Wednesday 30 January 2019

পাতঞ্জল যোগসূত্র- সমাধিপাদ (1)

পাতঞ্জল যোগসূত্র


মহর্ষি পতঞ্জলির জীবন সম্পর্কে প্রামাণ্য কোনো পরিচয় বিশেষ জানা যায় না। কারুর মতে. পতঞ্জলি মুনি ছিলেন গোনর্দপুর বাসী প্রাচীন-যোগের পুত্র। মাতার নাম গণিকাদেবী। 

আবার কারুর মতে গোনর্দ দেশে কোনো এক মহান ঋষির সান্ধ্য-উপাসনাকালে ঋষির অঞ্জলি হতে নির্গত হন পতঞ্জলি ।  অর্থাৎ ঋষির অঞ্জলি হতে নির্গত (পতন ) হয়েছিলেন, তাই তার নাম পতঞ্জলি।

একটি প্রচলিত কাহিনী আছে যে পতঞ্জলি ছিলেন অত্রিমুনি  ও অনুসূয়ার পুত্র। 

আবার কোনো কোনো পন্ডিতের মতে, পতঞ্জলি হচ্ছেন ভগবান বিষ্ণুর শয্যা অনন্তনাগের অবতার। কি ভাবে তিনি পৃথিবীতে এলেন তার সম্পর্কে একটা কাহিনী আছে। ভগবান বিষ্ণু যোগনিদ্রায় শায়িত ছিলেন। এবং মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্য দেখছিলেন। অনন্তনাগ বিষ্ণুর ভার আর সইতে পারছিলেন না। ভগবান বিষ্ণুকে জিজ্ঞেস করলেন, ভগবান আপনার ভার আমার কাছে অতিরিক্ত লাগছে কেন ? বিষ্ণু বললেন, আমি এতক্ষন মহাদেবের নৃত্য দেখছিলাম। আর তা দেখে, শিবশক্তি আমার উপরে ভর করেছে। তাই আমার ভার বেড়ে গেছে। অনন্তনাগ এই কথা শুনে, এই অদ্ভুত নৃত্য সম্পর্কে জ্ঞান যাঞা করেন। বিষ্ণু বললেন, ঠিক আছে মহাদেবের  এই কলা সম্পর্কে তোমাকে জ্ঞান দান করবো। কিন্তু তার জন্য তোমাকে মানুষ হিসেবে জন্ম গ্রহণ করতে হবে। ওই সময়ে গণিকা নাম্নী এক যোগবিদুষী, সন্তানের কামনা করছিলেন। তার হাতে একটি সাপ ছিল। ভগবানের  ইচ্ছেয় সেই সাপ হঠাৎ মানুষ্য সন্তানে পরিণত হয়ে যায়। এ সবই রূপক কাহিনী, এর অন্তর্নিহিত অর্থ  আছে, যা আমরা  অর্থ জানিনা। 

যাই হোক, মহামুনি পতঞ্জলি কে ছিলেন, সেই সত্য আমরা না জানলেও তার কার্য্য সম্পর্কে আমাদের কাছে অনেক তথ্য আছে। 

মহর্ষি পতঞ্জলি এক না একাধিক ব্যক্তি ছিলেন, সে নিয়েও পন্ডিতদের মধ্যে মতান্তর আছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে : তার নামে যেমন আমরা "যোগসূত্র" বইখানি পাই, তেমনি পাণিনির "অষ্টাধ্যায়ী"  এর মহাভাষ্য তাঁর নামেই পাই।  এ ছাড়া "চড়কপ্রতিসমস্ক্র্তাঃ" অর্থাৎ চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রথম প্রামাণ্য গ্রন্থ তার নামেতেই পাই।  

যাইহোক, আমাদের আলোচ্য "পাতঞ্জল যোগদর্শন" । পতঞ্জলি সম্পর্কে আমরা শুনলাম। কিন্তু যোগ -ই বা কি আর দর্শন-ই বা কী ? সে সম্পর্কে, আমরা শুনবো। 

যোগ কথাটার অর্থ মিলন। এখানে পরম-আত্মার সঙ্গে জীব-আত্মার মিলন। সমস্ত সাধনার উদ্দেশ্য এই মিলনের অনুভূতি লাভ। দর্শন কথাটার মানে ব্যবহারিক জ্ঞান। 
তাহলে যোগদর্শন কথাটার অর্থ হচ্ছে, পরম-আত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলনের ব্যবহারিক জ্ঞান। 
সাংখ্য দর্শন আত্মতত্ত্বের জ্ঞান। আর  সাংখ্যদর্শনের পরিশিষ্ট হচ্ছে যোগদর্শন, যা এই আত্মতত্ব জ্ঞানের, আমাদের ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ বিধি শেখায় ।

পাতঞ্জল যোগদর্শনে চারটি অধ্যায়। 

১) সমাধিপাদ ; ২) সাধনপাদ ; ৩) বিভূতিপাদ ; এবং ৪) কৈবল্যপাদ ।     

   
সমাধিপাদ 

০১ - অথ যোগ অনুশাসনম। 

এখন যোগ সম্পর্কে অনুশাসন বা বিধি-উপদেশ দেওয়া হচ্ছে।
অথ অর্থাৎ এখন। আসলে এইসব উপদেশ চিরকালীন। তাই অথ। না ভূত না ভবিষ্যৎ সবসময়ই বর্তমান। কারুর কারুর মতে, অথ শব্দের অর্থ অধিকার। অর্থাৎ একমাত্র অধিকারীই এই উপদেশ শ্রবণ যোগ্য।
যোগ অর্থাৎ মিলন, একের সঙ্গে অন্যের মিলন বা যোগ । যিনি এই যোগের প্রক্রিয়ায় বা চেষ্টায় রত তিনিই যোগী।
অনুশাসনম অর্থাৎ সুক্ষ নিয়ন্ত্রণ।  অনু কথাটার মানে সুক্ষ, শাসন অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ।
তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম - যোগ্যব্যক্তিকে বর্তমানে (চিরকালীন) মিলনের বা যোগের সুক্ষ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে উপদেশ প্রদান করা হচ্ছে।

০২ - যোগ চিত্তবৃত্তি নিরোধঃ। 

যোগ হচ্ছে চিত্তবৃত্তির নিরোধ। 
যোগ প্রক্রিয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে চিত্তবৃত্তিকে নিরোধ  করা অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ করা । এখন চিত্ত কী আর তার বৃত্তিই বা কী ? আমরা পঞ্চ ইন্দ্রিয়দ্বারা (চক্ষু, নাসিকা, জিহ্ববা ত্বক) যখনি বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হই, তখন আমাদের গ্রাহক  গ্রন্থির সাহায্যে গ্রন্থিচক্রে স্পন্দন তোলে। এবং গ্রন্থিচক্রের প্রধান কর্মকেন্দ্র মস্তিষ্কে আলোড়ন তোলে।  সেখানে সঞ্চিত স্মৃতি-অভিজ্ঞতা দ্বারা বহির্জগতের ক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করা হয়। এবং তত্ক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, এবং বাহক গ্রন্থির সাহায্যে কর্মকেন্ত্রগুলিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাঠায়। সেইমত ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। এই গ্রন্থিচক্রগুলোই চিত্ত।  আর এই চিত্তে যখন আলোড়ন হয় অর্থাৎ বহির্জগতের ক্রিয়া, দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ, আস্বাদ, ইত্যাদি যখন গ্রাহক যন্ত্রের সাহায্যে প্রতিফলিত হয়, তখন চিত্ত বা গ্রন্থিচক্রের রসে আন্দোলন তোলে।  এবং আমরা বিচলিত হয়ে উঠি। অর্থাৎ গ্রন্থিরসে আন্দোলন না হলে আমাদের চিত্ত বিক্ষিপ্ত হবে না।  তাই পতঞ্জলি বলছেন চিত্তবৃত্তিকে নিরোধ করতে পারলেই যোগ সম্পাদিত হবে। অর্থাৎ  চিত্তবৃত্তিকে নিরোধ করো।

এখন কথা হচ্ছে চোখ থাকলে আমরা দেখবো, কান থাকলে শুনবো, ত্বকে আমাদের অনুভূতি হবে, নাক থাকলে আমরা গন্ধ পাবো, জিহ্বা আস্বাদন করবে।  এগুলোকে কি ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে ? দেখুন চোখ দেখে না। এই প্রক্রিয়া কি করে সম্পাদিত হয় সেটা আমরা একবার দেখে নেই। মাথার মধ্যে যে উচ্চ, মধ্যে, ও নিম্ন মস্তিস্ক আছে, এগুলো তারই ক্রিয়া। মস্তিস্ক থেকে  এই গ্রন্থি সরিয়ে নিন। চোখকে চোখের  জায়গায় থাকতে দিন। তখন চোখ কি দেখতে পাবে ? পাবে না। মস্তিষ্কের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলেও চোখ ঠিক থাকে।  তাই মানুষের মৃত্যুর পরে মানুষের চোখ অন্যের শরীরে প্ৰতিস্থাপন করে চোখের ক্রিয়া বজায় রাখা যায়। তখন সে আবার দেখতে পায়। আমাদের এই মস্তিষ্কের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের যোগ নিষ্ক্রিয় করতে হবে। বিচ্ছিন্ন নয়, নিষ্ক্রিয় করতে হবে। এটাই যোগ। বহির্জগতের সঙ্গে নিজেকে বিচ্ছিন্ন  করা, যোগাযোগের মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা । আর এটা করা যেতে পারে যোগের মাধ্যমে। অর্থাৎ যিনি সত্যিকারে দ্রষ্টা তাকে আত্মস্থ করা। অর্থাৎ তাকে নিজের মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়া। নিজেকে নিজের মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়া। এই প্রক্রিয়ার নামই যোগ।

শ্রীমতি রাধারানী একাকিনী গিয়েছেন যমুনায়। কলসিতে জল ভরে আনবেন, নদী থেকে। কবির ভাষায়, "একা  কুম্ভ কাঁখে করি /  যমুনাতে জল ভরি " . আমরাও নিজ নিজ জীবন ঘট্ পূর্ন করবার জন্য মন যমুনার তটে যাই। এই মন-যমুনাতেই বংশীধারীর ছায়া পড়ে। রশিক আমি, প্রেমিক আমি তাকে ধরতে চাই। শ্রীরাধাও অনিন্দ্যসুন্দর সেই মুরলীধরকে  যমুনার জলে দেখে আকুল হয়ে ওঠে। তাকে পেতে চায়।  ধরতে চায়। কিন্তু কানু একবার দেখা দিয়েই আবার জলের মধ্যে লুকায়। শ্রী রাধার মনে হলো, কানু জলেই আছে। শ্রীরাধার ব্যাকুলতা বাড়ে। তাই তখন শ্রীরাধা, "অনেক প্রবন্ধ করি, ধরিবারে যায় হরি, ধীরে ধীরে কর বাঢ়াইনু" । শ্রীরাধার ব্যাকুলতা তীব্র হয়। যতই রাধা জলের মধ্যে হাত বাড়ায়, কানুকে ধরবার জন্য, কানু ততই জলেতেই মিলিয়ে যায়, যেন জলেতে লুকায়। শ্রীমতি    ধীরে  হাত বাড়ায় জলের মধ্যে।  কিন্তু ফল হয় উল্টো। "কর বাড়াইয়া যাই আর না দেখিতে পাই". শেষে "আকুল হইয়া জলেতে ডুবিনু " . শ্রীমতি যত হাত বাড়ায়, জল  তাতো আন্দোলিত হয়। শ্রীমতি যত যমুনার ভিতরে এগিয়ে যায়, মুরলীধর তাতো অদৃশ্য হয়। আকুল-ব্যাকুল শ্রীরাধা তখন যমুনার জলে ডুব দেয়। ভাবে ডুব দিলে নিশ্চয়ই কানুকে পাবে। কিন্তু হায়, ডুব দেবার ফলে জল হলো তোলপাড়, কানু হলো অগোচার। ডুব দেবার ফলে, জলে আন্দোলন উঠলো, তরঙ্গ সংকুল যমুনায়  কানুকে আর পাওয়া গেলো না। কোথায় তাঁর সেই প্রাণেশ্বর ? খেদ করে, শ্রীরাধিকা বলে উঠলো "ঢেউ মোর হলো কাল, না পাইনু নন্দলাল, উঠিলাম যমুনার তীরে। শ্রীমতি বুঝলেন, তরঙ্গ, যা আমি মন যমুনায়  নিজেই তুলেছি, সেই তরঙ্গই ছিন্ন-ভিন্ন করে দিলো আনন্দ-মুরতি। হায় হায়, এ কি করলাম আমি। কাঁদতে কাঁদতে শ্রীরাধিকা ঘরে ফিরলেন , শুন্য   কলসি নয়ন জলে পুরে। কবি বলছেন, "না হেরি বঁধুর মুখ, হইলো বিষম দুঃখ, কাঁদিতে কাঁদিতে এলাম ঘরে " . আমাদের সবার সেই এক দশা। মন যমুনার শান্ত জলে, হঠাৎ করে ক্ষণিক তরে ভেসে ওঠে সেই পরমেশ্বরের ছায়া।  চঞ্চল মন তাকে পেয়েও পায়  না। দেখেও দেখে না। "ক্ষণিক আলোকে আখির পলকে " একবার দেখা দিয়েই তিনি মিলিয়ে যান।

তাই মহর্ষি পতঞ্জলি বলছেন, আগে চিত্ত-তরঙ্গ শান্ত করো। উপাসনা যদি করতে চাও, তবে মনকে আগে শান্ত করো। অথবা উপাসনা দ্বারা মনকে শান্ত করো। একমাত্র তাহলেই তোমার শান্ত চিত্তে তিনি সমাহিত হবেন। তাকে সম্যক  রূপে জানতে পারবে।

এর পরের ধাপ তার মধ্যে লয়  হওয়া, আর সেটা করতে গেলে আরো এগুতে হবে। মনভূমিতে যা দেখছো তাতো তিনি নন। তার ছায়া মাত্র। তিনি তো ওপরে। চিত্তে ছায়া পড়েছে মাত্র। পরমপিতার প্রতিবিম্ব পরে চিত্তে। যার প্রতিবিম্ব আমার চিত্তে, যার ছায়া যমুনার জলে, তিনি তো আসলে কদম্ব ডালে। তাই কবি বলছেন, "মিছে কেন ডুবেছিলে জলে ? বুঝিতে নারিলে মায়া, জলে ছিল অঙ্গ-ছায়া, (তোমার) শ্যাম ছিল কদম্বেরি ডালে।"

আমরা আমাদের মনের দিকে তাকাই না। আমাদের আমাদের হৃদয়ের মধ্যেও তাকে অনুসন্ধান করি না। আমরা আমাদের বুদ্ধি দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে, পরম-পিতাকে জানতে চাই , ধরতে চাই, আর তাই তো আমরা বঞ্চিত হই, বিড়ম্বিত হয়, বিলম্বিত হই। তাই মহর্ষি পতঞ্জলি, তার যোগদর্শনে বলছেন, যোগ চিত্তবৃত্তি নিরোধঃ - অর্থাৎ চিত্তবৃত্তিকে নিরোধ করাই যোগ। পরম-পিতার সঙ্গে মিলনের প্রথম সোপান।       
     

০৩ - তদা দ্রষ্টূ স্বরূপে অবস্থানম। 

সেই অবস্থায় দ্রষ্টা  স্ব-রূপে অবস্থান করে।
পতঞ্জলি বলছেন এই যোগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে, দ্রষ্টা অর্থাৎ সত্যিকারের আমি স্বরূপে অবস্থান করবে। সে তখন ইন্দ্রিয় প্রদত্ত্ব তথ্য দ্বারা আবেশিত হবে না। এখন এই দ্রষ্টাই বা কে ? আর স্বরূপ-ই বা কি ? দ্রষ্টা হচ্ছেন আত্মা, আর স্ব-রূপ হচ্ছে সৎ-চিৎ-আনন্দম।  অর্থাৎ সত্য, চিন্ময়স্বরূপ, আনন্দ স্বরূপ। মহর্ষি পতঞ্জলি এর আগের শ্লোকে বলেছিলেন, চিত্তবৃত্তি নিরোধ করতে হবে। এখন বলছেন, এই অবস্থায় অর্থাৎ নিরোধ কালে, যোগী স্বরূপে অবস্থান করবেন। অর্থাৎ  পরমপুরুষ পরম-ঈশ্বর বা দ্রষ্টা স্বরূপে অবস্থান করবেন। তাহলে বলা যেতে পারে, দ্রষ্টার স্বরূপে অবস্থিতির জন্য, চিত্ত বৃত্তির নিরোধ আবশ্যিক, এবং চিত্তবৃত্তি নিরোধ হলে, পরমপুরুষ চিত্তে সঠিক ভাবে প্রতিফলিত হতে পারে।

আমাদের বাড়িতে একটা ডায়মন্ড শেপের কাঁচের  টুকরো আছে। সেই কাঁচের টুকরোতে বিরাট সূর্য প্রতিফলিত হয়। এবং সূর্য্যরশ্মি ঔ কাঁচে প্রতিফলিত হয়ে আবার ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ঘর আলোকিত হয়।
যোগী যখন নিরোধের অবস্থায় থাকে, তখন তার চিত্তে পরমপুরুষ  প্রতিফলিত হয়। যোগের ভাষায় এই অবস্থাকে বলে, অসম্প্রজ্ঞা। এই অসম্প্রজ্ঞাতে যোগী পূর্বাপূর্ব সংস্কারহীন হয়ে যান । এবং এই অবস্থায় যোগী নৈষ্কর্ম্যক হয়ে যায়। এই অবস্থায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তূ সম্পর্কে তিনি নির্লিপ্ত হয়ে যান। ফলতঃ, কান থাকতেও তিনি শোনেন না। চোখ থাকতেও তিনি দেখেন না। ত্বক থেকেও তিনি স্পর্শবোধ করেন না।জিব্বায় স্বাদবোধ থাকে না।  নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের গতি ধীর হতে হতে .... নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, অচেতন বা শ্বাসরুদ্ধ  অবস্থা বলা যেতে পারে। ভুলক্রমে এঁকে মৃত বলা যেতে পারে। কিন্তু দেহের অগ্নি, বায়ুর খেলা বন্ধ হয় না। এটাকে কেউ কেউ বিক্ষেপ অবস্থা বলে। এখন কথা হচ্ছে পরমপুরুষ সঙ্গে এই বিক্ষেপ অবস্থায় চিত্তবৃত্তির সম্বন্ধটা কি হয় ?

এর পরের  শ্লোকে মহর্ষি পতঞ্জলি বলছেন :           

০৪ -  বৃত্তি সারূপ্যম ইতর অত্র। 

এই সময় বৃত্তি স্বরূপে অবস্থান  করে, অন্য সময় বৃত্তি অন্যত্র অবস্থান করে।
এই যোগে অবস্থিত করতে পারলে, বৃত্তি অর্থাৎ গ্রন্থিরস স্থির, আন্দোলনহীন অবস্থায় অবস্থান করবে এবং এই আন্দোলনহীন অবস্থায় পরম-আত্মা চিত্তে প্রতিফলিত হবে। কিন্তু অন্য্ সময় চিত্ত যখন ইন্দ্রিয় লব্ধ অনুভূতিতে স্পৃষ্ট থাকবে, তখন বৃত্তি প্রতিনিয়ত চঞ্চল ও বাহ্যিক ক্রিয়াশীল থাকবে।

বৃত্তি সারূপ্যম, অর্থাৎ এই সময় বৃত্তি স্ব-রূপে অবস্থান করে। চিত্ত আসলে যেন একটা চুম্বক, পরম-পুরুষের কাছে আসা মাত্র, চিত্ত পরম-পুরুষের নিজস্ব স্ব-রূপ হয়। সেই জন্য, চিত্তবৃত্তি জ্ঞানের সঙ্গে পরম-পুরুষের একাত্মতা অনুভব হয়। এবং এই সম্বন্ধন আদি অনাদি। এই পুরুষ হলো ভোক্তা।  আর চিত্ত হলো ভোগ্য দৃশ্য। এবং বৃত্তি হলো বিষয়। চিত্তই বিষয় আকারে পরিমিত হয়ে আমিত্ত্বযুক্ত জ্ঞানবান পুরুষের সামনে তুলে ধরে। এবং আমিত্ত্বযুক্ত জ্ঞানবান পুরুষ তখন দ্রষ্টা। আর দ্রোষ্টা-ই সাক্ষী-চৈতন্য। আমাদের শরীরে চেতন-পুরুষের অবস্থান হওয়ায় ইন্দ্রিয় ও করণগুলি চেতনের মতো কাজ করে। তাই চিত্তবৃত্তি তার দর্শিত বিষয় চেতনপুরুষকে ভোগ করায়। তাই পরম-পুরুষ নিজে ভোগাতীত হয়েও যেন ভোগাধীন হয়ে যান। নিজেকে বৃত্তির অধীনে রেখে বৃত্তির সঙ্গে অভেদ প্রতিপন্ন হন। অনন্ত কালের এই অজ্ঞানতা আমাদের সংস্কার রূপে দৃঢ় হয়ে গেছে। তাই সংস্কারবসত আমাদের চিত্তের সঙ্গে পরম-পুরুষের একতানতা অনুভব হয়। দ্রষ্টা ও দৃশ্য আমরা এক করে ফেলি। দ্রষ্টা স্বয়ং-প্রকাশ, আর দৃশ্য প্রকাশ সাপেক্ষ। ভোগ্য, ভোক্তা, দ্রষ্টা। ভোগ্য হচ্ছে দৃশ্য। ভোক্তা হচ্ছে আমিত্ত্বযুক্ত পুরুষ, দ্রষ্টা হচ্ছেন পরম-পুরুষ। একটা সুন্দর উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানো হয়েছে। একটা গাছে দুটো পাখি। গাছের সুমিষ্ট  পার্থিব ফল একটা পাখি খাচ্ছে, তিনি আমিত্বযুক্ত পুরুষ, আর একটা পাখি দেখছে, যিনি দ্রষ্টা অর্থাৎ পরম পুরুষ ।

যুক্ত করে রাখাকেই বলে যোগ। এককে অগ্রাধিকার দিয়ে মনকে স্থির করতে পারলেই যোগ সম্ভব। চিত্ত সদা চঞ্চল। বহু বিষয়ে ধাবিত। চিত্তকে বহুমুখী অবস্থান থেকে সরিয়ে একমুখী করে যোগ। আমাদের চিত্তে পরস্পর বিচ্ছিন্ন চিন্তাধারার স্রোত বইছে। বিরামহীন, নিয়ন্ত্রণহীন এই চিন্তাস্রোত। এবং এসবই বিষয়মুখী। প্রকৃতি  থেকে উৎপন্ন। এ যেন এক বহমান নদী। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের মন থাকবে আর তার চঞ্চলতা থাকবে না সেটা তো হতে পারে না। এইখানেই যোগের কারিকুরি। যোগ আমাদের শেখায়, বহমান চঞ্চল ধারাকে অবিচ্ছিন্ন ধারায় প্রবাহিত করা যায় কি না। নদী বয়ে চলবে। কিন্তু তার ঢেউকে প্রশমিত করবার জন্য, আমাদের বুঝতে হবে ঢেউ কেন হয়। নদীর ভেতরের ভূমিকে যদি সমতল করা যায়, তবে বহমান নদী তার চঞ্চলটাকে স্তিমিত করে দেবে। আর আমরা এই চিত্তনদীতে পরম-পুরুষের স্থির প্রতিফলন অনুভব করতে পারবো। এই জন্য প্রথমে  দুটো ঢেউয়ের মাঝের সময়কে আমাদের ধরতে হবে।  এবং তখনি আমরা ধরতে পারবো ভূমির অচঞ্চল অবস্থা। আর আমাদের চিন্তা যেহেতু বিষয় ভিত্তিক, এবং বিষয় যেহেতু প্রকৃতির অঙ্গ মাত্র তাই প্রকৃতির পরিবর্তনের ক্ষণটিকে ধরতে হবে। অর্থাৎ বৃত্তির বিষয়ান্তরে যাবার ক্ষণটিকে ধরতে হবে। প্রকৃতির যেমন পাঁচটি সন্ধিক্ষণ আছে অর্থাৎ সকাল, সন্ধ্যা, দুপুর গভীর রাত ও ব্রাহ্মমুহূর্ত।  এই সময়গুলোকে কাজে লাগাতে হবে। যোগ দর্শন এক যুক্তিভিত্তিক, পৃকৃতিবন্ধু চিত্ত দিয়েই চিত্তকে উদ্ধারের প্রক্রিয়া। ধীরে ধীরে আমরা সে সব জানবো।       


০৫ -বৃত্তয়ঃ পঞ্চতয্য ক্লিষ্টা অক্লিষ্টাঃ।

বৃত্তি পাঁচ প্রকার - ক্লেশ সহ ও ক্লেশ বিহীন।
মহর্ষি পতঞ্জলি বলছেন বৃত্তি পাঁচ প্রকার, অর্থাৎ বৃত্তির ক্রিয়াফল পাঁচ রকম।  এর মধ্যে কিছু আছে ক্লেশকর আর কিছু আছে ক্লেশবিহীন। সেগুলি কী ? পরের  শ্লোকে বলছেন :

০৬ - প্রমান-বিপর্যয়-বিকল্প-নিদ্রা-স্মৃতয়ঃ। 

প্রমান অর্থাৎ প্রত্যক্ষ জ্ঞান ,বিপর্যয় অর্থাৎ  বিপরীত জ্ঞান বা  ভ্ৰম , বিকল্প অর্থাৎ প্রায় একই রকম,  এর পর আছে নিদ্রা, ও  স্মৃতি ইত্যাদি। 

প্রমান বা প্রতক্ষ্য জ্ঞান তিন রকম।
এক ) ইন্দ্রিয় উপলব্ধি : আমরা ইন্দ্রিয় দিয়ে যা  উপলব্ধি করি। যদিও ইন্দ্রিয় আমাদের মাঝে মধ্যে  বিভ্রম ঘটায়। এই বিভ্রম বাদ  দিলে, যা কিছু আমরা অনুভব করছি বা দেখতে পারছি সেটাই আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বা প্রমান। আমার চারিপাশে যা কিছু দেখছি, এটাই যথেষ্ট প্রমান যে এইসব দৃশ্যমান বস্তু আছে।

দুই) চিহ্ন : কোনো চিহ্ন দেখে আমরা চিহ্ন-সূচিত কোনো জিনিস আমরা বুঝতে পারি। অর্থাৎ ধোঁয়া দেখে আগুন, বাঘের পদচিন্হ দেখে বাঘের উপস্থিতি অনুমান করা যেতে পারে।

তিন) আপ্তবাক্য : সত্যদ্রষ্টা  যোগীদের অনুভবলবদ্ধ আপ্ত বাক্য। আপ্ত কথাটার মানে হচ্ছে সিদ্ধ। অর্থাৎ সিদ্ধ পুরুষ দ্বারা দেখা বা অনুমান করা যে বিষয়টি অপরকে শোনানো হয়েছে,  সেটাই
আগম- প্রমান। এখন যার কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়, যিনি অশ্রদ্ধেও সেই আগম-জ্ঞান মিথ্যা। মূল বক্তা যদি বিষয়কে প্রতক্ষ্য করে থাকেন, বা অনুমান দ্বারা স্থির সিদ্ধান্তে আসতে  পারেন,  বক্তব্যকে আগম প্রমান বলা হবে। এইবার সিদ্ধ পুরুষ থেকে বাক্য শোনার পর, সে কথা অনুযায়ী পদার্থের জ্ঞান হলে, বা সেই আকারের বৃত্তি জন্মালে তবেই তা আগম।

বিপর্যয় : বিপর্যয় কথাটার মানে বিভ্রান্তিকর।  আমরা কোনো জিনিষ বা বস্তু প্রতক্ষ্য করছি সত্য, কিন্তু অনুভবে সত্য প্রতিফলিত হচ্ছে না। আপাতত মনে হচ্ছে ওটা সাপ। কিন্তু আলো  জ্বালার পরে বুঝতে পারলাম ওটা আসলে দড়ি। এই বিপর্যয় জ্ঞান আমাদের হয় তখনই যখন আমরা বস্তুতে প্রয়জনীয় জ্ঞানের আলো বিকিরণ করতে না পারি।

এই প্রসঙ্গে একটা গল্প শুনেছিলাম : এক মাতাল রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করছিলো। সবাই তার দিকে তাকাতেই সে প্রচণ্ড বেগে, ল্যাম্পপোস্টে উঠে গেল। এক্ষেত্রে পুলিশ যা করে, তাই করলো।  তাকে ল্যাম্প পোস্ট থেকে জোর করে নাবিয়ে, কোর্টে  চালান করে দিলো।  বিচারক জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার তোমার ? মহাশয়, আমার কোনো দোষ  নেই, আমাকে বাঘের মতো দেখতে, তিনটে কুমির আমাকে তাড়া করলো যে, তাই ভয়ে, আর নিজেকে বাঁচাতে, আমি ল্যাম্প পোস্টে উঠে গিয়েছিলাম। শহরের রাস্তায়, কুমির বা বাঘ ?  আর বাঘের মতো দেখতে কুমির ? অথচ মাতাল কিন্তু দেখেছিলো, এবং সেই জন্যই লাফিয়ে ল্যাম্প-পোস্টে উঠেছিলো ।  আমরাও বিপর্যয় জ্ঞানে এইরূপ দেখছি।

বিকল্প :  চিত্ত যখন বিক্ষিপ্ত থাকে, আমরা তখন সত্য অনুভব করতে পারি না। এই বিক্ষিপ্ত চিত্তে আমরা যে জ্ঞান সঞ্চয় করি তা অসত্য হতে পারে, অসম্পূর্ন হতে পারে। তাই আমাদের জ্ঞান সংগ্রহের সময় সংযত হতে হবে, ধৈর্য্যশীল হতে হবে। নতুবা সংগৃহিত জ্ঞান অসম্পূর্ন বা অসত্য হতে পারে। এটাই বিকল্প জ্ঞান।

নিদ্রা : নিদ্রা অর্থাৎ ঘুম। আমরা ঘুমের মধ্যে  স্বপ্ন দেখি। এবং স্বপ্নে দেখা সবকিছুই আমাদের মধ্যে সাময়িক সত্য অনুভূতি দেয়। এবং আমাদের মধ্যে আলোড়ন তোলে, আমরা ভয় পাই, আনন্দ পাই। তাই নিদ্রা কালীন আমাদের জ্ঞান সাময়িক ও অসত্য জ্ঞান।  যা আমরা ঘুম থেকে জেগে উঠলে বুঝতে পারি।

স্মৃতি : আমাদের পূর্ব সংগৃহিত অভিজ্ঞতার নাম স্মৃতি। স্মৃতি আমাদেরকে বর্তমানেও বিব্রত করে। সুখ দুঃখের অনুভূতি তোলে। অথচ এই মুহূর্তে যার কোনো অস্তিত্ব নেই।আধ্যাত্মিক জগতে স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলাই কাজ। অর্থাৎ স্বরূপের স্মৃতি জাগ্রত করা। আমি কে সেই স্মৃতি জাগিয়ে তোলাই উদ্দেশ্য।    

০৭ - প্রত্যক্ষ অনুমান আগমঃ প্রমাণানি 

প্রমান হচ্ছে তিন প্রকার - প্রত্যক্ষ, অনুমান, ও আগম অর্থাৎ আপ্তবাক্য।

প্রত্যক্ষ জ্ঞান : আমাদের প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভের উপায় বা মাধ্যম হচ্ছে ইন্দ্রিয়বর্গ । আমরা চোখ দিয়ে দেখি, কান দিয়ে শুনি, নাক দিয়ে ঘ্রান নেই, জিভ দিয়ে আস্বাদ নেই, ত্বক বা চামড়া দিয়ে স্পর্শ করি। এগুলোর সাহায্যেই আমরা অকাট্য প্রমান পাই। এই ইন্দ্রিয় লব্ধ জ্ঞানই আমাদের সাক্ষাৎ জ্ঞান।

অনুমান : প্রতক্ষ্য পূর্ব-অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞানকে আশ্রয় করে মানুষ অনুমানের সাহায্যে নতুন জ্ঞান আহরণ করতে পারে। বাঘের পদ-চিহ্ন দেখে জঙ্গলে বাঘের বাস অনুমান করতে পারি ।

আগম বা আপ্তবাক্য : অর্থাৎ বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির কাছ থেকে, আমরা জ্ঞান সংগ্রহ করতে পারি।       

০৮ - বিপর্যয়ো মিথ্যা জ্ঞানম তদ্রুপ প্রতিষ্ঠম। 

বিপর্যয় হলো মিথ্যা জ্ঞান  অর্থাৎ আপাততঃ মনে হয় সত্য এবং সেইমতো জ্ঞান প্রতিষ্ঠা হয়।

বিপর্যয় বা মিথ্যা জ্ঞান অর্থাৎ আমরা যে প্রতক্ষ্য করছি এটা  সত্য, কিন্তু যা প্রতক্ষ্য করছি সেটাই  সত্য এমন নয়। অথবা এমন অনেক কিছু আছে, যা আমাদের প্রত্যক্ষের বাইরে, কিন্তু সত্য। আসলে আমাদের ইন্দ্রিয়বর্গের একটা নিজস্ব সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা অতিরিক্ত কাছের বস্তু দেখতে পাই না।  আমরা অতিরিক্ত দূরের কিছু দেখতে পাই না। আলো  কম হলে  আমরা দেখতে পাই না।  আলো  বেশি হলে আমরা দেখতে পাই না। এই সীমাবদ্ধতা চোখের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি আমাদের কানের ক্ষেত্রেও  সত্য। খুব উঁচুগ্রাম বা খুব নিচুগ্রামের শব্দ আমরা শুনতে পাই না। আমাদের চোখের দৃষ্টিগ্রাহ্যতার যেমন একটা সীমা  আছে। আমাদের কানেরও তেমনি শ্রূতিগ্রাহ্যতার একটা সীমা আছে। তাই ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে লব্ধ প্রতক্ষ্য জ্ঞান আমাদের সম্পূর্ণ জ্ঞান দান করতে পারে না।      

০৯ - শব্দ-জ্ঞানানুপাতী বস্তূ শূন্য বিকল্পঃ। 

শব্দ জ্ঞানের অনুধাবনকারী বস্তূ বিহীন বিকল্প।

শব্দজ্ঞান  আসলে বস্তু নিরপেক্ষ জ্ঞান।  কোনো শব্দই আমাদের বস্তুর জ্ঞান দিতে পারে না।
"বাঘ" বলতে আমাদের মনে একটা বাঘের ছবি  ভেসে ওঠে মাত্র। বাঘের গর্জন আমাদের কাছাকাছি বাঘ আছে এই জ্ঞান দিতে পারে মাত্র।  তার বেশি কিছু নয়।   

১০ - অভাব প্রত্যয়ালম্বনা বৃত্তিঃ নিদ্রা। 

(জ্ঞানের) অভাবকে আশ্রয় করে যে প্রত্যয় বৃত্তি-তে হয় তাকে নিদ্রা বলে।

নিদ্রা তিনটি স্তরে বিভক্ত।  আচ্ছন্ন, স্বপ্ন, সুষুপ্তি। আচ্ছন্ন অবস্থায় আমরা বিশ্রাম করি মাত্র। স্বপ্নে আমরা ক্রিয়াশীল হয়ে যাই। সুষুপ্তিতে  আমরা সাম্যাবস্থায় থাকি। স্বপ্নে আমাদের কর্ম-ইন্দ্রিয়গুলো ও জ্ঞান ইন্দ্রিয় গুলো জড়বৎ থাকে, কিন্তু মন, বুদ্ধি,চিত্ত অহংকার ইত্যাদি এবং মস্তিষ্কের পরিচালন অংশ অর্থাৎ মধ্যে-মস্তিস্ক সচেষ্ট থাকে।     

১১ - অনুভূত  বিষয় অসম্প্রমোষঃ স্মৃতিঃ। 

শুধুমাত্র অনুভূত হয়েছে, অন্যগুলো নয় , হচ্ছে স্মৃতি।

যা অনুভব হয়েছে, তাই স্মৃতি। আসলে সমগ্র আধ্যাত্মিক জগতে সবথেকে গুরুত্ত্বপূর্ন হচ্ছে স্মৃতি। এই স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলাই সাধনা। আমি কে, তা এই স্মৃতিতে আছে। সমস্ত জ্ঞান ভান্ডার এই স্মৃতি। আমরা নতুন করে কিছু জানি না। স্মৃতিতে যা আছে, তাকে উন্মোচন করাই জ্ঞানের সাধনা, আধ্যাত্মিক সাধনা।    

১২ - অভ্যাস বৈরাগ্যাভ্যাং তন্ নিরোধঃ। 

অভ্যাস ও বৈরাগ্যের সাহায্যে এদের নিরোধ করতে হবে। 

১৩ - তত্র  স্থিতৌ যত্ন  অভ্যাসঃ। 

এই অবস্থায় থেকে অর্থাৎ অভ্যাস ও বৈরাগ্যের সাহায্যে বৃত্তি নিরোধ ক্রিয়া  অবিরাম অভ্যাস করে যেতে হবে। 

১৪ - স তু  দীর্ঘকাল নৈরন্তর্য সৎকার আসেবিতো দৃঢ়ভূমিঃ। 

সেই অভ্যাস কিন্তু দীর্ঘকাল আদরের সঙ্গে পালন  করলে, তা দৃঢ় স্থান করে নেয়। 

১৫ - দৃষ্ট  আনুশ্রবিক বিষয় বিতৃষ্ণস্য বশীকার  সংজ্ঞা বৈরাগ্যম।

দেখা বা শোনা সমস্ত বিষয়ে বিতৃষ্ণাকারীর বাশিকার নামক বৈরাগ্য উৎপন্ন হয়। 

১৬ - তৎ পরং পুরুষখ্যাতেঃ গুনবৈতৃষ্ণ্যম্। 

তারপর পুরুষখ্যাতি সিদ্ধ হলে গুণে  বিতৃষ্ণার উদয় হয়।  

১৭ - বিতর্ক বিচার আনন্দ অস্মিতা রূপানুগমাৎ সম্প্রজ্ঞাতঃ। 

বিতর্ক, বিচার, আনন্দ ও অস্মিতা রূপে অনুগমনের পরে যে অবস্থা বা  সমাধি তাকে সম্প্রজ্ঞাত বলে।

১৮ - বিরাম প্রত্যয় অভ্যাস-পূর্বঃ সংস্কার-শেষঃ অন্যঃ

বিরামের প্রত্যয় অভ্যাস পূর্বক সংস্কারের যে শেষ অবস্থা তাকে অন্য অর্থাৎ সম্প্রজ্ঞাত  থেকে অন্য অর্থাৎ অসম্প্রজ্ঞাত বলে। 

১৯ -  ভব প্রত্যয়ো বিদেহ প্রকৃতিলয়ানাম্

বিদেহ ও প্রকৃতিলয় পুরুষদের ভব-প্রত্যয়  হয়।

২০ - শ্রদ্ধা বীর্য স্মৃতি সমাধি প্রজ্ঞা পূর্বক ইতরেষাম্। 

শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি, প্রজ্ঞা সমাধি  দ্বারাই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি লাভ হয়, অন্যথা নয়। 

২১ - তীব্র সংবেগানাম আসন্নঃ। 

তীব্র বেগশালীদের  সমাধি আসন্ন। 

২২ - মৃদু মধ্য অধিক মাত্র ত্বাৎ ততো অপি বিশেষঃ। 

বেগের মাত্রার তারতম্যে অর্থাৎ মৃদু, মধ্যে, বা অধিক বেগের জন্য  আসন্ন সমাধির তারতম্য  রয়েছে। 

২৩ - ঈশ্বর প্রণিধানৎ বা 

অথবা ঈশ্বরেতে প্রণিধান থেকেও সমাধি লাভ হয়। 

২৪ - ক্লেশ কর্ম বিপাকশৈঃ অপরামৃষ্টঃ পুরুষ বিশেষ ঈশ্বরঃ

অবিদ্যা জনিত যে ক্লেশ, ক্লেশ জনিত যে কর্মের  উদ্ভব , আবার কর্ম জনিত যে ফল তার সঙ্গে যিনি অপরামৃষ্ট অর্থাৎ সম্মন্ধ বিহীন সেই পুরুষই ঈশ্বর। 

২৫ - তত্র নিরতিশয়ং সর্বজ্ঞ বীজম। 

সেখানে সর্বজ্ঞ বীজ সদা সর্বদা বিরাজমান। 

২৬ - পূর্বেষামপি  গুরুঃ কালেন অনবচ্ছেদাৎ। 

তিনি পূর্ব  পূর্ব গুরুদেরও  গুরু, কারন কাল দিয়ে তাকে ছেদন করা যায় না। 

২৭ - তস্য বাচকঃ প্রণবঃ। 

সেই বাচক অর্থাৎ শব্দই প্রণব বা ওঁ-কার। 

২৮ - তৎ জপ তদ্ অর্থ ভাবনম্। 

তৎ অর্থাৎ প্রণব বা ওঁ জপ করো, এবং তার অন্তর্নিহিত অর্থ ভাবো।  তারই জপ্ তারই অর্থ ভাবনা।

২৯ - তৎ প্রত্যেক চেতন অধিগমঃ অপি অন্তরায় অভাবশ্চ।

তৎ অর্থাৎ এই ভাবে জপ্ করলে প্রত্যেক চেতনে অধিগমন হয় অর্থাৎ সমস্ত চেতনার  জ্ঞান হয়, এবং সমস্ত অন্তরায় দূর হয় বা অন্তরায়ের অভাব হয়। 

৩০ - ব্যাধি স্তান্যং সংশয়ঃ প্রমাদঃ আলস্যাৎ অবিরতি ভ্রান্তি দর্শন অলব্ধ
         ভুমিকত্বং অনবস্থিত ত্বানি চিত্ত বিক্ষেপাঃ তে অন্তরায়াঃ। 

ব্যাধি, চিত্তের অলসতা, সংশয়, প্রমাদ, আলস্য, অবিরাম ভ্রান্তি দর্শন, অলব্ধ  ভূমিকত্ব অর্থাৎ সমাধি লাভ করতে দেয় না। চিত্ত বিক্ষেপের  কারন তাই এগুলি  সমাধির অন্তরায়।  

৩১ - দুঃখম  দৌর্মনস্য অঙ্গমেজয়ত্বং শ্বাস-প্রশ্বাসঃ বিক্ষেপসহ ভুবঃ। 

দুঃখ, দূর্দমনস্য অর্থাৎ ইচ্ছায় বাঁধা সৃষ্টি হলে চিত্তে যে বিক্ষেপ জন্মায়, অঙ্গমেজয়ত্ব মানে শরীরের কম্পন, শ্বাস-প্রশ্বাস অর্থাৎ বায়ু গ্রহণ ও ত্যাগ, বিক্ষেপসহ ভুবঃ অর্থাৎ এই চিত্ত বিক্ষেপের সঙ্গে জন্ম। 
 অদমনীয় এবং অপূরণীয়  ইচ্ছার ফলে যে চিত্ত বিক্ষেপ হয় তাই দুঃখ। 

৩২ - তৎ প্রতিষেধার্থম একতত্ব  অভ্যাসঃ। 

তৎ অর্থাৎ এই দুঃখ উপশমের জন্য এক তত্বের অভ্যাস করা উচিত। 

৩৩ - মৈত্রী করুনা মুদিতা উপেক্ষানাম সুখ দুঃখ পুন্যা-
          পুন্য বিষয়াণাং ভাবনাতঃ চিত্ত প্রসাদনম্।

সুখী, দুঃখী, পুণ্যবান, অপূণ্যবান সবার প্রতি মৈত্রী, করুণা, মুদিতা অর্থাৎ হর্ষ বা উৎফুল্ল, উপেক্ষা - এইরূপ ভাবনা থেকেই চিত্ত  প্রসন্ন হয়। 

৩৪ - প্রচ্ছর্দন-বিধারণাভ্যাং বা প্রাণস্য। 

প্রাণবায়ু ছেড়ে দিয়ে সেই অবস্থাকে ধারণ করা অর্থাৎ কুম্ভক করলে চিত্ত স্থির করা যায়। 

৩৫ - বিষয়বতী বা প্রবৃত্তিঃ উৎপন্না মনসঃ স্থিতি নিবন্ধিনী। 

বিষয়বতী অর্থাৎ কোনো বিষয়ের প্রতি নিবিষ্ট চিত্ত হলে বা মনে উৎপন্ন প্রবৃত্তির প্রতি স্থিত হলে চিত্ত স্থির হতে পারে। 

৩৬ - বিশোকা  বা জ্যোতিষ্মতি। 

শোক রোহিত অথবা  জ্যোতিতে স্থির হলে চিত্ত শান্ত হয়। 

৩৭ - বীতরাগ বিষয়ং বা চিত্তম। 

বিষয়ে যার বীতরাগ অর্থাৎ বিতৃষ্ণা হয়েছে - সেই চিত্ত শান্ত। 

৩৮ - স্বপ্ন নিদ্রা জ্ঞান আলম্বনং বা। 

স্বপ্নজ্ঞান বা নিদ্রাজ্ঞান ভাবনাতেও চিত্ত স্থির হয়। 

৩৯ - যথাভি মত ধ্যানাৎ বা। 

যেমন যেমন নিজের অভিমত সেই বস্তুতে ধ্যান করলে চিত্ত স্থিত হয়। 

৪০ - পরমাণু-পরম-মহত্ত্বন্তঃ অস্য বশীকারঃ

পরমাণু অর্থাৎ সুক্ষ থেকে পরম মহৎ তত্ত্ব অর্থাৎ স্থুল যা কিছুতেই আপনি ধ্যানের মাধ্যমে পৌঁছান তাতেই চিত্ত বশিকার অর্থাৎ পরম বৈরাগ্য লাভ হয়। 

৪১ - ক্ষীণবৃত্তেঃ অভিজাতস্য এব মণেঃ গ্রহীতৃ- গ্রহণ -
         গ্রাহ্যেষু তৎস্থ তদঞ্জনতা সমাপত্তিঃ। 

ক্ষীনবৃত্তে অর্থাৎ বৃত্তি যার ক্ষীণ হয়েছে এমন চিত্ত মনি সম স্বচ্ছ। গ্রহীতা, গ্রহণ, ও গ্রাহ্য অর্থাৎ ধ্যেয় বিষয়ের  মধ্যে তদঞ্জনতা অর্থাৎ তন্ময়তা বা  স্থিতি এসেছে সেটাই সমাপত্তি অর্থাৎ জ্ঞানের সমাধি। 

৪২ - তত্র শব্দার্থজ্ঞান বিকল্পৈঃ সংকীর্ণা সবিতর্কা সমাপত্তিঃ। 

সেখানে শব্দের যে জ্ঞান, শব্দের বিষয়ের যে জ্ঞান, আর উভয়ের মিশ্রিত যে  একত্ত্ব  তাকেই সবিতর্কা বলে।  

৪৩ - স্মৃতি পরিশুদ্ধৌ স্বরূপ শূন্যে এব  অর্থ মাত্র নির্ভাসা নির্বিতর্কা। 

স্মৃতি যখন পরিশুদ্ধ হয়ে যায়, স্ব-রূপ অর্থাৎ অহং  যখন শুন্য হয়  বা বিস্মৃত হয় তখন লক্ষিত বিষয়েই স্থিত হয় - এবং এটাকেই বিতর্করহিত সমাপত্তি বলে। 

৪৪ - এতয়া এব সবিচারা নির্বিচারা চ সূক্ষ্ম বিষয়া ব্যাখ্যাতা। 

অতয়েব এই ভাবে বিচার দ্বারা নির্বিচারে পৌঁছে সূক্ষ্ম বিষয়ের ব্যাখ্যা করা হল। 

৪৫ - সূক্ষ্ম বিষয় ত্বং চ অলিঙ্গ পর্যবসানম। 

সূক্ষ্ম বিষয়কে আবার শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষন করতে হবে। 

৪৬ - তা এব সবীজঃ সমাধিঃ। 

সেগুলিই সবীজ সমাধি। 

৪৭ - নির্বিচার বৈশারদ্যে অধ্যাত্ম প্রসাদঃ। 

নির্বিচার-বিশেষ অবস্থায় অধ্যাত্ম প্রসাদ লাভ হয়। 

৪৮ - ঋতম্ভরা তত্র প্রজ্ঞা। 

যেখানে সত্য প্রতিষ্ঠিত সেখানেই প্রজ্ঞা। 

৪৯ - শ্র্ুত অনুমান প্রজ্ঞাভ্যম অন্য বিষয়া  বিশেষ অর্থ ত্বাৎ। 

শোনা কথা, অনুমান এই দুটি জ্ঞান থেকে পৃথক, কারন তার বিশেষ অর্থ রয়েছে। 

৫০ -  তজ্জঃ সংস্কারঃ অন্য সংস্কার প্রতিবন্ধী। 

সেই সংস্কার অন্য সংস্কারের প্রতিবন্ধী। 

৫১ - তস্যাপি নিরোধে সর্ব নিরোধাৎ নির্বীজঃ সমাধিঃ। 

তারও নিরোধে, সবকিছুর নিরোধে নির্বীজ সমাধি। 

ইতি শ্রীপাতঞ্জলে সাংখ্য প্রবচনে বৈয়াসিকে সমাধিপাদঃ। 

                   

                     


                       


    
  
    

Wednesday 23 January 2019

সত্যধর্ম ও প্রেম

সত্যধর্ম ও প্রেম

বাড়িতে বসে পুরোনো বই ঘাঁটছিলাম। হঠাৎ নজরে এলো "সত্যবার্তা" নামে  সত্যধর্ম্ম  মহামণ্ডলের একটা পত্রিকা। ৫ম সংখ্যা বৈশাখ (মিলনোৎসব) ১৪০৪ সাল, ১১২ সত্যাব্দ। সেখানে একদম শেষের পাতায় (১৯) শ্রী অশ্বিনী কুমার রানার একটি অসাধারণ আত্ম্বিশ্লেষণ-মূলক রচনা আছে  । সেখানে শ্রী অশ্বনীবাবু বলছেন :


"কিছুদিন ধরে বিশিষ্ট গুরুভাইদের মধ্যে গুরুদেবের "প্রেম" প্রবন্ধটি নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। একজন বিশিষ্ট দার্শনিক ও পণ্ডিত গুরুভ্রাতার ধারণা যে উক্ত প্রবন্ধটি গুরুদেবের রচিত নয়। হয়তো কোনো পারলৌকিক অনুন্নত আত্মা কর্তৃক কথিত। এই কারণে কতিপয় গুরুভ্রাতা এইসব কথার প্রতিবাদ করে, মহামণ্ডলের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। এবং মহামণ্ডলের উৎসবাদি বর্জন করে, নিজেরা বিভিন্ন স্থানে, উৎসব করে বেড়াচ্ছেন।"

এই লেখা দেখে, আমার মনে গুরুদেবের "প্রেম" প্রবন্ধটির গভীরে প্রবেশ করতে ইচ্ছা করে। সেই মতো আমি প্রবন্ধটি পড়তে শুরু করি। সেখানে কি পেলাম সেই কথাই আজ বলবো। 

আসলে প্রেম করা যায় না। প্রেম হয়। প্রেম বই পড়ে হয় না। কতকগুলো জিনিস আছে আপন নিয়মে  হয়, কেন হয়, কি ভাবে হয়, তা  আমরা জানি না।  শুধু হয়। প্রেম এমনি একটা জিনিস।  আর প্রেম এমনি একটি বিষয়, যা নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করা যায় না। এই আলোচনা সমানে সমানে  হয়, না যায় গুরুজনদের সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা, না যায় স্নেহভাজনদের সঙ্গে। তাই আমাদের সমাজে "প্রেম" কথাটা স্পর্শকাতর। আর কেউ প্রেমে পড়েছে শুনলে আমরা বলি
 - "ও গোল্লায় গেছে" । তাই "প্রেম" প্রবন্ধটি নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ ছিল না।

প্রেম একটা নৈস্বর্গিক বিষয়। এ কাউকে বোঝানো যায় না। যে প্রেমে পড়েনি তাকে বোঝানো কঠিন, প্রেম কি জিনিষ। পরম-আত্মাকে যেমন ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তেমনি প্রেম এমন একটি বিষয় যা কাউকে বলে বোঝানো যায় না। এটি এমনি এমনি হয়।  
   
কিন্তু মহাত্মা গুরুনাথের এই "প্রেম" প্রবন্ধটি পড়ে আমার ধারণা একদম পাল্টে গেছে। প্রেম-ও যে একটা করার বিষয়, তা এই প্রবন্ধটি না পড়লে আমি জানতে পারতাম না। প্রেম যে একটা শিক্ষার বিষয়, তা এই প্রবন্ধটি না পড়লে আমি জানতে পারতাম না।

মহাত্মা গুরুনাথ এখানে হাতে ধরে, প্রেম করা শিখিয়েছেন। কিসে প্রেম হয়। কিসে প্রেম টিকে থাকে, কিসে প্রেম নষ্ট হয়।  কিসে প্রেম গভীর হয়, ইত্যাদি বিষয় এমন নিখুঁত ভাবে ভাষার  কারিকুরি দিয়ে আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন, তা আমার কাছে অচিন্তনীয়। 

গুরুদেবের বই পড়ে, বুঝতে আমার মতো সাধারণের খুব কষ্ট হয়। তার পরিশীলিত ভাষা, ও বিষয়ের কাঠিন্যে আমি হারিয়ে যাই। ভাষার দঙ্গলে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। তবু, আমি আমার মতো করে যা বুঝেছি তারই দুএকটি কথা বলি। 

গুরুদেব, "প্রেম ও অভেদ জ্ঞান " আলোচনা  প্রসঙ্গে বলছেন, - প্রেম এই শব্দ শ্রবণ করলে, মানুষের নিধুবাবুর টপ্পা, দাশরথির পাঁচালির কথা মনে পড়ে।  আমাদের মধ্যে অনেকেই ঘৃণা প্রকাশ করে, আসলে "প্রেম" এই মহান সরল গুন্কে ঘৃণা করা দূরে থাকুক, এটি সবথেকে আদরের এবং সাধনের বিষয়। তাই সত্যিকারের প্রেমের আলোচনা  না কোনো শাস্ত্রীয় বিষয়, না কোনো কেতাবের বিষয়। একটা সত্যি গল্প বলি।

কোনো একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেবার জন্য,অনেক খুঁজে একজন যথার্থ সাধুকে আমরা আমন্ত্রণ করে ছিলাম। তো অনুষ্ঠানের দিন,আমি  সাধুকে আনতে  গেলাম । প্রেমের উপরে তার বক্তৃতা দেবার কথা ছিল। সাধুকে সঙ্গে নিয়ে, আমরা দ্রুত চলছিলাম। যেতে যেতে আমরা এক ক্ষত-বিক্ষত লোককে রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখলাম। লোকটি চিৎকার করছিলো - আমাকে একটু সাহায্য করো। ...
আমি ভাবলাম লোকটাকে গাড়িতে তুলে নেই।  আবার ভাবলাম, লোকটাকে নিলে তো তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।  আমাদের দেরি হয়ে যাবে। সাধু চুপচাপ ছিলেন, হয়তো আজকের বক্তৃতার বিষয় অর্থাৎ "প্রেম" নিয়ে কি বলা যায়, সে সব কথা ভাবছিলেন। আহত লোকটি আমাদের অবাক করে, বলে উঠলো, মহারাজ, আজতো আপনি প্রেমের উপরে বক্তৃতা দেবেন। আমি সেখানেই যাবো, আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে চলুন। আমরা দাঁড়ালাম। লোকটি আবার বললো, আমাকে ফেলে যেওনা। আমি মরণাপন্ন।  তোমরা আমাকে ফেলে গেলে আমি মরে যাবো। আর আমি যদি মরে  যাই, তবে ভগবান জানবে,তুমি কত নিষ্ঠূর, মিথ্যে প্রেমের কথা বলে বেড়াচ্ছো আর যদি  না মরি, তবে সবাই জানবে, তুমি নিষ্ঠূর , প্রেমের কনা মাত্র তোমার মধ্যে নেই, আর তা আমিই বলে বেড়াবো। আমরা অবাক হয়ে গেলাম, তার কথা শুনে।  গাড়ি থেকে নেবে তার কাছে গেলাম। সাধু তাকে দেখে একটু ঘাবড়ে গেলেন, তার মুখ দেখে মনে হলো সাধু আহত ব্যক্তিকে চেনেন। সাধু একটা হাত তার কাঁধে রাখলেন। অস্ফুট স্বরে সাধু বললেন, আমি যেন কোথায় তোমাকে দেখেছি। নিমেষে সাধু হাত সরিয়ে বলে উঠলো, এই লোকটা খুব খারাপ, নিষ্ঠূর। না না আমি তোমাকে বাঁচাতে পারবো না। বলে আমাকে বললো - চলো, এই সব লোক মরে  গেলেই ভালো। আমাদের অবাক করে দিয়ে, আহত লোকটি জোরে হেসে উঠলো।  বললো সাধু আমরা আছি বলেই তোমরা  আজ সাধু। আমরা যদি সব মরেই যাই তবে কাকে তুমি প্রেমের কথা শোনাবে ? আমাদের মতো খারাপ লোক আছে বলেই তোমরা বক্তৃতা দিয়ে বেড়াও। আমরা না থাকলে  তুমি কার ভালো করবে ? সাধু  ফিরে তাকালেন,  - আমাকে বললেন। চলো  সঙ্গে নিয়ে চলো - সত্যিই তো ওরা  আছে বলেই আমাদের দরকার। সবাই যদি ভালো হতো তবে আমাদের দরকার ফুরিয়ে যেত। সেদিন আর সাধুর আর বক্তৃতা দেওয়া হলো না। বেঁচে গেল খারাপ লোকটি। 

মহাত্মা গুরুনাথ, তার "প্রেম" প্রবন্ধে, প্রেমের কথা বলতে গিয়ে, প্রবন্ধের শেষে স্থূল প্রেমের কথা বলেছেন। আমার মনে হয়, সেইজন্যই  মহাত্মা গুরুনাথের কথা কিছু লোকের  পছন্দ হয় নি। আসলে সত্যকে উম্মুক্ত করতে হবে, অনাবৃত করতে হবে। তা না হলে আমরা সত্যকে জানবো  কি করে ? কিন্তু আমরা নগ্নতা পছন্দ করি না। সমাজ সত্যকে ঢেকে রাখতে চায়। মহাত্মারা তা উন্মূক্ত করেন।আমাদের তাই ভালো লাগে না। 

আসলে প্রেমকে বুঝতে গেলে কামকে বুঝতে হবে। কাম সম্পর্কে আমাদের ভুল ধারণা ভাঙতে হবে। তা-নাহলে প্রেমকে বোঝা যাবে না। আমার স্ত্রী যখন পঁচা খৈল ভেজানো বালতি, গাছের কাছে রাখে, তখন তার থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। সার থেকে তো দুর্গন্ধ-ই বেরোবে। কিন্তু তা ঠিক ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারলে বীজ অঙ্কুরে রূপান্তরিত হবে, অংকুর চারাগাছে পরিণত হবে। চারাগাছ বড় হবে, সজীব হবে, আর যখন সেই গাছে ফুল ফুটবে, তখন মন-প্রাণ ভরে যাবে। আমরা কখনো কি ভেবেছি, এই দুর্গন্ধযুক্ত পচা  খৈল থেকে একদিন সুগন্ধের জন্ম হবে। আসলে কামকে আমাদের রূপান্তরিত করতে হবে, তবেই আমরা প্রেমের স্বাদ পাবো। প্রেম নৈস্বর্গিক, আর তার উৎপত্তি কাম থেকেই। আমাদের তথাকথিত ধর্মগুরুরা, এই পবিত্র কামকে ধর্মের অন্তরায় বলে বুঝিয়েছেন।  যা অসত্য। মহাত্মা গুরুনাথ সেটা বলেননি। তাই ব্রাহ্মণ্য সমাজের যারা ধারক বাহক  তারা গুরুদেবের বিরুদ্ধে গিয়েছেন। এতে গুরুদেবের কিছু এসে-যায় না। 

প্রেমের তিনটি স্তর ।  প্রথমতঃ শরীর বা শারীরিক। যারা শরীরকে ঘিরে প্রেমের কথা ভাবে, তারা প্রেমের এই নিম্ন স্তরে পড়ে আছে। দ্বিতীয়তঃ হচ্ছে মানসিক। এটি খুব চঞ্চল। অস্থির। শরীর স্থির, কিন্তু মন চঞ্চল। শারীরিক প্রেম জোর করে হতে পারে, মানসিক প্রেম জোর করে হতে পারে না। শরীর জড় পদার্থ। আমাদের সমাজ এই শারীরিক প্রেমে বিশ্বাসী।  তাই তারা প্রেমের নামে বিবাহ-প্রথা চালু করেছে। আসলে এটা কোনো প্রেমের বাঁধন নয়। এটি শারীরিক ভোগের একটা সামাজিক স্বীকৃতি মাত্র। প্রেম তরল, মন চঞ্চল, শরীর জড়। জড়পদার্থ এক জায়গায় পড়ে থাকে। সকাল-সন্ধ্যে একই রকম পড়ে থাকে। কিন্তু সুগন্ধি ফুল সকালে ফোটে, সন্ধ্যায় ঝরে যায়। শারীরিক স্তরে আমাদের যে প্রেম, তা  মৃত, জড়  তাই সকাল-সন্ধ্যে একই রকম থাকে। কিন্তু মানসিক প্রেম , সকালে এক রকম, সন্ধ্যায় আর এক রকম। আসলে শরীরের সঙ্গে থাকতে থাকতে আমাদের শরীরের সঙ্গে একটা সন্মন্ধ তৈরি হয়, যাকে  আমরা প্রেম বলি। কিন্তু আসলে ওটা একটা সম্পর্ক মাত্র।  তার বেশি কিছু নয়। একটা যান্ত্রিক সম্পর্ক মাত্র। মানসিক প্রেম আবার অন্য কথা বলে। মানসিক প্রেম ক্ষনে ক্ষনে পাল্টায়। তাই আমরা দেখি, যারা প্রেম-করে বিয়ে করেছিল। বিয়ের পরে তাদেরপ্রেম উবে যায়, প্রেমহীন হয়ে যায়। ভাবে ভুল করেছি। মন তখন, অন্য প্রেমাস্পদ খোঁজে। শারীরিক স্তরে প্রেমের স্থিরতা আসতে  পারে।  কিন্তু মনের স্তরে প্রেমের কোনো স্থিরতা নেই। তৃতীয়তঃ আর একটা প্রেম আছে যাকে বলে আধ্যাত্মিক প্রেম। এই স্তরে যখন প্রেম হয়, তখন তা হয় অনন্ত জন্মের জন্য।আধ্যাত্মিক প্রেম,  মানসিক প্রেমের মতো চঞ্চল নয়, আবার শারীরিক প্রেমের মতো জড় নয়। এই প্রেম পুরুপুরি অনুভূতির বিষয়। এখানে না আছে শরীরের খেলা, না আছে মানসিক অস্থিরতা। এইখানে মানুষ অস্তিত্বের স্তরে প্রাণপুরুষের সঙ্গে এক হয়ে যায়। দূরত্ত্ব ঘুচে যায়। নদী যেমন  শান্ত হয়ে যায়, সমুদ্রের কাছে গিয়ে। পাহাড়ে অর্থাৎ উৎসে সে ছিল চঞ্চল। সমুদ্রে সে হলো শান্ত। 

আমাদের এই সব পথই পেরিয়ে আসতে হবে । অর্থাৎ শারীরিক-প্রেম , মানসিক-প্রেম পেরিয়ে যেতে হবে  এবং তবেই আমরা একদম শেষে আধ্যাত্মিক প্রেমের ধাপে  পৌঁছাতে পারবো ।  সিঁড়ির নিচের ধাপে যেমন পা রাখতে হবে। উপরের ধাপেও পা রাখতে হবে।   আমরা যদি ভাবি, ধর্মকথা আলোচনা করতে বসে, শারীরিক প্রেমের কথা কেন  বলবো। তাহলে আমরা ভুল করবো। আমরা যেখানে আছি, আমাদের সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। আমরা প্রথম ধাপে পা না দিয়ে যদি একদম উপরের ধাপে পা রাখতে চাই, তবে ভুল করবো। আমরা কোনোদিনই শেষ ধাপে পা দিয়ে শুরু করতে পারি না। আমরা তো শরীরেই আছি, আমাদের তো মন আছে, অতয়েব আমাদের শরীর থেকেই শুরু করতে হবে। ধীরে ধীরে আমরা মানসিক প্রেম আয়ত্ত্ব করতে পারবো, একদম শেষে আধ্যাত্মিক প্রেমের অপ্রাকৃত মজা আমরা উপলব্ধি করতে পারবো। 

তাই মহাত্মা গুরুনাথ প্রেমের কথা আলোচনা করে গিয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব কথাই বলেছেন। প্রকৃত সাধক বুঝে নেবেন। প্রেমকে গুরুদেবের বই পড়ে বোঝা যাবে না। গুরুদেবের সাক্ষাৎ সান্নিধ্যে যারা এসেছেন, তাঁরাই প্রেমের উপলব্ধি করতে পেরেছেন। প্রেমের বই পড়ে, বিদ্বেষ উৎপন্ন হতে পারে, রাগ হতে পারে, প্রেম হতে পারে না। তাই যারা যথার্থ গুরুর সান্নিধ্যে এসেছেন, তারাই প্রেমের মাহাত্য বুঝতে পারেন। আর যাদের সে সৌভাগ্য হয়নি, তারা গুরুদেবের বই পড়ে রেগে গেছেন। ভগবান এদের মঙ্গল করুন।

নারীর মধ্যে শারীরিক প্রেম, মাতৃত্বের স্বাদ পাবার জন্য উৎপন্ন হয়। পুরুষ কেবলমাত্র শারীরিক সুখ খোঁজে। এই শারীরিক সুখে সাময়িক ভাবে, ক্ষনিকের জন্য আধ্যাত্মিক প্রেমের স্বাদ পায়। তাই সে বারবার নারীর কাছে  ফিরে যায়। এই প্রেমের এক  ঝলক আবার ধ্যানের মধ্যেও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যে ধ্যানের স্বাদ পায়  নি, সে তো নারীকেই খোঁজে। পুরুষ সন্তান চায় না। যদি চায়-ও তা সে তার সম্পত্তির অধিকারীর পাবার জন্য  খোঁজে। প্রেমের জন্য নয়, ভালোবাসার জন্য নয়।পুরুষ সন্তান চায় না, পুরুষের সন্তান হয়। পুরুষ সন্তানের জন্য মিলিত হয় না, তারা মিলিত হয় তাই সন্তান আসে। কিন্তু নারী সন্তান চায়, আর তা আধ্যাত্মিক সুখের জন্য। সন্তান হবার পরে, নারীর  কামবোধ কমে যায়। পুরুষকে তখন সে পাষন্ড মনে করে।  কামাসক্ত পুরুষের মধ্যে স্ত্রী নরক দেখতে পায়, প্রেম নয়। শুধু ভয় আর সুরক্ষার জন্য মিলিত হয় মাত্র। মা সন্তানের মধ্যে আধ্যাত্মিক স্তরের সম্পর্ক অনুভব করে। তাই মা সন্তানের জন্য সব কিছু করতে পারে, এমনকি প্রাণ দিতে পারে। কারন সেখানে সে আধ্যাত্মিক সুখ পায়। ভাগ্যবান কোনো স্ত্রী যদি স্বামীর মধ্যে আধ্যাত্মিক সুখ পায়, তখন তারা ভাই বোন হয়ে যায়। পতিকে তখন সে সন্তানের মতো মনে করে। তার মাথায় বিলি কেটে দেয় , গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। পুরুষ তখন, স্থির হয়ে যায়। স্ত্রীর মধ্যে সে মায়ের ছায়া দেখে, ভগ্নির ছায়া দেখে।

সব শেষে, রামকৃষ্ণের জীবন থেকে আধ্যাত্মিক প্রেমের একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ দিয়ে শেষ করবো। মা সারদা দক্ষিনেশ্বর এসেছেন। মনে অনেক আশঙ্কা, বাসনা নিয়ে স্বামীর ঘর করতে এলেন। পথে জ্বর হয়েছিল। রুগ্ন শরীর।  ঠাকুর বললেন, তুমি এতদিনে এলে ? এর পরে, ঠাকুর সুযোগ পেলেই, মা সারদাকে মানব জীবনের উদ্দেশ্য, কর্তব্য ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া শুরু করলেন। রাতে একসাথেই এক বিছানায়  শুতেন। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের কোনো কিছুই হলো না। ঘুমোনোর আগে, মা সারদা ঠাকুরের পা টিপে দিতেন। একদিন সাহস করে, পা টিপতে টিপতে, জিজ্ঞেস করলেন, "আমাকে তোমার কি বলে বোধ হয়" ? আসলে তখনও সারদা তো মা হয়ে ওঠেনি। বিবাহিত জীবনের একটা স্বপ্ন তো তার মধ্যে ছিল। কিন্তু ঠাকুরের কাছ থেকে তার কোনো সারা না পেয়ে, বাধ্য হয়েই এই প্রশ্নের সম্মুখীন করে দিলেন, ঠাকুরকে। ঠাকুর বললেন, " যে মা মন্দিরে আছেন,  তিনিই তো শরীরের জন্ম দিয়েছেন, এখন নহবতে বাস করছেন, তিনিই এখন আমার পদসেবা করছেন। সাক্ষাৎ আনন্দময়ী রূপে তোমাকে দেখতে পাচ্ছি।"

একরাতে, মা সারদাকে নিজের পাশে শুয়ে  থাকতে দেখে, ঠাকুর আপন মনে বলছেন,  মন এরই নাম স্ত্রীশরীর, লোকে একে পরম উপাদেয় বস্তু বলে জানে, ভোগ করবার জন্য সর্বদা লালায়িত হয়। কিন্তু এসব গ্রহণ করলে দেহেই আবদ্ধ থাকতে হয়। সচ্চিদানন্দঘন ঈশ্বরকে লাভ করা যায় না। ভাবের ঘরে চুরি।  পেটে  এক মুখে এক, রেখো না। সত্যি করে বলতো তুমি শরীর চাও না ঈশ্বর চাও। যদি শরীর চাও তবে সামনেই রয়েছে গ্রহণ করো। এই না ভেবে মা সারদাকে স্পর্শ করতে উদ্দত হলেন। কিন্তু কুন্ঠিত মন সহসা সমাধি পথে বিলীন হয়ে গেল। রামকৃষ্ণ  আর এক জায়গায় বলছেন, মা সারদা যদি এতো ভালো না হতো, যদি দেহবুদ্ধি দিয়ে আমার সংযমের বাঁধ ভেঙে দিতো, তাহলে আমার দেহবুদ্ধি আসতো  কি না কে বলতে পারে ?

তাই গুরুদেব বলছেন, মাসে এক বছরে বারো, যদি পারো আরো কম করো। শরীর  ছেড়ে শরীরির সাথে প্রেমে মগ্ন হও। আমরা যারা গুরুদেবের কথা  বুঝতে পারি না, তারা অযথা বিতর্কে জড়াই। দেহপাশে আবদ্ধ হই। প্রেম ঈশ্বরের সর্ব্বোৎকৃষ্ট গুন্।  সেই গুনের সাধনা করতে হবে আমাদের । 


ওঁং মহাত্মা গুরুনাথায় নমঃ।
ওঁং পরম-পিতা পরম-আত্মায় নমঃ   

     

      

        
   
























Wednesday 16 January 2019

শ্রাদ্ধ ও তর্পন বিধি

শ্রাদ্ধ ও তর্পন বিধি

শ্রাদ্ধ ও তর্পন বিধি 

ওং হৌং জুং সঃ  ওং ভূঃ ভুবঃ স্বঃ
ওং ত্রয়ম্বকং যযামহে  সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্
উর্বারূকমিব বন্ধ্নান মৃত্যু্র্মুক্ষীয় মা মৃতাৎ
ওং স্বঃ ভুবঃ ভূঃ  ওং সঃ জুং  হৌং ওং

গুরুদেব মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন : "পরলোকগত পিতৃলোকদিগের উদ্ধারের নিমিত্ত শ্রদ্ধাপূর্বক যে কর্ম সম্পাদিত হয়, তাহাকে শ্রাদ্ধ কহে। " 
কত কঠিন কাজ চিন্তা করুন। পরলোকগত অর্থাৎ যারা এই লোকে বা  ভূর্লোকে  নেই। অন্য্ কোনো লোকে গেছেন। আমরা জানি, সাতটা লোক আছে।  জানি না, বলা যেতে পারে, শাস্ত্রে পড়েছি। এগুলো  হলো  -  ১.ভূ ; ২. ভুব ;৩. স্বঃ ৪. মহঃ ৫. জনঃ ৬. তপঃ ৭. সত্যম। আবার কেউ কেউ সংক্ষেপে এই লোককে তিন ভাগে ভাগ করেছেন, আমাদের বোঝার সুবিধের জন্য, সেই তিনটি হলো : ভূলোক, দ্যুলোক, অন্তরীক্ষ লোক।  প্রথম সাতটি লোকের ভৌগলিক সীমা  নেই।  এইগুলো সর্বত্র অন্তর্হিত।  কিন্তু পরের  তিনটি অর্থাৎ ভূলোক, দ্যুলোক ও অন্তরীক্ষ লোকের ভৌগলিক সীমা  আছে।  ভূ  অর্থাৎ পৃথিবী লোক, দৌ বা আকাশ -লোক আর এই আকাশের বাইরে যেটা সেটা অন্তরীক্ষ লোক । সেটা আমাদের মনের লোক-ও হতে পারে। অর্থাৎ ভূলোক, বা দৃষ্টিগোচর লোক থেকে যারা চলে গেছেন, কোথায় গেছেন, আমরা জানি না,  যে কোনো লোকেই যেতে পারেন, তাদের মঙ্গলের জন্য, তাদের উদ্ধারের জন্য শ্রদ্ধা সহকারে যে কাজ সম্পাদন করা হয় তাকেই শ্রাদ্ধ বলে। অর্থাৎ কঠিন থেকে কঠিনতম কাজ। আর এটা করতে হবে শ্রদ্ধা সহকারে। অর্থাৎ শ্রাদ্ধকর্মে মূল উপাদান হচ্ছে শ্রদ্ধা। শ্রাদ্ধ কথাটার আর একটা মানে হচ্ছে নিস্পত্তি। বাস্তবকে মেনে নেওয়া, সম্পর্ককে বিচ্ছিন্ন করা, নির্ভরশীলতাকে কাটিয়ে ওঠা - এটাই শ্রাদ্ধ কর্মের উদ্দেশ্যে।

গুরুদেব আর এক জায়গায় কবিতায়  বলছেন : 

না থাকিলে ধন / বনেতে গমন / করিয়া রোদন করো। 
তাহে শ্রাদ্ধ ফল,/ হ'বে নিরমল / হইবে তাহা শুভকর। 

অর্থাৎ বাহ্যিক উপাদান সংগ্রহের ক্ষমতা যদি না থাকে তবে তবে নিরালায় বসে রোদন করো, তাকে স্মরণ করো, তার জন্য দুফোটা চোখের জল ফেলো, তাতেই শুভ-কাজ সম্পন্ন হবে। 
এইখানে গুরুদেব অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র। 

আমার বাবার কাজের সময়, পুরোহিত ব্রাহ্মণ, যিনি আমাদের খুবই আপনজন, বাবার উদ্ধারের জন্য একটি ফর্দ ধরিয়ে বলেছিলেন, এগুলো লাগবে।  ১৩৮ রকম, জিনিসের লিস্ট। তাতে,সোনা দানা থেকে  খাট , বিছানা থেকে শুরু করে তিল তুলসী অবধি ছিল। গুরুদেব বলছেন কিছুই লাগবে না শুধু শ্রদ্ধা, একটু আকুতি, একটু চোখের জল।  প্রাণ ভরে প্রার্থনা করো। কয়েকজন সৎলোকের উপস্থিতিতে, উপবিষ্ট হয়ে প্রার্থনা করো। 

গঙ্গা সাগর মেলায় গিয়ে ছিলাম, দেখলাম একদল গ্রাম্য পুরোহিত, গরু বাছুর নিয়ে বসে আছে।  খদ্দের খুঁজছে।  বৈতারিনী পার করে দেবে বলে। বেটা তোরে কে পার করে তার ঠিক নেই , তুই অন্যকে বৈতারিনী পার করতে বসে আছিস।

আসলে জীবন-মরন, আত্মার গমন-নির্গমন, আত্মার প্রবেশ-বাহির, এমনকি আত্মার অস্তিত্ব- অনস্তিত্ব এসব বিষয় এতটাই দুর্বোদ্ধ যে, এগুলো নিয়ে ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ অনেক গল্প ফেঁদেছেন। আর গল্পের গরু গাছে চড়ে। আর গল্প শুনতেও আমাদের ভালো লাগে। অসম্ভব কিছু  সম্ভব হচ্ছে - এমন গল্প গাঁথা আমাদেরকে আকর্ষণ করে। তাই এর মাধ্যমে চতুর ব্রাহ্মণরা কিছু জাগতিক ফায়দা ওঠায়। আমরা অসম্ভব ভবিষ্যতের আশায় বর্তমানকে বিসর্জন দেই। আমাদেরকে  বোকা বানায়।  আমরাও বোকা হতে ভালো বাসি। নিজেকে নিপীড়নে আমরা একটা আত্মতৃপ্তি পাই। 

এইবার আমরা  জন্ম-মৃত্যু, বা আসা যাওয়ার খেলাটা একটু দেখে নেই। আমাদের দেহ পঞ্চভূতের সংমিশ্রণ। পুরুষ-প্রকৃতির খেলাতেই এই সংমিশ্রণ ঘটে।  প্রথমে মাংসপিন্ড, পরে ধীরে ধীরে জন্মদাতার-জন্মদাত্রীর আকার গ্রহণ।  এটি তখন দেহ মাত্র। এই দেহে ৪৪ থেকে ৪৮ দিনের মধ্যেই প্রাণের গমন নির্গমন গুরু হয়। তবে সেটা মায়ের প্রাণের অংশ মাত্র। সব থেকে বেশি হলে ৮৪ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হওয়া চাই।  এই সময় থেকেই আমরা মায়ের দেহের মধ্যে সন্তানের নাড়াচাড়া টের পাই। যদি না হয় জানবেন কিছু গোলমাল আছে।  অর্থাৎ যে দেহটি তৈরি হচ্ছে সে মায়ের প্রাণের গতি গ্রহণ করছে পারছে না। এমনটি হলে জানবেন কিছু গড়বার আছে।  হরিবোল - হরিবোল হয়ে গছে। এই মায়ের প্রাণের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যখন সে মায়ের দেহ থেকে আলাদা হয়ে যায়। তখন তার নিজস্ব প্রাণক্রিয়া, প্রাণের গমন-নির্গমন শুরু হয়। এবং সেটা যদি তাৎক্ষণিক ভাবে শুরু না হয় তখন সন্তানকে এই প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে ধাঁই। সে তখন ফুসফুস - তাকে উল্টে-পাল্টে ক্রিয়াশীল করে তোলে। বাচ্চা কেঁদে ওঠে। শুরু হলো জীবনের খেলা। 

এইবার চলে যাবো মৃত্যু প্রক্রিয়ায়। জীবন হচ্ছে শ্বাসের খেলা। এই শ্বাসের মাধ্যমেই আমাদের সমস্ত প্রক্রিয়া চলে। পঞ্চভূতের মধ্যে (ক্ষিতি, অপ,তেজ, মরুৎ, ব্যোম ) মরুৎ অর্থাৎ বায়ু সবথেকে শক্তিশালী ও সংযোগকারী। উপনিষদে একে ব্রহ্ম বলে আখ্যা  দেওয়া হয়েছে। প্রাণ শরীরের কোনে কোনে পরিব্যাপ্ত হয়। শরীরের কৰ্মইন্দ্রিয় (বাক,পানি,পাদ, পায়ু,উপস্থ ) জ্ঞান ইন্দ্রিয় (কর্ন, চর্ম, চক্ষু, জিহবা, ও নাসিকা) অর্থাৎ কান,ত্বক,চোখ,জিভ,নাক,মুখ,হাত,পা,মলদ্বার, ও লিঙ্গ। এর মধ্যে আমরা স্বাস প্রক্রিয়ার জন্য দুটো ইন্দ্রিয় কাজ করে, এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে নাক।  যদি কোনো কারণে নাক বন্ধ  হয়ে যায় মুখ দিয়ে আমরা এই স্বাস প্রক্রিয়া চালাই । একমাত্র স্বাস প্রক্রিয়ার জন্য দুটো অঙ্গ বা দুটো ইন্দ্রিয় ব্যবহার করতে পারি।  শরীরের অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো বিশ্রাম নিলেও, নিদ্রা গেলেও এই প্রাণশক্তির ক্রিয়া চলতে থাকে।  কখনই বিশ্রাম নিতে পারে না। দিন-রাত অনবড়ত  কাজ করতে থাকে। যতক্ষন এই প্রাণশক্তি প্রবাহমান থাকে ততক্ষনই আমাদের আয়ু থাকে। প্রাণ যতক্ষন কর্মক্ষম থাকে ততক্ষনই আমাদের জীবিত বলা হয়।  এই প্রাণশক্তির কাজ শেষ হয়ে গেলে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। এই প্রাণের শক্তিতেই দৃষ্টি-শক্তি, এই প্রাণের শক্তিতেই শ্রবণ শক্তি, এই প্রাণের শক্তিতেই ঘ্রান শক্তি, বাক শক্তি, জ্ঞানশক্তি, পাচন  শক্তি। প্রাণের ক্রিয়া শুরুতে জীবন শুরু হয় - আবার প্রাণের ক্রিয়া শেষে জীবনের শেষ হয়।ত্রিলোকে যা কিছু বর্তমান সবই প্রাণের অন্তর্গত। 

এবার আমরা যাবো আর একটু গভীরে। প্রাণ তো দেহটা কে বাঁচিয়ে রাখে। সবার মধ্যেই প্রাণ।  তাহলে "অমি"  কে ? এই দেহ যখন অকেজো হয়ে যায়, তখন তাকে আমরা পুড়িয়ে ফেলি, কবর দেই।  এর সঙ্গেই "আমি"  শেষ হয়ে গেলাম ? "আমি" যদি শেষ হয়ে গেলাম, তবে আর এই শ্রাদ্ধ-শান্তির দরকারটা কি ? "আমি" বলে কিছু আছে কি ? তাহলে কি, জগৎ সত্য, আমি মিথ্যা। 

এখান থেকেই ধোঁয়াশার শুরু। এই জায়গাটা উপল্বদ্ধির জায়গা। এই জায়গাটা বুদ্ধি দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে, বেশিদূর এগোনো যায় না।  মৃত্যুর পরে কেউ ফিরে আসেনা। এসে কেউ পরপারের কথা, পরপারের বর্ণনা দিতে পারে না।  এখানেই চতুর পন্ডিতরা গল্প ফাঁদে। স্বর্গ, নরকের গল্প ফাঁদে। যে যত রসালো গল্প বলতে পারে তাকে আমরা ততো বড় সাধক ভাবি। আসলে কল্পনা শক্তি, আমাদের ভাবের জগতে নিয়ে যায়। আমরাও আমাদের একটা কাল্পনিক ভাবের জগৎ তৈরি করি। কিন্তু বাস্তব  অন্য কথা বলে। সব ভাষায় বলা যায় না। কাউকে সেখানে নিয়ে যাওয়া যায় না। 

এবার একটু উপনিষদের গল্পে যাই। 

উপনিষদের মধ্যে আমি দুটো জায়গায়, মৃত্যুর রাজার গল্প পাই। অর্থাৎ যমরাজের গল্প পাই। তার প্রথমটি হলো কঠোপনিষদ। এই গল্প আপনারা নিশ্চই শুনে থাকবেন। যমরাজ বা ধর্মরাজ হিন্দু মতে  মৃত্যুর রাজা।  তিনিই নাকি আমাদের সবাইকে মৃত্যুরপুরীতে নিয়ে যান।  আর আমাদের কর্ম অনুযায়ী সাজা অথবা বিলাসের ব্যবস্থা করেন। গল্পটা সংক্ষেপে বলি :

পুরাকালে বাজ-শ্রবস নামে এক রাজা ছিলেন। তার পিতা বাজ-শ্রবা অজস্র  ধন-দান করে যশস্বী হয়ে ছিলেন। বাজ-শ্রবস ভাবলেন, তিনি তার পিতার থেকেও আরো বারো কীর্তি  করে যাবেন।  এবং মহা পুন্য অর্জন করবেন। এমনটি কামনা করে, তিনি এক আশ্চর্য যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। যজ্ঞের  নাম বিশ্বজিৎ।  এই বিশ্বজিৎ যজ্ঞে ঋষিকে তার যথা সর্বস্য দান করতে হবে। বিস্তারিত বলবো না।  এখন যজ্ঞের দান শুরু হয়েছে। সে যুগে গোদান সর্বশ্রেষ্ট দান বলে পরিগণিত হতো। চারিদিকে আনন্দের উৎসব হচ্ছে। সবাই উল্লাস কোলাহলে ব্যস্ত। কিন্তু বাজ-শ্রবসের পুত্র নচিকেতা বিমর্ষ। নচিকেতার বয়স ৮/৯ বছর ।  ভাবছে,পিতা কত ফল কামনা এই যজ্ঞ করছে। আর শেষে কিনা এই হাড্ডিসার গাভীগুলোকে দান করছে ? যাদের তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে।  যাদের গর্ভধারণের ক্ষমতা হারিয়েছে।  দুধ দেবার ক্ষমতা হারিয়েছে। এই গরুগুলো নিয়ে ব্রাহ্মণদের কি কাজে লাগবে। বিশ্বজিৎ যজ্ঞ মানে তো সর্বশ্রেষ্ট দানের প্রতিশ্রূতি। এই সব শীর্ণকায় গাভী দানে কি বাবা পূণ্যলাভ করতে পারবে ?তা যদি না হয় তবে তো বাবার যজ্ঞের উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। পিতার মঙ্গলের জন্য উদ্বিগ্ন নচিকেতা ধীর পায়ে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বাজ-শ্রবস তখন ঋষিদেরকে নিয়ে ব্যস্ত। দান-কর্মে লিপ্ত। নচিকেতা গিয়ে, বাবার মঙ্গল কামনায়, বাবাকে বললো - "বাবা সবই তো দিলেন, আমাকে কাকে দিলেন? আমিতো আপনার উত্তম ধন, আমাকে কাকে দিলেন ? বাজ-শ্রবস কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে, পুনরায় একই কথা বললেন।  বাবা আমাকে কাকে দিলেন। বাবা বিরক্ত হলেন। কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না। এদিকে বাবা কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে, নচিকেতা আবার বললেন, আমাকে কাকে দিলেন ? বাবা এবার চরম বিরক্ত হয়ে, রাগের মাথায় বলে দিলেন - "ব্যাটা তোমাকে যমের কাছে দিলাম"। নচিকেতা এবার চুপ হলো। ভাবলো ভালোই হলো।  বাবার এতে উপকার-ই  হলো।

নচিকেতা এবার যমের কাছে চললো। যমের বাড়িতো চেনেনা। চললো স্মশানে। যমের বাড়ী। যমের কাছে তো কেউ যায় না। সবার কাছে যম যায়। ফলে, যমের বাড়িতে যমকে পেলো না নচিকেতা। বসে থাকলো দুয়ারে। এদিকে ধর্মরাজ যম স্ব-ধৰ্ম রক্ষায় ব্যস্ত। বাড়ি এসে দেখে, ৮/৯ বাছারের একটা ফুটফুটে বালক বসে আছে। ধর্মরাজ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। সবার কাছে যম যায়। এ দেখি নিজে থেকে এসে বসে আছে। একি অনাসৃষ্টি। তাহলে নিশ্চই তার কর্তব্যে কোনো ভূল হয়ে গেছে। আসলে যমেরও ভয় আছে। ব্ৰহ্মের শাসনে, সূর্য যেমন আলো  দেয়, মেঘ যেমন বৃষ্টি দেয়, চন্দ্র যেমন জ্যোৎস্না দেয়, যম তেমনি তার কর্তব্য পালন করে। সূর্য যেমন আলো দেবোনা বলে বসে থাকতে পারে না। যমও তেমনি আর মানুষ মারবো না বলে বসে থাকতে পারে না। তাই যমরাজ ভয় পেয়ে গেল। পাচ্ছে এই ত্রূটি পাঁচজন জেনে যায়, তাই চুপি চুপি সে নাচিকেতাকে খুশি করে, বাড়ি ফেরাতে চাইলো। এবং বললো - কি চাও তুমি বলো, আর মানে মানে কেটে পরো। কেউ যেন জানতে না পারে। তা হলেই বিপদ। সুযোগ বুঝে, নচিকেতা তিনটি বর চেয়েছিলো। 
১.  মৃত্যুলোক হতে ফিরে গেলে সবাই যেন আমাকে চিনতে পারে। এবং প্রসন্ন হন। 
২.  শুনেছি, স্বর্গে কোনো ভয় নেই, জ্বরা নেই, ব্যাধি  নেই, যা চাওয়া যায় সবই সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায়।  এমনকি যমও সেখানে যেতে পারে না। তো আমি সেখানে কি করে যাবো তার পথ বলে দাও। 
৩. শুনেছি মরলে পর, কেউ বলে আত্মা থাকে, কেউ বলে আত্মা বলে কিছু নেই। আমাকে এই সম্পর্কে খুলে বলো। আমি আত্ম-বিদ্যা লাভ করতে চাই। 

এইবার আমি একটা প্রাসঙ্গিক ঘটনা বলি। ঘটনাটা পেপারে বেরিয়েছিল। এক ভদ্রলোক ট্রেনে করে যাচ্ছিলো।  ট্রেনটি এক্সিডেন্ট করে। বাড়িতে খবর আসে। ভদ্রলোকের বড়ছেলেকে নিয়ে যাওয়া হয়, হসপিটালে। সেখানে মর্গে একটি পচাগলা দেহ দেখিয়ে বলা হয়, দেখো ইনি তোমার বাবা কি না। ছেলে দেহ দেখে কিছু বুঝতে পারে নি।  কিন্তু তার জামা প্যান্ট এমনকি ঘড়িটা দেখে জানায়, হ্যাঁ ইনিই আমার পিতা। শোকাচ্ছন্ন সন্তান বাড়িতে এসে, সমস্ত পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে। এদিকে ভদ্রলোক কিন্তু  একসিডেন্টে মারা যায়  নি। ট্রেন থেকে ছিট্কে পাশের খালে পরে গিয়েছিলো। বেহুশ হয়ে ছিল। হুশ ফেরার পরে কোনো রকমে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে পরবর্তী স্টেশনে যায়।  এবং বিনা টিকিটে ফেরার পথে টিকিট চেকারের   হাতে ধরা পরে । সাত দিন জেল খেটে, হাটতে হাটতে, ক্লান্ত, ক্ষুধার্থ অবস্থায় সন্ধ্যেবেলা  বাড়ি ফেরে। এদিকে বাবাকে দেখে, ছেলেরা -মেয়েরা হাউমাউ জুড়ে দেয়। ভূত ভূত বলে পালাতে থাকে। সে যতই, ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে, ছেলেমেয়েরা ততই তার থেকে দূরে পালাতে থাকে। এমনকি তার স্ত্রী, তাকে এক পলক দেখে দরজায় খিল তুলে দেয়। ভদ্রলোক সেই ক্লান্ত শরীরে, সারারাত শীতের মধ্যে বাইরে পরে থাকে।  এবং সেই রাতেই মারা যায়। হরিবোল - হরিবোল।  আসলে আমরা মারা যাওয়াটা সহ্য করতে পারি। কিন্তু ফিরে আসাটা সহ্য করতে পারি না।  তার কারন আমরা জানি, এটা হয় না। হতে পারে না। ভগবানের কৃপা চাই। কিন্তু কৃপা পেলে, সন্দেহ করি, দূরে সরে  যাই।

নচিকেতা এই সত্যতা জানতেন। তাই ধর্মরাজের  কাছে  তার প্রথম প্রার্থনা ছিল, আমি বেঁচে ফিরে গেলে যেন সবাই চিনতে পারে। 


দ্বিতীয় প্রশ্ন স্বর্গলাভ। এটি লাভের জন্য, তিনি কর্ম পদ্ধতির কথা বললেন - যজ্ঞকর্ম বলা হয়। অর্থাৎ যথাযথ কর্মেই স্বর্গ লাভ হয়। এই স্বর্গ বাইরে নয়।  নিজের ভিতরে। কর্তব্য কর্ম সম্পাদনেই এই স্বর্গলাভ সম্ভব। 


তৃতীয় প্রশ্নই গুরুত্ত্বপূর্ণ। আত্মতত্ব। এই আত্মতত্ব লাভ-ই  জীবনের উদ্দেশ্য। আত্মজ্ঞান লাভ-ই  জীবনের লক্ষ্য। আত্ম অর্থাৎ নিজেকে জানা। আমি কে ? যমরাজ বলছেন ইনি 

"ওম " . যিনি বাক্যের অতীত, শব্দের অতীত, স্পর্শের অতীত,রূপের অতীত, ইনিই অনাদি-অনন্ত-বিভু। ইনিই আত্মা। জ্ঞানে এনাকে পাওয়া যায় না। অজ্ঞানেও পাওয়া যায় না। কর্মেও পাওয়া যায় না, নিস্কর্মেও পাওয়া যায় না। আকুতি দ্বারা নিজেকে দগ্দ্ধ করো।  তার করুনা, তার অনুগ্রহই একমাত্র আত্ম দর্শনের পথ। সর্ব বাসনার অতীতে চলে যাও, শরীর-বোধের উপরে ওঠো। শরীরতো রথ,আত্মাই রথী, বৃদ্ধি সারথি, মন রশ্মি, ইন্দ্রিয়গণ অশ্ব। রথীকে জানো, উপলব্ধি করো। 

আমরা শ্রাদ্ধ নিয়ে আলোচনা করছিলাম। শ্রাদ্ধের তিনটি পাঠ : এক : স্বাধ্যায় , পিন্ডদান, তর্পণ। 

স্বাধ্যায় : অর্থাৎ দেব দেবতার পূজা অর্চনা করা। 

 পিন্ড দান  - এক্ষেত্রে অন্ন, তিল, তুলসী,ধান ইত্যাদি এক সঙ্গে মেখে প্রদান করা হয়। 


এইগুলো কে খায়  জানিনা। দেখি যা, পশু পাখিতে খায়। গুরুদেব বলছেন, আমি খাই না খাই আমাকে কেউ যদি কিছু কেউ দান করে, তবে আমি তৃপ্ত হই। তেমনি পিতৃলোকের পক্ষেও জানবে। তাঁরা তোমাকে শ্রাদ্ধ বা তর্পন করতে দেখলে তৃপ্ত হন, পরম আনন্দ লাভ করেন। 

তর্পন - পূর্ব পুরুষের উদ্দেশে, জল দান করাকে তর্পণ  বলে।


এই তর্পণ  করার সময় প্রথমে দেব তর্পণ  করতে হয়। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, প্রজাপতি, যক্ষ, গন্ধর্ব, সুর, অসুর, জলচর জীব, মৃত্তিকাচারী, আকাশচারী  সবার উদ্দেশে জল দান করা ও তৃপ্তি দেওয়া। 


এর পারে মনুষ্য তর্পণ : সনক, সনন্দ,  সনাতন প্রভৃতি আদি পুরুষের উদ্দেশ্যে জল দন।


তারপরে ঋষি  তর্পণ : মরিচ, অত্রি,অঙ্গিরা,পুলস্ত ভৃগু,নারদ, বশিষ্ট, প্রভৃতি ঋষিদের উদ্দেশ্যে জল দান। 


এর পরে ভীষ্ম তর্পণ 


তার পরে পিতৃ-মাতৃ তর্পণ - অর্থাৎ পিতা, পিতামহ, মাতা, মাতামহ, প্রপিতামহ, প্রপিতামহী। প্রপিতামহ, প্রমাতামহী ইত্যাদিদের স্মরণ করে জল অঞ্জলি পূর্বক প্রদান করা।  এবং তৃপ্তি দান করা।



এখন আমার কাছে যা যুক্তি গ্রাহ্য তার দুটো কথা বলি।  


শরীরে আমাদের মুখ্য প্রাণ পাঁচটি। অর্থাৎ যা দিয়ে আমাদের শরীর  তৈরি হয়েছে। এগুলো হচ্ছে :

প্রাণ -এটি বায়ু। হৃদয়ের আশেপাশের অংশ - নাভি থেকে একটু উপরে - যাকে আমরা অনাহত চক্র বলি।   
অপান - এটি পৃথিবী।এটির অবস্থান মূলাধারে ও চোখের পাতায় -  
উদান -এটি আকাশ।  হৃদয়, কন্ঠ,তলপেট,ভ্রূকুটির মধ্যে, মস্তিস্ক ভাগে  - 
সমান - এটি অগ্নি। নাভি এবং আশেপাশের অংশে, শ্বাসনালীর কিনারায়- 
ধ্যান -জল  তত্ব এটি।  অস্থি, মাংস, চামড়া,রক্ত,চুল ইত্যাদি - 

মানুষের যখন স্বাভাবিক মৃত্যু হয় তার ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে এই অগ্নি বায়ু বেরিয়ে যায়। আর শরীর ঠান্ডা হতে শুরু  করে। ৩-৪ ঘন্টার মধ্যে  সমস্ত  তত্বই  বেরিয়ে  যাবার প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়।  জলতত্ব বেরোতে ১১-১৪ দিন লাগে। এখন দেহের মৃত্যুর পরে, তার অহং, তার সংস্কার অর্থাৎ  তার সঞ্চিত জ্ঞান-বুদ্ধি -অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি তাকে নতুন অবস্থার সামনে অসহায় করে দেয়। পুরোনো অভিজ্ঞতার সাথে সে মেলাতে পারে না - মৃত্যুকালীন অবস্থা। কারন এর আগে তো এমন হয় নি। তাই কিং কর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পরে। এবং দেহকে অনবরত নির্দেশ দিতে থাকে। অকেজো দেহ তার কোনো কথা শোনে না। অর্থাৎ তার নির্দেশ অনুযায়ী সারা দেয় না। তাই দেহকে ঘিরে সে ঘুরতে থাকে। এবং কষ্ট পেতে থাকে। তাই মৃত্যুর পরে অবিলম্বে দেহের সমস্ত ছিদ্র বন্ধ বিশেষ করে নাক মুখ, চোখ বন্ধ  করে দেওয়া উচিত এবং  যত তাড়াতাড়ি  সম্ভব দেহ পুড়িয়ে  দেওয়া উচিত। অগ্নিতে ভস্ম হয়ে গেলে সমস্ত তত্ব তার নিজের জায়গায় তাড়াতাড়ি ফিরে যায়।   তা হলে সংস্কারের বা অহং-এর  দেহের প্রতি মায়া বা আসক্তি কেটে যায়। এবং অহং ব্রহ্মান্ডের সাথে এক আত্মা হয়ে যায়।আর তা যদি না করা হয় তবে এই অহং আত্মীয় স্বজনের কান্না কাটি দেখে কষ্ট পায়, নিজেকে অসহায় দেখে চঞ্চল হয়ে ওঠে। দেহ বিনষ্ট  হয়ে গেলে, অহং ব্রহ্মান্ডের সাথে বিলীন হয়ে যায়।   এর পরে জাগতিক জগতের সঙ্গে তার আর কোনো সম্পর্ক থাকে না।


তাই শ্রাদ্ধ শান্তি আসলে আমরা যারা বেঁচে থাকি, তাদের শান্তি প্রক্রিয়া। এতে পারলোকবাসীর কোনো সম্পর্ক নেই। বাস্তবকে মেনে নেওয়া, সম্পর্ককে বিচ্ছিন্ন করা, নির্ভরশীলতাকে কাটিয়ে ওঠা - এটাই শ্রাদ্ধ কর্মের উদ্দেশ্যে। তাই গুরুদেব বলছেন - প্রতি তিথিতে, পারলে প্রতি  অমাবশ্যায়, উপাসনার আয়োজন করা কর্তব্য। নিজের শান্তির জন্য, নিজের বিচার বুদ্ধি সৎ পথে পরিচালনা করার জন্য।  


ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ 


শ্রাদ্ধ কর্মে উপাসনা বা প্রার্থনা করার উপকারিতা :


সত্যধর্মের  ভাই-বোনদের মৃত্যুর পড়ে, শ্রাদ্ধ-কর্মাদির সঙ্গে আমরা উপাসনা বা প্রার্থনা করতে দেখি। এর দ্বারা কি উপকার হয় ? যদি হয় কার উপকার হয়?

একটা কথা মনে রাখা দরকার আমাদের এই পার্থিব জগতে বা দৃশ্যমান জগৎ যেমন নিয়মে বাঁধা অর্থাৎ প্রত্যেক কাজের একটা কারন আছে, তেমনি পরলোকেও একটা নিয়ম শৃঙ্খলা আছে। নিতান্ত খেয়ালের উপরে কোনো কিছু হয় না। জগতের সমস্ত ঘটনাই নিয়মের অধীন। এবং মনে রাখবেন, ঈশ্বর আমাদের মঙ্গলের জন্যই সমস্ত ঘটনা ঘটাচ্ছেন। আমাদের উচিত অদৃশ্য শাসন-কর্তাকে সাহায্য করা। আমরা অজ্ঞতা বশতঃ অনেক সময় বিপরীত কাজ করে থাকি। এইসব ভুল পদক্ষেপ যেমন আমাদের নিজেদের পক্ষে ক্ষতিকারক, তেমনি আমাদের নিকটজনের জন্যও ক্ষতিকারক।

আমাদের সবারই অভিজ্ঞতা বলে, কেউ মারা গেলে আমরা শোক করি, কান্নাকাটি করি। কিন্তু এটা আমাদের করা উচিত নয়।  এতে আমাদের যিনি মারা গেছেন, তাঁর অর্থাৎ দেহ-মুক্ত জীবাত্মার ক্ষতি করি। এতে করে, সেই জীবাত্মার  কামলোকে অবস্থানের মেয়াদ বেড়ে যায়। তাই আমাদের শোক ত্যাগ করে, আমাদের ভাবা উচিত, কি ভাবে  আমাদের সেই স্নেহের পাত্র বা শ্রদ্ধার পাত্র যিনি দেহ থেকে মুক্ত হয়ে গেছেন, তিনি পরলোকে কিভাবে  সুখে শান্তিতে থাকতে পারেন।  এবং সেই উদ্দেশ্যেই আমাদের উচিত তার আত্মার শান্তির জন্য  পরমেশ্বর-এর কাছে প্রার্থনা করা  বা উপাসনা করা , এমনকি তার উদ্দেশে যদি আমরা ধ্যান করি, তাহলেও  পরলোকগত আত্মার শান্তি হয়।

"উপাসনা" সর্বদাই মঙ্গলময় বাসনা বা মঙ্গলমায়ের কাছে আবেদন  ছাড়া আর কিছু নয়। এর মধ্যে স্বার্থের লেশ মাত্র থাকা উচিত নয়। কিছু প্রত্যাশা করা  উচিত নয়। নিঃস্বার্থ শুভইচ্ছা প্রদান, গভীর ভাবে তার শুভ  চিন্তায় মগ্ন থাকলে তার উপকার হয়। এবং এই শুভকর্ম  করলে, তা কখনোই নিষ্ফল হয় না।

আমরা জানি, চিন্তার একটা আকার আছে, চিন্তা মাত্রেই বস্তূ, তা সে সুচিন্তাই হোক বা কুচিন্তাই  হোক। আমাদের স্বার্থহীন কল্যাণ  চিন্তা  অব্যর্থ ভাবে সেই অদৃশ্য সেই বিদেহী আত্মার কাছে বা বস্তূর কাছে, আমাদের চিন্তার প্রবাহ বা স্রোত   অবশ্য়ই পৌঁছাবে  । এবং তার কল্যাণ হবে। আমরা শুধু শ্রাদ্ধ শান্তি করে, নিয়ম রক্ষা করতে পারি। নিজেরা তৃপ্ত হতে পারি। কিন্তু তাতে তার কোনো মঙ্গল হয় না। বরং আমরা যদি পরম-ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, হে প্রভু তোমার এই পুত্রকে  " চির শান্তি দাও তারে, রেখো তারে আনন্দ পাথারে" - এই চিন্তা করে, দৈনিক কয়েকবার স্থির চিত্তে পরম-ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে পারি, তবে পরলোকগত আত্মার কল্যাণ  সাধিত হয়। আমাদের যে সব নিকট আত্মীয়, পরলোকে বাস করছে, তারা সবাই তখন এসে নবাগতকে অভ্যর্থনা করে। নতুন জগতের সব কিছু তাকে বোঝায়, এবং সাহায্য করে। তা না করে যদি আমরা শোকাচ্ছন্ন হয়ে থাকি, কান্নাকাটি করি, তবে মৃত ব্যক্তির আত্মা একটা দোটানায় পরে যায়, এবং অকুল পাথারে দুলতে থাকে। এবং এর ফলে, যে মৃত্যু তাকে এক আনন্দময় উজ্বল জীবনের সন্ধান দিতে পারতো, তাঁকে সে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে পারে না। ফলে আমাদের কান্নাকাটি, শোক, এগুলো মৃত আত্মার উন্নতির অন্তরায় হয়ে যায়। এবং নতুন জীবনে অভ্যস্ত হতে তার দেরি হয়। মৃত আত্মার প্রকৃত মঙ্গল সাধন করতে হলে তন্ময় চিত্তে প্রতিদিন, মৃত আত্মার জন্য প্রার্থনা করা কর্তব্য। একটা সুন্দর প্রার্থনার কথা আমি অনেক দিন আগে এক ব্রাহ্মণ পন্ডিতের কাছে শুনেছিলাম, জানিনা কার লেখা, সেটা বলি :

ঈশো দিশতু কল্যানং সর্ব্ব অশুভ নিবর্তকম।
নির্মল আনন্দ সন্দোহং শাশ্বতং তে প্রযচ্ছতু। ।

হে ঈশ্বর, সমস্ত অশুভকে দূর করে,  কল্যাণ  করুন। শাশ্বত নির্মল আনন্দ যথেষ্ট পরিমানে প্রদান করুন।

শান্তি নির্বাণ-পরমা ব্রহ্ম সংস্থা সদা অস্তু তে।
ভূয়াৎ চিরন্তনী তৃপ্তিঃ প্রীতির ঐকান্তিকী পরা। ।

পরম-নির্বাণ শান্তি স্বরূপ ব্রহ্মে স্থিতি যেন বিধেয় হয়।  তৃপ্তি ও প্রীতি যেন চিরস্থায়ী হয় ও ঐকান্তিক হয় ।

সৎ কৃপাবারি বর্ষৈস্তে ত্রিতাপানল সঞ্চয়াঃ।
চিরায় প্রশমং যান্তু-মাঙ্গল্যম ঈদম অর্থয়ে। ।
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি  ওঁং

ত্রিতাপ জ্বালা নিবারণের জন্য তোমার সৎ কৃপাবারি সদাই বর্ষাতে  থাকুক। অমঙ্গল প্রশমিত হোক চিরতরে। এই আমাদের প্রার্থনা। 

আমাদের মধ্যে কারুর কারুর ধারণা, উপাসনাতে, বা প্রার্থনাতে, পরলোকগত আত্মার কি  আসে যায়  ? বরং বলা যেতে পারে, যারা এই উপাসনা, বা প্রার্থনা করে, তাদের এতে লাভ হয়। মনের শান্তি আসে। মৃত ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা আমাদের পক্ষে আরো বেশি জরুরী।  কিন্তু তারা যেটা জানে না, সেটা হচ্ছে, জীবের মৃত্যু কিংবা জীবিত থাকা প্রকৃত পক্ষে অর্থহীন বাক্য। জীব যখন, আনন্দলোক থেকে বেরিয়ে আসে, তার পর থেকে সে ঘুরতে থাকে, কখনো স্থুল শরীর  ধারণ করে, যাকে  আমরা জীবিত বলি,  আবার কখনো সূক্ষ্ম শরীর ধারণ করে, তখন তাকে আমরা মৃত বলি। আসলে আমরা যেমন, তেমনই  আছি।  যখন আমরা মনুষ্য শরীরের মধ্যে প্রবেশ করি তখন মানুষ  হয়ে যাই।  আসলে আমি যার মধ্যে যখন প্রবেশ করি, তখন আমাকে তাই মনে হয়। আমি মানুষের মধ্যে প্রবেশ করলে আমি মানুষ হই , আবার যদি কোনো জীব অর্থাৎ গরু গাধা, বাঘ, হাতি যার মধ্যেই প্রবেশ করি, তখন আমি তাই হয়ে যাই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, আমাদের বাসনার তৃপ্তি সাধনের সমাপ্তিতে,  আবার সেখান থেকে বেরিয়ে নিজ ধামে ফিরে আসি।  এটাই মোক্ষ।  এটাই মুক্তি। আসলে আমি যা তাইই  থাকি। আমি যার মধ্যে প্রবেশ করি, সেটার লয় মানে আমার লয়  নয়।  এই সত্য আমাদের বুঝতে হবে।

তথাকথিত মৃত্যু আর কিছুই নয়, শরীরের পরিবর্তন, অর্থাৎ স্থূল থেকে সূক্ষ্ম শরীরে গমন। জীবিত মানুষের ক্ষেত্রে যেমন ভালো কথা, ভালোবাসার কথা আমাদের আনন্দ দেয়, ঠিক তেমনি বিদেহীর পক্ষে, তার সম্পর্কে প্রেমাত্মিকা চিন্তা, তার কাছে  উপাদেয়, বা উপভোগ্য। আমাদের শুভ চিন্তা যত  ঐকান্তিক হবে যত  গভীর হবে, ততই অধিক ফলবতী হবে।  আর একই জিনিস যদি সমবেত ভাবে করা যায়, অর্থাৎ উপাসনা যদি সমবেত ভাবে করা যায়, তবে সেটা আরো বেশি ফলপ্রসূ, আরো বেশি আনন্দ দায়ক হবে। আর বিদেহীর  আত্মউন্নতির পথে সহায়ক হবে। আত্মীয়স্বজন যদি একসঙ্গে, একই সময়ে একত্রে মিলিত হয়ে প্রতিদিন শুভচিন্তা প্রেরণ করে তার চেয়ে ভালো কিছু আর হয় না। যদি সবাই একই সময় এক জায়গায় মিলিত হতে নাও  পারেন, তথাপি, একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই শুভ চিন্তার অনুষ্ঠান করতে পারেন, তবে সেটাও খুব ফলপ্রসূ হবে। সুতরং আমাদের চিন্তাশক্তির এই শুভ দিকটি যদি আমরা সম্মিলিত ভাবে কাজে লাগাতে পারি, তবে শুধু পারলৌকিক আত্মাদেরই শান্তি হবে তাই নয়, আমাদেরও সর্বাঙ্গীন শান্তি লাভ হবে।

শোক আসলে স্বর্থের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।  আমরা মনে করি,  যে এত স্নেহ, মমতা, প্রেম, ভালোবাসা, সবই  জীবনের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায়। আমি তো জানিনা যে আমার শেষ নেই। নতুন ভাবে আমি পরলোকে বিকশিত হই।  পরলোকে তো জন্ম মৃত্যু নেই সেখানে আমরা আবির্ভূত হই, আবার সময় শেষ হয়ে গেলে আমরা সেখান থেকে প্রস্থান করি। অর্থাৎ হয় উচ্চতর স্তরে অথবা আবার মৃত্যুপুরীতে চলে আসি। কারুর সঙ্গেই আমার বিচ্ছেদ হয় না। পরলোকে বসে আমরা সব দেখতে শুনতে পাই শুধু আদান প্রদান পার্থিব ভাবে করতে পারি না। কিন্তু ভাবনা-চিন্তা আমাদের মিলনের সেতু হতে পারে। পুত্র যখন দূর দেশে চাকরি করতে যায়, তখন আমরা কান্নাকাটি করি, এগুলো ঠিক নয়। এতে দুরদেশবাসী আমার আত্মীয়ের বা পুত্রের  মানসিক যন্ত্রনা হয়।এতে তারা  সেখানকার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে না। আমরা সেটা বুঝতে পারি না। তেমনি পরলোকবাসীর জন্য আমরা যদি শোক করি, তাতে তাদের কষ্ট  হয়। এবং তাদের স্বাভাবিক উন্নতিতে বাধা হয়। কামনার লোকে তাদের বাসের সময় দীর্ঘায়িত হয়। সেটা আমাদের একদম অনুচিত। আমাদের নিকটজন বাড়ির বাইরে গেলে এক অশুভ আশঙ্কা আমাদের ঘিরে থাকে, এই বুঝি তার কোন খারাপ কিছু হলো। আসলে স্নেহ ভালোবাসা, আমাদের অনিষ্টের আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে। তাই শোক করা, বা অনিষ্টের আশঙ্কা থেকে আমাদের চিন্তাকে দূরে রাখতে হবে। শুভ চিন্তা-ভাবনা নিয়ে উপাসনা করুন, শুধুই উপাসনা করুন। আমাদের শুভভাবনার এক অলৌকিক ক্ষমতা আছে, সেটা প্রতক্ষ্য করুন।

            
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ