Saturday 29 February 2020

সাধনা - ৭ - কঠোপনিষদ - স্বর্গ লাভের উপায়/ জপ সাধনা


সাধনা - ৭ আধ্যাত্মিক জীবনের পথে - স্বর্গ লাভের উপায়। তথ্যসূত্রঃ শিবসংহিতা, হঠযোগ প্রদীপিকা, কঠোপনিষদ 
স্বর্গ লাভের উপায়।
আমরা কঠোপনিষদ সন্মন্ধে শুনেছি। সেখানে নচিকেতা ও যমরাজের মধ্যে কিছু উচ্চ স্তরের কথোপথন আছে। প্রশ্ন করছিলেন, নচিকেতা আর উত্তর দিচ্ছিলেন যমরাজ। তো নচিকেতা তখন একটা প্রশ্ন করেছিলেন, আর তা হচ্ছে, হে মৃত্যুর রাজা, স্বর্গলাভের উপায় যে অগ্নিবিদ্যা আছে, তা আমাকে সবিস্তারে বলুন। আমি শুনেছি, মৃত্যুর পরে যারা স্বর্গলোকে যান, তারা অমৃতত্ব লাভ করে থাকেন।  আমাকে এই অগ্নিবিদ্যা দান করুন।

যমরাজ বলছেন : অমরত্ব লাভের পথ হলো এই অগ্নি। অগ্নিই জগতের আশ্রয়। আর এই অগ্নি থাকে জ্ঞানী ব্যক্তির মনের গভীরে প্রচ্ছন্ন অবস্থায়।
আমরা এই স্বর্গলাভের উপায়টি একটু ভালোভাবে বুঝবার চেষ্টা করবো। প্রথমত স্বর্গ ব্যাপারটা কি ? আর এর অবস্থান কোথায় ? সেটা একটু শুনে নেই। স্বর্গ হচ্ছে একটা লোক বা জগৎ। যেখানে আনন্দই আনন্দ। আনন্দ বই কিছু নেই। আর এই স্বর্গলোক আমাদের এই পার্থিব জগতের মতোই একটা স্থান। আর সেখানকার বাসিন্দারা হচ্ছেন দেবতাগণ। যারা অসীম পুন্য করে, এখানকার বাসিন্দা হবার অধিকারী হয়েছেন। যারা ভোগ বিলাসে নিমগ্ন। আর এই অদ্ভুত স্থানটি নাকি পৃথিবী সংলগ্ন। স্বর্গপ্রাপ্তির আর একটা অর্থ আমরা জানি, সেটা হচ্ছে মৃত্যুবরণ। কিন্তু মৃত্যু হলেই সবাই আমরা স্বর্গে যেতে পারি না। তো আমরা কিভাবে এই স্বর্গলাভ করবো, বা আনন্দধামে যাবো, সেসব কথা আমরা শুনবো।  

আসলে আমরা সবাই অর্থাৎ  এই জীবজগৎ পৃথিবী সংলগ্ন  হয়েই আছে। কিন্তু এর মধ্যেও আমরা আসলে একেকজন এক-এক জগতের বাসিন্দা। আমাদের প্রত্যেকের একটা নিজস্ব জগৎ আছে। ঘর সংসার মাতা-পিতা,  ছেলে-মেয়ে,  বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন, ইত্যাদি নিয়ে একটা জগতে আমরা বাস করি। আবার আমাদের একটা কর্ম্ম জগৎ আছে, যেখানে আমরা আমাদের সহকর্ম্মী, আমাদের অফিসের বস, আমাদের গ্রাহক ইত্যাদি নিয়ে একটা জগৎ আছে। আবার আমাদের প্রত্যেকের একটা নিজস্ব মনো জগৎ আছে। যেখানে এদের সবাইকে নিয়ে "আমি" অবস্থান করে। প্রথম দুটি অর্থাৎ সংসার ও কর্ম্ম জগতের  প্রভাব আমার এই মনোজগতকে প্রভাবিত করে, আমরা ভালো থাকি বা খারাপ থাকি। স্থুল শরীরে যেমন আমরা শারীরিক সুখ-দুঃখ ভোগ করি, তেমনি এই মনোজগতের মধ্যে দুটো অবস্থা হয়, একটা খারাপ অবস্থা আর একটা ভালো অবস্থা। এই ভালো অবস্থাকে বলে স্বর্গ আর খারাপ অবস্থাকে বলে নরক। এখন কথা হচ্ছে, তাহলে একথা কেন বলা হয়, যে মৃত্যুর পরে আমার স্বর্গ অথবা নরকে অবস্থান হবে ? আসলে আমাদের তথাকথিত যে মৃত্যু তা হচ্ছে আমাদের স্থুল দেহের মৃত্যু। আমাদের যে সূক্ষ্ম দেহ আছে, তার কিন্তু সহজে মৃত্যু হয় না। এছাড়া আমরা যখন জাগ্রত অবস্থায় থাকি, তখন এই স্থুল দেহে অবস্থান করি, কিন্তু যখন আমার নিদ্রিত থাকি, তখন আমার এই মানসিক দেহে অবস্থান করি। এই অবস্থাতেও আমরা  মানসিক সুখ-দুঃখ অনুভব করি।
আমরা যখন স্থুল শরীর ধারণ করি, তখন কতকগুলো বহির্মুখী ইন্দ্রিয়শক্তি নিয়ে জন্ম গ্রহণ করি। আর এই বহির্মুখী ইন্দ্রিয়শক্তিএবং আত্মশক্তির মধ্যে সংযোগকারী হিসেবে কাজ করে মন।  আমাদের মন যখন ইন্দ্রিয়শক্তির কার্যপ্রণালীতে লিপ্ত থাকে তখন আমরা বহির্মুখী হই । আবার এই মন যখন অন্তর্মুখী হয়, অর্থাৎ আত্মশক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়, তখন আমরা আধ্যাত্মিক হই। ইন্দ্রিয়গুলো বাহ্যজগতের স্থূল বস্তু অনুভব করতে পারে। এই ইন্দ্রিয়গুলোকে নিষ্ক্রিয় ক'রে, মনও যখন নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে তখন আমাদের সুসুপ্তির অবস্থা হয়। অর্থাৎ মন এবং ইন্দ্রিয় সবই তখন কোনো কাজ করে না। মন আত্মার শক্তিতে শক্তিমান, কিন্তু ইন্দ্রিয়শক্তিতে ক্রিয়াশীল। ইন্দ্রিয়ের প্রভু হচ্ছে মন।  আর মনের প্রভু হচ্ছে আত্মা। জীবাত্মা ও পরম-আত্মা এক ও অভিন্ন। পঞ্চকোষের জালে আবদ্ধ আত্মাকে বলে জীবাত্মা, আর পরম-আত্মা সদা সর্বদা উন্মুক্ত।

সাধক প্রাণশক্তির মধ্যে আত্মাকে দর্শন করতে পারেন। কেননা প্রাণের মধ্যেই চেতনশক্তি বিদ্যমান। এই প্রাণের সাহায্যেই জীবের শরীরে চেতন  শক্তি ঘোরাফেরা করেন। প্রাণ হচ্ছে বাহক, চেতন হচ্ছেন, আরোহী। এই চেতন শক্তি তার বাহনে চেপে অর্থাৎ প্রাণশক্তিতে ভর করে, আমাদের হৃদয়গুহাতে অবস্থান করেন। তাই প্রাণের নিষ্ক্রমনে আমরা চেতনাহীন বা মৃত হয়ে যাই।
বেদবাদীগণ যজ্ঞের অগ্নি প্রজ্বলিত করে, ব্রহ্মের  সাধনা করেন। আর যোগীগণ হৃদয়ে অগ্নি প্রজ্বলিত করে, ব্রহ্মের ধ্যানে মগ্ন থাকেন। এই হৃদয়ে অগ্নি কিভাবে জ্বলানো হয় ?
আমরা জানি আমাদের দেহে আছে নটি দ্বার, দুটো চোখ, দুটো কান, দুটো নাকের ছিদ্র, মুখ, পায়ু (গুহ্যদ্বার), উপস্থ (জনন-ইন্দ্রিয়) । এছাড়া আরো দুটো ছিদ্র আছে নাভি ও ব্রহ্মরন্ধ্র। আমরা এও জানি, আত্মা বা চেতন শক্তি বায়ুর সাহায্যে আমাদের এই স্থুল দেহে প্রবেশ করেন। বায়ু আমাদের শরীরে তার গুন্শক্তি ও কর্ম্মক্ষেত্ৰ অনুসারে আমাদের দেহের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে  প্রাণবায়ু উর্দ্ধগতি সম্পন্ন হয়, আর অপান  বায়ু নিম্নগতি সম্পন্ন হয়। অপান  বায়ুর কর্মস্থল  নাভি থেকে নিচের দিকে। আর প্রাণ বায়ুর কর্মস্থল হৃদয় থেকে উপরে দিকে।
বায়ুর যেমন কোনো রূপ নেই, অগ্নির কোনো রূপ নেই, যেমন পাত্র বা যেমন দাহ্যবস্তু সেইমতো বায়ু বা অগ্নি রূপ ধারণ করে থাকে । আর বায়ুকে অগ্নি সর্বদা উর্ধমুখে পরিচালিত করে। অর্থাৎ বায়ু যখন অগ্নির স্পর্শে আসে, তখন বায়ু শুদ্ধ, সূক্ষ্ম ও উর্দ্ধমুখী হয়।  
মানুষের হৃদযন্ত্রের সঙ্গে অসংখ্য ধমনী যুক্ত। এদের একটা ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। ব্রহ্ম রন্ধ্র হচ্ছে সুষুম্না নাড়ীর ছিদ্রপথ।  জীবাত্মা যখন এই পথে বেরিয়ে আসে, তখন  মানুষ অমরত্ত্ব লাভ করে।
আরো একটু পরিষ্কার করে ব্যাপারটা বুঝে নেই। আমাদের শরীরে সাড়ে তিনলক্ষ নাড়ী বিদ্যমান। এদের মধ্যে চোদ্দটা নাড়ী প্রধান।  সুষুম্না, ইড়া, পিঙ্গলা, গান্ধারী, হস্তিজীহ্বা, কুহু, সরস্বতী, পূষা, শঙ্খিনী, পয়স্বিনী, বারনী, অলম্বুষা, বিশ্বদরী, যশস্বিনী। এর মধ্যে আবার তিনটি নাড়ী প্রধান, ইড়া - পিঙ্গলা -সুষুম্না। এই তিনটি নাড়ীর মধ্যে আবার সুষুম্না প্রধান। যোগ সাধনের জন্য এই সুষুম্না নাড়ীকে আমাদের আশ্রয় করতে হয়। ইড়া নাড়ীকে চন্দ্র নাড়ী বলা হয়। পিঙ্গলাকে সূর্য নাড়ী, আর সুষুম্নাকে অগ্নি নাড়ী বলা হয়। 
আবার এই সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে আছে বজ্রাক্ষা নাড়ী।  বজ্রাক্ষা নাড়ীর মধ্যে আছে চিত্রাণি নাড়ী।  এই চিত্রাণি নাড়ীর মধ্যে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর একটা ছিদ্রপথ আছে। তাকে বলে ব্রহ্মরন্ধ্র। আমাদের কুলকুণ্ডলিনী শক্তি মূলাধার থেকে সহস্রারে গমন করেন এই ব্রহ্মপথ দিয়ে। এবং সেখানে অর্থাৎ সহস্রারে গিয়ে  পরম-ব্রহ্মের সঙ্গে মিলিত হন। এই ব্রহ্মপথকে কেউ বলেন, ব্রহ্মবিবর, কেউ বলেন ব্রহ্মরন্ধ্র। 
সূর্য্যমন্ডলের মধ্যে দ্বাদশ কলা রশ্মি আছে। এই রশ্মিদের  সঙ্গে মিলিত হয়ে নাভির অধোদেশে প্রজ্বলিত অগ্নি আমাদের খাদ্যকে জীর্ন করে থাকে। এই অগ্নিকে যোগের ভাষায় বলা বৈশ্বানর অগ্নি। সূর্য বা রুদ্রদেবের তেজ থেকেই এই অগ্নির উদ্ভব। যোগী এই বৈশ্বানর অগ্নিকে কুম্ভকের সাহায্যে প্রজ্বলিত রেখে বায়ুকে উত্তপ্ত করেন। বায়ু তখন কুল-কুণ্ডলিনী শক্তিকে নিয়ে   ব্রহ্মবিবরে প্রবেশ করেন ও সহজেই পরম-ব্রহ্মের সঙ্গে মিলিত হন। এটাকেই বলে স্বর্গপ্রাপ্তি। এটাকেই বলে স্বর্গলাভ। এই অবস্থায় আমাদের বাহ্যজ্ঞান লোপ পায়। আমরা জ্ঞানাতীত ব্রহ্মে অবস্থান করি। তাই কঠোপনিষদ -এর আচার্য্য যমরাজ্  নচিকেতাকে   বলছেন, অমরত্ব লাভের পথ হলো এই অগ্নি। অগ্নিই জগতের আশ্রয়। আর এই অগ্নি থাকে জ্ঞানী ব্যক্তির মনের গভীরে প্রচ্ছন্ন অবস্থায়। এই অবস্থায় আমাদের স্ব-রূপের উপলব্ধি হয়। আমরা যে অমর  আত্মা, এই স্থূল দেহ বা মন বা জ্ঞান নোই , সেই বোধে স্থিত হই। তখন আমি বলে কিছু থাকে না। এটাকেই বলে স্বর্গলাভ। 
তবে একটা কথা আমরা বার বার বলে থাকি, এই কুম্ভকের ক্রিয়া গুরুমুখে শুনে, গুরুসান্নিধ্যে থেকে আয়ত্ত্ব করতে হয়। বই পড়ে বা আমাদের এই কথা শুনে কুম্ভকের ক্রিয়া করতে যাবেন না। আমাদের এই প্রয়াস, ভারতের মুনি-ঋষিদের সাধন-পদ্ধতির সম্পর্কে সাধারণের আগ্রহ সৃষ্টি করা মাত্র। তার বেশি কথা কিছু নয়।  
ওম শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।  হরি ওম। 

সাধনা - পর্ব্ব - ৮ : জপ-কুণ্ডলিনী জাগরণের একটি নিরাপদ উপায়।

জপ সাধনা 
তথ্যসূত্রঃ - তত্ত্বজ্ঞান সাধনা - মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত
আমাদের ছোটবেলায়, ভূতের হাত  থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য, রাম  নাম জপ্ করতাম ।   সেই  রাম  নাম জপ করে, আমরা ভূতের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতাম কি না জানিনা, তবে ভূতের ভয় থেকে নিষ্কৃতি পেতাম।
আজও আমাদের কেউ গালাগালি দিলে আমাদের রাগ হয়। কেউ প্রসংশা করলে, আমাদের ভালো লাগে। ভিড়ের মধ্যে আমার নাম ধরে কেউ ডাকলে, আমার দৃষ্টি আকর্ষণ হয়। এমনকি আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি, তখন কেউ আমার নাম ধরে ডাকলে, আমি সজাগ হয়ে উঠি। অর্থাৎ নামের সঙ্গে আমাদের স্বরূপের অনুভূতির একটা সম্পর্ক আছে। অর্থাৎ নাম একটা প্রতীক, যা আমাকে জাগিয়ে তোলে, বা আমার অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলে। 
সমস্ত ধর্ম্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই এই নাম-জপের একটা গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে। উপনিষদে ঈশ্বর-এর নাম রাখা হয়েছে ওঁ। পতঞ্জলি যোগসূত্রে ওঁ-কে ঈশ্বরের প্রতীক বলা হয়েছে। 
এছাড়া ঈশ্বরের গুন্ বর্ণনা ক'রে, বা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা ক'রে কিছু সংক্ষিপ্ত শব্দ বা বাক্য আমাদের ঋষি-মুনিরা রচনা করে গেছেন। এগুলোকে বলা হয় মন্ত্র। যেমন গায়েত্রী মন্ত্র, মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র, গনেশ মন্ত্র, বিষ্ণুমন্ত্র, শিব মন্ত্র, সূর্য মন্ত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। ইসলামে আল্লাহ বা আলি মন্ত্র জপের নির্দেশ আছে।  খ্ৰীষ্ট ধর্ম্মে যীশুর পুন্য নাম নিরন্তর জপের কথা বলা হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্ম্মে "নমু অমিদা বুৎসু" (জাপানী)
জপের নির্দেশ আছে। অর্থাৎ জপকে সবাই গুরুত্ত্ব দিয়েছে। 

হিন্দুদের মধ্যে তা সে শৈব বলুন, বৈষ্ণব বলুন শাক্ত বলুন সবাই কোনো না কোনো ভাবে জপের গুরুত্ত স্বীকার করেছেন। এমনকি এখনকার রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম, বা অন্যান্য ধর্মীয় সংগঠন সবারই জপের প্রতি নিষ্ঠা আছে।

জপ ধাতুর অর্থ হৃদয়ে স্মরণ। আর হৃদয়ে কাকে স্মরণ করা হয় ? না ঈশ্বরকে বা ঈশ্বরের গুন্গুলোকে। অনেক সময় ঈশ্বরের স্তুতি বা প্রার্থনাও করা হয়ে থাকে এই জপের মাধ্যমে। এই জপ তিনভাবে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। বাচিক, মৃদু, ও মানস জপ। অর্থাৎ যে জপ শ্রবণযোগ্য তাকে বাচিক জপ, যে জপ মনে মনে উচ্চারণ করা হয়ে কিন্তু  কেবলমাত্র ওষ্ঠ কম্পিত হতে থাকে,  তাকে মৃদু বা উপাংশু  জপ বলা হয়ে থাকে। সবশেষে মানসজপ যা কেবলমাত্র মনে মনে উচ্চারিত হয়ে থাকে। বাইরে থেকে কিছুই বুঝবার উপায় থাকে না। জপ আবার কেউ সংখ্যা গুনে রাখেন।  আবার কেউ সংখ্যা গোনেন না। কেউ আবার মালার সাহায্যে গুনে রাখেন, কেউ আবার হাতের আঙুলে গুনে রাখেন। সব ধরনের জপই ভালো, তবে প্রথমদিকে বাচিক, তারপরে মৃদু, এবং শেষে মানস জপ সাধনের নির্দেশ দিয়ে থাকে মহাত্মাগণ। কিন্তু আমরা লক্ষ করেছি, আপনি যদি বাচিক জপ দিয়ে শুরু করে, এবং শরীর ক্লান্ত  হয়ে গেলে মৃদু বা উপাংশু, এবং জপের গভীরতা বৃদ্ধি পেলে মানস জপ করতে পারলে ভালো ফল প্রদান করে থাকে।  এমনকি আমাদের মানস জপ তখন স্বতঃস্ফূর্ততা  প্রাপ্তি পায়। 

             




































     

Wednesday 12 February 2020

সাধনা - পর্ব্ব - তিন - ধ্যানের উপকারিতা


সাধনা - পর্ব্ব - তিন - ধ্যানের উপকারিতা - স্থুলদেহ ত্যাগের পরেও চলতে থাকবে। 

আমরা সাধনার  কথা শুনছিলাম । এর আগে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব্বের আলোচনায়, যম (অর্থাৎ সর্বদা সত্যকে আশ্রয় করে থাকতে হবে, হিংসা করা চলবে না, পরের দ্রব্য না বলে গ্রহণ করা চলবে না, শরীরের মূল্যবান  বীর্যশক্তি রক্ষা করতে হবে, দান গ্রহণ করা চলবে না ) এবং নিয়ম  (অর্থাৎ দেহের ও মনের শুচিতা বজায়  রাখতে  হবে, বর্তমান অবস্থায় সন্তুষ্ট থাকতে হবে, তপস্যা করতে হবে, স্বাধ্যায়  অর্থাৎ ভালো  অভ্যাসের ধারাবাহিকতা রাখতে হবে, প্রতিদিন ঈশ্বরের উপাসনা করতে হবে। ) এর পরে আমরা শুনেছি, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান, সমাধি সম্পর্কে। এর পরে আমরা শুনবো, আসন, প্রাণায়াম সম্পর্কে। কিন্তু তার আগে, আমরা শুনে নেবো, আসন, প্রাণায়াম, ধ্যান করলে আমাদের কি উপকার হতে পারে। আসন প্রাণায়াম করলে আমরা শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে পারবো। এগুলো সম্পর্কে আমরা ধীরে ধীরে বিস্তারিত শুনবো।   কিন্তু আজ আমরা শুনবো ধ্যান করলে আমাদের কি লাভ হতে পারে। আমরা এর আগে শুনেছি, ধ্যানে বসলে নানান রকম চিন্তা আসে, সেই নানানরকম চিন্তা থেকে মনকে সরিয়ে আনাকে প্রত্যাহার বলে।  আর ইষ্টে মনকে নিবিষ্ট করাকে ধারণা বলে । এই ধারণাই ধীরে ধীরে ধ্যানে পরিণত হয়। আর ধ্যান পরিপক্ক হলে স্বাভাবিক ভাবেই যা হয়, তার নাম সমাধি। এগুলো আমরা শুনেছি। কিন্তু ধ্যানের উদ্দেশ্য কি ?
ধ্যান হলো, প্রকৃত আমির উৎসে যাবার বিরামহীন  প্রয়াস। আমি আসলে জীবাত্মা। আর এই জীবাত্মা সদা সর্বদাই পরম-আত্মার সান্নিধ্যে রয়েছে। এবং সেই পরম-আত্মার কাছ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে নিজস্ব একটা অস্তিত্ত্ব তৈরি করেছে। এই সম্পর্কে আমরা সচেতন নোই। এই সচেতনতার বৃদ্ধির জন্য, আমাদের ধ্যানে প্রবৃত্ত হতে হয়। বস্তু জ্ঞান থেকে আমরা চৈতন্যের স্তরে নিজেকে উত্তরণ করতে চাই। আর এই যাত্রা পথের  শেষে আমাদের মন অনন্ত প্রশান্তিতে ভরপুর হয়ে যায়। অপরিসীম ও অহেতুক এক অনাবিল আনন্দ আমাদেরকে ঘিরে থাকে। এটাই ধ্যানের প্রাপ্তি।
এখন কথা হচ্ছে কিভাবে এটা হয় ? দেখুন, প্রাণহীন বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কের জন্য  আমাদের মধ্যে আনন্দ হয়। আবার প্রাণের বা প্রাণীর সঙ্গে  সম্পর্কেও  আমাদের একটা আনন্দ হয়। আর এই প্রাণ ও বস্তুর সমন্নয়ে  তৈরি যে জীবজগৎ তার সঙ্গে সম্পর্কেও আমাদের আনন্দ হয়। তো এই বস্তু ও জীবজগৎ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। ফলতঃ আমাদের এই বস্তু-নির্ভর ও জীব-নির্ভর যে আনন্দ তা ক্ষণস্থায়ী।ফলতঃ  বস্তুর অভাবে বা বিনাশে আমাদের দুঃখ উৎপন্ন হয়, ঠিক তেমনি জীবের জীবন তো অনিশ্চিত। কাল তাকে সর্বদা পরিবর্তন করছে, একটা সময় নাশ করছে। তো আমাদের আনন্দ যদি এদের উপরে নির্ভরশীল হয়, তবে আমাদের আনন্দ কখনোই চিরন্তন হতে পারে না। আমরা বিভিন্ন সম্পর্কের মধ্যে আনন্দ খুঁজি বা আনন্দ পাই। আমরা ছেলে-মেয়েকে ভালোবেসে আনন্দ পাই।  আমরা মা-বাবার উপরে নির্ভর করে নিশ্চিন্ত থাকি। কিন্তু মা-বাবা চিরকাল থাকেন না। আবার ছেলেমেয়েরাও আমাদের ছেড়ে কর্ম্মের সন্ধানে বেরিয়ে যায়। আমরা তখন দুঃখ অনুভব করি। আমরা বাড়ি-গাড়ী পেয়ে আনন্দ পাই। কিন্তু এই বাড়ি গাড়ি আমাদের সর্বোচ্চ সুখ দিতে পারে না। আর এগুলো সবই ক্ষণস্থায়ী। তাই বার বার করে মনে হয়, হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য  কোনোখানে।   এই আনন্দ চিরন্তন নয়। তাই  এই চিরন্তন আনন্দের জন্যই মুনি-ঋষিরা  চিরন্তন বস্তু খুঁজে বের করেছেন।  আর তা হচ্ছে চেতনা।  চেতনশক্তি।  আমরা যখন চেতনশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি, তখন আমরা নিরবিচ্ছিন্ন আনন্দ ভোগ করতে পারি। হ্যাঁ আমাদের দেহ, আমাদের জীবন বলতে আমরা যা বুঝি, তাতো চিরন্তন নয়।  তবে আমরা কেন এই চিরন্তন বস্তুর খোঁজ করি ? আসলে যিনি আমিকে বুঝতে  পেরেছেন, যিনি নিজের স্বরূপকে চিনতে পেরেছেন, তিনি জানেন, "আমি" কখনোই অস্থায়ী নয়। আমার এই দেহ অস্থায়ী। অর্থাৎ আমি এখন যেখানে বাস করছি, সেই দেহটি অস্থায়ী। আমরা, আমার-আমার বলে  যাকিছু ভাবছি, সেগুলো অস্থায়ী, কিন্তু আমিতো অস্থায়ী নয়, আমি চিরস্থায়ী ।   আমার এই দেহের নাশের  পরেও আমি থাকবো। কিন্তু সেই থাকা হবে, জন্ম জন্মান্তরের যে সংস্কার আমার মধ্যে তৈরি হচ্ছে, সেগুলোকে  নিয়েই তখন আমাদের চলতে হবে। অর্থাৎ আমি কর্ম্মক্ষম থাকাকালীন অবস্থায়, আমি যাকিছু সংগ্রহ করবো, আমার চাকরি থাকা কালীন অবস্থায় আমি যে ধন সঞ্চয় করতে পারবো, সেই সঞ্চয় দিয়েই  বৃদ্ধাবস্থার দিনগুলো আমাদের কাটাতে হবে। অর্থাৎ দেহ কর্ম্মের ক্ষমতা হারালে, বা দেহের  নাশের  পরে যে দিনগুলো আসবে, তখন আর আমাদের  সঞ্চয় করবার ক্ষমতা থাকবে না। কিন্তু ভোগ থাকবে। যেমন বৃদ্ধাবস্থায় আমাদের সংগ্রহ করবার ক্ষমতা থাকে না, কিন্তু ভোগ থাকে। ঠিক তেমনি আমাদের দেহ নাশের পরেও আমাদের ভোগ থাকবে, কিন্তু কর্ম্মক্ষমতা থাকবে না।  আসলে এই দেহ ভিন্ন আমরা কর্ম্ম করতে পারি না। তাই এই পৃথিবীকে বলা হয়, কর্ম্মক্ষেত্ৰ। আর এটি যেহেতু প্রতিনিয়ত মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে, তাই এর আর এক নাম মৃত্যুপুরী। আমাদের এটা বুঝতে হবে, আমাদের এই দেহ ধারনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, অনন্ত যাত্রার জন্য, রসদ সংগ্রহ করা । আমরা যতক্ষন এই দেহে থাকবো, ততক্ষন আমাদের উচিত হচ্ছে, আমাদের ভবিষ্যতের জন্য রসদ সংগ্রহ করা।

এখন কথা হচ্ছে, আমাদের এই স্থুল দেহ নাশের পরে, আমাদের ভোগ থাকবে, সেটা কি করে সম্ভব।  ভোগ তো দেহের। তো দেহ ভিন্ন আমাদের পক্ষে কিভাবে ভোগ করা সম্ভব হবে । সেক্ষেত্রে বলি, দেহ তো আমাদের একটা নয়, দেহ আমাদের অসংখ্য। এই অসংখ্য দেহকে  বুঝবার সুবিধের জন্য  তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে । স্থুল, সূক্ষ্ম, ও কারন। 
অনন্ময় দেহ স্থূল, অর্থাৎ হাড় -মাংসের শরীর । যে দেহ আমাদের চক্ষুগোচর।

প্রাণময় দেহ। অর্থাৎ আমরা জানি এই শরীরের মধ্যে সবর্ত্র ছড়িয়ে আছে প্রাণের শক্তি।  এই প্রাণ আর কিছু নয়, বায়ুর সূক্ষ্মতম সংস্করণ। তো স্থূল দেহের ভিতরেই আছে, এই প্রাণময় দেহ।  প্রাণময় দেহ সুক্ষ। দেখা যায় না কিন্তু বোঝা যায়। 
এর পরে আছে, মনোময় দেহ। আমাদের মনের একটা জগৎ আছে। আর এই জগৎটি আর কিছুই নয়, আমাদের চিন্তা ভাবনা দিয়ে গঠিত। অর্থাৎ আমাদের মনের চিন্তা -ভাবনা দিয়ে গঠিত হচ্ছে, আমাদের মনোময় শরীর। এটিও সূক্ষ্ম কিন্তু আমাদের বুদ্ধির অগোচর নয়।

এর পরে আছে বিজ্ঞানময় শরীর।  অর্থাৎ আমাদের যে জ্ঞান তার আধাঁর হচ্ছে বিজ্ঞানময় শরীর। 
আর যে শরীরে আনন্দ অনুভব হয়, সেটি হচ্ছে আনন্দময় শরীর। 

যাই হোক আমাদের আলোচ্য বিষয় ধ্যান, ও তার উপকার। তাই আমরা দেহ নিয়ে বেশি আলোচনা করবো না।  
আমাদের যখন মৃত্যু হয়, তখন আমাদের এই স্থুল  দেহের নাশ হয় মাত্র। সূক্ষ্ম ও কারন দেহ থাকে। এরমধ্যে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ মৃত্যুর পরে মনময় দেহে  অবস্থান করে থাকেন। 

আর সত্যি কথা বলতে কি, ভোগ শরীরের নয়, ভোগ হয় জীবাত্মার। আর আমাদের মৃত্যুর পরে, জীবাত্মা আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় শক্তি, আমাদের কর্ম্মফল , ইত্যাদি  সংস্কার আকারে  সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে থাকে। তাই আমাদের সংস্কার বা বৃত্তিগুলো  যদি শুদ্ধ হয়, তবে আমাদের তথাকথিত মৃত্যুর পরেও আমরা ভালো থাকতে পারি। একেই বলে স্বর্গবাস   আর আমাদের সংস্কারের মধ্যে যদি অশুভ বৃত্তির ভাগ বেশি থাকে, তবে আমাদের কষ্ট ভোগ করতে হয়।  একেই বলে নরক যন্ত্রনা।

ধ্যানের মাধ্যমে আমরা আমাদের বৃত্তিগুলোকে বা সংস্কারগুলোকে  ধরতে পারি। আর এই বৃত্তিগুলিকে আমরা যদি বিচার-বিশ্লেষণ দ্বারা সংশোধন করতে পারি, তবে আমরা যেমন এই স্থুল দেহে  থেকেও পরমশান্তি  ভোগ করতে পারি। তেমনি  আমরা যখন স্থূল দেহের নাশের পরে  সূক্ষ্ম দেহে অবস্থান করবো তখনও আমরা আনন্দে থাকতে  পারবো। ধ্যানের এটাই উদ্দেশ্য।

আমরা প্রকৃতির মধ্যে বাস করছি। প্রকৃতির গুন্ তিন রকম।  সত্ত্ব, রজঃ তম। এই গুনগুলোর ধর্ম্ম-ই হচ্ছে মানুষের মনকে সদা চঞ্চল করে রেখে, সুখ-দুঃখ আনন্দ-বিষাদ ভোগ করানো। কিন্তু আমরা যদি ধ্যানমগ্ন হতে পারি, তবে আমাদের মনের গতি হবে উর্দ্ধমুখী।  অর্থাৎ তখন আমাদের মন আত্মার সান্নিধ্য অনুভব করতে পারবে। আর এই আত্মার সান্নিধ্য মানে আনন্দময় সত্ত্বার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা।  আর এই আনন্দময় সত্ত্বার সঙ্গে যখন আমরা নিজেদেরকে  সম্পৃক্ত করতে পারবো, তখন প্রকৃতির যে প্রভাব আমাদের মধ্যে বিদ্যমান আছে,  সেই প্রভাব ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাবে । এবং আমাদের সমস্ত অস্তিত্ত্ব তখন শান্ত, সংযমী ও তেজস্বীতায় ভরপুর হয়ে হবে।  এই ধ্যানে যখন আমরা একটা নিরবিচ্ছিন্ন ধারা বজায় রাখতে পারবো, তখন আমাদের মন হবে স্থির, শান্ত।  আমাদের চিন্তাশক্তি তখন স্বচ্ছতা লাভ করবে।  আমাদের মন-প্রাণ তখন বিশ্বমনের স্পর্শে সতেজ  ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। আমাদের মনন শক্তি তখন বৃদ্ধি  পাবে।  আমাদের ধীশক্তি বৃদ্ধি পাবে। বুদ্ধি ধারালো হবে, বোঝার ক্ষমতা বৃদ্ধি  পাবে।  এমনকি বাহ্যিক কর্ম্মেও আমাদের উদ্দম বৃদ্ধি পাবে। সবার সঙ্গে আমাদের  একটা মধুর সম্পর্ক স্থাপন হবে। আর নিজের মধ্যে যখন আনন্দ উৎসারিত হবে, তখন আমাদের চারিপাশে যারা থাকবেন, তারাও শান্তিতে আনন্দে থাকবে। আপনার ভিতর থেকে একটা শান্তির তরঙ্গ প্রবাহিত হবে। যা অন্যকে প্রভাবিত করবে । আপনার মধ্যে উদ্বেগ কমে যাবে , দুশ্চিন্তা কমে যাবে। আর খেয়াল করবেন, একটা অদৃশ্য শক্তি আপনাকে সঠিক পথে পরিচালনা করবেন । আপনি তখন অনিষ্টকর কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে বাধ্য থাকবেন। শুভশক্তি আপনাকে চুম্বকের মতো টানতে থাকবে, আর যাকিছু আপনি করবেন, তা শুভ ফল প্রদান করবে। আপনার রক্ত চাপ কমে হবে। ধ্যান  যখন ঠিক ঠিক ভাবে হবে, তখন আপনার অল্পসময়ে বেশী বিশ্রামের উপযোগিতা মিলবে। আসলে ধ্যানে একটা প্রাণবন্ত সূক্ষ্ম-তড়িৎপ্রবাহ আমাদের দেহে সঞ্চালিত হয়। যা মস্তিস্ক থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত এক ধরনের শিহরনের সঞ্চার করে। দেহ মনে একটা পুলক, একটা রোমাঞ্চ অনুভব হয়। সত্যি কথা বলতে কি, ধ্যানের উপকারিতার কথা ভাষা দিয়ে বলে শেষ করতে পারা  যায় না। আর এটা ভাষার দোষ  নয়, ভাষার উপরে আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের জন্যই, আমরা সব কথা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না। আজ বাক্যের বিরাম দিলাম। 

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি ওম।












































Tuesday 4 February 2020

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ

দ্বিতীয় অধ্যায়

আজ আমরা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ থেকে কিছু কথা শুনবো। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ কৃষ্ণ যজুর্বেদের অংশ। ঋষি শ্বেতাশ্বতর এই উপনিষদের সংকলক। ঋষি শ্বেতাশ্বতর ইন্দ্রিয়গুলোকে সংযত করেছিলেন। আমরা জানি,কঠ উপনিষদে শরীরকে রথের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আর  রথের  ঘোড়াগুলোকে ইন্দ্রিয়ের সাথে তুলনা করে হয়েছে। শ্বেত - কথাটার অর্থ শুভ্র, অশ্ব কথাটার মানে ঘোড়া। তো যিনি ইন্দ্রিয়রূপ ঘোড়া গুলোকে বশ করেছিলেন, তিনি শ্বেতাশ্বতর। এই উপনিষদে কতকগুলো জটিল প্রশ্নের সমাধান করা হয়েছে। যেমন এই মহাবিশ্বের কারন কি ? কে আমাদের স্রষ্টা ? আমরা কোথা থেকে আসি ? পরিণামে যাবোই বা কোথায় ? কে আমাদের চালাচ্ছে ? আমাদের সুখ-অসুখের কারন কি ? আর সব থেকে বড় প্রশ্ন  হচ্ছে, আত্মজ্ঞান লাভের  উপায় কি ? আমরা আজ এই শেষ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজবো। 

তত্ত্বজ্ঞান লাভের  জন্য  বা পরম-আত্মাকে জানবার জন্য আমাদের কি করা উচিত।  পরমাত্মাকে জানলে সাধকের বা যোগীর কি হয়, সেই সম্পর্কে আমরা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ থেকে শুনবো।শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ বলছেন, পরমাত্মাকে জানতে গেলে  প্রথমে প্রার্থনা করতে হবে । কিন্তু কার কাছে প্রার্থনা করবো ? আর কেনই বা প্রার্থনা করবো ? ধরুন আমি অদ্বৈতবাদী। আমি মনে করি, ঈশ্বর এক এবং সবত্র।  তিনি আমার মধ্যেও আছেন, তিনি আমার বাইরেও আছেন। তাহলে আমি আবার  কার কাছে প্রার্থনা করবো।

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ উপনিষদ বলছেন, সূর্য্যের কাছে প্রার্থনা করুন। কারন  যতক্ষন আপনার দেহবোধ আছে, যতক্ষন আপনি নিজেকে বিশ্বসংসার থেকে আলাদা মনে করেন, যতক্ষন নিজেকে স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে মনে করেন, ততক্ষন আপনাকে সেই বিশ্বশক্তির কাছে প্রার্থনা করতে হবে। এখন এই বিশ্বশক্তি তো আমার উপল্বদ্ধিতে নেই। তাই আমার উপল্বদ্ধিতে যা  আছে, যা আমাদেরকে আমাদের জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করে, তিনি হচ্ছেন  আকাশের সূর্যদেব ।  সূর্য এতই বিরাট বিশাল, এতই শক্তিমান, যে সূর্য বিনা আমাদের জীবন অসম্ভম। সূর্য না থাকলে পৃথিবীতে প্রাণের স্পন্দন দেখা যেত না। সমস্ত আলোর উৎস  এই সূর্য, সমস্ত জীব উজ্জিত হয়ে ওঠে এই আলোর স্পর্শে। সূর্য ছাড়া কোনো কিছুর বেড়ে ওঠা বা আমাদের জীবন ধারণ অসম্ভব।  তাই এই আলোর উৎসর কাছে প্রার্থনা করুন। আমাদের মনের আকর্ষণের বিষয় হচ্ছে এই জগৎ।  এই জগৎ আমাদের মনটাকে প্রতিনিয়ত টানছে। আমরা যাতে এই জগৎ থেকে মনটাকে তুলে নিতে পারি,আর বিশ্বশক্তির   চরণপদ্মে নিবেদন করতে পারি, সেইজন্য প্রথমে   আমাদের সূর্যের কাছে প্রার্থনা করতে হবে।

আমরা গায়েত্রী মন্ত্র শুনেছি। যাঁকে  সাবিত্রী মন্ত্র বলা হয়ে  থাকে। সেখানে সবিতা দেবের উদ্দেশ্য প্রার্থনার সুর ধ্বনিত হয়েছে।  এখন কথা হচ্ছে, সবিতা দেবের  উদ্দেশ্যে আমরা কি প্রার্থনা করবো ? আমাদের উদ্দেশ্য জগতের যিনি উৎস সেই  ব্রহ্মের  কাছে যাওয়া।

তাই আমাদের প্রার্থনা হবে "সূর্য যেন কৃপা করে আমার মন ও ইন্দ্রিয়গুলোকে পরমাত্মার দিকে চালিত করেন। আমার ইন্দ্রিয়গুলো সর্বদা বহির্মুখী, তারা বাইরের বিষয় নিয়েই  মেতে থাকে। আমার এই ইন্দ্রিয়গুলো যেন  বহির্মুখ থেকে অন্তর্মুখী হয়। হে  সূর্যদেব, আপনার অগ্নির্জ্যোতি ও তার সমস্ত প্রকাশ শক্তি যেন আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে প্রোজ্জ্বল করে তোলেন, যাতে আমার দেহ -মন পরমাত্মার উপল্বদ্ধির যোগ্য হয়ে উঠতে পারে। "  

আসলে আমরা জানি অগ্নি সর্বদা উর্দ্ধমুখী। অগ্নিতে যা কিছু আহুতি দেওয়া হয়,  সবই উর্দ্ধমুখী হয়ে যায়।  আর সবিতাদেবের যে তেজঃশক্তি তা যেমন  পৃথিবীর সব কিছুকে প্রকাশ করে, তেমনি  মাটির ভিতরে যে সম্ভানাময় বীজ গ্রথিত আছে, তাকে উদ্গমন করে তোলেন এই সূর্যদেব । অগ্নি ব্যতীত প্রথিবীর কোনো কিছুই প্রকাশিত হতে পারে না। তাই নিজেকে প্রকাশিত করতে হলে আমাদের সেই সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা করতে হবে।

পঞ্চভূতের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মেলন হচ্ছে এই মানবদেহ। আর মানবদেহে স্থিত ইন্দ্রিয়গুলো বহির্মুখী  হওয়ার ফলে এই জগৎ দৃশ্যমান হয়েছে। শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ - এগুলোর উপলব্ধি ইন্দ্রিয় ব্যতীত হওয়া সম্ভব নয়। আর আমাদের সমস্ত জ্ঞান এই ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই হয়ে থাকে। তো এই ইন্দ্রিয়গুলোকে যদি আমরা বহির্মুখী না করে অন্তর্মুখী করতে পারি, তবে পরমজ্ঞান লাভ করতে আমরা সমর্থ  হবো।

এর পরের কাজ হচ্ছে ধ্যানে নিবিষ্ট হওয়া। জ্যোতির্ময় সূর্যদেবের কৃপায় আমরা পরমাত্মায় মন স্থির করবো। ধ্যান ইত্যাদি দ্বারা আমরা পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হবার চেষ্টা করবো। আর প্রার্থনা করবো, সূর্যদেব প্রসন্ন হয়ে আমার মনকে পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত করুন। তাহলে আমার পঞ্চইন্দ্রিয় অবশ্যই  পরমাত্মার দিকে ধাবিত হবে। আমরা প্রার্থনা করবো, সেই জ্যোতিস্বরূপ পরমাত্মাকে উপলব্ধি করবার জন্য, আমাদের যে বিচার শক্তি প্রয়োজন, তাও যেন সবিতাদেব আমাদেরকে দান করেন।

এতে করে আমরা একসময় দেখবো, আমাদের মন এবং ইন্দ্রিয়গুলো পরমাত্মাতে কেন্দ্রীভূত  হয়েছে। এইসময় আমাদের সর্বজ্ঞ সূর্যদেবের প্রতি একান্তভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। ধ্যানের  মাধ্যমে ইন্দ্রিয়সকল ও তার অধীশ্বরকে নমস্কার করা উচিত। প্রাণের আকুতি নিয়ে, স্তুতি করুন, মনে করুন অমৃতপুত্ররা, যারা দিব্যধামে আছেন, তারা সবাই আপনার কথা শুনতে পারছেন। আর এই অবস্থায় আমরা যা কিছু করি না কেন, তার ভালো মন্দ যাই হোক না কেন, সেই কর্ম্মের কোনো ফল আমাকে আবদ্ধ   করতে পারবে না। আমি সমস্ত কর্ম্ম বন্ধন থেকে মুক্ত থাকবো।

আমাদের জীবনে সবার একই লক্ষ মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ। আর এই সমাধি লাভের  জন্য, আমাদের এমন আসনে বসতে হবে, যাতে আমাদের মাথা-ঘাড়-বুক শরীরের এই তিনটি অংশ সোজা ও সমান্তরাল থাকে। এর পর  আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোকে প্রণব নামক নৌকার মাধ্যমে  মনের মধ্যে একত্রিত করতে হবে। এইভাবে আমরা ভয়ঙ্কর এই জীবন নদী পার হবো। আসলে এই নৌকারই  আর এক নাম ব্রহ্ম। আর ব্রহ্মই প্রণব।

যিনি যোগাভ্যাস করবেন, তার কর্তব্য-অকর্তব্য সম্পর্কে সদা সচেতন থাকতে হবে। অর্থাৎ  খাদ্যাভ্যাস ও পবিত্র চিন্তা।  শরীরকে পবিত্র রাখতে হবে। মনের চিন্তায় পবিত্রতা বজায় রাখতে হবে।  সচেতন ভাবে, যত্ন সহকারে, প্রাণবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ক্লান্তিবোধ না করা পর্যন্ত নিঃশাস ত্যাগ করবেন না। মন যেন দেহরূপ রথের দুরন্ত-অশান্ত ঘোড়া। দক্ষ সারথির মতো, চঞ্চল মনকে সংযত করে, পরমাত্মায় নিবদ্ধ করতে হবে।

যোগ হচ্ছে আত্মসংযমের বিজ্ঞান। মন ও আমাদের ইন্দ্রিগুলোকে বসে  আনতে  হবে,  আর এই কাজ অন্য কেউ করে দিতে পারবে না। তাই নিজেকে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যোগী হতে চাইলে ধর্ম্মের ঠাকুর ঘরে ঢুকতে চাইলে সংযমরূপ চাবি নিজের হাতে নিতে হবে।

যোগের স্থান হবে, ১. সমতল, ২.শুদ্ধ। ৩.নুড়ি-পাথর বালি, বা আগুন থাকবে না। ৪.কোলাহলমুক্ত ৫.কাছাকাছি কোনো নদী বা হ্রদ থাকবে না। ৬. স্থানটি হবে মনোরম ও নয়নসূখকর।  ৭.স্থানটি গুহা বা  ঐজাতীয় স্থান হলে ভালো হয়, অর্থাৎ বাতাস যেখানে শান্ত। উপনিষদ তাই গুহায় ধ্যানের  অভ্যাস করতে বলছেন।

ব্রহ্ম-উপলব্ধির ঠিক আগে যোগী-সাধক তুষার, ধোঁয়া, সূর্য, বাতাস, আগুন, জোনাকি, স্ফুলিঙ্গ, স্ফটিক, চাঁদ প্রভৃতি দেখতে পান। এগুলো সবই ব্রহ্মজ্ঞানের পূর্বাভাস।  এইসময় সাধক স্থুল বস্তুর মধ্যে যে গুন্ নিহিত আছে, তার সন্ধান পেতে থাকেন। এই সময় যোগীর কাছে, পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ এই স্থূল পঞ্চভূত আর স্থুল থাকে না। তিনি এসবের মধ্যে, এর গুণগুলো অর্থাৎ রূপ, রস, শব্দ, স্পর্শ, গন্ধ প্রভৃতি গুনগুলোকেই দেখতে পান।  যোগীর দেহও তখন আর স্থূল থাকে না।  সে দেহীর রূপান্তর ঘটে। ব্যাধি জরা, মৃত্যু আর  সে দেহকে স্পর্শ করতে পারে না। যোগীর তখন ইচ্ছা মৃত্যু হয়।



পৃথিবী-অপ-তেজঃ-অনিল-খে সমুত্থিতে
পঞ্চাত্মকে যোগগুনে প্রবৃত্তে।
ন তস্য রোগো ন জরা ন মৃত্যুঃ
প্রাপ্তস্য যোগাগ্নিময়ং শরীরম।  (২/১২)

এই সময় সাধকের শরীরে একটা হালকা ভাব অনুভূত হয়। অর্থাৎ শরীর হয় ছিপছিপে।  রোগাদি ও ভোগলিপ্সার অভাব দেখা দেয় তখন । গায়ের রঙ হয় উজ্জ্বল। কন্ঠস্বর হয় মধুর। দেহে একটা সুগন্ধ পাওয়া যায়। এই অবস্থায় যোগীর মল-মূত্রের পরিমান কমে যায়। (১৩) স্বামী লোকেশ্বরানন্দ বলছেন, লক্ষণগুলো যে সর্বদা দেখা যাবেই, এমন কথা বলা যায় না। তবে এগুলো এলো কি এলোনা তা নিয়ে মাথা ঘামাতে নেই। সাধকের একটাই লক্ষ আর তা হচ্ছে ব্রহ্ম-উপলব্ধি।

এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা শুনি। রামকৃষ্ণদেব নরেনকে অদ্বৈতবাদ সম্পর্কে অনেক নিগূঢ় তত্ত্ব উপদেশ দিতেন।  নরেন শুনতো কিন্তু সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম হত না। তো একদিন তামাক খেতে খেতে নরেন প্রতাপ চন্দ্র হাজরাকে বলছেন, " একি কখনো হতে পারে ? ঘাঁটিটা ঈশ্বর, বাটিটা ঈশ্বর, যা কিছু দেখছি এমনকি আমরা সকলেই ঈশ্বর। এমনসব ব্যাঙ্গালাপ চলছিল।  তো ঠাকুর তখন অর্ধবাহ্য দশায়। ঠাকুর "তোরা কি বলছিস রে ?" বলে হাসতে হাসতে  নরেনকে স্পর্শ করে সমাধিস্থ হলেন। আর এতে করে নরেনের মধ্যে এক অদ্ভুত ভাবান্তর উপস্থিত হল।  আমরা সেইকথা স্বামীজীর  মুখে শুনবো। বলছেন :
"ঠাকুরের ঐদিনকার অদ্ভুত স্পর্শে মুহূর্তের মধ্যে ভাবান্তর উপস্থিত হলো। স্তম্ভিত হয়ে সত্যি সত্যিই দেখতে লাগলাম, ঈশ্বর ভিন্ন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অন্য কিছু নাই। এমনটা দেখেও নীরব রইলাম, ভাবলাম - দেখি কতক্ষন পর্যন্ত এই ভাব থাকে।  কিন্তু সেই ঘোর সেদিন কিছু মাত্র কমল না। বাড়িতে ফিরলাম, সেখানেও তাই। যা কিছু দেখতে লাগলাম, সে-সবই তিনি, এমন বোধ হতে লাগলো।" 

যেকোনো কিছু ধৌত  করলে, তা সে জল দিয়েই হোক, অগ্নি দিয়েই হোক বা কোনো রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে, ধৌত  করলেই  সোনা খন্ডের উজ্জ্বল্য ফিরে আসে, তেমনি যিনি নিজের আত্মাকে সকলের আত্মা বলে উপলব্ধি করতে পারেন, তবে বুঝবেন তিনি অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন। তিনি তখন সব সুখ-দুঃখের পরে চলে যান। (১৪)

এই সময় যোগী নিজেকে উজ্জ্বল দীপশিখার মতো দেখতে পান। তিনি যে ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম অনুভব করেন, ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যান। আর এই উপল্বদ্ধির ফলে তিনি জন্ম মৃত্যু, অর্থাৎ সমস্ত পরিবর্তনের উর্দ্ধে চলে যান। অজ্ঞানতার প্রলোভন তার কেটে যায়। অবিদ্যাজনিত সকল বন্ধন  থেকে তিনি মুক্ত হয়ে জ্যোতিস্বরূপ পরম-আত্মাকে লাভ করেন। (১৫)

এই পরম-আত্মা, পরম-ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজ করছেন। তার প্রথম প্রকাশ বিশ্ব-মন রূপে। তিনিই মাতৃগর্ভে থাকেন। তিনিই  শিশু হয়ে জন্মান। ভবিষ্যতেও তিনিই আবার  শিশু হয়েই  জন্মাবেন। সব মুখ তো তাঁরই মুখ। সব দেহের সমষ্টি তিনিই ।  তিনি বিরাট পুরুষ তিনি সকল সত্তায় বিদ্যমান। (১৬)
আমরা সেই বিরাট পুরুষকে নমস্কার করি। জলে স্থলে, ঔষধিতে বনস্পতিতে  অর্থাৎ বিশ্বজুড়ে রয়েছেন সেই  পরমাত্মা। তস্মৈ দেবায় নমো নমঃ।  (১৭)

ওম শান্তি শান্তি শান্তিঃ।  হরি  ওম।