প্রথমেই বলি, এই ব্রাহ্মণ কিন্তু তথাকথিত শুধু জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ নন। ইনি যথার্থ ব্রহ্মজ্ঞানী। আর যে শূদ্রের কথা বলা হচ্ছে, ইনিও সেই অর্থে শুদ্র অর্থাৎ অজ্ঞানী নন। ইনি শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত। তো ব্রহ্মজ্ঞানীর ইচ্ছে হয়েছে, শাস্ত্রের কথা জানতে। আর তাই তিনি শুদ্র শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিতকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তো শুদ্র শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত সেই আহ্বান পেয়ে ব্রহ্মজ্ঞানীর কুটিরে এসে উপস্থিত হয়েছেন। উভয়ে মিলিত হলে, শুদ্র-শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ব্রহ্মজ্ঞানীকে প্রণাম করলেন। আর ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ শুদ্রকে আলিঙ্গন করে উভয়ে মুখোমুখি আসনে বসলেন।
এবার ব্রহ্মজ্ঞানী প্রশ্ন করলেন : বলো হে পণ্ডিত জীবগন কিভাবে সাধন-ভজন করলে, উদ্ধার পাবে ?
শাস্ত্রজ্ঞ শূদ্র ইতস্তত করতে লাগলেন, কারন এমন কিছু নেই, যে ব্রহ্মঞ্জ পুরুষের অজানা। আর তা ছাড়া এই ব্যাপারে তাঁর কি মত তাও তিনি জানেন না। কেননা সাধনার কোনো নির্দিষ্ট পথ হয় না। অধিকারী ভেদে সাধনার প্রকারভেদ হয়ে থাকে। মনে মনে ভাবলেন, ইনি কৃষ্ণভক্ত, আবার অসীম ধীশক্তিসম্পন্ন। সমস্ত শাস্ত্রে পারঙ্গম , তথাপি আজ আমাকে তিনি দয়া করে, উত্তরদাতার আসনে বসিয়েছেন। তাঁর কাছে এই প্রশ্নের উত্তর নেই, তা নয়। আবার ইনি সন্ন্যাসী। আর সন্ন্যাসী মাত্রেই স্বয়ং নারায়ণ। তো স্বয়ং নারায়ণের কাছে নারায়ণ পূজার বিধি বলা, ধৃষ্টতা ছাড়া আর কি হতে পারে ? তো শুদ্র শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত স্থির করে উঠতে পারলেন না - এই প্রশ্নের উত্তর তিনি কি দেবেন ? আবার এও বলবার সাহস সঞ্চয় করতে পারলেন না, যে "না প্রভু আপনি প্রথমে বলুন"।
যাইহোক, অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললেন, হে প্রভু, আমার সাধন ভজন নেই। নিতান্ত দু-পাতা পুঁথি পড়ে কিছু শুষ্ক জ্ঞানের সঞ্চয় করেছি।সেখান থেকেই আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। শ্রীবিষ্ণুপুরান পড়তে গিয়ে দেখলাম, এই প্রশ্নের উত্তরে সেখানে লেখা আছে, "স্বধর্ম্ম পালনে শ্রীভগবানে ভক্তি হয়।" শ্রীমৎ ভগবৎগীতাতেও স্ব-স্ব-ধর্ম্ম পালনের কথা বলা হয়েছে। আর এই কারণেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জ্জুনকে তার স্ব-ধর্ম্ম পালনে উৎসাহ দিয়েছেন।
ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ এই কথা শুনে, বললেন, তুমি পণ্ডিত, সর্ব্বশাস্ত্রে তোমার অবাধগতি, তুমি এতো মোটা কথা বলবে, তা আমি আশা করি নাই। দেখো, এসব কথা বাহ্য কথা। তুমি গুহ্য কথা বলো।
শুদ্র শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত এবার একটু ভেবে বললেন, ভক্তি ও জ্ঞান - এই উভয়ের যোগে ভগবানের উপাসনা হতে পারে। আবার একটু ভেবে বললেন, অবশ্য শ্রীভাগবতে বলা হয়েছে, জ্ঞানশূন্য ভক্তি দ্বারা শ্রীভগবানকে পাওয়া যায়।
ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ বললেন, এ অবশ্য ভালো কথা, তবে এর থেকে ভালো কথা যদি কিছু থাকে তবে তা আমাকে বলো।
অর্থাৎ জ্ঞানশূন্য ভক্তি দ্বারা শ্রী ভগবানের ভজনা হতে পারে, একথা সত্য হলেও , তিনি আরো গভীরে প্রবেশ করতে চাইলেন।
শূদ্র শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত এবার বললেন, দাস্য প্রেমের দ্বরা শ্রী ভগবানের সেবা করাই সর্বোত্তম সাধনা।
ব্রহ্মজ্ঞ এবার যেন খুশি হলেন, বললেন, তুমি আমাকে কৃতার্থ করলে। কিন্তু এর থেকে আরো আগে বারো, আরো সূক্ষ্ম তত্ত্বের কথা বলো।
শাস্ত্রজ্ঞ বললেন, দাস্য ভাবের থেকে সখ্য প্রেম ভালো। অর্জ্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সখা ছিল, তাই অর্জ্জুন সেই ভাগ্যবান পুরুষ যিনি দিব্যদৃষ্টি লাভ করে শ্রীভগবানের বিশ্বরূপ দেখতে পেয়েছিলেন। যিনি শ্রীভগবানের শ্রীমুখে শ্রীগীতার বাণী স্ব-কর্ণে শুনবার অধিকারী হয়েছিলেন।
ব্রহ্মজ্ঞ : এই কথায়, আমি তোমার মাধ্যে আমাকে দেখতে পাচ্ছি। তুমি কি আমাকে নিয়ে নিলে ?
শাস্ত্রজ্ঞ বললেন, এহ বাহ্য, শ্রী ভগবানকে কান্তভাবে ভজনা করাই উত্তম সাধনা।
এই কথা বলে, শুদ্র শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ভাবলেন, কান্তভাবের সাধনা সম্পর্কে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যেতে পারে, কেননা এর থেকে উত্তম সাধনা আর হতে পারে না।
শুদ্র শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত তাই বলতে শুরু করলেন : দেখুন সাধনার উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রীভগবানের প্রাপ্তি। তবে এই যে প্রাপ্তি, তা কখনো আংশিক, কখনো পূর্ন। কিন্তু সাধক এই পার্থক্য ধরতে পারে না। কেননা যার যেমন বোধ বুদ্ধি, সে তেমনটাই বুঝে থাকে। ক্ষুধার্থ ব্যক্তির কাছে শাকান্ন অতি তৃপ্তি দায়ক। কিন্তু শ্রী ভগবানের মধ্যে এতো মধু আছে, যে তার কনা মাত্র পেয়ে সাধক মুগ্ধ হয়ে যায়। ভাবে, আহা ! আসলে শ্রী ভগবানকে যে যেভাবে ভজনা করে, তার কাছে সেই ভাবই সর্বোত্তম বলে মনে হয়।
যারা দাস্য ভাবে ভজনা করে, তারা বলেন, এই দাস্যভাব-ই সর্বোত্তম। এমনকি তারা এও বলে থাকেন, যে কান্তভাবে ভজনার অধিকার জীবকুলের নেই। কেউ ভাবেন, বাৎসল্য প্রেমই সর্বোত্তম। তাই, শ্রীকৃষ্ণকে কেউ বাৎসল্য, কেউ দাস্য, কেউ সখ্য, কেউবা কান্ত ভাবে উপাসনা করে থাকেন।
কান্ত কথাটার অর্থ হচ্ছে স্বামী। স্ত্রী কখনো স্বামীর দাসী হন, কখনো সখী হন, কখনো মাতা, আবার কখনো-বা বক্ষবিলাসিনী। তো শুদ্র শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত বললেন, শ্রীকৃষ্ণকে পূর্ন মাত্রায় পেতে গেলে, কান্তভাবেই তা সম্ভব হতে পারে। কান্ত ভাবেই শ্রীকৃষ্ণকে পূর্ণরূপে পাওয়া যায়।
ব্রহ্মজ্ঞ আবার বললেন, সাধনার এখানেই কি শেষ ? যদি কিছু বাকি থাকে তবে তা আমাকে বলো।
শুদ্র শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত এবার ভাবতে লাগলেন, এর পরে আর কি অছে ? এক মিনিট চুপ করে রইলেন। শুদ্র শাস্ত্রজ্ঞের মনের মধ্যে থেকে কেউ যেন বলে উঠলো, এরও পরে শ্রীরাধিকার প্রেম।
ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ বললেন, আহা আমার প্রেম পিপাসা শান্ত হলো। শ্রী রাধিকার প্রেম। কি শোনালে যে তুমি। কিন্তু পণ্ডিত রাধার প্রেম কেন শ্রেষ্ঠ তা কি বলতে পারো ?
শূদ্র শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত বললেন দেখুন, শ্রীকৃষ্ণ তো সবার সঙ্গেই আছেন, কিন্তু তার আস্বাদন তো সবার ভাগ্যে জোটে না। শত শত গোপী, কিন্তু শ্রীরাধিকার প্রেমেই শ্রীকৃষ্ণের শান্তি। সবাই নিজের শান্তি খোঁজে, কিন্তু শ্রীরাধিকা শ্রীকৃষ্ণের শান্তির জন্য ব্যাকুল।
ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ এবার যেন দিশেহারা হয়ে গেলেন, বললেন, আহা কি শোনালে, আর কম্পিত স্বরে উদ্বেগের সঙ্গে বললেন, এরও পরে যদি কিছু থাকে তা আমাকে বলো।
শুদ্র শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত বললেন, জীবের দৃষ্টি সীমিত। বস্তু চার প্রকার, স্থুল, সূক্ষ্ম, সূক্ষ্মতর, সূক্ষ্মতম। জীবের বুদ্ধির স্বচ্ছতা হেতু তার দৃষ্টিও সীমিত। এই সীমা সে অতিক্রম করতে পরে না। এর পরে মৌন হয়ে রইলেন।
মনে মনে বললেন, হে ভগবান এর পরে কি আছে, তা তো আমি জানি না, শাস্ত্র তো এর পরে আর কিছুই শোনাতে পারে না। হে ভগবান তুমিই বলে দাও এর পরে কি আছে ? কেউ যেন বলে উঠলো, হে পণ্ডিত, এর পরে যা কিছু আছে তা বাক্যের অতীত। বাক্য দিয়ে তাঁকে কলুষিত করতে যেও না। অন্তরের জিনিস অন্তরেই থাক বাইরে প্রকাশ করো না। এটো হয়ে যাবে। এই কথা ভেবে নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরলেন। ততক্ষনে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ মূর্চ্ছা গিয়েছেন। আর কানের কাছে ভক্তদল হরিনাম করতে লাগলো।
শুদ্র শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত আসন ছেড়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালো।
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওম।
কাল বা মৃত্যুকে জয় করে অমরত্ব লাভ করবার যৌগিক উপায়। মূল সূত্র শিবসংহিতা।
আজ শিব চতুর্দশী। তাই বসে বসে শিবপুরাণ পড়ছিলাম। সেখানে সব অদ্ভুত অলৌকিক কথা লিপিবদ্ধ করা আছে। কাল বা মৃত্যুকে জয় করে কিভাবে অমরত্ব লাভ করা যায়, সে সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া আছে। মৃত্যুক্ষণ কিভাবে জানা যায়, সে সম্পকে বলা হয়েছে। আমরা মৃত্যুক্ষণকে না জেনে, বরং অমরত্ত্ব লাভের যৌগিক প্রক্রিয়াগুলো সম্পর্কে একটু শুনে নেই। জানিনা, এতে করে মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় কি না, তবে এই সব যৌগিক ক্রিয়ার ভূয়সী প্রসংসা আছে বিভিন্ন যোগশাস্ত্রে। এই সম্পর্কে আমরা সংক্ষেপে শুনে নেবো, গোটা পাঁচেক প্রক্রিয়া।
১. রাতে খাবার চার ঘন্টা পরে, যখন সবাই নিদ্রা গিয়েছেন, তখন অন্ধকর ঘরে নিভৃতে এই যোগ সাধন করতে হয়। সুখাসনে বসুন, চক্ষু মুদ্রিত করুন, তর্জনীর সাহায্যে দুই কান বন্ধ করে, ৪৮ মিনিট অপেক্ষা করুন। এতে করে, আপনি অগ্নি ও বায়ুর মিথুনে যে ধ্বনি প্রতিনিয়ত উদ্গীথ হচ্ছে সেই ব্রহ্মনাদ শুনতে পারবেন। এই অবস্থায়, উচ্চারণ না করে, চিন্তায় এই শব্দব্রহ্মের সাক্ষাৎ লাভ হয়, শ্রুতিগোচর হয় । এই শব্দ ব্রহ্মের সাক্ষাতে মৃত্যু ও কাম জয় হতে পারে। সংসার বন্ধন থেকে মুক্তি হতে পারে। সাবধান থাকবেন, এই সাধনার বিঘ্ন হচ্ছে নিদ্রা ও আলস্য, এদের সম্পর্কে সদা সতর্ক থাকুন।
২. শ্বাসের সঙ্গে গায়েত্রী মন্ত্রের জপ। সুখাসনে বসে চক্ষু মুদ্রিত করে ধ্যানস্থ হবার চেষ্টা করুন। এর পরে, গায়েত্রী মন্ত্রের ব্যহৃতি অর্থাৎ "ওম ভূর্ভুবঃস্বঃ"...... এর পরে "তৎসবিতুর বরেণ্যম",.... এর পরে "ভর্গো দেবস্য ধীমহি" এবং শেষে শিরোমন্ত্র- "ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ওং" ..... সহ তিনবার গায়েত্রী মন্ত্র জপ করবেন, এবং প্রাণবায়ুকে রুদ্ধ করবে। অর্থাৎ আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া কে চার ভাগে ভাগ করে যথা পূরক, অন্তঃকুম্ভক, রেচক ও বাহ্যকুম্ভক এই চারটি ভাগে ভাগ করে গায়ত্রীমন্ত্রের জপ করবে। এই ক্রিয়া প্রভাতে অথবা গভীর রাতে করলে, আশু ফল প্রদান করে থাকে।
৩. আলোক বর্জ্জিত স্থানে, সুখাসনে বসে, ভ্রূমধ্যে মনকে নিবিষ্ট করে চিন্তা করলে, অব্যক্ত অগ্নির তেজ দেখতে সক্ষম হবেন। এই জ্যোতি সাদা, লাল, হলুদ, কালো এমনকি ইন্দ্রধনুর মতো বিচিত্র বর্ণের হয়ে থাকে। এই তেজালোকের মধ্যে মনকে নিবিষ্ট করলে, মন শান্ত হয়ে আসে। অন্ধকারে এই তেজস্বী মহান পুরুষের ধ্যান করলে যোগী কালকে লঙ্ঘন করতে পারেন।
৪. যোগী নিজ চিত্তকে বশীভূত করে নির্জন সুখপ্রদ আসনে বসে দেহ উঁচু করে, অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে, তীক্ষ্ণ চঞ্চুর (পাখীর ঠোঁট) ন্যায় আকৃতিবিশিষ্ঠ মুখের দ্বারা ধীরে ধীরে বায়ু পান করবেন। কিছুক্ষন করলে, তালুর মধ্যে স্থিত জীবনদায়ী জলের ফোটা পড়তে থাকবে। সেই জলের ফোটা বায়ুর দ্বারা শুঁকতে হবে। যিনি এই অমৃতস্বরূপ শীতলজল প্রতিদিন পান করেন, তিনি ক্ষুধা-তৃষ্ণা জয় করেন, কালকে জয় করেন।
৫. যোগী পুরুষ নিজের জিহবা ভাজ করে, তালুতে লাগাবার জন্য চেষ্টা করবেন। কিছু দিন অভ্যাস করলে, জিহ্বা দীর্ঘ হয়ে গলার গোড়া পর্যন্ত চলে যাবে তখন সুশীতল সুধাস্রাব নির্গত হতে শুরু করবে। যে যোগী এই সুধাস্রাব পান করেন, তিনি অমরত্ব লাভ করেন।
যাইহোক, এইসব ক্রিয়া আপনাকে শারীরিকভাবে চিরকাল বেঁচে থাকবার প্রতিশ্রুতি হয়তো দেয় না। কিন্তু আপনাকে অমৃতলোকের বাসিন্দা করে দিতে পারে - একথা সত্য। শারীরিক মানসিক ভাবে আপনি তখন সুস্থ হয়ে উঠবেন। জীবন থেকে অভাববোধের বিলোপ ঘটবে, অহেতুক একটা আনন্দ আপনার মন-প্রাণ-শরীরকে ঘিরে থাকবে। শারীরিক ও মানসিক শান্তির অধিকারী হবেন আপনি, একথা হলফ করে বলা যায়।
ওম নমঃ শিবায়।