ? যার দেহ জ্ঞান থাকে না। 

এবার  আমরা সাকার সাধনা আর নিরাকার সাধনার পার্থক্যটা একবার আমরা বুঝে নেই। 

ঈশ্বর নিরাকার, নির্গুণ, অব্যক্ত, অব্যয়, সর্বত্র। 

ঈশ্বরকে কি দেখা যায় ? কিভাবে দেখা যায় ? ঈশ্বর কি আকার নেয় ?

ঈশ্বরকে অবশ্যিই দেখা যায়। কিভাবে ঈশ্বরকে দেখা যায় না,  সেটা আগে ভাবুন।  তবেই ঈশ্বরকে দেখতে পারবেন। ঈশ্বরকে না দেখার কোনো উপায় নেই। বরং ঈশ্বরকে দেখতে না পারাটাই আশ্চর্য্য। ঈশ্বর অবশ্যই  আকার নেন।  আপনি যেমন তাকে দেখতে চান, তেমন ভাবেই তিনি আপনাকে দেখা দেবেন। আপনি দেখছেন কিনতু সনাক্ত করতে পারছেন না।  তাই ভাবছেন আমি দেখতে পারছি না। আসলে ঈশ্বর আপনি, আপনার ভিতর, বাহির, সর্বত্র যা কিছু দেখছেন সবই ঈশ্বর। তবে আমি দেখছি না, এটা কত বড়ো ভুল, বুঝতে পারছেন ? ঈশ্বর-সমুদ্রের মধ্যে বুদ্-বুদ্ আমরা ।  এখানেই জন্ম, এখানেই লয়। মানুষের শরীরের  মধ্যে যেমন অসংখ্য কোষ, আমরাও  তেমনি ঈশ্বরের বিরাট শরীরের কোষ মাত্র।  ঈশ্বরের শরীরেই জন্ম, ঈশ্বরের শরীরেই মৃত্যু। যতদিন বাঁচি, ঈশ্বর থেকেই খাদ্য সংগ্রহ করি, বা ঈশ্বরই  খাদ্য যোগায়। এক সময় ঈশ্বরেই লয়  প্রাপ্ত হই, আমরা সবাই । আমি বা অহং বলে কিছু নেই।  এগুলো  আসলে মন-বুদ্ধির খেলা। মন বুদ্ধির ওপারে আমি বলে কিছু থাকে না।

নিরাকারই সাকার হয়।  আবার সাকার থেকে নিরাকার। জলের তিন রকম অবস্থা। বায়বীয়, তরল, কঠিন। তাপমাত্রার তারতম্যে এই প্রকারভেদ।  বায়বীয় জল সর্বত্র। তরল জল নদী, নালা, পুকুরে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পৃথিবীর মধ্যেও পাওয়া যায়। কঠিন জল আমরা বরফের আকারে দেখতে পাই। বায়বীয় জল আমাদের ভোগ্য বস্তু নয়। কঠিন জলের আইচক্রীম খাই, তরল জলে তৃষ্ণা মেটাই। বায়বীয়  জলে আমাদের তৃষ্ণা মেটায় না।  বাহ্যিক কোনো কাজ বায়বীয় জলে আমাদের হয় না। অর্থাৎ নিরাকারে আমরা আনন্দ পাই না। কোনো কাজে লাগে না। তৃষ্ণা পেলে, হা করে থাকলে বায়বীয় জল, আপনার তৃষ্ণা মেটাবে না  ? তাহলে বায়বীয় জল সত্য কিনতু আনন্দ দেয় না। তাই ঈশ্বর সাধনায় যদি আনন্দ পেতে চান তবে সাকারের সাধনা করুন। 

নিরাকারের শক্তি সাকারের মধ্যেই প্রকাশ পায়। আকাশের একটা গুন্ - শব্দ, বাতাসের দুটো গুন্  - শব্দ, স্পর্শ। আগুনের তিনটি গুন্ শব্দ, স্পর্শ, রূপ। জলের চারটি  গুন্ -শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস।  মাটির পাঁচটা  গুন্ - শব্দ, স্পর্শ, রূপ,রস, গন্ধ।  তাহলে দেখতে পাচ্ছেন, নিরাকার থেকে সাকারের দিকে যত  যাচ্ছে তত তার গুন্ বেড়ে যাচ্ছে। এবং আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো এই গুন্ গুলো থেকেই জ্ঞান সংগ্রহ করছে। কান দিয়ে আমরা শব্দ  শুনছি। চোখ দিয়ে আমরা রূপ দেখছি। নাক দিয়ে আমরা গন্ধ শুঁকছি। মুখ দিয়ে আমরা রসের আস্বাদন করছি। ত্বক দিয়ে আমরা স্পর্শ করছি। এ সবই  আমাদের সুখ ও দুঃখের আস্বাদন করাচ্ছে। এ থেকেই আমরা সুখ দুঃখের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছি আমাদের অজ্ঞাতসারে। দৈহিক সুখ দুঃখের কারন এই ইন্দ্রিয়গুলো। 

আপনি আগুন চান। আগুন পেতে গেলে আপনাকে একটা মাধ্যম করতে হবে। আগুন সবত্র আছে। কিনতু  কাঠি/কাঠ  চাই। আর চাই বারুদ।  এই বারুদ দেন সৎ-গুরুদেব।  মাধ্যম ছাড়া আগুনের প্রকাশ হয় না। তেমনি  ঈশ্বরের  প্রকাশ যদি দেখতে চান তবে মাধ্যমকে আশ্রয় করুন। আর নিজেকে তৈরি করুন। অপেক্ষা করুন আকুলতা নিয়ে।

আপনার আগে পিছনে সর্বত্র, গান ভেসে বেড়াচ্ছে। নাচের ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। কিনতু আপনার যদি এক্সপোজার অর্থাৎ টিভি থাকে তাতে যদি ইলেকট্রিসিটি থাকে, সুইচটা অন করে দিন আপনি সব দেখতে পাবেন। এক্সপোজারের, অর্থাৎ টি.ভি.র  মধ্যে কিনতু  কিছু নেই। ওটা ভেঙে ফেললেও ভিতরে ছবি পাবেন না. গান পাবেন না। গান আছে সর্বত্র,ছবি আছে সর্বত্র। আপনার এন্টেনা ঠিক করুন, নিজেকে যোগ্য করুন, ব্যাকুল হন, নিরন্তর তৎগতপ্রাণ হন , তবেই তাকে দেখতে পারবেন এই টি.ভি.র মধ্যে । 

আপনি  ফল খেতে চান ?  ফলের স্বাদ আপনি কান্ডে  পাবেন না। বীজ তো বিস্বাদ। ভক্তিবাদীরা ফল খায়। নিরাকারবাদীরা মাটির মধ্যে উৎস খোঁজে, মাটির মধ্যে  স্বাদ খোঁজে। আপনি কোনটা  চান ?


একটা ঘটনা বলি।  শিরডির সাঁইবাবা - নাম শুনেছেন নিশ্চই।  তো  তাকে এক ভদ্রলোক দুপুরে খাবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছেন।  খাবারের সমস্ত  আয়োজন সম্পূর্ণ।  ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন। এই বুঝি বাবা আসে। বাবা আর আসছেন না।   দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। বাবা আর আসেন না। সন্ধ্যে হয়ে গেল।  বাবা আর আসেন না। একটা কুকুর ঘুর ঘুর করছে। ভদ্রলোক  খাবার রেখে উঠতে পারছেন না। কুকুরটাকে যতই তাড়ানো হচ্ছে,  কুকুরটা একটু দূরে গিয়ে অপেক্ষা করছে।    ভদ্রলোক, লোক পাঠালেন, বাবার কাছে। বাবা বললেন - আমিতো গেছিলাম রে। কিন্তু তোর  মনিব তো লাঠি দিয়ে তারা করলো। লোকটি বললো - সে কি বাবা কখন গেছিলেন ? আমার বাবু তো সারাক্ষন আপনার অপেক্ষায় বসে আছেন।  বাবা বললেন - তোর  বাবুতো  লাঠি নিয়ে বসে আছে।  আমি যাই কি করে ? খাই-ই  বা কি করে ? 

ভগবানকে না চিনলে এই হয় দশা। ভগবান এসে বসে থাকেন ।  আর আমরা  লাঠি নিয়ে বসে থাকি। ভগবান আসতে  চান , আমরা তাকে তাড়াতে চাই। যারা জীবের মধ্যে ঈশ্বর দেখতে পান না, তারা ঈশ্বরকে চেনেন না।

অতএব  শ্রীকৃষ্ণ বলছেন : আমার মতে  তারাই শ্রেষ্ট যারা ভক্তি সহকারে আমার রূপের অর্থাৎ সমগ্র জীব জগতের  উপাসনা করে। ভক্তিবাদেই আনন্দ, জ্ঞানী নিরস।

ধ্যানে সাধকেরা তার ইষ্ট  বা গুরুদেবের প্রতিচ্ছবি কল্পনা করে ধ্যান করেন। তখন গুরুদেবকে বা তার ইষ্টকে জ্যান্ত বলে  মনে হয়। তখন সেই ইষ্টদেবতার সঙ্গে বা গুরুদেবের সঙ্গে কথা বলা যায়। এবং সাধকরা  কথা বলেন ।  সেই প্রতিচ্ছবিও কথা বলে। আপনারা নিশ্চয় শুনেছেন আমাদের আজ্ঞা চক্র বা তৃতীয় নয়ন বলে একটা কথা আছে। এটি একটি শক্তিশালী বার্তা প্রেরণ কেন্ত্র।এই বার্তা প্রেরণ কেন্দ্রে নিজের মনকে স্থির করে  আপনি যদি কাউকে আদেশ বা নির্দেশ দেন, তবে সে তা পালন করতে বাধ্য হবে।  এটি একটি অসাধারন গতিশীল শক্তি। কোনো ব্যক্তির ছবি, বা প্রতিমাকে মনের মধ্যে রেখে, তার ক্ষুদ্র প্রতিমাকে ধ্যানে নিয়ে আজ্ঞা চক্র থেকে যদি  মাটির মূর্তির উপরে, বা ছবির  উপরে নিবিষ্ট করা যায় তবে সেই মাটির মূর্তি আর সাধারণ থাকে না। সেটা আপনার আজ্ঞা দ্বারা সঞ্চারিত চলমান শক্তিতে পরিণত হয়ে যায়। তখন আপনি যা স্নরন করবেন, সেটা গতিশীল হয়ে যাবে। মূর্তিপূজা এই প্রক্রিয়ার গভীর প্রয়োগ ।   ঈশ্বর তো বিরাট। আর এই সর্বত্র বিরাজমান  বিরাটের কাছে  পৌঁছেতে আমরা মূর্তির মাধ্যমে যেতে পারি। একটা কথা আছে, যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে এই ভান্ডে অর্থাৎ মানব শরীরে।  । আপনার মস্তিস্ক আর পরমাত্মার মস্তিষ্কের সঙ্গে একটা সম্পর্ক আছে। এই দুই সন্মন্ধকে যুক্ত করার জন্য একটা সেতু চাই। এই সেতু নির্মিত হতে পারে মূর্তি দিয়ে। কেননা আপনি নিরাকার কিছুর সঙ্গে সোজাসুজি সম্পর্ক স্থাপিত করতে পারবেন না। আপনি আকারে বর্তমান।  নিরাকার সম্পর্কে তো আপনার কিছু জানা  নেই। তাই যে যাই বলুক না কেন পরমাত্মা নিরাকার, অপ্রকাশিত।  সেটা শুধু শুধু কথার কথা হয়ে যাবে আপনার কাছে। আপনার অনুভবের মধ্যে কিন্তু আসবে না। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের মস্তিষ্কের  মধ্যে যত  অনুভব আছে, সেগুলোর সবই  আকৃতির অনুভব। রূপের অনুভব। আমাদের কারুর মধ্যে নিরাকারের একটাও অনুভব নেই। কারুর কথা ভাবা মানে তার রূপের কথা ভাবা । অবয়বের কথা ভাবা । তার সূক্ষ্ম গুনের কথাতেও আমরা তার রূপ কল্পনা করি। আর যার সন্মন্ধে কোনো ধারণা নেই তার সম্পর্কে কোনো শব্দ আপনাকে তার স্মরণ করাতে পারবে না। তাই আপনি নিরাকারের কথা বলতে থাকবেন আর সাকারের মধ্যে বাস করবেন। যদি সত্যি সত্যি আপনি নিরাকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চান তবে আপনাকে এমন একটি মূর্তি নির্মাণ করতে হবে যার একদিকে সাকার আর এক দিকে নিরাকার। একটু ভাবুন, আমরা যেখানে রয়েছি, সেখানে তার সীমা  প্রকাশিত। আর অন্যদিকে পরমাত্মা যেখানে আছেন সেটা সীমাহীন অপ্রকাশিত। তাই মূর্তিকে দুটো কাজ করতে হবে আমরা যেখানে সেখানে সে প্রকাশিত হবে, আর পরমাত্মা যেখানে আছেন সেখানে নিরাকারের মধ্যে হারিয়ে যাবেন। 

একটা কথা শুনুন যে ব্যক্তি পূজা করে, সে ওই মাটির মূর্তিকে পূজা  করে না। সে ওই ছবিকে পূজা করে না। সে পূজা করে ওই ছবির  মধ্যে তার পিতাকে, মাতাকে, গুরুকে, দেবতাকে,  ইষ্টকে,  পরমাত্মাকে।  মূর্তির কখনো পূজা হয় না। মূর্তির মধ্যে আমি যাকে  দেখতে চাই তার পূজা করা হয়। আর যার কাছে মূর্তি দৃশ্যমান, সে কখনো পূজা শেখেনি, সে পূজা করে না। তার পূজা সম্পর্কে  কোনো ধারণাই  নেই। পূজা আর মূর্তি দুটো আলাদা কথা।মূর্তি মাধ্যম মাত্র।  পূজা মূর্তির হয় না, পূজা হয় ভাবনার। যে পূজা করে, সে কখনো মূর্তি দেখতে পায়  না।আর  যে মূর্তি দেখতে পায়, সে কখনো পূজা  করে না। পূজা মূর্তিকে মুছে ফেলার কৌশল। আমরা তো আকৃতি সম্পন্ন, সেই আকৃতিকে মুছে ফেলার কৌশলই পূজা। দেহাতীত হয়ে যাওয়াই পূজা।  পূজায় দৃশ্যমান আকৃতি, আকৃতিবিহীন হয়ে যায়। তবেই পূজা সম্পন্ন হয়। প্রকাশিত অংশে পূজা আরম্ভ হয়, অপ্রকাশিতে পূজা সম্পন্ন হয়। পূজা সাধককে গ্রাস করে নেয়। যারা পূজা করেনি তারা ভাবেন  পাথর রেখে কি হবে ? আর যারা পূজা করেছেন  তাদের পাথর হারিয়ে যায়, সীমা হারিয়ে যায়, অসীমে প্রবেশ করেন  আর তখন পরমাত্মা  প্রকট হয়ে যান ।
ভগবান শ্রীচৈতন্য যখন দুহাত তুলে কৃষ্ণনাম করেন , মিরাদেবী  যখন পূজার ছলে  নাচ করেন , মতুয়ারা যখন হরিবোল হরিবোল করেন, বাউলরা যখন নেচে নেচে গানের মধ্যে ডুবে যান,   তখন তারা নিজেরা পূজার মধ্যে বিলীন হয়ে যান ।  এদের জন্য সেখানে কোনো মূর্তির অস্তিত্ব থাকে না। পূজা শুরু হলে মূর্তি বিলীন হয়ে যায়।  মূর্তি তো প্রারম্ভ মাত্র।  আমরা যারা পূজার কিছু বুঝি না, তারা মূর্তি দেখতে পাই। তাই আমার মনে হয় - সত্যিকারের  পূজা শুরু হলে মূর্তি অন্তর্হিত হবে।

মূর্তি তো পরমাত্মাকে দেখবার জানলা মাত্র। আমি দেহের মধ্যে থেকে পরমাত্মাকে দেখতে চাই।  আমার তো দেহ আছে।  অর্থাৎ আমি আকৃতি সম্পন্ন। তো জালনাও তো আকৃতি সম্পন্ন হবে , কিন্তু জানলা খুলে যখন আকাশের দিকে তাকাবো তখন নিরাকারের মধ্যে প্রবেশ করবো। এই দেহের মধ্যে জানলা আছে, সেটাকে খুলতে হবে। আকাশকে দেখতে হবে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে জানলা ছোট্ট।  কিন্তু আকাশ তো বড়ো। কিন্তু ছোট্ট জানলা দিয়েইতো বড়ো আকাশকে দেখা যায়। এটা বোঝানো কঠিন কিন্তু সত্যি। যে জানলা কখনো খোলেনি, যুক্তি দিয়ে তাকে বোঝানো কঠিন হবে যে বৃহৎ আকাশকে, আয়তনে ছোট্ট জানলা দিয়েও দেখা যায়। মূর্তি পূজা এই জানলা খোলার প্রক্রিয়া। আপনি মন্দিরের কাছে যেতে পারেন। মূর্তির কাছে যেতে পারেন।  কিন্তু পূজার কাছে যেতে পারেন না।  কতকগুলো বিষয় আছে যার অভিব্যক্তি সম্ভব নয়। এগুলো অন্তরের ব্যাপার। আন্তরিক বস্তু প্রদর্শন সম্ভব নয়।

সাকার নিরাকার দুটি পৃথক নয়। একটি অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। যাকে  আমরা সাকার বলি সেটা নিরাকারের অংশ।  আবার যাকে  আমরা নিরাকার বলি সেটিও সাকারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আমরা সাকারে আছি। আমার দেহ সাকার। আমরা সম্পর্ক গড়ি সাকারের সঙ্গে। এই সত্য তো অস্বীকার করলে চলবে না যে আমরা সাকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। আর আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমাদের সেখান থেকেই যাত্রা  শুরু করতে হবে। যেখানে আমাদের যাওয়া  উচিত, সেখান থেকে যাত্রা শুরু করা যায় না। যেখানে আছি সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে হয়। যেখানে আমরা নেই সেখান থেকে যাত্রা শুরু করা যায় না। আমরা যা কিছু জেনেছি আকারের মধ্যেই জেনেছি। আমরা প্রেম করেছি - আকারে। আমরা রাগ করেছি আকারে।  আমরা ঘৃণা করেছি আকারে। আসক্ত হয়েছি তাও আকারে। বন্ধুত্ব করেছি আকারে।  শত্রূতা করেছি তাও আকারে। ঈশ্বরের নিরাকারত্ব যেমন সত্য। আমাদের আকারত্ব তেমনি সত্য। আমাদের মন যখন কিছু ধরে রাখে সেটা আকারেই ধরে রাখে।

তাই শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ বা কথা  যখন আমরা স্মরণ করি, তার গুনের কথা যখন আমরা স্মরণ করি, তখন তার আকারের কথাই আমাদের চোখে ভাসে। আর এই জন্য নিরাকারের দিকে যদি যাত্রার জন্য  আমাদের বেরোতে হয়, তবে আমাদের নিরাকারের জন্য আকার সৃষ্টি করতে হবে।এই আকারটা যদি শ্রীকৃষ্ণের হয়, গুরুদেবের হয় বা অন্য্ কারুর হয়,  যা আমাদের কাছে দৃষ্টিনন্দন, তবে আমাদের সাধনপথ সহজ হবে।

তাই সাধারণের জন্য, নিরাকারের চেয়ে আকারের সাধনা সহজ ও সঠিক।                      




Saturday 15 June 2019

প্রান-রহস্যঃ


প্রান-রহস্যঃ

ওঁ আপ্য়ায়ন্তু মম অঙ্গানি বাক প্রাণঃ চক্ষুঃ শ্রোত্রম অথোবলম ইন্দ্রিয়ানি চ সর্বানি। 

হে পরম-ঈশ্বর আমার সর্ব্ব অঙ্গ যেন পুষ্ট হয়। আমার প্রাণবায়ু, বাকশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো যেন শক্তিশালী হয়। 
ওঁ শান্তি শান্তি শান্তিঃ ।।
  
জীবন হচ্ছে  শ্বাসের খেলা। শ্বাসের শুরুতে প্রাণের শুরু, শ্বাসের  শেষে প্রাণের শেষ। চৈতন্য-হীন মানুষ বা জীব বেঁচে থাকতে পারে,  কিন্তু প্রাণহীন  জীব হয় না।   আমাদের সবাইকে বেঁচে থাকতে গেলে,  এই  প্রাণের সাধনা  করতে হয়।   আবার আত্মজ্ঞান লাভ করতে গেলেও প্রাণের সাধনা করতে হয়।  শারীরবিনা সাধন হয় না। আর আমাদের শরীরের প্রধান হচ্ছে  প্রাণ অর্থাৎ বায়ু। আমরা আজ এই প্রাণ বা বায়ু নিয়ে আলোচনা করবো। 
কোনো বাড়িতে ঢুকতে গেলে, কর্তার  সাথে দেখা করতে গেলে, যার সেই বাড়িতে যাতায়ত আছে, তেমন কারুর  সাহায্যে প্রবেশ করতে হয়।  আমাদের শরীরে এই বায়ু প্রতিনিয়ত যাতায়াত করছে, অর্থাৎ একবার ঢুকছে, একবার বেরোচ্ছে। আমাদেরও, ভগবানের তৈরি এই  দেহ-মন্দিরে ঢুকতে গেলে, এই প্রাণবায়ুর সাহায্য নিতে হবে। তাই আধ্যাত্মিক জগতে এই বায়ুর বা স্বাসপ্রস্বাস-এর  গুরুত্ত্ব অপরিসীম। বায়ু আমাদের আত্মা বা পরমাত্মার কাছে নিয়ে যাবার জন্য বাহক হিসেবে কাজ করতে পারে।
আজ আমরা  বায়ুর অর্থাৎ প্রাণের  গোড়ার কথায় যাবো। আমাদের সমস্ত সৃষ্টি প্রকৃতি প্রসূত। প্রকৃতি ত্রিগুণাত্বক - সত্ত্বঃ -রজঃ -তমঃ। এই ত্রিগুণের সাম্য়-অবস্থায় অব্যক্ত। আর বৈষম্য অবস্থায় হচ্ছে সৃষ্টি। সমস্ত সৃষ্টি তা চেতন বা অচেতন, যাই হোক না কেন, তা  এই প্রকৃতির সাহায্যেই  হয়েছে। সত্ত্বগুণ হচ্ছে আত্মশক্তির মুলস্পন্দন।  রজঃগুন হচ্ছে ক্রিয়া শক্তির মূল স্পন্দন। এই ক্রিয়া শক্তিই সৃষ্টিকে ভাঙে গড়ে। ক্রিয়াশক্তির এই যে কার্যরূপ তাকে বলে তমোগুণ।
শক্তির এই তমোগুণ থেকেই পঞ্চতত্ত্ব সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমে কারন-রুপী  মহাকাশ। এই আকাশ থেকে বায়ু, অর্থাৎ মহাপ্রাণশক্তি উৎপন্ন হয়েছে। মহাত্মারা বলেন, আমাদের এই দেহটি একটি ক্ষুদ্র ব্রহ্মান্ড। পঞ্চতত্ত্বের সমস্ত তত্ত্ব আমাদেরই এই দেহে বর্তমান।
এখন, আকাশ থেকে সৃষ্টি হয়েছে, বায়ু। আকাশের গুন হচ্ছে  শব্দ। বাতাসের,   নিজস্ব,গুন হচ্ছে স্পর্শ।   আর বায়ু আকাশের উত্তরাধিকারী হিসেবে যে গুন্ পেয়েছে তা হচ্ছে শব্দ । এই বায়ুই আমাদের স্পর্শ ইন্দ্রিয় অর্থাৎ ত্বকে অনুভব জাগায়। এই বায়ুই আমাদের দেহের প্রাণশক্তি, প্রাণবীজ ও প্রাণকোষ নির্মাতা। এই বায়ু আমাদের দেহের সমস্ত যন্ত্রগুলোকে, দেহের রস-রক্তকে দেহের সর্বাঙ্গে পরিচালিত করে।
আকাশভূতের ক্রিয়া আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না।  বায়ুকেও  আমরা চোখে দেখি না বটে, কিন্তু তার স্পর্শ অনুভব করি। আমরা যেমন আকাশ জুড়ে, বায়ু অগ্নি ও বরুনের খেলা প্রত্যক্ষ করি, অর্থাৎ ঝড়, বিদ্যুৎ ও মেঘ বা বৃষ্টির খেলা দেখতে পাই, তেমনি আমাদের দেহের মধ্যেও এই ত্রিদেবতার খেলা চলছে, এবং আমাদের দেহ যদিও পঞ্চভূতের তৈরি, তথাপি এই তিন ভূতের অধিক প্রাধান্য, আমাদের শরীরে। এর মধ্যে আবার বায়ু ভূতের প্রাধান্যই সর্বাধিক।
বক্ষ প্রদেশ বায়ুশক্তির প্রধান কর্ম্মকেন্দ্র।  যদিও সমস্ত দেহেই সমস্ত ভূতের কাজ চলতে থাকে, তথাপি প্রত্যেক তত্ত্বের একটি প্রধান কেন্দ্র আছে। বায়ুর প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে আমাদের বুক।  এখানে, ফুসফুসহৃদযন্ত্র, মঙ্গলগ্রন্থি এবং প্রাণকোষ নির্মাণকারী গ্রন্থি ইত্যাদি পাঁচটি গ্রন্থি ও অনেকগুলি উপগ্রন্থি আছে এখানে।  হৃদয়কেকে সাধকরা  অনাহত চক্রে কর্ম্মস্থল  বলে থাকেন । এই চক্রে অবিরত কাজ চলছে, একমুহূর্তের জন্য বিশ্রাম নেই। এই চক্রের বিশ্রাম মানে, আমাদের চিরবিশ্রাম বা মৃত্যু। বিজ্ঞান বলছে,  আমাদের বুকের পিছনের স্পাইনাল কর্ড লেভেল, বা সুষুম্না নাড়িতে অবস্থিত  অনাহত চক্র থেকে, অর্থাৎ আমাদের বুকের পিছনের সুষুম্না নাড়ি থেকে  বারোজোড়া স্নায়ু যার প্রত্যেক জোড়ায়  একটি  গ্রাহক, অন্যটি প্রেরক  স্নায়ু ( রিসেপ্টর আর একটি কন্ডাকটর ) আমাদের বুকের মধ্যে বিস্তার করে আছে।
বায়ুকে উপনিষদ পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন।  প্রাণ-ব্যান-অপান -সমান-উদান। এঁরা আমাদের দেহমন্দিরের রক্ষক। এইপাঁচজন দ্বাররক্ষক আমাদের হৃদযন্ত্রের পাঁচদিকে অবস্থান করছে।
ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছে : আমাদের হৃদয়ের পুব দিকে প্রাণ, পশ্চিমে অপান ,দক্ষিণে ব্যান, উত্তরে সম বা সমান আর উর্দ্ধ দিকে উদান।
পূর্ব দিকে আছেন - প্রাণ। হৃদয়ের যে পূর্বদ্বার সেখানে তিনি অবস্থান করছেন। প্রাণকে বলা হচ্ছে আদিত্য বা সূর্য্য । ইনি আমাদের চক্ষুস্বরূপ। আদিত্য অর্থাৎ তেজ। এই প্রাণ বায়ুর কাজ হচ্ছে শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ, হৃদযন্ত্র পরিচালন, খাদ্য বস্তুকে পেটের  মধ্যে পাঠানো। ধমনীর সাহায্যে আমাদের সর্ব্ব অঙ্গে রক্ত পরিচালনা - অর্থাৎ পাঠানো ও গ্রহণ করা। অর্থাৎ শিরা এবং স্নায়ুগুলোকে তাদের কাজে প্রবৃত্ত করা। 
দক্ষিণ দিকে আছেন - ব্যান।  হৃদয়ের দক্ষিণ দ্বারে ব্যানবায়ু অবস্থান করেন। ব্যান-কে  বলা হচ্ছে চন্দ্র। ইনি আমাদের কর্ন  স্বরূপ। মানুষ কানের সাহায্যে জ্ঞান লাভ করে। চন্দ্র আমাদের খাদ্যের উৎস - খাদ্য আমাদের শক্তি যোগায়। শরীরের রস-রক্তকে প্রয়োজনমতো সমস্ত শরীরে দ্রুত পরিবেশন করা, আমাদের শরীরের সংকোচন-সম্প্রসারণ, মস্তিষ্কে রক্ত পাঠানো, শরীর থেকে ঘাম বের করে দেওয়া  এই ব্যান বায়ুর কাজ। এই ব্যানবায়ু কুপিত হলে, আমাদের সমস্ত দেহে রোগের  প্রকপ হয়, এবং আমরা মারা যাই।  
পশ্চিমদ্বার, অর্থাৎ হৃদয়ের যে পশ্চিম দ্বার সেখানে অবস্থান করছেন  অপান। এটা আমাদের বাকশক্তি, আবার এই অপান-ই হচ্ছে অগ্নি। অপান বায়ুর প্রধান কাজ, প্রাণ বায়ুকে আকর্ষণ করে, প্রাণবায়ুর স্বাস প্রশ্বাস কাজকে সহায়তা করা। মল,মূত্র, শুক্র, প্রভৃতিকে নিচের দিকে চালিত করা। নারী দেহের সন্তান পোষণ, সন্তান ভূমিষ্ট করার ব্যবস্থা করা, রজঃ নিঃস্বরণ  ইত্যাদি ক্রিয়াও অপান বায়ুর অন্তর্গত।
এর পরে,হৃদয়ের উত্তর দ্বারে আছেন সমান বা সম।  আমরা যা কিছু খাই বা পান করি, সেই সকল বস্তুকে জীর্ন করে, রূপান্তরিত করে এই সমান বায়ু। অর্থাৎ সমান বায়ু আমাদের হজমশক্তি। জীর্ন খাদ্যের সার, ও অসার ভাগ অর্থাৎ প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়জনীয় অংশকে পৃথক করে অসার ভাগ বৃহৎ-অন্ত্রের ভিতর দিয়ে মলনারীতে প্রেরণ করে, এই সমান বায়ু। অপান  ও প্রাণ  বায়ুর কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করার দায়িত্ব এই সমান বায়ুর।
হৃদয়ের উর্দ্ধদিকের দিকে যে দ্বার সেখানে আছেন, উদান । পা থেকে উর্দ্ধগমনকারী বায়ু, এই ছিদ্রের মধ্য দিয়ে উপরের দিকে যায়। এই উদান বায়ুর সাহায্যেই মানুষ শব্দ করে, কথা বলে, গান ইত্যাদি করে। এই উদান বায়ুর সাহায্যেই আমাদের মন বুদ্ধি স্মৃতিশক্তি পরিপুষ্ট হয়। সাধকের কাছে, এই উদান বায়ুর খুব গুরুত্ত্ব , কারন  এই উদান বায়ুর সাহায্যেই কুন্ডলিনী শক্তিকে সাহস্রারের দিকে নিয়ে যায়। এর উদান বায়ুর সাহায্যেই  আমাদের মন অতীন্দ্রিয় জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
অতএব সচেতন ভাবে, আমাদের প্রাণকে রক্ষা করতে হবে, শক্তিশালী করতে হবে। আর এটা  করবার জন্য, আমাদের প্রতিনিয়ত খানিকটা সময়, প্রাণের অর্থাৎ স্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াকে একাগ্রভাবে পর্যবেক্ষন করতে হবে। তার কাছে উপবেশন করতে হবে, তাতেই তিনি খুশি হবেন, এবং আমরাও ভালো থাকবো।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ - হরি  ওঁং









  

  


Wednesday 5 June 2019

কর্মরহস্য


কর্মরহস্য (১)

কেউ বলেন "যেমন কর্ম্ম তেমন ফল" । কেউ  বলেন, "ভাগ্যের লিখন খণ্ডাবে কে ?" কোনটা যে ঠিক কে বলে দেবে ? কর্ম ফল নাকি কপাল - কোনটা কার্যকরী বেশী ? আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় কর্মরহস্য।

গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কর্মে তোমার অধিকার, ফলে কখনোই নয়। এই কথার গূঢ় অর্থ কী ?

কর্ম্ম কাকে বলে ?

পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করে আমরা যা কিছু করি সবই কর্ম্ম। সৃষ্টি এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য, যা কিছু করা হয় তাকেই কর্ম বা ক্রিয়া বলে।

কর্ম্ম কয় প্রকার  ? 

প্রাথমিক ভাবে, কর্ম্ম দুই প্রকার, দৈহিক কর্ম্ম ও মানসিক কর্ম্ম।

দৈহিক কর্ম্ম  বা অবচেতন মনের কর্ম্ম  :
দেহকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য, আমরা যে কর্ম্ম করি, বা যে কর্ম্ম সম্পাদিত হয়, তাকে দৈহিক কর্ম্ম বলে। যেমন - চোখের পাতা ফেলা, স্বাস প্রশ্বাস, পাচন  ক্রিয়া, বাতাস থেকে উর্জ্বা শক্তি সংগ্রহ করা।  এগুলো আমাদের দৈহিক কর্ম্ম। এগুলো অবচেতন মনের নির্দেশে হয়।  এই কর্ম্মের ফল তাৎক্ষণিক। সঞ্চয়ের কোনো সুযোগ নেই।

মানসিক কর্ম্ম  বা সচেতন মনের কর্ম্ম :
ইন্দ্রিয়গনের সাহায্যে বিষয় সংযোগে যে কর্ম্ম করা হয়, তাকে মানসিক কর্ম্ম বলা হয়। মানসিক কর্ম্ম আবার দুই প্রকার। প্রতক্ষ্য ও অপ্রতক্ষ্য ।

আসলে আমরা কর্ম্ম বলতে যা বুঝি তা এই এই মানসিক কর্ম্মের বহিরঙ্গ মাত্র। অর্থাৎ যে কর্ম্মের দ্বারা আমরা এক্ষুনি বা অদূর ভবিষ্যতে ফল পেতে পারি। অর্থাৎ প্রতক্ষ্য কর্ম্ম

ইন্দ্রিয়গনের দ্বারা আমাদের কর্ম্ম করতে হয়। আর মন হচ্ছে ইন্দ্রিয়গনের রাজা। মন যখন কোনো কিছু চিন্তা করে, সেটা হচ্ছে অপ্রতক্ষ্য কর্ম্ম।  এই অপ্রতক্ষ্য কর্ম্ম যখন ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বাহ্যিক রূপ নেয় তখন তাকে প্রতক্ষ্য কর্ম্ম বলা হয়। সাধারণ ভাবে একেই আমরা কর্ম্ম বলে থাকি।

তাহলে আমরা বুঝলাম, মন হচ্ছে কর্ম্মের রাজা। এই মনের আবার দুটো প্রবৃত্তি আছে। একটাকে বলি কামনা, আর একটা হচ্ছে বাসনা। এই দুটো প্রবৃত্তি আমাদের কর্ম্মে উদ্বুদ্ধ করে।

কামনা :  ইন্দ্রিয়গনের সঙ্গে বিষয়-সংযোগের যে ইচ্ছে আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয় তাকে বলে কামনা। শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ - প্রভৃতি উপভোগ করবার যে প্রবৃত্তি আমাদের মনে বর্তমান থাকে, তার দ্বারা ভোগ্য বিষয়ে আমাদের আসক্তি জন্মে। এই আসক্তিই কামনা-প্রসূত। মানুষের যাতে ন্যায্য অধিকার নেই,অথচ সেগুলো পাবার জন্য, আমরা সদাই চঞ্চল।  তাই কামনা প্রসূত কর্ম্ম আমাদের সুখ-দুঃখের কারন।

বাসনা : মনের আর একটা প্রবৃত্তির নাম বাসনা বা সংকল্প। আমি সংযম পালন করবো। চরিত্রের উন্নতি সাধন করবো। পরহিতার্থে কাজ করবো। জ্ঞান অর্জন করবো, ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ একটা হচ্ছে নিজের সুখ-দুঃখের জন্য কাজ যাকে  বলে কামনা আর একটা অন্যের হিত বা নিজের উন্নতি সাধনের কাজ, একে বলে সংকল্প বা বাসনা।

এই কামনা ও বাসনা দুটোরই উৎপত্তি স্থানই মন। এদুটোই মনের কাজ।  এটাকে সম্পাদন করা  বা না করা দুটোই কর্ম্ম। কর্ম্ম হিসেবে এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।  পার্থক্য হচ্ছে ফলে।

কর্ম্ম বলতে আমরা স্থুল দেহের কর্ম্ম বুঝে থাকি।  কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের আরো দুটো লিঙ্গদেহ বা সূক্ষ্ম দেহ আছে, একটা হচ্ছে কামদেহ আর একটা হচ্ছে মানসদেহ। এই দুটো দেহেরও  কর্ম্ম করবার শক্তি আছে। এবং এই দুটো দেহই সর্ব্বদা কর্ম্ম করছে। আর পৃথিবীই আমাদের কর্ম্মভূমি। আর এই পৃথিবীতে বসে আমরা যে  কর্ম্ম করবো, তার ফলও আমরা এই পৃথিবীতে বসেই ভোগ করবো। এই সব কর্ম্মের ফল আমরা পরলোকে গিয়ে ভোগ করবো না। যদি এই জীবনে আমাদের কর্ম্মফল ভোগ সম্পূর্ণ না হয় তবে আমাদের আবার পৃথিবীতে এসে ভোগ করতে হবে। আর একেই বলে প্রারব্ধ কর্ম্মফল ভোগ। ফলদানে প্রবৃত্ত এই সব কর্ম্মফলের গতি রোধ করা যায় না। আর পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করে যে সব কর্ম্ম আমরা করি, সেগুলো হচ্ছে ক্রিয়মান কর্ম্ম। ভবিষ্যৎ জন্মে আমাদের আজকের  ক্রিয়মান কর্মের ফল ভোগ করতে হবে। এছাড়া বহু জন্মের যে কর্ম্মফল আমাদের ভোগ করা হয় নি তাকে বলে সঞ্চিত কর্ম্ম। সেই সব সঞ্চিত কর্ম্মের ফলও  আমাদের ভোগ করতে হবে। ক্রিয়মান কর্ম্মের প্রতি আমাদের আমাদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি, কিন্তু প্রারব্ধ বা সঞ্চিত কর্ম্মফলের প্রতি আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই ক্রিয়মান কর্ম্মকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য আমাদের কর্ম্ম বা কর্ম্মফল সম্পর্কে জ্ঞান সঞ্চয় করতে হবে, এবং সেই অনুযায়ী কর্ম্মে লিপ্ত হতে হবে, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনে, এই জীবনের কোনো কর্ম্ম  প্রারব্ধ বা সঞ্চিত হিসেবে টেনে নিয়ে যেতে হবে না। এখন কি করে সম্ভব ?

চিন্তাদ্বারা কর্ম্ম :  আমরা কৰ্ম্ম-ইন্দ্রিয় দ্বারা যে সব কাজ করি, তাদের সন্মন্ধে ভালো-মন্দ জ্ঞান আমাদের নেই। অনেক সময় আমরা না বুঝে, বা বিচার বিবেচনা না করে, খারাপ কাজ করে বসি। পরে সেটা নিয়ে আমাদের অনুতাপ হয়। আবার অনেক সময়, আমরা বুঝে শুনে, বিবেকের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে, খারাপ কাজে লিপ্ত হই। অনেক সময়, রাগের বশে, বা হিংসার বশে  অনুচিত কাজ করে বসি। আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, চিন্তা দ্বারা যে কোনো কাজ করা যায়, তা আমরা মন করি না। আমরা মনে করি, শারীরিক উদ্দম ছাড়া কোনো কাজ করা যায় না। স্বামী বিবেকানন্দ একবার এক সাধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনারা সব উন্নত মহাত্মা, এই নির্জনে, পাহাড়ের কোলে বসে সাধনা কোরছেন।  এতে সাধারণ মানুষের কি কাজে লাগবে ? মহাত্মা বলেছিলেন, মনের দ্বারাও যে মানুষের উপকার করা যায়, এবং উপকার করতে চাইলে যে যে কোনো জায়গায় বসে সেটা করা যায়, তা কি তুমি জানো ? অর্থাৎ মানুষ তার শুভ চিন্তার দ্বারা কাজ করে থাকেন। আমরা মনে করি, চিন্তা মনের একটা অবস্থা-বিশেষ মাত্র। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তা নয়। চিন্তা একটা বস্তূ।  বস্তূর সমস্ত ধর্ম্মই এতে বর্তমান। এই চিন্তা দ্বারা, যেমন নিজের উপকার করা যায়, তেমনি অপরের উপকারও করা যায়। জড়-বিজ্ঞান এখনো এর আবিষ্কার করতে পারে নি বলে এটা অসত্য হয়ে যায় না। চিন্তার কার্য্যকরী শক্তি সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। আমরা তপস্যার কথা শুনে থাকি, ঐকান্তিকভাবে চিন্তা করাই তপস্যা। আর এই তপস্যার ফলই আমাদের "বেদ"। তপঃ-প্রভাব-সম্পন্ন ঋষির কাছে কিছুই দুর্লভ নয়। তা সে জাগতিক বস্তূই হোক আর আধ্যাত্মিক জ্ঞানই হোক। গভীর চিন্তা দূরে থাকুক, সাধারণ চিন্তাও কখনো নিষ্ফল হয় না।

আমাদের এই ভূলোকের সঙ্গে যেমন আরো অনেক লোক   (  ভূঃ , ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ, সত্যম ) ওতপ্রোত ভাবে অবস্থান করছে, তেমনি আমাদের এই স্থুল দেহের সঙ্গে সূক্ষ্ম দেহ ওতপ্রোত ভাবে অবস্থান করছে। আমাদের এই স্থুল দেহের চতুর্দিকে, এক-দেড় ফুট পর্যন্ত একটা জ্যোতির্বিম্ব আচ্ছাদন করে রেখেছে আমাদেরকে। এরও আকৃতি আমাদের দেহের মতোই। তবে এটি আলোর রশ্মি মাত্র। আমাদের মনের ভাবের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই আলোর রঙের পরিবর্তন হয়।  আমাদের চিন্তা ধারার গভীরতার সঙ্গে সঙ্গে এই আলোর ঘনত্ত্ব বাড়ে-কমে। আমাদের মনে যখন যে প্রবৃত্তি জেগে ওঠে, সেই অনুযায়ী আমাদের এই আউড়া দেহ বা জ্যোতির্বিম্ব সূক্ষ্ম জগৎ থেকে সূক্ষ্ম পরমাণু আকর্ষণ করে থাকে। এবং তা থেকে শত শত - এমনকি হাজার হাজার আজ্ঞাবহ  চিন্তামূর্তি সৃষ্ট হয়। এই সব চিন্তামূর্তি গুলো সূক্ষ্ম উপকরণে নির্মিত। এই সকল মূর্তিতে কিঞ্চিৎ চৈতন্যেরও সঞ্চার হয়। মনের প্রবৃত্তির লক্ষ্য বস্তূ কাছে থাকলে, তারা সেই বস্তূর নিকটে গিয়ে তার সূক্ষ্ম দেহে সেই রকম প্রবৃত্তির উন্মেষ করতে চেষ্টা করে। আমাদের চিন্তা যত গভীর হবে, এই চিন্তামূর্তিগুলোর স্থায়িত্ত্ব ও কর্মক্ষমতা তত বেশি হবে এবং ফলপ্রদ হবে। সুতরাং আমি যদি কারুর সন্মন্ধে, ভালো চিন্তা করি, তবে তার ভালো হবে আর আমি যদি কারুর সন্মন্ধে খারাপ চিন্তা করি তবে তার খারাপ হবে।  আমার চিন্তার গভীরতা অনুযায়ী এই ফল গভীরতা ও স্থায়িত্ত্ব পাবে।  এই জন্য বলা হয়ে থাকে খারাপ কাজের চাইতে খারাপ চিন্তা ভয়ঙ্কর। আমাদের শারীরিক শক্তির একটা সীমা আছে, কিন্তু মানসিক শক্তি সীমাহীন। শরীর দ্বারা কৃত, পাপকর্মের মাত্রা শারীরিক শক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু মনের গতি  অপ্রতিরোধ্য, তাই চিন্তাশক্তিও অসীম। অতএব  মনের সাহায্যে যত পাপ করা যায়, তা  সীমাহীন। আবার মনের সাহায্যে যে ভালো কাজ করা যায় তা-ও সীমাহীন। এই জন্য সমস্ত ধর্মশাস্ত্রে মনের উপরে নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। আমাদের শুভ-ইচ্ছা যত  গভীর হবে, সূক্ষ্ম জগতে আজ্ঞাবহ সচেতন মূর্ত্তি তত মঙ্গল কর্মে লিপ্ত থাকবে। আর আমাদের অশুভ চিন্তা যত গভীর হবে, সূক্ষ্ম জগতের আজ্ঞাবহ মূর্তিগুলো তত অমঙ্গল কর্মে লিপ্ত থাকবে। বেদে  যে সব মন্ত্র আমরা পাই, তা আসলে দেবতাদের   স্তূতি ও প্রার্থনা। দেবতাদের অর্থাৎ এক বা একাধিক গুনের অধিকারী যারা, তাদের আমরা দেবতা বলি। দেবতাদের স্তূতি মানে গুনের   স্তূতি ও গুণীর কাছে প্রার্থনা। এই সব মন্ত্র আমাদের মনকে শুভ চিন্তায় নিমগ্ন রাখে, বার বার উচ্চারণ বা জপ্ আমাদেরকে মঙ্গলের পথে নিয়ে যায়। মন্ত্রের এখানে সার্থকতা।

ক্রিয়মান কর্ম্ম :  বর্তমানে আমরা যা করছি, সেটাই ক্রিয়মান কর্ম্ম। এই ক্রিয়ামান কর্ম্ম খুবই গুরুত্ত্বপূর্ন, কারণ, এই ক্রিয়মান কর্ম্মই আমাদের ভবিষ্যৎ গঠন করবে। আমি এই জীবনে যাকিছু করবো, তা আমার ভবিষ্যৎ জীবন গড়ে দেবে। ভবিষ্যৎ জীবনের শুভ-অশুভ ব্যাপার সংগঠিত করে দেবে, এই জীবনের কর্ম্ম। অর্থাৎ আজ আমি কর্তা, কাল কিন্তু আমি হয়ে যাবো ভোক্তা বা দাস। আমাদের পুরুষাকার বা স্বাধীন ইচ্ছে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে তা এই জীবনে বিচারশীল হয়ে প্রয়োগ করতে হবে।  তবেই আমরা আগামী জীবনের সৌভাগ্য গঠন করতে পারবো।

আমরা কুকর্ম করি কেন ?  আমরা একটু স্থির হয়ে চিন্তা করলে  বুঝতে পারবো, আমাদের সমস্ত কর্মই আমাদের অবিচ্ছিন্ন চিন্তার ফল। তা সে ভালো বা মন্দ, পাপ বা পুন্য যে ধরনের কাজই হোক না কেন, এর মুলে আছে আমাদের কামনা। প্রবৃত্তির তাড়নায়, আমাদের মনে ক্ষনে ক্ষনে কুচিন্তা ফুটে উঠছে। অন্যদিকে আমাদের বিবেক-বুদ্ধি  এই কুচিন্তাকে কার্য্যে পরিণত করতে বাধা দিচ্ছে। কিন্তু যেসব কুচিন্তা বারবার স্ফূরণ ঘটাচ্ছে, তা আমাদের মনে চাপ ফেলছে। সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় আছে। এইসব দীর্ঘদিনের কুচিন্তা, একদিন উপযুক্ত সুযোগ পেয়ে, বিবেকের নির্দেশকে অগ্রাহ্য করে, আমাদেরকে কুকর্মে প্রবৃত্ত করবে। এইভাবে আমরা গর্হিত কাজ করে, পরে অনুতাপে দগ্ধ হই।

পুরুষাকার : একটা জিনিস মনে রাখবেন, বহু জন্মের কর্মফলে, আমাদের আজ এই মনুষ্য দেহ, আমাদের স্বভাব, মস্তিস্ক, চিন্তাশক্তি, বিবেক, এবং এই পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছি। আমাদের মধ্যে এই যে দৈন্যতা, এও  আমাদের পূর্ব পূর্ব জন্মের কর্মফল। আমাদের মধ্যে যে আধ্যাত্মিক ভাবের দৈন্যতা, আমাদের ইন্দ্রিয়াসক্তি, আমাদের নিষ্ঠূরতা, এগুলো সবই আমাদের পূর্ব পূর্ব জন্মের মজ্জাগত স্বভাব। এর মধ্যেও আছে আমাদের ক্ষীণ বিবেকশক্তি। আমরা যদি আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে বিবেকের নির্দেশ অনুযায়ী চালিত করতে পারি, তবে ক্রমশঃ উন্নতির দিকে যেতে পারবো। ভাগ্য ইচ্ছার অধীন নয়, ভাগ্য কর্মের অধীন।   স্বাধীন ইচ্ছেই  পুরুষকার। তাই বিবেকের দ্বারা পরিচালিত স্বাধীন ইচ্ছা আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। স্বাধীন ইচ্ছেকে শক্তিশালী করতে হবে। ইচ্ছেকে বিবেক দ্বারা পরিশীলিত করতে হবে।  এই ভাব যখন আমাদের দৃঢ় হবে, তখন আমাদের জীবনের গতি  উর্দ্ধমুখী হবে। দেখুন জীবন একটা যাত্রা।  এই পথে চড়াই উৎরাই আছে, আপনাকে লক্ষ্য স্থির রেখে, দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলে আপনি সঠিক সময় লক্ষে পৌঁছতে পারবেন, তা না হলে পথে পথে ঘুরতে হবে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ সময়। ঈশ্বরের ইচ্ছেয় লক্ষে আপনাকে যেতেই হবে, যেখান থেকে ঈশ্বর আপনাকে কোলে তুলে নেবেন। কিন্তু আপনি যত  বিপথে যাবেন, তত আপনার বার বার জন্ম নিতে হবে, এবং আপনি জন্ম-মৃত্যুর চক্রে সুখ-দুঃখের আবর্তে ঘুরপাক খাবেন।

ভাগ্য :  আমরা আগেই শুনেছি, কর্ম্ম তিন রকম, সঞ্চিত, প্রারব্ধ, এবং ক্রিয়মান। এর মধ্যে ক্রিয়মান কর্ম্ম হচ্ছে - এখন করছি। সঞ্চিত কর্ম্ম হচ্ছে, আমরা যে কর্ম্ম করেছিলাম, আর প্রারব্ধ কর্ম্ম হচ্ছে - যে সব কর্ম্ম ফল দানে উম্মুখ বলে আমাকে জন্ম গ্রহণ করতে হয়েছে।  অর্থাৎ প্রারব্ধ কর্ম্মফল আমাকে ভোগ করতেই হবে। এই প্রারব্ধ কর্মফলের সমষ্টি হচ্ছে আমার ভাগ্য। তাই ভাগ্য আমাদের ঈশ্বরের নিদান। এই জীবনে আমাকে সেই সব সুখ-দুঃখ ভোগ করতেই হবে। সঞ্চিত কর্ম্মের যেগুলো এই জীবনে ভোগ করা সম্ভব নয়, সেগুলো থেকে যাবে ভবিষ্যৎ জন্মের জন্য। অর্থাৎ আমাদের এমন কিছু কর্ম্ম আছে যার ফল এই জীবনে ভোগ করা যাবে না। অর্থাৎ আমি এখন যেখানে জন্ম গ্রহণ করেছি,  সেখানে, আর আমার সঞ্চিত কর্ম্ম যাদের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত তার হয়তো সেখানে জন্ম গ্রহণ করেন নি। অন্য কোনো দেশে আছেন, বা আদৌ জন্ম গ্রহণ করেন নি, তবে তার কাছে আমার যা ঋণ তা পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। তাই সঞ্চিত কর্মের অবলুপ্তি এক জীবনে সম্ভব নয়। আমরাশুধু প্রারব্ধ কর্মের দাস,  এই জীবনে। আমাদের জন্ম, মৃত্যু, সুখ দুঃখ  এই প্রারব্ধ কর্মের ফল, জেক আমরা ভাগ্য বলি। এবং এটি এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। প্রারব্ধ কর্ম্ম ক্ষয়ের  একমাত্র উপায়, ভোগ। এর কোনো অন্যথা নেই।
----------
কামনা অনুসারে আমাদের দেহলাভ :  কামনা মনের একটা ক্রিয়া।  আবার এই কামনা থেকেই আমাদের কামদেহ পুষ্টি লাভ করে। কামনার শুচিতার উপরে আমাদের পরের -জন্মের  কাম দেহের উৎকর্ষ নির্ভর করছে। এবং সেই অনুযায়ী আমাদের জন্মের স্থান, আমাদের মাতৃস্থান নির্দিষ্ট হয়। কামনা চরিতার্থ করবার জন্য আমাদের শরীর, এবং শরীর অনুযায়ী আমাদের কর্ম্ম। আবার কর্ম্ম অনুযায়ী ফল লাভ করে থাকি আমরা। কামনা দ্বারাই আমরা ঐহিক সম্পর্ক স্থাপন করি। আমাদের ভাব-বন্ধনের আকর্ষণ পরজন্মে তাদের সাথে সন্মন্ধে আবদ্ধ করে। এই ভাবেই তৈরি হয় আমাদের শত্রূ - মিত্র। আমরা কর্ম্মের দোষ গুন্ সন্মন্ধে ধারণা করতে পারি।  কিন্তু মনের মধ্যে যে কামনা উঠে তা আমাদের মনের মধ্যেই নিহিত থাকে, বাইরে প্রকাশ পায়  না। কিন্তু এর দ্বারা যে কর্ম্ম উৎপন্ন হয় - তার ফল আমরা ভোগ করি। চিন্তা ও কামনা যদি সুপথে প্রবাহিত হয়, তবে আমাদের যে শক্তি ও ক্ষমতা অর্জিত হবে, তা আমাদের সুখের কারন হতে পারে।          

আমরা অনেকে মনে করি, আমাদের মনের গভীরে যে চিন্তা স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে, সেতো মনের মধ্যেই আছে, তাতো কারুর কোনো ক্ষতি করে নি, তবে তার জন্য আবার ফল ভোগ করতে হবে কেন ? আমার মনে ভাব তো মনের মধ্যেই লয় প্রাপ্ত হয়ে গেছে - তবে তার আবার ফল কি ? লৌকিক জগতে সুপ্ত চিন্তার কোনো বিচার নেই। কিন্তু  আপনার সুপ্ত চিন্তাই আপনার ভবিষ্যৎ কর্ম্মের নির্ধারক হিসেবে কাজ করবে। আপনার চিন্তাই আপনাকে সুকর্ম-দূরকর্মে লিপ্ত করবে। এটাই কর্ম্ম পদ্ধতি।  তাই লৌকিক জগতে চিন্তার প্রতিফলন যতক্ষন না হচ্ছে ততক্ষন সেই চিন্তার বিষয় বিচার্য্য হয় না। কিন্তু সূক্ষ্ম জগতে, এই চিন্তার অপরিসীম গুরুত্ত্ব। কারন এগুলো হচ্ছে কর্ম্মের বীজ। তাই কুচিন্তা কুকর্মের বীজ। তাই আমাদের উচিত এই কুকর্মের বীজকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করা।আর আমরা আগেই শুনেছি, চিন্তাও সূক্ষ্ম বস্তূ দ্বারা নির্মিত, এবং তার অসীম শক্তি এবং এদের সামান্য চৈতন্যশক্তিও আছে। এবং এই চিন্তা শক্তি লক্ষ্য বস্তুর উপরে প্রভাব বিস্তার করে।  অতএব চিন্তা কিছু করছে না, তা নয়, এর প্রভাব সাধারণ কর্ম্মের থেকেও অনেক বেশী।  এমনকি, এই চিন্তা সময় সুযোগ পেলে আপনাকে অবশ্য়ই কর্ম্মে অনুপ্রাণিত করবে।

কর্ম্মের বিচিত্র গতি।  বিষয়টি অতিশয়  দুর্জ্ঞেয়। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, যে যেমন কর্ম্ম করবে, সে তেমনি ফল ভোগ করবে। ব্যাপারটা কিছু এতটা সহজ নয়। কর্ম্মের আরো একটা দিক আছে। আর তা হলো, আমরা অনেক সময় দেখি, আমরা ভালো কাজ করতে গিয়েও অনেক দুর্নামের ভাগিদার হই। বা অন্যের দোষে আমাদের ক্ষতি হয়ে যায় । এর কারন কী ?

আমাদের ব্যক্তিগত কর্ম্ম ছাড়াও আমাদের চারিদিকে যে সব কর্ম্ম সম্পাদিত হচ্ছে তার প্রভাব থেকে আমি মুক্ত হতে পারবো না। আমি যে পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছি, সেই পারিবারিক কর্ম্মফল আমাকে প্রভাবিত করবে। আমি যে সমাজে জন্ম গ্রহণ করেছি, তার প্রভাব আমার উপরে পড়বে।  আমি যে দেশে জন্ম গ্রহণ করেছি - সেই দেশের শাসন কর্তার কর্ম্মের প্রভাব আমাদের উপরে পড়বে। আমি যে জাতিতে জন্ম গ্রহণ করেছি, তার প্রভাব আমাদের উপরে পড়বে। অর্থাৎ আমাদের পারিবারিক কর্ম্ম, সামাজিক কর্ম্ম, দেশজ কর্ম্ম, জাতিগত কর্ম্ম সবই আমার উপরে প্রভাব পড়বে। তাই বলা হয়েছে, একা ভালো থাকা যায় না। আমাদের সবাইকে নিয়েই ভালো থাকতে হবে। পরিবারের চিন্তা, সমাজের চিন্তা, জাতির চিন্তা, দেশের চিন্তা সবই আমার সুখভোগ বা দুঃখভোগের কারন হতে পারে। তাই সমাজে যখন মহাত্মারা আসেন, তারা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন না, শুধুমাত্র নিজের মুক্তির চেষ্টা করেন না। তারা আমাদের সবার বিচারের শুদ্ধতা আনবার জন্য সচেষ্ট হন। এই প্রসঙ্গে গীতার কথা আসে। যোগীশ্রেষ্ঠ শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যোগভ্রষ্ট ব্যাক্তিগন পবিত্র স্বভাব ও ধনী পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। এবং আমাদের সবাইকে বলছেন, আসক্তি-হীন  ভাবে কর্ম্ম করতে। অর্থাৎ শুদ্ধ কর্ম্মে যেমন আমাদের লিপ্ত থাকতে হবে, তেমনি আসক্তিহীন হয়ে কর্ম্ম করতে হবে। ব্যষ্টির কল্যাণ নয়, সমষ্টির কল্যাণের জন্য আমাদের কর্ম্ম করতে হবে।    

কর্ম্ম বন্ধন থেকে মুক্তি পাবার উপায় : শুধু মানুষ নয়, যে কোনো জীব-জন্তু কর্ম্ম না করে বাঁচতে পারবে না। আর কর্ম্ম থাকলে তার ফল থাকবে। তাহলে আমরা এই জন্ম-মৃত্যু চক্র থেকে রেহাই পাবো কি করে ? দেখুন দৈহিক কর্ম্ম থেকে আমাদের বেরোবার কোনো উপায় নেই। অর্থাৎ দেহকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য আমরা যে সব কর্ম্ম করে থাকি, তাকে বলে দৈহিক কর্ম্ম । যেমন, খাওয়া, শোয়া, নিঃস্বাস -প্রশ্বাস নেওয়া, হজম করা, বাহ্য ত্যাগ করা ইত্যাদি ইত্যাদি । আর এর জন্য কোনো পাপ বা পুন্য হয় না। সঞ্চিত কর্মের মধ্যে এর কোনো আশ্রয় নেই। সচেতন মন, যে চিন্তার অনুশীলন করে, তা  থেকেই কর্ম্মের উদ্ভব। আর এই কর্ম্ম-ই আমাদের পাপ-পুণ্যের ভাগিদার করে। পূর্ব্ব জীবনে আমরা যেমন ও যে পরিমান চিন্তার অনুশীলন আমরা করেছি, এবং সেই অনুযায়ী কর্ম্ম করেছি, মানসিক শক্তি লাভ করেছি , আজ তারই ফল আমরা এখন ভোগ করছি। 

গাঢ় চিন্তাই হচ্ছে  ধ্যান। যে অবস্থায় চিত্তবৃত্তি এক বিষয়ে নিবদ্ধ থাকে, জ্ঞানবৃত্তির সেই একতানতাকে বলে ধ্যান। প্রতিদিন এই ধ্যানের অভ্যাস করলে ক্রমশঃ একাগ্রতা শক্তি বৃদ্ধি পাবে। এবং আমরা বাহ্য বিষয় থেকে মনকে ইষ্ট বিষয়ে আবদ্ধ করতে পারবো। মনের উচ্চতর স্তরে, যে চিন্তার উদ্ভব হয়, তাতে কামনার লেশমাত্র থাকে না।  স্বার্থসিদ্ধির কোনো কল্পনা তখন থাকে না। তাই
কামনা-জাত  কোনো কর্ম্মও  থাকে না। আমরা জানি, মানুষ প্রয়াণকালে যেমন চিন্তা করে, বা যে ভাবে তন্ময় থাকে, পরবর্তী জন্মে সে সেই মত দেহ ধারণ করে। তাই ধ্যানের মধ্যে থাকতে পারলে, আমরা পার্থিব বিষয় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারি, এবং জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকেও  মুক্ত থাকতে পারি। আমরা আজ যাদের সঙ্গে সন্মন্ধে আবদ্ধ হয়েছি, পূর্ব্বে বা পূর্ব্ব জন্মে নিশ্চই তাদের উদ্দেশ্য আমাদের চিন্তাস্রোত প্রবাহিত হয়েছিল, তাই আমরা তাদের সঙ্গেই, বা তাদের ঘরেই জন্ম গ্রহণ করেছি। তাই বন্ধন  মুক্তির একমাত্র পথ ধ্যান যা আমাকে বিষয় থেকে মুক্ত রাখবে। কর্ম্ম বন্ধন  থেকে মুক্তি দেবে, আর জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে রেহাই দেবে।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম 

পুনশ্চ :

গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, কর্ম্ম তিন রকম :কর্ম্ম, অকর্ম্ম, ও বিকর্ম্ম। শাস্ত্র অনুযায়ী কর্ম্ম করাকেই আসল কর্ম্ম বলে। আর শাস্ত্রনিষিদ্ধ যে কাজ তাকে বলে বিকর্ম্ম। আর কর্ম্ম থেকে বিরত থাকা অর্থাৎ কর্ম্ম সন্যাস - এর নাম হচ্ছে অকর্ম্ম।
কর্ম্ম : আমাদের সমস্ত কর্ম্ম-ই শাস্ত্র অনুযায়ী হওয়া উচিত। এখন কোন শাস্ত্র অনুযায়ী আমাদের কর্ম্ম করা উচিত। যে শাস্ত্র আমাদের যজ্ঞে পশুবলি দিতে বলছে ? যে শাস্ত্র মানুষকে অস্পৃশ্য করে রেখেছে। যে শাস্ত্র মানুষকে ঘৃণা করে শেখায়। প্রাচীন ঋষিরা, এমনকি রাজ্-রাজারা যজ্ঞ করতেন, বিভিন্ন ধরনের যজ্ঞ করতেন। এবং প্রত্যেকটি যজ্ঞের এক একটা উদ্দেশ্য ছিল।  এবং এর সবই কামনা প্রসূত। মন মন ঘি ঢালা হতো। তাহলে কি আমাদের সেই যজ্ঞকর্ম করতে হবে ? না, যজ্ঞ হচ্ছে, ব্রহ্মাগ্নিতে অহংকে আহুতি দেওয়া। আমাদের অহংকে আহুতি দিতে হবে, মন মন ঘি ঢালা নয়, বা পশুবলি দেওয়া নয়। আর দিতে হবে কোথায়, না ব্রহ্মাগ্নিতে, অর্থাৎ বেল কাঠের বা ডুমুর কাঠের অগ্নিতে নয়, জ্ঞান দ্বারা প্রজ্বলিত যে ব্রহ্ম সেখানে আহুতি দিতে হবে।   শাস্ত্র বলতে বোঝায় - স্ব-অস্ত্র। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য যার সাহায্য নিতে হয়, তাই আমাদের শাস্ত্র।  এখন এই শাস্ত্র যারা রচনা করেছেন,  তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যা বলে গেছেন, তাইই কি শাস্ত্র ? না মানব জাতির স্বার্থে যা রচিত হয়েছে, তাইই শাস্ত্র। তথাকথিত ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের রচনামাত্রই শাস্ত্র নয়। পশুবলি , বা হিংসায় প্রেরণা, বা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করা শাস্ত্রের উদ্দেশ্য নয়, শাস্ত্রের উদ্দেশ্য, সর্বেষাং মঙ্গলম ভব, সর্ব্বে সন্তু সুখিনঃ । সবার যাতে মঙ্গল হয়, অন্ততঃ বেশিরভাগের যাতে মঙ্গল হয়, সেই আপ্তবাক্যই শাস্ত্র। 
বিকর্ম্ম : শাস্ত্র অনুযায়ী কাজ না করাই বিকর্ম্ম। এখন শাস্ত্র বলছে, মিথ্যে কথা বলবে না। কিন্তু যদি মহৎ কাজের জন্য, বা কারুর প্রাণ রক্ষার জন্য, বা কোনো মায়ের সন্মান রক্ষার জন্য যদি মিথ্যে বলতে হয়, তবে সেটা কর্ম্ম হতে পারে। কাউকে আঘাত করবার জন্য অস্ত্র চালানো, আর ডাক্তারের অস্ত্র চালানো এক ব্যাপার নয়। ডাক্তারের অস্ত্র চালানো কর্ম্ম, কিন্তু ডাকাতের অস্ত্র চালানো বিকর্ম্ম। আসলে আমরা কি করছি সেটা বড়  কথা  নয়, কেন করছি সেটা বড়ো  কথা। তাই উদ্দেশ্য বিহীন হয়ে কর্ম্ম নয়, সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কর্ম্ম করতে হবে আমাদের।
অকর্ম্ম : কর্ম্ম সন্যাসকে  বলে অকর্ম্ম। কিন্তু তাই বলে, কোনো কাজ না করে, চুপ চুপ বসে থাকাকে, অকর্ম্ম বলে না। দেহ কর্ম্মহীন থাকতে পারে না। কর্ম্ম সন্যাস তাকেই বলে, যিনি কর্ম্মের দ্রষ্টা হতে পারেন, কর্তা  নয়। কর্ম্ম আমাদের জ্ঞানের আলো  এনে দিতে পারে। আর জ্ঞান মানে ঈশ্বর জ্ঞান। আর ঈশ্বর সম্পর্কে যখন আমাদের জ্ঞান হবে, তখন আমাদের ঈশ্বরভক্তি হবে। অতএব অকর্ম মানে আলসেমী নয়। অকর্ম মানে অকর্তা জ্ঞানে কর্ম করা।
এখন কর্ম্ম ফলের বন্ধন  কার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর কার ক্ষেত্রেই বা প্রযোজ্য নয়। আসলে কর্ম্ম কর্তাকেই বন্ধন  করে, কর্মচারীকে নয়। যার কর্তৃত্ব-অভিমান আছে, সেই কর্তা। তেমনি, ভোগে যার অভিলাষ আছে, তিনিই ভোক্তা। আসলে কর্ম্ম যেমন আমাদের চিন্তার ফল, ভোগও চিন্তার ফল। সেই জন্য, কি করছেন সেটা বড়  কথা নয়, কেন করছেন,  সেটা বড়  কথা। আপনার বিচার আপনার কর্ম্মকে প্রভাবিত করবে, এবং আপনাকে ফল ভোগ করাবে। সেই জন্য বলা হয়ে থাকে, যিনি কর্তৃত্বাভিমানহীন  তিনি নিরাশ্রয়, নিত্যতৃপ্ত। এনাদের  কর্ম্মে কোনো ফালাকাঙ্খা নেই, আমি করছি, সেই ভাবও  নেই। তাই ভোগ বা দুর্ভোগ এদের প্রভাবিত করতে পারে না।
এখন কথা হচ্ছে, জীব পুনঃ পুনঃ জন্মাচ্ছে, পুনঃ পুনঃ মরছে, জন্মালে কর্ম্ম করতে হচ্ছে, আবার কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য আবার জন্মাতে হচ্ছে। এই গোলক ধাঁধায় জীব অবিরত ঘুরছে।  এর থেকে অব্যহতি পাবার কি কোনো উপায় নেই ?
এইখানে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, "পরমাং গতিম" (৮/২১) . বা "মে পরমং ধাম" আমার পরমধাম, যা পেলে আর প্রত্যাবর্তন হয় না। এখন সেই পরম ধামে পৌঁছিবার উপায় কি ?  এইখানে ভগবান বলছেন, " ভক্ত্যা লভ্যস্ত্ব অনন্যয়া" - অর্থাৎ কেবল ঐকান্তিক ভক্তি দ্বারা তিনি প্রাপ্য।  এবং এই অনন্য ভক্তি দ্বারা জীবের গতাগতি শেষ হতে পারে।
দেখুন দুটো পথ, দুই ধরনের ভক্ত। একটা সরল-সোজা পথ। যে পথে গেলে আর ফিরে আসতে  হয় না। আর একটা পথ হচ্ছে, চক্রাকারে, যেটা ঘুরে ফিরে আবার একই জায়গায় মিলিত হয়। একদল বলছেন, ভগবান আমি মুক্তি চাই না।  আমি যেন তোমার দাসানুদাস হয়ে থাকতে পারি।  তোমার স্মরণাগতি  নিয়ে থাকতে পারি। এই চক্রটি বিশাল।  ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ ও সত্যম।  এই সত্যম বা ব্রহ্মলোক পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরতে হয়।
আর সরলরেখা ধরে  যারা যান, অর্থাৎ সেই বিরাট পুরুষের লীলালোকে, তারা আর ফিরে আসেন না। এই দুটো পথই সাধকদের জন্য।  অর্থাৎ এই জীবনে আপনি যে পর্যন্ত সাধনায় অগ্রসর হলেন, পরবর্তী জীবনে আপনি সেখান থেকে শুরু করবেন, এবং সাধনার উপুযুক্ত সময় ও পরিবেশ পাবেন।
আর একটা উপায় হচ্ছে, স্থান বা ক্ষণ মহত্ত্ব। পাণ্ডবেরা, স্বর্গারোহন করবার জন্য, উত্তরদিকে যাত্রা করেছিলেন । আমাদের অনেকের ধারণা হচ্ছে কাশীতে  মৃত্যু বরন আর মরজগতে ফিরে আসতে  হয় না। বা দেবস্থানে মৃত্যু  করলে জন্ম মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়।  আবার সময় ভেদ মানুষকে জন্ম মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেতে পারে।   ভীষ্মদেব, উত্তরায়ণে মৃত্যু কামনা করেছিলেন । কিন্তু কেন ?
আমরা জানি সূর্য্য পুব থেকে পশ্চিমে যায়। যে সব জীব মাত্র এক দিন বাঁচে, এই বিশ্বাস নিয়েই তারা মারা যায়।   সূর্য্যের আর একটা গতি আছে, সেটা হচ্ছে উত্তর-দক্ষিণ।  যারা এক বছর  বা তার বেশি বাঁচে, তারা এটা খেয়াল করলেই ধরতে  পারবে। সূর্য্য যখন, উত্তর দিকে যায়, অর্থাৎ পৌষসংক্রান্তি থেকে আষাঢ়মাসের সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত সূর্য্যের গতি উত্তর দিকে থাকে। আবার আষাঢ়মাসের সংক্রান্তির দিন  থেকে পৌষমাসের সংক্রান্তি পর্যন্ত দক্ষিণ অভিমুখী থাকে। ভারতের উত্তর দিকে হিমালয়, যেখানে দেবতাদের বাস। এবং উত্তর দিক উচ্চ অবস্থান, আমাদের দক্ষিণে সমুদ্র, অর্থাৎ নিম্ন ভূমি। সাধক সব সময় উর্দ্ধগতি প্রাপ্ত হতে চান । তাই নিম্নগতির সঙ্গে দক্ষিণ, আর উর্দ্ধ গতির সঙ্গে উত্তর গমনের একটা ভাবনা আমাদের প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে।
আমরা দেহ-মন ও আত্মার সম্মিলিত সত্ত্বা। আমরা  যখন দেহভুমিতে থাকি, তখন আমরা পশুবৎ। যখন আমরা মনোভূমিতে থাকি তখন, আমরা মননশীল বা মানুষ । আর যখন আমরা আত্মভূমিতে থাকি, তখন আমরা দেবতা বা মহামানব । আত্মা যখন সাধনা আরম্ভ করলো, তখন সে উত্তরের দিকে চললো। ধ্রুব নক্ষত্র তখন আমাদের মাথার উপরে।  ধ্রুব অর্থাৎ অচল সত্য তখন আমাদের মাথার উপরে। উত্তরদিকে গেলে সনাতন সত্য শিবে আরোহন করি আমরা। এর বিপরীতে চললে, ধ্রুব নক্ষত্র নিচের দিকে নাবতে লাগলো। সূর্য্য দক্ষিণের দিকে যেতে লাগলো। আমরা ভোগাভিমুখী হতে লাগলাম। সুতরাং ঈশ্বর বিমুখ হয়ে গেলাম।
আবার বলা হয়ে থাকে, আমাদের মন চন্দ্র দ্বারা প্রভাবিত। শুক্লপক্ষে চাঁদের উদয়ে মন আত্মমুখী।  আর কৃষ্ণপক্ষে আমাদের মন দেহমুখী। রাতে চাঁদের রাজত্ব, মানসিক উন্নতির সময় ।  তাই সাধকরা রাতে জেগে থাকেন। আমরা  রাতে নিদ্রিত থাকি । বলা হয়ে থাকে রাতে যারা সাধনার জন্য  জেগে থাকেন, তারা দেবযানে যাতায়াত করেন, আর যারা নিদ্রা যান তার পিতৃযানে যাতায়াত করেন।  পিতৃযান মানুষকে চক্রাকারে ঘোরায়।  অর্থাৎ জ্জন্মমৃত্যুর চক্র তার পরিক্রমার পথ।  আর দেবযান দিব্যলোকে নিয়ে যায়।  যেখানে গেলে,  ফিরে আসতে না চাইলে, আর ফিরে আসতে  হয় না।
এই দুই পথের সন্ধান যার জানা আছে, তিনি মোহগ্রস্থ হন না। তবে বই পড়ে জানা, বা কারুর কাছ থেকে শুনে জানা, জানা নয়, বিবেকগুরুর কাছ থেকে জানাই জানা। তাই ভগবান অর্জুনকে বলছেন, যোগযুক্ত হও হে অর্জুন।  "যোগযুক্ত ভবার্জ্জুন " ।
এবার আমরা আলোচনার শেষ দিকে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, একমাত্র অনন্য ভক্তির দ্বারাই আমাকে অর্থাৎ পরম পুরুষকে  জানা যায়। এখন ভক্ত কে ?
 ভক্ত হচ্ছেন তিনি যিনি : ১. সর্বদা আমার নাম কীর্ত্তন করেন ; ২. যিনি সর্ব্বদা আমাকে পাবার জন্য চেষ্টা করেন। ৩. আমাকে পাবার জন্য সাধনমার্গে দৃঢ়ভাবে লেগে থাকেন ; ৪. যিনি সর্ব্বদা আমাকেই নমস্কার করেন। ৫. সব সময় আমাতে যুক্ত থেকে আমারই উপাসনা করেন। এর থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি, যিনি কর্ম্মে, চিন্তনে, মননে সর্ব্বদা শ্রীহরিতে যুক্ত থাকেন তিনিই ভক্ত।
শ্রী ভগবান বলছেন, প্রাপ্য বস্তু হচ্ছে ভগবান আর প্রাপ্তির উপায় হচ্ছে ভক্তি। ভাগবত তত্ত্ব জ্ঞাত যে ভক্ত তিনি সেই পরমধামে নিত্য বিরাজ করেন। তার আর এই মর জগতে ফিরে আসতে  হয় না ।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ ; হরি ওং। .....
 -