Thursday 26 September 2019

মহা-মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র

মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র

মহা-মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র - অর্থ ও উপযোগিতা
ॐ त्रयम्बकं यजामहे सुगन्धिं पुस्टिबरधनं ।
ऊर्बारुक्मिब बन्धनान मृत्युर्मुक्षीय मामृतात।।

ওঁং ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্ । 
উর্বারুকমিব বন্ধনান্ মৃত্যুর্মুক্ষীয় মাঽমৃতাৎ।।
এই মন্ত্রের একটা বাঁধন আছে। সেই বাঁধন  দিয়ে মন্ত্রটি হবে এই রকম। 

ওঁং হৌং জূং স্বঃ ওঁং ভূর্ভূবঃ স্বাঃ
ওঁং  ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টি বর্ধনম। 
উর্ব্বারুক্মিব বন্ধনান্ মৃত্যুর্মুক্ষীয় মাঽমৃতাৎ।।
ওম্ স্বাহা ভুবঃ ভূঃ ওম্ স্বঃ জূং হৌং ওঁং 

আমরা ছোটবেলায় পড়েছি, আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের গল্প। একটা গুহার মধ্যে ধনরত্ন গচ্ছিত রেখেছিলো ডাকাতের দল। একটা পাথরের দরজা ছিল। যা সাধারণের মানুষের দ্বারা খোলা সম্ভব ছিল না। তো এই দরজা খোলার একটা মন্ত্র ছিল, চিচিং ফাঁক।  এই মন্ত্র উচ্চারণ করলেই সেই মনি-রত্ন ভান্ডারের দরজা খুলে যেত। তো আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের জন্যও একটা দরজা আছে। সেই দরজা খুলবার জন্য, শারীরিক শক্তি কোনো কাজ করতে পারে না। কিন্তু শব্দশক্তি বা মন্ত্রশক্তি মননশক্তি  এই অসাধ্য কাজ করতে পারে। এইরকম  দুটো মন্ত্র আমাদের কাছে খুব পরিচিত।  একটা হচ্ছে গায়ত্রী মন্ত্র, আর একটা হচ্ছে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র। আধ্যাত্মিক জগতের প্রবেশদ্বার উন্মোচনের মন্ত্র এগুলো। আজ আমরা সেই মহামৃত্যুঞ্জয় সম্পর্কে শুনবো। 
এই সুবিখ্যাত মন্ত্রটি মহামুনি মার্কন্ডেয় উদ্গীত নামে প্রচারিত। বলা হয়ে থাকে, চন্দ্রদেব একবার প্রজাপতি দক্ষের অভিশাপের কবলে পড়েন। তখন ঋষি মার্কেন্ডেয় প্রজাপতি দক্ষের কন্যা সতীকে এই মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র দান করেন।
অন্য কাহিনী হচ্ছে : এটি বীজ মন্ত্র। এই মন্ত্রের দ্রষ্টা হচ্ছেন ঋষি কহোল। ঋষি কহোল শিব সাধনায় এই মন্ত্র পেয়েছিলেন।
আর একটি কাহিনী আছে : এই মন্ত্র স্বয়ং শিব ঋষি শুক্রাচার্য্যকে  বলেছিলেন। শুক্রাচার্য্য় আবার ঋষি দধিচীকে দিয়েছিলেন।
যাইহোক, এই মন্ত্র মহাশক্তিশালী, এঁকে সর্বদা গোপন রাখা হতো। আজ আর অবশ্য এই গোপনীয়তা নেই।  এখন ঘরে ঘরে এই মন্ত্র সিডি ক্যাসেটের দৌলতে গীত হচ্ছে। এবং আমাদের  মনে হয়, এতে করে সবার মঙ্গল-ই হচ্ছে।  এঁকে কেউ বলে রুদ্র মন্ত্র  কেউ বলে, ত্র্যম্বকম মন্ত্র , কেউ বলেন, মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্র , কেউ বলেন  মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র বা মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র।
বেদে দুই-তিন জায়গায় এই মন্ত্র বা এই মন্ত্রের অভাস পাই। 
প্রথমতঃ : ঋকবেদের ৭ম মন্ডলের ৫৯ নং সুক্তের ১২নং ঋক ।  : এই মন্ত্রের দেবতা "রুদ্রদেব" । অনুষ্ট্ুপ  ছন্দে লেখা।  বশিষ্ট ঋষির  উদ্গীত বা লেখা। এখানে বলছেন :
ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্। 
উর্বারুকমিব বন্ধনান্ মৃত্যুর্মুক্ষীয় মাঽমৃতাৎ ।। 

দ্বিতীয়তঃ :  শুক্লযজুর্বেদে তৃতীয় অধ্যায়ে ৬০ নং মন্ত্রে আবার একই মন্ত্র পাই যা  ঋষি যাজ্ঞবল্কের উক্তি।   

(তৃতীয়তঃ :  অথর্ববেদেও চতুর্থ কাণ্ডের প্রথম অনুবাকের প্রথম  সুক্ত মন্ত্র নং ১৭ ; এখানে আমরা শ্লোকটি বা মন্ত্রটি একটু অন্য ভাবে পাই। এটি আসলে বিয়ের মন্ত্র।  যাই হোক সেখানে পাই :
অর্যমনং  যজামহে সুবন্ধুং পতিবেদনম্। 
উর্বারুকমিব বন্ধনাৎ প্রেতো মুঞ্চামি নামুতঃ।। )

এখন আমরা এই মন্ত্রের শব্দার্থ জানবো। যদিও আগেই আমরা একথা শুনেছি, তথাপি আর একবার শুনবো।
মন্ত্রের প্রথম ও শেষ লাইন আসলে মন্ত্রের বাঁধন। এই লাইন দুটো  মন্ত্র নয়।  কিন্তু মন্ত্রের সুরক্ষার্থে বা মন্ত্র শক্তি বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করে থাকেন। প্রথম লাইন  শেষে গিয়ে  উল্টোদিক থেকে গাওয়া হয়েছে।  এবার আমরা মন্ত্রের শব্দার্থ শুনবো।   
ওঁং - ওঁ- ওং-ওম  : সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নামই ওম। ওমকে প্রণব মন্ত্র বলা হয়।  হিন্দু ধর্মের সর্বজনগ্রাহ্য় মন্ত্র-ই ওম।  ওম-ই আদি শব্দ। সমস্ত মন্ত্রের বীজ আছে  এই ওম শব্দে।  অ-উ-ম এই তিন অক্ষরের মিলনেই ওম উচ্চারণ হয়। "অ" শব্দে ব্রহ্মা অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা ; "উ" অর্থাৎ বিষ্ণু বা পালনকর্তা ; আর "ম" বলতে বোঝায় মহেশ্বর - লয় কর্তা - যিনি সর্বদাই মঙ্গলময়। ওম শব্দটি যে কোনো বীজ মন্ত্রের আদি ও অন্তে ব্যবহৃত হয়। এটি সমস্ত মন্ত্রের বাঁধন। একটা জিনিস লক্ষ করুন, ওং এর বানান লিখবার সময় কেউ "ও" এর পরে অনুস্বার  অথবা   চন্দ্রবিন্দু  ব্যবহার করেন, কেউ কেউ দুটোই ব্যবহার করেন। এই চন্দ্র বিন্দুর অর্থ   দুঃখ নাশক, অনুস্বার এর অর্থ দুঃখ হরক ও সুখ বৃদ্ধিকারক। 
হৌং - ( হ্+ঔ+ং)= হৌং।  হ্ অর্থাৎ শিব। ঔ অর্থাৎ সদাশিব।  ং দুঃখ হরণ  ও সুখদায়ক। সর্বদা মঙ্গলকারী শিব আমার দুঃখ হরণ  করুন ও সুখ দায়ক হউন।  
জূং - জূ = সরস্বতী ; ং =  দুঃখ হরণ ও সুখদায়ক। হে বাগদেবী সরস্বতী আমার অজ্ঞানতা দূর করুন। "জু" কথাটার আর একটি অর্থ হচ্ছে, আকাশ অর্থাৎ ঈশ্বরের ব্যাপকত্ত্ব।  
স্বঃ - স্বাঃ-স্বাহা -  শব্দে  ঈশ্বরের ব্যাপ্তির কথা বলা হচ্ছে। ইনি সর্বত্র স্বমহিমায় স্বেছায় প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বব্রহ্মান্ড ব্যাপী সমস্ত কিছুতে এনার  অবস্থিতি।  নিজের কোনো রূপ না থাকলেও সমস্ত পার্থিব বস্তূতে ইনি প্রকট।  এই ভাবেই তিনি নিজের সাথে ক্রীড়ারত।  নিজের সৃষ্টিতে অবস্থান করছেন, অবগাহন করছেন,শাসন করছেন,সুস্থ ও সঠিক কার্যে রত থাকছেন।  
ভূর্ভুবঃ স্বঃ(ভূঃ-ভূবঃ-স্বঃ) -
ভূঃ :কথার মানে স্থিতি। ঈশ্বর স্বস্থিত।  সমস্ত কারণের কারণ এই ঈশ্বর।  এটি স্বাধীন, শ্বাশত , অপ্রাকৃত, অপরিবর্তনীয়। সীমাহীন - না আছে শুরু, না শেষ। সমস্ত তত্ত্বে এর অবস্থিতি, চিরকালীন অবস্থিতি, বিরামহীন গমন। 
ভূ -এর অন্য অর্থ পৃথিবী।  যে উৎপন্ন হয়েছিল বা যাতে উৎপন্ন হয়।
যেখানে আমরা জন্ম গ্রহণ করেছি। বেঁচে বর্তে আছি। এই পৃথিবীই আমাদের বেঁচে থাকার রসদ যোগাচ্ছে।  তার পরম কৃপা যা আমাদের উপর প্রতিনিয়ত বর্ষিত হচ্ছে, আমাদেরকে রক্ষা করছেন  , জীবন দান করছেন । 
ভূ - আর এক অর্থে প্রাণ অথবা জীবন। স্থুল  অর্থে নিঃস্বাস-প্রশ্বাস।
ভূবঃ- বলতে বোঝায় চেতনা। ঈশ্বরের চেতনা। চেতন স্বত্বা। এই চেতন সত্ত্বাই   বিশ্বভুবন শাসন করছেন ।  এই চেতন শক্তির দ্বারাই ঈশ্বর বিশ্বভুবনের সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করছেন ।  এই শক্তি আকাশ, বিশ্বচরাচর থেকেও বৃহৎ ব্যাপক। এই শক্তি  বন্ধনহীন, অসীম। এই চেতনা সমস্ত যন্ত্রণার অবসানকারী। একেই বলে 'অপান'।
স্বঃ - স্বাঃ-স্বাহা একে মানে আগেই বলা হয়েছে।    
এর পরে মূল   মন্ত্র যা আসলে আমরা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র নামে জানি সেটা হচ্ছে :
এ্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টি বর্ধনম। অর্থাৎ মূল মন্ত্রের প্রথম লাইন।  
ত্র্যম্বকং : ত্রি- অম্বকম অর্থাৎ যিনি তিন নেত্রের অধিকারী। স্বয়ং শিব, এখানে রুদ্রদেব । 
অম্বক কথাটার আর একটা অর্থ পিতা, তো ত্রিলোকের যিনি পিতা তিনি এ্যম্বক। অম্বা কথাটার অর্থ  মাতা। তো যার তিনজন মা তিনি এ্যম্বক।  এই প্রসঙ্গে পুরানে একটা কাহিনী আছে, পৌষ্যরাজা অর্থাৎ দক্ষের পৌত্র (নাতি) . দক্ষের পুত্র পূষা , পুষার পুত্র পৌষ্য। পৌষ্যের কোনো সন্তান ছিল না। ছিল তিন ভাৰ্য্যা। পুত্র কামনায় ব্রহ্মার শরণাগত হন তাঁরা । ব্রহ্মা তাদের একটা উজ্জ্বল সুবর্নবর্নের রসালো ফল প্রদান করেন। আর  শিবের আরাধনা করতে বলেন। তো তাঁরা শিব আরাধনা করতে থাকেন। শিব সন্তুষ্ট হয়ে ওই ফলের মধ্যে প্রবেশ করেন। আর ওই ফল তিন ভাগ করে ভক্ষণ করেন পৌষ্যের তিন ভাৰ্য্যা। ফলে তিন ভাৰ্য্যা তিনটি অঙ্গ প্রসব করেন, একজন শশীকলাযুক্ত শিরোদেশ, অন্যজন  মধ্য-অঙ্গ  ও অপরজন  নিম্ন-অঙ্গ।  এই তিনটি অঙ্গ একত্রিত হয়ে  স্বয়ং শিব পূষ্যার পুত্র হন। এইভাবে তিন খন্ডে  জন্মে ছিলেন বলে, শিব "ত্র্যম্বক" নামে খ্যাত হলেন।    
যজামহে : যার উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করা হয়।  অর্থাৎ যিনি যজ্ঞ ফল প্রাপক।  যজ কথাটা অর্থ পূজা। যিনি পূজার যোগ্য তিনি যজামহে।  
সুগন্ধিং : সুগন্ধযুক্ত।  সুগন্ধ কথাটার  অর্থ হচ্ছে রুদ্র-জটা। আর সুগন্ধি কথাটার অর্থ  হচ্ছে, ধর্ম্মাত্মা বা পরম-আত্মা।
পুষ্টি : পোষণ করা। যিনি ষোড়শ মাতৃকা। যার ইচ্ছায় ভরন, পোষন, পালন ও বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়।  
বর্ধনম্  : বর্ধনকারী। বর্দ্ধন কথার মানে ছেদন করা বা বৃদ্ধি পাওয়া। যার দ্বারা ছেদন করা যায় তিনিই বর্ধনম। তো দেবাদিদেব আমাদের ভববন্ধন থেকে মুক্তি প্রদান করে থাকেন।  
উর্ব্বারুক্মিব : (উরু + রুক্ম + ইব )উরু অর্থাৎ বড়, রুক্ম অর্থাৎ স্বর্নযুক্ত, ইব অর্থাৎ  এই। বিশাল স্বর্ণাভ ঈশ্বর। 
উর্ব্বারু কথাটার আর একটা মানে হচ্ছে কাঁকুড় (ফুটি) ।  অর্থাৎ বড় সোনালী রঙের অর্থাৎ পাঁকা কাঁকুড় (ফুটি)। 
বন্ধনান্ : বাঁধন থেকে। এখানে বলা হচ্ছে, ভব-বন্ধন থেকে।   
মৃত্যুর্মুক্ষীয় :মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে, অর্থাৎ মৃত্যুর পর মোক্ষ হতে যেন বিযুক্ত না হই।  
মামৃতাত্ : অমৃতত্ত্বে।
তাহলে মুখ মন্ত্রটির যথাযথ সম্পূর্ণ ভাবার্থ   হচ্ছে :  হে ভগবন, পার্বতীবল্লভে, আপনি ত্রিনেত্র ও সুগন্ধিযুক্ত।  ভক্তদের আপনি পুষ্টি বর্ধন করেন। আমরা আপনার পূজা করি। কর্কটি (ফুটি) ফল পাকলে যেমন অনাসায়ে খসে পড়ে, তেমনি আমরা যেন মৃত্যুর পর সহজেই মুক্ত হই, মোক্ষ হতে যেন বিযুক্ত না হই।
মন্ত্রের উপযোগিতা : কিছুদিন আগে একটা বাংলা দৈনিকে, পড়ছিলাম, দিল্লির একটা বিখ্যাত সরকারি মেডিকেল কলেজে, এই মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র  নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। সেখানে মুমূর্ষু রোগীকে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র পাঠ করে শোনানো হচ্ছে। এর ফলে নাকি মৃত্যু্-পথযাত্রী জীবনপথে ফিরে আসবে। এই সব মহাপন্ডিতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলতে চাই, এঁরা মন্ত্রের যথাযথ উদ্দেশ্য ও নির্ণায়ক শক্তি সম্পর্কে সম্যকরূপে সচেতন নন। এতে করে মন্ত্রের প্রতি আমাদের বিশ্বাস হারাবো।  
একটা কথা আছে, যে ভূতে বিশ্বাস করে, তাকেই ভূতে ধরে। আপনার যদি মন্ত্রে বিশ্বাস থাকে তবেই আপনার মন্ত্রে কাজ হতে পারে,  নতুবা নয়। আমরা অনেকেই লক্ষ্য করেছি, মৃতব্যক্তির বুকের উপরে, একখানা গীতা রেখে দেওয়া হয়। মৃত্যু-পথ যাত্রীর কানে হরে-কৃষ্ণ মন্ত্র শোনানো হয়। এতে নাকি তাদের বিষ্ণুলোক প্রাপ্তি হবে। এদের উচিত গীতার বাক্যকে জীবন থাকতে উপলব্ধি করা এবং নিজের জীবনে গীতার বাণী মেনে চলা। 
আমার এক পরিচিত প্রতিবেশী ফাৰ্মাসিস্ট, সত্তরের দশকে সাপে-কাটা রুগীর চিকিৎসা করতেন। অনেক রুগী  সেখান থেকে ভালো হয়েছেন, এটা আমার চোখে দেখা । বাড়িতে ১০/১২টা বেড পেতে দিয়েছিলেন, রুগীরদের জন্য। তো আমি তাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, দাদা ডাক্তাররা   বলছেন, সাপেকাটা রুগীকে অবশ্য়ই যথাশীঘ্র হাসপাতালে নিয়ে যেতে। তো আপনি এদের চিকিৎসা করছেন। কিভাবেই বা এদের ভালো করছেন ? তো তিনি বলেছিলেন, দেখো বেশিরভাগ সাপ বিষাক্ত নয়। সাপে কাটা রুগীর গায়ে সাপের কাটা*-দাগ দেখে আমি বুঝতে পারি, বিষাক্ত সাপ  কেটেছে নাকি, নির্বিষ সাপ  কামড়েছে। বিষাক্ত সাপ  হলে সেই রুগীকে আমি রাখি না।  দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলি। তাই আমার কাছে যারা চিকিৎসা পায়, তাদের মনের জোর বাড়িয়ে দেওয়াই আমার কাজ। অনেক মানুষ ভয়ে মারা যায়। আমি তাদের নির্ভয় দেই , সামান্য ঔষধ দেই, যা না দিলেও চলে।    আর আমার কাজ মনের জোর বাড়িয়ে দেওয়া মাত্র। তো সেই সময়, বিজ্ঞান-মনস্ক কিছু মানুষ কলকাতা থেকে গিয়ে তাকে বিষাক্ত সাপে কাটা মানুষকে বাঁচাবার জন্য, চ্যালেঞ্জ করে। এবং শেষমেশ তিনি তার ব্যবসা গুটিয়ে বাংলাদেশে চলে যান।      

আধ্যাত্মিক জগতের দ্বার উন্মোচন করতে পারে মন্ত্র। বলা হয়ে থাকে, এ মন্ত্র জপে মানসিক, আমাদের আবেগের, ও শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য খুবই উপকারী। এমনকি দীর্ঘ-জীবন, অমরত্ত্ব, এমনকি মোক্ষ দান করতে পারে এই মন্ত্র। পুরান মতে, এই মন্ত্র মুনি-ঋষিরা ব্যবহার করতেন। দক্ষ-কন্যা সতী প্রজাপতি দক্ষের অভিশাপে যখন চন্দ্রদেব অর্থাৎ তার স্বামী পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়েছিলেন, তখন এই মন্ত্র জপ করায় চন্দ্রদেব শিবের মস্তকে স্থান পেয়েছিলেন। অকাল-মৃত্যুর হাত থেকে এই মন্ত্র জীবকে রক্ষা করতে পারে। এই মন্ত্র জপের সময়  বিভিন্ন বিভূতি আমাদের শরীরের উপরে ভর করে, যা যজ্ঞ বা হোম করবার ফলে হয়ে থাকে। এই মন্ত্র আমাদের চেতনশক্তির সঙ্গে মিলন ঘটিয়ে দেয়।  প্রকৃতির প্রভাব থেকে শরীরকে রক্ষা করে। বার বার এই মন্ত্রের জপ আমাদের একাগ্রতা বৃদ্ধি করে, ফলে যেকোনো বিষয় জ্ঞান সহজেই লাভ করা সম্ভব হয়। আরোগ্য লাভ, জীবনীশক্তি পুনরুদ্ধারে ধাত্রী-মায়ের মতো কাজ করে এই মন্ত্র।
তাই বলি এই মন্ত্র জপ্ করে, মরা মানুষ জ্যান্ত হয়ে  যাবে, এমন ভাবার কোনো মানে নেই । খেয়াল করুন, এই মন্ত্র জপ করে চন্দ্রদেব মহাদেবের মস্তকে স্থান পেয়েছিলেন। অর্থাৎ শিব লোক প্রাপ্ত হয়েছেন। আমরা যা কিছু ভাবনা চিন্তা করি, সেটাই আমাদের মানস শরীর গঠনের উপাদান। অর্থাৎ আমরা যদি ত্র্যম্বকের বা ত্রিকালেশ্বরের   অর্থাৎ মঙ্গলময়ের চিন্তা করি, আর ভব বন্ধন থেকে মুক্ত হবার জন্য প্রার্থনা করি, অমৃতের পথে যাবার জন্য লালায়িত হই, তবে আমরা তাই প্রাপ্ত  হবো। স্থুল শরীর ত্যাগের পরে আমরা সবাই মানস শরীরে অবস্থান করি। মানস শরীর ত্যাগের পরে আমরা বিজ্ঞানময় শরীরে অবস্থান করি, অর্থাৎ আমরা স্থুল শরীরে থেকে যে চিন্তা করেছিলাম, সেই মতো মানস শরীর  প্রাপ্ত হবো।  আবার যে জ্ঞান সংগ্রহ করেছিলাম,  সেইমতো আমরা বিজ্ঞানময় শরীর প্রাপ্ত হবো। এই মন্ত্রের সঠিক অর্থ জানা, ও সেইমতো মনন করা, যেকোনো মন্ত্র জপের বা পাঠের উদ্দেশ্য। আর এই উদ্দেশ্য যদি আমরা সঠিক ভাবে বুঝতে পারি এবং আত্মস্থ করতে পারি তবে আমরা অবশ্য়ই অমরত্ত্ব লাভ করতে পারবো। মন্ত্র কোনো ভেলকি নয়। মন্ত্র মনকে ত্রাণ  করে। যাঁরা এই মন্ত্রের মধ্যে সঠিক ভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পেরেছেন, তারা অবশ্য়ই এই উপলব্ধি পেয়ে থাকবেন।    


ওম নমঃ ভগবতে রুদ্রায়। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ ।।  

অধ্যাত্ম জীবনের পথে -

অধ্যাত্ম জীবনের পথে 

 আধ্যাত্মিক জীবনের পথে পথে চলার বিবরণ। এক জীবন জিজ্ঞাসুর পথ চলা। জীবন যখন আত্মার অধীন হয়ে যায়, তখন কেমন হয় ? এযেন ছেড়ে দিয়ে আবার  ধরা।  মানুষ পয়সার   পিছনে  ছুটতে গিয়ে শরীর নষ্ট করে, আবার  শরীরের পিছনে পয়সা ঢালে। এ এক অদ্ভুত খেলা। পরম-আত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, আত্মা আবার পরমাত্মার খোঁজে বেরিয়ে পরে। পরম-আত্মা আত্মাকে ছেড়ে দেয়, খেলে বেড়াবার জন্য। সন্ধ্যে হলে আবার ঘরে তোলে। খেলনা পেয়ে আমরা মাকে  ভুলে থাকি, আবার খেলা শেষে আমরা কান্না জুড়ি। 

কার ডাকে, কেনই বা  সিদ্ধার্থ বেরিয়ে পড়েছিল, নিরালম্ব হয়ে ? কিসের আশায় মানুষ যুদ্ধ করে ? বোঝা বড়ো দায়। সেই শাশ্বত ও অনন্তকে পাবার টানে কত মানুষ যে ঘর-সংসার ছেড়ে বেরিয়ে গেছে, তার অন্ত নেই। আবার কত মানুষ, সংসারে থেকে  কেড়ে খাবার লড়াই চালাচ্ছে।  মানুষ জানে, মরন তার হবেই, তবু সে বেঁচে থাকতে চায়।  কেই বা মারে, আর কেই বা তাকে আবার জন্ম দেয়। এই রহস্যঃ উন্মোচনের জন্য, বেরিয়ে পড়ে কত  অন্বেষক। । 

প্রত্যেক মানুষের জীবনে একটা সময় আসে, যখন সে আধ্যাত্মিক আদর্শের ডাক  অনুভব করে। আর যখন সেই ডাক   আসে, তখন সে তা অস্বীকার করতে পারে না। এযেন এক ধর্মান্তরনের  সাধনা। সাংসারিক জীবন থেকে, পাওনাগণ্ডার জীবন থেকে, ত্যাগের জীবন। এই ঘটনা কারুর ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে ঘটে, কারুর ক্ষেত্রে হঠাৎ ঘটে।   মানুষটা কেমন বদলে যায় । একটা মুমুক্ষু ভাব, শ্বাশ্বত বস্তুর প্রতি একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ যেন ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে  চাইছে। এই সময় সে ঘুমুতে গেলেই স্বপ্ন দেখে, বরফ-ঠান্ডা দেশে ঘুরে বেড়ায়। শংকর থাকে সঙ্গে। শঙ্কর কথা বলে আর শশাঙ্কশেখর শোনে।

সত্যিকারের আধ্যাত্মিক মানুষকে বিচার করতে হয় তার আচরণ দিয়ে। কেউ একজন জ্যোতি দর্শন করছেন, বা শ্রীকৃষ্ণকে সশরীরে দেখতে পেয়েছেন, বা তার বাঁশি  শুনতে পেয়েছেন, বা শিব, কালির দর্শন পেয়েছেন, এই সব দিয়ে তাকে আধ্যাত্মিক উন্নত মানুষ, একথা বলা যায় না। একটা মানুষকে তখনই আধ্যাত্মিক উন্নত মানুষ বলা যেতে পারে, যখন সে সাধারণের  থেকে অধিক শক্তি সম্পন্ন। যখন সে পবিত্র চিন্তাধারার অধিকারী। অন্যের প্রতি যখন সে বেশি উদার। যখন সে আশাবাদী। যখন সে সন্তুষ্ট, পূর্ন। এবং এ সবই, তার প্রতিদিনকার কাজে, আচরণে প্রতিফলিত হয়। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলে, - "যারা বলে যে আমি রামকৃষ্ণকে দেখেছি, অথচ তাদের মধ্যে পবিত্রতা নেই, ত্যাগের কোনো লক্ষ্মণ নেই, ভক্তির ভাব নেই, তারা হয়তো বানরও দেখে থাকতে পারে।" এইসব ফালতু কল্পনায় নিজের সময় নষ্ট না করে,নিজের চরিত্রে শুদ্ধতা, পবিত্রতা, শান্ত ও শান্তিময় ভাব আনার চেষ্টা করা ভালো। 

যতক্ষন আমাদের দেহ আছে, আমাদের দেহবোধ আছে, ততক্ষন আমাদের অবশ্য়ই জড় জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আর যখন আমরা মন-জগতের বিচরণ করবো, তখন অবশ্য়ই আমরা অনন্ত চৈতন্যের সঙ্গে আমাদের চৈতন্যকে মেলাতে চেষ্টা করবো । উচ্চস্তরে আমরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করবো, সেই উপলব্ধি আমাদেরকে মানুষের কল্যানের কাজে  লাগাতে হবে। তবেই আমাদের আধ্যাত্মিক উন্মেষ হবে। চেতন স্তরগুলোর সঙ্গে, আমাদের জীবন যাত্রার মানের উন্নত করতে হবে। 

আমাদের মূল সত্ত্বা আত্মা। এই আত্মা অজ্ঞানের আবরণে ঢাকা বলেই,  আমরা মনে করি, আমরা আত্মা থেকে পৃথক। আমরা আমাদেরকে, মরণশীল জীব মনে করি। এই অজ্ঞানের ফলেই, আমরা নিজেদেরকে মনে করি, আমরা দেহ-মন।  এই কল্পনা সৃষ্টি করে অহং। আমরা মনে করি, আমরা ভৌত  বা জড় দেহ মাত্র।(স্থুল, মানস ও কারন দেহ মাত্র) . এই তিন শরীরের ভিতরে আছেন আত্মা, যা এই তিন শরীর  দিয়ে ঢাকা।

যখন আমাদের চেতন সত্ত্বা এই ভৌত শরীরের সঙ্গে একাত্মবোধ করে, তখন আমরা নিজেরদেরকে মনে করি এই দেহ, অর্থাৎ  এই রক্ত মাংসের দেহ। আবার এই চেতনা যখন আমাদের স্বপ্ন স্তরে থাকে, তখন আমরা মানসিক শরীরের সঙ্গে একাত্ম বোধ করি, আবার সুসুপ্তির সময় অর্থাৎ গভীর ঘুমের সময়,আমরা আমাদের চেতনা কারন শরীরের সঙ্গে একাত্মবোধ করে, তখন আমাদের মনের কাজ স্তব্ধ হয়ে যায়। এই তিন স্তরের পরে আছে, আমাদের তুরীয় অবস্থা। এটিই আমাদের শুদ্ধ-চৈতন্যবোধের স্তর। এই তুরীয় অবস্থা আমাদের গন্তব্য। 

আমরা যেখানে আছি, আমাদেরকে সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। আমরা এখন শরীরে আছি। আমাদের এই  শরীরে আছে বিভিন্ন চেতনা কেন্দ্র । আমরা এক কেন্দ্র থেকে অন্য কেন্দ্রে ঘুরে বেড়াতে পারি। এগুলো আমাদের সাধারণের উপল্বদ্ধিতে আসে না। আধ্যাত্মিক জগতে যাদের বিচরণ, তারা এগুলোকে উপলব্ধি করেন।  এই রকম সাতটি চক্র আছে। এগুলোকে গ্রন্থিচক্র বা চেতন কেন্দ্র বলা যেতে পারে। প্রত্যেকটি কেন্দ্র একটা নির্দিষ্ট চেতনা স্তরে ব্যক্তিপুরুষ  ও বিরাটপুরুষ এর মিলন স্থল হতে পারে। 

আমরা জানি আমাদের মেরুদণ্ডের বাঁদিকে থাকে ইড়া, ডান দিকে থাকে পিঙ্গলা নাড়ি।  এর মাঝখানে আছে সুষুম্না। এই সুষুম্নার ভিতরে আছে বজ্রাখ্য নাড়ি। বজ্রাখ্যা নাড়ীর মধ্যে আছে চিত্রিণী নাড়ী।  এই সুষুম্না নাড়ি হচ্ছে আমাদের আধ্যাত্মিক সাধনার স্থল। বাকি দুটো নাড়ি, অর্থাৎ ইড়া - পিঙ্গলা,  মানুষের দৈহিক ও মানসিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত। সাধারণ মানুষের বিভিন্ন চক্রে বা সংযোগস্থলে যে শক্তির উৎপন্ন হয়, তা ওই ইড়া ও পিঙ্গলা দিয়ে প্রবাহিত হয়। সুষুম্না বা বজ্রাখ্য বা চিত্রিণী  দিয়ে নয়। উন্নত সাধকরা এই রস বা শক্তি যা আমাদের বিভিন্ন চক্রে সঞ্চিত হয় তা ওই সুষুম্না নাড়িতে পপ্রবাহিত করাতে পারেন। অতি-উন্নত সাধকরা বজ্রাখ্য নাড়ি দিয়ে এই অসীম শক্তি প্রবাহিত করান। আবার উন্নতির শেষ পর্যায়ে এই চিত্রিণী নাড়ী পরমাশক্তির  গতাগতের রাস্তা হতে পারে। 

মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, ও মনিপুর চক্র  এই তিনটি কেন্দ্র, আমাদের ভোজন, পান, ইন্দ্রিয় সম্ভোগ ও যৌনসম্ভোগের মতো পাশবিক প্রবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত। একজন মানুষের যখন আধ্যাত্মিক জাগরণ হয়, তখন তার হৃদয়ের বিপরীতে যে কেন্দ্র অর্থাৎ অনাহত চক্রে সে তার আত্মার সন্ধান পায়।

আমাদের সুক্ষ শরীর ও স্থুল শরীর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই সূক্ষ্ম শরীরের উপরে যদি আমরা ধ্যান করি, তবে আমাদের মানসিক চরিত্র ও বৈশিষ্ঠ এবং তার ভাবাবেগ সম্পর্কে জ্ঞাত হতে পারবো। এবং এগুলোকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। আমাদের স্থূল শরীরের যে সব আবৃত বা ঢাকা অংশ আছে,তাদের ক্রিয়া পদ্ধতি আমরা দেখতে পাই না। তেমনি আমাদের মনের যে বিভিন্ন স্তর  আছে, অর্থাৎ চেতন, অবচেতন, অতিচেতন  ইত্যাদি যে স্তর আছে সেগুলো আমাদের অজ্ঞাত। আমাদের কামনা বাসনা, ইত্যাদি আমাদের অবচেতন স্তরে অবস্থান করে। আমাদেরকে সেগুলোকে খুঁজে বার করতে হবে, এবং সমূলে উৎপাটন করতে হবে, যদি আমরা আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করতে চাই। অতিচেতন স্তরে আমাদের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ হয়, আনন্দ লাভ হয়। অতয়েব আমাদের অতিচেতন, বা সুসুপ্তির স্তরে  যেতে হবে।  আর এসব জানতে গেলে আমাদের এই চক্রে অবস্থান করতে হবে।

চৈতন্য, ও মন,  শরীরের  এইসব গ্রন্থিচক্রে অবস্থান করছে। এই সব চক্রের মাধ্যমে আমাদের তিনটি শরীরের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে, এবং পরস্পরকে প্রভাবিত করছে। আমাদের সাধারণত নিচের তিনটি চক্র অর্থাৎ মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান,ও মনিপুর চক্র ক্রিয়াশীল। উপরের চারটি চক্র অর্থাৎ অনাহত, বিশুদ্ধি, আজ্ঞা ও সহস্রার সুপ্ত থাকে। যৌগিক ক্রিয়ার সাহায্যে এগুলোকে জাগরিত করা সম্ভব। আর তখনই প্রত্যেক কেন্দ্রের যে বিশেষ চেতনা তা প্রকাশ পেতে থাকবে। 

আমরা জানি চিন্তা ও আবেগ আমাদের শরীরকে প্রভাবিত করে। শরীর ও মনের সংযোগের মাধ্যমেই আমাদের মধ্যে পরিবর্তন এসে থাকে। নিম্নমানের চিন্তা যেমন আমাদের পাশবিক প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলে, তেমনি উচ্চচিন্তা আমাদের উচ্চকেন্দ্রগুলোকে প্রভাবিত করে। নিম্নতর চক্রে যারা যুক্ত থাকে তারা তমোগুণের অধিকারী, উচ্চতর কেন্দ্রে যারা অবস্থান করে, তার সত্ত্ব গুনের অধিকারী।  আবার যখন মিশ্র অবস্থা থাকে অর্থাৎ উচ্চ-নিম্ন স্তরের মধ্যে যখন সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলে বা লড়াই চলতে থাকে তখন সে অবস্থাকে বলে রজগুন সম্পন্ন মানুষ। এই অবস্থায় মন্দ ভাবের পরিবর্তন হয় না। 

সুষুম্নাকে জাগ্রত করবার উপায় কি ?  আমরা যখন সাত্ত্বিক ভাবে, জীবনযাপন শুরু করি, তখন আমাদের সুষুম্না সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর জন্য দরকার প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি ও সংযম। আমাদের শক্তির অপচয় বন্ধ করতে হবে। বীর্যশক্তি ক্ষয় করা চলবে না। বাকশক্তি অপচয় বন্ধ করতে হবে, শ্রবণ শক্তির অপচয় বন্ধ করতে হবে , ঘ্রান শক্তি, স্পর্শশক্তি  ইত্যাদির অপব্যবহার চলবে না। এমনকি এই সব শক্তির ব্যবহারের সীমা  টানতে হবে। প্রথমে এই সব জায়গা সম্পর্কে একটা কাল্পনিক অবস্থান বুঝে নিতে হবে। তার পরে , ভক্তি ভাব নিয়ে মনকে সেই স্থানে বা চেতন কেন্দ্রে বা গ্রন্থিচক্রে একাগ্র করতে হবে।  এই ভাবে একাগ্র হলে, আমাদের আধ্যাত্মিক চেতনা জাগ্রত হবে, এবং আমাদের কল্পনার পিছনে যে সত্য নিহিত আছে, তা আমাদের উপল্বদ্ধিতে আসবে। এবং আমরা তখন বুঝতে পারবো। যা ছিল এতদিন আমাদের কাছে শোনা কথা, বইপড়া কথা, তা আমাদের কাছে প্রকৃত সত্যতে পরিণত হবে। 

আপনি খেয়াল করে দেখবেন, আপনি যদি কোনো পুরুষ, মহিলা এমনকি কোনো জীব জন্তুর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন, অর্থাৎ মনোনিবেশ করেন, তবে তার মধ্যে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হবে। ঠিক তেমনি আপনি যদি আপনার চেতন কেন্দ্রে অর্থাৎ নির্দিষ্ট গ্রন্থিচক্রে মনোনিবেশ করেন, তবে সেখানেও  একটা আলোড়ন সৃষ্টি হবে। 

কিন্তু এই উপলব্ধি হবে সাময়িক। যতদিন আমাদের বাসনার বীজ, আমাদের পুরোনো সংস্কার অন্তরে লিন না হবে, ততদিন এই আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞাতার ধারা নিরবিচ্ছিন্ন হতে পারবে না। প্রথম প্রথম এক ঝলক অনুভূতি দিয়ে মিলিয়ে যাবে। নিরন্তর অভ্যাসের মাধ্যমে, আমাদের এই অনুভব প্রবল হবে এবং আমাদের বাসনার বীজ শুকিয়ে যাবে। আমাদের সংস্কার ধ্বংস  হয়ে যাবে।  আমরা যতদিন নিম্নস্তরের চেতনকেন্দ্রে ঘোরাফেরা করবো, ততদিন আমাদের সত্যিকারের আধাত্মিক উন্মেষ ঘটবে না। 

আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের উদ্দেশ্য হলো, জগৎ প্রপঞ্চের পেছেনে যে সত্য লুকিয়ে আছে তাকে অনুসন্ধান করা বা উন্মোচন করা। সত্যকে জানার শক্তি আমাদের সবার মধ্যে সুপ্ত থাকে। এই শক্তিকে  জাগিয়ে তুলতে অভ্যাসের দরকার। প্রতিটি চক্রে আমাদের উপলব্ধি ভিন্ন ভিন্ন হবে। যখন আমরা ঘুমন্ত শক্তিকে ভ্রূযুগলমধ্যে নিয়ে যাবো, সেই সময় থেকে মনে হবে, আমরা সবাই পরম-আত্মার অংশ। জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ। এইখানেই সাধনার একটা জংশন। বেশিরভাগ মানুষ এখান থেকে আর উপরে উঠতে পারে না। 

কুণ্ডলিনী জাগ্রত করবার আর একটা উপায় আছে।  আর সেটা হচ্ছে জপ্-ধ্যান।  বেশিরভাগের জন্য জপ্-ই উপযুক্ত। এতে একটু দেরি হলেও এই পথে মসৃন যাত্রা করা সম্ভব হয়। 

এখন কথা হচ্ছে, এই ঘুমন্ত শক্তি বা কুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে কি হয় ? এই অভিজ্ঞতার কথা আমরা শুনবো ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের কাছ থেকে। তিনি বলছেন, 

" (বহু) সাধ্য-সাধনার পর কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রতা হন।  ইড়া, পিঙ্গলা আর সুষুম্না নাড়ী - সুষুম্নার মধ্যে ছটি পদ্ম আছে।  সর্ব্ব নিচে মূলাধার। তারপর, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা।  এইগুলোকে ষঠ্চক্র বলে। 

"কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রতা হলে, মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর - এইসব পদ্ম ক্রমে পার হয়ে হৃদয়মধ্যে অনাহত পদ্ম - এইখানে এসে অবস্থান করে। তখন লিঙ্গ, গুহ্য, নাভি থেকে মন সরে গিয়ে চৈতন্য হয় আর জ্যোতিঃদর্শন হয়। সাধক অবাক হয়ে জ্যোতিঃ দেখে আর বলে, 'একি ! একি ! ষঠচক্র ভেদ হলে কুণ্ডলিনী সহস্রার পদ্মে গিয়ে মিলিত হন। কুণ্ডলিনী সেখানে গেলে সমাধি হয়। 

"বেদমতে এসব চক্রকে "ভূমি" বলে। সপ্তভূমি।  হৃদয় চতুর্থভূমি।  অনাহত পদ্ম, দ্বাদশ দল ।

"বিশুদ্ধচক্র পঞ্চম ভূমি।  এখানে মন উঠলে কেবল ঈশ্বর কথা শুনতে আর বলতে প্রাণ ব্যাকুল হয়।  এ চক্রের স্থান কন্ঠ।  ষোড়শ দল পদ্ম।  যার এই চক্রে মন এসেছে, তার সামনে বিষয় কথা - কামিনী কাঞ্চনের কথা হলে ভারী কষ্ট হয়। ওরূপ কথা শুনলে সে সেখান থেকে উঠে যায়। 

"তারপর ষষ্ঠভূমি।  আজ্ঞাচক্র - দ্বিদল পদ্ম এখানে কুলকুণ্ডলিনী এলে ঈশ্বরের রূপ দর্শন হয়। কিন্তু একটু আড়াল থাকে - যেমন লণ্ঠনের  ভিতর আলো , মনেহয় আলো  ছুঁলাম । কিন্তু কাঁচ ব্যবধান আছে বলে ছোঁয়া যায় না। 

"তারপর সপ্তমভূমি। সহস্রার পদ্ম। সেখানে কুলকুণ্ডলিনী গেলে সমাধি হয়। সহস্রারে সচ্চিদানন্দ শিব আছেন। তিনি শক্তির সঙ্গে মিলিত হন। শিব-শক্তির মিলন। 

"সহস্রারে মন এসে সমাধিস্থ হয়। আর বাহ্য থাকে না। সে আর দেহ রক্ষা করতে পারে না। মুখে দুধ দিলে দুধ গড়িয়ে যায়। এ অবস্থায় থাকলে একুশ দিনে মৃত্যু হয়। কালাপানিতে গেলে জাহাজ আর ফেরে না। 

"ঈশ্বরকোটি - অবতারাদি এই সমাধি থেকে নামতে পারেন। তারা ভক্তি-ভক্ত নিয়ে থাকেন, তাই নামতে পারেন। তিনি তাদের ভিতর 'বিদ্যার আমি' 'ভক্তের আমি' - লোকশিক্ষার জন্য রেখে দেন। তাদের অবস্থা যেন ষষ্ঠভূমি আর সপ্তমভূমির মাঝখানে বাচ্খেলা। "  অর্থাৎ নৌকাদৌড় খেলা। 

এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে, আর তা হলো আপনাকে শুধু অনুসন্ধিৎসু হলে হবে না। সাধক হতে গেলে আপনাকে দেহ-মনে পবিত্র হতে হবে। তবেই আপনি আধ্যাত্মিক অনুশীলনের যোগ্য। নতুবা কেবলমাত্র জিজ্ঞাসু হয়ে বইপড়া জ্ঞান নিয়ে এই ধরনের আধাত্মিক অনুশীলন শুধু অনুচিত নয়, মারাত্মক ভাবে ক্ষতিকারক। 

আমার এক বন্ধু আছে গুরুপ্রসাদ সাহা। এখন বেহালায় থাকে।  ও একসময় ভারত সেবা আশ্রমে থেকে পড়াশুনা করতো।  তো সেখানে অনেক প্রসন্নবদন সাধুদের দেখে, ওর সাধু হবার ইচ্ছে জেগেছিলো। চাকরিবাকরি পাচ্ছে না, তো সাধু হয়ে গেলে চাকরির প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। তো একদিন সে এক স্বামীজিকে বলে বসলো, আমি সন্ন্যাস নেবো, আমাকে সন্ন্যাস দিন। তো সেদিন স্বামীজি গুরুপ্রসাদকে এক মারাত্মক সত্য বলেছিলো। আর তা হলো : দেখ বটগাছের ছায়ার থাকা ভালো। বটগাছে ওঠার চেষ্টা করিস না। গাছের কোটরে বিষাক্ত জীব-জন্তুর বাস।  তাদের সঙ্গে বাস করা তোর  পক্ষে সম্ভব না। 

যারা দেহমনে পবিত্র নয় - তারা যদি এই ধরনের অনুশীলনে তৎপর হয়, তাহলে সে তার নিজের শক্তির অপচয় করবে।  শুধু তাই নয়, অত্যধিক শক্তি স্বল্প জায়গায় একত্রিত হওয়ায় সে তার শরীর মনের মারাত্মক ক্ষতি করবে। একদিকে যেমন জাগতিক দিকে এই শক্তি প্রবাহিত হয়ে ভোগের জীবনকে প্রবল করে তুলতে পারে।  শরীর এই শক্তি ধারণের জন্য প্রস্তুত না থাকায়, শরীর  ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে । 

ঠিক এমনই হয়েছিল আমার এক বন্ধুর ক্ষেত্রে। সে থাকতো পুরুলিয়ায়।  অধ্যাত্ম সাধনায় প্রলুব্ধ হয়ে, সে অফিস থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে, বাড়িতেই কুণ্ডলিনী জাগ্রত করবার চেষ্টা করেছিল নিজে নিজে । প্রথমে শারীরিক ভাবে মাথাঘোরা শুরু হলো। পরে, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে সে । শেষের দিকে সে রাস্তায় রাস্তায় পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতো। বাড়ি ফেরার রাস্তা হারিয়ে পথেই শুয়ে থাকতো। এবং শেষমেশ এক বছরের মাথায় শরীর ত্যাগ করে। 

ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, এ কেমন জান - এক চাষী জমিতে চাষ করবার জল আনতে  চাইছিলো।
চেষ্টা করে দেখলো, চারিদিকে ইঁদুরের গর্ত।  আর সেখান দিয়ে সব জল বেরিয়ে যাচ্ছে।  আমরা যারা সাংসারিক জীব, তাদের সাংসারিক বাসনাগুলো হচ্ছে এই ইঁদুরের গর্ত। আমাদের সমস্ত শক্তি এই বাসনা পূরণের জন্য ধাবিত হয়। আর আমাদের হাতে যদি অতিরিক্ত পয়সা বা ক্ষমতা  এসে যায়, তবে আমাদের স্বভাব খারাপ হয়ে যায়, আমরা বিভিন্ন অনাবশ্যক পণ্য বা পানীয়ের প্রতি আসক্ত হতে থাকি। তাই নিজেকে প্রশ্নাতীত পবিত্র করুন, তার পরে উপযুক্ত গুরু অর্থাৎ সৎগুরুর আশ্রয় নিন, তবেই আপনি এ পথে পা বারবার যোগ্য।  নতুবা যেমন আছেন, তেমন থাকুন , শক্তির অপচয় করবেন না। অহেতুক কৌতূহলী হবেন না।   কৌতহল ভালো অতিরিক্ত কৌতহল ভালো না। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

অধ্যাত্ম জীবনের পথে  ( দুই )

২০১৫ সালের কথা। আমি তখন উত্তরাখণ্ডের নেখড়িতে থাকি। ওখানে চন্দ্রবদনি নামে একটা মন্দির আছে।একদম পাহাড়ের চূড়াতে এর অবস্থান, সমুদ্রতল থেকে ৮/১০ হাজার ফুট উঁচুতে, পাহাড়ের গাঁবেয়ে জঙ্গল, শোনা যায় সেখানে নাকি বাঘ ঘুরে বেড়ায়।  যদিও আমি তাদের দর্শন পাইনি। তো সেখানে এক বাঙালি সাধুর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি তার পূর্বাশ্রমের কথা কিছু বলেন না। গেরুয়াধারী, জটাজুট সম্বল, এই সাধুর নাকি সোনার  ঠাকুর আছে। তো একদিন নির্জনে পেয়ে আমাকে বললেন আমি একজন সংসারত্যাগী মানুষ চাই, যে আমার সোনার গোপালকে রক্ষা করবে। আমি তাকে সেই মানুষের সন্ধান দিতে পারিনি।
সেখানে আর একজন সংসারত্যাগীর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল আমার ।  তার নাম স্বামী মুক্তানন্দ গিরী। ইনি পূর্বাশ্রমে দিল্লীতে একটা প্রাইভেট কলেজে প্রফেসর ছিলেন। এখন সারাক্ষন পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ান। ইনি পাইলট বাবার শিষ্য।একটা গ্রাম্য মন্দিরে পুজোপাঠ করেন, সেখানেই থাকেন। ।গ্রামবাসীরা যা দেন তাই খান, না পেলে উপোস থাকেন। আবার গ্রামের কিছু ছাত্র/ছাত্রীদের পড়ান।    তো তাকে আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি এই যে নির্জনে একা একা থাকেন, আপনার খারাপ লাগে না ? আর এখানেও আপনি দেখছি মাস্টারিও  করছেন, তাহলে পূর্বাশ্রম ছেড়ে দিয়ে কি লাভ ? জবাবে তিনি বলেছিলেন, সন্ন্যাসীর আবার ভালো-খারাপ। সংসারীরা ফল খায়। সন্ন্যাসী বীজের সন্ধান করে। সংসারীরা বর্তমানের চিন্তা করে, আমরা ভবিষ্যতের চিন্তা করি । সংসারীরা  কাঠের চিন্তা করে। আমরা জঙ্গলের চিন্তা করি। সংসারী নিজের চিন্তা করে, আমরা সবার চিন্তা করি। সংসারীর কাছে ভবিষ্যৎ অজানা।  আমরা ভবিষ্যতের গর্ভে প্রবেশ করি।     

আমরা সবাই পতঞ্জলির নাম শুনেছি। 

মহর্ষি পতঞ্জলির জীবন সম্পর্কে প্রামাণ্য কোনো পরিচয় বিশেষ জানা যায় না। ইনি কবে জন্মে ছিলেন বা কোথায় জন্মে ছিলেন, তা আমরা জানিনা।  কারুর মতে. পতঞ্জলি মুনি ছিলেন গোনর্দপুর বাসী প্রাচীন-যোগের পুত্র। মাতার নাম গণিকাদেবী। 

কেউ বলেন,  পতঞ্জলি ছিলেন অত্রিমুনি  ও অনুসূয়ার পুত্র। 

মহর্ষি পতঞ্জলি এক না একাধিক ব্যক্তি ছিলেন, সে নিয়েও পন্ডিতদের মধ্যে মতান্তর আছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে : 
ভারতের আধাত্মিক আকাশে দুটো নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে মহর্ষি কপিল, আর একটি হচ্ছে মহর্ষি পতঞ্জলি। একই আকাশে, কিন্তু একজনকে  দিনের বেলায় দেখা যায়, আর একজন রাতে। দিনের বেলায় যাকে  দেখা যায়, তিনি হচ্ছেন পতঞ্জলি, আর রাতের আকাশে থাকেন কপিল। রাতের আকাশে আর এক উজ্জ্বল মহাত্মাকে আমি দেখতে পাই, তিনি পশ্চিম আকাশের চার্বাক।   হাজার বছর না লক্ষ বছর  তা আমরা জানি না। কিন্তু আজও আধাত্মিক আকাশে তাকালে আমরা  এঁদেরই দেখতে পাই।চার্বাক আমাদের প্রশ্ন করতে শেখায়। জগতের রহস্যঃ উন্মোচন করতে শেখায়। আর  অধ্যাত্ম আকাশে  কপিলমুনির সাংখ্যদর্শন। এটি প্রাচীনতম। এই সাংখ্যদর্শনে আছে তত্ত্ব-আলোচনা। অর্থাৎ আমাদের কেন দুঃখ হয় ? আর পাতঞ্জল-দর্শন আমাদের শেখায় কিভাবে দুঃখ দূর করা যায়। এটাই জীবন শৈলী। চার্বাক আমাদের ঈশ্বর সন্মন্ধে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। সাংখ্যদর্শন আমাদের শেখায় কোথায় যেতে হবে, আর পাতঞ্জল-দর্শন আমাদের শেখায় কি ভাবে যেতে হবে। 

পাতঞ্জল-দর্শনে যে ক্রিয়া বা ক্রমোন্নতির ধাপ সম্পর্কে বলেছেন সেগুলো আমাদের সবার জানা।  যম -নিয়ম-সত্য-অস্তেয় -ব্রহ্মচর্য-শৌচ-সন্তোষ-স্বাধ্যায় আসন-প্রাণায়াম-প্রত্যাহার-ধ্যান-সমাধি ইত্যাদিগুলো হচ্ছে আধ্যাত্মিক জগতের সোপান অর্থাৎ সিঁড়ি। এই সিঁড়িগুলো পেরিয়ে গেলে তবে আমাদের  আধ্যাত্মিক আকাশে উত্তরণ হতে পারে। এই সিঁড়িগুলো না পেরিয়ে আমরা যারা সরাসরি ধ্যান সমাধিতে যেতে চাই , বা বড়জোর আসন -প্রাণায়াম থেকে শুরু করতে চাই, তাদের কিন্তু আধ্যাত্মিক জগতের ভীত বলতে যা বোঝায় তা গড়া হলো না। এক লাফে উপরে ওঠা যায় না, বা আপনাকে কেউ ছুড়ে উপরে তুলে দিতে পারবে না। তাতে হিতে বিপরীত হবে। তাই ধীরে কিন্তু দৃঢ়  ভাবে একটার পর একটা ইট গেথে ইমারত গড়তে  হবে। বাড়ি তৈরি করতে গেলে যেমন প্রথমেই ছাদ থেকে শুরু করা যায় না, বা জানলার উপরের থেকে শুরু করা যায় না  তেমনি, আমাদের আধ্যাত্মিক জীবন গড়তে  গেলে, প্রথম থেকেই শুরু করতে হবে।

তো আসুন আমরা প্রথম ধাপের কথা শুনি। আসলে এগুলো আমরা জানি,সবই কিন্তু মানি না। 

যম -নিয়ম-সত্য-অস্তেয়:  এগুলো হচ্ছে প্রথম ধাপ।  আমরা আজকে শুধু যম নিয়ে আলোচনা শুনবো।  যম কথাটা শুনলেই আমাদের মনে হয় আমাদের মৃত্যুর রাজা যমরাজ।  এনাকে ধর্মরাজও বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ যম  কথাটা দিয়ে আমরা  শ্বাশত নিয়মের আধিপতিকে বুঝতে পারি। যম কথাটার আর একটা মানে সংযত হওয়া, সংযমন। নিবৃত্ত করানো। শমন-জয়ী, অর্থাৎ শমনকে অর্থাৎ মৃত্যু বা সত্যকে  যে জয় করতে পারে।অন্য ভাবে বলা যায়, আমাদের সবার মধ্যে একটা প্রবৃত্তি আছে, যাকে  বলে শমন। অর্থাৎ অন্যকে বা নিজেকেই  মৃত্যুমুখে ফেলে দেওয়ার একটা প্রবৃত্তি। যাকে সোজা কথায় আমরা বলি হিংসা-প্রবৃত্তি। আমাদের এই প্রবৃত্তিকে নিবৃত্ত  করতে হবে। অর্থাৎ অন্যকে ক্ষতি করার যে প্রবৃত্তি আমাদের মধ্যে আছে, যা আখেরে  নিজেরই ক্ষতি করে,  তাকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে।

আমি ছোট বেলায় পায়রা পুষতাম।  তো পায়রারা আমার হাত থেকে খাবার খেত, আমার কাঁধে, মাথায় বসতো। মাথায় বসে ঘুরে ঘুরে কেশর উঁচু করে বকবকম করতো। অন্যকেউ আমার কাছে এলে অমনি  উড়ে যেত।  এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার।  ওদের আমার কাছ থেকে কোনো ভয় ছিল না, কিন্তু অন্যের কাছ থেকেভয়  থাকলেও থাকতে পারে, তাই উড়ে যেত।এখনো শালিক পাখী আমাদের ঘরের মধ্যে ঢুকে আসে খাবারের সন্ধানে। ঝগড়ুটে পাখী, কাক, ঝুটকুল পাখী এখনো আমার মাথার কাছের জানালায় সকালবেলায় ডাকাডাকি শুরু করে, খাবারের আশায়। আমার ঘুম ভাঙায়। 

হিংসাজয়ী মানুষের কাছে, কি জীবজন্তু, কি মানুষ সবাই নির্ভয়ে থাকে। সিদ্ধ সাধক বাবা লোকনাথ এই স্বভাবের একজন মানুষ ছিলেন। শুনেছি তার কাছে সাপ এসে নির্ভয়ে খাবার খেয়ে যেত। শুনেছি আচার্য্য শঙ্করের কাছে বাঘ হিংসা ত্যাগ করে, লুটিয়ে পড়তো। এইসব হিংসাজয়ী  মানুষের কাছে কি মানুষ কি পশু সবাই  নির্ভয়ে থাকতো। পশু হিংসা করে, খাদ্য ও নিরাপত্তার অভাবে। পর্যাপ্ত খাদ্য ও নিরাপত্তা পেলে সে হিংসা করে না। মানুষ যদি বাক্যে, চিন্তায়, ও কর্মে অন্যের অনিষ্ট করবার প্রবৃত্তিকে যদি  জয়  করতে পারে, তবে তার মধ্যে এক বিশেষ মানসিক ক্রিয়া সংগঠিত হয়। যার প্রভাব পরিবেশে পড়ে।

 যার কাছে যা আছে, সে তাই  আপনাকে  দেবে, কিন্তু আপনার  গ্রহণ করবার প্রক্রিয়া আপনাকে কি ভাবে আন্দোলিত করবে, সেটা আপনার ব্যাপার।  জলের মধ্যে জ্বলন্ত দেশলাইকাঠি ফেললে, নিভে যাবে।  সেই একই দেশলাইকাঠি পেট্রোলের মধ্যে পড়লে আধারসহ  জ্বলে পুড়ে যাবে। আপনার স্বভাবগত প্রতিক্রিয়া বাইরের জগতের কর্মকে প্রভাবিত করবে। শত্রূর  অমঙ্গল চিন্তা না করলে, তার জন্য শুভচিন্তা করলে, আপনার শত্রূ তখন মিত্রতে পরিণত হয়ে যাবে।সব সময় সবার মঙ্গল কামনা করুন।  আমাদের মনে যদি সদা সর্বদা মঙ্গল ভাবনা থাকে, তাহলে কোনো অনিষ্টকারী, আমাদের মনকে প্রভাবিত করতে পারবে না। আত্মরক্ষার এ একটা  উৎকৃষ্ট উপায়। 

এক সাধু তার শিষ্যদের নিয়ে একটা পাহাড়ী গ্রামে কিছু দিনের জন্য বাস করেছিল। তো সেখানে তার কাছে উপদেশ শুনবার জন্য, গ্রামের সাধারণ মানুষেরা আসতো। সেই কারণে গ্রামের মন্দিরে, সন্ধ্যে বেলায় জমায়েত কমতে থাকে। মন্দিরের পুরোহিত, এই পরিস্থিতিতে প্রমাদ গুনল। প্রথমে সাধুকে ভালোভাবে চলে যেতে বললো। সাধু ৭-দিনেও যাচ্ছে না দেখে, একদিন, লোকজন নিয়ে এসে যাচ্ছেতাই বলে গালাগাল করতে লাগলো। সাধু ছিল নাগা সম্প্রদায়েরভুক্ত।  তার শিষ্যদের মধ্যে এক অদ্ভুত উগ্রতা ছিল।  তারা সবাই এর প্রতিবাদ করতে চাইলো।  সাধু কিন্তু  হেসে সবাইকে শান্ত কিন্তু সাবধান থাকার উপদেশ দিলো। শিষ্যরা জিজ্ঞেস করলো, আপনাকে ওরা  এত গালাগাল করলো, আর আপনি হাসছেন ? তো সাধু বললো, আমাকে এখানে অনেক কিছু দিতে হবে, ওর যা আছে তা সে আমাকে দিয়ে গেছে। কেউ কিছু দিলে যদি তুমি তা না গ্রহণ করো , তবে সেটা কার থাকে ? তো শিষ্যরা বললো, যে দিতে এসেছিলো তার। তবে ? ও যা দিতে এসেছিলো তা আমি নেই নি, প্রথমে উপদেশ দিতে এসেছিলো - আমি তা গ্রহণ করিনি। এখন গালাগাল দিতে এসেছিলো, আমি তাও  নেই নি। এখন, ওকে আমি দেব।  সেই সাধু ওখানে এক বছর ছিল।ওই পুরোহিত ব্রাহ্মণ চেলা বোনে গেছে।   যেখানে সাধু ছিল, সেখানে এখন একটা মন্দির নির্মাণ হয়েছে। এখন সেখানে ধর্ম-আলোচনা হয়।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ - হরি ওম।
অধ্যাত্ম জীবনের পথে (তিন) আধ্যাত্মিক জীবনে প্রবেশের প্রাথমিক শর্ত নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা যম নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম। যম - এর পাঁচটি ভাগ : 

১. চিন্তায়, কথায়, কাজে কারুর অনিষ্ট না করা ; অহিংসা নিয়ে আমরা আগের দিন আলোচনা করেছি। 
২. চিন্তায়, কথায়,কাজে লালসা বর্জন ; আমাদেরকে লোভ লালসা বর্জন করতে হবে। লোভ লালসা মানুষকে কুকর্মে অনুপ্রাণিত করে। কোনো কিছু পাবার লোভ, কোনো কিছু খাবার লোভ, কোনো কিছু দেখার লোভ আমাদের মধ্যে অতৃপ্তির ভাব এনে দেয়।  আর এই অতৃপ্তি মানুষকে অনুপ্রেরণা যোগায় অসৎ কর্মে লিপ্ত হবার জন্য।  তাই আমাদেরকে সদা সতর্ক থাকতে হবে। 
৩. চিন্তায়, কথায়, কাজে, পূর্ন সত্যতা রক্ষা করা ; সততা বা সত্যতা মানুষের জীবনে, তা সে ব্যক্তি জীবনে বলুন, আর সামাজিক জীবনে বলুন, মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। সদা সত্য কথন , সত্য চিন্তন, আমাদের ভয় দূর করে। সাহসী করে তোলে।  
৪. অস্তেয় - অর্থাৎ চুরি না করা। অন্যের জিনিষ না বলে নেওয়াকেই চুরি বলে। চুরি মানুষকে তার ভিতরের অস্তিত্ত্বকে সংকুচিত করে রাখে।  ভয় দানা বাধে মনে। 
৫. দান গ্রহণ না করা। দান গ্রহণ, মানুষকে দাতার প্রতি পক্ষপাত দোষে দুষ্ট করে তোলে। আপনি যার কাছ থেকেই দান বা অনুগ্রহ গ্রহণ করবেন, তার কাছে আপনি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবেন না। 

এই সমস্তই আধ্যাত্মিক জীবনের ভীত।  এগুলো না থাকলে, বা এই গুন্গুলো না থাকলে, মানুষ যতই দান ধ্যান করুক, আসন প্রাণায়াম করুক, তা সবই ভষ্মে ঘি ঢালা হবে। নৈতিকতার দিক থেকে আমাদের উন্নত হতে হবে। কঠোপনিষদ (১/৩/৩) একজায়গায় বলছে : 
আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু। 
বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্ৰগ্ৰহম এব।।  

এখানে দেহ, বুদ্ধি, মন, ও আত্মা বা জীবাত্মা - এই চারের মধ্যে সম্পর্ক বোঝাতে একটা চমৎকার উদাহরণ দিয়েছেন। বলছেন শরীর হচ্ছে রথ, বুদ্ধি হচ্ছে সারথি, মন হচ্ছে বলগা বা লাগাম, আর আত্মা বা জীবাত্মা হচ্ছেন রথী। এই আত্মা হচ্ছেন আমাদের ইচ্ছাশক্তি। ইনি নিজে কিছু করেন না। কিন্তু এই শক্তি যতক্ষন আমাদের দেহে আছে, ততক্ষন আমাদের দেহ, মন, বুদ্ধি কাজ করতে পারে। ইচ্ছাশক্তি চলে গেলে আমরা কর্ম্মহীন বা কর্ম্মে অক্ষম হয়ে পড়ি। আমরা এই দেহগাড়ী চালিয়ে যেকোনো স্থানে যেতে পারি।  তা সে দেবস্থান বা মন্দির হতে পারে, আবার মৃত্যু স্থান বা শ্বশান হতে পারে। একমাত্র মনুষ্যদেহই হচ্ছে মুক্তির দ্বার। আমরা আমাদের  দেহকে মুক্তি লাভের  উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারি, আবার জাগতিক ভোগের কাজে অর্থাৎ সংসার জ্বালে বদ্ধ  করতে পারি। এই দেহ-গাড়ীর চালক হচ্ছে আমাদের বুদ্ধি। বুদ্ধি যদি সজাগ  থাকে, তবে আমরা আমাদের গন্তব্ব্যে পৌঁছতে কোনো সংকট হবে না। 

এইজন্য, পতঞ্জলি আমাদের যমের কথা বলেছেন, অর্থাৎ আমাদের বুদ্ধিকে সজাক , নির্ভয়, শুদ্ধ করতে বলছেন। 

আমাদের ইন্দ্রিয় তিন প্রকার। কর্মেন্দ্রিয়, (বাক,পাণি, পাদ, উপস্থ, ও পায়ু)  জ্ঞানেন্দ্রিয়, (চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিব্বা, ত্বক) ও অন্তরিন্দ্রিয় (মন, বুদ্ধি , চিত্ত, অহংকার)। মনে আমাদের দ্বিধা আছে, সংকল্প-বিকল্প আছে। বুদ্ধি আমাদের ভালো মন্দ বিচার করে দেয়। অর্থাৎ কোনটা ঠিক সেটা বলে দেয়। চিত্তে আমাদের অতীত সংস্কার সঞ্চিত থাকে, অহং আমাদের কর্মে প্রেরণা যোগায় ) আর এই অহংকে আমাদের ইচ্ছাশক্তি বা জীবাত্মা শক্তি যোগায়। আবার এরা  সবাই জীবাত্মার অধীন। 

কিন্তু আমরা যদি আমাদের ভিতরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি, তবে আমরা দেখতে পাবো, আমাদের জীব-আত্মা স্বরূপ রথস্বামী মাতাল হয়ে আছেন। বুদ্ধিরূপ সারথি অচৈতন্য। মনরূপ লাগাম ঢিলে হয়ে গেছে, ইন্দ্রিয়রূপ অশ্বগুলো লাগামবিহীন হয়ে উন্মত্ত্বের মত ছুটে চলেছে। এক্ষেত্রে যেটা ভবিতব্য তা হচ্ছে রথ, রথী, সারথি, এমনকি অশ্বেরও বিপদ আসন্ন। 
এইখানে মহর্ষি পতঞ্জলি বলছেন, অজ্ঞানই জীবাত্মাকে প্রকৃত স্বরূপকে ভুলিয়ে দেয়। জীবাত্মা তখন মিথ্যা স্বপ্নজ্বাল বুনতে থাকে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অতীতের স্মৃতিচারণ করে, আর ভবিষ্যতের অলীক কল্পনা করে সময় কাটায়। এটাই আমাদের অজ্ঞানের কাজ, অজ্ঞান থেকে আসে আমাদের অহঙ্কার,ভোগস্পৃহা, আসক্তি, ঘৃণা, হিংসা। সামান্য স্বার্থসিদ্ধির জন্য, আমাদের তখন অন্যের ক্ষতি করতে বাধে না। আমরা সত্য থেকে  ভ্রষ্ট হই, অপরের জিনিস চুরি করি।  আমরা কামার্ত হয়ে যাই, অন্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে যাই। 

পতঞ্জলি বলছেন, অধ্যাত্ম জীবন আরম্ভ করতে গেলে আমাদের এখান থেকে বেরোতে হবে, আমাদের জীবন ধারার পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের শোধরাতে হবে,  আমাদের নির্লোভী হতে হবে, সত্যবাদী হতে হবে, পবিত্র হতে হবে, স্বাধীন হতে হবে। আমাদের আলস্য কাটিয়ে শারীরিক ও মানসিক পরিচ্ছন্নতা অর্জন করতে হবে। আত্মকেন্দ্রিক হতে হবে। কে কি বললো, সেটা না শুনে আমাদের হৃদয়ের ডাক শুনতে হবে। গভীর অনুধাবন, অনুচিন্তন অভ্যাস করতে হবে। শুধু নিজের জন্য নয়, আমাদের সমস্ত কর্মফল সেই ঈশ্বরকে অর্পণ করতে হবে, যে ঈশ্বর সকালের নিয়ন্তা ও সকলের অন্তরে অধিষ্ঠিত। আসলে আমরা উপদেশ শুনতে চাই  না। আমরা আমাদের সংস্কার, আমাদের চিন্তা, আমাদের বিশ্বাস, আমাদের আবেগকে পোষন করে থাকি। আমরা ভিতরে ভিতরে জড়বুদ্ধিতে আচ্ছন্ন, তামসিক বৃত্ত্বের মধ্যে বাস করি। তাই আমরা শারীরিক ও মানসিক ব্যাধিগ্রস্থ হয়ে পড়ি।  আমরা কখনো নিজেকে অসহায় মনে করি।  কোনো সিদ্ধান্তে আসতে  পারি না। এইখান  থেকে বেরোতে হবে। মহর্ষি পতঞ্জলি বলেন, যখনি বাধা আসবে, আমাদের আত্মার বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। নিজের মধ্যে একটা উঁচু ভাব সৃষ্টি করবার চেষ্টা করতে হবে। নিজের প্রতি পূরণ বিশ্বাস রাখতে হবে। মন্দ চিন্তাকে ভালো চিন্তা দিয়ে রোধ করতে হবে, হিংসাকে, ঘৃনাকে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে  দিতে হবে। মনকে পবিত্র করতে হবে। অনন্তের চিন্তা করতে হবে। নিজের ভিতরে একটা দুর্দান্ত খিদে জাগিয়ে তুলতে হবে। তবেই আমরা আধ্যাত্মিক পথে চলবার, অগ্রসর হবার যোগ্য করে তুলতে পারবো। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি  ওম।         

নিয়ম , আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা ধ্যান সমাধি। এগুলো নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করবো। 

অধ্যাত্ম জীবনের পথে (চার ) :

আজ আমরাআধ্যাত্মিক পথে চলার  নিয়ম নিয়ে আলোচনা করবো। একদিন এক স্বামীজি তার সাপ্তাহিক আধ্যাত্মিক আলোচনা সভায়, জীবনের উদ্দেশ্য কি,  সেই আলোচনা করছিলেন, জীবনের উদ্দেশ্য আত্মউপলবদ্ধি। তিনি এই কথাটা শ্রোতাদের বোঝাচ্ছিলেন।  স্বামীজীর বাণী শোনানোর জন্য, সেখানে অনেকেই ছিল। একটা মেধাবী  ছেলে, যাদবপুরে পিএইচ ডি পড়ছে। খুব মনোযোগ দিয়ে স্বামীজীর কথাগুলো শুনছিলো। হঠাৎ বলে উঠলো, আমি আপনাদের মতো হতে চাই।  আমাকে আশ্রমে জায়গা দেবেন ? ছেলেটির জেদ স্বামীজিকে বাধ্য করলো কথা দিতে, যে সে সাতদিনের জন্য আশ্রমে থাকবার ব্যবস্থা করতে পারে। তো ছেলেটি মা-বাবাকে কিছু না জানিয়ে, আশ্রমে গিয়ে উঠলো। স্বামীজী তাকে একটা রুটিন করে দিয়েছিলো।  কিছু বই দিয়েছিলো, পড়তে।  আর বলেছিলো প্রতিদিন সকাল বিকেল সন্ধ্যা এক ঘন্টা করে চোখবুজে চিদাকাশ দেখতে। দুতিন দিন পরেই স্বামীজী সকালবেলায়  দেখলেন, ছেলেটি বারান্দায় ঘুরঘুর করছে। স্বামীজিকে দেখেই বলে উঠলো, স্বামীজী আমি বাড়ি যাবো। 
আধ্যাত্মিক জগতে যে যম ও নিয়মের শর্তগুলো পালন করতে পারে না, তার পক্ষে এই জগতের কিছুই আয়ত্ত্ব করা সম্ভব নয়। দূর থেকে এই জীবনকে লোভনীয় এবং আকর্ষণীয় মনে হলেও, আসলে এই জীবন কঠোর নিয়ম-শৃংঙ্খলায় আবদ্ধ। 
সমস্ত জীবের মধ্যে একমাত্র মানুষই ঈশ্বর সম্পর্কে জানতে সমর্থ ও আগ্রহী। সমর্থ আমরা সবাই কিন্তু আগ্রহ আমাদের সবার সমান নয়। তাই কেউ কেউ এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়। অন্যরা  মনে করে, শেষ জীবনেই ধর্মাচরণ করা উচিত। হিন্দুশাস্ত্রের আশ্রম ব্যবস্থাও  এই রকমই  শেখায়। পঞ্চাশ উর্দ্ধ বনং ব্রজেৎ। অর্থাৎ পঞ্চাশ পর্যন্ত কিছু না করলেও চলবে। কিন্তু সত্য হচ্ছে আধ্যাত্মিক জীবন এতো দেরিতে শুরু করলে, তাতে বিশেষ কিছু লাভ করতে পারা  যায় না। ব্যতিক্রম কিছু নিশ্চয়ই থাকতে পারে। আধ্যাত্মিক জীবন শুধু মানসিক ব্যাপার নয়, শারীরিক ব্যাপারও  বটে। সমর্থ শরীরেই এই কাজ সম্ভব। অল্প বয়সে এই বীজ বপন না করলে, ইহজীবনে এর ফল ভোগ করা যাবে না। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ছোকরারা শুদ্ধ আধার। কামিনী কাঞ্চন এদের স্পর্শ করেনি। আপনি যা কিছু নিয়ে ঘাটাঘাটি করবেন, তার ছাপ আপনার শরীর ও মনের উপরে পড়বে। আপনি যদি জেলে হন তবে আপনার গায়ে মাছের গন্ধ থাকতে পারে। তবে কি বয়স হয়ে গেলে আর আমাদের আধ্যাত্মিক সাধনা হবে না ? তা নয়, এই প্রসঙ্গে ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা 
বলি :  ঠাকুর একবার বিবেকানন্দকে গিরিশ ঘোষের সাথে মেলামেশার ব্যাপারে সতর্ক করে ছিলেন, বলেছিলেন - রসুনের বাটি  যত  ধোও না কেন, গন্ধ একটু থাকবেই। তো গিরিশ ঘোষ এটা জানতে পেরে ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, রসুনের গন্ধ কি যাবে না ? ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাতে বলেছিলেন,  জ্বলন্ত আগুনে পোড়ালে ঐ গন্ধ চলে যায়। তো  আমাদের মতো যাদের বয়স হয়ে গেছে, তাদের কামিনী কাঞ্চনের গন্ধ ঘোচাতে গেলে যেমন একটু সময় লাগে তেমনি আরো কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার  মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তবে অসম্ভব নয়। 

আমার এক বন্ধু ননীগোপাল সরকার, পঞ্চাশ বছর বয়সে নিজে নিজে গেরুয়া ধারণ করে স্বপাকে নিরামিষ ভক্ষণ করে সাধু হবার চেষ্টা করেছিল। আসলে তখন ও সংসারে বিতৃষ্ণ হয়ে গেছিলো। বৌ অসুস্থ, ছেলেরা কথা শোনে না। তো সাধু সেজে শান্তির খোঁজ করছিলো। এক সময় ওর মনে হলো, দীক্ষা নেওয়া দরকার। তো এক বাবাজির কাছে দীক্ষা নিতে গেলো। বাবাজি তাকে গেরুয়াধারী দেখে জিজ্ঞেস করলো, তোমাকে সন্যাস কে দিয়েছে ? তো ননীগোপাল বললো দীক্ষা নেই নি, সন্ন্যাসও হয়নি । তো বাবাজি তাকে গেরুয়া ছেড়ে সাদা কাপড়ের ব্যবস্থা করলো।  এবং বললো, এখন থেকে ১২ বছর যা বলি তাই  করতে হবে। ননিগোপালের  এখন বয়স প্রায় ৭০। আর কবে ভগবানের লাভ হবে ? 

তবে হ্যাঁ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, নিষ্কাম কর্মযোগের স্বল্পমাত্র অনুষ্ঠানও যদি কেউ করে,, তবে জন্ম মরনের ভয়াবহতা থেকে সে পরিত্রান পেতে পারে। এমনকি জন্মান্তরে সে ঈশ্বর সাধনার সুযোগ ও চেতনা সম্পন্ন হবে। তাই আমাদের ঈশ্বর চিন্তন এখনি শুরু করা উচিত। আর যতক্ষন মৃত্যু না আসে ততক্ষন আমাদের ঈশ্বর চিন্তায় আবিষ্ট থাকা উচিত। 

আমাদের ভগবানের জন্য আকুতি বাড়াতে হবে। কিন্তু কেন এই আকুতি বাড়াতে হবে ? আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশেরই বা  প্রয়োজনটা কি - এই কথাটা  না বুঝলে আমাদের এই আকুতি বাড়বে না।  আমরা যে জগতে বাস করি, সেখানে আমাদের প্রতিনিয়ত লড়াই করে বাঁচতে হয়। আমরা খাবারের জন্য লড়াই করি, বাসস্থানের জন্য লড়াই করি, নিরাপত্তার জন্য লড়াই করি, মানসন্মান বৃদ্ধির জন্য,বা রক্ষার জন্য লড়াই করি । অস্তিত্বের জন্য লড়াই করি। জীবনটাই যেন শুধু লড়াই করবার জন্য সৃষ্টি হয়েছে।  আর এই লড়াই থেকে আমাদের মনে একটা আশঙ্কা, একটা ভয়, একটা অসন্তোষ ভাব সর্বদা পোষণ করি। আর এই ভাব আমাদের মনে প্রতিনিয়ত একটা চাপ একটা দ্বন্দ সৃষ্টি করে চলেছে। আর এই চাপ-দ্বন্দ আমাদের মনের গভীরে এমনকি  শরীরের উপরেও  প্রভাব ফেলছে। আমরা মানসিক শারীরিক অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আর মানসিক ও শারীরিক ভাবে যখন অসুস্থ হয়ে পড়ি, তখন আমাদের জীবনের উপরে, আমাদের বিতৃষ্ণা জন্মে। যদিও আমাদের দৈনন্দিন জীবনশৈলী এর জন্য দায়ী। আমাদের মধ্যে শান্তির পরিবর্তে অশান্তির ভাগ বেশি হয়ে যায়। এতে আমাদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য, অর্থাৎ ভগবান যে জন্য আমাদের মানুষ হিসেবে তৈরি  করেছেন, সেখান থেকে আমরা বিচ্যুত হয়ে যাই। আর বার বার জন্ম-মৃত্যু হতে থাকে আমাদের।
একটা জিনিস মনে রাখবেন, ভগবান তার উদ্দেশ্য  পূরণ করবেনই। আজ না তো কাল। কামার লোহাকে বার বার পোড়াবে, পেটাবে  যতক্ষন না সে তার ইচ্ছেমতো জিনিস তৈরি করতে পারে। আবার ঠান্ডা করবে, যখন তার ইচ্ছেমতো জিনিস তৈরি হয়ে যাবে।
মনে রাখবেন, স্থুল শরীর ভিন্ন কর্ম করা যায় না। মনুষ্য শরীর-ই মোক্ষের দ্বার। তাই  সবাই মানুষ হয়ে জন্মাতে চায়। তা সে পশু পাখি বলুন, আর দেবতা কিন্নর বলুন।  সবাই মানুষ হয়ে জন্মাতে চায়। কিন্তু মানুষ হয়ে আমরা যে কর্ম করি, আর যে কর্ম আমাদের করা উচিত তার মধ্যে বিস্তর ফারাক। 
গরিব হয়ে জন্মানো আমাদের হাতে নয়, কিন্তু গরিব হয়ে থাকা বা না থাকা আমাদের হাতে। অজ্ঞানী হয়ে জন্মানো অপরাধ নয়।  অপরাধ হচ্ছে অজ্ঞানী হয়ে থাকা। ভগবান সমস্ত মানুষকে  দুটো হাত, দুটো পা দুটো চোখ, দুটো কান ইত্যাদি দিয়েছেন। ভগবান সমস্ত মানুষকে সমান সময় দিয়েছেন। সবার জন্যই  দিন রাত্রিতে ২৪ ঘন্টাই  থাকে। সূর্য্য সবাইকে উত্তাপ দেয়।  বাতাস সবাইকে  অক্সিজেন যোগায়। মাথার উপরে আকাশ সবারই আছে। তবু আমরা পৃথক।  মানুষে মানুষে ফারাক বিস্তর। কেন ? কেউ বলবেন, মানুষ পরিস্থিতির স্বীকার।পরিস্থিতি তার অনুকূল নয়, তাই সে গরিব, তাই সে অজ্ঞান । মানুষ মানুষকে শোষণ করছে। ধনী গরিবের ধন কেড়ে নিচ্ছে তাই সমাজে এত বৈষম্য ।   আমি বলি অজ্ঞানীরা, নিস্কর্মারা,  পরিস্থিতির  স্বীকার। আর জ্ঞানীরা, উদ্যোগীরা পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে নিয়ে নেন। তাই মানুষে মানুষে এত ফারাক। জঙ্গলের রাজত্ত্বে যোগ্যতার বিচার হয়। ভগবানের রাজত্বে ব্যাকুলতার  বিচার হয়। আমরা সেই সব নিয়ে আলোচনা করবো।  আপনারা শুনতে থাকুন। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম।       


অধ্যাত্ম জীবনের পথে (পাঁচ  ) :

আধ্যাত্মিক পথে চলতে গেলে প্রথমেই যেটা দরকার, নিজের স্বভাবকে ভালো করে চেনা। নিজের মনকে ভালো করে চেনা। আমাদের সবার মধ্যেই সত্ত্ব-রজ-তম তিনটি গুনই বর্তমান। এর মধ্যে যখন যার আধিপত্য থাকে, তখন আমরা সেই মত হয়ে যাই। একটি দুর্ধর্ষ ডাকাতের মনেও তার স্ত্রী পুত্রদের জন্য, স্নেহ ভালোবাসা থাকে। আবার নিতান্ত ভালো মানুষ বলে আমরা যাদের জানি, তাদের কঠোর ও নিষ্ঠূর আচরণ, এমনকি হঠাৎকরে অনৈতিক আচরণ আমাদেরকে অবাক করে দেয়। এইজন্য আমি কোন্ স্বভাবের মানুষ, আমার মনটা কেমন্ সেটা আমাদের বোঝার চেষ্টা করা উচিত।

তথাকথিত শিক্ষা বা ডিগ্রি আমাদের এই আধ্যাত্মিক  শিক্ষা দেয় না। অথচ এই তথাকথিত  শিক্ষার জন্যই  আমরা আমাদের জীবনের বহু মূল্যবান ২০/২৫বছর  সময় ব্যয় করি। আমি নিজেও তার ব্যতিক্রম নোই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েশন করেছি। সাংবাদিকতা নিয়ে এম.এ পাশ করেছি। আইনের ডিগ্রি লাভ করেছি। আর সত্যি কথা বলতে কি আমি যে চাকরি করেছি, তাতে যোগ-বিয়োগ গুন্ ভাগ ছাড়া বিশেষ কিছু ছিল না। যা শিখেছি, তা কাজে লাগাতে পারিনি, আর যা শিখিনি তাই করতে হয়েছে। রামকৃষ্ণদেব, বাবা লোকনাথ, স্বামী ত্রৈলঙ্গ স্বামী, এমনি আরো অনেক মহাপুরুষ  আছেন , যারা তথাকথিত শিক্ষায় শিক্ষিত নয়। কিন্তু এঁদের পায়ে মাথা  ঠুকেছে বহু উচ্চশিক্ষিত,  উচ্চপদাধিকারী ব্যক্তি। তাই বলে এটা ভাববেন না যে প্রথাগত শিক্ষার দরকার নেই।  তা নয়। প্রথাগত শিক্ষা আমাদের নিশ্চই দরকার। প্রথাগত শিক্ষা আমাদের বুদ্ধিকে শানিত করে।  কিন্তু যা শিখছি, তা যেন কাজে লাগাতে পারি। আমাদের সেই চেষ্টা করা উচিত।   

তো যা বলছিলাম। আমাদের এই দেহ-মন ঈশ্বরের মন্দির। আমাদের মন কি চাইছে সেটা বোঝার দরকার। আর আমার কিসে ভালো হবে সেটা  বোঝার দরকার। আর সেটা বুঝতে গেলে আমাদের বুদ্ধিকে শান দিতে হবে। আমাদের দেহ বন্ধন এতটাই বেশী যে, আমরা দেহের পরিতৃপ্তির জন্য সব কিছু করতে রাজি থাকি।  আধ্যাত্মিক জগতের মানুষের কাছে এগুলো  শিশুর খেলা মাত্র । বাড়ি নিয়ে খেলছে, গাড়ি নিয়ে খেলছে, খাবার নিয়ে খেলছে, খেলতে খেলতে একটা সময় বিরক্তি আসে সবার জীবনে, তখন এই শরীরটা ক্লান্ত হয়ে যায়। মন শান্ত হয়ে যায়।  তখন সে ঘুমিয়ে পড়ে। আর এই সময় আমাদের কাছে ঈশ্বর আসেন। কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই আগে থেকে আমাদের সতর্ক হতে হবে। 

শরীরের বিভিন্ন অংশ যখন ঠিক ঠিক মতো কাজ না করে, তখন শারীরিক ভাবে আমরা  অসুস্থ বোধ করি। আর এই অবস্থায় আমরা আমাদের কর্তব্য ঠিক ঠিক মতো সম্পাদন করতে পারি না। ঠিক তেমনি মনের বিভিন্ন অংশ বা স্তরের মধ্যে যখন সামঞ্জস্যের অভাব থাকে তখন আমাদের মন ঠিক ঠিক মতো কাজ করতে পারে না। আধ্যাত্মিক পথে পা বারবার জন্য সঠিক সংকল্প ভীষণ প্রয়োজন। অর্থাৎ আমি ঈশ্বর অনুভূতি চাই।  বা আমি ঈশ্বর জ্ঞান চাই। এই সংকল্প দৃঢ় হওয়া চাই। আর এই সংকল্প করবে মন।  তাই মনকে আমার নাগালে আনতে  হবে। মনকে নাগালে আনতে গেলে আমাদের মনকে জানতে বা বুঝতে হবে। 

আমরা সবাই জানি মনের তিনটি স্তর : চেতন-অবচেতন-অতিচেতন। জাগ্রত অবস্থায় আমরা যা কিছু চিন্তা করি, তা এই চেতন মনের কাজ। এই চেতন মনের নিচের স্তরে আর একটা মন আছে যাকে বলে অবচেতন মনের স্তর। ঘুমের মধ্যে আমাদের অবচেতন মনের স্তরের কাজ চলে। অবচেতন স্তরের  কাজ আমাদের অজ্ঞতসারে সংগঠিত হয়। এটি সাধারণত তাৎক্ষণিক  কোনো নির্দেশের অপেক্ষা করে না। যেমন শ্বাস-প্রশ্বাস, হজম করা, চোখের পাতা ফেলা ইত্যাদি। এই তিনটি স্তরের মধ্যে আমাদের সমন্বয় আনতে  হবে। চেতন মনে আমাদের যে চিন্তা ভাবনা উদয় হয় তার একটা অংশ এই অবচেতন মনের স্তরে সংরক্ষিত হয়। এগুলো যখন সক্রিয় হয় তখন তাকে আমরা বলি অভ্যাস।মনের পরবর্তী স্তর হচ্ছে অতিচেতন। এটি আমাদের সুসুপ্তির সময় দেখা দিতে পারে। এটি আসলে মনের স্থির অবস্থা। বা অক্রিয় অবস্থা। যদিও আমাদের গন্তব্য তুরীয় অবস্থা, কিন্তু আমাদের এই মনের  তিনটি অবস্থা পার করে আমরা সেখানে যেতে পারবো। 

চেতন ও অবচেতন মনের একটা দন্দ্ব আমাদের সব সময় চলতে থাকে। এরা  যেহেতু কাছাকাছি থাকে তাই ঠুনোঠুনি লেগেই থাকে। শীতের সকালে এক মন বলছে ঘুমো, আর এক মন বলছে উঠে পড়ো। এইখানে বুদ্ধি যাদের তীক্ষ্ন - বিবেক যাদের সচ্ছ, তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। দীর্ঘদিন যেটা অভ্যাস করা হয়েছে, সেইমত সিদ্ধান্ত  নেয়, বা কাজ করে  অবচেতন মন।

অর্জুন একবার শ্রীকৃষ্ণকে বলেছিলেন, মন বড় চঞ্চল তাকে স্থির করা অসম্ভব। শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন অভ্যাস ও বৈরাগ্য দ্বারা আমরা আমাদের মনকে শান্ত করতে পারি। আমি অনেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে দেখেছি,মনকে শান্ত করবার জন্য  আহারে শুদ্ধির কথা বলেছেন। এই আহারের শুদ্ধি বলতে তারা বোঝেন নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ। মাঝে মধ্যে উপোষ। কিন্তু এর দ্বারা আমরা কতটা উপকার পেতে পারি ? খাদ্যের একটা প্রভাব অবশ্যই  শরীরের উপরে পড়বে, এটা সত্য কিন্তু তাই বলে  বিষধর সাপকে দুধ-কলা
খাওয়ালেও তার বিষ যাবে না। কেউ মনকে শান্ত করবার জন্য পাহাড়ে চলে যায়। পরিবেশের একটা প্রভাব সাধারণ মানুষের উপরে পড়ে, এটা সত্য। কিন্তু পাহাড়ের সবার মনকি শান্ত ? তাতো নয়। তাহলে আমরা মনকে কি করে শান্ত করবো। আসলে প্রথম দিকে আমাদের মনকে শান্ত করবার দরকার নেই।  আমাদের যেটা দরকার সেটা হচ্ছে মনকে নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ মন যাতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সেই জায়গায় মনকে তুলে ধরা।

এইখানে যম নিয়মের পালনের কথা আসে। নিয়ম বলতে আমরা ৫টি চারিত্রিক শুচিতার কথা বুঝি। এগুলো হচ্ছে - শৌচ, সন্তোষ,তপঃ, স্বাধ্যায়  এবং শ্রোতব্যঃ। 

শৌচ অর্থাৎ দেহ ও মনের পবিত্রতা রক্ষা করা। সন্তোষ অর্থাৎ নিজের মধ্যে একটা তৃপ্তির ভাব রাখা। অর্থাৎ খুঁতখুঁতি ত্যাগ করা। তপঃ অর্থাৎ জীবনে কিছু কঠোর নিয়ম অভ্যাস করা প্রয়োজন। স্বাধ্যায় অর্থাৎ অধ্যয়ন  করা। অধ্যয়ন মানে কিন্তু শুধু গড়গড় করে বই পড়া  নয়, যা আমরা পড়ছি তা নিয়ে অনুধ্যান করা। শ্রোতব্যঃ অর্থাৎ শোনার অভ্যাস করা। আমরা অনেক সময় শুনতে চাই না, খালি বলতে চাই। এই অভ্যাসের সংশোধন আমাদের দরকার। 

আধ্যাত্মিক পথে যাবার এগুলো হলো উপায়। নৈতিক পথে যখন আমরা কিছুটা প্রতিষ্ঠিত হবো, এর পরে আমাদের দরকার হবে ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পন আমাদের এই দেহ মন আত্মাতে সমর্পন করতে হবে। 
ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম

অধ্যাত্ম জীবনের পথে (ছয়) :

ঋষি পতঞ্জলির কাছ থেকে যে সাধন পথের  সন্ধান পাওয়া গেছে, তার মধ্যে যম ও নিয়ম নিয়ে আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করেছি। যম ও নিয়মের পরে তিনি বলছেন আসন। যম  নিয়ম আসলে আমাদের মনের ব্যায়াম। আসন হচ্ছে শরীরের ব্যায়াম। এই শরীরের মাধ্যমেই আমাদের ঈশ্বরকে খুঁজতে হবে। তাই শরীরকে সুস্থ-সবল রাখতে হবে। আর তা করতে গেলে আমাদের যেমন খাদ্যের প্রতি নজর দিতে হবে তেমনি, সমস্ত অঙ্গের জন্য কিছু খালি হাতে ব্যায়াম  করতে হবে। যদিও খালি হাতে ব্যায়াম আর আসন এক কথা নয়। আসন হচ্ছে নির্দিষ্ট ভঙ্গিমায় নিজেকে স্থির রাখার অভ্যাস। যম নিয়ম যার অভ্যাস হয় নি তার আসন অভ্যাস করা বৃথা। 

আপনারা ঋষি জনকের নাম নিশ্চই শুনেছেন। যিনি ব্যাসদেবের পুত্র শুকদেবের গুরু ছিলেন। তো রাজর্ষি জনকের গুরু ছিলেন অষ্টাবক্র মুনি। রাজা জনক সংশয়ে পড়েছেন - রাজা সত্য - না ভিক্ষারী সত্য। অর্থাৎ বাস্তবে উনি রাজা, কিন্তু স্বপ্নে উনি নিজেকে ভিক্ষারী দেখেছেন। তাই তার মনে প্রশ্ন জেগেছে, স্বপ্নে যা দেখেছি সেটা  সত্য না এই যা দেখছি সেটা সত্য।যেসব ব্রাহ্মন কুলগুরু তার দরবারে নিত্য শাস্ত্রব্যখ্যান শোনাতেন তারা কোনো উত্তর দিতে পারছেন না। মহর্ষি অষ্টাবক্রের কাছে সংবাদ গেল। তিনি রাজদরবার -এ এসে বললেন - তুমিই সত্য আর সব মিথ্যা। কথাটা বিদেহ মহারাজের মনে ধরলো। তিনি মহর্ষির কাছে ব্রহ্ম উপদেশ প্রার্থনা করলেন। আচার্য বললেন - তুমি রাজা , সিংহাসনে বসে আছো। আমি আচার্য তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তোমার যদি ব্ৰহ্ম জ্ঞান পাওয়ার বাসনা হয় তবে নিচে নেবে এস। আমি তোমার যোগ্যতা পরীক্ষা করবো। তারপর যদি উপযুক্ত মনে করি তবেই ব্রহ্ম-উপদেশ দান করবো। উপদেশ প্রদানের এটাই শাস্ত্রীয় বিধি।

মহারাজা জনক তাই করলেন। নেবে এলেন নিচে। মহর্ষি অষ্টাবক্র রাজাকে বললেন চলো বনে , চলো নির্জনে। রাজা সম্মত হয়ে অশ্বারোহনে বনে চললেন আচার্যকে সঙ্গে নিয়ে। গভীর জঙ্গলে এলে অষ্টাবক্র মুনি অশ্ব থামাতে বললেন। নেবে এস সওয়ারী। জনক ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলেন।মহর্ষি অষ্টাবক্র বললেন, না এখানে নয়। আরো গভীর জঙ্গলে যেতে হবে। বলতেই রাজা আবার অশ্বের পিঠে উঠবার জন্য রেকাবিতে পা রাখলেন। যেই না দ্বিতীয় পা উঠাতে যাবেন, অষ্টাবক্র মুনি ধমক দিয়ে বলে উঠলেন - হে রাজন ! দ্বিতীয় পা উঠাবার আগে আমার এক প্রশ্নের উত্তর দাও। -

বিদেহ রাজ্ ! তুমি কি জানোনা, ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করতে গেলে গুরুকরণ করতে হয়? আর তুমি যদি আমাকে গুরুপদে অভিষিক্ত করতে চাও, শাস্ত্র অনুসারে গুরুদক্ষিণা দেওয়াও তোমার কর্তব্য। মহারাজা জনক বললেন - হ্যাঁ গুরুদেব আমার তন্,মন,ধন সবই আমি আপনার চরণে সমর্পন করলাম। এখন আপনি আমাকে কৃপা করে ব্রহ্ম-উপদেশ দান করুন। এ কথা শুনে মুনি দূরে এক গুহায় প্রস্থান করলেন।

কিছুক্ষন পরে মুনি এসে জনক রাজা-কে ঘোড়সওয়ারুনমুখ অবস্থায় দেখে অর্থাৎ এক পা রেকাবিতে আর এক পা ঝুলন্ত অবস্থায়, শরীরটাও সামনের দিকে ঝুকে আছে, এই অবস্থায়  দেখে  জিজ্ঞেস করলেন - এমনতরো গতিহীন নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন ? রাজা উত্তরে বললেন - গুরুদেব এই হাত, এই পা, এই শরীর , এই মন , সমস্ত ঈন্দ্রিয়াদি কিছুই তো আর এখন আমার নয়। এতদিন যা কিছু আমার ভাবতাম এমনকি বিদেহ-রাজের রাজ্য, সবই আপনাকে সঁপেছি। এখন আপনার আদেশ ছাড়া আমি আর কিছুমাত্র করতে সমর্থ নই। আচার্য অষ্টাবক্র মুনি, জনকের কথা শুনে খুশি হলেন এবং ব্রহ্মজ্ঞান দিতে উদ্যোগী হলেন।

এই হচ্ছে আসন। অর্থাৎ নির্দিষ্ট ভঙ্গিমায় দীর্ঘকাল অবস্থান করার অভ্যাস। আবার এও বলি, শুধু একাসনে বসে থাকাই শেষ কথা নয়। অলসরা একভাবে বসে থাকে, কোনো কাজ করতে চায় না। আপনি  কি উদ্দেশ্যে বসে আছেন, সেটাই বড়ো কথা। ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পনের ভাব নিয়ে বসে থাকতে হবে। আমাদের শরীর-বাক্য ও মনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে  হবে। মহর্ষি পতঞ্জলি বলছেন, আসনে বসবার আগে আমাদের যম -নিয়মে অভ্যস্ত হতে হবে। কোন আসনে আপনি বসছেন, সেটা বড়ো কথা নয়।  আসন তো অনেক আছে, পদ্মাসন, শবাসন, শলভাসন, শশাঙ্গাসন, সর্বাঙ্গাসন, বজ্রাসন, হলাসন, ভদ্রাসন ইত্যাদি ইত্যাদি। পতঞ্জলি বলছেন আপনি সুখাসনে বসুন, অর্থাৎ যে আসনে আপনি স্বস্তি বোধ করেন, স্থির থাকতে পারেন, সেই আসনেই আপনি বসতে পারেন। এই সঙ্গে একটা মুদ্রার অভ্যাস করতে পারেন। ধ্যানমুদ্রা বা যোগমুদ্রা অবলম্বন করতে পারেন। মেরুদন্ড সোজা রেখে বসতে পারলে ভালো হয়। কারন সমস্ত চক্রগুলো আমাদের মেরুদণ্ডের মধ্যে অবস্থিত। আর এখানেই ঈশ্বরশক্তি প্রবাহিত হয়। শান্ত শরীর ,উদ্বেগশূন্য মন, স্থির চিত্ত, এগুলো আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের সম্বল।

আমাদের চিন্তা ঈশ্বরকেন্দ্রিক হতে হবে। ইশ্বর আমাদের অন্তরে বাহিরে সর্বত্র অবস্থান করছেন। এই ঈশ্বরকে প্রণাম, মহাত্মাদের প্রণাম, গুরুচরণে  প্রণাম এগুলো আমাদের মনের উদারতা বাড়ায় । প্রার্থনার সময় সকলের জন্য প্রার্থনা করুন। নিজের জন্য নয়। এই ধরনের প্রার্থনার এক অদ্ভুত ফল আছে।  এই সময় আমাদের স্নায়বিক যন্ত্রণার উপশম হয়। মনে একটা শান্ত ভাব আসে। এই সময় আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস -এর দিকে খেয়াল করতে পারলে আরো  ভালো হয়। শ্বাসপ্রশ্বাস ছন্দবদ্ধ করতে পারলে ভালো হয়। এতে করে আমাদের মন ভালো হয়। আমরা যখন শ্বাস নিচ্ছি তখন যদি মনে মনে ভাবি যে আমরা বিশ্বশক্তির পবিত্রতা  গ্রহণ করছি, আর নিশ্বাস ছাড়ার সময় যদি ভাবি যে আমাদের মধ্যে যে অপবিত্রতা, অশুদ্ধতা জন্ম নিয়েছে, সেসব আমাদের বেরিয়ে যাচ্ছে, তাহলে দেখবেন, কিছুদিনের মধ্যে ইন্দ্রিয় সংযমের এক আশ্চর্য্য শক্তি আপনার ভিতরে জন্ম হবে।

ইন্দ্রিয় সবসময় বহির্মুখী। চোখ আমাদের বাইরের দিকে খোলে,কান বাইরের কথা  শোনে। মাঝে মধ্যে যদি আমাদের চোখের পাতা ভিতরের দিকে খুলি, কান যদি আমাদের অন্তরের ডাক শুনতে পারে, তবে দেখবেন, আপনি এক আশ্চর্য্য জগতের অধিবাসী হয়ে গেছেন। মস্তিস্ক যদি ঈশ্বর-চিন্তায় মগ্ন থাকে,কান যদি ঈশ্বরের কথা শোনে, মুখ যদি ঈশ্বরের কথা বলে, কন্ঠে যদি ঈশ্বরের সুর ধ্বনিত হয়, আমাদের হাত দুটো যদি ঈশ্বরের কাজে ব্যস্ত থাকে, পদদ্বয় যদি ঈশ্বরকে প্রদক্ষিনে ব্যস্ত থাকে,আমরা যদি ঈশ্বরের কাছে, আমাদের এই পিতৃমাতৃ প্রদত্ত শরীরকে সুস্থ রাখার  জন্য আবেদন করতে পারি, আমাদের হৃদয়ে যদি ঈশ্বরের স্পন্দন অনুভব করতে পারি। তবে আমরা সত্যিকারের আধ্যাত্মিক মানুষ হয়ে যাবো।  আর আমাদের জীবন এক আনন্দ লহরীতে প্রবাহমান থাকবে।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম।

অধ্যাত্ম জীবনের পথে (সাত) : 

ঈশ্বরকে পেতে গেলে আমাদের অনুভূতি সম্পন্ন হতে হবে। কারন ঈশ্বর কখনো এই চর্মচক্ষু দিয়ে দেখা যাবে না। আমাদের অন্তরের দীপ্তিকে উজ্বল করতে হবে।  এই অনুভূতি শক্তি কি ও কিভাবে তাকে বর্দ্ধিত করা যায় ? সেই সম্পর্কে আমরা আজ শুনবো।

এই শক্তিকে উপনিষদ বলছে স্বজ্ঞা। অর্থাৎ যে জ্ঞান আমাদের অন্তরে প্রস্ফুটিত হয়, সেই জ্ঞানকে বলে প্রজ্ঞা। এই শক্তি আমাদের সবার ভিতরে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। একে জাগিয়ে তুলতে হবে।

একই ঘটনা, বা দৃশ্য আমাদের বিভিন্ন লোকের মধ্যে বিভিন্ন রকমের অনুভূতি জাগায়। লবটুলিয়ার জঙ্গলে বিভূতিবাবু যা অনুভব করেছিলেন, তা আমাদের অনুভূতিতে আসে না। অর্থাৎ অনুভূতিতে আনার ক্ষমতার তারতম্য। এই অনুভূতি শক্তি কিভাবে বাড়ানো যায়, বা আমরা কিভাবে অনুভূতি সম্পন্ন হতে পারি। কোনোকিছুর সঙ্গে  আপনি যতবেশি  একাত্ত্ব বোধ করতে পারবেন, সেই বস্তু সম্পর্কে আপনার অনুভূতি তত প্রবল হবে।  

আমাদের সবার ঘুমের অভিজ্ঞতা আছে। একটু খেয়াল করুন আমাদের ঘুমের প্রক্রিয়া  কিভাবে সংগঠিত হয়। প্রথমে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো মনের দিকে ফিরে আসে। এর পরে আমাদের মনের ক্রিয়া অর্থাৎ চিন্তা লুপ্তপ্রায় হয়। এই সময় থাকে শুধু আমাদের অস্পষ্ট অহং চেতনা। এই অহং চেতনা যখন ধীরে ধীরে স্থির হতে থাকে তখন আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। শেষের দিকে এই অহং চেতনা একদম স্থির হয়ে যায়, আর আমরা গভীর নিদ্রায় ঢুকে যাই। ঠিক বিপরীত প্রক্রিয়ায় আমরা আবার জেগে উঠি।  অর্থাৎ আমাদের অহং চেতনা জাগ্রত হয়, মনের ক্রিয়া শুরু হয়, অর্থাৎ মন আবার চিন্তা করা শুরু করে দেয়। ইন্দ্রিয়গণ বহির্মুখী হয়। অহং চেতনাকে যতক্ষন আমরা ধরে রাখি, সেই সময় আমরা একটা আচ্ছন্ন ভাব অনুভব করি। অর্থাৎ ঘুম থেকে উঠে আমাদের মন যতক্ষন সক্রিয় না হয় ততক্ষন আমরা একটা আচ্ছন্ন ভাব অনুভব করি। এইসময় আমাদের বহির্বিশ্বকে আবছা বলে অনুভব হয়। ধীরে ধীরে আমরা চেতন অবস্থা বা জাগ্রত অবস্থা লাভ করি। 

বাইরের জগৎকে আমরা দেখতে পাই সূর্য্যের আলোর সাহায্যে। সূর্য্যের আলো  যখন না থাকে অর্থাৎ রাতে আমরা চাঁদের আলোর সাহায্যে বিশ্বকে দেখতে পাই। চাঁদের আলো  যখন না থাকে তখন আমরা আগুনের সাহায্যে বহির্বিশ্বকে দেখতে পাই। এই আলো বা অগ্নিও যদি না থাকে তখন আমরা বহির্বিশ্বকে শব্দ দ্বারা অনুভব করি। এতক্ষন আমরা দেখছিলাম, এবার আমরা অনুভবে পৌঁছে গেলাম। অর্থাৎ শব্দ আমাদের দেখায় না, আমাদের অনুভব করায়। আর এই দেখার কাজ বা শোনার কাজ করছিলো চোখ, তারপরে কান। আর এগুলো কাজ করে তখনই যখন আমাদের মন সক্রিয় থাকে। মন এই খবর পৌঁছে দেয়, আমাদের বুদ্ধি-চিত্ত ও জ্ঞানের কাছে। আমরা কি ভাবে দেখি - মনের পিছনে আছে আত্মা। অন্তরের কোনোকিছু যখন আমরা দেখতে চাই তখন আমাদের এই আত্মজ্যোতির সাহায্য নিতে হয়। অর্থাৎ আত্মার সাহায্যেই আমরা মনকে দেখতে পাই।  আবার মনের সাহায্যেই আমরা বহির্জগৎকে দেখতে পাই। এখন এই আত্মজ্যোতি  আমরা অনুভব করবো কি করে ? 

আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি, আমাদের অনুভূতি, ও আমাদের ইচ্ছাশক্তি - এগুলোকে ব্যবহার করে আমাদের আমাদের অন্তর্দৃষ্টিকে তীক্ষ্ন করতে পারি। আমাদের সবার মধ্যে আমাদের পূর্বে অর্জিত অভিজ্ঞতাগুলি সংস্কার আকারে আমাদের মধ্যে সঞ্চিত হয়ে আছে। এটাকে দূর করতে গেলে আমরা দুটি উপায় অবলম্বন করে তা করতে পারি।  প্রথমত, আমরা যদি আবার নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে পারি, তাহলে আমাদের পুরনো অভিজ্ঞতাকে পরিশীলিত করতে পারি। এর জন্য প্রচুর সময় ও সুযোগ দরকার।  আর একটা উপায় হচ্ছে, ইচ্ছাশক্তিকে জাগ্রত করা। সত্যকে জানবো এই ইচ্ছাকে প্রবল ভাবে জাগিয়ে তোলা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন - তোমার সঞ্চিত যে ধর্ম-অধর্ম জ্ঞান, এগুলো সব তুমি ত্যাগ করো। এই জ্ঞান তোমার বিচার বুদ্ধিকে প্রভাবিত করছে। পুরোনো সঞ্চিত তথাকথিত ধর্মজ্ঞান যতক্ষন না তুমি পরিত্যাগ করতে পারছো, যতক্ষন না তুমি আমাতে সমর্পিত হতে পারছো, ততক্ষন  তোমার পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। কর্মযোগ সম্পর্কে এটাই ভগবানের শিক্ষা। এই কর্মযোগের সাহায্যে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়, সেই অভিজ্ঞতার তেজরশ্মি আমাদের উচ্চখাতে প্রবাহিত করতে হবে। আমি ভালো হয়ে গেছি, পবিত্র হয়ে গেছি, আমি কাউকে ঘৃণা করি না, আমি সবাইকে ভালোবাসি, আমি সবাইকে আত্মা ভাবি। এইরূপ চিন্তা ভালো, কিন্তু এটাকে নিজের জীবনে প্রয়োগ করে দেখাতে হবে। প্রতিনিয়ত ঈশ্বরের গুনকীর্তন,অর্থাৎ জপ একটা উৎকৃষ্ট উপায়।  নিজেকে  শৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ করতে হবে। অর্থাৎ জীবনে চলার পথে নিয়ম-শৃঙ্খলার খুব প্রয়োজন। যা কিছু করুন, নিয়ম মেনে ধারাবাহিক ভাবে করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন। ধ্যান অর্থাৎ ঈশ্বরচিন্তায় একাগ্র হওয়ার জন্য  একটা নির্দিষ্ট সময় ও স্থান বেছে নিন। এবং এইসব কাজে ধারাবাহিকতা খুব গুরুত্ত্বপূর্ন। যখন আমাদের চিন্তাগুলো পবিত্র হবে, আমাদের ইচ্ছাগুলো পবিত্র হবে তখন আমাদের অনুভবশক্তিও  ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে। এই অনুভব শক্তির একটা বিপদ আছে, আর সেটা হচ্ছে সহানুভূতি। অর্থাৎ অন্যের দুঃখে নিজেকে সামিল করা, বা অন্যের সুখে নিজেকে সামিল করা। আধ্যাত্মিক পথে, এই জায়গাটা খুব বিপদজনক। অন্যের সুখ-দুঃখে নিজেকে সামিল করা নয়, কর্তব্য কর্ম সম্পর্কে সচেতন হওয়া। কারুর দুঃখে বা সুখে নিজেকে সুখী বা দুঃখী না ভেবে কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকা ও অন্যকে সচেতন করা।  ব্যাস তারপরে সব ভুলে যান।

ধ্যানের সাহায্যে আমরা আমাদের বিভিন্ন প্রতিভাকে একত্রীকরণ করতে পারি । ধ্যানের  মাধ্যমে আমাদের বিভিন্ন প্রতিভার সঙ্গে একটা সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব। নিজেকে পবিত্রকরন ও ধ্যান যখন ধারাবাহিক ভাবে সংগঠিত হবে, ধ্যান তখন  গভীর হবে।  আর ধ্যান যখন গভীর হবে, তখন একটা আলোর ছটা বিদ্যৎ চমকের মতো ঝলক দিয়ে উঠবে। এবং ধরে ধীরে এই আলোক জ্যোতি স্থির হতে শুরু করবে। এই সময় আমাদের মনের সঙ্গে জীবাত্মার একটা সংযোগ স্থাপন হবে। আর মন যেহেতু ইন্দ্রিয়গুলোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, আর ইন্দ্রিয়গুলো যেহেতু স্থূল শরীরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তখন আমরা  স্থূল শরীরে জীবাত্মার কাজকে অনুভব করতে পারবো। এই আলোক ছটা যত  স্থায়িত্ত্ব লাভ করবে, তত আপনার আপন-সত্ত্বা অর্থাৎ জীবাত্মা আপনার ইন্দ্রিয়গুলোর  মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে অর্থাৎ আপনার ভৌত শরীরের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে একটা আমিবোধের সৃষ্টি করবে। আর এটি তখন সমস্ত বস্তুতে বিভাসিত হবে।  এবং আপনার জানা সম্পূর্ণ হবে। এই অভিজ্ঞতা যখন ধারাবাহিক ভাবে চলতে থাকবে, তখন আত্মজ্যোতিকে অন্য কোনো জ্যোতির প্রতিফলন বলে মনে হবে। অর্থাৎ যে পরম-আত্মা আসলে সমস্ত প্রতিফলিত আত্মাকে অর্থাৎ জীবাত্মাকে আলোকিত করছিলো,  তাঁকে সমস্ত জীবের মধ্যে আমরা অনুভব করতে পারবো। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি  ওম 

  
অধ্যাত্ম জীবনের পথে (আট) 

অনাসক্তি : (১)

আমার ভাবতে খুব অবাক লাগে, নিজের মিথ্যে পরিচয়কে আঁকড়ে থেকে লোকে এত কষ্ট পায়, তবুও তাদের চৈতন্য হয় না। মিথ্যা জ্ঞানের অহংকার, পদের অহংকার, সম্পর্কের অহংকার, এগুলো যে সাময়িক, তা সে বোঝে, তবুও এগুলো পাবার জন্য, এগুলো ধরে রাখার জন্য, এগুলো বাড়াবার  জন্য, প্রতিনিয়ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। আর পরিশেষে পাচ্ছে দুঃখ। জাগতিক সম্পত্তি বাড়িয়ে নিজেকে সুখী করবার জন্য চেষ্টা করছে। আবার এগুলো রক্ষার জন্য সে সারা জীবন ভয়ে ভয়ে  কাটাচ্ছে। তবু মোহ  ছাড়তে পারছে না। বাপের সম্পত্তি পাবার জন্য, ছেলেমেয়েরা বাপ্ মাকে কষ্ট দিচ্ছে। বাবা-মা সম্পত্তি রক্ষার জন্য, ছেলেমেয়েদের কষ্ট দিচ্ছে। এ এক অদ্ভুত ঘোরালো অবস্থা। কুকুরগুলোকে দেখেছি, শুকনো হাড়  চিবোচ্ছে, চিবোতে  চিবোতে মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। সেই রক্তের স্বাদে সে আনন্দ পাচ্ছে। যখন হাড় চিবোনো শেষ হলো তখন সে বুঝতে পারে, তার গাল  ছড়ে গেছে। বিচিত্র এই জগৎ।

আধ্যাত্মিক পথে, মানুষ এই জাগতিক বন্ধনের  মধ্যে হারিয়ে যেতে চায় না। সে এই সবকিছুর মালিককে ধরতে চায়। তাই আধ্যাত্মিক জগতের মূল হলো ত্যাগ ও অনাসক্তি। ত্যাগ ভিন্ন আধ্যাত্মিক জীবন পূর্ন হতে পারে না। আর সেই ত্যাগ মানে বিষয় ত্যাগ নয়, মনের ত্যাগ। বেঁচে থাকার জন্য বিষয় তো চাই। কিন্তু বিষয়ে আসক্তি চাই না ।  আমাদের ভোগ হবে অকর্তা জ্ঞানে। আমরা যে খাবার খাবো, সেটাও  যেন ঈশ্বরের ভুক্তাবশেষ হয় । বস্তুকে পরিত্যাগ করা আসল ত্যাগ নয়। ত্যাগ হচ্ছে বিষয়ের প্রতি আমাদের মনোভাবের পরিবর্তন। ত্যাগ শুধু খারাপকে, মন্দকে, বিষয়কে ত্যাগ নয়। আমাদের ভালো মন্দ, প্রীতি-ঘৃণা সবই ত্যাগ করতে হবে। উচিত-অনুচিত, কর্তব্য-অকর্তব্য, আমাদের অন্ধ বিশ্বাস অন্ধ অবিশ্বাস সবই ত্যাগ করতে হবে। জ্ঞানের আলোতে নিজেকে উদ্ভাসিত করতে হবে। সত্যিকারের ত্যাগ ও অনাসক্তিতে আমরা যত সাফল্য অর্জন করতে পারবো, আমাদের ধ্যান-জপ ততো কার্যকরী হয়ে উঠবে।  যুগ যুগ ধরে আমাদের মনের কোনে সঞ্চিত, আত্মগ্লানি দূর করতে হবে। আমরা অমৃতের পুত্র। জগতের সমস্ত কিছুর মালিক আমার পিতা, আমি জগতের সমস্ত  কিছুর উত্তরাধিকারী। আমার আবার অভাব কিসে ? আমি এখনো বড় হইনি, এখনো আমার বুদ্ধি হয় নি, আমি এখনো  যোগ্য হতে পারিনি, তাই পিতা  আমাকে আমার প্রয়োজন মতো জিনিস দিচ্ছেন।  আমাকে কষ্ট  দিয়ে শিক্ষা দিচ্ছেন। আমি যখন যোগ্য হয়ে যাবো, পিতা আমাকেই তো সব ছেড়ে দেবেন। আর তা রক্ষার দায়িত্ত্ব তখন আমারই থাকবে। অতএব আমাকে যোগ্য হতে হবে।

আমাদের  বাড়ির সামনে সাহাবাবুর মুদির দোকান। তো তার দুই ছেলে। বড়োটি একটু বোকা বোকা। ছোটোটি চালাক চতুর, যাকে আমরা এখন বলি স্মার্ট। বড়টি  যখন দোকানে থাকে, তখন বাবার নির্ধারিত দামেই  জিনিস বিক্রি করে, যা কিছু বিক্রিবাট্টা হয়, বাবার হাতে তুলে দেয়। ছোটোটি  চালাক- চতুর খদ্দের বুঝে জিনিসের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করে,  আর বিক্রির পয়সা থেকে কিছু নিজের জন্য সঞ্চয় করে, বাকিটা বাবার হাতে তুলে দেয়। ছোটটির কথার মধ্যে একটা সবজান্তা ভাব আছে। ব্যবসাটা সে ভালোই করে। তো কিছুদিন পরে, ছোট ছেলেটি একটা মটোর সাইকেল কিনলো।  বাবা জিজ্ঞেস করলো, টাকা পেলি কোথায় ? ছেলে বললো লটারি পেয়েছিলাম। বাবা বিশ্বাস করলো। কিছুদিন পরেই ছেলেটির এক্সিডেন্ট হলো। পা ভেঙে বাড়িতে বসে আছে এখন ।

 ভগবান বিষ্ণু একদিন নারদকে বললো,  চলো একটু মর্তবাসীদের দেখে আসি।  আমার ভক্তরা কেমন আছে। তুমি আমার সঙ্গে গেলো।  ভগবান বিষ্ণু ও নারদ ব্রাহ্মণ বেশে মর্তে এলেন। এক জমিদারের বাড়িতে গেলেন।  সেখানে বিশাল মন্দির, মন্দিরে ভগবানের অবতার শ্রীকৃষ্ণের পুজো হচ্ছে। বিশাল উৎসবের আয়োজন। অষ্টপ্রহর কীর্তনের আয়োজন।  ব্রাহ্মণ দেখে জমিদার সমাদরের সঙ্গে আদর আপ্পায়ন করলেন। সেবা পেয়ে ভগবান খুশি হলেন। আশীর্বাদ করলেন, তোমার সমৃদ্ধি হোক। সুখে শান্তিতে সংসার করো।
সেখান থেকে বেরিয়ে নারদ, ভগবান বিষ্ণুকে নিয়ে চললেন, এক গরিব বৈষ্ণবের ঘরে। ঘর বলতে একটা কুঁড়ে। রোদ  বৃষ্টি দুটোই অনায়াসে প্রবেশ করে। ঘরের মধ্যে আছে এক শিলা খন্ড।  যাকে বলে শালগ্রাম শিলা। খুদকুঁড়ো যা পান তাই ভগবানকে নিবেদন করে, প্রসাদ খান । শীর্ণকায় চেহারা। কিন্তু ভগবানে অচলা ভক্তি। তো ভগবান নারদকে নিয়ে তার গৃহে প্রবেশ করলেন। ব্রাহ্মণ দেখে, বৈষ্ণব উদ্বিগ্ন হলেন। কি দিয়ে ব্রাহ্মণ ভোজন করাবো ?  আজ প্রসাদ  হয়েছে  কচুর শাক সিদ্ধ । ভগবান হৃষ্ট চিত্তে তাই খেলেন। খেয়েদেয়ে চললেন বিষ্ণুলোকে। তো নারদ জিজ্ঞাসা করলেন, ভগবান আপনি বৈষ্ণবকে আশীর্বাদ করলেন না ? জমিদারকে তো সুখ - সমৃদ্ধির আশীর্বাদ করলেন, বৈষ্ণব গরিব কিন্তু তোমার বড়  ভক্ত। তাকেইতো আপনার  আরো বেশি আশীর্বাদ করার কথা। তো ভগবান বললেন, পেছেনে তাকিয়ে দেখো নারদ । নারদ পেছনে তাকাতেই নজরে পড়লো, জ্বলন্ত অগ্নি শিখা।  বৈষ্ণবের কুরে ঘর জ্বলছে। নারদ বললেন - একি করলেন  ঠাকুর ?  এই আপনার  বিচার ? তো ভগবান বললেন - যে যা চায় আমি তাকে তাই দেই।  আর যে করে আমার আশ আমি তার করি সর্ব-নাশ। ওই শিলাখণ্ডের মায়া, ওই কুরে ঘরের আশ্রয়, ওকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে রেখে ছিল। আজ ও আমার হলো। ওই দেখো, বৈষ্ণব আমাদের পিছন পিছন রথে চড়ে আমারি ধামে চলেছে। নারদ বললেন - ঠাকুর আপনার  লীলা বোঝা  দায়।
এগুলো সব পৌরাণিক গল্প।  কিন্তু এর মাধ্যমে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। জাগতিক সমস্ত বস্তূ তা সে ধনদৌলত বলুন, আত্মীয়স্বজন বলুন, বৈষয়িক জ্ঞান বলুন আর মায়া-মমতা,বলুন এসবই আধ্যাত্মিক জগতে মূল্যহীন। আমরা কারুরপ্রতি আসক্ত হবো না, দয়াপ্রবণ হবো, অবশ্য়ই দয়া প্রবন  হবো। আমরা ভালোবাসবো, কিন্তু তার বিনিময়ে যেন কিছু প্রত্যাশা না করি। আবার আমাকে কে ভালোবাসলো, আর প্রতিদানে আমার ভালোবাসা প্রত্যাশা করলো, সেই প্রশ্রয় যেন আমরা না দেই।  এমনকি আমরা যখন ঈশ্বরকে ভালো বাসবো, তখনও যেন আমরা ঈশ্বরের কাছে কিছু প্রত্যাশা না করি। আমরা যেমন ভাবনা চিন্তা করবো, প্রতিদানে আমরা সেই মতো ফল আমরা প্রাপ্ত হবো। কিসে আমরা ভালো হবে তা কি আমরা জানি ? তাই চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারে আমরা নিষ্ক্রিয় থাকবো। যা কিছু পাবো, তা ঈশ্বরের দান বলে গ্রহণ করবো, আবার যা কিছু পাবো না, সেটাও ঈশ্বরের ইচ্ছা বলে জ্ঞান করবো। কারুর প্রতি এমনকি সৌজন্য প্রদর্শনেরও  দরকার নেই। আর কারুর কাছ থেকে সৌজন্য আশাও করবেন না।

সবাই আমার, আবার কেউ আমার নয়। এই অবস্থা তখনই হয়, যখন আমরা ঈশ্বর ভিন্ন অন্য কারুর ভালোবাসা পেতেও চাইনা আবার দিতেও চাই না। দেখুন সংসারে আমরা সংঘবদ্ধ হয়ে থাকি, আবার আশ্রমেও আমরা সংঘবদ্ধ হয়ে থাকি। সংসারে কেউ আমাদের ছেড়ে গেলে আমরা ভেঙে পড়ি।  কিন্তু আশ্রমে কেউ ছেড়ে গেলে আমরা ভেঙে পড়ি  না। আসলে নির্ভরশীলতা। আমরা যার প্রতি বা যাদের প্রতি  নির্ভরশীল হই, তার বিরহ আমাদের  তত বেশি কষ্ট  দেয়। একাধিক আশ্রমে আমি দেখেছি, সাধকদের এক আশ্রম থেকে অন্য আশ্রমে ঘোরানোর একটা ব্যবস্থা আছে। এর কারন হচ্ছে, এক জায়গায় থাকতে থাকতে আমাদের পাশাপাশি মানুষের প্রতি, নির্ভরশীলতা, মমতা, আসক্তি বেড়ে যায়। সেখান থেকে পরিত্রান পাবার জন্য, আশ্রমীরা এক জায়গায় বেশিদিন থাকেন না।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে আমাদের কি কেউ আপনজন থাকবে না ? নিশ্চই থাকবে, আর তারা হলো, আপনি যদি শিবভক্ত হন, তবে শিবভক্তরাই আপনার  আত্মীয়। আপনি যদি কৃষ্ণভক্ত  হন তবে কৃষ্ণভক্তরাই আপনার আত্মীয়। অর্থাৎ  আমাদের চিন্তাজগতের সঙ্গে যাদের চিন্তার  মিল আছে, তারাই আমার আত্মীয়। বিষয়ী লোকের বন্ধু তো বিষয়ী লোকেরাই হয়। তো আমাদের বন্ধু তারাই হবে, যারা আধ্যাত্মিক পথের পথিক।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম।

পাগলের গোবধে আনন্দ।

কথা হচ্ছিলো আনন্দ নিয়ে। কোনো মানুষই ভালো নেই, কিন্তু পাগলরা আনন্দে আছে। একটা প্রবাদ আছে, বুদ্ধিমানের বিষয়ে আনন্দ।  পাগলের গোবধে আনন্দ। বুদ্ধিমানের বিষয়ে আনন্দ হয়, এটা বোঝা শক্ত নয়। কিন্তু পাগলের গোবধে আনন্দ হয়, এটা আমাদের বোঝা খুব কঠিন। "গো" কথাটার গোটা কুড়ি অর্থ হয়। গো কথাটার মানে যেমন আমরা জানি গরু বা পশু যারা যথেচ্ছ বিচরণ করে বেড়ায়, আবার গো কথাটার মানে মাতা, পৃথিবী, গায়েত্রী, ইন্দ্রিয়, এমনকি স্বর্গ হতে পারে। তো পাগল যখন তার পশুবৃত্তিগুলোকে বধ করতে পারে, তখন তার আনন্দ হয়। পাগল যখন তার ইন্দ্রিয়গুলোকে বধ করতে পারে, তখন তার আনন্দ হয়, যখন সে স্বর্গের সুখকে বধ করতে পারে তখন তার আনন্দ হয়। পাগল যখন অনিত্য পৃথিবীকে বধ করতে পারে, তখন তার আনন্দ হয়। পাগল যখন গায়েত্রী অর্থাৎ বেদমাতা অর্থাৎ জ্ঞানকে বধ  করতে পারে তখন তার আনন্দ হয়। সাধারণ মানুষ আমরা এই বধ-কার্য  বে-বোধের পাগলামো  বুঝি , পাগল আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। সত্য কথা বলতে  কি,  যতক্ষন জ্ঞেয় সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞেয় বোধ থাকে ততক্ষন আমরা ঈশ্বরের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারি না। যতক্ষন আমরা সর্ব্ব ভাবনার অতীত ঈশ্বরকে সম্যকরূপে আশ্রয় না করতে পারি, ততক্ষন আমরা সংসারের সুখ-দুঃখ থেকে পরিত্রান পেতে পারি না। আবার ঈশ্বরের চঞ্চল ভাবকে যতক্ষন আমরা আঁকড়ে থাকি, ততক্ষন এই পরিবর্তনশীল অসার সংসার আমাদের অস্থির করে রাখে।  ঈশ্বরের চঞ্চল ভাবকে, অর্থাৎ ক্রিয়াশীল ভাবকে  যতক্ষন আমরা স্থির ও সত্য ভাবি, ততক্ষন আমাদের অজ্ঞাতসারে আমরা অস্থিরতার মধ্যে বিরাজ করি। এই বৈচিত্রময় চঞ্চল জগৎ যে স্থির সত্ত্বার উপরে প্রতিষ্ঠিত, তা আমরা বুঝতে পারি না।

ব্রহ্ম সর্বত্র। এই ব্রহ্ম যখন আমি বোধে ব্যাপ্ত হয় তখন তার মধ্যে ইচ্ছা শক্তি প্রকট হয়। এই ইচ্ছা শক্তি তখন একটা বিন্দুর আকার নেয়।  অর্থাৎ ঘনীভূত হয়। আর বিন্দু তখন ছড়িয়ে পড়ে আলোর তরঙ্গে। এই আলোর তরঙ্গে বিন্দু বস্তুর সমস্ত উপাদান নিয়ে অবস্থান করে। এই বিন্দু একসময় কালের অমোঘ নির্দেশে জ্যোতির মধ্যে ঘনীভূত হয়। জ্যোতির মধ্যে ঘনীভূত এই আকারই বস্তু। ব্রহ্মের মধ্যেই এই বস্তু। ব্রহ্ম  থেকে আলাদা নয়। কালে কালে ব্রহ্ম সৃষ্টির নানান অস্তিত্ত্বের মধ্যে ঢাকা পরে যায়। এই জন্য ব্রহ্মকে বুঝতে গেলে আমাদের চেতনাকে পেছনের দিকে অর্থাৎ বস্তুর গভীরের দিকে টেনে নিয়ে যেতে হয়। এইভাবে, যে স্তরে বস্তুকণার উদ্ভব হয়ে ছিল, তার সন্ধান পাওয়া যায়।
আমাদের শরীরের ব্রহ্মরন্ধ্রের উপরে এই বিন্দুর অবস্থান। এই বিন্দু শক্তি তরঙ্গ আকারে আমাদের সুষুম্না নাড়ির মধ্যে দিয়ে লিঙ্গমূলে কুলকুণ্ডলিনীতে বস্তুর আকার নিয়েছে। এই বস্তুকে ক্রিয়াশীল ক'রে, নিম্নদিকে ধাবিত করতে পারলে, জীবের সৃষ্টি হয়, আর উর্দ্ধগতি করতে পারলে  ব্রহ্মানন্দ উপলব্ধি হয়।
ঈশ্বর নিত্য-সচ্চিদানন্দ স্বরূপ। সত্যিকারের পাগল এটা বোঝে। আমরা পাগলকে বুঝতে পারি না। জ্ঞানাতীত এই পাগল সত্যিকারের জ্ঞানাতীতকে বোঝে, তাই আনন্দের মধ্যে বিরাজ করে। ত্রৈলঙ্গ-স্বামীকে আমরা দেখেছি, সারাদিন গঙ্গায় ভেসে বেড়াতে। রামকৃষ্ণকে আমরা দেখেছি পাগলের মতো আচরণ করতে। কেউ কেউ অবশ্য পাগলের অভিনয় করে থাকেন। আমরা দেখেছি ঠাকুর রামকৃষ্ণের ভাগ্নে হৃদয়কে পাগলের অভিনয় করতে।
সবকিছু তিনিই করেন। এই জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় সবার মধ্যে ঈশ্বরের প্রকাশ। স্বরূপতঃ ঈশ্বর নির্গুণ, তিনি অকর্তা। ঈশ্বরের পৃথক সত্ত্বা হচ্ছে মায়া বা প্রকৃতি। এই মায়া বা প্রকৃতি যেহেতু ক্রিয়াশীল, তাই আমরা অনেকে ঈশ্বর থেকে মায়াকে পৃথক ভাবি।
একটা কথা ভাবি, ঈশ্বরকে বুদ্ধির মাপকাঠি দিয়ে মাপবো, বা ভাষার বন্ধনে আবদ্ধ   করবো, আলোচনা করতে করতে ঈশ্বরকে বুঝে ফেলবো, বা অন্যকে বোঝাতে পারবো, এমন ধৃষ্টতা যেন কারুর কখনো না আসে। ঈশ্বরকে পাওয়া, ঈশ্বরকে বোঝা, ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া কিছুতেই হয় না। তবু কেন আমরা আলোচনা করি ? আলোচনা করতে ভালো লাগে তাই করি, এই আলোচনাতে আমাদের বুদ্ধির মলিনতা দূর হবে, জিহ্ববার জড়তা দূর হবে।  সেই আশাতেই করি।
আসলে আনন্দই ঈশ্বরের স্বরূপ। আনন্দই ব্রহ্ম। এই আনন্দের অনুভূতি আমাদের সবার অল্প-বিস্তর আছে। জগতে কাম্য বস্তু পেলে আমাদের ক্ষণকালের জন্য হলেও আমাদের আনন্দ অনুভূতি জেগে ওঠে। এই যে ক্ষনিকের আনন্দ, বিষয়-যোগে হয়ে থাকে, বা ইন্দ্রিয়-যোগে হয়ে থাকে, এটি আমাদের চিত্তের বিকার মাত্র। এই আনন্দ যখন বিষয় বহির্ভূত হয়, চিন্তা-ভাবনা বহির্ভূত হয়, গ্রহণ-ত্যাগ বহির্ভূত হয়, তখন যে স্বরূপে এই আনন্দ অনুভূত হয়, সেই স্বরূপ-ই ঈশ্বর। ভালো কিছু পেতে গেলে ছোট ছোট ভালোকে আমাদের ত্যাগ করতে হবে। রাখতে হয় গুরুর প্রতি অগাধ বিশ্বাস, ভক্তি।  এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি। গল্পটা আপনাদের  অজানা নয়। তবুও বলি।
গুরুনানক একবার,  শিষ্যদের পরীক্ষা করবার জন্য, জঙ্গলের পথে শিকারে যাবেন বলে প্রচার  করলেন। তো কিছু শিষ্য তার সঙ্গে যাবার জন্য বায়না ধরলো। তো জঙ্গলের মধ্যে তো নানান রকমের বিপদ, চোর ডাকাতের ভয়। নানক সবাইকে বললেন, দেখো জঙ্গলের পথে চোর ডাকাতের উৎপাত, তোমরা যদি আমার সঙ্গে যেতে চাও, তবে সঙ্গে জিনিসপত্র , বিশেষ করে টাকা পয়সা নিয়ে যাওয়া যাবে না। তো সবাই রাজি হয়ে গেল। তো কিছুদূর যাবার পরে, সবাই দেখলো, রাস্তার পাশে জঙ্গলের মধ্যে অজস্র তাম্রমুদ্রা। তো কিছু শিষ্য এই তাম্রমুদ্রা দেখে, আর লোভ সামলাতে পারলো না। তারা নানান বাহানায়, নানক থেকে পিছিয়ে পড়তে লাগলো। এবং সুযোগ বুঝে, ঝোলার মধ্যে তাম্রমুদ্রা গুলো কুড়িয়ে নিয়ে পেছন থেকে কেটে পড়লো।
কিন্তু গুরুদেবের সঙ্গে কিছু শিষ্য চলতে লাগলো।  ক্ষাণিকক্ষন পরে, দেখাগেলো কিছু রৌপ্যমুদ্রা। যা চকচক করছে। কয়েকজন শিষ্য এই রৌপ্যমুদ্রা নিয়ে পেছন থেকে চুপিসারে ভেগে পড়লো। গুরুদেব মনে মনে হাসতে  লাগলেন।
এর পরে দেখা মিললো, অসংখ্য স্বর্ণমুদ্রা। এবার আরো কিছু শিষ্য স্বর্ণমুদ্রা ঝুলিতে নিয়ে জঙ্গলের পথে পেছন দিকে হাত শুরু করলো।
কিন্তু এখনো সঙ্গে কিছু শিষ্য থাকলো। গুরুদেবের এবার শেষ পরীক্ষা। গুরুদেবের এবার মুখ খুললেন, দেখো তোমরা মনি-কাঞ্চনের লোভ ত্যাগ করেছো। আমি তোমাদের পরীক্ষা করবার জন্য এখানে নিয়ে এসেছি।  এবার তোমাদের সামনে অগ্নিপরীক্ষা। এখন আমি যা বলবো, তা তোমাদের পালন করতে হবে। শিষ্যরা মুখ চাওয়া চায়ি করছে। নাজানি কি পরীক্ষা দিতে হবে।  এর মধ্যেই দেখা গেলো, একটা শিশুপুত্রের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। গলা অবধি একটা চাদর দিয়ে ঢাকা। কতদিনের বাসি মরা কে বলতে পারে ? শবদেহ থেকে দুর্গন্ধ বেড়োচ্ছে। হতে পারে, যারা দাহ  করতে এসেছিলো, তারা বন্যজন্তুর ভয়ে পালিয়েছে। কাপড় দিয়ে ঢাকা শবদেহের দিকে আঙ্গুল তুলে নানক বললেন, তোমাদের মধ্যে কে এই শবদেহের মাংস খেতে পারবে ? শিষ্যদের সবার নাকে কাপড়। দুর্গন্ধে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। এই অবস্থায় গুরুদেবের এ কি প্রস্তাব ? এই ধরনের আচরণ অঘোরপন্থী সাধকরা করে থাকে শুনেছি। এই ঘৃণ্য কাজ কোনো সচেতন মানুষের পক্ষে করা সম্ভব ? সবাই ইতস্তত করছে, তখন একজন শিষ্য এগিয়ে এল, গুরুদেবকে প্রণাম করে, বললো কোথা দিয়ে খেতে হবে বলুন, পা, না মাথা ? গুরুদেব খুশি হলেন, বললেন,  কোমর থেকে তুমি খেতে শুরু করো। তো শিষ্য কোমর থেকে খাবার জন্য কাপড় ওল্টাতেই এক আশ্চর্য্য কান্ড সংগঠিত হলো। শবদেহ পরিবর্তন হয়ে গেলো সুস্বাদু খাদ্যসামগ্রীতে।
আমরা ত্রৈলঙ্গস্বামীকে দেখেছি, যখন সাহেব তাকে গোমাংস ভক্ষনের প্রস্তাব দিলো, স্বামীজী তখন তাকে  নিজের বিষ্ঠা হাতে নিয়ে সাহেবকে দিয়েছিলেন, খাবার জন্য। পাগলের ঘৃনাবোধ নেই।  তিনি সব কিছুর উর্দ্ধে। পাগলের বাহ্যজ্ঞান লোপ পায়।  ঠাকুর রামকৃষ্ণকে আমরা দেখেছি, মায়ের মূর্তির চিবুক ধরে আদর করতেন, গান গাইতেন, মায়ের সঙ্গে পরিহাস করতেন, কখনো মায়ের হাত ধরে নৃত্য করতেন। আবার ভোগ নিবেদন করবার সময়, বিড়ালকে পেয়ে, ভোগের অন্ন বিড়ালকে দিয়ে দিতেন । এমনি কত পাগলামির নিদর্শন পাওয়া যায় ঠাকুরের জীবনে। এই অবস্থাই  আমাদের কাছে পাগলামি, আর ঠাকুরের কাছে ব্রহ্মানন্দ।
আনন্দ আমাদের একপ্রকার অনুভব বা বোধ। যখন আমাদের বোধ এই আনন্দ থেকে আনন্দ পায়, তখন আমরা ঈশ্বরে অবস্থান করি। এটি কেবল অনুভব-আনন্দ-স্বরূপ। বোধ ও বস্তুর মিশ্রনে যে আনন্দ, তা তো আনন্দ নয়। যে আনন্দে কোনো বস্তুভেদ নেই, সেই আনন্দই ঈশ্বর। অহেতুক আনন্দ। অর্থাৎ এই আনন্দ-অনুভূতির কোনো বস্তুরূপ হেতু নেই। এই আনন্দকে শ্রূতি বলছে এক এবং অদ্বিতীয়। এই আনন্দকে ভক্তিবাদীরা বলছেন, প্রেম বা রস।  বাউলরা বলছেন অধরা।
এই আনন্দকে পাবার জন্য মানুষ খেলাধুলা করে, এই আনন্দকে পাবার জন্য মানুষ গান শোনে, এই আনন্দকে পাবার জন্য মানুষ ছবি আকে। এই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কেবল বোঝা যায়।  বোঝানো যায় না। কিন্তু রসিক  রসকে ধরবার জন্য চেষ্টা করে, বোঝাবার চেষ্টাও করে।  আবহমানকাল ধরে এই বোঝবার চেষ্টা চলে আসছে। বোঝাবার চেষ্টা চলে আসছে। এই আনন্দ নিত্যসুদ্ধ, নিরঞ্জন। এই নিরঞ্জন স্বরূপের দ্বিবিধ প্রকাশ, একটি ঈশ্বরত্ব অন্যটি জীবত্ত্ব। উপনিষদ বলছে, আনন্দ থেকেই ভূত সমূহের উৎপত্তি, আনন্দেই অবস্থান, আবার আনন্দতেই লয়। সর্ব্ব-ভাব বর্জিত যে নির্গুণ  আনন্দ আর বিষয়ভাব অর্জিত যে আনন্দ সে কি আলাদা ? আসলে নির্গুণ আনন্দ বলে কিছু হয় না। আনন্দ তো একটা গুন্ একটা বিশেষ গুন্। আর গুন্ কখনো বস্তু নিরপেক্ষ হতে পারে না। সূর্য আর সূর্যরশ্মি আলাদা করা যায় না। ব্রহ্ম আর বস্তু আলাদা নয়।  ব্রহ্ম সর্বদাই পূর্ন। ব্রহ্ম যার কাছে, যে ভাবে প্রকাশ পান, তিনি সেই ভাবেই তাকে দেখেন।

ওম ধ্বনি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।

 ঈশ্বরের ঘরে কোনো দরজা নেই।

একটা কথা বলি, কখনো কারুর কাছে কিছু চাইবেন না। কখনো কারুর কাছে কিছু প্রশ্ন করবেন না।আপনি চাইলে কেউ অবশ্যিই আপনাকে কিছু দেবে, আপনি প্রশ্ন করলে কেউ আপনাকেঅবশ্য়ই  জবাব দেবে। কিন্তু যা কিছু আপনি পাবেন, তা কি আপনি ধরতে পারবেন ? পারবেন না, কারন আপনি দেখতেই পান না,  আপনি ধরতেই পারেন না।  আরব দেশে একটা প্রচলিত কথা আছে, আল্লাহর প্রতি আপনার  বিশ্বাস আছে, ভালো, কিন্তু ঘুমোনোর আগে উটগুলোকে ভালোভাবে বেঁধে রাখুন । কেননা, উটগুলো আল্লাহর কথা বোঝে না। উটগুলোর কোনো ধর্ম নেই। আল্লাহ উটগুলোকে আটকে রাখতে পারবে না। তাই ঘুমোনোর আগে উটগুলোকে বেঁধে রাখার দায়িত্ত্ব আপনার। আল্লাহর দোহাই দিয়ে কোনো লাভ নেই।
একজন চশমা খুঁজছে। চশমা ছাড়া কিছুই নাকি সে দেখতে পায়  না। তো আমি বললাম, চশমা ছাড়া আপনি চশমাকে খুজবেন কি করে। আসলে চশমা আপনার চোখেই আছে, কিন্তু আপনি তাকে দেখতে পাচ্ছেন না। আপনি বাইরে চশমা খুঁজছেন।  তো পাবেন কি করে ?
তাই বলছি, সব প্রশ্নের উত্তর আপনার ভিতরে আছে। কিন্তু আপনি তাকে খুঁজে পাচ্ছেন না। কারন প্রশ্নের উত্তর আপনি বাইরে দেখতে চান।
যে সব মানুষ বাইরের জগতে সত্যকে খুঁজছেন, তারা একটা জিনিস ভুলে গেছেন, তা হলো নিজের ভিতরে সত্যকে খোজা। হরিনের নাভির মধ্যে সুগন্ধ আছে, তবু বাইরে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, সুগন্ধ কোথা থেকে আসছে, সেটা দেখার জন্য। আমাকে অনেকে প্রশ্ন করতে চায়, অনেক কিছু জানাতে চায় যা সে নিজেই জানে না। আসলে সে তার ভিতরের দিকে নজর দিতে শেখে নি। আমাদের চোখ বাইরের দিকে খোলে, তাই বাইরের দিকটা দেখতে পাই। আমাদের ছোটবেলা থেকে বাহিরটাকে বুঝতে বলা হয়, বাইরের বস্তুকে দেখানো হয়, শেখানো হয়, তাই আমরা বাইরের সম্পর্কে উৎসুক, বাইরের বস্তু যে আমারই প্রতিফলন তা আমরা বুঝতে পারি না।  বাইরে আমরা যা দেখতে চাই, আমরা তাই দেখি।  আমরা যা শুনতে চাই তাই শুনি।  রসগোল্লার স্বাদ আছে আমার জিহ্বায়। রসগোল্লার মধ্যে নয়। আমার জীভ  ভিন্ন অন্য কোথাও রসোগোল্লার স্বাদ নেই।
কাকে আপনি প্রশ্ন  করছেন  ? কার কাছ থেকে আপনি জবাব আশা করছেন ?  আপনি খুঁজছেন, বাইরের বস্তুকে, আসলে বাইরে কোনো বস্তু নেই।  যাকিছু সবই আপনার প্রতিফলন মাত্র। তাই ছবিকে হাতড়ে না খুঁজে, ছায়াকে না খুঁজে নিজেকে দেখুন। আপনার সঙ্গে সঙ্গে আপনার ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনি ভাবছেন, এগুলো সব বাইরে অবস্থান  করছে, না তা নয়, এগুলো শুধু আপনারই প্রতিফলন মাত্র ।
ত্রৈলঙ্গ-স্বামী সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন, ঈশ্বরের খোঁজে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, গ্রাম, নদী, সমুদ্র, পাহাড়ের পর পাহাড় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ঈশ্বরের খোঁজে। কোথাও ঈশ্বরকে পেলেন না। এক গভীর রাতে, আশ্রয় নিলেন পাহাড়ের গুহায়। হতাশ হয়ে পড়েছেন।  তাহলে কি ঈশ্বর নেই। চিৎকার করে ডাক ছাড়লেন - ঈশ্বর তুমি আছো ? পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে - শব্দ ফিরে এলো - ঈশ্বর তুমি আছো। আবার বললেন ঈশ্বর তুমি নেই ? - প্রতিধ্বনিত  হলো - ঈশ্বর তুমি নেই। স্বামীজী বুঝলেন, বাইরে যা কিছু আছে, সে সবই  আমারই প্রতিধ্বনি।  আমি ভিন্ন কোথাও কিছু নেই। আবার চিৎকার করলেন, ঈশ্বর তুমি কি আমাকে ভুলে গেছো ?  শব্দ আবার ফিরে এলো - ভুলে গেছো।
কোথাও কিছু নেই। ঈশ্বর কেন নেই ? কার কাছে এই অভিযোগ করবেন যে ঈশ্বর কেন নেই ? আমরা তো শুধু পাওয়নাগণ্ডার  মধ্যে ঈশ্বরকে খুঁজি। আমরা শুধু ঈশ্বরের কাছে, প্রার্থনা করি। ঈশ্বরের গুনগান করি, ঈশ্বরকে খুশি করবার জন্য। ঈশ্বর কখনো তার গুনের কথা বলেন নি। আমাদের কল্পনায় অশেষ গুণবান ঈশ্বরের খোঁজে থাকি। যা আসলে অলীক। এই অলীক ঈশ্বর আমাদের কল্পনার ফানুস দিয়ে তৈরি। আসলে মানুষের ক্ষমতার একটা সীমাবদ্ধতা আছে। প্রকৃতির কাছে সে অসহায়। তাই সে প্রকৃতিকে ভয় পায়। এই ভয় তাকে সমর্পণে বাধ্য করে। এই সমর্পনের সুর ভেসে ওঠে তার প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে। বেদের ঋকের মধ্য দিয়ে। ভয় আমাদের স্বাধীনতাকে কেড়ে নিয়েছে।

একটু চোখ বুজুন। ভিতরের দিকে তাকান। নিজেকে দেখুন, ভালো করে দেখুন। মনোযোগ দিয়ে দেখুন। আশ্চর্য হয়ে যাবেন, যাঁকে আপনি এতদিন ধরে, আকাশের প্রান্তে খুঁজছিলেন, যাঁকে আপনি তারকা মন্ডলীর মধ্যে খুঁজছিলেন, সে বসে আছে আপনার ভিতরে। হ্যাঁ আপনার ভিতরে, স্বয়ং আপনি। সাধক চিৎকার করে মরছে, দরজা খোলো, দরজা খোলো, আমি ভিতরে ঢুকবো। কেউ সারা দেয়  না, সারা কেউ দেবে না, আসলে দরজা খোলাই আছে, আপনার  দরকার শুধু ঢুকে পড়া।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ হরি ওম।


ঈশ্বরের এই খেলা বোঝা বড়  দায় মানুষ যে কখন পরিবর্তন হয়ে যায়। 

স্বামী বিবেকানন্দ তখন হিমালয় পরিভ্রমন করছেন। এখানে তিনি অনেক সাধুর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। হিমালয়ে সাধুদের সন্ধান পাওয়া কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু এখানে তিনি এক অদ্ভুত সাধুর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন, যাকে  তিনি চোর হিসেবেই জানতেন। স্বামী বিবেকানন্দ যখন গাজীপুরে পওহারীবাবার আশ্রমে ছিলেন, সেই সময় এই চোরের কথা তিনি শুনেছিলেন। আজ তার সামনে সেই চোর সাধুবেশে হাজির।  এ এক অদ্ভুত দর্শন। সৌম্যমূর্তি ও পবিত্র আচার ব্যবহার দেখে তিনি বুঝেছিলেন, এই সাধু অনুভূতি ক্ষেত্রে সত্যি অতিউর্দ্ধে উন্নীত হয়েছেন।

গাজীপুর অঞ্চলে সেবার চোরের খুব উপদ্রব। একদিন গভীর রাতে পহারীবাবার আশ্রমে এক চোর প্রবেশ করে। দেওয়ালে সিঁধ কেটে সবে চোর ঠাকুর ঘরে পা দিয়েছে, থালাবাসন ঝোলাতে পুড়ছে। এমন সময় , পওহারী বাবা শব্দ শুনে,ভজন গৃহ ছেড়ে ঠাকুর ঘরে  উপস্থিত। সাধুকে দেখে চোর, থালাবাসন রেখে পালাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু  পওহারীবাবা দরজার খিল তুলে দিল। ভীত লজ্জিত চোর, হুড়মুড় করে দরজার কাছে চললো। বাবাজি কিন্তু চোরটাকে পালতে না দিয়ে, দরজার কাছে এসে, হাতজোড় করে, মধুর কন্ঠে বললো, বাবা যদি কৃপাকরে এই দিনের কুটিরে এসেই পড়েছেন, তবে কিছুতেই, আপনাকে আমি খালি হাতে যেতে দিচ্ছি না। এখানে যা কিছু আছে, তা আপনি দয়াকরে নিয়ে যান। না হলে বুঝবো, আমার কোনো গুরুতর পাপের জন্য, আপনার সন্তুষ্টি বিধান করতে পারলাম না। তস্কর ব্যাটা তো  হতবম্ব। সাধু বলে কি ? অন্য অভিসন্ধি আছে নিশ্চয়। সাধু বার বার সকাতরে অনুনয় বিনয় করতে লাগলো। দরজাও খোলা যাচ্ছে না. সাধুবাবা  সেখানেই দাঁড়িয়ে। অন্য উপায় না দেখে, চোর মহাশয়, বাসনভর্তি ঝোলা নিয়ে গমনে উদ্দত হলে, সাধুবাবা দরজা খুলে দিলেন। চোর মহাশয়, দরজা দিয়ে বেরিয়ে, বাসনসহ ঝোলা ফেলে দিয়ে, উর্দ্ধশ্বাসে দৌড় লাগালো। চোর কখনো এমন বিপদে পড়ে  নি। এদিকে  সাধুবাবাও পিছন পিছন ঝোলা নিয়ে ছুটতে লাগলো। আর বলতে লাগলো, দয়াকরে, এগুলো নিয়ে যান, আমাকে অপারাধী  করবেন না। কিন্তু কে কার কথা শোনে। একসময় চোর অদৃশ্য হয়ে গেলো।  সাধু বাবা হতাশ হয়ে বসে পড়লেন।

এই গল্প কথা স্বামীজী গাজীপুরে থাকা কালীন শুনেছিলেন। কিন্তু সেই চোর মহাশয়ের যে একদিন সাক্ষাৎ হবে, তা তিনি স্বপ্নেও ভাবতেও পারেন নি।

পূর্বাশ্রমের সেই চোর আজ সত্যিকারের সাধু। তিনি স্বামীজিকে বললেন - পওহারী বাবা যখন, আমায় নারায়ান-জ্ঞানে অকুণ্ঠচিত্তে সর্বস্য অর্পণ করলেন, তখন আমি আমার নিজের ভুল ও হীনতা বুঝতে পারলাম। সেই থেকে আমি ঐহিক অর্থ ত্যাগ করে পারমার্থিক অর্থের সন্ধানে ঘুরতে লাগলাম। আজ ঘুরছি। স্বামী বিবেকানন্দ এই ঘটনা সারা জীবন মনে রেখেছিলেন। এবং বুঝেছিলেন, পাপী বলে কিছু হয় না, ভগবান যখন যাকে  দিয়ে যা করান । নিরন্তর এই উত্তরণের খেলা চলছে।

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।