Monday 26 November 2018

চার্বাক ও নারদের আখ্যান

                                                                                                             
                                                                                                                      
চার্বাক ও নারদের  আখ্যান

আজ আপনাদের একটা আজগুবি গল্পো শোনাবো। আপনারা সবাই ঋষি চার্বাকের নাম নিশ্চই শুনেছেন। শুধু তাই নয় তার বিখ্যাত উক্তি : ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ, আপনারা সবাই শুনেছেন। আজ সেই ঋষি চার্বাক ও ব্রহ্মাপুত্র নারদের সাক্ষাতের কাহিনী বলবো। যা আপনি কখনো শোনেননি .......
কলিকালে দেবতাদের  খাবারের খুব আকাল পড়েছে। জাগযজ্ঞ নেই বললেই চলে। এখন আর কেউ খাবার আগে দেবতাদের উদ্দেশে একমুঠো অন্ন তুলে দেয় না। শুলেই নরকের ঘন্টাধ্বনি শুনতে পান দেবরাজ ইন্দ্র। অসুরেরা পাতালে  নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।  মর্তের  লোকেরা অর্থাৎ মৃত্যুলোকেও মানুষেরা  নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। কেবল দেবরাজ ইন্দ্রের চোখে ঘুম নেই। উর্বশীর নাচ, রম্ভার নাচ আর ভালো লাগে না তার। সোমরস কেমন যেন বিস্বাদ  লাগে। কোথায় যেন এক বিপদের ঘন্টাধনি শুনতে পাচ্ছেন দেবরাজ ইন্দ্র।  মনে মনে ভাবছেন, এর আগে তো এমনতরো হয় নি। কতো গর্হিত কাজ করেছি, কিন্তু এমনতরো কখনো হয়নি।  ঋষি গৌতমের স্ত্রী অহল্যাকে একবার   সয্যাসঙ্গিনী করেছিলাম, ঋষি গৌতম আমাকে শাপ দিয়েছিলো।  আমার সমস্ত শরীর সহস্রযোনীর ক্ষতে পূর্ন হয়ে গিয়েছিলো । সেসবও  এককালে  ভালো হয়ে গেছে, অশ্বিনী কুমারদ্বয়ের  চিকিৎসায়। কিন্তু এখন কি হলো ?
দেবরাজ ইন্দ্রের এখন এক অদ্ভুত অসুখ, এক আশঙ্কা, এক ভীতি গ্রাস করেছে। এই অসময়ে,  তিনি সবজান্তা নারদকে, সর্বত্রগামী নারদকে শরণ  করলেন। মহামুনি নারদ এলে, তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বলতো আমার কেন এমন লাগছে ? তুমি একটু মর্ত থেকে খবর নিয়ে এস তো। সেখানে সব ঠিক ঠাক আছে কি না। ব্রাহ্মণরা সব সুরক্ষিত আছে কি না।  ধর্ম পালন করছে কি না সব। জাগযজ্ঞ সব ঠিক ঠাক মতো হচ্ছে কি না।   আমার কেন এত উদ্বিগ্ন লাগছে ? তুমি একটু মর্তে গিয়ে দেখতো,  আমাদের এজেন্টরা অর্থাৎ ব্রাহ্মণরা, ঋষিরা, মুনিরা সব ঠিকঠিক মতো কাজ করছে কি না।
নারদ এলেন মর্তে। এসে এক অদ্ভুত ঋষির দর্শন পেলেন। তিনি হচ্ছেন ঋষি চার্বাক। বেশ জাঁকিয়ে আশ্রম খুলে বসেছেন। হাজার হাজার গরু তার আশ্রমে। প্রচন্ড পরিশ্রমী। বুদ্ধিমান। আত্মনির্ভর। ঈশ্বরের প্রতি তার বিন্দুমাত্র বিশ্বাসও  নেই, আবার অবিশ্বাসও নেই। ঈশ্বর নিয়ে তার না আছে চিন্তা না আছে অনুষ্ঠান। মিষ্টভাষী, অতিথি পরায়ন। সত্যভাষী। ভয়ভীতি বলে কিছু নেই। নীরবে কর্মই যার ধর্ম। নারদ খবর নিয়ে জানলেন, এঁকে  কেউ বলেন, বৃহস্পতি, কেউ বলে চার্বাক।
নারদ ভাবলেন, চার্বাক শব্দের অর্থ মিষ্টভাষী।  আর একটা অর্থ হচ্ছে চারু-বাক অর্থাৎ সত্যভাষী। যার কাছে ঈশ্বর পৌঁছয়নি, তারাই চার্বাক। যার কাছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা  অনস্তিত্ত্ব, বলে  কিছুই   নেই সে-ই চার্বাক। এঁরা অর্থাৎ চার্বাকপন্থীরা, পুরুষাকারে বিশ্বাসী। ঈশ্বর বলে কিছু আছে, তা তারা মানেন না, আবার অস্বীকারও করেন না । এরা  না আস্তিক, না নাস্তিক। এরা  ঈশ্বর সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন, নির্লিপ্ত ।
নারদ তো সর্বজ্ঞ, চোখ বুজে নারদ চার্বাকের সৃষ্টি কেমন করে হলো, সেটা  দেখতে লাগলেন। এবং দেখলেন,  বার্ধ্ক্যে প্রজাপতি ব্রহ্মা রিপুগ্রস্থ হয়ে দুঃখের দেবী শোচনাকে কামনা করেছিলেন। শোচনা ব্রহ্মাকে শুধু প্রত্যাখ্যানই  করেন নি, তিরস্কার করেছিলেন এই বলে যে, তুমি একটা বিকৃতমনা ব্যভিচারী। এই ভর্ৎসনা শুনে প্রজাপতি ব্রহ্মা দুঃখের দেবী, শোচনাকে  অভিশাপ দিয়েছিলো এই বলে যে "দূর হ স্বর্গ থেকে"। তো শোচনা শাপগ্রস্থ হয়ে পৃথিবীতে অর্থাৎ মৃত্যুপুরীতে চলে আসে। দুঃখ দিয়ে যার জীবন গড়া। দুঃখ যার জীবন সঙ্গী তাদের আমরা বলি শুদ্র। সেবাই যার ধর্ম্ম সেই শুদ্র ।  সব ধৰ্ম থেকে বিতাড়িত হয়ে যেখানে  আশ্রয় হয় সবার, সেটাই শুদ্রঘর। সেই  শূদ্র ঘরে জন্ম নেন শোচনা । তার স্বামীর নাম ছিল পুরুষাকার। এই শোচনার পুত্রের নাম চার্বাক, কেউ বলেন বৃহস্পতি, কেউ বলেন শূদ্র চার্বাক।
নারদ ধীর পায়ে, চার্বাকের আশ্রমে প্রবেশ করলো। গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গাভী। অসংখ্য শিষ্য-সামন্ত, সন্তান-সন্ততি।  জমজমাট  সংসার। কিন্তু সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। কে এলো, কে গেল তার প্রতি তাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। চার্বাক তখন,গরুর খাবার দিচ্ছেন। নারদ গিয়ে চার্বাককে দর্শন দিলেন। চার্বাক নারদকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আপ্যায়ন  করলেন।  নারদ তো সব দেখে অবাক।  কি নেই, ঝলমলে আশ্রম। মাঠে সবজির বাগান, ফলের বাগান, আর সব আশ্রমীরা কর্মে ব্যস্ত। রূপবতী স্ত্রী এলো। কুণ্ঠাহীন সাবলীল গর্বিতা নারী। আপ্যায়ন করলো নারদকে । নারদতো খুব  খুশী।  কিন্তু একটা জিনিস তাকে অবাক করলো, আশ্রমের কোথাও কোনো  ঠাকুরের মূর্তি নেই।  পূজা অর্চনার কোনো ব্যবস্থা নেই। তো যাই হোক, নারদ দুপুরের খাবার খেলেন, বত্রিশ ব্যঞ্জনে তৃপ্তি নিয়ে খেলেন। খাবার পরে তাকে পান খেতে দেওয়া হলো। এইবার বিশ্রাম নিতে বললেন, কিন্তু নারদের খুম এলো না। যেখানে নারায়ণের মূর্তি  নেই, সেখানে তার ভালো লাগে না । যেখানে ধর্ম নেই।  সেখানে নারদের ভালো লাগে না। তো ভাবলেন, এঁকে  একটু ধর্মজ্ঞান দেওয়া দরকার। সবই ঠিক আছে, কেবল এদের ঈশ্বর বিশ্বাস নেই।  এটা  একটু জাগানো দরকার। তো আশীর্বাদের ভঙ্গিতে বললেন - ঈশ্বরের কৃপায় তোমার সব মঙ্গল হোক। এই কথা শুনে, চার্বাক আহত বাঘের মতো গর্জন করে উঠলো। আমি আপনার আশীর্বাদ চাই। আপনি আমার মঙ্গল কামনা করুন। আমি ঈশ্বরের কৃপা চাই না। এই জীবন আমার, এর রক্ষার দায়িত্ত্ব আমার, আমার মেধা, আমার পরিশ্রম আমাকে স্বছন্দ করেছে। এখানে ঈশ্বর নামক কল্পিত কারুর সহযোগিতা নেই। এই যা কিছু দেখছেন সবই আশ্রমীদের পরিশ্রমের ফল। এর মধ্যে কোনো ঈশ্বরের কৃপা নেই। আমার তথাকথিত ধর্ম আমাকে রক্ষা করে না। আমাকে রক্ষা করে, আমার কর্ম আমার জ্ঞান।এটাই আমার ধর্ম।  আমি ভিক্ষারী নোই। আবার ঈশ্বর কর্তৃক প্রতারিত একজন ব্যর্থ মানুষও নোই। যারা ঈশ্বর বিশ্বাস করে কর্মহীন হয়ে বসে থাকে। তারা নিজেকেই প্রতারণা করে। ঈশ্বরের কৃপাকে আমি উপেক্ষা করি। ঈশ্বরের দয়া আমার দরকার নেই। আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন। তাতেই হবে। যদি তা না করতে চান, বা না করতে পারেন,  তবে আশীর্বাদের বিষয় ছাড়ুন। যা  নিজে পারেন তাই  করুন, আর এক জনের দোহাই দেবেন না। এই ঈশ্বরটা কে আপনার ? তাকে দেখতে  পারেন ? কোথায় থাকেন ? কি কাজ  তাঁর  ?
দুপুরের ভোজনে তৃপ্ত নারদ, প্রমাদ গুনলো, তার শরীর  কাঁপতে লাগলো। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললো : দেখো চার্বাক এই পৃথিবীটা তো তাঁরই  সৃষ্টি।  ঈশ্বরের সৃষ্টি। এই সমস্ত জীব জন্তু, গাছপালা সবই তার সৃষ্টি। এমনকী তোমাকেও তিনিই সৃষ্টি করেছেন। তিনি না থাকলে এই জীবন কি করে এলো , কোত্থেকে এলো ?
চার্বাক বললো : দেখুন কারুর কৃপাতেই এই পৃথিবী সৃষ্টি হয় নি। এই পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে চারটি জড় পদার্থের সমাহারে।  অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এই চারটি জড় পদার্থের সমাহারে পৃথিবীর সৃষ্টি। এখানে তোমাদের ঈশ্বরের কোনো কেরামতি নেই। এই চারটি জিনিস বাদ  দিয়ে তোমাদের ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করতে পারে ? পারে না অতএব তোমার্  ওই আজগুবি ঈশ্বরের কথা রাখো। আর শোনো তোমরা বলো পাঁচ ভূত, আমি বলি চার ভূত কর্ম করে, আর এক ভূত খায়। তোমাদের ওই আকাশ ভূত খালি খায়। তোমরা আত্মা সম্পর্কে বলে থাকো " শস্ত্র দ্বারা ছেদন করা যায় না, অগ্নি একে  দহন  করতে পারে না, জল একে ভেজাতে পারে না, বায়ু একে শুকাতে পারে না। তো তোমার কাল্পনিক ঈশ্বর আকাশ ভূতেরও  উর্দ্ধে। শোনো তোমার শরীর, তোমাদের কথা অনুযায়ী এই শরীর পাঁচ ভূতের মিশ্রণ। আর তোমার আত্মা এই পাঁচ ভূতের ধরাছোঁয়ার বাইরে। যে ধরাছোঁয়ার বাইরে, অর্থাৎ যাকে  আমি ধরতে পারি না, সে আমাকে কি করে ধরবে ? আমার উপকারও করতে পারবে না, অপকারও করতে পারবে না। তো তোমার আজগুবি কল্পনা ছেড়ে, কাজে মন দাও।   
নারদ এবার ভীত হলো, শঙ্কিত হলো।  সত্য যদি প্রচার হয়ে যায় তবে আমাদের দেবতাদের কি হবে ? কিন্তু নারদ পিছু হটার পাত্র নয়।  সে বললো ঠিক আছে, মানলাম জড় পদার্থের সমাহারে এই পৃথিবী, কিন্তু এখানে প্রাণ কি করে এলো ? ঈশ্বরই তো প্রাণ সৃষ্টি করেছেন। জড় পদার্থতো জীবনের জন্ম দিতে পারে না। জড় জগতে প্রাণের জন্ম দিয়েছেন ঈশ্বর।
চার্বাক এবার  সতর্ক। এ ব্যাটা ঈশ্বরের চর।  আমাকে ঈশ্বরজ্ঞান দিতে এসেছে।  দেখুন, আপনার মুখে পান। ঠোঁট আপনার লাল। আপনি পান খেছেন, অর্থাৎ পান,, খয়ের,  চুন, সুপুরি খেছেন। এর কোনোটাই লাল নয়। কিন্তু আপনার ঠোঁট লাল। কোত্থেকে এলো এই লাল ? আসলে পদার্থের গুন্ অর্থাৎ দুটি পদার্থের গুন্ নতুন গুনের সৃষ্টি করে। পান সুপুরি চুন, খয়ের গালে ফেলে যখন চিবোনো হয় তখন এই লাল রঙের সৃষ্টি হয়। যা আপনার সারা গালে,  ওষ্ঠকে রাঙিয়ে ফেলেছে। তেমনি মাটি জল, বায়ু, অগ্নি যে জড় পৃথিবীর জন্ম দিয়েছে সেই জড় পদার্থের সমাহারে নতুন একটা গুন্ জন্ম নিয়েছে, আর তা হলো জীবন। জড় পদার্থের প্রকৃতিই হচ্ছে মানুষের অজৈব শরীর।  সুতরাং এই পৃথিবী বা জীবন সৃষ্টিতে ঈশ্বরের কোনো ভূমিকা নেই।
দেবর্ষি নারদে সারা গা দিয়ে ঘাম ঝরছে। মনে মনে ভাবছে। এই সব কথাতো ঈশ্বর সব শুনছেন। এখন নিশ্চয় কোনো অঘটন ঘটবে। আকাশ থেকে বজ্র নিক্ষিপ্ত হবে প্রবল আক্রোশে। এক্ষুনি প্রবল ঝড় ঝঞ্ঝা শুরু হবে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, কিছুই হলো না। ব্রহ্মাপুত্র নারদ বাকহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন অসহায় হয়ে।  পৃথিবীবাসী  এক প্রবল পরিশ্রমী, আত্মবিশ্বাসী, পুরুষ নির্বিবাদে কথাগুলো বলে গেল। হঠাৎ কোনো দৈবশক্তি তার মুখ চেপে ধরলো না। নারদের নিজেকে মনে হলো পরগাছা।
মানুষের বিশ্বাসের গভীরে, অজ্ঞানতার  অন্ধকারে, যে বীজ ব্রাহ্মণ ঋষিদের দ্বারা রোপন করা হয়েছিল, তা যেন ম্লান হয়ে গেল। স্বর্গ তো অন্তরীক্ষে। যেখানে দেবতারা থাকে, ঈশ্বর থাকে। সেখানে তো মাটি নেই। তাই সেখানে যা জন্মায় তার শিকড় গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। শুধু অন্ধ বিশ্বাসের ভিত্তিমূল কখনো দৃঢ় হতে পারে না। তাই ঈশ্বর উপরে উপরে থাকে, মানুষ যখন অসহায় হয় তখন ঈশ্বরকে ডাকে।  ভাবে ঈশ্বর তাকে উদ্ধার করবে।  কিন্তু কোনোদিন ঈশ্বর আসেও না।  আর মানুষের কষ্টের লাঘবও  হয় না। মানুষের উদ্ধারও হয় না।
মৃত সন্তানের প্রাণ ভিক্ষায় মাতা দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়।  ভগবানের কাছে যায়।মন্দিরে মন্দিরে মাথা ঠুকে ঠুকে রক্ত বের করে ফেলে।  আর ভগবান চাতুরীর আশ্রয় নেয়। বলে, যে বাড়িতে কেউ মারা যায় নি তার বাড়ি থেকে সরষে নিয়ে এস। প্রকৃতি প্রভাবশালী। তাকে ভগবানও  এড়িয়ে যেতে  পারে না। কর্মহীন জীবন হয় না। জ্ঞাতসারে অজ্ঞাতসারে আমরা কর্মে লিপ্ত। স্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অন্ন আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
নারদ বলছেন : আচ্ছা চার্বাক তোমার কথা মেনে নিলাম। জড় পদার্থের প্রকৃতিই পৃথিবীতে জীবন উৎপন্ন করেছে। কিন্তু চৈতন্য কোথা পেল এই জীবন। কে তাকে চেতনা দিল ?  চার্বাক তুমি  কিছু গুহ্য কথা শোনো। শরীরের বিনাশ আছে। তোমার ভিতরে যিনি শরীরী অর্থাৎ আত্মা তার মৃত্যু নেই। আত্মা কখনো জন্মায় না।  আত্মা কখনো মৃত্যু বরণ  করে না। আত্মা অনিশ্বর। আত্মা জন্ম-মৃত্যু রোহিত। চার্বাক তুমি সেই অমর আত্মাকে জানো। আত্মা কেবল এক শরীর ছেড়ে অন্য শরীরে প্রবেশ করে মাত্র। মানুষ যেমন তার পুরানো বস্ত্র পরিবর্তন করে ,তেমনি আত্মা মৃত শরীর ছেড়ে নতুন শরীরে প্রবেশ করে।
পরম-আত্মার অংশ এই জীবাত্মা । মানুষের শরীর তো জড় পদার্থ, এই শরীরের মধ্যে যতক্ষন পরম-আত্মার অংশ জীবাত্মা বর্তমান আছে, ততক্ষনই মানুষকে জীবিত বলা হয়। পরমাত্মা ভিন্ন সবই জড়প্রকৃতি।
চার্বাক এবার দৃঢ় ভাবে জবাব দিলো। তোমার  এইসব সৃষ্টিছাড়া কথা রাখো তো । তুমি যাকে আত্মা বলছো, আমি তাকে বলি চেতনা। শুনে রাখো চেতনা কখনো এক শরীর  ছেড়ে অন্য শরীরে প্রবেশ করে না। চেতনা সবত্র বর্তমান। শরীর প্রাণক্রিয়ার সাহায্যে এই চেতনা গ্রহণ করে। প্রাণের সাহায্যে গ্রহণ করে, আবার অপানের  সাহায্যে বের করে দেয়।  এই প্রক্রিয়া আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত, প্রতি মুহূর্তে চলছে। এই ক্রিয়ার মুহূর্তের বিরামে আমরা মৃত বলে গণ্য হই। তোমরা যাকে পঞ্চইন্দ্রিয় বলো, আমরা তাকে বলি, শরীরের দ্বার। অর্থাৎ আমাদের শরীরে পাঁচটি দরজা আছে। চোখ, কান, নাক, জিব্বা, ত্বক। এগুলো সাহায্যে আমরা প্রতিনিয়ত বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। এই পাঁচটি দরজা দিয়ে আমাদের মস্তিস্ক বাইরের খবর সংগ্রহ করে। এগুলো আমাদের গ্রন্থিচক্রে আলোড়ন তোলে। এই আলোড়নকে বলে মনের ক্রিয়া ।এই ইন্দ্রিয় দ্বারা সংগৃহিত খাবারগুলোই মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হয়ে সৃষ্টি করে অনুভূতি। এই অনুভূতিই চেতনা।  এর সঙ্গে ঈশ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই। আমার যদি এই পাঁচ ইন্দ্রিয়, কাজ বন্ধ কর দেয় বা  একমাত্র নাসিকা অর্থাৎ প্রানের আগমন নির্গমন বন্ধ হয়ে যায়, তবে কোনো ঈশ্বরই  আমাকে বাঁচাতে পারবে না। আমার কোনো চেতনা থাকে না।
আর শোনো, আমি চোখ দিয়ে কখনো ঈশ্বর দেখিনি।  কান দিয়ে কখনো ঈশ্বরের কথা শুনিনি। আমার ত্বক তাকে কখনো স্পর্শ করেনি। আমার স্বাদে অর্থাৎ জিব্বায় ঈশ্বর কখনো আসেনি। ইন্দ্রিয় বাহিত হয়ে ঈশ্বর কখনো আমার অনুভূতিতে আসেনি। তাই আমরা ঈশ্বরে বিশ্বাসও করিনা, অবিশ্বাসও করিনা। সে আছে কি নেই তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমরা কর্মে বিশ্বাস করি। কর্মই আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ফুসফুস আমাদের প্রাণের আগমন নির্গমন করাচ্ছে।  তাই আমরা বেঁচে আছি। কর্মই আমাদের অন্ন যোগাচ্ছে। বুদ্ধিযোগে কর্ম করাতেই  আমাদের বিশ্বাস। তোমার ওই কাল্পনিক ঈশ্বর আমাদের কাছে নেই। তুমি বরং সব ছেড়ে কর্মে মনযোগ দাও।
নারদ এবার পালাতে পারলে বাঁচে। আবার মনে মনে ভাবছে, আমরা তো পরগাছা। মানুষের পরিশ্রমের অন্নে আমরা প্রতিপালিত। মানুষের শ্রমে অর্জিত, মানুষের দেওয়া নৈবেদ্যর অন্নে আমরা বেঁচে আছি। এখন মানুষ যদি চার্বাকের মত সবাই ঈশ্বর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে আমাদের কি হবে ? এই চার্বাকদের মতো লোকেরা আমাদের অস্তিত্বকে বিলোপ করে দেবে।
এবার নারদ তার মোক্ষম দাওয়াই ছাড়লো।  দেখো চার্বাক, তুমি বলছো তোমার পঞ্চইন্দ্রিয় কখনো ঈশ্বরের খবর পায়নি  তাই তুমি তাকে বিশ্বাস করো না। কিন্তু  তুমি তোমার ঠাকুরদাকে দেখেছো ? চার্বাক বললো হ্যাঁ  দেখেছি। তোমার ঠাকুরদার বাবাকে দেখেছো ? না দেখিনি। আমার জন্মের আগে তিনি মারা গেছেন।  তুমি তোমার চোদ্দ পুরুষের নাম জান  নিশ্চয়।  কিন্তু তাদের তুমি  দেখোনি কোনোদিন।  কিন্তু তুমি নিশ্চই বিশ্বাস করো যে তারা ছিল।  এবং তোমার রক্তে তাদের ধারা বিদ্যমান। তাই যদি হয়, তবে শোনো, ঈশ্বরের প্রথম পুত্র মনু। এবং তারই বংশজাত আমরা সবাই। সুতরাং ঈশ্বরে বিশ্বাস না করে তোমার কোনো উপায় নেই। এই কথা বলে নারদ মনে মনে হাসতে  লাগলো।
চার্বাক এবার দিশেহারা। কি জবাব দেবেন তা বুঝতে পারছেন না। ......নারদ মুচকি হাসছেন।
চার্বাক  খানিকটা দম নিয়ে বললেন, তোমাদের ঈশ্বর দেখতে কেমন ? আমার মতো ? আমার বাপ্ ঠাকুরদা কিন্তু আমার মতো ছিল। তাহলে ঈশ্বর কিন্তু আমার মতো হওয়া উচিত। অবশ্য তোমাদের এজেন্ট, ওই বাওনদের ঘরেঘরে মানুষের অবয়বে বস্তু দিয়ে তৈরী নানান মূর্তি দেখছি। আমার পূর্ব পুরুষরা অতীত। কেননা তাঁরা আর দেহে নেই। আমি যদি ঈশ্বরের বংশধর হই, তবে আমার সেই প্রথম পুরুষ অবশ্যই অতীত। আর যিনি অতীত, তাকে দিয়ে কোনো কাজ হয় না। তাই তোমার ঈশ্বরকেও আমার কোনো কাজে লাগবে না।
নারদ বললো : না না তা কেন হবে ? ঈশ্বর নিরাকার। তবে তোমার মতো হতেও পারেন। তিনি অব্যয়, অক্ষয়, অবিনাশী।
চার্বাক বললো : ও তাহলে তোমাদের ঈশ্বর অবিনাশী।  দেখো অবিনাশী পরমাত্মা কখনো কোনো সৃষ্টির কারন হতে পারে না। কারন হওয়ার জন্য তাকে সক্রিয় হতেই হয়। আর যা সক্রিয় তা কখনো অক্ষয়, অব্যয় হতে পারে না। যা সক্রিয় তা স্বরূপে ও স্বভাবে নিত্য পরিবর্তনশীল। তাই তুমি যাকে অবিনাশী, অব্যয়, অক্ষয় বলছো, তেমন কোনো কিছু আর যাই হোক সৃষ্টির কারন হতে পারে না।

চার্বাকের এই অমার্জিত যুক্তিতে নারদ বিস্ময়ে বাক রোহিত  হয়ে গেলো।

চার্বাক এবার প্রশ্ন করলো, তোমাদের ঈশ্বর কি বস্তু থেকে আলাদা, না বস্তুসাপেক্ষ ?
নারদ জবাব দিলো : দেখো ঈশ্বর নিরাকার, বস্তুনিরপেক্ষ।
চার্বাক : যা বর্তমান তা আমি স্বীকার করি, কেননা তা আমার কাজে লাগে।  যা অতীত তা আমার কোনো কাজে লাগে না, তাই তা নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নেই। ঈশ্বর ছিল কি না, সেটা বড়ো  কথা না।  তিনি আছেন কি না সেটাই বড়ো  কথা। যদি বলো আছে, তবে অবশ্যই  সেটা বস্তুসাপেক্ষ হবে আমার ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য হবে। বস্তুহীন, নিরাকার শুন্যতাকে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।  আর তাকে আমি স্বীকারও  করি না অস্বীকারও করি না । এই ব্যাপারে আমরা নিস্পৃহ, নিরপেক্ষ।

নারদ এবার বিমর্ষ হয়ে স্বর্গের দিকে ফিরতে লাগলো। পরগাছাদের কোনো রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ থাকে না। নিরাকার, অবলম্বনহীন নারদের যাত্রাপথে কোনো ছায়া পড়লো না।  জেগে রইলো, জীবজগৎ, পৃথিবী, আর মানুষের কোলাহল। চার্বাক আবার নিজের কাজে মন দিলো। গরুকে খাবার দিতে গেল।

সমাপ্ত                             

       
      







Friday 16 November 2018

সত্যধর্ম ও অবতার শ্রীকৃষ্ণ

সত্যধর্ম ও অবতার শ্রীকৃষ্ণ



আজকের আলোচনার বিষয় একটু স্পর্শকাতর। অবতার শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে। কোটি কোটি ভক্ত তাঁর পূজা করেন। যারা শ্রীকৃষ্ণের আদর্শকে  মেনে চলেন, তাদের পক্ষে এই আলোচনা নিরর্থক না হলেও যারা শ্রীকৃষ্ণের অন্ধ ভক্ত, অর্থাৎ যারা গীতাকে লালরঙের কাপড়ে মুড়ে দুবেলা শুধু প্রণাম করেন, তাদের জন্য এই আলোচনা অস্বস্তিকর হতে পারে। তাদের বিশ্বাসকে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য ব্রহ্ম-জ্ঞানী শ্রীকৃষ্ণকে খোঁজা। প্রথমে আমি মহাত্মা গুরুনাথের বই থেকে এই আলোচনা শুরু করবো।  পরে আমার উপল্বদ্ধির কথা বলবো।
মহাত্মা গুরুনাথ প্রবর্তিত সত্যধর্ম আসলে পরমেশ্বরের সাধনার পথ নির্দেশক । আর পরমেশ্বর তো  নিরাকার। তাই পরমেশ্বরের পূজা হয় না।  পরমেশ্বরের উপাসনা হয়।পরমেশ্বরের গুনকীর্তন হয়। সাকারের পূজা হয়। আমি যখন এই সত্যধর্মের বই পড়তে আরম্ভ করি, তখন আমি প্রথমেই ধাক্কা খাই মহাত্মা গুরুনাথের একটা কথায়, আর সেটা হচ্ছে "শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর নয়" এই কথাটা শুনে। আমরা পারিবারিক সূত্রে শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত।  বাড়িতে শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহের পূজা হয়। ছোটবেলা থেকেই শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলে শুনে আসছি। কিন্তু ভগবান আর পরমেশ্বর এর মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে, সেটা আমার বোধের বাইরে ছিল।  তাই শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর  নয় এটা শুনে বা পড়ে, আমার মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। ভাবতাম মহাত্মা গুরুনাথকে কয়জন চেনে, জানে। শ্রীকৃষ্ণকে আমরা সবাই পূজা করি ভগবান জ্ঞানে, আর মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন, তিনি ভগবান নয়। এই সব অবান্তর কথা না শোনাই ভালো। এই সব কথা  অজ্ঞানীর অভিমান মাত্র। সেইথেকে  আমি  মহাত্মা গুরুনাথের বই পড়া  ছেড়ে দিয়েছিলাম। 
কিন্তু পরবর্তীতে, বলতে পারেন, বাধ্যতামূলক ভাবে সত্যধর্মের উপাসনায় উপস্থিত থেকে, বিশেষ করে আমার স্ত্রী ও শ্বশ্রুমাতার অগাধ ভক্তি ও নির্ভরতা দেখে , এই বিষয়ে আমার কৌতূহল বাড়ে। এবং আমি আবার তার বইগুলো পড়তে শুরু করি । এখন আমার মনে হয়, মহাত্মা গুরুনাথ ঠিকই বলেছেন। কিন্তু কি বলেছেন তিনি। 
প্রাসঙ্গিকক্রমে আর একটা কথা বলি, সত্যধর্মের যখন প্রকাশ হয় অর্থাৎ প্রায় একশ বছর আগে, প্রথম প্রথম এই ধৰ্ম প্রচার করা হতো গোপনে। এমনকি মহাত্মা গুরুনাথের নাম প্রকাশও নিষেধ ছিল। আমার মনে হয়, তখন সমাজ আরো গোড়ামিতে ভরা  ছিলো। এবং গুরুদেবের কথায় তখনকার আমলে, হিংস্র প্রতিবাদের সম্ভবনা ছিল, তাই এই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল। আজ সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।  তাই সত্য বলার রাস্তা সহজ হয়েছে। কিন্তু অন্ধত্ত্ব  আজও যায় নি। ঈশ্বর আজও আমাদের কাছে বিশ্বাসের বিষয়।  অনুভবের বিষয় নয়।  এখন আমরা আলোচ্য বিষয়ে আসি। শ্রীকৃষ্ণ কেন পরমেশ্বর নয়। বা শ্রীকৃষ্ণ আসলে কে ?

মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন :
কারুর কারুর মতে  ঈশ্বর যে জন্ম গ্রহণ করেন, বা ঈশ্বর মানুষ হিসেবে জন্ম গ্রহণ করেন, এটা একটা অন্ধ বিশ্বাস ছাড়া কিছু নয়। ঈশ্বর নিরাকার, তিনি কোনো নির্দিষ্ট রূপের মধ্যে আবদ্ধ নন। আর নিজেকে তিনি আবদ্ধ করেনও না। কোনো মনুষ্য দেহধারীকে ঈশ্বর বলা মানে, ঈশ্বরকে সীমাবদ্ধ করা। ঈশ্বর সীমাহীন, অনন্ত। সবার মধ্যেই ঈশ্বর প্রতিফলিত। তাই শ্রীকৃষ্ণের মতো দেহধারীকে ঈশ্বর বলা অজ্ঞানীর লক্ষণ। 
আর এক দলের মত্ হচ্ছে, ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। তিনি মানুষ বা যেকোনো  জীব হিসেবে জন্ম গ্রহণ করতে পারবেন না কেন ? এই অবতারবাদীদের বিশ্বাস তিনি শুধু মানুষ নয়, তিনি মৎস্, কুর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ  হয়ে জন্মেছেন আর কলিকালের সবশেষে কল্কি হয়ে জন্মাবেন। আমরা নয় জনকে জন্মাতে দেখেছি, আর একজনকে জন্মাতে দেখবো।  এই সত্যের কোনো অন্যথা হয় না। 
মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন : এই বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ত্ব দেওয়ার কিছু নেই। এগুলো আসলে শাস্ত্রকারদের সংস্কার ছাড়া কিছু নয়। আর এই শাস্ত্র দিয়েই প্রমান করা যায় এগুলো শাস্ত্র বিরোধী। 

কঠোপনিষদ বলছে :
"ন জায়তে ম্রিয়তে বা 
বিপশ্চিন্যায়ং কুতশ্চি
ন্ন বভূব কশ্চিৎ। " 

জগদীশ্বর জ্ঞানময়, তিনি জন্ম গ্রহণ করেন না, সুতরং মৃত্যুগ্রাসে পতিত হন না। আর তিনি কেহ হতে হন না, আর  কোনো জীবও হন না। অর্থাৎ তিনি কোনো কিছু থেকে আসেন নি।  আর কিছু হন না।  অর্থাৎ জীব হয়ে জন্মানও  না।   

স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ আত্মা  সম্পর্কে বলছেন : 
"ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ
নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ। 
অজ নিত্যঃ শাশ্বত অয়ং  পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শশীরে।"   গীতা-২/২০)

আত্মা কখনো জন্ম গ্রহণ করেন না, মরেন না। তিনি না জন্মেছেন, না জন্মাবেন। তিনি অজ, নিত্য শাশ্বত ও পুরান ; শরীর  বিনষ্ট হলেও এর বিনাশ নেই। 
শ্রীকৃষ্ণকে যারা ঈশ্বর বলে মনে করেন, তাদের  একটা জোরালো যুক্তি হচ্ছে, ঈশ্বর যখন সর্বশক্তিমান তখন তিনি জন্ম গ্রহণ করতে পারবেন না কেন ? গুরুদেব বলছেন, শক্তি থাকলেই সেই শক্তি তিনি প্রয়োজন অতিরিক্ত কাজে ব্যবহার করবেন তার কোনো মানে নেই। শক্তিশালী রাষ্ট্র ইচ্ছা করলে মুহূর্তের মধ্যে যে কোনো গ্রাম,বা বিশেষ নগর মানবশূন্য করতে পারেন।  কিন্তু তা কি করা হয় ? এমনকি আমাদের নিজেদের  শক্তি থাকলেই কি আমরা তার ব্যবহার সব জায়গায়  করি ? করি না। কারণ আমাদের ইচ্ছা শক্তি বাধা দেয়।  আর সত্যি কথা বলতে গেলে, ঈশ্বর অলক্ষে থেকেই সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। তার মায়া বা প্রকৃতির আশ্রয় নিয়ে কিছু করতে হয় না। বরং প্রকৃতির আশ্রয় নিলে, বা দেহধারী হলে তিনি তার সর্বশক্তিমান সত্ত্বা হারিয়ে ফেলেন। তাই তিনি এইরূপ ইচ্ছা কস্মিন কালেও করেন না। 
যদি বলা হয়, সাধুদের পরিত্রানের জন্য, বা দুস্টুদের দমনের জন্য তার আসার প্রয়োজন, সেটাও সত্য নয়। কারন এই প্রক্রিয়া মানুষই করে থাকে।  রাষ্ট্র করে থাকে। সাধুজনেরাই করে থাকে। এর জন্য ভগবানের দেহ ধারনের প্রয়োজন নেই। তার ইচ্ছা শক্তিই এইরূপ দন্দ্ব সৃষ্টি করছে, আবার তার এই  শক্তিই এই দ্বন্দ্বের নিরসন করছেন।  এর জন্য সেই পরম আত্মার বা পরমেশ্বরের দেহ ধারণ করার প্রয়োজন নেই। এই সব কথা কিছু গুরুত্ত্বহীন সাধুদের দ্বারা, নিজেদের গুরুত্ত্ব বাড়াবার জন্য প্রচার করেছেন । এর মধ্যে কোনো  সত্য নিহিত নেই। গুরুদেব বলছেন, যিনি পূর্ণব্রহ্ম, তিনি কখনো একজন দুষ্টাত্মার নিগ্রহে প্রবৃত্ত হয়ে পদে পদে বিপদগ্রস্থ ও কখনো কখনো পরাভূত এমনকি শাপগ্রস্থ (সত্যবতীর দ্বারা) হতেন না। শ্রীকৃষ্ণতো একজন শোকগ্রস্থ সত্যদ্রষ্টা  জ্ঞানীব্যক্তি ছিলেন ।  
একটা কথা মনে রাখতে হবে,  যার অব্যক্ত অংশ হতে এই জগৎ উৎপন্ন হয়েছে, এবং যার অংশই সমস্ত জীবাত্মা, সমস্ত ব্রহ্মান্ডের যিনি উপাদান ও নিমিত্ত-কারণ, তিনি যদি একস্থানে স্থিত হন, তবে ব্রহ্মান্ডের অন্য্ সব স্থান কিভাবে থাকবে ? 
অতএব এটা নিশ্চিত করে বলা যায় পরম-ঈশ্বর কখনো কোনো কিছু হয়েই  জন্মান না, তা সে মৎস্, কুর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, রাম , কৃষ্ণ যাই বলুন না কেন । জন্মানোর দরকার হয় না। এই অবতার তত্ত্ব আসলে প্রাণীর ক্রমবিকাশ বোঝাবার জন্য,  একটি রূপক গল্প মাত্র। 
এখন তাহলে কৃষ্ণ কে ? 
পরম-ঈশ্বর জন্মান না।  কিন্তু যারা জন্মান তাদের মধ্যে পরম-ঈশ্বরের অনেকগুন্ বা শক্তি  আয়ত্ত্ব করবার পুরুষাকার  থাকে। মানুষ জন্ম জন্মান্তরের প্রচেষ্টায় এই শক্তি সকল বা গুন্ সকল আয়ত্ত্ব  করতে পারে। প্রথম জন্মে বা শরীরে যে শক্তি সে লাভ বা আয়ত্ত্ব  করে, ক্রমাগত চেষ্টায়, ও জন্মান্তরের সাধনায়   তার সেই শক্তি বাড়তে থাকে।  এবং ধীরে ধীরে, সে সাধারণ মানুষ বা জীবের থেকে সে উন্নত হতে পারে।  তখন তার সঙ্গে সাধারণের প্রভূত পার্থক্য দেখা যায়। কেউই প্রথম জন্মেই অবতার হয় না।  জন্ম জন্মান্তরের সাধনাই  তাকে অবতার হিসেবে প্রতিপন্ন করে। তাই যাদের আমরা অবতার বলি, তাঁরা জন্ম-জন্মান্তরের সাধক। যোগবশিষ্ট। তারা সকলেই বহু জন্ম ব্যাপিনী সাধনার ফলে এই অবস্থা লাভ করেছেন । 
দেখুন শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলছেন, হে অর্জুন, তুমি-আমি বহুবার জন্ম গ্রহণ করেছি, আমি সে সকল জানি, তুমি জানো না। ভগবান বুদ্ধও তার পূর্বাপূর্ব জন্মের কাহিনী বলেছেন। অতএব মহাত্মা গুরুনাথ যে বলছেন বহু জন্মের সাধনার ফলে মানুষ ধীরে ধীরে অবতার হয়ে যান, সেটা সত্য। 
অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণ যে এককালে নর ও নারায়ণ ছিলেন, তার প্রমান পাই আমরা মহাভারতের প্রতিজ্ঞা পর্বে। সেখানে দেখছি, জয়দ্রথকে অর্থাৎ অর্জুনপুত্র অভিমন্যুর বধকারীকে শায়েস্তা কোরবার জন্য, শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন স্বয়ং মহাদেবের কাছে গিয়েছিলেন দিব্য অস্ত্র লাভের  আশায়। সেখানে স্বয়ং ত্রিকালেশ্বর মহাদেব তাদের সম্মোধন করছেন, নর ও নারায়ণ বলে। অর্থাৎ এখনকার অর্জুন হচ্ছেন পূর্বাপূর্ব জনমের নর আর শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন নারায়ণ। এঁরা দুই জনই মহান সাধক ছিলেন। সত্যযুগে বদ্রীনাথ ধামের কাছে (এখন যেখানে নর-নারায়ণ পর্বত ) হাজার হাজার বছর  ধরে তাঁরা দুই ভাই তপস্যা করেছিল।
মহাভারতের বিভিন্ন জায়গায় যেমন ভীষ্মপর্বে (৬৮ অধ্যায় ), উদ্দ্যোগপর্বে, এই শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের পূর্ব জন্মের কথা লেখা আছে।  অর্থাৎ মহাভারতের বিভিন্ন জায়গায় বহু মহাপুরুষের পূর্বজন্মের কথা লেখা আছে। সত্যিমিথ্যা যাই হোক না কেন, মানুষ তার সাধনার দ্বারা প্রাপ্ত ক্ষমতা জন্ম-জন্মান্তর বয়ে নিয়ে চলে এটা সত্য। 
অতএব যাঁকে  লোকে অবতার বলে. তিনি প্রথমে সামান্য অবস্থাতেই ছিলেন।  ক্রমে ক্রমে সাধন বলে, হাজার জন্মের সাধনায় নিজের উন্নতি সাধন করেছেন। পরম-ঈশ্বরের গুণাবলী, তার পরমাশক্তি লাভ করেছেন। এই জন্যই এইসব ঐশী শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিকেই অবতার বলা হয়। তার মানে এই নয় যে তিনি পরমপিতা -পরম-ঈশ্বর। সমস্ত ব্রহ্মান্ড যেমন পরম-ঈশ্বরের অংশ।  তেমনি সাধারণ মানুষ বলুন, কীট পতঙ্গ বলুন আর অবতারই  বলুন সবই পরমপিতার অংশ মাত্র। কেউই পরম-ঈশ্বর নন। 

আর একটা কথা মনে রাখা রাখা দরকার সেটা হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকে বিষ্ণুর অবতার বলা হয়। বিষ্ণু, শিব, ব্রহ্মা সবাই অনন্ত  ব্রহ্মের অংশ মাত্র। এই তিন জনকে আলাদা ভাবে তিনটি কাজের দায়িত্ত্ব দেওয়া হয়েছে বলে কল্পনা করা হয়েছে, হিন্দুদের মতে ।  ব্রহ্মা - সৃষ্টিকর্তা ; বিষ্ণু -পালনকর্তা ; শিব বা রুদ্র : সংহারকর্তা। অতএব শুধুমাত্র পালনকর্তাকে আমরা পরম-ঈশ্বর বলতে পারি না। এই তিন জনই স্ব-স্ব  ক্ষেত্রে প্রধান। আবার আমরা বিভিন্ন সময়ে এঁকে  অন্যের সহযোগিতা নিতে দেখি।  অতএব শ্রীকৃষ্ণকে আমরা সর্বশক্তিমান ভাবা মানে তাকে তাঁর উপযুক্ত সন্মান থেকে বঞ্চিত করা। আমি কোনো কনস্টেবলকে যদি বার বার ওসি স্যার বলে সম্বোধন করি, সে তাতে সম্মানিত বোধ না করে তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে বলে মনে করতে পারেন। অতএব শ্রীকৃষ্ণ যোগেশ্বর, পরম জ্ঞানী, ভগবান, ঈশ্বর, সব কিছু, কিন্তু পরম-ঈশ্বর নন,  পরম পিতা নন এটা আমাদের বুঝতে হবে।  
আসলে মানুষ অর্থাৎ এই শরীর প্রকৃতির অধীন। সুখ দুঃখ মানুষের স্বেচ্ছাসাধ্য নয়। মানুষ না চাইতেই বিপদের সম্মুখীন হয়।  আমরা কেউ দুঃখ চাই না।  কিন্তু  দুঃখ আসে। আমরা কেউ কর্তা  নোই।  স্বয়ং বিষ্ণু, ব্রহ্মা, রুদ্র কেউই কর্তা  নহে। সূর্য/পৃথিবী/চন্দ্র  যেমন ইচ্ছা করলে ঘোরা বন্ধ করতে পারে না । পৃথিবী আমাদের আশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে পারে না। সূর্য কিরণ দেওয়া বন্ধ করতে পারে না। বাতাস রুদ্ধ হতে পারে না ।  তারা সবাই যে যার কার্য্যে রত থাকতে বাধ্য, সেই পরম-ঈশ্বরের অমোঘ নির্দেশে। 

অতএব মহাত্মা গুরুনাথ বলছেন :
জগতে ঈশ্বর অনেক আছেন, কিন্তু পরমেশ্বর একজনই। অবতারগন অবশ্যই  প্রভূত গুনের অধিকারী। কিন্তু পরমেশ্বর অনন্ত গুনের অধিকারী। তাই শ্রীকৃষ্ণকে আমরা মহাপুরুষ বলতে পারি, ভগবান বলতে পারি, এমনকি ঈশ্বরও  বলতে পারি, কিন্তু পরম-ঈশ্বর বলা অতিশয় উক্তি বা মূর্খামি  ছাড়া কিছু নয়। 
______________
______________
এবার একটু অন্য কথা বলি।
শুনেছি, সত্যধর্মের নির্দেশিত পথে সাধনা করে, কবিবর রাজেন সরকার, শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। এবং সেই আনন্দে, বাংলাদেশে তার বসতবাটি সত্যধর্মের জন্য দান করেছিলেন। তো শ্রীকৃষ্ণ দর্শন করা যায়, এটা সত্য। অর্থাৎ আজও  শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভক্তদের দর্শন দেন। আমার কাছে কিন্তু আধ্যাত্মিক শ্রীকৃষ্ণের অস্তিত্ত্ব থাকলেও, দেহধারী শ্রীকৃষ্ণের কোনো অস্তিত্ত্ব নেই। আমার কাছে, শ্রীকৃষ্ণ কোনো ঐতিহাসিক চরিত্র নয়। তিনি সর্বকালের, অথবা কালেরও উর্দ্ধে। তিনি পুরান পুরুষ। তিনি এক কাহিনীর নায়ক। তিনি অভিনেতা। তিনি জন্মে ছিলেন কি না, বা পাঁচ হাজার বছর  আগে জন্মে ছিলেন কি না, সেটা বড়  কথা নয়। এমনকি তিনি ভগবান ছিলেন কি না সেটাও বড়  কথা নয়। আপনি যদি কৌরবদের জিজ্ঞেস করেন, দুর্যোধনকে জিজ্ঞেস করেন, যারা তাকে দেখেছিলো, সে কি বলবে - শ্রীকৃষ্ণ ভগবান ছিলো ? নিশ্চয়ই বলবে, অবশ্যই   না।  বলবে, শ্রীকৃষ্ণ গোয়ালার পুত্র ছিল। ছলনাকারী ছিল।  বড়োজোর বলতে পারে, বড়ো যোদ্ধা ছিলো।  যদি আপনি অর্জুনকে জিজ্ঞেস করেন, সে বলবে আমার হিতকারী সখা ছিলো। ভালো একজন  বন্ধু ছিলো। যদিও তাকেই ভগবান তার স্বরূপ দেখিয়েছিলো। তবু অর্জুন তাকে জানতে পারেনি, চিনতে পারেনি।   কিন্তু ভীষ্মকে যদি জিজ্ঞেস করেন, সে বলবে শ্রীকৃষ্ণ ভগবান ছিলো। আবার আপনি যদি সঞ্জয়কে জিজ্ঞাসা করেন, তো সে বলবে, তিনি যে কে ছিলেন, তা ভাষায় ব্যাক্ত করা যায় না।  আপনি যদি দ্রৌপদীকে জিজ্ঞেস করেন তো সে বলবে, যে আমাকে ভাত কাপড় জুগিয়েছে, সেই আমার ভগবান। শ্রীকৃষ্ণ আমাকে অসময় ভাত কাপড় দিয়েছে, তিনি অবশ্যই  ভগবান। তো দৃষ্টিশক্তির ফারাক। শ্রীকৃষ্ণ একটা আয়না। তার সামনে দাঁড়ালে, তোমার স্বরূপেই তিনি প্রকাশ হবেন। তুমি যা চাও, তুমি যা দেখতে চাও, তুমি তাই দেখবে। অর্থাৎ তুমি যা তুমি তাই দেখবে, তুমি সরে  গেলে,  আয়না আবার স্বচ্ছ হয়ে যাবে।
এই প্রসঙ্গে শ্রী রামকৃষ্ণের বলা একটা গল্পের কথা বলি। নদীর পারে, একটা উইয়ের ঢিপি।  তো অন্ধকারে, সন্ধ্যার সময় এক মাতাল এলো। উইয়ের ঢিপিটাকে দেখে ভাবলো, ব্যাটা কেমন সন্ধে থেকে মাল খেয়ে ভুর হয়ে আছে দেখো। গভীর রাতে এক চোর এলো, সে উইয়ের ঢিপি দেখে ভাবলো ব্যাটা সব কাজ সেরে এখানে বসে আছো ? আমার এখনো কিছুই হলো না। এবার শেষ রাতে এলো সাধু, সাধু উইয়ের ঢিপি দেখে ভাবলো, ব্যাটা কেমন সমাধিতে বিভোর হয়ে গেছে, আমি এখনো ধ্যানে বসতেই পারলাম না। আসলে আমরা যা তাই দেখি।   
শ্রীকৃষ্ণের নিজের কোনো ব্যক্তিত্ব নেই। তিনি কোনো ব্যক্তিও নন।  তিনি এক পূর্ণ পুরুষ। নামেই বোঝা যায়, তিনি আকর্ষক। নামেই বোঝা যায়, তিনি কালো, অন্ধকার। অর্থাৎ সৃষ্টির আঁতুরঘর। আবার শূন্য।  শুন্য, অর্থাৎ তার কাছে সব আছে আবার কিছুই নেই। শুন্য সদাই পূর্ন। শূন্য কখনো অপূর্ন হয় না। শুন্য কখনো  ভগ্নাংশ হয় না। আর সব সংখ্যার ভগ্নাংশ হয়।  শুন্যের হয় না। শুন্য থেকেই শুরু। ০,১, ২,৩,৪,৫,৬,৭,৮, ৯ আবার শুন্য।  শুন্য থেকে শুরু আবার শূন্যতেই শেষ। শ্রীকৃষ্ণ কিছুই নয়। শ্রীকৃষ্ণের কোনো মূল্য নেই। শুন্যের কোনো মূল্য নেই, সংখ্যার ডান দিকে বসলে, সংখ্যার গুরুত্ত্ব বাড়ে। অদ্ভুত ব্যাপার। যাঁকে সদ্ভাবে নিলে, যে নেয় তার গুরুত্ত্ব বাড়ে। আর যে অসৎ ভাবে নেয়, অর্থাৎ বা দিকে নিলে তার কোনো গুরুত্ত্বের হেরফের হয় না।
ভগবান কথিত গীতার কোনো ব্যাখ্যা,  শ্রীকৃষ্ণের নয়। এমনকি গীতার কথাও শ্রীকৃষ্ণ নিজে লিখে যান নি। শ্রীকৃষ্ণ কোনো আলাদা পথও  বাতলে দেননি । বেদ পুরাণের কথা তাঁর মুখে বসানো হয়েছে মাত্র।  কিন্তু যেকেউ গীতার মধ্যে পথ পেয়ে যেতে পারে। অথবা বলা যেতে পারে, গীতাতেই সব পথ আছে, যার যেটা দরকার, সে সেটাই পেতে পারে।  
আমার মনে প্রশ্ন জাগে, শ্রীকৃষ্ণ কি  আস্তিক ছিল ? আস্তিকরা সাধারণতঃ অহংকারী হয়। ঈশ্বর বিশ্বাসীরা বলেন, হে ঈশ্বর তুমিই সব। এই জগৎ মিথ্যা। তুমিই সত্য। শ্রীকৃষ্ণ বলছেন ঈশ্বর সত্য, জগৎ সত্য, আমিও  সত্য। শ্রীকৃষ্ণ এই জগতের সব কিছুকে স্বীকার করেন, আমরা যাকে ধৰ্ম-অধর্ম  বলে মনে করি, তা তিনি করেন না। তিনি সব কিছুকেই স্বীকার করেন। সুখ-দুঃখ কাউকেই তিনি বাদ  দিতে চান না। তিনি কাউকেই ত্যাগ করেন না। যতক্ষন না সে তাকে ত্যাগ করছে। এইখানেই শ্রীকৃষ্ণ ব্যক্তিত্বহীন হয়ে যান।  আমরা কিছু ছাড়ি , কিছু ধরি, শ্রীকৃষ্ণের ধরা-ছাড়া  বলে কিছু নেই। তাই শ্রীকৃষ্ণের আমিত্ত্ব বলে কিছু নেই। আমরা যখন কিছু ধরি বা ছাড়ি তখন আমি হয়ে যাই। ব্যক্তি হয়ে যাই। আমার স্ব-যে বস্তুতে প্রতিষ্ঠিত হয়, আমার তখন সেই বস্তুতে আমিত্ব ভাব হতে থাকে। যেমন নিজেকে ধনের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করলে, আমি ধনী হয়ে যাই।  নিজেকে বিদ্যার মধ্যে প্রতিষ্ঠা করলে আমি বিদ্বান হয়ে যাই। বুদ্ধির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করলে আমি বুদ্ধিমান হয়ে যাই। জ্ঞানের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করলে আমি জ্ঞানী হয়ে যাই। শরীরের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করলে আমি শরীর হয়ে যাই। শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে এই ধরা ছাড়া বলে কিছু নেই। তিনি সবেতেই আছেন, আবার কোনো কিছুর মধ্যেই  তিনি নেই। ধরা-ছাড়াই আমার ব্যক্তিত্ব। কিন্তু  শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে ব্যক্তি বলে কিছু নেই। তিনি কিছু ধরেন না ছাড়েন না। তাইতো সহজেই তিনি বলতে পারেন, সব ছেড়ে আমাকে ধরো। আমার শরণাপন্ন হও।  আপাততঃ কথাটায় মনে হতে পারে,  বোকারাই এ কথা বলতে পারে। বা বুদ্ধুরা   এ কথা বলতে পারে। অথবা একমাত্র বুদ্ধই  এই কথা বলতে পারেন।  অথবা এই কথা অহংকারীরা  বলতে পারে। একটা কথা বলুন তো, আমাদের মতো সাধারণের লোকের যেটা মনে হতে পারে, যে তিনি অহংকারী বা বোকার মতো কথা বলছেন, এই  কথা কি শ্রীকৃষ্ণের মনে হয়নি ? না মনে হয় নি, কারন তিনি অহঙ্কারীও নন আবার বোকাও নন। এ কথা সেই বলতে পারে, যিনি অহংকারী নন। "আমার শরণে এস" এ কথা সেই বলতে পারে যার "আমার" এই জ্ঞান একেবারেই  নেই। আসলে উনি বলতে চেয়েছেন, তোমার "তুমি"-কে ছেড়ে দাও। তোমার এই ভেদ বুদ্ধিকে ছেড়ে দাও। তোমার অহংকারকে ছেড়ে দাও। তোমার তথাকথিত জ্ঞান, যা তোমাকে ভালো মন্দ বিচার করতে শেখায় - সেই জ্ঞান ছেড়ে দাও। তুমি ভাবছো, আত্মীয়দের মারলে, তুমি দুঃখী হবে। এদের না মারলে তুমি সুখী হবে ? তুমি চাইছো এদের না মেরে তুমি মহান-মানবতার পরিচয় দিতে। তুমি ভিক্ষাবৃত্তি করে, ত্যাগের প্রতীক হতে চাইছো ? এদের না মেরে তুমি আত্মহত্যা করে চির বিজয়ী হতে চাইছো ? আসলে তোমাকে  ভয় গ্রাস করেছে। তুমি নিজেকে কর্তা  ভাবছো। আর সমস্ত কাজের পরিণামের কথা ভেবে আতঙ্কগ্রস্থ হচ্ছো।  
তোমার প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি নেই বলেই এমনটি ভাবছো। আমাদের মতো সাধারণের মানুষের  মনে হয়, অর্জুন ধার্মিক। সে এই বিনাশকার্য থেকে দূরে থাকতে চাইছে। শ্রীকৃষ্ণ অধার্মিক, সে এই বিনাশকার্যে প্রেরণা দিচ্ছে। কিন্তু যা সত্য তা হচ্ছে, তুমি নিমিত্ত মাত্র।  করেন তো তিনি, করানও তিনি। তুমি যেটা নিজের কাজ ভাবছো - অর্থাৎ নিজেকে কর্তা ভাবছো, এই ভাবনাই  তোমার কর্মফলের হেতু। এটাই তোমাকে "তুমিতে" পরিণত করেছে। এখান থেকে বেরিয়ে এস।  তুমি তার কাছে, পরম-আত্মার কাছে সমর্পিত হয়ে যাও।  কর্তব্য কর্মে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে নিয়োজিত করো। সমর্পনই উদ্ধারের রাস্তা, শান্তির রাস্তা।      
এই জগৎ কর্মক্ষেত্র। কর্মহীন জীবন হয় না। আবার কর্ম করলে তার ফল অবশ্যম্ভাবী। মনুষ্য জন্ম কর্ম নিমিত্ত। এই কর্মই  মানুষকে সুফল, কুফল ভোগ করায়। অতএব কর্ম  ও ভোগ এখানেই করতে হয়। ভোগ সম্পূর্ণ না হলে, অর্থাৎ ফল ভোগের আগেই আমাদের দেহত্যাগ হলে, আমরা ভোগযোনিতে জন্ম গ্রহণ করি। সেখানে সুখ দুঃখ ভোগের পরে আবার মানুষ হয়ে জন্ম গ্রহণ করি। এই জন্ম-মৃত্যুর চক্র চলছে। এখান থেকে বেরোতে গেলে আমাদের পরম-পিতা পরম-ঈশ্বরে নিবেদিত হতে হবে।  আর এখানেই মনুষ্য জীবনের সার্থকতা।
অদ্ভুত চরিত্র এই শ্রীকৃষ্ণ। কখনো চোর, কখনো সাধু, কখনো প্রেমিক, কখনো কঠোর। যখন যার কাছে থেকেছেন, পূর্ণরূপে থেকেছেন। যাকে ছেড়েছেন পূর্ণরূপে ছেড়েছেন। যখন যে কাজ করেছেন,  সে কাজে তিনি পূর্ণরূপে নিবিষ্ট হয়েছেন। তার মধ্যে অসম্পূর্ণতা বলে কিছু নেই।         

কৃষ্ণনাম : কৃষ্ণ কথাটার মানে কালো।  তার গায়ের রঙ-ও  ছিল কালো। কালো মানে অন্ধকার। অন্ধকার সব সময় রহস্যময়। অন্ধকারই শূন্য, অর্থাৎ তাতে আমরা কিছুই দেখতে পাই না। আর শূন্যই  পূর্ণ।
কৃষ্ণ কথাটার মানে আকর্ষণ। অর্থাৎ মাধ্যাকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। অর্থাৎ যার টানে সব কিছু কাছে চলে আসে। এ যেন চুম্বক। পাঁচ হাজারেরও বেশি সময় ধরে আমাদেরকে টানছে।

শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভাব বা জন্ম :
এবার আমরা শ্রীকৃষ্ণের জন্ম বা  আবির্ভাবটা  একটু দেখে নেই। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম দুর্যোগপূর্ণ অন্ধকার রাতে।  নিজের হাত নিজে দেখা যায় না। বাইরে ঝড় বৃষ্টির প্রচণ্ড প্রতাপ। এরই মধ্যে ভগবান এলেন। দুর্যোগের রাতেই-তো আমরা ভগবানকে ডাকি। আর তিনি তখনি হাজির হন। কি অদ্ভুত না ? আসলে জন্ম তো অন্ধকারেই হয়। আমার ভিতরে যা জন্ম নেয় তাতো সব গভীরে, অন্ধকারে। ধ্যান, সমাধি জন্ম নেয় অন্ধকারে। বীজ থেকে অঙ্কুর জন্ম নেয় অন্ধকারে। জন্মতো অন্ধকারেই হয়, মায়ের পেটে। বাবাওতো অন্ধকারেই  বীজ  রোপন করেন। অন্ধকারেই সব কিছুর জন্ম। আর দুর্যোগপূর্ণ অন্ধকারেই ভগবান আসেন। শ্রীকৃষ্ণও এসেছেন। আমরা সবাই অন্ধকারেই জন্মাই।  এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
ভগবান এলেন কারাগারে শৃঙ্খলাবদ্ধ মায়ের কাছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তো  ভগবান বুদ্ধের মতো রাজার পরিবারে আসতে  পারতেন। তা তিনি এলেন না। তিনি এলেন কারাগারে শৃঙ্খলাবদ্ধ মা-বাবার কাছে। এখানেই পার্থক্য। ভগবান বুদ্ধ দুঃখের মুক্তি চেয়ে ছিলেন। জন্ম মৃত্যুর চক্রের বন্ধন থেকে মুক্তির জন্য নয়। ভগবান বুদ্ধ ভগবানের কাছে কাউকে যেতে বলেন নি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু বন্ধন  মুক্তির জন্য এসেছিলেন। কাছে টেনে নিয়ে ছিলেন। তা সে তার তথাকথিত শত্রুই হোক আর তথাকথিত মিত্রই  হোক। কংশ মুক্তি পেয়েছিল। শিশুপাল মুক্তি পেয়েছিলো।    আর তা ছাড়া, আমরা তো কারাগারেই জন্মাই, কারাগারেই মারা যাই। কেউ কেউ অবশ্য মুক্তি পায়। তবে কোটিতে কটি ? আর জন্ম মানেই  তো  একটি সাময়িক বন্ধন।  দেহের মধ্যে আসাই তো বড়ো বন্ধন । দেহই  তো একটা কারাগার। দেহ ত্যাগ মানে বন্ধন থেকে মুক্তি।
আর একটা জিনিস আমরা কৃষ্ণের জন্মের পরে দেখি ।  তা হলো মৃত্যু ভয়। তাকে মেরে ফেলার জন্য কংসের  সাথীরা সক্রিয় ছিল।  জন্মের পরে মৃত্যু ভয় কার নেই ? জন্ম মানেই মৃত্যু অবসম্ভাবী। মৃত্যুর জন্য শুধু জন্মটাই দরকার। আর কোনো গুনের দরকার নেই। ঘর বাড়ি, বিছানা চাদর, জামা কাপড় নোংরা করার জন্য প্রয়াস করার দরকার নেই।  ওটা এমনি এমনি হয়। বেঁচে থাকার জন্য লড়াই দরকার, মরার জন্য কোনো লড়াই দরকার নেই, কোনো প্রয়াস নেই। অদ্ভুত ব্যাপার, না চাইলেও পাওয়া যায়। যাকে  আমরা জীবন বলি, সেটা তো শোভা  যাত্রা। স্মশান যাত্রা। আমরা স্মশানের দিকে এগিয়ে চলেছি। কেউ কেউ তো প্রতিক্ষণ মরছি। দেহে তো প্রতিনিয়ত মৃত্যু যাত্রা চলছে। প্রতিক্ষণেই আমাদের দেহকোষের, জন্ম মৃত্যু চলছে।  মৃত্যুমিছিল চলছে, একেই আমরা জীবন বলছি। বেঁচে থাকা বলছি।  আশ্চর্য।
ভগবান গীতাতে বলছেন : যখনই ধর্মের হানি হয় তখন আমি আসি। ধর্মের রক্ষার জন্য অধর্মের নাসের জন্য আমাকে আসতে  হয়। এ সম্পর্কে মহাত্মা গুরুনাথের যুক্তিকে আমি সমর্থন করি।  

সাধুদের রক্ষা করার জন্য ভগবানের কি সত্যিই দরকার ? কার রক্ষা করার দরকার - যে অনিশ্চয়তায় ভোগে। যে বিপন্ন, তার সুরক্ষা দরকার। নিজের অনিশ্চয়তায় যে সুরক্ষিত সেইই সাধু। যিনি স্ব-স্বরূপে স্থিত, তিনিই সাধু। যিনি স্ব-অধীন তিনিই সাধু।  বিপদেও যে শান্ত, সেইই সাধু। সাধুর অর্থই হলো, যার কাছে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। অথবা যে অনিশ্চয়তাকেই মেনে নিয়েছেন। ইনি ভবিষ্যতের অনিশ্চিয়তায় ভুগেন না। ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চয় করেন না। যার সঞ্চয় নেই, তার রক্ষার চিন্তাও নেই। যিনি দেহাতীত, তার দেহ রক্ষার কোনো তাগিদ নেই। তাকে বাঁচানোর জন্য কৃষ্ণের কি দরকার ? এই কথাটা আমার কাছে বিস্ময়ের। যার কাছে এখনো অনিশ্চিয়তা, সে তো সাধুই হয় নি। যেদিন সাধু আর সাধু থাকবে না, সেদিন তাকে বাঁচানোর জন্য কৃষ্ণের দরকার পড়বে। অতএব সাধুকে বাঁচানোর জন্য কৃষ্ণকে আসার দরকার নেই। 
আর একটা কথা বলছেন দুষ্টের দমনের জন্য অর্থাৎ মারার জন্য কৃষ্ণের প্রয়োজন। তাই তিনি এসেছিলেন। ভগবান নিজে জানেন, কাউকে মারা যায় না।  দেহান্তরিত হয় মাত্র।  অতএব দুষ্টকে মেরে দুষ্টমিকে খতম করা যায় না। দুষ্টকে  মারার কাজ যে কেউ করতে পারে। সারা বিশ্বে দুষ্টকে শাস্তি দেবার জন্য আইন আছে, শাস্তির ব্যবস্থা আছে। তাতে কৃষ্ণের আসার দরকার নেই। আসলে দরকার দুষ্টদের  রূপান্তর করা। আর এই কাজ সাধুদেরই করা উচিত।
আসলে সাধুরা মনে করে, আমাদের বাঁচানোর জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এসেছিলেন। তার মানে কি আমরা ধরে নেবো, এখন আর সাধু নেই, বা শ্রীকৃষ্ণের আগে সাধু ছিল না তাই শ্রীকৃষ্ণ আসেন না। দুষ্টরা মনে করতে পারে, আমাদের মারার জন্য ভগবান আসবেন।  তাদের এই বোঝাটা ঠিক হতে পারে। কিন্তু সাধুদের রক্ষার জন্য ভগবান আসবেন, এটা  ঠিক নয়। মনে রাখা দরকার, যে সাধু মনে করে, তার সুরক্ষার  দরকার, সে সাধুই নয়। আর কেউ তো মারাই যায় না, মারা যেতেই  পারে না, পুনর্জন্মে সে আবার আসবে, আর দুষ্টমি করবে। তাই দুষ্টদের বিনাশের জন্য শ্রীকৃষ্ণ এসেছিলেন, একথাটাও  ঠিক নয়। 
আসলে তথাকথিত সাধুরা এই ভেবে তৃপ্তি পায় মাত্র। বাস্তিবক পক্ষে, অন্তর যদি পরিশুদ্ধ হয়ে থাকে, তবে দুষ্টকেও বন্ধু মনে হবে। আমরা লোকনাথবাবাকে জানি, তার আশ্রমে একটা হিংস্র সাপ এসে দুধ খেয়ে যেত। আমরা ভগবান শঙ্করকে দেখেছি, তার কাছে হিংস্র বাঘ এসে শুয়েছিল। দেওঘরে, এক সাধুর (ভোলা গিরি ) আশ্রম আছে, তাকে নাকি দুটো বাঘ পাহারা দিতো। যে কষ্ট দেয়, তাকে শত্রূ মনে করা সাধুর কাজ নয়। সাধুর অর্থই হলো, কাউকে শত্রূ মনে না করা। তাকে কষ্ট দিলেও শত্রূ মনে হবে না। আসলে তথাকথিত সাধুরা  বসে বসে এই সব  ভাবে। আমি বলবো, যারা সাধুর বেশ ধরে আছে, তারা ভাবে, যে আমাদের রক্ষার জন্য ভগবান আসবেন। তারা জানেনা, এই শ্লোক দ্বারা তথাকথিত সাধুদের উপহাস করা হয়েছে। অথবা এটা কবি কল্পনা মাত্র। আর সত্যি সত্যি ভগবান যদি এটা  বলে থাকেন, তবে জানবেন এর কোনো গভীর অর্থ আছে। যা আমি জানিনা। 

আর একটা কথা বলছেন,  যুগে যুগে আমি আসি। যুগে যুগে আমি আসি - এমন কথা কে বলতে 
পারে ? যিনি স্বাধীন। এই প্রকৃতির জগতে কেউ স্বাধীন নয়। সবই  প্রকৃতির অধীন। কারণের অধীন।  এমনকি ভগবান, যখন প্রকৃতির আশ্রয় নেন, স্থূল দেহ ধারণ  করেন, তখন তিনিও প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলেন, চলতে বাধ্য হন। তাহলে ভগবান কখন আসেন ? আর কেনোই বা আসেন ? আমরা সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজবো। 

আসলে ভগবান আপনার আমার সবার মধ্যেই আছেন । এই আমি-আপনি যখন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন হই, তখন আমাদের মধ্যে আসুরিক বৃত্তি ম্রিয়মান হয়ে, সুরবৃত্তির উন্মেষ ঘটে। আমাদের মধ্যেই তখন অসীম  ক্ষমতাসম্পন্ন শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়। আমরা তখন অন্যের মঙ্গল কামনায় মঙ্গলকর্ম্মে লিপ্ত হই।  তখন আমাদের মধ্যে অসীম শক্তির আশ্রয় হয়, আর লোকহিতে আমরা প্রবৃত্ত হই। 

ভগবানের, অর্থাৎ  কৃষ্ণের মতো ব্যক্তিত্বের জন্ম যে কোনো সময় হতে পারে। সব পরিস্থিতিই তার পক্ষে অনুকূল। এমন কোনো পরিস্থিতি নেই, যখন তিনি আসতে  পারেন না। আবার, কোনো বিশেষ কাল বা পরিস্থিতি, কৃষ্ণের মতো মানুষের জন্মের অপেক্ষায় থাকে না। কোনো কারন ছাড়াই কৃষ্ণের মতো মহামানবের জন্ম হতে পারে। চেতন পুরুষের জন্য সর্ব কাল-ই সমান। অচেতন ব্যক্তির জন্মের জন্য কালের অপেক্ষা প্রয়োজন। চেতন পুরুষ সর্বকালে, সর্ব পরিস্থিতিতে আসতে  পারেন। অচেতন  পুরুষ পরিস্থিতির  দাস।  চেতন পুরুষ পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে করে নেন। সময় তাকে অনুসরণ করে, তিনি সময়কে অনুসরণ করেন না। তিনি সময়ের পিছনে থাকেন না।  সময় তার পিছনে থাকে। এমন ভাবার কোনো কারন নেই যে খারাপ সময় না হলে তিনি আসবেন না। এই ধরনের ভাবনাটাই ভুল। খারাপ সময় মানে কি ? তথাকথিত সাধুদের  পক্ষে,  যারা নিজেদেরকে সাধু বলে জাহির করেন , এমন লোকের পক্ষে   খারাপ, সেই সময় শ্রীকৃষ্ণের মতো ব্যক্তিত্বের আগমন হয়। ব্যাপারতা আদৌ তা নয়। আমাদের প্রয়োজনে আদৌ শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন না। আমরা মনে করি, আমাদের রক্ষার জন্য, আমাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ভগবান আসেন।  তার জন্মকে আমরা অন্য ভাবে দেখি না, দেখতে চাই না। অর্থাৎ ভাবখানা এমন যেন, দেখ আমি কত গুরুত্বপূর্ণ, আমাকে রক্ষা করার জন্য ভগবান স্বয়ং এসেছেন। 

যদি বাগানে  গাছে ফল হয়, আমি ভাবি আমার জন্য হয়েছে। আমি তার আস্বাদন পেতে চাই।  বাগানে যদি ফুল ফোটে, আমি ভাবি, আমার জন্য ফুটেছে। যদি গন্ধ ছড়ায়, আমি তা গ্রহণ করি, আর ভাবি, আহা  কি সুন্দর গন্ধ। কিন্তু ফলের গাছ, বা তার ফল যে কোনো জায়গায় হতে পারে। ফুল আমার জন্য গন্ধ দেয়  না। আমি ফুলের গন্ধ উপভোগ করি  মাত্র। ফল আপন খেয়ালে ফলে, বীজকে সুরক্ষিত রাখার  জন্য নিজেকে তৈরী করে।  আমরা ভাবি আমার খাবার জন্য ফল হয়েছে। এটা আমার বিচার মাত্র, বলা যায়, আমার স্বার্থে, আমি বিচারকে প্রভাবিত করি। একটা পিঁপড়েও আমার জন্য জন্মায় না।  এমনকি আমার সন্তানও আমার জন্য জন্মায় না। ফুল কারুর জন্য ফোটে না। নিজের জন্য ফোটে, অন্য কেউ তার গন্ধ পেতে পারে।  তাতে তার কিছু এসে যায় না। কৃষ্ণের মতো মানুষও কারুর জন্য জন্মায় না।  নিজের জন্য, নিজের আনন্দে জন্মায় , তাতে কারুর উপকার হতে পারে, কিন্তু তাতে তার কিছু এসে যায় না। এমন কোনো সময় আছে, এমন কোনো যুগ আছে, যখন কৃষ্ণ জন্মালে আমাদের উপকার হবে না? সব যুগেই কৃষ্ণকে দরকার। তারা সমস্ত যুগেই নিজের কাজে ব্যস্ত, আমরা ভাবি আমাদের জন্য এসেছেন, আমাদের জন্য করছেন। বিরাট শিশুরা আপন মনেই খেলে, আপন মনেই ভাঙে, গড়ে । আমরা কি ভাবে দেখছি, সেটা আমাদের ব্যাপার। দুঃখ ছিল না, এমন কোনো সময় নেই, দুঃখ থাকবে না এমন কোনো সময় হবে না। কৃষ্ণের মতো মানুষ সব যুগেই কাজে লাগবে। অসুর চিরকাল ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কৃষ্ণ এসেছিলো বলে সবাই শেষ হয়ে গেছে তা কিন্তু নয়। তারা আজও  আছে। মহাভারতের যুদ্ধের আগেও ছিল, পরেও ছিল। কৃষ্ণ বর্তমান থাকতেই ছিল। মহাভারতের যুদ্ধের পরে, যখন শান্তির রাজ্য স্থাপন করবার উদ্দেশ্যে, ভীম গান্ধারে  শান্তি প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন শকুনির ছেলে উলুখা অর্থাৎ গান্ধারীর ভাই-এর ছেলে, বা দুর্যোধনের মামাতো ভাইতো ভীমকে শান্তি প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে, যুদ্ধে আহ্বান করেছিল। এসব তো মহাভারতের যুদ্ধের পরের ঘটনা ।  আসলে সব সময়  সবই  থাকে। আমরা আসলে সবকিছু, আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। আমাদের কোনটা কাজে লাগবে আর কোনটা কাজে লাগবে না। আমাদের একটা সীমারেখা আছে।  আমরা সব কিছুর মধ্যে আমাদের উপযোগিতার কথা ভাবি। আমার কোনটা কাজে লাগবে আর কোনটা কাজে লাগবে না। যেটা আমার কাছে কাজে লাগবে না, তার কোনো মূল্য আমাদের কাছে নেই। কিন্তু, ভগবানকে উপযোগিতার মধ্যে খুঁজতে গেলে, তাকে পাওয়া যাবে না। সূর্য উত্তাপ দেয়  আপনার উপযোগিতার ভেবে নয়। এটা তার স্বভাব। মেঘ বৃষ্টি দান করে,  আপনার কথা ভেবে নয়।  এটা তার স্বভাব। বাতাস আপন মনে বয়ে চলে। আপনি তার কাছ থেকে কি নেবেন, আর কি নেবেন না এটা আপনার বিষয়। মেঘ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির জল  মাঠের চাষের কাজে লাগাবেন, না আপনার তৃষ্ণা মেটাবেন এটা আপনার ব্যাপার। এতে  মেঘের কিছু এসে যায় না।  তাই একথা ভাবা ঠিক নয়, কৃষ্ণ আমাদের কারুর জন্য জন্মে ছিলেন।  তিনি না সাধুর না অসাধুর। তুমি তার কাছ থেকে কি পাচ্ছো, কি পাচ্ছো না সেটা তোমার ব্যাপার। মানুষ ভাবে, তার অহংকে কেন্দ্র করে। সে ভাবে, কৃষ্ণ জন্মায় আমাদের জন্য, ফুল ফোটে আমাদের জন্য, সূর্য কিরণ দেয় আমাদের জন্য। চাঁদের আলো আমাদের জন্য। মেঘের বৃষ্টি আমাদের জন্য। ব্যাপারটা উল্টো।  ওদের জন্য, অর্থাৎ সূর্যের জন্য, চাঁদের জন্য, মেঘের জন্য, নদীর জন্য, পাহাড়ের জন্য, সমুদ্রের জন্য আমরা বেঁচে আছি। ওঁরা  আমাদের জন্য আসেও না, যায়ও না। তাই কৃষ্ণ সাধুদের জন্য এসেছিলো, এর থেকে হাস্যকর কথা আর কিছু হতে পারে না। ভগবানের রসিকতা। আসলে মহাপুরুষের জন্মের বহু পরে তার সম্পর্কে লেখা হয়। তার কথা লেখা হয়। অনেক প্রচিলিত কাহিনী, কবি তার নিজের ভাষাতে লেখে।  ভগবানের মুখে সেই কথা গুলো বসায়, যা সে বিশ্বাস করে, যা সে ভগবানের কাছে পেতে চায়। তাই ভগবান কি বলেছিলো, এটা বড়ো কথা নয়, আমি ভগবানকে দিয়ে কি বলাতে চাই, ভগবানের কাছে কি শুনতে চাই, তাই ভগবানের মুখে বসাই। এতে অবশ্য ভগবানের কিছু আসে যায় না। ভগবান আপন খেয়ালে লীলা করেন। আমি যা দেখতে চাই, তাই দেখি, যা শুনতে চাই, তাই শুনি। সূর্য উঠলে আপনি বাড়ী বসে আলো পাবেন, সেই আলো, সেই উত্তাপ আপনি কি ভাবে ব্যবহার করবেন, সেটা আপনার ব্যাপার।গরিবের ঘরেও যাবে, বড়োলোকের  ঘরেও যাবে। আপনি নিজেকে আড়াল করবেন কিনা সেটা আপনার ব্যাপার। তবে এটাও বলি ওই আড়ালও  তারই লীলা।  ভগবান কোনো বিরোধিতা করবে না, আবার সংগতও  করবে না। তার খেলা সে খেলবে। ভগবান কারুর জন্য আসেন না, কারুর জন্য আসা বন্ধও করেন না। পরিস্থিতি তাকে জন্মায় না।  তিনিই পরিস্থিতির জন্ম দেন। 

পরিস্থিতির কথা যখন এলো, একটা কথা বলি, আমরা পরিস্থিতির দাস। সামাজিক পরিস্থিতি, পরিবেশ, ব্যক্তির  ব্যক্তিস্বত্বাকে বা ব্যক্তিত্বকে জন্ম দেয়। পরিবেশ মানুষকে খারাপ করে, পরিবেশ মানুষকে ভালো করে। পরিস্থিতি মানুষকে উন্নতিতে সাহায্য করে।এইসব  কথা  দুর্বলের ক্ষেত্রে  প্রযোজ্য। কৃষ্ণের মতো ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়।

এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি : বাদশা আকবরের দরবারে বীরবল নাম এক পণ্ডিত ছিলেন। একদিন বাদশা বীরবল  জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা  বলতো বীরবল, হিন্দুরা যে বলে, মানুষের সংকটে, মানুষের বিপদে, ভগবান দেহ ধারণ করেন, মানুষের উদ্ধার করতে, এটা  কি সত্যি? ভগবানকে নিজে কেন আসতে  হবে ? আমরা বাদশারা তো আছি। নাকি ? তো বীরবল নিশ্চুপ রইলেন। বাদশা কিছু বললেন না, পাছে বীরবলের ধর্মে আঘাত লাগে। কিছু দিন পরে, যমুনায় নৌকা বাইচের আয়োজন হয়েছে।  আকবরের ছেলে সেলিম, সেই উৎসব দেখছিলো বজরা থেকে। চারিদিকে উৎসবের মেজাজ। হঠাৎ গেল গেল রব উঠলো। যুবরাজ সেলিম লাফালাফি করতে গিয়ে, বজরা থেকে পড়ে  গেছে। চারিদিক থেকে তাকে উদ্ধার করতে মানুষ নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। একবার বাদশা   নিজেও উদ্দত হলেন, ঝাঁপ দিতে। বীরবল তাকে নিষেধ করলেন। বীরবলের আদেশে, দেহরক্ষীরা তাকে ধরে রাখলেন। কিন্তু রাজা রেগে অস্থির। বীরবলকে এই মারে কি সেই মারে। রাজা বলছেন - আমাকে ছেড়ে দাও। আমি যাবোই। আমার ছেলে ডুবে যাচ্ছে, আমি তাকে উদ্ধার করতে যাবো না ? বীরবল বললেন, আপনি নিশ্চিত থাকুন, এই দেখুন, আপনার ছেলে। গুস্তাফি মাফ করবেন। আপনি যাকে  ডুবতে দেখছেন, সে আপনার ছেলে নয় , এটা আমার সাজানো ব্যাপার। আসলে ছেলে যখন ডুবতে বসে, তখন বাবা অস্থির হয়, উদ্ধার করতে আসে।  পরমপিতাও  সন্তানের উদ্ধারে  তাই  ধরাধামে আসেন ।  এটাই হিন্দুদের বিশ্বাস। 
       
তবু আমি বলি, কোনো পরিস্থিতিই কৃষ্ণকে জন্ম দিতে পারে না। কোনো পরিস্থিতিই  কৃষ্ণের জন্মের জন্য আবশ্যক  নয়। এমন কোনো পরিস্থিতিই নেই যা কৃষ্ণের মতো ব্যক্তির জন্ম দিতে পারে। কৃষ্ণ শুধু জন্মায়।  আর পরিস্থিতি তার পিছন পিছন যায়। কৃষ্ণ যখন জন্মায় তখন সমাজ তার পিছন পিছন চলে। কৃষ্ণ সমাজের পিছে চলে না। এটাই ভগবান আর সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য। মহাপুরুষ পথ দেখান, পথ তৈরি করেন।  আমরা পথের দাস, ওঁরা পথের  স্রষ্টা। আমরা পরিস্থিতির দোহাই দেই। ওঁরা পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে আনেন। আমরা পথ খুঁজি তাই কষ্ট পাই। আর ওঁরা যেখান দিয়ে যান সেটাই পথ হয়ে যায়। ওঁরা আনন্দে ঘুরতে বেরোন, আমরা উদ্দেশ্য নিয়ে ঘুরে বেড়াই।  তাই না পাবার  বেদনা হয় আমাদের, ওনাদের ঘোরাতেই আনন্দ। তাই ভগবান সদাই আনন্দে থাকেন।  আমরা উদ্দেশ্যপূরণের ব্যর্থতা নিয়ে হতাশ, উনি বেড়ানোর আনন্দে মশগুল। ভগবানের জন্ম কার্য-কারণের উর্ধে। ভগবান আমাকে পথ দেখিয়েছেন, মানে এই নয় যে উনি আমাকে পথ দেখাবার জন্য জন্মে ছিলেন, আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম, উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি পথের  সন্ধান চেয়েছিলাম, উনি বলে দিয়েছিলেন। উনি আমার জন্য পথে দাঁড়িয়েছিলেন তা নয়, উনি ছিলেন তাই বলে দিলেন। গীতা এই পথের সন্ধান দাতা। 

চেতনা চিরকালই স্বাধীন।  তাকে কেউ বাঁধতে পারে না।  একটা গল্প শুনেছিলাম, এই গল্পটা বলি   : এক  জ্যোতিষী খুব নাম করেছে। সে নাকি যা বলে তাই খেটে  যায়। এক সন্দিহান  যুবকের মনে দুষ্ট বুদ্ধি এলো।  সে জ্যোতিষীকে মিথ্যা প্রমান করার জন্য শীতের রাতে, চাদরের মধ্যে একটা কুকুরের বাচ্চা  লুকিয়ে নিয়ে, গ্রামবাসীদের নিয়ে চললো জ্যোতিষীকে মিথ্যা প্রমান করবার জন্য। জ্যোতিষী বাড়ির ভিতরে ছিল। ছেলেটি বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করলো, আমি একটা বাচ্চা  নিয়ে এসেছি। বলুনতো বাচ্চাটা  মৃত না জীবিত। ছেলেটি ভেবেছিলো, জ্যোতিষী যদি বলে মৃত তাহলে, জীবিত কুকুরের বাচ্চাকে  বের করে দেখাবো।  আর যদি বলে জীবিত তাহলে, চাদরের মধ্যেই বাচ্চাটাকে  মেরে দেখাবে, যে বাচ্চাটি  মৃত। জ্যোতিষী কিন্তু মজার জবাব দিলো : বললো বাচ্চা  তোমার হাতে,তার প্রাণ ও তোমার হাতে। তোমার যা ইচ্ছা তাই করো। 

তাই জীবন আমাদের হাতে। আমি কি ভাবে বাঁচবো সেটা আমাদেরই ঠিক করে নিতে হবে। কৃষ্ণের মতো মহামানবের জীবন তো পুরোপুরি তারই হাতে। বাসনা থেকেই জন্ম। আমাদের জন্ম ভোগের জন্য। ভগবানের জন্ম ভোগাতীত। তিনি কাউকে বাঁচাবার জন্য জন্মান না।  হ্যাঁ কেউ যদি  বেঁচে যায়, সেটা আলাদা কথা। ফুল ফোটে আপন খেয়ালে।  হ্যাঁ আপনি  সুগন্ধ পান সেটা আলাদা কথা। মেঘ আপন মনে ভেসে বেড়ায়। নদী আপন মনে বয়ে যায়।  বাতাস আপন খেয়ালে চলে। সূর্য তার গতিপথে প্রতিনিয়ত চলছে। তার সকালও  নেই, সন্ধ্যাও নেই। আমরা কেবল সকাল-সন্ধ্যা দেখি। আমরা কারনের  জন্য বেঁচে আছি। আমরা ভালোবাসি, তারও  কারন আছে। আমরা কারন খুঁজি, তাই কারন দেখি। প্রকৃতি অকারনেই সব দিচ্ছে।  ভগবান অকারণেই আসছে, যাচ্ছে। আমরা আমাদের মতো কারন আরোপ করছি। যেদিন সব কারন ভুলে যাবো, সেদিনই আমার ভগবান আসবেন।

এখন শ্রীকৃষ্ণকে আরো একটু গভীরে বোঝার চেষ্টা করবো। যদিও শ্রীকৃষ্ণকে আদৌ বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যাবে না, কিন্তু আমাদের আর কিই বা আছে। ধার্মিক লোক শান্তির খোঁজে  সংসার ছেড়ে  বেরিয়ে যায়। এটা বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু সংসারের ঝামেলায় থেকে, সংসারের সংঘর্ষের মধ্যে কেউ শান্তিকে খুঁজছে, এটা বোঝা খুব মুশকিল হয়ে যায়। আসক্তি ত্যাগ করে কেউ নিজেকে পবিত্র রাখছে, এটা বোঝা সহজ। কিন্তু ভোগের মধ্যেও কেউ পবিত্র থেকেছে, এটা বোঝা খুব মুশকিল। যুদ্ধ না করে শান্তিতে থাকা যায়, এটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু যুদ্ধও করবো আবার শান্তিতে থাকবো, এটা বোঝা দুরূহ। বালক কৃষ্ণ যদি কোনো মেয়েকে বিরক্ত করে সেটা আমরা মেনে নিতে পারি, কিন্তু যুবা  কৃষ্ণ  যখন মেয়েদের বিরক্ত করে, নগ্ন করে, তখন তাকে বোঝা খুব শক্ত। আসলে এই বোঝার কোনো মাপকাঠি নেই।  আমি আমার বোধ বুদ্ধি, বিচার দিয়ে ঘটনার বিচার করি। তাই আমরা যারা গীতার শ্রীকৃষ্ণকে চাই, তারা ভাগবতের শ্রীকৃষ্ণকে চাই না। কারন তাকে তখন আমার বুঝতে কষ্ট হয়। সুরদাস নিজের চোখকে অন্ধ করে দিয়েছিলেন, বালক শ্রীকৃষ্ণের রূপ ধরে রাখবেন  বলে। যুবা শ্রীকৃষ্ণ তার কাছে অসহ্য ছিলো ।

শ্রীকৃষ্ণ কখনো, সম্মানের জন্য, মর্যাদার জন্য কাজ করেন নি। তাই প্রয়োজনে ছল চাতুরীর আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি লক্ষে স্থির। তিনি হিংসা-অহিংসাকে আলাদা করে দেখেন নি। আসলে হিংসা তার কাছে অর্থহীন, আবার অহিংসাও  নিরর্থক। তাই তিনি এ সবের উর্দ্ধে অসীম। মারা বা না-মারার মধ্যে তিনি পার্থক্য দেখেন না। তাঁর উচ্চস্তরের অধ্যাত্ম-বোধ, যুদ্ধকেও ছেলেখেলা মনে করেন । তিনি পরম-আত্মার ও জীবাত্মার বা এই শরীরের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখেন না। প্রকৃতি ও পরমাত্মার মধ্যেও কোনো পার্থক্য দেখেন না। আসলে, দৃশ্যমান জগৎ প্রকৃতি, আর প্রকৃতির অদৃশ্য ভাগ পরমাত্মা। পরমাত্মা ও প্রকৃতিতে কোনো পার্থক্য নেই। এই সত্য শ্রীকৃষ্ণ খুব ভালো ভাবে বুঝতেন। তাই তার কাছে যুদ্ধ ও শান্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু অর্জুনের কাছে আছে।  আমাদের কাছে আছে। আসলে বড়  হতে গেলে গভীরে যেতে হবে। উঁচুতে যেতে গেলে নিচুতে যেতে হবে। ইমারত যত উঁচু হবে, ভীত্ ততো গভীরে হবে।  এই সত্য বুঝতে হবে। আমরা যদি ভালো থাকে চাই  তবে খারাপ থাকতে হবেই। স্বর্গ-নরক পরিপূরক, একটা বাদ  দিয়ে আর একটা হয় না। কামনা ও সৃষ্টি এক সঙ্গে চলে।  একটাকে বাদ  দিয়ে অন্যটা হয় না। এই সত্য আমাদের বুঝতে হবে, তবেই আমরা শ্রীকৃষ্ণকে বুঝতে পারবো।

একটা কথা বলি, কিছু লোক চিরকাল থাকেন, যাদের  আমরা বুঝতে পারি না, তাদেরকে  আমরা কেউ পাগল বলি, কেউ ভগবান বলি। নিজেকে যারা বুদ্ধিমান মনে করে, তারা অন্যকে পাগল বলে। আর যারা সহজ সরল তারা ওই একই ব্যক্তিকে ভগবান বলেন । শ্রীরামকৃষ্ণের ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল। আসলে আমার অজ্ঞানতা স্বীকার করা কঠিন। কিন্তু সত্য যেটা তা হচ্ছে, আমরা ভগবানকে বুঝতে পারি না। আবার পাগলকেও বুঝতে পারি না। আসলে ভগবানকে আমরা বুঝতে পারি না, ধরতে পারি না।  ভগবান আমাদের কাছে অধরা। তাই হয় তার পূজা করি, নয় তাচ্ছিল্য করি। দুই ধরনের লোকই থাকেন চিরকাল। যাঁরা সমকালীন, তাদের আমরা বুঝতে পারি।  যারা ভবিষ্যতের তাদের আমরা বুঝতে পারি না। তারা মৃত্যুর পরে পূজা পায় ।  আর বেঁচে থাকাকালীন, তাদের কপালে জোটে তাচ্ছিল্য, বা নির্যাতন। কৃষ্ণকেও আমরা আজও বুঝতে পারি না। কখনো তার ঠোঁটে বাঁশি, কখনো ময়ূর পালক নিয়ে নাচ। আবার এই শ্রীকৃষ্ণ শস্ত্র হাতে যুদ্ধের ময়দানে। সত্যি কথা বলতে কি শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকবে। শ্রীকৃষ্ণকে বুঝতে আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।                 
ওং নমঃ শিবায়ঃ ।
ওং নমঃ শ্রী ভগবতে বাসুদেবায়ঃ।
ওঁং নমঃ মহাত্মা গুরুনাথায়ঃ।
ওম শান্তিঃ, শান্তিঃ, শান্তিঃ। ।