Monday 25 February 2019

সত্যধর্ম ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ

















সত্যধর্ম ও ভগবান  শ্রীকৃষ্ণ 

এবার আমরা শ্রীকৃষ্ণ চরিত্র  সন্মন্ধে বোঝার চেষ্টা করবো। 

আসলে আমার অনেক প্রশ্ন।আমাদের বাড়িতে একবার ইসকন সদস্যদের  দিয়ে ভাগবত পাঠের অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানে ভাগবত শেষে, শ্রোতাদের কাছে, পাঠক জানতে চেয়ে ছিলেন, তাদের কোনো প্রশ্ন আছে কি না। তো, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, মানুষতো ভগবানের পুজো অর্চনা করে, ভালো থাকার জন্য। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সবথেকে কাছের পাণ্ডবরা কি ভালো ছিল ? যারা তাকে ভগবান বলে বিশ্বাস  করতো  তখনকার যুগে, তারাও  কি ভালো ছিল ? ভগবতপ্রেমী সেই ইসকনের সদস্য তখন তার নিজের  নাক কান মুচড়ে দিলেন। আর মুখে বলতে লাগলেন - হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ।........ বলে রাগে গর্ গর্  করতে করতে উঠে গেলেন। এর পরেও এই সব প্রশ্ন নিয়ে যার যার  কাছে জিগ্যেস করেছি, তারা সবাই  আমাকে এড়িয়ে চলতেন। তাই অন্যকে জিজ্ঞেস করা ছেড়ে দিয়েছি। এখন জিজ্ঞেস করি নিজেকে।    



শ্রীকৃষ্ণকে কেন ভগবান বলা হয় ?

আগে দেখে নেই ভগবান কাকে বলে

বিষ্ণুপুরান বলছেন :

ঐশ্বর্য্যস্য সমগ্র্যশ্চ বীর্য্যস্য যশসঃ শ্রিয়ঃ। 
জ্ঞান-বৈরাগ্যয়োশ্চৈব ষন্নাং ভগ ইতীঙ্গনা। । (বিষ্ণুপুরান)

সমগ্র ঐশ্বর্য্য, বীর্য্য যশ, শ্রী, জ্ঞান, বৈরাগ্য, - এই ছয়টি গুনের নাম  "ভগ" । এই ছয়টি গুন্ যার মধ্যে বিদ্যমান তাঁকে ভগবান বলে। 

উৎপত্তিং চ বিনাশাঞ্চ ভূতানামাগতিং গতিম 
বেত্তি বিদ্যামবিদ্যাঞ্চ স বাচ্যো ভগবান ইতি। । (বিষ্ণুপুরান) 

যিনি প্রাণীগনের, উৎপত্তি-বিনাশ, পঞ্চভূতের মিলন ও বিচ্ছুরণ, অর্থাৎ প্রাণীগণের পরলোকে গমন ও ইহলোকে আগমন ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে যিনি সম্য়ক  ভাবে বিদিত, এমনকি অজ্ঞানতা কাকে বলে সে সম্পর্কেও অবগত তাকেই ভগবান বলে।   

আধ্যাত্মিক জগতে তিনটি স্তরে  সন্ধান চলে। জীবাত্মা-আত্মা-পরমাত্মা  / শ্রীকৃষ্ণ-বিষ্ণু-নারায়ণ(হরি) / ভগবান-ঈশ্বর-পরমেশ্বর।

জীবাত্মা : প্রতিফলিত আত্ম-চেতনার নাম জীবাত্মা। 
আত্মা :  প্রতিফলিত বিশ্বচেতনার নাম আত্মা। 
পরমাত্মা : সমস্ত চেতনার উৎস বা বিশ্ব-চেতনার আর এক নাম পরম-আত্মা।  

শ্রীকৃষ্ণ : দেহধারী ভগবানকে, অর্থাৎ বিষ্ণুর দশ  অবতারের  মধ্যে  একজন।  
বিষ্ণু : বিশ্বপালন কর্তা । 
নারায়ণ বা হরি : সমস্ত নরের যিনি আশ্রয় (নর + আয়ন), তিনিই নারায়ণ।   

ভগবান : যার ভগবৎ অর্থাৎ ঈশ্বর জ্ঞান হয়েছে তিনি ভগবান। 
ঈশ্বর : সগুন ব্রহ্ম। 
পরমেশ্বর : নির্গুণ ব্রহ্ম।

এখন শ্রীকৃষ্ণকে কেন ভগবান বলা হয় ?  আমি দুএকটি  কথা  বলবো।

১) শ্রীকৃষ্ণের ভগবৎ জ্ঞান ছিলো, তাই তাকে ভগবান বলা হয় । শরীরি অর্থাৎ শরীরের অধিপতি সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণ,  অর্জুনকে  যা বলেছেন, তা থেকেই বোঝা যায়, আত্মা সম্পর্কে গুহ্য জ্ঞানে তিনি সমৃদ্ধ ছিলেন। পঞ্চভূতের শরীরের ওপারে, যিনি আমাদের নিয়ন্ত্রক, যিনি আমাদের প্রতিপালক, যিনি আমাদের রক্ষক ও মঙ্গলকারী তার সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণের  সম্যক পরিচয় ছিলো। এই দৃষ্টিতে দেখলে  শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলা যেতেই পারে। 

২) কংসের  মতো শক্তিশালী পুরুষকে যিনি মাত্র ৯/১০ বছর বয়েসেই মুষ্টিযুদ্ধে পরাজিত করেছিলে। অবশ্য, এর থেকে তার অসীম  শক্তির পরিচয় পাওয়া গেলেও, ভগবান বলে বোঝার কোনো উপায় নেই। এর পরের ঘটনা কিন্তু তাকে ভগবানের কাছে নিয়ে যায়। অর্থাৎ কংসের মৃত্যুর পরে, কংসের শ্বশুর  জরাসন্ধ যখন বিশাল সৈন্য বাহিনী(২৩ অক্ষৌহিণী) নিয়ে মথুরায় এলো, এবং প্রস্তাব দিলো যে শ্রীকৃষ্ণকে জরাসন্ধের কাছে নিঃশর্তে সমর্পন করতে হবে। তখন, কংসের পিতা উগ্রসেন বলেছিলো, শ্রীকৃষ্ণ আমাদের ভগবান। সে আমাদের রক্ষাকারী। তাকে আমরা ওই ক্রূদ্ধ হিংস্র জরাসন্ধের কাছে কিছুতেই সমর্পন করতে পারি না। তার চাইতে আমাদের যুদ্ধ করাই উচিত হবে। কিন্তু উগ্রসেন  রাজি না হলেও, সমবেত রাজন্যবর্গ এই শর্ত মেনে, একজনের অর্থাৎ একমাত্র শ্রীকৃষ্ণের জন্য হাজার হাজার মানুষের বলিদান সমর্থন করতে পারে নি। এবং রাজা উগ্রসেনের প্রস্তাবে তাঁরা  প্রতি-উত্তরে বলেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ যদি ভগবানই হবে,তবে তার রক্ষার জন্য আমাদের কেন চিন্তা করতে হবে ?   ভগবান নিজেকে নিজেই  রক্ষা করুক। শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু  এই প্রস্তাবকে স্বানন্দে গ্রহণ করেছিলেন, এই যুক্তিতে যে, একজনের প্রাণে বিনিময়ে  যদি হাজার হাজার লোকের প্রাণ বাঁচে, অর্থাৎ "বহুজন হিতায়" প্রবাদ মঙ্গলকর। এবং নিজেকে বাঁচিয়ে প্রমান করেছিলেন, তিনি সাধারণ মানুষ নন।

তিনি একজন ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ ছিলেন। অতীত জীবনের কথা তার জ্ঞাত ছিল। তিনি অর্জুনকে বলেছেন,  তুমি আমি বহু জন্ম অতিক্রান্ত করেছি, তুমি এ সব জানোনা।  আমি জানি। এ থেকেই বোঝা যায়।  তিনি সাধারণ মানুষ নন। তিনি একজন আত্মজ্ঞ পরম-পুরুষ ছিলেন।

আমি মহাভারতে বর্ণিত ঘটনা পরিক্রমায় যাবো না। আমি আধ্যাত্মিক শ্রীকৃষ্ণকে খোঁজার চেষ্টা করবো। শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে ভগবৎ-তত্ত্বকে খোঁজার চেষ্টা করবো।

একটা কথা মনে রাখতে হবে,  শ্রীকৃষ্ণ কোনো ঐতিহাসিক চরিত্র নয়। তিনি সর্বকালের, অথবা কালেরও উর্দ্ধে। তিনি পুরান পুরুষ। তিনি এক কাহিনীর নায়ক। তিনি অভিনেতা। তিনি জন্মে ছিলেন কি না, বা পাঁচ হাজার বছর  আগে জন্মে ছিলেন কি না, সেটা বড়  কথা নয়। এমনকি তিনি ভগবান ছিলেন কি না সেটাও বড়  কথা নয়।

আপনি যদি কৌরবদের জিজ্ঞেস করেন, দুর্যোধনকে জিজ্ঞেস করেন, যারা তাকে দেখেছিলো, সে কি বলবে - শ্রীকৃষ্ণ ভগবান ছিলো ? নিশ্চয়ই বলবে, অবশ্য়ই  না।  বলবে, শ্রীকৃষ্ণ গোয়ালার পুত্র ছিল। ছলনাকারী ছিল।  বড়োজোর বলতে পারে, বড়ো যোদ্ধা ছিলো। যদি আপনি অর্জুনকে জিজ্ঞেস করেন, সে বলবে আমার হিতকারী সখা ছিলো। ভালো একজন  বন্ধু ছিলো। যদিও তাকেই ভগবান তার স্বরূপ দেখিয়েছিলো। তবু অর্জুন তাকে জানতে পারেনি, চিনতে পারেনি।   কিন্তু ভীষ্মকে যদি জিজ্ঞেস করেন, সে বলবে শ্রীকৃষ্ণ ভগবান ছিলো। আবার আপনি যদি সঞ্জয়কে জিজ্ঞাসা করেন, তো সে বলবে,, তিনি যে কে ছিলেন, তা ভাষায় ব্যাক্ত করা যায় না।  আপনি যদি দ্রৌপদীকে জিজ্ঞেস করেন তো সে বলবে, যে আমাকে ভাত কাপড় জুগিয়েছে, সেই আমার ভগবান। শ্রীকৃষ্ণ আমাকে অসময় ভাত কাপড় দিয়েছে, তিনি অবশ্য়ই ভগবান। তো দৃষ্টিশক্তির ফারাক। শ্রীকৃষ্ণ একটা আয়না। তার সামনে দাঁড়ালে, তোমার স্বরূপেই তিনি প্রকাশ হবেন। তুমি যা চাও, তুমি যা দেখতে চাও, তুমি তাই দেখবে। অর্থাৎ তুমি যা তুমি তাই দেখবে, তুমি সরে  গেলে,  আয়না আবার স্বচ্ছ হয়ে যাবে। 


শ্রীকৃষ্ণের নিজের কোনো ব্যক্তিত্ব নেই। তিনি কোনো ব্যক্তিও নন।  তিনি এক পূর্ণ পুরুষ। নামেই বোঝা যায়, তিনি আকর্ষক। নামেই বোঝা যায়, তিনি কালো, অন্ধকার।অর্থাৎ সৃষ্টির আঁতুরঘর। আবার শূন্য।  শুন্য, অর্থাৎ তার কাছে সব আছে আবার কিছুই নেই। শুন্য সদাই পূর্ন। শূন্য কখনো অপূর্ন হয় না। শুন্য কখনো  ভগ্নাংশ হয় না। আর সব সংখ্যার ভগ্নাংশ হয়।  শুন্যের হয় না। শুন্য থেকেই শুরু। ০,১, ২,৩,৪,৫,৬,৭,৮, ৯ আবার শুন্য।  শুন্য থেকে শুরু আবার শূন্যতেই শেষ। শ্রীকৃষ্ণ কিছুই নয়। শ্রীকৃষ্ণের কোনো মূল্য নেই। শুন্যের কোনো মূল্য নেই, সংখ্যার ডান দিকে বসলে, সংখ্যার গুরুত্ত্ব বাড়ে। অদ্ভুত ব্যাপার। যাঁকে সদ্ভাবে নিলে, যে নেয় তার গুরুত্ত্ব বাড়ে। আর যে অসৎ ভাবে নেয়, অর্থাৎ বা দিকে নিলে তার কোনো গুরুত্ত্বের হেরফের হয় না।

ভগবান কথিত গীতার কোনো কথা বা তার  ব্যাখ্যা,  শ্রীকৃষ্ণের নয়। শ্রীকৃষ্ণ কোনো আলাদা পথ বাতলে দেননি । কিন্তু যেকেউ গীতার মধ্যে পথ পেয়ে যেতে পারে। অথবা বলা যেতে পারে, গীতাতেই সব পথ আছে, যার যেটা দরকার, সে সেটাই পেতে পারে।

সত্যি কথা বলতে কি গীতা কোনো ধর্মশাস্ত্র নয়। শ্রীকৃষ্ণ আদৌ কোনো তথাকথিত ধর্মগুরু নয়। এটি একটি রাজনৈতিক বক্তব্য। শ্রীকৃষ্ণ তার রাজনৈতিক  উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবার জন্য, ধর্মের কথা বলেছেন মাত্র। এখানে তিনি ধর্মশাস্ত্রকে কোট করেছেন মাত্র।যেমন রাজনৈতিক নেতারা করে থাকেন।   অর্জুনকে ধর্মশিক্ষা দেওয়া তাঁর উদ্দেশ্য নয়। তার উদ্দেশ্য অর্জুনকে দিয়ে দুর্যোধনকে অর্থাৎ বিপক্ষকে বা বলা যেতে পারে, যে তার বশ্যতা স্বীকার করতে রাজি নয় সেই দুর্ধর্ষ মহাবীর দুর্যোধনকে, পরাস্থ করা অর্থাৎ  নিজের বশে আনা। কৌশলে অর্জুনকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা। 

তাই তো দেখি, প্রথমে সাংখ্যযোগ থেকে উদ্ধৃতি। তাতে যখন কাজ হলো না, তখন বেদ  থেকে কর্মযোগ। তারপরে জ্ঞানযোগ অর্থাৎ খালি কাজ করলেই হবে না, বুদ্ধিযোগে কর্ম করতে হবে। তাতেও যখন কাজ হলোনা তখন , ভক্তির কথা বললেন, এবং সব শেষে স্ব-মূর্তি ধারণ করলেন।  অর্থাৎ ভীষণ আকার বা অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন।  এইবার অর্জুন ভয় পেয়ে গেলো। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, আমি যা বলছি তাই করো যুদ্ধ করো। অর্জুন সুরসুর করে, অঙ্গীকার করলো।  ঠিক আছে, তুমি যা বলছো, আমি তাই করবো। শ্রীকৃষ্ণ একজন  স্বার্থক রাজনীতিবিদ, নিপুন বক্তা, চতুর ও জ্ঞানী ।

আমাদের একটা মনে রাখতে হবে, আমরা যা শুনতে চাই, ভগবান তাই বলেছেন। আমরা যা বুঝি, অর্থাৎ যার সঙ্গে আমাদের সম্যক পরিচয় আছে, ভগবান তাই বলেছেন। তাই তিনি আমাদের কাছের মানুষ হয়ে গেছেন। কর্মের সঙ্গে আমাদের স্থূল পরিচয় আছে।তাই ভগবান কথিত কর্মযোগ আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় নি।  জ্ঞানের সম্পর্কে আমাদের শ্রদ্ধা আছে। তাই জ্ঞানযোগের কথা যখন বলেছেন, আমরা মনোযোগ সহকারে শুনেছি। ভক্তি আমাদের অন্তরের বিষয়।তাই কথা শুনতে শুনতে আমরা আপ্লুত হয়ে গেছি। এ সবই  আমাদের পরিচিত বিষয়। তাই গীতাকে গ্রহণ করতে আমাদের অসুবিধা হয় না। এবং কৃষ্ণও আমাদের কাছের মানুষ হয়ে যান। শুধু সাংখ্যযোগ আমাদের কাছে নতুন বিষয়। এটা  আমরা বুঝি  না, শুধু বিশ্বাস করি মাত্র। তাই আত্মা / পরম-আত্মা আমাদের কাছে বিশ্বাসের বিষয়, উপলব্ধি বা অনুভূতির বিষয় নয়। এটাকে ভগবানের আপ্তবাক্যের মতো মেনে নিয়েছি মাত্র। অনুসন্ধানে রত হয়নি। তাই জানিনা, শুধু মেনে নেই।               

শ্রীকৃষ্ণ কি আস্তিক ছিল ? আস্তিকরা সাধারণতঃ অহংকারী হয়। ঈশ্বর বিশ্বাসীরা বলেন, হে ঈশ্বর তুমিই সব। এই জগৎ মিথ্যা। তুমিই সত্য। শ্রীকৃষ্ণ বলছেন জগৎ সত্য, আমিও  সত্য। শ্রীকৃষ্ণ এই জগতের সব কিছুকে স্বীকার করেন, আমরা যাকে ধৰ্ম-অধর্ম  বলে মনে করি, তা তিনি করেন না। তিনি সব কিছুকেই স্বীকার করেন। সুখ-দুঃখ কাউকেই তিনি বাদ  দিতে চান না। তিনি কাউকেই ত্যাগ করেন না। যতক্ষন না সে তাকে ত্যাগ করছে। এইখানেই শ্রীকৃষ্ণ ব্যক্তিত্বহীন হয়ে যান।  আমরা কিছু ছাড়ি , কিছু ধরি, শ্রীকৃষ্ণের ধরা-ছাড়া  বলে কিছু নেই। তাই শ্রীকৃষ্ণের আমিত্ত্ব বলে কিছু নেই। আমরা যখন কিছু ধরি বা ছাড়ি তখন আমি হয়ে যাই। ব্যক্তি হয়ে যাই। আমার স্ব-যে বস্তুতে প্রতিষ্ঠিত হয়, আমার তখন সেই বস্তুতে আমিত্ব ভাব হতে থাকে। যেমন নিজেকে ধনের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করলে, আমি ধনী হয়ে যাই।  নিজেকে বিদ্যার মধ্যে প্রতিষ্ঠা করলে আমি বিদ্বান হয়ে যাই। বুদ্ধির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করলে আমি বুদ্ধিমান হয়ে যাই। জ্ঞানের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করলে আমি জ্ঞানী হয়ে যাই। শরীরের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করলে আমি শরীর হয়ে যাই। শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে এই ধরা ছাড়া বলে কিছু নেই। তিনি সবেতেই আছেন, আবার কোনো কিছুর মধ্যেই  তিনি নেই। ধরা-ছাড়াই আমার ব্যক্তিত্ব। কিন্তু  শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে ব্যক্তি বলে কিছু নেই। তিনি কিছু ধরেন না ছাড়েন না।  তাইতো সহজেই তিনি বলতে পারেন, সব ছেড়ে আমাকে ধরো। আমার শরণাপন্ন হও।  আপাততঃ কথাটায় মনে হতে পারে,  বোকারাই এ কথা বলতে পারে। অথবা এই কথা অহংকারীরা  বলতে পারে। একটা কথা বলুন তো, আমাদের মতো সাধারণের লোকের যেটা মনে হতে পারে, যে তিনি অহংকারী বা বোকার মতো কথা বলছেন, এই  কথা কি শ্রীকৃষ্ণের মনে হয়
নি ? না মনে হয় নি, কারন তিনি অহঙ্কারীও নন আবার বোকাও নন। এ কথা সেই বলতে পারে, যিনি অহংকারী নন। "আমার শরণে এস" এ কথা সেই বলতে পারে যার "আমার" এই জ্ঞান একেবারেই  নেই। আসলে উনি বলতে চেয়েছেন, তোমার "তুমি"-কে ছেড়ে দাও। তোমার এই ভেদ বুদ্ধিকে ছেড়ে দাও। তোমার অহংকারকে ছেড়ে দাও। তোমার তথাকথিত জ্ঞান, যা তোমাকে ভালো মন্দ বিচার করতে শেখায় - সেই জ্ঞান ছেড়ে দাও। তুমি ভাবছো, আত্মীয়দের মারলে, তুমি দুঃখী হবে। এদের না মারলে তুমি সুখী হবে ? তুমি চাইছো এদের না মেরে তুমি মহান-মানবতার পরিচয় দিতে। তুমি ভিক্ষাবৃত্তি করে, ত্যাগের প্রতীক হতে
চাইছো ? এদের না মেরে তুমি আত্মহত্যা করে চির বিজয়ী হতে চাইছো ? আসলে তোমাকে  ভয় গ্রাস করেছে। তুমি নিজেকে কর্তা  ভাবছো। আর সমস্ত কাজের পরিণামের কথা ভেবে আতঙ্কগ্রস্থ হচ্ছো।  

তোমার প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি নেই বলেই এমনটি ভাবছো। আমাদের মতো সাধারণের মানুষের  মনে হয়, অর্জুন ধার্মিক। সে এই বিনাশকার্য থেকে দূরে থাকতে চাইছে। শ্রীকৃষ্ণ অধার্মিক, সে এই বিনাশকার্যে প্রেরণা দিচ্ছে। কিন্তু যা সত্য তা হচ্ছে, তুমি নিমিত্ত মাত্র।  করেন তো তিনি, করানও তিনি। তুমি যেটা নিজের কাজ ভাবছো - অর্থাৎ নিজেকে কর্তা ভাবছো, এই ভাবনাই  তোমার কর্মফলের হেতু। এটাই তোমাকে "তুমিতে" পরিণত করেছে। এখান থেকে বেরিয়ে এস।  তুমি তার কাছে, পরম-আত্মার কাছে সমর্পিত হয়ে যাও।  কর্তব্য কর্মে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে নিয়োজিত করো। সমর্পনই উদ্ধারের রাস্তা, শান্তির রাস্তা।      

সত্যধর্ম ও অবতার শ্রীকৃষ্ণ

সত্যধর্ম আসলে পরমেশ্বরের সাধনার পথ । আর পরমেশ্বর নিরাকার। পরমেশ্বরের পূজা হয় না।  পরমেশ্বরের উপাসনা হয়।পরমেশ্বরের গুনকীর্তন হয়।  সাকারের পূজা হয়। আমি যখন এই সত্যধর্মের বই পড়তে আরম্ভ করি, তখন আমি প্রথমেই ধাক্কা খাই মহাত্মা গুরুনাথের একটা কথায়, আর সেটা হচ্ছে "শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর নয়" এই কথাটা শুনে। আমরা পারিবারিক সূত্রে শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত।  বাড়িতে শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহের পূজা হয়। ছোটবেলা থেকেই শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলে শুনে আসছি। কিন্তু ভগবান আর পরমেশ্বর এর মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে, সেটা আমার বোধের বাইরে ছিল।  তাই শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর  নয় এটা শুনে বা পড়ে, আমার মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। ভাবতাম মহাত্মা গুরুনাথকে কয়জন চেনে, জানে। শ্রীকৃষ্ণকে আমরা সবাই পূজা করি ভগবান জ্ঞানে, আর মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন, তিনি ভগবান নয়। এই সব অবান্তর কথা না শোনাই ভালো। এই সব কথা  অজ্ঞানীর অভিমান মাত্র। সেইথেকে  আমি  মহাত্মা গুরুনাথের বই পড়া  ছেড়ে দিয়েছিলাম। 

কিন্তু পরবর্তীতে, বাধ্যতামূলক ভাবে সত্যধর্মের উপাসনায় উপস্থিত থেকে, বিশেষ করে আমার স্ত্রী ও শশ্রূ-মাতার  অগাধ ভক্তি ও নির্ভরতা দেখে বা উপলব্ধি করে, এই বিষয়ে আমার কৌতূহল বাড়ে। এবং আমি আবার তার বইগুলো পড়তে শুরু করি । এখন আমার মনে হয়, মহাত্মা গুরুনাথ ঠিকই বলেছেন। কিন্তু কি বলেছেন তিনি। 

প্রাসঙ্গিকক্রমে আর একটা কথা বলি, সত্যধর্মের যখন প্রকাশ হয় অর্থাৎ প্রায় একশ বছর আগে, প্রথম প্রথম এই ধৰ্ম প্রচার করা হতো গোপনে। এমনকি মহাত্মা গুরুনাথের নাম প্রকাশও নিষেধ ছিল। আমার মনে হয়, তখন সমাজ আরো গোড়ামিতে ভরা  ছিলো। এবং গুরুদেবের কথায় তখনকার আমলে, হিংস্র প্রতিবাদের সম্ভবনা ছিল, তাই এই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল। আজ সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।  তাই সত্য বলার রাস্তা সহজ হয়েছে। কিন্তু অন্ধত্ত্ব  আজও যায় নি। ঈশ্বর আজও আমাদের কাছে বিশ্বাসের বিষয়।  অনুভবের বিষয় নয়।  এখন আমরা আলোচ্য বিষয়ে আসি। শ্রীকৃষ্ণ কেন পরমেশ্বর নয়। বা শ্রীকৃষ্ণ আসলে কে ?

মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন :

কারুর কারুর মতে  ঈশ্বর যে জন্ম গ্রহণ করেন, বা মানুষ হিসেবে জন্ম গ্রহণ করেন, এটা একটা অন্ধ বিশ্বাস ছাড়া কিছু নয়। ঈশ্বর নিরাকার, তিনি কোনো নির্দিষ্ট রূপের মধ্যে আবদ্ধ নন। আর নিজেকে তিনি আবদ্ধ করেনও না। কোনো মনুষ্য দেহধারীকে ঈশ্বর বলা মানে, ঈশ্বরকে সীমাবদ্ধ করা। ঈশ্বর সীমাহীন, অনন্ত। সবার মধ্যেই ঈশ্বর প্রতিফলিত। তাই শ্রীকৃষ্ণের মতো দেহধারীকে ঈশ্বর বলা অজ্ঞানীর লক্ষণ। 

আর এক দলের মত্ হচ্ছে, ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। তিনি মানুষ বা যেকোনো  জীব হিসেবে জন্ম গ্রহণ করতে পারবেন না কেন ? এই অবতারবাদীদের বিশ্বাস তিনি শুধু মানুষ নয়, তিনি মৎস্, কুর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ  হয়ে জন্মেছেন আর কলিকালের সবশেষে কল্কি হয়ে জন্মাবেন। আমরা নয় জনকে জন্মাতে দেখেছি, আর একজনকে জন্মাতে দেখবো।  এই সত্যের কোনো অন্যথা হয় না।

মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন : এই বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ত্ব দেওয়ার কিছু নেই। এগুলো আসলে শাস্ত্রকারদের সংস্কার ছাড়া কিছু নয়। আর এই শাস্ত্র দিয়েই প্রমান করা যায় এগুলো শাস্ত্র বিরোধী। 

কঠোপনিষদ বলছে :
"ন জায়তে ম্রিয়তে বা 
বিপশ্চিন্যায়ং কুতশ্চি
ন্ন বভূব কশ্চিৎ। " 

জগদীশ্বর জ্ঞানময়, তিনি জন্ম গ্রহণ করেন না, সুতরং মৃত্যুগ্রাসে পতিত হন না। আর তিনি কেহ হতে হন না কোনো জীব হন না। অর্থাৎ তিনি কোনো কিছু থেকে আসেন নি।  আর কিছু হন না।  অর্থাৎ জীব হয়ে জন্মানও  না।   

স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ আত্মা  সম্পর্কে বলছেন : 

"ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ
নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ। 
অজ নিত্যঃ শাশ্বত অয়ং  পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শশীরে।"   গীতা-২/২০)

আত্মা কখনো জন্ম গ্রহণ করেন না, মরেন না। তিনি না জন্মেছেন, না জন্মাবেন। তিনি অজ, নিত্য শাশ্বত ও পুরান ; শরীর  বিনষ্ট হলেও এর বিনাশ নেই। 

শ্রীকৃষ্ণকে যারা ঈশ্বর বলে মনে করেন, তাদের  একটা জোরালো যুক্তি হচ্ছে, ঈশ্বর যখন সর্বশক্তিমান তখন তিনি জন্ম গ্রহণ করতে পারবেন না কেন ? গুরুদেব বলছেন, শক্তি থাকলেই সেই শক্তি তিনি প্রয়োজন অতিরিক্ত কাজে ব্যবহার করবেন তার কোনো মানে নেই। শক্তিশালী রাষ্ট্র ইচ্ছা করলে মুহূর্তের মধ্যে যে কোনো গ্রাম,বা বিশেষ নগর মানবশূন্য করতে পারেন।  কিন্তু তা কি করা হয় ? এমনকি আমাদের নিজেদের  শক্তি থাকলেই কি আমরা তার ব্যবহার সব জায়গায়  করি ? করি না।  কারণ আমাদের ইচ্ছা শক্তি বাধা দেয়।  আর সত্যি কথা বলতে গেলে, ঈশ্বর অলক্ষে থেকেই সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। তার মায়া-প্রকৃতির আশ্রয় নিয়ে কিছু করতে হয় না। বরং প্রকৃতির আশ্রয় নিলে, বা দেহধারী হলে তিনি তার সর্বশক্তিমান সত্ত্বা হারিয়ে ফেলেন। তাই তিনি এইরূপ ইচ্ছা কস্মিন কালেও করেন না। 

যদি বলা হয়, সাধুদের পরিত্রানের জন্য, বা দুস্টুদের দমনের জন্য তার আসার প্রয়োজন, সেটাও সত্য নয়। কারন এই প্রক্রিয়া মানুষই করে থাকে।  রাষ্ট্র করে থাকে। সাধুজনেরাই করে থাকে। এর জন্য ভগবানের দেহ ধারনের প্রয়োজন নেই। তার ইচ্ছা শক্তিই এইরূপ দন্দ্ব সৃষ্টি করছে, আবার তার এই  শক্তিই এই দ্বন্দ্বের নিরসন করছেন।  এর জন্য সেই পরম আত্মার বা পরমেশ্বরের দেহ ধারণ করার প্রয়োজন নেই। এই সব কথা কিছু গুরুত্ত্বহীন সাধুদের দ্বারা, নিজেদের গুরুত্ত্ব বাড়াবার জন্য প্রচার করেছেন । এর মধ্যে কোনো  সত্য নিহিত নেই। গুরুদেব বলছেন, যিনি পূর্ণব্রহ্ম, তিনি কখনো একজন দুষ্টাত্মার নিগ্রহে প্রবৃত্ত হয়ে পদে পদে বিপদগ্রস্থ ও কখনো কখনো পরাভূত এমনকি শাপগ্রস্থ (সত্যবতীর দ্বারা) হতেন না। শ্রীকৃষ্ণতো একজন শোকগ্রস্থ সত্যদ্রষ্টা  জ্ঞানীব্যক্তি ছিলেন ।  

একটা কথা মনে রাখতে হবে,  যার অব্যক্ত অংশ হতে এই জগৎ উৎপন্ন হয়েছে, এবং যার অংশই সমস্ত জীবাত্মা, সমস্ত ব্রহ্মান্ডের যিনি উপাদান ও নিমিত্ত-কারণ, তিনি যদি একস্থানে স্থিত হন, তবে ব্রহ্মান্ডের অন্য্ সব স্থান কিভাবে থাকবে ? 

অতএব এটা নিশ্চিত করে বলা যায় পরম-ঈশ্বর কখনো কোনো কিছু হয়েই  জন্মান না, তা সে মৎস্, কুর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, রাম , কৃষ্ণ যাই বলুন না কেন । জন্মানোর দরকার হয় না। এই অবতার তত্ত্ব আসলে প্রাণীর ক্রমবিকাশ বোঝাবার জন্য,  একটি রূপক গল্প মাত্র। 
এখন তাহলে কৃষ্ণ কে ? 

পরম-ঈশ্বর জন্মান না।  কিন্তু যারা জন্মান তাদের মধ্যে পরম-ঈশ্বরের অনেকগুন্ বা শক্তি  আয়ত্ত্ব করবার পুরুষাকার  থাকে। মানুষ জন্ম জন্মান্তরের প্রচেষ্টায় এই শক্তি সকল বা গুন্ সকল আয়ত্ত্ব  করতে পারে। প্রথম জন্মে বা শরীরে যে শক্তি সে লাভ বা আয়ত্ত্ব  করে, ক্রমাগত চেষ্টায়, ও জন্মান্তরের সাধনায়   তার সেই শক্তি বাড়তে থাকে।  এবং ধীরে ধীরে, সে সাধারণ মানুষ বা জীবের থেকে সে উন্নত হতে পারে।  তখন তার সঙ্গে সাধারণের প্রভূত পার্থক্য দেখা যায়। কেউই প্রথম জন্মেই অবতার হয় না।  জন্ম জন্মান্তরের সাধনাই  তাকে অবতার হিসেবে প্রতিপন্ন করে। তাই যাদের আমরা অবতার বলি, তাঁরা জন্ম-জন্মান্তরের সাধক। যোগবশিষ্ট। তারা সকালেই বহু জন্ম ব্যাপিনী সাধনার ফলে এই অবস্থা লাভ করেছেন । 

দেখুন শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলছেন, হে অর্জুন, তুমি-আমি বহুবার জন্ম গ্রহণ করেছি, আমি সে সকল জানি, তুমি জানো না। ভগবান বুদ্ধও তার পূর্বপূর্ব জন্মের কাহিনী বলেছেন। অতএব মহাত্মা গুরুনাথ যে বলছেন বহু জন্মের সাধনার ফলে মানুষ ধীরে ধীরে অবতার হয়ে যান, সেটা সত্য। 

অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণ যে এককালে নর ও নারায়ণ ছিলেন, তার প্রমান পাই আমরা মহাভারতের প্রতিজ্ঞা পর্বে। সেখানে দেখছি, জয়দ্রথকে অর্থাৎ অর্জুনপুত্র অভিমন্যুর বধকারীকে শায়েস্তা কোরবারবার জন্য, শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন স্বয়ং মহাদেবের কাছে গিয়েছিলেন দিব্য অস্ত্র লাভের  আশায়। সেখানে স্বয়ং ত্রিকালেশ্বর মহাদেব তাদের সম্মোধন করছেন, নর ও নারায়ণ বলে। অর্থাৎ এখনকার অর্জুন হচ্ছেন পূর্বাপূর্ব জনমের নর আর শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন নারায়ণ। এঁরা দুই জনই মহান সাধক ছিলেন। সত্যযুগে বদ্রীনাথ ধামের কাছে (এখন যেখানে নর-নারায়ণ পর্বত ) হাজার হাজার বছর  ধরে তাঁরা দুই ভাই তপস্যা করেছিল।

মহাভারতের বিভিন্ন জায়গায় যেমন ভীষ্মপর্বে (৬৮ অধ্যায় ), উদ্দ্যোগপর্বে, এই শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের পূর্ব জন্মের কথা লেখা আছে।  অর্থাৎ মহাভারতের বিভিন্ন জায়গায় বহু মহাপুরুষের পূর্বজন্মের কথা লেখা আছে। সত্যিমিথ্যা যাই হোক না কেন, মানুষ তার সাধনার দ্বারা প্রাপ্ত ক্ষমতা জন্ম-জন্মান্তর বয়ে নিয়ে চলে এটা সত্য। 

অতএব যাঁকে  লোকে অবতার বলে. তিনি প্রথমে সামান্য অবস্থাতেই ছিলেন।  ক্রমে ক্রমে সাধন বলে, হাজার জন্মের সাধনায় নিজের উন্নতি সাধন করেছেন। পরম-ঈশ্বরের গুণাবলী, তার পরমাশক্তি লাভ করেছেন। এই জন্যই এইসব ঐশী শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিকেই অবতার বলা হয়। তার মানে এই নয় যে তিনি পরমপিতা -পরম-ঈশ্বর। সমস্ত ব্রহ্মান্ড যেমন পরম-ঈশ্বরের অংশ।  তেমনি সাধারণ মানুষ বলুন, কীট পতঙ্গ বলুন আর অবতারই  বলুন সবই পরমপিতার অংশ মাত্র। কেউই পরম-ঈশ্বর নন। 

আর একটা কথা মনে রাখা রাখা দরকার সেটা হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকে বিষ্ণুর অবতার বলা হয়। বিষ্ণু, শিব, ব্রহ্মা সবাই অনন্ত  ব্রহ্মের অংশ মাত্র। এই তিন জনকে আলাদা ভাবে তিনটি কাজের দায়িত্ত্ব দেওয়া হয়েছে বলে কল্পনা করা হয়েছে, হিন্দুদের মতে ।  ব্রহ্মা - সৃষ্টিকর্তা ; বিষ্ণু -পালনকর্তা ; শিব বা রুদ্র : সংহারকর্তা। অতএব শুধুমাত্র পালনকর্তাকে আমরা পরম-ঈশ্বর বলতে পারি না। এই তিন জনই স্ব-স্ব  ক্ষেত্রে প্রধান। আবার আমরা বিভিন্ন সময়ে এঁকে  অন্যের সহযোগিতা নিতে দেখি।  অতএব শ্রীকৃষ্ণকে আমরা সর্বশক্তিমান ভাবা মানে তাকে তাঁর উপযুক্ত সন্মান থেকে বঞ্চিত করা। আমি কোনো কনস্টেবলকে যদি বার বার ওসি স্যার বলে সম্বোধন করি, সে তাতে সম্মানিত বোধ না করে তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে বলে মনে করতে পারেন। অতএব শ্রীকৃষ্ণ যোগেশ্বর, পরম জ্ঞানী, ভগবান, ঈশ্বর, সব কিছু, কিন্তু পরম-ঈশ্বর নন,  পরম পিতা নন এটা আমাদের বুঝতে হবে।  

আসলে মানুষ অর্থাৎ এই শরীর প্রকৃতির অধীন। সুখ দুঃখ মানুষের স্বেচ্ছাসাধ্য নয়। মানুষ না চাইতেই বিপদের সম্মুখীন হয়।  আমরা কেউ দুঃখ চাই না।  কিন্তু  দুঃখ আসে। আমরা কেউ কর্তা  নোই।  স্বয়ং বিষ্ণু, ব্রহ্মা, রুদ্র কেউই কর্তা  নহে। সূর্য/পৃথিবী/চন্দ্র  যেমন ইচ্ছা করলে ঘোরা বন্ধ করতে পারে না । পৃথিবী আমাদের আশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে পারে না। সূর্য কিরণ দেওয়া বন্ধ করতে পারে না। বাতাস রুদ্ধ হতে পারে।  তারা সবাই যে যার কার্য্যে রত থাকতে বাধ্য, সেই পরম-ঈশ্বরের অমোঘ নির্দেশে। 

অতএব মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন :

জগতে ঈশ্বর অনেক আছেন, কিন্তু পরমেশ্বর একজনই। অবতারগন অবশ্যই  প্রভূত গুনের অধিকারী। কিন্তু পরমেশ্বর অনন্ত গুনের অধিকারী। 

এই জগৎ কর্মক্ষেত্র। কর্মহীন জীবন হয় না। আবার কর্ম করলে তার ফল অবশ্যম্ভাবী। মনুষ্য জন্ম কর্ম নিমিত্ত। এই কর্মই  মানুষকে সুফল, কুফল ভোগ করায়। অতএব কর্ম  ও ভোগ এখানেই করতে হয়। ভোগ সম্পূর্ণ না হলে, অর্থাৎ ফল ভোগের আগেই আমাদের দেহত্যাগ হলে, আমরা ভোগযোনিতে জন্ম গ্রহণ করি। সেখানে সুখ দুঃখ ভোগের পরে আবার মানুষ হয়ে জন্ম গ্রহণ করি। এই জন্ম-মৃত্যুর চক্র চলছে। এখান থেকে বেরোতে গেলে আমাদের পরম-পিতা পরম-ঈশ্বরে নিবেদিত হতে হবে।  আর এখানেই মনুষ্য জীবনের সার্থকতা।

অদ্ভুত চরিত্র এই শ্রীকৃষ্ণ। কখনো চোর, কখনো সাধু, কখনো প্রেমিক, কখনো কঠোর। যখন যার কাছে থেকেছেন, পূর্ণরূপে থেকেছেন। যাকে ছেড়েছেন পূর্ণরূপে ছেড়েছেন। যখন যে কাজ করেছেন,  সে কাজে তিনি পূর্ণরূপে নিবিষ্ট হয়েছেন। তার মধ্যে অসম্পূর্ণতা বলে কিছু নেই।         
এবার আবার একবার আমরা শ্রীকৃষ্ণকে কেন ভগবান বলা হয়, তার আলোচানা করবো।তাকে পূর্নাবতার বলা হয় কেন?  একটু একটু করে বোঝার চেষ্টা করি।

কৃষ্ণনাম : কৃষ্ণ কথাটার মানে কালো।  তার গায়ের রঙ-ও  ছিল কালো। কালো মানে অন্ধকার। অন্ধকার সব সময় রহস্যময়। অন্ধকারই শূন্য, অর্থাৎ তাতে আমরা কিছুই দেখতে পাই না। আর শূন্যই  পূর্ণ।
  
কৃষ্ণ কথাটার মানে আকর্ষণ। অর্থাৎ মাধ্যাকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। অর্থাৎ যার টানে সব কিছু কাছে চলে আসে। এ যেন চুম্বক। পাঁচ হাজারেরও বেশি সময় ধরে আমাদেরকে টানছে।

শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভাব বা জন্ম :

এবার আমরা শ্রীকৃষ্ণের জন্ম বা  আবির্ভাবটা  একটু দেখে নেই। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম দুর্যোগপূর্ণ অন্ধকার রাতে।  নিজের হাত নিজে দেখা যায় না। বাইরে ঝড় বৃষ্টির প্রচণ্ড প্রতাপ। এরই মধ্যে ভগবান এলেন। দুর্যোগের রাতেই-তো আমরা ভগবানকে ডাকি। আর তিনি তখনি হাজির হন। কি অদ্ভুত না ? আসলে জন্ম তো অন্ধকারেই হয়। আমার ভিতরে যা জন্ম নেয় তাতো সব গভীরে, অন্ধকারে। ধ্যান, সমাধি জন্ম নেয় অন্ধকারে। বীজ থেকে অঙ্কুর জন্ম নেয় অন্ধকারে। জন্মতো অন্ধকারেই হয়, মায়ের পেটে। বাবাওতো অন্ধকারেই  বীজ  রোপন করেন। অন্ধকারেই সব কিছুর জন্ম। আর দুর্যোগপূর্ণ অন্ধকারেই ভগবান আসেন। শ্রীকৃষ্ণও এসেছেন। আমরা সবাই অন্ধকারেই জন্মাই।  এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
ভগবান এলেন কারাগারে শৃঙ্খলাবদ্ধ মায়ের কাছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তো  ভগবান বুদ্ধের মতো রাজার পরিবারে আসতে  পারতেন। তা তিনি এলেন না। তিনি এলেন কারাগারে শৃঙ্খলাবদ্ধ মা-বাবার কাছে। এখানেই পার্থক্য। ভগবান বুদ্ধ দুঃখের মুক্তি চেয়ে ছিলেন। জন্ম মৃত্যুর চক্রের বন্ধন থেকে মুক্তির জন্য নয়। ভগবান বুদ্ধ ভগবানের কাছে কাউকে যেতে বলেন নি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু বন্ধন  মুক্তির জন্য এসেছিলেন। কাছে টেনে নিয়ে ছিলেন। তা সে তার তথাকথিত শত্রুই হোক আর তথাকথিত মিত্রই  হোক। কংশ মুক্তি পেয়েছিল। শিশুপাল মুক্তি পেয়েছিলো।    আর তা ছাড়া, আমরা তো কারাগারেই জন্মাই, কারাগারেই মারা যাই। কেউ কেউ অবশ্য মুক্তি পায়। তবে কোটিতে কটি ? আর জন্ম মানেই  তো  একটি সাময়িক বন্ধন।  দেহের মধ্যে আসাই তো বড়ো বাঁধন। দেহই  তো একটা কারাগার। দেহ ত্যাগ মানে বন্ধন থেকে মুক্তি।

আর একটা জিনিস আমরা কৃষ্ণের জন্মের পরে দেখি ।  তা হলো মৃত্যু ভয়। তাকে মেরে ফেলার জন্য কংসের  সাথীরা সক্রিয় ছিল।  জন্মের পরে মৃত্যু ভয় কার নেই ? জন্ম মানেই মৃত্যু অবসম্ভাবী। মৃত্যুর জন্য শুধু জন্মটাই দরকার। আর কোনো গুনের দরকার নেই। ঘর বাড়ি, বিছানা চাদর, জামা কাপড় নোঙর করার জন্য প্রয়াস করার দরকার নেই।  ওটা এমনি এমনি হয়। বেঁচে থাকার জন্য লড়াই দরকার, মরার জন্য কোনো লড়াই দরকার নেই, কোনো প্রয়াস নেই। অদ্ভুত ব্যাপার, না চাইলেও পাওয়া যায়। যাকে  আমরা জীবন বলি, সেটা তো শোভা  যাত্রা।  স্মশান যাত্রা। আমরা স্মশানের দিকে এগিয়ে চলেছি। কেউ কেউ তো প্রতিক্ষণ মরছি। দেহে তো প্রতিনিয়ত মৃত্যু যাত্রা চলছে। প্রতিক্ষণেই আমাদের দেহকোষের, জন্ম মৃত্যু চলছে।  মৃত্যুমিছিল চলছে, একেই আমরা জীবন বলছি। বেঁচে থাকা বলছি।  আশ্চর্য।


ভগবান গীতাতে বলছেন : যখনই ধর্মের হানি হয় তখন আমি আসি। ধর্মের রক্ষার জন্য অধর্মের নাসের জন্য আমাকে আসতে  হয়। এই ব্যাপারে  কিছু বক্তব্য আমাকে আকৃষ্ট করে।  শুনুন। 

সাধুদের রক্ষা করার জন্য ভগবানের কি সত্যিই দরকার ? কার রক্ষা করার দরকার - যে অনিশ্চয়তায় ভোগে। যে বিপন্ন, তার সুরক্ষা দরকার। নিজের অনিশ্চয়তায় যে সুরক্ষিত সেইই সাধু। যিনি স্ব-স্বরূপে স্থিত, তিনিই সাধু। যিনি স্ব-অধীন তিনিই সাধু।  বিপদেও যে শান্ত, সেইই সাধু। সাধুর অর্থই হলো, যার কাছে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। অথবা যে অনিশ্চয়তাকেই মেনে নিয়েছেন। ইনি ভবিষ্যতের অনিশ্চিয়তায় ভুগেন না। ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চয় করেন না। যার সঞ্চয় নেই, তার রক্ষার চিন্তাও নেই। যিনি দেহাতীত, তার দেহ রক্ষার কোনো তাগিদ নেই।  তাকে বাঁচানোর জন্য কৃষ্ণের কি দরকার ? এই কথাটা আমার কাছে বিস্ময়ের। যার কাছে এখনো অনিশ্চিয়তা, সে তো সাধুই হয় নি। যেদিন সাধু আর সাধু থাকবে না, সেদিন তাকে বাঁচানোর জন্য কৃষ্ণের দরকার পড়বে। অতএব সাধুকে বাঁচানোর জন্য কৃষ্ণকে আসার দরকার নেই। 

আর একটা কথা বলছেন দুষ্টের দমনের জন্য অর্থাৎ মারার জন্য কৃষ্ণের প্রয়োজন। তাই তিনি এসেছিলেন। ভগবান নিজে জানেন, কাউকে মারা যায় না।  দেহান্তরিত হয় মাত্র।  অতএব দুষ্টকে মেরে দুষ্টমিকে খতম করা যায় না। দুষ্টকে  মারার কাজ যে কেউ করতে পারে। সারা বিশ্বে দুষ্টকে শাস্তি দেবার জন্য আইন আছে, শাস্তির ব্যবস্থা আছে। তাতে কৃষ্ণের আসার দরকার নেই। আসলে দরকার দুষ্টদের  রূপান্তর করা। আর এই কাজ সাধুদেরই করা উচিত।

আসলে সাধুরা মনে করে, আমাদের বাঁচানোর জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এসেছিলেন। তার মানে কি আমরা ধরে নেবো, এখন আর সাধু নেই, বা শ্রীকৃষ্ণের আগে সাধু ছিল না তাই শ্রীকৃষ্ণ আসেন না। দুষ্টরা মনে করতে পারে, আমাদের মারার জন্য ভগবান আসবেন।  তাদের এই বোঝাটা ঠিক হতে পারে। কিন্তু সাধুদের রক্ষার জন্য ভগবান আসবেন, এটা  ঠিক নয়। মনে রাখা দরকার, যে সাধু মনে করে, তার সুরক্ষার  দরকার, সে সাধুই নয়। আর কেউ তো মারাই যায় না, মারা যেতেই  পারে না, পুনর্জন্মে সে আবার আসবে, আর দুষ্টমি করবে। তাই দুষ্টদের বিনাশের জন্য শ্রীকৃষ্ণ এসেছিলেন, একথাটাও  ঠিক নয়। 

আসলে তথাকথিত সাধুরা এই ভেবে তৃপ্তি পায় মাত্র। বাস্তিবক পক্ষে, অন্তর যদি পরিশুদ্ধ হয়ে থাকে, তবে দুষ্টকেও বন্ধু মনে হবে। আমরা লোকনাথবাবাকে জানি, তার আশ্রমে একটা হিংস্র সাপ এসে দুধ খেয়ে যেত। আমরা ভগবান শঙ্করকে দেখেছি, তার কাছে হিংস্র বাঘ এসে শুয়েছিল। দেওঘরে, এক সাধুর (ভোলা গিরি ) আশ্রম আছে, তাকে নাকি দুটো বাঘ পাহারা দিতো। যে কষ্ট দেয়, তাকে শত্রূ মনে করা সাধুর কাজ নয়। সাধুর অর্থই হলো, কাউকে শত্রূ মনে না করা। তাকে কষ্ট দিলেও শত্রূ মনে হবে না। আসলে তথাকথিত সাধুরা  বসে বসে এই সব  ভাবে। আমি বলবো, যারা সাধুর বেশ ধরে আছে, তারা ভাবে, যে আমাদের রক্ষার জন্য ভগবান আসবেন। তারা জানেনা, এই শ্লোক দ্বারা তথাকথিত সাধুদের উপহাস করা হয়েছে। অথবা এটা কবি কল্পনা মাত্র। আর সত্যি সত্যি ভগবান যদি এটা  বলে থাকেন, তবে জানবেন এর কোনো গভীর অর্থ আছে। যা আমি জানিনা। 

আর একটা কথা বলছেন  যুগে যুগে আমি আসি। যুগে যুগে আমি আসি - এমন কথা কে বলতে পারে ? যিনি স্বাধীন। এই প্রকৃতির জগতে কেউ স্বাধীন নয়। সবই  প্রকৃতির অধীন। কারণের অধীন।  এমনকি ভগবান, যখন প্রকৃতির আশ্রয় নেন, তখন তিনিও প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলেন, চলতে বাধ্য হন। তাহলে ভগবান কখন আসেন ? আর কেনোই বা আসেন ? আমরা সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজবো। 

ভগবানের, অর্থাৎ  কৃষ্ণের মতো ব্যক্তিত্বের জন্ম যে কোনো সময় হতে পারে। সব পরিস্থিতিই তার পক্ষে অনুকূল। এমন কোনো পরিস্থিতি নেই, যখন তিনি আসতে  পারেন না। আবার, কোনো বিশেষ কাল বা পরিস্থিতি, কৃষ্ণের মতো মানুষের জন্মের অপেক্ষায় থাকে না। কোনো কারন ছাড়াই কৃষ্ণের মতো মহামানবের জন্ম হতে পারে। চেতন পুরুষের জন্য সর্ব কাল-ই সমান। অচেতন ব্যক্তির জন্মের জন্য কালের অপেক্ষা প্রয়োজন। চেতন পুরুষ সর্বকালে, সর্ব পরিস্থিতিতে আসতে  পারেন। অচেতন  পুরুষ পরিস্থিতির  দাস।  চেতন পুরুষ পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে করে নেন। সময় তাকে অনুসরণ করে, তিনি সময়কে অনুসরণ করেন না। তিনি সময়ের পিছনে থাকেন না।  সময় তার পিছনে থাকে। এমন ভাবার কোনো কারন নেই যে খারাপ সময় না হলে তিনি আসবেন না। এই ধরনের ভাবনাটাই ভুল। খারাপ সময় মানে কি ? আমাদের পক্ষে, আমাদের মতো অ-সাধুদের পক্ষে, যারা নিজেদেরকে সাধু বলে ভাবতে চাই, এমন লোকের পক্ষে   খারাপ, সেই সময় শ্রীকৃষ্ণের মতো ব্যক্তিত্বের আগমন হয়। ব্যাপারতা আদৌ তা নয়। আমাদের প্রয়োজনে আদৌ শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন না। আমরা মনে করি, আমাদের রক্ষার জন্য, আমাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ভগবান আসেন।  তার জন্মকে আমরা অন্য ভাবে দেখি না, দেখতে চাই না। অর্থাৎ ভাবখানা এমন যেন, দেখ আমি কত গুরুত্বপূর্ণ, আমাকে রক্ষা করার জন্য ভগবান স্বয়ং এসেছেন। 
      
যদি বাগানে  গাছে ফল হয়, আমি ভাবি আমার জন্য হয়েছে। আমি তার আস্বাদন পেতে চাই।  বাগানে যদি ফুল ফোটে, আমি ভাবি, আমার জন্য ফুটেছে। যদি গন্ধ ছড়ায়, আমি তা গ্রহণ করি, আর ভাবি, আহা  কি সুন্দর গন্ধ। কিন্তু ফলের গাছ, বা তার ফল যে কোনো জায়গায় হতে পারে। ফুল আমার জন্য গন্ধ দেয়  না। আমি ফুলের গন্ধ উপভোগ করি  মাত্র। ফল আপন খেয়ালে ফলে, বীজকে সুরক্ষিত রাখার  জন্য। আমরা ভাবি আমার খাবার জন্য হয়েছে। এটা আমার বিচার মাত্র, বলা যায়, আমার স্বার্থে, আমি বিচারকে প্রভাবিত করি।একটা পিঁপড়েও আমার জন্য জন্মায় না।  এমনকি আমার সন্তানও আমার জন্য জন্মায় না। ফুল কারুর জন্য ফোটে না। নিজের জন্য ফোটে, অন্য কেউ তার গন্ধ পেতে পারে।  তাতে তার কিছু এসে যায় না। কৃষ্ণের মতো মানুষও কারুর জন্য জন্মায় না।  নিজের জন্য, নিজের আনন্দে জন্মায় , তাতে কারুর উপকার হতে পারে, কিন্তু তাতে তার কিছু এসে যায় না। এমন কোনো সময় আছে, এমন কোনো যুগ আছে, যখন কৃষ্ণ জন্মালে আমাদের উপকার হবে না? সব যুগেই কৃষ্ণকে দরকার। তারা সমস্ত যুগেই নিজের কাজে ব্যস্ত, আমরা ভাবি আমাদের জন্য এসেছেন, আমাদের জন্য করছেন। বিরাট শিশুরা আপন মনেই খেলে, আপন মনেই ভাঙে/গড়ে । আমরা কি ভাবে দেখছি, সেটা আমাদের ব্যাপার। দুঃখ ছিল না, এমন কোনো সময় নেই, দুঃখ থাকবে না এমন কোনো সময় হবে না। কৃষ্ণের মতো মানুষ সব যুগেই কাজে লাগবে। অসুর চিরকাল ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কৃষ্ণ এসেছিলো বলে সবাই শেষ হয়ে গেছে তা কিন্তু নয়। তারা আজও  আছে। মহাভারতের যুদ্ধের পরেও ছিল। কৃষ্ণ বর্তমান থাকতেই ছিল। শকুনির ছেলে উলুখা অর্থাৎ গান্ধারীর ভাই-এর ছেলে, বা দুর্যোধনের মামাতো ভাইতো ভীমকে শান্তি প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে, যুদ্ধে আহ্বান করেছিল। এসব তো মহাভারতের যুদ্ধের পরে।  আসলে সব সময়  সবই  থাকে। আমরা আসলে সবকিছু, আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। আমাদের কোনটা কাজে লাগবে আর কোনটা কাজে লাগবে না। আমাদের একটা সীমারেখা আছে।  আমরা সব কিছুর মধ্যে আমাদের উপযোগিতার কথা ভাবি। আমার কোনটা কাজে লাগবে আর কোনটা কাজে লাগবে না। যেটা আমার কাছে কাজে লাগবে না, তার কোনো মূল্য আমাদের কাছে নেই। কিন্তু, ভগবানকে উপযোগিতার মধ্যে খুঁজতে গেলে, তাকে পাওয়া যাবে না। সূর্য উত্তাপ দেয়  আপনার উপযোগিতার ভেবে নয়। এটা তার স্বভাব। মেঘ বৃষ্টি দান করে,  আপনার কথা ভেবে নয়।  এটা তার স্বভাব। বাতাস আপন মনে বয়ে চলে।  আপনি তার কাছ থেকে কি নেবেন, আর কি নেবেন না এটা আপনার বিষয়। মেঘ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির জল  মাঠের চাষের কাজে লাগাবেন, না আপনার তৃষ্ণা মেটাবেন এটা আপনার ব্যাপার। এতে  মেঘের কিছু এসে যায় না।  তাই একথা ভাবা ঠিক নয়, কৃষ্ণ আমাদের কারুর জন্য জন্মে ছিলেন।  তিনি না সাধুর না অসাধুর। তুমি তার কাছ থেকে কি পাচ্ছো, কি পাচ্ছো না সেটা তোমার ব্যাপার। মানুষ ভাবে, তার অহংকে কেন্দ্র করে। সে ভাবে, কৃষ্ণ জন্মায় আমাদের জন্য, ফুল ফোটে আমাদের জন্য, সূর্য কিরণ দেয় আমাদের জন্য। চাঁদের আলো আমাদের জন্য। মেঘের বৃষ্টি আমাদের জন্য। ব্যাপারটা উল্টো।  ওদের জন্য, অর্থাৎ সূর্যের জন্য, চাঁদের জন্য, মেঘের জন্য, নদীর জন্য, পাহাড়ের জন্য, সমুদ্রের জন্য আমরা বেঁচে আছি। ওঁরা  আমাদের জন্য আসেও না, যায়ও না। তাই কৃষ্ণ সাধুদের জন্য এসেছিলো, এর থেকে হাস্যকর কথা আর কিছু হতে পারে না। ভগবানের রসিকতা। আসলে মহাপুরুষের জন্মের বহু পরে তার সম্পর্কে লেখা হয়। তার কথা লেখা হয়। অনেক প্রচিলিত কাহিনী, কবি তার নিজের ভাষাতে লেখে।  ভগবানের মুখে সেই কথা গুলো বসায়, যা সে বিশ্বাস করে, যা সে ভগবানের কাছে পেতে চায়। তাই ভগবান কি বলেছিলো, এটা বড়ো কথা নয়, আমি ভগবানকে দিয়ে কি বলাতে চাই, ভগবানের কাছে কি শুনতে চাই, তাই ভগবানের মুখে বসাই। এতে অবশ্য ভগবানের কিছু আসে যায় না। ভগবান আপন খেয়ালে লীলা করেন। আমি যা দেখতে চাই, তাই দেখি, যা শুনতে চাই তাই শুনি। সূর্য উঠলে আপনি বাড়ী বসে আলো পাবেন, সেই আলো, সেই উত্তাপ আপনি কি ভাবে ব্যবহার করবেন, সেটা আপনার ব্যাপার।গরিবের ঘরেও যাবেন, বড়োলোকের  ঘরেও যাবেন। আপনি নিজেকে আড়াল করবেন কিনা সেটা আপনার ব্যাপার। তবে এটাও বলি ওই আড়ালও  তারই লীলা।  ভগবান কোনো বিরোধিতা করবে না, আবার সংগতও  করবে না। তার খেলা সে খেলবে। ভগবান কারুর জন্য আসেন না, কারুর জন্য আসা বন্ধও করেন না। পরিস্থিতি তাকে জন্মায় না।  তিনিই পরিস্থিতির জন্ম দেন।

পরিস্থিতির কথা যখন এলো, একটা কথা বলি, আমরা পরিস্থিতির দাস। সামাজিক পরিস্থিতি, পরিবেশ, ব্যক্তির  ব্যক্তিস্বত্বাকে বা ব্যক্তিত্বকে জন্ম দেয়।পরিবেশ মানুষকে খারাপ করে, পরিবেশ মানুষকে ভালো করে। পরিস্থিতি মানুষকে উন্নতিতে সাহায্য করে।এইসব  কথা  দুর্বলের ক্ষেত্রে  প্রযোজ্য। কৃষ্ণের মতো ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। কোনো পরিস্থিতিই কৃষ্ণকে জন্ম দিতে পারে না। কোনো পরিস্থিতিই  কৃষ্ণের জন্মের জন্য আবশ্যক  নয়। এমন কোনো পরিস্থিতিই নেই যা কৃষ্ণের মতো ব্যক্তির জন্ম দিতে পারে। কৃষ্ণ শুধু জন্মায়।  আর পরিস্থিতি তার পিছন পিছন যায়। কৃষ্ণ যখন জন্মায় তখন সমাজ তার পিছন পিছন চলে। কৃষ্ণ সমাজের পিছে চলে না। এটাই ভগবান আর সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য। মহাপুরুষ পথ দেখান, পথ তৈরি করেন।  আমরা পথের দাস, ওঁরা পথের  স্রষ্টা। আমরা পরিস্থিতির দোহাই দেই। ওঁরা পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে আনেন। আমরা পথ খুঁজি তাই কষ্ট পাই। আর ওঁরা যেখান দিয়ে যান সেটাই পথ হয়ে যায়। ওঁরা আনন্দে ঘুরতে বেরোন, আমরা উদ্দেশ্য নিয়ে ঘুরে বেড়াই।  তাই না পাবার  বেদনা আমাদের, ওনাদের ঘোরাতেই আনন্দ। তাই ভগবান সদাই আনন্দে থাকেন।  আমরা উদ্দেশ্যপূরণের ব্যর্থতা নিয়ে হতাশ, উনি বেড়ানোর আনন্দে মশগুল। ভগবানের জন্ম কার্যকারণের উর্ধে। ভগবান আমাকে পথ দেখিয়েছেন, মানে এই নয় যে উনি আমাকে পথ দেখাবার জন্য জন্মে ছিলেন, আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম, উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি পথের  সন্ধান চেয়েছিলাম, উনি বলে দিয়েছিলেন। উনি আমার জন্য পথে দাঁড়িয়েছিলেন তা নয়, উনি ছিলেন তাই বলে দিলেন।

চেতনা চিরকালই স্বাধীন।  তাকে কেউ বাঁধতে পারে না।  একটা গল্প শুনেছিলাম, এই গল্পটা বলি   : এক  জ্যোতিষী খুব নাম করেছে। সে নাকি যা বলে তাই খেটে  যায়। এক সন্দিহান  যুবকের মনে দুষ্ট বুদ্ধি এলো।  সে জ্যোতিষীকে মিথ্যা প্রমান করার জন্য শীতের রাতে, চাদরের মধ্যে একটা কুকুরের বাচ্চা  লুকিয়ে নিয়ে, গ্রামবাসীদের নিয়ে চললো জ্যোতিষীকে মিথ্যা প্রমান করবার জন্য। জ্যোতিষী বাড়ির ভিতরে ছিল। ছেলেটি বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করলো, আমি একটা বাচ্চা  নিয়ে এসেছি। বলুনতো বাচ্চাটা  মৃত না জীবিত। ছেলেটি ভেবেছিলো, জ্যোতিষী যদি বলে মৃত তাহলে, জীবিত কুকুরের বাচ্চাকে  বের করে দেখাবো।  আর যদি বলে জীবিত তাহলে, চাদরের মধ্যেই বাচ্চাটাকে  মেরে দেখাবে, যে বাচ্চাটি  মৃত। জ্যোতিষী কিন্তু মজার জবাব দিলো : বললো বাচ্চা  তোমার হাতে,তার প্রাণ ও তোমার হাতে। তোমার যা ইচ্ছা তাই করো। 

তাই জীবন আমাদের হাতে। আমি কি ভাবে বাঁচবো সেটা আমাদেরই ঠিক করে নিতে হবে। কৃষ্ণের মতো মহামানবের জীবন তো পুরোপুরি তারই হাতে। বাসনা থেকেই জন্ম। আমাদের জন্ম ভোগের জন্য। ভগবানের জন্ম ভোগাতীত। তিনি কাউকে বাঁচাবার জন্য জন্মান না।  হ্যাঁ কেউ যদি  বেঁচে যায়, সেটা আলাদা কথা। ফুল ফোটে আপন খেয়ালে।  হ্যাঁ আপনি  সুগন্ধ পান সেটা আলাদা কথা। মেঘ আপন মনে ভেসে বেড়ায়। নদী আপন মনে বয়ে যায়।  বাতাস আপন খেয়ালে চলে। সূর্য তার গতিপথে প্রতিনিয়ত চলছে। তার সকালও  নেই, সন্ধ্যাও নেই। আমরা কেবল সকাল-সন্ধ্যা দেখি। আমরা কারনের  জন্য বেঁচে আছি। আমরা ভালোবাসি, তারও  কারন আছে। আমরা কারন খুঁজি, তাই কারন দেখি। প্রকৃতি অকারনেই সব দিচ্ছে।  ভগবান অকারণেই আসছে, যাচ্ছে। আমরা আমাদের মতো কারন আরোপ করছি। যেদিন সব কারন ভুলে যাবো, সেদিনই ভগবান আসবেন।

ওং নমঃ শিবায়ঃ ।
ওং নমঃ শ্রী ভগবতে বাসুদেবায়ঃ।
ওঁং নমঃ মহাত্মা গুরুনাথায়ঃ।
ওম শান্তিঃ, শান্তিঃ, শান্তিঃ। ।
    

                   




       




Sunday 3 February 2019

মহাভারতে মহাদেব শিব স্তোত্র

মহাভারতে মহাদেব শিব স্তোত্র 

অনুশাসনপর্ব্ব :

চতুর্দশ অধ্যায় 

ভগবান বাসুদেবের পুত্র লাভের জন্য মহাদেবের আরাধনা 

যুধিষ্ঠির তার পিতামহকে অর্থাৎ ভীষ্মকে বললেন : হে পিতামহ আপনি সুর-অসুর-গুরু বিশ্বরূপ সর্ব্ব অন্তর্যামী ভূতপাবন ভগবান মহাদেবের নাম ও ঐশ্বর্য্য সমুদয় সম্যকরূপে অবগত আছেন।  আপনি যদি দয়াকরে, সেইসব অমৃতকথা সবিস্তর বলেন। 

ভীষ্ম বললেন, হে বৎস সেই দেবাদিদেব মহাদেবের গুনকীর্তন করা আমার সাধ্য নয়। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র ইত্যাদি দেবগনের  যিনি সৃষ্টিকর্তা, সে ভগবান সর্ব্বগত হয়েও সর্বত্র লক্ষিত হন না। তিনি প্রকৃতি ও পুরুষের অতীত, তাই ব্রহ্মাদি থেকে পিশাচ পর্যন্ত সকলেই তার উপাসনা করে থাকেন। তত্ত্বদর্শী যোগবিদ মাহর্ষিগনও কেবলমাত্র সূক্ষ্ম অথচ স্থুল অক্ষর-পর-ব্রহ্ম-স্বরূপ মহাদেবেরই চিন্তা করেন। ঐ আদি দেবাদিদেব প্রথমে আত্মতেজঃ প্রভাবে প্রকৃতি ও পুরুষকে নির্মাণ করেন। এবং তাদের দ্বারা প্রজাপতি ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করেছেন। জন্ম-মৃত্যু-জরা বশীভূত আমার মতো মানুষেরা কখনো সেই মহাত্মাকে জেনে, তাঁর গুন্-কীর্তন করতে পারে না। আমাদের মধ্যে বর্তমান, যদুকুলশ্রেষ্ট একমাত্র ভগবান, যিনি শঙ্খ-চক্র-গদাধারী সেই বাসুদেবই  তাঁর দিব্য চক্ষু দ্বারা, তাঁকে দেখতে পারেন।  এই মহাত্মা বাসুদেব, এককালে বদ্রিকাশ্রমে হাজার বছর যাবৎ সেই সনাতন মহেশ্বরের আরাধনা করেছিলেন। এবং সেই সর্বভুতেশ্বর জগৎব্যপ্ত মহেশ্বের প্রসাদে তাঁরই প্রিয়তম হয়েছেন। এই যোগেশ্বর প্রত্যেক যুগে পরম ভক্তি সহকারে, সেই চরাচর গুরু দেবাদিদেব মহাদেবের আরাধনা করে থাকেন। তাঁর প্রীতি সম্পাদন করে থাকেন।  এই বাসুদেবই কিছুদিন আগে, পুত্র লাভের  জন্য, সেই আদিদেবের আরাধনায় নিযুক্ত থেকে, তাঁর পরম ঐশ্বর্য্য প্রতক্ষ্য করেছেন।  সুতরাং  একমাত্র বাসুদেবই পারেন, সেই সনাতন মহাত্মার নাম, গুন্, ও  ঐশ্বর্যের সবিস্তর কীর্তন করতে। অতএব, হে ভগবান বাসুদেব, মহারাজ যুধিষ্ঠিরের এই অভিলাষ পূর্ন করো। পুরাকালে, ব্রহ্মযোনি মহাতপস্বী তন্ডি ব্রহ্মলোকে ব্রহ্মার নিকট ভগবান ভূতনাথের যে সহস্রনাম কীর্তন করেছিলেন, তুমি আজ এই বেদব্যাস সহ মহাত্মাগণ সম্মুখে সেই আনন্দময়, সনাতন, জ্ঞানস্বরূপ বিশ্বস্রষ্টা ভগবান ভূতনাথের মাহাত্ম কিন্তান করো।

ভগবান বাসুদেব বললেন, হে শান্তনু-তনয় ভগবান ভূতনাথের কাজ, তার গতি, তার আদি অন্ত, সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, তত্ত্বদর্শী মুনিগন  এমনকি ব্রহ্মাদি দেবতা পর্যন্ত জানতে বা বুঝতে পারেন না। তথাপি আমি এখন সেই যজ্ঞপতির সামান্যকিছু গুন্ কীর্তন করছি, আপনারা শুনুন।

এই বলে, ভগবান বাসুদেব, পবিত্রচিত্তে আচমন করলেন। তারপর বললেন, আমি আমার পুত্র শাম্বকে লাভ করবার জন্য যোগবলে ভগবান ভূতনাথের সাক্ষাৎ লাভ করেছিলাম। প্রথমে আমি আপনাদের  সেই কাহিনী বলবো, তারপরে, সেই পতিতপাবন ভূতনাথের নাম সমুদয় কীর্তন করবো।  আপনারা শুনতে থাকুন।

মহাবীর প্রদ্যুম্ন দ্বারা শম্বর-দৈত্য নিহত হবার বারো বছর পরে, একদিন, জাম্ববতী, রুক্মিনীর গর্ভজাত আমার পুত্র প্রদ্যুম্ন, চারুদেষ্ণ, সুচারু, চারুবেশ, যশোধর, চারুশ্রবা, চারুযশা, শম্ভূ প্রভৃতি পুত্রদের দেখে,পুত্র অভিলাষী হয়ে, আমার কাছে এসে বললো হে নাথ, আমাকে একজন আপনার মতো গুণবান, পরমসুন্দর, মহাবল পরাক্রান্ত পুত্র দেন করুন। এই ত্রিলোকে, আপনার অসাধ্য কিছু নেই, আপনি ইচ্ছে করলে লোকসমূদায় সৃষ্টি করতে পারেন। এর আগে আপনি বার বছর কঠোর ব্রত অনুষ্ঠান করে ভগবান পাশুপতির আরাধনা করেছিলেন।