Tuesday 30 April 2019

আচার্য্য ও গুরুদেব GURUDEV

 গুরুদেব 

ওং গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু গুরুর্দেব মহেশ্বরঃ
গুরুরেব পরম-ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ।

ভারতবর্ষে বহু অবতারের প্রাদুর্ভাব। শাস্ত্রকাররা বলেন, অনন্ত কি ভাবে সান্ত হবে ? অতএব সত্যিকারের ভগবানের অবতরণ হয় না।আবার কেউ কেউ বলেন, ঈশ্বরের অনন্ত গুনের মধ্যে যাঁরা বিশেষ কিছু  বা একাধিক গুনের অধিকারী হয়েছেন, তাঁকে অবতার বলা হয়।এদেরকে পরমহংস বলা যেতে পারে। এনার কোনো বিশেষ বসন নেই। ইনি যাদৃচ্ছিক, নিবন্ধ রোহিত।এই যতির বা চেতন মানুষের স্তূতি-নিন্দা নেই। নেই কোনো লৌকিক ব্যবহার, নেই কোনো ধরাবাঁধা  অনুষ্ঠান। এঁরা  লোক শিক্ষার জন্য জগতে আসেন। তিনি স্থায়ী বাসের জন্য কোনো ম্ঠ  বা ডেরা  স্বীকার করেন না। সংসারে তাঁর আমি আমার বোধ নেই। যিনি কারুর স্তূতি করেন না, কাকেও নমস্কার করেন না. চল-স্বভাব শরীর এবং অচলস্বভাব আত্মা ভিন্ন অন্য কোনো নিকেতন স্বীকার করেন না। তিনি  ইচ্ছাপ্রাপ্ত মাত্র দেহযাত্রা নির্বাহ করেন। এটি সাধনার উচ্চতম মার্গ। আমাদের ভারত মাতা বন্ধ্যা নন। হিমালয়ের কন্দরে কন্দরে আজও  এই উচ্চকোটির অনেক মহাত্মা আছেন। এঁরা নিজেদেরকে অবতার বলে প্রচার করেন না।  এমনকি যাঁরা এদের সন্ধান রাখেন, তারাও এঁদেরকে যুগাবতার বলে প্রচার করার দুর্মতি করেন না। কারন এই ধরনের প্রচার হাস্যকর। এই সব অবতাররাই আমাদের বিচারবুদ্ধির উন্নতির জন্য অবিরত কাজ করে চলেছেন। 
     
আমার বাড়ির কাছেও এক ভগবানের আশ্রম  আছে। তিনি নিজেকে ভগবান বলে পরিচয় দেন। আমি একবার তাকে এক অনুষ্ঠানে দেখতেও গিয়েছিলাম। খুব কৌতুক বোধ করেছিলাম। ঝুটা গুরু, ঝুটা ভগবানে দেশ ভরাট  হয়ে গেছে। 

বালকের সরলতার সুযোগে অভিভাবক মিথ্যে বলে। একটা বাচ্চাকে নিয়ে মা যাচ্ছিলো। রাস্তায় ঠাকুরের মূর্তি নিয়ে যাচ্ছিলো একটা লোক। বাচ্চাটি যুক্তকরে প্রণাম করলো বললো,  দেখো মা ঠাকুর যাচ্ছেন। মা জানে, এ মাটির মূর্তি মাত্র, ঠাকুর নয়।   তবুও  তাতেই সে  সায়  দেয়। শুধু তাই নয়, সেই মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠার অভিনয়ও করে। হে ভগবান। সাধারণের মানুষের বিশ্বাস সরলতার সুযোগে এই সব তথাকথিত গুরুদেবরা  বাহ্যিক ধন সম্পদ সংগ্রহে ব্যস্ত। এরা আসলে অসৎ-ধর্মের ব্যবসায়ী।
ব্যবসায়ী গুরুর রমরমা আজকাল । 

আমরা আজ  দেহধারী গুরুর লক্ষণ সন্মন্ধে আলোচনা করবো।তার আগে একটাকথা বলি, বহু জ্ঞানী ব্যক্তি আছেন, যাঁরা আমাদের আচার্য্য হতে পারেন। কিন্তু সৎ গুরু  পরম-পিতার  কৃপাদিষ্ট। জ্ঞান সঞ্চয় করে গুরু হওয়া যায় না। জ্ঞান সঞ্চয় করে আচার্য্য হওয়া যায়। আমাদের জীবনে এই দুজনেরই প্রভাব আছে। আমরা অনেক সময় আচার্য্য ও গুরুদেবকে গুলিয়ে ফেলি। যিনি আমাদের  শিক্ষা দান  করেন, তিনি আমাদের শিক্ষাগুরু, অর্থাৎ আচার্য্য। কিন্তু গুরুদেব আচার্য্য থেকে আলাদা। যিনি আমাদের মধ্যে ভিতরের বিবর্তন আনেন, তিনি আমাদের গুরুদেব। সৎগুরুদেবের লক্ষণগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করবো।    

১. সৎগুরু শান্তিদাতা -   সাপুড়ের কাছে গেলে, সাপ  যেমন নিস্তেজ হয়ে যায়। ঠিক তেমনি , আমাদের মন যতই চঞ্চল,বিষন্ন, চিন্তামগ্ন, বিরক্ত বা বিক্ষিপ্ত থাকুক না কেন, সৎগুরুর কাছে গেলে, তার দেহনিঃসৃত অদৃশ্য দিব্য  জ্যোতিঃকনা এবং সুগন্ধে আমাদের মন শান্ত ও শান্তিতে ভরপুর হয়ে যাবে ।

২. সৎগুরুর কোনো নিজস্বতা নেই : তরল পদার্থের যেমন নিজস্ব আকার নেই, যে পাত্রে রাখা হয়,  তার আকার ধারণ করে, ঠিক তেমনি সৎগুরুর চিত্তবৃত্তি ও মনের নাশ ঘটে গেছে বলে, তার মধ্যে নিজস্ব কোনো ভাবের লহর খেলে না। যে যেমন ভাব নিয়ে তার কাছে উপস্থিত হয়, তিনি গুরুদেবকে সেই ভাবেই দেখেন। গুরুরূপী আধারটির মধ্যে আকার প্রকার আচরণ ও কথাবার্তায় খনে খনে পট পরিবর্তন হতে পারে। কখনো তার রুদ্র রূপ কখন বা শান্ত, কখন প্রসন্ন। সমস্ত স্থুল ব্যাপার আলোচনাতে তিনি যেমন পটু, তেমনি পরা বিদ্যা বা শাস্ত্র আলোচনায় তিনি নিপুন। শাস্ত্রের দুরূহ আলোচনায়তে তিনি স্বছন্দ।

৩. যিনি সদ্গুরু, তিনি অহরহ দিব্য  ভাবলোকে বিচরণ করেন। স্তর  ও মন্ডল ভেদে তার দেহের জ্যোতিচ্ছটায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটে। ফলত স্থূল চোখে ধরা না পড়লেও, শক্তিশালী ক্যামেরায় এটি ধরা সম্ভব।  তাই তার ফটো, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম হবে।  এবং  সদ্গুরুর  স্থুল ভাব অনুসারে তার ফটোও  পৃথক পৃথক দেখা যাবে।

৪. সদ্গুরু স্থুল, সূক্ষ্ম, কারন, কারনাতীত, সমস্ত জগতের তাবৎ প্রশ্নের উত্তরদানে সমর্থ। তার কথা শুনলে মনে হবে, সহজ সরল বিষয় যেন সব। আসলে ব্রহ্মকে  জানলে, সমুদয় তত্ত্বই বিজ্ঞাত হয়ে যায়। সদ্গুরু ব্রহ্মসিদ্ধ  তাই তিনি জ্ঞানসিদ্ধ। শাস্ত্রের কঠিন তত্ত্বকথা তার মুখে শুনলে মনে হবে, সবই সহজ। 

৫.সদ্গুরুর কাছে, একই প্রশ্ন বিভিন্ন লোক, বা বিভিন্ন সময়ে উত্থাপন করলে, প্রত্যেকের মস্তিষ্কের স্পন্দন অনুসারে, পৃথক ভাবে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর দানে সমর্থ।

৬. কোনো বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানের ছাত্র কোনো জটিল সূত্র সম্পর্কে যদি প্রশ্ন করেন,তবে সদ্গুরু জিজ্ঞাসুর প্রজ্ঞাক্ষেত্রে এমন এক চেতনার উন্মেষ ঘটান, এমন এক চিৎ-স্পন্দনের উদ্ভব ঘটান, যাতে জিজ্ঞাসুর মধ্যে সেই বিষয়ে জ্ঞান স্বাভাবিক ভাবেই উজ্জীবিত হয়।  ফলে, এক মুহূর্তের মধ্যে জিজ্ঞাসুর মধ্যে যা অজ্ঞাত ছিল তা জ্ঞাত হয়ে যায়। তাই গুরুকে বলা হয় সমাধিবান, সমাধানের জীবন্ত বিগ্রহ। 

৭. সদ্গুরুর কাছে বহু লোক বহু প্রশ নিয়ে আসে। গুরুদেব, একজনের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে, সবার প্রশ্নের  সমাধান করে দেন। 

৮. সৎগুরু নিজে কখনো বিভূতি দেখান না। তার যোগৈশ্বর্য্য বা বিভূতি, তার যোগ্য শিষ্যের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়। সদ্গুরুর যোগৈশ্বর্য্য় বিনা সাধনে, সদ্গুরু আশ্রিত শিষ্যের মধ্যে প্রকাশ পায়। 

৯. যেটা সবথেকে বড়  কথা আপনার  জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে সদ্গুরুর দর্শন ঘটলে, আপনার অহংয়ের মৃত্যু ঘটবে। আপনি আর আপনাতে  থাকতে পারবেন না। সদ্গুরু পরিচালিত যন্ত্রে পরিণত হয়ে যাবেন।মুহূর্তে বিবর্তন ঘটবে আপনার মধ্যে। 

১০. জীবনের যেকোনো মুহূর্তে, তা সে সঙ্কটকালেই হোক, বা সুসময় হোক, স্মরণমাত্র সদ্গুরু আপনাকে রক্ষা করবেন, বা দর্শন দেবেন, এর অন্যথা হবে না। এমনকি সৎগুরু দেহাতীত হয়ে গেলেও, প্রতিপদে আপনি তার উপস্থিতি টের পাবেন। সংকটকালে সঠিক পথ দেখাবেন।

আজ এখানে গুরুকথার বিরাম দিলাম।  

ওং ব্রহ্মানন্দং পরমসুখদং কেবলং জ্ঞানমূর্ত্তিম
দ্বন্দ্বাতীতং গগনসদৃশং তত্ত্বমস্যাদিলক্ষ্যম। 
একং নিত্যং বিমলমচলম সর্ব্বধী সাক্ষীভূতম 
ভবাতীতং ত্রিগুন রহিতং সদ্গুরুং তং নমামি।   







    


   

Friday 26 April 2019

রুদ্রাক্ষ

রুদ্রাক্ষ 

রুদ্রাক্ষ কথাটা সংস্কৃত।  রুদ্র+অক্ষ= রুদ্রাক্ষ । যার অর্থ হচ্ছে - রুদ্রদেবের চক্ষু। রুদ্র কথাটা এসেছে - রুদ + নিচ = রোদি (রোদন  করানো  + র (কর্তৃ) . অর্থাৎ যিনি রোদন করান । পূরাণে আছে, ব্রহ্মা কল্পারম্ভে সৃষ্টি চিন্তায় মগ্ন ছিলেন, এমন সময় এক বালক মূর্তি তার ললাট হতে আবির্ভূত হয়ে, কাঁদতে কাঁদতে ইতস্তত ভ্রম করতে লাগলেন। ব্রহ্মা তাকে রুদ্র নামে অবহিত করে, রোদনে নিবৃত্ত হতে বললেন, এবং তাকে রুদ্র, ভব, শর্ব্ব, ঈশান,  পশুপতি, ভীম, উগ্র ও মহাদেব ইত্যাদি অষ্ট নামে ডাকতে লাগলেন। ইনিই একাদশ মূর্তিতে একাদশ রুদ্র নামে প্রসিদ্ধ।এই একাদশ রুদ্র হচ্ছেন - অজ, একপাদ, অহিব্রধু, পিনাকী, অপরাজিত, ত্র্যম্বক, মহেশ্বর, বৃষাকপি, শম্ভূ, হর, এবং ঈশ্বর।  শিবের সংহার মূর্তিকেই  বলে রুদ্র। 

তো রুদ্রাক্ষ বলতে আমরা বুঝলাম, রুদ্রদেবের আঁখি। কথিত আছে, ত্রিপুরাসুরের বধের পর শিবের আঁখি থেকে অশ্রুবিন্দু পতিত হয়েছিল। ঐ অশ্রুবিন্দু থেকে এই বৃক্ষ ও ফলের উৎপত্তি। ইংরেজিতে একে বলে, utrasum bead (ইউট্রাসাম বিড ) । 

রুদ্রাক্ষের দানাগুলির মধ্যে একরকম অদ্ভুত চুম্বকীয় শক্তি ও বিদ্যুৎশক্তি নিহিত থাকে। এটা শুধু সাধুসন্তদের কথা নয়। আধুনিক বিজ্ঞান, এমনকি চিকিৎসা বিজ্ঞান একথা স্বীকার করে। বস্তুগত দিক থেকে এর গুন্ বা প্রভাব অনস্বীকার্য্য। ভারতের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশেও রুদ্রাক্ষের চাহিদা ও প্রয়োগ দিন দিন বাড়ছে। 

রুদ্রাক্ষের গাছ খানিকটা আমাদের জলপাই গাছের মতো দেখতে । তবে পশ্চিমবঙ্গে বা বাংলাদেশে বিচ্ছিন্ন ভাবে দুচারটে গাছ থাকলেও রুদ্রাক্ষের গাছ এখানে নজরে পড়ে না। এটি আসলে পাহাড়ি অঞ্চলের একটা বুনো গাছ। ভারতের হিমালয়ের জঙ্গলে অর্থাৎ উত্তরকাশি, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, ইত্যাদি জায়গায় এমনকি দক্ষিণ ভারতেও এই গাছ দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া, তিব্বত, চীনের কিছু অংশে,নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, জাভা, সুমাত্রা ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই আধ্যাত্মিক গুন্ সম্পন্ন গাছের দেখা পাওয়া যায়। বর্তমানে, এই গাছের ফলের  ব্যবসায়িক মূল্য বৃদ্ধি হওয়ার জন্য, কেউ কেউ এর চাষ শুরু করেছেন।  কিন্তু সেটা চোখে পরার মতো নয়। 

ভৌগলিক ও জাতিগত কারণে, এই ফলের বিভিন্ন আকার, অর্থাৎ ছোট থেকে বড়, ও আকৃতি অর্থাৎ অর্দ্ধচন্দ্রাকৃতি থেকেচ্যাপ্টা, গোল ইত্যাদি হয়। যেমন ইন্দোনেশীয় রুদ্রাক্ষ আমাদের বুনো কুলের মতো হয়। নেপালের রুদ্রাক্ষ গোল হয়।এখানেই গোল একমুখী রুদ্রাক্ষ দুর্লভ হলেও পাওয়া যায়।   দক্ষিণ ভারতের রুদ্রাক্ষ একমুখী ও অর্দ্ধ-চন্দ্রাকৃতি হয়। 

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে রোগ উপশমের জন্য রুদ্রাক্ষের উল্লেখ দেখা যায়।  

রক্তচাপ : উচ্চ রক্তচাপের  রুদ্রাক্ষ ভষ্ম ও স্বর্ণমাক্ষিক ভষ্ম সমপরিমাণ নিয়ে এক রতি পরিমান সকল সন্ধ্যে দুধ বা দইয়ের খেলে উচ্চ রক্তচাপ কমে যায়।  এছাড়া, রুদ্রাক্ষের মালা হৃদয় পর্যন্ত ঝুলিয়ে ধারণ করলে আশ্চার্য্য ফল লাভ হয়।  কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। 

মানসিক রোগ : একটা চারমূখী রুদ্রাক্ষ গরুর বা ছাগলের দুধের সঙ্গে ভালো করে ফুটিয়ে  এক মাস খেতে দিতে হয়। এতে স্মরণশক্তিও বৃদ্ধি পায়। 

অগ্নিদাহ : একটা রুদ্রাক্ষ শিলে বেটে নারকেল তেলের সঙ্গে মিশিয়ে পোড়া জায়গায় প্রলেপ দিলে যন্ত্রনা কমে। যদি যন্ত্রনা বেশি হয় তবে সামান্য কর্পূর এর সঙ্গে মিশিয়ে প্রলেপ দিন। 

এমনি হাজার-এক রোগে রুদ্রাক্ষের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। 
এই গাছের মূল দিয়েও আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুসারে, অনেক রোগের  উপশম করা হয়।

কিন্তু আমরা লক্ষ করেছি, বহু সাধু-সনত্দের গলায়, হাতে এগুলো পরিধান করে থাকেন ।  এর কারন কি ?
এর প্রথম কারন, যারা ঈশ্বর চিন্তায় মগ্ন থাকে চায়, তাদের এই রুদ্রাক্ষের মালা এক অসাধারণ একাগ্রতা এনে দেয়। চিত্ত ঈশ্বরে নিবিষ্ট হয়। েকে আপনি দ্রাব্যগুন বলতে পারেন। এক স্বামীজী বলছিলেন, একমুখী রুদ্রাক্ষ নিয়ম মতো ধারণ করলে, সে বারো দিনের মাথায় সংসার ত্যাগ করবে। অর্থাৎ সংসারের সাথে তার এমন তিক্ততা সৃষ্টি হবে, যে সে আর সংসারে থাকে পারবে না। তবে সুখের কথা হচ্ছে, সেই একমুখী রুদ্রাক্ষ অতিদুর্লভ, একমাত্র নেপালে সেটি পাওয়া যায়।  তাও সাধারণমানুষ এটি সংগ্রহ করে কাছে রাখতে পারবে না। এই নাকি রাজ্ পরিবারের সম্পত্তি। 

দ্বিতীয় কারন হচ্ছে, সাধুদেরকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় রাত কাটাতে হয়। এই বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে শরীরকে মানিয়ে নেবার জন্য, এই রুদ্রাক্ষ আমাদের সূক্ষ্ম দেহ বা লিঙ্গাদেহকে সাহায্য করে। ফলে, দেহ সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে। রুদ্রাক্ষের মালা শরীরকে উর্জা শক্তি সংগ্রহ করতে সাহায্য করে, তাই তারা ক্লান্তিহীন জীবন কাটাতে পারে। অর্থাৎ রুদ্রাক্ষের মালা ধারণকারীকে বিশ্বশক্তিতে পূর্ন রাখতে সাহায্য করে। 

তৃতীয় কারণ : এঁরা  যেখানে যা পায়  তাই খায়। আপনার শরীরের পক্ষে অনুপযোগী কোনো খাবারের এমনকি জলের উপরে যদি রুদ্রাক্ষের মালা রাখেন অর্থাৎ  মালাটা উঁচু করে ধরেন, তবে উপযুক্ত খাদ্যের উপরে মালা ক্লকওয়াইজ ঘুরবে, খারাপ বা বিষাক্ত খাবার হলে মালা এন্টি ক্লক ওয়াইজ, ঘুরবে। ফলতঃ সাধুরা খাবার গ্রহণে সতর্ক হতে পারবে। রুদ্রাক্ষের মালা ধারণকারী সাধারণ-মানুষের থেকে অনেক বেশি সময় না খেয়ে থাকতে পারে। অর্থাৎ ক্লান্তিহীন জীবনের জন্য, এই মালা খুব উপকারী।এছাড়া এঁরা অনেক সময় জলে, জঙ্গলে, পাহাড়ে  ঘুরে বেড়ান। সেখানে সাহসী থাকবার জন্য, এমনকি  হিংস্র জীব জন্তুদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য , এই রুদ্রাক্ষ নাকি অব্যর্থ কাজ করে। 

চতুর্থ কারন :  এই মালা ধারণ করলে  যেমন একাগ্রতা বাড়ে, তেমনি ধ্যানস্থ অবস্থায় শরীরে কোনো ক্ষিদেবোধ থাকে না, ফলত যতক্ষন ইচ্ছে ধ্যানে নিমগ্ন থাকা যায়।

এই রুদ্রাক্ষের মালাতেও ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ জাত-পাতের ব্যবস্থা করে রেখেছে। এই রুদ্রাক্ষ চারটি রঙে পাওয়া যায়।  ১. শ্বেতবর্ণ, ২. রক্তবর্ণ, ৩. পিত্ বা হলুদবর্ন ৪. কালো বা শ্যামবর্ণ। বলা হয়ে থাকে - এই শ্বেতবর্ণ বা সাদা রঙের রুদ্রাক্ষ ব্রাহ্মণগণ ধারণ করবেন  . রক্ত বা লাল আভাযুক্ত রুদ্রাক্ষ ক্ষত্রিয়গন ধারণ করবেন।  পিত্ বা হলুদ আভাযুক্ত রুদ্রাক্ষ বৈশ্যগন ধারণ করবেন। আর শ্যাম বা কালো রঙের আভাযুক্ত রুদ্রাক্ষ শূদ্র-জাতির লোকেরা পরিধান করবে। পন্ডিতদের অসামান্য পান্ডিত্তের জন্য কৃতিত্ত্ব অবশ্যি প্রাপ্য। হাস্যস্কর এই ব্যবস্থা।

আচার্য্য শঙ্কর রুদ্রাক্ষ ধারণ করতেন।  এমনকি তার ভাবধারায় যে সব সন্যাসী আছেন, তারা সবাই রুদ্রাক্ষ ধারণ করেন। রামকৃষ্ণ মিশনের সমস্ত সন্যাসীর কাছে এই রুদ্রাক্ষের মালার খুব সমাদর। স্বয়ং শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ প্রত্যেকদিন রুদ্রাক্ষের মালায় জপ্ করতেন। জপ্ শেষে মায়ের পাদপদ্মে এই মালা রেখে দিতেন। স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে শরীর  ছাড়ার আগে, এই রুদ্রাক্ষের মালা নিয়ে জপে বসেছিলেন। রুদ্রাক্ষের মালা জপ্ করতে করতেই তার মহাসমাধি হয়েছিল। ভারত সেবাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা, শ্রী শ্রী প্রনাবন্দ এই রুদ্রাক্ষের মালা ধারণ করতেন। এবংসবাইকে  ধারণ করতে বলতেন। স্বামী ত্রৈলঙ্গস্বামী, ভোলানন্দ গিরি, বালানন্দ ব্রহ্মাচারী, স্বামী নিগমানন্দ, বাবা লোকনাথ, সাধক রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, বামাক্ষ্যাপা, আনন্দময়ী মা, প্রভৃতি সাধক সাধিকা, এমনকি অনেক রাজনৈতিক নেতা নেত্রী, যেমন ইন্দিরাগান্ধী এই রুদ্রাক্ষের মালা ধারণ করতেন।যা তিনি সাধিকা আনন্দময়ী মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন।  ভারতের হাজার হাজার যোগী-সন্যাসী আজও এই রুদ্রাক্ষের মালা জপ্ করেন। বালিগঞ্জে ভারত সেবাশ্রমে গিয়ে দেখেছি, সন্যাসীদের শরীর  ছাড়ার পরে, তাদের স্মৃতি জড়িত ঘরে, সেই রুদ্রাক্ষের দর্শন পাই, যা তিনি ব্যবহার করতেন।   জানিনা এঁরা  সবাই জাত পাতের বিচার বা  হিসাব করে রুদ্রাক্ষ ধারণ করতেন কি না। আসলে সমস্ত জাতির লোক তা সে ব্রাহ্মণ হোক বা চণ্ডাল হোক, গুণবান হোক বা গুণহীন হোক, রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে, দ্রব্য বা ফলের গুন্ ধারণকারীকে আশ্রয় করবে, এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এটা সত্য যে, প্রকৃতির যে কোনো দ্রব্য বা ব্যক্তি কিছু না কিছু গুন্ তার চারিদিকে বিচ্ছুরিত করছে। তন্মাত্রার মধ্যে  এই সব গুন্ মিশে যায় এবং কাছাকাছি জিনিস বা  ব্যক্তিকে প্রভাবিত করে। তা সে আপনি বিশ্বাস করুন আর না করুন, ঔষধের গুন্ আপনাকে প্রভাবিত করবে। তা সে ঔষধের গুন্ আপনি জেনেই খান আর না জেনেই খান।  

এখন কথা হচ্ছে, সাধুরা ভগবানকে পাবার জন্য, বা রমতা  জীবন কাটানোর জন্য রুদ্রাক্ষ ধারণ করেন, এটা না হয় বোঝা গেল।   কিন্তু সাধারণের জন্য, রুদ্রাক্ষ ধারনের কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে ? দেখুন রুদ্রাক্ষের প্রশংসা শুধু হিন্দু শাস্ত্রে বা পূরাণে আছে তাই নয়, বর্তমানে, ইউরোপ ও আমেরিকাতে পর্যন্ত এই রুদ্রাক্ষের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। ঐসব দেশে, রুদ্রাক্ষের অলৌকিক এবং ঔষধীয় গুন্ সমূহের সম্পর্কে  নিত্য-নতুন গবেষণা হচ্ছে। এর ফলে, এই অদ্ভুত বুনো ফলের অদ্ভুত শক্তি ও গুন্ সমূহ প্রকাশ হচ্ছে।  একজন ব্রিটিশ গবেষক লিখছেন, রুদ্রাক্ষের দ্বারা অসম্ভব কাজকেও সম্ভব করা যেতে পারে। ভ্রমনকারী ব্যক্তির পথের বাঁধা দূর হতে পারে। মানুষ কর্মক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে পারে। এমনকি তারা বলছেন, রুদ্রাক্ষের দ্বারা জীবনের দিশার  পরিবর্তন হতে পারে। আমেরিকার গবেষক শ্রীমতি সুসন একটি গবেষণা পত্রে লিখছেন, রুদ্রাক্ষের প্রয়োগে ইপ্সিত সন্তান লাভ করা যেতে পারে। শারীরিক দুঃসাধ্য রোগ নিরাময় হতে পারে। আসলে রুদ্রাক্ষের যে সব আশ্চর্য্যগুন্ নিহিত আছে, তা এখনো অপ্রকাশিত। আমাদের তন্ত্র শাস্ত্রে রুদ্রাক্ষের যে গুনাগুন বলা হয়েছে সেটা একটু শুনুন। 

শাস্ত্রে রুদ্রাক্ষ এক থেকে চোদ্দমুখী পর্যন্ত হয়ে থাকে বলে বলা হয়েছে। মুখ অর্থাৎ বাইরে থেকে দেখলে রুদ্রাক্ষের গায়ে চোদ্দটি পর্যন্ত শিরা বা দাগ দেখতে পাওয়া যায়। আসলে  রুদ্রাক্ষটি যদি ঠিক মাঝ বরাবর কাটেন তবে দেখতে পাবেন সেখানে চোদ্দটি গর্ত আছে। আর গর্তের মধ্যে চোদ্দটি বীজ আছে। যা থেকে রুদ্রাক্ষ গাছ হতে পারে। তো একেকটা রুদ্রাক্ষ ফলের মধ্যে এমনি এক থেকে চোদ্দটি পর্যন্ত গর্ত দেখা যায়। আপনি যদি রুদ্রাক্ষটাকে এক্সরে  (X -REY) করেন, তবে দেখতে পাবেন,  রুদ্রাক্ষের মধ্যে এমনিসব গর্ত আছে। যে রুদ্রাক্ষে যতগুলো গর্ত সেই অনুযায়ী বাইরে দাগ দেখা যায়। বা বলা যেতে পারে, সেই রুদ্রাক্ষের ততগুলো কোয়া। এই শিরা বা কোয়া  অনুযায়ী রুদ্রাক্ষকে ১৪ ভাগে ভাগ করা হয়। এর এক-একটার এক এক রকম গুন্ বা শক্তি আছে। যেমন :

একমুখী রুদ্রাক্ষ : এটি দুর্লভতম রুদ্রাক্ষ। এই একমুখী রুদ্রাক্ষের দেবতা স্বয়ং শিব।  বেশিরভাগ রুদ্রাক্ষ পঞ্চমুখী অর্থাৎ পাঁচটি গর্ত সম্পন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু এটিতে কেবলমাত্র একটি গর্ত থাকে। বলা হয়ে থাকে, এই একমুখী রুদ্রাক্ষের দর্শনেও পুন্য হয়। পূজন বা ধারণ করতে পারলেতো কথাই নেই।  একমুখী রুদ্রাক্ষ যিনি কাপালজোরে পেয়ে গেছেন, তিনি যে সৌভাগ্যশালী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইনি জীবনের সমস্ত বাধা-বিপত্তি থেকে মুক্ত থাকেন।  আধ্যাত্মিক জগতের জ্ঞান ও অনুভূতি তার বিনা আয়াশে হয়ে থাকে। মানুষ জন্ম-জন্মান্তরের সুকৃতির ফলে এই একমুখী রুদ্রাক্ষ লাভ করে থাকেন। এটি পাবার পরে, জীবনে আর কিছু চাইবার থাকে না। যাঁর কাছে এটি আছে,এমনকি যিনি এর পূজা অর্চনা করবার মতো সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, তিনি  অবশ্য়ই নমস্য।  শোনা যায়, অবতার গোরখ্নাথের গুরুদেব, কৌল-অবধূত মৎস্যেন্দ্রনাথের কাছে, অর্থাৎ নেপালের পশুপতিনাথের মন্দিরে এই একমুখী রুদ্রাক্ষ ছিল, এবং এখনো সেটা সুরক্ষিত আছে। ওঁং হ্রীং  নমঃ।

গৌরীশঙ্কর রুদ্রাক্ষ ও গনেশ রুদ্রাক্ষ  : এই একমুখী রুদ্রাক্ষের সাথে,আরো দুটি রুদ্রাক্ষের কথা বলবো, যা প্রকৃতির এক অপূর্ব এবং আশ্চর্য্য সৃষ্টি। যার মধ্যে একটি  হচ্ছে, গৌরী শঙ্কর রুদ্রাক্ষ, ও অন্যটি গনেশ রুদ্রাক্ষ। এই রুদ্রাক্ষ দুটি প্রাকৃতিক ভাবে একটু অন্য রকম। প্রথমটি অর্থাৎ গৌরীশঙ্কর রুদ্রাক্ষ আসলে দুটি রুদ্রাক্ষের প্রাকৃতিক মিশ্রণ। প্রাকৃতিক ভাবে দুটি রুদ্রাক্ষ একত্রে জোড়া থাকে। এটি বিভিন্ন মুখী হতে পারে। অর্থাৎ দুই বা তাতোধিক  গর্ত থাকতে পারে এর ভিতরে। ভাগ্যক্রমে যদি এটি দুটি শিরা ওয়ালা হয় তবে এটি একমুখী রুদ্রাক্ষের মতো কাজ করে। গৌরীশঙ্কর রুদ্রাক্ষের পূজা হয়। এটি ধারণযোগ্য নয়। 

গনেশ রুদ্রাক্ষ সাধারণতঃ একটাই রুদ্রাক্ষ কিন্তু এই রুদ্রাক্ষের গায়ে একটি গনেশের শুরের মতো দেখতে পাওয়া যায়। এটিও বিভিন্ন মুখী হতে দেখা যায়, বেশিরভাগই ৫ মুখী। তবে এটি যে কোনো মুখী হতে পারে। আসলে এটি যতমুখী হবে সেই অনুযায়ী ফল দান করবে। এটির দেবতা শ্রী শ্রীগণেশ। এই গনেশ রুদ্রাক্ষের সাধারণত পূজা করা হয়।  এটি ধারণ করা হয় না। 
      

             



    




  

Friday 19 April 2019

প্রণব মন্ত্র

প্রণব মন্ত্র 

প্রণব মন্ত্র
প্রণব কথাটার অর্থ ঈশ্বরের জপ্ । আমাদের অজ্ঞাতসারেই আমরা জন্ম থেকেই  প্রণব মন্ত্র উচ্চারণ করি। প্রণব কথাটার আর একটা মানে প্রতিনিয়ত নতুন। কথিত আছে ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রারম্ভে এই প্রণব মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন। আর এই প্রণব থেকেই সমস্ত সৃষ্টি। অতএব ব্রহ্মা যদি আমাদের পিতা হন তবে প্রণব আমাদের আদি মাতা।এই প্রণবের গর্ভেই আমাদের সবার জন্ম। আবার প্রণব কথাটার আর একটা মানে হচ্ছে যা উচ্চারণ করে স্তব করা হয় তাকেই বলে প্রণব। বেদের মূল এই প্রণব। অর্থাৎ সমস্ত শব্দের মূল এই প্রণব।  আমরা এমনকি সমস্ত জীব জগৎ,  জ্ঞাতসারে, অজ্ঞাতসারে, এই প্রনব দিয়েই  জীবনের প্রথম শব্দ উচ্চারণ করি। যা আসলে ঈশ্বরের জপ্। সমস্ত জীব জগৎ যে ভাষায় কথা বলে তাকে বলে বৈজিক ভাষা।  সমস্ত ভাষার বীজ এই বৈজিক ভাষা। বৈজিক থেকে বৈদিক, গ্রিক, হিব্রু, ল্যাটিন ইত্যাদি ভাষার জন্ম হয়। এই বৈজিক ভাষাতেই সমস্ত জীব কথা বলে বা মনের ভাব প্রকাশ করে। প্রণব বা ওং এই বৈজিক ভাষার উচ্চারিত  ধ্বনি ।     
সনাতন হিন্দুদের কাছে  প্রণব মন্ত্রের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ও বাধ্যতামূলক।  আমাদের সবার বীজ মন্ত্র  প্রণবপুত হওয়া জরুরী। নতুবা বীজ মন্ত্রের শক্তি অপ্রকাশিত থাকে। অবশ্য হিন্দু ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ এখানেও জাতপাতের ব্যাপারটা নিপুন ভাবে প্রয়োগ করেছেন। তান্ত্রিক সন্ধ্যা পদ্ধতির এক জায়গায় পড়ছিলাম স্ত্রী ও শূদ্রদের ওঁ বা ওম  উচ্চারন করার অধিকার নেই। তারা বলবে "ঔং"অর্থাৎ দীর্ঘ প্রণব। যজুর্বেদীয় তর্পন পদ্ধতিতেও  বলা আছে, শূদ্রগন "ওঁ" না বলে "নমঃ" বলবে।   
যাই হোক, "ওম ". কথাটাকে ভাঙলে দাঁড়ায় অ-উ-ম।  সনাতন হিন্দু মতে,  ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর  অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি, লয় এর কর্তা। আবার  সত্ত্বঃ, রজঃ, তমঃ এই তিন গুনের প্রতীক হচ্ছে "ওম"।  কিন্তু কেউ কেউ বলেন,  অ-আ-উ-ম্ এই চারটি বর্ণ নিয়ে প্রণব গঠিত। আবার কেউ কেউ বলেন, প্রণব পাঁচ অক্ষরের মিলন।  অর্থাৎ অ -আ -উ -ঊ -ম অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুত, ব্যোম।
আবার  প্রণব লেখাও হয় -  চার রকম বানানে  -ওম , ওঁ, ওং, ওঁং।
এর কারন কী  ? ওম আসলে কত অক্ষরের মিলন তা আমরা একটু দেখে নেবো।
ওম-কে বলা হয় অক্ষর ব্রহ্ম।  এঁকে  একাক্ষর বলা যেতে পারে।  অর্থাৎ অনুস্বার, চন্দ্রবিন্দু  এগুলোকে বর্ণ থেকে বাদ  দিয়ে  এক অক্ষর বলা যেতে পারে। সত্যি কথা বলতে কি  স্বরই পূর্ণ বর্ণ। কেবল স্বরেই পূর্ণমাত্রা আছে। ব্যঞ্জন  পূর্ণ বর্ণ নহে।  স্বর, স্বয়ং উচ্চারিত হতে পারে। কিন্তু ব্যঞ্জন, অন্যকে আশ্রয় করে উচ্চারিত হয়। সুতরং ও এবং ম্ এই দুটিতে মিলিত হয়ে যে ওম বা ওং হয়েছে, এঁকে এক বর্ণ বা এক অক্ষর বলা যেতে পারে। অতএব ব্যঞ্জন ও একটি স্বর একত্র থাকলে, এই দুটিকে একটি বর্ণ বলা হয়। অর্থাৎ প্রণব এক-অক্ষর, আবার দুই-তিন-চার-পাঁচ অক্ষর বলে বর্ণনা করা হয়।

ওম আসলে দুটো অক্ষরে লেখা হয় অর্থাৎ ও এবং ম অথবা ও এবং"  ঁ" বা  "ং" তাই এঁকে দুই অক্ষরের মিলন বলা যেতে  পারে। অর্থাৎ নিষ্ক্রিয় বা নির্গুণ ব্রহ্ম এবং সক্রিয় বা সগুন ব্রহ্ম।

তবে সব থেকে প্রচলিত অর্থ যেটা  আমরা জানি তা হচ্ছে,  অ, উ, ম - এই তিনটি বর্ণ নিয়ে ওম বা ওঁ অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের কর্তা (ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর ) .
 .
কিন্তু কেউ কেউ বলেন,  অ-আ-উ-ম্ এই চারটি বর্ণ নিয়ে প্রণব গঠিত। তাঁরা বলেন,  অ-কার হচ্ছে পালন কর্তা ,  আ-কার হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা অর্থাৎ ব্রহ্ম, উ কারে লয়-কর্তা অর্থাৎ তমোগুণাত্মক ব্রহ্ম এবং ম বা ং (অনুস্বার) শব্দে পরব্রহ্ম অর্থাৎ গুণাতীত ব্রহ্ম। আর চন্দ্রবিন্দু হচ্ছে স্বরের অনুনাসিকত্ব  জ্ঞাপক।

আবার কেউ বলেন ওং পঞ্চবর্নাত্বক  অর্থাৎ অ-আ-উ-ঊ-ম  অর্থাৎ পঞ্চভূতের (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম )-এর  প্রতীক বলা যেতে পারে।
এইখানে একটা কথা আমি বলি। প্রণব অর্থাৎ ওম, বা ওং বা ওঁ বা ওঁং। একটা জিনিষ খেয়াল করুন, ও এর সঙ্গে ম বা ং বা ঁ যোগ করা আছে -। "ম" অর্থাৎ মহেশ্বর বা কারুর কারুর, কথায় পরব্রহ্ম বা গুনাতীত ব্রহ্ম . কিন্তু,এই অনুস্বার বা চন্দ্রবিন্দু এর অর্থ কি ? বীজ মন্ত্রের  অর্থ খুঁজতে গিয়ে দেখেছি ঁ (চন্দ্রবিন্দু ) হচ্ছে দুঃখ হরাত্মক বাচক। আর ং ( অনুস্বর ) হচ্ছে সুখপ্রদ ও দুঃখনাশন।      
যাই হোক,   ওম , ওঁ, ওং, ওঁং - এই চারটিই প্রণব বাচক।  
প্রথম "ওম" প্রনবটি তমোগুণের প্রতিপাদক, তাই জ্ঞানীরা ব্যবহার করেন না। 
দ্বিতীয় প্রণব অর্থাৎ ওঁ নৈসর্গিক ঘটনায়  শোনা যায়।  বহু শাস্ত্রে, এই প্রণবের ব্যবহার পাওয়া যায়। 
তৃতীয় প্রণব অর্থাৎ ওং কার ত্রিদেবাত্মক অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের প্রতীক।  অনেকেই এটির ব্যবহার করেছেন।  
চতুর্থ প্রণব অর্থাৎ   ওঁং  এর কথা প্রায় শোনা যায় না। তার কারন হচ্ছে - যাদের সগুন সাধনা সমাপ্ত না হয়েছে, তাদের পক্ষে এর ব্যবহার শক্তির অধিক কাজ বলে নির্দিষ্ট হয়। যাদের ভিতর থেকে জাতিভেদ জ্ঞান দূর হয় নাই, নির্গুণ সাধনার যোগ্য হন নাই,  তাদের পক্ষে এই চতুর্থ প্রণব ব্যবহার করা উচিত  নয়। 
 "ওঁং" বানানের প্রতিধ্বনি পাই শিব পূরণে। সেখানে ভগবান শিব, ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকে বলছেন : আমার পাঁচটা মুখ। আর তা হচ্ছে সৃষ্টি, পালন, সংহার, তিরোভাব এবং অনুগ্রহ। সৃষ্টি ভূমিতে, স্থিতি জলে,সংহার অগ্নিতে, তিরোভাব বায়ুতে,অনুগ্রহ আকাশে স্থিত। পৃথিবী থেকে সৃষ্টি, জল থেকে বৃদ্ধি, অগ্নিতে সংহার, বায়ুতে স্থানান্তর আর আকাশ সকলকে অনুগ্রহিত করে। সর্বপ্রথম আমার মুখ থেকে ওঁংকার উদ্গারিত হয়। উত্তরদিকের মুখ থেকে অকার, পশ্চিম মুখ থেকে উকার, দক্ষিণ মুখ থেকে মকার, পূর্ব মুখ থেকে বিন্দু (ঁ) মধ্যের  মুখ থেকে নাদ (ং) উচ্চারিত হয়েছে।  এইভাবে পাঁচ অবয়ব দ্বারা "ওঁং"কার বিস্তারিত হয়েছে।  
বেশিরভাগ পন্ডিতদের মতে,  প্রণব আসলে ত্রিবর্ণাত্মক। আ বর্ণটি  প্রথমটির অর্থাৎ অ এর উচ্চারণ ভেদ মাত্র।

প্রণবকে ত্রিবর্ণাত্মক, অর্থাৎ সত্ত্ব, রজ, তম গুনের প্রতীক বলা যেতে পারে।  আবার পঞ্চবর্নাত্বক  অর্থাৎ অ-আ-উ-ঊ-ম  অর্থাৎ পঞ্চভূতের (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম )-এর  প্রতীক বলা যেতে পারে।

 আবার একাক্ষর বলা যেতে পারে।  অর্থাৎ অনুস্বার, চন্দ্রবিন্দু  এগুলোকে বর্ণ থেকে বাদ  দিয়ে  এক অক্ষর বলা যেতে পারে। সত্যি কথা বলতে কি  স্বরই পূর্ণ বর্ণ। কেবল স্বরেই পূর্ণমাত্রা আছে। ব্যঞ্জন  পূর্ণ বর্ণ নহে।  স্বর, স্বয়ং উচ্চারিত হতে পারে। কিন্তু ব্যঞ্জন, অন্যকে আশ্রয় করে উচ্চারিত হয়। সুতরং ও এবং ম্ এই দুটিতে মিলিত হয়ে যে ওম বা ওং হয়েছে, এঁকে এক বর্ণ বা এক অক্ষর বলা যেতে পারে। অতএব ব্যঞ্জন ও একটি স্বর একত্র থাকলে, এই দুটিকে একটি বর্ণ বলা হয়। 
 স্রষ্টা-সৃষ্টি-সৃষ্ট  এ তিনই এক। কিন্তু এ সব কথা যতক্ষন সাধকের  ব্রহ্মজ্ঞান না জন্মায় অর্থাৎ এক ব্রহ্মর জ্ঞান না জন্মায় ততক্ষন অনুধাবন করা যায় না। এইজন্য, যেমন সাধক, সে অনুযায়ী সে  বোঝে বা  তাকে সেইভাবে বোঝানো হয়। 
প্রণব অসীম শক্তির আধার। এই শক্তি অজ্ঞানীর কাছে সুপ্ত।  জ্ঞানীর কাছে উদ্ভাসিত। 
"ওম" বা প্রণবের মাহাত্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। অবিরত জপ্-ই এর উত্তর দিতে পারে।
এইবার প্রণব সম্পর্কে সুপ্ত সত্য   কথা বলবো, প্রণব আসলে একটা ধ্বনি।জীবনরূপ অগ্নি ও প্রাণরূপ বায়ুর মিথুনে বা সংঘর্ষে এই ব্রহ্ম-শব্দ উৎপত্তি হয়েছে। এটি   অর্থবহ শব্দ নয়। এই ধ্বনির  কোনো অর্থ হয় না। পন্ডিতরা যে যার মতো করে অর্থ বের করেছেন।এই ধ্বনি প্রতিনিয়ত উদ্গীথ হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সর্বত্র, ও সর্বদা। ধ্যানস্থ হয়ে কান পাতলে এই শব্দ শোনা যায়।  এবার, ধ্বনি বা শব্দ  সৃষ্টির রহস্যঃ একটু দেখে নেই।
আমরা জানি, ধ্বনি  চার প্রকার,  পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা ও বৈখরী।
শব্দের বা স্বরের উৎপত্তি হচ্ছে পরা - আমাদের শরীরের ক্ষেত্রে এটি মূলাধার। এই মূলাধারে আছে বায়ুশক্তি বা উর্জা শক্তি।সৃষ্টিতত্ত্বের এখানেই অবস্থান।  এইখানেই ধ্বনির উৎপত্তি। পরা  কথাটার অর্থ হচ্ছে উচ্চ। অর্থাৎ ধ্বনির সর্বোচ্চ পর্যায়, যা আমাদের গোচরীভূত নয়।
এর পরে আছে পশ্যন্তি : এটি  আমাদের নাভিমূল। যার জন্য কেউ কেউ বলে থাকেন, প্রণব নাভি থেকে উৎপন্ন শব্দ।আমাদের নাভিচক্রের বায়ু থেকে আসে। শোনা যায় যোগীরা এই ধ্বনি শুনতে পান।  একে বলে নাদব্রহ্ম।
ধ্বনি এর পরে, নাভি থেকে চলে আসে হৃদয়ে। এখানকার অবস্থানে ধ্বনিকে বলা হয়, মধ্যমা। হৃদয়ের বায়ুচক্রে  যখন ধ্বনি অবস্থান করে, তখন তাকে বলে মধ্যমা।  এটিও সূক্ষ্ম।  তাই হৃদয়ের ডাক সবাই শুনতে পায়  না।
এরপরে, কন্ঠে - যেখান থেকে ধ্বনির  উৎপত্তি বলে সাধারণের ধারণা। আসলে এই পর্যায়ে এসে ধ্বনি শব্দে পরিণত হয়ে যায়। এই ধ্বনি বা শব্দ আমরা শুনতে পাই।  একে বলে বৈখরী।

এবার  বিশ্বব্রহ্মান্ডকে যদি আমরা বিরাট পুরুষের দেহ বলে কল্পনা  করি, তবে দেখতে পাবো, সেই বিরাট পুরুষের মূল ঊর্যাশক্তি থেকে এই ধ্বনির উৎপত্তি। এটি সৃষ্টির সূচক মাত্র। এর কোনো অর্থ হয় না। কেবল গুন্ বর্তমান।
দ্রব্যের যেমন গুন্ বা শক্তি আছে, শব্দেরও তেমনি শক্তি আছে। ভালো সুর শুনলে আমাদের মন মোহিত হয়। আবার বাজির শব্দে বা বজ্রের শব্দে আমাদের মন চমকে ওঠে।

শব্দ দুই রকম : ধ্বনি ও বর্ণ। ধ্বনি অর্থবহ নয়। যেমন বিভিন্ন বাদ্যের বাজনা।কাঁসর ঘন্টা,বাঁশির সুর, বজ্রের ধ্বনি। মেঘের ডাক। ইত্যাদি। তেমনি প্রণব অর্থবহ নয়। প্রণব ধ্বনি, তাই অর্থবহ নয়। 
বর্ণ কিন্তু অর্থবহ। মানুষ এই বর্ণের সাহায্যেই কথা বলে।  তাই অর্থবহ। বর্ণ আবার দুই প্রকার ব্যঞ্জন  বর্ণ ও স্বরবর্ণ। স্বরবর্ণ নিজে থেকে উচ্চারিত হতে পারে। কিন্তু ব্যঞ্জন বর্ণ স্বরবর্ণের সাহায্যে উচ্চারিত হয়।
 আমাদের মুনি ঋষিরা ধ্বনি ও শব্দ, উভয়ের মাহাত্য দিয়েছেন। বেদে  ধ্বনির মাহাত্য।  এইজন্য বেদের সূক্ত বা শ্লোকের উচ্চারণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে।  এই জন্য এঁকে শ্রূতি   বিদ্যা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এটি একমাত্র গুরুমুখে শুনেই শেখা বা আয়ত্ত্ব করা যায়।

অগ্নি ও বায়ুর মিশ্রনে বর্ণের সৃষ্টি।  বর্ন আর কিছুই নয় আলোর বিন্দুর সমষ্টি।  পরাবিদ্যাবিদ-গন  বলছেন, দেবতারা যখন কথা বলেন, তখন এক আলোর আভা দেখতে পাওয়া যায়। তাই ওম হচ্ছে আদি ধ্বনি, এটি অর্থবহ নয়।অগ্নিতত্ত্ব ও বায়ুতত্ত্বের মিশ্রনে এই প্রণবের উৎপত্তি।  যে যার মতো করে আমরা অর্থ দিয়েছি মাত্র।

ফলাফল :
এবারে আমরা ছান্দোগ্য উপনিষদের থেকে জেনে নেবো প্রণব জপ্ করলে কি হয় ?ছান্দোগ্য  উপনিষদের প্রথম  পাঁচটা অধ্যায়  আছে এই প্রণব সন্মন্ধে।

দেখুন, ঈশ্বর নিরাকার, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। আমাদের মতো সাধারণের পক্ষে তাঁর সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভবই  নয়। সেই জন্য আমাদের পক্ষে সকাম উপাসনা করা ভালো।  সকাম উপাসনা করলে আমাদের ধন, স্বাস্থ্য, সুনাম, ক্ষমতা ইত্যাদি, এমনকি স্বর্গলাভও  হতে পারে। কিন্তু শাশ্বত শান্তি বা আনন্দ এতে পাওয়া যাবে না। একমাত্র আত্মজ্ঞান লাভই শাশ্বত শান্তির পথ বা মুক্তির পথ। এরই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে উদ্গীথ বা "ওম" আবৃত্তি বা জপ করতে বলা হয়েছে।

ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছে :

ওম-ইত্যে-তদ্-অক্ষরম-উদগীথম-উপাসিত : অর্থাৎ  উদ্গীথ  শব্দ-বাচ্য "ওম" এই অক্ষরকে উপাসনা করবে। 

ওম-ইতি  উদগায়তি : ওম দিয়েই উদ্গীথ গান করা হয়। (উদ্গাতার গেয় অংশই  উদ্গীথ।)

বাক্ ও প্রাণ যখন মিলিত হয় তখন উদ্গীথ জন্ম নেয়।  এই উদ্গীথ - এর বর্ণাত্মক অক্ষরই ওম বা ওঁ। 

"ওম" সম্মতিসূচক শব্দ। ওম অর্থাৎ হ্যাঁ। ওম সমস্তকিছুর  উৎস। সূর্য্য  

আচার্য্য চানক্য বলছেন, বেদে "ওম" কে পরব্রহ্ম বলে স্বীকার করা হয়েছে। এই "ওম" শব্দের সঠিক প্রয়োগে, ও জ্ঞান অর্জনের দ্বারা, স্বর্গলোক এমনকি এই পার্থিব জগতের সমস্ত কিছুই লাভ করা যায়।
প্রণব সন্মন্ধে শব্দের বিরাম দেব। শেষ করার আগে শুধু একটা কথা বলবো : 
প্রণব সর্ব্ব শক্তির আধার, তা সে জাগতিক বলুন আর আধ্যাত্মিক বলুন।

ওম নমঃ শিবায়ঃ। 

Thursday 11 April 2019

সাপ্তাহিক আলোচনা (পঞ্চম)-বিবেকচূড়ামণি (শ্লোক নং ৬৫)

বিবেকচূড়ামণি  (শ্লোক নং ৬৫)
আমাদের সাপ্তাহিক ধর্ম্ম আলোচনায় ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ হয় ।  আজ সাপ্তাহিক আলোচনার পঞ্চম দিন। আমাদের আলোচনায় একটা কথা উঠে এসেছে, যে আমাদের কথা আমরাই বুঝতে পারছি না। অর্থাৎ নিতান্ত গ্রন্থপাঠ করে গেলে, বিস্তারিত ভাবে আলোচনা না করলে, আমরা কিছুই অনুভব করতে পারছি না। এখন কথা হচ্ছে অন্ধ অন্ধকে পথ দেখাবে কি করে ? আমরা যারা একত্র হয়েছি, তারাতো কেউ শাস্ত্রজ্ঞ নোই। তাই শাস্ত্রের গুড়কথা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। তাই ঠিক হয়েছে, একদিনে বেশি পাঠ না করে, বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা করি। তাই আজ এবং এখন থেকে  আমরা একটা-আধটা  শ্লোক নিয়েই আলোচনা করবো। ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করবো। আমরা পাঠ করছিলাম বা শুনছিলাম, আচার্য্য শঙ্করের বিবেকচূড়ামণি  গ্রন্থ থেকে। গতদিন যেখানে শেষ করেছিলাম, আজ সেখান থেকেই শুরু করবো। 

শ্লোক  ৬৫ :

আপ্তোক্তিং খননং তথোপরি শিলাদ্যুৎকর্ষণং স্বীকৃতিং 
নিক্ষেপঃ সমপেক্ষতে ন হি বহিঃ শব্দৈন্তু নির্গচ্ছতি। 
তদ্ বদ্ ব্রহ্মবিদ-উপদেশ-মনন-ধ্যানাদিভিঃ লভ্যতে 
মায়াকার্য্যতিরহিতং স্বম মল তত্ত্বং ন দুর্যুক্তিভিঃ ।। 

এই একটা শ্লোকের মধ্যে দিয়ে আধ্যাত্মিক জগতের প্রবেশের পথ, সঠিক সাধনার সংক্ষিপ্ত পথ বলে দিলেন আচার্য শঙ্কর । বলছেন : 
আপ্তোক্তিং : আপ্ত উক্তি অর্থাৎ জ্ঞানী ব্যক্তির উপদেশ।  
খননং : খননকার্য্য অর্থাৎ ভূমি খোরা।  
তথোপরি : তথা উপরি অর্থাৎ ভূমির উপরে, বা সেই মূল্যবান ধনের উপরে যে মাটি আছে বা পাথর আছে তার উপরে।   
শিলাদ্যুৎকর্ষণং : শিলাদি-উৎকর্ষণং অর্থাৎ ধনের উপরে যে পাথর ইত্যাদি আছে তার অপসারণ  
স্বীকৃতিং : ধন পাওয়ার স্বীকৃতি, অর্থাৎ নিজে থেকেই ধন সংগ্রহ করতে হবে।  
নিক্ষেপঃ : যা ভিতরে ছড়িয়ে আছে, অর্থাৎ ভুমধ্যে যে ধন ছড়িয়ে আছে। 
সমপেক্ষতে ন হি বহিঃ : সমপেক্ষতে অর্থাৎ অপেক্ষা করে, অর্থাৎ ওই পাথর গুলোর সরানোর অপেক্ষায় থাকে, ন হি বহি অর্থাৎ বাহির হয় না। 
শব্দৈন্তু নির্গচ্ছতি: শব্দের দ্বারা বাইরে আসে না। 
তদ্ বদ্ ব্রহ্মবিদ-উপদেশ-মনন-ধ্যানাদিভিঃ : সেই রকম, ব্রহ্মবিদদের উপদেশ, সেই উপদেশের মনন, তার ধ্যান দ্বারা ;
লভ্যতে : অর্থাৎ লাভ করা যায়।  
মায়াকার্য্যতিরহিতং : মায়া অর্থাৎ মিথ্যা অহং-এর কাজ দূর হয়ে যায়। 
স্বমমল তত্ত্বং : স্বং তত্ত্বং অমলং অর্থাৎ নির্মল সেই তত্ত্ব অর্থাৎ ব্রহ্মতত্ত্ব 
ন দুর্যুক্তিভিঃ : অর্থাৎ দুর্যুক্তি বা কুতর্কের দ্বারা পাওয়া যাবে না।
এই একটা কথার মাধ্যমে,  ব্রহ্মকে কি করে জানা যাবে বা পাওয়া যাবে, সেটা যেমন বলে দিলেন, তেমনি এও বলে দিলেন, যে কিসে সেটা পাওয়া যাবে না।  

পুরো অর্থটা একবার দেখে নেই : 
 ভূগর্ভস্থ  সম্পত্তি পেতে গেলে যেমন প্রথমে যে ব্যক্তি এর সন্ধান জানেন, তার কাছ থেকে উপদেশ নিতে হয়, তার পরে,  ভূমি খনন করতে হয়, ধনের উপরে রাখা পাথর সরাতে হয়, সব শেষে নিজেকেই ধন সংগ্রহ করতে হয়, কেবলমাত্র ধন তুমি এস, ধন তুমি এস, বললেই ধন নিজের আয়ত্ত্বে আসে না, তেমনি মায়া-মুক্ত নিজের শুদ্ধ স্ব-রূপকে জানতে গেলে, যিনি এটা জানেন, অর্থাৎ সেই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের কাছে উপদেশ নিতে হয়, পরে তার সেই উপদেশের মনন করা দরকার, সবশেষে সেই সর্বজ্ঞ পুরুষের ধ্যান  ইত্যাদির দ্বারা, তাকে অনুভব করা যায়। 
ভগবান শঙ্কর বলছেন, ব্রহ্মকে জানতে গেলে আগে, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের  স্মরণ নিতে হবে। তার উপদেশ শুনতে হবে। অন্ধ অন্ধকে রাস্তা দেখাতে পারে না। তাই আমাদের জ্ঞানীর অর্থাৎ গুরুদেবের কাছে যেতে হবে।  এই গুরুদেব কেমন হবে, তা তিনি আগে বলেছেন। গুরুদেব হবেন ব্রহ্মজ্ঞ। 
এখন কথা হচ্ছে এই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ আমরা কোথায় পাবো? তাদের চিনবোই বা কি করে ? আর ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ আমাদের জ্ঞান দান করবেন, এই সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। তাহলে আমাদের কি করণীয় ? এই জায়গায় পারাবিদ্যাবিদগন বলছেন, আগে নিজেকে তৈরী করতে হবে। শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ, সৎ-সঙ্গ যাপন এবং সর্বক্ষণ শাস্ত্রগ্রন্থের বিষয় বা বক্তব্যকে মনন করা। এই মনন করতে করতেই, শাস্ত্রের যথার্থ অর্থ আপনার কাছে পরিষ্কার হবে। আগে নিজেকে উপযুক্ত শিষ্য হিসেবে তৈরী করতে হবে। তবেই সেই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের সন্ধান পাওয়া যাবে। এখন নিজেকে উপযুক্ত শিষ্য করতে গেলে আর কি করতে 
হবে ? গুরুকে বাইরে খুঁজতে যাবেন না। গুরু আপনার ভিতরে আছেন।  বিবেক আপনার পরম গুরু। আপনি বিবেকের নির্দেশে চলুন।পরম-ঈশ্বরই সবার আসল গুরু। তিনি-ই আপনাকে বিবেকের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠাবেন। তাই আপনি বিবেকের নির্দেশ অনুসরণ করুন।
মহতের অনুসরণ করো,  দীক্ষা নাও, গুরুর সাক্ষাৎ করো। গুরুর উপদেশ অনুযায়ী কাজ করো এইসব কথা  চির-পুরাতন।  কিন্তু আত্ম অনুসন্ধান করলে বোঝা যায়, সঠিক প্রক্রিয়া সম্পন্দন ব্যতীত, কারুরই আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্ভব নয়। দুর্গম এই পথ, অলসতা বা অবসর বলে এখানে কিছু নেই। নিরন্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে হয়। দিনের অবসর মতো ক্ষাণিক্ষনের জন্য গুরুমন্ত্র জপ্ করলাম, তাতে আধ্যাত্মিক জগতের কণামাত্রও সংগ্রহ করা যায় না। নিরন্তর নিজের মধ্যে ডুবে যেতে হবে। গুরুলাভের জন্য চেষ্টা করতে হবে না। উপযুক্ত হলে গুরু এসে যাবেন। গুরুরাও বসে থাকেন  উপযুক্ত পাত্রের জন্য। যাদের অন্তরাত্মা শুদ্ধ হয় নি, তার গুরু করে কি হবে ? গুরুমন্ত্র জপ্ করলে ক্ষতি নেই, কিন্তু আধ্যাত্মিক পথে বহুদূর পর্যন্ত একাই যেতে হয়। অন্তিম সময়ে গুরু এসে হাত ধরেন। তিনি দেহধারী গুরু নাও হতে পারেন, বহু পারলৌকিক মহাত্মারা আমাদের আধ্যাত্মিক পথে হাত ধরে নিয়ে যাবার জন্য সদা জাগ্রত আছেন। একটা নির্দিষ্ট পথ পর্যন্ত নিজেকেই যেতে হয়। তার জন্য আপনার সহায় হবে, ধর্মশাস্ত্র, শরণ, মনন, বিবেক বৈরাগ্য। 
এই পথে চলতে গেলে সৎ, অসৎ, এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। চরিত্র শোধন, অসতের প্রতি অনাসক্ত থাকতে হবে।  কর্তব্য কর্মে অবহেলা নয়, কিন্তু মোহের বন্ধন  থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে। আধ্যাত্মিক প্রেম বৃদ্ধি করতে হবে। চিত্ত সংযম, শারীরিক পবিত্রতা, বিশ্বাস, ধৈর্য্য, শ্রদ্ধা, তিতিক্ষা ইত্যাদির বৃদ্ধির দ্বারা মানবিক সম্পদ বৃদ্ধি করতে হবে। সবশেষে পরম-পিতার সাথে মিলিত হতে গেলে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করতে হবে। আকুলতা বাড়াতে হবে।  তবেই সেই পরম-পিতা আমাদের কোলে তুলে নেবেন। 
সুতরাং দীক্ষা নিতান্ত একটা অনুষ্ঠান নয়। দীক্ষা গ্রহণ একটি সাধনা। 
এর পরে ধ্যানের প্রস্তুতি, অর্থাৎ ধ্যানের যে কোনো প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢোকা। কেউ কেউ ত্রাটক দিয়ে শুরু করেন, কেউ ভ্রূযুগলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন, কেউ নাসিকা অগ্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন, কেউ হৃদয়ে মনোনিবেশ করেন, এমনি বহু প্রক্রিয়া আছে। যার কাছে যেটা সহজ মনে হয় সেটা দিয়ে শুরু করতে পারেন। তবে সব থেকে সহজ হচ্ছে, উদ্গীথ অর্থাৎ "ওম" দিয়ে শুরু করা। সশব্দে "ওম" দিয়ে শুরু করেন। একটা সময়, ধীরে ধীরে এই "ওম" শব্দ  আপনার নাভি থেকে উদ্গত হতে থাকবে, আপনার নিশ্বাস প্রশ্বাস -এর গতি ধীর হবে। একটা সময় আপনি "ওম" এই নাদব্রহ্মকে  আপনার ভেতর থেকে শুনতে পাবেন। অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে  এই অক্ষর-ব্রহ্মের সঙ্গে আপনি নিজেকে দেখতে পাবেন। 
সমুদ্রে প্রবেশের পথ বহু, নদী, নালা বহু আছে। সূর্য্যে যাবার জন্য নির্দিষ্ট কোনো রাস্তা নেই । যে যেখানে আছেন, সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে পারেন। শুধু লক্ষ ঠিক রাখতে হবে। আপনার রুচি অনুসারে পথ অবলম্বন করা যেতে পারে। আপনার সাংসারিক কাজের ব্যাঘাত না করে, ন্যায় পথে থেকে জীবনকে চালিত করলেই উন্নতির পথে অগ্রসর হওয়া যায়। মানুষের হৃদয় ও মন, সমস্ত কাজের উৎপত্তিস্থান। মানুষের চিন্তা, বিচার, বুদ্ধি, যত তীক্ষ্ন হবে, যত পবিত্র হবে, ততো আপনার জ্ঞান, স্বচ্ছ হবে।  এবং আপনার আত্মার উন্নতি হবে, অর্থাৎ আপনার আত্মার উপরে যে ভাব আত্মাকে অস্বচ্ছ করে রেখেছে, সেই মল দূরীভূত হবে। অবিদ্যা দূর হবে। আত্ম সমর্পনের ভাব যত বাড়বে, মনের উচ্চ স্তর  থেকে, আলোক রেখা এসে অবিদ্যারূপ অন্ধকারকে দুর করে, মানুষকে দেবত্ব আরোপ করবে। 

ওম নমঃ শিবায়ঃ।

সপ্তম সপ্তাহ  
৬৬ নং শ্লোক :
তস্মাৎ সর্ব প্রযত্নেন ভববন্ধ বিমুক্তয়ে 
স্বৈরেব যত্নঃ কর্তব্যো রোগাদৌ-ইব পণ্ডিতৈঃ।
তস্মাৎ - সেই রকম বা সেই জন্য
সর্ব প্রযত্নেন - সব রকম যত্ন  বা চেষ্টা করে 
ভববন্ধ - ভববন্ধন বা সংসার বন্ধন
বিমুক্তয়ে - মুখ হবার জন্য অর্থাৎ সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হবার জন্য
স্বৈরেব - স্বৈঃ+এব - অর্থাৎ নিজের থেকেই বা নিজের দ্বারাই
যত্নঃ কর্তব্যো - যত্ন বা চেষ্টা করা কর্তব্য
রোগাদৌ-ইব -  রোগ আদি যেমন
পণ্ডিতৈঃ।  - পণ্ডিত বা বিচারশীল ব্যক্তিগণ।

অর্থাৎ রোগ থেকে মুক্তি পাবার জন্য, যেমন নিজেকেই ঔষধ খেতে হয়, তেমনি ভব বা এই সংসারের  বন্ধন  থেকে মুক্তি লাভ কারবার জন্য, পণ্ডিত ব্যক্তিগণ বা বিচারশীল ব্যক্তিগণ নিজে থেকেই সব রকম উপায় অবলম্বন করেন।
এর আগে আমরা ৫৩ নং শ্লোকে এই একই রকম কথা পেয়েছি।  সেখানেও তিনি বলেছিলেন,  যে রুগী, নিজে থেকেই  ঔষধ ও পথ্য  সেবন করে, তাকেই আরোগ্য হতে দেখা যায়। অন্য কেউ ঔষধ খেলে আমার তাতে অন্যের কোনো উপকার হবে না।
অতয়েব সাধন জাগতে, আমাদেরকেই সক্রিয় হতে হবে। কেবল গুরু করলেই হবে না। গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী আমাদেরকে স্বয়ং সাধনায় লিপ্ত বা যোগক্রিয়া করতে হবে।

৬৭ নং শ্লোক :
যস্ত্বয়াদ্য কৃতঃ প্রশ্নো বরীয়াঞ্ ছাস্ত্রবিম্মতঃ
সূত্ৰপ্ৰায়ো নিগূঢ়ার্থো জ্ঞাতব্যশ্চ মুমুক্ষুভিঃ
গুরুদেব এবার শিষ্যের প্রসংশা করছেন। বলছেন :
যস্ত্বয়াদ্য - যঃ ত্বয়া অদ্য - অর্থাৎ যা তুমি আজ
 কৃতঃ প্রশ্নো - প্রশ্ন করেছো
 বরীয়াঞ্ ছাস্ত্রবিম্মতঃ - বরিয়ান-চ  শাস্ত্রবিৎ মৎ -  বরিয়ান চ অর্থাৎ বড় উৎকৃষ্ট।  শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তির মতো।
সূত্ৰপ্ৰায়ো - সূত্রের মতো অর্থাৎ সংক্ষেপে 
 নিগূঢ়ার্থো  - গভীর ভাবপূর্ণ বা গভীর অর্থবহ।
জ্ঞাতব্যশ্চ - জ্ঞাতব্য বা যা জানা উচিত
মুমুক্ষুভিঃ। - অর্থাৎ মুমুক্ষ ব্যক্তির জন্য, অর্থাৎ মুক্তি লাভের ইচ্ছুক ব্যক্তির জন্য।

৬৮ নং শ্লোক :
শৃণুষ্বাবহিতো বিদ্বন্  যন্ময়া সমুদীর্ঘতে
তদ্-এতত্-শ্রবণাৎ সদ্যো ভববন্ধনাৎ-বিমোক্ষসে।
শৃণুষ্বাবহিতো - শৃণুষ্ব অবহিত - অবধান সহ শোনো, অর্থাৎ স্থির হয়ে শোনো। 
বিদ্বন্  যন্ময়া সমুদীর্ঘতে - হে বিদ্বান, যন ময়া অর্থাৎ যা আমি, বা  আমার দ্বারা কথিত হচ্ছে  
তদ্-এতত্-শ্রবণাৎ - এর শ্রবণ থেকে সেই 
সদ্যো ভববন্ধনাৎ-বিমোক্ষসে। - সদ্য অর্থাৎ এখনি ভববন্ধনাৎ-বিমোক্ষসে অর্থাৎ ভববন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করবে।  

গুরুদেব বলছেন,  আজ যে প্রশ্ন তুমি করছো, তা সংক্ষিপ্ত ও শাস্ত্রবিদদের মনমতো। এবং মুমুক্ষব্যাক্তিদের জ্ঞাতব্য। কি প্রশ্ন করেছিলেন,  তা একবার একটু দেখে নেবো।  ৪৯ নং শ্লোকে শিষ্য জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বন্ধন  কি ? বন্ধন এলো কি করে ? বন্ধনের কিরকম স্থিতি। কি করলে মুক্তি হয় ? অনাত্মা কি ? পরম-আত্মাই বা কি ? কোনটা অনাত্মা, আর কোনটা আত্মা এটা কি করে বোঝা যাবে ?
জিজ্ঞাসুর এই প্রশ্ন শুনে, আচার্যদেব উত্তর শুরু করেছিলেন, উত্তর দিতে দিতে, তার মনে হলো, এই প্রশ্নই যথাযথ যা শুনলে, আমাদের সবার মুক্তি হতে পারে।
হে প্রিয় শিষ্য, তোমাকে যা বলছি, তা তুমি মনোযোগ সহকারে শোনো।  এই সব কথা শুনলে, তুমি অচিরে ভববন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।
ভালো শিষ্য পেলে গুরুর খুব আনন্দ হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলছেন, "শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম"(৪/৩৯) ;  "সংশয়াত্মা বিনশ্যতি "  (৪/৪০) ।
গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে গুরুর কাছে, মনের সংশয় দূর করবার জন্য, জ্ঞান  লাভের জন্য, প্রশ্ন করতে হবে। আমি এক স্বামীজীর কাছে শুনেছিলাম, বলছেন : আমার কাছে যারা প্রশ্ন নিয়ে আসে, তাদের মধ্যে সত্যিকারের জিজ্ঞাসু দেখতে পাই না। তারা আসে, প্রশ্নও করে, কিন্তু তাদের মনে যে  বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে আছে, সে সেই বিশ্বাসের সমর্থনে তারা আমাদের কাছ থেকে সমর্থন চায়। সত্যকে জানবার আগ্রহ তাদের নেই। যারা কৃষ্ণের ভক্ত তারা কৃষ্ণই একমাত্র পরম-ঈশ্বর সেটা তারা শুনতে চান। আবার যারা বুদ্ধের ভক্ত তারা বুদ্ধের ভগবানত্ত্ব শুনতে চান। এরা  নতুন কিছু, শুনলে পালাতে চায়। আমি যখন এই সব আহাম্মকদের তাড়াতে চাই, তখন বিপরীত কথা বলি। সত্যিকারের ভগবানের কথা কে শুনতে চায় ? মুক্তির কথা কে শুনতে চায় ? কেউ মূর্তিপূজার সমর্থনে বক্তব্য শুনতে চায়। কেউ আবার নিরাকারের উপাসনায় সর্বোচ্চ ফল জানতে চায়। খালি পেতে কেউ আসেনা।  বাসি পচা খেয়ে বদ হাজামের রুগী সব। আসলে গুরু সব সময় যোগ্য শিষ্য খোঁজে। অষ্টাবক্র মুনি পেয়েছিলেন, বিদেহী রাজা জনককে, কৃষ্ণ পেয়েছিলো অর্জুনকে, ধর্মরাজ পেয়েছিলো নাচিকেতাকে।

রাজা জনকের প্রশ্ন শুনুন :
কথং  জ্ঞানম  অবাপ্নোতি কথং মুক্তির্ভবিষ্যতি
বৈরাগ্যং চ কথং প্রাপ্তম এতদ ব্রূহি মম প্রভো। 

হে আমার প্রভু, জ্ঞান কি ভাবে হবে, মুক্তি কি ভাবে হবে, বৈরাগ্য প্রাপ্ত হাওয়া যায় কি ভাবে ? এই সব কথা আমাকে বলুন।
সংক্ষেপে অথচ জীবনের সার প্রশ্ন। যা আমাদের সবার প্রশ্ন।

এবার নচিকেতা কি বলছেন শুনুন :
যেয়ং প্রেতে বিচিকিৎসা মনুষ্যে  অস্তিত্যেকে নায়ম অস্তীতি চৈকে 
এতদ বিদ্যাম অনুশিষ্ট স্বত্বায় অহং, বরাণামেষ বরস-তৃতীয়ঃ। 

মানুষের মৃত্যুর পরে, যে সংশয় উপস্থিত হয়, অর্থাৎ পরলোকগত আত্মা - কেউ বলেন তিনি আছেন, কেউ বলেন, নেই - সেই সংশয়ের অর্থাৎ আত্মা আছেন কি নেই, অর্থাৎ আত্মার অস্তিত্ত্ব অনস্তিত্ত্ব জানতে চাই।
সূত্রাকারে, সূত্র কথাটার মানে সংক্ষেপে সার কথা।  সংক্ষেপে মূল প্রশ্ন করার মতো শিষ্যের অভাব। আমরা তো আমাদের সঞ্চিত অজ্ঞান গুরুদেবকে শোনাতে চাই, এবং গুরুদেবের কাছ থেকে সেই অজ্ঞানের রক্ষার্থে মংত্র চাই।
আমাদের ভিতরের সংশয় দূর করবার জন্য শ্রদ্ধাশীল হয়ে জ্ঞানীর কাছে অর্থাৎ আচার্য্যের কাছে তাকে  সেবায় সন্তুষ্ট করে, জীবনের অর্থ, উদ্দেশ্য, ও উপায় জেনে সাধনায় লিপ্ত হওয়া উচিত।
যখন গুরু বোঝেন, শিষ্য এখন তত্ত্বজ্ঞান গ্রহণ করবার জন্য প্রস্তুত। তখনি তিনি তত্ত্বজ্ঞান প্রদান করবার জন্য আগ্রহী হন। এবং সংসার বন্ধন   থেকে মুক্ত করার জন্য উপদেশ দিয়ে থাকেন, আর গুরুর উপদেশ শুনেই আমরা মুক্তির পথ লাভ করতে পারবো। বই পরে, এমনকি গুরুর কথা শুনে আমাদের কিছুই হবে না , যদি না আমরা নিজেরা সক্রিয় হই । আকুল না হই।

ওঁম নমঃ শিবায়ঃ।

 








    

   















        

Tuesday 9 April 2019

হরে রাম হরে কৃষ্ণ - সত্য শব্দার্থ

হরে রাম হরে কৃষ্ণ - সত্য শব্দার্থ 


হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে 
হরে রাম  হরে রাম রাম রাম হরে হরে।  

এর আগে আমরা এই মহামন্ত্রের  অর্থ শ্রী শ্রীচরণ দাস মহাশয়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম।  আজ আমরা এই মন্ত্রের শব্দার্থ শুনবো।
মন্ত্র বলতে আমরা সেই শব্দ বা শব্দভাণ্ডার বুঝি, যা আমাদের মনকে ত্রাণ করে । বেদে আমরা যে মন্ত্র আমরা পাই, তাতে ব্রাহ্মণদের একাধিপত্য। এই সব মন্ত্রে শুদ্র বা স্ত্রীজাতির অধিকার নেই। তা ছাড়া এই সব মন্ত্রের একটা নির্দিষ্ট ছন্দ আছে. যেমন গায়েত্রী ত্রিস্টুপ ছন্দে গাইতে হয়। এইগুলো আবার গুরুপ্রদত্ত। অর্থাৎ গুরুর কাছ থেকে এর যথাযথ উচ্চারণ শিখে নিতে হয়। নতুবা মন্ত্র শক্তি জাগ্রত হয় না। শ্রী শ্রীচৈতন্যদেব আমাদের একটা সহজ সরল, ও সর্ব্ব সাধারণের জন্য একটি সার্বজনীন মংত্র দান করলেন। যার কোনো নির্দিষ্ট সুর নেই। যার কোনো গোপনীয়তা নেই। এই মন্ত্র যেমন উচ্চস্বরে গাইতে পারেন। আবার জপের সময় আপনি অস্ফুট স্বরেও  গাইতে পারেন। এই সর্ব্বজনীন মন্ত্র আপামর জনসাধারণকে আপ্লুত করেছে।  ঘরে ঘরে অষ্টপ্রহর গীত হয় এই মন্ত্র, খোল করতাল সহযোগে। আবার খালি গলাতেও আপনি গাইতে পারেন। অদ্ভুত আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন এই মহামন্ত্র।    

এখানে তিনটি শব্দ আছে ১. হরে - আটবার ; ২. কৃষ্ণ চারবার  ; ৩. রাম চারবার। মোট ষোলোটি শব্দ ও বত্রিশটি অক্ষর। এই মন্ত্রের উদ্গাতা হচ্ছেন, শ্রী শ্রী চৈতন্যদেব।  

হরে :
হরে কথাটা এসেছে হরি থেকে। হরি  অর্থাৎ পরম-পুরুষ পরমেশ্বর। আর হরে  হচ্ছে হরি এর স্ত্রী লিঙ্গ। অর্থাৎ শ্রীলক্ষ্মী।

হরে কথাটার আর একটা অর্থ  হচ্ছে হরন  করা। অর্থাৎ সকলের হৃদয় হরণ  করেন যিনি তিনিই হরি বা হরে  । 

আবার বলা যেতে পারে, হরে কথাটার মাধ্যমে  ভক্ত ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছে, সমস্ত দুঃখ কষ্ট হরণ  করবার জন্য। একবার রামের কাছে, একবার কৃষ্ণের কাছে আর্তি জানানো হচ্ছে। এই রামচন্দ্র এবং শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন,  হিন্দুদের মতে  পালন কর্তা শ্রীবিষ্ণুর অবতার।  

হরি কথাটার আর একটি আভিধানিক অর্থ  হচ্ছে  হিন্দুসমাজের অস্পৃশ্য করে রাখা সম্প্রদায়ের লোক। এই মন্ত্রের স্রষ্টা  হচ্ছেন, শ্রী শ্রীচৈতন্যদেব। তিনি হিন্দু ধর্মের পুনরুদ্ধারের একজন অবতার পুরুষ। তিনি দেখেছিলেন,স্ব-ঘোষিত পন্ডিত ব্রাহ্মণদের বর্বরতা, এবং মূর্খতা ।  নিজে এর ভুক্তভোগী।  তথাকথিত এইসব ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের হাত থেকে হিন্দু সমাজকে উদ্ধার করতে এই সহজ সরল মংত্র দান করেছেন তিনি । হরি অর্থাৎ ভগবানের অংশ সমস্ত জীব। এই অন্তজ শ্রেণীর মানুষেরাও যে ভগবানের  অংশ,  সমাজকে চৈতন্যদেব এই বার্তা দিতে দিয়েছেন, এই মন্ত্রের মাধ্যমে । আর একটা জিনিস খেয়াল করবেন।  চৈতন্যদেব বুঝেছিলেন, খালিপেটে ভগবানের স্মরণ হয় না। তাই প্রচলন করেছিলেন, নর-নারায়ণের সেবা। অর্থাৎ হরিনাম সংকীর্তনের শেষে নারায়ণের সেবার নামে মহোৎসবের ব্যবস্থা।এটি বাধ্যতামূলক।  উপস্থিত সবাইকে অর্থাৎ ধনী দরিদ্র, জ্ঞানী অজ্ঞানী নির্বিশেষে খাবারের ব্যবস্থা।  এবং সেই খাবার খুব সাধারণ মানের  ও নিরামিষ খাবার। কিন্তু যিনি খেয়েছেন, তিনি জানেন,অপূর্ব স্বাদ হয়, এই অন্নে।   অর্থাৎ মানুষকে অন্নদান। এবং সবাই এক পংক্তিতে বসে এই খাবার গ্রহণ করে মানুষ। এইখানেই শ্রী শ্রীচৈতন্যদেবের বৈশিষ্ট। আজও  আপনি যদি বৃন্দাবনে যান দেখবেন , বহু নিরাশ্রয় ব্যক্তির খাবারের ব্যবস্থা হয় এই সংকীর্তনের আসরে।  এখানে, কীর্তনে অংশ গ্রহণ করলে, পয়সা, খাবার  ইত্যাদি পাওয়া যায়। এইখানেই  শ্রী চৈতন্যদেব সব ধর্মের মাহাত্মকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। এই কীর্তনের আসরে, না থাকে জাতিভেদ, না থাকে লিঙ্গভেদ। সবাই সবাইকে আপন করে নেয়। সনাতন হিন্দু ধর্মের এই তো ছিল মাহাত্ম।সর্ব্বেসাম স্বস্তিরভবতু, সর্ব্বেসাম শান্তিরভবতু, সর্ব্বেসাম পূর্নম ভবতু, সর্ব্বেসাম মঙ্গলম ভবতু  .কোথায় হারিয়ে গেছে সে সব।   

কৃষ্ণ

কৃষ্ণ আমাদের মহাভারতের দেবকী নন্দন। যারা শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত তারা এই অর্থই গ্রহণ করে থাকেন।

কৃষ্ণ কথাটা কৃষ ধাতু থেকে উৎপত্তি।(কৃষ + ন ) কৃষ মানে আকর্ষণ করা। যিনি সকলের হৃদয়  আকর্ষণ করেন, তিনিই কৃষ্ণ । কৃষ্ণ কথাটার আর একটি অর্থ হচ্ছে আকর্ষক বা মাধ্যাকর্ষন শক্তি । অর্থাৎ যা  আমাদের সকলকে আকর্ষণ করছে। জগৎ,  এই প্রেম বা আকর্ষণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। আকর্ষণই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডকে সঠিকভাবে  শৃঙ্খলিত করে  রেখেছে। তাই কৃষ্ণকে বলা হয় প্রেমপুরুষ। 

আবার কৃষ্ণকে ভাগ করলে দাঁড়ায় কৃৎস্ন + ন। কৃষ কথাটার মানে  সর্ব্ব। অন্য মানে, স্তূপ, জল। ন কথাটার মানে আত্মা।অর্থাৎ জলে স্থিত বা স্তূপাকৃতি আত্মা তাকেই বলে কৃষ্ণ। এই জন্য কৃষ্ণ বা বিষ্ণুকে আমরা দেখি সমুদ্রের মধ্যে শায়িত। ক্ষিরোদসাগরে শায়িত, পাশে শ্রীলক্ষ্মী বসা।     

কৃষ্ণ কথাটার আর একটি অর্থ হচ্ছে "কালো" । অর্থাৎ অন্ধকার। অর্থাৎ শুন্য। শুন্য থেকেই জগতের সৃষ্টি। অর্থাৎ কৃষ্ণ কথাটা দিয়ে সেই সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করা হচ্ছে, বা তার কাছে আর্তি বা আমাদের প্রার্থনা করা হচ্ছে। 

রাম :

রামায়ণের দশরথ রাজার প্রথম পুত্র রামচন্দ্র। যিনি বিষ্ণুর অবতার। যারা রামভক্ত তারা এই অর্থ গ্রহণ করে থাকেন। 

রাম কথাটার আর একটা মানে হচ্ছে বৃহৎ।

রাম কথাটার অন্য একটি গ্রহণযোগ্য অর্থ হচ্ছে - রময়তি য স রামঃ। অর্থাৎ যিনি  ক্রিয়ারত আছেন। ভগবানের দুটি সত্ত্বা একটি ক্রিয়ারত অর্থাৎ সৃষ্টিতত্ত্ব আর একটি হচ্ছে অক্রিয় বা নিষ্ক্রিয়। রাম  কথাটার মাধ্যমে  ভগবানের  এই ক্রিয়ারতসত্ত্বা বা সক্রিয়  ভগবানের কথা বলা হচ্ছে।

রময়তি য স রামঃ।  যিনি রমার বা লক্ষ্মীর সাথে রমন করেন। রা শব্দটি মহৎ-ঈশ্বর বাচক। ম শব্দে মঙ্গলের সূচক। অর্থাৎ পরম-মঙ্গলময় ঈশ্বর।
  
রময়তি য স রামঃ। কেউ কেউ  এখানে রাধা অর্থাৎ ভগবানের  সাথে যিনি  রমন করছেন সেই শ্রীরাধাকে স্মরণ করা হচ্ছে, বলে মনে করেন ।  

যাই হোক, ভক্তের শ্রেণী অনুযায়ী যে যার মতো বুঝে নেবেন।  তবে একটা কথা সত্যি এই মন্ত্র যেমন সর্ব্বজনীন, তেমনি এর আধ্যাত্মিক মূল্য অসীম। একই কথা বার বার উচ্চারণের ফলে আমাদের মানস শরীরে, একটা আনন্দ অনুভূতি এনে দেয়। ভয় দূর করে, একটা অদ্ভুত হিল্লোল তোলে আমাদের শরীর  ও মনে। 

হরিবোল হরিবোল হরিবোল জয় শ্রী শ্রীচৈতন্যদেবের জয়। 
        

  


Wednesday 3 April 2019

হরিনাম মহামন্ত্র ও তার তাৎপর্য

হরিনাম মহামন্ত্র ও তার তাৎপর্য 
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। 
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে। ।

এই মহামন্ত্র শোনেনি এমন কেউ আজ আর পৃথিবীটিতে আছে কিনা সন্দেহ। ঘরে ঘরে এই নাম উচ্চস্বরে ধ্বনিত হচ্ছে। খোল করতাল সহযোগে বিভিন্ন সুরে, গীত হচ্ছে এই মহামন্ত্র। এই মন্ত্রের উদ্গাতা মহাপ্রভু শ্রীশ্রী চৈতন্য।  কি আছে এই মন্ত্রে ? আমরা শ্রী শ্রী চরণ দাস বাবাজির - কাছ থেকে শুনবো। 

ষোলো সখা ষোলো সখী বত্রিশ অক্ষর /হরিনাম তত্ত্ব ধর্ম্ম অতি গুরতর।
মাধুর্য্য মহিমা তত্ত্ব যে জন জানয় / রাধাকৃষ্ণ নিত্যধামে গমন করয়। 
হরে, কৃষ্ণ, রাম, এই মন্ত্র ষড়ক্ষর /এই তিন নাম তন্ত্রে কৈলা হর। 
তিন নামে ষোলো নাম বত্রিশ অক্ষর / বৃত্তি করি কৈলা গৌড় জগৎ গোচর। 
নামরূপে প্রেম দিল আপনি যাচিয়া / নাম মত্ত ভক্ত চিত্ত বেড়ায় নাচিয়া। 
করুনার কল্পতরু এই হরিনাম  / কামনায় হবে মুক্তি প্রেম ব্রজধাম। 
সংক্ষেপে কহিনু  এই হরিনাম তত্ত্ব / জীবের দুর্লভ এই প্রেমের মহত্ত্ব।।

হরে কৃষ্ণ হরে রাম খুবই সহজ সরল মন্ত্র। শুনতে খুবই সাধারণ কিন্তু অসীম ক্ষমতাশালী আধ্যাত্মিক মন্ত্র এটি। হরে কথাটার অর্থ ভগবানের ভক্তিমূলক শক্তি। কৃষ্ণ এবং রাম  হলেন, দেবত্বের ব্যক্তিত্ত্ব।  ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপাসকেরা বিশ্বাস করেন যে এই মংত্র উচ্চারণ করে আমরা আমাদের কৃষ্ণচেতনা অর্থাৎ ভগবানের প্রতি ভালোবাসাকে জাগ্রত করতে পারি।  এই মন্ত্রের ধীর পুনরাবৃত্তি করলে আধাত্মিক শক্তি পাওয়া যায়।  ঘরে ঘরে এই মন্ত্রের অষ্টপ্রহর কীর্তন, মানুষকে ভক্তিরসে আপ্লুত করে।

এই মন্ত্রে চারবার "কৃষ্ণ" কথাটি আছে।  শ্রী শ্রী চরণ দাস  বাবাজি বলছেন, এই চার কৃষ্ণের অর্থ হচ্ছে - ১. পরমব্রহ্ম শ্রীগোবিন্দ  ২. শ্রী বাসুদেব ৩. শ্রী জগন্নাথ, ৪. শ্রী কৃষ্ণ-বলভদ্র।
চারবার "রাম" কথাটি আছে। এর অর্থ হচ্ছে ১. শ্রীরাধিকা, ২. শ্রীলক্ষ্মী,  ৩. শ্রী সরস্বতী, ৪. শ্রীমতি সুভদ্রা।
আটবার "হরে" এই শব্দটি আছে।  এর অর্থ হচ্ছে।  ১. চন্দ্রাবলী, ২. প্রেমময়ী শ্রীরাধা, ৩. সুভাষিণী, ৪. সিংহাসন,  ৫. সুদর্শন, ৬. শেষদেব, ৭. সাবিত্রী, ৮. রেবতী।

নামের ফল :
হরে : হ -কারে হিঙ্গুলবর্ন হয় সর্ব্ব শ্রেষ্ঠ /  জ্ঞানে বা অজ্ঞানে যত পাপ করে নষ্ট।  রে - করতে রক্তবর্ণ গোপাল নির্নয় / গুর্বাঙ্গনা উপগত পাপ হয় ক্ষয়।
কৃষ্ণ : কৃ-কার কজ্জ্বল বর্ণ  উপপাতক নাশে / গতি, শক্তি, রতি, প্রেম, ইহাতেই আসে। ষ্ণ-কার লোহিত বর্ণ নরক হইতে / মানবের উদ্ধার করে পাপ জন্মার্জিতে।
রাম  :  রা-কার বর্ণ হয় চন্দ্র সূর্য্য জ্যোতি / অজ্ঞান তমনাশক বর শক্তি ধৃতি। ম - কার স্বরূপ জ্যোতি  কলঙ্ক রোহিত / নিত্য স্থায়ী হয় মিথ্যা পাপ বিনাশিত।

এরূপ প্রতীক বর্ণে আছে শক্তিচয়/এইগুলি যাবে সম্মিলিত হয়।
ধরয়ে অসীম শক্তি মন্ত্র নাম তার / ষোলো নাম বত্রিশ অক্ষর জগতে প্রচার।
পাপ তাপ ভীত জীব শুনে উপদেশ / হরে কৃষ্ণ রাম নাম দূর করো ক্লেশ।
কলিকালে তরিবারে হরিনাম ভজ / গুরুপাশে লও শিক্ষা লয়ে পদব্রজ।
ভক্তিতে ভজনে পূর্ন হবে প্রেমভক্তি / ভক্তিবলে অবশ্য়ই হইবেক মুক্তি।             

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। 
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে। ।