Saturday 3 October 2020

ভারতের মহাযোগী - জীবন ও বাণী - জ্ঞানগঞ্জ

ভারতের মহাযোগী - জীবন ও বাণী 
ব্রহ্মানন্দ ব্রহ্মকথা  :
ঠাকুর রামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট অবস্থায় আছেন, যা তার মাঝে মধ্যেই হয়। হঠাৎ দেখলেন, বটতলায় একটি একটি লাবণ্যময় বালক দাঁড়িয়ে আছে।  ঠাকুরের দিকে সে  সতৃষ্ণ নয়নে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভাবাবেশ কেটে গেলে, ভাগ্নে হৃদয়কে ডেকে এই অলৌকিক দর্শনের কথা বলতেই, হৃদয় বলে উঠলো, মামা আমি কিন্তু ব্যাপারটা বুঝেছি - তোমার ছেলে হবে, তাই এটা তুমি দেখেছো।  ঠাকুর তক্ষনাৎ বলে উঠলেন, সে কিরে ? আমার তো মাতৃযোণি ! আমার ছেলে কখনো হবে না। এর পরে আবার একদিন ভাবাবেশে দেখলেন, জগন্মাতার কোলে একটা দিব্য  শিশু। আর জগন্মাতা  বলছেন, এই দেখ তোর ছেলে। এবার ঠাকুর বড্ড ভয় পেয়ে গেলেন। তাহলে কি, যে গার্হস্থ জীবন তিনি চিরতরে ত্যাগ করেছিলেন, সেই গার্হস্থ জীবনে আবার ফিরে যেতে হবে ? আর তারই ঘরে জন্ম নেবে তার
পুত্র ? ঠাকুর যেন মানস নেত্রে দেখতে পান, গঙ্গাবক্ষে পদ্মের উপরে  শ্রীকৃষ্ণ আর তার হাত ধরে আছে এক রাখাল সখা - মনোহর ভঙ্গিতে করছে নৃত্য।

এর পর একদিন  কোন্নগর থেকে যখন রাখাল নামক এক যুবক এসে  ঠাকুরকে প্রনাম করলেন, তখন তাকে দেখে, তার নাম শুনে, গদগদ অস্ফুট কন্ঠে বলে উঠলেন, সেই নাম - রাখাল - ব্রজের রাখাল। এই রাখাল - ব্রজের রাখাল, শ্রী রাখাল চন্দ্র ঘোষ, ঠাকুরের সংস্পর্শে এসে হয়ে উঠেছিলেন, ব্রহ্মানন্দ মহারাজ। ইনি ঠাকুরের মানস পুত্র। আমরা তার কাছে থেকে আজ ব্রহ্মানন্দের কথা শুনবো।

স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলছেন, আমাদের সমস্ত কর্ম্মের পিছনে একটা সাধন ভিত্তি গড়ে উঠুক। তা সে সংসারের কাজই  হোক, আর আশ্রমের কাজই হোক। খুব ভোরে বিছানা ত্যাগ করা ভালো। সকাল ও সন্ধ্যার সময় আমাদের সাধন ভজনের সময়। প্রকৃতি এই সময় শান্ত থাকে, এই সময়ে ধ্যান জপ করলে অধিক ফলপ্রসূ হয়। এই সময় আমাদের সুষুম্না নাড়ী দিয়ে, শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহিত হয়। মন শান্ত থাকে। অন্য সময় আমাদের হয় ইড়া  নাড়ী দিয়ে, অথবা পিঙ্গলা নাড়ী  দিয়ে  অর্থাৎ ডান  নাক অথবা বাঁ নাক দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস প্রবাহিত হয়। আর এই সময়, আমাদের চিত্ত চঞ্চল হয়। সতর্ক সাধক এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করেন, আর তক্ষুনি ধ্যানে বসে যান, তা সে যতই জরুরী  কাজ থাকুক না কেন।

স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলছেন : পরমাত্মা সর্বদা আমাদের সঙ্গে আছেন, এই অনুভূতি যাদের সর্ব্বক্ষন বজায় থাকে, তারাই উত্তম সাধক। অর্থাৎ যিনি সারাক্ষন তাঁরই ধ্যানে মগ্ন আছেন। এর পরে,  যে সাধক নিয়ম করে ধ্যান-জপ করেন, জপের মধ্যে উপলব্ধি করেন, যে তিনি আছেন, আমিও আছি, এই ধারণা বজায় রাখেন।  এদের ধীরে ধীরে জপ তপ বন্ধ হয়ে যায়। এঁরা  দ্বিতীয়  শ্রেণীর সাধক ।  এর পরের  স্তরের সাধক ব্যস্ত থাকেন বাহ্যপূজা  নিয়ে। প্রতীক বা প্রতিমার  পূজা অর্চনা করেন, উপাসনা করেন। এসব হচ্ছে, সাধকের ক্রমোন্নতির ধাপ। আমাদের মতো সাধারণের লোকের পক্ষে নির্গুণ ব্রহ্মের চিন্তা করা সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষকে সমাধির উপদেশ দিলে, তার ভালো লাগবে না। বুঝতেও পারবে না কিছু। কিন্তু এঁরা যখন ফুল বেলপাড়া নিয়ে পুজো করতে বসে, বা পুজোয় সাহায্য করতে বসে, তখন সে বেশ মনোযোগ দিয়ে সেটা করতে পারে। এই সময় তার মন স্থির হয়, এবং খানিক্ষন সে আনন্দে থাকে।  ধীরে ধীরে এই অবস্থার অতিক্রম করতে হয়।

আমাদের মন যত সুক্ষ হতে থাকে,  বিচার শক্তি যখন সূক্ষ্ম হতে থাকে, বায়ু সাধনের মাধ্যমে যখন আমরা বায়ুকে শুদ্ধ ও সূক্ষ্ম করতে পারি, তখন আর  আমাদের এই স্থূল পুজো-আরাধনায়  রস পাই না। কিন্তু প্রথমে পুজো দিয়েই শুরু করতে হয়। এর পর নিজের থেকেই জপের দিকে মন আকৃষ্ট হয়। তখন সে নিজে থেকেই কোনো না কোনো ঈশ্বরের নামের জপ করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সে ধ্যানের দিকে আকৃষ্ট হয়।  তখন তার ধ্যান করতে ইচ্ছে হয়। এইভাবে, সাধকের  মধ্যে একটা স্বাভাবিক অগ্রগতি লক্ষ করা যায়।

এর মধ্যে একদল মানুষ আছেন, যারা কিছু প্রাপ্তির আশায়, বা সাংসারিক অশান্তি থেকে বাঁচবার জন্য , বা বিপদে পড়ে, আধ্যাত্মিক গুরুর আশ্রয় নেন। এবং প্রত্যাশা করেন, গুরুদেব তাকে সমস্ত বিপদ থেকে উদ্ধ্বার করবেন।  এরা আদৌ সাধকের পর্যায় পড়েন না। তবে এর মধ্যে থেকেও কেউ কেউ ভাগ্যক্রমে, সৎগুরুর আশ্রয়ে উচ্চস্তরের সাধক হয়ে যান। এদের পূর্ব্ব পূর্ব্ব জীবনের সুকৃতির ফলেই এটা হয়ে থাকে। সাময়িক বিস্মৃতির জন্য, এরা  সংসার জালে   জড়িয়ে পড়ে ছিলেন। এখন আবার মুক্তির পথের পথিক হয়ে গেছেন।

ব্রহ্মানন্দ বলছেন, দেহই হচ্ছে, সর্ব্বশ্রেষ্ঠ দেব-মন্দির। ধ্যান আদি যা কিছু আমরা করি, সবই আমরা শরীরে সাহায্যে, বা শরীরের মধ্যে করে থাকি। যা আছে শরীর  ভান্ডে, তাই আছে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে। হৃদয়ের ভিতরেই পরম-পুরুষের দর্শন মেলে। সহস্রারে মন গেলে আর  নাবতে  চায় না। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন, ভ্রূমধ্যে জ্ঞাননেত্র আছে। এই জ্ঞাননেত্র উন্মিলিত হলে, চারিদিক আনন্দময় দেখায়।

কিন্তু কথা হচ্ছে, ধ্যানের  পদ্ধতি কি ? আর ধ্যানের  চরম উপলব্ধিই  বা কি ?  স্বামীজি  বলছেন, ধ্যানকালে ইষ্টমূর্তিকে জ্যোতির্ময় ভাবতে হয়।  মনে করতে হয়, যেন তার জ্যোতিতেই সব আলোকিত। ইষ্টমূর্তিকে চৈতন্যস্বরূপ ভাবতে হয়। এতে করে  ধীরে ধীরে ধ্যানের মধ্যে জ্যোতি দর্শনের ফলে, একসময় জ্যোতি এক স্নিগ্ধ আলোতে পরিণত হয়। এইভাবে প্রতীকের ধ্যান নিরাকারের ধ্যানে পরিণত হয়। এই সময় আমাদের বোধ শক্তির মধ্যে একটা বিশেষ বোধের খেলা চলতে থাকে। খুলে যায় জ্ঞানচক্ষু। তখন প্রতক্ষ্য হয়, অন্য এক জগৎ। এযেন এক আলাদা জগৎ। এইসময়  বাহ্য  জগতের কিছু মনে পরে না। মন লয় হয়ে যায়।  আর মন যখন লয় হয়ে যায়, তখন হয় সমাধি। এরও পরে নির্বিকল্প সমাধি। ব্রহ্মানন্দ মহারাজ বলছেন, নির্বিকল্প সমাধির পরেও এগিয়ে যেতে হয়,যার কথা মুখে বলা যায় না। সেখানে না আছে দেখা, না আছে শোনা, অনন্তই অনন্ত। এগুলো হচ্ছে এক একটা অবস্থা। এই সময় মনের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়, তখন মনকে জোর করে ফিরিয়ে আনতে  হয় এই জগতে।  এখানে দ্বৈত - অদ্বৈত জ্ঞান থাকে না। এই অবস্থায় শরীরটা এক বাঁধা বলে মনে হয়। তাই তিনি শরীর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। ব্রহ্মানন্দ বলছেন, যেন ঘটটাকে ভেঙে দেওয়া। ঠাকুর বলতেন,  দশটা সরায় জল আছে, তাতে সুজয়ের প্রতিবিম্ব পড়েছে। একটা একটা করে সরাগুলো ভাঙতে ভাঙতে শেষে একটা সরা আর সূর্য রইলো। শেষে শেষ সরাটাও ভেঙে দাও, রইলো বাকি সূর্য। কিন্তু কে বলবে যে সূর্য রইলো।  সূর্য্যই রইলো কিন্তু দেখার বা বলার কেউ রইলো না।

ব্রহ্মানন্দ বলছেন, পাকা বিশ্বাস চাই, কিন্তু সেই পাকা বিশ্বাস তখনই হবে, যখন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হবে, যখন প্রতক্ষ্য অনুভূতি হবে। তার   আগে বিশ্বাসে   ভর  করে  এগুতে হয়। আবার প্রত্যক্ষ অনুভূতি না হলে বিশ্বাস দৃঢ় হয় না। অবিশ্বাস নিয়ে এই পথে এগুতে উৎসাহ পাওয়া যায় না। দ্বিধাগ্রস্থ মন নিয়ে এই পথে অগ্রসর হওয়া যায় না। একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমাদের মুনি-ঋষিগণ এই পথে অগ্রসর হয়ে সত্যকে উপলব্ধি করেছেন, আমার পক্ষেও সত্য দর্শন হবে। আমি এখন দেখতে পাচ্ছি না এটা সত্য। আর এর কারন হচ্ছে, আমাদের দৃষ্টিশক্তির অভাব। মেঘে ঢাকা এই দুটো চোখ সূর্যকে দেখতে পাচ্ছে না। সংস্কারের রঙ্গিন চশমা লাগানো, আগে পরিষ্কার করতে হবে। সংস্কার যখন গুরুকৃপায় দূরীভূত হবে, তখন ঈশ্বরের কৃপা বর্ষিত হবে। আমাদের ক্ষুদ্র মন কি সেই অনন্ত- বিশাল ঈশ্বরের ধারণা করে পারে ? বুদ্ধি দিয়ে কি ঈশ্বরের বিচার করতে পারা  যায় ? তিনি তো মন-বুদ্ধির অনেক দূরে। এই পার্থিব জগতে যা কিছু দেখতে পাচ্ছি, সেই আমাদের মনের বিচরণ ক্ষেত্র। এখানে মন   রাজা। মনই কর্তা। আমরা যা কিছু দেখছি, যা কিছু শুনছি, যা কিছু ভাবছি, সবই মনের সৃষ্টি। আমাদের মতো সাধারণের মানুষের পক্ষে এর বাইরে যাবার উপায় নেই।

কিন্তু ঈশ্বরের নাম করতে করতে আমাদের মধ্যে একটা সুক্ষ মনের সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি নয়, বলা যেতে পারে, সুক্ষ মনের বিকাশ হয়।  কারন এই সুক্ষ মন আমাদের সবার মধ্যেই আছে। তাকে যোগের মাধ্যমে, জাগ্রত করতে হয়। সাধনার মাধ্যমে উদ্ভাসিত করতে হয়। তখন আমরা সুক্ষ অনুভূতি সম্পন্ন হয়ে উঠতে পারি। ঈশ্বরের নামে এই শক্তি আছে। তাই নাম-জপার জন্য এতো গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে।  এই সূক্ষ্ম মন আমাদের ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু সুক্ষ অনুভূতি সম্পন্ন হলে জাগতিক কোনো কিছু তখন আমাদের আর ভালো লাগে না। তখন টেবিল না দেখে আমরা কাঠের কথা, কাঠের কথা না ভেবে আমরা গাছের কথা ভাবি , গাছের কথা না ভেবে আমরা বিজের কথা ভাবতে থাকি। অলংকারের কথা না ভেবে আমরা সোনার কথা ভাবতে থাকি।  এই সময় সেই সূক্ষ্ম ভাবনায় অর্থাৎ ভগবৎ ভাবনায় বুদ্ হয়ে   থাকতে ভালো লাগে। এই বুদ্ হয়ে থাকার নামই সমাধি। সমাধির অবস্থা বর্ণনা করা যায় না। অস্তি-নাস্তির পারে। সেখানে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-নিরানন্দ, আলো-আঁধার  বলে কিছু নেই।  কিন্তু কি আছে সেটা মুখে, বা ভাষায় বলা সম্ভব নয়। যার জন্য একে বলা হয়ে থাকে অনির্বচনীয়। এখানে জ্ঞাত জ্ঞেয়, দ্রষ্টা-দৃশ্য,  বলে কিছু থাকে না। সমস্ত শাস্ত্রে, অর্থাৎ মুনি-ঋষিগণ এই পর্যন্ত এসে নির্বাক হয়ে যান। কিন্তু সাধক অনুভব করেন। এটা হচ্ছে স্বয়ংবেদ্য আর একেই উপনিষদ বলছেন ভূমা বস্তু। এখানে না আছে অভাব, না আছে ভয়। কেউ বলেন, এখানেই নিত্যলীলা চলছে। কেউ বলেন, শূন্য অবস্থা।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

আমরা যখন মা-বাবার সঙ্গে থাকি, তখন আমরা নিশ্চিন্ত থাকি, নির্ভয়ে থাকি। যে সব মহাত্মা ঈশ্বরের সান্নিধ্যে আছেন, তাদের ভয়-ডর বলে কিছু থাকে না। অপ্রাপ্তি বলে কিছু থাকেনা।  ঈশ্বর উপলব্ধির দুটো দিক সমর্পনের  শক্তি  :
মনের শক্তি বৃদ্ধি ও মনের ভয়শূন্যতা।
গল্পটা আমরা সবাই শুনেছি, আরো একবার শুনে নেবো।  স্বামী বিবেকানন্দ তখন কাশীতে। দুর্গামন্দির থেকে ঘরে ফিরছেন। সরু গলির মধ্যে একদল বাঁদর তার পথ অবরোধ করে দাঁড়ালো। তিনি ভয় পেয়ে  দৌড়তে লাগলেন, বাঁদরগুলোও তার পিছনে ধাওয়া করলো। সামনে থেকে আসছিলেন, এক প্রবীণ সন্যাসী।  তিনি স্বামীজিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দাঁড়াও, বাঁদরগুলোর সামনে রুখে দাঁড়াও।  স্বামীজী ঘুরে দাঁড়ালেন,  আর সঙ্গে সঙ্গে বাঁদরগুলো পালিয়ে গেলো। সমস্যাকে সামনে থেকে দেখুন।  সমস্যাকে এড়িয়ে যেতে চাইলে, সমস্যা আপনার পিছু ছাড়বে না। আপনি এই সত্যটি জানবেন, আমরা  ঈশ্বরের কথা ভুলে গেছি , ঈশ্বর কিন্তু আমাদের কথা ভুলতে পারেন না।  ঈশ্বর আপনার কাছে কাছেই  আছেন , আপনি দেখতে পাচ্ছেন না, কারন আপনার চোখে এখন মায়ার কালো চশমা। এই কালো চশমাটা খুলে ফেলুন, দেখবেন, ঈশ্বরের করুনা হস্ত আপনার দিকেই বাড়িয়ে আছে।
কখনো কখনো বিপদ আপদ আকস্মিক ভাবে এসে পরে। এমনকি এর মোকাবিলার সময় পাওয়া যায় না। এই সময় দরকার আমাদের সাহস অর্থাৎ মনের শক্তি এবং উপস্থিত বুদ্ধি। এই গুণগুলো আমাদের অর্জন করতে হয়, যোগ অভ্যাসের মাধ্যমে। ধ্যান-জপের  মাধ্যমে এই গুনগুলোকে বাড়িয়ে নেওয়া যায়। আর দরকার ঈশ্বরের প্রতি সম্পূর্ণ ভাবে সমর্পন।  
আবার সেই স্বামীজীর কথা। তিনি তখন হিমালয়ে জপ-ধ্যান করেন, আর পাহাড়ি গ্রামের বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে শরীরের ক্ষিদে মেটান। তো একসময় ভাবলেন, পাহাড়ের গ্রামবাসীরা বড়োই গরিব। এরা বড্ড কষ্টে নিজের খাবার জোগাড় করে, আর আমি তাদের খাবারে ভাগ বসাই ? তো দুদিন আর ভিক্ষে করতে বেরুলেন না। এই সময় তার নদীর জলই ক্ষুধা-তৃষ্ণার একমাত্র অবলম্বন। একদিন গভীর জঙ্গলে, গিয়ে ঈশ্বরের ধ্যানে লিপ্ত হলেন। ধ্যান ভাঙতেই, চোখ খুলে, দেখেন একটা ভয়ঙ্কর বাঘ তার সামনে। বাঘটি তার হিংস্র চোখদুটো দিয়ে স্বামীজিকে দেখছে। স্বামীজী ভাবলেন, ভালোই হলো। আমার দ্বারা একটা ক্ষুদার্থ জীবের ক্ষিদে মিটবে। আমার জীবন সার্থক। স্বামীজী আবার চোখ বুজলেন, আবার ঈশ্বরের ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। কিন্তু আশ্চার্য্য বাঘটি স্বামীজিকে আক্রমন করলো না। জঙ্গলে ফিরে গেলো। স্বামীজী বুঝলেন, তার দেহ সৎকারের সময় এখনো আসে নি। ঈশ্বর তাকে দিয়ে আরো অনেক কাজ করাতে চান। 
তো আমরা আসলে আমাদের প্রারব্ধ কর্ম্মফল ভোগ করবার জন্য জন্মাই। শুধু তাই নয়, পৃথিবী একটা কর্ম্মক্ষেত্ৰ।  এখানে এলে সবাইকেই কিছু  না কিছু কর্ম্ম করতেই হবে। ঈশ্বর সমর্পিত প্রাণ মনিষী দেহ ধারণ করেন, পরহিতের  জন্য। এবং এঁরা যেকোনো কাজকেই, ঈশ্বরের কর্ম্ম বলেই মনে করেন। দেহটা সেই কর্ম্মের যন্ত্র মাত্র। এই সব মানুষের জীবনে এমন কিছু ঘটনা সংগঠিত হয়, আপাত দৃষ্টিতে তার ব্যাখ্যা মেলে না, কিন্ত ঈশ্বর ভক্ত এইসব ঘটনার মধ্যে ঈশ্বরের করুনা  দেখতে পান।
বিশ্বাস ও ভক্তি থাকলে, আমরা আমাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান অবশ্যই  খুঁজে পাবো। এমন কোনো সমস্যা নেই যার সমাধান নেই। অন্য কোনো দিক না পেলেও, কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।  আমাদের শুধু ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়। ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করাও ভগবানেরই  পরীক্ষা।
ধৈর্য্য ধরে, একাগ্রতার সঙ্গে নিরন্তর যদি আমরা শারীরিক বা মানসিক কাজে লিপ্ত থাকি, তবে আমাদের স্বভাবের মধ্যে, প্রাকৃতিক গুনের প্রকাশ ঘটতে থাকবে। জ্ঞান সংগ্রহ করতে করতে মানুষ যেমন জ্ঞানী হয়ে যায়। দান করতে করতে মানুষ যেমন স্বভাবের মধ্যেই দাতার গুন্  প্রকাশ হয়ে পরে, ঠিক তেমনি জপ-ধ্যান করতে করতে মানুষের মধ্যে ঐশ্বরিক শক্তির প্রকাশ হতে পারে। একটা আধ্যাত্মিক আলো তার মধ্যে জেগে ওঠে। নিরন্তর ধ্যানের অভ্যাসে মানুষ  তার মধ্যে নির্ভীকতা, বিপদের সময় উপস্থিত বুদ্ধির জাগরণ দেখতে পায়।  নিরন্তর সে একটা অদৃশ্য শক্তির অনুভব করে, যা তাকে নির্ভয়ে থাকতে  সাহায্য করে। এখনকি তার ভাগ্য খুলে যায়। ক্ষুধা পেলে, ভগবানই তার খাদ্যের যোগান দেন ।  অসুস্থ হলে, তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন , আশ্রয়ের দরকার পড়লে, ঘর জুটে  যায়। এটা কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়, এটা আপনার ধ্যান জপের পরিণতি মাত্র । আপনি অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে যান। আর যাঁরা  ঈশ্বরে সমর্পিত, তারা অসুস্থ হলে ডাক্তার তাদের কাছে আসেন। 
আপনি যখন কোনো বই পড়েন, তখন আপনি কি ভেবে দেখেছেন, আপনি শুধু অক্ষর দেখছেন না। আপনি শব্দ, বাক্য শুনছেন। আপনি অনেকগুলো বাক্যের মধ্যে একটা ভাব দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু আপনি যখন শিশু ছিলেন, যখন মা আপনাকে বর্ণলিপি স্লেটে লিখে হাত বোলাতে বলতেন। আপনি তখন কিন্তু জানতেন না, যে এর মাধ্যমে একসময় ভাবের বিনিময় করতে পারবেন। প্রথম দিকে ধ্যান জপ এই অক্ষরে পেন্সিল বোলানো  মাত্র। কিন্তু এই ধ্যান-জপ যখন রপ্ত হয়ে যাবে, তখন আপনি বুঝতে পারবেন, এর মাধ্যমে সেই বিশ্বশক্তির সঙ্গে ভাবের বিনিময় করা যায়।  ঈশ্বরের ইচ্ছেকে অনুধাবন করা যায়। আর বিশ্বশক্তির সঙ্গে এই শরীরের যে মিলন কেন্দ্র আছে, অর্থাৎ আমাদের মস্তিষ্কে অবস্থিত বিন্দু, সেখানে ঈশ্বরের সঙ্গে সহাবস্থান করা যায় যোগের মাধ্যমে । এটি কোনো কল্পনা নয়, বাস্তব সত্য।
একটা কথা বলি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলুন, রোগশোক বলুন, মানসিক দুশ্চিন্তা বলুন, কোনো কিছুই বিনা কারণে আসে না। এমন ভাবার কোনো কারন নেই, যে ভগবান আমাদের দুঃখ-কষ্টের খাঁচায় পুড়ে দিয়ে মজা দেখছেন। আসলে তিনি নির্লিপ্ত। তিনি সব দেখছেন। আমরা যদি নিষ্ঠার সঙ্গে তার সাহায্য চাই, তবে তিনি কারুর না কারুর মাধ্যমে আমাদের কাছে সেই সাহায্য পৌঁছে দেবেন। আর যদি  নৈর্ব্যক্তিক হন তবে, আপনার সব দায়িত্ব নিয়ে নেবেন।  সদ্যজাত সন্তানের দায়িত্ত্ব যেমন পরম স্নেহময়ী মা-ই পালন করে থাকেন।কিন্তু আমাদের সেই সদ্যজাত সন্তানের মতো হতে হবে। আমরা জানি মানুষের অনেক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতা আছে।  মানুষের  এই  শক্তির সীমাবদ্ধতার দিকে লক্ষ রেখে, আমাদের প্রত্যেকের উচিত, সেই বিশ্বশক্তির উপরে পরিপূর্ন বিশ্বাস ও নির্ভরতা জাগিয়ে তোলা । প্রথম দিকে আমাদের অবশ্য়ই প্রার্থনা দিয়ে শুরু করা উচিত। এবং ধীরে ধীরে আধ্যাত্মিক অনুভূতি যখন দৃঢ় হয়, তখন মানুষ  নির্লিপ্ত হয়ে  যায়। তখন জাগতিক কোনো দুঃখ-কষ্ট তাকে পীড়ন করতে পারে না।                                                           
 আমরা প্রার্থনা করছি, কিন্তু মনোসংযোগ করতে পারছি না। মনকে সংযত করতে পারা  যায় তখনই যখন আমরা সৎসঙ্গ করবো, সৎগ্রন্থ পাঠ  করবো।  আর এর ফলে আমাদের মনে একটা উচ্চভাব জেগে উঠবে। দৃঢ় সংকল্প নিয়ে নিরন্তর অভ্যাস চালিয়ে যেতে হবে।  
এখন কথা হচ্ছে,  আমাদের দুঃখ বা সুখ হয় কেন ? এককথায় বলতে গেলে, এগুলো আমাদের কর্ম্ম ফল। প্রত্যেকটি ঘটনা এই কর্ম্মফলের  সুতোয় বাঁধা।  কিন্তু কথা হচ্ছে, সুখ-দুঃখ যদি আমাদের কর্ম্মফল হবে, তবে বহু সৎলোককে আমরা দুর্দশাগ্রস্থ হতে দেখি কেন ?এই প্রশ্নের উত্তর পাবেন, ভগবান বুদ্ধের কাছে।  ভগবান গৌতম বুদ্ধ মানুষের এই জরা, ব্যাধি ও বার্ধক্য -এর কারন খুঁজতে রাজপ্রসাদ থেকে নিরালম্ব হয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তিনি বলছেন, জগৎ দুঃখময়।  কারন হচ্ছে, এই জগতে আমাদের অস্তিত্ত্বের প্রশ্নে অনেক সীমাবদ্ধতা ও  ত্রূটি  আছে। আমাদের আবেগ, অভিজ্ঞতা, অসন্তোষ, দুশ্চিন্তা, ভয়, ঘৃণা-প্রেম ইত্যাদি আমাদের অস্তিত্ত্বকে টিকিয়ে রাখে। বাহ্যিক পরিবেশ আমাদের সুখ-দুঃখ ভোগের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়। আসলে এই সমস্যার মূল গ্রথিত আছে, আমাদের চেতনার স্তরে। আর আধ্যাত্মিক জীবন ও ধ্যান ধারণাই পারে এই সমস্যার সমাধান করতে। অন্য কোনো পথ নেই। 
আর একটা মোক্ষম পথ আছে। মহাত্মন বিদুর, হস্তিনাপুর ত্যাগ করে, জঙ্গলের  মধ্যে  মুনি-ঋষিদের মতো জীবন অতিবাহিত করছিলেন।  ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর পরে, যদুকুল ধংশে হয়ে যায়। মহাত্মা বিদুরের মন উতলা হয়ে ওঠে।  কোথায় শান্তি ? কিসে শান্তি ? তিনি তখন ঋষি মৈত্রেয়র কুটিরে গেলেন। আর তার মনের ব্যথিত হবার কথা, উল্লেখ করে বললেন, এর থেকে পরিত্রানের রাস্তা কি ? তখন, মৈত্রেয় ঋষি তাকে কেবল ঈশ্বরের মহিমা কীর্তন করেছিলেন। আসলে জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান এখানেই। এখানেই স্বস্তি, এখানেই শান্তি। অর্থাৎ মনকে ব্যস্ত রাখো, ঈশ্বর চিন্তনে। তবেই সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হতে পারবো। আমাদের এই দেহ নশ্বর।  আমাদের মন, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে, দুঃখের রসদ সংগ্রহ করছে, লোভ-লালসা-রাগ-ঘৃণা-ভয়-মোহ বাড়িয়ে তুলছে। এখানে সত্যিকারের প্রেম কোথায় ? প্রেম আসলে গুনের সাধনা। আপনি যদি কাউকে ভালোবাসেন, তবে তার গুন্ আপনার মধ্যে প্রকাশিত হতে থাকবে। ঠিক তেমনি, আপনি যদি ঈশ্বরকে ভালোবাসেন, তবে ঈশ্বরের বিভিন্ন গুন্ আপনার মধ্যে প্রকাশিত হতে থাকবে। বার বার ঈশ্বরের কথা স্মরণ মনন করতে করতে আমরা জাগতিক সুখ-দুঃখের কথা ভুলে যাবো। আর আর আমাদের জীবন  হবে, ভয়শুন্য, জীবনে কোনো অভাববোধ থাকবে না।  একটা নিশ্চিন্ত, পরিপূর্ন জীবন হবে। 

 ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

কারাগারে ভগবৎ দর্শন - ঋষি অরবিন্দ। 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কারাগারে আবির্ভাব হয়েছিলেন। আর কারাবাসকালে বাসুদেবের দর্শন পেয়েছিলেন, ঋষি অরবিন্দ। 

ঋষি অরবিন্দ বলছেন : বহুদিন পূর্বে স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ হবার কয়েক বছর আগে ভগবানকে চেয়েছিলাম, এবং দেশের কাজের জন্য আকৃষ্ট হয়েছিলাম। এইসময় আমি ভগবানের দিকে অগ্রসর 
হই । তাঁর উপর যে জ্বলন্ত বিশ্বাস ছিল তা বলতে পারি না। আমার মধ্যে বিদ্যমান ছিল অবিশ্বাসী, সংশয়বাদী নাস্তিক।  ভগবান আদৌ আছেন কি না, সে বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ ছিলাম না। আমি তার বিদ্যমানতা অনুভবও  করতাম না।  তথাপি কি যেন, আমাকে বেদের সত্যের দিকে, গীতার সত্যের দিকে, হিন্দু ধর্ম্মীর সত্যের দিকে আকর্ষণ করতো ।  আমি অনুভব করতাম যে এই যোগের মধ্যে, বেদান্তের উপর প্রতিষ্ঠিত এই ধর্ম্মের মধ্যে, মহাশক্তিশালী সত্য নিশ্চই  আছে। 

তাই আমি যোগের দিকে ফিরলাম, সংকল্প করলাম যে যোগসাধনা করবো, দেখবো আমার ধারণা সত্য কি না।  তখন আমি এই ভাব নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলাম - "যদি তুমি থাকো, তুমি আমার মর্মের কথা জানো, তুমি জানো, আমি মুক্তি চাই না, অপরে যা চায়, এমন কোনো জিনিসই আমি চাই না। 

যোগের সিদ্ধির জন্য, আমি অনেকদিন ধরে চেষ্টা করেছিলাম এবং শেষ পর্যন্ত আমি কতকটা লাভও করেছিলাম। কিন্তু তাতে আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আমি ভগবানকে বললাম, আমাকে আদেশ দাও , আমি জানিনা আমার কি কাজ করতে হবে, কেমন করে করতে হবে।  আমাকে একটা বাণী দাও।  তারপর জেলের নিঃসঙ্গতার মধ্যে, নির্জন সেলের মধ্যে আবার আমি সেটি পেলাম।

ঋষি অরবিন্দ বলছেন : এই নির্জন কারাবাসে, কাল যাপনের  উপায়স্বরূপ পুস্তক বা অন্য কোনো বস্তু ব্যতীত আমাকে কয়েক দিন থাকতে হয়েছিল। পরে, এমারসন সাহেব আমাকে বাড়ি থেকে ধুতি, জামা ও পড়বার বই আনাবার অনুমতি দিয়ে যান। আমি আমার মেশোমহাশয় শ্রী কৃষ্ণ  কুমার মিত্রর  কাছে ধুতি, জামা এবং বইয়ের মধ্যে গীতা ও উপনিষদ পাঠাতে  অনুরোধ করলাম। বইগুলো পেতে দুই চারদিন লাগে। 

এর মধ্যে আমি বুঝে গেছি, কারাবাসে মানুষ কেন উন্মাদ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। আবার ও বুঝলাম, এইসময় ভগবানের দুর্লভ দয়া লাভের সুবিধে হয়, সেটাও হৃদয়ঙ্গম হলো। শোবার  ঘরের পাশে পায়খানা রাখা।  শোবার  ঘর, খাবার ঘর, ও পায়খানা একসাথে ।  আমরা ভারতবাসী, সভ্যতার এত উচ্চস্তরে পৌঁছনো আমাদের পক্ষে কষ্টকর ।কয়েদিদের স্নানের নামমাত্র ব্যবস্থা ছিল। একসময় তৃষ্ণার  জলের অভাবে আমি  পিপাসা মুক্ত হয়ে উঠেছিলাম। যখন গরমের ক্লেশ অসহ্য হয়ে আর থাকা যেতো  না, তখন মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে শরীর  শীতল করতাম। বসুন্ধরার স্পর্শসুখ তখন বুঝলাম। এর পরে একসময় কষ্ট অনুভব করবার শক্তি আমার হারিয়ে গেলো। একেই বলে ভাগ্যচক্র। যিনি সিভিল সার্ভিসের নিলে, বহুলোককে কারাগারে পাঠাতে পারতেন, তিনিই স্বয়ং আজ কারাগারে। অচিরে নরের  মধ্যে নারায়ণকে প্রতক্ষ্য করবার এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা লাভ করলাম। এইখানে ক্ষুদ্র ঘরের  দেওয়াল সঙ্গী-স্বরূপ, যেন নিকটে এসে ব্রহ্মময় হয়ে আলিঙ্গন করতে উদ্দত। উঠোনে দেওয়ালের গায়ে একটা গাছ ছিল,তাকে দেখে প্রাণ জুড়াইতাম। ঘরের পার্শবর্তী গোয়াল ঘরের কয়েদিরা, ঘরের সামনে দিয়ে গরু চড়াতে  নিয়ে যেত।  গরু ও গোপাল আমার নিত্য প্রিয় দৃশ্য ছিল।      

যাই হোক, কারাবাসের আগে, আমার সকালে একঘন্টা ও সন্ধ্যেবেলা একঘন্টা ধ্যান করবার অভ্যাস ছিল. এই নির্জন কারাবাসে আর কোনো কাজ না থাকায়, বেশিসময় ধ্যানে থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মানুষের চঞ্চল মনকে ধ্যানের  জন্য সংযত এবং এক লক্ষ্যগত করা অনভ্যস্ত লোকের পক্ষে সহজ নয়। কোনো মতে দেড়-দুই ঘন্টা একভাবে থাকতে পারতাম, শেষে মন বিদ্রোহ করে উঠতো। 

প্রথম দিকে মনে নানান চিন্তা উঠতো। এর পরে মানুষের সঙ্গে আলাপ করতে না পারা, অসহনীয় বিষয়শূন্যতা, অকর্মণ্যতা ইত্যাদি আমাকে চিন্তাশক্তি রোহিত করতে লাগলো। এই অবস্থায় মনে হতে লাগলো, হাজার হাজার অস্পষ্ট চিন্তা মনের দ্বারের চারিদিকে ঘুরছে, কিন্তু প্রবেশ পথ পাচ্ছে না। দুই একটা চিন্তা প্রবেশ করলেও, আমার নিস্তব্ধ মনোরাজ্যের নীরবতায় ভীত হয়ে, নিঃশব্দে পলায়ন করতে লাগলো। আমি আচ্ছন্ন অবশ অবস্থায় অতিশয় মানসিক কষ্ট  পেতে লাগলাম। 

ধ্যানে বসলাম। ধ্যান কিছুতেই হলো না। এই বিফল চেষ্টায় মন আরো শ্রান্ত ও দগ্ধ হতে লাগলো। সময় আর কাটে না। মনকে বুঝালাম। জোর করে চিন্তা আনিলাম, কিন্তু দিন দিন মন বিদ্রোহী হতে লাগলো, হাহাকার করতে লাগলো। কাল যেন আমার উপরে ভর  করে চেপে বসে আমাকে পীড়ন করছে, মন সেই চাপ সহ্য করতে পারছে না। স্বপ্নে  শত্রূ গলা চেপে পীড়ন করলে,  মানুষ যেমন অসহায় হয়ে যায়, হাত পা থাকতেও যেমন নড়বার শক্তি থাকে না, আমার সেই অবস্থা হলো। আগে নির্জনতা অসহ্য লাগতো। এখন নির্জনতার জন্য আকুলতা জন্মালো । আমি শুনেছিলাম, নির্জনতা যে সহ্য করতে পারে, সে হয় দেবতা নয় পশু।  এই কথায় আমি আগে বিশ্বাস করতাম না এখন বুঝলাম, সত্যসত্যই যোগে অভ্যস্ত সাধকের পক্ষেও এই সংযম সহজসাধ্য নয়। 

তখন আমি বুঝতে পারি নাই যে ভগবান আমার সাথে খেলা করছেন, খেলাচ্ছলে আমাকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিচ্ছেন।  প্রথমত কিভাবে মনের গতিতে নির্জন  কারাবাসে কয়েদি উন্মত্তের দিকে ধাবিত হয়, তিনি  তা দেখিয়ে কারাবাসের অমানুষিক নিষ্ঠূরতা  বুঝিয়ে আমাকে জেল-প্রণালীর ঘোর বিরোধী করলেন। 
দ্বিতীয়ত ভগবান আমার মনের  এই দুর্বলতা মনের সম্মুখে তুলে ধরে, তা চির কালের জন্য বিনাশ সাধন করতে লাগলেন । আমি বুঝলাম, যোগ অবস্থা প্রার্থীর পক্ষে জনতা ও নির্জনতা সমান। বাস্তবিক পক্ষে অল্পদিনের মধ্যে আমার এই দুর্বলতা ঘুঁচে  গেলো।  এখন মনে নয়, আমি দশ বৎসর একাকী থাকলেও আমার মন তলিয়ে যাবে  না। মঙ্গলময় অমঙ্গলের দ্বারা ও আমাদের মঙ্গল ঘটান।

 তৃতীয়ত একটা জিনিস বুঝলাম, যোগ অভ্যাস স্বচেষ্টায় হবে না, শ্রদ্ধা ও আত্মসমর্পনই সিদ্ধি লাভের  পন্থা। ভগবান স্বয়ং প্রসন্ন হয়ে যে শক্তি-সিদ্ধি বা আনন্দ দেবেন, সেটাই গ্রহণ করে, কাজে লাগানো, আমার যোগ-লিপ্সার  একমাত্র উদ্দেশ্য। যেদিন থেকে অজ্ঞানের অন্ধকার দূরীভূত হতে লাগলো, সেদিন থেকে আমি সমস্ত ঘটনার মধ্যে মঙ্গলময় শ্রীহরির আশ্চর্য অনন্ত মঙ্গল স্বরূপত্ব উপলব্ধি করতে লাগলাম।

 এইভাবে মনের নিশ্চেষ্টতায় পীড়িত হয়ে কয়েকদিন কষ্টে  কাল যাপন করলাম। একদিন বিকেল  বেলায়, আমি চিন্তা করছিলাম। চিন্তাগুলো এমন অসংযত ও অসংলগ্ন হতে লাগলো, যে বুঝতে পারলাম চিন্তার উপর আমার বুদ্ধির নিগ্রহশক্তি লোপ পাচ্ছে। যখন প্রকৃতস্থ হলাম, তখন মনে হল, বুদ্ধির নিগ্রহশক্তি লুপ্ত হলেও, বুদ্ধি স্বয়ং লোপ পেয়ে যায়নি । বরং শান্ত ভাবে মনের  এই অপূর্ব ক্রিয়া বুদ্ধি নিরিক্ষন করতে লাগলাম । আমার মনে ভয় হতে লাগলো, আমি বোধহয়, পাগল হয়ে যাবো। প্রানপনে ভগবানকে ডাকতে লাগলাম, আর ভগবানকে আমার বুদ্ধিভ্ৰংশ নিবারণ করতে বললাম। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই অন্তঃকরণে হঠাৎ এমন শান্তি প্রসারিত হলো, সমস্ত শরীরে শীতলতা ব্যাপ্ত হতে লাগলো। উত্তপ্ত মন এমন স্নিগ্ধ, প্রসন্ন ও পরম সুখী হলো।  এই সুখময় অবস্থা যা আমি কখনো অনুভব করতে পারিনি। মাতৃক্রোড়ে শিশু যেমন আস্বস্ত ও নির্ভিক হয়ে শুয়ে থাকে, আমি যেন বিশ্ব-জননীর  কোলে সেইমতো শুয়ে রইলাম। আর এই দিন থেকে আমার কারাবাসের সমস্ত কষ্ট ঘুচে গেল। 

এই সময় ডাক্তার ডেলীয়  আমাকে সকালে বিকালে বাইরে বেড়াবার ব্যবস্থা করলেন। ইতস্তত ভ্রমন করতে করতে আমি উপনিষদের শ্লোকগুলো আবৃত্তি করতাম। সর্ব্বঘটে নারায়ণ এই মূল সত্তা উপলব্ধি করবার চেষ্টা করতাম। গাছে, গৃহে, প্রাচীরে, মানুষে, পশুতে পাখিতে, ধাতুতে, মাটিতে সর্বং খল্লিদং ব্রহ্ম - মনে মনে এই মন্ত্র উচ্চারণ করে, সর্বভূতে সেই উপলব্ধি আরোপ করতাম। এইসব করতে করতে আমার এমন ভাব হয়ে যেত, যে কারাগার আর কারাগার বোধ হতো না। সেই উঁচু প্রাচীর, লোহার গারদ, সেই সাদা দেওয়াল, রশ্মি -দীপ্ত সূর্য, নীল  পাতায় ভরা  গাছ, এই সামান্য জিনিস যেন আর অচেতন মনে হতো  না। যেন সর্বত্র চৈতন্য সজীব মনে হতো, তারা যেন আমাকে ভালোবাসে, আমাকে যেন কোলাকুলি করছে।  এইরকম মনে হতো। মনে হতো প্রকৃতির মধ্যে এক নির্মল নিলিপ্ত আত্মা শান্তিময় আনন্দে নিমগ্ন হয়ে রয়েছে। 

এক একবার বোধ  হতো, যেন ভগবান সেই বৃক্ষতলে দাঁড়িয়ে  আনন্দের বাঁশি বাজাচ্ছেন। আর সেই মধুর সুর, আমার হৃদয় টেনে বার করছে। সব সময় মনেহতো কেউ যেন আমাকে আলিঙ্গন করছে। কে যেন আমাকে কোলে করে রয়েছে। এই ভাবের বিকাশে আমার মনে যে একটা নির্মল  শান্তি বিরাজ করতে লাগলো, তা বর্ননা করা যায় না। প্রানের কঠিন আবরণ খুলে গেল এবং সর্বজীবের উপর প্রেম-স্রোত  বইতে লাগলো। আর যতই এই অবস্থা চলতে লাগলো, ততই আমার আনন্দ বৃদ্ধি পেতে লাগলো। মামলা-মোকদ্দমার দুশ্চিন্তা আমার প্রথম  থেকেই দূর হয়ে গিয়েছিলো। এখন মনে হতে লাগলো, আমার মঙ্গলের জন্যই  ভগবান আমাকে কারাগৃহে এনেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হতে লাগলো, আমার কারামুক্তি হবে, অভিযোগ খন্ডন হবে। এর পরে আমার আর কোনোদিন আমার জেলের কোনো কষ্ট  আমাকে পীড়া  দিতে পারেনি। 

এই হলো, শ্রী অরবিন্দের ভূমা, বিশ্বাত্মা সচ্চিদানন্দ মহৎ আত্মার উপলব্ধি। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম। 

আমেরিকায় স্বামীজীর প্রথম দিনগুলো। তথ্যসূত্রঃ স্বামী গম্ভীরানন্দের  -যোগনায়ক বিবেকানন্দ। 
আমরা স্বামীজীর শিকাগো বিশ্বধর্ম্ম-সভায় আকর্ষণীয় বক্তৃতার কথা শুনে,আর তার বিশ্বব্যাপী প্রশংসা শুনে খুব খুশি হই।   স্বামীজীর ধর্ম্ম-সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে শিকাগো পৌঁছনোর পরে কি হয়েছিল, সেই কথাগুলো শুনবো। 
স্বামীজী যখন শিকাগোতে পৌঁছলেন, তখন সেখানে বিশ্বমেলা উপলক্ষে  বিরাট লোকসমাগম  হয়েছে। তখন নানান দিক থেকে নানান দেশ থেকে নরনারী রাস্তায় ভিড় করে চলেছে। কিন্তু এর মধ্যে একটা মুখও  স্বামীজীর পরিচিত নয়। অচেনা শহরে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে স্বামীজী বিব্রত। কোথায় যাবেন, কোথায় থাকবে, কি করবেন কিছুই ঠিক নেই। এদিকে সুযোগ বুঝে সবাই তাকে ঠকাচ্ছে।  কুলিরা পর্যন্ত ন্যায্য পাওনার চারগুন আদায় করছে। আর এই কিম্ভুত-কিমাকার পোশাক পরিহিত অদ্ভুত দর্শন  লোকটিকে দেখে কেউ বিদ্রুপ করছে, কেউ হাততালি দিচ্ছে, দুস্টু ছেলের দল, তার পিছু নিয়ে নানান ভাবে বিরক্ত করছে। একে  অনাহার, এবং শীতে জর্জরিত, তার উপর এই অত্যাচার। অবশেষে তিনি একটা হোটেলে আশ্রয় নিতে গেলেন। হোটেলওয়ালাও বুঝিয়ে দিলেন, এছাড়া আর উপায় নেই। যদিও হোটেলের খরচ অনেক। 

শিকাগোতে তিনি বারো দিন ছিলেন, এখানে পৌঁছাবার দ্বিতীয়দিন থেকেই তিনি ঘুরে ঘুরে বিশ্বমেলা দেখতে লাগলেন। মেলার অনেক কিছু তাকে আকর্ষণ করতে লাগলো, কিন্তু এখানে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ একা বন্ধুহীন । সারাদিন আপন মনে মেলার মধ্যে ঘুরতেন, সন্ধ্যায় ক্লান্ত  হয়ে হোটেলে ফিরতেন। 

স্বামীজীর মধ্যে এক অদ্ভুত আকর্ষণী শক্তি ছিল। দীর্ঘদিন তিনি নিজেকে অজানা রাখতে পারতেন না। বিশ্বমেলাতেও ধীরে ধীরে তার প্রতি লোকে আকৃষ্ট হতে লাগলো। এর মধ্যে দুজনের কথা স্বামীজী বলেছেন। বলছেন, কপুরতলার রাজা এখানে এসেছিলেন। আর শিকাগো সমাজ তাকে কেষ্টবিস্টু করে তুলেছিল। তো তিনি বড়োলোক, আমার মতো ফকিরের সাথে তিনি কথা বলবেন কেন ? এখানে একটা পাগলাটে ধুতিপরা মারাঠি ব্রাহ্মণ মেলায় কাগজের উপর নখের  সাহায্যে ছবি  এঁকে বিক্রি করছিলো। আর এই লোকটা রাজার বিরুদ্ধে নানান কথা বলছিলো। এই রাজা খুব নিচ জাতি, এই রাজারা ক্রীতদাস স্বরূপ, দুর্নীতি পরায়ণ  ইত্যাদি ইত্যাদি।  খবরের কাগজের লোকেরা তার এই কথাগুলো  গিলছিল। অবাক কান্ড হচ্ছে, পরদিন খবরের কাগজে বড় বড় স্তম্ভে সেগুলো প্রকাশিত হলো, আমার নামে।  আমাকে তারা ভারত থেকে আগত একজন জ্ঞানী পুরুষ বলে বর্ণনা করে, অর্থাৎ আমাকে স্বর্গে তুলে, আমার মুখে এমন সব কথা বসলো, যা আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি। এই মিথ্যাবাদী সম্পাদকগণ আমাকে দিয়ে আমার দেশের লোককে বেশ ধাক্কা দিলো। 

সাংবাদিকগন স্বামীজী সম্পর্কে কিন্তু আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানবার জন্য, স্বামীজীর  সঙ্গে আলাপ করেছিল। এমনকি স্বামীজী  যে হোটেলে থাকতেন, সে হোটেলের মালিকের সাথেও যোগাযোগ করেছিল। আসলে স্বামীজীর চেহারা ও চালচলনে একটা বৈশিষ্ঠ ছিল। স্বামীজীও নিজেকে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে  লাগলেন। তবু মাঝে মধ্যেই এক নৈরাশ্যের ভাব এসে পড়তো। মেলাতে ও অন্যত্র অনেকের সঙ্গে আলাপ হলেও, তার কোনো বন্ধুও  জোটেনি, অর্থ সাহায্য তো দূরের কথা। মনে মনে  বিধাতার বিধানের উপরে তার বিশ্বাস থাকলেও, সাময়িকভাবে দুশ্চিন্তা তাকে বিব্রত করতো। 

শিকাগোতে কয়েকদিন কেটে গেলে, তিনি একদিন পত্রিকার অফিসে গেলেন মহাসভার অধিবেশন সম্পর্কে খোঁজ খবর করতে। আর এটা শুনে তিনি হতভম্ব হলেন যে সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের  আগে, অধিবেশন আরম্ভ হবে না। ৩০-জুলাই, ১৮৯৩ রাত্রি দশটায়, তিনি শিকাগোতে পৌঁছেছিলেন। অর্থাৎ এখন আগস্টের প্রথম সপ্তাহ হবে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি মানে তার আরো প্রায় এক/দেড়মাস অপেক্ষা করতে হবে। আরো বড় কথা হচ্ছে,  উপযুক্ত পরিচয় -পত্র না থাকলে  কাউকেই এই সভায় প্রতিনিধিত্ত্ব করতে দেওয়া হবে না। তো তার কাছে তো কোনো পরিচয়পত্র নেই। সবচেয়ে বড়  দুঃসংবাদ হচ্ছে, প্রতিনিধি নেবার সময় চলে গেছে।  এখন আর নতুন কোনো প্রতিনিধির নাম নেওয়া হবে না।

বড্ড দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়লেন স্বামী বিবেকানন্দ। মন ভেঙে গেলো। তাহলে কি তার এতদূর আসা নিস্ফল হলো ? এতটা বিফলতা সহ্য করা তার পক্ষে কঠিন। আর নিজেকে  অসহায় লাগতে লাগলো . মনে মনে ভাবলেন, এটাতো আমি ভেবে দেখি নি, যে প্রতিনিধি হতে গেলে কোনো প্রতিষ্ঠানের ছাপ নিয়ে আসতে  হয়। নিজের দায়িত্ত্বে কেউ কখনো কারুর প্রতিনিধি হয় না। এই সামান্য কথাটা যাত্রা করবার আগে কারুর মধ্যেই আসেনি ? আসলে জাগতিক রীতিনীতি সম্পর্কে স্বামীজী ও তার শিষ্যগণ এমন সরল ছিলেন, যে ভেবেছিলেন, ধর্ম্ম সভায় উপস্থিত হতে পারলেই হলো। 

এদিকে ভারতের ভক্তদের দেওয়া অর্থ দ্রুত নিঃশেষ হতে লাগলো। ১৭৯ পাউন্ড নিয়ে এসেছিলেন। এখন আছে ১৩০ পাউন্ড।  এখন দৈনিক প্রায় ১ পাউন্ড খরচ হয়ে যাচ্ছে। এখানে একটা সিগারেট কিনতে ভারতের  ৮ আনা  লাগে। স্বামীজী ভাবছেন, এখানে আসবার আগে, যেসব সোনার স্বপ্ন দেখতাম, সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। মনে হচ্ছে এদেশ থেকে চলে যাই। চোখে কোনো পথ দেখতে পাচ্ছেন না স্বামীজী।  কিন্তু মন বলছে, মরি বাঁচি উদ্দেশ্য ছাড়ছি না। 

বিশ্বাস যতই অটুট হোক, বাস্তবকে তো অস্বীকার করা চলে না। বন্ধু-বান্ধবহীন এই শিকাগো মহানগরীতে রিক্ত হস্তে বাস করাও চলে না। শেষে ঠিক করলেন, শিকাগো ছেড়ে, আমেরিকার পুর্বদিকে বস্টন শহরে যাবেন, কেননা সেখানে দৈনন্দিন ব্যয় অপেক্ষাকৃত কম। বস্টনে যাবার জন্য রেলে চেপে বসলেন, আর সেখানে সাথী হলেন শ্রীযুক্ত লালুভাই। ট্রেনের মধ্যে আলাপ হলো, এক ভদ্র মহিলার সঙ্গে, তিনিও বস্টন যাচ্ছেন। শ্রীমতি ক্যাথেরিন এবট স্যানবর্ন। সংক্ষেপে কেট। এই কেট নামক ভদ্রমহিলা, স্বামীজী বলছেন - আমাকে নিমন্ত্রণ করে নিকটে রেখেছেন। এখানে থাকায় আমার সুবিধে হলো, প্রতিদিন যে ১ পাউন্ড খরচ হচ্ছিলো, সেটা বেঁচে গেলো। আর ভদ্রমহিলার লাভ হলো, তিনি তার বন্ধু-বান্ধবদের নিমন্ত্রণ করে, ভারত থেকে আগত এক অদ্ভুত জীব দেখাতে পারছেন। এসব যন্ত্রনা সহ্য করতেই হবে। একদিকে অনাহার-ক্লিষ্ট শরীর আর ওই প্রচন্ড শীতে আমার অদ্ভুত পোশাকের জন্য রাস্তার লোকেরা আমাকে বিদ্রুপ করতে লাগলো। 

এই কেট নামক ভদ্রমহিলার সমাজে বাগ্মী ও লেখিকা হিসেবে প্রতিপত্তি ছিল। স্বামীজীও তার সাহায্যে ওই অঞ্চলের শিক্ষিত ও গণ্যমান্য সমাজে সহজে প্রবেশ করতে পারলেন। এইখানেই কেটের সাহায্যে অধ্যাপক ডাঃ রাইট-এর সাথে পরিচয় হয়। এবং সেই সূত্রেই ধর্ম্ম-সভার  প্রতিনিধির আসন লাভ করেন।

যাইহোক, এখানে মিস কেটের সহযোগিতায়, তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেবার সুযোগ পান। আর এগুলো বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। স্বামীজীর পরিচয় সম্পর্কে এইসময় বেশ অসচ্ছ ধারণা  ছিল।  এমনকি তার নাম উচারনে ভ্রান্তি ছিল।  কেউ বলতো বিব-কানন্দ, কেউ শুধু কানন্দ।  বস্টন ইভনিং ট্রান্সক্রিপ্ট পত্রিকায় ২৫সে অগাস্ট ছাপা হলো, "ইন্ডিয়া থেকে আগত, ব্রাহ্মণ সন্যাসী স্বামী বেরে কানন্দ  আগামী শিকাগো ধর্ম মহা সভায় উপস্থিত থাকার জন্য এই দেশে এসেছেন। এখানেই আলাপ হয়, মিস কেটের জ্ঞাতিভাই শ্রীযুক্ত ফ্রাঙ্কলিন বেঞ্জামিন স্যানবর্ন এর সাথে। যিনি ছিলেন, সাংবাদিক, লেখক, এবং বিভিন্ন সভা সমিতির পৃষ্ঠপোষক। এখানেই আলাপ হয়,  নারী কারাগারের অধ্যক্ষ মিসেস জনসন -এর সাথে। 

বস্টনের গ্রামে শ্রীমতি কেটের আতিথ্য পাওয়ায় যদিও স্বামীজীর অর্থ খরচ  হ্রাস পেলো। তথাপি, তার প্রয়োজনীয় খরচ কিছু তো ছিলই। স্বামীজী শীতবস্ত্র আনেননি।  এখন শীত আসছে, স্বামীজিকে গরম জামা-কাপড় জোগাড় করতে হবে, এবং একটু বেশিই জোগাড় করতে হবে, কারন ভারতের থেকে বস্টনের গ্রামে শীতের আধিক্য অনেক বেশি। এছাড়া স্বামীজীর অদ্ভুত পোশাক দেখে  এখানকার লোক দাঁড়িয়ে যায়। স্বামীজী ভাবলেন, কেবল বক্তৃতার সময়, গেরুয়া আলখেল্লা ও পাগড়ি পড়বেন, অন্য সময় কালো রঙের লম্বা জামা পড়বেন। 

এখন সম্বল এসে দাঁড়িয়েছে, ৬০/৭০ পাউন্ড। কিছুদিন এখানে থাকতেও হবে। অন্ততঃ ছয় মাস এখানে থাকতে হবে। তাই ভারতীয় বন্ধুদের তিনি পত্র লিখলেন, "এইমাত্র দর্জির কাছে গিয়েছিলাম। কিছু শীতবস্ত্রের অর্ডার দিয়ে আসলাম। তাতে তিনশো টাকা বা তার বেশি পড়বে। এ যে খুব ভালো কাপড় তা নয়, চলনসই হবে। - এখানে তার করতে প্রতিশব্দে চার টাকা করে লাগে। 

স্বামীজী পরবর্তী কালে বলছেন, আমি আমেরিকায় পৌছালাম।  টাকা আমার নিকট অতি অল্পই ছিল - আর ধর্ম্মসভা বসবার পূর্বেই সব খরচ হয়ে গেলো। এদিকে শীত আসছে।  আমার শুধু গ্রীষ্ম-উপযোগী পোশাক ছিল। একদিন আমার হাত হিমে আড়ষ্ঠ হয়ে গেলো। এই ঘোরতর শীতপ্রধান দেশে আমি যে কি করবো, তা ভেবে পেলাম না। কারন যদি রাস্তায় ভিক্ষা করতে বেরোই তবে পুলিশ আমাকে জেলে পাঠিয়ে দেবে। তখন আমার কাছে শেষ সম্বল মাত্র কয়েকটা ডলার ছিল। আমি মাদ্রাজে কয়েকটি বন্ধুর কাছে তার করলাম। থিওজফিস্টরা এই ব্যাপারটা জানতে পারলো।  তাদের মধ্যে একজন লিখেছিলো, শয়তানটা শীঘ্র মরবে - ঈশ্বরের ইচ্ছেয় বাঁচা গেলো। 

একথা মানতে হবে, স্বামীজীর বস্টনে আগমন দৈব-প্রেরণাতেই ঘটেছিলো।  কেন না একে অবলম্বন করেই শিকাগো ধর্ম্ম-সভায় হিন্দু ধর্ম্মের প্রতিনিধিত্ত্ব করা সম্ভব হয়েছিল। একসময় স্বামীজীর মনে এই সংকল্প ত্যাগের কল্পনাও জেগেছিলো। স্বামীজী তখন বস্টনের গ্রামে,  বলছেন, আমি শিকাগো আর যাবো কি না, জানিনা। আমার সেখানকার বন্ধুগন আমাকে ভারতের প্রতিনিধি হতে বলেছিলো, আর বরোদ  রাও যে ভদ্রলোকের সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি শিকাগো মেলার একজন কর্তা। কিন্তু আমি প্রতিনিধি হতে অস্বীকার করি , কারন শিকাগোয় এক মাসের অধিক থাকতে গেলে আমার সামান্য সম্বল ফুরিয়ে যেত। স্বামীজী  কি তাহলে ধর্ম্ম-সভার আশা ছেড়ে দিয়ে বস্টনে গিয়েছিলেন ? কিন্তু ধর্ম্ম-মহাসভার আশা ত্যাগ করলেও বিদেশে কাজ করবার সংকল্প তখনও  অব্যাহত ছিল। তিনি একজায়গায় লিখছেন - "প্রথমে আমেরিকায় চেষ্টা করবো।  এখানে অকৃতকার্য হলে, ইংল্যান্ডে চেষ্টা করবো।  তাতেও কৃতকার্য না হলে ভারতে  ফিরবো আর ভগবানের পুনরাদেশের অপেক্ষায় থাকবো।

আজ এই পর্যন্ত। এর পরে দিন আমরা শুনবো, ধর্ম্ম-মহাসভায় যোগদানের আগে আর কি কি ঘটেছিলো, আমাদের প্রাণপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের বিদেশবাস কালে। 

------------------------------------------------------------ 
 
 "বকলমা" ব্যাপারটা কী ?

শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ ঠাকুরের জীবনী পড়তে পড়তে একটা অদ্ভুত  জিনিস আমাদের সবার নজরে পড়েছে, সেটা হচ্ছে, শ্রী গিরিশ ঘোষ ঠাকুরকে বকলমা দিয়েছিলেন। বকলমা অর্থাৎ নিজের কাজ অন্যকে করবার অধিকার প্রদান করা। Power of  Attorney - দায়িত্ত্ব ছেড়ে দেও। এই ব্যাপারটা আমরা সাংসারিক জীবনে অনেক সময় করে থাকি। আমাদের বিষয়-সম্পত্ত্বি রক্ষা বা বেচাকেনা করবার জন্য, এই বকলমা দিতে পারি আমরা আমাদের পছন্দের কাউকে। কিন্তু আধ্যাত্মিক জীবনে এই ধরনের বকলমা কাউকে দেওয়া যায়, এটা বোধ হয়, এই প্রথম ও শেষ বার ঘটেছিলো, ঠাকুর রামকৃষ্ণ বকলমা  নিয়েছিলেন, আর শ্রী গিরিশ ঘোষ বকলমা দিয়েছিলেন। আর আগে কোনো ধর্ম্মশাস্ত্রে এই প্রথার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় না।   

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করবার জন্য, বলেছিলেন, যা করবার তা আমি করে রেখেছি। তুমি নিমিত্ত মাত্র। যা বলছি করো। অর্থাৎ অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ অনুযায়ী কাজ করতে হয়েছিল। 
সাধারণ ভাবে আমরা দেখি, গুরুদেবগন  শিষ্যকে মন্ত্র-তন্ত্র বা বিশেষ ক্রিয়ার কথা বলে বা শিখিয়ে দেন। গুরুদেব নিজে পবিত্র জীবন যাপন ক'রে, অন্যকে সেই পবিত্র জীবনে উৎসাহিত করতে পারেন। কিন্তু মানুষ যখন সংসাসের বন্ধনে আষ্ঠে  পৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ে , অথবা শোকে দুঃখে মুহ্যমান হয়ে পড়ে , তখন গুরুদেবের সৎ-উপদেশে সে বলে ওঠে "করবো কিভাবে ? আমি তো কিছুতেই করতে পারছি না।  তুমি যদি শক্তি দাও তবে করতে পারি" । তখন কিন্তু সাধারণ গুরুর আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যায় ব্যাপারটা। অর্থাৎ শক্তি প্রদান করা, সেটা অসম্ভব। গুরুদেব  উপদেশ দিতে পারেন, বলে দিতে পারেন, কি করতে হবে আর কি না করতে হবে। কিন্তু করতে তো হবে তোমাকেই, আর করবার শক্তি অর্জনও  করতে  হবে তোমাকেই। 

আমি একজন গুরুদেবের কথা জানি, তিনি দীক্ষা দেবার সময় বলতেন, মনে মনে তোমার দ্বারা কৃত সকল পাপের কথা স্বীকার করো। তাহলে সমস্ত পাপের ভার আমি নিজে নিয়ে নেবো। এবং তিনি মনে করতেন, সমস্ত জীব পাপী। সমস্ত মানুষ কোনো না কোনো ভাবে পাপের কাজ করে চলেছে। তো কেউ যদি বলতো, জ্ঞানত আমি কোনো পাপ করি নাই। তবে গুরুদেব রেগে যেতেন, এবং তাকে দীক্ষিত করতেন না। এই গুরুদেব ছিলেন সংসারী।  অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এই গুরুদেব আবার  অন্যকে আয়ু দান  করতেন,  এমনকি অন্যকে আয়ুদান বিদ্যা শিখিয়ে দিতেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে  "তোমার পাপের ভার আমি নিলাম, আমিই তোমার এইসকল পাপের ফল ভোগ করবো" এইসব কথা বা প্রতিশ্রুতি দেওয়া এবং সেই অনুযায়ী কাজ করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব কি না। মহাত্মাগন বলছেন, মানুষের হৃদয়ে যখন গ্লানি উপস্থিত হয়, তখন কৃপালু ভগবান অবতীর্ন হন, এবং শরণাগতের সমস্ত কর্ম্মফল ভোগ ক'রে, তাকে সেই বন্ধনের আবর্ত  থেকে উদ্ধার করে থাকেন। এই উপলব্ধি আমাদের নেই, এই সুযোগও সবার ভাগ্যে জোটে না। আমরা সাধারণ মানুষ সাধারন ভাবে, বকলমার মর্মার্থ  বুঝবার চেষ্টা করবো। 

শ্রী গিরিশ ঘোষ, অত্যন্ত প্রতিভাবান ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। মাদকাসক্ত ছিলেন। তো গিরিশ চন্দ্র  ঠাকুরের কাছে কয়েকবার যাতায়াত করবার পর, ঠাকুরের প্রতি নিবেদিত প্রাণ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "এখন থেকে আমি কি করবো ?"

ঠাকুর বললেন, যা করছো, তাই করো, তবে সকাল-বিকেল ভগবানের স্মরণ-মনন রেখো। গিরিশ কোনো জবাব দিলেন না। ঠাকুর আবার বললেন, "আচ্ছা তা যদি না পারো, তো খাবার এবং শোবার  আগে, তাঁকে একবার স্মরণ করে নিও। গিরিশ এবারও কোনো জবাব দিলেন না. ঠাকুর এবার নিজেই বললেন, "তুই বলবি, তাও যদি না পারি" -  আচ্ছা তবে আমাকে বকলমা দে।" বকলমা অর্থাৎ ভালোবাসার বন্ধন। গিরিশ এবার ঠাকুরের এই ভালোবাসার  বন্ধনে  উদ্বেল হয়ে উঠলেন। মনে মনে ভাবলেন, যাক - এখন যাই করি না কেন, ঠাকুরের অসীম দিব্যশক্তি তাকে রক্ষা করবে। 

গিরিশ কোনো নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ হতে চাইছিলেন না, কিন্তু হলো যেটা তা হচ্ছে, পড়ে  গেলেন ঠাকুরের ভালোবাসার বন্ধনে। এখন গিরিশ - ভালো বা মন্দ যে অবস্থাতেই পড়ুন না কেন, যশ  বা অপযশ হোক না কেন, দুঃখ-কষ্ট যাই উপস্থিত হোক না কেন, নিঃশব্দে তাকে মেনে নেওয়া ছাড়া তার কিছু করবার রইলো না। আর  যেটা হলো, সেটা হচ্ছে, তার অহংয়ের মধ্যে একটা নিশ্চিন্ত ভাব। যা খুশি তাই করতে পারি, যাই করি না কেন সব দায় ঠাকুরের। এই ভাব তার মনে সদা-সর্বদা উদয় হতে লাগলো। এতে করে, সব সময় শয়নে, স্বপনে  গিরিশ, নিজের অজ্ঞাতসারে  ঠাকুরের শ্রীমূর্তির ধ্যান করতে লাগলেন । যাকিছু করেন, মনে  করেন ঠাকুর আছেন। ঠাকুর দেখছেন। সবসময়  চোখের সামনে ঠাকুর ভেসে ওঠেন। এইভাবেই কি ঠাকুর গিরিশকে ধ্যানের  পথে পরিচালিত করলেন ? 

এর পরে, একদিন কথায় কথায়, গিরিশ বললেন, ঠিক আছে আমি করবো। বলতেই ঠাকুর বলে উঠলেন, ওকি গো, যদি না করতে পারো ? তার চেয়ে বলো, ঈশ্বরের যদি ইচ্ছে হয় তো করবো। গিরিশ পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন, ঠাকুরের কথার অর্থ বুঝতে তার অসুবিধা হয় নি। ভাবলেন, ঠিকই তো, আমি যখন ঠাকুরের উপরে সমস্ত বিষয়ের সম্পূর্ণ ভার দিয়েছি, এবং যখন তিনি সেই ভার নিয়েছেন, তখন ঠাকুর যদি কোনো কাজ আমাকে দিয়ে করান, তবেই তা আমি করতে পারি। অন্যথা সাধ্য কি আমি তা করি। 

একটা সময় এলো, যখন ঠাকুর অদর্শন, স্ত্রী-পুত্রাদির বিয়োগ ইত্যাদি নানান রকম দুঃখ-কষ্ট ভোগ এসে উপস্থিত হলো গিরিশ ঘোষের জীবনে । গিরিশ কিন্তু ভেঙে পড়লেন না। মনে মনে ভাবতে লাগলেন, ঠাকুর যেমন যেমন আমার পক্ষে মঙ্গল ভেবেছেন, তেমনটি করেছেন। যার উপর ভর করে যাত্রা শুরু করেছি, তিনি যে পথ দিয়ে নিয়ে যাবেন , যে ভাবে নিয়ে যাবেন, সেই পথে সেই ভাবেই  আমাকে যেতে হবে।  তিনি যে পথ আমার জন্য  সহজ মনে করেছেন, যে পথ নিরাপদ মনে করেছেন, সেখানে আমার না বলা, বা বিরক্ত হবার কথা নয়। তা যদি না হয়, তবে বুঝতে হবে, বকলমা দেবার কথা শুধু মুখের কথা। আসলে সাধন-ভজন-জপ-তপ, এসবের প্রতি সাধকের নিয়ন্ত্রণ আছে। এসব কাজের একসময় অন্ত হয়। কিন্তু যে বকলমা দিয়েছে, তার কাজের অন্ত  নেই। যে বকলমা দিয়েছে, তাকে সব সময় প্রতি পদে, প্রতি নিঃশ্বাসে দেখতে হয়, তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন ঈশ্বরের উপরে নির্ভরশীল হয়।  ঈশ্বরের ইচ্ছেতে হয়। কখনো হতচ্ছাড়া "আমি" যেন কিছু না করে বসে। আমরা ঠাকুরের উপর নির্ভর করে থাকি।  কিন্তু যখন ঠাকুর আমাদের দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিয়ে আমাদের নিয়ে যান, যখন আমরা প্রিয়জনের মৃত্যুশোকে বিমূঢ় হয়ে পড়ি, তখন ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করি, হে ঠাকুর কেন তুমি এমনটি করলে, আমি কি দোষ  করেছিলাম যে, আমার প্রিয়জনকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিলে ? আমার কপালে এই ছিল ? ইত্যাদি ইত্যাদি।  অর্থাৎ ঠাকুরকে আমরা প্রশ্নের সম্মুখীন করে দেই । একটু অন্য ভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, আমরা ঠাকুরের কাছে কৈফিয়ত তলফ করে বসি।   

বকলমা দেওয়া মানে এই নয়, যে সাধকের আর কিছু করবার রইলো না। ঈশ্বর তাকে দিয়ে সব কিছু করিয়ে নিচ্ছেন, তা সে দুঃখ ভোগ হোক, বা সুখ ভোগ হোক, সবই করতে হচ্ছে, কিন্তু মনটা পরে আছে, ঈশ্বর চরণে। ভাবটা যেন এমন, যে ঈশ্বর সব কিছু করছেন। আমি নিমিত্ত মাত্র। ঠাকুর রামকৃষ্ণ  বলছেন, এই ভাব এলে, ঈশ্বরের কৃপায়, মানুষের দশ জন্মের ভোগ এক জন্মে হয়ে যায়। 

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, বকলমা দেওয়া খুবই সহজ। আসলে কিন্তু এই বকলমা দেওয়া মোটেই সহজ নয়। গিরিশ ঘোষের মতো ভাগ্যবান মানুষ কোটিতে গুটি। ঠাকুরের কৃপাধন্য। আমরা তো প্রবৃত্তির দাস। ধর্ম্ম-কর্ম্ম করতে এসেও কেবল সুবিধে খুঁজি। সংসারের সুখ বিসর্জন দিতে চাই না।  আবার ভগবৎসুখ থেকেও যেন বঞ্চিত না হই। কিভাবে এই দুটোকেই পেতে পারি সেই রাস্তা খুঁজি।  তাই মাঝে মধ্যে সাধুসঙ্গ করি, দান-ধ্যান করি, আবার সুযোগ পেলে শেয়ারবাজারে ঘোরাঘুরি করি। 

সাংসারিক জগতে বা আধ্যাত্মিক জগতে অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেবার জন্য, আর তার সুফল ভোগ করবার জন্য, আমরা নানান রকম  ফন্দি-ফিকির খুঁজি। আধ্যাত্মিক জগতে বকলমা দেওয়া চলে, একথা শুনে আমাদের মন লাফিয়ে ওঠে। তবে আর কি, ইহকালে আমি যা ইচ্ছে তাই করবো, আর পরকালেও যাতে সুখে থাকতে পারি, তার ব্যবস্থা করা হয়ে গেলো। মরতে তো একদিন হবেই, তো  আমার  হয়ে, বুদ্ধ, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ - ইত্যাদি মহাপুরুষগন নিদেন পক্ষে গুরুদেব যদি কিছু করে দেন, তবে তাদেরকে বকলমা  দিতে আমাদের আপত্তি কোথায় ? আসলে এই দুর্বুদ্ধি যার মাথায় এসেছে, তিনি নিজেকেই ঠকাচ্ছেন। চোখ বন্ধ করলে, বিপদ আসবে না এই ভাবনা মূর্খের ভাবনা। 

বকলমা দেওয়া সহজ নয়। বকলম দেবো, বললেই দেওয়া যায় না। আর আপনার বকলমা কে নেবে ? লাগাতার  উদ্যম, অধ্যবসায় দ্বারা নিজেকে স্পৃহাশূন্য করতে হয়। মানুষ যখন সারাটা জীবন দিয়ে বুঝতে পারে, তার নিজের কোনো ক্ষমতাই নেই, যা কিছু হচ্ছে, সবই একটা অদৃষ্ট  শক্তি নিয়ন্ত্রণ করছে, মানুষ যখন বুঝতে পারে, সে আসলে অসহায়, কোনো কিছুরই উপরে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, জগতের উপর তো দূরে থাকুক,  ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী এমনকি  নিজের উপরেও তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, কারুর এক অমোঘ নির্দেশে এই জগৎ তার নিজস্ব নিয়মে চলছে। যখন নিজেকে বড্ডো একা লাগে, নিঃসঙ্গ লাগে, যখন সে বুঝতে পারে, একটা পিঁপড়েকেও সে একদিনের জীবন দিতে পারে না, তখন তার মধ্যে  স্মরণাগতির জন্য আকুলতা জন্মে। এই সময় সে ঈশ্বরের কাছে নিজেকে আহুতি  দেয়। আশ্রয় খোঁজে। বাস্তু-সাপের মতো নির্বিষ হয়ে যায়। এমনকি ফনা তুলতেও অক্ষম হয়ে  যায়। "আমি" থাকবে আর বকলমা  দেবো, তা হতে পারে না। বকলমা  মানে আমার মৃত্যু। 

ঠাকুরের একটা ছোট্ট গল্প দিয়ে শেষ করবো। 

এক ব্রাহ্মণ  একটা ছোট্ট বাগান করেছে। ফল-ফুল-শাক-সবজি ইত্যাদিতে ভরপুর। সবাইকে ডেকে ডেকে সে তার বাগান দেখায়। তাদের প্রশংসায়, সে নিজেকে তৃপ্ত করে। তো একদিন, সে বাইরে কাজে গিয়েছিলো, এসে দেখে তার বাগানে একটা গরু ঢুকে বাগান তছনছ করে দিয়েছে।  তার সাধের বাগান ভেঙে-ছুড়ে একাকার। রাগের চোটে তার মাথা গরম হয়ে গেলো। ডান্ডা দিয়ে গরুটার মাথায় আঘাত করলো। আর এতে করে গরুটা সেখানেই ছটফট করতে করতে মারা গেলো। গরুটা মারা যাবার পরে, সে  হুশ ফিরে পেলো। একি করলাম আমি, ব্রাহ্মণ হয়ে  গোহত্যা ?   এতো মহাপাপ।

এদিকে গোহত্যের জন্য, পাপবোধ তার শরীরে প্রবেশ করতে এলো। কিন্তু সে মনে মনে ভাবলো, আমার এই যে হাত, এতো ইন্দ্র দ্বারা পরিচালিত হয়। ইন্দ্রের শক্তিতে এই হাত কাজ করে থাকে।  তবে, আমি কেন এই পাপের  ভাগি  হবো ? তো পাপকে বললো, গোহত্যা করেছে, স্বয়ং ইন্দ্র।  তুমি ইন্দ্রের কাছে যাও ।  তো পাপবোধ তখন ইন্দ্রের কাছে গেলো। ইন্দ্র বললো, তুমি একটু সবুর করো, আমি বাগানের মালিকের কাছ থেকে একটু ঘুরে আসি।  তারপর, তুমি আমার শরীরে প্রবেশ কোরো। ইন্দ্র ব্রাহ্মণ বেশে এসে, বাগানে প্রবেশ করলো, - বললো, মহাশয় বলতে পারেন, এই বাগানটি কার ? আহা  সুন্দর বাগান। এমনটি স্বর্গেও নেই। এই গাছগুলো এমন সুন্দর ভাবে কে লাগিয়েছে ? কে এর দেখাশুনা করে ? তো ব্রাহ্মণ ইন্দ্রের প্রশংসা শুনে, আহ্লাদে গদগদ হয়ে উঠলো। বললো, আজ্ঞে এই বাগান আমার।  আমিই এর পরিচর্য্যা করি। এমন বাগান এই তল্লাটে আর একটিও পাবেন না। আসুন দেখুন। বলে ঘুরে ঘুরে বাগানটিকে দেখাতে লাগলো।  আর কোথা থেকে কোন গাছটি এনেছে।  কার কতদিন বয়স। কোন ফুলে কেমন সুরভী।  ইত্যাদি ইত্যাদি হাস্যরসের সাথে বলতে লাগলো।  তো কথা বলতে বলতে তারা  মৃত গরুর কাছে চলে এলো। ইন্দ্র গরুটিকে দেখে, চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলো।  রাম -রাম এখানে গোহত্যা কে করলো। এতো মহাপাপ। আহা। তো ব্রাহ্মণ এতক্ষন আমি করেছি, আমি লাগিয়েছি, আমার বাগান ইত্যাদি বলছিলো। এখন সে চুপ হয়ে গেলো। এবার ইন্দ্র ব্রাহ্মণের বেশ ছেড়ে নিজের রূপ পরিগ্রহ করলো, আর বললো, ব্যাটা  ভন্ড, এতক্ষন আমার আমার, আমি করেছি - আমি করেছি। সব ভালো আমি করেছি, আর গোহত্যা করেছে ইন্দ্র ? নাও তোমার্  গোহত্যার পাপ।  বলে ইন্দ্র স্বর্গের দিকে যাত্রা করলো। 

তো যতক্ষন আমি বোধ - ততক্ষন কর্ম্মফল অবশ্য়ই আমার। যেদিন মন থেকে বলতে পারবো, আমি কেউ নয়, সবই তিনি সেদিন তিনি আমাদের সব ভার নেবেন। 

ঋষি অষ্টাবক্র রাজা জনকের কাছে, গুরুদক্ষিণা চেয়েছিলেন। রাজা জনক বলেছিলেন, তন-মন-ধন সবই তোমার। আজ থেকে আমার বলে কিছুই রইলো না।  মায় এই যে বিদ্বেষ রাজ্য  এ  সবই আজ থেকে তোমার ইচ্ছেতেই রক্ষিত হোক। এই হচ্ছে বকলমা, সবই তোমার, ভালো আমার মন্দ তোমার এমনটা নয়। ভালো-মন্দ, সুখ দুঃখ, ন্যায় অন্যায়, জ্ঞান-অজ্ঞান সবই তোমার তোমার তোমার। একেই বলে বকলমা। আমিত্ত্বের নাশ হলেই বকলমা দেওয়া যায়। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

ইচ্ছেশক্তির সম্পর্কে আলোচনার সময় আমরা বলেছিলাম, ইচ্ছেশক্তি প্রয়োগে যেকোনো কিছু পাওয়া সম্ভব।  এমনকি ইচ্ছেশক্তির প্রয়োগে শারীরিক রোগ উপশম হতে পারে। মনকে একাগ্র করে, অসুস্থ অঙ্গে বা স্থানে কিছুক্ষন রাখতে পারলে, সব অসুখের থেকে রেহাই পেতে পারি। তো এসব কথা তথাকথিত বিজ্ঞান মনস্ক  কিছু মানুষের  মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে তো আর ডাক্তার বদ্যির প্রয়োজন হতো না। ঠাকুর রামকৃষ্ণের শরীরে কর্কটরোগ বাসা বেঁধেছিলো।  তিনি তো মহাপুরুষ, তো তার শরীরে এই রোগ তার ইচ্ছেশক্তির প্রয়োগে কেন নিরাময় করা গেলো না। ঠিক এই প্রশ্নই করেছিলেন, শ্রী শশধর তর্কচূড়ামনি। বলছেন, মহাশয়, শাস্ত্রে পড়েছি, আপনাদের ন্যায় পুরুষ ইচ্ছামাত্রেই শারীরিক রোগ আরাম করে ফেলতে  পারেন। তো আপনি কেন করছেন না ? তার উত্তরে ঠাকুর বলেছিলেন, তুমি পণ্ডিত হয়ে একথা  কি করে বললে  গো ? যে মন সচ্চিদানন্দকে দিয়েছি, তাকে সেখান থেকে তুলে এনে এই ভাঙা হাড়-মাসের খাঁচাটার উপর দিতে কি আর প্রবৃত্তি হয় ?

তবে ঠাকুরের জীবনে অনেক ইচ্ছেশক্তির প্রয়োগের দৃষ্টান্ত আছে। ঠাকুর পঞ্চবটিতে নিজের হাতে কিছু ছাড়া গাছ লাগিয়েছিলেন। তো গরু ছাগলে সেগুলো নষ্ট করছে দেখে, সেখানে একটা বেড়া দেবার ইচ্ছে হলো।  তার কিছুক্ষন পরেই  দেখা গেলো,  গঙ্গায় বান  এলো, আর সেই বানের  জলে ভেসে এলো, বেড়া দেবার প্রয়োজনীয় সামগ্রী অর্থাৎ গড়ানের খুঁটি,নারকেল দড়ি, এমনকি একটা কাটারি। যার সাহায্যে  ভর্তাভারি নামক মালি বেড়া দিয়ে দেয়। 

কথায় কথায় ঠাকুর একদিন মথুরকে বললেন, ঈশ্বরের ইচ্ছে হলে, লাল ফুলের গাছে সাদা ফুল হতে পারে। স্বাভাবিক ভাবেই,  মথুর এসব কথা বিশ্বাস করতে পারে নি। আশ্চর্য্যের কথা ঠিক তার পরের দিন, লালজবা গাছে, দুটো ফুল হলো একটা সাদা আর একটা লাল।  ফুল দুটো তুলে মথুরকে দেওয়া হলো।

এমনি অনেক ঘটনা আছে, বিভিন্ন মহাত্মাদের জীবনে। আমাদের মতো সাধারণের জন্য, ডাক্তারের দরকার হতে পারে। ভারতবর্ষে বহু লোক আছে, তাদের বিনা চিকিৎসাতেই মৃত্যু বরন  করতে হয়।  তাদের রোগ হলেই, তারা ডাক্তার দেখাতে  পারে না, কিন্তু তাই বলে তাদের সবার অকাল -মৃত্যু হয়, এমন ভাবার কারন নেই।  অনেকে   প্রকৃতির নিয়মেই  দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে। প্রকৃতির নিয়মে, বা তাদের ইচ্ছেশক্তির জোরে, রোগের  উপশম হয়। এসব রহস্যঃ আমাদের জানা নেই বলে মিথ্যে ভেবে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে একটা কথা অবশ্য়ই বলা যায়, বিশ্বাস-অবিশ্বাস না করে, নিজেই প্রয়োগ করে দেখুন।  তবে সত্য আপনার উপল্বদ্ধিতে আসবে। আর এর জন্য, কাউকে আপনার কিছুই দিতে হবে না।        
গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর সঙ্গম স্থল - প্রয়াগ। ত্রিবেণীর ঘাট। স্বামীজী যোগাসনে বসে আছেন। হঠাৎ ঝড়-জল-বৃষ্টি শুরু হলো। ঝড় জলে পাচ্ছে, স্বামীজীর দুর্ভোগ হয়, তাই রামতারণ  ভট্টাচার্য্য ব্যস্ত হয়ে স্বামীজিকে এখান  থেকে চলে যেতে বললেন। স্বামীজী বললেন, দেখছো না একটা যাত্রীবোঝাই নৌকা আসছে। নৌকাটা  এক্ষুনি ডুবে যাবে, কিন্তু যাত্রীগুলোকেতো বাঁচাতে হবে। আর দেখতে দেখতে নৌকাটা  সত্যি সত্যি ডুবে গেলো - আর তক্ষুনি স্বামীজীও অদৃশ্য হলেন। একটু পরে নৌকাটা আবার ভেসে উঠলো - যাত্রীরা সবাই নিরাপদে ঘাটে এসে নাবল। আর একই নৌকা থেকে নাবলেন, স্বামীজী। 
রামতারন নির্বাক, হতবুদ্ধি হয়ে স্বামীজীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। স্বামীজী মুচকি হেসে বললেন, বাবা তুমি এই ঘটনায় অবাক হয়েছো ? অনন্ত শক্তির আধার ঈশ্বর - এই মানব শরীর সৃষ্টি ক'রে, এই শরীরেই অবস্থান করছেন। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই এই ঐশী শক্তি আছে, কিন্তু সে সংসার  বিষয়ে মজে থাকে সে আত্মউন্নতির  দিকে খেয়াল করে না। মানুষ যদি তার অন্তর-নিহিত শক্তির বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা করে, তবে তার অসাধ্য কিছু নেই। সন্দেহ করো না, ঝড়-জলে কষ্ট  পেয়ো না, বাড়ি যাও। এই স্বামীজী আর কেউ নয়, শিবরাম, যাঁকে  আমরা ত্রৈলঙ্গ স্বামী বলে জানি। কিন্তু কি সেই সাধন পদ্ধতি - যা শিবরামকে ত্রৈলঙ্গ স্বামী - বারাণসীর চলন্ত শিব হতে সাহায্য করেছিল। আমরা ভবিষ্যতে এসব কথা স্বামীজীর  মুখ নিঃসৃত বাণী যা লিপিবদ্ধ করেছিলেন, উমাচরণ মুখোপাধ্যায়, সেখান থেকে শুনবো।

জ্ঞানগঞ্জ -  ত্রৈলঙ্গস্বামী ২৮০ বছর কিভাবে  বেঁচেছিলেন?

ত্রিকালেশ্বর ত্রৈলঙ্গস্বামী যাঁকে বারাণসীর সচল শিব বলা হয়, তিনি ২৮০ বছর বেঁচেছিলেন। অর্থাৎ তার জন্ম বাংলা ১০১৪ সনের পৌষ মাসে  (ইং- ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে) আর এই মরদেহ ত্যাগ করেন, ১২৯৪ বাংলা সনের পৌষ মাসে (ইং ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে)। তো একটা দীর্ঘ জীবনকাল। অন্য কোনো মহাপুরুষ সম্পর্কে এত দীর্ঘ জীবনের কথা শোনা যায় না।  বাবা লোকনাথ বেঁচেছিলেন,  ১৬০ বছর (১৭৩০-১৮৯০) । শ্রীকৃষ্ণ বেঁচেছিলেন ১২৫ বছর।  ভীষ্ম যার ইচ্ছেমৃত্যু বড় ছিল, তিনি বেঁচেছিলেন, ১৮৬ বছর। অবশ্য বাবাজি সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে তাঁর বয়েসের কোনো গাছ পাথর ছিল না। দেখতেও ৩০ বছরের যুবকের মতো লাগতো। আর একজন সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, যিনি শঙ্করাচার্য্যের গুরু শ্রী গোবিন্দপাদ। এঁর সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, ইনি  স্বয়ং ঋষি পতঞ্জলি, হাজার বছর অপেক্ষা করেছিলেন, নর্মদার তীরে, এক গুহার মধ্যে, শংকরকে দীক্ষা দেবেন বলে। তো স্বামীজীর এই দীর্ঘ জীবন অর্থাৎ ২৮০ বছর থাকার পিছনে রহস্যঃ-টা কী ? প্রকৃতির নিয়মেই আমাদের ব্যাধি-জ্বরা-মৃত্যু এসে থাকে। আবার  শরীরকে আপনি যদি পুষ্টিদায়ক অন্ন-জল  না দেন, তবে দেহ মৃত্যুমুখে পতিত হবে। এটা প্রকৃতির নিয়ম। এই নিয়ম থেকে সাধারণ মানুষ থেকে মহাপুরুষ অবধি প্রযোজ্য। এমনকি যারা স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরণ  করে থাকেন, তাদের দেখেছি, মৃত্যুর আগে থেকে অন্ন-জল ত্যাগ করতে। অর্থাৎ শরীরের শক্তিক্ষয় বা বৃদ্ধি স্বাভাবিক ভাবেই কালের নিয়মে হয়ে থাকে। এর ব্যতিক্রম কি ভাবে সম্ভব ? যোগক্রিয়ার মাধ্যমে শরীরকে সুস্থসবল, এমনকি নীরোগ রাখা সম্ভব হলেও, মৃত্যুকে কে রোধ করতে পারে ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করবো আমরা। 

আপনারা লক্ষ করেছেন, চীন অনেক দিন থেকে মাঝে মধ্যে ভারতের মধ্যে প্রবেশ করবার চেষ্টা করে। ১৯৬২ সনে একবার করেছিল, আবার সম্প্রতি  ২০২০ চেষ্টা করছে। চীন যে ভূসম্পত্তির জন্য, ভারতের সীমানার মধ্যে ঢুকে আসছে, যেখানে না আছে কোনো খনিজদ্রব্য, না সেগুলো বসবাস যোগ্য জমি, না সেগুলো চাষযোগ্য জমি। এখান থেকে রাজস্ব আদায় বা বৃদ্দির সম্ভাবনা নেই।  চিনাসৈন্য  মাঝে মধ্যে টিলার উপরে  উঠে চারিদিক পর্যবেক্ষন করছে। তারা  কি নিতান্তই ভারতীয় সেনার উপরে নজর রাখছে, নাকি অন্য কিছু খুঁজছে। আসলে ওরা যেকোনো মূল্যে সাংগ্রীলা  ঘাঁটিকে খুঁজে বার করবার চেষ্টা করছে, এবং তার দখল  নিতে চাইছে। এবং এই উদ্দেশ্যেই তাঁরা তিব্বতের দখল নিয়েছে। এমনকি আকাশযানে করে, তারা এই স্থানের সন্ধান করে যাচ্ছে। 

জেমস হিলটন নাম এক ভদ্রলোক, একটা বই লিখেছেন, বইটার  নাম হচ্ছে "লস্ট হরাইজন" । তিনি এই বইয়ে দাবি করেছেন, তিব্বত ও ভারতের মধ্যে এমনকিছু ঘাঁটি আছে, যেখানে মানুষ শতশত বছর বেঁচে থাকে। কেউ বুড়ো হয় না। ৫০০-৬০০ বছর বেঁচে থাকা সেখানে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তাও সুস্থ-সবল ভাবেই। তিনি জায়গাটির ভৌগলিক অবস্থান  নির্দিষ্ট করে কিছু বলেন নি।  তবে বলেছেন, এটি তিব্বত-ভুটান ও ভারত সীমান্তের কাছাকাছি। এই বইটির প্রকাশ হবার পরে, দেশ-বিদেশ থেকে অনেক অনুসন্ধানকারী দল এই সাংগ্রীলা নামক স্থানটির সন্ধানে এসেছেন, কিন্তু সফল হতে পারেন নি, কেউ কেউ তো এই অনুসন্ধানের সময় নিখোঁজ বা অদৃশ্য হয়ে গেছেন।

এই সাংগ্রীলার আর একটা নাম জ্ঞানগঞ্জ। আসলে এই অঞ্চলে উচ্চকোটি সাধকগণ যেতে পারেন। আমরা জানি, ত্রৈলঙ্গস্বামী তিব্বতে দীর্ঘ উনিশ বছর কাটিয়েছেন। সেখানে তিনি নাগা-সন্যাসীর জীবন অতিবাহিত করেছেন। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা তার কিছু করতে পারে নি। হিংস্র জীব-জন্তু ছিল তার বশ। এমনকি বারাণসীতে গভীর শীতেও   তিনি গঙ্গাবক্ষে বিচরণ করে ফিরতেন। এবং আমাদের মনে হয়, ত্রৈলঙ্গস্বামী মাঝে মধ্যেই এই জ্ঞানগঞ্জে যাতায়াত করতেন। জ্ঞানগঞ্জের সঙ্গের তাঁর যোগাযোগ ছিল।শুধু যোগাযোগ ছিল বললে ঠিক হবে না, তিনি জ্ঞানগঞ্জেই বাস করতেন,  এই মহাযোগী দেহত্যাগের পরে জ্ঞানগঞ্জের পরিধিতেই প্রবেশ করেছেন।  কেননা, শোনা যায়, ত্রৈলঙ্গস্বামী মরদেহ ত্যাগের পরে, সেই  মৃতদেহকে একটা সিন্দুকে ভর্তি করে রেখেছিলেন, তার ভক্তগন। আর গঙ্গাবক্ষে সেটি ভাসিয়ে দেবার আগে, কৌতহল বশত শেষ-দেখা দেখবেন বলে, সিন্দুক খুলে দেখেন, সিন্দুকের মধ্যে ফুলের মালা মাত্র, দেহের কোনো চিহ্ন নেই। এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয়, যে দেহকে বারাণসীতে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত, সেটি আসলে তাঁর সুক্ষ দেহের ঘনীভূত আকার  মাত্র। আমরা তো এমন অনেক যোগী-মহাপুরুষের কথা শুনেছি, যাঁরা নিজ দেহকে গুহার মধ্যে ধ্যানস্থ রেখে, ইচ্ছে মতো ভক্তের সঙ্গে দেখা করতেন। এমনকি তাদের উপদেশ ইত্যাদি দান করতেন। এমনকি আমরা অনেক ঐতিহাসিক মহাপুরুষের পুজো করে থাকি। শোনা যায়, ভাগ্যবান ভক্তদের তাঁরা সশরীরে দেখা পর্যন্ত দিয়ে থাকেন, এমনকি সাধন উপদেশাদি দিয়ে থাকেন। এটা কিভাবে সম্ভব ? আসলে এঁরা সবাই জ্ঞানগঞ্জের বাসিন্দা।  

 যাইহোক, এখন কথা হচ্ছে এই জ্ঞানগঞ্জ স্থানটি কোথায় ? এবং কেমন সেই স্থান। 

জ্ঞানগঞ্জ বা সাংগ্রীলা বা শাংগ্রিলা  আসলে একটা ভুমি-হীন জায়গা। এখানে কাল বা সময়ের কোনো প্রভাব নেই। এখানে চতুর্থ স্তরের জীবগন বসবাস  করে থাকেন। আমরা যে জীবজগতের বাসিন্দা, সেটি হচ্ছে তৃতীয় স্তর। এই চতুর্থ স্তরে যেতে গেলে, আমাদের দেহাতীত হতে হবে। দেখুন, আপনি যখন পাহাড়ের উচ্চ শিখরের দিকে যাচ্ছেন, তখন প্রাণবায়ুর অভাব বোধ করবেন। অর্থাৎ আমাদের দেহ ধারনের জন্য যে প্রাণবায়ুর দরকার সেখানে তা পর্যাপ্ত পরিমানে নেই। আবার আমাদের দাঁড়াবার জন্য একটা আধার দরকার, তা সে পাথর হোক, বরফের চাঁই  হোক, বা মাটি হোক। পৃথিবী সংলগ্ন এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে ভূমিহীন-বায়ু শূন্যতা বিরাজ করছে। এখানে সময় বলে কিছু হয় না। দেশ বলে কিছু হয় না। কোনো বস্তু বা প্রাণী যদি এই চতুর্থ স্তরে প্রবেশ করে, তবে আমরা যারা তৃতীয় স্তরের বাসিন্দা, আমাদের  দৃষ্টিতে সেই বস্তু বা প্রাণী অদৃশ্য হয়ে যাবে। কিন্তু তার অস্তিত্ব যেমন ছিল, তেমনই থাকবে। কিন্তু ভবিষ্যতে কবে সেই সব বস্তু বা প্রাণী দৃশ্যমান হবে অর্থাৎ তৃতীয় স্তরে প্রকট হবে, তা নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাবে ,না। আমাদের এই সংসারে সব কিছু, দেশ-কাল-নিয়মে বাঁধা। এই পৃথিবীর যে ভূমি তা বাঁকা, যা আমরা বুঝতে পারি না। আমরা যদি কোনো কারনে স্থানহীন হয়ে পড়ি, বা শূন্যতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ি, তবে আমাদের যে বক্র আধার তার সমাপ্তি ঘটবে। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের কথা হচ্ছে, কেউ যদি ভুহীনতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যায়, তবে সে বুঝতেই পারবে না, যে সে এক বিচিত্র রহস্যঘন বাতাবরণে প্রবেশ করেছে। এখানে কালের প্রভাব নেই বললেই চলে। আর কালের প্রভাব যদি না থাকে, তবে আপনার আজ যে শরীর  আছে, তার উপরে কোনো প্রভাব পড়বে  না।  অর্থাৎ যেমন ছিল, তেমনই থাকবে। কিন্তু সেখানে আপনার শারীরিক ক্ষমতা, জীবনীশক্তি এমনকি মানসিক চেতনশক্তি ভীষণ ভাবে বেড়ে যাবে। নিজেকে এক আনন্দময় সত্তা বলে মনে হবে। এই চতুর্থ স্তরের বাসিন্দাদের শরীরে কোনো বয়সের বা কালের চাপ পড়তে পারবে না। এইজন্য বলা হয়ে থাকে, চতুর্থ স্তরের সঙ্গে যাদের গতাগতি আছে, তারা বহুদিন জীবিত থাকে পারেন, এমনি হাজার হাজার  বছর পর্যন্ত শরীর ধারণ করতে পারেন। অর্থাৎ যে বয়সে তিনি চতুর্থ স্তরে প্রবেশ করেছেন, সেই বয়সেই তিনি  অবস্থান করবেন। এইজন্য দেখবেন, এই স্তরে প্রবেশের পরে আর তাদের শরীরের বয়স আর বাড়ে না।  চেহারার কোনো পরিবর্তন লক্ষিত হয় না। ত্রৈলঙ্গ স্বামী এমনই একজন চতুর্থ স্তরের বাসিন্দা ছিলেন, কিন্তু তিনি লোকশিক্ষার জন্য, স্থুল শরীর ধারণ করে, এই পৃথিবীতে যত্রতত্র বিচরণ করবার অধিকারী ছিলেন। আজও তিনি এই চতুর্থ স্তরেই বিরাজ  করছেন। এমনতো বহু মহামানব, সেই মহাভারতের আমল থেকে এখানে বাস করছেন। আমরা ধ্যানে এদের সাক্ষাৎ পেতে পারি। বহু সাধকের এই অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। এই জ্ঞানগঞ্জ সম্পর্কে আলোচনা আমাদের মতো সাধারনের কাছে, অবিশ্বাস্য-অবৈজ্ঞানিক মনে হলেও, সময়বিজ্ঞান ও শূন্যবিজ্ঞান সম্পর্কে যাদের ধারণা  আছে, তাদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে।
 
শান্তিঃ শান্তিঃ  শান্তিঃ।  হরি ওম। 

মৃন্ময়ী কখন চিন্ময়ী হতে পারে ? মাটির প্রতিমা কি ক্রিয়াশীল হতে পারে  ? 



তো স্বামীজী একদিন, এই ভাগ্যবান যুবককে বললেন, ব্যাকুল হয়ে যে যাকে  ডাকে, সে তাকেই পায়। কেবল জ্ঞান ও বিচার দিয়ে তাঁকে খুঁজে বের করতে হয়। মানুষ যা কিছু কল্পনা করতে পারে, তার সব কিছুই এই জগতে স্থুল অথবা সূক্ষ্ম অবস্থায় আছে। শুধু খুঁজে বার করা চাই। এর জন্য চাই সাধনা ও গুরুকৃপা। এমনকি সাধনা বিহীন জীবেরও গুরুকৃপায়, ঈশ্বর দর্শন হতে পারে। তুই দেখবি ? তো দেখ। স্বামীজীর ঘরের একদিকে ছিল, মায়ের মূর্তি।  স্বামীজী মায়ের দিকে মুখ করে, ধ্যানে মগ্ন হলেন। একঘন্টা পরে,  বললেন এবার দেখ।

তো স্বামীজীর সামনে উপবিষ্ট যুবক বলছেন, দেখলাম, একটা ছোট্ট বালিকা, ধীর পায়ে স্বামীজীর সামনে উপস্থিত হলেন।  প্রদীপের অস্পষ্ট আলোয়, বালিকার উজ্জ্বল জ্যোতি ও রূপের ছটা  দেখে, বিহ্বল হয়ে পড়লাম। জাগতিক সমস্ত বুদ্ধি যেন লোপ পেয়ে গেছে, চেতন ও অচেতন অবস্থার মধ্যবর্তী অবস্থায় ভীত কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়লাম। শরীর কাঁপছে। স্বামীজী বললেন, মায়ের বেদির দিকে দেখ। চোখ ঘোরাতেই দেখলাম, মায়ের বেদি শূন্য। আমার শরীরের কাঁপুনি আরো বেড়ে গেলো। মায়ের পা-ছুঁয়ে  প্রণাম করলাম। মানুষের পায়ের মতোই নরম আর শীতল  মনে হলো। স্বামীজী ধীর কন্ঠে বললেন, মাকে  ভালো করে দর্শন কর, মনে যেন কোনো আক্ষেপ না থাকে। আমি স্তম্ভিত, বোবা হয়ে মাকে দেখছি। শেষে স্বামীজীর কথায় সম্বিদ  ফিরে পেলাম। স্বামীজী মাকে আসনে  ফিরে যেতে ইঙ্গিত করলেন। মা ফিরে গেলেন নিজের আসনে। চিন্ময় মূর্তি আবার পাষাণে পরিণত হয়ে গেলো। এ এক বিরল অভিজ্ঞতা। এই স্বামীজী হলেন শ্রী ত্রৈলঙ্গধর। আর এই কৃপা বর্ষিত হয়েছিল, উমাচরণ মুখোপাধ্যায়-এর প্রতি। 

এই বিরল অভিজ্ঞতা আমাদের সবার কেন হয় না। আর সত্যিই কি মাটির মূর্তি জ্যান্ত হয়ে উঠতে পারে নাকি যুবকের  ভ্রম।  যদি মাটির মূর্তি জ্যান্ত হয়, তবে কিভাবে ? নাকি এগুলো কেবল গল্প কথা। আমরা এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো  ।

 প্রকৃতির জগতে নিয়মের বাইরে কিছু হয় না। মাটির পুতুল হেটে বেড়াবে, নাচবে-গাইবে, মানুষের মতো আচরণ করবে, এটা আমাদের দৃষ্টিতে প্রকৃতির নিয়মের বাইরে। কিন্তু যেসব গুটিকয় মানুষ এসব কথা বলেন, তারাতো মহাত্মা তাদের কথায় অবিশ্বাস করি কি করে ? আমরা মহাভারতের অর্জুন ও সঞ্জয়কে দেখেছি ঈশ্বরের বিশ্বরূপ দর্শন করতে।  সেখানে মাটির পুতুলও ছিল না। স্রেফ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় অর্জুন, আর ব্যাসদেবের কৃপায় সঞ্জয় এই অতি আশ্চার্য্য-ভয়ংকর দৃশ্য দেখেছিলো। এমন বহু কাহিনী আমাদের পুরান-কাহিনীতে লিপিবদ্ধ করা আছে। যেখানে সাধক ঈশ্বরের মূর্তি দর্শন করেছেন। অথচ আমাদের কাছে এগুলো বইয়ের গল্প-গাঁথা। লেখকের কল্পনা মাত্র। কিন্তু তাহলে সত্য কি ?

প্রথমে বলি এই ধরনের অতি-আশ্চার্য্য ঘটনা  দুটো কারনে হতে পারে। এক গুরুকৃপায়।  আর হচ্ছে নিজ সাধনবলে।  আর এই দুটোই অর্থাৎ সাধনবল ও গুরুকৃপা  যেখানে একত্রিত হয়, সেখানে এই ধরনের ঘটনা সাবলীল ভাবেই হতে পারে।  কেমন করে ?

দেখুন জীব যখন মায়ের পেটে  থাকে তখন ৪৪ দিনের আগ পর্যন্ত তার মধ্যে কোনো চেতনা থাকে না। কারুর কারুর ক্ষেত্রে এটা ৯০ দিন পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে। ৪৪-৫০ দিন থেকে তার মধ্যে মায়ের প্রাণবায়ু প্রবেশ করে। আর প্রাণবায়ুর সঙ্গেই থাকে চৈতন্য শক্তি। চৈতন্যশক্তি ও প্রাণবায়ু ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এরপরে,  এই শিশু যখন মায়ের গর্ভ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে, তখন সে মায়ের প্রাণবায়ু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর তার নিজস্ব প্রাণক্রিয়া শুরু হয়। যদি কোনো কারনে শিশুর প্রাণক্রিয়া শুরু না হয়, তাকে মৃত শরীর বা বস্তু বলে মনে করা হয়। এই সময় ধাঁই বা নার্স শিশুর ফুসফুসকে কার্যকর করবার জন্য, মুখে বা তালুতে মুখ লাগিয়ে বাতাস প্রবেশ করাতে চেষ্টা করে।  শিশুকে উল্টে পাল্টে তার ফুসফুসকে ক্রিয়াশীল করবার চেষ্টা করে। ফুসফুসের ভিতরে বায়ুর প্রবেশ ঘটাতে চেষ্টা করে। একবার এই ফুসফুস ক্রিয়াশীল হয়ে গেলে, শ্বাসের ক্রিয়া শুরু হলে, শিশু তখন জীবন্ত হয়ে ওঠে, আর মুখ দিয়ে প্রাণবায়ুর নিঃসরণ হয়। এই প্রাণবায়ুর নিঃসরণই আমাদের কাছে, বাচ্চার কান্না। আমাদের মুখে হাসি ফোটে। তো প্রাণবায়ুর সঙ্গে চৈতন্য শক্তি যখন আমাদের শরীরে প্রবেশ করে, তখন আমরা জীবিত, আর এই প্রাণবায়ু যখন বেরিয়ে যায়, তখন আমরা মৃত। আর এই মৃত শরীর  তখন পচনশীল বস্তুতে পরিণত হয়। অর্থাৎ দ্রুত পরিবর্তনশীল বস্তুতে পরিবর্তন হয়। এবং ধীরে ধীরে পঞ্চভূত অর্থাৎ যা দিয়ে শরীর তৈরি হয়েছিল, তার উৎসে ফিরে যায়। এই হচ্ছে বস্তু থেকে প্রাণী হবার প্রক্রিয়া। 

আমি এক স্বামীজিকে দেখেছি, ভোর বেলা তার আশ্রমের সমস্ত শিষ্যের ডাকতেন "মিট্টিকা পুতলি উঠ"। এখন কথা হচ্ছে এর সঙ্গে মাটির পুতুলের কি সম্পর্ক ? দেখুন  পুতুল কি দিয়ে তৈরি হয়, মাটি-জল-খড়-বাঁশের কাঠামো ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ আমাদের শরীর যে উপাদানে নির্মিত একটা মাটির পুতুলও একই উপাদানে নির্মিত। অর্থাৎ মাটি , জল, তেজ -অর্থাৎ খড়-বাঁশের কাঠামো, মরুৎ অর্থাৎ বায়ু  - ব্যোম - আকাশ বা ফাঁকা জায়গা। এগুলো সবই একটা পুতুল নির্মাণের জন্য লাগে।  মাটির সঙ্গে জল মেশানো হয়, খড়ের কাঠামোর  সঙ্গে তা লেপে দেওয়া হয়।  এই করে একটা আকৃতি তৈরী হয়। যাকে  আমরা প্রতিমা বলি। একটা শিশুর দেহ ও একটা পুতুলের দেহের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, শিশুর দেহে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে, আর পুতুলের দেহে প্রাণের সঞ্চার হয় নি। 
আর একটা পার্থক্য হচ্ছে শিশুর দেহের বৃদ্ধি দেখতে পাই আমরা, কিন্তু পুতুলের দেহের কোনো বৃদ্ধি নেই। কিন্তু দুই দেহেরই ক্ষয় আছে। শিশুর দেহে যদি প্রতিনিয়ত পুষ্টি প্রদান করা না হয়, তবে শিশুর দেহের নাশ অবশ্যম্ভাবী। অন্যদিকে শিশুর দেহ দ্রুত ক্ষয়শীল।   কারন হচ্ছে শিশুর  দেহে জল ও বায়ুর  ভাগ বেশী।  আর পুতুলের দেহে, অগ্নি ও মাটির ভাগ বেশি। কিন্তু উভয়ের দেহের উপাদান একই - সেই পঞ্চভূত।

এখন কথা হচ্ছে, পুতুলের দেহে প্রাণের সঞ্চার কি করে হতে পারে ? যাতে করে সে মানুষের মতো আচরণ করতে পারে। গুরুদেবের আজ্ঞা সে কিভাবে পালন করবে ?  বেদি থেকে হেটে স্বামীজীর কাছে কিভাবে চলে আসতে  পারে। 

এই জায়গায় সাধক বা গুরুদেবের ভূমিকা। আপনারা জানেন, আমাদের দুই ভ্রূর  মাঝখানে আজ্ঞা চক্রের অবস্থান। এই আজ্ঞাচক্র যখন কারুর ক্রিয়াশীল, তখন তিনি যাকে যা নির্দেশ করেন, সে তা মানতে বাধ্য থাকে । তা সে মানুষ বলুন, পশু বলুন আর প্রকৃতি বলুন। আর এই সমস্ত বিরল তত্ত্বজ্ঞ পুরুষ - যার সমস্ত চক্রগুলোই যোগের মাধ্যমে ক্রিয়াশীল করতে পেরেছেন, তিনি মনে মনে যা কিছু চিন্তা করেন, সেটাই বাস্তবে ঘটে থাকে। এর অন্যথা হবার কোনো উপায় নেই। স্বামী ত্রৈলঙ্গস্বামী ছিলেন, মহাযোগী, তার স্থুল শরীরের সমস্ত চক্র ছিল, ক্রিয়াশীল।  এই শক্তিই পাষাণমূর্তিকে ক্রিয়াশীল করেছিল, আর তা দর্শন করেছিলেন, পরম ভাগ্যবান, শ্রী উমাচরণ মুখোপাধ্যায়।  এঁরাই  পারেন, মৃত শরীরের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করতে, এঁরাই পারেন, অসম্ভবকে সম্ভব করতে। আমরা সবাই যোগক্রিয়ার মাধ্যমে, আমাদের এই চক্র গুলোকে গতিশীল করতে পারি। কিন্তু আমরা এই ব্যাপারে সচেষ্ট হই  না। সাধারণ ভাবে আমরা  তিনটি চক্র অর্থাৎমূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, ও মনিপুর চক্রের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে থাকি। অভীষ্ট সাধক ধীরে ধীরে, সমস্ত চক্রকে ক্রিয়াশীল করে থাকেন। আর অনির্বচনীয় আনন্দের মধ্যে থাকেন, ও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হন। ঋষি পতঞ্জলি এই সমস্ত যোগক্রিয়ার সন্ধান দিয়েছেন। মৎস্যেন্দ্রনাথ হঠযোগের কথা বলেছেন। ঘেরন্ড ঋষি নানান প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন। তবে এঁরা লোকহিত ব্যতীত এইসব অলৌকিক কর্ম্মে নিজেকে নিযুক্ত করেন না। মহাত্মা ত্রৈলঙ্গস্বামী মাঝে মধ্যেই নানান অলৌকিক ঘটনাকে সংঘটিত করেছেন, খেয়ালের বশে নয়, লোকশিক্ষার জন্য। আমরা স্বামীজিকে আমাদের সশ্রদ্ধেয় প্রণাম জানাই। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  
    
জন্মান্তর - গুরু হো তো এয়সা। 

এক জিজ্ঞাসু যুবকের মনে প্রশ্ন জেগেছে, জন্মান্তর বলে সত্যি সত্যি কিছু আছে কি ? তো অনেক খুঁজে পেতে  একবার এক স্বামীজীর কাছে গিয়েছিলেন, জন্মান্তর সত্যি কি না সেই কথা জানতে। তো স্বামীজীর কাছে প্রণাম করে দাঁড়াতেই  স্বামীজী তাকে ইশারায় চলে যেতে বলতেন। আর স্বামীজীর সহ্চরবৃন্দ তাকে তাড়িয়ে দিতো। তো যুবক এক কৌশল বের করলো, স্বামীজী তো তাকে বেরিয়ে যেতে বলেন, কিন্তু বাস্তবে,  হাত ধরে তাকে বের করে দেয় এই ষন্ডামার্কা সহচরগুলো। স্বামীজী তো এক আসনে বসে থাকেন।  তিনি শুধু ইশারায় চলে যেতে বলেন। আর অমনি ষন্ডামার্কা সহচর গুলো এসে তাকে জোর করে বের করে দেয়। তো যুবক, এক আধুনিক উপায় বের করলো। সহচরদের কিছু কিছু করে পয়সা হাতে ধরিয়ে দিলো। তারা সেই পয়সাটা নিয়েও নিলো, কিন্তু বললো, স্বামীজী না চাইলে, আমরা কাউকে থাকতে দিতে পারি না।  এতে স্বামীজী রাগ করবেন। কিন্তু, পয়সায় কাজ হলো। এবার আর তাকে তারা জোর করে না।  শুধু মুখে বলে চলে যেতে। কিন্তু যুবক আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করজোড়ে স্বামীজিকে দেখতে থাকে। এইভাবে ১৪ দিন অতিবাহিত হলো। প্রতিদিন সে স্বামীজিকে প্রণাম করে আর আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে স্বামীজিকে দেখতে থাকে।  পনেরোতম দিনে যুবক যখন স্বামীজিকে প্রণাম করছে, তখন সে একেবারে কেঁদে ফেললো। আর এতে করে স্বামীজী একটু যেন নরম হলেন। ওকে বসবার অনুমতি দিলেন। আর এতে যুবক স্বামীজীর পায়ে ধরে উচ্চস্বরে কান্নাকাটি জুড়ে দিলো। তখন স্বামীজী ইঙ্গিতে তাকে শান্ত হতে বললেন। আর ইশারায় বললেন, কাল সকালে আসতে । আর সেদিন থেকে তার কাজ হলো, আশ্রমে গেরিমাটি ঘষার কাজ। আর বললেন, ওই ঘষা গেরিমাটি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খেয়ে নিতে। পরে অবশ্য গেরিমাটি খেতে বলতেন না, গোলা  গেরিমাটি দিয়ে সন্ধ্যার দিকে এক ভদ্রলোক দেওয়ালে স্বামীজীর বাণী দেবনাগরী হরফে লিখে রাখতো। এই শুরু এরপরে, স্বামীজিকে নিয়ে ওই যুবক গঙ্গার ঘটে স্নান করতে যেতেন । তার দীক্ষিত শিষ্য হয়ে ছিলেন  ওই যুবক। আর অনেক অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হবার সৌভাগ্য হয়েছিল। . 

 

 






     

         
  

ধর্ম্মিক যদি বৈজ্ঞানিক হতো, বা বৈজ্ঞানিক যদি ধর্ম্মিক হতো।

                                    ধর্ম্মিক যদি বৈজ্ঞানিক হতো, বা বৈজ্ঞানিক যদি ধর্ম্মিক হতো। 

আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্ত্বে বিশ্বাস করি, কিন্তু ঈশ্বরে আস্থা রাখতে পারি না। আমরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করি, কারন আমরা জীবনে সফলতা পাই না। আবার ঈশ্বরের অস্তিত্ত্বে আস্থা রাখতে পারি না, কারন ঈশ্বর কাউকেই সম্পূর্ণ সফল করেন না। আজ থেকে আমরা এমন সব কথা শুনবো, যা আমাদের জীবনে সফল এনে দিতে পারে। জীবনটাকে বদলে দিতে পারে। একটা কথা বিশ্বাস করুন, প্রত্যেকটি মানুষ সফল হতে পারে, সফল হচ্ছে, উন্নত হচ্ছে। আমরা জন্ম গ্রহণ করেছি, উন্নত হবার জন্য। আমরা সবাই সুস্বাস্থের অধিকারী হতে পারি, আমরা সুখে স্বাছন্দে বেঁচে থাকতে পারি, আমরা সাহসের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারি। আমরা সবাই অর্থনৈতিক স্বাছন্দ ভোগ  পারি। আমরা কেউ সারাজীবন অসুস্থ থাকবার জন্য জন্ম গ্রহ করিনি।  আমরা কেউ সারাজীবন গরিব হয়ে থাকবার জন্য জন্ম গ্রহণ করিনি। আমরা কেউ সারাজীবন ভয়ে ভয়ে জীবন কাটানোর জন্য জন্ম গ্রহণ করিনি। আমরা কেউ নিঃসঙ্গ জীবন কাটাবার জন্য জন্ম গ্রহণ করিনি। আমরা কেউ সারা জীবন দুশ্চিন্তা নিয়ে জীবন কাটাবার জন্য জন্ম গ্রহণ করিনি। আমরা যদি অসফল হয়, আমরা যদি উন্নত না হতে পারি, তবে জানবেন আমাকে সৃষ্টি করবার পিছনে ঈশ্বরের যে উদ্দেশ্য তা ব্যর্থ। আর ঈশ্বর কখনো ব্যর্থ হতে পারেন না। আমাদের জীবন হবে সৃষ্টিধর্ম্মি।  আমাদের জীবন হবে সদাহাস্যময়।  আমাদের জীবন হবে নিশ্চিন্ত। আমাদের এই যে দারিদ্র, আমাদের এইযে অসুখ-বিসুখ, আমাদের এই যে দুর্ভোগ, এটা আমাদের জীবন ধর্ম্মের বিপরীত দিক।   তুমি এর থেকে বেরিয়ে এস, সুখী সমৃদ্ধ জীবন উপভোগ করো। ঈশ্বর এটাই চান। ঈশ্বর তার  কোনো সন্তানকে কষ্ট   দিতে চান না। তিনি আমাদের উন্নতি চান, তিনি আমাদের জীবনের সফলতা চান। ভালো থাকায় জীবনের ধর্ম্ম। যত তোমার বয়স বাড়বে, তত তুমি সফলতার দিকে এগিয়ে যাবে, তত তুমি উন্নতি করবে,    ভগবান এটাই আশা করে থাকেন।  ধর্ম্মিক যদি বৈজ্ঞানিক হতো, বা বৈজ্ঞানিক যদি ধর্ম্মিক হতো, তাহলে দুটো জিনিস হতে পারতো, এক হচ্ছে, ধর্ম্ম কখনো মানুষকে প্রতারিত করতো না। আবার বিজ্ঞান কখনো মানুষের অকল্যাণে ব্যবহার করতে পারতো না। ধর্ম্মের প্রাথমিক প্রাথমিক শর্ত  হলো বিশ্বাস, আর বিজ্ঞান এগিয়ে চলে সন্দেহের দৃষ্টিকোন থেকে। 

মানুষ ক্ষুধা, ব্যাধি ও মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে চলেছে। শুধু মানুষ কেন সমস্ত জীব এই লড়াই করেই পৃথিবীটাকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে। ধর্ম্ম মানুষকে মানসিক দিক থেকে নিঃস্ব করবার জন্য সমস্ত চেষ্টা করে থাকে। মানুষ আসলে দুর্বল, মানুষ আসলে অসুরক্ষিত।  তাই সে একদিকে যেমন একটা কাল্পনিক সুরক্ষার বেড়া তৈরী করতে চায় , যা সামাজিক সুরক্ষা নামে  পরিচিত, অন্যদিকে মানুষ প্রকৃতির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে সবল করতে চায়, যাকে  বলে বিজ্ঞান । 

এক ফেরিওয়ালা কাপড় বিক্রি করে।  তো তার কাপড়গুলো মোটা বলে, অনেকে তাচ্ছিল্য করে। তো সে  এক ব্রাহ্মণ পন্ডিতের কাছে গেলো । আর তার সমস্যার সমাধান চাইলো। পণ্ডিত সমাধান একটা দিলো বটে, কিন্তু লাভের  অর্ধেক দাবি করে বসলো। এই পণ্ডিত  সূক্ষ্ণ কাপড় তৈরি করে দেবে, সেই কাপড় এতটাই সূক্ষ্ম হবে, যে সাধারণ চোখে দেখা যাবে না। যার আত্মা শুদ্ধ, পবিত্র, যারা বংশানুক্রমিক ভাবে শুদ্ধ অর্থাৎ যাদের পূর্ব্বপুরুষ স্বর্গে বাস করেন, তারাই এই কাপড় দেখতে পারবেন।  অন্য কেউ এই কাপড় দেখবার যোগ্য নন। আর এই কাপড় তারাই কিনতে পারবেন, যারা ধনবান।  

এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মানুষ একটা কিটসম।  জীব  এতটাই ক্ষুদ্র, আর বিশ্বব্রহ্মান্ড এতটাই বৃহৎ যে এই স্বল্প-সময়ের জীবনে তাকে জানা যায় না। আর স্বল্প-জীবনকালে ভোগ করতে হয়, তার হাজার হাজার রোগ-ভোগ।  নানান রকম প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে তাকে এগুতে হয়। আর তথাপি সে এমন জায়গায় পৌঁছায় যেটা মৃত্যুগহ্ববর ছাড়া কিছু নয়। পৃথিবীটা তার কাছে অজানা, অচেনা - সর্বত্র লুকিয়ে আছে ভয়, কেউ তাকে সুরক্ষা দিতে পারে না। ঠিক এই  সময় তার হাতে একটা সর্ব্বশক্তিমান ঈশ্বর ধরিয়ে দাও। যা সে অন্তরের  ভিতর থেকে চাইছিলো।   ব্যাস কেল্লা ফতে। এই ঈশ্বরকে সে ফেলে দিতে পারে না, একে সে সন্দেহও করতে পারে না। মানুষের যখন নারভাস সিস্টেম ফেল করেছে, এই সময় গ্রাম্য কুশলী পুরোহিত তাকে ঈশ্বর ধরিয়ে দেয়। এই পুরোহিত রাজনৈতিক নেতাদের থেকেও অধিক শক্তিশালী। আমাদের দেশে দেখেছি, রাজনৈতিক নেতারাও  ইলেক্শনের আগে পুরোহিতদের কাছে, মন্দিরে মন্দিরে হত্যা দিচ্ছে।  এর পরে পাঁচ বছর সে এইসব ভুলে থাকে। তখন সে পুরোহিতদেরও তোয়াক্কা করে না। আবার ইলেকশন এলে পুরোহিতেরা আবার এদের দেখা পায়।