Sunday 28 March 2021

পরের জন্মে কোন দেহপ্রাপ্তি হবে ?

 


পরের জন্মে কোন দেহপ্রাপ্তি হবে ?
পর্ব -১
এক ব্রহ্মচারী সাধুর সাথে আমাকে মাঝে মধ্যে কথা বলতে হয়। তিনি একসময় সংসার করেছেন।  তাঁর একটা মেয়ে আছে। এখন তিনি ব্রহ্মচারী। তার আশ্রমে প্রচুর দান আসে। সরকারি সাহায্যও নাকি পেয়ে থাকেন।  তিনি অনেক সমাজসেবামূলক  কাজও  করে থাকেন। ইনি দান-ধর্ম্মকে সর্বশ্রেষ্ট ধর্ম্ম বলে মনে করেন। ইনি তার শিষ্যদেরকে দান দেবার জন্য উৎসাহিত করে থাকেন।  বলেন : কি নিয়ে এসেছিলে ? যা কিছু পেয়েছো, তা এখন থেকেই পেয়েছো। খালি হাতে এসেছো, খালি হাতেই চলে যেতে হবে। অতএব দানধ্যান করে কিছু পুন্য সঞ্চয় করে যাও। 

এখন  প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কেউ খালি হাতে এসেছিলাম কিনা, বা আমাদের খালি হাতে যেতে হবে কি না। আসলে বিষয় সম্পত্তি আমরা কেউ নিয়ে আসিনি, এটা সত্যি, আবার এই বিষয়সম্পত্তি  আমরা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবো না,  এটাও সত্যি। কিন্তু আমি তো জন্মের পর থেকেই দেখছি, আমার বাপের অঢেল সম্পত্তি। আমার পূর্ব জন্ম যদি থেকে থাকে তবে আমি তো মনে করতেই পারি  যে এই অঢেল সম্পত্তি আমার পূর্ব  জন্মে অর্জিত হয়েছিল। আবার  যদি মনে করি, যে আজ  এই যে বিষয়সম্পত্তি আপনি আজ সংগ্রহ করছেন, এর কিছুই বিফলে যাবে না, এই বিষয়সম্পত্তি ভোগ করবার জন্যই আপনাকে আবার সেই পরিবারে জন্ম গ্রহণ করবেন, যেখানে আপনি বিষয়সম্পত্তি গচ্ছিত রেখে যাচ্ছেন। মানুষ যে গরিব বা ধনীর ঘরে জন্ম গ্রহণ করে থাকে এর মূল কারন এই বিষয়-সম্পদ সংগ্রহের প্রবৃত্তি। এই সিদ্ধান্ত  যদি আমরা মেনে নিতে পারি, তবে গরিব-বড়োলোক ঘরে জন্ম গ্রহণের একটা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে।   আপনি জানবেন, পাপ হোক বা পুন্য হোক, ভালো হোক বা খারাপ হোক,  কর্ম্ম যদি আমার হয়, তবে তার ফলও আমার। আর বলা হয়ে থাকে কর্ম্মফল ভোগবিনা নিস্পত্তি হয় না।   

 আসলে কিন্তু  কেউ আমরা খালি হাতে আসিনি, আবার কেউই খালি হাতে যেতেও  পারবো না। আমরা আমাদের পূর্বপূর্ব জীবনের সংস্কার নিয়ে এসেছি, আবার আমরা নতুন সংস্কার নিয়ে দেহ ত্যাগ করবো।এখন কথা হচ্ছে, এ জন্ম তো গেলো, পরের  জন্মটা আমার কেমন হবে। আবার কি আমি লেখক, শিল্পী, ডাক্তার, শিক্ষক হবো ? মহাত্মাগণ বলছেন, এটা নির্ভর করছে, আপনার নতুন সংস্কার ও সময়-পরিবেশ-পরিস্থিতির উপরে। 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যোগভ্রষ্ট ব্যক্তির ইহলোকে বা পরলোকে কোথাও বিনাশ নেই। কল্যাণকামী ব্যক্তি কখনো দুর্গতিপ্রাপ্ত হন না। এঁরা পুন্যকর্ম্ম হেতু, স্বর্গলোক প্রাপ্ত হন, এবং সেখানে দীর্ঘকাল বাস করবার পরে, ধনীর গৃহে অথবা জ্ঞানবান যোগীর কূলে জন্ম গ্রহণ করে থাকেন। (গীতা-৬/৪১-৪২)

আমরা লক্ষ করেছি,  ভগবান বুদ্ধ, মহাবীর, মীরাবাঈ এরা  সবাই রাজকুলে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। হ্যাঁ সব মহাপুরুষ যে রাজপরিবারে বা ধনীর গৃহে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, তা নয়, ধনীর গৃহে তারাই জন্মান, যারা পূর্বজীবনে ধনসংগ্রহ করেছিলেন, আর যারা পূর্বজীবনে জ্ঞান সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন, তারা  সেই পরিবেশেই জন্ম গ্রহণ করে থাকেন, যেখানে জ্ঞানের চর্চা করতে পারেন। আর যারা যোগ অনুশীলন করতে করতে দেহ ত্যাগ করেছিলেন, তারা সবাই যোগের পরিবেশেই বা সেই ধরনের পরিবারেই জন্মলাভ করে থাকেন। 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবার বলছেন, মানুষ মৃত্যুকালে যে-ভাব স্মরণ করতে করতে দেহত্যাগ করে, সে সেই ভাবে তন্ময়চিত্ত  থাকায় সেই ভাবই প্রাপ্ত হয়ে থাকেন । অর্থাৎ  যেমন চিন্তা নিয়ে দেহ ত্যাগ করেন, পরবর্তীতে সেইমতো দেহপ্রাপ্ত হন। (গীতা -৮/৬) 

এখন কথা হচ্ছে, আমি যে কি চিন্তা করবো, তার নিয়ন্ত্রক কে ? আপনি বলতেই পারেন, কেন আমিই তো চিন্তা করছি, তাই আমিই আমার চিন্তার প্রবর্তক, নির্ধারক, পরিচালক। কিন্তু এই "আমি"  যে কে তা কি আমরা জানি ? যাইহোক, প্রসঙ্গ পাল্টাবো না। ভবিষ্যতে আমার কোন ধরনের দেহ হবে, কোথায়,  কোন বংশে, কোন জাতিতে আমার জন্ম হবে সেই আলোচনাতেই থাকবো।   

এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি, কেউ কেউ  মনে করেন, চুরাশি লক্ষ যোনী পরিভ্রমের পরে, জীব মনুষ্যদেহ পরিগ্রহ করেছে। এখন মনুষ্যদেহ লাভ করবার পর, যদি সে পশুবৎ আচরণ করেন, বা পশুর প্রতি আসক্ত বা মোহ -সম্পন্ন হন, তবে তিনি  আবার পশুযোনিতে জন্মগ্রহণ করবেন । এই প্রসঙ্গে রাজা  ভরত-এর দৃষ্টান্ত  দেওয়া হয়।   কেউ বলেন,  একবার মনুষ্যদেহ লাভ করবার পর, আর তাকে পশুযোনিতে ফিরে যাবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। মনুষ্যদেহ ছেড়ে জীবাত্মা আবার মনুষ্য দেহেই অনুপ্রবিষ্ট হয়ে থাকে। তবে সংস্কার যদি পশুবৎ হয়, তবে তার আচরণের মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তির প্রকাশ ঘটবে। আমরা মনে করি, মানুষ কখনো পশুযোনিতে প্রবিষ্ট হতে পারে না। মানুষ আবার মানুষ হয়েই জন্ম গ্রহণ করবে।  তবে হ্যাঁ তার আচরণ, স্বভাব যেমন মনুষ্যচিত  হতে পারে, আবার পশুবৎ হতে পারে। আমরা তো চোখের সামনে দেখতেই পাই কতো মানুষ ঘৃণ্য জীবন বহন করছে।   

যাই হোক, এখন কথা হচ্ছে, আমাদের পরবর্তী জন্ম কেমন হবে। শ্রী প্রনাবন্দ বলতেন, প্রতিদিন মৃত্যুচিন্তা করবে। এই কথাটার একটা তাৎপর্য্য আছে। আসলে আমরা কেউ জানিনা, কখন আমরা মারা যাবো। আজ বেঁচে আছি, কালকের প্রভাতসূর্য্য আমরা দেখতে পারবো কি না তা আমরা জানি না। তাই দেহে যতক্ষন প্রাণ আছে, তার প্রতিটি মুহূর্তই খুব গুরুত্ত্বপূর্ন। মৃত্যুমুহূর্তের চিন্তা-ভাবনা আমাদের পরবর্তী শরীর প্রাপ্ত হতে সাহায্য করবে, পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করবে । তাই আমাদের মধ্যে যদি মৃত্যু চিন্তা থাকে, তবে আমরা অবশ্য়ই শুভ চিন্তায়, হিত  চিন্তায় সময় অতিবাহিত করবো।  তাতে করে, আমাদের ভবিষ্যৎ জীবন  অবশ্য়ই  উচ্চ তরঙ্গে প্রবাহিত হবে।  

স্বামীজী বলছেন, আমাদের পরিণত বয়সের ভাবধারা আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের ইঙ্গিত বহন করে থাকে। পরিণত বয়সে যারা মৃত্যুর সম্মুখীন হন, তাদের ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ দেহপ্রাপ্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়া যেতে পারে, । কিভাবে আপনি শেষ জীবন কাটাচ্ছেন, তার উপরে নির্ভর করছে আপনার ভবিষ্যৎ জীবনের দেহপ্রাপ্তির। আমরা যাকিছু করি, তা সে ভালো মন্দ যাই হোক না কেন, আমাদের সমস্ত কাজেরই একটা প্রভাব আমাদের অবচেতন মনের উপরে একটা ছাপ  ফেলে। আমরা দেখেছি, শেষ জীবনে বা বলা  যেতে পারে অবসর জীবনে বেরিয়ে আসে আমাদের মূল-ইচ্ছে, যা আমি সারা জীবনে পূরণ করতে পারিনি।  অর্থাৎ আমরা পড়াশুনা করেছি, চাকরি করেছি, এমনকি সংসার করেছি, অন্যের প্রভুত্ব  মেনে। সমাজের নিয়ম  মানতে গিয়ে আমাদের ভিতরের সুপ্ত ইচ্ছেগুলোকে কোনো গুরুত্ত্ব দিতে পারিনি।  কিন্তু অবসর জীবনে এসে, বা শেষ বয়সে এসে, আমাদের সেই মূল ইচ্ছে বা আমাদের ভিতরের প্রবণতাকে কার্যকরী করবার দিকে আমরা ঝুঁকতে পারি। এই সময়েই আমাদের মধ্যে ধর্ম্ম-জিজ্ঞাসা জেগে ওঠে, এই সময় আমাদের ঈশ্বর-পিপাসা জেগে ওঠে। তাই এই বয়সের অর্থাৎ ৬০ বা তার উর্দ্ধের বয়সের মানুষকে দেখে  তার আচরণের বিচার করলে একটা আভাস মিলতে পারে, তার পরজন্ম কেমন হবে। 

এই প্রসঙ্গে স্বামীজী  বলছেন, আমাদের সংস্কারগুলো থাকে আমাদের অবচেতন মনে। আর মানুষের চেতনার স্থিতি কোথায় অবস্থান করছে, সেই দিকে খেয়াল করলেই, অর্থাৎ আমাদের যে ছয়টি গ্রন্থিচক্র  আছে তার কোন চক্রে  তার মন ঘোরাফেরা করছে, সেটা খেয়াল করলেই, তার ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে একটা ধারণা আমরা পেতে পারি। 

এর আগে আমরা গ্রন্থিচক্র  সম্পর্কে যখন আলোচনা করেছিলাম, তখন আমরা জেনেছিলাম যে মন বলে আসলে কোনো বস্তু বা অঙ্গ  আমাদের শরীরে নেই। এই যে চিন্তা-ভাবনা আমাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত উদয় হচ্ছে, যাকে আমরা মনে কাজ বলে আখ্যা দিয়েছি,  এসব আসলে গ্রন্থিচক্রের মধ্যে যে রস অর্থাৎ হরমোন নিঃসৃত হচ্ছে তার  তরঙ্গ, বিদ্যুৎ তরঙ্গ। তাই যে গ্রন্থিচক্রের রসে  যখন তরঙ্গ আন্দোলিত  হয়, সেইমতো আমাদের চিন্তার ধারা প্রবাহিত হয়। 

আর এই গ্রন্থি চক্রগুলোর মধ্যে যেগুলো আমাদের শরীরের উপরের দিকে অবস্থান করে, তার  বেশিরভাগ গ্রন্থি চক্র  আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নিষ্ক্রিয় থাকে। কিন্তু নিচেরদিকের গ্রন্থিচক্রগুলো রস নিঃসরণ ক্ষমতা  বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে অধিক ক্রিয়াশীল হয়  আবার বয়সের শেষে স্বাভাবিক ভাবেই স্তিমিত হতে থাকে।  আর উপরের দিকের গ্রন্থিচক্র গুলোর মধ্যে রস নিঃসরণক্রিয়া  আমাদের আমাদের কিছু অভ্যাসের দ্বারা জাগ্রত করতে হয়, অর্থাৎ এইসব চক্রের হরমোন রসে স্পন্দন তুলতে হয় । আর আপনি উপরের দিকের চক্রগুলোকে যত  ক্রিয়াশীল করতে পারবেন, তত আপনার চিন্তার মধ্যে একটা উচ্চভাব ফুটে উঠবে। 

এই গ্রন্থি চক্রগুলো ক্রিয়াশীল হয় আমাদের জ্ঞানীন্দ্রিয়গুলোর সাহায্যে। অর্থাৎ চক্ষু-কর্ন-নাসিকা-জিহ্বা-ত্বক এর সাহায্যে। 
 
মূলাধার চক্র বা বরুন গ্রন্থি : আপনারা যারা ধ্যানের  অভ্যাস করেন, তারা জানেন, মূলাধারে আমাদের মনকে বেশিক্ষন রাখতে নেই। তার কারন হচ্ছে, এখানে আছে, মূত্রগ্রন্থি,(KIDNEY)  প্রজাপতি গ্রন্থি, - TESTIS কন্দর্পগ্রন্থি PROSTATE  GLAND,   মদন গ্রন্থি, COWPERS GLAND মাতৃগ্রন্থি বা OVARY রতি গ্রন্থি, মিথুন  গ্রন্থি।  আবার এই মিথুন গ্রন্থিতেই আছে,  এমনসব উপগ্রন্থি যা আমাদের শরীরের রক্ষাকারী জীবাণু উৎপাদন করে থাকে। তো আমাদের বরুন গ্রন্থি যদি সক্রিয় থাকে তবে মানুষ বৈষয়িক জগতে জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে থাকেন। এবং তাদের চিন্তাধারার মধ্যেও দৈহিক ও বৈষয়িক বিষয় ঘোরাফেরা করে। 
  
মনিপুর চক্র বা অগ্নিগ্রন্থি :  এখানে থাকে আমাদের প্লীহা, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয়। সূর্য যেমন আমাদের পৃথিবীর সমস্ত জীব, জন্তু উদ্ভিদকূলকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তেমনি আমাদের এই মনিপুরের অগ্নিতত্ত্ব আমাদেরকে সজীব করে রেখেছে।  এই অগ্নি প্রধান লোকেরা হন, তেজস্বী, উদ্দমী। এবং এদের চিন্তাধারার মধ্যেও দেহ ও বৈষয়িক বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। 

অনাহত চক্র  বা বায়ু গ্রন্থি :  বুকের মধ্যে আছে আমাদের ফুসফুস, হৃদযন্ত্র, এবং প্রাণকোষ নির্মাণকারী গ্রন্থি। আমরা জানি বায়ু আমাদের দেহের প্রধান রক্ষক ও পরিচালক। বায়ু গ্রন্থি  যাদের সক্রিয় থাকে তারা আত্মজয়ী বিশুদ্ধ স্বভাবের হয়ে থাকেন। এরা  সংসারে থাকলেও ঈশ্বরমুখী হন। 

আজ্ঞা চক্র বা অহং গ্রন্থি   অহং তত্ত্বের স্থান আমাদের ললাট প্রদেশ। আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের পরিচালন শক্তি নিহিত আছে, এই ললাট দেশে। মানুষের মধ্যে যখন জীবন-জিজ্ঞাসা জাগে, জানবেন তখন মানুষ আজ্ঞাচক্রে অবস্থান করছেন। এইসময় সাধনপথ, ধর্ম্ম পথ এদের সহায় হয়।  এরা  পরবর্তী জীবনেও এই সাধনজীবনে আগ্রহী হয়ে থাকে। এবং সেইমতো দেহ-পরিবার পিতা-মাতা  পেয়ে থাকেন।

এখন এই যে চেতনার স্থিতি অর্থাৎ আমি কোন ধরনের মানুষ, আমার ভাবধারা কি, আমার জীবনের উদ্দেশ্য কি, এই সম্পর্কে আমার ভাবনাগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়,  গ্রন্থির ক্রিয়ার উপরে। আর এই গ্রন্থিগুলো ক্রিয়াশীল হয় তখনই যখন আমরা গ্রন্থি সম্পর্কে মনোযোগী হই।   

এই যে ভবিষ্যৎ জীবনের ধারণা, এই ধারণার ব্যতিক্রম নেই তা নয়। তবে, সবার ক্ষেত্রেই পরিবেশ, পরিস্থিতি, সৎসঙ্গ প্রত্যেক মানুষকেই যে কোনো মুহূর্তে পরিবর্তন করতে পারে।  তাই জীবনের সর্বোচ্চ পর্যায় নির্ভর করে, বর্তমান জীবনের চিন্তা-ভাবনা থেকে। এবং বর্তমান জীবনের চিন্তা ভাবনায় পরিবর্তন এলে ভবিষ্যৎ জীবনেরও পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। 

তাই আমাদের যাদের বয়স হয়েছে, বিশেষ করে যারা ষাট বছর অতিক্রম করেছেন, তাদের চিন্তাধারায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনবার চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন, আপনার শেষ বয়সের চিন্তাই আপনার ভবিষ্যৎ জীবন গড়ে দেবে। ভবিষ্যতে আপনি কেমন পিতা-মাতা পাবেন, কেমন ঘরে জন্ম গ্রহণ করবেন, কেমন দেহ পাবেন, সবই নির্ভর করছে, আপনার আজকের মানসিক স্থিতির উপরে। ভুলে যান আগে আপনি কি চিন্তা করেছেন, কি কাজ করেছেন, আজ থেকে আপনি শুভ চিন্তায়, ঈশ্বর চিন্তায় অতিবাহিত করুন। আপনি কি করছেন, সেটা বড়ো  কথা নয়, আপনার মধ্যে কি ধরনের চিন্তার প্রবাহ চলছে সেটাই আপনার ভবিষ্যৎ  জীবন, ভবিষ্যৎ দেহপ্রাপ্তির কারন হবে।   

যেমন ধরুন, কারুর মন ঘোরাফেরা করছে, মূলাধারে - তো তিনি বলা যেতে পারে, নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ তার চিন্তার মধ্যে জৈবিকশক্তি বেশি ক্রিয়াশীল। দৈহিক চিন্তা, দৈহিক অস্তিত্ত্বই তার কাছে গুরুত্ত্বপূর্ন। এদের সাথে যদি আপনি কথা বলেন, তবে শুনবেন, তারা এই বয়সে এসে দৈহিক ভালো-মন্দের কথা বেশি ভাবছেন। আর বলবেন না দাদা, কালকে একটু বেশি খাওয়া হয়েছিল, আজ বোধহয়, প্রেসার-সুগার বেড়েছে। হাঠুতে ব্যথা, রাতে ঘুম হয় না। ইত্যাদি ইত্যাদি।  আর সত্যি কথা বলতে কি, এই বয়সে এসে সবারই শরীর একটা রোগের বাসা হিসেবে কাজ করে থাকে। এরা শরীর  সচেতন, শরীর নিয়ে সারাক্ষন চিন্তা করছেন,  ডাক্তার এদের নিত্যসঙ্গী। আত্মীয়-স্বজন, টাকা-পয়সা, বিষয়সম্পত্তি এইসব নিয়েই এরা সারাক্ষন চিন্তা করছেন। তার এই যে চিন্তা-ভাবনা, এই চিন্তা ভাবনা নিয়েই একসময় সে দেহ ত্যাগ করবেন ।  এবং পরবর্তী জীবনেও একটা গতানুগতিক জীবনেই তারা ফিরে আসবেন। এই ধরনের মানুষকে তামসিক চরিত্রের মানুষ বলা যেতে পারে। 

স্বাধিষ্ঠান চক্র : আমরা দেখেছি, কিছু মানুষ বৃদ্ধ বয়সেও প্রাণ শক্তি উচ্ছল।  এই বয়সেও তারা হৈচৈ করতে ভালোবাসেন। এমনকি এইবয়সে নতুন করে তারা সংসার পাততে পারেন। এদের মন স্বাধিষ্ঠান চক্রে  অবস্থান করে থাকে। এদের শরীর খারাপ থাকলেও, এরা প্রাণবন্ত। স্বামীজী বলছেন, এরা  ভবিষ্যৎ জীবনে প্লেয়ার, নেতা, এমনকি ভালো ব্যবসায়ী হতে পারেন। তবে এদের মধ্যে প্রাণশক্তির অর্থাৎ পঞ্চবায়ুর মধ্যে যদি অসাম্য থাকে, তবে এরা  পাড়ার মাস্তান, নীতিহীন কিন্তু শক্তিশালী পুরুষ হতে পারেন, পরবর্তী জীবনে। অর্থাৎ এরা যাকিছুই করুক না কেন, তার মধ্যে অদম্য প্রাণশক্তি কাজ করবে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে, পরবর্তী জীবনের পরিবেশ-পরিস্থিতির উপরে।

এখানে মন থাকলে মানুষ হয় রাগী, খিটখিটে, সব সময় অন্যের দোষ ধরতে ওস্তাদ, সবসময় একটা দাদাগিরি ভাব। সংসারকে এরা নিজের জমিদারি ভাবেন । কিন্তু সাহসী, ঝুঁকি নিয়েও কাজে উৎসাহী।  এরা অন্যদের জোরকরে  নিজের বশীভূত থাকতে বাধ্য করে থাকেন । স্বামীজী বলছেন, এরা  পরবর্তী জীবনে মিলিটারি, পুলিশ, হতে পারেন । পর্বত আরোহী, সমুদ্র যাত্রা করতে পারেন।  শিকারী অর্থাৎ সাহসী হবার সম্ভাবনা।

অনাহত চক্রে যাদের মন স্থিত, তারা হন কোমল স্বভাবের। এরা  সৃজনশীল শিল্পী।  এরা  অন্যায়কে সমর্থন করেন না, কিন্তু প্রতিবাদও করতে পারেন না, তারা ভিতরে ভিতরে কষ্ট  অনুভব করেন। এরা ভবিষ্যৎ জীবনে শিল্পী, সাহিত্যিক, সমাজসেবী হয়ে  করে থাকেন। শরীরে বায়ুর ভারসাম্যের অভাবে এরা হন, ছিঁচ কাঁদুনে, ভীতু। 

বিশুদ্ধ চক্র বা  : এরা হন বাকপটু, এদের মধ্যে পান্ডিত্য ও স্মৃতিশক্তি বেশি থাকে। পরজন্মে ইনি হতে পারেন, শিক্ষক, দার্শনিক, সাংবাদিক, বিজ্ঞানী। কিন্তু বায়ুশক্তির ভারসাম্যের অভাবে এরাই হন, সবজান্তা নির্বোধ, অহংকারী বাক্যবাগীশ। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

অকালমৃত্যু রোধের উপায় : তথ্যসূত্রঃ  খাদ্যনীতি এবং শিশুপালন-বিধি - শ্রীমৎ স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী 

অকালমৃত্যু রোধের উপায় - 
ঠাকুর থাকবে কতক্ষন, ঠাকুর যাবে বিসর্জন। (১)  পুনঃ প্রচার। 

অকালমৃত্যু প্রতিরোধের উপায় জানতে গেলে আমাদের আগে জানার দরকার, আমরা কতদিন বাঁচতে পারি। অর্থাৎ আমরা যে মনুষ্যদেহ পেয়েছি তা প্রাকৃতিক ভাবে কতদিন বেঁচে থাকতে পারে । জীবের যখন সুস্থ সবল সন্তানের জন্ম দেবার ক্ষমতা জন্মে জানবেন, তখনই স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি সমাপ্ত হয়েছে। অর্থাৎ তার দেহের বৃদ্ধিকাল সমাপ্ত হয়েছে। আর এই সময়কালকে ধরে একটা জীবের মৃত্যুকাল  বা আয়ু পরিমাপ করা হয়ে থাকে। তা সে জীবজন্তু বলুন, উদ্ভিদ বলুন, সবারই জীবনসীমা এই হিসেবে  পরিমাপ করা হয়ে থাকে। (ব্যতিক্রম হচ্ছে  ঔষধী উদ্ভিদ যা একবার মাত্র সন্তান অর্থাৎ ফুল-ফল-বীজের জন্ম দিয়ে মারা যায়।) সাধারনতঃ দেখা যায়, আমাদের যখন দেহবৃদ্ধি সমাপ্ত হয়, এর পরেও ৩-৫ বছর পরে আমরা পরিণত মনের অধিকারী হয়ে থাকি। আর দেহ বৃদ্ধির সময়কাল  থেকে ৫/৬গুন্ সময় এই দেহ জীবিত থাকতে পারে।
 ধরুন, একটা গরু ৪ বছর বয়সে সন্তান ধারনের ক্ষমতা লাভ করে, তো সেক্ষেত্রে গাভীর আয়ু হতে পারে ৪*৫/৬ অর্থাৎ ২০-২৪ বছর। আবার একটা বিড়াল ধরুন ১.৫ বা ২ বছরে সন্তান ধারনের ক্ষমতা অর্জন করে, তো সেক্ষেত্রে বিড়ালের আয়ু হতে পারে ১০-১২ বছর। একজন পুরুষের দেহ সম্পূর্ণ বৃদ্ধি পেতে অন্তত ২৪-২৫ বছর সময় লাগে অর্থাৎ পুরুষ  সুস্থসবল  সন্তানধারন করবার ক্ষমতা অর্জন করে থাকে ২৫ বছর বয়সে। আর পরিণত মনের অধিকারী হতে আরো তিন-চার বছর সময় লাগে।  তো সেই হিসেবে, একজন পুরুষের আয়ু হতে পারে, ১০০ থেকে ১২৫ বছর।  আবার একজন মহিলার মা হবার ক্ষমতা, দেহের সম্পূর্ণ বৃদ্ধি হতে অন্তত ১৮-২০ বছর লাগে, আর পরিণত মনের অধিকারী হতে ২১-২২ বছর সময় লাগে । সেইজন্য একজন মহিলার আয়ু হতে পারে ৯০-১১০ বছর। এই হিসেবে মানুষের গড় আয়ু ধরা হয়েছে ১০০ বছর। আমাদের বেদ-উপনিষদে আমরা দেখতে পাই, সুস্থদেহে জীবিতকাল ১০০ বছর থাকার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। 

ওঁং তৎ-চক্ষুর-দেব-হিতং পুরস্তাচ্ছুক্রমুচ্চরৎ।
পশ্যম শরদঃ শতং জীবেম শরদঃ শতং। 
শৃনুয়াম শরদঃ শতং প্রব্রবাম শরদঃ শতমদীনাঃ। 
স্যাম শরদঃ শতং ভূয়শ্চ শরদঃ সতাৎ।। 

হে দেবতাদের হিতকারী চক্ষুস্বরূপ আদিত্য,  তুমি শুদ্ধ-আলোক নিয়ে পূর্বদিকে উদিত হোচ্ছ।  তোমার প্রসাদে তোমারি মহিমাকে যেন  শতবছর  দেখি, আমরা যেন শত বছর বেঁচে থাকি। শত বছর তোমার কথা শুনবো, তোমার আজ্ঞা পালন করবো। শত বছর তোমার গুন্-কীর্তন করবো। শত বছর অ-দীন অর্থাৎ স্বাধীন হয়ে বাঁচবো। শত বছরের অধিক যেন এইভাবে বেঁচে থাকি।

এই যে বৈদিক প্রার্থনা এর থেকে বোঝা যায়, মানুষের আয়ু কম বেশি একশত বছর । আর এই বয়সের অর্থাৎ ১০০-১২৫ বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আমাদের দেশে বা বিদেশে যথেষ্ট সংখ্যক আছেন। যাইহোক, আমাদের এই স্থুল দেহ ১০০ থেকে ১২৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকবার কথা থাকলেও, আজ অধিকাংশ মানুষ তার আগেই দেহ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। যদিও আমাদের এই স্থুল দেহের লয় হলেও, আমাদের মানস  দেহের্ সমাপ্তি ঘটে না। মানসিক উন্নতির  ধারা আর স্থূল দেহের  পরিণতির ধারা সমবেগে ধাবিত হয় না। মানস শরীরের গতি তুলনামূলক ভাবে শ্লথ। ব্যক্তি ভেদে বা কর্ম্ম ভেদে বা ভাবনা চিন্তা ভেদে, এই মানসিক উন্নতির গতি ভিন্নতর। 

একটা কথা মনে রাখতে হবে, যে আমরা দেহ ধারণ করি, কর্ম্ম করবার জন্য। আর এই কর্ম্মের উৎপত্তি হচ্ছে আমাদের চিন্তা-ভাবনা। আর এই চিন্তা ভাবনার উৎপত্তি হচ্ছে আমাদের বাসনা-সংকল্প। আর এই বাসনা-সংকল্পের উৎপত্তি হচ্ছে ইচ্ছেশক্তি। আর এই ইচ্ছে শক্তি হচ্ছে বিশ্বশক্তির অংশ মাত্র। আমরা ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, যে মলিনতা প্রাপ্ত হয়েছি, অর্থাৎ খেলতে এসে যে ধূলি-কালি মেখেছি, তাকে ধৌত না করা পর্যন্ত,  আমরা  জন্ম মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হতে থাকবো।  একটা অজ্ঞান আচ্ছন্ন মুঢ় মন, একটা ইন্দ্রিয়াসক্ত মন, একটি পার্থিব বিষয়ে আসক্ত মন, যতক্ষন না পর্যন্ত প্রতিভাদীপ্ত হচ্ছে, মনে যতক্ষন না শুদ্ধতা আসছে, মনে যতক্ষন না পর্যন্ত দিব্য অনুভূতির স্ফূরণ ঘটছে, ততক্ষন আমাদের এই জন্ম-জন্মান্তরের ঘূর্ণিপাকে ঘুরে বেড়াতে হবে। স্বামীজী বলছেন, মনের  এই যে শম্বুকগতি তা দেখে আমরা অনুমান করতে পারি, এই সময়টা হাজার বছর বা তার বেশি হতে পারে। আর মানবমনের এই পরিণতি লাভের  জন্য ২/১ জীবন,  বা দুই একবার স্থূল শরীরে প্রবেশ করলেই ঈশ্বরের উদ্দেশ্য সফল হবে না। স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী বলছেন, আমাদের গড় আয়ু অর্থাৎ আমাদের এই পৃথিবীবাসের আনুমানিক সময় একহাজার বছর। তো এই ১০০০ বছর আমরা কেউ এক জীবনে সমাপ্ত করতে পারি না। এক স্থুল দেহে অবস্থানকালে যদি আমাদের ১০০ বছর হয়, তবে আমাদের অন্তত ১০টি স্থুলদেহ ধারণ করতে হবে। কারুর কারুর ক্ষেত্রে এটি ১৫-২০ বারও হতে পারে। আবার  যোগী পুরুষগন যোগের সাহায্যে স্থূল শরীরে অবস্থানকাল দীর্ঘায়ীত করে, জন্ম-মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনতে  পারেন। আবার নিজের মনকে বসে এনে জ্ঞান বৃদ্ধি করে, শুদ্ধ করে, সংযত চিত্তে নিজেকে উন্নততর করে সত্বর  পরিণতির দিকে ধাবিত হতে পারেন। যদিও একবার স্থুল দেহের মধ্যে প্রবেশ করলে, দেহের নাশ অবশ্যম্ভাবী জেনেও, দেহের আয়ুর হ্রাস-বৃদ্ধি সম্ভব। স্বামীজী বলছেন, এই স্বাধীনতাটুকু আমাদের আছে। অকালমৃত্যু কিন্তু অবশ্যম্ভাবী নয়।  যেকোনো কারণেই হোক, আমাদের শরীর যদি স্বল্পায়ু হয়ে যায়, তবে আমাদের বারবার ফিরে ফিরে আসতে  হবে। আর আমরা যদি দীর্ঘায়ু হয়ে, যথাযথ কর্তব্য করতে পারি, তবে সংসারে যাতায়াতের সংখ্যা কমে যাবে। তখন  আমরা সাংসারিক সুখ-দুঃখ-যন্ত্রনা, এমনকি জন্ম-মৃত্যু কালীন যে যন্ত্রণা তার  হাত থেকেও  রেহাই পাবো।

আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ধারণা  হচ্ছে, মানুষের মৃত্যুর উপরে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।  কবে আমাদের মৃত্যু আসবে তা আমরা জানি না। কিন্তু স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী বলছেন, এই ধারণা  সত্য নয়, অকালমৃত্যু রোধ করবার ক্ষমতা আমাদের সবার আছে। এমনকি শিশুর অকালমৃত্যু রোধ করবার ক্ষমতাও আমাদের আছে। হ্যাঁ যেটা নেই, সেটা হচ্ছে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর উপরে আমাদের কোনো হাত নেই। হিন্দু শাস্ত্রের মতে অকালমৃত্যু মুলে আছে আমাদের অশুভ কর্ম্মফল। আমরা বহু নির্দোষ প্রাণীকে কারনে  অকারনে হত্যা করে থাকি। এছাড়া আমার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত জীব-জন্তু-সমাজ-জাতি-পরিবেশ-রাষ্ট্র ইত্যাদির কর্ম্মফল আমাদের উপরে বর্তায়। এইসব কর্ম্মের যে প্রতিক্রিয়া, তাকে আমরা প্রতিহত করতে পারি না। তবে এটা  ঠিক, কথায় বলে, সাবধানের মার্ নেই।  তাই আমরা যদি সতর্ক থাকি, সাবধান থাকি, সময়মতো নিজের কর্তব্য কর্ম্ম সমাপ্ত করে থাকি, তবে অনেক দুর্ঘটনা থেকে আমরা রেহাই পেতে পারি। 

ঠাকুর থাকবে কতক্ষন, ঠাকুর যাবে বিসর্জন। (২) পুনঃ প্রচার। 

ভারতীয় যোগী-ঋষিগণ আমাদের আয়ু বৃদ্ধির প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের অনেক আগেই বলেছেন। মুনিঋষিগন বলছেন, আমরা প্রতি মিনিটে ১৫-বার শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া করে থাকি। এই হিসেবে ঘন্টায় ৯০০ বার, দিনে ২১৬০০ বার আমরা শ্বাস গ্রহণ  ও বর্জন করে থাকি । আর একটা কথা হচ্ছে, শ্বাস-প্রশ্বাসের দীর্ঘতা বা স্বল্পতা। অর্থাৎ স্বাভাবিক অবস্থায়, আমাদের শ্বাস যখন ভিতরে প্রবেশ করে, তখন তার দীর্ঘ হয় ১০ আঙ্গুল পরিমান। আর যখন আমরা স্বাস ছাড়ি তখন সেই প্রশ্বাসের দীর্ঘ হয় ১২ আঙ্গুল পরিমান। অন্যদিকে আমরা যখন উত্তেজিত হi, বা শারীরিক পরিশ্রম করি, তখন এই গতি অনেক দীর্ঘায়িত হয়। আমরা যখন গভীর নিদ্রাতে থাকি, তখন প্রশ্বাসের গতি হয় ৮০ আঙ্গুল পরিমান। এই হচ্ছে স্বাভাবিক গতি। এই হিসেবে আমাদের শরীরের ১০০ বছর  আয়ু নির্ধারিত হয়ে থাকে। এখন আমরা যদি অতিরিক্ত পরিশ্রম করি, আমরা যদি কারনে অকারনে উত্তেজিত হই, এমনকি আমরা যদি অতিরিক্ত ঘুমাই, বা অসংযমী হই, তাহলে আমাদের শ্বাসের যে দীর্ঘতা বা যত  আঙ্গুল শ্বাস-প্রশ্বাস, আমাদের ১০০ বাছরের জীবনে নেবার ও ছাড়ার কথা ছিল, তা আমরা হয়তো ১০০ বছরের অনেক আগেই নিঃশেষিত করে ফেলবো। ফলত আমরা তখন স্বল্পায়ু হয়ে যাবো। জানিনা ব্যাপারটা আমি আপনাদের বোঝাতে পারলাম কি না। 

প্রসঙ্গত একটা ঘটনার কথা বলি, ডাঃ ইন্দ্রনীল আইচ, একবার কৌতূহল বশত তার গুরুদেবকে ধ্যানস্থ অবস্থায় শারীরিক পরীক্ষা করেছিলেন। ডঃ আইচ তার  "ব্রহ্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞান" গ্রন্থে লিখছেন, 
 
"হঠাৎ খেয়াল করলাম, গুরুজীর বুক ও পিঠের  কোনো নাড়াচাড়া নেই। আপনি জানেন, যে আমরা যখন শ্বাস নিই তখন আমাদের বুক কিঞ্চিৎ চওড়া হয়, শ্বাস ছেড়ে দেওয়া মাত্রই বুক আগের আকৃতি ধারণ করে. কিন্তু গুরুজীর বুকে সেই ধরনের নাড়াচাড়া আমার চোখে পড়লো না। ব্যাগ থেকে স্টেথোস্কোপ বার করে গুরুজীর বুকে বসালাম। প্রায় ১০ মিনিট স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুকের শব্দ পরীক্ষা করবার পরে, নিশ্চিত হলাম যে উনি শ্বাস নিচ্ছেন, কিন্তু তা অত্যন্ত ঢিমে গতিতে। আমার হিসেবে মতো উনি এক একটা প্রশ্বাস নিচ্ছেন প্রায় তিন মিনিট সময় ধরে।  এর পরের তিন মিনিট শ্বাস বন্ধ  থাকছে, পরের তিন মিনিট ধরে তিনি অত্যন্ত ধীর গতিতে শ্বাস ছাড়ছেন।  অর্থাৎ ওনার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় লাগছে প্রায় ৯ মিনিট। ................ প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, যেকোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ এক-একটা breath cycle ৪ সেকেন্ডে সম্পন্ন করে।

এই ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, যোগীপুরুষগন তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াকে এতটাই ধীর গতিতে চালনা করেন, যে  দীর্ঘ সময় এতে তিনি ব্যায়  করেন। একটু ঘুরিয়ে বলতে বলা যায়, ডাক্তারবাবুর কথা অনুযায়ী, আমরা একবার শ্বাসক্রিয়া সম্পন্ন করি চার  সেকেন্ডে আর উনি সেই চার  সেকেন্ডের ক্রিয়াকে করছেন, ৯ মিনিট ধরে। দীর্ঘ জীবন লাভের এটাই ঋষিকথিত পথ।   
   
যাই হোক, আরো একটা ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের পরিমিত আহার, সহজ পাচ্য খাবার । বলা হয়ে থাকে যে আমরা সাধারণত যে পরিমান খাবার খাই তার এক-চতুর্থাংশ খাবারেই আমাদের শরীর সুস্থ রাখতে পারি।  আমাদের পেটে  যত  জায়গা আছে, তার মধ্যে কেবলমাত্র অর্ধেক জায়গা আমরা খাদ্য সামগ্রী দিয়ে পূরণ করবো, একচতুর্থাংশ জায়গা জল দিয়ে পূরণ করবো, বাকি একচতুর্থাংশ জায়গায় বাতাস থাকবে। কিন্তু আমরা অনেকেই এই নিয়ম মেনে চলি না। এর জন্য আমরা অনেক কারন দেখাই । না খেলে পরিশ্রম করবো কি করে ? ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার বেশিক্ষন যেমন আমাদের পেট খালি রাখা উচিত নয়, তেমনি, খাবার দেখলেই, বা যখন পেলাম তখনই খেয়ে নিলাম, এই ধরনের অভ্যাস ঠিক নয়। আবার সকালের দিকে আমাদের খাবারের পরিমান বেশি হওয়া উচিত। আবার বেলা পড়ে গেলে, বা রাতের দিকে হালকা খাবার, অল্প পরিমানে খাওয়া উচিত।  

আর একটা কথা হচ্ছে ঘুম।  ঘুমও আমাদের পরিমিত হওয়া উচিত। সুস্থ মানুষের ৬ ঘন্টা ঘুম যথেষ্ট।  যোগী পুরুষের ৪ ঘন্টা ঘুম যথেষ্ট। দিনে ৮ ঘন্টার  বেশি  ঘুম শরীরকে অকেজো, অলস করে দেয়। জীবনী শক্তি যেমন আমরা ঘুম থেকে সংগ্রহ করে থাকি, তেমনি ঘুম আমাদের জড়তা ডেকে আনতে  পারে। এই ব্যাপারটার দিকে আমাদের সদা সতর্ক থাকতে হবে। তবেই আমরা ১০০ বছরের আয়ু উপভোগ করতে পারবো। 

তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম, আমরা যদি ১০০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে চাই, তবে আমাদের পরিমিত আহার নিতে হবে, পরিমিত শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে, স্বাস্থ্যকর  সহজ  পাচ্য খাবার নিতে হবে, পরিমিত নিদ্রা উপভোগ করতে হবে, কাম-ক্রোধকে নিজের আয়ত্ত্বে রাখতে হবে, শ্বাসপ্রশ্বাসের অনুপাতের পরিমান ঠিক রাখতে হবে।  আর এর ব্যতিক্রম হলে আমাদের শরীর  ব্যাধিগ্রস্থ হয়ে পড়বে । আর এই অসংযমী - ব্যাধিগ্রস্থ শরীর শ্বাসের গতিকে অস্বাভাবিক ভাবে বাড়িয়ে দেবে, এবং আমাদের আয়ু হ্রাস পেতে থাকবে। একেই আমরা অকালমৃত্যু বলে থাকি। 

স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী একটা উদাহরনের দ্বারা আয়ু হ্রাসের রহস্যঃ বুঝিয়েছেন। বলছেন, ৩০ মিনিটে আমরা নিঃশ্বাস ত্যাগ করি ( ৩০*১৫*১২) ৫৪০০ অঙ্গুলি। আবার নিদ্রাকালীন সময়ে সেই আধাঘন্টায় নিশ্বাস ত্যাগ করি (৩০*১৫*৮০) ৩৬০০০ অঙ্গুলি। আমরা যদি অলসতা বশত অতিরিক্ত আধাঘন্টা ঘুমাই, তবে এই আধাঘন্টার জন্য (৩৬০০০-৫৪০০) /(১৫*১২) = দুই ঘন্টা পঞ্চাশ মিনিট। অর্থাৎ আধাঘন্টা বেশি ঘুমিয়ে আমি  প্রায় তিন ঘন্টার আয়ুক্ষয় হলো। এইজন্য বলা হয়ে থাকে যারা ভোর বেলা আলস্যের বসে ঘুমিয়ে থাকে তারা কখনো দীর্ঘায়ু হয় না। 

আমাদের যখন কঠিন অসুখ হয়, তখন আমাদের নিঃশ্বাসের দৈর্ঘ ৮০ অঙ্গুলি থেকেও বেশি হয়। যা বলা হয়ে থাকে নাভিশ্বাসের চেয়েও বেশি দীর্ঘ। শোকগ্রস্থ অবস্থায়, দীর্ঘশ্বাস আমাদের আয়ুক্ষয় করে থাকে।এই দীর্ঘতম নাভিশ্বাসেই একসময় আমাদের প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়। 

আমরা আগেই শুনেছি, আত্মহত্যা, দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, বা যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু বা যেকোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু এই নিয়মের অন্তর্ভুক্ত নয়।  এসবই অকালমৃত্যু আর এইসব অকালমৃত্যুর জন্য ব্যাষ্টিসমাজ ও সমষ্টি  সমাজ, রাষ্ট্রনায়ক  ইত্যাদির  অশুভ কর্ম্ম  দায়ী।  একে আপনি অদৃষ্ট বা নিয়তি বলতে পারেন। 

অতএব শুনলাম, আমাদের অসংযম, ও বাহ্যিক সংক্রমণ আমাদের শ্বাসের গতিকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করতে পারে। তেমনি আমরা  মুনি ঋষিদের দেওয়া যোগক্রিয়া অবলম্বনে আমরা আমাদের শ্বাসের গতিকে হ্রাস করতে পারি। আর যদি শ্বাসের গতি হ্রাস করতে পারি, তবে আমাদের জীবনের বা স্থূলদেহের আয়ু বৃদ্ধি হতে পারে। যোগীগণ শ্বাসপ্রশ্বাসের গতিকে ১২ থেকে নাবিয়ে ৮/৯ আঙ্গুল সহজেই করতে পারেন। আর সেই অনুপাতে, আমাদের আয়ু দুই তিন শতাব্দী বৃদ্ধি পেতে পারে। এইজন্য আমাদের ত্রৈলঙ্গ স্বামী, বাবা লোকনাথ, বাবাজি, গোবিন্দপাদ এমনিতর  ভারতের অনেক সাধু যোগী ২০০-৩০০ বছর বেঁচে থেকে নিজেদের স্থূল দেহের কর্তব্য সম্পাদন করে গেছেন ।  এমনকি তারা জন্ম-মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে সত্ত্বর ইশ্বরের সঙ্গে একাত্ত্ব বোধ করতে   পেরেছেন । এযুগেও এমন সাধু-যোগী দুর্লভ নয়। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি  ওম।  

তথ্যসূত্রঃ : উমাচল গ্রন্থাবলী - ৮ - খাদ্য-নীতি এবং শিশুপালন-বিধি - শ্রীমৎ স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী - অধ্যায় অকালমৃত্যু প্রতিরোধের উপায়,  পৃষ্ঠা - ৫৯ - আপনি ভাগ্যবান। "আমি" ভালো আছি সত্য কিন্তু "আমরা" কি ভালো আছি ? "আমি" - যাকে শশাঙ্ক শেখর বলা হয়, সে  যোগীও নয়,, মহারাজও নয়,, গুরুও নয়,, আচার্য্যও  নয় ।  পাঠক মাত্র,  বক্তা মাত্র।  মহাপুরুষদের  অমৃতকথা শুনতে ভালো লাগে তাই নিজেকেই শোনাই। ঈশ্বর সবাইকে ভালো রাখুন, এই কামনা করি ।

আত্মা চলে গেলে দেহের নাশ হয়, না দেহের নাশ হলে আত্মা দেহত্যাগ করে ?

        
















                          


Saturday 27 March 2021

জীবন রহস্যঃ THE SECRET OF LIFE

 


জীবন রহস্যঃ 
THE SECRET OF LIFE 
শশাঙ্ক শেখর শান্তিধাম 

জীবন রহস্যঃ THE SECRET OF LIFE (১)
দুশ্চিন্তাহীন  জীবন

দুশ্চিন্তা কথাটার সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। দুশ্চিন্তার কুফল সম্পর্কেও আমরা উপলব্ধি করতে পারি।  কিন্তু কথা হচ্ছে, এই দুশ্চিন্তাকে আমরা পরিহার করতে পারি না। আমরা ভাবি দুশ্চিন্তা ত্যাগ করবো কি করে ? দেখুন দুশ্চিন্তা নিয়ে আমরা কেউ জন্ম গ্রহণ করি না। একটি শিশু যখন জন্ম গ্রহণ করে, তখন তার মাথার মধ্যে কোনো দুশ্চিন্তা থাকে না। ধীরে ধীরে আমরা দুশ্চিন্তা নামক বস্তুটিকে গ্রহণ করে থাকি। জন্মের পর থেকে আমরা যেমন ধীরে ধীরে বাহ্যিক জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান সংগ্রহ করে থাকি, তেমনি দুশ্চিন্তাও আমাদের অজ্ঞাতসারে আমরা গ্রহণ করে থাকি। দুশ্চিন্তার অভিধানগত অর্থ হচ্ছে অশুভ চিন্তা, দুর্ভাবনা, কুচিন্তা। আমাদের মনের মধ্যে যে আবেগ তৈরী হয়, তা মূলত আসে, তিনটে কারনে, ১) হতাশা, ২) আশঙ্কা, ৩) দূর-ভাবনা থেকে। আর এই তিনের কারন হচ্ছে ভয়, ও অজ্ঞান থেকে। ভবিষ্যৎ আমাদের কাছে, অজানা, আর বর্তমান আমাদের কাছে ভয়ের।  

চারিদিকে বৈষম্য। একই পৃথিবীতে কেউ চোদ্দ তলার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে আছেন, কেউ ফুটপাতে আছেন। কেউ মন্ত্রী সান্ত্রী, কেউ বা মানুষের তৈরি জেলের খুপরিতে বসে কাঁদছেন। কেউ ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছেন , কেউ আস্তাকুড়ে খাবার কুড়োচ্ছেন। কেন এমন হয় ? আমরা কি ভাগ্যের দাস ? আমরা কি পূর্ব-পূর্ব জীবনের কর্ম্মফল ভোগ করছি ? নিয়তিকে অতিক্রম করবো কি করে ? আমরা কি নিজেদেরকে একটু ভালো রাখতে পারি না ?

আমরা সবাই ভালোভাবে বাঁচতে চাই। তা ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র জীবকোষ থেকে শুরু করে, মনুষ্য পর্যন্ত। আমরা সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চাই। আমরা আমাদের শারীরিক সুস্থতা চাই। আমরা বংশ বিস্তার করতে চাই।   আমরা রাতে শান্তিতে ঘুমুতে চাই। আমরা দুশ্চিন্তাহীন মুক্ত জীবন চাই। আমরা ব্যক্তি-স্বাধীনতা চাই। আমরা আত্মবিশ্বাসী হতে চাই। আমরা প্রাচুর্য্যের মধ্যে দিন কাটাতে চাই। চাই তো অনেক কিছু, কিন্তু পাবো কেমন করে ? আজ থেকে আমরা সেই আলোচনাগুলো শুনবো। 

এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে, আমাদের জানতে হবে  আমি কে ? কেন এসেছি এই পৃথিবীটিতে ? এই মনুষ্য দেহ ধারনের কারনই বা  কি ? এই জীবন নিয়ে কি করবো ? শুধু সুখে-দুঃখে  সংসার করবো, আর দুই দিন পরে, কবরে চলে যাবো, অথবা অগ্নিতে দগ্ধ হবার জন্য এই মানুষ্য দেহ ? 

প্রথমতঃ আমি কে ? 

আমাকে যদি বিষশ্লেষন করি, তবে আমরা তিনটে জিনিস পাই. দেহ, মন ও আত্মা । দেহ স্থুল পদার্থ, মন সূক্ষ্ম পদার্থ, আর আত্মা হচ্ছে  শক্তি।  একটা শক্তি যা দেহ ও মনের সাহায্যে কাজ করে থাকে, তাকেই বলা হয়ে থাকে "আমি" ।. 

আমি একটা দেহ। দেহ একটা ধারাবাহিক মরণশীল প্রক্রিয়া। যা স্বল্পস্থায়ী কিছু কোষের সমষ্টি। প্রতিদিন আমাদের দেহের অসংখ্য  কোষ জন্মাচ্ছে, আবার মারা যাচ্ছে।  এই দেহ এসেছে আমার মায়ের কাছ থেকে। মা পেয়েছেন  পিতার কাছ থেকে।  মায়ের পেটে বিন্দু থেকে ধীরে ধীরে এই দেহের বা জন্মদাতার  আকৃতি পেয়েছি "আমি"।  পিতা এই শক্তি বা বিন্দু   পেয়েছেন  খাদ্য থেকে।  আমি  যখন কিছু খাচ্ছি  তখন সেটি আমি হয়ে যাচ্ছি। ভাত, ডাল , সবজি, ফলফলাদি যা কিছু খাচ্ছি তখন সেটি কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি হয়ে যাচ্ছে। তো প্রকৃতির কাছ থেকে এই দেহ পুষ্টি লাভ করছে, এবং বেঁচে বর্তে আছে। আমি যে নাক দিয়ে বাতাস সংগ্রহ করছি, সেটিও কিছুক্ষনের মধ্যে আমি হয়ে যাচ্ছে, আমার সমস্ত শরীরের মধ্যে একটা বাতাসের প্রবাহ চলছে। তো খাদ্য, বায়ু ও তেজের সাহায্যে দেহের মধ্যে যে কোষসমষ্টি সেগুলো ক্রিয়াশীল থাকছে, । অদ্ভুত এই দেহখানা।  যখন আমি নিজে থেকে কিছুই  করতে পারতাম না. অর্থাৎ শিশু অবস্থায়, বা মায়ের গর্ভে ছিলাম,  তখনও আমার এই দেহ বৃদ্ধি ও রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন, কেউ না কেউ ।  এখনো আমাদের শারীরিক এমন অনেক ক্রিয়া আছে, যা স্বয়ংক্রিয়। এর জন্য আমাদের কিছু করতে হয় না। আমরা দেখি, শুনি, স্পর্শ নেই, এর জন্য আমাদের কিছু করতে হয় না।  আমরা হজম করি, স্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া করি, মল-মূত্র ত্যাগ করি, এর জন্য আমাদের আলাদা কিছু করতে হয় না।  এইসব ক্রিয়া স্বাভাবিক ভাবেই হয়।  ভাবতে অবাক লাগে, অদ্ভুত এই দেহ কি নিখুঁদ ভাবে তৈরী করেছেন সৃষ্টিকর্তা। 

আবার অন্যদিকে থেকে দেখতে গেলে, এই দেহের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। দেহ ভান্ডার  অতিরিক্ত তাপ, অতিরিক্ত ঠান্ডা   সহ্য করতে পারে না। পৃথিবীর ছেড়ে বাইরে যেতে পারে না। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তাকে টেনে নামায়। এই দেহের একটা গতিমুখ আছে, এই দেহ ধীরে ধীরে শিশু থেকে বৃদ্ধে পরিণত হয়, কখনো বৃদ্ধ থেকে শিশু হয় না। অর্থাৎ দেহের একটা স্বাভাবিক গতিপথ আছে। এই জায়গাটা আমাদের বুঝতে হবে, ধরতে হবে। আমার দেহের একটা ক্ষমতা আছে, বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের  একটা নির্দিষ্ট জায়গায়, একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, একটা নির্দির্ষ্ট পরিবেশে সে তার অস্তিত্ত্বকে ধরে রাখতে পারে, তার বাইরে গেলে, তার অস্তিত্ত্বের বিলোপ সাধন হয়। তো এই ক্ষমতা ও পরিধিকে আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের যে ইন্দ্রিয়গুলো  আছে, সেগুলোর একটা নির্দিষ্ট ক্ষমতা আছে, বেশি কাছের জিনিস সে দেখতে পায়  না, বেশি দূরের  জিনিস সে দেখতে পায়  না। আস্তে শব্দ হলে, সে শুনতে পায়  না। এমনকি বেশি জোরে শব্দ হলেও  সে শুনতে পায় না। পেটের একটা নির্দিষ্ট ক্ষমতা আছে, ইচ্ছে হলেই অতিরিক্ত খাদ্য সে খেতে পারে না। শ্বাস প্রশ্বাসও একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় প্রবাহিত হয়।  তো প্রকৃতির তৈরী এই দেহের সীমাবদ্ধতাকে আমাদের বুঝতে হবে। তবেই আমরা দেহের ক্ষমতার পরিমাপ করতে পারবো, এবং দেহের ক্ষমতার সত্ব্যবহার করতে পারবো। অতিরিক্ত পরিশ্রম করলে যেমন আমাদের শরীর টিকবে না, তেমনি কোনো মানুষ শুয়ে বসে সারা জীবন কাটাতে পারবে না, তাতেও সে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তো এই তুল্যমূল্য ব্যাপারটা বুঝতে হবে।  

আমার এই দেহের মধ্যে আছে একটা মন, সে সারাক্ষন ইন্দ্রিয়ের সংস্পর্শে এসে বাহ্যিক জগতের সঙ্গে একটা সম্পর্ক অনুভব করছে, চিন্তা করছে। এই যে চিন্তা, এটাও আমি, এই যে ভালো-মন্দের অনুভব এটাও আমি । আমরা লক্ষ করেছি, আমরা যখন খাদ্য সংগ্রহ করতে না পারি, বা বাতাস সংগ্রহ করতে না পারি, তখন আমাদের মন ম্রিয়মান হয়ে পড়ে, বা চঞ্চল হয়ে পড়ে  । অর্থাৎ খাদ্যের সঙ্গে, বাতাসের সঙ্গে  মনের একটা সম্পর্ক আছে। এমনকি আলো-সূর্যকিরণ-এর সঙ্গেও আমাদের মনের সম্পর্ক আছে। মেঘলা দিনে আমাদের মন খারাপ হয়।  অন্ধকারে আমাদের মনের মধ্যে একটা ভয়ের আবহ তৈরী হয়। তো খাদ্য-বায়ু-তেজ দ্বারা প্রভাবিত হয় আমাদের মন। তাই মন সূক্ষ্ম বস্তু। এই মনের নির্দেশেই আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাজ করে থাকে। শরীরের যাবতীয় কর্ম্ম এমনকি প্রেম-ভালোবাসা-ভয়-আত্মোপলব্দ্ধি, জ্ঞান-আহরণ ইত্যাদি  মনের নির্দেশেই  হয়ে থাকে। সংকীর্ণ-অজ্ঞান-ভীতু মন আমাদের অনেক কাজ থেকে বিরত রাখে । আমরা যেমন ইচ্ছে করলে, যা ইচ্ছে তাই চিন্তা করতে পারি, তেমনি, আমাদের মতো সাধারণ মানুষ ঈশ্বর সম্পর্কে, ব্রহ্মান্ডের ব্যাপকত্ত্ব সন্মন্ধে এমনকি  আকাশের অসীমত্ত্ব সম্পর্কেও  চিন্তা করতে পারি না।  এখানেই  মনের সীমাবদ্ধতা।    

আবার আমি যে জ্ঞান সংগ্রহ করছি, এটাও আমি।   যে আনন্দ আমার মধ্যে অনুভব হচ্ছে সেটাও আমি। এগুলো সবই দেহ, বা দেহের কাজ। এগুলো মিলে আমার মধ্যে একটা শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে, সেটাও আমি। এই শক্তিকেই বলা হয়, আত্মা। আর সমস্ত শক্তি বা সমস্ত আত্মাকে মিলিত ভাবে বলা হয়ে থাকে  বিশ্বশক্তি বা পরমাত্মা ।  

কেন এসেছি এই পৃথিবীতে ?

একটা কথা মনে রাখবেন, সৃষ্টিকর্তা  আমাদের সবাইকে এক একটা ছোট্ট সৃষ্টিকর্তা  হিসেবে তৈরি করেছেন। পিতা-মাতা যেমন তাদেরই আকৃতি দিয়ে পুত্র-কন্যার জন্ম দেন। ঈশ্বরও  তেমনি ঈশ্বরের আকৃতি দিয়ে আমাদের তৈরী করেছেন। আপনি আসলে একজন মূর্তিমান ঈশ্বর। আপনার মধ্যে কোনো ত্রূটি  নেই। আপনার  জীবনে অসন্তোষ আসে   তার কারন হচ্ছে, আপনার মধ্যে যে  সৃজনশীল ক্ষমতা  আছে, যা ঈশ্বর প্রত্যেক জীবের মধ্যে  মধ্যে বপন করে  দিয়েছেন, সেটাকে আমরা খুঁজে পাই না, বর্ধিত করতে পারি না। প্রকৃতি তার পুষ্টি দিয়ে, আমাদের শরীরটাকে বাঁচিয়ে রাখে, দিন দিন বড়ো করে তোলে। আর এই পুষ্টিকর বস্তু আমাদেরই সংগ্রহ  করতে হয়। ঠিক তেমনি  আমাদের অন্তরাত্মাকেও জ্ঞানরূপ পুষ্টি দিয়ে শুদ্ধ বা পবিত্র  করবার জন্য আমাদের জন্ম। আমরা এই উদ্দেশ্যকে ভুলে যাই। 

জীবন ঈশ্বরের অংশ। ঈশ্বরের মধ্যেই জীবন লালিত পালিত হচ্ছে। এই সত্যকে শ্রদ্ধা করুন। ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে নিজেকে এক করে দেখুন। আপনার যে শক্তি তা ঈশ্বরের শক্তি। আপনার স্বাধীনতা আছে, এই সত্যকে অস্বীকার করবার, আবার এই সত্যকে স্বীকার করবার স্বাধীনতাও আপনার মধ্যে আছে । নদীতে মরা ভেসে থাকে, জ্যান্ত নদীতে ডুবে যায়।  কারন মরা স্রোতের সঙ্গে লড়াই করে না, জ্যান্ত স্রোতের সঙ্গে লড়াই করে । আপনার মনটাকে দিগন্তে বিস্তার করুন, আর যত সংস্কার আছে আপনার ভিতরে, যত  অজ্ঞান আছে আপনার ভিতরে সেগুলোকে ধুয়ে মেজে পরিষ্কার করুন। তাহলে আসল আমিকে দেখতে পারবেন। জীবনের উদ্দেশ্যকে খুঁজে পাবেন। আপনি পৃথিবীতে এসেছেন ভালো কিছু করবার জন্য। আপনাকে সেই ভালোর জন্য সৃজনশীল কিছু করতে হবে। 

প্রথমেই একটা কথা বলি, আপনি জন্ম গ্রহণ করেছেন, সাফল্যের শিখরে পৌঁছবেন বলে। যারা বলে থাকেন  এটি সম্ভব নয়, তারা ঈশ্বরের ইচ্ছে, ঈশ্বরের ক্ষমতা সম্পর্কে অজ্ঞ। আপনিও যদি অসম্ভব ভাবেন, তবে জানবেন, আপনিও ঈশ্বরের ক্ষমতা সম্পর্কে ভুল ধারণা  করে বসে আছেন। সাফল্যের চরম শিখরে তারাই পৌঁছুতে পারে, যারা কুদরত কি কানুন, বিধির বিধান  সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আমরা সবাই  ভগবানের রাজত্বে বাস করি, আমরা সবাই কোনো না কোনো রাষ্ট্রে বাস করি। কারুর না কারুর অধীনে বাস করি।   যারা ভগবানের রাজত্বে বাস করেন , আর ভগবানের আইন মেনে চলেন , তারা সব কিছু সহজেই পেতে পারেন । যারা রাষ্ট্রের আইন মেনে চলে, তারা সহজেই শান্তিতে ঘুমুতে পারেন । 

ভগবান সবার মধ্যে বিশেষ বিশেষ গুন দিয়ে পাঠিয়েছেন। আপনার আমার  ভিতরেও  সেই প্রতিভা-বীজ সুপ্ত আকারে আছে। আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে, এই বীজের অনুসন্ধান করা। তারপর  সেই  প্রতিভাকে লালন-পালন করে, জাগিয়ে তোলা। আর এই প্রতিভাকে জাগিয়ে  তুলতে গেলে আমাদের মনের সাহায্য নিতে হবে। সেক্ষেত্রে যদি আপনি প্রস্তুত থাকেন, তবে এই জ্ঞান অস্ত্রের সাহায্যে আপনার এই মনুষ্য জীবনকে  সাফল্যের শিখরে নিয়ে যেতে পারবেন ।

ভগবান বলছেন, মানুষ নিজেই নিজের শত্রূ আবার নিজেই নিজের মিত্র। প্রকৃতি যেমন দেহকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করছে, ঠিক তেমনি, আমাদের মন আমাদেরকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করছে। আর তাই আমরা যাকিছু ভাবছি, যা কিছু চিন্তা করছি, সেই মতো কার্য্যে লিপ্ত হচ্ছি, সেইমতো কর্ম্মফল ভোগ করছি। নিজেই নিজের জন্য একটা কৃত্তিম সুরক্ষার বেড়াজাল তৈরী করছি। আর সেই বেড়াজালের মধ্যে নিজেই স্বেচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে আটকে  রাখছি, বন্দি হচ্ছি । এর পরের দিন আমরা শুনবো, কিভাবে আমরা আমাদের মানুষ্য জীবনকে সফল করে তুলবো। না মৃত্যুর পরে কি হবে, কেমন থাকবো, সেই কাল্পনিক দিনগুলোর কথা নয়, এই জীবনেই আমরা কি করে সফলতা পাবো, সেই সম্পর্কে শুনবো।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  

----------------- 

জীবন রহস্যঃ THE SECRET OF LIFE (2) নিজের ভাগ্য নিজেই গড়ুন। 

ছোট্ট একটা জীবন। 

৮০ থেকে ১০০ বছরের এই জীবন। পন্ডিতগণ বলছেন, বর্তমানে কষ্ট করলে ভবিষ্যতে  ভালো থাকবে। ধর্মগুরুগন  বলছেন, এই ক্ষুদ্র জীবনের পরে আরো বিশাল জীবন আছে, সেখানে তোমাকে ভালো থাকতে হবে। তাই দান  ধ্যান করো। রাজনীতিবিদগণ বলছেন, তোমার জীবনের চাইতে দেশ বড়ো। কেউ বলছেন, তোমার জীবনের চাইতে আদর্শ বড়ো। নেতাজি  বলেছিলেন, আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। অর্থাৎ তোমার বর্তমান জীবনের চাইতে ভবিষ্যতের জীবন ভালো। তোমার জীবনের চাইতে দেশের স্বাধীনতা বড়ো। কিন্তু দেশ স্বাধীন হলেও, নেতাজি স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিলেন কি না জানিনা। কেউ জীবন দিয়ে সন্তানকে বাঁচাতে চাইছেন। কেউ জীবন দিয়ে সম্পত্তিকে বাঁচাতে চাইছেন। সবাই জীবন দান  করতে বলছেন, কেউ জীবনকে বাঁচাতে চাইছেন না।  জীবনকে তারা মূল্যবান বলে মনেই করছেন না। আর যদি তুমি বেঁচেও থাকো, তবে বর্তমানে সবকিছু ত্যাগ করো, তবে তুমি ভবিষ্যতে ভালো থাকবে। আর সেই ভবিষ্যৎ কোনো দিনই আসে না। কাল কখনো আজ হয় না। এই ত্যাগ করতে করতে জীবনের শেষে এসে বুঝি, সবই বৃথা। জীবন চলে গেলে, স্বাধীনতা দিয়ে কি হবে, জীবন চলে গেলে দেশ দিয়ে কি হবে, জীবন চলে গেলে আদর্শ দিয়ে কি হবে, জীবন চলে গেলে ছেলেমেয়ে দিয়ে কি হবে, জীবন চলে গেলে সম্পত্তি দিয়ে কি হবে ? আপনি কি বলতে পারেন, স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়ে ক্ষুদিরাম কি পেয়েছেন। আপনি কি বলতে পারেন, হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামীর ত্যাগের ফলে  তাঁরা নিজেদের জন্য  কি পেয়েছেন ?  তাই আমরা চাই একটা সফল জীবন। শুধু ত্যাগের মধ্যে জীবন নেই, জীবন আছে দেওয়া নেওয়ার মধ্যে। দিবে আর নিবে মেলাবে মিলিবে। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, যারা শুধু দিলে পেলে না কিছুই।এই জীবন আমরা চাই না, যেখানে শুধু  দিতে হয়, পায়  না কিছুই।   আমরা চাই সেই জীবন, যেখানে কোনো দুঃখ কষ্ট  থাকবে না।  জীবন হবে আনন্দপূর্ণ। জীবন হবে আরো বেশি উপভোগ্য। আরো বেশি চনমনে। জীবন হবে সৃষ্টিধর্ম্মি। জীবন হবে সবুজের মধ্যে রঙ্গিন ফুলের মেলা। জীবন হবে একটা খেলার ময়দান, যেখানে হার বা  জিত দুইয়ের মধ্যেই আনন্দ থাকবে। জীবন হবে দ্বন্দ্বহীন। জীবন যুদ্ধের জন্য নয়। জীবন শান্তির জন্য। 

 অসফল জীবন মৃত্যুসম।  প্রত্যেকের  জীবনে সফলতা কাম্য।  কিন্তু জীবনে সফলতা বলতে আমরা কি বুঝি ? সফলতা বিভিন্ন মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম। কেউ গণ্য-মান্য লোক হতে চায়, কেউ আবার ধনবান  হতে চায়। কেউ আদর্শ নিয়ে বেঁচে থাকতে চান, তো কেউ সমৃদ্ধির মধ্যে বেঁচে থাকতে চান। আমার এক শিক্ষক বন্ধু যখন তার মেয়েকে শিক্ষকের কাছে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তখন তার স্ত্রী প্রবল বাধা দিয়েছিলেন, তিনি তার মেয়েকে সরকারি অফিসার-এর  কাছে বিয়ে দেবার  জন্য চাপ দিতেন। তো কেউ দারিদ্রতার মধ্যেও আদর্শ জীবন যাপন করতে ভালো বসেন আবার কেউ আবার এইসব ঠুনকো আদর্শের গুরুত্ত্ব দিতে চান না। 

বিশেষজ্ঞগণ সাফল্য ও অসাফল্যের কারন হিসেবে বলছেন, সফল মানুষ জানেন বেঁচে থাকবার অর্থ, সফল মানুষ জানেন তার ভিতরের গুন্, সফল মানুষ জানেন কেন তিনি পৃথিবীতে এসেছেন।   তিনি সেই ভগবান প্রদত্ত গুনগুলোকে সদর্থক ভাবে প্রয়োগ ক'রে, তিনি নিজের লক্ষে পৌঁছোবার জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ নেন। আর অসফল ব্যক্তি সারা জীবন সংগ্রাম করেন উদ্দেশ্যহীন ভাবে।  তারা বেঁচে থাকবার কোনো অর্থ খুঁজে পান না। তারা জানেন না কেন তারা পৃথিবীতে এসেছেন। তাই তার মধ্যে যে সৃজনশীল ক্ষমতা আছে, তার সদ্ব্যবহার করতে পারেন না, নিজেদের উন্নত করতে পারেন না।  

নিজেকে জানবার জন্য, এবং নিজের মনকে বুঝবার জন্য, বার বার নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি জীবনে কি পেতে  পারেন, কি করবার জন্য আপনি পৃথিবীতে এসেছেন। সব মানুষ দুটো শক্তি নিয়ে জন্মায়, একটা তার বাহ্যিক অর্থাৎ শারীরিক শক্তি আর একটা আত্মিক বা অন্তর-মনের শক্তি। পাশ্চাত্য শিক্ষা আমাদের বাহ্যিক জগতের সুখ-দুঃখের উপরে জোর দেয়। প্রাচ্য শিক্ষা আমাদের অন্তর-জগতের সুখ দুঃখের উপরে জোর দেয়। 

জীবন একটা নদী, জীবন একটা  নদীপথ  । আমি এই নদীপথের একজন যাত্রী। শরীর একটা নৌকা। আর নৌকার  যাত্রী আমরা জীবাত্মা  । যেখানে মানব জীবন  বয়ে চলেছে। এই জীবন-নদীর  একটা  উৎস আছে, অর্থাৎ জন্ম আছে, পরিণতি আছে অর্থাৎ মৃত্যু আছে  । আবার এই স্থুল শরীরেরও  জন্ম  মৃত্যু আছে। জীবাত্মারও বিক্ষেপন -সংযোজন, বিয়োগ-মিলন আছে।

ঈশ্বর যখন আমাকে শরীর  দিয়েছেন, তখন ঈশ্বর আমাদেরকে স্বাধীন ইচ্ছেশক্তি দিয়েছেন। জীবনকে সে তার ইচ্ছে মতো পরিচালনা করতে পারে। জীবন বৃক্ষের এই ফল উপভোগ করতে গেলে, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যটাকে জানতে হবে। জীবন বৃক্ষের নিচে আছে শিকড়,  শিখরে আছে ফল।  তো ফল ও তার উৎস দুটোকেই  আমাদের বুঝতে হবে।  মানুষ প্রাথমিক ভাবে একটি চলমান শক্তি। উড়োজাহাজ। যা একদিন তার উৎসে ফিরে যাবে। যা যেখান থেকে এসেছিলো, সেখানেই ফিরে যাবে। মানুষের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে, তার মধ্যে সৃষ্টিকর্তা  যে সৃজনশীল ক্ষমতা প্রদান করেছেন, তাকে আবিষ্কার করা। আর এই সৃজনশীল ক্ষমতাকে নিজের ও অন্যের উপকারে কাজে লাগানো। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবাইকে একজন সৃজনশীল ব্যক্তি হিসেবে তৈরী করেছেন। এবং এই ক্ষমতার সাহায্যেই  জীবনের সাফল্যের স্বাদ পাবো। কৃতকার্য হবার জন্য আমাদের জন্ম, অকৃতকার্য হবার জন্য নয়। সফল হবার জন্য আমাদের জন্ম অসফল হবার জন্য নয়।  

আপনি যে সবার থেকে আলাদা, তা অন্যকে অনুভব করতে দিন, নিজেও  অনুভব করুন । একদিক থেকে দেখতে গেলে, আপনি সবার থেকে আলাদা। আপনার মধ্যে একটা বিশেষত্ত্ব আছে। ঈশ্বর প্রত্যেকটি মানুষকে আলাদা আলাদা করে তৈরী করেছেন। যদিও দৈহিক দিক থেকে দেখতে গেলে, একই রকম মনে হয়, কিন্তু আপনি জানবেন, আপনার মতো আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে। আপনার নিজস্ব একটা চিন্তা আছে, যা অন্য কারুর মধ্যে নেই। আপনার নিজেকে ব্যক্ত করবার একটা নিজস্ব ভঙ্গি  আছে, যা অন্য কারুর মধ্যে নেই। আপনি একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি। আপনার একটা নিজস্ব জগৎ আছে, আপনি সবার থেকে আলাদা। 

কিভাবে নিজেকে জানবেন ? 

প্রথমত নিজেকে জানতে গেলে, নিজেকে নিয়ে একটু বসুন, নিজেকে নিয়ে একটু ভাবুন। নিজের সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ লিখুন। আপনি কি কোনো কাজের জন্য প্রসংশিত হয়েছেন কখনো, তবে তা লিখে ফেলুন।  আপনার কি করতে ভালো লাগে,  আপনার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আনন্দের ঘটনা,  আপনি কি হতে চান, সেটা লিখে ফেলুন। এবং সেটা হতে গেলে, বা পেতে গেলে, কি কি গুনের দরকার, সেটা লিখে  ফেলুন।  এবার আপনার যোগ্যতা সম্পর্কে  নিজেই বিচার করুন। আপনার প্রত্যাশিত জিনিস পেতে গেলে, যে গুনের দরকার, তা আপনার মধ্যে আছে, এই বিশ্বাসকে দৃঢ় করুন।ব্যাস আপনার লেখার কাজ শেষ।

নিজের লক্ষ স্থির করুন   

এবার নিজের একটা ছবি  আঁকুন। ছবির  চোখের তারাটি গভীর কালো রঙ করুন। দুই মিনিট ওই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকুন। নিজেকে জানবার এই প্রক্রিয়া আপনাকে অতি সত্তর নিজের সম্পর্কে সচেতন করে তুলবে। নিজের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তুলবে। জীবনে বেঁচে থাকবার একটা লক্ষ পেয়ে যাবেন।  

 নিজের ভবিষ্যৎ ছবি আঁকুন। 

এবার ভবিষ্যৎ আমির একটা ছবি  আঁকুন। ধরুন আপনি পাইলট হতে চান, বা ডাক্তার হতে চান, ক্রিকেটার, গায়ক হতে চান,বা সাধু মহারাজ হতে চান, তবে নিজেকে পাইলট সাজিয়ে, বা ডাক্তার সাজিয়ে, বা  সাধু মহারাজ সাজিয়ে  একটা ছবি আঁকুন।   গভীর দৃষ্টিতে সেই দিকে দুই মিনিট তাকিয়ে থাকুন। যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করুন, এগুলো আপনার পাবার যোগ্যতা আছে।  মনে মনে ভাবুন, আপনি একজন সাধু মহারাজ, মনে মনে ভাবুন, আপনি একজন ডাক্তার, পাইলট, গায়ক, ক্রিকেটার, ইত্যাদি ইত্যাদি। 

প্রত্যাশিত জিনিসের একটা ছবি আঁকুন। 

আপনার প্রত্যাশিত জিনিসের একটা ছবি আঁকুন। হতে পারে তা সে কোনো মানুষ, জিনিস, বা টাকা-পয়সা  - যাই হোক না কেন, প্রত্যাশিত জিনিসের একটা প্রতিকৃতি আঁকুন। গভীর দৃষ্টিতে সেই দিকে দুই মিনিট তাকিয়ে থাকুন। মনে মনে ভাবুন, আপনি তাই হয়েছেন, যা আপনি চেয়েছিলেন।  আপনি তাই পেয়েছেনা যা আপনি চেয়েছিলেন। আপনি হয়তো  বলবেন, এগুলো সব অলীক স্বপ্ন, কল্পনা মাত্র। হ্যাঁ তাই করুন। একটা জিনিস জানবেন, ভবিষ্যতে যা বাস্তব বর্তমানে তাই থাকে মানুষের কল্পনার স্তরে, স্বপ্নের স্তরে। আপনার এই স্বপ্নই একদিন বাস্তবে পরিণত হবে, হবেই হবে। 

আপনি কোথায় আছেন, আপনি কোথায় জন্ম গ্রহণ করেছেন,  আপনার কত বয়স সেসব কোনো ব্যাপার নয়। তবে নিজের প্রতি আস্থা রাখতে হবে, বিশ্বাস রাখতে হবে। আর এই বিশ্বাস আস্থা তখনি হবে, যখন আপনি নিজেকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারবেন, যে আপনার এগুলো পাবার বা হবার যোগ্যতা  আছে। হ্যাঁ প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের সমস্ত ক্ষমতা আছে। আপনার মধ্যেও সেই একই ঈশ্বর আছেন, যিনি এই সমগ্র বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা, অধিকর্তা। আসলে কি জানেন, যে পাখি লোহার খাঁচার মধ্যে জন্মায়, সে খাঁচার মধ্যে দুঃখ পায় ঠিকই কিন্তু দরজা খুলে দিলেও তার বুক দুরুদুরু করে, বন্ধ না থাকলে বাঁচবো কি করে। এটাই চিরকালের অভ্যাস। আপনার ভিতরে একটা সিন্দুক আছে, সিন্দুকের মধ্যে আছে জীবন ভোমরা। সিন্দুকের তালা খুলে ফেলুন।  দেখবেন, আপনি অঢেল ধনের অধিকারী। চাবি আপনার মধ্যেই আছে, আমরা সেটি খুঁজতে সাহায্য করবো।  

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম। 

 জীবন রহস্যঃ (৩)  THE SECRET OF LIFE (III) 

 জীবনের ভাইরাস হচ্ছে দুশ্চিন্তা-ভয়. ভ্যাকসিন হচ্ছেঅটল আত্মবিশ্বাস। স্বামীজিকে এক ভক্ত প্রশ্ন করেছিল, আমি কিভাবে মৃত্যুর পরে, সুখে-শান্তিতে-আনন্দে থাকতে পারবো।  স্বামীজী উত্তরে বলেছিলেন, আরে বেয়াকুব, তুমি তোমার মৃত্যুর পরের কথা চিন্তা করছো ? তুমি যদি সুখেশান্তিতে আনন্দে থাকতে চাও তবে, এখনই সেটা চাও। এই মুহূর্তেই সেটা চাও।  এখনই তুমি আনন্দে থাকো, এখানেই প্রেমপূর্ণ হয়ে বসবাস করো। সুখশান্তি, আনন্দের ঝর্ণা এখানেই বইছে। সেই ঝর্ণাতে তুমি অবগাহন করো। কেন অপেক্ষা করছো ? 

কিন্তু কথা হচ্ছে কি করে আমরা এখনই ভালো থাকবো। সমস্যা জর্জরিত এই জীবন। মানুষ ভাবে এক আর হয় আর-এক। মানুষ কেউ দুঃখী হতে চায় না, তবু দুঃখ আসে।   মৃত্যুপুরীতে  কেউ চিরকাল ভালো থাকে না। তো আমিই বা কি করে ভালো থাকবো ? আমরা যা চাই তা কি ভাবে আমরা পেতে পারি ?  

আমরা সবাই জ্ঞাতসারে হোক, বা অজ্ঞাতসারে হোক, প্রতিদিন পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।  তা সে শারীরিক হোক বা মানসিক হোক। এমনকি আমাদের সামনে যে দৃশ্যমান জগৎ, তাও প্রতিদিন পরিবর্তন হচ্ছে। যেখানে রোদ-বৃষ্টি-বাতাস পর্যাপ্ত সেখানে সবুজের সমারোহ।   আর যেখানে তা নেই, বা প্রয়োজন-অতিরিক্ত সেখানে রুক্ষ্মতার ছোঁয়া, মলিন দৃশ্য । আপনি একসময় চিন্তা করেছিলেন বলেই আজকে ফাঁকা জায়গায় একটা বাড়ি দেখতে পাচ্ছি। তো প্রকৃতি যেমন নিজের শরীরকে প্রতিক্ষনে পরিবর্তন  করছে, তেমনি প্রকৃতি আমাদের শরীরকে অর্থাৎ যা প্রকৃতির অংশ, তাকেও   প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করছে, শিশু থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবনে নিয়ে যাচ্ছে।  অন্যদিকে   চিন্তা মানুষের অন্তর্জগতের পরিবর্তন করছে। আবার  আমাদের এই অন্তর্জগতের পরিবর্তনই বহির্জগতে পরিলক্ষিত হচ্ছে। উচ্চচিন্তা, উচ্চভাব   মানুষকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে, আর তার বিপরীত হলে, মানুষের অধোগতি হয়ে থাকে।  তো এই যে পরিবর্তন, একে আমরা নিয়ন্ত্রণ করবো কি করে ?  

দুশ্চিন্তা ও ভয় 

মানুষের জীবনে উন্নতির অন্তরায় হচ্ছে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভয় , এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে  দুশ্চিন্তা । আর উন্নতির সোপান হচ্ছে আমাদের আত্মবিশ্বাস। মানুষের জন্মগত স্বাভাবিক প্রকৃতি হচ্ছে, সে ভীতু আর দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। জন্ম থেকেই সে নিরাপত্তার অভাব বা ভয় অনুভব করে। মা তাকে নিরাপত্তা দেয়, তাই সে মাকে  হারানোর ভয় পায়। সে যত বড়ো  হতে থাকে, তত  এই ভীতি তার মধ্যে বাড়তে থাকে। আরো বড়ো হলে,  সে তার পরিবার নিয়ে চিন্তা করে, প্রতিবেশী নিয়ে চিন্তা করে, পড়াশুনা নিয়ে, স্কুল নিয়ে চিন্তা করে। তার কাজ বা অফিস নিয়ে চিন্তা করে, রাষ্ট্র নিয়ে চিন্তা করে, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে। দুশ্চিন্তা মনুষ্য জাতি সৃষ্টির আদিম কাল থেকে বয়ে নিয়ে  চলেছে। পশুরা দুশ্চিন্তা করে না। তার ভয় পায়, এমনকি তাদের মনও  খারাপ হয়.।  কিন্তু কখনো দুশ্চিন্তা করে না। তাই পশুদের  জীবনের স্বাভাবিক উন্নতি বা পরিণতি  কখনো ব্যাহত হয় না। দুটো সিংহ, দুটো বাঘ, দুটো বিড়াল-কুকুর এদের মধ্যে কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। কারন তারা কখনো দুশ্চিন্তার মধ্যে জীবন কাটায় না। এমনকি দেবতারাও দুশ্চিন্তা করে না, তাই তাদের অধোগতি বা অগ্রগতি হয় না।  কিন্তু মানুষের মধ্যে ভালো বা শুভ  চিন্তা যেমন আছে,তেমনি খারাপ বা অশুভ  চিন্তা আছে । আর এই শুভ চিন্তা মানুষকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারে, আবার অশুভ চিন্তা মানুষকে অধোগতি সম্পন্ন করতে পারে। আমরা ভালো মানুষ তাকেই বলি, যিনি উচ্চ চিন্তার অধিকারী।  আবার খারাপ মানুষ তাকেই বলি, যিনি নিম্নমানের চিন্তায় ডুবে আছেন। চিন্তার মধ্যে আরো একটা দিক আছে, যাকে  বলা হয় দুশ্চিন্তা। চিতায় মানুষের দেহ পুড়ে ছাই হয়ে যায়।  আর দুশ্চিন্তায় মানুষের জীবনটাই পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।   

আশ্চর্য্যের কথা হচ্ছে, দুশ্চিন্তা মনুষ্য জাতির ধর্ম্ম।  আর মানুষ যত উন্নত হচ্ছে, যত সে জাগতিক ধনসম্পত্তির অধিকারী হচ্ছে, তত তার দুশ্চিন্তার পরিধি বেড়ে চলেছে। দুশ্চিন্তা মানুষকে ভীতু করে তোলে। দুশ্চিন্তা ভয়ের জন্ম দেয়।  আর ভয় মানুষকে অসফল করে তোলে। ভয়ে-ভয়ে কোনো কাজ করতে গেলে, সেই কাজ ঠিকঠিক ভাবে কিছুতেই করা যায় না। সাহস মানুষকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে থাকে। সাহসে ভর করে মানুষ অন্ধকারে পথ চলতে পারে। দুর্গম পাহাড় পেরিয়ে যেতে পারে।   আর ভয় মানুষকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করে। আগামী কালের ভয়াবহতা নিয়ে দুশ্চিন্তা করা বোকামি। আর একটা কথা শুনুন, আগামীকাল কোনোদিন আসে না। আগামীকাল আসলে একটা কথার কথা। ভবিষ্যৎকে বোঝাবার জন্য আগামীকাল কথাটা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যে সময়টা কেউ দেখেনি, কোনোদিন  আসেনি, তাকেই বলে ভবিষ্যৎ বা আগামীকাল। আসলে ভবিষ্যৎ সবসময় অনিশ্চিত। আদৌ ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। আছে বর্তমান আর অতীত। অতীত অর্থাৎ যে দিনটি চলে গেছে। যে দিনটি আমরা পেরিয়ে এসেছি। যেখান থেকে আমরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি।  আর বর্তমান অর্থাৎ যেখানে আমরা আছি। কে বলতে পারে, আপনি কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পারবেন কি না। তাই যা অনিশ্চিত, তা নিয়ে চিন্তা করতে যাবেন  না, তা নিয়ে ভেবে নিজেকে ভীতু-দুশ্চিন্তাগ্রস্থ করবেন না। কে বলতে পারে, আগামী সকাল, আমার/আপনার  জীবনে আদৌ আসবে কি না। তাই অতীতের  অভিজ্ঞতা নিয়ে আজকের দিনে বাঁচুন, ভবিষ্যতের কাল্পনিক দুর্দিনের কথা ভাবতে যাবেন না। কিন্তু কথা হচ্ছে, এখন থেকে আমরা বেরুবো কি করে ?                

দেখুন মানুষ সেই কাজই  করতে পারে, যা সে সারাক্ষন চিন্তা করে। অবিরত কোনো বিষয়ের চিন্তা মানুষের অবচেতন মনে বাসা বাঁধে।   আপনার চিন্তা আপনার অনুভব, আপনার বিশ্বাস, এগুলো আপনার জীবনে একটা আমূল পরিবর্তন এনে দিতে পারে। আপনার কোনো বুদ্ধি কাজ করবে না, যখন আপনি অবচেতন মনের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবেন। আপনি তখন বুঝতেই পারবেন না, যে একাজ আপনার দ্বারা কি করে সম্ভব হলো ?  তা সে খারাপ কাজ হোক বা ভালো কাজ হোক। বিপদে প'ড়ে , মানুষ কি করতে পারে, তা সে নিজেই জানে না। আবার চিত্ত যখন উৎফুল্ল হয়, মানুষ যখন উৎসাহিত হয়, মানুষ যখন অনুপ্রাণিত হয়, মানুষ যখন প্রসংশিত হয়, তখনও মানুষ অনেক কিছু করতে পারে, যা সে আগে করতে পারতো না।  আসলে সে তখন পরিস্থিতির দাস হয়ে যায়।  তার শরীর, চেতন মন তখন  তার আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যায়। প্রতিনিয়ত যে জিনিস আপনি চিন্তা করছেন, আপনি যে চিন্তায় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, তা আপনাকে অবশ্য়ই সফলতার দিকে নিয়ে যাবে। ভালো চিন্তা হলে ভালো কাজের সফলতা পাবেন, আবার খারাপ চিন্তা হলে, খারাপ কাজে সফলতা পাবেন। আর আপনার চিন্তা, বিশ্বাস, অনুভব যখন নির্জীব থাকবে, তখন কোনো কাজেই আপনার হাত দিতে ইচ্ছে হবে না, আর তখন যে কাজেই আপনি হাত  দেবেন, তখন আপনি সে কাজে সফলতা পাবেন না।  আপনার ভিতরে সমস্ত কাজ করবার ক্ষমতা আছে। এক অসীম শক্তির ধারক আপনি।  আপনি তা জানেন না।একটা জাদুকরী শক্তি আছে আপনার মধ্যে।  আর তা ক্রিয়াশীল হতে পারে, আপনার চিন্তার মধ্যে দিয়ে। তাই সব সময় শুভ চিন্তা করুন। সদর্থক চিন্তা করুন। আমি পারবো না, সে কথা ভাবতে যাবেন না, যে ভাবে পারবো না সে কোনোদিন পারে না।  যে ভাবে পারবো  সে একদিন না একদিন পারবেই।

বিশ্বাস বা আত্মবিশ্বাস  

বিশ্বাস ও ইচ্ছে কিন্তু এক জিনিস নয়। বিশ্বাস একটা শক্তিশালী একতানতা। আর ইচ্ছে হচ্ছে বাসনা, লোভ। ইচ্ছে থাকলেই আপনার কাছে জিনিস এসে যাবে তা কিন্তু নয়।  কিন্তু বিশ্বাস আপনাকে অন্ধের মতো ধাবিত করতে থাকবে। আপনার সম্পূর্ণ শক্তি নিয়োজিত হয়ে তখন আপনার লক্ষের দিকে ধাবিত হবে। আপনি ইচ্ছে করলেই একটা নতুন বাড়ি পেতে পারেন না, কিন্তু যদি আপনার মধ্যে  বিশ্বাস  প্রবল হয়, যে আপনি একটা বাড়ি পেতে পারেন,   তবে আপনার মধ্যের সুপ্ত শক্তি জাগ্রত হবে। আপনি তখন একটা পরিকল্পনা করবেন, ও কাজে নেবে যাবেন। একটা প্ল্যান তৈরী করবেন, কোথা থেকে টাকা আসবে, সেটা ভাববেন। কোথায় বাড়িটা হবে, সেটা ভাববেন। অর্থাৎ একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আপনার মাথার মধ্যে এসে যাবে। এই শক্তি আপনাকে যেমন জাগতিক বস্তু, পেতে সাহায্য করবে তেমনি সুস্বাস্থ্য, মানসিক তৃপ্তি বা শান্তি পেতে সাহায্য করবে। আপনার মধ্যে যদি বিশ্বাস থাকে, তবে আপনি শুকনো  সর্যের মধ্যেও তেলের সন্ধান পাবেন। আর যদি বিশ্বাস না থাকে তবে, আখের মধ্যে চিনি আছে, সেটা কোনোদিনই আপনি খুঁজে পাবেন  না।

ছোটছোট সাফল্যের মধ্যে থেকে মানুষ বিরাট সাফল্যের অনুপ্রেরণা পেতে পারে। আগে সহজ অংক গুলো করুন, তবে আপনার মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্মাবে।  আর ভবিষ্যতে কোনো অঙ্কই কঠিন মনে হবে না। যে কোনো কাজ হাতের কাছে এলে, তা সত্তর সময়মতো করে ফেলবার চেষ্টা করুন। আর যখনই কোনো কাজ করবেন, দেখবেন, সেখান থেকে আপনার একটা অভিজ্ঞতা হবে, এমনকি আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে। আর একটা জিনিস করবার চেষ্টা করুন, সেটি হচ্ছে, যখনি আপনি কোনো কাজ করবেন, সেটি নিখুঁদ ভাবে করবার চেষ্টা করুন। সেই কাজের মধ্যে আপনার নিজস্বতার ছাপ  রাখবার চেষ্টা করুন। একটা নিরবিচ্ছিন্ন চেষ্টা, কোনো কাজে সফল না হওয়া পর্যন্ত লেগে থাকা, এটাই জীবনে সফলতার মূলমন্ত্র। 

নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। মনকে এমন ভাবে তৈরী রাখুন, যাতে যেদিক  থেকেই বল আসুক না কেন, যত  জোরে বল আসুক  না কেন, আপনি যেন তাকে ফেরত পাঠাতে পারেন। হ্যাঁ একবার দুবার আপনার পা থেকে বল বেরিয়ে যাবে, কিন্তু আপনি যত  সতর্ক থাকবেন, চোখ যত বলের দিকে থাকবে, তত আপনি সফল হবেন। একবার দুবার সাফল্য পেয়ে আপনার মন যেন চঞ্চল হয়ে না ওঠে মনকে স্থির রাখুন। সাফল্য হচ্ছে একটা করে সিঁড়ি তৈরী করা, যার উপরে ভর করে, আপনি আরো উপরে উঠতে পারবেন। জীবন একটা যুদ্ধ, জীবনের উচ্চশিখরে উঠে হবে আপনাকে। আপনি জন্মেছেন মানে আপনি শুরু করেছেন, সাফল্যের পাহাড়ে উঠবার জন্য তৈরী হয়েছেন। এবং আপনি অবশ্য়ই একদিন এই জীবন-সাফল্যের উচ্চে  পৌঁছে যাবেন। শুধু আপনার মধ্যে দৃঢ় বিশ্বস রাখতে হবে, আমি পারি, এই বিশ্বাসে  অটল থাকতে হবে।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

জীবন রহস্যঃ (৪)  THE SECRET OF LIFE (IV) 

অসম্ভব  কিভাবে সম্ভব হবে ? 

একটি শক্তিশালী ক্রিয়া যা আপনার জীবনকে পূর্নতা এনে দিতে পারে। A UNIQUE TECHNIC FOR SUCCESSFUL & HEALTHY LIFE
জীবন একটা কথাবলা গাছ। জীবন একটা চলমান বৃক্ষ। জীবন একটা চারাগাছ। জীবনরূপ বৃক্ষের এই চারাগাছটাকে আপনাকে পূর্নতা দিতে হবে। ফলে ফুলে ভরিয়ে দিতে হবে। পূর্নতাই মনুষ্য জীবনের লক্ষ। পূর্নতাই জীবনের প্রাপ্তি। আপনার জীবন ব্যর্থতার জন্য নয়, আপনার জীবন সফলতার জন্য।আর এটি করতে পারে, একমাত্র আমাদের মন। শিল্পী আপন খেয়ালে কাগজে কলমের আঁচড় কাটছেন, ধীরেই ধীরে দেখলাম, একটা অপূর্ব নারীমূর্তি ভেসে উঠলো চোখের সামনে কাগজের পাতায় । সমস্ত মানুষকে ভগবান পূর্ণরূপে রচনা করেছেন। সবারই দুটো হাত, দুটো পা, দুটো চোখ, দুটো কান, ইত্যাদি ইত্যাদি এমনকি সবাই একটা মাথা একটা মন। আমাদের শাস্ত্র পুরানে অবশ্য মা দুর্গার যেমন দশ হাত, রাবনের দশ মাথার বর্ননা আছে, এমনকি গনেশ ঠাকুরের স্কন্ধে হাতির মাথা বসানো আছে, কিন্তু বাস্তবে এমনটি দেখা যায় না। আমরা সবার ঘাড়ে একটাই মাথা দেখতে পাই, আর সেটি মানুষেরই মাথা। তো ভগবান আমাদের সবাইকে যদি একই রকম শরীর, একই রকম মন দিয়ে থাকেন, তবে এই বৈষম্য কেন ? কেউ পণ্ডিত, কেউ মাথামোটা। কেউ শক্তিশালী, কেউ দুর্বল।
আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, আমরা কিভাবে ভালো থাকবো, কিভাবে জীবনকে সফল করে তুলবো। কথায় বলে, আমরা যেমন কর্ম্ম করি, তেমন ফল ভোগ করে থাকি। তো আমরা যে কাজ করি, তা আসলে কার নির্দেশে করে থাকি ? কেউ বলেন, ভগবানের নির্দেশে করে থাকি। আসলে, ভগবান নয়, আমরা আমাদের মনের নির্দেশে সমস্ত কাজ করে থাকি। অর্থাৎ আমাদের সমস্ত কাজের নিয়ন্ত্রক হচ্ছে আমাদের মন। এই মনের আবার চারটি স্তর আছে, চেতন, অবচেতন, নিষ্ক্রিয়, ও অতিচেতন। তবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মন দুটো স্তরে ঘোরাফেরা করে থাকে। চেতন মন ও অবচেতন মন। চেতন মন বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন স্তর। আর অবচেতন মন আসলে বিচার বুদ্ধিহীন স্তর। আমরা আমাদের সচেতন মন দিয়ে চিন্তা করে থাকি। আর যখন একই চিন্তা বারবার আমাদের মনে ওঠে, অর্থাৎ অভ্যাসগত ভাবে, বা গভীরভাবে যখন আমরা চিন্তা করি, তখন ওই চিন্তা আমাদের অবচেতন মনের স্তরে একটা দাগ কাটে। আর তখন আমাদের অবচেতন মনে একটা আবেগের সৃষ্টি হয় । এইবার একটা কথা বুঝতে হবে, আমাদের অবচেতন মনে যখন কোনো গভীর দাগ কেটে গেলো, তখন সে এই চিন্তাকে কার্য্যে পরিণত করতে শুরু করে দেবে। অবচেতন মন কখনো ভালো মন্দ চিন্তা করবে না। তাই অবচেতন মনের দাগ যদি আমাদের নেতিবাচক চিন্তা দিয়ে ঘটে থাকে তাহলে আমাদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা, অসফলতা এবং অসুখী ভাব সৃষ্ট করবে। আর যদি এই দাগ কোনো গঠনমূলক চিন্তার হয়, তবে, আপনি সুখী, সবল, সমৃদ্ধির অনুভব করবেন।
ধরুন আপনি সচেতন মনে একটা চিন্তার উদ্রেগ করলেন, যে আমি মহা শান্তিতে আছি, আমি সুস্বাস্থের অধিকারী। তো এই চিন্তা যখন আপনার সচেতন মনে বার বার উদয় হবে, তখন এই চিন্তাটা আপনার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে। আর এই অভ্যাসগত চিন্তা আপনার অবচেতন মনে দাগ কাটতে থাকবে অবিরত । ফলতঃ অবচেতন মনের দাগটা হবে গভীর। আর যেই এটা ঘটলো, অবচেতন মনের স্বভাব অনুযায়ী, আপনার সামনে নিয়ে আসবে সুস্বাস্থ্য, শান্তি। অর্থাৎ যেটা আপনি চেয়েছিলেন। অর্থাৎ অবচেতন মন এই শান্তি ও সুস্বাস্থ্যকে প্রদর্শন করবে।
মনস্তত্ত্ববিদগন দেখেছেন, মানুষ যখন সচেতন মনে কোনো চিন্তা করে, তখন তা অবচেতন মনে প্রবেশ করতে থাকে আর তা মুদ্রিত হয় মস্তিস্ক কোষে। আর অবচেতন মন তক্ষুনি এগিয়ে যায় এই চিন্তাকে কার্যকরী রূপ দিতে। আর এই কার্যকরী রূপ দেবার জন্য, আপনার মনে সঞ্চিত পূর্বপূর্ব অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানকে সে ব্যবহার করে থাকে। আপনার অন্তরের অসীম শক্তি, আপনার ভিতরের উর্যাশক্তি ইত্যাদিকে একত্রিত করে, আপনার চিন্তাকে সে কার্যকরী রূপ দেয়। আপনি কোথায় জন্ম গ্রহণ করেছেন, আপনার গায়ের রঙ কালো কি সাদা, আপনি ব্রাহ্মণ কি অব্রাহ্মণ, এমনকি আপনি শারীরিক দিক থেকে সম্পূর্ণ কি অসম্পূর্ন, তাতে কিছুই আসে যায় না, আপনার মাথার মধ্যে কি চিন্তা ঘুরছে, সেটাই বড়ো কথা। আর এই মাথাবিহীন মানুষ বলে কিছু হয় না। সবারই একটা করে মাথা আছে। আর মাথার মধ্যেই আমাদের যত চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এই চিন্তা যার যেমন ধীরে ধীরে সে তাই হয়ে যাবে। এ এক অদ্ভুত স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। যা আপনার ভিতরে অবিরত চলছে। আপনি যখন জেগে আছেন, বা আপনি যখন ঘুমিয়ে আছে, আপনি কলকাতায় আছেন, কি লন্ডনে আছেন, আপনার ভিতরে এই ক্রিয়া অবিরত চলছে। আপনার শরীরের আবশ্যিক ক্রিয়াগুলো, যেমন স্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া, খাদ্য থেকে রক্ত তৈরির প্রক্রিয়া, বর্জ্য পদার্থগুলোকে আলাদা করা, আপনার সমস্ত শরীরে রক্ত সরবরাহ করা, আপনার শরীরে হাড়-মাংস তৈরি করা, তাদের বৃদ্ধি করা, সমস্ত কোষকে খাদ্য সরবরাহ করা, শরীরে বিভিন্ন ধরনের রস নিঃসরণ করা, যা আমাদের অনুভূতি সম্পন্ন করছে, বাঁচিয়ে রাখছে, ইত্যাদি নানান ক্রিয়া বিরামহীন ভাবে করে চলেছে, একটা ছন্দবদ্ধ ভাবে চলছে এই অদৃশ্য ক্রিয়া । আর এটা সম্পন্ন হচ্ছে অবচেতন মনের নির্দেশে। এই অদ্ভুত নিরবিচ্ছিন্ন কর্ম্ম যেমন বোকার শরীরে চলছে, তেমনি বুদ্ধিমানের শরীরেও চলছে, আফ্রিকার মানুষের শরীরেও চলছে, এশিয়ান বা আমেরিকানদের শরীরেও একই প্রক্রিয়া চলছে । বড়োলোকের শরীরে চলছে, গরিবের শরীরে চলছে। এখানে কোনো ভেদ নেই, কোনো পার্থক্য নেই। এইসব কাজ করবার জন্য, আমাদের কারুর ক্লান্তিও নেই। অদ্ভুত এই জটিল প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান সঞ্চয় করতে হয় না। এটা আমরা জন্ম সূত্রেই সবাই পেয়ে থাকি। আর এই স্বাভাবিক ক্রিয়ার সঞ্চালক হচ্ছে আমাদের অবচেতন মন।
এখন কথা হচ্ছে, এইসব আবশ্যিক ক্রিয়া যখন অবচেতন মন করে থাকে, আমাদের চেতন মনের অজ্ঞাতসারেই হয়ে থাকে, তখন সেখানে আপনার আমার কিছু করবার নেই। তাহলে, এই ব্যাপারে এত কথা বলছি কেন ? দেখুন, আপনি ফুটবল খেলতে পারেন না, কিন্তু খেলোয়াড়কে আপনি বিজ্ঞের মতো পরামর্শ দিতে পারেন, আপনি প্রধান মন্ত্রী হতে পারেন না, কিন্তু আপনি পন্ডিতের মতো প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিতে পারেন। একটা শিশু পিতার কাজে সাহায্য করতে পারে না, কিন্তু সে পিতার কাজকে লন্ডভন্ড করে দিতে পারে। আপনি গাড়ি চালাতে পারেন না, কিন্তু গাড়িতে বসে গাড়ির চালককে নির্দেশ দিতে পারেন, এমনকি গাড়ির চালককে বিরক্ত করে, দুর্ঘটনাও ঘটাতে পারেন। ঠিক তেমনি আমাদের চেতন মন আমাদের শরীরের ভিতরে যে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা আছে, যার জন্য একটা মানুষ বেঁচে আছে, এবং যে কাজটা আমাদের অবচেতন মন করে থাকে, তাকে আমাদের চেতন মন লন্ডভন্ড করে দিতে পারে। আপনার শরীরে যদি আপনি খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেন, তবে আপনার শরীরের ভিতরে যে কাজগুলো স্বাভাবিক ভাবে হতো, তা ব্যাহত হবে। আপনার যে শ্বাসক্রিয়া স্বাভাবিক ভাবে চলছে, তাকে যদি আপনি বাধা দেন, অর্থাৎ আপনি যদি নাক-মুখ চেপে ধরেন, বা আপনি চেতন ভাবে কুম্ভক ক্রিয়া শুরু করে দেন, তবে আপনার শরীরে পৰ্য্যাপ্ত বাতাস ঢুকতে পারবে না। আর আপনার ভিতরে যে স্বাভাবিক ক্রিয়া চলছিল, তা বাধাপ্রাপ্ত হবে। এবং আপনাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে। এমনকি আপনি বাইরে থেকে আঘাত দিয়ে ফুসফুসের স্বাভাবিক ক্রিয়াকে বন্ধ করে দিতে পারেন। তাই বলছিলাম, আপনার সচেতন মন আপনার শরীরের স্বাভাবিক প্রাণসঞ্চারকারী ক্রিয়াগুলোকে সঞ্চালন করতে পারে না ঠিকই, কিন্তু সচেতন মন এই সঞ্চালন কর্মে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
আপনার সচেতন মনের চিন্তা, উদ্বেগ, ভয়, বিষন্নতা আপনার হৃদয়-ফুসফুস-পাকস্থলী এবং অন্ত্রের স্বাভাবিক কাজকে বাধা সৃষ্টি ক'রে, আপনার শরীরে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করতে পরে। অর্থাৎ আপনার চেতন মন শরীরকে সুস্থ রাখবার জন্য স্বাভাবিক ভাবে কিছু করতে পারে না, কিন্তু অবচেতন মনের কাজে বাধা সৃষ্টি করে, আপনার শরীরের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। যাতে আপনি রোগগ্রস্থ হয়ে উঠতে পারেন। এইজন্য যেটা দরকার, সেটা হচ্ছে, আমাদের চেতন মন ও অবচেন মনের মধ্যে একটা একতানতা বজায় রাখা, একটা ঐক্য, একটা ভারসাম্যতা রক্ষা করা । তাই আপনি যখন শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্থ বা অস্থির ভাব অনুভব করবেন, তখন আপনার কাজ হচ্ছে, কিছুক্ষনের জন্য বিশ্রাম নেওয়া। নিজের মনের সাথে কথা বলুন। মনকে বলুন, শান্তি-সংহতি ও ঈশ্বরীয় ভাব অনুসরণ করতে। আপনি তখন দেখবেন, ঈশ্বরের সমস্ত শক্তি যা আপনার ভিতরে আছে, সেগুলো সক্রিয় হয়ে উঠবে এবং আপনার শরীরকে আবার স্বাভাবিক করে দেবে। আপনি আপনার চেতন মন ও অবচেতন মনকে নিয়ে একান্তে বসুন, বিশ্বাসের সঙ্গে, অধিকারের সঙ্গে ভালোবাসা দিয়ে দৃঢ়ভাবে নির্দেশ পাঠাতে থাকুন। আপনার এই নির্দেশ তখন একটা মিরাকেল ঘটাবে আপনার ভিতরে, আপনার সচেতন মন ও অবচেতন মন একত্রে বন্ধুত্ত্বপুর্ন আচরণ করবে। দুই ভাইয়ে গোলমাল হলে যেমন পিতা দুজনকে নিয়ে বসে,তাদেরকে বোঝান ও নির্দেশ দিয়ে থাকেন, সেইমতো, ছোট্ট-ঈশ্বররূপী আপনি আপনার চেতন ও অবচেতন রূপ দুই সন্তানকে বিশ্বাসের সঙ্গে ভালোবাসার সঙ্গে দৃঢ় স্বরে আদেশ দিতে থাকুন। আসলে শরীর-মনের একতানটাই, সুস্থতা, আর এর বিপরীত হলে আসে অসুস্থতা।
আমরা আপনাদের একটা কথা বলতে পারি, এগুলো কোনো কাল্পনিক ব্যাপার নয়, এগুলো পরীক্ষিত সত্য। ভারতের এমনকি বিশ্বের বহু মনীষী এই প্রক্রিয়াতে নিজেদের শরীর ও মনের মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রেখে আজীবন সুস্থ থেকেছেন।জীবনকে সফলতার চূড়োয় পৌঁছে দিয়েছেন।এইভাবেই ছোটছোট ক্রিয়া, মানুষকে সাফল্যের পথে নিয়ে যেতে পারে। যাকিছু, আমরা চাইতে পারি, তা সে জাগতিক বস্তু হোক, বা সুখ শান্তি হোক, সবই আমাদের অধিকার। কেননা আমরা সবাই ঈশ্বরের মধ্যেই আছি। আর এই জগৎ ঈশ্বর বই কিছু নয়।
আগামী কয়েকদিন জন্য এই ভাবনার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিন।
"আমি ঈশ্বরের মধ্যে, আমি ঈশ্বরের অংশ, আমি শুদ্ধ, মুক্ত। আমার এই শরীর একটা স্বতন্ত্র সত্ত্বা যা সূক্ষ্ম জ্যোতির্বিন্দুর সমষ্টি মাত্র। প্রেম-ভালোবাসার এক অবিরাম ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হচ্ছে এই শরীরে। আমি সুস্থ স্বাভাবিক মনের অধিকারী।"
এই ভাবকে বারবার স্মরণ করতে থাকুন, যতক্ষন না এই ভাব আপনার অবচেতন মনে গভীর রেখাপাত করছে। নিরন্তর এই চিন্তা স্মরণ -মনন চালিয়ে যান। এতে করে আপনার সমস্ত উদ্বেগ, দুঃশ্চিন্তা দূরীভূত হবে. আপনি একজন সম্পূর্ণ তৃপ্ত সন্তুষ্ট মনের, সুস্থ স্বাভাবিক শরীরের অধিকারী হবেন। নিজেকে ক্ষুদ্র ঈশ্বর হিসেবে স্বীকৃতি দিন। সবাইকেই আপনার স্বরূপ হিসেবে কল্পনা করুন। এটি প্রথম দিকে অভিনয় বলে মনে হলেও, ক্রমশঃ আপনার বিশ্বাসের গভীরে এই সত্য উদ্ভাসিত হবে। আর আপনি এক অন্য মানুষ হয়ে যাবেন। শান্তি, সফলতা, আপনার জীবনে চিরসাথী হয়ে যাবে।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।

জীবন রহস্যঃ (৫)  THE SECRET OF LIFE (5)

মনের রহস্যঃ (১)   

১. জীবনে সাফল্য পেতে গেলে আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে মনকে বোঝা। আমরা ভাবি জীবনে সাফল্য পেতে গেলে আমাদের কাজ করতে হবে।  কিন্তু আমাদের মন যদি খারাপ থাকে, তবে আমরা কোনো কাজে উৎসাহ পাই না। আসলে আমাদের সমস্ত কাজের এমনকি কাজের সাফল্য নির্ভর করে আমাদের মনের উপরে। মনই সমস্ত কাজের নিয়ন্ত্রক। কাজে আমাদের যত  মন বসবে, তত সেই কাজে সাফল্য আসবে।    আমাদের মন একটা বিষ্ময়কর বস্তু।মনোবিজ্ঞানীগন বলছেন, মনকে বোঝা শুধু কঠিন, আজও এটা সম্পূর্ণ রূপে সম্ভব হয় নি।  মনকে বলা হয়ে থাকে সমস্ত কিছু সৃষ্টির আঁতুরঘর। এখানেই জগতের সমস্ত কিছুর জন্ম হচ্ছে। অথচ এই আঁতুড়ঘরের কারিগরি বিদ্যা  আমরা জানিনা, আবার এই মনের কারুকুরি, অর্থাৎ মন কিভাবে কাজ করে, সে  সম্পর্কেও আমরা সামান্য কিছুই জানতে পারি। একটা অদৃশ্য অসীম শক্তি।  আজ অবধি লক্ষ কোটি মানুষ জন্ম গ্রহণ করেছে এই পৃথিবীতে, আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে সবারই একটা করে মন ছিল, এখন যারা বেঁচে আছেন, তাদেরও একটা করে মন  আছে, ভবিষ্যতে যারা  জন্মাবেন  তাদেরও একটা মন থাকবে । কিন্তু কোনো জীবিত মানুষ এই মন কি তা সম্পূর্ণরূপে  জানতে পারেনি, জানতে পারবেও  না। মনের অসীম শক্তি সম্পর্কেও বিশেষ কিছুই জানতে পারবে না। শুধু অনুমান করতে পারবে, যে তাদের একটা মন আছে।
 
২. আমাদের মনে হয়, মন কোনো নিয়মের ধার ধারে না, সে যা কিছু চিন্তা করতে পারে। ব্যাপারটা আদৌ তা নয়, মনও একটা নিয়মের পথে চলে। আসলে  মনের শক্তির কোনো সীমা  পরিসীমা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা  নেই। তাই আমরা মনকে বুঝতে পারি না। আমরা ভাবি মন কোনো নিয়মের ধার ধরে না।  আমরা পৃথিবীর পরিধি জানি, আমরা পৃথিবীর গতিপথ জানি।  এমনকি  আমরা লক্ষ-কোটি মাইল দূরের সূর্যকে পরিমাপ  করতে পারি, সূর্য কোথা থেকে কোথায় যায়, এমনকি সর্য্যের বয়স কত, সূর্য্যের আয়ু সম্পর্কেও বিজ্ঞানীগন অংককোষে অনুমান করতে পারেন।   আমাদের জীবনীশক্তি দিচ্ছে বাতাস , সেই  বাতাসের পরিধি সম্পর্কেও আমরা   জানতে পারি। আমরা চাঁদে ভ্রমন করে আসতে  পারি, মঙ্গলগ্রহ  সম্পর্কে জানতে পারি। কিন্তু মন যা আমাদের  সবথেকে কাছের বস্তু, তার সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না। না জানি তার শক্তি, না জানি তার গতিপথ, না জানি তার পরিণতি। অথচ এই মন আমাদেরকে প্রতিদিন পরিচালিত করছে, সুখ-দুঃখের   অনুভব এনে দিচ্ছে, আমাদের জ্ঞান আহরণে, জ্ঞান সঞ্চয়ে সাহায্য করছে। এমনকি আমাদেরকে পরিবর্তন করছে।  উন্নত বা অবনতির কারন এই মন। আমার এই যে অস্তিত্ত্ব তার অনুভব করছে আমাদের মন। আমরা যদি আমাদের এই মনের সম্পূর্ণ শক্তিকে জানতে পারতাম, ব্যবহার করতে পারতাম, তবে জগতের চিরন্তন নিয়ম, জগতের স্থায়িত্ব  এবং জগতের বিলুপ্তির সর্তগুলোকে কে ধরতে পারতাম। আমাদের ব্যাক্তিত্ত্বের উন্মেষ ঘটাতে পারে এই মন, জীবনে  চরম শান্তিকে এনে দিতে পারে এই মন । আমাদের বাহ্যিক ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ ক'রে , আমাদের আবেগকে  নিয়ন্ত্রণ ক'রে, আমরা  স্বপ্নের  রাজ্যে পৌঁছে যেতে পারতাম।  তখন স্বপ্ন আর স্বপ্ন  থাকতো না, স্বপ্ন তখন বাস্তবে পরিণত হতে পারতো। 
 
৩ মনের মধ্যেই জীবনের সাফল্যের চাবিকাঠি লুকোনো আছে। মানুষের মনের শক্তি আমাদের ধারণার বাইরে, আমাদের কল্পনারও বাইরে । এক অনন্ত পরমাণু শক্তি লুকিয়ে আছে আমাদের মনের মধ্যে। আমরা তার পরিমাপ জানিনা। বলা হয়ে থাকে মনের  এই অব্যক্ত অসীম শক্তির  মাত্র ৫ থেকে ১০ ভাগ, মানুষ ব্যবহার করতে পারে। এমনকি এলবার্ট আইনস্টাইন যিনি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী, মাত্র ১০-১৫ ভাগ মনেরশক্তি ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ মানসিক শক্তি অব্যবহৃত হয়ে পড়ে  থাকে। এই শক্তির ব্যবহার আমরা যত বাড়াতে পারবো, আমাদের জীবন তত সুখ, শান্তি, সুস্বাস্থ্য,  সমৃদ্ধি, সফলতায় ভোরে উঠবে । আর এই মনকে জাগ্রত করবার উপায় হচ্ছে মনকে চার্জ করা, উজ্জীবিত বা  উদ্দীপিত করা। হাড়ির জলের   মধ্যে আলু  নিচে পরে থাকে। আর আগুন দিয়ে  জ্বাল দিলেই আলু উপরে উঠে আসে। আর এই আগুন হচ্ছে আমাদের চিন্তা, চিন্তারূপ উত্তাপ মনরূপ আলুকে ভাসিয়ে তুলবে। কিভাবে সেটি সম্ভব হবে ?

৪ মন  একটি বিষ্ময়কর কম্পিউটার। আর কম্পিউটারে আপনি যেমন যেমন তথ্য ঢোকাবেন, সেই অনুযায়ী কম্পিউটার ফলাফল দেবে। ঠিক তেমনি আমাদের মনের মধ্যে আমরা যেমন যেমন তথ্য অনুপ্রবেশ করাবো, মন তেমনি ফলাফল দেবে। জীবন মনের প্রতিফলন  মাত্র। মনে যা কিছু উদয় হচ্ছে, আমাদের জীবন সেই মতো প্রতিভাত হচ্ছে। 

৫. ঈশ্বরকে কেউ দেখে  নি, তবু ঈশ্বর আছেন, মনকে কেউ দেখে নি, তবু মন আছে, জীবন বলে কিছু দেখা যায়  না, তবু জীবন আছে আমাদের অভিজ্ঞতাতে। মন সূক্ষ্ম পদার্থ।  সূক্ষ্ম মনের স্থূল রূপ হচ্ছে, আমাদের মস্তিস্ক। মস্তিস্ক হচ্ছে পদার্থের সূক্ষতম অংশ যা রাসায়নিক বৈশিষ্ঠ সম্পন্ন। অসীম সূক্ষ্মতম শক্তির আধার এই মস্তিস্ক, যার মধ্যে আছে স্ফুলিঙ্গ বা বিদ্যুৎশক্তি । অসংখ্য অনু-পরমাণু যার রস নিঃসরণের ক্ষমতা আছে, অর্থাৎ রাসায়নিক বিক্রিয়ার ক্ষমতা আছে - আবার বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের ক্ষমতা আছে, এমনিতর অসংখ্য অনু-পরমাণুর  সমষ্টি হচ্ছে আমাদের মস্তিস্ক। অর্থাৎ বিদ্যুৎশক্তি ও তরঙ্গশক্তি সম্পন্ন আমাদের মস্তিস্ক। 

৬. প্রকৃতি মনের মাধ্যমে জীবজগৎ নিয়ে খেলা করছে। মস্তিস্ক হচ্ছে মনের খেলাঘর বা মাধ্যম। মস্তিস্ক চিন্তা করতে পারে না, মন চিন্তা করতে পারে, মস্তিষ্কের মাধ্যমে। তাই মন মস্তিষ্কের থেকে উচ্চস্তরের । আর এই মনই মস্তিষ্কের মাধ্যমে দেহকে  নিয়ন্ত্রণ করছে। দেহ মনের দাস। ইন্দ্রিয়  প্রাণশক্তির সাহায্যে কাজ করে থাকে, আর প্রাণশক্তি থাকে মনের নিয়ন্ত্রণে। তাই  মনকে বাদ  দিয়ে, দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। মন ও দেহ পরস্পর সম্পর্কিত। মানসিক শক্তি ও শারীরিক শক্তি একজন আরেকজনকে সাহায্য করে থাকে। তাই শরীরের বিশ্রাম, মনের চিন্তা শক্তিকে, বৌদ্ধিক শক্তিকে বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করে থাকে। তাই মন যখন সক্রিয় হয়, মনের ক্ষমতা যখন বেড়ে যায়, তখন শরীরের ক্ষমতাও বেড়ে যায়। আবার মনের উচ্চচিন্তা পবিত্র চিন্তা শরীরকে আবেগে পরিপূর্ন করে রাখে। এক পবিত্র শান্তি বিরাজ করে তখন  আমাদের শরীরে।

৭. মন কিভাবে চলে ? মন চলে বিশ্বাসের উপরে ভর করে। বিশ্বাস হচ্ছে একটা চিন্তা একটা ভাব যা মনের মধ্যে বিরাজ করছে, এবং স্বীকার করে নিয়েছে। মন কখনো বাহ্যিক ক্রিয়াকে তৈরি করে না, কিন্তু বাহ্যিক ক্রিয়াকে সেই ভাবেই সে গ্রহণ করে, যা সে বিশ্বাস করে। এথেকে বোঝা যায় যে মানুষের জীবন বিশ্বাসের উপরে চলে,যা সে ঘটনার উপরে আরোপ করে থাকে । আপনার ভবিষ্যৎ আপনার চিন্তার ধরনের উপরে নির্ভর করছে। ভালো কিছু চিন্তা, আপনাকে ভালো কিছুর জন্ম দেবে। মন তাকেই বাস্তবে পরিণত  করবে, যা আপনি বিশ্বাস করেন। তাই সবসময়, যেকোনো কাজে  আমাদের সফলতা নিয়েই চিন্তা করতে হবে। আর আপনি যা চিন্তা করবেন, তাই হবে। তাই কথায় বলা হয়ে থেকে, আপনি যা চিন্তা করবেন, আপনি তাই হয়ে যাবেন। 

৮. আপনার মন হচ্ছে একটা একটা রেডিও স্টেশন, যেখানে যাকিছু সংবাদ আসছে, তাই সম্প্রচারিত হচ্ছে। যেমন গ্রহণ করছে, তেমন প্রচার করছে। চিন্তা হচ্ছে একটা শক্তি, যা আমাদের মন থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে।  একটা পরীক্ষা করে দেখুন : একই ঘরে বসে আছেন এমন কারুর প্রতি মনোযোগ দিন। এবং মনে মনে বলতে থাকুন, আমার দিকে তাকাও - আমার দিকে তাকাও। একটু পরে দেখবেন, যার প্রতি আপনি মনোযোগ দিয়েছিলেন, যাকে  আপনি আপনার দিকে তাকাতে বলছেন, সে আপনার দিকে ফিরে তাকিয়েছে। এটি একটি সাধারণ পর্যবেক্ষন মাত্র - যার দ্বারা বোঝা যায়, যে চিন্তা একটা শক্তি যা নিক্ষেপ করা যেতে পারে। মন যে চিন্তাতরঙ্গ সৃষ্টি করে, সেই  তরঙ্গের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। দেশ কাল ছাড়িয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।  
আমরা যখন পতঞ্জলি দর্শন*-এর বিভূতিপাদ  নিয়ে আলোচনা করেছি, তখন আমরা শুনেছি, মানুষ কিভাবে মানসচক্ষু  দিয়ে ভূত ভবিষ্যৎ জানতে পারে। ভবিষ্যতের গর্ভে কি আছে, তাও মানুষ মানসচক্ষুতে  দেখতে পারে। যদিও এই বিদ্যা সাহজলভ্য নয়, কিন্তু সত্য-দ্রষ্টা  ঋষিদের কাছে, পরীক্ষিত সত্য। তো মনের শক্তি অসীম। এই শক্তিকে আমরা অনুমানের মধ্যেও আন্তে পারি না। 

ঘটনার উর্দ্ধে মন। শারীরিক ক্রিয়াহীন হয়েও, মন ঘটনাকে প্রভাবিত করতে পারে। গভীর মনোযোগ আমাদের অভিলাষকে এমনকি আশঙ্কাকে  বাস্তবে পরিণত  করতে পারে। তো মনটাকে আমাদের ভালোভাবে বুঝতে হবে। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।  
--------------------------------------
জীবন রহস্যঃ (৬)  THE SECRET OF LIFE (VI)

মনের রহস্যঃ (২) 

মনের কথা আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই  মনকে বুঝতে হবে , মন দুই রকম, একটা হচ্ছে সমষ্টি  মন, অপরটি ব্যষ্টি মন। সমষ্টি মন আমাদের  সবার মধ্যেই আছে। আর একেই বলা হয়ে থাকে ঈশ্বর। মনই ব্রহ্ম। জগতের সমস্ত কার্য্যের কারন হচ্ছে এই সমষ্টি মন। মানুষের জন্মগত - বা জাতিগত প্রাপ্তি এই সমষ্টিগত মনের থেকে এসে থাকে। আমাদের যে ইচ্ছেশক্তি, আমাদের যে চেতন শক্তি, এগুলো সবই সমষ্টিগত মন থেকে আমরা পেয়ে থাকি। সমষ্টি মন অসীম-অনন্ত।  এই মনের সৃষ্টি করা যায় না, এই মনের ধংশও  নেই।  এই মনের শক্তি অক্ষয় অবিনশ্বর । আর একটা হচ্ছে ব্যষ্টি  মন যা সমষ্টি মনের অংশ। ব্যষ্টি  মনে  যখন সমষ্টি মনের জ্ঞান জাগ্রত হয়, তখন ব্যষ্টি  মনের শক্তিও অসীম অপ্রতুল হয়ে ওঠে। ব্যষ্টি  মনের কর্ম্মক্ষেত্ৰ তিনটি। বা মনের কর্ম্মধারা তিন ভাবে সম্পন্ন হয়ে থাকে।  

প্রথম হচ্ছে চেতন মনের স্তর দ্বিতীয়তঃ অবচেতন মনের স্তর তৃতীয়তঃ অতিচেতন মনের স্তর। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ দুটো মনের স্তরে ঘোড়া ফেরা করে থাকে, চেতন ও অবচেতন। তাই আমরা এই দুটো মন নিয়ে আলোচনা করবো। যদিও উপনিষদ  বলছেন, মনের আর একটা স্তর আছে, যাকে বলা হয়, মনের নিষ্ক্রিয় স্তর। যীশুকে যখন ক্রশবিদ্ধ করা হয়েছিল, তখন তিনি তার দেহ থেকে মনকে আলাদা করে রেখেছিলেন। মনের আর একটা স্তর আছে একে বলা হয় তুরীয় অবস্থা। যারা কৈবল্যের অধিকারী তারা এই তুরীয় অবস্থায় বিচরণ করেন।  উপনিষদে ব্রহ্মার চার অবস্থার কথা বলা হয়েছে,  জাগ্রত-স্বপ্ন-সুষুপ্তি-তুরীয়। তো মনের তিনটি কর্ম্মধারা ও একটি বিশ্রামের স্থল। 
আমরা জানি মস্তিস্ক চিন্তা করে না, চিন্তা করে আমাদের মন। মন চিন্তার জন্য মস্তিষ্ককে ব্যবহার করে মাত্র। চেতন মন ইন্দ্রিয় দ্বারা লব্ধ জ্ঞানকে মস্তিষ্কের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করে তোলে।  আর এই জ্ঞান সে বিচার-বুদ্ধি সহযোগে প্রয়োগ করে থাকে। চেতন মন সমস্ত কিছুর অস্তিত্ত্বের অনুভব করে। অন্যদিকে অবচেতন মন এই জ্ঞানকে সংরক্ষন  করে, অর্থাৎ যা সে অনুভব করেছে, অর্থাৎ যা সে অনুভব করছে পরবর্তীতে সে এটা স্মৃতি হিসেবে ফিরিয়ে দেয়। সবশেষে অতিচেতন মন তার এই জ্ঞান শক্তিকে বিশ্বশক্তির সঙ্গে  একতানে নিয়ে আসে। আমরা যেমন বিনার তার একসুরে বেঁধে নিয়ে, তবে গান শুরু করি।  এইভাবে আমাদের জ্ঞানশক্তি বা  উপলব্ধি অতিচেতন মনের স্তরে এসে ঐশ্বরিক অনুভূতি লাভ করে থাকে।  

চেতন মন হচ্ছে মানুষের চিন্তা করবার ক্ষমতা, মানুষের জীবনীশক্তি। সাধারণত একজন মানুষ তার নিজের অস্তিত্ত্ব সম্পর্কে স্বীকৃতি পায় এই চেতন মনের স্তরে। চেতন মন যে কোনো জাগতিক বস্তুকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে  অনুভব করবার শক্তি যোগায়। কিন্তু এই  অভিজ্ঞতাকে  সে ধরে রাখতে পারে না। চেতন মন কখনো সন্মোহিত, অর্থাৎ বিচারবুদ্ধি  হীন হয় না।  আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যা কিছু তাৎক্ষণিক  সিদ্ধান্ত নেই, তা এই চেতন মন করে থাকে। যেমন দোকানে গিয়ে কোন  বইটা, বা কোন জামাটা কিনবো, তা এই চেতন মন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কোনো পথে গেলে আমার গন্তব্যে পৌঁছবো, তা এই চেতন মন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কি খাবো, কি পড়বো, তা এই চেতন মন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এই চেতন মন আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাহায্যে জ্ঞান সংগ্রহ করে, তার পর সেই জ্ঞান  মস্তিষ্কের মাধ্যমে অবচেতন মনের স্তরে পাঠিয়ে দেয়। মানুষ পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যা  অনুভব করে, তাকে সে বিশ্বাস করে। এবং এই বিশ্বাস সে তার অবচেতন মনের স্তরে পাঠিয়ে দেয়। আর অবচেতন মন বিশ্বাসকে  সংরক্ষণ করে,  ভবিষ্যতের তথ্য হিসেবে। অবচেতন মন কখনো এই বিশ্বাসকে প্রশ্ন করে না। যেমন পায়  তেমনি রেখে দেয়। আর এই জন্য, অবচেতন মন যখন যাকিছু সংরক্ষণ করে, তা সেই অবস্থাতেই থেকে যায়। এমনকি ইন্দ্রিয়ের ভ্রমে যদি চেতন  মন  ভুল অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়, অর্থাৎ মরীচিকাকে যদি সে জল হিসেবে দেখে, দড়িকে সে যদি স্যাপ হিসেবে ভাবে, তবে অবচেতন মন সেই বিশ্বাসকেই সে স্মৃতিতে রেখে দেয়। এই কারনেই অবচেতন মনে যাকিছু পাঠাচ্ছেন খেয়াল করবেন তা যেন হ্যাঁ-সূচক হয়। একবার আপনার অবচেতন মনে কোনো ভাবনা  ঢুকে গেলে, এই ভাবনায় আপনার জীবনে প্রতিফলিত হবে ভবিষ্যতে। চেতন মন কখনো কোনো ভাবনা, যা একবার আমাদের অবচেতন মনে ঢুকে গেছে  তাকে মনে করতে পারে না। চেতন মনকে এই ব্যাপারে, অর্থাৎ পুরোনো অভিজ্ঞতাকে মনে করতে গেলে অবচেতন মনের দ্বারস্থ হতে হয়। চেতন মন আসলে একটা চালুনি, ঝাঁজরি অর্থাৎ বাইরে সে যাকিছু দেখছে, শুনছে, অনুভব করছে, সেটাকে সে বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে, একটা বিশ্বাস তৈরী করে।  এবং তৎক্ষণাৎ সেই  বিশ্বাস বা ভাবনা সে অবচেতন মনে পাঠিয়ে দেয় ভবিষতে ব্যবহারের জন্য। অবচেতন মন সেগুলোকে সংরক্ষণ করে স্মৃতি হিসেবে। এবং প্রয়োজনে এই স্মৃতি থেকে সেই ভাবনার ব্যবহারিক প্রয়োগ করে থাকে। 

এইজন্য অবচেতন মনকে বলা হয়ে থাকে একটা সংগ্রহশালা। যেখানে বিশ্বাস, অনুভব, ভাবনা যা চেতন মন সংগ্রহ করেছিল, সেগুলোকে সে স্মৃতির ভাণ্ডারে সুরক্ষিত করে রাখে। স্মৃতি হচ্ছে আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা, ভাবনা, চিন্তার ফসল। যা কিছুদিন পরে, বা অনেকদিন পরে আমাদের কাজে লাগতে পারে। অবচেতন মন কখনো কাল্পনিক ঘটনা  ও সত্যিকারের অভিজ্ঞতার মধ্যে কোনো পার্থক্য করতে পারে না। অবচেতন মন বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে কাজ করে থাকে কিন্তু আত্মসচেতন জ্ঞান দিয়ে নয়। অবচেতন মন চেতন মনের ভাবনাগুলোকে ভবিষ্যতে কার্যকরী করে থাকে। অবচেতন মন ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান থেকে চেতন মনের  মাধ্যমে আসা জ্ঞানকে স্বতঃস্ফূর্ত অবস্থায় নিয়ে আসে এবং অন্তর্দৃষ্টিতে পরিণত  করতে পারে। 

একবার যখন অবচেতন মন কোনো ভাবনাকে গ্রহণ  করে, তখন সে দ্রুত সেই ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত  করবার জন্য ক্রিয়া শুরু করে দেয় । এই জন্য আমরা চেতন মনে যা কিছু ভাবি, আমাদের সামনে তাই উপস্থিত হয়। এইজন্য দেখা যায় বহু অযোগ্য ব্যক্তি অনেক কিছু পায় যা সে নিজের যোগ্যতায় পাবার কথা ছিল না। আসলে সে যা ভেবেছে, সে তাই পেয়েছে। যোগ্যতা মানুষকে লক্ষে পৌঁছে দিতে পারে না, কিন্তু সঠিক ভাবনা মানুষকে তার বাঞ্চিত  ফল পাইয়ে দিতে পারে সহজেই। আমরা তাই পাই যা আমরা বিশ্বাস করি, যা আমরা ভাবি। যোগ্যতা অনুযায়ী আমরা কিছুই পাই না। আমরা আমাদের ভাবনাকে যে পথে নিয়ে যাই, সেই মতো প্রাপ্তি ঘটে। আপনার ভাবনা ভালো হলে আপনাকে ভালো অনুসরণ করবে। আপনি হ্যাঁ বলবেন, আপনার জীবনে হ্যাঁ আসবে।  আপনি না বলবেন, আপনার জীবনে না-ই আসবে। আপনার ভাবনার মধ্যে দ্বন্দ থাকবে তো আপনার জীবনের প্রাপ্তি হবে দ্বন্দ। আমি পাশ করবো, ভাবলে আপনি পাশ করবেন।  তাই সারা বছর ধরে ভাবুন, আমি পাশ করবোই, তবে অবশ্য়ই আপনি পাশ করবেন। মেয়ের বিয়ে হবে, কি হবে না, ভাববেন, তো আপনার মেয়ের বিয়েতে বাধা আসবে। আমার মেয়ের বিয়ে ভালো ঘরে বরে হবে, ভাববেন, অবশ্য়ই আপনার মেয়ের বিয়ে ভালো ঘরে হবেই। আপনি যা কিছু দাবি করছেন, আপনার অবচেতন মন সেগুলোকে বাস্তবে পরিণত করবে। আর যাকিছু আপনি সন্দেহের দৃষ্টিতে ভাবছেন, সেগুলো আপনার জীবনে অধরা থেকে যাবে। অবচেতন মন আপনার মুখের কথায় বিশ্বাস করে না, কিন্তু আপনার ভাবনার গুরুত্ত্ব দেয়। আপনার মধ্যে যখন দৃঢ় প্রত্যয় হবে, তখন অবচেতন মন আপনাকে  অনুপ্রেরণা যোগাবে, সেই কাজে লিপ্ত হবার জন্য। আপনি ভাবেন না আপনার মন আকাশ থেকে কোনো কিছু আপনার কাছে এনে দেবে, কিন্তু আপনার ভিতরে যখন কোনো কিছু পাবার জন্য আকুলতা জন্মাবে, তখন আপনি খেয়াল করবেন, আপনার কাছে তখন সেই কাজগুলোই গুরুত্ত্ব পাবে, যা আপনাকে আকাঙ্খিত ফল দিতে পারে। কথায় বলে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। আপনার ইচ্ছে যত  প্রবল হবে, আপনি ইচ্ছে পূরণের জন্য যত  আকুল হবেন, আপনার কাছে তখন উপায় এসে যাবে। আপনি তখন এই উপায়গুলোকে কাজে লাগাতে যাবেন, আর ফল আপনার দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে।  তবে হ্যাঁ সব কিছুর একটা সময় আছে, বীজ থেকে গাছ, গাছ থেকে ফুল, ফুল থেকে ফল তৈরী হতে একটা সময় লাগে, সেই সময় পর্যন্ত আপনাকে লক্ষে লেগে থাকতে হবে। এবং অপেক্ষা করতে হবে।  সব কিছুর একটা নিয়ম আছে, নিয়ম ছাড়া এই পৃথিবীতে কিছু হয় না। প্রকৃতির নিয়ম,  রাষ্ট্রের নিয়ম, জীবের বেঁচে খাবার নিয়ম।  সবাই আমরা নিয়মে বাঁধা।  নিয়মের বাইরে কেউ নয়। তেমনি আমাদের মন যখন ক্রিয়া করে তখন তার একটা নিয়মে চলতে হয়। নিয়ম যখন আমাদের জীবনধারার সঙ্গে সঙ্গতিসম্পন্ন হবে, তখন আমাদের জীবন হবে আরো বেশি সুখী সমৃদ্ধ আনন্দপূর্ণ।

জীবনে আপনি কি চান ? কিভাবে সেগুলো পেতে পারেন  ? আপনার জীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিন। সিদ্ধান্তগুলোকে কার্যকরী করবার জন্য, একটা পরিকল্পনা করুন। পরিকল্পনা রূপায়ন করবার জন্য, নিজের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করুন।  যতক্ষন আপনার লক্ষ পূরণ না হচ্ছে, ততক্ষন দাতকাম্ড়ে লেগে থাকুন। 
প্রকৃতি যেমন একটা নিয়মে বাঁধা, আপনি জানবেন মানুষের অস্তিত্ত্বও কিছু নিয়মে বাঁধা। আমাদের শারীরিক অসুস্থতার যেমন একটা কারন আছে, আমাদের মানসিক দুঃখের যেমন একটা কারন আছে, তেমনি যেকোনো কাজে সফলতার বা অসফলতার একটা কারন আছে। আর এই কারণগুলোকে খুঁজে বের করবার প্রয়াস করুন। দেখবেন কারণগুলো সবই আপনি  জানেন, আপনার মনের ভিতরেই সব কারন লুকিয়ে আছে । আর  আপনি যা জানেন, তার ভিত্তিতেই সমস্যার সমাধানের প্রয়াস করুন। আপনার সাফল্য নিশ্চিত। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।
 
জীবন রহস্যঃ (৭)  THE SECRET OF LIFE (VII)

অবচেতন মনের রহস্যঃ 

নিজের সঙ্গে কথা বলুন। 

এর মধ্যে আমরা বুঝে গেছি, আমাদের শরীর দুই ধরনের ক্রিয়া করে থাকে, একটা হচ্ছে তার বাহ্যিক ক্রিয়া, যা আমরা সরাসরি ইন্দ্রিয় বা আমাদের শারীরিক অঙ্গাদি দ্বারা সম্পন্ন করে থাকি।  এই ক্রিয়া আমাদের ইচ্ছাধীন।  অর্থাৎ এগুলো আমরা ইচ্ছে  করলে করতেও পারি, আবার নাও করতে পারি। যেমন আপনি অফিসে যাবে কি যাবেন না, আপনি বাজারে যাবেন কি যাবেন না, আপনি কোন জামাটা  পড়বেন, আপনি জমিতে চাষ করবেন কি করবেন না, আমি বই পড়বেন  কি পড়বেন  না,  এসব ক্রিয়া আমাদের ইচ্ছাধীন।
 কিন্তু কতকগুলো কাজ আছে, যেগুলো আমাদের ইচ্ছের অধীন নয়, এগুলো আমাদের আবশ্যিক  ক্রিয়া, যেমন আমাদের স্বাস-প্রশ্বাস, চোখের পাতা ফেলা, হজম করা,  শরীর থেকে ঘাম বা মলমূত্র  নির্গত করা। এমনকি এই শরীরের ক্ষয়-বৃদ্ধি, রক্ত উৎপাদন রজঃ-বীর্য উৎপাদন, এগুলো সবই আবশ্যিক ক্রিয়া ।  এমনি অনেক কাজ আছে, যা আমাদের জন্য আবশ্যিক আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এগুলো  স্বয়ংক্রিয়। অর্থাৎ এর জন্য আমাদের বিশেষ কোনো প্রয়াস করতে হয় না। এইসব কাজ আমাদের  শরীরের ভিতরে এমনি এমনি চলছে এবং এই কাজে আমাদের কোনো ক্লান্তি নেই, বিশ্রামও  নেই, এই কাজের জন্য আমাদের কোনো জ্ঞান সঞ্চয় করতে হয় না। জ্ঞানী অজ্ঞানী, ধনী-গরিব  সবাই এই কাজ করতে পারে। জন্মসূত্রেই আমরা এইসব ক্রিয়া করবার জন্য আমাদের ভিতরে কেউ একজন একটা শক্তি দিয়েছেন। এই শক্তি যদি না থাকতো তবে আমাদের এই শরীর দৃশ্যমান থাকতো না। বেঁচেও থাকতে পারতো না, বেড়েও উঠতে পারতো না। আর একেই আমরা বলে থাকি ঈশ্বরের শক্তি। একটা  ক্ষুদ্র ঈশ্বর আছেন আমাদের সবার মধ্যে যিনি  আমাকে আপনাকে  বাঁচিয়ে রেখেছেন । 

তো যে শক্তি আমাদের আবশ্যিক ক্রিয়াগুলো করায়, সেই একই  শক্তির  আর একটা দিক আবার এই ঐচ্ছিক ক্রিয়াগুলো করায় । প্রথম দিকে এটা বুঝতে আমাদের একটু অসুবিধা হবে। কিন্তু ধীরে ধীরে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। আমাদের যেমন ইচ্ছে আছে, তেমনি আছে আবেগ। আমাদের ইচ্ছে থাকে চেতন  মনে। আর আমাদের এই  আবেগের বাসস্থান হচ্ছে অবচেতন মন। আমরা আগেই শুনেছি, আমাদের শরীরের যে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা, অর্থাৎ শ্বাসপ্রশ্বাস, হজমক্রিয়া, ফুসফুসের ক্রিয়া, রক্তসঞ্চালন, বর্জ পদার্থ নিঃসরণ, শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে এই অবচেতন মন। 

শরীরের মধ্যেই  আছে মন।  উপনিষদ বলছে ব্রহ্ম, আমরা বলি জীবাত্মা  বা ঈশ্বর। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে  এই মনের  একটা নিয়ন্ত্রণ কায়েম আছে। মনের নির্দেশ ব্যতীত আমাদের শরীর  এক পাও এগুতে পারে না। আমরা সবাই একটা জীবাত্মা,  একটা শক্তি যা আমাদের শরীর ও মনের  মাধ্যমে  ক্রিয়া করে চলেছে ।
 
দুটো শক্তি, একটা ঋণাত্মক আর একটা ধনাত্মক। দুটো শক্তি একত্রিত হয়ে আলো  জ্বলে ওঠে। আর চেতন মন ও অবচেতন মন  যখন একত্র হয়ে কাজ করে, তখন আমাদের শরীর  মনে একটা ভারসাম্য বজায় থাকে। একেই আমরা স্বাভাবিক সুস্থ অবস্থা বলে থাকি। অন্যদিকে আমাদের চেতন মন  যখন অবচেতন মনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করতে পারে না, তখন আমরা অস্বস্তি বোধ করি।  আমরা অসুস্থ হই, অসুখী হই।   
 অবচেতন মন কখনো এই শরীরকে  অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না, বা অসুস্থ করতে চায় না। যার জন্য, তার যে স্বাভাবিক ক্রিয়া তা সে প্রতিনিয়ত বিরামহীন হীন ভাবে করে চলেছে। এক মুহূর্তের জন্যও  সে বিশ্রাম নেয় না। আর এই বিরামহীন কর্ম্ম চলছে একটা সামঞ্জস্য রক্ষা করে। যতক্ষন চেতন মন ও অবচেতন মনের মধ্যে একটা বোঝাপড়া থাকে, ততক্ষন আমাদের শরীর একটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলে। আর আমরা সুস্থ  বোধ করি।
 কিন্তু যখনি এই চেতন মন ও অবচেতন মন-এর মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব ঘটে তখন আমাদের শরীর-মন   আনচান করতে থাকে। একটা অস্বস্তির অবস্থা সৃষ্টি হয় আমাদের শরীরে। অনিশ্চয়তা, ভয়, দুশ্চিন্তা, রাগ, ঘৃণা ইত্যাদি    আমাদের হৃদ যন্ত্র, পরিপাক যন্ত্র, ফুসফুস-এর স্বাভাবিক কাজকে বাধা সৃষ্টি করে। যার জন্য আপনারা  দেখবেন, এইসময় আমাদের হজমের গোলমাল দেখা দেয়, জোরে জোরে স্বাস-প্রশ্বাস বইতে থাকে। হৃদযন্ত্রের ধুকধুক অর্থাৎ কম্পনের গতি বেড়ে যায়। রক্তের যে স্বাভাবিক গতি তা বেড়ে বা কমে যায়।  অর্থাৎ আমাদের প্রেসার বেড়ে বা কমে যায়। অর্থাৎ  এই যে সব স্বাভাবিক ও স্বয়ংক্রিয় শারীরিক কর্ম্ম পরিচালনা করছিলো যে অবচেতন মন, সে তখন বিরক্ত ও বিব্রত বোধ করছিলো। তাই শরীরের মধ্যে অস্বাভাবিকতা দেখা দিয়েছে।
ধরুন আপনি মিষ্টির দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন, তো আপনার অবচেতন মনে তখন পুরোনো দিনে  মিষ্টি খাবার যে স্বাদ পেয়েছিলেন, সেই স্মৃতি  আপনার মধ্যে মিষ্টি খাবার ইচ্ছেকে  জাগ্রত করে দেবে। কিন্তু আপনার চেতন মন বলবে, না মিষ্টি খেলে সুগার  বেড়ে যেতে পারে।  ডাক্তারবাবু মিষ্টি খেতে নিষেধ করেছেন। তো আপনার মধ্যে একটা দ্বন্দ সৃষ্টি হবে। একটা আবেগের সৃষ্টি হবে।  
যখনই আমাদের মধ্যে আবেগের সৃষ্টি হয়, তখন আমাদের শরীরে একটা রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু হয়। কখনো প্রয়োজন-অতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ হয়, অথবা কম মাত্রায় নিঃসরণ হয়।  এমনকি যে রস নিঃসরণ হয়, তার মধ্যে যে উপাদান যে মাত্রায় থাকবার কথা ছিল, তার ব্যতিক্রম হয়। আর এর ফলে আমাদের মাথাধরা, মেরুদণ্ডে ব্যথা,  চোখে কম দেখা, আলসার (ulcers), এমনকি কর্কট রোগে (cancer) আক্রান্ত হতে পারি আমরা। কিন্তু এই দ্বন্দ যা চেতন মন ও অবচেতন মনের মধ্যে হয়ে থাকে, সেখান থেকে আমরা বেরুবো কি করে ? 

এইজন্য আমরা আমাদের  আরোগ্য লাভের একটা উপায় করতে পারি। নিজের সঙ্গে কথা বলা। আমাদের মধ্যে যে ক্ষুদ্র ঈশ্বর আছেন, তার সঙ্গে কথা বলা। এটি আমাদের অনেকের কাছে পাগলামো মনে হতে পারে। কিন্তু আমরা নিজের সঙ্গে কথা বলেই আমরা আমাদেরকে ভালো রাখতে পারি। আমরা আমাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে পারি, ঈশ্বরের সহযোগিতা নিয়ে।  আমরা আগেই  বলেছি, সৃষ্টিকর্তা আমাদের, তার নিজের আদলে  একজন ছোট্ট-সৃষ্টিকর্তা হিসেবে তৈরী করেছেন।   

একটা উদাহরণ দেই, ধরুন আপনাকে কেউ গালাগালি দিলো, তো তক্ষুনি আপনার খারাপ লাগবে।  এমনকি আপনি সেইসময় তার দিকে তেড়ে যেতে পারেন। তাকে দু ঘা  বসিয়ে দিতে পারেন। আমি বলছি, তা করবেন না, বরং এই সময় দরকার, নিজের সঙ্গে কথা  বলা। নিজেকে বলতে থাকুন, আমি তো কোনো অন্যায় করিনি, ,তাহলে সে কেন বাজে কথা বলছে, হয়তো আজ লোকটার  মাথার ঠিক নেই, হয়তো শরীর  ভালো নেই, হয়তো সকালে সে তার স্ত্রীর কাছ থেকে গালাগাল খেয়েছে। অথবা নিজেকে বলুন যে, লোকটা নিশ্চই পাগল, তাই এইভাবে কথা বলছে। তো এইভাবে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করুন।  না অন্যকে বোঝাতে যাবেন না, ওই মুহূর্তে।  কারন এখন আপনি যাকিছু বলেন না কেন, তার মাথায়  সে কথার যথার্থ অর্থ ঢুকবে না,  এখন সে বুঝবার অবস্থায়  নেই। যদি সম্ভব হয়, পরে কখনো বুঝিয়ে বলবেন, কিন্তু ওই মুহূর্তে আপনি নিজের সঙ্গে কথা বলুন। দেখবেন, আপনার খারাপ লাগবে না, আপনি সুস্থ থাকবেন, আর যে আপনাকে খারাপ কথা বলছিলো, সে জ্বলেপুড়ে মরছে, একসময় শান্ত হয়ে গেছে। আগুন যেমন ইন্ধন না পেলে একসময় নিভে যায়, সেও একসময় চুপ হয়ে যাবে। 

তো যেটা বলছিলাম, যদি বিশ্বাসের উপরে ভর করে, নিজের মনকে নির্দেশ পাঠাতে পারি, তবে আমরা আশ্চার্য্যজনক ভাবে সুস্থ  হয়ে উঠতে পারি। কথায় বলে  প্রত্যেকটি ক্রিয়ার  একটা প্রতিক্রিয়া  আছে। এই নিয়মের উপরে ভর করে, আমরা যদি আমাদের মনকে বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতিনিয়ত দৃঢ় স্বরে নির্দেশ পাঠাতে থাকি, যে আমি সুস্থ হয়ে উঠবোই, সুস্থতাই আমার শরীরের স্বাভাবিক ধর্ম্ম। আমি সুস্থ আছি। এটি যদি প্রকৃত বিশ্বাসের সঙ্গে করা  হয়, বারবার  করা হয়, তবে আমাদের শরীরে আবার  ভারসাম্য ফিরে আসবে। বিশ্বাস হচ্ছে ঔষধ, আর এই বিশ্বাসের উপর ভর করেই আমাদের অবচেতন মন সমস্ত কাজ করে থাকে। আসলে আপনি যাকিছু বিশ্বাস করেন, আপনার অবচেতন মন সেই বিশ্বাসকেই  বাস্তবে পরিণত করে। তাই আপনি যা মনপ্রান দিয়ে বিশ্বাস করেন না,  আপনার অবচেতন মন সেই কাজ কখনো করতে যাবে না। আমরা বিশ্বাস করে যা কিছু চাই না কেন, আমাদের অবচেতন মন সেই বিশ্বাসকেই  কার্যকরী রূপ দেবে, দেবেই দেবে। তাই আপনি হ্যাঁ বললে  হ্যাঁ হবে, আর না বললেন, তো নাই  হবে। কোনো ব্যপারে  আপনার বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকলে, অবচেতন মন সেটাকে না করে দেবে। 

আমরা শুনেছি, উপনিষদ বলছে, মনই ব্রহ্ম। চেতন মনের চিন্তাই অবচেতন মনে দাগ কাটে। অবচেতন মন কখনো যুক্তি তর্কের ধার ধরে না। অবচেতন মনের কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই। তাই বিশ্বাস  যদি দৃঢ় হয়. তবে অবচেতন মন তার উপরই কাজ শুরু করে  দেবে অবশ্য়ই, এবং আপনার বিশ্বাসকে কার্যকর করবে অবশ্য়ই। চেতন মন নির্দেশ দেয় আর সেই  ইচ্ছেকে কার্যকরী  করাই অবচেতন মনের কাজ। অবচেতন মন কখনো, অচেতন হয় না। সবসময় সে সজাগ। নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে। 
জাহাজের উপরে দূরবীন নিয়ে বসে আছে, জাহাজের ক্যাপ্টেন, আর মেশিন ঘরে বসে আছে ড্রাইভার। ক্যাপ্টেন দূরবীন দিয়ে বহির্বিশ্বকে দেখছে, আর ড্রাইভারকে নির্দেশ দিচ্ছে। ক্যাপ্টেন যেমন যেমন নির্দেশ দিচ্ছে, ড্রাইভার সেই মতো কাজ করছে। জাহাজের ড্রাইভার ক্যাপ্টেনের  নির্দেশকে কখনো অস্বীকার করে না, কখনো জানতে চায় না কেন করবো, কখনো প্রতিবাদ করে না। ঠিক তেমনি আমাদের চেতন মন ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বহির্বিশ্বকে দেখছে, আর অবচেতন মনের কাছে বিশ্বাসরূপ নির্দেশ পাঠাচ্ছে। অবচেতন মন সেইমতো বিশ্বাসকে কার্য্যে পরিণত করছে।   

তাই আমাদের যেটা করতে হবে, সেটি হচ্ছে, প্রতিনিয়ত নিজের সাথে সচেতন ভাবে কথা বলুন। এবং মনকে সদর্থক নির্দেশ পাঠান। আর আপনি যা কিছু নির্দেশ আপনার অবচেতন মনকে পাঠাবেন, অবচেতন মন সেটাকেই কার্যকরী রূপ দেবে।

এখন কথা হচ্ছে, আমরা কি বলবো। আমাদের ঋষিগণ যে সব মন্ত্রের কথা বলেছেন, আপনি খেয়াল করে দেখবেন, সেখানে কিছু প্রার্থনা ও কিছু স্তুতি আছে।  প্রার্থনা হচ্ছে, বিশ্বশক্তির কাছে নিজের ইচ্ছে প্রকাশ করা। শুধু দাও দাও করা। জ্ঞান দাও, ভক্তি দাও, শক্তি দাও, ধন দাও, সম্পদ দাও, মুক্তি দাও ইত্যাদি ইত্যাদি  আর স্তূতি  হচ্ছে দেবতাদের গুনের বর্ণনা।  

আপনি যদি বারবার এই মন্ত্রের সঠিক অর্থ জেনে মনে মনে উচ্চারণ  করতে থাকেন, তবে আমাদের অবচেতন মনে একটা সদর্থক বার্তা পৌঁছে যায়।  আর সেইমতো সে কাজ করা শুরু করে দেয়।  সেইজন্য মুনিঋষিগন আমাদের বারবার জপ-তপের  কথা বলেছেন। অর্থাৎ ঈস্বররূপ জীবাত্মার সঙ্গে কথা, ঈস্বররূপ নিজের সঙ্গে কথা বলা। আপনার যা কিছু কামনা বাসনা, তা পাবার যোগ্যতা আপনার আছে, শুধু আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে, যে এটা আপনি পেতে পারেন। আর এই বিশ্বাস আপনার অবচেতন মনকে ক্রিয়া করতে বাধ্য করবে। আপনি বাঞ্চিত ফলের অধিকারী হবেন। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃশান্তিঃ। হরি ওম। 

জীবন রহস্যঃ (৮)  THE SECRET OF LIFE (VIII)

অবচেতন মনের রহস্যঃ : সঠিক বার্তা পাঠান 

একটু খেয়াল করলে বুঝতে  পারবেন, আপনার চারিদিকে সব পন্ডিতের বাস। আপনার চারিদিকে বুদ্ধিমানলোকেরা  ঘোরাফেরা করছে। এরা  আপনাকে প্রতিক্ষনে প্রভাবিত করছে। আপনার চারিদিকে প্রভাবশালী লোক। তা সে আপনার মা-বাবা হতে পারে, আপনার প্রতিবেশী  হতে পারে, আপনার স্কুলের মাস্টারমহাশয় হতে পারেন, আবার আপনার অফিসের বস হতে পারে, এমনকি বিভিন্ন বই, বা শাস্ত্রগ্রন্থের লেখক হতে পারে।  তারা আপনাকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করছে।  আপনি তাদের কথাগুলো শুনছেন, গিলছেন, আর আপনার মধ্যে এগুলোর প্রভাব পড়ছে। আপনি অনেক নতুন কিছু শিখছেন, আর এতে আপনি আনন্দ পাচ্ছেন, আপনি দুঃখ পাচ্ছেন, আপনার মধ্যে একটা পরিবর্তন হচ্ছে। আপনার পরিবার, আপনার সমাজ, আপনার প্রাকৃতিক অবস্থা, প্রতিনিয়ত আপনার মধ্যে পরিবর্তন করছে। তা সে আপনি বুঝুন আর না বুঝুন।  আর এই যে পরিবর্তন আপনার মধ্যে হচ্ছে, সেটা হচ্ছে তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী, সমাজের ইচ্ছে ইনুযায়ী । আপনার ইচ্ছে মতো হচ্ছে না। কিন্তু আমরা তো চাই আমাকে আমার মতো তৈরী করতে, আমার  ইচ্ছে মতো তৈরী করতে। আমার প্রত্যাশিত বস্তু চাই, আমাকে আমার মতো করে উন্নত করতে চাই। । আমার জীবনে সাফল্য আমার ইচ্ছে মতো করতে চাইলে, এইসব কথা শোনা বন্ধ  করতে হবে। এদেরকে আপনার জীবনে বেশি গুরুত্ত্ব দেওয়া চলবে না। কিন্তু এদের থেকে তো আমি দূরে চলে যেতে পারবো না। তাহলে কি করবো ? আমি আমার মতো কিভাবে হবো ?   

আমরা বলছি, আপনি এই কথাগুলোকে শোনা  বন্ধ তো  করতে পারবেন না, কিন্তু এদের কথাগুলোকে উপেক্ষা করতে পারবেন যদি আপনি নিজেকে এদের থেকে আলাদা করতে পারেন। তো এদের থেকে নিজেকে আলাদা করবেন কি করে ? দেখুন জল দুধকে অনায়াসে গুলিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু সেই দুধ থেকে তৈরী মাখনকে কিন্তু জল আর গুলিয়ে ফেলতে পারে না,  তার সঙ্গে মেশাতেও  পারে না। তো আপনাকে দুধ থেকে মাখন হতে হবে। কিন্তু আপনি তো আর পাঁচজনের মতোই একজন সামাজিক মানুষ।  এদের থেকে আপনি কিভাবে নিজেকে আলাদা করবেন ? সেই জন্য আপনাকে প্রতিদিন একটু একটু করে তৈরী করতে হবে। আর সেটাই হচ্ছে সাধনা। এই সাধনা করতে হবে নিভৃতে, নির্জনে। নিজের মনকে সান দিন। সান দেওয়া বোঝেন তো, ধার দেওয়া। কাঠ মিস্ত্রিরা দেখবেন, বাড়িতে এসেই প্রথমে কিছুক্ষন বাটালি, করাত ইত্যাদিতে ধার দেওয়া শুরু করে।  আর এর জন্য অনেকটা সময় নষ্ট হয়।  কিছুক্ষন কাঠের কাজ করবার পরেই আবার ধার দেওয়া শুরু করে। আর এই ধার দেওয়া যন্ত্র দিয়ে যখন সে কাজ করে, তখন  তার কাজ যেমন দ্রুত হয়, তেমনি নিখুদ হয়। এই কাজটাই আপনাকে করতে হবে। অর্থাৎ আপনার মনকে প্রতিদিন কিছুটা সময় শান   দিতে হবে। শান  দিলে যেমন যন্ত্র তীক্ষ্ণ হয়, তেমনি  প্রতিদিন যদি মনটাকে শান   দিতে পারেন, তবে আপনার মনের  বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি পাবে। আর কোন্ কথার কতটা গুরুত্ত্ব, সেটা বুঝবার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।আপনি যদি জলের স্বভাব অর্জন করতে পারেন, তবে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ এলেও, আপনার কিছু হবে না।  কিন্তু আপনি যদি নিজেকে  পেট্রোলের মতো করে রাখেন, তবে বাইরে থেকে আসা আগুনের ফুলকি আপনাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেবে।    

তাই আপনি যদি নিজেকে আপনার ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করতে চান তবে এদের কথাগুলোকে গুরুত্ত্ব দেবেন না। আপনি সেই কথাগুলোই  শুনুন, যা আপনার ভিতর থেকে আসছে, আর সেই কথাগুলো উপেক্ষা করুন, যা বাইরে থেকে আসছে। আপনার ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে, আপনার ভিতরে। আপনার সফলতা অসফলতা নির্ভর করছে আপনার নিজের চিন্তার ধরনের উপরে। বাইরে থেকে আসা কোনো কিছু, আপনাকে আপনার মতো করে তৈরী করতে পারবে না। আপনি যখন  বাইরের কথা শুনবেন,  আপনি তখন তাদের মতো হবার চেষ্টা করবেন, হয়তো তাদের মতোই হয়ে উঠবেন। 

মনোবিজ্ঞানীগন বলছেন, এমনকি আধুনিক চিকিৎসকগন বলছেন,  আপনার অসুস্থ শরীর, আপনার মনের অশান্তি, আপনার দারিদ্র - এগুলো আপনার নঞৰ্থক চিন্তার ফল। আর এই নঞৰ্থক চিন্তাগুলো বেশিরভাগ আসে বাইরে থেকে। প্রকৃতি, সমাজ,পরিবেশ আপনার উপরে প্রভাব ফেলছে, আর তার কুপ্রভাব আপনাকে অসুস্থ করছে, আপনার অধোগতির কারন হচ্ছে এই নঞৰ্থক চিন্তা । তোর  দ্বারা কিচ্ছু হবে না, তুই অপদার্থ, সবাই চাকরি পেয়ে গেলো, তোর মামা-কাকাও নেই, তো চাকরি হবে না, তুই ব্রাহ্মণ ঘরে জন্মেছিস, তোর জন্য বিশেষ সুবিধা রাষ্ট্র করে দেবে না। তোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তুই গরিবের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছিস, তুই অব্রাহ্মণ, সমাজটাতো ব্রাহ্মণদের দাপটে চলছে, অনুন্নত শ্রেণীর কথা কে ভাবে ? ইত্যাদি ইত্যাদি।  এইসব কথা গুলো আসে, বাইরে থেকে।  নঞৰ্থক কথা আমরা বাইরে থেকেই বেশিরভাগ সংগ্রহ করে থাকি। আর নিজেরা একটা হীনমন্যতায় ভুগি। নিজের প্রতি বিশ্বাস হারাই। আর এই বিশ্বাস হারানোই আমাদের অধোগতির কারন। আপনার এই যে অধোগতি, তার পরিবর্তন করতে গেলে, আপনাকে আপনার চিন্তাধারার মধ্যে পরিবর্তন আনতে  হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে কি সেই নতুন  চিন্তা যা আমাদেরকে  পরিবর্তন করতে পারে ? তাই বলছি, বাইরের কথা নয়, নিজের ভিতরের কথাগুলো শুনুন। আর বাইরের কথাগুলোকে অবজ্ঞা করুন। 

দ্বিতীয়ত, দুটো চিন্তা একসাথে করা চলবে না। হ্যাঁ-সূচক আবার না-সূচক চিন্তা একসাথে করা চলবে না। এই দুধরনের চিন্তা আপনার মধ্যে যখন আসবে, জানবেন আপনার মধ্যে তখন দ্বন্দ উপস্থিত হবে। আপনি যখন খাচ্ছেন, তখন অফিসের চিন্তা বাদ  দিন, ছেলেমেয়ের চিন্তা বাদ দিন।  আপনি যখন ঠাকুরের ধ্যানে বসেছেন, তখন মোবাইলটাকে বন্ধ রাখুন। সব চিন্তা বাদ  দিয়ে ঠাকুরের চিন্তাই করুন। দুই ধরনের চিন্তার মধ্যে যারা একসঙ্গে প্রবেশ করে, তাদের মধ্যে দ্বন্দ আসে, এবং তারা কখনোই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এদের নার্ভাস সিস্টেম দুর্বল। এরা সব সময় বিভ্রান্ত থাকে। 

আপনার সুনিয়ন্ত্রিত চিন্তা, আপনাকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে যেতে পারে। আপনার সমস্ত 
উচ্চাকাঙ্খ্যাকে  পূরণ করতে পারে। সুনিয়ন্ত্রিত চিন্তা আসলে জীবনকে সফলতায় ভরিয়ে দিতে পারে ।  প্রত্যেকের  জীবনে সফলতার চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে তার চিন্তার মধ্যে, তার নিয়ন্ত্রিত চিন্তার মধ্যে। এটা এমন একটা কারিগরি বিদ্যা যা আপনাকে অর্থ উপার্জনে সাহায্য করবে, সুস্থ শরীরের অধিকারী করবে, সুস্থ মনের অধিকারী করবে। এটা এমন একটা প্রক্রিয়া, যার জন্য কোনো তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রয়োজন পরে না, যার জন্য দরকার শুধু অভ্যাস, নিয়ম মেনে অভ্যাসই পারে, আপনার চিন্তার মধ্যে পরিবর্তন আনতে।  আপনার সদর্থক চিন্তায় আপনাকে জীবনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। 

চিন্তা করে চেতন  মন। তো আপনার চেতন মনে কেবল সদর্থক চিন্তা ফুটিয়ে তুলুন। নিজেকে  শান্তি, আনন্দ, ভালোবাসা, সাম্যভাব, প্রশান্তি, গভীর মনোযোগ, ভালো থাকা, সৌভাগ্যশালী, উন্নত ও সমৃদ্ধশালী ইত্যাদি সমস্ত গুনের ভান্ডার হিসেবে ভাবতে থাকুন। আর মন থেকে যত হিংসা, ভয়, একাকীত্ত্ব, অসুস্থতা, দারিদ্র, বিষন্নতা, সীমাবদ্ধতা - এগুলো মন থেকে দূর করে দিন। যখন আপনার মধ্যে এই নঞৰ্থক চিন্তার উদ্রেগ হবে, তক্ষুনি সদর্থক চিন্তা দিয়ে নিজেকে ভরিয়ে তুলুন।

একটা নির্জন জায়গায় বসে, অথবা ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে স্থির হয়ে, মনে মনে বা উচ্চস্বরে  বলুন : 

"আমার অবচেতন মন, সমস্ত সদর্থক চিন্তাকে কার্যকরী করছে, এবং যত নঞৰ্থক চিন্তাকে পরিহার করছে। তা সে আমি ঘুমিয়েই থাকি বা জেগেই থাকি। আমার শারীরিক সুস্থতা, মানসিক সুস্থতা এবং আমাদের জীবনের  উন্নতি বিধানকারী সমস্ত ক্রিয়া কার্যকর করছে আমার অবচেতন মন। আজ যা আমি অনুভব করছি, যে শান্তি সমৃদ্ধি আমার মধ্যে জাগ্রত হয়েছে, কাল আরো বেশি শান্তি-সমৃদ্ধি আমি অনুভব অবশ্যই করবো। আমার মধ্যে সমস্ত ভালো দিক জেগে উঠছে, ঈশ্বর আমাকে ভালোর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। অজ্ঞান অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার জন্য যা কিছু ভালো, সব তিনি আমার মধ্যে প্রতিফলিত করছেন। এক ঐশ্বরিক শান্তি আমার মধ্যে সারাক্ষন বিরাজ করছে। আমার যোগ্যতার প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস আছে। এই শরীর-মন যা ঈশ্বরের দান  সবই অলৌকিক ঐশ্বরিক ক্ষমতায় পরিপূর্ন। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে সফলতা পাবার জন্য আমার জন্ম। ঈশ্বর সমস্ত যোগ্যতা আমাকে দিয়েছেন।  আমি সেই যোগ্যতার অধিকারী। আমি পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ। ঈশ্বর যার সহায়, তার সমস্ত কাজই সফলতার জন্য। সফলতাই আমার  প্রাপ্য। আমি সফল-আমি দক্ষ-আমি শান্তির আধার। আমাতেই সমস্ত ভালো কিছু প্রস্ফুটিত হচ্ছে। ঈশ্বর তোমাকে কোটি কোটি প্রণাম। তোমার কোলেই আমার বাস। তুমিই আমার আশ্রয়।  ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হে ত্রিকালেশ্বর আমার ত্রিবিধ শান্তি দান করো।"

ঈশ্বরে আপনার বিশ্বাস থাক বা  না থাক, বিশ্বশক্তিকে কেউ অগ্রাহ্য করতে পারে না। আপনারও মধ্যেও যেন সেই বিশ্বশক্তিকে উপেক্ষা বা অগ্রাহ্য করবার দুর্মতি না হয়। আপনি জানবেন, প্রকৃতি যেমন আপনাকে শরীর দিয়েছেন, তেমনি একটা অদৃশ্য শক্তি আপনাকে সব সময় অনুসরণ করছেন, আপনাকে জীবনের পথে চলবার শক্তি যোগাচ্ছেন । এই শক্তিকে স্বীকার করে নিন, আর মন-প্রাণ ঢেলে দিন, তার শ্রীচরণে। আপনার জীবনের সমস্ত দুঃখ, দারিদ্র দূর করে দেবেন তিনি। ভগবান আপনাকে যে কাজ দিয়ে পাঠিয়েছেন, সেই কাজ আপনাকে করতে হবে।  আপনি অসফল হবার জন্য জন্ম গ্রহণ করেন নি, আপনি অবশ্যি সফল হবার জন্য জন্মেছেন। মানুষের সন্তান যেমন মানুষ হয়, তেমনি 
আপনি ঈশ্বরের সন্তান ঈশ্বর।  

মনটাকে পরিষ্কার করুন। আপনার যা কিছু চিন্তা চেতন মনে জাগ্রত হবে, অবচেতন মন সেটাই সত্য বলে মেনে নেবে। তা সে ভালো মন্দ যাই হোক না কেন। ভবিষ্যতে যেকোনো দিন আপনার সেই বিশ্বাস চিন্তাকে আপনার সামনে উপস্থিত করে দেবে। তাই মনকে পরিষ্কার করবার গোপন কথা হচ্ছে শক্তিশালী-প্রভাবশালী সৎচিন্তা দিয়ে মনটাকে ভরিয়ে দিন। আর জানবেন, চেতন মনে যে চিন্তার উদ্রেগ হবে, সেটাই অবচেতন মনে দাগ কাটতে থাকবে। আর অবচেতন মন সেই চিন্তাকেই কার্যকরী রূপ দেবে, অবশ্যই  দেবে। আপনার এই ভালো চিন্তা করবার প্রবণতা একসময় অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে। আপনার নিজের সম্পর্কে ধারণা, নিজের অগাধ  বিশ্বাস, আপনার ভিতরের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেবে। আর যেকোনো বস্তু তা সে সুখ শান্তি  হোক, বা কোনো জাগতিক পদার্থ হোক, সবই আপনার দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে। আপনি  ভগবানের আশীর্বাদ ধন্য সন্তান।  আপনার আবার অভাব কিসের। আপনি  পূর্ন, শান্ত,  অমৃতকুম্ভ । 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম।  

জীবন রহস্যঃ (৯)  THE SECRET OF LIFE (IX) 

অতিচেতন মনের রহস্যঃ 

আমরা সবাই ভালো থাকতে চাই।  কিন্তু কখনো কি ভেবেছি, কেন আমরা ভালো থাকতে চাই ? গাধাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, তুমি কোথায় যাচ্ছো  ? গাধা কোনো জবাব দিতে পারবে না। কারন গাধা জানেই না সে কোথায় যাচ্ছে। কোথায় গাধা যাচ্ছে, সে কথা বলতে পারে  তার মালিক। কিন্তু গাধা যদি আরেকটা গাধার সঙ্গে যায়, তবে যেখানে সে খাবার পাবে, গাধাটা সেখানেই যাবে। কারন গাধার  চাহিদা হচ্ছে খাবার। অজ্ঞানী মানুষ তার লক্ষ জানে না। কেউ একজন তাকে ধাবিত করে, তাড়া  করে নিয়ে যায়। আর অজ্ঞানী মানুষ বারবার তার হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে, বিষয়মুখী হবার চেষ্টা করে।  

আমাদের চেতন মনের স্বভাব হচ্ছে চিন্তা করা। আমরা কখনো চিন্তাবিহীন হয়ে এক মুহূর্ত থাকতে পারি না।  আর এই চেতন মনের চিন্তার বিষয়বস্তু হচ্ছে ইদ্রিয়গ্রাহ্য় বস্তু।  যা তাকে প্রতিনিয়ত আকর্ষণ করছে। অন্যদিকে অবচেতন মন স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতে পারে না।  অবচেতন মনের  স্বভাব হচ্ছে চিন্তাকে কার্যকরী রূপ দেওয়া । আমাদের আর একটা মন আছে যাকে  আমরা বলি, অতিচেতন মন  (super conscious mind) । এটি মনের চতুর্থ স্তর।  এই অতিচেতন মনের স্বভাব হচ্ছে শান্তি। আর এই শান্তি ঈশ্বরীয় সান্নিধ্যের জন্য হয়ে থাকে। যোগীপুরুষগন এই অতিচেতন মনের স্তরে ঘোরা  ফেরা করেন। এগুলো সবই আমাদের বিভিন্ন ধরনের জ্ঞানের স্তর মাত্র । অতিচেতন মনের স্তরে এমন একটা কিছু পাওয়া যায়, যা অন্য দুটো মনের স্তরে পাওয়া যায় না। একটা ঐশ্বরিক অনুভূতি এই অতিচেতন মনের স্তরে সব সময় বিরাজ করে। এই স্তরে থেকে আমরা ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান  দেখতে পারি। অতিচেতন মন বুদ্ধি ও স্মৃতির উর্দ্ধে একটা জ্ঞানের স্তর, কিন্তু বুদ্ধি ও স্মৃতির অভাব সেখানে থাকে না। কোনো কোনো  সময়, আকস্মিক ভাবে আমরা একটা বিশেষ মুহূর্তের সম্মুখীন হই। এই সময় আমাদের মধ্যে একটা অভূতপূর্ব সৃষ্টিধর্ম্মী ক্ষমতা দেখা যায়। যদিও এই অবস্থা আমাদের মধ্যে বেশিক্ষন থাকে না। মনের এই অবস্থাকে আমরা ধরে রাখতেও  পারি না। আমরা জানিনা, এই অবস্থায় কিভাবে পৌঁছনো যায়। বলা হয়ে থাকে, প্রত্যেক মানুষের মৃত্যুর আগে সামান্য ক্ষনের জন্য, এই অতিচেতন মনের স্তরের অবস্থান করে থাকে। আর এই সময় সে তার সমস্ত জীবনের ঘটনাবলী, চোখের সামনে স্পষ্ট  দেখতে পায়। 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমুখ থেকে বা ব্যাসদেবের লেখনী থেকে যখন গীতার বাণী, ঝর্নাধারার মতো নিঃসরণ হচ্ছিলো, তখন তিনি এই মনের চতুর্থ স্তরে বিরাজ  করছিলেন। মহাপুরুষগন যখন আমাদেরকে অমৃতকথা, ঈশ্বরের কথা শোনান, তখন তাঁরা এই মনের চতুর্থ স্তরে অবস্থায় বিরাজ করেন। কিন্তু যখন তারা আবার স্বাভাবিক মনুষ্যস্তরে বা চেতন মনের স্তরে ফিরে আসেন, তখন আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো আচরণ করেন। মহাভারতের অনুগীতা পর্বে আমরা দেখেছি, অর্জুন যখন শ্রীকৃষ্ণকে পুনরায় গীতার উপদেশ-কথা বলবার জন্য অনুরোধ  করেছিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ আক্ষেপের স্বরে বলেছিলেন, আমি আর সেই কথাগুলো বলতে পারবো না। তুমি যে তখন আমার কথাগুলো, ভালোভাবে অনুধ্যান করতে পারোনি, তার জন্য আমার খারাপ লাগছে। শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, সেই কথাগুলো আমি আর কখনোই বলতে পারবো না। তবে অনুরূপ উপদেশ কাহিনী তোমাকে বলতে পারি মাত্র। গীতা একবারই হয়, ঈশ্বর স্বয়ং যখন যার উপরে ভর করেন, তখনই তিনি  ঈশ্বর কথা বলতে পারেন । নতুবা মানুষের কি সাধ্য ঈশ্বরকথা বলে।     

 তৃতীয় স্তরে মন স্থির হয়ে যায়। নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এই তৃতীয় স্তর  থেকেই মন চতুর্থ স্তরের স্বাদ পাওয়া শুরু করে। ধ্যান অভ্যাসের মাধ্যমে আমরা তৃতীয় স্তরে পৌঁছতে পারি।  কিন্তু চতুর্থ স্তর স্বাভাবিক ভাবেই আসে। এই চতুর্থ স্তর সমষ্টি  মনের অংশ। এই অবস্থাই  জ্যান্তে মরা। এই স্তরের কার্যকারন ব্যাখ্যা করা যায় না। শুধু একটা স্বর্গীয় আনন্দ অহেতুক আনন্দ অনুভব হয়। এই অবস্থাতেই মনে হয়, স্বর্গ নেমে এসেছে পৃথিবীতে। 

কথা হচ্ছিলো, আমরা সবাই কেন ভালো থাকতে চাই। আসলে মনের চতুর্থ স্তরের স্বভাব হচ্ছে ভালো থাকা।   এই সহজাত স্বভাব আমাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। তাই আমাদের সব সময় মনে হয়, আমরা একটু ভালো থাকি। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।
     
জীবন রহস্যঃ (১০)  THE SECRET OF LIFE (X) 

জীবন পরিবর্তন হচ্ছে। সব কিছুই পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা সবাই কাল যা ছিলাম, আজ তা নেই। কাল আমার যা ছিল, আজ তা নেই। আর এই পরিবর্তনের মধ্যে দিয়েই মানুষ এমনকি সমগ্র জগৎ এগিয়ে চলেছে। এখন কথা হচ্ছে, এই যে এগিয়ে চলা , সে আমাদের পিছন দিকে হতে পারে, আবার সামনের দিকে হতে পারে।উপরের দিকে হতে পরে, আবার নিচের দিকে হতে পারে।  অর্থাৎ এই পরিবর্তন যদি আমাদের উন্নতির দিকে নিয়ে যায়, তবে বলতে পারি সামনের দিকে এগুচ্ছি। আর যদি এই পরিবর্তন আমাদের অধোগতির নিয়ে যায়, তবে আমাদের অবনতি হচ্ছে।  পরিবর্তনকে কেউ রুখে দিতে পারে না। কিন্তু আশ্চর্য্যের কথা হচ্ছে, এই পরিবর্তনকে আমরা ভীষণ ভয় পাই। বর্তমানের মধ্যে আমরা একটা সুরক্ষার ছোঁয়া পাই।  আর এই সুরক্ষার বাতাবরণ থেকে আমরা বেরুতে চাই না। কিন্তু পরিবর্তন না হলে, নতুন জীবনের অংকুর উদ্গমন হবে কি করে ? নতুন জীবন কিভাবে হবে ? আসলে ধংশের মধ্যেই লুকিয়ে আছে, সৃষ্টির বীজ। ধংশ আমাদের কাম্য নয়।  কিন্তু ধংশই নতুনের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে। ধংশ অনিবার্য।  কিন্তু কাকে ধংশ করবো, আর কাকে নিয়ে এগিয়ে যাবো, প্রশ্নটা এখানেই। 

প্রত্যেকটি মিনিট, প্রত্যেকটি ঘন্টা, দিন, আমাদের প্রাকৃতিক ভাবেই পরিবর্তিত হতে হচ্ছে।  তা সে মানসিক ভাবে বলুন, শারীরিক ভাবে বলুন আর আধ্যাত্মিক ভাবে বলুন। শরীরের যে স্বাভাবিক পরিবর্তন, অর্থাৎ শিশু থেকে ধীরে ধীরে যৌবনে, যৌবন থেকে ধীরে ধীরে বৃদ্ধে  পরিণত হওয়া, এতে আমাদের কোনো হাত নেই বললেই চলে। এই পরিবর্তন আমরা রুখে দিতে পারবো না।  কিন্তু আমাদের মানসিক পরিবর্তন ও আধ্যাত্মিক পরিবর্তনে আমাদের একটা ভূমিকা আছে। আমরা যদি সঠিক ভাবে সেই  পরিবর্তনের চাবিকাঠিকে ধরতে না পারি, তবে জীবন প্রবাহ চলবে প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী। জন্মাবেন, ধীরে ধীরে বড়ো  হবেন, শিশু থেকে বৃদ্ধ হবেন, একদিন শরীর ছেড়ে বেরিয়ে পড়বেন। আবার জন্ম নেবেন, কোনো না কোনো দেহে,কিন্তু  আপনি আপনার ইচ্ছে অনুযায়ী জীবনকে গড়ে তুলতে পারবেন না। ঈশ্বরের ইচ্ছেও পূরণ হবে না।  
পরিবর্তনের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে, আমাদের চিন্তার মধ্যে। আমাদের সবার মধ্যে নানান রকম চিন্তার উদয় হচ্ছে।  এর মধ্যে একধরনের চিন্তা হচ্ছে নেতিবাচক, আর একধরনের চিন্তা হচ্ছে ইতিবাচক। আমাদের কাজ হচ্ছে, নেতিবাচক চিন্তাকে পরিহার করে ইতিবাচক চিন্তাকে ধরে রাখা। আপনি যদি আপনার নেতিবাচক চিন্তাকে পরিহার করতে না পারেন, আপনি যদি আপনার সেকেলে ক্ষতিকারক চিন্তা ধারাকে পরিবর্তন করে, আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তায় পরিবর্তন করতে না পারেন, তবে আপনার জীবনে সাফল্য আসার সম্ভাবনা কম।  আপনি যদি জীবনে সাফল্যের  মহাজাগতিক নিয়মকে ধরতে পারেন, এবং আপনার চেতনাকে সেই পথে চালিত করতে পারেন, তবে আপনার জীবন পৌঁছে যাবে সাফল্যের শিকড়ে। আর তা যদি না করতে পারেন, আপনি যদি গতানুগতিক চিন্তাকে নিয়েই জীবন অতিবাহিত করতে চান, তবে আপনার জীবনও হবে, গতানুগতিক। আর পাঁচজন মানুষের মতো।

নেতিবাচক চিন্তা মানুষের জীবনে নিয়ে আসে, ভয়, অসুরক্ষা, দুশ্চিন্তা, এমনকি শারীরিক অসুস্থতা। আর আপনি যদি একবার আপনার মনটাকে ইতিবাচক চিন্তা দিয়ে ভরিয়ে দিতে পারেন,সঠিক দিশা দেখাতে  পারেন, মনটাকে যদি একবার সময়-উপযোগী করে নিতে পারেন,  তবে স্বাভাবিক ভাবেই, আপনার জীবনে আসবে একটা সাম্য  ভাব, যা আপনি কখনো স্বপেও ভাবেন নি । যদি আপনার জীবনভূমিতে একবার সঠিক ভাবনার বীজ রোপন করতে পারেন,  যদি আপনার জীবনে ভালোবাসা, শান্তি, ধৈর্য্যশীলতার ভাবনা আপনার অবচেতন মনে প্রবাহিত করে দিতে পারেন, তবে এগুলো আপনার জীবনেও  প্রবাহিত হতে থাকবে। ফুলে ফলে ভোরে উঠবে আপনার জীবন বৃক্ষ। মনে রাখবেন, যখনি আপনার মনের ভাব পরিবর্তন করতে পারবেন, তখন আপনার চারিদিকের আবহাওয়া পরিবর্তন হতে থাকবে । প্রত্যেকটি জিনিস যা আপনি চিন্তা করেন, যা আপনি অনুভব করেন, যা আপনি বিশ্বাস করেন, অর্থাৎ আপনার মনটা যে মোড়কে বাঁধা, সেই মতো আপনার জীবনে ঘটনা ঘটতে থাকবে। চিন্তা যেমন যেমন প্রবাহিত হবে, আপনার জীবনে সেই মতো সাফল্য বা অসাফল্য  আসতে  থাকবে। 

এখন কথা হচ্ছে, আমরা তো বুঝলাম, খারাপ চিন্তা করলে আমাদের খারাপ হবে, আবার ভালো চিন্তা করলে আমাদের ভালো হবে। ইতিবাচক চিন্তা করলে আমাদের আমরা সফল হবো, আর নেতিবাচক চিন্তা করলে আমরা অসফল হবো। এই কথা গুলো বলা যত  সহজ,  এই মহৎবাক্যকে কার্য্যে পরিণত করা এতটা সহজ নয়। আসলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ,  চিন্তা  করি না, চিন্তা আমাদের হয়। দুশ্চিন্তা আমরা করি না, দুশ্চিন্তা আমাদের আসে। দেখুন ছোটবেলায়, আমাদের মা-বাবা পড়াশুনায় করতে বসায়। আর খেলাটা করবার জন্য, আমাদের বলতে হয় না। ভালো কাজ আমাদের শেখাতে হয়, খারাপ কাজ আমাদের শেখাতে হয় না। খারাপ ছেলেদের সাথে মেলামেশা করবার জন্য আমাদের কেউ বলে দেয়  না, তবু আমরা খারাপ ছেলেদের সাথে মিশি। ঠিক তেমনি দুশ্চিন্তা আমাদের কাউকে শেখাতে হয় নি। তবু পৃথিবীর আপামর সমস্ত মানুষ কেমন সুন্দরভাবে দুশ্চিন্তা করতে শিখে  গেছে। ভয় পাবার জন্য আলাদা কোনো প্রশিক্ষণ নিতে হয় না, ভয় আমরা এমনি এমনি পাই। তো আসলে চিন্তার জন্য, আমাদের কোনো প্রশিক্ষণ নেবার দরকার পরে না।  চিন্তা আমাদের এমনি এমনি হয়। এটা আমরা জন্মসূত্রেই পাই। আমরা যেমন শ্বাস-প্রশ্বাস নেবার জন্য কোনো প্রশিক্ষণ নেই নি।  হজম করবার জন্য কোনো প্রশিক্ষণ নেই না। তেমনি চিন্তা আমাদের এমনি এমনি হয়। তাহলে আমাদের আগে বুঝতে হবে, চিন্তা কি করে আসে? কোথা থেকে আসে ? আর এই চিন্তাকে কে নিয়ন্ত্রণ করে, বা করতে পারে। 

চিন্তা হচ্ছে মনের কাজ। মনের যে প্রথম স্তর আছে অর্থাৎ চেতন মন এখানেই প্রথমে চিন্তার উদ্রেগ হয়। আর এই চিন্তার প্রভাব ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয় দ্বিতীয় স্তরে, অর্থাৎ অবচেতন মনে, সেখানে চিন্তাকে কার্যকরী রূপ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলে। আর মনের  স্বাভাবিক স্বভাব হচ্ছে আনন্দ শান্তি আহরণ ।

এর আগের দিন আমরা যখন  মনের চতুর্থ স্তর বা অতিচেতন মন SUPER CONSCIOUS MIND   সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম, তখন আমরা শুনেছি, মনের চতুর্থ স্তরে আনন্দ বই কিছু নেই। এখন আমাদের চেতন মন অর্থাৎ প্রথম স্তর, এই আনন্দ পাবার জন্য কি করে থাকে, সে আমাদের পাঁচটি  ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে চিন্তার বিষয়বস্তু সংগ্রহ করে থাকে। অর্থাৎ চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক দ্বারা সে বিষয়ের সংস্পর্শে আসে, এবং সেই বিষয়বস্তু থেকেই সে চিন্তার জ্বলানি সংগ্রহ করে থাকে। এই চিন্তাকে প্রভাবিত করতে পারে একমাত্র আমাদের চেতনশক্তি  বা জীবাত্মা। কিন্তু জীবাত্মা সাধারণত নিষ্ক্রিয় অবস্থায় মনের তৃতীয় স্তরে বসে কেবলমাত্র পর্যবেক্ষন করতে থাকে। সে তখন নিষ্ক্রিয়। এই চেতনাকে আমাদের জাগ্রত করতে হবে, ক্রিয়াশীল করতে হবে।  ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব  বলেছিলেন, তোমাদের চৈতন্য হোক। অর্থাৎ তোমাদের চেতনশক্তি জাগ্রত হোক। যাতে করে, তোমার চিন্তার মধ্যে চেতনার প্রভাব পড়তে পারে। 

আমরা আগেই শুনেছি, আমাদের মনের তৃতীয় স্তর হচ্ছে মনের নিষ্ক্রিয় অবস্থা। মনকে নিষ্ক্রিয় করবার জন্য, আমাদের সাধন ভজন করতে হয়। জপ-তপঃ করতে হয়। ঋষি পতঞ্জলি বলছেন, "যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ" . যোগ হচ্ছে চিত্তবৃত্তিকে নিরোধ করা। 

আমাদের মন ক্ষিপ্ত। আমাদের যে স্ব-স্বরূপ সেই অতীন্দ্রিয় শক্তি তাকে মন অস্বীকার ক'রে, মিথ্যা ও কাল্পনিক জগতে বিচরণ করে থাকে। আমাদের মন মূঢ় অর্থাৎ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে চরিতার্থ করবার জন্য,রজঃগুনের আবেশে আচ্ছন্ন। আমাদের মন বিক্ষিপ্ত। ইতস্তত ঘোরাফেরা করছে।  এই মনকে আমাদের করতে হবে একাগ্র, এই মনকে করতে হবে  নিরোধ। 

আমাদের মন যখন তৃতীয় স্তরে স্থিত হবে, অর্থাৎ নিষ্ক্রিয় হবে, তখন আত্মার সঙ্গে বুদ্ধি-সহ মনের যোগ হবে। তখন আমরা ইতিবাচক চিন্তা করবার অধিকারী হবো। আর এই প্রক্রিয়ার জন্য দিনে মাত্র একঘন্টা আপনাকে সময় দিতে হবে।  পরবর্তী দিন আমরা এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করবো। আর এই প্রক্রিয়া আর কিছুই নয়, গায়ত্রী মন্ত্রের স্থুল ও সূক্ষ্ম ধ্যান করবো। গায়ত্রী মন্ত্রের ধ্যান কথাটা খেয়াল করুন, জপ বা আবৃত্তি নয়, ধ্যান।  আমাদের দৃষ্টিতে চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য, আমাদের ধীশক্তিকে বৃদ্ধি করবার জন্য একটি উৎকৃষ্ট কার্যকরী প্রক্রিয়া এই গায়ত্রী দেবীর ধ্যান ।   আজ বাক্যের বিরাম দিলাম। পরবর্তীতে আমরা গায়ত্রী মন্ত্রের জপ ধ্যান কিভাবে করতে হবে, সে সম্পর্কে শুনবো। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

জীবন রহস্যঃ (১১)  THE SECRET OF LIFE (XI)

১৯৭৮ সালের কথা। সবে  চাকরি পেয়েছি। তো অন্যদিন সম্ভব না হলেও, শনিবার ও রবিবারের সন্ধ্যেবেলার আড্ডায়, যোগদান করা একটা নেশা ছিল।  একদিন  সেদিন, গিয়ে দেখি, বন্ধুরা একটা চোর ধরেছে, আর তাকে বেধড়ক পেটাচ্ছে। সবাইমিলে একটা ছেলেকে পেটাচ্ছে, আর ছেলেটি অসহায় হয়ে, আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম, এই চোরটি আর কেউ নয়, আমাদের ঝন্টু। ওর বাবা হাসপাতালের চতুর্থ-শ্রেণীর কর্ম্মচারী। আমি সবাইকে অনুরোধ করে ওকে পেটানোর হাত থেকে বাঁচলাম। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি চুরি করো কেন ? এর আগেও তুমি চুরি করেছো, কেন করো ? তোমাকে সবাই মিলে  মারে, এতে তোমার খারাপ লাগে না। ও কিন্তু কোনো কথার জবাব দিলো না।  কেবল কাঁদতে লাগলো। পরের দিন, ওকে বাড়িতে ডেকে কিছু টাকা দিয়ে বললাম, আর চুরি করো না, এই টাকা দিয়ে কোনো একটা ব্যবসা করো। ঝন্টু টাকাটা নিয়ে চলে গেলো। পরে শুনলাম, মাছের ব্যবসা শুরু করেছে। কিন্তু ওকে আর আমাদের গ্রামে দেখতে পেলাম না। বছর  কয়েক পরে, একদিন রাস্তায় দেখা।  শুনলাম, দক্ষিণ বঙ্গে কোথাও থাকে, বিয়ে থা করেছে।  একটি ছেলে আছে।  এখন সে ভালো আছে।

আজকের কথাগুলো মন দিয়ে শোনো। গতকালের ঘটনার ফল আজকের তুমি। আজকের তুমিকে পরিবর্তন করতে পারবে না। অতীতের ঘটনাকেও পরিবর্তন করতে পারবে না। অতীতের তুমি পরিবর্তিত হয়ে আজকের তুমি হয়েছো। বর্তমানে যে ছাঁচে, যে রূপে  তুমি নিজেকে কল্পনা করছো, সেই মতো তুমি  তোমার ভবিষ্যৎ আমিকে  তৈরী করছো। অতীতের ঘটনার জন্য, অনুতাপ করতে যেও না , আবার কাল্পনিক ভবিষ্যতের চিন্তায় ডুবে যাওয়া ঠিক হবে না। একটা জিনিস জানবে, অতীত ও ভবিষ্যতের দরজা চিরকাল বন্ধ  থাকে। বর্তমানের কাজের আবর্তে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত করো। এখন যে কাজ করছো, সেই কাজে গভীর মনোযযোগের সাথে, দৃঢ়তার সাথে তোমার সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করো। তুমি জানবে, তোমার সঙ্গে সর্বদা ঈশ্বর আছেন। তিনি তোমার কাজের প্রতি প্রতিক্ষনে নজর রাখছেন। তোমার সমস্ত উচ্চাকাঙ্খ্যা পরিত্যাগ করো। ভবিষ্যতে কি হবে, সে চিন্তা করে, নিজের সময় অতিবাহিত করো না। অতীত ও ভবিষ্যৎ ভাবনাকে পরিত্যাগ ক'রে, যে বর্তমানের মধ্যে ডুব দেয়, ঈশ্বর তাকেই সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দেন। ভবিষ্যৎ তোমার হাতে নয়, আবার অতীত তোমার থেকে ছেড়ে চলে গেছে।  তোমার হাতে আছে, কেবলমাত্র বর্তমান।  ঈশ্বর বর্তমানের উপর প্রভাব বিস্তার করেন না, কিন্তু ঈশ্বর বর্তমানকেই সব থেকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করে থাকেন। তাই জ্ঞানীগণ কখনো অতীতের জন্য অনুতাপ করেন না, ভবিষ্যতের তোয়াক্কাও করেন না। তাঁরা বর্তমানের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। 

বর্তমান স্পষ্ট।  বর্তমান তুমি দেখতে পাচ্ছ।  ভবিষ্যৎ অস্পষ্ট।  ভবিষ্যৎ দুর্গম। তাই যা তুমি দেখতে পাচ্ছ, তাকে তুমি গুরুত্ত্ব দাও। যা দেখতে পাচ্ছ না, তাকে নিয়ে ভেবো না, তাকে গুরুত্ত্বও দিও না। অতীত মৃত।  ভবিষ্যৎ অনাগত। বর্তমান অবশ্যই  সুন্দর। তাই সুন্দর বর্তমানকে উপেক্ষা ক'রে, অতীত নিয়ে অনুশোচনা করো না, ভবিষ্যৎ নিয়েও কোনো দুশ্চিন্তা করো না।  বর্তমানের কাজে নিযুক্ত হওয়াই শ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম। বর্তমান যদি তোমার ভালো কাটে, তবে ভবিষ্যৎ যেমনই হোক, তোমার স্মৃতিতে এই ভালো দিনগুলোর কথা মনে পড়বে। বর্তমানের সাফল্য, তোমাকে ভবিষ্যতের সাফল্য পেতে অনুপ্রাণিত করবে। ভবিষ্যৎ তোমার নাগালের বাইরে। বর্তমান তোমার হাতের মুঠোয়। তাই বর্তমানকে সার্থক করে তোলো। 

এই সব কথায় তোমার বুদ্ধিদীপ্ত  মনে প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি আমরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো কিছু ভাববো না ? আমরা কি অতীতের কাজের পর্যালোচনা করবো না ? দেখো লক্ষ স্থির অবশ্য়ই করতে হবে। উদ্দেশ্যবিহীন পথ চলা ঠিক নয়। আর উদ্দেশ্য পূরণের জন্য, কাজের পরিকল্পনাও  করতে হবে। পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য, সর্বশক্তি নিয়োগ  করতে হবে। আর এটি করতে হবে খোলা মন নিয়ে, বর্তমানের নেতিবাচক চিন্তা, কল্পনার ফানুস, এবং পুরোনো নেতিবাচক  বিশ্বাস ত্যাগ করতে হবে। তুমি  যাকিছু বিশ্বাস করবে, যা কিছু চিন্তা করবে, নতুন ভাববে, তা যেন সব সময় ইতিবাচক হয়। কোনো সন্দেহের দোলায় দুলবে না। হবে না, এই ধরনের পুরোনো ভাবনা ছুড়ে ফেলে দাও, মাথা থেকে দূর করে দাও। পূর্ন  উৎসাহ উদ্দীপনা  নিয়ে নতুন জীবনের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ো।আগে কি হয়েছে, সেসব ভাবনা দূর করে দাও। 
 তোমার অবচেতন মনকে বলো, আমি আমার জীবন পরিবর্তন করবো। আমি নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবো। আমি নতুন ভালো কিছুর সন্ধান করবো। বার বার এই প্রতিজ্ঞা মনে মনে উচ্চারণ করতে থাকো। 
তখন তোমার মনের মধ্যে পুরোনো বস্তাপচা নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা দূর হয়ে যাবে। আর অবচেতন মন এই কথাই বিশ্বাস করবে যে আমি জীবন পরিবর্তন করবো। আমি যা চাই আমি তাই হবো। আমি যা চাই আমি তাই পাবো। আমি যা চাই তা পাবার যোগ্যতা আছে আমার।  আমি ঈশ্বরের অসীম ক্ষমতার অধিকারী। দেখবে, তোমার মধ্যে তখন আত্মবিশ্বাস জাগ্রত হবে। যা তুমি খুঁজছিলে তোমার সামনে বিশ্বশক্তি তাই এনে হাজির করে দেবে। তোমার ইচ্ছে শক্তি যত  দৃঢ় হবে, তোমার বিশ্বাস যত গাঢ় হবে তোমার অবচেতন মন তোমার বিশ্বাস, ইচ্ছেকে রূপ দেবার জন্য, ক্রিয়াশীল হয়ে উঠবে। এটাই বিজ্ঞান।জীবনকে ফুল-ফলে ভরিয়ে তোলা আমাদের জন্মগত অধিকার। মনের শান্তি, শারীরিক সুস্থতা, সার্বিক আনন্দ এটা মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম্ম। এই ধর্ম্ম থেকে আমরা তখনই বঞ্চিত  হই, যখন এগুলো পাবার ব্যাপারে আমাদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে, নেতি- বাচক চিন্তা আমাদেরকে  ঘিরে রাখে।  সুখ,শান্তি,সাফল্য, আমাদের ভিতরেই আছে। আমারা তাকে নেতিবাচক চিন্তার দ্বারা আড়াল করে রেখেছি। যখন আমাদের মধ্যে থেকে নেতিবাচক চিন্তার জ্বাল ছিড়ে  যাবে, আমরা সাফল্যের স্বাদ পাবো। 

একটা ইতিবাচক ভাবনাকে সামনে রেখে, জীবনে তা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা, ভাবটি মস্তিষ্কের গভীরে, শরীরের পেশীতে, সমস্ত স্নায়ুতে, ধমনীতে,  এমনকি শয়নে, স্বপনে অনুরণিত হতে থাকুক। আর অন্য কোনো ভাব যেন, প্রশ্রয় না পায়। ভাবনাই মানুষকে পরিবর্তন করতে পারে। এইভাবেই জীবনে সাফল্য আসে।  এইভাবেই একজন সফল মানুষের জন্ম হয়।  তা সে আধ্যাত্মিক জগতের কথাই বলো  আর দৈনন্দিন জীবনে বলো । তোমার  ভাবনাই আপনাকে ইচ্ছেপূরণ করে দেবে। যাই হোক, আমাদের এই আলোচনা চলতে থাকবে। আর এই আলোচনা শুনতে শুনতেই দেখবে, নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তনের আগ্রহ দেখা দিয়েছে। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।         
   
জীবন রহস্যঃ (১২)  THE SECRET OF LIFE (XII) 

সফল জীবনের জন্য গায়ত্রী মন্ত্রের ধ্যান। TRANSCENDENTAL MEDITATION - GAYATRI 

এই বেদমন্ত্রের দ্রষ্টা বিশ্বামিত্র মুনি। বেদমন্ত্র  যে গান করে, তাকে যে ত্রান করে তিনি গায়ত্রী  (গায়ৎ-  অর্থাৎ গানে ;ত্রৈ- অর্থাৎ পালনে ; এর সঙ্গে অ যোগ করে - গায়ত্র।  গায়ত্র-এর স্ত্রী লিঙ্গ -গায়ত্রী)  অর্থাৎ বেদমাতা। গায়ত্রীদেবীর আরাধনাই গায়ত্রী মন্ত্র। মন্ত্র  কথাটার অর্থ মনন করা। আবার কেউ কেউ বলেন মনকে যে ত্রান করে তাই মন্ত্র। 
ধ্যান = ধ্যৈ+অন। ধ্যৈ কথার অর্থ চিন্তা করা। ধ্যান মানে মনে মনে চিন্তন করা অর্থাৎ মনন করা। রূপ চিন্তন। কোনো বিশেষ রূপের চিন্তন। সূক্ষ্ম ধ্যান মানে হৃৎপদ্ম মধ্যে মূর্তি চিন্তা।  গভীর ভাবে চিন্তন, গাঢ় চিন্তা। আর ধ্যানের  প্রাপ্য হচ্ছে জ্ঞান, প্রজ্ঞা। সত্যকে জ্ঞাত হওয়াই ধ্যানের  উদ্দেশ্য। 
যাই হোক আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে জীবনে সফলতা কিভাবে পেতে পারি। সেই আলোচনায় আমরা শুনেছিলাম, আমাদের চিন্তাধারায় যদি পরিবর্তন আনতে পারি, আমরা যদি নেতিবাচক চিন্তা পরিহার করে, ইতি বাচক চিন্তা করতে পারি, তবে আমাদের জীবনের সফলতা  আসবে। আমাদের জীবন সার্থক হবে। এখন কথা হচ্ছে, চিন্তার প্রতি আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই,  অচেতন ভাবেই, আমরা অবিরাম চিন্তা করে চলেছি। এই চিন্তার পরিবর্তন কি শুধু উপদেশ দিয়ে করানো যাবে ? কাউকে বললাম, তুমি চিন্তা করো না, বা তুমি দুশ্চিন্তা করো না, এতে করে কি তাকে চিন্তা থেকে বিরত করা যাবে ? আবার আমি যদি কাউকে বলি, তুমি খারাপ চিন্তা বাদ  দিয়ে ভালো চিন্তা করো। তবে কি তাকে দিয়ে ভালো চিন্তা করানো যাবে ? যাবে না, তবে আমরা কি করতে পারি ? সেই কথাই আজ আমরা শুনবো।  

আপনার অসুখ হয়েছে, আপনি ডাক্তারের কাছে গেলেন, ডাক্তার আপনাকে ঔষধ না দিয়ে কেবল উপদেশ দিতে লাগলেন। এতে আপনার অসুখ ভালো হবে ? আপনি মন্দিরের  কাছে গেলেন, ঠাকুরের কাছে গেলেন, ফুল-জল-বেলপাতা না দিয়ে পুজো হবে ? তো আমাদের মধ্যে একটা সাধারণ জ্ঞান আছে, একটা সংস্কার আছে, ঔষধে রোগ সারে, ফুল-জল-বেলপাতা দিয়ে পুজো হয়। তেমনি আমাদের মধ্যে একটা ধারণা  আছে, কিছু করলে কিছু পাওয়া যায়। কিছু না করলে জগতের কোনো কিছুই পাওয়া যায় না। অর্থাৎ  জীবনকে পরিবর্তন করতে গেলে আমাদের কিছু করতে হবে। কিন্তু কি করতে হবে ?  

ঋষি শ্বেতাশ্বতর  বলছেন, জীবনকে পরিবর্তন করতে গেলে, প্রথমে প্রার্থনা দিয়ে শুরু করতে হবে। তো কার কাছে প্রার্থনা করবো ? কিসের জন্য প্রার্থনা করবো ? বলছেন, বিশ্বশক্তির কাছে,পরমাত্মার কাছে প্রার্থনা করতে হবে।  কিন্তু পরমাত্মা সম্পর্কে আমরা কোনো ধারণা  করতে পারি না। তার কোনো রূপ নেই।  কিন্তু আমাদের সমস্ত ভাবনা রূপ নির্ভর। আমরা কারুর না কারুর উপরে রাগ করি। আমরা কাউকে না কাউকে ঘৃণা করি, আমরা কাউকে না কাউকে ভালোবাসি। আমরা শূন্যের সাথে লড়াই করি না।  এমনকি কারুর ভালো মন্দ চিন্তা করতে গেলে, তার  গুনের কথা চিন্তা করতে গেলে, তার  মূর্তি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তো আমরা এই শরীর।  শরীরের মধ্যেই আমি। আকারবিহীন কোনোকিছুর চিন্তা আমরা করতে পারি না।

তো আমাদের পরিবর্তনের যাত্রা শুরু করতে গেলে, আমরা যেখানে আছি, সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে হবে।তাই ঋষি বলছেন, সবিতাদেবের  কাছে  প্রার্থনা করতে হবে। আর আমাদের মন-বুদ্ধিকে উপযুক্ত করে তুলবার জন্য প্রার্থনা  করতে হবে। ।  প্রথম কথা হচ্ছে, সূর্য আমাদের দৃষ্টিগোচর বস্তুর মধ্যে বিরাট-বিশাল। সূর্য্যের শক্তি সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণাও  আছে। সূর্যই, এই পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির  কারন, প্রাণ রক্ষার কারন,  সূর্যই আমাদের লালন পালন করছে। আবার সূর্য্যশক্তি আমাদের বিনাশ  করতে পারে। সূর্য বা অগ্নিই  আমাদের স্থুল দেহের মৃত্যুর পরে, আমাদের অন্তিম কালে, মূলসত্তায় ফিরে যাবার মাধ্যম হতে পারে। তো সূর্য আমাদের দৃষ্টিগোচর জগৎ পদার্থের মধ্যে বিশ্বস্রষ্টার শক্তিশালী প্রতিনিধি।  এছাড়া জাগতিক সমস্ত  বস্তুই আমাদের আকর্ষণের বিষয়। এই জগৎই আমাদের মনকে টেনে রেখেছে। তাই আমরা সূর্যকে কেন্দ্র করে পরমাত্মার কাছে প্রার্থনা করতে পারি। কি প্রার্থনা করতে পারি ! 

ঋষি বলছেন, "হে জ্যোতিস্বরূপ সূর্য আমার মন-বুদ্ধিকে পরমাত্মা অভিমুখী করে তোলো। হে অগ্নির প্রকাশশক্তি আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে প্রজ্বলিত  করে তোলো। হে অগ্নের-জ্যোতি  আমার স্থুল  দেহ যেন পরমাত্মার উপল্বদ্ধির যোগ্য হয়ে উঠতে পারে। আমি জগতের উৎস ব্রহ্মের (বিশ্বশক্তির)  উপলব্ধি করতে চাই। দয়া করে, তুমি আমার মন বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়গুলোকে ব্রহ্মের (বিশ্বশক্তির) সাথে  যুক্ত করো। " 

এই একই প্রার্থনার কথা বলা আছে।  আমাদের পরিচিত সাবিত্রী বা গায়ত্রী মন্ত্রে।   
ॐ भुर्भुब: स्वः।
ॐ ततसबिटुर बरेण्यं ।
भर्गो देबष्य धीमहि। धियो यो नः प्रोचोदयात ॐ ।
ওঁং ভূর্ভুবঃ স্বঃ। তৎসবিতুর্বরেন্যং।
ভর্গো দেবস্য ধীমহি।
ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ওঁং।
হে (ভূঃ-ভূবঃ-স্বঃ) ত্রিলোকেশ্বর ! সবিতাদেবের পরব্রহ্মাত্মক সেই বরণীয় তেজকে আমরা ধ্যান করি। সেই সবিতা আমাদের বুদ্ধি-বৃত্তিকে প্রেরিত করুন।

এই মন্ত্রেরও একটা বাঁধন আছে। সেই বাঁধন দিয়ে মন্ত্রটি হবে এই রকম।
ওঁং ভূর্ভুবঃ স্বঃ।
ওঁং তৎসবিতুর্বরেন্যং।
ভর্গো দেবস্য ধীমহি।
ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ওঁং।

গায়ত্রী মন্ত্রের ধ্যানে প্রবেশ করবার আগে, মন্ত্রের সূক্ষ্ম ও স্থুল অর্থ কী , সেটা জেনে নেবো।

ওঁ- ওম-ওঁং  :  স্থুল অর্থে  : ওম একটা ধ্বনি মাত্র। অ-উ-ম এর সংযোগে ওম। সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের প্রতীক।  এই ধ্বনিকে বলা হয় আদি শব্দ। যা হিরণ্যগর্ভ সম্ভূত। ওম হ্যাঁ-সূচক শব্দ। ওম বলতে আমরা স্বীকৃতি বুঝি। তো আমাদের চিন্তাকে ইতিবাচক করতে বারবার এই ওম উচ্চারণ সাহায্য করতে পারে। 

সূক্ষ্ম অর্থে : ওম সমস্ত সৃষ্টির মূল। মহাজাগতিক শক্তি নিহিত আছে এই একাক্ষর বর্ণের মধ্যে। 

ভূর্ভুবঃ স্বঃ(ভূঃ-ভূবঃ-স্বঃ) -
 স্থুল অর্থে ভূ -এর  অর্থ পৃথিবী।  যে উৎপন্ন হয়েছিল বা যাতে উৎপন্ন হয়।
ভূ -  সূক্ষ্ম  অর্থে প্রাণ অথবা জীবন। অর্থাৎ  নিঃস্বাস-প্রশ্বাস।

ভূবঃ- স্থুল  অর্থে স্থুল পৃথিবীর বাইরের অংশ যা বায়ুপূর্ণ। অন্তরীক্ষক লোক। এর মধ্যেই আছে    প্রান, অপান, সমান, ব্যান, ও উদান বায়ু 

সূক্ষ্ম অর্থে ভুবঃ বলতে  বোঝায় চেতনা। আসলে বায়ুর সঙ্গে মিশে আছে চেতনশক্তি।   চেতন স্বত্বা। এই চেতন সত্ত্বাই   বিশ্বভুবন শাসন করছে।    

স্বঃ- এক অর্থে  স্বর্গলোক।  অর্থাৎ ঈশ্বরের আনন্দময়  সত্তার স্থান। 
সূক্ষ্ম অর্থে আকাশ বা শুন্যস্থান যা আমাদের হৃদয় সংলগ্ন। 

তৎ - তৎ কথাটার মানে "সে" . এখানে সে অর্থাৎ ঈশ্বর। ঈশ্বর বা বিশ্বশক্তির কোনো নাম নেই। আমি-তুমির বাইরে যিনি আছেন  তিনি হচ্ছে সে বা তিনি। তাই উপনিষদে মাঝে মধ্যেই ঈশ্বর বোঝাতে সে কথাটা ব্যবহার করা হয়েছে। 

সবিতুর  -সবিতুর কথাটা এসেছে "সবিতা" থেকে। সবিতা অর্থাৎ সূর্যের তেজ থেকে তৈরি রশ্মি।      সমস্ত জাগতিক পদার্থের উৎস, সূর্যকে সবিতা বলা হয়। সূর্য্যের এই তেজই বা এই তেজের দ্বারাই পুষ্টিপ্রাপ্ত হচ্ছে জাগতিক সমস্ত পদার্থ। আমাদের পালনকর্তা এই সূর্য বা সূর্য-রশ্মি। অসংখ্য  সূর্য্যরশ্মি অসংখ্য গুনের অধিকারী। একেই আমরা দেবতা বলি। তাই দেবতা আমাদের অসংখ্য। 
সূক্ষ্ম অর্থে,  আমাদের শরীর মূলত তেজ, জল এবং মাটির সমষ্টি। এই তেজের রশ্মি আমাদের শরীরকে রক্ষা করছে।আমরা যখন স্থূল দেহ ত্যাগ করি, তখন প্রথম আমাদের শরীর  থেকে বেরিয়ে যায় তেজ। তাই মৃত্যুর সময় মানুষের শরীর প্রথমেই  ঠান্ডা হতে শুরু করে।

বরেণ্যম  :  বরণ  করি - আহ্ববান  করি - গ্রহণ করি। 

ভর্গো  :  ভর্গো অর্থাৎ জ্যোতি। স্থুল  অর্থে সূর্য। সূর্য জ্যোতি জগতের সমস্ত কিছুকে প্রকাশিত করে।  আমাদের শরীরকে শুদ্ধ পবিত্র করে। মাদেরকে অভয় দেন করে।  
আর সুক্ষ অর্থে জ্ঞানসূর্য্য। জ্ঞান আমাদের শুদ্ধতা, পবিত্রতা, প্রেম, শক্তিকে বাড়িয়ে তোলে । জ্ঞান আমাদের নির্ভীক করে। 

দেবস্য  : দেবতাদের  - ঈশ্বরের অসীম গুনের কোনো একটি বা একাধিক গুনের অধিকারীকে দেবতা বা দেবী বলা হয়। 
সূক্ষ্ম অর্থে জ্ঞানসূর্য্যের রশ্মি যা আসলে আমাদের মনে  জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালাতে পারে।  

ধীমহি  :  ধ্যান করা।  মনটাকে ঈশ্বরে নিবিষ্ট করা। মনের সমস্ত চিন্তাকে প্রত্যাহার করে ঈশ্বরে  সমর্পিত হওয়া। সমস্ত চিত্তবৃত্তিকে  নিরুদ্ধ করে ঈশ্বরময় হয়ে যাওয়া।   

ধীও : ধী অর্থাৎ বুদ্ধিমত্তা।  আমার বুদ্ধিমত্তা তাঁর উপস্থিতিকে উপলব্ধি করুক। মন পার্থিব চিন্তামুক্ত হয়ে ঈশ্বর-চিন্তায় মগ্ন হোক।
য়ো : "কে" - "ওকে" - একমাত্র ওনাকেই। 
নঃ  :  স্থূল অর্থে  আমাদের - সূক্ষ্ম অর্থে আমিত্ববিহীন  আমাদেরকে। 
প্রচোদয়াৎ  :  প্রেরণ করুন - সমস্ত জীবনীশক্তির উৎস সূর্যদেব, তার জ্যোতি রশ্মির সাহায্যে আমাদেরকে পুষ্টি বর্ধন করুন। 
সমস্ত গুনের আধার জ্ঞানজ্যোতি, সেই জ্ঞান সূর্য্যের রশ্মির সাহায্যে সমস্ত শুভ শক্তি ও গুন্ গুলো আমাদেরকে প্রেরণ করুন।
 
সামগ্রিক ভাবে অর্থ দাঁড়ালো : স্থূল : হে (ভূঃ-ভূবঃ-স্বঃ) ত্রিলোকেশ্বর ! সবিতাদেবের পরব্রহ্মাত্মক সেই বরণীয় তেজকে আমরা ধ্যান করি। সেই সবিতা আমাদের বুদ্ধি-বৃত্তিকে প্রেরিত করুন।
 সূক্ষ্ম অর্থে জ্ঞানসূর্য্যের তেজকে আমরা ধ্যান করছি। জ্ঞানসূর্য তার তেজগুন্সমূহ  দ্বারা  আমাদের সমৃদ্ধ করুন । 
----------

ধ্যান : 

এবার আমরা ধ্যানের  প্রস্তুতি নেবো। একটা কথা শুনুন, আমরা যখন কোনো উপন্যাস পড়ি, গল্প পড়ি, তখন আমাদের চোখের সামনে একটা ঘটনা চলতে থাকে, ঘটনার চরিত্রগুলো ঘোরাফেরা করে, তারা কথা বলে। আর এর ফলে আমাদের মনের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া হয়, আসলে এইসময় আমাদের শরীরে মধ্যে একটা রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে। আমাদের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ফলে আমাদের মধ্যে একটা পরিবর্তনের ক্রিয়া চলতে থাকে । আসলে এই জায়গাটা আমাদের ধরতে হবে।

 আমরা যখন কোনো মন্ত্র উচ্চারণ করবো, তা যদি যান্ত্রিক হয়, গতানুগতিক হয়, অর্থাৎ আমরা মন্ত্র পাঠ  করছি, বা মুখে উচ্চারণ করছি বটে, কিন্তু আমাদের মন  অন্যত্র ঘোরাফেরা করেছে তখন আমাদের শরীরের মধ্যে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম হয় না। কিন্তু মন্ত্র যখন আমরা মনন করি, অর্থাৎ যথাযথ অর্থ বুঝে উচ্চারণ করি, তখন আমাদের সামনে একটা চিত্র ফুটে ওঠে। এমনকি এই চিত্র তখন ক্রিয়াশীল হয়, অর্থাৎ চরিত্রগুলো জ্যান্ত  হয়। তখন বুঝতে হবে আমাদের শরীরের মধ্যেও রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমাদের মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো এক-অভিমুখে গমন করছে।  এর ফলে আমাদের শরীর  ও মনে পরিবর্তন হতে শুরু করে। মন শান্ত হয়ে যায়। মাথায় অন্য কোনো চিন্তা আমাদের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। 

ভোরবেলা সূর্যোদয়ের দেড় ঘন্টা আগে উঠে পড়ুন। আধা ঘন্টার মধ্যে বাহ্যক্রিয়া সম্পন্ন করুন। হাতে, পায়ে, চোখে, মুখে ভালো করে জলের ছিঁটে দিন। এর পর একটা নির্দিষ্ট কম্বলের আসনে মেরুদণ্ড সোজা করে বসুন, হাতদুটো কনুই থেকে ভাজ করে কোলের উপরে রাখুন, আঙুলের মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিন, নিচে না বসতে পারলে চেয়ারে বসুন। চেয়ারে কম্বল বিছিয়ে নিন । পা-টা মাটিতে না রেখে কম্বল বা কাঠের উপরে রাখুন। সূর্যোদয়ের থেকে একঘন্টা গায়েত্রী মন্ত্রের ধ্যান করুন ।

এইবার আমরা গায়ত্রী মন্ত্রের চিত্রটির কথা শুনবো। 

ওম অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার  স্মরণ। নিজেকে  ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জ্যোতির্বিন্দু হিসেবে কল্পনা করুন।  তারপরে ভূ অর্থাৎ পৃথিবীর রূপ স্মরণ করুন । অর্থাৎ যার উপরে আপনি স্থিত। তার একটা চিত্র মনে মনে আঁকুন।   তারপরে ভূব অর্থাৎ বায়ুমন্ডলের স্মরণ। অর্থাৎ যার মধ্যে আপনি অবস্থান করছেন।   তারপর   স্বঃ অর্থাৎ বায়ুমন্ডলের বাইরে যে জগতের স্থিতি তার স্মরণ করুন । তো তিনটি জগৎ আমাদের চোখের সামনে ভাসবে। পৃথিবী-বায়ুমন্ডল-অনন্ত আকাশ। এর পরে ভর্গো অর্থাৎ জ্যোতিরূপ সূর্য্যের কথা চিন্তা করবো। এর পর সূর্য্যথেকে যে রশ্মি বেরুচ্ছে তার চিন্তা করবো। আর রশ্মি আমাদের শরীরের ভিতরে প্রবেশ করছে।  অর্থাৎ আমরা তাকে আহবান করছি। এই রশ্মিগুলো হচ্ছে একেকজন দেবতা, অর্থাৎ এক বা একাধিক গুনের অধিকারী, যাদের সান্নিধ্য এখন আমি অনুভব করছি। এখন এই দেবতাদের কাছে আমাদের প্রার্থনা, আমাকে তোমার গুনে গুণান্বিত করো। এটি হচ্ছে স্থুল  চিন্তা। এই চিন্তাকে ধরে রাখতে হবে।  ধীরে ধীরে সময় বাড়াতে হবে। 

এবার সূক্ষ্ম চিন্তা : ওম  অর্থাৎ বিশ্বশক্তির স্মরণ। ভূ অর্থাৎ সমস্ত তত্ত্বে যার স্থিতি  প্রাণ অথবা জীবন।  নিঃস্বাস-প্রশ্বাস। এবার আমরা প্রাণশক্তিকে স্মরণ করছি। অর্থাৎ আমার শ্বাসের প্রতি নিজের মনকে স্থির করছি। প্রাণবায়ু আমাদের হৃদয়গুহায় প্রবেশ করছে,  এবার প্রাণ শক্তির মধ্যে যে চেতন শক্তি আছে তার স্মরণ করছি। এবার চেতন  শক্তির ব্যাপ্তির কথা স্মরণ করছি। অর্থাৎ এই চেতন শক্তি সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।  তাকে আমরা স্মরণ করছি। এই চেতন শক্তি জ্যোতিস্বরূপ। অর্থাৎ জ্ঞানজ্যোতি। এই জ্যোতিস্বরূপ চেতন শক্তির মধ্যে অসংখ্য গুনের সমাহার। আমরা সেই গুনের স্মরণ করছি। এবং প্রার্থনা করছি, এই গুন্ আমাদের মধ্যে সমাহিত হোক। 

তো এই হচ্ছে গায়ত্রিদেবীর ধ্যান। এটি নিতান্তই মন্ত্র উচ্চারণ নয়। মনকে একাগ্র করা। মন্ত্রের মধ্যে যে অর্থ নিহিত আছে, সেই অর্থের একটা রূপ বা  চিত্র নিজের মানসপটে  প্রস্ফুটিত করে তোলা ।  নিজেকে একাগ্র করে তোলা এবং আমার প্রার্থনারুপ মনস্কামনা ব্যক্ত করা । এই হচ্ছে গায়েত্রী মন্ত্রের ধ্যান।

কার্যকারিতা  : এটিকে বলা যেতে পারে transcendental meditation অর্থাৎ  যে প্রক্রিয়া আপনার চিন্তাকে transform  করতে পারে। একই শব্দ ধ্বনি বার বার উচ্চারিত হলে,  বা কোনো বাক্য বারবার উচ্চারণ করলে, বা একটা বিশেষ চিত্রকে অনুধ্যান  করলে, এই পুনরাবৃত্তির প্রক্রিয়ায় আমাদের মস্তিস্ক এবং চেতনশক্তি পুরোপুরি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলতঃ  বাইরের কোনো অনুভূতি, বা অন্য কোনো চিন্তা আর সেখানে প্রবেশের পথ পায়   না। হানিকারক ও মনঃসংযোগ নষ্টকারী চিন্তা ভাবনা কেটে যায়, আর আমাদের মস্তিস্ক স্নায়ুসকল শান্ত ও একমুখী হয়ে পড়ে ।  এতে করে যেসব চিন্তা আমাদের মানসিক টেনশান বা শারীরিক ভারসাম্যের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছিল, এই ধ্যানপ্রক্রিয়া  তা থেকে আমাদের দূরে নিয়ে যাবে।

 আপনি শুধু মনে মনে ভাবুন, একটা জ্ঞানসূর্য্য, যা এই প্রত্যক্ষ সূর্য থেকেও কোটি কোটি গুন্ বড়। এই জ্ঞানসূর্য্য থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে কোটি কোটি রশ্মি। যা জ্ঞানতেজঃ সম্পন্ন। এই জ্ঞান তেজ আমার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করছে। আমার বুদ্ধিবৃত্তি এতে করে সমৃদ্ধ হচ্ছে। আমি জ্ঞান তেজষ্মী হচ্ছি। মন্ত্রটি মনে মনে জপ করুন, আর এই ভাবনাকে জাগিয়ে তুলুন। এই সময় আপনার শরীরের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত হবে। আপনি অনুভব করতে পারবেন, আপনার শরীরে একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছে। আপনার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে পারে। খানিক্ষন পরে, আপনার শরীর স্থির হয়ে যাবে, এবং আপনি অনুভব করবেন , গায়েত্রী মন্ত্র আপনার ভিতরে আপনা-আপনি ধ্বনিত হচ্ছে।আপনি তখন সাক্ষী হয়ে যান। আর যতক্ষন সম্ভব এটাকে উপলব্ধি করতে থাকুন।
মাত্র কয়েকদিন এটা করতে পারলে, আপনি লক্ষ করবেন, এতে করে আপনার মধ্যে একটা পরিবর্তন হচ্ছে । আপনি লক্ষ করবেন, আপনার বৌদ্ধিক শক্তি বেড়ে গেছে। যা কিছু আপনি দেখছেন, যাকিছু আপনি পড়ছেন, যা কিছু আপনি শুনছেন, সবকিছুই আপনার কাছে বোধগম্য হচ্ছে। বিষয় আপনার কাছে, পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। আপনার মনে হবে, শিক্ষক আপনার ভিতরেই আছেন। আপনার মধ্যে একটা পবিত্র ভাব জেগে উঠবে। আপনার ভয় দূর হয়ে যাবে। আপনার মধ্যে শঙ্কা দূরীভূত হবে। আপনি মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত শান্তি অনুভব করবেন। আসলে এই মন্ত্র আমাদের গ্রন্থিগুলোকে সক্রিয় করে। গ্রন্থিগুলিতে রস নিঃসৃত হতে শুরু করে। নিস্তরঙ্গ এই রস আমাদের এক স্বর্গীয় আনন্দে ভরপুর করে দেয়।  

Harvard Medical School ধ্যান চলাকালীন একটা সাধকের মস্তিষ্কের একধরনের স্ক্যান করে দেখেছেন, এইসময় আমাদের মস্তিস্ক শান্ত ও উত্তেজনাহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু সচল থাকে সেই স্থানগুলো, যা আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, রক্তচলাচল, হৃদয়কে নিয়ন্ত্রণ করে। অথচ মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে অর্থাৎ মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায়। ভাবতে অবাক লাগে আমাদের মুনিঋষিগন হাজার হাজার বছর  আগে, এইসব বৈজ্ঞানিক ক্রিয়ার সন্ধান দিয়েছিলেন।    

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ। হরি ওম।

জীবন রহস্যঃ (১৩)  THE SECRET OF LIFE (XIII)
 
এইজন্য আধুনিক মনোবিদগন বলছেন, এমনকি আমাদের উপনিষদকার মুনিঋষিগন বলেছেন, আপনি সেই কথাগুলো শুনুন, যা আপনার ভিতর থেকে আসছে। আপনি সেই কথাগুলোর কথা চিন্তা করুন, যা আপনার হৃদয়ের কথা, অন্তরের কথা। আপনি সেই কথা গুলোর কথা ভাবুন, যা আপনার হৃদয় গুহায় অবস্থান করছে। আপনি যা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, আপনি যা আপনার ভিতরে অনুভব করেন। আপনার ভবিষ্যৎ জীবন সেইভাবেই গড়ে উঠবে, যা আপনি ভাবছেন। আপনি যদি গঠনমূলক হতে চান, আপনার মন যদি গঠনমূলক হয়, তবে আপনার মনে গঠন মূলক চিন্তা দিয়ে ভরিয়ে তুলতে হবে। আমি সুস্বাস্থের অধিকারী, আমার শরীর ভালো। আমাকে ভালো থাকতেই হবে। তখন দেখবেন, আপনার মন এমন কোনো কাজ করতে চাইবে না, যা আপনার শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক। আপনি তখন অবশ্যই লোভ সম্বরন করবেন, কেননা আপনি জানেন, লোভ বশতঃ কোনো খাবার, বা অতিরিক্ত খাবার খেলে আপনার শরীর খারাপ করতে পারে। আপনার ভিতরে আছে বুদ্ধিমত্ত্বা। সেই বুদ্ধি আপনাকে সুস্থ থাকার প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়োজিত করে দেবে। আপনার তখন মনে হবে, একটু শরীর চর্চা করবার জন্য, সকল সন্ধ্যা প্রাণায়াম বা ভ্রমন করবার প্রবৃত্তি জাগিয়ে তুলবে। আর ফল হবে, আপনি সুস্থ শরীরের অধিকারী হবেন।
আর আপনার মধ্যে যদি উল্টো চিন্তা প্রবাহিত হয়, বা স্বাস্থ সম্পর্কে উদাসীন থাকেন, তবে সেইমতো আপনার শরীর ভারসাম্যহীন হয়ে উঠবে। কারন আপনার শরীরের স্বাভাবিক স্বভাব হচ্ছে, ভালো থাকা। আপনার শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলো আপনাকে সবসময় ভালো রাখতে চায়, কিন্তু যখনই আপনি সেই সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েন, তখন আপনার মধ্যে একটা অস্বাভাবিকতা দেখা দেবে। শরীর আনচান করা শুরু করে দেবে। শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলোতে বাঁধা সৃষ্টি হবে। একটা বাচ্চা ছেলেও চায়, তার প্রতি মা-বাবা মনোযোগ দিক। যখন সে মা যাবার আকর্ষণ থেকে বঞ্চিত হয়, তখন সে খুঁতখুঁত শুরু করে দেয়, অভিমান করে, কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। এটি আসলে করে সে মা-বাবাকে আকর্ষণ করবার জন্য। আকর্ষণ পেলে, সে উৎফুল হয়ে ওঠে, আনন্দে মেতে ওঠে। তেমনি আমাদের শরীর যার পরিচালক মন, সবসময় মনের সান্নিধ্য চায়। শরীরের সমস্ত অঙ্গপ্রতঙ্গ মনকে আকর্ষণ করতে চায়। আর মন যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে শরীর অভিমান করে। এবং স্বাভাবিক কাজে বাধা সৃষ্টি হয়। যার মা-বাবা সন্তানকে ভালোবাসে, তার প্রসংসা করে, সে কিছুতেই বাইরে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে চাইবে না। যে পড়াশুনায় ভালো হতে চায়, সে পড়াশুনার দিকে অবশ্য়ই আকর্ষণ বোধ করবে। আর যে পড়াশুনার প্রতি আকর্ষণ বোধ করবে, তার পরীক্ষার ফল অবশ্যই ভালো হবে। এটাই নিয়ম, এটাই বিজ্ঞান । আসলে আপনি যা মন-প্রাণ দিয়ে চাইবেন, আপনার ভিতরের ঐশ্বরিক শক্তি সেটাকেই কার্যকরী রূপ দেবে।

আপনি এমন একটা জগতে বাস করেন, যেখানে প্রতিটি জিনিস চেতন-বুদ্ধি সম্পন্ন যা আপনার মনের অবস্থাকে প্রতিনিয়ত আকর্ষণ-বিকর্ষণ-এর খেলায় মেতে আছে। যখন এই অবস্থা সম্পর্কে আপনি সচেতন থাকেন, তখন পরিবেশ আপনার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। অথবা বলা যেতে পারে, মন তখন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারে। একেই বলে সদর্থক চিন্তা। অর্থাৎ পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া।

যখন একটার পর একটা চিন্তা আপনার মাথার মধ্যে আসে, তা সে সদর্থক হোক, বা নেতিবাচক হোক, সেই ভাবেই ভবিষ্যতের ঘটনাগুলো আপনার সামনে ঘটতে থাকবে। আপনি একটা জিনিস মনে রাখবেন, দুটো চিন্তা আপনার মনের মধ্যে একই সময় এসে গেলে, অর্থাৎ নেতিবাচক ও ইতিবাচক চিন্তা একসঙ্গে এসে গেলে, আপনার বুদ্ধি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আর আপনার সামনের ভবিষ্যৎ হবে অচিশ্চিত। তাই কোনো ঘটনার ভালো মন্দ দুটো দিক সম্পর্কে জানতে গেলে, আগে ভালো দিকগুলো চিন্তা করুন। খারাপ দিকগুলো চিন্তা করে আপনি সময় নষ্ট করবেন না। আর আপনার মধ্যে তখন ভালো দিকগুলো চোখের সামনে ভাসবে। আর সেটাই ভবিষ্যতে হবে, যা আপনি ভেবেছিলেন। আর যদি অন্য কিছু হয়, তবে জানবেন, এই খারাপর দিক গুলোরও একটা ভালো দিক আছে, যা আপনি এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু ভবিষ্যতে নিশ্চই প্রকাশ পাবে। তাই আপাতত খারাপ হয়েছে বলে - মন খারাপ করে বসে থাকবেন না, জানবেন, এই খারাপের মধ্যেও লুকিয়ে আছে, ভবিষ্যতের আরো ভালোর সম্ভাবনা। আমরা তো ভবিষ্যৎ জানিনা, আমরা ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারি মাত্র। আর কল্পনা সবসময় সত্য-মিথ্যার মিশ্র অবস্থায় থাকে। এই কল্পনা আমাদের কাছে চাটনির মতো আকর্ষণীয়, সুখকর। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে সেটাই, যা ঘটছে বা ঘটতে চলেছে।

চিন্তা হচ্ছে আপনার ভবিষতের ভিসা। আর ভালো চিন্তা হচ্ছে আপনার ভালো ভবিষ্যতের ভিসা। চিন্তা হচ্ছে একটা কায়দা টেকনিক, একটা শিল্প, একটা উৎপাদন শিল্প, যা আপনার ভবিষ্যৎ উৎপাদন করতে পারে। ভবিষ্যৎ কখনো কারুর ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট নয়। ভবিষ্যৎ সবসময় সম্ভাবনাপূর্ন। ভবিষ্যতে যা কিছু হতে পারে। যারা ভবিষৎ দৃষ্টা তারা হয়তো ভবিষ্যৎ দেখতে পান। কিন্তু ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে পারেন না। ভবিষ্যৎ তারাই পরিবর্তন করতে পারেন, যারা ভবিষতের স্রষ্টা। তো আপনি, আপনার চিন্তা, আপনার ইতিবাচক বা নেতিবাচক চিন্তাই হচ্ছে ভবিষ্যতের সৃষ্টা। তো আপনিই ভবিষ্যৎ গড়তে পারেন, আপনিই ভবিষ্যৎ ভাঙতে পারেন । তাই আপনার উপরেই নির্ভর করছে, আপনি কিভাবে ভবিষ্যৎ গড়বেন।

আর এই চিন্তা করবার জন্য, ভালো চিন্তার জন্য, কোনো বুদ্ধির দরকার পড়ে না। অনেকে ভাবেন, ছেলেটার বুদ্ধি কম, তো যার বুদ্ধি কম তার ভবিষ্যৎ কিভাবে ভালো হবে ? এই ধারণা একেবারেই ভুল। বুদ্ধিমান ছেলের ভবিষ্যৎ ভালো হবে, আর স্বল্পবুদ্ধি সম্পন্ন ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, এমন ভাবা মানে মূর্খের স্বর্গে বাস করা। ভবিষ্যৎ তাদেরই ভালো হয়, যারা ভালো চায়। যারা ভালোর জন্য চিন্তা করে। আপনি আপনার চারিপাশে অনেক ছেলেদের দেখবেন, পেছনের বেঞ্চে বসা ছেলে, কেমন জীবনে সাফল্য পেয়েছে। আর অনেক বুদ্ধিমান ছেলের জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছে।বা প্রত্যাশা অনুযায়ী সাফল্য পায় নি। এর কারন হচ্ছে, ভালো বা সাফল্য তাদের জীবনেই আসে, যার বারবার স্বপ্ন দেখে ভালো থাকার জন্য, সাফল্য পাবার জন্য। যে যার জন্য প্রতিনিয়ত চিন্তা করে, শেষমেশ তার জীবনে তারই প্রাপ্তি ঘটে। যারা আজ ধনী হয়েছেন, তাদের দিকে খেয়াল করলে দেখবেন, তাদের মাথার মধ্যে সব সময় ধনের চিন্তাই এসেছে। তারা সবসময় ধনের স্বপ্নে মশগুল থেকেছেন। আর এর জন্য, তারা তাদের জীবনের অনেক কিছু বিসর্জন দিয়েছেন। কিন্তু ধনের চিন্তা তাদের মাথা থেকে যায় নি কখনো। ঠিক তেমনি সাফল্য তাদের জীবনেই আসে, যারা সব সময় এই সাফল্যের কথাই ভেবেছে।

নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন। আমি বার বার বলেছি, আমরা সবাই ঈশ্বরপুত্র। ঈশ্বরের সন্তান। আমরা সবাই একেক জন ক্ষুদ্র ঈশ্বর। আর ঈশ্বরের সমস্ত গুন্, আমাদের মধ্যে আছে। আমরা সবাই আনন্দময় সত্তার অংশ, আনন্দ আমাদের স্বভাবের মধ্যেই আছে। তাই আমাদের চেতন মনে জাগিয়ে তুলুন সেই আনন্দময় সত্ত্বাকে । মনে মনে ভাবুন, শান্তি-আনন্দ-সাম্যাবস্থা-ভালোবাসা-স্থিরতা-একাগ্রতা- প্রশান্তি-লক্ষে স্থির থাকা-উন্নতি ইত্যাদি ইত্যাদি ইতিবাচক চিন্তা দিয়ে মনটাকে ভরিয়ে তুলুন। সমস্ত নেতিবাচক চিন্তা যেমন ভয়-দুশ্চিন্তা-ঘৃণা-রাগ-সীমাবদ্ধতা-একাকীত্ত্ব-দারিদ্র-মানসিক দ্বন্দ্ব -অসুস্থতা - এগুলো যখন আপনার মধ্যে উঁকি দেবে, বা জেগে উঠবে, তক্ষুনি তাকে দূর করে দিন। এগুলোকে, এই নেতি বাচক চিন্তা যখন মনের মধ্যে আসবে, তক্ষুনি উল্টো চিন্তা দিয়ে নিজে ভরিয়ে তুলুন। ভাববেন, আমি সাফল্যের জন্য জন্মেছি, আমি ঈশ্বরপ্রদত্ত কাজ করবার জন্য জন্মেছি, আমি শান্তির জন্য জন্মেছি, আমি সমৃদ্ধির মধ্যে বেঁচে থাকবার জন্য জন্মেছি, আমি পৃথিবীকে নতুন কিছু দেবার জন্য জন্মেছি। আমি আনন্দের সন্তান। আমার মধ্যে আনন্দই আনন্দ। আমি সব সময় ভাবের মধ্যেই আছি, আমার আবার অভাব কিসের ? আমি পূর্ন।

মনে মনে বলুন, বারবার বলুন - আমার অবচেতন মন সম সময় ইতিবাচক চিন্তায় ভরপুর থাকছে, আমার জীবনে যা কিছু ইতিবাচক, তারই জন্ম দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমি যদি ঘুমিয়েও থাকি, তাহলেও আমার অবচেতন মন সব সময় ইতিবাচক সম্ভাবনার জন্ম দিচ্ছে। আমার বর্তমান ভালো, আমার আগামীকালও ভালো। হে ঈশ্বর আমার মনে সব সময় সত্য ও শান্তির বাতাবরণ আলোড়ন তুলুক। হে ঈশ্বর তুমি আমার মধ্যে সুখে নিদ্রা যাও। আমি তোমার পায়ের কাছে, তোমার পাহারায় আছি। আমি তোমার জন্য, তুমি ঘুমিয়ে থাকলেও, আমাদের মধ্যেই আছো। এই ধরনের ইতিবাচক চিন্তা, বার বার আপনার চেতন মনে উদিত হলে, ধীরে ধীরে এই চিন্তার ছাপ আপনার অবচেতন মনে দাগ কাটতে থাকবে। এবং আপনার অবচেতন মন এই ভাবনাকে সত্যে পরিণত করবার জন্য, ক্রিয়াশীল হয়ে উঠবে। এবং বাহ্যিক জগতে এটি দৃষ্টিগোচর হতে থাকবে। মনকে পরিষ্কার করবার জন্য, আমাদের মনের মধ্যে যে সব ধংসাত্মক প্রবণতা আছে, যেসব অন্ধবিশ্বাস, যুক্তিহীন বিশ্বাস, নেতিবাচক ভাবনা আছে সেগুলো দূর করে দৃঢ় বিশ্বাস, যুক্তিযুক্ত বিশ্বাস, ইত্যাদি ইতিবাচক চিন্তা দিয়ে ভরিয়ে তুলতে হবে। আমাদের মধ্যে যে দৃঢ় যুক্তিপূর্ন বিশ্বাস আছে, সেগুলোকে জাগ্রত করতে হবে। নিজের সম্পর্কে ভাবনার পরিবর্তন করতে হবে। অন্য কে কি ভাবলো, তাতে আপনার কিছু আসে যায় না, আপনি কি ভাবছেন, সেটাই বড় কথা। আর সেইমতো আপনার সাফল্যের দ্বার উন্মোচন হয়ে যাবে। আপনার জীবন হয়ে উঠবে, আনন্দপূর্ণ। আপনার ভবিষ্যৎ হবে সাফল্যে পরিপূর্ন।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।

জীবন রহস্যঃ (১৫)  THE SECRET OF LIFE (XV)

ভাগ্যবান তারাই, যারা নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করেন না। যারা নিজের ভবিষ্যৎকে ভাগ্যের উপরে ছেড়ে দেন না। ভাগ্যবান তারাই যারা নিজের ভাগ্যকে নিজেই তৈরি করতে পারেন । ভাগ্যবান তারাই, যারা ভাগ্য তৈরিতে ঈশ্বরের শক্তিকে কাজে লাগাতে পারেন । হ্যাঁ এটা সত্যি, আমরাই আমাদের ভাগ্য লিখে থাকি। আমরাই আমাদের ভাগ্য তৈরী করি। আপনার নিজের সম্পর্কে পুরোনো বিশ্বাস-অবিশ্বাস, অনুভব, বদলে যাবে, যদি আপনার ভাবনার মধ্যে বদল আনতে পারেন। আর এই কাজটি কেবলমাত্র আপনিই করতে পারেন। এই কাজটি আপনার হয়ে অন্য কেউ করে দিতে পারবে না। আপনি প্রতি মুহূর্তে প্রতি ঘন্টায়, আপনার ভাগ্য গড়ছেন, কেবল মাত্র আপনার ভাবনার মধ্যে দিয়ে। যেটা আপনি জানেন না। কিন্তু যদি আপনি জানতেন, আপনিই আপনার ভাগ্যের নির্মাতা, আর সেটি হচ্ছে কেবলমাত্র আপনার ভাবনা-চিন্তার মধ্যে দিয়ে, তবে আপনি অবশ্য়ই সচেতন হতেন, আর আপনার ভাবনাকে এমন ভাবে পরিচালিত করতেন, যাতে আপনার ভাগ্য ভালো হয়। আপনার জীবন সার্থক হয়, আপনি সফলতার চরম শিখরে উঠতে পারেন।

এইজন্য আমরা প্রথমেই বলেছি, বার বার বলে থাকি, নিজেকে জানবার চেষ্টা করুন। আপনি কে কেন পৃথিবীতে এসেছেন, কিভাবেই বা এসেছেন, সেই কথাগুলো অনুভব করবার চেষ্টা করুন। বই পড়া বিদ্যা, বা কারুর কাছ থেকে শুনে নয়, এই সব প্রশ্নের উত্তর আপনার ভিতরেই আছে। সেই জীবাত্মার জন্ম কথা অনুভব করবার চেষ্টা করুন। আপনি কে, কোথা থেকে এসেছেন, সেটি স্মৃতি জাগিয়ে তুলুন। প্রশ্নের মধ্যে আপনি নিজেকে যত একাত্ম বোধ করাতে পারবেন , প্রশ্নের উত্তর তত তাড়াতাড়ি এবং তত অধিক স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, যে জীব ব্রহ্মের অংশ, কিন্তু ব্রহ্ম থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ব্রহ্ম সৎ-চিৎ-আনন্দ-ঘন আর জীব সৎ-চিৎ-আনন্দ-কণ। এই ঘন আর কণ কথাটা আমরা একটু বুঝে নেই। ধরুন কাঁসর ঘন্টা। একে যদি কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়, তবে একটা ধ্বনি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এই যে অবিচ্ছিন্ন কাঁসরঘন্টার ধ্বনি একে বলা হয় কণ। কাঁসরঘন্টা হচ্ছে একটা তামা বা কাঁসার ঘনীভূত রূপ। এটি গরম অবস্থায় তরল। আরো গরম অবস্থায়, বাষ্প, আরো গরম অবস্থায়, অদৃশ্য। তো এই কাঁসর ঘন্টায় বা পরমতত্ত্বে যখন সন্ধিনী, সম্বিৎ, ও হ্লাদিনী শক্তি প্রয়োগ করা হয়, তখন একটা ধ্বনি বা রশ্মি প্রকট হয়। একেই বলে প্রণব। এই সন্ধিনী, সম্বিৎ, ও হ্লাদিনী শক্তি পরমাত্মায় পূর্ন ভাবে প্রকটিত। কিন্তু জীবাত্মায় বীজরূপে প্রসুপ্ত। জীব প্রকৃতির ক্ষেত্রে রোপিত বা উপ্ত হয়েছে। যাতে বিভিন্ন লোকে অর্থাৎ বিভিন্ন চেতন স্তরে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে, সে ব্রহ্মসারূপ্য লাভ করতে পারে। সন্ধিনী, সম্বিৎ ও হ্লাদিনী কথাটার অর্থ কি ? সন্ধিনী কথার অভিধানগত অর্থ হচ্ছে বৃষদ্বারা আক্রান্ত ঋতুমতী গাভী। অর্থাৎ যার জন্ম দেবার ক্ষমতা ও মিলন ক্ষণ উপস্থিত হয়েছে। সন্ধি কথাটার অর্থ যোগ বা মিলন। স্ত্রী লিঙ্গে সন্ধিনী। সম্বিৎ কথার অর্থ হচ্ছে চেতনা, চেতন শক্তি। হ্লাদিনী হচ্ছে মিশ্রিত ও অবিমিশ্রিত হবার শক্তি।

জীবাত্মার অধিষ্ঠান তপঃলোকে। তপঃলোক কথাটার অর্থ পুরান মতে পৃথিবী হতে কোটি যোজন উর্দ্ধে স্থিত ভুবন। সপ্তলোকের অন্যতম। সমস্ত জীবের আদি জন্মভূমি। আধুনিক নৃতত্ত্ববিদগন বলে থাকেন, বর্তমানের সাইবেরিয়ার অন্তর্গত অঞ্চলকে তপঃভূমি বলা হয়ে থাকে। এখানেই মানুষের বা জীবের প্রথম উৎপত্তি। আর এই জীবাত্মা আর কিছুই নয় monad অর্থাৎ পরমাণু সদৃশ্য কীটাণু, Ultimate atom, রশ্মি মাত্র । তপোলোক থেকে বেরিয়ে এই রশ্মি জনলোকে প্রবেশ করে। এইলোক অর্থাৎ জনলোক থেকে সে এই জনলোকের তত্ত্বগঠিত হিরন্ময় কোষ গ্রহণ করে থাকে। হিরন্ময় কোষ হচ্ছে স্বর্ণাভ সূক্ষ্ম দেহ বিশেষ, জ্যোতির্বিন্দু । আত্মার সাতটি আবরণের প্রথম ও অন্যতম। (অন্নময়, প্রাণময়, মনময় (বাসনাময় ও ভাবনাময়) বিজ্ঞানময় আনন্দময়, ও হিরণ্ময় ) এরপর ক্রমশ মহর্লোকে অবতরণ করে। এই মহর্লোকে আনন্দময় কোষ গ্রহণ করে। আনন্দ অর্থ হর্ষ। পরমাত্মার পঞ্চকোষের মধ্যে অন্যতম কোষ হচ্ছে আনন্দময় কোষ। অর্থাৎ জীবের আনন্দময় সত্ত্বা। এরপর, অরূপ-স্বর্গলোকে বিজ্ঞানময় কোষে আবৃত হয়। অর্থাৎ জীবের জ্ঞানময় সত্ত্বা। এই তিনটি কোষের আশ্রিত অর্থাৎ হিরন্ময়, আনন্দময় ও বিজ্ঞানময় কোষে আশ্রিত চৈতন্যকে বলা হয়ে থাকে, আত্মা-বুদ্ধি-মনস যা পরে আরো পুষ্ট ও সুসংহত হয়ে জীবাত্মায় পরিণত হবে।

এখন এই আত্মা-বুদ্ধি-মনসের অংশ রূপস্বর্গে নেমে ভাবনাময় হয়ে ওঠে। এরপর ভুবর্লোকে নেমে বাসনাময় এবং একদম শেষে ভুর্লোকে নেমে ইথার নির্মিত কোষ ও স্থুলজড় নির্মিত কোষ গ্রহণ ক'রে
স্থাবর রূপে প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ শরীর বা রূপ পরিগ্রহ করে থাকে।
তো রূপস্বর্গে এসে আমরা ভাবনাময় হয়ে পড়ি। এর আগে আমাদের হিরন্ময়, আনন্দময়, ও বিজ্ঞানময় কোষের দ্বারা আবৃত ছিলাম। তখন অবধি আমাদের কোনো বিশেষ রূপ ছিল না। আমাদের প্রথম রূপ হচ্ছে ভাবনা। অর্থাৎ চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে একটা বস্তু, যার একটা সূক্ষ্ম রূপ আছে। চিন্তা হচ্ছে আমাদের মানস শরীরের ক্রিয়া। অর্থাৎ আমাদের যে ছয়টি অবস্থা তার একটির ক্রিয়া হচ্ছে চিন্তা। (অন্নময়, প্রাণময়, মনময় (বাসনাময় ও ভাবনাময়) বিজ্ঞানময় আনন্দময়, ও হিরণ্ময় ) । অর্থাৎ মনময় শরীরের ক্রিয়া হচ্ছে চিন্তা। এই মনময় শরীর আবার দুটি কোষের সমষ্টি একটি হচ্ছে বাসনাময় আর একটি হচ্ছে ভাবনাময়। এই ভাবনাময় কোষের কাজ হচ্ছে সংকল্প গ্রহণ। চিন্তা-ভাবনা অসীম ক্ষমতার অধিকারী। চিন্তা ধীরে ধীরে বাসনার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আমাদের স্বভাবের জন্ম দেয়, এমনকি আমাদের স্বভাবের পরিবর্তন করে থাকে। আর আমাদের স্বভাব ঘটনাকে ঘনীভূত করে। অবস্থার পরিবর্তন করে। আপনি একরকম চিন্তা করবেন, আর অন্যরকম হবে, এই আশা আপনি করতে পারেন না। যে যেমন সে তেমন বস্তুকেই আকর্ষণ করে থাকে। যাদের চিন্তাধারার মধ্যে একটা সামঞ্জস্য আছে, তারাই কাছের মানুষ হয়ে যায়। জীবন হচ্ছে চিন্তার একটা ধারাবাহিক প্রবাহ। আপনি চিন্তার মধ্যে যা কিছু গড়বেন, বা ভাঙবেন, আপনার বাস্তব জীবনে তাইই ঘটতে থাকবে। চিন্তাই মানুষকে জ্ঞান ও অনুভূতি এনে দেয়। আপনি চিন্তা করছেন, আপনি খাচ্ছেন, আপনি খেলাধুলা করছেন, আপনি ঘুমুচ্ছেন এসবই চেতনার বহিঃপ্রকাশ। আপনার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে চেতনা আপনাকে ঘিরে রেখেছে, এবং চেতনা ধীরে ধীরে বাড়ছে যেমন যেমন আপনি জ্ঞান সংগ্রহ করছেন। আমরা যা কিছু করি, সবই চেতন ও অবচেতন মনের দ্বারাই হয়ে থাকে। চেতন মন হচ্ছে আপনার সমস্ত চিন্তা, বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতা যা আপনি বাইরের বস্তুতে ও মানুষের মধ্যে আরোপ করছেন। চেতন মন একটা অদৃশ্য কম্পিউটার। আপনার ভাবনা ও প্রবণতা চেতন মনের তথ্য, যার ভিত্তিতে সে বাহ্যিক পরিবেশকে দৃশ্যমান করছে। প্রকাশ করছে। নেতিবাচক চিন্তা প্রবণতা নেতিবাচক অবস্থার প্রদর্শন করে। এইজন্য বলা হয়ে থাকে, ব্যক্তিগত চিন্তা ভাবনাই মানুষকে লক্ষে স্থির করে দেয়। এবং পিপিলিকার মতো সেই লক্ষের দিকে অন্ধের মতো ধাবিত হয়।

যাইহোক, আজ এই পর্যন্ত বাক্যের বিরাম দিলাম।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।

জীবন রহস্যঃ (১৬)  THE SECRET OF LIFE (XVI)

ব্যবহারিক জীবনে আধ্যাত্মিকতা

দেখুন আধ্যাত্মিক জীবনে আপনি অনেক উন্নতি করলেন, কিন্তু আপনার মা-বাবা, ছেলেমেয়ে না খেয়ে থাকবে এটা নিশ্চয় আপনি চাইবেন না।  আপনার ছেলেমেয়ে প্রথাগত  শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকবে, অর্থের কারনে। এটা নিশ্চই আমাদের কাম্য নয়। আপনি একজন ভালো গুরু পেলেন, কিন্তু আপনার শরীর রোগগ্রস্থ হয়ে রইলো। আপনি অকাল-মৃত্যু-পথযাত্রী হয়ে রইলেন। আপনি জলের উপর দিয়ে হাটতে পারেন কি পারেন না সেটা বড়ো  কথা নয়, জলের তৃষ্ণা আপনার মিটলো কি না সেটাই  বড়ো  কথা।  পরমহংস যোগানন্দের গুরুদেব শ্রী যুক্তেশ্বর গিরিজি মহারাজ (যার পূর্বাশ্রমে নাম ছিল, প্রিয়নাথ কড়ার) যিনি একজন উচ্চ স্তরের যোগী ছিলেন, তিনি  তার বিষয় সম্পত্তি রক্ষার জন্য, মামলা-মোকাদ্দমা করতে দ্বিধা করেন নি  । পরগাছা হয়ে সন্যাসী হবার চেয়ে, ঈশ্বর সন্ধানে  বন-পর্বতে  না ঘুরে, বরং  সংসারী হয়ে, কর্তব্য পালন অনেক বেশি শ্রেয়। 

আমাদের বাড়ির কাছে স্টেশন সংলগ্ন কৃষ্ণের ফলের দোকান। কৃষ্ণ সহজ সরল মানুষ, প্রথম দিকে ওকে বোকা বোকা লাগতো। ওর সহজ সরল কথা, আর ফলের দামও  একটু কম নিতো বলে আমি ওর দোকান থেকেই ফল কিনে থাকি। একদিন বিকেলের দিকে ফল কিনতে গিয়ে দেখি, কৃষ্ণ দোকানে নেই।  দোকান সাজানো, কিন্তু দোকানদার নেই। আমি দোকানের ফলগুলোকে দেখছিলাম, কিছু কিছু ফলের উপরে একটা স্টিকার লাগানো, তাতে লেখা ok . যাইহোক,  ক্ষাণিক্ষণ অপেক্ষা করবার পরে, কৃষ্ণ এলো। বললাম, কোথায় গিয়েছিলে ? কৃষ্ণ বললো, একজনের হাঁটুতে কোমড়ে ব্যথা, তো একটা ব্যায়াম শেখাতে গিয়েছিলাম। ওই ব্যায়াম করে, আমার হাটু-কোমরের ব্যাথা ভালো হয়েছে। বললাম, বাহ্ তুমি ব্যায়ামও জানো ? ও একটু লজ্বা পেলো। আমি বললাম, তুমি ফলের উপরে ওই স্টিকারগুলো, লাগিয়েছো কেন ? ও বললো, ভালো ভালো ফল গুলোকে বেছে, স্টিকার লাগাই, তাহলে একটু বেশি দামে বিক্রি হয়। 

একজন বিখ্যাত সাধুবাবার জীবনী পড়ছিলাম, নামটা বলা ঠিক হবে না, তো তিনি লিখছেন, "আমার ঘুম তোমাদের মতো নয়। বাইরে যদি খুব গন্ডগোলও হয়, তাহলেও  আমার ঘুম ভাঙবে না, কিন্তু সামান্য যদি একটু শব্দ হয়, তোমরা যদি ফিস্ ফিস্ করে কথা বলো, তাহলেই হয়তো আমার ঘুম ভেঙে যাবে।  তোমাদের মতো সাধারণের ঘুম আর আমার ঘুমের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। ঘুমোবার সময় আমি গভীর নিস্তব্ধতায় ডুবে যাই। একবার অতি সন্নিকটে এক বাড়িতে আগুন লাগলো, আমি কিন্তু আগুন নেভাবার মন্ত্র জানি। কত লোকজনের হৈচৈ, আমার কিন্তু ঘুম কিছুতেই ভাঙলো না। ভাঙলে হয়তো আগুন নিভিয়ে দিতে পারতাম আমি।"

তো এই সাধুবাবা, যুবক বয়সে স্ত্রীর মৃত্যুতে শোকাতুর হয়ে, মৃত স্ত্রীকে ফিরে পাবার আশায়, সংসার ছেড়ে,  প্রথমে পরাবিদ্যাবিদদের কাছে, তারপর বামাক্ষ্যাপার কাছে গিয়েছিলেন। আত্মা-আকর্ষণ বিদ্যা আয়ত্ত্ব করে, তিনি  নাকি মৃত স্ত্রীর গলায় গান শুনতেন। আর বামাক্ষেপার দয়ায় মায়ের সাক্ষাৎ পান।  মা বর  দিতে চাইলে বলেছিলেন, আমি যেন সব সময় তোমাকে আমার স্ত্রীর  রূপেই  দেখতে পাই,  এই বর  দাও । 

পরবর্তীতে ইনি কয়েকজন মহিলা দ্বারা সেবিত হতেন। তো এক মহামূর্খ বেয়ারা শিষ্য এইসব  নারীসেবা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন । বলেছিলেন, বহু মহাপুরুষ  নারীর দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে, তপঃভ্রষ্ট হয়েছিলেন, ঋষি পরাশর, ঋষি বিশ্বামিত্র এর জ্বলন্ত উদাহরণ। আপনি এই  নারীসেবা  থেকে বিরত থাকুন। তো এই অবান্তর   প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, আমি কাছা এঁটে  সাধু হয়েছি, আমি যদি ভ্রষ্ট হই , তবে জানবি, একজন ব্যাসদেব, একজন শকুন্তলার জন্ম দেবো।  ব্যাসদেব মহাভারত লিখেছেন, শকুন্তলার ছেলে ভরতের  নামেই ভারতবর্ষ। তোর সে ক্ষমতা নেই।

তো কৃষ্ণ ফল বেচার মাঝেও মানুষের উপকার করবার কথা ভাবে, আবার নিজের আয় বাড়াবার জন্য বুদ্ধি করে ভালো ফলের উপরে স্টিকার লাগায়। সাধুবাবা আগুন লাগলে ঘুমায়, নারী সংসর্গে ভ্রষ্ট হলে, ব্যাসদেবের জন্ম দেবার মতো আত্ম অহংকারের কথা শোনায়। হে ভগবান, আমরা যেন ওই কৃষ্ণের মতো হতে পারি। সংসারত্যাগী সাধুবাবা না হই, যাঁরা আগুন নেভানোর মতো অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েও, কাজের সময় ঘুমিয়ে থাকেন। আর স্বপ্ন দেখেন, অবৈধ সংসর্গে লিপ্ত হয়ে, ব্যাসদেবের পিতা  হবার।   

সমস্ত জীব-জগৎ যেমন প্রকৃতির উপরে নির্ভরশীল, তেমনি সমাজ-সংসার গৃহস্থের উপরে নির্ভরশীল। 
জীবজগৎ  জল, বায়ু  তাপ বিহীন বাঁচতে পারে না। তেমনি জগৎ সংসারের উন্নতি নির্ভর করে, মানুষের ব্যক্তিগত উন্নতির উপরে। গৃহীগণই সমস্ত মানুষকে তা সে সাধু বলুন, অসাধু বলুন, গৃহস্থ  বলুন, আর সন্যাসী বলুন, সবাইকে খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। 

মহাত্মাগণ বলে থাকেন,  আমাদের সবাইকে  প্রথমে আমাদের সংসারের নীতিগত কর্ম্ম ও ভোগের পথ শেষ করতে হবে। তার পর, ঈশ্বর-অনুভূতির জন্য চেষ্টা করতে হবে। আমরা অনেক সময় প্রথম সিঁড়ি পার না হয়ে পরবর্তী সিঁড়িতে পা রাখতে চাই। এতে ফল হয় বিপরীত। আমরা পথভ্রষ্ট হই। জাগতিক কর্ম্ম  করে, সম্পদ লাভ যেমন জরুরি, তেমন সেই সম্পদের উপযুক্ত বন্টন জরুরি। শুধু নিজের জন্য, সম্পদ সংগ্রহ নয়, সমাজের কল্যানে সেই সম্পদের ব্যবহার করতে হবে। আবার একটা সময় আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ যেমন জরুরি, তেমনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান মানুষের কল্যানের  জন্য ব্যবহার করা জরুরি। তাই আমাদের কর্ম্মকে ঈশ্বরমুখী করতে হবে। আমাদের মন যখন ঈশ্বরমুখী হয়ে সমস্ত কাজ করবে, তখন জাগতিক সম্পদ ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান আমাদের আত্মার শান্তির কারন হবে। 

প্রত্যেকটি জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ। মানুষ যখন তার নিজের আত্মার প্রতি কর্তব্য সম্পাদন করে, তখন তার সমস্ত দায়িত্ব পালন  করা হয়। মানব আত্মা স্বীয় অভিব্যক্তির, বিকাশের অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু অহংয়ের দ্বারা রাহুগ্রস্থ হয়ে আছেন। তাই ইন্দ্রিয়ভোগ লালসা আমাদের আত্মার ক্রন্দনকে উপেক্ষা করে থাকে। তাই তার সমস্ত কর্ম্ম-প্রচেষ্টা একসময় ব্যর্থতায় পরিণত  হয়। এমনকি স্বজন-সাথীদের প্রতি কর্তব্যও তাকে ক্লান্ত ও বিফল মনোরথ করে তোলে। 

মানব দেহ একটি মন্দির। এই মন্দিরেই আত্মার বাস। তাই প্রথমে দেহকে জানবো। দেহের সেবাযত্ন করবো। নিজের সমস্যার সমাধান করবো।  তার পর অন্যের সাহায্যে আসতে  পারবো। নিজের দেহকে যেমন শুদ্ধ পবিত্র  রাখবো, তেমনি মনকে অনাসক্ত রাখতে হবে। আসক্ত মানব মন শরীরের স্নায়ুর উপরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া করে থাকে।  আর অনাসক্ত মন আমাদের স্নায়ুকে উজ্জীবিত করতে পারে, উন্নত চিন্তার কারন হতে পারে । অনাসক্ত মনের চিন্তাশক্তি উচ্চস্তরে প্রবাহিত হয়। ফলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাব পড়ে। 

অসংলগ্ন, অস্পষ্ট চিন্তার মতো বিপদজনক আর কিছু নেই। কর্ম্ম ও চিন্তা একটা মিলিত শক্তি, যা আমাদের জীবনে সফলতা ও অসফলতার কারন। তাই চিন্তা যদি আমাদের উচ্চতর হয়,দৃঢ় হয়, গভীর হয়,  তবে কর্ম্ম আমাদের ভালো ফল দেবেই দেবে। আমরা সাধারণত কর্ম্ম করে থাকি, তথাকথিত কর্তব্য বোধ থেকে। আর এই তথাকথিত কর্তব্য হচ্ছে, আমাদের আমাদের স্বজন প্রীতি, আমাদের বস্তুপ্রীতি, যা আসলে আসক্তির নামান্তর মাত্র । 

যতদিন আমরা আমাদের আত্মার ডাক অনুভব না করতে পারবো, ততদিন আমরা কেউ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে পারবো না। কারুর কারুর ক্ষেত্রে বিশেষ করে তথাকথিত সাধু সন্যাসীদের ক্ষেত্রে দেখেছি, একটা উদাসীন ভাব।  আসলে এই উদাসীনতা আলস্য ও স্বার্থপরতার নামান্তর। এটি তামসিক অবস্থা। এইসব অলস ও নির্বোধ মানুষের কখনো উন্নতি হয় না। প্রকৃত অনাসক্তি, প্রকৃত সাক্ষীর মনোভাব, ঈশ্বরের প্রতি সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা, আমাদের প্রত্যেকটি কর্ম্মে মনোযোগ এনে দেবে। এটাই ধ্যান। আর ধ্যানীর সমস্ত কর্ম্মই উচ্চ ফল প্রদান করে থাকে। অর্থাৎ যে কাজে আপনি ধ্যান দেবেন, সেটি অবশ্যই  নিখুঁদ, সর্বাঙ্গ সুন্দর হবে, যে বিষয়ের প্রতি আপনি ধ্যান দেবেন, সেই বিষয় আপনার কাছে সহজ হয়ে যাবে, আরো বোধগম্য হয়ে উঠবে । এটাই জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে সফলতার মন্ত্র।  আপনাকে জীবনে সফলতা এনে দেবে, এই অনাসক্ত ঈশ্বরমুখী কর্ম্ম । 

যাইহোক আমাদের সবার জীবন সুখ-শান্তি-অনাসক্তি-কর্ম্মমুখী হোক, এই আশীর্বাদ প্রার্থনা করি পরমপ্রিয়-পরমাত্মার কাছে।  আজ এই পর্যন্ত, বাক্যের বিরাম দিলাম ।

 ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।
 
জীবন রহস্যঃ (১৭)  THE SECRET OF LIFE (XVII)

একটা রূপক দিয়ে শুরু করি। ভগবান তো মানুষ  সৃষ্টি করলেন, কিন্তু মানুষের বেড়ে ওঠা, সুস্থ থাকা, ইচ্ছে পূরণ, সফলতা ইত্যাদির  চাবির গোছা কোথায় রাখা যায় ? তো তিনি সমস্ত দেবতাদের ডাকলেন, পরামর্শ করবার জন্য।  তো দেবতাগণ এক এক জন এক রকম বলতে লাগলেন, কেউ বললেন, মেঘের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে, কেউ বললেন, সমুদ্রের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে, কেউ বললেন, পাহাড়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে, কেউ বললেন, গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে রাখতে। তো ভগবান ভাবলেন, মানুষ তো প্রকৃতির দ্বারা তৈরী হয়েছে। তো প্রকৃতির মধ্যে সে তার গুপ্ত চাবির খোঁজ করবে। তার চেয়ে ভালো হবে, চাবিটা আমার কাছেই থাক, আমি থাকি মানুষের অন্তরে। মানুষ যারা দেহ সর্বস্য তারা তো  নিজের মধ্যে এই চাবি কখনোই খোঁজ করবে না। এই ভেবে, ভগবান স্বয়ং মানুষের অন্তরে চাবির গোছা নিয়ে লুকিয়ে পড়লেন।
 
মানুষের মধ্যেই সেই বিশ্বয়কর শক্তির চাবি লুকিয়ে আছে, যা মানুষকে উন্নতির চরমে নিয়ে যেতে পারে।সর্ব্ব শক্তির আধার সেই  ভগবানও  আমাদের অন্তরেই  অবস্থান করছেন । আমরা তার সন্ধান করি না। এটা আমাদের অজ্ঞতা। এই অজ্ঞানতা যখন আমাদের দূরীভূত হবে, তখন আমাদের জীবনের সমস্ত অন্ধকার দূরীভূত হবে। তখন জীবন রহস্যঃ, জীবনের উদ্দেশ্য, জীবনের অর্থ খুঁজে পাবো। আর জীবন হয়ে উঠবে আনন্দময়।     

জীবনের লক্ষ ঠিক করুন। একটা কাগজ কলম নিন।  লিখে ফেলুন - আমি কোথায় আছি, আমি কোথায় যাবো, সেখানে যাবার জন্য আমার কি করতে হবে। আমি যেখানে আছি, সেখানে একটা অবস্থা বিরাজ করছে, তো নতুন জায়গায় যেতে গেলে, আমাকে যাত্রা শুরু করতে হবে। বর্তমান অবস্থার পরিবর্তনই  আমাকে নতুন অবস্থায়  নিয়ে যেতে পারে। বর্তমান  অবস্থার পরিবর্তন করতে পারলে, তবেই আমি পরবর্তী জায়গায় যেতে পারবো। আপনি কি চান, সেটা যতক্ষন না আপনার মনে পরিষ্কার হচ্ছে , ততক্ষন আপনি নিজেকে পরিবর্তন করতে পারবেন না। তাই প্রথমেই চাই, আপনি কি চান সেটা পরিষ্কার করা । মনকে সেই মতো ভাবিয়ে তোলা। আপনার কত বয়স সেটা বড়ো  কথা নয়। আপনার কি ক্ষমতা সেটাও বড়ো কথা নয়। আপনি কি ভাবছেন, সেটাই বড়ো  কথা।

ক্যালেন্ডারের পাতায় যে তারিখগুলো লেখা আছে, তার মতো মিথ্যে আর কিছু হতে পারে না। আজ বৃহস্পতি   বার।  এটা মানুষের কল্পনা মাত্র। আজ ১৭-ই ডিসেম্বর, ২০২০, এটা মানুষের কল্পনা মাত্র। এটা একটা মাপকাঠি - যা মানুষ সময়কে মাপার জন্য ঠিক করেছে। ঘটনাকে ধরে রাখবার জন্য, ব্যবহার করা হয়ে থাকে।  কিন্তু সময়কে কখনো মাপা যায় না  সত্য হচ্ছে, সময় স্থির। সময় অসীম।সময় কখনো গতিশীল হয় না। সময় কখনো অতীত হয় না, সময় কখনো ভবিষ্যৎ হয় না, সময় সর্বদা সর্বত্র বর্তমান। আপনার এখন কত বয়স, সেটা বড়ো কথা নয়, আপনি কি ভাবছেন, সেটাই আপনি  হতে চলেছেন।  আপনি কলকাতায় বসে, যে সময়ে যা করছেন, সেটা যদি লন্ডনের সময় ধরেন, তবে তা পাল্টে  যাবে। আপনি দিন  বারোটার সময় কলকাতার যা করছেন, ওই একই সময়কে আমেরিকার রাত্রি বারোটা হতে পারে - যা মানুষ ঠিক করেছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ জায়গায় হয়তো  দিন-রাত্রি ২৪ ঘন্টা। কিন্তু  এই পৃথিবীতে এমন জায়গাও  আছে, উত্তর গোলার্ধে বা দক্ষিণ গোলার্ধে, যেখানে ৬ মাস রাত, ছয়  মাস দিন। অর্থাৎ বছরে একটা দিন আর একটা রাত  মাত্র।  তো  সময়ের এই তারতম্য চিরন্তন সত্য। যা মানুষের মাপকাঠিতে ধরা পড়েছে মাত্র। আপনি যদি চাঁদে  যান, তখন দিন-রাত্রির সময়ের তারতম্য ঘটবে। আমি যদি সূর্য্যের উপরিভাগে অবস্থান করেন, তখন আপনার কাছে দিন রাত্রি বলে কিছু থাকবেই না ।  

আমরা জানি  পৃথিবীর পরিমন্ডলে মাত্র ৫০০ কিলোমিটার স্থান পর্যন্ত   বাতাস ঘোরাফেরা করছে। আর সেখানে  সূর্যের আলোও   ঘোরাফেরা করছে।  আর কেবলমাত্র এই পরিমন্ডলেই  এই জীবন দেহরূপ ধারন করে পরিভ্রম করছে। কিন্তু এই পৃথিবীতেই এমন জায়গা আছে, যেখানে বাতাসের দেখা নেই।  যেখানে সূর্য্যের আলো  ঢুকতে পারে না। যেখানে জীবন কোনো রূপের মধ্যে আবধ্য়   নয়। যেখানে কোনো পরিবর্তন নেই। লক্ষ বছর ধরে, পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম থেকে সেখানে রূপহীন এক শক্তির রাজ্য বিরাজ করছে। রূপ তো বিশেষ ভৌগলিক পরিস্থিতির মধ্যে বজায় থাকে মাত্র । ভৌগলিক, প্রাকৃতিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হলে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রূপের পরিবর্তন হতে থেকে।  এমনকি একসময় রূপের গঠনের মূল বস্তুর মধ্যেই রূপ  মিলিয়ে যায়। কিন্তু মূল বস্তু  আগে যেমন ছিল, তেমনি থাকে। প্রাকৃতিক পরিবেশের দান  হচ্ছে রূপ। প্রকৃতি ও  পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে রূপের পরিবর্তন হয়। পরিবেশ ভেদেই  পৃথিবীতে রূপের ভেদ। এমনকি এই যে পৃথিবী বা যত গ্রহ নক্ষত্র আমরা দেখতে পাই,সেই  নক্ষত্র মন্ডলীর রূপের পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু এটা আমাদের মতো সাধারণ মানুষ ধরতে পারি না। কিন্তু বিষয়ের গভীরে যখন আমরা ধ্যান দেই, তখন এগুলো আমাদের কাছে ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে  থাকে।  তখন মনে হয়, বাহ্যিক এই যে গতিশীল রূপ, এই রূপ আক্ষরিক অর্থেই  ক্ষণস্থায়ী।  কিন্তু আমি স্বরূপ  যে দৃষ্টা, তার সহজে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। আসলে, আমি স্বরূপ দৃষ্টারও পরিবর্তন  হচ্ছে, যত  আমাদের জ্ঞান হচ্ছে, অজ্ঞতা  কেটে যাচ্ছে, তত পরিবর্তনকে আমরা প্রতক্ষ্য করতে পারি। আপনি কি জানেন, আপনার চোখে যে তারামন্ডলী আপনি দেখতে পাচ্ছেন, তার মধ্যে অনেক তারা এর মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে গেছে। অথচ এগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার কারন হচ্ছে আলোর গতি। লক্ষ্ত্র থেকে আলো আসতে  যে সময় লাগে ধরুন ৪০০ বছর। তো ৪০০ বছর আগে আকাশে যে নক্ষত্রগুলো  ছিল, আজ ৪০০ বছর পরে, সেটাই আমাদের চোখে ধরা পড়ছে।  অর্থাৎ আজ যা দেখছি, তা আসলে ৪০০ বছর  আগের চিত্র।     

ঠিক তেমনি পৃথিবীর বাইরের জগতে যা কিছু আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেসব একটা পরিবর্তনশীল কম্পন,তরঙ্গ মাত্র। এই সব বস্তুর স্থায়িত্ত্ব ক্ষনিকের জন্যও নয়।  এই আছে, এই নাই। তো সময়, আলো, ও স্থান time-light-space এর প্রভাবে বস্তু ফুটে উঠছে, আবার মিলিয়ে  যাচ্ছে। এই সত্যকে আমাদের স্বীকার করতে হবে। তবে জাগতিক সাফল্যর, জীবনের সফলতার সূত্রটি আমরা ধরতে পারবো। 

ভক্ত তুলসীদাস  বলেছিলেন, তুলসী যব জগমে  আয়ো জগ হসে তুম রোয়। এয়সী করণী কর-চলো কি তুম্, জগ রোয়। - তুলসী যখন তুমি জন্মেছিলে, তখন জগতের সবাই হেসেছিলো, আর তুমি কাদঁতে লাগলে। এখন এমন কাজ করে চলো, যাতে যখন তুমি মারা যাবে, তখন যেন জগতের সবাই তোমার জন্য কাঁদে আর তুমি হাসতে হাসতে জগৎ ছাড়তে পারো । স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, মানুষ আইন তৈরী করে, আইন মানুষকে তৈরী করে না। মানুষ টাকা উপায় করে, টাকা মানুষকে উপায় করে না। মানুষই নাম-যশ করে থাকে, নাম-যশ মানুষকে তৈরী করতে পারে না। বিবেকানন্দ বলছেন, মানুষ হও, তবে দেখবে, টাকা-পয়সা, নাম-যশ, তোমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। দেখবে, সবকিছু গড়গড়িয়ে আসছে। বিবেকানন্দকে অনেকে হিংসে করে বলতেন, বিবেকানন্দ ধর্ম্মের ব্যবসায়ী। অর্থাৎ ধর্ম্মের কথা বলে তিনি অনেক টাকা উপার্জন করেছিলেন। কিন্তু তাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে, এই টাকা কিন্তু তিনি তার নিজের জন্য, বা তার মা-বাবা-ভাই-বোন-স্ত্রী-পুত্রের  জন্য ব্যায় করেননি। সে সব তিনি ব্যয় করেছিলেন, সমাজের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। আজও বিবেকানন্দের নাম করে যারা সংগঠন  করেছেন, দেশের সেবা করছেন, তাদের অর্থের  অভাব হয় না। কোথা  থেকে আসে এই অর্থ ? আপনি বলতে পারেন, লোকে দান  করে তাই, কিন্তু এই দানের জন্য কেন মানুষ উদ্বুদ্ধ হয় ? আসলে এইসব সংগঠনের কাজে মানুষ সন্তুষ্ট হয়, আর দান  ক'রে তাঁরা একটা তৃপ্তি পায়। আমাদেরও এই পথে যেতে হবে। মানুষকে তৃপ্ত করতে  পারলে,মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারে, এমনকি আপনি যদি পশু পাখিদের তৃপ্ত করতে পারেন,  তবে দেখবেন, আমাদের সমস্ত অভাব দূর হয়ে যাবে, আমাদের জীবন সফল হয়ে উঠবে।  জীবন সার্থক হবে। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।   

জীবন রহস্যঃ (১৮)  THE SECRET OF LIFE (XIX)

সমস্যার  সমাধান হোক না হোক, সমস্যা যেন আমাদের পীড়িত  করতে না পারে। 
জীবনে দুটো জিনিস খুব গুরুত্ত্বপূর্ন। একটা হচ্ছে বিশ্বাস আর একটা হচ্ছে অভ্যাস। বিশ্বাস অর্থাৎ আত্মবিশ্বাস, নিজের প্রতি বিশ্বাস। আর অভ্যাস অর্থাৎ  কাজের স্বাভাবিক অভিগতি, যা সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, স্বভাবের একটা নিজস্ব অপ্রতিরোধ্য গতি আছে । অভ্যাস  আমাদেরকে বিশেষ ধরনের কর্ম্মে প্রবুদ্ধ করে। এটাকে আমরা আমাদের প্রবৃত্তিও  বলতে পারি।    

আজ আমরা এই সম্পর্কে   কিছু কথা শুনবো। 

অভ্যাস : কথায়  বলে অভ্যাস যায় না মলে।  অর্থাৎ অভ্যাস আমাদের মৃত্যুর পরেও বজায় থাকে। মৃত্যুর পরেও আমাদের অভ্যাস বজায় থাকে কিনা জানি না, তবে অভ্যাস যে সহজে যায় না এটা  সত্য। 
আমাদের অফিসের  প্রায় সমস্ত আর্মড গার্ড, প্রাক্তন সেনা কৰ্ম্মী। আমি লক্ষ করেছি, এদের পিছনে লাগবার জন্য, অফিসের কিছু দুস্টু ছেলে, কখনো কখনো, "এটেনশন" বলে চিৎকার করে  উঠতো। আর অফিসের আর্মড গার্ড হয়তো তখন  টিফিন করছে, লক্ষ করতাম ও তখন উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিতো। আমরা তখন মনে করতাম, ছেলেটার মাথায় ছিট্  আছে। তা না হলে, যখন তখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অকারনে সেলুট দেয় ? পরে বুঝেছি, আসলে এটা পুরোনো চাকুরী জীবনের অভ্যাস। ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে, যেটাকে ও সহজে ত্যাগ করতে  পারে না। তাই এটেনশন কথাটা  শুনলেই, ও অজ্ঞাতসারেই দাঁড়িয়ে উঠে স্যালুট দিতে থাকে।  

একটি বাচ্চা ছেলে, যে এখনো স্কুলে যায় না, অক্ষর জ্ঞান হয় নি, তাকে  আপনি কবিতা মুখস্ত করালে, সে গড় গড়িয়ে কবিতা বলে দেবে। এমনকি আমি দেখেছি,  ঠাকুর ঘরে বসে পিতা মন্ত্র পাঠ  করছে, শিশু  বসে সেই মন্ত্র শুনছে, পিতার পূজা করা দেখছে।  সেই ছেলে যখন বড়ো  হয়, তার মধ্যে পিতার পূজা-পাঠ তার ভিতরে একটা জায়গা করে নেয়। আপনি যদি প্রতিদিন একই মন্ত্র পাঠ করেন, দেখবেন, এটি আপনার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এবং নির্দিষ্ট সময়, নির্দিষ্ট স্থানে এলে সেই মন্ত্র ভিতর থেকে জপ হতে আরম্ভ  করে। আসলে বার বার একই জিনিস করবার ফলে, মানুষের অবচেতন মনে একটা দাগ কাটে, আর অবচেতন মন সেটিকে কার্য্যে পরিণত করে, ধীরে ধীরে পরবর্তীতে সেটি আমাদের  অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। 

আমাদের দেশের বহু ধর্ম্মশাস্ত্রকে বলা হয়ে থাকে শ্রুতি।  শুনে শুনে মুখস্ত করা বিদ্যা। মুখস্ত করবার মধ্যে একটা বিরক্তি, একটা একঘেয়েমি আছে সত্য, কিন্তু এই মুখস্ত বিদ্যা আসলে একমাত্র অভ্যাসের ফলেই সম্ভব হতে পারে। জাদুকর অনেক ভেলকি দেখান, যা আসলে হাতের কাজ। আমরা দেখে অবাক হই , কিন্তু জাদুকর বলছেন, এইগুলো  সবই, বারবার অভ্যাসের ফলে  আয়ত্ত্ব করা সম্ভব হয়েছে। আমরা সার্কাসে অনেক ব্যালান্সের খেলা দেখে থাকি, যা আসলে তারা বার বার অভ্যাস করেই রপ্ত করতে পেরেছেন। আপনি একজন টাইপ-রাইটারকে টাইপ করতে দেখেছেন, না দেখে কি সুন্দর নির্দিষ্ট অক্ষরে অনবরত দ্রুততার সাথে  আঙ্গুল চালিয়ে যাচ্ছে, সচেতন ভাবে এই কাজটি আপনি করতে পারবেন না।কিন্তু অভ্যাসের বশে আপনি এই কাজটি  কথা বলতে বলতেও করে যেতে পারবেন।

 তবে, একটা কথা বলি, ইচ্ছে করলেই, আপনি একটা অভ্যাস করতে পারবেন তা নয়, কিন্তু বার বার একটা জিনিস করতে থাকলে সেটি আপনার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে। অভ্যাস করা যায় না।  করতে করতে অভ্যাসে পরিণত  হয়।  আপনি সিগারেট খাওয়া  শিখেছেন, প্রথম দিকে এক-আধটা বন্ধুদের সঙ্গে খেয়েছেন। তার পরে ধীরে ধীরে এটি আপনার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এখন আপনি এক প্যাকেট সিগারেট কিনবার জন্য, এক মাইল  হেটে যেতেও দ্বিধা করবেন না। একদিকে যেমন আপনি ইচ্ছে করলেই নতুন অভ্যাস তৈরী করতে পারবেন না, তেমনি ইচ্ছে করলেই আপনি আপনার পুরোনো অভ্যাস ছাড়তে পারবেন না। অভ্যাস ছাড়তে গেলে আপনাকে চেতন মনে বারবার উল্টো চিন্তা ওঠাতে হবে।  অর্থাৎ সিগারেট ছাড়তে গেলে, আপনাকে সিগারেট সম্পর্কে বিরক্তি বা সিগারেটের ক্ষতিকারক দিক গুলো নিয়ে ভাবতে হবে। 

অভ্যাস একটা নিয়ন্ত্রণ শক্তি, যা আমাদের অজ্ঞাতসারে আমাদেরকে পরিচালিত করতে পারে। এটি যেমন ভালোর জন্য হতে পারে, তেমনি খারাপের জন্যও  হতে পারে। যারা সিগারেট খায়, তাদের খাবার পরে, একটা সিগারেটের জন্য ক্ষুত ক্ষুত করতে থাকে। এর ক্ষতিকর প্রভাব জেনেও, সে সিগারেটের জন্য হাত বাড়াবে । ঠিক তেমনি আমাদের মধ্যে যদি কোনো ভালো অভ্যাস থাকে, সেটিও আপনাকে আপনার অজ্ঞাতসারে পরিচালিত করবে।  যেমন ধরুন, আপনি পরিষ্কার পরিছন্ন থাকতে  পছন্দ করেন, তবে দেখবেন, কোনো কারনে যদি   আপনাকে নোংরা জামা-কাপড় পড়তে হয়, তখন আপনার মন ক্ষুত ক্ষুত করতে থাকবে। আর আপনি নিজের অজ্ঞাতসারেই, জামা-কাপড় পরিষ্কার করতে বসে যাবেন। আপনি যদি প্রতিদিন সকাল  সন্ধ্যা পুজো-অর্চনা বা ধ্যানে প্রাণায়ামে বসবার অভ্যাস করেন, তবে সেটি একসময় আপনার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে।  আর আপনি সময় হলেই, যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, ধ্যান বা পুজোয় বসবার জন্য আপনার মন ক্ষুত ক্ষুত করতে থাকবে। আপনি যদি বহুদিন যাবৎ  সকাল বেলা এক কাপ চা খান, তবে আপনার সেটি অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে। আর সকাল হলেই  চায়ের জন্য মনটা ক্ষুত ক্ষুত করতে থাকবে। 

তো মোদ্দা কথা হচ্ছে, আমরা সবাই অভ্যাসের দাস। অভ্যাস আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাই কোনো কিছু করবার আগে, বিশেষ করে, কোনো কিছু বার বার করবার আগে, ভাবুন সেটি আপনার জীবনে কতটা উপকারে আসবে, বা আপনার অপকার করতে পারে কি না। যদি দেখেন, এটি আপনার জীবনে উপকার হতে পারে, তবে সেটি বারবার করতে থাকুন, আর যদি বোঝেন সেটি খারাপ, তবে তৎক্ষণাৎ পরিত্যাগ করুন। 

আত্মবিশ্বাস :
এর পরে আসছি, বিশ্বাস বা আত্মবিশ্বাসের কথায়। আত্মবিশ্বাস অর্থাৎ নিজের প্রতি বিশ্বাস। বিশ্বাসী মানুষ সব কিছু করতে  পারে, যা সে বিশ্বাস করে।  হ্যাঁ হয়তো সে একবারে পারবে না, কিন্তু একদিন না একদিন অবশ্যই  করতে পারবে। নিজের উপরে ভরসা রাখুন, তবেই আপনি আপনার খারাপ অভ্যাস যেমন পাল্টাতে পারবেন, তেমনি পারবেন ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে। মানুষে মানুষে যে পার্থক্য আমরা লক্ষ করে থাকি, তা এই আত্মবিশ্বাসের তারতম্যের জন্য। আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য, তিনটি জিনিস করুন ১) নিয়মিত শরীর  চর্চা। ২) সঠিক খাদ্য খান, যাতে আপনার পেট খারাপ না হয়। ৩) পরিষ্কার পরিছন্ন সঠিক ড্রেস পড়ুন। 

একটা জিনিস ভালো ভাবে বুঝতে চেষ্টা করতে হবে, নিজে কি করতে পারি, আর কি করতে পারিনা এই ধারণা বা অনুভূতির উপরে ভিত্তি করে আমাদের আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে। বিষয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে। আত্মবিশ্বাস হলো, নিজের সম্পর্কে একটা ইতিবাচক বা সদর্থক ধারণা বা অনুভূতি। আপনার যদি আত্মবিশ্বাস থাকে তবে যে কোনো কাজ আপনি সাফল্যের সঙ্গে করতে পারবেন। আর যখনই আপনি কোনো কাজ সাফল্যের সঙ্গে করতে পারবেন, তখন আপনি নিজেকে নিজে পুরস্কৃত  করতে থাকবেন। আর পুরস্কার, অর্থাৎ স্বীকৃতি পেলেই আমাদের মন ভালো হয়ে যায়। তখন আপনি ভবিষ্যতে  এই ধরনের কাজ করবার জন্য, নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারবেন। মূলত সেরোটনিক, ডোপামিন, ও এন্ডোরফিন নামক নিউরো-ট্রান্সমিটারগুলো আত্মবিশ্বাস গঠনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
শুধু কর্ম্ম-দক্ষতা নয়, মানুষ যত  বেশি নিজেকে পুরস্কৃত করতে পারবে, নিজেকে যত  প্রসংসা করতে পারবে, তত মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকবে। একই রকম যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষের মধ্যে সে-ই সাফল্য পায়, যার মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেশি আছে। আত্ম বিশ্বাসের  অভাবে মানুষ তোতলাতে থাকে, ঘামতে থাকে, শরীর কাঁপতে থাকে । এমনকি পেট খারাপ হতে পারে, পেটে ব্যথা হতে পরে, মাথা ধরতে পারে, ঘাড়ে  ব্যাথা হতে পারে।  এর থেকে বোঝা যায়, আত্মবিশ্বাসের অভাব মানুষের কার্যক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। 

একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমরা যা কিছু করি না কেন, তা যেন আমরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে করি।  তা সে বাজার করা হতে পরে, রান্না করা হতে পারে, বই পড়া হতে পারে।  যাই করি না কেন, আমরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে করবো।  হ্যাঁ এটা সত্যি আমরা সবাই সব কাজ পারি না। কেউ হয়তো গান গাইতে পারে, কেউ লেখা-লেখি করতে পারে। কিন্তু যেটা পারি না, সেটা স্বীকার করতে হবে, সময় মতো সৎ সাহসের সঙ্গে  "না" বলতে শিখতে হবে, অথবা নিজের অক্ষমতা বুঝে নিয়ে, সেই কাজে পারদর্শী হবার চেষ্টা করতে হবে। 

আমরা সবাই সমাজের অঙ্গ, সামাজিক জীব। সামাজিক সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে, নিজেদের  মধ্যে ভাবের বিনিময় করতে হবে। আর এই ভাবের বিনিময়ের মাধ্যম হচ্ছে গুছিয়ে কথা বলা। আর গুছিয়ে কথা তারাই বলতে পরে, যারা গুছিয়ে চিন্তা করতে পারে। আপনি যার সঙ্গে কথা বলছেন, জানবেন সে আপনার কথা শুনতে আগ্রহী। আসলে সবাই আপনার কথা শুনতে কিন্তু আগ্রহী নয়, সে তার নিজস্ব বিষয় সম্পর্কে শুনতে আগ্রহী। তাই আপনার সামনে যারা দাঁড়িয়ে আছেন, তাদের আগ্রহের বিষয় সম্পর্কে আপনাকে কথা বলতে হবে। অথবা আপনার বিষয় সম্পর্কে তাদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। তবেই আপনার কথা তারা শুনতে চাইবে, নতুবা আপনাকে অগ্রাহ্য করবে। বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে, কথা  কম বলা, কিন্তু যা কিছু বলবেন, তার বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আপনার মতামত ব্যক্ত করুন। আপনার হাঁটাচলা, বসা, কথাবলা, এমনকি চাহুনি ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে আপনার ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটবে। তাই মেরুদণ্ডে সোজা রেখে, চোখে চোখ রেখে কথা বলুন। তাহলে দেখবেন, আপনাকে লোকে সমীহের চোখে দেখবে। 

আপনি যা পারেন না, তা স্বীকার করুন।  আপনি ভালো বিরিয়ানি রাঁধতে পারেন না, সেটা খোলাখুলি বলুন।  কিন্তু তাই বলে বিরিয়ানি রাঁধতে পিছপা হবেন না।  তবে রাঁধবার আগে, সবাইকে আগেভাগে বলে রাখুন, আপনার রান্না ভালো নাও হতে পারে। সমস্ত কাজে নিজেকে এগিয়ে রাখুন। অজুহাত দিয়ে কাজ থেকে পালাবার চেষ্টা করবেন না। কাজের উৎকর্ষতা নির্ভর করে, বারবার আন্তরিকভাবে কাজের মধ্যে দিয়ে। 
আমরা কেউ আত্মবিশ্বাস নিয়ে জন্ম গ্রহণ করি না। জীবন-পথে চলতে চলতে চলতে আমরা আত্মবিশ্বাসী  হয়ে উঠতে পারি, আবার আত্মবিশ্বাসহীন  হয়ে উঠতে পারি। আত্মবিশ্বাস হচ্ছে একটা প্রক্রিয়া, যা আমাদের ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের মধ্যে শুরু হয়। দৈনন্দিন কাজের মধ্যে দিয়ে, ধীরে ধীরে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়  হয়, তাতেই আমাদের আত্মবিশ্বাসের  জন্ম হয়  ।   ছোট বেলায় আমরা যদি কোনো কাজের প্রসংসা পাই, তবে আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়তে সাহায্য করে, অন্যদিকে আমরা যদি ছোট বেলা থেকে বকুনি খাই, তাহলে আমাদের আত্মবিশ্বাস ক্ষয় হতে শুরু করে। কোনো কাজে একবার প্রসংসা পেলে, পরবর্তীকালে সেই কাজ করবার জন্য আমরা উৎসাহ পাই। বিপরীত ক্ষেত্রে অনুৎসাহিত হয়ে পড়ি, এমনকি আমাদের এতে করে ভয়ের আবহ তৈরী হতে পারে। আর ভীতু মনে অত্মবিশ্বাসহীনতার জন্ম হয়। সাহসী মনে আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হয়। তো ছোট বেলা থেকেই, এই বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে  আমাদের মধ্যে একটা ব্যাক্তিত্ত্বের জন্ম হয় ।  এইজন্য, আপনার ছোটবেলা  ,কোন পরিবেশে কেটেছে, সেখানে আপনাকে কতটা গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে, কতটা ভালোবাসা আপনি পেয়েছেন, কতটা ঘৃণা-অবহেলা আপনি পেয়েছেন,তার উপরেই আপনার আত্মবিশ্বাসের মাত্রা নির্ভর করছে। 

তবে এটা তো সত্যি, ছোটবেলা আপনার কোথায় কাটবে বা কেটেছে , তার উপরে আপনার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কারুর  ক্ষেত্রেই থাকে না। তো সেই চিন্তা করে আক্ষেপ করে, সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। এক্ষেত্রে আমাদের যেটা করতে হবে, সেটা হচ্ছে : 

১) নিজের গুনগুলোর দিকে  খেয়াল করুন। আপনি কোন কাজটি ভালো পারেন, সেটা নির্দিষ্ট করুন। এবং সেই কাজে নিজেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে তুলে ধরুন। নিজেকে বারবার বলুন, আমি একাজটা ভালো পারি।  সম্ভব হলে, সেই পেশা বেছে নিন, যা আপনার ভালো লাগে। তবে দেখবেন, আপনার আত্মবিশ্বাস, বেড়ে গেছে, এবং আপনি সেই কাজে সফলতা অবশ্য়ই নিরন্তর পেতে থাকবেন। 

২) ধরুন, আপনার যা ভালো লাগে, সেই কাজ আপনার পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না, অথচ বেঁচে থাকবার জন্য, সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকবার জন্য, আপনার এমন একটা কাজ করতে হচ্ছে, যা আপনার ভালো লাগার বিষয় নয়। তখন আপনি সেই বিষয়ের প্রতি কৃত্তিম ভাবে হলেও আগ্রহ দেখাতে শুরু করুন। প্রথম দিকের এই কৃত্তিম ভালোবাসা, একসময় আপনাকে সেই কাজে সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে ভালোবাসা এনে দেবে। আপনার চাকরী ভালো লাগে না, কিন্তু সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকবার জন্য আপনি চাকরী  ছাড়া অন্য উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না, তখন আপনি চাকরী পাবার জন্য, যে সব বিষয়ের জ্ঞান আবশ্যক সেই জ্ঞান আহরণ করবার চেষ্টা করুন। ধরুন আপনি চাকরীর জন্য চেষ্টা করছেন, তো চাকরী পাবার জন্য, যে সব বিষয়ের জ্ঞান থাকা দরকার, সেই জ্ঞান সংগ্রহ করবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে থাকুন।  দেখবেন, সেই কাজে আপনার সাফল্য এসে যাবে।  আর এই যে কৃত্তিম ভালোবাসা নিয়ে আপনি জ্ঞান সংগ্রহ করেছিলেন, সেই জ্ঞান আপনার অন্য কাজে এসে যাবে, সেই  বিষয়ের প্রতিও আপনার ভালোবাসা জন্মে যাবে ।

৩) আমাদের সবার মধ্যে দুটো মন।  একটা মন হ্যাঁ বলে তো আরেকটা না বলে। একটা মন বলে, তোর দ্বারা এটা হবে না। তুই এটা পারবি না। তখন নিজেকে প্রশ্ন করুন, কেন আমি পারবো না ? কেন আমার দ্বারা হবে না ? অমুক যদি পারে, তবে আমি কেন পারবো না ? ওরও দুটো হাত, দুটো পা, একটা মাথা, দুটো চোখ ইত্যাদি ইত্যাদি, আমি কেন ওর থেকে পিছিয়ে থাকবো ? আমার মধ্যে কমতি কোথায় ? তখন দেখবেন, আপনার ওই নেতিবাচক মন কোনো জবাব দিতে পারবে না। আসলে নেতিবাচক মনের কাছে কোনো জবাব নেই। বরং  আপনার ইতিবাচক মন তখন বলতে থাকবে, তুমি চেষ্টা করলেই পারবে। তোমার কোনো কিছুই  কম নেই।  তুমিও পারো।  কেবল এগিয়ে চলো।  কাজে নেবে পড়ো।  কাজে নেবে পড়লে, ভুলত্রূটি  হবে, সেগুলো সংশোধন  করে এগিয়ে যাওয়াই আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর উপায়।

৪) প্রথমেই বড়ো কোনো কিছু পাবার আশা না করে, ছোট ছোট কাজ দিয়ে, নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হবে। ফলাফলের কথা আগবাড়িয়ে চিন্তা না করে, কাজের মধ্যে নিজের সমস্ত ক্ষমতা উজাড় করে দিতে হবে। আর ছোটোখাটো কাজে সাফল্য এলে নিজেকে প্রসংসা করুন । . নিজের মনকে বলুন, দেখছো, আমিও পারি।  দেখবেন, এইভাবেই ধীরে ধীরে আপনার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছে। তখন ওই নেগেটিভ মন ধীরে ধীরে চুপ হয়ে যাবে। 

৫) অন্যকে দোষারোপ করতে যাবেন না। জানবেন, আপনার ব্যর্থতা আপনার নিজের জন্যই হয়েছে। অন্যের দিকে আঙ্গুল তোলা মানে, নিজের ভুল ত্রূটিগুলোকে ঢেকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করা। আর এতে করে আপনার মধ্যে অসহায়তা, ব্যর্থতার যন্ত্রনা ফুটে উঠবে।  নিজেকে প্রশ্ন করুন, কেন হয় নি, কেন পারিনি, কোথায় আমার দুর্বলতা।  দেখবেন, আপনার মন তখন আপনার ভূলত্রূটি, দুর্বলতার জায়গাগুলো তুলে ধরবে।  আর পরবর্তীতে আপনি দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে সেই ভুল ত্রূটিগুলোকে  শোধরাবার চেষ্টা করুন।  সাফল্য আপনার আসবেই। আর আত্মবিশ্বাস বেড়েই চলবে। 

তাই বলছিলাম, আমাদের বিশ্বাস, ও অভ্যাস আমাদেরকে জীবনকে পরিপূর্ন করে দিতে পারে। অন্য কোনো উপায় নেই। আপনি যা অভ্যাস করবেন, ধীরে ধীরে তা আদতে পরিণত হবে, আপনি যা বিশ্বাস করবেন, আপনি তাই হয়ে উঠবেন। এটাই সাফল্যের চাবি। 

আজ এই পর্য্যন্ত। বাক্যের বিরাম দিলাম। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম। 

 জীবন রহস্যঃ THE SECRET OF LIFE (২০) 

মহান আত্মার অধিকারী কিভাবে হবেন ? 

প্রথমেই বলি মহান আত্মার মরদেহ ত্যাগের পরে কি হয়, এই সম্পর্কে কেউ কেউ জানতে চেয়েছেন, এই সম্পর্কে পরের  দিন আলোচনা করবো। আজ মহান আত্মার অধিকারী কি করে হওয়া যায়, সেই সম্পর্কে একটা কথা বলি। 

আমরা সবাই দুটো জিনিসের অধিকারী। যদিও এই দুটোর কোনোটিই আমি নোই। এগুলো আমার।   একটা হচ্ছে পিতৃপ্রদত্ত প্রকৃতির একটা রক্তমাংসের শরীর, আর একটি হচ্ছে মন, বা মানসিক শরীর। আর এই দুটো শরীরই পরিবর্তনশীল। প্রতিদিন ভোর বেলা উঠে হয়তো আমাদের মনে হয়, আমি আগের দিনের মতোই  আছি।  কিন্তু এটা যে কতোবড় অসত্য সেটা আশাকরি আমাদের কাউকেই বুঝিয়ে বলতে হবে না। পরিবর্তনই জগতের নিয়ম - তাই আমাদের মন শরীরও পরিবর্তন হচ্ছে।  কিন্তু কথা হচ্ছে, এই পরিবর্তন আমাকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে। এই স্থুল শরীর বিনাশশীল - বিনাশের দিকেই এর গতি। মনও পরিবর্তনশীল অর্থাৎ মানসিক শরীরও পরিবর্তনশীল। আমাদের চিন্তা, আমাদের ভাবাবেগ, আমাদের জ্ঞান -বুদ্ধি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন  হচ্ছে।
মনের এই পরিবর্তনকে আমরা কোনো পথে নিয়ে যাচ্ছি, বা কোন পথে যাচ্ছে, সেটাই আমাদের স্থুলদেহ ত্যাগের অব্যবহিত পরের অবস্থা। তার কারন হচ্ছে, ঋষিদের আপ্তবাক্য হচ্ছে, স্থুলদেহ নাসের পরে, আমরা সবাই এই মানসিক দেহে কিছু কাল অবস্থান করে থাকি। এই ঋষিবাক্যে  যদি আপনি বিশ্বাস করেন, তবে আপনার কাজ হচ্ছে, মানসিক দেহের সমৃদ্ধি যাতে হয়, মানসিক দেহের যাতে উন্নতি হয়, তার জন্য এখনই চেষ্টা করা। 

দেহ তৈরী হয়েছে আমাদের কর্ম্মের জন্য।  স্থুলদেহ ভিন্ন আমরা কোনো কর্ম্ম করতে পারি না। আর  এই কর্ম্মে প্রবুদ্ধ করে থাকে আমাদের মন।  অর্থাৎ মন আমাদের সমস্ত  কর্ম্মের পরিচালক। তাই বাহ্যিক ভাবে শুধু কর্ম্মের পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনের সমূহ পরিবর্তন করতে পারবো না। সুতরাং কর্ম্মের উৎপাদন পদ্ধতি কি সেটা আমাদের জানতে হবে। অভিপ্রায় ও কর্ম্মের মধ্যে যে জিনিসটি প্রথমে আসে তা হচ্ছে চিন্তা। চিন্তার উপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা-ভাবাবেগ অনুভূতি ইত্যাদি গড়ে ওঠে। মনের মধ্যেই আমাদের অতীতের কথা ফুটে ওঠে, সুখ-দুঃখের অনুভূতি ফুটে ওঠে। এবং ভবিষ্যৎ কর্ম্মের চিত্র ফুটে ওঠে।  ধরুন আপনার মনে চা খাবার কথা ফুটে উঠলো, তখন আপনি চা-তৈরির সরঞ্জাম জোগাড় করবার জন্য লেগে গেলেন। চিন্তার ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয় বুদ্ধি। যা আসলে আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান। এই বুদ্ধি দ্বারাই আমরা মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।

বুদ্ধি যত  স্বচ্ছ হবে, আপনার কর্ম্মে তত নিপুনতা দেখা দেবে। বুদ্ধি বা জ্ঞান আমরা দুই ভাবে সংগ্রহ করতে  পারি। এক হচ্ছে বাহ্যিক বিষয়ের সংস্পর্শে এসে, যাকে   আমরা বলি ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান। আর ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের মধ্যে দুটো দিক আছে।  ধরুন আপনি একটা বট  গাছ দেখছেন, তার ডালপালা, পাতা ফল ইত্যাদি ইত্যাদি ।  তো বট গাছ সম্পর্কে আপনার একটা বাহ্যিক জ্ঞান হলো। আপনি যখন আরো নিবিষ্ট হয়ে বটগাছের ভূত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তা করবেন, তখন জানতে পারবেন, এই গাছ যেমন একদিন না একদিন মারা যাবে, তেমনি, এই গাছ একদিন খুব ছোট্ট ছিল, তারও  আগে এই গাছ একসময় একটা সামান্য বীজের মধ্যে নিহিত ছিলো। তো এই যে   বিষয়ের গভীরে  প্রবেশ, যাকে মুনি ঋষিগণ বলে থাকেন, প্রজ্ঞা। আরো একটি জ্ঞান আছে, যাকে  অন্তরের অনুভূতি লব্ধ  জ্ঞান বলা হয়, তাকে বলে সজ্ঞা। অর্থাৎ নিজের সম্পর্কে জ্ঞান।  আমি কে কোথা থেকে এসেছি, কেন এসেছি, আবার  কোথায় চলে যাবো। ইত্যাদি ইত্যাদি এই যে নিজেকে জানবার  জন্য  জ্ঞানের আগ্রহ, এ থেকে নিজের মধ্যে প্রশ্ন জাগে আবার নিজের  মধ্যেই জবাব খুঁজতে হয়।  একেই বলে সজ্ঞা।

তো যা বলছিলাম, বুদ্ধিবৃত্তিই আমাদের বিষয়ের গুনাগুন বিচার ও সিদ্ধান্ত নেবার কাজ করে থাকে। তো মন কাজ করে থাকে বুদ্ধির সাহায্যে। তো প্রতিনিয়ত আমরা যা কাজ করি, তা আমাদের মধ্যে একটা ছাপ  রেখে যায়। এবং এর থেকেই তৈরী হয়, আমাদের মানসিক গঠন, আবেগ, আগ্রহ, অভ্যাস, ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এই সবের সমষ্টি  হচ্ছে আমাদের সংস্কার। এই সংস্কারই মানুষের ব্যাক্তিত্ত্ব গড়ে তোলে। আর মন-বুদ্ধি-সংস্কার চক্রাকারে কাজ করে চলেছে। সংস্কার মানুষের চিন্তা-ভাবনা-আচার-ব্যবহার ইত্যাদি দ্বারা একটা মানসিক অবস্থা তৈরী করে, অর্থাৎ একটা মানসিক শরীর তৈরী করে। 

"আমি" যখন প্রথম রূপ নেয়, তখন সে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জ্যোতির্বিন্দু মাত্র। প্রথিবীর প্রথম রূপও অগ্নিগোলক। সূর্য্যও অগ্নিগোলক। এই সূর্য থেকে পৃথিবী,অর্থাৎ খণ্ডিত সূর্য, আবার  পৃথিবী থেকে "আমি"র উৎপত্তি। অর্থাৎ সেই অর্থে  "আমি"  খণ্ডিত পৃথিবী। অর্থাৎ সমস্ত কিছুর প্রথম রূপ হচ্ছে অগ্নির্জ্যোতি। আমাদের শরীরের প্রধান বস্তু হচ্ছে এই অগ্নি। মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহংকার এগুলো ওই জ্যোতির্বলয়কে ঘিরেই  অবস্থান করে, সঙ্গে থাকে প্রাণবায়ু ও শ্রদ্ধা অর্থাৎ জলের সূক্ষাতিসূক্ষ্ম অংশ । রূপের শুরু অগ্নিআর  শেষ হচ্ছে মনুষ্যদেহ। মনুষ্যদেহ পরিণতিতে অগ্নিতে লয় হয়। এই অগ্নিতে ফিরে যাওয়াই যোগ সাধনা। যোগে আমরা বায়ুর  মধ্যে ঘর্ষন ক্রিয়া শুরু করি।  এতে করে অগ্নি সৃষ্টি হয়। বায়ুর সঙ্গে অগ্নি মিশ্রিত হলে, বায়ুর উর্দ্ধগতি হয়। অর্থাৎ প্রাণবায়ু ও অপান  বায়ুর ঘর্ষনে অগ্নি প্রাণবায়ুকে উর্দ্ধগতি সম্পন্ন করে থাকে। একসময় প্রাণবায়ু ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে বহির্গত হয়।

নিজেকে সম্পূর্ণরূপে জানার পদ্ধতিই যোগ। আর এই আমি হচ্ছে ইতিবাচক আমি। যা আমার প্রকৃত সত্ত্বা। যোগ হচ্ছে একাগ্রভাবে নিজের সন্ধান করা। তাই নিজের অন্তর্জগতের ভান্ডার উন্মোচন করতে হবে। কোনো বস্তুকে সঠিক ভাবে পর্যবেক্ষন করতে হলে বস্তুর স্থিরতা প্রয়োজন। তাই প্রথমে নিজেকে স্থির অর্থাৎ শরীরকে স্থির করতে হবে। তারপর মনকে স্থির করতে হবে। নিজেকে জ্যোতির্বিন্দু হিসেবে কল্পনা  করুন।  এটি যদিও কল্পনা, তথাপি জানবেন, আপনি যখন প্রথম রূপের মধ্যে এসেছিলেন, তখন আপনি এই জ্যোতির্বিন্দু হিসেবে নিজেকে  প্রকাশ করেছিলেন। 

আমরা জন্ম জন্মান্তরের স্বভাবের দাস। এইবার নিজের স্বভাবের পরিবর্তন করতে হবে।  তাই প্রথমে যেকোনো একটি স্বভাব যা আপনার মধ্যে আছে, সেটিকে বেছে  নিন। যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করুন, আপনার এই স্বভাব আপনাকে মহা-মানব হতে বাধা সৃষ্টি করছে কি না । আপনার মুক্তির পথে বাধা কি না। যদি বোঝেন, আপনার এই স্বভাবের জন্যই, আপনি এগুতে পারছেন না, তবে সেগুলোকে নির্দিষ্ট করুন। একটা দুটো স্বভাব নিয়ে, তার পরিবর্তনের জন্য নিজের মধ্যে একটা সংকল্প গড়ে তুলুন। সংকল্পকে দৃঢ় করুন। গভীর আগ্রহের সঙ্গে, সর্বশক্তি প্রয়োগ করে, আপনি সেই স্বভাবকে পরিবর্তন করবার জন্য, নিজের মধ্যে ইতিবাচক চিন্তাগুলোকে ভাসিয়ে তুলতে চেষ্টা করুন। আপনার এই আগ্রহ, আপনার এই ঐকান্তিক ইচ্ছে যথা সময়ে কার্য্যে পরিণত হতে শুরু হবে। আপনার মধ্যে একটা রূপান্তর  শুরু হবে। 

নিজেকে জানতে হবে, নিজেকে বুঝতে হবে, নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে, সব শেষে নিজের এই পরিবর্তনের ছোঁয়া আপনার চারিদিকে বিলিয়ে দিতে হবে। 

নিজেকে জানতে হবে - অর্থাৎ আমি কে ? আমরা আগেই শুনেছি, আমরা এই দেহ, মন, ও শক্তি বা আত্মা। আমার জ্ঞান, আমার বুদ্ধি, আমার অহংকার, আমার সংস্কার বা চিত্তবৃত্তি - এগুলো সবই আমার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এই সবকিছু মিলিয়ে আমি। 

প্রথমে এই আমাকে যুক্তি দিয়ে বুঝতে হবে।  এর পর, এই আমিকে উপলব্ধি দিয়ে বুঝতে হবে। কবিতার মতো মুখস্তবিদ্যা নয়।  কবিতার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে হবে। তাকে বিশ্বাস করতে হবে। 

এইবার যে বিশ্বাস আপনার মধ্যে দৃঢ় হয়েছে, সেইমতো নিজেকে প্রকাশ করতে হবে।  অর্থাৎ সেইমতো আচরণ করতে হবে। বাসব জীবনে এই বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করতে হবে। আসলে আমি যা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করবো, যোগে সেটাই আমি অনুভব করতে শুরু করবো। যোগের এই অনুভূতি যথাসময়ে  কার্য্য করতে শুরু করবে। আমাদের তাত্ত্বিক জ্ঞান আর বাস্তবিক অভিজ্ঞতা যদি যথার্থ হয়, তখন সেই জ্ঞানের উপর নির্ভর করে বিশ্বাসের জন্ম হয়।  আর বিশ্বাস অনুযায়ী আমরা কার্য্যে অগ্রসর হয়।  কার্য্যের পরিণতিই কর্ম্মফল - যা আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে থাকে। সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে। 

এর পর আমাদের অভিজ্ঞতাকে সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। কোনো প্রত্যাশা না রেখে জীবনের দৈন্দিন কাজের মধ্যে দিয়ে ইতিবাচক চিন্তা ছাড়িয়ে দিতে হবে। প্রকৃত আত্মসচেতন মানুষ বর্তমান জীবনকে পূর্বপূর্ব জীবনের অশুভ অভ্যাসকে পরিবর্তন করে  নিজেকে সমস্ত পাশ থেকে মুক্ত করতে পারেন, তার চারিদিকে সে বাতাবরণ ছড়িয়ে দিতে পারেন।  এইভাবেই মানুষ মহান আত্মার অধিকারী হয়ে উঠে পারেন। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

জীবন রহস্যঃ - ২১

মরণ-কালে  হরিনামে কি কোনো লাভ হয় ? 

স্বামীজী  বলছেন,  হ্যাঁ অবশ্য়ই পারে।  তা সে মরন কালে হোক বা জীবনকালে হোক।  শান্তি কোনো সময়ের অপেক্ষা করে না। শান্তি কোনো বয়সের অপেক্ষা করে না। শান্তি কোনো পরিবেশ-পরিস্থিতির অপেক্ষা করে না। শান্তি আমাদের স্বাভাবিক স্বভাব।  শান্তি আমাদের মূল সত্ত্বা। শান্তি আমাদের কামনার বস্তু নয়। শান্তি আমাদের অধিকার। তাই যখনই আপনি নিজের মধ্যে প্রবেশ করতে পারবেন, সেই মুহূর্তেই আপনি শান্তির রাজ্যে প্রবেশ করবেন। তা সে এখনই হতে পারে, আবার সারা জীবনের  শেষে দেহ  ত্যাগ-কালীন  সময়ও হতে পারে। নিজের মধ্যে প্রবেশ বা আত্মোপলব্ধিই  শান্তি দিতে পারে।   

আমাদের প্রত্যেকের জীবন একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু জীবনের শুরুতে মানুষের উৎসাহ, উদ্দীপনার মাত্রা বেশি থাকে।  ধীরে ধীরে তা স্তিমিত হতে থাকে।  মানুষ যখন নিজের মধ্যে প্রবেশ করে, যতক্ষন সে উদ্দীপ্ত থাকে, ততক্ষন সে জীবনের স্বাদ পেতে পারে। জীবনকে সে উপভোগ করতে পারে। জীবনের সিঁড়ি বেয়ে সে আরো উচ্চস্তরে নিজেকে স্থাপন করতে পারে। 

চারিদিকে করোনার গ্রাস হাতছানি দিচ্ছে। পরিবারের সবাই বলছে, তোমার বয়স হয়েছে, এখন একদম বাইরে বেরোবে না। গাছে একটা পেঁপে পেঁকেছে, হাত খানেক উঁচুতে উঠতে পারলেই, আমি সেটাকে পেড়ে  আনতে  পারি, কিন্তু স্ত্রীর কড়া নিষেধ, না তোমাকে পেঁপে পাড়তে হবে না। এমনকি, তোমার বয়েস হয়েছে, তোমাকে বাজারে যেতে হবে না। ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সত্য হচ্ছে, মানুষের বয়স  বাড়ে না, বয়স বাড়ে দেহের। আরোসূক্ষ্ম ভাবে দেখলে, আমরা বুঝতে পারবো, সত্য হচ্ছে, আমাদের  দেহের পরিবর্তন হয়, দেহের বয়স কখনো ৭ বছরের বেশি বাড়ে না, বাড়তেই পারে না। কারন আমাদের দেহ যে সমস্ত কোষের সমষ্টি তার আয়ু সবথেকে বেশি হলে সাত বছর। তাই আমাদের প্রত্যেকের  দেহের্ বয়স বড়োজোর সাত বছর।   আর দেহ হচ্ছে কর্ম্ম সম্পাদনের জন্য একটা অস্ত্র মাত্র। আর এই কর্ম্ম নির্দেশিত হয় মনের দ্বারা। আর এই মন হচ্ছে স্থান-কালের উর্দ্ধে।  

আমাদের চাকরিতে  প্রবেশের জন্যও  একটা নির্দিষ্ট বয়স আছে। আবার একটা নির্দিষ্ট বয়সের পরে, চাকুরী থেকে অবসর নিতে হয়।  এগুলো আমাদের সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় বিধি। এমনকি আমাদের জীবনকে মুনি ঋষিগণ চার ভাগে ভাগ করেছেন, ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ, বানপ্রস্থ ও সন্যাস। প্রত্যেক বয়সের জন্য, কিছু নির্দিষ্ট কাজের কথা বলা হয়েছে এখানে। এখন কথা হচ্ছে বৃদ্ধ বয়সে আমাদের কি কাজ ? সাধারণ  মানুষ বা আমাদের সমাজ ভাবে, বৃদ্ধ বয়সে আমাদের ধর্মাচরণ করা উচিত। আবার  কেউ বলেন, সারা জীবন যে ধর্ম্মের কথা ভাবলো না, এই বুড়ো বয়সে তার ধর্ম্মের কথা ভেবে কি হবে ? বরং বৃদ্ধ বয়সে এসে বাহ্যিক শারীরিক কর্ম্ম থেকে বিরত থাকা উচিত, বিশ্রাম নেওয়া উচিত । এমনকি কোনো গভীর চিন্তা যেন আমরা বৃদ্ধ বয়সে না করি। তাহলে নাকি  আমরা ভালো থাকতে পারবো। 

এই যে গতানুগতিক চিন্তা বা জীবনধারা, তা আমাদের বৃদ্ধাবস্থার  জীবনকে হতাশায় পরিপূর্ন ক'রে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিচ্ছে। ছোটবেলায় ভেবেছি, কবে বড়ো  হবো, কবে নিজের পায়ে দাঁড়াবো। তবে ভালো থাকবো।  আবার যৌবনে, কর্ম্মস্থলের বা চাকুরী জীবনের নানান ঝামেলা সহ্য করতে করতে একসময় মনে হয়েছে , আমরা অবসর গ্রহণের  পরে নিশ্চয়ই ভালো থাকবো। যৌবনে মনে হয়, ছোটবেলাটা ভালো ছিল।  আবার  বৃদ্ধ বয়সে ভাবছি, জীবনটা যৌবনের।  অর্থাৎ বর্তমান আমাদের কাছে সবসময়  দুর্বিষহ হয়ে দেখা দিয়েছে । অতীত হয়তো ভালো ছিলো, আর আশায় থাকি ভবিষ্যতে হয়তো ভালো থাকবো।  কিন্তু ভালো আর থাকা  হয়ে ওঠে না কোনোদিন। আমাদের অনেক স্বপ্ন আছে, কিন্তু স্বপ্ন রূপায়নের জন্য, আমরা কিছু করি না। বরং আমরা ভাবি, আমার টাকা নেই, আমার বয়স নেই, পরিবেশ নেই, আমার মামা-কাকা নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি, তাই এই জীবনের স্বপ্ন পূরণ হলো না ।

 এইভাবেই আমরা আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যকে উপেক্ষা করেছি, জীবনকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। জীবনকে জীবনের মতো করে এগিয়ে যেতে দেই  নি। আসলে নিজেই নিজেকে কোনো সুযোগ দেইনি। নিজেই নিজের জীবনটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছি। পরের জন্য, সারা জীবন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটেছি। নিজেকে কখনো সুখী করবার চেষ্টাই করিনি। সব সময় ভেবেছি, কে আমাকে কি বললো, কে আমার সম্পর্কে কি ভাবছে, ইত্যাদি ইত্যাদি ।  পরের জন্য আমার কি কর্তব্য।  কিন্তু কখনো ভাবিনি আমার জন্য আমি কি করছি। আমার জন্য আমার কি কর্তব্য। বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজেকে নিয়ে ভাবি।  কারন এখন আমাকে সবাই আবর্জনার স্তুপ মনে করে।  এখন আমাকে সবাই অপ্রয়োজনীয় মনে করে, এখন সবাই আমাকে অনুৎপাদক সামগ্রী ভাবে। তাই সবার অবহেলা আমাকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে যেতে বাধ্য করছে, আর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছি। ভাবছি হয়তো মৃত্যুতেই  চির-শান্তি। কিন্তু সত্য হচ্ছে, মৃত্যু কাউকে কখনোই শান্তি দিতে পারে না। আপনি দিনে যে চিন্তা করেন, রাতে আপনি সেই স্বপ্ন দেখেন। তেমনি জীবনভর যে চিন্তা দিয়ে আপনি আপনার মানস দেহ তৈরী করছেন, স্থূল দেহের মৃত্যুর পরে আপনাকে সেই মানস-দেহে সেইমতো চিন্তার জগতে বাস করতে হবে। এর কোনো অন্যথা হবে না।   

নিজেকে সুখী করবার একমাত্র উপায় হচ্ছে, নিজের জন্য কিছু করা।  নিজের জন্য কিছুটা সময় বের করা। তা সে যে বয়সের হোন না কেন আপনি। নিজের স্বাস্থ্য, নিজের শান্তি, নিজের সাফল্য, অবশ্য়ই আপনি পেতে পারেন, যদি আপনি সেটি পাবার ব্যাপারে নিজের মধ্যে সত্যিকারের বিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে পারেন। হ্যাঁ আপনার ভাবনাই  আপনাকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করে তুলতে পারে, আপনার ভাবনাই  আপনাকে মানসিক শান্তি এনে দিতে পারে। আপনার ভাবনাই আপনার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে পারে। আপনি যখন এগুলোকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করবেন, তখন আপনার জীবন সার্থক হবে। আপনি জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পাবেন। আর সেই উদ্দেশ্যে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। জীবনের উদ্দেশ্যপূরণ করবার জন্য, জীবন কোনো বয়সের তোয়াক্কা করে না। জীবনের উদ্দেশ্য[পূরণ করবার জন্য, জীবন  কোনো পরিবেশের তোয়াক্কা করে না। জীবনের উদ্দেশ্য পূরণ কোনো বাইরের বস্তুর উপরে নির্ভর করে না। আপনার নিজের  মধ্যে যে মন আছে, আপনার নিজের মধ্যে যে অসীম শক্তি আছে, আপনার নিজের মধ্যে যে অদম্য উৎসাহ আছে, আপনার নিজের মধ্যে যে অসীম ইচ্ছেশক্তি আছে, এগুলোকে জাগিয়ে তুলতে পারলেই, জীবন তার উদ্দেশ্যে তরতর করে এগিয়ে যেতে পারে। জীবনে চলার পথ মসৃন হবে, না কাঁটায় ভরা হবে, তা নির্ভর করছে, আপনার নিজের চিন্তা-ভাবনার উপরে। আপনি নিজেকে নিয়ে যা ভাবছেন, সেটাই আপনি হতে চলেছেন।

প্রত্যেক বয়সের একটা সৌন্দর্য্য আছে।  একটা শিশু যেমন সুন্দর।  একজন কিশোরও সুন্দর। একজন যুবক যেমন সুন্দর, তেমনি একজন বৃদ্ধও সুন্দর। প্রত্যেক বয়সের এই সৌন্দর্যের উপভোগ করুন। যারা ভাবে জীবনের সফলতার জন্য আমার বয়স দায়ী, যারা ভাবে জীবনের সফলতার জন্য পরিবেশ-পরিস্থিতি দায়ী, তাদের জন্য শুধু ব্যর্থতাই  অপেক্ষা করছে। যারা অসুরক্ষা রোগে ভোগেন, যারা সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ, যারা অলস, যাদের উৎসাহের অভাব, তাদের জীবন অসম্পূর্ন, দুঃখে ভরা, তারা কেবল হতাশায় ভোগে। সফলতা যেমন অর্জন করতে হয়, তেমনি ব্যর্থতাও আমরাই ডেকে আনি । দুঃখও আমরাই ডেকে আনি। 

আপনি আপনার বয়স পরিবর্তন করতে পারবেন না, কিন্তু আপনি আপনার পরিবেশ পরিস্থিতি নিজের মতো করে গড়ে তুলতে পারেন, শুধু আপনার চিন্তার দ্বারা, আপনার বোধের দ্বারা, আপনার কাজের দ্বারা । আপনার জীবনের সাফল্য কোন্ বয়সে এলো, প্রথম জীবনে না শেষ জীবনে সেটা বড়ো কথা নয়, কথা হচ্ছে জীবন আপনার সফল হলো কি না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছে, মানুষ সারাজীবন যাই করুক না কেন, সে যদি মৃত্যুকালে সবকিছু ছেড়ে কেবল আমার চিন্তায় মগ্ন থাকতে পারে, মৃত্যুকালে কেবল আমার স্মরণ করে, তবে তার আমারই ধামে তার স্থান হয়, সে আমাকেই প্রাপ্ত করে । হাজার বছরের  অন্ধকার  কেটে যেতে পারে, একটামাত্র দেশলাই ও কাঠির ঘষায়। আপনার জীবনও এই মুহূর্তে পরিবর্তন হতে পারে, যদি আপনি আপনার চিন্তার মধ্যে, আপনার বিশ্বাসের মধ্যে, আপনার ইচ্ছে শক্তির মধ্যে  পরিবর্তন আনতে  পারেন। আর এই পরিবর্তনের জন্য, না কোনো বয়স লাগে, না কোনো পরিবেশ লাগে, না কোনো পরিস্থিতির প্রয়োজন দরকার পড়ে। যে মুহূর্তে আপনার অবচেতন মন ক্রিয়া শুরু করবে, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই দেখবেন, আপনার শরীর, মন, চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

 দেখুন এই জীবনে বেঁচে থাকবার জন্য, খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই। শরীর সুস্থ রাখবার জন্য, আমাদের ভালো ভালো খাবার খেতে হবে, তার কোনো মানে নেই, ঘুমুনোর জন্য আমাদের ডানলপের গদি লাগবে তার কোনো মানে নেই, বসবার জন্য সিংহাসন লাগবে তার কোনো মানে নেই। শান্তিতে থাকবার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শরীর  সচেতনতা, প্রয়োজন সাধারণ অথচ পরিমিত আহার। প্রয়োজন দুশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন। প্রয়োজন ভাবনার মধ্যে শান্তির ভাব, তৃপ্তির ভাব জাগিয়া তোলা। ভবিষ্যতের কাল্পনিক সুখের কথা নয়, এখন যা আছে তাতেই সন্তুষ্টি। কাজ থেকে অবসর নিন, কিন্তু জীবন থেকে নয়। বৃদ্ধ বয়সের মনুষ্যরূপ গাছের পরিপক্ক সুমিষ্ট ফলকে উপভোগ করুন। সুখ আমাদের স্বাভাবিক স্বভাব। নিজেকে নিজের মধ্যে ডুবিয়ে দিন তবে দেখবেন, আপনি সুখের সাগরে ভাসছেন।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম। 

জীবন রহস্যঃ - ২২

প্রার্থনার গোপন-সূত্রঃ 

প্রার্থনা কাকে বলে ? কার কাছে প্রার্থনা ? কেন প্রার্থনা ?প্রার্থনা কিভাবে কাজ করে ? প্রার্থনার ফল। 

ভূমিকা :
ভগবান মানুষকে দুটো হাত দিয়েছেন। গরু ছাগলের হাত নেই।  আমরা যখন এই হাতের সাহায্যে  কাজ করি, তখন আমাদের হাত দুটো আলাদা হয়েই থাকে। কিন্তু আমরা যখন অপরাধমূলক কাজ  করি, তখন আমাদের হাতদুটো বেঁধে দেওয়া হয়। আবার  আমরা যখন ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, তখন আমাদের হাতদুটো জোড়া লেগে যায়। জোড়া হাতের অপূর্ব ক্ষমতা। জোড়া হাতেই প্রার্থনা হয়। জোড়া হাতে অপরাধ দমন হয়। জোড়া হাতের  প্রার্থনার মাধ্যমে এমনসব অসম্ভব সম্ভব হতে পারে, যা সারা বিশ্ব  কখনো কল্পনাই করতে পারেনি। 
মনুষ্য জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা হচ্ছে, চিন্তা, ভাষা, ও প্রার্থনা। চিন্তা,ভাষা ও প্রার্থনা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আনুগত্যের সাথে বুদ্ধিদীপ্ত প্রার্থনা মানুষকে সমস্ত কিছু পাইয়ে দিতে পারে, যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। সমস্ত ধর্ম্মমতেই এই প্রার্থনার গুরুত্ত্ব স্বীকার করা হয়েছে। হাজার হাজার বছর  আগেও বহু মুনিঋষি এই প্রার্থনার মাধ্যমেই নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করেছেন।  
 
প্রার্থনা কাকে বলে ? 
আমাদের অনেকের ধারণা হচ্ছে, প্রার্থনা মানে ঈশ্বরের কাছে কিছু যাঞা করা। তো আমরা সবাই জীবনের কোনো না কোনো মুহূর্তে ক্ষমতাশালীর  কাছে তো বটেই, এমনকি ঈশ্বরের কাছে, যার সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা  নেই, সেই সর্ব্বশক্তিমানের কাছেও  প্রার্থনা করেছি।  তা সে পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার আগের রাতে হোক, বা প্রিয়জনের অসুস্থতার সময় হোক, বা ঘোরতর বিপদের দিনে হোক, যখন আমরা  অন্য কোনো উপায়  খুঁজে না পাই, তখন আমাদের মধ্যে থেকে স্বতস্ফূর্ত ভাবেই প্রার্থনার স্বর ভেসে ওঠে। আর এই প্রার্থনা সোজা কথায় ঈশ্বরের কাছে ভিক্ষে করা। একটা অবুঝ বালকের কাছে, হয়তো বিষয়টি  এমনতরো হতে পারে, কিন্তু সত্যিকারের প্রার্থনা ব্যাপারটা এমন নয়।  
 প্রার্থনা হচ্ছে আকুতি, যা ঈশ্বরের উদ্দেশ্য নিবেদিত হয়ে থাকে।  প্রার্থনা হচ্ছে নিজেকে ঈশ্বরের কাছে আহুতি দেওয়া, যা জীবনকে ঈশ্বরময় করে তুলতে পারে। প্রার্থনা  জীবনকে  সঠিক  দিশা দেখাতে পারে, তা নিজের জন্য হোক বা পরের জন্য হোক। প্রার্থনা হচ্ছে, সঠিক পরিস্থিতির জন্য আবেদন। প্রার্থনা হচ্ছে ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের একটা উত্তম মাধ্যম বা উপায় । ঈশ্বরের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের একটা সুযোগ । আমার জীবনে যা কিছু ঘটছে, তার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানবার একটা উপায়। আপনি যখন প্রার্থনা করেন, আপনি তখন নিজেকে সমস্ত জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। ঈশ্বরের থেকে বিচ্ছিন্নতাই জীবনের ব্যর্থতা ও দুঃখের কারন। প্রার্থনা একটা অতিশক্তিশালী প্রক্রিয়া যার সাহায্যে আমরা অন্তরের শক্তিকে বৃদ্ধি করতে পারি। আপনি আপনার বাসনাকে, আপনার বিশ্বাসকে  নিজের জীবনে সুস্পষ্ট ভাবে প্রকাশ করতে পারেন এই প্রার্থনার সাহায্যে। যখন আপনি প্রার্থনা করেন, তখন আপনার মধ্যে চিন্তার একটা নতুন মোড় আসে। ঈশ্বরের চিন্তার সঙ্গে নিজের চিন্তা, ঈশ্বরের ইচ্ছের সঙ্গে নিজের ইচ্ছেকে মিলিয়ে নেবার এক প্রবল শক্তি আপনার মধ্যে তখন জেগে ওঠে। যা কিছু ভালো, তার সঙ্গে আপনি বিলীন হতে চান। প্রার্থনা আপনাকে ঈশ্বরের অস্তিত্ত্বকে স্বীকার করতে বাধ্য করে থাকে। 

প্রার্থনার ফল। 
প্রার্থনার প্রয়োগ আপনার জীবনে বুদ্ধির বিকাশ ঘটাবে।  আর আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার যোগ্য হয়ে উঠবেন। আপনি তখন আপনার পারিপার্শিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠবেন। এই সময় আপনি নিজের সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা  করতে পারবেন, এবং আপনার জীবনের কর্তব্য সম্পর্কে আপনি সচেতন হয়ে উঠবেন। আপনার নিজের যা ধর্ম্ম, আপনার নিজের যা কর্তব্য, আপনার নিজের যা স্বভাব, সে সম্পর্কে আপনার চিন্তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কি হতে পারে, আর কি হতে পারে না, সে সম্পর্কেও আপনি সচেতন হয়ে যাবেন। আপনি কি চান, তার থেকে বড়ো  কথা আপনার কি পাওয়া উচিত, সে সম্পর্কে আপনি আরো অধিক জ্ঞাত হতে পারবেন। আপনি জানবেন, আপনি ঈশ্বরের ইচ্ছেতেই, এই শরীর, এই জীবন, এই মন, এই হৃদয় পেয়েছেন।  আর জানবেন, এগুলো সবই ঈশ্বরেরই অংশ। আপনি ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। আপনি ঈশ্বরের মধ্যেই অবস্থান করছেন। আপনি বুঝতে পারবেন, ঈশ্বরের এটা  ইচ্ছে নয়, যে আপনি দুর্ভোগের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেন। কিন্তু আপনি নিজের ইচ্ছেতে বার বার ঈশ্বরের হাত ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে, লোভ-লালসা চরিতার্থতার জন্য আপনি বিপাকে পড়ছেন। প্রার্থনা মানে ঈশ্বরের কাছে, নিজের দুর্ভোগের নিস্পত্তি চাওয়া নয়, নিজের ধন সম্পত্তি চাওয়া নয়, কারুর ক্ষতি চাওয়া নয়, প্রার্থনা মানে ভিক্ষা নয়। প্রার্থনা মানে ছেলের চাকরি নয়, মেয়ের বিয়ে নয়, প্রার্থনা মানে রোগ-ভোগ থেকে নিষ্কৃতি নয়, প্রার্থনা মানে ঈশ্বরের ইচ্ছের সঙ্গে নিজের ইচ্ছেকে  মিলিয়ে ফেলা।  প্রার্থনা মানে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ ঈশ্বরের ইচ্ছেতেই চলা । 

কার কাছে প্রার্থনা ? 
 যাকিছু  সঠিক, জানবেন সেই সমস্ত সঠিকের সমাহারই  হচ্ছে ঈশ্বর। ঈশ্বর সমস্ত ভালো কিছুর প্রতিনিধি, ঈশ্বর সমস্ত ভালোবাসার প্রতিনিধি, ঈশ্বর হচ্ছে সর্বোচ্চ  সত্য, ঈশ্বর হচ্ছে সমস্ত সৌন্দর্য, ঈশ্বর হচ্ছে একতানতা, ঈশ্বর হচ্ছে আনন্দ, ঈশ্বর হচ্ছে সুমিষ্ট সুর । ঈশ্বরের এই একতানতাকে উপলব্ধি করা যায় প্রার্থনার মাধ্যমে। ঈশ্বরের রাজত্ত্বে যা কিছু আছে, তার সমস্ত কিছুই আপনার আমার মধ্যে আছে। এটাকে বোঝার চেষ্টা করুন, এটাকে মেনে নেবার চেষ্টা করুন, আর ঈশ্বরের মধ্যে বাস করতে থাকুন।  আপনার সমস্ত জ্বালা যন্ত্রনা দূর হয়ে যাবে। জীবন হয়ে উঠবে আনন্দময়। তখন যে কাজেই আপনি হাত দেবেন সেই কাজেই সোনা ফলবে। 
শ্রীমৎ ভগবৎ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, ভালো মন্দ, শুভ-অশুভ সমস্ত প্রবৃত্তি ও সংস্কারের স্রষ্টা  হচ্ছেন ঈশ্বর। তা সে জ্ঞান   বলুন, অজ্ঞান বলুন বা হিংসা বলুন অহিংসা বলুন, ভয় বলুন বা অভয় বলুন সব  কিছুই ঈশ্বর সৃষ্ট। বলছেন, (১০/২০) সর্বভূতের হৃদয়ে স্থিত আত্মা আমি, আমিই সর্ব ভূতের উৎপত্তি, স্থিতি ও সংহারস্বরূপ। "অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্ব্বভূতাশয়-স্থিত। অহমাদিশ্চ মধ্যঞ্চ ভূতানামন্ত এব চ"।

আবার শ্লোক নং ১০/২১-৩৭ পর্যন্ত  ভগবান  নিজেকে সমস্ত কিছুর মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে নিজেকে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ তিনি সর্বশক্তিমান, ভালোর ভালো, আবার খারাপের খারাপ।শেষে ১০/৩৮ নং শ্লোকে এসে বলছেন, আমি সর্ব প্রাণীর বীজ, আমি  ব্যতীত চরাচরে কিছুই নেই , আমিই সব।  আবার উপনিষদ বলছে অহম-ব্রহ্ম।  আমিই ব্রহ্ম, তুহি। আসলে ঈশ্বরের সমস্ত অশুভ  দিকগুলো যেমন আমাদের সবার মধ্যে আছে, তেমনি ঈশ্বরের সমস্ত শুভশক্তিও আমাদের মধ্যেই আছে। এই বিভূতি অর্থাৎ আশ্চার্য্যজনক শক্তিকে জাগাতে আমাদের প্রার্থনার প্রয়োজন। 

প্রার্থনা কিভাবে কাজ করে দেখুন। 

 আপনি যদি কিছুটা সময়, নির্জনে-নিভৃতে ধ্যানমগ্ন হয়ে প্রার্থনা করেন, তবে আপনার আত্মা, মন এবং শরীর আপনার সেই প্রার্থনা অনুযায়ী স্পন্দিত হতে থাকবে। এমন নয়, যে আপনি একবার একদিন প্রার্থনা করলেন, আর অমনি আপনার মধ্যে অলৌকিক কিছু ঘটে গেলো তা নয়। কিন্তু আপনার নিরন্তর ঐকান্তিক প্রার্থনা, আপনার শরীরের মধ্যে যে স্পন্দন তুলবে, তা  আপনাকে একটা একতানতায় পৌঁছে দেবে। দেখুন, ঢাক, ঢোল, বাঁশি, কাঁসর-রূপ জীবনের উপাদান সব সময় আপনার শরীরকে আন্দোলিত করছে। সেই  বাজনার মধ্যে কোনো সাযুজ্য না থাকার জন্য, আপনার মধ্যে বিরক্তি উৎপাদন হচ্ছে, কিন্তু যখন এর মধ্যে একটা একতানতা দেখা দেবে, তখন সেই একই ধ্বনি, মধুর সুরে  পরিণত হতে পারে।  প্রার্থনা এই কাজটিই করে থাকে।  অর্থাৎ শরীর-মন-আত্মার মধ্যে একটা একমুখী গতি, আপনার জীবনধারাকে আনন্দ ধারায় বইয়ে দিতে পারে। প্রার্থনার মাধ্যমে আপনার মধ্যে আত্মবিশ্বাস, নিজের পায়ে দাঁড়াবার শক্তি উজ্জীবিত হবে। 
দেখুন, ভগবান কিছু করেন না - তিনি আপনাকে দিয়েই  সবকিছু করিয়ে থাকেন। আবার ও সত্যি, যে  আপনার কোনো শক্তি নেই কিছু করবার। ঈশ্বরের শক্তিই আপনার সমস্ত কাজ, এমনকি চিন্তা করবার  শক্তি যোগাচ্ছে । তাই প্রার্থনা হচ্ছে এই শক্তির জাগরণ । অর্থাৎ আপনার ভিতরে যে ঈশ্বরীয় শক্তি আছে, তাকে স্মরণ করা, তাকে জাগিয়ে তোলা। একটা জিনিস জানবেন, বাইরে থেকে কোনো শক্তি এসে, আপনার সাহায্য করবে, এমন ভাবার কোনো কারন নেই। আপনি যখন, পরামর্শের জন্য, আপনি যখন প্রেম-ভালোবাসার  জন্য, আপনি যখন স্ব-নির্ভরতার জন্য,  আত্মশক্তির কাছে প্রার্থনা করবেন, অর্থাৎ যার প্রতি আপনি ধ্যান দেবেন, সেই মুহূর্তেই সেই শক্তি আপনার ভিতরে জাগ্রত হতে শুরু করবে। প্রার্থনা হচ্ছে, মনের ধ্বনি, মনের ডাক।  এটি তখনি কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে, যখন আপনি আপনার আত্মশক্তি ও ঐশ্বরিক শক্তিকে একত্রিত করতে পারবেন। বারবার শুভ প্রার্থনা, আপনার ভিতরে শুভ শক্তিকে কার্যকরী রূপ দিতে উদগ্রীব হবে। শুভ কামনা আপনার যত বাড়তে থাকবে, অশুভ কামনা আপনার কাছ থেকে তত দূরে চলে যেতে থাকবে। 
দেখুন, আমরা জন্ম-জন্মান্তর থেকে অনেক দুঃখের স্বীকার হয়েছি।  আর এর ফলে আমাদের মধ্যে রাগ, দ্বেষ, হিংসা জমাট  বেঁধে আছে। এগুলোকে দূর করবার  জন্য, আমাদের প্রার্থনা করতে হবে, নিজের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা জাগিয়ে তোলাই প্রার্থনার কাজ । প্রার্থনা তখনই বেশি কার্যকরী হয়ে উঠতে পারেন, যখন আপনার প্রার্থনা মধ্যে   একটা ধারাবাহিকতা থাকবে, ঐকান্তিকতা, থাকবে দৃঢ় বিশ্বাস, আর অসীম ধৈর্য্য থাকবে । 

প্রার্থনা কিভাবে করবেন ? 

দেখুন, প্রার্থনা পুরোপুরি ভাবে ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটি আপনার জীবনকে বিশ্বশক্তির কাছে উন্মুক্ত করবার উপায়। আপনার নিজস্ব মনের কক্ষে প্রবেশ করবার সময় এটি। এটি আপনার ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সময়। আপনি জীবনে যা কিছু পেয়েছেনা,তার জন্য ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা জানান। আপনি হয়তো বলবেন, আমি তো গরিবের ঘরে জন্মেছি ।  জন্ম থেকেই দেখছি, অভাব, আশ্রয়হীন, অসহায়।.কিন্তু ভেবে দেখুন, আপনার মতো দুটো চোখ, দুটো কান, দুটো হাত, দুটো সুস্থ  পা হয়তো অনেকে পান নি।  আপনি তা পেয়েছেন তা আপনি নিজের যোগ্যতায় পান নি । সবচেয়ে বড়ো  কথা আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য,  চন্দ্র-সূর্য নিঃশর্তে আলো প্রদান করছে, আপনাকে বেঁচে থাকবার জন্য, নিঃখরচায়, ভগবান  বাতাস দিচ্ছেন, গলায় আপনার মধুর ধ্বনি দিয়েছেন। ইত্যাদি ইত্যাদি অর্থাৎ যাকিছু আপনি পেয়েছেন, এর জন্য আপনি কিছুই করেন নি। আর এই অযাচিত  দানের জন্য, সবচেয়ে বড়ো  কথা, আপনি একটা মনুষ্য দেহ পেয়েছেন, এর থেকে বড়ো  আর কি হতে পারে ? তার জন্য, আপনি নিশ্চয়ই ভগবানের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন। 
প্রার্থনা হচ্ছে, ঈশ্বরের ঘরে প্রবেশ। প্রার্থনা করবার জন্য, আপনাকে মন্দিরে মসজিদে যেতে হবে, তার কোনো মানে নেই। পাহাড়ে-জঙ্গলে যেতে হবে তার কোনো মানে নেই। আপনি আপনার শোবার  ঘরে, এমনকি আপনি যখন যেখানেই থাকুন না কেন, সেখানে বসেই, আপনি আপনার পার্থনা কাজটি সারতে পারেন। একটা জিনিস সব সময় মনে রাখতে হবে, আপনি যখনই প্রার্থনা করবেন, তখন যেন আপনি সজাগ থাকেন। আপনি যে একটা দিন ভালোভাবে, অতিবাহিত করলেন, বা আরো একটা শুভ  সকাল দেখতে  পেলেন, তারজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিন।  কৃতজ্ঞতা জানান। তবে যা কিছু আপনি প্রার্থনাতে নিবেদন করবেন, তা যেন স্বতস্ফূর্ত  হয়। কৃত্তিম না হয়। প্রার্থনায় যদি মন খুলতে না পারেন, প্রার্থনায় যদি নিজের দুর্বলতাকে প্রকাশ করতে না পারেন, তবে আপনার মনের ইচ্ছে পূরণ হবে কি করে ? আর প্রার্থনা আমাদের দুর্বলতাকে দূর করবার জন্য, দুর্বলতাকে  ঢাকবার জন্য নয়, তাই প্রার্থনা যেন, আমাদের দুর্বলতাকে দূরীভূত করবার উপায় অনুসন্ধান করতে পারে।  সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রার্থনা সবসময় ভালোর জন্য, তা সে নিজের বা অপরের হোক। প্রার্থনায় কখনোই কারুর ক্ষতির কথা যেন মনে না আসে।  এমনকি আপনাকে যারা হিংসে করে, আপনার যারা ক্ষতি চিন্তা করে, আপনাকে যারা কষ্ট  দেয়, তাদের জন্যও আপনার মঙ্গল  প্রার্থনা করা উচিত। আর আপনি যত  মঙ্গল কামনা করতে থাকবেন, ততই আপনার মঙ্গল হতে থাকবে। যখনই সুযোগ পাবেন, মনের ভিতরে ঢুকে যান, ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব  করুন। আর ঈশ্বরের কাছে, কিছুক্ষন মৌন হয়ে বসে থাকুন। মৌনতা মানে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে যাওয়া। মনে মনে চিন্তা করুন, এই বিশাল ব্রহ্মান্ডের একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীট আমি । এই বিশাল শক্তির কাছে, আমি একজন শক্তিহীন অনু মাত্র । কিন্তু আমি যখনই  এই বিশাল বিশ্বশক্তির অঙ্গ  হিসেবে নিজেকে ভাবতো পারবো, তখন এই বিশাল শক্তির পরিবারের  সঙ্গে, আমার শক্তিও অসীম হয়ে যাবে। বড়ো পরিবারের  সদস্যরা যেমন ভেবে থাকে। শক্তিশালী দেশের নাগরিকগণ যেমন ভেবে থাকে। 
আমাদের ভয় দূর করবার জন্য, বা আমাদের রাগ,ঘৃণা,দ্বেষ, হিংসা দূর করবার জন্য, যেন আমরা প্রার্থনা না করি। কারন যত  অশুভ বৃত্তিগুলোর কথা আপনার মাথার মধ্যে আসবে, তত আপনার মধ্যে সেই অশুভ বৃত্তগুলোই বৃদ্ধি পেতে থাকবে। ভয় দূর করবার জন্য প্রার্থনা না করে, সাহসের জন্য প্রার্থনা করুন। রাগ, হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণা দূর করবার জন্য প্রার্থনা না করে, প্রেম-সম্প্রীতি-মমতা-ভালোবাসার জন্য প্রার্থনা করুন। আসলে বিশ্বশক্তি কখনো, শুভ অশুভ বোঝে না। ভয় ও নির্ভয়ের মধ্যে সে পার্থক্য নির্নয় করতে পারে না ,  সাহস ও কাপুরুষতার মধ্যে পার্থক্য বোঝে না । তাই দারিদ্র দূর করবার জন্য প্রার্থনা নয়, প্রার্থনা করুন ধনী হবার জন্য। অর্থাৎ সবসময় সদর্থক শব্দের সাহায্যে প্রার্থনার সংগীত রচনা করুন। নঞৰ্থক শব্দ পরিহার করুন। আপনি যদি শারীরিক সুস্থ থাকতে চান, তবে  আমার অসুস্থতা দূর করো, না বলে বলুন, আমাকে সুস্থ  করে দাও বলুন । তবে একটা কথা বলি, নিজের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে পারলে, তবেই জীবন সুখী সমৃদ্ধ হতে পারে, তাই ঈশ্বরের কাছে প্রেম নিবেদন করুন।  আর পরিণামে নিজের মধ্যে প্রেমের আস্বাদন করতে থাকুন। 
যখন প্রার্থনার মধ্যে থাকবেন, তখন নিজেকে ঢিলে করে ছেড়ে দিন। শরীর-মনে একটা আরামদায়ক পরিস্থিতির অনুভব করুক। উদ্বিগ্নতা নিয়ে কখনো প্রার্থনায় বসতে নেই।  উদ্বিগ্ন হলে, আগে নিজেকে স্থির চিত্ত করবার চেষ্টা করুন।  শরীর স্থির করে, স্নায়ুগুলোকে স্থির হতে দিন। তারপর প্রার্থনা শুরু করুন। আমাদের দুশ্চিন্তা আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রূ।  এই দুশ্চিন্তা যেমন আমাদের মানসিক কষ্টের কারন হতে পারে, তেমনি আমাদের শারীরিক কষ্টেরও কারন। আমরা যখন ঈশ্বর-বিমুখ হয়, তখনই আমাদের দুশ্চিন্তা আসে। যেকোনো সমস্যায় আমি যখন পিতার উপরে নির্ভরশীল হতে পারি, তখন আমরা দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকতে পারি।  ঠিক তেমনি, সবাই পিতা পরম-পিতা, পরম-ঈশ্বর-এর  উপরে নির্ভরশীলতা আমাদেরকে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে সাহায্য করতে পারে। সময়মতো সঠিক কাজ করা যেমন আমাদের দুশ্চিন্তা মুক্ত করতে পারে, আবার কখন কি করতে হবে, কোনটা সঠিক আর কোনটা সঠিক নয়, তা আমরা সব সময় নির্ধারণ করতে পারি না। তাই আমরা যে কোনো সিদ্ধান্ত যদি ঈশ্বরাভিমুখী হয়ে নিতে পারি, তবে, আমাদের সিধান্তরে কখনো ভুল হতে পারে না।  আর যদি সাময়িক ভাবে ভুল বলে মনেও হয়, তথাপি জানবেন, দীর্ঘ-মেয়াদে বুঝতে পারবেন, যে সিদ্ধান্ত ঈশ্বরকে স্মরণ করে নেওয়া হয়েছিল, তা সঠিক হয়েছিল।  ঠাকুর রামকৃষ্ণকে যখন তোতাপুরি সন্যাস নিতে বলেছিলো, তখন রামকৃষ্ণ মায়ের কাছে ছুতে গিয়েছিলো, অনুমতি নিতে।  অর্থাৎ যখন আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ হয়, তখন যদি আমরা ঈশ্বরের স্মরণ করি, তখন অবশ্যি তিনি আমাদের সঠিক পাথেয় পরিচালিত করে থাকেন। 
তবে একটা কথা বলি, প্রার্থনা করতে গিয়ে, ঈশ্বর অভিমুখী থাকতে গিয়ে যেন  আমাদের সাধারণ বুদ্ধি  লোপ পেয়ে না যায়।  অনেকে "সবই তার ইচ্ছে বলে" নিজের ইচ্ছে ঈশ্বরের উপরে চাপাতে চায়। এই প্রবণতা নিজের সঙ্গে প্রবঞ্চনা ছাড়া কিছু নয়। আমি ভালো স্বাস্থ্যের জন্য প্রার্থনা করবো, আর অপরিমিত পরিমানে  কু-খাদ্য গ্রহণ করবো, স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করবো, তাহলে জানবেন, আপনি নিজেকেই নিজে ঠকাচ্ছেন । আপনি পরীক্ষায় পাশ করবার জন্য ভাবানের কাছে প্রার্থনা করছে, আর সারা বাঁচার খেলা-ধুলা করে সময় অতিবাহিত করছে, তাহলে ঈশ্ববরের বাপ্-ও আপনাকে পরীক্ষায় পাশ করতে পারবে না। আপনি তিন-তোলা থেকে ঝাঁপ দেবেন, আর বলবেন, ঈশ্বর আমাকে বাঁচাও। তাহলে, ঈশ্বর আপনাকে যদি প্রাণে নাও মারেন, জানবেন আপনার হাত-পা ভেঙে দেবেন। অর্থাৎ আপনি মন থেকে যখন প্রার্থনা করবেন, তখন দেখবেন, আপনার ভিতর থেকেই কর্ম্মের নির্দেশ আসবে, আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন, আপনার ইচ্ছে পূরণের জন্য এখন আপনার কি কর্তব্য, আর সেই কর্তব্যে আপনার উৎসাহ, আপনার কর্মশক্তি, আপনার শারীরিক শক্তি সম্পূর্ণ ভাবে নিয়োজিত করুন। আর এই কাজে সম্পুর্নশক্তি নিয়োগে আপনার যদি গাফিলতি  আসে, তবে জানবেন, আপনার প্রার্থনা ঐকান্তিক ছিল না।  আপনি ঈশ্বরকে যাচাই করতে চাইছিলেন। এটি একটি হঠকারীতা  ছাড়া আর কিছু নয়। আপনি মনে এক, আর কাজে আর-এক এমনি হলে জানবেন, ঈশ্বর আপনাকে ন্যাংটা করে ছেড়ে দেবেন । ঈশ্বর আপনাকে ছাড়বেন  না, কিন্তু ঈশ্বরই আপনাকে দ্বন্দ্বের মধ্যে নিবদ্ধ করে রাখবেন। তাই এই কাজটি কখনো ভুলেও করতে যাবেন না। ঈশ্বরের কাছে যারা চাই চাই করে, কিন্তু ঈশ্বরকে কিছুই দিতে চায় না, তারা ঈশ্বরের করুন থেকে বঞ্চিত হয়। আর ঈশ্বরের অস্তিত্ত্বে তারা সন্দিহান হয়ে ওঠে। সফল মানুষ সবাই ঈশ্বরে বিশ্বাসী, বিশ্বশক্তির দুয়ারে তারাই ধর্ণা দিয়ে বসে আছেন। আর বিশ্বশক্তিও তাদের উদার হস্তে দান করে থাকেন। আমি এইসব কথা কোনো কেতাবি বিদ্যা থেকে বলছি না, এ আমার জীবনের অভিজ্ঞতা। আব্রাহাম লিঙ্কন তখন প্রেসিডেন্ট। তো তার কাছে, বহু পূর্ব পরিচিত-অপরিচিত বহু ব্যক্তি আসতেন, নিজের উচ্চাশা পূরণের প্রত্যাশা নিয়ে। একবার তার এক বন্ধু এসেছিলেন, নিতান্তই বন্ধুত্ত্বপুর্ন আলাপের জন্য।  তো কিছুক্ষন আলাপের পর, লিংকন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কেন এসেছো, কি দরকারে তুমি আমার কাছে এসেছো ? বন্ধুর সঙ্গে দুদন্ড ভালো-মন্দ কথা বলা ছাড়া তার আর কোনো উদ্দেশ্য নেই জেনে, লিংকন বিস্ময়ের সাথে বলেছিলেন, তুমি ভাবতে পারবে না, তোমার সাক্ষাৎ আমাকে কত আনন্দ দিলো, আমার কাছে আজকাল যারা আসে, সবাই কিছু না কিছু প্রত্যাশা নিয়ে আসে। তারা আমাকে দেখতে আসে না, আমি কেমন আছি, তা তারা জানতে আসে না, তারা আসে প্রেসিডেন্টের কাছে, প্রত্যাশার ঝুলি নিয়ে। 
ভগবানের কাছে ভিক্ষে নয়, ভগবানকে অন্তরথেকে  ধন্যবাদ দিন। এবং প্রার্থনা করুন, সঠিক নির্দেশের জন্য। ঈশ্বরের ইচ্ছেয় যে জীবন আমরা প্রাপ্ত হয়েছি, সেই জীবন কিভাবে উন্নত হবে, কিভাবে আরো বেশি উপভোগ্য হবে, সবচেয়ে বড়ো  কথা ঈশ্বর কেন আমাদের এই শরীর  ধারণ করিয়েছেন, সেই প্রশ্ন জাগিয়ে তুলুন নিজের মধ্যে। আর ঈশ্বরের মাধ্যমে, প্রার্থনার সুরে, সেই সব প্রশ্নের জবাব খুঁজে নিন। জানবেন, ঈশ্বরের ইচ্ছে পূরণের জন্য, এই জীবন, আমার ইচ্ছে পূরণের জন্য এই জীবন নয়।  তাই সংগোপনে ঈশ্বরের কাছে জেনে নিন, তার ইচ্ছে ও তা পূরণের শর্তাবলী। এবং সেই মতো নিজের জীবনকে পরিচালিত করুন। ঈশ্বরের আশীর্বাদ সবসময় আপনার উপরে বর্ষিত হচ্ছে, এই অনুভব আপনাকে  একটা শান্তির জীবনের অধিকারী করে দেবে। 
বিশ্বাস করুন ১. ঈশ্বর আমার  পরামর্শ দাতা - পরিচালক।  ২. আমি সব সময় ঈশ্বরের নির্দেশে সঠিক পথে বাঁক নিচ্ছি ৩. আমার লক্ষে যেতে, যেখানে কোনো পথ নেই, সেখানে ঈশ্বরই পথ তৈরী করে দেবেন। ৪.সমস্ত কিছুই সম্ভব, যদি ঈশ্বরের ইচ্ছে হয়। প্রার্থনার সঙ্গে ধ্যান প্রণালী ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। প্রার্থনা দিয়ে শুরু করুন, ক্ষাণিক্ষণ নিজের ইষ্টের  ধ্যান  করুন, আবার প্রার্থনা দিয়ে শেষ করুন। তবে জীবন অবশ্য়ই সমৃদ্ধ হবে - একথা হলফ করে বলা যায়। 
  
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম।  

 জীবন রহস্যঃ - ২৩ 

সার্থক জীবনের জন্য সাধনা - কিসে শান্তি হয় ?   

আমরা আগের জীবনে কি করেছি, কেমন ছিলাম, কিসব চিন্তা করেছি, তা আমাদের স্মৃতিতে নেই। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র এখন কোথায় আছেন, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখন কোথায় আছেন, তা আমাদের জানা নেই। ঋষি ব্যাসদেব, মহামুনি বাল্মীকি কোথায় আছেন, তা আমরা জানিনা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান বুদ্ধ, ঠাকুর রামকৃষ্ণ কোথায় আছেন, তা আমরা জানি না।  কিন্তু এখন আপনি আছেন, আর এখন আপনি  যা করছেন, যা কিছু চিন্তা করছেন, তার ফল আপনার পরবর্তী জন্মের মানুষগণ পেতে পারেন, এটা আমরা বেশ বুঝতে পারি । ঠিক তেমনি মহাপুরুষ তার জীবদ্দশায় যা কিছু করেছিলেন, যা কিছু বলেছিলেন, যা কিছু চিন্তা করেছিলেন, সেই কথাগুলো, আমাদের কাছে মূল্যবান গ্রন্থের আকারে রয়ে গেছে। সেগুলো থেকে আমরা অভিজ্ঞতা, জ্ঞান সংগ্রহ করে আমাদের বর্তমান জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারি। 
তাই বলছি, আপনি যদি খ্রিস্টান ধর্ম্মে জন্ম গ্রহণ করে থাকেন, তাহলে বাইবেল গ্রন্থখানি অবশ্য়ই পড়বেন, এবং বাড়িতে রাখবেন।  আপনি যদি ইসলাম ধৰ্মাৱলম্বী হন, তবে অবশ্যই কোরানখানি কাছে রাখবেন। আপনি যদি বৌদ্ধ হন তবে ত্রিপিটক গ্রন্থখানি ঘরে রাখবেন। আপনি যদি হিন্দু ধর্ম্মে জন্ম গ্রহণ করে থাকেন, আর পুরুষোত্তম রাম  চন্দ্রের গুনগ্রাহী হন, তবে আপনি আপনার পছন্দমত  , রামায়ণ, রাখতে পারেন। আপনি যদি সমন্বয়বাদে বিশ্বাসী হন, তবে শ্রীকৃষ্ণ-উক্ত শ্রীমৎ ভগবৎ  গীতাগ্রন্থখানি বাড়িতে রাখবেন। আপনি যদি সর্বধর্ম্মে বিশ্বাসী হন, তবে ঠাকুর রামকৃষ্ণের জীবনী গ্রন্থ অথবা কথামৃত কাছে রাখবেন।আপনি যদি সমস্ত জীবের মধ্যে ভগবানের দর্শন পেতে চান, তবে স্বামী বিবেকানন্দের বইগুলো কাছে রাখবেন।  আপনি যদি নাস্তিক হন, তবে চার্বাকের বইখানি কাছে রাখবেন। 

অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, আপনি যে ভাবের মানুষ হন না কেন, আপনার একই ভাবের পূর্বপুরুষদের স্মরণে রাখুন।  তাদের জীবন-কথা স্মরণ করলে, আপনি আপনার জীবনে অনেক সমস্যার সমাধান পেয়ে যেতে পারেন। একথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমি লক্ষ করেছি, বহু মানুষ ধর্ম্ম ধর্ম্ম করেন বটে কিন্তু সে তার নিজের ধর্ম্ম সম্পর্কে কিছুই জানেন না।  না আমি বলছি না যে সবাই একরকম - তবে যারা সমস্যার মধ্যে জীবন কাটান, তারা বেশিভাগ ক্ষেত্রে ধর্ম্মবিমুখ।  কেবলমাত্র , বিপদের দিনে, ঠাকুরকে ডাকেন, আবার বিপদ সরে গেলে, ঈশ্বরের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। এই জায়গা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনুন। 

এখন কথা হচ্ছে, বইগুলো বাড়িতে রেখে দিলেই কি আমাদের ক্লেশ দুঃখ  যাবে ? বইগুলো, আলমারিতে রেখে দিলেই, বা লাল কাপড়ে মুড়ে সযত্নে ঠাকুরের  আসনে রেখে প্রতিদিন ফুল-জল-বেলপাতা দিয়ে পুজো করলে কি আপনার দুঃখ দূর হয়ে যাবে ?  না তা যাবে না, এগুলোর মধ্যে কি আছে, তা আমাদের ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করতে হবে, তবেই আমাদের ক্লেশ-দুঃখ দূর হতে পারে। 

১. দেখুন যে বিষয় নিয়ে আপনার চিন্তা করা উচিত নয়, যে বিষয়ে আপনার মনোযোগ দেওয়া উচিত নয়, আর যে বিষয়ে আপনার মনোযোগ দেওয়া উচিত, এই দুই চিন্তা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আর এই জন্য, চিন্তাশীল ব্যক্তির সহযোগিতা নিতে হবে। দেখুন, চিন্তা দুই রকম, মনোযোগী চিন্তা, আর অমনোযোগী চিন্তা। যে চিন্তা আমাদের এমনি এমনি আসে, এগুলো আমাদের অমনোযোগী চিন্তা, অর্থাৎ অহেতুক চিন্তা বা বলা যেতে পারে দুশ্চিন্তা। এগুলো আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকে, কিন্তু মন কিছুতেই এগুলোকে মেনে নেয় না, অথচ এই চিন্তাগুলোকে না করেও পারে না।  ভবিষ্যতের কাল্পনিক অমঙ্গল চিন্তা, প্রিয়জনের অমঙ্গল চিন্তা, ছেলেটা মোটরসাইকেল নিয়ে বেরুলো, কি হবে, রাস্তায় কোনো অসুবিধা হবে কি না, ছেলেটা পরীক্ষায় ভালো ফল করবে কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি যে সব চিন্তা আমাদের বিব্রত করে থাকে, অথচ যেখানে আমাদের কিছুই করবার নেই, সে ধরনের চিন্তাকেই বলা হয়ে থাকে অমনোযোগী চিন্তা  - এই যে অহেতুক চিন্তা এগুলো অমনোযোগী চিন্তা। একে আমাদের পরিহার করতে হবে। এই অহেতুক চিন্তা বা দুশ্চিতাই  আমাদের বহু ক্লেশ-দুঃখের কারন। আবার সমস্যা সমাধানের জন্য, চিন্তা, বা বর্তমানের কর্তব্য কর্ম্ম  সম্পাদনের জন্য চিন্তা, বা ভবিষ্যৎ কর্ম্মের পরিকল্পনা জনিত চিন্তা - এগুলো আমাদের মনোযোগী চিন্তা। এই চিন্তা আমাদের এমনি এমনি আসে না, এগুলোকে আনতে  হয়। এই মনোযোগী চিন্তা যাদের বুদ্ধিদীপ্ত হয়, অর্থাৎ বিচার বুদ্ধির সাহায্যে যদি চিন্তাগুলোকে সাজানো হয়. তবে আমাদের ভাবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে।  আমাদের জীবনে সার্থকতা আসতে  পারে। অর্থাৎ কতকগুলো চিন্তা, যা অমূলক তাকে পরিহার করতে হবে, আবার যে চিন্তা আমাদের অপরিহার্য, তাকে গ্রহণ করতে হবে। 

২. আবার - আমি অতীতে আমি কি ছিলাম, বা কি ছিলাম না, কি ভাবে ছিলাম, বা ছিলাম না, আবার ভবিষ্যতে আমি কি হবো, বা হবো না, কিভাবে থাকবো বা থাকবো না- এই ধরনের চিন্তা যারা করে থাকে তাদের বর্তমান সম্পর্কেও সংশয় জন্মায়। সে ভাবে আমি এখন আছি - কি নেই। কিভাবে , কোথা থেকে এসেছি, কোথায় চলে যাবো, এই সব চিন্তা থেকে তার মধ্যে নানান রকম অমনোযোগী চিন্তার উৎপত্তি হয়। আমি এই শরীর  নোই, আমি আত্মা।  আবার কেউ ভাবেন, আমার আত্মা বলে কিছু নেই। আমার স্মৃতি আছে, তাই আমি আছি। আমার স্মৃতি লোপ পেয়ে গেলে আমি বলে কিছু থাকবো না। কেউ ভাবে আমার কর্ম্মফল জন্ম-জন্মান্তর যাবৎ  আমাকেই ভোগ করতে হবে।  কেউ ভাবে, যা কিছু ভোগ এই জন্মেই - এর পরে আর কিছু নেই। এই যে চিন্তা এগুলো আমাদের ভ্রমাত্মক চিন্তা, যার কোনো শেষ নেই। ঈশ্বরের খোঁজে মানুষ জন্ম-জন্মান্তর ধরে ছুটে বেড়াচ্ছে।  হাজার - কোটি বছর  ধরে ঈশ্বরকে খুঁজে বের করবার জন্য, মানুষ চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু, আজও কোনো সার্বজনীন উপায়, বের করা সম্ভব হয় নি, যাতে করে সেই সর্বশক্তিমানের কাছে সবাই সজ্ঞানে পৌঁছতে পারে। আর ঈশ্বরকে ধরলেই, আমাদের সমস্ত দুঃখের উর্দ্ধে উঠতে পারবো, ঈশ্বর আমাদের সমস্ত জাগতিক দুঃখের নিরসন করে দেবেন, এমন নিশ্চয়তা কোনো মহাত্মাই দেন না। বরং মহাত্মাগণ  বলে থাকেন, তিনি অক্রিয়। তিনি দ্রষ্টা মাত্র। তিনি কিছুই করেন না, তিনি শুধু নীরব দর্শক মাত্র।  

৩. যাইহোক, এইসব অমনোযোগী চিন্তা আমাদের মানুষের জন্ম - মৃত্যু-জরা-শোক-দুঃখ-দুর্ভোগ-সংশয়-হতাশা অর্থাৎ আমাদের মনুষ্য জীবনের দুঃখ-ক্লেশ থেকে মুক্ত করতে পারে না। তাই আমাদের উচিত মনোযোগী চিন্তা আর অমনোযোগী চিন্তার পার্থক্য নির্নয় করা এবং যেসব বিষয়ে আমাদের মনোযোগ দিতে নেই, সেগুলোকে পরিহার করা আর যেসকল বিষয়ে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে, সেগুলোকে আরো বেশি করে জ্ঞাত হওয়া। এই জ্ঞানের দর্শনেই আমরা আমাদের দুঃখ-ক্লেশ থেকে  পরিত্রান পেতে পারি। 

এগুলো হচ্ছে  ১ - সংযম - ইন্দ্রিয় সংযম - আমরা যদি ইন্দ্রিয়-সংযম করতে পারি, তবে তবে ইন্দ্রিয় দ্বারা আমাদের কোনো কলুষ উৎপন্ন হতে পারবে না। অর্থাৎ যা দেখলে যা শুনলে, যা স্পর্শ করলে, যা বললে, আমাদের মধ্যে ক্লেশ উৎপন্ন হয়, সেগুলো থেকে আমাদের বিরত হতে হবে।  নিজের মধ্যে সংযম আনতে  হবে।  আমাদের ইন্দ্রিয়শক্তিকে আমাদের কল্যানের কাজে লাগাতে হবে, উদ্বিগ্ন সৃষ্টিকারী ইন্দ্রিয়কর্ম থেকে আমাদের সংযমী হতে হবে।
 
২. ব্যবহার - আমাদের প্রয়োজনমতো জিনিসের ব্যবহার করতে হবে। লজ্জ্বা নিবারনের জন্য,দেহকে মশা ইত্যাদি কীট থেকে রক্ষার জন্য, আমাদের বস্ত্রের প্রয়োজন কিন্তু বাহারি পোশাকের কোনো প্রয়োজন নেই। দেহ রক্ষার জন্য, ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য, আমাদের খাদ্যের প্রয়োজন, সহজ পাচ্য খাদ্যের প্রয়োজন কিন্তু সুস্বাদু খাবারের প্রয়োজন নেই। অতিরিক্ত খাবার প্রয়োজন নেই। আমাদের আনন্দ-উল্লাস ও দেহ সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির  প্রয়োজন নেই।  আমাদের শয়ন-ভোজন যেন প্রয়োজনের থেকে অতিরিক্ত না হয়।  আর এই অতিরিক্ত প্রয়োজন-ভাবনা  আমাদের ক্লেশ-দুঃখের কারন জানবেন। অতিরিক্ত ঘুম আমাদের আলস্য  এনে দিতে পারে।  অতিরিক্ত ভোজন আমাদের শরীর  খারাপের কারন হতে পারে।  এইভাবে ব্যবহারিক দিক আমার সংযত হলে, আমাদের দুঃখ-ক্লেশের উৎপত্তির বীজকে নষ্ট করে দিতে পারবো। 

৩. সহ্য : কথায় বলে শরীরের নাম মহাশয়, যা সহাবে তাই সয়।   কিছু ক্লেশ-দুঃখ আমাদের সহ্যের মাধ্যমে নিরসন হতে পারে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, শারীরিক কষ্ট, অসুখ-বিসুখ ইত্যাদি প্রকৃতির নিয়ম - যদি আমরা এগুলোকে সহ্য করবার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারি, তবে আমাদের মধ্যে সহ্য ক্ষমতার বৃদ্ধি  হতে থাকবে, আর শীত-গ্রীষ্ম-শারীরিক অসুখ-বিসুখ, ক্ষুধা-তৃষ্ণা  এগুলো আমাদের কখনোই  বিচলিত করতে পারবে না। হ্যাঁ এগুলো থাকবে, কিন্তু আমাদের কখনো মানসিক পীড়ার কারন তো হবেই না, বরং অভ্যাস আমাদের সহ্য ক্ষমতাকে বাড়িয়ে, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইতে নিতে শরীরকে উপযোগী করে গড়ে তুলবে।  আমাদেরকে তখন নিরুদ্বিগ্ন থাকতে সাহায্য করতে পারে। 

৪. এর পর আছে, পরিহার :  কিছু জিনিসকে পরিহার করুন।  কিছু জিনিস থেকে সচেতন ভাবে দূরে থাকুন। নিষ্ঠুর জীবজন্তু থেকে,  নিষ্ঠুর মানুষ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখুন। এমনকি স্বাভাবিক জীবন যাপনের অনুপযুক্ত পরিবেশ থেকে দূরে থাকুন। যেমন পচা  জলাশয়, ক্ষতিকর গ্যাসীয় স্থান, অক্সিজেন-এর অভাব যেখানে আছে, এমনকি কর্দমাক্ত রাস্তা, বা কণ্টকপূর্ন স্থান, পাশ কাটিয়ে চলুন। নোংরা স্থানে বা আসনে বসবেন না। বোকার সাথে বন্ধুত্ত্ব করবেন না। হিংসুটে, পরশ্রীকাতর, হিংস্র, লোভী, তথাকথিত পন্ডিতদের থেকে দূরে থাকুন।  তো কিছু জিনিস পরিহারে আমরা ক্লেশ-দুঃখ মুক্ত থাকতে পারি। 

৫. নিবৃত্তি : হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, কাম-ভাব, লোভ, ইত্যাদি থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করুন। এগুলো মনের মধ্যে যখনি আসবে, তখনই নিজের মধ্যে উল্টো চিন্তা প্রবাহিত করতে থাকুন। আসলে বিভিন্ন ভাবনা মানুষকে ক্লেশ-কষ্টের মধ্যে নিক্ষেপ করে থাকে। সেখান থেকে বাঁচবার উপায় হিসেবে  সচেতন ভাবনার, বিচারশীল চিন্তার উদয় ঘটাতে  থাকুন, নিজের মধ্যে । 

অর্থাৎ কিছু ক্লেশ আমাদের সংযমে রুদ্ধ হতে পারে। কিছুক্লেশ  নিবৃত্তিতে রুদ্ধ হতে পারে।  এগুলোর দিকে প্রখর  দৃষ্টি রেখে চলুন, তবে দেখবেন আপনার জীবনে দুঃখের অন্ত হবে। 

সবশেষে বলি :  সারাদিনের মধ্যে অন্তত ১৫ মিনিট সময় দিন, হয় শুতে যাবার আগে অথবা ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার পরে । এমন একটা জায়গায় বসুন, যেখানে আপনাকে কেউ বিরক্ত করতে পারবেন না। যদি সম্ভব হয়, তবে ভোর  বেলা পূর্ব্ব দিকে মুখ করে বসুন, কারন এই সময় সূর্য্যরশ্মি পুব থেকে পশ্চিমে ধাবিত হচ্ছে। যা আমাদের জীবনী শক্তি।  সন্ধ্যে বা রাতে উত্তর দিকে মুখ করে বসুন। কারন সর্ব-শুভশক্তি রাতের দিকে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। আরাম করে বসুন। স্থির হয়ে বসুন। সম্ভব হলে মেরুদন্ড সোজা করে বসুন। চোখ দুটো বন্ধ করুন। ধীরে ধীরে মনটাকে  মস্তিষ্কে নিবদ্ধ করুন।  মনটাকে মস্তিষ্কের মধ্যস্থলে মস্তিষ্কের উপরে স্থাপন করুন।  মস্তিষ্কের উপরিস্থলে, অর্থাৎ সহস্রারের উপরে যে বিন্দু সেখানে মনটাকে নিবদ্ধ করুন। একটি সদ্যজাত শিশুর  মাথায় হাত দিলে দেখবেন, মাথার ঠিক মাঝামাঝি একটা নরম জায়গা আছে। আপনার মাথাতেই এমন একটি জায়গা আছে।  তাকে নির্দিষ্ট করুন। এবার এই স্থানের  ঠিক উপরে মনটাকে নিয়ে যান। এটাই বিশ্বশক্তির সঙ্গে জীবশক্তির মিলন স্থল। আসলে মানুষের অন্তঃস্থলে কোনো সমস্যা নেই।  মানুষের সমস্যা আছে বাইরে। সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দকে মন থেকে দূর করে দিন। মনের বাইরের দিকে যে দরজা সারাক্ষন খোলা ছিল,  তার ঝাঁপ বন্ধ   করে দিন। শরীরের সমস্ত মাংসপেশীকে ঢিলে করে ছেড়ে দিন। এবার আপনার মনের মধ্যে কি চিন্তা আসছে - যাচ্ছে  খেয়াল করতে থাকুন। মনের এই চিন্তার দিকে খেয়াল করলে দুই এক দিনের মধ্যেই দেখবেন, আপনার মধ্যে চিন্তাগুলো যেন লজ্জ্বা পেয়ে আর দেখা দিচ্ছে না। অর্থাৎ আপনার মন   চিন্তাহীন হয়ে গেছে। এবার  মনে মনে ভাবুন,  "আমি এক শান্তির জগতে বাস করছি। একটা, প্রশান্তি, পূর্নতা, একটা সাম্যভাব, একটা একতানতা আমার মধ্যে বিরাজ করছে"। আপনি যেন একটা পাহাড়ের কোলে অবস্থান করছেন, আর একটা  প্রশান্তির ঝর্ণাধারা তরঙ্গ-আকারে আপনার শরীরের বাইরে স্পর্শ করছে। এই তরঙ্গগুলোর  দিকে খেয়াল করতে থাকুন। নিজের মনটাকে অসীমে বিস্তার করে দিন। যখন ঈশ্বরের সামনে উপবেশন করবার একটা ধারাবাহিক অভ্যাসের মধ্যে নিজেকে নিবদ্ধ করতে পারবেন,  তখন আপনার মধ্যে একটা ঐশ্বরিক অনুভূতি হবে। আপনি তখন উপলব্ধি করবেন, মনের  শান্তি, শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে সমতান,  ঐক্যভাব, সুসমঞ্জস্য ভাব।  শুভ-ইচ্ছা,  আনন্দ আপনার ভিতরে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে জেগে উঠবে ।  এইসময় আপনি  নিজের মধ্যে একটা পরিপূর্নতা বোধ করবেন । এখন আপনার ব্যক্তি মন আর  সমষ্টি মনের সঙ্গে একটা যোগসূত্র তৈরী হবে। একটা জিনিস জানবেন, ঈশ্বর নামে  কোনো ব্যক্তি নেই, ঈশ্বর নামে বস্তু নেই, ঈশ্বর নামে কোনো অবয়ব নেই, ঈশ্বর হচ্ছেন  একটা শক্তি, চেতন শক্তি। আর জীবন বা জীবসত্ত্বা  হচ্ছে এই  চেতন শক্তির একটা বিশেষ সময়ের বিশেষ  অবস্থা মাত্র। নিজের চেতনশক্তিকে উত্তোলন করুন। অসীম চেতন শক্তির সঙ্গে নিজের চেতনশক্তির একাত্মতা অনুভব করবার চেষ্টা করুন।  

একটা জিনিস মনে রাখবেন, আজকের  আপনি, আপনার কাছে যা কিছুআছে বলে  দেখছেন, সে সব আপনার ব্যক্তি চিন্তা বা সমষ্টি  চিন্তার ফল মাত্র।  আপনি আজ যে বাড়িতে বাস করছেন, সেটি আপনার বহু দিনের চিন্তার ফলে তৈরী হয়েছে।   আজ যে চাকরি বা কাজ আপনি করছেন, সে সব আপনার মধ্যে একদিন চিন্তার আকারে দেখা দিয়েছিলো।  আজ যে আপনি সন্তানের পিতা বা মাতা  হয়েছেন, সেটিও আপনাদের অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর চিন্তার ফল। তো আপনার ব্যক্তি চিন্তা থেকে যদি এতগুলো, জাগতিক পদার্থের জন্ম হতে পারে, তবে জানবেন, সমস্ত চিন্তা বা বিশ্বশক্তির চিন্তারও একটা ফল হয়ে থাকে। যার ফলে এই জাগতিক বিশ্বের উৎপত্তি হয়েছে।  তাই আপনার ব্যক্তি  চিন্তা  ও সমষ্টি  চিন্তা যেমন ভাবে প্রবাহিত হবে, আপনার সামনের বাস্তবিক জগৎও সেই ভাবে প্রকাশমান হয়ে উঠবে। এই সত্যে উপনীত হলে, আপনার মধ্যে একটা প্রশান্তির ভাব বিরাজ করবে, আপনি সমস্ত ক্লেশ-দুঃখের উর্দ্ধে বিরাজ করবেন।   

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম। 

জীবন রহস্যঃ - ২৪

পৃথিবীবাসী এখন একটা অদ্ভুত আতঙ্কের মধ্যে, দিন কাটাচ্ছে। একটু আগে শুনলাম,  আমার একছোটবেলার  বন্ধু (পরিমল হালদার) দেহত্যাগ করেছে।  শুনলাম, করোনা ভ্যাকসিনের দুটো ডোজই নেওয়া হয়েছিলো। খুব খারাপ লাগছিলো, ওর জন্য।  

কথায় বলে শরীর  থাকলে রোগ থাকবে। শরীর হচ্ছে ব্যাধির মন্দির।  আমরা বলি, এটি সম্পূর্ণ অসত্য।  হ্যাঁ ঠিকই শুনছেন, শরীর ব্যাধির মন্দির এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। শরীরে রোগ থাকে না, রোগ থাকে আমাদের মনে। রোগের প্রকাশ ঘটে শরীরের মাধ্যমে।  অর্থাৎ শরীর একটি মাধ্যম মাত্র। এখানে রোগ আসে আমাদের মানসিক বৃত্তি থেকে। ধরুন, আপনি ভীষণ লোভী।  তো অতিরিক্ত কিছু খেয়ে ফেললেন, বা বাসীপচা কিছু খেয়ে ফেললেন।  এবার আপনার শরীরে আইঢাই শুরু হবে। তো রোগটা ছিল আমার মনের বৃত্তির মধ্যে লুকিয়ে, যখনি সেটি কার্য্যে পরিণত হলো, তখন একটা কর্ম্মফলের উৎপত্তি হলো।  আর পরিণতি হলো, আপনার পেটের  অসুখ। আমার কথাটা শুনতে একটু অদ্ভুত লাগছে তাইতো ? শুনুন আজকের বিশ্ব-স্বাস্থ সংস্থা  (WHO) বলছে, আজকের পৃথিবীর অর্ধেক মানুষই নাকি মানসিক রোগের  স্বীকার। আর এই দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য, আমরা শারীরিক ভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আপনি যদি ভীষণ রাগী মানুষ হন, তবে জানবেন, ক্যান্সার, টিউমার এমনকি আপনি দুর্ঘটনার স্বীকার হতে পারেন, আপনার রাগী  স্বভাবের জন্য । সংসারে যিনি পদে পদে সমালোচনার সম্মুখীন হন, তার বাত-বেদনা হবার সম্ভাবনা। আপনার মধ্যে যদি ভয়, দুশ্চিন্তা, থাকে আপনার আলসার  চুলপড়া রোগ হবে । 

এই জিনিষটা আমাদের মুনি-ঋষিগণ হাজার হাজার বছর  আগেই ধরতে পেরেছিলেন। শুধু ভারতের মুনি-ঋষিগণ নয়, প্রথিবীর তাবৎ মহাত্মাগণ  এটা বুঝতে পেরেছিলেন।  তাই তারা মানুষের জন্য,   মানবিকতার বাণী প্রচার করেছিলেন । যা আসলে আমাদেরকে ভালো রাখতে পারে। যাকে  আমরা ধর্ম্ম বলে থাকি। যা আমাদের মনকে ভালো রাখতে পারে। সর্বোপরি, শরীরকে ভালো রাখতে পারে। আমাদের স্বাৰরিক রোগের  কারন হচ্ছে, আমাদের মনের মধ্যে পুষে রাখা রাগ, ঈর্ষা, হিংসা, ভয়  অপরাধবোধ, ইত্যাদি নঞৰ্থক চিন্তা । 

আমাদের মনের দুটো ভাগ। চেতন ও অবচেতন। অবচেতন মনের বিশ্বাস অনুযায়ী চেতন মন কাজ করে থাকে। আমাদের রোগ ব্যাধির ক্ষেত্রেও এই শরীর একই ভাবে কাজ করে থাকে। এইজন্য আমাদের চিন্তাধারার মধ্যে পরিবর্তন আনতে  হবে।  তবেই আমরা সুস্থ-সবল থাকতে পারবো। যদিও আমাদের যে চিন্তার ধারাবাহিকতা, তা একদিনে গড়ে ওঠে নি। এগুলো আমাদের ছোটবেলা থেকে গড়ে উঠেছে। আমি যে বংশে অর্থাৎ মা-বাবার কোলে জন্ম গ্রহণ করেছি, তাদের চিন্তা ধারা আমাকে প্রভাবিত করেছে। এমনকি যে পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছি, যে স্থানে জন্ম গ্রহণ করেছি, যে জাতিতে জন্ম গ্রহণ করেছি, যে দেশে জন্ম গ্রহণ করেছি, সব কিছু সম্মিলিত ভাবে আমাকে একটা নির্দিষ্ট চিন্তাধারার মধ্যে প্রবাহিত করেছে।  তাই আমরা দেখতে পাই, আমরা অনেক অসুখ বংশগতির কারনে ভোগ করে থাকি। এমনকি স্থানভেদেও নানান রোগের  স্বীকার হয়ে থাকে মানুষ।  যেমন অনেকের হৃদরোগ,বংশগত। আসলে এই পরিবারের সদস্যদের জীবনে একটা সময় পর আনন্দের ধারা রুদ্ধ হয়ে আসে। এমনি এই পরিবারের বিশ্বাস করতে শুরু করে, আমার বাপ্-ঠাকুরদা হৃদরোগে মারা গিয়েছেন, আমিও একদিন এই হৃদরোগের কারনে দেহত্যাগ করবো। তার এই অন্ধবিস্বাস একসময় তাকে হৃদরোগের কাছে টেনে নিয়ে যায়। আমরা যদি এই নেগেটিভ বিশ্বাসগুলোকে ত্যাগ করে, নতুন বিশ্বাসের জন্ম দিতে পারি, তবে এইসব বংশগত রোগ থেকে রেহাই পেতে পারি। সমস্ত রোগই আসলে আমাদের বহুদিনের চিন্তার ফসল, যা আমরা অজ্ঞাতসারে নিজেই নিজের মধ্যে জন্ম দিয়েছি। 

আপনি যা করতে ভালোবাসেন, অর্থাৎ যেসব সৃজনশীল কাজ আপনার ভালো লাগে, তাকে কখনো ছাড়বেন না। ধরুন, আপনার ছেলে গান গাইতে ভালোবাসে, বা ছবি আঁকতে   ভালোবাসে, বা কবিতা লিখতে ভালোবাসে, বা খেলাধুলা করতে ভালোবসে ।  কিন্তু আপনি তাকে জোর করে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা  কোনো অর্থকরী বিদ্যা আয়ত্ত্ব করবার জন্য, চাপ সৃষ্টি করতে লাগলেন।  দেখবেন আপনার ছেলের টনসিলের সমস্যা দেখা দেবে। ধরুন আপনার ছেলে ক্লাসের পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে না, বা ভুলবশতঃ কোনো অন্যায় করে বসেছে, আর আপনারা সবাই মিলে তাকে বকাবকি শুরু করলেন। এথেকে তার মধ্যে  হিনমন্যতার  সৃষ্টি হবে।  নিজের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করতে শুরু করবে। এতে করে তার শরীরে ব্যথা-বেদনার সৃষ্টি হবে। এমনকি গলব্লাডারে স্টোন পর্যন্ত হতে পারে। আপনাকে যদি কাছের লোকেরা সবসময় বিরক্ত করে ইর্রিটেটেড করে, তবে আপনার শরীরে সাইনাস দেখা দিতে পারে। আপনি যদি নিজেকে দুর্বল ভাবেন, তবে আপনার এলার্জি হবে। আপনার জীবন যখন আনন্দের অভাব হবে, তখন আপনার এনিমিয়া দেখা দিতে পারে।  আপনার পায়ে দুর্গন্ধ হয়েছে, জানবেন আপনি অন্যদের ভয় পাচ্ছেন। জীবনে নিরাপত্তার অভাব হলে কোলাইটিস হবার সম্ভাবনা। আপনি সবসময় অতীত নিয়ে চিন্তা করছেন, তো আপনার পেট পরিষ্কার হবে না। আগেই বলেছি, আনন্দের অভাব মানুষকে হৃদরোগে কবলে ফেলে দেয়। আপনি কোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করছেন, বা বলা যেতে পারে যা নয়, তাই চিন্তা করছেন, আপনার অফিসে কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় আপনার চিন্তা বেড়ে গেছে, তাহলে আপনার প্রেসার বা সুগার হতে পারে। 

মোট কথা আমার কথায় আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে না, আপনার মধ্যে যদি কোনো রোগ থাকে, তবে আপনি একটু নিভৃতে বসে মনকে জিজ্ঞেস করুন, আপনি কেন অসুস্থ হয়েছেন, আপনার মনের কোনে  কখনো চিন্তা এসেছিলো কি না। মনের গভীরে ডুব দিন। নিজে প্রবলভাবে ভালো থাকার বার্তা দিতে থাকুন মনকে। রোগমুক্ত জীবনের জন্য নিজের মধ্যে চিন্তা গড়ে তুলুন। মনের আকুলতা বাড়ান। মনে রাখবেন, যে বাঁচতে চায়, সে বাঁচে।  যে সুস্থ  থাকতে চায়, সে সুস্থ থাকে ।  নিজেকে ভালোবাসুন।  আর যে নিজেকে ভালোবাসে, সে নিজেকে ভালোরাখে। 

মোদ্দা কথা হচ্ছে, আমাদের মনের মধ্যে যেসব নঞৰ্থক চিন্তা, সেই নঞৰ্থক চিন্তাই আমাদের জীবনকে আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে।  আর এই নেগেটিভ চিন্তাগুলোকে পরিহার করতে পারলেই, আমাদের জীবন হয়ে উঠতে পারে সর্বাঙ্গ সুন্দর।  আমাদের শরীর  হয়ে উঠতে পারে সুস্থ-সবল। 

এখন কথা হচ্ছে, নেগেটিভ চিন্তা কেউ কি করতে চায়, এগুলো আমাদের এমনি এমনি আসে।  পরিবেশ পরিস্থিতি আমাদেরকে বাধ্য করে এইসব উল্টোপাল্টা চিন্তা করতে। আর আমরা তখন এই উল্টোপাল্টা চিন্তার ফলস্বরূপ জীবনকে বিষময়  করে তুলি। এখান থেকে আমরা বেরুবো কি করে ? দেখুন আমি কিন্তু ডাক্তার নোই, যে একটা পরীক্ষার লিস্ট ধরিয়ে দেবো, বা ঔষধের নামের তালিকা ধরিয়ে বলবো, এগুলো কিনে খান, তবে ভালো হয়ে যাবেন। 

আমার কাছে একটাই ঔষধ আর তা হচ্ছে, নিজেকে আধ্যাত্মিক ভাবে ভাবিয়ে তুলুন।  নিয়ম করে প্রাণায়াম করুন। নিয়ম করে ধ্যানে বসুন। দেখবেন, আপনার জীবনে অনেক অর্থের সাশ্রয় হবে। অনেক সময়ের সদ্ব্যবহার হবে।  সব চেয়ে বড়কথা জীবন হবে আনন্দময়। কিন্তু কথা হচ্ছে এর জন্য আমাদের কি করে হবে ? কিছুই নয়, প্রতিদিন নিয়ম করে, অন্তত আধাঘন্টা শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে কাটান। জানবেন, শ্বাসপ্রশ্বাসই আমাদের জীবনকে বাঁচিয়ে রেখেছে।  আমাদের শরীরকে সুস্থ রেখেছে। আপনি যখন স্বাভাবিক থাকেন, খেয়াল করলে দেখবে, আপনার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক।  কিন্তু আপনি যখন রেগে যান, আপনি যখন ঈর্স্বানিত হন, আপনি যখন লোভাতুর হন, উত্তেজিত হন, তা সে আনন্দে হোক, বা দুঃখে, তখন আপনার এই শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া দ্রুততালে বইতে থাকে।  এই শ্বাসপ্রশ্বাসকে আমাদেরকে ধীরতালে প্রবাহিত করতে হবে। আর এর জন্য কিছুই নয়, আধাঘন্টা সময় ৫/৬ সেকেন্ডে শ্বাস নিন আর এর দ্বিগুন সময় অর্থাৎ ১০/১২ সেকেন্ড সময় নিয়ে শ্বাস ছাড়ুন। এই শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি যত ধীর করতে পারবেন, তত জানবেন, শরীর-মন সুস্থ থাকবে। 

জীবনে সৎভাবে থাকুন। ভাগ্যের উপরে নিজেকে ছেড়ে দেবেন না।  নিজের সাধ্যমতো কর্ম্ম করুন। আর যেটি আপনার সাধ্যের বাইরে, তার সমাধানের জন্য, ঈশ্বরের উপরে নির্ভর করে থাকুন। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করুন। দেখুন, কতকগুলো সমস্যা আছে, যার সমাধান আমাদের হাতে থাকে।  আবার এমন কিছু সমস্যা আছে, যার সমাধান আমাদের হাতে থাকে না।  যে সব সমস্যার সমাধান আমাদের হাতে থাকে না, তার সমাধানের জন্য অহেতুক  চেষ্টা বা সময়ের অপচয় না করে, নিজেকে অন্যখাতে বইয়ে দিন।  ঈশ্বরের উপরে ভরসা রাখুন।  দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।  যা আপনি শত চেষ্টা করেও সমাধান করতে পারেন নি, তা কেমন আকস্মিকভাবে সমাধান হয়ে গেছে। Be relax at every moment.

যা শুনলে বা দেখলে, আপনার মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়, ভয় হয়, দুর্ভাবনা আসে, সেই স্থান, সেইকথা, সেই ধরনের মানুষকে পরিহার করুন। এমনকি এই ধরনের কোনো সিনেমা বা সিরিয়াল দেখবেন না, যা দেখলে বা শুনলে আপনার মধ্যে আতঙ্কের বা ভয়ের জন্ম হতে পারে। এগুলোকে অবশ্যই  পরিহার করুন।  খাবারের ব্যাপারেও নিজেকে সংযত রাখুন। জানবেন, না খাওয়ার চেয়ে, অতিরিক্ত আহার, বা সহজে হজম হয় না, এমন খাবার আপনার উপকারের চেয়ে ক্ষতি করবে। দুঃখী মানুষের সহায়ক হন, কিন্তু দুঃখী মানুষের বন্ধু হবেন না।    
 
আর একটা কথা হচ্ছে, জ্ঞান, ইন্দ্রিয় দিয়ে সংগ্রহ করবেন না. জ্ঞান সংগ্রহ করুন সজ্ঞা দিয়ে। অর্থাৎ যেকোনো জিনিসের, বা বিষয়ের গভীরে বুঝবার চেষ্টা করুন। যে কোনো বিষয়ে, একাগ্রতা বারবার চেষ্টা করুন। দেখুন, দুল, চুড়ি, মালা, ইত্যাদি না দেখে এগুলোকে রুপো বা সোনা হিসেবে  জানুন।  সব জিনিসের পরিণতির কথা চিন্তা করুন।  কোনো জিনিসই চিরস্থায়ী নয়। আপনি,  আমি, এমনকি আমাদের মন, চিত্ত সবই নিয়ত পরিবর্তনশীল। কোথাও কেউ স্থির নয়। এই সত্যকে স্বীকার করুন। নিজের জন্য নয়, অপরের জন্য বেঁচে থাকুন। যারা অন্যের জন্য বেঁচে থাকে, তাদের নিজের জন্য কোনো কষ্ট  হয় না। 
সবশেষে আবার বলি, শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে খেয়াল করুন। শ্বাস-প্রশ্বাসকে দীর্ঘ হতে দেবেন না। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে ধীর থেকে ধীরতর করবার প্রয়াস করুন। আপনার শারীরিক ও মানসিক শান্তি বজায় থাকবেই। আগেও বলেছি,  আরো একবার বলি, আধাঘন্টা সময় ৫/৬ সেকেন্ডে শ্বাস নিন আর এর দ্বিগুন সময় অর্থাৎ ১০/১২ সেকেন্ড সময় নিয়ে শ্বাস ছাড়ুন। এই প্রক্রিয়া দিনে অন্তত আধাঘন্টা অভ্যাস করুন।  শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি যত ধীর করতে পারবেন, তত জানবেন, শরীর-মন সুস্থ থাকবে। ঘোড়ায় টানা গাড়ি  তখনই চলা শুরু করবে, যখন আপনি ঘোড়াকে চাবুক মারবেন। গাড়ি চলছে না দেখে  ,যদি গাড়িকে চাবুক মারতে  থাকেন, তাতে গাড়ি  চলবে না। শরীরকে গতিশীল রাখতে  গেলে মনকে চাবুক মারুন।  ভালো থাকবেন।  আজ বাক্যেরে বিরাম দিলাম। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।

 জীবন রহস্যঃ - ২৫

দুঃসময়ে নিজেকে সামলাবেন কি করে ? 

প্রত্যেক মানুষের জীবনে যেমন সুসময় থাকে, তেমনি আসে দুঃসময়।  এই দুঃসময়ে আমরা দিশাহারা হয়ে যাই।  কি করবো ভেবে পাই না। ভগবান বুদ্ধ মানুষের এই দুঃখের সময় মানুষের অবস্থা দেখে বিচলিত হয়েছিলেন। আর মানুষের এই দুঃখ নিবারনের জন্য, রাজসুখ ছেড়ে দিয়ে দুঃখের পথকে  বেছে  নিয়েছিলেন। কেননা সমস্যার প্রতক্ষ্য অনুভূতি না থাকলে, সমস্যা সম্পর্কে জ্ঞান জন্মায় না, আর সমস্যা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে, সমস্যা সমাধানের রাস্তার সন্ধান পাওয়া যাবে না। তাই রাজপুত্র গৌতম   অনাহারে থেকে অসহ্য  শারীরিক কষ্ট ভোগ করে, রাজপ্রাসাদ ছেড়ে গৃহহীন হয়ে, পাহাড়ে জঙ্গলে উন্মুক্ত প্রান্তরে দীর্ঘ সাধনার পর উপলব্ধি করেছিলেন,  জীবন দুঃখময়। দুঃখ কষ্ট দিয়েই একটা মানুষের জন্ম হতে পারে। আবার দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে করতেই একদিন মানুষ মৃত্যুর কাছে হার মানে। আবার জন্মায়, এই দুঃখ ভোগ করবার জন্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি আমাদের দুঃখ থেকে পরিত্রানের কোনো রাস্তা নেই ? ভগবান বুদ্ধ বলছেন, জীবন দুঃখময় সত্য, কিন্তু এই দুঃখের  একটা কারন আছে, আর তা থেকে পরিত্রান পাবার রাস্তাও  আছে। বলছেন, জীবের  বেঁচে থাকবার  যে প্রবল ইচ্ছে, এখান থেকেই দুঃখের উৎপত্তি। জীবন হচ্ছে শ্বাসের খেলা, আর এই শ্বাস বায়ুর গমনাগমন আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আর এই দুই শ্বাস ও প্রশ্বাসের মধ্যে যে অন্তর যত  সংক্ষিপ্ত হতে থাকে, তত আমাদের মনের শান্তি নষ্ট হতে থাকে। আমরা কাঙ্খিত সুখের বস্তুটি পাবার জন্য, কষ্ট করি, কিন্তু কাঙ্খিত বস্তুটি পাবার পরেও বস্তু পাবার তৃষ্ণা আমাদের থেকেই যায়।  আবার আমরা অন্য বস্তুর দিকে ধাবিত হই। আর এই জীবনভর উর্দ্ধশ্বাসে ছোটা আমাদেরকে দুঃখের আবর্তে ঘুরপাক খাওয়াতে থাকে। আর এই শ্বাসের আবর্ত একসময় ঘূর্ণিপাকে পরিণত হয়। আর সেই ঘূর্ণিপাকে পড়ে আমরা হাবুডুবু খাই। সেখান থেকে পরিত্রানের রাস্তা খুঁজে পাই না। 

এই জায়গা থেকে বেরুতে গেলে, আমাদের তিনটে জিনিস করে হবে।  প্রথমতঃ সৎসঙ্গ দ্বিতীয়ত জপধ্যান, আর তিন নম্বর হচ্ছে শরণাগতি। আজ আমরা এই সৎসঙ্গ ও শরণাগতি  সম্পর্কে আলোচনা করবো। 

সৎসঙ্গ : সৎসঙ্গ হচ্ছে, যেখানে জীবনমুখী হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে, সেই পরিশুদ্ধ বাতাস গ্রহণের সুযোগ নেওয়া। যারা সদর্থক চিন্তার অধিকারী, তাদের সঙ্গে জীবনের খানিকটা সময় অতিবাহিত করা।  সৎসঙ্গ মানে এই নয়, যে সাধু শুধু মহাত্মাদের সাথে আমাদের সময় কাটাতে  হবে , সৎসঙ্গ মানে হতে পারে সৎগ্রন্থ পাঠ। মহাপুরুষদের জীবনীগ্রন্থ পাঠ করতে পারেন ।  নিজের পরিবারের মধ্যেই কিছু সৎ-আলোচনার পরিবেশ গড়ে, সৎ-বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করতে পারেন । স্বামীজী বলছেন, শিক্ষক থেকে সহপাঠী ভালো। তাই আলোচনা করুন তার সাথে   যার সাথে মন খুলে কথা  করা যায়। 

ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন, বৈদ্যের কাছে না গেলে রোগ ভালো হয় না। আমাদের রোগ লেগেই আছে, তাই সাধুসঙ্গ সর্বদাই দরকার। আবার বৈদ্যের কাছে থাকতে থাকতে নাড়ীজ্ঞান হয়ে যায়।  তখন কোনটা কফের নাড়ী, কোনটা পিত্তের নাড়ী সেটা বোঝা যায়। সাধুসঙ্গ করতে করতে যেমন ত্যাগের বৃত্তি জেগে ওঠে, তেমনি সাধু সঙ্গ  করতে করতেই ঈশ্বরকে ত্যাগের যে অশুভ বৃত্তি আমাদের মধ্যে আছে, সেই অশুভ শক্তির  নাশ হয়।  তখন ঈশ্বরকে অনুভব করবার আকাঙ্খা জন্মায়।  

আসলে আমাদের মতো সাধারন মানুষের প্রবৃত্তি হচ্ছে, অসতের দিকে ধাবিত হওয়া।  জল যেমন স্বাভাবিক ভাবেই নিচের দিকে গড়িয়ে যায়, কোনো প্রয়াস ছাড়াই তেমনি আমাদের বৃত্তিও অসতের দিকে   আমাদেরকে টানে। আমাদের মনস্তত্ত্বই হচ্ছে, নিম্নগতি সম্পন্ন। আর এই নিম্নগতি প্রাপ্ত হবার জন্য, আমাদের কোনো প্রয়াস করতে হয় না। শরীর-মনের ক্লান্তি কাটানোর জন্য, বা মনের বিকৃত স্ফুর্তির জন্য, আমরা নেশা করি। শোনা যায়, সাধুসন্তগন পাহাড়ের  শীত থেকে বাঁচার জন্য শঙ্খিয়া অর্থাৎ শঙ্খচূড় সাপের বিষ পান করেন। এগুলোর কোনোটিই অভিপ্রেত নয়। এর দ্বারা কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে। না  
দেখুন, দুটো শক্তি নিরন্তর কাজ করছে, একটা দৈবশক্তি, আর একটা আসুরিক শক্তি। চেতনাসম্পন্ন সাধকের কাজ হচ্ছে, আসুরিক শক্তিকে পরাস্থ করে, দৈবশক্তিকে জাগ্রত করা। তো এই যে নেশা, শঙ্খিয়া বা মাদক দ্রব্য গ্রহণ, এটি আমাদের শরীরের নেগেটিভ ভাইব্রেশন -এর ক্রিয়া।  অন্যদিকে আমি যদি মহাত্মাদের জীবনী বই পড়ি, সত্যিকারের সাধুসঙ্গ করি, বা মনকে কোনো সৃজনশীল কর্ম্মে লাগিয়ে, মনকে চাঙ্গা করতে পারি, তবে সেটি হবে আমাদের পজেটিভ ভাইব্রেশন। শারীরিক ব্যায়াম, প্রাণায়াম, ধ্যান-ধারণা  আমাদের শরীর  ও মনকে একটা সদর্থক জীবনে প্রবেশ করিয়ে দিতে পারে।  স্বামীজী বলছেন, আমরা একটা দুঃখ থেকে বাঁচতে, আর একটা দুঃখকে টেনে আনি। আর একদল মানুষ আছেন, যারা কষ্ট  দিয়েই কষ্টের নিবৃত্তি করে থাকেন। দেখুন, ভোগ শেষ না হলে বৈরাগ্য আসবে না।  জীবনে দুঃখ ভোগ শেষ করতে না পারলে, সুখের দেখা মিলবে না। 

তাই বিপদের দিনে, আমাদের অধিক মাত্রায় সচেতন থাকতে হয়। এই অবস্থায় এমন ব্যক্তির আশ্রয় খুঁজে নিতে হয়, যিনি আমাকে পজেটিভ  ভাইব্রেশন দান  করতে পারেন। আপনি যদি কখনো সত্যিকারের মহাত্মাদের সংস্পর্শে আসেন, তবে আপনার চোখ খুলে যাবে, আপনি নতুন চিন্তা-ধারার মানুষ হয়ে যেতে পারেন। দুঃখ নিবৃত্তির জন্য আকুলতা যখন দৈবশক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়, তখন এই দিশা দেখা দেয়। বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাবার কথা ভাববেন না, খেয়াল করুন, যাকে  আপনি বিপদ ভাবছেন, সেটি আসলে আদৌ কোনো বিপদ কি না। দ্বিতীয়তঃ হচ্ছে, একটা কথা জানবেন, বিপদ-দুঃখ-কষ্ট মানুষের একটা পরীক্ষা যে পরীক্ষায় উত্তীর্ন হলে, বাহ্যিক দিকে থেকে মানুষ অভিজ্ঞাতার সম্মুখীন হয়, আবার অন্তরের দিক  থেকে এইসময় মানুষ ঈশ্বরের সান্নিধ্য অনুভব করে থাকে। 

এখন কথা হচ্ছে, বিপদের দিনে আপনি মহাত্মাকে কাছে পেয়ে যাবেন, এমনটা নাও হতে পারে, এবং না হবার সম্ভাবনাই বেশি, তখন আপনি আপনার মা-বাবাকে বা দীক্ষাগুরুকে  শরণ  করুন।  তারা যদি দেহে থাকেন, তবে তাদের কাছে দুদন্ড বসুন। তাদেরকে আপনার বিপদের কথা খুলে বলুন। দেখবেন, মন ভালো হয়ে যাবে। এবং এমন হতে পারেন, বিপদ থেকে উদ্ধারের রাস্তা পেয়েও  যেতে পারেন। যদি মা-বাবা বা নিদেনপক্ষে দীক্ষাগুরু দেহে না থাকেন, তবে তাদের ছবি সামনে নিয়ে আপনার বিপদের কথা তাদের বলুন, প্রার্থনা করুন, দেখবেন আপনি অবশ্যই সুফল পাবেন। 
সবশেষে বলি,  উৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে, নিজের কাছে বসা, নিজের সঙ্গে কথা বলা।  জানবেন, ঈশ্বর যেমন সর্বত্র বিরাজ  করছেন, তেমনি ঈশ্বরের সমস্ত শক্তি আপনার মধ্যেও বিরারজমান। আমরা সবাই একেকজন ক্ষুদ্র ঈশ্বর।  সমস্যা যেমন মানুষ সৃষ্টি করে তেমনি সমস্যা মানুষের দ্বারাই সমাধান হয়ে থাকে। তো আপনি যখন সমস্যা সমাধানের জন্য, নিজের কাছে আর্তি জানাবেন, পক্ষান্তরে এই আর্তি ঈশ্বরের কাছেই পৌঁছে যাবে। আর সমাধানের রাস্তা বা উপায় তিনিই বাতলে দেবেন।  এমনকি হয়তো সমাধানও তিনিই করে দেবেন। তাই দুঃখের দিনে, উতলা না হয়ে, নিজের অন্তরের ঈশ্বরের শরণাপন্ন হন। দেখবেন, আপনার অশান্ত মন শান্ত হয়ে গেছে। সমাধানের পথও দেখবেন, আপনার হাতের কাছেই আছে।  

 আরো একটা উপায় হচ্ছে,  আপনার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে তাদের স্মরণ  করুন,  দেখবেন বিপদের প্রকোপ কমবেই কমবে। এটি কেবল অন্ধবিশ্বাস  নয়, এটি একটি ক্রিয়া।  যার ফল আপনি অবশ্য়ই প্রতক্ষ্য করতে পারবেন। এখানে দুটো জিনিসের কথা ভালো করে খেয়াল করবেন, একটি হচ্ছে ইষ্টদেবতা বা উদ্ধ্বারকর্তার স্মরণ। অর্থাৎ তাদের স্মৃতি আপনার মনের মধ্যে জাগিয়ে তোলা।  আর একটি হচ্ছে শরণাগতি বা সমর্পন। এই শরণাগতি মন্ত্রের মতো কাজ করে থাকে। 

সৎসঙ্গের কার্যকারিতা সম্পর্কে একটা রূপক গল্প দিয়ে আজ বাক্যের বিরাম দেবো।  আমরা ছোটবেলায় সবাই এই গল্প  শুনেছি। গল্পের নাম যতদূর মনে হয় "পুনর্মুষিক ভব" ।   এক ঋষির গুহায় ছিল একটা নেংটি ইঁদুর বাস করতো । সারাদিন সে ঋষির দেওয়া খাদ্যের অংশ খেত, আর ঋষির চারিদিকে ঘুরঘুর  করতো। ঋষি ধ্যানস্থ হলে ইঁদুর তার শরীর বেয়ে উপরে উঠতো, আবার নিচে নেবে আসতো। ঋষির প্রশ্রয়ে  বড়ো আনন্দে, নির্ভয়ে বাস করতো ইঁদুরটি ।  কিন্তু আনন্দ কারুর চিরকাল থাকে না।  একদিন গুহার কাছে  দেখা দিলো একটা বিড়াল।  বিড়ালের ভয়ে, সে গুটিসুটি মেরে গেলো।  সারাক্ষন সে একটা ভয়ের রাজত্ত্বে বাস করতে লাগলো। ইঁদুর এখন সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো। সবসময় বিড়াল-আতঙ্ক তাকে পেয়ে বসলো।  ঋষি তার এই ভয়ের কারন শুনে, তাকে কমণ্ডলু থেকে জল ছিঁটিয়ে ইঁদুর থেকে বিড়াল বানিয়ে দিলো।  এখন আর সে বিড়ালকে ভয়  করে না।  বিড়ালও তাকে স্বজাতি ভেবে, আর বিরক্ত করে না। কিন্তু এই বিড়ালসুখ তার বেশিদিন টিকলো না। একদিন সে কুকুরের খপ্পরে পড়ে গেলো। ঋষি বিড়ালের ভয় দূর করতে তাকে, কমণ্ডলুর মন্ত্রপূত জল ছিঁটিয়ে  কুকুর বানিয়ে দিলো। বিড়াল যখন কুকুরের দেহ পেলো।  তখন সে কুকুরের ভয় থেকে নিস্তার পেলো।  কিন্তু এক যায় তো আর এক আসে। কুকুর যখন একদিন খাদ্য সংগ্রহের জন্য জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তখন একটা বাঘের তাড়া খেয়ে, সে ঋষির গুহায় লুকালো। ঋষি আবার তাকে বাঘের চেহারায় পরিণত করে দিলো। এবার আর সে বাঘকে ভয় পায়  না। এর পরের পরিণতি আপনারা সবাই জানেন, বাঘ হয়ে, সে তার স্বরূপের কথা ভুলে গেলো। একসময় সে বাঘের স্বভাব প্রাপ্ত হলো। আর একদিন সে তার প্রভু ঋষিমুনিকেই আক্রমন করে বসলো। যার পরিণতিতে ঋষি তাকে পুনরায় মূষিক অর্থাৎ ইঁদুরে পরিণত করে দিলো। 

তো মহাত্মাদের আশ্রয়ে যদি আপনি যেতে পারেন, যদি আপনি সত্যিকারের সৎসঙ্গের আশ্রয়ে থাকতে পারেন, তবে আপনি সেইসব মহাত্মাদের করুনায়, তাদের আশ্রয়ে নির্ভয়ে জীবন-যাপন করতে পারবেন। আপনি যতক্ষন তার শরণাগত হয়ে থাকতে পারবেন, ততক্ষন আপনার জীবনের যা কিছু সমস্যা তা তিনি সমাধান করে দেবেন। আমাদের এই বিশ্বাস নেই। আর তা ছাড়া, আমরা মনে করি, সেই অলৌকিক শক্তিধর ঋষি-মহাত্মাগণ কোথায়, যার আশ্রয়ে মানবজাতি  সমস্যাসংকুল জীবন থেকে রেহাই পাবে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, তারা আজও  আছেন। আমরা বুদ্ধিমান, তাই তাদের আমরা খুঁজে পাই না। ইঁদুর বুদ্ধিমান ছিল না। সে নির্ভরশীল ছিলো। শিশু যেমন মা ছাড়া কিছু বোঝে না। এই ইঁদুরটিও ঋষি ছাড়া কিছু বুঝতো না। আপনার আর কেউ যদি নাও থাকে আপনার পিতা-মাতা আছেন। দীক্ষাগুরুও থাকতে পারে।   যদি তারা দেহে বর্তমান নাও  থাকেন, তথাপি জানবেন, সন্তানের মঙ্গলার্থে তারা দেহহীন হয়েও  আপনার প্রতি সর্বক্ষণ খেয়াল রেখেছেন।  আপনি তাদের স্মরণে অর্থাৎ স্মৃতিতে রাখুন  এবং তাদের শরণে অর্থাৎ তাদের প্রতি নির্ভরশীল থাকুন, দেখবেন দুঃসময়ে সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন, সেই দৈব শক্তি । 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি  ওম।  
 
          
জীবন রহস্যঃ - ২৬ 

পরম-শান্তি লাভের  উপায়
 
আমরা সবাই শান্তির খোঁজ করছি। কিন্তু শান্তি কোথায় আছে ? আর কি ভাবেই বা সেখানে পৌঁছানো যায় ? আমাদের মতো সাধারণ মানুষ শান্তি বলতে বুঝি , টাকাপয়সা-বিষয়-সম্পত্তি-পুত্র-পৌত্র  অর্থাৎ একটা  জমাটিয়া প্রাচুর্য্যে ভরা  সংসার। কিন্তু আপনি যেদিন এগুলো সত্যি সত্যি পেয়ে যাবেন, তখন দেখবেন, শান্তি নেই। টাকাপয়সার রক্ষার জন্য চোর-ডাকাতের ভয়। এমনকি পাড়ার মাস্তান আপনাকে বিরক্ত করে ছাড়বে। খারাপ সন্তান হলে  তো আপনার জীবনটাই বরবাদ, কিন্তু সন্তান যদি ভালোও হয়, মেধাবী হয়, তবে ও চাকুরীর খোঁজে বিদেশবাসী না হলেও ভিন্ন রাজ্যবাসী হতে বাধ্য হয়েছে। আপনি দানধ্যান করে আনন্দ পেতে চান, আপনার পিছনে চক্রান্ত শুরু হয়ে যাবে। লোকটার নিশ্চই কোনো ধান্দা আছে, আপনাকে সন্দেহের চোখে দেখবে। আপনি এদের তোয়াক্কা না করলেও, উপেক্ষা করতে পারবেন না। এছাড়া আছে রোগ-শোক যা উপেক্ষা  করতে পারবেন না।  এমনকি অজস্র টাকা-পয়সা ঢেলেও নিজেকে সুস্থ ও প্রিয়জনকে সুস্থ রাখার কৌশল আমাদের জানা নেই। 

আসলে শান্তি আছে জ্ঞানলাভে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই জ্ঞান লাভ কিভাবে আমরা করতে পারি ? আর জ্ঞানলাভ করলে আমরা কিভাবে শান্তি পেতে পারি ? 

দেখুন, জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায় হচ্ছে, নিজের ভিতরে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলা। আর আপনার ভিতরে যখন প্রশ্ন জেগে উঠবে, তখন দেখবেন, আপনার ভিতরে জ্ঞানবৃক্ষ জন্মাতে শুরু করবে। জীবন একটা যাত্রীবাহী গাড়ি। আপনি তার সওয়ার। এই গাড়ির তেল একসময় ফুরিয়ে যাবে।  সময়-সময় বিকল হয়ে যাবে। তো একটু সময় নিয়ে,   জীবন সম্পর্কে ভাবতে থাকুন। কে আপনি, কেন এসেছেন,  কোথায় এসেছেন, এখানে আপনার কি কাজ, এখান থেকে আবার আপনার কোথায় যেতে হবে। আপনি যদি ১০০ বছরের কম বয়সী দেহধারী হন, তবে নিশ্চই একশ বছর  আগে আপনি এই দেহে ছিলেন না, তো কোথায় ছিলেন ? অন্য কোনো দেহে ছিলেন ? নাকি দেহাতীত অবস্থায় বিরাজ করছিলেন ? নাকি আপনি ছিলেনই   না ? যদি অতীতে না থেকে থাকেন, তবে জানবেন, ভবিষ্যতেও আপনি থাকবেন না। তাহলে আপনি বর্তমান নিয়ে সুখে, সন্তুষ্ট থাকুন।  যদি বোঝেন, আপনি আগে ছিলেন, তবে আপনি নিশ্চয়ই ভবিষ্যতেও থাকবেন।  কি অবস্থায় থাকবেন, কোথায় থাকবেন তা আপনি জানেন না। নিজের সত্তা সম্পর্কে নিজের মধ্যে প্রশ্ন  জাগিয়ে তুলুন, দেখবেন নিজের ভিতর থেকেই আপনার সমস্ত প্রশ্নের উত্তের ভেসে আসবে। তখন দেখবেন, মায়ারূপ অক্টোপাসের বাঁধনে আটকে আছেন আপনি। তখন এখান থেকে বেরুবার জন্য আপনার মধ্যে একটা আকুলি-বিকুলি ভাবের জন্ম হবে। সমস্ত জাগতিক শুভ বা অশুভ চিন্তা তখন দূর হয়ে যাবে। পাখি কেন, আকাশে ওড়ে, মাছ কেন জলে ভেসে বেড়ায় ? জীব-জন্তু কেন ডাঙায় চলাফেরা করে ? ভাবতে ভাবতে একসময় আপনার মধ্যে একটা প্রতক্ষ্য জ্ঞান অনুভূত হবে। তখন নিজেকে অবিনশ্বর পরম-পিতার   সন্তান বলে মনে হবে। নিজেকে একটা আনন্দময় সত্তা বলে অনুভব করতে পারবেন। শান্তির মধ্যে আপনি বিরাজ করবেন। জ্ঞানযোগই শান্তির উৎকৃষ্ট পথ। জ্ঞান হলেই  আপনি বুঝতে পারবেন, আপনি নিদ্রাচ্ছন্ন। আপনি স্বপ্ন দেখছেন।  আর স্বপ্নে যা কিছু দেখছেন, তা স্বল্পস্থায়ী, সত্য নয়। চেতনা জাগ্রত হলে স্বপ্ন ভেঙে যাবে।  তখন আপনি স্ব-স্বরূপে স্থিত হবেন। যা আসলে আনন্দময় সত্তা ছাড়া আর কিছু নয়।  জীবনের যা কিছু দুঃখ কষ্ট তা স্বপ্ন বৈ কিছু নয়। 

তো যা বলছিলাম, জীবন একটা স্বপ্ন। এই স্বপ্ন-অবস্থায় আমরা যা কিছু দেখি, শুনি, উপভোগ করি, তা সে সুখ দুঃখ যাই হোক না কেন, তা সাময়িক। জেগে  উঠলেই আমরা বুঝতে পারি, আমি এতক্ষন স্বপ্ন  দেখছিলাম।  এখন ধরুন, স্বপ্নে আপনাকে  ষাঁড়ে তাড়া  করেছে, আপনি ভয় পেয়ে গেছেন আপনি উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছেন। যারা জেগে আছে, তারা দেখছে, আপনি গোংড়াচ্ছেন, আপনার মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ ভেসে আসছে, শরীর  ঘেমে নেয়ে একাকার। হঠাৎ আপনার ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়া হলো, আপনি জেগে উঠলেন।  আপনি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। ভাবলেন,  বাঁচলাম। এতো স্বপ্ন, সত্যি নয়।  আবার ধরুন, আপনি স্বপ্নে অনেক ধনরত্ন পেয়েছেন। বিষয় সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। ছেলে-মেয়ে-নাতি-পুতি নিয়ে আনন্দে সংসার করছেন। আপনার প্কেট ভর্তি টাকার তোড়া।  আপনি সবাইকে টাকা পয়সা দান  করছেন, আর নিজের মধ্যে একটা আত্মশ্লাঘা অনুভব করছেন। হঠাৎ আপনার স্ত্রী আপনাকে ডেকে তুললো। জেগে উঠে আপনি দেখলেন, আপনার অভাবের সংসার। কোথায় টাকা-পয়সা ? কোথায় পুত্রকন্যা ? আপনি তো নিঃসন্তান, আপনি তো ছাপোষা কেরানি। । তখন আপনার খুব খারাপ লাগতে লাগলো, স্বপ্ন যদি সত্যি হতো। 
তো স্বপ্নে যারা কষ্ট  পায়, জেগে উঠে তারা  স্বস্তি পায়, শান্তি পায় ।  আর স্বপ্নে যারা প্রাচুর্য্যের সুখের মধ্যে  মধ্যে থাকে জেগে উঠলে তাদের আপসোস হয়, কষ্ট  হয় । তো যখন উভয়ই জেগে ওঠে, তখন তাদের সবাই কিছু একটা হারায়।  একজন স্বপ্নের কষ্ট হারায়, একজন স্বপ্নের সুখ হারায়। স্বপ্নাবস্থা কারুর চিরকাল থাকে না, একদিন তাকে জাগতেই হয়। আর জেগে উঠলে, তার চেতনা হলে, সে উল্টো ফল দর্শন করে ।  
তো আপনার মধ্যে যদি এই জ্ঞান জন্মায় যে আপনি যাকে জাগ্রত অবস্থা বলছেন, সেটি আসলে ৮০ বছর বা ১০০ বছরের স্বপ্নাবস্থা মাত্র এবং আপনার সামনে  অনন্ত জীবন পড়ে আছে। তো এই জীবনে আমরা যারা বিষয়সুখে আছি, এই জীবনের পরে, এর ঠিক উল্টোটা হবে, কেননা তখন তো আর এই বিষয়সুখ থাকবে না। আবার এই জীবনে যারা বিষয়সুখ থেকে বঞ্চিত তাদের পরবর্তীকালে বিষয় হারানোর কোনো কষ্ট  থাকবে না। তারা শান্তিতে থাকবেন। 

আমার এক বন্ধু বলছিলেন, স্বপ্ন কখনো সত্য নয়, কেননা  কার্য্য-কারন সম্পর্ক নেই।  স্বপ্নের কোনো পরম্পরা নেই। থাকি বলেছেন, স্বপ্নের কোনো পরম্পরা নেই।  কিন্তু স্বপ্নের কোনো কার্য্য-কারন নেই তা নয়। প্রতিটি স্বপ্নের একটা কার্য্য-কারন সম্পর্ক আছে। স্বপ্নে বাচ্চারা হিসু করে দেয়। যুবক স্বপ্নদোষে আক্রান্ত হয়ে, বীর্য স্খলন করে ফেলে।  আপনি যদি স্বপ্নে খাবার খান, তবে আপনার পেট খারাপ হবে। স্বপ্নে বহু মানুষ অনেক নির্দেশ পেয়ে থাকেন, যা বাস্তবে সত্য। তো স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্যে একটা ফারাক আছে সত্য, কিন্তু দুটোই সত্য। 

আসলে আমরা আগে শুনেছি, ব্রহ্মার চার অবস্থা , জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ও তুরীয়।  এই তিন অবস্থাই ব্রহ্মার গতিপথ। উপনিষ বলছে, অহম ব্রহ্মাস্মিন। অর্থাৎ আমরা সবাই ব্রহ্ম। আমাদের সবারই গতি এই চার অবস্থার মধ্যে দিয়ে হয়ে থাকে। আমরা সাধারণ মানুষ যতক্ষন জন্ম-মৃত্যুর চাকরি আবদ্ধ থাকি, ততক্ষন আমরা তিনটি চক্রে অর্থাৎ জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুসুপ্তির মধ্যে ঘোরাফেরা করে থাকি। মহাপুরুষগন এই তিন অবস্থার বাইরে, অর্থাৎ তুরীয় অবস্থার মধ্যে প্রবেশ করে ব্রহ্মে লিন হয়ে যান। 
   
আমরা জানি বা না জানি, আমরা ৮০/১০০ বছর এই জীবদেহে থাকি, এর পর আমরা দেহাতীত হয়ে, হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকি। অপূর্ন  বাসনা-সংকল্প পূরণের জন্য, আমরা আবার দেহের মধ্যে প্রবেশ করি। তো দেহাতীত-কাল বা সময়  থেকে দেহধারী হিসেবে অবস্থানের সময় অতিঅল্প। দেহাতীত হয়ে অবস্থানের সময়সীমা অনেক দীর্ঘ। 
যদিও দেহধারী হয়েই আমরা কর্ম্ম করতে পারি, দেহধারী হয়েই আমরা আমাদের আত্মিক উন্নতি করতে পারি। দেহ আমাদের কর্ম্মফল  সঞ্চয়ের সুযোগ করে দেয়, যা আমাদের পুনঃপুনঃ দেহধারনের সাহায্য করতে পারে, বা কারন হতে পারে । আবার এই দেহে থাকাকালীন, আমরা আমাদের দেহকে কাজে লাগিয়ে,  জপ-তপ-ধ্যানাদির দ্বারা আমাদের চিন্তাধারাকে যখন স্বচ্ছ করতে পারি ।  চিন্তা আমাদেরকে কর্ম্মে প্রবৃত্ত করে, আর কর্ম্ম আমাদের জ্ঞান সংগ্রহে সাহায্য করে থাকে। আর জ্ঞান যখন একাগ্রতার সাহায্যে গভীরতা প্রাপ্ত হয়, তখন আমাদের সজ্ঞা জেগে ওঠে। সজ্ঞা আমাদের প্রজ্ঞা এনে দেয়। এই প্রজ্ঞাই আমাদের   জ্ঞানচক্ষু দান করে । জ্ঞানচক্ষু যখন খুলে যাবে, তখন  দেহাতীত হয়ে পরব্রহ্মে লিন হয়ে যেতে পারি। এই যে ধীরে ধীরে আত্মিক পরিবর্তন  বা উন্নতিলাভ, এটি  আমাদের  দেহাতীত অবস্থায় সম্ভব নয়। তাই মানবদেহকে  অমূল্য সম্পদ বলা হয়েছে। এই মানব দেহেই আমরা জাগতিক সুখ অনুভব করতে পারি, এই সুখ ইন্দ্রিয় লদ্ধ,  আবার এই মানবদেহই আমাদের আত্মিক উন্নতির সোপান যা আমরা সজ্ঞা দ্বারা অর্জন করতে পারি ।  যে যেমন ভাবে কাজে লাগাবে, তার তেমন লাভ হবে। মহাত্মাগণ বলে থাকেন, আত্মার পরিবর্তন হয় না। তো যার পরিবর্তন হয় না, তার আবার উন্নতি বা অবনতি কি করে হতে পারে ? বিষয়টি একটু ভালোভাবে বোঝার দরকার।  আত্মার উন্নতি হয় না, উন্নতি হয় হয় জীবাত্মার। আত্মার প্রতিচ্ছবি হচ্ছে জীবাত্মা। আর এই দেহ বা জগৎ হচ্ছে, আত্মার প্রতিচ্ছবি মাত্র। যা একটা রূপ বা আয়নার মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে। এই আয়নার স্বচ্ছতার উপরে নির্ভর করে, আত্মার প্রতিচ্ছবি কতটা যথাযথ হবে। তাই নিজেকে স্বচ্ছ করতে হবে, পবিত্র করতে হবে, স্থির করতে হবে। জীবতরঙ্গকে শান্ত করতে হবে।  তবেই আত্মা আমাদের মধ্যে যথাযথরূপে প্রতিফলিত হতে পারবে। 

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম।
 

জীবন রহস্যঃ - ২৭

চিত্রগুপ্তের খাতা
 
হিন্দু ধর্ম্মশাস্ত্রে যমরাজ বলে একটা চরিত্রের বর্ণনা আছে। ইনি  সূর্যপুত্র। এঁকে কাল বলেও ডাকা হয়ে থাকে। অর্থাৎ সময়। সূর্যোদয় ও সূর্য অস্ত যাবার সঙ্গে কাল বা সময়ের সম্পর্ক। আমাদের প্রতীকের জীবনে এই কালের প্রভাব  পড়ে থাকে। এই কালের প্রধান সহায়ক হচ্ছেন চিত্রগুপ্ত। যিনি নাকি প্রত্যেক মানুষের এমনকি সমস্ত জীবজন্তুর কার্যকলাপ লিপিবদ্ধ করেন। চিত্রগুপ্ত কথাটার অর্থ হচ্ছে গুপ্ত ছবি, বা গোপন চিত্র। আমরা শুনেছি আমরা যা কিছু করি না কেন, তা সে ভালো হোক, বা মন্দ, সবই এই চিত্রগুপ্তের খাতায় লেখা হয়ে যাচ্ছে। এই চিত্রগুপ্তকে কেউ কখনো দেখেনি। কিন্তু আপনি যদি এই চিত্রগুপ্তকে দেখতে চান, তবে দেখবেন আপনার মনের ভিতরেই তার কাজের নমুনা দেখতে পারবেন। আমরা যদি একটু গভীরে ভাবি, তবে দেখতে পারবো, আমাদের সবার মনই এই চিত্রগুপ্তের কাজ করে চলেছে। বর্তমানের মনোবিজ্ঞানীগন এই বিষয়ে আমাদের জ্ঞাত করেছেন। 

মনোবিজ্ঞানীগন বলছেন, কাউকে যদি সন্মোহিনী বিদ্যার সাহায্যে ঘুমের মধ্যে আচ্ছন্ন করা যায়, তবে সে তার অতীতের অভিজ্ঞতা যা তার স্মৃতির মধ্যে লুকিয়ে আছে, তা সে উন্মোচন করতে পারে। কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় এই চেষ্টা সফল হতে ম্পারে না। সম্মোহনে আছন্ন ব্যক্তি, তার অতীত অভিজ্ঞতার সচিত্র বর্ণনা দিতে পারে। এমনকি তার জন্মকালীন অভিজ্ঞতার বর্ননা  সে দিতে পারে। এই অভিজ্ঞতা আমাদের নেই, কিন্তু আমরা দেখেছি, আমাদের চিন্তা যখন ভয় রাগ হিংসা, দ্বেষ ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন আমাদের মধ্যে নেতিবাচক চিন্তার উদ্রেগ করে আর কাজ হয় ধংসাত্মক, ফলও নেতিবাচক হয়।  কিন্তু আমরা যদি প্রেম, ভালোবাসা, শদ্ধা, বিনয় ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত থাকি, তবে আমাদের মধ্যে ইতিবাচক চিন্তার উদ্রেগ হয়। আর এর ফলও ভালো হয়। এই সময় আমাদের কাজ হয়ে থাকে সৃজনমূলক। এইজন্য বলা হয়ে থাকে, আমাদের পছন্দ, আমাদের ইচ্ছে, আমাদের বাসনা অনুযায়ী আমাদের চিন্তার উৎকর্ষতা বা নিকৃষ্টতা নির্ধারণ হয়ে  থাকে। একটু যদি ঘুরিয়ে বলি, আমরা যদি ভালোকিছু চিন্তা করি, তবে আমাদের কাজও ভালো হবে, আর আমরা মানুষ হিসেবে ভালো হয়ে উঠতে পারবো। আর যদি উল্টোটা হয়, তবে আমাদের আর ভালো হয়ে ওঠা সম্ভব হবে না।  আর আমাদের প্রাপ্তিও হবে, আমাদের চিন্তা অনুযায়ী। 

আমরা এখন যা হয়েছি, তা আমাদের অতীতের চিন্তার ফসল। অতীতের চিন্তাই আমাদের বর্তমান অবস্থার ভিত্তিভূমি। আবার বর্তমান ভাবনা চিন্তা আমাদের ভবিষতের জীবন গড়ে দেবে। আপনি যদি সৎচিন্তা করেন, এবং সেইভাবে কাজ করেন, তবে আপনার জীবনে সুখ-শান্তি ছায়ার মতো অনুসরণ করবে। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি  ওম।    

জপধ্যান 

যা ভাবলে কার্যসিদ্ধি হয়, তাকেই বলে জপ । ধ্যান হচ্ছে ধেয় বস্তুতে একাগ্র হওয়া। তো ধেয় বস্তু সম্পর্কে গভীর মনোনিবেশ করলে, সেই বস্তুর জ্ঞান হয়। আর জানবেন জ্ঞানই মানুষকে সমস্যা সমাধানের রাস্তা দেখায়।     

মানুষ যদি নিজের সঙ্গে বন্ধুত্ত্ব পাতাতে পারে, তবে সে জীবনে কখনো নিঃসঙ্গ হতে পারে না। মানুষ যদি নিজেকে চিনতে পারে, তবে সে নিজেকে  কখনো বয়স্ক ভাববে না।  মানুষ যদি নিজেকে চিনতে পারে, সে কখনো নিজেকে দুর্বল ভাববে না।  মানুষ যদি নিজেকে চিনতে পারে তবে সে নিজেকে দরিদ্র ভাবতেই পারে না। 

ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে কোনো ক্যালেন্ডার ছিল না, পঞ্জিকা ছিল না।  সারা গ্রামে পাঁজি একটা থাকতো পুরোহিত ঠাকুরের বাড়িতে। অর্থাৎ কালা ঠাকুরের বাড়িতে। গ্রামের সবাই কোনো শুভ কাজের জন্য, ওই কালঠাকুরের কাছে, দিন-তারিখ জানতে যেতেন। আমাদের কোনো জন্মের শংসাপত্র নেই। ফলত আমাদের কারুরই জন্ম সাল-তারিখ জানতাম না। আমরা যখন ক্লাস ফোর থেকে ফাইভ-এ উঠতাম, অর্থাৎ প্রাইমারি স্কুল থেকে হাইস্কুল-এ ভর্তি হতে যেতাম, তখন প্রাইমারি স্কুল এর হেড মাস্টার মশাই আমাদের জন্মের একটা সাল-তারিখ লিখে দিতেন। আবার যখন আমরা হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষা দিতে যাবো, তার আগে, স্কুলের হেড মাস্টার মহাশয় স্কুলবোর্ডের কাছে, পুরোনো জন্ম  তারিখ বা কোনো সংশোধিত সাল-তারিখ লিখে বোর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতেন। আর সেটাই হতো আমাদের জন্মদিন। আমাদের অফিসের এক কর্ম্মচারী ছিলেন, তার কোনো জন্মতারিখ অফিসের রেকর্ডে লেখা ছিল না।  ফলত বৃদ্ধ হয়ে যাবার পরেও তাকে অবসর দেওয়া হচ্ছিলো না। শেষে তার কাছ থেকে একটা জন্মকুল্ডলি চেয়ে, দেখা গেলো, অন্ততঃ ১১ বছর  আগে তাকে চাকরি থেকে অবসর দেওয়া উচিত ছিল। আমাদের অমরদা তো গর্ব করে বলতেন, অফিস রেকর্ডে আমার জন্ম সাল-তারিখ দশ বছর কম করে দেওয়া আছে। আমি তোদের থেকে বয়সে অনেক বড়ো। 

তো আমি যেটা বলতে চাইছি, এই যে জন্ম তারিখের ব্যাপার - এটা আসলে আমাদের মন গড়া। আপনি বলতেই পারেন, আপনার জন্ম তারিখ আপনি না জানতে পারেন, বা কোথাও লেখা না থাকতে পারে, তাইবলে আপনার কোনো সঠিক জন্ম তারিক নেই তা তো নয়, একদিন না একদিন তো আপনি জন্মে ছিলেন। তো জন্ম তারিখ  আমাদের মন গড়া এটা  কেমন করে হয় ?  

দেখুন একটা সময় বিশ্বাস করা হতো,  মানুষের শারীরিক মানসিক গঠন পূর্নতা পায় ২৫ বছর বয়সে। এই সময়ের মধ্যেই তাকে গড়ে-পিটে নিতে হয়।  কেননা এর পরে তার শরীর-মন পরিবর্তনের অযোগ্য হয়ে যায়। আর এই জন্য পুরাকালে আমাদের ২৫ বাঁচার পর্যন্ত গুরুগৃহে থেকে ব্রহ্মচর্য পালন ও শাস্ত্র শিক্ষা দান করা হতো। আবার বলা হয়ে থাকে, ৬৫ বছরের পর থেকে তার শরীরের কোষের মৃত্যু সংখ্যা জন্ম সংখ্যা থেকে কমতে থাকে। এই সময় থেকে তার শরীরের অবক্ষয় শুরু হয়। আমরা এখন ৬০/৬৫ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করি কর্ম্ম জীবন থেকে অবসর নেবার জন্য।  এবং আমরা মনের মধ্যে একটা ধারণা জন্মায় যে এখন আর আমার সংসারে করবার কিছু নেই। সংসারের সমস্ত দায়িত্ত্ব ছেলে-বৌমার হাতে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত অবসর জীবন কাটাতে চাই। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি আমরা যদি নাই জানতাম যে আমাদের কবে জন্ম হয়েছে, তাহলে কিন্তু শরীর অবসন্ন না হওয়া পর্যন্ত অবসরের কথা ভাবতাম না।  

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম। 
--------------------------------------------------------

    
 
জীবন রহস্যঃ কথা সমাপ্ত হলো। 
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি  ওম।  
শশাঙ্ক শেখর শান্তিধাম