ওঁ সহ নাববতু। সহ নৌ ভুনক্তু সহ বীর্যং করবাবহৈ।
তেজস্বি নাবধীতমস্তু মা বিদ্বিষাবহৈ।।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।
ওঁ অর্থাৎ পরম আত্মা বা পরম ঈশ্বর, আমাদের উভয়কে সমভাবে রক্ষা করুন। সমভাবে বিদ্যাফল দান করুন।আমরা যেন সমভাবে বিদ্যাফল লাভের জন্য সামর্থ অর্জন করতে পারি। আমাদের লব্ধ বিদ্যা সফল হোক। আমরা যেন পরস্পর বিদ্বেষ না করি। - হে পরম আত্মা-পরম ঈশ্বর আমাদের ত্রিবিধ শান্তি অর্থাৎ শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্বিক শান্তি হোক।
এবার আমাদের আলোচনা শুরু করি।
গুরুদেব : আজ আমরা আলোচনা করবো পঞ্চভূত নিয়ে। তুমি পূজার আরতি দেখেছো ?
প্রশ্ন : আমি কিন্তু ভালো থাকতে চাই। আর তা ছাড়া পূজার আরতির সঙ্গে পঞ্চভূতের কি সম্পর্ক ? ঠিক আছে, দেখেছি বলুন।
গুরুদেব : কি দিয়ে পূজার আরতি করা হয় ?
শাঁখ, ঘণ্টা, বিভিন্ন বাদ্য - অর্থাৎ শব্দ। এটা কার গুন্ ? আকাশের। এই শব্দ তুমি কি করে টের পাও ? যে হেতু তোমার কান আছে তাই টের পাও। যদি তোমার কান না থাকে, তবে কি হবে ? তুমি শুনতে পাবে না। অর্থাৎ তোমার কাছে শব্দের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। অতএব শব্দদূষণের কষ্ট তোমার থাকবে না। আবার মধুর ধ্বনি অর্থাৎ গান বাজনা বা মায়ের মধুর বাণী তুমি শুনতে পাবে না। অতএব শব্দজনিত কোনো সুখ বা দুঃখ হবে না তোমার কান যদি সতেজ না থাকতো। আকাশের গুন্ হচ্ছে শব্দ। এই আকাশ আমাদের আমাদের কর্ণে স্থিত। এর রূপ সুক্ষ। এর বর্ণ ধুম্র বা ধোঁয়াটে। এর গুন্ শব্দ।
এর পরে কি দিয়ে আরতি হয় ? ঝালর বা পাখা। এই পাখা চালালে বা ঝালর দোলালে কি হয় ? বাতাসের গতির পরিবর্তন হয়, বাতাস আলোড়ন তোলে । তুমি শীতলতা অনুভব করো। তুমি স্পর্শ সুখ বা দুঃখ অনুভব করো। এই শীতলতা কি দিয়ে অনুভব করো ? চর্ম বা ত্বক দিয়ে। দেখো এই চর্ম যদি সতেজ না থাকে বা তোমার যদি ত্বক না থাকতো তবে তুমি স্পর্শসুখ অনুভব করতে পারতে না। আবার স্পর্শ জনিত যে দুঃখ অর্থাৎ গরম হাওয়া লাগলে তোমার যে কষ্ট হয় তাও তুমি অনুভব করতে পারতে না। অতয়েব স্পর্শ জনিত কোনো সুখ বা দুঃখ হবে না যদি তোমার ত্বক সতেজ না থাকে। বায়ুর গুন্ হচ্ছে স্পর্শ।
অতএব এই বায়ু আমাদের চর্ম বা ত্বকে স্থিত। এর রূপ শ্যামার্ত্ত। এর বর্ণ শ্যামল। এর গুন্ স্পর্শ।
প্রশ্ন : সে-তো বুঝলাম। আমার এই দেহ না থাকলে, আমার কোনো কষ্ট বা সুখ থাকবে না। কিন্তু আমার তো দেহ আছে। এখনো আমি শব্দ শুনতে পাই , এখনো আমার চামড়ায় অনুভূতি আছে। এই অবস্থায় আমি কি করে ভালো থাকবো ? সেটা আমাকে বলুন।
গুরুদেব : তুমি বড্ড অস্থির। এই অস্থিরতাই তোমার দুঃখের কারন। তুমি স্থির হয়ে বসো। যা বলছি শোনো। তুমি সবই জানো, আমি তোমাকে কেবল স্মরণ করাতে চাইছি। সত্য তোমার স্মরণে এলে তোমার সুখ দুঃখ চলে যাবে। তুমি সত্যে স্থিত হবে। সুখ দুঃখের ওপারে চলে যাবে। আনন্দে অবস্থান করবে। তোমার দরকার স্থিরতা। এবং সত্য অনুভব করা। অস্থির চিত্ত কখনো সুখী হতে পারে না। শুধু তাই না, অস্থিরমতি মানুষ কখনো গুরুর আশ্রয়ে যেতে পারে না। গুরুও তাকে আশ্রয় দেয় না। তুমি কি রাজা জনক ও ব্যাসদেব পুত্র- শুকদেব-এর কাহিনী শোনো নি ? শোনো :
ব্যাসদেব যিনি স্বয়ং মহাভারতের স্রষ্টা। সেই ব্যাসদেব ও পিঞ্জলা পুত্র শুকদেবকে তার পিতা রাজা-জনকের কাছে পাঠালেন, ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার জন্য। ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করার জন্য। শুকদেব ব্যাসদেব থেকেও উচ্চ স্তরের মহামানব, মহাঋষি ছিলেন। শুকদেব পিতার আজ্ঞায় বিদেহ রাজা জনকের কাছে গেলেন। শুকদেব যখন রাজা জনকের রাজ্য-দরবারে পৌঁছালেন, তখন জনক রাজার দরবারে নাচ-গান-বাজনা চলছিল। রাজার কাছে সংবাদ গেলো। রাজা শুকদেবকে দরবারে ডেকে পাঠালেন। শুকদেব রাজার কাছে ব্রহ্মজ্ঞান জানার জন্য এসেছেন শুনে - কানায় কানায় ভরা একটি জলপাত্র হাতে দিয়ে বললেন দরবারের চতুর্দিকে পরিক্রমা করে এস। শুকদেব জলপাত্র হাতে নিয়ে নিবিষ্ট চিত্তে, নাচ-গান-বাজনার উন্মাদনাকে উপেক্ষা করে স্থির চিত্তে পরিক্রমা সমাপ্ত করলেন, ও রাজার কাছে জোড় হাত করে নতজানু হলেন।
চিত্ত স্থির না হলে জ্ঞান চিত্তে প্রতিফলিত না। তুমি চিত্ত স্থির করো। অস্থির চিত্ত দুঃখের উদ্রেক করে। অতএব যদি তুমি দুঃখ থেকে নিবৃত্তি চাও তবে স্থির চিত্ত হও। যা বলছি শোনো। হ্যাঁ যা বলছিলাম :-
আরতিতে প্রদীপ জ্বালা হয়। প্রদীপ আগুন, বা তেজের প্রতীক। আকাশ ও বাতাসের কোনো রূপ ছিল না। এইবার আত্মা রূপ পরিগ্রহ করলেন। আগুনের বা তেজের রূপ আছে। এই রূপ, আমরা কি দিয়ে অনুভব করি ? চোখ দিয়ে। আমাদের যদি চোখ না থাকতো তবে এই রূপ দেখতে পারতাম না। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু প্রতিভাত অর্থাৎ আমরা দেখতে পারছি, সবই এই তেজের জন্য দেখতে পারছি। আলো না থাকলে আমরা কিছুই দেখতে পারতাম না। অন্ধকারে আমরা কিছুই দেখতে পাই না। চোখ না থাকলে জাগতিক জগৎ আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয় না। তাকে আমরা অনুভব করতে পারি না। তাই দৃষ্টিনন্দন জনিত সুখানুভূতি বা কুদৃশ্য জনিত দুঃখের যে অনুভূতি বা ভীতিপ্রদ দৃশ্য জনিত কষ্টের যে অনুভূতি বা ভয় তা আমাদের থাকতো না। আগুনের রূপ সুন্দর, তেজোময়। এর বর্ণ ভস্ম বা ধূষর । তেজ-এর গুন্ হচ্ছে রূপ।
এরপর জল বা গঙ্গা জলের ব্যবহার : দেখেছো নিশ্চই আরতির সময় শান্তিজল ছিঁটানো হয়। জলকেই বলা হয় অপ। এই অপের স্থিতি আমাদের জিহ্বায়। এই জিহ্বা না থাকলে আমরা আস্বাদন করতে পারতাম না। খেয়াল করে দেখেছো নিশ্চই খাবার যতক্ষন আমাদের জিহ্বার সঙ্গে সঙ্গে থাকে ততক্ষন আমাদের স্বাদবোধ। পেটে চলে গেলে আর স্বাদবোধ বা বিস্বাদবোধ থাকে না। জিভ অসার হয়ে গেলে স্বাদবোধ চলে যায়। এই জিভ-ই আমাদের খাদ্যে গুন্ আরোপ করে। অর্থাৎ রসগল্লায় মিষ্টি, নিমপাতার তেতো, লংকায় ঝাল ইত্যাদি ইত্যাদি কল্পিত গুন্ আরোপ করে। আমাদের ভালো লাগা বা মন্দা লাগা অনুভূতি উৎপন্ন করে। এই জিভ না থাকলে আমাদের খাবার জিনিসের জন্য প্রলোভন বা বিরক্তির উদ্রেক হতো না। আমরা সাম্যাবস্থায় থাকতাম। নির্লোভী অর্থাৎ খাদ্যের প্রতি নির্লোভী হতে পারতাম। তা হয়নি তাই আমরা লোভনীয় খাবার পেলে খুশী হই, না পেলে আমরা দুঃখী হই। এই অপের রূপকেই বলা হয় দ্রব্য, .এর বর্ন কিঞ্চিৎ গৌর। অপের গুন্ হচ্ছে রস।
এর পর দেখো আরতির উপাদান ফুল, ধুপ। এ গুলো গন্ধের প্রতীক। এই ধূপের গন্ধ, ফুলের গন্ধ তুমি কি করে পাও ? অর্থাৎ কোন্ ইন্দ্রিয় দ্বারা পাও ? নাক দিয়ে। তাই আমাদের শরীরে নাসিকায় পৃথ্বী ভূতের স্থিতি। দেখো নাক না থাকলে, নাক বন্ধ হয়ে গেলে তোমার সুগন্ধ, বা দুর্গন্ধের অনুভূতি হবে না। সুগন্ধ বা দুর্গন্ধ জনিত সুখ বা দুঃখ তোমার নাক থাকার কারণেই হচ্ছে। নাসিকা না থাকলে তোমার এসব হতো না। এই পৃথ্বী ভূতের রূপ স্থির, বর্ন শুক্ল আর গুন্ হচ্ছে গন্ধ ।
এতক্ষন যা বললাম তাতে তুমি নিশ্চই বুঝেছো যে আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় আমার সুখ দুঃখের অনুভূতি এনে দেয়। এর পর আমরা আরও গভীরে যাবো। দেহের অঙ্গ হিসেবেই এই ইন্দ্রিয় কাজ করে, না এর কোনো পরিচালক শক্তি আছে ? কারন জগতের সব শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ সবাইকে কি সমান অনুভূতি দেয় ? নাকি প্রকার-ভেদে তার তারতম্য হয় ? এ সব আলোচনা আমরা পরের দিন করবো।
ওম শান্তিঃ, শান্তিঃ, শান্তিঃ।